০১. কমলেশ রায়চৌধুরীর জীবনে

আশা-আকাঙ্ক্ষা – শংকর
প্রথম প্রকাশ ১৯৭৩

উৎসর্গ

ওপার বাংলার তরুণ রাজদূত আনোয়ারউল করিম চৌধুরীকে–এপার বাংলার জনৈক লেখকের হৃদয় যিনি অনায়াসেই জয় করেছেন ।

লেখকের নিবেদন

বছর বয়েক আগে কোনো এক ছুটির দিনে বাংলার বাইরে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক আধুনিক গবেষণাগারে কয়েকজন তরুণ বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে আকস্মিকভাবে পরিচিত হবার সুযোগ এসেছিল। সেই পরিচয় থেকেই এই উপন্যাসের সূত্রপাত। আমাদের এই ভারতবর্ষে তাঁরা নীরবে যে আশা আকাঙ্খার স্বর্ণলোক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তা সার্থক হোক, দেশজননীকে তাঁরা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করুণ এই প্রার্থনা।

শংকর
১৫.১.১৯৭৩

কমলেশ রায়চৌধুরীর জীবনে একটু আগে যে অধ্যায় শুরু হয়েছে, সহজেই তার নামকরণ করা যায়: ‘ফুলশয্যার পরেই’ । নবদম্পতির জীবনে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত, চরম রোমাঞ্চকর এবং বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতার পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। এমন সময়ে সুখশয়নের নায়ককে একাকী হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের কামরায় বসে থাকতে দেখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না ।

কিন্তু বত্রিশ বছরের সুদর্শন কমলেশ রায়চৌধুরী সত্যিই হাওড়া-চন্দনপুর এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণীর কামরায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । গত রাত্রে নতুন অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ হওয়ার পরও তার মুখে তীব্র বিরক্তির রেখা ফুটে উঠেছে কেন?

সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় কমলেশ একটু বেশি লম্বা। সুতপাদি সেবার ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, “ভাই, তোমার হাইট কত?”

কমলেশ ফোন ধরে বলেছিল, “বেশ মানুষ তো আপনি? একটা লোক কতখানি লম্বা জানবার জন্যে কলকাতা থেকে চন্দনপুরে ট্রাঙ্ক টেলিফোন করছেন।”

“আঃ কমলেশ, তুমি বড্ড কথা বাড়াতে পারো। জানোই তো মাত্র তিন মিনিট সময় । চটপট তোমার হাইট বলে ফেলো,” কলকাতা থেকে সুতপাদি অনুরোধ করেছিলেন ।

“আমার হাইট নিয়ে আপনার কি হবে?” কৌতূহলী কমলেশ একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করেছিল ।

সুতপাদি এবার ট্রাঙ্ক কলের রহস্য ফাঁস করলেন, “একটি সুন্দরী মহিলার মাকে তোমার সম্পর্কে খবরাখবর দিতে হবে, বুঝলে শ্রীমান? মেয়েটির গোঁ, পুরুষমানুষ খুব লম্বা না হলে গলায় মালা দেবে না ।

“লিখে নিন–১.৮০ মিটার,” কমলেশ সুতপাদিকে বলেছিল ।

“আঃ কমলেশ! আইসক্রিমের মতো ফর্সা মিষ্টি একটা কমবয়সী নরম মেয়ে সেন্টিমিটার থেকে কী করে ভাবী বর সম্বন্ধে আন্দাজ পাবে?”

কমলেশ রসিকতা করেছিল, “তাহলে কিলোগ্রামে লিখে নিন–গতকালই ওজন নিয়েছিঃ ৬৬ কিলো । গজ-ফুট-ইঞ্চি মণ-সের-ছটাক এসব যে বাতিল হয়ে এখন মেট্রিক হিসেব চালু হয়েছে জানেনই তো ।

ফোনের ওপার থেকে সুতপাদি বলেছিলেন, “কিলোতে গিয়ে কী জিনিস হাতছাড়া করছো জানো না! পাত্রী ইতিহাসে এমএ পড়ে, অতশত অঙ্ক জানে না। তোমার হাইট কত বলো। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি?”

সুতপাদি ঠিক ধরেছেন। কমলেশ জানতে চাইলো, “আন্দাজ করলেন কেমন করে?” সুরসিকা সুতপাদি সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিবেন, “কেন! আমার কর্তার পাশে ফেলে । উনি হচ্ছেন পাঁচ ফুট আট–তার থেকে ইঞ্চি তিনেক লম্বা তুমি।”

সুতপাদি চন্দনপুরে ফিরে আসবার পরে কমলেশ বলেছিল, “ধন্য আপনারা আজকালকার মেয়েরা! সে-যুগে মেয়েরা বিয়ের আগে তাদের স্বামীর নাম পর্যন্ত জানতো না, জিজ্ঞেস করবার সাহসও পেতো না। আর আজকালকার মেয়েরা ভাবী বরের নাড়ীনক্ষত্রের খবর নিচ্ছে। তাছাড়া বিয়ের পর আপনারা স্বামীদের বাড়তেও দিচ্ছেন না!”

“মানে?” সুতপাদি কপট রাগ দেখিয়ে কমলেশের অভিযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন ।

শুভাশিসদাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কমলেশ বলেছিল, “বিয়ের আগেও দাদার যা উচ্চতা ছিল এখনও তাই রয়েছে– পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।

“তাতে মহাভারতের কী অশুদ্ধি হয়েছে শুনি?” তর্কে পারদর্শিনী সুতপাদি টিপয়ে চা রাখতে-রাখতে দেবরসদৃশ কমলেশকে কোণঠাসা করবার চেষ্টা করলেন।

কমলেশ চায়ের কাপে মুখ দিয়ে বলেছিল, “মাই ডিয়ার সুতপাদি, পুরাকালের ঋষিরা বলেছিলেন–শুয়ে থাকাটাই কলি, বসে থাকাটাই দ্বাপর, উঠে দাঁড়ানোই ত্রেতা এবং চলাটাই হলো সত্যযুগ। আর আমাদের এই যুগে, ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রে বলছে….”

“রাখো তোমাদের ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্র,” সুতপাদি এবার কমলেশকে মিষ্টি মুখঝামটা দিলেন।

“বেশ! পতিদেবতার মুখেই শুনুন, উনিও তো আজ দিগম্বর বনার্জির সেমিনার লেকচার সেবন করেছেন।

শুভাশিসদা বললেন “আমাদের বলা হচ্ছে, গ্রোথ অর্থাৎ এই বাড়ন্ত ভাবটাই হলো জীবন। বাড় না থাকাটাই এক ধরনের মৃত্যু। প্রত্যেক কোম্পানিকে, এমনকি আমাদের এই ভারত সরকারি সংস্থা হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালস লিমিটেডকে, স্রেফ বেঁচে থাকবার জন্যে প্রতি বছর অন্তত শতকরা দশভাগ বেড়ে যেতে হবে।”

কমলেশ হাসতে-হাসতে মন্তব্য করেছিল, “সুতপাদি, তার মানে শুভাশিসদাকেও বছরে শতকরা দশভাগ বাড়বার অনুপ্রেরণা দিতে হবে আপনাকে!”

“দিচ্ছি!” সুতপাদি নিজের নরম সুন্দর মুখ বেঁকিয়েছিলেন। স্বামীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, “অফিসে যত খুশি বাড়াবাড়ি করো; কিন্তু নিজের ওজন বাড়ালেই ডাইভোর্স ।”

ঘরোয়া আক্রমণে বিপর্যস্ত শুভাশিসদার পক্ষ নিয়ে কমলেশ টেবিলে আলতো টোকা মেরে প্রশ্ন তুলেছিল, “বিয়ের সঙ্গে ওজনের সম্পর্ক কী?”

প্রশ্নটার ওপর কোনোরকম গুরুত্ব না দিয়ে সুতপাদি মিটমিট করে হাসতে লাগলেন । এবং যার জন্যে লড়াই করা সেই শুভাশিসদা নির্লজ্জভাবে বউকে সাপোর্ট করলেন। কমলেশের অনভিজ্ঞতা যে ধরা পড়ে গিয়েছে তার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আছে আছে; দাম্পত্যজীবনের সঙ্গে নরনারীর ওজনের একটা নিবিড় সম্পর্কই আছে! এখনও আইবুড়ো রয়েছ, বিয়েশাদি হোক তখন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে ।

শুভাশিসদার উত্তর শুনে অমন যে সপ্রতিভ সুতপাদি, তিনিও একটু লজ্জা পেয়েছিলেন । মুখের হাসি চেপে রেখে গম্ভীর ভাব করে তিনি অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন, যেন কথাটা শুনতেই পাননি ।

শুভাশিসদার শেষ কথাটাও এখন ট্রেনের কামরায় বসে কমলেশের মনে পড়ে যাচ্ছে। শুভাশিসদা বলেছিলেন, “আসলে, মেয়েরা সব সময় একটা মাঝামাঝি জিনিস চায়– কমও নয়, বেশিও নয়। খুব রোগা নয়, মোটাও নয়।”

শুভাশিসদা জিওলজির ছাত্র। কমলেশের সঙ্গে একই কলেজে পড়েছেন–কয়েক বছরের সিনিয়র। কিন্তু কলেজ হোস্টেল থেকেই কমলেশের সঙ্গে আলাপ ছিল । তারপর পাকে-চক্রে কর্মসূত্রে এই চন্দনপুরে দুজনের আবার দেখা হয়ে গেলো ৷ ইতিমধ্যে কমলেশ এমটেক পাস করেছে; নামের সামনে একটা ‘ডক্টর’ যোগ হয়েছে । আর শুভাশিসদাও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করে দু-একটা বাড়তি ডিগ্রির রবার স্ট্যাম্প যোগাড় করেছেন। শুভাশিসদা হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালসে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। শুভাশিস– গৃহিণী সুতপা মজুমদার ব্যাচেলর কমলেশ রায়চৌধুরীকে প্রায়ই বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন ।

দেবরসদৃশ কমলেশকে সুতপাদিই বলেছিলেন, “আর এইভাবে আইবুড়ো হয়ে কতদিন যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াবে ভাই?”

সুতপাদির স্নেহপ্রশ্রয়ে কমলেশ খুব সহজ হয়ে যেতে পারে। সে হেসে বললো, “স্বীকার করছি আমি আইবুড়ো। কিন্তু ‘যেখানে-সেখানে’ ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন বদনাম দিচ্ছেন কেন?”

কমলেশের প্রশ্নে মোটেই বিব্রত হলেন না আধুনিকা সুতপাদি । কমলেশের দিকে ডান হাতের আঙুল তুলে বললেন, “ব্যাচেলরদের আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।”

কমলেশ নিজেকে নিরাপরাধ প্রমাণ করবার জন্যে বললো, “চরে খাবার সময় কোথায়, সুতপাদি? নিজের কাজকর্ম, নিজের ল্যাবরেটরি এবং নিজের ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জিকে নিয়েই তো মশগুল আছি!”

সুরসিকা সুতপাদি সঙ্গে-সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, “ব্যস্ত হয়তো আছো কিন্তু মশগুল কিনা জানি না। সত্যেন দত্ত লিখেছিলেন: আমি চাই মধু মশগুল হাওয়া।”

“শুভাশিসদা, সত্যি আপনি গুছিয়ে নিতে জানেন: দেখে-শুনে খুঁজে-পেতে বিয়ে করলেন বাংলায় এমএ সুতপাদিকে । কথায় কথায় মিষ্টি মিষ্টি কোটেশন পাচ্ছেন!”

কমলেশের কথা শুনে মজুমদার দম্পতি অনেকক্ষণ ধরে হেসেছিলেন। তারপর সুতপাদি কোলের ওপর পড়ে-যাওয়া আঁচলটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, “বাংলায় এমএ পাস-করা সুন্দরীরা এখনও এদেশে বিরল হয়ে ওঠেনি। প্রতি বছর শতখানেক করে বেরুচ্ছে কলকতা ইউনিভার্সিটি থেকে । তাছাড়াও আধডজন বিশ্ববিদ্যালয় আছে। একটু ইচ্ছে দেখালেই ঘটকীর ব্যবসায় নেমে যেতে পারি। এমএ পাস মেয়ের বাবারা এমন ছেলের খোঁজ পেলে আমরা বাড়ির সামনে লাইন দেবে।”

কমলেশ ব্যাপারটাকে এবারে হাল্কা করে দিয়েছিল । গম্ভীরভাবে বলেছিল, “ সুতপাদি, এটা মনে রাখবেন, আপনি সরকারি সংস্থায় একজন পদস্থ অফিসারের ওয়াইফ। এইচএসির বিনা অনুমতিতে সরকারি বাংলো থেকে প্রাইভেট ব্যবসা চালাতে পারেন না। ভিজিলেন্স ডিপার্টমেন্টে দাসাপ্পা আমার জানাশোনা ।

“বেশ করবো, একশ’বার করবো!” সুতপাদি আবার আঁচল সামলে নিলেন। বক্ষদেশের আৰু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বললেন, “আমি তো আর পয়সা রোজগারের জন্যে এ লাইনে নামছি না। নামছি পুণ্যের লোভে। আইবুড়ো ছেলেমেয়েদের ঘটকালি করলে স্বর্গলাভ হয়।”

মুখটিপে হেসে কমলেশ বললো, “যতই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুন, দাসাপ্পা জানে ঘটকালিটা আজকাল এদেশে একটি ভালো ব্যবসা–অনেকেই টু-পাইস করছে । আপনার অপরাধে দাদা কিন্তু বিপদে পড়ে যাবেন ।

নির্ভীক সুতপাদি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “তোমাদের তিনটে দাসাপ্পাকে বগলে পুরে রেখে আমি প্রজাপতির কাজ করবো।“

“শাস্তি না হয়ে দাসাপ্পার পক্ষে সেটা দুর্লভ সৌভাগ্যই হতো, কিন্তু বেচারাকে সে সুযোগ কোনোদিনই দিতে পারবেন না সুতপাদি! ভদ্রলোককে আপনি দেখেননি। অর্ডিনারি ওজন-মেশিনে উঠলে কাঁটা পুরো ঘুরে গিয়ে কল খারাপ হয়ে যায়। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ তো, তাই তিন মন ওজনের লোক দেওয়া হয়েছে!”

সুতপাদি এসব কথাতে মোটেই দমে যাননি। কমলেশকে বলেছিলেন, “বাজে কথা ছাড়ো। মেঘে-মেঘে বয়স তো কম হলো না । এখন বিয়ে না করলে, কবে করবে? সোজা পথে না গেলে, শেষ পর্যন্ত কোনো খাণ্ডারনী প্রেমিকার ফাঁদে পড়বে, জীবনটা মিজারেবল করে ছেড়ে দেবে ।”

সুতপাদির সেদিনের কথাগুলো এই মুহূর্তে ট্রেনের কামরাতেও কমলেশের মনে পড়ে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে গতরাত্রের কথা। গত রাতটা সত্যিই কমলেশের বত্রিশ বছর ধরে গড়া জীবনটাকে মধুরভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।

কমলেশের কাছে এখন বিবাহের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। ডানহাতের মণিবন্ধে হলদে রঙের সুতোটা সে আগেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। পকেটে শুধু আছে একটা ছবি। এই ছবিটাও সুতপাদি একদিন কমলেশের কাছে চালান করেছিলেন। বম্বে ফটো স্টুডিওর মি. বোসের নিজের হাতে তোলা চন্দ্রমল্লিকার ছবি। মল্লিকার মুখের ওপর স্টুডিওর অনেকগুলো লাইট নানা কোণ থেকে পড়ে এক বিচিত্র আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে। চন্দ্রমল্লিকাকে একটু বেশি ফর্সাই দেখাচ্ছে। ঠিক যেন চলচ্চিত্রের নায়িকা–যে-কোনো গল্পে নামিয়ে দেওয়া যায় ।

ছবি দেখিয়ে সুতপাদি যখন কমলেশের মতামত জানতে চেয়েছিলেন তখন সে বলেছিল, “সিনেমার কাগজে ছাপিয়ে দিন। ডিরেক্টররা দেখলেই চান্স দেবে।”

সেই শুনে সুতপাদি বলেছিলেন, “সিনেমা-থিয়েটার বুঝি না, তোমার জীবনের নায়িকা করে নাও–ঠকবে না ।”

কমলেশ মুচকি হেসেছিল। সুতপাদি বলেছিলেন, “ভারি মিষ্টি মেয়ে। যেমন নরম লক্ষ্মীমন্ত গড়ন, তেমনি হরিণ চোখের দুষ্টুমি। যদি একবার ধরা পড়ে যাও সারাজীবন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে!”

“ওরে বাবা ছেলেরা কি গোরু নাকি?” কমলেশ কপট উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ।

“অন্যের কথা জানি না, তবে তুমি একটি গোরু; এইরকম এক উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরীর ছবি হাতে তুলে দিলাম, বিয়ে করো না কারো, কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখবে তো? তা নয়, একবার দায়সারাভাবে তাকিয়ে খামের মধ্যে পুরে টেবিলে রেখে দিলে, “ সুতপাদি সোজাসুজি কমলেশকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

“আহা! করো কি করো কি! আমার কলেজতুতো ভাই এবং সহকর্মীকে খলনুড়িতে ফেলে এমনভাবে মারছো কেন?” শুভাশিসদা সেসময় অফিস থেকে ফিরে এসছিলেন। গিন্নির বক্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েও শুভাশিসদা কিন্তু কমলেশের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। বলেছিলেন, “হাজার হোক আমরা সরকারি কোম্পানিতে দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছি–আমাদের প্রেস্টিজবোধ আছে। স্বয়ং নূরজাহানের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব হলেও আমরা হ্যাংলার মতো হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারি না।”

“বটে!” স্বামীর দিকে তির্যক দৃষ্টিপাত করে সুতপাদি কপট রাগ দেখালেন ।

শুভাশিসদা বললেন, “বেচারাকে একটু সময় দাও। ছবিটা সঙ্গে নিয়ে যেতে অনুরোধ করো। নিজের ঘরে গিয়ে, একান্তে আলো জ্বালিয়ে প্রয়োজন হলে একশ’বার দেখবে, যেমন তোমার ছবিটা আমি দেখেছিলাম…”

সুতপাদির উপরের ঠোঁটে ডানদিকে একটা কালো বিউটি স্পট আছে । রাগ দেখিয়ে মুখ কুঞ্চিত করলে তিলটা স্থানচ্যুত হয়ে ভারি সুন্দর দেখায়। সুতপাদি সেইভাবেই বললেন, “কলকাতার ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্য দেখছি মোটেই ভালো নয়।”

“তুমি ইউ পির বাঙালি– সুযোগ পেলেই পশ্চিমবঙ্গবাসীদের গালাগালি দাও । কিন্তু কেন মিথ্যে বলবো, তোমার ছবিখানা আমি প্রথম দিনে সাড়ে-একাশিবার দেখেছিলাম।”

“সাড়ে কেন?” সহাস্য কমলেশ জানতে চেয়েছিল।

শুভাশিসদা বলেছিলেন, “একমাত্র কারণ, আলেখ্যদর্শনের সময় মা বিনা নোটিশে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। আমিও ক্রিকেট খেলোয়াড়–ঝটিতি মালমসলা বালিশের তলায় থ্রো করেছিলাম ।”

“তারপর?” সুতপাদিকে বিব্রত করার উপাদান পেয়ে কমলেশ বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলো ।

শুভাশিসদা গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, “মা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলেন না। ভাবলেন আমি অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছি। নিশ্চয়ই মেয়ে পছন্দ হয়নি। তখন মা বললেন, খোকা, তুই আর বাধা দিস না! মেয়েটি হিন্দুস্থানী হলেও বেশ ভালো । লক্ষ্মী সোনা আমার, তুই রাজি হয়ে যা। আমি বললাম, এখন জ্বালাতন কোরো না, একটু ভেবে দেখি ৷ মা তখন ফটোখানা ফেরত চেয়ে বিপদে ফেলে দিলেন! বললাম, কোথায় রেখেছি খুঁজে দেখতে হবে । মা তবুও নাছোড়বান্দা ৷ তখন মোক্ষম দাওয়াই দিলাম, মা একটু পরে এসো । ভীষণ মাথা ধরেছে।”

সুতপাদি সঙ্গে-সঙ্গে স্বামীকে মধুর মুখ-ঝামটা দিলেন, “রাখো রাখো। পুরুষ-মানুষের ভালোবাসা মোল্লার মুরগী পোষা! এখন তো মুখ ফিরে তাকিয়েও দেখোনা।”

দাম্পত্য কলহ যাতে আর না বাড়ে সেই উদ্দেশ্যে শুভাশিসদা এবার টেবিল থেকে ছবির খামটা তুলে দিলেন। তারপর খুঁটিয়ে মেয়েটির ছবি দেখলেন। মন্ত্রবৎ কাজ হলো। স্বামীর ওপর মুহূর্তের মধ্যে প্রসন্না হয়ে উঠলেন সুন্দরী সুতপাদি। একগাল হেসে বললেন, “তুমি তো চন্দ্রমল্লিকাকে আগে দেখোনি। কেমন মনে হচ্ছে? শিষ্যকে একটু সৎপরামর্শ দাও।”

শুভাশিসদার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “যদি ফ্র্যাংক ওপিনিয়ন চাও, তাহলে সোজাসুজি বলবো: কোকাকোলা ।”

শুভাশিসদার মন্তব্য শুনে দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসলো । সন্দিগ্ধ সুতপাদি এবার স্বামীকে সাবধান করে দিলেন, “আমার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তোমাদের কারখানার সস্তা রসিকতা চলবে না, একথা আগে থেকেই বলে রাখছি কিন্তু।”

আত্মরক্ষায় তৎপর শুভাশিসদা বললেন, “সস্তা সমালোচনা হলো? এতো বড় প্ৰশংসা করলাম। পড়োনি বিজ্ঞাপন: Things go well with Coke– সোজা বাংলা করলে যার মানে: জমে ভালো কোকাকোলা থাকলে!” এবার কমলেশের দিকে চোখ ফিরিয়ে শুভাশিসদা বললেন, “বুঝলে ব্রাদার! ওয়াইফের দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে নয়–নামটা একটু জবড়জং হলেও, এ-মেয়ের সঙ্গে জমবে ভালো ।

সুতপাদি কয়েদিন পরে আবার টেলিফোনে খবরাখবর নিয়েছিলেন। “কী হলো কমলেশ? ছবি দেখে এমন ঘাবড়ে গেলে যে আর দাদার বাড়িমুখো হচ্ছো না?”

কমলেশ বলেছিল, “উঃ সুতপাদি, আর বলবেন না। কর্তা একবারে ভাবের ঘোরে রয়েছেন। কাজ–কাজ ছাড়া ক’দিন কিছুই বুঝছেন না। এতোই তো বশীকরণ মন্ত্র জানেন, বুড়ো এন ডি বনার্জির একটা বিহিত করতে পারেন না?”

এইচএসির ডিরেক্টর নোয়েল দিগম্বর বনার্জিকে সুতপাদি যে একেবারেই পছন্দ করেন না, তা কমলেশের অজানা নয়। সুতপাদি গম্ভীর হয়ে বললেন, “হিন্দুস্থান সার কোম্পানি সমস্ত ভারতবর্ষ খুঁজে-খুঁজে আর লোক পেলো না–কোথা থেকে যে খেংরাগুঁফোকে এসে চন্দনপুরে বসালো। রসকষ একটুও নেই।

কমলেশ বলেছিল, “রস না থাকুক কষের যে অভাব নেই এ-কথা আপিসের লোকেরা হাড়ে হাড়ে জানে, সুতপাদি ।”

সুতপাদি বললেন, “তোমাদের অফিসের কথা থাক। চন্দনপুরে দিনরাত অফিস কীর্তন শুনতে-শুনতে কান পচে গেলো । তুমি ‘কোকাকোলা’র কী করলে বলো?”

কমলেশ সলজ্জভাবে মন্তব্য করেছিল, “মহিলাটি কোকাকোলার মতোই বরফ-ঠাণ্ডা নয়তো?”

বউদিরা অন্যদিকে যতই স্নেহশীলা হোক, প্রেমের দৌত্যে অনেক সময় তারা নিষ্ঠুর হতে দ্বিধা করে না । না-হলে, এই বরফ-ঠাণ্ডার ব্যাপারটা কেউ সোজাসুজি অপর পক্ষের কানে তুলে দেয়?

কলকাতায় কয়েকদিন ছুটিতে এসেছিল কমলেশ । সেই সময় সুতপাদি সুযোগ বুঝে হাজির হয়েছিলেন। সুতপাদির আগ্রহেই চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে কমলেশের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রথমে মেট্টো সিনেমা, তারপর পার্ক স্ট্রিটে কোয়ালিটি রেস্তোরাঁয়। সঙ্গে সুতপাদি ছাড়া আর কেউ ছিল না। সুতপাদিও ভাষায়, এর নাম কন্ট্রোলড প্ৰণয়!

চন্দ্রমল্লিকা সেদিন কী সুন্দর সেজেছিল । সাজ-সাজ ভাব নেই, অথচ সাজ । আমাদের শিক্ষিতা আধুনিকারা এই আর্ট আজকাল বেশ আয়ত্তে এনেছে। দেখানোর ব্যস্ততা নেই; অথচ আমার যে সবই আছে এই আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে আছে চন্দ্রমল্লিকার দেহে মুখে ভঙ্গিতে চলনে বলনে ।

সুতপাদি বলেছিলেন, “তোমাদের আলাপ করিয়ে দিই। এই হলো আমার পিসতুতো দিদির ছোট মেয়ে চন্দ্রমল্লিকা চ্যাটার্জি– ওরফে মল্লিকা–ওরফে ঝুমঝুমি । জন্ম এলাহাবাদে, প্রথমজীবন কেটেছে বোম্বাইতে; তারপর বাবার চাকরির সঙ্গে বদলি হয়ে এসেছে কলকাতায় কনভেন্ট শিক্ষিতা বলতে পারো–কারণ ডায়োসেশানের ছাত্রী। তারপর আশুতোষ থেকে বিএ ‘হস্’ হয়ে এখন কলেজ স্ট্রিট থেকে এমএ পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট বেরোয়নি, পরীক্ষা কেন্দ্রে টোকাটুকি করে কোনো বিপত্তি বাধিয়ে এসেছে কিনা জানা নেই!”

“আঃ মাসি,” চন্দ্রমল্লিকা চাপা রাগ প্রকাশ করে সুতপাদিকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করেছিল।

সুতপাদি বলেছিলেন, “ইনি কমলেশ রায়চৌধুরী। আমাদের প্রোজেক্টের নামকরা বৈজ্ঞানিক। সারকেই জীবনের সারসত্য বলে মেনেছেন। আইআইটির এমএসসিটেক। তারপর পাগলা দিগম্বরের নেকনজরে পড়ে মহামান্য ভারত সরকার পরিচালিত হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালসে দ্রুত উন্নতি করেছেন। সায়েন্টিস্ট সম্বন্ধে অনেক ইংরেজি নভেল পড়েছ নিশ্চয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক চোখে দেখেছ কি না জানি না; তাই আলাপ করিয়ে দিলুম ৷”

“দেশে হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক রয়েছেন, দেখবার কী আছে?” এই বলে কমলেশ হাত তুলে নমস্কার করেছিল চন্দ্রমল্লিকাকে। একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল চন্দ্রমল্লিকা। কিন্তু দ্রুত সাহস সঞ্চয় করে কমলেশকে একটা পরিচ্ছন্ন প্রতিনমস্কার জানিয়েছিল।

স্বল্পলোকিত কোয়ালিটি রেস্তোরাঁয় সুতপাদি দুজনকে মুখোমুখি বসিয়েছিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, “এ-কোথায় আনলে বাবা কমলেশ? একেবারে অমাবস্যার অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না।”

সুতপাদি যে জীবনে এই প্রথম কোয়ালিটি রেস্তোরাঁয় আসছেন এমন নয় । কমলেশ বুঝলো সুতপাদি সুযোগ পেয়ে চাপা রসিকতা করেছেন ।

কফির কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে কমলেশ ও চন্দ্রমল্লিকা দুজনেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল । সুতপাদি বললেন, “অন্য সময়ে দুজনেই এতো কথা বলো, এখন কী হলো?”

কমলেশ বাধ্য হয়ে নিস্তব্ধতা ভাঙবার চেষ্টা করলো। বললো, “ইতিহাস, সে তো অতীতেরর ব্যাপার; আর বিজ্ঞান, এ-বিষয়ে আমাদের ডিরেক্টর ডক্টর বনার্জি বলেন, ভবিষ্যৎ নিয়েই আমাদের কাজ-কারবার।”

চন্দ্রমল্লিকা চুপ করেই শুনছিল। সুতপাদি খোঁচা দিয়ে বললেন, “বৈজ্ঞানিকদের আজকাল বড় দেমাক, এমন ভাব দেখান যেন পৃথিবীটা ওঁদেরই হাতের মোয়া । ছাড়িস না ঝুমঝুমি, একটা কড়া উত্তর দিয়ে দে।”

চন্দ্রমল্লিকা ওর বড়-বড় চোখ দুটো আরও বড় করে নিঃশব্দ হাসি ফুটিয়েছিল। তাপর বলেছিল, “জানো মাসি, আমাদের হেড-অফ-দি ডিপার্টমেন্ট প্রায়ই বলেন: অতীতকে প্রভাবিত করবার সাধ্য মানুষের নেই । বর্তমান সে তো তার নিজস্ব রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এসেই পড়েছে। সুতরাং হাতে আছে কেবল ভবিষ্যৎ। একমাত্র ইতিহাসের আলোতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায়।”

সুতপাদি বললেন, “বেশ উত্তর হয়েছে।”

এরপর ছল করে সুতপাদি কিছুক্ষণের জন্য টয়লেটের দিকে চলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তোমরা কফি খাও, কথাবর্তা চালাও, আমি এক মিনিটে আসছি।”

কমলেশ ও চন্দ্রমল্লিকা মুখোমুখি তাকিয়েছিল । কমলেশ জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনাকে আর একটু গরম কফি দেবো?”

চন্দ্রমল্লিকা এবার বেশ গম্ভীরভাবেই উত্তর দিয়েছিল, “আপনি তো বলেছেন: আইস কোল্ড, বরফ-ঠাণ্ডা!”

কমলেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে, সুতপাদি বলেছিলেন, “কমলেশ, আমার কথা শোনো, এখানেই বিয়ে করো । চন্দনপুরে একলা পড়ে থাকি–হৈ-চৈ করবার মতো লোকজন নেই । তোমরা ও আমরা মিলে বেশ জমানো যাবে। এতোদিন বউদি ছিলাম এবার শাশুড়ি হয়ে যাবো। তোমার জামাই আদরের কোনো অসুবিধে হবে না ।

কিন্তু সে বোধহয় ঈশ্বরের অভিপ্রেত নয়। বিয়ে ঠিক হবার পরেই ডিরেক্টরের সঙ্গে ঝগড়া করে শুভাশিসদা চন্দনপুর ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে গেলেন। চন্দনপুর মাইনাস সুতপাদি ভাবতেই পারা যায় না। কিন্তু সুতপাদি সেকথা বিশ্বাস করেননি। বলেছিলেন, “ওসব লেকচার রাখো। বরং তোমাদের সুবিধে হলো। বিয়ের প্রথম বছরটা কাছাকাছি চেনাশোনা লোকজন না থাকলেই ভালো লাগে!”

সুতপাদি আরও বললেন, “একটু-আধটু মনে রেখো–একদিন তোমাদের দুজনের মধ্যে হাইফেনের কাজ করেছিলাম । সমাস হয়ে গেলে লোকে হাইফেনকে তাড়িয়ে দেয়!”

“কোথায় সমাস? এখনও তো বিয়ের কার্ড ছাপা হয়নি,” কমলেশ প্রতিবাদ করেছিল ।

সুতপাদি হেসে বলেছিলেন, “একটু প্রাকবৈবাহিক প্রেমটেম করবে নাকি? তাহলে তো সুতপা ঘটকীকে দরকার হবেই।”

কমলেশের যে ইচ্ছে হয়নি এমন নয়। চন্দনপুর থেকে উইক-এন্ডে পালিয়ে এসে চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে একটু দেখাসাক্ষাৎ করতে পারলে মন্দ হতো না ।

সুতপাদিরও আপত্তি ছিল না। কলকাতায় নিজের বাড়িতে দুজনকে জড়ো করবার বিস্তারিত পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন চন্দ্রমল্লিকার মা। সুতপাদি জানিয়েছিলেন, “ভেরি স্যরি, কমলেশ! নীহারদি এখনও খুব মডার্ন হয়ে উঠতে পারেননি। রাজি হলেন না।”

কমলেশ যে একটু হতাশ হয়েছিল তা মিথ্যে নয় ।

কিন্তু সুতপাদি বললেন, “এই যে বিয়ে ঠিক-ঠাকের পর মেলামেশা নেই এটা একদিকে ভালো । অদেখা জিনিসে টান বাড়ে, বুঝলে শ্রীমান?”

“তাই বুঝি?” কমলেশ জিজ্ঞেস করেছিল।

“পুরুষমানুষ তুমি, তোমাদের কথা জানি না। কিন্তু আমাদের মেয়ে তো এখন থেকেই মনোমন্দিরে দিবসযামিনী ভাবী পতিদেবতার পুজো করছে।

এরপর হনিমুনের প্রসঙ্গ উঠেছে। সুতপাদি জানতে চেয়েছেন, “মধুচন্দ্রের ব্যবস্থা করেছো তো? বিয়ের মন্তর পড়েই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউকে নিয়ে ইলোপ করবে– যাকে বলে লোপাট হয়ে যাবে।“

“কিন্তু কোথায় লোপাট হওয়া যায় বলুন তো?” কমলেশ পরামর্শ চেয়েছিল। চার সপ্তাহ ছুটির জন্য দিগম্বর বনার্জির কাছে সে আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে।

“মধুচন্দ্রের ব্যাপারটা চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করতে হয়, বুঝলে মূর্খ।” প্রেমক্রীড়ায় অনভিজ্ঞ দেবরটিকে সুতপাদি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ।

সহাস্য কমলেশ অভিযোগ করেছিল, “কী করে আলাপ করবো? তাকে তো আপনারা গায়েব করে দিয়েছেন।”

ওরে বাবা! ছেলের কথার ধরন দেখো! নীহারদিকে এখনই খবর পাঠাচ্ছি, মল্লিকা উদ্ধারের জন্যে জামাই আপনার নামে পুলিশ কেস করবে।”

কমলেশ বলেছিল, “দোহাই সুতপাদি, হানিমুনের ব্যাপারে চন্দমল্লিকার মতামতটা আনিয়ে দিন। একবারে গোপনে কিন্তু

সুতপাদি বললেন, “এখনও পর্যন্ত ঘটকীর পারিশ্রমিকটা ঠিক করলে না। অথচ দিনরাত খাঁটিয়ে নিচ্ছ। বিয়ের পর কী করবে সে-সম্পর্কেও পরামর্শ চাইছ!”

“গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেবেন না, সুতপাদি।” কমলেশ কাতর অনুনয় করেছিল ।

সুতপাদি হেসে বলেছিলেন, “আমাকে যে-সে ঘটকী পাওনি। কমলেশবাবু কখন হনিমুনের কথা তুলবেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে নিজেই নায়িকার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে রেখেছি।“

“কোথায় যেতে চায়?” সলজ্জ কমলেশ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো ।

“হনলুলু-হাওয়াই-ওয়াইকিকি বীচে আমাদের মেয়ে হনিমুন করুক আমরা চাইবো । কিন্তু তোমার ইচ্ছে কোথায়?”

“আমার কোনো ইচ্ছে নেই, ও যা বলবে।”

সুতপাদি বললেন, “উনিও তো সেই এক কথা জানালেন; কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম । উঃ পারো বটে–তোমরা এখন থেকেই আদর্শ দম্পতি হয়ে উঠলে ।”

মাথা চুলকে কমলেশ বললো, “হোয়াট অ্যাবাউট খাজুরাহ? ইতিহাসের ছাত্রী, ওর নিশ্চয় ভালো লাগবে ।”

সুতপাদি মুখ টিপে হেসে বললেন, “তোমার বউ, তুমি যেখানে খুশি নিয়ে যাবে, আমরা বাধা দেবার কে? আমাদের মেয়েটা একবারে ইনোসেন্ট এবং সরল, তাকে যদি খাজুরাহ মন্দিরে পাথুরে মানব-মানবীদের নির্লজ্জ কীর্তিকাহিনী দেখিয়ে তুমি পাকাতে চাও, পাকাবে!”

শুভাশিসদা এখন কলকাতায় নেই । থাকলে কমলেশের হয়ে তর্ক করতেন। শুভাশিসদার একটা থিওরি আছে: “কলকাতার কলেজে-পড়া মেয়েরা আজকাল অনেক পাল্টেছে। হেদোর ধারে শুভাশিসদার এক চেনা স্টল থেকে তারা অশ্লীল বই এবং পত্র-পত্রিকা কিনে প্রকাশ্যে ভ্যানিটি ব্যাগে পুরতে দ্বিধা করে না।”

ফুলশয্যার দিনেও শুভাশিসদা আসতে পারেননি। নতুন চাকরি, ছুটি মেলেনি । কিন্তু কমলেশের বন্ধু-বান্ধব অনেকে এসেছিল ।

ফ্ল্যাশলাইটে বরবধূর ছবিও উঠেছিল । কমলেশের মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেমন দেখলেন?”

চন্দ্রমল্লিকার মামা বলেছিলেন, “কী আর বলবো — ঠিক যেন ফিল্টার সিগারেটের বিজ্ঞাপন– মেড্‌-ফর-ইচ-আদার। এনার জন্যে ওনাকে তৈরি করা হয়েছে!”

নবদম্পতিকে আশীর্বাদ অথবা শুভেচ্ছা জানিয়ে কমলেশের অনেক সহকর্মী চন্দনপুর থেকে রঙিন টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। সেই সব টেলিগ্রাম দেখতে দেখতে কমলেশের বাবা একটা টেলিগ্রামের কাছে এসে একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। কী ভেবে সেই কাগজটা নিজের পকেটে পুরে রেখেছিলেন। অন্যগুলো ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ।

সুতপাদি নিজে এসেও খোঁজ করেছিলেন, “তোমার ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জি কোনো টেলিগ্রাম পাঠাননি?”

,

“এখনও পাইনি । হয়তো পাঠিয়েছেন–পরে হাজির হবে,” কমলেশ বলেছিল ।

কমলেশের বাবা সুধন্যবাবু কিন্তু টেলিগ্রামটা পকেটে পুরেই ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিলেন। প্রায় সাড়ে-দশটা বাজে, বাড়ির লোককে তাগাদা দিয়েছিলেন। “অনেক দেরি হচ্ছে, তোমরা এবার ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো। “

ফুলশয্যার ঘরে নবদম্পতিকে ঢুকিয়ে দেবার সময় পর্যন্ত সুতপাদি সঙ্গে-সঙ্গে ছিলেন। চুপিচুপি কমলেশকে বলেছিলেন, “কী হে শ্রীমান, নাড়িটা একবার মেপে দেখবো নাকি? মিনিটে কতবার বুকটা ধুকপুক করছে? মেয়ে আমাদের যে বরফ-ঠাণ্ডা নয় তার প্রমাণ একটু পরেই পাবে।”

তারপর ওর হাতটা ধরে আশীর্বাদ জানিয়ে সুতপাদি বলেছিলেন, “আজকের রাতটা জীবনে একবারই আসে–সুতরাং বুঝে-সুঝে খরচ কোরো । কোনোরকম আক্ষেপ থেকে যেন না যায় ।”

বিদ্যুৎবাহিত চন্দনপুর এক্সেপ্রেস ইতিমধ্যেই তীব্র বেগ নিয়েছে। একটা ছোট স্টেশন চোখের নিমেষে বেরিয়ে গেলো । একটা বুড়ো মালগাড়ি পাশের লাইনে ধুঁকছিল । উদ্ধত চন্দনপুর এক্সপ্রেসের কাণ্ডকারখানা দেখে নিজেকে আর বেইজ্জতি করবার ইচ্ছে যেন তার নেই। তাই একধারে সরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কমলেশ রায়চৌধুরী এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। হিসেব করে দেখলো গত রাত্রে ফুল-দিয়ে-সাজানো শয়নমন্দিরে প্রবেশ করবার পর এখনও চব্বিশ ঘণ্টা সময় পার হয়নি।

চশমার মোটা ফ্রেমে কমলেশ একবার হাত দিলো। এখানেও চন্দ্রার স্পর্শ লেগে আছে। চশমাটা কমলেশ যখন একবার খুলেছিল তখন নিজের শাড়ির আঁচলে সে কাঁচ মুছে দিয়েছিল ।

সে এক আশ্চর্য অনুভূতি । বিজ্ঞানের সংযত সেবক কমলেশ রায়চৌধুরী গত রাত্রের বাঁধনহারা বন্যায় অকস্মাৎ কোথায় যেন ভেসে গিয়েছিল।

বাড়ির মেয়েরা সালঙ্কারা সুসজ্জিত চন্দ্রমল্লিকাকে আগে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল । কমলেশ ঘরে ঢুকতে একটু ইতস্তত করছিল। কিন্তু বাবা আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। “বড় দেরি করছিস তোরা সকলে ।”

চন্দ্রমল্লিকা দেখলো পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা একটা পুরুষ-মানুষ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো । ঘষা কাঁচের জানালার সার্টারগুলো আগে থেকেই কারা যেন বন্ধ করে দিয়েছে। কমলেশ তবু একবার খুটিয়ে পরীক্ষা করে নিলো। ফুলের অলঙ্কার সামলাতে-সামলাতে চন্দ্রমল্লিকা লাল বেনারসি ঘোমটার ফাঁক দিয়ে এই প্রস্তুতিপর্ব দেখলো; কিন্তু একটুও ভয় পেলো না । বরং নিশ্চিন্তে বাঁ হাতের বড় নখগুলো নিয়ে খেলা করতে লাগলো ।

অথচ এই মেয়েকেই মাত্র ছিয়ানব্বই ঘণ্টা আগে একই কমলেশ রায়চৌধুরীর সঙ্গে প্রকাশ্য রাজপথে একটা চায়ের দোকানে মুখোমুখি বসতে দেওয়া হয়নি। আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে, রাত্রি দশটা বেজে চৌদ্দ মিনিট পর্যন্ত দুজনের মধ্যে কতরকম সঙ্কোচ ও দূরত্ব ছিল। পরের মিনিটে যেমনি পিঁড়িতে বসে সাতপাক খাওয়া হলো অমনি সব পাল্টে গেলো। বাইরে থেকে পরিবর্তন নয়–একেবারের রাসায়নিক পরিবর্তন; কমলেশদের কারখানায় যেমন পরিবর্তন হয় কয়লার ।

দাদার বিয়ের সময় কমলেশ খুব কাছে দাঁড়িয়ে বউদির এই রাসায়নিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে । সাতপাক হবার আগে পর্যন্ত মেয়েদের একটা নিজস্ব সত্তা থাকে–যতই নম্র এবং লজ্জাবিধুরা হোক, সে তখনও আলাদা। পিঁড়িতে বসবার ঠিক আগে বিপত্তি হয়েছে এবং বিয়ে ভেঙে গিয়েছে কিন্তু পাত্রী আবার বধূ সেজে পরের এক শুভলগ্নে হাসি মুখে অন্য কাউকে মালা দিয়েছে–এমন ঘটনা দুর্লভ নয় । কিন্তু ঐ যে সাতপাকের মুহূর্তে কী একটা হয়, আমাদের দেশের মেয়েরা যুগ-যুগান্তের ট্রাডিশনে অকস্মাৎ পাল্টে যায়। এতোগুলো লোকের চোখের সামনে, চড়া বিজলীবাতির প্রকাশ্য আলোকে এই আশ্চর্য অনুঘটন হয়; কিন্তু কেউ তা লক্ষ্য করে না; কেউ বিস্মিত হয় না। যে-মেয়ে পিঁড়িতে ওঠে এবং যে-মেয়ে পিঁড়ি থেকে আসে তারা যে এক নয় ত আমাদের খেয়াল থাকে না।

চন্দ্রমল্লিকার ডানহাতটা আলাতোভাবে ধরেছিল কমলেশ–বাংলা সিনেমার ফুলশয্যার দৃশ্য এইভাবেই শুরু হয়। চন্দ্রমল্লিকা বাধা দেয়নি। কমলেশ বলেছিল “মোটেই বরফ ঠাণ্ডা নয়–বরং…….”

“বরং কী?” চন্দ্রমল্লিকা ওর বড়-বড় চোখ দুটো বিকশিত করে জানতে চেয়েছিল।

কমলেশ মৃদু হেসে বলেছিল, “কফির মতো উষ্ণ।”

“কফি তো বড্ড গরম থাকে। বেশিক্ষণ হাতে ধরে রাখা যায় না।”

চন্দ্রমল্লিকার উত্তরটা বেশ লেগেছিল কমলেশের।

“হাতে ধরা যায় না, কিন্তু ঠোঁটে নেওয়া যায়,” এমন একটা কথা বলবার লোভ হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রেক কষেছিল কমলেশ। সে শুনেছে, প্রথম রাতে সাবধানে না এগিয়ে তড়িঘড়ি করায় অনেকের সারাজীবনের দাম্পত্য সুখ নষ্ট হয়েছে।

“তোমার নামটা মস্ত বড়, চন্দ্রমল্লিকা,” নববধূর নরম হাতটা নিয়ে খেলা করতে করতে কমলেশ বলেছিল ।

“পছন্দ হয়নি?” চন্দ্রমল্লিকা নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ।

“খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বেনারসি শাড়ির মতো দামি এবং ভারী । চন্দ্রমল্লিকার কপালে চন্দনের ফোঁটাগুলো চকচক করে উঠেছিল । ওর সিঁথিতে মোটা করে-টানা লাল সিঁদুররেখাও হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কমলেশ বলেছিল, “তুমি যেমন ফুরফুরে হাল্কা, তেমনি একটা আটপৌরে আদুরে নাম পেলে বেশ মজা হতো ।”

চন্দ্রমল্লিকা লজ্জায় সিঁটিয়ে যায়নি, বরং স্বামীর দাবি মেনে নিয়ে উৎসাহ দিয়ে বলেছিল, “আমি যখন তোমার হয়ে গিয়েছি, তখন তোমার যা-খুশি নাম দিও। তা বলে, বাবা-মার সামনে সেই নামে ডেকে বসো না, তাহলে খুব লজ্জায় পড়ে যাবো ।

স্ত্রীর মধুর প্রশ্রয়ে কমলেশ আরও লোভী হয়ে ওর হাতের চুড়িগুলো ওপরের দিকে তুলে এঁটে দিয়েছিল। হাতের কাজ একটু থামিয়ে এবার সে বললো, “তোমার একটা আদুরে নাম আছে ঝুমঝুমি । কিন্তু ঝুমু বললে একটু কম রোমান্টিক মনে হয় । তার চেয়ে আমার যখন যা-খুশি সেই নামে ডাকবো–কখনও চন্দ্রমল্লিকা, কখনও চন্দ্রা, কখনও-বা ঝুমু ।”

কমলেশ এবার স্ত্রীর ডান হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে তুলে নিলো । নিজের হাতের সঙ্গে তুলনা করে বললো, “এই হচ্ছে কুলির হাত–আঙুলগুলো ছাড়ালে কুলোর সাইজ হয়ে যাবে। কোথাও কোমলতা নেই, দু-এক জায়গায় কড়াও পরেছে। আর এই হলো রূপকথার রাজকুমারীর হাত–নরম তুলতুলে–একটু ঠাণ্ডা একটু গরম।’

চন্দ্রমল্লিকা কোনো প্রতিবাদই করলো না। নিজেকেই যখন সমর্পণ করেছে, তখন হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো মানে হয় না ।

কমলেশ এবার পাঞ্জাবির পাশপকেট থেকে লাল রঙের বাক্স বের করলো । তার মধ্যেই ছিল আংটিটা । আস্তে আস্তে গভীর আদরে এবং খুব সাবধানে কমলেশ সেটা বউয়ের নরম আঙুলে পরিয়ে দিলো। আংটিটা যে এতো সুন্দর কমলেশ নিজেই তা কেনবার সময় বুঝতে পারেনি। যে জিনিস যেখানে শোভা পায়!

চন্দ্রমল্লিকা সলজ্জ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললো, “থ্যাংকস।”

“মাপটা কোথা থেকে পেলাম, জিজ্ঞেস করলে না তো?” কমলেশ বলেছিল ।

“জানি । সুতপা মাসির কাছে চেয়েছিলে–আরও বলেছিলে, কেউ যেন না জানতে পারে ।

“তাহলে তুমি জানলে কী করে?” কমলেশ অভিযোগ করেছিল ।

“বারে! আমার আঙুল আমি জানতে পারবো না? সুতপা মাসি তবু বলেছিল, আমার এক বয়-ফ্রেন্ড চেয়ে পাঠিয়েছে।”

আংটি-পরা হাতটা কমলেশ নিজের কপাল ও মুখে ঠেকিয়েছিল । শান্তভাবে চন্দ্রমল্লিকা বললো, “তুমি আমাকে এমন সুন্দর আংটি দিলে, অথচ তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই ।”

এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো কমলেশ। তারপর আর সঙ্কোচ রইলো না । সে বলে ফেললো, “উঁহু। দেবার মতো অনেক কিছু আছে।” স্ত্রীর পাতলা রঙিন ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে স্বামীদেবতা এবার যা ইঙ্গিত করলো তা তৎক্ষণাৎ বুঝতে, সম্মতি জানাতে এবং দান করতে চন্দ্রমল্লিকা কোনো দ্বিধা করলো না ।

সেই ভেলভেটের মতো নরম, সামান্য ভিজে অথচ তাজা মিষ্টি ঠোঁটের প্রথম স্পর্শ এবং সুদীর্ঘ প্রশ্রয় কমলেশের ওষ্ঠে যেন এখনও লেগে রয়েছে। শরীরের ওই বিশেষ অংশটা এখনও অনির্বচনীয় অক্ষয় স্বর্গলোকে পড়ে রয়েছে।

তারপর ওরা দুজনে নির্ভয়ে ছোট্ট এক স্বপ্নের ডিঙিতে চড়ে কখনও দুরন্ত অভিজ্ঞতার অতলান্ত সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে, কখনও প্রশান্ত প্রেমের সরোবরে ভেসে বেড়িয়েছে। উত্তাল মুহূর্তে কখনও হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের, কখনও আবার পরস্পরকে খুঁজে সভয়ে খুব কাছাকাছি সরে এসেছে।

কমলেশ বুঝেছে, এই যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার আদিম আকাঙ্ক্ষা, তা অনেকটা রাসায়নিক বিপ্লবের মতো–ল্যাবরেটরিতে যে-মিলনের চূড়ান্তে পৌঁছে পদার্থ নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলে, যে-বিপ্লবের পরে পুরানোকে আর পাওয়া যায় না, নিজেকে নিঃশেষ করে সে নূতনের জন্ম দেয়।

কিন্তু সাগরে ভেলা ভাসিয়েও ওরা দুজনে হাঁপিয়ে ওঠেনি, ব্যস্তও হয়নি কারণ এই তো সবে শুরু, সামনে পড়ে রয়েছে অনেক সময়। এক মাস অফিসের কথা পর্যন্ত ভাববার প্রয়োজন নেই কমলেশের।

বধূকে খুব কাছে টেনে নিয়ে কমলেশ বলেছে, “চন্দ্রা, খাজুরাহতেই সব পাকা ব্যবস্থা করা আছে। শুভচণ্ডীর পুজোটা শেষ করে ঐদিনই ট্রেনে চড়বো। টিকিট, রিজার্ভেশন, কূপে সব ব্যবস্থা করা আছে। ওখানকার নতুন হোটেলটাও শুনেছি নববিবাহিতদের পক্ষে খুব সুন্দর ।”

আধুনিকা বধূও উৎসাহিত বোধ করছে। “বেশ মজা হবে, খুব ঘুরে বেড়ানো যাবে,” চন্দ্রা আস্তে-আস্তে বলেছে। আত্মসমর্পণের পর তার দেহটা এখনও সুখের বিহ্বলতায় অবশ হয়ে আছে ।

নিবিড় আলিঙ্গনশৃঙ্খল থেকে সুদেহিনীকে মুক্তি না দিয়েই কমলেশ বলেছে, “যদি আমি হোটেলের ঘর থেকে বেরোতে না চাই?”

“বেরুবো না! তুমি যা-চাইবে তাই হবে,” স্বামীর সব দাবি চন্দ্রমল্লিকা বিনা প্রশ্নে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে রাজি আছে।

নিঃশব্দ পদসঞ্চারী রাত্রি এরপর নবদম্পতির নতুন খেলাঘরে বিনানুমতিতে প্রবেশ করে ওদের দুজনকে ঘুমের দেশে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নতুন অভিজ্ঞতায় পরিতৃপ্ত কিন্তু পরিশ্রান্ত দেহটা যে এবার অবসন্ন হয়ে পড়েছে তা বোধহয় চন্দ্রমল্লিকা বুঝতে পেরেছিল । স্বামীকে চুপি-চুপি বলেছিল, “আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তাহলে কিন্তু ভোর হলেই তুলে দিও।” স্বামীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেই মল্লিকা ঘুমিয়ে পড়তে চায়। কমলেশ বললো, “ভোর হলেই উঠতে হবে কেন?”

“নতুন বউ অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে বিশ্রী দেখায়। লোকজন হাসাহাসি করে,” চন্দ্রমল্লিকা বলেছিল ।

“এখানে কেউ তোমাকে কিছু বলবে না । ফুলশয্যার পরের দিনই বউমা ভোর পাঁচটায় উঠে পড়ুক আমাদের বাড়ির কেউ তা প্রত্যাশা করে না । “

“যা বলছি শোনো, লক্ষ্মীটি। আমি ঘুমিয়ে পড়লে তুলে দিও । মা বার বার করে বলে দিয়েছেন–দরকার হলে দুপুরে ঘুমিও, কিন্তু সকালে কিছুতেই আটটা পর্যন্ত ঘরে খিল দিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে না ।

রাতের আলোয় সবার উপস্থিতিতে যে-দরজা বন্ধ করতে আপত্তি নেই, দিনের বেলায় তা খুলতে একটু দেরি হলে জিনিসটা কেন অশ্লীল হয়ে যাবে, কমলেশ বুঝতে পারে না । কিন্তু চন্দ্রার সঙ্গে এই মুহূর্তে তর্ক করবার মন নেই–চন্দ্ৰা যা-চাইছে তাই পাবে ।

.

আসল সময়ে কমলেশ কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ভোরবেলায় ওঠার সযত্ন লালিত অভ্যাসটা আজ সকালে বিশ্বাসভঙ্গ করেছে। কিন্তু চন্দ্রাকে লজ্জায় পড়তে হয়নি, সে নিজেই যথাসময়ে উঠে পড়েছে।

চন্দ্রমল্লিকা প্রথমেই বিধ্বস্ত বিছানার চাদরটা টেনে সোজা করে দিয়েছে, ছেঁড়া ফুলগুলোকে কুড়িয়ে বাস্কেটে ফেলে দিয়েছে এবং অতি সাবধানে চুড়ির আওয়াজ না করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনির সাহয্যে নিজের বিশৃঙ্খল চুলগুলোকে শাসনে এনেছে । এবার দরজা খুলে দিয়ে লজ্জাবতী নববধূ ঘরের কোণে চেয়ারে বসেছে এবং মাথায় সামান্য ঘোমটা টেনে দিয়েছে। পরিচিত পরিবেশে নিজের অস্বস্তি অপনোদনের জন্যে চন্দ্রমল্লিকা একখানা বই তুলে নিয়েছে । বইটা সে পড়বার চেষ্টা করেছে, কিন্তু একটা লাইনও মাথায় ঢুকছে না ।

চন্দ্রার মুখ দেখলে সহজেই বলে দেওয়া যায় সে এখন নিজেকে ভীষণ বড়লোক মনে করছে–বিয়ের মন্ত্র পড়ে সে অকস্মাৎ এতো পেয়ে গিয়েছে যে, এক রাত্রি কেন বহু রাত্রি ফেলে-ছড়িয়ে খরচ করলেও নিঃস্ব হবার আশঙ্কা নেই। বিবাহিতা সহপাঠিনীদের কাছে মল্লিকা শুনেছিল অনেক স্বামীদেবতা প্রথম রাত্রেই বড় হ্যাংলামি করে–স্বামী কিন্তু নিজেকে ছোট করেনি। এক রাত্রেই সব ফুরিয়ে যাচ্ছে না, কমলেশ বলেছিল । একান্ত পরিচয়ের প্রথম সুযোগ মল্লিকার জন্যে নির্লজ্জ লোভের মলিনতা বয়ে আনেনি, তার নিজস্ব নিভৃত স্বাধীনতাকেও লণ্ডভণ্ড করেনি।

মল্লিকার বিবাহিতা ননদ ভোরবেলায় উঠে পড়েছিলেন। নববিবাহিতদের দরজা খোলা দেখে তিনি অবাক। বললেন, “ওমা, নতুন বউ এরই মধ্যে উঠে পড়লে? এখনও বাড়ির কেউ তো বিছানা ছাড়েনি।”

চন্দ্রমল্লিকা কোনো কথার উত্তর দেয়নি। মুখে গম্ভীর ভাব দেখালেও একটু লজ্জা লাগছে তার–সিঁথির সিঁদুরটা অনভ্যাসে সমস্ত কপালে ছড়িয়ে গিয়েছে। মুখটা আর একবার মুছে ফেললে হতো।

বিবাহিতা ননদ কোনো কথা না বলে অভিজ্ঞ চোখে মল্লিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রতি অঙ্গ খুঁটিয়ে দেখেছেন। তাঁর দৃষ্টি বুকের কাছে থমকে দাঁড়াতেই ভীষণ অস্বস্তি বোধ করলো চন্দ্রমল্লিকা–আঁচল কাঁধের ওপর পুরোপুরি ছড়ানো থাকলেও আরও একটু টেনে দিলো ।

অতি কৌতূহলী মেয়েরা এইসব মুহূর্তে লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে নির্মম হয়ে ওঠে, নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর চায়। ছোট-বড় জ্ঞান থাকে না, যা-তা মন্তব্য করে বসে, শুনেছে চন্দ্রমল্লিকা । কিন্তু দিদি কিছুই করলেন না। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুম হয়েছিল তো? নতুন জায়গায় অনেক সময় ঘুম আসে না ।

ঘুমের যে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি তা চন্দ্রমল্লিকা নীরবেই জানিয়ে দিলো । –মুখ ফুটে মিথ্যে কথা বলতে তার কেমন সঙ্কোচ লাগে। দিদি বললেন, “বাথরুম খালি রয়েছে।

রাতের জামাকাপড় পাল্টে কলঘর থেকে বেরিয়ে চন্দ্রমল্লিকা দেখলো শ্বশুরমশায় অস্থিরভাবে বারান্দায় পায়চারি করছেন। তিনি খোঁজ নিলেন খোকা উঠেছে কিনা ।

ফুলশয্যার পরে বেলা দুপুর পর্যন্ত স্বামী নাক ডাকিয়ে ঘুমোক চন্দ্রমল্লিকার তা মোটেই পছন্দ নয়। আটটা বাজতেই কমলেশের পায়ে সে একটা আলতো চিমটি কেটেছিল । পাশবালিশটাকে আবার জড়িয়ে ধরবার আগে কমলেশ মুহূর্তের জন্যে তাকিয়েছিল ।

চন্দ্রমল্লিকা চাপা গলায় বলেছিল, “বাবা তোমার খোঁজ করেছেন।

ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে কমলেশ সোজা বাইরে চলে যাচ্ছিল। চন্দ্রমল্লিকা হুমড়ি খেয়ে পথ রোধ করলো। বললো, “মুখটা একটু মুছে নাও । আয়নাতে একটু দেখে নাও, কোথাও কিছু লেগে রইলো কিনা?”

বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বাবা চুপচাপ বসেছিলেন । গত রাত্রের টেলিগ্রামখানা সামনেই পড়েছিল । গভীর অভিনন্দনবার্তা নয়, জরুরি টেলিগ্রাম ।

“বনার্জি তোদের অফিসের কে হয় রে?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন ।

“আমাদের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এন ডি বনার্জি,” কমলেশ বললো ।

“তুই যে বিয়ে করবার জন্য কলকাতায় এসেছিস তা তিনি জানেন?” বাবা আবার গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ।

“খুব জানেন । ওঁকে নিজের হাতে বিয়ের কার্ড দিয়ে এসেছি। এখানে আসবার দিনে আশীর্বাদ করলেন । বললেন, তেমন অসুবিধে না হলে বউ ভাতে নিশ্চয় আসবেন।

বাবা আর কথা না বাড়িয়ে কমলেশের দিকে জরুরি টেলিগ্রামটা এগিয়ে দিলেন । তাতে লেখা–’রিগ্রেট, তোমার ছুটি নাকচ করতে হলো। অবিলম্বে চন্দনপুরে ফিরে এসো। বনার্জি ।

টেলিগ্রাম গতকাল রাত্রেই এসেছে তাও দেখতে পেলো কমলেশ । বাবা ইচ্ছে করেই কমলেশের ফুলশয্যার রাত্রি নষ্ট হতে দেননি ।

বাবা শান্তভাবেই ব্যাপারটা নিয়েছেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। গম্ভীরভাবেই জানিয়ে দিলেন, “যদুকে আমি ফেয়ারলি প্লেস বুকিং অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি, চন্দনপুর এক্সপ্রেসে একখানা ফার্স্টক্লাস টিকিট কিনে আনবে।”

খবরটা এবার দ্রুতবেগে আত্মীয়মহলে ছড়িয়ে পড়েছিল । চন্দ্রমল্লিকার বাড়িতে টেলিফোন যেতেও দেরি হয়নি। এমন আকস্মিক ঘটনার জন্যে কোনোপক্ষই তৈরি ছিল না! দু’ পক্ষের মধ্যে কয়েকরাউন্ড আলোচনার পরে ধুলো-পায়ে লগ্নটা সঙ্গে-সঙ্গে সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ।

বাপের বাড়িতে ফিরবার সময় চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে কমলেশ ছাড়া আর কেউই ছিল না । আকস্মিক বিচ্ছেদের আশঙ্কায় মল্লিকা বেচারা বেশ মুষড়ে পড়েছে। কমলেশ নিজেও এ-ধরনের বিনা-মেঘে-বজ্রপাতের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। চন্দনপুরে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত রহস্যটা মোটেই বোঝা যাচ্ছে না ।

.

আচমকা ব্রেক কষার ফলে ট্রেনটা একটু ধাক্কা দিয়ে থামলো । কমলেশের মনে হলো একটা অপ্রত্যাশিত অন্যায় ধাক্কা খেয়েছে সে । চাকরি কমলেশ একলাই করে না । হাজার লক্ষ লক্ষ লোক ছুটি নিয়েই বিয়ে করতে আসে–কিন্তু ফুলশয্যার রাতে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কোনো অফিসের কর্তা তাদের বিয়ের আনন্দ ভণ্ডুল করে দেন না ।

বাড়ির সবার মন খারাপ। শ্বশুরবাড়ির তো কথাই নেই। তারা ভাবছিল হৈ-চৈ হবে কয়েকদিন, তারপর মেয়েজামাইকে হনিমুনে রওনা করে দেওয়া হবে। তা নয় হরিষে বিষাদ । চন্দ্রমল্লিকা বেশ ঘাবড়ে গেছে–ওর দুঃখটাই বেশি, কিন্তু বেচারা ভয় পাচ্ছে, লোকে হয়তো ওর ঘাড়েই দোষ চাপাবে ।

একঘণ্টা মল্লিকাদের বাড়িতে ওরা দুজনে আবার ফিরে এসেছিল। কমলেশের বাবা দুপুরে আবার হুকুমনামা জারি করেছিলেন। “খোকাকে অনেকক্ষণ ট্রেনে ধকল সইতে হবে। খেয়ে-দেয়ে চটপট ওকে একটু গড়িয়ে নিতে দাও।”

এই ‘গড়িয়ে নেওয়ার’ অর্থ কমলেশ বুঝতে পারে। বাবা চাইছেন, নববধূর সঙ্গে আকস্মিক বিচ্ছেদের আগে তারা একান্তে আরও একটু সময় কাটিয়ে নিক । এইটুকু সুযোগ অবশ্যই ওদের দুজনের প্রাপ্য, কারোর আপত্তিও নেই । কিন্তু চন্দ্রার ভীষণ লজ্জা লেগেছিল । সে ঘরে ঢুকতে রাজি হয়নি। প্রায় জোর করেই তাকে স্বামীর ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দরজাটা দিদি ভিজিয়ে দিলেও, মল্লিকা ভিতর থেকে বন্ধ করেনি।

চন্দ্রাকে মুহূর্তের মধ্যে কাছে টেনে নিয়েছিল কমলেশ। কিন্তু বেচারা ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে গেছে। বলেছে, “আমি অপয়া, তাই এমন হলো ।”

অফিসের ওপর ভীষণ বিরক্তি ধরেছিল কমলেশের । সে কোনোরকমে বলেছিল, “ফার্স্ট রাউন্ডেই এমন বিচ্ছেদের জন্যে তৈরি ছিলাম না আমরা দুজনে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজে ছাড়ছি না। কয়েক ঘণ্টা পরেই অফিসের কারণটা বোঝা যাবে।”

ট্রেনের কামরায় কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর চন্দনপুর ক্রমশই এগিয়ে আসছে। কর্মজীবনের কথা কমলেশের এবার বেশি করে মনে পড়ছে। কয়েকদিন প্রজাপতির ষড়যন্ত্রে চন্দনপুরের কথা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল কমলেশ।

ছোট-ছোট পাহাড়ে সাজানো ছবির মতো শহর এই চন্দনপুর । ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের এই অঞ্চলকে কেউ চিনতো না । এখানে থাকার মধ্যে তখন ছিল মিলিটারিদের মস্ত ঘাঁটি । মাইলখানেক জায়গা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে তার মধ্যে অজস্র গোপন জিনিসপত্তর রাখা হতো–যা নাকি যুদ্ধের জন্য দরকার ।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেই সেখানে গড়ে উঠেছে সুবিশাল ফার্টিলাইজার কারখানা– হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালসের প্রথম উদ্যোগ চন্দনপুর প্রোজেক্ট। স্বাধীনতার প্রথম দশকে এই চন্দনপুর ছিল সবার দর্শনীয়, সব থেকে স্মার্ট । প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে রাজধানীর শক্তিমানরা রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিয়ে প্রাই আসতেন এই চন্দনপুরে। চীনের চৌ এন লাই থেকে ইংলন্ডেশ্বরী এলিজাবেথ পর্যন্ত কেউ বাদ যাননি। চন্দনপুর তাঁদের মুগ্ধ করেছিল ।

কি সুন্দর নাম এই চন্দনপুর । কিন্তু এ-যুগে সরকারি ফিতের ফাঁসে স্থানীয় নামের সৌন্দর্য ও স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। সংক্ষেপকরণের উদ্ভট উৎসাহে কোনো একজন ছন্দকানা নিষ্ঠাবান অফিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট সরকারি ফাইলে লিখেছিলেন: সিপি । চন্দনপুর প্রোজেক্ট সেই যে সিপি হলো, তা থেকে আর মুক্তি পায়নি।

কারখানা যেখানে শেষ হয়েছে তার কিছু দূরেই ছিমছাম আধুনিক ডিজাইনের বিরাট লম্বা দোতলা বাড়ি নবাগতদের নজরে পড়ে। আড়াই দশকের বৃদ্ধ কারখানর সঙ্গে নতুন বাড়িটার কোনো মিলই নেই। সরকারি কোম্পানির অফিস-বাড়ি সচরাচর এমন সুরুচিপূর্ণ হয় না! দূর থেকে দেখলে কোনো আধুনিক রঙ্গশালা বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু এইটাই হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালস ওরফে এইচএসি গবেষণা বিভাগ ।

গেটের কাছে একটা নাকচাপা দারোয়ান বন্দুক হাতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে । দারোয়ানকে পিছনে ফেলে লাল নুড়ি বিছানো রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যেতে হবে । ল্যাবরেটরির প্রধান দরজার গোড়ায় গ্রানাইট পাথরের ওপর খোদাই করা কয়েকটি অক্ষর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, কয়েক বছর আগে কোনো এক জুলাই প্রভাতে প্রধানমন্ত্রী এই গবেষণগারের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন এবং এই পবিত্র জ্ঞানমন্দিরকে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন ।

মূল দরজা পেরিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলেই রিসেপশন হল্ । সেখানকার দেওয়ালে তামার পাতে তৈরি এক অপরিচিত বিদেশির অস্পষ্ট রিলিফ মূর্তি আগন্তুকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ফলকের তলায় ফরাসিতে কী একটা উক্তিও খোদাই করা রয়েছে, যার অর্থ: “সন্ধান করো তাকে নিশ্চয় খুঁজে পাবে।” অনেকদিন আগে অমর ফরাসি বৈজ্ঞানিক নিকোলাস লে ব্লাঙ্ক নাকি এই বিশ্বাস পোষণ করতেন ।

লে ব্লাঙ্কের কালজয়ী ছোট্ট এই উক্তিটি দিগম্বর বনার্জি তাঁর অফিসঘরের টেবিলে কাঁচের তলাতেও রেখে দিয়েছেন। যখনই কোনো সন্দেহ উপস্থিত হয়, হতাশার মেঘ মনের আকাশকে ছেয়ে ফেলবার উপক্রম করে, তখনই দিগম্বর বনার্জি লে ব্লাঙ্কের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন । তিনি অকস্মাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে ভাবশিষ্যক স্মরণ করিয়ে দেন সন্ধান করতে হবে, তবেই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে ।

এখন রাত আটটা । ল্যাবরেটরি বাড়িটা অন্ধকার থাকলেও, বনার্জি সায়েবের অফিসঘরে চারটে টিউবলাইট জ্বলছে।

টেবিল ল্যাম্পের তলায় ঝুঁকে পড়ে একমনে কতকগুলো এক্স-রে রিপোর্ট দেখছেন দিগম্বর বনার্জি। এক্স-রে পাউডার ডিফ্র্যাকশন প্যাটার্ন সংক্রান্ত রিপোর্ট পড়তে পড়তে ছোট একটা নোট বুকে দিগম্বর বনার্জি লিখছেন, আগামীকাল সকালেই এক্স-রে ডিপার্টমেন্টের বি এস আয়ারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ছ’রকম অবস্থা সম্পর্কেই তিনি রিপোর্ট চান । তিন নম্বর ফেজের স্ট্রাকচারে করোগেটেড লেয়ার দেখা যাচ্ছে না কেন? নোট বইতে মন্তব্য লেখা হঠাৎ বন্ধ করে দিলেন দিগম্বর বনার্জি । আরও একটা দিন অযথা নষ্ট হয়ে যাবে। সময় সংরক্ষণের জন্যে দিগম্বর বনার্জি টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিলেন । তারপর আয়ারের বাড়ির নম্বর ডায়াল করলেন। অন্য যে-কোনো অফিসে রাত আটটার সময় ডিরেক্টরের টেলিফোন পেলে অফিসাররা চিন্তিত হয়ে পড়তেন । কিন্তু চন্দনপুরের ব্যাপারটা সকলেরই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।

দিগম্বর বনার্জি বললেন, “আয়ার, তুমি কি ডিনার করছিলে? আই অ্যাম ভেরি স্যরি । তোমার ডিপার্টমেন্টের এক্স-রে ডাটাগুলো দেখতে-দেখতে হঠাৎ মনে হলো, এক্স-রে ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা আজকাল কুলির মতো কাজ করেছে, একেবারে মাথা ঘামাচ্ছে না । ইনফ্লুয়েন্স অফ স্ট্রাকচার অন বিহেভিয়ার সম্পর্কে বেনহাম এবং রেস্ট্রিকের যে-পেপারটা আমরা আনিয়েছি, তা ওদের একবার দেখতে বোলো। ডকুমেনটেশন ডিভিসনে ঐ পেপারটা দেড়মাস এসেছে । অথচ তোমার ডিপার্টমেন্টের কোনো ছেলে সেটা এখনও পর্যন্ত নেয়নি শুনলাম।” এরপর শুভরাত্রি জানিয়ে দিগম্বর বনার্জি টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন ।

বনার্জি এবার তাঁর অ্যাসিসটেন্ট অধর সিনহাকে ডাকলেন। “অধর, গতকাল কমলেশের কলকাতার ঠিকানায় টেলিগ্রামটা ঠিক পাঠিয়েছিলে তো?”

“নিশ্চয় স্যার।” অধর এসব কাজে কখনও ভুল করে না।

“এক্সপ্রেস তো?” দিগম্বর বনার্জি জানতে চাইলেন ।

“হ্যাঁ স্যার।”

“হাওড়া-চন্দনপুর এক্সপ্রেস তো এতোক্ষণ এসে পড়া উচিত, তাই না?” দিগম্বর বনার্জি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অধরকে জিজ্ঞেস করলেন ।

“দেড় ঘণ্টা লেট আছে,” অধর খবর দিলো ।

বেশ বিরক্ত হলেন দিগম্বর। মনে-মনে ভাবলেন, আমাদের দেশটাই লেটলতিফের দেশ–আমরা কাউকে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে দেবো না। আমরা জন্মজন্মান্তর ধরে লক্ষ কোটি বছরের ওপর নজর রাখছি, সময়ের সীমাহীনতা সম্পর্কে ভারতবর্ষে বেদ উপনিষদ মহাভারত সর্বদা সোচ্চার, তাই তুচ্ছ মিনিট ঘণ্টা দিন অপব্যয় করতে এখানে কেউ লজ্জিত হয় না ।

দিগম্বর বনার্জি আবার মণিবন্ধের ঘড়ির দিকে তাকালেন । তারপর নিজের সহকারীকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দিয়ে বললেন, “অধর, তোমার তো যাবার সময় হলো । তুমি বরং কমলেশের কোয়ার্টারে একটু ঘুরে যাও–আমার ড্রাইভার তোমাকে নামিয়ে দেবে। ওখানে খবর দিয়ে এসো, ডক্টর রায়চৌধুরী ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে আজই দেখা করতে পারেন ।

“আপনি বাড়ি ফিরবেন না?” অধর জিজ্ঞেস করে।

“তোমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা ফিরে আসুক। তারপর দেখা যাবে।

এই যে বিরাট বাড়িটা এবং এখানে যে কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি এবং শ’চারেক লোক আছেন তাঁদের হর্তাকর্তাবিধাতা বাহান্ন বছরের নোয়েল দিগম্বর বনার্জি। তিন বছর আগে বনার্জি যখন এইচএসির ডিরেক্টর হলেন, তখন অনেকে আশা করেছিল অন্য ডিরেক্টরদের মতো তিনিও কোম্পানির দিল্লির অফিসে বসবেন ।

কিন্তু দিগম্বর বনার্জি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে সোজাসুজি জানিয়েছিলেন, “ডিরেক্টর করেছেন করুন। মিটিংয়ে ডাকলে আসবো। কিন্তু রিসার্চ ডিরেক্টর মাইনাস হিজ ল্যাবরেটরি মানে হয় না । আমাকে চন্দনপুরেই থেকে যেতে হবে।” ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রয়োজনীয় অনুমতি না দিয়ে পারেননি ।

চন্দনপুরের সবাই জানতো, হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালস ল্যাবরেটরি ছেড়ে এন ডি বনার্জি দিল্লি তো দূরের কথা, স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাবেন না।

এন ডি বনার্জি কাঁচের তলায় লেখা সেই ছোট্ট কোটেশনটা আবার দেখলেন: সন্ধান করো তাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে ।

“কোথায় সন্ধান করবো? কাকেই-বা খুঁজে পাবো?” দিগম্বর নিজেকেই জিজ্ঞেস করলেন ।

নিজের চেয়ারে বসে দক্ষিণের বিশাল জানালা দিয়ে দিগম্বর বনার্জি এবার বাইরে তাকালেন। গত কুড়ি বছরে রাসায়নিক সারবিজ্ঞানে অবিশ্বাস্য অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে চন্দনপুর কারখানা তার গুরুত্ব হারিয়েছে– সে এখন বিগতযৌবনা। বুড়ী ফ্যাক্টরিকে এই রাতে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে। কে বলবে, হেডঅফিসে বিশেষজ্ঞ কমিটির সভ্যরা ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন, নানা রোগে জীর্ণ এই কারখানার পিছনে আর টাকা ঢেলে লাভ নেই । চন্দনপুর প্রোজেক্টের দিন শেষ হয়েছে।

অথচ এই চন্দনপুর কারখানা থেকেই একদিন এইচএসির সূত্রপাত হয়েছিল। তখন ভারতবর্ষে চাষবাস নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা মাথা ঘামাতেন না । চাষ করে গেঁয়ো ভূতরা: গোরুর গাড়ি কিংবা লরিতে বোঝই হয়ে চাষের ফসল কর্তাদের ভোগের জন্যে শহরে চলে আসবে । মূর্খ চাষা গ্রামে পচবে এবং বাবুরা শহরে ফুর্তি করবেন, এই তো ছিল সামাজিক প্রত্যাশা ।

দিগম্বর বনার্জির মনে পড়লো, তিনি নিজেও এই শহুরে বাবুদের দলে ছিলেন। কোনোদিন গ্রামে যাননি, যাবার উৎসাহ বোধ করেননি । চন্দনপুর সার কারখানা বসাবার পিছনে যত না ছিল কৃষিচিন্তা তার থেকে বেশি ছিল যুদ্ধ থেকে সদ্য ছাঁটাই হওয়া সৈন্যদের কাজে লাগানোর গরজ । বেকার সৈন্যদের সাকার করতে গিয়ে যদি দেশে কিছু সার তৈরি হয়, মন্দ কী?

দিগম্বর বনার্জি ভাবলেন, ভাগ্যে চন্দনপুর তৈরি হয়েছিল । পাকেচক্রে একদিন শহুরে লোকদের ভাতেও টান পড়লো । বোঝা গেলো, এবার যদি দুর্ভিক্ষ আসে তাহলে শুধু গাঁয়ের লোক নয়, শহরের বাবুদেরও প্রাণ নিরাপদ থাকবে না। তার ওপর বিদেশিদের অপমান । যারা নিজেদের খাবার উৎপাদন করতে পারে না, যাদের বন্দরে ভিক্ষের গম পৌঁছে দেবার জন্যে দুনিয়ার অর্ধেক জাহাজকে গলদঘর্ম হতে হয় তাদের মুখে বড়-বড় কথা কোন দেশ সহ্য করবে? স্বাধীন ভারতবর্ষ বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েও বিশ্বজনের অবজ্ঞা ও কৌতুকের পাত্র হয়ে উঠলো। দেশের কর্তারা অবশেষে অপমানিত বোধ করলেন!

দিগম্বর বনার্জি জানেন, অপমানে ফল হয়েছে। দিবানিদ্রা থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে শহুরে বাবুরা জানতে চাইলেন, চাষীরা কেন চাষ করছে না? এতো জমি, এতো মানুষ, এতো সাধ্যসাধনা, তবে বসুমতী কেন কৃপণা? কেন ফসল নেই?

দুনিয়ার লোকেরা অনেকদিন আগেই যা জানতো, ভারতবর্ষের বাবুরা অবশেষে তার খবর পেলেন। এদেশের জমি থেকে শত-শত বছর ধরে নির্মমভাবে আমরা নিয়েই চলেছি–কিন্তু কিছুই ফিরিয়ে দিই না। জননী ধরিত্রীরও ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা আছে। আকাশের বৃষ্টি অনেক সময় তেষ্টা মেটায় কিন্তু ক্ষিধে মেটাবার সার কোথায়? বাঁচার মতো ফসল পেতে হলে, অনেক সার চাই ।

দিগম্বর বনার্জি তখন সামান্য একজন বিজ্ঞানী। অন্তত দশবার দিল্লিকে লিখেছেন, জমি যা ফসল হিসেবে দিচ্ছে, তা আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। এতো খাবার প্রাকৃতিক পথে পাবার উপায় নেই–তাই চাই রাসায়নিক সার । সমগ্র পৃথিবীতে এই সার নিয়ে যে কর্মকান্ড চলেছে, ভারতবর্ষ তার থেকে পিছিয়ে থাকলে ভুল করবে।

দিগম্বর বনার্জির মনে আছে দিল্লি দরবারে তন্দ্রা-ছোটার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে লাগলো এই হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো-কেমিক্যালস। কৃষি রসায়নের সর্বস্তরে প্রবেশ করবে এই কোম্পানি। চন্দনপুর থেকে যার শুরু তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে ভারতবর্ষের সর্বপ্রান্তে। দিগম্বর বনার্জির ঘরে-টাঙানো ভারতবর্ষের মানচিত্রে লাল এবং সবুজ রঙয়ের অনেকগুলো পিন পোতা রয়েছে, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের নানা অঞ্চলে । লাল মানে যেসব জায়গায় নতুন কারখানার প্রস্তাব রয়েছে, আর সবুজ মানে সেখানে কারখানা চালু হয়ে গিয়েছে।

কাজকর্মের সুবিধার জন্যে এইচএসির হেডঅফিস দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু গবেষণার কাজ এই চন্দনপুরেই চলছে । দিগম্বর বনার্জির ধারণা, বড়-বড় শহরে, বিশেষ করে দিল্লিতে জ্ঞানের সাধনা চলে না। সভ্যতার নানা প্রলোভন ওখানে নিরীহ মানুষকে বিপথে নিয়ে যাবার জন্যে অহরহ হাতছানি দিচ্ছে। সর্বক্ষণ চোখের সামনে অনেকগুলো জোচ্চোর ব্যবসাদার এবং ততোধিক অপদার্থ জননেতাদের মোগলাই সুখে থাকতে দেখলে বিজ্ঞান সাধকের তপোভঙ্গ হতে পারে ।

আপন জীবনের গতিপথে তাকিয়ে দিগম্বর বনার্জি এই মুহূর্তে অবাক হয়ে যাচ্ছেন । কোথায় ছিলেন, কেমন করে পাকেচক্রে এই এইচএসির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন ।

দিগম্বর বনার্জি তেমন সামাজিক নন। রাগও আছে তাঁর প্রচণ্ড। কিন্তু রাগতে ইচ্ছে করে না আজকাল । করণ এইচএসির কর্মকর্তারা তাঁকে বেঁধে রাখেননি । দিগম্বর বলেছেন, রিসার্চের চাকাই পৃথিবীর কেমিক্যাল শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজ যা আধুনিক, আগামীকালই তা পচা পুরানো হয়ে যাবে। সুতরাং এগিয়ে যাবার এই তীব্র প্রতিযোগিতায় এইচএসিকে অংশ নিতে হবে। কোম্পানির কর্তারা তাঁর সঙ্গে একমত। বনার্জিকে তাঁরা এমন স্বাধীনতা দিয়েছেন যা আজকের এই সরকারি যুগে অবিশ্বাস্য। গবেষণার জন্য তিনি যা চাইবেন তা দিতে প্রস্তুত আছেন বোর্ডের মেম্বাররা। এর ফলেই বিপদে পড়েছেন দিগম্বর বনার্জি। এঁদের বিশ্বাসের যোগ্য হয়ে দেশের প্রত্যাশা মেটাতে পারবেন কিনা ভয় হয় তাঁর ।

কত স্বপ্ন দেখেন দিগম্বর বনার্জি। এমন একদিন আসবে, যেদিন রাসায়নিক সারের আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারতবর্ষের নাম জ্বলজ্বল করবে। ভারতবর্ষের কোটি-কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার জোগাবার জন্যে যদি লক্ষ লক্ষ টন ফসফেট, অ্যামোনিয়া এবং পটাশ দরকার হয় তাহলে রসায়ন শিল্পে আমরা কেন পরনির্ভর হয়ে থাকবো?

দিগম্বর বনার্জির মনে হতাশা ঢোকাবার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলেন ইন্ডিয়াতে নাকি কিছু সম্ভব নয় । এখানে কেউ নাকি চেষ্টা করেও সফল হতে পারে না । সুতরাং বনার্জির কপালেও ব্যর্থতা লেখা আছে ।

কিন্তু দিগম্বর বনার্জি ইতিহাসের খোঁজখবর রাখেন । একজন মানুষের জীবন ও সাধনা তাঁকে আশা-ভরসা দেয়। তাঁর নাম নিকোলাস লে ব্লাঙ্ক। ১৮০৬ সালে কপর্দকশূন্য হতাশ লে ব্লাঙ্ক অন্য কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে যখন আত্মহত্যা করলেন, তখন কি তিনি জানতেন পৃথিবী একদিন তাঁকে আধুনিক রসায়ন শিল্পের পিতা বলে মেনে নেবে? ফ্রান্সের এই ভদ্রলোক চেয়েছিলেন, কম খরচে এমন সব কেমিক্যাল তৈরি করবেন যা মানুষের প্রয়োজনে লাগে। পৌনে দু’শো বছর আগে লে ব্লাঙ্ক যা চেয়েছিলেন, চন্দনপুরের দিগম্বর বনার্জিও তাই চাইছেন: আরও কম খরচে সার তৈরির পদ্ধতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি ।

দিগম্বর বনার্জির মনে পড়লো, লে ব্লাঙ্ক প্রথমে আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন একটা প্রতিযোগিতা থেকে। সস্তায় অ্যালকেলি তৈরির উপায় আবিষ্কারের জন্যে ফরাসি বিজ্ঞান পরিষদ বারো হাজার ফ্রাঙ্ক পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। মাত্র ১৭৯০ সালের কথা, অথচ পৃথিবীর কেউ তখনও অ্যালকেলি তৈরির সহজ উপায় জানতো না । লে ব্লাঙ্ক সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে সালফিউরিক অ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি করলেন সোডিয়াম সারফেট। তারপর সোডিয়াম সালফেটের চাঙড়কে চুনের মধ্যে রেখে কয়লার আগুনে রোস্ট করলেন। পাওয়া গেলো কালো রঙের ছাই, যাতে আছে সোডিয়াম কার্বনেট এবং ক্যালসিয়াম সালফাইড। এবার সোডিয়াম কার্বনেটকে জলে গুলে ফেললেন লে ব্লাঙ্ক এবং তারপর দানা বেঁধে পৃথিবীকে উপহার দিলেন উনিশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী কেমিক্যাল প্রসেস ।

কিন্তু এই রাসায়নিক পদ্ধতি আবিষ্কারের পরিবর্তে একটুও সুখের মুখ দেখেননি লে ব্লাঙ্ক । প্রাইজের টাকা তাঁর হাতে আসেনি। ফরাসি বিপ্লবের সময় তাঁর কারখানা তছনছ এবং বাজেয়াপ্ত হলো। নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত দয়া করে কারখানা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু কারখানার দরজা খোলার মতো কাঁচা টাকা লে ব্লাঙ্ক আর যোগাড় করতে পারেননি ৷

যাদের জন্যে লে ব্লাঙ্ক এতো বড় আবিষ্কার করলেন সেই ফরাসিরা তাকিয়েও দেখলো না : কিন্তু ধূর্ত ইংরেজ ব্যবসাদারেরা লে ব্লাঙ্কের রাসায়নিক পদ্ধতি নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে সাবান তৈরিতে কাজে লাগালো ।

এসব খবর আজকালকার ছেলে-ছোকরারা জানে না । দিগম্বর বনার্জি তাই ল্যাবরেটরির ছেলেদের বলেন, “তোমরা ইতিহাসের খবরাখবর রাখবে–শুধু দৈনন্দিন রিসার্চ এবং রিপোর্টে ডুবে থাকলে বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় না ।

তরুণ বিজ্ঞানীরা কথাটা শোনে কিন্তু কাজে লাগায় না। আরও কিছু টাকা পেলে দিগম্বর বনার্জি তাঁর গবেষণাগারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রির ঐতিহাসিক খবরাখবর যোগাড় করবার জন্যে একজন সহকারী রাখবেন। প্রিয় শিষ্য নগেন বসুকে এসব কথা দিগম্বর বনার্জি একদিন বলেছিলেন। “নগেন, আজকের যুগে গজদন্তমিনারে বাস করলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলবে না। বৈজ্ঞানিকদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে; তাদের জানতে হবে দেশের মানুষ কোন পথ থেকে কোথায় যেতে চাইছে; তবেই তো আমরা দেশের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব করে তুলতে পারবো ।

নগেন বলতো, “বৈজ্ঞানিক গবেষণাও একধরনের রিলে রেস । তাই না?”

দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “নিশ্চয় । না হলে, সাবান কারখানায় অ্যালকেলি তৈরির যা বিদ্যে লাগানো হলো, তা এই ক’বছরে কেমন করে পৃথিবীর রূপ পাল্টে দিলো? কয়লা, নুন, চুন, সালফার, বাতাস, জল, পেট্রল এর মধ্যে থেকে প্রকৃতির সযত্নে লুকানো রহস্য ছিনিয়ে এনে এখন তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ জিনিস–রঙ, সাবান, খাবার, ওষুধ, সার, প্লাস্টিক, জামাকাপড় আরও কত কি।”

নগেন বসু মন দিয়ে শুনতো। ছোকরার মধ্যে সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দিগম্বর বনার্জি তার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত পেয়েছেন । এমন আঘাত যার জন্যে তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না । নগেনকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন।

গাড়িটা বোধহয় ফিরে এসেছে। ড্রাইভারকে আর আটকে রাখা ঠিক হবে না। দিগম্বর বনার্জি হাতের ব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লেন।

লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-পাশের বন্ধ কাঁচের দরজাগুরোর দিকে তাকাচ্ছেন ডক্টর নোয়েল দিগম্বর বনার্জি। ফিজিক্যাল রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে একটা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দু-দিন হলো কাজ করেছে না। রাওকে তাড়াতাড়ি সারাবার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন দিগম্বর । রাও পরের দিন তাঁকে একটা লম্বা নোট পাঠিয়েছিল । নোটটা পড়ে দিগম্বর বনার্জি একবার ভেবেছিলেন ওঁকে ডেকে পাঠাবেন । তারপর কী ভেবে, কাগজটা হাতে নেয় নিজেই ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপরুমে হাজির হয়েছিলেন। রাও তখন স্পেকট্রোফটোমেট্রির জন্যে নতুন নিযুক্ত অফিসার খোসলার সঙ্গে কথা বলছিল ।

দিগম্বর বনার্জিকে দেখে রাও উঠে দাঁড়িয়েছিল। “উঠতে হবে না”, এই বলে তিনি পাশের একটা টুল টেনে নিলেন । কাগজটা রাও-এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পাশের ঘরেই যখন রয়েছি তখন চিঠি না লিখে নিজেই আমার কাছে চলে এলে না কেন? মেশিন যখন খারাপ হয়েছে, তখন আগে মেশিন চালু করো, তারপর অন্য সব ফর্মালিটি ।

রাও বললো, “আমি ব্যাপারটা অন রেকর্ডে রাখতে চেয়েছিলাম । হাজার হোক সরকারি সম্পত্তি।”

বনার্জি বলেছিলেন, “রাও, আমাদের ডিপার্টমেন্টে তুমি নতুন বদলি হয়ে এসেছো, তাই তোমার গোটা কয়েক কথা জেনে রাখা দরকার । গভরমেন্টের অনেক গবেষণাগারে চিঠি লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই হয় না । এইচএসির এই যে বাড়ি দেখছো এখানে বৈজ্ঞানিকদের রাখা হয় গবেষণার জন্যে–চিঠি লেখার জন্যে নয়। আমি সবাইকে বলেছি, তোমাকেও মনে করিয়ে দিচ্ছি–তোমার তদারকিতে যেসব মেশিন রয়েছে সেগুলোকে সরকারের সম্পত্তি ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই । সমস্ত যন্ত্রপাতি তোমার নিজের বলে মনে করবে এবং সেইভাবে আদরযত্ন করবে। তার জন্যে যদি কোনো হাঙ্গামা হয়, অডিট যদি কোনো কথা তোলে, সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেবে রিসার্চ ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জিকে ধরুন গে যান, তাঁর হুকুম মতো কাজ হয়েছে।”

রাও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল । বনার্জি বলেছিলেন, “আমি চাই তোমরা এখানে নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে বিজ্ঞানের কাজ করে যাও–অকাজ যতটা আছে আমি সামলাবো ।”

দিগম্বর বনার্জির এইমাত্র মনে হলো রাওকে বলবেন, “প্রত্যেক যন্ত্র একটু-আধটু মেরামতের কাজ ছেলেদের শিখতে উৎসাহ দিতে। অনেক আধুনিক মেশিন আছে যা মডার্ন মহিলাদের চেয়েও পলকা –কিন্তু ভয় পেয়ে কাজকর্ম বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। বিদেশি বড়-বড় কোম্পানিরা ভারতীয়দের এই দুর্বলতার কথা জানে–তাই তারা মেশিন বিক্রি করে, কিন্তু মেরামতি এবং স্পেয়ার পার্টসের দড়ি পরিয়ে আমাদের ওঠায় বসায়।”

দিগম্বর বনার্জি সেবার রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। দেখলেন প্রত্যেক ল্যাবে বৈজ্ঞানিকরা নিজেদের যন্ত্রগুলোকে বালিকা-বান্ধবীর মতো আদর করে । রুশরা ঠেকে শিখেছে–ওরা কথায় কথায় ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি থেকে মেশিনের সেলসম্যানদের ডেকে পাঠাতে পারে না। তাই হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে ওরা নিজেরাই যন্ত্রের প্রাথমিক তদারকি এবং মেরামতি কাজগুলো শিখেছে ৷ ব্যাপারটা খুব ভালো লেগেছিল দিগম্বর বনার্জির অভ্যসটা চন্দনপুরে চালু করবেন ভাবছেন ।

করিডর ধরে সামনে এগিয়ে চললেন দিগম্বর বনার্জি । মাঝে-মাঝে তাঁর মাথায় এই জনহীন বিরাট বাড়িটা একা-একা ঘুরে দেখবার নেশা চেপে বসে। সাত বছর আগে চন্দনপুর প্রোজেক্টের ছোট কেমিক্যাল অ্যানলিসিসরুমে বসে যখন তিনি গবেষণা বিভাগের স্বপ্ন দেখতেন তখন অনেকেই তাঁকে পাগল ভাবতো ।

দিগম্বর বনার্জি তখন থেকেই বলছেন, সামনে এমন যুগ আসছে যখন কেমিক্যাল সারের জন্যে ভারতবর্ষের চাষীরা কাড়াকাড়ি শুরু করবে। সামান্য এই চন্দনপুরের সাধ্য কী সেই দাবি মেটায় । তখন লক্ষ লক্ষ টন সারের জন্যে অন্তত দেড়শ দু’শো নাইট্রোজেন তৈরির কারখানা প্রয়োজন হবে । কিন্তু বিদেশিদের কাছে ধার করে, ভিক্ষে মেগে এইসব কারখানা বসানের সম্ভব হবে না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার মতো কারিগরি বিদ্যা আমাদের আয়ত্তে করতেই হবে ।

দিগম্বর বনার্জির কথায় অনেকে তখন হেসেছিলেন। তাঁরা বলতেন, ফার্টিলাইজার টেকনলজি ছেলের হাতের মোয়া নয়। ইচ্ছে করলেই নিজের চেষ্টায় অ্যামোনিয়াম রাইট্রেট, অ্যামোনিয়াম কার্বনেট বা ইউরিয়া তৈরি করা যায় না। গোটা পৃথিবীতে মাত্র আট-দশটা কোম্পানি আছে যারা কোটি কোটি ডলার এবং পাউন্ড গবেষণায় ঢেলে এই বিদ্যা আয়ত্ত করেছে।

দিগম্বর বনার্জি তখন সবে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, “বিলেত আমেরিকা যদি পারে তবে আমরাও পারবো না কেন? গবেষণার গোড়াপত্তন এখনই হয়ে যাওয়া প্রয়োজন । আর দেরি করা চলবে না।”

চন্দনপুর প্রোজেক্টের আইসিএস কর্মকর্তা মিস্টার আচার্য তখন মন্তব্য করেছিলেন, “বনার্জি, তুমি যেসব কথা বলছো তা এদেশের কোনো কারখানায় সম্ভব নয়। গবেষণা যদি করতেই হয় তাহলে গভরমেন্টকে লিখি, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সার সংক্রান্ত গবেষণাকেন্দ্ৰ খুলতে।”

দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “ইউনিভার্সিটির মাস্টারমশাইরা কোনোদিনই সার তৈরি করতে পারবেন না। বাস্তবের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক বড় কম। দেশের সমস্যা এবং সুখ-দুঃখের কোনো খবরই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছায় না । তাঁরা অন্য এক জগতে পড়ে রয়েছেন। আমি চাই, এই চন্দনপুর প্রোজেক্টের সঙ্গেই গবেষণা শুরু হোক, যে-কাজ চন্দনপুর কারখানার সঙ্গেই তাল রেখে চলবে।”

দিগম্বর বনার্জির কথা তখনকার কর্তাদের মনঃপূত হয়নি। তাঁরা ভেবেছেন লোকটা পাগল । বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চায় বনার্জি। বাঙালে গোঁ নিয়ে ডুপন্ট, কেমিকো, আইসিআই, মন্টিকাটিনির মতো বিশ্বজোড়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দেবার লোভ। এই চন্দনপুরের জেনারেল ম্যানেজারই বলেছিলেন, “বনার্জি, একটা জিনিস ভুলো না, এইসব কোম্পানি বছরে যত টাকা গবেষণায় খরচ করে আমাদের কোম্পানির মোট আয়ও তার শতকরা একভাগ নয় ।

দিগম্বর বনার্জি জানেন, এইরকম কথা শুনেই তাঁকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হতো, যদি-না ইতিমধ্যে কিছু অঘটন ঘটতো। সেসব ঘটনা ঘটেছে বলেই আজ তিনি এই রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যেখানে শুধু রসায়ন নয়–ফিজিক্স, এগ্রনমি, বোটানি, জিওলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি নানা বিষয় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।

ল্যাবরেটরি ভবনের বাইরে এসে দাঁড়ালেন দিগম্বর বনার্জি। মনটা তাঁর মোটেই ভালো নয় । নগেন বসুর খবরটা পাওয়া পর্যন্ত তিনি বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছেন ।

ট্রেন থেকে নেমে কমলেশ সোজা নিজের কোয়ার্টারে চলে এসেছিল। সেখানে দিগম্বর বনার্জির বার্তা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

হাত-মুখ ধুয়ে রিসার্চ ডিরেক্টরের বাংলোর দিকে যেতে যেতে কমলেশের মন অভিমানে ভরে উঠলো। বিয়ের পর আচমকা এইভাবে তাঁকে ডেকে আনাটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছে না। বাবা অবশ্য কমলেশকে শান্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞাতা থেকে বলেছিলেন, “ব্যাটাছেলের কাছে চাকরিটা বড় কথা ৷ চাকরি না থাকলে সংসারের সাধ-আহ্লাদ নষ্ট হয়ে যায় । দুনিয়ার আর সবাই তো তোমার কাছ থেকে নেবার তালে রয়েছে–সবার সঙ্গেই তো দেবার সম্পর্ক, এই অফিসটুকু ছাড়া। সুতরাং সেখানে একটু-আধটু অসুবিধে হলে হাসিমুখে মেনে নিতে হবে।”

কিন্তু বাবা যে-যুগে চাকরি করতেন তারপর দিনকাল অনেক পাল্টেছে। মার্চেন্ট অফিসেও সেই ডিকটেটরি যুগ এখন আর নেই। তাছাড়া কমলেশ সহকারী সংস্থায় কাজ করে । সেখানে প্রত্যেক মানুষের কয়েকটা আইনসঙ্গত অধিকার আছে ।

সুতপাদি ভোরবেলাতেই টেলিফোনে বুদ্ধি দিয়েছিলেন, “সিক রিপোর্ট করো । বাৎসরিক ছুটিতে এসেও লোক অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। ডাক্তারের সার্টিফিকেট থাকলে, দিগম্বর বনার্জি টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না।।”

টেলিগ্রামে অন্য কারুর নাম থাকলে কমলেশ কিছুতেই ফিরে যেতো না । কিন্তু দিগম্বর বনার্জির সঙ্গে তার অন্য সম্পর্ক। চন্দনপুর ল্যাবের ছোকরা বৈজ্ঞানিকরা কেউ তো দিগম্বর বনার্জিকে ঠিক অফিসের বড়কর্তা হিসেবে দেখে না। তিনি সত্যিই তাদের গুরু । আজকের যুগে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি । রিসার্চ ল্যাবে যে সাড়ে-তিনশ’ বৈজ্ঞানিক কাজ করছে তাদের প্রত্যেকের গবেষণার খুঁটিনাটি খবর রাখেন দিগম্বর বনার্জি। কে কী কাজ করছে, গবেষণা কতখানি এগিয়েছে, তা ফাইল না দেখেই বলে দিতে পারেন তিনি। অফিসের ভদ্রতা রক্ষা করে ‘আপনি’ বলার নিয়ম, মানেন না দিগম্বর বনার্জি । প্রায় সবাইকে ‘তুমি’ বলে ডাকেন, দু-একজনকে ‘তুই’ বলতেও দ্বিধা করেন না ।

সব দিকে দিগম্বর বনার্জির তীক্ষ্ণ নজর। কাউকে বলেন, “অজয়, তোমার ভুঁড়ি সামলাও । তোমার ডেট অফ বার্থ তো অমুক সালের অমুক তারিখ। এর মধ্যে এতো মোটা হলে কাজ করতে পারবে না ।

কাউকে বলেন, “চিন্তাহরণ, মুখটুখ বেঁকিয়ে অতশত কী ভাবছো? করোসন সম্বন্ধে গবেষণা করতে গিয়ে নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলো না। মনের মধ্যে উত্তেজনা থাকলে বড় আবিষ্কার করা যায় না। পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত আবিষ্কারের ইতিহাস দেখো, হঠাৎ হাল্কা এবং সহজভাবেই প্রথম মতলব এসে গিয়েছে । আর্কিমিডিস তখন বাথ টবে বসেছিলেন, স্যার আইজাক নিউটন আপেল গাছের তলায়।”

চিন্তাহরণ ফিক করে হেসে ফেলেছিল । দিগম্বর বনার্জি বললেন, “হাঙ্গেরিয়ান বায়োকেমিস্ট আলবার্ট সেন্ট জর্জির সঙ্গে একবার আমার আলাপ হয়েছিল । উনি বললেন, বৈজ্ঞানিকদের আসরে যেতে এক-একসময় আমার লজ্জা হয়–সভা এবং সেমিনারে তাঁদের চিন্তাশীল গম্ভীর মুখগুলো দেখলে নিজের সম্বন্ধে ধারণা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় ওঁরা কত জানেন, কত ওঁদের ভাবনা। বিশ্বাসই হতে চায় না যে এঁরা এখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। অথচ আমি পেয়ে গিয়েছি।’

কমলেশ রায়চৌধুরীকে দিগম্বর বনার্জিই এই চন্দনপুরে এনেছিলেন । আইআইটিতে ডক্টরেটের জন্যে কমলেশ যে থিসিস জমা দিয়েছিল তার একজন পরীক্ষক ছিলেন দিগম্বর বনার্জি । ক্যাটালিস্ট তৈরির কয়েকটা সমস্যা নিয়েই ছিল কমলেশের গবেষণাপত্র। মৌখিক পরীক্ষায় কমলেশকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেছিলেন দিগম্বর বনার্জি । প্রশ্ন করবার ক্ষমতাও রাখেন ভদ্রলোক। ক্যাটারিস্টের সব রহস্য ভদ্রলোক যেন জেনে বসে আছেন। তর্কযুদ্ধে সন্তুষ্ট হয়ে দিগম্বর বনার্জি অবশেষে কমলেশকে ছুটি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাত্রেই আইআইটি গেস্টহাউস থেকে কমলেশের হোস্টেলে দিগম্বর বনার্জি টেলিফোনে কথা বলেছিলেন ।

পাস করবার সুখবরটা দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন দিগম্বর । তারপর প্রশ্ন করেছিলেন, “নামের পাশে এবার না হয় ডক্টর কথাটা লিখবেন। তারপর কী হবে?”

কমলেশ তখন বিদেশ যাবার স্বপ্ন দেখছিল । বললো, “ভাবছি বিদেশে কোনো কেমিক্যাল কারখানায় কিছুদিন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসি ।’

হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন দিগম্বর বনার্জি। তারপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, “বিদেশের কারখানায় আপনাকে কাজ শেখাবে? সায়েবরা বাইরের লোককে গুপ্তবিদ্যা দিয়ে দেবে? আপনি স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছেন মিস্টার রায়চোধুরী । তিন বছর গাধার খাটুনি খাটবার পরে আবিষ্কার করবেন, ওরা আপনাকে ওদের জ্ঞানের সদর ঘরেও ঢুকতে দেয়নি। অবশ্য আপনার মুখ বন্ধ করবার মতো মাইনে ওরা দেবে।”

কমলেশ বেশ চিন্তিত হয়ে দিগম্বর বনার্জির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিল । আইআইটি গেস্টহাউসের দু-নম্বর ঘরে দিগম্বর বনার্জিকে বেশ খুঁটিয়ে দেখেছিল কমলেশ । সে কয়েক বছর আগেকার কথা, কিন্তু এখনও মনে আছে কমলেশের ।

দিগম্বর বনার্জির চোখে তখনও মোটা পাওয়ারের চশমা ছিল। তাঁর চোখ দুটোতে অদৃশ্য চুম্বকের আকর্ষণ । অথচ দিগম্বর বনার্জি কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না । সব সময় অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সাজগোজে বেশ ফর্মাল মানুষ। ইভনিং ড্রেস পরে ডিনারের জন্যে তৈরি হয়ে নিয়েছেন। কালো আবলুস কাঠের মতো রঙ। নাকটা টিকোলো । কথা বলবার সময় মাঝে-মাঝে নিচের ঠোঁট উল্টে দেন ।

দিগম্বর বনার্জি বললেন, “আপনার কেরিয়ার ভালো। সুতরাং ব্রিটিশ-কেমিক্যালসের একটা স্কলারশিপ অবশ্যই পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু একটা কথা জোর করেই বলতে পারি, ইংলন্ড, জাপানি, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মান, আমেরিকা, কানাডার কোনো কেমিক্যাল কোম্পানি আপনাকে ভিতরের ব্যাপারটা শিখতে দেবে না। আমাদের দেশে যে ঘোমটা ও বোরখা চালু ছিল তা এখন পশ্চিমের বড়-বড় কোম্পানিগুলো পরছে! তাদের সর্বদা ভয়, গুপ্তবিদ্যা বুঝি জানাজানি হয়ে গেলো। তাহলে ওদের মোটা রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। এক পা এগোলে, ওরা একশ’ পেটেন্টের জন্যে অ্যাপ্লিকেশন করে। তারপর আবার এগোয়।”

কমলেশ ওঁর মুখের দিকে নীরবে তাকিয়েছিল । দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “অথচ সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানেন? লে ব্লাঙ্ক–যিনি আমাদের এই আধুনিক রসায়ন শিল্পের জন্মদাতা–তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফর্মুলা ফরাসি বিপ্লবীরা মানুষের মঙ্গলের জন্যে সবাইকে বিনামূল্যে জানিয়ে দিয়েছিল । তারা পেটেন্টে বিশ্বাস করতো না । অ্যালকেলি তৈরির সেই ফর্মুলা নিয়েই তো ইংলন্ড অত জাঁকিয়ে বসলো । তারপর এলো জার্মানরা । আর আমেরিকানদের সম্বন্ধে যত কম বলা যায় তত ভালো ।”

মার্কিন বিজ্ঞান সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতামতও দিগম্বর বনার্জি একটু পরেই দিয়েছিলেন। কমলেশকে বলেছিলেন, “অপরের আবিষ্কার কিনে নিয়ে এবং অন্য দেশের বৈজ্ঞানিক ভাঙ্গিয়ে এসে নিজের ব্যবসা ফাঁদায় ওই জাতের জুড়ি নেই । আপনি গত পঁচাত্তর বছরের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ইতিহাস দেখুন। মোটর গাড়ি আবিষ্কার করলো ইউরোপীয়রা, কিন্তু বিশ্ব জোড়া মোটর ব্যবসা হলো আমেরিকানদের । ইস্পাত গবেষণার প্রধান-প্রধান অগ্রগতি অন্য দেশে, কিন্তু তা কাজে লাগালো আমেরিকান ইস্পাত কোম্পানিগুলো। কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে আপনাকে ডজন-ডজন উদাহরণ দিতে পারি। আর আমেরিকানদের আণবিক গবেষণার ব্যাপারটা পৃথিবীর সবাই জানে–আগাগোড়া জার্মান নামে বোঝাই।”

কমলেশ সত্যি সেদিন বিস্মিত হয়েছিল । দিগম্বর বনার্জি পাইপ টানতে-টানতে বলেছিলেন, “আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আমার কোনো রাগ নেই। বহু বৈজ্ঞানিককে তারা সাধনার সুযোগ দিয়েছে । জ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও মার্কিনীরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী । কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দেশও ইচ্ছে করলে এই পথে নামতে পারে। এবং আমরা যদি তেমন মন দিয়ে কাজ শুরু করি, দুনিয়ার কেউ আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। জাপানি, জার্মান, আমেরিকান, ইংরেজ সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসবে ।

“আপনি সত্যই বিশ্বাস করেন সে-কথা?” কমলেশ প্রশ্ন করেছিল।

দিগম্বর বনার্জি দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, “নিশ্চয় করি। আমাদের কী নেই বলুন? আমাদের অজস্র মেধাবী ছেলে-ছোকরা আছে, কোটি-কোটি পরিশ্রমী শ্রমিক আছে, অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের নানা প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, আর অন্য দেশের মতো আমাদের পঞ্চাশ বছরের বস্তাপচা কারখানা নেই। আমরা নতুনভাবে আরম্ভ করতে যাচ্ছি । আমরা বুঝে-সুঝে যা সর্বাধুনিক, যা কাজের, তাই যদি গ্রহণ করি তাহলে আমাদের কলকারখানার সঙ্গে কে পেরে উঠবে বলুন?”

কিন্তু কিছুই হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল কমলেশ।

দিগম্বর বনার্জি নিজেই সে প্রসঙ্গ তুললেন। “হচ্ছে না এই জন্যে যে আমরা ভাবছি বাইরের লোকজন এসে আমাদের কলকারখানা বসিয়ে দেবে। আমরা ঘুমিয়ে থাকবো আর রাতারাতি অসংখ্য কারখানা গজিয়ে উঠবে । আসলে আমরা এখনও নিজের ওপর নির্ভর করতে শিখলাম না- পরনির্ভরতা না ঘুচলে আমাদের মুক্তি হবে না।”

একটু থেমে দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “এখনও সময় আছে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা যদি উঠে-পড়ে লাগি তাহলে অনেক গর্বিত দেশের মাথা আমাদের কাছে নিচু হয়ে যাবে।”

দিগম্বর বনার্জি তারপর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। “ফার্টিলাইজার ক্যাটালিস্টের কথা ধরুন না। সার কারখানায় প্রতি একশ’ টাকায় তিন টাকা খরচ হয় এই ক্যাটালিস্টে । এ-জিনিস যে বিদেশ থেকে আনা ছাড়া আর কোনো পথ আছে তা আমাদের চন্দনপুর কারখানার কর্মকর্তারা বিশ্বাসই করতেন না। ক্যাটালিস্ট কথাটার বাংলা-টাংলা আছে নাকি?” দিগম্বর বনার্জি প্রশ্ন করেছিলেন।

কমলেশ হেসে বলেছিল, “আজকাল ‘অনুঘটক’ কথাটা চালু হয়েছে–যেসব পদার্থ অন্যান্য পদার্থের রাসায়নিক ক্রিয়া দ্রুততর করে, অথচ নিজে ওই রাসায়নিক ক্রিয়ায় কোনোরকম অংশগ্রহণ করে না। “

দিগম্বর বললেন, “চন্দনপুর সার কারখানায় হঠাৎ একবার আমদানি করা সমস্ত ক্যাটালিস্ট বিষাক্ত হয়ে গেলো । কিছুতেই কাজ করে না । মাথায় হাত দিয়ে বসলেন সবাই, কারণ নতুন জিনিস জাহাজে আনতেই অনেক সময় লেগে যাবে। কর্তারা তখন বাধ্য হয়ে আমাদের বললেন । কারখানা তো বন্ধ হতেই চলেছে, দ্যাখো তোমরা যদি কিছু করতে পারো । আমাদের এই ক্ষুদে ল্যাবরেটরিতে একশ’ কুড়ি ঘণ্টা টানা পরিশ্রমের পর ঈশ্বর আশীর্বাদ করলেন । অকেজো পুরানো ক্যাটালিস্টগুলো আবার বাঁচিয়ে তোলার একটা পথ বেরিয়ে পড়লো । সেই শুরু । তারপর হয়তো কাগজে পড়ে থাকবেন, চন্দনপুরে আমরা কয়েক ধরনের ক্যাটালিস্ট আবিষ্কার করেছি । এই ক্যাটালিস্ট এখন আমরা ইচ্ছে করলে বিদেশের বাজারেও বিক্রি করতে পারি ।

দিগম্বর বনার্জির মধ্যে একটু রুক্ষভাব ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে কোথাও প্রচণ্ড আকর্ষণও ছিল। বিদেশ যাবার পরিকল্পনায় ইস্তফা দিয়ে কমলেশ রায়চৌধুরী তাই শেষ পর্যন্ত এইচএসিতেই চাকরির আবেদন করেছিল ।

চন্দনপুরের মতো অখ্যাত জায়গায় যে এমন গবেষণাগার আছে তা না দেখলে কমলেশের বিশ্বাসই হতো না। দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “এই তো সবে শুরু! আরও বাড়াবো। তোমরা মন দিয়ে কাজকর্ম আরম্ভ করে দাও।’

বেশ উৎসাহ বোধ করেছিল কমলেশ। কিছুদিনের মধ্যে সে নিজেও ল্যাবরেটরিতে কাজের নেশায় মেতে উঠেছিল। পদোন্নতিও হয়েছিল দ্রুত । সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার থেকে রিসার্চ ম্যানেজার ।

তারপর দিগম্বর বনার্জি একদিন কমলেশকে ডেকে বললেন, “তোমাকে এবার অন্য জায়গায় সরাবো ভাবছি। নিষ্কাম গবেষণার বড়লোকী এই গরিব দেশের মানুষেরা সহ্য করতে পারবে কেন? দেশের পক্ষে এখন যা দরকার তা হলো বিজ্ঞানের বিদ্যেগুলো চটপট কলকারখানায় উৎপাদনের কাজে লাগানো । তাই প্রসেস ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের ওপর আমি এখন জোর দিতে চাই–যাতে কম খরচে আমরা নতুন-নতুন কারখানা বসাতে পারি। হরিপুরে যে সার কারখানা হচ্ছে তার জন্যে বিদেশি নকশা কিনলাম । মহারাষ্ট্রে আমাদের কোম্পানি যে সার কারখানা করলো সেখানেও পরনির্ভর হয়ে থাকতে হলো । অনেকগুলো টাকা বাইরের দেশকে দিতে হচ্ছে। অথচ আমাদের অত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। ম্যানেজিং ডিরেক্টর তো জানুয়ারি মাসে আমাকে আমেরিকা নিয়ে গেলেন । সামান্য কিছু ধার পাবার জন্যে থার্ড ক্লাস লোকদের কাছে ওঁকে যেভাবে মাথা নিচু করে থাকতে হলো, তা দেখে আমার বিরক্তি ধরে যাচ্ছিলো।”

“ওরা বুঝি অপমান করে?” কমলেশ প্রশ্ন করেছিল ।

“যে-দেশ জিনিস কিনতে চায় অথচ নগদ টাকা দিতে পারে না, তাকে পৃথিবী কেন খাতির করবে কমলেশ? আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার সময় ওরা নিশ্চয় মনে-মনে হাসে। ধার দিচ্ছে তার জন্যে সুদও নেবে–অথচ খবরের কাগজে লিখবে ‘এড’ অর্থাৎ সাহায্য দিচ্ছে। তা ছাড়া, ধার করলেই ডবল খরচ হয়। দশ বছরের পুরানো পদ্ধতি তোমার ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করবে। একশ’ টাকার জিনিসের জন্যে দেড়শ’ টাকা দাম চাইবে। তোমাকে দিতেও হবে। আগেকার দিনে বলতো, ভিখিরিদের কোনো পছন্দ অপছন্দ নেই। এখন বিদেশ ভ্রমণ করে বুঝলাম, ধারের চালও কাঁড়া আর আকঁড়া।”

দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এবার নিজেদের জানা পদ্ধতিতেই এক-আধটা কেমিক্যাল সার কারখানা চালু করতে হবে। আমরা সাড়ে তিনশ’ লোক গবেষণার নামে করে ঠাণ্ডা ঘরে বসে-বসে মাইনে নেবো, আর আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিদেশে গিয়ে বলবেন, ওগো, তোমরা এসো আমাদের কারখানাগুলো বসিয়ে দিয়ে যাও, এ আমার ভালো লাগছে না।”

কমলেশ রায়চোধুরী সেই থেকে প্রসেস ডিজাইন বিভাগে বদলি হয়েছিল । সুতপাদি রসিকতা করে বলতেন, “কী ব্যাপার কমলেশ? নন্দ ঘোষের নন্দগোপাল বলতে এখন নাকি তোমাকেই বোঝাচ্ছে?”

“মানে?” কমলেশ সহাস্যে প্রশ্ন করেছে।

“মানে দিগম্বর বনার্জির প্রধান চেলা নাকি তুমি? কমলেশ বলতে ভদ্রলোক একবারে ইগনরেন্ট অর্থাৎ অজ্ঞান!”

কমলেশ বলেছিল, “উঃ! সুতপাদি, অন্য কোনো বিষয় তুলুন। ছাত্রাবস্থায় শুনেছিলাম, কারখানা কলোনিতে যারা থাকে তারা পৃথিবীর কোনো খবর রাখে না, দিনরাত অফিসের কর্তাদের সম্পর্কে আলোচনা করে।’

শুভাশিসদা বলেছিলেন, “অফিসে, ল্যাবে, বাথরুমে, বাসায়, মাঠে, বাজারে, ড্রইংরুমে এমনকি বিছানায় পর্যন্ত এই অফিস সম্পর্কে আলোচনা ।”

“অন্য কোনো প্রসঙ্গ তুলুন তাহলে,” কমলেশ বলেছিল ।

শুভাশিসদা বললেন, “আমার জানাশোনা এক পদার্থবিদ্ বন্ধু চুম্বন সম্পর্কে রিসার্চ করছে। সে বলছে, চুম্বন জিনিসটা সোজা ব্যাপার নয়–এর ওজন পঞ্চাশ গ্রাম থেকে রারোশ’ গ্রাম হতে পারে।”

আইবুড়ো ছেলের সঙ্গে চুম্বন সম্পর্কে আলোচনার জন্যে সুতপাদি স্বামীকে প্রচণ্ড বকুনি লাগালেন। ফলে, কথাবার্তা ঘুরে-ফিরে আবার রিসার্চ ল্যাবে ফিরে এলো। শুভাশিসদা বললেন, “দিগম্বর বনার্জি এখন দুজনের ওপর সন্তুষ্ট । নগেন বসু এবং কমলেশ রায়চৌধুরী। এদের মধ্যে কে ডান হাত এবং কে বাঁ হাত অবশ্য জানি না।”

দিগম্বর বনার্জির বাংলোয় যাবার পথে টুকরো-টুকরো এইসব পুরানো কথা কমলেশের মনে পড়তে লাগলো। বনার্জি সায়েবের সঙ্গে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক আছে বলেই তো কমলেশ টেলিগ্রামটা অবজ্ঞা করতে পারলো না ।

.

অনেকখানি জমির মধ্যে ছোট একটা বাংলো। গেট খুলে লাল কাঁকর বেছানো রাস্তা ধরে একটু এগোতেই দিগম্বর বনার্জিকে দেখতে পেলো কমলেশ। লনের মধ্যে একটা বেতের ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে ভদ্রলোক বসে রয়েছেন। সামনে একটা টেবিল। দূর থেকে সামান্য একটু আলো ভেসে আসছে।

এই অন্ধকারে দিগম্বর বনার্জি যে অনেকক্ষণ একা-একা বসে থাকেন এ-খবর চন্দনপুরের অনেকেই জানে। কর্মব্যস্ত জীবনের বাইরে ভদ্রলোকের যতটুকু সময় থাকে তা আঁধারের রূপ দেখতে-দেখতে কেটে যায়। বনার্জির ব্যক্তিগত জীবনটাও রহস্যাবৃত। কেউ বলে চিরকুমার। কেউ বলে মোটেই নয়, কোনো এক পাঞ্জাবি মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন । পরে সংসারযাত্রা অসহ্য হওয়ায় ভদ্রমহিলা বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন । দিগম্বর বনার্জির মা আগে এখানেই থাকতেন । তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি রবিবার ভোরবেলায় দুজনে বেরিয়ে পড়তেন গির্জায় প্রার্থনা করতে । চার্চ এখান থেকে প্রায় মাইল পনেরো দূরে। মায়ের মৃত্যুর পর দিগম্বর বনার্জিকে চার্চে যেতেও দেখা যায় না। যতক্ষণ পারেন ল্যাবরেটরিতেই কাটিয়ে দেন, তারপর ফিরে এসে অন্ধকার লনে আরাম কেদারায় একলা বসে থাকেন । বাঙালিদের জীবনযাত্রার বিস্তারিত খবরাখবর দিগম্বর বনার্জির জানা নেই। তিনপুরুষ পাঞ্জাবে কেটেছে। দিল্লিতে পড়াশোনা করেছিলেন। কিছুকাল আর্মিতে ছিলেন। পরে হঠাৎ বিদেশে বেপাত্তা হয়েছিলেন। তারপর অজ্ঞাত কারণে আবার স্বদেশে ফিরে এসেছেন ।

কমলেশকে দেখেই উৎফুল্ল দিগম্বর বনার্জি বললেন, “এসো । শুনলাম ট্রেন দেরি করেছে?”

“হ্যাঁ, স্যার,” কমলেশ নিষ্প্রাণভাবে কিন্তু পোশাকি-ভদ্রতার সঙ্গে উত্তর দিলো । সে একটু দূরত্ব রাখতে চায়। ডিরেক্টরকে বুঝিয়ে দিতে চায়, আপনার সামনে যে বসে রয়েছে, তাকে আপনি বিনা নোটিশে ফুলশয্যা থেকে তুলে এনেছেন।

নোয়েল দিগম্বর বনার্জি ওদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। বললেন, “ভালোভাবে সব কাজ হয়েছে তো? হাউ ডিড ইট গো?”

‘তেমন কিছু গোলমাল হয়নি,” কমলেশ কোনোরকমে ভদ্রতা রক্ষা করলো ।

তোমাদের দুজনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। তোমাদের জন্যে একটা উপহারও কিনে রেখেছি।” দিগম্বর বনার্জির কথায় খুব খুশি হতে পারলো না কমলেশ ।

“কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুধু-শুধু হাঙ্গামা করতে গেলেন কেন?” কমলেশ ঠাণ্ডাভাবে বললো ।

“তোমাদের বউভাতে অ্যাটেন্ড করবো বলে ট্রেনের টিকিটও কিনে রেখেছিলাম, কিন্তু—”

কমলেশ এবার দিগম্বর বনার্জির মুখের দিকে তাকালো ।

বনার্জি বললেন, “সমস্ত ব্যাপারটা তোমাকে জানতেই হবে, কমলেশ। স্টেশনে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় কৃষিনগর পাইলট প্রোজেক্ট থেকে খবর এলো নগেন বসুর একটা ছোটখাট হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। অসুখটা খুবই সামান্য, এ-খবরও কৃষিনগর হাসপাতালের ডাক্তার সেনের কাছে পেলাম ।”

একটু থামলেন দিগম্বর বনার্জি। তারপর শান্তভাবে বললেন, “তুমি জানো নগেনের ওপর আমি কতখানি নির্ভর করেছিলাম। কৃষিনগরে আমরা যে ছোট্ট পাইলট কারখানা করছি তার ওপরেই আমাদের রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের মান-সম্মান নির্ভর করছে।”

একটু থেমে বনার্জি আরও চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশ করলেন। বললেন, “সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার, নগেন বসু কিছুদিন থেকেই বিব্রত আছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ওর পিছনে লেগে রয়েছে। আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত, কিন্তু সিবিআইয়ের অফিসার বলে গেলো, ওদের কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে নগেন নাকি গতবারে যখন ইউরোপ গিয়েছিল তখন বিদেশি কোন এক কোম্পনির কাছে ঘুষ নিয়েছে। সিবিআই ওকে কৃষিনগর থেকে সরিয়ে নেবার কথা বলেছে। আমি দ্বিধা করছিলাম, ঠিক সেই সময় ওর অসুখের খবর এলো ।”

দিগম্বর বললেন, “বাধ্য হয়ে তোমার কথাই আমাকে ভাবতে হলো, কমলেশ ৷ আই অ্যাম স্যরি, তোমার হনিমুন নষ্ট করালাম। কিন্তু কৃষিনগর প্রোজেক্টের পুরো ভার আমি আর কাকে দিতে পারি বলো । নগেনকে আজই কৃষিনগর থেকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। প্রোজেক্ট ম্যানেজার পদে তোমার পোস্টিং অর্ডার আমি সই করে রেখেছি। কাল সকালেই রওনা হয়ে যাও।”

দিগম্বর বনার্জি এবার উঠে দাঁড়ালেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, “নগেন আমার আশাভঙ্গ করেছে। তুমি আমার মুখ রক্ষা করো।” দিগম্বর বনার্জি এবার তাঁর প্রিয় সহকারী কমলেশ রায়চৌধুরীর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললেন, “আই উইশ ইউ অল দি লাক মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড।”

খুব ভোরবেলাতেই কমলেশের জিপ চলতে শুরু করেছিল। চন্দনপুর থেকে কৃষিনগর একশ’ মাইলের পথ। দিগম্বর বনার্জি অনেক দেখেশুনে এই জায়গা নির্বাচন করেছিলেন তাঁর পরীক্ষামূলক কারখানার জন্যে । আগের নাম ছিল দরিয়াপুর। দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “বলা যায় না, এই নতুন জায়গা একদিন সারশিল্পের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে । তাই অনেক ভেবেচিন্তে নতুন নাম দিয়েছি কৃষিনগর ।”

কৃষিনগর এখন সত্যিই একটা ছোট শহর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বছরখানেক আগে দিগম্বর বনার্জির সঙ্গে কমলেশ প্রথম এখানে এসেছিল । দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “চন্দনপুরের পাশে যে জমি পড়ে রয়েছে সেখানেই আমাদের এই নতুন পরীক্ষা চালানো যেতো । কিন্তু আমার ছেলেদের আমি চন্দনপুর কারখানার পরনির্ভরশীল বাবুদের থেকে একটু দূরে রাখতে চাই। চন্দনপুর কারখানায় সাদাচামড়া সায়েবদের এখনও বড় সুনাম। এইচএসির রিসার্চ ডিপার্টমেন্টের ওপর ওরা নির্ভর করতে পারে না। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে ওরা পরের লাঠি ধরতে ভালোবাসে!

স্পিডোমিটারের কাঁটা ত্রিশ পেরিয়ে চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই করছে। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া কমলেশের দেহে মধুর ঝাঁপটা দিচ্ছে। এমন অবস্থায় কলকাতায় ফেলে আসা সেই মিষ্টি মেয়েটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। চন্দ্রমল্লিকা বেচারা সারারাত নিশ্চয় ছটফট করেছে। এতোক্ষণে বিছানা থেকে উঠে সে নিশ্চয় আবার স্বামীর কথা ভাবতে আরম্ভ করেছে। আজ সকালেই তার বাপের বাড়ি ফিরে যাবার কথা । কৃষিনগর পৌঁছেই একটা খবর করতে হবে।

গত রাত্রেই কমলেশ চটপট গিন্নিকে একটা চিঠি লিখে ফেলেছে। তাতে বলেছে, “মাই ডিয়ার বউ, স্ত্রীভাগ্যে স্বামীদের উন্নতি যারা বিশ্বাস করে না, তারা যেন তোমার কথা মনে রাখে। বিয়ের রাত্রি থেকেই প্রমোশন। দিগম্বর বনার্জি আমাকে নতুন চাকরি দিয়ে কৃষিনগরে পাঠাচ্ছেন। নতুন পদের সঙ্গে যেমন বাড়তি সম্মান আছে, তেমনি বাড়তি দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলো । এ-সম্বন্ধে সাক্ষাতে বলবো । প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ বেশ মূল্যবান । কারণ তারপরেই বনার্জি সায়েব কিছুদিনের জন্যে বিলেত যাচ্ছেন । উনি চন্দনপুরে থাকতে থাকতে কৃষিনগরের সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিতে হবে।”

দূর থেকে কৃষিনগরের বিস্তৃত এলাকা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপর মস্ত বড় একটা সাইনবোর্ডে নোটিশ লেখা আছে: সংরক্ষিত এলাকা । ভারতরক্ষা আইনের কোনো-এক ধারা অনুযায়ী বিনা অনুমতিতে এই এলাকায় প্রবেশ নিষেধ ।

নতুন ম্যানেজারের আগমন সংবাদ গতকালই কৃষিনগরে ছড়িয়ে পড়েছে। এইচএসি এলাকায় প্রবেশমাত্র অন্যদিক থেকে আরেকটা জিপ আসতে দেখা গেলো । গাড়ি থামিয়ে জিপ থেকে নেমে পড়ে নতুন ম্যানেজারকে এক ভদ্রলোক লম্বা স্যালুট ঠুকলেন । বললেন, “আমি হরগোবিন্দ দাস, সিকিউরিটি অফিসার।”

আর একজন নেপালি দারোয়ান এসে কমলেশের গলায় মালা পরিয়ে দিলো ।

দাস বললেন, “পিছনের গাড়িতে আপনার সেক্রেটারি মিস সুজাতা দাস এবং আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার সুদর্শন সেন আছেন।”

টাকমাথা গোলগাল চেহারা মিস্টার সেনের। দেখলেই বোঝা যায় অনেকদিনের অভিজ্ঞ অফিসার। জিপ থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। বললেন, “ওয়েলকাম টু কৃষিনগর। আমাদের সমস্ত অফিসার আপনাকে স্বাগত জানাবার জন্যে প্রজেক্ট অফিসে অপেক্ষা করছেন।

সুদর্শনবাবুর পিছন পিছন সুজাতা দাসও সলজ্জভাবে এগিয়ে এলো । দুটি হাত তুলে সে আলতোভাবে কমলেশকে নমস্কার করলো । শ্যামবর্ণা তন্বী সুজাতার বড়-বড় চোখদুটো দেখে কমলেশের অকস্মাৎ কাব্যলোকের সেই মহিলাটির কথা মনে পড়ে গেলো, কবি জীবনানন্দ দাশ যাঁর নাম দিয়েছিলেন বনলতা সেন। সুদর্শনবাবু বললেন, “আপনার সেক্রেটারির আসবার খুব ইচ্ছে অথচ লজ্জা পাচ্ছিল। আমি জোর করে ধরে নিয়ে এলাম ।”

প্রতি-নমস্কার জানিয়ে কমলেশ বললো, “এই ভোরবেলায় কষ্ট করে আপনারা এসেছেন, তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

সুজাতা দাস যে কমলেশকে দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েছে, তা সুদর্শন ও কমলেশ দুজনেই লক্ষ্য করলো । সুজাতাও কারণটা বলতে সাহস করলো না। কারণটা সুজাতার ব্যাগে পড়ে রয়েছে । কয়েকদিন আগে, কলকাতা থেকে ডাকে ‘শুভবিবাহ’ মার্কা একটা চিঠি এসেছে। বান্ধবী রজনীগন্ধার বোন চন্দ্রমল্লিকার বিয়ে জনৈক কমলেশ রায়চৌধুরীর সঙ্গে।

কমলেশকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে সুজাতার সাহস হলো না। হাজার হোক বড় অফিসার, আর সুজাতা সামান্য একজন শর্টহ্যান্ড টাইপিস্ট । যতদূর মনে পড়ছে, একদিন আগে মল্লিকার ফুলশয্যার দিন। কিন্তু তাহলে, ভদ্রলোক এখানে হাজির হলেন কী করে? তাহলে অন্য কোনো কমলেশের সঙ্গে মল্লিকার বিয়ে হয়েছে । সুজাতা ভুল করেছে । ব্যাগ থেকে চিঠি বার করে তারিখটা মিলিয়ে দেখলে হতো। কিন্তু সুজাতা ভরসা পেলো না । বন্ধুর ছোট বোনের স্বামী হিসেবে যতই রসিকতার সম্পর্ক হোক, অফিসাররা কর্মক্ষেত্রে ওসব তোয়াক্কা করে না। শুধু-শুধু অপমান ডেকে আনতে চায় না সুজাতা দাস ৷

আর একপ্রস্থ ধন্যবাদ জানিয়ে, কমলেশ সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করলো। তারপর নিজের জিপে এসে বসলো ।

ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে কমলেশ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো । গাড়িটা একটু উঁচু জায়গায় উঠেছে। ছোট্ট একটা টিলার ফাঁক দিয়ে কৃষিনগর কারখানা এবার দেখা গেলো । খোলা আকাশের নিচে কোনো এক ময়দানব ইস্পাতের খেলাঘর সাজিয়ে বসেছে। বিচিত্র বর্ণ এবং আকারের ধাতুস্তম্ভ সে নিজের খেয়ালখুশি মতো সাজিয়ে যাচ্ছে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানা গোপন রহস্য এবং সার কারখানার এতো খুঁটিনাটি জেনেও কমলেশের মনে হলো, খোলা আকাশের নিচে কোনো দুর্বোধ্য অথচ প্রখ্যাত আধুনিক শিল্পীর প্রদর্শনী দেখছে সে। গোল, লম্বা, বেঁটে, সরু, মোটা নানা আকারের ইস্পাত স্তম্ভের মধ্যে কোথায় যেন আপাতত উদাসীন সৃষ্টিকর্তার সযত্নলালিত ছন্দবোধ ফুটে উঠেছে।

প্রোজেক্ট অফিসে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে কমলেশ ছুটেছিল নগেন বসুর স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কিন্তু তাঁরা ইতিমধ্যে বাংলো ছেড়ে দিয়েছেন। মিসেস নবনীতা বসু অসুস্থ স্বামীর সঙ্গে কলকাতা রওনা হয়েছেন, বাড়ির অন্য সবাই মালপত্তর নিয়ে চন্দনপুরে গিয়েছে। চন্দনপুরের কোয়ার্টার ওঁরা ছাড়েননি, নগেন বসু সাময়িকভাবে এখানে চলে এসেছিলেন ।

সমস্ত দিন ঘুরে-ঘুরে কমলেশ প্রোজেক্টের কাজ দেখেছে । এমন কিছু বড় নয়, ছোট একটা পরীক্ষামূলক কারখানা তৈরি হচ্ছে বলে বলা যায়। কিন্তু তাতেই কয়েক কোটি টাকার প্রয়োজন । কম পয়সায় পৃথিবীতে আজকাল কোনো কাজ হয় না । কমলেশ ভাবলো এই জন্যেই পৃথিবীতে যেসব দেশের টাকা আছে কেবল তারা এগিয়ে যাচ্ছে। যাদের সঙ্গতি নেই তারা খরচের এই প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না ।

কৃষিনগর পাইলট প্রোজেক্টের কাজ বুঝতে কমলেশের বেশি সময় লাগবে না। কারণ এই কারখানার নকশা দিগম্বর বনার্জি যখন নিজের হাতে করেছিলেন, তখন কমলেশ সর্বদা তাঁর পাশে-পাশে ছিল। প্রসেস ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি কর্মচারী তখন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেছে। তারাও কীরকম উৎসাহ পেয়ে গিয়েছিল ।

দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “সিনথেটিক অ্যামোনিয়া এবং ইউরিয়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা যা করতে চাইছি তা যদি সফল হয়, তাহলে ফার্টিলাইজার জগতে একটা ছোটখাট বিস্ফোরণ ঘটবে। পেটেন্টের পাঁচিল তুলে ছ’টা-সাতটা কোম্পানি পৃথিবীতে এমন অবস্থা করে রেখেছে দুনিয়ার বুভুক্ষু সব লোকদের তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। এইসব কোম্পানির হাতে রয়ালটির টাকা না দিয়ে, চড়া দামে তাদরে যন্ত্রপাতি না কিনে কেউ রাসায়নিক সার তৈরি করার কথা ভাবতেই পারে না । ইন্ডিয়ার নিজস্ব বিদ্যা আয়ত্তে এলে, অন্তত একটা প্রধান বিষয়ে আত্মনির্ভর হবো । তেমন ভাগ্য হলো ওদের কাছেও আমাদের বিদ্যে বিক্রি করা যাবে।”

কমলেশের তৈরি ডিজাইন সংক্রান্ত সব কাগজপত্তর নিয়ে দিগম্বর বনার্জি হেডঅফিসে গিয়েছিলেন। যাবার আগে বলেছিলেন, “আমার মুশকিল, আমার ওপর হিন্দুস্থান অ্যাগ্রো কেমিক্যালসের অগাধ বিশ্বাস। আমি যা চাই, তাতেই হাঁ বলে ফেলেন ওঁরা।” এবারেও ওঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ইউরিয়া তৈরির যে নকশা হয়েছে, দিগম্বর বনার্জি তা ছোটখাট একটা পাইলট কারখানায় পরীক্ষা করিয়ে নিন । কারণ, যদি আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি কার্যকর হয়, তাহলে পরবর্তী যোজনায় সমস্ত নতুন কারখানাগুলিকে এই ছকে ফেলা যাবে। আর যদি দেখা যায় এই পদ্ধতি নির্ভুল নয়, তাহলে এখন থেকেই আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারে খোঁজখবর করে দেখতে হবে কোন কোম্পানির কাছ থেকে কী নেওয়া যায় ।

মাত্র দু-সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন হেডঅফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর । তারপর টেলেক্সে বনার্জিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এগিয়ে যান। খরচের যে আন্দাজ দিয়েছিলেন দিগম্বর বনার্জি, তাও বিনা আপত্তিতে তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন।

সেই থেকেই কৃষিনগর প্রকল্পের উৎপত্তি। বাইরে ব্যাপারটা বিশেষ প্রচার করা হয়নি ৷ শুধু বলা হয়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদ্ধতির গুণাগুণ যাচাই করবার জন্যে এই ছোট্ট পাইলট প্রোজেক্টের জন্ম । তাছাড়া নতুন যৌগিক সার, যার নাম নেওয়া হয়েছে ‘উর্বরা’, সে-সম্পর্কে এখানে গবেষণা করা হবে। তবে পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যে কিছু-কিছু উৎপাদনও হবে, তার ফলে ঘরের পয়সা দিয়ে কৃষিনগর প্রকল্পকে পুষতে হবে না–মাছের তেলেই মাছ ভাজা যাবে।

দিগম্বর বনার্জি দিল্লির অনুমতি পেয়েই নগেন বসুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রিয় শিষ্য নগেন বসু তখন সবে ইউরোপের পাঁচটা দেশ ঘুরে ফিরেছেন। ওঁরা গিয়েছিলেন বড় বড় কোম্পনির সঙ্গে দেখা করতে, খোঁজখবর করে জানতে কার সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের গাঁটছড়া বাঁধলে পরের কারখানাগুলো একটু কম খরচে ভারতের বিভিন্ন অংশে বসানো যাবে। প্রচণ্ড উৎসাহে টগবগ করতে-করতে নগেন বসুকে দিগম্বর বনার্জি বলেছিলেন, “আমরা মস্ত সুযোগ পেয়ে গিয়েছি, নগেন । এবার তুমি হাতেকলমে দেখিয়ে দাও এইচএসির গবেষণা ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা দেশের জন্যে কী করতে পারে ।”

নগেন বসু নিজের হাতে কৃষিনগরের গোড়াপত্তন করেছিলেন । প্রথমে কয়েকটা দৈত্যাকৃতি বুলডোজার এলো । বেপরোয়া মেজাজে কৃষিনগরের এবড়ো-খেবড়ো জমিকে কয়েক সপ্তাহে তারা সমান করে ফেললো। ছোটখাট একটা পাহাড়কে পর্যন্ত ঠিকাদারের লোকেরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিলো । তারপর এলো নানা ধরনের মানুষ; কেউ এইচএসির কর্মী, কেউ দিনমজুর, কেউ ঠিকাদারের প্রতিনিধি। ছোট-ছোট বাড়ি তৈরি হয়েছে অনেকগুলো । ক্যাম্পও পড়েছে বেশ কয়েকটা। সবার চোখের সামনে কারখানা ক্রমশঃ মাটি থেকে আকাশের দিকে উঠতে আরম্ভ করেছে। আশেপাশে অনেকগুলো বাড়িও তৈরি হয়েছে। তার কোনোটায় অফিস, কোনোটায় টেস্টিং ল্যাবরেটরি। একটা বিরাট গুদাম তৈরি হয়েছে–কারখানা চালু হলে ওইখানে সার থাকবে। এখন সিমেন্ট, লোহা এবং প্রোজেক্টের জন্য জিনিসপত্র বোঝাই করে রাখা হচ্ছে।

দূরে একেবারে নদীর ধারে উঠেছে প্রোজেক্ট হাসপাতাল । সেখানে সাধারণ চিকিৎসা ছাড়াও অপারেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে–কারখানা তৈরির সময় কর্মীদের আহত হবার আশঙ্কা বেশি ।

রেললাইন পাতার কাজও বেশ এগিয়েছে । অনেক মাল ইতিমধ্যেই ওয়াগনে আসতে শুরু করেছে। ওসব আগে পাঁচ মাইল দূরে রেল স্টেশন পর্যন্ত আসততা — তারপর ট্রাকে চড়িয়ে মাঠে আনতে হতো। এবার সোজা রেলেই কারখানার ভিতর পর্যন্ত চলে আসবে ।

এসব তো কারখানার বাহ্যিক দিক। প্রসেস ডিজাইন সম্পর্কে কমলেশ দু-একদিনের মধ্যেই ডিরেক্টরকে একটা রিপোর্ট পাঠাতে চায়। সে-সম্পর্কে খবরাখবর যোগাড় করবার জন্যে কমলেশ প্রোজেক্ট অফিসারদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করলো । সুজাতা মেয়েটি বেশ কাজের। চটপট কমলেশের কয়েকটা চিঠি টাইপ করে দিলো। চা খাবে কিনা খোঁজ করলো ।

.

কর্মক্লান্ত দিনের শেষ কোয়ার্টারে ফিরে এসেছে কমলেশ। এখানে একজন চাকর আছে। একটা খাট আছে। আর একটা টেলিফোন ।

শাওয়ারে স্নান সেরে বাথরুম থেকে এসে বউকে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবছিল কমলেশ ৷ এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে সুতপাদির গলা ভেসে এলো কলকাতা থেকে। “হ্যালো কমলেশ, বেশ ছেলে যা হোক । বউ ফেলে পালালে । একটা খবর পর্যন্ত নেই।

“একটা চিঠি তো সকালেই পোস্ট করেছি,” কমলেশ জানালো ।

সুতপাদি বকুনি দিলেন, “এসব কি চিঠির কাজ– টেলিগ্রাম করা উচিত ছিল, যদিও বউকে টেলিগ্রামে প্রেম জানানো চলে না।”

“এখানে যে এসেছি খবর পেলেন কি করে?” কমলেশ একটু আশ্চর্য হলো ।

“তোমার বউয়ের শুকনো মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্যে প্রথমে চন্দনপুরে ফোন করলাম । ওখান থেকেই সুখবরটা পেলাম । তারপর তোমার গিন্নির আর তর সইলো না, বাধ্য হয়ে ফোন করলাম। নাও, এখন গিন্নির সঙ্গে কথা বলো। আমরা এখান থেকে এমন জায়গায় সরে যাচ্ছি যেখান থেকে তোমার বউয়ের কথাবার্তা শোনা যাবে না ।

ওপাশ থেকে চন্দ্রমল্লিকার গলা ভেসে এলো। “এই, সুতপা মাসির কথা বিশ্বাস কোরো না। ট্রেনে তোমার কষ্ট হয়নি তো?”

“কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সে কষ্ট কাকে বোঝাবো?” কমলেশ খুব মিষ্টি করে বললো ।

“তুমি সাবধানে থেকো, বুঝলে?” চন্দ্রমল্লিকা এই ক’ঘণ্টার মধ্যেই স্বামীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে চিন্তা শুরু করে দিয়েছে।

“তুমিও খুশিতে থেকো । আমার জন্যে ভেবে শরীর নষ্ট কোরো না ।” কমলেশ অনুরোধ করলো।

“রাখি। কেমন?” চন্দ্রমল্লিকার কথায় কমলেশ টেলিফোন রাখতে যাচ্ছিল কিন্তু সুতপাদি আবার ফোন ধরলেন। “শোনো শ্রীমান, যে ক’দিন বনবাসে থাকবে বউকে রোজ ফোন করবে।

“ওরে সর্বনাশ, রোজ ট্রাঙ্ককল করার মানে বুঝতে পারছেন? সরকারি চাকরি করে অত টাকা কোথায় পাবো?” কমলেশ জানতে চাইলো ।

“অতশত বুঝি না ৷ আমাদের মেয়ের সুখদুঃখ বলে কোনো জিনিস নেই বুঝি? হয় ফোন করবে, না-হয় বউকে কাছে নিয়ে যাবে।” এই বলে সুতপাদি ফোন নামিয়ে দিয়েছিলেন । একটু পরে ফোনটা আবার বেজে উঠেছিল। প্রোজেক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার সুদর্শন সেন ফোন করছেন। “মিস্টার রায়চৌধুরী, গৃহিণীর খুব ইচ্ছে, আজ আমাদের এখানে আপনি দুটো অনুগ্রহণ করুন! যদি আপত্তি না থাকে একটু পরেই আপনাকে নিয়ে আসবো।”

অমত করেনি কমলেশ । ভদ্রলোক একটু পরেই এলেন। বেশ হাসিখুশি মানুষ এই সুদর্শন সেন। বললেন, “যদিও আপনি মস্ত বড় অফিসার, কিন্তু বয়সে আমার ছেলের মতো । কোনো ব্যাপারে প্রয়োজন হলে দ্বিধা করবেন না।”

সুদর্শন-গৃহিণী বেশ মিশুকে। আদর করে কমলেশকে বসতে দিলেন।

সুদর্শন সেন বললেন, “ডাস্টেড হ্যান্ডলেগ বলতে যা বোঝায় আমরা তাই! একেবারে ঝাড়া হাত-পা! দুই মেয়ে–দুজনেই বিবাহিতা, দুজনেরই প্রথম সন্তান হয়ে গিয়েছে। সুতরাং গ্যারান্টি পিরিয়ডের দায়িত্ব শেষ। পুত্রের লেখাপড়া কমপ্লিট, চাকরিতে ঢুকেছে। বিবাহ দিয়ে রাউরকেল্লায় কোয়ার্টারস্থ করেছি। এখন কোনোরকমে হাতের নোয়া এবং সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় রেখে এইচএসি থেকে রিটায়ারের চিঠিটা আদায় করতে পারলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।”

সুদর্শন-গৃহিণী স্বামীকে বকুনি লাগালেন, “তোমার কথা ছাড়ো–যেদিন থেকে বিয়ে হয়েছে, সেদিন থেকেই শুনছি তোমার চাকরি গেলো, চাকরি গেলো ।”

নিরুৎসাহ না হয়ে সুদর্শনবাবু এবার কমলেশকে বললেন, “কী আর বলবো স্যার । তবিলদারির চাকরি থেকে বিপজ্জনক কাজ পৃথিবীতে নেই–এর থেকে মিলিটারি সার্ভিস পর্যন্ত নিরাপদ । ওখানে প্রাণে মারা যেতে পারেন, কিন্তু কেউ ধনে হাত দেবে না । কিন্তু আমাদের এই কাজে শ্রমিকরা যে-কোনোদিন জান দিতে পারে, আর কোম্পনি সুযোগ পেলেই প্রভিডেন্ট ফান্ডের জামানত জব্দ করবেন।”

সুদর্শন সেনের কথা শুনে কমলেশ হেসে ফেললো । সে বললো, “আমরা তো শুনেছি, স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রথমে ছিল ভকিলরাজ, তারপর এসেছে গোমস্তারাজ। এখন বড়-বড় কোম্পানির বড়কর্তা হচ্ছেন অ্যাকাউন্টেন্টরা। যাঁরা জিনিস আবিষ্কার করেন, তৈরি করেন, বিক্রি করেন, মেরামত করেন, তাঁদের মাথায় উঠতে দেওয়া হচ্ছে না, সব ক্ষমতা হিসাবরক্ষকের।”

সুদর্শন সেন বললেন, “ওসব আপনারা রসিকতা করে বলেন । অনেক পাপ করলে লোক আমাদের লাইনে আসে। যেমনি শুনি নতুন কোনো কারখানা হচ্ছে, অমনি আমি গিন্নিকে বলি, তোমার স্বামীর মতো আর এক অভাগা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের ঘুম বন্ধ হলো! নতুন প্রোজেক্ট মানে দেশের উন্নতি নয়–চোর-জোচ্চোরদের পৌষমাস, আর গোমস্তার সর্বনাশ । কন্ট্রাক্টর ঠকাবার চেষ্টা করবে, সাপ্লায়ার খারাপ মাল দেবে, কর্মচারীরা মিথ্যে টিএ বিল করবে, ভাঁড়ার থেকে চুরি হবে, হিসেব মিলবে না–এই হলো প্রোজেক্ট । আপনারা আমাকে পাগল ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার আর ছ’মাস চাকরি আছে,– রিটায়ারের বিল্বিপত্তর হাতে পেলুম বলে, রেখে-ঢেকে কথা বলার প্রয়োজন নেই ।”

কমলেশ বললো, “আপনি বেশ মজা করতে পারেন, মিস্টার সেন ।“

সুদর্শন-গৃহিণী বললেন, “ওঁর কথাবার্তাই এইরকম। বাড়িতে, রাস্তায় আপিসে সব সময় উল্টো বকছেন।’

গম্ভীর মুখে সুদর্শন সেন বললেন, “স্বীকার করছি, উল্টোরথের দিন আমার জন্ম । সার কোম্পানিতে কাজ করে প্রাণ ধারণ করেছি; কিন্তু স্যার, সোজা কথা বলছি, ইন্ডিয়াতে আপনারা কেন জমিতে ফসল বাড়াবার বৃথা চেষ্টা করছেন?”

হেসে ফেললো কমলেশ । বললো, “বলছেন কি মিস্টার সেন? ভারতবর্ষে জমির পরিমাণ তো আর বাড়বে না, তাই ফসলের পরিমাণ বাড়িয়ে আমাদের দেশের লোকের মুখে অন্ন দিতে হবে।”

করুণভাবে সুদর্শন সেন জানিয়ে দিলেন, “পারবেন না স্যার! আপনি এবং আমাদের ডিরেক্টর দিগম্বর বনার্জি যতই চেষ্টা করুন, হেরে যাবেন। দেশে যে কি হারে বাচ্চা বেড়ে যাচ্ছে সে খবর তো আপনারা রাখছেন না। আমাদের স্যার গোড়ায় গণ্ডগোল। বাৰ্থ কন্ট্রোলের ব্যবস্থা হলো না, তার আগেই গভরমেন্ট ‘ডেথ্ কন্ট্রোল’ করে বসলেন। যারা আগে কলেরা, বসন্ত, পাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরে আট-দশ বছরের মধ্যে ফেঁসে যেতো তারা এখন সাবালক হচ্ছে, বে-থা করছে, ছেলেপুলের বাপ হচ্ছে। পঞ্চাশ-ষাট বছরের আগে ডজন দুয়েক নাতিনাতনীর মুখ না দেখে কেউ দুনিয়া থেকে নড়ছে না।”

“সেটা কি খারাপ মিস্টার সেন?” কমলেশ জিজ্ঞাসা করে ।

সুদর্শনবাবু জিভ কেটে বললেন, “মোটেই না । কিন্তু বাবা, একটু বুঝেসুঝে চলো! মা ষষ্ঠীকে অত মাথায় তুলো না উনি সন্তুষ্ট হয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাজ চালালে হাজার দশেক দিগম্বর বনার্জি এদেশের কিছু করতে পারবে না। তোমরা ব্যাটাচ্ছেলে অবুঝের মতো ছেলে পুলে আনবে, আর তার ঠেলা সামলাবার জন্য বুড়ো বয়সে সুদর্শন সেনকে এই বনজঙ্গলে ক্যাম্প খাঁটিয়ে সার কারখানার তদারকি করতে হবে, এ কেমন কথা? “

কমলেশ নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলো না। সুদর্শন সেন স্ত্রীর রক্তচক্ষু অবজ্ঞা করে বললেন, “বৈজ্ঞানিক হিসাবে আপনাদের যতই আত্মবিশ্বাস থাকুক, পারবেন না স্যার । এক জায়গায় পড়েছি, যীশুখ্রিস্ট যখন জন্মালেন তখন গোটা পৃথিবীতে ত্রিশ কোটি লোক ছিল। দেড় হাজার বছর পরে পেটের দায়ে কলম্বাস যখন ভারতবর্ষ আবিষ্কারে বেরুলেন তখন পৃথিবীর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ কোটি। তারপর মাত্র সাড়ে-চারশ’ বছরে সেই পঞ্চাশ কোটি হয়েছিল তিনশ’ কোটি। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে শুধুমাত্র ইন্ডিয়ার লোকই বেড়েছে প্রায় আট কোটি! ডিডিটি, পেনিসিলিন এবং সাবান এই তিনটে জিনিস চালু করে সরকার যে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করেছেন তা সামলাতে এখন শ’য়ে শ’য়ে সার কারখানা লাগবে ।

কমলেশ জিজ্ঞেস করলো, “যারা এখানে কাজ করে, তারা কি জানে কত বড় কাজে তারা সাহায্য করছে?”

হা-হা করে হেসে উঠলেন সুদর্শন সেন। “কিসসু জানে না। ওসব জানবার আগ্রহ নেই কারুর । সবাই এসেছে নিজের পেটের দায়ে, কিংবা টু-পাইস কামাবার ধান্দায় । আপনি এখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখবেন । যে-লোক মাটি কেটে রোজ পাচ্ছে তার কোনো আগ্রহ নেই জানবার, কেন মাটি কাটা হচ্ছে। সে শুধু চাল কেনবার টাকা চায় । পাঞ্জাবি যে-টিকাদার বাড়ি তৈরি করছে তার কোনো আগ্রহ নেই জানবার, সেই সব বাড়িতে কে থাকবেন এবং কেন থাকবে। সে শুধু জানতে চায় বিলের টাকাটা কবে পাবে এবং কবে আবার টেন্ডার ডাকা হবে। আমার অফিসের কেরানিরা জানতে চায়, মাগ্যি ভাতা কেন বাড়ছে না। আপনার মেশিনে সার তৈরি হলো কি হলো না সে-সম্পর্কে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই । সংসার বড় কঠিন জায়গা স্যার । আপনি এবং দিগম্বর বাঁডুজ্যে যা আশা করেছেন তা নাটক-নভেলের চরিত্র ছাড়া ভাততবর্ষের কোথাও পাবেন না । “

কমলেশ চুপ করে সুদর্শন সেনের কথা শুনছিল । সেন বললেন, “হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন কেন? কী ভাবছেন স্যার?”

“ভাবছি, দায়িত্ব পালন করতে পারবো কিনা? সব কাজকর্ম শেষ করে নির্ধারিত দিনে কারখানা চালু করতে পারবো কিনা?”

সুদর্শন সেন সান্ত্বনা দিলেন, “ভাববেন না স্যার। কপালে যা আছে তাই হবে। নির্ধারিত দিনে ইন্ডিয়াতে কোনো কিছু হয়েছে এ পর্যন্ত? আমাদের ডিপার্টমেন্টে এক ফড়ফড় কেরানিবাবু আছে । তাকে একদিন বকুনি লাগাতে মুখের ওপর বললো, মানুষ তো ছার, ভগবানও আজকাল নির্ধারিত দিনে কাজ করতে পারছেন না! নির্ধারিত দিনে পেটের ছেলে ভূমিষ্ট হচ্ছে না, নির্ধারিত দিনে বর্ষা নামছে না; নির্ধারিত দিনে গাছে ফুল ফুটছে না। সুতরাং নির্ধারিত দিনে অফিসে কাজ হবে কি করে?”

সুদর্শন সেনের কথায় চিন্তা বাড়লো কমলেশের। সে বললো, “আমাদের ডিরেক্টর নির্ধারিত দিন ছাড়া কিছুই বোঝেন না । তাঁকে আমি একরকম কথা দিয়ে এসেছি।”

সুদর্শনবাবুর ওখান থেকে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে এসে একজনের কথা কমলেশের আবার মনে পড়ে গেলো ৷ তাকেও কথা দেওয়া ছিল যত শীঘ্র সম্ভব দেখা হবে। সে এখন কলকাতায় বাপের বাড়িতে পুরানো বিছানায় নিঃসঙ্গ রাত্রির দুঃসহ বিরহ ভোগ করছে। কী আশ্চর্য বিধাতার নিয়ম। মাত্র একসপ্তাহ আগে যার সম্বন্ধে কোনো দায়িত্ব ছিল না, এখন সে-ই কমলেশের সমস্ত ভাবনা-চিন্তা গ্রাস করে বসে আছে। চন্দনপুরে ক্যাটালিস্ট ডিপার্টমেন্টের গোবিন্দবাবু বলতেন, “বৈজ্ঞানিকরা যতই ক্যাটালিস্ট আবিষ্কার করুন, জেনে রাখবেন বিবাহের মতো ক্যাটালিস্ট এখনও বেরোয়নি। দুটো মন্ত্র পড়া হলো, দুটো ওং ভোং হলো, আর জলজ্যান্ত অজানা-অচেনা, একজোড়া ছেলেমেয়ে কেমিক্যাল অ্যাকশনে এক হয়ে গেলো ।

এই ক্যাটালিস্টের কথা কমলেশ বেশ গুছিয়ে বউকে লিখেছিল। চন্দ্রমল্লিকা তার উত্তরে লিখলো, “সুতপা মাসি তোমার চিঠি পড়ে ফেলেছেন। বললেন, বরকে লিখবে বিজ্ঞানের কথা অত না ফেঁদে প্রেমের কথা লিখতে। প্রেম নাকি অত অনুঘটকের ধার ধারে না । তবে শোনো, এখানে আর এক মুহূর্ত আমার ভালো লাগছে না! দিন যেন কাটতে চায় না । বই পড়তে চেষ্টা করি কিন্তু শুধু বরের মুখ ভেসে ওঠে; গান শুনতে আরম্ভ করি শুধু বরের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। দিনে যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে রাত্রির কথা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারছো । লোকে, বলছে, আমি নাকি শুকিয়ে যাচ্ছি; আমার রঙ কালো হয়ে যাচ্ছে। কবে আসছো?”

যাবার ইচ্ছা হয় খুব । কৃষিনগর থেকে কলকাতা আর কত দূরে? ভালো ট্রেনও আছে কয়েক মাইল দূর থেকে । কিন্তু কৃষিনগর ছেড়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না । কাজ চলছে পুরোদমে । জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে গিয়েছে। কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে ওদের কাছ থেকে । সেগুলো তারা বসাবে। দুজন জার্মান ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওদের কাছ থেকেও ইউরিয়া প্ল্যান্টের দু-একটা মেশিন কেনা হয়েছে। এসব যন্ত্র এখনও এদেশের কোনো কারখানায় তৈরি হয় না। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজও চলছে পুরোদমে। এখন একদিনের জন্যেও কৃষিনগর ছেড়ে কলকাতায় যেতে হলে দিগম্বর বনার্জির অনুমতি প্রয়োজন হবে । অন্য কোনো ব্যাপার হলে ডক্টর বনার্জিকে ফোন করা যেতো, কিন্তু এখন ছুটি চাইলেই ভদ্রলোক অন্য কিছু ভেবে বসবেন । কলকাতায় যাওয়া প্রায় অসম্ভব ।

মাসখানেক পরে অধৈর্য বউ লিখেছে, “কলকাতায় তোমার কি কোনো কাজ পড়ে না? কত লোকের তো কলকাতায় মিটিং থাকে । আমার বন্ধু বকুল, তারও বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’মাস আগে। এতোদিন বরের কাছেই ছিল। সবে দু-সপ্তাহ বাপের বাড়ি এসেছে, এর মধ্যে স্বামী দু-বার কলকাতায় অফিসের কনফারেন্স করে গিয়েছে।’

বেচারা চন্দ্রমল্লিকা বিয়ের আগে অফিসের কোনো খোঁজখবরই রাখতো না। এখন বাধ্য হয়ে অনেক খবরাখবর নিচ্ছে।

কমলেশ নিজেও আজকাল চিঠিতে অফিসের খবরাখবর পাঠায়। দিগম্বর বনার্জির সংবাদ যেমন থাকে, তেমনি থাকে কৃষিনগরের অনেক নতুন ঘটনা । সুদর্শন সেনের কথা চন্দ্রমল্লিকার অজনা নেই। এতোদিনে সে অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টের সুপারভাইজার ঘনশ্যাম দাস, ভিজিলান্স অফিসার নরহরি পাত্র, মেডিক্যাল অফিসার ড. সেনকে চিনে গিয়েছে । নরহরিবাবু সম্পর্কে কমলেশ লিখেছিল, “কাজের সঙ্গে নামের এমন নিকট সম্পর্ক বড় একটা দেখা যায় না । নরকে হরণ করে চুড়ি-জোচ্চুরি বন্ধ করাই এঁর কাজ । তোমার বাবাকে চেনেন। কোনো এক সময় তোমার বাবার অধীনে কাজ করেছেন ।

পরের চিঠিতে কমলেশ লিখেছিল, “আমার সেক্রেটারির কথা তোমাকে জানানো হয়নি । সুজাতা দাস । ভদ্রমহিলা খুবই কাজের। বড়-বড় শহরে মহিলাসহকারিণীর এতো চাকরি থাকতে কেন এই পাণ্ডববর্জিত কৃষিনগরে হাজির হলেন জানি না।’

চন্দ্রমল্লিকার উত্তর এসে গিয়েছিল দ্রুত। “তোমার লেডি সেক্রেটারির খবর সুতপা মাসিকে বলায়, উনি যেসব ইঙ্গিত করলেন তাতে বেশ ভয় পেয়ে যাচ্ছি। তোমার চিঠি পেয়ে মনে হয়েছিল সেক্রেটারিরা চিঠিপত্তর টাইপ করে, সায়েবের কাগজপত্তর গুছোয়, কিন্তু এখন শুনছি, লেডি সেক্রেটারিকে কাছে পেলে অনেক সায়েব বেমালুম বউয়ের কথা ভুলে যায়। তার থেকেও চিন্তার কথা, তোমার একান্ত সচিব সম্পর্কে এতো কথা লিখেছো, কিন্তু ভদ্রমহিলা মিস না মিসেস তা জানাওনি।’

লেডি সেক্রেটারি সুজাতা দাস অফিসের কাগজপত্তর নিয়ে সায়েবের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সায়েব নীল রঙের খাম থেকে নীল রঙের চিঠি বার করে মন দিয়ে পড়ছেন। সুজাতা দেখলো, পড়তে-পড়তে সায়েবের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে; কখনও আপন মনে মুখ টিপে হাসছেন । সুজাতা বুঝতে পারে, সায়েব বিরহিণী বধূর সঙ্গে পত্রপ্রেমে ব্যস্ত রয়েছেন! খামের ওপর ভদ্রমহিলার হাতের লেখার সঙ্গে সুজাতা এখন বেশ পরিচিত, কারণ সপ্তাহে দু-তিনখানা চিঠি ওর হাতেই প্রথম এসে হাজির হয়। সায়েব ওই চিঠি পেলেই পড়বার জন্য ছটফট করেন, কোনো একটা ছুতোয় সেক্রেটারিকে ঘর থেকে বিদায় করে দেন ।

কুমারী সুজাতা দাস এই ধরনের অভিজ্ঞতা এখনও পায়নি। তাই কৌতূহলের মাত্রাটা বোধহয় বেশি। প্রেমপত্র পড়তে ইচ্ছে করে খুব। সাহেবের সব গোপন পত্রাবলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তার, কিন্তু এসব চিঠি ভুলেও কমলেশ টেবিলের ওপর ফেলে রেখে যান না । একই চিঠি দু-তিনবার পড়ে, পকেটে পুরে ফেলেন। নববিবাহিতের এই কাণ্ডকারখানা দেখে সুজাতা দাস মিটমিট করে হাসে ।

সাহেবের কাজের চাপও প্রচণ্ড। অনেকদিন সময়মতো দুপুরের লাঞ্চ পর্যন্ত জোটে না । কিন্তু সাহেব যে আজ রাত জেগে বউকে প্রেমপত্র লিখবেন একথা সুজাতা জোর করে বলতে পারে। আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ সাহেবের স্বহস্তলিখিত একটা ভারী নীল খাম সুজাতার হাতে আসবে । তার কাজ সামান্য, কোণের দিকে একটা ডাকটিকিট লাগিয়ে পোস্টাপিসে পাঠিয়ে দেওয়া।

এক-একবার সুজাতার লোভ হয়েছে খুব সাবধানে সাহেবের চিঠিটা খুলে পড়ে ফেলে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোভ সংবরণ করেছে সে। কেবল সাহেবের স্বহস্তলিখিত নামটা, চন্দ্রমল্লিকা রায়চৌধুরী, বেশ কয়েকবার খুঁটিয়ে দেখেছে।

চিঠিটা খুললেও সুজাতা দাস তেমন কিছু পেতো না । দেখতো ওখানেও কারখানা প্রসঙ্গ উঠেছে । এরপর সুজাতার কথাও উঠেছে। কমলেশ লিখেছে, “তুমি এবং সুতপাদি যা ভয় পাচ্ছ, তাই। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়! সুজাতা দাস কুমারী। বয়সটাও বিপজ্জনক, ত্রিশের সীমান্ত পেরোয়নি। এখানে একলা থাকেন। স্বভাব মধুর, দেখতে বনলতা সেনের মতো, পাখির নীড়ের মতো চোখ দুটো তুলে সবিস্ময়ে কথাবার্তা বলেন । বাড়ি শ্রীরামপুরে।”

শ্রীরামপুরের খবর পেয়ে মল্লিকা লিখেছিল, “সুজাতা দাস এবং শ্রীরামপুর যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। জিজ্ঞেস কোরো তো ডায়োসেশান স্কুলে পড়তো কিনা?”

কয়েকদিন পরে কমলেশ আবার চিঠি লিখলো: “কারখানার কাজ বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের ছোট কোয়ার্টারেও বেশ গুছিয়ে বসেছি। কিন্তু যে-গৃহে লক্ষ্মী বিরাজ করেন না তা গৃহই নয়, এ-কথা বলছে কেউ কেউ। বিয়ের পর কোথা দিয়ে তিনটে মাস পেরিয়ে গেলো, ভাবতে আশ্চার্য লাগে। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করে ফেলবো ভাবছি। দিগম্বর বনার্জি আবার আসছেন ইন্সপেকশনে তখন কথাটা পাড়বো। ছুটি চাই-ই। হ্যাঁ, লেডি সেক্রেটারি সুজাতা দাস ডায়োসেশন স্কুলের কথা তুলতেই অবাক হয়ে গেলেন। বনলতা সেন কায়দায় বিস্ফারিত চোখ দুটো তুলে বললেন, “ঠিকই ধরেছেন । কেমন করে জানলেন?’ বললাম, আমার স্ত্রী লিখেছেন । তারপর উচ্ছ্বাস: ‘চন্দ্রমল্লিকা চ্যাটার্জি আপনার স্ত্রী! আমার থেকে তিনবছরের জুনিয়র ছিল । আপনার বিয়ের নেমন্তন্ন পর্যন্ত পেয়েছিলাম; কিন্তু তখন বুঝিনি সেই কমলেশ এবং আপনি এক । দেখুন পৃথিবীটা কত ছোট। সুজাতা দাস এখন আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে খোঁজ করছেন। অফিসের চায়ের কাপটা পরের দিনই চকচকে হয়েছে। বেয়ারাগুলো অফিসঘর পরিষ্কার না রাখার জন্যে মেমসায়েবের কাছে বকুনি খাচ্ছে । “

চিঠি শেষ করে কমলেশ আর একবার পড়লো । বউ ভারি মিষ্টি বাংলা লেখে–তাই তাকেও একটু সাবধানে কলম ধরতে হয়। বউকে আগেই জানিয়েছে, “হাতের গোড়ায় বাংলা অভিধান নেই । সুতরাং বানান বিভ্রাট নিয়ে হাসাহাসি কোরো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *