১৫. কৃষিনগরের বিরাট দায়িত্ব

১৫

কৃষিনগরের বিরাট দায়িত্ব ক্রমশ আয়ত্তের মধ্যে আসছে। রায়চৌধুরী সায়েব যে কাজের অগ্রগতিতে খুশি তা সুজাতা দাস নিজের চেম্বারে বসেই বুঝতে পারছে। অনেকক্ষণ ধরে নকশা এবং রিপোর্ট পরীক্ষা করবার পরে সায়েব আপনমনে শিস দিচ্ছেন ।

দিগম্বর বনার্জি খুবই সৌভাগ্যবান যে কমলেশ রায়চৌধুরীর মতো সহকারী পেয়েছেন । বনার্জিকে রায়চৌধুরী যে কতখানি শ্রদ্ধা করেন তা সুজাতা তো নিজের চোখেই দেখেছে । সুদর্শন সেন এবার ফাইল হাতে সায়েবের ঘরে ঢুকলেন ।

রায়চৌধুরী বললেন, “সমস্ত সেকশনের লোকেরা এখনই আসছেন—কারখানা চালু করা সম্পর্কে জেনারেল মিটিং।

সুদর্শন সেন পালাবার চেষ্টা করলেন। “টেকনিক্যাল ব্যাপারে আমি আর কী করবো স্যার?

কমলেশ বললো, “টেকনিক্যাল কাজে আপনার বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। আপনিই তো বলেন, সম্রাট সাজাহান যখন তাজমহল তৈরি করেছিলেন, তখন তার হিসেব রাখতে গিয়ে কাউকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল। অথচ অকৃতজ্ঞ আমরা সেই ভদ্রলোকের নাম পর্যন্ত মনে রাখিনি ।”

সুদর্শন বুঝলেন সায়েব আজ বেশ খুশি আছেন । কমলেশ বললো, “সার কারখানার স্টার্ট-আপ বা প্রাণপ্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। আমরা সমস্ত কারখানা চারভাগে ভাগ করে নিয়েছি । প্রথমে সিনথেসিস এবং অ্যামোনিয়া রিকভারি, দ্বিতীয়– রিসার্কুলেশন এবং ইউরিয়া সলুসান, তিন নম্বর ইউরিয়াকে ক্রিস্টাইলাইজ এবং চার নম্বর ড্রাইং রিমেলটিং এবং প্রিলিং ।”

এইসব টেকনিক্যাল শব্দ শুনলে সুদর্শন সেনের মাথা ঝিমঝিম করে । কিন্তু উপায় কি? সায়েব বলে যাচ্ছেন, “সমস্ত ফ্যাক্টরি চল্লিশটা সার্কিটে ভাগ হয়েছে, চালু করবার সুবিধের জন্যে । প্রত্যেক লোকের আলাদা দায়িত্ব। মেশিনের পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে। আগামীকাল ফ্ল্যাশিং শুরু হবে।”

এবার ঘরে লোক এসে পড়লো। মিটিং শুরু হয়ে গেলো ।

সুজাতা আশা করেছিল, জার্মান যুবক ম্যাক্সকেও দলের মধ্যে দেখতে পাবে। তারপর মনে পড়ে গেলো, পুরো কারখানা ইন্ডিয়ানরাই চালু করবে, সেখানে বিদেশিদের কোনো সাহায্য নেওয়া হবে না ।

সেই রাত্রের অভিজ্ঞতার পর থেকে কন্দর্পকান্তি ম্যাক্স সম্পর্কে সুজাতা বেশ দুর্বলতা বোধ করে । রোজ সকালে ম্যাক্স চিঠির খোঁজে আসে; আর পাঁচটা মিনিট সুজাতার অনির্বচনীয় আনন্দে কেটে যায় । সুজাতা যেন ওর খুব কাছাকাছি চলে আসে ।

আজ এলো না ম্যাক্স। বেচারা রোজ কেনই-বা আসবে? চিঠিপত্তর তো থাকে না ।

তবু মনটা ছটফট করছে সুজাতার। কি সুন্দর হাসে ম্যাক্স। ওর হাসিতে এদেশের ব্যাটাছেলেগুলোর মতো পাপ নেই।

ঘরের মধ্যে মিটিং পুরোদমে চলছে, সুজাতা উঁকি মেরে দেখলো । হাতে একটা সরু লাঠি নিয়ে, দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপ দেখিয়ে কমলেশ বলে যাচ্ছে।

রায়চৌধুরী সায়েব চান যে প্রত্যেক মজুর এবং কর্মী যেন মোটামুটি জেনে রাখেন কীভাবে এখানে ইউরিয়া তৈরি হবে। মজদুরদের পিছনে অত সময় দিতে অনেক সুপারভাইজার চান না। কিন্তু কমলেশের কথা সুজাতা শুনতে পেলো। কমলেশ বলছে, “এটা খুবই প্রয়োজনীয়। কারখানার পুরো ছবিটা মনের মধ্যে না থাকলে মজদুরদের কাছে নিজের কাজটুকু অর্থহীন হয়ে পড়বে। ভুল হতে পারে, ক্লান্তি আসবে। “

সুজাতার ওসব ভালো লাগছে না। সে এই সুযোগে প্রিলিং টাওয়ারে ফোন করলো ম্যাক্সকে যদি পাওয়া যায়। কোথায় ম্যাক্স? একটা মজদুর এই মেছোবাজারী আওয়াজের মধ্যে কি যে বলছে, সুজাতা শুনতে পাচ্ছে না। ম্যাক্স যে আজ কাজে আসেনি, তা শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে সুজাতা বুঝতে পারলো ।

সুজাতার চিন্তা বাড়ছে । নাকের ডগায় আবার ঘাম জমেছে। প্রথমে ভাবলো ছোকরা সায়েবের খোঁজ করবে না। কেনই বা করতে যাবে? কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসছে না ৷ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুজাতা দাস এবার গেস্টহাউসে ফোন করলো ।

গেস্টহাউসের ফোনটা ডাইনিংরুমের পাশে। সেখানে কুকবেয়ারা আবদুল ফোন ধরলো। বললো, “শীলারসাব? হ্যাঁ । উনকা তবিয়ত আচ্ছা নেহি।” সায়েব নাকি ঘুমোচ্ছেন। আবদুল ডেকে দিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু সুজাতা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে লাইন কেটে দিয়েছিল ।

আচমকা এইভাবে লাইনটা কেটে দেওয়া ঠিক হলো কিনা ভাবছিল সুজাতা দাস । এমন সময় কমলেশ বেল বাজিয়ে সুজাতাকে ডাকলো। “মিস দাস, আপনি একটা ছোট নোট নিয়ে নিন তো। আমি এখানকার ইউরিয়া তৈরির পদ্ধতিটা সোজা ভাষায় বর্ণনা করতে চাই–যাতে প্রত্যেক কর্মীকে আমরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারি।”

সুদর্শন বললেন, “ভীষণ গোলমেলে ব্যাপার স্যার। আমার তো গুলিয়ে যাচ্ছে। কী বললেন–তরল অ্যামোনিয়ার সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর অনেক রকম সলিউশন মিশিয়ে কোনো এক রি-এক্টরে পাঠাবেন। তারপর সেখানে স্টিমের চাপ কমিয়ে কীসব করবেন। সেখানে থেকে মালমশলা চলে যাবে সংশোধন স্তম্ভে।”

“বাঃ, এইতো রেকটিফাইং কলামের ভালো বাংলা বার করেছেন,” কমলেশ উৎসাহ দিলো ৷

সুদর্শন বললেন, “সত্যি কথা বলছি স্যার, কর্মীরা আপনার ওই হিটার, সেপারেটর, দ্বিতীয় সংশোধন স্তম্ভ, ৭৫% ইউরিয়া সলিউশন ওসব কিছুই জানতে চাইবে না।”

“তবে তারা কী জানতে চাইবে?” কমলেশ জিজ্ঞাসা করলো ।

“তারা জানতে চাইবে, কারখানা চালু হলে মাইনে বাড়বে কিনা, বোনাস কত হবে, আরও কোয়ার্টার তৈরি হবে কিনা, এইসব ।”

হেসে ফেললো কমলেশ। বললো, “কারখানা চললে, এসব তো হবেই। কিন্তু তার আগে তো ইউরিয়া বেরোনো চাই ।

নোট ডিকটেশন নিয়ে সুজাতা বেড়িয়ে এলো। কমলেশ এবার দিগম্বর বনার্জিকে ফোন বুক করলো। কমলেশ ভাবছে বাইরে অ্যামোনিয়া জলে গুলে প্রিলিং সেকশনে কাজটা এগিয়ে রাখবে। হাজার হোক স্যাকশন পদ্ধতিতে দেড়শ ফুট উপরে কাদার মতো ইউরিয়াকে টেনে তুলতে হবে, তারপর স্প্রে-ড্রাইং করার জন্যে ছড়িয়ে দিতে হবে ।

দিগম্বর বনার্জি ওসব শোনবার পরেই নিজের প্রসঙ্গে ফিরে আসবেন। তাঁর এখন একটি মাত্র প্রশ্ন, ইউরিয়া কারখানা ৩০শে নভেম্বর চালু হচ্ছে কিনা । ইদানীং ভদ্রলোক একটু পাল্টে গিয়েছেন। বিলেত থেকে ফেরা পর্যন্ত, কেবল একইভাবে কাটা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন ৩০শে নভেম্বর কাজ শেষ হচ্ছে কিনা।

অথচ সেই অনুপাতে কৃষিনগরে আসা কমিয়ে দিয়েছেন দিগম্বর বনার্জি । কিন্তু টেলিফোনে আলাপ আলোচনা বেড়েই চলেছে। কণ্ঠস্বরে আগেকার প্রসন্নতা ফুটে ওঠে না । কমলেশের ওপর তিনি কি পুরনো বিশ্বাস রাখতে পারছেন না? না, সিবিআই কমলেশ সম্পর্কেও তাঁর কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছে?

এসব সত্ত্বেও কমলেশের হৃদয়ে দিগম্বর বনার্জি আজও আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

১৬

তখন প্রায় সন্ধ্যা। গেস্টহাউসের ডাইনিংরুমে ফুল রাখতে বাবুর্চি-কাম-বেয়ারা আবদুল দেখলো একজন সুবেশিনী মহিলা এদিকেই আসছেন। গেস্টহাউস এখন তো খালি । জার্মান শীলার সায়েব ছাড়া আর কেউই নেই। ইনি আবার কার খোঁজে আসছেন?

আবদুল একটু সেকেলে ধরনের। একলা যুবতী মেয়ে দেখলে ভয় পেয়ে যায় । বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারি অফিসারদের মেসে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে, সায়েবরা একলা বেশ থাকে। কিন্তু মেয়েমানুষ এলেই বিগড়ে যায়। কিন্তু আবদুল সামান্য বেয়ারা, কে তার কথা শোনে?

সুজাতা দাস আজ খোঁপায় ফুল গুঁজেছে। জিজ্ঞেস করলো, “শীলার সায়েবের ঘর কোথায়?”

সন্ধ্যাবেলায় ঝকঝকে জামাকাপড় পরা কমবয়সী মেয়েমানুষকে একলা ঘরে ঢুকতে দিতো না আবদুল, কিন্তু মনে পড়লো হেডআপিসে বড়সায়েবের ঘরে এই মেমসায়েবকে সে দেখেছে । তাই সেলাম করলো। তারপর শীলার সায়েবের ঘর দেখিয়ে দিলো । দরজায় দুটো হাল্কা টোকা দিয়ে সুজাতা অপেক্ষা করলো। ভিতর থেকে আওয়াজ এলো, “কাম ইন।”

ম্যাক্স ভেবেছিল আবদুল । কিন্তু তার পরিবর্তে সুজাতাকে দেখে একেবারে ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো । শীলারের অনাবৃত রোমশ বুকটা দেখা যাচ্ছে । অসংখ্য ক্ষমা প্রার্থনা করে সে বুশ শার্টের খোলা বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো। “হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!” মধুর বিস্ময়ে সায়েব বেশ খুশি হয়েছেন ।

সুজাতা প্রথমে একটু লজ্জা পাচ্ছিল । এবার মনোবল সংগ্রহ করে সহজভাবে স্নেহভরা কণ্ঠে অনুযোগ করলো, “অসুখ করেছে, ডাক্তার ডাকেননি?”

ম্যাক্স অপ্রত্যাশিত আনন্দে ইংরাজি ভুলে যাচ্ছে। বললো, “ডক্টরকে ডাকবার মতো অসুখ নয়। তবে অসুখকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার বর্তমান সৌভাগ্যের জন্যে ।” ম্যাক্সের চোখ দুটো কী সুন্দর। ওর মার্বেল পাথরের মতো সাদা দেহটাও সামান্য জ্বরে ভুগে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

সুজাতার খোঁপায় বাঁধা ফুল ম্যাক্সের দৃষ্টি এড়ালো না। ইন্ডিয়ান সুন্দরীদের মাথায় ফুল গুঁজলে স্বর্গীয় মনে হয় । “তোমরাও কি দেবতাদের সন্তুষ্ট করবার জন্যে মাথায় ফুল দাও?” ম্যাক্স জিজ্ঞেস করলো ।

“গড-টড্ জানি না, অনেকে দেয়– আমিও দিই।” সুজাতা হেসে বললো ।

“ওহো, স্বামী তো ইন্ডিয়ান মেয়েদের গড়”, ম্যাক্সের মনে পড়ে গেলো ।

সুজাতা বললো, “আমার পতিদেবতা নেই, হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই । সুতরাং ওসব নিয়ে মিথ্যে মাথা ঘামাই না ।

ম্যাক্স জিজ্ঞেস করলো, “দুপুরবেলায় তুমি কি আমাকে ফোন করেছিলে? ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনের কাছে যাবার আগেই লাইন কেটে গেলো। আবদুল বললো, মহিলার গলা । আমি একবার ভাবলাম মিস ইন্ডিয়া ছাড়া কে হবে? কিন্তু ফোন তুলে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না ।

“তুমি আমাকে মিস ইন্ডিয়া বোলো না ম্যাক্স। লোকে হাসবে। ইন্ডিয়ান মেয়েদের তুলনায় আমি অনেক নিরেস। আমার গায়ের রঙ কালো।”

ম্যাক্স কোনো কথাই শুনলো না! বললো, “ব্ল্যাক ইজ সুইট।”

ম্যাক্স কি ওর দিকে তাকিয়ে আছে? সুজাতা বুঝতে পারছে না। সুজাতার মাথাটা একটু যেন ঘুরতে আরম্ভ করেছে । আটাশ বছরের সংযমশাসিত কুমারী দেহকে সুজাতা ঠিক আয়ত্তে রাখতে পারছে না ।

সুজাতা জানে সে বিয়ে করবে না। কিন্তু পুরুষ সম্বন্ধে সেই অনাদি অনন্ত আদিম কৌতূহলকে মন থেকে সম্পূর্ণ তাড়াতে পারেনি। অথচ দিশি পুরুষগুলোকে সে সত্যিই ঘেন্না করে । ওগুলোকে বড় নোংরা মনে হয় ৷

সায়েবরা হিপক্রিট নয়। ম্যাক্স তো অকপটে বলছে, সে অবিবাহিত, কিন্তু কুমার নয়। দিশিদের এই সততা নেই। সব ব্যাটাই সাধু সেজে সমাজে ঘুরে বেড়াতে চায় ৷

সব জেনে শুনে ম্যাক্সকে ভালো লাগছে সুজাতার। ম্যাক্স জানালো, মিস ইন্ডিয়ার সাময়িক বন্ধুত্ব তার কাছে অমূল্য এবং আশাতীত ৷

তারপর?

তারপর আর স্মরণ করতে পারছে না সুজাতা দাস । সমস্ত জেনেশুনেও অকস্মাৎ অঘটন ঘটে গিয়েছে। ম্যাক্সকে দোষ দিতে পারছে না সুজাতা। সে যে বিয়ে করে ইন্ডিয়াতে জড়িয়ে পড়তে পারবে না তা খোলাখুলিই বলেছে। সুজাতাও জানিয়েছে, তোমার ইচ্ছে থাকলেও আমি রাজি নই। কিন্তু তারপর–কী যে হলো। নভেম্বরের নিভৃত নির্জন সন্ধ্যায় ম্যাক্সের উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে নিজের কুমারী দেহকে মুক্ত করেনি।

চরম মুহূর্তের চকিত চমকে সুজাতা বোধহয় কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল । তার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ম্যাক্স একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর নরম হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নাড়ি দেখেছিল। ওকে চাঙ্গা করবার জন্যে মুখে একটু ভারমুথ ঢেলে দিয়েছিল । তারপর পরম স্নেহে সুজাতাকে বলেছিল, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত । চলো তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসি

“না, আমি একাই চলে যেতে পারবো,” এই বলে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ অথচ সন্ত্রস্ত সুজাতা দাস রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছিল ।

সুজাতা দাস এবার যেন সংবিৎ ফিরে পাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে কি পাগল হয়ে গিয়েছিল? পাগলামীর মাথায় কী একটা করে ফেললো সে । সুজাতা আর ভাবতে পারছে না । কিন্তু সেই সঙ্গে মাঝে-মাঝে এক অনাস্বাদিত প্রশান্তি অনুভব করছে সে।

সুজাতা দাস বাড়ির দিকে এগিয়ে চললো ।

১৭

সুজাতা দাস নিজেকে আর প্রকৃতিস্থ রাখতে পারছে না। প্রথমে প্রচণ্ড জয়ের আনন্দ অনুভব করলো সে। তারপর নিজেই বুঝতে পারছে এর মধ্যে প্রতিশোধের প্রবৃত্তিও ছিল। কালো, রোগা, লম্বা, শীর্ণবক্ষ, ঈষৎ ট্যারা, ডাইলেটেড্ হার্টের সুজাতা দাসকে যেসব স্বার্থপর দিশি পাত্র এবং তাদের ততোধিক লোভী অভিভাবকরা মনোনয়ন করেননি, তাদের প্রত্যেকের অবহেলা এবং অপমানের চরম প্রতিশোধ নিতে পেরেছে সে ।

কিন্তু এক অচেনা-অজানা ভয় ওর কুমারিত্বহারা দেহের ওপর ক্রমশ নেমে আসছে । কিছু না ভেবেই, কোনোরকমে প্রস্তুত না হয়েই তো সে গেস্টহাউসে গিয়েছিল। যে-সুজাতা সেখানে গিয়েছিল, সে ফিরে আসেনি।

যত সময় যাচ্ছে সুজাতার ভয় তত যেন বাড়ছে। মেয়েদের নিজস্ব কয়েকটা দিনের কথা মনে পড়তেই অজানা আশঙ্কা ধোঁয়ার মতো তাকে গ্রাস করতে চাইছে। যদি কেলেঙ্কারি হয়?

সেক্রেটারির ঘরের মধ্যে দিয়ে নিজের অফিসঘরে ঢুকতে ঢুকতে কমলেশ দেখলো, তার সেক্রেটারি যেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার চোখের কোনে কালি। কমলেশ বললো, “মিস দাস, রাত্রে কি ঘুমোননি? আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’

হাসলো সুজাতা। কোনোরকমে কমলেশকে বললো, “একটু মাথা ধরা রয়েছে।”

কমলেশ বললো, “সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ সারিডন রাখুন। আপনার, আমার এবং এই অফিসের অনেকের এখন মাথাধরার ওষুধ ঘন-ঘন দরকার হবে!”

ম্যাপ এবং কাগজ নিয়ে প্রোজেক্ট ম্যানেজার আবার সাইটে বেরিয়ে গেলেন। সুজাতার মাথাটা আবার গোলমাল হয়ে যেতে লাগলো। ম্যাক্স কি আজ আসবে? কেন আসবে? পুরুষমানুষের তো আর আসবার প্রয়োজন নেই। সে তো যা পাবার পেয়ে গিয়েছে। এখন যত উদ্বেগ সুজাতার। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সুজাতার। ঈশ্বরের ওপর খুব রাগ হচ্ছে, সব দায়িত্বের বোঝা মেয়ে জাতটার ওপর চাপিয়ে তাদের এমন অসহায়ভাবে সৃষ্টি করবার কী প্রয়োজন ছিল?

একটু পরেই ম্যাক্সকে আসতে দেখলো সুজাতা। সেই হাসি-হাসি পবিত্র মুখ। সঙ্গে-সঙ্গে মনে ভরসা পেলো সুজাতা। সে লিখে দিতে পারে, দিশি চ্যাংড়াগুলো এইরকম কোনো ঘটনার পর আর পাড়ামুখো হতো না । সায়েবদের সম্পর্ক সুজাতার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আরও দৃঢ় হচ্ছে।

হরিণীর মতো সরল বিস্ময়ে সুজাতা এবার ম্যাক্সের মুখের দিকে তাকালো। শুভ প্রভাত জানালো ম্যাক্স। গতকালের দুর্ঘটনাকে কত সহজভাবে নিয়েছে ম্যাক্স। তার জন্যে কোনো পাপবোধ নেই, লজ্জা নেই । অন্য দিনের মতোই সুজাতার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলো।

এমন সময় সুদর্শন সেন ঘরে ঢুকলেন । জিজ্ঞেস করলেন, “মিস্টার শীলার, তোমার কাজ কতদূর?”

ম্যাক্স বললো, “আমার কাজ শেষ । দিন চারেকের মধ্যেই প্রিলিং টাওয়ারে ইউরিয়া চালান করা হবে। তারপর আমার ছুটি।’

“তাই এতো খুশি-খুশি দেখাচ্ছে তোমায়,” সুদর্শনবাবু মন্তব্য করলেন । “এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের ছেলে দেশে ফিরে যাবে। রায়চৌধুরী সায়েবও তাঁর কারখানা চালু করে দেবেন।”

ওরা হাসলো । সুদর্শনবাবু জানালেন, “আমিও মাদার কালীকে একটি কমপ্লিট গোট প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। কারখানা চালু হলেই, টেক্ মাই বস্তা অ্যান্ড সী মাই রাস্তা।”

১৮

ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মল্লিকাও দিন গুনছে। স্বামীকে মোটেই বিশ্বাস নেই, শেষ পর্যন্ত ধর্মপুরে দম্পতি-প্রতিযোগিতায় যাবে কিনা। হাজার রকম কাজ আছে কমলেশের সুতরাং একটা ছুতো তুলতে কতক্ষণ? কিন্তু মল্লিকা মনস্থির করে রেখেছে, তাদের প্রেমের ওইটাই অগ্নিপরীক্ষা। কমলেশ যদি এবারও ডোবায়, তাহলে মল্লিকা কিছুদিনের জন্যে কলকাতায় চলে যাবে। স্বামীর কর্মদ্যোগকে এখনও সে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তাই বলে তুমি ভালোবাসার প্রমাণ দেবে না তা চলবে না। হে ঈশ্বর রক্ষা করো, কমলেশ যেন এবার তার কথা রাখে। মল্লিকা এই সুযোগটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে মনে-মনে। দিগম্বর বনার্জিকে লিজ দেবার পর কমলেশের হৃদয়ে স্ত্রীর জন্যে একটু জায়গা পড়ে আছে কিনা তার প্রমাণ নিয়ে ছাড়বে মল্লিকা ৷

ধর্মপুর ক্লাবের প্রতিযোগিতা বেশ নতুন ধরনের। মেড-ফর-ইচ-আদার নাইট । রিংকি ফোনে বললো, “আমার তো মনে হচ্ছে তোরাই প্রাইজ পেয়ে যাবি। তোদের দেখলেই মনে হয় ভগবান সত্যিই জোড় হিসেবে তৈরি করেছেন।’

কমলেশ জিজ্ঞেস করেছে, “ব্যাপারটা কী?”

“আহা, ফিল্টার সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখেননি। কে না জানে তামাকের সঙ্গে ফিল্টারের রাজযোটক মিল যেন আদর্শ স্বামী-স্ত্রী-মেড-ফর-ইচ-আদার ।

“ইচ-আদার।” কমলেশ বললো, “কথা দুটো হাড়ে হাড়ে জানি । ভুল মানে করায় হিমাংশুবাবু স্যার স্কুলে বেঞ্চিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। একজনের সঙ্গে মাত্র আর একজনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইচ-আদার; আর একাধিক হলে ওয়ান-অ্যানাদার ।“

“মানে?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো ।

কমলেশ বললো, “মানে, সুদর্শনবাবুর ভাষায় আজকালকার প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রী মেড-ফর-ইচ-আদার–নিজের কর্তা বা নিজের গিন্নি ছাড়া সমাজ-সংসারে কাউকে চেনে না। সুদর্শনবাবুর যৌবনে ছিল মেড-ফর-ওয়ান-অ্যানাদার। শুধু কর্তা গিন্নি নিয়ে জগৎ নয়, বাবা মা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন, সমাজ সংসার রয়েছে।”

মল্লিকা বললো, “রিংকিটা ভীষণ অসভ্য । জিজ্ঞেস করলাম প্রতিযোগিতায় কী করতে হবে? রিংকি উত্তর দিলো, ‘বরের সঙ্গে এমন ভাব করবি, যেন দুজনে চাবি আর তালা, হাঁড়ি আর কড়া কিংবা শিল আর নোড়া। একজন ছাড়া আর একজনের গতি নেই!”

তালিকা বাড়িয়ে দিয়ে কমলেশ বললো, “যেমন ঝিনুক আর বাটি, খল আর নুড়ি, কালি আর কলম, সায়া আর ব্লাউজ, জুতো আর মোজা ।“

বেজায় খুশি হয়ে মল্লিকা বললো, “বেশ বানিয়ে যাচ্ছ তো! লক্ষ্মীটি আরও কয়েকটা উদাহরণ দাও।”

মাথা চুলকে কমলেশ বললো, “যেমন সুচ আর সুতো, বোতল আর ছিপি, গাল আর দাড়ি, ঠোঁট আর গোফ, সায়েব আর স্টেনো, কোট আর প্যান্ট, মুড়ি আর বেগুনি।”

বউকে খুশি করবার জন্যে কমলেশ বাইরে খুব হাসছে। কিন্তু মনে-মনে সে প্রার্থনা করছে যেন ইতিমধ্যে কৃষিনগরের কাজটা নির্বিঘ্নে এগিয়ে যায়। ওর নিজেরও ক্লান্তি আসছে । একটু বিশ্রাম পেলে মন্দ হতো না ।

মল্লিকা বললো, “ধর্মপুরের মেয়েগুলো স্বামীদের নিয়ে প্রতিদিন মেড-ফর-ইচ-আদার রিহার্সাল দিচ্ছে। তুমি তো বাড়িতে থাকো না, যে একটু মহড়া দেবো ৷

“কিছু ভেবো না তুমি, স্টেজে মেরে দেবো । “

“আগেকার বুড়ো-বুড়িরা এইসব কম্পিটিশনের কথা শুনলে রেগে যেতো,” মল্লিকা বললো ।

কমলেশ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, “বলা যায় না। আগের যুগেও তো একটা খারাপ কথা ছিল: আহা যেন মাগ ভাতার ৷”

মেড-ফর-ইচ-আদার বলতে আজকালকার স্বামী-স্ত্রীরা অন্যরকম বোঝে। সুখে দুঃখে, ভোগে-ত্যাগে কেউ কাউকে অতিক্রম করবে না।”

কমলেশ ফিল্টার সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে বললো, “এক কথায় হরগৌরী । আদর্শ দম্পতি।”

মল্লিকা বললো, “ফিল্টার সিগারেটের বিজ্ঞাপনে যেসব ছবি বেরোয় তাতে স্বামীরা খুব সুন্দর দেখতে হয়। দেখলেই বোঝা যায় কোনো অভাব-অনটন নেই। স্বামীর সিগারেট খাওয়ার পুরুষালি অভ্যাসকে বউ একটু প্রশ্রয় দেয় । স্বামীর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ভাব এবং দুজনের মধ্যে নিবিড় প্রেমের ইঙ্গিত। যে প্রেম বৈধ এবং যে প্রেমে লুকোচুরি নেই।

কমলেশ স্ত্রীর সূক্ষ্ম দৃষ্টির প্রশংসা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু আবার টেলিফোন বেজে উঠলো আবার সেই কারখানার কথাবার্তা। কথা চলছে তো চলছেই । কারখানার লোকগুলো যেন ষড়যন্ত্র করে তৈরি হয়ে থাকে। স্বামীর সঙ্গে মল্লিকা একটু গল্প আরম্ভ করলেই ওরা টেলিফোন বাজাতে শুরু করে।

মল্লিকার মনে হচ্ছে মেড-ফর-ইচ-আদার যদি কেউ হয় সে হলো ওই টেলিফোন আর কমলেশ ।

কমলেশ নিজেও একটু বিরক্ত আজ। কিন্তু কারণটা মল্লিকাকে জানালো না । টেলিফোনের ওদিকে ছিলেন দিগম্বর বনার্জি। এতো করছে কমলেশ, তবু দিগম্বর বনার্জি সন্তুষ্ট নয় ৷ আবার সেই পুরানো কথা মনে করিয়ে দিলেন, ত্রিশে নভেম্বর–সাতই ডিসেম্বর নয় ।

কমলেশ মনস্থির করে ফেলেছে প্রতিযোগিতার দিন বিকেলে সে গোপনে বেরিয়ে যাবে ধর্মপুরের দিকে। কোনো কথাই শুনবে না ।

.

নির্ধারিত দিনে কমলেশ ভোর ছ’টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেছে। বিকেলে থাকবে না বলেই, লাঞ্চের সময় বাড়ি ফেরেনি। আপিসে সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে টোটো করে সাইটে ঘুরেছে। স্টার্ট আপের কাজে বেশ চলছে। কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়।

তিনটের সময় বাড়ি ফিরেও অব্যাহতি নেই । ফোনটা বাজছে তো বাজছেই । টেলিফোনের জ্বালায় মল্লিকার মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো । স্বামীকে বলেই ফেললো, “শেষ পর্যন্ত তোমার যাওয়া হবে না। শুধু-শুধু আমাকে কেন সাজতে বলছো?”

স্ত্রীর আক্রমণ কমলেশ গায়ে মাখলো না । হাসিমুখে বললো, “চটপট তৈরি হয়ে নাও । কোনো বাগড়া এসে পড়বার আগেই আমরা বেড়িয়ে যাবো । “

“বাগড়াই তো তুমি চাও,” মল্লিকা অভিযোগ করলো ।

“বটে!” স্ত্রীর মনে কমলেশ আজ কিছুতেই কষ্ট দেবে না ।

“বউয়ের কাছে অভিনয় করছো যে কাজের থেকেও তাকে ভালোবাসো,” মল্লিকা বললো ।

টেলিফোনটা আবার বেজে উঠলো । কিন্তু কমলেশ কোনোদিন যা করেনি হঠাৎ তাই করে বসলো । মল্লিকা দেখলো কমলেশ কথা না বলেই ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিলো

মল্লিকা এরকম অবস্থার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। যতই অভিযোগ করুক, যতই বিরক্তি দেখাক, স্বামীর কাজের টানের প্রতি মল্লিকা নিজের অজান্তেই কখন শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করেছে। মল্লিকার কেমন যেন আশঙ্কা ছিল আজও স্বামীর শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে উঠবে না । টেলিফোনটা স্বামী যখন নামিয়ে রাখলো, তখন খুশি হলেও গর্বিত হতে পারলো না মল্লিকা। মনে হলো, এটা ঠিক কমলেশ রায়চৌধুরীকে মানায় না। এ এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থা– স্বামীকেও চাই, স্বামীর জন্যে গর্বিত হতেও চাই । মল্লিকা মনে-মনে নিজেকে বকুনি লাগালো ।

কমলেশ জিপের গতি বাড়াচ্ছে। সমস্ত কৃষিনগর কোনো আধুনিক চলচ্চিত্রের নয়নাভিরাম দৃশ্যের মতো পর্দার ওপর থেকে সরে যাচ্ছে । মজদুর কলোনিতে এরই মধ্যে আঁচ পড়েছে। ছোট-ছোট কয়েকটা উলঙ্গ ছেলে রাস্তার ওপর খেলা করছে। আদিবাসী পুরুষ ও মেয়েরা কর্মক্লান্ত দিনের শেষে কাঁধে লাঠি ও লাঠির ওপর হাঁড়ি বেঁধে গ্রামের পথে রওনা দিয়েছে।

হাসপাতাল এবং নার্স কোয়ার্টার পেরিয়ে জিপ ছুটে চললো। গেস্টহাউসও এগিয়ে আসছে। দূরে একজন দীর্ঘদেহী তরুণ বিদেশিকে আপন মনে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে দেখা গেলো ।

মল্লিকা বললো, “তোমাদের জার্মান সায়েব না?”

কমলেশ বললো, “হ্যাঁ। কাজ-পাগল ম্যাক্স শীলার আমাদের কাজ শেষ করে দিয়েছে আজ সকালে । তাই বোধহয় হাল্কা মেজাজে কৃষিনগর দেখছে। আগামীকাল দেশে ফিরে যাবে।”

আজ কিন্তু কমলেশ যত কৃষিনগরের কথা ভুলে যেতে চাইছে মল্লিকা ততই সেসব মনে করিয়ে দিচ্ছে। হাওয়ায় বিভ্রান্ত আঁচল সামলাতে সামলাতে মল্লিকা বললো, “তোমার সেক্রেটারির কী খবর? আর একদিনও তো এলো না।”

“তোমাকে এড়িয়ে চলে হয়তো। হাজার হোক সায়েবের বউ ।“

“বসের বউ তো কামড়াবে না।” মল্লিকা অভিমানভারা কণ্ঠে বললো ।

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে কমলেশ বললো, “বেচারার কি যে হয়েছে, ক’দিন বেশ চিন্তায় রয়েছে। আজ তো অফিসেই আসেনি, শরীর খারাপ।”

“শরীর খারাপের জন্যে বাবা-মা তো বিয়েই দিলো না,” মল্লিকা বললো। “স্কুলে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।”

মল্লিকার ইচ্ছা হলো একবার সুজাতার কোয়ার্টারে যায়। বিশেষ করে বেচারা যখন অসুস্থ ।

কিন্তু কমলেশ এখন অফিস সংক্রান্ত কোনো কথায় কান দিতে চাইছে না; এমনকি একবার কৃষিনগর কারখানার দিকেও সে তাকালো না । পশ্চিম আকাশের সূর্যালোক পায়রার পালকের মতো সাদা প্রিলিং টাওয়ারের ওপর পড়ছে। ঠিক যেন বরফওয়ালা গুঁড়ো বরফের পুতুল তৈরি করে তার ওপর লাল সিরাপ ছড়িয়ে দিলো ।

কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য মল্লিকার দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কমলেশ জিপের গতি কমালো না । মল্লিকার মনে হলো কমলেশ আজ প্রতিজ্ঞা করেছে বউকে খুশি করা ছাড়া অন্য কিছুই সে করবে না ।

কমলেশ আজ আনন্দে উচ্ছল হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে। খোলা রাস্তায় গাড়ির স্পিড অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। গুনগুন করে গানও গাইছে ৷ মল্লিকা এতোদিন ধরে যা চেয়েছে অবশেষে তা পেয়েছে, তার আনন্দ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে কেমন অস্বস্তি বোধ করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে স্বামীর তপোভঙ্গ করবার মতো স্বার্থপরায়ণা সে তো নয় ৷

কমলেশকে দেখেই রিংকি আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বললো, “যাক এলেন তাহলে।”

“আসবো না কেন?” সোফায় বসে পড়ে কমলেশ উল্টো প্রশ্ন করলো ।

“আজকে যদি না আসতেন, তাহলে আমার বোন আপনাকে ডাইভোর্স করে দিতো । আপনার অবস্থাও বউ-পালানো দিগম্বর বনার্জির মতো হতো।” রিংকির কথায় মল্লিকা একটু অস্বস্তি বোধ করলো ।

স্বামীর হয়ে মল্লিকা বললো, “বেচারার কাজ খুব বেড়ে গিয়েছে।

রিংকি ঠোঁট বেঁকালো। “ওরে বাবা। যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! তোর বর তোকে বনবাসে ফেলে রেখে তাহিতি আইল্যান্ডে দশ বছর ধরে কারখানা তৈরি করুক না। আমার কী? পেটে ক্ষুধা মুখে লাজ আমার ভালো লাগে না ।“

মল্লিকার লজ্জা লাগছে। কমলেশ হয়তো ভাববে, প্রতিদিন সে রিংকির কাছে স্বামীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে যাচ্ছে।

সমরেন্দ্রবাবু বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে শ্যালিকাকে সংবর্ধনা জানালেন। চাপা হেসে বললেন, “ঝুমু, আজ তোমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বেশি বলবো না! তোমরা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী– দম্পতি-প্রতিযোগিতায় আমরা তোমাদের হারাবার চেষ্টা করবো। তোমরা শুধু এখানে জামাকাপড় পাল্টে নাও।”

মল্লিকা বললো, “প্রাইজ না পেলেও আমার বোন এবং আপনি আদর্শ দম্পতি । দুজনে দুজনকে দু ঘণ্টা না দেখতে পেলে চোখে অন্ধকার নেমে আসে। আমার বোনের কোনো আর্থিক অভাব আপনি রাখেননি; আমার বোনও আপনার ঘরসংসার লক্ষ্মীশ্রীতে ভরিয়ে রেখেছে। মেড-ফর-ইচ-আদার তো একেই বলে।”

“খুব তো ভগ্নীপতিকে তোল্লা দিচ্ছিস । বলে দিলি, পয়সার অভাব রাখেনি । কতদিন থেকে বলছি, একটা মুক্তোর সেট কিনে দাও–কোনো উত্তর নেই। ওর নাকি পয়সার অভাব।” রিংকির কথায় সবাই হেসে উঠলো ।

কমলেশ জিজ্ঞেস করলো, “সিগারেট কোম্পানি কি ঠিক করে দিয়েছে, আদর্শ দম্পতি বলতে কাদের বোঝায়?”

রিংকি বললো, “ওসব গোপন খবর বিচারকরা জানেন। তবে অনেক আদর্শ দম্পতি দেখতে পাবে আজকে । কেউ বরের সঙ্গে লাঠালাঠি করে, কেউ স্বামীর বাপ-মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, কেউ অন্যের বরের সঙ্গে গোপন অভিসার করছে, এরাই আজ প্রাইজ পাবার লোভে পমেটম পাউডার মেখে সাতপাক-খাওয়া বরের হাত ধরে পার্টিতে আসবে।”

“মুখাগ্নিটা আর একবার প্র্যাকটিশ করবে নাকি?” সমরেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন ।

“কী কথা ভরসন্ধেবেলায়!” রিংকি স্বামীকে মুখঝামটা দিলো । তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “ঝুমু তুইও বরের সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া একটু অভ্যেস করে নে। জোর গুজব ওতে দশ পয়েন্ট আছে।”

মল্লিকা আঁতকে উঠলো। “ওখানে ওই সব করতে বলবে নাকি?”

“কিছুই বলবে না । তোমার বরকে নিয়ে তুমি যা-খুশি করো! তবে ওরা নজর রাখবে, সেই অনুযায়ী পয়েন্ট পড়বে। তোমরা জোড়ে কেমনভাবে হাঁটো, বরের জামাকাপড়ের সঙ্গে তোমার শাড়ির কীরকম ম্যাচিং হয়েছে, তোমাদের মানিয়েছে কীরকম, তোমরা নিজেদের মধ্যে কেমনভাবে কথা বলো, কেমনভাবে হাসো, সব দেখবে।”

বোনের মন্তব্য শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলো মল্লিকা । সমরেন্দ্রবাবু আরও জুড়ে দিলেন, “আসলে প্রত্যেক স্ত্রীকে নিজের স্বামীর কাছে পরস্ত্রীর মতো মোহময়ী হতে হবে এবং স্বামীকে কথায় বার্তায় এমন ভাব দেখাতে হবে যেন এখনও প্রেমপর্ব চলেছে, বিয়ের কথাটা পাড়া যায়নি ৷”

এক কাপ চা খাইয়ে, কনক ঘড়ির দিকে তাকালো । এবং বললো, “ঝুমু, তোর আর আমার বরদুটোকে কারখানার কুলির মতো দেখাচ্ছে। এদের স্নান করতে পাঠানো যাক । সময় বেশি নেই।”

১৯

লম্বা-লম্বা পা ফেলে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটছে ম্যাক্স শীলার । এইমাত্র সে সুজাতা দাসের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে। সুজাতার খোঁজে দুপুরে সে অফিসে গিয়েছিল। সুজাতা অফিসে যায়নি শুনে বাড়িতে দেখা করবে ঠিক করেছিল ।

জার্মানিতে ষোল বছর বয়স থেকে নির্দ্বিধায় বালিকা বান্ধবীদের সঙ্গে ম্যাক্স ডেট করছে কিন্তু কখনও এমন অসুবিধায় পড়েনি। ইন্ডিয়া যে রহস্যময়, এ-কথা ম্যাক্স আগে শুনেছিল; কিন্তু অনাদি অনন্তকালের অভিজ্ঞতা নিয়েও এদেশের রহস্যময়ী মেয়েরা যে এমন অসহায় তা সে আগে জানতো না । শীলার শুনেছিল, ভারতবর্ষের মেয়েরা আধুনিক হচ্ছে, তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, রাষ্টদূতের দায়িত্ব নিচ্ছে। কিন্তু সে এখন দেখছে, এদেশের কলকারখানার মতো মেয়েরাও আত্মনির্ভর হতে পারেনি।

সুজাতা দাসের সঙ্গে দু দণ্ড দুর্বলতার জন্যে ম্যাক্স লজ্জিত নয় । সুজাতার অত চিন্তিত হবার কী আছে? কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পর কী যে ঘটলো, সুজাতা একেবারে ভেঙে পড়েছে ।

শীলার অভদ্র নয় । সুজাতার সঙ্গে অফিসে দেখা করেছে। অসুস্থতার খবর পেয়ে এইমাত্র বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল । চাদর মুড়ি দিয়ে বেচারা সুজাতা দাস চুপচাপ শুয়েছিল; নাইট্রোজেনবিহীন গাছের মতো বিবর্ণ দেখাচ্ছিল সুজাতাকে।

শীলার এর কারণ জানতে চেয়েছিল। সুজাতা কিছুই বলেনি, শুধু ওর চোখের কোণে অশ্রু দেখা গিয়েছিল। পুরুষসান্নিধ্যে যেসব বিপদ আসতে পারে তার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে প্রতিটি স্বাধীন মেয়েই নিজেদের প্রস্তুত রাখে, এই জানতো ম্যাক্স। সুজাতা যে তার ব্যতিক্রম এবং সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ তা ম্যাক্সের কল্পনায় আসেনি। বিপদের নিশ্চিত কোনো দৈহিক ইঙ্গিত আজও পায়নি সুজাতা, কিন্তু অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সে ।

পুরুষবন্ধুকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করে কেউ কেউ এমন পিতৃত্বেও ফাঁদ পাতে । কিন্তু সুজাতা তেমন নয়, ম্যাক্সের কাছে তার কোনো প্রত্যাশা নেই। কিন্তু ম্যাক্সও দায়িত্বহীন নয়, সুজাতা যতক্ষণ না দৈহিক দিক দিয়ে নিশ্চিত হচ্ছে ততক্ষণ তারও কিছু করবার আছে।

চার-পাঁচটা দিন পরেই নিজের সম্পর্কে সুজাতা নিশ্চিত হতে পারবে। কিন্তু ততদিন শীলার তো ভারতবর্ষে থাকছে না। সুজাতা যেমন শুনলো, ম্যাক্সের বিমান টিকিট কেনা, এখানে কাজ শেষ এবং জার্মানিতে টেলিগ্রাম চলে গিয়েছে, তখন বেচারা শুকনো পাতার মতো কাঁপতে লাগলো ।

সুজাতা মুখ ফুটে কিছুই দাবি করছে না । কিন্তু বিদেশে বিপদেপড়া নিঃসঙ্গ মেয়েটা তার কাছে কী প্রত্যাশা করে তা ম্যাক্স সহজেই বুঝতে পারছে। আরও কয়েকটা দিন ম্যাক্স কাছে থাকলেই সে ধন্য ।

কিন্তু ম্যাক্সের তো এখানে আর থাকবার উপায় নেই। কোম্পানি কেন তাকে রাখবে? নিজে থাকতে চাইলেও; এখানকার কর্তারা সন্দেহ করবে। এসব সুজাতার অজানা নয় । ম্যাক্স শীলার চঞ্চল হয়ে উঠলো । আজ ভোরবেলায় প্রিলিং সেকশনের সব পরীক্ষা শেষ । এইচএসির ইঞ্জিনিয়াররা খুশি আজ বিকেলেই ওরা ট্রায়াল ইউরিয়া পাঠাবে প্রিলিং টাওয়ারের ওপর। কোম্পানির নাম লেখা ছোট্ট একটা ফলক ম্যাক্স আজই টাওয়ারের তলায় লাগিয়ে দিয়েছে। অনেকদিন পরে যারা এই কারখানা দেখতে আসবে তারা জার্মান কোম্পানির নাম জানতে পারবে ।

সুজাতার মুখের দিকে ম্যাক্স শীলার নীরবে তাকিয়ে আছে । সুজাতা মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। কিন্তু ওর রহস্যময় চোখে অসহায় ভীতি এবং করুণ মিনতি ফুটে উঠেছে।

সুজাতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ম্যাক্স শীলার ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । দুদিন তিনদিন বড় জোর দু-সপ্তাহের মধ্যে নিঃসন্দেহ হবে মেয়েটা । এখানে আর কয়েকটা দিন কেমনভাবে থাকা যায়?

দূরে হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালস কারখানার দিকে তাকিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতিতে ম্যাক্স শীলারের মন ভরে উঠলো। শীলারের দুঃখ হচ্ছে তার কাজটা এতো তাড়াতাড়ি না শেষ করে, আর কয়েকটা সপ্তাহ টেনে নিয়ে যেতে পারলে লাভ হতো। ওদিকে যে ভদ্রলোক এইমাত্র জিপে চড়ে সস্ত্রীক বেরিয়ে গেলেন, সেই কমলেশ রায়চৌধুরী নির্ধারিত তারিখের এক সপ্তাহ আগে কাজ শেষ করবার জন্যে কী অদম্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সময়ের কি বিচিত্র টাগ-অপ-ওয়ার এই অখ্যাত কৃষিনগরে শুরু হয়েছে–কেউ সময় বাড়াতে চায়, আর কেউ কমাতে চায় ।

কিন্তু দার্শনিক চিন্তায় বিভোর হয়ে যাবার মতো সময় নেই ম্যাক্স শীলারের। তার লক্ষ্য সহজ। সুজাতার জন্যে তাকে কিছু সময় লুণ্ঠন করতে হবেই। কিন্তু কেমনভাবে? কীভাবে আরও কয়েকটা দিন এই কৃষিনগরের কাজে থাকতে পারা যায়?

ম্যাক্স শীলার দেখলো পশ্চিম আকাশে সূর্য নেমে এসেছে। ভারতের অফুরন্ত সম্পদ ও ঐশ্বর্যের মতো রঙের রাজসভা বসেছে দিকে-দিকে। লাল স্প্রে মেশিনে রূপালী টাওয়ারের একদিকে যেন ম্যাক্সের বিনা অনুমতিতেই কেউ রঙ করে দিয়েছে। ম্যাক্স কী ভাবলো । মাথায় কোনো পরিকল্পনা এসেছে বোধহয় । কিছুক্ষণ চিন্তার পর দৌড়ে গেস্টহাউসে ঢুকে গিয়ে নিজের যন্ত্রপাতির ব্যাগ বার করলো ম্যাক্স শীলার। তারপর জিপগাড়িটা ড্রাইভ করে কারখানার চার নম্বর গেটের দিকে চললো–প্রিলিং টাওয়ারটা যেখানে সব থেকে কাছে ।

এইচএসির নিরাপত্তা বিভাগের নেপালি দারোয়ানটা সায়েবকে প্রতিদিন দেখছে । সায়েব সাধারণত এসময় ফিরে আসেন না। কিন্তু উনিই তো এই বিরাট যন্ত্রটা খাড়া করেছেন। সে সেলাম ঠুকলো, কোনো সন্দেহ করলো না ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *