1 of 2

রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, কে সি এস আই

রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, কে সি এস আই

রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, কে সি এস আই ১৭০৫ শতাব্দে ১ চৈত্র (১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ) কলকাতার সিমলায় নিজ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানার্জনের প্রবল ইচ্ছা তাঁর বাল্যকাল থেকেই প্রকাশ পেতে থাকে; সে জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে অল্পকালের মধ্যেই তিনি সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সী ভাষায় পন্ডিত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন; সে যুগে হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন বিশেষ না থাকলেও তিনি ইংরেজি ভাষাও ভালভাবে আয়ত্ত করেন। বিশপ হেবার তাঁর জার্নালে লিখেছেন, “তিনি রাধাকান্ত দেব, চেহারায় সুদর্শন, ইংরেজি বলেন চমৎকার, আর বহু ইংরেজ গ্রন্থকারের পুস্তক, বিশেষ করে ইতিহাস ও ভূগোল তিনি অধ্যয়ন করেছেন। রিকার্ডস্ ভারত সম্পর্কিত তাঁর পুস্তকে, এদেশবাসীদের উন্নত মানসিক গুণের কথা বলতে গিয়ে রাধাকান্তের উচ্চগুণাবলীর উল্লেখ করেছেন।

রাজা রাধাকান্ত দেবের বিবাহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক ঘটনা। পিতামহ মহারাজা নবকৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করে সেযুগের প্রখ্যাত গোষ্ঠীপতি গোপীনগরের গোপীকান্ত সিংহ চতুধুরীণ মহাশয়ের কন্যার সহিত রাধাকান্তের বিবাহ দেন; ফলে, ঘটকদের কঠোর কারিকা অনুযায়ী, প্রথম গোষ্ঠীপতি শ্রীমন্ত রায়ের পর পর্যায়ক্রমে রাধাকান্ত হলেন ত্রয়োদশ গোষ্ঠীপতি অর্থাৎ হিন্দু সমাজের সকল সামাজিক সমাবেশে তিনি শ্রেষ্ঠের সম্মানস্বরূপ সর্বপ্রথম পুষ্পচন্দনে ভূষিত হতেন।

ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আন্তরিক ভক্তি রাধাকান্ত লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে কাজেই স্বীয় ক্ষেত্রে তিনি ইংরেজদের মত ও উদ্দেশ্য (স্বার্থ) সিদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিলেন; তার সঙ্গে তিনি তাঁর যথাসাধ্য করেছিলেন এদেশীয়দের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য। তাঁর অদম্য চেষ্টা ও শ্রমের ফলেই কলকাতার কয়েকটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ (শিক্ষা) প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত ও প্রথম অবস্থায় উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পেরেছিল। স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট, বার্ট-এর সহযোগিতায় তিনি হিন্দু কলেজ (বর্তমানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত) প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন, পরিশ্রমেরও অন্ত ছিল না। উদার ইংরেজি শিক্ষা নেবার জন্য যেমন তিনি একদিকে দেশবাসীকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন, অপর দিকে তেমনি পরিচালক সমিতির সদস্যরূপে তিনি এইচ এইচ উইলসনকে সাহায্য করেন যাতে প্রতিষ্ঠানটি সবিশেষ উন্নতি করতে পারে। জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশের চৌত্রিশটি বছর তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজের অবৈতনিক সম্পাদক ও পরীক্ষক; প্রায়ই তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যেতেন; এর শিক্ষার উচ্চমান আরও উন্নত করার দিকে তাঁর যত্নের অবধি ছিল না।

স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হবার পর, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতার যে সকল পুস্তক প্রকাশিত হতে থাকল, তাদের মধ্যে এদেশীয় ধর্ম বিরোধী কিছু থাকার আশঙ্কা এদেশীয় (হিন্দু)-গণ ঐ সকল পুস্তক কিনতে ভয় পেতেন; রাধাকান্ত এই সমিতির পরমোৎসাহী সভ্য হয়ে ঘোষণা করলেন যে, তাঁদের আশঙ্কার কোন কারণ নেই এবং এইভাবে তিনি বিদ্যালয়সমূহে ও সমাজে ঐ সকল পুস্তক প্রচারের পথ প্রশস্ত করলেন। স্কুল সোসাইটির অবৈতনিক সম্পাদকরূপে তিনি মহান মানবপ্রেমিক ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় এদেশে দেশীয় ভাষা শিক্ষার পথ প্রশস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন; এদেশীয় পাঠশালাগুলিতে নিয়ম শৃঙ্খলা প্রবর্তনের জন্য নিয়মিত ও প্রকৃত তত্ত্বাবধান, পরিদর্শন এবং পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন। স্কুল সোসাইটির হেডপন্ডিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারকে তিনি ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়িকা’ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশে সাহায্য করলেন; এতে স্ত্রীশিক্ষার গুরুত্ব ও স্ত্রীশিক্ষা যে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত তা ব্যাখ্যা করা হল। ১৮২০তে তিনি ইংরেজি রীতি অনুযায়ী প্রথম বাংলা নীতিকথা ও বাংলা বানান বহি বা পাঠ্য পুস্তক প্রকাশ করেন; পুস্তক দুখানি ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের রয়্যাল এসিয়াটিক সোসাইটির উচ্চ প্রশংসা লাভ করে এবং বর্তমানে ভারতীয় ছাপাখানাগুলি থেকে যে বহু পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাদের আদর্শ ঐ পুস্তক দুখানি। সাধারণ বিদ্যালয়ে না হলেও, স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে তিনি এতই সচেষ্ট ছিলেন যে, ড্রিংকওয়াটার বাঁটন একবার তাঁকে লেখেন, ‘এদেশীয় স্ত্রীলোকদিগকে নিরন্ধ অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে দেওয়ার মধ্যে যে নির্বুদ্ধিতা ও নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান, সে বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি ভারতীয়গণের মধ্যে আপনিই সর্বপ্রথম আকৃষ্ট করার জন্য আমি আপনাকে আপনার প্রাপ্য প্রশংসা জ্ঞাপন করছি।’

এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি (কৃষি ও উদ্যান বিষয়ক সমিতি)- র উপসভাপতিরূপে তিনি সমিতির উদ্দেশ্য প্রসারিত করার জন্য বহু প্রকারে চেষ্টা করেন এবং বাংলার কৃষির উপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করেন, সেগুলি উক্ত সমিতির ট্র্যানজ্যাকশন্‌স্ (কার্য বিবরণীসমূহের) প্রথম দিকের সংখ্যাগুলিতে প্রকাশিত হয়।

তিনি রয়্যাল এসিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ডের পত্ৰ আদান-প্রদানকারী সভ্য ছিলেন; তাছাড়া সাম্মানিক সভ্য ছিলেন বার্লিনের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, কোপেনহেগেনের রয়্যাল সোসাইটি অব সায়েন্সেস, বোস্টনের আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি এবং ভিয়েনার কাইজারলিশেন অ্যাকাডেমির। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলেরও তিনি সভ্য ছিলেন। প্রাচ্য বিদ্যাবিষয়ে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন; সেগুলি ঐ সকল সমিতির কোন না কোনটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থকার হিসাবে রাজা রাধাকান্ত দেবের খ্যাতি প্রধানত তাঁর সুবৃহৎ চারখন্ডে প্রকাশিত সংস্কৃত শব্দকোষ ‘শব্দকল্পদ্রুম’-এর জন্য। এই গ্রন্থটি রচনায় তিনি জীবনের চল্লিশটি বছর ব্যয় করেন এবং সম্পদেরও একটি বৃহৎ অংশ এর প্রকাশে ব্যয়িত হয়। এতে একই সঙ্গে আছে সংস্কৃত শব্দার্থ, বিশ্বকোষের মতো বিশদ ব্যাখ্যা এবং সংস্কৃত সাহিত্য বিজ্ঞানের সকল বিভাগের নির্ঘণ্ট। এই শ্রেণির একখানি গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশে যে সীমাহীন শ্রম, পান্ডিত্য, ব্যাপক ও বিস্তৃত গবেষণা করতে হয়েছিল তার তুলনা নেই, বিশেষ করে ভারতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সেই প্রথম যুগে; প্রভূত ব্যয়ও অনুমেয়। তিনি নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন; নিজস্ব প্রয়োজনের টাইপ নির্মাণ ও চালাই করান; ঐ শ্রেণির অক্ষরকে এখনও রাজা টাইপ নামে অভিহিত করা হয়। প্রথম খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৮২২ তে এবং শেষটি ১৮৫৮-এ। প্রকৃত ব্যবহারকারীকে এবং পৃথিবীর যে সকল দেশে সংস্কৃতের পঠনপাঠন ব সংস্কৃতের গুরুত্ব উপলব্ধ হয় সে সকল দেশের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুস্তকখানি বিনামূল্যে বিতরণ করে তিনি সবিশেষ আনন্দ পেতেন ৷ পান্ডিত্য, শ্রম ও ব্যয়ের জন্য প্রাপ্য প্রশংসা তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে প্রচুর পেয়েছেন। ভাষাতত্ত্বের পত্রপত্রিকা ও পুস্তকসমূহে গ্রন্থখানির উচ্চ প্রশংসা প্রকাশিত হতে থাকে এবং ভারতবর্ষ, ইউরোপ ও আমেরিকার পন্ডিতগণ পুস্তকখানি পেতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিদ্বৎসমাজ স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে তাঁকে সাম্মানিক বা পত্রব্যবহারকারী সভ্য করে নেন। রাশিয়ার জার, ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিক প্রভৃতি ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ তাঁকে রাজকীয় সম্মান ও অনুগ্রহ জ্ঞাপন করে আনন্দ লাভ করেন। সপ্তম ফ্রেডারিক তাঁর জ্ঞানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে পদক দ্বারা সম্মানিত করেন; সুবৃহৎ চেন সমন্বিত এই পদকটির এক পিঠে ছিল উক্ত রাজন্যে প্রতিকৃতি এবং অপর পিঠে মাল্যধারী বিজ্ঞান দেবতার প্রতিকৃতির উপরিভাগে লিখিত ছিল ‘প্রো মেরিটিস্’; পর্যায়ক্রমে একটি করে “FVII” এবং একটি মুকুট দ্বারা চেনটি তৈরি হয়েছিল। পদকটি প্রাপকের কাছে পাঠানো হয় কোর্ট অব ডিরেক্টরস মারফৎ।

তিনি সাহিত্য আলোচনা ও রচনায় প্রচুর পরিশ্রম করতেন ও সময় দিতেন। এতেই তাঁর সমস্ত সময় ও মনোযোগ সীমাবদ্ধ ছিল না। সে যুগের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় অংশ নিতেন; দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক বা সরকারকে সমর্থন করে এমন সকল আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। এদেশীয় বা ইউরোপের যে স্থানেরই হোক যোগ্য প্রার্থী হলেই তাঁর দান অকৃপণভাবে প্রসারিত হত।

১৮৫৫তে সরকার যে দু’জন ভারতীয়কে জাস্টিস অব দি পীস্ এবং মেট্রোপলিস- এর অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করেন, তিনি তাঁদের অন্যতম ছিলেন। বহু বছর তিনি ঐ পদদুটির কর্তব্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে সম্পাদন করেন।

১৮৫১তে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হবার সময় সর্বসম্মতিক্রমে তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন; আমৃত্যু তিনি ঐ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। প্রয়োজনীয় এই প্রতিষ্ঠানটি যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা নিতেন সে সবের নেতৃত্বে থাকতেন রাধাকান্ত। ১৮৩৭ এ তাঁর পিতা রাজা গোপীমোহন দেব বাহাদুরের মৃত্যু হলে অল্প দিনের মধ্যেই সরকার রাধাকান্তকে রাজা বাহাদুর পদবী, খেলাৎ (অর্থাৎ সাম্মানিক সজ্জা, মণিরত্ন, তরবারী ও ঢাল) উপহার দেন। এ উপলক্ষে সরকার ১৮৩৭-এর ১০ জুলাই লেখেন, ‘আপনার পূর্বপুরুষদিগের উচ্চ মর্যাদা, আপনার স্বদেশবাসীগণের মধ্যে আপনার উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানের গভীরতা এবং জনগণের মঙ্গল হইতে পারে, এমন সকল কার্যে আপনার অশেষ আগ্রহ বিবেচনা করিয়া সপারিষদ গভর্নর- জেনারেল সানন্দে আপনাকে এই মর্যাদা দান করিতেছেন।

১৮৫৯-এ মহামান্যা মহারাণী ভিক্টোরিয়া চমৎকার একটি পদক উপহার দিয়ে বিশেষ রাজকীয় অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন; পদকটির এক পিঠে অঙ্কিত মহারাণীর মুখ এবং অপর পিঠে লেখা ছিল ‘মহামান্যা রাণী ভিক্টোরিয়ার নিকট থেকে রাজা রাধাকান্ত বাহাদুরকে।’ এই উপলক্ষে সেক্রেটারি অব স্টেট স্যার চার্লস উড্ রাজাকে লেখেন, ‘মহারাণীকে উপহার স্বরূপ আপনার প্রেরিত শব্দকল্পদ্রুম মহারাণীর নিকট উপস্থাপিত করা হইয়াছে এবং যে রাজভক্তি সহকারে আপনি এই উপহার প্রেরণ করিয়াছেন, মহামান্যা অনুগ্রহপূর্বক এবং সম্পূর্ণতঃ তাহা উপলব্ধি করিয়া উপহারস্বরূপ এই পদকটি আপনাকে প্রেরণ করিবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়াছেন।

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ। রাজার বয়স তখন ৮৪ বছরের বেশি। কর্মবহুল জীবন থেকে বিদায় নিয়ে ঐ বছর তিনি নির্জনে ভগবদ্ চিন্তা করবার উদ্দেশ্যে পবিত্র বৃন্দাবনধামে চলে যান; কিন্তু ১৮৬৬ তে নতুন স্টার অব ইন্ডিয়া খেতাব দান উপলক্ষে আগ্রায় ভাইসরয় যে মহাদরবারের অনুষ্ঠান করেন, সেখানে ‘নাইট কমান্ডার অব দি মোস্ট এজলটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া’ খেতাব গ্রহণের জন্য রাজাদেশ অনুযায়ী রাজা রাধাকান্ত দেবকে উপস্থিত হতে হয়; তাঁকে নাইটের প্রতীক চিহ্ন, ২১টি পর্চার খেলাৎ, একটি হাতি ও একটি ঘোড়া উপহার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। জনশ্রুতি যে, রাজা রাধাকান্ত দরবার কক্ষে প্রবেশ করলে স্বয়ং ভাইসরয় স্যার জন লরেন্স দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান এবং মহারাণী ও ডেনমার্কের রাজা কর্তৃক উপহৃত পদক দুটি সাগ্রহে দেখতে থাকেন– পদক দুটি রাজা ঐ সময় নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাইসরয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমবেত সকল করদ নৃপতি, সম্ভ্রান্ত ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দাঁড়িয়ে উঠে রাজা রাধাকান্তকে দরবার কক্ষে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন; এরূপ সম্মাননার দৃষ্টান্ত দুর্লভ।

সকলেরই জানা যে, রাজা রাধাকান্ত দেব কখনও সম্মান পাবার চেষ্টা করেননি; সম্মান এসেছে আপনা থেকেই। মহারাণীর নির্দেশে তাঁকে নাইট কমান্ডার অব দি মোস্ট এগজলটেড অর্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া পদবীতে ভূষিত করা হবে জেনে তিনি কলকাতায় আত্মীয়স্বজনকে লেখেন যে, এতে তিনি খুব সম্মানিত বোধ করছেন, কিন্তু ঐ সম্মান গ্রহণ করবার জন্য তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে কলকাতা যেতে পারবেন না বলে দুঃখও বোধ করছেন। তাঁর এই চিঠির কথা জানতে পেরে স্যার সেসিল বিডন তাঁকে দার্জিলিং থেকে লেখেন :

প্রিয় রাজা,

গভর্নর জেনারেল বাহাদুর চান যে, আগামী নভেম্বরে আগ্রায় অনুষ্ঠিতব্য দরবারে সকল নব সৃষ্ট ‘নাইটস্ অব দি স্টার’ যেন উপস্থিত থাকেন।

আপনি ঐ দরবারে উপস্থিত থাকতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব; মথুরা থেকে (আগ্রার) দূরত্ব বেশি নয়, তাই আশা করব আপনার স্বাস্থ্য বা অন্য কোন কারণে আপনার যাওয়া বন্ধ হবে না।

আশা করছি, ১০ নভেম্বর নাগাদ আমি আগ্রা যেতে পারব; দরবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকবার ইচ্ছা আছে।

ইতি ভবদীয়

(স্বা) সেলিল বিডন

এই পত্র পাবার পর রাজা পন্ডিতবর্গের পরামর্শ চান; তাঁদের মতে, আগ্রা বৃন্দাবন ক্ষেত্রের মধ্যেই পড়ে, কাজেই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী আগ্রায় দরবার অনুষ্ঠানে রাজার যোগদান কোন সমস্যা নেই। পন্ডিতবর্গের অনুমতি পেয়ে রাজা উক্ত দরবারে উপস্থিত হন।

আমাদের বিশ্বাস, দরবার কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলে, রাজা সে দরবারে নিশ্চয়ই আসতেন না; তাই বাংলার এই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে সম্মান জানাবার জন্যই মহামান্য ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল দরবারের স্থান পরিবর্তন করেন।

রাজার উচ্চ শিক্ষা, জনহিতৈষী জীবন, আদর্শস্থানীয় পদমর্যাদা এবং সম্ভ্রান্ত বংশ, আর তার সঙ্গে হিন্দু ধর্মের প্রতিটি নির্দেশের প্রতি তাঁর দ্বিধাহীন আনুগত্য, ব্যক্তিগত চারিত্র্য গুণ, প্রবীণ বয়স, সংস্কৃতিবান কিন্তু সারল্যপূর্ণ প্রকৃতির জন্য তিনি সর্ব সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয়তা, মর্যাদা ও সম্মান পেয়েছেন। এরূপ সম্মানীয় জীবন বিরল।

স্বাভাবিকভাবে এবং যুক্তিযুক্ত কারণেই রাজা স্যর রাধাকান্ত দেব বাহাদুরকে কলকাতার হিন্দু সমাজের নেতারূপে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল; তাঁকে শ্রেষ্ঠ হিন্দুর মর্যাদা দেওয়া হত। তাঁর জীবনের আদর্শ ছিল “ঈশ্বর, রাজা ও মাতৃভূমি’। কায়স্থ সমাজের গোষ্ঠপতির কর্তব্যেও তিনি কখনও অবহেলা করেন নি। এই সব কারণে তিনি কলকাতার মিশ্র সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য নেতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর পৌত্রের বিবাহে এবং অন্যান্য উপযুক্ত অবকাশে ‘একজাই’ অনুষ্ঠানটি মহা সমারোহে সম্পন্ন করেন। ঐসব উৎসব-অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন গভর্নর জেনারেলসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসার উপস্থিত থাকতেন, তেমনি অতি সাধারণ জনের জন্যও সে সময় তাঁর প্রাসাদের দ্বার অবারিত থাকত। ‘দিল্লী পুনরুদ্ধার, লখনৌয়ের ত্রাণ এবং ভারতের শাসনব্যবস্থা ইংল্যান্ডেশ্বরীর হস্তে স্থানান্তর’ উপলক্ষে রাজা যে বল্ নাচ ও ভোজের আয়োজন করেছিলেন, সে উৎসব তাঁর পূর্ববর্তী সকল উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছিল। এই উপলক্ষে ইউরোপীয়দের পরিচালনায় রাজবাড়িটিকে আলোক ও অন্যান্য সজ্জায় যে মহাসমারোহের সঙ্গে সজ্জিত করা হয়েছিল, যে শ্রেণির অতিথিবর্গ উপস্থিত হয়েছিলেন, বল্ নাচের চমৎকারিত্ব, ভোজ্যের তালিকা ও উপাদেয়তা সমসাময়িক সংবাদপত্রে উচ্চ প্রশংসিত হয়। নিচে ওভারল্যান্ড ইংলিশম্যান থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হলো–

‘ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ এতদূরবর্তী একটি দেশে একজন সে দেশবাসীর পক্ষ থেকে ব্রিটিশ শক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রকাশ এই প্রথম; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, রাজার প্রাসাদটি এই প্রথম (ইংরেজের জয়ে) জয়ধ্বনি ও আনন্দ কলরবে মুখর হয়ে উঠল না। (ইতিহাসের) এ এক দুর্লভ সংঘটন যে, (পুরো এক শতাব্দী পূর্বে) এই শোভাবাজার রাজবাড়িতেই পলাশী যুদ্ধের বিজয়ী বীর ক্লাইভ ও অন্যান্য বীরের জয়ধ্বনি ও আনন্দ কোলাহলের প্রতিধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠেছিল : ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষার এমনি আগ্রহ ও ব্রিটিশ শক্তির প্রতি ভক্তির প্রকাশ সেদিনও এইভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই, একই পল্লীতে একই প্রাসাদে শতবর্ষ পূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষ (ইংরেজ) বীরদের সম্মান জানিয়ে যে আনন্দ লাভ করেছিলেন, আজ বংশগত রাজভক্তিতে এই সৎ শ্রদ্ধেয় প্রবীণ রাজা সেই (ইংরেজ) বীরগণের বংশধরগণকে সম্মান জানাতে পেয়ে গর্ব বোধ করেছেন। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর বংশে বহু প্রকারের পরিবর্তন ও সুযোগ এসেছে, কিন্তু পুরাতন ইংল্যান্ডের প্রতি তাঁর বংশের যে অবিচল রাজভক্তি প্রকাশ পেয়ে চলেছে, তাঁর মধ্যে দিয়ে সেই রাজভক্তি আজ প্রকাশ হতে পারায় তিনি গর্ব বোধ করছেন। মহামহিমান্বিতা, মঙ্গলময়ী মাধুর্যময়ী মহারাণী ভিক্টোরিয়া স্বহস্তে (এদেশের) শাসনভার নেওয়ার মুহূর্তে জনগণের রাজভক্তি ও অনুরাগ তাঁর মাধ্যমে সর্বপ্রথম প্রকাশ করতে পারার সৌভাগ্যলাভের জন্য তিনি দীর্ঘায়ু হউন এবং এই সৌভাগ্যের জন্য তিনি অধিকতর গর্ব বোধ করেছেন’।

১৮৬০-এ রাজা ঐরূপ একটি উৎসবের আয়োজন করেন; উপলক্ষ ছিল দেশে শান্তি স্থাপন। এ উপলক্ষে অধিকতর জৌলুসের জন্য ক্রোমোর্নে নিযুক্ত প্রফেসরদের নিয়োগ করা হয় বাজী পোড়ানো প্রদর্শন করার জন্য। বল্ নাচের আয়োজন তো ছিলই। এই নাচ ও অতিথি আপ্যায়নের বর্ণনায় ইংলিশম্যান পত্রিকা লেখে, ‘কি ব্যান্ডের বাদ্যে, কি আতশবাজি, কি সুরুচিপূর্ণ উদ্যানের আলোক সজ্জায় সামগ্রীকভাবেই রাজার উদ্যানটি যেন আরব্য রজনীর এক স্বপ্নলোকে পরিণত হয়েছিল আর প্রস্তর চত্বরসমন্বিত আলোকোদ্ভাসিত বিস্তৃত জলরাশি দেখিয়া মার্টিন অঙ্কিত বেলম্যাজারের ভোজসভার চিত্র বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল।’

এদেশীয় শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত সমাজ এবং রাজার গুণমুগ্ধ ব্যক্তিগণ তাঁর বিদ্যাবত্তা ও গুণাবলীর স্বীকৃতিতে ১৮৬০-এ তাঁকে একখানি মানপত্র দেন। তাছাড়া, মানপত্ৰ দানকারীদের প্রদত্ত চাঁদায় শিল্পী হাডসনকে দিয়ে তাঁর একটি পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি আঁকান হয়; প্রতিকৃতিখানি এখন এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের হলঘরে টাঙান আছে। মানপত্রে স্বাক্ষরদানকারী এবং চাঁদাদাতাদের মধ্যে অনারেবল অ্যাশলি ইডেন (বর্তমানে বাংলার ছোটলাট) ও রাজার অন্যান্য ইউরোপীয় বন্ধুগণও ছিলেন।

সকলকে শোকাচ্ছন্ন করে শ্রদ্ধেয় রাজা ১৮৬৭-র ১৯ এপ্রিল তাঁর বৃন্দাবনের আশ্রমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর কে সি এস আই-র শেষ সময়ের একটি প্রতিবেদন ‘দি ফ্রাইডে রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল আদর্শ মৃত্যু, আদর্শ সৎকার। পত্রিকাটি লিখেছে– ‘সকলেই জানেন যে, মৃত্যুর তিন দিন আগে থেকে রাজা ভয়াবহ সর্দিতে ভুগছিলেন। মৃত্যুর পূর্বরাত্রে শরীর ভারি বোধ হওয়ায় তিনি কোন আহার্য গ্রহণ করেন নি, সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্যাদি সম্পন্ন করে তিনি তাঁর উপাসনাগৃহে প্রবেশ করেন। এই সময় তাঁর বেয়াই তাঁকে ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিলে তিনি বলেন, ঔষধ রোগ নিরাময় করে, মৃত্যুর পথ রোধ করতে পারে না। যে ঔষধ সেবনে শাশ্বত জীবন লাভ করা যায়, তেমন কোন ঔষধ আপনার জানা থাকলে দিন। এই প্রকারের আর দু-চারটি কথা বলার পর, তিনি জপে মনোনিবেশ করেন, মালা জপ করা শেষ হলে, তিনি তাঁর প্রিয় ভৃত্যকে বলে, ‘নবীন, দুর্বল বোধ করছি, আমাকে দুধ খেতে দে’। দুধ খেয়ে তিনি জপমালা হাতে বসবার ঘরে যান। কিছুক্ষণ পরে আবার দুধ আনতে বলেন; এবার কিন্তু কোন কিছু গিলতে কষ্ট হওয়ায় তিনি আর বেশি দুধ খেতে পারলেন না। তারপর নবীনকে বললেন, ‘আজ আমি দেহত্যাগ করব; এজন্য দো-তলায় আর আমার থাকা উচিত নয়। পুরোহিতকে ডেকে পাঠা। (প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায়, বৃন্দাবনে পৌঁছে একজন স্থানীয় পন্ডিতকে তিনি পুরোহিত নিযুক্ত করেছিলেন; বহু পরিশ্রম করে বহুশাস্ত্র থেকে শেষকৃত্যের তিনি যে গুহ্যতত্ত্ব সংগ্রহ করেছিলেন, সে সবই তিনি পুরে াহিতকে শিখিয়েছিলেন।) পুরোহিত এলে, শেষকৃত্য সম্পর্কে আরও শিক্ষা দিলেন। ওই আসনে উপবিষ্ট থেকেই তিনি নবীনকে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর পর, দেহের সৎকার কিভাবে করতে হবে তোকে আগেই বলেছি। আবার তোকে বলছি, ভালভাবে শুনে নে। মৃত্যুর পর দেহটিকে ভালভাবে স্নান করাবি তারপর সেটিকে নতুন ধুতি পরাবার পর, তাতে গন্ধমাল্য ও বিভিন্ন প্রকারের ফুল সাজিয়ে দিবি। তারপর দেহ নিয়ে যমুনা তীর পর্যন্ত শোকযাত্রা হবে, সঙ্গে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে যাবেন বৈষ্ণব সমাজ। ঘাটে দেহটিকে আবার স্নান করাবি, আর পুরোহিতকে শেষকৃত্য সম্পর্কে যে উপদেশ দিয়েছি, এখনও বললাম, সেইমত প্রতিটি অনুষ্ঠান যেন সুচারুরূপে করা হয়। চিতা সাজাবি কেবলমাত্র তুলসী ও চন্দন কাঠ দিয়ে, অন্য কোন রকম কাঠ যেন দেওয়া না হয়, দেখবি (উল্লেখ করা যায় যে, তিনি নিজেই এই উদ্দেশ্যে প্রচুর শুষ্ক তুলসী সংগ্রহ করে রেখেছিলেন)। জীবিত অবস্থায় আমি যে-ভাবে শুই, ঠিক সেই ভাবে চিতায় আমার দেহ শোয়াবি, চিতার চার কোনে চারটে বেশ উঁচু বাঁশ পুঁতে তাতে আমার মশারী টাঙিয়ে দিবি; কিন্তু তাতে চিতার আগুন যাতে ধরে যেতে না পারে সেই রকম উঁচুতে মশারিটা খাটাবি। তারপর আমার দেওয়া উপদেশ অনুযায়ী দাহকার্য হবে। দেহের এক সের মাত্র যখন অবশিষ্ট থাকবে, সেই সময় চিতা নিবিয়ে ফেলবি। না-পোড়া এই দেহাবশেষটিকে তিন ভাগে ভাগ করে, একভাগ কচ্ছপদের খাওয়াবি, এক অংশ যমুনার গভীর জলে বিসর্জন দিবি আর শেষ অংশটি বৃন্দাবনের মাটিতে সমাধি দিবি; কিন্তু সাবধান, সমাধির গর্ত যেন বেশ গম্ভীর হয়, যাতে কোন জন্তু জানোয়ার সেটা মাটি খুঁড়ে তুলতে না পারে। দাহকার্য শেষ হবার পর নিঃশব্দে বাসায় ফিরে আসবি; বাসায় যেন সেদিন কোনো রান্না না হয়; খুব ক্ষিদে পেলে অন্য কোথাও গিয়ে কিছু খেয়ে নিবি। আমার মৃত্যুর দশদিন পর যমুনায় দশটি পিন্ড দিয়ে বৃন্দাবনের ব্রাহ্মণদের ভালভাবে ভোজ করাবি; এই সব শেষ হলে তোরা দেশে ফিরতে পারিস।’

এই সব কথা বলে রাজা নিচে নামবার উদ্যোগ করছেন, সেই সময় তাঁর বেয়াই মশাই এবং বৃন্দাবনের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। স্বাভাবিক শিষ্টাচার সহকারে তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। আঙিনায় তৈরি তুলসী বাগানে একটি তুলসী গাছের পাশে বৃন্দাবনের রজঃ দিয়ে একটি শয্যা প্রস্তুত করতে বলেন। এরপর জীবনক্ত রাজা শিরোদেশে শালগ্রাম শিলা রেখে সে শয্যায় শুয়ে মালাজপ করতে থাকেন। এরপর ‘আর কোনো মানুষের সঙ্গে তিনি কোন বাক্যালাপ করেননি। এই ভাবে, দুই ঘণ্টা যাবৎ ধ্যানময় হয়ে থাকার পর তিনি দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর সমগ্র মুখমন্ডল যেন হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁর মৃত্যুতে বৃন্দাবনের কুঞ্জে কুঞ্জে হরিধ্বনি ওঠে। তার মারফৎ তাঁর মৃত্যু সংবাদ কলকাতা পৌঁছে যায়। পল মল গেজেট যাঁকে ‘হিন্দু রোমান ক্যাথলিক’ নামে অভিহিত করে, এই ভাবেই তিনি পরলোক গমন করেন।

তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৬৭র ১৪ মে বেলা পাঁচটায় কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলে একটি শোক-সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, তাঁর একটি প্রতিকৃতি, (কটিদেশ পর্যন্ত) একটি প্রস্তর-মূর্তি এবং শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত ভাষার ছাত্রকে বাৎসরিক একটি স্বর্ণপদক দেবার জন্য একটি নিধি স্থাপিত হবে। এই উদ্দেশ্যে বড়লাট বাহাদুর থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের ছাত্র পর্যন্ত সকল শ্রেণির জনগণ চাঁদা দেন। মূর্তিটি এখন টাউন হলের একটি কুলুঙ্গিতে রক্ষিত আছে, পদকটি দেওয়া হয় সরকারী সংস্কৃত কলেজের শ্রেষ্ঠ স্নাতক ছাত্রকে, আর তাঁর প্রতিকৃতিটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলের শোভা বর্ধন করছে।

পরলোকগত রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর কে সি এস আই-র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বহু সম্ভ্রান্ত ইউরোপীয় ও ভারতীয় ভদ্রলোক বক্তৃতা করেন; আমরা এখানে এরূপ কয়েকটি বক্তৃতা সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি।

সভাপতি বাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সি এস আই, যে শোকাবহ ঘটনার জন্য এই সভা আহুত তাতে তিনি দুঃখ প্রকাশ না করে পারেন না। কিন্তু একটা সান্ত্বনা এই যে, যাঁকে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন, তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারছেন। সংস্কৃত কলেজে ছাত্রাবস্থায় রাজা রাধাকান্ত ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক; বক্তার মনে পড়ছে, প্রতিষ্ঠানটির মঙ্গলের দিকে রাজার কি গভীর আগ্রহ ছিল। পরবর্তীকালে তিনিও সংস্কৃত কলেজের অন্যতম পরিচালক হন; তখন এবং জনহিতকর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে কাজ করবার সময় তিনি দেখেছেন ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের উন্নতি বিধানে রাজার কি পরিমাণ আগ্রহ ছিল। আজ দেশে সংস্কৃত শিক্ষার তেমন মর্যাদা নেই, কিন্তু রাজার যৌবনকালে সংস্কৃত শিক্ষাকে সম্মান দেওয়া হত। অল্প বয়সেই তিনি সংস্কৃত পন্ডিত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর শব্দকল্পদ্রুম এক বিরাট কীর্তি। গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যিক বিশ্বকোষ; এতে নিহিত আছে অশেষ পান্ডিত্য ও পরিশ্রম। ইউরোপে এইরূপ একটি গ্রন্থ সংকলন করতে বহু পন্ডিতের প্রায় শতাব্দীকালের পরিশ্রম প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক পুস্তকসহ রচনা করে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারেও তিনি বিশেষ সহায়তা করেন। এদেশীয়দের রাজনৈতিক উন্নতি বিধানের জন্য যত আন্দোলন হয়েছে তিনি সব সময় সে-সবের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। লাখেরাজ পুনঃগ্রহণের বিরুদ্ধে এদেশে এক বিরাট আন্দোলন হয়েছিল; (সরকারের) এই চেষ্টার প্রতিবাদে টাউন হল-এ মহতী এক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে সভায় কমপক্ষে আট হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন; রাজা সে আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। জমিদার সভার তিনি অন্যতম প্রধান সভ্য এবং শুরু থেকেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্মানিত সভাপতি ছিলেন। তিনি স্ত্রীশিক্ষা প্রসারেও উৎসাহী ছিলেন। সেই যুগেও তিনি তাঁর গৃহ স্ত্রীশিক্ষার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ‘আজ আপনারা সেই মাননীয় মানুষটিকে সম্মান জানাতে সমবেত হয়ে নিজেদেরও সম্মানিত করেছেন।

বাবু (পরে, মহারাজা এবং সি এস আই) রমানাথ ঠাকুর বলেন :

‘আমার মনে হয়, রাজা রাধাকান্তর মৃত্যু জাতির পক্ষে এক বিরাট ক্ষতি। কি প্রবীণ কি নবীন, কি শিক্ষিত সকলেই তাঁর মৃত্যুতে সমবেত অশ্রুপাত করছেন; যে- কোন দিকে ফিরলেই শুনতে পাই সকল স্তরের মানুষের বিলাপ ধ্বনি। সত্যসত্যই তাঁর মৃত্যু আমাদের কাছে বিরাট এক দুঃখবহ ঘটনা ৷

‘রাজা রাধাকান্ত ১৭০৫ শকাব্দের ১ চৈত্র তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ধনী অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম; কিন্তু ধনী পরিবারের সন্তানদের যে-সকল আচার আচরণের ফলে আমাদের বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল, তিনি সে-সব দিকে যান নি, এটা বিস্ময়কর। তরুণ বয়সে তিনি ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন এবং অল্পকালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষার বিশিষ্ট পন্ডিতরূপে পরিচিত হন। সে-যুগের বিবেচনায় তাঁর ইংরেজি শিক্ষাও যথেষ্ট প্রশংসার যোগ্য। বেশ কয়েকখানি বাংলা পুস্তক, অধিকাংশই প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক, তিনি রচনা ও প্রকাশ করেন, তার ফলে এদেশে শিক্ষা বিস্তারে অনেক সুবিধা হয়। তাঁর শেষ ও মহৎ রচনা, যে রচনার জন্য তাঁর নাম সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে চিরকাল যুক্ত থাকবে, সে হল ‘শব্দকল্পদ্রুম।’ সংস্কৃতে আমার কোন পান্ডিত্য না থাকায়, এই পুস্তকটির গুণাগুণ সম্বন্ধে কিছু বলার অধিকার আমার নেই; তবে, এরূপ একখানি পুস্তক বিচার বিবেচনা করবার যোগ্যতা যাঁদের আছে, সে-সব পন্ডিত একবাক্যে স্বীকার করেন যে, পুস্তকখানি হিন্দু সাহিত্যের স্তম্ভস্বরূপ। এই পুস্তকখানি রচনায় তিনি জীবনের প্রায় পঞ্চাশটি বছর অতিবাহিত করেন, তাঁর এই আয়াস ও শ্রমের জন্য তিনি, আমাদের প্রিয় মহারাণী সহ ইউরোপের বহু রাজন্যের ও পন্ডিতমন্ডলীর মুগ্ধ প্রশংসা অর্জন করেছেন।

‘রাজা রাধাকান্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু হলেও, সংকীর্ণমনা ছিলেন না। মতবাদে ও চিন্তায় তিনি ছিলেন উদার। উদাহরণস্বরূপ আমি একটি দৃষ্টান্ত দিতে চাই; এদেশীয় কোন এক ভদ্রলোক বর্তমান সর্বোৎকৃষ্ট সভ্যতার মহান দিকগুলি স্বচক্ষে দেখবার ও স্বদেশবাসীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনে একদল গোড়া লোক তাঁর সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার অনুরোধ জানাতে রাজার নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন; রাজা তাঁদের কথা শোনার পর, পরের দিন আসতে বলেন। পরের দিন তাঁদের তিনি বলেন, ভদ্রলোককে অসম্মান তো দূরের কথা, সম্মান জানান উচিত; ‘আমি তাঁকে কখনও বর্জন করব না। দেশের মঙ্গলের জন্যই তিনি ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন; এই ধরনের মানুষদের সামাজিকভাবে অমর্যাদা করা উচিত নয়।’ ভদ্রলোকের প্রতি তাঁর নিজেরও শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গোঁড়ারা বলতে থাকেন, ‘ঘোর কলিযুগ, তা নইলে রাজার মতো অমন ঋষিতুল্য মানুষও কি এমন বিচার করতে পারেন’? সভাপতি মশায় পূর্বেই উল্লেখ করেছেন, রাজা স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে উৎসাহী ছিলেন; উৎসাহী তিনি অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু তিনি চাইতেন না যে, মেয়েরা সাধারণ বিদ্যালয়ে যাক, চাইতেন গৃহের উপদেশের মারফৎ তারা শিক্ষিত হয়ে উঠুক।

‘আপনারা সকলেই জানেন, রাজাকে ইউরোপীয় ও ভারতীয়গণ সমভাবে সম্মান করতেন; এই সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা মহা বিস্ময়কর যে, রাজা রাধাকান্তর কোনো শত্রু ছিল না। তিনি ছিলেন মূর্তিমান সজ্জনতা। তাঁর মতো একজন ব্যক্তিকে সম্মান জানাতে পেরে, দেশবাসী নিজেদেরই সম্মানিত করল’ (উচ্চ-করতালি ধ্বনি)।

বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র (বর্তমানে ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রায় বাহাদুর এবং সি আই ই) বলেন :

‘এই সভায় এমন কেউ উপস্থিত নেই, যিনি শ্রদ্ধেয় রাজাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না। এমন কেউ নেই যিনি মনে করেন না যে, রাজা দেশের যে সেবা করে গেছেন তাঁর প্রতি সম্মান জানাবার জন্য এই সভায় উপস্থিত হয়ে উচিত কাজ করেছেন। এইভাবে মিলিত হয়ে আমরা উপযুক্ত কাজই করেছি, আর যাঁরা আমাদের মঙ্গলসাধন করে গেছেন, তাঁদের গুণকীর্তন করাও আমাদের উচিত। মৃতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের রীতি চলে আসছে সর্ব যুগে সর্ব দেশে সর্ব সমাজে; যাঁরা মানবজাতির মঙ্গলসাধন করে গেছেন, এই সম্মান লাভের অধিকারী তাঁরা আরও বেশি। যোগ্যতার প্রতিই এই সম্মান, এই সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্য। শুধুমাত্র লাভ লোকসানের হিসাবকারী নিম্নরুচির মানুষের পক্ষেও এই সম্মান প্রদর্শন উপকারজনক; কারণ মৃতব্যক্তিগণ এতদ্বারা উপকৃত হন, বা না হন, জীবিত ব্যক্তিরা এর দ্বারা বেশি উপকৃত হন। রাজা রাধাকান্তর স্মৃতি অবশ্যই এই মর্যাদা দাবী করতে পারে। উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের অনেকেই, বিশেষত সভাপতি মহাশয় স্বয়ং, রাজার সঙ্গে আপনাদের দীর্ঘদিনের এবং ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কারণে, তাঁর সম্বন্ধে আমা অপেক্ষা অনেক বেশি কথা আরও ভালভাবে বলতে পারবেন; তবে, আমি তাঁর সঙ্গে পঁচিশ বছরব্যাপী বন্ধুত্বের সুযোগ পেয়েছি; এটুকু বলতে পারি যে, এই সময়কালে তাঁর উচ্চগুণাবলী দেখতে ও উপলব্ধি করতে আমি ভুল করিনি।

‘রাজার বাল্য-বৈশোর-যৌবনকালের কথা আমার বিশেষ কিছু জানা নেই; যেটুকুও বা জানি, তার আভাস ইতিপূর্বে বাবু রমানাথ ঠাকুর দিয়েছেন। রাজার বালক বয়সের যুগে বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া শেখা ছিল অসম্মানের বিষয়, অবশ্য কিছু পাঠশালা ব্যতীত সেযুগে উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয়ও ছিল না; আর সে পাঠশালাগুলিও ছিল আদিম অবস্থায়। কিন্তু তাঁর যোগ্য পিতা ইংরেজদের সঙ্গে বহু মেলামেশার ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষালাভের উপকারিতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাই সে যুগের অসুবিধা সত্ত্বেও পুত্রকে তিনি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন। তার সঙ্গে বাড়িতে আরবি, ফার্সী ও মাতৃভাষা শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছিল– সমাজে উচ্চস্থলাভিষিক্তের উপযুক্ত শিক্ষার কোন ত্রুটি রাখা হয় নি। আর তিনিও এই সব প্রচেষ্টার অনুপযুক্ত ছিলেন না। পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান, স্বাস্থ্যবান, প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী রাধাকান্ত পুস্তকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন; গৃহশিক্ষকদিগের প্রদত্ত শিক্ষার পূর্ণ সুযোগ তিনি গ্রহণ করেন। মিঃ কামিংসের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করবার সময় তিনি গৃহে শিক্ষালাভ অপেক্ষা বিদ্যালয়ে উপযোগিতা ও উপকারিতা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন, সেইজন্য পরবর্তী জীবনে তিনি ইংরেজি ধরনের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও উৎসাহ প্রদর্শন করেন। সে যুগে রাজকুমার ও অভিজাত ব্যক্তিদের পক্ষে চাকুরি বা পদ গ্রহণ স্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু রাজা ওইসব প্রচলিত চালচলনে আস্থাশীল ছিলেন না। এদেশে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দ্বারা শিক্ষার প্রসার ও উন্নতির জন্য পরলোকগত ডেভিড হেয়ার কর্তৃক পরিকল্পিত স্কুল সোসাইটির তিনি সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন। এই পদে থাকাকালে তিনি কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিমূলক বহু পরিবর্তন সাধন করেন। বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় তাঁর পরিচালনাধীন ছিল; প্রায়ই তিনি এই সকল বিদ্যালয় প্রদর্শনে যেতেন, তাদের উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য অনেক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন; বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তকসমূহ রচনা করেন– আমাদের ভাষায় এই প্রকারের পুস্তক এই প্রথম রচিত ও প্রকাশিত হয়। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরকাল অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ও কঠোর পরিশ্রম সহকারে এর গভর্নরের দায়িত্বভার বহন করেন। তিনি এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলে কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন এক সাধারণ সভায় তাঁর অপরিমেয় (ঐ পদে) সেবামূলক কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কেবলমাত্র বালকদের শিক্ষাপ্রসারেই তাঁর মনোযোগ ও চেষ্টা সীমাবদ্ধ ছিল না। এদেশীয় স্ত্রীলোকদিগের শিক্ষা ও সংস্কৃতিগত দুরবস্থা প্রথমাবধিই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল; অনারেবল্ মিঃ বেথুনের ভাষায়, এদেশীয় স্ত্রীলোকদের আজীবন অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে দেওয়ার মধ্যে যে নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বুদ্ধিতা আছে একথা ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। এদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম তাঁরই বাড়িতে বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রীদের পুরস্কার গ্রহণের জন্য সমবেত হওয়ার আনন্দময় দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। এ বিষয়ে তিনি যে পরিপূর্ণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি উচ্চ প্রশংসার দাবী অবশ্যই করতে পারেন। আবার, হিন্দু সমাজের নেতা ও প্রতিনিধিরূপে তিনি তাঁর পরিশীলিত ব্যবহার, ঔদার্য ও একান্ত সততার জন্য তাঁর সম্প্রদায়ের সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিরূপে তিনি সাধারণভাবে সর্বসম্প্রদায়ের মঙ্গলের জন্য যেরূপ উৎসাহ ও আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তার জন্য দীর্ঘকাল স্বদেশবাসী তাঁকে স্মরণ করবে। প্রায় প্রতিটি জনসভার তিনি ছিলেন সভাপতি এবং এদেশবাসীর সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। এদেশের কিছু কিছু তথাকথিত সমাজ সংস্কারক তাঁর মধ্যে যে সকল বৈশিষ্ট্য আশা করেছিলেন, তার সব কিছুই হয়তো তাঁর মধ্যে ছিল না; তাঁদের বহু কাজেরই হয়তো তিনি বিরোধিতা করেছিলেন; পূর্বপুরুষদের (গোঁড়া) ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে প্রতিপালিত তিনি হয়তো, শিশু ও বালকবালিকাদের ধর্মান্তরের প্রতি বিমুখ ছিলেন; অবশ্যই তিনি গো- হত্যার বিরোধিতা করেছিলেন; মদ্যপানের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর তীব্র বিরূপতা প্রকাশ করেছেন, অনেকের কাছে আবার তাঁর এই মনোভাব ছিল সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু মহাশয়, যে কাজের দ্বারা সমাজের প্রকৃত উপকার হতে পারে, তিনি কখনও তার বিরোধিতা করেননি; কুসংস্কারগ্রস্তের গোঁড়ামিও তাঁর মধ্যে ছিল না ৷ প্রকৃত সমাজ-সংস্কারকদের প্রতি তিনি শত্রুভাভাপন্ন ছিলেন না। মেডিক্যাল কলেজে সব ব্যবচ্ছেদকে তিনি দোষাবহ মনে করেননি। গোড়া ধর্মীয় বিষয়ে তিনি যেমন উদার হস্তে অর্থ ব্যয় করেছেন, ঠিক তেমনি ঔদার্যের সঙ্গে চিকিৎসা বিদ্যার উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য যাঁরা ইংল্যান্ড যেতে চেয়েছেন, তাঁদের জন্যও অর্থব্যয় করেছেন। হিন্দু সমাজের উপর তাঁর অসীম প্রভাবকে তিনি এ বিষয়ে যে ভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন, তার জন্য তিনি সর্বোচ্চ প্রশংসার অধিকারী। কোন কারণেই কারও কাছে তাঁর বিবেকের তিনি স্বাধীনতা বর্জন করেননি– স্বাধীনমনা কেই-বা তা করে? কিন্তু তাই বলে তিনি মুষ্টিমেয় সেই সব মানুষদেরও একজন ছিলেন না, যাঁরা নিজেদের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগের নামে সমগ্র জাতির বিবেককে পদদলিত করে চলেন। নিজ নিজ মতবাদ বা বিশ্বাসে দৃঢ় থেকেও অপরের মতবাদে বা বিশ্বাসে আঘাত না করার মধ্যে যে মহত্ত্ব নিহিত আছে, সেটা যে কারও মতো আমিও ভালভাবে উপলব্ধি করি; উপলব্ধি করতে পারি না সেই সব মানুষের মতবাদের দৃঢ়তা, যাঁরা স্বীয় মতবাদ রক্ষার জন্য অন্যরূপ মতবাদীর উপর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করেন– রাজা রাধাকান্ত তাঁদের মতো ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু হয়েও যে অন্যমতাবলম্বীর প্রতি উদার ছিলেন, এ বিষয়ে আমার সঙ্গে আপনারা একমত হবেন বলেই আমার ধারণা। তাঁর কঠোর সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ঔচিত্যবোধ সম্বন্ধে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারি, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই, কেননা আপনারা সকলেই এ-বিষয়ে আমার মতই বিস্তারিত ভাবে জানেন। আচার আচরণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় ও আদর্শস্থানীয় এ বিষয়ে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন চীফ জাস্টিস স্যার লরেন্স পীল ঠিকই বলেছিলেন, ‘তার (রাজা রাধাকান্তর) পরিশীলিত শিষ্টাচারবোধ আমাদের সকলেরই অনুকরণযোগ্য।’

‘এখন আমি তাঁর পান্ডিত্য সম্পর্কে কিছু বলব। দুঃখের বিষয়, এখন এদেশে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না; কাজেই, এদেশে প্রচলিত প্রাচীন ভাষা সমূহে তিনি যে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, অনেকেই হয়তো সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন না। আমি সামান্য ব্যক্তি হলেও, যেহেতু ভারতীয় সাহিত্যের উপর কিছু কাজ করছি, সেই অধিকারে আপনাদের বলতে পারি যে, তাঁর এই ক্ষেত্রের কাজ ছিল উচ্চতম মানের। প্রতিভাধর বা ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতার অধিকার বলতে যা বোঝায়, রাজা তা ছিলেন না। তাঁর পান্ডিত্য অনায়াসলব্ধ ছিল না। ‘আমার কথা ফুটেছিল কবিতার মধ্য দিয়েই, কেননা কবিতা আমার মধ্যে এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই’ একথা বলার অধিকারী তিনি ছিলেন না। অন্যদের পক্ষে যেমন, তাঁর পক্ষেও তেমনি জ্ঞানার্জনের কোন রাজপথ ছিল না। প্রচুর পরিশ্রম করেই তাঁকে পথ করে নিতে হয়েছিল। ধন সম্পদের মধ্যেই তাঁর জন্ম হয়েছিল, কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে অন্যরা যেমন আরাম আয়েসের জীবন-যাপন করেন, তিনি তা করেন নি। পান্ডিত্য অর্জনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন কঠোর পরিশ্রমের জীবন; আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের গভীরে প্রবেশের জন্য তিনি সারাটা জীবন ব্যয় করেছেন। বহু বছরের অবিরাম পরিশ্রমে– একটানা চল্লিশ বছরের পরিশ্রমে– তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘শব্দকল্পদ্রুম’ প্রকাশ করেছিলেন– যিনিই এই বিরাট সাহিত্যকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছেন, তিনিই এর প্রশংসা না করে পারেন নি। আমাকে আপনারা বিশ্বাস করেন বলেই, এবিষয়ে আমার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে বলছি না। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত রচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করার যোগ্যতা যাঁদের সর্বাধিক, পান্ডিত্যের রাজ্যে যাঁদের অভিভাবকরূপে গণ্য করতে পারি, অনেক বিচার বিবেচনার পর যাঁরা কোন রচনার প্রশংসা করেন, অর্থাৎ ইউরোপের সেই পন্ডিতসমাজ সর্বপ্রথম রাজার এই অভিধানখানির উচ্চ প্রশংসা করেন এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতেও তাঁরা বিলম্ব করেন নি। সেন্ট পিটারবর্গের ইম্পিরিয়্যাল অ্যাকাডেমি, গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল এসিয়াটিক সোসাইটি এবং উত্তরাঞ্চলের পুরাতত্ত্ব-বিষয়ক রয়্যাল অ্যাকাডেমি তাঁকে হয় সাম্মানিক ডিপ্লোমা দেন বা পত্রীয় সদস্য করে নেন। এইসব প্রশংসাপত্রের মূল্য সন্দেহাতীত। এ ছাড়া ইউরোপের রাজন্যবর্গও তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রাশিয়ার প্রাক্তন জার ও ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিক তাঁকে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন; সর্বোপরি আমাদের মহামহিমাময়ী সম্রাজ্ঞী তাঁর প্রদত্ত সম্মানসমূহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দি অর্ডার অব দি মোস্ট এগ্‌জটেড স্টার অব ইন্ডিয়া’ দ্বারা তাঁকে সম্মানিত করেন। কোষগ্রন্থখানির যোগ্যতা না থাকলে, এত সম্মান তিনি নিশ্চয়ই লাভ করতে পারতেন না। রাজা রাধাকান্ত আজ আর নেই; পরিণত বয়সে রাজন্যবর্গ ও পন্ডিতমন্ডলী প্রদত্ত সম্মাননা ও সাধারণ্যের শ্রদ্ধার মধ্যে তিনি পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু তাঁর কীর্তি বর্তমান– যতদিন পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনা হবে, ততদিন তাঁর অপরিমেয় পরিশ্রমে সার্থক এই কীর্তিও অক্ষয় থাকবে।’

জন কোরেন বলেন,

‘ইতস্তত করছিলাম যে বক্তৃতা করব কিনা, ইতস্ততার আরও কারণ এই যে, আজকের বিষয়বস্তুটা একান্তই আপনাদের, কিন্তু ভেবে দেখলাম এই বৃহৎ ব্যক্তি, পূণ্যবান ব্যক্তি কোন জাতি বিশেষের নিজস্ব সম্পত্তি নন, তিনি ছিলেন সকলের, সর্বজাতির সাধারণ সম্পত্তি।

‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর দেশের সাহিত্য ও শিক্ষার উন্নতির জন্য চেষ্টা করে গেছেন। এই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই, তিনি আজ সেই লোকে অবস্থান করছেন, যেখানে দুর্বৃত্তরা আর জ্বালাতন করতে পারে না, ক্লান্ত ব্যক্তিগণ পান বিশ্ৰাম।

‘আপনারা সমবেত হয়েছেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য, স্মরণ করবার জন্য নয়- তাঁকে স্মরণ করার প্রশ্ন ওঠে না, কেননা মনে হয়, তিনি তাঁর সেই প্রশান্ত, নম্র, শান্ত মূর্তিতে –আভিজাত্যের প্রতীকস্বরূপ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

‘আজ আপনারা যে সম্মান প্রদর্শন করছেন, ভবিষ্যৎ বংশধরগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে তা স্মরণ করবেন।

‘বহু বছর যাবৎ তাঁর সঙ্গে পরিচিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল– অতি সঙ্কট ও সমস্যার মধ্যেও তাঁকে আমি দৃঢ় থাকতে দেখেছি–মনে হয়েছে এদেশবাসীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশেষ্ঠ ব্যক্তি।

‘প্রাচীন গ্রীক বাগ্মী বলেছিলেন, ‘পাণ্ডিত্যই আমাদের ভালমন্দ বিচার করতে শেখায়,’ কিন্তু রাজা রাধাকান্তর মানবতাবোধ, দয়া, শিষ্টাচার–মানুষ মাত্রেরই প্রতি তাঁর প্রেম ছিল সহজাত, হৃদয়জাত, শিক্ষা ও পাণ্ডিত্যসঞ্জাত নয়। দু’ একজন বাদে এদেশবাসীদের মধ্যে আর কেউই তাঁর মতো স্বাভাবিক উচ্চস্থানের অধিকারী ছিলেন না——সর্বসাধারণের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাও তাঁর মতো আর কেউ লাভ করেন নি। স্বদেশবাসীকে তিনি ভালবেসেছিলেন। কিছু বলব বলে আজকের সভায় আমি আসিনি, কিন্তু আসার পর, প্রয়াত শ্রদ্ধেয়কে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন না করে পারলাম না। তাঁর মতো ধার্মিক ও মহাপ্রাণ ব্যক্তি হয়তো আর আমরা পাব না।’

বাবু কিশোরীচাঁদ বলেন :

‘যে মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি, তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার সবিনয় শ্রদ্ধা নিবেদনের এই সুযোগের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমাদের সমাজ (সম্প্রদায়ে) তাঁর মতো এমন সরল, নিষ্কলঙ্ক, সম্মানিত ও প্রশংসাধন্য জীবন খুব কম ব্যক্তিই যাপন করেছেন। যাতে স্বদেশের মঙ্গল হয়, তার প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা সব সময়ই বিদ্যমান ছিল, (করতালি)। সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্য, কিন্তু এইরূপ একটি পরিবারের ভোগোন্মত্ত মাত্র নগণ্য পুরুষরূপে তিনি ভবিষ্যৎ বংশধরগণের নিকট পরিচিত হয়ে থাকতে চাননি। অলস এশিয়াবাসীর নিকট যে সকল প্রলোভন অপ্রতিরোধ্য, তিনি সেই সকল প্রলোভন ও ‘বাবু প্রথার’ বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজেকে সাহিত্যের কাজে উৎসর্গ করেছিলেন, নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশে শিক্ষাবিস্তারের মহান কাজে। মানব সেবাই হল মানব জীবনের সর্বোচ্চ আদর্শ, এই আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার এবং প্রতীচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান প্রসার কেন্দ্র ‘মহাবিদ্যালয়’টির প্রতিষ্ঠাতা ও সমর্থকদের সঙ্গে সহযোগিতা দ্বারা তিনি তাঁর এই উচ্চ আদর্শকে সার্থকতা দিতে পারবেন। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটির বিকাশ ও উন্নতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষা প্রসারে যাঁকে আমরা দেবদূত বলতে পারি সেই ডেভিড হেয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বহু প্রাথমিক ও সহায়ক পাঠশালার উন্নতির প্রতিও তাঁর সবিশেষ দৃষ্টি ছিল। এই সকল পাঠশালায় নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রচলিত করে সক্রিয়ভাবে ও পন্ডিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তরে সেগুলির জন্য স্বগৃহে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সকল পাঠশালায় নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রচলিত করে সক্রিয়ভাবে ও পন্ডিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে এবং নির্দিষ্ট সমায়ান্তরে সেগুলির জন্য স্বগৃহে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তিনি এগুলির সবিশেষ উন্নতি বিধান করেন। নব প্রতিষ্ঠিত স্কুল বুক সোসাইটিকে তিনি তাঁর সাগ্রহ পরামর্শ ও সহায়তা দিয়েছিলেন যাতে উক্ত সোসাইটি কোমলমতি বালক বালিকাদিগের জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে পারে। কিছুকাল তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক দেশীয় সম্পাদকও ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের সম্পর্করূপে, হিন্দু কলেজের পরিচালক সমিতির সভ্য হিসাবে, স্কুল বুক সোসাইটির সম্পাদক এবং ডেভিড হেয়ারের পাঠশালাসমূহের পরিদর্শকরূপে তিনি এদেশের শিক্ষা বিস্তারে যে বিপুল কাজ করে গেছেন, তার জন্য দেশবাসী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে চিরকাল স্মরণ করবে।

‘তাঁর সময়ে স্ত্রীশিক্ষা ছিল বিতর্কিত বিষয়; তিনি মধ্যপন্থা গ্রহণ করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্য বিদ্যালয়ের পরিবর্তে ‘জেনানা’ ব্যবস্থা সুপারিশ করেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, তিনি মেয়েদের অজ্ঞ ও অলস করে রেখে মানুষ করার কুফল সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। কিন্তু রাজার খ্যাতি পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে তাঁর প্রখ্যাত সংস্কৃত কোষগ্রন্থখানির জন্য পূর্ববর্তী বক্তাগণ এ সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে বলেছেন। বহু পরিশ্রমসাধ্য এই পুস্তকখানি রচনায় তাঁর জীবনের সর্বোত্তম সময় ব্যয়িত হয়েছে। এই পুস্তকখানিই তাঁর স্মৃতির জয়স্তম্ভ হয়ে থাকবে। সংস্কৃতশাস্ত্র ও সাহিত্য অধ্যয়ন যাতে সুগম হয় সেইভাবেই গ্রন্থখানিকে ব্যাপক ও বিশদ করা হয়েছে।

‘একাধিক বক্তা রাজার ধর্মমত বিষয়ে বলেছেন। এ বিষয়টির আলোচনা আমার মনোমত বিষয় নয়; কারণ, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই বিষয়টি জনসভার আলোচিত না হলেই ভাল হয়। রাজার উচ্চ গুণাবলী অপর কোন ব্যক্তি অপেক্ষা আমি কম হৃদয়ঙ্গম করি না; কিন্তু বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র যেভাবে প্রশংসার বান ডাকিয়ে দিয়েছেন, সেটা আমি তো নই-ই, রাজার আত্মাও সম্ভবত সমর্থন করবেন না। বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র রাজাকে এমনভাবে বর্ণনা করলেন, যেন রাজা রাধাকান্তর মধ্যে মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল, যেন তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানব; তাঁর কু- সংস্কারসমূহকে তিনি এমনভাবে বর্ণনা করলেন, যেন সেগুলি প্রগতির পক্ষে বাধাস্বরূপ না হয়ে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। উনি আমাদের বোঝাতে চাইলেন যে, রাজা যেন সব সময়েই সমাজের প্রগতির জন্য কাজ করে গেছেন– তাঁর কোন কাজই যেন প্রতিক্রিয়াপন্থী ছিল না। এই ধরনের উক্তির বিরোধিতা না করলে, আমি আমার বিবেকের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকব। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইনের বিরোধিতা করে, ‘ধর্মসভা’র পৃষ্ঠপোষকতা করে, বা ‘লেক্স-লসি’ (ধর্মান্তরিত হলেও পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার রক্ষা সম্পর্কিত আইন)-এর বিরুদ্ধতা করে, বা ‘বান্ধবসমাজের বহুবিবাহ-বিরোধী আন্দোলন দ্বারা সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র পেশ করে রাজা রাধাকান্ত প্রগতিশীল কাজ করেন নি। এ সব কাজ করার সময় তিনি অবশ্যই ভেবেছিলেন যে, তিনি আপন বিবেক অনুযায়ী কাজ করছেন, কিন্তু যত না বুঝেই হোক, তিনি যে প্রগতি ঘড়ির কাঁটা পিছনে ঘোরাচ্ছিলেন, এতে তো কোন সন্দেহ নেই। সত্য কথা বলতে কি, তাঁর সময়ের অপর কয়েকজন সুপন্ডিত ব্যক্তির মতো তিনি তাঁর পান্ডিত্য সত্ত্বেও, যে ভাবধারার মধ্যে তাঁরা মানুষ হয়েছিলেন, সেই ভাবধারাই তাঁরা আজীবন আঁকড়ে ধরেছিলেন। আসল কথা, তিনি সেই সব বিধিব্যবস্থা, অভ্যাস ও সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারেন নি এ সবের প্রতি তাঁর আসক্তি ও শ্রদ্ধা, তাঁর শিক্ষা সংস্কার ও প্রসার ও অন্যান্য উদার চিন্তা ও কাজের মতই কর্মোম্মাদনায় পূর্ণ। কিন্তু হিন্দু ধর্মে তাঁর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা তাঁকে অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি অনুদার করে তোলেনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি আপন বিবেকের আলোকে আপন পথে চলেছেন। অকপট বিশ্বাস যে- কোন মানুষেরই সর্বোচ্চ গুণরূপে পরিগণিত হয়। ধর্মের প্রতি তাঁর এই অকপট বিশ্বাসকে সেই মর্যাদা অবশ্যই দিতে হবে। তিনি যা বলতেন, যা বিশ্বাস করতেন, কাজও করতেন সেই অনুযায়ী– এ বৈশিষ্ট্য তাঁর আরও কিছু উচ্চশিক্ষিত স্বদেশবাসী সম্পর্কে অবশ্যই বলা যায় না– যারা সকালে পূজা-আহ্নিক করেন, আর বিকালে নিষিদ্ধ মাংস দিয়ে আহার সমাধা করেন– তাঁরা মুখে বলেন এক, করেন আর এক। পরলোকগত রাজার ধর্মমত ও বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ধর্মমত ও বিশ্বাসের অবশ্যই পার্থক্য ছিল, কিন্তু তাঁর ছিল আদর্শের প্রতি একাত্মতা, গভীর বিবেকবোধ, শিক্ষা প্রসারের প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ, এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন মানবতাবোধ—- এই সকল কারণে, আমি একান্ত বিনীতভাবে এই মহান পুরুষের স্বর্গত আত্মার প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’ (উচ্চ অভিনন্দন)

মিঃ মনত্ৰো :

‘বাগ্মী মিঃ কোকরেন যে ভাব ও ভাষায় তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন, তার সঙ্গে সহমত হলেও, আমি সামান্য দু’চার কথায় আমার বক্তব্য রাখব। বেশ কয়েক বছর যাবৎ রাজার বন্ধুত্বলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সত্য সত্যই একজন প্রকৃত মহৎ ও সৎ মানুষের তিরোধান ঘটল। পূর্ববর্তী বক্তাগণ পরলোকগত রাজার ধর্মমত সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেও, এ সম্পর্কে আমি অল্প দু’একটি কথা বলতে চাই। তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের অনুসৃত প্রতীকী মরমীয়াবাদের প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন। রাজার নৈষ্ঠিক হিন্দুর আগাগোড়া ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। আজ এখানে স্বৰ্গত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য খ্রিস্টীয়ান ধর্মগুরুগণও সমবেত হয়েছেন দেখে, আমি সভায় একটি প্রশ্ন রাখতে চাই, যাঁরা তাঁকে জানতেন বা তাঁর মন ও চরিত্র বোঝাবার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কি কখনও তাঁকে কুসংস্কারগ্রস্ত বলে মনে করেছেন? ধর্মে নিষ্ঠা বা গোঁড়ামি ছিল তাঁর নিজস্ব ব্যাপার– তাঁর বিশ্বাস, তাঁর সংস্কার ছিল (যেমন হওয়া উচিত প্রতিটি মানুষের) তাঁর ঈশ্বর ও তাঁর বিবেকের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়। তাঁর ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে আমরা শুধু তাঁর পবিত্রতা, মানব হিতৈষণা, ঐকান্তিকতা ও সক্রিয় গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করতে পারি—- তাঁর এই সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে দূর দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বীকার করতেই হবে, ‘সময়ের বালুতটে তাঁর পদচিহ্ন পড়েছে’ আরও বহু স্মরণীয় বিষয়ে। তাঁর জীবনের সক্রিয় ধর্মাচরণ তাঁর ক্লান্তিহীন সহানুভূতি ও দান এবং তাঁর চিন্তা ও আচরণের সম্ভ্রান্ততার জন্যই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর আসন আজ শূন্য; জীবিতদের আমি ছোট করতে চাইনা; কিন্তু আজ রাজা রাধাকান্তর আসন কে নেবেন? তিনি ছিলেন সকলের সামনের স্থানে, ছিলেন স্বাভাবিক ভাবেই সর্বজন স্বীকৃত স্বীয় জাতির নেতা। নিষ্ঠাবান হিন্দুদের তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক ও শাসন—- তাঁর মৃত্যুতে এঁদের অপূরণীয় ক্ষতি হল; অপরাপরের কাছে, বিশেষত প্রগতিশীলদের (প্রগতি বলতে যাঁরা গোমাংস ভোজন ও শ্যাম্পেন পান বোঝেন; তাঁদের কথা বলছি না) নিকট, তিনি ছিলেন হিন্দুমতাদর্শের আলোকবর্তিকা– পবিত্র ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রকৃতই তিনি ছিলেন একজন প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষ। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও একথা সত্য যে, রাজা ছিলেন সনাতনী মতবাদী ও আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে সংযোজন ও সীমারেখা। সব সময় তাঁর নামই ছিল শক্তি স্তম্ভ। তাঁর মধ্যে হিন্দুধর্ম মূর্তি লাভ করেছিল, আর সেই জন্যই তিনি কি হিন্দু, কি খ্রিস্টান, আর কি দার্শনিক, সকলেরই– সকল চিন্তাশীল মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। আমি চাই এই মহান বিরাট মানুষটির একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। শিক্ষাপ্রসার বা দাতব্য উদ্দেশ্যে তাঁর নামে নিধি স্থাপনের আমি বিরোধী নই, কিন্তু আমি চাই যে, আদর্শ স্থানীয় মানুষ রাজার মহান গুণাবলী ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মর্মরে রূপায়িত হয়ে থাক ৷

রেভ : (বর্তমানে ডঃ) কে এম ব্যানার্জী :

‘বক্তৃতা করার উদ্দেশ্য আমার নেই, কিন্তু রাজা রাধাকান্তর যে সকল মহৎ গুণাবলী ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা, সেই সম্পর্কে এবং তাঁর বিদ্যোৎসাহিতার ফলে আমি ব্যক্তিগতভাবে যে উপকার পেয়েছি, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে দু’একটি কথা বলতে চাই। তাঁর ও ডেভিড হেয়ারের যুগ্ম সম্পাদকত্বে পরিচালিত (প্রাক্তন) ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির অন্যতম বিদ্যালয় সেন্ট্রাল ভার্নাকুলার স্কুলে আমি আমার প্রাথমিক শিক্ষা পাই; আর আমার উচ্চতর শিক্ষা হিন্দু কলেজের জন্য—- এই প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপক। রাজার জনহিতৈষণার যে সকল কাজের জন্য আমি, অন্যান্য অনেকের মতো, তাঁর মহান সাহিত্যকীর্তি ‘শব্দকল্পদ্রুম’ সম্পর্কে আমি এইটুকু বলতে চাই যে, এ বিষয়ে পূর্ববর্তী বক্তাগণ যা বললেন, তার সঙ্গে আমি সহমত। তার বেশি বলতে গেলে আপনাদের ধৈর্য্যশক্তির উপর অত্যাচার করা হবে। তবে, এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলতে চাই। কয়েকমাস পূর্বে মাদ্রাজে জনৈক হিতৈষী ভদ্রলোক আমাকে জানান যে, তিনি দাক্ষিণাত্যের জনগণের উপকারার্থে তেলুগু লিপিতে শব্দকল্পদ্রুমখানি মুদ্রিত করতে চান—- এ জন্য রাজার প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র নিয়ে যেন তাঁকে পাঠিয়ে দিই। রাজা তখন কলকাতায় ছিলেন না; মাদ্রাজের এই বন্ধুকে তাই আমি লিখে জানালাম, আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেওয়া না হলেও, আমার মনে হয় না যে, রাজা তাঁর এই মহান সংকল্পে কোনরূপ আপত্তি করবেন। বাঙালী হিসাবে আমরা একটু গর্ববোধ না করে পারি না যে, আমাদের বঙ্গলিপিতে প্রকাশিত এই বিরাট বিশ্বকোষ জাতীয় পুস্তকখানি এই মুহূর্তে মাদ্রাজে একজন ধনী ব্যক্তি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণদের উপকারার্থে তেলুগু লিপিতে প্রকাশ করছেন। দেশ ও জাতি আজ এই মহান সৃষ্টির মহান স্রষ্টাকে হারিয়েছে। রাজার ধর্মমত সম্পর্কে বলতে গিয়ে এখানে কিছু অপ্রীতিকর মন্তব্য করা হয়েছে, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এখানে এই ধরনের মন্তব্য হওয়ায় আমি দুঃখিত বোধ করছি। মিশ্র মত ও পেশার জনগণ ও সুধীবৃন্দ প্রয়াত মানুষটির বন্ধু ও গুণমুগ্ধ রূপে তাঁর মহান গুণাবলী স্মরণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে সমবেত হয়েছেন—- উদ্দিষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ এই স্মৃতিসভায় সঙ্গতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এরূপ উক্তি অত্যন্ত দুঃখজনক। রাজার প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রগতির পথে তৎসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কথা বলা অত্যন্ত অযৌক্তিক, কারণ এর দ্বারা, তাঁর চেয়ে পঞ্চাশ বছর পরে জন্মেছেন এমন সব মানুষের চিন্তাধারার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে– এটা অযৌক্তিক। ঠিক যেমন যুক্তিহীন উক্তি হবে মিঃ পিটের মতো বিগত যুগের কোন বিজ্ঞ রাজনীতিককে এ-যুগের আলোকে বিচার করে বলা যে, তিনি আদৌ কোন সংস্কারক ছিলেন না বা তিনি সকল গৃহের জন্য ভোটাধিকার দান করেন নি। একমাত্র সমসাময়িকদের কাজ ও চিন্তার সঙ্গেই মাত্র কোন মানুষের কাজ ও চিন্তার তুলনা চলতে পারে। এই মানদন্ডে বিচার করলে, স্বীকার করতেই হবে যে, রাজা তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াপন্থীতো ছিলেনই না, বরং বলা যায় প্রগতিশীল ছিলেন।

‘আপনারা কিভাবে নেবেন জানি না, তবে একটি বিশেষ ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। একবার রাজার প্রাসাদে খ্রিস্টিয়ান গীর্জা-সংস্থার একজন উচ্চপদাধিকারীর দেখা পাই– এঁর সঙ্গে পরে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কলকাতার আর্টডিকন (পরে মাদ্রাজের বিশপ) মিঃ কোরি সেদিন রাজারবাড়িতে বিদ্যালয় সমূহের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। পরবর্তীকালে, তাঁর নিজের মুখ থেকে অনেকবার শুনেছি যে, তিনি রাজার গুণাবলীতে মুগ্ধ এবং তাঁর গুণাবলীর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমনই একজন শ্রদ্ধেয় মানুষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।’

বাবু কইলাশ চন্দার (কৈলাশ চন্দ্র) বসু :

‘বিগত কয়েক বছর রাজা সামাজিক ও অন্যান্য কাজকর্ম, ঘর-সংসার ত্যাগ করে বৃন্দাবনের ছায়াময় সুরভিত আশ্রমে অবস্থান করছিলেন, তবুও বলতে পারি, কলকাতার ভারতীয় সমাজের স্বাভাবিক নেতা রাজা আমাদের কাছে থেকে দূরে আধ্যাত্ম সাধনায় মগ্ন থাকলেও, আমরা তাঁর প্রভাব সব সময়ই অনুভব করেছি (করতালি)। গোঁড়া হোক বা বহু দেবদেবীর ধর্মে বিশ্বাসী, উদারনীতিক হোক বা রক্ষণশীল– সকলেই তাঁর কাছে নত হতেন। প্রকৃত মহৎব্যক্তির পরিচয় এখানেই– আপন পরিবার বা সমগ্র জাতির মধ্যে বহু মত বহু রুচি বহু ধর্মমত সত্ত্বেও সকলেই এইরূপ ব্যক্তির মহত্ত্বকে স্বীকার করে নেন (করতালি)। বর্তমান যুগের মতামত, রুচি বা ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে রাজা রাধাকান্তের ধর্মমত, রুচি বা অন্যান্য বিষয়ে মতো সামঞ্জস্য অবশ্যই ছিল না। আজ ‘এগিয়ে চল’ মতের মানুষ প্রশংসনীয় উদ্যমে আমাদের সমাজে প্রচলিত বহু কুসংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করছেন– ‘এগিয়ে চল’ মতোর মানুষেরা বিধবা বিবাহের প্রচলন, জাতপাতের উচ্ছেদ, বহুবিবাহ রোধ, প্রভৃতি আইনের সাহায্য নিয়ে হলেও করতে চান– এঁরা হয়তো মুমূর্ষু মা বাবার অন্তর্জলির ব্যবস্থা করবেন না, তাঁদের মৃতদেহ চিতায় দাহ না করে এঁরা সানন্দে সেগুলিকে সমাধিস্থ করবেন– এঁদের মতের সঙ্গে রাজা রাধাকান্তর মতের অবশ্যই বিরোধ ছিল। আমার ধারণা সম্ভবত ঠিক যে, এই সভা তাঁদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যাঁরা বিধবা বিবাহ ও অন্যান্য প্রকারে সমাজ সংস্কারের প্রবক্তা– স্বধর্ম ও বিশ্বাসের জন্য রাজার মত এঁদের বিরুদ্ধেই ছিল। তথাপি সকলে যে সমবেত হয়েছেন এতেই কি সপ্রমাণ হয় না, এটাই কি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, সর্ব মতের মানুষ তাঁর তিরোধানে শোক প্রকাশের জন্য এখানে সমবেত হয়েছি? ধর্মে অবিশ্বাসীরাও যখন গোঁড়া ব্যক্তির তিরোধানে শোক প্রকাশের জন্য সমবেত হন, তখন প্রমাণ হয় যে, ধর্মীয় ও সামাজিক সকল প্রকার বিরোধেরও উপরে স্থান পায় প্রকৃত মহত্ত্ব।

“তিনি বিরাট পন্ডিত বা সংস্কৃত বিশ্বকোষের রচয়িতা, বা নিষ্ঠাবান হিন্দু, বা সহৃদয় অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন বলে নয়, আমরা সেই প্রয়াতকে সম্মান জানাচ্ছি এই জন্য যে, তাঁর মধ্যে অন্তর ও মেধার সমন্বয়ে যে মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছিল, সেরূপ মহত্ত্ব সর্ব দেশে সর্ব যুগে সকল মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করে (উচ্চ অভিনন্দন)। এদেশের কোন ব্যক্তি সম্পর্কে যদি বলা যায় যে, যিনি স্বভাবে ছিলেন রাজকীয়, যাঁর মুখাবয়বে প্রতিভাত হত দাতার মহিমা, যাঁর অন্তরে ছিল জ্বলন্ত দেশপ্রেম তাহলে সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি ছিলেন সেই শ্রদ্ধেয় ও ধার্মিক রাজা রাধাকান্ত। তিনি আজ প্রয়াত, তাঁর দেহাবশেষ আজ পূন্যতোয়া সুরধুনীর পুতসলিলে বিলীন। প্রার্থনা করি, তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করুক।

রেভঃ মিঃ ড্যাল :

‘রাজা রাধাকান্ত দেব বহু বছর যাবৎ শুধু ইংল্যান্ড ও ইউরোপেই পরিচিত ছিলেন না, আমেরিকাতেও তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। পৃথিবীপৃষ্ঠে ভারতের প্রায় বিপরীত দিকেও বহুসংখ্যক এমন পন্ডিত বর্তমান যাঁরা আজকের এই সভায় রাজার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর মতো একজন মনীষীকে পৃথিবীতে প্রেরণের জন্য ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারলে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করতেন– এখানে আর কোন মার্কিন নাগরিক না থাকায় এই কথাগুলি বলা আমার কর্তব্য বলে আমি মনে করি। প্রায় বারো বছর যাবৎ আমি এই মনীষীর সঙ্গে মেলামেশার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। এই প্রবীণ এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কিছুদিন মিশলেই, তাঁর প্রতি পিতার ন্যায় শ্রদ্ধা এসে যেত। বহুবারই তিনি তাঁর বাণী মার্কিন মনীষীদের নিকট প্রেরণে, বিশ্বাস করে আমার উপর ভার দিয়েছেন, আবার তাঁর মহাগ্রন্থখানি মার্কিন দেশের বহু গ্রন্থাগারে আমার মারফই উপহার-স্বরূপ প্রেরণ করেন, যাতে সে-দেশের যে-সব পন্ডিত সংস্কৃত ভাষার মধ্যে নিহিত প্রাচ্যের সত্য সম্পর্কে পরিচিত হতে আগ্রহী তাঁরা গ্রন্থখানি ব্যবহারের সুযোগ লাভ করেন। আমেরিকায় যে-সব গ্রন্থাগার শব্দ-কল্পদ্রুমের শেষ খন্ডটি লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে মার্কিন দেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কেমব্রিজ ও নিউহ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয় দুটি এবং নিউইয়র্কের অ্যাস্টর লাইব্রেরিও আছে। আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটির দূত হিসাবে বহুবার তাঁদের জার্নাল এনে রাজাকে উপহার দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সেগুলি তিনি স্মিতহাস্যে গ্রহণ করে বলতেন ‘সেলাম’। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সৌজন্যপূর্ণ এমনি আরও পত্রপত্রিকা তাঁরই নামে প্রেরিত হয়েছিল। মার্কিন পন্ডিতমহলে তাঁর মৃত্যু প্রিয়জন বিয়োগরূপেই পরিগণিত হবে; যেন ব্যক্তিগত বন্ধুর মৃত্যু; জ্ঞানরাজ্যের অধিবাসী এবং শিক্ষাজগতের সুনাগরিকরূপে তো বটেই। তাঁর সম্পর্কে এত কথা বলতে বাকি আছে যে, কোনটা বলব আর কোনটা ছাড়ব, সেটা স্থির করাই আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে। এই যুগ তাঁর জীবন থেকে যে শিক্ষা পেতে পারে, তা হল– অধ্যয়নে দীর্ঘকালব্যাপী শ্ৰম। এমন একটা ক্ষেত্রে তিনি বিরামহীন পরিশ্রম করে গেছেন, এদেশে সেটা যেমন অসাধারণ, তেমনি অন্তহীন সুযোগপূর্ণ। এ বিষয়ে অনেকেই বলেছেন, তাই আমি বিষয়ান্তর নিয়ে বলব। গত অর্ধশতাব্দী ধরে কাউন্সিলারের পর কাউন্সিলার, গভর্নরের পর গভর্নর এসেছেন– এই শোভাযাত্রার সকলেই তাঁকে পেয়েছেন স্বাভাবিক, দয়ালু এবং বিজলী আলোর মতো প্রেরণাদায়ক– লর্ড বেন্টিংক (বা তাঁর আগে) থেকে ক্যানিং, এলগিন ও লরেন্স, হেবার থেকে বিশপ কটন– কি সরকারি আর কি চাৰ্চ সংগঠনের– সকল প্রধানই তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন– তাঁর ভদ্র আচরণ, সহজলভ্যতা এবং আন্তরিকতা সকলকেই সমভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মণিমুক্তাহীন শুভ্র বেশ এই বৃদ্ধের মধ্যে একটা স্নেহপরায়ণ গোষ্ঠীপতিভাব ছিল– যে ভাবের সুবাস ছিল র উদ্যানের বেলা আর ম্যাগনোলিয়ার মতো–উল্লেখ্য তাঁর বাগানের এই ফুলগাছগুলির পাশে পাশে ভ্রমণের সময় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে ভালবাসতেন। তাঁর চরিত্রের বিশেষ একাটি দিক হল–প্রার্থনায় না হোক, আত্মনিবেদন, অনন্তের নিকট নিজেকে নিবেদিত করে রাখা–সকল ধর্মেরই গূঢ় তত্ত্ব তো এই-ই। মাননীয় সভাপতি কতকটা কৌতুকের জন্য বললেন, রাধাকান্ত পৌত্তলিক ছিলেন। যাঁরা তাঁকে পৌত্তলিক ভাবেন, তাঁদের কাছে আমার বিশেষ একটা বক্তব্য আছে। আমি যেন তাঁকে বলতে শুনছি, ‘সকলকে বলুন; সতত্যকে তারা জানুক; সকলকে জানিয়ে দিন, কোন ধর্ম সারা জীবন আমাকে আমার সকল কাজে শক্তি জুগিয়েছে।’ তাঁর প্রাঙ্গণে তিনি কৃষ্ণের যে সুন্দর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছেন, শুনেছি তার মধ্যে মূল্যবান ন’টি ধাতু দ্বারা গঠিত দেবমূর্তি আছে। শ্রদ্ধেয় এই বন্ধুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা রাজা, আপনি কি ঐ প্রতিমাটির পূজা করেন?’ উত্তরে বললেন ‘না–মানুষ কখনও প্রতিমার পূজা করে না। এগুলি তো আমাদের ছোটদের জন্য। তারপর একটু হেসে বললেন, ‘আপনারা বাচ্চাদের পুতুল দেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ দিই তবে পূজা করবার জন্য নয়, খেলবার জন্য।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের বাচ্চারা প্রতিমা ছাড়াই পূজা করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের পুতুল দিই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুতুল পূজা করেন না বলছেন, তাহলে আপনি কার পূজা করেন’? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমার পূজা, আমার ধর্ম–সালোক্য ঈশ্বরের সাথে সর্বসময় একই লোকে বা স্থানে অবস্থান করা; সামীপ্য; ঈশ্বরের নিকট থেকে নিকটতর হওয়া; সাযুজ্য ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ; নির্বাণ; ঈশ্বরে বিলীন হওয়া ঠিক যেমন শুকতারা অরুণ কিরণে মিলিয়ে যায়।’ আমি বললাম, ‘রাজা, আমার ধর্মও তো তাই। খ্রিষ্টয়ান শিশু হিসাবে আমি আমার খ্রিষ্টীয়ান মায়ের কাছে গাইতে শিখেছিলাম-

মানুষ কিছুই না, মানুষ শূন্য;
তুমি, হে ঈশ্বর, তুমিই সৎ, তুমিই শুধু পূর্ণ।

“বন্ধুগণ, এই থেকেই আমি বুঝেছিলাম, রাধাকান্ত পুতুল বা প্রতিমাপূজক ছিলেন না–জীবনের দুর্যোগে যা তাঁকে শক্তি জুগিয়েছে, ভ্রান্তি থেকে যা তাঁকে উদ্ধার করেছে, কামনার দাসত্ব থেকে যা তাঁকে মুক্তি দিযেছে, মহৎ জীবন-যাপনে যা তাঁকে আজীবন সাহায্য করেছে এবং যার জন্য তিনি সারা জগতের কাছে সম্মানিত হয়েছেন– সে হল ধর্মের–সর্ব ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য, সর্ব মানবের অন্যনিরপেক্ষ ধর্ম, পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের জন্য আত্মার ব্যাকুলতা, স্রষ্টা ও পিতার সঙ্গে চিরন্তন ও চিরনবীন মিলন। বলা বাহুল্য, এই হল সেই সর্বব্যাপীর সংজ্ঞাহীন পূজা। আমার মনে হয়, এটা বলা আমার কর্তব্য, দায়িত্বও যে রাজার ধর্ম ছিল বাইরের নয়, অন্তরের বস্তু। তিনি চাইতেন সব জাতির সর্ব মানব একদিন এই ধর্ম অনুসরণ করবেন; তাঁর এই ভাব অনেক সময়ই প্রকাশ পেত–একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। রাণী ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী হলে তিনি বিপুল এক উৎসবের আয়োজন করেন; এই উপলক্ষে তাঁর রাজভক্তির প্রশংসা করে যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তাদের একটিতে আপনাদের পরিচিত নিম্নলিখিত মন্তব্যটি পড়ে তিনি বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন; ‘কোন অজ্ঞাত অতীতে এতেই এক মহাজ্ঞানের প্রকাশ হল যে দেবতাগণ একটি মানব হতে বহুমানব সৃষ্টি করলেন, যেমন হাতকে বিভক্ত করেন অঙ্গুলীতে যাতে হাত বেশি কাজ করতে সক্ষম হয়। এইটি পড়ে রাজা আমাকে বলেন, ‘এই হল ব্যাপার, এই হল আসল কথা। মনে হয়, কথাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন।’ আরও ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘মনে হয়, বিশ্বের প্রকৃত ধর্মের বিস্তৃতির জন্য ঈশ্বর পৃথিবীর সর্বজাতির মধ্যে শ্রম বিভাজনের মতো একটা কিছু করেছেন।’

‘এভাবেই তিনি প্রকৃত মনুষ্যত্ব অর্জন করেছিলেন, লাভ করেছিলেন প্রকৃত পণ্ডিতের মর্যাদা–সে শুধু তাঁর স্বদেশ ভারতে নয়, ইংল্যাণ্ড এবং আমেরিকাতেও। ভবিষ্যতের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই ভক্ত ও চিন্তাবিদকে স্মরণ করবেন। ‘

বাবু গিরীশচন্দ্র ঘোষ বলেন :

‘রাজা রাধাকান্ত দেব শুধু সাহিত্য ও রাজনীতি ক্ষেত্রে বিখ্যাত ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একান্তভাবে নিরীহ মানুষ, নৈতিক দিক থেকে সমসাময়িক যে কোন ব্যক্তি অপেক্ষা তাঁর স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। চাঁদেও কলঙ্ক থাকে কিন্তু এই মহতী সভায় আমি জোর গলায় বলতে পারি, যে ব্যক্তির স্মরণের জন্য এই সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাঁর চরিত্রে কোন কলঙ্ক বা ত্রুটি ছিল না। নৈতিক দিক থেকে মহৎ ছিলেন বলেই তিনি সতীপ্রথা রোধকারী আইনের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এই বিরোধিতা স্বার্থ-বুদ্ধিসম্পন্ন গোঁড়ামি থেকে উদ্ভূত হয়নি; আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিধাতা তাঁকে পুরুষ না করে যদি স্ত্রীলোকরূপে সৃষ্টি করতেন, আর তাঁকে যদি বিধাতার ঐ করুণ ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হতো, তাহলে তিনি তাঁর বিশ্বাসের স্বর্গলাভের জন্য স্বেচ্ছায়, স্বেচ্ছায় কেন, মহানন্দে ওভাবে আত্মবিসর্জন দিতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সতীপ্রথা দমনের আইন দ্বারা ওঁর দেশের ধর্মপ্রাণা মহিলারা ক্ষুব্ধ হবেন, এই সরল বিশ্বাস থেকেই তিনি ঐ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। পরিশেষে আইন ব্যবসায়ী, ধর্মযাজক ও স্বদেশীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ যে আন্তরিকতা ও আগ্রহ নিয়ে বর্তমান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দুর প্রতি সম্মান জানালেন, তাঁদের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা জানিযে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।’

রাজা রাধাকান্ত তিন পুত্র রেখে যান; ১. কুমার মহেন্দ্রনারায়ণ দেব, ২. কুমার রাজেন্দ্রনারায়ণ দেব এবং ৩. কুমার দেবেন্দ্রনারায়ণ দেব। জ্যেষ্ঠ ছিলেন নিঃসন্তান; আর কনিষ্ঠের দুই সন্তান রাজেন্দ্রনারায়ণ ও সুরেন্দ্রনারায়ণ। সুরেন্দ্রনারায়ণ জীবিত আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *