1 of 2

সুকিয়াস স্ট্রিটের রাজা রামমোহন রায়ের পরিবারবর্গ

সুকিয়াস স্ট্রিটের রাজা রামমোহন রায়ের পরিবারবর্গ

রামকান্ত রায়ের পুত্র রাজা রামমোহন রায় ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বগৃহে বাংলা শেখার পর তিনি পাটনা যান– সেখানে তিনি শেখেন ফার্সী, ভূগোল এবং আরবী ভাষায় লিখিত অ্যারিস্টটলের রচনাবলী। তারপর তিনি যান বারাণসী; সেখানে কয়েক বছর থেকে খুব ভালভাবে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধতা করে (একখানি পুস্তিকা) লেখেন। বারাণসী থেকে তিনি যান তিব্বত; সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও এর লামাবাদ সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করেন। দেশে যখন ফিরলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর; এই সময় ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই ভাষা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে শেখেন ও উন্নতিও করেন খুব কম সময়ের মধ্যে। ১৮০৩-এ তাঁর পিতার মৃত্যু হলে, রংপুরের কালেক্টর মিঃ জন ডিগবির অধীনে তিনি করণিকের চাকরি নিতে বাধ্য হন। তাঁর গুণাবলী উপলব্ধি করতে ডিগবির বিলম্ব হয় না; অল্পকালের মধ্যেই তিনি রামমোহনকে দেওয়ানের পদে আসীন করেন। এই পদে আসীন থাকাকালে তিনি বেশ কিছু অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় করেন এবং বার্ষিক দশ হাজার টাকা আয়ের একটি ভূসম্পত্তি ক্রয় করেন। এখন তিনি গণিত শাস্ত্রের উচ্চতর শাখাসমূহ ও ল্যাটিন ভাষা এবং সাহিত্য শিখতে আরম্ভ করেন। রংপুর থেকে তাঁকে তারপর (বিহারের) রামগড় ও ভাগলপুরে বদলি করা হয়। এই দুইস্থানে তিনি কিছুকাল বাস করেন। শেষ পর্যন্ত ১৮১৪ নাগাদ তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সর্বজাতির পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এই সময় তিনি ফার্সী, আরবী ও বাংলায় গ্রন্থ রচনা করেন; ফলে, তাঁর কয়েকজন ইউরোপীয় বন্ধু ব্যতীত অন্য সকলেরই তিনি বিরাগভাজন হন। মাতার তিরস্কার এবং দেশবাসীর বিরুদ্ধতা তিনি ধীরস্থিরভাবে গ্রহণ করেন।

খ্রিস্টীয় শাস্ত্র ভালভাবে জানবার জন্য তিনি গ্রীক ও হিব্রু ভাষা শেখেন। (ঐ দুই ভাষা মারফৎ খ্রিস্টীয় ধর্মশাস্ত্র ভালভাবে শিখে) তিনি ইংরেজি, সংস্কৃত ও বাংলায় লেখকের নাম না দিয়ে একখানি বই লেখেন; বইটির নাম : The Prcepts of Jesus, the Guide to Peace and Happiness (যীশুখ্রিস্টের উপদেশাবলী, শান্তি ও সুখের পথপ্রদর্শক)। Friend of India পত্রিকায় ডাঃ মার্শম্যান এর কয়েকটি সমালোচনা প্রকাশ করেন। A Friend to Truth, Second Appeal ও Final Appeal নামে কয়েকটি যোগ্য উত্তরও রাজা দেন। উত্তর প্রত্যুত্তর যাই হোক, তাঁর সম্পর্কে ইন্ডিয়ান গেজেট লেখেন, ‘স্বজাতিয়দের মধ্যে জাতি, পদমর্যাদা ও সম্ভ্রান্ততায় তিনি বিশিষ্ট সকল মানুষের মধ্যে তিনি তাঁর মানবপ্রেম, গভীর বিদ্যাবত্তা এবং সাধারণভাবে উচ্চ সংস্কৃতি- মানসের জন্য চিরকাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হয়ে থাকবেন।’ তাঁর Precepts of Jesus পুস্তকের জন্য যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মন্তব্য করেন, ‘এর দ্বারা আরও ভালভাবে তাঁর (রাজার) সূক্ষ্ম বিচারবোধ, বৌদ্ধিক তর্কশক্তি এবং সর্বোপরি অতুলনীয় শালীনতার সঙ্গে বিতর্ক চালাবার ক্ষমতা’ প্রকাশ পাচ্ছে। এবং ফলে আজ উপস্থিত হয়েছেন, ‘ধর্মীয় বিতর্কের ক্ষেত্রে বিরাট ব্যক্তিত্বময় প্রতিদ্বন্দ্বী, যাঁর সমকক্ষ, দুঃখের সঙ্গে বলছি, এখনও কেউ নেই।’

রাজা রামমোহন রায় স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষ অবলম্বন করেন বহুবিবাহকে আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলে মনে করতেন। তিনি বেদান্ত অনুবাদ করেন হিন্দুস্তানী, বাংলা ও ইংরেজিতে। স্যার এডওয়ার্ড ইস্টের পক্ষ থেকে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এলে এদেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা জানিয়ে দেন, এ বিষয়ে রাজা রামমোহন রায়ের কোন সংস্রব থাকলে, তাঁরা একে সমর্থন করবেন না। তিনি সংস্রব রাখলে তাঁর প্রিয় দেশবাসীর পক্ষে কল্যাণকর এই কাজটি বন্ধ হয়ে যাবে বুঝতে পেরে, তিনি সানন্দে ঐ প্রস্তাবের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ ত্যাগ করে, নিজে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্বরচিত গ্রন্থগুলি মুদ্রণের উদ্দেশ্যে তিনি দি ইউনিটেরিয়ান প্রেস নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ‘Conference between an advocate for, and an opponent of, the Practice of Burning Widows alive’ (বিধবাদিগকে জীবন্ত দগ্ধ করার পক্ষাবলম্বী ও বিপক্ষাবলম্বীর আলোচনাবৈঠক) বইটি তিনি ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশ করেন ১৮২০ সালে। এর দু’বছর পর ঐ একই বিষয়ে তিনি আর একখানি পুস্তক প্রকাশ করেন; এটি তিনি মার্সিওনেস অব হেস্টিংসকে উৎসর্গ করেন। (তাঁর এই সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিন্তু) ১৮২৯-এর পূর্বে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ সাধন করেননি। ওই মহান বড়লাটকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য যে প্রতিনিধি দলটি গঠিত হয়, তাতে যোগ দিলে, জাতিচ্যুত হতে হবে জেনেও, রাজা তাতে যোগদান করেন। ১৮২৮-এ তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন; ধর্মীয় সমাবেশে গেয় এই গানগুলি আজও শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। ডাঃ ডাফের শিক্ষা পরিকল্পনায় তিনি সহায়তা করেন এবং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ইউস্ট্যাস কেরিকে জমি দান করেন।

Society Asiatique নামক প্রখ্যাত পন্ডিতসমাজ কর্তৃক ১৮২৬-২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিনিধিরূপে প্রেরিত কর্নেল ল্যানচান রাজাকে উক্ত সমাজের সাম্মানিক সদস্যপদসূচক উপাধিপত্র প্রদান করেন। ব্রিটিশ ও ফরেন ইউনিটেরিয়ান সোসাইটির বার্ষিক অধিবেশনে, ইতিপূর্বে, সভাপতি কর্তৃক উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে রাজার স্বাস্থ্য কামনা করা হয়।

রাজার বহুদিনের বাসনা ছিল ইংল্যান্ডে যাবেন। এতদিনে সে বাসনা পূর্ণ হল। দিল্লীর বাদশাহ্ ১৮৩০-এর ১৫ নভেম্বর একটি ফরমান দ্বারা তাঁকে রাজা খেতাব দিয়ে স্বীয় অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে ইংল্যান্ডের রাজার নিকট আপীল করবার জন্য তাঁকে ইংল্যান্ড প্রেরণ করেন। ১৮৩১-এর ১৮ এপ্রিল তিনি লিভারপুল পৌঁছলে সেখানে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান মাননীয় উইলিয়ম র‍্যাথবোস, ডাঃ স্পারঝেইম, মিঃ রকো এবং অন্যান্য বহু বিশিষ্ট ভদ্রলোক। লন্ডন যাত্রাকালে তিনি মিঃ রসকোর কাছ থেকে লর্ড ব্রাউহামের উদ্দেশে লিখিত একটি পরিচয়পত্র নিয়ে যান। তাঁর ইংল্যান্ড গমনের এই সময়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩১-৩২-এ হাউস অব কমন্সের ভারত বিষয় সম্পর্কিত একটি কমিটির অধিবেশন চলছিল। কাজেই ভারত বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আনুপূর্বিক কার্যপ্রণালী ও আলোচ্য বিষয়াবলী নিয়ে তাঁর সময় ও চিন্তা ব্যয়িত হতে থাকল। কমিটির প্রয়োজন পড়লেই তাঁর ডাক পড়ত; তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ দিতেন। এজন্য রাজাকে প্রায়ই পার্লামেন্ট ভবনে যাতায়াত করতে দেখা যেত। ভারতের দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র সম্পর্কে তিনি প্রিভি কাউন্সিলকে কয়েকটি স্মারকপত্র লেখেন। কলকাতার সুপ্রীম কোর্টের কার্যকলাপ ও ভারতে লবণ ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার সম্পর্কেও কয়েকটি (স্মারক) পত্র লেখেন। (ইংল্যান্ডের) সপারিষদ রাজার নিকট প্রেরিত ভারতস্থ গোঁড়া হিন্দুদের আর্জি যে, সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক যে আইন বিধিবদ্ধ করেছেন তা রদ্ করা হোক। রাজা রামমোহন এই ঘৃণিত প্রথা রক্ষা করার আর্জির বিরুদ্ধে আপীল করেন; ফলে প্রিভি কাউন্সিলের রায় যায় আর্জির বিরুদ্ধে। কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস তাঁকে সবিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক বহু প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য এত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেন যে সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। লন্ডন ব্রীজ উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভোজসভায় ইংল্যান্ডের মহামান্য রাজা তাঁকে একটি ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। অনারেবল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসও ১৮৩৩-এর ৬ জুলাই একটি ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করে সমানিত করেন। ব্রিটিশ অ্যান্ড করেন ইউনিটেরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন’ এক সভায় তাঁকে সাদর সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।

রাজা রামমোহন রায় ১৮৩২-এ ফ্রান্সে যান। সেখানে (রাজা) লুই ফিলিপের কাছে তিনি হৃদ্য আচরণ লাভ করেন। মহামান্য এই রাজা তাঁকে দু’বার ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। এখানে ফরাসী ভাষা শিখে, ১৮৩০-এ তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলটন গ্রোভে মিস ক্যাসল তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। তাঁর বাড়িটি তিনি রাজার ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেন। এখানে তাঁর সঙ্গে নিত্য সাক্ষাৎ করতে আসতেন মিঃ জন ফস্টার ও ডঃ কার্পেন্টার। তিনি আয়ারল্যান্ড ও অন্যান্য বহু স্থান থেকে প্রেরিত সংবর্ধনাপত্র পান। দিল্লীর বাদশাহের পক্ষ থেকে তিনি ইংল্যান্ডের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে সফল মীমাংসায় উপনীত হন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর চিকিৎসা করেন ডাঃ প্রিচার্ড এবং ডাঃ ক্যারিক। কিন্তু চিকিৎসায় কোন ফল হয় না। ১৮৩৩-এর ২৭ সেপ্টেম্বর ভিতনি ব্রিস্টলে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইতালীয় ভাস্কর পাগের (Pugh) এক সঙ্গী (তনিও ইতালীয়) রাজার মুখমন্ডল ও মাথার ছাঁচ তুলে নেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কুমারী ক্যাল্কে বলে যান, ইংল্যান্ডেই যদি তাঁর মৃত্যু হয়; তাহলে যেন এক টুকরো সুন্দর নিষ্কর জমি কিনে তাতে তাঁকে সমাহিত করা হয়; সমাধির উপর যেন নির্মিত হয় সুন্দর একটি কুটির এবং সেটি দেখাশোনা করবার জন্য তাতে বাস করবেন কোন পন্ডিত অথচ দুঃস্থ ব্যক্তি। ১৮৩৩- এর ১৮ অক্টোবর সুন্দর একখন্ড জমিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই জমি দান করেন কুমারী ক্যা। ১৮৪৩-এর ২৯ মে তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু প্রখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর ঐ স্থান থেকে ব্রিস্টলের নিকটবর্তী আর্নস তেল নামক জায়গায় নির্মিত সুদৃশ্য একটি সমাধিতে তাঁর শবাধারটি স্থানান্তরিত করে পরের বছর তার ওপর চমৎকার একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন।

রাজার মৃত্যুকালে বর্তমান ছিলেন তাঁর একমাত্র পুত্র রমাপ্রসাদ রায় (সাধারণ্যে রাজা রমাপ্রসাদ নামে পরিচিত)। তিনি পুরাতন হিন্দু স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন, বাংলা, সংস্কৃত ও ফার্সী ভাষা বেশ ভালই শিখেছিলেন। পিতার মতো তিনি বহু সদ্‌গুণের অধিকারী ছিলেন। স্বীয় অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে তিনি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বাড়িয়ে তোলেন। হাইকোর্টের সরকারি উকিল হিসাবে তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং তাঁকে ওই আদালতেরই প্রথম দেশীয় জজরূপে মনোনীত করা হয়। তাঁর দুটি পুত্র হরিমোহন ও পিয়ারীমোহন। এঁরা কলকাতার সুকিয়াস স্ট্রিটের পৈতৃকভবনে বাস করেন। তাঁদের জমিদারী আছে ২৪ পরগণা এবং অন্যান্য কয়েকটি জেলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *