2 of 2

কাঁটাপুকুর, বাগবাজারের দেওয়ান হরি ঘোষের পরিবারবর্গ

কাঁটাপুকুর, বাগবাজারের দেওয়ান হরি ঘোষের পরিবারবর্গ

বনেদি এবং এককালে প্রভাবপ্রতিপত্তিশালী এই পরিবারটি বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত। এই পরিবারটি দাবী করে, আদিশূর যে পঞ্চ ব্রাহ্মণ ও পঞ্চ কায়স্থকে কনৌজ থেকে আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন, তাঁদের অন্যতম মকরন্দ ঘোষ থেকে এই বংশের সূত্রপাত। রাজআমন্ত্রিত মকরন্দ ঘোষ স্থান লাভ করেন গৌড়ের রাজদরবারে। গৌড়েই তিনি সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন। ষষ্ঠ পুরুষে এই বংশের বড় তরফ গৌড় ছেড়ে বর্তমান হুগলী জেলার আকনায় বসবাস করবার জন্য চলে আসেন– বড় তরফের প্রধান ছিলেন প্রভাকর ঘোষ। ঐ জেলারই বালি গ্রামে– এই পরিবারের প্রধান ছিলেন নিশাপতি ঘোষ। মাধব বা মনোহর ঘোষের সময় এই ছোট তরফ বালি ছেড়ে ব্যারাকপুরের চন্দনপুকুর গ্রামে বসবাসের জন্য চলে আসেন।

মকরন্দ ঘোষের উনবিংশ পুরুষ এই মনোহর ঘোষ ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। সম্পত্তি বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। সুযোগ আসায় এবং বুদ্ধি ও দক্ষতা বলে তিনি নিজে অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় আকবর বাদশাহের রাজপুত বাহিনীর সেনাপতি টোডরমলের অধীনে সামান্য গোমস্তার চাকরি নিয়ে। গোমস্তার চাকরিতে তিনি অবস্থা ফেরাতে পারলেন না। উক্ত সম্রাটের নির্দেশে এই সুবাহ্ সকল জাগীর ও খালসা জমির প্রথম জরিপ শুরু হলে, তিনি টোডরমলের মুহরার নিযুক্ত হন। এই পদে চাকরি করার সময় তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হন। এই ঐশ্বর্য নিয়ে শেষ জীবন শান্তিতে নিরুপদ্রবে কাটার উদ্দেশ্যে তিনি সুবর্ণরেখার তীরে বসবাস করতে চলে যান। কিন্তু তাঁর আশা পূরণ হয় নি।

সুবর্ণরেখার তীরে মহারাজা মানসিংহ ও আফগানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে, মনোহর ঘোষ তাঁর সম্পদ ও সম্পত্তির বৃহত্তর অংশ হারিয়ে, চিত্রপুরীতে (বর্তমান চিৎপুর) আশ্রয় নেন। যা কিছু নিয়ে পালাতে পেরেছিলেন, তাই দিয়ে এখানে একটি কুটির তৈরি করে বাস করতে থাকেন। লুকিয়ে আনা সম্পদের একটা অংশ দিয়ে তিনি সর্বমঙ্গলা ও চিত্রেশ্বরীর মন্দির নির্মাণ ও প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন; দেবসেবার ব্যয় নির্বাহের জন্য মোহান্তকে কিছু ভূসম্পত্তিও দান করেন। ইউরোপীয়গণ চিত্রেশ্বরী মন্দিরকে কালী মন্দির বলে বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে ক্যালকাটা রিভিয়্যু (খ- তিন, ১৮৪৫) লিখছেন : ‘জনগণের ধারণা এবং এ-ধারণার প্রতিবাদও কোথাও হয়নি যে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে, এখানেই সর্বাধিক সংখ্যক নরবলি দেওয়া হয়েছিল!’

মনোহর ঘোষের মৃত্যু হয় ১৬৩৭ নাগাদ। তাঁর অল্প পরেই ডাকাতরা এখানে এত বেশী নরবলি দিতে থাকে যে সে বীভৎসতার নিরুপায় দর্শক হয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ায় মনোহর ঘোষের পুত্র রামসন্তোষ ঘোষ, ওরফে সন্তোষ ঘোষ, চিৎপুর ছেড়ে সপরিবারে বর্ধমান পালিয়ে যান। সন্তোষ বহুভাষা জানতেন; তিনি ক্রমান্বয়ে ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ কুঠীতে চাকরি করেন। ৭০ বছর বয়সে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় রহিম সিংহ জানতে পারেন যে সন্তোষ ঘোষ বহু ধন সঞ্চয় করেছেন; এই ধন ছিনিয়ে নেবার জন্য রহিম সসৈন্য তাঁর ওপর চড়াও হন; বৃদ্ধ হলেও সন্তোষ ঘোষ মরবার আগে রহিমের কয়েকজন সৈন্যকে বধ করেন এবং স্ত্রী ও পুত্র বলরামের পলায়নের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। আশ্রয় ও নিরাপত্তার খোঁজে বলরাম স্থান থেকে স্থানান্তরে চলতে চলতে শেষে আশ্রয় নেন ফরাসী অবিকৃত চন্দননগরে। এখানে, ব্যবসায় করে আবার তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়ান।

[বলরামের জ্ঞাতিভ্রাতা বারাণসী ঘোষ ছিলেন ২৪ পরগণার কালেকটর মি : গ্রাডউইনের দেওয়ান। বারাণসী ঘোষের পিতা ও পিতামহের নাম ছিল যথাক্রমে রাধাকান্ত ও গণেশচন্দ্র এবং শ্বশুর ছিলেন জোড়াসাঁকোর শান্তিরাম সিংহ। জোড়াসাঁকোতেই বারাণসা একটি সুরম্য বাসভবন নির্মাণ করেন এবং ব্যারাকপুরে গঙ্গাতীরে ছ’টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে তিনি ছিলেন কলকাতার প্রভাব- প্রতিপত্তিশালী অধিবাসী; সেইজন্য তাঁর নামে শহরের এদেশীয়দের এলাকায় একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়।]

(বলরামের কথায় ফিরে আসা যাক।) তখন মঁশিয় দুপ্লে ছিলেন চন্দননগরের গভর্নর; পরে তিনি ভারতস্থ ফরাসী অধিকৃত এলাকাসমূহের গভর্নর জেনারেল হন; তাঁরই উর্বর মস্তিষ্কে এই চিন্তার উদ্ভব হয় যে, ভারতীয়দের দ্বারা সেনাবাহিনী গঠন করে এবং ভারতীয়দেরই সহযোগিতায় ভারতবর্ষকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের অধীনস্থ একটি দেশে পরিণত করা যায়–এই দুপ্নে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষত ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ে বলরামের পরামর্শ নিতে থাকেন। বলরামও প্রচুর ধন অর্জন করতে থাকেন কিন্তু জীবনযাপন করতে থাকেন অতি দরিদ্রের মতো। ১৭৫৬ তে, অর্থাৎ ‘ব্লাক হোল’ হত্যাকান্ডের বছর বলরামের মৃত্যু হয়–তখন তাঁর বয়স ৯৫ বছর। তাঁর চার পুত্র : রামহরি, শ্রীহরি, নরহরি, ও শিবহরি বা শিবনারায়ণ। ছোট দুজন বলরামের জীবিতাবস্থাতেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। পিতার মৃত্যুর পর রামহরি ও শ্রীহরি চন্দননগরের ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতা চলে আসেন। এখানে তাঁরা বাগবাজারে ২০ বিঘা জমি কিনে পুষ্করিনী ও বাগানসহ যক্ষ-প্রাসাদতুল্য বিরাট একখানি অট্টালিকা নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন; থাকতেন তাঁরা রাজার মতই। পুকুরটি এখনও আছে, আর সে অট্টালিকার যেটুকু ধ্বংসাবশেষ এখনও টিকে আছে তা থেকে বোঝা যায় যে অট্টালিকাটির যেটুকু উত্তরে ছিল বোসপাড়া লেন, দক্ষিণে কাঁটাপুকুর, পশ্চিমে, গৌর বোসের লেন আর পূর্বে ছিল গোপালচন্দ্র বোস ও অন্যান্যের বাড়ি।

বলরাম ঘোষের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামহরি, স্ত্রী মারা যাওয়ায় পর পর ছ’বার বিয়ে করেন। পঞ্চম বারে তিনি বিয়ে করেন রাজা গোপীমোহন দেব বাহাদুরের কন্যাকে, সে স্ত্রীও মারা যাবার পর ষষ্ঠ বারে তিনি বিয়ে করেন বার সিমলার বিনোদরাম দাসের কন্যাকে। এই স্ত্রীর গর্ভে তাঁর তিনটি পুত্র হয়। তার মধ্যে দু’জনের আগেই মৃত্যু হয়; জীবিত থাকেন একমাত্র পুত্র আনন্দমোহন। কাবুল যুদ্ধের সময় আনন্দমোহন ছিলেন কমিসারিয়েটের গোমস্তা; এই চাকরির সুবাদে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে বেনারসে একটি নাচঘর স্থাপন করেন। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় নাচের আসর বসত। এতে তাঁর বহু অর্থ ব্যয় হয়; অবশ্য তিনি উদারভাবে দানেও ব্যয় করতেন। এই সব কারণে এই পবিত্র শহরের লোক এখনও তাঁকে স্মরণ করে। তিনি দু’বার বিয়ে করেছিলেন, তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী ভুবনেশ্বরী দাসী গয়াতে বাস করেন; যেখানে তাঁর একটি ছোট তালুক আছে। এই সম্ভ্রান্ত প্রাচীনা বাংলা ভাষা ভালই জানেন; অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি তাঁর ধনসম্পত্তি পরিচালনা করেন। প্রতি বছর মহাধুমধামের সঙ্গে তিনি অন্নপূর্ণা পূজা করেন। আনন্দ-মোহনের রক্ত সম্বন্ধের কোন উত্তরাধিকারী নেই।

বলরামের মধ্যম পুত্র শ্রীহরি ঘোষ বাংলা ও ফার্সী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন, ইংরেজিও কিছু শিখেছিলেন। তিনি অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঙ্গের কেল্লার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন। সামরিক ও অসামরিক সকল শ্রেণির আধিকারিকের তিনি প্রিয়পাত্র ছিলেন। এই চাকরি দ্বারা তিনি বিশেষ ধনবান হয়ে ওঠেন, ধনবান হয়েও তিনি মাত্রা হারান নি; অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন কিন্তু তাঁর দান ছিল প্রায় সীমাহীন।

[মুঙ্গের কেল্লার একটি বিস্তৃত বর্ণনা আছে, কলকাতার বাবু বৃত্তান্তের সঙ্গে সেটির সঙ্গতি না থাকায়, আমরা এই অংশটি বাদ দিচ্ছি।]

দেওয়ানের পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর শ্রীহরি ঘোষ কলক।তায় বসবাস করতে থাকেন। তিনি বহু জ্ঞাতি কুটুম্ব ও স্বজাতীয় অসহায় মানুষকে নিজ বাড়ীতে খেতে থাকতে দিতেন। গৃহহীন বহু মানুষের আশ্রয়স্থল হওয়ায় তাঁর বাড়ীটিকে লোকে বলত হরি ঘোষের ‘গোয়াল’।

‘হরি ঘোষের গোয়াল’ এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ভর্তি বাড়ীকে এখন বলে ‘হরি গোষের গোয়াল’। কন্যাদায়গ্রস্ত বহু ব্রাহ্মণ ও কায়স্থকে তিনি কন্যাদায় থেকে উদ্ধার এবং ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করেছিলেন। শ্রীহরি ঘোষের ছেলে ও অন্যান্য নিকট আত্মীয় যে আহার্য পেতেন, আশ্রিতজনকেও সেই খাদ্যই দেওয়া হত। অপর পক্ষে নিষ্ঠাবান ও ধনী হিন্দু হিসাবে তিনি বার মাসের তের পার্বণ সমারোহের সঙ্গে পালন করতেন।

জীবনের অধিকাংশ সময় এইভাবে অতিবাহিত করবার পর, শেষজীবনে এক বন্ধুর হয়ে জামিন দাঁড়িয়ে, বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যাপারে বন্ধুটি তাঁকে প্রতারণা করায়, তিনি বন্ধু ও সংসার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে জীবনের অবশিষ্ট অংশ পবিত্র কাশীধামে অতিবাহিত করবার উদ্দেশ্যে কলকাতা ত্যাগ করেন। কলকাতা ত্যাগ করার পূর্বে তিনি তাঁর বাসভবনটি গাঙ্গুলীদের কাছে বিক্রি করে দেন এবং কাঁটাপুকুর ও শ্যামপুকুর অঞ্চলের বিস্তৃত ভূসম্পত্তি নকুড়চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামক জনৈক ব্রাহ্মণের হেফাজতে রেখে যান। নকুড়চন্দ্রের বংশধরগণ এখন ওই ভূসম্পত্তি ভোগ করছেন। বহুদিন যাবৎ এই সব জমিতে কেউ বসবাস করেনি, তাই এগুলির নাম হয়ে গিয়েছিল ‘হরি ঘোষের পোড়ো। হরি ঘোষের বংশধরগণ ইচ্ছে করলেই এই সব জমি-জমার দখল নিতে পারেন, কিন্তু তাঁদের দিক থেকে সে রকম কোন চেষ্টা করা হয় নি ৷

কলকাতার বাড়ী ও অন্য কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে শ্রীহরি ঘোষ জ্যেষ্ঠ পুত্র কাশীনাথ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে কাশীবাসী হন। অল্পকাল পরে তিনি শান্তিতে পরলোক গমন করেন। শ্রীহরি ঘোষের চার পুত্র : কাশীনাথ, বিশ্বনাথ, হরলাল এবং রসিকলাল, আর দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা কন্যা ভগবতী দাসীর বিয়ে হয়েছিল বাগবাজারের নিধুরাম বসুর পৌত্র জগন্নাথ বসুর সঙ্গে। কাশীনাথ অপুত্রক অবস্থার কাশীতেই পরলোক গমন করেন।

বিশ্বনাথ ঘোষের একমাত্র পুত্র ভৈরবচন্দ্র সরকারের অধীনে কিছুদিন মীর্জাপুরে চাকরি করেন। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে একটি শিশুপুত্র রেখে তিনি মারা যান। এই শিশু বেণীমাধব তাঁর মাতুল, চোরবাগানের আনন্দচন্দ্র বোসের আশ্রয়ে মানুষ হন। বেণীমাধব ডেভিড হেয়ারের স্কুলে ইংরেজি শেখেন, সামান্য ফার্সীও তিনি জানতেন। তাঁর প্রথম বিবাহ হয় চাষা-ধোপাপাড়ার তারাচাঁদ বসুর কন্যার সঙ্গে। এই স্ত্রী মারা গেলে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন ঠনঠনিয়ার নবকৃষ্ণ সরকারের কন্যাকে। বেণীমাধব মেসার্স পীল, ব্লেয়ার অ্যান্ড কোম্পানির বাজার সংক্রান্ত ব্যবসায়ের দায়িত্বে ছিলেন। এই পেশায় তাঁর ভালই উপার্জন হয়েছিল, কিন্তু অর্জিত সম্পদের অধিকাংশই তিনি সৎকাজে ব্যয় করেন। তিনি ধর্মীয় সঙ্গীত বেশ ভাল গাইতেন। তাঁর দুই পুত্র : চন্দ্রনাথ ও যোগেন্দ্রনাথ। এঁদের মধ্যে যোগেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি প্রেসের মালিক। মুদ্রণ সম্পর্কে তাঁর তাত্ত্বিক ও কার্যকরী উভয় প্রকারেরই গভীর জ্ঞান আছে।

দেওয়ান শ্রীহরি ঘোষের তৃতীয় পুত্র হরলালের একমাত্র পুত্র ভোলানাথ ঘোষ ছিলেন আলিপুর মুন্সেফ কোর্টের উকিল। তিনি ভবানীপুরে বাড়ি করেন, সেখানে বর্তমানে তাঁর বিধবা বাস করেন; তাঁর একমাত্র পুত্র সূর্যকুমার ঘোষ ভবানীপুরের লন্ডন মিশনারী ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। মিশনারীদের উপদেশ অনুযায়ী তিনি খ্রীস্টিয় যাজক হন। রেভারেন্ড সূর্যকুমারের কলেরায় মৃত্যু হয়। তাঁর সন্তানগণ খ্রিস্টধর্মাবলম্বী।

দেওয়ান শ্রীহরি ঘোষের কনিষ্ঠ পুত্র রসিকলালের বিবাহ হয় বাগবাজারের বিখ্যাত রামচরণ, ওরফে চরণ সোমের কন্যা হরসুন্দরী দাসীর সঙ্গে। জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে রসিকলাল যৌবনেই প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রী হর-ওরফে কালাচাঁদ আর এক কন্যা তারাসুন্দরী। কেদারেশ্বর বাল্যকালেই মারা যান। তারাসুন্দরীর বিবাহ হয় সিমলার তারিণীচরণ সরকারের সঙ্গে। বিবাহের অল্পকাল পরেই তারাসুন্দরীর মৃত্যু হয়। জীবিত পুত্রদ্বয় মুক্তীশ্বর ও ভুবনেশ্বর মাতুলালয়ে মানুষ হতে থাকেন। মুক্তাশ্বর ডেভিড হেয়ারের স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। দেওয়ান শ্রীহরি ঘোষের বন্ধু ডাঃ কাম্বারল্যান্ড ও কটকের কমিশনার মিঃ এ জে এম মিস বালককে স্বগৃহে রেখে ডাক্তারী বিদ্যা পড়াতে ও শেখাতে থাকেন– পুঁথিগত এবং হাতে কলমে উভয় প্রকার শিক্ষাই মুক্তীশ্বর তাঁর কাছে পেতে থাকেন। ডাক্তারী শাস্ত্রে সুপন্ডিত মিঃ কাম্বারল্যান্ড উড়িষ্যা থেকে চলে আসবার সময় পুরীর সমুদ্রতীরে তিনি যে বাংলোটি নিজের জন্য নির্মাণ করেছিলেন সেটি মুক্তীশ্বরকে দান করে যান!

মুক্তীশ্বর কটক ডিস্পেনসারিতে কিছুকাল ডাক্তারী করার পর পুরীতে জগন্নাথ পিলগ্রিম হসপিটালে বদলী হন। এখানে সুনামের সঙ্গে তিনি ৩৫ বছর ডাক্তারী করেন; ডাক্তারী শাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ও চিকিৎসায় পারদর্শিতার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার সিভিল সার্জনগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ ই বি থ্রিং, ডাঃ রবার্ট প্রিংগল, ডাঃ বি ক্যেডালি, ডাঃ জে জে ডিউর‍্যান্ট, ডাঃ মেরেডিথ এবং অন্যান্য কয়েকজন।

ডাঃ প্রিংগল লিখছেন, “তাঁর কাজে কোন ত্রুটি হয়েছে এমন ঘটনা স্মরণ করতে পারি না; বরং এই ডিস্পেনসারিতে মানবতার সেবায় তিনি যতদূর সম্ভব নিজের জ্ঞান ও পরিশ্রম সহকারে কাজ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত বহু। এদেশীয় একজন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা শাস্ত্রে যতখানি জ্ঞান আশা করা যায়, তাঁর জ্ঞান তার অনেক ঊর্ধ্বে। আকস্মিক উৎসাহে আমি এই অভিমত ব্যক্ত করছি না, দীর্ঘ চার বছর প্রতিক্ষণ তাঁর কাজ লক্ষ্য করে এই মন্তব্য (লিপিবদ্ধ) করছি।’

ডাঃ ডিউর্যান্ট লিখছেন, ‘ইনি পুরাতন ও চমৎকার কর্মচারী। চিকিৎসা-শাস্ত্রের ব্যবহারিক দিকটা ভালই আয়ত্ত করেছেন– হাসপাতালে দীর্ঘকাল কাজ করার ফলে তিনি এ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন।’

ডা: জন মেরিডিথ লিখেছেন, ‘ডা: মুক্তীশ্বর ঘোষ সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণার কথা লেখবার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত বোধ করছি। যে-ভাবে তিনি তাঁর কর্তব্যকাজগুলি করেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এই হাসপাতালে তিনি দীর্ঘকাল সরকারী কর্মচারী হিসাবে কাজ করছেন এবং যোগ্য কারণেই সর্বশ্রেণির মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন।

জগন্নাথ পুরীতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক এবং জনগণের উপকারী বন্ধুরূপে পরিচিত ছিলেন। তাঁর পসার ছিল ব্যাপক, কিন্তু রোগী ধনী বা দরিদ্র যাই হোক তিনি কারও কাছ থেকে চিকিৎসক হিসাবে প্রাপ্য তাঁর দক্ষিণা নিতেন না। তিনি ছিলেন সদানন্দ পুরুষ, দুঃখ-দুর্বিপাকের মধ্যেও সর্বদা প্রফুল্ল থাকতেন। বন্ধুদের তিনি বলতেন, ‘আমার টাকা নেই যে দান করব–কাজেই (দরিদ্রকেও ধনীর মত সমানভাবে সকলের সেবা করব’ –অর্থাৎ ‘দক্ষিণা আমি কারও কাছে থেকে নেব না’। এ কারণেই পুরীর মহারাজাগণ তাঁকে ভালবাসতেন, শ্রদ্ধাও করতেন। অতি ধনী থেকে অতি দরিদ্র পর্যন্ত সকলেরই প্রতি তাঁর সহানুভূতি অন্তর থেকে প্রবাহিত হত। তাঁর চিকিৎসায় উপকৃত হয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁকে কোন মূল্যবান উপহার দিতে চাইলে সসম্মানে সবিনয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন–এরূপ দৃষ্টান্ত বহু। তাঁর ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে একজন সিভিল সার্জন তো তাঁকে ফীজ নেবার জন্য জেদাজেদি করতে থাকেন। মুক্তীশ্বরের বিনীত উত্তর, ‘আমি শপথ করেছি কারও কাছ থেকে কোন দক্ষিণা নেব না। পিতা হিসাবে আমি ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বাধ্য, কিন্তু সে বাধ্যবাধকতা আমার জীবিতকাল পর্যন্ত। আমার মৃত্যুর পর তারা ধনী হয়ে যাক, সে আমি চাই না। জগতে একা এসেছি একাই যাব।’

সরকার থেকে মাইনে তিনি সামান্যই পেতেন, তবু অনাহারক্লিষ্ট গরীবদের তিনি খাওয়াতেন; যে সব বাঙালী তীর্থযাত্রী পুরী গিয়ে টাকার অভাবে ফিরতে পারতেন না, ধার করে হলেও তিনি তাঁদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। তার ওপর যে-সব রোগী সরকারী হাসপাতালে থাকতে চাইতেন না, তাঁদের তিনি নিজের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতেন। এইভাবে দান খয়রাৎ করতে করতে অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ঋণমুক্ত হবার জন্য তখন তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক ডাঃ কাম্বারল্যান্ড তাঁকে যে বাংলোটি উপহার দিয়েছিলেন সেই বাংলোটি বিক্রী করতে বাধ্য হলেন; অথচ সরকারী চাকুরে এক ইউরোপীয় ভদ্রলোককে বাংলোটি ভাড়া দিলে তাঁর ভাল মাসিক আয় হত। নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসাবে তিনি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। পুরীর রামচন্ডীর মন্দিরটির তিনি সংস্করণ ও উন্নতি সাধন করেন। যাতে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে মধ্যরাতে এখানে তিনি পুজা-অর্চনা করতেন।

পেনশন নিয়ে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তাঁর পরিবারের সকলে তাঁকে বর্ধমানে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যাতে তাঁদের অবস্থা কিঞ্চিৎ ভাল হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে, তিনি বর্ধমান জেলার কুলীন গ্রামে তাঁর আত্মীয় গোলকচন্দ্র সিংহের বাড়িতে ডিসপেনসারী খোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সহানুভূতিশীল সুচিকিৎসক হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এখানে প্রায় এক বছর তিনি চিকিৎসা ব্যবসা করেছিলেন। কেউ স্বেচ্ছায় তাঁকে ফী দিলে তিনি নিতেন, নিজে থেকে কারও কাছে ফী চাইতেন না। এইজন্য ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেন নি। বন্ধু ও গুণমুগ্ধদের শোকসাগরে ভাসিয়ে ১৮৪৯র ৩ জানুয়ারী তিনি পরলোকগমন করেন।

মুক্তীশ্বর ঘোষ রোগী-পিছু সামান্য কিছু ফী নিলেও, পুরীতে তিনি যে ৩৫ বছর যাবৎ চিকিৎসক ছিলেন তার মধ্যে তিনি নিজের আর্থিক অবস্থা ভাল করে নিতে পারতেন। কিন্তু টাকাপয়সা সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদাসীন, ধনী হবার উচ্চাশাও তাঁর ছিল না। তাই মিঃ উইলন্সিক্টন, মিঃ আনন্দ, মিঃ মানি এবং অন্যান্য অনেকের সঙ্গে পুরীর ম্যাজিস্ট্রেট-কলেকটরগণও তাঁকে ফী নেবার জন্য বারবার অনুরোধ জানালে তিনি সেই একই উত্তর দিতেন–’একাই এসেছি ভবে, একাই তো যেতে হবে।’ এঁরা তাঁকে বেশি রোজগারের কাজ দিতে চাইলেও তিনি নিতে চাইতেন না তাঁর ধারণা ছিল মানবতার সেবায় তিনি নিয়োজিত আছেন, এ কাজ ছেড়ে যাওয়া মানে সে সেবাধর্ম ত্যাগ করা।

তাঁর সমগ্র জীবনটাই ছিল শিক্ষনীয়। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁর যা কিছু গুণ, সে প্রকৃতিগত বা অর্জিত যাই হোক, সবই ঈশ্বরের শক্তি, তাঁর কাছে গচ্ছিত আছে মাত্র। সংসার অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে, অভাবও ছিল, দান ও সেবা করার আকাঙ্ক্ষাও ছিল, তবু তিনি শ্রমের বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিকই নিতেন না; তাঁর বিশ্বাস ছিল তাঁর সকল সাফল্যের মূলে আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। দুঃখের বিষয় মুক্তীশ্বর ঘোষের এই আদর্শ আজ আর অনুসৃত হয় না। এই স্বার্থপর পরিবেশের মধ্যেও তিনি নিঃস্বার্থপরতার আদর্শ অনুসরণ করে গেছেন, সেটিই তাঁর চরিত্রবত্তার উজ্জল দিক। সন্তানদের জন্য টাকা পয়সা রেখে যেতে না পারলেও তিনি তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের আদর্শ তাঁর সন্তানদের জন্য রেখে যান, আর রেখে যান রোগী আর অভাবী মানুষের অজস্র আশীর্বাদ।

মুক্তীশ্বর ঘোষ সংস্কৃত জানতেন; দাবা খেলায়ও তাঁর নাম ছিল। বর্ধমান জেলার বেনাপুর নিবাসী রাধাগোবিন্দ বসুচৌধুরীর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে তিনি বিবাহ করেন। তাঁর পাঁচ পুত্র: লোকনাথ, প্রমথনাথ, চন্ডীচরণ, ত্রৈলোক্যনাথ ও পূর্ণচন্দ্র। এঁদের মধ্যে শুধু জীবিত আছেন লোকনাথ ও চন্ডীচরণ।

লোকনাথ ঘোষের বিবাহ হয় শ্যামপুকুরের কালীচরণ বসুর একমাত্র কন্যার সঙ্গে। কালীচরণবাবু ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তি। শোভাবাজারের রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেব বাহাদুর এবং এই রকম আরও কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন তাঁর বন্ধু। এঁর জ্ঞাতি নয়ন বসু তমলুকের সল্ট এজেন্ট এবং জঙ্গীপুরের কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট মিঃ অ্যানড্যু র‍্যামজের অধীনে চাকরি করে ঐশ্বর্যবান হয়ে ওঠেন। হাটখোলার নিকটবর্তী দর্মাহাটায় তাঁর বিরাট বাসভবন ছিল।

মুক্তীশ্বরের সেজ ছেলে চন্ডীচরণের বিয়ে হয়েছিল জগদ্দল নিবাসী বিখ্যাত সেন পরিবারের গোবিন্দচরণ সেনের একমাত্র কন্যার সঙ্গে।

মুক্তীশ্বর ঘোষের বিধবা পত্নীও বহু সদগুণের অধিকারিণী, আর্ত আতুরের সেবায় তিনি সব সময় তৎপর ছিলেন।

রসিকলাল ঘোষের তৃতীয় পুত্র ভুবনেশ্বর বা কালাচাঁদ দুই পুত্র রেখে মারা যান ৷ এঁদের মধ্যে কনিষ্ঠ বিহারীলাল এখন জীবিত আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *