১০. পদ্ম মেঝের উপর

পদ্ম মেঝের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া বুড়ি রাঙাদিদির জন্য কাঁদিতেছিল। বুড়ি সত্যই তাহাকে ভালবাসিত। পদ্ম অনেকদিন ভাল করিয়া কান্দিবার কোনো হেতু পায় নাই। সংসারে তাহার থাকিবার মধ্যে ছিল অনিরুদ্ধ—সে তাহাকে কবে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে; তাহার জন্য কান্না আর আসেও না। যতীন-ছেলে দিন কয়েকের জন্য আসিয়াছিল, সে চলিয়া গেলে কয়েক দিন পদ্ম কাঁদিয়াছিল। তাহাকে মনে পড়িলে এখনও চোখে জল আসে, কিন্তু বেশ প্রাণ ভরিয়া কাঁদিতে পারে না।

বুড়ি শেষ রাত্রেই মরিয়াছে। মরিবার আগে জগন ডাক্তার প্রভৃতি পাঁচজনে বুড়িকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল—দিদি, তোমার শ্রাদ্ধশান্তি আছে। টাকা-কড়ি কোথায় রেখেছ বল, আমরা শ্ৰাদ্ধ। করব। আর যাতে যেমন খরচ করতে বলবে, তাতেই তেমন করব।

বুড়ি উত্তর দেয় নাই। পাশ ফিরিয়া শুইয়াছিল। কিন্তু ডাক্তার আসিবার পূর্বেই দেবুকে বুড়ি বলিয়াছিল—তখন সেখানে ছিল কেবল সে ও দুর্গা। বলিয়াছিল—দেবা, ষোল কুড়ি টাকা আমার আছে, এই আমার বিছানা বালিশের তলায় মেজেতে পোঁতা আছে। কোনোমতে আমার ছেরাদ্দটা করি, বাকিটা তুই নিস্—আর পাঁচ কুড়ি দি কামারনীকে।

যে কথা বুড়ি তাহাকে একরূপ গোপনে বলিয়াছিল, সেই কথা দেবু ঘোষ ভোরবেলা সকলকে ডাকিয়া একরকম প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়া দিল। শ্ৰীহরি ঘোষকে পর্যন্ত ডাকিয়া সে বলিয়া দিলরাঙাদিদি এই বলিয়া গিয়াছে; এবং টাকাটার গুপ্তস্থানটা পর্যন্ত দেখাইয়া দিল।

ফলে যাহা হইবার হইয়াছে। জমিদার শ্ৰীহরি ঘোষ—তখন পুলিশে খবর দিয়া ওয়ারিশহীন। বিধবার জিনিসপত্র, গরু-বাছুর, টাকা-কড়ি সব দখল করিয়া বসিয়াছে। দেবুর কথা কানেই তোলে নাই। দুর্গা অযাচিতভাবে দেবুর কথার সত্যতা স্বীকার করিয়া সাক্ষ্য দিতে আগাইয়া আসিয়াছিল-জমাদার এবং শ্রীহরি ঘোষ তাহাকে একরূপ ঘর হইতে বাহির করিয়া দিয়াছিল। পুনরায় ডাকাইয়া আনিয়া তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে তিরস্কার করিয়াছে। সে তিরস্কারের ভাগ পদ্মকেও লইতে হইয়াছে।

জমাদার দুর্গাকে পুনরায় ডাকাইয়া বলিয়াছিল—তুই মুচির মেয়ে, আর বুড়ি ছিল সদ্‌গোপের মেয়ে; তুই কি রকম তার মরণের সময় এলি? তোকে ডেকেছিল সে?

দুর্গা ভয় করিবার মেয়ে নয়, সে বলিয়াছিল—মরণের সময় মানুষ ভগবানকে ডাকতেও ভুলে যায়, তা বুড়ি আমাকে ডাকবে কি? আমি নিজেই এসেছিলাম।

শ্ৰীহরি পরুষকণ্ঠে বলিয়াছিল—তুই যে টাকার লোভে বুড়িকে খুন করি নাই, তার ঠিক কি?

দুর্গা প্রথমটা চমকিয়া উঠিয়াছিল—তারপর হাসিয়া একটি প্রণাম করিয়া বলিয়াছিল—তা বটে, কথাটা তোমার মুখেই সাজে পাল।

জমাদার ধমক দিয়া বলিয়াছিল—কথা বলতে জানিস না হারামজাদী? ঘোষ মশায়কে পাল বলছি, তোমার বলছিস?

দুর্গা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়াছিল—লোকটি যে এককালে আমার ভালবাসার লোক ছিল, তখন পাল বলেছি, তুমি বলেছি, মাল খেয়ে তুইও বলেছি। অনেক দিনের অভ্যেস কি ছাড়তে পারি জমাদারবাবু? এতে যদি তোমাদের সাজা দেবার আইন থাকে দাও।

শ্ৰীহরির মাথাটা হেঁট হইয়া গিয়াছিল। জমাদারও আর ইহা লইয়া ঘাটাইতে সাহস করে নাই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়াছিল—সদ্‌গোপের মেয়ের মৃত্যুকালে তার জাতজ্ঞাত কেউ এল না, তুই এলি, আর ওই কামার-বউ এল, ওর মানে কি? কেন এসেছিল ব?

পদ্মর বুকটা এবার ধড়ফড়, করিয়া উঠিয়াছিল।

দুর্গাকে এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই জমাদার বলিয়াছিল—কামার-বউকে জিজ্ঞাসা। করছি—উত্তর দাও না গো।

সমবেত সমস্ত লোক এই অপ্রত্যাশিত সন্দেহে হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল। উত্তর দিয়াছিল দেবু পণ্ডিত; সে এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল, এবার সামনে আসিয়া বলিল-মশায়, পথের ধারে মানুষ পড়ে মরছে, সে হয়ত মুসলমানকোনো হিন্দু দেখে যদি তার মুখে জল দেয়, কি কোনো মুমূর্ষ হিন্দুর মুখেই কোনো মুসলমান জল দেয়—তবে কি আপনারা বলবেন—লোকটাকে খুন করেছে? তাকে কি জিজ্ঞাসা করবেন—এর কোনো স্বজাতকে না ডেকে, তুই কেন ওর মুখে জল দিলি?

জমাদার বলিয়াছিল কিন্তু বুড়ির টাকা আছে।

–পথের ধারে যারাই মরে—তারাই ভিখারি নয়; পথিক হতে পারে, তাদের কাছেও টাকা থাকতে পারে।

—সে ক্ষেত্রে আমরা সন্দেহ করব বৈকি, বিশেষ টাকা যদি না পাওয়া যায়।

–টাকার কথা তো আমি বলেছি আপনাদের।

–আরও টাকা ছিল না তার মানে কি?

–ছিল, তারই বা মানে কি?

–আমাদের মনে হয়, ছিল। লোকে বলে … বুড়ির টাকা ছিল হাজার দরুনে।

–পরের ধন আর নিজের আয়ু-এ মানুষ কম দেখে না, বেশিই দেখে। সুতরাং বুড়ির টাকা হাজার দরুনেই তারা বলে থাকে!

শ্ৰীহরি বলিল—বেশ কথা। কিন্তু যখন দেখলে বুড়ির শেষ অবস্থা, তখন আমাকে ডাকলে না কেন?

—কেন? তোমাকে ডাকব কেন?

–আমাকে ডাকবে কেন? শ্ৰীহরি আশ্চর্য হইয়া গেল।

জমাদার উত্তর যোগাইয়া দিল—কেনো, উনি গ্রামের জমিদার।

–জমিদার খাজনা আদায় করে সরকারের কলেকটারিতে জমা দেয়। মানুষের মরণকালেও তাকে ডাকতে হবে, এমন আইন আছে নাকি? না ধর্মরাজ, যমরাজ, ভগবান এদের দরবার থেকেও তাকে কোনো সনদ দেওয়া আছে? কামার-বউ প্রতিবেশী, দুর্গা কামার-বউয়ের বাড়ি এসেছিল, এসে রাঙাদিদির খোঁজ করতে গিয়ে

—তাই তো বলছি, জাত-জ্ঞাত কেউ খোঁজ করলে না—শ্ৰীহরি ঘোষ মশায় জানলেন না, ওরা জানলেওরা খোঁজ করলে কেন?

—জাত-জ্ঞাত খোঁজ করলে না কেন, সেকথা জাত-জ্ঞাতকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনার ঘোষ মশাই বা জানলেন না কেন সে কথা বলবেন আপনার ঘোষ। অন্যের জবাবদিহি ওরা কেমন করে করবে? ওরা খোঁজ করেছে সেটা ওদের অপরাধ নয়। আর অপরে খোঁজ কেন করলে না, সে কৈফিয়ত দেবার কথা তো ওদের নয়।

-–তোমাকে খবর দিলে, ঘোষ মশাইকে খবর দিলে না কেন?

–আইনে এমন কিছু লেখা আছে নাকি যে, ঘোষকে অর্থাৎ জমিদারকেই এমন ক্ষেত্রে খবর। দিতেই হবে? ওরা আমাকে খবর দিয়েছিল আমি ডাক্তার ডেকেছিলাম, মৃত্যুর পর ভূপাল চৌকিদারকে দিয়ে থানায় খবর পাঠিয়েছি। এর মধ্যে বার বার ঘোষ মশাই আসছে কেন?

জগন ডাক্তার এবার আগাইয়া আসিয়া বলিয়াছিল—আমি রাঙাদিদির শেষ সময়ে দেখেছি। মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু। বৃদ্ধ বয়সতার ওপর জ্বর। সেই জ্বরে মৃত্যু হয়েছে। আপনাদের সন্দেহ হয়—লাশ চালান দিন। পোস্টমর্টেম হোক, আপনারা প্রমাণ করুন অস্বাভাবিক মৃত্যু। তারপর এসব হাঙ্গামা করবেন। ফাঁসি, শূল, দ্বীপান্তর যা হয়—বিচারে হবে।

শ্ৰীহরি বলিয়াছিল-ভাল, তাই হোক। না জমাদারবাবু?

জমাদার এতটা সাহস করে নাই। অনাবশ্যকভাবে এবং যথেষ্ট কারণ না থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুটাকে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলিয়া চালান দিয়া থানার কাজ বাড়াইতে গেলে তাহাকেই কৈফিয়ত খাইতে হইবে। তবুও সে নিজের জেদ একেবারে ছাড়ে নাই। শ্ৰীহরিকে বলিয়া জংশনের পাস করা এম-বি ডাক্তারকে কল পাঠাইয়াছিল এবং হাঙ্গামাটা আরও খানিকক্ষণ জিয়াইয়া রাখিয়াছিল।

জংশনের ডাক্তার আসিয়া দেখিয়াশুনিয়া একটু আশ্চর্য হইয়াই বলিয়াছিল—আন্ন্যাচারাল ডেথ ভাববার কারণটা কি শুনি?

শ্ৰীহরি উত্তর দিতে পারে নাই। উত্তর দিয়াছিল জমাদার। মানে, বুড়ির টাকা আছে কিনা। দেবু ঘোষ, দুর্গা মুচিনী বলছে—সে টাকার একশো টাকা দিয়ে গেছে কামার-বউকে, আর বাকিটা দিয়ে গেছে দেবু ঘোষকে।

ডাক্তার ইহাতেও অস্বাভাবিক কিছুর সন্ধান পায় নাই। সে বলিয়াছিল—বেশ তো!

—বেশ তো নয়, ডাক্তারবাবু। এর মধ্যে একটু লখটি ব্যাপার আছে। মানে দেবু ঘোষই। আজকাল অনিরুদ্ধের স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করে। তার মধ্যে আছে দুর্গা মুচিনী। এখন বুড়ির মৃত্যুকালে এল কেবল দুর্গা মুচিনী আর কামার-বউ। তারা এসেই ডাকলে দেবু ঘোষকে। দেবু এল, ডাক্তারকে খবর পাঠালে। বুড়ির মুখে-মুখে উইল কিন্তু হয়ে গেল ডাক্তার আসবার আগেই। সন্দেহ একটু হয় না কি?

হাসিয়া ডাক্তার বলিয়াছিল—সেটা তো উইলের কথায়। তার সঙ্গে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে। ব্যাপারটাকে অনাবশ্যক—আমার মতে অনাবশ্যকভাবেই ঘোরালো করে তুলছেন আপনারা।

—অনাবশ্যক বলছেন আপনি?

–বলছি। তা ছাড়া জগনবাবু নিজে ছিলেন উপস্থিত।

—বেশ। তা হলে মৃতদেহের সৎকার করুন। টাকাকড়ি, জিনিসপত্র, গরু-বাছুর আমি থানায় জিমা রাখছি। পরে যদি দেবু পণ্ডিত আর কামারনীর হক পাওনা হয়—বুঝে নেবে আদালত থেকে।

রাঙাদিদির সৎকারে দেবু শ্ৰীহরিকে হাত দিতে দেয় নাই। বলিয়াছিল রাঙাদিদির দেহখানির ভেতরে সোনা-দানা নাই। রাঙাদিদির দেহখানা এখন আর কারও প্রজা নয়, খাতকও নয়। জমিদার হিসাবে তোমাকে সৎকার করতে আমরা দোব না। আর যদি তুমি আমাদের স্বজাত হিসাবে আসতে চাও, তবে এস-যেমন আর পাঁচজনে কাঁধ দিচ্ছে, তুমিও কাধ দাও। মুখে আগুন আমি দোব। সে আমাকে বলে গিয়েছে। তার জন্যে কোনো সম্পত্তি বা তার টাকা আমি দাবি করব না।

শ্ৰীহরি উঠিয়া পড়িয়া বলিয়াছিল—কালু, বস্ ওইখানে। জমাদারবাবু, নমস্কার, আমি এখনি যাই। আপনি সব জিনিসপত্রের লিস্টি করে যাবেন তা হলে। আর, যাবার সময় চা খেয়ে যাবেন কিন্তু।

শ্ৰীহরির এই চলিয়া যাওয়াটাকে লোকে তাহার পলাইয়া যাওয়াই ধরিয়া লইল। জগন ঘোষ খুশি হইয়াছিল সকলের চেয়ে বেশি। কিন্তু তার চেয়েও খুশি হইয়াছিল পদ্ম নিজে। ওই বর্বর চেহারার লোকটাকে দেখিলেই সে শিহরিয়া ওঠে! সেদিনকার সেই নিৰ্নিমেষ দৃষ্টিতে সাপের মত চাহিয়া থাকার কথাটা মনে পড়িয়াছিল। কিন্তু তাই বলিয়া সে দেবুর প্রতি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে পারে নাই। লোকে যখন দেবুর প্রশংসা করিতেছিল, তখন সে অবগুণ্ঠনের অন্তরালে ঠোঁট বাঁকাইয়াছিল। জীবনে দেবুর প্রতি বিরাগ তাহার সেই প্রথম। পণ্ডিতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রীতি কৃতজ্ঞতা করুণার তার সীমা ছিল না। কিন্তু দেবুর সেদিনকার আচরণে সে তাহার প্রতি বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

কেন সে সকলের কাছে টাকার কথাটা প্রকাশ করিয়া দিল? দুৰ্গা বলে—জামাই আমাদের পাথর। পাথরই বটে। পণ্ডিতের টাকার প্রয়োজন নাই, কিন্তু পদ্মর তো প্রয়োজন ছিল। তাহার স্বামী তাহাকে ভাসাইয়া দিয়া চলিয়া গিয়াছে, এককণা খাইবার সংস্থান নাই; তাহাকে যদি দয়া করিয়া একজন টাকা দিয়া গেল তো দেবু ধাৰ্মিক বৈরাগী সাজিয়া তাহাকে সে প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিয়া দিল। দেবুর খাইয়া-পরিয়া সে আর কতদিন থাকিবে? কেন থাকিবে? দেবু তাহার কে?

রাঙাদিদি ছিল সেকালে সিধা মানুষ। সে কতদিন পদ্মকে বলিয়াছেওলো, দেবাকে একটুকু ভাল করে যত্ন-আত্যি করি। ও বড় অভাগা, ওকে একটু আপনার করে নিস।

পদ্মর সামনেই দেবুকে বলিয়াছে—দেবা, বিয়ে-থাওয়া না করিস্ তো একটা যত্ন-আত্যির লোক তো চাই ভাই। পদ্মকে তুই তো বাঁচিয়ে রেখেছিস ওই তোর সেবাযত্ন করুক। ওকে বরং তুই ঘরেই নিয়ে যা। মিছে কেনে দুটো জায়গায় রান্নাবান্না, আর তুই-ই বাঁ হাত পুড়িয়ে বেঁধে খাস্ কেনে!

দেবু পণ্ডিত, পণ্ডিতের মতই গম্ভীরভাবে বলিয়াছিলনা দিদি! মিতেনী নিজের ঘরেই থাকবে।

বুড়ি তবু হাল ছাড়ে নাই, পদ্মকে বলিয়াছিল—তুই একটুকুন বেশ ভাল করে যত্ন-আত্যি করবি, বুঝলি?

যত্ন-আত্মীয়তা করিবার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে তাহা করিতে পারে নাই। দেবুই তাহাকে সে সুযোগ দেয় নাই। সে-ই বা কেন দেবুর দয়ার অন্ন এমন করিয়া খাইবে? বুড়ি রাঙাদিদির টাকাটা পাইলে সে এখান হইতে কোথাও চলিয়া যাইত। তাই সে বুড়ির জন্য এমন করিয়া কাঁদিতেছে।

দুর্গা উঠান হইতে ডাকিল-কামার-বউ কোথা হে!

পদ্ম উঠিয়া বসিল; চোখ মুছিয়া সাড়া দিল—এই যে আছি।

দুৰ্গা কাছে আসিয়া বলিল—সঁদছিলে বুঝি? তা হলে শুনেছ নাকি?

পদ্ম সবিস্ময়ে বলিল—কি? হঠাৎ এমন কি ঘটিল যাহা শুনিয়া সে আরও খানিকটা কাঁদিতে পারে? অনিরুদ্ধের কি কোনো সংবাদ আসিয়াছে? যতীন-ছেলের কি কোনো দুঃসংবাদের চিঠি আসিয়াছে দেবু পণ্ডিতের কাছে? উচ্চিংড়ে কি জংশন শহরে রেলে কাটা পড়িয়াছে?

দুর্গার মুখ উত্তেজনায় থমথম করিতেছে।

—কি দুর্গা? কি?

—তোমাকে আর দেবু পণ্ডিতকে পতিত করছে ছিরু পাল। দুৰ্গা ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিল। উত্তেজনায় রাগে ঘৃণায় সে শ্ৰীহরিকে সেই পুরনো ছিরু পাল বলিয়াই উল্লেখ করিল।

–পতিত করবে? আমাকে আর পণ্ডিতকে?

হা। পণ্ডিত আর তোমাকে। হাসিয়া দুর্গা বলিলতা তোমার ভাগ্যি ভাল ভাই। তবে আমিও বাদ যাব না।

একদৃষ্টে দুর্গার মুখের দিকে চাহিয়া পদ্ম প্ৰশ্ন করিল—তাই বলছে? কে বলছে!

—ঘোষ মশায় ছিরে পাল গো, যে এককালে মুচির মেয়ের এঁটো মদ খেয়েছে, মুচির মেয়ের ঘরে রাত কাটিয়েছে, মুচির মেয়ের পায়ে ধরেছে। রাঙাদিদির ছেরাদ্দ হবে, সেই ছেরাদ্দে পঞ্চগেরামী জাত-জ্ঞাত আসবে, বামন-পণ্ডিত আসবে, সেইখানে তোমাদের বিচার হবে। পতিত হবে তোমরা।

মৃদু হাসিয়া পদ্ম বলিল—আর তুই?

–আমি! দুর্গা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।আমি! দুর্গার সে হাসি আর থামে না। দুই দিকে পাড় ভাঙিয়া বৰ্ষার নদী খলখল করিয়া অবিরাম যে হাসি হাসে সেই হাসির উচ্ছাস। তাহার মধ্যে যত তাচ্ছিল্য তত কৌতুক ফেনাইয়া উঠিতেছে। খানিকক্ষণ হাসিয়া সে বলিল–আমি সেদিন সভার মাঝে একখানা ঢাক কাঁধে নিয়ে বাজার আর লাচব; আমার যত নষ্ট কীর্তি সব বলব। সতীশ দাদাকে দিয়ে গান বাঁধিয়ে লোব। বামুন, কায়েত, জমিদার, মহাজন–সবারই নাম ধরে বলব। ছিরু পালের গুণের কথা হবে আমার গানের ধুয়ো।

দুৰ্গা যেন সত্য সত্যই নাচিতেছে। পদ্মরও এমনই করিয়া নাচিতে ইচ্ছা হয়। সে বলিল–আমাকেও সঙ্গে নিস ভাই, আমি কাঁসি বাজাব তোর ঢাকের সঙ্গে।

কিছুক্ষণ পর দুর্গা বলিল—যাই ভাই, একবার জামাই-পণ্ডিতকে বলে আসি। বলিয়া সে তেমনিভাবে প্রায় নাচিতে নাচিতে গেল।

পণ্ডিত শুনিয়া কি বুলিবে! পদ্মর বড় কৌতুহল হইল—সঙ্গে সঙ্গে সে অপরিমেয় কৌতুকও বোধ করিল। যাক আজ দেখা হইল না, নাই বা হইল। দেখিতে তো সে পাইবে, পঞ্চগ্রামের সমাজপতিগণের সম্মুখে যেদিন বিচার হইবে সেদিন সে দেখিবে। কি বুলিবে দেবু পণ্ডিত, কি করিবে সে? তীব্র তীক্ষ কণ্ঠে সে প্রতিবাদ করিবে, লম্বা ওই মানুষটি আগুনের শিখার মত জ্বলিতেছে মনে হইবে। কিন্তু পাঁচখানা গাঁয়ের জাত-জ্ঞাতি, নবশাখার মতব্বরবর্গ তাহাকে কি বাগ মানিবে? পদ্ম জোর করিয়া বলিতে পারে—মানিবে না। এ চাকলার লোকে শ্রীহরি ঘোষের চেয়ে পণ্ডিতকে বহুগুণে বেশি ভালবাসে, এ কথা খুব সত্য; তবু তাহারা দেবুর কথা সত্য বলিয়া মানিবে না; লোককে চিনিতে তো তাহার বাকি নাই! প্রতিটি মানুষ তাহার দিকে যখন চাহিয়া দেখে, তখন তাহাদের চোখের চাহনি যে কি কথা বলে সে তা জানে। তাহারা এমন একটি অনাত্মীয়া যুবতী মেয়েকে অকারণে ভরণ-পোষণ করিবার মত রসালো কথা শুনিয়া, সে সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাতে-নাতে পাইয়াও বিশ্বাস করিবে না এমন কখনও হয়? আকাশ হইতে দেবতারাও যদি ডাকিয়া বলেন–কথাটা মিথ্যা, তবু তাহারা মিথ্যাই বিশ্বাস করিবে। তাহার উপর শ্ৰীহরি ঘোষ করিবে লুচি-মণ্ডার বন্দোবস্ত। বিশেষ করিয়া পাকামাথা বুড়াগুলি ঘন ঘন ঘাড় নাড়িবে আর বলিবে—উঁহুঁ? বাপু হে, শাক দিয়া মাছ ঢাকা যায় না! তখন পণ্ডিত কি করিবে? তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া, হয়ত প্ৰায়শ্চিত্ত করিবে কে জানে? পণ্ডিতের সম্বন্ধে ও কথাটা ভাবিতে তাহার কষ্ট হইল।

পণ্ডিত তাহাকে পরিত্যাগ না করুক, সে এইবার পণ্ডিতের সকল সাহায্য প্রত্যাখ্যান করিবে। তাহার সহিত কোনো সংস্রব সে রাখিবে না। ওই পঞ্চায়েতের সামনেই সে কথা সে মুখের ঘোমটা খুলিয়া দুর্গার মত ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিবেপণ্ডিত ভাল মানুষ গো, তোমরা যেমন সে তেমন নয়। তার চোখের উপর চাউনিতে কেরোসিনের ডিবের শীষের মত কালি পড়ে না। আমাকে নিয়েও তোমরা ঘোট পাকিয়ো না। আমি চলে যাব; যাব নয়, যাচ্ছি—এ গা থেকে চলে যাচ্ছি। কারুর দয়ার ভাত আমি খাব না। তোমাদের পঞ্চায়েতকে আমি মানি না, মানি না, মানি না।

কেন সে মানিবে? কিসের জন্য মানিবে? ঘোষ যখন চুরি করিয়া তাহাদের জমির ধান কাটিয়া লইয়াছিল—তখন পঞ্চায়েত তাহার কি করিয়াছে? ঘোষের অত্যাচারে তাহার স্বামী সর্বস্বান্ত হইয়া গেল তাহার কি করিয়াছে পঞ্চায়েত? তাহার স্বামী নিরুদ্দেশ হইয়া গেলকে তাহার খোঁজ করিয়াছে? সে খাইতে পায় নাই, পঞ্চায়েত কয় মুঠা অন্ন তাহাকে দিয়াছে? তাহাকে রক্ষা করিবার কি ব্যবস্থা করিয়াছে? তাহারা তার স্বামীকে ফিরাইয়া আনুক তবে বুঝি। তাহাদের যে সব সম্পত্তি শ্ৰীহরি ঘোষ লইয়াছে সেগুলি ফিরাইয়া দিক, তবেই পঞ্চায়েতকে মানিবে। নতুবা কেন মানিতে যাইবে?

দেবু পণ্ডিত পাথর। দুর্গা বলে সে পাথর। নহিলে সে আপনাকে তাহার পায়ে বিকাইয়া দিত। তাহাকে দেখিয়া তাহার বুকের ভিতরটা ঝলমল করিয়া ওঠে, এই বর্ষাকালের রাত্রির জোনাকি-পোকা-ভরা গাছের মত জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিয়া ওঠে; কিন্তু পরক্ষণেই নিভিয়া যায়। আজ সে সব ঝরিয়া যাক, ঝরিয়া যাক। দেবুর ভাত সে আর খাইবে না। সে আবার মাটির উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

 

দুর্গা আসিয়া দেখিল পণ্ডিত নাই। দরজায় তালা বন্ধ। বাহিরের তক্তপোশের উপর একটা কুকুর শুইয়া আছে। রোয়া-ওঠা একটা ঘেয়ো কুকুর। পণ্ডিত ফিরিয়া আসিয়া ওইখানেই বসিবে, বেশি ক্লান্ত হইয়া আসিলে হয়ত ওইখানেই শুইয়া পড়িবে। তাহার বিলু-দিদির সাধের ঘর। একটা ঢেলা লইয়া কুকুরটাকে সে তাড়াইয়া দিল। সেই রাখাল ঘোড়া খামারের মধ্যে একা মনের উল্লাসে প্ৰাণ খুলিয়া একেবারে সপ্তম সুরে গান ধরিয়া দিয়াছে–

কেঁদো নাকো পান-পেয়সী গো,
তোমার লাগি আনব ফাঁদি নৎ।

মরণ আর কি ছোঁড়ার! কতই বা বয়স হইবে? পনের পার হইয়া হয়ত ষোলয় পড়িয়াছে। ইহার মধ্যে প্রাণ-প্রেয়সীর কান্না থামাইবার জন্য ফাদি নৎ কিনিবার স্বপ্ন দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে! দুৰ্গা ছেড়াকে কয়েকটা শক্ত কথা বলিবার লোভ সংবরণ করিতে পারি না। সে খামারবাড়িতে ঢুকিয়া পড়িল। ছোঁড়া তন্ময় হইয়া গান গাহিতেছে আর খসখস করিয়া অ্যাঁটিখড় কাটিতেছে। দুর্গার পায়ের শব্দ তাহার কানেই ঢুকি না। দুর্গা হাসিয়া ডাকিল ওরে ওই! ও পান-পেয়সী।

ছোঁড়া মুখ ফিরাইয়া দুর্গাকে দেখিয়া হাসিয়া ফেলিল। গান বন্ধ করিয়া আপন মনেই খুক খুক করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

দুর্গা হাসিয়া বলিল—তোর কাছে এলাম ফাঁদি নতের জন্যে। দিবি আমাকে?

ঘোড়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া বলিল-ধেৎ!

—কেনে রে? আমাকে সাঙা কর না কেনে! শুধু ফাদি নৎ দিলেই হবে।

ছোঁড়া আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া সারা হইল।

দুর্গা বলিল—মরণ তোমার! গলা টিপলে দুধ বেরোয়, একবার গানের ছিরি দেখ!

ছোঁড়া এবার ভ্রূ নাচাইয়া বলিল—মরণ লয়! এইবার সাঙা করব আমি।

–কাকে রে?

–হুঁ। দেখ্‌বা এই আশ্বিন মাসেই দেখবা।

–ভোজ দিবি তো?

–মুনিবকে টাকার লেগে বলেছি।

–মুনিব গেল কোথা তোর?

ছোঁড়া এবার সাহসী হইয়া ন্যাকামির সুরে জিজ্ঞাসা করিল—একবার দেখে পরানটো জুডোতে আইছিলি বুঝি?

দেবুর প্রতি দুর্গার অনুরাগের কথা গোপন কিছু নয়; সে মুখে বলে না, কিন্তু কাজে-কর্মেব্যবহারে তাহার অনুরাগের এতটুকু সংকোচ নাই—দ্বিধা নাই; সেটা সকলের চোখেই পড়ে। তাহার উপর দুর্গার মা কন্যার এই অনুরাগের কথা লইয়া আক্ষেপের সহিত পাড়াময় প্রচার করিয়া ফেরে। এই অযথা অনুরাগের জন্যই তাহার হতভাগী মেয়ে যে হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলিতেছে—এ দুঃখ সে রাখিবে কোথায়? কঙ্কণার বাবুদের বাগানের মালীগুলো এতদিন আসাযাওয়া করিয়া এইবার হাল ছাড়িয়া দিয়াছে, আর আসে না। কন্যার উপাৰ্জনে তাহার অবশ্য কিছু স্বাৰ্থ নাই, তাহার একমুঠা করিয়া ভাত হইলেই দিন যায় তবু তাহার দেখিয়া সুখ হইত। তাই তাহার এত আক্ষেপ! দুর্গার মায়ের সেই আক্ষেপ-পীড়িত কাহিনী ঘোড়াটাও শুনিয়াছে। দুর্গার রসিকতার উত্তরে সে এইবার কথাটা বলিয়া শোধ লইল।

দুর্গা কিন্তু রাগ করিল না—উপভোগ করিল। হাসিয়া বলিল ওরে মুখ পোড়া! দাঁড়া, পণ্ডিত আসুক ফিরে এলেই আমি বলে দেব তুই এই কথা বলেছিস।

এবার ছোঁড়ার মুখ শুকাইয়া গেল। বলিল—মুনিব নাই। মুনিব গিয়েছে কুসুমপুর, সেথা থেকে যাবে কঙ্কণা।

ফিরবে তো?

ছোঁড়া বলিল-কঙ্কণা থেকে হয়ত জংশন যাবে। হয়ত সদরে যাবে। আজ কাল হয়ত ফিরবে না। পরশুও ফিরবে কিনা কে জানে!

দুর্গা সবিস্ময়ে বলিল-জংশনে যাবে, সদরে যাবে, পরশুও হয়ত ফিরবে না! কেন রে? কি হয়েছে?

দুর্গাকে চিন্তিত দেখিয়া ছোঁড়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। এইবার দুর্গা সে কথাটা ছাড়িয়াছে। সে খুব গম্ভীর হইয়া বলিল—মুনিবের কারণ মুনিবকেই ভাল। কে জানে বাপু! হেথা ঝগড়া হল লোকে লোকে, ছুটল মুনিব। হোথা দাঙ্গা হল রামায় শামায় মুনিব আমার ছুটল। কুসুমপুরে শ্যাভেদের সাথে কঙ্কণার বাবুদের দাঙ্গা হয়েছে না কি হয়েছে—মুনিব গেল ছুটতে ছুটতে।

–কঙ্কণার বাবুদের সঙ্গে কুসুমপুরের শেখদের দাঙ্গা হয়েছে? কোন্ বাবু? কোন্ শেখদের? কিসের দাঙ্গা রে?

–কঙ্কণার বড় বাবুদের সাথে আর রহম শেখ সেই যি সেই গট্টা-গোঁট্টা চেহারা, এ্যাঁই চাপ দাড়ি—শ্যাখজী, তারই সাথে।

—দাঙ্গা কিসের শুনি?

—কে জানে বাপু! শ্যাখ বাবুদের তালগাছ কেটে নিয়েছে, না কি কেটে নিয়েছে, বাবুরা তাই শ্যাখকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, থাম্বার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। শ্যাভেরা সব দল বেঁধে গেইছে কঙ্কণা। দেখুড়ের তিনকড়ি পালবানের আগু হাদি সেই আইছিল; মুনিবও চাদরটা ঘাড়ে ফেলে ছুটল।

–জংশন যাবে, সদর যাবে, তোকে কে বললে?

–দেখুড়ের সেই পাল বললে যি! বললেকঙ্কণার থানায় নেকাতে হবে সব। তারপরে সদরে গিয়ে লালিশ করতে হবে।

বহুক্ষণ দুর্গা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর বাড়ি আসিয়া ডাকিল—বউ! পাতুর বউ বাহির হইয়া আসিল।

–দাদা কোন্ মাঠে খাটতে গিয়েছে?

–অমর-কুড়োর মাঠে।

দুর্গা অমর-কুণ্ডার মাঠের দিকে চলিল। মাঠে গিয়া পাতুকে বলিল—তুই একবার দেখে আয় দাদা। ধান পোঁতার কাজ আমি করতে পারব।

পাতু সতীশের মজুর খাঁটিতেছিল, সে কোনো আপত্তি করিল না। দুর্গা আপনার পরনের ফরসা কাপড়খানা বেশ অ্যাঁট করিয়া কোমরে জড়াইয়া ধান পুঁতিতে লাগিয়া গেল। মেয়েরাও ধান পোতে, লঘু ক্ষিপ্ৰ হাতে তাহারা পুরুষদের সঙ্গে সমানেই কাজ করিয়া যায়। দুর্গাও এককালে করিয়াছে, অল্প বয়সে সে তাহার দাদার জমিতে ধান পুঁতিত। এখন অবশ্য অনেকদিনের অনভ্যাস। প্রথম কয়েকটা গুচ্ছ কাদায় পুঁতিতে খানিকটা আড়ষ্টতা বোধ করিলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ভাবটা কাটিয়া গেল। জমিভরা জলে তাহার রেশমি চুড়ি-পরা হাত ড়ুবাইয়া জলের ও চুড়ির বেশ একটা মিঠা শব্দ তুলিয়া ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সারবন্দি ধানের গুচ্ছ পুঁতিয়া যাইতে আরম্ভ করিল।

সে একা নয়, মাঠে অনেক মেয়ে ধান চারা পুঁতিতেছে। কোলের ছেলেগুলিকে মাঠের প্রশস্ত আলের উপর শোয়াইয়া দিয়াছে। মধ্যে মধ্যে মেঘলা আকাশ হইতে ফিনফিনে ধারায় বৃষ্টি ঝরিতেছে। ছেলেগুলির উপর আচ্ছাদন দিয়া তালপাতার ছাতা ভিজা মাটিতে পুঁতিয়া দিয়াছে। অপরিমেয় আনন্দের সহিত নিরবসর কাজ করিয়া চলিয়াছে কৃষক-দম্পতি। স্বামী করিতেছে হাল, স্ত্রী পুঁতিতেছে ধানের গুচ্ছ; প্রচণ্ড বিক্ৰমে স্বামী ভারী কোদাল চালাইয়া চলিয়াছে, স্ত্রী পায়ের চাপে টিপিয়া বাঁধিতেছে আল। বৃষ্টির জলে সৰ্বাঙ্গ ভিজিয়াছে, কাদায় ভরিয়া গিয়াছে সর্ব দেহ। মধ্যে মধ্যে রোদ উঠিয়া গায়ের জল কাদা শুকাইয়া দরদরধারে ঘাম বহাইয়া দিতেছে, শ্রাবণ শেষের পুবালি বাতাসে মাথার চুলের গুচ্ছ উড়িতেছে। পুরুষদের কণ্ঠে মেঠো দীর্ঘ সুরের গান দূর দূরান্তে গিয়া মিলাইয়া যাইতেছে।

মেয়েরা ধন পুঁতিতে পুঁতিতে এক পা করিয়া পিছাইয়া আসিতেছে—একতালে পা পড়িতেছে, হাতগুলিও উঠিতেছে নামিতেছে একসঙ্গে, একসঙ্গেই বাজিতেছে রুপাদস্তার কাকন ও চুড়ি। পুরুষেরা ক্লান্ত হইয়া গান বন্ধ করিলে তাহারা ধরিতেছে সেই গানেরই পরের কলি, অথবা ওই গানের উত্তরে কোনো গান। পঞ্চগ্রামের সুবিস্তীর্ণ মাঠে শত শত চাষী এবং শ্রমিক চাষীর মেয়ে বিশেষভাবে সাঁওতাল মেয়েরা চাষ করিয়া চলিয়াছে। তাহাদের মধ্যে মিশিয়া দুর্গা ধান পুঁতিতে পুঁতিতে মধ্যে মধ্যে চাহিতেছিল কঙ্কণার পথের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *