1 of 2

জোড়াসাঁকোর বাবু হরচন্দ্র ঘোষ

জোড়াসাঁকোর বাবু হরচন্দ্র ঘোষ

২৪ পরগণা জেলার বেহালার তালুকদার বিখ্যাত সীতারাম ঘোষের পৌত্র এবং দেওয়ান অভয়চরণ ঘোষের পুত্র হরচরণ ছিলেন কলকাতা স্মল কজ কোর্টের তৃতীয় জজ । এঁরা জাতিতে কায়স্থ ।

বাল্যকালে পিতৃহীন হওয়ায় তিনি আত্মনির্ভর হয়ে ওঠেন। একান্তভাবে নিজ চেষ্টায় তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন; সেখানে পড়াশোনায় তাঁর অধ্যবসায় ও উৎসাহে খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি ডেভিড হেয়ার ও ড: উইলসনের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন পাশ্চাত্য শিক্ষার গুণে এই হিন্দু স্কুলেই নব-জীবনের ও শক্তির সঞ্চার হয়েছিল সামান্য কয়েকজন নবযুবকের মধ্যে–উজ্জ্বল এই সকল নবযুবকের একজন ছিলেন হরচন্দ্র । হরচন্দ্রের সাহিত্যপ্রেমিক কয়েকজন সহপাঠী তাঁরই বাড়িতে সমবেত হয়ে ইউরোপের দিক্‌পাল সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের সৃষ্টিসমূহ নিয়ে সপ্তাহে দু’দিন আলোচনায় বসতেন–নেতৃত্ব দিতেন মিঃ ডিরোজিও। কলেজের প্রতিভাবান ছাত্র হরচন্দ্র প্রতি বছরই বাৎসরিক পরীক্ষায় বহু পুরস্কার লাভ করতেন । তাঁরই উদ্যোগে তাঁর আত্মীয়, বন্ধু ও সহপাঠী শ্রীকিষেণ সিংহের মানিকতলা বাগানবাড়িতে অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়; তিনিই হন উক্ত অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক । (উল্লেখ্য এই শ্রীকিষেণ সিংহই পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজের গভর্নর হন।) বলা যায়, হিন্দু কলেজ যে-সকল জ্ঞানবীর সৃষ্টি করত, তাঁদের ব্যায়ামগার ছিল এই অ্যাসোসিয়েশন; এখানেই হরচন্দ্রের সঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত ইউরোপীয়ের পরিচয় হয়–এই পরিচয় পরে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয় । এই সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে– হরচন্দ্র তখন সবেমাত্র কলেজের শিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে চলেছেন । লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তখন ভারতের বড়লাট । পাঠকবর্গকে মনে করিয়ে দেওয়া বাহুল্য যে, জনহিতব্রতী এই রাজপুরুষ এদেশীয়দের উন্নতিসাধনে কত ব্যগ্র ছিলেন । একজন শিক্ষিত এদেশবাসীকে নিজ ব্যক্তিগত সচিব, তৎকালীন ভাষায় দেওয়ান, নিযুক্ত করবার অভিলাষে তিনি বাবু হরচন্দ্রকে এই পদ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তাঁর সঙ্গে উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ভ্রমণে যেতে বলেন । হরচন্দ্র রাজি হয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের আর লর্ড বেন্টিঙ্কের প্রশংসনীয় চেষ্টায় বাধা হয় দাঁড়ায় তাঁর বাড়ির কুসংস্কার। ঈর্ষাপরায়ণ জ্ঞাতিকুটুম্বগণ তাঁর মা’কে বোঝালেন, লাট সাহেবের সঙ্গে গেলে হরচন্দ্রকে জাত খোয়াতে হবে । এই যুক্তিহীন নির্বোধ ধারণার বিরুদ্ধে তিনি মা’কে বহুভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আজ (১৮৮১) থেকে চল্লিশ বছর আগেকার কোন হিন্দু মা-কে তাঁর মজ্জাগত কুসংস্কার মুক্ত করা ছিল অতি কঠিন। ফলে, খুব দুঃখ পেলে, চাকুরীটি তিনি নিতে পারলেন না । বড়লাটও বিরক্ত হলেন, কিন্তু হরচন্দ্রের কথা তিনি ভুললেন না। ইতিমধ্যে লর্ড বেন্টিঙ্ক মুন্সেফ আইন পাস করে এদেশীয়দের সামনে চাকুরীর নতুন পথ খুলে দিলেন । হরচন্দ্রকে ডেকে তিনি ওই চাকুরী নিতে বললেন; কিন্তু হরচন্দ্রের আর্থিক অবস্থা ছিল বেশ সচ্ছল; ওই সামান্য মাইনের চাকুরী নিতে তিনি অনিচ্ছুক; কিন্তু লর্ড বেন্টিঙ্ক চাকুরীটি নেবার জন্য চাপ দিতে লাগলেন । কী আর করেন, হরচন্দ্র ১৮৩২ সালের ২৫ এপ্রিল বাঁকুড়ায় ওই চাকুরীতে বহাল হলেন। বাড়িতেই তিনি আইন পড়ে নিয়েছিলেন। সুবিচারকের সব গুণই তাঁর ছিল ধীর, শান্ত, ভাবাবেগবর্জিত, পরিশ্রমী এবং ভালোমন্দ বোঝবার স্বাভাবিক ক্ষমতা। তাঁর কর্মপদ্ধতিও ছিল বিস্ময়কর। প্রাচীনপন্থীদের মতো না করে ঠিক দশটায় তিনি আদালতে যেতেন; তারপর ঘড়ির কাঁটা ধরে বিচার-কাজ পরিচালনা করতেন । সাক্ষ্য এজাহার নিজের হাতে লিখে নিতেন– এই পদ্ধতি সরকার পরে প্রবর্তন করেন । আদালতেই উভয় পক্ষ ও উকিলদের সামনেই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত বা রায় লিখতেন–ফলে, সকলের মধ্যেই আস্থার সঞ্চার হত ।

পরিশ্রমী ও নিয়মানুগ হওয়ায় তাঁর কাজ কখনও জমে থাকত না । একদিকে বাদী- বিবাদী সকল পক্ষই তাঁর ওপর আস্থাশীল হয়ে ওঠেন–অপরদিকে ওপরওয়ালাদেরও ধারণা হয় যে, তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ও যোগ্যতার পরিচায়ক। এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে সদর আমীন পদে উন্নীত করা হয় । বাঁকুড়ায় দু’বছর কাজ করার পর তিনি হুগলীতে বদলী হন ১৮৩৮ সালে । ১৮৪১ সালে তাঁকে ২৪ পরগণার অ্যাডিশনাল প্রিন্সিপ্যাল সদর আমীন পদে উন্নীত করা হয় এবং ঐ পদে পাকা করা হয় ১৮৪৪ সালে । ১৮৪৭ সালে তাঁকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করে ম্যাটিস্টেটের ক্ষমতাও দেওয়া হয় । তাঁর কার্যক্ষমতা এত বেশি ছিল যে, সিভিল জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ একাই করলেও, তাঁর কোন ফাইল বকেয়া পড়ে থাকত না । সেই যে যুগে, এদেশে নিযুক্ত এদেশীয় বিচারকের কাজ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না । ইংরেজ সরকারের নীতি উদার হলেও, জেলা জজেরা ভারতীয়দের উচ্চাশা চাপা দিতে বিশেষ তৎপর ছিলেন । সেই জন্য, এদেশে নিযুক্ত এদেশীয় জজদের বিশেষ কঠিন অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হত–এঁদের যোগ্য নেতা ছিলেন বাবু হরচন্দ্র ঘোষ । সৌভাগ্যবশত হরচন্দ্র উচ্চতম কর্তৃপক্ষের নিকট সুপরিচিত ছিলেন, সদর কোর্টে ওপরওয়ালার কাছে পাত্তা না পেলেও, তিনি সমর্থন পেতেন সপরিষদ বড় লাটের । লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক অবসর নেওয়া পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত লর্ড অকল্যান্ডও হরচন্দ্রের প্রতি একইভাবে সহানুভূতিপূর্ণ নজর রাখেন। সহৃদয় এবং শক্তিশালী মিত্ররূপে হরচন্দ্র পেয়েছিলেন ছোটলাট লর্ড অকল্যান্ডের ব্যক্তিগত সচিব মিঃ জে বি কোলভিনকে; ইনি পরে সদর আদালতের অন্যতম জজ এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের গভর্নর হয়েছিলেন। এঁরই সাহায্যে হরচন্দ্র এদেশেই নিযুক্ত জজ এবং এদেশীয়দের স্বার্থবিরোধী সদর কোর্টের বহু সার্কুলার অর্ডার রদ করাতে পেরেছিলেন । চাকুরীতে নিজের পদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি যে-সব সংগ্রাম করেছিলেন, সে-সব আজ কল্পকাহিনীর মতো শোনায় ৷ কখনও কখনও বিরোধ এত তীব্র হয়ে উঠত যে, সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হত; ফলে, প্রভুত্বকামী জেলা জজই অন্য জেলায় বদলি হয়ে যেতেন । বাবু হরচন্দ্র ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, তার ওপর কলকাতার মানুষ। ওপরওয়ালাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতেন, চিঠিপত্রও লিখতেন ইংরেজিতে। ইংরাজের আদব কায়দাও বলতেন, চিঠিপত্রও লিখতেন ইংরেজিতে। ইংরেজের আদব কায়দাও ব্যক্তিগত জীবনে মেনে চলতেন । ইউরোপীয় অফিসারদের এসব আদৌ ভাল লাগত না; হরচন্দ্রের সমকক্ষতার ভাব তাঁদের কাছে অসহ্য মনে হত । স্কটল্যান্ডবাসী একজন জেলা জজ, ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও ধার্মিক ছিলেন, হরচন্দ্রের কর্মদক্ষতা ও চরিত্রগুণের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধাও করতেন; তিনিও একদিন হরচন্দ্রকে ডেকে খোলাখুলি বললেন, ‘দেখ হরচন্দ্র, ব্যক্তিগতভাবে আমি তোমাকে শ্রদ্ধাও করি, কিন্তু তোমার ইংরেজি শিক্ষা আমার ভাল লাগে না। আমরা এদেশ জয় করেছি, সেই জন্যই আমরা (পরাজিত) এদেশবাসীকে কোন দিক দিয়েই আমাদের সমকক্ষ ভাবতে পারি না । খোলাখুলিভাবেই তোমাকে আমার মনের কথা বললাম, শুনতে তোমার খুব খারাপ লাগবে; কিন্তু জেনে রেখ, মোটামুটিভাবে এই হল সব ইউরোপীয়ের চিন্তাধারা ।’ হরচন্দ্রের জীবিতকালেই ইউরোপীয়দের এই ভাবধারা বহুলাংশে পরিবর্তিত হয় । বহু সম্মানিত ইউরোপীয় তাঁর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন ।

সিপাহী বিদ্রোহের ফলে এই পরিবর্তনের ধারা ভীষণভাবে ব্যাহত হল। তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন (ইউরোপীয়) জেলা জজ ও সদর আদালত অত্যন্ত প্রশংসাসূচক যে সকল মন্তব্য করেছিলেন, সে-সব উদ্ধৃত করবার মতো স্থান এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে হবে না– তবে একথা বলা যায়, প্রশংসাগুলি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সম্পর্কে হলেও, তিনি যে পদে ছিলেন, সেই পদে নিযুক্ত সকল এদেশীয়ই ঐ প্রশংসার অংশীদার। তাঁর সম্পর্কে সরকারের এত ভাল ধারণা ছিল যে, লর্ড ডালহৌসি একজন এদেশীয়কে পুলিস বেঞ্চে নিয়োগ করতে মনস্থ করে সদর জজদের মতামত চাইলে, তাঁরা সকলেই একবাক্যে হরচন্দ্রের নাম সুপারিশ করেন । এই পদের জন্য অনেক উমেদার ছিলেন; কিন্তু নিজের জন্য ধরাধরি করা হরচন্দ্রের ধাতুতে ছিল না; তিনি বলতেন, বিচার বিভাগীয় আধিকারিকদের পদের পিছনে দৌড়ানো উচিত নয়, পদই তাঁদের খুঁজে নেবে । নিজের ক্ষেত্রেও তিনি এই আদর্শ মেনে চলতেন । তাঁর বিশ্বাস ছিল গুণের পুরস্কার আছেই; তাঁর নিজের ক্ষেত্রে অন্তত তাঁর এই বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয়েছিল । (উচ্চতর) পদের পিছনে তিনি কখনও দৌড়াননি; পদোন্নতির জন্য কখনও ধরাধরিও করেননি । এদেশে নিযুক্ত এদেশীয় বিচারবিভাগীয় আধিকারীকদিগের তালিকায় তাঁর নামটাই থাকত সর্বপ্রথমে; কাজেই, তাঁর পদোন্নতিও হত যেন আপনা থেকেই। পুলিশ বেঞ্চে নিয়োগের পূর্বে হরচন্দ্রের ব্যক্তিগত মতামত জানবার জন্য লর্ড ডালহৌসি তাঁকে ডেকে পাঠান । একটি এদেশীয় পরিবার তাঁর প্রতি অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন–এ বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল । এছাড়া ঐ পদের উমেদার কয়েকজন ব্যারিস্টার তাঁর নিয়োগে আশাহত হওয়ায় তাঁকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছদ্মনামে চিঠি লিখতে থাকেন । সংবাদপত্রগুলির পরিচালকবর্গ অবশ্য হরচন্দ্রকেই সমর্থন করতে থাকেন । পুলিশ বেঞ্চে তাঁকে নিয়োগ করার বিরুদ্ধে এই চক্রের কথাই হরচন্দ্র মি: হ্যাঁলিডের কাছে উল্লেখ করেন; অতি-কথনে অভ্যস্ত হ্যাঁলিডে এই কথাকেই বহুলাংশে বাড়িয়ে হাউস অফ কমন্স কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিলেন–এর জন্য অবশ্য হ্যাঁলিডে বাবু রামগোপাল ঘোষের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি, আসল কাহিনীতে ফিরে আসা যাক । লর্ড ডালহৌসি পুলিশ কোর্টের কাজে যোগ দেবার জন্য হরচন্দ্রের কছে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রস্তাব করলে, তিনি সংবাদপত্রে তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনার কথা জানিয়ে পদটি গ্রহণে তাঁর ইতস্তততা প্রকাশ করেন । উত্তরে বলিষ্ঠ রাজনীতিক বললেন, দেখ হরচন্দ্র, সংবাদপত্রগুলি তো আমার বিরুদ্ধে প্রতিদিন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য কি আমি আমার কর্তব্য সাধন থেকে বিরত হয়েছি । ওদের সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হবার কিছু নেই । তোমার স্বদেশীয়দের উন্নতি ও অগ্রগতি এখন সংকটের মুখে, তোমার নিজের দৃষ্টান্ত দিয়ে তোমাকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, ইউরোপীয়দের মতই তোমরাও উচ্চ ও সম্মানিত পদলাভের যোগ্য । হরচন্দ্র পদটি গ্রহণ করলেন । ১৮৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির গেজেটে তাঁর নাম কলকাতার জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট-রূপে প্রকাশিত হল । ১৮৫৪ সালে তাঁকে কলকাতা স্মল কজ্ কোর্টের অন্যতম জজরূপে মনোনীত করা হল । সংবাদপত্র সমূহের তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁর কাজের ওপর, জনগণও তাঁর কাজের দোষত্রুটি ক্ষমা করে নেবে এমন অবস্থা ছিল না, তৎসত্ত্বেও তিনি পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও স্মল্ কজ্ কোর্টের অন্যতম জজ রূপে অত্যন্ত সন্তোষজনক ভাবে ষোল বছর তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করেছিলেন; এতেই বোঝা যায়, তাঁর ওপর আস্থা স্থাপন করে লর্ড ডালহৌসি আদৌ কোন ভুল করেননি ।

এতক্ষণ আমরা চুম্বকে তাঁর কর্মজীবনের একটা চিত্র দেবার চেষ্টা করলাম । তাঁর পদের তিনি অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন, তাঁর কাজ ও উচ্চ চারিত্রিক গুণের জন্য তিনি সর্বদাই সরকারের প্রশংসা পেয়েছেন । একথা বললেই যথেষ্ট হবে যে, তাঁর দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন জজ, সেক্রেটারি ও গভর্নরের অধীনে চাকুরী করেছেন, তাঁদের কেউই কখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোন বিরূপ মন্তব্য করেন নি । বরং সর্বদা তিনি তাঁদের সপ্রশংস সমর্থন পেয়েছেন । যে জেলাতেই তিনি কাজ করতে গেছেন, সেখানেই জনমতের সমর্থন পেয়েছেন । তাঁর সুবিচারের প্রতি জনগণের প্রবল আস্থা ছিল, তাই রায়ে তারা হারুক বা জিতুক, উভয়পক্ষ সমভাবেই সন্তুষ্ট হত । তাঁর এই বিস্ময়কর সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর উন্নত নীতিবোধ । তিনি কলেজে পড়বার সময় অন্য ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা তো নয়ই, উচ্ছলতাতেও যোগ দিতেন না । তখন নতুন জীবন ও নতুন সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ছাত্রদের উদ্দাম স্ফূর্তির জীবনেও তিনি কঠোরভাবে সংযত সরল জীবনযাপন করেছেন; বিনয় ছিল তাঁর স্বাভাবিক গুণ । তিনি ছিলেন সকলপ্রকার বদভ্যাসমুক্ত, সত্যবাদী, সৎ এবং বিবেকবান । এসব বিবেচনা করলে বলতে হয়, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ । অত উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকলেও, ব্যবহারে তিনি ছিলেন বিনয়নম্র; সর্বসাধারণের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল মধুর–এরকম একজন আদর্শ মানুষ খুব কম দেখা যায় । মিত্র হিসাবে তিনি ছিলেন হৃদয়বান, আর কোন ভাল কাজ করতে পারলে খুব খুশি হতেন। অপর পক্ষে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ তিনি অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করতেন, সুযোগ পেলে তিনি এদের আচার আচরণের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতেন । পাছে পরিচিতজনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে, এজন্য তিনি মফঃস্বলে থাকবার সময় সেখানকার সমাজকে এড়িয়ে চলতেন আর শহরে অবসরপ্রাপ্তের ন্যায় একক জীবনযাপন করতেন । তবু তাঁর স্বদেশবাসী তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন । যেস্থান থেকে তিনি বদলী হতেন সেখানকার জনগণ সেটাকে তাদের মহা বিপদরূপে গণ্য করতেন । আত্মপ্রচার বিমুখ হরচন্দ্র নিজ সৎকাজের জন্য কখনও হৈ চৈ করে নিজের ঢাক নিজে বাজাতেন না । গোপনে তিনি সৎকাজ সম্পাদন করতে চাইতেন । বাঁকুড়ায় থাকবার সময় তিনি নিজ ব্যয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন; এর পরিচালন ব্যয়ও তিনি বহন করতেন । বাঁকুড়ার যে সকল ব্যক্তি, (এঁদের মধ্যে অনেক ধনীও ছিলেন) তাঁরই সহায়তায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর কাজের গুণগান করেন । ২৪ পরগণার সদর আমীন বা জমি জরিপকারী কর্মকর্তা থাকবার সময় তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের আবাসস্থল বেহালায় বাস করতেন–এখানেও তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, বহু বছর যাবৎ তার ব্যয়ভার স্বয়ং বহন করেন। জজ ছিলেন বলে, কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ না দিলেও, তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন সমূহের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন । বাংলার ইংরেজি শিক্ষার জনক ডেভিড হেয়ারের স্মৃতিরক্ষাকল্পে যে আন্দোলন হয়, তিনি সক্রিয়ভাবে তাতে অংশগ্রহণ করেন । হেয়ারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছাত্রজীবন থেকেই । এই জন্য এই মানব প্রেমিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তিনি টেস্টিমোনিয়াল কমিটির সচিবপদ গ্রহণ করেন । (হিন্দু প্যাটরিয়ট, ৭ ডিসেম্বর ১৮৬৮)

দীর্ঘকালের অর্শরোগী হরচন্দ্র ওই রোগেই ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর পরলোকগমন করেন । এদেশবাসীর মর্যাদা ও আদর্শের প্রতীক হরচন্দ্রের মৃত্যুকে দেশবাসী এখনও (১৮৮১) জাতীয় ক্ষতি বলে মনে করে । স্মল কজ কোর্টের নতুন বাড়িতে এদেশীয়দিগের যোগ্য প্রতিনিধি ও আদর্শস্থানীয় জজ হরচন্দ্রের আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে ।

তাঁর মৃত্যুকালে তাঁর চার পুত্র বর্তমান ছিলেন; জ্যেষ্ঠ প্রতাপচন্দ্র, বিএ কলকাতা রেজিস্ট্রার অফ ডীস এবং কয়েকখানি ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত পুস্তকের লেখক ছিলেন; তাঁর বিবাহ হয়েছিল কুমারটুলির বিশিষ্ট অধিবাসী বেণীমাধব মিত্রের কন্যার সঙ্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *