2 of 2

কাশিমবাজারের রাজপরিবার

কাশিমবাজারের রাজপরিবার

যে সকল সদগুণ মানবচরিত্রের অলঙ্কারস্বরূপ, সে সকলের মধ্যে আর্তের সেবা ও ভাগ্যহীনদের প্রতি সহানুভূতিই বোধ হয় সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম। এর দ্বারা, বিচার বিবেচনা করে হলেও, সম্পদের প্রকৃত সদব্যবহার হয়। শিক্ষাবিস্তার, জাতির নৈতিক উন্নতি এবং আর্তের সেবার জন্য কাসিমবাজার রাজপরিবারের মহারাণী স্বর্ণময়ী যে বিপুল পরিমাণ দান নিয়মিতভাবে করে থাকেন, তার তুলনা বর্তমান বাংলায় কেন, ভারতেও বোধ হয় নেই। দান, সেবা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বোধ হয় শুধুমাত্র নাটোরের রাণী ভবানী ও ইন্দোরের অহল্যাবাঈ-এর সঙ্গে তুলনীয়া।

বনেদী ও সম্ভ্রান্ত এই পরিবারটির ইতিহাস মোটামুটি সকলেরই জানা। বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের অধীনে ও আনুকূল্যে বাবু (পরবর্তীকালে, দেওয়ান) কৃষ্ণকান্ত নন্দী, বা কান্ত বাবু বিত্ত ও মর্যাদার অধিকারী হন। কিন্তু জনগণ ও সরকারের কাছে এই বংশের যে মর্যাদা তার মূলে আছে সদগুণের অধিকারিণী মহারাণী স্বর্ণময়ীর ধর্মপ্রণতা ও জনহিতৈষণার জন্য দান। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন কাশিমবাজারে কোম্পানির রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় বাংলার তদানীন্তন নবাব নাজিম সিরাজউদ্দৌলা কোন কারণে রুষ্ট হয়ে হেস্টিংস সহ সেখানকার সকল ইংরেজকে বন্দী করবার নির্দেশ দেন। এই দুঃসময়ে হেস্টিংসকে আত্মগোপন করবার ও পালাবার ব্যবস্থা ও সুযোগ করে দেন এই কান্তবাবু। এই সাহায্য না পেলে হেস্টিংস হয়তো প্রাণে মারা পড়তেন। হেস্টিংস কখনও এই উপকারের কথা ভোলেন নি। ১৭৭২ এ বাংলার গভর্নর জেনারেল হয়ে তিনি কান্তবাবুকে দেওয়ান পদে নিয়োগ করেন। হেস্টিংয়ের সমগ্র শাসনকালে কান্তবাবু এই পদেই আসীন ছিলেন।

কান্তবাবুর রাজভক্তি এবং কোম্পানির উপকার হয় এমন বহু সৎকাজের স্বীকৃতিস্বরূপ হেস্টিংস তাঁকে গাজিপুর এবং আজমগড় জেলায় ‘দুহা বেহারা’ জাগীর দেন আর তাঁর পুত্র লোকনাথকে রাজা বাহাদুর খেতাব দান করেন।

১১৯৫ বঙ্গাব্দের (১৭৮৮ খ্রীস্টাব্দের) পৌষ মাসে কান্তবাবু পরলোকগমন করেন। তাঁর সমগ্র সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন রাজা লোকনাথ রায় বাহাদুর।

আঠারো বছর কাল অর্থাৎ ১৮০৪ পর্যন্ত রাজা লোকনাথ রায় বাহাদুর এই বংশের প্রধান ছিলেন; কিন্তু এর অর্ধেক সময় তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ অবস্থায় কাটান। তাঁর মৃত্যুকালে তাঁর পুত্র হরিনাথের বয়স ছিল মাত্র এক বছর।

কুমার হরিনাথ সবালকত্ব প্রাপ্ত হন ১৮২০ তে। ১৮৮৫এর ২৬ ফেব্রুয়ারি আর্ল অ্যামহার্সট একটি সনদ দ্বারা তাঁকে রাজা বাহাদুর পদবীতে ভূষিত করেন। স্বল্পায়ু রাজা হরিনাথের বহু বিশিষ্ট দানের মধ্যে রয়েছে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ২০,০০০ টাকা দান এবং কাশিমবাজারে সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারের জন্য উদারভাবে অর্থব্যয়। উল্লেখ্য যে, তাঁর সময়ে ওই অঞ্চল সংস্কৃত শিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটে। ১২৩৯ বঙ্গাব্দের (১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে) অগ্রহায়ণ মাসে তাঁর মৃত্যু হয়, মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তাঁর একমাত্র পুত্র কিষেণনাথকে, তিনিই হন সমস্ত সম্পদের উত্তরাধিকারী।

১৮৪০ (১২৪৭ বঙ্গাব্দ)-এ কুমার কিষেণনাথ সাবালকত্ব লাভ করেন। ১৮৪১-এ লর্ড অক্ল্যান্ডের শাসনকালে তাঁকে রাজা বাহাদুর খেতাব দ্বারা ভূষিত করা হয়।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষা সুচারু ও সঠিকভাবে পরিচালিত হলে এর দ্বারাই দেশবাসীর নৈতিক ও অর্থনৈতিক মানের উন্নতি হবে এবং প্রাচীন ভারতের মতো নতুন ভারত আবার জ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নত স্থানের অধিকারী হতে পারবে; বয়সে তরুণ হলেও তিনি শিক্ষার একাগ্র ও উৎসাহী পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিলেন। স্বয়ং যেমন তিনি শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি আন্দোলনে অগ্রণীর ভূমিকায় থাকতেন, তেমনি শিক্ষা প্রসারে যারা সক্রিয় অংশ নিতেন তাঁদেরও তিনি মর্যাদা দানে পিছিয়ে থাকতেন না। ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুতে শিক্ষিত দেশবাসীর মনোভাব উপলব্ধি করে তিনি এই সমুন্নত মানবপ্রেমিক এবং ভারতীয় জনগণের মহান ও প্রকৃত বন্ধুর স্থায়ীভাবে স্মৃতিরক্ষার জন্য ব্যবস্থাগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজের থিয়েটারে একটি সভা আহ্বান করেন। ডেভিড হেয়ারের একটি মূর্তিস্থাপনের প্রস্তাবে তিনি সানন্দ সমর্থন জানান এবং এজন্য সংগৃহীত অর্থের বৃহত্তম অংশ আসে তাঁরই প্রদত্ত চাঁদা থেকে। বয়সে তরুণ হওয়ায়, তাঁর জনহিতৈষণার কাজে যুক্তি অপেক্ষা ভাবপ্রবণতা থাকত অনেক অধিক; কিন্তু এ কথাও সত্য যে যাঁরা তাঁর কাজ করতেন বা তাঁর সৎ কাজে তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করতেন, সুচিন্তিত ভাবেই তিনি তাঁদের গুণের মূল্য দিতেন। বাংলার হিন্দু সমাজের সম্ভ্রান্ত ও সুপরিচিত ব্যক্তি রাজা দিগম্বর মিত্র, সি এস আই-কে তিনি এক লক্ষ টাকা উপহার দিয়েছিলেন।

(মহারাণী) স্বর্ণময়ীর স্বামী রাজা কিষেণনাথ রায়, বাহাদুর আত্মহননের পথ বেছে নেন। তিনি আত্মহত্যা করেন ১৮৪৪-এর ৩১ অক্টোবর। এই দুঃখজনক ঘটনার পর সরকার পরিবারটির সমগ্র সম্পত্তি অধিগ্রহণ করেন; ‘স্ত্রীধন’ ব্যতীত রাজা কিষেণনাথের পত্নী স্বর্ণময়ীর আর কোনো সম্পত্তি রইল না। স্বীয় সম্পত্তির সুপরিচালনা ও মিতব্যয়িতা দ্বারা অর্থ সঞ্চয় করে তিনি স্বামীর সম্পত্তিতে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে মোকদ্দমা করলেন। এই অবস্থাতেও বংশের মর্যাদা অনুযায়ী সংসারের ব্যয় নির্বাহ তাঁকে করতে হয়েছিল।

রাজা কাশীনাথের শেষ উইল অনুযায়ীই কোম্পানি উক্ত সম্পত্তি অধিকার করেছিলেন; কিন্তু সাক্ষ্যে প্রমাণিত হল যে, উইল সম্পাদনের সময় রাজা মানসিক দিক থেকে সুস্থ ছিলেন না; ফলে এই মামলায় মহারাণী জয়ী হলেন। সম্পত্তির পুনরুদ্ধার হলেও, কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের অবস্থা তখন শোচনীয়; জমিদারীতে চলছে অরাজক অবস্থা; খাজনা আদায় নেই বললেই চলে; তার ওপর এস্টেটটি ঋণে ঋণে জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে স্বর্ণময়ী এস্টেটের পরিচালনার দায়িত্ব স্বহস্তে তুলে নিলেন; আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ সহায়তা পেলেন দেওয়ান রাজীবলোচন রায় বাহাদুরের কাছ থেকে; জমিদারী-সংক্রান্ত সকল বিষয়ে রাজীবলোচন ছিলেন গভীর জ্ঞানের অধিকারী; চরিত্রও ছিল তাঁর নিষ্কলঙ্ক। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টা ও পরিচালনায় জমিদারীটি তার পূর্ব গৌরবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। এই জমিদারীর রায়তগণই বোধ হয় সব থেকে বেশি সন্তুষ্ট ও সুখী; তৎসত্ত্বেও জমিদারী থেকে যে আয় হতে থাকল, তার দ্বারা উচ্চতম ব্রিটিশ অভিজাতদের সমপর্যায়ে পরিবারটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *