১৬. পদ্মর জীবনের নিরুদ্ধ কামনা

পদ্মর জীবনের নিরুদ্ধ কামনা—যাহা এতদিন শুধু তাহার মনের মধ্যেই আলোড়িত হইত, সেই কামনা অকস্মাৎ তাহারই মনের ছলনায় গোপন দ্বারপথে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। সে কামনা আসিল সহসমুখী হইয়া। মানুষ যাহা চায়, নারী যাহা চায়, যে পাওনার তাগিদ নারীর প্রতি দেহকোষে, প্রতি লোমকূপে-চেতনার প্রতি স্তরে স্পন্দিত হয়—সেই দাবি তাহার। দেহের তৃপ্তি-উদরের তৃপ্তি স্বামী-সন্তান—অন্ন-বস্ত্ৰ-সম্পদ, ঘর-সংসারের দাবি। একাধিপত্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে শুধু তাহার নিজস্ব করিয়া এইগুলি সে পাইতে চায়। ওই কামনাগুলিকে কৃচ্ছ্বসাধনের নিগ্ৰহে নিগৃহীত সে অনেক করিয়াছে। বারব্ৰত করিয়াছে, উপবাস করিয়াছে; কিন্তু তাহার প্রাণশক্তির প্রবল উচ্ছাস কিছুতেই দমিত হয় নাই। গোপন মনে অনেক কল্পনা-অনেক সংকল্প মৃত্তিকাতলস্থ বীজাঙ্কুরের মত উপ্ত হইতেছিল, অকস্মাৎ তাহারা সেদিন জীবনের স্বাধীন চিন্তা ও কর্মক্ষেত্রের উপর চাপানো সামাজিক সংস্কারের পাথরখানার একটা ফাটল দিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। আলোর রেখাকে মানুষ ভাবিয়া সে নিচে নামিয়া আসিয়াছিল। তারপর বাতাসে দরজা নড়িয়া উঠিতে সে তাহার মধ্যে শুনিয়াছিল কাহার আহ্বানের ইঙ্গিত। দাখানা হাতে করিয়াই সে দরজা খুলিয়াছিল। দরজার সামনে কেহ ছিল না, কিন্তু তাহার মনে হইয়াছিল—কে যেন সফ্ট করিয়া সরিয়া গেল। তাহার অনুসন্ধানে সে পথে নামিয়াছিল। সে যত আগাইয়াছিল মরুভূমির মরীচিকার মত তাহার কল্পনার আগন্তুকও তত সরিয়া সরিয়া শেষ পর্যন্ত তাহাকে আনিয়া দাড় করাইয়া দিয়াছিল ওই শিউলিতলায়। অদূরে দেবুর ঘরখানা নজরে পড়িবামাত্র তাহার অজ্ঞাতসারেই দাখানা হাত হইতে খসিয়া পড়িয়া গিয়াছিল।

দেবুর ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইতেই তাহার চেতনা ফিরিয়াছিল। কিন্তু তখন তার জীবনের সযত্ন-পোষিত নিরুদ্ধ কামনা গুহানিমুক্ত নিৰ্বরের মত শতধারায় মাটির বুকে নামিবার উপক্রম করিয়াছে। উথলিত বাসনায় ভয় নাই-সঙ্কোচ নাই; তাহার সর্বাঙ্গে লক্ষ লক্ষ জৈব দেহকোষে খলখল হাসি উঠিয়াছে, শিরায় শিরায় উঠিয়াছে কলস্বরা গান; অজস্র অপার সুখে সাধে আনন্দে প্ৰাণ উচ্ছ্বসিত; ঘর-সংসার-সন্তানের মুকুলিত কল্পনায় সে বিভোর হইয়া উঠিয়াছে। সে দেবুকে বলিল তাহার কথা—যে কথা এতদিন তাহার গোপন মনের আগল খুলিয়া ঘৃণাক্ষরে কাহাকেও বলে নাই, আভাসে ইঙ্গিতেও জানায় নাই।

দেবুর নিরাসক্ত নির্মম উপদেশে তাহার চমক ভাঙিল—চেপে জল আসছে—বাড়ি যাও কামার-বউ।

নিরুচ্ছ্বসিত নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের অপমানে সে যেন অধীর হইয়া গেল। বাধার আক্ৰোশে আবৰ্তময়ী স্রোতধারার মত কূল ভাঙিয়া দেবুকে ছাড়িয়া লাফ দিয়া শ্ৰীহরির অবজ্ঞাত জীবন তটের দিকে ছুটিয়া চলিল। বিচার করিল না—শ্ৰীহরির মরুভূমির মত বিশাল বালুস্তর, সেখানে জলস্রোত কলকলনাদে ছুটিতে পায় না—বালুস্তরের মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া যায়। একবার ভবিষ্যৎ ভাবিল না, ভালমন্দ বিচার করিল না—পদ্ম সরাসরি শ্ৰীহরির ঘরে গিয়া উঠিল।

সে গিয়া দাঁড়াইল শ্রীহরির কোঠাঘরের পিছনে। শ্ৰীহরির কথা সত্য—সে জাগিয়াই ছিল। কিন্তু তখন হইতেই পদ্ম ঘুমাইতেছিল। অঘোরে অবচেতনের মত ঘুমাইতেছিল। দেবুর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর সহসা তাহার নিদ্ৰাতুর চেতনার মধ্যে জাগরণের স্পন্দন তুলিল। জাগিয়া উঠিয়া জানালা দিয়া চাহিয়া দেখিল দেবু ও শ্রীহরি মুখোমুখি দাঁড়াইয়া কথা বলিতেছে। সে চারিদিক চাহিয়া দেখিল; এতক্ষণে উপলব্ধি করিল সে কোথায়! রাত্রের কথাটা একটা দুঃস্বপ্নের মত ধীরে ধীরে তাহার মনে জাগিয়া উঠিল। কিন্তু আর উপায় কি?

 

দুৰ্গা দেবুর ঘরেই বসিয়া ছিল। সে সংবাদ দিতেই আসিয়াছিল যে, কামার-বউ বাড়িতে নাই।

দেবু শুনিয়া সংক্ষেপে বলিল—জানি।

দেবুর মুখ দেখিয়া দুৰ্গা আর কোনো কথা বলিতে সাহস করিল না। চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

দেবু বলিল—তুই এখন বাড়ি যা দুর্গা, পরে সব বলব।

দুর্গা উঠিল।

দেবু আবার বলিল না। বোস্ শোন্। তোর যদি অসুবিধে না হয় দুৰ্গা, তবে তুই আমার বাড়িতেই থাক্‌ না!

দুর্গা অবাক হইয়া দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। জামাই-পতি এ কি বলিতেছে!

দেবু বলিল ঘরদোরগুলোয় ঝট পড়ে না, নিকোনো হয় না; রাখাল ছোঁড়া যা পাজি হয়েছে! তুই এসব কাজকর্মগুলো কর। এইখানেই খাবি। মাইনে যদি নিস, তাও দোব।

অকস্মাৎ চাবুক-খাওয়া ঘোড়ার মত দুর্গা সচকিত হইয়া উঠিল। বলিল-ঝিয়ের কাজ তো আমি করতে পারি না, জামাই-পণ্ডিত। আমার বাড়িঘর ঝটপাটের জন্যে দাদার বউকে দিনে এক সের করে চাল দি।

দেবু তাহার দিকে চাহিয়া বলিল—ঝি কেন? তুই তো বিলুকে দিদি বলতিস। আমার শালীর মত থাকবি; মাইনে বলাটা আমার ভুল হয়েছে। হাতখরচও তো মানুষের দরকার হয়।

দুর্গা তাহার মুখের দিকে মূঢ়ের মত স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

দেবু বলিলপরশু পঞ্চায়েত বসবে দুর্গা, অন্তত একদিন তুই আমার এখানে থাক্।

দুর্গা এবার ব্যাপারটা বুঝিয়া লইয়া হাসিয়া ফেলিল। পরম কৌতুক অনুভব করিল সে। পঞ্চায়েতের মজলিসে জামাই-পণ্ডিতের সঙ্গে তাহাকে জড়াইয়া মজার আলোচনা হইবে।

দেবু গম্ভীরভাবেই বলিল—কি বলছিস বল?

–চাবিটা দাও, ঘরদোর ঝুঁট দি।—দুর্গা চাবির জন্য হাত বাড়াইল।

দেবু চাবিটা তাহার হাতে তুলিয়া দিল। বলিল—দেখ, কলসিতে জল আছে কিনা?

—জল! দুৰ্গা বলিল—সে আমি দেখব কি গো? তুমি দেখ!

দেবু বলিল—তুই-ই দেখ। না থাকে নিয়ে আসবি; যতীনবাবু তোকে বলেছিল—মনে আছে? তা ছাড়া তুই আমাকে যে মায়া-ছেদ্দা করিস, সে তো কারুর মা-বোনের চেয়ে কম নয়। তোর হাতে আমি জল খাব। জাত আমি মানি না। পঞ্চায়েতের কাছে আমি সে কথা খুলেই বলব।

–না। সে আমি পারব না জামাই-পণ্ডিত। আমার হাতের জলকঙ্কণার বামুন-কায়েত বাবুরা নুকিয়ে খায়, মদের সঙ্গে জল মিশিয়ে দিই, মুখে গ্লাস তুলে ধরি—তারা দিব্যি খায়। সে আমি দি–কিন্তু তোমাকে দিতে পারব না। দুর্গার চোখে জল আসিয়াছিল—গোপন করিবার জন্যই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত সে ঘুরিয়া দরজার চাবি খুলিতে আরম্ভ করিল।

দেবু একটু ম্লান হাসি হাসিয়া নীরব হইয়া বসিয়া রহিল।

সম্মুখেই রাস্তার ওপারে সেই শিউলিগাছটা। একা বসিয়া কেবলই মনে হইতেছে গতরাত্রির কথা! ছি—ছি—ছি! পদ্ম এ কি করি? কোনোমতেই আর সে পদ্মের প্রতি এককণা করুণা করিতে পারিতেছে না।

আকাশের মেঘটা এতক্ষণে কাটিতেছে। এক ঝলক রোদ উঠিল। আবার মেঘে ঢাকিল। আবার মেঘ কাটিয়া রোদ উঠিল। বৃষ্টি ধরিয়াছে।

—পেন্নাম গো পণ্ডিত মশাই! প্ৰণাম করিল সতীশ বাউরি; সঙ্গে আছে আরও কয়েকজন বাউরি মুচি চাষী মজুর। সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছে, ভিজিয়া ভিজিয়া কালো রঙও ফ্যাকাশে হইয়া উঠিয়াছে, পায়ের পাতার পাশগুলা-আঙুলের ফাঁক হাতের তেলো মড়ার হাতের মত সাদা এবং আঙুলের ডগাগুলি চুপসিয়া গিয়াছে।

প্রতিনমস্কার করিয়া দেবু কেবলমাত্র কথা বলিয়া আপ্যায়িত করিবার জন্যই জিজ্ঞাসা করিল-জল কেমন?

ভাসান বইছে মাঠে। ধানপান সব ড়ুবে গিয়েছে। গুছিটুছি খুলে নিয়ে যাবে। বড় ক্ষেতি করে দিলে পণ্ডিতমশায়!

পণ্ডিতকে এই দুঃখের কথা কয়টি বলিবার জন্য সতীশের ব্যগ্রতা ছিল। পণ্ডিতমশায়কে না বলিলে তাহার যেন তৃপ্তি হয় না।

দেবু সান্ত্বনা দিয়া বলিল—আবার দুদিন রোদ পেলেই ধান তাজা হয়ে উঠবে। ভাসান মরে যাক, যেসব জায়গায় গুছি খুলে গিয়েছেনতুন বীজের পরিনে লাগিয়ে দিও।

সতীশ কিন্তু সান্ত্বনা পাইল না, বলিল—ভেবেছিলাম এবার দুমুঠো হবে। তা ভাসানের যে রকম গতিক।

–তা হোক। ভাসান মরে যাবে। কতক্ষণ? এবার বর্ষা ভাল। দিনে রোদ রেতে জল–ফসল এবার ভাল হবে; জলও শেষ পর্যন্ত হবে।

–তা বটে। কিন্তু এত জলও যি ভাল নয়।

হঠাৎ দেবুর মনে একটা কথা চকিতের মত খেলিয়া গেল। নদী! ময়ূরাক্ষী! সে ব্যথভাবে প্রশ্ন করিল-নদী কেমন বল দেখি?

—আজ্ঞে, নদী দু-কানা। তবে ফেনা ভাসছে। ওই দেখেন, ইয়ের ওপর ময়ূরাক্ষী যদি পাথার হয়—বান যদি ঢোকে, তবে তো সব ফরসা হয়ে যাবে।

–বাঁধের অবস্থা কি? দেখেছ? কুঞ্চিত করিয়া দেবু প্রশ্ন করিল।

মাথা চুলকাইয়া সতীশ বলিল—গেলবার বান হয় নাই কিনা! উবারেও বান হয় নাই! তারপর নিজেই একটা অনুমান করিয়া লইয়া বলিলবাধ আপনার ভালই আছে। তা ছাড়া ইদিকে বাঁধ ভেঙে বান আসবে না। সে হলে পিথিবীই থাকবে না মাশায়—বলিয়া সতীশ একটু পারমার্থিক হাসি হাসিল।

দেবু উত্তর দিল না। বিরক্তিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। নিজ হইতে ভবিষ্যৎ ভাবিয়া ইহারা কোনো কাজ করে না-করিবে না।

সতীশ প্রণাম করিয়া বলিল যাই এখন পণ্ডিত মশায়, সেই ভোরবেলা থেকে বলিতে গিয়া সে হাসিয়া ফেলিল; হাসিয়া বলিল—চৌপর রাতই ভিজছি মাশায়। তার ওপর ভোরবেলা থেকে ভাসান ভেঙে হালুনি লেগে গিয়েছে। বাড়ি যাই। ইয়ের পর একবার পলুই নিয়ে বেরুব। উঃ, মাছে মাঠ একেবারে ময়লাপ হয়ে গিয়েছে।

অন্য একজন বলিল-কুসুমপুরের জনাব শ্যাথ আপনার কেঁচে গেঁথে একটা সাত সের কাতলা মেরেছে।

আর একজন বলিল কঙ্কণার বাবুদের লারান (নারায়ণ) দিঘি ভেসেছে।

দেবু উঠিয়া পড়িল।

পদ্মের এই অতি শোচনীয় পরিণতিতে সে একটা নিষ্ঠুর আঘাত পাইয়াছে। তাহার নিজের শিক্ষা-সংস্কার-জ্ঞান-বুদ্ধি-মত অপরাধ ষোল আনা পদ্মেরই, সে নিজে নির্দোষ। সে তাহাকে মেহ করিয়াছে—আপনার বিধবা ভ্ৰাতৃবধূর মত সসম্মানে তাহার অন্নবস্ত্রের ভার সাধ্যমত বহন করিয়াছে। গতরাত্রে সে যেভাবে আপনাকে সংযত রাখিয়া অতি মিষ্ট কথা বলিয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে তাহাতে অন্যায় কোথায়? মিথ্যা অপবাদ দিয়া শ্ৰীহরি পদ্মের জন্যই সমাজকে ঘুষ দিয়া তাহাকে পতিত করিতে উদ্যত হইয়াছে, তাহাও সে গ্রাহ্য করে নাই; নিৰ্ভয়ে পঞ্চায়েতের সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল। সুতরাং তাহার দোষটা কোনখানে?

তবুও কিন্তু মন মানিতেছে না। মানুষের ভগ্নী বা কন্যার এমন পরিণামের জন্য গভীর বেদনা-দুঃখ-লজ্জার সঙ্গে থাকে যে নিরুপায় অক্ষমতার অপরাধবোধ, পদ্মের জন্য দুঃখবেদনা-লজ্জার সঙ্গে সেই অক্ষমতার অপরাধবোধও অনাবিষ্কৃত ব্যাধির পীড়নের মত তাহাকে পীড়িত করিতেছিল। দুঃখ-বেদনা-লজ্জা সবই ওই অক্ষমতার অপরাধবোধের বিভিন্ন রূপান্তর। তাহার মন শত যুক্তিতৰ্কসম্মত নিৰ্দোষিতা সত্ত্বেও সেই পীড়নে পীড়িত হইতেছিল। দুর্গাকে বাড়িতে থাকিতে বলিয়া—তাহার হাতে জল খাইতে চাহিয়া বিদ্রোহের উত্তেজনায় মনকে উত্তেজিত করিয়াও সে ওই দুঃখ-বেদনা হইতে মুক্তি পাইল না। উপস্থিত বন্যারোধী বাঁধের উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া দেবু বধ দেখিতে বাহির হইয়া পড়িল সে কেবল ওই আত্মপীড়া হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য। দুর্গাকে ডাকিয়া বলিল-দুর্গা, আমি এসে রান্না চড়াব। তুই বাড়িটাড়ি যাস্ তো একবার ঘুরে আয় ততক্ষণ।

বিস্মিত হইয়া দুর্গা বলিল—কোথা যাবে এখন? পিথিমীতে আবার কার কোথা দুঃখু ঘটল?

গম্ভীরভাবে দেবু বলিল–ময়ূরাক্ষীতে বান বাড়ছে। বাঁধটা একবার দেখে আসি।

দুর্গা অবাক হইয়া গালে হাত দিল।

দেবু ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল কি?

—কি? কাঁদি-কাঁদি মন করছে, কেঁদে না আত্মি মিটছে, রাজাদের হাতি মরেছে, একবার তার গলা ধরে কেঁদে আসি—সেই বিত্তান্ত। আচ্ছা, বাঁধ ভেঙে বান কোন কালে ঢুকেছে শুনি?

—বকিস্‌নে। আমি আসি দেবু ছাতাটা হাতে লইয়া বাহির হইয়া গেল।

দুর্গা মিথ্যা কথা বলে নাই। প্ৰকাণ্ড চওড়া বাঁধের দুই পাশে ঘন শরবনের শিকড়ের জালের জটিল বাঁধনে বাঁধের মাটি একেবারে জমি এক অখণ্ড বস্তুতে পরিণত হইয়া গিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দশ-বিশ বৎসর অন্তর হড়পা বান আসেবা খুব প্রবল বান হয়, তখন অবশ্য একটু আধটু বধ ভাঙে; পরে সেখানে মাটি ফেলিয়া মেরামত করা হয়। কিন্তু বর্ষার আগে হইতে কোথাও বধ দুৰ্বল আছে—এ ভাবনা কেহ ভাবে না।

আগে কিন্তু ভাবিত। এই বাঁধ রক্ষার রীতিমত ব্যবস্থা ছিল।

দেবু মনে মনে সেই কথাগুলিকেই খুব বড় করিয়া তুলিল। ওই বাঁধের ভাবনাকেই একমাত্র ভাবনার কথা করিয়া তুলিয়া সে বাহির হইয়া পড়িয়ছিল।

অর্ধচন্দ্রাকারে অবস্থিত এই পঞ্চগ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠখানার প্রান্তে ধনুকের ছিলার মত বহিয়া গিয়াছে পাহাড়িয়া নদী ময়ূরাক্ষী। পাহাড়িয়া মেয়ের মতই প্রকৃতি। সাধারণত বেশ থাকে। জল বাড়ে কমে। কিন্তু বন্য প্রকৃতির উচ্ছ্বসের মত বন্যা আসে অকস্মাৎ হু-হু করিয়া—আবার তেমনি দ্রুতবেগেই কমিয়া যায়। তাহাতে বড় ক্ষতি হয় না। পঞ্চগ্রামের মাঠের প্রান্তে বন্যারোধী বাঁধ আছে—তাহাতেই বন্যাবেগ প্রতিহত হয়। বাঁধটি মাত্র পঞ্চগ্রামের সীমাতেই আবদ্ধ নয়। নদীকূলের বহু দূর পঞ্চগ্রামের প্রান্তসীমা অতিক্ৰম করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কবে কে এই বাঁধ। বাঁধিয়াছে কেহ বলিতে পারে না। লোকে বলে পাচের জাঙাল বা পঞ্চজনের জাঙাল। লোকে ব্যাখ্যা করিয়া বলে—পঞ্চজন মানে পঞ্চপাণ্ডব। মা কুন্তীকে লইয়া যখন তাহারা আত্মগোপন করিয়া ফিরিতেছিল—তখন এ অঞ্চলে ময়ূরাক্ষীর বন্যা আসিয়াছে, দেশঘাট ভাসিয়া গিয়াছে, ধান ড়ুবিয়াছে, ঘর ভাঙিয়াছে, দেশের লোকের দুঃখ-দুর্দশার আর সীমা নাই। রাজার মেয়ে, রাজার রানী, পঞ্চপাণ্ডব-জননীর চোখে জল আসিল লোকের এই দুর্দশা দেখিয়া। ছেলেরা বলিল—কাদ কেন মা? মা আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলেন লোকের দুর্দশা। যুধিষ্ঠির বলিল এর জন্য কাঁদ কেন? তোমার চোখে যেখানে জল আসিয়াছে, সেখানে কি লোকের দুর্দশা থাকে, না থাকিতে পারে? এমন প্রতিকার আমরা করিতেছি, যাহাতে আর কখনও বন্যায় এ অঞ্চলের লোকের ক্ষতি না হয়। বলিয়াই পাঁচ ভাই বাঁধ বাঁধিতে লাগিয়া গেলেন। বাঁধ বাধা হইল। পঞ্চপাণ্ডব চাষীদের ডাকিয়া বলিয়া গেলেনদেখ বাপু বধ বাঁধিয়া দিলাম। রক্ষণাবেক্ষণের ভার তোমাদের রহিল। প্রতি বৎসর-বর্ষার প্রারম্ভে রথযাত্রা, অম্বুবাচি, নাগপঞ্চমী প্রভৃতি হল-কর্ষণের নিষিদ্ধ দিনগুলিতে প্রত্যেকে কোদাল ঝুড়ি লইয়া আসিবে আপন আপন গ্রামের সীমানার বাধে প্রত্যেকে পাঁচ ঝুড়ি করিয়া মাটি দিয়া যাইবে; তিন দিনে, তিন-পাঁচ পনের ঝুড়ি মাটি দিবে।

সেই প্রথাই প্রচলিত ছিল আবহমানকাল। যখন হইতে জমিদার হইল গ্রামের সর্বময় কর্তা–হাসিল-পতিত-খাল-বিল-খানাখন্দ, ঘাসকর, বনকর, জলকর, ফলকর, পাতামহল, লতামহল, এমনকি উৰ্ধ-অধঃদরবস্ত হক-হুকুমের মালিক তখন হইতেই বাঁধ হইয়াছে। জমিদারের খাস সম্পত্তি; জমিদারের বিনা হুকুমে কাহারও বাঁধের গায়ে মাটি দিবার বা কাটিবার অধিকার রহিল না। যখন এ প্রথা উঠিয়া গেল, তখন জমিদার বেগার ধরিয়া বাঁধ মেরামত করাইতেন। হাল আমলে বাঁধ ভাঙিলে সেই রেওয়াজ অনুযায়ী বাঁধ বাঁধিবার খরচের কতক দেয়। জমিদার, কতক দেয় প্রজা। বৎসরে বাধে মাটি দেওয়ার দায়িত্ববোধ লোকের চলিয়া গিয়াছে। বাঁধ ভাঙিলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরখাস্ত যাইবে, তদন্ত হবে, এস্টিমেট হইবে জমিদারপ্রজাকে নোটিশ হইবে, তারপর ধীরেসুস্থে বাঁধ মেরামত হই তে থাকিবে।

বিস্তীর্ণ পঞ্চগ্রামের মাঠ জলে প্রায় ড়ুবিয়া গিয়াছে। দেবু ঠাহর করিয়া আল-পথ ধরিয়া চলিয়াছিল। রাত্রে আকাশে যে ঘনঘটা জমিয়াছিল—সে ঘনঘটা এখন অনেকটা কাটিয়া গিয়াছে। প্রখর রৌদ্র উঠিয়াছে। রৌদ্রের ছটা জলে পড়িয়া বিস্তীর্ণ মাঠখানা আয়নার মত ঝকমক করিতেছে। ধানের চারাগুলি বড় দেখা যায় না।

জল কোথাও এক-হাঁটু-কোথাও এককোমর। বর্ষার জল-নিকাশের যে দুইটা নালা আছে সেখানে জল এক-বুক, স্রোতও প্রচণ্ড। বাকি মাঠের মধ্যে জলস্রোত মন্থর, প্রায় স্থির রহিয়াছে বলিয়া মনে হয়; মধ্যে মধ্যে সেই মন্থর জলস্রোত চিরিয়া একটি রেখা অতি দ্রুতবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। সেই রেখার পিছনে পিছনে লোক ছুটিয়াছে—হাতে পলুই অথবা কোচ। ওগুলি মাছ, বড় মাছ। মাঠে মৎস্য-সন্ধানী লোক অনেক। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ।

দেবু সমস্ত মাঠটা অতিক্ৰম করিয়া বাঁধের সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিল; মনে পড়িয়া গেল, যেখানটায় সে উঠিবে, ওপাশে তাহারই নিচে ময়ূরাক্ষীর চরভূমির উপর শ্মশান; তাহার বিলু ও খোকার চিতা। বিলু আজ থাকিলে ঠিক এমনটা হইত না। পদ্মের এ পরিণাম হইতে পারিত না। যে মন্ত্র সে জানে নাসে মন্ত্ৰ তাহার বিলু জানিত। বিলু থাকিলে, কামার-বউকে দেবু নিজের বাড়িতেই রাখিতে পারি। বিলু হাসিমুখে তাহার কোলে খোকাকে তুলিয়া দিত। সকাল-সন্ধ্যায় তাহার কানে মন্ত্ৰ দিত। সকালে দুর্গানাম স্মরণ করিতে শিখাইত সকালে উঠিয়া যেবা দুর্গানাম স্মরে, সূর্যোদয়ে তার সব পাপ-তাপ হরে। শিখাইত কৃষ্ণের শতনাম। শিখাইত পুণ্যশ্লোক নাম স্মরণ করিতে, পুণ্যশ্লোক নলরাজা, পুণ্যশ্লোক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, পুণ্যশ্লোক জনার্দন নারায়ণ সর্বপুণ্যের আধার। সন্ধ্যায় গল্প বলিত, পরে সতীর গল্প, সীতার গল্প, সাবিত্রীর গল্প। কামার-বউয়ের সব ক্ষুধা, সব ক্ষোভ, সব লোলুপতার নিবৃত্তি হইত।

সে বাঁধের উপরে উঠিল। শরবনে উতলা বাতাসে সরসর শনশন শব্দ উঠিয়াছে। তাহারই সঙ্গে মিশিয়া রহিয়াছে একটা একটানা ক্ষীণ গোঙানির শব্দ। নদীর ডাক। নদীর বুকে ডাক উঠিয়াছে। এ ডাক তো ভাল নয়! ওপাশের ঘন শরবনের আড়াল ঠেলিয়া দেবু নদীর বুকের দিকে চাহিয়া সচকিত হইয়া উঠিল। এ যে ময়ূরাক্ষী ভীষণ হইয়া উঠিয়াছে, ভয়ঙ্কর-বেশে সাজিয়াছে। এপারে বধের কোল হইতে ওপারে জংশনের কিনারা পর্যন্ত ভাসিয়া উঠিয়াছে। জলের রঙ গাঢ় গিরিমাটির মত। দুই তটভূমির মধ্যে ময়ূরাক্ষী কুটিল আবর্তে পাক খাইয়া—তীরের মত ছুটিয়া চলিয়াছে। গেরুয়া রঙের জলস্রোতের বুক ভরিয়া ভাসিতেছে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা ফেনা। পশ্চিম হইতে পূর্বদিকে যতদূর দেখা যায়—ততদূর শুধুই ফেনা। তাহার উপর ময়ূরাক্ষীর বুকে জাগিয়াছে ডাক, ওই অস্ফুট গোঙানি। দেবু বন্যার কিনারা পর্যন্ত নামিয়া গেল। সেখানে দাঁড়াইয়া বাঁধের বুকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল। এদিক-ওদিক চাহিয়া হঠাৎ দেখিতে পাইল—শরবনের গায়ে জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে পিঁপড়ে এবং পোকার পুঞ্জ; বড় বড় গাছগুলির কাণ্ড বাহিয়া লক্ষ লক্ষ পতঙ্গ উপরে উঠিয়া চলিয়াছে। পায়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখিলমাত্র পায়ের পাতাটা ড়ুবিয়া ছিল ইহারই মধ্যে জল প্রায় গোড়ালির কাছ পর্যন্ত উঠিয়াছে। দেবু আবার বাঁধের উপর উঠিল। বাঁধটার অবস্থা দেখিতে সে অগ্রসর হইয়া চলিল।

ময়ূরাক্ষীতে এখন যে বন্যা, সে বন্যায় বেশি আশঙ্কার কারণ নাই। বর্ষায় নদীর বন্যা স্বাভাবিক। তবে এটা ভাদ্র মাস, ভদ্রে বন্যা হইলে মড়ক হয়। ডাক-পুরুষের কথায় আছে চৈত্রে কুয়া ভাদরে বান, নরমুণ্ড গড়াগড়ি যান। ভাদ্রের বন্যায় ফল পচিয়া অজন্ম হয়, গরিব গুনায় না-খাইয়া মরে। আর হয় বন্যার পরেই সংক্রামক ব্যাধি যত জ্বর-জ্বালা-কাল ম্যালেরিয়া। ছোটখাটো বন্যার ফলও কম অনিষ্টকর নহে। কিন্তু দেবু আজ যে বন্যার কথা ভাবিতেছে—সে বন্যা ভীষণ ভয়ঙ্কর। হড়পা বান, কেহ কেহ বলে ঘোড়া বান। হড়হড় শব্দে উন্মত্ত হ্ৰেষাধ্বনি তুলিয়া প্রচণ্ড গতিতে ধাবমান একপাল বন্য ঘোড়ার মতই এ বান ছুটিয়া আসে। কয়েক ফিট উঁচু হইয়া এক বিপুল উন্মত্ত জলরাশি আবর্তিত হইতে হইতে দুই কূল। আকস্মিকভাবে ভাসাইয়া, ভাঙিয়া, দুই পাশের প্রান্তর, ঘাম, ক্ষেত, খামার, বাগান, পুকুর তছনছ। করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। সেই হড়পা বান বা ঘোড়া বান আসিবে বলিয়া মনে হইতেছে।

ময়ূরাক্ষীতে অবশ্য এ বন্যা একেবারে নূতন নয়। পাহাড়িয়া নদীতে কৃচিৎ কখনও এ ধারায় বন্যা আসে। যে পাহাড়ে নদীর উদ্ভব, সেখানে আকস্মিক প্রবল প্রচণ্ড বৰ্ষণ হইলে সেই জল পাহাড়ের ঢালুপথে বেগ সঞ্চয় করিয়া এমনিভাবে নিম্নভূমিতে ছুটিয়া আসে। ময়ূরাক্ষীতেই ইহার পূর্বে আসিয়াছে।

একবার বোধহয় পঁচিশ-ত্রিশ বৎসর পূর্বে হইয়াছিল। সে বন্যার স্মৃতি আজও লোকে ভুলিয়া যায় নাই। নবীনেরা, যাহারা দেখে নাই, তাহারা সে বন্যার বিরাট বিক্রমচিহ্ন দেখিয়া শিহরিয়া ওঠে। দেখুড়িয়ার নিচেই মাইলখানেক পূর্বে ময়ূরাক্ষী একটা বাঁক ঘুরিয়াছে। সেই বাঁকের উপর বিপুল-বিস্তার বালুস্তৃপ এখনও ধু-ধু করিতেছে। একটা প্রকাও আমবাগান দেখা যায়-ওই বন্যার পর হইতে এখন বাগানটার নাম হইয়াছে গলার্পোতার বাগান; বাগানটার। প্রাচীন আমগাছগুলির শাখা-প্রশাখার বিশাল মাথার দিকটাই শুধু জাগিয়া আছে বালুভ্রুপের উপর। সেই বন্যায় ময়ূরাক্ষী বালি আনিয়া গাছগুলার কাণ্ড ঢাকিয়া আকণ্ঠ পুঁতিয়া দিয়া গিয়াছে। বাগানটার পরই মহিষডহরের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, এখনও বালিয়াড়ির উপর ঘাস জন্মে নাই। মহিষডহর ছিল তৃণশ্যামল চরভূমির উপর একখানি ছোট গোয়ালার গ্রাম। ময়ূরাক্ষীর উর্বর চরভূমির সতেজ সরস ঘাসের কল্যাণে গোয়ালাদের প্রত্যেকেই পুষিত মহিষের পাল। মহিষডহর গ্রামখানা সেই বন্যায় নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। ময়ূরাক্ষীর দুকূলভরা বন্যায় গোয়ালার ছেলেদের পিঠে লইয়া যে মহিষগুলা এপার-ওপার করিত, সেবারের সেই হড়পা বানে মহিষগুলা পর্যন্ত নিতান্ত অসহায়ভাবে কোনোরূপে নাক জাগাইয়া থাকিয়া ভাসিয়া গিয়াছিল।

এবার কি আবার সেই বন্যা আসিতেছে? শিবকালীপুরের সম্মুখে বাঁধের গায়ে বান বাঁধের বুক ছাপাইয়া উঠিয়াছে। পিঁপড়েগুলা চাপ বাঁধিয়া গাছের উপরে উঠিয়া আশ্ৰয় লইয়াছে। মুখে তাহাদের লক্ষ লক্ষ ডিম। শুধু পিঁপড়েই নয়, লাখে লাখে কত বিচিত্র পোকা। বাঁধের গায়ে ছিল। উহাদের বাসা। বন্যা আসিবার আগেই উহারা কেমন বুঝিতে পারে। বৃষ্টি আসন্ন হইলে উহারা। যেমন নিম্নভূমির বাসা ছাড়িয়া উঁচু জায়গায় উঠিয়া আসে, বন্যা আসিবার পূর্বেও তেমনি করিয়া উহারা বুঝিতে পারে এবং উপরে উঠিয়া আসে। সাধারণত বাঁধের মাথায় গিয়া আশ্ৰয় লয়। এবার উহারা গাছের উপরে আশ্রয় লইতেছে। আরও আশ্চর্য পিঁপড়েরা ডিম লইয়া উপরে উঠিলেই অন্য পিঁপড়ের দল তাহাদের আক্রমণ করে; ডিম কাড়িয়া লয়; এবার সে রকম যুদ্ধ পর্যন্ত নাই; এতটা পথ আসিতে সে মাত্র দুইটা স্থানে এ যুদ্ধ দেখিয়াছে। এখানে যাহারা আক্ৰমণ করিয়াছে তাহারা গাছেই থাকে, বিষাক্ত হিংস্র কাঠ-পিঁপড়ের দল। যাহারা নিচে হইতে উপরে উঠিয়াছে তাহারা যেন অতিমাত্রায় বিপন্ন, বন্যার জলে ভাসমান চালায় মানুষ ও সাপ যেমন নিৰ্জীবের মত পড়িয়া থাকে, উহাদের তেমনি নির্জীব অবস্থা।

বাঁধের অবস্থাও ভাল নয়। দীর্ঘকাল কেহ লক্ষ্য করে নাই। বাঁধের গায়ে অজস্র ছোট গর্ত। দিয়া জল ঢুকিতেছে। ইঁদুরে গর্ত করিয়াছে। এ গর্ত রোধ করিবার উপায় নাই। সর্বনাশা জাত। শস্যের আপদ-ঘরের আপদ, পৃথিবীর কোনো উপকারই করে না। বাঁধের ভিতরটা বোধহয় সুড়ঙ্গ কাটিয়া ফোঁপরা করিয়া দিয়াছে। বাঁধটা প্রকণ্ড চওড়া এবং ওই শরবনের শিকড়ের জালের। বাঁধনে বাধা বলিয়া সাধারণ বন্যায় কিছু হয় না। কিন্তু প্ৰমত্ত স্রোতের মুখে যে ডাক জাগিয়াছে সে যদি তাহার মনের ভ্রম না হয় তবে ময়ূরাক্ষীর বুকের মধ্যে হইতে ঘুমন্ত রাক্ষসী জাগিয়া উঠিবে। এবার ঘোড়া বানই আসিবে। সে বন্যার মুখে এই সংস্কার-বঞ্চিত প্রাচীন বাঁধ কিছুতেই টিকিয়া থাকিতে পারিবে না।

আবার আকাশে মেঘ করিয়া আসিল।

বাতাস বাড়িতেছে; ফিনফিন ধারায় বৃষ্টি নামিল। বাতাসের বেগে ফিনফিনে বৃষ্টি কুয়াশার পুঞ্জের মত ভাসিয়া যাইতেছে। এ বাদলা সহজে ছাড়িবে বলিয়া মনে হয় না। দুর্ভাগ্য—এ শুধু তাহাদেরই দুর্ভাগ্য। মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া তৈরি করা বুকের রক্ত-সেচা-মাঠ-ভরা ধান। পচিয়া যাইবে, গ্রাম ভাসিয়া যাইবে, ঘর-দুয়ার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হইবে, সমগ্র দেশটায়। হাহাকার উঠিবে। মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত, সহসা তাহার একটা কথা মনে হইল,—লোকে বলে সেকালের লোক পুণ্যাত্মা ছিল। কিন্তু সেকালেও তো এমনিভাবে এই হড়পা বান আসিত! এমনিভাবেই শস্য পচিত, ঘর ভাঙিত! লোকে হাহাকার করিত।… ভাবিতে ভাবিতে মহাগ্রামের সীমানা পার হইয়া সে দেখুড়িয়ার প্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল।

বাঁধের উপরে দুটি লোক দাঁড়াইয়া আছে, মাথায় ছাতা নাই, সর্বাঙ্গ ভিজিয়া গিয়াছে। একজনের হাতে একটা লাঠির মত একটা-কিছু, অন্যজনের হাতে একটা কি—বেশ ঠাওর করা গেল না। কুয়াশাপুঞ্জের মত বৃষ্টিধারার মধ্যে তাহাদের স্পষ্ট পরিচিতিকে ঝাপসা করিয়া রাখিয়াছে। আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া দেবু চিনিল—একজন তিনকড়ি, অন্যজন রাম ভল্লা, তিনকড়ির হাতে কোচ, রামের হাতে পলুই। তাহারা বাহির হইয়াছে মাছের সন্ধানে।

দেবু আসিয়া বলিল–মাছ ধরতে বেরিয়েছেন?

নদীর দিকে অখণ্ড মনোযোগের সহিত চাহিয়া তিনকড়ি দাঁড়াইয়া ছিল, দৃষ্টি না ফিরাইয়াই সে বলিল—বেরিয়েছিলাম। নদীর কাছ বরাবর এসেই যেন কানে গেল গো-গো শব্দ। নদী ডাকছে।

রাম বলিল পর পর তিনটে লাঠি পুঁতে দিলাম, দুটো ড়ুবেছে, ওই দেখেন—শেষটার গোড়াতে উঠেছে বান। গতিক ভাল লয় পণ্ডিতমশায়।

দেবু বলিল-আমিও সেই কথা ভাবছি। ডাক আমিও শুনেছি। ভাবছিলাম আমার মনের আমার মনের ভুল।

—উঁহুঁ! ভুল নয়! ঠিক শুনেছ তুমি!

–বাঁধের অবস্থা দেখেছেন? ইদুরে ফোঁপরা করে দিয়েছে।

রাম বলিল–ওতে কিছু হবে না। ভয় আপনার কুসুমপুরের মাথায়… কঙ্কণার গায়ে বাঁধ ফেটে আছে।

–ফেটে আছে?

—একেবারে ইমাথা-উমাথা ফাটল। সেই যে শিমুলগাছটা ছিল—বাবুরা কেটে নিয়েছে, তখুনি ফেটেছে। পাহাড়ের মতন গাছটা বাঁধের ওপরেই পড়েছিল তো, তার ওপর এইবার শেকড়গুলা পচেছে। লোকে কাঠ করতে শেকড় বার করে নিয়েছে। ভয় সেই জায়গায়; সেখানটা মেরামত না করলে, ও ময়ূরাক্ষী তো ভূয়োর মতন চেটে মেরে দেবে।

দেবু বলিল—যাবেন তিনু-কাকা?

তিনু তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত, সে যেন এতক্ষণ বল পাইতেছিল না। লোকে তাহাকে বলে হোপো। হইহই করা নাকি তাহার অভ্যাস। রামাও সেই কথা বলিয়াছে। কথাটা তাহাদের মধ্যে আগেই হইয়াছে। তিনকড়ি তখনই যাইতে উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু রামা বলিয়াছিল–যাবা তো! যেতে বলছ—যাচ্ছি—চল! কিন্তুক—যেয়ে করবা কি শুনি? কেউ আসবে বাঁধ। বাঁধতে?

—আসবে না?

—তুমিও যেমন, আসবে। তার চেয়ে লোকে খপর পেলে ঘরদুয়ার সামলাবে, ঘরে মাচান। বাঁধবে। চুপ করে বসে থাক। চল বরং নিজেদের ঘর সামলাই গিয়ে, মাচান বেঁধে রাখি। হরি করে রাতারাতি বান আসে–সব শালাকে ভাসিয়ে লিয়ে যায়।

তিনকড়ি তাহাতে গররাজি নয়। উৎফুল্ল হইয়া বলিল—মন্দ বলিস নাই রামা, ঠিকই বলেছিস! সেই হলেই শুয়ারের বাচ্ছাদের ভাল হয়। শুয়ারের বাচ্ছা, সব শুয়ারের বাচ্ছা। ঘুরে ফিরে পেট ভরণের জন্যে হুড়মুড় করে সব শালা সেই ছিরে পালের আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়ল।

দেবু তাগিদ দিলচলুন কাকা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দেখুড়িয়ার সীমানার পর মহাগ্রাম, তারপর শিবকালীপুর, তারপর কুসুমপুর। গোটা কুসুমপুরের সীমানাটা পার হইয়া কঙ্কণার সীমানার সঙ্গে সংযোগস্থলে বাঁধের গায়ে বেশ একটি ফাটল দেখা দিয়াছে। পূর্বে এখানে ছিল প্রকাণ্ড একটা শিমুলগাছ। সেকালে দেবু যখন স্কুলে পড়িত তখন গাছটাকে দেখিলেই মনে পড়িত অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শাল্মলী তরু।… গাছটায় অসংখ্য বনটিয়ার বাস ছিল। দেবুর বয়স তো অল্প, এমনকি তিনকড়ি এবং রামাও বাল্যকালে এই গাছে উঠিয়া বনটিয়ার বাচ্ছা পাড়িয়াছে।

শিমুলের তক্তা ওজনে খুব হালকা এবং তক্তাগুলিকে যথেষ্ট পাতলা করিয়া চিরিলেও ফাটে না; সেই হিসাবে পালকি তৈয়ারির পক্ষে শিমুল-তক্তাই প্রশস্ত। কঙ্কণার বাবুদের জমিদারি অনেক দুর্গম পল্লীগ্রাম অঞ্চলেও বিস্তৃত। এই বিংশ শতাব্দীর ঊনত্রিশ বৎসর চলিয়া গেল, এখনও সব গ্রামে গরুর গাড়ি যাইবারও পথ নাই। পূর্বকালে বরং পথ ছিল, কাঁচা মেঠো পথ; মাঠের মধ্য দিয়া একখানা গাড়ি যাইবার মত রাস্তা। বর্ষায় কাদা হইত, শীতে কাদা শুকাইয়া গাড়ির চাকায় গরুর খুরে গুঁড়া হইয়া ধূলা উড়িত নাম ছিল গো-পথ। ওই পথে মাঠ হইতে ধান আসিত, গ্রামান্তরে যাওয়া চলিত। পঞ্চায়েত রক্ষণাবেক্ষণ করি। কিন্তু জমিদার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই-গোচরের পতিতভূমির সঙ্গে গো-পথও প্রজাবিলি করিয়াছে। ভূমিলোভী চাষীরাও অনেক ক্ষেত্রে আপন জমির পাশে যেখানে গো-পথ পাইয়াছে সেখানে আত্মসাৎ করিয়াছে। আজকাল ইউনিয়ন বোর্ড পাকা রাস্তা লইয়া ব্যস্ত, এদিকে দৃষ্টি দিবার অবকাশও নাই। কাজেই এই মোটর-ঘোড়াগাড়ির যুগেও জমিদারের পালকির প্রয়োজন আছে; সেই পালকির জন্যই শিমুলগাছটা কাটা।

দীর্ঘকালের সম্বন্ধ-বন্ধন ছিন্ন করিয়া বনস্পতি যখন মাটিতে পড়িল, তখন তাহারই বত্রিশ নাড়ির টানে মাটির বাঁধটার উপরের খানিকটা ফাটিয়া বসিয়া গেল। সেই তখন হইতেই বাঁধটার এইখানটায় ফাট ধরিয়া আছে। উপরের অর্ধাংশে ফাটল, নিচেটা ঠিকই আছে। বন্যা সচরাচর বাঁধের উপরের দিকে ওঠে না। তাই ওদিকে কাহার দৃষ্টি পড়ে নাই। এবার বন্যা হুহু করিয়া উপরের দিকে উঠিতেছে। দেবু, তিনকড়ি ও রাম তিনজনে ফাটল-জীৰ্ণ বধটাকে দেখিয়া একবার পরস্পরের দিকে চাহিল। তিনজনের দৃষ্টিতেই নীরব শঙ্কিত প্রশ্ন ফুটিয়া উঠিয়াছে।

তিনকড়ি বলিল—এ তো দু-চারজনের কাজ নয় বাবা!

রাম হাসিয়া বলিলবান যে রকম বাড়ছে, তাতে লোক ডাকতে ডাকতেই বধ বেসজ্জনের মা-কালীর মত কেতিয়ে পড়বে।

তিনকড়ি গাল দিয়া উঠিল–হারামজাদা, হাসতে তোর লজ্জা লাগে না?

রাম প্রবলতর কৌতুক অনুভব করিল, সে হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। তাহার ঘর। বলিতে একখানা কুঁড়ে; সম্পদ বলিতে খানকয়েক থালা-কঁসা, একটা টিনের পেঁটরা, কয়েকখানা কথা, একটা হুঁকো আর কয়েকখানা লাঠি ও সড়কি। নিজে সে এই পৌঢ় বয়সেও ভীমের মত শক্তিশালী, সাঁতারে সে কুমির; তাহার শঙ্কাও কিছু নাই গ্রাম্য গৃহস্থদের উপরেও মমতা কিছু নাই। তাহারা তাহাকে ভয় করে, ঘৃণা করে, নির্যাতনে সাহায্য করে বি-এল। কেসে সাক্ষ্য দেয়; তাই তাহাদের চরমতম দুর্দশা হইলেও সে ফিরিয়া চায় না। তাহাদের। দুর্দশায় রামের মহা-আনন্দ। সে হাসিয়া সারা হইল।

দেবু ফাটল-ভরা বাঁধটার দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিল।

দুরন্ত প্লাবনে পঞ্চগ্রাম ভাসিয়া যাইবে। মনশ্চক্ষে ভাসিয়া উঠিল দুর্দশাগ্ৰস্ত অঞ্চলটার ছবি। রাক্ষসী ময়ূরাক্ষী যুগে যুগে এমনি করিয়া পঞ্চগ্রামের শস্যসম্পদ, ঘর-দুয়ার ভাঙিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়। কিন্তু সেকালে মানুষের অবস্থা ছিল আলাদা। মানুষের দেহে ছিল অসুরের মত শক্তি। সেকালের চাষীর হাতে থাকিত সাত-আট সের ওজনের কোদালি, গ্রামের মধ্যে ছিল একতা। ময়ূরাক্ষী বাঁধ ভাঙিয়া সব ভাসাইয়া দিয়া যাইত, শক্তিশালী চাষীরা আবার বাঁধ বাঁধিত; জমির বালি ঠলিয়া ফেলিত। সেকালের বলদগুলাও ছিল ওই চাষীদের মত সবল—সেই বলদে হাল জুড়িয়া আবার জমি চষিত, পর বৎসরেই পাইত অফুরন্ত ফসল। আবার ঘরদুয়ার হইত, নূতন সুন্দরতর ঘর গড়িত মানুষ। গ্রামগুলি নূতন সাজে সাজিয়া গড়িয়া উঠিত; সংসারে বৃদ্ধা গিনির অন্তর্ধানের পর নূতন গিন্নির হাতে সাজানো সংসারের মত চেহারা হইত গ্রামের। কিন্তু এ কাল আলাদা। অনাহারে চাষীর দেহে শক্তি নাই, গরুগুলাও না খাইয়া শীর্ণ দুর্বল। এখন জমিতে বালি পড়িলে মাঠের বালি মাঠেই থাকিবে, ক্ষেত হইবে বালিয়াড়ি; ভাঙা ঘর মেরামত করিয়া কুঁড়ে হইবে, মানুষ মরিবার দিনের দিকে চাহিয়া কোনোরূপে মাথা গুঁজিয়া থাকিবে, এই পর্যন্ত। এই বিপদের মুখে ডাক দিলে তবু মানুষ আসিবে, কিন্তু বিপদ কাটিয়া গেলে তারপর বাঁধ বাঁধিতে আর কেহ আসিবে না। মানুষের একতার বোটা কোথায় কে কাটিয়া দিয়াছে—আর বাধা যায় না। তবু এই সময় এই সময় ডাক দিলে, মানুষ আসিলেও আসিতে পারে।

সে বলিল—তিনু-কাকা, লোক যোগাড় করতেই হবে। আপনি দেখুড়ে আর মহাগ্রাম যান। আমি কুসুমপুর আর শিবকালীপুরে যাই।

তিনু বলিল–রামা, তোর নাগরা নিয়ে এসে পেট্‌।

রাম বলিল—মিছে—নাগরা পিটিয়ে আমার হাত বেথা বাড়াবে মোড়ল। কেউ আসবে না।

তিনু বলিল–তুই সব জানিস্! ভল্লারাও আসবে না?

রাম বলিল—দেখো! আমাদের গায়ের ভল্লাদের কথা ছাড়, তারা আসবে। কিন্তুক আর এক মামুও আসবে না—তুমি দেখো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *