১৭. রামের কথাই সত্য হইল

রামের কথাই সত্য হইল। অবস্থাপন্ন চাষী কেহ আসিল না, আসিল শুধু দরিদ্রের দল। আর মাত্র দু-একজন। তাহাদের মধ্যে ইরসাদ।

দেবু কুসুমপুরে ছুটিয়া গিয়াছিল। ইরসাদ বাড়ি হইতে বাহির হইতেছিল।

কাল অমাবস্যা, রমজান মাসের শেষদিন, পরশু হইতে শাওয়াল মাসের আরম্ভ। শওয়ালের চাঁদ দেখিয়া ঈদ মোবারক ঈফেতর পর্ব। রোজার উপবাসব্রতের উদ্যাপন। এ পর্বে নূতন পোশাক চাই, সুগন্ধি চাই, মিষ্টান্ন চাই। জংশনের বাজারে যাইবার জন্য সে বাহির হইতেছিল। দেবু ছুটিয়া গিয়া পড়িল। বাজার করা স্থগিত রাখিয়া ইরসাদ দেবুর সঙ্গে বাহির হইল। গ্রামের অবস্থাপন্ন চাষী মুসলমানেরা কেহই প্রায় বাড়িতে নাই। সকলেই গিয়াছে জংশনের বাজারে। ওই বাঁধের উপর দিয়াই গিয়াছে, বন্যার অবস্থা দেখিয়া চিন্তাও তাহাদের হইয়াছে, কিন্তু আসন্ন। উৎসবের কল্পনায় আচ্ছন্ন চিন্তাটাকে এড়াইয়া গিয়াছে। ইরসাদ দুয়ারে দুয়ারে ফিরিল। গরিবেরা বাড়িতে ছিল, টাকা-পয়সার অভাবে তাহাদের বাজারে যাওয়া হয় নাই; তাহারা সঙ্গে সঙ্গে। বাহির হইয়া আসিল।

ওদিকে বাঁধের উপর বসিয়া রাম নাগরা পিটিতেছে—দুম্‌–দুম্‌–দুম্‌–

শিবকালীপুর হইতে বাহির হইয়া আসিল—সতীশ, পাতু ও তাহাদের দলবল। চাষীরা কেহ আসে নাই। চণ্ডীমণ্ডপে শ্ৰীহরির ওখানে নাকি মজলিস বসিয়াছে।

দেখুড়িয়ার ভল্লারা পূর্বেই জুটিয়াছে। মহাগ্রামেরও জনকয়েক আসিয়াছে। মোটমাট প্রায় পঞ্চাশজন লোক। এদিকে বন্যার জল ইতিমধ্যেই প্রায় হাতখানেকের উপর বাড়িয়া গিয়াছে। বাঁধের গায়ে ফাটলটার নিচেই একটা গর্তের ভিতর দিয়া বন্যার জল সরীসৃপের মত মাঠের ভিতর ঢুকিতে আরম্ভ করিয়াছে। বধের উপর পঞ্চাশজন লোক বুক দিয়া পড়িল।

এই ধারার সুড়ঙ্গের মত গর্তের গতি অত্যন্ত কুটিল। বাঁধের ওপারে কোথা, তাহার মুখ, সেই মুখ খুঁজিয়া বাহির করিতে না পারলে কোনোমতেই বন্ধ হইবে না। পঞ্চাশ জোড়া চোখ ময়ূরাক্ষীর বন্যার জলের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলবাঁধের গায়ে কোথায় জল ঘুরপাক খাইতেছে-ঘূর্ণির মত।

ঘূর্ণি একটা নয় দশবারটা। অর্থাৎ গর্তের মুখ দশ-বারটা। এ পাশেও দেখা গেল জল। একটা গৰ্ত দিয়াই বাহির হইতেছে না অন্তত দশ জায়গা দিয়া জল বাহির হইতেছে। বাঁধের ফাটলের মাটি গলিয়া ঝাপঝুপ করিয়া খসিয়া পড়িতেছে; ফাটলটা বাড়িতেছে; বধের মাটি নিচের দিকে নামিয়া যাইতেছে।

তিনকড়ি বলিলদাঁড়িয়ে থাকলে কিছু হবে না।

জগন-লেগে যাও কাজে।

হরেন উত্তেজনায় আজ হিন্দি বলিতেছিলজলদি! জলদি! জলদি।

দেবু নিজে গিয়া ফাটলের গায়ে দাঁড়াইয়া বলিল-ইরসাদ-ভাই, গোটাকয়েক খুঁটো চাই। গাছের ডাল কেটে ফেল। সতীশ, মাটি আন!

মাঠের সাদা জলের উপর দিয়া পাটল রঙের একটা অজগর যেন অগ্রসর হইয়া চলিয়াছে বিসর্পিল গতিতে ক্ষুধার্ত উদ্যত গ্ৰাসে।

বাঁধের গায়ে গর্তটার মুখ কাটিয়া, গাছের ডালের খুঁটা পুঁতিয়া, তালপাতা দিয়া তাহারই মধ্যে ঝপাঝপ মাটি পড়িতেছিলঝুড়ির পর ঝুড়ি। পঞ্চাশজন লোকের মধ্যে জগন ও হরেন। মাত্র দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু আটচল্লিশজনের পরিশ্রমের মধ্যে এতটুকু ফাঁকি ছিল না। কতক লোক মাটি কাটিয়া ঝুড়ি বোঝাই করিতেছিল—কতক লোক বহিতেছিল; দেব, ইরসাদ, তিনকড়ি এবং আরও জনকয়েক বন্যার ঠেলায় বাঁকিয়া যাওয়া খুঁটাগুলিকে ঠেলিয়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।

—মাটি-মাটি-মাটি!

বন্যার বেগের মুখে তালপাতার আড় দেওয়া বেড়ার খুঁটাগুলিকে ঠেলিয়া ধরিয়া রাখিতে হাতের শিরা ও মাংসপেশিসমূহ কঠিন হইয়া যেন জমাট বাঁধিয়া যাইতেছে; এইবারে বোধহয় তাহারা ফাটিয়া যাইবে। পাঁতে পাঁত চাপিয়া দেবু চিৎকার করিয়া উঠিল—মাটি, মাটি, মাটি!

রাম ভল্লার মূর্তি ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছে; নিশীথ অন্ধকারের মধ্যে মারাত্মক অস্ত্ৰ হাতে তাহার যে মূৰ্তি হয়—সেই মূর্তি। সে তিনকড়িকে বলিল—একবার ধর।…সে চট করিয়া পিছনে ফিরিয়া মাটিতে পায়ের খুঁট দিয়া-পিঠ দিয়া বেড়াটাকে ঠেলিয়া ধরিল। তারপর বলিল—ফেল মাটি।

ইরসাদ পাইতেছিল। রমজানের মাসে সে এক মাস যাবৎ উপবাস করিয়া আসিতেছে। আজও উপবাস করিয়া আছে। দেবু বলিল-ইরসাদ-ভাই, তুমি ছেড়ে দাও। উপরে গিয়ে একটু বরং বস।

ইরসাদ হাসিল, কিন্তু বেড়া ছাড়িল না। ঝাপঝপ মাটি পড়িতেছে। আকাশে মেঘ একবার ঘোর করিয়া আসিতেছে, আবার সূর্য উঠিতেছে।

একবার সূর্য উঠিতেই ইরসাদ সূর্যের দিকে চাহিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিল, বলিল—একবার ধর, আমি এখুনি আসছি। নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে ভাই।

বেলা ঢলিয়া পড়িয়াছে। মানুষের আকারের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ দীর্ঘ হইয়া ছায়া পড়িয়াছে। জোহরের নামাজের সময় চলিয়া যাইতেছে। দেবু রাম ভল্লার মত পিছন ফিরিয়া পিঠ দিয়া বেড়াটায় ঠেলা দিয়া বলিল—যাও তুমি।

শ্রমিকের দল কাদা ও জলের মধ্যে প্রাণপণে দ্রুতগতিতে আসিয়া ঝুড়ির পর ঝুড়ি মাটি ফেলিতেছিল। মাটি নয় কাদা। ঝুড়ির ফাঁক দিয়া কাদা তাহাদের মাথা হইতে কোমর পর্যন্ত লিপ্ত করিয়া গলিয়া পড়িতেছে। এই কাদার মত মাটিতে বিশেষ কাজ হইতেছে না। বানের জলের তোড়ে কাদার মত মাটি মুহূর্তে গলিয়া যাইতেছে। ওদিকে ময়ূরাক্ষী ফুলিয়া ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিতেছে। বান বাড়িতেছে। উতলা বাতাসে প্রবহমান বন্যার বুকে শিহরনের মত চাঞ্চল্য জাগিয়া উঠিতেছে।.

নদীর বুকের ডাক এখন স্পষ্ট। খরস্রোতের কল্লোলধ্বনি ছাপাইয়া একটা গর্জনধ্বনি উঠিতেছে।

জলস্রোত যেন রোলারের মত আবর্তিত হইয়া চলিতেছে। নদীর বুক রাশি রাশি ফেনায় ভরিয়া উঠিয়াছে।

ফেনার সঙ্গে আবর্জনার প—শুধু আবৰ্জনাই নয়—খড়, ছোটখাটো শুকনো ডালও ভাসিয়া চলিয়াছে।

সহসা হরেন আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিয়া উঠিল—Doctor, look, one চালা! একটা ছোট ঘরের চাল ভাসিয়া চলিয়াছে।

–There—there—ওই একটা ওই একটা। ওই আর একটা। By God—a big গাছের গুঁড়ি।

ঘরের চাল, কাটা গাছের গুঁড়ি, বাঁশ, খড় ভাসিয়া চলিয়াছে, নদীর উপরের দিকে গ্রাম ভাসিয়াছে।

জগন ডাক্তার আতঙ্কিত হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—গেল! গেল!

তিনকড়ি এতক্ষণ পর্যন্ত পাথরের মানুষের মত নির্বাক হইয়া সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিয়া বেড়াটা ঠেলিয়া ধরিয়াছিল। এবার সে দেবুর হাত ধরিয়া বলিল পাশ দিয়ে সরে যাও। থাকবে না ছেড়ে দাও। রামা, ছাড়ু! মিছে চেষ্টা। দেবু, পাশ দিয়ে সর। নইলে জলের তোড়ে মাটির মধ্যে হয়ত গুজে যাবে! গেলগেলগেল!

গিয়াছে! দ্রুত প্রবর্ধমান বন্যার প্রচণ্ডতম চাপে বাঁধের ফাটলটা গলিয়া সশব্দে এপাশের মাঠের উপর আছাড় খাইয়া পড়িল। রাম পাশ কাটিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। তিনকড়ি সুকৌশলে ওই জলস্রোতের মধ্যে ড়ুব দিয়া সাঁতার কাটিয়া ভাসিয়া চলিল। দেবু জলস্রোতের মধ্যে মিশিয়া গেল।

জগন চিৎকার করিয়া উঠিল—দেবু! দেবু!

রাম ভল্লা মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়া পড়িল জলস্রোতের মধ্যে।

ইরসাদের নামাজ সবে শেষ হইয়াছিল; সে কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতের মত দাঁড়াইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—দেবু-ভাই!

মজুরদের দল হায় হায় করিয়া উঠিল। সতীশ বাউরি, পাতু বায়েনও জলস্রোতের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

পিছনে বন্যারোধী বাঁধের ভাঙন ক্রমশ বিস্তৃততর হইতেছে, গৈরিক বর্ণের জলস্রোত ক্রমবর্ধিত কলেবরে হুড়হুড় শব্দে মাঠের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে; মাঠের সাদা জলের উপর এবার গৈরিক বর্ণের জল—কালবৈশাখীর মেঘের মত ফুলিয়া ফুলিয়া চারপাশে ছড়াইয়া পড়িতেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই হাঁটুজল প্রায় এক কোমর হইয়া উঠিল। ইরসাদও এবার জলের স্রোতের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল।

বন্যার মূল স্রোতটি ছুটিয়া চলিয়াছে—পূর্ব মুখে। ময়ূরাক্ষীর স্রোতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে। পাশ দিয়া ঠেলিয়া চলিয়াছে গ্রামগুলির দিকে। মূল স্রোত মাঠের সাদা জল চিরিয়া প্রবল বেগে ছুটিয়াছে কুসুমপুরের সীমানা পার হইয়া শিবকালীপুর, শিবকালীপুরের পর মহাগ্রাম, মহাগ্রামের পর দেখুড়িয়া, দেখুড়িয়ার সীমা পার হইয়া, পঞ্চগ্রামের মাঠ পার হইয়া, বালুময় মহিষডহর গলাপোঁতা বাগানের পাশ দিয়া ময়ূরাক্ষীর বাঁকের মুখে ময়ূরাক্ষীর নদীস্রোতের মধ্যে গিয়া পড়িবে।

রাম ওই জলস্রোতের সঙ্গেই চলিয়াছে, এক-একবার মাথা তুলিয়া উঠিতেছে—আবার ড়ুব দিতেছে। তিনকড়িও চলিয়াছে। সে যখন মাথা তুলিয়া উঠিতেছে তখন চিৎকার করিয়া উঠিতেছে—হায় ভগবান!

বন্যার জলে মাটির ভিতরের জীব-জন্তু-পতঙ্গ ভাসিয়া চলিয়াছে। একটা কালকেউটে জলস্রোতের উপর সাঁতার কাটিয়া তিনকড়ির পাশ দিয়া চলিয়া গেল। তিনকড়ি মুহূর্তে জলের। মধ্যে ড়ুব দিল। জল-প্লাবনে মাঠের গর্ত ভরিয়া গিয়াছে, সাপটা খুঁজিতেছে একটা আশ্রয়স্থল, কোনো গাছ অথবা এক টুকরা উচ্চভূমি। এ সময়ে মানুষকে পাইলেও মানুষকে জড়াইয়া ধরিয়া বচিতে চাহিবে। কীট-পতঙ্গের তো অবধি নাই। খড়কুটা-ডাল-পাতার উপর লক্ষ কোটি পিঁপড়া চাপ বাঁধিয়া আশ্ৰয় লইয়াছে। মুখে তাহাদের সাদা ডিম, ডিমের মমতা এখনও ছাড়িতে পারে নাই।

কুসুমপুরে কোলাহল উঠিতেছে—বান গ্রামের প্রান্তে গিয়া উঠিয়াছে। শিবকালীপুরেও বান ঢুকিয়াছে। বাউরি-পাড়া মুচি-পাড়ায় জল জমিয়াই ছিল, বন্যার জল ঢাকিয়া এখন প্রায় এককোমর জল হইয়াছে। সতীশ ও পাতু ছাড়া সকলেই পাড়ায় ফিরিল। প্রতি ঘরে মেয়েরা ছেলেরা কলরব করিতেছে। ইহারই মধ্যে অনেকের ঘরে জল ঢুকিয়াছে। তৈজসপত্র হাঁড়িকুড়ি মাথায় করিয়া, গরু-ছাগলগুলাকে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া তাহারা পুরুষদেরই অপেক্ষা করিতেছিল; উহারা ফিরিতেই সকলে হইহই করিয়া উঠিল—চল চলচল।

গ্রামও আছে-নদীও আছে চিরকাল। বানও আসে, গ্রামও ভাসে। কিন্তু সর্বাগ্রে ভাসে এই হরিজনপল্লী। ঘর ড়ুবিয়া যায়, অধিবাসীরা এমনিভাবেই পলায়, কোথায় পলাইয়া গিয়া আশ্রয় লইবে–সেও তাহাদের ঠিক হইয়া থাকে। তাহাদের পিতৃপিতামহ ওইখানেই আশ্ৰয় লইত। গ্রামের উত্তর দিকের মাঠটা উঁচুওই মাঠের মধ্যে আছে পুরনো কালের মজা দিঘি। ওই উত্তর-পশ্চিম কোণটায় প্রকাণ্ড সুবিস্তৃত একটা অৰ্জুন গাছ আছে, সেই গাছের তলায় গিয়া আশ্রয় লইত; আজও তাহারা সেইখানেই চলিল।

দুর্গার মা অনেকক্ষণ হইতেই চিৎকার করিতেছিল। দুর্গা সকাল হইতে দেবুর বাড়িতে ছিল। দেবু বাহির হইয়া গিয়া আর ফিরিল না। বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া সে বাড়ি ফিরিয়া উপরে উঠিয়াছে, আর নামে নাই। রঙ্গিণী বুকে বালিশ দিয়া উপুড় হইয়া জানালা দিয়া বান দেখিতেছে। শুধু বান দেখা নয়, গানও গাহিতেছে—

কলঙ্কিনী রাইয়ের তরে কানাই আজ লুটোয় ধুলাতে।
ছিদ্ৰকুম্ভে আনিবে বারি–কলঙ্কিনীর কলঙ্ক ভুলাতে।

দুর্গার মা বারবার ডাকিতেছে—দুগ্‌গা, বান আসছে। ঘর-দুয়োর সামলিয়ে নে। চল্ বরং দিঘির পাড়ে যাই।

দুর্গা বারকয়েক সাড়াই দেয় নাই। তারপর একবার বলিয়াছে—দাদা ফিরে আসুক। তারপর সে আবার আপন মনে গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছে। এখন সে গাহিতেছিল—

এ পারেতে রইলাম আমি, ও পারেতে আর-একজনা–
মাঝেতে পাথার নদী পার করে কে সেই ভাবনা,
কোথায় তুমি কেলে সোনা?

হঠাৎ তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল–মাঠ হইতে প্রত্যাগত লোকগুলির কোলাহল। সে বুঝিল পণ্ডিতের ব্যর্থ উত্তেজনায় লোকগুলি অনর্থক বানের সঙ্গে লড়াই করিয়া হার মানিয়া বাড়ি ফিরিল। সে একটু হাসিল। পণ্ডিতের যেন খাইয়াদাইয়া কাজ নাই, এই বান আটক দিতে গিয়াছিল!… দুর্গার মা নিচে হইতে চেঁচাইয়া উঠিল—দুগ্‌গা, দুগ্‌গা! অ দুগ্‌গা!

—যা-না তু দিঘির পাড়ে। মরণের ভয়েই গেলি হারামজাদী।

–ওলো, না!

–তবে এমন করে চেঁচাইছিস কেনে?

দুর্গার মা এবার কাঁদিয়া বলিল ওলো, জামাই-পণ্ডিত ভেসে যেয়েছে লো!

দুর্গা এবার ছুটিয়া নামিয়া আসিল—কি? কে ভেসে যেয়েছে?

–জামাই-পণ্ডিত। বনের তোড়ের মুখে পড়ে—

দুর্গা বাহির হইয়া গেল। কিন্তু পথে জল থইথই করিতেছে, এই জল ভাঙিয়া সে কোথায় যাইবে? যাইয়াই বা কি করিবে? মনকে সান্ত্বনা দিল—দেবু শক্তিহীন পুরুষ নয়, সে সাঁতারও জানে। কিন্তু বাঁধভাঙা বানের জলের তোড়—সে যে ভীষণ! বড় গাছ সম্মুখে পড়িলে শিকড়সুদ্ধ টানিয়া ছিঁড়িয়া পাড়িয়া ফেলে জমির বুক খাল করিয়া চিড়িয়া ফাড়িয়া দিয়া যায়। ভাবিতে ভাবিতেই সে পথের জলে নামিয়া পড়িল। এক কোমরের বেশি জল। ইহারই মধ্যে পাড়াটা জনশূন্য হইয়া গিয়াছে। কেবল মুরগিগুলা ঘরের চালায় বসিয়া আছে। হাসগুলা বন্যার জলে ভাসিতেছে। গোটাকয়েক ছাগল দাঁড়াইয়া আছে একটা ভাঙা পঁচিলের মাথায়। হঠাৎ তাহার নজরে পড়িল—একটা লোক জল ঠেলিয়া এক বাড়ি হইতে বাহির হইয়া অন্য একটা বাড়িতে গিয়া ঢুকিল। দুঃখের মধ্যে সে হাসিল। রতনা বাউরি। লোকটা ছিচকে চোর। কে কোথায় কি ফেলিয়া গিয়াছে সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। সে অগ্রসর হইল। তাই তো পণ্ডিতজামাই-পণ্ডিত ভাসিয়া গেল!

যাইতে যাইতে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া সে মাকে ডাকিয়া বলিলদাদা না-ফেরা পর্যন্ত ওপরে উঠে বস্ মা। বউ, তুইও ওপরে যা। জিনিসপত্তরগুলা ওপরে তোল্‌।

মা বলিল—ঘর পড়ে মরব নাকি?

—নতুন ঘর! এত শিগগিরি পড়বে না।

–তু কোথা চললি?

–আসি আমি।

সে আর দাঁড়াইল না। অগ্রসর হইল।

 

দিনের আলো পড়িয়া আসিতেছে। দুর্গা পথের জল ভাঙিয়া অগ্রসর হইল। নিজেদের পাড়া ছাড়াইয়া ভদ্রপল্লীতে আসিয়া উঠিল। ভদ্রপল্লীর পথে জল অনেক কম, কোমর পর্যন্ত জল কমিয়া হাঁটুতে নামিয়া আসিল। কিন্তু কম থাকিবে না। বান বাড়িতেছে। ভদ্রপল্লীর ভিটাগুলি আবার পথ অপেক্ষাও উঁচু জমির উপর অবস্থিত, পথ হইতে মাটির সিঁড়ি ভাঙিয়া উঠিতে হয়। আবার ঘরগুলির মেঝে-দাওয়া আরও খানিকটা উঁচু। সিঁড়িগুলা ড়ুবিয়াছে–এইসব উঠানে জল ঢুকিবে। গ্রামের মধ্যে প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে। স্ত্রী-পুত্র, গরু-বাছুর, জিনিসপত্র লইয়া ভদ্র গৃহস্থেরা বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। ওই বাউরি-হাড়ি-ডোম মুচিড়ের মত সংসারটিকে বস্তাঝুড়ির মধ্যে পুরিয়া বাহির হইবার উপায় নাই। গ্রামের চণ্ডীম পিটা ইহারই মধ্যে মেয়েছেলেতে ভরিয়া গিয়াছে। তাহারা চিরকাল বন্যার সময় এই চণ্ডীমণ্ডপেই আসিয়া আশ্ৰয় লয়। এবারও লইয়াছে।

পূর্বাকালে চণ্ডীমণ্ডপ ছিল মাটির, ঘর-দুয়ারগুলিও তেমনি ভাল ছিল না। এবার বিপদের মধ্যেও সুখচণ্ডীমণ্ডপ পাকা হইয়াছে, খটখটে পাকা মেঝে। ঘর-দুয়ারগুলিও ভাল হইয়াছে। কিন্তু তবুও লোকে ভরসা করিয়া চণ্ডীমণ্ডপে ঢুকিতে পারে নাই। ঘোষ কি বলিবেন—এই ভাবিয়া ইতস্তত করিয়াছিল; কিন্তু শ্রীহরি নিজে সকলকে আহ্বান করিয়াছে; গায়ে চাদর দিয়া সকল পরিবারগুলির সুখ-সুবিধার তদবির করিয়া বেড়াইতেছে। মিষ্টভাষায় সকলকে আহ্বান করিয়া, অভয় দিয়া বলিতেছে-ভয় কি, চণ্ডীমণ্ডপ রয়েছে, আমার বাড়ি রয়েছে, সমস্ত আমি খুলে দিচ্ছি।

শ্ৰীহরি ঘোষের এই আহ্বানের মধ্যে একবিন্দু কৃত্রিমতা নাই, কপটতা নাই। গ্রামের এতগুলি লোক যখন আকস্মিক বিপর্যয়ে ধন-প্ৰাণ লইয়া বিপন্ন—তখন সে অকপট দয়াতে আর্দ্র হইয়া উঠিল। শুধু চণ্ডীমণ্ডপই নয়; সে তাহার নিজের বাড়ি-ঘর-দুয়ারও খুলিয়া দিতে সংকল্প করিল। শ্ৰীহরির বাপের আমলেই ঘর-দুয়ার তৈয়ারি করিবার সময় বন্যার বিপদ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করিয়াই ঘর তৈয়ারি করা হইয়াছিল। প্রচুর মাটি ফেলিয়া উঁচু ভিটাকে আরও উঁচু করিয়া। তাহার উপরে আরও এক বুক দাওয়া উঁচু শ্ৰীহরির ঘর। ইদানীং শ্ৰীহরি আবার ঘরগুলির ভিতরের গায়ে পাকা দেয়াল গাঁথাইয়া মজবুত করিয়াছে; দাওয়া মেঝে, এমনকি উঠান পর্যন্ত সিমেন্ট দিয়া বাঁধাইয়াছে। নতুন বৈঠকখানা-ঘরের দাওয়া তো প্রায় একতলার সমান উঁচু। সম্প্রতি শ্ৰীহরি একটা প্ৰকাণ্ড গোয়ালঘর তৈয়ারি করাইয়াছে, তাহার উপরেও কোঠা করিয়া দোতলা করিয়াছে। সেখানেও বহু লোকের স্থান হইবে, সে ঘরখানার ভিতরও বাঁধানো। তাহার এত স্থান থাকিতে গ্রামের লোকগুলি বিপন্ন হইবে?

শ্ৰীহরির মা ইদানীং শ্ৰীহরির গাম্ভীর্য ও আভিজাত্য দেখিয়া পূর্বের মত গালিগালাজ বা চিৎকার করিতে সাহস পায় না; এবং সে নিজেও যেন অনেকটা পাল্টাইয়া গিয়াছে, মান-মর্যাদা বোধে সে-ও যেন অনেকটা সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। তবুও এক্ষেত্রে শ্ৰীহরির সংকল্প শুনিয়া সে প্রতিবাদ করিয়াছিলনা বাবা হরি, তা হবে না—তোমাদের আমি ও করতে দেব না। তা হলে আমি মাথা খুঁড়ে মরব।

শ্ৰীহরির তখন বাদ-প্রতিবাদ করিবার সময় ছিল না। এতগুলি লোকের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিতে হইবে, তা ছাড়া গোপন মনে সে আরও ভাবিতেছিল ইহাদের আহারের ব্যবস্থার কথা। যাহাদের আশ্রয় দিবে তাহাদের আহার্যের ব্যবস্থা না করাটা কি তাহার মত লোকের পক্ষে শোভন হইবে? মায়ের কথার উত্তরে সংক্ষেপে সে বলিল—ছিঃ মা!

—ছিঃ কেনে বাবা, কিসের ছিঃ? তোমাকে ধ্বংস করতে যারা ধর্মঘট করেছে—তাদিগে বাঁচাতে তোমার কিসের দয়া, কিসের গরজ?

শ্ৰীহরি হাসিল, কোনো উত্তর দিল না। শ্ৰীহরির মা ছেলের সেই হাসি দেখিয়াই চুপ করিল—সন্তুষ্ট হইয়াই চুপ করিল, পুত্ৰ-গৌরবে সে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করিল। জমিদারের মা হইয়া তাহারও অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। এতগুলি লোকের দণ্ডমুণ্ডের মালিক। তাহারা, এ কি কম গৌরব? লোকে তাহাকে বলে রাজার মা। সে মনে মনে স্পষ্ট অনুভব করিল—যেন ভগবানের দয়া-আশীর্বাদ তাহার পুত্র-পৌত্র, তাহার পরিপূর্ণ সম্পদ-সংসারের উপর নামিয়া আসিয়া আরও সমৃদ্ধ করিয়া তুলিতেছে। শ্ৰীহরিও ঠিক তাই ভাবিতেছিল।

ময়ূরাক্ষী চিরকাল আছে, চিরকাল থাকিবে; তাহাতে বন্যাও আসিবে। লোকেরা বিব্রত হইলে তাহার পুত্ৰ-পৌত্ররাও এমনিভাবেই সকলকে আশ্রয় দিবে। সকলে আসিয়া বলিবে শ্ৰীহরি ঘোষ মশায় ভাগ্যে চণ্ডীমণ্ডপ করে গিয়েছিলেন। সেদিনও তাহার নাম হইবে।

তাই শ্ৰীহরি নিজে আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপে দাঁড়াইয়া সকলকে মিষ্ট ভাষায় আহ্বান জানাইল, অভয় দিলভয় কি চণ্ডীমণ্ডপ রয়েছে, আমার বাড়ি-ঘর রয়েছে, সমস্ত খুলে দিচ্ছি আমি।

চাষী গৃহস্থেরা সপরিবারে আসিয়া আশ্ৰয় লইতেছে। শ্ৰীহরির গুণগান করিতেছে। একজন বলিতেছিল—ভাগ্যিমান পুরুষ যে গাঁয়ে জন্মায় সে গায়েরও মহাভাগ্যি। সেই ধুলোয়-ধুলোকীনি। ছয়ে থাকত; আর এ হয়েছে দেখ দেখি! যেন রাজপুরী!

শ্ৰীহরি হাসিয়া বলিল—তোমরা তো আমার পর নও গো। সবই জাত-জ্ঞাত। আপনার জন। এ তো সব তোমাদেরই।

দুর্গা পথের জলের উপরেই দাঁড়াইয়া ছিল। এ পাড়া পার হইয়াই আবার মাঠ। জল ইহারই মধ্যে হাঁটু ছাড়াইয়া উঠিয়া পড়িল। মাঠে সাঁতার-জল। এদিকে বেলা নামিয়া পড়িতেছে। জামাই-পণ্ডিতের খবর লইয়া এখনও কেহ ফিরিল না। জামাই-পণ্ডিত, তবে কি ভাসিয়া গেল? চোখ ফাটিয়া তাহার জল আসিল। তাহার জামাই-পণ্ডিত, পাঁচখানা গ্রাম যাহার নাম লইয়া ধন্য ধন্য করিয়াছিল, পরের জন্য যে নিজের সোনার সংসার ছারখার হইতে দিল, গরিব-দুঃখীর আপনার জন, অনাথের আশ্রয়, ন্যায্য ছাড়া অন্যায্য কাজ যে কখনও করে না, সেই মানুষটা ভাসিয়া গেল আর এই লোকগুলা একবার তাহার নামও করে না।

সে জল ভাঙিয়া অগ্রসর হইল। গ্রামের ও-মাথায় পথের উপরে সে দাঁড়াইয়া থাকিবে। প্রকাণ্ড বড় মাঠ। তবুও তো দেখা যাইবে কেহ ফিরিতেছে কি না। জামাই-পণ্ডিত ভাসিয়া গেলে এই পূর্বদিকেই গিয়াছে। মানুষগুলো তো ফিরিবে! দূর হইতে ডাকিয়াও তো খানিকটা আগে খবর পাইবে। দুর্গা গ্রামের পূর্ব মাথায় আসিয়া দাঁড়াইল। নির্জনে সে কেঁপাইয়া কেঁপাইয়া কাঁদিয়া সারা হইয়া গেল, বারবার মনে মনে গাল দিতে লাগিল কামার-বউকে। সর্বনাশী রাক্ষসী যদি এমন করিয়া পণ্ডিতের মুখে কালি মাখাইয়া মাথাটা হেঁট করিয়া দিয়া চলিয়া না যাইত, তবে জামাই-পণ্ডিত এমনভাবে তখন মাঠের দিকে যাইত না। সে তো জামাই-পণ্ডিতের ভাবগতিক জানে। সে যে তাহার প্রতি পদক্ষেপের অৰ্থ বুঝিতে পারে।

কে একটা লোক দুতবেগে জল ঠেলিয়া গ্রামের ভিতর হইতে আসিতেছে। দুর্গা মুখ ফিরাইয়া দেখিল। কুসুমপুরের রহম শেখ আসিতেছে। রহমই প্ৰশ্ন করিলকে, দুৰ্গ নাকি?

–হ্যাঁ।

–আরে, দেবু-বাপের খরব কিছু পেলি? শেখের কণ্ঠস্বরে গভীর উদ্বেগ। দেবুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে তাহার বিচ্ছেদ ঘটিয়া গিয়াছে। রহম আজ জমিদারের লোক। এখনও সে জমিদারের পক্ষে থাকিয়াই কাজকর্ম করিতেছে; দৌলতের সঙ্গে তাহার যথেষ্ট খাতির। দেবুর প্রসঙ্গ উঠিলে সে তাহার বিরুদ্ধ-সমালোচনাই করিয়া থাকে। কিন্তু দেবুর এই বিপদের সংবাদ পাইয়া কিছুতেই সে স্থির থাকিতে পারে নাই, ছুটিয়া আসিয়াছে। সে বাড়িতে ছিল না; থাকিলে হয়ত বাঁধ-ভাঙার খবর পাইবামাত্র দেবুদের সঙ্গেই আসিত। সেই গাছ-বেচা টাকা লইয়া সে সকালে উঠিয়াই গিয়াছিল জংশনের বাজারে। রেলের পুল পার হইবার সময়েই বান দেখিয়া সে খানিকটা ভয় পাইয়াছিল। বাজারে বসিয়াই সে বাঁধ ভাঙার সংবাদ পায়। দৌড়াইতে দৌড়াইতে সে যখন গ্রামে আসিয়া পৌঁছিল তখন তাহাদের গ্রামেও জল ঢুকিয়াছে। তাহার বাড়ির ছেলেমেয়েরা দৌলতের দলিজায় আশ্রয় লইয়াছে। গ্রামের মাতব্বরদের পরিবারবর্গ প্রায় সকলেই সেখানে। সাধারণ চাষীরা মেয়েছেলে লইয়া মসজিদের প্রাঙ্গণে আশ্ৰয় লইয়াছে। মজুর খাঁটিয়া, চাকরি করিয়া যাহারা খায়—তাহারা গিয়াছে গ্রামের পশ্চিম দিকে উঁচু ডাঙায়, এ গ্রামের প্রাচীনকালের মহাপুরুষ গুলমহম্মদ সাহেবের কবরের ওখানে। কবরটির উপর প্রকাণ্ড একটা বকুলগাছের ছায়াপত্ৰতলে আশ্রয় লইয়াছে। রহম তাহাদের খবর করিতে গিয়াই দেবুর বিপদের সংবাদ পাইয়াছে। সংবাদটা পাইবামাত্র সে যেন কেমন হইয়া গেল।

মুহূর্তে তাহার মনে হইল—সে যেন কত অপরাধ করিয়াছে দেবুর কাছে। উত্তেজনার মুখে লোকাপবাদের আকারে প্রচারিত দেবুর ঘুষ ওয়াটা বিশ্বাস করিলেও রহমের মনের কোণে একটা সন্দেহ ছিল, দেবুকে সে যে ছোট হইতে দেখিয়া আসিয়াছে তাহাকে সে ভালবাসিয়াছে। ওই জানা এবং ভালবাসাই ছিল সেই সন্দেহের ভিত্তি। কিন্তু সে সন্দেহও এতদিন মাথা তুলিবার অবকাশ পায় নাই। দাঙ্গার মিটমাটের ফলে জমিদার তরফ হইতে তাহাকে সম্মান দিল—সেই সম্মানটাই পাথরের মত এতদিন সে সন্দেহকে চাপিয়া রাখিয়াছিল। আজ এই সংবাদ অকস্মাৎ যেন পাথরটাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল, মুহূর্তে সন্দেহটা প্রবল হইয়া জাগিয়া উঠিল। দেবু—যে এমন করিয়া জীবন দিতে পারে, সে কখনও এমন শয়তান নয়। দেবু-বাপ কখনও বাবুদের টাকা লয় নাই। এমন প্রকৃতির লোক নয়। ওটা বাবুদের ধাপ্লাবাজি। সে যদি। বাবুদের লোক হই, তবে এই অত বড় বৃদ্ধির ব্যাপারে একদিনের জন্যও কি তাহাকে বাবুদের কাছারিতে দেখা যাইত না? সে যদি তেমন স্বার্থপর লোকই হইবে—তবে কেন অসমসাহসিকতার সহিত বাঁধের ভাঙনের মুখে গিয়া দাঁড়াইল? রহম সেখান হইতেই ছুটিয়া আসিতেছে।

রহমের প্রশ্নে দুর্গার চোখ দিয়া দরদরধারে জল বহিয়া গেল। এতক্ষণে একটা লোক তাহার জামাই-পণ্ডিতের খবর করিল।

রহম অধিকতর ব্যগ্রতার সঙ্গে প্রশ্ন করিল—দুগ্‌গা?

দুর্গা কথা বলিতে পারি না, সে ঘাড় নাড়িয়া ইঙ্গিতে জানাইল–না, কোনো সংবাদই পাওয়া যায় নাই।

রহম সঙ্গে সঙ্গে মাঠের জলে নামিয়া পড়িল। দুর্গা বলিল–দাঁড়ান্ শেখজী, আমিও যাব।

রহম বলিল-আয়। পানি-সাঁতার! এতটা সাঁতার দিতে পারবি  তো?

দুৰ্গা কাপড় সাঁটিয়া অগ্রসর হইল।

রহম বলিল—দাঁড়া। হুই দেখ কতকগুলো লোক বেরিয়েছে মহাগ্রাম থেকে।

বানে-ডোবা নিচু মাঠকে বায়ে রাখিয়া মহাগ্রামের পাশে-পাশে কতকগুলি লোক আসিতেছে। গ্রামের ধারে মাঠের অপেক্ষা জল অনেক কম। মাঝমাঠে সাঁতার-জল স্রোতের বেগে বহিয়া চলিয়াছে।

রহম সেইখান হইতেই হাঁক দিতে শুরু করিল। চাষীর হাক! হাঁক কিন্তু জোর হইল না। সারাটা দিন রোজার উপবাস করিয়া গলা শুকাইয়া গিয়াছে। নিজের কণ্ঠস্বরের দুর্বলতা বুঝিয়া। রহম বলিল—দুগ্‌গা, তু সমেত হাঁক পাড়।

দুর্গাও প্রাণপণে রহমের সঙ্গে হাঁক দিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বরও বারবার রুদ্ধ। হইয়া আসিতেছিল। যদি তাহারা অর্থাৎ পাতু, সতীশ, জগন ডাক্তার, হরেন ঘোষালই হয়। যদি তাহারা আসিয়া বলেনা, পাওয়া গেল না!

তাহারাই বটে! হাঁকের উত্তর আসিল; শুনিয়াই রহম বলিল হ্যাঁ! উয়ারাই বটে। ইরসাদের কথা মালুম হচ্ছে।

সে এবার নাম ধরিয়া ডাক দিল-ই-র-সা-দ!

উত্তর আসিল–হ্যাঁ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক কয়টি আসিয়া উপস্থিত হইল ইরসাদ, সতীশ, পাতু, হরেন ও দেখুড়িয়ার একজন ভল্লা।

রহম প্ৰশ্ন করিল-ইরসাদ–পণ্ডিত? দেবু-বাপকে পেয়েছ?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ইরসাদ বলিল–পাওয়া গিয়েছে। জলের তোড়ের মুখে পড়ে। মাথায় কিছু ঘা লেগেছে। জ্ঞান নাই।

দুর্গা প্রশ্ন করিল—কোথায়? ইরসাদ মিয়ে—কোথা জামাই-পতি?

—দেখুড়তে। দেখুড়ের ধারে গিয়ে রাম ভল্লা টেনে তুলেছে।

–বাঁচবে তো?

—জগন ডাক্তার রয়েছে। দুজন ভল্লা গিয়েছে কঙ্কণা—যদি হাসপাতালের ডাক্তার আসে। ছিদেম ভল্লা এসেছে—জগন ডাক্তারের বাক্স নিয়ে যাবে।

দুর্গা বলিল–আমিও যাব।

 

চণ্ডীমণ্ডপ লোকজনে ভরিয়া গিয়াছে। তাহারা কলরব করিতেছিল। আপন আপন জিনিসপত্র গুছাইয়ারাত্রির মত জায়গা করিয়া লইবার জন্য ছোটখাটো কলহও বাঁধিয়া উঠিয়াছে। ছেলেগুলা চা-ভ্যা লাগাইয়া দিয়াছে। কাহারও অন্যের দিকে দৃপাত করিবার অবসর নাই। আগন্তুক দলটি চণ্ডীমণ্ডপের কাছে উপস্থিত হইতেই কিন্তু কয়েকজন ছুটিয়া আসিল। কয়েকজনের পিছনে পুরুষেরা প্রায় সকলেই আসিয়া দাঁড়াইল।

–ঘোষাল, পণ্ডিতের খবর কি? পণ্ডিত? আমাদের পণ্ডিত?

–সতীশ-অ সতীশ?

–পাতু? বল্ কেনে রে?

চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যে মেয়েরা উদ্গ্রীব হইয়া কাজকর্ম বন্ধ করিয়া স্তব্ধভাবে প্রতীক্ষা করিয়া আছে।

হরেন উত্তেজিতভাবে বলিল—হোয়াট ইজ দ্যাট টু ইউ? সে খবরে তোমাদের কি দরকার! সেলফিশ পিপল সব!

ইরসাদ বলিলপণ্ডিতকে বহুকষ্টে পাওয়া গিয়াছে। তবে অবস্থা খুব খারাপ।

চণ্ডীমণ্ডপের মানুষগুলি যেন সব পাথর হইয়া গেল। স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া একটি নারীকণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া উঠিল। এক পৌঢ়া মা-কালীর মন্দিরের বারান্দায় প্রায় মাথা ঠুকিয়া ঐকান্তিক আৰ্তস্বরে বলিলবাঁচিয়ে দাও মা, তুমি বাঁচিয়ে দাও। দেবুকে তুমি বাঁচিয়ে দাও। দেবু আমাদের সোনার দেবু! মা-কালী, তুমি মালিক, বাঁচাও তুমি।

স্তব্ধ মানুষগুলির মধ্য হইতে আত্ম-প্রার্থনার গুঞ্জন উঠিল—মা! মা! চাও! মা-কালী!

মেয়েরা বার বার চোখ মুছিতেছিল।

সন্ধ্যা হইয়া গেল। জন ডাক্তারের ওষুধের বাক্স লইয়া ভল্লা জোয়ানটি চলিয়াছিল, পিছনে পিছনে দুর্গা। সেও অহরহ মনে মনে বলিতেছিল বাঁচাও মা, বাঁচিয়ে দাও। মা-কালী, তুমিই মালিক। জামাই-পণ্ডিতকে বাঁচিয়ে দাও। এবার পুজোয় আমি ডাইনে-বায়ে পাঁঠা দোব মা! .

বারবার তাহার চোখে জল আসিতেছিল—মনকে সে প্রবোধ দিতেছিল—আশায় সে বুক বাঁধিতে চাহিতেছিল-জামাই-পণ্ডিত নিশ্চয় বাঁচিবে! এতগুলি লোক, গোটা গ্রামসুদ্ধ লোক যাহার জন্য দেবতার পায়ে মাথা কুটিতেছে, তাহার কি অনিষ্ট হয়? কিছুক্ষণ আগে যখন তাহারা ঘোষের তোষামোদ করিতেছিল—কই, তখন তো তাহাদের বুক চিরিয়া এমন দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হয় নাই, চোখ দিয়া জল আসে নাই। সে শুধু দায়ে পড়িয়া বড়লোকের আশ্রয়ে মাথা গুঁজিয়া লজ্জার মাথা খাইয়া মিথ্যা তোষামোদ করিয়াছে। সে তাহাদের প্রাণের কথা নয়। কখনও নয়। এইটাই তাহাদের প্রাণের কথা। দুরদর করিয়া চোখ দিয়া জল কি শুধুই পড়ে? মানুষের কদৰ্যপনার সঙ্গেই দুর্গার জীবনের পরিচয় ঘনিষ্ঠ। মানুষকে সে ভাল বলিয়া কখনও মনে করে নাই। আজ তাহার মনে হইল মানুষ ভালমানুষ ভাল। বড় বিপদে, বড় অভাবে পড়িয়া তাহারা খারাপ হয়। তবুও তাহাদের বুকের ভিতর থাকে ভালত্ব। মানুষের সঙ্গে স্বার্থের জন্য ঝগড়া করিয়াও তাহার মন খারাপ হয়। পাপ করিয়া তাহার লজ্জা হয়।

মানুষ ভাল। জামাই-পণ্ডিতকে তাহারা ভুলিয়া যায় নাই! জামাই-পতি তাহার বাঁচিবে!

—কে যায় গো? কে যায়?—পিছন হইতে ভারী গলায় কে ডাকিল।

ভল্লা জোয়ানটি মুখ না ফিরাইয়া বলিল-আমরা।

–কে তোমরা?

এবার ছোকরা চটিয়া উঠিল। সে বলিল—তুমি কে?

শাসন-দৃপ্ত কণ্ঠে পিছন হইতে হাঁক আসিল–দাঁড়া ওইখানে।

না।

–এ্যাই!

ছোকরা হাসিয়া উঠিল, কিন্তু চলিতে বিরত হইল না। দুর্গা শঙ্কিত হইয়া উঠিল। পিছনের লোকটি হাকিয়া বলিল এই শালা।

ছোকরা এবার ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–এগিয়ে এস বুনুই, দেখি তোমাকে একবার।

—কে তুই?

–তুই কে?

–আমি কালু শেখ, ঘোষ মহাশয়ের চাপরাসী। দাঁড়া ওইখানে।

–আমি জীবন ভল্লা! তোমার ঘোষ মহাশয়ের কোনো ধার ধারি না আমি।

–তোমার সঙ্গে কে? মেয়ে নোক–? কে বটে?

দুর্গা তীক্ষকণ্ঠে উত্তর দিল—আমি দুগ্‌গা দাসী!

–দুগ্‌গা?

–হ্যাঁ!

কালু একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-আচ্ছা যাও।

কালু বাহির হইয়াছে পদ্মর সন্ধানে। পদ্ম শ্ৰীহরির বাড়িতে নাই। বানের গোলমালের মধ্যে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে—কেহ লক্ষ্য করে নাই। সন্ধ্যার মুখে শ্ৰীহরি তথ্যটা আবিষ্কার করিয়া রাগে ক্ষোভে একেবারে পাগল হইয়া উঠিয়াছে। কালুকে পাঠাইয়াছে, ভূপালকে পাঠাইয়াছে পদ্মর সন্ধানে।

পদ্ম পলাইয়াছে। গতরাত্রে এক অসুস্থ মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত পাগলে যেমন করিয়া পঙ্কপলের বুকে ঝপাইয়া পড়ে, তেমনি ভাবেই শ্ৰীহরির দরজার সম্মুখে আসিয়া তাহার বাড়িতেই ঢুকিয়াছিল। আজ সকাল হইতে তাহার অনুশোচনার সীমা ছিল না। তার জীবনের কামনা সুদ্ধমাত্র রক্তমাংসের দেহের কামনাই নয়, পেটের ভাতের কামনাই নয়, তাহার মনের পুষ্পিত কামনা—সে ফলের পরিণতির সফলতায় সার্থক হইতে চায়। অন্ন সে শুধু নিজের পেট পুরিয়া চায় না—অন্নপূর্ণা হইয়া পরিবেশন করিতে চায় পুরুষের পাতে, সন্তানের পাতে; তাহার কামনা অনেক। শ্ৰীহরির ঘরে থাকার অর্থ উপলব্ধি করিয়া সকাল হইতে সে অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতে এবং বন্যার বিপদে এই জনসমাগমের সুযোগে কখন। তাহাদের মধ্য দিয়াই বাহির হইয়া চলিয়া গিয়াছে। গ্রামের দক্ষিণে বন্যা, পূর্বে বন্যা, পশ্চিমেও তাই, সে উত্তর দিকের মাঠ ধরিয়া অন্ধকারের আবরণে চলিয়াছে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে যেখানে হোক।

ভল্লাটির পিছনে দুর্গা চলিয়াছিল।

মাঠের বন্যা বাড়িয়া উঠিয়াছে যেখানে বৈকালে এক-কোমর জল ছিল, সেখানে জল এখন বুক ছাড়াইয়াছে। শিবকালীপুরে চাষীপাড়াতেও এবার ঘরে জল ঢুকিতেছে। তাহারা মহাগ্রামের ভিতর দিয়া চলিল। মহাগ্রামের পথেও হাঁটুর উপর জল। বন্যার যে রকম বৃদ্ধি, তাহাতে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই চাষীদের ঘরেও বান ঢুকিবে। মহাগ্রাম এককালের সমৃদ্ধিসম্পন্ন। গ্রাম—অনেক পোড়ো ভিটায় ভাঙা ঘরের মাটির স্তৃপ জমিয়া আছে—সেকালের গৃহস্থের পোঁতা। গাছগুলির ছায়াকে আশ্ৰয় করিয়া সেই মাটির স্থূপের উপর সব গিয়া আশ্ৰয় লইয়াছে। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের চণ্ডীমণ্ডপে ও বাড়িতে যত লোক ধরিয়াছে, তিনি আশ্রয় দিয়াছেন।

দেখুড়িয়ায় একমাত্র ভরসা তিনকড়ির বাড়ি; তিনকড়ির বাড়িটা খুব উঁচু। সেখানেই অধিকাংশ লোক আশ্ৰয় লইয়াছে। অনেকে গ্রামান্তরে পলাইয়াছে। ভল্লাদের অনেকে এখন বাঁধের উপরে বসিয়া আছে। কাঠ ভাসিয়া গেলে ধরিবে। গরু ভাসিয়া গেলে ধরিবে। রাম, তারিণী প্রভৃতি কয়েকজন রাত্রেও থাকিবে স্থির করিয়াছে। কত বড়লোকের ঘর ভাঙিবে; কাঠের সিন্ধুক আসিতে পারে। অলঙ্কার-পরা বড়লোকের মেয়ের মৃতদেহও ভাসিয়া আসিতে পারে। বড়লোক। বাবু ভাসিয়া আসিতে পারে—যাহার জামায় থাকিবে সোনার বোম, আঙুলে হীরার আংটি, পকেটে থাকিবে নোটের তাড়া—কোমরে পেঁজলেভরা মোহর। কেবল এক-একজন পালা করিয়া তিনকড়ির বাড়িতে থাকবে। পণ্ডিতের অসুখকখন কি দরকার লাগে কে জানে!

জগন ডাক্তার তিনকড়ির দাওয়ায় বসিয়া ছিল।

জীবন বাক্সটা নামাইয়া দিল। দুর্গা ব্যাকুল হইয়া প্রশ্ন করিল—ডাক্তারবাবু, জামাই-পণ্ডিত কেমন আছে?

ডাক্তার ওষুধের বাক্স খুলিয়া ইন্‌জেকশনের সরঞ্জাম বাহির করিতে করিতে বলিল–গোলমাল করিস নে, বোস্।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের মধ্যে দেবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—কে? কে?

দুইজনেই ছুটিয়া গেল ঘরের মধ্যে; দেবু চোখ মেলিয়া চাহিয়াছে; তাহার শিয়রে বসিয়া। শুশ্ৰুষা করিতেছিল তিনকড়ির মেয়ে স্বর্ণ। রাঙা চোখে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া অকস্মাৎ সে দুই হাতে স্বর্ণের চুলের মুঠি ধরিয়া তাহার মুখখানা আপনার চোখের সম্মুখে টানিয়া আনিয়া বলিতেছে—কে? কে?

স্বর্ণের চুলগুলি যেন চিড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু অপরিসীম ধৈর্য তাহার। সে নীরবে দেবুর হাত দুইখানা ছাড়াইতে চেষ্টা করিতেছে।

দেবু আবার প্রশ্ন করিল—বিলু? বিলু? কখন এলে তুমি? বিলু!

জগন দেবুর দুই হাত চাপিয়া ধরিয়া স্বর্ণকে মুক্ত করিয়া দিল।

দুর্গা ডাকিল—জামাই-পণ্ডিত।

জগন মৃদুস্বরে বলিল—ডাকিস না। বিকারে বকছে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *