মরুতীর্থ হিংলাজ – ৪

বর্ষা নেমেছে।

বাংলাদেশের আটপৌঢ়ে ঘরোয়া বর্ষা। জন্ম থেকেই যে বর্ষার সঙ্গে আমাদের নাড়ীর যোগ, যে বর্ষার সঙ্গে আমার হাড় মাংস অস্থি মজ্জার একান্ত ঘনিষ্ঠ পরিচয়, সেই বর্ষা-যে বর্ষার অঝোরধারায় মনও গলে পড়ে। একেবারে ছেলেবেলায় ঠাকুরমার কোলে বসে আকাশের পানে চেয়ে যে বর্ষার দিনে ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম—”বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান” সেই টাপুর টুপুর গানের বর্ষা নেমেছে আমার প্রাণের মধ্যে।

চোখ বুজে দেখছি-আকাশ জুড়ে একখানি মেঘ ঝুলছে। ঝুলছে একখানি ধোঁয়া রঙের চাঁদোয়া তাল-নারকেলের মাথা ছুঁয়ে, সেই চাঁদোয়ার উপর থেকে কারা হুড় হুড় করে জল ঢালছে। কখনো কম, কখনো বেশি; ঢালছেই জল, পড়ছেই জল।

পড়ছে জল তাল নারকেলের মাথায়,-অত বড় লম্বা দেহ, ওইটুকু ছাতায় জল মানবে কেন? সারা দেহ ভিজে জল গড়িয়ে পড়ছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে ওরা। অপেক্ষা করছে জলটা একটু থামলে হয়, অমনি মাথা দোলাতে শুরু করবে।

পড়ছে জল আমগাছটার ঝাঁকড়া মাথায়। ভিজে একেবারে জবুথবু বেচারা। অত বড় দেহ নিয়ে কাঁহাতক ভেজা যায়! মনমরা হয়ে মুখ কালো করে রয়েছে। লক্ষ লক্ষ পাতা বেয়ে ডাল বেয়ে জল নামছে মাটিতে ওর পায়ের গোড়ায়। আহা পায়ের তলায় মাটিটুকুও ভিজে গেল, মন খারাপ হয় না কার!

কাকপক্ষীর টু শব্দ নেই। কে কোথায় মাথা গুঁজে লুকিয়ে বসে আছে! একবার যদি সামান্য ক্ষণের জন্যে জল থামে অমনি সবাই বেরিয়ে আসবে যে যার আশ্রয় ছেড়ে। তারপর চেঁচামেচি আর পাখা-ঝাড়া আরম্ভ হয়ে যাবে।

দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলাই করতে করতে মা একবার হাতের কাজ থামিয়ে মুখ তুলে আকাশের দিকে খানিক চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “কে যেন ফুটো করে দিয়েছে আজ আকাশটায়।” বলে আবার কাঁথায় ফোঁড় দিতে লাগলেন।

উঠানের ওধারে গোয়ালের গায়ে ছোট চালাটায় দাঁড়িয়ে ধলী আর লক্ষ্মী একেবারে চুপ করে আছে, জাবর কাটছে না, মুখ নাড়ছে না। ওদের চোখেও মেঘের রঙ ধরেছে। আদুরে আবদেরে অভিমানী মেয়ের মতো ওদের চোখের ভাবখানা।

ঘরের চালে পড়ছে জল, চাল বেয়ে নামছে এসে উঠানে। উঠানে স্রোত বইছে। পায়ে-চলা পথটা বেয়ে সেই স্রোত চলেছে খিডুকি-পুকুরে। কই-মাছেরা একজন দুজন করে উঠে আসছে সেই পথ ধরে। ওরা শেষ পর্যন্ত এসে একবার দেখবে এত জল কোথা থেকে গিয়ে নামছে ওদের পুকুরে।

জল উঠেছে বাঁশঝাড়ের গোড়ায়। ওখানকার বাসিন্দারা প্রাণপণে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি জুড়ে দিয়েছে। মোটা গলায় ‘গ্যা, গোঁ, গ্যা, গোঁ করছে ভারিক্কী চালের কর্তারা। ছেলেপুলেরা ‘করর কট, করর কট’ লাগিয়েছে, ওদের গিন্নীদের বউদের আলাদা গলার আওয়াজ, দূর থেকে বেশ বুঝা যায়। মহা শোরগোল হুলস্থুল ব্যাপার, যায় বুঝি ওদের গৃহস্থালি সব ভেসে।

কলাগাছের দফা রফা, একেবারে শোচনীয় অবস্থা। হাঁফিয়ে উঠেছে বেচারারা, অনবরত পড়ছে জল-ঝিম্‌ ঝিম্ ঝিম্ ঝিম্, ঝম্ ঝম্ ঝম্ ঝম। একটু ছেদ দিলে ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

ওধারে উঠানের কোনায় মাচাটার উপরে দুটো একটা ঝিঙেফুল ইতিমধ্যেই মুখ তুলে চেয়ে চেয়ে দেখছে। বোকারা মনে করছে সন্ধ্যা বুঝি হয়ে এল। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক দেরি। আগে বৃষ্টিটা একটু কমবে, তারপর দেখা যাবে পশ্চিম দিকটা লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য অবশ্য তার অনেক আগেই পশ্চিমে নেমে গেছেন।

একবার চোখ চাইলাম। মুখ ফিরিয়ে পশ্চিম দিকটা একবার দেখে নিলাম। আগুনের গোলার মকো প্রকাণ্ড একটা মাথা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। সভয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলাম, যে বর্ষা আমার দেহের প্রতি অণু-পরমাণুতে অঝোরে ঝরছিল তা নিমেষে কোথায় উবে গেল।

অনেকক্ষণ ধরে ডান কাঁধে আর ডান হাতটায় ভার-ভার ঠেকছিল। এবার খেয়াল হল, কুন্তী আমার কনুই-এর উপর দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে একরকম ঝুলতে ঝুলতে চলেছে। নিজেকে টেনে নিয়ে চলবার ওর শক্তি ফুরিয়েছে।

ঊর্বশীর পিঠের উপর ভৈরবীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে তাঁর বদলে কি একটা কালো কম্বল ঢাকা হেলতে দুলতে চলেছে। রোদের তাপ থেকে বাঁচবার উপায় আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দেওয়া।

অনেক আগে বড় উট চলেছে, দলসুদ্ধ সবাই তার সঙ্গে এগিয়ে গেছে। আমি কুন্তী আর দিলমহম্মদ-তিনজনে আছে ঊর্বশীর সঙ্গে।

দিলমহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কতক্ষণ লাগবে সামনের কুয়োর ধারে পৌঁছতে।

ও বললে, “বোধ হয় অর্ধেকটা পথ আমরা এসেছি। এধারে পথের তো কোনো নিশানা নেই। উপের মেজাজ আর মর্জির উপর নির্ভর করে সব। ওদের পেটে ক্ষুধা আছে। ক্ষুধার টানে ওরা সব থেকে সোজা পথে চলে। কিন্তু এবারে এধারের যা অবস্থা দেখছি-তাতে চন্দ্রকূপের ওধারে না পৌঁছানো পর্যন্ত ওদের পেটে দেবার কিছু মিলবে বলে তো মনে হয় না।”

জিজ্ঞাসা করলাম, “তা হলে অন্য বছর এধারের অবস্থাটা অন্য রকম থাকে নাকি?”

দিলমহম্মদ বললে, “গত বছর এ মুল্লুকে একবারে জল পড়েনি। নয়তো এই মরশুমে এ অঞ্চলে দু-চারটে ঝোঁপঝাড় সব জায়গাতেই দেখা যায়। এবারে একেবারে সব কিছু পুড়ে সাফ হয়ে গেছে। এই চন্দ্রকূপ এলাকাটা পোড়া মুল্লুক, এধারে কেউ বাসও করে না, আসা-যাওয়াও নেই কারও। হিংলাজযাত্রীরাই শুধু আসে। চন্দ্রকূপ দর্শন না করে হিংলাজ দর্শন হয় না। এই জন্যই এ পথে আসে। নয়তো লোকে এই সমুদ্রের চড়ায় আসবে কোন কাজে!

সমুদ্রের কথাটা কানে যেতে দু-দিন আগে ছেড়ে আসা চোখ-জুড়ানো নীল সাগরকে মনে পড়ে গেল। বললাম, “ওখানটাও তাহলে সমুদ্রের চড়া। সমুদ্রের জল এখান থেকে কতদূর হবে মনো করো?”

ও উত্তর দিলে, “কমসে কম পনেরো-ষোল ক্রোশ সোজা পশ্চিমে চললে দরিয়ার পানি মিলবে। চন্দ্রকূপও দরিয়ার চড়ায়, তবে ওখান থেকে দরিয়া অনন্ত ত্রিশ ক্রোশ!”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললে, “হিংলাজ থেকে ফেরবার সময় এই পথে আর আমাদের আসতে হবে না। চন্দ্রকূপকে বামে রেখে তিন-চার ক্রোশ দূর দিয়ে সোজা অন্য পথ আছে, যে পথে লোক চলাচল করে। সেই পথে কোনো তকলিফ নেই। এখন খোদার মেহেরবানিতে চন্দ্রকূপ পৌঁছতে পারলে হয়।”

বললাম, “কিন্তু না খেয়ে উটেরা কদিন চলবে?”

দিলমহম্মদ বললে, “শুধু জল খেয়ে দু-তিন দিনও ওরা চলতে পারে। তবে ভয়ানক কমজোর হয়ে পড়বে। এমনও হয়, এই সব জায়গায় উট খেপে ওঠে। তখন তাদের সামলানো যায় না। সওয়ার উট সব একসঙ্গে মারা পড়ে। দেখছেন তো কোনো দিকে কোনও নিশানা নেই। এখানে উট যদি পথ ঠিক করে না চলে তবে আর উপায় নেই। সবই নসিব, সবই নসিব।”

এই বলে সে নিজের কপালটা দুবার চাপড়ালে। নসিবই বটে। নসিবে না থাকলে খামকা আমরা এখানে মরতে আসব কেন? নসিবই যদি না পুড়বে তবে এভাবে উপর-ভিতর পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে কেন? নসিবই সব, নসিবই এভাবে নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়ে মারছে; আর ঘুরে ঘুরে নসিবের হুকুম যদি পালন না করি তবে আছে নসিবের হাতে চকচকে টাঙ্গি, তখন নসিব সেই টাঙ্গি দিয়ে দু-আধখানা করে ছাড়বে।

সামনের বড় উটটার কাছে কি হল? ওরা সবাই থামল। ওদের কাছে পৌঁছে দেখি মণিরাম তপ্ত বালুর উপর শুয়ে পড়েছে। জ্বরে একেবারে বেহুঁশ।

তার মাথায় একখানা ভিজে গামছা জাড়ানো হল। ভৈরবী নামলেন। উর্বশীর উপর তাকে তুলে দিয়ে খাঁটিয়ার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। আমাদের যে এগিয়ে যেতেই হবে।

এগিয়ে যেতেই হবে, এগিয়ে যেতেই হবে। মরুভূমি হোক, পাহাড় হোক, জঙ্গল হোক, সারা জীবনভোর শুধু আগুবাড়ি, চলা। থামবার উপায় নেই। থামা মানে একেবারে চরম থামা, তার মানে শেষ বিরতি।

এগিয়েই চললাম।

রূপলাল বললে, “আজ আর কাল এই দুটো দিন এইভাবে চলবে। তারপর আমরা চন্দ্রকূপ এলাকায় গিয়ে পৌঁছব। সেখানে পাহাড়, পর্বতের আড়ালে-অন্তত দিনের বেলাটা পড়ে থাকা যাবে।”

পোপটলাল জিজ্ঞাসা করলেন, “আজ রাতে যেখানে গিয়ে পৌঁছব সেখানে কি কোনো ছায়া মিলবে না, যেখানে কাল দিনের বেলাটা পড়ে থাকা যায়?”

রূপলাল জবাব দিলে, “শয়তানের ছায়া মিলতে পারে। সইে ছায়ায় আরাম করে বালির উপর পড়ে শুকিয়ে মরতে পারা যাবে।”

দিলমহম্মদ বললে, “সবসে আচ্ছা হয় সামনের কুয়োর ধারে পৌঁছে ঘণ্টা দুই আরাম করে আবার এই রাতে চলা। তাহলে কাল রোদ চড়বার আগেই আমরা পাহাড় মুল্লুকে গিয়ে পড়তে পারি। কিন্তু তা কি আর হবে, এতক্ষণ হাঁটতে পারবে কে?”

রূপলাল বললে, “দু-দুটো রুগি সঙ্গে। একটা ছায়া না পেলে কাল দিনের বেলা ওদের রাখা যাবে কোথায়? সামনে এগিয়ে যেতেই হবে আজ রাতে।’

কুন্তী হাঁটছিল ভৈরবীর কাঁধে ভর রেখে, ভৈরবী বললেন, “এ মেয়েটাকেও হারাতে হবে, ওর আর চলবার শক্তি বিন্দুমাত্র নেই।”

আর কোনও কথা কেউ বললে না। আগে তো আজকের মত সন্ধ্যা হোক। ওই চণ্ডাল সূর্যটা বিদায় হোক ওর পোড়ারমুখ নিয়ে। তখন দেখা যাবে কি করা যায়। আসুক একটা এমন রাত্রি যে রাত্রি আর কখনো পোয়াবে না, কখনও পথ ছেড়ে দেবে না প্রভাতকে। তাহলে আর ওই সূর্যটা কখনো আসতে পারবে না আমাদের মাথা খেতে, আমাদের রক্ত শুষতে।

অবশেষে গেলেন তিনি। গেলেন সেই নির্মম রক্তশোষক, রক্তচক্ষু, রক্তাম্বর মার্তণ্ডদেব। আমাদের ঘাড়ের উপরের মাথাগুলি জলশূন্য ঝুনা নারিকেল করে দিয়ে গেলেন তিনি, একেবারে শাঁসশূন্যও করে গেলেন কিনা কে বলতে পারে। তবে গেলেন যে এই যথেষ্ট। আমরা চোখে চেয়ে বাঁচলাম।

নেমে এল সন্ধ্যা। আমাদের এপিঠ ওপিঠ দু-পিঠই ভাজা হয়ে গেছে দেখে তার দয়া হল। নিবিড় মমতায় হাত বুলিয়ে দিলে আমাদের গায়ে মাথায়। বহুকাল পরে মায়ের হাতের পরশ পেলাম। অকারণে পোড়া চোখ দুটি সজল হয়ে উঠল।

ঠান্ডা হয়ে এল বালুর মেজাজ, তবু সহজে কি তার তেজ কমে!

সন্ধ্যার দিদি রাত্রি এসে পৌঁছলেন অবশেষে। বড় বিলম্ব করে এলেন তিনি। আমাদের ধৈর্যের শেষ সীমা পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ তাঁর অপেক্ষায়। সব জ্বালা যন্ত্রণা, সমস্ত দুঃখ তিনি নিমিষে হরণ করে নিলেন তাঁর নিবিড় কালো চোখের করুণার ধারা ঢেলে দিয়ে। কানে কানে বলতে লাগলেন, আর ভয় কি? আমি তো এসে পড়েছি, আমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে নিয়ে তোমাদের পার করে দিচ্ছি এই ভয়ঙ্কর মরুভূমি। ভুলে যাও সব জ্বালা-যন্ত্রণা, বুকে সাহস আনো, মুখে হাসি ফোঁটাও। ভেঙে পড়লে চলবে কেন? হিংলাজ যে এখনও বহু দূর।”

ছড়িওয়ালা রূপলাল চিৎকার করে উঠল, “শ্রীহিংলাজ দেবী কি—”

আমাদের সাধ্যে যত দূর কুলোল উচ্চকণ্ঠে সাড়া দিলাম, “জয়!”

জয়াশঙ্করের শিষ্যসেবকেরা আর পারে না তাদের গুরুদেবকে বয়ে নিয়ে যেতে। তাদের কাছ থেকেই প্রথম প্রস্তাব উঠল, “এবার থামতে হবে।” একেবারে নেতিয়ে পড়েছেন জয়াশঙ্করজি। সমস্ত দেহ থেকে প্রাণের আগুনটা পালিয়ে এসে জমা হয়েছে তাঁর চক্ষু দুটিতে। মুখ দিয়ে কথা সারছে না, কেবলমাত্র জ্বলন্ত চক্ষু দুটি দিয়ে সবাইয়ের মুখের উপর তিনি তাকাচ্ছেন। যেন ইচ্ছা করলে আমরা এমন একটা কিছু করতে পারি যাতে তাঁর যন্ত্রণার লাঘব হয়, তাঁর জীবনটা রক্ষা পায় ৷

তাঁর চোখের সেই দৃষ্টি আজও যেন দেখতে পাই। মানুষ কি অসহায় হয়ে পড়ে বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে! আর কতদূর শোচনীয় অবস্থায় পড়েছিলাম আমরা সেদিন তাঁর সেই মূক দৃষ্টির দিকে চেয়ে! কিছুই করবার ছিল না আমাদের, কেবল নিজেদের গায়ের মাংস দাঁত দিয়ে ছেঁড়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাদের প্রত্যেকের বাকরোধ হয়ে গেছে তখন, তাঁর জন্য কিছু একটা না করতে পারলে তীব্র অনুশোচনায় আমরা তিলে তিলে দগ্ধে মরছি। যা হবার তা হবেই এটুকু বুঝতে আর বাকি নেই কারও। এখন সকলেরই একান্ত কামনা-একটা কোথাও পৌঁছে তবে যেন কিছু হয়। এভাবে এখানে তাঁর দেহটাকে যেন ফেলে যেতে না হয় আমাদের। কোনো একটা আশ্রয়স্থানে পৌঁছে তবে যেন সেই চরম ক্ষণটি উপস্থিত হয়।

অনুনয় করে রূপলাল বোঝাতে লাগল সকলকে, এ সময় এ জায়গায় কোনো মতেই থাকা উচিত নয়। এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো সামনের কুয়োর ধারে। যেভাবে হোক সেখানে পৌঁছতেই হবে, নয়তো একবিন্দু জল না পেয়ে মরতে হবে সকলকে। মনে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলো সবাই। মা হিংলাজের কৃপায় ওখানে পৌঁছে একটা কিছু উপায় হবেই। পুরো একটা দিন আমরা পড়ে থাকব সেই কুয়োর ধারে। তখন পাণ্ডেজি নিশ্চয়ই সামলে উঠবেন, দয়া করে আর একটু কষ্ট করে চল নিয়ে ওঁকে সামনের কুয়োর কাছে।

কে নিয়ে যাবে পাণ্ডেজিকে বয়ে? চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলল সকলের পেট খালি, সকলেরই প্রাণ কণ্ঠাগত। সবাই মাথা নিচু করে রইল।

কোথা থেকে থিরুমল উদয় হল। এতক্ষণ তার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। জয়াশঙ্করের কাছে এসে সে পিঠ পেতে দাঁড়াল। বললে, “দাও ওঁকে আমার পিঠের উপর বসিয়ে একখানা চাদর দিয়ে আমার বুকের সঙ্গে বেঁধে। আমি নিয়ে যাচ্ছি পিঠে করে।”

সকলে স্তম্ভিত। এ বলে কি! জয়াশঙ্কর হাল্কা মানুষ নন, থিরুমলের চেয়ে মাথায় কিছুটা বড়ই হবেন তিনি। থিরুমলও এমন কিছু পালোয়ান নয়। মাথা খারাপ আর কাকে বলে-ও বয়ে নিয়ে যাবে পাণ্ডেজিকে সকলকে ইতস্তত করতে দেখে থিরুমল চটে উঠল। বললে, “আমি ইয়ারকি করছি না। এভাবে মানুষ বয়ে বেড়ানো আমার অভ্যাস আছে। প্রথম মা-বাপ যখন আমাকে তাড়িয়ে দেয় তখন যিনি আমাকে আশ্রয় দেন তাঁর বিমার হলে পর অনেকদিন তাঁকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি। তখন তো আমি খুবই ছেলে মানুষ, আর এখন পারব না এঁকে বয়ে নিয়ে যেতে! বেঁধে দাও তোমরা, আর দেরি কোরো না।”

কুন্তী কি বলতে গেল থিরুমলকে। কোনও ফল হল না। একটা প্রচণ্ড ধমক খেয়ে ফিরে এল।

শেষ পর্যন্ত তাই করা হল। একখানা মোটা চাদর দিয়ে জয়াশঙ্করকে থিরুমলের পিঠে বেঁধে দেওয়া হল। দু হাত দিয়ে পিছন থেকে থিরুমলের গলাটা জড়িয়ে ধরে ওর কোমরের দু-পাশ দিয়ে দুই পা বাড়িয়ে বসে রইলেন জয়াশঙ্কর। একখানা লাঠি একজনের হাত থেকে টেনে নিলে থিরুমল। আবার আমরা অগ্রসর হলাম।

দলের একেবারে সামনে গুলমহম্মদ বিড়বিড় করে যেন কোনো মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে চলেছে। অন্য সকলেই সম্পূর্ণ নির্বাক।

ভৈরবী হাঁটছেন। কুন্তীর একখানা হাত ধরে বেশ ভাল ভাবেই হাঁটছেন তিনি। সন্ধ্যার পর থেকে কুন্তীও আর কারও কাঁধে ভর রেখে হাঁটছে না।

ঊর্বশীর পিঠে খাঁটিয়ার উপর মণিরাম একটু জল চাইলে। ঊর্বশীকে বসিয়ে তাকে জল খাওয়ানো হল। সামনের ওরা আরও এগিয়ে গেল। তা যাক, নয়তো থিরুমলকে থামতে হয়। ঊর্বশী তার মাকে ঠিক ধরবে গিয়ে। মণিরামের জ্বর কমে আসছে, তবে এখনও তার সম্পূর্ণ হুঁশ আসেনি।

ভৈরবীকে হাঁটতে হচ্ছে মণিরামের জন্য। মণিরাম পোপটলালের লোক, সেজন্যে পোপটলাল মহা আফসোস জুড়ে দিলেন এবং ভৈরবীর কাছ থেকে ধমক খেয়ে তবে থামলেন।

ভৈরবী বললেন, “আপনি থামুন তো বাবা দয়া করে। এখন ভালয় ভালয় সকলে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। তা আমি হেঁটেই পারি আর গড়িয়ে গিয়েই পারি তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই।”

ঠিক–এখন পৌঁছনোটাই সব চেয়ে বড় কথা। কে হাঁটছে, কে গড়াচ্ছে, পিঠে চড়ে চলেছে কে–এ সমস্তর বিচারের এখন ফুরসত কোথায়? কোনোক্রমে একটা কোথাও পৌঁছে আজকের মতো এই যাত্রার বিরতিই হচ্ছে এখন প্রধান লক্ষ্য।

অনেকক্ষণ স্বস্থানে প্রস্থান করেছেন সূর্যদেব। আমাদের উপরের জ্বালা জুড়িয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়েছে তার এক তাগিদ। বাইরে আগুন নিভেছে, ভিতরের আগুন জ্বলে উঠেছে। সব চেয়ে চরম সত্য যা এই দুনিয়ায়, সেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে সকলের উদরের মধ্যে। ন্যায়-অন্যায় আচার-অনাচার সব একসঙ্গে ভস্মীভূত হয় যে আগুনের টানে সেই আগুন-যা সঙ্গে নিয়েই আমরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হই– সেই আগুন ভিতর থেকে বলছে, “ম্যয় ভুখা হুঁ।” কিছু না কিছু এখন পাঠাতেই হবে ভিতরে, নয়তো নিস্তার নেই। অল্পবিস্তর সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অনেকে আবার ইতিমধ্যে ডালপালা যা পায়ে ঠেকছে তা কুড়াতে শুরু করেছে, সামনে কুয়োর ধারে পৌঁছে রুটি পোড়ানো হবে।”

শ্রীমান সুখলালের দু-পাশের দুই পকেট খেজুর দিয়ে ভৈরবী বোঝাই করে দিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ আগেই সেগুলো নিঃশেষ হয়েছে। ভৈরবীর পাশে চলতে চলতে ছেলেটা চুপিচুপি পরামর্শ জুড়ে দিলে, ওখানে পৌঁছে রাত্রে কি কি রান্না হবে।

রূপলালকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “যেখানে যাচ্ছি সেখানে রান্না করবার কাঠ পাওয়া যাবে তো?”

রূপলাল বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলে, “খেপেছেন আপনি? কে আমাদের জন্যে সেখানে কাঠ নিয়ে বসে থাকবে? এই বালুর রাজত্বে কাঠ কোথায়? আজও আটা আর গুড় গুলে খেয়ে কাটাতে হবে।”

দিলমহম্মদ বললে, “সেই জন্যেই তো বলছি, ঘণ্টা দুই ওখানে আরাম করে জলটল ভরে নিয়ে আবার হাঁটাই ভালো। রাতে রাতে যতদূর যাওয়া যায়….

কুন্তী খিঁচিয়ে উঠল, “তাহলে সারারাত একজন একজনকে পিঠে করে চলবে নাকি?”

তা কখনো সম্ভব নয়। মহা অপ্রস্তুত হয়ে দিলমহম্মদ বার বার দুঃখ জানাতে লাগল।

তারার আলো পড়েছে বালির উপর, ফলে আয়নায় আলো পড়লে যা হয় তাই হচ্ছে। অন্ধকার অনেক ফিকে হয়ে গেছে। আকাশের তারার আলোয় সম্পূর্ণ উলঙ্গ চকচকে মরুভূমিতে আঁধার জমে না। আমাদের চারিদিকে একটা রহস্যময় আলোর জগৎ, তার মাঝে আমরা ভাসছি। এখানে ছায়া পড়ে না। যারা কায়াহীন তাদের কোথাও ছায়া পড়ে না। এখানে যদিও সশরীরে আমরা চলেছি তবুও আমাদের একবিন্দু ছায়া পড়ছে না কোথাও। এ এক বিচিত্র আজগুবি দুনিয়া!

আরও অনেকক্ষণ কাটল। চুপচাপ সব চলেছি নিজেদের পেটের ক্ষুধা পেটে নিয়ে ৷ হঠাৎ সামনে থেকে কে উৎকট আর্তনাদ করে উঠল, “আঁ-আঁ-আক!”

কে যেন কার কন্ঠনালী চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে মারছে।

গুলমহম্মদ হায় হায় করে চেঁচিয়ে উঠল। রূপলালও কি সব বলে চেঁচাচ্ছে ওখান থেকে।

দৌড়লাম ওদের দিকে

কি একটা ঘিরে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছবার পূর্বেই ভিড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল থিরুমলকে ধরে নিয়ে রূপলাল আর পোপটলাল। থিরুমলের পা দুটো শূন্যে ঝুলছে, মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে, মুখটা এসে ঠেকেছে তার নিজের বুকে।

রূপলাল বলে উঠল, “ খুন করেছে- গলা টিপে মেরে ফেলেছে একবারে।”

থিরুমলের অসাড় দেহটা ওরা শুইয়ে দিলে আমার সামনে।

কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয় রইলাম। তারপরই দপ করে মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। ওদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে একলাফে ঢুকলাম সামনের ভিড়ের মধ্যে। সামনে যারা পড়ল তাদের দু-হাত ঠেলে মাঝখানে গিয়ে পৌঁছলাম। উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন, দৃঢ় মুষ্টিতে তার কাঁধ ধরে চিত করে ফেললাম। আমার সর্বশরীরের ভিতর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা হিমপ্রবাহ বয়ে গেল। লোকটা মরে একবারে কাঠ হয়ে গেছে। তার দেহটা বরফের মতো ঠাণ্ডা। শ্রীজয়াশঙ্কর মুরারজি পাণ্ডে মহাশয় আর নেই। তাঁর দিকে চেয়ে আমিও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বহুক্ষণ পূর্বেই প্রাণটা তাঁর বেরিয়ে গেছে। শেষ সময়ও থিরুমলের গলা জড়িয়ে ধরে ছিলেন তিনি। ক্রমে তাঁর দেহ শক্ত হতে থাকে, হাতের বাঁধনও থিরুমলের গলা চেপে বসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত যখন থিরুমল শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয় তখন সে প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারে। একটা মরা মানুষ পিঠের উপর গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে এটুকু বুঝতে পেরেই সে ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে আর প্রাণপণে নিজের গলাটা ছাড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু মড়ার হাত ছোঁড়ানো অত সহজ নয়। প্রাণহীন জয়াশঙ্করকে পিঠে নিয়ে থিরুমল হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়।

টানটানি করে জয়াশঙ্করের কবল থেকে যখন থিরুমলকে ওরা উদ্ধার করলে তখন সেও মৃতপ্ৰায় ৷

যাক– যে গেছে সে ত গেছেই, এখন আর একজন না গেলে হয়। থিরুমলের মুখে মাথায় জলের ছিটা দিচ্ছেন ভৈরবী। হাহাকার করে কাঁদছে কুন্তী, নিজের কপাল চাপড়াচ্ছে, চুল ছিঁড়ছে।

কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, খুঁজেই বা পাবে কোথায় সান্ত্বনার ভাষা!

উটেদের পিঠ থেকে বোঝা গুলি নামিয়ে তাদের রেহাই দেওয়া হল। একটা মৃত আর একটা অর্ধমৃতকে ঘিরে আমরা সেখানে বসলাম।

হিংলাজ তখনও বহুদূর।

সঙ্গের সব-কটা আলো জ্বালানো হল। হাত দিয়ে বালি সরিয়ে, থালা দিয়ে বালি খুঁড়ে একটা গর্ত করা হল। যে নূতন কাপড়খানি পরে জয়াশঙ্করজি হিংলাজ দর্শন করতেন সেইখানি দিয়ে তাঁর সর্বাঙ্গ ঢেকে দেওয়া হল। তারপর সেই বালির গর্তের মাঝে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হল।

ব্রাহ্মণ জয়াশঙ্করজির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উপযুক্ত শাস্ত্রীয় আচার কিছুই পালন হল না। হল না মন্ত্রপাঠ, হল না পিণ্ডদান। তাঁর উপযুক্ত সন্তানেরা কত দূরে, আর তিনি কোথায়! তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে, তিনি ঘরে ফিরবেন মা হিংলাজের প্রসাদী নিয়ে, আর্শীবাদী নিয়ে, ফিরে পুনরায় গৃহ-সংসার করবেন পরম শান্তিতে– সব আশা শেষ হয়ে গেল!

খুঁতখুঁতে মন ছিল জয়াশঙ্করজির। যেখানে তিনি গিয়েছেন সেখান থেকে তাঁর অপদার্থ সহযাত্রীদের ক্রিয়াকলাপ দেখে হয়তো আরও বিরক্তই হচ্ছেন। এ সময় যা যা হওয়া উচিত ছিল তার কিছুই করতে পারলাম না। এমনকি তাঁর দেহটা আগুনের বুকে তুলে দেওয়াও আমাদের সামর্থ্যে কুলোল না। কোনো কর্মের লেশমাত্র অঙ্গহানি ছিল তাঁর অসহ্য, আর তাঁর শেষকৃত্যটুকু যেভাবে আমরা করলাম তার আগাগোড়াই অঙ্গহীন ব্যাপার। কিন্তু তখন তাঁকে ওইভাবে সেখানে শুইয়ে রেখে যেতে আমাদের অন্তরের অন্তস্তলে যে তীব্র মোচড় দিতে লাগল তা যদি তিনি সেখান থেকে টের পেয়ে থাকেন তবে নিশ্চয় আমাদের সকল অপরাধ ভুলে, তাঁর হতভাগ্য সহযাত্রীদের ব্যথায় তিনি নিজেই আকুল হয়ে উঠেছিলেন। সেই গভীর নিশীথে যে মূক মন্ত্ৰ আমাদের হৃদয়ের মধ্যে গুমরে গুমরে উচ্চারিত হয়েছিল হয়তো সেগুলি শাস্ত্রমতে শুদ্ধ ছিল না, কিন্তু তার চেয়ে সজীব মন্ত্র কোনো পাঁজি-পুঁথিতে কোনও কালে লেখা হয়নি।

আপন আপন কুঁজো থেকে সকলে জল দিলে জয়াশঙ্করের সমাধির উপর। তাঁর নিজের কুঁজোটি পরিপূর্ণ করে রেখে দেওয়া হল তাঁর মাথার কাছে। আটা আর গুড় সকলেই কিছু কিছু করে দিলে। ভৈরবী দিলেন তাঁর কিশমিশ আখরোট মিছরি বাদাম। সমস্ত ভোজ্য একখানা নূতন গামছায় বেঁধে রেখে দেওয়া হল তাঁর কুঁজোর পাশে। তারপর হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে বালি ফেলে আমরা জয়াশঙ্করজিকে চাপা দিয়ে দিলাম।

সাক্ষী রইল আকাশ, সাক্ষী রইল বাতাস, সাক্ষী রইল ওই ওপরের তারাগুলি আর নীচের এই দিগন্তবিস্তৃত বালুকা। আমরা আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিচার মতো যথাসাধ্য করে আমাদের প্রিয়তম সহযাত্রীকে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের আর কীই-বা করবার আছে? কেউ জানে না, কেউ বলতে পারে না, সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমাদের মধ্যে আর কতজনকে এইভাবে চিরবিশ্রাম নিতে হবে, এই বালির বুকে শুয়ে পড়ে।

এবার সেই সময় উপস্থিত হল, যখন পাণ্ডেজিকে ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে ৷ অনেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ছেলেমানুষের মতো হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল গুলমহম্মদ। শেস সময় সে বললে, “দোস্ত, তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারলাম না তোমার মুল্লুকে, খোদা তোমায় নিজের কোলে টেনে নিলেন। তুমি নিশ্চয়ই তাঁর মেহেরবানিতে শান্তি পাবে। কিন্তু এই আফসোস আমার আর ইহজন্মে ঘুচবে না।”

কেবলমাত্র নির্বিকার থিরুমল হা-হা করে হাসতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে চোখ চেয়ে উঠে বসল যখন আবার, তখন থিরুমল আর আমাদের চিনতেই পারল না। হতভাগাটার মাথার মধ্যে আবার জট পাকিয়ে গেছে।

মণিরাম বললে, “এবার আমি হাঁটতে পারব।” সে আর উটের উপর কিছুতেই গেল না। আবার ভৈরবী উঠলেন উর্বশীর পিঠে। আমি চললাম থিরুমলকে ধরে নিয়ে। অন্য সকলে, এমনকি কুন্তী পর্যন্ত তাকে ভয় করতে শুরু করেছে।

রাত্রি বিদায় নিচ্ছে। বিষাদিনী রাত্রি কেঁদে বিদায় নিচ্ছে। আমরা কুয়োর ধারে পৌঁছে আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করে কোনো কিছু না বিছিয়েই শুয়ে পড়লাম। আমার পাশে শুয়ে অকাতরে ঘুমোতে লাগল থিরুমল। খাওয়া-দাওয়ার কথা আর কারও মনের কোণেও এল না।

ডান হাতখানা চোখের উপর চাপা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছি। সহজে কিছুতেই খুলছি না চোখ আজ। চোখ খুললেই তো দেখতে হবে আবার সগৌরবে সমুপস্থিত হয়েছেন সূর্যদেব, কিংবা উঠি-উঠি করছেন পূর্বদিকে। তার চেয়ে চোখ বুজে যতটা সময় পার করে দেওয়া যায়। নিত্য ঠিক সময় ঠিক জায়গায় হাজির দেওয়া কর্মটি থেকে অন্তত একটি দিন কি করে সূর্যদেবকে কামাই করানো যায়–চোখ বুজে শুয়ে তার একটা উপায় ঠাওরাতে লাগলাম।

মনে পড়ে গেল ঋগ্বেদের কয়েকটি শ্লোক। অতি মারাত্মক জাতের সংস্কৃত মন্ত্ৰ ৷ ব্রহ্মা সূর্যদেবকে স্বাগত জানাচ্ছেন–

বিভ্রাড় বৃহৎ সুভূতং বাজ সাতমং ধর্মান্দিবোধরুণে সত্যমর্পিতং।
অমিত্রহা বৃত্রহা দস্যুহংতমং জ্যোতির্জজ্ঞে অসুরহা সপত্নহা।
–ঋগ্বেদ, ১০ মণ্ডল, ১৭০ সূক্ত

সূর্যদেবের গুণগান করছেন ব্রহ্মা। বলছেন-”সূর্যস্বরূপ আলোকময় পদার্থের উদয় হইতেছে।

ইহা প্ৰকাণ্ড, অতি দীপ্তিশালী, উত্তমরূপে সংস্থাপিত। ইহার মতো অন্নদান কেহ করে না, ইহা আকাশের অবলম্বনের উপর যথাযোগ্যরূপে সংস্থাপিত হইয়া আকাশকে আশ্রয় করিয়া আছে। ইহা শত্রুনিধন করে, বৃত্রকে বধ করে, দস্যুদিগের প্রধান নিধনকারী, অসুরদিগের বধকারী, বিপক্ষদিগের সংহারকারী।”

তারপর আরও অনেক কঠোর কঠোর শ্লোকে আবাহনের পালা সাঙ্গ করে ব্রহ্মা স্তব আরম্ভ করলেন সবিতা দেবতার–

বিশ্বানিদের সবিতর্দুরিতানি পরাসুব। যদ্ভদ্রং তন্ন আসূব ৷
–ঋগ্বেদ, ৫ মণ্ডল, ৮২ সূক্ত

–’হে দেব সবিতা, তুমি আমাদিগের সমস্ত দুর্ভাগ্য দূর করো এবং যাহা কল্যাণকর তাহা আমাদিগের অভিমুখে প্রেরণ করো।’

এ সমস্ত ব্যাপার বহুকাল পূর্বে ঘটিয়াছিল। সে যে কতকাল হয়ে গেল তার হিসেব দেওয়াও যায় না। ঋগ্বেদ হালফিল লেখা হয়নি। তারপর কালে কালে সবই গেছে পালটে, এসেছে আমাদের এই কাল। ঋগ্বেদ যাঁরা লিখেছিলেন তাঁদের বদলে এখন জগৎ জুড়ে আমরা রয়েছি, দুনিয়ার সমস্ত কিছু বদলেছে, সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যদেবের স্বভাব-চরিত্রেরও যে ঘোরতর পরিবর্তন হয়েছে এ কথা বলাই বাহুল্য। ব্ৰহ্মা বলেছিলেন- ‘তুমি আমাদের দুর্ভাগ্য দূর করো এবং যাহা কল্যাণকর তাহা আমাদিগের অভিমুখে প্রেরণ করো!’

হায়, তখন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে একমাত্র জ্বলিয়ে পুড়িয়ে খাক করা ভিন্ন ভবিষ্যতে আর কোনো সামর্থ্য থাকবে না সূয্যিঠাকুরের। আর এই সৎকর্মটি সুসম্পন্ন করবার জন্যে তাঁকে আবাহন করে ডেকে আনবারও প্রয়োজন হবে না কারও। যথাসময়ে যথাস্থানে উদয় হয়ে সামনে তিনি অনল উদ্‌গিরণ করতে থাকবেন। আবাহন বিসর্জন এ সব কোনো কিছুরই ধার ধারবেন না তিনি। বিশুদ্ধ বিসর্জনের মন্ত্র আউরে বা অন্য কোনো উপায়েই তাঁকে তাঁর এই প্রাত্যহিক ভয়াবহ কর্তব্য পালন করা থেকে তিলমাত্র নড়ানো যাবে না।

সৃষ্টিকর্তাকে যদি আমাদের সঙ্গে হিংলাজের পথে পড়ে থাকতে হত তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আকুল আক্ষেপ জুড়ে দিতেন একদা ওইইনর্দয় মার্তণ্ডদেবকে খোশামুদি করেছিলেন বলে। খোশামুদি করার ফল কি ভীষণ–তাঁর সৃষ্ট এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডখানাকে একেবারে পুড়িয়ে ছাই না করে কিছুতেই ছাড়বে না তপন দেবতা। আদর করে আবাহন করার দাম ষোল আনা দিয়ে তবে ছাড়বে।

হাতের লাঠিগুলো বালির মধ্যে পুঁতে কাপড় কম্বল সব টাঙানো হচ্ছে। হোক–সকলে শেষ চেষ্টা করে দেখুক যদি বাঁচবার কোনো একটা উপায় কেউ বার করতে পারে মাথা থেকে। এইভাবে কাপড় কম্বল খাঁটিয়ে কোনো উপকারই যে হবে না এটুকু বেশ বুঝছি এবং অন্য সকলেও যে না বুঝছে তা নয়। কিছুতেই এখানে রোখা যাবে না ভানুর রোখ। ওই সব টাঙিয়ে হয়তো মাথার ওপর একটু ছায়া মিলবে কিন্তু বালির রোষ থেকে বাঁচবার উপায় কি? একটু পরেই এমন তাতা তাতবে বালি যে, ধান দিলে সঙ্গে সঙ্গে খই হয়ে ফুটে উঠবে চড়বড় করে। তখন? তখন আমরা যাব কোথায়? কিসের উপর পা রাখব? জ্যান্ত কইমাছদের উনুনের উপর ফুটন্ত তেলের কড়াতে ছেড়ে দিয়ে আর তার উপর ছাতা খুলে ধরলে যদি সেই মাছগুলোর দগ্ধানির কিছুটা লাঘব হবার সম্ভাবনা থাকে তবে এভাবে এখানে কাপড় কম্বল টাঙিয়ে আমাদেরও যন্ত্রণার উপশম হতে পারে। সুতরাং ওই কাপড় কম্বল টাঙানোর ব্যাপারে মাতবার প্রবৃত্তি হল না। একধারে চুপ করে বসে চোখ মেলে সমস্ত দেখতে লাগলাম।

সকলেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেউ কাঠ খুঁজছে রুটি পোড়াবার জন্যে, কেউ চারিদিকে ঘুরে দেখছে কাছে-পিঠে কোথাও কোনো রকম ছায়া আছে কি না, কেউ কুয়োর মধ্যে নেমে বালি খুঁড়ছে জলের আশায়। বাকি সকলে টাঙাচ্ছে কাপড় কম্বল।

এখানকার কুয়ো বলে যে গর্তটাকে দেখানো হল তাতে জল দাঁড়ায় না। গর্তটির মধ্যে নেমে থালা দিয়ে বালি সরিয়ে অসীম ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। একটু একটু করে জল জমবে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জলটুকু তুলে নিয়ে কুঁজো ভরতি করা চাই। নয়তো ঝুর ঝুর করে চারিদিকের বালি পড়ে আবার জলটুকু অদৃশ্য হয়ে যাবে। জলওয়ালা বা এই কুয়ের রক্ষক কাকেও খুঁজে পাওয়া গেল না এখানে কোথাও।

সন্ধ্যা পর্যন্ত খালি পেটে এই কুয়োর ধারে পড়ে থাকা আমাদের ললাটের লিখন। দিনের বেলা হাঁটবার সাহস কারও প্রাণে নেই। যা হয় হোক, এখানে পড়ে থেকেই হোক। অন্তত জলের ধারে কো পড়ে আছি-এইটুকুও কি কম সান্ত্বনা!

সকাল থেকে সকলের কুঁজো ভরতেই আদিত্য ভগবান মাথার উপর এসে পৌঁছে গেলেন। তারপর উটেদের জল খাওয়ানোর পালা। চারবার জন্যে ওদের কোথাও নিয়ে যাওয়া হল না। যাবে কোথায়? বালি বালি বালি, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম-যতদূর দৃষ্টি যায়-ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুভ্র পবিত্র বালি চকচকে অগুনতি দাঁত বার করে আমাদের দুর্দশা দেখে মহাস্ফূর্তিতে হেসেছে। উট দুটি ঠায় বসে গাল নাড়াতে লাগর, যেন কোনো অদৃশ্য খাদ্য চর্বণ করে চলেছে।

শেষে ওদের জল খাওয়ানো হল। সময় লাগল দু-ঘণ্টার ওপর। গুলমহম্মদ আর তার ছেলে থালায় করে একটু একটু জল তুলে প্রথম ওদের দুটো ছাগলের চামড়ার থলে বোঝাই করলে। শেষে উটের মুখের সামনে বালতি বসিয়ে ধীরে ধীরে জল ঢেলে দিলে। আগে ঊর্বশী, তারপর তার মা বালতিতে মুখ জুবড়ে জল শুষতে লাগল। ব্যস–ওই পর্যন্ত, আর দাঁতে কাটবার কুটোটি জুটল না।

আমরা অবশ্য সকলেই দাঁতে কিছু কাটলাম। আবার সেই চীনাবাদাম আর সেই খেজুরের পিণ্ডি-সঙ্গে লবণ ও কাঁচা পেঁয়াজ। এক বস্তা বাদাম আর এক বস্তা খেজুরের কতটুকুই বা খরচ হয়েছে এ পর্যন্ত। অক্লেশে সবাইকে এক এক মুঠো দিলেন ভৈরবী। কিন্তু কাঁচা চীনাবাদাম চিবুনী কি চাট্টিখানি কথা! ভাজা বা পোড়ানো অনায়াসে চিবোনও যায় আর তা গিলে পেটেও রাখা যায়। তবুও যা হোক কিছু উদরস্থ হল। তারপর জল দিয়ে উদরের বাকি জায়গাটুকু বোঝাই করা গেল। আটা জলে গুলে গুড় মিশিয়ে আজ আর কেউ খেলে না। দু-একজন জলে আটা আর গুড় গুলেও মুখে দিতে পারলে না। উটদের মুখের সামনে নামিয়ে দিয়ে এল। ওরাও মুখ ছোঁয়ালে না। খাবে কি-ওদের চোখেও ত্রাস ফুটে উঠেছে।

ঠিক ত্রাস না হলেও সকলেরই চোখেমুখে একটা কালো ছায়া পড়েছে। জয়াশঙ্কর গেছেন, সঙ্গে নিয়ে গেছেন আমাদের মনের বলটুকু। তীর্থদর্শনের উদ্যম উৎসাহ কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে, মনে দেহে কোথাও তার ছিটেফোঁটাও এখন খুঁজলে মিলবে না। ভালো কথা ভালো ভাবে ভাবাও যাচ্ছে না। বার বার নজর গিয়ে পড়েছে মণিরামের দিকে।

রোদ চড়বার সঙ্গে সঙ্গে মণিরামের জ্বরও চড়তে লাগল। তাকে খাঁটিয়ার উপর শুইয়ে খাঁটিয়ার পায়াগুলোর সঙ্গে চারটি লাঠি বেঁধে উপরে একখানা কম্বল খাটানো হল। অন্তত নীচের তাপ থেকে তো রক্ষা পাক। প্রথম কিছুক্ষণ ছটফট করলে মণিরাম, তারপর নির্জীব হয়ে পড়ে রইল।

কাঁচা বাদাম খেজুর আর পেট ভরে জল খেয়ে দু-তিনজন বমি করতে শুরু করলে। থিরুমলকে এক ফোঁটা জলও গেলানো গেল না। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে, ও ভয়ানক একটা চিন্তায় পড়েছে।

এবার সেই মারাত্মক লগ্নটি উপস্থিত হল। ভগবান ভাস্কর ধীরে-সুস্থে এগিয়ে এসে আমাদের মাথার উপর গ্যাঁট হয়ে বসলেন। বসে মনে মনে বললেন- “দেখি এবার তোরা যাস কোথা!”

সকলের সব রকম আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। কারও মুখে আর টু শব্দটি নেই। কেউ ওঠে কেউ বসে-কেউ আবার ও কম্বলের নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। কেউ বা খানিক লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে বেড়ায়। হু হু করে ঝড় বইতে লাগল। রাশি রাশি তপ্ত বালি সাঁই সাঁই করে উড়ে পশ্চিম থেকে পুবে পালাচ্ছে। সকলকেই মাথা মুখ সর্বাঙ্গ কাপড় কম্বল দিয়ে ঢেকে ফেলতে হল। এখন আর অন্য কোনো ভাবা চিন্তা মাথায় নেই-কেবল এক চিন্তা, পা রাখবার মতো একটু স্থান চাই জননী ধরিত্রীর উপর। নয়ত শূন্যে ভেসে থাকা যায় এমন কিছু একটা উপায় হওয়া এখনই প্রয়োজন।

এখানে এখন শূন্যে ভেসে থাকাও সম্ভব নয়। নীচ থেকে বালির তাপ উঠে পুড়িয়ে মারবে। তা যদি না হত তাহলে অন্তত একটা পাখিকেও এখানকার আকাশে উড়তে দেখা যেত। সেই সকাল থেকে একটা কাকপক্ষীও চোখে পড়েনি। সমস্ত আকাশখানা জুড়ে একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড ভেসে বেড়াচ্ছে, আর কোনো কিছুর স্থান নেই সেখানে।

গ্রীষ্মকালে বাংলা দেশে প্রাণ আইঢাই করে। সেখানে সে রকমের কিছু করে না। প্রাণ মন আত্মা শরীর, এক কথায় সমস্ত সত্তা জ্বলতে থাকে সেখানে। সে জ্বলুনি ভাসায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মাথার খুলি থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত কোথাও কোনো সাড়াই থাকে না। বাইরেটা জ্বলছে ভিতরটা জ্বলছে–মনে হচ্ছে যেন ভিতরে দাউ দাউ করে চিতার আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের শিষ বেরুচ্ছে নাকমুখ দিয়ে, চোখ দিয়েও।

এক একটি মুহূর্ত মনে হতে লাগল আস্ত এক একটি দিন। নাক মুখ চোখ কান সমস্ত কম্বলে ঢাকা, তার মধ্যে গুনে গুনে শ্বাস টানছি। যখন শ্বাস টানছি ফেলছি তখন অনলের হলকা ভিতরে গিয়ে ঢুকছে, ঢুকে ভিতরটা ঝলসে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে থেকে আবার যখন শ্বাস টানছি তখন চোখ ঠেলে প্রাণটা বেরিয়ে আসবার যোগাড় করছে-কিছুতেই স্বস্তি নেই।

আমার মাথার উপরে রূপলাল একখানা কম্বল টাঙিয়ে দিয়ে গেছে, আর যা কিছু কাপড় চাদর ছিল সঙ্গে সব বিছিয়ে তার উপর চেপে বসে আছি, সেগুলো এত তেতে উঠল যে, ভয় হল দপ করে জ্বলে না ওঠে, ডাইনে বায়ে সামনে পিছনে ওপরে নীচে শত শত চিতা দাউ দাউ করে জ্বলছে। পরিত্রাণ কোথায়?

শুনেছি-সতীদাহের সময় মেয়েদিকে চিতার উপর বাঁশ দিয়ে চেপে ধরে থাকা হত। সতীদাহ প্রথাটিকে মন্দ বলতে আমারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ওই বাঁশ দিয়ে চেপে ধরা কাজটিকে সমর্থন না করে পারি না। যারা ওই ভাবে চেপে ধরে থাকত মেয়েটিকে, তাদের আমি কোনো মতে নিষ্ঠুর বলতে পারব না। এবং বলব তারা একান্ত দয়ার বশেই ওই কর্মটি করত। তা না হলে স্ব-ইচ্ছায় সুস্থচিত্তে জ্বলন্ত চিতার উপর বসে আগাগোড়া ধীরেসুস্থে পোড়ার সাধ্য হত না কারও, তা স্বামীভক্তি যতই থাকুক না কেন মনে-প্রাণে ঠাসা। একান্ত দয়ার বশেই বউটির আত্মীয়স্বজন তাকে ওইভাবে চিতার উপর বাঁশ দিয়ে চেপে ধরে থাকতেন। সতীর মনের জোরের আর স্বামীভক্তির বহর দেখে ধন্য ধন্য পড়ে যেত। নয়তো শতকরা একশো জন সতীই আগুন জ্বলে উঠলে পর চিতার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে দৌড় মারতেন এ কথা হলফ করেই বলা চলে।

কিন্তু আমাদের জ্বলন্ত বালির বুকে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরবে কে দয়া করে? এক উপায়, হাত-পা দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে চুপ করে পড়ে থাকা। কিন্তু কে কাকে বাঁধে? শেষে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর মুখের উপর থেকে চাদর কম্বল সামান্য সরিয়ে একবার দেখে নিলাম কে কোথায় কি করছে।

আমার বাঁ ধারে ওই ওপাশে গোটাকতক কম্বল দিয়ে একটা গোলমতো নিচু তাঁবু খাড়া করা হয়েছে। তার ভিতর থেকে অনর্গল ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে মাথাটা তার ভিতর গলিয়ে দেখি, ওরা সব ঠাসাঠাসি করে গোল হয়ে বসেছে-আর হাতে হাত ফিরছে লম্বা কলকে। জানি না আজ ওদের শেষ দশা কি হবে! হয়তো বা খানিক পরে ঘাড়ের উপর থেকে মাথাগুলো দুমদাম করে ছিটকে বেরিয়ে যাবে সকলের।

তাড়াতাড়ি নিজের মাথাটা বার করে নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাইরের প্রচণ্ড তাপ আর কম্বলের তাঁবুর ভিতর ওই উৎকট ধোঁয়া। তার মধ্যে আরাম করে বসে টানের পর টান লম্বা কলকেয়। নির্ঘাত বুকের জোর না থাকলে মানুষ ও কাজ পারে কি করে! আর খালি পেটে করবেই বা কি, অন্তত ধোঁয়া দিয়ে তো কিছুটা ভরতি হবে পেটের।

লাফাতে লাফাতে গেলাম মণিরামের কাছে। জন চার-পাঁচ বসে আছে ওর খাঁটিয়া ঘিরে। মণিরামের কপালে জলপটি দিয়ে অনবরত ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই আগুনের হলকায় জলপটি কতটুকু উপকারে আসবে! হাঁসফাঁস করে হাঁপাচ্ছে ছোকরা। গায়ে হাত না দিয়েই বেশ বোঝা যায় জ্বরের প্রতাপ

ওদের ওখানে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করা যায় এখন? কিছুই মাথায় এল না। একটা জুতসই সাহসের কথাও শোনাতে পারলাম না মণিরামকে। রক্তবর্ণ চক্ষু দুটি মেলে সে একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, একটা কিছু তাজ্জব কাণ্ড ঘটবেই যাতে এযাত্রা রক্ষা পাবে ছোকরা। আর কি করব?”

সরে পড়লাম ওদের কাছে থেকে। একটু দূরে উট দুটো বসে রয়েছে। কোনো আচ্ছাদন নেই ওদের উপর। পাশেই আটার বস্তায় হেলান দিয়ে গুলমহম্মদ আর তার ছেলে বসে আছে। ওদের আচ্ছাদন হচ্ছে মাথার পাগড়ির ফালতু লম্বা অংশটুকু। তাই দিয়েই ওরা মুখ ঢেকেছে।

ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় কুন্তীর আর ভৈরবীর সংবাদ পেলাম। গুলমহম্মদ আঙুল দিয়ে কুয়োটা দেখিয়ে দিলে।

সেই দিকেই চললাম। দেখেই আসি-কোথায় কি ভাবে আছে তারা। কুয়োর ধারে পৌঁছে দেখি–কই, কোথাও তো কাকে দেখা যায় না! গেল কোথায় তারা? আরও এগিয়ে দেখতে পেলাম-কুয়োর ভিতর লাঠি চাদর কম্বল দিয়ে বেশ একটি চমৎকার ছোট্ট তাঁবু বানানো হয়েছে। তাঁবুর একটা দিক অল্প একটু খোলা। সেখান দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, ভৈরবী কুন্তী আর সুখলাল একটি নেহাত প্রয়োজনীয় কর্মে ব্যস্ত। ওদের গায়ে মাথায় কাঁথা কম্বল জড়াতে হয়নি। একরকম শান্তিতেই আছে ওরা। চীনাবাদাম না আখরোট কি একটা জিনিস ভাঙছে আর চিবুচ্ছে

আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি কুয়োয় নেমে তাঁবুতে ঢোকবার জন্যে ভৈরবী চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কুয়োর তলায় বালির নীচেই জল, সেই জন্যেই ওরা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আমার তখন সেখানে নামা সম্ভব নয়। পাড়ের বালি তেতে আগুন আর শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়েছে। নামতে গেলে রাশীকৃত বালি আমার সঙ্গেই নেমে যাবে পাড় থেকে। তখন ওদের ওই তাঁবুর দশা হবে কি? তারপর আবার উপরে উঠে আসব কেমন করে? ওই পাড় বেয়ে হড়কে নেমে যাওয়া হয়তো সম্ভব কিন্তু এখন উঠে আসা ওখান থেকে সম্পূর্ণ অসম্ভব…সর্বাগ্রে ফোস্কা পড়ে যাবে। ওদের কাছেই বা এখন থাকি কি করে? দলসুদ্ধ সবাই জ্বলেপুড়ে মরছে আর আমি কোন মুখে এখন মেয়েদের কাছে আরামে বসি থাকি?

হেঁকে বললাম, “ওখানে এখন আমার যাওয়া অসম্ভব, ভয়ঙ্কর জ্বর মণিরামের, সেখানেই এখন যাচ্ছি আমি। যদি ঠাণ্ডা জল থাকে ত দাও এক ঘটি খেয়ে যাই।”

জলটা ঠাণ্ডাই ছিল। নীচ থেকে সুখলাল লোটাটা বাড়িয়ে দিলে। হাত বাড়িয়ে ধরে নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে চলে এলাম। থাকুক ওরা আরাম করে ওখানে।

খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে আকাশ থেকে। হিলহিল করে উত্তাপ উঠছে বালির বুক থেকে। চোখ মেলে থাকলে স্পষ্ট মনে হয় যেন বর্ণহীন আগুন লকলক করে লাফিয়ে উঠছে আকাশপানে। সাধ্য নেই আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইবার, প্রয়োজনও নেই তার। চোখ বুজেই বেশ মালুম হচ্ছে যে, মাত্র হাত দুই পশ্চিমে ঢলেছেন সূর্য। ভয় হল-কাপড় কম্বলে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যাবে না তো?

মণিরামের কাছে ফিরে এসে তার মাথার দিকে খাঁটিয়ার এক কোনায় বসলাম। ওর নাক মুখ চোখ ফুলে উঠেছে। একজনকে এক কুঁজো জল আনতে বললাম।

এক কুঁজো দু-কুঁজো করে আট কুঁজো জল ঢালা হল। ফলে মণিরামের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবে বইতে লাগল। মনে হল মাথায় যে রক্ত উঠেছিল তা এবার নামছে।

খালি কুঁজোগুলো ভরতি করবার জন্যে ভৈরবীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। বসে বসে চর্বণক্রিয়ার সঙ্গে কুঁজোগুলোও ভরতি করুক ওরা। ওদের তাঁবুর মধ্যেই জল-বালি সরালেই মিলবে।

পোপটলাল এলেন, এসে খাঁটিয়ার পাশে বালির উপর বসে পড়লেন। অনেকেই এল এবং চলে গেল। কি করবে, কেউ কোথাও স্থির হয়ে তিষ্ঠতে পারছে না।

রক্তচক্ষু করে পোপটভাই মণিরামের দিকে চেয়ে বসে রইলেন-একেবারে নির্বাক নিস্পন্দ। সকলেই প্রায় তাই, কারও মুখে রা নেই। কেবল শোনা যাচ্ছে মণিরামের শ্বাসের আওয়াজ। তখনও সমানে জল ঢালছি তার মাথায়।

বেলা গড়িয়ে চলল। রোদ না কমলেও সময় ঠেকে রইল না। দিন শেষ হয়ে এল। তখনও হুঁশ ফিরে পাবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না রুগীর। রূপলালকে ডেকে বললাম, “সকলকে বলো এক কুঁজো জল আনতে আরও জল ঢালব মণিরামের মাথায়।

আবার থালায় করে ছেঁচে ছেঁচে কুয়ো থেকে জল তুলতেও কারও বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, যতই দিকদারি লাগুক না কেন। ছুটল সবাই কুঁজো নিয়ে।

গুলমহম্মদ এসে দাঁড়াল। বেরুবার সময় হয়ে এল আমাদের। কি করবে সে, উটেদের পিঠে মালপত্র বাধঁবে কি?

বললাম, “আরও একটু সবুর করো। রোদ পড়ুক আরও। নয়তো বেরুব কি করে একে নিয়ে? আরও জল ঢালা হোক এর মাথায়। তারপর কুঁজোগুলো ভরতি করে নিয়ে বেরুনো যাবে।

পাগড়ির মধ্যে আঙুল চালিয়ে বুড়ো মাথায় উকুন খুঁজতে লাগল।

লাফাতে লাফাতে শ্ৰীমান সুখলাল উপস্থিত। জরুরি সংবাদ এনেছে একটি। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললে সেই গুহ্য কথাটি। একটি প্রাণজুড়ানো সংবাদ। কুয়োর মধ্যে বালি সরাতে সরাতে একখানা শুকনো কাঠ মিলে গেছে। বাবাজি তাই জানতে এসেছে যে, এখান থেকে যাবার আগে চায়ের জল গরম করবে কিনা। ওইটুকু কাঠে চায়ের জলই শুধু গরম হতে পারে ৷

শ্রীমানকে সম্মতি দিয়ে ফেরত পাঠালাম। বললাম, “বেশ অনেকটা জল চড়াওগে। অনেকেই চা খাবে। আর মণিরামের জন্যে এক লোটা জলে মিছরি দিয়ে নিয়ে এসো।”

চা খাবার কথাটি গুলমহম্মদকে জানিয়ে বললাম, “দেখো গিয়ে ওখানে, আগুন জ্বালাতে গিয়ে সর্বস্ব না পুড়িয়ে ফেলে ওরা।”

বুড়ো মহাখুশি। চা হচ্ছে-এটি তার কাছে সবচেয়ে বড় সুসংবাদ।

আবার জল ঢালা শুরু হল মণিরামের মাথায়। অনেকক্ষণ পরে সে চোখ মেলে চাইলে। ধরাধরি করে তাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলাম। উঠে বসে মণিরাম ধীরে ধীরে মিছরির শরবত গিলতে লাগল।

খাঁটিয়া ছেড়ে নেমে এলাম। পোপটলাল প্যাটেল উঠে এলেন, এসে আমারই সামনে দাঁড়িয়ে আমার দু-হাত জাপটে ধরলেন। কোনো কথা নেই তাঁর মুখে–

বেশ বুঝলাম কি তাঁর মনের কথা, কি তিনি বোঝাতে চান।

হাত টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময় নয় এখন। কোনো রকমে পৈতৃক প্রাণটুকু ধরে থাকতে থাকতেই সবাইকে নিয়ে ফিরতে পারলে বাঁচি এই সাক্ষাৎ যমালয় থেকে। তখন বোঝা যাবে ওই সব কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ ইত্যাদি ভাল ভাল জিনিসের মাহাত্ম্য। এ সময় সব কিছুই বিষতুল্য বোধ হচ্ছে।

কাপড়-কম্বলগুলো খুলে মোটঘাট উঠের পিঠে বাঁধা আরম্ভ হল। কুঁজোগুলি আবার ভরতি করতে করতেই চা হয়ে গেল। ভাত রাঁধবার ডেকচিতে করে দু-ডেকচি চা বানিয়েছে কুন্তী। পোপটলালও একটু চা পান করলেন। হাতে হাতে প্রমাণ হয়ে গেল, “দারুণ গ্রীষ্মে চা একমাত্র শীতল পানীয়।”

খাঁটিয়ার উপর মণিরাম যাবে। ভৈরবীর জন্যে এক অভিনব ব্যবস্থা। তিনি যাবেন ঊর্বশীর মায়ের পিঠে মালপত্রের উপর চড়ে। গুলমহম্মদ তাঁকে বুঝিয়েছে-এতে কোনো মুশকিল নেই। মুশকিল আর কি-তাদের দেশের আওরতরা ত ওই ভাবে উটে চড়ে হামেশা ঘোরাফেরা করে। ভৈরবীও তৈরি। কিন্তু সামান্য একটু বাড়তি মুশকিল দেখা গেছে তখন। তা হচ্ছে, টাল সামলাবার জন্যে দু-হাত দিয়ে ধরবেন কি?

সে মুশকিলের আসান হয়ে গেল। উটের পিঠে আটার বস্তাগুলো তো একগাছা মোটা কাছি দিয়ে কষে বাঁধা হয়ই, সেই কাছি দু-হাতে ধরে থাকলেই হল। কিছু না ধরেই তো বেশ স্বচ্ছন্দে ও-দেশের মেয়েরা একরকম ঘুমোতে ঘুমোতেই উটের উপর বসে চলে যায়। সুতরাং ভাবাবার কিছু নেই।

বুদ্ধি খাঁটিয়ে গুলমহম্মদ বড় উটটার পিঠের মাঝখানে একটু সমতল স্থান বানাল। আটার বস্তাগুলো দু-ভাগ করে উটের দু-পাশে সাজিয়ে বেঁধে ভৈরবীর জন্যে আরামের স্থান বানাতে সে কিছুমাত্র কসুর করলে না। তার উপর কম্বল বিছানো হল। এইবার চড়বার পালা। একবার চড়ে বসতে পারলে তখন আর পায় কে ভৈরবীকে বালির উপর দিয়ে যে হাঁটতে হবে না এইটিই সবচেয়ে বড় কথা।

উর্বশীর মা বসে আছে। তারপাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ভৈরবী। দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখলেন কতটা উঁচুতে চড়তে হবে। ঊর্বশী বসে থাকলে তার পিঠে বাঁধা খাঁটিয়ার পাড় নাগাল পাওয়া যায়। তাই ধরে কোনো রকমে ঝুলতে ঝুলতে উঠে পড়েন তিনি খাঁটিয়ার ওপর। কিন্তু এখন– উর্বশীর মা’র পিঠের উপর চড়া সহজ কথা নয়। ঊর্ধ্বমুখ করে ওপর দিকে তাকিয়ে ভৈরবী মতলব ঠাওরাতে লাগলেন।

বুড়ো গুলমহম্মদ নিজের হাঁটুতে দু-হাত দিয়ে পিঠ পেতে দাঁড়াল। ওর পিঠে দাঁড়িয়ে উটের ঘাড়ে চড়তে হবে।

ভৈরবী নারাজ।

কুন্তী এগিয়ে এল। বললে, “উঠে দাঁড়ান আমার কাঁধে, তারপর উপরে উঠে পড়ুন।” কুন্তি

চিঁড়ে-চ্যাপটা হয়ে যাবে-ভৈরবী ঘাড় নাড়লেন।

শেষে কি করি-সবাই অপেক্ষা করছে তাঁর উটের চড়ার জন্যে-এগিয়ে গেলাম।

“ধরো দড়ি বাগিয়ে– ঠেলে তুলে দিচ্ছি।”

তাই হল। দড়ি ধরতেই পেছন থেকে ঠেলে তুলে দিলাম। হাঁচোড় পাঁচোড় করে কোনো রকমে তিনি চড়ে বসলেন নিজের আসনে। এইবার ঊর্বশীর মা উঠে দাঁড়াবে।

“হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার!”

ওরা বাপ-বেটা দুজনে উটের দু-পাশে সাবধান হয়ে দাঁড়াল।

“হ-হট্-হৈ-হট্‌-হট্!” সামনের পেছনের চারখানা পায়ের আটখানা ভাঁজ খুলে খুলে উট উঠে দাঁড়াচ্ছে। উপরে ভৈরবী দড়ি ধরে একবার এ কোণে একবার ও কোণে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলাচ্ছেন। নীচে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমছে। যাক্-এইবার চলা শুরু হবে।

“জয় শ্রীহিংলাজ মাতা কি–”

“জয়!”

কিন্তু ও কি! পেছন ফিরে কে আবার বসে রইল ওখানে? কে ও?

থিরুমল ৷

কি আবার হল ওর? কাছে গিয়ে ডাকলাম, “থিরুমল!”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। চোখ বুজে বসে আছে। এইমাত্র তো চা খেয়ে এল। এর মধ্যে আবার কি হল?

একটা হাত ধরে টান দিলাম–”থিরুমল, ওঠো-আমরা যাচ্ছি যে।”

কোনো উত্তর দিলো না থিরুমল। হাতখানা ছাড়িয়ে নেবার জন্যে টানাটানি করতে লাগল। পোপটলাল এসে তার আর একটা হাত ধরলেন

“কি হয়েছে তোমার? ওঠো।“

থিরুমল বললে, সে আর যাবে না। এখান থেকেই ফিরবে করাচী। উত্তর শুনে একেবারে হতভম্ব। ওর দু-হাত ধরে আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। কি বলব? এখন কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। এ অবস্থায় পড়তে হবে বলে কেউই তৈরি ছিলাম না। তখন কুন্তী এগিয়ে এল কাছে। থিরুমলের সামনে দাঁড়িয়ে একান্ত মিনতি করে বললে, “ওঠো আমরা যাচ্ছি যে।”

কয়েক মুহূর্ত থিরুমল কুন্তীর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর আমাদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

চক্ষের নিমেষে ঘটে গেল এক তাজ্জব কাণ্ড। থিরুমল খপ করে কুন্তীর একখানা হাত ধরে ফেললে এবং পরমুহূর্তেই কুন্তীকে টানতে টানতে নিয়ে ছুটল। কি যে হল বা হচ্ছে এসব আমাদের মাথায় ঢোকাবার আগেই অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে গেল কুন্তীকে। তার হাত ছাড়াবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করতে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল কুন্তী।

সবাই আমরা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উটের উপর থেকে ভৈরবী চিৎকার করে উঠলেন, “ধরো-ধরো ধরো ওদের। নিয়ে গেল যে।”

দৌড়ে গেল অনেকে, ঘিরে ধরলে ওদের। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গেলাম সেখানে। কুন্তীকে থিরুমল কিছুতেই ছাড়বে না। এখনই তাকে নিয়ে ফিরে যাবে করাচী I আমরা আপত্তি করবার কে?

কাছে গিয়ে থিরুমলকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, “বেশ তো আমরাও তো ফিরে যাবো করাচী-একলা তুমি ফিরবে কেমন করে-মানে, তুমি-”

আর এগোল না আমার কথা। কাকে বোঝাবার চেষ্টা করছি আর কেই বা শুনছে আমার কথা! কারও কোনও কথা ও শুনবে না। চোখ পাকিয়ে বললে, এখনই ফিরে যাবে সে তার কুন্তীকে নিয়ে। তখনও কুন্তী চেষ্টা করছে হাতখানা ওর মুঠো থেকে ছাড়াবার জন্যে। কিন্তু সে মুঠো কি সহজে ছাড়ানো যায়?

এ তো এক মহা বিপদ ঘটল দেখছি! এই পাগলকে এখন রাজি করানো যায় কি করে? অকূল সমুদ্রে পড়লাম।

রূপলাল সামনে এসে দাঁড়াল। থিরুমলের দুই কাঁধের উপর দুই হাত রেখে সে বললে, “ঠিক বন্ধু, ঠিক। চলো আমরা ফিরে যাই করাচী। আর কিছুতেই সামনে এগোনো নয়। এখনই আমরা করাচী ফিরে যাব।”

সামান্য একটু সময়-রূপলালের চোখের উপর নিজের চোখের দৃষ্টি স্থিরভাবে রেখে থিরুমল কুন্তীর হাত ছেড়ে দিলে। তারপর দু-হাত দিয়ে জাপটে ধরলে রূপলালকে। এখন সে মহাসুখী-তার চোখে-মুখে আনন্দ উথলে উঠেছে। বন্ধু রূপলালও ফিরে যাবে তাদের সঙ্গে, এর চেয়ে বড় কথা আর কি আছে।

ছড়া পেয়ে কুন্তী পিছনে ফিরে দৌড়। দৌড়ে গিয়ে লুকাল ভৈরবীর উটের পাশে। থিরুমলের কাঁধে হাত রেখে রূপলাল ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে আমাদের সকলের অনেকটা আগে চলল। গুলমহম্মদ পেছনে থেকে হেঁকে হেঁকে ডাইনে বাঁয়ে বলে রূপলালকে চালাতে লাগল। আমরা দলসুদ্ধ সবাই উট দুটিকে নিয়ে ওদের পেছন পেছন চললাম।

চন্দ্ৰকূপ। চন্দ্ৰকূপ পৌঁছতে আর মাত্র দু-দিন বাকি।

নেমে গেলেন পশ্চিমদিকে সূর্যদেব। আমাদের শেষবারের মতো শাসিয়ে গেলেন, “দাঁড়া, কাল আবার ঘুরে আসি। তখন তোদের ভালো করে দেখে নেব।” মনে হল একান্ত অনিচ্ছায় তাঁকে বিদায় নিতে হচ্ছে। যেতে হচ্ছে কারণ তাঁর চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী কার অদৃশ্য হস্ত তাঁকে জোর করে টেনে নামিয়ে নিয়ে গেল আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। জানি না আজ ঠাকুরের বরাতে কি ঘটবে সেই অতি-শক্তিশালীর হাতে-যাক্ গে–

আপাতত আমাদের নিষ্কৃতি মিলল তো ওঁর হাত থেকে। এই-ই যথেষ্ট। পরম কৃতজ্ঞ অন্তরে দু-হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে সেই অদৃশ্য হস্তের মালিককে প্রণাম জানালাম। একান্ত তুচ্ছ-একান্ত অসহায় এই কজন মনুষ্য-সন্তানের-অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতার যে শ্রদ্ধার্ঘ্য সেই সর্বনিয়ন্তার উদ্দেশে নিবেদিত হল তা যথাস্থানে পৌঁছল কিনা কে জানে! আমরা কিন্তু শান্তি পেলাম।

কিন্তু সে কতক্ষণের জন্যে?

শান্তি বস্তুটি ঠিক কি জাতের পদার্থ তার হদ্দ হদিস কি কেউ কখনো দিতে পেরেছে! কি হলে বা কি করলে, শান্তিলাভ হয় এইজন্যে সকলে ব্যতিব্যস্ত। এইটি যদি ঠিক এই রকমের না হয়ে ওই রকমের হত, হাতে না পাওয়া বস্তুটি যদি ষোল আনা দখলে এসে যেত, কিংবা দুনিয়ার তামাম ঘটনাগুলি যদি হুবহু আমার মনের মতো করে ঘটত, তবেই না নির্জলা শান্তিভোগ করা যেত। এই জাতের উচ্চাশা বুকে নিয়ে শান্তি বস্তুটিকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্যে দুনিয়াসুদ্ধ সকলে এতই উৎকট উদগ্রীব যে, তার ফলে ঠিক বিপরীতটি ঘটে বসেছে। শান্তি লাভার্থে বা স্থাপনার্থে হানাহানি কামড়া-কামড়ি এমন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে যে, প্রকৃত শান্তি কি জিনিস এবং তার স্থায়িত্বই বা কতটুকু এ সমস্ত চিন্তা-ভাবনা আমার মন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছি।

বর্তমানে যে অবস্থায় পড়ে আছি এটি থেকে উদ্ধার পেলেই সুনিশ্চিত শান্তি লাভ-এই ধরনের চিন্তায় অষ্টপ্রহর সবাই হাঁকুপাঁকু করে মরছি। যে মুহূর্তে পরের দশাটিতে পৌঁছনো গেল অমনি আবার আরম্ভ হল হাঁসফাঁসানি-কি করে এটি থেকেও অচিরাৎ উদ্ধার পাওয়া যায়। অবিরত এই ই চলেছে। বর্তমান নিয়ে কেউ তুষ্ট নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে যত মাথাব্যথা। এই দুরারোগ্য ব্যাধিটির হাত থেকে মুক্তি পাওয়াকেই শান্তি বলা চলে কিনা কে জানে।

কিন্তু এই ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া কি সহজ কথা? আশা করারই যদি কিছু না রইল বেঁচে থাকার সুখটা কোথায়? মন নামক পদার্থটি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা যাবে কোথায়? আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মারতে হলে মনকেও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে হবে। কোনো উপায়ে যদি এই কর্মটিকে একবার সমাধা করে ফেলা যায়-তাহলের শুধু শান্তি কেন–যাকে বলে আপদের শান্তি-তাই হয়ে যাবে।

কিন্তু সেই মনের নাগাল পেলে তো! সে কাজটি আরও ভয়ানক শক্ত ব্যাপার।

এধারে খালি পেটে আর কতক্ষণ আমরা মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখি? যে কোনো রকমের একটা পেটে পোরার মতো জিনিস দিয়ে পেটটা যদি বোঝাই থাকে, তখন ধমক দিয়ে চোখ রাঙিয়ে মনকে দাবিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব-”ছি, হ্যাংলার মত এদিক-ওদিক তাকাতে নেই!”

কিন্তু এ যে একেবারে পেটের মধ্যে ঘটছে কিনা ব্যাপারটা বাইরের কোনো কাণ্ড তো নয় যে, মনকে চোখ বুজে থাকতে বলব। এ যে একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। নিজের ঘরের ভিতর যদি অবিরাম কান্নাকাটি চলতে থাকে–”ওগো দাও, আমায় কিছু দাও গো”, তখন সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে যে। তখন কে কাকে দাবায়, আর কি বলেই দাবায়?

গ্রাসাচ্ছাদনের আচ্ছাদনটুকু না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু গ্রাসটুকু পর্যন্ত বাদ পড়লে নিজেরই গ্রাসের মধ্যে ঢোকবার যোগাড় হয়ে দাঁড়ায়।

যা হোক একটা গ্রাসের ব্যবস্থাটুকুও যদি কায়েম থাকে, তখন চোখরাঙানো সবাই সহ্য করে-তা ভিতরের মনই হোক আর ঘরের পরিবারই হোক। যেখানে সেটুকুও জোটে না সেখানে মুখের উপর জবাব শুনতে হয়, “ভাত দেবার কেউ নয়, কিল মারবার গোসাঁই!” এই মোটা কথাটা তলিয়ে না বুঝে মনকে চোখ ঠারলে হবে কি! ক্ষুধাকে কি গোঁজামিল খাইয়ে তুষ্ট করা যায়?

এক উপায় হচ্ছে ক্ষুৎপিপাসা জয় করা। শোনা যায় এজন্যে নাকি নানা রকমের যৌগিক পন্থাও বাতলানো আছে। জানি না সেই সব পন্থাগুলিও অব্যর্থ কিনা। তা যদি হয় তবে জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে স্কুল-কলেজ খুলে সকলকে ওই বিদ্যায় পোক্ত করে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তা হলে পৃথিবীর পনেরো আনা গণ্ডগোল যায় চুকে। যাদের পেটের দায় নেই তাদের শান্তির কথা বোঝানো সহজ, আর তা হৃদয়ঙ্গম করে তারা নির্দিষ্ট নিরাসক্ত চিত্তে জগতে শান্তি স্থাপনের কাজে আত্মনিয়োগও করতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ তা না হচ্ছে ততক্ষণ শান্তির মেয়াদ একান্তই এতটুকু মাত্ৰ।

কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত যাওয়ার দরুন হাঁফ ছেড়ে-বাঁচা বহু-দুঃখে-পাওয়া শান্তি ক্রমে ক্রমে মিইয়ে এল। তখন সর্বত্র যা হয়ে থাকে তাই শুরু হল। খালি পেটে একে অন্যের ছুতো খুঁজবেই। লেগে গেল ঝগড়াঝাঁটি।

এই নিয়ম। দুনিয়ার সর্বত্র ছোট বড় যত ঝগড়া-বিবাদ বেধেছে বা বাধব বাধব করছে, তলিয়ে খুঁজলে দেখা যাবে সকলটির মূলেই ঐ একটি হেতু। ক্ষুধা-শাশ্বত সর্বজনীন সার্বত্রিক ক্ষুধা। ছোট্ট দুটি অক্ষরের তুচ্ছ কথাটি কিন্তু কি অপরিসীম শক্তি যে লুকিয়ে আছে ওর মধ্যে! ন্যায়নীতি ধর্মাধর্ম সব কিছু ওটির মধ্যে পড়ে নিমেষে ছাই হয়ে যায়। মানুষের মনগড়া আইন কোন ছার-পেটের ক্ষুধা বিধাতার বিধানকেও হার মানায়। ঐ একটি মাত্র জিনিস সঙ্গে নিয়ে জীব ধরিত্রীর বুকে পদার্পণ করে। যে কদিন এখানে টিকে থাকে, ওই ভয়ঙ্কর রোগটি সঙ্গে নিয়েই চলে ফিরে বেড়ায়।

মস্ত বড় তীর্থদর্শন করে মস্ত বড় পুণ্যের বিরাট বোঝাটা ঘাড়ে করে ফিরব এখান থেকে, এই আশায় চলেছি মনের জোরে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা পেটের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল মনের সঙ্গে। মন হার মানল-সেই ভিতরের ধস্তাধস্তিটাই বাইরে এসে দাঁড়াল-যাকে সামনে পাবে তাকেই ছোবল মারবে। আরম্ভ হল খিটিমিটি।

গোকুলদাস ভাট-ঝাড়া সাড়ে পাঁচ হাত লম্বা মানুষ। আমাদের দলে সে-ই সকলের চেয়ে মাথায় উঁচু। আগাগোড়ায়ই লক্ষ করা গেছে যে, চিরঞ্জীলাল নামে একটি বেঁটে জোয়ান ছোকরা গোকুলদাসের কুঁজো আর ঝোলাটা বয়ে নিয়ে চলেছে, আর দু পাশে লম্বা দু-হাত দুলিয়ে নির্ঝঞ্চাট গোকুলদাস মাথা উঁচু করে সকলের আগে আগে এগিয়ে চলেছে। আমরা সবাই মনে করতাম যে, ওই ছোকরা গোকুলদাসের একান্ত অনুগত আপনার লোক। সেই গোকুলদাসে আর চিরঞ্জীলালে লেগে গেল তুমুল কাণ্ড।

চিরঞ্জীলাল তার বেঁটে বেঁটে হাত-পা ছুঁড়ে বলছে-”আমি কি তোমার কেনা চাকর নাকি যে, আগাগোড়া তোমার কুঁজো আর ঝোলা বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে?”

গোকুলদাসের মুখ অনেক উঁচুতে। সেখান থেকে এল এক বিরাট দাবড়ি–”চুপ করে থাক বেইমান। না নিবি আমার কুঁজো তো বড় বয়েই গেল। কিন্তু আমার সেই জিনিসটা কোথায় তাই বল, নয়তো টুটি টিপে একেবারে শেষ করে দেব।” বলে বোধ হয় সত্যি সত্যিই টুটি টিপে শেষ করবার জন্যে তেড়ে এল। অন্য সকলে মাঝে পড়ে অতটা আর হতে দিলে না।

কিন্তু কি সেই জিনিসটি, যার জন্যে টুটি টিপতে যাওয়া? কি এমন ভয়ঙ্কর মূল্যবান পদার্থ সেটি, যার জন্যে খুনোখুনি হবার উপক্রম? ওদের দুজনের কেউ কিছুতেই বলবে না সেই মহামূল্যবান বস্তুটির নাম। শেষে রাগের মাথায় চিরঞ্জীলাল ফাঁস করে দিলে ভিতরের কথাটি। বললে-”ওই লম্বা বদমাশটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল একটা বালিস। সেটার ভিতর ছিল তুলোর বদলে চূর্ণা বোঝাই করা। সকলকে লুকিয়ে ও মাঝে মাঝে চূর্ণা খেত। নিজে খেয়ে কবে সবটা সাবাড় করেছে। এখন বলে যে, আমি নাকি খেয়ে ফেলেছি সমস্ত।”

চূর্ণা আবার কি জিনিস রে বাবা-যার জন্যে এই মহামারী কাণ্ড!

পোপটলাল বুঝিয়ে দিলেন- আটায় জল না দিয়ে বেশি করে ঘি দিয়ে ভাজা যায়-তারপর সঙ্গে চিনি মিশিয়ে নেওয়া হল, তাহলে যে পদার্থ তৈরি হয় তার নামই চূর্ণা। সেই উপাদেয় খাদ্যে বহুদিন নষ্ট হয় না।

হিসেবি গোকুলদাস বাড়ি থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিল যে, পথে খাওয়া জুটবে না। তাই ওই জিনিস সুদূর কাথিওয়াড় থেকে সঙ্গে করে এনেছিল। সেই মহামূল্য খাদ্যদ্রব্য তার সঙ্গে আছে এ কথা সকলে না জানতে পারে এই ছিল তার অভিপ্রায়। জানাজানি হলে তেমন-তেমন অবস্থায় ভাগ না দিয়ে উপায় থাকবে না এই কারণেই এত সাবধানতা। বিশ্বাস করে বলেছিল সে একমাত্র চিরঞ্জীকে। একজনকে অনন্ত না বলে উপায় নেই। বলতে হবে, সামলাতে হবে। শুধু বলা নয়, ভাগও দিচ্ছিল সমানে চিরঞ্জীলালকে। হঠাৎ সেটার সবটুকু উধাও হয়ে যাওয়ায় এই গণ্ডগোল।

বিষম চটে গিয়ে শেষটা গুম হয়ে গেল গোকুলদাস। সবটুকু চেটেপুটে শেষ করেছে চিরঞ্জী এ শোকও বরং সহ্য করা যায় কিন্তু কথাটা সকলের কাছে ফাঁস করে দিয়ে কি লজ্জাতেই ফেলে দিলে সে বেচারাকে। ভাটের উঁচু মাথা হেঁট হয়ে গেল।

এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও এই ব্যাপারে সবাই বেশ মজা উপভোগ করলে। কিছুক্ষণ অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটা গেল। এধারে রাতও যত বাড়ে ক্ষুধাও তত বাড়ে-পথ যেন আর ফুরোয় না। বার বার গুলমহম্মদকে সবাই বিরক্ত করছে, “কতটা পথ আর বাকি আছে?” উত্তর দিতে দিতে বুড়োর মেজাজ গেল বিগড়ে। একে ওই বয়স, তার উপর খালি পেট–কতক্ষণ মেজাজ ঠিক থাকে।

কয়েকটা চড়া চড়া কথার আদান-প্রদান হয়ে গেল।

সর্বাগ্রে চলেছে রূপলাল আর থিরুমল, তারপর বড় উট, যার উপরে ভৈরবী, সামনে গুলমহম্মদ। অন্য সকলে সেই সঙ্গে চলেছে। তারপর ছোট উটের উপর মণিরাম, সঙ্গে পোপটলাল আর দিলমহম্মদ। কুন্তী আর আমি বড় উটের সঙ্গে হাঁটছিলাম। ক্রমেই কুন্তী পিছিয়ে পড়তে লাগল। তার শরীরে সামর্থ্য ফুরিয়ে এসেছে। অন্তিম চেষ্টায় নিজের শরীরটাকে কোনো মতে টেনে নিয়ে চলেছে সে। উপর থেকে তার অবস্থা দেখে ভৈরবী আমাকে সাবধান করলেন, “মেয়েটার উপর নজর রাখুন–ওর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠেছে-এইবার পড়বে।”

তাই করলাম, তার ফলে ক্রমে আমিও পিছিয়ে পড়তে লাগলাম। যতই উৎসাহ দিই কুন্তী ততই পিছিয়ে পড়ে। ছোট উটটাও আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। অনেক আগে বড় উটের পিঠে একটা কালো পদার্থ দুলতে দুলতে চলেছে। অন্ধকারের মধ্যে সেদিকে নজর রাখছি। মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছি কুন্তীকে। শেষে নিরুপায় হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম।

“ধরো আমার হাত, তাহলে জোরে চলতে পারবে।”

কুন্তী দু হাত দিয়ে আমার হাতটা চেপে ধরলে। তার জ্বলন্ত চক্ষু দুটি অন্ধকারে আমার চোখের উপর স্থির ভাবে রেখে কি দেখল, তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল।

কি ব্যাপার! এর আবার হল কি? দাঁড়াতে হল বাধ্য হয়ে। কান্না আর থামতেই চায় না। আমার হাতখানা ওর নিজের মুখের ওপর চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল কুন্তী। যেন কান্না চাপতে গিয়ে নিজেই এবার ফেটে পড়বে। যত জিজ্ঞাসা করি “কি হল কি?” তত কান্না বাড়ে। এ ত মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি।

ওধারে ওরা সব আরও এগিয়ে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে ওদের থামতে বলব নাকি! শেষে নিজেকে একটু সামলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রুদ্ধকন্ঠে কুন্তী জিজ্ঞাসা করলে-”কি হবে আমার?”

এ আবার কোন ধরনের প্রশ্ন? সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম-”তার মানে?” কুন্তী কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার তার কান্না উথলে উঠল। সেই সঙ্গে সে একগাদা প্রশ্ন করে বসল।

“কি হবে আমার? কি হবে আমার বেঁচে থেকে? আমি আর পারি না- আর আমি কোথাও যাব না। আমাকে এখানেই ফেলে রেখে যাও তোমরা। আমি… আমি… আমি…”

বলতে বলতে সত্যিই যে সেইখানে শুয়ে পড়তে গেল। যেন আর খাড়া থাকার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। বসে পড়ার আগেই তার হাত ধরে টেনে খাড়া করে দিলাম। কুন্তী একটু সামলে নিলে। নিয়ে আমার হাত থেকে ওর নিজের হাতখানা ছাড়াবার জন্যে মোচড়াতে লাগল। কান্না মিশিয়ে আবার একরাশ প্ৰশ্ন

“কেন তুমি বাঁচাতে এলে? কেন তখন আমায় মরতে দাওনি? কে তোমায় বলেছিল আমায় বাঁচাতে? আমি ম’লে কি ক্ষতি হত তোমার? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন?”

তার একখানা হাত জোর করে ধরে আছি-সেই ধরা হাতখানার উপর সে কপাল ঠুকতে লাগল সজোরে।

“এখন তুমি কিছুই জানো না, কিছুই বুঝতে চাও না তুমি। তোমাকে কিছু বলা আর পাথরে মাথা খোঁড়া দুই-ই সমান। কেন তুমি আমায় টেনে নিয়ে চলেছ? ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও-আমায়-শান্তিতে মরতে দাও এখানে।’

একটা যে কিছু বলব তারই বা ফুরসত দিচ্ছে কই? কি করি? এটাও খেপে উঠল নাকি? সামনে চেয়ে দেখলাম। অনেক দূরে সবাই চলে গেছে। মনে হল যেন ওরা থেমেছে। ভৈরবী রয়েছেন খোলা উটের পিঠে। নজর করে দেখবার চেষ্টা করলাম। এতদূর থেকে অন্ধকারে স্পষ্ট কিছুই বোঝা গেল না। কিন্তু মনে হল বড় উটটা বসে পড়েছে।

কি হল আবার ওদের? একটা সন্দেহ আর আশঙ্কায় মনটা ভরে উঠল। পড়ল নাকি উটের উপর থেকে? কুন্তীর হাতে একটা ঝাঁকানি দিয়ে তাকে ধমক দিলাম।

“পাগলামি কোরো না-চলে এসো পা চালিয়ে।”

জোর করে সে হাত ছাড়িয়ে নেবেই।-”না, কিছুতেই আর যাব না আমি যাব না তোমার সঙ্গে আর। তুমি আমাকে ফের ওর হাতেই দিয়ে দেবে। তোমার কাছে আমি কিছু নই-এক কানাকড়ি আমার দাম নেই তোমার কাছে। যেদিকে খুশি আমি এখান থেকেই চলে যাব। আমায় তুমি ছেড়ে দাও- আমি…’।

আর ওর কথায় কান দিলাম না। হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে ছুটলাম।

উট থেকে নেমে পড়েছে ভৈরবী। বাধ্য হয়ে তাকে নামতে হয়েছে। মোটা কাছি প্রাণপণে ধরে টাল সামলাতে তাঁর দু হাতের চেটোয় ফোঁসকা পড়েছে। উট থেকে নেমে আমাদের না দেখতে পেয়ে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। এমন সময় খাড়া করে দিলাম, কুন্তীকে তাঁর সামনে।

“ধরো তোমার কুন্তীকে। ওর মাথাটাও বোধ হয় বেগড়াল এবার।”

“মাথায় কি হবে? শরীর আর বাছার বইছে না।” বলে পরম স্নেহে ভৈরবী তাকে জড়িয়ে ধরলেন।

ঊর্বশীকে বসিয়ে মণিরামকেও নামানো হল। তার জ্বর ছেড়ে গেছে। ভৈরবী শ্রীমান সুখলালকে বললেন, সেই ঝোলাটাও নামিয়ে আনতে। সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলাম কোন ঝোলা- কি আছে সেই ঝোলায়?

ঝোলা এলে তার ভিতর থেকে বেরুতে লাগল-পোড়ানো চীনাবাদাম, ছড়ানো পেঁয়াজ, খেজুর কিশমিশ মিছরি। অফুরন্ত ভাণ্ডার। আজ সারা দুপুর সেই কুয়োর মধ্যে বসে এই সব গোছানো হয়েছে। আমরা গোল হয়ে বসে পড়লাম। ভৈরবী সকলের কোলে মুঠো মুঠো দিয়ে গেলেন ভাগ করে। জয় জয় করে উঠল সবাই। রূপলালের পাশে বসে থিরুমল পরমানন্দে চর্বণ করতে লাগল। কোনো গোলমাল নেই। গোকুলদাস প্রথমে কিছুই নেবে না, পোপটলালের ধমক খেয়ে শেষে নিলে। শুধু কিশমিশ আর মিছরি পেলে মণিরাম, বাদাম তাকে দেওয়া হল না। জল খেয়ে সে আর খাঁটিয়ায় চড়তে রাজি হল না। সে এবার সকলের সঙ্গে আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে পারবে। ভৈরবী কিছুতেই শুনলেন না-অগত্যা আবার মণিরামকেই খাঁটিয়ার উপর উঠতে হল।

কুন্তীর কাঁধে হাত রেখে ভৈরবী হাঁটতে লাগলেন। সকলেরই মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হল। বুড়ো গুলমহম্মদের মুখের ভাবটাও যেন একটু নরম হল।

সুযোগ বুঝে বিনীতভাবে এবার আমিই বুড়োকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি শেখ সাহেব, আমরা কি এখনও অর্ধেক পথও পার হইনি?”

মুখ তুলে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু দাড়িতে হাত বুলিয়ে বার দুই মাথা নেড়ে শেখ সাহেব আন্দাজ করে উত্তর দিলেন-”খোদা মেহেরবান-আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই আমরা সামনের কুয়োর ধারে পৌঁছব।” বলে ঊর্বশীর মায়ের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন।

আমরা অগ্রসর হলাম।

মেহেরবান খোদার অপার মেহেরবানিতে বেশ মশগুল হয়ে হাঁটছি আর ভাবছি।

ভাবছি অনেক কিছু। তলিয়ে দেখছি-তাঁর মেহেরবানির আর মর্জির দৌড় কতখানি।

কথায় কথায় আমরা বলে ফেলি, “প্রভু, তোমারই ইচ্ছা, সবই তোমার কৃপা।” এই কৃপাময়ের কৃপার বেড়ে কতটুকু কুলোয় তাই ভাবছি।

সব দিকে সব বেশ সচল অবস্থা, যেটি যেমন হওয়া উচিত তেমনই হচ্ছে, যেটি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় তা কখনো ভুলেও হচ্ছে না। যে কাজে হাত দেওয়া যাক তা এমন স্বচ্ছন্দে অক্লেশে সমাধা হয়ে যাচ্ছে যেন আগে থেকে কার্যটি সমাপ্ত করা ছিল। কোথাও কিছু আটকাচ্ছে না। কাম্যবস্তুটি চট করে হাতের মুঠোয় এসে ঢুকছে, আর যেগুলি হাত ফসকে গেলে বুক চড়চড় করে ওঠে সেগুলি কিছুতেই হাত ফসকাচ্ছে না। ঠিক এইরকম যদি চালু থাকে আগাগোড়া, তবেই না পরম তৃপ্তিভরে বলা যায়, “সবই তাঁর দয়া, সবই তাঁর ইচ্ছা।”

আর তা যদি না হয়–তখন?

যদি একটার পর একটা গড়বড় শুরু হয়ে যায়, সবই যদি বেসুরো বাজতে থাকে– কোনো দিকে হাত বাড়ালেই হাতে ফোঁসকা পড়বার উপক্রম হয়, হেসে কথা কইতে গেলে সবাই দাঁত বার করে ভেংচায়, পদে পদে ঠোকর খেতে খেতে পা হয় ক্ষত বিক্ষত-তখন?

তখন আর মেহেরবানির কথা, দয়া কৃপা করুণা এই সমস্ত মিষ্টি বয়েগুলি মনের কোণেও আসে না। নিজের পোড়া নসিবের দোহাই পাড়া ছাড়া আর কিছুতেই সান্ত্বনা পাবার কোনো উপায় থাকে না তখন। লম্বা লম্বা নিশ্বাস জোরে জোরে বেরিয়ে আসে তখন কলিজা খালি করে। নিজের কপালে করাঘাত করে ‘নিয়তি-সবই নিয়তির খেলা’ বলা ভিন্ন আর কিছুই বেরোয় না তখন মুখ দিয়ে।

তাই ভাবছি আর হাঁটছি।

কোনটির ক্ষমতা বেশি-করুণাময়ের করুণা, না নিয়তির কুটিল পরিহাস? বরাতের ফের, না ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা? বিধির বিধান, না ভাগ্যের বিড়ম্বনা? কোনটি সত্য? কার উপর নির্ভর করে সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে হাত-পা ঝেড়ে চুপ করে বসে থাকা যায়?

একটা কিছু অবলম্বন চাই তো। নয়তো এই যে অবিরাম ডুবছি আর ভাসছি, ভাসছি আর ডুবছি, এর থেকে পরিত্রাণ পাব কি করে? কি সে অবলম্বন যাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে ডুবতে হবে না, ভাসতে হবে না-ভাগ্য, বরাত, বিধির বিধান, করুণাময়ের করুণা, খোদার মেহেরবানি-এর একটিকেও পরোয়া না করে স্বচ্ছন্দে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করা যাবে; বুক দুরদুর করবে না, হাত থরথর করে কাঁপবে না, চোখ ছলছল, পা টলটল, মন ধুকপুক এ-সমস্ত কিছুই ধার ধারতে হবে না?

সেই আঁকড়ে ধরার মতো অবলম্বনটির তল্লাসেই তো ছুটে মরছি। এই যে চলেছি এগিয়ে আরও সামনে, এরও ওই এক উদ্দেশ্য। ওই অবলম্বটিকে তল্লাস করে বার করা, পাকড়াও করা, তারপর বুকের মধ্যে সেটিকে পুরে নিয়ে ফিরে আসা-ব্যস, তা হলেই মোক্ষম লাভ, যাকে বলে একেবারে কেল্লা ফতে।

কেল্লা ফতে করতে চলেছি। ডাইনে বাঁয়ে কোনো দিকে নজর দেবার এখন ফুরসত কই! আর এখনই জুটছে যত সব আপদ বালাই, পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

কান্না আর সেই চিরকালের পুরনো প্রশ্ন, “আমার কি হবে?”

কি হবে তা আমি জানব কেমন করে? জানতে যাবই বা কেন? আর জানলেই বা বলতে যাব কোন্ দুঃখে? কি এমন গরজ আমার?

তোমার হবে কি? এর চেয়ে ঢের বড় প্রশ্ন-আমার নিজের কি হবে? সে প্রশ্নের মীমাংসা কে করে? আজ পর্যন্ত কত দরজায় কতবার মাথা খুঁড়লাম, কত পায়ে চোখের জল ঢালোম, কত আঁস্তাকুড় ঘাঁটলাম, কত ছোটা ছুটলাম, ফল কি পেয়েছি? কোথাও উত্তর মিলল না ওই প্রশ্নের যে, ‘আমার কি হবে?’ কেউ ওর উত্তর দিলে না, সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে। মুখের উপর কপাট বন্ধ করে দিলে বা মুখ টিপে হাসতে লাগল।

আমাকে প্রশ্ন করতে এসেছে, ‘আমার হবে কি?’ যা খুশি যেমন হোক–তাতে আমার কি? আমার কতটুকু ক্ষতিবৃদ্ধি। যত সব উড়ো আপদ! যেতে দাও, যেতে দাও–যত সব বাজে ফ্যাসাদ!

পাশ থেকে ভৈরবী একটি ধাক্কা দিলেন, চমকে উঠলাম।-”কি বকছেন গোঁ গোঁ করে, হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?”

“নাঃ কিছু নয়”, বলে একটি বিড়ি ধরালাম।

বিড়িটি ধরিয়ে মুখ তুলে চেয়ে দেখি দিগন্তে আকাশচুম্বী এক নিকষকালো প্রাচীর চোখের দৃষ্টি আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ওইখানেই পৃথিবীর শেষ হয়ে গেছে।

পায়ের তলায় বালি কখন যে বড় বড় পাথরের চাঙড়ে পরিণত হয়েছে, খেয়াল করিনি। পদে পদে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে সামলে নিচ্ছি। মাথার উপর বহু উঁচুতে তারাগুলি এখনও দপ্ দপ্ করে জ্বলছে, কিন্তু নীচে তকতকে ঝকঝকে বালি না থাকায় ওদের আলো আর কোনো কাজেই লাগছে না। কিসের উপর প্রতিফলিত হয়ে তারার আলো অন্ধকার ঘোচাবে এখানে। ক্রমেই ঘুটঘুঁটে আঁধারের মধ্যে আমরা প্রবেশ করতে লাগলাম।

উঁচুনিচু সরু অসমান পথে সাবধানে পা ফেলে আমরা এগোচ্ছি সামনের উট দুটির উপর নজর রেখে। ছোট-বড় ধারালো ভোঁতা নানা আকারের পাথর সর্বত্র ছড়ানো। তাও চোখে কিছু ঠাওর হচ্ছে না। হোঁচট খেয়ে বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে হাতে পায়ে যা সব ঠেকছে তাতেই মালুম হচ্ছে যে, যেখান দিয়ে আমরা চলেছি তাকে পথ বা বিপথ কিছুই বলে চলে না।

মাথার উপরের আকাশ ক্রমশ ছোট হয়ে আসতে লাগল। সামনের কালো দৈত্যটা ক্রমেই আরও বিরাট আকার ধারণ করল। আমাদের ডাইনে বাঁয়ে তার প্রকাণ্ড ডানা দুটো ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন একটা মজার খেলা আরম্ভ হল। আমরা যত এগোই সেই দৈত্যটাও তত পিছায়। এইভাবে পিছু হটতে হটতে সে তার অন্ধকার রহস্যময় গর্তের মধ্যে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে লাগল। যেন এক জাদুমন্ত্রের প্রভাবে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি।

সামনে থেকে গুলমহম্মদ বলে উঠল, “লা ইলাহা ইল্লালাহ্!” সেই সঙ্গে পুত্র দিলমহম্মদ গলা মিশিয়ে দিলে, “মহম্মদুর রসুলুল্লাহ।” আমরা থামলাম।

উট দুটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে চারিদিকের নিবিড় অন্ধকারের দিকে চেয়ে, ভয় বা ভরসা এর কোনোটিরই বোধ হল না। শুধু দেহে আর মনে একটা থমথমে অস্বিস্ত বোধ পাথরের মতো চেপে বসল।

এই ভাবটা কাটাবার জন্যেই বোধ হয় চিৎকার করে উঠল, “জয় হিংলাজ মাতাকি-”

“জয়!”

আরম্ভ হয়ে গেল, “জয় জয় জয় জয়।” চতুর্দিকের আঁধারের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে শত শত অশরীরী “জয় জয়” করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে সেই ধ্বনি উপরের দিকে উঠতে উঠতে পাহাড়ের মাথায় উঠে তবে থামল। আমরা আরও স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

তখন সকলেই ব্যস্ত হয়ে উঠল আলো জ্বালাতে, কাঠ খুঁজতে, জল আনতে। কুয়ো কই? জল কোথায়?

উট দুটিকে বসিয়ে মালপত্র নামানো হচ্ছে। মণিরাম নেমে এসে সামনে দাঁড়াল ৷ গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর তার সত্যিই ছেড়ে গেছে।

রূপলাল পণ্ডিত থিরুমলকে সঙ্গে করে সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন পণ্ডিতজি যে, আগামী কাল শেষ রাত পর্যন্ত আমাদের ছুটি। এখান থেকে কাল রাত্রিশেষে রওয়ানা হয়ে পরশু বিকালের দিকে আমরা পৌঁছব চন্দ্ৰকূপ। সেখান পরশু রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা চন্দ্রকূপ-বাবার দর্শন করে তবে আবার রওয়ানা, তখন আর পথে কোথাও কোনো তকলিফ নেই।

শুনে সেইখানেই বসে পড়লাম। শুধু বসে পড়া নয়, একেবারে গা এলিয়ে দিলাম ৷ যাক এতক্ষণে নিষ্কৃতি মিলল পুরো চব্বিশ ঘণ্টার মতো। নিশ্চিন্ত।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হবার কি জো আছে! ভৈরবী উপস্থিত-পিছনে কম্বল ঘাড়ে কুন্তী।

কোথায় পাতব কম্বল?”

মুখে এল, “যে চুলোয় খুশি!” কিন্তু তা তো আর বলা চলে না। সুতরাং ঢোক গিলে কথাটিকে আবার পেটের মধ্যে চালান করে দিয়ে বেশ মোলায়েম করে বললাম, “দেখো না কোথায় সুবিধা হয়।” হাত বাড়িয়ে একখানা পাথর টেনে নিয়ে মাথার নীচে দিয়ে ওপাশ ফিরে শুলাম।

জানি এই পাহাড়ের গর্ভে এই আঁধারের অন্য কোথাও সুবিধা হবে না তাঁর। খোলামেলা জায়গায় তারার আলোতে আলাদা জায়গা পছন্দ করতে বাধত না। কিন্তু আজ আর অন্য কোনো চুলোয় যাবার সাহস নেই।

সেইখানে দাঁড়িয়েই একবার চারিদিকে দেখে নিলেন ভৈরবী। কম্বলগুলো ঘাড়ে করে কুম্ভী পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষে তাকে হুকুম হল সেইখানেই কম্বল পাততে। তাই হল এবং সঙ্গে সঙ্গে সটান শুয়ে পড়ে একটা লম্বা “আ-।” উচ্চারণ করলেন তিনি।

কুন্তীকেও তাঁর পাশে শুয়ে পড়বার আদেশ হল। “কাজ নেই আর এই শেষরাতে রান্নাবান্নার হাঙ্গামা করে। ঘণ্টা দুই আর রাত আছে বড় জোর। এইটুকু সময় গড়িয়ে নিয়ে কাল সকালে রান্নার ব্যবস্থা করা যাবে। কি বলেন?”

কি আর বলব। কিছু না বলাই বুদ্ধিমানের কাজ, চোখ বুজে শুয়ে রইলাম।

ওধারে পটাপট শুকনো ডালপালা পুড়ছে। চটাচট শব্দ উঠছে হাতে করে আটা চাপড়ানোর। পোড়া রুটির গন্ধ ভেসে আসছে।

এলেন পোপটভাই। একান্ত কুণ্ঠিতভাবে নিবেদন করলেন যে, তিনি স্বহস্তে এই শেষরাতে রুটি বানাচ্ছেন আমাদের জন্যে। সেগুলি ভোজন করে তবে আমাদের ঘুমোতে হবে। এইটুকু কষ্ট আজ আমাদের করতে হবে নয়তো তিনি ছাড়বেন না।

তাঁর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল অফুরন্ত উৎসাহের আধার আমাদের শ্রীমান সুখলাল, তারও একটু সংবাদ আছে। সে চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছে। চা আনল বলে।

ওদের দুজনের পিছনে উপস্থিত শেখ সাহেব। ওরা চলে গেলে বুড়ো মাথার পাগড়িটা খুলে পাশে ফেলে থপ্ করে তার উপরে বসে পড়ল। বুড়োমানুষ, শরীর আর কত বয়!

তারও একটু জরুরি আরজি আছে, নয়তো এ সময় সে বিরক্ত করতে আসত না ৷

বললাম, “তবে আর একটু কষ্ট করে আরজিটা পেশ করে ফেলো।”

যৎসামান্য ব্যাপার। গুলমহম্মদের বক্তব্যে হচ্ছে এই-দু-দুটো দিন উট দুটো দাঁতে কুটো কাটতে পায়নি। এখনই তার ছেলে চলেছে উট নিয়ে চরাতে। সন্ধ্যার আগে সে ফিরবে না। সকলেই আগুন জ্বেলে রুটি পোড়াচ্ছে। তার অবশ্য আর রুটি চাইবার হক নেই। কারণ সে তো আগেই তাদের প্রাপ্য সমস্ত আটাটা নিয়ে নিয়েছে। তবু যদি প্রত্যেকে একখানা করে রুটি তাকে খয়রাত করে তবে বড়ই উপকার হয়, এখনই দিলমহম্মদ উট নিয়ে রওয়ানা হতে পারে। নয়তো রুটি বানিয়ে বেরুতে গেলে অনকে দেরি হয়ে যাবে। এ কয়দিন তো আর ওদের রুটি বানিয়ে হয়নি, তার বেটি কুন্তী-মায়ীর কৃপাতেই কাজ চলে গেছে।

বুঝলাম যে আমাদের শুয়ে পড়তে দেখে অন্য কোনো উপায় না করতে পেরে বুড়ো শেষে আমাদের কাছেই আসতে বাধ্য হয়েছে।

“বললাম, “বেশ তো, নাও গিয়ে সকলের কাছ থেকে একখানা করে রুটি চেয়ে।”

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ো উত্তর দিলে, সে চেষ্টা সে ইতিমধ্যেই করেছে। ফলে সকলেই বিরক্ত হয়েছে। কেউ কেউ তাকে আইন দেখিয়েছে। একখানা রুটি পাওয়াই আইন। আর স্ব-ইচ্ছায় তামাম আটা হিসাব করে নিয়ে নিয়েছে তারা। এখন আবার রুটি চাইতে আসে কোন মুখে?

শুনে কুন্তী ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল। দু-দিন উপবাসের পর না খেয়ে একটা লোক চলে যাচ্ছে আর সে আরাম করে শুয়ে থাকবে! কাঠ কই? চারটি লাকড়ি এনে দাও তাকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে খানা বানিয়ে দেবে সে।

গোলমাল শুনে পোপটভাই আবার ছুটে এলেন। তাঁর দু-হাতে আটা মাখা। সমস্ত শুনে কুন্তীকে উঠতে বারণ করলেন, “কই, গুলমহম্মদ ত আমার কাছে যায়নি, ওদের দুজনের রুটি তো ওখানেই বানানো হচ্ছে, “হল বলে, আর পাঁচ মিনিট—”

বুড়ো বললে, “তোবা তোবা! সে কি একেবারে বেশরম, ওখানে মহান্ত মহারাজের খানা বানানো হচ্ছে, ওখানে আগে থেকে সে যায় কি করে! তার চেয়ে চারটি বাদাম আর খেজুর যদি তাকে খয়রাত করি আমরা তাহলেই হাঙ্গামা চুকে যায়।”

রূপলাল এসে দাঁড়াল। হাতে একগাঁদা রুটি- ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বললে, “আনলাম সকলের কাছ থেকে একখানা করে রুটি করে কেড়ে নিয়ে, এতেই আমার দোস্তের সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে যাবে। এখন তোফা হয় খানিকটা গুড় পেলে।

গুড়, লঙ্কার চাটনি, পেঁয়াজ বার করে দেওয়া হল। দুটো লোটার গলায় গামছা দিয়ে দু-হাতে ধরে সুখলাল উপস্থিত। গেল ঢুকে গণ্ডগোল। চা-রুটি খেয়ে আর সারাদিনের রুটি বেঁধে নিয়ে দিলমহম্মদ উটসহ বেরিয়ে গেল। তখনও শুকতারা বিদায় নেয়নি।

আমরা খেতে বসলাম। পোপটভাই-এর বাড়ি থেকে আনা খাঁটি ঘি মাখানো পাতলা পাতলা গরম রুটি-রসুনের চাটনি সহযোগে আকণ্ঠ বোঝাই করে হিংলাজের জয়ধ্বনি দিয়ে যখন আমরা আবার শয়ন করলাম, তখন পাহাড়ের মাথার উপরের আঁধার পাতলা হয়ে আসছে, তবে নীচে তখনও বেশ জমাট অন্ধকার।

কিছুক্ষণ পরেই পাহাড়ের চূড়া থেকে একটা প্রকাণ্ড পাখি তার বিরাট দুই ডানা মেলে নেমে এল। সেই ডানার তলায় আমরা সকলে ঢাকা পড়লাম। সে পাখিটির নাম নিদ্রা, অপর নাম সর্বসন্তাপহারিণী, যার বুকের তলায় আশ্রয় পেয়ে সদ্য-পুত্রহারা জননী পুত্রশোকের জ্বালা ভুলে নাক ডাকায়।

নাক আমাদের ডেকেছিল কিনা তা সঠিক বলব কি করে? কেউই তো কারুর নাক ডাকার সাক্ষী থাকবার দরুন জেগে ছিলাম না!

নাক ডাকা বন্ধ হবার পর আবার যখন চক্ষু মেলে চাইলাম, তখন–

‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে’ গান জুড়ে দেবার বাসনা থাকলেও সামর্থ্যে কুলোল না। শেষরাতে আকণ্ঠ রুটি গেলার ফলে গলা শুকিয়ে এমনই কাঠ হয়ে গিয়েছিল যে, “ভৈরবী, একটু জল!’ এটুকুও গলা দিয়ে বার হল না। বহুকষ্টে উঠে বসে ভৈরবীকে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে চক্ষের নিমেষে চক্ষের তৃষ্ণা দুই-ই উধাও হয়ে উবে গেল।

হাঁ করে চেয়ে রইলাম।

কালো পাথরের পাহাড়, গাছপালা ঝোঁপ-জঙ্গল কিছুই নেই। পাথরের পর পাথর দিয়ে উঁচু করতে করতে সেটার মাথাটা আকাশের গায়ে ঠেকানো হয়েছে। কোনো ছাঁদ নেই ছিরি নেই। যুগ যুগ ধরে কারা যেন এই রাশীকৃত পাথর অন্য কোথাও থেকে বয়ে এনে এনে এখানে জমা করেছে। আর যারা এই কর্ম করেছে সেই অমিতবলশালী মহাবীরদেরই এক উপযুক্ত বংশধর ওই পাথরের স্তূপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে উপরে দাঁড়িয়ে নীচের সমস্ত সুপ্তিময় দলটিকে নিরীক্ষণ করছে।

ওই পাহাড়ের পটভূমিকায় মানুষটিকে, এমন চমৎকার মানিয়েছে যে, একটির থেকে আর-একটিকে আলাদা করে চিন্তা করা যায় না।

সাধারণ মানুষ তাকে কিছুতেই বলা চলে না। বলা উচিত একটি নরপর্বত।

লোকটির দৈর্ঘ্য যদি হয় সাড়ে পাঁচ ফুট, প্রস্থ হবে অন্তত সাড়ে চার ফুট। এমন চার চৌকো মানুষ জীবনে আর কখনো সামনে পড়েনি। চৌকস কথাটি যদি কারও নামের আগে জুড়ে দিতে হয়, তবে এই-ই হচ্ছে একমাত্র উপযুক্ত পাত্র।

লোকটির শরীরে মেদ নেই, ভুঁড়িও নেই। ঘাড় গর্দান কিছু নেই। হাড়মাংসে গড়া সেই নিরেট পিণ্ডের দু-পাশে অত্যধিক খাটো যে দুটি জিনিস আটকানো রয়েছে, ওই ওর হাত। অন্তত দশ-পনেরো জনের ভাত রেঁধে যাওয়া চলে এমনি মাপের একটা পোড়া তিজেল হাঁড়ি ওর দেহের উপর বসানো আর সেই তিজেলের গায়ে আটকানো রয়েছে এক থ্যাবড়া নাক। নাকের দু পাশে দুই চক্ষু যা দিয়ে আমাদের উপর নজর নিক্ষেপ করছে। চক্ষু দুটির দিকে চেয়ে চট করে দ্বারিকের দোকানের চার আনা দামের পানতুয়ার কথা মনে পড়ে গেল। সবচেয়ে বেখাপ্পা হচ্ছে তার মাথার উপরের টুপিটি। সেই বিশাল মস্তকের ঠিক মাঝখানটিতে উপুড় করে বসানো রয়েছে-ইঞ্চি দেড়েক উঁচু চারিদিকে জাফরি কাটা একটি কাপড়ের বাটি। কি উপায়ে যে সেটি ওখানে আটকে রয়েছে কে জানে!

সেই নরপর্বত অল্প কিছুক্ষণ অচল রইলেন। তাঁর পানতুয়া-প্রতিম চোখ দুটি থেকে নীচে শোয়া ঘুমন্ত মানুষগুলির উপর দুটি অদৃশ্য ঘোলাটে জ্যোতি গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরতে লাগল। শেষে তিনি সচল হলেন। তারপর সেই সচল বপুখানি তরতর করে নেমে আসতে লাগল, একটা পাথর থেকে আর একটি পাথরের উপর টপাটপ লাফাতে লাফাতে অক্লেশে, অনায়াসে, অবলীলাক্রমে-যাকে বলে লঘু পদক্ষেপ। অত বড় একটা বস্তুকে অমন হালকা ভাবে চালিয়ে নিয়ে আসতে কি প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন তাই চিন্তা করে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।

একমাত্র আমিই উঠে বসে আছি-আর সকলেই ঘুমে অচেতন-সে তো এগিয়েই আসছে। এসে পড়ল বলে আমাদের উপর। চিৎকার করে সকলকে জাগাবার জন্য হাঁ করলাম, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম-পারলাম না-হাত-পা অসাড়। নিরুপায় হয়ে চোখ বুজলাম।

“সালাম আলোকুম!” একটি বছর আষ্টেকের কিশোরীর গলার স্বর। চমকে চোখ চাইলাম। সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। পাহাড়টা তাঁর আড়ালে লুকিয়েছে। তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা সামনের দিকে হেঁট হয়ে আবার বললেন, “সালাম আলেকুম। বিলকুল একটি ছোট মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠধ্বনি। বহু চেষ্টায় উচ্চারণ করলাম, “আলেকুম সালাম।” নিজের গলার আওয়াজ নিজেই শুনতে পেলাম না। তিনি হাসলেন। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল।

আলাপ-পরিচয় হল। নাম তার শেরদিল। দুশমন খাঁ নাম হলেও আমার আপত্তি করবার কিছু ছিল না। ভদ্রলোক এখানকার কুয়ার রক্ষক। এই পাহাড়ের এক চমৎকার গুহায় সপরিবারের বসবাস করেন। আরও উত্তরে পাহাড়ের পিছন দিকে তাঁর খেত-খামার ছাগল উট সমস্তই আছে। বড় বড় ছেলে আছে তাঁর, তারাই সেসব দেখাশুনা করে। এখানে তিনি এই খোদার খিদমতগারি নিয়েই শেষ জীবনটা গুজরান করছেন।

কথা বলছিলেন তিনি তাঁর দুখানি বেঁটে বেঁটে হাত সজোরে আমার নাকের সামনে নাড়তে নাড়তে। অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন তাঁর যা খুশি সেই ছেলেমানুষি গলায়! আর আমি কোনো মতে হাঁ-না ইত্যাদি দিয়ে আলাপটা চালু রাখছিলাম- আমার নিজের পায়ের গোছের চেয়ে ঢের সুস্পষ্ট তাঁর হাতের কব্জি দুখানির উপর নজর রেখে, বার বার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম আর ছটফট করছিলাম গুলমহম্মদের জন্যে, এ সময় সে আবার গেল কোথায়?

শেরদিল তখন আমাকে বোঝাচ্ছেন, এখানে বিন্দুমাত্র কোনো তকলিফের কোনো সম্ভাবনা নেই। কাঠ জল সমস্ত মজুত। আর তার মতো খিদমতগার উপস্থিত থাকতে কোনো ভয়ের কারণ নেই। অনায়াসে আমরা দিন দুই আরাম করতে পারি তাঁর আশ্রয়ে।

“আল হামদোলিল্লাহ!”

পিছন ফিরে দেখি গুলমহম্মদ উপস্থিত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।

ওরা দুজনে আঁকড়ে ধরলে। বোধ হয় উভয়ে উভয়ের দাড়িগোঁফের জঙ্গলে বার বার চুম্বন দিলে কয়েকটা। হুড়মুড় করে দুজনে একসঙ্গে অনর্গল যা মুখে এল বলতে লাগল। সেই মহা শোরগোলে সকলের ঘুম ভেঙে গেল, যে যার বিছানায় উঠে বসে স্তম্ভিত বিস্ময়ে সেই জাপটাজাপটি দেখতে লাগল হাঁ করে।

অবশেষে ওদের শরীরে আর মনের উথলে-ওঠা আহ্লাদটা একটু ঝিমিয়ে এলে পর ওরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হল। তখন গুলমহম্মদ মস্ত ভূমিকাসহ আরম্ভ করলে তাঁর পরিচয় দিতে। নাম তাঁর শেরদিলই বটে। কারণ দিলটা এঁর বিলকুল শেরের মতোই। তাঁর নামে এ মুল্লুকের সকলেরই দিল কেঁপে ওঠে। বহু বহু বেয়াকুফ বেয়াদব এঁর হাতে শায়েস্তা হয়েছে। আবার এঁর দয়ারও অন্ত নেই। লোকের বিপদে আপদে নিজের বুক ইনি পেতে দেন, তখন আর শত্রু-মিত্র বাছ-বিচার নেই। এঁকে যে এখানে এখন পাওয়া যাবে এ হচ্ছে আশাতীত ব্যাপার। চাকর-বাকর দিয়েই ইনি এই কুয়া রক্ষার কার্যটি চালিয়ে নেন, এবার যে স্বয়ং উপস্থিত আছেন এ একমাত্র জোর নসিবের ফল বলতে হবে।

আমরাও একবাক্যে সে-কথা বলতে কসুর করলাম না। বৎস রূপলাল তার পণ্ডিতি পরিত্যাগ করে শেরদিলের পিছনে পিছনে ঘুরতে লাগল। তিনি ঘুরে ঘুরে তদ্বির তদারক করতে লাগলেন। দলের দু-দুটো আওরাত আছে দেখে গুলমহম্মদকে অনুরোধ করলেন এখনই তাঁর গুহায় উঠে গিয়ে তাঁর বিবিকে সংবাদটা জানাতে। গুলমহম্মদ তৎক্ষণাৎ উঠে গেল। তারপর তিনি আমাদের সকলকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন আরও খানিকটা উপরে একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সমতল জায়গায়। সেই স্থানটির চারিদিকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। স্থানটি ছায়াশীতল 1

একটি সরু গলির মতো পথ বেয়ে বেশ অনেকটা উঠে তারপর ফের খানিকটা নীচে নেমে আমরা সেখানে পৌঁছলাম। পৌঁছে চারিদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল হল-এ কি-এলাম আমরা কোন পথ দিয়ে?

চারিদিকে খাড়া পাহাড়, সব একরকম দেখতে। কোন পথ দিয়ে যে এসে পৌঁছলাম তার আর কোন চিহ্ন নেই। যে ফাঁকটি দিয়ে নেমে এলাম এইমাত্র, সেটি বেমালুম লোপ পেয়ে গেল। সকলেই দাঁড়িয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি, এ আবার কোনো ফাঁদে পড়লাম না তো রে বাবা!

আমাদের সকলের আগে শেরদিল মহাশয় এখানকার সুখ-সুবিধাগুলির ফিরিস্তি দিতে দিতে এগিয়ে চলেছেন। এখানে দিনভর রোদ লাগবে না, উড়ন্ত বালির জ্বলন্ত ঝাঁপটারও ভয় নেই, জল একেবারে হাতের কাছে। কাজেই তাঁর স্থানটিকে বেহেস্ত বললে বাড়িয়ে বলা হয় না।

বাড়িয়ে কমিয়ে বলাবলির কথা তখন আমাদের মাথায় উঠেছে। সশরীরে বেহেস্তে ঢুকে পড়ে তখন মাথার মধ্যে দুমদাম হাতুড়ির ঘা পড়ছে, কি করে কোন ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এই বেহেস্ত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে আমাদের সকলকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শেরদিল হাঁ হয়ে গেলেন। শেষে সকলের মুখের পর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হা-হা করে হেসে উঠলেন তাঁর সেই ছেলেমানুষী গলায়। তারপর ফিরে এলেন আমাদের কাছে। কিন্তু থামলেন না আমাদের সামনে। আমাদের পাশ কাটিয়ে তরতর করে উঠে গেলেন পাহাড়ের হা বেয়ে। আমরা দলসুদ্ধ সকলে ফিরে দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখছি তাঁর সেই স্বছন্দ পর্বতারোহণ। উঠতে উঠতে টুপ করে অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁর সেই বপুখানি। কেবল কানে বাজতে লাগল তাঁর হাসির প্রতিধ্বনি।

একবারে চক্ষুস্থির!

কয়েকটি মুহূর্ত গড়িয়ে গেল, সকলের দৃষ্টি পাহাড়ের গায়ের সেই স্থানটির উপর, যেখানে শেরদিল মিলিয়ে গেলেন। তারপর দৌড়ল রূপলাল সেই পথে, যে পথে এইমাত্র শেরদিল উঠে গেছেন। উঠতে উঠতে ঠিক সেই স্থানটিতে পৌঁছে সেও ফস করে আমাদের এত জোড়া চক্ষুর সামনে একেবারে উবে গেল। যেন ওখানটায় পৌঁছনোমাত্র পাহাড়টা টপ করে গিলে ফেলল তাকে।

তাজ্জব কাণ্ড!

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সকলে সেইদিকে চেয়ে আছি। চোখের পলক পড়ছে না, বুকের ধুক ধুক শব্দ নিজের কানে শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ আবার সেই অপূর্ব মধুর হাসি, হা হা হা হা। পরমুহূর্তে শেরদিল রূপলালকে ধরে নিয়ে ঠিক সেইখানটি থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে আসতে লাগলেন।

শেষে যখন বোঝা গেল যে ওইটেই পথ, ওই পথেই আমরা নেমে এসেছি-লজ্জায় এতটুকু হয়ে যাওয়া ভিন্ন আর উপায় কি?

পণ্ডিত রূপলাল কিন্তু অপ্রতিভ হওয়ার পাত্র নয়। নেমে এসে দলপতি-জনোচিত এক হাঁকার দিলে-”চলে এসো জলদি আমার সঙ্গে কুঁজো নিয়ে, যার যার জলের দরকার।” যেন কুয়োটা কোথায় এইটুকু জানবার জন্যেই সে ছুটে গিয়েছিল শেরদিলের পিছু পিছু।

যাক। আবার আরম্ভ হল ঘর-গৃহস্থালি সাজানো সামনের সারা দিনটা আর অর্ধেক রাত্রির জন্যে।

স্থানটি প্রায় গোলাকার আর বেশ চাঁচাছোলা। অন্তত পাঁচশো লোক আরামে শুয়ে থাকতে পারে। মনে হল যেন মস্ত একটা কুয়োর তলায় শুকনো তকতকে বালির উপর আমরা নেমে পড়েছি।

শেরদিল সকলকে নির্দেশ দিলেন পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কম্বল পাঁততে; আমাকে নিয়ে চলে এলেন একবারে উত্তর প্রান্তে।

সেখানে পড়ে ছিল একখানা হাত পাঁচ-ছয় লম্বা আর হাত তিনেক চওড়া কালো পাথর, উপরটা একেবারে সমান না হলেও শোওয়া-বসা চলতে পারে। তার উপর পড়ল আমার কম্বল, আর সেই কম্বলের উপর আমাকে বসিয়ে শেরদিল তৃপ্তির সঙ্গে বললে, ‘ইয়া!” বলে কোমরের দু-পাশে দু-হাত রেখে অল্পক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর চলে গেলেন অন্য সকলের সুখ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে।

সেই হাত-দেড়েক উঁচু পাষাণ-সিংহাসনের উপর চেপে বসে চক্ষু মুদিত করে আমিও মনে মনে একেবারে না বলে পারলাম না, “ইয়াঃ!” এ হেন স্থানে এ হেন আসনে বসে মন আর মেজাজ দুই-ই বাগ মানতে চাইল না, উড়তে লাগল খেয়ালের আকাশে।

তৎক্ষণাৎ দৃশ্য পরিবর্তন হল।

সেই দৃশ্য আমি স্বয়ং হলাম এক দুর্দান্ত পাহাড়ি দস্যুসর্দার, আর আমার সঙ্গী সাথীরা আমার উপযুক্ত শাগরেদ। বড় রকমের একটা লুটপাট সুসম্পন্ন করে আমরা সবেমাত্র আড্ডায় ফিরেছি। দলপতির সম্মানিত উচ্চাসনটি দখল করে বসে চারিদিকে শাগরেদদের কার্যকলাপ অবলোকন করছি। আমার সম্মান বাঁচিয়ে ওরা দূরে গোল হয়ে বসেছে। সামনের ফাঁকা জায়গায় এখনই নাচ আরম্ভ হবে।

আরম্ভ হল নৃত্য।

বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে কোথা থেকে উদয় হল একটি নর্তকী। প্রকাণ্ড ঘেরের ঘাঘরা তার পরনে। ঘাঘরার নীচের দিকে আধাহাত সোনালি জরির কাজ। গায়ে আঁটা লাল রঙ্গের কাঁচুলি। বুকের নীচ থেকে নাভি পর্যন্ত অনাবৃত। কোমর এত সরু যে হাতের মুঠোয় ধরা যায় ৷

প্রচণ্ড বেড়ে সে ঘুরছে। ঘুরছে আর তার ঘাঘরার জরির কারুকার্য অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে তার হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অতি দ্রুত তালে বাজছে বাজনা, তার সঙ্গে মিশিছে তার পায়ের ঘুঙুরের শব্দ। সমস্ত মিলেমিশে একসঙ্গে এমন এক অদ্ভুত ধ্বনির তরঙ্গ তুলেছে যে, দর্শকদের শরীরের রক্তের মধ্যে প্রবল আলোড়ন উঠেছে। সকলের চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠেছে। মেয়েটি নৃত্যের তালে তালে ঘুরতে ঘুরতে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। ঠিক আমার সামনেই বারকতক ঘুরপাক খেয়ে সে থামল, আর সেই মুহূর্তেই তেহাই পড়ল ঢোলে। একেবারে স্তব্ধ। …

চোখ মেলে চাইলাম… সামনে দাঁড়িয়ে স-কুন্তী ভৈরবী। দুজনের একজনও ঘাঘরা পরে না, সাদা-সাপটা শাড়ি মাত্ৰ ৷

মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। অমন একটা মুখরোচক ব্যাপারের শেষটুকু আর দেখা হল না। অদৃষ্টটাই এমনি বটে।

ভৈরবীর সেই এক প্রশ্ন-”কোথায় পাতব কম্বল?” এবার মুখে এল, ‘জাহান্নামে’। ঢোক গিলে ফেললাম, ফেলে আসন ছেড়ে নেমে এলাম। হাত নিশপিশ করছিল একখানা চাবুকের জন্যে, এ হেন অবস্থায় এ হেন বে-আদবির দরুন দস্যুসর্দার হিসাবে চাবুক চালানোই আমার একমাত্র কর্তব্য। কিন্তু চাবুক কোথায়? ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাটিতে যেটির প্রয়োজন সেটি ত থাকবে না কিছুতেই। কি করি, ওদের দিকে রক্তচক্ষু হেনে একটা লোটা হাতে নিয়ে সোজা চলে গেলাম সেই দিকে যেখানে একটু আগে শেরদিল আর রূপলাল নেমে এসেছে।

মন-মেজাজ ঠাণ্ডা করে আবার যখন এলাম ঘণ্টাখানেক পরে, তখন আরও দুজন লোক বেড়েছে দলে। গুলমহম্মদ ফিরে এসেছে শেরদিল-গৃহিণী আর তার চাকরানিকে সঙ্গে নিয়ে। আমার আসনের অনেকটা দূরে ডান দিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওঁরা সংসার পাতছেন। বিলি-ব্যবস্থা করছেন শেরের পত্নী তাঁর চাকরানির উপর হুকুম চালিয়ে। বাঁ দিকে বসেছে বড় কলকের বৈঠক, শেরদিলকে মাঝখানে নিয়ে। ওখানটায় ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার।

নিজের উচ্চাসনের উপর গুছিয়ে বসলাম এসে।

এবার একটু চা হলে হত। গেল কোথায় শ্রীমান সুখলাল?

বাঁ হাতে নাকে আঁচল চাপা দিয়ে ডান হাতে একটা কালো ভাঁড় নিয়ে কুন্তী উপস্থিত। ভাঁড়টা সামনে নামিয়ে উপরকার ঢাকাটা দিলে খুলে।

ওরে বাপ রে, একেবারে দম আটকে আসবার যোগাড়! কি ওটা, সরাও সরাও!”

তাড়াতাড়ি ঢাকাটা ভাঁড়ের মুখে চাপা দিয়ে কিছু দূরে ওটাকে সরিয়ে রাখলে কুন্তী, তারপর নাকের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে হেসেই খুন।

জিজ্ঞাসা করলাম, “ওই ভাঁড়টায় কি? মারা পড়েছিলাম যে এখনই!”

হাসি সামলে কুন্তী বলল, “বকরির ঘি।”

বললাম, “বকরির ঘি এখানে এল কোত্থেকে? খুলনার কবরেজ মশায় ছাগলাদ্য ঘৃত বানাতে জানেন, এই পদার্থ এত দূরে পৌঁছল কি করে?”

কুন্তী বললে, “আমাদের জন্য ভেট এনেছেন শেরের গৃহিণী। ও খেলে শরীরের জ্বালা জুড়াবে, তাগদ বাড়বে, মেজাজ শরীফ থাকবে, পেটের গোলমাল…”

বললাম, “থামো, থামো, আর বলতে হবে না। আমি সমস্ত জানি। বাত সারবে, গোদ পালাবে, গণ্ডগোলে ফেঁসে গিয়ে চুপসে যাবে, টেকো মাথায় চুল গজাবে, নড়নড়ে দাঁত শক্ত হয়ে খাসির হাড় চিবোবে–এ সমস্ত আমার মুখস্থ আছে, কিন্তু ওই ছাগলাদ্য তো এ-দেশের ওরাও বানাতে জানে তা তো জানতাম না!”

কুন্তীর হাসি ততক্ষণে উবে গেছে, চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলে, “কেন, বকরির ঘি বানানো শক্ত কি? গোরুর দুধ থেকে যে ভাবে ঘি হয়, এ ঘিরিও ছাগলের দুধ থেকে সেইভাবেই বানিয়েছে।”

এবার আমার চক্ষু ছানাবড়া হবার পালা। এতকাল শুনে আসছি-ছাগলে কি না খায়, পাগলে কি না বলে! আজ স্বচক্ষে দেখবার সৌভাগ্যে হল যে ‘কি না খেয়ে ছাগলে দুধ দেয়–তা থেকে ঘৃত বানানো যায় ৷

কিন্তু ঘৃত বস্তুটি–শুনেছি দেবভোগ্য।

হায়, কে বলে দেবে সে দেবতার নামটি কি–যাঁর ভোগে লাগবে এই ঘৃত, যাঁর প্রতি বিন্দুটিই এতদূর মারাত্মক রকমের খাঁটি যে, দুগ্ধ শুঁকেই আমার মতো সামান্য জীবের প্রাণ গিয়েছিল আর কি!

কুন্তীকে বললাম, “এখনই ফেরত দাও ওই সাংঘাতিক জিনিস, নয়তো দলসুদ্ধ সকলের একটা বিপদ ঘটবে।”

দু-আঙুলে চওড়া ছোট্ট কপালটিকে যতদূর সম্ভব কুঁচকে ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গেল কুন্তী।

“তা কি করে দেওয়া যায়, তাহলে যে ওদের অপমান করা হবে!”

অপমান করা হবে? আমিও ভুরু কুঁচকে কুন্তীর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

আর যা কিছু করা যাক, এখানে বসে শেরদিল যাতে অপমান বোধ করবেন এমন কিছু করবার কথা মনেও আনা যায় না।

দুধের মতো সাদা আস্ত একখান কাপড় দিয়ে তৈরি পায়জামা পরিহিতা-শ্রীমতী শেরদিলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে এলেন ভৈরবী। হাত দশেক দূর থেকেই শ্রীমতী দু তিনবার নত হয়ে আপন কপালে হাত ঠেকালেন।

উঠে দাঁড়াতে হল।

একমাত্র দুটি চোখ আর সাদা ভুরু জোড়া ছাড়া, মাথা মুখ নাক গলা বুক একেবারে কোমর পর্যন্ত তাঁর ঢাকা একখানি মিশমিশে কালো সিল্কের চাদর দিয়ে। কপালে ছোঁয়াবার সময় একখানি হাতের যেটুকু দেখা গেল তাতে বোঝা গেল যে, অন্তত ষাটের কোঠা তাঁর পেরিয়ে গেছে। তা না হলে চামড়া অত কোঁচকায় না।

তাঁকে এধারে আসতে দেখে স্বামী শেরদিলও কলকের বৈঠক ছেড়ে উঠে এলেন। এসে আদব-কায়দা মাফিক পরিচয় করিয়ে দিলেন।

তখন সেই কালো কাপড়ের ভেতর থেকে কি কতকগুলো বাক্য-স্রোত গড়গড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল।

শেরদিল তার তরজামা করে বুঝিয়ে দিলেন যে, আমাদের আগমনে তাঁর স্ত্রী কি খুশিই হয়েছেন! ‘নানী কি হজ’ যাত্রায় অতদূর থেকে আওরত এসেছেন। বিশেষত জীবনে তো তিনি কলকাতার আওরত দেখেননি। এ তাঁর একান্ত নসিবের জোর যে কলকাতার আওরত দেখতে পেলেন।

প্রমাদ গুনলাম।

খাল-বিল-হোগলা-কুমির বাঘের দেশ হচ্ছে বরিশালের দক্ষিণ সীমা। সে দেশকে যমের দক্ষিণ দরজা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেখান থেকে এসেছেন ভৈরবী। সেখানকার ঠেঙাড়ে ভাষা, চালচলন–এক কথায় সেখানকার কৃষ্টি আর সংস্কৃতির তিনি জলজ্যান্ত প্রতিনিধি। তাঁকে দেখে যদি এই মরুবাসিনীর কলকাতার আওরত দর্শনের সাধ মেটে, তবে সেটা যে একেবারে হরিপালের করমচা চিবিয়ে কাশ্মীরি আঙুর খাওয়ার শখ মেটানো হবে!

প্রবল প্রতিবাদ করে আদত কলকাতা-বাসিনীদের রূপগুণ পোশাক-পরিচ্ছদ চালচলন ইত্যাদি সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত ভাষণ দেবার জন্যে চুলবুল করতে লাগল। কোনো ফল হবে কিনা ভেবে না পেয়ে ঢোক গিলে ফেলে দাঁত বার করে নীরব হাস্য করে কৃতজ্ঞতা জানালাম।

তারপরই উঠে পড়ল সেই ছাগলাদ্য ঘৃত প্ৰসঙ্গ।

শেরদিল-পত্নী তাঁর স্বামী মারফত জানালেন যে, ওই সামান্য জিনিসটুকু যদি আমরা গ্রহণ করি তবে তিনি ধন্য হবেন। ওই মহামূল্য দ্রব্য তাঁর নিজের হাতে বানানো একেবারে সর্বগুণ সম্পন্ন সর্বরোগহর বস্তু। অতএব

সভয়ে কিছুদূরে বসানো ভাঁড়টির দিকে একবার চাইলাম। তারপর মাথা চুলকে উভয়কে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করলাম।

ভৈরবীর মুখের দিকে চয়ে দেখি তিনি ঘাড় হেঁট করে নিজের পায়ের আঙুলের নখের শোভা দর্শনে একান্ত ব্যস্ত।

কুন্তী তার আঁচলের খুঁটটা নিজের মুখে পুরছে, তবু, তার নাক মুখ চোখ দিয়ে হাসি উপচে পড়তে চায়।

শেষে মরীয়া হয়ে শুরু করলাম, “আপনার মতো বন্ধু পথে পাওয়া যে কত বড় সৌভাগ্যের কথা এ আর মুখে কি করে বলি! আর ওই ঘি যে কত বড় অমৃততুল্য জিনিস সে কথা কি আর আমরা জানি না? কিন্তু কি করব, আমাদের যিনি গুরু, মানে ওস্তাদ, তাঁর আদেশমতো ওই সমস্ত ভালো ভালো জিনিস আমরা ছুঁতেও পারি না। সবই ত্যাগ করতে হয়েছে কি-না-এই যাকে আপনারা ‘কোরবান’ বলেন–তাই আর কি। এখন কি যে করি–”

বলে উভয়ের চোখের দিকে চাইলাম।

নাঃ দপ করে জ্বলে ওঠেনি চোখ আমার কথা শুনে। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কুন্তীর দিকে চেয়ে দেখি হাসির তোড় সামলাতে গিয়ে সে কাঁপছে।

জলদি চা বানাবার হুকুম দিয়ে তাকে তাড়ালাম।

তখন জুত করে বসে ওরা কলকাতার গল্প শুনতে বাসনা প্রকাশ করলেন।

তথাস্তু। শুধু কলকাতার কেন খাস লন্ডন শহরের গল্পও করতে এখন আমার আপত্তি নেই। ছাগলাদ্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলেছে এ কি কম কথা!

ভৈরবীকে বললাম, “এঁদেরও ভাত চড়াওগে যাও। ঘি ছোট এলাচ আর কিশমিশ পেস্তা বাদাম ছাড়তে যেন ভুল না হয়। প্রত্যেক দিন দু-বেলা কলকাতার লোকে কি খেয়ে বেঁচে আছে তা এঁরা মালুম করে যান। একেবারে কলকাতাটা চাখা হয়ে যাক।

গম্ভীর মুখে ভৈরবী উঠে গেলেন।

কলকাতাটা কেমন পদার্থ তার বর্ণনা শুরু করলাম।

ঘণ্টা দু-এক পরে তখনও আমি বলে যাচ্ছি-”কলকাতার লোক মোটে হাঁটে না, হুস হুস কলের গাড়ি চেপে যেদিকে ইচ্ছে চলে যায়। সব্‌সে তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে, কলকাতায় যে সমস্ত আশমান-ছোঁয়া বাড়ি আছে সেই সমস্ত বাড়িতে দিন রাত হুড়হুড় করে জল পড়ছে তো পড়ছেই, এমনই সব আজব কল লাগানো আছে, কলকাতায় কখনো আঁধার হয় না, কলের চিরাগ জ্বলছে তো জ্বলছেই। তারপর আরও আছে, খিদে পেলে কলকাতার লোকের আর কোনো কথা নেই, তখনি ছুটে গিয়ে দোকান থেকে লাড্ডু মেঠাই কিনে পেট ভরে খেয়ে তবে নিশ্চিন্ত। তার সঙ্গে চালায় আঙুর বেদানা আপেল যত খুশি।

হঠাৎ শেরদিল জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “কলকাতার লোক বিবাহ করে কটি করে?”

প্রশ্নের মতো প্রশ্ন। গুটিকতক করে বিবাহ করেন বললে কলকাতার লোকের ইজ্জতটা বাড়বে, না একটিমাত্র বিয়ে করেন বললে এঁরা খুশি হবেন? চিন্তায় পড়ে গেলাম।

এমন সময় শ্রীমান সুখলাল এসে সুসংবাদ দিলে –খানা প্রস্তুত ৷

আর কথা বাড়ানো কাজের কথা নয়। আপাতত কলকাতার লোকের মান-ইজ্জষ্টা তো বাঁচুক। হই হই করে ওঠে পড়লাম ওঁদের নিয়ে।

খাওয়া-দাওয়ার পরে ওঁরা বিদায় নিলেন। রূপলাল আর গুলমহম্মদ ধরে বসল যে, সন্ধ্যায় গানের আসর বসবে, শেরদিল যেন দয়া করে বাজানা সঙ্গে আনেন। কলকাতার খানা হজম করবার জন্যে শেরদিল পত্নীসহ চলে গেলেন নিজের গুহায়।

আমরাও গড়িয়ে নেবার আশায় তোড়জোড় শুরু করলাম। স্থানটি সত্যিই তেতে উঠল না। অনেক উঁচু দিয়ে সূর্যদেব নিজের বাঁধাধরা পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন পশ্চিম দিকে। গর্তের মধ্যে পড়ে আছি আমরা, আজ আমাদের পাত্তা পাবেন কি করে তিনি? কি আফসোস!

একটি লম্বা ঘুম দেওয়া গেল-নিরেট নিশ্চিদ্র নিখুঁত নিদ্রা-যতক্ষণ পর্যন্ত না শেরদিল ফিরে এলেন টোল নিয়ে। তাঁর স্ত্রী এলেন আরও একটু পরে ঠিক সন্ধ্যার পূর্বেই।

গোটাচারেক আলো জ্বেলে ফেলতে হল। তাতে কি হবে? অন্ধকারটা যেন আরও দানা বেধে উঠল।

যে যার আসন কম্বল টেনে নিয়ে এল আমার সামনে। দিনের বেলা ছড়িয়ে থাকতে কারও আপত্তি নেই, কিন্তু সন্ধ্যার পর সকলের কাছাকাছি ছোঁওয়া-ছুঁয়ির মধ্যে থাকা চাই। জয়াশঙ্করজি এইটুক করে গেছেন। তাঁর বিদায় আমাদের এক-প্রাণ এক-মন এক-আত্মা করে দিয়ে গেছে।

পোটলাল ভাই একবার লোক গুনে নিলেন। রূপলাল দেখে নিলেন সকলের কুঁজো ভর্তি হয়েছে কিনা। মালপত্র গোছগাছ করে বেঁধেছেদে তৈরি করে রাখলে গুলমহম্মদ। রাত্রি শেষ প্রহরে আবার যাত্রা আরম্ভ। এখন ঊর্বশীদের নিয়ে দিলমহম্মদ ফিরলেই হয়।

যে পাথরখানায় চড়ে আমি বসে আছি তার ডান দিকে ভৈরবী আর কুন্তীরা কম্বল পাতল। রূপলাল বসল থিরুমলকে নিয়ে আমার বাঁ ধারে। পোপটলাল সমস্ত দলবল নিয়ে সামনে বসলেন। শ্রীমান সুখলাল থাকবে আমার সঙ্গে।

মাঝখানটা ফাঁকা রেখে সকলের বিছানা বিছানো হল। মাঝখানে গানের আসর বসবে, গান ভাঙলে যে যার নিজের কম্বলে শুয়ে পড়বে। রাত্রির জন্যে নিশ্চিন্ত হয়ে বসা গেল একেবারে।

থিরুমলের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখছি। সে হাসছে, কথা বলছে, কলকে টানছে, কিংবা রূপলালের গলা জড়িয়ে চলাফেরা করছে। কে বলবে কিছু হয়েছে তার, কোনো গণ্ডগোল নেই। তবে লক্ষ করলে বেশ বোঝা যায়-একবার ভুলক্রমে ও সে কুন্তীর দিকে চেয়ে দেখছে না– যেন কুন্তীকে সে চেনেই না। রূপলালের একান্ত বাধ্য হয়ে আছে সে। দেখেশুনে একরকম নিশ্চিন্ত হয়ে আছি।

দিলমহম্মদ ফিরল। ঊর্বশীর গলার ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে। ছুটে চলে গেল গুলমহম্মদ বাইরে। উপর দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখলাম, একখানা আশমানী রঙের কাপড়ে চমৎকার জ্বলজ্বলে তারার ফুল ফুটে উঠেছে।

দিলমহম্মদ নেমে এল অন্ধকারের ভিতর থেকে, পাহাড়ের গা বেয়ে। দুদিন পরে উটেদের পেটে কিছু পড়েছে, সেজন্যে দিলমহম্মদের মুখে তৃপ্তির হাসি 1

হাতের কাছে তার ভাত রুটি চাটনি গোছানো ছিল। কুন্তী উঠে গিয়ে এগিয়ে দিলে।

শেরদিল উঠে গেলেন গুলমহম্মদকে নিয়ে আসতে। উটেদের ছেড়ে বুড়ো যদি আসে আর উট যদি কোনও দিকে পাড়ি জমায়, তবেই চিত্তির! এখানে তো ওদের নিয়ে আসা অসম্ভব। যে পথে আমরা আসা যাওয়া করছি উট ও-পথে আসবে কি করে?

কি করে গুলমহম্মদ! ভাবনায় পড়ে গেলাম।

হঠাৎ শুনি পাহাড়ের ভিতর দিকে ঘণ্টার শব্দ তার সঙ্গে গুলমহম্মদের গলা–”হৈ হৈ হট হট হৈ।” সেই সরু পথ বেয়ে ঊর্বশী আর তার মাকে সাবধানে নামিয়ে আনা হচ্ছে। পিঠে বোঝা না থাকায় ছাগলের মতো অক্লেশে ওরা সেই গড়ানে-পথে নেমে এল।

এসে বসল আমাদের সামনে লম্বা গলা উঁচু করে। গানের উপযুক্ত সমঝদার। ভৈরবী গেলেন বাম খেজুর নিয়ে ঊর্বশীকে আদর করতে।

বাইরে পড়ে রইলো আটার বস্তাগুলো। তা থাকুক, কে নেবে ওখান থেকে শেরদিল জ্যান্ত থাকতে?

গুলমহম্মদ এসে বসে ঢোল কোলে তুলে নিলে। দিলমহম্মদ বসল তার ডান পাশে, আর ওদের মুখোমুখি বসলেন শেরদিল। তিনি গাইবেন, ঢোল বাজাবে গুলমহম্মদ আর আখর দেবে তার ছেলে।

চাঁটি পড়ল ঢোলে। গুড় গুড় গুড় গুড় গুড়ুম।

ঘুরতে লাগল সেই শব্দ হাজার লক্ষ গুণ বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ঘুরতে ঘুরতে উঠতে লাগল উপর দিকে, যেন শব্দময় ধূপের ধোঁয়া। নীচে থেকে উপর দিকে বার বার দেখতে লাগলাম চেয়ে চেয়ে, স্পষ্ট মনে হল সেই গুড় গুড় গুড়ুম জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, চোখে বেশ দেখা যাচ্ছে।

থামল ঢোল, আরম্ভ হল গান। সুরটা ঠিক কি ছিল আজ সঠিক বলতে পারব না। হয় কাওয়ালী, নয় গজল। ভাষা জানি না, কিন্তু এটুকু বুঝতে বাকী রইল না যে, সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশেই এই গানের ভাষা সুর সমস্ত নিবেদিত। যখন ঢোল থামে, তখন টেনে টেনে করুণ বিচিত্রসুরে শেরদিল কয়েক পদ বলে যান। যা বলেন তার মধ্যে সুরে আর ভাষায় যা ফুটে উঠে সে হচ্ছে নির্জলা আকুল আকুতি। ভাষা না জানা থাকলেও সেই সুর মর্মস্থলে আঘাত হেনে সবটুকু বেশ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়। তারপর দ্রুততালে ঢোল বেজে ওঠে, শেরদিলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গানের দু-পদ গেয়ে ওঠে দিলমহম্মদ। তখন শ্রোতারা কেউ স্থির থাকতে পারে না। হাতে হাতে চাপড় মেরে তাল দেয়। ঘাড় নড়ে, দেহ দুলতে থাকে সকলের।

চলল গান একটার পর একটা। গাওয়ারও যেমন শেষ হয় না, শোনারও তেমনি শেষ হয় না। যে গান শুনতে শ্রান্তি জন্মায় না তেমন জাতের গান ক্বচিৎ কদাচিৎ ভাগ্যে ঘটে মনে পড়ে হিংলাজের পথে সেই পাহাড়ের গহ্বরে গোটাচারেক টিমটিম আলোর আবছা অন্ধকারে একতালে একদল লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো দুলছে আর হাতে তালি দিচ্ছে। এখনও গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে প্রথমে মাথার মধ্যে তারপর বুকের মধ্যে গুরু গুরু বাজতে থাকে সেই ঢোল। যখন কোথাও গান শুনতে বসি তখন হঠাৎ অন্যমনষ্ক হয়ে শুনতে থাকি সেই ন-দশ বছরের মেয়েলী গলার অপূর্ব সুর। যেন মনে হয়, আবার যদি কোনো রাতে সেই রকমের পরিবেশে কোথাও আরম্ভ হয় সেই সুরের গজল ও কাওয়ালী, তবে হাতে হাতে চাপড় মেরে ঠিক জায়গায় তাল দিয়ে মাথা নাড়তে পারি।

জাহাজের খোলের মধ্যে কাবুলির গান শুনে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত যা বলেছিলেন সেটুকু হয়তো মিথ্যে নয়। জাহাজের খোলে, ড্রইংরুমে, পাড়ার জলসায় বাঁধা স্টেজে কাবুলিওয়ালার গান মানাবেই বা কেন, জমবেই বা কেন? বৈষ্ণবের আখড়ার অঙ্গনে তুলসীগাছের পাশটিতে খেমটা জমে কি না জানি না, তবে অন্য সুরের অন্য বস্তু এমন জমাই জমে যে, শ্রোতাকেও জমিয়ে নিয়ে গলিয়ে ছাড়ে এ আমি অনেকবার নিজ চক্ষে দেখেছি। তেমনি কাবুলির গানের মর্ম বুঝতে হলে, কাবুলির দেশেই যাওয়া দরকার, যেখানে তার গান উন্মুক্ত আকাশের তলায় কোথাও বাধা পায় না। পায় না বলেই বোধ হয় শ্রোতাকে সুদ্ধ সঙ্গে নিয়ে উধাও হয়ে যায় এমন রাজ্যে যেখানে আর জাতিবিচার থাকে না, সেখানে কাবুলির গানের সঙ্গে হালিশহরের রামপ্রসাদীর তফাত করা অসম্ভব। চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে স্বাধীন প্রাণের গানের প্রাণ থাকে না যে।

গান যখন থামল তখন যে ঠিক কখন এ আমরা জানতেই পারলাম না। শেষরাতে আমাদের বিদায় দিতে আসবেন জানিয়ে শেরদিল সস্ত্রীক উঠে চলে গেলেন। উট দুটি নিয়ে গুলমহম্মদরাও পিতাপুত্রে বাইরে চলে গেল যেখানে আটার বস্তা পড়ে আছে ৷

আমরা কেউই উঠলাম না। যে যেখানে বসে ছিল সেখানেই শুয়ে পড়ল। গান তখনও চলতে লাগল আমাদের মনের কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে।

সেই রাতে এমন এক কাণ্ড ঘটে বসল যার সঙ্গে তুলনা দিতে গেলে অনেকদিন আগেকার এক সন্ধ্যার একটি ঘটনা বড় বেশি করে মনে পড়ে। সে মাসটাও বোধ হয় আষাঢ়-শ্রাবণই ছিল। সন্ধ্যার সময় আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে যথানিয়মে আমরা খুড়তুতো জেঠতুতো পাঁচ ভাই আলোটার চার ধারে গিয়ে বই খুলে বসেছি। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সেই সময় একটা চামচিকে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকে চুপচাপ এক কোণে বসে থাকতেই পারত বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত। তা নয়। একটা হাঙ্গামা বাধাবার বদ মতলব রয়েছে কিনা মাথার মধ্যে। চুপ করে থাকতে পারবে কেন। চারিদিকের দেওয়ালের গায়ে ঠোক্কর খেয়ে বনবন করে উড়তে লাগল। সেদিকে প্রথম কার নজর পড়েছিল বলতে পারব না। যারই সে সৌভাগ্য হয়ে থাকুক, এটুকু বেশ মনে পড়ছে যে, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমরা পাঁচজনেই একযোগে চূড়ান্ত বিক্রমে সেই চামচিকের পিছনে আক্রমণ চালিয়েছিলাম। সেই আক্রমণে হাতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছিল সমস্তই নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছিল। বই খাতা টেনিস বল হকি স্টিক, মায় জুতো পর্যন্ত সব কিছুই সেই মহা-আক্রমণে কাজে লেগে গেল।

নিমেষের মধ্যে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে গেল পড়বার ঘরে। দেওয়ালের গায়ে যে কখানা ছবি টাঙানো ছিল তার একখানাও আস্ত রইল না। দোয়াত ভাঙল, বই ছিঁড়ল, বই এর আলমারির কাঁচ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। ছোট কাকার সদ্য-বিয়েতে পাওয়া পাম্পশু-জোড়ার এ-হেন অবস্থা হল যে, তা দেখলে তাঁর অতি বড় শত্রুর চোখেও জল আসত। শেষ পর্যন্ত আলোটা গেল উল্টে; শুধু উল্টে গিয়েই ক্ষান্ত হল না, তক্তপোশের উপর পাতা চাদর শতরুঞ্জি সমস্ত ভিজিয়ে দিলে কেরোসিন তেলে। তারপর সেটা দপ্ দপ্ করতে করতে গেল নিভে। তখন সেই ঘোর অন্ধকারে আমরা পাঁচ বীরপুরুষ আক্রমণ বন্ধ করে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এর পরেরটুকু একান্ত করুণরসাত্মক ব্যাপার। তারপরে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। বড়দা ছোটকাকা মা এবং আরও কে কে মনে নেই ছুটে এলেন। এল আলো, এল বেত। তখন সেই চামচিকের পক্ষ অবলম্বন করে তাঁরাও একযোগে চালালেন পাল্টা আক্রমণ। ঘণ্টাখানেক পরে যখন শান্তি স্থাপিত হল তখন আবার আমরা সেই ঘরের আরেকটা আলোর চারধারে বই খুলে বসতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু সবাই দু হাতে চোখের জল মুছছি। সবচেয়ে দুঃখের কথা, সব অনর্থের মূল সেই হতভাগা চামচিকেটার চুলের টিকিটাও আমরা আর দেখতে পেলাম না…

এই রকমেরই একটা কাণ্ড ঘটে গেল সেই রাতে। শেরদিলের সেই পরম শান্তিময় আশ্রমে নিরুদ্বেগ চিত্তে ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে অন্য সকলের সঙ্গে সেই স্থানটির ভিতরে ছুটতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে। শুধু ছোটা নয়, প্রাণপণে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচাতে লাগলাম, আর নিচু হয়ে যা হাতে ঠেকল তা-ই কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়তে লাগলাম, পাহাড়ের গায়ে অনেকটা উঁচুতে আর একটি ছুটন্ত প্রাণীর দিকে। সেও ছুটছে ঘুরে ঘুরে, সেই চামচিকেটার মতোই পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছে। আমাদের সকলের হাতের পাথর গিয়ে পড়ছে তার দিকে। আমাদের সমবেত কণ্ঠের চিৎকার লক্ষগুণ হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাহাড়ের মধ্যে। তুমুল কাণ্ড। হঠাৎ সে প্রাণীটির ছুটন্ত দেহটা কালো পাহাড়ের গায়ে অন্ধকারের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। তবু কি সহজে আমাদের চিৎকার থামে! শেষে একান্ত হয়রান হয়েই আমাদের পা আর গলা থামল। আমরা হুঁশ ফিরে পেলাম।

তখন প্রথম যে-কথা মাথায় এল তা হচ্ছে- ভৈবরী আর কুন্তীর অবস্থাটা কি?

যেখানে ওরা শুয়ে ছিল সকলেই সেই দিকে ছুটে গেলাম। গিয়ে পৌঁছে যা দেখা গেল তাতে আর কারও মুখে রা ফুটল না।

কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে ভৈরবী বসে আছেন। স্পষ্ট কিছুই দেখা গেল না, তবে এটুকু বেশ বোঝা গেল যে, নিশ্চয়ই একটা কিছু হয়েছে কুন্তীর, নয়তো তাকে ওভাবে জড়িয়ে ধরে বসে ভৈরবী কাঁদছেন কেন।

“আলো, আলো জ্বালাও জলদি।”

গোটা-তিনেক আলো তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠল। ওদের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি, হয়েছে কি?”

কাঁদতে কাঁদতে ভৈরবী উত্তর দিলেন, “হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু। ওদের সঙ্গে আপনিও কি এতক্ষণ জ্ঞানহারা হয়ে ছিলেন নাকি? কাকে ও রকম করে তাড়ালেন তা জানেন?”

সকলে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। সত্যিই তো–কাকে তাড়ালাম আমরা?

ভৈরবীই জানালেন, “ও থিরুমল-এতক্ষণ ধরে যাকে শেয়াল-তাড়া করে তাড়ানো হল। এই দেখুন ও কি করে গেল মেয়েটার!”

সবাই ঝুঁকে পড়লাম দেখবার জন্যে। আলো ধরে দেখা হল কুন্তীর গলায় মোক্ষম নিপীড়নের স্পষ্ট দাগ। দু-হাতে গলা টিপে তাকে শেষ করে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরম্ভ হল মাথায় জল ঢেলে বাতাস করে কুন্তীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার প্রাণপণ চেষ্টা। ইতিমধ্যে আমরা শুনলাম কি করে ব্যাপারটা এতদূর গড়াল।

ভৈবরী বললেন, “গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ চেয়ে দেখি, কে চড়ে বসে রয়েছে কুন্তীর বুকের উপর। তখন লাফিয়ে উঠে সজোরে একটা ধাক্কা মারি, সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি। লোকটা ছিটকে পড়ে ওধারে। আমার চিৎকার শুনে যে যার বিছানা থেকে উঠে চেঁচাতে চেঁচাতে তার পিছনে তাড়া করে। কেউ একবার ফিরেও দেখলো না যে, আমরা দুটো মেয়েমানুষ যে পড়ে রইলাম আমাদের দশা কি হল?”

সকলেই নির্বাক।

মুখ তুলে তাকালাম। অনেক উঁচুতে, পাহাড়ের একেবারে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিলাম। আরও উঁচুতে দৃষ্টি পড়তে দেখি, ভোর হয়ে এল। মাথার উপর গোল আকাশটুকুর রং ফিকে হয়ে এসেছে। তারাগুলিকে দেখতে পাওয়া গেল না।

গুলমহম্মদ এসে দাঁড়াল। বাইরে উটের পিঠে মালপত্র বাঁধা হয়ে গেছে। আমাদের বিদায় দিতে শেরদিলও এসে উপস্থিত হলেন।

দলসুদ্ধ সবাই বাক্যহারা। তখনও কুন্তীর মুখে মাথায় জলের ঝাঁপটা দেওয়া চলছে।

শেষে ওদের শোনানো হল সমস্ত ব্যাপারটা। শুনে ওরাও স্তম্ভিত।

শেরদিল বললেন যে, তিনিও কিছুক্ষণ আগে বিষম গোলমাল শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর আস্তানা থেকে। পাহাড়ে নানা জাতের আওয়াজ তো হামেশাই হয়। হয় কোথাও পাহাড়ের গা থেকে প্রকাণ্ড পাথরের স্তূপ পড়তে লাগল গড়িয়ে, নয়তো পাহাড়ি জিনেরা গুহায় গুহায় কেঁদে বেড়াতে লাগল–কাজেই তিনি ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারেননি যে, আমরাই প্রাণপণে চেঁচিয়ে মরেছি।

গুলমহম্মদ বললে, “তা হলে থিরুমল গেল কোথা? এখান থেকে বেরুবার রাস্তা ঠিক সামনেই তো আমরা উট নিয়ে বসে আছি, ওই পথে সে গেলে আমরা নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পেতাম।”

ভৈরবী উঠে দাঁড়ালেন-তখনও কুন্তী বেহুঁশ। দাঁড়িয়ে তিনি হুকুম করলেন গুলমহম্মদকে-”এখনই যাত্রা করব আমরা। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা নয়। বুড়োবাবা, নিয়ে চলো তো তুলে এই মেয়েটাকে। ওকে আমার সঙ্গে খাঁটিয়ার ওপর তুলে দেবে।”

কেউই আপত্তি করলে না। যে যার কুঁজো কম্বল নিয়ে তৈরি হল। চুপ করে বসে সব দেখছি। শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু থিরুমল যে রইল, তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে না?”

ভৈরবী বললেন, ঝাড়ু মারি তার মুখে।” বলে আবার গুলমহম্মদকে মিনতি করলেন-”বুড়োবাবা, দাও না মেয়েটাকে তুলে!”

দলসুদ্ধ সকলের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। দেখলাম, ঘৃণায় বিরক্তিতে সকলের মুখ থমথম করছে। কেউ এরা চায় না থিরুমলকে। সে বাঁচল না ম’লো এটুকু জানবারও বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই কারো মনে।

ছড়িদার রূপলাল এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমার সামনে। দৃঢ় কণ্ঠে সে জানালে যে, থিরুমলের জন্যে আর কারও এক মুহূর্ত নষ্ট করবার ইচ্ছা নেই। সকলেরই যথেষ্ট লোকসান হয়েছে তার জন্যে। যাচ্ছে সকলে তীর্থ করতে। সেই হতভাগার জন্যে সকলের তীর্থযাত্রায় বিঘ্ন পড়ছে বার বার। শেষ পর্যন্ত এই যাত্রা পণ্ড হয় এই কি আমার বাসনা?

পোপটভাই এসে আমার একটা হাত ধরলেন। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম ৷ দেখলাম পোপটভাই-এর মুখের ওপরেও দৃঢ় সঙ্কল্পের ছাপ ফুটে উঠেছে।

যেমন ভাবে ছোট শিশুকে দু-হাতের উপর শুইয়ে নেয় তেমনি করে কুম্ভীর জ্ঞানহীন দেহটা তুলে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন শেরদিল। সামনে চলেছেন ভৈরবী 1

পোপটভাই আমাকে টেনে তুলে নিয়ে চললেন।

অনেকটা উঠে সেই পাহাড়ি গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নেমে গিয়ে আমরা খোলা জায়গায় পৌঁছলাম। যেন মুক্তি পাওয়া গেল কারাগার থেকে। সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় তার শেষ সীমায় আকাশের গায়ে গিয়ে মিশেছে পাণ্ডুবর্ণ ধরণীতল I সেইখানটিতে ক্ষিপ্রহস্তে রঙের পর রং চড়াচ্ছেন কোন এক অদৃশ্য শিল্পী। প্রথমে ফিকে গোলাপি। তারপর আরও একটু চড়া ওই একই রং। তারপর ফিকে লাল রং। তারপর তাঁর নিপুণ হাতের টানে সারা দিগন্তটা ঘোর রক্তবর্ণ হয়ে জ্বলতে লাগল। সেইদিকে চেয়ে রইলাম। দুটো রাত আর একটা পুরো দিন চোখের দৃষ্টি ছিল চতুঃসীমার মধ্যে আবদ্ধ। এতক্ষণে টের পেলাম সেটাও একটা কম জ্বালা নয়।

সবাই প্রস্তুত। উটের পিঠে খাঁটিয়ার মধ্যে স্বস্থানে বসেছেন ভৈরবী। কোলে তাঁর বেহুঁশ কুন্তী। সার বেধে দাঁড়িয়েছে সবাই কুঁজো কম্বল ঘাড়ে করে। এবার যাত্রা শুরু হবে।

পিছনে ফিরে তাকালাম কালো রুক্ষ পাহাড়টার দিকে। ওর গায়ের অত খাঁজ খোঁজের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথায়ও লুকিয়ে বসে আমাদের দেখছে থিরুমল। পাহাড়টার আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম যদি কোথাও তার মুখখানা দেখতে পাওয়া যায়।

সামনে থেকে রূপলাল চিৎকার করে উঠল, “হিংলাজ মাতাকি–” সকলে বেশ বলিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দিলে, “জয়”।

উট দুটো আর মানুষের সারিটা নড়ে উঠল।

স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে আছি। আমার একপাশে শেরদিল, অন্য পাশে পোপটভাই। পোপটভাই বললেন, “চলুন।”

শেরদিল বললেন, “কিছু ভাববেন না আপনি। নিশ্চয় সেই ছোকরাকে আমি পাব। পাগলই হোক আর যাই হোক, জল তেষ্টা পেলে তাকে নেমে আসতেই হবে পাহাড় থেকে। তখন আমার কাছেই রেখে দেব তাকে। গুলমহম্মদকে আমি বলে দিয়েছি যে, আপনারা যে পথে ফিরবেন সেই পথে একটা কুয়োর কাছে লোকের বসতি আছে। সেখানে আমি আমার লোক সঙ্গে দিয়ে ছোকরাকে পাঠিয়ে দেব।”

আমি তখন ভাবছি শোনবেণীর সেই ঝড়জলের রাতটার কথা। ভাবছি সেই রাতে থিরুমলকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে আমি প্রাণের মায়া ভুলে গিয়েছিলাম। ওর হাতে ধরে টানতে টানতে ছুটে চলেছি। এক একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে, অন্ধকারের মাঝে পিছনে তাড়া করে ছুটে আসছে ঠিক ওই কালো পাহাড়টার মতো সমুদ্রের বিরাট ঢেউ। আমার কানে তখন বাজছে- থিরুমল সেই প্রথম অর্থহীন হাসি হেসে উঠল-হা হা হা হা। বিদ্যুতের আলোয় ওর চোখ দুটোর দিকে চেয়ে আঁতকে উঠেছিলাম। তবু ওর হাত ছাড়িনি। কিন্তু-কেন?

কি করে তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে আসব? তার একটু আগে পাঁচিলের উপর থেকে যে শুনেছিলাম- শুনেছিলাম থিরুমলের সেই কাকুতি-মিনতি–”কিছুই হয়নি কুন্তী। কিচ্ছু হয়নি। আমি তোমায় ছেড়ে বাঁচব কি করে, কোথায় যাব আমি? যে করে হোক আমরা আবার দাঁড়াব। আবার ঘর বাঁধব। কেন অবুঝ হচ্ছ তুমি?”

আবার নতুন করে শুনতে পেলাম, সেই আকুল আকুতি থিরুমলের। আর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম পিছনে দাঁড়ানো পাহাড়টার চূড়া থেকে নীচে পর্যন্ত। নিশ্চয় ওখানে রয়েছে থিরুমল। নিশ্চয়ই সে কোনও একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। অসহায়ভাবে দেখছে থিরুমল যে, আমরা তাকে ফেলে রেখে তার কুন্তীকে নিয়ে পালাচ্ছি।

কিন্তু কোন অধিকারে?

এক ঝটকায় পোপটলালের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। প্রাণপণে ছুটলাম সামনে ডাকতে ডাকতে, “গুলমহম্মদ, গুলমহম্মদ!”

সামনের বড় উট থামল। তার পিছনে থামল ছোট উট যার উপর ভৈরবী আর কুন্তী। দৌড়ে গিয়ে পৌঁছলাম ওদের পাশে।

“নামাও কুন্তীকে। নামিয়ে দাও বলছি এখনই। আমাদের কোনো অধিকার নেই ওকে নিয়ে যাবার—”

সবাই স্তম্ভিত। আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে সকলে। আমি হাঁফাচ্ছি।

উটের উপর থেকে ভৈরবী ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তার মানে?”

উত্তর দেবার আগে সকলের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। সকলেই রুদ্ধ নিশ্বাসে চেয়ে আছে আমার দিকে। কি রকম যেন হয়ে গেল আমার ভিতরটায়। গলাটা কেঁপে উঠল। তবু বললাম, বললাম একান্ত মিনতি করে, “বুঝে দেখো তোমরা। সবাই মাথা ঠাণ্ডা করে বুঝে দেখো, কেন আমরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছি? আমরা ওর কে? থিরুমল এখানে থেকে গেল। শেরদিল বলছেন যে, সে ফিরে আসবেই জলের জন্যে। জল পর্যন্ত না খেয়ে সে কতক্ষণ থাকবে! কুন্তীও থাকুক শেরদিলের কাছে। ওদের দুজনকেই শেরদিল পাঠিয়ে দেবেন আমাদের ফেরার পথে সেই কুয়োর ধারের বস্তিতে। কুন্তীকে যদি আমরা নিয়ে যাই, থিরুমল ফিরে এসে যখন দেখবে যে কুম্ভীও নেই তখন সে আরও খেপে উঠবে। আর যদি তার মাথায় গোলমাল কেটে যায়–তখন সে কি ভাববে? থিরুমল ভাববে যে তাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা তার কুন্তীকে নিয়ে পালিয়েছি।”

আরো হয়তো বলতে পারতাম। রূপলাল সামনে এসে দাঁড়াল চোখ পাকিয়ে। তার চোখে তখন নিদারুণ ঘৃণা। থেমে থেমে চিবিয়ে চিবিয়ে সে উচ্চারণ করলে, “ আপনি কি বলতে চান আমরা এতজন হিন্দুসন্তান ওই হিন্দুর মেয়েটাকে এই মুল্লুকে ফেলে রেখে চলে যাব?”

ভৈরবীর চোখে আগুন জ্বলছে। তিনি শুধু বললেন, ‘ভীমরতি ধরছে’ বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দিলমহম্মদকে আদেশ করলেন-”চলো।”

ঘাড় হেঁট হয়ে গেল আমার। আর একবার কি একটা বলবার জন্যে চোখ তুলে ওদের দিকে চাইতে নজর পড়ল কুন্তীর চোখের ওপর। কুন্তী চেয়ে আছে। চেয়ে আছে সোজা আমার দিকে। কি যে দেখছে কুন্তীই জানে। কিন্তু আমি তার চোখে দেখলাম ত্রাস আর তার সঙ্গে মেশানো ঘৃণা। বোধ হল যেন ব্যাকুল মিনতিও ঝরে পড়ছে সে দৃষ্টি থেকে। সে চোখ দুটি মুখর হয়ে উঠছে তখন, শব্দহীন ভাষায় বলছে আমাকে, ফেলে যাবে? আমাকেও এখানে বিসর্জন দিয়ে যাবে তুমি?

চোখ নামিয়ে নিলাম আমার।

পোপটলাল হাত ধরে টান দিলেন- “চলুন।“

সামনে চেয়ে দেখলাম সূর্যদেব উঠে আসছেন। কি জানি কেন আজ বহুদিন পরে একবার চোখ বুজে আমার ইষ্টদেবতাকে সূর্যমণ্ডলের মধ্যে দেখবার চেষ্টা করলাম। থিরুমলের মুখখানাই ভেসে উঠল। মুখ টিপে সে হাসছে।

তারপর কখন যে সবাই-এর সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে আরম্ভ করেছি তা নিজে বুঝতেও পারিনি।

চলেছি। কারণ, না চলে উপায় কি! এ চলার কি বিরাম আছে কোথাও। সবাই চলছে এ দুনিয়ায়। সবাই তীর্থযাত্রী। যে মহাতীর্থে গিয়ে পৌঁছতে পারলে এই চলা কর্মটির হাত থেকে একবারে রেহাই মেলে সে তীর্থের নাম-ঠিকানা আজও জানা নেই। এই যে হিংলাজ-যাত্রা, যেখানে এর শেষ হবে সেই খানেই শুরু হবে আরেক যাত্রার। হয়তো সে পথে চোর-কাঁটার মতো সঙ্গ নেবে আর একদল কুন্তী আর থিরুমল। তখনও হয়তো এইভাবে চোখের জল মুছতে হবে কারো জন্যে। এক হাতে চোখের জল মোছা আর অন্য হাতে এই চলার পথের দু-ধারে যা মেলে তা কুড়িয়ে নিয়ে আঁচলে বাঁধা–এই হচ্ছে এ চলার নীতি। কিন্তু আঁচলটা হচ্ছে শতচ্ছিন্ন। তার অজস্র ছিদ্র দিয়ে সব গলে পড়ে পথের ধূলায় গড়াগড়ি যায়। তবু দঁড়াবার সময় নেই কারও। পিছন ফিরে তাকাবার সময় নেই। কারণ অন্য সবাই এগিয়ে যাচ্ছে যে।

তাই তো দেখছি। জীবনের অনেকগুলো দিন মাস বছর গঙ্গার ঘাটে বসে কাটাতে কাটাতে দেখছি। দেখছি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাহাকারে আকাশ-বাতাস কাঁপাতে কাঁপাতে মা এসে উপস্থিত হলেন। চিতায় তুলে দেবার পরও হাহাকার। সে হাহাকারে পাষাণ গলে যায়। চিতা নিভল। নেয়ে ধুয়ে ফিরে গেলেন মা। দিন গেল, মাস গেল-বছরও প্রায় যায় যায়। সেই মাকেই আবার ঘুরে আসতে দেখেছি। এবার তাঁর কোলে আর একটি নূতন আগন্তুক। সূতিকাগার থেকে বেরিয়ে গঙ্গাস্নানে এসেছেন। শুদ্ধশুচি হয়ে ঘরে ফিরবেন ছেলে কোলে নিয়ে। বুকের ভিতর তাঁর সীমাহীন কামনা-তাঁর এই সন্তান বড় হবে, এরই কোলে মাথা রেখে তিনি চোখ বুজবেন, আর এই ছেলেই তখন তাঁর জন্যে চোখের জলে বুক ভাসাবে।

শহরের রাস্তায় দেখেছি-পথের এক পাশ দিয়ে শুষ্কমুখ নগ্ন-পা, নগ্ন-গা একদল চলেছে একখানা খাঁটিয়া কাঁধে করে। চোখের দৃষ্টি তাদের শূন্য, মুখে তাদের ভাষা নেই। সেই সময় সেই রাস্তারই মাঝখান দিয়ে মস্ত এক গাড়িতে চলছে একজন,-পাশে তার নববিবাহিতা বধূ। চোখে সোনালি স্বপ্নের কাজল, বুকে তাদের মধু-ভাষার কলধ্বনি। ওদের দেখে এরা মুখ ফিরিয়ে নিল। বিতৃষ্ণায় মনটা ভরে গেল এদের-”মরবার আর দিন পেলে না ব্যাটা!” এই অলক্ষণে দৃশ্য চোখে পড়ে আজকের দিনে মনের আমেজটুকু না মাটি হয়ে যায় এজন্যে নববধূকে একটু আড়াল করে বসল।

জীবনভর যেখানে যা কিছু চোখে পড়েছে তার সবটুকুই একটা বিরাট হ্যাংলাপনার উলঙ্গ মূর্তি ধরে সামনে এসে দাঁড়াল। এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার সোজা অর্থটা হচ্ছে আগাগোড়া গোঁজামিলের মিল খুঁজে বেড়ানো। যা কিছু সামনে পড়ুক তাকে কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে চরম কথা। অজস্রবার নিজের সঙ্গে আপোসে মিটমাট করে নিয়ে সামনে শুধু চোখ বুজে ছুটে চলাটাই বেঁচে থাকার পরম সার্থকতা।

তাই-ই করতে হল। প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে নিজেকে বোঝাতে লাগলাম-”তুমি চলেছ তীর্থ করতে। বেঁচে যদি ফিরতে পারো এখান থেকে তাহলে দাঁড়ি-পাল্লায় পুণ্যের দিকটা কতখানি ঝুঁকে পড়বে তার হিসাব রাখো বাপু? শুধু কি তাই? যদি ধড়ে প্রাণটুকু বজায় রেখে গিয়ে দাঁড়াতে পারো তোমার সমশ্রেণীর সগোত্রদের মাঝে, তখন তোমার যাযাবরত্বের মহামূল্য এই মুকুটে হিংলাজ-পথে কুড়িয়ে পাওয়া জ্বলজ্বলে হীরাখানি দেখে সকলের কতটা তাক লেগে যাবে সেটা কি ভুলে গেছ? পা চালাও, সামনে পা চালাও ঘাড় গুঁজে, কোনো দিকে না চেয়ে। সামনেই চন্দ্রকূপ জানো সেটা আবার কি পদার্থ। যখন সেটা চোখের নাগালের মধ্যে আসবে তখন বুঝতে পারবে কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে। যে পড়ে রইল সে থাকুক। কোনও লাভ নেই পিছন ফিরে চেয়ে। শুধু সামনে এগিয়ে চলো।”

চলতে লাগলাম ভাই পোপটলাল প্যাটেলের আমার চেয়ে আধ হাত উঁচু দীর্ঘ দেহখানির পাশে পাশে।

একটা লম্বা নিশ্বাস পড়ার শব্দ শুনলাম। আমার ডান কানের আধ হাত উঁচুতে পোপটলালের মুখ, সেখান থেকে সেই নিশ্বাসের সঙ্গে চাপা গম্ভীর স্বরে বেরুল-”হে ভগবান, হে হিংলাজ মাতাজি, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকি। একবার যেন চন্দ্রকূপ পৌঁছতে পারি এই দেহটা নিয়ে। তারপর মরণই আসুক আর পাগলই হয়ে যাই কোনো আফসোস নেই।

মুখ তুলে চেয়ে দেখলাম পোপটলালের মুখ। পোপটভাই ওই দেহটার মধ্যে কোথায় তলিয়ে গেছেন। বহুদূরে কোথায় চলে গেছেন তিনি। তাঁর লম্বা দেহটা দম দেওয়া পুতুলের মতো আমার পাশে পাশে হাঁটছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ ৷ দুজনে আপন চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছি। আবার অতি নিচু গলায় কি বলতে লাগলেন পোপটলাল। এবার মনে হল যেন বহু দূর থেকে তাঁর কথাগুলি ভেসে আসছে। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম।

“উঃ কতদিন! কতদিন ধরে কাটালাম এই দিনটির অপেক্ষায়। বারো বছর-বারোটা বছরের প্রত্যেক দিন-রাত গুনে গুনে কাটিয়েছি। এই বারোটা বছরের প্রত্যেকটি রাতে স্বপ্ন দেখেছি চন্দ্রকূপের। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা। এই কয়েকটা ঘণ্টা যদি সামর্থ্যটুকু বজায় থাকে তবে পৌঁছব নিশ্চয়ই চন্দ্ৰকূপে। এই দেহ নিয়েই চন্দ্রকূপ দর্শন হবে। সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে যাবে। জয় বাবা চন্দ্রকূপ! এইটুকু সময় যেন তোমার দয়ায় আমার হুঁশ বজায় থাকে বাবা।“

আবার চেয়ে দেখলাম পার্শ্ববর্তী চলন্ত দেহটার মুখের দিকে। প্রকাণ্ড পাগড়ির নীচে কপালের উপর এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত পর পর পাঁচটা রেখা। সুগভীর সুস্পষ্ট পাঁচটা দাগ। যদি পড়তে জানতাম ওই দাগগুলোর অর্থ! কত কিছুই যে জানা যেত। সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছেন পোপটলাল। তাঁর চোখের পাতা পড়ছে না। সামান্য ঘোলাটে তারা-দুটিও স্থির নিশ্চল। যেন এখান থেকেই তিনি দেখতে পাচ্ছেন চন্দ্ৰকূপ। না, তা ঠিক নয়। দেখছেন তিনি পার হয়ে-আসা বারোটা বছর আগেকার কোনো কিছু, যা জানতে পারলে ওঁর কপালের ওই রেখাগুলোর মানে বোঝা যেত, যা হয়তো আর ওঁর মুখ দিয়ে বার হবে না কখনো ৷

রুদ্ধ নিশ্বাসে মন কান সজাগ রেখে হাঁটছি তাঁর পাশে পাশে। অনেকটা সময় নিঃশব্দে পার হওয়া গেল। পায়ের নীচে চাঙড়া চাঙড়া পাথর শেষ হয়ে গেছে। আরম্ভ হয়েছে বালি। সাদা ঝুরঝুরে চিকচিকে নির্ভেজাল বালি। পা বসে যাচ্ছে। বহু আগে দেখা যাচ্ছে উট দুটিকে। সামনের বড় উটটার উপর এতগুলো লোকের বেঁচে থাকার রসদ। পিছনেরটার উপর খাঁটিয়ার মধ্যে ওরা দুজন। হেলছে দুলছে দুটো দেহ। এতদূর থেকে মনে হচ্ছে যেন হাওয়ায় দুলছে। তারপর মানুষের একটা লম্বা সারি। পাশাপাশি দুজন, তাদের পিছনে আরও দুজন বা একলা একজন। সার বেঁধে একমনে চলেছে সবাই জলের কুঁজো কাঁধে নিয়ে। মুখে কথা নেই, যেন সকলেই গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। কি ভাবছে ওরা এখন? ভাবছে নাকি থিরুমলের কথা? পিছনে যে পড়ে রইল সে হতভাগার একমাথা রুক্ষ কোঁকড়ানো চুল। আর ভাসা ভাসা চোখ দুটো সুদ্ধ শুকনো মুখখানা সকলের মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হয়তো। হয়তো ইতিমধ্যে অনেকের বুকের মধ্যেই তোলপাড় করছে একটা চিন্তা–এই তীর্থপথে এখন এই সময় হঠাৎ যদি বিগড়ে বসে দেহের মধ্যে মন নামে যে কলটা চলেছে সেই কলটা-তাহলে? হঠাৎ যদি সেটার কোথাও কিছু ঢিলে হয়ে যায়? দৈবাৎ যদি এমন হয়ে বসে যার ফলে এতদিনের চেনা-জানা এই পুরনো জগত্‍টাকে আর চেনাই যাবে না-তখন? তখন আর কি, তখন নির্বিঘ্নে নির্বিবাদে সহযাত্রীরা তাকে ফেলে রেখে এগিয়ে চলে যাবে। তারপর এই বিশাল মরুভূমির আদিগন্ত সমস্তটুকু মৌরসী স্বত্বে ভোগদখল করতে থাক। কেউ কোনো দিন তিলমাত্র আপত্তি করতে আসবে না।

দেশে-গাঁয়ে নিজের স্বজাতি-স্বজনের মাঝে স্বাধীনতা বলতে কোনো কিছুর বালাই নেই। না যায় প্রাণ খুলে একটা কথা বলা, না চলে নিজের প্রাণটা নিয়ে একটা কিছু করা। এখনই খপ করে মরব বললে সহজে কেউ মরতেও দেবে না। গলায় দড়ি দিলে লুকিয়ে দিতে হবে। টের পেলে দড়ি কেটে নামাবে। বিষ খেলে তৎক্ষণাৎ বদ্যি ডেকে আনবে। টেনে-হিঁচড়ে যমের দরজা থেকে আনবে ফিরিয়ে। পাগল হয়ে ও শান্তি নেই, দড়িদড়া শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে। যার কেউ কোথাও নেই তারও না খেয়ে মরবার ভয় নেই। দিগম্বর হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়। তখন সবাই দেয় খেতে, সকলেই তার ভার বয়। সকলেরই নজর থাকে তার উপর। দুদিন না দেখতে পেলেই অমনি আরম্ভ হয়ে যায় চারিদিকে-”তাই তো, পাগলটা আবার গেল কোথায়? কনি দেখা যাচ্ছে না তো?” সকলের দরজার সামনের খোলা রাস্তাটুকু তার জন্যে। দিন-রাত যদৃচ্ছা পড়ে কাটাও। কেউ আপত্তি করবে না।

কিন্তু এখানে? এখানে কেউ নেই যে তোমার শান্তির ব্যাঘাত ঘটাবে। তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে এমন জনপ্রাণী কখনো এখানে এসে জুটবে না। উপরের ওই আকাশ আর পায়ের তলায় এই ধূ ধূ মরুভূমি-এরা দুজনেই নির্বাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে, যতক্ষণ না তুমি এই মরুভূমির বুকে লুটিয়ে পড়ো। তারপর এই শ্বেতশুভ্র অকলঙ্ক বালির বুকে পড়ে থাকবে একখানি শ্বেতশুভ্র পবিত্র হাড়।

বালির বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসেছি আমরা জয়াশঙ্করকে। উপরের খোসা ছাড়ানো তাঁর হাড় কখানা আকাশের দিকে চেয়ে নির্লজ্জের হাসি হাসতে পারবে না। কিন্তু থিরুমলের যে সে-উপকারটুকু করে আসা হল না। তা না হল তো কি এমন ক্ষতি হল। যতক্ষণ এই খোলা হাওয়ায় ছুটে বেড়াতে পারে, বেড়াক। তারপর পড়ে থাকবে আরাম করে এই খোলা হাওয়ায়।

এতক্ষণ পরে খেয়াল হল খোলা হাওয়ার মধুর আস্বাদটুকু। চোখ মুখ পুড়িয়ে ঝলসে দিতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি চাদরটা দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে ফেললাম।

আবার মুখ খুললেন পোপটলাল

“এই আগুন-বারো বছর ধরে দিনরাত অষ্টপ্রহর এই আগুনে দগ্ধে মরছি। আজ আর এর আঁচ গায়ে লাগে না আমার। এ তো অতি তুচ্ছ। এ শুধু বাইরেটাই পোড়াতে পারে। যে আগুনে আমি পুড়ছি তা শুধু পুড়িয়েছে ভিতরটা। মুখ বুজে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে। সে জ্বালা সে দগ্ধানি কোথাও কারও কাছে তিলমাত্র প্রকাশ করার উপায় নেই। এইবার তার শেষ। আর কয়েকটা ঘণ্টা যদি এই শরীরের শক্তিসামর্থ্যটুকু বজায় থাকে! জয় বাবা চন্দ্ৰকূপ!”

বোধ হয় বাবা চন্দ্রকূপকেই উদ্দেশ্য করে বার বার জোড়হাত কপালে ঠেকালেন তিনি ৷

চুপ করে চলেছি। আমাকে তো শোনাচ্ছেন না পোপটলাল। কথা বলছেন তিনি নিজের সঙ্গে। বলুন, কান আছে শুনে যাই। তাঁর সেই নিজের সঙ্গে বাক্যালাপের মাঝে আমি কি কথা কইব!

কথা না বললেও তাঁর স্বগতোক্তি আর এক নূতন ভাবনায় ফেলে দিলে। এই যাত্রার প্রথম থেকেই নানাজনের মুখ থেকে নানাকথা কানে আসছে চন্দ্রকূপ সম্বন্ধে ৷ চন্দ্রকূপের কোনো আলোচনা উঠলেই বেশ সন্ত্রস্ত ভাব এসে পড়েছে সুরে আর ভাষায়। রহস্যজনক সমীহ করা হচ্ছে চন্দ্রকূপ বাবাকে। অনেকবার এ জাতের আলাপও শুনছি যে, চন্দ্রকূপ বাবার কৃপা হলে, তাঁর হুকুম পেলে, তবে তো হিংলাজ দর্শন। এতদিন বিশেষ করে এ সব কথায় আমি মাথা ঘামাইনি। ভারতবর্ষের প্রায় সব তীর্থেই কুণ্ডু আর কূপের ছড়াছড়ি। উষ্ণ শীতল শ্যামা রাধা গৌরী সৌভাগ্য সূর্য-আরও নানা রকমের কুণ্ড দেখেছি, স্পর্শ করেছি। কূপেরও কিছু কমতি নেই। সর্বত্রই এক আইন, এক চাল। স্নান করবার মতো জল থাকলে স্নান করো, নয়তো সেই ফুল-বেলপাতা-পচা জল মাথায় ছিটিয়ে নাও। তারপর সেই সমস্ত কুণ্ড-কূপের রক্ষক পাণ্ডা-পুরুতদের সঙ্গে যথারীতি খেচাখেচির পর যথাশক্তি দান-দক্ষিণা শেষ করে হাঙ্গামা চুকিয়ে ফেলো। চন্দ্রকূপে পৌঁছে ওই ধরনের কিছু করলেই চলবে-এতদিন এই ধারণাই করে আসছিলাম। পোপটলাল প্যাটেলের কথাগুলি শুনে বাবা চন্দ্রকূপের প্রতি ভক্তির মাত্রাটা কতখানি বৃধি হল বলা শক্ত, তবে ভয় না হোক, দুশ্চিন্তা যে খানিকটা বৃদ্ধি হল তাতে সন্দেহ নেই। কি জানি কি আছে সেই চন্দ্ৰকূপে, যার মাহাত্ম্য এমনই অসীম যে, একবার সেখানে পৌঁছতে পারলে দীর্ঘ বারো বছরের তুষানলের জ্বালা জুড়িয়ে যাবে।

কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন-কি সে কারণটি যার জন্যে এই সদানন্দ প্রৌঢ়ের এই সুদীর্ঘ অর্ন্তদাহ। সেখানে পৌঁছলেই ত জানা হয়ে যাবে চন্দ্রকূপের রহস্যটা কি-কিন্তু পোপটভাই-এর গোপন রহস্যটি আর কখনই জানা যাবে না।

আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অল্পক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ পোপটলাল জিজ্ঞাসা করলেন–”স্বামীজি মহারাজ, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই আপনাকে, যদি কিছু না মনে করেন।“

এতক্ষণ পরে কথা বলবার সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হয়ে গেলাম, তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, “বলুন না কি জানতে চান?”

“ঐ যে মাতাজি চলেছেন আপনার সঙ্গে, উনি আপনার কে?”

এই প্রশ্নটির জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। আশা করেছিলাম পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে একটি সারগর্ভ বক্তৃতা করবার সুযোগ পাব তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে। কিন্তু এ একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন। উত্তর দিতে গিয়ে ঢোক গিলতে হল। বাস্তবিক আমি নিজেও তো কখনো ভেবে দেখিনি উনি আমার কে। কিন্তু চট করে উত্তর না দিলে চলে না। পোপটলাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। যা মুখে এল তাই বললাম, “কই- কেউ নয় তো। মানে কোনো সম্বন্ধ নেই আমার সঙ্গে ওঁর। দুনিয়ায় আমি স্রেফ একা, কারও সঙ্গেই কোনো সম্বন্ধ নেই আমার।”

উত্তরটা শুনে তাঁর কপালের পাঁচটা রেখা সঙ্কুচিত হয়ে উঠল। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, তবে? তাহলে কিসের জন্য একটা মেয়ে-মানুষের দায়িত্ব বয়ে বেড়াচ্ছেন আপনি শুধু শুধু; এখানে এই যমের মুখে এসেছেন আজন্মের পাপ-তাপের জ্বালা থেকে পরিত্রাণ পেতে? এখানেও ওই আপদ সঙ্গে এনেছেন কেন?”

একটু যেন রাগের ছোঁয়াচ তাঁর স্বরে, যেন একটু ধমকের সুর মেশানো। আমিও ভাবনায় পড়ে গেলাম- বললাম-”কই, মনে তো পড়ছে না এমন কোনো বড়সড় পাপ-টাপের কথা, যার জ্বলুনির হাত থেকে রেহাই পাবার আশায় এতদূর ছুটে এসেছি। আর জন্মাবার সময় যখন ঐ আপদের জাতেরই একজনের পেট থেকে বেরুতে হয়েছে-তখন আছেই না হয় একটা সঙ্গে। এতে আর দায়-দায়িত্বটা কোথায় আছে বলুন? এমনকি নিজের কুঁজো থেকে একবিন্দু জলও তো দেবার উপায় নেই। হাব নদীর কিনারার সেই প্রতিজ্ঞাগুলো সঙ্গে চলেছে তো। কি আর এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হচ্ছে আর ও সঙ্গে থাকলে। তীর্থ করে ও ওর ভাগের পুণ্য নিয়ে ফিরবে, আমি আমার ভাগেরটুকু নিয়ে ফিরব। কেউ কারও পুণ্যে ভাগ না বসালেই হল।”

শুনে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। টেনে টেনে বলতে লাগলেন-হায়, আমিও যদি পারতাম আপনার মতো বলতে। এত বড় পাপের বোঝাটা বয়ে যদি আমাকে এখানে আসতে না হত। আপনার আর ওই মাতাজির মতো আমিও তাহলে অনায়াসে পারতাম যাকে-তাকে কুড়িয়ে নিয়ে বুকে করে আগলে বেড়াতে। কোনো ঝঞ্ঝাটই তাহলে আপদ বলে মনে হত না আমার। কিন্তু তা হবার উপায় নেই। নিজের ভার যতক্ষণ না নামছে বুক থেকে, ততক্ষণ অন্য কিছুর সেখানে স্থান নেই। এই দলের অনেকেরই এই তীর্থপথে অন্য কোনো দিকে নজর দিবার উপায় নেই। অনেকেরই বুকের উপর চাপা জগদ্দল পাথর। সামনে ওই চন্দ্রকূপ। ওখানে পৌঁছলে সে পাষাণ বুক থেকে নামবে। জয় বাবা চন্দ্ৰকূপ!

কাঁধের ঝোলা থেকে দুটি বিড়ি বার করে একটি তাঁকে দিলাম। একটা কাঠি জ্বেলে দুজনের বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। এক সুদীর্ঘ টানে বিড়িটার সুতো পর্যন্ত পৌঁছে নাক মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছেড়ে পোপটভাই বললেন, ‘কিছু মনে বরবেন না, স্বামীজি মহারাজ, আমার বেয়াদবির জন্যে। ও কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা কখনই আমার উচিত হয়নি। মাতাজি তো সাক্ষাৎ দেবী! ওর কথা আলাদা। কিন্তু মেয়েমানুষ জাতটাকেই আমি সাপের চেয়ে বেশি ভয় করি। বারো বছর আগে আমিও আপনার মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, কই মনে তো পড়ছে না এমন কোনো বড়সড় পাপের কথা–যদি না তখন সে এসে জুটত আমার জীবনে। ওই মায়ের জাতেরই সে একজন। কিন্তু আমার এই পোড়া চোখে তাকে দেখেছিলাম অন্য নজরে। সেই বয়সই ছিল তখন আমার। আগুন জ্বলে উঠল আমার দেহমনে। নিজের সর্বনাশ নিজে করে বসলাম। সেই সর্বনাশের ফাঁস থেকে মাথা গলিয়ে পালাবার জন্যে যা করলাম তার ফলে এই বারো বছর আমার চোখের ঘুম গেছে ঘুচে, মুখের গ্রাস বিস্বাদ হয়ে গেছে। ওই জাতকে আমি সাপের চেয়ে বেশি ভয় করি। শুধু ভয় নয়, ঘৃণাও করি। হাঁ, ঘৃণাই করি। নিজের এই দু-চোখে যা দেখেছি, এই হাত দুটো দিয়ে যা ঘাঁটতে হয়েছে আমাকে, তার ফলে ওই জাতের উপর আর কোনো নেশা নেই আমার। ভালোও না মন্দ-ও না। শুধু ঘৃণা-শুধু বিতৃষ্ণা–”, বলতে বলতে পোপটলাল বার বার শিউরে উঠলেন, যেন কি একটা বীভৎস দৃশ্য আজও দেখতে পাচ্ছেন তিনি।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বার বার মুখ ফিরিয়ে দেখলাম পোপটলাল প্যাটেলকে। আমার দেহের চেয়ে আধ-হাত লম্বা লোহার মতো শক্ত ওই দেহটির ভিতর থেকে, আসল যে পোপটলাল, তিনি যেন এইবার ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন আমার চোখের সামনে। দেখলাম সেই আসল মানুষটির সর্বাঙ্গে বড় বড় ফোঁসকা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে।

“কি নিদারুণ অবস্থা! একদিকে বংশের সুনাম, সমাজ, আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি, গ্রামদেশ সব ছেড়ে পালানো, নয় আত্মহত্যা করা; অন্যদিকে জেল-হাজত পুলিশ আর তার জীবন। কি করি, কোথায় যাই, কার সঙ্গে পরামর্শ করি! যত বড় আত্মবন্ধুই হোক সেই বিপদের কথা জানিয়ে কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলেই জাহান্নামের অতলতলে তলিয়ে যেতে হবে। সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মহাফ্যাসাদ থেকে উদ্ধার হতে হবে। তার না জানি কোনো উপায়, না জানি কোনও ওষুধ। নিজের গ্রামে সকলের মাঝখানে সে কর্ম করবার স্থানই বা কোথায়? শেষে সুযোগ নিজে থেকেই এসে উপস্থিত হল। সেই রাক্ষুসে সুযোগ এ জীবনের বারোটা বছর বিষিয়ে দেবার জন্যেই এসে ধরা দিলে। তারপর সেই শেষ দুটো দিন আর দুটো রাত। অসীম ধৈর্য ধরে এক-একটি মুহূর্ত গুনতে গুনতে অপেক্ষা করা। প্রাণ যখন একেবারে কণ্ঠাগত প্রায়-তখন উপস্থিত হল সেই মোক্ষম সময়। সেই একটা রাতেই আমার বয়স বিশ বছর বেড়ে গেল। বাইরে আলকাতরার মতো আঁধার, আর বৃষ্টি পড়ছে। কাছে-পিঠে এক ক্রোশের মধ্যে জন-প্রাণী নেই। নদীর কিনারায় একটা ভাঙা ঘরের ভিকর আমরা দুটি প্রাণী। অসহ্য যন্ত্রণায় সে গোঙাচ্ছে সে মেঝেয় পড়ে, মিটমিটে আলোয় তার দিকে চেয়ে আমি অসহায় ভাবে বসে আছি। কি ভাবে কি হয়, তখন কি করা দরকার, তার কিছুমাত্র জ্ঞান নেই আমার। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে, ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যদি মরে যায়? ছেলে হবার সময় অনেকেই তো মরে ছেলে আটকে। যদি তাই হয়–তখন? অমানুষিক তার সেই কাতরানি, তার উপর তার দেহটা কুঁকড়ে মুচড়ে দুমড়ে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াল যে, সেদিকে আর চাওয়াই যায় না। একবার মনে হল-দিই দু-হাতে গলাটা টিপে চিরকালের মতো সমস্ত আওয়াজ বন্ধ করে। চোখ বুজে নিজের দু-কানে আঙুল দিলাম। ও একটা তীব্র চিৎকার করে উঠল। ভয়ে আঁতকে উঠে চোখ খুললাম। দেখি নীল হয়ে গেছে তার মুখ। ঠিক করলাম ছুটে পালাব। উঠে দাঁড়ালাম তার পাশ থেকে। চোরের মতো পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছি ঘরের দরজার দিকে, আবার সে করুণ আর্তনাদ করে উঠল।

পিছন ফিরে তাকালাম। ইশারায় কাছে ডেকে বহু কষ্টে সে বললে—

কে যেন পোপটলালের কণ্ঠ চেপে ধরল দৃঢ়মুষ্টিতে। হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। নিজের দু হাতের মুঠো দুটো বার বার খুলে আর বন্ধ করে কি যেন দেখতে লাগলেন। যেন কিসের দাগ তাঁর দুই হাতে লেগে রয়েছে।

হঠাৎ হু-হুঁ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। নিজেকে খাড়া রাখতে পারলেন না আর, হাঁটু মুড়ে বালির উপর বসে পড়লেন। কান্নার সঙ্গে মিশিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন পোপটভাই–

“জ্যান্ত লাল-টুকটুকে এতটুকু একটি মেয়ে আমার এই দু-হাতে। কেঁদে উঠল নিষ্কলঙ্ক সদ্য-আগতের প্রথম ধ্বনি। তাড়াতাড়ি মুখ চেপে ধরলাম। তার সেই ছোট্ট মাথাটা ধরে একটা পাক দিতেই কোঁক কোঁক করে আবার সামান্য একটু আওয়াজ বেরুল। এক মুহূর্ত নষ্ট করবার কি সময় আছে তখন আমার? চক্ষের নিমেষে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নামালাম নদীর জলে। গলা পর্যন্ত জলে গিয়ে পুঁটলিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম নদীর মাঝে। তখন সেই জলের মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার আমার শ্বাস বইতে লাগল। যেন প্রচণ্ড নেশা করেছিলাম এতক্ষণ। এবার সেই নেশার ঘোর কেটে যেতে লাগল। সভয়ে একবার পিছনে ফিরে দেখলাম কেউ সাক্ষী রইল কি না কোথাও। সেখানে সেই আধারে বৃষ্টির মাঝে কে আসবে! চেয়ে রইল শুধু মাথার উপরের ওই আকাশ। নিকষ-কালো বিরাট দুই চক্ষু মেলে, সভয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। ওই আকাশ আজও ঠিক তেমনি করেই চেয়ে আছে। ওর দিকে চোখ তুলে তাকালেই দেখতে পাই মুখ টিপে হাসছে আর নীরব ভাষায় বলছে আমায়-তোমার সেই মহাপাতকের সাক্ষী আছি আমি। আগাগোড়া আমি সমস্তই দেখেছি। আমাকে তো লুকাতে পারোনি তুমি কিছু। আমার কাছ থেকে কোথায় লুকাবে তুমি তোমার মুখ?”

সমস্ত পাগড়িসুদ্ধ মাথাটা সজোরে বার-কতক নেড়ে নিজের দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে পোপটভাই কাঠ হয়ে বসে রইলেন।

তাঁর কাঁধের উপর আলতো করে একটা হাত রেখে নীরবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

একসঙ্গে একগাদা প্রশ্ন ঠেলাঠেলি করতে লাগল মনের দরজায়। কে সেই মেয়ে? তারপর কি হল সেই মেয়ের? নদীর জল থেকে উঠে এসে কি করলেন তিনি, কোথায় গেলেন তারপর? মরবার জন্যে মেয়েটাকে সেই ঘরে ফেলে রেখে পালিয়ে এলেন নাকি? না ফিরে এসে দেখলেন ঘরের মেঝেয় সেও মরে কাঠ হয়ে আছে?– আরও কত রকমের কত প্রশ্নই করবার ছিল তাঁকে। একটি কথাও জিজ্ঞাসা করা হল না। যা জিজ্ঞাসা করব সেটাই হবে অবান্তর প্রশ্ন। আসল কথাটা হচ্ছে-পোপটলাল প্যাটেল সেই রাতের পর থেকে আজ পর্যন্ত বেঁচে রয়েছেন। বেঁচে থেকে তুষানলে দগ্ধ হচ্ছেন মাত্র এই আশাটুকু বুকে নিয়ে যে, একদিন না একদিন তিনি সশরীরে এসে পৌঁছবেন চন্দ্ৰকূপে–যেখানে পৌঁছলে তাঁর ভ্রূণহত্যার মহাপাতকটা বেমালুম যাবে উবে।

সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম। কোথাও কিছুমাত্র নেই। ওই যে বিরাট শূন্যতার সমুদ্র, ওর ওপারে পৌঁছতে হবে। সেই তীরে আছে চন্দ্রকূপ, যার মাহাত্ম্য এমনই ভীষণ যে–যত বড় পাপই থাকুক না কেন-চন্দ্রকূপের জলে নিঃশেষে তার সবটুকু ধুয়ে গলে সাফ হয়ে যাবে। চেয়ে থাকতে থাকতে কিন্তু আমার মনে হল যে, পাপ নিয়ে কেউ চন্দ্ৰকূপ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। মনে হল যেন, এখানে পায়ের তলার বালি আর মাথার উপরের আকাশ-এ দুটোও এই অপার অতল শূন্যতার মাঝে কোথায় তলিয়ে গেছে। শুধু থাকবার মধ্যে আছে একটা অগ্নি-তরঙ্গ, যার উপর ভাসতে ভাসতে আমরা কোথায় যে চলেছি তা নিজেরাই জানি না। যদি সত্যই এই ভাসার অন্তে কোথাও কোনও কূলে গিয়ে ঠেকতে পারি তখন পাপপূণ্য, কর্মফল, এর কোনো কিছুই সঙ্গে থাকবে না, সবই নিঃশেষে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে আমাদের কূল পাওয়ার আগেই। আমরা তখন অগ্নিশুদ্ধ নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক জ্যোতি মাত্র। অমৃতের সন্তান আমরা, আমাদের ভয় কি?

তবু একবার আগাগোড়া সমস্ত জীবনটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম-আছে নাকি কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে একটা মস্ত বড় জাত-পাপ। নাঃ, সেদিক দিয়ে আমি দেউলিয়া। মনের অন্ধকার কোনা-খুঁজিগুলোয় ছোটখাটো ঢোঁড়া ঢ্যামনা চিতি জাতের নির্বিষ পাপ অনেকগুলো কিলবিল করে উঠল বটে, কিন্তু চন্দ্রকূপের জলে ডুবিয়ে মারবার মতো এক-আধটা কেউটে গোখরো-জাতের কোনো কিছু খুঁজেই পেলাম না। নাঃ, এই সামান্য পুঁজি নিয়ে এর তোড়জোড় করে এতদূর আসা ডাহা মূর্খামি হয়েছে। আমার খুদে পাপগুলোর জন্য ঘরের কাছের গঙ্গাসাগর বা শ্রীধাম নবদ্বীপই যথেষ্ট হত।

হিসাবটা উলটিয়ে নিলে অবশ্য লোকসান কিছুমাত্র নেই। চা-বাগানে ম্যালেরিয়ার বিষ পাছে শরীরে প্রবেশ করে এই ভয়ে আগে থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে কুইনাইন গেলানো হয়। তেমনি যার শরীরে মহাপাপের বিষ ঢোকেনি, সে যদি চন্দ্ৰকূপ-দর্শনটা সমাধা করে গিয়ে দু-একটা কুলীন জাতের পাপ করেই ফেলে, তাহলে সেই পাপের ফল নিশ্চয়ই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সুতরাং এ জীবনের বাকী দিনগুলোর জন্যে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে চলতে ফিরতে পারব যদি একবার চন্দ্রকূপ থেকে সশরীরে ফিরে যেতে পারি। এও কি কম কথা নাকি!

দল থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। সেদিকে খেয়াল হতে পোপটভাই বললেন, “চলুন একটু পা চালিয়ে, নয়তো ওরা নাগালের বাইরে চলে যাবে।

অসম্ভব নয়। আমাদের ফেলে রেখে চলে যাওয়া কিছুমাত্র অন্যায় হবে না ওদের। ওরা যে তীর্থযাত্রী। ওদের এখন একমাত্র লক্ষ চন্দ্রকূপ। যে করে হোক একবার সেখানে পৌঁছে পাপের বোঝাটা ঘাড় থেকে নামাতে পারলে হয়। এ হেন সময়ে কে রইল পড়ে পিছনে তা দেখবার জন্যে ফিরে তাকাবার মতো দুর্বলতাটা যে হবে অমার্জনীয় অপরাধ।

সামনে নজর করে সমস্ত দলটা দেখতে পেলাম। অগ্নিকুণ্ডের মাঝে সুমুখ দিকে ঝুঁকে যেন সত্যই কি গুরুভার পিঠে নিয়ে চলেছে সব। দেখলাম যেন কালো কাপড়ে জড়ানো এক-একটা বিরাট মোট বাঁধা রয়েছে প্রত্যেকের পিঠে। সেইটের ভারে সকলে সামনের দিকে নুয়ে পড়েছে। বেচারা চন্দ্রকূপ বাবার বরাতটা কেমন! কি চমৎকর উপাচার নিয়ে চলেছি আমরা তাঁকে ভেট দিতে! এক-এক মোট উৎকট বিষাক্ত কালো কালো পাপ।

আবার কানে এল পোপটলালের স্বর।

“এবার দেখবেন ওই কুন্তীও আর আপনার সঙ্গ ছাড়বে না।”

চমকে উঠলাম। পোপটভাই বলতে লাগলেন, “ঠিক এই-ই হয়। একটা মেয়ের জন্য কেউ সর্বস্ব পণ করে বসে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আগুনের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সেই মেয়েকে যখন হাতের মুঠোয় পায় তখন সেই মেয়েই তাকে দেখে সকলের চেয়ে ঘৃণার চোখে। দুটি জিনিস হচ্ছে মেয়েদের কাছে কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। নিজের জন্যে ইজ্জৎ আর নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয়, আর তার গর্ভের সন্তানের জন্যে সমাজে উপযুক্ত স্থান। প্রবৃত্তির তাড়নার নেশার ঝোঁকে ঘরের বার হয়ে এসে সে দেখে যে, মান ইজ্জৎ শালীনতা সর্বস্ব খুইয়ে যার হাত ধরে সে পথে নামল সে তাকে আর যাই দিক ও-দুটি জিনিস কখনও দিতে পারবে না। আজীবন কাটাতে হবে শুধু ভয় বিড়ম্বনা আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে। তখন সেই লোকটিই হয়ে ওঠে সেই মেয়ের চোখে সব চেয়ে বড় শত্রু। তারপর সুযোগ-সুবিধা মেলে তো ছেঁড়া জুতোর মতো সেই লোকটিকে টেনে ফেলে দেয় দূর করে।

“কি দিয়েছে ওই থিরুমল কুন্তীকে? আপনি বলবেন ওই মেয়েটার জন্যে থিরুমলের প্রাণটা যেতে বসেছিল। কিংবা হয়তো এও বলতে পারেন যে, ওই মেয়ের জন্যেই থিরুমল আজ পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু থিরুমল গেল কেন কুন্তীকে তার বাপের নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভাগিয়ে আনতে? এই লাঞ্ছনা এই নির্যাতন এই নরক যন্ত্রণা ভোগ আজ কুন্তীর ভাগ্যে কিসের জন্যে? থিরুমলের সঙ্গে যদি দেখা না হত তাহলে কুন্তী তার বাপের ঘরে যেমন ছিল তেমনিই থাকত। কোনো দুর্ভোগ ঘটত না তার কপালে। সেই জন্যেই থিরুমলের চেয়ে বড় শত্রু আজ আর কুন্তীর কাছে কেউ নয়। থিরুমলকে সে আর কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না, কারণ তার নারীত্বের ইজ্জটুকু ওই থিরুমলের জন্যেই খোয়া গেছে।”

এর জবাবে অনেকগুলো ভালো কথা শোনাতে পারতাম পোপটভাইকে। বলতে পারতাম তাঁর মুখের উপর। এই দুনিয়ার একান্ত পবিত্র সব অমূল্য কথাগুলি,–প্রেম ভালোবাসা আত্মত্যাগ বিরহ ইত্যাদি। প্রেমের জন্যে কবে কোথায় কখন কি ভাবে কোন কোন চিরস্মরণীয়া অতুলনীয় আত্মত্যাগ আর বিরহযন্ত্রণা ভোগ করে জ্বলন্ত আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। ইতিহাস-পুরাণের বিখ্যাত বিখ্যাত নজিরগুলি টেনে এনে তাঁর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে অপূর্ব পুলক অনুভব করতে পারতাম। সাড়ম্বরে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম, সহজিয়া পরকীয়া ইত্যাদি সব গুহা রসতত্ত্বের অপার মহিমা। একখান জুতসই গীতও হয়তো তাঁকে শুনিয়ে দিতে পারতাম যাতে প্রেমিকা প্রেমিকের জন্য কেঁদে আকুল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করা হল না। তার বদলে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে শিউড়ে উঠলাম পোপটভাই-এর মনটায় গাময় দগদগে বিষাক্ত ঘা। অনর্থক পাছে সেই ব্যথার স্থানেই আবার আঘাত দিয়ে ফেলি এই ভয়ে চুপ করে রইলাম।

“আমার ভাগ্যেও ঠিক তাই হয়েছিল। সেই রাতের পর থেকেই আমি তাঁর দু চোখের বিষ হয়ে উঠলাম। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে তাঁকে নিয়ে তো বাড়ি ফিরলাম। মেলা থেকে ফেরবার পথে ডাকাতের হাতে পড়ে তিনটে দিক কি ভয়ঙ্কর অবস্থায় কেটেছে তার লোমহর্ষক বিবরণ, আর কি অদ্ভুত উপায়ে তাদের হাত থেকে আমরা পালিয়ে আসতে পেরেছি তার আশ্চর্য কাহিনী শুনিয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে রেহাই মিলল। উপোসে আর পথের কষ্টে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছে এই অছিলায় তিনি কয়েকদিন শুয়ে রইলেন। কোথাও কারও মনে কিছু সন্দেহ হল না। সন্দেহ করবেই বা কে। চিরকালই গ্রামে আর নিজের লোকের কাছে আমি একজন আদর্শ নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের মানুষ। সেই আমি যদি মৃত বড় ভাই-এর স্ত্রী আর গ্রামের দু-চারজন বুড়িকে নিয়ে মেলা দেখিয়ে আনতে যাই তাতে আর সন্দেহ করবার কি আছে। তারপর সেই বুড়ি কটাকে ফাঁকি দিয়ে দুজনের সরে পড়তে কতক্ষণ লাগে? আগে থেকেই নদীর ধারে একটা ভাঙা ঘর আমার জানা ছিল। সেইখানেই গিয়ে উঠেছিলাম আমরা দুজনে। জনপ্রাণীও সেধারে যায় না। কাজেই দুটো দিন লুকিয়ে থাকতে কোনো বাধাই ছিল না সেখানে। প্রাণ নিয়ে যে বাড়ি ফিরে এসেছি আমরা এই আনন্দেই সকলে উন্মত্ত হয়ে উঠল।

“সবই সব দিক থেকে যেমন আশা করেছিলাম সেই রকমটি হয়ে গেল। আবার আমার মনে কল্পনার রং ধরতে শুরু করল। তখনই আরম্ভ হল সেই আসল খেলা। তিনি আর আমার ছায়া পর্যন্ত সহ্য করতে পারলেন না। দূর থেকে কি উপায়ে কত রকমে সকলের চোখে আমায় হেয় করা যায়-সর্বদা সেই চেষ্টা করতে লাগলেন। অন্য সমস্ত সৎগুণের সঙ্গে মেয়েদের একটি শক্তি আছে যা কোনো পুরুষ কখনো আয়ত্ত করতে পারবে না। সে শক্তিটি হচ্ছে নিজের ভালোমানুষি ষোল আনা বজায় রেখে দূর থেকে নানা উপায়ে শত্রুতা করে জ্বালানো। এ বিদ্যেটা মেয়েরা কষ্ট করে বহু যত্নে শেখে। যে হতভাগার উপর এই বিদ্যের পরীক্ষা প্রয়োগ চলে তার অবস্থা হয় শোচনীয়। মুখ বুজে শুধু মার খেয়ে যাও। মুখ খুলেছ কি মরেছ। তৎক্ষণাৎ চারিদিক থেকে সকলে একবাক্যে বলে উঠবে, তোমার চেয়ে নীচ তোমার চেয়ে হীন নরাধম আর দুনিয়ায় দুটি নেই। এ দুর্ভোগে যে কখনো পড়েনি সে বুঝবে না সেই বর্ণচোরা শত্রুতার স্বরূপটি কি।

“মুখ বুজেই মার খেয়ে চলেছিলাম আমি। চিরকাল তাই চলতাম। কখনো ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতো না আমার। কিন্তু সব চেয়ে চরম শত্রুতা যা তা-ই তিনি করে বসলেন। আমাদের বংশের মুখে কালি লেপে দিলেন। আমার বাপ-ঠাকুর্দা চৌদ্দপুরুষের উঁচু মাথা হেঁট করলেন। করবেনই তো, তাঁর কি দোষ। সেই বংশেরই বংশধর আমি-আমিই তো তাঁকে সর্বনাশের পথে টেনে নামিয়েছি। কেন তিনি প্রতিশোধ নিতে ছাড়বেন।”

অসহ্য ক্ষোভে পুনরায় পোপটভাই-এর কণ্ঠ রুদ্ধ হল। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখন আপনার বৌদি কোথায়?”

নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন পোপটভাই।

“নাগালের বাইরে। একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এখন তিনি অনেক উঁচুতে উঠে গেছেন। আমাদের কুমার সাহেবের সব চেয়ে বড় বাঈজি এখন তিনি। কত নামডাক এখন তাঁর। নাচ জানেন গান জানেন। দেশসুদ্ধ লোক বলাবলি করছে-অমুক বাঈজি অমুক বাড়ির বড় বৌ। এই কথা শুনতে শুনতে আমার বাবা মারা গেছেন। আমি যখন মরব তখনও লোকে আমাদের বাড়ির বড় বউ-এর খ্যাতি গাইবে। আমার মা পাগলপ্রায় হয়ে আছেন। দেশে আজ আমরা একঘরে। এ সমস্তের জন্য আমিই দায়ী। হাঁ, আমিই। আমিই সংসারে এই বিষ ঢুকিয়েছি, উঃ!”

এরপর পোপটলাল সত্যিই সজোরে পা চালালেন। চন্দ্রকূপ যে তাঁকে পৌঁছতে হবেই তাড়াতাড়ি।

একাই চলেছি। অনেকটা আগে এগিয়ে গেছে সকলে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছি ওদের। রোদের ঝলকানিতে এতদূর থেকে ওদের দেখাচ্ছে যেন একটা লম্বা সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী। উট দুটো সামনে থাকায় মনে হচ্ছে যে প্রাণীটা মাথা উঁচু করে বুকে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। আরও অনেক সামনে অজস্র যজ্ঞকুণ্ড জ্বালা হয়েছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে সাদা ধোঁয়া সেই সমস্ত কুণ্ড থেকে উঠে আকাশ স্পর্শ করেছে। তার ওধারে আর দৃষ্টি পৌঁছয় না। ওই ধোঁয়ার যবনিকার অন্তরালে বসে কে জানে কোন জন্মেঞ্জয় আবার নূতন করে সর্পযজ্ঞ আরম্ভ করেছেন- যাঁর মন্ত্রের অমোঘ অনিবার্য আকর্ষণে ওই বিরাট সরীসৃপটি আপ্রাণ চেষ্টায় অগ্রসর হচ্ছে তাঁর সেই যজ্ঞকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুড়ে মরবার জন্যে। আমিও চলেছি সরীসৃপটাকে দূর থেকে অনুসরণ করে যজ্ঞের পূর্ণাহুতি দেখবার আশায়।

যজ্ঞস্থানে পৌঁছে কতটা সমারোহ-কাণ্ড দেখা ভাগ্যে জুটবে এই চিন্তায় অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম; হঠাৎ চমকে উঠে মুখ তুলে দেখি কে একজন ফিরে আসছে। কি হল আবার ওর! কাছাকাছি হতে চিনতে পারলাম-আমার ছড়িদার পণ্ডিত রূপলাল ঠাকুর করাচীওয়ালে। বত্রিশখানা দাঁত বার করে নীরবে সামনে এসে দাঁড়াল, –হাতে এক লোটা পানি।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞসা করলাম, “কি ব্যাপার- আবার ফিরে চলেছ কোথায়?” সলজ্জ সুরে বললে, ‘আপনার জন্যে জল নিয়ে এলাম। বড্ড পিছিয়ে পড়েছেন। হয়তো তেষ্টাও পেয়েছে আপনার।”

চেয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। এ কি সেই রূপলাল, যে আজ ভোরেই আমায় চোখ রাঙিয়েছে, যে বিন্দুমাত্র দিক্কা না করে তারই সমবয়সী জুড়িদার আর একজনকে বিসর্জন দিয়ে চলে এল অবলীলাক্রমে!

পকেট থেকে এক ডেলা মিছরি আর কয়েকটা খেজুর বার করে দিয়ে রূপলাল বলেন, “নিন-জল খেয়ে নিন। এখনও অনেকটা যেতে হবে। একেবারে চন্দ্রকূপের কাছে গিয়ে তবে আমরা থামব।”

নিলাম। তেষ্টায় পায়ের নখ পর্যন্ত শুকিয়ে টা-টা করছিল। মিছরির ডেলাটা চিবিয়ে লোটার সবটুকু জল গলায় ডেলে দিয়ে আবার ওর মুখের দিকে চাইলাম। ওর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে।

বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা আরম্ভ হল। এবার আমার ছড়িদার আমার পাশে। এতক্ষণ পরে কি জানি কেন মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। সকাল থেকে এতক্ষণ একটা দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম, সেটার হাত থেকে মুক্তি পেলাম। মহাতীর্থ হিংলাজ দর্শনে চলেছি আমি, আমার পাশে আমার পাণ্ডা আমার এই তীর্থপথের কাণ্ডারী, যে আমাকে হিংলাজ দর্শন করিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে করাচীর সেই নাগনাথের আখড়ায়। হোক সে বয়সে ঢের ছোট, নেহাত লক্ষ্মীছাড়ার মতো হলই বা তাকে দেখতে, টানলই না হয় সে ছিলিমের পর ছিলিম। তবু এখানে এই তীর্থপথে এই ছোকরাই আমার একমাত্র বন্ধু, সব চেয়ে বড় আপনার। তাই তো পিছিয়ে পড়েছি বলে ওকে ফিরে এসে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে আমাকে। এ আমাকে যেখানে নিয়ে গিয়ে দেখাবে তা-ই হবে আমার কাছে মহাতীর্থ। যে কোনো উপাখ্যান যে ভাবেই বোঝাক, যে কোনো মন্ত্র যে রকম উচ্চারণ করেই পড়াক, তার বিচার করবার আমি কে? একবার যখন ওর হাতে সমস্ত সঁপে দিয়েছি তখন আমার একমাত্র কর্তব্য ভালো মন্দ সব কিছুর ভার ওর হাতে ছেড়ে দেওয়া-ওকে বিশ্বাস করে ওর আদেশ শিরোধার্য করে তীর্থ করে ফেরা। অবিশ্বাস সংশয় বিচারবুদ্ধি শুধু যন্ত্রণাই বাড়াবে। শান্তি পাব না। তীর্থযাত্রা বিফল হবে আমার।

পাশে চলতে লাগল রূপলাল চিৎকার উঠল, “হিংলাজ রানি-মাতা কি—”

সামনে থেকে সকলেই একযোগে উত্তর দিলে ওর ডাকে–”জয়!”

আরো জোরো পা চালালাম।

“ও কি! কি ও?”

আচম্বিতে আর্তনাদ করে উঠলেন ভৈরবী। সামনে বহুদূরে অসাধারণ কিছু দেখতে পেয়েছেন তিনি উটের উপর থেকে, যা দেখে তাঁর বাহ্যজ্ঞান হারিয়েছে। কাঠ হয়ে চেয়ে আছেন দু চোখ মেলে। তাঁকে আঁকড়ে ধরে কুন্তীও সেইভাবে চেয়ে আছে সামনের দিকে।

চেঁচিয়ে উঠলাম নীচে থেকে, “কি হয়েছে– কি দেখছ অমন করে?” কোনো উত্তর নেই। আমার কথা কানেও গেল না ওদের। দুজনেই যেন পাষাণ হয়ে গেছে।

অনেকটা আগে বড় উট নিয়ে চলেছে গুলমহম্মদ। আরও কয়েক পা এগিয়ে একটা বালির টিলার উপর পৌঁছল সে, সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভূত একটা আওয়াজ করে উঠল। তারপর একটানে মাথার পাগড়িটা খুলে আছড়ে ফেললে পায়ের কাছে। উটের দড়ি আর টাঙিখানা তার হাত থেকে খসে পড়ল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে বালুর উপর।

রূপলাল ছুটে গেল তার পাশে। গিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা চন্দ্ৰকূপ স্বামী!” কথাটা শেষ হবার আগেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে।

চক্ষের নিমেষে সবাই কাঁধের কুঁজো নামিয়ে লুটিয়ে পড়ল অগ্নি জ্বলন্ত বালুর বুকে। একেবারে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম।

মাথার পাগড়ি খুলে দিলমহম্মদ বসে পড়ল ঊর্বশীর পায়ের কাছে। একা আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে পিছনে কোনো দিকে পা বাড়াবার উপায় নেই। চারিদিকে সবাই নিচুমুখ হয়ে পড়ে আছে টান টান হয়ে ৷

আবার ধমক দিলাম ভৈরবীকে, “হয়েছে কি? দেখছ কি তুমি অমন করে?”

কোনো জবাব দিলেন না তিনি, তবে কাজ হল। হুঁশ ফিরে পেয়ে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলেন। তাঁর দেখাদেখি কুন্তীও।

একে টপকে ওকে ডিঙিয়ে গুলমহম্মদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেয়ে দেখি- যা দেখলাম তা দেখে ভয় বিস্ময়ে আমিও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হয়তো উচিত ছিল তখনই সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়া। কিন্তু তা আর আমার ভাগ্যে হয়ে ওঠেনি। উচিত-অনুচিতের প্রশ্নই তখন উঠতে পারে না। বিচার-বিবেচনা করে মন আর বুদ্ধি। এমন কিছু দেখছি দু-চোখ দিয়ে যার লেশমাত্র ধ্যানধারণা ছিল না মনের কোণেও। সে দৃশ্য চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ হয়ে গেছে। ক্ষণেকের তরে হলেও সুখ দুঃখ আনন্দ অনুভূতি–সব কিছুর হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এক অপার্থিব মহাজিজ্ঞাসার মাঝে ডুবে গেলাম। হারিয়ে ফেললাম নিজেকে সেই মুহূর্তে। চোখ দিয়ে-শুধু চোখ নয় সমস্ত মন দিয়ে নমস্কার দিয়ে সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে গিলতে লাগলাম দৃষ্টির শেষ সীমায় আকাশের বিচিত্র আঁকা সেই ছবিখানি।

ছোট বড় মেজ সেজ অনেকগুলি নৈবেদ্য সাজানো রয়েছে সেখানে। যাঁর উদ্দেশ্য সাজানো হয়েছে ওগুলি, তাঁর পায়ের তলা স্পর্শ পাবার আশায় নৈবেদ্যর চূড়াগুলি ধোঁয়াটা মেঘ ভেদ করে উড়ে গেছে আকাশের মধ্যে। কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠেছে ধোয়া ওখান থেকে। তা দেখে বেশ আন্দাজ করা যায় কি পরিমাণ ধূপ-ধুনা পোড়ানো হচ্ছে ওখানে। কিংবা হয়তো বিরাট যজ্ঞ হচ্ছে। ধরিত্রীর একেবারে শেষ প্রান্তে ওই নিভৃত স্থানটি খুঁজে বার করে তামাম জীবজগতের দৃষ্টির অন্তরালে যাঁরা ওই পূজা-অনুষ্ঠানের বিপুল আয়োজন করেছেন-ভালো করে নজর করেও এতদূর থেকে তাঁদের কাকেও দেখতে পাওয়া গেল না। কিন্তু কেমন একটা আতঙ্কে বার বার বুকের ভিতর কেঁপে উঠল।

কারা করছেন ওই অনুষ্ঠান? কোন দেবতার তুষ্টির জন্যে ওই অমানুষিক আয়োজন? কি উদ্দেশ্যে এত সঙ্গোপন? কি মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে ওখানে? কোন মহাবিল নিবেদন করা হবে ওই পূজায়?

ওই চন্দ্রকূপ। অথবা ওখানেই চন্দ্রকূপ। ওই চন্দ্রকূপের অধীশ্বর সকলের সর্বপাপ নিঃশেষে হরণ করেন। আর তা করেন বলেই তাঁকে এই নিরালায় সকলের ধরা ছোঁয়ার নাগালের বাইরে পালিয়ে এসে ধুনি জ্বালাতে হয়েছে। দুনিয়ার পাপ-স্রোত নিরন্তর গড়িয়ে এসে পড়ছে তাঁর ধুনিতে। সেই হচ্ছে চন্দ্রকূপ স্বামীর ধুনির হবি। তারপর সেই পাপ ধোঁয়া হয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অনন্ত আকাশের গায়ে। মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা জগতে। জল হয়ে নামছে মানুষের মাথায়। পড়ছে শস্য-ফসলের উপর। তা-ই খাচ্ছে সবাই জীবনধারণের তাগিদে। ফলে পাপই জন্মাচ্ছে আবার তাদের রক্ত-মাংস থেকে। সেই পাপ আবার হুড়হুড় করে এসে পড়ছে চন্দ্রকূপ দেবতার ধুনিতে। সৃষ্টির কোন আদিকালে এই অখণ্ড অনির্বাণ যজ্ঞাগ্নি জ্বালা হয়েছে, আজও তা জ্বলছে সমানে। অনাগত অন্তহীন ভবিষ্যৎ জুড়ে জ্বলতে থাকবে এই ধুনি। কখনো কোনো কালে ক্ষুন্নিবৃত্তি হবে না এই বৈশ্বানরের। নিরবচ্ছিন্ন হবিঃস্রোত চাই আহুতির জন্যে। সুতরাং পাপীরা চিরকাল জন্মাবেই নয়তো মহাকালের এই মহাপ্রয়োজন সিদ্ধ হবে কি করে।

কিন্তু যদি কেউ প্রাণের মায়া ত্যাগ করে একবার এসে পড়তে পারে এখানে, এসে একটিবার স্পর্শ করতে পার এই যজ্ঞাগ্নি, তবে তৎক্ষণাৎ সে হবে অগ্নিশুদ্ধ নিষ্পাপ জ্যোতিষ্মান আনন্দের সন্তান। তার তখন অধিকার মাতৃদর্শনের। ব্রহ্মরন্ধ্রের মহাপীঠে সে তখন জ্যোতিঃদর্শন করতে পারবে। জ্যোতিঃস্বরূপিণী আনন্দময়ী জননী পাপপুণ্য প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি জ্ঞান-বিচার এ সবের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেই মাতৃলোকের দ্বার জুড়ে এই ধুনি জ্বেলেছেন মহাকাল। আজ আমরা অগ্নিশুদ্ধ হব। আনন্দের সন্তান হতে চলেছি আমরা। আজ আমাদের নবজন্ম লাভের পরম ক্ষণটি সমুপস্থিত।

নিজের অজ্ঞাতে কখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছি বালুর উপর-কখন উঁচু মাথা নিচু হয়ে পোড়া কপালটা ঠেকেছে পোড়া বালুর উপর-এ সমস্ত কিছুই টের পাইনি। শুধু মনে আছে তখন একটিমাত্র মন্ত্র সমস্ত ভক্তির মধ্যে ছুটোছুটি করে বুকের মধ্যে তোলপাড় লাগিয়েছিল। সেই মহামন্ত্রটি হচ্ছে-মা।

এসে যে আমরা পৌঁছেছি এ সংবাদ বার বার গলার জোরে পৌঁছে দেওয়া হল চন্দ্রকূপ স্বামীর দরবারে। বুক ফাটিয়ে বার বার জয়ধ্বনি দেওয়া হল চন্দ্রকূপ বাবার। একে অপরকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কেউ বা বুক চাপড়ে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। জন-দুই সেই যে উপুড় হয়ে শুয়েছে আর ওঠেই না।

ইতিমধ্যে ঊর্বশীকে বসিয়েছে দিলমহম্মদ। কুন্তীকে নিয়ে ভৈরবী নেমে পড়েছেন। আর উটের উপর চড়ে এগোনো চলতেই পারে না। সে স্পর্ধা থাকাও একান্ত অনুচিত। ওই দীন দুনিয়ার মালিক দীনবন্ধু দয়ালের দরবারে দীনহীনের মতো পায়ে হেঁটে যাওয়াই প্রয়োজন। দেহ মন আত্মা জুড়িয়ে যাবে তাঁর কল্যাণস্পর্শে। যে দুর্বার পিপাসা নিয়ে জন্মেছি, যা বুকে নিয়ে এতদিন ছুটে মরছি, আজ হবে সেই অনন্ত পিপাসার শান্তি। করুণাময়ের আঁখির করুণাধারায় স্নান করে জীবনের সকল জ্বালা আজ জুড়োবে। চলো, এগিয়ে চলো আর একটু।

কিন্তু এ আবার কী! ওরা দুজনে যে ওঠেই না!

ওরা দণ্ড খাটতে খাটতে যাবে।

যেখান থেকে চন্দ্রকূপ প্রথম দর্শন হবে সেখান থেকে দণ্ড খাটবে চন্দ্রকূপ পর্যন্ত–এই মানত করে ওরা রওয়ানা হয়েছে বাড়ি থেকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে হাত দুটো মাথার দিকে সোজা করে দিয়ে। হাত যে পর্যন্ত পৌঁছল সেখানে একজন বালির উপর দাগ টানবে। তখন উঠে হেঁটে সেই দাগ পর্যন্ত পৌঁছে আবার উপুড় হয়ে পড়বে। তখন আবার দাগ টানা হবে। এইভাবে শুতে শুতে ওরা যাবে চন্দ্রকূপ পর্যন্ত।

ব্যাপারটা মাথায় যখন ঢুকল তখন শিউরে উঠলাম ভয়ে দুর্ভাবনায়। ওরা যে ঝলসে যাবে। বড় বড় ফোঁসকা পড়বে ওদের মুখে হাতে সর্বাঙ্গে। কিন্তু কে যাবে ওদের বারণ করতে? আর বারণ ওরা শুনবেই বা কেন? কার আছে এত বড় বুকের পাটা, যে দেবতার মানত শোধ না দিয়ে তার রোষবহ্নিতে জ্বলে পুড়ে খাক হবে!

অতএব তারা ওইভাবেই চলল। সঙ্গে দাগ টানতে টানতে চলল পাণ্ডা রূপলাল ঠাকুর ছড়িওয়ালা। আমি দুই চোখ বুজে মনে মনে বার বার ক্ষমা চাইলাম চন্দ্ৰকূপ বাবার কাছে

“হে দেবতা, তুমি এদের ক্ষমা কোরো। যারা তোমার করুণাময় স্বরূপটি বুঝতে পারল না, তাদের তুমি দয়া কোরো দয়াময়। খানিকটা আত্মতৃপ্তি ওরা পাবে এই নিষ্ঠুর আত্মপীড়নের ফলে। হয়তো তাতে কিছুটা আত্মগ্লানির উপশম হবে ওদের। কিন্তু এই মিথ্যা আত্মতৃপ্তি লাভের মোহে ওরা তোমাকে কোথায় নামিয়ে আনছে তা বোঝবার শক্তিও ওদের নেই। চিরকাল ওরা পরের কাছ থেকে পেয়েছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। নিজেরাও অন্যকে দিয়েছে নির্দয় আঘাত। একমাত্র নৃশংসতা ছাড়া অন্য কিছু ওরা জানেও না বোঝে ও না। সেই উপাচারেই তোমায় তুষ্ট করতে চায় ওরা। ওরা যে তোমায় আত্মবৎ কল্পনা করেছে। নির্যাতন করে ওরা চিরকাল আনন্দ পেয়েছে বলেই তোমাকেও একজন চরম নিপীড়নকারী বলে ওদের ধারণা হয়েছে। তাই এই বীভৎস আয়োজন তোমার অনুগ্রহ লাভের আশায়। একমাত্র তুমিই এদের এই মহাভ্রম থেকে মুক্তি দিতে পারো। কে এদের বোঝায় যে তুমি জমিদারের নায়েব মশাই বা থানার দারোগা সাহেব নও!”

কতক্ষণ চোখ বুজে হাঁটছিলাম খেয়াল ছিল না। আর কেনই বা দু-চোখের জল গড়িয়ে নামছিল বুকে তাও আজ সঠিক বলতে পারব না। কানে এল–

“কেন কাঁদছেন?”

চোখ মেলোম, আর তখন খেয়াল হল যে আমার চিরশুষ্ক চোখে শ্রাবণের ঢল নেমেছে। একটু লজ্জায় পড়ে গেলাম বৈকি। মুখ ফিরিয়ে দেখি, পাশে কুন্তী। তখনও সে চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আবার জিজ্ঞাসা করলে চাপা গলায়, “কেন কাঁদছেন?”

এ কেন’র জবাব দেওয়া সহজ নয়। সব সময় সব কেন’র জবাব কি দেওয়া সম্ভব? তাহলে সমস্যা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকত না যে দুনিয়ায়। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই সকলে সর্বাগ্রে কেঁদে ওঠে কেন? কেউ কি কখনো শুনেছে না দেখেছে যে খিলখিল করে হাসতে হাসতে কোনো শিশু পৃথিবীতে শুভ পদার্পণ করেছে?

তেমনি আমার সেদিনকার অহেতুক চোখের জলের যেমন কোনো মানে খুঁজে পাই না, তেমনি সে পোড়া চোখের জল পড়া সহজে বন্ধ হতেও চাইল না। কি জানি কেন বার বার মনে হতে লাগল যে, চন্দ্রকূপের দেবতাও ওই ওখানে একলা বসে অশ্রু বিসর্জন করছেন নীরবে। এই মূঢ় মানুষ দুটির দিকে অসহায় আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তিনি। এদের এই অমানুষিক আত্মপীড়নে তাঁর বুক হাহাকারে ভরে উঠেছে। বার বার গুমরে গুমরে বলছেন তিনি, “ওরে না না না, দুঃখ দিয়ে আর দুঃখ পেয়ে আমকে তুষ্ট করতে চাস নে তোরা। তোদের এই দানবীয় ভক্তির অত্যাচার আর আমার সহ্য হয় না। ওসব সইবার আমার শক্তি নেই বলেই এখানে দুনিয়ার এই শেষপ্রান্তে পালিয়ে এসেছি আমি। এখানেও কি তোরা আমায় রেহাই দিবি না রে? এখানেও তাড়া করে এসে আমাকে জ্বালা দিচ্ছিস তোরা! তোদের এই রাক্ষুসে ভক্তি দেখানোটা বন্ধ করে আমায় শান্তি দে এবার!”

স্পষ্ট দেখতে পেলাম চোখ বুজে-জটাজটধারী, কপালে অর্ধচন্দ্র, পরনে বাঘছাল–এক জ্যোতিময় ক্ষমা সুন্দর পরম দেবতাকে। দুটি অনুপম আঁখি হতে মুক্তার মতো বড় বড় ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে তাঁর বুকের উপর। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি একেবারে আড়ষ্ট নীল হয়ে গেছেন।

আবার শুনতে পেলাম পাশ থেকে-”কাঁদবেন না আপনি। অনর্থক চোখের জল ফেলছেন কেন? সে আসবে, ঠিক আসবে। দেখবেন আমার কথা সত্যি হয় কি-না।”

কুন্তী! এ হতভাগীর আর অন্য কোনো চিন্তা নেই। এ শুধু আপন দুঃখসাগরেই হাবুডুবু খাচ্ছে। ফিসফিসিয়ে বলতে বলতে চলল কুন্তী আমার পাশে পাশে-”এত সহজে কি রেহাই পাব নাকি আমি তার হাত থেকে? এখন হয়েছে কি আমার? কতটুকু হয়েছে? আজীবন আমাকে নরকযন্ত্রণা ভুগতে হবে যে। কুকুরে শেয়ালে আমাকে নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি করবে তবে না আমার কাজের উপযুক্ত ফল মিলবে! কি দেখে, কার উপর নির্ভর করে আমি ঘর ছেড়ে পথে নেমেছি? বাপ-মায়ের মুখে কালি মাখিয়ে দিয়েছি কিসের লোভে? তার ফল ভুগতে হবে আমাকে? কিসের অভাব ছিল আমার? আজ আমায় কোথায় আশ্রয় মিলবে? কুষ্ঠব্যাধি হয়েছে যে আমার সর্বাঙ্গে–আমাকে ছোঁবে কে? শুধু ওই আমায় ছোঁবে, আর ওর মতো আমার হাড় মাংস নিয়ে যারা ছেঁড়াছিঁড়ি করবে তারাই আমায় ছোঁবে। তার জন্যে আপনার চোখের জল পড়ছে-পড়বেই তো! সে যে পুরুষমানুষ, তার তো কোনো অপরাধ থাকতে পারে না। সব দোষ সব অপরাধ আমার কারণ আমি মেয়ে হয়ে জন্মেছি। শুধু শুধু আর কাঁদবেন না আপনি। সে ঠিক এসে পৌঁছবে। না এসেই পারে না। যতক্ষণ আমার এই হাড় রক্ত মাংস আছে ততক্ষণ সে এর লোভ ছাড়তেই পারে না। তা সে পাগলই হোক আর যাই-ই হোক।

এবার জল পড়তে লাগল কুন্তীর চোখ দিয়েও। কোনো কথা না বলে তার কাঁধে একটা হাত তুলে দিলাম। সে ফোঁপাতে লাগল। কাঁদুক খানিক। পড়ুক চোখের জল এই বালুর উপর। তাতে যদি জুড়ায় ধরিত্রীর অঙ্গ, তাহলে ওর বুকের জ্বালাও নিশ্চয়ই জুড়োবে। অন্য কারও চোখের জল পড়তেই পারে না ওর জন্যে। এতটুকু সহানুভূতির বিন্দুমাত্র আশা ও করতে পারে না কারও কাছে। স্বেচ্ছায় সমাজ স্বজাতি আত্মজন সব কিছু ছেড়ে আজ ও এমন জায়গায় নেমে দাঁড়িয়েছে যেখানে সব কিছুর জন্যেই মূল্য দিতে হয়। এটুকু ও নিজেই ভালো করে বোঝে। তাই আজ ও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে সম্পূর্ণ অকারণ এবং কিছুমাত্র প্রত্যাশা না করেই এই তীর্থযাত্রী দলের সব কটি লোক ওর হিতাকাঙ্ক্ষী। আমরা সকলেই মরণের মুখ গহ্বরের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এ সময় কোনো শখ কোনো বাসনা-কামনা কারও মনে আসতেই পারে না। তাছাড়া সকলেই এখানে এসেছে জান কবুল করে নিজের নিজের বুকের ভার নামাতে। তবুও যে কেউ ওকে এখানে ফেলে যেতে চায় না, তার কারণ সকলেরই মা বোন কন্যা ঘরে আছে। কোনো রকমে ওকে নিয়ে করাচী পৌঁছতে পারলে হয়। তারপর যা থাকে হোক ওর কপালে। আমরা কেউ ফিরেও দেখতে যাব না।

ঠিক সমানেই চলছেন ভৈরবী-তাঁর ঠোঁট নড়ছে। ডানহাতের কব্জি পর্যন্ত জপমালার লাল ঝুলিটির মধ্যে ঢোকানো। ঝুলিসুদ্ধ হাতটি বুকের কাছে ধরা রয়েছে। বাঁ হাতখানি সুখলালের কাঁধে। অর্থাৎ এখনও ইষ্টমন্ত্রটা ভোলেননি তিনি। এটাও সহজ কথা নয়।

অনেকে সুর করে ভজন গাইতে গাইতে চলেছে। দীর্ঘকায় গোকুলদাস সবার আগে চলেছে লম্বা লম্বা পা ফেলে। চিরঞ্জীর সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। দুটো কুঁজোই বইছে চিরঞ্জীলাল। কে জানে আর কোনো খাবার জিনিস লুকানো আছে কিনা গোকুলদাসের কাছে।

চলেছেন পোপটভাই মাথা হেঁট করে। পিছন থেকে আজ তাঁকে দেখলাম এক নতুন দৃষ্টিতে। সকলের সঙ্গে থেকেও এ ব্যক্তি সম্পূর্ণ একা, সঙ্গীহীন। মুখ বুজে ইনি নিজের বোঝা নিয়ে চলেছেন নিঃশব্দে। সে বোঝার অংশ নেবার শক্তিও নেই অপর কারও। চন্দ্রকূপে পৌঁছে বিসর্জন দেবেন সেই জঞ্জালের পুঁটলিটি। তখন ভারমুক্ত হবেন পোপটভাই। স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পাবেন দুনিয়ার সব কিছু। সেদিন হাসিমুখে সকলের বেদনার ভার স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেবেন পোপটভাই। সেই পোড়-খাওয়া পোপট-লালের ছায়ায় তখন লোকে এসে আশ্রয় নেবে শান্তির আশায়। বহুর দুঃখ দূর করবেন ইনি, অনেকের ভার বইবেন নিজের কাঁধে। সার্থক শুভঙ্কর হবে মাতৃদর্শন পোপটভাই-এর।

ক্রমে সামনের দিকচক্রবাল আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সেখানকার আকাশচুম্বী নৈবেদ্যগুলির ধূসর রং গাঢ় হতে হতে মাটির রং হয়ে ধরা দিল চোখে। এতদিন পরে সত্যই এবার খাঁটি মাটি দেখতে পেলাম। পায়ের তলায় বালু কমতে কমতে রুক্ষ কঠিন মৃত্তিকায় পরিণত হল। এখানে ওখানে নজরে পড়তে লাগল সবুজের আভা। আরও কমে এল মাটির কর্কশতা। শেষে আমরা চলতে লাগলাম নরম মাটির উপর দিয়ে। মাটির ছোঁয়ায় শরীর মন জুড়িয়ে গেল। দু-পাশে কচি কচি পাতা বেরুনো কাঁটার ঝোঁপ দেখে উর্বশী আর তার মা চঞ্চল হয়ে উঠল। পায়ের তলায় কাঁটার অনুভব করে অনেকদিন পরে আবার সর্বশরীরে সিরসির করে উঠল। মাঝে মাঝে দেখা গেল ছোট ছোট খানা ডোবা গর্ত। সেই সব গর্তের তলায় জল দেখে অনেকে তো আঁজলা করে মাথায় মুখে দিতে গেল। তাতে ঘটল আর এক বিভ্রাট। জলে গন্ধকের গন্ধ–এমনই বিটকেল গন্ধ যে কুঁজোর জর খরচ করে মুখ হাত ধুয়ে ফেলেও সে গন্ধ গেল না। কাজেই সে জলের লোভ সংবরণ করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনে। শেষে যখন সেদিনের শেষ আদেশ শোনা গেল গুলমহম্মদের কাছ থেকে, তখন চন্দ্রকূপের বিপরীত দিক থেকে সূর্যদেব আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছেন–আর আমাদের সামনে সেই নৈবেদ্যগুলির ওপর কারা যেন রাশি রাশি আবীর ঢেলে দিচ্ছে। তীর্থযাত্রীদল ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্তাচলগামী বিভাবসুকে জোড়হাতে প্রণাম করলে অনেক দিন পরে।

অনেক দিন পরে। অনেকদিন বটে। মানে আজকের এই রাতটি হচ্ছে একাদশী রাত, আজ থেকে ঠিক দশ রাত্রির আগের যে রাত সেই রাতে আমরা এই মানুষ কজন হাব নদীর ধারে এসে যখন বসলাম তখন আমাদের বুকের মধ্যে সে কি প্রবল উত্তেজনা, রক্তের তালে তালে সে কি বিচিত্র ঝঙ্কার! তখন আমরা একে অপরকে চিনতামও না। তবু কেউ কাউকে পর বলে ভাবতে পারিনি। সেই রাতে ত্রিশজন মানুষের এক চিন্তা এক সঙ্কল্প এক মন এক প্রাণ। ত্রিশ জনে সেদিন এক হয়ে গিয়েছি। একজন কিছু বললে অপরের কানে তা মধু বর্ষণ করেছে। কখন রাতটা পোহাবে, কখন নদী পার হব আর প্রকৃত যাত্রা আরম্ভ হবে, সেই উৎকণ্ঠায় সে রাতে আমরা কেউ চোখের পাতা এক করিনি। তখন দেহ মন প্রাণ সব কিছু হালকা শোলার মতো মনে হচ্ছিল। নদীটা একবার পার হতে পারলেই হয়, একেবারে পাখির মতো উড়ে গিয়ে পৌঁছব হিংলাজ। পথের দুঃখকষ্টের কথা সেদিনও বেশ ভালো করে জানা ছিল। রক্ত মাংস অস্থি মজ্জা দিয়ে যেটুকু সাক্ষাৎপরিচয় ঘটেছে এই দশ দিনে পথের সঙ্গে, তার চেয়ে শতগুণে ভয়াবহ ছিল এই পথ তখন আমাদের মনে। তবুও সেই রাতে কারও মন টলেনি, পা কাঁপেনি, চোখের পাতা ভিজে ওঠেনি। অদেখাকে দেখার, না-জানাকে জানার দুর্নিবার আকর্ষণে তখন আমাদের বদ্ধ মাতালের মতো অবস্থা। বাঁধন ছেঁড়ার জন্যে দেহের মধ্যে রক্ত টগবগ করে ফুটছে তখন আমাদের।

সেই রাত যথাসময়ে প্রভাত হল, হাব নদী পেরিয়ে এপারে এসে ‘বাঁধন ছেঁড়ার সাধন’ সমাধা করে আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তারপর?

তারপর জুড়োতে জুড়োতে জুড়িয়ে একেবারে হিম হয়ে গেল দেহের রক্ত, তার সঙ্গে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা। উঁহু-ঠিক হল না-বলা উচিত, শরীর মন প্ৰাণ সমস্ত শুকিয়ে গেল-একেবারে রসকষশূন্য ছিবড়ে হয়ে গেল শুকিয়ে। কোথায় গেল সেই অদম্য উৎসাহ আর কোথায়ই বা গেল সে তড়পানো! এখন পা চলে না, ঘাড় আর সোজা হয় না, গলা দিয়ে আওয়াজও বার হয় না ভালো করে। এখন আমরা একে অপরের মুখদর্শন না করতে পারলেই বাঁচি। কারও কথা কানে ঢুকলে সর্বশরীরে যেন বিষ ছড়িয়ে দেয় ৷

ওই তো সামনেই চন্দ্রকূপ। জাগ্রত অবস্থায় এই কদিন ওই চন্দ্রকূপের কল্পনা করেছি মনে মনে, ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি এই চন্দ্রকূপের। এই চন্দ্রকূপের কিনারায় এসে দাঁড়িয়ে এখন আর চোখ তুলে ভালো করে চেয়ে দেখবার সামর্থ্যও নেই কারও দেহে–গরজও নেই মনে। সর্বস্ব খোয়া গেলে লোকে কিছুক্ষণের জন্যেও নিরাসক্ত নিস্পৃহ হয়ে ওঠে। সেই রকমের একটা তুরীয় অবস্থায় পৌঁছেছি আমরা তখন। এগারো দিনের ধকলে পুণ্যার্জনের, উদ্ধার পাবার, পাপক্ষয়ের দুরন্ত বাসনাও ঝিমিয়ে এসেছে। কোনো কিছুর জন্যেই আর ছিটেফোঁটা আঁকুপাঁকু নেই মনে দেহে কোথাও ৷ এসেই পড়েছি-কাল সকাল হোক, তখন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দর্শন-স্পৰ্শনটা সারলেই চলবে। অতএব এখন লুটিয়ে পড়া যাক ধরিত্রীর বুকে।

দুনিয়ার জ্বালা-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবার স্পর্শমণি এই মহাতীর্থগুলি সকলের ধরা ছোঁয়া-নাগালের বাইরে এই রকমের উৎকট পথের শেষপ্রান্তে নির্দেশ করা হয়েছে কি কারণে, তার একটা সহজ সরল অর্থ খুঁজে পেলাম। ঝাঁ করে মেলগাড়িতে চেপে রাতারাতি কাশী পৌঁছে বিশ্বনাথের মাথায় ফুল-বেলপাতা চাপিয়ে তার পরদিনই আবার বাড়ি ফিরে আপিস করলে কাশী বিশ্বনাথ-দর্শনের ফল কতটুকু পাওয়া যায় তা মা অন্নপূর্ণাই জানেন। কিন্তু পুণ্যকামীর পুণ্যার্জনের ক্ষুধাটা যে তাতে ষোল আনা মেটে না এটুকু জোর দিয়েই বলা যায়। আর-পুরানো তেঁতুল ইসবগুল পর্যন্ত পুটুলি বেঁধে পিঠে ফেলে দু-মাস ধরে পাহাড় পর্বত ভেঙে সর্বশরীরে ঘা করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কেদারবদরী থেকে ফিরে এলে তৃপ্তিতে বুকখানা দশ হাত ফুলে ওঠে। তাই বোধ হয় কেদারনাথের মহিমা বিশ্বনাথের চেয়ে অনেক উঁচুতে পৌঁছেছে। আসল কথা, তীর্থপথের কষ্টটুকু হচ্ছে ‘তপঃ’। তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মদর্শন হয়, তাই বলা হয়েছে ‘তপোহি ব্রহ্ম’। মেলে চেপে তীর্থদর্শন করে ফিরে এলে তীর্থদর্শনও হয়, গায়েও আঁচড় লাগে না, তবে ‘তপ’টুকু বাকি থেকে যায়।

তীর্থপথ এমন হওয়া চাই যা পার হয়ে তীর্থে পৌঁছতে মন বুদ্ধি অহঙ্কার-তার সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলি পর্যন্ত-পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে যায়। অন্য কোনো কামনা-বাসনা তো দূরের কথা, খাস যে উদ্দেশ্য নিয়ে তীর্থযাত্রা সেই পুণ্যকামনারও ছিটেফোঁটা যেন না থাকে তীর্থে পৌঁছে। সৎ হোক অসৎ হোক যে কোনো জাতের বাসনা-কামনা বুকে থাকলে ঈশ্বরকেও দেখা যাবে রঙিন কাঁচের ভিতর দিয়ে। ওই রঙিন কাঁচ ভেঙে ফেলে সব কিছু সাদা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়ার শক্তিলাভ করার জন্যেই এই সব তীর্থদর্শন সাধন-ভজন ধ্যান-ধারণা দুরূহ তপস্যা।

সবাই বসে পড়েছে গোল হয়ে। অন্য সব দিনের মতো ‘কোথায় জল, কোথায় কাঠ, দাও এখনই বড় কলকের মাথায় আগুন চাপিয়ে, এই সব ডাকহাঁকও উঠল না। ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত সামনে চলে এসেও কারও ক্ষুধা-পিপাসার গরজ নেই। কেউ কারও সঙ্গে আলাপ করছে না। যেন কেউ কাউকে চেনে না। এমনকি আমাদের সুখলালও একপাশে আলাদা হয়ে বসে পড়েছে। অন্যদিন যাত্রাবিরতির সঙ্গে সঙ্গে যে হয়ে ওঠে একজন কর্মবীর। জল আনো, আগুন জ্বালাও, চা চড়াও–এই সব হাঁকডাকে একেবারে অস্থির করে তোলে সবাইকে। সুখলালও চুপটি করে বসে থাকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে চন্দ্রকূপের দিকে। সবাই আমরা নিশ্চল হয়ে বসে আছি সেই ছোট-বড় মেজ-সেজ পাহাড়গুলির দিকে চেয়ে। আশ্চর্য হয়ে দেখছি, সব চেয়ে বড়টি থেকে সব চেয়ে ছোটটি পর্যন্ত প্রত্যেকটির আকার একই ধরনের। ঠিক দুর্গাপূজার চালের নৈবেদ্য। নৈবেদ্যের চূড়ায় বসানো থাকে একটা বড় নারকেল নাড়ু বা ক্ষীরের সন্দেশ। সেইগুলি দিতে ভুল হয়ে গেছে এখানে। সেই জন্যেই এই বিরাট বিরাট মাটির নৈবেদ্যগুলিকে কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়-আরও তাজ্জব কাণ্ড হচ্ছে এই যে, চ্যাপটা চূড়াগুলি থেকে সাদা ধোঁয়া উঠছে। জল ফুটলে যেমন ধোঁয়া ওঠে ঠিক তেমনি। সূর্য অস্ত যাবার পরেও পশ্চিম দিক থেকে যে স্বচ্ছ আলোটুকু এসে পড়েছে ওখানে তাতে সেই সাদা ধোঁয়া আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা গেল।

একটু একটু করে আঁধার জমা হতে লাগল সেই চ্যাপটা-মাথা ধোঁয়া-বেরুনো মাটির নৈবেদ্যগুলির পায়ের তলায়। ওইদিকে একভাবে চেয়ে থাকতে একটা অদ্ভুত চিন্তা একেবারে পেয়ে বসল আমাকে। চোখের দৃষ্টি আড়াল করে ওই যে বিচিত্র ছবি আঁকা পর্দাখানি ঝুলছে, ওর পিছনে নিশ্চয়ই তোড়জোড় চলছে এক বিরাট নাটক অভিনয়ের। ওই যবনিকাখানি হঠাৎ উঠে যাবে চোখের উপর থেকে। তখন উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে-আর স্পষ্ট দেখতে পাব ওই যবনিকার অন্তরালে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই প্রতীক্ষায় রুদ্ধ নিশ্বাসে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম সেই দিকে। শেষে নিবিড় আঁধারের মাঝে একেবারে তলিয়ে গেল সব কিছু। লেপে মুছে একাকার হয়ে গেল সেই পর্দার গায়ে আঁকা ছবিখানি, শুধু দেখা যেতে লাগল অনন্ত আকাশ আর আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা অসংখ্য জ্বলজ্বলে ছোট ছোট রূপালী ফুলগুলি। তখনও মিথ্যে আশায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি ওইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে। নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটবে ওখানে। হঠাৎ ওই আঁধার যবনিকাখানি অদৃশ্য হয়ে যাবে চোখের উপর থেকে, আর চোখ-ধাঁধানো আলোয় আরম্ভ হবে এক নাটক, যে নাটক দেখে ইহজন্ম পরজন্ম কর্মফল পুরুষকার-এই সমস্ত চিরন্তন দ্বন্ধ-সমস্যার একেবারে চরম সমাধান পেয়ে যাব। আগে কি ছিলাম, এখন কি হয়েছি আর আগামীতে কি হব-এইসব বিশ্রী বিদঘুঁটে জিজ্ঞাসার শেষ উত্তর মিলে যাবে সেই নাটক দেখে।

“ওই যে দেখছেন ডানধারে সব চেয়ে উঁচু পাহাড়–ওই পাহাড়টাই হচ্ছে চন্দ্ৰকূপ।” আচমকা কানে এল কথাটি। সঙ্গে সঙ্গে সর্বেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল।

“ওই পাহাড়ের উপরেই কাল সকালে আমাদের উঠতে হবে।”

আমাদের পাণ্ডা রূপলাল কথা বলছেন। কিন্তু কোথায় যে তিনি বসে আছেন তা ঠাহর করতে পারলাম না।

“ওখানে উঠে কাল আমার কবুল করতে হবে যদি আমাদের মধ্যে কেউ এই দুটি মহাপাতক করে থাকেন জীবনে : একটি হচ্ছে-নারীহত্যা, অপরটির নাম-ভ্রূণহত্যা। আমাদের মধ্যে যদি কেউ ওই দুটি মহাপাতকের একটিও করে থাকেন আর তা কবুল না করেন চন্দ্রকূপ স্বামীর দরবারে, তাহলে চন্দ্রকূপ বাবার হুকুম মিলবে না আর এগোবার। তাহলে তাঁকে এখানেই আমাদের ত্যাগ করতে হবে। মাতা হিংলাজের গুহায় প্রবেশ করার তাঁর অধিকার নেই।“

ধীর অচঞ্চল কণ্ঠে রূপলাল বলে যেতে লাগল।

“আপনারা সকলেই চাক্ষুস প্রমাণ পাবেন চন্দ্রকূপ বাবার হুকুমের। ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখতে পাবেন, ওখানে ওঁর সমস্ত মাথাটা জুড়ে রয়েছে একটা মস্ত পুকুর। ওই যে দেখছেন সাদা ধোঁয়া উঠছে ওখান থেকে–ওই ধোঁয়া উঠছে সেই পুকুর থেকেই। সে পুকুরে জল নেই, জলের বদলে আছে থকথকে নরম কাদা। সেই কাদা ফুটছে অনবরত, বড় বড় বুজকুড়ি উঠছে সেই কাদার পুকুরে। দেখলে মনে হবে, যেন ওই পাহাড়ের ভিতর আগুন জ্বলছে আর সেইজন্যেই ফুটছে ওই নরম কাদা। মা ধরণীর ভিতর থেকে কত যুগ ধরে ওই নরম মাটি বেরুচ্ছে আর তা জমে জমে ওই অত উঁচু পাহাড়টা তৈরি হয়েছে। শুধু ওই পাহাড়টা নয়, এত বড় দুনিয়াখানা সৃষ্টি হয়েছে ওই কাদায়। ওখানে পৌঁছে দেখতে পাবেন এখনও সেই নরম কাদা ওই পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে নামছে অনেক জায়গা দিয়ে। চন্দ্রকূপ দর্শনের পর আমি আপনাদের শোনাব এই চন্দ্রকূপের উপাখ্যান। কি করে এর সৃষ্টি হল আর কেনই বা চন্দ্রকূপ বাবা সকলের সর্বপাপ হরণ করেন, সে-সব কথা তখন শুনবেন। এখন শুনতে নেই, শুনলে বিপদ ঘটে।”

রূপলাল হঠাৎ নামল। যেন কে তার মুখ চেপে ধরলে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মনে হল যেন সে আরও কিছু বলতে ইতস্তত করছে। শেষে গলা নামিয়ে এক-রকম ফিসফিস করে সে তার বক্তব্যটুকু এইভাবে শেষ করলে।

“ওখানে সেই অত বড় পুকুরের সর্বত্র সব সময় বুদবুদ উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট বুদবুদ হয়। দু মণ চাল-গম রাখা যায় এমন মাপের বড় ঝোড়া উল্টে রাখলে যত বড় দেখায় তার চেয়ে ঢের বড় বড় বুজকুড়ি উঠছে সেই কাদায়। আমি আবার বলছি, চন্দ্রকূপ স্বামীর হুকুমের চাক্ষুষ প্রমাণ পাবেন আপনারা সেখানে গিয়ে। যদি কেউ ওই দুটো পাপের একটি করে থাকেন আর তা চেঁচিয়ে কবুল না করেন এখানে দাঁড়িয়ে, তাহলে তৎক্ষণাৎ বুজকুড়ি ওঠা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। যতক্ষণ না তিনি স্বীকার করছেন তাঁর পাপ, কিংবা যতক্ষণ না তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হবে পাহাড় থেকে, ততক্ষণ কিছুতেই আর একটিও বুদবুদ উঠবে না। ওখানে দাঁড়িয়ে নিজের নাম, বাপ মা ঠাকুরদাদা এঁদের নাম বলে প্রত্যেককে চন্দ্ৰকূপ মহারাজের হুকুম প্রার্থনা করতে হবে হিংলাজ দর্শনে যাবার। সেই সময়ই কবুল করতে হবে নিজের পাপ। তা যদি কেউ না করেন, তবে কখনই বুদবুদ ওঠা না থাকে, তবে আর কোনো মুশকিলই নেই। বুদবুদ উঠতেই থাকবে। আমরা ওখান থেকে নেমে হিংলাজ মায়ীর গুহায় রওয়ানা হয়ে যাবে।

রূপলাল আবার থামল। চারিদিক থেকে নাকঝাড়ার ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যেতে লাগল। বুড়ো গুলমহম্মদ কখন এসে দাঁড়িয়েছে আমার পেছনে।

বিড়বিড় করে সে তার নিজের ভাষায় কি সব মন্ত্র আওড়াচ্ছে। অন্ধকারে কেউ কারও মুখও দেখতে পাচ্ছি না। পোপটভাই-এর কথা মনে পড়ল। এ সময় তাঁর পাশে থাকা আমার একান্ত উচিত ছিল। অন্তত তাঁর হাতখানা চেপে ধরে তাঁর প্রাণে একটু শান্তি দিতে পারতাম।

কে একজন উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বেশ চেঁচিয়ে সে বলতে লাগল। গলা শুনে বুঝলাম রূপলালই উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওখানে আমাদের কি কি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে, ওখানে পৌঁছে কি ভাবে তীর্থকর্ম করতে হবে, এই সব সম্বন্ধে আমাদের ওয়াকিবহাল করছে সে এবার।

“আপনাদের প্রত্যেকের কাছে দুটি করে নারকেল আছে, তার একটি এইখানে পূজায় লাগবে। চন্দ্রকূপ বাবার পূজার জন্যে আপনার সঙ্গে যে ছোট কল্কেটি আর গাঁজা এনেছেন তাও সঙ্গে নিতে হবে পূজার জন্যে। ঐ সব পূজোর জিনিস সঙ্গে নিয়ে কাল ভোরে আমরা ওই পাহাড়ের উপর উঠব। উঠতে কষ্ট নেই কিছুই, তবে পা না হড়কায়। এক ঘণ্টা বা সওয়া ঘণ্টা লাগবে ওই পাহাড়ের মাথায় গিয়ে পৌঁছতে। সেখানে সেই কাদার পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বাপ-মায়ের নাম বলে চন্দ্রকূপ স্বামীর হুকুম চাইতে হবে। হুকুম মিললে তখন নারকেলটি, কল্কেটি আর গাঁজাটুকু ফেলে দিতে হবে চন্দ্রকূপে। বাবার হুকুম না পেয়ে যদি ওসব জিনিস ফেলা হয় বাবা পূজা গ্রহণ করেন না। মানে জিনিসগুলো কাদার উপর পড়ে থাকবে, কাদায় তলিয়ে যাবে না। আর বাবার হুকুম পেয়ে পূজো ফেললে বাবা সে পূজো তখনই গ্রহণ করবেন। সমস্তই আপনারা চাক্ষুষ দেখতে পাবেন। আজ সারারাত আমরা জেগে থাকব। আজ রাতে চন্দ্রকূপ স্বামীর ‘লোট’ বানানো হবে। সেই লোট নিয়ে যাওয়া হবে উপরে। তা-ই বাবার ভোগে নিবেদন করা হবে। ওখান থেকে নেমে এসে কাল আমরা সেই লোট প্রাসাদ খাব সকলে। ওইখানে চন্দ্রকূপের কিনারায় দাঁড়িয়ে আপানারা যা দান-দক্ষিণা করবার করবেন।”

এরপর রূপলাল জোড় হাত করে চন্দ্রকূপের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘আমি রূপলাল ছড়িওয়ালা, আমার বাপের নাম ছগনলাল ছড়িওয়ালা, আমার ঠাকুদা ছিলেন ছেদীলাল ছড়িওয়ালা, যিনি সওয়া দু-শ বার হিংলাজ দর্শন করে গেছেন-আর আমার মায়ের নাম হচ্ছে বাসন্তী; আজ আমি আর আমার ছোট ভাই সুখলাল ছড়িওয়ালা এইখানে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার কাছ থেকে হুকুম চাচ্ছি-দয়া করে বাবা আমাদের সকলকে হিংলাজ দর্শনের অনুমতি দিন। বহু যাত্রীকে নিয়ে বহুবার আমাদের বাবা-ঠাকুর্দা এই চন্দ্রকূপ স্বামীর দরবারে এসেছেন, আবার সকলকে হিংলাজ দর্শন করিয়ে ফিরিয়েও নিয়ে গেছেন। আমরা দু-ভাই তাঁদের বংশধর। আজ আমরা যাদের সঙ্গে করে এনেছি তাদের সব পাপ সব অপরাধ বাবা ক্ষমা করুন। আমরা যেন তাদের মঙ্গলমতো হিংলাজ-মাতা দর্শন করিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি-জয় বাবা চন্দ্রকূপ মহারাজ কি- “জয়!”

বার বার তিনবার জয়ধ্বনি দেয়া হল। সকলের কণ্ঠে আবার আওয়াজ ফুটল। এতক্ষণে যেন সকলে প্রাণ ফিরে পেল।

সব কটা আলো জ্বেলে ফেলা হল। ছড়ি পুঁতে কল্কে সাজিয়ে ছড়ির ভোগসেবা চলতে লাগল ওধারে। কিন্তু সব কিছুই আজ একান্ত নিঃশব্দে। অন্যদিন এই সময় হৈ-হল্লা ইয়ারকি-ঠাট্টা হাসি-চিৎকার এই সমস্ত চলতে থাকে। আজ সে সব কিছুই হল না। নেহাত প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কেউ কথাই বলছে না। যদিও বা কিছু বলছে কেউ, তাও গলা খাটো করে। সাবধানে সসম্ভ্রমে চলাফেরা করছে সকলে। চন্দ্রকূপ স্বামীর বিশ্রামের না ব্যাঘাত ঘটে।

এখান থেকে অনেকদূরে ওই চন্দ্রকূপের ধারেই কোথায় জল উঠছে নিজ থেকে। দুটো আলো আর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গুলমহম্মদ চলল সেই জল আনতে। আমাদের দুটো কুঁজোর জল একটায় রেখে একটা কুঁজো তার হাতে পাঠালেন ভৈরবী। জল এল। দারুণ গন্ধকের গন্ধ জলে। সেই জলে গা হাত মুখ মাথা ধুয়ে মুছে ফেলা হল। সে রাতে রুটি পোড়াবার হাঙ্গামা নেই কারও। এক এক মুঠো বাদাম আর খেজুর খেয়ে সকলে জল খেলে। অনেকে তাও খেলে না। নিরম্বু উপবাস করে রাতটা কাটাবে তারা। কাল চন্দ্রকূপ দর্শন করার পর তবে জল খাওয়া ৷

তবে সকলকেই সেই অন্ধকারে কুড়িয়ে আনতে হল এককাঁড়ি শুকনো ডালপালা। লোট পোড়ানো হবে, অর্থাৎ চন্দ্রকূপ বাবার ভোগ বানানো হবে।

একখানা নতুন কাপড়ের চার কোণ টেনে ধরে চারজন দাঁড়াল। সেই কাপড়ে প্রত্যেকে আধপো করে আটা আর যার যেমন সামর্থ্য চিনি ঘি ফেলে দিল। অনেকে কিছু কিছু কিশমিশ পেস্তা বাদামও দিলে। এ সমস্ত জিনিস সকলেই আলাদা করে সঙ্গে এনেছে চন্দ্ৰকূপ আর হিংলাজের ভোগের জন্য।

তখন রূপলাল আদুড় গায়ে জোড়হাত করে সেই চারজন লোক আর তাদের ধরা চাদরখানাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে নিলে। নিয়ে চন্দ্রকূপের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে জল দিয়ে সেই সমস্ত জিনিস ওই চাদরের উপরেই মেখে ফেললে। মাখা কর্মটি শূন্যে সমাধা হয়ে গেল। মাটির উপর রেখে মাখা নিষেধ। ততক্ষণে সেই ডালপালার কাঁড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এইবার সেই প্রকাণ্ড আটার ডেলাটা তুলে দেওয়া হল সেই আগুনের উপর। তার উপর আরও ডালপালা চাপিয়ে দেওয়া হল। সারারাত ধরে আগুন জ্বলবে, তারপর নিববে আর জুড়োবে। ততক্ষণে ভোর হয়ে যাবে। তখন আমরা এই লোট ওই চুলা থেকেই তুলে নিয়ে পাহাড়ে চড়া আরম্ভ করব। চন্দ্রকূপ বাবার লোট মাটিতে স্পর্শ করালেই উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়। তাই এত কড়াক্কড়ি।

সেই আগুনের ধারেই কম্বল বিছিয়ে আমরা সকলে শুয়ে বসে রইলাম।

চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম। শুনতে পেলাম-”তাহলে কি বলব আমি চন্দ্ৰকূপে গিয়ে? মাথার কাছে বসে ফিসফিস করে বলছেন ভৈরবী। দারুণ দুশ্চিন্তায় তাঁর গলা ভেঙে পড়ল।

সজোরে এক ধাক্কা দিলে আমার মাথার মধ্যে তাঁর কথাটি। “তার মানে?”

একটু চুপ করে থেকে ভৈরবী বললেন-”মানে, ওই পাপ সম্বন্ধে–” আর কোন কথা বেরুল না তাঁর মুখ দিয়ে।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম –“কি বললে! পাপ! তা তোমার কি?” আমারও আর একটি কথা বেরুল না মুখ দিয়ে। উত্তেজনায় উৎকণ্ঠায় গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কোনো রকমে তিনি উচ্চারণ করলেন, “সেই কথাই তো বলছি-আমি যে একবার-” এবার তিনি সত্যই কেঁদে ফেললেন।

শরীরের সমস্ত রক্ত চনচন করে মাথায় উঠে গেল। আগুন বেরুতে লাগল আমার দু চোখ দিয়ে। দম বন্ধ করে চেয়ে রইলাম একদৃষ্টে পার্শ্ববর্তিনীর অন্ধকার মূর্তির দিকে।

একটু সামলে আবার আরম্ভ করলেন তিনি ভাঙা গলায়-”কিন্তু আমার কোনো দোষ ছিল না। সে যে মারা যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।“

এতক্ষণে দম ছাড়লাম। সর্বরক্ষে হোক। তা হলে অন্য কিছু নয়। কবে কোথায় হত্যা করে ফেলেছেন কাকে। কিন্তু এত বড় ব্যাপরটা ঘটল কোথায়?

ভাঙা গলায় আস্তে আস্তে বলেই চলেছেন ভৈরবী –”রোজই তাকে স্নান করাতাম। রোজ স্নান করালে যে মরে যাবে এ কথা তো তখন কেউ আমায় বলে দেয়নি। শেষে যখন সে ম’লো তখন ঠাকুমা খুব বকলেন। বললেন, স্ত্রী হত্যা করলি তো-তোর আর উদ্ধার হবে না কোনও কালে।”

এই পর্যন্ত বলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। একটা চাপা ধমক দিলাম-”বলোই না ছাই সে? কবে আবার কাকে হত্যা-টত্যা করে মরতে গেলে তুমি–”

প্রায় কাঁদতে কাঁদতেই তিনি জবাব দিলেন-”তার নাম রেখেছিলাম লক্ষ্মী। এই এত বড় বড় লোম, লালে সাদায় মেশানো রঙ। আমাদের বাড়ির পাশের বাড়ির খাঁদু পিসি তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে এনে দিয়েছিল। মাদী বেড়াল, খুব সুলক্ষণা। আমার কপালে টিকবে কেন। আদর যত্ন সেবার তো ত্রুটি করিনি কোনো দিন। রোজ স্নান করিয়েছি, পাউডার মাখিয়ে, চিরুনি দিয়ে তার গায়ের চুল আঁচড়ে দিয়েছি। তবু সে মরে গেল আর আমাকে স্ত্রী হত্যার ভাগী করে রেখে গেল।” তিনি ফোঁপাতে লাগলেন।

তাঁর দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম। মনে পড়ে গেল আজ ভোরেই ইনি আমাকে শেষ সম্বোধন করেছিলেন-”ভীমরতি হয়েছে!” কারণ মরবার জন্যে একলা একটা অজ্ঞান পাগলকে সেখানে আমি ফেলে আসতে চাচ্ছিলাম না। সারাটা দিন পরে অর্ধেক রাতে সেই “ভীমরতি হওয়া” আমার সঙ্গে এই প্রথম আলাপ করতে এসেছেন। কি ব্যাপার-না কবে কোথায় একটি মাদী বেড়াল মেরে ইনি স্ত্রী হত্যার পাপ করে ফেলেছেন!

আদিখ্যেতা নেকাপনা ইত্যাদি চোখা চোখা কথাগুলো জিবের ডগায় এসে গিয়েছিল। অনর্থক আর সে-সব ব্যবহার করলাম না। এই মানুষটিকে যাঁরা জানেন তাঁরা জীবজন্তুর ব্যাপার নিয়ে এঁর সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে যাবেন না কিছুতেই। কুকুর বেড়াল পশু পাখি-এরা যে ষোল আনা মানুষের খাতির পাবার যোগ্য নয়, এ কথা এঁকে বোঝাতে গেলে লাঠালাঠি করা ভিন্ন উপায় নেই। চন্দ্রকূপের পাশে বসে এই রাতে খেয়োখেয়ি করে লাভ কি? আবার চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম ৷

বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কান্নার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চাদর মুড়ি দিয়েই শুনতে লাগলাম ৷

“না না না-যাব না আমি ওই পাহাড়ের উপরে। একলা আমি ওখানে কিছুতেই যাব না। বড় আশা করেছিলাম আমি একবার তাকে নিয়ে চন্দ্রকূপ বাবার স্থানে পৌঁছতে পারলেই তার মাথার গোলমাল সেরে যাবে, সে আবার মানুষ হয়ে উঠবে। তার হাত ধরে সারাজীবন আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াব। লোকের দরজায় দরজায় ভিক্ষা মেগে খাব। সে ভিন্ন আর কেউই আমাকে ছোঁবে না। যতক্ষণ তার হুঁশ ছিল সে আমায় ছেড়ে পালায়নি। আমাকে বাঁচাবার জন্যে সে নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিতে গিয়েছিল আর আজ তাকে যমের মুখে ফেলে রেখে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি আমি! এখন তার হুঁশ নেই, এখন সে একটা ছোট বাচ্চার মতো, মুখে তুলে না দিলে এখন সে এক ফোঁটা জলও খাবে না। এই অবস্থায় তাকে আমি এই নির্জলা মুল্লুকে শুকিয়ে মরবার জন্যে ছেড়ে দিয়ে পালাচ্ছি। মরবার সময়ও তার মুখে এক ফোঁটা জল পড়বে না। আমার জন্যেই আজ সে পাগল হয়ে গেছে আর আমিই তাকে একলা শুকিয়ে মরবার জন্যে ফেলে রেখে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এলাম গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল কুন্তী।

একেবারে নিচুস্বরে তাকে কি বললেন ভৈরবী। কথাগুলো শুনতে পেলাম না–মিনতি ঝরে পড়ছে তাঁর গলা দিয়ে।

আবার কুন্তীর গলাই শুনতে পেলাম।

“না না না-সে আর আসবে না। আমাকে খুঁজে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে জলতেষ্টায় সে এতক্ষণে মরে কাঠ হয়ে গেছে। হয়তো তার দেহটা নিয়ে এখন নেকড়েরা ছেঁড়াছেঁড়ি লাগিয়েছে। কেউ তাকে ধরতে পারবে না, কারও কাছে সে জলের জন্যে যাবে না। উঃ, কেন আমি তাকে সেখানে ছেড়ে রেখে এলাম, কেন আমি রইলাম না সেখানে, তাহলে সে ঠিক আমার কাছে এসে ধরা দিত।”

অকস্মাৎ গুলমহম্মদ হাঁক দিয়ে উঠল। নিমেষের মধ্যে আকাশ বাতাস ভরে গেল বহু কণ্ঠের

তুমুল গর্জনে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দলসুদ্ধ সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে, এমনকি উট দুটি পর্যন্ত। প্রত্যেক হাতের লাঠি শুন্যে তুলে বিকট চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ কি এক পাও এগুচ্ছে না। ওরা বাপ-বেটা দুজনে মাথার উপর টাঙি বাগিয়ে ধরে হাঁকার দিচ্ছে। সবাই-এর মুখ একদিকে। ওইদিক থেকেই যেন কোনও কিছু এগিয়ে আসছিল এদিকে। এই হই-চই লম্ফঝম্ফ তাকে ভয় দেখিয়ে দূর করে দেবার জন্যেই করা হচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে সেই চিৎকার চলল। নিশ্চয়ই নেকড়ে। এ জায়গায় একপাল নেকড়ে থাকাও কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়। আমার সামনে ঠিক ভৈরবী এক হাতে কুন্তীকে, অন্য হাতে সুখলালকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।

তখনও হই-চই থামেনি। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি কে বললে, “স্বামীজি মহারাজ, কাকে তাড়ানো হল বুঝতে পারলেন?”

চেয়ে দেখি পোপটভাই। মাথায় পাগড়ি নেই, অন্ধকারে তাঁর মুখ ভালো করে দেখা গেল না। পোপটভাই চুপি চুপি বললেন-”ও নিশ্চয়ই আমাদের থিরুমল?”

“অ্যাঁ!” আঁতকে উঠলাম একেবারে।

পোপটভাই খপ করে আমার একটা হাত ধরে ভীষণ চাপ দিলেন।

“চুপ, মুখ বুজে থাকুন। এ সময় কোনো কথা বলে লাভ নেই। আমারও ভুল হতে পারে। এখানে ওই পাহাড়ের মধ্যে বাহেড়া আছে। হয়তো সেই বাহেড়া একটা আসছিল এধারে। গুলমহম্মদকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন কি দেখেছে সে।”

বাহেড়া!

‘বাম’ এই তার আর একটি নাম। বিশদ পরিচয় শুনে ধারণা হল বনমানুষ জাতীয় প্রাণী এরা। এইখানেই এই পাহাড়ের মধ্যে কোথাও আছে তাদের আস্তানা। তাদের স্বভাব হচ্ছে ঘুমন্ত মানুষ চুরি করা। রাতের অন্ধকারে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দে তারা আসে, মানুষের মতো দু-পায়ে হেঁটে তারা চলাফেরা করে। ঘুমন্ত মানুষের কাছে এসে তার পায়ের কাছে মুখ রেখে শুয়ে পড়ে বাহেড়া। শুয়ে তাদের লম্বা লকলকে জিব দিয়ে মানুষের পায়ের তলায় চাটতে থাকে। যত চাটে লোকটির ঘুমও তত গাঢ় হয়। শেষ পর্যন্ত মানুষটি চৈতন্য হারায়, আর এ কর্মটি হয় বোধ হয় তাদের বিষাক্ত লালার স্পর্শে। আবার যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে দেখে যে পাহাড়ের মধ্যে এক গুহায় শুয়ে আছে, কিন্তু উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তখন তার পায়ের তলায় দগদগে ঘা, ছাল-চামড়া সব উঠে গেছে।

বুঝলাম- বনে যেমন বনমানুষ, তুষারশৃঙ্গে তুষারমানব, তেমনি মরুর মাঝে রয়েছে মরুমানব।

কিন্তু কিসের জন্য মানুষ চুরি করে তারা? এ রকমের বিদঘুঁটে বদখেয়াল কেন তাদের? মানুষ তো গরু-ছাগল নয় যে দুধ দেবে বা লাঙল টানবে! মানুষ দিয়ে তারা করে কি? খায় নাকি?

তা কেউ বলতে পারে না। ওটা ওদের স্বভাব-গুলমহম্মদের ভাষায় ‘খুশ খেয়াল’। তাদের বেটাছেলেরা চুরি করে মেয়েমানুষ পেলে, আর স্ত্রী-বহেড়া পুরুষমানুষ চুরির তালে থাকে। চুরি করে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখে। মারধর বা অন্য কোন অত্যাচারই করে না। হুঁশ ফিরে এসেছে দেখলেই পা চাটতে থাকে, তখন লোকটি আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এই ভাবে চাটতে চাটতে পায়ের গোছ পর্যন্ত তাদের জিবে জিবেই চলে যায়। এধারে কিছুই না খেতে পেয়ে লোকটা মারা পড়ে। মরে গেলেও অনেকদিন পর্যন্ত তারা যত্ন করে রাখে। শেষে যখন পা চাটলে আর তাদের জিভে রক্ত লাগে না, তখন তাকে বয়ে এনে বাইরে খোলা জায়গায় ফেলে রেখে যায়।

শেষবার কতদিন আগে হয়েছিল এই রকম মানুষচুরি? শেষবার কাকে চুরি করেছিল তারা?

হরদম আলাপ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই বুড়ো গুলমহম্মদের। সে তার পাগড়ি খুলে মাথার চুলের মধ্যে আঙুল দিয়ে কি খুঁজতে লাগল। তার হয়ে রূপলাল উত্তর দিলে–

“আমার বাবার কাছ থেকে সে গল্প আমরা শুনেছি। বাবা শুনেছিলেন ঠাকুরাদার কাছ থেকে। নরসিং ছড়িওয়ালা ছিলেন আমার ঠাকুরদার পিসতুতো ভাই। যেমন ছিল তার তাঁর সাহস তেমনি অসুরের মতো গায়ের জোরও ছিল তাঁর। একবার একটা উট করাচী শহরের রাস্তায় খেপে উঠে অনেক লোককে কামড়ে বেড়াচ্ছিল। নরসিং এক লাফে সেই খেপা উটটার উপর লাফিয়ে উঠে তার লম্বা গলা মুচড়ে একেবারে দফারফা করে দেন। এইজন্যে লোকে তাঁকে উটমারা বলে ডাকত।

“সেই নরসিং ছড়িওয়ালা একবার তাঁর এক বড়লোক যজমান আর তার বউকে নিয়ে হিংলাজ আসেন। সে সময় শোনবেণী শহর ছিল না, নাম-ধাম লিখিয়ে খাজনাও দিতে হত না। এ মুল্লুক থেকে কোনো উটওয়ালাও তখন যাত্রী নিয়ে আসত না। যাত্রীরা আসত পায়ে হেঁটে, পথ দেখিয়ে আনত ছড়িওয়ালা। আর তাদের মালপত্রও আসত মানুষের পিঠে। ছড়িওয়ালাই মাল বয়ে আনবার লোকের ব্যবস্থা করত।

“নরসিং এখানে এসে পৌঁছলেন তাঁর যজমান আর তার বউকে নিয়ে। পরদিন চন্দ্রকূপ দর্শন করাবেন তাদের। রাত্রে সকলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পরদিন সকালে আর বউটিকে পাওয়া গেল না। তখন নরসিং আর তাঁর যজমান প্রতিজ্ঞা করলেন যে, বউটিকে উদ্ধার করতেই হবে। সঙ্গের লোকজনদের রেখে ওঁরা দুজনে দুখানা খোলা কৃপাণ হাতে করে এই চন্দ্রকূপ এলাকার মধ্যে ঢুকলেন। বাহেড়াদের অনেকগুলোকে মেরে তাদের গুহা থেকে বউটিকে তুলে নিয়ে তিনদিন পরে তাঁরা বেরিয়ে এলেন ওই পাহাড়ের ভিতর থেকে। এখান থেকেই সেবার নরসিংকে করাচী ফিরতে হয়। বউটি তো আর হাঁটতে পারে না, কাজেই হিংলাজ যায় কি করে! সেই নরসিং বলেন বাহেড়াদের কেমন দেখতে। সুস্থ হয়ে বউটিও ওদের স্বভাব চরিত্রের ঘরসংসারের গল্প করে। কিন্তু তারপর থেকে তারা আর কাউকে চুরি করেছে কি না বলতে পারি না।”

দিলমহম্মদ স্বল্প কথায় জানাল যে, মানুষ চুরি তাদের এই মুল্লুকে হামেশাই হয়। বালুর উপর বাহেড়াদের অস্বাভাবিক লম্বা পায়ের ছাপ দেখে সবাই বুঝতে পারে কারা চুরি করল মানুষটিকে

আরও অনেক রকমের প্রশ্নই করবার ছিল। ভাবলাম দরকার কি! বাম, বাহেড়া যে নামেই হোক সেই মানুষচোরদের, তবুও যে তারা এই মানুষ গোরু পশু পাখি কীট পতঙ্গ, এক কথায় এই জগতের তাবৎ প্রাণীর দ্বারা বর্জিত এই ভয়ঙ্কর স্থানে বাস করছে আর বেঁচে আছে, এটাও তো কম কথা নয়। বেশি খোঁচাখুঁচি করে জানতে গেলে হয়তো সন্দেহ জাগবে মনে যে ওই রকমের কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই নেই। তাতে কার কতটুকু লাভ হবে জানি না, তবে চন্দ্রকূপের যে বিশেষ ক্ষতি হবে তাতে আর সন্দেহ নেই। শান্তিতে থাকুক বেঁচে বাহেড়ারা দুনিয়ার এই শেষ প্রান্তে। তাদের নামে যে বিভীষিকা এই চন্দ্রকূপকে ঘিরে রয়েছে তার মূল্য কম নয়। ভয় আর ভক্তি এ দুটি হচ্ছে যমজ ভাইবোন। একটিকে হারালে অপরটির তেজও কমতে থাকে সঙ্গে সঙ্গে।

বাহেড়া-কাহিনী রাত শেষ করে আনলে। চন্দ্রকূপের ন্যায় চূড়ার উপর পিছন থেকে আলো এসে পড়ল। আকাশের গায়ে তখনও দু-একটা নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

আমরা প্রস্তুত হলাম।

আগে দুজনে চলে গেল রূপলালের সঙ্গে স্নান করে আসতে। ওরা লোট বয়ে নিয়ে যাবে।

তারা স্নান করে এলে আমরা সকলে যাত্রা করলাম। উট নিয়ে গুলমহম্মদরা চলল চন্দ্রকূপের উত্তর ধার দিয়ে ঘুরে। দর্শন করে নেমে গিয়ে আমরা ওদের সঙ্গে মিলব।

নারকেল গাঁজা কলকে ইত্যাদি পূজা-উপাচার সঙ্গে নিলে সবাই। কুঁজোও বাদ গেল না। পাহাড়ের তলায় কুঁজো রেখে উপরে চড়তে হবে। অনেকে এক টুকরো লাল সালু সঙ্গে নিলে। চন্দ্রকূপের মাটি বেঁধে আনবে ওই কাপড়ে।

দণ্ড খাটার ভক্ত দু-জন খাটতে খাটতে চলল। ভেবে পেলাম না ওই ভাবে ওই পিছল পাহাড়ের গা বেয়ে উঠবে কি করে ওরা।

কুন্তীর বাঁ হাতের কবজি মজবুত করে ধরে একরকম তাকে টানতে টানতেই নিয়ে চললেন ভৈরবী। শুকনো মুখ, কোটরে-বসা চোখ, রুক্ষ চুল, এই সব মিলে কুন্তীকে ভয়াবহ করে তুলেছে। তার চোখের দৃষ্টিও অস্বাভাবিক। নীচেকার ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। জ্বালাময়ী দৃষ্টিতে সে একভাবে চেয়ে আছে চন্দ্রকূপের দিকে।

আরম্ভ হল ছোট খাটো মাটির নৈবেদ্যগুলি। কোনে-কোনোটি আমাদের কোমর বা বুক পর্যন্ত উঁচু। সকলের মাথা চ্যাপটা, এক রকমের গড়ন, উপরটা শুকনো। মা ধরণীর অঙ্গ ফুটো হয়ে কিছুদিন ক্লেদ রক্ত নির্গত হয়েছিল, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্রমে আরও বড় বড় অগুনতি সেই সব মাটির ঢিবির মধ্যে আমরা ঢুকতে লাগলাম। গাছপালা ঝোঁপঝাড় কিছু নেই। এ হচ্ছে মাটির ঢিবির জঙ্গল। এর মাঝে কেউ যদি হারায় তবে যুগ-যুগান্তর খুঁজেও তাকে বার করা যাবে না। ক্রমে উঁচুতে উঠতে লাগলাম আমরা। ঢিবিগুলিকে টপকে ডিঙিয়ে ঘুরে ঘুরে। শেষে পাওয়া গেল একটি ক্ষীণ জলধারা। সেটি এই ঢিবি-জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আবার ঘুরে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এখন একটি বাঁধ দিতে হবে।

কোদাল ঝোড়া কিছুই লাগল না, পঁচিশ-ত্রিশ জোড়া হাত আছে কি করতে! ডেলা ডেলা মাটি তুলে এনে ফেলা হল দুটো ঢিবির মাঝখানে। জলাধারাটির গতি রোধ হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটি ডোববার মতো ব্যবস্থা হয়ে গেল।

তখন স্নান দান মন্ত্রপাঠ পিতৃপুরুষের তর্পন এই সব তীর্থকর্ম সমাপন করা গেল ৷ পণ্ডিত রূপলাল মন্ত্রপাঠ করালেন, দক্ষিণা গ্রহণ করলেন। সর্ববিধ অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে শেষ করে আমরা পাহাড়ে চড়া আরম্ভ করলাম। আর কিছুক্ষণ এ-ঢিবির ডান পাশ দিয়ে ও-ঢিবির বাঁ পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে এগিয়ে মূল চন্দ্রকূপের অঙ্গ স্পর্শ করা গেল। প্রত্যেকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে। নিজে নিজের নাক-কান মললে। এইবার আরোহণের পালা।

প্রথমে কিছুক্ষণ কোনও কষ্টই হল না। এখানে-ওখানে পা রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে বেশ খানিকটা ওঠা গেল, তারপর অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়াল। ক্রমশ ঢালু মসৃণ চন্দ্রকূপের অঙ্গ বেয়ে ওঠা অত সহজ ব্যাপার নয়। দু’জোড়া হাত-পায়ের সাহায্য নিতে হল। বলা যায় দলসুদ্ধ সবাই একরকম দণ্ড খাটতে খাটতেই উঠতে লাগলাম। হাত-পা আটকাবার মতো খাঁজ খাঁজ যেখানে একটু পাওয়া গেল সেখানে একটু থেমে দম নিয়ে আবার চার হাত পায়ে আরোহণ। তবে বেশি সময় লাগল না। এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা যথাস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম ৷

সেখানেও দাঁড়াবার উপায় নেই। প্রচণ্ড ঝড় বইছে, দাঁড়ালে উল্টে নীচে গড়িয়ে পড়তে হবে চন্দ্রকূপের গা বেয়ে। সেই কাদায় কূপের কিনারায় আমরা পাশাপাশি মাটি আঁকড়ে বসে পড়লাম।

এবং এতক্ষণে চোখ মেলে ভালো করে দেখবার ফুরসত পেলাম।

যা দেখলাম তা রূপলালের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। এ-পাড় থেকে ও পাড়- মাঝখানের মাপ একশ’ হাতের কম নয়-সুডৌল গোল একটি কালো থকথকে কাদার পুকুর। বহু জায়গায় পাড়ের উপর দিয়ে উপচে সেই কাদা গড়িয়ে নামছে নীচে। আর হাঁ-মস্ত মস্ত ধামার মতো বুদবুদদ হরদম উঠছে সেই কাদায়, সঙ্গে সঙ্গে সাদা বাষ্পও। জীবন্ত, একেবারে ষোল আনা প্রাণময় এই চন্দ্রকূপ।

সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বার বার সর্বশরীর শিউরে উঠল।

পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, যতদূর দৃষ্টি যায়- হাজার হাজার চন্দ্রকূপের বংশধরেরা স্থির নিশ্চল হয়ে ধ্যান করছে। বাঁ দিকেও তাই। ডান দিকে বিছানো রয়েছে একখানি ধূসর রঙের চাদর, একেবারে সেই আকাশের সীমা পর্যন্ত। আর ওই–ওই চলেছে দুটি উট আর দুটি মানুষ। ওরা চন্দ্রকূপ ঘুরে আমাদের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এইবার চেয়ে দেখলাম আশেপাশে কে কি করছে। কিছুই করছে না কেউ। সবাইকার চোখ প্রায় কপালে উঠেছে। দু-হাতে মাটি আঁকড়ে ধরে সবাই চেয়ে রয়েছে সেই মাটির বুদবুদগুলির দিকে। সেগুলি অনবরত উঠছে আবার তৎক্ষণাৎ ভেঙে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামনে দু হাত দূরেই কাদার আরম্ভ। আমাদের পায়ের তলার মাটিও বেশ নরম। যদি দৈবাৎ কেউ ওই কাদার মধ্যে পড়ে তবে-। তবে কি হবে তা ভাবতে গিয়ে সভয়ে চোখ বন্ধ করতে হল।

আমার ডান পাশের পাঁচ-ছ জনের ওধারে বসেছেন ভৈরবী। তখনও তিনি এক হাতে কুন্তীর একখানা হাত ধরে রয়েছেন। কুন্তী বসেছে তাঁর পিছনে। ভৈরবীর এদিকে বসেছে মণিরাম আর ওদিকে কে বসেছে তার মুখ দেখতে পেলাম না। ওইদিকেই সকলের শেষে বসেছে রূপলাল। তার সামনে সেই নতুন চাদরখানা পেতে তার উপর লোট রাখা হয়েছে। লোটের পাশে পোঁতা হয়েছে হিংলাজের ছড়ি। সেই ঝড়ে বহু কষ্টে একগোছা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে মাটিতে পুঁতলে রূপলাল। এইবার সে তার ঝোলা থেকে আরও সব কি কি জিনিস বার করতে লাগল।

সকলের থেকে দূরে আলাদা হয়ে পোপটলাল প্যাটেল বসেছেন। তাঁর স্তিমিত চোখ দিয়ে গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নেমেছে, ঠোঁট দু’খানি নড়ছে। এইবার চরম বোঝাপড়া করছেন তিনি চন্দ্রকূপ স্বামীর সঙ্গে।

আমার ঠিক পিছনেই আমার দুই কাঁধ ধরে দাঁড়িয়ে আছে সুখলাল। ধরে না থাকলে হাওয়ার চোটে উড়েই যাবে অতটুকু ছেলে।

ওধারে মন্ত্রপাঠ শুরু হল, যার একবর্ণও কারও কানে ঢুকল না। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেল পণ্ডিত রূপলালের মন্ত্র আর তার গলার স্বর-উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে খাস চন্দ্রকূপনাথের কর্ণেই পৌঁছে দিল বোধ হয়।

মন্ত্র পড়তে পড়তে রূপলাল এক এক চাপড়া ভেঙে নিতে লাগল সেই মস্ত বড় পোড়া আটার ডেলাটার গা থেকে আর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল চন্দ্রকূপে। সভয়ে দেখলাম ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল কাদার মধ্যে সেই চাপড়াগুলো। শেষে একটি নারকেলও ফেললে রূপলাল। সেটিরও ওই গতি হল। তারপর এক একটা করে দশ বারোটা কলকেতে গাঁজা ভরে আগুন দিয়ে ছুঁড়লে রূপলাল সেই কাদার মধ্যে। সেগুলিও সব আস্তে আস্তে তলিয়ে গেল। কি জ্যান্ত দেবতা রে বাবা, সব কিছুই চোখের উপর গ্রাস করলে!

পাণ্ডার নিজের পূজা শেষ হলে পর, এল আমাদের যাত্রীদের পূজার পালা। প্রথমেই দণ্ড খাটা দু’জনের হাত ধরে খাড়া করলে রূপলাল। তারা একে একে উচ্চৈঃস্বরে নাম বাপের নাম ইত্যাদি ঘোষণা করে আরও কত কি বলে গেল যার বিন্দুবিসর্গও কারও কানে ঢুকল না হাওয়ার জন্যে। তারপর নারকেল কলকে গাঁজা সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে অর্পণ করলে দেবতাকে। দু-হাত সামনে থেকে কাদা তুলে নিয়ে বেশ করে তাদের কপালময় লেপে দিল রূপলাল। তখন ওরা দক্ষিণা দিয়ে পাণ্ডার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। রূপলাল তাদের পিঠ চাপড়ে দিলে। শেষে ওরা নিজেদের হাতে এক এক থাবা কাদা তুলে নিয়ে ওপাশে গিয়ে বসল।

এইভাবে একের পর এক নাম ডাকতে লাগল রূপলাল আর এক একজনে উঠে গিয়ে যথাকর্তব্য করে আসতে লাগল। গড়গড় করে বেশ চলতে লাগল পূজা দেওয়া। কোনো বাধা-বিঘ্ন ঘটল না। ওধারে ধোঁয়াও উঠছে আর বুজকুড়িও কাটছে সমানে চন্দ্ৰকূপময়। সেই দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনষ্ক হয়ে ভাবছিলাম-আমার নাম ডাকা হলে কি কি বলব গিয়ে দাঁড়িয়ে। এ পর্যন্ত কত রকমের কত পাপই যে করেছি, তার তো ঠিক ঠিকানা নেই। ভাগ্যে সব গুলি পাপের ফিরিস্তি এখানে দিতে হবে না, তা হলে আমারগুলো আওড়াতে আওড়াতেই সন্ধে হয়ে যেত। ভৈরবীর কথা মনে হল-বেচারি ওখানে দাঁড়িয়ে ঠিক ওর লক্ষ্মীহত্যার পাপই কবুল করবে। আর কুন্তী? কুন্তী বলবে কি? করবে নাকি কবুল যে থিরুমলের মৃত্যুর জন্যে ও-ই দায়ী? কুন্তীর জন্যে একটা নারকেলও সঙ্গে এনেছে ভৈরবী। তার কলকে গাঁজার জন্যে নাকি মূল্য ধরে দিলেই চলবে।

পূজার পালা শেষ করে ফিরে এসে আমার পাশেই বসে পড়লেন পোপটলাল। তাঁর মুখে চোখে যেন জোয়ার এসেছে। এখান থেকে নেমে পোপট নিশ্চয়ই সেই আগের মানুষটি হয়ে যাবেন, সেই সদা হাসি-খুশি প্রাণখোলা সহৃদয় লোকটি।

ও কি! ও কি হল?

চন্দ্রকূপের সেইদিকেই চেয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আর একটি ও বুজকুড়ি উঠছে না। সমস্ত জায়গাটা একেবারে প্রাণহীন নিস্পন্দ নিথর। যেন জুড়িয়ে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল চন্দ্রকূপ, নীচেকার আগুন নিবে গেল আচম্বিতে। সেই সঙ্গে সেই প্রচণ্ড ঝড়ও একেবারে স্তব্ধ।

মুখ ফিরিয়ে দেখি রূপলাল উঠে দাঁড়িয়েছে আর তার পাশে দাঁড়ানো লোকটির হাত চেপে ধরেছে। রূপলালের দুই চোখ দিয়ে আগুনের হলকা বেরুচ্ছে।

কে ওই লোকটা?

সুন্দরলাল।

সুন্দরলাল বাজোরিয়া কাথিওয়াড়ের লোক নয়। গোয়ালিয়রের মানুষ সুন্দরলাল। প্রায় চল্লিশ বছর হবে তার বয়স, ওর বাবা রাজকোটে ব্যবসা করে প্রচুর টাকা আর খানকয়েক বাড়ি রেখে গেছেন। গোটাতিনেক বিয়ে করেও যখন বংশরক্ষা হল না তখন একমাত্র উপায় মা হিংলাজ দর্শন। হিংলাজ দর্শন করে এলে মায়ের দয়ায় তার বংশরক্ষা হবে।

কিন্তু এখন বংশরক্ষার চেয়ে নিজের প্রাণরক্ষাই বড় কথা হয়ে দাঁড়াল যে! রূপলাল তার হাতখানায় ঝাঁকানি দিতে দিতে গর্জন করতে লাগল- “বলো- বলো তুমি জলদি-কি অন্যায় কাজ করে এসেছ তুমি এখানে। কবুল করো, স্পষ্ট করে স্বীকার করো যদি বাঁচতে চাও–”

সুন্দরলাল চুপ। মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মোচড় দিতে দিতে আবার ধমক দিয়ে উঠল রূপলাল। ডুকরে কেঁদে উঠল সুন্দরলাল। না-সে সজ্ঞানে একটিও স্ত্রীহত্যা বা ভ্রূণ হত্যা করেনি।

“তবে বন্ধ হল কেন বুদবুদ কাটা-বাবা চন্দ্রকূপ কিসের জন্য নারাজ হলেন তোমার বেলায়?”

উত্তর নেই সুন্দরলালের মুখে। শুধু কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে তার সর্বশরীর। একেবারে বলির পাঁঠার মতো অবস্থা তার। ব্যাপার দেখে ভয় হল-লোকটাকে যদি ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় রূপলাল! চন্দ্রকূপের ভিতর বার যে ধারেই হোক–ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে আর রক্ষা নেই। সকলের পিছন দিয়ে সাবধানে পা ফেলে পৌঁছলাম ওদের কাছে। গিয়ে সুন্দরলালের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালাম। সে মুখ তুলে চাইলে আমার দিকে। বললাম- “সুন্দরলাল, ভ্রূণহত্যা তুমি না করতে পারো, কিন্তু তোমার কি মনে পড়ে এমন কোনো ব্যাপার যে, তোমার দ্বারা কোনো মেয়ের গর্ভ হয়েছিল, যে-মেয়ে তোমার স্ত্রী নয়!”

দপ্ করে আলো জ্বলে উঠল সুন্দরলালের চোখে। চিৎকার করে উঠল সে-”হাঁ হাঁ মহারাজ, এইবার আমার মনে পড়েছে। কিন্তু তাকে আমার মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর তার কোনো খবরই পাইনি আমি।”

বললাম, “খবর আর নাওনি ভালোই করেছ। নিলে জানতে পারতে যে, সেই মেয়ে তোমাদের কাছ থেকে গিয়ে গর্ভ নষ্ট করেছে কিংবা সে নিজেই মরে সব বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছে। আর এ দুটির যেটিই ঘটে থাকুক, তার জন্যে তুমিই দায়ী। এইটুকুই বাবার কাছে কবুল করে ক্ষমা চাও। তাহলেই বাবার দয়া হবে।”

ঘুরে দাঁড়াল সুন্দরলাল চন্দ্রকূপের দিকে। দু হাত জোড় করে বলে গেল সেই মেয়ের নাম আর তার সঙ্গে যা যা ঘটেছিল আগাগোড়া সেই কাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে বার বার নিজের নাক-কান নিজের দু হাতে মলতে লাগল।

আবার একটি-দুটি করে বুজকুড়ি কাটতে আরম্ভ হল চন্দ্রকূপে। আবার হাওয়া বইতে লাগল। সুন্দরলালের হাতে নারকেল কল্কে গাঁজা তুলে দিয়ে রূপলাল মন্ত্রপাঠ শুরু করলে। সবাই বার বার জয়ধ্বনি দিতে লাগল, “জয় বাবা চন্দ্ৰকূপ স্বামী মহারাজ, জয়!”

আবার পা টিপে টিপে নিজের জায়গায় ফিরে চললাম। নাম ডাকলে উঠে আসব।

“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ-হা হা-”

সমস্ত শরীরের ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুখ তুলে চেয়ে দেখি–ওই– যে সে এসে দাঁড়িয়েছে, একেবারে ঠিক আমাদের সামনা সামনি চন্দ্রকূপের ওপারে।

দু-হাতে নিজের মাথায় দু-পাশের চুল মুঠি করে ধরে আবার সেই উৎকট হাসি হেসে উঠল বিরুমল-”হাঃ হাঃ হাঃ-হা-হা-!”

প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম, “থিরুমল, হুঁশিয়ার আর এক পা এগিও না, খবরদার-আর এক পা-”

আমার কথা শেষ হল না। থিরুমল প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে উঠল উপর দিকে।

পরমুহূর্তেই তার দেহটা নামল এসে সামনে চন্দ্রকূপের মধ্যে। বহু উঁচুতে ছিটকে উঠল কাদা। কি জানি কেন সেই মুহূর্তেই চোখ বন্ধ করলাম, কিংবা সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় আর অজ্ঞাতে দু চোখ বুজে গেল আমার।

তৎক্ষণাৎ খুলেও গেল চোখ। দেখতে পেলাম আকাশের দিকে উঁচু করা দুখানি পা মাত্র ৷ দম বন্ধ করে চেয়ে রইলাম সে পা দুখানির দিকে। কাঁপতে কাঁপতে পা দুখানি কাদার তলায় তলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *