2 of 2

রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাহাদুর এল এল ডি, সি আই ই (শুরাহ্ রাজপরিবার)

রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাহাদুর এল এল ডি, সি আই ই (শুরাহ্ রাজপরিবার)

[১৮৭৮-এর ৩ ডিসেম্বর তারিখে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেওয়া হল।]

আজ থেকে প্রায় ন’শো বছর আগে কনৌজ থেকে বাঙলায় আদিশূর কর্তৃক আনীত মুখী কুলীন কালিদাস মিত্র থেকে উদ্ভুত বংশে ডা: রাজেন্দ্রলাল মিত্র জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চবংশীয়দের স্বাভাবিক বা অর্জিত গুণ থাকলে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ অবশ্যম্ভাবী হয় এ বংশটির ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। কালিদাস মিত্রের অধস্তন চতুর্দশতম পুরুষ সভ্যভাম মিত্র ২৪ পরগণার বরষেতে বাস করতেন– তাই থেকে পরিবারটি বরষের মিত্র পরিবার নামে অভিহিত হয়ে থাকে। পরিবারটির একটি শাখা হুগলী জেলার ‘ক্যান্নাঘরে’ বসবাস করবার জন্য চলে যায়, ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের জন্ম, তাঁর মতে, এই বংশে। কালক্রমে পরিবারটি ‘ক্যান্নাঘর’ থেকে কলকাতা (উপনিবেশে)-র মধ্যে অবস্থিত গোবিন্দুপুরে, সেখান থেকে ‘মছুয়াবাজার’ এবং শেষ পর্যন্ত কলকাতার উপকণ্ঠ শুরাহতে বসবাস করতে থাকেন। সম্মানিত বংশ হিসাবে পরিচিত হলেও, সত্যভামের পৌত্র রামরাম মিত্রের পূর্বে এঁরা সম্ভ্রান্ত বংশরূপে পরিচিত হতে পারেন নি। রামরাম মিত্র ছিলেন মুর্শিদাবাদে নবাবের দেওয়ান। রামরামের পুত্র অযোধ্যারাম রায় বাহাদুর খেতাব লাভ করেন। বংশের মর্যাদা শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায় অযোধ্যারামের পৌত্র পীতাম্বরের সময়ে। পীতাম্বর দিল্লীর বাদশাহী দরবারে অযোধ্যার নবাবের ভকীল ছিলেন; পরে তিনি বাদশাহী সরকারে উচ্চ পদ লাভ করেন। বাদশাহ তাঁকে রাজা বাহাদুর ও ‘তীন হাজারী মন্‌সর্’ খেতাবে ভূষিত করেন। শেষোক্ত পদবীটি সেকালে নাইট পদবীর সমতুল্য এবং শাহজাদাদের পরবর্তী মর্যাদা ছিল, শাহজাদারা হতেন ‘দস হাজারী মন্‌সর’। পীতাম্বর মিত্র যাতে রাজা বাহাদুর খেতাবের মর্যাদা রক্ষা করে চলার মতো আর্থিক সঙ্গতি লাভ করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে তাঁকে দোয়াবের অন্তর্গত কোরাহ্ জেলা জাগীর হিসাবে দেওয়া হয়। বাদশাহ তাঁকে এত নেকনজরে দেখতেন এবং দরবারে তাঁর এত প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল যে, বাদশাহ তাঁকে রাজা বাহাদুর খেতাব দেবার সময় তাঁর দুই ভাইকেও রায় বাহাদুর খেতাব দান করেন। বেনারসে চৈং সিংহের বিদ্রোহ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঐ কেন্দ্রে জনগণের আন্দোলন দমনের জন্য ১৭৮৪তে ওয়ারেন হেসটিংস কর্তৃক প্রেরিত সেনাপতি পামার যখন ‘রাম নগর’ দুর্গ অধিকার করেন, রাজা পীতাম্বর মিত্র বাহাদুর তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনার কিছু পরে, ১৭৮৭ বা ১৭৮৮-তে রাজা কলকাতা ফিরে আসেন এবং তার দু’তিন বছর পর বিষয়কর্ম ত্যাগ করে পুরোপুরি বৈষ্ণব হয়ে যান। তিনি মারা যান ১৮০৬-এ। মৃত্যুকালে রেখে যান তাঁর একমাত্র পুত্র বৃন্দাবনচন্দ্র মিত্রকে; বৃন্দাবনচন্দ্ৰ পিতার খেতাব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। বাদশাহের চাকরি ত্যাগ করার সময় রাজা পীতাম্বর মিত্র বাহাদুর আউধের নবাব সুজাউদদৌলার বিরুদ্ধে ন’লাখ টাকার দাবী পেশ করেন, এবং নগদে ঐ অর্থ আদায় করেন; এই অর্থই তাঁর শেষ উপার্জন। কোরাহ্ জাগীর থেকে তিনি বার্ষিক সোয়া দু’লাখ টাকা খাজনা পেতেন–মারাঠা যুদ্ধের সময় তিনি এই জাগীর ছাড়তে বাধ্য হন, কিন্তু ছ’মাসের বেশি চাকরি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

‘রামনগর’ দুর্গ লুণ্ঠনের সময় রাজা পীতাম্বর মিত্র হস্তগত করেছিলেন বহু দুর্লভসংস্কৃত পুঁথি। সেই সব পুথির একটা অংশ এখন এই পরিবারের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ। এই নিবন্ধের নায়কের পিতা ‘জনমেজয়’ মিত্র ছিলেন বৃন্দাবন মিত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং বংশের প্রতিষ্ঠাতা কালিদাস মিত্রর চতুর্বিংশতম পুরুষ। তাঁর (রাজেন্দ্রলালের) পিতাসহ বা পিতা সরকারী চাকরি করেন নি, তবে তাঁর পিতা ছিলেন সংস্কৃতিবান মানুষ–তিনি সংস্কৃত ও ফার্সী সাহিত্য চর্চা করে সময় কাটাতেন। তাঁর অপ্রকাশিত রচনা সমূহের মধ্যে আছে বহু সংস্কৃত শ্লোক ও ফার্সী গজল, আর তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে বাংলা স্তোত্র সংগ্রহ, উচ্চভাব সমন্বিত ফার্সী সংগ্রহ, অষ্টাদশ পুরাণের টাকা এবং ভাগবদ্‌গীতার বর্ণানুক্রমিক নির্ঘন্ট। ডা: শৌলব্রেড নামক জনৈক ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর কাছে তিনি রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন–এক্ষেত্রে বাঙালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্থানের অধিকারী। রাজেন্দ্রলাল উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সাহিত্য রুচি পেয়েছিলেন, তাঁর পিতা সে গুণের অধিকারী ছিলেন না। প্রকৃতিদত্ত প্রতিভাকে রাজেন্দ্রলাল সীমাবদ্ধ সুযোগ সুবিধার মধ্যেও কঠোর পরিশ্রমের সাহায্যে পরিপুষ্ট করে তুলেছিলেন।

পূর্বেই বলেছি, রাজা পীতাম্বর মিত্র পুরোপুরি বৈষ্ণব হয়ে যান; বৈষ্ণব হবার পর তিনি ‘মছুয়া বাজারের’ বাসভবন ছেড়ে পরিবারবর্গ নিয়ে সাধন ভজনের সুবিধার জন্য ‘শুরাহ-’র বাগান বাড়িতে বাস করতে চলে যান। এই বাসভবনে ১৮২৪-এর ১৫ ফেব্রুয়ারী ডা: রাজেন্দ্রলাল মিত্রের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের অল্পকাল পরে, তাঁর অমিতব্যয়ী পিতামহ ‘মছুয়া বাজারের’ বসতবাটা বিক্রি করে দেন। অবশ্য বৃন্দাবনের সপক্ষে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ব্যক্তিগত বিলাস ব্যসনে তিনি অমিতব্যয়ী হয়ে সংসারকে দারিদ্র্যের মধ্যে টেনে আনেন নি; তিনি অতি সহজে অভাবগ্রস্ত বন্ধুবান্ধব বা সাহায্যপ্রার্থীদের বিশ্বাস করতেন এবং বিশ্বাস করে প্রবঞ্চিত হতেন। জোড়াসাঁকোর স্যান্ডেল পরিবার এককালে ধনী ছিল, এই বংশের মধুসুদন সান্ডেলের মা জনৈক অকিঞ্চিৎকর সরকারের বেনামীতে নাবালক পুত্রদের মঙ্গলের জন্য সুপ্রীম কোর্টের রিসিভারের কাছে থেকে একটি জমিদারী ইজারা নেন। বৃন্দাবন ছ’ বছর যাবৎ বার্ষিক তিন রাখ টাকা দেবার শর্তে এঁদের জামিন দাঁড়ালেন। মধুসুদনের মা টাকা দিতে না পারায়, শর্ত অনুযায়ী বৃন্দাবন ‘মছুয়া বাজারের’ ভদ্রাসন বিক্রি করে জামিনের টাকা দিয়ে দিলেন। আর একটি ক্ষেত্রে, রমজানী ওস্তাগর আর্মি ক্লোদিং ডিপার্টমেন্ট থেকে এক লাখ টাকার একটি ঠিকা নিলেন ওস্তাগর চুক্তির শর্ত পূরণে অক্ষম হলে বা ব্যর্থ হলে ঐ পরিমাণ অর্থ মিটিয়ে দেবার শর্তে বৃন্দাবন তার জামিন দাঁড়ালেন। টিকা অনুযায়ী কাজ হল না–ফলে বৃন্দাবনের লোকসান হল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। এই দুটি লোকসানের ফলে, পরিবারটির সম্পদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়।

(রাজেন্দ্রলালের পিতা) ‘জনমেজয়’ মৃত্যুকালে রেখে যান ছয় পুত্র ও এক কন্যা, এঁরা সকলেই জীবিত। [জনমেজয়ের ছয় পুত্র হলেন : গোপাললাল, ব্রিজেন্দ্রলাল, রাজেন্দ্রলাল, উপেন্দ্রলাল, দেবেন্দ্রলাল ও ভন্দ্রেলাল।]

রাজেন্দ্রলাল পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। যথারীতি গৃহদেবতার পূজাপাঠসহ তাঁর হাতে খড়ি অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় এবং হাতেখড়ির পর শুরু হয় ফার্সী বর্ণমালা শিক্ষা। এরপর তিনি রাজা বৈদ্যনাথ রায়ের পারিবারিক (পাঠশালার) গুরু-মশায়ের কাছে বাংলা ভাষা। শেখেন তিন বছর ফার্সী ও বাংলা শেখার পর পাথুরিয়াঘাটায় ‘খেম’ বোসের স্কুলে, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা শুরু করেন উল্লেখ্য ‘এখন’ যেমন পটলডাঙ্গা, তখন পাথুরিয়াঘাটা তেমনি ছিল এদেশীয়দের শিক্ষার কেন্দ্ৰ স্থল। বাল্যকালে থাকতেনও তিনি পাথুলিয়াঘাটাতে তাঁর নিঃসন্তান পিসিমার কাছে। এরপর তিনি ভর্তি হন গোবিন্দ বসাকের বিদ্যালয়ে। পনের বছর বয়স থেকে তিনি পুরো এক বছর, ১৮৩৮-এর অক্টোবর থেকে ১৮৩৯-এর অক্টোবর পর্যন্ত হাঁপানী, জ্বর আর প্লীহা বৃদ্ধিতে ভুগতে থাকেন; বিরুক্ত হয়ে তিনি স্থির করলেন নিজে ডাক্তারী পড়ে চিকিৎসক হবেন; সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮৩৯ এর নভেম্বর মাসে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষা একই সঙ্গে চলতে থাকল; তার সঙ্গে চলল গৃহে মিঃ ক্যামেরনের কাছে উচ্চ শিক্ষা। স্কুলে যেমন কলেজেও তেমনি তিনি পুরস্কারের পর পুরস্কার পেতে থাকেন। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁকে সঙ্গে করে ইংল্যান্ড নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা দেবার প্রস্তাব করেন। যুবক রাজেন্দ্রলাল সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান; কিন্তু কথাটা তাঁর বাপের কানে যেতেই তিনি দ্বারকানাথের প্রস্তাব শুধু নাকচ করলেন না, পুত্রের মেডিক্যাল কলেজে পড়াও বন্ধ করে দিলেন। রাজেন্দ্রলাল তখন আইন পড়তে লাগলেন, প্রতিভার পক্ষে যা স্বাভাবিক– অতি দ্রুত তিনি আইন শাস্ত্রের ও পেশার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় অধিগত করে একটি পরীক্ষায় বসলেন, এবং সফলও হলেন এখন তিনি সদর আদালতের উকীল বা মুনসেফ হবার যোগ্যতা অর্জন করলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এবং সাহিত্য জগতের সৌভাগ্য, এই পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের সব উত্তরপত্র চুরি হয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তাঁর ছিল, সেও শেষ হয়ে গেল। জীবনে একটা পেশা গ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে এত পরিশ্রম এতখানি অধ্যরসায় নিয়ে যে বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন, তিতিবিরক্ত হয়ে এখন তার সঙ্গে সব সংশ্রব ত্যাগ করলেন। যে দুটি বৃত্তির যে-কোন একটি অবলম্বন করে যুবা বয়সে মানুষ যশ ও অর্থ অর্জনের স্বপ্ন দেখে, সেই দুটি বৃত্তির দ্বার তাঁর সামনে রুদ্ধ হয়ে গেল। এসব দেখে মনে হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর যে বিপুল দান, সে পথে তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য ভাগ্য অঁকে শিক্ষিত জনের অর্থকরী পেশায় যেতে দেননি। বাইরের শিক্ষার ক্ষেত্র ছেড়ে এবার তিনি স্বাধীনভাবে জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশ করলেন; গভীর ও ব্যাপকভাবে তিনি অধ্যয়ন করতে লাগলেন সংস্কৃত, ফার্সী, হিন্দী এবং উর্দু ভাষা ও সাহিতসমূহ আর বাইরে নয়, এখন সাধনা চলল স্বগৃহে। ১৮৪৬ এর নভেম্বর মাসে, ভেইশ বছর বয়সে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির অফিস সেক্রেটারী ও লাইব্রেরিয়ান পদে নিযুক্ত হলেন, এই পদে এর আগে অধিষ্ঠিত ছিলেন মহান হাঙ্গেরীয় প্রাচ্যতত্ত্ববিদ সোমা দ্যা কোরাস চোমা ডি কোরর্?] জ্ঞান তপস্বী এই মানুষটি আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের গবেষণায় এই ভারতেই আত্মোৎসর্গ করেন। অর্থ মূল্যের দিক থেকে পদটি আদৌ লোভনীয় ছিল না; কিন্তু ডা: রাজেন্দ্রলালের কাছে এর অন্য মূল্য ছিল অপরিসীম, স্বগৃহে তিনি যে রুচি নিয়ে তাঁর জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে চাইছিলেন, তারই পরিপুষ্টি সাধনের জন্য জ্ঞান রাজ্যের অমূল্য সম্পদসমূহ সোসাইটির গ্রন্থাগারে অবাধে ব্যবহারের তিনি সুযোগ পেয়ে গেলেন। এই পদে তিনি দশ বছর চাকরি করেন– এই সময়ের মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটির রত্নরাজী ব্যবহার করে তিনি তাঁর বহু ব্যান্ড বিপুল জ্ঞানরাশিকে যে অনেক সমৃদ্ধ করেছিলেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ১৮৫৬র মার্চ মাসে তিনি কলকাতাহিত গভর্নমেন্ট ওয়ান্ডসের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হন।

মেডিক্যাল কলেজে পড়বার সময়, সতের বছর বয়সে তাঁর প্রথমবার বিবাহ হয়। একটি কন্যা সন্তান রেখে এই স্ত্রী মারা যান; কন্যাটিও তার দু’মাস পরে মারা যায়; তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ছত্রিশ বছর বয়সে। এই বিবাহের ফলে তাঁর দুটি পুত্রের জন্ম হয়; এঁরা জীবিত আছেন।

বহু-ভাষাবিদ ডা: রাজেন্দ্রলাল সম্পর্কে এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, বাল্যকাল থেকেই তিনি বাংলা, সংস্কৃত, উর্দু, হিন্দী, ফার্সী ও ইংরেজি ভাষাসমূহ শিখছিলেন, মেডিক্যাল কলেজে পড়বার সময় দেখলেন, ন্যাচিন ও গ্রীক ভাষা দুটি না শিখলে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎসে পৌঁছতে পারবেন না; ঐ সময় তিনি এই ভাষা দুটি শিখে নিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির অফিস সেক্রেটারী পদে কাজ করার সময় তিনি কাজ চালাবার মতো ফরাসী ভাষা এবং কিঞ্চিৎ জার্মান ভাষা শেখেন।

উল্লেখ্য, তিনি লিখতে আরম্ভ করেন এশিয়াটিক সোসাইটিতে চাকরি নেবার পর; প্রথম লেখেন সোসাইটির জার্নালের জন্য ১৮৪৭-এর কোন এক সময়। ১৮৫১ তে (?) তিনি তাঁর বাংলা সাময়িক পত্র বিবিধার্থ সংগ্রহ’ প্রকাশ করতে থাকেন; [ এর সাতটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। [১৮৫৬ তে এর প্রকাশ বন্ধ করে। সমগোত্রীয় সাময়িক পত্ৰ “রহস্য সন্দর্ভ’ প্রকাশ করেন [১৮৫৮ ভে], সন্দত প্রকাশিত হয় পাঁচ বছর। [এর ছ’টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়]। বলা প্রয়োজন যে, ‘সংগ্রহ’, ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য বিষয়ক সচিত্র বাংলা সাময়িক পত্র, উচ্চতম কোচির এই সাময়িক পত্রটির সমকক্ষ আর কোন পত্র আজ (১৮৮১) পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নি। বিবিধার্থ সংগ্রহ-এর পর তিনি ১৮৪৯-এ প্রকাশ করেন সংস্কৃত কামন্দকী ও নীতিসারের একটি সংরক্ষণ। ঐ বছরই তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ামের একটি ক্যাটালগ প্রকাশ করেন। তাঁর রচনা

একটি তালিকা বর্তমান নিবন্ধের শেষে সংযোজিত হন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা বহু, বলা বাহুল্য তাঁর হিস্ট্রি অব দি অ্যানটিকুইটিজ অব উড়িষ্যা’ গ্রন্থখানিই আজ পর্যন্ত লিখিত গ্রন্থগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ভবিষ্যতে যদি এর থেকে উন্নততর কোন গ্রন্থ তিনি রচনা করেন তো সে আলাদা কথা, সে যাই হোক, ইংরেজি ভাষায় এমন দখল নিয়ে গ্রন্থ রচনার দিক থেকে তিনিই প্রথম স্থানের অধিকারী থাকবেন। শুধু তাই নয়, তাঁর বিস্তৃত ও ধৈর্য্যপূর্ণ গবেষণা, গভীর ও ব্যাপক পান্ডিত্য এবং ভুলনীয় দৃষ্টান্ত থেকে নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিক থেকে গ্রন্থখানিকে তাঁর কীর্তি বলা যায়। তাছাড়া এই গ্রন্থ প্রমাণ করে যে, আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা দ্বারা জ্ঞান ও পবেষণার যে স্তরে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দেবার বৃথা চেষ্টা করছে, এদেশীয় যুবকদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিভা থাকলে এবং সে প্রতিভাকে প্রশ্ন ও সাবধানতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারলে, (স্কুল কলেজের বাইরে স্বীয় চেষ্টায়) যুবকদের পক্ষে পৌঁছান সম্ভব। ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সক্রিয় মনন শুধুমাত্র সাহিত্য ও বিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে ব্যাপৃত থাকে নি; জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়েও তাঁর সদাপ্রস্তুত লেখনী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, এত বছর ধরে, প্রবন্ধ লিখে চলেছে। পুরাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কিত তাঁর প্রবন্ধাদি দেশ বিদেশের বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে; গুরুত্বের দিক থেকে এগুলি তাঁর বড় বড় গ্রন্থগুলি অপেক্ষা কোন অংশেই উপেক্ষনীয় নয়। তাঁর বড় বড় গ্রন্থগুলি তাঁকে যে সাহিত্যিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, এই প্রবন্ধগুলির দ্বারা সে খ্যাতি আরও প্রতিষ্ঠিত ও পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। এখানে আমাদের একটা ধারণার কথা বললে আশা করি পাঠকবর্গ আমাদের ক্ষমা করবেন। বর্তমানে তিনি ‘বুদ্ধগয়ার বিষয় একখানি গ্রন্থ রচনার ব্যাপৃত আছেন আমাদের ধারণা, এটি তাঁর উড়িষ্যা সংক্রান্ত গবেষণা গ্রন্থ অপেক্ষা অধিক শূন্যবান যদি না-ও হয় তার সমকক্ষ হবে এবং এর দ্বারা ব্যাতি যদি বৃদ্ধি না-ও পায় ক্ষুণ্ণ যে হবে না এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত।

এই নিবন্ধে নায়কের আর একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না করলে, তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। জনস্বার্থ বিষয়ক কোন প্রশ্নে যুক্ত হতে হলে তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। যে সরকারের অধীনে তিনি চাকরি করছেন তারও কোন নীতির প্রতি ভৎর্সনা জানাতে হলে বিস্ময়কর স্বাধীনচিত্ততার সঙ্গেই তিনি তা করেন। রাজনৈতিক সভা সমাবেশে তিনি সাধারণত অংশ নেন না কিন্তু আমাদের এই মেট্রোপলিটন মিউনিসিপ্যালিটির সম্পর্কে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থাকলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশ নেন, এই সংস্থার দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসনের মুখোশ তিনি নির্ভীকভাবে খুলে দেন; কাজকর্মে এই সংস্থার অনিয়মিত সীমাহীন দুর্নীতির ফলে নাগরিকদের ওপর ট্যাক্সের অসহনীয় যে বোঝা দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত চাপিয়ে চা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে ডা: রাজেন্দ্রলালের প্রভাব বার বার সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জনসভায় তাঁর বক্তৃতা তাঁর বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরাও একান্ত মনোযোগ ও ব্রহ্মার সঙ্গে শোনেন, তার কারণ তাঁর বাসীতা, যুক্তিসিদ্ধ উক্তি এবং ইংরেজি ভাষার ওপর পরিপূর্ণ দখল।

ইউরোপ ও আমেরিকার বিদগ্ধজনেরা তাঁকে সম্মান জানিয়ে নিজেদেরও সম্মানিত করেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করলে আশা করি পাঠকগণ অণুশী হবেন না। প্রাচ্যতত্ত্বের যে সব শাখায় ডাঃ মিত্র বিশেষজ্ঞরূপে পরিচিত সেসব বিষয় তাঁরা চিঠিপত্র মারফৎ তাঁর মতামত জানতে চান; এঁদের মধ্যে আছেন : ডা: ম্যাক্সমুলার, স্বর্গীয় এম পার সাঁ দ্য ভাসি, অধ্যাপক ফূক (ফরেস্ট অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত) অধ্যাপক কুন বার্লিনের অধ্যাপক মায়ের ডিলার ও অধ্যাপক ওয়েবার, সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রাক্তন এবং বর্তমানে জেনার অধ্যাপক বোহৎলিংক, খ্রীস্টিয়ানার অধ্যাপক হোলম্ রোয়ে, কোপেনহ্যাগেনের পরলোকগত অধ্যাপক রুফ, ক্লোরেনসের অধ্যাপক ‘দা গুবারনাতিম, স্ট্রাসবুর্গের অধ্যাপক গোল্ডস্মিট, এডিনবার্গের অধ্যাপক হারমান একহুল, এডিনবার্গের অধ্যাপক কাওয়েল, প্রিসেপস এসেজ পত্রিকার সম্পাদক ও মুদ্রাতত্ত্ববিদ মিঃ এডওয়ার্ড টমাস, নিউ ইয়র্কের অধ্যাপক হুইটনি, স্যান্ডহার্ট স্টাফ কলেজের মি ড’ সন, বনের অধ্যাপক অ’য়েরৎ, কলকাতা মাদ্রাসার প্রাক্তন ও বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের শিক্ষক ডাঃ স্প্রেংগার, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ডাঃ রমট পূর্বে নেপালের এবং বর্তমানে ইংল্যান্ড অবস্থানকারী মিঃ ব্রায়ান হজসন, বোম্বাই—এর ডাঃ রুহলার, পুনরা ডাঃ কিয়েলস্থর্ণ এবং ম্যাঙ্গালোরের ডাঃ বর্নেল। ইচ্ছে করলে এই তালিকা আরও অনেক বাড়ানো যায়; কিন্তু যে তালিকা দেওয়া হল, থেকে এ কথা পরিষ্কার হবে যে, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব ও প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানকে বৈদেশিক পন্ডিতগণ কতখানি মর্যাদা দেন।

তাঁর বিপুল পান্ডিত্যের প্রতি সম্মান জানাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালায় তাঁকে সাম্মানিক এল এল ডি ডিগ্রী প্রদান করেছে। দিল্লীর সাম্রাজ্যিক সমাবেশে লর্ড লিটন তাঁকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেন এবং ১৮৭৮ এর একটি ঘোষণা দ্বারা তাঁকে নবসৃষ্ট কমপ্যানিয়ন অব দি অর্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এমপায়ার খেতাব দান করা হয়।

ডাঃ মিত্র এশিয়াটিক সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, ১৮৬৫-র ডিসেম্বর থেকে হাঙ্গেরীয় পত্রিকা দি সানডে নিউজ অব বুদাপেস্ত যথোপযুক্তভাবেই তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন “ইউরোপীয় বিজ্ঞান সমূহের গর্ব’, তাছাড়া তিনি গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য; জার্মান ও মার্কিন ওরিয়েন্টাল সোসাইটিদ্বয়ের পত্রাচারী সদস্য; ভিয়েনার ইম্পিরিয়াল অ্যাকাডেমির সাম্মানিক সদস্য, কোপে হ্যাঁগেনের সোসাইটি অব নর্দান অ্যান্টিকুইটিজের ফেলো এবং বার্লিনের অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সোসাইটির পত্রাচারী সদস্য। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, কিছু কাল আগে ফরাসী রিপাবলিক তাঁকে ফরাসী পাবলিক ইনসট্রাকশন দপ্তরের পামলীফ ও ডিপ্লোমা প্রেরণ করেছে।

ডাঃ মিত্রের স্বাস্থ্য দুর্বল, তবু আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা তিনি দীর্ঘজীবী হোন; যাতে কারও সাহায্য না নিয়ে স্বীয় সহজাত প্রতিভা ও পরিশ্রম দ্বারা তিনি যে সম্মানসমূহ অর্জন করেছেন নূতন নূতন সম্মান দ্বারা অর্জিত সম্মান আরও বৃদ্ধি পায়।

রাজেন্দ্রলাল মিত্রের প্রকাশিত গ্রন্থাদির তালিকা :

ইংরেজি

১। অ্যানাটিকুইটিজ অব উড়িষ্যা, ভল্যুম ১,১৮৭৫

২। সামবেদের অন্তর্গত ছন্দোগ্য উপনিষদের অনুবাদ ৮ভো, ১৮৬২

৩। নোটিসেস অব ম্যাসকট ম্যানুসকপটস

৪ ভল্যুম, রয়্যাল ৮ভো, ১৮৭১–১৮৭৮

৪। ডেসকূপটিভ ক্যাটালগ অব কিউরিওসিটিস ইন দি এশিয়াটিক সোসাইটিজ মিউজিয়াম, ১৮৪৯

৫। ক্যাটালগ অব দি এশিয়াটিক সোসাইটিজ লাইব্রেরি ৮ভো, ১৮৫৪

৬। ইনডেক্স টু ভল্যম্স I টু XXIV অব দি জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি, ৮ভো ১৮৫৬

৭। ডেসকূপটিভ ক্যাটালগ অফ স্যাঁসকট গ্রামারস, ১৮৭৭

৮। বুদ্ধগয়া দি হার্মিটেস অব শাক্যমুনি টো, ১৮৭৮

৯। এ স্কীম অব দি রেডারিং অব ইউরোপীয়ান সায়েনটিফিক টার্মস ইন টু ভার্নাক্যুলার্স অব ইন্ডিয়া ৮ভো ১৮৭৭

এছাড়া, জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি, ট্রানজ্যাকশনস্ অব দি অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সোসাইটি, ক্যালকাটা রিভিউ, মুখার্জি’জ ম্যাগাজিন, জার্নাল অব দি ফোটোগ্রাফিক্যাল সোসাইটি এবং অন্যান্য পত্র পত্রিকায় তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ ও আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে।

ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ ও ফিনিক্স পত্রিকায় পত্র ও আলোচনা সহ সিটিজেন, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু পেটরিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও স্টেটসম্যান পত্রিকার জন্য তাঁর লেখা সম্পাদকীয়ের সংখ্যা এক হাজারের অপেক্ষা কম নয়।

সংস্কৃত

১। যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, ভো, ১৮৫৪-১৮৬৯

২। ঐ আরণ্যক, ঐ, ১৮৭২

৩। ঐ প্রতি সাখ্য, ঐ, ১৮৭২

৪। অথর্ব বেদের গোপথ ব্রাহ্মণ, ঐ, ১৮৭২

৫। কামন্দকীয় নীতি, ঐ, ১৮৪৯

৬। চৈতন্য চন্দোদয় নাটক, ঐ, ১৮৫৪

৭। ললিত বিস্তার, ৮ ভো, ১৮৫৪-১৮৭৭ ছয় অংশে ক্রমশ প্রকাশিত

৮। অগ্নি পুরাণ, ৮ ভো, ১৮৭৩-১৮৭৮

৯। ঐতরেয়ারণ্যক, ১৮৭৬

বাংলা

১। বিবিধার্থ সংগ্রহ, ৪টো, ১৮৫০-১৮৫৬

২। রহস্য সন্দর্ভ, ঐ, ১৮৫৬-১৮৬৩

৩। প্রকৃত ভূগোল, ১২ মো., ১৮৫৪ (৫টি সংস্করণ)

৪। পত্র কৌমুদী, ঐ, ১৮৬৩

৫। ব্যাকরণ প্রবেশ, ঐ, ১৮৬২ (৪টি সংস্করণ)

৬। তিলপিকা দর্শন, ঐ, ১ খন্ড, ১৮৬০

৭। আসঞ্চ ব্যবস্থা, ১ খন্ড, ৮ভো., ১৮৭৩

৮। শিবাজীর জীবনী, ১৮৬২

৯। মেবারের ইতিহাস ১৮৬২

মানচিত্র ভূচিত্রবালী

১। ভারতবর্ষ (বাংলায়) ১৮৫২

২। ঐ (নাগরী) ১৮৫৩

৩। ঐ (ফার্সীতে) ১৮৫৪

৪। এশিয়া (ফার্সীতে) ১৮৫৫

৫। ফিজিক্যাল চার্ট, ১৮৫৪

৬। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সকল জেলার মানচিত্র, ১৮৬৮

৭। বৃহৎ ভূচিত্রাবলী (বিদালয়ের জন্য)

৮। ছোট ভূচিত্রাবলী (ঐ) (পাঁচটি সংস্করণ)
ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র বর্তমানে মাসিক ৫০০ টাকা পেনশন পাচ্ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *