1 of 2

ঝামাপুকুরের বাবু দুর্গাচরণ লাহা এবং তাঁর দুই ভাই

ঝামাপুকুরের বাবু দুর্গাচরণ লাহা এবং তাঁর দুই ভাই

প্রখ্যাত বাঙালী ধনিক, ব্যবসায়ী এবং জমিদার বাবু দুর্গাচরণ লাহা আর তাঁর দুই ভাই বাবু শ্যামাচরণ লাহা ও বাবু জয়গোবিন্দ লাহা ছিলেন প্রাণকিষেণ লাহার পুত্র এবং রাজীবলোচন লাহার পৌত্র। তাঁদের আদি বাস ছিল হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়–স্থানটি একদা ওলন্দাজ উপনিবেশ ছিল । পাটনার নন্দরাম বৈদ্যনাথের কুঠিতে বা মহাজনী কারবারে মাসিক ২৫ টাকা মাইনেতে রাজীবলোচন পোদ্দারের চাকুরী গ্রহণ করে জীবন শুরু করেন । মাইনে কম আর চুঁচুড়ায় পারিবারিক জমিজমার আয়ও অল্প, তবু তিনি ছেলেদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে কার্পণ্য করেননি । ছেলেরা রোজগার না করা পর্যন্ত তিনি ঐ চাকুরীতেই বহাল ছিলেন। ১৮৩০ সালে ৬২ বছর বয়সে তিনি চুঁচুড়ায় প্রাণত্যাগ করেন । প্রকৃতপক্ষে তাঁর বড় চেলে প্রাণকিষেণই ঐ মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে প্রতিষ্ঠিত করেন ।

পিতার দারিদ্র্যের জন্য ইচ্ছা থাকলেও তিনি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি; ইংরেজি শিখেছিলেন প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত। প্রথমে তিনি মি: অ্যানডুর লাইব্রেরীতে মাসিক ১২ টাকা মাইনের একটি চাকুরী পান; গ্রন্থাগারটি উঠে না যাওয়া পর্যন্ত ঐ চাকুরীই তিনি করতে থাকেন । ঐ চাকুরী যাবার পর, বেকার প্রাণকিষেণ কারও কোন সাহায্য ছাড়াই হুগলী আদালতে শিক্ষানবিশি শুরু করেন; অন্যদিকে তাঁর ইংরেজি শিক্ষাও এগোতে থাকে । এই আদালতেই তিনি আইন কানুন এবং অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন; এর পর সুপ্রীম কোর্টের তখনকার প্রভাবশালী অ্যাটর্নি মি: হাওয়ার্ডের অফিসে হেড ক্লার্কের চাকরি পেয়ে যান । তাঁর ইংরেজি শিক্ষাও এগোতে থাকে । তাঁর চরিত্রগুণ ও দক্ষতার জন্য তাঁর মাসিক মাইনে ধীরে ধীরে ৩০০ টাকায় ওঠে । তাঁর সততা ও দক্ষতার জন্য ঐ অ্যাটর্নি অফিসের পরবর্তী মালিক মি: পিয়ার্ড, প্রাণকিষেণ অবসর নেবার পর তাঁকে মাসিক ২০০ টাকা পেনশন দিতে থাকেন। মি: পিয়ার্ড যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন প্রাণকিষেণ এই পেনশন পেয়েছিলেন ।

অ্যাটর্নি অফিসে হেড ক্লার্ক থাকবার সময়ই প্রাণকিষেণ কোম্পানির কাগজ আর আফিমের ফাটকা নামেন । এতে প্রচুর অর্থও উপার্জন করেন । এই সময় কলকাতার লটারি কমিটি পরিচালিত লটারির এক লাখ টাকার পুরস্কারের এক তৃতীয়াংশ ৩৩,০০০ হাজার টাকা তিনি পেয়ে যান । কিন্তু ফাঁকটা ব্যবসায়ে ছ’মাসের মধ্যে টাকাটা লোকসান যায় । বাবু মতিলাল শীল তাঁকে খুব স্নেহ করতেন; তাঁরই সহায়তায়, প্রাণকিষেণ প্রথমে মেসার্স সন্ডার্স, মে, সার্কিনস অ্যান্ড কোম্পানির বানিয়ান নিযুক্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত আরও কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বানিয়ান হন । তাঁর নিজেরও একটি ছোট খাট ব্যবসায় ছিল । ১৮৪৭ সালের ব্যবসায়িক মহাসঙ্কটের সময়, তিনিও নানা দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন । কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি ক্ষয়ক্ষতি সামলে ওঠেন । ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান । তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৫৯-এ তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাণকিষেণ ল’ নামক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় ‘প্রাণকিষেণ ল’ অ্যান্ড কোং’ ।

সম্ভবত ১৮২৩ সালে বাবু দূর্গাচরণ লাহা চুঁচূড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । কলকাতার শিবু ঠাকুর লেনের গোবিন্দ বসাকের স্কুলে তিনি ইংরেজির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন । এখানে তিনি সুপন্ডিত ডা: রাজেন্দ্রলাল মিত্র সি আই ই’র সহপাঠী ছিলেন । এই স্কুলে দুবছর পড়ার পর তিনি ভর্তি হন হিন্দু কলেজে এবং সহপাঠীরূপে লাভ করেন রামবাগানের রসময় দত্তের তৃতীয় পুত্র বাবু গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ও অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই’র পুত্র গণেশমোহন ঠাকুরকে । এখানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়বার সময়ই দুর্গাচরণকে কলেজ ত্যাগ করতে হয়। তাঁর বাবা চাইলেন, তিনি ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি যত গোপন রহস্য রয়েছে সেগুলিই এখন থেকে শিখতে থাকুন । কর্মজীবন আরম্ভ হল পিতার সহকারীরূপে । পিতার মৃত্যুর পর, তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা ও অধ্যবসায় দ্বারা প্রতিষ্ঠানটির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন । সম্মানিত জমিদার দুর্গাচরণ কলকাতার বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বানিয়ানও । লন্ডন ও ম্যাঞ্চেস্টারে তাঁর নিজস্ব এজেন্সি ছিল । কলকাতা পোর্ট কমিশনার্সের তিনিই একমাত্র দেশীয় সভ্য। তাছাড়া, তিনি কলকাতার জাস্টিস অফ দি পীস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, কলকাতার মেয়ো হাসপাতালের গভর্নর এবং বঙ্গীয় আইন পরিষদের সভ্য । ব্যবসায়িক বিষয়ে দুর্গাচরণবাবু বিশেষ বিচক্ষণ ও জ্ঞানী । ব্যবসায় ও ফাটকায় তাঁর দূরদৃষ্টি ও জ্ঞান অতুলনীয় । দেশীয় ও ইউরোপীয় ব্যবসায়ীমহলে তিনি অপরিমেয় খ্যাতি অর্জন করেন । স্বীয় কর্মোদ্যমেই তিনি খ্যাতি ও সম্পদ অর্জন করেছেন। পিতা প্রাণকিষেণ লাহার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্যবসাটির উন্নতিতে বাবু শ্যামাচরণ ও বাবু জয়গোবিন্দও দাদাকে প্রভূত সাহায্য করেছেন ।

বাবু শ্যামাচরণ লাহা বাল্যকালে হেয়ার (পূর্বে ‘স্কুল সোসাইটির স্কুল’ নামে পরিচিত) স্কুলে শিক্ষালাভ করেন । পরে তাঁকে হিন্দু স্কুলে ভর্তি করা হয়; এখানে তিনি শিক্ষায় দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন; বৃত্তিও লাভ করেন । তাঁর পিতা নিজস্ব তত্ত্বাবধানে শ্যামাচরণকে ১৯ বছর বয়স থেকেই ব্যবসায়ে শিক্ষা দিতে থাকেন । ১৮৬৮-এ তিনি নিজস্ব ব্যবসায়ের জন্য ইংল্যান্ড যান; এবং ব্যবসা সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে কলকাতা ফিরে আসেন । দক্ষ ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে তাঁকে কয়েকবারই সাউথ সাবার্বন মিউনিসিপ্যিালিটির কমিশনার নিয়োগ করা হয় । তিনিও ২৪ পরগণা জেলার অন্যতম অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন । দুর্গাচরণের কনিষ্ঠ ভাই জয়গোবিন্দও কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির অন্যতম কমিশনার এবং ২৪ পরগণার অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ।

সম্ভ্রান্ত এই তিন ভাই-ই বদান্যতা ও জনসেবার জন্য বিখ্যাত ছিলেন । তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৫০,০০০ টাকা দান করেন; ‘এখন’ এই পরিবারটি কলকাতার অন্যতম ধনাঢ্য পরিবার হিসাবে পরিচিত ।

১৮৮০ সালের ৪ জানুয়ারী ভাইপোর বিয়ে উপলক্ষে বাবু দুর্গাচরণ বিরাট এক ‘নাচের’ আয়োজন করেন । এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন বাংলার মাননীয় ছোটলাট, ভারতের প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ, প্রধান বিচারপতি, কাউন্সিলের সভ্যবৃন্দ, সরকারের সচিবগণ, উল্লেখযোগ্য বহু অফিসার এবং দেশীয় অভিজাতবর্গ 1 শহরের পেশাদারী নাচওয়ালীদের নাচে এবং ফুল লতাপাতা গাছ ও আলোক-সজ্জায় তাঁরা সকলেই খুব খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হয় । মহারাণীর ৯০তম রেজিমেন্ট এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে স্বাগত সুর বাজিয়েছিল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *