০৪. দেবু চলিয়াছিল কুসুমপুর

কয়েক দিন পর দেবু চলিয়াছিল কুসুমপুর।

পাঁচখানা গ্রাম–মহাগ্রাম, শিবকালীপুর, বালিয়াড়া–দেখুড়িয়া, কুসুমপুর ও কঙ্কণা এই লইয়া এককালে হিন্দুসমাজের পঞ্চগ্রাম গঠিত ছিল। তারপর কবে, কেমন করিয়া সমগ্র কুসুমপুর পুরাপুরি মুসলমানের গ্রাম হইয়া দাঁড়াইয়াছে সে ইতিহাস অজ্ঞাত না হইলেও বর্তমান ক্ষেত্রে অবান্তর। হিন্দু-সামাজিক বন্ধন হইতে কুসুমপুর দীর্ঘকাল বিচ্ছিন্ন, কিন্তু তবুও একটা নিবিড় বন্ধন ছিল কুসুমপুরের সঙ্গে। এককালের কুসুমপুরের মিঞাসাহেবরাই এ অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। কুসুমপুরের মিঞাদের প্রদত্ত লাখেরাজ, ব্ৰহ্মোত্তর এবং দেবোত্তরের জমি এ অঞ্চলে বহু ব্রাহ্মণ এবং বহু দেবস্থান আজও ভোগ করিতেছে। আবার কুসুমপুরের প্রান্তে যে মসজিদটি দেখা যায়, সেটির নিম্নাংশ যে এককালে কোনো দেবমন্দির ছিল—সে কথা দেখিবামাত্র বোঝা যায়। ধর্মকর্ম, পালপার্বণ এবং বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপে দুই সমাজের মধ্যে নিমন্ত্রণ এবং লৌকিকতার আদান-প্রদানও ছিল; বিশেষ করিয়া বিবাহাদি ব্যাপারে দুই পক্ষের সহযোগিতা ছিল নিবিড়। সেকালে মিঞাসাহেবদের পালকি ছিল চার-পাঁচখানি। এ অঞ্চলের যাবতীয় বিবাহে সেই পালকিই ব্যবহৃত হইত। শামিয়ানা, শতরঞ্জি মিঞাদের বাড়ি হইতেই আসিত। বিবাহে মিঞারা লৌকিকতা করিতেন। বিবাহ-বাড়ি হইতে নিমন্ত্রিত মিঞাসাহেবদের বাড়িতে অধিকাংশ স্থলেই পান-সুপারি এবং চিনির সওগাত পাঠানো হইত; ক্ষেত্রবিশেষে অবস্থাপন্ন। হিন্দুর বাড়ি হইতে যাইত সিধা-ঘি, ময়দা, মাছ, মিষ্টান্ন ইত্যাদি। মিঞাসাহেবদের বাড়ির বিবাহ উৎসবে হিন্দুদের বাড়িতেও অনুরূপ উপটৌকন আসিত। হিন্দুদের পূজার্চনায়, পূজার ব্যাপার চুকিয়া গেলে, মুসলমানেরা প্রতিমা দেখিতে আসিত, বিসর্জনের মিছিলে যোগ দিত; এককালে মিঞাসাহেবদের দলিজার সম্মুখ পর্যন্ত বিসর্জনের মিছিল যাইত, মিঞাসাহেবরা প্রতিমা দেখিতেন; হিন্দুত্বের জন্য সেখানে তামাকের বন্দোবস্ত থাকিত। মুসলমানদের মহরমের মিছিলও হিন্দুদের গ্রামে আসিত, তাজিয়া নামাইয়া তাহারা লাঠি খেলিত, তামাক খাইত। সেকালে হিন্দুদের পূজা-পার্বণে বাদ্যকর, প্রতিমা বিসর্জনের বাহক, নাপিত, পরিচারক প্রভৃতিদের, মিঞাসাহেবদের সেরেস্তায় পার্বণী বা বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। হিন্দুদের অনেক বাড়িতেও মহরমের পর আসিত লাঠিয়ালের দল, তাহারা সেখানে বৃত্তি পাইত। লাঠিয়ালদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই-ই থাকিত। পীরের দরগায় হিন্দু বাড়ির মানসিক চিনি-মিষ্টির নৈবেদ্যের রেওয়াজ এখনও একেবারে উঠিয়া যায় নাই। কঠিন শূলরোগের জন্য দেখুড়িয়া কালীবাড়িতে মুসলমান রোগী আজও আসিয়া থাকে।

বর্তমান কালে কিছুদিন হইতে এসব কথা ক্ৰমে লোপ পাইতেছে, বিশেষ করিয়া এই ভোটপ্রথা প্রচলিত হইবার পর। ইহা ছাড়া কারণ অবশ্য লোকের বৈষয়িক অবস্থার অবনতি; মিঞারা আজ সর্বস্বান্ত। অন্যান্য হিন্দু-মুসলমানের অবস্থাও ক্ৰমশ খারাপ হইয়া আসিয়াছে। যাহাদের নূতন অভ্যুথান হইয়াছে, তাহাদেরও ধারা-ধরন নূতন রকমের। আপনাদের সমাজ, আপনাদের জাতির মধ্যেও তাহাদের বন্ধনটা নিতান্তই লৌকিক। এখনকার দেশকাল সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। তবুও বন্ধন কিছু আছে, সেটুকু গ্ৰাম্যজীবন যাপন করিতে হইলে ছিন্ন করা অসম্ভব। সমস্তটুকুই চাষের ব্যাপার লইয়া। কামার-চুতারের বাড়িতে এখনও বর্ষার সময় দুই দলই ভিড় করিয়া একত্র বসে গল্প করে। জমিদারের কাছারিতে কিস্তির সময় পাশাপাশি বসিয়া খাজনা দেয়, অজন্মার বৎসর খাজনা ও সুদ লইয়া উভয়পক্ষ একত্রিত হইয়া পরামর্শ করিয়া জমিদার সেরেস্তায় একসঙ্গে দাবি উত্থাপন করে। যাত্রা ও কবিগানের আসরে উভয় পক্ষ ভিড় করিয়া আসে। কঙ্কণার বাবুদের থিয়েটার দেখিতে দুই পক্ষের ভদ্রশিক্ষিতেরা সমবেত হন। অম্বুবাচী উপলক্ষে চাষীদের যে সর্বজনীন কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়, তাহাতে উভয় পক্ষের চাষীরাই যোগদান করে। হিন্দুর আখড়ায় মুসলমান লড়িতে আসে, মুসলমানের আখড়ায় হিন্দুরা যায়। তবে আজকাল একটু সাবধানে দল বাঁধিয়া যায়। মারামারি হইবার ভয়টা যেন ইদানীং বাড়িয়াছে। উভয় পক্ষের গানের প্রতিযোগিতা এখনও হয়। হিন্দুরা গায় ঘেটুগান, মুসলমানদের আছে। আলকাটার কাপ, মেরাচিনের দল। মনসার ভাসানের গান দুই দলেই গায়।

 

বর্তমানে কুসুমপুরের চামড়ার ব্যবসায়ী দৌলত শেখ সর্বাপেক্ষা অবস্থাপন্ন ব্যক্তি। শেখ ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বর। গ্রামে ঢুকিতেই পড়ে তাহার দলিজা। সে আপনার দলিজায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল, পথে দেবুকে দেখিয়া সে ডাকিল আরে দেবু পণ্ডিত নাকি? কুথাকে যাবে বাপজান? আরে শুন শুন!

দেবু একটু ইতস্তত করিয়া উঠিয়া আসিল। দৌলত শেখ সহৃদয়তার সঙ্গেই তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া দলিজায় বসাইল। তারপর বিনা ভূমিকায় সে বলিলই কাম তুমি ভাল করছ। না বাপজান।

দেবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শেখের দিকে চাহিল। শেখ বলিল—খাজনা বৃদ্ধি নিয়া হাঙ্গামা করছ, ধর্মঘট বাঁধাইছই কাম তুমি ভাল করছ না।

সবিনয়ে হাসিয়া দেবু বলিল—কেন?

দাড়িতে হাত বুলাইয়া দৌলত বলিল—আপন কামে কলকাতায় গেছিলাম। লাটসাহেবের মেম্বরদের সঙ্গে মুলাকাত হয়েছিল আমার। আমার মক্কেল আমারে নিয়া গেছিল মিনিস্টরের বাড়ি। হক সাহেবের পেয়ারের লোক মুসলমান মিনিস্টর, তাঁর বাড়ি। আমি শুধালাম। মিনিস্টর। আমারে বললেন– মিটমাট করে নিবার লেগে।

দেবু চুপ করিয়া রহিল। দৌলতই বলিল—তুমি বহু ফৈজতে পড়বা পণ্ডিত, ই কাম তুমি করিও না। শেষমেশ সকল হুজ্জত তোমার উপর গিয়ে পড়বা। বেইমানরা তখন ঘরের কোণে জরুর আঁচল ধরে গিয়ে বসবা। মিনিস্টর আমারে বললেন– সরকারি আইনে যখন জমিদার বৃদ্ধি পাবার হকদার হইছে, তখন ঠেকাবে কে? তার চেয়ে মিটমাট করে নেন গিয়া—সেই ভাল হবে। হুজ্জত বাঁধাইলে সরকারের ক্ষতি সরকার সহ্য করবা না।

দেবু এবার বলিল—কিন্তু যে বৃদ্ধি জমিদার দাবি করছেন, সে দিতে গেলে আমাদের থাকবে কি? আমরা খাব কি?

দৌলত মৃদুস্বরে বলিল ঘোষের সাথে আমি কথা বলেছি বাপজান। আমারে ঘোষ পাকা কথা দিছে। তুমি বল-তুমারও আমি সেই হারে করে দিব। টাকায় আনা। ব্যস! দৌলত অত্যন্ত বিজ্ঞের মত হাসিতে লাগিল।

—তাতে তো আমরা এক্ষুনি রাজি। আজই আমি ডেকে বলছি সব—

বাধা দিয়া দৌলত বলিল—সবার কথা বাদ দিতে হবে, ই আমি তুমার কথা বলছি।

দেবু এবার সমস্ত কথা এক মুহূর্তে বুঝিয়া লইল। সে ঈষৎ হাসিয়া সবিনয়ে বলিল মাফ করবেন চাচা, একলা মিটমাট আমি করব না। আপনি চার পয়সা বলছেন—আমি জানি, এদের পক্ষ আমি যদি ছেড়ে দি—শ্ৰীহরি টাকায় এক পয়সা বৃদ্ধি নিয়ে আমার সঙ্গে মিটমাট করবে, কিন্তু সে আমি পারব না।—দেবু উঠিয়া দাঁড়াইল।

দৌলত তাহার হাত ধরিয়া বলিল—বস, বাপজান বস!

দেবু বসিল না, হাতও ছাড়াইয়া লইল না; দাঁড়াইয়া থাকিয়াই বলিল–বলুন।

–দেখ বাপ, আমার বয়স তিন কুড়ি হয়ে গেল দুনিয়ার অনেক দেখলাম, অনেক শুনলাম। ই কাম তুমি করিয়ো না দেবু। আমি তোমাকে বুলছি, ই কাম তুমি করিয়ো না। শুন দেবু, দুনিয়াতে মানুষ বড় হয় ধনদৌলতে, আর বড় হয আপনার এলেমে। ভাল কাম যে করে আল্লা তাকে বড় করে। বাপজান, প্রথম বয়সে খালি পায়ে ছাতা মাথায় বিশ কোশ হেঁটেছি–মুচিদের বাড়ি গিয়ে খাল কিনেছি, জমিদারে সেলাম ঠুকেছি, তুমার লন্দিরে বুলেছি চাচা। আজ আল্লার মেহেরবানিতে ক্ষেত-খামার করলাম নগদ টাকা জমালাম,এখন যদি আমারে আমি কদর না করি, তবে দশজনা ছোট আদমিতেই বা আমায় খাতির করবে কেনে, আর আল্লাই বা আমার উপর মেহেরবানি রাখবে কেনে? তোমার গায়ের ঘোষেরে দেখ, দেখ তার চালচলন। আরও শুন, কঙ্কণার মুখুৰ্জাদের কর্তার সবে তখন ব্যবসার পত্তন। তখন মুখুর্জা রায়বাবুদের, বাড়ুজ্জা বাবুদের সালাম বাজাত, পায়ের ধূলা নিত। আবার দেখলাম-লাখ টাকা রোজগার করলে, মুখুৰ্জা কৰ্তাই মুলুকের সেরা আদমি হল; তখুনি নিজে বসত চেয়ারে, রায়বাবুদের বসতে দিতে তক্তপোশে! ইজ্জত রাখতে হয়! বাপজান, তুমার বেটা গেছে—বহুত মাশুল তুমি দিছ, তার জন্যে দশজনা তুমাকে ধন্যি করছে। আমীর রইস থেকে ছোটলোক সবাই ভাল বুলছে। এই সময় নিজের ইজ্জত তুমার নিজেকে বুঝতে হবে। ছোটলোক হারামিদের সাথে উঠা-বসা তুমি করিও না। কঙ্কণার বাবু, পেসিডেন্ বাবু বুলছিল—দেবু ঘোষ যদি ইবার বেড়ে দাঁড়ায় তবে মুশকিল করবে। বোড়ে দাঁড়াও তুমি। ব্যবসা-পাতি কর, এখুন তুমাকে খাতির করে বহুত মাহাজন মাল দিবে; আমি বুলছি দিবে! শাদি কর, ঘর-সংসার কর।

দেবু ধীরে ধীরে হাতখানি টানিয়া লইল। অভিবাদন করিয়া বলিল-সেলাম চাচা, রাত্রি হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই।

দৌলত এবার স্পষ্টই বলিয়া ফেলিল—তুমি ব্যবসা কর, শ্ৰীহরি ঘোেষ মাহাজনের কাছে তোমার লাগি জামিন থাকবে।

হাত জোড় করিয়া দেবু বলিল—সে হয় না চাচা, কিছু মনে করবেন না আপনি।

সে আসিয়া উঠিল চাষী মুসলমানদের পাড়ায়। সেখানে তখন অনেক লোক জুটিয়াছে। সমবেত হওয়ার আনন্দে উৎসাহে তাহারা তাহাদের পাড়ার গানের দলটাকে লইয়া গান-বাজনার ব্যবস্থাও করিয়াছে। শ্রমিক ও শ্রমিক-চাষীদের গান-বাজনার দল। পশ্চিম বাংলায় এই ধরনের দলকে বলে—াচড়ার দল। কয়েকটি সুকণ্ঠ ছেলে ধুয়া ধরিয়া গান গাহিতেছিল, মূল গায়েন। ইট-পাড়াইয়ের ঠিকাদার ওসমান—মূল গানটা গাহিয়া চলিয়াছে। বাংলাদেশের বহু প্রাচীনকালের গান। ছেলেগুলি ধুয়া গাহিতেছে–

–সজনি লো—দেখে যা—এত রেতে চরকায় ঘরঘরানী–
সজনি—লো–!

ওসমান গাহিয়া চলিয়াছিল—

কোন্ সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক হিয়া–
চরখার দৌলতে আমার সাতটি বেটার বিয়া।
কোন্ সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক পাঁতি–
চরখার দৌলতে আমার দোরে বাধা হাতি।
কোন্ সজনি বলে রে ভাই চরখার নাইক নোরা–
চরখার দৌলতে আমার দোরে বাঁধা ঘোড়া।

দেবু আসিতেই গান থামিয়া গেল। কয়েকজন একসঙ্গেই বলিল–এই যে, আসুন—পণ্ডিত সাহেব আসুন।

রহম বলিল-বুড়ো শয়তান তুমাকে কি বুলছিল চাচা?

দেবু হাসিল, কোনো উত্তর দিল না।

চাষীদের মাতব্বর, কুসুমপুর মক্তবের শিক্ষক ইরসাদ বলিলবসেন ভাই সাহেব। দৌলত শেখ যা বুলছিল—সে আমরা জানি। আমাদের গায়ে মজলিশের কথা শুনেছি ঘোষও যে এসেছিল আজ দৌলত শেখের কাছে।

দেবু এ-কথার কোনো উত্তর দিল না।

ইরসাদ বলিল—আপনি বুড়াকে কি বললেন–?

–ওর কথা থাক্‌ ভাই ইরসাদ। এখানে আমাকে ডেকেছেন যার জন্যে, সেই কথা বলুন।

ইরসাদ স্থিরদৃষ্টিতে দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। উদ্ধত দুর্ধর্ষ রহম মুহূর্তে উগ্র উত্তেজনায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—আলবাত বুলতে হবে তুমাকে।

দেবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–না।

—আলবাত বুলতে হবে।

দেবু এইবার প্রশ্ন করিল ইরসাদকে–ইরসাদ ভাই?

ইরসাদ রহমকে ধমক দিয়া বলিল রহম চাচা, করছ কি তুমি? বস, চুপ করে বস।

রহম বসিল, কিন্তু তে দাঁত ঘৰ্ষণ করিয়া আপন মনেই বলিল—যে হারামি বেঈমানি করবে, তার নলিটা আমি দু ফাঁক করে ময়ূরাক্ষীর পানিতে ভাসায়ে দিব, হ্যাঁ! যা থাকে আমার নসিবে।

দেবু এবার হাসিয়া বলিল—সে যদি করি রহম চাচা, তবে তুমি তাই কোরো! সে সময়ে যদি চেঁচাই কি তোমাকে বাধা দিই, তবে আজকের কথা তুমি আমাকে মনে করিয়ে দিও। আমি তোমাকে বাধা দেব না, চেঁচাব না, কাদব না, গলা বাড়িয়ে দেব।

সমস্ত মজলিশটা স্তব্ধ হইয়া গেল। ছাচড়ার দলের ছোকরা কয়টি বিড়ি টানিতে টানিতে মৃদুস্বরে রসিকতা করিতেছিল—তাহারা পর্যন্ত সবিস্ময়ে দেবু ঘোষের মুখের দিকে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। অনুত্তেজিত শান্ত স্বরে উচ্চারিত কথা কয়টি শুনিয়া সকলেই তাহারা মুখের দিকে চাহিয়াছিল—এবং কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মুখে আশ্চর্য সে এক মিষ্টি হাসি ফুটিয়া উঠিতে দেখিয়া তাহাদের বিস্ময়ের আর অন্ত রহিল না। ওই কথাগুলা বলিয়া মানুষ এমন করিয়া হাসিতে পারে? রহম যে রহম, সেও একবার দেবুর মুখের দিকে চাহিয়া, পরমুহূর্তেই মাথাটা নিচু করিল, এবং অকারণে নখ দিয়া মাটির উপর হিজিবিজি দাগ কাটিতে আরম্ভ করিল।

কিছুক্ষণ পর ইরসাদ বলিল—আপনি কিছু মনে করবেন না দেবু-ভাই। রহম চাচাকে তো আপনি জানেন।

—না–না-না, আমি কিছু মনে করি নাই। দেবু হাসিল।—এখন কাজের কথা বলুন। ইরসাদ ভাই। রাত্রি অনেক হয়ে গেল।

ইরসাদ বিড়ি বাহির করিয়া দেবুকে দিল দেবু হাসিয়া বলিল—সব আমি ছেড়ে দিয়েছি।

–ছেড়ে দিয়েছেন? ইরসাদ নিজে একটা বিড়ি ধরাইয়া ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল—আপনি ফকির হয়ে গেলেন দেবু ভাই।

 

খাজনা-বৃদ্ধি সম্পর্কিত কথাবার্তা শেষ করিতে রাত্রি অনেকটা হইয়া গেল। কথা হইল, কুসুমপুরের মুসলমান প্রজারা আলাদাভাবেই ধর্মঘট করিবে; হিন্দুদের সঙ্গে সম্পর্ক এইটুকু থাকিল যে, পরস্পরে পরামর্শ না করিয়া কোনো সম্প্রদায় পৃথকভাবে জমিদারের সঙ্গে মিটমাট করিতে পারিবে না। মামলা-মকদ্দমায় দুই পক্ষেরই পৃথক উকিল থাকিবেন, তবে তাহারাও পরামর্শ করিয়া কাজ করিবেন।

ইরসাদ বলিল—সদরে নূরউল মহম্মদ সাহেবকে জানেন তো? আমাদের জেলার লীগের সভাপতি; উনাকেই আমরা ওকালতনামা দিব। আমাদের সুবিধা করে দিবেন।

—বেশ, তাই হবে। আজ তাহলে আমি উঠি!—বলিয়া কথা শেষ করিয়া দেবু উঠিল।

–রাত্রি অনেক হয়েছে দেবু ভাই, দাঁড়ান আলো নিয়ে তোক সঙ্গে দিই আপনার।

–দরকার হবে না। বেশ চলে যাব আমি।

–না, না। বর্ষার সময়, অ্যাঁধার রাত, সাপ-খোপের ভয়। তা ছাড়া তোমার ঘোষকে বিশ্বাস নাই। ঘোষের সাথে দৌলত শেখ জুটেছে। উঁহুঁ!

সম্মুখের প্রাঙ্গণটায় লোকজন তখনও দাঁড়াইয়া ছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে হইতে অগ্রসর হইয়া আসিল রহম চাচা, এক হাতে হারিকেন, অন্য হাতে একগাছা লাঠি।আমি যাচ্ছি ইরসাদ, আমি যাচ্ছি। চল বাপজান।—বলিয়া সে একমুখ হাসিল।

রহম দুর্দান্ত গোয়ার হইলেও চাষীদের মধ্যে একজন মাতব্বর ব্যক্তি। তাহার পক্ষে এইভাবে কাহাকেও আগাইয়া দেওয়া অগৌরবের কথা। দেবু ব্যস্তভাবে প্রতিবাদ করিয়া বলিল–না না, চাচা,–সে কি, তুমি কেন যাবে?

—আরে বাপজান, চল। দেখি তুমার দৌলতে যদি পথে ঘোষ কি শেখের লোকজনের সাথে মুলাকাত হয় তো একপ্যাচ আমূতির লড়াই করে লিব। … সে পরম গৌরবে হাসিতে আরম্ভ। করিল। দেবু আর আপত্তি করিল না। ইরসাদও বাধা দিল না। অন্যায় সন্দেহে আকস্মিক ক্রুদ্ধমুহূর্তে সে দেবুকে যে কটু কথা বলিয়াছে, তাহারই অনুশোচনায় সে এমনভাবে লাঠি-আলো লইয়া এই রাত্রে দেবুর সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইয়াছে; আন্তরিক ইচ্ছা সত্ত্বেও মাফ কর কথাটা তাহার মুখ দিয়া বাহির হয় নাই; সে তাই মমতাময় অভিভাবকের মত আপনার সকল সম্মান খর্ব করিয়া তাহাকে সর্ব বিপদ হইতে রক্ষা করিয়া বুঝাইতে চায়—সে তাহাকে কত ভালবাসে, সে তাহার কত বড় আত্মীয়।

ইরসাদ বলিল—যাও চাচাতাই তুমিই যাও। …

মাঠে পড়িয়াই রহম উচ্চকণ্ঠে গান ধরিয়া দিল—

কালো বরন মেঘ রে, পানি নিয়া আয়
আমার জান জুড়ায় দে।

হাসিয়া দেবু বলিল-আর জল নিয়ে করবে কি চাচা? মাঠ যে ভেসে গেল।

রহম একটু অপ্রস্তুত হইল। চাষের সময় এই মাঠের মধ্যে তার এই গানটাই মনে আসিয়া গিয়াছে। বলিলব্যাঙের শাদির গান চাচা। বলিয়াই আবার দ্বিতীয় ছত্ৰ ধরিল–

বেঙীর শাদি দিব রে মেঘ, ব্যাঙের শাদি দিব,
হুড়-হুড়ায়ে দেরে জল, হুড়-হুড়ায়ে দে।
আমার জান জুড়ায়ে দে।

আষাঢ়-শ্রাবণে অনাবৃষ্টি হইলে এ অঞ্চলে ব্যাঙের বিবাহ দিবার প্রথা আছে। ব্যাঙের বিবাহ দিলে নাকি আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি নামে। বাল্যকালে দেবুও দল বাঁধিয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিয়া ব্যাঙের বিবাহ দিয়াছে। ব্যাঙের বিবাহে তাহার প্রিয়তমা বিলুরও বড় উৎসাহ ছিল। তাহার মনে পড়িল, বিলু একবার একটা ব্যাঙকে কাপড়চোপড় পরাইয়া অপূর্ব নিপুণতার সঙ্গে কনে সাজাইয়াছিল। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।

বিলু ও খোকা! তাহার জীবনের সোনার লতা ও হীরার ফুল। ছেলেবেলায় একটি রূপকথা শুনিয়াছিল রাজার স্বপ্নের কথা। স্বপ্নে তিনি দেখিয়াছিলেন—এক অপূর্ব গাছ, রুপার কাণ্ড সোনার ডাল-পালা, তাহাতে ধরিয়াছে হীরার ফুল। আর সেই গাছের উপর পেখম ধরিয়া নাচিতেছে হীরা-মোতিপান্না প্রবাল-পোখাজ-নীলা প্রভৃতি বিচিত্র বর্ণের মণিমাণিক্যময় এক ময়ূর। বিলু ছিল তাহার সেই গাছ, খোকা ছিল সেই ফুল, আর সেই গাছে নাচিত যে ময়ুর সে ছিল তাহার জীবনের সাধ-সুখ-আশা-ভরসা, তাহার মুখের হাসি, তাহার মনের শান্তি! সে। নিজে, হ্যাঁ নিজেই তো, সেই গাছ কাটিয়া ফেলিয়াছে। আজ সে শুধু ধর্ম, কর্তব্য, সমাজ লইয়া কেবল ছুটিয়া বেড়াইতেছে। তাই যদি সে ভগবানকে ডাকিতে পারিত!

রাজবন্দি যতীনবাবু এখান হইতে চলিয়া যাওয়ার পর মধ্যে মধ্যে কতদিন তাহার মনে হইয়াছে যে, সব ছাড়িয়া যে কোনো তীর্থে চলিয়া যায়। কিন্তু সে যেন পথ পাইতেছে না। যেদিন যতীনবাবু চলিয়া গেলেন, সেই দিনই ন্যায়রত্ন মহাশয় চিঠি পাঠাইলেন—পণ্ডিত, আমাকে বিপদ হইতে ত্রাণ কর।

খাজনা-বৃদ্ধি লইয়া জমিদার-প্রজায় যে বিরোধ বাঁধিবার উপক্রম হইয়াছে সে বিরোধে প্রজাপক্ষের সমস্ত দায়িত্ব, বিপুল-ভার পাহাড়ের মত তাহার মাথায় আজ চাপিয়া বসিয়াছে। খাজনা-বৃদ্ধি! প্ৰজার অবস্থা চোখে দেখিয়াও জমিদার কেমন করিয়া যে খাজনা-বৃদ্ধি চায়, তা

সে বুঝিতে পারে না।

প্রজার কি আছে? ঘরে ধান নাই, বৈশাখের পর হইতেই চাষী প্রজা ধান ধার করিয়া খাইতে শুরু করিয়াছে। গোটা বৎসর পরনে তাহাদের চারখানার বেশি কাপড় জোটে না, অসুখে লোকে বিনা চিকিৎসায় মরে। চালে খড় নাই; গোটা বর্ষার জলটা তাহাদের ঘরের মেঝের উপর ঝরিয়া পড়ে। ইহা দেখিয়াও খাজনা বৃদ্ধি দাবি কেমন করিয়া করে তাহারা? এ অঞ্চলে জমিদারেরা একটা যুক্তি দেখাইয়াছেন যে ময়ূরাক্ষী নদীর বন্যারোধী স্বাধ তাহারা তৈয়ার করিয়া দিয়াছেন, তাহার ফলে এখানকার জমিতে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ বাড়িয়াছে। এত বড় মিথ্যা কথা আর হয় না। এ বাঁধ তৈয়ারি করিয়াছে প্রজারা। জমিদার মাথা হইয়া তত্ত্বাবধান করিয়াছে, চাপরাসী দিয়া প্রজাদের ধরিয়া আনিয়া কাজ করিতে বাধ্য করিয়াছে। আজও প্রজারাই প্রতি বৎসর বাঁধ মেরামত করে। ইদানীং অবশ্য চাষী-প্রজারা অনেকে বাঁধ মেরামতের কাজে যায় না। এখন আইনও কিছু কড়া হইয়াছে বলিয়া জমিদার সদগোপ প্রভৃতি জাতির প্রজাকে ধরিয়া-বাঁধিয়া কাজ করাইতে সাহসও করে না; কিন্তু বাউরি, মুচি, ডোম প্রভৃতি শ্রেণীর প্রত্যেককে আজও বেগার খাটাইয়া লয়। সেটেলমেন্ট রেকর্ড অব রাইটসে পর্যন্ত এই বেগার দেওয়াটাই তাহাদের বসতবাটির খাজনা হিসেবে লেখা হইয়াছে। ভিটার খাজনা বৎসরে তিনটি মজুর-একটি বাঁধ মেরামতের জন্য, একটি চণ্ডীমণ্ডপের জন্য, অপরটি জমিদারের নিজের বাড়ির জন্য।

–দেবু চাচা! ইবার আমি যাই? এতক্ষণ ধরিয়া রহম শেখ সেই গানটাই গাহিতেছিল, অকস্মাৎ গান বন্ধ করিয়া দেবুকে বলিল-গাঁয়ের ভিতরে আমি আর যাব না। লণ্ঠন ও লাঠি হাতে দেবুর সঙ্গী হিসেবে রহম এ গ্রামে ঢুকিতে চায় না।

দেবু চারিদিকে চাহিয়া দেখিল গ্রামপ্রান্তে মুচিপাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সে বলিলহ্যাঁ, , এবার তুমি যাও চাচা।

–আদাব।

–আদাব চাচা।

–আমার কথায় তুমি যেন কিছু মনে করিও না বাপজান! … রহম এতটা পথ লাঠি ও লণ্ঠন হাতে দেবুর সঙ্গে আসিয়া রূঢ় কথার অপরাধবোধের গ্লানি হইতে অনেকখানি মুক্ত হইয়াছে, হাঙ্কা মনে এবার সে সহজভাবেই কথাটা বলিয়া ফেলিল।

দিব্যহাস্যে দেবুর মুখ ভরিয়া উঠিল, বলিল–না, না, চাচা। ছেলেপিলেকে কি শাসন করি না? বলি না-খারাপ কাজ করলে খুন করব?

—তা হলে আমি যাই?

–হ্যাঁ, যাও তুমি।

–নাঃ, চল তুমারে বাড়িতে পৌঁছায়ে দিয়া তবে যাব।…দেবুর মিষ্টহাস্যে, তাহার ওই পরম আত্মীয়তাসূচক কথাতে রহমের মনের গ্লানি তো মুছিয়া গেলই উপরন্তু সেই আনন্দের উচ্ছ্বাসে মুহূর্তে মান-অপমানের প্রশ্নটাও মুছিয়া গেল। সে বলিল—আপন ছেলেকে পৌঁছায়ে দিতে আসছি—তার আবার শরম কিসের? চল।

দেবুর বাড়ির দাওয়ায় লণ্ঠন জ্বলিতেছিল। দেবু বিস্মিত হইয়া গেল। আপনজনহীন বাড়ি—সেখানে কাহারা এমন করিয়া বসিয়া আছে? এত রাত্রিতে কোথা হইতে কাহারা আসিল? কুটুম্ব নয় তো? অম্বুবাচী ফেরত গঙ্গাস্নানের যাত্রী হওয়াও বিচিত্র নয়।

বাড়ির দুয়ারে আসিতেই পাতু মুচি বলিল–এই যে এসে গিয়েছেন পণ্ডিত।

দাওয়ার উপরে বসিয়া ছিল হরেন ঘোষাল, তারা নাপিত, গিরিশ ছুতার এবং আরও কয়েকজন। শঙ্কিত হইয়াই দেবু প্রশ্ন করিল—কি হল?

হরেন বলিল—This is very bad পণ্ডিত very bad; এই জল-কাদা, সাপ-খোপ, অন্ধকার রাত্রি, তার ওপর জমিদারের সঙ্গে এইসব চলছে। তুমি সন্ধ্যাবেলায় আসবে বলে গেলে, তারপর এত রাত্রি পর্যন্ত আর নো পাত্তা!

দরজার মুখের অন্ধকার হইতে বাহির হইয়া আসিল দুর্গা; সে হাসিয়া বলিল—জামাই তো কাউকে আপন ভাবে না ঘোষাল মশায়, যে মনে হবে আমার লেগে কেউ ভাবছে!

দেবু মৃদু হাসিল।

পাতু বলিল—আমি এই বেরুচ্ছিলাম লণ্ঠন নিয়ে।

দুর্গা বলিলরাত হল দেখে কামার-বৌকে দিয়ে রুটি করিয়ে রেখেছি। মুখ হাতে জল দাও, দিয়ে—চল খেয়ে আসবে। আজ আর রান্না করতে হবে না।

এই দুৰ্গা আর কামার-বউ পদ্ম! দেবুর স্বজনহীন জীবনে শুধু পুরুষেরাই নয়, এই মেয়ে দুটিও অপরিমেয় স্নেহমমতা লইয়া অযাচিতভাবে আসিয়া তাহাকে অভিসিঞ্চিত করিয়া দিতে চায়। কামার-বৌ তাহার মিতেনী। অনি ভাই যে দেশ ত্যাগ করিয়া কোথায় গেল! কামার-বউ। পদ্ম এখন তাহার পোষ্যের শামিল; স্বামী-পরিত্যক্তা বন্ধ্যা মেয়েটার মাথাও খানিকটা খারাপ হইয়া গিয়াছে। পদ্মকে লইয়া সে যে কি করিবে ভাবিয়া পায় না।

ভাবিতে ভাবিতে সে দুর্গার সঙ্গে চলিতে আরম্ভ করিল। হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল। দুর্গা বলিল—দেবতা ললপাচ্ছে। রাতে জল হবে। ওঃ কি মেঘ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *