১. ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা

প্রথম অধ্যায় : ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা

দার্শনিক চিন্তার ব্যাপকতা ও গভীরতার জন্য প্রাচ্য দর্শনের ইতিহাসে ভারতীয় দর্শন অনন্য স্থান দখল করে আছে। বিশেষত জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় দর্শনের সবকটি সম্প্রদায়ই জ্ঞানবিদ্যার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।১ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অধিবিদ্যার আলোচনা জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভারতীয় দার্শনিকদের আলোচনারীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পূর্বপক্ষ, পূর্বপক্ষ-খণ্ডন ও উত্তরপক্ষ বা সিদ্ধান্ত। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে কোনো কোনো দার্শনিক সম্প্রদায় তাঁদের পূর্ববর্তী দার্শনিক সম্প্রদায়ের জ্ঞানবিদ্যা আংশিক বা পূর্ণভাবে গ্রহণ করেছে, আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় পূর্ববর্তী মতবাদ খণ্ডন করে নিজস্ব মতবাদ প্রদান করেছে। এভাবেই জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা ভারতীয় দার্শনিকদের অপরিহার্য আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার ধারা পর্যালোচনা করলে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কারণ, সকল পাশ্চাত্য দার্শনিক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা করেননি। প্রাচীন যুগে প্লেটো-পূর্ব গ্রিক দার্শনিকগণ বিশ্বতত্ত্বের আলোচনাকে মুখ্য বিবেচনা করেছেন। তাঁদের অনেকেই জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন। বস্তুত পাশ্চাত্য দর্শনে সোফিস্টদের হাতেই জ্ঞানবিদ্যাগত প্রশ্নের সূচনা।২ অর্থাৎ দর্শনের শাখা হিসেবে মর্যাদালাভের জন্য পাশ্চাত্যে জ্ঞানবিদ্যাকে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় বা সোফিস্টদের কাল পর্যন্ত আপেক্ষা করতে হয়েছে। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি ।

ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার চেয়ে জটিলতর। ভারতীয় দর্শনের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের ব্যাখ্যায় এই জটিলতার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর মতে, যে ধরন অনুসারে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস রচিত হয়েছে সে ধরন অনুসারে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস রচনা খুব কমই সম্ভব বলে মনে হয়।৩ কেননা, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যে সুবিধা পাওয়া যায় ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস রচনায় সে সুবিধা অনুপস্থিত। দাসগুপ্তের ব্যাখ্যা অনুসারে, দর্শনের ইতিহাসের প্রাথমিক কাল থেকেই ইউরোপে একের পর এক দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের মতবাদ প্রকাশ করেছেন। একজন আধুনিক ঐতিহাসিক সহজেই এসব মতবাদকে কালক্রম অনুসারে সাজিয়ে এক গোষ্ঠীর মতবাদ অন্য গোষ্ঠীকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, অথবা দার্শনিক

ভারতীয় ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যা : চার্বাক ও হিউম চিন্তার ধারায় এসব মতবাদ বিভিন্ন সময়ে সাধারণভাবে কী প্রভাব ফেলেছে তা পর্যালোচনা করতে পারেন। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের প্রধান দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর উৎপত্তিকাল সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রামাণ্য দলিল না থাকায় এদের উৎপত্তিকাল নিয়ে সঠিকভাবে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব। এমনকি এসব দার্শনিক সম্প্রদায় কীভাবে বা কীসের প্রভাবে গড়ে উঠেছে তাও সঠিকভাবে বলা কষ্টসাধ্য। এছাড়া সূত্রাকারে রচিত তাদের দার্শনিক মতবাদগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দেওয়া ছিল না। সেহেতু পরবর্তীকালে প্রায় সবক্ষেত্রেই এগুলোর তাৎপর্য ব্যাখ্যার জন্য বিভিন্ন ভাষ্য রচিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভাষ্যকারগণ একই সূত্রের অর্থ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন, এমনকি কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এসব কারণে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের জ্ঞানবিদ্যার ধারাবাহিক আলোচনায় যে সুবিধা পাওয়া যায় ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় তা অনুপস্থিত। তাই এ গ্রন্থে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনারীতি অনুসরণ না করে স্বতন্ত্র রীতি অনুসরণ করা হলো।

ভারতীয় দর্শনের সকল সম্প্রদায়ই জ্ঞানের জন্য জ্ঞাতা, জ্ঞেয়বস্তু ও জ্ঞানের উৎসকে স্বীকার করেছেন। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞাতাকে ‘প্রমাতৃ’, জ্ঞেয়বস্তুকে ‘প্রমেয়’, যথার্থ জ্ঞানকে ‘প্রমা’৪ এবং যথার্থ জ্ঞানের উৎসকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা প্রমাণকেন্দ্রিক। তাই এ গ্রন্থে প্রমাণতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলো।

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় বিভিন্ন প্রমাণের কথা বলেছে। এর মধ্যে ভাট্ট-মীমাংসা ও বেদান্ত জ্ঞানবিদ্যায় সর্বাধিক সংখ্যক, অর্থাৎ ছয়টি প্রমাণের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি। জৈন জ্ঞানবিদ্যাও ছয়টি প্রমাণকে স্বীকার করে। কিন্তু জৈন দার্শনিকগণ এসব প্রমাণের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় ভাট্ট-মীমাংসা ও বেদান্ত নির্দেশিত সবগুলো প্রমাণকে স্বীকার করেনি। তবে কোনো কোনো সম্প্রদায় এসব প্রমাণের কোনো কোনোটিকে হুবহু স্বীকার করেছে, আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় এগুলোর কোনো কোনোটিকে স্বীকার। করে নিয়ে নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছে। কোনো সম্প্রদায়ই এর চেয়ে বেশি সংখ্যক প্রমাণের কথা বলেনি। তাই আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে মীমাংসা ও বেদান্ত প্রমাণতত্ত্ব আলোচনা করার পর অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রমাণতত্ত্ব আলোচনা করা হলো।

মীমাংসা জ্ঞানবিদ্যা

মীমাংসা দার্শনিক সম্প্রদায় ভারতীয় দর্শনে আস্তিক ধারার কট্টরতম সমর্থক। এ সম্প্রদায় বৈদিক ভাবধারাকে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈনদের বিরোধিতার হাত থেকে পুনরুদ্ধার করে সুবিন্যস্ত ও যৌক্তিক রূপ দিয়ে ভারতীয় মননে এর পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়। এ দর্শন বেদের কর্মকাণ্ডে বর্ণিত ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে।৫ মীমাংসা জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় প্রমা, প্রমাণ, সত্যতার মানদণ্ড, ভ্রমের লক্ষণ ইত্যাদি সমস্যা গুরুত্ব পেয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রমাণতত্ত্বই প্রধান।

মীমাংসা দার্শনিকের মতে, আত্মাই হলো জ্ঞাতা। প্রত্যক্ষ ও অনুমানসহ অন্য সকল জ্ঞানই অনিবার্যভাবে আত্মার বা জ্ঞাতার মধ্যে সরাসরি উদ্ভূত হয়। যে জ্ঞান পূর্বে, জ্ঞাত নয় এমন কোনো বিষয় বা বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করে, এবং তা এর কোনো অংশের সঙ্গে স্ববিরোধী নয় সে জ্ঞানই যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা। যথার্থ জ্ঞানলাভের পদ্ধতি বা প্রমাণ সম্পর্কে মীমাংসা দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা জৈমিনির মতে, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা প্রমাণ তিন প্রকার : প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ। জৈমিনির মীমাংসাসূত্র গ্রন্থের প্রখ্যাত ভাষ্যকার কুমারিল ভট্টের মতে, প্রমাণ ছয় প্রকার : প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি।৬ কিন্তু কুমারিল ভট্টের শিষ্য, মীমাংসা দর্শনের অন্যতম ভাষ্যকার প্রভাকর মিশ্র, কুমারিল ভট্ট দ্বারা নির্দেশিত অনুপলব্ধিকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন না। তার মতে, প্রমাণ পাঁচ প্রকার : প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান ও অর্থাপত্তি। মীমাংসা দর্শনের সবকটি প্রমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য এখানে কুমারিল ভট্ট প্রদত্ত ছয় প্রকার প্রমাণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।৭

(১) প্রত্যক্ষ : জৈমিনি অস্তিত্বশীল বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের৮ সঠিক সংযোগের৯ ফলে আত্মায় যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলেছেন। বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সঠিক সংযোগে বৈধ বা যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। যখন সঠিক সংযোগ ঘটে না তখন যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। ‘সঠিক সংযোগ’ বলতে কুমারিল ভট্ট ত্রুটিহীন সংযোগকেই বুঝিয়েছেন। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর ত্রুটিপূর্ণ সংযোগই ভ্রান্তি বা অধ্যাসের জন্ম দেয়।১০ জ্ঞান উৎপত্তির সময় আত্মা মন নামক অভ্যন্তরীণ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। এরপর মন বাহ্য ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। ফলে বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর সঠিক সংযোগ ঘটে। এ মতানুসারে বর্তমানে যে বস্তু অস্তিত্বশীল এবং ইন্দ্রিয়ের উপর ক্রিয়াশীল সে বস্তুই প্রত্যক্ষ জ্ঞান উৎপন্ন করতে পারে। অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো বস্তু, যা বর্তমানে অস্তিত্বশীল নয় তা ইন্দ্রিয়ের উপর কাজ করতে পারে না। তাই এগুলো প্রত্যক্ষ জ্ঞান উৎপন্ন করতে অক্ষম। সুতরাং প্রত্যক্ষ দ্বারা কেবল বর্তমানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর জ্ঞান পাওয়া যায়, অতীন্দ্রিয় বিষয়ের জ্ঞান পাওয়া যায় না।১১

প্রভাকর মিশ্র প্রত্যক্ষকে সাক্ষাৎ প্রতীতি অর্থাৎ সাক্ষাৎ জ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মতে, প্রত্যক্ষ দ্বারা বস্তু, আত্মা ও জ্ঞানকে সংযুক্ত করা হয়। একটি বস্তুকে যখন প্রত্যক্ষ করা হয় তখন আত্মা, জ্ঞান এবং বস্তু–এ তিনটি বিষয়ই প্রত্যক্ষিত হয়। একে প্রভাকরের ত্রি-প্রত্যক্ষণ নীতি বলে।১২ ইন্দ্রিয় সংযোগের বিষয়বস্তু অনুসারে দ্রব্য, গুণ এবং সার্বিকেরও প্রত্যক্ষণ হতে পারে।১৩ আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত হয় বলে সব ধরনের জ্ঞানই প্রত্যক্ষের শ্রেণিভুক্ত বলে গণ্য হতে পারে।১৪

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকর মিশ্র উভয়ই প্রত্যক্ষের দুটি স্তরকে স্বীকার করেন। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ ও সবিকল্প প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে এ বিভাগ করা হয়।

নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ : বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের প্রথম সংযোগে যে প্রত্যক্ষ ঘটে তাকেই ঐ বস্তুর নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলে। কুমারিল ভট্ট নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকে বস্তু সম্পর্কিত সরল অনুভূতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। এতে বস্তুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অনুভূতি জন্মে না। কেবলমাত্র স্বতন্ত্র বস্তুর অনুভূতি জন্মে।১৫ প্রভাকর মিশ্র নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলতে বস্তুর প্রকৃতির অনুভূতিকে বুঝান।১৬ তাঁর মতে, ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগের ফলে বস্তুর অস্তিত্ব বহনকারী একটি দ্রব্য, একটি গুণ এবং একটি জাতি অনুভূত হয়। তবে এদের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে তা অনুভূত হয় না। এছাড়া, এতে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বহির্ভূত কিছু প্রত্যক্ষিত হয় না। এক কথায়, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বিশেষ ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষিত হয় কি-না এ সম্পর্কে কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকর মিশ্রের মধ্যে মতদ্বৈততা থাকলেও তারা উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বিশেষ ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য বলে চেনা যায় না। কারণ, বিশেষ ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে অনুভূত হওয়ার জন্য যে প্রত্যাভিজ্ঞা দরকার তা নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে অনুপস্থিত।

সবিকল্প প্রত্যক্ষ : কুমারিল ভট্ট কোনো বস্তুর জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে জাতিগত এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ বা স্বতন্ত্র হিসেবে উপলব্ধি করাকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ বলেন। সবিকল্প প্রত্যক্ষ প্রত্যক্ষিত বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন উভয় প্রকার বস্তুর প্রত্যাভিজ্ঞাজাত উপাদান ধারণ করে। এতে একটি বস্তু এবং এর জাতিগত ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে কর্তা ও কর্ম সম্পর্কে সম্পর্কিত করে উপলব্ধি করা হয়।১৭ প্রভাকর মিশ্র সবিকল্প প্রত্যক্ষের যে প্রকৃতি বর্ণনা করেন তা কুমারিল ভট্ট বর্ণিত সবিকল্প প্রত্যক্ষের প্রকৃতির অনুরূপ। মীমাংসা ভাষ্যকার পার্থসারথী মিশ্রের মতে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ ছাড়া সবিকল্প প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। কুমারিল ও প্রভাকর নির্বিকল্প ও সবিকল্প উভয় প্রকার প্রত্যক্ষকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তাঁদের উভয়ের মতে, এই দুটি প্রত্যক্ষই স্বতঃপ্রামাণ্য ।

(২) অনুমান : জৈমিনিসূত্রের খ্যাতনামা ভাষ্যকার শবরস্বামী অনুমানের সংজ্ঞা দিয়ে বলেন যে, প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তু থেকে এ বস্তুর সঙ্গে স্থায়ী বা নিয়ত ঐক্য সম্পর্কের জ্ঞানের ভিত্তিতে অপ্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুর জ্ঞানকে অনুমান বলে।১৮ স্থায়ী ঐক্য সম্পর্কের জ্ঞান অনুমানের ভিত্তি। এই সম্পর্ককে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় ব্যাপ্তি১৯ বলে। কুমারিল ভট্ট শবরস্বামী প্রদত্ত অনুমানের সংজ্ঞাকে গ্রহণ করেন। শবরস্বামী প্রদত্ত সংজ্ঞার ভিত্তিতে কুমারিল ভট্ট দেখান যে, যখন বহুসংখ্যক ঘটনার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বা বস্তু (যেমন, ধোঁয়া ও অগ্নি) একটি তৃতীয় বস্তুর মধ্যে (যেমন, পাকশালা) স্বাধীন সম্পর্কের মাধ্যমে বিদ্যমান থাকে শুধু তখনই অনুমান সম্ভব হয়। “স্বাধীন সম্পর্ক” বলতে কুমারিল ভট্ট এমন সম্পর্ককে বুঝান, যে সম্পর্কের কারণে এদের একত্রে অবস্থান অন্য কোনো শর্তের বা উপাদানের উপর নির্ভর করে না।

প্রভাকর মিশ্র শবরস্বামী প্রদত্ত অনুমানের সংজ্ঞা থেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি অনুমানকে একটি উদ্দেশ্যের মধ্যে এমন একটি বিধেয়ের জ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন যার সঙ্গে অন্য কোনো জ্ঞানের বিরোধিতার সম্পর্ক নাই। উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের মধ্যকার ঐক্য সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো একটি চিহ্ন বা কারণ অর্থাৎ লিঙ্গকে প্রত্যক্ষ করাই হলো এই জ্ঞানের ভিত্তি।২০ অপরিবর্তনীয় সম্পর্কের উপর অনুমান নির্ভর করে। এই সম্পর্ককে মানসিক প্রত্যক্ষের মাধ্যমে জানা যায়। কুমারিল ভট্টের মতো প্রভাকর মিশ্রও অনুমানের জন্য দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে স্থায়ী ঐক্য সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। তবে এ দুটি বিষয়ের সম্পর্ক যে একটি তৃতীয় বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান করে এ বিষয়টির উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেননি।

অনুমানের শ্রেণিবিভাগ : মীমাংসা দর্শনে অনুমানকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে মোট চার ভাগে ভাগ করা হয়। অনুমানের বিষয়বস্তুর প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে মীমাংসা অনুমান দুই প্রকার : প্রত্যক্ষতোদৃষ্টসম্বন্ধ ও সামান্যতোদৃষ্টসম্বন্ধ। অনুমানকর্তার উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে মীমাংসা অনুমান দুই প্রকার : স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান।

প্রত্যক্ষতোদৃষ্টসম্বন্ধ ও সামান্যতোদৃষ্টসম্বন্ধ অনুমান : অনুমানের বিষয়বস্তুর প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে শবরস্বামী দুই প্রকার অনুমানের কথা বলেন। যথা, প্রত্যক্ষতোদৃষ্টসম্বন্ধ ও সামান্যতোদৃষ্টসম্বন্ধ অনুমান। কুমারিল ভট্ট এই দুই প্রকার অনুমানকে যথাক্রমে দৃষ্টস্বলক্ষণবিষয় এবং অদৃষ্টস্বলক্ষণবিষয় বলে অভিহিত করেন। প্রভাকর মিশ্র আবার এগুলোকে যথাক্রমে দৃষ্টস্বলক্ষণ ও অদৃষ্টস্বলক্ষণ অনুমান বলেন।২১ প্রথম ক্ষেত্রে দুটি মূর্ত বা প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর মধ্যে নিয়ত বা অনিবার্য সম্পর্কের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়। যেমন, আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে এই সম্পর্কের অনুমান। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার অনুমানের ক্ষেত্রে একটি প্রত্যক্ষযোগ্য এবং একটি অপ্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর মধ্যে নিয়ত সম্পর্কের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়। যেমন, আকাশে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে সূর্যের গতির অনুমান। দ্বিতীয় প্রকার অনুমানে দুটি মূর্ত বস্তুর মধ্যে নিয়ত সম্পর্ক নির্ণয় করা হয় না; বরং দুটি সাধারণ ধারণার মধ্যে নিয়ত সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়। কারণ, অবস্থান পরিবর্তন ও গতির নিয়ত সম্পর্ক মূলত দুটি সাধারণ ধারণার মধ্যেকার নিয়ত সম্পর্ক, মূর্ত বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক নয়। প্রভাকর মিশ্র অবস্থান পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষযোগ্য এবং গতিকে অপ্রত্যক্ষযোগ্য বলে মনে করেন।২২

স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান : অনুমান কর্তার উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে প্রভাকর মিশ্র অনুমানকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। জ্ঞাতা নিজের জন্য তত্ত্ব নিশ্চয়ার্থে যে অনুমান করেন তা স্বার্থানুমান। জ্ঞাতা অপরকে বুঝাবার জন্য যে অনুমান করেন তা পরার্থানুমান। উভয় প্রকার অনুমানই প্রতিজ্ঞা, হেতু ও উদাহরণ– এই তিনটি বাক্য বা অবয়ব দ্বারা গঠিত। অনুমানে যে বিষয়টি প্রমাণ করা প্রয়োজন সে বিষয়টি যে বাক্যে থাকে তা হলো প্রতিজ্ঞা। প্রতিজ্ঞার কারণ বা যুক্তি যে বাক্যে থাকে তা হেতুবাক্য। এতে তিনটি পদ থাকে। যথা, সাধ্য, পক্ষ ও হেতু বা মধ্য পদ।

(৩) শব্দ : কোনো বাক্য যেসব শব্দ দ্বারা গঠিত হয় সেসব শব্দের অর্থ অনুধাবন করার ফলে ঐ বাক্য থেকে যে জ্ঞান পাওয়া যায় তাকে শব্দজ্ঞান বলে। কুমারিল ভট্ট অতীন্দ্রিয় বস্তুর জ্ঞানকে শব্দজ্ঞান বলেন। বাক্য থেকে এই জ্ঞান পাওয়া যায়। বাক্য গঠনকারী শব্দসমূহের অর্থ উপলব্ধির উপর এই জ্ঞান নির্ভর করে।২৩ প্রভাকর মিশ্র শব্দজ্ঞানকে অক্ষর দ্বারা গঠিত শব্দাবলির জ্ঞানের ভিত্তিতে পাওয়া অতীন্দ্রিয় জ্ঞান হিসেবে বর্ণনা করেন।

শব্দের শ্রেণিবিভাগ : কুমারিল ভট্ট শব্দকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। যথা, মানবীয় ও অতিমানবীয়। মানবীয় শব্দ বিশ্বস্ত ব্যক্তির বচন। এ জাতীয় শব্দজ্ঞানের বৈধতা নির্ভর করে বাক্য উচ্চারণকারী ব্যক্তির বিশ্বস্ততার উপর। অতিমানবীয় শব্দ বেদের বচন। এর বৈধতা স্বতঃপ্রমাণিত। সুতরাং উভয় প্রকার শব্দই বৈধ জ্ঞান দান করে। কুমারিল ভট্ট মানবীয় ও অতিমানবীয়–এই দুই প্রকার শব্দের কথা বললেও প্রভাকর মিশ্র মানবীয় শব্দকে অনুমানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। কেননা, কোনো ব্যক্তি যে বচন উচ্চারণ করে সে বচনের বৈধতা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির চরিত্রের বিশ্বস্ততার উপর। অন্যকথায়, চরিত্রের বিশ্বস্ততার বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বচনের বিশ্বস্ততা অনুমিত হয়। এখানে ব্যক্তির জ্ঞান হলো কারণ, উচ্চারিত বাক্য হলো কার্য। কারণ থেকে কার্য অনুমিত হয়। এজন্য মানবীয় শব্দ অনুমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বৈদিক ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান অনুমিতভাবে বৈধ নয়। বরং স্বতঃপ্রমাণিতভাবে বৈধ। তাই তার মতে, ধর্মগ্রন্থের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ জ্ঞান নাই।২৪

(৪) উপমান বা তুলনা : প্রভাকর মিশ্র উপমান বা তুলনাকে কোনো প্রত্যক্ষিত বস্তুর সঙ্গে স্মৃতিতে অধিষ্ঠিত বস্তুর সাদৃশ্যজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।২৫ যেমন, পূর্বে দেখা কোনো গরুর স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানে বনে দেখা গরুসদৃশ প্রাণীকে ‘গবয়’ বলে চিনতে পারাই হলো উপমান। প্রভাকর মিশ্র প্রদত্ত উপমানের সংজ্ঞা কুমারিল ভট্ট প্রদত্ত সংজ্ঞার সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। তবে উপমান সম্পর্কে কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকর মিশ্রের মতের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। কুমারির ভট্টের মতে, যে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান জ্ঞান লাভ করা যায় সে সাদৃশ্য একাধিক বস্তুতে অবস্থিত একই রকম গুণাবলি থেকে গঠিত হয়। অন্যদিকে, প্রভাকর মিশ্র এই সাদৃশ্যকে একটি স্বতন্ত্র প্রকার (category) হিসেবে গণ্য করেন।২৬

উপমান কেন স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়, এর পক্ষে মীমাংসা দার্শনিকগণ যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, উপমান প্রত্যক্ষ নয়। কারণ, এতে পূর্বজ্ঞাত বস্তুটি জ্ঞানোৎপত্তির সময় অনুপস্থিত থাকে। উপমান স্মৃতিও নয়। কারণ, বর্তমান বস্তুর সাদৃশ্য পূর্বজ্ঞাত নয়। ব্যক্তিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল না হওয়ায় তা অনুমানও নয়। আবার বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন নয় বলে তা শব্দও নয়। তাই উপমান স্বতন্ত্র প্রমাণ।

(৫) অর্থাপত্তি : অৰ্থাপত্তি প্রমাণ হলো মীমাংসা দর্শনে স্বীকৃত একটি নতুন প্রমাণ। শবরস্বামী অর্থাপত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন যে, প্রত্যক্ষিত বস্তুর অসঙ্গতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য যখন কোনো অপ্রত্যক্ষিত বস্তুর পূর্বধারণা করা হয় তখন তাকে অর্থাপত্তি বলে।২৭ যেমন, যদি আমরা জানি যে দেবদত্ত জীবিত অথচ যদি প্রত্যক্ষ করি যে সে তার বাড়িতে অনুপস্থিত তবে দুটি বিষয়ের মধ্যে যে অসঙ্গতি উৎপন্ন হয় তা সমাধানের জন্য বাড়ির বাইরে দেবদত্তের অস্তিত্বের ধারণা করি। এই ধারণা অর্থাপত্তি। কুমারিল ভট্ট শবরস্বামীর এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

অর্থাপত্তি সম্পর্কে কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকর মিশ্রের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। প্রভাকর মিশ্রের মতে, অৰ্থাপত্তির মধ্যে সন্দেহের উপাদান আছে। কিন্তু কুমারিল ভট্টের মতে, অর্থাপত্তির মধ্যে সন্দেহের উপাদান নাই। প্রভাকর মিশ্রের মতে, দেবদত্ত জীবিত অথচ বাড়িতে অনুপস্থিত দেখে আমাদের মনে সন্দেহ জাগে। এ সন্দেহ নিরসনের জন্য আমরা যে পূর্বধারণা করি তা দেবদত্তের জীবিতাবস্থা ও বাড়িতে অনুপস্থিতির মধ্যে সন্দেহ নিরসন করে। তার মতে, অৰ্থাপত্তিতে সন্দেহের যে উপাদান থাকে তা-ই একে অনুমান থেকে পৃথক করে। কেননা অনুমানে সন্দেহ নেই।

কুমারিল ভট্ট মনে করেন, অর্থাপত্তিতে সন্দেহের উপাদান অনুপস্থিত। তার মতে, আমরা দেবদত্তকে তার বাড়িতে প্রত্যক্ষ করি না। অথচ এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, সে জীবিত। এ দুটি জ্ঞাত এবং সন্দেহহীন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য আমরা বাড়ির বাইরে দেবদত্তের উপস্থিতির পূর্বধারণা করি। যদি দেবদত্ত জীবিত এই জ্ঞান সন্দেহজনক হতো তবে তা পূর্বধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারত না।২৮

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাস রচয়িতা এবং বিশেষজ্ঞ যদুনাথ সিন্‌হা প্রভাকর মিশ্রের সঙ্গে দ্বিমত ও কুমারিল ভট্টের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন যে, দেবদত্তের জীবিতাবস্থা সম্পর্কে যদি সন্দেহ থাকে তবে তার গৃহে অনুপস্থিতির পূর্বধারণা করা যায় না। কেবলমাত্র তার জীবিতাবস্থা নিশ্চিত হলেই গৃহে তার অনুপস্থিতি সম্পর্কে পূর্বধারণা করা যায়।২৯

যদিও অনুমানের মতোই অর্থাপত্তি পূর্বধারণার উপর নির্ভরশীল, তবুও ব্যাপ্তিজ্ঞান নির্ভর। নয়। তাই তা অনুমান নয়। এছাড়া, অনুমানে দুটি বিষয়ের মধ্যে অসঙ্গতি থাকে না। কিন্তু অর্থাপত্তিতে দুটি জানা বিষয়ের মধ্যে অসঙ্গতি থাকে। এবং এই অসঙ্গতি নিরসনের জন্যেই পূর্বধারণা করা হয়। কিন্তু অনুমানকে পূর্বধারণা বলা যায় না।

অর্থাপত্তির শ্রেণিবিভাগ : অৰ্থাপত্তি দুই প্রকার। যথা, দৃষ্টাৰ্থাপত্তি ও তাৰ্থাপত্তি। দৃষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনো বিরোধিতার মধ্যে সামঞ্জস্য করার জন্য যে অদৃষ্ট বিষয়ের কল্পনা করা হয় তা দৃষ্টাৰ্থাপত্তি। যেমন, দেবদত্ত জীবিত অথচ বাড়িতে অনুপস্থিত থাকায় যখন দেবদত্ত বাড়ির বাইরে আছে বলে ধারণা করা হয় তখন তা দৃষ্টাৰ্থাপত্তি। অন্যদিকে, শ্রুত কোনো শব্দের অর্থ সহজে উপলব্ধি করা না গেলে যে অর্থান্তর কল্পনা আবশ্যক হয় তাকে শ্রুতার্থাপত্তি বলে। যেমন, কথোপকথনের সময় একজন অন্যজনকে বলল, শেষ করো । তখন প্রথম ব্যক্তির বক্তব্যের অর্থ সুস্পষ্টভাবে বোঝার জন্য শেষোক্ত ব্যক্তি ‘কথা’, ‘কাজ’ এ জাতীয় শব্দের কল্পনা করে। এটাই শ্ৰুতার্থাপত্তি।

(৬) অনুপলব্ধি : উপরিলিখিত পাঁচ প্রকার প্রমাণ ছাড়াও কুমারিল ভট্ট আরো একটি প্রমাণকে স্বীকার করেন যাকে অনুপলব্ধি বলা হয়। শবরস্বামীর মতে, যে বস্তু ইন্দ্রিয়ের নিকট অস্তিত্বশীল নয় সে বস্তুর অস্তিত্বহীনতার জ্ঞানই অনুপলব্ধি।৩০ তিনি অনুপলব্ধি-জ্ঞানকে যে কোনো প্রকার বৈধ জ্ঞানের অনুপস্থিতি হিসেবে উপস্থাপিত করেন। কুমারিল ভট্টও শবরস্বামীর সঙ্গে একমত। তিনি প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান ও অর্থাপত্তি দ্বারা বস্তুর অনস্তিত্বের যে জ্ঞান পাওয়া যায় না সে জ্ঞানকেই অনুপলব্ধি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর মতে, অনস্তিত্বের জ্ঞান কেবল অনুপলব্ধি থেকেই জানা যায়। তাই একে যোগ্যানুপলব্ধি বলে। এটা বৈধ জ্ঞানের স্বতন্ত্র উপায়। উল্লেখ্য, যে অবস্থায় যে বস্তু প্রত্যক্ষিত হয় সে অবস্থায় সে বস্তু প্রত্যক্ষিত না হলেই তার অভাব আছে বলা যায়। সুতরাং অনস্তিত্বের জ্ঞান অনুপলব্ধির মাধ্যমেই আসে ৷

শবরস্বামী ও কুমারিল ভট্ট অনুপলব্ধিকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করলেও প্রভাকর মিশ্র অনুপলব্ধিকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না। তিনি অনস্তিত্বকে তত্ত্বগত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না, এবং একে জানার জন্য অনুপলব্ধিকে একটি আলাদা প্রমাণ বলেও মনে করেন না। তাঁর মতে, সকল প্রকার বৈধ জ্ঞানই বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনুপলব্ধির কোনো স্বতন্ত্র বস্তু নাই। সুতরাং তা জ্ঞানের স্বতন্ত্র উপায় নয়। তাই অনুপলব্ধি স্বতন্ত্র প্রমাণ নয় ৷৩১

জ্ঞানের প্রামাণ্য : মীমাংসা দর্শনে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করা হয় । মীমাংসা দার্শনিকদের মতে, স্মৃতি ব্যতীত অন্য সব জ্ঞানই স্বতঃপ্রামাণ্য। কারণ, এগুলো অতিরিক্ত কোনো শর্তের উপর বা অন্য কোনো জ্ঞানের উপর নির্ভর না করে নিজেরাই নিজেদের বৈধতা প্রত্যয়ন করে। মীমাংসা দর্শনে এ সূত্রটিকে স্বতঃপ্রামাণ্যবাদ বলা হয়।

মীমাংসা জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপরের আলোচনায় দেখা যায়, এতে ভারতীয় দর্শনের সর্বাধিক ছয়টি প্রমাণ স্বীকৃত হয়েছে, এবং এসব প্রমাণের দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানকে বিভিন্ন শ্রেণিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথা, বৌদ্ধ দর্শনের আপেক্ষিকতাবাদ, সাম্যবাদ ও অহিংসা নীতি এবং এর পূর্ববর্তী চার্বাক ও জৈন দর্শনের বেদবিরোধিতার প্রভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজকাঠামো সংশয়ের সম্মুখীন হয়। ভারতীয় মানসে বেদবিরোধী মনোভাব গভীরতর প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রেক্ষাপটে বেদের অপৌরুষেয়তা, প্রামাণ্য ও নিঃশর্ত কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মীমাংসা দার্শনিক জৈমিনি বিপুলাকার মীমাংসাসূত্র প্রণয়ন করেন। ধর্মের স্বরূপ অনুসন্ধান করা এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য হওয়ায় ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানলাভ করার জন্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা এ গ্রন্থে বিশেষ গুরুত্ব পায়। মীমাংসা দার্শনিকগণ ধর্মকে জানার জন্য বেদ বা শব্দ প্রমাণকে একমাত্র প্ৰমাণ বলে মনে করেন। তবে, শব্দ-প্রমাণ বা বেদ ছাড়া অন্য কোনো প্রমাণের মাধ্যমে ধর্মের যথার্থ জ্ঞান যে সম্ভব নয় একথা প্রমাণের জন্য তাঁরা প্রত্যক্ষসহ অন্যান্য সকল লৌকিক প্ৰমাণ নিয়ে বিশদ বিচারমূলক আলোচনা করেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভারতীয় দর্শনালোচনায় স্বীকৃত বিচারমূলক ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া, বৈধ জ্ঞানোৎপত্তির বিভিন্ন উপায় এবং এসব উপায়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রকৃতিগত ভিন্নতা সম্পর্কে খ্রিষ্টপূর্ব যুগেও মীমাংসা দার্শনিকগণ সচেতন ছিলেন, তাঁদের প্রমাণতত্ত্বের আলোচনায় তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মীমাংসা প্রমাণতত্ত্বে কুমারিল ভট্ট নির্দেশিত ছয়টি প্রমাণ এবং এসব প্রমাণ দ্বারা প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রকার জ্ঞান নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।

ছকে মীমাংসা প্রমাণতত্ত্ব

ছকে মীমাংসা প্রমাণতত্ত্ব
ছকে মীমাংসা প্রমাণতত্ত্ব

বেদান্ত জ্ঞানবিদ্যা

মীমাংসা জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের বেদ বিরোধিতার প্রভাব থেকে ব্রাহ্মণপ্রধান সমাজ ও বৈদিক চিন্তা-চৰ্চাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে জৈমিনি রচিত মীমাংসাসূত্র গ্রন্থের ভিত্তিতে বেদের কর্মকাণ্ডের উপর প্রাধান্য দানকারী মীমাংসা দর্শন গড়ে ওঠে। ফলে উপনিষদীয় জ্ঞানকাণ্ড গৌণ হয়ে পড়ে। একদিকে বৌদ্ধদের বেদবিরোধিতা অন্যদিকে মীমাংসকদের জ্ঞানকাণ্ড বিমুখতা, এই দুটি বিরোধী শক্তির প্রতিক্রিয়ার ফলই হলো জ্ঞানকাণ্ড প্রধান বেদান্ত তথা অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন। তাই এ দর্শনে জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।৩২ অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা শঙ্করাচার্য অজ্ঞানতা বা অবিদ্যাকে সংসার বন্ধনের কারণ মনে করে তত্ত্বজ্ঞান বা সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের বিশুদ্ধ জ্ঞানকে মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং প্রমাণ, প্রমেয়, খ্যাতিবাদ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন অনুসারে যথার্থ জ্ঞানের দুটি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার : অবাধিতত্ত্ব বা অবিরোধিতা, এবং অনধিগতত্ত্ব বা নতুনত্ব। যথার্থ জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে, এবং যথার্থ জ্ঞানে নতুনত্ব থাকবে। অর্থাৎ তা পূর্বে জ্ঞাত কোনো বিষয় হবে না। অন্যকথায়, এই জ্ঞান অভিজ্ঞতালব্ধ হবে। স্মৃতি অনধিগত নয় বলে তাকে অদ্বৈত বেদান্তে যথার্থ জ্ঞান বলে স্বীকার করা হয় না। ব্রহ্মজ্ঞান অবাধিত ও অনধিগত বলে তা যথার্থ জ্ঞান। এই জ্ঞান অদ্বয়। কারণ, তা অন্য কোনো জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হয় না।

শঙ্করাচার্য তত্ত্বগত সত্তা ও অভিজ্ঞতামূলক সত্তার মধ্যে পার্থক্য করেন। তার মতে, তত্ত্বগত সত্তাকে যথার্থ বা উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যমে এবং অভিজ্ঞতামূলক সত্তাকে অযথার্থ বা নিম্নতর জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায়। তত্ত্বগত সত্তার জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞানের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। কেবল অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাই তাঁর মতে, সকল প্রকার প্রমাণ হলো আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতার জ্ঞান। যখন অদ্বৈত আত্মাকে জানা যায় তখন জ্ঞাতা ও জ্ঞানের উপায় বা প্রমাণের মধ্যে পার্থক্য লুপ্ত হয়।

বেদান্ত দর্শনেও যথার্থ জ্ঞানের কারণ বা উৎসকে প্রমাণ বলা হয়।৩৩ শঙ্করাচার্য প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ–এ তিনটি প্রমাণ স্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে বেদান্ত ভাষ্যকারগণ ভাট্ট মীমাংসকদের মতো মোট ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করেন। যথা, প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি। নিম্নে এসব প্রমাণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

(১) প্রত্যক্ষ : শঙ্করাচার্য নির্দেশিত প্রত্যক্ষের প্রকৃতি মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট নির্দেশিত প্রত্যক্ষের অনুরূপ।৩৪ শঙ্করাচার্যের মতে, বাহ্যিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে মন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং বস্তুর আকারে আকারিত হয়।৩৫ বস্তুর আকারে আকারিত মানসিক ধরনকে বৃত্তি বলে। এই বৃত্তিই প্রত্যক্ষ জ্ঞান।

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : শঙ্করাচার্যের দর্শনে বিভিন্ন দিক থেকে প্রত্যক্ষকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন, প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে : নির্বিকল্প ও সবিকল্প প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষের উপায়ের ভিন্নতার ভিত্তিতে : ইন্দ্রিয়জাত ও অ ইন্দ্রিয়জাত বা মানসিক প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষজাত বিষয়ের প্রকৃতির ভিত্তিতে : বিষয়গত ও জ্ঞানগত প্রত্যক্ষ, এবং ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষ করার প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে : জীবসাক্ষী ও ঈশ্বরসাক্ষী প্রত্যক্ষ।

নির্বিকল্প ও সবিকল্প প্রত্যক্ষ : প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষকে নির্বিকল্প ও সবিকল্প–এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। শঙ্করাচার্য প্রদত্ত এই দুই প্রকার প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা ভাট্ট-মীমাংসকদের নির্বিকল্প ও সবিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার অনুরূপ।৩৬ কুমারিল ভট্টের মতে, প্রথমে নির্বিকল্প ও পরে সবিকল্প প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত দার্শনিকদের মতে, সবিকল্পের পরেও নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ সম্ভব। সবিকল্প প্রত্যক্ষ যে ভেদজ্ঞান থাকে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে তা লোপ পায় এবং জীব ও ব্রহ্মের অভিন্ন জ্ঞান জন্মে।৩৭

ইন্দ্রিয়জাত ও অ-ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ : প্রত্যক্ষের উপায়ের ভিন্নতার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষকে ইন্দ্রিয়জাত ও অ-ইন্দ্রিয়জাত এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে প্রত্যক্ষ হয় তা ইন্দ্রিয়জাত এবং মনের সাহায্যে যে প্রত্যক্ষ হয় তা অ-ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ। বেদান্ত দর্শনে মনকে ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করা হয় নি। তাই মনের প্রত্যক্ষকে অ-ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ বলা হয়। ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষে মন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাহ্য বস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু মানস প্রত্যক্ষে মন বাহ্য বস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয় না। এই প্রত্যক্ষের দ্বারা শুধুমাত্র আনন্দ, বেদনা এবং এই জাতীয় মানসিক অবস্থাকে প্রত্যক্ষ করা যায়।

বিষয়গত ও জ্ঞানগত প্রত্যক্ষ : প্রত্যক্ষজাত বিষয়ের প্রকৃতির ভিত্তিতে শঙ্করাচার্য প্রত্যক্ষকে বিষয়গত ও জ্ঞানগত প্রত্যক্ষে বিভক্ত করেন। প্রত্যক্ষের বিষয়কে মানসিক ধরনগুলোর সাহায্যে প্রত্যক্ষ করে প্রত্যক্ষিত বিষয়ের অনুরূপ যে বৃত্তিজ্ঞান জন্মে তাকে বিষয়গত প্রত্যক্ষ বলে। পক্ষান্তরে, যখন মানসিক ধরনের সাহায্য ছাড়াই কোনো জ্ঞানকে আত্মা প্রত্যক্ষ করে তখন তা জ্ঞানগত প্রত্যক্ষ। এতে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়’র মধ্যে পার্থক্য বা ভেদ রহিত হয়।

জীবসাক্ষী ও ঈশ্বরসাক্ষী প্রত্যক্ষ : ব্রহ্মকে উপাধি ও বিশেষণভেদে দুভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। এই দুই প্রকার প্রত্যক্ষকে জীবসাক্ষী ও ঈশ্বরসাক্ষী প্রত্যক্ষ বলা হয়। শাশ্বত চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম যখন অন্তঃকরণের অবিদ্যাপ্রসূত উপাধি দ্বারা শর্তাবদ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষিত বিষয়ের আকার ধারণ করে তখন তাকে জীবসাক্ষী প্রত্যক্ষ বলা হয়। অন্যদিকে, শাশ্বত চৈতন্যরূপ ব্ৰহ্ম যখন মায়াবৃত্তি দ্বারা শর্তাবদ্ধ হয়ে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয়ের আকার ধারণ করে তখন তা ঈশ্বরসাক্ষী প্রত্যক্ষ। জীবসাক্ষী প্রত্যক্ষের বহুবিধ কারণ থাকে। কিন্তু ঈশ্বরসাক্ষী প্রত্যক্ষের কারণ একটিই, তা হলো মায়া ৷

(২) অনুমান : শঙ্করাচার্য মধ্য পদের সঙ্গে সাধ্য পদের নিয়ত বা ব্যাপ্তি সম্পর্কের ভিত্তিতে যে জ্ঞান হয় তাকে অনুমান বলেন। শঙ্করাচার্যের অনুমানের প্রকৃতি মীমাংসা দার্শনিক শবরস্বামী বা কুমারিল ভট্টের অনুমানের প্রকৃতির অনুরূপ।৩৮ ভারতীয় দর্শনের বিশিষ্ট পণ্ডিত কৃষ্ণচন্দ্ৰ ভট্টাচার্য অনুমান ও প্রত্যক্ষ প্রমাণের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেন যে, অনুমানে মন অনুমিত বস্তু সম্পর্কে শুধুমাত্র চিন্তা করে। কিন্তু এর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য বেরিয়ে যায় না। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষের উপাদান এবং এর ব্যাখ্যা একটি এককে মিলিত হয়। কিন্তু অনুমানে এগুলো আলাদা থাকে।৩৯

অনুমানের শ্রেণিবিভাগ : অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে শুধুমাত্র দুই প্রকার অনুমানকে স্বীকার করা হয়। যথা, স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। বেদান্ত স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানের প্রকৃতি মীমাংসা স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানের প্রকৃতির অনুরূপ।৪০ ন্যায় দর্শনেও দুই প্রকার অনুমানকে স্বীকার করা হয়েছে। তবে পার্থক্য হলো, ন্যায় দর্শনে শুধু পরার্থানুমানের জন্য প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন এই পাঁচটি অবয়বকে স্বীকার করা হয়। পক্ষান্তরে, মীমাংসা দর্শন স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান উভয়ের জন্য পাঁচটির পরিবর্তে প্রথম তিনটি অবয়বকেই যথেষ্ট মনে করে। অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন শুধু পরার্থানুমানের ক্ষেত্রে তিনটি অবয়ব স্বীকার করে। এই অবয়ব তিনটি হলো : প্রতিজ্ঞা, হেতু ও উদাহরণ, অথবা উদাহরণ, উপনয়ন ও নিগমন ।

(৩) শব্দ : যখন কোনো বাক্য অন্য কোনো প্রমাণের বিরোধিতা না করে এর পদগুলোর মধ্যে নিরপেক্ষ সম্পর্ককে নির্দেশ করে তখন সে বাক্যকে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে শব্দজ্ঞান বলা হয়। এখানে ‘নিরপেক্ষ সম্পর্ক’ বলতে স্ববিরোধিতা বর্জিত সম্পর্ক বোঝানো হয়েছে।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন অনুসারে একটি বাক্য অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। প্রথমত, আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ বাক্যের আবশ্যকীয় পদসমূহের মধ্যে সংশ্লেষণাত্মক সম্পর্ক। যেমন, একটি ক্রিয়া উদ্দেশ্য, সহকারী ক্রিয়া, কর্ম ইত্যাদির প্রয়োজন বোধ করবে। দ্বিতীয়ত, যোগ্যতা, অর্থাৎ তাৎপর্যবোধক শব্দসমূহের অর্থের মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকবে না। যেমন, ধোঁয়া দ্বারা জলসেচন করছি, এরূপ বাক্য হবে না। তৃতীয়ত, আসক্তি, অর্থাৎ বাক্যের বিভিন্ন পদের উচ্চারণের মধ্যে সময়ের নৈকট্য থাকবে। বাক্যের একটি পদ চার ঘণ্টা আগে অন্য পদ চার ঘণ্টা পরে উচ্চারিত হলে চলবে না। চতুর্থত, তাৎপর্য, অর্থাৎ বাক্যের দ্বারা নির্দেশিত বস্তুর সঙ্গে বাক্য সঙ্গতিপূর্ণ হবে। যেমন, খেতে বসে ‘সৈন্ধব’ আনতে বললে লবণের কথা বুঝতে হবে, ঘোড়ার কথা নয়। যদিও ঘোড়ার আরেক নাম সৈন্ধব। তাৎপর্য হলো বক্তার উদ্দীষ্ট ও বাক্য দ্বারা নির্দেশিত বস্তুর অনুরূপতা।

বাক্য শব্দ বা পদ নিয়ে গঠিত। পদ ধ্বনি নিয়ে গঠিত। অদ্বৈত বেদান্ত মতে, ধ্বনি সৃষ্ট নয় বরং প্রকাশিত। ধ্বনির আকার শাশ্বত। শুধু এর প্রকাশ একটি বিশেষ সময়ে। এভাবে শব্দও শাশ্বত। ঈশ্বর একে স্মরণ করেন ও আমাদের কাছে প্রকাশ করেন। বেদ হলো এরূপ শব্দ। তাই তা শাশ্বত ও শাশ্বত সত্যের প্রকাশক। বৈদিক শব্দ স্বতঃপ্রমাণিত।

(৪) উপমান : সাদৃশ্য জ্ঞানের উপায়কেই উপমান বলা হয়। অদ্বৈত বেদান্ত নির্দেশিত উপমানের প্রকৃতি মীমাংসা উপমানের অনুরূপ।৪১ পূর্বপ্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বর্তমানে প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুর জ্ঞানকে উপমান বলে। এ ধরনের জ্ঞান প্রত্যক্ষ বা অনুমান দ্বারা নয় বরং কেবলমাত্র উপমান দ্বারাই লাভ করা যায়। তাই জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র উপায় হলো উপমান। যেমন, বর্তমানে প্রত্যক্ষত ‘ক’ যদি পূর্বে প্রত্যক্ষিত ‘খ’-এর সদৃশ হয় তবে আমাদের এই জ্ঞান হয় যে, ‘ক’ হয় ‘খ’ সদৃশ্য। এতে ক-এর সঙ্গে খ এর সাদৃশ্যের উপলব্ধি জন্মে। এটি ব্যাপ্তি দ্বারা অনুমিত বা প্রত্যক্ষিত নয়। কারণ, এখানে শুধু ক-ই প্রত্যক্ষিত হয়।

(৫) অর্থাপত্তি : মীমাংসা জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট অর্থাপত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষিত বিষয়ের অসঙ্গতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য অপ্রত্যক্ষিত বিষয়ের পূর্বধারণা করাকে অর্থাপত্তি বলেছেন। অদ্বৈত বেদান্ত নির্দেশিত অর্থাপত্তির প্রকৃতি কুমারিল ভট্ট নির্দেশিত অর্থাপত্তির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।৪২ কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতে, অর্থাপত্তি হলো সিদ্ধান্ত, অনুগ বা ফল থেকে আশ্রয় বাক্য, পূর্বগ বা কারণের পূর্বধারণা। এটি জ্ঞাত কোনো তথ্য থেকে একটি প্রকল্প গঠনের মতো।৪৩ সুতরাং, অর্থাপত্তিতে কার্য বা ফল জ্ঞাত থাকে। কারণ সম্পর্কে পূর্বধারণা করা হয়।

(৬) অনুপলব্ধি : অদ্বৈত বেদান্ত মতে, অনুপলব্ধি হলো এমন একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ যার মাধ্যমে অনস্তিত্বের জ্ঞান পাওয়া যায়। অনস্তিত্বের জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষযোগ্য কোনো কিছুর অনস্তিত্ব জ্ঞান। অদ্বৈত বেদান্ত নির্দেশিত অনুপলব্ধি প্রমাণের প্রকৃতি মীমাংসা কুমারিল ভট্ট নির্দেশিত অনুপলব্ধির অনুরূপ।৪৪

উল্লেখ্য যে, মীমাংসা দার্শনিক প্রভাকর মিশ্র অনস্তিত্বকে শূন্য আধারের প্রত্যক্ষের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্টের সঙ্গে একমত হয়ে প্রভাকর মিশ্রের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে একথা বলা হয় যে, যদি পানি-পাত্রের অনস্তিত্বের জ্ঞান পানি-পাত্রহীন শূন্যস্থানের জ্ঞানের সঙ্গে অভিন্ন হয় তবে পানি-পাত্র যখন উপস্থিত তখনও তা প্রত্যক্ষ করা যাবে। তবে, অদ্বৈত বেদান্তে একথা মনে করা হয় যে, কোনো বস্তুর অনস্তিত্ব ঐ বস্তুর আধেয় অর্থাৎ যেখানে বস্তুটি ছিল সে স্থানের জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, জগতের অবভাস ব্রহ্মের আধেয় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, অনস্তিত্বের জ্ঞান অনুপলব্ধির দ্বারাই ঘটে। আধেয়কে প্রত্যক্ষ করা থেকে এই জ্ঞান পাওয়া যায় না।

বেদান্ত দর্শনে চার প্রকার অনস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে।৪৫ এগুলো হলো : (ক) প্রাক-অনস্তিত্ব, অর্থাৎ নির্দিষ্ট আকার লাভের আগে উপাদানের মধ্যে কোনো বস্তুর অনস্তিত্ব; (খ) পরবর্তী অনস্তিত্ব, অর্থাৎ বস্তুর ধ্বংসের পরে এর অনস্তিত্ব; (গ) পারস্পরিক অনস্তিত্ব, অর্থাৎ একটি বস্তুতে অন্যটির অনস্তিত্ব; যেমন, ব্রহ্মে জগতের সত্তার অনস্তিত্ব, এবং (ঘ) পরম অনস্তিত্ব, অর্থাৎ সর্বকালীন ও সর্বজনীন অনস্তিত্ব। যেমন, বায়ুতে রং-এর অনস্তিত্ব। অদ্বৈত বেদান্ত মতে, এই চার প্রকার অভাবের যে কোনোটি অনুপলব্ধির বিষয় হতে পারে।

জ্ঞানের প্রামাণ্য : শঙ্করের মতে, সঙ্গতিই হলো সত্যতার মানদণ্ড। অবশ্য সঙ্গতি ছাড়াও তিনি অনুরূপতা ও প্রায়োগিক উপযোগিতাকে সত্যতার মানদণ্ড বলে স্বীকার করেছেন। তার মতে, সঙ্গতি তত্ত্বজ্ঞানের এবং অনুরূপতা ও প্রায়োগিক উপযোগিতা ব্যবহারিক জ্ঞানের সত্যতার মানদণ্ড। শঙ্কর নির্দেশিত তত্ত্বজ্ঞানের সত্যতার মানদণ্ড জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্যকে এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের সত্যতার মানদণ্ড জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্যকে নির্দেশ করে। সুতরাং তত্ত্বজ্ঞান বা বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রামাণ্য জ্ঞানের মধ্যে নিহিত, বাইরের কোনো শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়। ফলে, দেখা যায়, অদ্বৈত বেদান্ত নির্দেশিত জ্ঞানের প্রামাণ্য মীমাংসা জ্ঞানের প্রামাণ্য সম্পর্কিত মতের অনুরূপ। কারণ, মীমাংসা দর্শনেও জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে।

অদ্বৈত বেদান্ত প্রমাণতত্ত্ব সম্পর্কে উপরের আলোচনায় দেখা যায়, বেদের কর্মকাণ্ডের অনুসারী মীমাংসা দর্শনে স্বীকৃত সবগুলো প্রমাণ বেদান্ত দর্শনে স্বীকার করা হয়েছে, এছাড়া অনেকগুলো প্রমাণের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বেদান্ত দার্শনিকগণ ভাট্ট-মীমাংসকদের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেছেন। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম–মোক্ষের এই তিনটি উপায়ের কথা ভারতীয় দর্শনে সাধারণভাবে স্বীকৃত হলেও বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় জ্ঞান বা ভক্তি বা কর্মের প্রাধান্য দিয়েছে। উপনিষদের নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদের দার্শনিক প্রবক্তা বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র গ্রন্থে এবং এর অনুসারী অদ্বৈত বেদান্তে কর্ম ও ভক্তির তুলনায় জ্ঞানকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত আলোচিত বেদান্ত প্রমাণতত্ত্ব ছকের সাহায্যে নিম্নে দেখানো গেল।

ছকে বেদান্ত প্রমাণতত্ত্ব
ছকে বেদান্ত প্রমাণতত্ত্ব

 ন্যায় জ্ঞানবিদ্যা

ন্যায় দর্শনে বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা হলেও এ দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত।৪৬ ষড়দর্শনের অন্যান্য প্রধান মতবাদসমূহের মতো ন্যায় দর্শনেও মোক্ষের উপর যথেষ্ঠ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োজন। ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি গৌতম তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য যে ষোল প্রকার পদার্থের জ্ঞান প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন এগুলোর মধ্যে প্রমাণ হলো প্রথম পদার্থ। তাই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব কি-না তা নির্ধারণের জন্য যথার্থ জ্ঞানের পদ্ধতি বা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা ন্যায় দর্শনে যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। তাই ন্যায় তত্ত্ববিদ্যা, মুক্তিতত্ত্ব ইত্যাদি ন্যায় জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ন্যায় দর্শন সবিস্তারে জ্ঞানপদ্ধতি ও জ্ঞানপ্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করেছে এবং সংশয়বাদ যে যুক্তিসিদ্ধ নয় তা প্রমাণ করেছে। এ কারণেই ন্যায় দর্শন জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক।৪৭

যথার্থ জ্ঞানলাভের পদ্ধতি বা প্রমাণ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করে বলে ন্যায় দর্শনকে প্রমাণশাস্ত্রও বলা হয়। ন্যায় জ্ঞানবিদ্যায় প্রমা বা বৈধজ্ঞানের প্রকৃতি, প্রমাণ বা বৈধজ্ঞানের উপায়, জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য, সত্যতার যাচাইনীতি ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। ন্যায় জ্ঞানবিদ্যা অনুসারে জ্ঞাতা বা প্রমাতৃ, জ্ঞেয় বা প্রমেয়, প্রমাণ এবং প্রমা মিলেই সত্তা গঠন করে। ন্যায়সূত্র গ্রন্থের ভাষ্যকার বাৎসায়ন যে জ্ঞান বস্তুর যথার্থ প্রকৃতির অনুরূপ সে জ্ঞানকেই প্রমা বা বৈধজ্ঞান বলেছেন। যে জ্ঞান বস্তুর যথার্থ প্রকৃতির অনুরূপ নয় সে জ্ঞান হলো অপ্রমা। অর্থাৎ অনুরূপতাই যথার্থ জ্ঞানের মানদণ্ড।

ন্যায় দর্শনে চারটি প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে। যথা, প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ।৪৮ এছাড়া ন্যায় দর্শনে অপ্রমাও চার প্রকার। যথা, বিপর্যয়, স্মৃতি, তর্ক ও সংশয়। এখানে চার প্রকার প্রমাণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো ।

(১) প্রত্যক্ষ : ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষকে আত্মার কার্য বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষে প্রথম আত্মার সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটে। এরপর মনের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর সংযোগ প্রত্যক্ষ হয়। ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম ন্যায়সূত্র গ্রন্থে প্রত্যক্ষের যে সংজ্ঞা দেন তা মীমাংসা প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার সঙ্গে অভিন্ন।৪৯ গৌতমের সংজ্ঞানুসারে প্রত্যক্ষে চারটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত। যথা, ইন্দ্রিয়, বস্তু, ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সন্নিকর্ষ, এবং সন্নিকর্ষ থেকে উৎপন্ন জ্ঞান। তাই গৌতমের সংজ্ঞানুসারে যা প্রত্যক্ষযোগ্য নয় তার জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা লাভ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যোগীদের ইন্দ্রিয় বহির্ভূত প্রত্যক্ষের জ্ঞান গৌতমের প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় অনুপস্থিত। কিন্তু পরবর্তী নব্য-নৈয়ায়িক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গেশ উপাধ্যায় প্রত্যক্ষকে সাক্ষাৎ সচেতনতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।৫০ নব্য-নৈয়ায়িক ভরদ্বাজ প্রত্যক্ষ বলতে সাক্ষাৎ বৈধ জ্ঞানকে বুঝান। পরবর্তী নব্য-নৈয়ায়িক বিশ্বনাথ ন্যায় পঞ্চানন অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা নির্দেশিত নয় এমন সাক্ষাৎ জ্ঞানকেই প্রত্যক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।৫১ নব্য-নৈয়ায়িকদের সঙ্গে গৌতমের প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার পার্থক্য হলো, গৌতম প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি অনিবার্য মনে করেন। কিন্তু নব্য-নৈয়ায়িকগণ প্রত্যক্ষের জন্য ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন না। প্রত্যক্ষের এই সংজ্ঞাগুলো যোগজপ্রত্যক্ষণসহ মানুষের সকল প্রকার প্রত্যক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করে।

ন্যায় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্থান সর্বপ্রধান। বাৎসায়নের মতে, যখন কোনো ব্যক্তি বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো জ্ঞান পায় তখন কোনো একটি বিশেষ লক্ষণের মাধ্যমে আরোহাত্মক অনুমান দ্বারা এই জ্ঞানকে যাচাই করার বাসনা তার মধ্যে থেকে যায়। আবার অনুমান দ্বারা যাচাই হয়ে গেলে তার মধ্যে বিষয়টিকে চোখে দেখার বাসনা থাকে। কিন্তু প্রত্যক্ষ করার পর তার মধ্যে অন্য কোনোভাবে জ্ঞান নেবার আর বাসনা থাকে না। এছাড়া অনুমান, উপমান, শব্দ, সবই প্রত্যক্ষনির্ভর। যেমন, যাকে আগে দেখি নাই তাকে অনুমান করা যায় না। দুটি জিনিসকে প্রত্যক্ষ না করলে উপমান অসম্ভব। শব্দের ক্ষেত্রেও আগে শব্দ শুনতে হয়। সুতরাং শ্রবণও এক প্রকার প্রত্যক্ষ।

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : মীমাংসা দার্শনিকদের মতো ন্যায় দার্শনিকগণও নির্বিকল্প ও সবিকল্প, এই দুই প্রকার প্রত্যক্ষ স্বীকার করেন। ন্যায় দর্শনে প্রত্যাভিজ্ঞাকে প্রত্যক্ষের একটি প্রকার হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। গঙ্গেশ লৌকিক ও অলৌকিক এই দুই প্রকার প্রত্যক্ষের কথা বলেন। লৌকিক প্রত্যক্ষ বলতে তিনি সবিকল্প ও নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকে বুঝিয়েছেন। অলৌকিক প্রত্যক্ষকে তিনি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেন। সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ প্রত্যক্ষ। সুতরাং ন্যায় দর্শনে মোট প্রত্যক্ষ হলো ছয় প্রকার। যথা, নির্বিকল্প, সবিকল্প, প্রত্যাভিজ্ঞা, সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ প্ৰত্যক্ষ

নির্বিকল্প, সবিকল্প ও প্রত্যাভিজ্ঞা প্রত্যক্ষ : নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে প্রাচীন ও নব্য-ন্যায় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষিত হয়। প্রাচীন নৈয়ায়িকগণ নির্বিকল্প প্ৰত্যক্ষ বলতে অসংজ্ঞায়নযোগ্য ও নামহীন প্রত্যক্ষকে বোঝান। প্রত্যক্ষের একটি স্তরে কোনো বস্তু তার দ্রব্য, গুণ, কার্য ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা যেভাবে গুণান্বিত থাকে সেভাবে বস্তুটিকে উপলব্ধি করা যায়। অথচ এর কোনো নামকরণ করা যায় না। এরূপ প্রত্যক্ষকে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলে। কোনো বস্তুকে উপরোক্ত সকল গুণাবলির দ্বারা উপলব্ধি করে সে বস্তুর নাম দিতে পারাকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ বলে।৫২ নব্য-নৈয়ায়িকগণ নির্বিকল্প ও সবিকল্প প্রত্যক্ষের যে সংজ্ঞায়ন করেছেন তা মীমাংসা দার্শনিকদের নির্বিকল্প ও সবিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার সঙ্গে অভিন্ন।৫৩ ন্যায় দার্শনিকদের মতে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ হলো সকল জ্ঞানের সূচনাবিন্দু। তবে সঠিক অর্থে তা নিজে জ্ঞান নয়।৫৪

প্রত্যাভিজ্ঞা হলো পূর্ব প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুকে পূর্ব প্রত্যক্ষিত বলে প্রত্যয়ন করতে পারা। এতে প্রত্যক্ষ ও স্মৃতি উভয় উপাদান অন্তর্ভুক্ত। ইন্দ্রিয় ও বস্তুর সংযোগ এর প্রধান কারণ এবং স্মৃতির উপাদান সংস্কার এর সহযোগী কারণ।

সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ প্রত্যক্ষ : নব্য-নৈয়ায়িক গঙ্গেশ-এর মতে, যখন কোনো বিষয়ের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে সে বিষয়ের জাতিগত লক্ষণসমূহ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সাধারণভাবে বিষয়টিকে প্রত্যক্ষ করা হয় তখন তাকে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলে। যেমন, সাধারণভাবে যখন আমরা ধোয়া প্রত্যক্ষ করি তখন এর জাতিগত লক্ষণ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সমস্ত ধোয়াকেই প্রত্যক্ষ করি। কোনো ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের সময় যদি উক্ত। বিষয় সম্পর্কিত কোনো পূর্ব প্রত্যক্ষিত জ্ঞানের স্মৃতি জাগ্রত হয় তবে তাকে জ্ঞানলক্ষণ প্রত্যক্ষ বলে। যেমন, বরফের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের সময় শীতলতার পূর্বসংবেদনের স্মৃতিজ্ঞান। ঘটে। জ্ঞানলক্ষণ পূর্বপ্রত্যক্ষ নির্ভর। যোগ সাধনালব্ধ অলৌকিক শক্তির সাহায্যে যোগীদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, দূরবর্তী ও অতিসূক্ষ্ম বস্তুকে সমানভাবে প্রত্যক্ষ করাকে যোগজ প্রত্যক্ষ বলে। এই প্রত্যক্ষ স্বজ্ঞাজাত, তাই অলৌকিক। সামান্যলক্ষণ, জ্ঞানলক্ষণ ও যোগজ প্রত্যক্ষ হলো বিশেষ সন্নিকর্ষের মাধ্যম।

প্রাচীন ও নব্য উভয় ন্যায় দার্শনিকগণই সবিকল্প প্রত্যক্ষকে বৈধ বলে স্বীকার করেন।৫৫ তবে প্রাচীন নৈয়ায়িকগণ নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকে সবিকল্প প্রত্যক্ষের উপায় হিসেবে বৈধ বলেছেন।৫৬ নব্য-নৈয়ায়িকগণ নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকে বৈধ বা অবৈধ কিছুই বলেননি। কেননা নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ এর বিষয়বস্তু ও গুণাবলির মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা সম্পর্ককে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়।

(২) অনুমান : ন্যায় দর্শনে অনুমানের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা মীমাংসা দার্শনিক শবরস্বামী প্রদত্ত অনুমানের সংজ্ঞার অনুরূপ।৫৭ ন্যায় মতে, অনুমানের ক্ষেত্রে প্রথমে পক্ষের মধ্যে হেতু বা চিহ্ন বা লিঙ্গ বা কারণকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। দ্বিতীয় স্তরে এই কারণ বা লিঙ্গের সঙ্গে সাধ্য বা বিধেয়ের নিয়ত সম্পর্কের প্রত্যাভিজ্ঞা হয়; এবং তৃতীয় স্তরে পক্ষের মধ্যে অপ্রত্যক্ষিত বিধেয় বা সাধ্যের বা লিঙ্গের উপস্থিতির অনুমান করা হয়। এই ধরনের অনুমান ব্যক্তির নিজের জন্য করা হয়। অনুমানের এই ব্যাখ্যা হলো মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির ব্যাখ্যা। অনু’ শব্দের অর্থ পশ্চাৎ, ‘মান’ শব্দের অর্থ জ্ঞান। তাই ‘অনুমান’ বলতে ন্যায় দার্শনিকগণ এমন জ্ঞানকে বুঝান যা অন্য কোনো জ্ঞান অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরে আসে।

অনুমানের শ্রেণিবিভাগ : তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায় দর্শনের অনুমানকে মোট সাত ভাগে ভাগ করা যায়। উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে ন্যায় অনুমান দুই প্রকার। যথা, স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কের প্রকৃতির ভিত্তিতে ন্যায় অনুমান তিন প্রকার। যথা, পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট। হেতু ও সাধ্যের মধ্যেকার ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির ভিত্তিতে ন্যায়ের অনুমান তিন প্রকার। যথা, কেবলান্বয়ী, কেবলব্যতিরেকী এবং অন্বয়ব্যতিরেকী।

স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান : উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে ন্যায় অনুমানকে স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান, এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। জ্ঞাতা নিজের জন্য যে অনুমান করেন তা স্বার্থানুমান। স্বার্থানুমান প্রকাশের প্রয়োজন হয় না। নব্য-নৈয়ায়িক অনুংভট্টের মতে, এই অনুমান হলো ব্যক্তির নিজের জন্য অনুমানের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া।৫৮ অন্যদিকে, যখন অপরকে বোঝানোর জন্য কোনো অনুমান করা হয় তখন তাকে পরার্থানুমান বলে। এই অনুমান প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়।৫৯ প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন এই পাঁচটি বাক্য বা অবয়বে পরার্থানুমান প্রকাশিত হয়। এই অনুমানের তিনটি পদ থাকে। সাধ্য, পক্ষ ও হেতু। এর সিদ্ধান্তে অনুমানের পাঁচটি অবয়বকে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে পক্ষের মধ্যে সাধ্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়। এই ধরনের অনুমানকে ভারতীয় দর্শনে ন্যায় অনুমান বলে।৬০

সুতরাং দেখা যায়, উদ্দেশ্যের দিক থেকে মীমাংসা ও ন্যায় স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান পরস্পরের অনুরূপ হলেও অবয়বের প্রকৃতির দিক থেকে মীমাংসা ও ন্যায় স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান ভিন্ন। কারণ, মীমাংসা স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান তিনটি অবয়ব দ্বারা গঠিত, অথচ ন্যায় স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানকে অবয়ব পাঁচটি। বেদান্ত দর্শনেও এই দুই প্রকার অনুমানকে স্বীকার করা হয়েছে। পার্থক্য হলো, ন্যায় দর্শনে পরার্থানুমানের অবয়ব পাঁচটি। পক্ষান্তরে, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে পরার্থানুমানের অবয়ব তিনটি। এই অবয়ব তিনটি, হলো, প্রতিজ্ঞা, হেতু ও উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন।

পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান : গৌতম তার ন্যায়সূত্র গ্রন্থে পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট–এই তিন প্রকার অনুমানের কথা বলেন। হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্কের প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে অনুমানকে এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যখন প্রত্যক্ষ কারণের ভিত্তিতে অপ্রত্যক্ষ কার্যের অনুমান করা হয় তখন তাকে পূর্ববৎ অনুমান বলে। যেমন, আকাশের মেঘ দেখে বৃষ্টি হবে এই অনুমান করা। পূর্ব-অভিজ্ঞতাই এ অনুমানের ভিত্তি। যে অনুমানে কার্যকে প্রত্যক্ষ করে অপ্রত্যক্ষ কারণ সম্পর্কে অনুমান করা হয় সে অনুমান শেষবৎ অনুমান। যেমন, নদীর স্রোতের প্রখরতা দেখে অতিবৃষ্টির অনুমান। আবার, যখন কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষিত নয় বরং পূর্ব-অভিজ্ঞতা ও সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষিত চিহ্ন থেকে অপ্রত্যক্ষিত বস্তুকে অনুমান করা হয় তখন তা সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। এতে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপ্তিসম্পর্ক থাকে। তবে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না। যেমন, শিংযুক্ত প্রাণী দেখে তার দ্বিখণ্ডিত ক্ষুর অনুমান।

বাৎসায়ন এই তিন প্রকার অনুমানের অন্য তিনটি অর্থের কথা বলেন।৬১ পূর্ববৎ অনুমান হলো পূর্বজ্ঞাত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল অনুমান। অর্থাৎ যেখানে কারণের দ্বারা কার্য অনুমিত হয়। শেষবৎ অনুমান হলো অপনয়ন বা পরিশেষ পদ্ধতিনির্ভর অনুমান। এখানে কার্যের দ্বারা কারণ অনুমিত হয়। সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান হলো প্রত্যক্ষযোগ্য চিহ্ন থেকে অপ্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর অনুমান। এখানে চিহ্ন ও বস্তুর সম্পর্ক প্রত্যক্ষিত নয়।

কেবলায়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান : গঙ্গেশ অনুমানকে অন্য যে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন তা হলো, কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী এবং অন্বয় ব্যতিরেকী।৬২ হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির ভিত্তিতে এ তিনটি ভাগ করা হয়।

যে অনুমানে কেবল হেতু ও সাধ্যের অন্বয়ের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় তাকে কেবলান্বয়ী অনুমান বলে। এতে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে শুধুমাত্র অন্বয়-ব্যাপ্তি থাকে। কোনো প্রকার বিরূদ্ধ-ব্যাপ্তি থাকে না। এই অনুমানের সাধ্য ও পক্ষ আশ্রয় বাক্য এবং সিদ্ধান্ত সদর্থক। এরিস্টটলীয় সহানুমানের প্রথম সংস্থানের (BARBARA) মূর্তির সঙ্গে কেবলান্বয়ী অনুমানের তুলনা করা যেতে পারে। যখন হেতু ও সাধ্যের মধ্যে কেবলমাত্র নঞর্থক ব্যাপ্তি সম্পর্ক থাকে বা ব্যতিরেকী সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা হয় তখন তা কেবল ব্যতিরেকী অনুমান। এতে হেতু ও সাধ্যের অনুপস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই অনুমানের সাধ্য আশ্রয় বাক্য সার্বিক নঞর্থক, পক্ষ আশ্রয় বাক্য এবং সিদ্ধান্ত সার্বিক সদর্থক হয়। তাই এর অনুরূপ বৈধ কোনো মূর্তি পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যায় পাওয়া যায় না

যেমন, কোনো বস্তু যা পানি, আগুন, বায়ু ও আকাশ থেকে পৃথক নয় তার গন্ধ নাই
মাটি হয় এমন বস্তু যার গন্ধ আছে
সুতরাং মাটি হয় এমন বস্তু যা উক্ত চারটি পদার্থ থেকে পৃথক ।

যে অনুমানে হেতু ও সাধ্যের মধ্যে অন্বয় ও ব্যতিরেকী উভয় প্রকার সম্পর্কের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় সে অনুমানই অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমান। এতে পূর্ববর্তী ক্ষেত্রে অন্বয়ী পদ্ধতি এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে ব্যতিরেকী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে অন্বয়ী দৃষ্টান্তে হেতু উপস্থিত।৬৩ কিন্তু, ব্যতিরেকী দৃষ্টান্তে হেতু অনুপস্থিত থাকে। যেমন,

সকল মানুষ হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন।
রহিম হয় একজন মানুষ ।
সুতরাং, রহিম হয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন
কোনো জীব, যে মানুষ নয় সে নয় বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন।
রহিম হয় একজন মানুষ ।
সুতরাং, রহিম হয় বিচারবুদ্ধিহীন।

উল্লেখ্য যে, ন্যায় দর্শনের কেবলান্বয়ী, কেবল-ব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানের মতো পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিলের অন্বয়ী, ব্যতিরেকী ও অন্বয় ব্যতিরেকী–এই তিন প্রকার অনুমানকে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে অস্বীকার করা হয়েছে। অদ্বৈত বেদান্ত মতে, কেবলান্বয়ী অনুমান বলে কোনো অনুমান নেই। কারণ, ব্রহ্ম হলো সকল বিসদৃশ সত্তার স্থায়ী ভিত্তি। সকল বস্তুর নাস্তিকতা এতে অস্তিত্বশীল। অন্বয়-ব্যতিরেকী বলেও কোনো অনুমান নেই। কারণ, এর আংশিক ভিত্তি ব্যতিরেকী ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমানের কারণ হতে পারে না। আবার কেবল-ব্যতিরেকী বলেও কোনো অনুমান নেই। কারণ, সাধ্য ও পক্ষ-পদের নিয়ত অনুপস্থিতির সম্পর্ক অনুমানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। শঙ্করাচার্যের মতে, কেবল-ব্যতিরেকী অনুমান মূলত অর্থাপত্তি। ন্যায় দর্শন নির্দেশিত উপর্যুক্ত তিন প্রকার অনুমানের স্থলে বেদান্ত দর্শন শুধু অন্বয়ীরূপ অনুমানের কথা বলে ।

(৩) উপমান : ন্যায় মতে, উপমান হলো তৃতীয় প্রমাণ। প্রসিদ্ধ বা পূর্বপরিচিত বস্তুর সঙ্গে সাদৃশ্য দ্বারা অপ্রসিদ্ধ বা অপরিচিত নতুন বস্তুর জ্ঞানলাভই হলো উপমান।৬৪ কোনো বস্তুর বিশদ বিবরণকে সংজ্ঞা, সংজ্ঞা দ্বারা যে বস্তু নির্দেশিত হয় তাকে সঙ্গি, এবং সংজ্ঞা ও সঙ্গির সম্বন্ধ দ্বারা যে জ্ঞান হয় তাকে উপমান জ্ঞান বা উপমিতি বলে। যেমন, কোনো ব্যক্তি পূর্বে নীলগাই বা গবয় দেখে নি। একজন অরণ্যবাসী তাকে বলল, গবয় গরু সদৃশ। এটা সংজ্ঞা। সে ব্যক্তি বনে গিয়ে একটি প্রাণী প্রত্যক্ষ করল যার সঙ্গে গরুর সাদৃশ্য আছে। এই প্রাণী হলো সঙ্গি। সংজ্ঞা ও সঙ্গির মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপন করে জ্ঞান হলো যে, প্রাণীটি গবয় । এই জ্ঞান উপমান। গৌতমের মতে, কোনো অপরিচিত বস্তুর সঙ্গে পরিচিত বস্তুর সাদৃশ্যের উপরই উপমান নির্ভরশীল। এই সাদৃশ্য একটি অপরিচিত বস্তুর সঙ্গে একটি বিশেষ নামের বা সংজ্ঞার সম্পর্ক নির্দেশ করে। এতে যা উপলব্ধি করা হয় তা প্রত্যক্ষ, অনুমান বা শব্দ দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না।

ন্যায়ের উপমানে পাঁচটি উপাদান থাকে।৬৫ (১) পূর্বে অপ্রত্যক্ষিত অপরিচিত বস্তুর প্রত্যক্ষণ; (২) অন্য একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি যিনি উভয় বস্তুই দেখেছেন এবং উভয়ের সাদৃশ্য সম্বন্ধে জানেন সে ব্যক্তির কাছ থেকে শব্দ-জ্ঞানের মাধ্যমে শুনে অপরিচিত বস্তুর সঙ্গে পরিচিত বস্তুর সাদৃশ্যের পরোক্ষ জ্ঞান; (৩) পরিচিত বস্তুর সঙ্গে অপরিচিত বস্তুর সাদৃশ্য জ্ঞানের প্রত্যক্ষণ; (৪) বিশ্বস্ত ব্যক্তির প্রত্যাভিজ্ঞা; এবং (৫) প্রত্যক্ষিত অপরিচিত বস্তু অর্থাৎ সৃঙ্গি ও তার নাম বা সংজ্ঞার মধ্যে সম্পর্কের জ্ঞান। একে বলে উপমিতি। এই সাদৃশ্যজ্ঞানে স্মৃতি ও প্রত্যক্ষ অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়ে সংজ্ঞা বা উক্তি থেকে যে জ্ঞান আহরিত হয় তা স্মৃতি, এবং প্রত্যক্ষিত প্রাণী জ্ঞান হলো প্রত্যক্ষ।

পরবর্তী নৈয়ায়িক গঙ্গেশ প্রদত্ত উপমানের সংজ্ঞা গৌতম প্রদত্ত উপমানের সংজ্ঞা থেকে ব্যাপকতর। গঙ্গেশের মতে, উপমান হলো এমন একটি জ্ঞান যেখানে একটি শব্দ একটি অপরিচিত বস্তুর জাতিগত লক্ষণকে প্রকাশ করে এবং এই জাতিগত লক্ষণের সঙ্গে একটি পরিচিত বস্তুর মিল ও অমিল খুঁজে পাওয়া যায়।৬৬ তাঁর মতে, গবয় কোনো বিশেষ বস্তুর নাম নয়, বরং এটি একটি বস্তুর জাতিগত লক্ষণ নির্দেশ করে।

উপমানের শ্রেণিবিভাগ : উদয়নাচার্য এবং বৈদিক ভাষ্যকার বাচস্পতি মিশ্র দুই প্রকার উপমানের কথা বলেন। স্বধর্মোপমান বা সাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান। বিধর্মোপমান বা বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান। গঙ্গেশও এই দুই প্রকার উপমানের কথা বলেন।৬৭

যখন সংজ্ঞা ও সঙ্গির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান জ্ঞান সাধিত হয় তখন তা স্বধর্মোপমান। যেমন, গবয় গরুসদৃশ্য। আবার যখন বৈসাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে উপমান জ্ঞান সাধিত হয় তখন তা বিধর্মোপমান। যেমন, ঘোড়া গরুর মতো নয়।

ভরদ্বাজ এই দুই প্রকার উপমান ছাড়াও আরেক প্রকার উপমানের কথা বলেন। এতে নির্দিষ্ট গুণাবলির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান সাধিত হয়। যেমন, ঘাড় লম্বা ও গলা ঝুলন্ত চতুষ্পদ জন্তুই উট–ভারতের উত্তর প্রদেশের একজন লোকের এই উক্তি থেকে দক্ষিণ প্রদেশের একজন লোকের উট সম্পর্কে জ্ঞানই হলো এই প্রকার উপমান। কিন্তু বাচস্পতি মিশ্রের মতে, এই ধরনের উপমান বিধর্মোপমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

মীমাংসা ও ন্যায় উপমানের পার্থক্য : মীমাংসা ও ন্যায় উপমানের দুটি পার্থক্য দেখা যায়; (১) মীমাংসা উপমানে স্মৃতিতে অধিষ্ঠিত বস্তুর সঙ্গে প্রত্যক্ষিত বস্তুর সাদৃশ্য দেখা হয়, কিন্তু ন্যায় উপমানে সংজ্ঞা বা প্রসিদ্ধ বস্তুর বিবরণের সঙ্গে সঙ্গি বা সংজ্ঞা নির্দেশিত বস্তুর জ্ঞানের সাদৃশ্য দেখা হয়। (২) মীমাংসা উপমানে কেবলমাত্র সাদৃশ্যের ভিত্তিতে উপমান জ্ঞান হয়। কিন্তু ন্যায় উপমানে কোনো কোনো সময়ে বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতেও উপমান সাধিত হয়।

পাশ্চাত্য সাদৃশ্যানুমান ও ন্যায় উপমানের মধ্যে পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যায় সাদৃশ্যমূলক অনুমান ও ন্যায়ের উপমান উভয়ই সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সাধিত হলেও তিন দিক থেকে.এদের পার্থক্য আছে। (১) সাদৃশ্যানুমান শব্দ জ্ঞান নির্ভর নয়, কিন্তু উপমান শব্দ-জ্ঞান নির্ভর। (২) সাদৃশ্যানুমান লিঙ্গ ও লিঙ্গির সম্বন্ধ নয়, কিন্তু উপমান লিঙ্গ ও লিঙ্গির সম্বন্ধ জ্ঞান। (৩) সাদৃশ্যানুমানে কখনও বৈসাদৃশ্যের উপর নির্ভর করা হয় না। কিন্তু উপমানে কোনো কোনো সময় বৈসাদৃশ্যের উপর নির্ভর করা হয়।

(৪) শব্দ : ন্যায় দর্শনের চতুর্থ বা শেষ প্রমাণ হলো শব্দ। গৌতম শব্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তির নৈতিক নিয়ম বা ধর্ম সম্পর্কে সাক্ষাৎ জ্ঞান আছে এবং যে ব্যক্তি অন্যান্য মানুষের পাপমুক্তি ও পুণ্যলাভের পথ প্রদর্শন করতে পারে সে ব্যক্তিই বিশ্বস্ত বা আপ্ত ব্যক্তি, এবং তার বচনই আপ্ত বচন বা শব্দ। এসব ব্যক্তি বস্তুর যথার্থ স্বরূপের জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম।৬৮ বাক্য বা বচনের মাধ্যমে শব্দ-জ্ঞান প্রকাশিত হয়। বচনের জ্ঞানই হলো। প্রমাণ এবং বচনের জ্ঞানের অর্থ উপলব্ধিই হলো প্রমিতি। উল্লেখ্য যে, ন্যায় মতে, প্রত্যক্ষণ হলো ইন্দ্রিয় ও বস্তুর পারস্পরিক সংযোগের জ্ঞান; অনুমান হলো ব্যাপ্তি-জ্ঞান, উপমান সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের জ্ঞান এবং শব্দ হলো বাক্য বা শব্দের জ্ঞান।

মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট মানবীয় ও অতিমানবীয় শব্দ-জ্ঞানের কথা বলেন। প্রভাকর মিশ্র শুধুমাত্র বৈদিক শব্দের কথা বলেন, কিন্তু ন্যায় শব্দ প্রমাণ মানবীয়। ন্যায় শব্দ প্রমাণকে যথার্থ হওয়ার জন্য এর প্রায়োগিক মূল্য থাকতে হবে। অর্থাৎ তা শ্রোতার পাপমুক্তির পথ নির্দেশ করবে। মীমাংসা শব্দ প্রমাণের এই প্রায়োগিক গুরুত্ব নাই।

শব্দের শ্রেণিবিভাগ : প্রাচীন ও নব্য-ন্যায় মিলে ন্যায় শব্দ প্রমাণকে মোট চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন নৈয়ায়িকগণ শব্দের বিষয়বস্তুর প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে শব্দ প্রমাণকে দুইভাগে ভাগ করেন। যথা, প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর শব্দ ও অপ্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর শব্দ। অন্যদিকে, শব্দকর্তার প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে নব্য-নৈয়ায়িকগণ শব্দকে দুইভাগে ভাগ করেন। যথা, লৌকিক শব্দ ও বৈদিক শব্দ।

প্রাচীন ন্যায় দার্শনিকগণ শব্দকে প্রত্যক্ষযোগ্য ও অপ্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর শব্দ–এই দুই ভাগে ভাগ করেন।৬৯ শব্দের বিষয়বস্তুর প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে এই পার্থক্য করা হয়। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তু সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির বচনকে প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর শব্দ এবং ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির বচনকে অপ্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর শব্দ বলে। প্রথম প্রকার শব্দজ্ঞানের বিষয়বস্তু এ জগতে পাওয়া যায়, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার শব্দজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে এ জগতে পাওয়া যায় না। পরজগতে অর্থাৎ স্বর্গ, নরক বা পরজন্মে এ ধরনের শব্দজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে পাওয়া যায়।৭০

নব্য-নৈয়ায়িকগণ দুই ধরনের শব্দ প্রমাণের কথা বলেন। এগুলো হলো, লৌকিক শব্দ ও বৈদিক শব্দ।৭১ শব্দকর্তার প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে এ বিভাগ করা হয়। লৌকিক শব্দ ব্যক্তি মানুষের বচন। বিশ্বস্ত ব্যক্তির বচন হলে তা বৈধ এবং অবিশ্বস্ত ব্যক্তির বচন হলে তা অবৈধ। সুতরাং লৌকিক শব্দের বৈধতা স্বতঃপ্রমাণিত নয়, বরং ব্যক্তির চরিত্রের বিশ্বস্ততার উপর নির্ভর করে। বৈদিক শব্দ বেদের বচন। নৈয়ায়িকদের মতে, বেদ নৈর্ব্যক্তিক নয়। বেদ সর্বোজ্ঞ ব্যক্তি ঈশ্বরের শব্দ দ্বারা গঠিত। তাই তা বৈধ। সুতরাং বৈদিক শব্দ স্বতঃপ্রমাণিত।

মীমাংসা ও নৈয়ায়িক শব্দ প্রমাণের পার্থক্য : মীমাংসা দর্শনে শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হলেও নৈয়ায়িক শব্দ প্রমাণ ও মীমাংসা শব্দ প্রমাণের পার্থক্য লক্ষিত হয়। এগুলো হলো : (১) মীমাংসা ভাষ্যকার কুমারিল ভট্ট ও প্রভাকর মিশ্র উভয়ই শব্দ জ্ঞানকে অতীন্দ্রিয় বস্তুর জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অর্থাৎ মীমাংসা শব্দ-জ্ঞান অতীন্দ্রিয় বস্তুর জ্ঞান। মীমাংসা শব্দ-জ্ঞানের বিষয়বস্তু অতীন্দ্রিয়। কিন্তু ন্যায় শব্দ-জ্ঞান শুধু অতীন্দ্রিয় বস্তুর জ্ঞান নয়। প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুর জ্ঞানকেও শব্দ বলা হয়েছে। সুতরাং ন্যায়ের শব্দ-জ্ঞান। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অতীন্দ্রিয় উভয় প্রকার বস্তুর জ্ঞান। কিন্তু মীমাংসা শব্দ-জ্ঞান শুধুমাত্র অতীন্দ্ৰয় । বস্তুর জ্ঞান। (২) নব্য-নৈয়ায়িকগণ বৈদিক শব্দের কথা বললেও পূর্ববর্তী নৈয়ায়িকগণ কেবল মানবীয় শব্দের কথা বলেছেন। কিন্তু মীমাংসা দর্শনে দুই প্রকার শব্দকে স্বীকার করা হয়েছে।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ন্যায় দর্শন প্রধানত জ্ঞানবিদ্যাকেন্দ্রিক এবং ন্যায় তত্ত্ববিদ্যা মূলত ন্যায় জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। ন্যায় প্রমাণতত্ত্বের উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, ন্যায় দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় জ্ঞানের সংজ্ঞা, প্রকৃতি, প্রমা, অপ্রমা, প্রমাণ, সত্যতা, প্রামাণ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গুরুত্বসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ন্যায় দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ, অনুমান শব্দ এবং উপমান এই চার প্রকার প্রমাণকে গ্রহণ করলেও প্রত্যক্ষকে সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম স্থান দিয়েছেন। কারণ, নৈয়ায়িকদের মতে, প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কোনো প্রমাণই সিদ্ধ হয় না। অনুমান, উপমান, শব্দ সবই প্রত্যক্ষনির্ভর। এছাড়াও, নৈয়ায়িকগণ মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্ত স্বীকৃত অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধিকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না। তাঁরা অর্থাপত্তিকে অনুমানের মধ্যে এবং অনুপলব্ধিকে প্রত্যক্ষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মনে করেন।৭২

ন্যায় প্রমাণতত্ত্ব সম্পর্কিত উপরের আলোচনা প্রমাণ করে যে, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যা বিচারবিযুক্তবাদী নয়, বরং সূক্ষ বিচার বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া, তত্ত্ববিদ্যার পূর্বে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার উপর প্রাধান্য দেওয়ার জন্য ন্যায় জ্ঞানবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ মর্যাদার দাবিদার। কেননা, তত্ত্ববিদ্যার আলোচনার পূর্বে তত্ত্ববিদ্যার জ্ঞান কীভাবে পাওয়া যায় সে আলোচনা অর্থাৎ জ্ঞানবিদ্যার, বিশেষত প্রমাণতত্ত্বের, আলোচনা যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

নৈয়ায়িকগণ তাঁদের প্রমাণতত্ত্বে যেসব প্রমাণকে স্বীকার করেছেন এবং এসব প্রমাণ দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানকে যেভাবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন তা নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো ।

ছকে ন্যায় প্রমাণতত্ত্ব
ছকে ন্যায় প্রমাণতত্ত্ব

সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যা

ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন চিন্তাগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হলো সাংখ্য দর্শন। এ দর্শন মূলত বেদের জ্ঞানকাণ্ডের অনুসারী।৭৩ সাংখ্য দার্শনিকগণ তত্ত্বজ্ঞান লাভকেই আত্মা অর্থাৎ পুরুষ বা কর্তা বা জ্ঞাতার মোক্ষলাভের একমাত্র পথ বলে মনে করে। ফলে দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। সাংখ্য শব্দটির একটি অর্থ সম্যক জ্ঞান (সম্ > সম্যক, খ্যা > জ্ঞান)। সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য বৈধ জ্ঞানের উপায় বা প্রমাণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তাই সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যায় যথার্থ জ্ঞানের প্রকৃতি তথা প্রমা ও প্রমাণতত্ত্ব বিশেষ গুরুত্বসহ আলোচিত হয়েছে।

সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, জ্ঞানের মধ্যে চারটি উপাদান অন্তর্ভুক্ত। জ্ঞাতা বা প্রমাতৃ, জ্ঞেয় বা প্রমেয়, জ্ঞানের উপায় বা প্রমাণ এবং বৈধ জ্ঞান বা প্রমা। সাংখ্য দর্শনের অন্যতম ভাষ্যকার, সাংখ্য প্রবচনভাষ্য এবং সাংখ্যশাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থের রচয়িতা, বিজ্ঞান ভিক্ষুর মতে, বিশুদ্ধ আত্মা বা পুরুষই জ্ঞাতা বা প্রমাতৃ, বুদ্ধির ধরন যা বিষয়বস্তুর আকারে আকারিত হয় তাই প্রমাণ, আত্মায় বস্তুর আকারের সাথে বুদ্ধির ধরনের যে প্রতিফলন ঘটে তা-ই বৈধ জ্ঞান এবং আত্মায় প্রতিফলিত বুদ্ধির ধরন দ্বারা যে বস্তুর উপলব্ধি ঘটে তাই জ্ঞেয় বস্তু। সুতরাং বুদ্ধির ধরন হলো জ্ঞানের উপায়, এবং বুদ্ধির ধরনের ফলস্বরূপ আত্মায় যে জ্ঞান হয় তাই বৈধ জ্ঞান। আত্মা প্রত্যক্ষভাবে বুদ্ধির ধরনকে জানে। বুদ্ধির ধরনের মাধ্যমে বাহ্য বস্তু আত্মায় প্রতিফলিত হলে আত্মা বাহ্য বস্তুর জ্ঞান পায়। অর্থাৎ আত্মা বাহ্য বস্তুকে পরোক্ষভাবে জানে। জ্ঞানোৎপত্তির সময় বাহ্য বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের, এবং ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মনের সংযোগ হয়। তখন বুদ্ধি বিষয়াকারে পরিণত হয়। এতে পুরুষের বা আত্মার চৈতন্য প্রতিবিম্বিত হয়। এই অবস্থায় পুরুষ বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে।

সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিল বৈধজ্ঞান বলতে পূর্বজ্ঞাত নয় এমন কোনো বস্তুর সবিকল্প জ্ঞানকে বুঝান।৭৪ সাংখ্যতত্ত্ব কৌমুদী গ্রন্থের রচয়িতা বাচস্পতি মিশ্রের মতে, বুদ্ধির ধরন যখন একটি বস্তুকে সংশয়াতীত, যথার্থ এবং পূর্বে অজ্ঞাত বলে উপলব্ধি করে তখন বৈধজ্ঞান উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ বুদ্ধির ধরনের ফলস্বরূপ আত্মায় যে জ্ঞান হয় তা-ই বৈধ জ্ঞান।৭৫ বৈধজ্ঞান নির্দিষ্ট ও সবিকল্প জ্ঞান। বৈধ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য যথার্থতা, নতুনত্ব ও সুনির্দিষ্টতা। সাংখ্য দর্শনে তিনটি প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো হলো : প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ।৭৬

(১) প্রত্যক্ষ : সাংখ্যকারিকা গ্রন্থের রচয়িতা ঈশ্বরকৃষ্ণ প্রত্যক্ষ প্রমাণের যে সংজ্ঞা দেন তা মীমাংসা বা ন্যায় দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রমাণের সংজ্ঞার অভিন্ন।৭৭ বাচস্পতি প্রত্যক্ষের। তিনটি উপাদানের কথা বলেন। প্রথমত, প্রত্যক্ষের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক একটি যথার্থ বস্তু থাকবে। এ বৈশিষ্ট্যই ভ্রান্তি থেকে প্রত্যক্ষকে আলাদা করে। যেমন, মাটি, জল, এগুলো বাহ্য এবং সুখ, দুঃখ অভ্যন্তরীণ বস্তু। দ্বিতীয়ত, বিশেষ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিশেষ ধরনের বস্তুর সংযোগের ফলে বিশেষ ধরনের প্রত্যক্ষ ঘটে। এই বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষকে অনুমান, স্মৃতি ইত্যাদি থেকে পৃথক করে। তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষ বুদ্ধির ক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষকে সংশয় ও অনির্দিষ্ট জ্ঞান থেকে পৃথক করে।

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : সাংখ্য দর্শনে প্রত্যক্ষকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্যক্ষের উপায়ের ভিন্নতার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ দুই প্রকার। যথা, লৌকিক ও অলৌকিক। প্রত্যক্ষের প্রকৃতির দিক থেকে প্রত্যক্ষ দুই প্রকার। যথা, সবিকল্প ও নির্বিকল্প।

প্রত্যক্ষের উপায়ের ভিন্নতার ভিত্তিতে সাংখ্য দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষকে লৌকিক ও অলৌকিক দুই ভাগে ভাগ করেন। বাহ্য ইন্দ্রিয় ও বাহ্য বস্তুর সংযোগের ফলে যে প্রত্যক্ষ হয় তা লৌকিক প্রত্যক্ষ। পক্ষান্তরে, অন্তরেন্দ্রিয় দ্বারা যে প্রত্যক্ষ হয় তা অলৌকিক প্রত্যক্ষ। যোগীদের স্বজ্ঞাজাত জ্ঞান অলৌকিক প্রত্যক্ষ।

মীমাংসা দর্শনের মতো সাংখ্য দর্শনেও প্রত্যক্ষের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে প্রত্যক্ষকে সবিকল্প ও নির্বিকল্প এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বাচস্পতি মিশ্র নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট প্রদত্ত সংজ্ঞার উদ্ধৃতি দিয়েছেন।৭৮ তিনি সবিকল্প প্রত্যক্ষের যে সংজ্ঞা দেন তা কুমারিল ভট্ট প্রদত্ত সবিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার অভিন্ন।৭৯ সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বাহ্য ইন্দ্রিয় এবং সবিকল্প প্রত্যক্ষ অন্তরেন্দ্রিয় বা মনের কাজ।

(২) অনুমান : সাংখ্য দার্শনিকগণ পঞ্চ-অবয়বযুক্ত ন্যায় অনুমানকে স্বীকার করেছেন।৮২ সাংখ্য দার্শনিকদের দেওয়া অনুমানের সংজ্ঞা মীমাংসা দার্শনিক শবরস্বামী প্রদত্ত অনুমানের সংজ্ঞার অনুরূপ।৮০ বাচস্পতি মিশ্রের মতে, অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা মধ্য পদের ভিত্তিতে সাধ্য ও পক্ষ পদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। তাঁর মতে, অনুমান-জ্ঞান সাধ্য ও পক্ষ পদ থেকে নিঃসৃত হয়।৮১

সাংখ্য দর্শনে মধ্য পদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, মধ্যপদ অবশ্যই পক্ষপদে উপস্থিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপদ সকল সদর্থক দৃষ্টান্তে উপস্থিত থাকবে। তৃতীয়ত, মধ্যপদ সকল নঞর্থক দৃষ্টান্তে, অর্থাৎ যেখানে সাধ্যপদ অনুপস্থিত সেখানে অনুপস্থিত থাকবে। চতুর্থত, স্ববিরোধী সিদ্ধান্তে মধ্যপদ অনুপস্থিত থাকবে। পঞ্চমত, মধ্যপদ পক্ষ পদের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হবে না।

অনুমানের শ্রেণিবিভাগ : অনুমানকে সাংখ্য দর্শমে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। বাচস্পতি মিশ্র অনুমানকে দু’ভাগে ভাগ করেন। যথা, বীত এবং অবীত। অবীত অনুমানকে শেষবৎ বা পরিশেষ অনুমানও বলা হয়। তিনি বীত অনুমানকে আবার দু’ভাগে ভাগ করেন। যথা, পূর্ববৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট। সুতরাং বলা যায়, সাংখ্য অনুমান মোট তিন প্রকার। পূর্ববৎ সামান্যতোদৃষ্ট এবং অবীত বা শেষবৎ। বিজ্ঞান ভিক্ষুও এই তিন প্রকার অনুমানের কথা বলেন। সাংখ্য দার্শনিকদের বিভিন্ন প্রকার অনুমানের সংজ্ঞা ন্যায়ের পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমানের সংজ্ঞার সঙ্গে অভিন্ন।৮৩

(৩) শব্দ : ইতোপূর্বে মীমাংসা শব্দ-প্রমাণ আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট শব্দকে মানবীয় এবং অতিমানবীয়, এই দু’ভাগে ভাগ করেন। কিন্তু প্রভাকর মিশ্র মানবীয় শব্দকে অস্বীকার করেন এবং শুধুমাত্র অতিমানবীয় শব্দকে স্বীকার করেন। সাংখ্য দার্শনিকদের শব্দ প্রমাণ কুমারিল ভট্ট নির্দেশিত অতিমানবীয় শব্দ এবং প্রভাকর মিশ্র নির্দেশিত শব্দ-জ্ঞানের অভিন্ন।৮৪ লৌকিক শব্দ প্রত্যক্ষ ও অনুমান নির্ভর বলে সাংখ্য দার্শনিকগণ একে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। প্রাচীন ন্যায় দর্শনে বৈদিক বা অতি মানবীয় শব্দকে স্বীকার করা হয়নি। নব্য-ন্যায় দর্শন উভয় প্রকার শব্দকে স্বীকার করেছে। সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, বৈদিক শব্দ বলতে যথার্থ প্রত্যাদেশকে বুঝায়। বেদ হলো অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রত্যাদেশ। তা প্রত্যক্ষ ও অনুমানের উর্ধ্বে এবং নৈর্ব্যক্তিক। যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই সেহেতু শব্দ-প্রমাণ ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট নয়। আবার শব্দ ব্যক্তির দ্বারাও সৃষ্ট নয়। তথাপি তা শাশ্বত নয়।৮৫ বেদ হলো প্রজ্ঞাশীল ঋষিদের প্রতি শাশ্বত সত্যের প্রত্যাদেশ। এর শাশ্বততা বলতে এটাই বুঝানো হয় যে, একই রকম সত্য বিভিন্ন সময়ের ঋষিদের কাছে বিরামহীনভাবে প্রত্যাদেশিত হয়।৮৬ বৈদিক শব্দ নৈর্ব্যক্তিক। তাই তা সন্দেহ ও প্রতারণার ঊর্ধ্বে। বেদের সত্য-প্রত্যাদেশ দেবার অভ্যন্তরীণ শক্তি আছে। তাই তা স্বতঃপ্রামাণ্য ।

উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি স্বতন্ত্র প্রমাণ নয় : সাংখ্য দর্শনে উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কেননা, গবয়ের জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ব্যক্তির বচন হলো লৌকিক শব্দ, গরুর প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষ এবং এর দ্বারা নির্দেশিত গবয়ের জ্ঞান হলো অনুমান। সুতরাং, সাংখ্যদের মতে, উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে অর্থাপত্তি দুটি ঘটনার অসঙ্গতি অপসারণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে অর্থাপত্তিকে অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়। সুতরাং অর্থাপত্তিও অনুমান ছাড়া অন্য কিছু নয়। এছাড়া, সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, অনুপলব্ধির কোনো স্বতন্ত্র বস্তু নাই। সুতরাং অনুপলব্ধি স্বতন্ত্র প্রমাণ নয়। কারণ, একমাত্র অপরিবর্তনীয় আত্মা ছাড়া অন্য সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন প্রত্যক্ষযোগ্য। একটি বিশেষ স্থানে একটি পানিপাত্রকে প্রত্যক্ষণ না করার অর্থ হলো ঐ স্থানের নির্দিষ্ট পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা । মীমাংসা দার্শনিক প্রভাকর মিশ্রের মতো সাংখ্য দার্শনিকগণও একথা বলেন যে, অনুপলব্ধিতে যেহেতু কোনো বস্তু যেখানে ছিল সেখানে সে বস্তুর অনুপস্থিতি উপলব্ধি করা হয় সেহেতু এই অনুপলব্ধি মূলত শূন্যস্থান বা আধারের জ্ঞানের সাথে অভিন্ন।৮৭ সুতরাং এটি স্বতন্ত্র প্রমাণ নয়।

জ্ঞানের প্রামাণ্য : সাংখ্য দার্শনিকগণ জ্ঞানের বৈধতা ও অবৈধতা জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন। জ্ঞানের বৈধতা জ্ঞানের কারণের উপর নির্ভর করে না। তাই বৈধজ্ঞান স্বতঃপ্রামাণ্য। যে জ্ঞান বৈধ তা স্বনিহিতভাবেই বৈধ এবং যে জ্ঞান অবৈধ তা স্বনিহিতভাবেই অবৈধ। কার্যকারিতা বা বাস্তব উপযোগিতা হলো সত্যতা বা যথার্থতার পরীক্ষা। বৈধজ্ঞান কার্য সম্পাদনে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে জ্ঞানের বৈধতা সফল কার্য সম্পাদনের উপর নির্ভর করে না। সুতরাং জ্ঞানের প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকগণ মীমাংসা ও বেদান্ত দার্শনিকদের মতের সাথে অভিন্ন এবং ন্যায় মতের বিরোধী। কারণ, ন্যায় দর্শনে জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে।

সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যা তথা প্রমাণতত্ত্বের উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, সাংখ্য দার্শনিকগণ মীমাংসা ও বেদান্ত দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধিকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে গ্রহণ করেন নি। কারণ, তাঁদের মতে, এ তিনটি প্রমাণ প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ–এই তিনটি প্রমাণের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। সাংখ্য প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ অদ্বৈত বেদান্ত প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগের অনুরূপ আবার সাংখ্য শব্দ-জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ প্রভাকর মীমাংসক ও অদ্বৈত বেদান্তের শব্দ-জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগের সাথে অভিন্ন। জ্ঞানের প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকগণ মীমাংসা ও বেদান্ত দার্শনিকদের সঙ্গে একমত। সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যার সমালোচনায় একথা বলা হয় যে, সাংখ্য দার্শনিকগণ জ্ঞাতা অর্থাৎ পুরুষ এবং জ্ঞেয় অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে যে দ্বৈতবাদ সৃষ্টি করেন এর সন্তোষজনক সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই সমালোচনা সত্ত্বেও তাঁদের প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা থেকে একথা স্বীকার করতে হয় যে, প্রাচীনকালেও তাঁরা যথেষ্ট বিশ্লেষণী ও বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। সাংখ্য দার্শনিকদের দ্বারা স্বীকৃত প্রমাণগুলো এবং এসব প্রমাণ দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।

ছকে সাংখ্য প্রমাণতত্ত্ব
ছকে সাংখ্য প্রমাণতত্ত্ব

যোগ জ্ঞানবিদ্যা

মহর্ষি পতঞ্জলী প্রতিষ্ঠিত যোগ দর্শন মূলত সাংখ্য দর্শনের পদ্ধতিগত ও ব্যবহারিক একটি দিক।৮৮ পতঞ্জলী কতিপয় বিষয় ব্যতীত কপিলের দ্বারা প্রবর্তিত সাংখ্য মতকেই স্বীকার করেন। সাংখ্য দর্শনের নিরীশ্বরবাদের ক্ষেত্রে যোগ দর্শন ঈশ্বরবাদ সমর্থন করে বলে যোগ দর্শনকে সেশ্বর সাংখ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই দর্শনে কেবলমাত্র জ্ঞানকেই মোক্ষলাভের উপায় মনে করা হয়েছে। যোগ দর্শন সাংখ্যের জ্ঞানযোগ সমর্থন করে। কিন্তু এর সঙ্গে কর্মযোগকে যুক্ত করে। এতে জ্ঞান, ধ্যান, ক্রিয়া সবকিছুকেই মোক্ষের উপায় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং যদিও সাংখ্যের মতো যোগ দর্শনে জ্ঞানকেই একমাত্র মোক্ষের উপায় বলে অভিহিত করা হয়নি তবুও একথা সত্য যে, মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার উপর যোগ দর্শনেও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এজন্যই যোগ দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

সাংখ্য দর্শনের মতো যোগ দর্শনও দেহস্থ ইন্দ্রিয়জ ও বাহ্য বিষয়ের সংযোগের ফলে চিত্তে যে সকল বিকার বা পরিণাম ঘটে তাকে বৃত্তি নামে আখ্যায়িত করে। এই বৃত্তিই হলো জ্ঞান। বৃত্তি বা জ্ঞান পাঁচ প্রকার। যথা, প্রমাণ, বিপর্যয়, বিকল্প, নিদ্রা ও স্মৃতি। প্রমাণের মাধ্যমেই যথার্থ জ্ঞান সাধিত হয়।

যোগ দর্শন জড়বাদকে সমর্থন করে। এই দর্শন অনুসারে বাহ্যবস্তুর যথার্থ সত্তা আছে, এবং জ্ঞানের মানসিক প্রকারগুলো দ্বারা বাহ্য বস্তুকে যথার্থভাবে জানা যায়। বস্তু স্বকীয় যোগ্যতার জন্যই চৈতন্যের কাছে উপস্থিত হয়। এর ফলে জ্ঞান সম্ভব হয়। সুতরাং জ্ঞানের যথার্থতার জন্যই বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব এবং জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করতে হয়। যোগ দর্শনের অন্যতম ভাষ্যকার, যোগভাষ্য বা ব্যাসভাষ্য গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাসের মতে, বৈধজ্ঞান দ্বারা যথার্থ বস্তুকে উপলব্ধি করা যায়। যোগভাষ্যের ভাষ্য তত্ত্ববৈশারদী গ্রন্থের রচয়িতা বাচস্পতি মিশ্র বৈধ জ্ঞানকে অনধিগত বা পূর্বে অজ্ঞাত অথচ সফল কার্য সম্পাদনকারী জ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।৮৯ ব্যাসের মতে, ভ্রান্তি বৈধ জ্ঞানের সঙ্গে আত্মবিরোধী। যোগদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি পতঞ্জলীও সাংখ্য দার্শনিকদের মতো তিন প্রকার প্রমাণ স্বীকার করেছেন। এগুলো হলো প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ।৯০ এগুলোর প্রকারভেদ সম্পর্কে যোগ দার্শনিকদের মতো সাংখ্য মতের অনুরূপ।

(১) প্রত্যক্ষ : প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ সম্পর্কে যোগ দার্শনিকগণ সাংখ্য দার্শনিকদের সঙ্গে একমত।৯১ যোগ দর্শনে সরাসরি উপলব্ধিকেই প্রত্যক্ষ বলা হয়েছে। বাচস্পতি মিশ্র প্রত্যক্ষের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। প্রথমত, প্রত্যক্ষে জ্ঞানের সঠিক বস্তুর যথার্থ উপলব্ধি ঘটে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যক্ষে একটি বাহ্য বস্তুকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা হয়। তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষে জ্ঞানের আকার বাহ্য বস্তুর অনুরূপ হয়। কারণ, বুদ্ধি বাহ্য বস্তুকে জ্ঞানাকারে পরিণত করে। চতুর্থত, প্রত্যক্ষে বস্তুর সামান্য লক্ষণ বা বিশেষ লক্ষণকে প্রত্যক্ষ করা হয় না। এমনকি এতে এমন কোনো দ্রব্যকে প্রত্যক্ষ করা হয় না যার মধ্যে এসব লক্ষণ অবস্থান করে। বরং এতে সামান্য ও বিশেষ উভয় লক্ষণ দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বস্তুর জ্ঞান হয়। এতে বিশেষ লক্ষণগুলোর উপলব্ধিই হলো প্রধান। এই বৈশিষ্ট্যই প্রত্যক্ষকে অনুমান থেকে আলাদা করে। কারণ, অনুমানে শুধু সামান্যলক্ষণের জ্ঞান হয়। সাংখ্য ও ন্যায় দর্শনের মতো যোগ দর্শনেও অনুমান এবং শব্দের চেয়ে প্রত্যক্ষকে অধিকতর শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

(২) অনুমান : যোগ দর্শনের অনুমান প্রমাণের প্রকৃতি ও প্রকারভেদ সাংখ্য অনুমান প্রমাণের অনুরূপ।৯২ যোগ দর্শন অনুসারে, লিঙ্গ বা চিহ্ন এবং অনুমিত বস্তুর বা লিঙ্গির মধ্যে নিয়ত সম্পর্কের জ্ঞানই অনুমানের ভিত্তি।৯৩ প্রত্যক্ষে যেখানে বিশেষ লক্ষণকে উপলব্ধি করা হয় সেখানে অনুমানের ক্ষেত্রে সামান্যধর্মকে উপলব্ধি করা হয়।

(৩) শব্দ : যোগ দর্শনের শব্দ প্রমাণ সাংখ্য শব্দ প্রমাণের অনুরূপ।৯৪ যিনি কোনো বস্তু প্রত্যক্ষ বা অনুমান করেছেন, এমন কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তি যদি অন্য ব্যক্তিকে বচনের মাধ্যমে জ্ঞান দেন তবে বক্তার বচন থেকে শ্রোতার যে জ্ঞান হয় তা-ই শব্দ-জ্ঞান বা আগম। যোগ দার্শনিকদের মতে, বক্তাকে অবশ্যই সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে হবে। এছাড়া তার সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান ও শ্রোতার প্রতি সহানুভূতি থাকতে হবে। চরিত্রের দিক থেকেও বক্তা অবশ্যই বিশ্বস্ত হবেন। যদি বক্তা যথার্থ বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা অনুমান না করেন এবং তিনি যদি বিশ্বস্ত না হন তবে শব্দ প্রমাণ বৈধ হবে না। যোগ দার্শনিকদের মতে, ঈশ্বর আদি বক্তা। তিনি সর্বজ্ঞ। তাই তার দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট বেদই হলো শব্দ-জ্ঞান।

জ্ঞানের প্রামাণ্য : জ্ঞানের প্রামাণ্যর ক্ষেত্রে যোগ দার্শনিকগণ সাংখ্য দর্শনের অনুসারী। অর্থাৎ যোগ দর্শনে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং জ্ঞানের প্রামাণ্যর ক্ষেত্রে যোগ দর্শনের সঙ্গে সাংখ্য, মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মিল এবং ন্যায় দর্শনের অমিল পরিলক্ষিত হয়। কারণ, ন্যায় দর্শনে পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করা হয়।

যোগ জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যোগ দার্শনিকগণ মূলত সাংখ্য দর্শনের মূলতত্ত্বকে গ্রহণ করে নিয়ে তাদের দার্শনিক মত প্রদান করেছেন। এ জন্য যিনি সাংখ্য ও যোগকে একরূপ দেখেন তাকেই গীতায় সমর্শী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।৯৫ সাংখ্য দর্শনের সঙ্গে যোগ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, যোগ দর্শনে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়েছে এবং সাংখ্যের জ্ঞানমার্গের সঙ্গে যোগ দর্শন কর্মমার্গকেও যুক্ত করেছে। অর্থাৎ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানলাভ যাতে সহজসাধ্য হয় তার পদ্ধতি নির্দেশ করেছে। তবে প্রমাণতত্ত্বের ক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকদের মতকেই যোগ দার্শনিকগণ স্বীকার করে নিয়েছেন। যোগ প্রমাণতত্ত্বে স্বীকৃত প্রমাণ এবং এর দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রকারভেদ ছকের সাহায্যে নিম্নে দেখানো গেল।

ছকে যোগ প্রমাণতত্ত্ব
ছকে যোগ প্রমাণতত্ত্ব

বৈশেষিক জ্ঞানবিদ্যা

সাংখ্য ও যোগ দর্শনের মতো ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়ে মিল লক্ষিত হয়।৯৬ ন্যায় দর্শনের সঙ্গে অভিন্নতার কারণে বৈশেষিক ও ন্যায়কে সমানতন্ত্র বলা হয়। ন্যায়ের মতো বৈশেষিক দর্শনেও মোক্ষকে জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে মোক্ষের জন্য দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তত্ত্বজ্ঞান তথা যথার্থ জ্ঞানলাভের মাধ্যমে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটলেই মোক্ষলাভ সম্ভব। এজন্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা বৈশেষিক দর্শনেও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।

বৈশেষিক দর্শনে বৈধ জ্ঞানকে বিদ্যা এবং অবৈধ জ্ঞানকে অবিদ্যা বলা হয়। বিদ্যা হলো বস্তুর যথার্থ প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, আর অবিদ্যা হলো বস্তুর যথার্থ প্রকৃতি সম্পর্কে ভ্রান্ত জ্ঞান। বৈশেষিক দর্শনে দুই প্রকার প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো হলো, প্রত্যক্ষ ও অনুমান। প্রত্যক্ষ ও অনুমানের প্রকৃতি ও বিভাগ সম্পর্কে বৈশেষিক মত ন্যায় দার্শনিকদের মতের অনুরূপ।৯৭ ন্যায় দার্শনিকগণ উপমান ও শব্দকে আলাদা প্রমাণরূপে স্বীকার করেন। কিন্তু বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, উপমান ও শব্দ অনুমানের অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের মতে, যেহেতু শব্দ-প্রমাণের ভিত্তি হলো শব্দ ও এর অর্থের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ এবং শব্দ হলো লিঙ্গ বা চিহ্নস্বরূপ, যার মাধ্যমে শব্দের অর্থ অনুমান করা হয়, সেহেতু শব্দ হলো অনুমান। উপমান প্রকৃতপক্ষে শব্দ-প্রমাণ নির্ভর। কেননা উপমান বিশ্বস্ত ব্যক্তির উক্তির বৈধতার উপর নির্ভরশীল। এজন্য উপমানও অনুমানের অন্তর্গত।৯৮

ন্যায় উপমানের সমালোচনা : বৈশেষিক দার্শনিকগণ উপমানকে প্রত্যক্ষিত বস্তুর সঙ্গে স্মৃতিতে অধিষ্ঠিত বস্তুর সাদৃশ্যজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। ন্যায়ের উপমান প্রমাণকে সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা একথা বলেন যে, ন্যায়ের উপমানে সংজ্ঞার সঙ্গে সংজ্ঞির সাদৃশ্য থাকে। তাই এতে যখন গবয়কে গবয় বলে উপমিতি জন্মে তখন জ্ঞাতা হয় লিঙ্গি গবয়ের স্বতন্ত্র স্বরূপ অর্থাৎ গবয়-স্বরূপ উপলব্ধি করেন, নয়তো লিঙ্গি গবয় লিঙ্গ গরুর যে সাদৃশ্যমূলক লক্ষণগুলো ধারণ করে সে লক্ষণগুলো উপলব্ধি করেন। কিন্তু এতে গবয়স্বরূপের যে উপলব্ধি হয় তাতে উপমান হয় না। কারণ, লিঙ্গ বা গবয় দর্শনের সময় মূলত লিঙ্গির সাথে লিঙ্গ বা গরুর সাদৃশ্য করা হয়। ফলে এতে লিঙ্গি বা গরুর প্রত্যাভিজ্ঞা হয়। এজন্যই বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, ন্যায়ের উপমান হয় প্রত্যক্ষ, নয়তো প্রত্যাভিজ্ঞা,৯৯ উপমান নয়। সালিকানাথ মিশ্র একইভাবে ন্যায়ের উপমানের সমালোচনা করে একে প্রত্যাভিজ্ঞা বলেছেন।১০০

জ্ঞানের প্রামাণ্য : ন্যায় দর্শনের মতো বৈশেষিক দর্শনও জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করে। অর্থাৎ জ্ঞানের প্রামাণ্য জ্ঞানের বাইরের শর্তের উপর নির্ভরশীল। এদিক থেকে বৈশেষিক দর্শন সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন থেকে ভিন্নমত পোষণ করে। কারণ, এসব দার্শনিক মতবাদে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে।

বৈশেষিক জ্ঞানবিদ্যা তথা প্ৰমাণতত্ত্ব সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যদিও বৈশেষিক দর্শন মোক্ষ বা মুক্তির প্রকৃতি ও মুক্তিলাভের উপায়ের ক্ষেত্রে ন্যায়ের অনুরূপ মত পোষণ করে তবুও জ্ঞানবিদ্যার, বিশেষত প্রমাণতত্ত্বের, আলোচনায় ন্যায় প্রমাণতত্ত্বকে অনুরূপভাবে মেনে না নিয়ে বৈশেষিক দর্শন স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছে। তত্ত্ববিদ্যার ক্ষেত্রে ন্যায়ের ষোড়শ-পদার্থে যেমন বৈশেষিকের সপ্ত-পদার্থ প্রতিস্থাপিত হয়েছে তেমনি প্রমাণতত্ত্বের ক্ষেত্রেও ন্যায়ের চতুর্বিধ প্রমাণ বৈশেষিক দর্শনে দ্বিবিধ প্রমাণে রূপান্তরিত হয়েছে। বৈশেষিকগণ যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ন্যায়ের উপমান ও শব্দ প্রমাণ কীভাবে স্বতন্ত্র প্রমাণ না হয়ে বরং অনুমানের অন্তর্ভুক্ত তা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সুতরাং বলা যায়, ন্যায় ও বৈশেষিক সমানতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানবিদ্যার, বিশেষত প্রমাণতত্ত্বের, আলোচনায় বৈশেষিক দর্শন স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বৈশেষিক নির্দেশিত প্রমাণতত্ত্ব নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।

ছকে বৈশেষিক প্রমাণতত্ত্ব
ছকে বৈশেষিক প্রমাণতত্ত্ব

বৌদ্ধ জ্ঞানবিদ্যা

গৌতম বুদ্ধ (৪০৩-৪৮৩ খ্রিঃ পূঃ) প্রবর্তিত বৌদ্ধ দর্শন ভারতীয় দর্শনের বেদ বিরোধী তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি।১০১ একটি বিশেষ সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে একদিকে যেমন যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের আগ্রহ ও শাস্ত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য মানুষের মনকে অধিকার করেছিল অন্যদিকে তেমনি একেশ্বরবাদের প্রভাবে ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান অপেক্ষা চরমতত্ত্বের জ্ঞানকেই শ্রেয়তর বিবেচনা করা হচ্ছিল। এই দুটি ভাবধারার সংঘাতের সন্ধিক্ষণে প্রধানত পরাজাগতিক চিন্তাসর্বস্ব চিরায়ত সমাজ কাঠামোর মধ্যে গৌতম বুদ্ধ ভারতীয় দর্শনের একটি স্বাধীন যুক্তিনির্ভর চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন। জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়কারী এ চিন্তাধারায় যথার্থ জ্ঞানের বিষয়টিকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনের মূল লক্ষ্য মানুষের দুঃখের বিনাশ, তথা নির্বাণের পথনির্দেশ করা। দুঃখের জন্য বৌদ্ধ দর্শনে যে দ্বাদশ নিদান বা বারটি কারণজনিত ভবচক্রের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে প্রথমটি হলো অবিদ্যা বা চারটি আর্য সত্য সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব। সুতরাং দুঃখমুক্তির জন্য প্রথম প্রয়োজন অবিদ্যা দূরীকরণ বা যথার্থ জ্ঞানলাভ। যথার্থ জ্ঞানলাভের জন্য যথার্থ জ্ঞানের পদ্ধতি বা প্রমাণ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ অত্যাবশ্যক। তাই বৌদ্ধ দর্শনে প্রমাণতত্ত্ব যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে।

আঠারো শতকের পাশ্চাত্য দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের মতো খ্রিষ্টপূর্ব ছয়শত অব্দের বৌদ্ধ দর্শনেও জ্ঞানের উপাদানগুলো দেশ ও কালে অস্তিত্বশীল থাকে বলে মনে করা হয়েছে। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ সম্যক্ জ্ঞানকে প্রমা এবং অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞানকেই সম্যক জ্ঞান বলে মনে করেন। যা পূর্বে জ্ঞাত ছিল না তা জানিয়ে দিয়ে জ্ঞাতাকে প্রবৃত্ত কিংবা নিবৃত্ত করাই জ্ঞানের কাজ। স্মৃতিজ্ঞান যেহেতু পূর্বে জানা জ্ঞানেরই পুনরুৎপাদন সেহেতু বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে তা প্রমা নয়।।

বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মোত্তর বৈধ জ্ঞান বলতে জ্ঞেয় বস্তুর সঙ্গে সমন্বয়পূর্ণ জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, সঠিক জ্ঞান অকাম্য বস্তু বর্জন করতে সাহায্য করে। ন্যায় দার্শনিকদের মতো ধর্মোত্তর সত্যতার প্রায়োগিক পরীক্ষার কথা বলে বাস্তববাদী প্রয়োগবাদ সমর্থন করেন।১০২ বৌদ্ধ দর্শনে মোট দুই প্রকার প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো হলো, প্রত্যক্ষ ও অনুমান।১০৩ শুধুমাত্র এই দুই প্রকার উৎস থেকেই বৈধ জ্ঞান সম্ভব হয়। নিম্নে এসব প্রমাণ সংক্ষেপে আলোচিত হলো।

(১) প্রত্যক্ষ : ন্যায়বিন্দু গ্রন্থের রচয়িতা প্রখ্যাত বৌদ্ধ নৈয়ায়িক ধর্মকীর্তি প্রত্যক্ষ বলতে কল্পনাবর্জিত ভ্রান্তিহীন বস্তুর জ্ঞানকে বুঝান।১০৪ এই জ্ঞান বৈধ। কারণ, এতে একটি বস্তুর স্বলক্ষণ বা স্বতন্ত্র উপলব্ধি জন্মে। প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের প্রকৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে মীমাংসা দর্শনে প্রত্যক্ষকে সবিকল্প ও নির্বিকল্প–এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি সবিকল্প প্রত্যক্ষকে তথাকথিত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, সবিকল্প প্রত্যক্ষ প্রত্যক্ষের আওতাভুক্ত নয়। কারণ, এতে কল্পনা অন্তর্ভুক্ত। সবিকল্প প্রত্যক্ষ অবৈধ। কারণ, তা বস্তুর যথার্থ জ্ঞান নয়। নির্বিকল্প এবং গুণবিশিষ্ট বস্তুর উপর মনের প্রাকপ্রভাবকৃত আদর্শ গঠনই সবিকল্প প্রত্যক্ষ। এতে বস্তুর নাম জানা যায়। কিন্তু বস্তুর নাম বস্তুর গঠনের সাথে যুক্ত নয়। তাই তা অবৈধ। ধর্মকীর্তির মতে, কেবলমাত্র নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞানই বৈধ। কারণ, এতে বস্তুর স্বতন্ত্র বা স্বলক্ষণ উপলব্ধি জন্মে। এতে কোনোপ্রকার কাল্পনিক গঠন নাম মিশ্রিত থাকে না। সুতরাং দেখা যায়, বৌদ্ধ দর্শনে একমাত্র নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : প্রত্যক্ষের উপায়ভেদে বৌদ্ধ দর্শনে চার প্রকার প্রত্যক্ষের কথা বলা হয়েছে। যথা, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়জ্ঞান, মানসিক প্রত্যক্ষ বা মনবিজ্ঞান, আত্মসচেতনতা বা স্বসংবেদন এবং যোগীপ্রত্যক্ষ বা যোগীর স্বজ্ঞজ্ঞান।

ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ হলো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো বস্তুর সরাসরি জ্ঞান। মানসিক প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের দ্বারা উৎপন্ন হয়। যখন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ কাজ করে তখন কোনো বস্তুর রং সম্পর্কে জ্ঞাতার উপলব্ধি জন্মে।

যখন ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের কাজ সম্পন্ন হয় তখন রং-এর মানসিক প্রত্যক্ষ হয়। তাই মানসিক প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তা একই অনুক্রমে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের পরবর্তী মুহূর্তে উৎপন্ন হয়। ধর্মোত্তর মানসিক প্রত্যক্ষ সম্পর্কে এ কথা বলেন যে, ইন্দ্রিয় তার কার্য সম্পাদনে বিরত না থাকলে মানসিক প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হতে পারে না।১০৫ তাই মানসিক প্রত্যক্ষকে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের পরবর্তী প্রতিরূপ বলে মনে হয়। ন্যায় ও মীমাংসা দর্শনের মানস প্রত্যক্ষ থেকে বৌদ্ধ মানসিক প্রত্যক্ষ বা মনবিজ্ঞান আলাদা। আত্মসচেতনতা বা স্বসংবেদন হলো চিত্ত ও অনুভূতির জ্ঞান। সকল প্রকার চিত্ত ও অনুভূতির আত্মসচেতনতা আছে। এগুলো স্বআলোকে আলোকিত। এসব নিজেরাই নিজেদের উপলব্ধি করে। আত্মা দ্বারা এদের উপলব্ধি ঘটে না। কারণ, আত্মা অস্তিত্বশীল নয়। তাই চিত্ত বা অনুভূতির দ্বারা প্রত্যক্ষ করাকে আত্মসচেতনতা বা স্বসংবেদন বলে। আনন্দ, বেদনা ইত্যাদির অভ্যন্তরীণ প্রত্যক্ষ স্বসংবেদনের অন্তর্ভুক্ত। আমরা আনন্দ, বেদনা ইত্যাদি আত্মার বিভিন্ন অবস্থার দ্বারা আত্মাকে প্রত্যক্ষ করি। যোগী-প্রত্যক্ষ বলতে গভীর অনুধ্যান দ্বারা যোগীদের সাক্ষাৎ ও স্পষ্ট জ্ঞানকে বুঝানো হয়। এই জ্ঞান ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ নয়। ধর্মকীর্তির মতে, চারটি আর্য সত্যের জ্ঞান যা জ্ঞানের সাধারণ উপায় দ্বারা লব্ধ নয় এবং সকল প্রকার ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে তা যোগী প্রত্যক্ষ দ্বারা লাভ করা যায়।১০৬

(২) অনুমান : অনুমান দ্বারা বস্তুর জাতিগত বা সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলি উপলব্ধি করা যায়। অনুমান সাধ্য ও হেতুর ব্যাপ্তি সম্পর্কনির্ভর। বৌদ্ধ দর্শনে দুই প্রকার অনুমানের কথা বলা হয়েছে। যথা, স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান। পক্ষের মধ্যে অবস্থানকারী মধ্যপদ বা হেতু পদের জ্ঞানের মাধ্যমে সাধ্যের যে জ্ঞান হয় সে জ্ঞানই স্বার্থানুমান। স্বার্থানুমান বচন দ্বারা সাধিত হয় না, বরং সাধ্যের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কে সম্পর্কিত হেতু পদের মাধ্যমে সরাসরি স্বার্থানুমান সাধিত হয়। বৌদ্ধ দ্বিতীয় প্রকারের অনুমান হলো পরার্থানুমান। এই অনুমানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো স্বার্থানুমানের অনুরূপ। এদের মূল পার্থক্য হলো, পরার্থানুমানকে বচনের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়।১০৭ এদিক থেকে ন্যায় স্বার্থানুমানের ও পরার্থানুমানের সাথে বৌদ্ধ স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমানের মিল পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু অমিল হলো, পরার্থানুমানের অবয়বের সংখ্যা নিয়ে। বৌদ্ধ পরার্থানুমান ত্রি-অবয়বী। এর তিনটি অবয়ব হলো : সিদ্ধান্ত, পক্ষ ও সাধ্য। সাধ্যে উদাহরণ থাকে। যেমন,

পর্বতে আগুন আছে ।
কারণ, পর্বতে ধূম আছে ।
যেমন, পাকশালায় ধূম থাকে কিন্তু হ্রদে থাকে না ।

উল্লেখ্য যে, বৌদ্ধ দার্শনিকদের ত্রি-অবয়বী পরার্থানুমানের সাথে মীমাংসা দার্শনিকদের ত্রি-অবয়রী পরার্থানুমানের মিল পরিলক্ষিত হয়। ন্যায় দার্শনিকদের দ্বারা স্বীকৃত পঞ্চ-অবয়বী অনুমানকে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ সমালোচনা করেন।

জ্ঞানের প্রামাণ্য : বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, যে জ্ঞান বিষয়ানুযায়ী হয়, সে জ্ঞানই যথার্থ। যদি জ্ঞান অনুসারে বিষয়প্রাপ্তি ঘটে, অর্থাৎ জ্ঞান যদি সফল প্রবৃত্তির কারক হয় তবেই তা বিষয়ানুযায়ী হয়েছে বোঝা যাবে। সুতরাং জ্ঞানের প্রামাণ্য জ্ঞানের মধ্যে নয়, বরং অন্যান্য বাহ্যিক শর্তের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ জ্ঞান পরতঃপ্রামাণ্য। সুতরাং জ্ঞানের প্রামাণ্যের ব্যাপারে বৌদ্ধ দর্শন ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের সঙ্গে একমত এবং সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে। কারণ, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে।

বৌদ্ধ প্ৰমাণতত্ত্ব সম্পর্কে উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, বৌদ্ধ দর্শনেও নির্বাণ বা মুক্তির জন্য যথার্থ জ্ঞানের উপায় তথা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। তবে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ মীমাংসা বা বেদান্তের ছয়টি, ন্যায়ের চারটি, সাংখ্য ও যোগের তিনটি স্বীকৃত প্রামাণের মধ্যে মাত্র দু’টিকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এদিক থেকে তাঁদের সাথে বৈশেষিক প্রমাণতত্ত্বের মিল পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া বৌদ্ধ দর্শনে যথার্থ জ্ঞানের মানদণ্ড হিসেবে সফল ক্রিয়াকারিত্বের কথা বলায় তাঁদের জ্ঞানতত্ত্বে বিশ শতকের পাশ্চাত্য প্রয়োগবাদী ও উপযোগবাদী দর্শনের মূল সূর ধ্বনিত হয়েছে বলে মনে হয়। এসব দিক থেকে বিচার করে বৌদ্ধ দর্শন, বিশেষত বৌদ্ধ জ্ঞানবিদ্যা, পরবর্তী দর্শনের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলা যায়। এখানে বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব ছকের সাহায্যে দেখানো হলো ।

ছকে বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব
ছকে বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব

জৈন জ্ঞানবিদ্যা

ভারতীয় দর্শনে প্রাগৈতিহাসিক ধারার বাহক গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক অন্যতম বেদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী জৈন দর্শন জ্ঞানবিদ্যা, তর্কবিদ্যা, অধিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।১০৮ অন্য দুটি বেদবিরোধী দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাক ও বৌদ্ধ শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। কিন্তু জৈনগণ বেদবিরোধী ও নিরীশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধমতের বিরোধিতা করে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং চৈতন্যকে আত্মার স্বাভাবিক গুণ বলে অভিহিত করেন। তাদের মতে, চৈতন্য জ্ঞান। তাই তারা সর্বজ্ঞতাকেও আত্মার স্বাভাবিক গুণ বলে মনে করেন। অবিদ্যামূলক কর্মের প্রভাবে সর্বজ্ঞ আত্মা সাময়িকভাবে যখন দেহাবদ্ধ হয় তখন তার সর্বজ্ঞতা সাময়িকভাবে ঢাকা পড়ে। এই বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য জৈন দার্শনিকগণ সম্যক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞানের বিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা করেন। মিথ্যাজ্ঞান থেকে সম্যক জ্ঞানকে পৃথকভাবে জানার জন্য যথার্থ জ্ঞানের পদ্ধতি বা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা জৈন দর্শনে সমধিক গুরুত্ব পায়।

জৈন দর্শনে জ্ঞেয় বস্তুর মননিরপেক্ষ অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। জৈন দার্শনিকদের মতে, জ্ঞেয় বস্তুর যথাযথ ধারণাই যথার্থ জ্ঞান। যথার্থ জ্ঞান সন্দেহের উর্ধ্বে। এই জ্ঞান মানুষের উদ্দেশ্য সাধনে সাহায্য করে। জৈন জ্ঞানকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পরীক্ষামুখসূত্র। এর রচয়িতা মানিক্যনন্দি পূর্বে অজ্ঞাত কোনো জ্ঞানের ও বস্তুর সবিকল্প অবগতিকে বৈধ জ্ঞান বলেন। বৌদ্ধ দর্শনে যেখানে শুধু নির্বিকল্প জ্ঞানকেই বৈধ জ্ঞান বলা হয়েছে সেখানে জৈন দার্শনিকদের মতে, বৈধ জ্ঞান হলো সবিকল্প জ্ঞান। প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক বাদিদেব সূরি মানিক্যনন্দির বৈধ জ্ঞানের সংজ্ঞার সাথে একমত।১০৯ বৈধ জ্ঞানের বাস্তব দিকও বর্তমান। এর প্রায়োগিক উপযোগিতা আছে। কারণ, এই জ্ঞান জ্ঞাতার অজ্ঞতা নিবারণ করে এবং জ্ঞাতাকে মন্দ বর্জন ও ভাল নির্বাচন করতে পরিচালিত করে। এছাড়া বৈধ জ্ঞান জ্ঞাতাকে সত্যের জ্ঞানের সাথে অভিন্ন করে তুলে।১১০

জৈন দর্শনে বৈধ জ্ঞানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ বা সাক্ষাৎ জ্ঞান এবং পরোক্ষ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা সাধিত হয়। পরোক্ষ জ্ঞানের জন্য পাঁচটি প্রমাণ আছে। যেমন, স্মৃতি, প্রত্যাভিজ্ঞা, তর্ক বা আরোহ, অনুমান বা অবরোহ এবং শব্দ বা আগম। সুতরাং জৈন দর্শনে মোট ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। এগুলো নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

(১) প্রত্যক্ষ : মীমাংসা, বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক প্রভৃতি দর্শনে স্বীকৃত প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার সাথে জৈন দার্শনিকদের প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার মিল দেখা যায়।১১১ মীমাংসা, বেদান্ত, সংখ্যা, যোগ, বৈশেষিক প্রভৃতি দর্শনে স্বীকৃত প্রত্যক্ষ থেকে জৈন দার্শনিকদের প্রত্যক্ষের পার্থক্য হলো, জৈন দর্শনে প্রত্যক্ষের জন্য ইন্দ্রিয় আবশ্যিক নয়। কিন্তু অন্যান্য দর্শনে ইন্দ্রিয় ছাড়া প্রত্যক্ষ অসম্ভব।

প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ : জৈন দর্শনে দুই প্রকার প্রত্যক্ষ স্বীকার করা হয়েছে।১১২ যথা, অভিজ্ঞতামূলক বা সম্ব্যবহারিক এবং অতীন্দ্রিয় বা পারমার্থিক। অভিজ্ঞতামূলক প্রত্যক্ষ বিরোধিতা বর্জিত। কাম্য বস্তুকে লাভ করার বা অকাম্য বস্তুকে বর্জন করার পথে এটি সব রকম কার্য সম্পাদন করে। অভিজ্ঞতামূলক প্রত্যক্ষ আবার ইন্দ্রিয়জাত বা অ ইন্দ্রিয়জাত হতে পারে। বাহ্য ইন্দ্রিয়ের উপর বাহ্য বস্তুর উদ্দীপনা সৃষ্টির ফলে ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ ঘটে। বাহ্য বস্তুর সংবেদনযোগ্য গুণগুলোই এ প্রত্যক্ষে উপলব্ধি করা যায়। অন্যদিকে অ-ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ মানসিক এবং এতে মনের মাধ্যমে আনন্দ, বেদনা, ইচ্ছা, অনুভূতি প্রভৃতির উপলব্ধি জন্মে। কিন্তু মন কোনো ইন্দ্রিয় নয়। ইন্দ্রিয়জাত ও মানসিক উভয় প্রকার প্রত্যক্ষে একটি বস্তুর একটি অংশের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। এসব প্রত্যক্ষে কোনো বস্তুর অসীম গুণাবলি ও সম্বন্ধকে উপলব্ধি করা যায় না।

অপরপক্ষে, অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষ। কর্ম বন্ধনের মুক্তি হলে আত্মায় সমস্ত বস্তুর জ্ঞানের যে প্রত্যাদেশ হয় তা-ই অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ। এই প্রত্যক্ষ শুধু আত্মার উপর নির্ভরশীল। অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ দুই প্রকার। অপূর্ণাঙ্গ বা বিকল এবং পূর্ণাঙ্গ বা সকল। অপূর্ণাঙ্গ অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ আবার দুই প্রকার। অবধি ও মনপর্যায়। অবধি হলো ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষ সংবেদনশীল বস্তুর প্রত্যক্ষ। মন বা আত্মা যখন কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয় তখন অবধি জ্ঞান হয়। যথার্থ সংজ্ঞা, যথার্থ বিশ্বাস ও যথার্থ আচরণের দ্বারাই এই জ্ঞান লাভ করা যায়। এই প্রত্যক্ষ হলো দূরবর্তী সংবেদনশীল বস্তুর স্বজ্ঞাজাত প্রত্যক্ষ। মনপর্যায় হলো ট্যালিপ্যাথিক দ্বারা প্রাপ্ত অন্যমনের পদ্ধতি সম্পর্কিত জ্ঞান। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ হলো সকল প্রকার দ্রব্য এবং অসংখ্য দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দ্রব্যের ধরন সম্পর্কে সর্বজ্ঞের জ্ঞান। মুক্ত আত্মার পক্ষেই এই জ্ঞান সম্ভব।

জৈন দার্শনিকগণ সবিকল্প প্রত্যক্ষের পূর্বস্তর হিসেবে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন না। কারণ, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বিশেষ গুণাবলিসহ বস্তুর প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যর্থ হয়। এ জ্ঞান দ্বারা ভাল অর্জন ও মন্দ বর্জন করা যায় না।১১৩

(২) স্মৃতি : স্মৃতি হলো পূর্ব প্রত্যক্ষিত কোনো বস্তুর পূর্ব-বিন্যাসকে ঠিক সেভাবে পুনরুদ্রেক করার মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান। স্মৃতি আত্মার একটি বিশেষ শক্তি। যেহেতু স্মৃতি পূর্ব-প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল সেহেতু তা স্বতন্ত্র কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে জৈন দার্শনিকদের মতে, স্মৃতি এর উৎপত্তির জন্য পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষের উপর নির্ভরশীল এবং স্মৃতি আত্মায় এর পূর্ব বিন্যাস থেকে উৎপন্ন হয় একথা সত্য। কিন্তু স্মৃতি এর বস্তুকে জানার জন্য পূর্ব-প্রত্যক্ষের উপর নির্ভর করে না। যেহেতু স্মৃতি পূর্ব-প্রত্যক্ষিত বস্তুর যথার্থ প্রকৃতি যথার্থভাবে নির্ধারণ করতে পারে সেহেতু তা একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ।

(৩) প্রত্যাভিজ্ঞা : প্রত্যাভিজ্ঞা প্রত্যক্ষ ও স্মৃতি দ্বারা উৎপাদিত যৌগিক জ্ঞান। প্রত্যাভিজ্ঞার দ্বারা একটি বস্তুর অভিন্নতা, সাদৃশ্য, পার্থক্য, আন্তঃসম্পর্ক এবং বস্তু ও তার চিহ্নের সম্পর্ক উপলব্ধি করা যায়। যেমন, এ হয় সেই দেবদত্ত। এতে পৃথক প্রাণী অথবা, বস্তুর মধ্যে জাতিগত গুণাবলি উপলব্ধি করা হয়। জৈন দার্শনিকদের মতে, প্রত্যাভিজ্ঞা একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ। উপমান প্রত্যাভিজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

(8) তর্ক বা আরোহ : অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাধ্য ও মধ্য পদের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্পর্কের যে জ্ঞান তা-ই আরোহ বা তর্ক। এ জ্ঞান সাধ্য বা পক্ষ পদের সহ-উপস্থিতি বা অন্বয়ী-ব্যাপ্তির দ্বারা সাধিত হতে পারে, আবার এ দুয়ের সহঅনুপস্থিতি অর্থাৎ ব্যতিরেকী ব্যাপ্তি দ্বারাও সাধিত হতে পারে। যেমন, শুধু আগুন থাকলেই ধোয়া থাকে। যেখানে ধোয়া সেখানেই আগুন। অথবা, আগুন ছাড়া ধোয়া থাকে না। যেখানে ধোয়া নেই সেখানে আগুন নেই। তর্কপ্রমাণ সাধ্য পদের দ্বারা মধ্য পদের সর্বজনীন উপস্থিতি নির্দেশ করে।১১৪

(৫) অনুমান বা অবরোহ : অনুমান বা অবরোহ হলো মধ্য পদের জ্ঞান থেকে সাধ্য পদের জ্ঞান নির্দেশ করা। যেমন, ধোয়া থেকে অগ্নি অনুমিত হয়।১১৫ ধোয়া মধ্য পদ, অগ্নি সাধ্য পদ। অনুমান তর্ক নির্দেশিত ব্যাপ্তির উপর নির্ভরশীল। এতে সাধ্য, পক্ষ ও মধ্য এই তিনটি পদ থাকে। সাধ্য পদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত পদই মধ্য পদ। সাধ্য পদের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির সঙ্গে মধ্যপদের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি সংযুক্ত। এটাই মধ্য পদের একমাত্র লক্ষণ।

(৬) শব্দ বা আগম : শব্দ হলো বিশ্বস্ত বা আপ্ত ব্যক্তি নির্দেশিত বস্তুর জ্ঞান। যে বাক্যের দ্বারা শব্দ-জ্ঞান প্রকাশিত হয় সে বাক্যের পদসমূহ তাদের প্রাকৃতিক ব্যক্তর্থের ক্ষমতা ও প্রথা অনুসারে তাদের বস্তুকে প্রকাশ করে। যিনি জ্ঞানের বস্তুগুলো যেভাবে আছে যথার্থ অর্থে ঠিক সেভাবেই এগুলোকে জানেন এবং তাঁর ধারণা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন তিনিই বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এরূপ ব্যক্তির বচন বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বস্তুর প্রকৃতির বিরোধী নয় ।।

শব্দ প্রমাণের শ্রেণিবিভাগ : শব্দ দুই প্রকার। লৌকিক ও লোকত্তোর । জনক ও অন্যান্য ব্যক্তির দ্বারা উচ্চারিত শব্দ লৌকিক এবং তীর্থঙ্করদের দ্বারা উচ্চারিত শব্দ লোকত্তোর।১১৬ জৈন দর্শন বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাস করে না। এই দর্শন তীর্থঙ্করদের প্রামাণ্যে বিশ্বাসী। কারণ, তীর্থঙ্করগণ পূর্ণতা অর্জন করেছেন এবং তাঁরা সর্বজ্ঞ।

জ্ঞানের প্রামাণ্য : জৈন দার্শনিকদের মতে, জ্ঞানের বিষয়ের সঙ্গে জ্ঞানের মিল থাকলে জ্ঞান প্রামাণ্য, আর বিষয়ের সঙ্গে মিল না থাকলে প্রামাণ্য নয়। অর্থাৎ জ্ঞানের প্রামাণ্য জ্ঞানের মধ্যে নয়, অন্য শর্তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং জ্ঞান পরতঃপ্রামাণ্য। তবে জৈন দার্শনিকগণ মুক্ত পুরুষ অর্থাৎ তীর্থঙ্করগণ যে জ্ঞানের অধিকারী হন সে জ্ঞানকে স্বতঃপ্রামাণ্য বলে মনে করেন।

জৈন প্রমাণতত্ত্বের উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, জৈন প্রামণতত্ত্ব ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার অন্যান্য প্রমাণতত্ত্ব থেকে স্বতন্ত্র। যদিও জৈন প্রমাণতত্ত্বে মীমাংসা ও বেদান্ত প্রমাণতত্ত্বের মতো ছয়টি প্রমাণকে স্বীকার করা হয়েছে তবুও তাঁদের স্বীকৃত অধিকাংশ প্রমাণই মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে স্বীকৃত প্রমাণ থেকে পৃথক। মীমাংসা ও বেদান্তের মতো জৈন দার্শনিকগণও প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং শব্দ-প্রমাণকে স্বীকার করেছেন। তবে প্রত্যক্ষ ও অনুমান সম্পর্কে জৈন প্রমাণের ব্যাখ্যা মীমাংসা ও বেদান্ত দার্শনিকদের ব্যাখ্যা থেকে আলাদা। শব্দ-প্রমাণের ক্ষেত্রে তাঁরা অতিমানবীয় শব্দকে স্বীকার করেননি। শুধু মানবীয় শব্দকেই স্বীকার করেছেন। যদিও শব্দপ্রমাণলব্ধ জ্ঞানকে জৈনগণ লৌকিক ও লোকোত্তর এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন তবুও এ দুটি বিভাগই মানবীয় শব্দ-প্রমাণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ।

উল্লেখ্য যে, একমাত্র জৈন দর্শন ছাড়া অন্য কোনো ভারতীয় দর্শনে শুধুমাত্র মানবীয় শব্দ-প্রমাণ স্বীকৃত হয়নি। এর কারণ হলো, জৈন দার্শনিকগণ বেদবিরোধী ও নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, অথচ তারা শব্দ-প্রমাণকে স্বীকার করেছেন। সুতরাং যৌক্তিক কারণেই তাঁদের শব্দ-প্রমাণ শুধু মানবীয় শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জৈন দর্শন ছাড়া অন্য কোনো ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় অনুমানকে পাশ্চাত্য দর্শনের মতো আরোহ ও অবরোহ অনুমানে ভাগ করে আলোচনা করেনি। বরং বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় অনুমানের মধ্যে পাশ্চাত্য আরোহ ও অবরোহ উভয় প্রকার অনুমান একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। কিন্তু একমাত্র জৈন দার্শনিকগণই অনুমানকে আরোহ ও অবরোহ অনুমানে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। অবরোহকে তাঁরা বলেছেন অনুমান এবং আরোহকে বলেছেন তর্ক বা আরোহ। এছাড়া তাঁরা বুদ্ধিমান, অতি বুদ্ধিমান এবং কম বুদ্ধিমানের জন্য তিন প্রকার অনুমানের কথাও বলেছেন। মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে আলোচিত উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি এই তিন প্রকার প্রমাণের মধ্যে উপমানকে জৈনগণ প্রত্যাভিজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তারা জ্ঞাতার ও প্রমাণের প্রকৃতির ভিন্নতা অনুসারে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য ও পরতঃপ্রামাণ্য উভয়কে স্বীকার করেছেন। কিন্তু অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় যেমন, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও অদ্বৈত বেদান্ত দর্শন জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য এবং বৌদ্ধ, ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করে। সুতরাং জ্ঞানের প্রামাণ্যর ক্ষেত্রে জৈন দর্শনে ভারতীয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতের সমন্বয় দেখা যায়। এসব দিক বিবেচনা করে এটা বলা যায় যে, ভারতীয় নিরীশ্বরবাদী জৈন দর্শন প্রমাণতত্ত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র অবদান রেখেছে এবং এ দর্শন ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বে নতুন ধারণা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। জৈন দর্শনে স্বীকৃত প্রমাণগুলো এবং এগুলোর দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রকারভেদ নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।

ছকে জৈন প্রমাণতত্ত্ব
ছকে জৈন প্রমাণতত্ত্ব

ভারতীয় দর্শনের মীমাংসা, বেদান্ত, ন্যায়, সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন এই আটটি সম্প্রদায়ের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে উপরের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ :

ভারতীয় দর্শনের সবকটি সম্প্রদায় জ্ঞানবিদ্যার আলোচনাকে সাধারণভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং গুরুত্ব সহকারে এর আলোচনা করেছে। এর ফলে ভারতীয় দর্শনে জ্ঞানবিদ্যার আলোচনা সকল দার্শনিক সম্প্রদায়ের কাছে অপরিহার্য বিষয়রূপে পরিগণিত হয়েছে। জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় প্রধানত প্রমা, প্রমেয়, প্রমাণ, জ্ঞানের প্রামাণ্য এবং ভ্রম ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে প্রমাণতত্ত্বের আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। ভারতীয় দার্শনিকদের দর্শনালোচনার এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করে বলা যায়, পাশ্চাত্য দর্শনের সকল দার্শনিক ভারতীয় দার্শনিকদের মতো জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় অপরিহার্য গুরুত্ব আরোপ করেননি।

মোক্ষ বা মুক্তির প্রকৃতি নিয়ে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদীভেদে সবগুলো সম্প্রদায়ই মোক্ষ বা মুক্তির পথ নির্দেশ করাকে দর্শনালোচনার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মোক্ষলাভের যথার্থ উপায় জানার জন্য যথার্থ জ্ঞানলাভের পদ্ধতি তথা প্রমাণতত্ত্বের আলোচনাকে প্রাধান্য দিয়েছে। এছাড়া, অধিকাংশ ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় অধিবিদ্যা সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং অধিবিদ্যার জ্ঞান পাওয়ার জন্যও জ্ঞানবিদ্যা, বিশেষত প্রমাণতত্ত্বের আলোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, ভারতীয় দার্শনিকদের মোক্ষতত্ত্ব এমনকি অধিবিদ্যার আলোচনাও জ্ঞানবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। কারণ যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা, যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায় বা প্রমাণ, ভ্রান্ত জ্ঞান থেকে যথার্থ জ্ঞানের পার্থক্যের মানদণ্ড, প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে মোক্ষতত্ত্ব এবং অধিবিদ্যার জ্ঞান পাওয়া যে অসম্ভব একথা ভারতীয় দার্শনিকগণ যথার্থই অনুধাবন করেছেন। তাই এক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বেশি বিচারমূলক মনে হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে আধুনিক যুগে, বিশেষত কান্টের দর্শনে, অধিবিদ্যার আলোচনার জন্য জ্ঞানবিদ্যার উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। এছাড়া ভারতীয় প্রায় সবগুলো দার্শনিক সম্প্রদায়ই যথার্থ জ্ঞানকে আগে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং পরে এই জ্ঞান পাবার উপায় তথা প্রমাণতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। যা পাশ্চাত্য দর্শনে দেখা যায় না। পাশ্চাত্য দর্শনে প্রাচীন যুগ থেকে জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনা হয়েছে। তবে আধুনিক যুগের জার্মান দার্শনিক কান্টই সম্ভবত প্রথম দার্শনিক যিনি সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যাকে বিচারবিযুক্তবাদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

এ অধ্যায়ে আলোচিত আটটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বৌদ্ধ ও বৈশেষিক দর্শনে শুধু প্রত্যক্ষ ও অনুমান নামক দুটি প্রমাণ স্বীকৃত হয়েছে। সাংখ্য ও যোগ দর্শন বৌদ্ধ ও বৈশেষিক দর্শনে স্বীকৃত প্রত্যক্ষ ও অনুমানের সঙ্গে শব্দ প্রমাণ, ন্যায় দর্শন এই তিনটির সঙ্গে উপমান প্রমাণ। এবং মীমাংসা ও বেদান্ত এই চারটি প্রমাণের সঙ্গে অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি নামক দুটি প্রমাণ যোগ করে মোট ছয়টি প্রমাণকে স্বীকার করেছে। জৈন দর্শন মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে স্বীকৃত উপমান, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি প্রমাণ স্বীকার করেনি। তবে এ দর্শনে প্রত্যাভিজ্ঞা ও স্মৃতিকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে এবং অন্যান্য দর্শনে স্বীকৃত অনুমান প্রমাণকে আরোহ ও অবরোহে পৃথক রূপ দিয়ে মোট ছয়টি প্রমাণ স্বীকার করেছে। এককথায়, আলোচিত আটটি সম্প্রদায় সর্বোচ্চ ছয়টি এবং সর্বনিম্ন দুটি প্রমাণ স্বীকার করেছে এবং সকলেই সাধারণভাবে প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেছে। এই কারণে ভারতীয় দার্শনিকদেরকে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতো বিশুদ্ধ বুদ্ধিবাদী ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী গোষ্ঠীতে পৃথক করা যায় না। এছাড়া, পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানের সর্বোচ্চ তিনটি উপায় যথা, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও স্বজ্ঞাকে স্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় দর্শনের স্বীকৃত ছয়টি প্রমাণ পাশ্চাত্য দর্শনে অনুপস্থিত।

জ্ঞানের প্রামাণ্যর সমস্যাটিও ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার একটি সাধারণ বা অপরিহার্য সমস্যা। উপরের আটটি সম্প্রদায়ই প্রমাণতত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের প্রামাণ্য সম্পর্কে আলোচনা করেছে। ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞানের প্রামাণ্যকে অপরিহার্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার কারণ হলো, ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যায় সকল জ্ঞানকেই যথার্থ জ্ঞান বলা হয়নি। বরং জ্ঞানের মধ্যে যথার্থ এবং অযথার্থ দুই প্রকার জ্ঞানই অন্তর্ভুক্ত। তাই যথার্থ জ্ঞান বা প্রমাকে অযথার্থ জ্ঞান বা অপ্রমা থেকে পৃথক করার জন্য ভারতীয় দর্শনের আটটি সম্প্রদায়ই জ্ঞানের প্রামাণ্য নিয়ে আলোচনা করেছে। ফলত সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনে জ্ঞানের স্বতঃপ্রামাণ্য এবং ন্যায়, বৈশেষিক ও বৌদ্ধ দর্শনে জ্ঞানের পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকৃত হয়েছে। জৈন দর্শনে সাধারণ মানুষের জ্ঞানকে পরতঃপ্রামাণ্য এবং তীর্থঙ্করদের জ্ঞানকে স্বতঃপ্রামাণ্য বলা হয়েছে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় জ্ঞানের প্রামাণ্যের সমস্যাটি ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার মতো অপরিহার্য গুরুত্ব পেতে দেখা যায় না ৷ এর অন্যতম কারণ হলো, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যায় জ্ঞান বলতে যথার্থ ও অযথার্থ উভয় প্রকার জ্ঞানকে বুঝানো হয়নি, বরং শুধুমাত্র যথার্থ জ্ঞানকে বুঝানো হয়েছে। সম্ভবত এ কারণেই শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী জ্ঞানের প্রামাণ্যের প্রশ্নটিকে ইউরোপীয় দর্শনের সমস্যা না বলে ভারতীয় দর্শনের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।১১৭

ভারতীয় দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় তাঁদের ঐতিহ্যগত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অর্থাৎ পূর্বপক্ষ, পূর্বপক্ষ খণ্ডন ও উত্তরপক্ষ, পদ্ধতি অনুসরণ করে বিচারমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। কারণ, ভারতীয় দর্শনে কোনো সম্প্রদায় যখন কোনো নতুন প্রমাণকে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছে তখন এর পেছনে যুক্তি উপস্থাপন করেছে। আবার যখন অন্য কোনো সম্প্রদায়ের স্বীকৃত কোনো প্রমাণকে স্বতন্ত্র প্রমাণ নয় বলে বর্জন করেছে তখনও এর বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছে। এসব কারণে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতীয় দর্শনের একটি সম্প্রদায় যখন তাদের প্রমাণতত্ত্ব উপস্থাপন করেছে তখন অন্য সম্প্রদায়ের নির্দেশিত প্রমাণতত্ত্বকে উপেক্ষা করেনি। পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচনায় ভারতীয় দর্শনালোচনার এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। কারণ, পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ তাঁদের দার্শনিক মতবাদ উপস্থাপনের সময় আবশ্যিকভাবে প্রচলিত মতবাদকে বিচার করে দেখেননি। যদিও ব্রিটিশ দার্শনিক লক, বার্কলে ও হিউমের জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি লক্ষ করা যায় ৷

এ অধ্যায়ে ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার, বিশেষত ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বের, আলোচনাকালে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা আলোচিত হয়নি। পরবর্তী অধ্যায়ে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যাই আমাদের আলোচ্য বিষয়। আলোচনার অগ্রগতিতে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখবো যে, চার্বাক প্রমাণতত্ত্ব পূর্বালোচিত আটটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের প্রমাণতত্ত্বের চেয়ে স্বতন্ত্র। মূলত ভারতীয় দর্শনে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যা অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। কারণ, একমাত্র চার্বাক জ্ঞানবিদ্যায় শুধুমাত্র একটি প্রমাণ, বা প্রত্যক্ষকে স্বীকার করা হয়েছে। তাই চার্বাক ভিন্ন অন্য কোনো ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়কে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। প্রত্যক্ষ-প্রমাণ তথা অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তিতে চার্বাকগণ ঈশ্বর, আত্মা, কার্যকারণের আবশ্যিক সম্পর্ক ইত্যাদি অভিজ্ঞতা দ্বারা পাওয়া যায় না এমনসব ধারণাকে পরিহার করেছেন। এছাড়া, চার্বাকগণ অন্যান্য সকল সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃত অনুমান প্রমাণকেও অস্বীকার করেছেন যা ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় থেকে চার্বাক দর্শনকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে চার্বাক জ্ঞানবিদ্যার আলোচনার সময় আমরা ভারতীয় জ্ঞানবিদ্যার ইতিহাসে চার্বাকদের স্থান নির্ণয় করতে প্রয়াসী হবো। নিম্নে চার্বাকদের প্রমাণতত্ত্বসহ ভারতীয় প্রমাণতত্ত্ব সংক্ষেপে ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো। সুবিধার জন্য জৈন প্রমাণতত্ত্ব সর্বপ্রথমে সন্নিবেশিত হলো ।

ছকে ভারতীয় প্রমাণতত্ত্ব
ছকে ভারতীয় প্রমাণতত্ত্ব

* অন্যান্য সম্প্রদায় কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞার সাথে অভিন্ন নয়।

তথ্যপঞ্জি

১. ভারতীয় দর্শন প্রধানত নয়টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এর মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত এ ছয়টি সম্প্রদায় বেদ বিশ্বাসী এবং চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন এ তিনটি বেদ বিরোধী। বেদ বিশ্বাসী ছয়টি সম্প্রদায়কে ষড়দর্শন বলা হয়। এ ছয়টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংখ্য ও মীমাংসা দর্শন বেদে বিশ্বাস করলেও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। বাকি চারটি সম্প্রদায় ঈশ্বর ও বেদ উভয়ে বিশ্বাস করে। অবশ্য এ নয়টি সম্প্রদায় ছাড়া তন্ত্র ও শৈব নামের আরও দুটি সম্প্রদায় আছে। তবে তাদের গুরুত্ব ভারতীয় দর্শনে উল্লেখযোগ্য নয়। তাই এখানে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায় বলতে এ নয়টি সম্প্রদায়কেই বোঝানো হলো।

২. Paul Edwards (ed.): The Encyclopedia of Philosophy. New york. Macmillan Publishing Co. Inc, and Free Press, 1972, Vol. I. goals; F. Thilly: A History of Philosophy. Allahabad, Central Book Depot, 1978. 4. OY! Robert Ackermann: Theories of Knowledge, Bombay, Tata McGrow-hill Publishing Co. Ltd. 1956 45 ভূমিকায় প্লেটো ও এরিস্টটলের হাতেই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার শুরু বলা হয়েছে। অবশ্য Paul Edwards (ed.): The Encyclopedia., গ্রন্থের ৯ পৃষ্ঠায় যদিও সোফিস্টদের হাতেই পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সূত্রপাত বলে উল্লেখ করা হয় তবুও প্লেটোকেই “real originator of epistemology” বলা হয়।

৩. S. N. Das Gupta: A History of Indian Philosophy, New York. Cambridge University Press, 1969, Vol. I, পৃ.৬৫।

৪. নৈয়ায়িকগণই বৈধ জ্ঞান বুঝাতে প্রমা এবং অবৈধ জ্ঞান বুঝতে অপ্রমা কথা দুটির প্রচলন বলেন। প্রমাকে সাধারণত এমন একটি জ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যার মধ্যে সত্য ও নতুনত্ব এ দুটো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্রথম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনের সবগুলো গোষ্ঠীই একমত। দ্রষ্টব্য: D. M. Datta: Six Ways of Knowing, Calcutta, University of Calcutta, 1972, পৃ. ২০।

৫. মহর্ষি জৈমিনি (৪০০ খ্রি:পূ:) প্রতিষ্ঠিত মীমাংসা দর্শনের অন্য নাম জৈমিনি দর্শন। বেদ কর্মকাণ্ড বা পূর্বকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড বা উত্তরকাণ্ডে বিভক্ত। মীমাংসা দর্শন বেদের কর্মকাণ্ড এবং বেদান্ত দর্শন বেদের জ্ঞানকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। বেদের পূর্বকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে এ দর্শনকে পূর্বমীমাংসাও বলা হয়। জৈমিনি প্রণীত মীমাংসাসূত্র-ই এর মূল গ্রন্থ। খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সমাজ কাঠামো বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথা, বৌদ্ধ দর্শনের আপেক্ষিকতাবাদ, সাম্যবাদ ও অহিংসা নীতির দ্বারা সংশয়ের সম্মুখীন হয়। ধর্মকর্মের এ বিতর্কের সমাধানকল্পে জৈমিনি বিপুলাকার মীমাংসাসূত্র প্রণয়ন করেন। (দ্রষ্টব্য: রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভারতীয় দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ফেব্রুয়ারি,১৯৮৩, পৃ.৩৬৫) শবরস্বামী মীমাংসাসূত্রের একজন খ্যাতনামা ভাষ্যকার। শবরস্বামীর পরবর্তী মীমাংসাসূত্রের ভাষ্যকারদের মধ্যে কুমারিল ভট্ট (৭০০ খ্রি:) এবং তাঁর শিষ্য প্রভাকর মিশ্র (৭০০ খ্রি:) সুপ্রসিদ্ধ। কুমারিল ভট্ট শবরস্বামীর মতকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু প্রভাকর মিশ্র কুমারিল ভট্টের মত গ্রহণ করেন না। এদের মতপার্থক্যের কারণে মীমাংসা দর্শন কুমারিল মীমাংসা ও প্রভাকর মীমাংসা, এ দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। পার্থসারথী মিশ্র (১৩০০ খ্রি:) কুমারিল ভট্টের সমর্থক একজন প্রখ্যাত মীমাংসা দার্শনিক।

৬. J. N. Sinha: A History of Indian Philosophy, Vol. I, Calcutta, Sinha Publishing House, 1956, পৃ.৭৭২।

৭. প্রভাকর মিশ্র ও তার অনুসারীগণ প্রমাণকে প্রত্যক্ষ ও অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

সি. ডি. বিজলবনের মতে, প্রভাকরের সংজ্ঞা শূন্যগর্ভ। কারণ, অনুভূতি শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া দুঃসাধ্য। কুমারিল ভট্টের মতে, প্রমাণ হলো বস্তুর সেই নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত জ্ঞান যা অন্য কোনো জ্ঞানের দ্বারা নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কুমারিল এবং তার অনুসারীদের প্রমাণ সম্পর্কিত এ সাধারণ সংজ্ঞাটিতে ন্যায়, বৈশেষিক এমনকি বৌদ্ধ দর্শনের প্রমাণ সম্পর্কিত মতবাদের মূল সূরের সমন্বয় লক্ষিত হয়। দ্রষ্টব্য : C. D. Bijalwan, পূর্বোক্ত, পৃ.৪৫।

৮. ইন্দ্রিয় বলতে এখানে জ্ঞানেন্দ্রিয়কে বুঝানো হলো। মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে, জ্ঞানেন্দ্রিয় ছয়টি। এর মধ্যে পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়। যথা চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। একটি অন্তরেন্দ্রিয়, অর্থাৎ মন। প্রতিটি বাহেন্দ্রিয় এক একটি ভূত দ্বারা গঠিত। চক্ষু তেজস দ্বারা গঠিত। তেজসের ধর্ম হলো বর্ণ। তাই চক্ষু প্রত্যক্ষ করে। কর্ণ ব্যোম বা আকাশ দ্বারা গঠিত। ব্যোমের ধর্ম শব্দ। তাই কর্ণ শোনে। নাসিকা ক্ষিতির দ্বারা গঠিত। ঘ্রাণ ক্ষিতির ধর্ম। তাই নাসিকা ঘ্রাণ নেয়। জিহ্বা অপ বা জল দ্বারা গঠিত। জলের ধর্ম আস্বাদন। তাই জিহ্বা স্বাদ গ্রহণ করে। ত্বক মরুৎ বা বায়ুর দ্বারা গঠিত। বায়ুর ধর্ম স্পর্শ। তাই ত্বক স্পর্শ করে। অর্থাৎ যে ভূত দ্বারা যে বাহ্য ইন্দ্রিয় গঠিত সে বাহ্য ইন্দ্রিয় সে উপাদানের বিশেষ গুণ প্রত্যক্ষ করে। মন বা অন্তরেন্দ্রিয় কোনো ভৌত গুণের দ্বারা গঠিত নয় বলে এর প্রত্যক্ষের সীমারেখা নাই। মন বাহ্য ইন্দ্রিয়গুলোর তদারক করে সবরকম জ্ঞানকে সুবিন্যস্ত করে। সাংখ্য দর্শনে মোট একাদশ ইন্দ্রিয় স্বীকার করা হয়েছে। পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় এবং মন। মন জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় উভয়ের সহায়ক। অবশ্য সাংখ্য দর্শনে মন ছাড়াও বুদ্ধি ও অহং নামে আরও দুটি অন্তকরণের কথা বলা হয়েছে। এরা সকলেই জ্ঞানোৎপত্তি ও জ্ঞানকে কর্মে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করে থাকে। সুতরাং বলা যায়, সাংখ্য দর্শন তেরোটি ইন্দ্রিয় স্বীকার করেছে। তিনটি অভ্যন্তরীণ এবং দশটি বাহ্য। এছাড়া বুদ্ধ অভিধর্ম মতাবলম্বীরা বাইশটি ইন্দ্রিয়ের কথা বলেছেন।

৯: মীমাংসা দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্র, প্রাচীন ন্যায় দার্শনিক উদ্দয়ঠাকুর প্রমুখ ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর ছয় প্রকার সংযোগ হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে তিনটি মুখ্য এবং তিনটি গৌণ। মুখ্য সংযোগগুলো হলো, (১) সংযোগ, অর্থাৎ কোনো দ্রব্যের সাথে ইন্দ্রিয়সংযোগ, (২) সমবায়, অর্থাৎ কোনো শব্দের সাথে ইন্দ্রিয়সংযোগ, (৩) বিশেষ্য-বিশেষভাব, অর্থাৎ অনস্তিত্বের সাথে ইন্দ্রিয়সংযোগ। গৌণ তিনটি সংযোগ হলো, (১) সামান্যলক্ষণ, (২) জ্ঞানলক্ষণ ও (৩) যোগজ সংযোগ। সুতরাং নব্যনৈয়ায়িকদের মতে, সংযোগ নয় প্রকার। (দ্রষ্টব্য : C. D. Bijalwan : Indian Theory of Knowledge, পূর্বোক্ত, পৃ.১১০-১১৩) এজন্য নৈয়ায়িকগণ একে সংযোগ না বলে সন্নিকর্ষ বলেছেন। কারণ, সার্বিক বা গুণ ইত্যাদির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে না, বরং সন্নিকর্ষ ঘটে।

১০. সমযোগৰ্থে চ সং শব্দো দুস্প্রয়োগনিবারণম্ ।
কুমারিল: শ্লোকবার্তিক, বেনারস, চৌখম্ব সংস্কৃত সিরিজ,১৮৯৮-৯৯,৪:৩৮।

১১. পূর্বোক্ত,৪:৬০,৬৯,৮৩–৮৫। পার্থ সারথী মিশু: শাস্ত্রদীপিকা, বোম্বে, নির্ণয় সাগর প্রেস,১৯১৫, পৃ.

১২. J. N. Sinha: History of Indian Philosophy, Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৭৭৩।

১৩. মেয়মাতৃপ্রমাসু সা।… দ্রব্যজাতিগুণেম্বিন্দ্রিয়সংযোগোথা সা প্রত্যক্ষা প্ৰতীতিঃ ৷
শালিকানাথ : প্রকরণপঞ্চিকা, পণ্ডিত মুকুন্দ শাস্ত্রী (সম্পাদিত), বেনারস, চৌখম্ব সংস্কৃত সিরিজ,১৯০৩, পৃ.৫২।

১৪. মীমাংসা মতে, যেহেতু সকলপ্রকার জ্ঞানই আত্মায় উৎপন্ন হয় সেহেতু আত্মার দিক থেকে বিচার করলে জ্ঞান এক প্রকার। তা হলো প্রত্যক্ষ। এছাড়া প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি জ্ঞানের যে বিভাগ মীমাংসা দ র্শনে স্বীকার করা হয়েছে তা মূলত জ্ঞানের বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিচার করে। অর্থাৎ জ্ঞানের বিষয়বস্তু যে বিভিন্ন ধারায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে আসে সেদিক থেকে বিচার করে জ্ঞানের বিভিন্ন প্রকারভেদ স্বীকার করা হয়েছে। দ্রষ্টব্য: S. N. Das Gupta: History., Vol. I, পূর্বোক্ত, পৃ.৩৮২–৩৮৩।

১৫. কুমারিল : শ্লোকবার্তিক, পূর্বোক্ত,৪:১১২,১১৩।

১৬. J. N. Sinha: History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৭৭৪ ।

১৭. কুমারিল : শ্লোকবার্তিক, পূর্বোক্ত,৪:১২০-১২৫।

১৮. J. N. Sinha: History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৭৭৭। এবং S. N. Das Gupta: History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৭৮।

১৯. কুমারিল হেতুপদের সঙ্গে সামান্যধর্ম বা সাধ্যপদের নিত্য সম্পর্ককেই ব্যাপ্তি বলেছেন। তাঁর মতে, সামান্যধর্মের ভূয়োদর্শনহেতু ব্যাপ্তি হয়। সাংখ্যকার কপিলের মতে, নিয়ত ধর্মলক্ষণযুক্ত উভয় পদের সম্পর্কই ব্যাপ্তি। বাচস্পতি, জয়ন্ত, উদয়ন ও ভরদ্রাজ ব্যাপ্তিকে সাধ্য ও হেতুর মধ্যকার নিয়ত, শর্তহীন স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে বৈশেষিক দার্শনিক কণাদ ব্যাপ্তি শব্দটির ব্যবহার না করে ‘প্রসিদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রশস্তপদ ‘ব্যাপ্তি’ বা ‘প্রসিদ্ধি’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘সহচর্য’ কথাটির ব্যবহার করেছেন। দ্রষ্টব্য, J. N. Sinha: History., পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯০।

২০. জ্ঞানসম্বন্ধনিয়মসৈকদেশস্য দর্শনাৎ ।
একদেশান্তরে বুদ্ধিরনুমানসবাধিতে।।
শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.৬৪ (একদেশ = লিঙ্গ এবং একদেশান্তর = সাধ্য)

২১. J. N. Sinha: History., Vol. I, পূর্বোক্ত, পৃ.৩৮৯।

২২. Ganga Nath Jha: Indian Thought, Allahabad University of Allahabad, 1911,
পৃ.৪৯ শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.৭৮-৭৯। পার্থসারথী মিশ্র: শাস্ত্রদীপিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.৬৪,৬৯।

২৩. বাক্যার্থে তু পদার্থেভ্যঃ সম্বন্ধানুভবাদ্ ঋতে ।
বুদ্ধিরুৎপদ্যতে তেন ভিন্নাসাবক্ষবুদ্ধিবৎ।।
কুমারিল: শ্লোকবার্তিক, পূর্বোক্ত, শব্দ,১০৯।

২৪. শাস্ত্রং শব্দবিজ্ঞানাদসন্নিকৃষ্টে২র্থে বুদ্ধি: (পৃ.৮৭)।
এবং, ন শাস্ত্রব্যতিরিক্তং শব্দমস্তি (পৃ.৯৪)। শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত।

২৫. সাদৃশ্যদর্শনোথং জ্ঞানং সাদৃশ্য বিষয়কমুনমানম্। শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.১১০ ।

২৬. S. N. Das Gupta: History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৯১ ।

২৭. দৃষ্টেনার্থেন দৃষ্টস্যার্থস্যার্থান্তরকল্পনায়ামসত্যামনুপপত্তিমাপাদয়তা যা২র্থান্তরকল্পনা সা২র্থাপত্তিঃ ।
শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.১১৩।

২৮. পার্থসারথী মিশ্র: শাস্ত্রদীপিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.৭৭-৭৯।

২৯. J. N. Sinha : A History of Indian Philosophy, Vol. II, Calcutta, Central Book Agency, 1952. পৃ.৫৬৮।

৩০. পূর্বোক্ত, Vol. I. পৃ.৭৮৯ ।

৩১. সর্বং প্রমাণং প্রমেয়াবিনাভাবি।
ন চাভাবাখ্যস্য প্রমাণস্য প্রমেয়ং কিং চিৎ প্রতীতিবলসিদ্ধ। শালিকানাথ: প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ.১১৮।
প্রমেয়াসদৃভাবাচ্চ ন প্রমাণানন্তরমকল্পত ইতি স্থিত। পূর্বোক্ত, পৃ.১২৫।

৩২. মহর্ষি বাদরায়ণ পাঁচশত পঞ্চান্নটি সূত্র সমন্বিত যে ব্ৰহ্ম সূত্র রচনা করেন একে ব্যাসসূত্র, বেদান্তসূত্র, বাদরায়ণসূত্র, শারীরকৃতসূত্র, শারীরক মীমাংসা, উত্তর মীমাংসা, উপনিষদ দর্শন, বেদান্ত দর্শন ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। ব্ৰহ্মসূত্র আনুমানিক ২০০ খ্রি: পূ: অব্দের রচনা। ব্রহ্মসূত্রের সূত্রগুলো সংক্ষিপ্ত হওয়ায় এর উপর বিভিন্ন ভাষ্যকার ভাষ্য রচনা করেন। ভাষ্যগুলোর মধ্যে শঙ্করাচার্য রচিত শারীরক ভাষ্য উল্লেখযোগ্য। তার ব্যাখ্যাত বেদান্তকে অদ্বৈত বেদান্ত বলা হয়।

৩৩. তত্র প্রমায়াঃ করণং প্রমাণ। ধর্মরাজাধ্বরীন্দ্র: বেদান্ত পরিভাষা, শ্রীশচন্দ্র ঘোষাল (অনূদিত), ১ম খণ্ড, কলিকাতা, ১৩২২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫।

৩৪. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা প্রত্যক্ষ প্রমাণ, পূর্বে আলোচিত।

৩৫. ভারতীয় দর্শনে মনকে তার বিভিন্নমুখী কাজের প্রেক্ষিতে অন্তকরণ, বুদ্ধি, অহঙ্কার, চিত্ত ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। বেদান্ত দর্শনে মন বা অন্তঃকরণকে স্বতন্ত্র ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করা হয় নাই।

৩৬. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা প্রত্যক্ষ প্রমাণ, পূর্বে।

৩৭. রমেন্দ্রনাথ ঘোষ : ভারতীয় দর্শন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ফেব্রুয়ারি ‘৮৩, পৃ.৫০২।

৩৮. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা অনুমান, পূর্বে আলোচিত। Os. K.C. Bhattacharya: Studies in Vedantism, Calcutta, Calcutta University. 1909. পৃ.৫৪।

৪০. পরার্থানুমান অংশ, পূর্বে আলোচিত।

৪১. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা উপমান, পূর্বে আলোচিত।

৪২. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা অর্থাপত্তি প্রমাণ, পূর্বে আলোচিত।

৪৩. K. C. Bhattacharya: Studies in Vedantism, পূর্বোক্ত, পৃ.৬৭।

৪৪. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা অনুপলব্ধি প্রমাণ, পূর্বে।

৪৫. J. N. Sinha, History., Vol. II, পূর্বোক্ত, পৃ.৫৬৯।

৪৬. মহর্ষি গৌতম (২০০ খ্রি: পূ:) ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। স্কন্ধপুরাণে অহল্যাপতি গৌতম মুনিকেই অক্ষপাদ বলা হয়েছে। তাই মাধবাচার্য তার সর্বদর্শন সহগ্রন্থে ন্যায় দর্শনের নাম দিয়েছেন অক্ষপাদ দর্শন। গৌতম লিখিত ন্যায়সূত্র-ই ন্যায় দর্শনের মূল গ্রন্থ। বাৎসায়ন গৌতমের ন্যায়সূত্রের উপর ভাষ্য রচনা করেন। দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে মিথিলার গঙ্গেশ উপাধ্যায় ন্যায় দর্শনকে তাঁর তত্ত্বচিন্তামনি গ্রন্থে পুনরায় আলোচনা করেন। এ আলোচনাকে ভিত্তি করে দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে সোড়শ শতকের তৃতীয় পাদ পর্যন্ত মিথিলায় নব্যন্যায় গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। পনেরো থেকে সতেরো শতকের বাংলাদেশই নব্যন্যায় এর আবাসস্থল হিসেবে গণ্য হয়। দ্রষ্টব্য: রমেন্দ্রনাথ ঘোষ : ভারতীয় দর্শন, পূর্বোক্ত, পৃ.২৯৬।

৪৭. ন্যায় দর্শনে মোক্ষের জন্য ১৬টি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান লাভের কথা বলা হয়েছে। এর প্রথম দুটি হলো যথাক্রমে প্রমাণ ও প্রমেয়। দ্রষ্টব্যঃ ন্যায়সূত্র১.১.১। বুদ্ধ মতানুসারী নৈয়ায়িকগণ যে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তার উত্তর হিসেবেই ন্যায় জ্ঞানবিদ্যার জন্ম ও বিকাশ। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে, সকল প্রকার জ্ঞানই অভিজ্ঞতাপূর্ব। কিন্তু ন্যায় দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন এবং দৃঢ় অভিজ্ঞতাবাদী সম্ভাবনার প্রতিষ্ঠা করেন। দ্রষ্টব্য: C. D. Bijalwan: Indian Theory of Knowledge, 26578, “Forword”.

৪৮. প্রত্যক্ষানুমাণোপমানশব্দা : প্রমাণানি। ন্যায়সূত্র (১.১.৩)।
বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, ফনিভূষণ তর্কবাগীশ (অনূদিত), কলিকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১০১। গৌতম ন্যায়সূত্রে প্রমাণ শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই জ্ঞানের চারটি উপায় সম্পর্কে বর্ণনা দেন। ফলে ন্যায় দর্শনে প্রমাণ শব্দটির সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। দ্রষ্টব্য: C. D. Bijalwan. পূর্বোক্ত, পৃ.৪১।

৪৯. ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষোৎপন্নং জ্ঞানমব্যপদেশ্যমব্যভিচারি ব্যবসায়াত্মকং প্রত্যক্ষ। বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.১১৪। তুলনীয়, মীমাংসা প্রত্যক্ষ প্রমাণ, পূর্বে আলোচিত।

৫০. প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকারিত্বম লক্ষণম্। উদ্ধৃত: S. N. Das Gupta, History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৩৪।

৫১. জ্ঞানাকরণকং জ্ঞানাং প্রত্যক্ষ। বিশ্বনাথ: সিদ্ধান্তমুক্তাবলী, বোম্বে, নির্ণয়সাগর প্রেস,১৯১৬, পৃ.২৩৭।

৫২. জয়ন্তভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, বেনারস, বিজিঅনগরম সংস্কৃত সিরিজ,১৮৯৫, পৃ.৯৯।

৫৩. নব্যন্যায়ের দুই প্রকার প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার জন্য, বিশ্বনাথ : সিদ্ধান্তমুক্তাবলী, পূর্বোক্ত, পৃ.২৫৩-৫৪ দ্রষ্টব্য। তুলনীয় : মীমাংসা প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ, পূর্বে আলোচিত।

৫৪. S. Radhakrishnan: Indian Philosophy, Vol. II, New York, The Macmillan Publishing Co., 1962, পৃ. 60।

৫৫. দ্রষ্টব্যঃ S. N. Das Gupta, History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৩৩৯। এবং J. N. Sinha, History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৪৭৩।

৫৬. জয়ন্তভট্ট: ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত,৮৮,৯৬।

৫৭. দ্রষ্টব্য: মীমাংসা অনুমান, পূর্বে আলোচিত।

৫৮. অনুমানং দ্বিবিধ-স্বার্থং পরার্থং চ।।
তত্র স্বার্থং স্বানুমিতিহেতুঃ।। অন্নভট্ট : তর্কসংগ্রহ (অনুমান খণ্ড, শ্লোক ৪), শ্রীনারায়ণ চন্দ্র গোস্বামী অনূদিত, কলিকাতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩০৪।

৫৯. ষভু স্বয়ং ধুমাদগ্নিমনুমায় পরপ্রতিপত্ত্যর্থং পঞ্চাবয়ববাক্যং প্রযুজ্যতে তৎ পরার্থানুমান। পূর্বোক্ত (শ্লোক৫), পৃ. ৩১০।

৬০. প্রতিজ্ঞাহেতুদাহেদারণোপনয়–নিগমনান্যবয়বাঃ।
বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.২৩৫ এবং জয়ন্ত ভট্ট : ন্যায়মঞ্জরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৮৫। বাৎসায়ন উক্ত গ্রন্থে দশাবয়বযুক্ত ন্যায় অনুমানের অনুপপত্তি প্রদর্শন করে খণ্ডন করেন এবং পঞ্চাবয়বকে সমর্থন করেন। দ্রষ্টব্য, পৃ.২৩৮-২৪৩।

৬১. বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.১৪২-১৪৯।

৬২. উদ্দয়ঠাকুর এবং ভরদ্ৰাজও গঙ্গেশের মতো তিন প্রকার অনুমানের কথা বলেছেন। উদ্দয়ঠাকুর এ তিন প্রকার অনুমানের নাম দেন অন্বয়ী, ব্যতিরেকী এবং অন্বয় ব্যতিরেকী। ভরদ্রাজ, উদ্দয়ঠাকুর ও গঙ্গেশ উভয়ের নামই ব্যবহার করেন।

৬৩. প্রাচীন নৈয়ায়িক উদ্দয়ঠাকুর তিন প্রকার হেতুর কথা বলেছেন–সদর্থক বা অন্বয়ী, নঞর্থক বা ব্যতিরেকী এবং সদর্থক-নঞর্থক বা অন্বয়-ব্যতিরেকী। প্রথমটির ক্ষেত্রে সাধ্যের সাথে নিয়ত অন্বয়ী সম্পর্ক, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সাধ্যের সাথে নিয়ত ব্যতিরেকী সম্পর্ক ও তৃতীয়টির ক্ষেত্রে সাধ্যের সাথে নিয়ত অন্বয়ী ও ব্যতিরেকী সম্পর্ক বর্তমান থাকে। কেবলান্বয়ী, কেবলব্যতিরেকী ও অন্বয়-ব্যতিরেকী অনুমানে যথাক্রমে এই তিন প্রকার হেতু পদই ব্যবহৃত হয়েছে। উদ্দয়ঠাকুরের এই মতকেই নব্যনৈয়ায়িক ভরদ্রাজ ও গঙ্গেশ এবং তাদের অনুসারীগণ ব্যাখ্যা করেছেন। দ্রষ্টব্য: J. N. Sinha, History., Vol. I. পূর্বোক্ত, পৃ.৪৯৩।

৬৪. প্রসিদ্ধধৰ্মাৎ সাধ্যসাধনমুপমান, (ন্যায়সূত্র,১.১.৬)। বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.১৫২।

৬৫. J. N. Sinha: History., পূর্বোক্ত, Vol. I. পৃ.৫৫৮।

৬৬. পূর্বোক্ত, পৃ.৫৮০।

৬৭. বাচস্পতি মিশ্র : ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা, (১.১.৬)। বেনারস, বিজিওনগরম সংস্কৃত সিরিজ,১৮৯৮, পৃ.১৩৪।

৬৮. আাপ্তোদেশ: শব্দ(ন্যায়সূত্র,১.১.৭)।
বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.১৫৬। গৌতমের মতে, ঋষিগণই আপ্তব্যক্তি। কিন্তু ভাষ্যকার বাৎসায়নের মতে, সাক্ষাৎকৃতধৰ্মা অর্থাৎ যিনি ধর্ম বা পদার্থকে সুদৃঢ় প্রমাণের দ্বারা অবধারণ করেছেন, যিনি বাক্যপ্রয়োগে কৃতযত্ন অর্থাৎ প্রযুক্ত এবং যিনি এরূপ উপদেশ দানে সমর্থ অর্থাৎ উদেষ্টা তিনি ঋষি, আর্য বা ম্লেচ্ছ যাই হোন না কেন তিনিই আপ্ত ব্যক্তি।

৬৯. স দ্বিবিধো দৃষ্টাদৃষ্টার্থত্বাৎ (ন্যায়সূত্র,১.১.৮)।
বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ.১৫৭।

৭০. বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, (১.১.৮), পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৭-১৫৮।

৭১. বাক্যং বিবিধং-বৈদিক, লৌকিকং চ। বৈদিকমীশ্বরোক্ততাৎ সর্বমের প্রমাণম্ লৌকিকং ত্বাপ্তোকং প্রমাণম্ । অন্যদপ্রমাণম্। (শব্দখণ্ড, শ্লোক, ১৪) অনুংভট্ট : তর্কসংগ্রহ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৮৫। 72. D. M. Datta: Six Ways of Knowing, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬২।

৭৩. ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্য কারিকা–ই অন্যতম প্রাচীন সাংখ্য দর্শনের প্রাচীনতম প্রামাণ্য গ্রন্থ। ঈশ্বরকৃষ্ণ ছিলেন পঞ্চশিখ-এর শিষ্য। পঞ্চশিখ ছিলেন সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি কপিলের শিষ্য। কপিল ঈশ্বরকৃষ্ণের পূর্ববর্তী দার্শনিক। বাচস্পতি মিশ্র নবম শতকে ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্য কারিকা গ্রন্থের উপর তত্ত্বকৌমুদী নামক ভাষ্য রচনা করেন। সাংখ্য শব্দের একটি অর্থ যথার্থ জ্ঞান। সাংখ্য দর্শন দ্বৈতবাদী তথা পুরুষ ও প্রকৃতিতত্ত্বে বিশ্বাসী। পুরুষ হলো চেতনা বা আত্মা এবং প্রকৃতি হলো জড়। উভয়ের মিলনেই জগতের সৃষ্টি। পুরুষকেই সাংখ্য দর্শনে জ্ঞাতা বলা হয়েছে। সাংখ্য দর্শনে জ্ঞানকে মোক্ষ বা মুক্তির উপায় বলা হয়েছে।

৭৪. বিজ্ঞানভিক্ষু : সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য, (১.৮৭) Rechard Garbe (ed.), London, Ginn and Company, 1895, পৃ. 83-88।

৭৫. বাচস্পতি মিশ্র : সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী, (৪), Tr. By Ganga Nath Jha, Bombay. Tookaram Tatya. FT.C. 1896.

৭৬. দৃষ্টমনুমানমাপ্তবচনঞ্চ সর্বপ্রমাণ সিদ্ধত্বাৎ ।
ত্রিবিধং প্রমাণমিষ্টং প্রমেয়সিদ্ধিঃ প্রমাণাদ্ধি। ঈশ্বরকৃষ্ণ: সাংখ্যকারিকা, (৪), স্বামী দিবাকরানন্দ অনূদিত কলিকাতা, মডার্ন আর্ট প্রেস,১৯৮২,২য় সংস্করণ, পৃ. ১৬।

৭৭. পূর্বোক্ত (৫), পৃ. ১৯ ।

৭৮. J. N. Sinha: History., Vol. II. পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১।

৭৯. দ্রষ্টব্য : মীমাংসা সবিকল্প ও নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ অংশ, পূর্বে।

৮০. মীমাংসা অনুমান, পূর্বে ।

৮১. ঈশ্বরকৃষ্ণ : সাংখ্যকারিকা (৫), পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯ ।

৮২. পঞ্চাবয়বযোগাৎ সুখসংবিত্তি। বিজ্ঞান ভিক্ষু : সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য, (৫.২৭), পূর্বোক্ত, পৃ. ১২২। দ্রষ্টব্য : ন্যায় অনুমানের পরার্থানুমান অংশ, পূর্বে আলোচিত।

৮৩. দ্রষ্টব্য : ন্যায় অনুমানের পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান, পূর্বে আলোচিত ।

৮৪. বিজ্ঞান ভিক্ষু : সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য (১.১০১), পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।

৮৫. পূর্বোক্ত, (৫.৪৮), পৃ. ১২৬।

৮৬. পূর্বোক্ত, (৫.৪৫), পৃ. ১২৬।

৮৭. পার্থসারথী মিশ্র : শাস্ত্রদীপিকা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩৫-২৩৫, এবং J. N. Sinha: Introduction to Indian Philosophy. Agra, 1949, পৃ. ২৩২।

৮৮. মহর্ষি পতঞ্জলি প্রতিষ্ঠিত যোগ দর্শনকে পতঞ্জল দর্শন বা সাংখ্য প্রবচন নামেও অভিহিত করা হয়। পতঞ্জলি কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য মত স্বীকার করেন। পতঞ্জলির যোগ দর্শন সাংখ্য দর্শনের একটি পদ্ধতিগত ও ব্যবহারিক দিক। পার্থক্য হলো, সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু যোগদর্শন ঈশ্বরবাদী। সাদৃশ্যের কারণে পতঞ্জল দর্শনকে সাংখ্য প্রবচন নামেও অভিহিত করা হয়। যোগসূত্র বা পতঞ্জলসূত্রই যোগ দর্শনের মূল গ্রন্থ। পতঞ্জলি১৯৪টি সূত্রে যোগসূত্র লিপিবদ্ধ করেন। যোগসূত্রের উপর ব্যাস রচিত ভাষ্যকে যোগভাষ্য বা ব্যাসভাষা (৪০০ খ্রিঃ) বলে। বাচস্পতি মিশ্র ব্যাসভাষ্যের উপর তত্ত্ববৈশারদী (৯০০ খ্রিঃ) নামক ভাষ্য রচনা করেন। বিজ্ঞান ভিক্ষু রচিত যোগবার্তিক (১৬০০ খ্রিঃ) যোগদর্শনের অন্যতম ভাষ্য । যোগদর্শন সাংখ্য তত্ত্ববিদ্যাকে গ্রহণ করে এর সাথে ঈশ্বরের ধারণাকে যোগ করে। তাই যোগদর্শনকে আস্তিক সাংখ্য বলা হয় ৷

৮৯. J. N. Sinha, History., Vol. II. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৯।

৯০. প্রত্যক্ষানুমানাগম: প্রমাণানি। পতঞ্জলি: যোগসূত্র, (১.৭)।

৯১. দ্রষ্টব্য : সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যা, প্রত্যক্ষ প্রমাণ অংশ, পূর্বে আলোচিত।

৯২. দ্রষ্টব্য : সাংখ্য অনুমান, পূর্বে আলোচিত।

৯৩. পতঞ্জলী : যোগসূত্ৰ (১.৭)।

৯৪. দ্রষ্টব্য : সাংখ্য শব্দ প্রমাণ, পূর্বে আলোচিত।

৯৫. যৎ সাংখ্যেঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে ।
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।। (শ্রীমদ্ভগবদগীতা-৫.৫)।
জগদশী চন্দ্র ঘোষ (অনূদিত): শ্রীমদ্ভগবদগীতা, কলিকাতা, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, পঞ্চদশ সংস্করণ, ১৩৮৪ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৭৭।

৯৬. ঋষি কণাদ (৩০০ খ্রিঃ পূঃ) বৈষেশিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রকৃত নাম উলুক। তাই মাধবাচার্য তার সর্বদর্শন সংগ্রহ গ্রন্থে বৈশেষিক দর্শনকে কণাদ বা উলুক্য দর্শন নামে অভিহিত করেন। এ দর্শন বিশেষ নামক একটি পদার্থকে স্বীকার করেছে বলে একে বৈশেষিক দর্শন বলা হয়। কণাদ প্রণীত বৈশেষিকসূত্র বৈশেষিক দর্শনের মূল গ্রন্থ। কনাদের বৈশেষিকসূত্রের উপর পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভাষ্যকার ভাষ্য রচনা করেন। কণাদ প্রণীত বৈশেষিকসূত্রে প্রকাশিত বৈশেষিক দর্শন নিরীশ্বরবাদী। কিন্তু পরবর্তী ভাষ্যকারদের দ্বারা প্রণীত বৈশেষিক দর্শন ঈশ্বরবাদী।

৯৭. দ্রষ্টব্য: পূর্ববর্তী ন্যায় অনুমানের আলোচনা। উল্লেখ্য যে, বৈশেষিকগণ অনুমানের ভিত্তি হিসেবে নিয়ত সম্বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু তারা ব্যাপ্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। কণাদ এ সম্পর্ককে প্রসিদ্ধি এবং পরবর্তী বৈশেষিক দার্শনিক প্রশস্তপাদ একে ‘বিধি’ বা ‘সম্য’ বলেন।

৯৮, বাৎসায়ন : ন্যায়ভাষ্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮০,২৮৫ এবং বাচস্পতি মিশ্র: ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৮৬।৯৯. J. N. Sinha: History., Vol. I, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৮৫।

১০০. শালিকানাথ : প্রকরণপঞ্চিকা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১২।

১০১. পালি ভাষায় লিখিত ত্রিপিটক-ই বৌদ্ধ দর্শনের মূল গ্রন্থ। মিলিন্দপঞ্চহ (১০০ খ্রি. পূ.), বুদ্ধঘোষের বিশুদ্ধি-মাগগা (৫০০ খ্রিঃ) প্রভৃতি ত্রিপিটকের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। বুদ্ধ পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ হীনযান ও মহাযান এ দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। বৈভাষিক ও সৌভ্রান্তিক হীনযান বা জড়বাদী শাখার এবং যোগাচার ও মাধ্যমিক মহাযান বা ভাববাদী শাখার অন্তর্ভুক্ত।

১০২. J. N. Sinha: History, Vol. II, পূর্বোক্ত,৪১৪।

১০৩. এখানে বৈভাষিক ও সৌভ্রান্তিক অর্থাৎ হীনযান মতানুসারে প্রমাণতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। ব্যবহারিকভাবে প্রমাণতত্ত্বের ব্যাপারে মাধ্যমিক ও যোগাচার অর্থাৎ মহাযান হীনযানদের সাথে মোটামুটি একমত। দ্রষ্টব্য : দেবব্রত সেন : ভারতীয় দর্শন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২য় সংস্করণ,১৯৮৫,পৃ. ১৩০ এর পাদটীকা। উল্লেখ যে, প্রমাণতত্ত্বের ক্ষেত্রে সৌভ্রান্তিক ও বৈভাষিকদের মধ্যে মতভেদ থাকার কারণে তাদেরকে যথাক্রমে বাহ্যানুমেয়বাদী (Representative Empirisist) এবং বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদী (Direct Empiricist) বলা হয়। সৌভ্রান্তিকদের মতে, বাহ্যবস্তু প্রত্যক্ষের মাধ্যমে জানা যায় না। একমাত্র অনুমানের মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু বৈভাষিকদের মতে, প্রত্যক্ষ ও অনুমান দুইই জ্ঞানের উৎস। তবে অনুমান প্রত্যক্ষ নির্ভর। দ্রষ্টব্য : নীরু কুমার চাকমা : বুদ্ধ; তার ধর্ম ও দর্শন ঢাকা, ১১ এইচ, ফুলার রোড,১৯৯০, পৃ. ৪৬।

১০৪. J. N. Sinha: History., Vol. II, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১৪।

১০৫. ধর্মোত্তর ন্যায় বিন্দুটিকা, বেনারস, কাশী সংস্কৃত সিরিজ, ১৯২৪, পৃ. ১৩।

১০৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪-১৫ এবং A. B. Keith. Indian Logic and Atomism, New Dilhi, Orental Books Reprint Corporation, 1977. পৃ. ৮১।

১০৭. S. N. Das Gupta: History., Vol. II, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৬।

১০৮. চব্বিশজন তীর্থঙ্কর বা শাস্ত্রকার জৈন দর্শনের প্রচারক। এদের প্রথম জনের নাম ঋষভদেব। শেষজনের নাম বর্ধমান, যাকে মহাবীর বলা হয়। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক মহাবীরের শিক্ষার উপরই জৈন ধর্ম ও দর্শনের গ্রন্থগুলো নির্ভরশীল। তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ৭৭৬ খ্রি: পূ: অব্দে দেহত্যাগ করেন। মহাবীর ৭২ বছর বয়সে, আনুমানিক ৪৮০ খ্রি: পূ: অব্দে দেহত্যাগ করেন। মৌর্য যুগে বৌদ্ধ দর্শনের মতো জৈনদর্শনও পুনরায় প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জৈন ধর্ম ও দর্শনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হন। দ্রষ্টব্য: W. M. Theodore de Bary (ed.): Sourse of Indian Tradition, Vol. I. New York, Columbia U. P. 1966, পৃ. ৪৩। পরবর্তী জৈন দার্শনিকগণ শ্বেতাম্বর ও দীগম্বর এই দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে মূল জৈন মত নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। দীগম্বরদের মতে, তীর্থঙ্করগণ বস্ত্র পরিধান করতেন না এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধারণ করতেন না। কারণ, এসব মোক্ষের পরিপন্থী। কিন্তু শ্বেতাম্বরদের মত দীগম্বর মতের বিপরীত। জৈন দার্শনিক গ্রন্থগুলোর মধ্যে উমাস্বামীর তত্ত্বার্থাধিগম সূত্র নামক গ্রন্থে জৈন দর্শনের মূল নীতিগুলো যায়। এর উপর বহু আলোচনাগ্রন্থ লিখিত হয়েছে। তন্মধ্যে বিদ্যানন্দি স্বামী প্রণীত তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক এবং অবলম্বনদেব প্রণীত রাজবাৰ্তিক উল্লেখযোগ্য। সিদ্ধসেন দিবাকর প্রণীত ন্যায়াবতার, মল্লিসেন প্রণীত সাদ্বাদমঞ্জরী, মানিক্যনন্দি রচিত পরীক্ষামূর্খসূত্র প্রভৃতি জৈন জ্ঞানবিদ্যা ও যুক্তিবিদ্যার প্রামাণ্য গ্রন্থ।

১০৯. J. N. Sinha: History., Vol. II. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৪।

১১০. মানিক্যনন্দি : পরীক্ষামূর্খসূত্র, (৫,১-৩), এস, সি, বিদ্যাভূষণ (সম্পাদিত), কলিকাতা, বিবলিওথিকা ইণ্ডিকা, ১৯০৯, পৃ. ৫।

১১১. দ্রষ্টব্য : ন্যায় প্রত্যক্ষ প্রমাণ, পূর্বে।

১১২. J. N. Sinha: History., Vol. II. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৬।

১১৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৮৭।

১১৪. মানিক্যনন্দি : পরীক্ষামূর্খসূত্র, (২,১২-১৪), পূর্বোক্ত, পৃ. ২।

১১৫. পূর্বোক্ত, (২.৯), পৃ. ২।

১১৬. বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য : J. N. Sinha : History., পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৬।

১১৭. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী : বেদান্ত দর্শন : অদ্বৈত বেদান্ত, পুরাণ প্রেস, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৯, পৃ. ৩১৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *