০৫. চিঠির খামটা হাতে নিয়ে

ব্রেকফাস্ট শেষ করে চিঠির খামটা হাতে নিয়ে কমলেশ বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো । আলো ঝলমল শরতের ভোরবেলা স্নিগ্ধ কৃষিনগরকে বিরল মাধুর্য দান করেছে। সাহিত্যিক না হয়েও শরৎ ঋতুর অরুণ আলোর অঞ্জলির কথা বিরহী কমলেশের মনে পড়ছে। জিপের ওপর উঠে বসলো কমলেশ। সকাল বেলায় ড্রাইভারের ওপর নির্ভর করে না সে।

সামনে চওড়া কালো রাস্তা এঁকে-বেঁকে নিজের খেয়ালে নেমে গিয়েছে প্রথমে নদীর ধার পর্যন্ত, তারপর ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে কালো রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে প্রোজেক্ট সাইটের দিকে। ডানদিকে না বেঁকে বাঁদিকের পথ ধরলেই রেল স্টেশন। তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে। সে-পথ ধরে মাইল ত্রিশেক গেলেই বড় শহর ধর্মপুর।

টিলা থেকে নামার পথে উল্টোদিক থেকে একটা অপরিচিত নতুন গাড়ি আসতে দেখে জিপের গতি কমিয়ে দিয়েছিল কমলেশ । মনে হলো গাড়ির মধ্যে থেকে হাত বাড়িয়ে কে যেন তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

জিপ এবং প্রাইভেট অ্যামবাসাডার গাড়ি প্রায় মুখোমুখি এসে একসঙ্গে থমকে দাঁড়ালো । প্রাইভেট গাড়ির সুদর্শন মালিক-ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন । কমলেশকে নমস্কার জানিয়ে বললেন, “আর একটু হলেই আপনাকে ধরা যেতো না ।”

চন্দ্রমল্লিকাও ততক্ষণে পিছনের সিট থেকে বেরিয়ে এসেছে ভোরের আলোয় শিশিরভেজা তাজা শিউলি ফুলের মতো সেও ঝলমল করছে ।

কমলেশ একেবারে তাজ্জব । গাড়ির ভেতরে নজর দিলেও চন্দ্রমল্লিকাকে সে প্রথমে চিনতে পারেনি । পারবে কী করে? এখানে এইভাবে তার হাজির হওয়াটা অকল্পনীয় ।

পিছনের সিট থেকে আর-এক সুবেশিনী বিবাহিতা সুন্দরী বেরিয়ে এলেন । সপ্রতিভভাবে কমলেশের দিকে তাকিয়ে এই যৌবনবতী বললেন, “কেমন সারপ্রাইজ দেওয়া হলো?

ভদ্রমহিলা যে সুরসিকা এবং সাহসিকা তা কমলেশ অচিরেই বুঝতে পারলো । কমলেশের খুব কাছে এগিয়ে এসে সুন্দরী বললেন, “আমি চন্দ্রমল্লিকার মামাতো বোন কনকলতা । আর এই লোকটা মিস্টার সমরেন্দ্র রায়–আমার আদমি! আপনার বিয়ের সময় আমরা যেতে পারিনি। তখন ওঁর সঙ্গে বিলাতে ছিলাম । আমরাও এই পাড়াতে থাকি । ধর্মপুরে ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ লিমিটেডে কর্তাটি গোমস্তাগিরি করেন ।

অপ্রত্যাশিত আনন্দে উৎফুল্ল কমলেশ দু-এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মল্লিকাকে বললো, “একটা টেলিগ্রাম করে দিলে না কেন?”

মল্লিকা কিছু বলবার আগেই ভদ্রমহিলা চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলেন, “কেন করবে? তিন মাস বিয়ে করে বউকে যখন বনবাসে ফেলে রেখেছেন তখন সে কেন আপনাকে খবর পাঠাবে?”

সহাস্য সমরেন্দ্রবাবু এবার মুখ খুললেন। বললেন, “কমলেশবাবু, সমস্ত ব্যাপারটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলতে পারেন। আমার গাড়ি নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ফেরবার সময় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জানাজানি হলো আপনি এতো কাছাকাছি থাকেন । তখন সবাই মিলে ফন্দি আঁটলো, আপনাকে একেবারে অবাক করে দেওয়া হবে ।

“মেঘ না চাইতেই জল, একে বলে! বুঝলেন মশাই?” সমরেন্দ্র-পত্নী মন্তব্য করলো। “ভাবছেন, অবলা বধূ অ্যাডভেঞ্চার করতে পারবে না, তাই এখানে যা-খুশি চালিয়ে যাবেন । এবার বুঝুন! ইন্ডিয়া এখন মেয়েমানুষদের খপ্পরে, এটা আপনি এবং এই ভদ্রলোক দুজনেই মনে রাখবেন!” মল্লিকার বোন আঙুল দিয়ে নিজের স্বামীকেও সাবধান করে দিলো।

সমস্ত পরিবেশটা হাল্কা করে দিয়ে সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “আপনার গৃহিণী অর্থাৎ আমাদের ঝুমু কিন্তু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, স্বামীর কাছে না পৌঁছে আমরা অন্য কোথাও চলে যাবো কিনা। যাক সেসব কথা। ঝুমুর মা এবং আপনার বাবাকে এখনই খবর পাঠাতে হবে । তার আগে আপনি ডেলিভারি চালানে সই করে দিন; রিসিভড্ ওয়ান বউ কমপ্লিট–ইন্ট্যাক্ট কন্ডিশন ।

“হ্যাঁ, সমরেনদা, পুরো গতটাই লিখিয়ে নিন, রেলের চালানে যেমন থাকে।” চন্দ্রমল্লিকা হাসিমুখে স্বামীর বিরোধীপক্ষে যোগ দিয়ে বললো ।

“তাহলে আরও লেখাতে হয়, ইন ফুল অ্যান্ড ফাইন্যাল স্যাটিসফ্যাকশন।” সমরেন্দ্রবাবু মন্তব্য করলেন ।

“স্যাটিসফ্যাকশন যে হয়েছে তা তো ভদ্রলোকের মুখ দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে!” মল্লিকার বোন কমলেশকে একটু বিব্রত করবার জন্যেই যেন বলে উঠলো। কনকলতা কী যেন ভাবলো । সে এবার বললো, “উঁহু, বউ আমরা ডেলিভারি দিচ্ছি না। নিতান্ত আমার বোন মুষড়ে পড়েছিল, তাই বরকে চোখের দেখা দেখিয়ে দিলাম। এবার নিয়ে যাবো ধর্মপুরে এবং সেখান থেকে কলকাতায়!”

কমলেশ খুশিতে উচ্ছল হয়ে বললো, “ব্যাপারটা নিয়ে যখন এতো গোলমাল এবং মতদ্বৈধ রয়েছে, তখন বাড়িতে চলুন।”

চন্দ্রমল্লিকা আবার জামাইবাবুর প্রাইভেট গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু বোন কনকলতা গম্ভীর মুখ করে কমলেশকে বললো, “এইটুকু পথ স্ত্রীকে গাড়িতে রাখবার অনুমতি দিচ্ছি!”

চন্দ্রমল্লিকা এবার এসে স্বামীর পাশে বসলো। কমলেশ এবার জিপগাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো। তারপর জিপ এবং অ্যামবাসাডার গাড়ি টিলার দিকে চলতে লাগলো ।

পিছনে গাড়ি না থাকলে কমলেশ এখানেই স্ত্রীকে একটা চুমু খেতো । আলতোভাবে সে কেবল মল্লিকার হাতে একটু হাত ঠেকালো । হাতটা প্রবলভাবে চেপে ধরলো চন্দ্রমল্লিকা । কয়েকমুহূর্ত পরে শান্ত হয়ে সে বললো, “তোমাকে বেশ বিপদে ফেলে দিলাম তাই না?”

“প্রত্যেকটি স্বামী প্রতিদিন এমন বিপদে পড়তে রাজি আছে। এমন যে একটা সম্ভাবনা আছে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি,” কমলেশ গাড়ি চালাতে চালাতে বললো ।

চন্দ্রমল্লিকা বললো, “আমার সাহস হচ্ছিল না। তোমাদের বাড়িতে গেলাম। বাবা খুব উৎসাহ দিলেন। বললেন, হতভাগা যখন একবারও এলো না, তখন বউমা একটু শিক্ষা দিয়ে এসো।”

“বাবাকে একেবারে হাত করে ফেলেছো,” কমলেশ বললো ।

“ফুলশয্যার পরদিন থেকেই স্বামী যার হাতছাড়া হয়ে গেলো, তার আর উপায় কী?” চন্দ্রমল্লিকার সাহস বেড়ে গিয়েছে। বেশ চটপট উত্তর দিচ্ছে।

মালপত্তর নামিয়ে কমলেশ বললো, “আমার চাকর শ্রীমান একটু বাজারে বেরিয়েছে। কনকলতা এবার অফিসের কথা তুললো । সোজা প্রশ্ন করে বসলো, “অফিস থেকে আপনাদের ক’জন চাকর দেয়?”

“কোম্পানি থেকে একজনও নয়। নিজের মাইনে থেকে যতজন খুশি রাখতে পারেন,” কমলেশ জানালো ।

স্ত্রীর প্রশ্নে সমরেন্দ্রবাবু একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। বললেন, “ওসব কথা থাক । এখন তোমরা দুই বোনে দুই স্বামীর জন্যে সটাসট চা তৈরি করে ফেলো ।

কনকলতা কপট রাগ দেখিয়ে কমলেশকে প্রশ্ন করলো, “আপনাকে বউ পুরস্কার দিয়ে এই আমার লাভ হলো?”

কমলেশ বললো, “এখানকার যন্ত্রপাতি বুঝতে আপনাদের একটু সময় লাগবে । সুতরাং প্রথম রাউন্ড চা আমিই করে খাওয়াচ্ছি।’

ওরা আপত্তি করেছিল। কিন্তু কমলেশ শোনেনি । সিলিন্ডার গ্যাস জ্বেলে চটপট জল গরম করে ফেলেছিল ।

কনকলতা চায়ের কাপে মুখ দিয়ে স্বামীকে খোঁচা দিয়ে বললো, “শেখো, বউকে কেমন করে সেবাযত্ন করতে হয়।” কমলেশের দিকে মুখ ফিরিয়ে কনক জিজ্ঞেস করলো, “এমন সুন্দর চা করতে শিখলেন কেমন করে?”

কমলেশ হেসে বললো, “আমাদের ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জির পাল্লায় পড়ে। ল্যাবরেটরিতে যখন-তখন হুকুম করবেন, কমলেশ চা করো।”

আঁতকে উঠলো কনকলতা । “অ্যাঁ! আপনাদের কোম্পানিতে এটা অ্যালাউড? ডিরেক্টর চায়ের হুকুম করবে? কেন? বেয়ারা নেই?”

কনকের প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ কমলেশ গায়ে মাখলো না। বললো, “অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে কাজ হয় । তখন কোথায় বেয়ারা? থাকার মধ্যে আমরা কয়েকজন এবং ডক্টর বনার্জি । উনি তো বলেন, চায়ের কেমিস্ট্রি যার আয়ত্তে এলো না সে ফার্টিলাইজারের জটিল রসায়ন কী করে বুঝবে?”

কমলেশ এবার অফিসে ফোন করে দিলো। “মিস দাস, আমার যেতে একটু দেরি হচ্ছে। অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টের কো-অর্ডিনেশন মিটিংটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিন। সাইকেল পিওন দিয়ে সবাইকে প্ল্যান্টে খবর পাঠাতে হবে, না হলে কাজ বন্ধ করে প্রোজেক্ট অফিসে ওঁরা অপেক্ষা করবেন।”

“তুমি মিটিং সেরে এলেই পারতে।” চন্দ্রমল্লিকা বললো। “আমরা ততক্ষণ গল্প-গুজব করতাম।

“রাখ রাখ,” বোনকে মিষ্টি মুখ-ঝামটা দিয়ে উঠলো সুরসিকা কনকলতা । “তিন মাস পরে বউ এসেছে, এখন মিটিং! আমার কর্তার অফিসেও মিটিং হয়–কিসসু নয়। পট-পট কফি আসে, প্যাকেট-প্যাকেট কোম্পানির সিগারেট ধ্বংস হয় এবং আলোচনার ছদ্মবেশে আড্ডা চলে । অফিসের মিটিং এবং লেডিজ কফি মিটের মধ্যে কোনো তফাত নেই ৷ “

মুখ টিপে হাসতে লাগলো সবাই । কমলেশ আর একটা ফোন করলো সুদর্শন সেনকে । “দুটো খাট বাড়া করতে চাই, মিস্টার সেন।

“এখানে আর কোথায় ভাড়া পাবেন । দুটো লোহার কট পাঠিয়ে দিচ্ছি।” সেন বললেন ৷ কনকলতা বললো, “শুনুন রায়চৌধুরী মশাই। আমরা দুজনে পিঠোপিঠি বোন– এক সপ্তাহের ফারাকে। একই হাসপাতালে ভূমিষ্ট হয়েছি। আমার দাদামশায়, অর্থাৎ আপনার গিন্নির দাদু ছিলেন পুষ্প প্রেমিক। আমাদের নাম রাখলেন চন্দ্রমল্লিকা এবং কনকলতা । বিয়েটা আমার এক বছর আগেই হয়েছে । সুতরাং বোনকে আপনার সংসারে চালু করে দেবার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।”

নতুন বউকে চালু করে দেওয়া কথাটা কমলেশের বেশ ভালো লাগলো । কনকলতাকে সে বললো, “আমাদের প্রোজেক্টে যারা মেশিন বিক্রি করে, তাদের সঙ্গেও ওইরকম চুক্তি থাকে । মেশিন চালু করে দেবার দায়িত্ব প্রয়োজন হলে তাদের ঘাড়ে চাপানো যেতে পারে।”

চাকর ফিরে আসতেই কমলেশ তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলো। তারপর ওদের অনুমতি নিয়ে একবার কর্মস্থলে চলে গেলো। পর পর কয়েকটা মিটিং ছিল। বিছিন্ন বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে সপ্তাহে দু-বার মুখোমুখি বসার ব্যবস্থা কমলেশই চালু করেছে । যার যা সমস্যা থাকে সামনাসামনি আলোচনা হয়ে যায়। অন্য সবাই জানতে পারে কাজ কতখানি এগুলো। দিগম্বর বনার্জির মতো কমলেশ রায়চৌধুরীও যে অনাবশ্যক চিঠি লেখায় বিশ্বাস করেন না তা সবাই জেনে গিয়েছে ।

কমলেশ বললো, “আপনারা জানেন, আমরা ড. বনার্জির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে সাতই ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা পুরো চালু করে দেবো । সেই অনুযায়ী ড. বনার্জি হেডঅফিসে এক অন্যত্র নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । আমাদের একজন কাজে পিছিয়ে পড়লে অন্য সকলের পরিশ্রম বিফলে যাবে। এজন্য আমি চাই যার ওপর যতটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ততটা যেন নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যায়। যেসব ঠিকাদার আপনার কাজ করছে তাদের ওপর প্রতিদিন নজর রাখবেন । প্রতিদিন তদারক করলে বড় করমের ভুল হবার সম্ভাবনা কম।”

কমলেশ জিজ্ঞেস করলো, “মিস্টার হাজরা, আপনার পাইপ লাগানোর কাজ কেমন এগোচ্ছে?”

“প্রগ্রেস রিপোর্ট আমি আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি,” হাজরা উত্তর দিলেন ।

কমলেশ বললো, “মনে রাখবেন, পাইপ হলো কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির শিরা-উপশিরা– সেখানে থ্রম্বসিস হলে কারখানা বাঁচবে না । “

হাজরা বললেন, “সিনথেটিক অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টের পাইপ বসানো শেষ। আমরা এখন ঢালগুলো চেক করছি।”

“ওয়েল্ড করে জোড়া পাইপ সম্পর্কে ড. বনার্জি একটু খুঁতখুঁতে সেকথা আপনি তো জানেন । ওয়েল্ডিং ঠিক না হলে বিপদ।” কমলেশ বললো ।

হাজরা উত্তর দিলো, “তা যা বলেছেন স্যার। তার ওপর দেশি ঠিকাদার। সায়েব কোম্পানিকে কাজটা দিলে কোনো চিন্তা থাকতো না। হরিয়ানা ফার্টিলাইজারে পাইপ বসিয়েছিল হল্যান্ডের ওভারসিজ পাইপ কোম্পানি । ছবির মতো কাজ । সায়েবটা আমাদের বলে দিলো, তোমরা নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোতে যাও, ঘুম থেকে উঠে পাইপলাইন পেয়ে যাবে।

কমলেশ হাসলো। তারপর বললো, “ডক্টর বনার্জির ওখানেই আপত্তি। আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে সায়েরা কাজ করে দেবে সে-যুগ এদেশে উনি আর থাকতে দেবেন না । সুতরাং আমাদের স্বদেশি পাইপ কোম্পানিকে দিয়েই কাজ করাতে হবে। আপনি পাইপলাইনের প্রত্যেকটা বড়-বড় জোড়ের জায়গা এক্স-রে করার ব্যবস্থা করুন। চন্দনপুর ল্যাবে এক্স-রে ইনচার্জ মিস্টার আয়ার রয়েছেন, ওঁর সঙ্গে এখনই ফোনে কথা বলুন।”

ইউরিয়া প্ল্যান্টে পাইপের ইনচার্জ পান্ডের স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা। স্ত্রীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর নেবার পর কমলেশ বললো, “মিস্টার পান্ডে, আপনি চিন্তা করবেন না । চন্দনপুর হাসপাতালে ধাত্রীবিদ্যার প্রধান ডা. সেনগুপ্ত আমার বন্ধু। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। কাজ কী রকম চলছে বলুন?”

পান্ডে বললেন, “টারগেট থেকে সামান্য একটু পিছিয়ে আছি আমরা । এই শনি-রবিবারে কাজ চালিয়ে সেটা মেক-আপ করতে রাজি ছিল কন্ট্রাক্টর সিং। কিন্তু পাইপ এখনও পেলাম না, স্যার।”

“সে কী?” কমলেশ এবার সুদর্শন সেনের দিকে তাকালেন সেন বললেন, “জামসেদপুরে দু-বার টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি। রোজই শুনছি পাইপ এসে যাবে।”

কমলেশ বললো, “ওখানকার মিস্টার সুন্দরম্ আমাদের ডক্টর বনার্জির বিশেষ বন্ধু। আজই আপনি লোক পাঠিয়ে দিন জামসেদপুরে । পরশু সকালে আমরা আবার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবো ।”

দ্বিতীয় মিটিংয়ের পরই কমলেশ একবার বাড়িতে ফোন করেছে। চাকর ফোন ধরলো । মাঈজীকে ফোন দিতে বলায় জানালো মেমসাব গোসল করছেন। সমরেন্দ্রবাবু ফোন ধরে বললেন, “আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। রান্নাঘর থেকে যেরকম গন্ধ-টন্ধ ভেসে আসছে তাতে মনে হয় মধ্যাহ্ন-ভোজন খারাপ হবে না।”

সেক্রেটারিকে অনেকগুলি চিঠি ডিকটেশন দিলো কমলেশ। তারপর সুদর্শন সেনের কাছে গেলো। “মিস্টার সেন, একটু পরামর্শ দিন, কিছু কাঁচের থালাবাসন দ্রুত কিনতে চাই ।”

“একি আর কলকাতা, যে, টাকা ফেললেই সব জিনিস পাবেন? ধর্মপুরে লোক পাঠাতে হবে।” সুদর্শন সেন এবার একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন । এবং প্রশ্নোত্তর জানলেন মিসেস রায়চৌধরী বিনা নোটিশে হঠাৎ হাজির হয়েছেন।

“একটু বিপদে পড়া গেছে, বাড়িতে অতগুলো বাসন আছে কিনা সন্দেহ।” কমলেশ জানায় ।

“বিপদে ফেলার জন্যেই তো স্যার এগুলো করা হয়। আমার অভ্যাস আছে, ভিজিল্যান্সের লোকেরা এইভাবে মাঝে-মাঝে সারপ্রাইজ ভিজিট দেয়।” সুদর্শন সেন কিছুতেই শুনলেন না। বললেন, “আমার বাড়ি থেকে কিছু বাসন দিচ্ছি। দ্যাবা-দেবীর সংসার হলেও, আমার গিন্নি রাবণের ফ্যামিলিকে আপ্যায়নের মতো বাসন জমা করে রেখেছেন। ওটাই ওঁর হবি–চিনেমাটি, পেতল, কাঁসা, তামা, এলুমিনিয়াম, এনামেল, স্টেনলেস স্টিল, হিন্দালুমিন কিছুই বাদ দেননি ।”

বাসনপত্তর নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে কমলেশ অবাক হয়ে গেলো। টেবিলে বেশ কয়েকটা ডিস সাজানো রয়েছে।

কমলেশের হাতে ডিশগুলো দেখে কনক সকৌতুকে বললো, “মিটিংয়ের নাম করে বাসন যোগাড় করতে গিয়েছিলেন নাকি?”

কমলেশ বেচারা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলো । স্বামীর এই অবস্থা দেখে চন্দ্রমল্লিকা হাসতে আরম্ভ করলো।

কনক বললো, “ছেলেদের দোষে বউমা যাতে কষ্ট না পান তার জন্যে আপনার বাবা এবং মা অনেক জিনিস গুছিয়ে দিয়েছেন ৷ সঙ্গে অতগুলো ট্রাঙ্ক এবং প্যাকিং বাক্স নামলো কি জন্যে?”

বেশ হৈ-চৈ করে সকলে খেতে বসে গেলো । রান্নার স্বাদটা যে আজকে অন্যরকম লাগছে তা কমলেশ জানিয়ে দিলো। কনকলতা সঙ্গে-সঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো । বললো, “লাগবেই তো। আপনার বউয়ের হাতে একটু হলুদ দিয়ে সেই হাতধোয়া জল তরকারিতে ঢালা হয়েছে–মিষ্টি তো হবেই!”

চন্দ্রমল্লিকা বললো, “রিংকির কথা বিশ্বাস কোরো না। ও নিজেই রেঁধেছে।

শোবার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলো কমলেশ । এরই মধ্যে সাজিয়ে-গুছিয়ে সমস্ত ঘরে শ্রী ফিরিয়ে এনেছে চন্দ্রমল্লিকা। বিছানা আর অবিন্যস্ত নেই। খাটের ওপর নতুন একটা বেডকভার টান-টান করে পাতা রয়েছে। মাথার গোড়ায় র‍্যাকে বই গুলো সুন্দর করে সাজানো । পেন এবং লেখার প্যাড যথাস্থানে যোগ্য সমাদর পেয়েছে। সিগারেটের ছাইদানি একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। টেবিলের কোণে একগ্লাস জলও আছে–কিন্তু আঢাকা নয়, মাথার ওপর একটা ডিশ উল্টে দেওয়া রয়েছে।

কনকলতা ড্রইংরুমে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। চন্দ্রমল্লিকা ওকে ধরে নিয়ে এলো । চাপা হেসে কনক এবার কমলেশকে আক্রমণ করলো। “খুব তো নিজের দেশকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছেন; সেই জন্যে ফুলশয্যার বউকে পর্যন্ত ফেলে রেখে চলে এসেছেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই বুঝলাম বউনির্ভর হওয়া ছাড়া আপনার গতি নেই!”

“আমার ছবি তুলে রাখার ইচ্ছে ছিল । বউ আসিবার পূর্বে ঘরের অবস্থা; বউ আসিবার পরের অবস্থা; দেখুন, বউরা আপনাদের জীবনে কী ভূমিকা পালন করে।” কনকলতা নির্দ্বিধায় শুনিয়ে দিলো।

“আপনার প্রত্যেকটি কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছি,” কমলেশ সহাস্যে সারেন্ডার করলো।

কনকলতা বললো, “শুধু মেনে নিলেই হবে না, বউদের আরও দায়িত্ব দিতে হবে । বুঝলেন রায়চৌধুরী সাহেব?”

“পুরো দায়িত্ব তো দিতে চাই আমরা,” কমলেশ উত্তর দিলো।

কনকলতা তার অল্পবয়সী সুন্দর চোখ দুটো আরও টানা-টানা করে বললো, “রাখুন রাখুন। পুরুষমানুষরা এদেশে বউকে কেবল রাঁধুনি আর বিছানাসঙ্গিনী করে রাখতে চায় । জীবনসঙ্গিনী হবার সুযোগ মেয়েরা পায় না ।”

কমলেশ বললো, “দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বিছানায় বসুন!”

ঠোঁট উল্টে কনক বললো, “কোন দুঃখে? আমার কী কর্তা নেই? উনি ওখানে একলা বসে আছেন।”

“আপনারা দুজন বরং এই ঘরে বিশ্রাম করুন,” কমলেশ অনুরোধ করে ।

আবার ঠোঁট উল্টে চোখে অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করে কনক বললো, “থাকেন তো বনবাসে । কিন্তু কবে বউ এসে পড়বে এই আশায় নিজের ঘরটিতে ডবলসাইজের খাট পেতে রেখেছেন । অন্য কারুর তো ব্যবস্থাই দেখছি না।”

কমলেশ হেসে বললো, “এটা অতিথিদের জন্যেই! আরও দুটো সিঙ্গল খাট আধঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়ছে দেখবেন।” ঘড়ির দিকে তাকালো কমলেশ । বললো, “আমি আর একবার সাইট থেকে ঘুরে আসি। আপনারা ততক্ষণ একটু গড়িয়ে নিন। ফিরে এসে অনেক রাত্রি পর্যন্ত গল্পগুজব চলবে।”

কনক আবার ভ্রূধনু ভঙ্গ করলো। “চলবে, তবে আমার সঙ্গে নয়। এর সঙ্গে । আমি এবং আমার বর ততক্ষণ ধর্মপুরে আমাদের কোয়ার্টরে।”

অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল কমলেশ। কিন্তু ওরা শোনেনি। বলেছিল বিকেলের চা খেয়েই তারা রওনা দেবে। সন্ধে সাড়ে ছ’টার মধ্যে নিজেদের আস্তানায় পৌঁছে যাবে।

কমলেশ বলেছিল, “সমরেনবাবু, আমি সাইটে যাবো আর ফিরবো । ততক্ষণে স্ত্রী ও শ্যালিকা দুজনের সেবাযত্ন আপনি উপভোগ করুন।”

স্তব্ধ দুপুরে বোন এক বিছানায় শুয়ে পড়েছে। মল্লিকা বলছে, “সমরেনবাবুর ওপর সুবিচার হচ্ছে না! তোরা দুজনেই এখন বিশ্রাম নে। আমি অন্য ঘরে সোফাতে একটু গড়িয়ে নিই ।”

“বাজে বাজে বকিস না, ঝুমু,” মুখ ঝামটা দিলো কনকলতা । “একটু বিরহ ব্যথা ভোগ করুক না–আখেরে ফল ভালো হবে ।

“তুই ভারি অসভ্য রিকি,” চিমটি কাটলো চন্দ্ৰমল্লিকা ।

দুষ্টু হাসিতে মুখ ভরিয়ে চুলের খোঁপাটা আলগা করতে-করতে কনক বললো, “বিয়ে হয়ে যাবার পরে সভ্যতা-অসভ্যতা বলে কোনো জিনিস থাকে না, বুঝলি বোকচন্দ্র? ইতিহাস মুখস্থ করলি, মনোবিজ্ঞান তো জানলি না।

বোনের ডান হাতটা ধরে মল্লিকা দুটো আঙুল মটকে দিলো। কনক বললো, “আমার হাত ধরে আর কী হবে? কয়েক ঘণ্টা পরে আসল লোকের আঙুল টিপবি ।

“উঃ! রিংকি, বিয়ের আগে তো তুই এমন ঠোঁটকাটা ছিলি না,” মল্লিকা লজ্জা ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো ।

একটু পরে নিজের পা নাড়তে-নাড়তে কনক বললো, “ঝুমু!”

“বল!”

“তোর মনের অবস্থাটা এখন কেমন?” কনক জানতে চাইলো ।

মল্লিকা বললো, “তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না রিংকি । তবে খু-উ-ব ভালো লাগছে ।

“এই ভালো লাগাটাই বিবাহিত জীবনের সব, বুঝলি ঝুমু । যেদিন বরের কথা ভেবে বুকের কাছটা চনমন করে উঠবে না, যেদিন সংসারের অর্থহীন খুঁটিনাটির মধ্যে মধুর কৌতূহল খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেদিন বিবাহতজীবনটা ডবল সেদ্ধকরা চায়ের পাতার মতো বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে বুঝতে হবে।

“এখন ওসব ভাববার মতো ক্ষমতাও আমার নেই, রিংকি, তোকে সত্যি কথা বলছি! শুধু খু-উ-ব ভালো লাগছে।”

একটু পরে রিংকি জিজ্ঞেস করলো, “ঝুমু, তুই ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? রাত্তিরের নাটকের জন্যে তৈরি হচ্ছিস?”

রাত্রের কথাই ভাবছিল ঝুমু । ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে উঠলো। বোনের দিকে মুখ না ফিরিয়ে সে কোনোরকমে বললো, “না রে জেগে রয়েছি।”

“জীবনে একদিন মাত্র যাকে একলা পেয়েছিস, সে তোকে এমনভাবে সর্বস্বান্ত করলো কী করে?” রিংকি এবার বোনকে চিমটি কাটলো ।

“সত্যি রিংকি । কেমন করে এমন হয় বল তো?” মল্লিকা চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো ।

ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কনক বললো, “আমরা এইভাবে পুরুষমানুষদের জন্যে আই-ঢাই করি, অথচ ছেলেরা কেমন নিস্পৃহ দ্যাখ । বউকে ফেলে রেখে তোর বর কেমন চলে গেলো মাঠে গোরু চরাতে।”

“গোরু না চরালে জরুকে খাওয়াবে কী করে?” স্বামীকে সমর্থন করে মল্লিকা । “নতুন পদোন্নতি হয়েছে বেচারার।’

“হ্যাঁরে, তোর বরের এখন কী পোস্ট?”

“প্রোজেক্ট ম্যানেজার ।”

“মাইনে কত পাচ্ছে তোর বর?”

“জানি না।”

মল্লিকার উত্তর শুনে কনক আঁতকে উঠলো । জিজ্ঞেস করলো, ফুলশয্যায় শুয়ে সারারাত ধরে করলি কী?”

“বা রে, প্রথম রাতে এসব কথা কেউ জিজ্ঞেস করে নাকি?”

“জিজ্ঞেস করে না। স্বামীরা নিজেই বলে। আমার স্বামী তো বলেছিল ।

মল্লিকা একটু ঘাবড়ে গেলো। তারপর বললো, “ও একবার অফিসের কথা তুলেছিল । ওর সাধনার কথা–কী সব আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।

“তুইও গলে গেলি–ভাবলি আইনস্টাইনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তোর।” রিংকি মুখ ঝামটা দিলো ।

“দিগম্বর বনার্জি ওদের রিসার্চ ডিরেক্টর। খুব ভালোবাসেন ওকে ।”

“নিজের কাজ হাসিল হলে সব ডিরেক্টর তার কর্মচারীদের ভালোবাসে,” কনক অবিশ্বাসের সুরে বললো ।

“তুই তো অনেক খবর রাখিস,” মল্লিকা বললো ।

“তুই কি ভাবছিস, বিয়ে মানে শুধু পাখির মতো বরের ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে বসে থাকা? স্বামীদের ঠিকমতো চালানো শিক্ষিত মেয়েদের একটা মস্ত দায়িত্ব ।

“ওরে বাবা!”

“ওরে বাবা নয়,” আবার চিমটি কাটলো কনকলতা । “অনেক ছেলে থাকে, একেবারে হাঁদাগঙ্গারাম। অফিসে খেটেই মরে, মালিকরা ঠকায়।”

মল্লিকা বললো, “প্রাইভেট কোম্পানিতে মালিক থাকে । ওদের গভরমেন্ট অফিস।” রিংকি খিলখিল করে হেসে উঠলো। বললো, “দুনিয়ার সব মালিকই এক, কিবা প্রাইভেট কিবা গভরমেন্ট। ভাবছিস গভরমেন্ট ঠকাতে পারে না? সুযোগ পেলে ভগবান পর্যন্ত ঠকাতে ছাড়ে না! যাক গে ওসব কথা। এখন একটু ঘুমিয়ে নে! না-হলে রাতে বর বিরক্ত হবে।”

ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে কমলেশ বাংলোর বাগানে এসে বসেছিল । মল্লিকা খালি পায়ে ঘাসের ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল। কমলেশের নজর পড়ায় টুক করে ভিতর থেকে হাওয়াই চটি এনে হাজির করলো। বললো, “পরে ফেলো! এখানকার শিশিরভেজা ঘাসগুলো সহজেই ঠাণ্ডা লাগিয়ে দেয়।

পুব আকাশের সূর্য সাত-সকালে তাঁর ডিউটি শুরু করে দিয়েছেন । ভোরের আলোতে বাংলোর এই উঁচু জায়গা থেকে কৃষিনগরের প্রায় সবটা দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে আর কোনো বসতি নেই । শালকাঠ আর কাঁটা তারের বেড়া কৃষিনগরের পাঁচশ একর জমি ঘিরে রয়েছে। বেড়ার ধারে ধারে ছোট-ছোট একতলা কেয়ার্টার তৈরি হয়েছে অনেকগুলো । পশ্চিম দিকে কিছু বড়-বড় বাড়ি। ওগুলো সুপারভাইজারদের কোয়ার্টার। তার পাশে অফিসারদের কলোনি এবং আরও দূরে গেস্টহাউস। মূল কারখানাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে শহরটা বৃত্তাকারে গড়ে উঠবে। কারখানা ঘিরে রিং রোডের মস্তো রাস্তা। আরও অনেকগুলো চওড়া রাস্তা বিভিন্ন দিক থেকে এসে রিং রোড মিশেছে!

ফুলের নামে কৃষিনগরে রাস্তার নাম দেবেন এই ঠিক করেছেন দিগম্বর বনার্জি। গোলাপ অ্যাভিন্যুতে থাকবে শুধু গোলাপ গাছ, লোকের চিনতে অসুবিধে হবে না । কৃষ্ণচূড়া সরণিতে থাকবে কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি, পলাশ পথে কেবল পলাশ গাছ। তারপরেই রজনীগন্ধা রোড–যে রাস্তায় দু-ধারে শুধু রজনীগন্ধার চাষ হবে ।

কমলেশ দেখলো রূপসী মল্লিকা পটে আঁকা ছবির মতো এক মনে সুদূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কারখানাটা প্রকৃতির ক্যানভাসে শেষ না-করা ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে রয়েছে। ফুলের মতো তাজা এবং পবিত্র মল্লিকাকে বারবার দেখছে কমলেশ। পাতলা টেরিনকটন শাড়ি পরেছে মল্লিকা । ব্লাউজের রঙ লাল । সেই লালের ওপর এসে পড়েছে স্নিগ্ধ ভোরের সোনালি আলো। বধূর হাতে সোনার কাঁকন এবং লাল শঙ্খের বালা। চুলটা ভোরবেলায় নিখুঁতভাবে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করেনি মল্লিকা। খোলাই রয়েছে বেণী বাড়ন্ত লাউডগার মতো দু-একটা কোঁকড়া চুল কপাল পেরিয়ে মুখে এসে পড়েছে।

সামনের টেবিল থেকে লাইটার এবং সিগারেট তুলে নিলো কমলেশ। হাতের কাছে ক্যামেরা থাকলে এই মিষ্টি মুহূর্তের একটা ছবি সে অবশ্যই তুলে নিতো

সুন্দর হরিণচোখ দুটো বিস্ময়ে বড়-বড় করে চন্দ্রমল্লিকা জিজ্ঞেস করলো, “ঐ যে দূরে যা-কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, এসবের কর্তা তুমি?”

কমলেশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ।

“এখানে যত লোক কাজ করে তারা সবাই তোমার হুকুম শুনবে?” চন্দ্রমল্লিকা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

“তা এখন হাজারখানেক লোক প্রতিদিন এখানে কাজ করছে।” একটু থামলো কমলেশ । তারপর কারখানার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে বললো, “সেইটাই তো দুশ্চিন্তা । এতোগুলো লোককে ঠিকমতো কাজ করিয়ে নির্ধারিত দিনের মধ্যে এই কারখানা চালু করতে হবে।” চন্দ্রমল্লিকার বিস্ময়ের শেষ নেই। জিজ্ঞেস করে, “প্রত্যেকটা লোক কী কাজ করছে তুমি জানো?”

“তা জানি বৈকি। আমাদের নকশায়, আমাদের প্রোজেক্ট রিপোর্টে সব খুঁটিনাটি লেখা আছে। সেই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে চন্দনপুর রিসার্চ ল্যাবে দিগম্বর বনার্জির নির্দেশ মতো । আমরা এখানে যা করতে যাচ্ছি, পৃথিবীতে তা এখনও পর্যন্ত হয়নি।

‘পৃথিবীতে হয়নি! বলো কি? তোমার ভয় করে না?” সুস্পষ্ট বুকের ওপর আঁচল টানতে-টানতে চন্দ্রমল্লিকা জিজ্ঞেস করে ।

কনুইটা টেবিলে এবং চিবুকের ভার হাতের ওপর রেখে কমলেশ বললো, “ভয় পাবারই কথা। কিন্তু দিগম্বর বনার্জি কাউকে ভয় পান না । নিজের হাতে তিনি কৃত্রিম অ্যামোনিয়া এবং ইউরিয়া রিকভারির নতুন পথ বার করেছেন।”

“তাহলে বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভদ্রলোকের নাম লেখা থাকবে তো?” ছোট্ট মেয়ের মতো সরল বিস্ময়ে মল্লিকা জিজ্ঞেস করে ।

বউয়ের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন কমলেশ বললো, “ইতিহাসে ক’জনের আর নাম থাকে । প্রতিদিন শত-শত আবিষ্কারের আবেদন তো বিভিন্ন দেশের পেটেন্ট অফিসে জমা হচ্ছে । তবে দিগম্বর বনার্জির স্বপ্ন সফল হলে আমাদের এই হতভাগা দেশের কিছু উপকার হবে। অন্তত একটা বিষয়ে আমরা আর পরনির্ভর থাকবো না।

মল্লিকা চায়ের জল চাপিয়ে এসেছিল। এবার চা ভিজিয়ে টিপট এনে টেবিলে জমা করলো । কমলেশ ওকে সাহায্য করতে গেলো। কিন্তু মল্লিকা সাবধান করে দিলো, বউয়ের কাজ যেন বউকে করতে দেওয়া হয়। চায়ের চামচের সঙ্গে মল্লিকার চুড়িগুলোও মিষ্টি সুরে বাজতে লাগলো ।

কমলেশ বললো, “তোমাকে একদিন কারখানার সাইটে নিয়ে যাবো । ইতিহাসের ছাত্রী তুমি, মালমসলা যোগাড় করে নতুন ভারতবর্ষের একটা ইতিহাস লিখে ফেলতে পারো।”

ওরে বাবা! এখন পড়াশোনার নাম শুনলেই, আমার হাই ওঠে। বাপীর বন্ধু ডক্টর সিন্হা বলেছিলেন, তুই আমার আন্ডারে রিসার্চ কর। বিষয়ও ঠিক করে দিয়েছিলেন; মীরজাফর ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ।”

কমলেশ হাসলো। বললো, “বৈজ্ঞানিকদের দুঃখ–রাজ-রাজড়া এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন ও সময়ের ইতিবৃত্ত নিয়েই ঐতিহাসিকরা ব্যস্ত। কিন্তু সমাজের বড় পরিবর্তন বৈজ্ঞানিকরাই এনে থাকেন। এমনকি দেশের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাও এখন বিজ্ঞাননির্ভর। কিন্তু বিজ্ঞানের এই অমোঘ শক্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ আজও কিছুই জানে না ৷ তুমি এ-বিষয়েও কাজ শুরু করে দাও। তোমার গোরু খোঁজার (গো+এষণা=গবেষণা) বিষয় হোক: কমলেশ রায়চৌধুরী ও তৎকালীন বৈজ্ঞানিক সমাজ!

মল্লিকা বললো, “বাবার খুব দুর্বলতা ছিল বৈজ্ঞানিকের ওপর। এক জামাই ডাক্তার, এক জামাই আইএএস, এক জামাই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। বৈজ্ঞানিক ছোটজামাইয়ের খবর যখন সুতপা মাসি দিলেন, বাবা তখনই লাফিয়ে উঠলেন। এক কথায় রাজি।“

“আর বাবার ছোট মেয়ে?” প্রশ্ন করতে গিয়ে কমলেশ হেসে ফেললো ।

“আমি ওসব বুঝি না। আমার ধারণা ছিল সায়েন্টিস্ট মানে দিন-রাত একটা উঁচু টেবিলের সামনে চশমা পরে দাঁড়িয়ে থাকে। অসংখ্য কাঁচের জার থাকে সেই টেবিলে । একটা বুনসেন বার্নার সারাক্ষণ জ্বলে, আর লোকটা টেস্টটিউবে নানা রঙের কেমিক্যাল মেশানো ছাড়া কিছুই জানে না ।”

“এখন দেখছো তো বৈজ্ঞানিক মানেই ঐরকম নয়। বৈজ্ঞানিকরা কাজও করে এবং বউকেও ভালোবাসে।

এবার দুজনেই এক সঙ্গে হেসে উঠলো এবং যুগল হাসির সেই কোমল ঝঙ্কার পাখির ডাকের সঙ্গে দূরদূরান্তে প্রেমের মাদকতা ছড়িয়ে দিলো ।

মল্লিকা এবার খুঁটিয়ে স্বামীর মুখ দেখতে লাগলো। তারপর বললো, “আইনস্টাইনের মতো গুঁফো বৈজ্ঞানিক হলে তোমাকে কিন্তু কিছুতেই বিয়ে করতাম না ।”

“ওপেনহাইমারের মতো কদমছাঁট চুল হলে বিয়ে করতে?” কমলেশ পাল্টা প্রশ্ন করলো।

সজোরে মাথা নেড়ে আপত্তি জানালো মল্লিকা। কমলেশ বললো, “নোবেল পুরস্কার পাওয়া বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফেনম্যানের ছবি দেখাবো তোমায়–একেবারে সিনেমার হিরো, তোমাদের কলেজের মেয়েরা বিয়ে করতে আপত্তি করবে না, যদিও অ্যাটম বোমার অপকর্মের পিছনে তাঁর হাত ছিল।”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়াং করে লাফিয়ে উঠলো কমলেশ। এখনই ছুটতে হবে কাজে । ইউরিয়া প্ল্যান্টের রি-এক্টরে আজ ভোরবেলাতেই কাজকর্ম শুরু হবে।

“আধঘণ্টা বসো! কিছু জলখাবার বানিয়ে দিই।” চন্দ্রমল্লিকা অনুরোধ করলো।

রাজি হলো না কমলেশ। বউকে বুঝিয়ে বললো, “বোঁ করে জিপগাড়ি চালিয়ে গেলেও তিন মিনিট দেরিতে পৌঁছবো । তুমি বরং লক্ষ্মীটি খাওয়া-দাওয়া করো, ইচ্ছে হলে আরও একটু গড়িয়ে নাও । আমি প্ল্যান্টে কিছু খেয়ে নেবো!”

বুশ শার্ট প্যান্ট পরে, মাথায় স্টিল হেলমেট লাগিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে কমলেশ বউকে একবার দ্রুত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো।

অপসৃয়মাণ জিপগাড়িটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল মল্লিকা। খুব ভালো লাগছে তার। কমলেশের এই কর্মনিষ্ঠা, তার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে মল্লিকার । স্বামীর সাধনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সে নিজেকেও জড়িয়ে নেবে, মল্লিকা মনে-মনে ভাবলো ।

ঘড়ির দিকে তাকিয়েই মল্লিকার সময়টা কেটে গেলো । টাইমপিসের ছোট কাঁটাটা বেজায় কুঁড়ে, কিছুতে নড়তে চায় না । অনেক কষ্টে তিনি একটার ঘরে ঢুকলেন । তারপর যখন দুটো ছুঁইছুঁই করছেন, তখন বাইরে জিপের আওয়াজ পাওয়া গেলো। স্নান সেরে এলোচুলে বসে ছিল চন্দ্ৰমল্লিকা ।

কমলেশ মিলিটারি গতিতে বাথরুমে ঢুকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্নান সেরে টেবিলে এসে বসলো । তারপর গিন্নিকে বললো, “আমাকে দেখছি ক্যামেরা কিনতেই হবে।” তারপর ফিসফিস করে বললো, “সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে বসিয়াছিলে উপল উপকূলে ।

খুব খুশি হয়ে গিন্নি বললো, “সবটাই কল্পনা।“

“অর্ধেক মানবী এবং অর্ধেক কল্পনা,” কমলেশ উত্তর দিলো।

খাবার মুখ দিয়েই কমলেশ বুঝতে পারলো যে গৃহিণী নিজেই রান্না করেছে । প্ৰশংসা করে কমলেশ বললো, “বনার্জি সায়েবের ধারণা, রান্না রহস্য যারা আয়ত্ত করেছে, তাদের পক্ষে কেমিষ্ট হওয়া খুব সহজ।

খাওয়া শেষ করে বসতে পারলো না কমলেশ। বললো, “বেচারা গুরুনাম সিংকে সাইটে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। আমি ফিরলে সে বাড়ি যাবে।”

ঝড়ের মতোই কমলেশ আবার উধাও হয়ে গেলো। আর অনিচ্ছুক ঘড়িটা আবার সেই পুরানো কায়দায় খোঁড়াতে-খোঁড়াতে সামনের দিকে এগিয়ে চললো ।

লনের সামনে এসে চন্দ্রমল্লিকা কিছুক্ষণ বসেছিল। দূরে সাইটে কয়েকটা জিপ ও লরিকে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। উঁচু টাওয়ারের ওপর সোঁ-সোঁ করে একটা প্ল্যাটফরম উঠছে এবং কিছুক্ষণ পরে সশব্দে নেমে যাচ্ছে, দূর থেকে এইসব দেখতে চন্দ্রমল্লিকার বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না ।

শোয়ার ঘরে এসে বসলো চন্দ্রমল্লিকা। কমলেশের বিছানায় মাথার গোড়ায় একটা ফ্রেমে মল্লিকার ছবি আটকানো ছিল। পুরানো একক ছবিটা খুলে ফেলে ওদের দুজনের একটা ছবি লাগালো মল্লিকা। তারপর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো । স্বামীর কথা ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল চন্দ্রমল্লিকা। ঘুম ভাঙলো মৃদু ধাক্কায়। “ঝুমু, ঝুমু ।”

হুড়মুড় করে উঠে মল্লিকা দেখলো কমলেশ ফিরে এসেছে। বাইরে সূর্য অস্ত গিয়েছে । সন্ধ্যা নেমেছে । স্ত্রীর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে কমলেশ জানতে চাইলো, “শরীর খারাপ নাকি?”

আঁচল দিয়ে নিজের বুকটা দ্রুত ঢেকে মল্লিকা বললো “না।”

ওরা দুজনে আবার লনে এসে বসলো । চাকর চা দিয়ে গেলো। দূরে ফ্যাক্টরি সাইটে নীলাভ এইচপিএল বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। রাত্রির সঙ্গে ওদের মোটেই বনিবনা নেই । অন্ধকার দেখলেই অ্যালসেসিয়ান কুকুরের মতো তাড়া করে দূরে হটিয়ে দেয়।

একটু শীত-শীত লাগছে মল্লিকার। কেমন একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব। স্বামীর কাপে দ্বিতীয়বার চা ঢেলে দিয়ে মল্লিকা জানতে চাইলো, “এই সময় এখানকার লোকেরা কী করে?”

প্রশ্নটা মন দিয়ে শুনে কমলেশ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো। ওই ধোঁয়াটাই যেন তার উত্তর । কমলেশ এখনই বউকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না। একটু ভেবে বললো, “ভারতবর্ষের সব প্রান্তের লোক এখানে জড়ো হয়েছে। এরা কাজের সময় কাজ নিয়ে মেতে থাকে; তারপর কে যে কী করে বলা শক্ত।”

স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মল্লিকা । কলকাতায় আত্মীয় এবং বন্ধু পরিবৃত মেয়েরা যে এই ধরনের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত নয় তা কমলেশ বুঝতে পারছে।

আরও একটু ব্যাখ্যা করলো কমলেশ । বললো, “দৈত্যের মতো বিশাল দেহ সর্দারজীরা এখানে পাইপলাইন বসাচ্ছে । কাজের সময় এদের দেখলে মনে হয় ওয়েল্ডিং ইলেক্ট্রোডের সাহায্যে পাইপ জোড়া দেওয়া ছাড়া জীবনের আর কিছুই এরা জানে না। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই সর্দারজীরা দল বেঁধে ট্রাকে চড়ে ধর্মপুরে চলে যায়। বেপরোয়াভাবে মদ খায়। নিজেদের মধ্যে রসিকতা করে, তারপর গভীর রাতে কৃষিনগরে ফিরে আসে ।

ওদের কেউ নেই?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে ।

“আছে নিশ্চয়। কিন্তু কোথায় কে জানে। লোকগুলোর হাবভাব দেখলে তো মনে হয় বত্রিশ ইঞ্চি ডায়ামিটার পাইপের মধ্যেই এদের জন্ম এবং পাইপ জোড়া দিতে-দিতে হঠাৎ নিজেরাই একদিন পাইপ হয়ে যাবে।

“বেচারা!” মল্লিকা সহানুভূতি প্রাকাশ করে। “ওদের বউদের আনতে বলো না কেন?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে ৷

“ওরা ঠিকাদারের লোক! আজ বিহারে, কাল মহারাষ্ট্রে, পরশু তামিলনাড়ুতে পাইপ ঝালাই করবে । সুতরাং বউকে কোথায় রাখবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের নয় ।

মল্লিকা খুশি হতে পারলো না । ‘বারে! ঠিকাদারের লোক বলে ওদের বুঝি সুখ-দুঃখ নেই?”

কমলেশ গম্ভীরভাবে বললো, “তুমি যা বলতে চাইছ তা বুঝেছি ঝুমু । কিন্তু সকলের সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে হলে আমাদের এই কারখানা কোনোদিন তৈরি হবে না। “

মল্লিকা এবার অন্য সব শ্রমিকদের খোঁজখবর করলো । কমলেশ জানালো, “স্থানীয় শ্রমিকরা এতোক্ষণে কাজ শেষ করে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। দশ মাইল বারো মাইল হেঁটে ওরা ক্যাজুয়াল শ্রমিকের চাকরি করতে আসে। বাড়িতে কতক্ষণ থাকতে পায় জানি না । কারণ অনেকে ভোর চারটের সময় বেরোয় এবং রাত দশটার আগে ফেরে না । আসবার সময় গামছায় ভাত বেঁধে নিয়ে আসে।”

কমলেশ বললো, “অফিস ক্লার্কদের অনেকে সন্ধেবেলায় তাস খেলে । আজকাল আবার থিয়েটারের রিহার্সাল দেয়। নাটক হয়তো কোনোদিন মঞ্চস্থ হবে না। কারণ স্ত্রীচরিত্রে লোক নেই । তবে মহড়া চলছে। সুপারভাইজার বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে গল্পগুজব করেন, একটু-আধটু তাস-পাশাও চলে । শুনেছি হুইস্কিও আসে মাঝে-মাঝে।”

“তার মানে, প্রত্যেকটি লোক অবসর পেয়ে জানে না কী করবে। তারা শুধু আবার পরের দিনের কাজের জন্যে অপেক্ষা করে।” মল্লিকার প্রশ্নের ধরন থেকেই ওর অস্বস্তির ইঙ্গিত পাওয়া গেলো ৷

“অনেকটা তাই,” কমলেশ উত্তর দিলো । “এখানে একটা অফিসারস ক্লাব মতো হয়েছে। খেলাধুলোর ব্যবস্থা আছে। যাবে নাকি?” কমলেশ জিজ্ঞেস করে।

মল্লিকা রাজি হলো না। স্বামীর সঙ্গে একান্তে সে থাকতে চায় একটু ।

ভোরবেলায় বেশ কুয়াশা নেমেছিল। ওয়েল্ডিং সেটের আগুন দিয়ে অভিজ্ঞ এবং সুদক্ষ সূর্যদেব ক্রমশ কুয়াশা সরিয়ে দিচ্ছেন। অসমাপ্ত কারখানাটা আবার দিগন্তে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।

মল্লিকা তার আনন্দ উচ্ছ্বাস ফিরে পেয়েছে। দুপুরবেলায় যেন ভাঁটায় টান লেগেছিল, মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। রাত্রি আবার জোয়ার এনেছে। নিবিড় সান্নিধ্যে স্বামীকে সে নানাভাবে আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেছে। মল্লিকা এখন জোয়ারে ভরা নদীর মতো টলমল করছে।

চায়ের ব্যবস্থা করে স্বামীকে বিছানা থেকে টেনে তুলে দিলো মল্লিকা। “এই, আর দেরি নয়। শেষে, কালকের মতো না খেয়ে অফিসে ছুটতে হবে।

ওরা দুজনে আবার এসে বসলো দক্ষিণের লনে । মল্লিকা চা এগিয়ে দিলো । কমলেশ এক মনে কারখানার দিকে তাকিয়ে আছে। মল্লিকার মনে হলো সম্রাট সাজাহান এমনিভাবেই তাঁর সাধের তাজমহল তৈরির সময় তাকিয়ে থাকতেন।

মল্লিকা বললো, “তোমাদের এই সারের ব্যাপারে বইপত্তর নেই?”

“অজস্র বই আছে–কিন্তু সেসব চন্দনপুর লাইব্রেরিতে। তুমি কি সার সম্বন্ধে পড়াশোনা করবে?” কমলেশ কৌতূহল প্রকাশ করে ।

“স্বামী সারাদিন কীসের তপস্যা করেন, সহধর্মিণীর তা জানতে ইচ্ছে করে বৈকি!” মল্লিকা বললো ।

কমলেশ বললো, “সোজা বাংলায়, যে-মাটি পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে আমরা সেই মাটির খাদ্য যোগাবার চেষ্টা করছি।”

“মাটি আবার খাবে কী?” মল্লিকা সন্দেহ প্রকাশ করে।

“মা বলে কি ক্ষিদে লাগবে না?” কমলেশ হাসলো। “মাটিতে যে সার দেবার দরকার একথা আড়াই হাজার বছর আগেও মানুষ জানতো। কিন্তু গাছ কী করে বড় হয় তা জানবার কোনো পথ বের হচ্ছিল না। চারশ’ বছর আগে ভ্যান হেলমন্ট নামে এক আধপাগলা ভদ্রলোক পাঁচ বছর ধরে এক আজব গবেষণা করলেন। দু’শ পাউন্ড মাটির ওপরে তিনি পাঁচ পাউন্ড ওজনের একটা উইলো গাছ পুঁতে দিলেন। পাঁচ বছর ধরে চারা গাছের ওপর তিনি কড়া নজর রাখলেন। তারপর মাপ-জোখ করে দেখলেন গাছের ওজন হয়েছে ১৬৯ পাউন্ড, কিন্তু মাটি কমেছে মাত্র দু আউন্স । এর থেকে তিনি ধারণা করলেন, জলই গাছের খাদ্য এবং প্রাণশক্তি । ডাহা ভুল, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নবযুগ আরম্ভ হয়ে গেলো ।”

নিজের চুল সামলে মল্লিকা বললো, “লোকটার বউ বকুনি দেয়নি?”

কমলেশ হেসে বললে, “বউ বিরক্ত হলে উইলো গাছের চারা পাঁচ বছর ধরে বাড়তেই পারতো না।“

একটু থেমে কমলেশ বললো, “জন উডওয়ার্ড নামে এক ইংরেজ বিভিন্ন রকম জলে– যেমন বৃষ্টির জল, টেমস নদীর জল, হাইড পার্কের নর্দমার জল–আলাদা আলাদাভাবে চারা গাছের চাষ করলেন। উডওয়ার্ড দেখলেন জলে কাদা থাকলে গাছগুলো তাড়াতাড়ি বাড়ে। এইভাবে প্রায় দু’শ বছরের সাধ্যসাধনায় উনিশ শতাব্দীর শেষ দিকে মানুষের কাছে মাটির রহস্য ধরা পড়লো। জানা গেলো, মাটি এবং বায়ুমণ্ডলে যে নব্বই রকমের মৌলিক পদার্থ আছে তার মধ্যে ষোলটি গাছের পক্ষে অপরিহার্য । এর মধ্যে তিনটি আসে হাওয়া থেকে–কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন । বাকি তেরোটি মাটি থেকে। এদের মধ্যে আবার তিনটি–নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশ সবচেয়ে দরকারি।”

সিগারেট ধরালো কমলেশ। হেসে জিজ্ঞেস করলো, “নিশ্চয় কলেজের লেকচারের মতো শোনাচ্ছে।”

মল্লিকা উৎসাহ দিলো । “বলো না। রেডিও শুনি না ভাবছ? কৃষিকথার আসরে রোজ চিৎকার করছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশ। তখন মন দিয়ে শুনিনি–কী করে জানবো যে সারওয়ালার সঙ্গে বিয়ে হবে?”

কমলেশ হাসলো। “ঝুমু, আমাদের দেশের লোকেরা কৃষি সম্বন্ধে এতো কম জানে যে ভাবলে দুঃখ হয় । চাষ-আবাদের দেশ ভারতবর্ষ–এক বছর ধান ভালো না হলে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যাবে । তবু শিক্ষিত ছেলেরা গাছের পরিপুষ্টি কী করে হয়, সে-সম্বন্ধে কোনো খোঁজখবর রাখে না। চন্দনপুর ল্যাবে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এক একর জমিতে একবার গম হলে মাটি থেকে ৫০ পাউন্ড নাইট্রোজেন, ২১ পাউন্ড ফসফরাস ৬০ পাউন্ড পটাশ কমে যায়। ওই জমিতে যদি পাটের চাষ হয় নাইট্রোজেন এবং পটাশ কমে ৬০ পাউন্ড করে। আবার তামাক চাষ হোক: নাইট্রোজেন কমবে ৮৪ পাউন্ড। তার মানে…”

কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে মল্লিকা বললো, “তার মানে সিগারেট খেয়ো না! সবাই মিলে সিগারেট খেলে জমিতে নাইট্রোজেন একটুও থাকবে না।” মল্লিকা এবার হেসে ফেললো ।

কমলেশ প্রতিবাদ জানালো। “উঁহু, নাইট্রোজেন ফিরিয়ে দেবার জন্যে তো আমরা রয়েছি। এই কাজে আগে লোকে গোবর সার, এমনকি গোচোনা পর্যন্ত ব্যবহার করতো। এ-সম্বন্ধেও দিগম্বর বনার্জির রিপোর্ট আছে । একটা গোরু গড়ে প্রতি বছর ১৫ টন গোবর এবং ৯০০ গ্যালন গোচনা দেয়। আর গোবরে আছে ০.৩% নাইট্রোজেন ।”

কাল্পনিক দুর্গন্ধে মল্লিকা নাক কুঞ্চিত করলো। “অ্যাঁ। এর নাম তোমাদের রিসার্চ! আগে শুনলে বাবা আমার বিয়েই দিতেন না। গোবরে আমার ভীষণ ঘেন্না।”

হেসে ফেললো কমলেশ। “ঠিক হ্যায়! সেই জন্যেই তো গোরুকে বাদ দিয়ে আমরা রাসায়নিক সারের দিকে যেতে বলেছি। বছরে লক্ষ-লক্ষ টন কেমিক্যাল যে-জমি থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তা আবার ফেরত দেওয়া হোক। এই আমাদের দাবি।”

“ফেরত না দিলে?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো ।

‘ফেরত না দিলে জমিও ফসল দেবে না। গাছের চেহারা দেখলেই আমাদের অফিসের লোকেরা বলে দিতে পারে কোন মাটি কী খাদ্যাভাবে ভুগছে। নাইট্রোজেন কম থাকলে গাছ বাড়বে না, হলদে মেরে যাবে, ডালপালা গজাবে না। পটাশ কম থাকলে পাতার ওপর ছিটে ছিটে দাগ পড়বে, পাতার ডগাগুলো শুকিয়ে যাবে।”

“তোমরা তাহলে গাছের ডাক্তার?” মল্লিকা বলে ।

“ডাক্তার অন্য লোক–আমরা গাছের কমপাউন্ডার। কোন ফসলের জন্যে কোন মাটিতে কী সার লাগবে সেইটাই বিরাট বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ। এঁরা খোঁজখবর করে যেসব রাসায়নিক সার চাইবেন আমরা তাই তৈরি করে দেবো। যতকরম কেমিক্যাল আছে এখন তার মধ্যে নাইট্রোজেনের চাহিদা সবচেয়ে বাড়ছে।”

“তাহলে উপায়?” মল্লিকা চিন্তিত হয়ে পড়ে ।

“বিজ্ঞানীরা সমস্ত দুনিয়া তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে নাইট্রোজেনের সন্ধানে । সৌভাগ্যক্রমে ওই জিনিসটা পৃথিবীতে অঢেল রয়েছে। বাতাসের আশিভাগই তো নাইট্রোজেন । অর্থাৎ আমাদের এই এক মাইল চত্বরে বায়ুমণ্ডলে কুড়ি লক্ষ টন নাইট্রোজেন জমা হয়েছে।”

“তাহলে তোমাদের অত ভাবনা কেন? দিগম্বর বনার্জি দিনরাত অত লেখালেখি করছেন কেন?” মল্লিকা সোজা জিজ্ঞাসা করলো ।

হাসলো কমলেশ । “নাইট্রোজেন মশাই আছেন তো আকাশে । কিন্তু তাঁকে পাকড়াও করে বস্তায় পুরে জমি পর্যন্ত আনতে হবে তো? এই পাকড়াও করার কাজেই তো ব্যস্ত রয়েছি আমরা।”

মল্লিকা বললো, “যা সর্বত্র রয়েছে তাই ধরতে মানুষ এতো নাস্তানাবুদ হচ্ছে?” কমলেশ বললো, “প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লুকোচুরি খেলা চলছে মল্লিকা। আমরা তো কিছুই তৈরি করি না, যা আছে তাই খুঁজে বার করি, মেলাই, মেশাই, কাটি, ছাঁটি, নিজের মতো করে নিই। এইটুকুই তো মানুষের সাধনা–এতেই আমরা গলদ্ঘর্ম। প্রকৃতি যদি সত্যিই কোনোদিন মুখ ফিরিয়ে নেন তাহলে আমরা কেউ বেঁচে থাকবো না ।”

একটু থেমে কমলেশ বললো, অ্যামোনিয়া থেকে আমরা নানা পদ্ধতিতে নানারকম নাইট্রো সার তৈরি করি। চন্দনপুরের কারখানা থেকে আমরা পাই অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট । কৃষিনগরে তৈরি হবে ইউরিয়া । ইউরিয়াতে নাইট্রোজেনের ভাগ খুব বেশি : শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ ।”

মন দিয়ে শুনছে মল্লিকা। বললো, “অত পরিশ্রম করো কেন তোমরা? একবার অ্যামোনিয়া তৈরি হলো, তারপর তাকে আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ইউরিয়ায় চেঞ্জ করো।”

হেসে ফেললো কমলেশ। “একেবারে কেউ কী ধরা দিতে চায়? হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে আমরা এগোই। অ্যামোনিয়া জিনিসটা কিছুই নয়–নাইট্রোজেনের সঙ্গে হাইড্রোজেনের রাসায়নিক বিয়ে । দুজনে মুখোমুখি এসেও মালা বদল করতে চায় না । তাই আমরা ঘটক অ্যাপয়েন্ট করি: ক্যাটালিস্ট। সাধারণ পরিবেশে অ্যামোনিয়া এক ধরনের গ্যাস, কিন্তু চাপে এবং ঠাণ্ডায় পড়ে তিনিও জল হয়ে যান। আমরা বলি লিকুইড অ্যামোনিয়া । “

“চাপ দিলে কেউ জল হয় না, বরং তেতে ওঠে,” মল্লিকা প্রতিবাদ করলো । মৃদু হেসে কমলেশ বললো, “অ্যামোনিয়ার মেজাজ ভাগ্যে মানুষের মেজাজের মতো!” আবার একটা সিগারেট ধরালো কমলেশ। “জানো ঝুমু, ১৯১৩ সালের আগে কেউ কৃত্রিম অ্যামোনিয়া তৈরি করতে জানতো না। জার্মানরা উপায়টা বার করে–তবে সার তৈরির জন্যে নয়, বোমা বানাবার জন্যে। যুদ্ধের শেষে বোমার যখন চাহিদা রইলো না, তখন চাষের কাজে অ্যামেনিয়া লাগানো হলো। দেখবে অনেক বিস্ফোরক কোম্পানি সার তৈরি করে। যেমন সমরেন্দ্রবাবুদের ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ কোম্পানি।”

মল্লিকা এবার স্বামীর দাড়ি কামাবার সরঞ্জামগুলো বাইরে নিয়ে এলো এবং জানতে চাইলো, “অ্যামোনিয়া বাবাজীকে জল করে তারপর কী করো?”

মুখে সাবানের ফেনা ঘষতে ঘষতে কমলেশ বললো, “আমাদের যা কাজ! আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করি।”

“এ মা! কী অসভ্য তোমরা, একবার তো বিয়ে হয়েছে।”

“সে তো প্রথম পক্ষ– হাইড্রোজেনের সঙ্গে নাইট্রোজেনের । এবার দ্বিতীয় পক্ষে তরল অ্যামোনিয়ার সঙ্গে শ্রীমতি কার্বন ডাই-অক্সাইডের মিলন । কিন্তু অনিচ্ছুকদের মধ্যে বিয়ে! এই প্রচণ্ড গরম এবং প্রচণ্ড চাপ না পড়লে পাত্র-পাত্রী রি-অ্যাকট করেন না। এই বিয়ে বড় কঠিন ব্যাপার । সাতরকমের মন্ত্র আছে এবং সাতটি বিদেশি কোম্পানি তা পেটেন্টের আড়ালে গোপন করে রেখেছেন । দিগম্বর বনার্জি এখানে এলে কয়েকটা নাম শুনতে পাবে: ডুপন্ট পদ্ধতি, মন্টিকাটিনি পদ্ধতি, ইনভেন্টা প্রসেস, মিৎসুই প্রসেস ইত্যাদি । এঁরা কেউ আমেরিকান, কেউ ইটালিয়ান, কেউ সুইস, কেউ জাপানি । এর মধ্যে আমরাও এখন নতুন মন্তর নিয়ে ঢোঁকবার চেষ্টা করছি ঐ ফ্যাক্টরিতে। নাম হওয়া উচিত বনার্জি পদ্ধতি। কিন্তু ডক্টর বনার্জি নিজের প্রচার একেবারেই চান না । তাই এখনও পর্যন্ত বলা হচ্ছে: এইচএসি পদ্ধতি । আমাদের সুদর্শনবাবু রসিকতা করে বলেন, দিগম্বর পদ্ধতি এবং আমাদের নাম দিগম্বর সম্প্রদায়।”

“দিগম্বর মন্ত্রে লাভ?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে ।

“পুরুতের আবার লাভ কী? অ্যামোনিয়া বিয়ে করে ইউরিয়া গোত্র নেবে; ভারতবর্ষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে–বস্তা বস্তা টাকা অন্য দেশকে দিয়ে আসতে হবে না।“

“পুরুতের চাল কলা?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু উত্তর দেবার আগেই অ্যালার্ম ঘড়িটা সজোরে বেজে উঠলো। আর কমলেশ দ্রুত বাথরুমে ঢুকলো ।

সেই ভিজে স্যাঁতসেঁতে একাকীত্ববোধ ঘন কুয়াশা মতো আবার নেমে আসছে এই দুপুরবেলায় । চন্দ্রমল্লিকার জীবনধারা স্তব্ধ হয়ে আসছে। রান্নাঘরে চাকরটা মাঝে-মাঝে ঠনঠন আওয়াজ করছিল । এখন তাও বন্ধ । শুধু টেবিল ঘড়িটা তার রুটিনমাফিক মন্তর আউড়ে যাচ্ছে।

স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া চন্দ্রমল্লিকার কোনো কাজ নেই । কয়লা এবং ন্যাপথার মধ্য থেকে অ্যামোনিয়ার প্রাণরস নিষ্কাশন করছেন স্বামী, আর মল্লিকার ভয় হচ্ছে মধ্যযৌবনেই সে শুকিয়ে যাচ্ছে। শরীর নয়–মনে । অথচ এখনও তো হনিমুন চলছে– যুগল জীবনের সবচেয়ে তাজা, সবুজ সজীব অধ্যায়, যখন কোনো সারের প্রয়োজন হওয়া উচিত নয় ।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মল্লিকা মাঝে-মাঝে ভয় পেয়ে যাচ্ছে । এইভাবে কত দিন, কত মাস, কত বছর কাটাতে হবে? প্রাণোচ্ছল সুন্দর স্বাস্থ্যবান স্বামী ফার্টিলাইজারের রহস্য উন্মোচনের জন্যে অফিসে, ল্যাবরেটরিতে, খোলা মাঠে, কারখানায় সমানে ব্যস্ত থাকবে, আর বন্দিনী মল্লিকা অপেক্ষা করবে কখন প্রিয়তমের ঘরে ফেরার সময় হবে। কখন দুজনে কাঁচের প্লেটে ভাত নিয়ে মুখোমুখি বসবে, দু-চারটে কথা হবে। আধঘণ্টা পরে জিপটা আবার গর্জন করে এসফল্ট দিয়ে মোড়া কালো রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে যাবে। মল্লিকার প্রতীক্ষা শুরু হবে আবার ।

রাতে শুয়ে শুয়েও অফিসের চিন্তা কমলেশকে ছাড়ে না । সেই বিখ্যাত সার প্রকল্পের গল্প বলে– সেখানে এক বছর পরে দেখা গেলো ম্যানেজার প্রীতম সিং বারো মাসের মধ্যে নিজের মহিলা সেক্রেটারিকে ফার্টিলাইজ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। খুব হেসেছিল মল্লিকা। কিন্তু তারপরেই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল কমলেশ ৷ কারখানা চালু করার নির্ধারিত দিনটা আর মাত্র তিন মাস দূরে–৭ই ডিসেম্বর বড্ড তাড়াতাড়ি কাছে চলে আসছে ।

কমলেশ কথা দিয়েছে, আজ রাত্রে জিপে চড়ে বেড়াতে বেরুবে। সঙ্গে শিপিং ব্যাগও থাকবে । বলেছে, ইচ্ছে করলে মল্লিকা যেখানে খুশি শুয়ে পড়তেও পারে। স্বামী বিজ্ঞানে পন্ডিত হলেও অনেক সহজ ব্যাপারে জানে না। মেয়েরা কি ইচ্ছে করলেই যেখানে সেখানে শুয়ে পড়তে পারে? কমলেশ বলেছে তাতে কী হয়েছে? আমরা পাহারা দেবো । কিন্তু মল্লিকার বিশ্বাস নেই, স্বামীর যা ঘুম! মল্লিকা জানিয়ে দিয়েছে, রাস্তায় শোওয়া টোওয়ার মধ্যে সে নেই। কিন্তু স্বামীর হাত ধরে সে একটু ঘুরে বেড়াবে।

বৃদ্ধ মালগাড়ির মতো চলতে-চলতে ঘড়ির কাঁটা এবার দেড়টার জংশনে ঢুকে পড়েছে । কিন্তু কমলেশের দেখা নেই টেলিফোন করবে কিনা ভাবছে, এমন সময় স্বামীদেবতার প্রবেশ । দরজা বন্ধ করবার ফুরসত পর্যন্ত দিতে চায় না কমলেশ । বউকে প্রায় কোলে তুলে ড্রইংরুমে নিয়ে এলো ।

অনেক কষ্টে ছাড়ান পেয়ে মল্লিকা স্বামীর জামার বোতামগুলো খুলে দিলো । তারপর কমলেশ পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্নান পর্ব শেষ করে বাথরুম থেকে বিরিয়ে এলো ।

কমলেশ বললো, “আজ যা ফ্যাসাদে পড়েছিলাম, মনে হলো দুপুরের খাওয়া বন্ধ।”

“সে কি?” মল্লিকা ভয় পেয়ে যায় । “কেমিস্ট্রির কোন সমস্যা আবার মাথা-চাড়া দিয়ে উঠলো? অত চিন্তা কিসের? তুমিই তো বললে কুড়ি লক্ষ টন নাইট্রোজেন মাথার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে।”

হেসে ফেললো কমলেশ। “রাসায়নিক নয় মানবিক সমস্যা।” একটু ভরসা পেলো মল্লিকা । এখানে তাহলে মানুষ আছে! ওর কীরকম ধারণা যন্ত্রের সঙ্গে সর্বদা বসবাস করে এখানে সবাই যন্ত্র হয়ে গেছে।

বউয়ের পাতে ডাল ঢেলে দিয়ে কমলেশ বললো, “একেবারে আদিম মানব-মানবীর সমস্যা বলতে পারো । বেশ ফ্যাশাদে পড়া গেলো । আমাদের অফিসের কয়েকজন কর্মচারী এখানকার আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন । কৃষিনগরের গোড়াপত্তনের সময় এই ক’জন এসেছেন। আদিবাসীগুলো বোকা, সভ্য মানুষদের লোভের কথা জানতো না। সর্বস্ব দিয়ে ঠকে গিয়ে এখন যুবতীরা কান্নাকাটি করছে।”

বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো, “তারপর?”

কমলেশ বললো, “কোথায় আমি ৭ই ডিসেম্বরের ভয়ে ছটফট করছি, আর কোথায় এইসব বিশ্রী সমস্যা । আদিবাসীরা নাকি বেজায় খাপ্পা — খুনোখুনী বেধে না যায় । জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলেন–বলছেন আমাদের ছেলেগুলোকে জেলে পুরবেন। জেলে পোরা মানে, আমাকেও ওইসব স্টাফকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। এ কি কেলেঙ্কারি বলো তো? সুদর্শনবাবু ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপক সান্যাল আইএএসকে গেস্টহাউসে রেখে চলে এলাম দুটো মুখে গোঁজবার জন্যে। ফিরে গিয়ে আবার বৈঠকে বসবো। প্রেমিক প্রবরদেরও ডাকা হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আজই অ্যাকশন নিতে চান। সুদর্শন সেন এবং আমি হিমসিম খাচ্ছি।”

“কী করবে ভাবছো?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো ।

“সুদর্শনবাবু বলছেন, হাত-পা বাঁধা! সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া উপায় নেই । অথচ ছেলেগুলোও কান্নাকাটি করছে। আমার ইউরিয়া রি-এক্টরের কাজও বন্ধ হয়ে যাবে।”

মল্লিকা কী একটু ভাবলো। তারপর মিষ্টি হেসে বললো, “গোলমাল না বাড়িয়ে, আদিবাসী প্রেমিকাদের সঙ্গে ওদের বিয়ে দিয়ে দাও।”

প্রস্তাবটা কমলেশের মনে ধরে গেলো । মল্লিকার পিঠে হাত দিয়ে উল্লসিত কমলেশ বললো, “ইউরেকা । বেশ ভালো পথ দেখিয়েছ ঝুমু! এমন সহজ সমাধান কারও মাথায় আসেনি। সুদর্শন হয়তো বলবেন, কোনো কর্মচারীকে বিয়েতে বাধ্য করার ক্ষমতা কোম্পানির নেই । কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সাহায্য করতে পারেন। হয় বিয়ে, না-হয় জেল!”

বিকেলবেলায় কমলেশ ফোন করে মল্লিকার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। বেশ উৎসাহের সঙ্গে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেছিল, “তোমার বুদ্ধিটা খুব কাজে লেগেছে। ছ’জন প্রেমিকের মধ্যে পাঁচজনই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। একজন একটু গড়িমসি করছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট এবং সুদর্শনবাবু এখনও তার সঙ্গে একান্তে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলাফলে সবাই তাজ্জব। আদিবাসী সর্দারও আমার ওপর সন্তুষ্ট।”

সন্ধেবেলায় বেড়ানোর পরিকল্পনাও বানচাল হয়ে গেলো। বড় আশা করে মল্লিকা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু টেলিফোনে সুদর্শনবাবু জানালেন, ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জি হঠাৎ অফিসে হাজির হয়েছেন। এক সপ্তাহের জন্যে বিদেশে গিয়েছিলেন দিগম্বর বনার্জি। গতকাল বিলেত থেকে ফিরে আজই চলে এসেছেন কৃষিনগরে। কমলেশের সঙ্গে তিনি এখন কারখানা দেখছেন; রাত্রে এখানেই খাবেন ।

অনেক আশা করে মল্লিকা ঘরদোর দ্রুত সাজিয়ে ফেলেছিল। বাগান থেকে কিছু ফুল তুলে এনে ফুলদানিতে রেখেছিল । নিজের আঁকা একটি ছবি শোবার ঘর থেকে খুলে এনে ড্রইংরুমে টাঙিয়ে দিয়েছিল। দিগম্বর বনার্জি সম্পর্কে শ্রদ্ধামিশ্রিত একটা ছবি মল্লিকার মনের মধ্যে আঁকা ছিল ।

কিন্তু মল্লিকাকে হতাশ করলেন ভদ্রলোক । গোমড়া মুখে দিগম্বর বনার্জি কমলেশের সঙ্গে বাড়িতে ঢুকলেন। কমলেশ পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি মল্লিকাকে ঠাণ্ডা একটা নমস্কার জানালেন। কমলেশকে প্রশ্ন করলেন, “বউকে এখানে কবে আনলে? আমাকে বলোনি তো?”

কমলেশ বললো, “না স্যার, বেশিদিন নয়।”

দিগম্বর বনার্জি ওসব কথা কানেই তুললেন না। একটু বিরক্তভাবেই বললেন, “মনে রেখো, সামনের কয়েকটা মাস আমাদের অগ্নিপরীক্ষা। জার্মান এবং জাপানিরা কেন এগিয়ে গেলো জানো? ওরা কাজটা সিরিয়াসলি নিয়েছে। এক-একটা প্রকল্প যেন এক একটা যুদ্ধ । ওয়ারে হেরে গিয়েও যুদ্ধের মনোবৃত্তিটা ওরা কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে, জানো কমলেশ। আমরা মুখে বলি ওয়ার ফুটিং–কিন্তু কথাটার অর্থ বুঝি না।”

ঘরের মধ্যে আরেকটা প্রাণী যে উপস্থিত রয়েছে দিগম্বর বনার্জি তা লক্ষ্য করলেন না । মল্লিকা নিজের হাতে চা আনলো । একটা প্রাণহীন ধন্যবাদ জানিয়ে দিগম্বর বনার্জি আবার কমলেশের সঙ্গে আলোচনায় ডুবে গেলেন। বললেন, “রি-এক্টর ট্যাঙ্কের ক্ষয় সম্পর্কে এবার খবরাখবর নিয়ে এসেছি। আমরা এতোদিন জারকোরিয়াম লাইনিং ব্যবহার করছি– পরের বার টাইটোনিয়াম অ্যালয় লাইনিংয়ে চলে যাবো । মিৎসুই-টোটসু প্রসেস, খরচ কম লাগবে ।

তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ঘরে বসে ওঁদের কথাবার্তা শোনে তাও বোধহয় দিগম্বর বনার্জির মনঃপূত হচ্ছে না। এবার মল্লিকার দিকে মুখ ফিরিয়ে দিগম্বর বনার্জি প্রশ্ন করলেন, “কত দিন থাকবেন ভাবছেন?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মল্লিকা। কমলেশ রক্ষে করলো। বললো, “এখনও ঠিক হয়নি । দিগম্বর বনার্জি এরপর নানা জটিল অথচ আপাত অর্থহীন শব্দের মধ্যে ডুবে গেলেন। মিক্সার, হিটার, রি-এক্টর, কনডেন্সার, ফিডপাম্প, সলিউশন ট্যাঙ্ক, ক্রসটালাইজার, ব্লোয়ার, রিমেলটার, প্রিলার ইত্যাদি অসংখ্য শব্দ দিগম্বর বনার্জি ওর দিকেই ইটের মতো ছুঁড়ে মারছেন, মল্লিকার মনে হলো ।

কী করবে বুঝতে না পেরে মল্লিকা কিছুক্ষণের জন্যে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল । কিন্তু দিগম্বর বনার্জি আরও একঝাঁক শব্দ তার পিছনে লেলিয়ে দিলেন। কয়লা, হাইড্রোকার্বন, ন্যাপথা, ফিড অ্যামোনিয়া, অ্যামোনিয়া সিনথেসিস ইত্যাদি শব্দ রান্নাঘরেও চন্দ্রমল্লিকার দিকে তেড়ে আসছে ।

ডিনারের ব্যবস্থা করে দুজনকে ডাকতে এসে মল্লিকার মনে হলো ভদ্রলোকের খাবার আগ্রহ নেই। দিগম্বর বনার্জি বললেন, “৭ই ডিসেম্বরের জায়গায় ৩০শে নভেম্বর কারখানা চালু করে দাও।” কমলেশ বলছে, “সিনথেটিক অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট তো এক সপ্তাহের মধ্যে চালু হয়ে যাবে । কিন্তু ইউরিয়া কারখানা–এখনও বুঝতে পারছি না স্যার ।

কিছুই খেলেন না দিগম্বর বনার্জি। বললেন, “এতো আয়োজন কার জন্যে করেছেন মিসেস রায়চৌধুরী?” সামান্য একটু স্যুপ মুখে দিয়ে আবার কারখানা সম্বন্ধে কথা তুললেন তিনি। তারপর গৃহবধূর দিকে একটা দায়সারা ধন্যবাদ ছুঁড়ে দিয়ে দিগম্বর বনার্জি নিজের গাড়িতে উঠলেন। আজ রাত্রেই তিনি চন্দনপুর ফিরে যাচ্ছেন।

দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে কমলেশ দেখলো মল্লিকা বিছানায় বসে আছে। বেচারা বেশ গম্ভীর ।

“কী ভাবছো?” কমলেশ জিজ্ঞেস করলো ।

“বউকে নিজের কাছে রাখতে হলে তোমাদের অফিসে বুঝি অনুমতি নিতে হয়?” মল্লিকা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ।

“মোটেই না। পাগল হয়েছো নাকি?” কমলেশ সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দেয়।

“তাহলে তোমার ডিরেক্টর ঐভাবে জিজ্ঞেস করলেন কেন?” মল্লিকা থমথমে মুখ করে জানতে চাইলো ।

“ভালোবাসেন বলেই জিজ্ঞেস করলেন। চন্দনপুর রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে আমরা একটা পরিবারের মতো। ডক্টর বনার্জি আমাদের হেড অফ দি ফ্যামিলি।”

“হেড অফ দি ফ্যামিলি বুঝি বাড়ির বউকে জিজ্ঞেস করেন স্বামীর কাছে কতদিন থাকবে?” মল্লিকা কিছুতেই অপমান ভুলতে পারছে না!

“তুমি কিছু মনে কোরো না, ঝুমু।” স্ত্রীকে বোঝাবার চেষ্টা করলো কমলেশ। তার কাছে ক্ষমা চাইলো ।

ঝুমু আজ বিছানায় শুয়ে গল্প করলো না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কমলেশ জানে, আজকালকার কমবয়সী লেখাপড়া-জানা মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ প্রখর হয়। স্যার নিজেই সেকথা কতবার বলেছেন, অথচ আজ ঝুমুর সঙ্গে অযথা খারাপ ব্যবহার করলেন ।

দিগম্বর বনার্জিকে এবার একটু রোগা-রোগা দেখালো। বিলেত থেকে ফিরে বেশ পাল্টে গেছেন। আগে এরকম খিটখিটে ছিলেন না। এরপর আবার বলছেন, কারখানা চালু করার নির্ধারিত দিন এক সপ্তাহ এগিয়ে নিয়ে এসো ।

দিগম্বর বনার্জিকে কমলেশ শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। তাঁর জন্যে সব করতে রাজি আছে। কিন্তু ভদ্রলোকের এই অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্যে দুঃখও হয় ।

ঘুম আসছে না কমলেশের। বনার্জির সঙ্গে যেসব আলোচনা হয়েছে সেগুলো এখনও মাথার মধ্যে ঘুরছে । ৩০শে নভেম্বরের ওপর জোর দিয়ে দিগম্বর বনার্জি নতুন বিপদ ডেকে আনলেন। এ-বিষয়ে কমলেশের যে কিছু বলার থাকতে পারে তা বনার্জি বুঝলেন না । কিন্তু কমলেশ যদি এতোই বিরক্ত তাহলে প্রতিবাদ করলো না কেন? কেমন করে প্রতিবাদ করবে কমলেশ? কমলেশ দেখতে পাচ্ছে এলিজাবেথীয় যুগের স্যার ওয়াল্টার র‍্যালের মতো বিচিত্র বেশবাস পরে দিগম্বর বনার্জি স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছেন । তাঁর হাতে একটা ছোট লাঠি । দিগম্বর বনার্জি কে দেখে দর্শকরা হর্ষধ্বনি করে উঠলো । চার্লি চ্যাপলিন ভঙ্গিতে দিগম্বর বনার্জি লাঠিটা দু-হাতে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি করলেন: “Urea is a white odourless prismatic crystalline solid containing 46.1% of nitrogen with cool saline taste. “

বনার্জি এবার কমলেশের খুব কাছে সরে এলেন। তার মুখের ওপর সার্চলাইটের মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলেন: “স্পেসিফিক গ্রাভিটি?”

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কমলেশ। আশ্চার্য! ইউরিয়ার স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি মনে করতে পারছে না চন্দনপুর রিসার্চ ল্যাবরেটরিরর উজ্জ্বল রত্ন কমলেশ রায়চৌধুরী। বিরক্ত দিগম্বর বনার্জি আবার চিৎকার করে উঠলেন: “স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি?” কমলেশকে যেন শেষ সুযোগ দিচ্ছেন তিনি ।

এবার আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো কমলেশের। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। উত্তেজনায় দেহ ঘেমে উঠেছে। মল্লিকাও পাশ ফিরলো কাছে সরে এসে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঘুমোওনি?”

“ঘুমিয়েছিলাম । হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম ইউরিয়ার স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি মনে করতে পারছি না । অথচ সবাই জানে ১.৩৩৫ ৷

“তুমি কি ঘুমিয়েও ইউরিয়া দেখো?” মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো ।

“কখনও দেখিনি । আজ কী রকম গোলমাল হয়ে গেলো,” কমলেশ শান্তভাবে বললো । তারপর আবার চোখ বন্ধ করলো ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *