২.১ বর্ণের শ্রেণীবিভাগ (বর্ণ ও ধ্বনি-প্রকরণ)

দ্বিতীয় অধ্যায় : বর্ণ ও ধ্বনি-প্রকরণ
প্রথম পরিচ্ছেদ : বর্ণের শ্রেণীবিভাগ

“আমাদের বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে”–বলিলে এক সঙ্গে পাঁচটি কথা বলা হইল। ‘আমাদের’, ‘বাগানে’, ‘অনেক’, ‘ফুল’ এবং ‘ফুটেছে’–এই পাঁচটি বাংলা শব্দের প্রতিটিকে বিশ্লেষণ করা যায়। এখন দেখা যাক, প্রত্যেকটিকে ভাঙিয়া দেখিলে কী পাওয়া যায়।

আমাদের = আ + ম্‌ + আ + দ্‌ + এ + র্‌ + অ।

বাগানে = ব্‌ + আ + গ্‌ + আ + ন্‌ +এ।

অনেক = অ + ন্‌ + এ + ক্‌ + অ।

ফুল = ফ্‌ + উ + ল্‌ + অ।

ফুটেছে = ফ্‌ + উ + ট্‌ + এ + ছ্‌ + এ।

প্রথম ক্ষেত্রে সাতটি, দ্বিতীয়টির বেলায় ছয়টি প্রভৃতি কয়েকটি বিশেষ ধরনের চিহ্ন পাই। প্রতিটি চিহ্ন মুখে উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে আমরা কানে যে শব্দটি শুনিতে পাই, তাহাকেই ধ্বনি বলা হয়। ফুসফুস হইতে পাঠানো শ্বাসবায়ু বাহিরে আসিবার সময় কণ্ঠনালী, তালু, মূর্ধা, দাঁত, জিভ, ঠোঁট ইত্যাদি আমাদের মুখের ভিতরের বা বাহিরের কোনো-না-কোনো অংশে বাধা পায়; তখনই বিভিন্ন প্রকার ধ্বনির সৃষ্টি হয়। সুতরাং, কোনো ভাষায় উচ্চারিত শব্দকে ভাঙিয়া দেখিলে যে নানা রকমের বিশেষ চিহ্ন পাওয়া যায়, সেগুলি মুখে উচ্চারণ করিবার সময়ে আমরা কানে যে শব্দ শুনি, তাহাই ধ্বনি।

৯। ধ্বনিঃ দৃষ্টিগ্রাহ্য বর্ণকে বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারণ করিলে ক্ষতিগ্রাহ্য যে শব্দ পাই, তাহাকে ধ্বনি বলা হয়।

কিন্তু ধ্বনি তো শুধুমাত্র কানেই শুনিতে পাওয়া যায়; তাহাকে আমাদের চক্ষের সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে হইলে নির্দিষ্ট কিছু চিহ্নের প্রয়োজন হয়। তবেই তো আমরা কর্ণে শ্রুত সেই ধ্বনিকে বিশেষ কয়েকটি চিহ্নের দ্বারা নির্দেশ করিয়া লিখিতে পারি; প্রত্যক্ষ বস্তুর রূপে দেখা ধ্বনির সেই লিখিত সুন্দর রূপটিই হইল বর্ণ। অন্যভাবে বলিতে পারি, বাগযন্ত্র বা জিহ্বার সাহায্যে আমরা যে-সমস্ত কথা উচ্চারণ করি, তাহা কতকগুলি ধ্বনির সামঞ্জস্যপূর্ণ সমষ্টিমাত্র। প্রতিটি ধ্বনি লিখিবার জন্য এক-একটি সুডৌল চিহ্ন রহিয়াছে। ধ্বনির নির্দেশক এই সমস্ত প্রতীক বা চিহ্নকে বর্ণ বলে।

১০। বর্ণ: বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত শ্রুতিগ্রাহ্য ধ্বনির দৃষ্টিগ্রাহ্য সুদর্শন লিখিত রূপটিকে বর্ণ বলে। অ, আ, ক, খ্‌ ইত্যাদি এক-একটি বর্ণ।

“জল পড়ে” বলিলে দুইটি কথা বলা হয়; “জল” একটি কথা, আর “পড়ে” আর একটি কথা। “জল” কথাটি ভাঙিলে পাওয়া যায় জ্‌ + অ + ল্‌ + অ এই চারিটি ধ্বনি বা বর্ণ। ইহাদের কোনোটিকেই আর ভাঙা যায় না। তেমনি “পড়ে” কথাটি ভাঙিলে প্ + অ + ড়্‌ + এ এই চারিটি ধ্বনি বা বর্ণ পাওয়া যায়। ইহাদেরও কোনোটিকেই আর ভাঙা যায় না। এইজন্য বর্ণকে ভাষার অবিভাজ্য অঙ্গ বলা হয়।

বাংলা ভাষায় মোট সাতচল্লিশটি বর্ণ আছে। এই বর্ণগুলির সমষ্টিকে বর্ণমালা বলে। বাংলা বর্ণমালা দুইভাগে বিভক্ত–স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ।

স্বরবর্ণ

১১। স্বরবর্ণ: যে বর্ণ অন্য বর্ণের সাহায্য ব্যতীতই স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয় এবং অন্য বর্ণের উচ্চারণে সাহায্যও করে, সেই বর্ণকে স্বরবর্ণ বলে।

বাংলা ভাষায় অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ-বারোটি স্বরবর্ণ; ইহাদের মধ্যে ৯ (উচ্চারণ : লি)-এর প্রয়োগ বাংলায় নাই।

উচ্চারণ-সময়ের তারতম্য-অনুসারে স্বরবর্ণগুলিকে হ্রস্ব ও দীর্ঘ এই দুইভাগে ভাগ করা হয়। অ, ই, উ, ঋ–এই চারিটি বর্ণের উচ্চারণে কম সময় লাগে। বলিয়া ইহাদিগকে হ্রস্বস্বর বলে। সংস্কৃতমতে প্রত্যেকটি হ্রস্বস্বরের মাত্ৰাসংখ্যা এক। আর আ, ঈ, উ, এ, ঐ, ও, ঔ–এই সাতটি বর্ণের উচ্চারণে বেশী সময় লাগে বলিয়া এইগুলিকে দীর্ঘস্বর বলে। সংস্কৃতমতে প্রতিটি দীর্ঘস্বরের মাত্ৰাসংখ্যা দুই। কিন্তু বাংলায় দীর্ঘস্বরগুলি নামেই দীর্ঘ; ইহাদের স্বাভাবিক উচ্চারণ হ্রস্ব অর্থাৎ একমাত্ৰা। সংস্কৃতের অনুকরণে এই দীর্ঘস্বরগুলির উচ্চারণ দীর্ঘ করিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়। তবে কদাচিৎ গদ্যে জোর দিবার জন্য এবং মাঝে মাঝে কবিতায়ও ইহাদের উচ্চারণ দীর্ঘ হয়।

গদ্যে : কী যে কর দিনরাত! “কলি! কলি! ঘোর কলি! ব্রাহ্মণ বলে কেউ কি আর মানছে, না মানবে?”

কবিতায় : (ক) কত কাল পরে বল, ভারত রে।
দুখ-সাগর সাঁতারি পার হবে।…..
নিজ বাসভূমে পরবাসী হলে,
পর-দাসখতে সমুদায় দিলে। –গোবিন্দচন্দ্র রায়।

(খ) রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিতালে–
গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।–রবীন্দ্রনাথ।

একইভাবে হ্রস্বস্বরের উচ্চারণও মাঝে মাঝে দীর্ঘ হয়।–মহানগরীর সর্বত্রই এখন “জল” “জল” রব। “সে পথ নবাবী পথ নয়, কিন্তু পথ।”

এই হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বর ছাড়া আর এক ধরনের স্বর আছে–প্লুতস্বর। গানে, দূর হইতে কাহাকেও আহ্বানে বা রোদনে পুতস্বরের ব্যবহার হয়।

১২। প্লুতস্বর ও গানে, রোদনে বা দূর হইতে কাহাকেও আহ্বানে যখন হদীর্ঘ-নির্বিশেষে যেকোনো স্বর অতিরিক্ত মাত্রায় বিলম্বিত করা হয়, তখন সেই বিলম্বিত স্বরটিকে পুতস্বর বলে। প্লুতস্বর কমপক্ষে তিনমাত্রার হইবেই।

আহ্বানে : অরুণ (অ-রু-উ-উ-ন্‌)! একটু দাঁড়া।

গানে : “মা বলে ডাকে না ভরত মুখ দেখে না শত্রুঘন।”

মনে রাখিও, প্লুতস্বরে হ্রস্বদীর্ঘভেদ নাই। সুরকে আশ্রয় করিয়া গানে যেকোনো স্বর দীর্ঘ হয়। আহ্বানেও তাহাই হয়। অবশ্য প্লুতস্বরের লিখিত চিহ্ন কিছু নাই, শুধু অর্থ ও পরিবেশ বুঝিয়া স্বরকে বিলম্বিত করিতে হয়।

১৩। যৌগিকস্বর (Diphthong) : যে কয়েকটি স্বরধ্বনি পাশাপাশি থাকিবার ফলে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, তাহাদের সন্ধিস্বর বা যৌগিকস্বর বা সন্ধ্যক্ষর বলে। ঐ (অই বা ওই), ঔ (অউ বা ওউ)। বাংলায় আরও পঁচিশটি যৌগিক স্বরধ্বনি আছে। সেগুলির জন্য পৃথক বর্ণ নাই। মৌলিক বর্ণগুলিকে পাশাপাশি লিখিয়াই সেগুলিকে প্রকাশ করা হয়। যেমন : ইউ [ পিউ, মিউ ]; এই [ নেই, যেই, খেই ]; আই [ যাই, খাই, নাই, চাই ]; আইয়া ( নাইয়া, খাইয়া, গড়াইয়া ]; আইয়াও (করাইয়াও, জানাইয়াও]; আওয়াইয়া [খাওয়াইয়া, নাওয়াইয়া, পাওয়াইয়া]; আওয়াইয়াও [নাওয়াইয়াও] ইত্যাদি। লক্ষ্য কর, কেবল ঐ এবং ঔ এই দুইটি যৌগিক স্বরের লিখিত রূপ (বর্ণ) রহিয়াছে, অন্যগুলির লিখিত রূপ নাই।

ব্যঞ্জনবর্ণ

১৪। ব্যঞ্জনবর্ণ: যে-সকল বর্ণ স্বরবর্ণের সাহায্য ব্যতীত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হইতে পারে না, তাহাদিগকে ব্যঞ্জনবর্ণ বলে।

ব্যঞ্জনবর্ণ পঁয়ত্রিশটি—ক্‌ খ্‌ গ্‌ ঘ্‌ ঙ্‌। চ্‌ ছ্‌ জ্‌ ঝ্‌ ঞ্‌। ট্‌ ঠ্‌ ড্‌ ঢ্‌ ণ্‌। ত্‌ থ্‌ দ্‌ ধ্‌ ন্‌। প্‌ ফ্‌ ব্‌ ভ্‌ ম্। য্‌ র্‌ ল্‌ ব্‌। শ্‌ ষ্‌ স্ হ্‌। ং ঃ। ইহা ছাড়া আরও অতিরিক্ত কয়েকটি বর্ণ—ড়্‌ ঢ়্‌ ৎ (ত্‌) এবং ঁ বাংলায় আছে।

ব্যঞ্জনবর্ণগুলি উচ্চারিত হইবার সময় শ্বাসবায়ু মুখগহ্বর দিয়া বাহিরে আসিবার পথে কোনো-না-কোনো স্থানে বাধা পায়। এইজন্য ইহারা আপনা-আপনি উচ্চারিত হইতে পারে না। ইহাদের উচ্চারণে কোনো-না-কোনো স্বরবর্ণের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। সেই স্বরবর্ণের উচ্চারণ-হিসাবেই স্বরযুক্ত ব্যঞ্জনটির উচ্চারণ হয়। যথা : ক্‌ + অ = ক; ক্‌ + আ = কা; ক্ + ই = কি; ক্ + উ = কু; ক্ + ঋ = কৃ; ক্‌ + ঐ = কৈ; ক্‌ + ঔ = কৌ ইত্যাদি।

লক্ষ্য কর, প্রত্যেক ব্যঞ্জনবর্ণের নীচের ডানদিকে হস্‌চিহ্ন (্‌) আছে। কোনো স্বর যখন ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত হয়, তখন এই চিহ্নটি লোপ পায়, এবং যুক্ত স্বরবর্ণের আকৃতিরও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়। কিন্তু অ-কারযুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে মাত্র হস্‌চিহ্নটি লোপ পায়, অ-কারের কোনো চিহ্নই আর থাকে না। ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হইলে কোন স্বরের কীরূপ পরিবর্তন হয়, দেখ : আ (া), ই (ি), ঈ (ী), উ (ু), ঊ (ূ), ঋ (ৃ), এ (ে), ঐ (ৈ), ও (ো), ঔ (ৌ)। ব্যঞ্জনে যুক্ত স্বরধ্বনির এই রূপগুলিকে স্বরধ্বনির সাংকেতিক রূপ বলা হয়।

ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ স্বরবর্ণগুলির লিখিবার রীতি যাহাই হউক না কেন অর্থাৎ সাংকেতিক রূপটি ব্যঞ্জনের ডানদিকে বা বামদিকেই আসুক, অথবা ডান-বাম দুইদিকেই ভাগাভাগি অবস্থায় থাকুক, কিংবা নীচেই নামুক, প্রথমে ব্যঞ্জন ও পরে স্বর রহিয়াছে, ইহাই জানিবে।

১৫। স্পর্শবর্ণ : ক্ হইতে ম্ পর্যন্ত পঁচিশটি বর্ণ উচ্চারণ করিবার সময় জিহ্বার কোনো-না-কোনো অংশ কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা বা দন্ত স্পর্শ করে কিংবা অধরের সহিত ওষ্ঠের স্পর্শ হয় বলিয়া এই পঁচিশটি বর্ণকে স্পর্শবর্ণ বলে।

স্পর্শবর্ণগুলিকে উচ্চারণস্থান-অনুযায়ী নিটোল বৈজ্ঞানিক রীতিতে পাঁচটি বর্গে বা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এক-একটি বর্গে পাঁচটি করিয়া বর্ণ। প্রত্যেকটি বর্গের প্রথমবর্ণের নাম-অনুসারে সেই বর্গের নামকরণ হইয়াছে।

(১) ক্‌ খ্‌ গ্‌ ঘ্‌ ঙ্‌–ক-বর্গ–উচ্চারণে জিহ্বামূল কণ্ঠ স্পর্শ করে।

(২) চ্‌ ছ্‌ জ্‌ ঝ্‌ ঞ্‌–চ-বর্গ উচ্চারণে জিহ্বার মধ্যভাগ তালু স্পর্শ করে।

(৩) ট্‌ ঠ্‌ ড্‌ ঢ্‌ ণ্‌–ট-বর্গ–উচ্চারণে জিহ্বাগ্র উলটাইয়া মূর্ধা স্পর্শ করে।

(৪) ত্‌ থ্‌ দ্‌ ধ্‌ ন্‌–ত-বর্গ–উচ্চারণে জিহ্বা উপর পাটির দন্ত স্পর্শ করে।

(৫) ফ্‌ ব্‌ ভ্‌ ম্‌–প-বর্গ–উচ্চারণে অধরের সহিত ওষ্ঠের স্পর্শ হয়।

১৬। অল্পপ্রাণ বর্ণ ও প্রতি বর্গের প্রথম ও তৃতীয়বর্ণের উচ্চারণে নিশ্বাস জোরে বাহির হয় না বলিয়া ইহাদিগকে অল্পপ্রাণ বর্ণ (Unaspirated) বলে। যথা : ক্ গ, চ্‌ জ্‌, ট্‌ ড্‌, ত্‌ দ্‌, প্‌ ব্‌। প্রাণ বলিতে হ্‌-কার জাতীয় নিশ্বাসধ্বনি বুঝায়।

অল্পপ্রাণ বর্ণ মাঝে মাঝে মহাপ্রাণ বর্ণের মতো উচ্চারিত হইলে পীনায়ন হয়। কাঁটাল > কাঁঠাল; কাঁক > কাঁখ; থুতু > থুথু।

১৭। মহাপ্রাণ বর্ণ ও প্রতি বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থবর্ণের উচ্চারণ নিশ্বাস যুক্ত হয় বলিয়া এই বর্ণগুলিকে মহাপ্রাণ বর্ণ (Aspirated) বলে। যথা : খ্‌ ঘ্‌, ছ্‌ ঝ্‌, ঠ্‌ ঢ্‌, থ্‌ ধ্‌, ফ্‌ ভ্‌। অল্পপ্রাণ বর্ণের সঙ্গে হ্‌-কার জাতীয় নিশ্বাসধ্বনি যুক্ত হইলেই মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণ হয়। ক্ + হ্‌ = খ; জ্‌ + হ্‌ = ঝ্‌; ড্‌ + হ্‌ = ঢ; ত্‌ + হ্‌ = থ্‌; ব্‌ + হ্‌ = ভ্‌ ইত্যাদি।

সহজ কথায় বলা যায়? বর্গের প্রথমবর্ণ + হ্‌-কার জাতীয় নিশ্বাসধ্বনি = বর্গের দ্বিতীয়বর্ণ; বর্গের তৃতীয়বর্ণ + হ্‌-কার জাতীয় নিশ্বাসধ্বনি = বর্গের চতুর্থবর্ণ।

মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণ বিশেষ আয়াসসাধ্য বলিয়া এই বর্ণগুলি মৌখিক বাংলায় প্রায়ই অল্পপ্রাণ বর্ণের মতো উচ্চারিত হয়; তখন ক্ষীণায়ন হয়। কাঁধ + উয়া = কাঁধুয়া > কেঁধো > কেঁদো (কেঁদো বাঘ); মাথা > মাতা; চোখ > চোক; ধাই-মা > দাই-মা; হয়েছ > হয়েচ; অষ্টরম্ভা > অষ্টরম্বা; কাঠ > কাট; খাচ্ছি > খাচ্চি।

১৮। অঘোষবর্ণ ও প্রতি বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয়বর্ণের উচ্চারণের সময় কণ্ঠস্থ স্বরতন্ত্রীর কম্পন হয় না বলিয়া কণ্ঠস্বর মৃদু থাকে; এইজন্য এই বর্ণগুলিকে অঘোষবর্ণ (Unvoiced Sounds) বলে। যথা : ক্‌ খ্‌, চ্‌ ছ্‌, ট্‌ ঠ্‌, ত্‌ থ্‌, প্‌ ফ্‌। ধ্বনিবিজ্ঞানে স্বরের গাম্ভীর্যকে ঘোষ বলে; সুতরাং যে বর্ণের উচ্চারণে স্বরগাম্ভীর্য নাই, তাহাই অঘোষ। শ্‌ ষ্‌ স্ ইহারাও অঘোষ।

১৯। ঘোষবর্ণ ও প্রতি বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমবর্ণের উচ্চারণের সময় বাতাসের ধাক্কায় কণ্ঠস্থ স্বরতন্ত্রীর কম্পন হয় বলিয়া কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়; এইজন্য এই বর্ণগুলিকে ঘোষবর্ণ বা নাদবর্ণ (Voiced Sounds) বলে। যথা : গ্‌ ঘ্‌ ঙ্‌, জ্‌ ঝ্‌ ঞ্‌, ড্‌ ঢ্‌ ণ্‌, দ্‌ ধ্‌ ন্‌, ব্‌ ভ্‌ ম্‌। হ্‌-কেও ঘোষবর্ণ বলা হয়।

কোনো কোনো অঘোষবর্ণ যখন শিথিল উচ্চারণে ঘোষবর্ণে পরিণত হয়, তখন ঘোষীভবন হইয়াছে বলা হয়। “দুধমাখা ভাত কাগে খায়” (কাক>কাগ)। শাক>শাগ; ধপধপে>ধবধবে। আবার, কোনো কোনো ঘোষবর্ণ অঘোষবর্ণে পরিণত হইলে অঘোষীভবন হয়। বড়ঠাকুর>বট্‌ঠাকুর; বাবু>বাপু; বীজ>বিচি।

২০। নাসিক্যবর্ণ ও প্রত্যেক বর্গের পঞ্চমবর্ণ অর্থাৎ ঙ্‌ ঞ্‌ ণ্‌ ন্‌ ম্‌–এই পাঁচটি বর্ণের উচ্চারণকালে মুখমধ্যস্থ বায়ু কেবল মুখবিবর দিয়া বহির্গত না হইয়া নাসিকা দিয়াও বহির্গত হয় বলিয়া এই পাঁচটি বর্ণকে নাসিক্যবর্ণ বা অনুনাসিকবর্ণ (Nasals) বলা হয়। অন্যান্য স্পর্শবর্ণ অপেক্ষা এই নাসিক্যবর্ণগুলির উচ্চারণ একটু বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়। বর্ণগুলির উচ্চারণ লক্ষ্য কর ও ঙ্‌ = ং, ঞ্‌ =ন্‌, ণ্‌ =ন্‌, ন্ =ন্‌, ম্ = ম্।

নিম্নলিখিত তালিকাটি বর্গীয় বর্ণগুলির শ্রেণীনির্দেশে বিশেষ সহায়ক।–

বর্গঅঘোষবর্ণঘোষ বা নাদবর্ণ 
অল্পপ্রাণ
১ম
মহাপ্রাণ
২য়
অল্পপ্রাণ
৩য়
মহাপ্রাণ
৪র্থ
নাসিক্য
৫ম
উচ্চারণস্থান
ক-বর্গক্‌খ্‌গ্‌ঘ্‌ঙ্‌কণ্ঠ
চ-বর্গচ্‌ছ্‌জ্‌ঝ্‌ঞ্‌তালু
ট-বর্গট্‌ঠ্‌ড্‌ঢ্‌ণ্‌মূর্ধা
ত-বর্গত্‌থ্‌দ্‌ধ্‌ন্‌দন্ত
প-বর্গপ্‌ফ্‌ব্‌ভ্‌ম্‌ওষ্ঠ

২১। উষ্মবর্ণ : যে-সমস্ত বর্ণের উচ্চারণে উন্মা অর্থাৎ শ্বাসবায়ুর প্রাধান্য থাকে, তাহাদিগকে উষ্মবর্ণ বলে। যথা : শ্‌ ষ্‌ স্ হ্। যতক্ষণ শ্বাস থাকে ততক্ষণ এই বর্ণগুলির উচ্চারণ প্রলম্বিত করা যায়। শ্বাসের দীর্ঘতার সঙ্গে ইহাদের উচ্চারণ সম্ভব, সেইজন্য ইহারা উষ্মবর্ণ (Spirants)। অঘোষ, হ্‌ ঘোষ। শ্‌ ষ্‌ স্‌ উচ্চারণের সময় প্রলম্বিত একটি শিসধ্বনির সৃষ্টি হয় বলিয়া–এই বর্ণত্রয়কে শিসধ্বনিও বলা হয়।

২২। অন্তঃস্থবর্ণ ও একদিকে স্পর্শবর্ণ, অন্যদিকে উষ্মবর্ণ, এই দুই শ্রেণীর অন্তঃ অর্থাৎ মধ্যে স্থান বলিয়া এবং উচ্চারণে স্বর ও ব্যঞ্জনের মধ্যবর্তী বলিয়া য্‌ র্‌ ল্‌ ব্‌ এই চারিটি বর্ণ অন্তঃস্থবর্ণ।

স্বরবর্ণের উচ্চারণকালে মুখবিবর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত থাকে। ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণকালে শ্বাসবায়ু বাহিরে আসিবার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এই চারিটি বর্ণের উচ্চারণে মুখবিবর সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্তও থাকে না, আবার শ্বাসবায়ু সম্পূর্ণরূপে বাধাপ্রাপ্তও হয় না; এইজন্য ইহারা না স্বর, না ব্যঞ্জন। ইহাদের মধ্যে য্‌ ও ব্‌-কে বলা হয় অর্ধস্বর (Semi-Vowels); এবং র্‌ ও ল্‌-কে বলা হয় তরল-স্বর (Liquids)।

২৩। আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ : যে-সকল বর্ণ পূর্ববর্তী স্বরবর্ণের আশ্রয় ছাড়া উচ্চারিত হয় না, তাহাদিগকে আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ বলে। যেমন ং (অনুস্বর–স্বরের অনু অর্থাৎ পশ্চাতে বসে বলিয়া এই নাম) ওঃ (বিসর্গ)। অন্য ব্যঞ্জনের মতো ইহারা পরে কোনো স্বরবর্ণের সাহায্য লয় না। ব্যঞ্জন ও স্বরের সঙ্গে ইহাদের কোনো যোগ নাই বলিয়া ইহারা অযোগ; অথচ উচ্চারণকালে ইহারা নানারূপ পরিবর্তন ঘটায়, সেইজন্য বাহ। এই দুইটি বৈশিষ্ট্যের জন্যই ইহাদিগকে অযোগবাহ বর্ণ বলা হয়।

কী স্বর কী ব্যঞ্জন সকলপ্রকার ধ্বনির জন্ম কণ্ঠে এবং অবসান ওষ্ঠে। সেইজন্য ধ্বনির প্রতীক বর্ণগুলিকে উচ্চারণস্থান অনুযায়ী এইভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।

বর্ণউচ্চারণস্থাননাম
অ, আ, ক্‌, খ্‌, গ্‌, ঘ্‌, ঙ্‌, হ্‌, ঃকণ্ঠ+জিহ্বামূলকণ্ঠ্যবর্ণ
ই, ঈ, চ্‌, ছ্‌, জ্‌, ঝ্‌, ঞ্‌, য্‌, য়্‌, শ্‌তালু+জিহ্বামধ্যতালব্যবৰ্ণ
ঋ, ট্‌, ঠ্‌, ড্‌, ঢ্‌, ণ্‌, র্‌, ষ্‌মূর্ধা+উলটানো জিহ্বাগ্রমূর্ধন্যবর্ণ
ত্‌, থ্‌, দ্‌, ধ্‌, ন্‌, ল্‌, স্দন্ত+জিহ্বাগ্রদন্ত্যবর্ণ
উ্‌, ঊ্‌, প্‌, ফ্‌, ব্‌, ভ্‌, ম্ওষ্ঠ+অধরঔষ্ঠ্যবর্ণ
এ, ঐকণ্ঠ-তালুকণ্ঠতালব্যবৰ্ণ
ও, ঔকণ্ঠ+ওষ্ঠকণ্ঠৌষ্ঠ্যবর্ণ
অন্তঃস্থ ব্‌দন্ত+ওষ্ঠদন্তৌষ্ঠ্যবর্ণ
ঙ্‌, ঞ্‌, ণ্‌, ন, ম, ং, ঁনাসিকানাসিক্যবর্ণ

বাংলায় ব্যবহৃত সবগুলি ধ্বনির সমষ্টিকে ধ্বনিমালা বলা হয় এবং যতগুলি বর্ণ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়, তাহাদের সমষ্টিকে বর্ণমালা বলা হয়। এইবার, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিমালা এবং বর্ণমালার মধ্যে কী কী মিল ও গরমিল রহিয়াছে, সংক্ষেপে দেখিয়া লওয়া প্রয়োজন। সর্বাগ্রে নীচের সারণীটি লক্ষ্য কর :

বর্ণ বা ধ্বনি ধ্বনিমালাতেবর্ণমালাতে
অ, আ, ই, উ, এ, ওস্বরআছেআছে
অ্যা, আ’ (প্রাদেশিক উচ্চারণে)আছেনেই
ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ঔনেইআছে
ক্‌, খ্‌, গ্‌, ঘ্‌, ঙ্‌, চ্‌, ছ্‌, জ্‌, ঝ্‌, ট্‌,  ঠ্‌, ড্‌, ঢ্‌, ত্‌, থ্‌, দ্‌, ধ্‌, ন্‌, প্‌, ফ্‌, ব্‌, ভ্‌, ম্‌, র্‌, ভ্‌, ম্‌, র্‌, ল্‌, য়্‌, শ্‌, হ্‌, ড়্‌ব্যঞ্জনআছেআছে
ঞ্‌, ণ্‌, য্‌, ব্‌ (অন্তঃস্থ), ষ্‌, স্, ঢ়্‌, ৎ, ং, ঃ, ঁনেইআছে
ওয়্‌আছেনেই

বাংলা ভাষার প্রচলিত বর্ণমালায় যতগুলি স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ আছে, অতগুলি স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনি বাংলাতে নাই। খাঁটি বাংলা উচ্চারণে ‘ই’ ও ‘ই’ এবং ‘উ’ ও ‘ঊ’-এর মধ্যে কোনোই পার্থক্য নাই। লিখিত বানানে পার্থক্য লক্ষ্য করা যাইলেও ‘ঈ’-এর ও ‘উ’-এর উচ্চারণ যথাক্রমে ‘ই’ ও ‘উ’ স্বরধ্বনি দুটির। উচ্চারণের সহিত পুরাপুরি মিলিয়া গিয়াছে। তেমনি য্‌, ণ্‌, ষ্‌, ও স্‌ বর্ণগুলির যে উচ্চারণ আধুনিক আদর্শ চলিত বাংলায় এখন শুনা যায়, তাহাতে বর্ণগুলির উচ্চারণ যথাক্রমে জ্‌, ন্‌, শ্‌ ও শ্‌-এর সহিত মিলিয়া যায়। বানানে জ্‌ ও য্‌, ন্‌ ও ণ্‌ এবং শ্‌, ষ্‌, স্‌-এর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, জ্‌ ও য্‌-এর উচ্চারণ—জ্‌-এর মতো হয়, ন্ ও ণ্‌-এর উচ্চারণ ন্‌-এর মতো, আর শ্‌, ষ্‌, স্‌ এর উচ্চারণ-ধ্বনি শ্‌-এর মতোই হয়।

বাংলা বর্ণমালা এবং ধ্বনিমালার মধ্যে গরমিলের কারণটুকুও সংক্ষেপে জানিয়া রাখ। বাংলা বর্ণমালা সংস্কৃত ভাষার ধ্বনিগুলি লইয়া প্রথমে তৈরি হইয়াছিল। তাহার পরে কতকগুলি ধ্বনি বাংলা ভাষায় লোপ পাইলেও আমাদের বর্ণমালা হইতে তাহাদের বাদ দেওয়া হয় নাই (যেমন–৯, ণ্‌, স্‌,,ষ্‌)। আবার কতকগুলি নুতন ধ্বনি পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় আসিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার জন্য নূতন কোনো বর্ণ বাংলায় গঠিত হয় নাই; পুরানো বর্ণ কিংবা দুইটি বর্ণ মিলাইয়া এই ধ্বনিকে রূপ দেওয়া হইয়াছে (যেমন, বাঁকা এ = ‘অ্যা’)। এই জন্যেই এই অমিল।

বাংলা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য

বাংলায় একই বর্ণের অবস্থাভেদে বিভিন্ন ধ্বনি হয়। আবার বিভিন্ন বর্ণেরও ধ্বনি মাঝে মাঝে একইরকম হয়। কোন্ অবস্থায় কোন্ বর্ণের ধ্বনিময় উচ্চারণটি কীরূপ হয়, জানিয়া না রাখিলে উচ্চারণ-বিকৃতির জন্য হাস্যাস্পদ হইতে হয়।

স্বরবর্ণ

স্বরবর্ণের সংখ্যা যাহাই হউক, বাংলা ভাষায় মোট সাতটি শুদ্ধ স্বরধ্বনি আমরা লক্ষ্য করি–অ, আ, ই, উ, এ, অ্যা, ও। ইহা ছাড়া প্রাদেশিক উচ্চারণে আরও একটি বিকৃত আ’ ধ্বনি আছে। এই আটটি ধ্বনির উচ্চারণকালে জিহ্বা ও ওষ্ঠদ্বয়ের অবস্থান এবং মুখগহ্বরের সংকোচন-প্রসারণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পরপৃষ্ঠায় প্রদত্ত চিত্রের বামদিকে লক্ষ্য কর-ই, এ, অ্যা, আ’-এই ধ্বনিগুলির উচ্চারণের সময় জিহ্বা দন্তের দিকে সম্মুখে অগ্রসর হইয়াছে, ওষ্ঠদ্বয় ক্রমশঃ বিস্তৃত হইতেছে এবং সঙ্কুচিত মুখগহ্বর ক্রমশঃ উন্মুক্ত হইতেছে। এইজন্য এই চারিটি ধ্বনিকে সম্মুখ স্বরধ্বনি (Front Vowels) বলা হয়। ই-কারের উচ্চারণকালে জিহ্বা সর্বাপেক্ষা উচ্চে (তালুর কাছাকাছি) থাকে, এ-কারের বেলায় একটু নীচে, অ্যা-কারের বেলায় আরও নীচে এবং আ’-কারের বেলায় সর্বনিম্নে শয়িত থাকে। এই চারিটি স্বরকে প্রসারিত স্বরও বলা হয়।

স্বরধ্বনির উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান

চিত্রের ডানদিকে দেখ–উ, ও, অ, আ–এই চারিটি ধ্বনি উচ্চারণ করিবার সময় জিহ্বা ভিতরের দিকে পিছাইয়া যায় ও ওষ্ঠদ্বয় অল্পাধিক গোলাকার দেখায় এবং সঙ্কুচিত মুখগহ্বর ক্রমশঃ উন্মুক্ত হয়। এইজন্য এই চারিটি স্বরধ্বনিকে পশ্চাৎ স্বরধ্বনি (Back Vowels) বলে। উ-কারের উচ্চারণকালে জিহ্বা তালুর পিছনের দিকে সর্বোচ্চ স্থানে থাকে; ও-কার এবং অ-কারের উচ্চারণকালে ক্রমশঃ নীচের দিকে নামিয়া আ-কারের বেলায় একেবারে নিম্নে অবস্থান করে। উ ও অ স্বরগুলিকে কুঞ্চিত স্বরও বলে।

পশ্চাৎ স্বরধ্বনির নিম্নতম স্বর আ-এর উচ্চারণ কণ্ঠে। এই উচ্চারণকালে ওষ্ঠদ্বয় বেশ বিবৃত হয়। কিন্তু সম্মুখ স্বরধ্বনির নিম্নতম স্বর আ’-এর উচ্চারণ তালুতে। কাল (কল্য অর্থে), মার (প্রহার অর্থে), ভাজ>ভাউজ, চাল (চাউল অর্থে), আজ (অদ্য অর্থে) প্রভৃতি শব্দে এই প্রাদেশিক স্বরধ্বনির প্রয়োগ হয়। এই প্রাদেশিক আ’-টির পরে একটি ই বা উ থাকে; উচ্চারণে সেই ই বা উ বর্ণটির লোপ হয়।

বাংলা স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণক্ষেত্রে এই সম্মুখ স্বরধ্বনি ও পশ্চাৎ স্বরধ্বনির বিশেষ প্রভাব রহিয়াছে। কারণ ঊর্ধ্বম্বরের আকর্ষণে নিম্নের স্বর যেমন ধ্বগামী হয়, তেমনই নিম্নস্বরের আকর্ষণেও উধস্বর নিম্নগামী হইয়া স্বরসাম্য-স্থাপনের চেষ্টা পায়।

এইবার বিভিন্ন স্বরের উচ্চারণ দেখানো হইতেছে। ভাগীরথী-তীরবর্তী বঙ্গ ভাষাভাষীদের উচ্চারণ বাংলা ভাষার Standard উচ্চারণ বলিয়া পণ্ডিতমহলে স্বীকৃত। সেইজন্য আমরা এই স্বীকৃত উচ্চারণই নির্দেশ করিলাম।

অবস্থান-অনুযায়ী কণ্ঠ্যবর্ণ অ-কারের উচ্চারণ কখনও স্বাভাবিক, কখনও বিকৃত (ও-কারের মতো), আবার কখনও-বা অ-কার অনুচ্চারিত। অ-এর স্বাভাবিক উচ্চারণের সময় মুখগহ্বর অর্ধোন্মুক্ত থাকে এবং ওষ্ঠদ্বয় অল্প গোলাকৃতি ধারণ করে; কিন্তু ও-কারঘেঁষা উচ্চারণের সময় মুখগহ্বর ও ওষ্ঠদ্বয় বেশ সঙ্কুচিত হয়।

আদ্য অঃ শব্দের আদিতে অবস্থিত অ-কারের উচ্চারণ স্বাভাবিক ও বিকৃত–এই দুইপ্রকার হয়। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে স্বাভাবিক উচ্চারণ হয়।–

(ক) শব্দের দ্বিতীয় স্বর অ, আ, ও হইলে শব্দের আদ্য অ-কার স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয়। যথা–শয়ন, কথা, সখা, অজ, অন্ন, অশ্ব, চলা, রবাহুত, বরাহ, কলস, সরোজ, ক্ষমা, সর্প, তফাত, পরোয়া ইত্যাদি।

(খ) একাক্ষর শব্দের আদ্য স্বর অ স্বাভাবিক এবং কিছুটা দীর্ঘভাবাপন্ন। যথা–জপ, বশ, কর, খল, দম, ঝম, রব, শর ইত্যাদি।

(গ) ‘সহিত” অর্থে “স” অথবা “সম্যক্‌” অর্থে ‘সম”-উপসর্গযুক্ত শব্দের আদি অ-ধ্বনি স্বাভাবিক হয়। যথা–সরস, সস্নেহ, সস্ত্রীক, সশিষ্য, সদল, সজীব, সবীজ, সমূল, সঙ্গম, সম্পূর্ণ, সমৃদ্ধ, সংস্কৃত, সবিনয় ইত্যাদি। লক্ষ্য কর, সস্ত্রীক সশিষ্য সজীব সবীজ সম্পূর্ণ সবিনয় প্রভৃতি শব্দে উ-বর্ণ ও ই-বর্ণের পূর্ববর্তী অ ও-কারঘেঁষা হয় নাই।

(ঘ) “না” অর্থে শব্দের আদিতে “অ” বা “অ” থাকিলে সেই আদ্য অ-কার স্বাভাবিক হয়। যথা-অনন্ত, অতুল, অনিয়ম, অজ্ঞান, অসীম, অবিকল, অবিচল, অনিবার, অশোক, অমূল্য, অলিখিত, অস্থির [কিন্তু অস্থির (ওস্থির) = হাড়ের], অনুচিত, অকথিত, অসাম্য, অসুখ, অধীর, অব্যয়, অমৃত, অনুদ্ধত। কিন্তু ব্যক্তির নাম বুঝাইলে কেবল নিম্নলিখিত শব্দগুলির আদি “অ”-এর উচ্চারণ ও-কারবৎ হয়। অমিয় (ওমিও), অতুল্য (ওতুলো), অবিনাশ (ওবিনাশ), অমূল্য (ওমুল্‌লো)।

নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে আদ্য অ বিকৃত হইয়া ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়।–

(ক) শব্দের প্রথমেই র্‌-ফলাযুক্ত অ-ধ্বনি বিকৃত হয়। যথা–শ্রম (স্রোম), ক্রমশঃ (ক্রোমোশো, কিন্তু ক্রয়, ত্রয় ব্যতিক্রম), বত (ব্রোতো), বণ (ব্রোনো), ভ্রমণ (ভ্রোমোন্), দ্রষ্টা (দ্রোসটা), অষ্টা (স্রোস্‌টা), ব্ৰজ (ব্রোজো), শ্রবণ (স্রোবোন্‌), স্রবণ (স্রোবোন্), গ্রহণ (গ্রোহোন্), গ্রন্থন (গ্রোন্‌থোন্) ইত্যাদি।

এই কারণে “প্ৰ” উপসর্গযুক্ত শব্দের আদ্য অ-ধ্বনি বিকৃত হইয়া ও-কারবৎ, উচ্চারিত হয়। যথা–প্রভাত (প্রোভাত্‌), প্রকৃতি (প্রোক্রিতি), প্রণাম (প্রোনাম্‌), প্রমাণ (প্রোমান্‌), প্রবেশ (প্রোবেশ্‌), প্রত্যয় (প্রোত্‌তয়্‌), প্রণয় (প্রোনয়্‌), প্রণব (প্রোনোব্‌), প্রহর (প্রোহোর্‌), প্রহার (প্রোহার্‌), প্রশংসা (প্রোশোংশা), প্রণম্য (প্রোনোম্‌মো) ইত্যাদি।

(খ) অ-কারের পরে বা পরবর্তী ব্যঞ্জনে ই ঈ উ ঊ ঋ য্‌-ফলা থাকিলে অথবা পরবর্তী ব্যঞ্জন যদি ক্ষ (খিয়) বা জ্ঞ (গঁ) হয়, তবে সেই অ-কার ও-কারের মতো উচ্চারিত হয়। যথা–খই (খোই), রবি (রোবি), নদী (নোদি), মধু (মোধু), বধূ (বোধু), মসৃণ (মোস্রিন), কর্তৃকারক (কোর্‌ত্রি…), বক্তৃতা (বোক্‌ত্রিতা), বক্ষ (বোক্‌খো), লক্ষ (লোক্‌খো), লক্ষ্য (ঐ), গদ্য (গোদদো), দন্ত্য (দোন্তো), সদ্য (সোদ্‌দো), অদ্য (ওদ্‌দো), সামর্থ্য (সামোর্‌থো), হত্যা (হোত্‌তা), যদ্যপি (যোদূদোপি), সন্ধ্যা সোধা), চর্ব্য (চোর্‌বো), লক্ষণ (লোখোন্) [কিন্তু লক্ষ্মণ (লক্‌খোন)–সুমিত্রার পুত্র ]; যজ্ঞ (যোগ্‌গোঁ) [কিন্তু অজ্ঞ (অগ্‌গোঁ), অজ্ঞাত (অগ্‌গাঁতো)–আগের (ঘ) সূত্র দেখ ]। সেইরূপ অলি, অনুমতি, অনুপাত, হনুমান, কবিতা, অতীত। বন্ধ্যা (বন্‌ধা–ব্যতিক্রম)।

ক্ষণ শব্দটির ক্ষ-র উচ্চারণে অ-কার স্বাভাবিক। যেমন ক্ষণকাল, ক্ষণজীবী। কিন্তু শব্দটি সমাসবদ্ধ হইয়া সমস্ত-পদের দ্বিতীয়াংশ হইলে ক্ষ-র উচ্চারণে অ-কার বিকৃত হয়। যেমন–কিছুক্ষণ, শুভক্ষণ (শুভোক্‌খোন্), কতক্ষণ ইত্যাদি।

কয়েকটি শব্দ ও ক্রিয়ার চলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপে পূর্ণাঙ্গ সাধুরূপের ই-ধ্বনির লোপ হইলেও ইহার প্রভাব পূর্বস্বর অ-কারের উপর থাকিয়া যায়। কলকাতা (কোল্কাতাকেলিকাতা), খদ্দের (খোদূদেরখেরিদ্দার), সরষে (শারশে), সাতঘরে (সাঘোরেসাঘরিয়া), মরকে (মোর্চে), বললেন (বোলেন্), চলছে (চোলছে), চলবে (চোলবে), করলাম (কোরলা), বস (বোস), হস (হোস), নস (নো<নহিস), হল (হোলো), হলে (হোলে), হতে (হোতে), কিন্তু হবে, হব ব্যতিক্রম (ই-র লোপ হওয়া সত্ত্বেও অ-কারের উচ্চারণ খাঁটী)। পরম সৌভাগ্য মোর জন্মেছি এই দেশে। মন দিয়ে পড়লে ফল আরও ভালো হত। কিন্তু দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে হত (“হত্যা করা হইয়াছে” অর্থে বিশেষণপদ : হ্‌-এর পরে কোনো ই-বর্ণ বা উ-বর্ণ ছিলও না, লোপও হয় নাই, তাই হ্‌-এর অ-কারের উচ্চারণ খাঁটী) ও আহতের সংখ্যা কম নয়। উনি প্রায়ই জ্ঞানহারা হন (খাঁটী অ)। কিন্তু, দয়া করে (< করিয়া) আপনারা একটু প্রকৃতিস্থ হন (হোন্‌<হউন)। “তুমি রবে (খাঁটী) নীরবে হৃদয়ে মম (মোমো)।”

কয়েকটি বিশেষ্য বা বিশেষণপদের চলিত রূপের উচ্চারণ বিশেষভাবে লক্ষ্য কর : খড়ো (খোড়ো), ঝড়ো (ঝোড়ো), পড়ো (পোড়ো), মারধর (মার্‌ধোর্‌) ইত্যাদি। খড়ো ঘর; ঝড়ো হাওয়া; পড়ো বাড়ি; ছেলেদের মারধর করতে নেই। রাতভর (ভোর্‌) গান চলল। কিন্তু স্নেহভরে (খাঁটী অ) শুধালেন গুরু। ভরপেট (খাঁটী অ) খেয়ে একটু বিশ্রাম চাই। এমন ভরদুপুরে (খাঁটী) বেরচ্ছিস কোথা?

(গ) শব্দের আদিতে “নঞ্‌”-অর্থক “অ” থাকিলে শব্দটিতে যদি ব্যক্তির নাম বুঝায়, তবে সেই অ-কার বিকৃত হইয়া যায়। যথা–অমিয় (ওমিও), অনুপমা (ওনুপমা), অনুকূল (ওনুকুল), অতীশ (ওতি), অখিল (ওখি)। কিন্তু অশোক, অসীমা, অসিত, অদিতি, অনাদি ইত্যাদি ব্যতিক্রম। অমূল্যবাবু (ও-কারবৎ) অমূল্য (খাঁটী) সময়ের এতটুকু অবহেলায় নষ্ট করেন না।

(ঘ) একাক্ষর শব্দের অন্তে যদি ণ্‌ বা ন্‌ থাকে, তবে সেই শব্দের আদিতে স্থিত অ-কার বিকৃত হয়। যথা–মন (মোন্), জন (জোন্‌=মজুর অর্থে), পণ (পোন্‌=এক টাকার বোল ভাগের এক ভাগ–এক আনা, কিন্তু প্রতিজ্ঞা অর্থে পণ = পন্‌), ধন (ধোন্‌), বন (বোন্‌) ইত্যাদি। কিন্তু হন (প্রথমপুরুষ সমার্থে সাধারণ বর্তমান), রণ, কন প্রভৃতি ব্যতিক্রম।

(ঙ) শব্দের আদিতে য্‌-ফলাযুক্ত অ-কারের বিকৃত উচ্চারণ দ্বিবিধ :

(i) অ্যা-এর মতো–ব্যয় (ব্যায়), ব্যবস্থা (ব্যাবোস্‌থা), ব্যথা (ব্যাথা), ব্যবধান (ব্যাবোধান্‌), ব্যবহৃত (ব্যাবোহ্রিতো), ব্যধিকরণ (ব্যাধিকরন), ব্যজন (ব্যাজোন্‌), ব্যক্ত (ব্যাক্‌তো), ব্যর্থ (ব্যার্থে), ব্যস্ত (ব্যাস্‌তো), ব্যঞ্জন (ব্যান্‌জোন্‌)। কিন্তু শব্দের আদিতে নয় বলিয়া অব্যক্ত (অব্‌বক্‌তো), অব্যর্থ (অব্‌বর্থো), অব্যয় (অব্‌বয়্‌) প্রভৃতি শব্দে য্‌-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়।

(ii) এ-কারের মতো–ব্যক্তি (বেক্‌তি), ব্যষ্টি (বেস্‌টি), ব্যথী (বেথি), ব্যথিত (বেথিতো), ব্যতীত (বেতিতো), ব্যতিরেক (বেতিরেক্‌), ব্যতিক্রম (বেতিক্রোম্)।

শব্দমধ্যস্থ অ : শব্দমধ্যস্থ অ-ধ্বনি মাঝে মাঝে লোপ পায়। যথা–মদনা (মনা), ফেলনা (ফ্যাল্‌না), কলসী (কোল্‌সি), বাদলা (বাদ্‌লা), সকড়ি (সোক্‌ড়ি), ঝলসানো (ঝল্‌সানো), পাগলী (পাগ্‌লি), পায়রা (পায়্‌রা)। সেইরূপ কাজলা, নাদনা, এমনি, অমনি, তেমনি, কাটরা, কারখানা, কালকূট।

অন্ত্য অ : শব্দের শেষস্থ অ কোথাও অনুচ্চারিত থাকে, আবার কোথাও-বা ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়।

অনুচ্চারিত অন্ত্য অ : মধ্যযুগের বাংলায় পদের শেষস্থ অ-কার উচ্চারণ করাই রীতি ছিল।

(ক) শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরি।
শূন ভেল দশ দিশ শূন ভেল সগরি।–বিদ্যাপতি।

(খ) বিপুল পুলককুল আকুল কলেবর
গরগর অন্তর প্রেমভরে। –গোবিন্দদাস।

কিন্তু আধুনিক বাংলায় কী তৎসম, কী তদ্‌ভব, উভয় প্রকার শব্দের অন্ত্য অ-ধ্বনি অধিকাংশ স্থলেই উচ্চারিত হয় না। ফলে এইসকল শব্দের শেষ ব্যঞ্জনটি হসন্তরূপে উচ্চারিত হয়। ব্যঞ্জনের এই হসন্ত উচ্চারণকে হলন্ত উচ্চারণ বলে।

তৎসম : নয়ন (নয়োন্), কমল (কমোল্‌), দিনেশ (দিনেশ্‌), কেশর (কেশর্‌), উদার (উদার্‌), অনুমান (ওনুমান্‌), বিচারক (বিচারক্‌), কাল (কাল্‌=সময়), ভাল (ভাল্‌=কপাল), সঙ্গম (শংগম্), পদ (পদ্‌) ইত্যাদি। কিন্তু শেষে পদযুক্ত শব্দে নাম বুঝাইলে, হরিপদ (হেরিপদো), শ্রীপদ (স্রিপদো), তারাপদ (তারাপদো), দুর্গাপদ (দুর্গাপদো) ইত্যাদি শব্দের অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়।

কিন্তু অ-কারান্ত তৎসম শব্দটি প্রত্যয়যুক্ত হইলে কিংবা পরবর্তী শব্দের সঙ্গে সমাসবদ্ধ হইলে সেই অ-কারের উচ্চারণ স্বাভাবিক (ক্কচিৎ ও-কারঘেঁষা) হয়। যথা–গুণ (গুন্), কিন্তু গুণবতী, গুণময়, গুণধর; গণ (গ), কিন্তু গণদেবতা, গণপতি, গণচেতনা; জন (জ), কিন্তু জনচিত্ত, জনহিতকর, জনসেবা; দুর (দুর), কিন্তু দুরবর্তী, দূরবীক্ষণ, দুরদর্শন, দুরবিস্তৃত; স্বাধীন (সাধি), কিন্তু স্বাধীনতা; বিহ্বল (বিউহ), কিন্তু বিহ্বলতা; বন (বোন), কিন্তু বনবাস (বোনোবাস্), বনমালী, বনশ্রী, বনবীথিকা; হল (হ), কিন্তু হলকর্ষণ (হলকর্স) হলচালনা, হলধর। সেইরূপ জনগণ, গণ-আন্দোলন, জলপ্লাবন, লোকনায়ক, লোকগীতি, যোগযুক্ত, রণনিপুণ, মেঘমন্দ্র, দলগত, সারবত্তা, নয়নলোভন, গীতগোবিন্দ, পদচ্যুত, দেবপ্রিয়, বিধুরতা, বনমল্লিকা, সুরবালা।

অথচ একবচন, নগরপিতা, সমাজশাসক, রাজধানী, প্রস্তরখণ্ড প্রভৃতি তৎসম শব্দে এবং পরশমণি (পরোশমোনি), ফুলদানি, বনবাদাড়, ঘরদোর প্রভৃতি কয়েকটি অতৎসম শব্দে এরূপ অ-র উচ্চারণ লোপ পায়।

দর্শন বর্ষণ কর্ষণ ভর্ৎসন স্পর্শন কর্তন কীর্তন কর্দম আবর্তন প্রভৃতি শব্দের শেষ অংশটির উচ্চারণ ওন হইতেছে।

তদ্‌ভব : চাঁদ (চাঁদ্‌), দাঁত (দাঁৎ), হাত (হাৎ)। তদ্রূপ ঘর, ধান, বান, বামুন, কায়েত, কামার, চামার, সাঁঝ, কান, বাজ ইত্যাদি শব্দের অন্ত্য অ অনুচ্চারিত।

ইহা ছাড়া উত্তমপুরুষের অতীতকালের ক্রিয়ার, মধ্যম ও প্রথমপুরুষের (সম্মানার্থে) বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ–সর্বকালের ক্রিয়ার, মধ্যমপুরুষের (তুচ্ছার্থে) বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যতের কোনো কোনো ক্রিয়ার এবং প্রথমপুরুষের (সাধারণার্থে) বর্তমানের কোনো কোনো ক্রিয়ার অন্ত্য অ অনুচ্চারিত থাকে। যথা–খাইলাম, খেলিতাম, বলেন, যান, হাসুন, আসিবেন, করিয়াছিলেন, করিস, খেলিতিস, দেয়, শুনুক, দেখুক ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় তৎসম-অতৎসম-নির্বিশেষে শব্দান্তিক অ-এর উচ্চারণলোপ অত্যন্ত ব্যাপক।

উচ্চারিত অন্ত্য অ : যে-সকল তৎসম ও তদ্‌ভব শব্দের অন্ত্য অ বিকৃত হইয়া ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়, তাহাদের তালিকা নিম্নে দেওয়া হইল।–

তৎসম : (১) শব্দের শেষে হ কিংবা যুক্তবর্ণ থাকিলে শেষস্থ অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–দেহ, গেহ, স্নেহ, মোহ, লোহ, বরাহ, প্রবাহ, রক্ত, বক্ত্র (মুখ), বর্ণ, সৌহার্দ্য, সামর্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, সমৃদ্ধ, সমাসান্ত, দুর্ধর্ষ, বিমর্ষ, দোর্দণ্ড।

(২) ঢ়-কারান্ত, ‘ত’ ও ‘ইত’ প্রত্যয়ান্ত অথবা ‘তর’ ও ‘তম’ প্রত্যয়যুক্ত বিশেষণের অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–বিগত, আনীত, অধীত, আগত, অগীত [কিন্তু সঙ্গীত (শোংগিত্‌) বিশেষ্যপদ ], বৃহত্তর, বৃহত্তম, মহত্তর, মহত্তম, ক্ষুদ্রতর, ক্ষুদ্রতম, প্রিয়তর, প্রিয়তম (কিন্তু উত্তর=উৎতর্‌, উত্তম=উৎতম্‌), পুলকিত, আহত, পালিত, রক্ষিত (পদবী অর্থে বিশেষ্য–রক্ষিত=রোক্‌খিত্‌, পালিত=পালিৎ)। অথচ ব্রত ক্ষত বিশেষ্য হওয়া সত্ত্বেও অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত। আবার ক্ষীণ, হীন–ত-প্রত্যয়ান্ত বিশেষণ হওয়া সত্ত্বেও অন্ত্য অ অনুচ্চারিত।

ভূ ধাতু হইতে প্রত্যয় যোগে প্রাপ্ত শব্দ যখন বিশেষণ, তখন অন্ত্য অ উচ্চারিত। যথা–অভিভূত, পরাভূত, উদ্ভূত ইত্যাদি। কিন্তু পদটি বিশেষ্য হইলে হলন্ত উচ্চারণ হয়। ভূত (ভুৎ–প্রেতযোনি)। অদ্ভূত শব্দটি ভূ ধাতু হইতে উদ্ভূত বিশেষণ হওয়া সত্ত্বেও উচ্চারণে স্বরান্ত নয়, ব্যঞ্জনান্ত। বানানটিও বিশেষভাবে লক্ষ্য কর।*

[* হ্রস্ব সূত্রানুযায়ী ভূ ধাতুর ঊ উ হইয়াছে।]

(৩) ই-বর্ণ এবং এ-কারের পর য় (ইঅ) থাকিলে অন্ত্য অ-কার ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–দেয় (কিন্তু ক্রিয়াপদ দেয় = দ্যায়), পেয়, প্রিয়, গেয়, শ্রেয়, হেয়, অজেয়, মৈত্রেয়, রাধেয়, বৈমাত্রেয়, পালনীয়, পরিধেয়, অনুমেয়।

(৪) অ-কারযুক্ত অন্ত্য ব্যঞ্জনের পূর্বে ঋ, ঐ, ঔ, ং, ঃ থাকিলে অন্ত্য অ-কার ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–তৃণ, নৃপ, মৃগ, ঈদৃশ, দৈব, শৈল, তৈল, জনৈক, নৈশ, মৌন, ক্ষৌর, মৌল, পৌর, গৌণ, ধৌত, হংস, ধ্বংস, বংশ, দুঃখ [ কিন্তু গৌর (গোউর্‌), পৌষ (পোউশ্‌)]।

(৫) কয়েকটি জ-কারান্ত, ন-কারান্ত, ম-কারান্ত ও ব-কারান্ত শব্দের অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–দ্বিজ, নিজ, ব্রজ, অণ্ডজ, সরসিজ, মনসিজ, অগ্রজ, অনুজ, আত্মজ, প্রকৃতিজ, ঘন, ধ্রুব, তব, তদ্‌ভব, নব, সম, শম, মম, ভবদম; কিন্তু পঙ্কজ, রামানুজ, মনোজ, সরোজ, যম, যব, রব, অনুভব, সম্ভব, তদ্ভাব, সদ্ভাব ব্যতিক্রম (উচ্চারণ হলন্ত)।

তদ্‌ভব : (১) দুই অক্ষরের কয়েকটি বিশেষণের অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–বড় (বড়), ছোট (ছোটো), ভাল (ভালো), কাল (কালো), সেজ (সেজো), খাট (খাটো), ধল (ষোলো) ইত্যাদি।

(২) যত, তত, এত, অত, যেন, কত, কেন, কোন, হেন ইত্যাদি কয়েকটি সর্বনামজাত বিশেষণ বা অব্যয়ের অন্ত্য অ ও-কারের মতো উচ্চারিত হয়।

(৩) এগার, বার, তের, পনর, ষোল, সতের, আঠার–এই কয়েকটি সংখ্যাবাচক বিশেষণের অন্ত্য অ ও-কারের মতো উচ্চারিত হয়।

(৪) কাঁদকাঁদ, ছলছল, ডুডু, কলকল, জরজর, মরমর, ঝরঝর প্রভৃতি কয়েকটি দ্বিরুক্ত বিশেষণ ও অনুকার শব্দের অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়।

(৫) খাওয়ান, দেখান, শুনান, করান, আনান, পাঠান, জানান প্রভৃতি ‘আন’ প্রত্যয়ান্ত ক্রিয়াপদের শেষস্থ অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। কিন্তু মধ্যম ও প্রথমপুরুষ সমার্থে প্রযোজিকা ক্রিয়ারূপে ইহাদের হলন্ত উচ্চারণ হয়। তিনি কাজটা করে দেখান (দ্যাখান)। ছবিটা তাকে দেখান (দ্যাখানো) উচিত।

(৬) উত্তমপুরুষের ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া, মধ্যমপুরুষের (সাধারণার্থে) বর্তমান কালের ক্রিয়ার কোনো কোনো স্থানে, প্রথমপুরুষের (সাধারণার্থে) অতীত কালের ক্রিয়ার সাধু-চলিত দুইটি রূপেই অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–হাসিব, খাইতে থাকিব, করিয়া থাকিব, গাহিয়াছ, শুনিতেছ, করছ, কর, মরিব, আসিব, পড়িতেছিল, মরেছিল, হাসিত, নাচিত, খাওয়াইল ইত্যাদি।

(৭) সাদৃশ্যবাচক “মত” শব্দটির অন্ত্য অ ও-কারবৎ উচ্চারণ করাই বিধেয়। রবীন্দ্রনাথ-প্রমুখ কবিসাহিত্যিকগণ অ-কারান্ত তদ্‌ভব শব্দকে উচ্চারণের সুবিধার জন্য অনেকক্ষেত্রে ও-কারান্ত করিয়া লইয়াছেন। যথা-(ক) “আমার সকল ভালোবাসায় ….. কত কাল যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে।”–রবীন্দ্রনাথ। (খ) “বেয়ারাগুলো ….. পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো!”–ঐ। (গ) “একবার পাখিটাকে আনো তো দেখি।”–ঐ। (ঘ) “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারি সমান রাঙা।”–সত্যেন্দ্রনাথ। (ঙ) “তুমি বড়ো হইয়া দাঁড়াইবে কি ছোটো হইয়া থাকিবে, তাহা তোমারই হাতে।”–শিবনাথ শাস্ত্রী। (চ) “ঝাপটা আসার পূর্বে … পালগুলি গুটানো ও নামানো হইয়াছিল।”–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। (ছ) “এই দুই ত্যাগী মহাপুরুষের মিলনদৃশ্য বড়ো করুণ।”–দীনেশচন্দ্র সেন। (জ) “সঙ্গের নতুন ঘোড়া … অনেক দূরে একটি ছোটো কালো ফোঁটার মতো। আস্তে আস্তে ….. মিলিয়ে গেছে।”–অবনীন্দ্রনাথ। (ঝ) “তিনি সেটা জড়ো করিয়া … তামাক টানিতে লাগিলেন।”–শরৎচন্দ্র। (ঞ) “সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরোথরো ….. জীবনের সোনার হরিণ।”–বুদ্ধদেব বসু।

অবশ্য এইরূপ উচ্চারণ-অনুযায়ী বানান বানানো সব সময় নিরাপদ্‌ নয়। আমাদের প্রদত্ত তদ্‌ভব শব্দের (২) ও (৬) নং সূত্রের আওতায় যে-সমস্ত শব্দ পড়ে সেগুলিকে ও-কারান্ত না করাই ভালো হবে যেখানে ও-কারযোগে অর্থের পার্থক্যটি সহজবোধ্য হয়, সেখানে ও-কার যোগ করাই বিধেয়। (ক) “অম্বরচুম্বিতভাল-হিমাচল।”–রবীন্দ্রনাথ। সবসময় ভালোমন্দ বোধশক্তি সকলের থাকে না, অমিতা। (খ) “ভোর হল দোর খোল, খুকুমণি ওঠ রে।” রাতভর (উচ্চারণ : রাৎভোর্‌) বৃষ্টি, দিনভর রোদ্দুর, ধান ফলে সুপ্রচুর। (গ) মাথাল (উচ্চারণ : মাথাল্‌) মাথা মাথায় চলছে চাষী মাঠে। গ্রামের মাথালো লোকেরা এখন শহরমুখী হচ্ছেন। (ঘ) “কাল বিকালে খাটো (অর্থ ও খর্বাকৃতি) কালো (অর্থ : কৃষ্ণকায়) লোকটি হঠাৎ মত (মৎ) বদলিয়ে খাট থেকে নেমেই পুকুরে পানকৌড়ির মতো বারো বার (বার্‌) ডুব দিলে।” (ঙ) পাঠান (পাঠান্‌) সম্রাটের কাছে সামান্য দুতকে পাঠানো বিবেচনার কাজ নয়, মহারাজ; আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পাঠান (পাঠান্‌–ক্রিয়া)।–”অবশ্য এই জাতীয় গোলযোগের সম্ভাবনা না থাকিলেও এগারো, পনরো, নাওয়ানো, খাওয়ানো, দেখানো প্রভৃতি শব্দে ও-কার যোগ করা আজকাল রীতিতে দাঁড়াইয়াছে।”

দ্বি-অক্ষর শব্দের অন্ত্য অ-কার অনুচ্চারিত হইলে তৎপূর্ববর্তী অ-কার ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। যথা–যেমন (য্যামোন্‌), এমন (অ্যামোন্‌), জীবন (জিবোন্)। তদ্রূপ আদর, নয়ন, শয়ন, মদন, মোহন, কমল, কখন, যখন, এখন, তখন, বদন, সদন, তিলক, তাপস, সময়, যুগল, যৌবন ইত্যাদি।

এই কণ্ঠ্যবর্ণটির উচ্চারণে মুখগহ্বর সম্পূর্ণ উন্মুক্ত থাকে। জাতিতে এই স্বরবর্ণটি দীর্ঘ হইলেও বাংলায় প্রায় সর্বত্রই হ্রস্বস্বররূপে উচ্চারিত হয়, কদাচিৎ দীর্ঘস্বররূপে ইহার ব্যবহার দেখা যায়।–”না বললে আমরা কিন্তু মানছি না।” কবিতায়–

(ক) “আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি।”

(খ) “নিজ ভাল বুঝে পর মন্দ নিলে
ছিল আপন যা ভাল তাও দিলে।”

অ-কার ও আ-কারকে একসঙ্গে অ-বর্ণ বলা হয়।

ই ঈ

বর্ণদ্বয়ের উচ্চারণে জিহ্বা সম্মুখে প্রসারিত হয় ও উচ্চে উঠিয়া তালুর কাছাকাছি আসিয়া যায়, মুখগহ্বর খুব বেশী সঙ্কুচিত হয় এবং ওষ্ঠদ্বয় দুইপার্শ্বে অল্প প্রসারিত হয়। ঈ নামে দীর্ঘস্বর হইলেও ই-এর মতোই প্রায় সর্বত্র উচ্চারিত হয়, কদাচিৎ দীর্ঘ উচ্চারণ হয়। যথা–সকাল থেকে খেটেই চলেছ; কিছু খেয়েছ। কি? কী খেলে? “গাহে বিহঙ্গম পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে।” ধ্বনি একই বলিয়া ই ও ঈ-কে ই-বর্ণ বলা হয়।

উ, ঊ

এই বর্ণদ্বয়ের উচ্চারণকালে জিহ্বা পিছাইয়া তালুর পিছনের দিকে অনেকটা উঠিয়া পড়ে, মুখগহ্বর সর্বাপেক্ষা বেশী সঙ্কুচিত হয় এবং ওষ্ঠদ্বয় অল্প গোলাকার ধারণ করে। বাংলায় উ-র উচ্চারণ প্রায় সর্বত্রই হ্রস্ব, কদাচিৎ দীর্ঘ। যথা–দুনিয়ায়। আজকাল উপাসনায় কিছু হয় কি! চাই রূপা আর সোনা। “রূপে ভরল দিঠি সোঙরি পরশ মিঠি।”–জ্ঞানদাস। ধ্বনি একই বলিয়া উ ও ঊ-কে উ-বর্ণ বলে।

উচ্চারণের দিক্ দিয়া ঋ-কার স্বরকৌলীন্য হারাইয়াছে। ইহার উচ্চারণ এখন রি। যথা–ঋষি (রিশি), কৃশ (ক্রিশো), কৃষ্ণ (ক্রিশ্‌নো) ইত্যাদি। ঋ-কারেরা এই উচ্চারণের জন্যই বিদেশী শব্দে ঋ-কারের পরিবর্তে ই-বর্ণযুক্ত র-ফলা লিখিবার রীতি দাঁড়াইয়াছে। যথা–ব্রিটিশ, খ্ৰীষ্ট, স্ট্রীট ইত্যাদি। ঋ-কারের উচ্চারণে জিহ্বাকে যথেষ্ট মেহনত করিতে হয়। যথা–ছৃ, জৃ, নৃ, শৃ, সৃ প্রভৃতি। এইজন্য ছাত্রদের মধ্যে জৃম্ভণ, নৃত্য, নৃতত্ত্ব, মৃত্যু, আবৃত্তি, শৃঙ্খলিত প্রভৃতি শব্দের উচ্চারণে উচ্ছৃঙ্খলতা লক্ষ্য করা যায়।

এই দীর্ঘস্বরটি বাংলায় হ্রস্বস্বররূপেই সাধারণতঃ উচ্চারিত হয়, কদাচিৎ দীর্ঘ উচ্চারণ পাওয়া যায়।

(ক) “পর দীপশিখা নগরে নগরে,
তুমি যে তিমিরে তুমি সে তিমিরে!” –গোবিন্দচন্দ্র রায়।

(খ) “কি ছিলে কি হলে, কি হতে চলিলে,
অবিবেক-বশে কিছু না বুঝিলে।” –ঐ

এ-কারের দুইটি ধ্বনি–স্বাভাবিক (অর্ধ-সংবৃত) ও বিকৃত (অর্ধ-বিবৃত)। সংস্কৃতে এ-ধ্বনি কখনই বিকৃত হয় না। সেইজন্য যে-সমস্ত সংস্কৃত শব্দ অবিকৃতভাবে বাংলা ভাষায় চলিতেছে, তাহাদের আদ্য মধ্য বা অন্ত্য এ-ধ্বনি স্বাভাবিকই থাকে। তদ্‌ভব বা দেশী-বিদেশী শব্দের শব্দমধ্যস্থ বা শব্দান্তস্থিত এ-ধ্বনিও কখনও বিকৃত হয় না। এইসমস্ত শব্দের মাত্র আদ্য এ-ধ্বনিই স্থান বিশেষে বিকৃত হইয়া অ্যাকারের মতো উচ্চারিত হয়। তবে ধ্বনি যেমনই হউক, তৎসম, তদ্‌ভব ও দেশী শব্দে বানান এ-কার লেখাই সঙ্গত। বিদেশী শব্দে ধ্বনি-অনুযায়ী এ-কার বা অ্যাকার লেখা চলিতে পারে।

স্বাভাবিক এ-কার (অর্ধ-সংবৃত) : উচ্চারণের সময় জিহ্বা তালু হইতে বেশ একটু নীচে নামিয়া আসে, মুখগহ্বর অর্ধসঙ্কুচিত থাকে আর ওষ্ঠদ্বয় একটু প্রসারিত হয়। উদাহরণ-(১) তৎসম, তদ্‌ভব, দেশী, বিদেশী–সকলপ্রকার শব্দের মধ্য বা অন্ত্য এ-কারের উচ্চারণ স্বাভাবিক। যথা–অনলে, সবেগে, রমেশের, নোভেম্বর, ব্যোমকেশ, খোকনের ইত্যাদি।

(২) তৎসম শব্দের আদ্য এ-ধ্বনি স্বাভাবিক। যথা–স্নেহ, প্রেম, কেশ, রেখা, হেম, গেয়, দেহ, বেদ, দেশ, মেঘ, চেষ্টা, শ্রেষ্ঠ, সেতু, নেতা, মেধা, সেবা, এলা, এরণ্ড, এষা, বেশ, ফেন, একক, একাকী, একান্ত, একতা, একতান, একলব্য, একলভ্য, একাদশী, একান্নবর্তী, একাকিনী, একান্তর, একাধিক, একদা, একতাল, ফেনিল ইত্যাদি। এলা (খাঁটী এ-কার), কিন্তু বাংলা এলাচ (অ্যালা)।

(৩) অ-তৎসম শব্দের আদি স্বরধ্বনি এ-কারের পরে ই ঈ উ ঊ থাকিলে বা ই, ঈ, উ, ঊ-যুক্ত ব্যঞ্জন থাকিলে বা অ-বর্ণযুক্ত যুক্তব্যঞ্জন বা হ থাকিলে সেই এ-কারের উচ্চারণ স্বাভাবিক হয়। যথা–দেখি, বেটী, নেই, খেই, খেলিব, নেউগী, পেটুক, তেলী, ঠেলি, নেড়ী, বেলুন, কেহ, কেষ্ট, তেষ্টা ইত্যাদি।

(৪) বিশেষণ শব্দের শেষ য় উচ্চারিত হইলে আদি স্বরধ্বনি এ-কার স্বাভাবিক হয়। গেয়, পেয়, জ্ঞেয়, দেয় (কিন্তু ক্রিয়াপদ দেয় =দ্যায়্‌)।

(৫) আদিতে ই-ধ্বনিযুক্ত একাক্ষর ধাতুর কয়েকটি রূপে এবং ধাতুর উত্তর প্রত্যয়যোগে নিষ্পন্ন বিশেষ্য বা বিশেষণপদের আদ্য এ-কার স্বাভাবিক। যথা—শিখ্‌ ধাতু হইতে শেখ, শেখেন, শেখা, শেখ, শেখানো; লিখ্‌ ধাতু হইতে লেখ্‌, লেখ, লেখে, লেখানো, লেখাই; মিল্‌ ধাতু হইতে মেল, মেলা, মেলে, মেলানো; কিন্ ধাতু হইতে কেনেন, কেন (কেনো), কেনা, কেনানো; গিল্ ধাতু হইতে গেলে, গেল (গেলো), গেলা, গেলানো। কিন্তু “গ” ধাতু (< √গম্‌) হইতে গেলেন (গ্যালে), গেল (গ্যালো), গেলা (গ্যালা : কবিতায়)। “এখন বিশ্বের সহিত তাহার (শকুন্তলার) সম্বন্ধ পরিবর্তন হইয়া গেছে” (গ্যাছে)। “সশরীরে কোন্ নর গেছে (গ্যাছে) সেইখানে!” “ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে (গ্যাছে)।” “যে ভেসে গেল (গ্যালো), সে অদৃশ্য হয়ে গেল।” “কাল বলি কালা গেলা (গ্যালা) মধুপুর, সে কালের কত বাকী।”

(৬) হেথা, যেথা, সেথা, সেখানে, যেখানে, এখানে, যেরূপ, সেরূপ, এরূপ–শব্দগুলির আদ্য এ-কার স্বাভাবিক।

বিকৃত এ-কার (অর্ধ-বিবৃত) : উচ্চারণের সময় জিহ্বা সম্মুখ হইতে পিছাইয়া তালু হইতে অনেক নীচে নামিয়া পড়ে, মুখগহ্বর অর্ধোন্মুক্ত হয় এবং ওষ্ঠদ্বয় বেশ প্রসারিত হয়। তদ্‌ভব দেশী ও বিদেশী শব্দের আদ্য এ-ধ্বনিই নিম্নলিখিত স্থলে বিকৃত হইয়া অ্যাকারের মতো উচ্চারিত হয়।

(ক) শব্দের আদ্য এ-কারের পর অ-কার (অনুচ্চারিত) বা আ-কারযুক্ত ব্যঞ্জন থাকিলে সেই আদ্য এ-কার বিকৃত হইয়া যায়। যথা–ফেন (ফ্যান্), ফেনা (ফ্যানা), নেড়া (ন্যাড়া), বেলা (ব্যালা), বেটা (ব্যাটা), ছেঁদা, চেলা, ডেলা, ঢেলা, টেরা, হেলান, হেলা (অবহেলা), লেজ (ল্যাজ), লেজা ইত্যাদি। (কিন্তু পেটা, তেলা–এ-কার স্বাভাবিক।) “তার লেজের ঝাঁপটে ….. বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে।” “ফেন দাও ফেন দাও চিৎকার-যামিনীম্।” “মাতৃহারা বেচারা!” “পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে!” “ডাহিনে বাঁশবন হেলায়ে শাখা।” “আপন হাতে হেলায় গড়ি পাতায় গাঁথা ভেলা। জগৎ-পারাবারের তীরে ছেলেরা করে খেলা!” “যার যা মেরামতের ছিল, মেরামত করা হইল।”

(খ) আদিতে এ-কারযুক্ত একাক্ষর কয়েকটি রূপে এবং এই সমস্ত ধাতুর উত্তর প্রত্যয়যোগে গঠিত বিশেষ্য বা বিশেষণ শব্দের আদ্য এ-কার বিকৃত হয়। যথা—দেখ্‌ ধাতু হইতে দেখ (দ্যাখো), দেখা (দ্যাখা), দেখানো (দ্যাখানো); খেল্ ধাতু হইতে খেল্ (খ্যা), খেল (খ্যালো), খেলা (খালা), খেলানো (খ্যালানো); বেচ্‌ ধাতু হইতে বেচ (ব্যাচো), বেচা (ব্যাচা); ঠেল্‌ ধাতু হইতে ঠেল (ঠ্যালো), ঠেলা (ঠ্যালা); কিন্তু ঠেলিয়া লইবার গাড়ি = ঠেলা–এ-কার অবিকৃত; হেল্‌ ধাতু হইতে হেল্ (হ্যাল্‌), হেল (হ্যালো = হেলিয়া পড়ো), হেলানো (হ্যালানো) ইত্যাদি। ঠেস (এ-কার স্বাভাবিক) দিয়ে কথা বল কেন? কিন্তু “ব্যোম চৌকিতে ঠেসান (ঠ্যাসা) দিয়া বসিয়া জানালার উপর দুই পা তুলিয়া দিল।”–রবীন্দ্রনাথ। হাটে ব্যাপারীরা রোজ কি লাভেই মালপত্র বেচে (ব্যাচে–সমাপিকা)? কিন্তু, গ্রামের জমিজমা বেচে (আদ্য এ খাঁটী উচ্চারণ–‘বেচিয়া’ সাধুরূপের চলিত অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ) দিলাম। বইখানা এতদিনে মুক্ত আলোয় চোখ মেলবার (ম্যাল্‌বার্‌) অবকাশ পেয়েছে। মাদুরখানা খোলা বারান্দার হাওয়াতে মেলে (খাঁটী এ–চলিত অসমাপিকা ক্রিয়া<মেলিয়া) দাও।

(গ) এখন (অ্যাখোন), কেমন (ক্যামোন্‌), এমন (অ্যামোন্‌), এমনই (অ্যামোন্‌ই), তেমন (ত্যামোন্‌), যেমন (য্যামোন্), পেখম (প্যাখোম্‌) প্রভৃতি শব্দের আদ্য এ-কার বিকৃত। কিন্তু এমনি (এম্‌নি), তেমনি, যেমনি প্রভৃতি শব্দের আদি এ-কারের উচ্চারণ খাঁটী।

(ঘ) একা, একটা, একলা, এগারো, তেরো, একচল্লিশ (৪১), একান্ন (৫১), একষট্টি (৬১), একাত্তর (৭১), একাশি (৮১), একানব্বই (৯১), একটানা, একতারা, একেবারে, এতটা, এতটুকু, একশা প্রভৃতি শব্দের এ-কার বিকৃত।

(ঙ) ব্যতিহারসূচক পদের আদ্য এ-কার বিকৃত : দেখাদেখি (দ্যা …), ঠেলাঠেলি (ঠ্যা…)।

একই শব্দে আদ্য এ-কারের উচ্চারণভেদে অর্থের পার্থক্য :

বেলা (ব্যালা) = (১) সময়, (২) ময়দা ইত্যাদির পিণ্ড পাতলা করা।
বেলা (এ স্বাভাবিক) = (১) সমুদ্রতীর, (২) ফুলবিশেষ।

দেখে (এ স্বাভাবিক)=দেখিয়া অসমাপিকা ক্রিয়ার সকল পুরুষে চলিত রূপ।
দেখে (দ্যাখে) = লক্ষ্য করে (প্রথমপুরুষে)।

মেলা (ম্যালা) = (১) অনেক, (২) ক্রেতাবিক্রেতা দর্শকের সমাগমস্থান।
মেলা (এ স্বাভাবিক) = (১) মিলিত হওয়া (মিল্ ধাতু হইতে), (২) প্রসারিত বা উন্মীলন করা (মী ধাতু হইতে)–”নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে।”

সে চমৎকার খেলে (খ্যালে < খেল্‌)।
দুধ একটুও খেলে (এ স্বাভাবিক < vখা ও ‘খাইলে’-এর চলিত) না কেন?

গেলেন (এ স্বাভাবিক) = গিলিয়া ফেলেন।
গেলেন (গ্যালেন্) = গমন করিলেন।

সবাই অবাক্‌ হয়ে দেখছিল, কীভাবে তিনি রাজভোগগুলো চোখের নিমেষে গপাগপ গেলেন (স্বাভাবিক)। তিনি কখন গেলেন (বিকৃত) টের পাইনি।

কেন (ক্যানো) = প্রশ্নাত্মক অব্যয়।
কেন (এ স্বাভাবিক) = ক্রয় কর।

এমন বাজে জিনিস কেন (বিকৃত) যে কেন (স্বাভাবিক), জানি না।

কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ্য কর। “হেরো (হ্যারো) অন্ধকার ব্যাপিয়াছে। দিগ্বিদিকে।” “মোর নাম তার মুখে কেন (ক্যানো) হেন (হ্যানো) মধুর সঙ্গীতে উঠিল বাজিয়া!” “ছোটো হয়ে গেছ (গ্যাছো) আজ।” ফুলগুলো হাওয়ায় হেলে (হ্যালে), তরী চলে হেলে (আদ্য এ-কার স্বাভাবিক) দুলে। সন্ধ্যাতারা দেখা (দ্যাখা) দেয় (দ্যায়) দিগন্তের ধারে। “একদা (এ-কার স্বাভাবিক) যাহার অর্ণবপোত ভ্ৰমিল ভারতসাগরময়।” “মেনকা (ম্যানোকা), মাথায় দে লো ঘোমটা।” “আজ তাহারা তোমার সিদ্ধির প্রসাদ যে একফোঁটা আমাকে দেয়। (দ্যায়) নাই।” “যদি দেখাইয়া (দ্যাখাইয়া) দাও কোত্থানে আছে?” “তিনি গেছেন (গ্যাছে) যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ।” “মন্ত্রী কহে, “আমারো ছিল মনে, কেমনে (ক্যামোনে) বেটা (ব্যাটা) পেরেছে সেটা (স্বাভাবিক) জানতে।” “হৃদয় এলায়ে (অ্যালায়ে) পড়ে যেন কী স্বপনভরে …।” “কেশ (স্বাভাবিক) এলাইয়া (অ্যালাইয়া) ফুল কুড়াইয়া …।” “মেরামত (ম্যারামত্‌) তো লাগিয়াই আছে।” “বিজলী হেন (হ্যানো) ঝিকিমিকে।” “বেচারা (ব্যাচারা) পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে।” “বালকবেলা হতে তাহারই গীতে দিল সে এত কাল যাপি।” [ প্রথম পদটিতে সমাসবদ্ধ পদের শেষাংশের আদি এ-কারও অ্যা হইয়াছে।] এতগুলো ভুল? এ (স্বাভাবিক) কি সহজে ঠিক হবে?

আদিতে এ-কারযুক্ত ক্রিয়াপদের (সাধু বা চলিত) উচ্চারণবিষয়ে আমাদের একটু লক্ষ্য রাখা দরকার। ধাতু বা শব্দের শেষ বর্ণটির পূর্ববর্ণটিকে উপধা বলা হয়। যে-সব সংস্কৃত বা বাংলা ধাতুর উপধা ই, সেইসব ধাতু হইতে উৎপন্ন সাধু। ক্রিয়ার চলিত রূপটিতে দ্বিতীয় স্বর হ্‌-কারের লোপ হয় এবং আদ্য এ-কার অর্ধ-সংবৃত (খাদী) থাকে, কখনও অর্ধ-বিবৃত (বিকৃত) হয় না।

লিখ্‌ (ধাতু) > লিখিবার (সাধু) > লেখবার (চলিত–অর্ধ-সংবৃত)।

শিখ্‌ (ধাতু) > শিখিবার (সাধু) > শেখবার (চলিত-অর্ধ-সংবৃত)।

ফির্‌ (ধাতু) > ফিরিবার (সাধু) > ফেরবার (চলিত–অর্ধ-সংবৃত)।

ঘির্‌ (ধাতু) > ঘিরিবার (সাধু) > ঘেরবার (চলিত–অর্ধ-সংবৃত)।

লিখ্‌ (ধাতু) + ইয়া = লিখিয়া (সাধু)–লিখে (চলিত)। অনুরূপভাবে শিখিয়া > শিখে; ফিরিয়া > ফিরে; ঘিরিয়া > ঘিরে ইত্যাদি।

আবার, লিখ্‌ (ধাতু) + এ = লেখে (সমাপিকা ক্রিয়া–আদি এ খাঁটী)। অনুরূপভাবে শেখে, ফেরে, ঘেরে।

কিন্তু দে (দ্যা-বাংলা ধাতু) > দেখিবার (সাধু–আদি এ খাঁটী) > দেখবার (চলিত–উচ্চারণ দ্যাখা); ফেস্ (ফ্যা) ধাতু > ফেলিবার (সাধু–খাঁটী) > ফেলবার (চলিত–উচ্চারণ ফ্যাল্‌বার্‌)। ওটা দেখবার (দ্যাখ্‌বার্‌) বা ফেলবার (ফ্যাল্‌বার্‌) কী এমন দরকার ছিল? “দেখবার মতো দৌড়টা।”

আবার, শব্দমধ্যস্থ ই বা উ লোপ পাওয়ার পর অভিশ্রুতি বা স্বরসঙ্গতির প্রভাবে যে আদ্য এ-কারের সৃষ্টি হয়, তাহার উচ্চারণ অর্ধ-সংবৃত। যেমন, রাগিয়া > রেগে, মাগিয়া > মেগে, গাছুয়া > গেছে, দাড়িয়াল > দেড়েল।

ও-কারের উচ্চারণের সময় জিহ্বার মধ্যাংশ কণ্ঠের দিকে পিছাইয়া যায়, মুখগহ্বর ও ওষ্ঠদ্বয় অল্প সঙ্কুচিত থাকে। বাংলায় এই দীর্ঘস্বরটি অন্যান্য দীর্ঘস্বরের মতোই সাধারণতঃ হ্রস্বস্বররূপে উচ্চারিত হয়। ইহার উচ্চারণ কোথাও বিকৃত হয় না। হ্রস্ব–যোগী, ঘোরা, বোগী। দীর্ঘ–যোগ, ঘোর, লোগ।

ঐ, ঔ

ঐ-কারের উচ্চারণে ওষ্ঠদ্বয় হঠাৎ দুইপার্শ্বে অর্ধ-সঙ্কুচিত হইয়া পড়ে, ঔ-কারের বেলায় অর্ধ-সঙ্কুচিত ওষ্ঠদ্বয় হঠাৎ সর্বাপেক্ষা বেশী সঙ্কুচিত হয়। এই দুইটি যৌগিকস্বর দীর্ঘস্বরের পর্যায়ভূত। কিন্তু ইহাদের উচ্চারণও অধিকাংশ স্থানেই হ্রস্ব। কবিতায় কোথাও কোথাও ছন্দোমাধুর্য-রক্ষায় ইহাদের দীর্ঘস্বররূপে গণ্য করা হয়।

ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা। –রবীন্দ্রনাথ।

গদ্যেও বিশেষ জোর দিবার জন্য কখনও ইহাদের দীর্ঘ উচ্চারণ হয়। রাজা বলিলেন, “ঐ যাঃ! মনে তো ছিল না।”

ব্যঞ্জনবর্ণ

ক-বর্গ—ক্‌, খ্‌, গ্‌, ঘ্‌, ঙ্‌। জিহ্বামূলদ্বারা কণ্ঠের দিকে তার কোমল অংশ স্পর্শ করিয়া এই বর্গের ধ্বনিগুলি উচ্চারিত হয়। এইজন্য ইহাদিগকে জিহ্বামূলীয় বর্ণ বা কণ্ঠ্যবর্ণ (Gutturals) বলে।

ঙ–ক-বর্গের এই পঞ্চমবর্ণটির নাম উঁঅঁ। বর্ণটি কখনই শব্দের আদিতে বা ব্যঞ্জনের পরে বসে না, সর্বদাই স্বরের পরে বসে। প্রাচীন বাংলায় ইহার উচ্চারণ ছিল উঁঅঁ। বর্তমান বাংলায় ইহার উচ্চারণ দুইপ্রকার দাঁড়াইয়াছে।

(১) স্বরশূন্য হলন্ত উচ্চারণ হইলে ং (অনুস্বর)-এর মতো শুনায়। বানানে অনেক সময় অনুস্বর লেখাও হয়। যথা—সঙ্‌ সং, রঙ্‌ রং, বালা বাংলা, ঢঙ্‌ ঢং, টঙ্‌ টং ইত্যাদি। “হৃদয়ে কি জং ধরে পুরনো খাপে?”

(২) স্বরযুক্ত হইলে ঙ্‌-র উচ্চারণে গ-ধ্বনির সামান্য স্পর্শ থাকে। যথা বাঙালী (বাঙ্গালি), কাঙাল (কাঙ্গাল্‌), লাঙল (লাঙ্গল্‌), রঙিন (রোঙ্গিন্‌), ডিঙি (ডিঙ্গি) ইত্যাদি।

চ-বর্গ–চ, ছ, জ, ঝ, ঞ্‌। জিহ্বার মধ্যভাগদ্বারা তালুর কঠিন অংশ স্পর্শ করিয়া উচ্চারণ হয় বলিয়া ইহাদিগকে তালব্যবৰ্ণ (Palatals) বলে। ইহাদের মধ্যে চ, ছ, জ, ঝ্‌ বর্ণগুলির উচ্চারণকালে বাতাসে বাগযন্ত্রের সামান্য ঘর্ষণে উষ্মধ্বনির স্পর্শ লাগে বলিয়া ইহাদের ধৃষ্টবর্ণ (Affricated) বলা হয়।

জ ও ঝ–ইহাদের আসল উচ্চারণ যথাক্রমে ইংরেজী ‘z’ ও ‘zh’-এর মতো; অথচ কদাচিৎ এই খাঁটী উচ্চারণ পাওয়া যায়।–মজদুর, সেজদা, রাজধানী ইত্যাদি। বাংলায় অধিকাংশ স্থানেই জ-এর উচ্চারণ য্‌-এর সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছে। যেমন–জল, জমিদারী, জননী, জন্মভূমি, যশোদা, যোগীন্দ্র ইত্যাদিতে জ্‌ ও য্‌ দুইটি পৃথক্ বর্ণের ধ্বনি একই হইয়া গিয়াছে। (ক) এই কটা বাসন মাজতে এত দেরি! (খ) এমনটা হবে যে বুঝতে পারিনি। (গ) ঠাকুর, লুচি ভাজতে আরম্ভ কর। (ঘ) বালকদের শিক্ষার তপোবন তাকে দূরে খুঁজতে হবে কেন? (ঙ) দশটা বাজতে আর দেরি নেই। (চ) কী রে, প্রথম দৃশ্যেই তোর অভিনয়, তবু এখনও সাজতে বসিস নি? (ছ) শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কতক্ষণ যুঝতে পারবি? [প্রতিটি ক্ষেত্রেই উচ্চারণ খাঁটী ‘z’ বা zh-এর মতো ] অথচ (ক) বোঝাবুঝির দরকার আছে বইকি। (খ) ঠাকুর, লুচিভাজা হল কি? [ দুটি ক্ষেত্রেই য্‌-এর উচ্চারণ ] সুতরাং দেখিলাম, শব্দের আদি বা অন্ত্য জ, ঝ কখনই z বা zh-এর মতো উচ্চারিত হয় না। শব্দমধ্যস্থ জ বা ঝ উচ্চারণে স্বরশূন্য হইলেই যথাক্রমে z বা zh-এর উচ্চারণ পায়।

ঞ–বর্ণটির নাম ইঁঅঁ, উচ্চারণও ইঁঅঁ। বর্ণটি কখনই শব্দের আদিতে বসে না। যেমন–মিঞা (মিয়াঁ); মুঞি (মুয়িঁ)। ইহার সহিত চ-বর্গের কোনো বর্ণ সংযুক্ত হইলে ইহার উচ্চারণ হয় দন্ত্য ন্‌-এর মতো। যেমন-বঞ্চনা (বন্‌চোনা), লাঞ্ছিত (লান্‌ছিতো), ব্যঞ্জন (ব্যান্‌জোন্‌), ঝঞ্ঝা (ঝন্‌ঝা)। যাচ্‌ঞা শব্দটির প্রাচীন উচ্চারণ ছিল যাচিঙ্গা, এখন দাঁড়াইয়াছে যাচঙা (কদাচিৎ যাচ্‌ন্যা)।

ট-বর্গ—ট্‌, ঠ্‌, ড্‌, ঢ্‌, ণ্‌। জিহ্বার অগ্রভাগকে উলটাইয়া তালুর পশ্চাতের কঠিন অংশ মূর্ধা স্পর্শ করিয়া এই ধ্বনিগুলির উচ্চারণ হয় বলিয়া ইহাদের নাম মূর্ধন্যবর্ণ (Cerebrals)।

ণ–ট-বর্গের পঞ্চমবর্ণটির বিশুদ্ধ উচ্চারণ সংস্কৃতে পাওয়া যায় কতকটা ড়ঁ। ওড়িয়া হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায়ও এই উচ্চারণ পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলায় ইহার উচ্চারণ ত-বর্গের পঞ্চমবর্ণ দন্ত্য ন্‌-এর সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছে। অবশ্য ণত্ব-বিধি-অনুসারে বানানে মূর্ধন্য ণ-এর কৌলীন্য অক্ষুণ্ণ রাখিতেই হয়।

ড় ও ঢ়–ড ও ঢ-এর তলদেশে বিন্দুযোগে যথাক্রমে ড় ও ঢ়-এর সৃষ্টি আধুনিক বাংলার কীর্তি। সংস্কৃত বা প্রাচীন বাংলায় ইহাদের অস্তিত্ব ছিল না। জিহ্বার অগ্রভাগ উলটাইয়া তাহার তলদেশদ্বারা ঊর্ধ্বে মূর্ধায় তাড়ন বা আঘাত করিয়া এই বর্ণদ্বয়ের উচ্চারণ হয়। এইজন্য ইহাদের তাড়নজাত-ধ্বনি (Flapped) বলা হয়। ড় ঘোষ অল্পপ্রাণ, ঢ় তাহার ঘোষ মহাপ্রাণ। ড় স্বরশূন্য থাকিতে পারে–ষড়যন্ত্র, ষড়রিপু, ষড়দর্শন, ষড়ভুজ, ষড়ঋতু প্রভৃতি; কিন্তু ঢ় কখনই বানানে স্বরশূন্য থাকে না–আষাঢ় (উচ্চারণ যদিও স্বরশূন্য)।

শব্দের আদিতে ড ও ঢ অক্ষত থাকে। যথা–ডিম্ব, ডুব, ডম্বরু, ডঙ্কা, ডাক, ডিঙি, ডাব, ঢল, ঢাকাই, চিল, ঢাল, ঢালাও, ঢিঢি, ঢেঁকি, ঢেঁড়স, ঢোকা, ঢোসকা, ঢৌকন ইত্যাদি।

শব্দের মধ্যে বা অন্তে বসিলে ড ও ঢ যথাক্রমে ড় ও ঢ় হইয়া যায়। যেমন–কড়া, দাঁড়া, দাঁড়ানো, বড়ো, পীড়া, গুড়, গূঢ়, মূঢ়, অব্যূঢ়।

শব্দের মধ্যে বা অন্তে ড্‌ ও ঢ-এর দ্বিত্ব হইতে পারে, কিন্তু ড ও ঢ-এর দ্বিত্ব হয় না। বড্ড, আড্ডা, গড্ডলিকা ইত্যাদি। ড বা ঢ-এ য্‌-ফলা (্য) হয়, কিন্তু ড় ও ঢ়-এ য্‌-ফলা হয় না।–জাড্য, আঢ্য, বর্ণাঢ্য, দার্ঢ্য, ড্যাবডেবে, ঢ্যাপসা।

দ্রষ্টব্য–আজকাল ড় ও র ধ্বনি দুইটির উচ্চারণে ও লিখিত বানানে যথেষ্ট ব্যভিচার লক্ষিত হয়। শৈশব হইতে এই দুইটি ধ্বনির উচ্চারণে বিশেষ যত্ন না লওয়ার ফলেই শ্রোতা, শিক্ষক বা পরীক্ষকের কাছে হাস্যাস্পদ হইতে হয়। ড়-এর স্থানে র কিংবা র-এর স্থানে ড় লিখিলে বা উচ্চারণ করিলে উপহাসের পাত্র হওয়া ছাড়াও যে কী নিদারুণ অর্থবিভ্রাট ঘটে, সে বিষয়ে শিক্ষার্থীকে প্রথম হইতেই অবহিত হইতে হইবে। এ-বিষয়ে কবিশেখর কালিদাস রায়ের নির্দেশটি বিশেষ মূল্যবান–”ভাগীরথীতীরের লোকদের মুখে উচ্চারণ শুনিয়া এবং কোন্‌গুলিতে ড়-এর ব্যবহার আছে, জানিয়া লইতে হইবে।” বর-বড়, বরা–বড়া, আমরা–আমড়া, করা–কড়া, খর–খড়, ঘর–ঘড়, চুরি–চুড়ি, চর–চড়, পরানো–পড়ানো, জরানো–জড়ানো, ঝর-ঝড়, তোর–তোড়, ধরা–ধড়া, নারী–নাড়ী, মরা–মড়া, সারা–সাড়া, হার–হাড়।

র বা ড়-যুক্ত কয়েকটি শব্দের প্রয়োগ দেখ।–ছোড়দি অলংকারের দোকানে একছড়া হার চাইল, কিন্তু তার স্বরযন্ত্রের ত্রুটিতে কথাটা শোনালো হাড়। পুকুরপাড়ে গোধন চরে। নদীর চরে চড়াই চরে। বীরপুরুষে ঘোড়ায় চড়ে। আমরা কাপড় ছেড়ে প্যান্ট পরছি। ছেলেরা মন্দ পড়ছে না। বেড়াতে হলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়। চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘরঘর। হাড়জিরজিরে কুকুরটার গলা ঘড়ঘড় করছে। গঙ্গার বুকে চড়া পড়ছে। যুক্তিটা বড়ো জোরদার হল কি? ডেকে ডেকে সারা হলেও কেষ্টর সাড়া মেলে না। করকরে নোট, কড়কড়ে ভাত। নীড়ে ফেরে পাখি। নীরে ভাসে আঁখি। ওসব পাঁয়তারা কষা ছাড় দেখি। বেশ নিরাড়ম্বর উৎসব। সারি সারি তরুণী রঙিন শাড়ি পরে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মনে রাখিও, জিহ্বার অগ্রভাগ উলটাইয়া তাহার তলদেশ দিয়া মূর্ধায় আঘাত করিলে ড়-এর উচ্চারণ, আর জিহ্বার অগ্রভাগ কম্পিত করিয়া উপরের পাটির দন্তমূলে আঘাত করিলে র-এর উচ্চারণ পাওয়া যায়।

ত-বর্গ—ত্‌, থ্‌, দ্‌, ধ্‌, ন্। প্রসারিত জিহ্বাগ্রভাগ-দ্বারা উপরের পাটির দাঁতের নীচের দিকে স্পর্শ করা হয় বলিয়া এই বর্ণগুলির নাম দন্ত্যবর্ণ (Dentals)।

কোনো কোনো সংস্কৃত শব্দ বাংলা শব্দে রূপান্তরিত হওয়ার সময় ত-বর্গের বর্ণ ট-বর্গের বর্ণে পরিণত হয়; তাহাকে মূর্ধনীভবন (Cerebralization) বলা হয়। পতিত > পড়ে (ত এখানে ড় হইয়াছে); মৃত্তিকা > মাটি (ত এখানে ট্‌ হইয়াছে); বৃদ্ধি > বাড়; বৃদ্ধ > বুড়া (দ্ধ ড় হইয়াছে); গ্রন্থি > গাঁট (থ ট হইয়াছে); স্থান > ঠাঁই (থ ঠ হইয়াছে)।

প-বর্গ—প্‌, ফ্‌, ব্‌, ভ্‌, ম্। ওষ্ঠের সহিত অধরের স্পর্শে এই ধ্বনিগুলির উচ্চারণ হয় বলিয়া ইহাদের নাম ঔষ্ঠ্যবর্ণ বা ওষ্ঠ্যবর্ণ (Labials)।

“দুই ঠোঁট পরস্পর স্পর্শ করিয়া তাহার মধ্য দিয়া জোরে বাতাস ছাড়িয়া দিলাম। অমনি ধ্বনি জন্মিল ‘প’।” –রামেন্দ্রসুন্দর।

ব-বাংলায় বর্গীয় ব্‌ এবং অন্তঃস্থ ব-এর মধ্যে আকৃতিগত পার্থক্য আদৌ নাই; উচ্চারণও প্রায় এক ব-কারে দাঁড়াইয়াছে। আসলে বর্গীয় ব্‌-এর উচ্চারণ ব্‌ (b), আর অন্তঃস্থ ব্‌-এর উচ্চারণ উঅ (w)। এইজন্যই এই অন্তঃস্থ ব-কে অর্ধস্বর বলে। এই অন্তঃস্থ ব্‌ যখন ব্‌-ফলারূপে পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে যুক্ত হয়, তখন ইহার উচ্চারণ চারিপ্রকার হয়।–

(১) ব্‌-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়। পক্ব (পক্‌কো ), বিল্ব, বিশ্ব, অন্বয়, পঞ্চত্ব (পন্‌চোৎতো), পৃথী, বিদ্বান্‌, সরস্বতী।

(২) শব্দের ব-ফলাযুক্ত প্রথম বর্ণটির সামান্য দ্বিত্ব হয়। ত্বরা (ত্‌তরা), স্বদেশ (শ্‌শদেশ), স্বভাব (শ্‌শভাব্‌), দ্বীপ (দ্‌দীপ্‌)।

(৩) তৎসম শব্দে হ্-এর সঙ্গে যুক্ত ব্‌-ফলার উচ্চারণ ইংরেজী w-এর মতো।–আহ্বান (আওহান্), জিহ্বা (জিউহা), বিহ্বল (বিউহল্‌), গহ্বর (গওহর)।

(৪) একাধিক সংযুক্ত ব্যঞ্জনে ব্‌-ফলা যুক্ত হইলে সেই ব্‌-ফলা অনুচ্চারিত থাকে। সান্ত্বনা (শান্‌তোনা), উচ্ছ্বসিত (উচ্‌ছোশিত), মহত্ত্ব (মহৎতো), উজ্জ্বল (উজ্‌জল্‌), দ্বন্দ (দন্‌দো), সাত্ত্বিক (সাৎতিক্‌) ইত্যাদি।

বর্গীয় ব্‌ ও অন্তঃস্থ ব্‌ চিনিবার উপায়টি জানিয়া রাখ। যে ‘ব্‌’ উ বর্ণে পরিণত হয়, কিংবা উ-বর্ণ হইতে জাত হয়, যে ‘ব’ প্রত্যয়জাত বা সন্ধিজাত, তাহাই অন্তঃস্থ ব্‌। অন্য সব বর্গীয় ব্‌। সম্বোধন, উদ্বোধন, দিগ্বিজয়, উদ্বেল, সম্বন্ধ প্রভৃতি শব্দের ব্‌ বর্গীয় ব্‌। বর্গীয় ব্‌ ব-ফলা হইলেও উচ্চারণ ব-ই থাকে, অবশ্য সম্বন্ধ শব্দটিতে ব্যতিক্রম হইয়াছে। √ব প>উ প্ত, √ব হ্‌>ঊঢ়, অধি- √বস্>অধ্যুষিত, মনু>মানব, রঘু>রাঘব; স্থাবর, যাযাবর, ঈশ্বর, ভাস্বর, শ্রদ্ধাবান্, লক্ষ্মীবান্, বিদ্বান্, যশস্বী, আত্মবৎ, পশ্বাচার, ভাবুক, সংবাদ, সংবরণ, কিংবদন্তী, এবংবিধ, কিংবা, মেধাবী–এই ব-গুলি অন্তঃস্থ ব্‌।*

[* বুধ্‌, ব্রূ, বাধ, বন্ধ ধাতুর ব্‌ এবং বহু, বাহু প্রভৃতি শব্দের ব্ বর্গীয়।
বচ্‌, বদ্‌, বন্দ্‌, বপ্‌, বস্‌, বহ্, বা, বিদ্‌, বিশ্‌, বৃ, বৃৎ, বৃধ, ব্যথ্‌, ব্যধ্‌, ব্রজ্‌–ধাতুগুলির ব্‌ এবং বহিঃ, বিনা, বা, বৃথা, বরং প্রভৃতি অব্যয়ের ব্‌ অন্তঃস্থ ব্‌।
সমস্ত অসংস্কৃত শব্দের আদ্য ব্‌ বর্গীয় ব্‌।]

ম–প-বর্গের এই পঞ্চমবর্ণটির স্বাভাবিক উচ্চারণ ও-কারবৎ। যেমন–মমতা (মোমোতা), মন্দ (মোন্‌দো ), সমতা (সমোতা), সময় (সোমোয়্‌), মঙ্গল (মোংগোল্‌), মণ্ডন, মহাকরণ, মন্থর, সমজদার, মজবুত, মজলিস, মরশুম; কিন্তু মহেশ, মহোৎসব, মলয়, মরণ, মশাল, মদন, মশক, মঠ, মরকত, মহর্ষি, মরাল, মত্ত, মৎস্য, মক্কেল, মলাট, মদত, মগজ, ময়রা, মসলা প্রভৃতি শব্দে ম্‌-এর উচ্চারণ খাঁটী অ-কার।

ম যখন ম্‌-ফলারূপে পূর্বব্যঞ্জনে যুক্ত হয়, তখন কোথাও তাহার ধ্বনি অক্ষুণ্ণ থাকে, আবার কোথাও-বা ধ্বনিটির কিছু পরিবর্তন হয়।

(১) ধ্বনি অক্ষুণ্ণ ও ম্‌-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনটি শব্দমধ্যে থাকিলে প্রায়ই ম্-ধ্বনি অক্ষুণ্ণ থাকে। তন্ময় (তন্‌ময়্‌), চিন্ময়ী (চিন্‌মোয়ি), বাল্মীকি (বাল্‌মিকি), বাগ্মী (বাগ্‌মি), যুগ্ম (যুগ্‌মো) ইত্যাদি।

(২) ধ্বনি পরিবর্তিত : (ক) ম্‌-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনটি শব্দের প্রথমে থাকিলে ব্যঞ্জনটির অনুনাসিক উচ্চারণ হয়।–স্মরণ (শঁরন্‌), শ্মশান (শঁশান্‌), ধ্মাত (ধাঁত), শ্মশ্রু (শোঁস্‌রু) ইত্যাদি।

(খ) ম্-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনটি শব্দের মধ্যে বা শেষে থাকিলে ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়, কোথাও কোথাও একটা অনুনাসিক ধ্বনি শ্রুত হয়।–পদ্ম (পদ্‌দো), ভস্ম (ভশশোঁ), ভীষ্ম (ভিশ্‌শোঁ), রুক্মিণী (রুক্‌কিনি), সূক্ষ্ম (শুক্‌খোঁ), আত্মা (আৎতাঁ), মহাত্মা (মোহাৎতাঁ) [‘মোহাৎমা’ সংস্কৃত বা হিন্দী উচ্চারণ–বাংলা নয়]।

(গ) যুক্ত ব্যঞ্জনে ম্‌-ফলা যুক্ত হইলে ম্-এর ধ্বনি মাঝে মাঝে লোপ পায়। লক্ষ্মণ (লক্‌খোন্‌), লক্ষ্মী (লোক্‌খি) ইত্যাদি।

য, য়

অন্তঃস্থবর্ণের আদি বর্ণ য। সংস্কৃতে ইহার খাঁটী উচ্চারণ ‘ইঅ’। এইজন্যই ইহাকে অর্ধস্বর বলা হয়। বাংলায় কিন্তু এই খাঁটী উচ্চারণ পাই না। বাংলায় য ও জ–এই উভয় বর্ণের উচ্চারণ এক হইয়া গিয়াছে। শব্দের আদিতে বসিলে য-কারের আকৃতি অটুট থাকে, তখন ইহা ব্যঞ্জন। যেমন—যশোদা, যোগস্থা, যদি, যজ্ঞেশ্বরী, যাদবী, যাজ্ঞসেনী, যোগক্ষেম।

কিন্তু শব্দের আদিতে না থাকিলে ইহার নীচে একটি বিন্দু যোগ করিয়া ইহাকে য় (অন্তঃস্থ অ)-এর রূপ দেওয়া হয়। য় বাংলার নিজস্ব সৃষ্টি। এই য়-তে য-এর প্রাচীন উচ্চারণ ইঅ-র একটু আভাস পাওয়া যায়। যেমন–ময়ূর, বিয়োগ, অপেয়, নিয়োগ, নিরুপায়। কিন্তু সরযূ, সংযোজন, নিযুক্ত, ন্যায্য, আতিশয্য–ব্যতিক্রম।

তৎসম শব্দের অ-কার, আ-কার, উ-বর্ণ, ও-কারের পরস্থিত য় স্পষ্ট শ্রুত হয়।–প্রয়োজন, বায়ু, দয়া, মায়া, জায়া, ভূয়সী, অনসূয়া, স্বচ্ছলতায়, পুণ্যতোয়া। কিন্তু ই-বর্ণ ও এ-কারের পরস্থ য় উচ্চারণে অস্পষ্ট হইয়া পড়ে, কেবল সংশ্লিষ্ট স্বরবর্ণটির উচ্চারণ শ্রুত হয়। গিয়ে (গিএ), লঘীয়ান্ (লোঘিআন্), কায়িক (কাইক), দয়িত (দোইতো), তেয়াগো (তেআগো) ইত্যাদি।

অতৎসম শব্দে এ-কার এবং ও-কারের পরস্থিত য় অশ্রুত থাকে। কেয়া (কেআ), মোয়া (মোআ), শোয়া (শোআ) ইত্যাদি; অথচ আয়া, শায়া (য় উচ্চারিত হইতেছে)।

যখন কোনো ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে য যুক্তভাবে বসে তখন ইহা য্‌-ফলা (্য) হইয়া যায়। এই য্‌-ফলার উচ্চারণ ছয়প্রকার।–

(১) শব্দের প্রথমবর্ণে অ-কারযুক্ত য্‌-ফলা থাকিলে তাহার উচ্চারণ কোথাও কোথাও অ্যা হইয়া যায়। ব্যয় (ব্যায়), ব্যবহার (ব্যাবোহার), ব্যথা (ব্যাথা), ব্যজন (ব্যাজোন্), ব্যক্ত (ব্যাক্‌তো), ব্যত্যয় (ব্যাৎতয়), ব্যর্থ (ব্যার্থো); কিন্তু অব্যক্ত (অব্‌বক্‌তো), অব্যর্থ (অব্‌বর্থো), অব্যয় (অব্‌বয়) ব্যতিক্রম।

(২) পরবর্তী ব্যঞ্জনে ই-বর্ণ থাকিলে শব্দের প্রথমবর্ণে অ-কারযুক্ত য্‌-ফলার উচ্চারণ এ-কারের মতো হয়। ব্যক্তি (বেক্তি), ব্যথী (বেথি), ব্যথিত (বেথিতো), ব্যতীত (বেতিতো), ব্যতিহার (বেতিহার্‌), ব্যতিরেক (বেতিরেক্‌) ইত্যাদি। কবিতায় : ত্যজিলে (তেজিলে), ত্যজিলাম (তেজিলাম্‌)। “সাগরে ত্যজিব (তেজিবো) প্রাণ তোমার শোকেতে।” “আয়ু কত যে ব্যয়িলি (বেয়িলি) হায়!” “ত্যজিলাম (তেজিলাম্‌) যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়।”

(৩) শব্দের প্রথমবর্ণে উ, ঊ, ও, এ-কারযুক্ত য্‌-ফলার ধ্বনি লোপ পায়। দ্যুলোক, দ্যূত, চ্যুত, দ্যোতনা, ধ্যেয়, ন্যূজ, ন্যূন, ব্যুৎপত্তি, ব্যূহ, ব্যূঢ় ইত্যাদি।

(৪) শব্দের মধ্যে বা শেষে য্‌-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জন থাকিলে সেই ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়। অদ্য (ওদ্‌দো), বিদ্যা (বিদ্‌দা), উদ্যান (উদ্‌দান), ব্যাখ্যা (ব্যাখ্‌খা), অব্যয় (অব্‌বয়্‌), পরিত্যক্ত (পোরিৎতক্‌তো), সত্যি (শোৎতি), সৌম্য (শোউম্‌মো), প্রাত্যহিক (প্রাৎতোহিক্‌) ইত্যাদি। কিন্তু উদ্যোগ (উদ্‌যোগ্‌), উদ্যোগী (উদ্‌যোগী) শব্দে য্‌-র উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে।

(৫) শব্দমধ্যস্থ হ্‌-এ য্‌-ফলা যুক্ত হইলে হ্ এবং য্‌-ফলার মিলিত ধ্বনি জ্‌ঝ হয়।–লেহ্য (লেজ্‌ঝো), গ্রাহ্য (গ্রাজ্‌ঝো), দাহ্যতা (দাজ্‌ঝোতা)। কিন্তু শব্দের আদিতে স্থিত হ্য-র উচ্চারণে বর্ণদ্বয় অক্ষুণ্ণ থাকে–হ্যাঁ, হ্যাংলা।

(৬) সংযুক্ত ব্যঞ্জনে য্‌-ফলা যুক্ত হইলে য্‌-ফলার ধ্বনি লোপ পায়।–লক্ষ্য (লোক্‌খো), দৌরাত্ম্য (দোউরাৎতোঁ), বন্দ্য (বন্‌দো), হর্ম্য (হর্‌মো), বৈচিত্র্য (বোইচিৎত্রো), স্বাচ্ছন্দ্য (সাচ্‌ছন্‌দো ), দ্ব্যর্থ (দর্‌থো–আদি ব্যঞ্জনে ব্‌-ফলা , য্‌-ফলা উভয়েরই উচ্চারণ লুপ্ত), অন্ত্যজ (অন্‌তজো) ইত্যাদি।

মনে রাখিও—ড়্‌ ঢ়্‌ য়্‌ র্‌ এই বর্ণগুলিত, য্‌-ফলা যুক্ত হয় না।

র–কম্পিত জিহ্বাগ্র-দ্বারা উপরের দন্তপক্তির মূলে আঘাত করিলে এই ধ্বনিটির বিশুদ্ধ উচ্চারণ পাওয়া যায়। এইজন্য ইহাকে কম্পনজাত বর্ণ (Trilled) বলে। এই বর্ণটির উচ্চারণ বিশেষ যত্নসাপেক্ষ। র ও ড় এই দুইটি ধ্বনির উচ্চারণের পার্থক্য ভালোভাবে আয়ত্ত করিতে না পারিলে উচ্চারণে ও লেখায় বর্ণবিভ্রাট এবং নিদারুণ অর্থবিভ্রাটও ঘটে।

র্‌ চারিটি অবস্থায় থাকে–র, রেফ (), র-ফলা () এবং বিসর্গ (ঃ)। র্‌ কোনো ব্যঞ্জনের পূর্বে বসিলে রেফ (1) হইয়া সেই ব্যঞ্জনের মস্তকে চলিয়া যায় (ধর্ম, মর্ম); এবং ব্যঞ্জনের পরে বসিলে র-ফলা (এ) হইয়া সেই ব্যঞ্জনের পদতলে বসে (নম্র, শুভ্র)। রেফ-এর উচ্চারণ শিথিল, কিন্তু র-ফলার উচ্চারণ বেশ কঠিন। বিশেষভাবে ছ, জ, সু, হ্র প্রভৃতি র-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনগুলির উচ্চারণে জিহ্বাকে খুবই ক্লেশস্বীকার করিতে হয়।

র-ফলাযুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ দুইপ্রকার।

(১) শব্দের মধ্যে বা শেষে র্‌-ফলা যুক্ত হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যঞ্জনটির দ্বিত্বভাব হয়। বজ্র (বজ্‌জ্রো), নম্রতা (নোম্‌ম্রোতা), সুব্রত (সুব্‌ব্রোতো), বিব্রত (বিব্‌ব্রোতো), প্রস্রুত (প্রোস্‌স্রুতো), বক্র (বক্‌ক্রো)।

(২) শব্দের আদি ব্যঞ্জনে কিংবা অন্যত্র সংযুক্ত ব্যঞ্জনে র-ফলা থাকিলে উচ্চারণে সেই ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয় না।–প্রভাত (প্রোভাৎ), হ্রেষা (হ্রেশা), ঘ্রাণ। (ঘ্রান্), কৃচ্ছ্র (কৃচ্‌ছ্রো), সন্ত্রস্ত (শন্‌ত্রস্‌তো), শিরস্ত্রাণ (শিরস্‌ত্রান্‌)।

মনে রাখিও, রেফ বা র-ফলার উচ্চারণ সাধু বাংলায় কখনও লুপ্ত হয় না।

ল–জিহ্বার অগ্রভাগ উপরের পাটির দন্তমূলে স্পর্শ করিয়া জিহ্বার দুই পার্শ্ব দিয়া মুখ হইতে বায়ু বাহির করিয়া এই ধ্বনিটির উচ্চারণ হয় বলিয়া ইহার নাম পার্শ্বিক ধ্বনি (Lateral)।

এই ল্‌ ল্‌-ফলা-রূপে ব্যবহৃত হইলে ইহার দুইরকম উচ্চারণ হয়।

(১) শব্দের মধ্যে বা অন্তে কোনো ব্যঞ্জনে–ফলা যুক্ত হইলে ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়।-বিপ্লব (বিপ্লব), অশ্লীল (অশস্লি), শুক্লা (শুক্লা)।

(২) শব্দের আদি বর্ণে ল্‌-ফলা থাকিলে ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয় না। ক্লান্তি, ক্লিশ্যমান, শ্লীলতা। মনে রাখিও, ফলার উচ্চারণ কখনও লুপ্ত হয় না।

উষ্মবর্ণ—শ্‌, ষ্‌, স্, হ্‌। প্রথম তিনটি বর্ণের উচ্চারণের সময় শ্বাসবায়ু নির্গত হইবার ফলে বেশ একটি শিসধ্বনির সৃষ্টি হয়। সংস্কৃতে এই ধ্বনি তিনটির উচ্চারণ-পার্থক্য রহিয়াছে–শ-এর তালব্য উচ্চারণ, ষ-এর মূর্ধন্য উচ্চারণ ও স-এর দন্ত্য উচ্চারণ। বাংলায় কিন্তু ইহাদের উচ্চারণ এক হইয়া মাত্র শ (sh)-এর ধ্বনি দাঁড়াইয়াছে। ইহাই এখন এই শিসধ্বনিগুলির রীতিসম্মত উচ্চারণ। যেমন–সশিষ্য (শশিশ্‌শো)। অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য শ ও স-এর দন্ত্য (s) উচ্চারণ হয়। সেগুলি বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার।

শ-এর স্বাভাবিক উচ্চারণ (sh)–শৈশব, আশা, আশিস্, (আশিশ্‌), শুশ্রূষা (শুস্‌স্রুশা)।–কিন্তু ঋ-কার, র-ফলা, ল্‌-ফলা ও ন্‌-যুক্ত শ-এর উচ্চারণ দন্ত্য (s) হয়। শৃগাল (স্রিগাল্‌), বিশৃঙ্খল (বিস্রিংখল্‌), শ্রীমান্ (স্রিমান্), শ্রবণ (স্রোবোন্), প্রশ্ন (প্রোস্‌নো), শ্লাঘা (স্লাঘা)।

স–বাংলা স-এর নিজস্ব উচ্চারণ নাই। আকৃতি নিজের আছে বটে, কিন্তু ধ্বনিটি শ (sh) এর মতো হইয়া গিয়াছে। যেমন–সত্য (শোৎতো), সমস্যা (শমোশ্‌শা), সুপারিশ (শুপারিশ্‌), সিরিশ (শিরিশ্‌) ইত্যাদি। কিন্তু ঋ-কার, র্‌-ফলা, ত, থ, ন ও ল-যুক্ত স-এর উচ্চারণ দন্ত্য (s) হয়। সৃষ্টি (স্রিস্‌টি), সংস্রব (শংস্‌স্রোব্‌), সস্তা (শস্‌তা), অসুস্থ (অশুস্‌থো), শুচিস্নাতা (শুচিস্‌নাতা), স্লেট (স্লেট্‌)।

শ ও স-এর উচ্চারণ-সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না হওয়ার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, এমন-কি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও, ইহাদের উচ্চারণ-ব্যভিচার দেখা যায়। এ বিষয়ে আচার্য সুনীতিকুমার বলিয়াছেন, “শ, ষ, স-এর শুদ্ধ বা ভদ্রসমাজে প্রচলিত বাঙ্গালা উচ্চারণ ইংরেজীর sh-এর মতো–বাঙ্গালা ভাষায় কদাচ এগুলিকে ইংরেজীর s-এর মতো উচ্চারণ করা উচিত নহে। শিক্ষকগণ এ বিষয়ে অবহিত হইবেন।”

হ–কণ্ঠনালী হইতে উৎপন্ন উষ্ম ঘোষবর্ণ। ইহার উচ্চারণে নিঃশ্বাসের বিশেষ প্রয়োজন। এইজন্য ইহার উচ্চারণ কখনও স্বরশূন্য হয় না। যেমন–দেহ, গেহ, স্নেহ–শব্দের শেষে থাকা সত্ত্বেও অ-ধ্বনির বিকৃত উচ্চারণ হইতেছে।–ফলাযুক্ত হ্‌-এর উচ্চারণ দুইপ্রকার–(১) ধ্বনি পরিবর্তিত, (২) ধ্বনি অক্ষুণ্ণ।

(১) শব্দের আদিতে না থাকিলে হ্‌ এবং য্‌-ফলা–দুইটিরই ধ্বনি পরিবর্তিত হইয়া জন্ম হয়। গ্রাহ্য (গ্রাজ্‌ঝো), লেহ্য (লেজ্‌ঝো), দাহ্য (দাজ্‌ঝো)।

(২) শব্দের আদিতে থাকিলে হ্‌-ধ্বনি অক্ষুণ্ণ থাকে। হ্যারিসন, হ্যারিংটন, হ্যারিকেন, হ্যারো, হ্যাঁ, হ্যাংলা।

ং–এই আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণটির প্রভাবে ইহার পূর্ববর্তী স্বরবর্ণটিতে কিঞ্চিৎ অনুনাসিক সুরের স্পর্শ লাগে; ইহাই ইহার খাঁটী উচ্চারণ। সংস্কৃতে এই উচ্চারণ অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। কিন্তু আধুনিক বাংলায় অনুস্বরের উচ্চারণ দাঁড়াইয়াছে “ঙ্‌“। ফলে লেখাতেও ং-এর স্থলে অনেক ক্ষেত্রে ঙ্‌ দেখা যায়। রং–রঙ, টং–টঙ, বাংলা–বাঙলা ইত্যাদি। অবশ্য তৎসম শব্দে ং অক্ষত থাকে। বংশ, জিঘাংসা, হিংসা, আংশিক, বশংবদ ইত্যাদি।

ঃ–এই আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণটি হইতেছে ঘোষধ্বনি হ্‌-এর অঘোষ ধ্বনি। বাংলায় একমাত্র বিস্ময়াদি-সূচক অব্যয়ের বিসৰ্গতে ইহার প্রকৃত ধ্বনিটি শ্রুত হয়।–আঃ (আহ্‌), উঃ (উহ্‌), এঃ (এহ্‌), ওঃ (ওহ্‌), বাঃ (বাহ্‌), ছিঃ (ছিহ্‌)।

পদান্তস্থিত বিসর্গ বাংলায় সাধারণতঃ ও-কারের মতো উচ্চারিত হয়। বস্তুতঃ (বোস্‌তুতো), ক্রমশঃ (ক্রোমোশো), কার্যতঃ (কার্যোতো) ইত্যাদি। উচ্চারণে আবশ্যক হয় না বলিয়া আধুনিক লেখকগণ অনেকেই পদান্তস্থিত বিসর্গটি লোপ করিয়া শব্দটিকে অ-কারান্ত করিয়া লেখেন। যেমন–বস্তুত, ক্রমশ, বিশেষত, দৃশ্যত, সাধারণত ইত্যাদি।

শব্দমধ্যে বিসর্গ থাকিলে উচ্চারণে পরবর্তী ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়। দুঃখ (দুখ্‌খো), অতঃপর (অতপ্‌প্‌র), স্বতঃসিদ্ধ (শতশ্‌শিদ্‌ধো), পৌনঃপুনিক (পোউনোপ্‌পুনিক্‌), পুরঃসর (পুরশ্‌শর)।

–চন্দ্রবিন্দু সংস্কৃতে বিরলদৃষ্ট, কিন্তু বাংলার বহুলপ্রযুক্ত। ইহার উচ্চারণ হয় নাসিকায়। কিন্তু স্বতন্ত্র বর্ণ-হিসাবে ইহার প্রয়োগ নাই। যে বর্ণে চন্দ্রবিন্দুটি যুক্ত হয় সেই বর্ণে অনুনাসিক ধ্বনির স্পর্শ লাগে। আঁখি, বাঁশি ইত্যাদি শব্দে যথাক্রমে “আ” “বা” অনুনাসিকত্ব পাইয়াছে।

যে-সমস্ত তৎসম শব্দে বর্গের পঞ্চমবর্ণ ঙ্‌ ঞ্‌ ণ্‌ ন্‌ ম্ প্রভৃতির সহিত অন্য ব্যঞ্জন যুক্তভাবে থাকে, বাংলায় সেইসমস্ত শব্দের বর্গীয় পঞ্চমবর্ণ লুপ্ত হয় এবং পূর্ববর্তী স্বরবর্ণটি চন্দ্রবিন্দুযুক্ত হইয়া দীর্ঘ হয়। যেমন, অঙ্ক–আঁক, শঙ্খ-শাঁখ, অঞ্চল–আঁচল, পঞ্জিকা–পাঁজি, কণ্টক–কাঁটা, ষণ্ড–ষাঁড়, দন্ত–দাঁত, কন্থা–কাঁথা, ধন্ধ–ধাঁধা, চম্পক–চাঁপা, গুম্ফ–গোঁফ, ঝম্প–ঝাঁপ, পঙ্ক–পাঁক, কম্পন–কাঁপন। কিন্তু লুপ্ত পঞ্চমবর্ণের পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনটি যদি বর্গীয় পঞ্চমবর্ণ হয় তখন নূতন করিয়া আর চন্দ্রবিন্দু হয় না, পঞ্চমবর্ণটির অনুনাসিক উচ্চারণই যথেষ্ট। যেমন মণ্ড–মাড়, মঞ্চ–মাচা।

তৎসম শব্দে ং থাকিলে বাংলায় সেই অনুস্বর লোপ পায় এবং পূর্ববর্তী স্বর চন্দ্রবিন্দুযুক্ত হইয়া স্থানে স্থানে দীর্ঘ হয়। অংশু–আঁশ, হংস–হাঁস, বংশী–বাঁশি, কংস–কাঁসা।

সম্মানসূচক “সে” ও “যে” শব্দের রূপে শব্দের প্রথমবর্ণে প্রায়ই চন্দ্রবিন্দু যুক্ত হয়। তাঁহাকে, তাঁর, যাঁহাদের, যাঁকে ইত্যাদি। কিন্তু তিনি যিনি ইনি শব্দে চন্দ্রবিন্দু নাই, পরবর্তী ন-র উচ্চারণই যথেষ্ট।

২৪। নাসিক্যীভবন : কোনো তৎসম শব্দ বাংলা শব্দে রূপান্তরিত হইবার সময় শব্দমধ্যস্থ যুক্তব্যঞ্জনের নাসিক্য ব্যঞ্জনটি (অর্থাৎ ঙ্‌ ঞ্‌ ণ্‌ ন্‌ ম্‌) কিংবা লুপ্ত হইবার সঙ্গে-সঙ্গে পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরটি অনুনাসিক হইয়া বৃদ্ধি পাইলে নাসিক্যীভবন (Nasalisation) হয়। যেমন, অঙ্ক–আঁক (পঞ্চমবর্ণ ঙ্‌ লুপ্ত, পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বর অ অনুনাসিক আঁ হইয়াছে); পঞ্চ-পাঁচ (ঞ লুপ্ত, প-এ যুক্ত অ অনুনাসিক আঁ হইয়াছে); দণ্ড–দাঁড় (ণ লুপ্ত, দ্‌ দাঁ হইয়াছে); চন্দ্র-চাঁদ (নলুপ্ত, চ্‌ চা হইয়াছে); কম্পন–কাঁপন (ম লুপ্ত, ক্‌ ক হইয়াছে); শঙ্খ-শাঁখ; অঞ্চল-আঁচল; পঞ্জিকা–পাঁজি; কণ্টক-কাটা; ষণ্ড–যাঁড়; দন্ত–দাঁত; কন্থা–কাঁথা; ধন্ধ–ধাঁধা; চম্পক–চাঁপা; ঝম্প–ঝাঁপ; গুম্ফ–গোঁফ; সন্ধ্যা–সাঁঝ; হংস–হাঁস; বংশ–বাঁশ; অংশু–আঁশ।

বদ্ধ–বাঁধা; বক্র–বাঁকা–এই দুইটি উদাহরণের মূল সংস্কৃত শব্দে আপাতদৃষ্টিতে কোনো বর্গীয় পঞ্চমবর্ণ চোখে পড়িতেছে না; কিন্তু শব্দদ্বয়ের মূল ধাতুতে যে ন্ ছিল (√বন্ধ্‌ > বদ্ধ, √বন্‌ক্‌ > বক্র), সেই ন্‌ ঘুরিয়া-ফিরিয়া বাংলা শব্দ দুইটিতে চন্দ্রবিন্দু-সৃষ্টির প্রভাব রাখিয়া গিয়াছে।

কিন্তু নাসিক্যবর্ণের (বর্গীয় পঞ্চমবর্ণের বা অনুস্বরের) সংস্রব ব্যতীত কোনো স্বরধ্বনি যখন স্বতঃই (আপনা-আপনি) অনুনাসিক হয়, তখন তাহাকে স্বতোনাসিক্যীভবন (Spontaneous Nasalisation) বলা হয়। যেমন, কাঁচ–কাঁচ; পুথি–পুঁথি; শস্য–শাঁস; ছিদ্র–ছেঁদা; সূচ–ছুঁচ; পেচক–পেঁচা; সপ্তত্রিংশৎ–সাঁইত্রিশ; উচ্চ–উঁচু; অক্ষি–আঁখি। অবশ্য খুঁটি, খাঁটী, ডাঁসা, ডাঁটো, খোঁজ, গোঁজ, পিঁপড়ে, আঁঠি (আঁটি), খুঁটি প্রভৃতি বাংলা শব্দে কেন যে চন্দ্রবিন্দু হইয়াছে, বলা যায় না।

চন্দ্রবিন্দু-প্রয়োগের প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান জেলার সাধারণ লোকের মধ্যে একটু বেশীই দেখা যায়। সাপ, খোকা, ঘাস, চা, কুকুর প্রভৃতিকে তাঁহারা যথাক্রমে সাঁপ, খোঁকা, ঘাঁস, চাঁ, কুঁকুর বলিয়া উচ্চারণ করেন। এমন-কি খাস কলিকাতার শিক্ষিতমহলেও কাঁছারি হাঁসপাতাল ঘোঁড়া হাঁসি বাঁসা ভিঁড় টাঁকশাল সোঁডা ঘুঁড়ি দোঁহাই হুঁজুর টিঁয়া তেঁতো প্রভৃতি শোনা যায়। আবার পূর্ববঙ্গবাসীদের মধ্যে চন্দ্রবিন্দু-প্রয়োগে যথেষ্ট শৈথিল্য দেখিতে পাওয়া যায়। তাহারা বাঁশকে বলেন বাশ; রাজহাঁস তাহাদের কাছে রাজহাস হইয়া গিয়াছে; চাঁদ, পাঁচ, কাঁটা হইয়াছে যথাক্রমে চাদ, পাচ, কাটা। এগুলি আদৌ শিষ্ট উচ্চারণ নয়।

চন্দ্রবিন্দু-প্রয়োগে এই যথেচ্ছাচারিতার ফলে অর্থবিভ্রাটও কম ঘটে না। আকার–আঁকার, কাচা–কাঁচা, কাদা–কাঁদা, কাটা–কাঁটা, কাসি–কাঁসি, খাটি–খাঁটি, খোজা–খোঁজা, চাপা—চাঁপা, খাড়া–খাঁড়া, দাড়ি–দাঁড়ি, পাক-পাঁক, বাটা–বাঁটা, বাক–বাঁক, বাধা–বাঁধা, রাধা–রাঁধা, বাচন–বাঁচন, ছাদ–ছাঁদ, শাখা–শাঁখা ইত্যাদি শব্দপ্রয়োগে ছাত্রদের প্রথম হইতেই অবহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

সংযুক্তবর্ণের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য

২৫। যুক্তবর্ণ : দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনবর্ণ মাঝখানে স্বরবর্ণের অভাববশতঃ পরস্পর যুক্ত হইয়া যে সংঘবদ্ধ রূপলাভ করে, তাহাকে যুক্তবর্ণ বলা হয়। সকলের শেষে একটি স্বরধ্বনি আসিয়া যুক্ত ব্যঞ্জনগুচ্ছকে একটি সংহত পৃথক্‌ রূপ দান করে। যেমন, ক্ + ষ্‌ + অ = ক্ষ; ক্‌ + + ম্‌ + ঈ = ক্ষ্মী; জ্‌ + ঞ্‌ + আ = জ্ঞা; দ্‌ + ধ্‌ + অ = দ্ধ; ব্‌ + ধ্‌ + অ = ব্ধ; ন্ + ধ্‌ + য্‌ + আ = ন্ধ্যা; হ্ + ণ্‌ + অ = হ্ণ; হ্ + ন্ + অ = হ্ন; হ্ + ম্ + অ = হ্ম; ত্‌ + র্‌ + উ = ত্রু; ক্‌ + র্‌ + অ = ক্র; শ্‌ + র্‌ + ঊ = শ্রূ; ষ্‌ + ণ্‌ + উ = ষ্ণু; গ্‌ + ন্ + অ = গ্ন; ঞ্‌ + চ্‌ + আ = ঞ্চা; ঞ্‌ + জ্‌ + উ = ঞ্জু; গ্‌ + ণ্‌ + অ = গ্‌ণ ইত্যাদি।

কতকগুলি যুক্তবর্ণ দেখিবামাত্র চিনিতে পারা যায় কোন্ কোন্ বর্ণের সমন্বয়ে তাহারা গঠিত। কিন্তু কতকগুলি যুক্তবর্ণের আকৃতি দেখিয়া তাহাদের উপাদান বর্ণগুলিকে বুঝিয়া উঠা বেশ কষ্টকর। এইজন্য প্রথম হইতেই সংযুক্তবর্ণের আকৃতি-সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়।

এইবার কয়েকটি সংযুক্তবর্ণের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য দেখানো হইতেছে :

ক্ষ–সংস্কৃতে এই যুক্তবর্ণটির উচ্চারণে ইহার উপাদান-বর্ণ ক্ ও ষ-এর ধ্বনি অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। পরীক্ষা (পোরীক্‌ষা), লক্ষ্য (লোকষ্য) ইত্যাদি। কিন্তু বাংলায় এই যুক্তবর্ণটির উচ্চারণ বিকৃত হইয়া গিয়াছে।–

(১) শব্দের আদিতে থাকিলে ক্ষ-র উপাদান-বর্ণদ্বয়ের ধ্বনি বিলুপ্ত হইয়া তৎস্থানে ‘খ্‌’-ধ্বনি শ্রুত হয়। ক্ষুধা (খুধা), ক্ষুণ্ণ (খুন্‌নো), ক্ষমা (খমা), ক্ষিতি (খিতি), ক্ষৌণী (খৌনি) ইত্যাদি।

(২) ক্ষ যখন শব্দমধ্যে বা শব্দান্তে থাকে, তখন ক্‌-এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে, কিন্তু ষ-এর উচ্চারণ খ্‌-ধ্বনির মতো হয়। অক্ষর (ওক্‌খোর্‌), মোক্ষদা (মোক্‌খোদা), যোগক্ষেম (যোগক্‌খেমো), রক্ষা (রোক্‌খা) ইত্যাদি।

জ্ঞ—জ্‌ ও ঞ-র সংযোগে এই যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি। (কিন্তু ‘ঞ’ ও ‘জ’-এর সংযুক্ত রূপ ঞ্জ)। বর্তমানে এই সংযুক্তবর্ণটির দুইটি উচ্চারণ দাঁড়াইয়াছে।

(১) শব্দের আদিতে জ্ঞ থাকিলে তাহার উচ্চারণ গ্যঁ হয়। যেমন–জ্ঞান (গ্যাঁন্‌), জ্ঞাতি (গ্যাঁতি), জ্ঞেয় (গ্যেঁয়) ইত্যাদি।

(২) শব্দের মধ্যে বা শেষে জ্ঞ থাকিলে তাহার উচ্চারণ হয় গ্‌গঁ-এর মতো। যেমন–অজ্ঞ (অগ্‌গোঁ), বিজ্ঞ (বিগ্‌গোঁ), ধর্মজ্ঞ (ধর্‌মোগোঁ), জিজ্ঞাসু (জিগ্‌গাঁশু), জিজ্ঞাস্য (জিগ্‌গাঁশ্‌শো), জিজ্ঞাসা (জিগ্‌গাঁশা), সংজ্ঞা (সংগাঁ–এখানে অনুস্বরের প্রভাবে পরবর্তী গ্‌ লোপ পাইয়াছে), প্রজ্ঞা (প্রোগ্‌গাঁ), কিন্তু বিজ্ঞান (বিগ্‌গ্যাঁন্‌), অজ্ঞান (অগ্‌গ্যাঁন্‌) [ কদাপি বিগ্‌গাঁন বা অগ্‌গাঁন্ নয় ], প্রজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত একটি য্‌-ফলার ধ্বনি শ্রুত হয়।

লক্ষ্য কর, জ্ঞ-র জ-ধ্বনিটি সর্বত্রই লুপ্ত, তৎপরিবর্তে গ্য কিংবা গ্‌গ-ধ্বনি শ্রুত হইতেছে; অবশ্য ঞ্‌-ধ্বনিটি চন্দ্রবিন্দুর ধ্বনি পাইয়া কোনোপ্রকারে আত্মরক্ষা করিতেছে। আবার, পূর্ববঙ্গের উচ্চারণে এই অনুনাসিক চন্দ্রবিন্দু ধ্বনিটিও পাওয়া যায় না। অবশ্য সে উচ্চারণ ব্যাকরণ-সম্মত নয়।

ঞ্চ—ঞ্‌ ও চ-এর সংযোগে এই যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি। উচ্চারণে বর্ণগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু এ নিজস্ব উচ্চারণ হারাইয়া–এর উচ্চারণ পায়। মঞ্চ (মন্‌চো), পঞ্চ (পন্‌চো), সঞ্চিতা (শোন্‌চিতা), বঞ্চিত (বোন্‌চিতো) ইত্যাদি।

ঞ্ছ—ঞ্‌ ও ছ-এর সংযোগে যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি। উচ্চারণে বর্ণগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু এখানেও এ নিজস্ব উচ্চারণ হারাইয়া ন্-এর উচ্চারণ পায়। যেমন–বাঞ্ছা (বান্‌ছা), লাঞ্ছনা (লান্‌ছোনা), লাঞ্ছিত (লান্‌ছিতো) ইত্যাদি।

ঞ্জ—ঞ্‌ ও জ-এর সংযোগে যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি। উচ্চারণে বর্ণগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু এখানেও ঞ্‌ নিজস্ব উচ্চারণ হারাইয়া ন্‌-এর উচ্চারণ পায়। যেমন–অঞ্জনা (অন্‌জোনা), গুঞ্জিত (গুন্‌জিতে), মঞ্জুষা (মোন্‌জুশা) ইত্যাদি।

ষ্ণ—ষ্‌ ও ণ-সংযোগে যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি (কদাপি ষ্‌ + ঞ নয়)। উচ্চারণে বর্ণগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু ষ্‌ বা ণ্‌ নিজস্ব উচ্চারণ স্বাভাবিক কারণেই হারাইয়া ফেলিয়াছে। যেমন–কৃষ্ণ (ক্রিশ্‌নো), তৃষ্ণা (ত্রিশ্‌না), বিষ্ণু (বিশ্‌নু), নিষ্ণাত (নিশ্‌নাতে) ইত্যাদি।

হ্ণ, হ্ন–মূর্ধন্য ণ্‌ ও দন্ত্য ন্‌–এই বর্ণদ্বয়ের ধ্বনি বাংলায় এক হইয়া গিয়াছে। উভয় স্থলেই দন্ত্য ন্‌-এর উচ্চারণ পাই। অথচ আকৃতিতে উভয়ের পার্থক্য বজায় রাখিতেই হয়। সেইজন্য হ্‌ + ণ্‌ = হ্ণ, হ্‌ + ন্‌ = হ্ন এই যুক্তবর্ণ দুইটির আকৃতিগত পার্থক্যটি বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে।

এই সংযুক্তবর্ণ দুইটি উচ্চারণের দিক্ দিয়া একটু বিশেষত্ব দাবি করে। এইজন্য ইহাদের উল্লেখ বিশেষ দরকার। যুক্তবর্ণে উপাদান-বর্ণগুলি সাধারণতঃ নিজেদের অবস্থানের ক্রম-অনুযায়ী উচ্চারিত হয়। ব্যক্তি (বেক্‌তি), লুব্ধ (লুব্‌ধো) ইত্যাদি। কিন্তু হ্ণ ও হ্ন-এর উপাদান-বর্ণগুলি নিজেদের অবস্থানের ক্রম মানে না, ন্‌-ধ্বনি আগেই ধ্বনিত হয়, হ-ধ্বনি পরে আসে। যেমন–অপরাহ্ণ (অপোরান্‌হো), পূর্বাহ্ণ (পু্র্‌বান্‌হো), মধ্যাহ্ন (মোধ্‌ধান্‌হো ), বহ্নি (বোন্‌হি), জাহ্নবী (জান্‌হোবি), আহ্নিক (আন্‌হিক্‌) ইত্যাদি।

হ্ম—হ্‌ ও ম এই দুইটি বর্ণের সংযুক্ত রূপ হইতেছে হ্ম। ইহারও উচ্চারণে উপাদান-বর্ণ দুইটি নিজেদের অবস্থানের ক্রম মানিতেছে না। ম-ধ্বনি পূর্বে শ্রুত হয়, হ-ধ্বনিটি আসে পরে। যেমন–ব্রহ্ম (ব্রোহো), ব্রাহ্মণ (ব্রাহা), ব্রহ্মাণ্ড (ব্রোম্হানডো), ব্রহ্মিষ্ঠ (ব্রোহিশঠো) ইত্যাদি।

হ্ল–এই যুক্তবর্ণটির উপাদান-বর্ণ দুইটি বাংলা উচ্চারণে স্থান পরিবর্তন করে অর্থাৎ ল প্রথমেই উচ্চারিত হয়, পরে হ আসে। প্রহ্লাদ (প্রোল্‌হাদ্‌), কহ্লার (কল্‌হার্‌), আহ্লাদিনী (আল্‌হাদিনি)।

সংযুক্তবর্ণের তৃতীয় বা চতুর্থ উপাদান ব্যঞ্জনটি ব্‌-ফলা বা য্‌-ফলা হইলে তাহার উচ্চারণ লোপ পায়। যেমন–সত্ত্ব, ঊর্ধ্ব, সান্ত্বনা (ব্‌-ফলার উচ্চারণ লোপ); স্বাতন্ত্র, মাহাত্ম্য, বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য (য্‌-ফলার উচ্চারণ লুপ্ত)। কিন্তু বর্ণটি ব্‌-ফলা বা য্‌-ফলা না হইলে উচ্চারণে তাহার প্রভাব থাকিবেই। যেমন,–সূক্ষ্ম, যক্ষ্মা (উভয় ক্ষেত্রেই তৃতীয় উপাদান-বর্ণ ম-এর প্রভাবে উচ্চারণ স্বল্প অনুনাসিক হইতেছে)। স্নেহার্দ্র–শব্দটিতে তৃতীয় ব্যঞ্জন র্‌-ফলার উচ্চারণ অক্ষুণ্ণই রহিয়াছে।

উচ্চারণ-প্রসঙ্গে একটি মূল্যবান্ কথা মনে রাখিবে–বাংলা বর্ণমালায় এমন কিছু বর্ণ আছে স্থলবিশেষে যাহাদের ধ্বনি (উচ্চারণ) এক-একরকম এবং এমনকিছু বর্ণ আছে যাহারা নামে ভিন্ন হইলেও উচ্চারণে একইরকম।

একই বর্ণের বিভিন্ন ধ্বনি–অ (অ, ও, ধ্বনিলোপ), এ (এ, অ্যা), জ (য, ইংরেজী z), ম্‌ (মো, ম, ম্-ফলারূপে সামান্য অনুনাসিক), য্‌-ফলা (এ, অ্যা, ধ্বনিলোপ), ব-ফলা (ইংরেজী w, ধ্বনিলোপ), শ (তালব্য, দন্ত্য), স (তালব্য, দন্ত্য), ক্ষ (ক্‌খ, খ), জ্ঞ (গ্যঁ, গ্‌গোঁ) ইত্যাদি।

বিভিন্ন বর্ণের একই ধ্বনি–ই ঈ (ই), ঊ ঊ (উ), ঋ রি (রি), ঙ্ ং (ং), জ য (য), ঞ ণ ন (ন), শ ষ স (শ), হ ঃ (হ) ইত্যাদি।

২৬। ধ্বনিতত্ত্ব : ব্যবহারিক ক্ষেত্রে একই বর্ণের বিভিন্ন ধ্বনি, বিভিন্ন বর্ণের একই ধ্বনি, ধ্বনির লোপ, পরিবর্তন, দ্বিত্বসাধন, ধ্বনিসাম্য প্রভৃতি ধ্বনির বিচিত্র গতিপ্রকৃতির মৌল কারণ-সম্বন্ধে যে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, তাহারই সমষ্টীভূত নাম ধ্বনিতত্ত্ব।

স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সুষ্ঠু সংযোগে গঠিত হাজার হাজার শব্দ বাংলা ভাষার ভাণ্ডারটিকে পূর্ণ করিয়াছে এবং এখনও শক্তিশালী শিল্পীর হাতে নিত্য নূতন নূতন শব্দ গঠিত হইয়া মাতৃভাষার ভাণ্ডারটিকে পরিপুষ্টি দিতেছে। কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ্য কর।–অ ম্ অ ন্ ই বর্ণগুলি যেমনটি রহিয়াছে, সরাসরি যোগ করিলে পাওয়া যায় ‘অমনি’ শব্দটি। আবার একটু ঘুরাইয়া ফিরাইয়া যোগ করিলে পাইবে ‘ইমন’ শব্দ। ব্ র্ অ জ্ অ পাঁচটি বর্ণ সরাসরি যোগ করিয়া ‘ব্রজ’ শব্দ পাইবে, একটু ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া যোগ করিলে পাইবে ‘বজ্র’ শব্দটি। ম্ আ ত্ আ এই বর্ণগুলি হইতে ‘মাতা’, ‘তামা’ ও ‘আত্মা’ তিনটি শব্দ পাওয়া যায়।

র্-এর পর কোনো ব্যঞ্জন থাকিলে র্ রেফ ( ? ) হইয়া সেই ব্যঞ্জনের মস্তকে চলিয়া যায়। র্ + য্‌ = র্য (যেমন সূর্য)। র্ + গ্য = র্গ্য (যেমন গার্গ্য)। র্ + ঘ্য = র্ঘ্য (যেমন দৈর্ঘ্য)। আর, স্বরশূন্য ব্যঞ্জনের পরে র্ থাকিলে র্-ফলা (্র) হইয়া সেই ব্যঞ্জনের পদতলে বসে। ম্ + র্‌ = ম্র (যেমন তাম্র)।

দুইটি য্‌ পরস্পর যুক্ত হইলে প্রথমটি অটুট থাকে, দ্বিতীয়টি য্‌-ফলা (্য) হইয়া যায়। য্ + য্‌ = য্য (যেমন ন্যায্য, শয্যা, সাহায্য)।

প্রতিটি শব্দে ব্যঞ্জন ও স্বরের অবস্থানক্রম-সম্বন্ধে সচেতন থাকা দরকার, বিশেষভাবে ণ্‌ত্ব-যত্ন-বিধি, সন্ধি, কারক-বিভক্তি প্রভৃতি অধ্যায়ে। শব্দের অন্তর্গত বর্ণগুলিকে ক্রমানুযায়ী বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখানোর নাম বর্ণ-বিশ্লেষণ।

২৭। বর্ণ-বিশ্লেষণ : যে-সমস্ত স্বর ও ব্যঞ্জনের সুষ্ঠু সংযোগে কোনো একটি শব্দ গঠিত হয় সেই বর্ণগুলিকে ক্রমানুযায়ী পৃথক্ করিয়া দেখানোর নাম বৰ্ণ-বিশ্লেষণ।

যুক্তবর্ণ-সমন্বিত কয়েকটি শব্দের বর্ণ-বিশ্লেষণ দেখ।–

শব্দ = শ্ + অ + ব্ + দ্ + অ ।

সুষ্ঠু = স্ + উ + ষ্ + ষ্ + উ!

শ্রীমান্ = শ্ + র্ + ঈ + ম্ + আ + ন্।

প্রোজ্জ্বল = প্ + র্ + ও + জ্ + জ্ + ব্ + অ + ল্ + অ।

বহ্ন্যুৎসব = ব্ + অ + হ্‌ + ন্ + য্ + উ + ত্ + স্ + অ + ব্ + অ ।

অপরাহ্ণ = অ + প্ + অ + র্ + আ + হ্ + ণ্ + অ।

ঊর্ধ্বে = ঊ + র্ + ব্ + ব্ + এ।

সত্ত্বেও = স্ + অ + ত্ + ত্ + ব্ + এ + ও।

স্বাস্থ্য = স্ + ব্ + আ + স্ + থ্ + য্ + অ।

সান্ত্বনা = স্ + আ + ন্ + ত্ + ব্ + অ + ন্ + আ।

স্নেহার্দ্র = স্ + ন্ + এ + হ্ + আ + র্ + দ্ + র্ + অ।

জ্যৈষ্ঠ = জ্ + য্ + ঐ + ষ্ + ঠ্‌ + অ।

সহিষ্ণুতা = স্ + অ + হ্ + ই + ষ্ + ণ্ + উ + ত্ + আ।

শৌক্ল্য = শ্ + ঔ + ক্ + ল্ + য্ + অ।

লক্ষ্মীবান্ = ল্ + অ + ক্ + ষ্ + ম্ + ঈ + ব্ + আ + ন্ ।

শত্রুতা = শ্ + অ + ত্ + র্ + উ + ত্ + আ।

ক্রূর = ক্ + র্ + ঊ + র্ + অ ।

নর্ম = ন্‌ + অ + র্‌ + ম্‌ + অ।

নম্ৰ = ন্ + অ + ম্ + র্ + অ ।

কাঁচা = ক্‌ + ঁ + আ + চ্‌ + আ।

কুঁড়ি = ক্ + ঁ + উ + ড়্‌ + ই।

অ্যাঁকা = ঁ + অ্যা + ক্‌ + আ।

সৌক্ষ্ম্য = স্ + ঔ + ক্ + ষ্ + ম্ + ষ্ + অ।

স্বাচ্ছন্দ্য = স্ + ব্ + আ + + ছ্‌ + অ + ন্ + দ্ + য্ + অ।

অক্ষর ও বর্ণ

শব্দমধ্যস্থ যতটুকু ধ্বনি বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রচেষ্টায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, তাহাকে অক্ষর (syllable) বলে। একটি ধ্বনিতেও অক্ষর হয়, একাধিক ধ্বনিতেও অক্ষর হয়। প্রত্যেক অক্ষরের উচ্চারণে একটি স্বরধ্বনি থাকিবেই। মা = একটি অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ। পিতা = দুইটি অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ। জানকী = তিনটি অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ। কালীপুজো চারিটি অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ।

অক্ষর স্বরান্তও হয়, ব্যঞ্জনান্তও (হলন্ত) হয়। যে অক্ষরের শেষ স্বরধ্বনিটি উচ্চারিত হয়, তাহা স্বরান্ত অক্ষর। জা-ন-কী প্রত্যেকটি অক্ষরই স্বরান্ত। পৃথক্‌ (পৃ-থক্) এই দুই অক্ষরবিশিষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষরটি (পৃ) স্বরান্ত, দ্বিতীয় অক্ষরটি (থক্) ব্যঞ্জনান্ত।

অক্ষর ও বর্ণ এক নহে। মা শব্দটিতে দুইটি বর্ণ আছে, কিন্তু শব্দটি একাক্ষর। মধু শব্দে দুইটি ব্যঞ্জন ও দুইটি স্বর মোট চারিটি বর্ণ আছে, কিন্তু শব্দটি দ্বি-অক্ষর। পৃথক্ শব্দটিতে ব্যঞ্জন তিনটি ও স্বর দুইটি–মোট পাঁচটি বর্ণ আছে, কিন্তু শব্দটি দ্বি-অক্ষর। নালন্দা শব্দটিতে স্বর ও ব্যঞ্জনে মোট বর্ণ আছে সাতটি, কিন্তু শব্দটি ত্রি-অক্ষর (না-লন্-দা)।

জল (জল্), ফল (ফল্) মন (মোন্), বন (বোন্), বোন (বোন্), কোণ (কোন্) প্রভৃতি শব্দের উচ্চারণে শেষ স্বরটি লোপ পায়, একটিমাত্র স্বরই অবশিষ্ট থাকে, তাই শব্দগুলি একাক্ষর। কিন্তু জলধারা (জ-লো-ধা-রা), ফলন্ত (ফ-লোন্-তো), বনবাস (বো-নো-বাস্) এবং বৃন্দাবন (বৃন্দা–বোন্) শব্দগুলির অক্ষর-সংখ্যা লক্ষ্য কর।

জল, ফল, মন, বন প্রভৃতি শব্দগুলির শেষ স্বরধ্বনিটি উচ্চারণে লোপ পায় বলিয়া প্রথম স্বরধ্বনিটির উচ্চারণ দীর্ঘ হয়। সেইজন্য শব্দগুলিকে দীর্ঘ অক্ষর বলা হয়।

সুতরাং শব্দের অক্ষর-নির্ণয়ে উচ্চারণের প্রাধান্যটি লক্ষ্য করিবে।

আধুনিক বাংলায়, বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গের কথ্য ভাষার উচ্চারণে, শব্দের আদি অক্ষরে ঝোঁক পড়ে বলিয়া শব্দটির ধ্বনিসংখ্যা যত বেশীই হউক না কেন, সমগ্র শব্দটিকে মাত্র দুইটি মাত্রায় বা দুই মাত্রার গুচ্ছে পরিণত করার যে প্রবণতা দেখা দেয়, তাহাকে দ্বিমাত্রিকতা বা দ্ব্যক্ষরতা (Bimorism) বলা হয়। যেমন–দেবতা (দেব্‌-তা), কমলা (কম্‌-লা–লেবু অর্থে), গামোছা (গাম্‌-ছা), নারায়ণ (না-রান্‌)। পরিণাম (পরি + নাম্‌), অপরাজিতা (অপ্‌-রা + জিতা) এই দুইটি উদাহরণ দুই মাত্রার গুচ্ছে পরিণত হইয়াছে।

যে ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণকালে একইসঙ্গে দুইটি ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হয়, তাহাকে দ্বিব্যঞ্জন ধ্বনি বলা হয়। এই ধ্বনি দুইপ্রকার–মহাপ্রাণ (Aspirated) ও ঘৃষ্টধ্বনি (Affricated)। (১) মহাপ্রাণ : খ্‌ = ক্‌ + হ; ঝ্‌ = জ্‌ + হ্; ধূ = দ্‌ + হ্; ভূ = + হ্‌–প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্পর্শবর্ণের সঙ্গে হ্ উচ্চারিত হইতেছে। (২) স্পর্শবর্ণ ও উষ্মবর্ণ একইসঙ্গে উচ্চারিত হইলে খৃষ্টধ্বনি হয়। যেমন, গাছতলা>গাচ্‌স্‌তলা; আগাপাছতলা>আগাপাচ্‌স্‌তলা; কিছু> কিৎসু; এগুলি শিক্ষিত লোকের মুখের উচ্চারণ। কাগজ> কাগদ্‌জ–পুরানো কাগজ কিনিতে ইচ্ছুক কাগজওয়ালার মুখের উচ্চারণ। বাতাসে বাগ্‌যন্ত্রের সামান্য ঘর্ষণ লাগে বলিয়াই নাম ঘৃষ্টধ্বনি।

মাত্রা

অক্ষরের উচ্চারণকালের একক হইল মাত্রা (Mora)। সাধারণতঃ হ্রস্বস্বর একমাত্রার, আর দীর্ঘস্বর দুইমাত্রার। কিন্তু বাংলায় দীর্ঘস্বরগুলি প্রায়ই একমাত্রার, হ্রস্বস্বরও আবার মাঝে মাঝে দীর্ঘ হয়।

বন (বোন্–অন্ত্য অ অনুচ্চারিত বলিয়া আদ্য অ দীর্ঘ হইয়া দুই মাত্রার হইয়াছে); ঘোর (ঘোর্‌–অন্ত্য অ অনুচ্চারিত বলিয়া আদ্য দীর্ঘস্বর ও-কার দুইমাত্রারই রহিয়াছে); বনবাস (বোনোবাস্‌–প্রথম দুইটি অ এক-এক মাত্রার; কিন্তু অন্ত্য অ অনুচ্চারিত বলিয়া তৃতীয় স্বর আ-কার দুইমাত্রার হইয়াছে)।

কৌতুকী (কৌ-তু-কী–তিন অক্ষরে একটি করিয়া মোট তিনমাত্রা–প্রথম ও শেষ অক্ষরে দীর্ঘস্বরও একমাত্রার), কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে–”এ কি কৌতুক নিত্য নূতন ওগো কৌতুকময়ী” (ঔ-কার এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুইমাত্রার; প্রথমটিতে অন্ত্য অ অনুচ্চারিত বলিয়া দ্বিতীয়স্বর উ-কার দুইমাত্রার; কৌতুকময়ী শব্দটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্বরধ্বনি এক-এক মাত্রার)।

বাংলা ছন্দের ক্ষেত্রে এই সঠিক উচ্চারণ এবং মাত্রা-সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা থাকা বিশেষ প্রয়োজন।

দল ( Syllable )

আগে ইংরেজী Syllable (সিলেব্‌ল্‌)-এর বাংলা প্রতিশব্দ ছিল অক্ষর। বর্তমানে মাননীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ ‘অক্ষর’-এর পরিবর্তে শ্রদ্ধেয় প্রবোধচন্দ্র সেন-প্রদত্ত ‘দল’ প্রতিশব্দটি গ্রহণ করিয়াছেন।

পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত ভাষার মতো বাংলা ভাষাতেও পড়িবার সময় কিংবা কথা বলিবার ক্ষেত্রে শব্দমধ্যে বিন্যস্ত সবগুলি ধ্বনিকে কখনই আমরা একসঙ্গে একটানা উচ্চারণ করিতে পারি না–কতকগুলি ছোটো ছোটো ধ্বনিগুচ্ছে ভাগ করিয়া উচ্চারণ করি। শ্বাসবায়ুর এক-একটি ধাক্কায় একক প্রয়াসে আমরা যে কয়টিমাত্র ধ্বনিকে একসঙ্গে উচ্চারণ করিতে সমর্থ হই, সেই কয়টি ধ্বনি এক একটি ধ্বনিগুচ্ছে সংবদ্ধ হইয়া যায়। বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রচেষ্টায় উচ্চারিত শব্দমধ্যস্থ সেই এক-একটি ধ্বনিগুচ্ছকেই ভাষাবিজ্ঞান ও ছন্দোবিজ্ঞানে ‘দল’ পরিভাষায় অভিহিত করা হইয়াছে।

মুক্তি চমৎকার গান গাহিতেছে–বাক্যটিতে চারিটি শব্দ আছে। শব্দগুলিকে দল-রূপে বিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায় :

মুক্তি = [ মুক্ ] – [ তি ] = [ ম্ + উ + ক্ ] – [ ত্ + ই ]।

চমৎকার = [ চ ] – [ মোৎ ] – [ কার্ ] = [ চ্ + অ ] – [ম্ + ও + ত্ ] – [ ক্ + আ + র্ ] ।

গান = [ গান্ ] = [ গ্ + আ + ন্ ]।

গাহিতেছে = [ গা ] – [ হি ]- [ তে ] – [ ছে ] = [ গ্ + আ ] – [ হ্ + ই ] – [ ত্ + এ ] – [ ছ্ + এ ]

লক্ষ্য কর, প্রথম শব্দটিতে দুটি, দ্বিতীয়টিতে তিনটি, তৃতীয়টিতে একটিমাত্র এবং চতুর্থ শব্দটিতে চারিটি দল রহিয়াছে। সুতরাং, এইটুকু বুঝিতে পারিলাম যে, শব্দে এক বা একাধিক দল থাকিতে পারে। যে শব্দে একটিমাত্র দল থাকে, তাহাকে একদল (Mono-syllabic) শব্দ বলে। যেমন : আখ, আম, ওল, বল, ফল, প্রাণ, কান, মান, শ্রী, মা, স্ত্রী, ধান, আট, ইট, বই, কাঠ ইত্যাদি।

অনুরূপভাবে, যে শব্দে দুটি দল থাকে, তাহাকে দ্বি-দল (Di-syllabic / Bi-syllabic) শব্দ বলে। যেমন : চঞ্চল, বিমল, উৎসব, যন্ত্র, বস্তি, সস্তা, পাথর, জঞ্জাল, বিজ্ঞান, অজ্ঞ, মন্দ, ছন্দ, কল্লোল, উত্তর, লজ্জা, ব্যস্ত, সুন্দর, বিকাশ, ঝঞ্ঝা, গন্ধ প্রভৃতি।

যে শব্দে তিনটি দল থাকে, তাহাকে ত্রিদল ( Tri–syllabic) শব্দ বলে। যেমন : আনন্দ, জীবন্ত, প্রচণ্ড, উপহার, উপকার, অন্ধকার, ব্যবহার, অবসর, উন্মত্ত, কবিতা, প্রমত্ত, ইতিহাস ইত্যাদি।

যে শব্দে চারিটি দল থাকে, তাকে চতুর্দল (Tetra-syllabic) শব্দ বলে। যেমন: উচ্ছ্বসিত, প্রজ্বলিত, বিশিষ্টতা প্রভৃতি।

মনে রাখিবে; দল-নির্ণয়ে শব্দটির উচ্চারণেরই প্রাধান্য থাকে; শব্দটি যেরূপে উচ্চারিত হয়, দলের বানানও সেইভাবেই লিখিতে হয়।

যেমন, মন্ত্রণাসভা = [ মোন্ ] – [ ত্রো ] – [ না ] – [ স ] – [ ভা ], দিবাবসান [ দি ] – [ বা ] – [ ব্‌ ] – [ সান্ ], ব্যঞ্জনধ্বনি = [ ব্যান্ ] – [ জোন্ ] – [ ধো ] – [ নি,], তুফানতরঙ্গিণী = [ তু ] – [ ফান্ ] – [ ত্‌ ] – [ রোঙ্ ] – [ গি ] – [ নি ] ইত্যাদি।

দলের কাঠামো বিশ্লেষণ

লক্ষ্য কর, উপরিলিখিত যে শব্দগুলিকে কয়েকটি দলে বিশ্লেষণ করা হইয়াছে, তাহাদের প্রতিটি দলেই একটি করিয়া স্বরধ্বনি রহিয়াছে; কোনোটিতে একটি, কোনোটিতে-বা একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। সুতরাং দল-গঠনের নিয়মটি হইল–

প্রতিটি দলে স্বরধ্বনি অবশ্যই থাকিবে এবং কেবলমাত্র একটিই স্বরধ্বনি থাকিবে। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিবার ব্যাপারে কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা নাই। অর্থাৎ প্রতিটি দলে এক বা একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিতে পারে, আবার একটিও না থাকিতে পারে।

যেমন : ‘ওপার’ শব্দটিকে দলে বিশ্লিষ্ট করিলে [ ও ] এবং [ পার্ ] দুইটি দল পাই। প্রথম দলটিতে একটিমাত্রই স্বরধ্বনি রহিয়াছে, কোনো ব্যঞ্জনধ্বনিই নাই। দ্বিতীয় দলটির বর্ণ-বিশ্লেষণ করিলে ‘প্’ ও ‘র্’ ব্যঞ্জনধ্বনি এবং ‘আ’ স্বরধ্বনিটি পাই। তেমনভাবে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “অয়ি ভুবনমনোমোহিনী” গানের প্রথম শব্দটিকে দলে বিশ্লেষণ করিলে পাই, অয়ি = [ ও ] – [ ই ]; লক্ষ্য কর, দুটি দলের কোনোটিতেই কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি নাই, শুধুমাত্র একটি করিয়া স্বরধ্বনি উপস্থিত রহিয়াছে।

স্বরধ্বনি স্বয়ং-উচ্চারণে সক্ষম, কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্য ব্যতীত উচ্চারিত হইতে পারে না। তাই, দলের প্রধান উপাদান এই স্বরধ্বনিকে দলের প্রাণ অর্থাৎ দলকেন্দ্র (Syllable Nucleus) বলা হয়। প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ রামেশ্বর শ’ বলিয়াছেন–ব্যঞ্জনধ্বনির তুলনায় স্বরধ্বনি বেশী মধুর (Sonorous ) এবং বেশী অনুরণনশীল ( resonant)। স্বরধ্বনির এই অধিক অনুরণন তরঙ্গশীর্ষ এবং ব্যঞ্জনধ্বনির স্বল্প অনুরণন নিম্নদেশ রচনা করে। এইজন্য স্বরধ্বনিকে দলের শীর্ষ (Peak) এবং ব্যঞ্জনধ্বনিকে নিম্নদেশ (Valley) বলে।

সুতরাং দলের সংজ্ঞার্থটি এইরূপে নির্ণয় করিতে পারি?

২৮। দল : যে ক্ষুদ্রতম ধনিগুচ্ছ নিঃশ্বাসের এক ধাক্কাতে একসঙ্গে উচ্চারিত হইতে পারে এবং যাহাতে একটিমাত্র স্বরধ্বনি থাকে, তাহাকে দল বলে।

কোনো দলে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিলে তাহা স্বরধ্বনির আগে বা পরে অথবা উভয়স্থানেই বসিতে পারে। স্বরধ্বনির আগে অবস্থিত ব্যঞ্জনধ্বনিটিকে দলারম্ভ বা আরম্ভাংশ (Onset) এবং স্বরধ্বনির পরে অবস্থিত ব্যঞ্জনধ্বনিকে দলান্ত বা শেষাংশ (Coda) বলা হয়। যেকোনো দলে দলারম্ভ ও দলান্ত থাকিবার ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা না থাকিলেও প্রতিটি দলে দলকেন্দ্র বা কেন্দ্রক (Syllable Nucleus) অবশ্যই থাকিবে।

শব্দের মধ্যে কতকগুলি ধ্বনিগুচ্ছ লইয়া প্রথমে দল গঠিত হয়; তাহার পরে কয়েকটি দল মিলাইয়া এক-একটি শব্দ গড়িয়া উঠে। বাংলা ভাষায় দল-গঠনের কাঠামোটি বিশ্লেষণ করিয়া আমরা ভাষায় ধ্বনি-সমাবেশের পদ্ধতি উদ্ঘাটন করিতে পারি। খাঁটী বাংলায় দলের গঠনরূপ প্রধানত চারি প্রকারের

(১) [ স্বর] কেবলমাত্র স্বরধ্বনি (দলকেন্দ্র) দ্বারা গঠিত দল। “ও পাড়া হইতে আয় মায়ে-ঝিয়ে।” “তুমি এ-পার ও-পার কর কে গো ওগো খেয়ার নেয়ে।” “আমার কঠিন হৃদয়টারে ফেলে দিলেম পথের ধারে।” বাক্যগুলিতে আয়তাক্ষর শব্দগুলি লক্ষ্য কর। প্রথম বাক্যে ‘ও’ শব্দটিতে একটি মাত্রই দল রহিয়াছে, এবং দলটি কেবল একটিই স্বরধ্বনি দ্বারা গঠিত। দ্বিতীয় বাক্যে এ-পার’, ‘ও-পার’ এবং ‘ওগো’ শব্দতিনটির অন্তর্গত দুইটি করিয়া দলের প্রথম দলগুলি–’এ’, ‘ও’ এবং ‘ও’–শুধুমাত্র একটি করিয়া স্বরধ্বনি লইয়া গঠিত হইয়াছে। তৃতীয় বাক্যে ‘আমার’ শব্দের প্রথম দল আ’ সেইরকমই একটিমাত্র স্বরধ্বনিবিশিষ্ট। এই দলগুলিতে কোনো ব্যঞ্জনধ্বনিই নাই।

(২) [ব্যঞ্জন + স্বর] : দলারম্ভ (ব্যঞ্জন) ও দলকেন্দ্র (স্বর) দ্বারা গঠিত দল। “মা আমায় ছুটি দিতে বল্।” “যা পেয়েছি প্রথম দিনে।” “এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।” বাক্যগুলির আয়তাক্ষর শব্দগুলি লক্ষ্য কর। ‘মা’, যা’, ‘না’ একদল শব্দ; মা = [ ম্ + আ ], যা = [ য্‌ + আ ], না = [ ন্‌ + আ]। শব্দ–তিনটিতে একটি করিয়া যে দল রহিয়াছে, তাহাদের বর্ণ-বিশ্লেষণে প্রথমে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি ও পরে একটি স্বরধ্বনি দেখা যায়। এই দলগুলিতে দলারম্ভ ও দলকেন্দ্ৰ থাকিলেও দলান্ত নাই।

(৩) [ স্বর + ব্যঞ্জন ]ঃ দলকেন্দ্র (স্বর) ও দলান্ত (ব্যঞ্জন) দ্বারা গঠিত দল। ইস, কী ক্ষতি! “আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।” “সেই সাপ জ্যান্ত গোটা-দুই আন্ তো।” লক্ষ্য কর, আয়তাক্ষর তিনটি শব্দই একদল এবং প্রতিটি দলেই প্রথমে স্বরধ্বনি ও পরে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি রহিয়াছে। ইস্ = [ ই + স্ ]; আজ = [ আজ্‌ ] = [ আ + জ্ ]; আন্ = [ আ + ন্ ]; এক্ষেত্রে দলগুলি দলারম্ভ বাদ দিয়া কেবল দলকেন্দ্র ও দলান্ত দ্বারা গঠিত হইয়াছে।

(৪) [ ব্যঞ্জন + স্বর + ব্যঞ্জন ] : দলারম্ভ, দলকেন্দ্র ও দলান্ত দ্বারা গঠিত পূর্ণাঙ্গ দল। “সব যেন মোর বিকিয়েছে পাই নি তাহার দাম।” ফল দেখে গাছ চেনা যায়। “দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।” “থাক্ প্রাণ, যাক্ প্ৰাণ, বাঁচুক দেশের মান।” লক্ষ্য কর, আয়তাক্ষর প্রতিটি শব্দই একদল এবং দলটিতে প্রথমে একটি ব্যঞ্জনধ্বনি (দলারম্ভ), মাঝে স্বরধ্বনিটি (দলকেন্দ্র) এবং শেষে আর একটি ব্যঞ্জনধ্বনি (দলান্ত) রহিয়াছে।

সব = [ সব্ ] = [ স্ + অ + ব্ ]; মোর = [ মোর্ ] = [ ম্ + ও + র্ ]; দাম = [ দাম্ ] = [ দ্ + আ + ম্ ]; ফল [ ফল্ ] = [ ফ্ + অ + ল্ ]; দূর = [ দুর্ ] = [ দ্ + উ + র্ ]; মান = [ মান্ ] = [ ম্ + আ + ন্ ] ইত্যাদি।

স্বরধ্বনির আগে বা পরে একাধিক ব্যঞ্জনও থাকিতে পারে, তবে সেইগুলি প্রধানত তৎসম বা বিদেশী শব্দে। যেমন, স্ত্রী = [ স্ত্রি ]=[ স্ + ত্ + র্ + ই ]; শ্রী = [ স্রি ] = [ স্ + র্ + ই ]; সংস্কৃতি = [ সংস্ ] – [ কৃ ] – [ তি ] – [ স্ + অ + ং + স্ ] – [ ক্ + ঋ ] – [ ত্ + ই ]; প্রান্ত = [ প্রান্ ] – [ তো ] = [ প্ + র্ + আ + ন্ ] – [ ত্ + ও ]; স্টেশন = [ স্টে ] – [ সন্ ] = [ স্ + ট্ + এ ] – [ স্ + অ + ন্ ];

মনে রাখিবে, খাঁটী বাংলায় দল-এ যুক্ত-ব্যঞ্জন থাকে না এবং যথার্থ সংযুক্ত ব্যঞ্জন শুধুমাত্র দলারম্ভ অংশেই পাওয়া যায়, দলান্ত অংশে নয়; দলান্ত অংশে একাধিক ব্যঞ্জনও থাকে না।

“করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার স্খলন পতন ত্রুটি?” স্খলন = [ স্খ ] – [ লোন্ ] = [ স্ + খ্ + অ ] – [ ল্ + ও + ন্ ]; ত্রুটি = [ ত্ + র্ + উ ] – [ ট্‌ + ই ]

“চন্দন গন্ধ-নিন্দিত অঙ্গ।” চন্দন = [ চন্ ] – [ দোন্ ]; গন্ধ = [ গন্ ] – [ ধো ]; নিন্দিত = [ নিন্ ] – [ দি ] – [ তো ]; অঙ্গ [ অঙ্ ] – [ গো ]। লক্ষ্য কর, যুক্ত-ব্যঞ্জনের প্রথম ধ্বনিটি পূর্ববর্তী দলের দলান্ত এবং বাকি ধ্বনি পরবর্তী দলের দলারম্ভ।

উচ্চারণ-প্রক্রিয়ার একাধিক স্বরধ্বনি একটি স্বরধ্বনির উচ্চারণকালের মধ্যে নিশ্বাসের এক ধাক্কায় উচ্চারিত হইলে তাহাদের যৌগিক স্বর বা সন্ধ্যক্ষর বলে। কিন্তু, দুটি স্বর পাশাপাশি অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও নিশ্বাসের এক ধাক্কায় না-ও উচ্চারিত হইতে পারে; সেই ক্ষেত্রে স্বরদুটিকে একত্র একটি যৌগিক স্বর বলা যাইবে না। যেমন : এই দিনটা ভোলা যাবে না। এখানে ‘এই’ যৌগিক স্বর। কিন্তু, একমাত্র এ-ই কাজটা করতে পারবে, অন্য কেউ নয়। বাক্যটিতে এক্ষেত্রে ‘এ-ই’ যৌগিক স্বর নহে। যে স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময় তাহার গুণগত চরিত্র পরিবর্তিত হইয়া যায় অর্থাৎ উচ্চারণকালে জিহ্বার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে, তাহাকে যৌগিক স্বর বলে। বাংলায় ঐ (ওই) যৌগিক স্বরের দ্বিতীয় স্বর ‘ই’ অর্ধোচ্চারিত বলিয়া ইহাকে অর্ধস্বর বলা হয়। বাংলায় দলগঠনে ই, এ, উ, ও–এই চারিটি স্বরধ্বনি অর্ধস্বরের ভূমিকা পালন করে, তবে ইহারা সর্বদাই পূর্ণাঙ্গ স্বরধ্বনিটির পরে বসে। যেমন–লাউ [ ল্ + আ + উ ], যাই [ য্ + আ + ই ], মৌমাছি = [ ম্ + ও + উ ] – [ মা ] – [ ছি ]; বিউলি = [ ব্ + ই + উ ] – [ লি ] ইত্যাদি।

এই যে স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনিকে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত করিয়া দল গঠিত হয়, তাহার উপরে নির্ভর করিয়া দলকে দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়–মুক্ত দল ও রুদ্ধ দল।

২৯। মুক্ত দল : যে দলের অন্তে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বরধ্বনি থাকে, তাহাকে স্বরান্ত বা মুক্ত দল ( Open Syllable) বলা হয়। প্রয়োজনবোধে ইহাদের উচ্চারণ প্রলম্বিত করা যায়; টানিয়া টানিয়া দলগুলি উচ্চারিত হইবার সুবিধার জন্য ইহাদের উচ্চারণ রুদ্ধ নয়, তাই ইহারা মুক্ত দল। যেমন : প্রতীতি [ প্রো ] – [ তি ] – [ তি ] = [ প্ + র্ + ও ] – [ ত্ + ই ] – [ ত্ + ই ]; লেখাপড়া = [ লে ] – [ খা ] – [ প ] – [ ড়া ]; হেলেদুলে = [ হে ] – [ লে ] – [ দু ] – [ লে ]; গ্রথিত = [ গ্রো ] – [ থি ] – [ তো ]; সমিতি = [ সো ] – [ মি ] – [ তি ]; নবীনা [ নো ] – [ বি ] – [ না ]; ভাগীরথী = [ ভা ] – [ গি ] – [ রো ] – [ থি ] প্রভৃতি শব্দগুলির প্রতিটি দলই মুক্ত দল।

৩০। রুদ্ধ দল : যে দলটি কোনো পূর্ণাঙ্গ স্বরধ্বনি দিয়া শেষ হয় না, অর্থাৎ যে দলের অন্তিম ধ্বনিটি কোনো ব্যঞ্জন কিংবা অর্ধস্বর, সেই দলটিকে রুদ্ধ দল (Closed Syllable) বলা হয়। মুক্ত দলের মতো ইহাদের উচ্চারণ প্রলম্বিত করা যায় না। যেমন : সাত = [ সাৎ ] = [ স্ + আ + ত্ ]; ধন [ ধোন্ ] = [ ধৃ + ও + ন্ ]; যৌবন = [ যোউ ] – [ বোন্ ]; ছৌনাচ = [ ছোউ ] – [ নাচ্ ]; গৈরিক = [ গোই ] – [ রিক্ ]; ঐহিক = [ ওই ] – [ হিক্ ] ইত্যাদি শব্দের অন্তর্গত প্রতিটি দলই রুদ্ধ দল।

তবে যেকোনো শব্দকে দলরূপে বিশ্লেষণ করা হইলে, যে দলগুলি পাইবে, তাহাদের সবই একধরনের (মুক্ত বা রুদ্ধ) দল হইবে, এমন নয়। জীবন্ত = [জি] – [ বোন্ ] – [ তো ]; শব্দের তিনটি দলের মধ্যে [ বোন্ ] রুদ্ধ, বাকি দুটি মুক্ত। গঙ্গাধর = [ গং ] – [ গা ] – [ ধর্ ] শব্দের [ গা ] মুক্ত দল, বাকি দুটি রুদ্ধ। বিশ্বম্ভর = [ বিস্] – [ সম্] – [ ভ]; শব্দের তিনটি দলই রুদ্ধ। মৌলীন্দু = [ মোউ ] – [ লিন্।–[ দু] শব্দের শেষ দলটি মুক্ত, প্রথম দুটি রুদ্ধ। আনন্দধারা = [ আ ] – [ নোন্ ] – [ দো ] – [ ধা ] – [ রা ] শব্দের দ্বিতীয় দলটি রুদ্ধ, বাকি চারিটি দলই মুক্ত।

পরীক্ষাকক্ষে বিভিন্ন শব্দের ‘দল’ বিশ্লেষণ করিয়া কোন্ শব্দে কয়টি করিয়া দল রহিয়াছে, তাহা তোমাদের নির্ণয় করিতে হয়। সেইসঙ্গে কোন্‌টি মুক্ত আর কোটি রুদ্ধ, তাহাও নির্ণয় করিবার নির্দেশ থাকিতে পারে। নীচে দুটি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর (দলের শ্রেণীবিভাগ-সহ) করিয়া দেওয়া হইল, দেখ।

১। ‘দল’ বিশ্লেষণ করিয়া কোন্ শব্দে কয়টি দল আছে নির্দেশ কর : প্রতিহিংসা, পরিবেশ, ধানখেত, শ্ৰীমন্ত, কণ্ঠস্বর, ছেলেবেলা। [ মাধ্যমিক, ২০০৭]

উ: প্রতিহিংসা = [ প্রো ] – [ তি ] – [ হিং ] – [ সা ]; শব্দটিতে চারিটি দল আছে। ইহাদের মধ্যে [ হিং ] রুদ্ধ দল, বাকি তিনটি মুক্ত দল।

পরিবেশ = [ পো ] – [ রি ] – [ বেস্ ]; তিনটি দল; প্রথম দুটি মুক্ত, শেষটি রুদ্ধ দল।

ধানখেত = [ ধান ] – [ খেত্ ]; দুটি দল আছে, দুটিই রুদ্ধ দল।

শ্ৰীমন্ত = [ স্রি ] – [ মোন্ ] – [ তো ]; তিনটি দল দ্বিতীয়টি রুদ্ধ, বাকি দুটি মুক্ত।

কণ্ঠস্বর = [ কন্)–[ ঠোস্ ] – [ সর ]; তিনটি দল–তিনটিই রুদ্ধ।

ছেলেবেলা = [ ছে] – [ লে] – [ ব্যা ] – [লা]; চারটি দল–প্রতিটিই মুক্ত।

২। ‘দল’ বিশ্লেষণ করিয়া কোন্ শব্দে ক’টি দল আছে নির্দেশ কর ও রবীন্দ্রনাথ, প্রতিবিধান, প্রত্যন্ত, অধিনায়ক, টেরাকোটা, কৃষ্ণকান্ত। [মাধ্যমিক, ২০০৮ ]

উ: রবীন্দ্রনাথ = [ রো ] – [ বিন্ ] – [ দ্ৰো ] – [ নাথ ]; শব্দটিতে চারিটি দল আছে; ইহাদের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টি মুক্ত, বাকি দুইটি রুদ্ধ।

প্রতিবিধান = [ প্রো ] – [ তি ] – [ বি ] – [ ধান ]; শব্দটিতে চারিটি দল আছে; তাহাদের মধ্যে প্রথম তিনটি মুক্ত, শেষটি রুদ্ধ।

প্রত্যন্ত = [ পোৎ ] – [ তন্] – [ তো ]; শব্দটির তিনটি দলের মধ্যে প্রথম দুইটি রুদ্ধ, শেষটি মুক্ত।

অধিনায়ক = [ও ] – [ ধি ] – [ না ] – [ য় ); শব্দটিতে চারিটি দল আছে; ইহাদের মধ্যে প্রথম তিনটি মুক্ত, শেষটি রুদ্ধ।

টেরাকোটা = [ টে ] – [ রা ] – [ কো ] – [ টা ]; শব্দটিতে যে চারিটি দল রহিয়াছে, তাহাদের প্রতিটিই মুক্ত দল।

কৃষ্ণকান্ত = [ ক্রি ] – [ নো ] – [ কান্] – [ তো ]; শব্দটির চারিটি দলের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টি রুদ্ধ, বাকি দুইটি মুক্ত।

বাংলা উচ্চারণ ও ধ্বনি-পরিবর্তনের কয়েকটি বিশিষ্ট রীতি

বাংলা বর্ণগুলির উচ্চারণে দেখিলাম–মূলধ্বনি অতি-অল্পক্ষেত্রেই অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। বিশেষতঃ সংযুক্তবর্ণ বা ফলার উচ্চারণে কোথাও কোনো ধ্বনির বিলোপ ঘটিয়াছে, কোথাও-বা একই ধ্বনির দ্বিত্ব হইয়াছে, কোথাও অন্য ধ্বনির আবির্ভাব ঘটিতেছে, আবার কোথাও-বা ধ্বনিগুলি অবস্থানের ক্রম মানিতেছে না। সংস্কৃত ব্যাকরণের মাপকাঠিতে আপাতদৃষ্টিতে এগুলিকে উচ্চারণের ব্যভিচার বলিয়া মনে হয়। কিন্তু বাংলার মতো এমন পেলব দেশের ভাষা বলিয়া বাংলা ভাষার প্রাণেও যে সেই পেলবতা আর মধুরতা মিশানো রহিয়াছে। কঠিনকে সহজ ও জটিলকে সরল করাই সে ভাষার প্রাণের সাধনা। অতীতের বিধিনিষেধের গণ্ডিকে আঁকড়াইয়া সে মৃতবৎ পড়িয়া থাকে নাই। প্রাণের আবেগ তাহাকে সম্মুখে চলিবার প্রেরণা দিয়াছে। আপন প্রকৃতিই তাহাকে পথ দেখাইয়াছে। ফলে নিত্যনবীনতার স্পর্শে সে ভাষার শুধু ধ্বনি-পরিবর্তনই নয়, রূপেরও পরিবর্তন ঘটিয়াছে, এখনও ঘটিতেছে। তাই বাংলা ভাষার বৈয়াকরণগণ নিয়ত পরিবর্তনশীলা প্রাণবতী এই ভাষার প্রকৃতি-পরিচয়টুকু লইবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন। তাঁহাদের সন্ধানী দৃষ্টিতে উচ্চারণ ও ধ্বনি-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার কয়েকটি বিশেষ ধরনের রীতি ধরা পড়িয়াছে। এখন আমরা সেই রীতিগুলির আলোচনা করিব।

স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ (Vowel Insertion or Anaptyxis)

“মুকুতাফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে যতনে ধীবর,
শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু-জলতলে ফেলিস, পামর!”–শ্রীমধুসূদন।

আয়ত অংশ দুইটি লক্ষ্য কর। একটি মুক্তা, অন্যটি মুকুতা। মুক্তা শব্দটির বর্ণবিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায় ম্ + উ + ক্ + ত্ + আ; এখানে ক্ কোনো স্বরবর্ণ পায় নাই বলিয়া পরবর্তী ত্-এর সহিত মিলিত হইয়া “ক্ত্‌” এই যুক্তবর্ণটির সৃষ্টি করিয়াছে। কিন্তু মুকুতা শব্দটিকে ভাঙিলে পাওয়া যায় ম্ + উ + ক্ + উ + ত্ + আ; এখানে ক্ ও ত্-এর মাঝখানে একটি উ আসিয়া ক্-কে ত্ হইতে পৃথক্‌ করিয়া দিয়াছে। উ-কারযুক্ত ক্ এখন স্বতন্ত্র অক্ষরের মর্যাদা পাইয়াছে। দুইটি ব্যঞ্জনের মধ্যে এই যে স্বরধ্বনির আবির্ভাব, ইহা কি নেহাত খেয়াল-খুশি মাফিক হইয়াছে? না, তাহা নহে। ক্ ও ত্ দুইটি পৃথক্ বর্গীয় বর্ণ। ইহাদের একসঙ্গে উচ্চারণ করিবার জন্য জিহ্বাকে খুব তাড়াতাড়ি কণ্ঠ হইতে দত্ত পর্যন্ত এসৃত হইবার আয়াস স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার সহজপ্রবণতা বাগযন্ত্রকে এতটা ক্লেশ দিতে চায় না। সেইজন্য ক্ ও ত্-এর মাঝখানে একটি বাংলা উচ্চারণ ‘ও ধ্বনি পরিবর্তনের কয়েকটি বিশিষ্ট রীতি উ-ধ্বনি আনিয়া জিহ্বার ক্লেশ সাধ্যমতো লাঘব করিয়া দিয়াছে। ইহাই স্বরভক্তি।

৩১। স্বরভক্তি : যুক্তবর্ণের উচ্চারণক্লেশ লাঘব করিবার জন্য দুই ব্যঞ্জনের মাঝে একটি স্বরধ্বনি আনিয়া বর্ণ দুইটিকে পৃথক্ করিবার রীতিকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বলে।

ভক্তি কথাটির অর্থ পৃথক্ করিয়া দেওয়া। নূতন স্বর আনিয়া সেই স্বপ্নের দ্বারা যুক্তব্যঞ্জন দুইটিকে পৃথক্ করা হয় বলিয়া নাম স্বরভক্তি। বিপ্রকর্ষ কথাটির অর্থ ব্যবধান। স্বরবর্ণটি আসিয়া যুক্তব্যঞ্জনের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করিল।

বিপ্রকর্ষের ফলে শব্দটির উচ্চারণই যে শুধু সহজ হয় তাহা নয়, শব্দটি শ্রুতিমধুরও হয়। কবিতার ছন্দোমাধুর্য-রক্ষায় বিপ্রকর্ষ বড়োই সহায়ক। কিন্তু শব্দের শ্রুতিমাধুর্য বা ছন্দোমাধুর্য-সম্পাদনের এই রীতিটি আদৌ আধুনিক নয়। প্রাচীন বাংলা ভাষাতেও স্বরভক্তির বহুল প্রচলন ছিল। আধুনিক বাংলা কবিতার ভাষাতেও ইহার যথেষ্ট আদর দেখা যায়। গ্রাম্য উচ্চারণেও এই রীতি বেশ প্রবল। প্রায়ই তৎসম ও বিদেশী শব্দের যুক্ত-ব্যঞ্জনধ্বনিকে এইভাবে ভাঙিয়া সহজ ও শ্রুতিমধুর করা হয়।

অ-কারের আগম : কর্ম–করম, ধর্ম-ধরম, মর্ম–মরম, হর্ষ–হরষ, রত্ন রতন, স্বপ্ন–স্বপন, জন্ম–জনম, লগ্ন–লগন, মগ্ন–মগন, প্রসাদ–পরসাদ, বর্ষিল–বরষিল, নির্জন–নিরজন, দর্শন–দরশন, মূর্তি–মুরতি, ভক্তি–ভকতি, শক্তি–শকতি, সত্তা–সততা, সূর্য–সুরজ, চন্দ্র–চন্দর, ধৈর্য–ধৈরজ, পূর্ব পুরব, প্রাণ–পরান, মুগ্ধ–মুগধ, লুব্ধ–লুবধ। বিদেশী শব্দে : নম্–নরম, শর্ম–শরম, মর্দ–মরদ, গার্ড–গারদ।

প্রয়োগ : “মরম না জানে ধরম বাখানে।” “নিরজনে বারেক ডাকি এমন সুযোগ কই!” “এত আলো জ্বালিয়েছ কী উৎসবের লগনে!” “কত বিদগধ জন রসে অনুমগন।” “জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু।” “সোই মধুর বোল….. শ্রুতিপথে পরশ না গেল।” “যো দরপনে পহুঁ নিজ মুখ চাহ।” “তোহারি গরবে গরবিনী হাম।” “পুষ্পাসার বরষিল মুনীন্দ্রে আচ্ছাদি।” “নিঝুম মধ্যাহ্নকাল অলস স্বপনজাল রচিতেছে অন্যমনে হৃদয় ভরিয়া।” “রসনা-প্রসূন কোন্ পরসাদ-মধুরসে পরিষিক্ত?” “যমসম শীত তাহে নিরমিল বিধি।” “সত্যের আনন্দরূপ এ ধুলিতে নিয়েছে মুরতি।” “মতি রহু তুয়া পরসঙ্গ।” “বাঁশীর শবদেঁ মো আওলাইল রান্ধন।” “বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া মোর মনে হেন করে।” “প্রবাহিয়া চলে যাই….উত্তরে দক্ষিণে পুরবে পশ্চিমে।”  

ই-কারের আগম : প্রীতি–পিরীতি, স্নান–সিনান, শ্রী-–ছিরি, হর্ষ–হরিষ, মিত্র–মিত্তির। বিদেশী শব্দে : ফিক্র্‌–ফিকির, জিক্র্‌–জিকির (জিগির), জিন্‌স্‌–জিনিস, ফিল্ম–ফিলিম, ক্লিপ–কিলিপ, নির্‌খ্‌–নিরিখ।

প্রয়োগ : “অমিয়সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।” “সেই পিরীতি অনুরাগ বাখানিতে তিলে তিলে নূতন হোয়।” নিবারণ মিত্তির কম ফন্দি-ফিকির ধরে না, দত্তজা। “কে না বাঁশী বা বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।”

উ-কারের আগম : মুক্তা-মুকুতা, প্রভুরু, দুর্জন–দুরুজন, পদ্মিনী–পদুমিনি, পুত্র–পুর, শূদ্র-শুদুর, রৌদ্র-রোদ্দুর, শুক্র-শুক্কুর। বিদেশী শব্দে : বুর্জ-বুরুজ, মুল্কমুলুক, ফুট-ফুলুট, ব্রুশ–বুরুশ, ব্লু-বুলু।

প্রয়োগ : “ঘরে দুরুজন ননদী ভীষণ।” “ভুরু কুঁচকিয়ে লাভ নেই রাজপুত্তুর। মুই শুদুর হলেও ক্ষুদ্র নই।” “কেল্লার বুরুজের ধরনে কাঁচামাটির দেওয়াল-ঘেরা খামার বাড়ি।” “কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি।” “এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাছদুয়ারে।”

এ-কারের আগম : ধ্যান–ধেয়ান, ব্যাকুল–বেয়াকুল, ভ্রম–ভেরম, গ্রাম–গেরাম, গ্রাস–গেরাস, শ্রাদ্ধ–ছেরাদ্দ, প্রণাম–পেরনাম। বিদেশী শব্দে : গ্লাসগেলাস, ক্লাস–কেলাস, সি–সেরেফ, প্রেগু-পেরেক, ব্ল্যাক–বেলাক। প্রয়োগ : “বেয়ানের ধনে মূর্তি দিয়েছে আমাদের ভাস্কর।” পেরনাম হই দাঠাউর। গেরামে আর থাকব কী লেগে, এক গেরাস অন্ন মেলে নে যেখানে? “আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।”

ও-কারের আগম : শ্লোক–শোলোক, চক্র–চক্কোর, চন্দ্র–চন্দোর, স্লো–সোলো। প্রয়োগ:”মাগো আমার শোলোক-বলা কাজলা-দিদি কই?” চন্দোরদের পাড়া থেকে এক চক্কোর ঘুরে আসা যাক।

ঋ-কার বাংলায় ‘রি’-ধ্বনি প্রাপ্ত হয়। সেইজন্য কোনো ব্যঞ্জনে ঋ-কার যুক্ত হইলে তাহা আকৃতিতে যেমনই হউক, যুক্তব্যঞ্জনের মতো শুনায়। সেইজন্যই তৃপ্ত (ত্রিপূততা), সৃজিল (সিজিলো) প্রভৃতি শব্দে বিপ্রকর্ষ দেখা যায়। ঋ-কার স্থলে ইর হয়। তৃপ্ত–তিরপিত; সৃজিল-সিরজিল; কৃপা (ক্রিপা)–কিরপা।

প্রয়োগ : “জনম অবধি হাম রূপ নেহারলুঁ নয়ন না তিরপিত ভেল।” “কোন্ বিধি সিরজিল স্রোতের শেঁওলি।”

স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্যের দৌলতেই তৎসম শব্দ হইতে তদ্‌ভব এবং অর্ধ-তৎসম শব্দের সৃষ্টি হইয়া বাংলা শব্দভাণ্ডার পুষ্ট করিয়াছে।

স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony)

‘জিলাপি’ ও ‘জিলিপি’ শব্দ দুইটি লক্ষ্য কর। জিলাপি’র ল-এ আ-কার ‘জিলিপি’তে এ ই-কার হইয়াছে। এই স্বর-পরিবর্তন কি নিছক খেয়াল-খুশি? না, ইহার পশ্চাতে সঙ্গত কারণই রহিয়াছে। ৭২ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত স্বরবনির উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান-চিত্রটি দেখ। জিলাপি’র ই-ধ্বনি-উচ্চারণে জিহ্বাকে প্রথমে সম্মুখের দিকে আগাইয়া আসিয়া একেবারে উচ্চে অবস্থান করিতে হইতেছে; তাহার পরেই আ-ধ্বনির জন্য পিছন দিকে পিছাইয়া একেবারে নীচে নামিতে হইতেছে। আবার শেষের ই-ধ্বনির বেলাতেও সম্মুখের দিকে আসিয়া ঊর্ধ্বে অবস্থান করিতে হইতেছে। আরামপ্রিয় জিহ্বা এতটা কষ্ট-স্বীকার করিতে চায় না। সেইজন্য সে মাঝখানের আ-ধ্বনিকে ই-ধ্বনিতে পরিবর্তিত করিয়া লইয়াছে। ফলে ‘জিলাপি’ হইয়াছে ‘জিলিপি’। ‘জিলাপি’তে বিভিন্ন স্বরের মধ্যে সঙ্গতির অভাব ছিল, ‘জিলিপি’তে স্বরধ্বনিগুলিতে একটি সঙ্গতি স্থাপিত হইয়াছে।

‘শুনা’ অপেক্ষা ‘শোনা’ উচ্চারণ আরামদায়ক। কারণ, না-এর আ-কারের টানে শু-এর উ-কার সর্বোচ্চ স্থান হইতে একটু নীচে নামিয়া ও-কার হইয়াছে। উ-কার হইতে আ-কারে আসিতে জিহ্বাকে যে ক্লেশস্বীকার করিতে হয়, ও-কার হইতে আ-কারে আসিতে তদপেক্ষা কম পরিশ্রম লাগে। একই পথে ‘উঠা’ কথাটি ‘ওঠা’ হইয়া চলিত বাংলায় (এবং বর্তমান সাধু বাংলাতেও) স্থান করিয়া লইয়াছে। ‘পূজা’ অপেক্ষা ‘পুজো’ কথাটি উচ্চারণ করিতে জিহ্বা আরাম পায়; কারণ, ঊর্ধ্বস্বর উ-বর্ণ হইতে সর্বনিম্ন-স্বর আ-তে আসিতে জিহ্বাকে অনেক ক্লেশস্বীকার করিতে হয়। কিন্তু উ-কার হইতে একধাপ নীচে নামিলেই ও-কার। সেই সহজ পথেই ‘বুড়া’ হইয়াছে ‘বুড়ো’। একটি শব্দে বিভিন্ন প্রকৃতির স্বরধ্বনির মধ্যে সামঞ্জস্য-স্থাপনের এই রীতিকেই বলে স্বরসঙ্গতি।

৩২। স্বরসঙ্গতি : বাংলায়, বিশেষ করিয়া চলিতে বা মৌখিক বাংলায়, কোনো কোনো শব্দে পূর্বস্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরধ্বনির এবং পরবর্তী স্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির যে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়, বাংলায় উচ্চারণগত এই বিশিষ্ট রীতিকে স্বরসঙ্গতি বলা হয়।

স্বরসঙ্গতির ফলে শব্দের যে পরিবর্তন হয়, তাহার লিখিত রূপ (বানান) আমরা সবসময়ে পাই না, কিন্তু উচ্চারণটুকু সর্বত্রই মানিয়া লই।

(১) পূর্বস্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরের পরিবর্তন :

(ক) পূর্ববর্তী ই-কারের প্রভাবে পরবর্তী অ-কার বা আ-কার এ-কার হয়। ইচ্ছা–ইচ্ছে, মিথ্যা–মিথ্যে, মিছা–-মিছে, মিঠা-–মিঠে, শিক্ষা–শিক্ষে, ভিক্ষা–ভিক্ষে, শিকা–শিকে, ফিতা–ফিতে, পিপা–পিপে, মিতা–-মিতে, হিসাব-–হিসেব, নিকাশ–নিকেশ, বিলাত–বিলেত, বিশ্বাস–বিশ্বেস, গিয়া–গিয়ে, দিলাম–দিলেম, নীরস–নিবেস, তিনটা–তিনটে।

(খ) পূর্ববর্তী উ-বর্ণের প্রভাবে পরবর্তী আ-কার ও-কার বা উ-কার হয়। পূজা–পুজো, চূড়া–চুড়ো, খুড়া–খুড়ো, মুড়া–মুড়ো, হুঁকা–হুঁকো, মূলা–মুলো, ধুলা–ধুলো, তুলা–তুলো, ধুনা–ধুনো, দুয়ার–দুয়োর, কুমড়া–কুমড়ো, বুড়া-–বুড়ো, শুয়ার–শুয়োর, দুটা–দুটো, মুঠা–মুঠো, উনান–উনুন।

(২) পরস্বরের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরের পরিবর্তন :

(ক) ই-বর্ণ, উ-বর্ণ কিংবা য্-ফলা (উচ্চারণে ইঅ), জ্ঞ (উচ্চারণে গ্যঁ—য্‌ ফলা আসিতেছে), ক্ষ (খিয়) প্রভৃতি পরে থাকিলে পূর্বস্বর অ-কার ও-কারবৎ উচ্চারিত হয়। অবশ্য বানানে অ-কারই থাকে। করি, করী, নদী, মধু, বধু, নব্য, যজ্ঞ, দৈবজ্ঞ (দোইবোগ্‌গোঁ), পক্ষ, যক্ষ, হর্যক্ষ (হোযোখো)। এবিষয়ে ৭৩-৭৫ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত (ক) হইতে (ঙ) পর্যন্ত সূত্রাবলী বিশেষভাবে স্মরণীয়।

(খ) পরবর্তী আ-কার বা এ-কারের প্রভাবে পূর্ববর্তী উ-কার ও-কার হয়। ডুবা–ডোবা, শুনা–শোনা, বুঝা–বোঝা, উড়ে–ওড়ে।

(গ) পরবর্তী স্বর ‘আ’ বা ‘এ’ হইলে তাহার প্রভাবে পূর্ববর্তী ই-কার এ-কার হয়। ছিঁড়া–ছেঁড়া, মিলা–মেলা, শিখা–শেখা, লিখা–লেখা, শিখে–শেখে, লিখে–লেখে। মনে রাখিও, স্বরসঙ্গতিজাত ছেঁড়া, মেলা, মেলে, ফেরা, ফেরে, লেখা, লেখে প্রভৃতি শব্দের আদি এ-কারের উচ্চারণ সর্বত্রই অর্ধ-সংবৃত (খাঁটী), কখনই অর্ধ-বিবৃত (অ্যা-কারের মতো) নয়।

(ঘ) পরবর্তী ই-বর্ণের প্রভাবে পূর্ববর্তী আ-স্থানে ই-কার বা উ-কার বা এ-কার হয়। বিলাতী–বিলিতী, সন্ন্যাসী–সন্নিসী, ভিখারী–ভিখিরী, কুড়ানী–কুড়ুনী, শুনানী–শুনুনি, নাই–নেই।

(ঙ) পরবর্তী ই-বর্ণের প্রভাবে পূর্ববর্তী এ-কার ই-কার হয়। দেশী–দিশি, বিলেতী–বিলিতী, দেই–দিই।

(চ) হেলায়, খেলানো, ডেরা, যেমন, একলা, এত প্রভৃতি শব্দের এ-কারগুলি যে অ্যা-ধ্বনি পাইয়াছে (বানানে না হউক, উচ্চারণে), তাহার মূলেও স্বরসঙ্গতির প্রভাবটি লক্ষণীয়।

অপিনিহিতি (Epenthesis)

‘করিয়া’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করিলে আমরা পাই ক্+অ+র+হ+য়+আ; এখানে ই-কার রহিয়াছে র্-এর পরে। এই ই-কারকে যদি তৎপূর্ববর্তী ব্যঞ্জন র্-এর পূর্বেই আনিয়া ফেলি তবে শব্দটি দাঁড়ায় ক্+অ+হ+র্+য়+আ=কইর‍্যা (য় পূর্ববর্তী র্-এ য্‌-ফলা হইয়া গিয়াছে)। এই উচ্চারণ-রীতিই অপিনিহিতি।

৩৩। অপিনিহিতি : শব্দের মধ্যে বা শেষে ব্যঞ্জনযুক্ত কোনো ই-কার বা উ-কার থাকিলে তাহাকে ব্যঞ্জনটির অব্যবহিত পূর্বেই উচ্চারণ করিয়া ফেলিবার রীতিকে অপিনিহিতি বলে।

ই-কারের অপিনিহিতি : আজি–আঁইজ, কালি–কাইল, রাতি–রাইত, রাখিয়া–রাইখ্যা, দেখিয়া–দেইখ্যা, শুনিয়া–শুইন্যা ইত্যাদি।

য (ইঅ) যখন পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে য্‌-ফলারূপে বুক্ত হয়, তখনও এই ই-ধ্বনির জন্যই ই-কারের অপিনিহিতি হয়। যেমন, সত্য–সইত্ত, কাব্য–কাইব্ব, কন্যা–কইন্না। ক্ষ (খিয়), জ্ঞ (গ্যঁ)–এই সংযুক্তবর্ণ দুইটিরও অপিনিহিতি লক্ষ্য করা যায়। লক্ষ > লক্‌খ্য > লইক্‌খো, যজ্ঞ > যগ্‌গ্যঁ > যইগ্‌গোঁ।

উ-কারের অপিনিহিতি : সাধু-সাউথ; মাছুয়া–মাউছুয়া (এখানে উ-কার স্ব-স্থানে থাকা সত্ত্বেও পূর্বব্যঞ্জনের পূর্বে আর একটি উ আসিয়াছে)। সেইরূপ সাথুয়া–সাউথুয়া; গাছুয়া–গাউছুয়া; জলুয়া–জউলুয়া ইত্যাদি।

এক সময়ে সমগ্র বঙ্গদেশেই এই অপিনিহিতি প্রচলিত ছিল। পুরানো পুঁথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, প্রাচীন কবিতা ইত্যাদিতে এই বিশিষ্ট উচ্চারণ-রীতিটি কিঞ্চিৎ দৃষ্ট হয়। “যে পণ কর‍্যাছি মনে সেই সে করিব।”–জ্ঞানদাস। “পর‍্যাছি কালা পাটের জাদ।”–চণ্ডীদাস। “তুমি হও গহীন গাঙ্‌ আমি ডুব্যা মরি।”–মৈমনসিংহ গীতিকা। “ঘষিয়া মাজিয়া বাপু কর‍্যাছ উজ্জ্বল।”–কবিকঙ্কণ। এখনো পূর্ববঙ্গবাসিগণের মধ্যে মৌখিক ভাষায় অপিনিহিতির অস্তিত্ব বজায় রহিয়াছে। কিন্তু কী পশ্চিমবঙ্গ কী পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) কোথাও লিখিত ভাষায় ইহার প্রচলন আর নাই।

অভিশ্রুতি (Umlaut at Vowel Mutation)

পূর্ববঙ্গের মৌখিক ভাষা অপিনিহিতিতে আসিয়া থামিয়া গিয়াছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ অপিনিহিতি হইতে অভিশ্রুতিতে আসিয়া মুখের ভাষাকে সাহিত্যের চলিত ভাষার মর্যাদা দিয়াছে। ধর–’রাখিয়া’ অসমাপিকা ক্রিয়াটির চলিত রূপ ‘রেখে’। ‘রাখিয়া’ হইতে ‘রেখে’ কী করিয়া পাইলাম? ‘রাখিয়া’ অপিনিহিতিতে ‘রাইখ্যা’ হইল। আয়ত স্বরধ্বনি দুইটি পাশাপাশি থাকার ফলে সন্ধিবদ্ধ হইয়া এ-কার (আ + ই = এ) হইয়া গিয়াছে। সুতরাং অপিনিহিতির পরবর্তী স্তরে রাইখ্যা হইল রেখ্যা। স্বরসঙ্গতির প্রভাবে এই রেখ্যা ক্রমশঃ রেখ্যে > রেখে হইয়াছে। এইভাবে ‘রাখিয়া’ হইতে ‘রেখে’ পাইলাম। ইহাই অভিশ্রুতি। করিয়াছ’ ক্রিয়াটির চলিত রূপ কী করিয়া ‘করেছ’ হইল দেখ।–করিয়াছ > কইর‍্যাছ। (অপিনিহিতি) > ক’র‍্যাছ > করেছ বা করেছ (উচ্চারণ কোরেছে)। এখানে অপিনিহিতির অ এবং ই সন্ধিবদ্ধ হইয়া ও-কার হইয়াছে। অবশ্য এই ও-কার মাত্র উচ্চারণেই স্থান পাইয়াছে, বানানে নয়। কেহ কেহ বানানে ক-এর মাথায় ঊর্ধ্ব-কমা দিয়া ও-কারের উচ্চারণটি বজায় রাখিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাষাতত্ত্বগত কোনো বর্ণলোপের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্ব-কমার প্রয়োগ না করাই ভালো। আবার ‘মাছুয়া’ শব্দটি কেমন করিয়া ‘মেছো’ রূপ পাইল, দেখ। মাছুয়া > মাছুয়া (অপিনিহিতি) > মাইছুয়া > মেছুয়া > মেছো (অভিশ্রুতি)। এখানে লক্ষ্য কর–অপিনিহিতির উ-কার পরবর্তী স্তরে ই-কার হইয়াছে। সেইরূপ গাছুয়া > গেছো; বাতুয়া > বেতো; হাটুয়া > হেটো।

৩৪। অভিশ্রুতি : অপিনিহিতি-জাত ই-কার বা উ-কার (কিংবা উ-কার হইতে জাত ই-কার) এক বিশেষ সন্ধির নিয়মে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সহিত মিলিত হইয়া উহার রূপের যে পরিবর্তন ঘটায়, স্বরধ্বনির সেই পরিবর্তনকেই অভিশ্রুতি বলে।

অভিশ্রুতির আরও কয়েকটি উদাহরণ দেখ।–

(ক) আসিয়া > আইস্যা (অপিনিহিতি) > এস্যা > এস্যে > এসে। (খ) জাগিয়াছে > জাইগ্যাছে (অপিনিহিতি) > জেগ্যাছে > জেগেছে > জেগেছে। (গ) মরিয়া > মইর‍্যা (অপিনিহিতি) > ম’র‍্যা > মর‍্যে > ম’রে বা মর‍্যে (উচ্চারণ মোরে)। (ঘ) কন্যা > কইন্ন্যা > ক’ন্যা > কন্যে > ক’নে বা কনে (উচ্চারণ কোনে)। (ঙ) পানিহাটী > পাইন্হাটী > পাইনাটি (হ্ লুপ্ত) > পেনাটি> পেনেটি (স্বরসঙ্গতি)। (চ) জলুয়া > জউলুয়া > জইলুয়া > জলুয়া > জলো (উচ্চারণ জোলো)। (ছ) পটুয়া > পউটুয়া > পটুয়া > প’টো বা পটো (উচ্চারণ–পোটো)। (জ) মাতৃকা > মাইআ > মাইয়া > মেয়া > মেয়ে। (ঝ) নদীয়াব > নইদ্যার > ন’দ্যের > ন’দের বা নদের (উচ্চারণ–নোদের)। অপিনিহিতির ই-কার একাক্ষর শব্দে সাধারণতঃ লোপ পায়, এবং একাধিক অক্ষরের শব্দেই পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিকে প্রভাবিত করিয়া নবরূপে রূপায়িত করে। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, চলিত ভাষার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য অভিশ্রুতির মূলে অপিনিহিতি বর্তমান রহিয়াছে। অভিশ্রুতিজাত শব্দগুলির শেষাংশের গঠনে স্বরসঙ্গতির প্রভাবটিও লক্ষণীয়। অবশ্য সাধু ভাষার প্রভাবে অপিনিহিতির ই-কার বা উ-কারের লোপ হইলে অভিশ্রুতির পূর্ণ রূপটি আমরা পাই না।–

(ক) আজি—আইজ–আজ (বর্ণলোপেই পরিসমাপ্তি; অভিশ্রুতি হইলে আইজ > এজ হইত)।

(খ) কালি > কাইল–কাল (অভিশ্রুতি হইলে কেল হওয়া উচিত ছিল)।

(গ) রাতি–রাইত–রাত (উচ্চারণ–রাত্)।–অভিশ্রুতি হইলে রাইত > রেত হইবে : “ওস্তাদের মার শেষ রেতে।”

মনে রাখিও, “বসিয়াছিল”-র চলিত রূপ “বসেছিল”, “করিতেছিলেন”-এর চলিত রূপ “করছিলেন” প্রভৃতি অভিশ্রুতির ফল। কিন্তু “বসাইয়াছিল”, “করাইতেছিলেন” ইত্যাদির চলিত রূপ যথাক্রমে “বসিয়েছিল”, “করাচ্ছিলেন” প্রভৃতির মূলে অপিনিহিতি নাই বলিয়া এইগুলিকে অভিশ্রুতিজাত বলা যায় না। ইহারা আভ্যন্তর সন্ধিজাত রূপ। অভিশ্রুতিজাত ভেতো, মেঠো, গেছো, জেলে, ঢেকে, চেয়ে, বেনে, বেনো প্রভৃতি শব্দের আদি এ-কারের উচ্চারণ সর্বদা খাঁটী।

য়-শ্রুতি ও অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি (Euphonic Glides)

৩৫। য়-শ্রুতি বা ব-শ্রুতি : বাংলায় পাশাপাশি দুইটি স্বরবর্ণ থাকিলে উহাদের মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণের অভাবজনিত শূন্যতাটুকু পূর্ণ করিবার জন্য য় কিংবা অন্তঃস্থ ব্–এই যে অর্ধস্ফুট ব্যঞ্জনধ্বনির আগম হয়, তাহাকেই য়-শ্ৰুতি কিংবা অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি (শ্রুতিধ্বনি) বলে।

য়-শ্ৰুতি : (ক) মা + এর > মা + য়্ + এর > মায়ের; (খ) লাঠি + আল > লাঠি + য়্ + আল > লাঠিয়াল; (গ) বাবু + আনা > বাবু + য়্ + আনা > বাবুয়ানা; (ঘ) গো + আলা > গো + য়্ + আলা > গোয়ালা; (ঙ) দে + আল > দে + র্ + আল > দেয়াল।

“মা আমায় ঘুরাবি কত?” আয়ত অংশটির প্রথমপদের শেষেও আ-কার এবং দ্বিতীয় পদের প্রথমেও আ-কার থাকায় উচ্চারণে ব্যঞ্জনের অভাব মিটাইবার জন্য য়্-এর আগম হইবে। তখন শুনাইবে “মায়্‌ আমায়…..।” অবশ্য এই য়-ধ্বনি বানানে লেখা হয় না। এখানে পাশাপাশি দুইটি শব্দের মধ্যেও য়-শ্রুতি যোগসূত্র স্থাপন করিতেছে। আর একটি অনুরূপ উদাহরণ–”রাধার কি হৈল অন্তরে (হৈলোয়ন্তরে) ব্যথা।“

অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি : অন্তঃস্থ ব-এর উচ্চারণ উঅ বা ওয়। এইজন্য অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি যেখানে হয় সেখানে ওয়, ও কিংবা য় ব্যবহৃত হয় (অধিকাংশ স্থলেই ও), অন্তঃস্থ ব্‌ কোথাও লেখা হয় না।* কারণ, অন্তঃস্থ ব-এর উচ্চারণ এবং আকৃতি স্বীকার না করিয়া বাংলায় ইহাকে আমরা বর্গীয় ব-এর সঙ্গে মিশাইয়া ফেলিয়াছি; যেমন–খা + আ > খাবা > খাওয়া; না + আ > নাবা > নাওয়া; ছা + আ > ছাবা > ছাওয়া; মো + আ > মোবা > মোয়া (এখানে ওয়-র ও-কার পূর্ববর্তী ও-কারে মিশিয়া গিয়াছে); শূকর > শুঅর > শুবর > শুয়র (উয়-র উ-কার পূর্ববর্তী উ-কারে বিলীন হইয়াছে) > শুয়ার; কেআ > কেবা > কেয়া (এখানে ব-শ্রুতির শুধু য় বিরাজ করিতেছে); চেআর > চেবার > চেয়ার; কেঅড়া > কেবড়া > কেওড়া।

“ওগো আমার (ওগোয়ামার্) দুখিনী মা।”–এখানে আয়ত অংশটুকু পড়িতে গেলে ‘ওগো’ এবং ‘আমার’ পদ দুইটির মধ্যে একটি অন্তঃস্থ ব-ধ্বনি শ্ৰুত হয়; কিন্তু বানানে উহা লেখা হয় না। লক্ষ্য কর, যেখানে ব-শ্রুতি হইতেছে, সেখানে প্রথম স্বর ই ঈ ভিন্ন যেকোনো স্বর এবং পরবর্তী স্বর আ।

য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতির মধ্যে অদলবদলও হয়। যেমন দে + আল > দেয়াল (য়-শ্রুতি) এবং দেওয়াল (ব-শ্রুতি); ছাআ > ছায়া (য়-শ্রুতি) এবং ছাওয়া (ব-শ্রুতি)।

জিহ্বার আরাম ও শ্রুতিমাধুর্য–এই দুইটি কারণেই য়-শ্রুতি ও ব-শ্রুতির সৃষ্টি।

[* “বাঙ্গালায় ও-কার দ্বারা সাধারণতঃ ব-শ্রুতি নির্দেশ করা হয়।” আচার্য সুকুমার সেন।]

সমীভবন বা সমীকরণ (Assimilation)

৩৬। সমীকরণ : একই শব্দের মধ্যে বিভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনি পাশাপাশি থাকিলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য ধ্বনি দুইটিকে একই ধ্বনিতে, কখনও-বা একই বর্গের ধ্বনিতে রূপান্তরিত করার নাম সমীভবন বা সমীকরণ। যেমন, গল্প–গল্প; দুর্গা—দুগ্‌গা; ধর্ম–ধম্ম; কর্ম–কম্ম; জন্ম–জন্ম; মূর্খ–মুখখু; বড়ঠাকুর–বঠাকুর; চন্দন–চন্নন; কাঁদনা–কান্না। এমনকি পাশাপাশি দুইটি শব্দের মধ্যেও (কেবল উচ্চারণে–লিখনে নয়) এই সমীকরণ লক্ষ্য করা যায়। এত দিন–অ্যাদ্দিন; পাঁচ সের—পাঁশ্‌শের; আর না–আন্না; এক গজ—অ্যাগ্‌গজ।

পূর্ববর্তী ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হইলে প্রগত সমীকরণ বলে। চন্দন–চন্নন; পদ্ম–পদ্দ।

যখন পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হয়, তখন তাহাকে পরাগত সমীকরণ বলে। গল্প–গপ্প; কর্ম–কম্ম; জন্ম–জম্ম।

পরস্পরের প্রভাবে ধ্বনিদ্বয়ের যখন পারস্পরিক পরিবর্তন হয়, তখন অন্যান্য সমীকরণ হয়। দুহত = দুগ্ধ, উদ্‌শ্বাস = উচ্ছ্বাস।

মৌখিক ভাষায় এই সমীকরণের খুবই প্রচলন দেখা যায়। “সীতেনাথের এই ঝামেলা কদ্দিন পোয়াব!”–বিভূতিভূষণ। এমনকি সাধু ভাষার মূল্যবান্ অঙ্গ সন্ধির মূলে এই সমীকরণ বিশেষতঃ অনন্যান্য সমীকরণের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়।

স্বরসঙ্গতি ও সমীকরণের পার্থক্যটি মনে রাখিও। স্বরসঙ্গতিতে বিভিন্ন স্বরধ্বনির মধ্যে সামঞ্জস্যস্থাপন, সমীকরণে বিভিন্ন ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে সাম্যস্থাপন। (এইজন্য সমীকরণকে ব্যঞ্জনসঙ্গতিও বলা হয়।)

এই প্রসঙ্গে স্বরসঙ্গতি ও অভিশ্রুতির পার্থক্যটুকুও মনে রাখিবে। অপিনিহিতির সংস্পর্শ ছাড়াই স্বরধ্বনির যে পরিবর্তন তাহার নাম স্বরসঙ্গতি, আর অপিনিহিতির পরে স্বরের যে রূপান্তর তাহার নাম অভিশ্রুতি।

গ্রাম্য উচ্চারণে শব্দমধ্যস্থ দুইটি সমবর্ণের মধ্যে যেকোনো একটি ব্যঞ্জনবর্ণ অন্য বর্ণে পরিবর্তিত হইলে তাহাকে বিষমীভবন বলা হয়। ইহা সমীভবন বা সমীকরণের বিপরীত প্রক্রিয়া। যেমন, লাল–নাল, শরীর–শরীল। তবে বিশুদ্ধ ভাষায় ইহাদের প্রয়োগ বেশী দেখা যায় না।

৩৭। বর্ণবিকার : শব্দের অন্তর্গত কোনো মূল ধ্বনির পরিবর্তন ঘটিলে তাহাকে বর্ণবিকার বলে। যেমন, বীজ–বীচি; শাক–শাগ; বাষ্প–ভাপ; বিনতি–মিনতি; ধোবা–ধোপা; কবাট–কপাট; পাশ–ফাঁস; ভগিনী–বোন; আধলা–আদলা (ইহা ক্ষীণায়নও বটে); গুলাব (ফারসী শব্দ)–গোলাপ; নেবু–লেবু।

প্রয়োগ : “দুধমাখা ভাত কাগে খায়।” “কপাট-বিশাল বুক।”–কবিকঙ্কণ “ছোটো বোনের কান্নাভরা সেই চিঠি।”–অবনীন্দ্রনাথ। “মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।”–বিদ্যাপতি।

৩৮। বর্ণবিপর্যয় (Metathesis) : চলিত বাংলায় উচ্চারণদোষে একই শব্দের অন্তর্গত দুইটি ব্যঞ্জনবর্ণ পরস্পর স্থান পরিবর্তন করিলে তাহাকে বর্ণবিপর্যয় বা বিপর্যাস বলে। যথা, রিক্‌শা–রিশকা; বাক্স–-বাস্ক; পিশাচ–পিচাশ; দাগা–গাদা (বড় মাছের পিঠের টুকরা); মুকুট–মুটুক; আলনা–আনলা; তলোয়ার–তরোয়াল; লাফ–ফাল (পূর্ববঙ্গে ব্যবহৃত); হ্রদ > হদ (র্-ফলা লোপ)–দহ; বড়িশ–বড়শি; বারাণসী–বানারসী; কুফ্‌ল্ (আরবী)–কুলুপ; রিস্ক—রিক্‌স্‌; বাসক–বাকস; বাতাসা–বাসাতা; লোকসান—লোসকান; গ্ল্যাকসো–গ্ল্যাসকো; ডেস্ক–ডেক্‌স্। বড়শি ও দহ শব্দ ছাড়া বিশুদ্ধ ভাষায় ইহাদের বড়ো-একটা প্রয়োগ দেখা যায় না। কিন্তু সংস্কৃতের হিন্‌স্ + অচ্ সিংহ শব্দটি প্রয়োগ–কৌলীন্য পাইয়াছে।

৩৯। বর্ণাগম (Prothesis) : উচ্চারণের সুবিধার জন্য শব্দের আদিতে মধ্যে বা শেষে নূতন বর্ণের আবির্ভাব ঘটিলে তাহাকে বর্ণাগম বলে।

স্বর ও ব্যঞ্জন–দুইপ্রকার বর্ণেরই আগম হয়।

(i) স্বরাগম : (১) শব্দের আদিতে যুক্তবর্ণের পূর্বে : স্ত্রী–ইস্তিরি; স্কুল–ইস্কুল; স্টেশন–ইস্টিশন; স্পর্ধা–-আস্পর্ধা; স্টেবল্–আস্তাবল; স্টেব্‌ট–এস্টেট।

(২) শব্দের মধ্যে : মূর্ছি–মুরছি; নয়ন–নয়ান; বয়ন–বয়ান। বিপ্রকর্ষের সমস্ত উদাহরণ (পৃঃ ১০৭-১০৮) এই পর্যায়ে পড়ে।

(৩) শব্দের অন্তে যুক্তবর্ণের পরে : সত্য–সত্যি; পথ্য–পথ্যি; ধন্য–ধন্যি; জমাট–জমাটি; পিণ্ড–-পিণ্ডি; মধ্য–মধ্যি; দুষ্ট–দুষ্টু; বেঞ্চ–বেঞ্চি; ইঞ্চ–ইঞ্চি; লিস্ট–লিস্টি;

প্রয়োগ : শ্রীমায়ের বুকের মধ্যিখানটায় টনটন করে উঠল।

(ii) ব্যঞ্জনাগম : (১) শব্দের মধ্যে : অম্ল–অম্বল; ডমরু–ডম্বরু; বানর–বান্দর; পোড়ামুখী–পোড়ারমুখী।

(২) শব্দের শেষে : নানা–নানান; সীমা–সীমানা; ধনু–ধনুক; ফাট–ফাটল; এলা–এলাচ; হাত–হাতল ইত্যাদি।

স্ক্রু–ইস্কুপ বিচিত্র উদাহরণ, আদিতে স্বর, অন্তে ব্যঞ্জনের আগম।

সাহিত্যে বর্ণাগমের যথেষ্ট আদর আছে। যেমন–“তাঁর বাড়ির দুহাত দূরে আস্তাবল আছে।”–প্রমথ চৌধুরী। “তোমার এতবড়ো আস্পর্ধা, তুমি বল কিনা আমি পায়ে পায়ে তোমার বাড়ি যাব!”–বিভূতিভূষণ। ইস্কুলের ছেলেটার হাতে ছিল ইশকাপনের টেক্কা। বেঞ্চিতে যে আর এক ইঞ্চি জায়গাও নেই রে বিরিঞ্চি। “নানান দেশের নানান ভাষা; বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?”–রামনিধি গুপ্ত। “নয়ানের কাজল বয়ানে লেগেছে।” “ইস্টিশান! ইস্টিশান….বেশী দূর নয়।” “এখন কি শেষ হয়েছে, প্রাণেশ, যা-কিছু আছিল মোর?”–রবীন্দ্রনাথ। “লবঙ্গ এলাচ মরিচ…..প্রভৃতি মসলার স্থান ভারতবর্ষ।”–স্বামীজী। “মানসমধুপ পদতলে মুরছি পড়িছে পরিমলে।”

৪০। বর্ণদ্বিত্ব : অর্থের গুরুত্ব বুঝাইবার জন্য শব্দমধ্যস্থ বর্ণকে দ্বিত্ব করিয়া উচ্চারণ করিবার রীতিকে বর্ণদ্বিত্ব বলে।

সকাল–সক্কাল; সবাই–সব্বাই; একরতি–একরত্তি; বড় –বড্ড; মুলুক–মুল্লুক; পাকা–পাক্কা; একেবারে–এক্কেবারে। বর্ণদ্বিত্বের প্রয়োগ সাহিত্যেও বেশ দেখিতে পাওয়া যায়। (ক) “নাম রেখেছি বাবলারানী একরত্তি মেয়ে।”–রবীন্দ্রনাথ। (খ) “দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে, উঃ দাদা বড্ড লেগেছে!” (গ) হাতে ছিল তার পাক্কা একটা বাঁশের লাঠি। (ঘ) “ছোট্ট যে জন ছিল রে সব-চেয়ে সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।”–সত্যেন্দ্রনাথ। (ঙ) মুসৌরি থেকে মাসিমারা সব্বাই এক্কেবারে সক্কালবেলাতেই এসে গেছেন।

৪১। বর্ণলোপ (Haplology): উচ্চারণ সহজ করিবার জন্য অনেক সময় শব্দমধ্যস্থ এক বা একাধিক বর্ণের যে বিলোপসাধন করা হয়, তাহাই বর্ণলোপ। প্রয়োজনমতো যেকোনো বর্ণের লোপ হয়। তবে র-কার ও হ্‌-কারের লোপ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

(ক) র লোপ : ব্যঞ্জনের পুর্বের র্ (রেফ) চলিত ভাষায় বহুক্ষেত্রে লোপ পায়। কার্পাস > কাপাস, স্মার্ট > স্মার্ট, শার্ট > শাট; অন্যত্র ফেরু > ফেউ।

কিন্তু কতকগুলি বিদেশী শব্দের র-এর লোপ হয় না।–সরকার, কার্নিস, ফার্নিচার ইত্যাদি।

(খ) হ্‌-কার লোপ : দুই স্বরের মধ্যবর্তী হ্‌ এবং শব্দান্তস্থিত হ্‌-এর লোপ পাইবার দিকেই ঝোঁক বেশী। ফলাহার > ফলার; পুরোহিত > পুরুত; গাহিতাম > গাইতাম; সিপাহী (ফা) > সেপাই; মহার্ঘ > মাগগি (হ্ ও র্ উভয়ই লুপ্ত); সাহু > সাউ; শিয়ালদহ > শিয়ালদা।

হ-কার লোপে সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্যটি পরিস্ফুট হইয়াছে। গাহিল > গাইল, চাহিলাম > চাইলাম, যাহারা > যারা, তাঁহাদের > তাদের।

(গ) অন্যান্য বর্ণের লোপ : অতসী (সং) > তিসি, অলাবু (সং) > লাউ, রাশি > রাশ, অপিধান > পিধান, অভ্যন্তর > ভিতর, ফাল্গুন > ফাগুন, নবধর > নধর, উদ্ধার > উধার বা ধার, উডুম্বর > ডুমুর, কুটুম্ব > কুটুম, স্ফটিক > ফটিক, নাতিনী > নাতনী, বড়দাদা > বড়দা, নদিদি > নদি, ছোটকাকা > ছোটকা, স্থান > থান, গোষ্ঠ > গোঠ, দুস্তর > দুতর, নিষ্ঠুর > নিঠুর, অশ্বত্থ > অশথ, মজদুর > মজুর, এনোনা (পোর্তু) > নোনা, ঘূর্তি > ফুর্তি, আলোক > আলো, দুগ্ধ > দুধ, নবনী > ননী। প্রয়োগ : “পড়েছে নধর বট হেলে ভাঙা তীরে।” “তোমার দরশ-বিহীন দুচোখ রইল মসীমাখা।” “ঝনঝনিল অসি পিধানে।” “এই করেছ ভালো, নিষ্ঠুর হে।”

বড়দা, নদি, ছোটকা প্রভৃতির মূলে পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি একই বর্ণের মধ্যে একটি লোপ পাইতেছে বলিয়া এই ধরনের বর্ণলোপকে সমাক্ষরলোপ বলা হয়।

স্পর্শ > পর্শ (বর্ণলোপ) > পরশ (স্বরাগম তথা বিপ্রকর্ষ)–একই সঙ্গে বর্ণলোপ ও বিপ্রকর্ষের উদাহরণ। “মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও।”

৪২। সম্প্রকর্ষ ও শব্দমধ্যস্থ স্বরবর্ণের লোপ হইলে তাহাকে সম্প্রকর্ষ বলে। ইহা বিপ্রকর্ষের বিপরীত ব্যাপার। নাতিনী > নাতনী, কলাপাতা > কলাপাত, আশা > আশ, ভগিনী > ভগ্নী, জানালা > জানলা, জোনাকি > জোনাক। “চন্দ্রসূর্য হার মেনেছে জোনাক জ্বালে বাতি।” “ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া।”–সম্প্রকর্ষের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। চক্ষু শব্দটির উ লোপ করিয়া এ বিভক্তিচিহ্ন যোগ করা হইয়াছে।

মৌখিক ভাষায় এই বর্ণলোপের যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। এমনকি সাহিত্যে মাধুর্যসৃষ্টির জন্যও এই রীতিটি অনুসৃত হইয়া আসিতেছে।–”তাহার উপরে নখচান্দ সুশোভিত হেরইতে জগ-মন-লোভা।” “রূপে ভরল দিঠি সোঙরি পরশ মিঠি।” “তাঁহা তাঁহা থল-কমলদল খলই।” “দুতর পন্থ-গমন-ধনী সাধয়ে মন্দিরে যামিনী জাগি।” “কে না বাঁশী বা বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।” “স্বপনে দেখি যে শ্যামল বরণ দে।” [হ লোপের একটি বিচিত্র উদাহরণ; দে = দেহ।] “জোছনার ফুল যারা ফুটিবে বসন্তবায়।” “জলের পারে ঝাউয়ের সারি জ্যোস্নালোকে দেখায় কালো।” “জোনাক জ্বলে আলোর তালে হাসির ঠারে ঠারে।” “নেই নীলাকাশ মাথার ‘পরে উজল রবি-চন্দ্ৰকরে।” খোকনের কাণ্ড দেখছ নদি! “গাইল, ‘জয় মা জগন্মোহিনী!” “কোথা সে বাঁধাঘাট, অশথতল!” “সুরনদীর কুল ডুবেছে সুধা নিঝর-ঝরা।” শর্মা পষ্ট কথাই শুনতে চায়।

৪৩। গুণ : ই ঈ স্থানে এ-কার (বা অয়্), উ ঊ স্থানে ও-কার (বা অব্), ঋ স্থানে অর্ হওয়াকে স্বরের গুণ বলে। যেমন–√লিখ হইতে লেখন, লেখা; √দিশ হইতে দেশ; √ নী হইতে নয়ন, নেতা; √ মুচ্ হইতে মোচন; √ কৃ হইতে করণ; √বৃষ্ হইতে বর্ষণ; √শী হইতে শয়িত; আ–শ্রি হইতে আশ্রয়; পূ হইতে পবন; √ভূ হইতে ভবন; √শ্রু হইতে শ্রবণ ইত্যাদি।

৪৪। বৃদ্ধি : অ আ স্থানে আ-কার, ই ঈ এ স্থানে ঐ-কার (বা আয়), উ ঊ ও স্থানে ঔ-কার (বা আব্), ঋ-স্থানে আর্ হওয়ার নাম স্বরের বৃদ্ধি। যথা–অর্জুন হইতে আর্জনি, আত্মা হইতে আত্মিক, দিন হইতে দৈনিক, দীন হইতে দৈন্য, বেদ হইতে বৈদিক, সুমিত্রা হইতে সৌমিত্রি, কুলীন হইতে কৌলীন্য, ভূমি হইতে ভৌম, লোক হইতে লৌকিক, ভৃগু হইতে ভাৰ্গব (ঋ-কারের বৃদ্ধি আর্, উ-কারের গুণ অব্), কুরু হইতে কৌরব (প্রথম উ-কারের বৃদ্ধি ঔ, দ্বিতীয় উ-কারের গুণ অর্), গুরু হইতে গৌরব ইত্যাদি। নীচের তালিকাটি লক্ষ্য কর :

স্বরগুণবৃদ্ধি
অ, আ 
ই, ঈএ (অয়্‌)ঐ (আয়্‌)
 
উ, ঊও (অব্)ঔ (আব্)
 
অর্‌আর্‌

৪৫। সম্প্রসারণ : অন্তঃস্থ য ই-কার হইলে, র ঋ-কার হইলে এবং অন্তঃস্থ ব উ-বর্ণ হইলে সম্প্রসারণ হয়। যেমন–√যজ্ > হষ্টি ও ইষ্ট (য ই হইয়াছে), √ব্যধ্‌ > বিদ্ধ; √বচ্ > ডক্তি, অধি-√বস্ > অধ্যুষিত, √স্বপ্ > সুপ্তি, দ্বার > দুয়ার, দ্বি > দুই (পাঁচটি উদাহরণেই ব উ হইয়াছে); √বহ্ > ঊঢ় (ব ঊ হইয়াছে; √প্রচ্ছ > পৃষ্ট; √গ্রহ্ > গৃহীত (র ঋ হইয়াছে)।

৪৬। অপশ্রুতি (Ablaut) : ধাতু হইতে শব্দগঠনে বা শব্দ হইতে অন্য শব্দগঠনে স্বর-পরিবর্তনের এই যে তিনটি সংজ্ঞার্থ–গুণ, বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ ইহাদিগকে একসঙ্গে অপশ্রুতি বলে। √দুল্ > দোলন, জহ্নু > জাহ্নবী, পরশ্ব > পরশু, উদার > ঔদার্য, ঋষি > আর্য।

৪৭। আদেশ : এক বর্ণ বা শব্দাংশের স্থানে অন্য বর্ণ বা শব্দাংশ আসিলে আদেশ বলা হয়। যেমন–আছ্ (ধাতু) + ইলে = থাকিলে (এখানে আছ্ ধাতুর স্থানে “থাক্” আদেশ হইয়াছে); পরা- √অয়্ + ক্ত = পলায়িত (র্-স্থানে “ল্”); √হন্ + অনট্‌ = ঘাতন (হ্-স্থানে “ঘ”); অব-√হেড্ + অ + আ = অবহেলা (ড্‌-স্থানে “ল” হইয়াছে)।

এখন, ধ্বনিতত্ত্বঘটিত ব্যাকরণগত টীকার কয়েকটি উদাহরণ দেখ :

(ক) সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ-পানে না চলে নয়ান-তারা।

(১) ধেয়ানে : ধ্যান শব্দটির ধূ ও ফ্-ফলার মাঝখানে স্বরভক্তির নিয়মে একটি এ-কার আসিয়াছে, ফ্-ফলাটি পৃথভাবে বসায় হ্য় হইয়া গিয়াছে। শেষে কারক-বিভক্তির ফলে এ-বিভক্তি বসিয়াছে।

(২) নয়ান : নয়ন শব্দটি হইতে নয়ান হইয়াছে। য়্-এ অ-কার স্থানে আ-কার হইয়াছে। ধ্বনিতত্ত্বে এইপ্রকার পরিবর্তনকে বর্ণাগম (স্বরাগম) বলা হয় ।

(খ) হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরশ : স্পর্শ শব্দটির প্রথমবর্ণ স্ লোপ করিয়া পর্শ কথাটি পাইয়াছি; পরে র্ ও শ দুইটি যুক্তব্যঞ্জনের মাঝে অ ধ্বনি আসিয়া ব্যঞ্জন দুইটিকে পৃথক্ করিয়া দিয়াছে। সুতরাং প্রথমটি বর্ণলোপ এবং দ্বিতীয়টি বিপ্রকর্ষের উদাহরণ। একটি শব্দে একই সঙ্গে বর্ণলোপ ও বিপ্রকর্ষের সহাবস্থান।

(গ) খুব যন্তন্না হচ্ছে, না!

যন্তন্না : যন্ত্রণা শব্দটির র্-ফলা লোপ, তাহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ ন্ দ্বিত্ব-রূপ পাইয়াছে। র্-ফলা লোপ পাওয়ার ফলে মূর্ধন্য ণ্‌ দন্ত্য ন্‌ হইয়াছে। সুতরাং শব্দটিতে একইসঙ্গে বর্ণলোপ ও বর্ণদ্বিত্ব হইয়াছে। পল্লীগ্রামে সাধারণ লোকের মধ্যে শব্দটির বহুল প্রয়োগ রহিয়াছে।

(ঘ) রয়্যা বস্যা দিহ কড়ি।

১) রয়্যা : রহিয়া শব্দটির ই-কারের অপিনিহিতি-জাত রূপ রইয়্যা > রয়্যা। হ্-এর লোপ এবং ব্যঞ্জনের অভাব পূরণের জন্য য়-শ্রুতি।

(২) বস্যা : বসিয়া > বইস্যা > বস্যা।

সমগ্র বঙ্গদেশে প্রাচীন কবিতায় অপিনিহিতির বহুল প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। পশ্চিমবঙ্গ অপিনিহিতির স্তর অতিক্রম করিয়া অভিশ্রুতির দৌলতে শব্দ দুইটির আধুনিক রূপ দিয়াছে যথাক্রমে রয়ে এবং বসে (কী কথাবার্তায়, কী লেখায়)। কিন্তু পূর্ববঙ্গ-বাসিগণের মধ্যে এখনও মৌখিক ভাষায় রয়্যা, বস্যা–রহিয়া গিয়াছে।

(ঙ) চক্ষের পলকে নৌকা পাক খাইয়া পিছাইয়া গেল।

চক্ষের : চক্ষু শব্দটির শেষস্থ উ-কারের লোপ করিয়া সম্বন্ধ-পদের বিভক্তিচিহ্ন ‘এর’ যোগ করা হইয়াছে। প্রদত্ত শব্দটি সম্প্রকর্ষের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ।

(চ) জিনিসপত্তর ঠিক মতো যোগাড় করতে পাল্লে তো?

পাল্লে : পারলে > পাল্লে। পরবর্তী ল ব্যঞ্জনধ্বনিটির প্রভাবে পূর্ববর্তী র-এর পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সুতরাং ইহা পরাগত সমীকরণের উদাহরণ।

(ছ) কুঁজো লোকটি তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন।

কুঁজো = কুব্জ > কুজ (ব্ লোপ) > কুঁজ (স্বতোনাসিক্যীভবন) + উয়া > কুঁজুয়া > কুঁজো (অভিশ্রুতি)।

অনুশীলনী ১

[প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]

১। বর্ণ কাহাকে বলে? বর্ণমালা কী? বাংলা বর্ণমালা কয়ভাগে বিভক্ত? স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংজ্ঞার্থ নির্দেশ করিয়া উহাদের পার্থক্যটি বুঝাইয়া দাও।

২। দীর্ঘস্বর ও হ্রস্বস্বর কাহাকে বলে? উচ্চারণে হ্রস্বস্বর দীর্ঘ হয় এবং দীর্ঘস্বরও হ্রস্ব হয়, উদাহরণ দিয়া দেখাও।

৩। অল্পপ্রাণ বর্ণকে মহাপ্রাণ বর্ণে রূপান্তরিত করিবার উপায়টি কী? বর্গীয় বর্ণগুলির মধ্যে। অল্পপ্রাণ বর্ণগুলির উল্লেখ করিয়া উহাদের মহাপ্রাণ বর্ণগুলি দেখাও।

৪। ঘোষবর্ণ, মহাপ্রাণ বর্ণ, দীর্ঘস্বর, অন্তঃস্থবর্ণ, নাসিক্যবর্ণ, অঘোষবর্ণ, অল্পপ্রাণ বর্ণ, উষ্মবর্ণ, দন্ত্যবর্ণ, ঔষ্ঠ্যবর্ণ, হ্রস্বস্বর, মূর্ধন্যবর্ণ–এই সংজ্ঞার্থগুলির ডানদিকে সমানচিহ্ন দিয়া নীচের বিক্ষিপ্ত বর্ণগুচ্ছকে যথাযথ বসাও :

ত থ্‌ দ্‌ ধ্‌ ন্ স্ স্; ক্‌ খ্‌ ছ্‌ ট্‌ হ্‌ ত্‌ থ্‌ প ফ; ঙ্ ঞ্‌ ণ্‌ ন্ ম্; ঋ ট্‌ ঠ্‌ ড় ঢ্‌ ণ্‌ র্‌ ম্; উ উ প ফ্‌ বৃ ভ্‌ ম্; খৃ ঘ্‌ ছ্‌ ঝুঠ ঢ্‌ থ্‌ ধ্‌ ফ্‌ ভূ; শ্‌ ষ্‌ স্‌ হ; অ ই উ ঋ; গ্‌ ঘ্‌ ঙু জ্‌ ঝ্‌ ঞ্‌ ড় ঢ় দ্‌ ধ্‌ ন্‌ ব্‌ ভ্‌ ম্; আ ঈ উ এ ঐ ও ঔ ক্‌ গ্‌ ছ্‌ জ্‌ ট্‌ ড্‌ ত্‌ দ্‌ প ব্‌ য্‌ র্‌ ন্।

৫। বাংলা ভাষার নিজস্ব সৃষ্ট বর্ণগুলির যেকোনো তিনটির উচ্চারণবৈশিষ্ট্য বল।

৬। অর্থপার্থক্য দেখাইয়া বাক্যরচনা কর : পরা পড়া, কি কী, জরানো জড়ানো, পাড়া পারা, সাড়া সারা, ধড়া ধরা, পাট পাঠ, বড়া বরা, কড়া করা, পার পাড়, চরা চড়া, মোড় মোর, মোরা মোড়া, ঘোরা ঘোড়া, গোরা গোড়া, খুরি খুড়ী, নারী নাড়ী।

৭। (ক) শব্দগুলির চন্দ্রবিন্দু বাদ দিলে অর্থের কীরূপ ব্যতিক্রম হয়, বল ও কাটা, বাঁধা, রাঁধা, গাঁথা, পাঁজি, পাঁক, তাহার, আঁটা, হাঁড়ি, বাঁ, খাঁড়া, দাঁড়া, দাঁড়ি, চাপা, বাঁদী, চাচা, ফোঁটা, বাঁচন, বেঁচে, কাঁচা, চাই, গাঁ, কুঁড়ি, বেঁটে, কাদা, আঁধার, হাঁটে, আঁট, বাঁট, দাঁও, গোপ, ছাঁদ, শাঁখা, ফোঁড়া, রোঁয়া, আঁকার, কড়া, ধোঁয়া, গোঁড়া, বাঁটা, কড়ি, খাঁটি।

(খ) ঘুরি, ওরে, পারি, বারে, বারি, ভারা, তারা–শব্দগুলির র্‌ পালটাইয়া ড় বসাইলে অর্থের কী পরিবর্তন হয়, দেখাও।

৮। উদাহরণের সাহায্যে বুঝাইয়া দাও : আদ্য অ-কারের উচ্চারণবৈশিষ্ট্য; অন্ত্য অ-কারের উচ্চারণবৈশিষ্ট্য; শব্দমধ্যস্থ অনুচ্চারিত অ; আদ্য আ-কারের দীর্ঘ উচ্চারণ; এ-কারের অর্ধ-সংবৃত ও অর্ধ-বিবৃত উচ্চারণ; এ-কারের দীর্ঘ উচ্চারণ; ঞ্‌-র ন’ উচ্চারণ; ম্‌-ফলা,–ফলা ও য্‌-ফলার বিবিধ উচ্চারণ; শ-এর দন্ত্য উচ্চারণ; স-এর দন্ত্য উচ্চারণ; শব্দমধ্যস্থ ও শব্দান্তিক হ্‌ লোপ; র্‌ লোপ; অ-কারের দীর্ঘ উচ্চারণ; ই-বর্ণ; উ-বর্ণ; সমাক্ষরলোপ; একই বর্ণের বিভিন্ন ধ্বনি; বিভিন্ন বর্ণের একই ধ্বনি; ন্‌-ধ্বনি হয় এমন বর্ণগুলি।

৯। (ক) উচ্চারণ-সম্বন্ধে টীকা লিখ? উ প দ্‌ ছ্‌ ঘ্‌ ভ; য্‌ জ্‌ ম্‌ ণ্‌; ঐ ল হং ন্‌ ঞ্‌। (খ) উচ্চারণবৈশিষ্ট্য দেখাওঃ ক্ষ, হু, মা, জ্ঞ, ঞ্জ, হু, শ্রী, শ্ম, স্ব, হ্ন, স্ত, স্ম, ক্ষ্ম, হ্য, হ্ব।

(গ) শব্দযুগের মধ্যে স্থলাক্ষর একই বর্ণের উচ্চারণপার্থক্য দেখাও? এক এবং; দ্বন্দ্ব উদ্বোধন; আমল অভ্যন্তর; স্বত্ব নিজস্ব; হরা স্বত্ব।

(ঘ) কলম, কলমি, কমল (নাম), কমল (ক্রিয়াপদ), কমলা (লক্ষ্মী), কমলা (লেবু, কমলে (অসমাপিকা ক্রিয়া) শব্দগুলির প্রত্যেকটি অ-কারের উচ্চারণ লিখ।

(ঙ) গরম, নরম, পরম, শরম, নবম, দশম, কলম, ধরম, ধরন, শরণ, বরণ, দর্শন, করণ, “ শবর–প্রতিটি শব্দের অ-কারগুলির উচ্চারণের ক্রম যে একইরকম রহিয়াছে, দেখাইয়া দাও।

(চ) দেখা, শেখা, একা, এক, কেন, বেলা (সময়), বেলা (নাম)–শব্দগুলিতে এ-কারের উচ্চারণ-বৈচিত্র্য নিরূপণ কর।

১০। কয়েকটি যুক্তবর্ণ ও সেগুলির উপাদান-বর্ণগুচ্ছ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে; যুক্তবর্ণগুলির ডানদিকে সমানচিহ্ন দিয়া উপাদান-বর্ণগুলি এক-একটি পঙ্ক্তিতে সাজাও : ক্র, ক্র, ক্রু, র্য, য্যা, জ্ঞ, ঞ্জু, ষ্ণু, ক্ষা, হ্লা, হ্নি, স্থা, ঞ্চি, ক্ষু, হু, হ্ম, ক্ষ্মী, ঞ্ছ। ঙ্ + ক্ + ষ্ + আ; ঞ্‌ + জ্ + উ; ষ্ + ণ্ + উ; জ্ + ঞ্ + অ; ঞ্‌ + ছ্‌ + অ; হ্ + ণ্ + অ; ক্ + র্ + অ; র্ + য্ + অ; ন্ + ণ্ + আ; হ্ + ল্ + আ; হ্ + ম্ + অ; ঞ্‌ + চ্ + ই; ক্ + ষ্ + উ; হ্ + ন্ + ই; ক্ + ষ্ + ম্ + ঈ; ত্ + র্ + উ; ক্ + র্ + ঊ; য্ + ষ্ + আ।?! প্রতিটি যুক্তবর্ণকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়া এক-একটি (মোট ১৮টি) শব্দ গঠন কর এবং প্রত্যেকটি শব্দকে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।

১১। (ক) সংজ্ঞার্থ বল এবং উদাহরণদ্বারা বুঝাইয়া দাও : দীর্ঘ অক্ষর; স্বরভক্তি; অনুনাসিক বর্ণ; অল্পপ্রাণ বর্ণ; ঘোষবর্ণ; যৌগিক স্বর; স্পর্শবর্ণ; মহাপ্রাণ বর্ণ; উষ্মবর্ণ; অন্তঃস্থবর্ণ; আশ্রয়স্থানভাগী বর্ণ; অঘোষবর্ণ; শিসধ্বনি; বর্ণাগম; খৃষ্টবর্ণ; স্বরসঙ্গতি; বর্ণবিশ্লেষণ; অপিনিহিতি; অভিশ্রুতি; দ্বিমাত্রিকতা; মূর্ধন্যবর্ণ; কণ্ঠ্যবর্ণ; মূর্ধন্যীভবন; দন্ত্যবর্ণ; সম্প্রসারণ; বর্ণদ্বিত্ব; বিষমীভবন; বৃদ্ধি; গুণ; সমীকরণ; বর্ণবিপর্যয়; তালব্যবর্ণ; অপশ্রুতি; য়-শ্রুতি; কণ্ঠতালব্য বর্ণ; আদেশ; যুক্তবর্ণ; নাসিক্যীভবন; অন্তঃস্থ ব-শ্রুতি; তরল স্বর; পার্শ্বিক ধ্বনি; স্বতোনাসিক্যীভবন; খৃষ্টধ্বনি; সম্প্রকর্ষ; বর্ণলোপ; কম্পনজাত বর্ণ; দ্বিব্যঞ্জন ধ্বনি; বর্ণবিকার।

(খ) উদাহরণযোগে পার্থক্য দেখাও : দীর্ঘস্বর ও প্লুতস্বর; স্বরসঙ্গতি ও সমীভবন; স্বরসঙ্গতি ও অভিশ্রুতি; ধ্বনি ও বর্ণ; বর্ণ ও অক্ষর; সম্প্রকর্ষ ও বিপ্রকর্ষ; নাসিক্যীভবন ও স্বতোনাসিক্যীভবন।

১২। বন্ধ, ফলাহার, জলাভাবে, জননী, বাবা, বাপ, ছেলেমেয়ে–প্রত্যেকটি শব্দে কয়টি করিয়া অক্ষর আছে, দেখাও।

১৩। আয়ত অংশগুলির উচ্চারণবৈশিষ্ট্য দেখাও : “অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে।” “এ জীবনে সঁপিছে সান্ত্বনা আজিও তাহারি দান!” “আমি বেলাভূমিতে দাঁড়াইয়া উপলখণ্ড সংগ্রহ করিতেছি।” “শৃঙ্খলা রোজ বাড়ীতেও চাই, ভোজবাড়ীতেও চাই।” “দেশহিতে নরে যেই তুল্য তার নাই হে।” “সব ক্ষুরধার দুর্গম পথই চলেছে নশ্বর থেকে অবিনশ্বরের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোয়, নাস্তি থেকে অস্তিতে।” যেমন ভয়ংকর আস্য, তেমনি অভয়ংকর হাস্য। “এরা বিয়োগ করে বেশী, যোগ করে কম, তাই জীবনের খাতা শুধু শূন্যেই ভরে ওঠে, পুণ্য পর্যন্ত পৌঁছয় না।” “যশোলাভ-লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায় কব তা কাহারে।” সমস্ত বিষয়েই কর্তৃপক্ষ যখন সম্মত রয়েছেন, তখন অধস্তন দু-একজনের মত না থাকলেও ক্ষতি নেই। “কেন তুমি ত্যজিলে আমারে?” মেলায় বেপারীর দল লাভক্ষতি মেলায়। সামান্য যন্ত্রণায় এমন অস্থির হলে চলে? অস্থির অভ্যন্তরভাগে থাকে মজ্জা। এখন এখানকার খবর কী? একি! তুমি একা! একই ব্যাপার। একে এনেছ কেন? একে একে এস। “হেরো তাঁরে অঙ্গে অঙ্গে এ কী লীলা করেছে বেষ্টন!” সত্য কথা বলতে এখন আর বড়ো ঠেকে না। মহাকবির গৌরীকেও ঠকে ঠেকে শিখতে হয়েছে। কল্পনার সঙ্গে সত্যের প্রায়ই বনে না। “যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।” তেলটুকু ফুটন্ত জলে ফেলে দাও। একটুখানি কালি সে রোজই মাটিতে ফেলে। নেপালদা রোজ মায়ের পদধূলি মাথায় নেয়, তাই না তার ন্যায়বোধ এত প্রখর। মেঘে সূর্য ঢাকা থাকলে পদ্ম আর তার দল মেলে না। ডিশখানা টেবিলে কি ঠেকিয়েছিস? না, ঠেকাই নি। একজন একনিষ্ঠ ভক্তের ভক্তির তাপে পাণ্ডিত্যের তুষারস্তূপ গলে গিয়েছে। তিনি এখন সুদে-আসলে পুষিয়ে নিচ্ছেন। বাবু আসলে বলে দেব বলছি। মানুষের দাম ক্রমশঃ কমেই চলেছে। সরোজ আর ব্রজ এখন টাকা কমিয়ে দিয়েছে, সেই কমেই কোনোক্রমে চালিয়ে যাচ্ছি। কর্মপন্থা আগে থেকে ছকে নেবে। মূল ছকে এ ছবি ছিলই না। ছলে-বলে-কৌশলে যেন-তেন-প্রকারেণ এটা তোমায় করতেই হবে; একবার হলে আর করার দরকার নেই। গুরুদেব সশিষ্য এসেছেন বলে তাঁদের সবাইকেই প্রণামী দেব। “কন্যা গেল অন্তঃপুরে ফিরে।” কনেবউয়ের মতো ঘরের কোণে বসে কেন? ছড়িয়ে-পড়া ছেলেদের এক জায়গায় জড় কর। জড় জগতে টাকাকড়িই কি আমাদের একমাত্র কাঙ্ক্ষণীয়? অমূল্যবাবু অমূল্য সময়ের বিন্দুমাত্র অপচয় করেন না। দয়া করে একটা বিহিত (বিশেষণ) ব্যবস্থা করুন। এই অব্যবস্থার একটাকিছু বিহিত (বিশেষ্য) করা চাই-ই। এদেশে এরণ্ডকে দ্রুম আখ্যা দেওয়া একটা রীতি হয়ে গেছে। উনি তো বাবার পিসেমশায় হন। আন্দোলনে আপনি আমাদের শামিল হন। হঠাৎ কী মনে করে? এমনি। মাঝে মাঝে মনটা এমনই কেমন করে যে না এসে থাকতে পারিনে। সুর তান লয়ে যেখানে মিলল সেখানেই সংগীত, অন্যথায় সঙ-গীত। এমন ভরসন্ধেয় ঘুমাচ্ছিস কেন? ফাঁকা মাঠে এসে বুক ভরে দম নিলাম। অশ্রুত এ অশ্রুর সংগীত। মার্গসংগীতে শীর্ষস্থান পেয়েছেন এলা মিত্র। পায়েসে গোটাদুই ছোটো এলাচ ফেলে দাও। সাঁঝের বেলায় যমুনাবেলায় দেখা হল সই কার সাথে! এ বছর অগণিত ছেলেমেয়ে গণিত পরীক্ষায় অতি শক্ত প্রশ্নের কারণে অকৃতকার্য হয়েছে। পড়ন্ত বেলায় বেলাদি চটের বস্তা নিয়ে যেতে গিয়ে বেলগাছের তলায় পা হড়কে পড়ে গিয়ে খুব চটে গেল। অবিরাম কাঁদায় কাদাটুকু যখন ধুয়ে যাবে তখনই হৃদয়দর্পণ স্বচ্ছ হবে। প্রথমে প্যান্ট পরে এলেও পরে অপরের দেখাদেখি ধুতি পরে এল।

১৪। আয়ত অংশগুলির উপর ব্যাকরণের পরিভাষাগত টীকা লিখ : “সাধিতে মনের সাধ ঘটে যদি পরমাদ।” “করম বিপাকে গতাগতি পুন পুন মতি রহু তুয়া পরসঙ্গে।” “পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।” “অশথের নব পত্রোদ্‌গমন মনে পড়ে ফাল্গুনে।” “পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু বজর পড়িয়া গেল।” “নক্ষত্রের নহে সাধ্য উজলে ধরণী।” “মুদিয়া নয়ান শুনি সেই গান।” “দুয়ারের কাছে কে ওই শয়ান!” “ভোরের বেলা পুরগগনে সূয্যিঠাকুর দেন উঁকি।” ‘ফাগুনের হাওয়া কলার পাতায় নাচিছে ঘুরি।” “ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ।” “চুমাটি খাইতে মু’খানি গেল যে নড়ে।” “সোয়াস্তি নেই মনে।” “বামুনমা ওই রথে চড়ে সঙ্গে যাচ্ছে।” “আমার ক্ষিদে পায়নি বুঝি?” “লেঠেলি আমার জাতব্যবসা নয়।” “কেন এ রকম দিব্যি করেছিলে?” “তারাবাই একটি ছুরির ঘায়ে তার সব আস্পর্ধা শেষ করে দিলেন।” “অবাক্ হয়ে দেখতে লাগলাম দুই বুড়ো লোকের কান্না।” “জুয়োচুরির দিনে, মিথ্যে কথার দিনে বড্ড বেশি করে রুপো কাকার কথা মনে পড়ে।” “তাদের জন্য বিলিতি টেবিল না হয় না রহিল, দিশি কলাপাত মন্দ কী?” “সাথে যদি দাও ভকতি।”

১৫। (i) অ ন্ ই আ ম্; (ii) ক্ অ অ ল্ ম্ ব্ অ ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া যে-সমস্ত শব্দ পাও, সেগুলির অর্থ লিখ।

১৬। প্রতিটি শব্দের হলন্ত ও অ-কারান্ত (ও-কারান্তও বটে) উচ্চারণে যে অর্থপার্থক্য হয়, দেখাও : কাল, ভাল, হল, মত, চিত, অজ, জড়, জাত, বার, গীত, দেয়, তাত, পালিত, রক্ষিত, ভূত, ভাত।

১৭। দল কাহাকে বলে? দুটি শব্দকে দল-এ বিশ্লেষণ করিয়া সংজ্ঞার্থটি বুঝাইয়া দাও।

১৮। বাংলায় দলের প্রধান চার ধরনের গঠন-বৈচিত্র্য উদাহরণ-সহ আলোচনা কর।

১৯। দল কয় প্রকার ও কী কী? একটি করিয়া উদাহরণ দিয়া দলের শ্রেণীগুলির নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন কর।

২০। বাংলা ভাষায় দলগঠনে স্বরধ্বনির গুরুত্ব-বিষয়ে আলোচনা কর।

২১। উদাহরণ-সহকারে সংজ্ঞার্থ বুঝাইয়া দাও : মুক্ত দল, ত্রিদল শব্দ, একদল শব্দ, রুদ্ধ দল, চতুর্দল শব্দ, দ্বি-দল শব্দ।

২২। নির্ভুল বাক্যগুলির পাশে (টিক) চিহ্ন দাও। অশুদ্ধ বাক্যগুলির ভুল সংশোধন কর? (ক) যেকোনো শব্দে অবশ্যই একাধিক দল থাকে। (খ) ব্যঞ্জনধ্বনি ব্যতীত দল গঠিত হইতে পারে। (গ) প্রতিটি দলে অন্তত একটি স্বরধ্বনি থাকিবেই। (ঘ) কোনো দলে একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিতে পারে। (ঙ) কোনো দলে একাধিক স্বরধ্বনি থাকা অসম্ভব। (চ) দলের শেষে স্বরধ্বনি থাকিতে পারে। (ছ) দলের শেষে বা প্রথমে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিলেও স্বরধ্বনি থাকে না। (জ) দলান্ত ও দলারম্ভ ছাড়া দলগঠন অসম্ভব। (ঝ) পূর্ণাঙ্গ দলে দলান্ত এবং দলার অবশ্যই থাকিবে। () দলারম্ভ ও দলান্ত ধ্বনিদুটি স্বরধ্বনি হইতে পারে না। (ট) দলান্ত অংশে একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকিতে পারে না।

২৩। ঠিক বিকল্প বাছিয়া লইয়া বাক্যগুলি সম্পূর্ণ কর? (ক) (স্বর। ব্যঞ্জন) ধ্বনিকে দলকেন্দ্র বলা হয়। (খ) (স্বর ব্যঞ্জন) ধ্বনিকে দল-এর নিম্নদেশ বলে। (গ) স্বরধ্বনিকে দলের (শীর্ষ। নিম্নদেশ) বলা হয়। (ঘ) (স্বর / ব্যঞ্জন) ধ্বনির আগে অবস্থিত (স্বর ব্যঞ্জন) ধ্বনিকে দলারম্ভ বলে। (ঙ) (স্বর ব্যঞ্জন) ধ্বনির পরে অবস্থিত (স্বর ব্যঞ্জন) ধ্বনিকে দলান্ত বলে। (চ) যে কোনো দল-এ (দলান্ত দলারম্ভ দলকেন্দ্র) অবশ্যই থাকিবে। (ছ) খাঁটী বাংলায় দল-এ যুক্তব্যঞ্জন (থাকে। থাকে না)। (জ) যথার্থ সংযুক্ত ব্যঞ্জন (দোরম্ভ / দলান্ত) অংশেই শুধুমাত্র পাওয়া যায়। (ঝ) বাংলায় দলগঠনে (দুটি। তিনটি চারটি) স্বরধ্বনি অর্ধস্বর-রূপে পাই। (ঞ) দল-এ অর্ধস্বরটি পূর্ণাঙ্গ স্বরধ্বনির (আগে পরে) বসে।

২৪। শব্দগুলির দল বিশ্লেষণ করিয়া কোটি মুক্ত দল এবং কোটি রুদ্ধ দল লিখ।

ছান্দসিক, কাঁচাপয়সা, জননী, বিচুলি, অরণ্য, অপিনিহিতি, সমাপ্তি, নোজল, গৌরী, দয়াময়, ফলাহার, গোলাপ, মহল, ছানাপোনা, নাগরিক, ভাঁটফুল, যুবক, আনন্দ, দাবানল, প্রদীপ, অন্ধকার, পিতৃদেব, গীতাঞ্জলি, পাঠশালা, হাততালি, হরিণ, আকাশকুসুম, সিদ্ধান্ত, চঞ্চল, তারতম্য, অভিশ্রুতি, পশ্চিম, মহেশ, বিধিলিপি, শ্রীজাত, বারিবিন্দু, গৌরাঙ্গ, স্বরসঙ্গতি, জীবন্ত, মৃগয়া, ঝরনা, সতত, বর্বরতা, সীমান্ত, জমিদার, বৃন্দাবন, জলধর, সশঙ্কচিত্তে, কালাপাহাড়, বর্তমান, দুর্নীতি, অধিনায়ক, নির্মুল, মাধ্যমিক, প্রতিদিন, রবীন্দ্রনাথ, নিরিবিলি।

২৫। উদাহরণ-সহকারে মুক্ত দল ও রুদ্ধ দলের পার্থক্য বুঝাইয়া দাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *