2 of 2

চোরবাগানের পিরারীচরণ সরকার ও তাঁর পরিবারবর্গ

চোরবাগানের পিরারীচরণ সরকার ও তাঁর পরিবারবর্গ

শিবরাম সরকার থেকে এই বংশের সূত্রপাত। তাঁর পিতার নাম ইন্দ্রনাথরায়ণ সরকার এবং পিতামহের নাম ছিল বিশ্বেশ্বরদাস দাস।

জাতিতে এঁরা কায়স্থ। বিশ্বেশ্বরের জন্ম ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁদের নিবাস ছিল হুগলী জেলার তারা গ্রামে। বিশ্বেশ্বর ছিলেন নবাব সরকারের তহশিলদার। হিসাবে ও জমিদারীর কাজে বিশেষ দক্ষতার জন্য নবাব তাঁকে সরকার পদবী দেন। তখন থেকে পরিবারটির পদবী হয় সরকার। ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে ৭৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তাঁর একমাত্র পুত্র ইন্দ্রনারায়ণকে। ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয় ১৭৬৩ তে; তখন তাঁর বয়স ৬২ বছর। তিনিও রেখে যান একমাত্র পুত্র শিবরামকে।

শিবরামের জন্ম ১৭২২ এ; জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন। তাঁর স্বগ্রাম তারায়। ১৭৯১এ গ্রাম ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন; তখন তাঁর বয়স ৬৯ বছর। চোরবাগানের মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে একখানি বাড়ি কিনে সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু বেশি দিন তিনি বাড়ি ভোগ করতে পারেন নি; এর ছ’ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর দুই পুত্র তারিণীচরণ ও ভৈরবচন্দ্র এবং স্ত্রী ধানমণি দাসীকে রেখে যান। তারিণীচরণ ও ভৈরবচন্দ্রের বয়স তখন যথাক্রমে তেরো ও আট। আঁটপুরের কৃষ্ণমোহন মিত্রে কন্যা ধনমণি শেষ বয়সে তীর্থযাত্রা করেন; বারাণসীতে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৪৮ এ; তখন তাঁর বয়স ১১৫ বছর।

অল্প বয়সে পিতৃহীন হয়ে দুই ভাই, তারিণীচরণ ও ভৈরবচন্দ্র আত্মনির্ভরশীলতার গুরুত্ব বুঝতে পারেন; সহজাত বুদ্ধিবলে ও কঠোর শ্রম করে তাঁরা সামান্য কিছু ইংরেজি শিখে নিয়ে বিখ্যাত থ্যাকার স্পিঙ্ক কোম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রবেশ করেন। সততা ও কর্মদক্ষতার গুণে তাঁরা অল্পকালের মধ্যেই কর্তৃপক্ষের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাঁদের আস্থা অর্জন করেন। প্রতিষ্ঠানটির বেনিয়ান হতে তারিণীচরণের বিলম্ব হল না; তখন দুই ভাই মিলিতভাবে সততা ও পরিশ্রম সহকারে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটির সমৃদ্ধিসাধনে প্রভূত পরিমাণে সহায়ক হয়ে উঠলেন। দাদার সহকারী হওয়া ছাড়াও, ভৈরব বন্দরে আগত জাহাজে খাদ্যদ্রব্যাদি সরবরাহ করে নিজেও পৃথকভাবে উপার্জন করতে থাকেন। দুজনেই ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও দানশীল। ছোট ভাই ভৈরব ছিলেন সরল, সাদাসিধে মানুষ, দাদার চেয়ে তাঁর সাংসারিক আসক্তি কম ছিল। যা কিছু তিনি উপার্জন করতেন, সে সবই ব্যয় হয়ে যেত দান ও ধর্মকর্মে। তাঁর জীবনের একমাত্র কামনা ছিল সাড়ম্বরে হিন্দু পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান ও দরিদ্রনারায়ণকে ভুরিভোজে আপ্যায়ন। তারিণীচরণ মারা যান ১৮৩৯-এ, তখন তাঁর বয়স ৫৫ বছর। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তাঁর স্ত্রী এবং তিন পুত্র; পত্রিকাঁচরণ, প্রেমচাঁদ এবং রাজকিশোর; তাঁর স্ত্রী তারামণি ছিলেন খানাকুলের গোকুল বোসের কন্যা; এঁর মৃত্যু হয় ১৮৬৬ সালে।

ভৈরবচন্দ্রের জন্ম ১৭৮৯-তে এবং বংশের ধারা অপেক্ষা অল্প বয়সে, ১৮৩৮-এ, তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, চার পুত্র ও তিন কন্যা রেখে যান। তাঁর স্ত্রী দ্রবময়ী ছিলেন চোরবাগানের গোকুলচন্দ্র বসুর পৌত্রী এবং ভৈরবচন্দ্র বসুর কন্যা। দ্রবময়ী এখনও জীবিত আছেন; তাঁর বর্তমান বয়স ৮৫ বছর। ভৈরবচন্দ্রের চার পুত্রের নাম পার্বতীচরণ, প্রসন্নকুমার, পিয়ারীচরণ, এবং রামচন্দ্র।

পার্বতীচরণের জন্ম কলকাতায়, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ডেভিড হেয়ারের প্রিয়পাত্র এবং পুরাতন হিন্দু কলেজের বিশিষ্ট ছাত্র ছিলেন। কলেজের পড়া শেষ হলে তাঁকে ঢাকা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। সেখানে গিয়ে তিনি পুরাতনপন্থীদের প্রতিকূলতার মুখে পড়লেন; তাঁরা তাঁদের পুত্রদের ইংরেজি তথা ইংরেজি-কেতার শিক্ষা নিতে দেবেন না; এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শান্তভাবে অগ্রসর হয়ে, তাঁদের ধীরে ধীরে বুঝিয়ে তিনি সেখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন–এই স্কুলটিই ক্রমে বর্তমান ঢাকা কলেজে উন্নীত হয়। এখানে বছর তিনেক শিক্ষকতা করে তিনি স্থানীয় জনগণের প্রভূত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেন। ঢাকা থেকে তাঁকে হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক করে বদলী করা হয়। তাঁর প্রজ্ঞা ও নৈতিক শৃঙ্খলাবোধের দ্বারা অল্পকালের মধ্যে তিনি বিদ্যালয়ে একটি নতুন চেতনার সূচনা করেন; ফলে, অনতিবিলম্বে এই স্কুলটি হয়ে ওঠে বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তনগুলির অন্যতম। পার্বতীচরণ ছিলেন স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, বন্ধুবৎসল এবং সদালাপী। তাঁর বন্ধুও ছিলেন বহু। অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয়, সবচেয়ে আনন্দ পেতেন সেতার-বাদনে।

কর্মব্যস্ত জনহিতৈষী পার্বতীচরণ অকালে, ১৮৪৩ এর ১১ নভেম্বর কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন; তাঁর এই অকালমৃত্যুতে তাঁর বন্ধুগণ, কি ইউরোপীয় কি ভারতীয় সকলেই শোকাভিভূত হন। শিক্ষা-বিভাগের তিনি অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন; শিক্ষাপর্ষদ একটি প্রস্তাবে তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। দর্জিপাড়ার কুলীন কায়স্থ দূর্গাচরণ মিত্রের অন্যতম পৌত্র হরচন্দ্র মিত্রের কন্যার সঙ্গে পার্বতীচরণের বিয়ে হয়েছিল। মৃত্যুকালে পার্বতীচরণ স্ত্রী ও চার পুত্র রেখে যান। পতিপ্রাণা স্ত্রী পতির সঙ্গে পরলোকে মিলিত হবার আশায়, স্বামীর মৃত্যুর মুহূর্ত থেকেই খাদ্য পানীয় ত্যাগ করেন; এই অবস্থায় কোনোপ্রকারে তিন মাস জীবিত থাকার পর ১৮৪৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারী তাঁর মৃত্যু হয়। চার পুত্রের মধ্যে দুজন অল্প বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যেষ্ঠ গোপালচন্দ্র এবং মধ্যম ভুবনমোহন এখনও জীবিত আছেন। যথাস্থানে তাঁদের প্রসঙ্গ আলোচনা করব।

ভৈরবচন্দ্রের মধ্যমপুত্র প্রসন্নকুমারের জন্ম ১৮২১-এ। তিনি কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ১৮৭৭-এ তাঁর মৃত্যু হয়; মৃত্যুকালে তিনি এক পুত্র, উপেন্দ্রচন্দ্র, এবং এক কন্যা রেখে যান। উপেন্দ্রচন্দ্র পোর্ট কমিশনার্সে চাকরি করেন।

ভৈরবচরণের তৃতীয় পুত্র পিয়ারীচরণ সরকারের জন্ম কলকাতায়, ১৮২৩-এর ২৩ জানুয়ারী। ‘ভারতীয় শিক্ষার জনক’ ডেভিড হেয়ারের তত্ত্বাবধানেই তাঁর শিক্ষার শুরু শিক্ষারম্ভ হেয়ার স্কুলে, সেখান থেকে তিনি উন্নীত হন (তখনকার) হিন্দু কলেজে। তাঁর ছাত্রজীবন ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল; এখানকার সর্বোচ্চ পুরস্কার ও বৃত্তি তিনিই অর্জন করেছিলেন– বৃত্তিটি তিনি বেশ কয়েক বছর ভোগ করেন। তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ হয় হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুলের শিক্ষকরূপে। পরে, তাঁকে বারাসাত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হয়। তাঁর পরিচালনার গুণে বারাসাত বিদ্যালয়টি অল্পকালের মধ্যে বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়গুলির অন্যতম হয়ে ওঠে। এখানে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁরই উদ্যোগে এখানে একটি ছাত্রাবাস ও একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সারল্য, অমায়িকতা এবং সদাশয়তার গুণে তিনি শুধু তাঁর ছাত্রদেরই একান্ত আপনজন হয়ে ওঠেন নি, স্থানীয় জনগণেরও অশেষ প্রীতি ও শ্রদ্ধাভাজন হন। বারাসাত থেকে চলে আসার সময় সত্যসত্যই জনগণ তাঁকে চোখের জলে বিদায় জানান। এরপর তাঁকে হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষকরূপে নিয়োগ করা হয়। তাঁর পরিচালনগুণে কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্যালয়টি সর্বশ্রেষ্ঠ সরকারী স্কুলে পরিণত হয়। কয়েক বছর পূর্বে তাঁকে অর্জিত বিপুল জ্ঞানরাশি এখানে পূর্ণরূপে প্রকাশিত হবার ক্ষেত্র লাভ করেছে। ইংরেজি সাহিত্য থেকে দুরূহ জটিল গদ্য বা পদ্যাংশ পড়াবার সময় চিরায়ত সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি ও উদাহরণ দিয়ে, কাহিনী, কিংবদন্তী বলে যেভাবে তিনি ব্যাখ্যা করতেন, সে দেখবার মতো, শোনবার মতো–তিনি যা পড়াতেন, বোঝাতেন, ছাত্রদের মনে তার স্থায়ী ছাপ পড়ে যেত। ছাত্রদের তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, তাঁদের তিনি কখনও দূরে সরিয়ে রাখতেন না–এটাই ছিল তাঁর সাফল্যের প্রধান কারণ। তাঁদের সঙ্গে মেলামেশায় তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ প্রশান্তভাব, অত্যন্ত জেদী বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছাত্রকেও বশীভূত করে ফেলত। গুরুমশায়ের বেত কখনও তাঁর হাতে ওঠেনি তাঁর পড়ানোর আবেদন ছিল ছাত্রদের অন্তরে। তিনি যেমন তাঁর ছাত্রদের ভালবাসতেন, ছাত্ররাও তেমনি তাঁকে ভালবাসত। আজকের উঠতি যুবাদের অনেকেই এর সত্যতা স্বীকার করবেন। বাবু পিয়ারীচরণ কখনও ভাবতেন না যে, ক্লাস ঘরেই তাঁর কর্তব্য শেষ হয়ে গেল–ক্লাস ঘরের বাইরেও তিনি তাদের উন্নতি ও মঙ্গলের জন্য একইভাবে চিন্তা ও চেষ্টা করতেন। আক্ষরিক অর্থে-ই তিনি ছিলেন শিক্ষার শুভঙ্কর। দরিদ্র ছাত্ররা সরকারী বিদ্যালয়ে যেতে পারে না দেখে তিনি চোরবাগানে ‘চোরবাগান প্রিপেরটরী স্কুল’টি স্থাপন ও কয়েক বছর এর নির্বাহ করেন। অভাবগ্রস্ত ছাত্রকে তিনি অর্থ, বস্ত্র ও পুস্তকাদি দিয়ে সাহায্য করতেন। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারেও উৎসাহী ছিলেন; ঐ পল্লীতে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি এখনও বিদ্যমান। তিনি বিধবা বিবাহেরও উৎসাহী সমর্থক ছিলেন; এ-বিষয়ে তিনি তাঁর বন্ধুবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রশংসনীয় কর্মোদ্যোগকে সমর্থন করতেন। এই আন্দোলনের প্রসারের জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে বা পরিশ্রম করতে কুণ্ঠিত হতেন না। দেশীয় সমাজে মদ্যপানজনিত কুফল লক্ষ্য করে তিনি ‘বেঙ্গল টেমপারেন্স সোসাইটি’ স্থাপন করেন। আশানুরূপ সাফল্যের সঙ্গে এই সমিতি কাজ করতে পারে নি, সে কথা সত্য হলেও নব্য যুবকদের ওপর এর প্রভূত প্রভাব পড়েছিল। এই বিষয়েই তিনি ‘ওয়েল উইশার নামে একখানি পত্রিকা প্রশংসনীয় ভাবে কয়েক বছর পরিচালনা করেন। কিছুকালের জন্য তিনি ‘এডুকেশন গেজেট’ সম্পাদনার দায়িত্বেও ছিলেন। স্বভাবতই তিনি ছিলেন দানশীল, দরিদ্রের বন্ধু, অথচ বণিকদের মতো ধনাঢ্য মানুষ তিনি ছিলেন না; ১৮৬৬- এর দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য অন্নবস্ত্রের সংস্থান করবার উদ্দেশ্যে সবিশেষ কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠেন।

শিক্ষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে বাবু পিয়ারীচরণ যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার জন্য তিনি অবশ্যই স্মরণীয়, তবে জনগণের মনে তিনি ভালবাসার স্থান অধিকার করে আছেন তাঁর উজ্জল নৈতিক গুণাবলীর জন্য। তাঁর মধ্যে কোন কপটতা ছিল না। বিনয়ী, বিবেকী, সৎ এই মানুষটি কারও ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইতেন না। দানশীল হলেও তার কোন প্রচার ছিল না, বাহ্য প্রকাশও ছিল না। ইংরেজি শিক্ষার তিনি ছিলেন চরমোৎকৃষ্ট নিদর্শন; যাঁরা সরকার পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা-ব্যবস্থার পক্ষপাতী, তাঁরা এই আদর্শ বাঙালী ভদ্রলোকের জীবনী অনুধাবন করলে ভাল করবেন। ৪ অক্টোবর, ১৮৭৫-এর হিন্দু পেট্রিয়টের মতে, তাঁর মৃত্যুতে পারিবারিক ক্ষেত্রে, বন্ধুমহলে এবং দেশের বৃহত্তর সামাজিক ক্ষেত্রে যে স্থান শূন্য হল তা সহজে পূর্ণ হবে না। হাটখোলার মাণিকরাম বসুর পৌত্র শিবানারায়ণ বসুর চতুর্থ কন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। আমৃত্যু তিনি ছিলেন মাতৃভক্ত। হিন্দু পেট্রিয়টের মতে, তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ ভারতীয় শিক্ষক এবং প্রাচ্যের আর্নল্ড।

দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি কঠিন বহুমূত্র রোগে ভুগছিলেন; এই রোগেই ১৮৭৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে বারোটায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ামাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ টনির নির্দেশে প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু স্কুল ও হেয়ার স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। মিঃ টনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রগণ এই শিক্ষাব্রতীর স্মৃতিরক্ষার্থে চাঁদা তুলতে আরম্ভ করেন; এই কলেজের ছাত্রগণ বাইরের দেশীয় জনগণের মতো, তাঁর মৃত্যুতে স্বজনবিয়োগের শোক অনুভব করেন।

পিয়ারীচরণ রেখে যান পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা। জ্যেষ্ঠ যোগেন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে ইংল্যান্ড যান, সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরেন; মধ্যম নগেন্দ্রনাথ বি এ পাস করে বর্তমান মেদিনীপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরূপে কর্মে নিযুক্ত আছেন।

ভৈরবচন্দ্রের চতুর্থ পুত্র রামচন্দ্র অল্প বয়সে মারা যান, তাঁর জন্ম ১৮২৭-এ এবং মৃত্যু হয় ১৮৫৬তে — তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ বছর। তাঁর দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ। এঁরা দুজনেই এম এ বি এল পাস করে ওকালতি করছেন। সুরেন্দ্রনাথ স্মল জজ কোর্টের উকিল।

পার্বতীচরণের দুই পুত্র গোপালচন্দ্র এবং ভুবনমোহন পিতৃহারা হবার পর স্নেহময় ও শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য পিয়ারীচরণ হলেন তাঁদের অভিভাবক; তিনি তাঁদের নিজের ছেলের মতই স্নেহ করতেন। বারাসাত নিয়ে গিয়ে তিনি তাঁদের নিজ তত্ত্বাবধানে লালন-পালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন।

বাবু গোপালচন্দ্রের জন্ম হয় ঢাকায় ১৮৩৬-এর মে মাসে। প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষা শেষ করে তিনি ওকালতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও ভাগলপুরে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। বিশেষ দক্ষতা ও চারিত্রিক সততার গুণে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর পসার জমে ওঠে; আর সেই সঙ্গে তিনি স্থানীয় জনগণের শ্রদ্ধাভক্তিও অর্জন করেন। ভাগলপুর উকিলমহলেও তিনি সম্মানিত; ফৌজদারী মামলায় তাঁর স্থান প্রথম। তাঁর কর্মদক্ষতা ও আদর্শনিষ্ঠার জন্য সরকারিমহলও তাঁকে সম্মান করে। এখন তিনি সেখানকার অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং স্থানীয় প্রায় সকল কমিটিরই সদস্য।

বাবু ভুবনমোহন সরকারের জন্ম কলকাতায় ১৮৩৮-এর ৪ জানুয়ারি। বাবু পিয়ারীচরণ স্বয়ং তাঁকে যত্ন সহকারে পড়াতেন; তাঁরই পরিচালনায় ভুবনমোহন প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষালাভ করেন; ১৮৫৬তে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র-রূপে ভর্তি হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিনে লাইসেনসিয়েট হন। তাঁর সর্বপ্রকারের সংযম, নগর বৈদগ্ধ্য আর রোগীদের প্রতি সহানুভূতির জন্য অল্পকালের মধ্যেই তিনি শহরের প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকদের অন্যতম হয়ে উঠেছেন। বাবু পিয়ারীচরণের মৃত্যুর পর বাবু ভুবনমোহন বেঙ্গল টেম্পারেন্স সোসাইটির সম্পাদক হয়েছেন। চোরবাগানে স্বগৃহে তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন, তারও তিনি সম্পাদক। তিনি অন্যতম মিউনিসিপ্যাল কমিশনার এবং ডিসট্রিকট চ্যারিটেব্ল সোসাইটিতে নেটিভ কমিটির সদস্য।মহামান্যা মহারাণী ‘ভারত সম্রাজ্ঞী’ উপাধি ধারণ উপলক্ষে ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত দরবারে তাঁকে সার্টিফিকেট অব অনার দেওয়া হয় ৷

উচ্চ নৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বাবু ভুবনমোহন সরকার স্বভাবতই দানশীল মানুষ; সর্বদাই তিনি দরিদ্রদের শুধু বিনা পারিশ্রমিককে চিকিৎসাই করেন না, প্রয়োজনে অর্থও দান করেন। তাঁর ভদ্র মার্জিত আচার আচরণের জন্য তাঁর বন্ধুর সংখ্যাও বহু– এঁরা সকলেই তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *