২৫. সবগুলো জানলা-দরজা বন্ধ

২৫

–হ্যাঁরে আপিসে কিছু খেয়েছিলি তো?

দীপঙ্কর আবার বাড়িটার দিকে চেয়ে দেখলে। সারা বাড়ির সবগুলো জানলা-দরজা বন্ধ। কালকের ঘটনার পর থেকেই বন্ধ। যেন কালীঘাটের সমস্ত অপবিত্রতাকে রাখবার চেষ্টাতেই কাকাবাবুরা বাড়ির সব জানলা-দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

দীপঙ্কর মুখ তুললে। বললে–মা, দেখলাম লক্ষ্মীদির বাবা এল হঠাৎ–সেই বৰ্মা থেকে এল–হঠাৎ কেন এল বলো তো? তোমার কী মনে হয়?

মা বললে–তা মেয়েদের জন্যে ভাবনা হবে না বাপের?

–কিন্তু এতদিন তো শরীর খারাপ ছিল শুনেছি, সতীরই তো যাবার কথা ছিল, হঠাৎ সব উল্টে গেল কেন?

মা বললে–ওঁদের আর আসতে কী? ওঁদের তো আর পয়সার অভাব নেই, এলেই হলো–তা আমি যা বলছি, সে-কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কী খেয়েছিলি আপিসে শুনি?

হঠাৎ রঘু এসে হাজির বাড়ির ভেতরে।

মা বললে–কী রঘু, তোমার বাবু এল বুঝি বৰ্মা থেকে?

–হ্যাঁ মাসীমা, বাড়ির সব জিনিসপত্র তো ভেঙে-চুরে গেছে, তেল-নুন, মশলা চাল-ডাল, সব কিনে আনতে হলো আবার–

দীপঙ্কর বললে–তোমাদের বাড়িতে ঢুকতে-বেরোতে দিচ্ছে?

রঘু বললে–কাউকে যেতে দিচ্ছে না। সকাল বেলা থেকেই গয়লা ভেতরে আসতে পারেনি। কাকাবাবু কাউকে ঢুকতে দিতে বারণ করে দিয়েছে পুলিসকে। এখন ক’দিন ধরেই পুলিস পাহারা থাকবে। কালকে শেষ রাত্রেও নাকি সবাই ঘুমিয়ে পড়বার পর আবার ইঁট পড়েছিল উঠোনে।

মা বললে–হ্যাঁ আমি শুনেছি–খুব দুম্ দাম্ করে শব্দ হলো দুবার—

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তা পুলিসরা ছিল, কিছু করলে না?

রঘু বললে–বাবু ছাদের ওপর থেকে পিস্তলের গুলি ছুঁড়তেই আবার সব চুপ হয়ে গেল–

সত্যিই দীপঙ্কর তো কিছুই টের পায়নি। কখন ইঁট পড়লো, কখন পিস্তলের শব্দ হলো, কিছুই জানতে পারেনি। তখন বোধহয় অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছিল। সারাদিন আপিসের পরিশ্রম, তারপরে বউবাজারে লক্ষ্মীদির কাছে যাওয়া, তারপর কিরণের সঙ্গে ম্যাডক্স স্কোয়ারে হেঁটে-হেঁটে যাওয়া–তারপর রাত্রিবেলা ওই কাণ্ড। অন্তত পাঁচশো লোকের ভিড়। যে যা কিছু পেরেছে ভেঙে ফেলেছে। একটা বাসনও আস্ত নেই। সব থান ইঁট দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আয়নাগুলোকে পর্যন্ত লাঠি দিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে। সতীর গয়না ছিল আলমারির মধ্যে–সে-সব একটাও নেই। শাড়ি সেমিজ ব্লাউজ–সব ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফর্দাফাই করেছে। শেষকালের আর কিছু না পেয়ে ভাত ডাল তরকারি, রান্নাঘরে যা কিছু রান্না তৈরি ছিল, সব উল্টে ফেলেছে। রান্নাঘরে সব থই থই করছে। একবার গেলে দেখতে পেতেন আপনারা।

রঘু বললে–কাকীমা তো ঘরের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন, তাই বেঁচে গেছেন–আর ছোটদিদিমণিকে তো মেরে ফেলতো–নেহাত–

দীপঙ্করের মনে আছে সে-সব।

হুড়মুড় করে যখন সব ঢুকে পড়েছিল, তখন সতী একটু গরম গরম কথা বলেছিল।

সতী বলেছিল–কে আপনারা? বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে–ভদ্রলোকের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন যে না বলে কয়ে? কে আপনারা? কোথা থেকে আসছেন?

সতীর সে-চেহারা দেখে ভয় পাবার লোক নয় তারা। সতী বর্মার মানুষ। বর্মীদের মতো নিরীহ মানুষ নয় কালীঘাটের লোকরা। সবাই কালীঘাটের লোক। দীপঙ্করের একটু-একটু মুখচেনা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে সকলকে তো দেখা যায়নি ভালো করে। ‘কালীঘাট ব্যায়াম সমিতি’র লোকও থাকতে পারে। পুলিস তাদেরও কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করেছে। কালীঘাটময় যেন অ্যারেস্ট করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল।

হয়তো সতীর কথায় তারা একটু চটে গিয়েছিল। কে একজন লাঠিও উঁচিয়েছিল সতীর দিকে।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তোমার বড়বাবু সব শুনে কী বললেন রঘু?

রঘু বললে–দোতলায় সবাই মিলে কথা হচ্ছে এখন, বড়বাবুর জাহাজ এসে পৌঁছেছে বিকেল বেলা–

–তা আগে থেকে খবর ছিল নাকি যে বড়বাবু আসছেন?

–কী জানি বাবু, আমি তো কিছু জানতাম না।

মা জিজ্ঞেস করলে–তা তোমার বড়বাবু ক’দিন থাকবেন কলকাতায়?

রঘু বললে–তা-ও জানি না মাসীমা, বড়বাবু তো চিল্লাচ্ছেন খুব ওপরে, আমি রান্নাঘর থেকে শুনতে পেলাম–

হঠাৎ যেন কী মনে পড়লো রঘুর। বললে–আমাকে দুটো থালা দিতে পারেন মাসীমা, থালা কম পড়েছে বাড়িতে–

–থালা! মা বললে–থালা তো তোমাকে দিচ্ছি, তা তুমি তো জানো, আমি এ বাড়ির কেউ-ই নই, অঘোরদাদুই এ-বাড়ির মালি, কাজ হয়ে গেলেই আবার থালা দুটো দিয়ে যেও বাবা

রঘু বললে–কালই নতুন থালা-বাসুন কিনে আনবে বাবু, আজকে কী দিয়ে খেতে দিই, তাই চাইতে এলাম আপনার কাছে–

মা দুখানা থালা দিলে বার করে। দীপঙ্কর বললে– রঘু, তোমাদের বাড়ি আমাকে যেতে দেবে না পুলিস?

রঘু বললে–পুলিস তো হুকুম দিয়ে দিয়েছে, কাউকে ঢুকতে দেবে না–সকাল বেলা গয়লাকে পর্যন্ত ঢুকতে দেয়নি–

মা বললে–দরকার কী তোর এখন ওদের বাড়ি যাবার? এই সব হাঙ্গামার মধ্যে না-ই গেলি–

রঘু নিজের বাড়ির দিকে গেল। বললে–সদর দরজাটা বন্ধ করে দিন মাসীমা–

দীপঙ্কর উঠে বন্ধ করে দিয়ে এল। সমস্ত উঠোনটা যেন থমথম্ করছে। আগে দোতলার জানলা থেকে আলো এসে পড়তো উঠোনের ওপর। পেছনের আমড়া গাছের দিকে খিড়কির দরজাটাও আজ বন্ধ করে দিয়েছে ওরা। কাল পুলিস আসবার পর ওই দরজাটা দিয়েও অনেকে পালিয়ে গিয়েছিল। অঘোরদাদু সেই শব্দ পেয়েই চিৎকার করে উঠেছিল। তার মনে হয়েছিল যেন ডাকাতি করতে এসেছে কারা। বলছিল মুখপোড়ারা বাড়ি ভেঙে ফেললে আমার, মুখপোড়ারা আমার সর্বনাশ করলে–ও মেয়ে, কোথায় গেলি মেয়ে তুই, মুখপোড়া শোনেও না–

তখন সেই হট্টগোল। হট্টগোলের মধ্যেও কিন্তু মা সম্বিৎ হারায় নি। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেছে অঘোরদাদুর ঘরে। মা’কে দেখেই অঘোরদাদু চিৎকার করে উঠেছে– মুখপোড়া ডাকাত পড়েছে বাড়িতে, শুনতে পাসনি–

–ডাকাত না বাবা, ওরা স্বদেশী–

–হ্যারামজাদা স্বদেশী, তা আমার বাড়িতে ক্যান রে? আমি কী করেছি মুখপোড়াদের? আমি কি মুখপোড়াদের মুখ পুড়িয়ে দিয়েছি?

মা বললে–না বাবা, আমাদের বাড়ি নয় ওই ভাড়াটেদের বাড়ি–

অঘোরদাদু বললে–মুখপোড়া, ভাড়াটেদের বাড়ি হলেই-বা, বাড়িটা তো আমার রে? বলি, বাড়িটাও কি মুখপোড়া ভাড়াটেদের

মা বললে–আপনি চুপ করুন বাবা, আমি দেখে আসছি কী হয়েছে–

অঘোরদাদু বললে–মুখপোড়া মেয়ের বুদ্ধি দেখ, বলি তুই যাবি কেন শুনি? ভাড়াটেরা মরবে তাতে তোর কীরে মুখপোড়া? সে মুখপোড়াটা কোথায় গেল? সেই মুখপোড়াটা?

–তার জন্যে আপনি ভাববেন না বাবা

অঘোরদাদু যেন ক্ষেপে উঠলো। বললে–সে ভাববো কেন? তুই তুই ভাববি কেবল, না? মুখপোড়াটা আপিসে গেল, এখনও এল না, তা আমি ভাববো না তো কে ভাববে রে মুখপোড়া? কে ভাববে?

মা সান্ত্বনা দিয়ে বললে– আপনি বুড়ো মানুষ, চোখে দেখতে পান না, আপনি বরং ঘুমোতে চেষ্টা করুন

অঘোরদাদু যেন অন্ধকারের মধ্যেই থিতিয়ে এল। বললে–আমি ঘুমোব? মুখপোড়া আমাকে ঘুমোতে বলছিস? এবার তো ঘুমিয়েই পড়বো মুখপোড়া, এবার একেবারে ক্যাওড়াতলায় গিয়ে ঘুমোব–

অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। চারিদিকে তুমুল হট্টগোল। তখন ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দে কান পাতা দায়। সমস্ত কালীঘাটটাই যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে সেই শব্দে। সেই শব্দের তরঙ্গ ভাসতে ভাসতে অনেকদূর চলে গেল। কয়েকজন লাঠি দিয়ে কী সব ভাঙছে। সত্যিই, দীপঙ্কর এখনও এল না আপিস থেকে। মা বড় অস্থির হয়ে পড়েছিল তখন। কিন্তু এর চেয়েও ভীষণ অবস্থার মধ্যেও পড়তে হয়েছে মা’কে। এর চেয়েও ভীষণ ষড়যন্ত্রের জালে আটকে পড়তে হয়েছে মা’কে। সেদিন দেড় মাসের দীপুকে নিয়ে একলা নিঃসম্বল অবস্থায় সেই গ্রামের মধ্যে, একমাত্র ভগবান ছাড়া আর কেউ সহায় ছিল না মা’র। সেদিনই যদি মা’র ভয় না হয়ে থাকে, তো এই স্বদেশী ব্যাপারে মা ভয় পাবে?

পচা সন্দেশের গন্ধে তখন বাতাস দুর্গন্ধ হয়ে উঠেছে। হঠাৎ মনে হলো অঘোরদাদুর গলা দিয়ে কেমন যেন একটা অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছে। অঘোরদাদু রাগলে ওরকম শব্দ বেরোয় না, বকলে ওরকম শব্দ বেরোয় না, গালাগালি দিলেও ওরকম শব্দ বেরোয় না। তবে কি কাঁদছে?

মা বললে–আপনি কাঁদবেন না বাবা, আমি তো রয়েছি–আমিই সব দেখছি– আর যায় কোথায়? হঠাৎ যেন বাঘের মতো ফেটে পড়লো অঘোরদাদু। যেন দুই হাত দিয়ে মাটির ওপর ভর দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করলে। বললে–মুখপোড়া, আমি কাঁদবো? আমার কী হয়েছে শুনি যে, কাঁদতে যাবো মুখপোড়া? আমি কাঁদবো কোন্ দুঃখে রে মুখপোড়া?

বলে সত্যি সত্যিই এঁকে বেঁকে দাঁড়িয়ে উঠলো।

বললে–কেন আমি কাঁদতে যাবো বল্ তো মুখপোড়া? আমার যজমান নেই? লখার মাঠের একাদশী বাঁড়ুজ্জে আমার যজমান নয়? চালপট্টির শশধর চাটুজ্জে আমার যজমান নয়? এখুনি যজমান-বাড়ি খবর দিলে দৌড়ে আসবে না? আমার কে নেই মুখপোড়া? কে নেই? আমার সব আছে, আমার টাকা আছে, যজমান আছে। টাকাকড়ি থাকলে কাকে পরোয়া শুনি? কড়ি দিয়ে সব কেনা যায় মুখপোড়া, বুজলি, সব কেনা যায়…

বলতে গিয়ে বোধহয় পড়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ ধরে ফেলেছে মা। বোধহয় কোমরটায় ব্যথাও লেগেছে একটু। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো অঘোরদাদু সঙ্গে সঙ্গে। মা ধরে আবার শুইয়ে দিলে। মাথার বালিশটা টেনে সোজা করে দিলে। কথা বললে আবার বকুনি বাড়বে। মা জানে ৷

তারপর সেই রাত্রে যখন কাকীমা সতী সবাইকে এনে ঘরে তুলেছে, তখন খাওয়া দাওয়ার পর মা বললে–একবার তোর অঘোরদাদুকে দেখে আয় দীপু–

দীপঙ্কর বলেছিল–কেন কী হয়েছে অঘোরদাদুর? অসুখ?

–না, তোর আপিস থেকে আসতে দেরি হয়েছে শুনে খুব ভাবছিলেন বাবা দীপঙ্কর সেই অত রাত্রেই আবার অঘোরদাদুর ঘরে গিয়েছিল। তখন কাকীমা আর সতী ঘরে গিয়ে শুয়েছে। অনেক রাত হয়েছে তখন। মা ছিটে-ফোঁটার ভাত ঢাকা দিয়ে রাখলে রোজকার মতো। তখনও তারা আসেনি। বিন্তিদির ঘরেও আলো নিভিয়ে দিয়ে দরজায় খিল দিতে বলেছে মা। চন্নুনী অত রাত্রে উঠেও এঁটো পেড়েছে, বাসন সরিয়েছে। গজ্ গজ্ করতে করতে সব কাজই করেছে। দীপঙ্কর আস্তে আস্তে অঘোরদাদুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। শুধু ভ্যাপসা একটা গন্ধ আসে নাকে। তারপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল। মনে হলো যেন অঘোরদাদুর নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে।

দীপঙ্কর আবার ফিরে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে। বলেছিল–অঘোরদাদু ঘুমিয়ে পড়েছে মা, আমি ডাকিনি আর

–ঘুমিয়েছেন, তাহলে ভালোই হয়েছে, এখন ঘুমো–

কিন্তু ঘুম কি আসে! তারপরেই কাকাবাবু এসে ডেকে নিয়ে গেলেন কাকীমাকে। সতীও গেল। তারপর সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বিছানায় এসে ভেবেছিল সে রাত্রে বুঝি আর ঘুম আসবে না। প্রথমটা সত্যিই ঘুম আসেনি কুকুরগুলো পুলিস দেখে ঘেউ ঘেউ করছিল খুব–সে-শব্দটাও কানে গেছে। শ্মশান থকে ঘন ঘন হরিবোল ধ্বনি হচ্ছিল–তাও কানে গেছে। সেই জাগরণের মধ্যেই সমস্ত ঘটনাটা যেন আবার মনে করতে ভালো লাগছিল। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। সতী হয়তো কোন কথা বলতেই চেয়েছিল তার সঙ্গে। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছিল তার। হয়তো কিছু বলতো। হয়তো সত্যিই কিছু কথা ছিল তার। হঠাৎ সেই সময়ে রান্নাঘরের টিনের চালের ওপর ইঁটটা পড়লো, আর সব ছত্রখান হয়ে গেল।

এর পরে আর কিছু মনে নেই। কখন ঘুমের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিল, কিছুই খেয়াল ছিল না। কখন আবার শেষ রাত্রের দিকে উঠোনে ইঁট পড়েছে, তা-ও টের পায়নি দীপঙ্কর। তারপর সকাল বেলা উঠেছে। উঠে বাজারে গেছে। আপিসে গেছে, আপিস থেকে এসেছে। উত্তেজনায় উত্তেজনায় দীপঙ্কর যখন কান্ত হয়ে আপিস থেকে ফিরেছে, তখন ও-বাড়িতে বর্মা থেকে ভুবনেশ্বরবাবু এসেছেন।

২৬

পরের দিনও আবার রাত হলো। আবার মা ছিটে-ফোঁটার ভাত ঢেকে রেখে দিলে। আবার যথারীতি বিন্তিদি আলো নিভিয়ে দিয়ে দরজায় খিল বন্ধ করে দিলে। দীপঙ্কর আবার বিছানায় গিয়ে শুলো। আবার কালকের মতো কুকুরগুগুলো রাস্তায় চিৎকার শুরু করে দিলে। আবার শ্মশানের দিক থেকে হরিধ্বনির আওয়াজ এলো। এই সব রাতগুলোই যেন দীপঙ্করের বিনিদ্র কাটাতে ভালো লাগে। তার মনে হয় তার সমস্ত আকাঙ্খার জগৎটার মধ্যে কোথাও যেন অশান্তি না থাকে। দীপঙ্কর কেবল অনুভব করতে চায় যেখানে তার অধিকার, সেখানে যেন কোনও কিছু ক্ষুণ্ণ না হয়। তার এই আকাঙ্খার জগৎ যেন তার নিজস্ব। যেন তার নিজস্ব তালুক। সেখানে সে যেন লিখে দিয়েছে–’যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ’। যতদিন তার ইচ্ছে, ততদিন সে তার এই আকাঙ্খার জগতের অধিকার ভোগ করবে। কেউ তাকে বাধা দেবার নেই। তার অধিকারের আওতার মধ্যে যদি লক্ষ্মীদি কষ্ট পায় তো সেটা দীপঙ্করের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব নিয়ে দীপঙ্কর লক্ষ্মীদিকে কষ্ট থেকে উদ্ধার করবে। তার অধিকারের আওতার মধ্যে সতীও একজন। সতীকেও রক্ষা করার দায়িত্ব যেন দীপঙ্করেরই। সেখানে লাঠি-ধরা পুলিসের দরকার নেই, বর্মা থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে ভুবনেশ্বরবাবুরও আসবার প্রয়োজন নেই, দীপঙ্কর নিজেই যথেষ্ট। তাই তার তালুকদারিতে যখন বেনিয়ম ঘটে, তখন দীপঙ্করের ভালো লাগে না। কাকাবাবুর সি-আই-ডি হওয়া দীপঙ্করের ভালো লাগেনি। আপিসে নৃপেনবাবুর পাঁঠার চপ্ খাওয়া ভালো লাগেনি। চেয়ারে ছারপোকা থাকাতে ভালো লাগেনি। এক গেলাস চা চারজনে ভাগ করে খাওয়াও ভালো লাগেনি তার। এই অধিকার-বোধ নিয়েই দীপঙ্কর এক-একবার অহঙ্কারে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তখন আর কাউকেই মানতে চায় না মন। তখন যে তার অধিকার হরণ করতে আসে, তাকেই দুহাতে নির্মমভাবে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।

–মা!

খুব সজাগ ঘুম মা’র। তবু ক’দিন ধরে মা’রও খুব পরিশ্রম চলছে। পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। আজকাল খানিকটা যেন আশার আশ্বাস দিতে পেরেছে মা’র মনে। মা যেন আবার আলো দেখতে পেয়েছে এই চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে। মা স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে এবার–তার দীপঙ্কর একদিন সাহেবের মন পাবে। একদিন এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের কদর্য আবহাওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেবে। হয় ভবানীপুর, নয় নতুন শহর বালিগঞ্জে। এমন জায়গায় আশ্রয় নেবে মা, যেখানে মানুষের লজ্জা বাঁচুক-না-বাঁচুক, নিন্দে বাঁচুক-না-বাঁচুক, সম্ভ্রম বাঁচুক-না-বাঁচুক, ধৰ্ম যেন বাঁচে। ধর্ম মানে মা’র কাছে মনুষ্যত্ব। শুধু ধর্ম নয়। দীপঙ্করের মনুষ্যত্বও যেন বাঁচে, দীপঙ্করের সত্যও যেন বাঁচে। অবশ্য তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে দীপঙ্করের চাকরি হয়েছে, কিন্তু সেই সত্য বাঁচাতে, সেই ধর্ম বাঁচাতে তেত্রিশ টাকার কলঙ্ক আর কতটুকু। তেত্রিশ টাকার গ্লানি একদিন মুছে যাবে হযতো, কিন্তু দীপঙ্কর তো মনুষ্যত্বের গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে দশজনের মধ্যে দাঁড়াবে! তখন সবাই বলবে–ও কে? না, দীপঙ্কর! তখন তেত্রিশ টাকার দাগ কি আর তার গায়ে লেগে থাকবে!

হায়রে! এখন ভাবলে হাসি পায় দীপঙ্করের। মা তো সেদিন জানতো না, কলঙ্ক, তা সে যতটুকুই হোক, অসত্য, তা সে যত নগণ্যই হোক, একদিন সেই এক কণা অসত্য, এক কণা কলঙ্কই সারা দেশকে মনুষ্যত্ববর্জিত করতে পারে, ধর্মবর্জিত করতে পারে। একজনের সামান্য পাপ লক্ষ লক্ষ লোকের সর্বনাশ দিয়েও, কোটি কোটি লোকের ধ্বংস দিয়েও মোছা যায় না। মা তো জানতো না যে, একজন চেঙ্গিস খাঁর পাপের ঋণ একদিন কোটি লোকের মৃত্যু দিয়ে শোধ করতে হয়! এই যে কোথায় কার হিসেবের ভুলে ঘটলো ট্রেড-ডিপ্রেশন, আর এখানে বৌবাজারের একপ্রান্তে দাতারবাবুকে তার খেসারত দিতে হলো। শুধু দাতারবাবু কেন, লক্ষ্মীদিকেও তার খেসারত দিতে হচ্ছে! মা’র দোষ নেই, হয়তো কেউই বোঝে না। নইলে যেদিন টোকিও থেকে ক্যানটনে এসে নামলো জাপানীরা, সেদিন আমেরিকাই তাদের দিয়েছিল এরোপ্লেন, গ্রেট ব্রিটেন দিয়েছিল রাইফেল, রাশিয়া দিয়েছিল ট্যাঙ্ক, জার্মানী দিয়েছিল মেশিনগান। ব্যবসা হলো ব্যবসা। তাতে বাছ-বিচার করতে নেই। কিন্তু তখন কি ওরা জানতো, একদিন সেই জাপানই আবার সমস্ত আফ্রিকা আর এশিয়ার চেহারা এমনভাবে আমূল বদলে দেবে! এশিয়ায় তাদের সব কলোনিগুলো এমন করে হাতছাড়া হয়ে যাবে!

মা মনে মনে হিসেব করে ফেলেছিল। তেত্রিশ টাকা! তেত্রিশ টাকার হিসেব বড় সোজা হিসেব। ভবানীপুরে ছোট্ট একটি বাড়ি, ভদ্রপাড়ার আওতায় একটুকরো আরাম, এক ছটাক বিশ্রাম আর এক কাঁচ্চা শান্তি। মা’র আকাঙ্ক্ষা বড় পরিমিত।

মা জিজ্ঞেস করতো–বছরে ক’টাকা করে মাইনে বাড়বে?

দীপঙ্কর বলতো–তিন টাকা–

মনে মনে হিসেব করতো মা রাঁধতে রাঁধতে। বছরে তিন টাকা যদি হয়, তাহলে পাঁচ বছরে পনের টাকা। অর্থাৎ দীপঙ্করের যখন বয়েস হবে পঁচিশ তখন মাইনে হবে আটচল্লিশ টাকা। তখন দীপুর একটি বউ হবে। সুন্দরী একটি প্রীতিময়ী মেয়ে। এমন মেয়ে যে দীপঙ্করকেও সেবা-যত্ন করবে, শাশুড়ীকেও ভক্তি-শ্রদ্ধা করবে। আটচল্লিশ টাকায় সংসার চালাতে পারা চাই। দুহাতে খরচ করে উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে মাসের শেষে আবার পরের কাছে তেল-নুন-হলুদ ধার করতে হবে–তেমন বউ হলে চলবে না। তা আটচল্লিশ টাকাও কম নয়। গুছিয়ে চলতে পারলে ওই টাকাতেই বেশ চালানো যায়।

খেতে বসেও মা জিজ্ঞেস করে–তিন টাকা করে বেড়ে বেড়ে কত টাকায় শেষ হবে?

–নব্বুই টাকা!

নব্বুই টাকা কত বছরে হয়, তারই তখন হিসেবের পালা। হিসেব করতে করতে ছেলের সংসারের জমা-খরচের একটা আলগা খতিয়ানও তৈরি করে। শুধু তো বউ নয়, ছেলে-পুলেও হবে। ছেলের লেখাপড়া আছে, মেয়ের বিয়ে আছে, মেয়ের তত্ত্ব-তাবাশ আছে, নাতি-নাতনীর ভাত, নাত-জামাই-এর…

হিসেব করতে করতে মা অনেকদূর এগিয়ে যায়। তখন আর হিসেবে কুলোয় না। তখন নব্বুই টাকার অঙ্কটার ভগ্নাংশগুলো সব গোলমাল হয়ে যায়। তাহলে একটা বাড়ি হবে কী করে? বেশি নয়, ছোট এক কাঠা দু কাঠা জমি হলেই চলবে। দুখানা ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা ভাঁড়ার ঘর। কিন্তু যাই বলো বাপু ঠাকুরঘর একটা চাই। সে-সব পাট তো উঠেই গেছে দীপঙ্করের মা’র। নিজের বাড়ি হলে একটা ঠাকুরঘর আগে করতে হবে। একটি পশমের আসন থাকবে সেখানে, গঙ্গাজল, ধূপদানি, কোষাকুশি, প্রদীপ এই রকম টুকি-টাকি। তারপর আর ক’টা দিন! দীপুর সংসার দীপুই দেখবে বিয়ে দিয়ে মা’র কাজ শেষ। মা’র কর্তব্য শেষ। আজকাল ভালো করে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ায় মা। বাজারের পয়সা একটু বেড়েছে। অত আপিসের খাটুনি খাটতে পারবে কেন? কোথা থেকে গাওয়া-ঘি এনেছে মা। ঘিটা দইটা পাতের কাছে এগিয়ে দেয়।

বিন্তিদি মুখটা শুকনো করে এসে দাঁড়ায়। বলে–দিদি, দীপুর চাকরি হয়েছে বুঝি?

–হ্যাঁ মা, অ্যাদ্দিনে মা মুখ তুলে চেয়েছেন।

তারপর খানিক পরে আবার বলে-এবার তুমি চলে যাবে নাকি দিদি?

–যাবো আর কোথায় মা? কোন্ চুলোয় আর যাবো, যাবার কি ঠাঁই আছে মা আমার?

বিন্তিদি বলে–তবে যে বলেছিলে দীপুর চাকরি হলেই এ-বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে যাবে?

–ওমা, তুমি বুঝি সেই কথা মনে করে রেখে দিয়েছ, আ আমার কপাল, ওর তো ভারি মাইনে, সেই মাইনেতে কি আলাদা সংসার করা যায় মা? নিজের পেটে খেতেই বলে কুলোবে না-দীপুর আবার সংসার হবে, দীপুর আবার সুখ হবে–কী যে বলো মা তুমি!

কিন্তু বিন্তিদি ছাড়ে না। মা রাঁধতে রাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন। হঠাৎ বিন্তিদি আবার ডাকে–দিদি–

–কী মা?

–আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যেও দিদি, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো, আমি এখানে একলা থাকতে পারবো না ৷

মা বলে–তুমি কেন আমাদের সঙ্গে যাবে মা, তুমি কত বড়লোকের নাতনী, তোমার দাদুর কত টাকা, তোমার কত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হবে, তোমার দুঃখু কিসের মা? তুমি কেন আমাদের সঙ্গে কষ্ট করতে যাবে!

অনেক সান্ত্বনা দেয় মা বিন্তিদিকে। আঁচল দিয়ে বিন্তিদির চোখের জল মুছিয়ে দেয়। কত সুখ-সৌভাগ্যে স্বপ্ন দেখায়। হয়তো বিন্তিদিও বিশ্বাস করে, কিন্তু আবার যখন পাত্রপক্ষ এসে দেখে চলে গিয়ে কোনও খবর দেয় না, তখন আবার কাঁদে। চুপ করে ঘরের খিল বন্ধ করে কাঁদে। সে-কান্না কেউ টের পায় না। সংসারে এত লোকের এত সমস্যা, এত লোকের এত দুঃখ, এত লোকের এত কাজ, তবু বিন্তিদির হয়তো মনে হয় তার সমস্যা তার দুঃখের বুঝি তুলনা নেই ৷

দীপঙ্কর বিছানায় শুয়ে শুয়েই আর একবার পাশ ফিরলো।

–মা!

মা’র সাড়া-শব্দ নেই। কুকুরগুলো তখনও চেঁচাচ্ছে। শ্মশানের দিক থেকে তখন হরিধ্বনি আসছে। এত লোক কোত্থেকে মরে! প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু যেন তার দাবি মেটাবেই। এক মুহূর্তের জন্যেও ফাঁক যায় না হরিধ্বনির। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হলো। দীপঙ্কর মাথাটা তুললো। সতী এল নাকি! সেই সেদিনকার স্বপ্নের মতন আবার তাদের ঘরে এল নাকি সতী! কিন্তু আসবে কী করে? আর কী জন্যেই বা আসবে? বাড়ির সামনে তো পুলিসরা এখনও পাহারা দিচ্ছে। তাদের চোখের সামনে দিয়ে আসবে? না কি পেছনের খিড়কির দরজা দিয়ে আমড়া গাছের তলা দিয়ে উঠোন পেরিয়ে আসবে।

দীপঙ্কর চারদিকে চেয়ে দেখলে।

স্বপ্ন দেখছে না তো সেদিনকার মতো! না, স্বপ্ন তো নয়। এই তো হাত দিয়ে পা ছুঁয়ে দেখছে। এই তো ওপরের কড়িকাঠগুলো কালো কালো দেখা যাচ্ছে অন্ধকারের মধ্যেও। এই তো চোখ বুজলেই সব ঝাপসা, আর চোখ খুললেই সব অন্ধকার! দীপঙ্কর নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে লাগলো। কিন্তু কোনও শব্দই তো আর হচ্ছে না। না, সতী কেন আজ আবার আসবে? তার কিসের দরকার? এখন তো বাবা এসেছে। এত বাবাকে ভালোবাসে সতী। বাবার চিঠি একটু দেরিতে পেলেই যে-মেয়ে ভেবে অস্থির হয়, তার বাবা এতদিন পরে এসেছে। এখন তো সতী আর আসতে পারে না। অবশ্য কোনও কিছুই ঠিক করে বলা যায় না। আসলেও আসতে পারে সতী। হয়তো কালকের কথা বলতে এসেছে। কালকে অত কাণ্ড হয়ে গেল, তারপর হয়তো কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। হয়তো এসে বলবে–তুমি কালকে ছিলে দীপু, তাই রক্ষে, নইলে ওরা আমাকে আর আস্ত রাখতো না-হয়তো এইটুকু জানাতেই এসেছে চুপি চুপি

দীপঙ্করের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলো। কোথাও কোনও শব্দ নেই এখন। কুকুরগুলোও যেন এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্মশান থেকেও যেন আর হরিধ্বি নর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কত রাত এখন কে জানে!

খুট্!

এতক্ষণে মনে হলো শব্দটা তাদের ঘরে নয়। যেন একটু দূরে। মনে হলো কাকাবাবুদের বাড়িতে সতীর ঘরের জানালাটা হঠাৎ খুট্ করে কে খুললে!

দীপঙ্কর আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠলো। আস্তে আস্তে খিলটা খুলল। বাইরে তখন গাঢ় অন্ধকার। চাঁদের কোনও চিহ্ন নেই আকাশে। তারপর উঠোনে দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখলে সতীর ঘরের জানালাটার দিকে। সন্ধ্যেবেলা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি বন্ধই রয়েছে। কেউ খোলেনি। কেউস খোলেনি, কেউ বন্ধও করেনি। পাখিগুলোও বন্ধ রয়েছে। তবে কিসের শব্দ হলো? কোন্ শব্দ শুনলে সে? কোন্ শব্দ শুনে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এল?

হঠাৎ চমকে উঠলো দীপঙ্কর। একটা বেড়াল ঝপ্ করে লাফিয়ে পড়েছে সদরের পাঁচিল থেকে। লাফিয়ে পড়েই আস্তে আস্তে সামনে এল। চেনা বেড়াল। সামনে এসে দীপঙ্করের দিকে মুখ তুলে আদর দেখাল

— ম্যাও–

–তুই? তুই শব্দ করেছিলি?

বেড়ালটা আস্তে আস্তে পশ্চিম দিক থেকে এসে পূব দিকে চলে গেল। গিয়ে আমড়া গাছের তলা দিয়ে সতীদের বাড়ির পাঁচিলে উঠলো এক লাফ দিয়ে। রাত্রের এঁটো-কাঁটা খাবার জন্যে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দীপঙ্কর আবার নিজের ঘরের দিকে চলে এল।

হঠাৎ যেন বাইরে আবার একটা শব্দ হলো।

–কৌন্ হ্যায়?

পাঁচিল টপ্‌কে কে যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকছিল। তার মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে। দীপঙ্কর চিনতে পারলে–ফোঁটা। ফোঁটা রোজকার মতো বাড়ি ফিরছে এখন। পেছন থেকে পুলিসের হাঁক-ডাক শুনে ফোঁটা বললে–আমি, পাহারাওলা সাহেব, আমি–

পুলিস-পাহারা তাহলে সজাগ হয়ে উঠেছে। ক’জন পুলিসের ভারীবুটের শব্দ শোনা গেল। তারা কাছে এল। কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করলে–কৌন্ হ্যায় তুম্?

–আমি ফোঁটা, এ-বাড়ির ছেলে, এই বাড়িতে থাকি আমি–

পুলিস যে-যুক্তি শুনবে না। বাড়ির ছেলে তো পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকবে কেন? আর তাছাড়া এই এত রাত্রে? এত রাত্রে তো বাড়ির বাইরে বাড়ির ছেলেদের থাকবার কথা নয় ৷

–উরো, জলদি উরো, বদমাশ্ চোট্টা কাঁহাকা!

ফোঁটাও কালীঘাটের ছেলে। অনেক পাহারাওয়ালা দেখেছে জীবনে। অনেক পাহারাওয়ালার সঙ্গে ভাব আছে। একসঙ্গে বিড়ি খেয়েছে। বিড়ি খেতেও দিয়েছে তাদের। ভেবেছিল পুলিসের দলের লোক সে। তাকে কিছু বলবে না। দীপঙ্কর উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো।

ফোঁটা দীপঙ্করকে দেখে বললে–দেখছিস, মাইরি, দেখছিস, তুই একটু বল্ তো এদের, তুই বল তো এদের–আমি এ-বাড়ির ছেলে। অঘোর ভট্চায্যির নাতি–বল্ তো তুই এদের– তারপর পুলিসের দিকে চেয়ে বললে–আরে বাবা, এ বাড়িও আমার, অঘোর ভট্চায্যি মরে গেলে আমিই এ-বাড়ির মালিক হবো–

পুলিস কিন্তু নাছোড়বান্দা। বলে–উরো তুম্, উরো জলদি–

ফোঁটা বললে–এই দ্যাখ, আবার ইয়ারকি করছে। ওরে আমি অঘোর ভট্টচায্যির নাতি ফটিক ভট্টচায্যি, ফোঁটা বললে কালীঘাটের সব্বাই আমাকে চিনবে, কেন বাবা আমার সঙ্গে দিল্ লাগি করছো?

এবার আর সহ্য করলে না পুলিস। পা ধরে টেনে নামিয়ে দিলে ফোঁটাকে। দীপঙ্কর শুনতে লাগলো ফোঁটা কত করে অনুনয় বিনয় করছে। সব কথা বোঝা গেল না। মনে হলো যেন ফোঁটাকে গলা-ধাক্কা দিয়ে টেনে নিয়ে গেল পুলিস। তারপর আবার সব শান্ত। আর কারো গলা শোনা গেল না। দীপঙ্কর ঘরে ঢুকে আস্তে আস্তে দরজায় খিল লাগিয়ে দিল। ছিটে এখনও ফেরেনি। ছিটেও ঠিক ওইরকম করে পাঁচিল টপকে ফিরবে। তাকেও ধরবে পুলিস। তাকেও হাজতে আটকে রাখবে। এক কাকাবাবুদের জন্যে দোষী নির্দোষী সব ধরা পড়বে আজ। অথচ কাল যত লোক কাকাবাবুদের বাড়ি ঢুকেছিল তাদের মধ্যে ফোঁটাও ছিল না। ছিটেও ছিল না। ওরা এ-সবের মধ্যে নেই। ওদের গতিবিধি কালীঘাটের বাজারের আশেপাশের টিনের বস্তিগুলোতে। সেখানে ওরা তবলা বাজায়, বিড়ি খায়–নেশা করে। রাত বারোটা পর্যন্ত ওখানে দিন হয়ে থাকে। ওখানেই ওদের রাজত্ব। ও-পাড়ায় খুন-রাহাজানি হলে ওরা এগিয়ে যায় ফয়সালা করতে। খুব বড় জোর কখনও গাঁজায় দম দিতে ইচ্ছে হলে শ্মশানে চলে যায়। ক্যাওড়াতলার শ্মশানে। সাধু-সন্নিসীদের তালিম দিয়ে দু’এক চিলিম্‌ দম দিয়ে আসে। এই পর্যন্ত। ওরা সি আর দাশকে চেনে না। কংগ্রেস চেনে না। ওদের চাকরি করতে হয় না, নৃপেনবাবুদের ঘুষ দিতেও হয় না। ওদের উন্নতির দরকার নেই, অবনতির দরকার নেই। ওরাই হলো সত্যিকারের সিটিজেন অব্ দি ওয়ার্লড্। ওরা ইংরেজ-রাজত্বে আছে। আবার যদি কখনও কংগ্রেস-রাজত্ব হয় তখনও থাকবে। ওদের নিয়ে কোনও দিন কোনও গভর্নমেন্ট মাথা ঘামায় না। ওরা অজর-অমর। ইতিহাসও বদলায়, কিন্তু ওরা অক্ষয় অব্যয়! ওরাই ইতিহাসের ডাস্টবিন্।

.

দীপঙ্কর ঘুমোতে ঘুমোতে একবার পাশ ফিরলো।

শেষ রাত্রের ঘুম একটু গাঢ় হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথমটা কিছু বুঝতে পারেনি। প্রথমটা একটু ঠেলাঠেলি করতে হয়েছিল। প্রথমটায় এমন ঘটনা বিশ্বাস না হবারই কথা। এতদিনের সমস্ত রুটিন ওলট-পালট হয়ে গেলে বিশ্বাস হবেই বা কেমন করে? হঠাৎ পায়ের তলার সমস্ত মাটি যেন এক মুহূর্তে সরে গেল, আর দীপঙ্কর যেন সেই ধ্বংসস্তূপের তলায় বিলীয়মান হয়ে গেল নিঃশেষে।

প্রথমে দীপঙ্কর তো টের পায়নি। দীপঙ্করের মা-ও টের পায়নি 1

শেষ রাত্রেই উনিশের একের বি বাড়িটার চারদিক ওরা ঘিরে ফেলেছিল। চন্নুনী ভোর বেলাই ওঠে চিরকাল। বুড়োমানুষ। ভোর হবার আগেই ঘুম ভেঙে যায় আর ঘুম আসে না তখন। তখনই উঠে পড়ে ঝাঁটা নিয়ে উঠোন ঝাঁট দেয় আর গালাগালি দেয়। কাকে গালাগালি দেয় ভগবান জানে। চন্নুনীর মেয়ে বহুদিন আগে কবে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে, তাকে উদ্দেশ করেই এক-একদিন গালাগালি করে হয়তো।

বলে–মর তুই, মরলে আমার হাড় জুড়োয়, আমার পেটের মেয়ে, তোকে আমি পেটে ধরেছি বলে আমাকে এত হেনস্থা? ঝাঁটা মারবো না তোর মুখে! ভগমান সাক্ষী আছে আমার, ভগমানকে সাক্ষী করে এই শাপন্তি করছি–তুই মর, তুই মর, মর। আবার আমার গয়নার লোভ! তোকে গয়না দেব না ছাই দিয়ে দেব–আমার গয়না আমি কালীঘাটের ভিখিরিদের বিলিয়ে দেব, তবু তোকে দেব না–তুই আমার শত্তুর, তোর মুখে ঝাঁটা মারি–

এসব রোজকার গালাগালি। এ-শুনেও কেউ কিছু বলে না। কবে একদিন চন্নুনীর মেয়ে মাকে ছেড়ে বাজারে গিয়ে ঘর-ভাড়া করেছিল, বহুদিন পরে সেই মেয়েকে লক্ষ্য করেই এক একদিন বিষ ছড়ায়

হঠাৎ সদর দরজায় কে যেন কড়া নাড়লে।

–কে গা? ভোরবেলা বাসি উঠোনে এখনো গোবর-ছড়া দেয়া হয়নি, এখন কে দরজা ঠেলে গো?

ভারি একটা গলার আওয়াজ। তার সঙ্গে জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে চন্নুনী এবার আরো জোরে গালাগালি শুরু করলে। বললে–হাতের জোর দেখ না মিনসের, তোর হাতে কুট্ হোক্ মিনসে্‌ কুঠের জ্বালায় যে-হাত দিয়ে কড়া নাড়ছিস সেই হাত খসে পড়ুক–

গালাগালি দিয়ে দরজা খুলতেই কিন্তু গলা বন্ধ হয়ে গেছে চন্নুনীর। দুজন পুলিস আর একজন দারোগা সামনে দাঁড়িয়ে।

বললে–দীপঙ্কর সেন আছে?

–ওমা, কী হলো গো! কার সব্বনাশ হলো গো! আমি কোথায় যাবো গো!

চন্নুনীর গলায় যে আবার এত জোরও থাকতে পারে তাও যেন আগে জানা ছিল না কারো।

চন্নুনী দীপঙ্করের ঘরের দরজায় ঘা দিতে দিতে বললে–ও দিদি, পাহারোলো এসেছে গো–ও দিদি–দীপু কার সব্বনাশ করেছে গো–

সে এক তুমুল হৈ চৈ কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছিল সেদিন চন্নুনী। সে চিৎকারে দীপঙ্করের মা’ও উঠেছে, বিন্তিদিও উঠেছে। অঘোরদাদুও হৈ-চৈ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে এ-এস আই আর কনস্টেবল দুটোও ঢুকে পড়েছে উঠোনের মধ্যে। তাদের এক্তিয়ার সর্বত্র

মা ঠেলা-ঠেলি শুরু করে দিয়েছে–ও দীপু–ওঠ–উঠে পড়–পুলিস এসেছে—পুলিস–

অনেক ঠেলাঠেলিতে উঠলো দীপঙ্কর। ঘুম চোখে সামনে আসতেই এ-এস-আই বললে–আপনার নাম দীপঙ্কর সেন?

দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ–

–আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে, আপনাকে অ্যারেস্ট করছি আমরা।

মনে আছে দীপঙ্কর সেদিন প্রথমটা যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্করকে অ্যারেস্ট করবে! কী করেছে সে! কী তার অপরাধ! আর তাছাড়া তার যে আপিস। রেলের আপিসে চাকরি করে সে। সাড়ে দশটায় যে তাকে আপিসে যেতে হবে। এখুনি বাজার করে আনলে মা রান্না করে দেবে, সেই খেয়ে আপিস যেতে হবে যে তাকে। যদি অ্যারেস্টই করে তাহলে সাড়ে দশটার আগে তো ছেড়ে দিতে হবে! তা না হলে তার নতুন চাকরি, চাকরি থাকবে না যে! রবিনসন সাহেব যে খোঁজাখুঁজি করবে! ট্র্যানজিট সেকশনের কাজ যে অচল হয়ে যাবে। জাপান-ট্র্যাফিক যে চলবে না ৷

সাদা গলা-বন্ধ ইউনিফর্ম পরা এ-এস-আই। শেষ রাত্রে তাকেও ঘুম ভেঙে ডিউটি করতে আসতে হয়েছে। বিরক্ত হবারই কথা।

বলতে–অত কথা বলবার সময় নেই, থানায় গিয়ে সব জবাব পাবেন

–তাহলে?

–তাহলে থানায় চলুন এখন আমার সঙ্গে–

–কখন ছেড়ে দেবেন?

–সে থানার ও-সি বলতে পারেন।

দীপঙ্কর বললেন—চলুন–

মা এতক্ষণ শুনছিল সব কথা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলা। বললে–কী করেছিস তুই? বল্, তুই কী করেছিস? কার সর্বনাশ করেছিস? আমি এতদিন এত কষ্ট করে পরের বাড়িতে রান্না করে দাসীব”ত্তি করে তোকে মানুষ করেছি এই জন্যে? ভগবান শেষ পর্যন্ত এই আমার কপালে লিখেছিল? তোকে পেটে ধরে শেষে এই আমার ফল হলো? তুই ছেলে হয়ে শেষকালে আমাকে এই শাস্তি দিলি রে? তোকে যে দু’মাস বয়েস থেকে বুকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি দীপু, নিজে না-খেয়ে তোকে খাইয়েছি, নিজের সুখ আহ্লাদ বলে কিছু করিনি সারাজীবন, সেই তুই বড় হয়ে আমাকে এই শাস্তি দিলি আজ? আমার সব আশায় ছাই দিলি তুই এমন করে? এখন আমি কার কাছে দাঁড়াবো? কার কাছে হাত পাতবো বিধবা মানুষ হয়ে? আর চাইবোই বা কিসের জন্যে? কার জন্যে হাত পাতবো? কে রইল আমার?

মা’র চিৎকারে সমস্ত পাড়া যেন সেই ভোরবেলা সচকিত হয়ে উঠলো। মা’র কান্নার রোলে সমস্ত কালীঘাটের বাতাস যেন স্থির স্তব্ধ হয়ে গেল। মা সেই ঘরের বারান্দাতেই মূর্ছিত হয়ে পড়লো। বিন্তিদি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। চন্নুনীও ঝাঁটা হাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে সব দেখে শুনে যেন স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সামনের কাকাবাবুদের বাড়ির জানালাগুলো যেমন বন্ধ তেমনি বন্ধ রইল। সেখানে কারোর কাছ থেকে কোনও সাহায্যের ইঙ্গিত এল না। কাকাবাবু আছেন, কাকীমাও আছেন, সতী আছে। ভুবনেশ্বরবাবুও নতুন এসেছেন এখানে–তিনিও আছেন। আর খানিক দূরেই প্রাণমথবাবু আছেন, কিরণের মা বাবা আছে। তারও ও-পাশে নৃপেনবাবু আছেন। কারো কাছ থেকে কোনও সাহায্যের ক্ষীণতম প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেল না। দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ মা’র দিকে চেয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে চাইতেই দেখলে আমড়া গাছের ডালে সেই কাকটা। ভোর না হতেই উঠে এসে বসেছে ওখানে। ও-ও একলা।

–চলুন।

মনে আছে রাস্তায় বেরিয়েও দীপঙ্করের আর কোনও দিকে মন ছিল না। তখনও মা’র আর্তনাদটাই কানে আসছিল যেন সারা রাস্তাটা। কেন মা’র কপাল এমন করে পুড়লো! প্রতিদিন কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে সব ঠাকুরের কাছে ফুল দিয়ে এসে তার ছেলের কপালে কেন এমন ঘটলো! প্রাণমথবাবুকে ধরে তার পড়ার খরচ চালিয়েছে মা, নৃপেনবাবুকে ধরে চাকরিও যোগাড় করেছে, চাকরি হবার পরেও মা মায়ের মন্দিরে গিয়ে প্রসাদ এনে খাইয়েছে। এত সাধ্য সাধনা কেন তবে ব্যর্থ হলো! মা’র সমস্ত আশা কেন এমন করে ধূলিসাৎ হয়ে গেল, কে বলে দেবে?, মা রোয়াকের ওপর শুয়ে পড়ে চিৎকার করে নিজের ভাগ্যবিধাতাকেও লক্ষ্য করে যেন এই প্রশ্নগুলোই করছিল।

আগের দিনই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের চার পাশের সমস্ত বাড়ির লোকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ‘ব্যায়াম-সমিতি’র সব ছেলেরা তখন পুলিসের হেফাজতে। টেগার্ট সাহেব নিজে এসে সব জায়গায় ঘুরে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। ব্রিটিশ-রাজত্বের একেবারে কেন্দ্ৰে এতখানি অরাজকতা যেন টেগার্ট সাহেবকে উন্মাদ করে দিয়েছে, ক্ষিপ্ত করে তুলেছে, অসহ্য করে তুলেছে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে যখন টেগার্ট সাহেব খাস-বাংলায় কথা বলেছে, গালাগালি দিয়েছে, তখন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে। এ-লোকটাকে তারা কতদিন এই পাড়ার মধ্যেই আদ্দির পাঞ্জাবি পরে বেড়াতে দেখেছে, কিন্তু সেদিন জানতো না এই-ই হলো সেই টেগার্ট সাহেব–কলকাতার পুলিস কমিশনার, ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতিভূ চার্লস টেগার্ট!

পাড়ার সমস্ত জোয়ান ছেলে ধরা পড়েছিল। বাকি ছিল শুধু দীপঙ্কর। তাকেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হলো। অপরাধ? অপরাধের কথা পরে হবে, আগে তো থানায় চলো, আগে তো জিজ্ঞাসাবাদ হোক্, তখন চার্জ তৈরি হবে, তখন শাস্তি হবে!

বাজারের পাশ দিয়ে রাস্তা। লোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে। দীপঙ্কর মাথা নিচু করে চলেছে তখনও। তার কানে তখনও ভেসে আসছে মা’র আর্তনাদের সুর।

ভবানীপুর থানায় এসে ও-সি’র কাছে প্রথম ধাপ।

একটা ভাঙা চেয়ারে বসলো দীপঙ্কর

–নাম কী?

শুধু নামই নয়। নাম, ধাম, পিতৃ-পরিচয় সবই লেখা হলো। চারিদিকে পুলিস পাহারা। চারদিকে শাসনের যন্ত্র। চারদিকে ক্রূর কঠিন কর্তব্য। লৌহ-কঠিন নির্মম শাসন। এতটুকু শৈথিল্য নেই কোথাও। সাত সমুদ্রের ওপার থেকে তৈরি আইন কানুনের নিগড় দিয়ে বাঁধা যন্ত্র, সেই যন্ত্র গড়িয়ে চলেছে। সেই যন্ত্রই গড়াতে গড়াতে এল একেবারে গেটের সামনে। কালো একখানা গাড়ি। সেপাই-এর দল লে-রাইট্ করে রাস্তা তৈরি করে দিলে। আসামী যেন না পালায়। খুব সাবধান। বেয়নেট খাড়া রেখো। একটু শিথিল হলেই হাত-ছাড়া হয়ে যাবে ইন্ডিয়া। দীপঙ্কর সেই গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে ডুব দিতেই ভারত-শাসন আইনের যন্ত্রটা আবার গড়িয়ে চললো। এবার উত্তর দিকে। তারপর সোজা চৌরঙ্গী রোড ধরে থামলো গিয়ে একেবারে ইলিশিয়াম রো’র উঠোনের মধ্যে!

ছোট ছোট খুপরি-খুপরি সব ঘর। ঘরের পর ঘর। এস-বি আর আই-বি অফিস। সেখানেও সেই এক নিয়ম। বাঁধা প্রশ্নের সাইক্লোন উঠলো সামনে যেতেই।

–এসব কী শুনছি?

বজ্র-গম্ভীর আওয়াজে দীপঙ্কর মুখ তুলে চাইল। বিরাট লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারার মানুষ। ভদ্রলোকের মতো সাদাসিধে পোশাক। এই প্রথম রায়-বাহাদুরকে দেখলে। রায়-বাহাদুর নলিনী মজুমদার। কালো কুচকুচে গায়ের রং। একবার দেখলেই মানুষটার সব যেন দেখা হয়ে যায়। আসলে মানুষটার মনের ভেতরের ছবিটার ছাপ যেন মুখের ওপরেও পড়েছে।

–কী শুনছি এ সব?

দীপঙ্কর স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলে–কী শুনছেন?

–যা শুনছি সব সত্যি কিনা বলুন, বাজে কথা শুনতে চাই না!

অদ্ভুত প্রশ্ন এখানকার। দীপঙ্কর তবু বললে–কী শুনছেন আপনারা বলুন না?

–আপনি কিছু জানেন না, না? কিরণ চাটুজ্জের সঙ্গে আপনি মেশেন না?

দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ মিশি। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু–

–জানেন সে কী?

দীপঙ্কর বললে–জানি।

–কী জানেন?

দীপঙ্কর বললে–সে খুব গরীবের ছেলে। ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেনি– রায় বাহাদুর হুঙ্কার দিলেন–শান্তি–

শান্তি এ-এস্-আই। কাছেই ছিল,–এই যে স্যার–বলে দৌড়ে এল। –একে ব্যাটারি ঘরে নিয়ে যাও, ছোকরা বড় বেয়াদব–

সত্যি দীপঙ্করকে নিয়ে শান্তি চলে যাচ্ছিল কোন ব্যাটারি-ঘরে। কিন্তু রায় বাহাদুর আবার হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলেন। বললেন—শুনুন–

তারপর অসংখ্য প্রশ্ন। সত্যিই তখন প্রশ্নের সাইক্লোন বয়ে গেল যেন মাথার ওপর দিয়ে। ম্যাডক্স স্কোয়ারে কিরণের সঙ্গে যাওয়া, সেখানে ভজুদার জন্যে অপেক্ষা করা, ভজুদার না-আসা-সমস্ত জেনেছে আই-বি-আপিস। কবে কবে কিরণের বাড়িতে বেড়াতে গেছে দীপঙ্কর, কবে তারা লাইব্রেরী করেছে, লাইব্রেরীতে কী-কী প্রেসক্রাইবড় বই ছিল, সব ইতিহাস এদের জানা। শুধু জানা নেই কিরণের ঠিকানা, শুধু জানা নেই ভজুদার ঠিকানা!

–বলুন? বলুন শিগগির?

দীপঙ্কর বললে–কী বলবো? কিরণের ঠিকানা, ভজুদার ঠিকানা কিছুই আমি জানি না–

রায় বাহাদুর পারলে যেন তখনি দীপঙ্করের মাথাটা নিজের হাতেই কেটে নিতেন। কিন্তু তখন বোধ হয় তাঁর অনেক কাজ। আরো অনেক স্বদেশী অপেক্ষা করে আছে পাশের ঘরে। শান্তিকে বললেন–একে থানার লক্-আপে রেখে দাও গিয়ে–পরে দেখছি–

তারপর আবার যন্ত্রটা গড়িয়ে চললো। চৌরঙ্গী রোড ধরে আবার এসে দাঁড়াল ভবানীপুর থানার সামনে। আবার লেফ্ট-রাইট্। বেয়নেট খাড়া করে রাখো। পালায় না যেন। সাবধান। এবার আর থানার আপিস-ঘরে নয়। এবার একেবারে লক-আপের মধ্যে। শক্ত শক্ত লোহার রেলিং-এর দরজাটা হাঁ করে খুলে গেল। একটা দুর্গন্ধ আবহাওয়ার মধ্যে দীপঙ্করের দম্ বন্ধ হয়ে এল সঙ্গে সঙ্গে। প্রথমটায় কিছু নজরে পড়েনি। অন্ধকারের মধ্যে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। তারপরে মনে হলো যেন ভেতরে অনেক লোক কিল্-বিল্ করছে।

–কী রে, দীপু? মাইরি তুই এখেনে? তোকেও ধরেছে?

ফোঁটার গলা। ভালো করে দীপঙ্কর লক্ষ্য করে দেখলে। ছিটেও রয়েছে। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে পা-মুড়ে মেজের ওপর বসে রয়েছে।

ফোঁটার কাছে সরে এল। আশ্বাস দিলে দীপঙ্করকে। বললে–অত মনমরা কেন রে? এই প্রথম বুঝি তোর?

দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিতে পারলে না চট্ করে।

ছিটেও এবার কাছে এল–বললে–প্রথমবার একটু মনমরা তো লাগবেই। প্রথমবার আমরাও মন-মরা হয়ে গিয়েছিলুম–না রে ফোঁটা?

ফোঁটা বললে–তোর কিছু ভয় নেই দীপু, এখানে কোনও অসুবিধে হবে না তোর, দরকার হলে তোকে এখানেই বিড়ি আনিয়ে দেব

দরজার ভারি পাল্লাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল তখন।

২৭

শুধু একদিন নয়, পর পর কদিনই তাকে নিয়ে গেল আর এনে রেখে দিলে আবার। মনে আছে কত রকম অত্যাচার, কত রকম অনুনয়-বিনয়। কিন্তু দীপঙ্কর জানতোই বা কী যে বলবে?

দীপঙ্কর বলেছিল–আপনি বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না–

রায় বাহাদুর শেষে অন্য পথ ধরলেন। বললেন–ছি-ছি, আপনাকে এরা মেরেছে নাকি কপালে? দাগ দেখছি যে?

দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। একথার উত্তর দিতেও তার ঘেন্না হলো।

রায় বাহাদুর বললেন–যাক, তা আপনি এখনও দাঁড়িয়ে? বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আরে আপনিও বাঙালী, আমিও বাঙালী–

আগের দিনের রায় বাহাদুরের কথাগুলো তখনও দীপঙ্করের মনে ছিল। তবু চুপ করে রইল। কদিন ধরে কিছু খাওয়াও হয়নি। এ-এস-আই ভদ্রলোক দুখানা কচুরি আর একটু আলুর তরকারি দিয়েছিল দয়া করে। পুলিসের লোকেরও তাহলে দয়া আছে। ভারি ভালো লেগেছিল তাঁর ব্যবহার দেখে। জিজ্ঞেস করছিল–আচ্ছা আপনার নামটা কী?

এ-এস-আই ভদ্রলোক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন–কেন? নাম জিজ্ঞেস করছেন কেন?

দীপঙ্কর বলেছিল–আগের কদিন খেতে পাইনি, অথচ আজকে আপনি এত খেতে দিলেন

–কী আর খেতে দিলাম, আপনিও তো ভদ্রলোকের ছেলে, আপনারও তো মা আছে–

মা’র কথা বলতেই দীপঙ্করের চোখ দিয়ে ঝর-ঝর করে জল পড়েছিল। বাড়ি থেকে আসবার সময় মা’র সেই আর্তনাদের সুরটা যেন হঠাৎ আবার কানে ভেসে এল।

–আপনার নামটা বলুন, আমি আপনাকে চিরকাল মনে রাখবো।

ভদ্রলোক বললেন–নাম শুনে আর কী করবেন, চাকরি করতে হয় আমাদের পেটের জন্যে-নইলে…

ইলিশিয়াম রো’তে এসে রায় বাহাদুরের খাতিরে বহর দেখে শুনে সেই কথাগুলোই মনে পড়ছিল।

রায় বাহাদুর একটা আরদালীর ওপর হঠাৎ চিৎকার করে ধমকে উঠলেন–এই শুয়োর-কা-বাচ্চা চেয়ার দে, দেখছিস না দীপঙ্করবাবু দাঁড়িয়ে আছেন, বেটা এখনও সহবৎ শিখলো না–মশাই পুলিসের চাকরিতে এসে এই সব দেখে শুনে আমার ঘেন্না ধরে গেল, সাধে কি আর বদনাম হয় পুলিসের–

দীপঙ্কর বললে–থাকগে, কী কথা জিজ্ঞেস করছিলেন-বলুন

–হ্যাঁ বলি, পুলিসের চাকরি করি বলে কি ছোটলোক হতে হবে? এইটেই এ লাইনে কেউ বোঝে না। আমি তো সকলকে এই কথাই বলি—যাকগে–

তারপর একটু থেমে আবার বললেন–আপনি এক কাজ করুন, আপনি পুরোন লোক, অনেক জানেন। সকলের নামই আপনি ইচ্ছে করলে বলতে পারেন, কিন্তু তার দরকার নেই, কারো নামই আপনার বলতে হবে না, আপনি কেবল অমৃত সরকারের ঠিকানাটা বলুন! আপনি তো তার বাসায় অনেকদিন গিয়েছেন। এখান থেকে একটা ঘোড়ার গাড়িতে দরজা-জানালা-খড়খড়ি বন্ধ করে আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, যদি বাসার নম্বর না মনে থাকে তো দূর থেকে শুধু খড়খড়ি দেখিয়ে দেবেন-ব্যস, আর কিছু না–

দীপঙ্কর বললে–কে অমৃত সরকার?

রায় বাহাদুর সেকথার ধার দিয়েও গেলেন না। হঠাৎ চুরুটের গলগলে ধোয়া মুখ থেকে বার করে পকেট থেকে একগাদা নোট বার করলেন। দশ টাকার নোট। কেবল বারই করতে লাগলেন। থাক্‌-থাক্ নোট। বার বার পকেটে হাত দিয়ে বললেন–রাখুন এগুলো আপনার কাছে-দশ হাজার টাকা, আমি শুনেছি, তবু আপনার সামনে আবার গুনছি–

বলে একটা থাক্‌ গুনতে লাগলেন–এক, দুই, তিন–

দশ হাজার টাকা। এই টাকার জন্যেই সতীর কাছে সেদিন ধর্না দিতে গিয়েছিল দীপঙ্কর। দশ হাজারেরও দরকার নেই। ছ’ হাজার হলেই চলে যায়। সব দেনা তাহলে শোধ হয়ে যায় দাতারবাবুর। দীপঙ্কর টাকাগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলো।

–নিন এগুলো, আপনার কাছেই রাখুন, দেখি আপনার পকেট দেখি, আমিই পকেটে পুরে দিচ্ছি, তারপর না-হয় ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেব-নিন, আসুন একটিমাত্র নাম তো ভারি বলবেন, অথচ কেউ যে জানতে পারবে, সে-ভয়ও নেই মাঝখান থেকে আপনি এই দশটি হাজার টাকা বেকসুর পেয়ে গেলেন। কত লোকই তো রোজ অ্যারেস্ট হচ্ছে অমৃত সরকারও তো অ্যারেস্ট হবে, আপনি কিছু না-বললেও অ্যারেস্ট হবে-বলতে গেলে আপনি ফাঁকতালে এতগুলো টাকা পেয়ে যাবেন। অথচ দেখুন আপনার পোজিশন নষ্ট হলো না–আপনি ভেবে দেখুন–

সেদিন এই পর্যন্ত।

অনেকখানি সময় দিয়েছিলেন রায় বাহাদুর ভাবতে। লক্-আপের মধ্যেও অনেক ভেবেছিল দীপঙ্কর। দশ হাজার টাকা! তার মায়ের অভাব, তার তেত্রিশ টাকার চাকরি, তার ভবিষ্যৎ! জীবনে কোনও দিন সে কি দশ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারবে? কেউ জানবে না, কেউ সন্দেহও করবে না। কিন্তু অমৃত সরকার! কে অমৃত সরকার। এক কিরণ ছাড়া কাকেই বা সে জানে! আর কিরণের ঠিকানাও তো সে জানে না। কিরণের বাবার অসুখ, মায়ের দারিদ্র্য-নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের বস্তির বাড়িতে কিরণ তো আর থাকে না! কোথায় থাকে কিরণ, তারও তো ঠিক নেই। অথচ কিরণের নামটা বলে দিলেও দশ হাজার টাকা চলে আসে। কোথায় কেমন করে কিরণের সঙ্গে ম্যাডক্স স্কোয়ারে গিয়েছিল, কী-কী কথা হয়েছিল–সেইটুকু বললেও দশ হাজার টাকার মালিক হওয়া যাবে!

পরের দিন আবার সেই ঘরে। রায় বাহাদুর বসেছিলেন। পাশে আরো দুজন পুলিসের ইন্সপেক্টর দাঁড়িয়ে।

দীপঙ্কর এগিয়ে যেতেই রায় বাহাদুর বললেন–এই যে আসুন, আসুন, বসুন—

তারপর ইন্সপেক্টরদের দিকে চেয়ে বললেন–দীপঙ্করবাবুকে আপনারা মেরেছেন?

দুজনে চুপ করে রইলেন।

ধমকানি দিলেন রায় বাহাদুর। বললেন–ছি-ছি, আপনারা কি জানোয়ার? একজন ভদ্রলোকের ছেলের গায়ে হাত দিতে আপনাদের বাধলো না–যা বেরিয়ে যা এখান থেকে–

তারা দুজনে বেরিয়ে গেলেন। রায় বাহাদুরের আবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বললেন–কী ঠিক করলেন?

–কী সম্বন্ধে বলছেন?

–ওই দশ হাজার টাকা! আরে মশাই আপনাদের মতন বোকা তো আমি পৃথিবীতে দেখিনি, আমার এই এত বয়েস হলো। আপনি রেল কোম্পানীতে কত মাইনে পান? তেত্রিশ টাকা তো? আপনি একজন স্কলার বি-এ পাশ করে তেত্রিশ টাকার চাকরিতে ঢুকেছেন–শেষ-জীবনে আপনার কত মাইনে হবে? নব্বই টাকা? তার বেশি তো নয়? দশ হাজার টাকা জীবনে একসঙ্গে কখনও পাবেন ভেবেছেন?

দীপঙ্কর কোনও উত্তর দিলে না। চুপ করে রইল।

–আচ্ছা, এক কাজ করুন, অমৃত সরকার বা আর কারো নাম বলতে হবে না। আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিরণকে শুধু আপনি দেখিয়ে দেবেন, রাস্তায়, আপনার সঙ্গে আমাদের লোক দেব-ব্যস, তারপর যদি আপনি চান তো আপনাকে আমরা বিলেত পাঠিয়ে দেব। আপনি পি-এইচ-ডি ডিগ্রী নিয়ে আসুন–নিজের উন্নতি করুন, দেশের মুখ উজ্জ্বল করুন, আপনার বিধবা মার কথাও ভাবুন। একদিন এসব স্বদেশী দল ভেঙে যাবেই, তখন এসব নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাবে না-ডিগ্রী নিয়ে মোটা মাইনের চাকরি করবেন, আমরাই আপনার চাকরি জুটিয়ে দেব। রেল কোম্পানীতে আর আপনাকে ঘানি ঘষতে হবে না। আর তাছাড়া এই সামান্য কাজটা এমন কিছু শক্ত নয় আপনার পক্ষে-কিরণ চাটুজ্জে আপনাকে খুব ভালোবাসে তা আমরা জানি, সে আপনাকে সন্দেহও করতে পারবে না

দীপঙ্কর তখনও চুপ করে ছিল।

রায় বাহাদুর বললেন–উত্তর দিচ্ছেন না কেন বলুন?

দীপঙ্কর বললে–উত্তর দেবার আমার কিছুই নেই–

রায় বাহাদুর এবার কড়া হলেন একটু। বললেন–তাহলে কিন্তু আপনাকে রেগুলেশন থ্রি-তে আটকে রাখবো। জীবনে কখনও আর শিরদাঁড়া সোজা করতে পারবেন না বলে রাখছি-টি-বি হবে, কালাজ্বর হবে, মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যাবেন–

দীপঙ্করের মনে হলো এক ঘুষি মেরে রায় বাহাদুরের মুখখানা বেঁকিয়ে বিকৃত করে দেয়। কিরণ! তার প্রাণের বন্ধু কিরণকে সে ধরিয়ে দেবে! এরা ভেবেছে কী? রেগুলেশন থ্রির ভয় দেখাচ্ছে! টাকার লোভ দেখাচ্ছে! বিলেতে পাঠাবার লোভ দেখাচ্ছে! এরা কি মানুষকে জানোয়ার ধরে নিয়েছে? চোখের সামনে রায় বাহাদুরের চুরোট-ধরা মুখখানা বড় বীভৎস দেখাতে লাগলো হঠাৎ। হঠাৎ মনে হলো আবার যেন শয়তান সশরীরে নেমে এসেছে সংসারে। আবার যেন কালাপাহাড় এসেছে মানুষের সমস্ত মনুষ্যত্ব চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে।

–কী হলো, জবাব দিন?

দীপঙ্কর বললে–আমি জবাব দেব না, আপনাদের যত কিছু অস্ত্র আছে সব আপনারা ব্যবহার করতে পারেন

–তার পরিণাম কী ভেবে দেখেছেন?

দীপঙ্কর বললে–টি-বি, মুখে রক্ত উঠে মারা যাবো–

রায় বাহাদুর হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন–না মশাই, এতক্ষণ আপনাকে পরীক্ষা করছিলুম-আপনি দেখছি সত্যিকারের বন্ধু-বৎসল লোক–

তারপর শান্তিকে ডাকলেন-শান্তি, ভদ্রলোককে আর একদিন ভাবতে সময় দাও কাল একবার নিয়ে এসো-বলে রায় বাহাদুর চলে গেলেন।

এ-এস-আই শান্তিবাবু ঘরের বাইরে আসতে আসতে বললেন–কী মশাই, আপনি এমন চান্সটা ছেড়ে দিচ্ছেন?

–কিসের চান্স?

শান্তিবাবু বললেন–রায় বাহাদুরকে তো আপনি চেনেন না, রায় বাহাদুর এমন চান্স কাউকে দেন না। আপনার ওপর কীরকম একটা ফ্যান্সি এসে গেছে ওঁর, এক-কথায় দশ হাজার টাকা বার করে দিলেন! আর আপনাকেও বলিহারি মশাই, সামান্য রেলের চাকরি করেন, আপনার বিধবা মা রয়েছেন-তার মুখের দিকে একবার দেখলেন না–

দীপঙ্কর চুপ করে রইল।

শান্তিবাবু বলতে লাগলেন–আমি পুলিসের লাইনের লোক মশাই, এ-সব কথা আপনাকে বলা উচিত নয়, কিন্তু আপনার কথা ভেবে না-বলেও পারছি না-আমারও মশাই বিধবা মা আছে বাড়িতে, তিনটে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, আমাকে যদি এই চান্স কেউ দিত তো আমি ছাড়তুম না-আপনি হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছেন।

তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন–যাক গে, আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন, আমার কী বলার দরকার–যান, আজকে রাত্তিরটা গিয়ে ভাবুন কালকে বোধ হয় ব্যাটারি-ঘরেই ঠেলবে রায় বাহাদুর–

দীপঙ্কর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল।

শান্তিবাবু হন্ হন্ করে এগিয়ে এল। বললে–একটা কথা আপনাকে বলতে ভুলে গেছি মশাই কাউকে যেন বলবেন না, নইলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে–

–কী কথা?

–আপনি কায়স্থ, আমিও কায়স্থ, স্বজাতি। স্বজাতি বলেই বলছি-আসলে কী হয়েছে জানেন? আসলে আপনার বন্ধু কিরণ চাটুজ্জে ধরা পড়েছে–

দীপঙ্কর অবাক হয়ে আকাশ থেকে পড়লো! কিরণ ধরা পড়েছে? তাহলে কী হবে?

শান্তিবাবুর মুখখানা কালো হয়ে উঠলো। গলা নিচু করে বললে–খুব দুঃখের কথা অবশ্য। দেশ স্বাধীন হোক আমরাও চাই। চাকরি করি বলে আর একেবারে অমানুষ তো হয়ে যাইনি, আপনি খবরটা শুনে যেমন কষ্ট পেলেন, আমিও সেইরকম কষ্টই পেয়েছি– সত্যিই বড় দুঃসংবাদ!

দীপঙ্কর কী বলবে বুঝতে পারলে না। কিরণের ধরা পড়া মানে যে ফাঁসি হওয়া। দীপঙ্করেরই সমান বয়েস। এই বয়েসেই তার সমস্ত আশা-আকাঙ্খা নির্মূল হয়ে গেল।

শান্তিবাবু সান্ত্বনা দিয়ে বললে–আর ভেবে কী করবেন–যান–

দীপঙ্কর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল। শান্তিবাবু কাছে সরে এল এবার। বললে কাউকে যেন বলবেন না যে খবরটা আপনাকে আমি বলেছি–

দীপঙ্কর বললে–না বলবো না–

–না, বলবেন না, কথা থেকে অনেক কথার জন্ম হয়। এই দেখুন না কিরণ আপনার নাম ধাম বলতেই তো আপনি ধরা পড়ে গেলেন! নইলে আপনার নাম তো আমাদের জানবার কথা নয়!

–কিরণ আমার নাম বলেছে?

শান্তিবাবু বললে–তবে আর বলছি কি মশাই, আজকালকার বন্ধুত্ব এমনি জিনিস, আপনি তো দশ হাজার টাকার লোভ হেলায় এড়াতে পারলেন–কিন্তু যার জন্যে আপনি এত করলেন, সে তো করলে না? সে তো আপনার নাম ঠিকানা বলে দিলে টপ করে–

তারপর একটু থেমে শান্তিবাবু বললে–তাই তো আপনাকে বলছিলুম, দুনিয়া এইরকমই মশাই, আপনি এ-চান্স নষ্ট করবেন না–

সমস্ত মাথাটা যেন তোলপাড় করতে লাগলো দীপঙ্করের। অন্ধকার দরজা-বন্ধ ভ্যানের মধ্যে বসে দীপঙ্করের মনে হলো, সে যেন মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়বে। সমস্ত পৃথিবীটা যেন তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছে। সেই কিরণ! সে এমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে! নিজের সর্বনাশ করেছে সে, দীপঙ্করেরও সর্বনাশ করলে। দীপঙ্করের ওপর তার এত হিংসে! সেই কিরণ! কত ভালো ভালো কথা শুনিয়েছে সে! কত ভালো-ভালো বই পড়িয়েছে। ভেতরে ভেতরে তার এই মতলব! সমস্ত রাস্তাটা দীপঙ্করের ফেটে পড়তে ইচ্ছে হলো! কাউকেই তো সংসারে বিশ্বাস করা চলে না! শেষকালে অত্যাচারের কাছে মাথা নিচু করলে সে! কই, গোপীনাথ সাহা তো কারো নাম বলেনি। ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, যতীন দাস, শিবরাম, রাজগুরু-লাহোর মামলার কেউ তো কারো নাম বলেনি! তবে কেন কিরণ এমন করতে গেল? কেন কিরণ ছোট করলে নিজেকে? দীপঙ্করের চোখে কেন এমন করে কিরণ নিজেকে ছোট করলে!

প্রত্যেক দিনই সেই ইলিশিয়াম রো আর ভবানীপুর থানা। সমস্ত পৃথিবী যেন পরিক্রমা করে আসা। সেদিন ইলিশিয়াম রো থেকে এসে দেখলে লআপ ফাঁকা। কেউ নেই। কেউ নেই। ছিটে নেই, ফোঁটা নেই। এ ক’দিনে বড় ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল ওদের সঙ্গে। ওদের বাড়িতে বাস করেও এত ঘনিষ্ঠ হয়নি দীপঙ্কর। যখন দেয়ালে মাথা দিয়ে দীপঙ্কর চুপ করে একলা বসে থাকতো, তখন ছিটে এক-একদিন কাছে আসতো। বলতে-কাঁদছিস নাকি রে? দেখি, মুখ তোল, মুখ তোল–

দীপঙ্করের মুখখানা নিজেই হাত দিয়ে তুলে ধরতো। বলতো–তাই বল, আমি ভাবলাম কাঁদছিস বুঝি–

তারপর অভয় দিত। বলতো-অত ভাবছিস কেন? এই আমাদের কথা ভাব দিকিনি! আমরা কতবার এখানে এসেছি, আবার একদিন ছেড়ে দিয়েছে–গায়ে কি সে সব লেখা আছে আমাদের? সুভাষ বোসের কথা ভাব না, গান্ধীর কথা ভাব না।-কতবার এই ঘরে আমরা এক সঙ্গে পাশাপাশি কাটিয়েছি, আবার একদিন ছেড়েও দিয়েছে। তবে যাই বলিস ভাই, এতগ লোকের সঙ্গে তো কাটালাম এখানে, তার মধ্যে সুভাষ বোস লোকটা দেখলাম সত্যিই ভালো মাইরিলোকে যে-যাই বলুক, একদিন একটা বিড়িও খায় নিও খাঁটি লোক মাইরি–

ছিটেও আসতো। বলতো–আমারও এক-একবার এ-সব লাইন ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়, জানিস্ দীপু, ঘেন্না ধরে গেছে এ-লাইনের ওপর। আগে এ-লাইনটা ভালো ছিল, ভদ্দরলোকরা আসতো এ-লাইনে, মাল খেতো, ফুর্তি করতো, আর্টিস্টের খাতির করতো–আর আজকাল যত ছোটলোকের ভিড় হয়েছে, একটুখানি মাল খেলেই বেচাল হয়ে যায়, বাপ-মা তুলে কথা বলে

একটা মনের মত শ্রোতা পেয়ে ফোঁটা যেন বেঁচে গিয়েছিল। দীপঙ্করের কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে বসততা।

বলতো-তবে শোন, রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে একবার বাজাতে গেছি, লখনৌ থেকে আখতারী বাইজী এসেছে, আমি বাজাবো বলে যন্তর নিয়ে আস্তিন গুটোচ্ছি, রাজার ম্যানেজার কাছে এসে হাত জোড় করে বললে–ফটিকবাবু, একটু অনুগ্রহ করতে হবে-বলে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বললে, বিশ্বাস করবি না দীপু, খাঁটি বিলিতি হুইস্কির একটা বোতল খুলে দিলে। বললে–আগে নিবেদন করে নিন ফটিকবাবু, তা না হলে তবলা জমবে না আপনার

তারপর যেন হঠাৎ দার্শনিক হয়ে উঠতো ফোঁটা। থানার সেই অন্ধকার বীভৎস হাজতখানার ভেতরে দার্শনিক হওয়া ছাড়া কোনও গতি ছিল না যেন। বলতো-তাই জন্যেই তো তোকে বলছিলাম দীপু, ভদ্দরলোকের ছেলেদের এ-লাইনে থাকা চলে না, আজকাল আর মান-সম্মান থাকছে না আমাদের বুঝলি, যারা এখনও ধা-গে-ধি-না শেখেনি, তারাই আজকাল তেহাই মেরে আসর পয়মাল করতে আসে-দুঃখের কথা আর কাকে কী বলবো ভাই!

সত্যি, ছিটে-ফোঁটারও যে দুঃখ আছে এ-কথা সেদিন ভবানীপুর থানার লক-আপের মধ্যে না বাস করলে কী দীপঙ্কর কোনও দিন জানতেই পারতো? তখন বড় অশান্তিতে দিন কাটছিলো দীপঙ্করের। সে-ক’দিন। সেই কিরণ! সেই কিরণ এমন করে ছোট করলে নিজেকে! এমন করে ছোট করলে সমস্ত দেশকে! এমন করে সমস্ত লোকের মুখে চুন-কালি লেপে দিলে! দীপঙ্কর না-হয় তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারী চাকরি নিয়েছে! কিন্তু কিরণ? কিরণ তো দীপঙ্কর নয়! দীপঙ্করের কাছে কেন কিরণ এত ছোট হয়ে গেল? এ অনুশোচনা যেন দীপঙ্কর ভুলতে পারলো না সে-ক’দিন। দশ হাজার টাকার লোভের প্রশ্ন তার মনে জাগতো না, বিলেত যাবার প্রলোভনও তাকে বিচলিত করতো না, রেগুলেশন-থ্রির ভয়ও তাকে সন্ত্রস্ত করতো না। কিরণের জন্যে সত্যিই তার দুঃখ হতো। এমন অধঃপতন কেন হল তার? ব্যাটারি-ঘরের এই অত্যাচারই সে সহ্য করতে পারলো! তা হলে কেন এসেছিল স্বদেশীদের দলে? এইটুকু অত্যাচারেই সে সব বলে দিলে?

–কী ভাবছিস রে দীপু?

দীপঙ্কর বলতো-কিছু ভাবছি না তো

–তবে অত মন-মরা হয়ে গেছিস কেন? কথা বলছিস না যে?

দীপঙ্কর স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতো। বলতো–আমি আর কী বলবো? আমি তো তলার কিছু জানি না, তবৃলা আমি বাজাতেই পারি না

ফোঁটা বলতো-তুই তবলা শিখবি? শিখবি তো বল, আমি শিখিয়ে দিতে পারি

দীপঙ্কর বলতো–আমার দ্বারা ও-সব হবে না ভাই

ফোঁটা বলতে হবে না বলে কোনও কথা নেই। আমি শিখলুম কী করে?

ছিটে বলতো-চেষ্টা করলে আমিও শিখতে পারতুম, আমাকে যে আবার অন্য নেশায় ধরলে, নইলে

ফোঁটা বলতো-তাহলে এক কাজ কর দীপু, তুই আমার কাছে রেগুলার আয়, রাতৃতির এগারোটার সময় লোটনের ঘরে আয়–আমি তোকে তালিম দেব, তিন দিনে তোকে ধা-গে-ধি-না তুলে দেব

দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। বললে–লোটন কে?

–সে কি রে! লোটনকে চিনিস না? কালীঘাট বাজারের নামজাদা মেয়েমানুষ যে রে, ঠিক হিন্দু হোটেলের পেছনেই পাকা টিনের ঘর, আমাদের চন্নুনীর মেয়ে

চন্নুনীর মেয়ে! সেই অন্ধকার লক্-আপের মধ্যেই দীপঙ্কর মুখ তুলে চাইলে ফোঁটার দিকে।

ছিটে বললে–সে কি রে, তুই লোটনের নামই শুনিসনি, অ্যাদ্দিন কালীঘাটে আছিস? তা লক্কার নাম শুনেছিস?

লক্কা! দীপঙ্করের চাউনি দেখেই ছিটে-ফোঁটা বুঝতে পারলে যে, দীপঙ্কর দুজনের নামই শোনেনি। সত্যিই অবাক হবার মতই খবর বটে! এতদিন কালীঘাটে আছে, এতদিন এই পাড়ার মধ্যে লেখাপড়া করেছে, এই পাড়া থেকেই বি-এ পাশ করেছে এই লক্কা আর লোটনের খবরটাই রাখে না!

–তুই দেখছি বি-এ পাশই করেছিস, বিদ্যের নামে অষ্টরম্ভা!

ফোঁটা বললে–তা নাম শুনিস আর না-শুনিস কিছু আসে যায় না। তুই হিন্দু হোটেলের পেছনে ঢুকে পাকা টিনের চালের বাড়ির দরজায় গিয়ে–লোটন লোটন বলে ডাকবি, রাত এগারোটার সময়, ডাক শুনেই আমি বেরিয়ে আসবো।

তারপর অভয় দিয়ে বললে–তোর কিছু ঘাবড়াবার দরকার নেই, লোটন আমার নিজের মেয়েমানুষ, কেউ যদি কিছু বলে তো আমার নাম বলে দিবি, ব্যস, ও-পাড়ার গুণ্ডারা সব আমার হাত-ধরা! তুই অ্যাদ্দিন আছিস্ আর এইটেই জানতিস্ না! আমি তো লোটকে রেখেছি রে–আর দাদা রেখেছে লক্কাকে–চন্নুনীর বড় মেয়েকে

ছিটেও সায় দিলে। বললেহ্যাঁরে, তুই জানতিস না? লক্কা তো আমারই মেয়েমানুষ, চন্নুনীর বড় মেয়ে

ছিটে হঠাৎ জিজ্বেহস করলেতা চন্নুনী অঘোরদাদুর কে জানিস তো? জানিস তুই, না জানিস না?

থানার লক্-আপের মধ্যে মানুষ বোধ হয় সত্যিই অমানুষ হয়ে যায়। সুস্থ স্বাস্থ্যবান মানুষই অসুস্থ হয়ে ওঠে, তাতে ছিটে-ফোঁটার তো কথাই নেই। সে-কদিন ছিটে ফোঁটার কথা শুনে শুনে দীপঙ্করের সত্যিই কোনও ঘৃণা হতো না ওদের ওপর, শুধু বড় মায়া হতো। মায়া হতো এই ভেবে যে, এই একই দেশের মধ্যে এরাও তো থাকে! এরাও বাঁচে আর এদেরও তো বংশব”দ্ধি হয়! দেশে স্বরাজ এলে এদেরও কি একদিন ভোট দেবার ক্ষমতা হবে? এরাও কি আবার ভোট দেবে! এদেরও ভোটের ওপরেই কি একদিন দেশের ভাল-মন্দ নির্ভর করবে! কোথায় যেন কোন বইতে পড়েছিল দীপঙ্কর–এরাই ইতিহাসের ডাস্টবিন! ছিটে-ফোঁটা বোধ হয় তাই!

–আরে সেই জন্যেই তো বিন্তির বিয়ে হচ্ছে না। তা জানিস না! ছিটে-ফোঁটার হাসির আওয়াজ শুনে লকআপের বাইরের কনস্টেবলটা পর্যন্ত একবার পেছন ফিরে চাইলে।

–হল্লা মাত্ করো, হল্লা মাত্ করো—

যত কুৎসিতই হোক, যত অশ্রাব্যই হোক, তবু দীপঙ্করের কাছে মনে হয়েছিল এ ও তার এক আবিষ্কার যেন। এখানে এসেই যেন জীবনকে আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করল দীপঙ্কর। এতদিন ছোটবেলা থেকে কেবল লাইব্রেরী করে বেড়িয়েছে, স্বদেশীর খবর রেখেছে, সি আর দাশ, সুভাষ বোস আর কংগ্রেসের নাম শুনেছে, সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধু আর প্রাণমথবাবুর উপদেশ–এই সবই জেনে এসেছে। কিন্তু এরাও তো সংসারের মানুষ! এরাও তো পৃথিবীতে রয়েছে। এ দিকটা এতদিন দেখেনি তো সে! দীপঙ্কর সত্যিই অবাক হয়ে গেল।

–তুই এইতেই অবাক হয়ে গেলি, আর আরো সব যদি বলি তো তুই সঙ্গে সঙ্গে মূৰ্ছা যাবি রে।

ছিটে বললে–আরে চন্নুনী যে আগে জোয়ান বয়েসে খাসা দেখতে ছিল–

তা হবে। তাই হয়ত লোকে বিন্তিদিকে দেখতে আসে, রসগোল্লা-সিঙাড়া খায়, পছন্দও করে। কিন্তু তার পরে বংশ-পরিচয় খোঁজ-খবর নেবার পর আর কোনও খবর দেয় না। আর কোনও উৎসাহ দেখায় না। সেই জন্যেই হয়ত ও-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্যে মা অত পীড়াপীড়ি করে। সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে তার দীপুকে উদ্ধার করে ভদ্র পরিবেশে নিয়ে যেতে চায়। সব আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলে দীপঙ্কর। চন্নুনীর মুখটা মনে করবার চেষ্টা করলে। যৌবনে কি সুন্দরী ছিল চন্নুনী? বিপত্নীক অঘোরদাদুকে হয়ত সেদিন চন্নুনীই সান্ত্বনা দিয়েছে। চন্নুনী না-থাকলে সেদিন একটি নাতনী আর দুজন নাতির সেই সংসার কে চালাতো! কে তাদের বড় করেছে, কোলে করে মানুষ করেছে! হয়ত অঘোরদাদুর তখনও রক্তের তেজ কমেনি, হয়ত চোখে তখনও ছানি পড়েনি। বিপত্নীক অঘোরদাদুর চোখে হঠাৎ ভালো লেগে গিয়েছিল চন্ননীকে। গ্রাম থেকে চোদ্দ বছরের একটি বামুনের ছেলে একদিন একটি বস্ত্র সম্বল করে কালীঘাটের এলাকায় এসে ভাগ্য-অন্বেষণ করতে করতে কখন যৌবন কাটিয়ে দিয়েছিল অবহেলায়। সেদিন অর্থ ছিল না, আশ্রয় ছিল না, বলতে গেলে কিছুই ছিল না। যখন হলো সব, তখন আর-একটা দিক একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। স্ত্রী গেছে, কন্যা গেছে, তিনটি নাতি-নাতনী গলগ্রহ হয়ে গলায় ঝুলছে। আর ঠিক সেই সময় হঠাৎ নজরে পড়লো চন্নুনীকে। আর অঘোর ভট্টাচার্য যেন নতুন করে আবার তার যৌবন ফিরে পেলে। আবার তার জীবন ফিরে পেলে। বিপত্নীক অঘোর ভট্টাচার্যির সংসার আবার পূর্ণ হয়ে উঠলো। স্ত্রী, কন্যা হারিয়ে যে-সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল, আবার তা জোড়া লাগলো। তখন একদিন এসে হাজির হলো মা, আর এসে হাজির হলো দীপঙ্কর।

সে-সব অনেক দিনের কথা। তারপর চন্নুনী বৃদ্ধা হয়েছে, অস্থিসার চেহারা হয়েছে তার। বিন্তি বড় হয়েছে, ছিটেফোঁটাও বড় হয়েছে। কিন্তু ঘোল দিয়েই বুঝি দুধের স্বাদ মিটিয়েছে অঘোরদাদু। তাই ভাঙা সংসার আবার ভেঙেছে। যৌবন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্য আবার তর চরম প্রতিশোধ নিয়েছে।

এতদিন পরে দীপঙ্করের চোখের সামনে সব যেন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয়ে উঠলো।

যাবার আগের দিনও বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। আগের দিনও ফোঁটা বলেছিল–তা হলে ঠিক আসিস কিন্তু বাজারের পেছনের পাকা টিনের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকবি। লোটনের নাম মনে থাকবে তো?

.

পরের দিন আবার সেই ইলিশিয়াম রো। আবার সেই রায় বাহাদুর নলিনী মজুমদারের জেরা।

–কী ঠিক করলেন, দীপঙ্করবাবু?

শান্তিবাবু সঙ্গে ছিল। বললে–আমিও অনেক বুঝিয়েছি স্যার, কিন্তু কিছু বার করতে পারছি না।

দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। রায় বাহাদুর যেন কী ভাবতে লাগলেন চুরোট মুখে দিয়ে। বললেন–তা হলে রেগুলেশন থ্রি-তেই ঠেলে দাও

দীপঙ্কর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা, আপনারা সত্যি বলছেন,-কিরণ ধরা পড়েছে

–তা সত্যি বলছি না তো মিথ্যে বলছি? মিথ্যে বলে আমাদের লাভ?

–কিরণ আমার নাম করেছে আপনাদের কাছে?

–তা কিরণ না-বললে আমরা আপনার নাড়ী-নক্ষত্র জানলুম কী করে বলুন? এই রকম ভাবেই তো নাম-ধাম আদায় হয়। আর তাছাড়া শুধু কিরণ কেন, আপনাদের দলের সব লোককেই একে-একে ধরে ফেলবো। কেউ-ই বাকি থাকবে না। আর কা মাস আমাদের সময় দিন। তাই তো বলছিলুম, আপনি খুব বোকামি করছেন নেহাত আপনি বিধবার একমাত্র ছেলে বলে আপনাকে এই স্পেশ্যাল অফার দিচ্ছি

দীপঙ্কর হতবাক হয়ে গেল আবার। এমন কেন বললে সে! এমন করে কেন সকলের সর্বনাশ করতে গেল সে! কিরণই তো বুঝিয়েছিল তাকে একদিন যে বড় বড় রাজ্য-সাম্রাজ্য একদিন ধূলিসাৎ হয়ে যায়, বড় বড় ঐশ্বর্য-ভাণ্ডারও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু মনুষ্যত্বের সম্বন্ধ, সে যে চিরকালের! সেই মনুষ্যত্বের অপমান শূন্যতার চেয়ে শূন্যতর, কারণ তা পূর্ণতার অন্তর্ধন। সেই মনুষ্যত্বই ছিল কিরণের একমাত্র সম্পদ। কিরণের অর্থ ছিল না, ঐশ্বর্য ছিল না। বংশগৌরব, পদমর্যাদা, বিত্ত-বৈব, কিছুই ছিল না তার। তবু তো দীপঙ্কর তাকে ভালবাসততা। সেই ভালবাসার এমন করে প্রতিদান দিতে হয়?

সেদিন ফিরে এসে ছিটে-ফোঁটাকে আর দেখা গেল না। পাশের অন্য দু-চারজন লোক যারা ছিল, তারা বললে, তারা সকালেই ছাড়া পেয়ে গেছে। ভালোই হলো। দীপঙ্কর একলাই এক কোণে বসে কাটিয়ে দিয়েছিল সেদিনটা। ভালোই হয়েছিল সেদিন। দিন-রাত বড় বিরক্ত করতে দুজনে। সমস্ত পৃথিবীটা যেন ওরা ব্রায়ত্ত করে ফেলেছে এমনি ওদের ভঙ্গি। অথচ দীপঙ্করের মায়া হতো। মনে হতো ওরা কত দরিদ্র তা ওরা নিজেরাই জানে না। কালীঘাট বাজারের পৃথিবীটাকেই ওরা গোটা দুনিয়া ভেবে নিয়ে মহা আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। লোটন আর লক্কা আর নুনী আর বিন্তিদি আর অঘোরদাদুকে কেন্দ্র করেই ওদের পরিক্রমা, তার বাইরের হাজার হাজার ঐশ্বর্যের সন্ধানই রাখে না ওরা। ওরা বড় অল্পেতে তুষ্ট, দুটো বিড়ি দুটো হাত খরচের পয়সা, একটা নেশার জিনিস দিয়েই যে-কেউ ওদের কিনে নিতে পারে। তাই যখন গল্প করতে করতে দীপঙ্কর ওদের দিকে চেয়ে দেখতোতখন দুঃখও হতো ওদের জন্যে, মায়াও হতো ওদের জন্যে। বেশি হৈ-চৈ, গোলমাল করার জন্যে ওরা চাবুক খেত, বেত খেত, শাস্তি পেত। তবু একটু পরেই আবার হাসততা।

বলতো-এর সব শোধ নেব একদিন কড়ায়-গণ্ডায়-দেখে নিস দীপু, কড়ায়-গণ্ডায় শোধ তুলে নেব একদিন

তারপর গলাটা নিচু করে মুখটা কাছে সরিয়ে এনে বলতো–মাসে মাসে যে পাড়া থেকে তিরিশ টাকা চাঁদা তুলে দিই, তা কি ওমনি-ওমনি?

–মাগীদের রক্ত-ওঠা পয়সা, তার দাম নেই?

প্রতি মাসে পুলিস-কনস্টেবলদের কত করে ঘুষ খাওয়াতে হয় বাজারের মেয়েমানুষদের, তার হিসেব ছিটে-ফোঁটার মুখস্থ। আবগারী ডিপার্টমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে কারবারের যা কিছু মুনাফা হয়, তাতে বখরাও নেবে, আবার চোখও রাঙাবে। সেই লআপের মধ্যে বসেই ছিটে-ফেঁটা মিথ্যে আস্ফালন করতো গলা নিচু করে আর বলতো-এখান থেকে বেরিয়ে সব কড়ায়-গণ্ডায় শোধ নেব, এই তোকে বলে রাখছি দীপু, দেখে নিস–

সেই ছিটে-ফোঁটাই আর নেই। সমস্ত লকআপটা যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল তাই।

হঠাৎ চোখের সামনে লোহার রেলিং দেওয়া ভারী গেটটা হড়-হড় করে খুলে গেল একদিন।

–দীপঙ্কর সেন!

এ-এস-আই-এর গলা। দীপঙ্কর চোখ তুলে চাইলে।

–আপনার অর্ডার হয়ে গেছে, আসুন, বাইরে আসুন

অর্ডার! কিসের অর্ডার? দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। যেন বিশ্বাস হলো না। একদিন দীপঙ্কর ভুলেই গিয়েছিল যে, সে এই পৃথিবীরই মানুষ একজন। ভুলেই গিয়েছিল এই পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের অধিকার আছে তার।

–কিসের অর্ডার বললেন?

–রিলিজ অর্ডার!

মনে আছে দীপঙ্কর প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। বাইরে এসে তখন রাস্তায় রাস্তায় বাতি জ্বললো দেখেও তবু বিশ্বাস হয়নি। তাই সেই চেনা ভবানীপুরের চেনা রাস্তায় দীপঙ্কর প্রাণ ভরে চারদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল শুধু খানিকক্ষণ। যে-পৃথিবী সুখ দেয়, দুঃখও দেয়, যন্ত্রণা দেয়, সান্ত্বনাও দেয়, যে-পৃথিবী প্রতিদিনের ঘনিষ্ঠতায় সহজেই পুরোন হয়ে ওঠে, যে-পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের জন্মের সম্পর্ক, মৃত্যুর সম্পর্ক, যাকে প্রতি মুহূর্তে পদদলিত করি, আবার যার আশ্রয়ে আবহমানকাল বাঁচি, সেই পুরোন পৃথিবীকেও যেন বড় ভালো লাগলো দীপঙ্করের। সেইদিনই বিশেষ করে মনে হয়েছিল–এই পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যেন আর শেষ নেই। সে-সম্পর্ক যেন জীবনকালেরই নয়, জীবনাতীত কালেরও। একদিন অন্য সব সম্পর্কের মত পৃথিবীর সম্পর্কেরও হয়ত সাময়িকভাবে শেষ হয়, কিন্তু মানুষের ইতিহাসের বিচারে সেইটুকুই যেন তার কাছে কল্পকাল বলে মনে হয়েছিল সেদিন। সেদিন সেই ভবানীপুরের জনবহুল রাস্তাটাকেই দেখে দীপঙ্করের মনে হয়েছিল তার জীবনের সব সম্পর্কের সূত্র যেন এইখানে এসেই মিলেছে। এতদিন যে-পথের বিভ্রমে দীপঙ্কর ঘুরে মরেছে, কখনও প্রেম, কখনও অবিশ্বাস, কখনও তাচ্ছিল্য, কখনও বাধা-বিপত্তি, কখনও আনন্দ-আজ যেন সকলের ঐক্য-সাধন হয়েছে এই জেলখানার দরজার সামনেই–এই হাজতঘরের বাইরেই। এতদিনে যেন ভাগ্যচক্র তাকে ঠিক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ভালাবাসা

যে দীপঙ্কর পায়নি তা সত্যি নয়, আবার ভালবাসা যে পেয়েছে তা-ও সত্যি নয়। এই পাওয়া-না-পাওয়ার দ্বন্দ্বের আন্দোলনে যখন আছাড় খেয়ে পড়েছে দীপঙ্কর, তখনই যেন ঠিক পথের সন্ধিস্থলে এসে তার গম্যস্থানের নির্দশটুকু পেয়েছে। হয়ত বিচ্ছিন্ন না হলে দৃষ্টির বিভ্রম দূর হয় না। পৃথিবী থেকে একদিন বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বলেই যেন আবার এই পৃথিবীর এই ভবানীপুরকে এত ভালো লাগলো। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে এ অনেক দূর নয়, তবু এইটুকু রাস্তা চিনে আসতে যেন তার বহুকাল সময় লাগলো। কিরণকে হয়ত সে ভোগই করতে চেয়েছিল প্রাণ ভরে। কিরণকে হয়ত ভালবেসেছিল দীপঙ্কর স্বার্থপরের মতই। তাই বোধহয় তার অনুরাগ আর বিচ্ছেদের মধ্যে এমন বিরোধ ঘটলো আজ। তাই বোধহয় কিরণের এই অপঘাত-মৃত্যু, তাদের দুজনের সমস্ত সম্পর্কের সূত্র এমন করে বিলোপ ঘটিয়ে দিলে!

–দীপঙ্কর!

কোন দিন, কোনও রাত্রে যদি কোন অশরীরী আত্মা তাকে ডাকে, সে-ও যেন এমনি করেই ডাকবে। হরিশ মুখার্জি রোডের ভেতর দিয়ে আত্মগোপন করেই চলেছিল দীপঙ্কর। মনে হলো তার অতীত যেন তাকে আবার পেছনে ফিরতে বলছে। বলছে–সব ভুল, আমিই সত্যি। অতীতের আনন্দও সত্যি, অতীতের দুঃখটাও সত্যি। ভবিষ্যৎ তোমার যতটুকু সত্যি, অতীত তার চেয়ে কম সত্যি নয়। তবু দীপঙ্কর দু চোখ বুজে চলতে লাগলো। কী হয়েছে তার! কিছুই হয়নি! এমন কত বিপর্যয় ঘটে, কত অধঃপতন ঘটে! আবার উত্থানও আছে, সংসারে অভ্যুত্থানও আছে। হয়ত এই কদিনের অনুপস্থিতিতে তার চাকরি আর নেই, হয়ত তার জন্যে কেঁদে-কেঁদে মা-ও রোগশয্যায়। তবু উত্থান আছে, অভ্যুত্থানও আছে সংসারে। হয়ত ভুবনেশ্বরবাবু এসে সতীকে বর্মায় নিয়ে চলে গেছেন। হয়ত বাবার আসার খবর পেয়ে লক্ষ্মীদিও এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে, আশীর্বাদ পেয়েছে। হয়ত ভুবনেশ্বরবাবু আশীর্বাদ করেছেন। তা হোক, তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক…

–দীপঙ্কর!

দীপঙ্কর দুই হাতে নিজের কান বন্ধ করে দিলে-না, তার আত্মার পেছু-ডাক সে শুনবে না। পেছনটা মিথ্যে! অতীতটা অসত্য!

–কী রে, অমন করে কোথায় চলেছিস?

একটা হাত এসে কাঁধে পড়লো। দীপঙ্কর মুখ তুলে চাইতেই হতবাক হয়ে গেল।

নির্মল পালিত! কোট, প্যান্ট, টাই–একেবারে নিখুঁত পরিপাটি নির্মল পালিত!

দীপঙ্কর কী করবে ভেবে পেলে না খানিকক্ষণ। সেই ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে। তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। এই বাড়ি থেকেই একদিন তাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের, আবার এই বাড়ির সামনেই একদিন সতীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দীপঙ্করের। সে কত বছর আগের ঘটনা সব। বুকের বোতামের ফুটোতে গোলাপ ফুলের কুঁড়ি, ঘন ঘন রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে।

–কী কছিস তুই আজকাল?

–চাকরি।

নির্মল জিজ্ঞেস করলে–কোথায়?

–রেলওয়েতে!

–কত পাস?

–তেত্রিশ টাকা স্টার্টিং।

নির্মলের মুখখানা ম্রিয়মাণ হয়ে উঠলো। বললেব পুওর পে তোদের–তা হলেও তোর পক্ষে নট ব্যাড আইদার–

দীপঙ্কর কিছু বলবার আগেই নির্মল বলতে লাগলো–আমি সেদিন সেই কথাই কাকে যেন বলছিলাম-যা, মনে পড়েছে রবিনসনকে-রবিনসনকে চিনিস তো?

–হ্যাঁ, তোর সঙ্গে কী করে আলাপ হলো?

নির্মল বললেও তো আমার ওল্ড ফ্রেন্ড রে, তেরি ওল্ড ফ্রেন্ড–

–তোর বাবার বন্ধু?

–না না, আমার। রোটারীর মেম্বার আমরা। লোকটা ভালো, বেশ মাইডিয়ার লোক, আমি বলছিলাম বুড়োকে যে, এই যে কান্ট্রি-ওয়াইড ডিসস্যাটিসফ্যাকশান, এর জন্যে দায়ী তোমাদের পুরু পে–এটা রিভাইজ না করলে এসব দিন দিন বেড়েই চলবে-যা, ভালো কথা–

নির্মল পালিতের যেন একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

বললো–বাই-দি-বাই, আমাদের সেই কিরুণ, তোরও বন্ধু ছিল, আমি একবার তার লাইব্রেরীর চাঁদাও দিয়েছিলাম মনে পড়ছে–সে নাকি একেবারে বখে গেছে? শুনেছিস কিছু তুই?

দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল।

নির্মল বলতে লাগলো–শুনলাম, টেররিজম করে বেড়াচ্ছে–শুনে আমি বড় শক পেলাম, আই গট হার্ট–হাজার হোক এককালে তো চিনতাম তাকে–সেই শেষকালে…অবশ্য পভার্টি, পভার্টিই এর একমাত্র কজ–আমি সেই কথাই সেদিন রবিনসনকে….

হঠাৎ বাঁ-হাতের কব্ধিটা উল্টে দেখেই লাফিয়ে উঠলো।

–মাই গড–

পাশের গ্যারেজ থেকে একটা বিরাট গাড়ি বেরিয়ে আসছিল। সেই দিকে চেয়েই ফেন কথাটা মনে পড়ে গেল নির্মলের।

বললে–পাস্ট সেভেন–

–কোথাও যাবি বুঝি দেরি করিয়ে দিলাম—

নির্মল বললে–বেশি দূরে যাবো না, সতী মিত্তিরের বিয়ে–জয়ন্তীর বন্ধু–

সতী!

নির্মল বললে–আগে তোদর পাড়াতেই ভাড়া থাকতো, ভদ্রলোকের অপরাধ তিনি-সি-আই-ডি–দেশটা যে লিডিং টুওয়ার্ডস হোয়াট–আমি বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় পভার্টি–আর কিছু নয়, আমি সেদিন সেই কথাই রবিনসনকে…

–সতীর বিয়ে হচ্ছে? সতীর? ঠিক বলছিস?

নির্মল বললে–বিয়ে ঠিক নয়, মানে যাকে বলে বৌভাত আর কি, এই তো কাছেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে, জয়ন্তীকে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেব–আমিও একটু দেখা করে যাবো আর কি! সতীর বাবা যাহোক এ কদিনের মধ্যে একটা ভাল পার্টি পেয়ে গেছেন। মালটি-মিলিওনেয়ার লোক, জানিস্ তো–বরটাও ভালো পেয়েছে, বেশ হ্যান্ডসাম চেহারা সনাতন ঘোষ আমাদের পুরোন কায়েন্ট আবার–

আরো যেন কী সব বলে গেল নির্মল পালিত। আধা-ইংরিজী আধা-বাঙলা মিলিয়ে যত কথা বললে তার কিছুই কানে যায়নি দীপঙ্করে। হঠাৎ গাড়িটার স্টার্ট নেওয়াতেই চমকে সরে এল ফুটপাথের ওপর। এক পলকে শুধু দেখতে পেলে গাড়ির ভেতরে নির্মল পালিত বসে আছে, আর তার পাশেই তার বোন জয়ন্তী। এক পলকই মাত্র। বলতে গেলে এক পলকও নয় ঠিক। এক পলকের হয়ত একটা ভগ্নাংশ। কিন্তু গাড়ি চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ নিথর নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল দীপঙ্কর সেখানে।

রাত আরও বাড়ছে।

তারপর হরিশ মুখার্জি রোড পেরিয়ে, হাজরা রোড পার হয়ে সেই কালীঘাট বাজারের রাস্তাটা। ওখানে আরো ভিড়, আরো আলো, আরো গোলমাল। অনেক পথচারীকে পাশ কাটিয়ে আসতে আসতে দীপঙ্কর নিজেকেও যেন অতিক্রম করে গেল। যেন তার উত্তরণ হলো। যেন তার প্রমোশন।

ভিড়ের মধ্যে থেকেই একজন তার হাত ধরেছে।

–তোকে ছেড়ে দিলে ব্যাটারা? এই এখন আসছিস বুঝি?

দীপঙ্কর একেবারে ফোঁটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো।

ফোঁটা বললে ভালোই হয়েছে, আয়, চল তোকে আজ থেকেই আরম্ভ করে দিই—

ফোঁটা বাজারের পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল হাত ধরে।

দীপঙ্কর বললে কোথায়?

–সেই তবলা? ধা-গে-বি না’টা তুলে দেব চল–লোটনের ঘরে।

দীপঙ্কর এক বকুনি দিয়ে হাতটা টেনে নিলে। হঠাৎ যেন কোথা থেকে অমানুষিক শক্তি ফিরে এলদীপঙ্কশেরীরে ফেটাও অবাক হয়ে গেছে সেবকনি খেয়ে প্রায়টলে পড়েছিল আর একটুহলে। আর ততক্ষণেদীপরহকরে সোজা পাখপটির দিকে এগিয়ে গেছে। পেছনে বেঁটা ক যেন বললে কিন্তু তাতে কান দেবার সময় তখন আর নেই। ফেন দেরি করলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে তার ॥ সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল। তার সামনে দিয়ে ঈর গাঙ্গুলী লেনের গলিটার মধ্যে ঢুকতে হয়। কেমন যেন অল্প করতে লাগলো দীপঙ্করে। অকারণ যে কেন, কেন যে এই অরুণ রোমা কে জানে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো। বাড়ির সামনে সতীদের বাড়ির জানালা দরজা সমস্ত বন্ধ। সদর দরজায় একটা মস্ত ভারি তালা ঝুলছে। আর দেয়ালের গায়ে সেই সাইনবোর্ডটা আবার কুলছে-বাটি ভাড়া দেওয়া যাইবে।

বাড়িতে ঢুকতে গিয়েও যেন ঢুকতে পা সরলো না দীপঙ্করের।

মা হয়ত বিছানায় শুয়ে আছে। হয়ত দীপুর জন্যে কেঁদে কেঁদে শেষ পর্যন্ত শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে! যাবার দিন মার আর্তনাদ যেন তাকে থানা পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল! সে আর্তনাদ যেন তখনও থামেনি। হঠাৎ তাকে দেখে মা হয়ত লাফিয়ে উঠবে। মা জানেও না দীপঙ্কর ছাড়া পেয়ে গেছে। মা’র কাছে কেউ এসে খবরটা দেবারও নেই।

–মা!

একবার ভাবলে বাইরে থেকেই ডাকবে মাকে। ডেকে বলবে যে একবার এখুনি সে ফিরে আসবে। কিন্তু ডাকতে গিয়েও গলা দিয়ে তার স্বর বেরোল না। আজ কতদিন সে খায়নি! শুধু কয়েকটা কচুরি আর আলুর তরকারি দিয়েছে তাকে দু-বেলা। পা-ও যেন টলছে দীপঙ্করের। যেন বাড়িতে গিয়ে বিছানার ওপর গড়াতে পারলেই ভালো হয়। কিন্তু ডাকতে গিয়েও গলাটা বন্ধ হয়ে এল তার। যদি কেউ তাকে এ অবস্থায় দেখে ফেলে? যদি চন্নুনীও এই সময়ে বাইরে আসে হঠাৎ? দরজা খুলে বাইরে আসতেই হঠাৎ তার ওপর নজর পড়ে যায়? দীপঙ্কর আবার ফিরলো।

ঠিক যে-পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়ে। তারপর মায়ের মন্দিরটার উত্তর দিকের নতুন রাস্তাটা ধরে আবার চলতে লাগলো। তারপর রসা রোড ধরে সোজা হাজরা রোড। তারপর পুব দিকে বেঁকে বাঁ দিকে প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। কত নম্বর বাড়ি তা-ও জানা নেই। শুধু রাস্তার নামটা বলেছে নির্মল পালিত।

গলিটার মধ্যে ঢোকবার আগেই দূর থেকে নহবৎ-এর সুর কানে এল।

দীপঙ্কর গলির মুখ থেকে ভেতরে ঢুকে আস্তে আস্তে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সমস্ত বাড়িটা আলো দিয়ে সাজানো। বাড়ির ছাদের মাথায় ম্যারাপ বাধা। গলির মুখ থেকে গাড়ির ভিড় শুরু হয়েছে, সেই সার-দেওয়া গাড়ি শেষ হয়েছে অনেক দূরে গিয়ে। নহবতে কী সুর বাজাচ্ছে কে জানে! যেন নেশা ধরতে লাগলো দীপঙ্করের মাথার ভেতরে। কদিন থেকে যে দীপঙ্কর না-খেয়ে আছে তাও যেন সে ভুলে গেল। কাল থেকে তার চাকরি থাকবে না তাও যেন তার মনে রইল না। তার যে মা’র অসুখ, তার মা যে শয্যাশায়ী তাও মনে রইল না। চারিদিকে অনেক ভিড়, অনেক উৎসব, অনেক আদর-আপ্যায়নের অকুণ্ঠ আয়োজন। সেখানে বোধহয় দীপঙ্করই একমাত্র অনাহুত, দীপঙ্করই বোধহয় একমাত্র অপাঙক্তেয়। তবু তার মনে হলো এই ভালো হলো। এই-ই তো ভালো। একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা অপাঙক্তেয় হয়ে যাওয়াই তো ভালো। এই বিচ্ছেদকে অতিক্রম করেই দীপঙ্কর পূর্ণ হবে। এতদিন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি বলেই যেন যত বিক্ষোভ তাকে বিব্রত করেছে। এখন আর কোনও দায় রইল না তার, দায়িত্বও রইল না। এখন আর কাউকে তার প্রয়োজন নেই, এখন আর কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই তার। একে একে তার তালুকদারির সমস্ত স্বত্ব উপস্বত্ব যেন সে ত্যাগ করে দিলে সুস্থচিত্তে বহালতবিয়তে! একদিন অন্যের ভালো-মন্দ নিয়ে যদিই বা তার কোনও কিছুরই প্রয়োজন নেই তার। একে একে তার তালুকদারির সমস্তস্বত্ব উপস্বত্ব যেন সে ত্যাগ করে দিলে সুস্থচিত্তে বহালতবিয়তে। একদিন অন্যের ভালো-মন্দ নিয়ে যদিই বা তার কোনও অস্থিরতা সে প্রকাশ করে থাকে, আজ আর তা রইল না। আজ সর্বরিক্ত হয়ে দীপঙ্কর তার সর্বস্ব নিবেদনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলে।

তখনও আলো আর আনন্দ আর আপ্যায়নের অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই।

লাল শালু ঢাকা কানাতের পাশ দিয়ে অসংখ্য নিমন্ত্রিতের আনাগোনা চলেছে তখনও। দীপঙ্কর দোতলার খোলা জানালাগুলোর দিকে অনির্দিষ্ট চাউনি তুলে নিজের মনে কী দেখতে লাগলো কে জানে! আজকের এই নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দীপঙ্কর কেউই নয়, আজকের উৎসবের অনুষ্ঠানে দীপঙ্করের উপস্থিতি অপরিহার্যও নয়। তবু কান্নায় বুকটা ভারি হয়ে এল তার। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্করের মনে হলো তার অন্তরের গোপন অন্তস্তল থেকে কে যেন অত্যন্ত নিঃশব্দে এক অস্ফুট বাণী উচ্চারণ করে চলেছে। দীপঙ্কর কান পেতে শুনতে লাগলোতোমার আমার মধ্যে এই দুস্তর ব্যবধান, এ তো আমারই সৃষ্টি। ব্যবধান না থাকলে তুমি যে থেমে যাবে মাঝপথে, বিচ্ছিন্ন না হলে তুমি যে ভুলে যাবে আমাকে! এখানেই তোমার যে শেষ নয়, এখানে যে তোমার পূর্ণচ্ছেদও নয়। এখনও যে তোমার অনেক পথ বাকি। এগিয়ে চলো দীপঙ্কর, এগিয়ে চলো

দীপঙ্কর অস্থির হয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো ভয়ে ভয়ে। কে বলছে কথাগুলো! কে কাকে বলছে! চারদিকের ওই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে উঠলো সে। সবাই যেন তাকে সন্দেহ করছে। সে এখানে কী করতে এল! ছি, ছি!

হঠাৎ একটা গাড়ি আসতেই চারদিকে পুলিস পাহারার কড়া ব্যবস্থা হয়ে গেল। সসম্ভ্রমে সরে গেল সবাই। এতক্ষণে সবাই সাদর অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এল।

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল দেখে। সেই রায় বাহাদুর। আই-বি ব্র্যাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার। রায় বাহাদুর নলিনী মজুমদার। কালো কুচকুচে দশাসই চেহারা। বিরাট লম্বা দেহখানা গাড়ি থেকে নামতেই সবাই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন–আসুন আসুন রায় বাহাদুর

দীপঙ্কর লজ্জায় ঘৃণায় আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সেখানে।

.

গলিটা পেরিয়ে হাজরা রোডের বিস্তৃত পরিধির অবকাশে হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলো। এই-ই তো ভালো হলো। এখানেই তার শেষ নয়, এখানেই তার পূর্ণচ্ছেদ নয়। এখনও যে অনেক দূর–এখনও যে অনেক দূর যেতে হবে তাকে।

বাড়িতে ঢুকেই কিন্তু মাকে ডাকতে সাহস হলো না। মা’র যদি অসুখ হয়ে থাকে! মা যদি সেই দিন থেকে কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ করে ফেলে থাকে!

প্রথমেই চন্নুনীকে দেখতে পেলে।

চন্নুনী দীপঙ্করকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল–ও দিদি, তোমার দীপু এয়েচে গো, এই দ্যাকো

মনে আছে তখন দীপঙ্কর আর ছেলেমানুষ নয়। দিনে দিনে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায়, প্রতি মুহূর্তের অনুভাবনায় দীপঙ্কর তখন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু চন্নুনীর হয়ত সে-খেয়াল নেই। চন্নুনীর কাছে সে হয়ত সেই ছোট দীপুই রয়েছে। সেই দু’মাসের শিশু দীপু। যে-দীপু নিরাশ্রয় হয়ে মার কোলে উঠে একদিন এই বাড়িতে এসেছিল। এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের উনিশের একের বি-র বাড়িতে। চন্নুনীর কাছে সেই কোলে চড়া দীপুর সঙ্গে এই বড়-দীপুর যেন কোনও পার্থক্যই নেই। তাই হয়ত দীপুর সামনে সেই আগেকার মতই গালাগালি দিত-অশ্রাব্য অসভ্য গালাগালি।

কিন্তু দীপঙ্কর সেদিন এক অন্য দৃষ্টি দিয়ে দেখলে চন্নুনীর দিকে। কবে একদিন বয়েস কম ছিল চন্নুনীর। কবে একদিন এই সংসারে উপ-গৃহিণী ছিল, সে-চিহ্ন খুঁজলে তার চেহারায় কি কোথাও পাওয়া যাবে না? বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমস্ত অতীত কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়? সব কলঙ্ক অবলুপ্ত হয়ে যায়?

সবাই দৌড়ে এসেছে। বিন্তিদি নিজের ঘর থেকে এসে বাইরে দাঁড়াল। তার মুখে আর কথা নেই। অবাক বিস্ময়ে সে যেন হতবাক হয়ে গেছে। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-মা কোথায় চন্ননী? মা ভালো আছে তো?

বিন্তিদি বললে–তোমার মা খুব কাঁদছিল দীপু

এতক্ষণে মা নিজের ঘর থেকে বেরোল। কাঁধ থেকে আঁচলটা খসে পড়ছিল। সেটা আস্তে আস্তে কাঁধে তুলে নিলে। তারপর দরজার দুটো চৌকাঠ ধরে দাঁড়াল।

দীপঙ্করের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ঠায়। যেন আর নড়বার সামর্থ্য নেই মার। মার মুখ দিয়ে কোনও কথাও বেরোচ্ছে না। যেন বোবা হয়ে গেছে মা।

দীপঙ্কর কাছে এগিয়ে গেল।

–মা, আমি এসেছি মা, আমি এসেছি

মা যেন কী কথা বলতে গেল। কিন্তু বড় গম্ভীর দেখাল মা’র মুখখানা। আশ্চর্য চোখের দৃষ্টি! সে-দৃষ্টি তিরস্কারেরও নয়, স্নেহেরও নয়। দুই মিলিয়ে সে এক বিভ্রান্তি! মার চোখের দিকে চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেল দীপঙ্কর। এ ক’দিনেই কী হয়ে গেছে মা! কী অদ্ভুত বদলে গেছে। নিজের মাকেও যেন চিনতে কষ্ট হয়। মার সমস্ত শরীরটা থর থর করে কাঁপছিল।

দীপঙ্কর মাকে গিয়ে ধরে ফেললে।

–আমি এসেছি মা, তুমি কথা বলো, কথা বলো তুমি!

আর সঙ্গে সঙ্গে মার সমস্ত শরীরটা অবশ হয়ে গেল হঠাৎ?

মুখ দিয়ে শুধু আওয়াজ বেরোল-দীপু–

অস্পষ্ট অপ্রত্যক্ষ একটা অভিযোগের সুর শুধু গলা দিয়ে বেরিয়ে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দীপঙ্কর খপ করে মাকে ধরে ফেলেছে। তারপর আস্তে আস্তে মা’কে ধরে শুইয়ে দিলে বিছানায়। একদিন এমনি করে দীপঙ্করকে মা শুইয়ে বসিয়ে দাঁড় করিয়ে এত বড় করে তুলেছে। আর আজ দীপঙ্করেরই সেই মা’কে সেবা করবার পালা। মা বিছানায় শুয়ে হাঁফাতে লাগলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো মার।

ননীর গলা শোনা গেল বাইরে।

–কী আক্কেল গা ছেলের, মা রইল পড়ে আর ছেলে স্বদেশী করতে গেল। পোড়াকপাল অমন ছেলের, ঝাটা মারি অমন ছেলের মুখে।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বিন্তিদির শুকনো মুখটা দেখা যাচ্ছিল। কোনও দিন তার মুখে কথা থাকে না। আজও নেই। দীপঙ্কর বুঝতে পারলে দীপঙ্করের চেয়ে যেন বিন্তিদির সহায়হীনতার তুলনা নেই। এই সংসারের ভিতটুকু তার চোখের সামনেই ধ্বসে যেতে বসেছে।

একটা পাখা এনে দীপঙ্করের হাতে দিল বিন্তিদি।

দীপঙ্কর একটু অবাক হয়ে চাইলে বিত্তািদির মুখের দিকে। বিন্তিদির এ-বুদ্ধিটাও তো আছে! দীপঙ্কর পাখাটা দিয়ে হাওয়া করতে লাগলো মা’কে। মার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ পরে মনে হলো যেন মা একটু নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে। মা যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে–

বাইরে এসে ননীকে ডাকলে-কবে থেকে এমন হলো চন্নুনী!

স্বনী গলা-বাটা দিয়ে উঠলোবলিহারি তোমার আক্কেল বাছা, বুড়ী মা রইল বাড়িতে, আর তুমি কোন আকেলে স্বদিশী করতে গেলে শুনি? আমার নিজের পেটের ছেলে হলে আমি বাটা মেরে বিদেয় করতুম না! ছেলে-মেয়ে নয় তো শর! তাই তো দিদিকে বলেছিলুম–ছেলে দিয়েছে সগ্যে বাতি, বাকি রয়েছে নাতি-পোড়া-কপাল আমার।

–কই, মুখপোড়া এসেছে। এসেছে মুখপোড়া?

হঠাৎ কেমন করে যেন গলার আওয়াজ পেয়েছিল অঘোরদাদু। সেই অন্ধকারের মধ্যেই চিৎকার করতে করতে নেমে এল। বিন্তিদি হঠাৎ অঘোরদাদুর গলা পেয়েই নিজের ঘরে পালিয়ে গিয়েছে।

–হারামজাদা কই? কোনদিকে গেল সে? সে কী রুদ্র মূর্তি! বড় বীভৎস চেহারা অঘোরদাদুর!

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একেবারে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে, যেন ঝড়ের মতন ফেটে পড়বে একেবারে দীপঙ্করের ওপর। চনীও কাঠ হয়ে গেছে অঘোরদাদুকে দেখে! এখনি যেন সর্বনাশ হয়ে যাবে! এখনি যেন প্রলয় শুরু হবে! এমন মূর্তি যেন কেউ কখনও দেখেনি অঘোরদাদুর!

–কই? কোথায় গেল সে?

বলতে বলতে আর তাল সামলাতে পারলে না। একেবারে সোজা এসে পড়লো থামের ওপর। থামের গায়ে ধাক্কা লেগে পড়েই যেত হয়ত অঘোরদাদু। হয়ত একটা রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেত। কিন্তু দীপঙ্কর ধরে ফেলেছে।

অঘোরদাদু তখনও চিৎকার করছে-এই কোথায় গেল মুখপোড়া? কোথায় সে? ছাড় আমাকে, আমি দেখে নেব মুখপোড়াকে–

–এই যে আমি!

হঠাৎ এতক্ষণে যেন জ্ঞান হলো। দুদণ্ডের জন্যে একটু সামলে নিলে নিজেকে। তারপর হঠাৎ দীপঙ্করের মাথার চুলের মুঠি ধরে টানতে লাগলো। বললে–মুখপোড়া, আমার মেয়েকে কষ্ট দেওয়া? আমি চোখে দেখতে পেলে তোমাকে খুন করে ফেলতাম না! তোমাকে ক্যাওড়াতলায় নিয়ে গিয়ে জ্যাঙ চিতেয় তুলে পড়াতাম না! আমার মেয়ে ভালমানুষ বলে এত হেনস্থা?

অঘোরদাদুর গায়ে যে তখনও অত জোর তা কে জানতো! দীপঙ্করের মাথার চুলের মুঠি ধরে প্রাণপণে টানা-হাচড়া করতে লাগলো অঘোরদাদু আর চিৎকার করতে লাগলো গলা ছেড়ে।

–বল্ মুখপোড়া, স্বদেশী করতে শেখালে তোকে কে? কে তোকে মুখপোড়া স্বদেশী দলে নিয়ে গেল?

আবার চুল টানা, আবার চিৎকার।

দীপঙ্করের সমস্ত মাথাটা টন টন করতে লাগলো যন্ত্রণায়। কিন্তু তবু এতটুকু মাথা টেনে নেবার চেষ্টাও করলে না। ভালই হয়েছে। এই অত্যাচার যেন তার কাছে অত্যাচার বলে মনে হলো না। মনে হলো এ শাস্তি যেন তার প্রাপ্য। দীপঙ্কর মাথা পেতে দিলে অঘোরদাদুর সামনে। মনে হলো–অঘোরদাদু যেন তাকে শাস্তি দিচ্ছে না, আশীর্বাদ করছে। অঘোরদাদুর স্নেহের আশীর্বাদ তার মাথায় আরো ঝরুক। আরো শাস্তি দিক তাকে। আরো অত্যাচার করুক।

শুধু একবার মুখ ফুটে বললে দীপঙ্কর-একটু আস্তে আঘোরদাদু, মা এখনি একটু ঘুমিয়েছে–

–তবে রে মুখপোড়া! আবার দরদ হচ্ছে! গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া হচ্ছে! থামবো না আমি, আমি চেঁচাব। আমি চেঁচিয়ে তোর মার ঘুম ভাঙাবো-তুই কী করতে পারিস কর দিকি দেখি–

সেদিন চন্নুনী শেষ পর্যন্ত না ছাড়িয়ে দিলে হয়ত ছাড়তোই না অঘোরদাদু। সেদিন মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল অঘোরদাদুর।

চন্নুনী বুড়ী মানুষ। সেই বুড়ীই শেষকালে অঘোরদাদুর হাত চেপে ধরেছিল। বলেছিল–করছো কী? ওকে মেরে ফেলবে নাকি?

অঘোরদাদু তখন হাঁফাচ্ছে। বললে–মেরেই ফেলবো, আজ আমি মুখপোড়াকে মেরেই ফেলবো।

–তা ও কি আর সেই তোমার আগেকার ছোট ছেলেমানুষ আছে? ও যে এখন বড় হয়েছে, ছাড় ওকে ছাড়, ছেড়ে দাও

কী হলো কে জানে! সেই অন্ধ বুড়ো অঘোরদাদু হঠাৎ থেমে গেল। হয়ত এতণে খেয়াল হয়েছে, দীপু আর সেই ছেলেমানুষ নেই, তার দীপু এখন বড় হয়েছে, তার দীপু বি-এ পাশ করেছে, তার দীপু চাকরি করছে।

কাঁপতে কাঁপতে অঘোরদাদু নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

চন্নুনী কাছে এল। বললেছি বাবা, কানতে নেই, বুড়োমানুষ কী বলতে কী বলেছে, ওর কি মাথার ঠিক আছে

দীপঙ্কর হঠাৎ মুখটা ঘুরিয়ে চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করলে।

২৮

পান্না ডাক্তার কালীঘাটের হালদার পাড়ায় নামকরা ডাক্তার। নগদ এক টাকা নেয় বাড়ি এসে রোগী দেখতে। সকাল বেলাই এল।

সব দেখে শুনে বললে–ওই ওষুধ লিখে দিলাম, আমার ডিসপেনসারী থেকে নিয়ে এসো–চার আনা দাম লাগবে

সেদিন চন্নুনী ছিল তাই রক্ষে। চন্নুনী সমস্ত রাত মা’র পাশে জেগেছে। তারপর সকালে উঠোন ঝাঁট দিয়েছে, বাজারে গেছে। তারপর রান্না করে আপিসের ভাত দিয়েছে।

চন্নুনী বলেছে–কী আক্কেল গা তোমার? নতুন চাকরি, কামাই করলে তোমার চলবে?

–কিন্তু মা’কে একলা ফেলে কেমন করে যাই চন্নুনী?

–ওমা, তা আমি কি মরে গেছি? আমি তো ক্যাওড়াতলায় গিয়ে চিতেয় উঠিনি গো!

আপিস যাবার আগে দীপঙ্কর বার বার চন্নুনীকে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল। বিন্তিদিকেও বুঝিয়ে দিয়েছিল। পাশে সব সময় যেন কেউ-না-কেউ থাকে। সাবু, বার্লি, নেবু, সব রইল। দীপঙ্কর যাবে আর ছুটি হলেই সোজা চলে আসবে। অনেকদিন আপিসে যাওয়া হয়নি। সে চাকরি আছে কি নেই তারও ঠিক নেই। এ কদিন লক-আপের মধ্যে ঘুম ছিল, খাওয়া ছিল না, শান্তি ছিল না। বাড়িতে এসেও মা’র অসুখ। সারা রাত ঘুম হয়নি। মা ছাড়া সংসারে আর কে তার রইল। কিরণ গেছে লক্ষ্মীদি গেছে, সতীও গেছে! আছে শুধু মা। দীপঙ্কর এত বড় হয়েছে, এত বুঝতে শিখেছে, এত লেখাপড়া করেছে! তবু যেন কোথায় তার মধ্যে একটা চিরস্থায়ী শিশু রয়েছে। সে শিশুটা যেন এতদিনেও বড় হলো না। যেন এতদিনেও তার সাবালকত্ব এলো না। এখনও মা’র অসুখে তার কান্না এসে পড়ে। এখনও মায়ের মৃত্যু সে যেন কল্পনাও করতে পারে না।

সেই ক’দিনেই হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল আপিসে। সামান্য ক’দিনের চাকরি। কিন্তু জাপান-ট্রাফিক যেন এর মধ্যেই অচল হয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের যেন ভিত ধ্বসে যাচ্ছিল। ক’দিন ধরে রবিন্স সাহেবের মত ঠাণ্ডা মেজাজের লোকও মাঝে মাঝে গরম হয়ে উঠত। বার বার কেবল জিজ্ঞেস করেছে-বাট, হোয়ার ইজ সে?

ট্রানজিট সেকশনের বড়বাবু রামলিঙ্গমবাবু। রামলিঙ্গমবাবু অস্থির হয়ে পড়েছে রবিন্স সাহের হুকুমের ঠেলায়। একবার সেকশন একবার সাহেবের কামরা–এই করেছে কেবল। কাগজ-পত্র, ফাইল, স্টেটমেন্ট কোথায় রেখে গেছে দীপঙ্কর, তাও জানা ছিল না। সেকশনে তোলপাড় পড়ে গেছে কদিন ধরে।

–ও হরিপদ, জাপান-ট্রাফিকের স্টেটমেন্ট কোথায় আছে, বলতে পারো?

শুধু হরিপদ নয়, সেকশনের যত ক্লার্ক, সবাই গরু-খোঁজা করে খুঁজেও পায়নি স্টেটমেন্ট। ওদিকে রেলওয়ে বোর্ড থেকে কড়া নোট এসেছে। রেলওয়ে বোর্ড আর্জেন্ট স্লিপ লাগিয়ে চিঠির জবাব চেয়ে পাঠিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসেছে রামলিঙ্গমবাবু।

–ও হরিপদ, রেকর্ড সেকশনে গিয়ে একবার খোঁজ নাও তো। শিগগির বলো গিয়ে অ্যাসেব্লিতে কোশ্চেন উঠেছে-এখখুনি দরকার

আশ্চর্য কিন্তু! সেই স্টেটমেন্ট ফাইল প্রতিদিন ঘাঁটা হয়, প্রতিদিন নাড়া-চাড়া হয়, প্রতিদিন সামনেই থাকে। রেলওয়ে বোর্ড থেকে চিঠি এলেই রবিনসন সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখালেই স্টেনোগ্রাফারকে নোট দিয়ে সাহেব উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু সেই সামান্য জিনিসের জন্যেই বজ্রপাত হয়ে গেল আপিসে!

রবিনসন সাহেবের চাপরাশী দ্বিজপদও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। দৌড়তে দৌড়তে এল। বললে–রামলিঙ্গমবাবু, জলদি

–আবার?

রামলিঙ্গমবাবু সেইমাত্র ঘরে এসে বসেছিলেন। আবার ডাক এল, আবার ছুটলেন।

হরিপদ জিজ্ঞেস করলেও দ্বিজপদ, কী হলো সাহেবের? এত গরম কেন সকাল থেকে?

দ্বিজপদ বললে–সাহেবের কুকুরের অসুখ করেছে, মেমসাহেব কেবল টেলিফোন করছে বাড়ি থেকে

সর্বনাশ করেছে! রামলিঙ্গমবাবু সেই যে সাহেবের ঘরে ঢুকেছে, আর আসবার নাম নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিন পা একেবারে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল বড়বাবুর। রেলের চাকা বোধহয় আর চলবে না। এমনি অবস্থা তখন। পাঁচটা পর্যন্ত কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে পারলেই ক্লার্কদের ছুটি, তারপর তাদের আর কোনও দায়িত্ব নেই। যত ঝঞ্ঝাট বড়বাবুর। আর যত ঝঞ্ঝাট সাহেবের। শেষে ডিস্ট্রিক্টে টেলিফোন করা হলো। ট্রাঙ্ক কল। শেষকালে সেই ফিগার এনে কোনও রকমে চাকরি বজায় রইল সেদিনকার মত। পরের দিন যা-হয় হবে।

আর পরের দিনই দীপঙ্কর আপিসে গিয়ে হাজির।

–কী মশাই? কোথায় ছিলেন অ্যাদ্দিন? কী হয়েছিল একটা খবর দিতে পারেননি। এদিকে সাহেব যে ক্ষেপে লাল?

দীপঙ্কর এ-অবস্থায় জন্য তৈরী হয়েই ছিল। আপিসে আসার পথে বুকটা বার বার কেঁপে উঠেছে। যখন কিছুই রইল না, তখন চাকরিটাও হয়ত চলে যাবে। চাকরি তখনও পাকা হয়নি। আর নৃপেনবাবুর লোক বলে কেউ কিছু বলতেও পারেনি এতদিন। কিন্তু সুযোগ তো খুঁজছিল সবাই। কে কার ভাল দেখে সংসারে। চাকরি দীপঙ্করের প্রয়োজন। চাকরিটা বলতে গেলে তার কাছে অপরিহার্য। তবু আপিসে ঢোকবার মুখে যেন বিতৃষ্ণায় সারা মনটা ভরে উঠলো। পৃথিবীতে যে এত ঘটনা ঘটে চলেছে, এখানে যেন তার কোনও তরঙ্গের স্পর্শ লাগে না। এখানে কেবল প্রমোশন, গ্রেড়, ট্রান্সফার আর ইনক্রিমেন্ট! তবু বিতৃষ্ণা থাকলে চলবে না। চাকরি করতেই হবে তাকে। মা’র অসুখের সময় চিকিৎসাও করতে হবে। মাকে নিয়ে অন্য বাড়িতে উঠতে হবে। সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে মা’কে। তার জন্যে এমনি করেই বোধহয় এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তার উত্তরণ হবে একদিন। মানুষের সব রকম পরিত্রাণের একমাত্র মূল্যই বোধহয় দুঃখ। হয়ত এই অবহেলা, দুঃখ, কষ্ট স্বীকার–সমস্তই একদিন তাকে সন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করবে। কিরণ বলতোকষ্ট সহ্য করা ভালো। তাই সে হাসিমুখে তেতো ওষুধ খেতো। দীপঙ্করও যে এই কষ্ট সহ্য করছে, সে তো একদিন কষ্টাতীত হবে বলেই। অন্তত নিজে না হোক, মাকে সে তো শান্তি দিতে পারবে, সুখ দিতে পারবে।

হড়িকাঠে যেমন পাঁঠারা কালীঘাটে গলাটা বাড়িয়ে দেয়, এও যেন তেমনি।

রবিনসন সাহেব টেবিলের ওপর ঘুষি মারলে একটা।

পাশেই রামলিমবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার দায়িত্ব যেন ফুরিয়ে গিয়েছে। তিনি আসামীকে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, এখন আসামীর হাজতবাস হোক, জেল হোক, দ্বীপান্তর হোক, ফাঁসি হোক, তার আর কিছু যেন করণীয় নেই।

দীপঙ্কর লক্ষ্য করলে ঘরের মধ্যে সাহেবের কুকুরটা কোথাও নেই। কোথায় গেল কুকুরটা! হঠাৎ কি কুকুরটারও সময় বুঝে শরীর খারাপ হয়েছে নাকি!

রবিনসন সাহেব বললে–কোথায় ফাইলটা ছিল? উত্তর দিলেন রামলিঙ্গমবাবু। বললেন–সেকশনের র‍্যাকে

–তাহলে তোমার লোকগুলো কী করছিল এতদিন? দোজ ক্লার্কস

তারপর বললে–নো, নো, আমি সমস্ত সিস্টেম বদলে দিতে চাই—জাপান-ট্রাফিকের সমস্ত কাগজ পত্র, ফাইল, স্টেটমেন্ট কিছু রেকর্ড-সেকশনে থাকবে না, সব

আমি আমার চোখের ওপর দেখতে চাই। সব আনো আমার ঘরে–আই ওয়ান্ট ইট নাউ ওনলি

দীপঙ্কর আর রামলিঙ্গমবাবু চলে আসছিল।

সাহেবের কী মনে পড়লো হঠাৎ। বললে–অ্যানাদার থিং–আর একটা কথা–সেন শুড় সীটু হিয়ার, সেন এখানে বসবে, এই পাশের ঘরে

সেকশনে আসতেই হরিপদ দৌড়ে এল। কী খবর বড়বার রামলিঙ্গমবাবু বললে–দরকার নেই বাবা, জাপান-ট্রাফিকের ঝঞ্ঝাটসে বাঁচ গিয়া–

–কেন? কেন?

–সাহেবের অর্ডার হয়ে গেছে, জাপান-ট্রাফিক-ক্লার্ক ওর স্টেনোগ্রাফারের ঘরে বসবে এবার থেকে, স্টোরে অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। নতুন ড্রয়ার টেল চেয়ারের হুকুম দে দিয়া–

ভালোই হয়েছে। রামলিঙ্গমবাবুও বেঁচে গেলেন, সেকশন সুদ্ধ লোকও বেঁচে গেল। ও-ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পেয়ে গেল সবাই। সকাল থেকেই ওই জাপান-ট্র্যাফিক নিয়ে যে-ঝড় ওঠে তার ঠেলা সামলানো দায় হয়ে পড়ে। এতে মাইনে তো এক পয়সা বাড়বে না, শুধু খেটে মরো। তাছাড়া, সাহেবের চোখে চোখে থাকা, সে-ও এক বিপজ্জনক চাকরি। পান খেতে পারা যাবে না, গল্প করতে পারা যাবে না, খবরের কাগজ নিয়েও মুখরোচক আড্ডা দেওয়া যাবে না। আপিসে এসেই ফাইল নিয়ে বসতে হবে, আর যতক্ষণ সাহেব আপিসে থাকবে ততক্ষণ বন্দী হয়ে থাকো। দরকার নেই মশাই অমন চাকরিতে। ও আপনাদেরই পোয়। আপনারা বিয়ে-থা করেন নি, ব্যাচিলর মানুষ, সমস্ত দিন সাহেবকে তেল দিতে পারবেন।

এস্টাবলিশমেন্ট-ক্লার্ক দরখাস্তখানা দেখেই বললে–এ কি, নতুন চাকরিতে ঢুকেই কামাই?

দীপঙ্কর বললে–কী করবো বলুন, আমি তো ইচ্ছে করে কামাই করিনি–

–তাহলে সার্ভিস ব্রেক হচ্ছে, এই কদিনের মাইনে কাটা যাবে

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু রবিনসন সাহেব নিজে দুটি গ্রান্ট করে দিয়েছে, এই দেখুন সাহেবের সই

–সে কি? টেম্পোরারী সার্ভিসে ছুটি কী করে দেয় সাহেব?

দীপঙ্কর বললে–তা জানি না, আপনি রবিনসন সাহেবকে বরং জিজ্ঞেস করে আসুন গিয়ে–

খুব যেন প্রশ্ন হলো না এস্টাবলিশমেন্ট ক্লার্ক। সত্যিই কেউই যেন প্রসন্ন নয় তার চাকরির ব্যাপারে। কেউই খুশী নয়। সবাই যেন খুশী হতো তার চাকরি গেলে। নতুন সার্ভিস, পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে আটকে রেখে দিলে এতদিন, তবু সাহেব দরখাস্তের ওপর বড় বড় অরে গ্যান্টেড’ লিখে দিয়েছে। নিজেরা আলোচনা করতে লাগলো রুল নিয়ে। এস্টাবলিশমেন্ট ম্যানুয়েলে কী আইন আছে, আর সে-আইন ভঙ্গ হয় কী করলে, তা তাদের মুখস্থ! অথচ ডি-টি-এস সাহেব তাদের সঙ্গে কনসাল্ট না করেই অর্জর ইস্যু করে দিলে! তা ছাড়া ওদিকে স্টোর সেকশনেও তখন আলোচনা চলছে!

–কে হে? কবে ঢুকেছে কী নাম বললে? দীপঙ্কর সেন?

–ওই যে হে, নৃপেনবাবুর লোক, ট্রাফিক আপিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট

–তা বলে পুরোন চেয়ার টেবিল আলমারি দিলে চলবে না? কে এমন কেষ্ট-বিষ্ণু এল একেবারে

স্টোরের বড়বাবু তাড়াতাড়ি রবিনস সাহেবের ঘরে গিয়ে বললে—স্যার—

–ইয়েস?

–পুরোন চেয়ার টেবিল দিলে চলবে না স্যার? এখন তো স্টকে নতুন কিছু নেই আমাদের।

রবিনসন সাহেব বিরক্ত ছিল সকাল থেকেই। বেশি তর্ক করবার সময়ও ছিল না। বিশেষ করে কুকুরের অসুখ চলছে কদিন ধরে। মেমসাহেব ঘনঘন টেলিফোন করছে। তাই নিয়ে। সি-এম-ও-কে টেলিফোন করেছিল সাহেব একবার দেখে আসার জন্যে।

তখনও খবরটা আসেনি। হঠাৎ স্টোর-ক্লার্কের কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো।

বললে–লিসন, শোন, আই ওয়ান্ট টু সী দ্যাট মাই অর্ডার ইজ ক্যারেড় আউট

স্টোর-ক্লার্ক আর বেশি কথা বললে না। সোজা এসে বললে–ওহে, নতুন ফার্নিচারই দিতে হবে, সাহেবের মেজাজ গরম–

সেদিন স্টকে না-থাকা সত্ত্বেও কোথা থেকে যে নতুন ফার্নিচার বেরোল শেষ পর্যন্ত সেটাই আশ্চর্য! স্পেশ্যাল টাইপের চেয়ার, টেবিল, আলমারি। ইম্পর্ট্যান্ট কাগজ-পত্র থাকবে সেখানে। যেটা যখন হঠাৎ দরকার হবে, সেটা খুঁজে পাওয়া চাই। সেকশনের মধ্যে থাকলে অন্য ফাইলের সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে। এখানে প্রত্যেকটা আইটেম্ বাই-আইটেম সাজানো থাকবে। একদিন যদি দীপঙ্কর হঠাৎ ছুটি নেয়, তাতেও কোনও অসুবিধে হবে না। যে-কেউ এসে খুঁজে দেবে। দরকার হলে সাহেব নিজেও এসে নিয়ে যেতে পারে। কিম্বা মিস্ মাইকেল আছে। রবিনসন সাহেবের স্টেনোগ্রাফার। মিস মাইকেলের বেশি বয়েস হয়নি। বড় সুন্দর দেখতে।

করিডরেই গাঙ্গুলীবাবুর সঙ্গে দেখা। দৌড়তে দৌড়তে আসছিলেন। বললেন–এই এখুনি খবর পেলাম, আপনি এসেছেন–তাই দৌড়ে আসছি, এসে গেছেন ভালোই হয়েছে, আজকেই নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েল–

–আজকে–সে কি? আমি তো জানতাম না!

–হ্যাঁ, আপনার নামে এক টাকা চাঁদা ধরেছি

দীপঙ্কর বিব্রত হয়ে পড়লো। বললে–কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই, শুধু ট্রাম ভাড়াটা আছে

–সে দেবেন অখন, মাইনে পেলে দেবেন; এখন আপনার নামে চাঁদা ফেলে দিলাম, তারপর দেখা যাবে মাসকাবারে! কী দিচ্ছি জানেন তো?

–কী?

–আমরা দিতে চেয়েছিলাম, একখানা মহাভারত আর একখানা রামায়ণ, কিন্তু উনি বললেন, মহাভারত-রামায়ণ ওঁর আছে, উনি নিজে থেকেই তখন এক সেট সোনার বোম চাইলেন।

–সোনার বোতাম?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–চল্লিশ টাকার কমে তো আর বোম হবে না, তাই আট-আনা করে ধরেছিলাম প্রথমে, এখন মাথা পিছু এক টাকা করে ধরতে হলো–

দীপঙ্করের তবু যেন বিশ্বাস হলো না। বললে–উনি নিজে মুখ ফুটে চাইলেন?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–হ্যাঁ, তা যাক গে, আজকে বিকেল পাঁচটার সময় টিফিন-রুমে ফেয়ারওয়েল হবে, আপনি থাকবেন কিন্তু, ফটো ভোলা হবে,-আমি যাই–

গাঙ্গুলীবাবু চলে গেলেন। দীপঙ্করের বিতৃষ্ণাটা যেন আবার মনের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। নৃপেনবাবু চলে যাবেন, আর আসবেন না। ভাবতে একটু দুঃখও হলো। এতদিনের চাকরি। ছাড়তে কষ্ট হবারই কথা! আজকের দিনে কোনও ঘৃণা, কোনও বিরাগ রাখতে নেই মনে। রাখা অন্যায়। যে চলে যাচ্ছে, তাকে যেন সবাই প্রসন্ন মনেই বিদায় দেয়। একদিন তো দীপঙ্করও চলে যাবে! সেদিন? সেদিন কি এমনি কুণ্ঠিত চিত্তে তাকে বিদায় দেবে তার সহকর্মীরা? কিন্তু কেন ভালো হতে পারে না মানুষ! কেন এত লোভ মানুষের! দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। এই ছোট লোভটুকু ত্যাগ করলে নৃপেনবাবু কি দরিদ্র হয়ে যেতেন? গাঁটের কড়ি দিয়ে যে-জিনিস কিনি আমরা, তার চেয়ে উপরি পাওনায় কি বেশি তৃপ্তি? অথচ সুখের উপকরণ কিনতে জীবনে যে-জিনিসের যা দাম দিই, অনেক সময়ে তার চেয়ে অনেক বেশিই তো আসলে পাই! কিন্তু তখন কি ভেবে দেখি আমি তার অযোগ্য?

নৃপেনবাবুর ঘরে ঢুকতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল।

আজকে ফেয়ারওয়েলের দিন। শেষ-দেখা করে যাওয়া ভাল। কিন্তু দীপঙ্কর ভেবেছিল, নৃপেনবাবুর মুখটা ম্রিয়মাণ হয়ে থাকবে। বিদায়ের দিনে একটু হয়ত গম্ভীর, একটু মর্মাহত। এতদিনের অবলম্বন ত্যাগ করার সময় সেইটেই হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু নৃপেনবাবুর ভারি হাসি-হাসি মুখ।

সব শুনে বললেন–তা যাকগে, মিটমাট হয়ে গেছে এখন, ভালোই হয়েছে। আমি তখুনি বলেছিলুম স্বদেশী-ফদেশীর মধ্যে থেকো না, ওতে সাহেবদের নজর খারাপ হয়ে যায়–

তারপর হাসতে হাসতে বললেন–শুনেছ তো, আজকে আমার ফেয়ারওয়েল?

দীপঙ্কর বললে–এখুনি শুনলুম

নৃপেনবাবু টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। গলা নিচু করে বললেন–তুমি কত চাঁদা দিলে?

দীপঙ্কর বললে–এক টাকা চাঁদা ধরেছে

নৃপেনবাবু বললেন–কী কাণ্ড দেখ, মতলব ছিল একখানা মহাভারত আর রামায়ণ দিয়ে ব্রাহ্মণ-বিদায় সারবে, শোন ব্যাপারখানা! তা আমি বললাম-না, যদি দিতেই হয় তো একসেট সোনার বোতম দাও, যেটা সত্যিই থাকবে! আমরা অসর সাহেবের ফেয়ারওয়েলের সময় তিন টাকা করে চাঁদা দিয়েছিলাম। চাঁদা দিয়ে সোনার একটা পাইপ কিনে দিয়েছিলাম, আর আমার বেলাতেই কিনা রামায়ণ-মহাভারত-এ কি পুরুত–বিদায়? তুমিই বলল না, সোনার বোম চেয়ে ভাল করিনি? পনের টাকার মধ্যে সারছিল, আর গোটা পঁচিশেক টাকা বেশি পড়লো–এই যা! এমন কিছু বেশি চাইনি আমি-কী বলে?

তারপর একটু থেমে বললেন–তুমিই বলো না, আমি সোনার বোতাম চেয়ে কিছু অন্যায় করেছি? ওই কে-জি-দাশ, ওই রামলিঙ্গম, ওরা আমি না থাকলে সিনিয়র-গ্রেড় পেতো? এই তোমারই কথা ধরো, তুমি চাকরি পেতে রেলে?

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি বললে–আচ্ছা আমি আসি তাহলে–

–দাঁড়াও, দাঁড়াও না হে, অত ব্যস্ত কিসের, আসল কথাই তো বলা হয়নি তোমাকে। তুমি মিটিং-এ যাচ্ছো তো?

–যাবো’খন!

–যাবো’খন নয়, যেতেই হবে, বুঝলে না, মীটিং-এ লোক-জন না হলে বড় খারাপ দেখায়, বড় ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগে, তাই বলছি তুমি যাবে আর কিছু বলতেও হবে তোমাকে। লেকচার দিতে হবে–

দীপঙ্কর লজ্জায় পড়লো। বললে–লেকচার? আমি তো লেকচার দিতে পারি না–

–সে কি? তুমি যা জানো আমার সম্বন্ধে, তাই-ই দু’চার কথা বলবে। তোমরা যদি কিছু না লেকচার দাও তত মীটিং মানাবে কেন? তুমি কী বলবে বলো দিকিনি? একটু ভাবো না–

–কী বলবো বলুন?

নৃপেনবাবু বললেন–ইংরিজীতে বলতে হবে কিন্তু। ইংরিজীতে না বললে সাহেবরা আবার বুঝতে পারবে না। আর সাহেবরা না বুঝলে বলেই বা কী লাভ?

–কিন্তু আমি যে কখনও লেকচার দিইনি কোথায়?

–আরে তুমি যা জানো তাই বলবে, তাকে লেকচার বলো আর যা-বলল, আমার সম্বন্ধে তুমি কিছু জানো না?

দীপঙ্কর বললো, হ্যাঁ, জানি বৈ কি।

–তা সেইটেই বলবে তুমি। তুমি তো জানো আমি কীরকম ভালো লোক! আমি কী-রকম পরিশ্রমী লোক, কী-রকম পরোপকারী লোক, আপিসের কাজে কী-রকম খাঁটি-তুমি তো জানো সব। তুমি জানো না যে আমি জীবনে কখনও মিথ্যে কথা বলিনি? কখনও কারোর কাছে ঘুষ নিইনি? কারোর কোনও ক্ষতি করিনি? কারোর অনিষ্ট চিন্তাও করিনি? এই কথাগুলো তুমি জানো না?

দীপঙ্কর কী বলবে বুঝতে পারলে না।

–জানো আর না-জানো, বলতে তোমার দোষটা কী? এই কথাগুলোই গুছিয়ে বলতে পারবে না?

মীটিং-এ দাঁড়িয়ে সেদিন কী বলেছিল দীপঙ্কর তা আর নিজের কানে যায়নি। কিন্তু নৃপেনবাবু যে-কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজো মনে আছে। আপিসের ছুটির পর টিফিন-রুমে ভিড় হয়েছিল মন্দ নয়। ফুলের মালা এসেছিল নিউমার্কেট থেকে। রবিন্স সাহেব আর ম্যাকফারসন সাহেব দলের মধ্যখানে বসেছিল। আর ট্রাফিক আপিসের তেষট্টিজন লোক তাদের ডাইনে আর বাঁয়ে।

গাঙ্গুলীবাবু দেখতে পেয়েই দৌড়ে এলেন।

বললেন–আপনি এসেছেন? কিছু বলতে হবে আপনাকে কিন্তু–

দীপঙ্কর বললে–না না, আমি সত্যিই বলতে পারি না।

–তবু বলতে হবে, নৃপেনবাবু আমাকে নিজে ডেকে আপনাকে বলতে বলেছেন-ইংরিজীতে, মনে থাকে যেন! ইংরিজীতে না বললে সাহেবরা বুঝবে না! এখনও তত কুড়ি মিনিট সময় আছে, ততক্ষণ ভেবে নিন–

একটা উদ্বোধন-সঙ্গীত হলো।

প্রথমে বলতে উঠলেন কে-জি-দাশবাবু। পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে পড়তে লাগলেন। দীপঙ্কর মন দিয়ে শুনতে লাগলো। নৃপেনবাবু শুধু যে রেলের ট্র্যাফিক আপিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাই-ই নয়, তিনি রেলসেবক। রেল-সেবা মানেই দেশ-সেবা। সুতরাং নৃপেনবাবু একজন আদর্শ দেশ-সেবক। যেদিন সমস্ত রেল-কর্মচারী নৃপেনবাবুর মত দেশ-সেবক হতে পারবে সেইদিনই রেলওয়ে-কোম্পানী সার্থক হবে। সেইদিনই সমস্ত দেশ সার্থক। বোমা-গুলি-গোলা যারা ছেড়ে তারা দেশের শত্রু। প্রকৃত দেশ সেবা যদি কেউ চায় তো সে নৃপেনবাবুর পথ অনুসরণ করুক। আজ বেয়াল্লিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নৃপেনবাবু রিটায়ার করছেন, আমরা শ্রীভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যেন তাঁর বিশ্রাম-গ্রহণ শান্তিপূর্ণ হয়। আর আজকের সভার সভাপতি মিস্টার রবিনসন আর মিস্টার ম্যাকফারসন-তারা যে তাঁদের অমূল্য সময় নষ্ট করে আমাদের উৎসাহ দিতে এসেছেন, তার জন্যেও ধন্যবাদ। তাঁরা নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে শুধু ভারতবর্ষের কল্যাণের জন্যে অমানুষিক কষ্টস্বীকার করে এখানে এই দেশে এসেছেন, তাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা মিস্টার রবিনসন আর মিস্টার ম্যাকফারসনের সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।

খুব হাততালি পড়লো।

দীপঙ্করকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকলেন নৃপেনবাবু। মুখ নিচু করে ফিসফিস্ করে বললেন–দেখলে তো কে-জি-দাশবাবুর কাণ্ড, আমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কেমন সাহেবদের খোশামোদ করলে? মানে এত অকৃতজ্ঞ লোক, ছিঃ–অথচ আমি না হলে সিনিয়র গ্রেডই পেত না, জানো-যাক্ গে, তুমি ততক্ষণ মুখস্থ করো….

নৃপেনবাবু আজ ফুলের মালা পরেছেন। বেশ হাসি-হাসি মুখ।

একে একে রামলিঙ্গমবাবু, গাঙ্গুলীবাবু সবাই বললে। ওই এক কথা সকলের। সাহেবরা নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতবর্ষের কল্যাণ করতে এসেছেন, কষ্ট করে রেলের চাকরি করছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। সকলেই কাগজে লিখে এনেছে বক্তৃতা।

এবার দীপঙ্কর! পাশ থেকে গাঙ্গুলীবাবু ঠেলে দিলেন। বললেন–উঠুন, উঠুন,ভয় কী–

কী যে বলেছিল দীপঙ্কর, কী গুণকীর্তন করেছিল নৃপেনবাবুর, তা নিজের কানে কিছুই গেল না। মনে হলো আগাগোড়া সমস্তটাই যেন ভণ্ডামি! জব চার্নক থেকে শুরু করে লর্ড ক্লাইভ, ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে কুইন ভিক্টোরিয়া সবাই নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ভারতবর্ষের কল্যাণের জন্যেই এসে ছিলেন বটে। তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই একদিন এসেছিল রেলওয়ে কোম্পানি। রেল প্রতিষ্ঠার মূলে যে-উদ্দেশ্যই থাক, তা বিচার করার ভার ঐতিহাসিকের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তাতে ভারতবর্ষের কল্যাণ হয়েছে কি হয়নি, তার বিচারের ভারও ভবিষ্যতের গর্ভে থাকুক। আজকে নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েলের দিন। সুতরাং নৃপেনবাবুর প্রশংসা করারই দিন আজকে। আজকে অপ্রিয় কিছু থাকলেও তা বলা নিষেধ। বলতে নেই। তিনিই আমাকে চাকরি করে দিয়েছেন। আমি যদি তার সম্বন্ধে কিছু বলি তো সে আত্মপ্রশংসা হবে আত্মপ্রশংসা মহাপাপ। সুতরাং…..

সভার শেষে নৃপেনবাবু একেবারে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন–তুমি তো এম-এ পাশ হে?

–না, বি-এ।

নপেনবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–বি-এ পাশ? অথচ কিছু না-পড়েই তো গড় গড় করে বলে গেলে! অথচ তুমি বললে লেকচার দেওয়া তোমার অভ্যেস নেই।….তা যাকগে, আমার লেকচারটা কেমন হয়েছিল?

দীপঙ্কর বললে—ভাল—

তাতে যেন সন্তুষ্ট হলেন না নৃপেনবাবু। বললেন–কী রকম ভালো?

–খুব ভালো।

–রবিনসন সাহেব, ম্যাকফারসন সাহেবের চেয়েও ভালো?

এবার মুশকিলে পড়লো দীপঙ্কর। একটু হাসলো।

নৃপেনবাবু বললেন–দেখ, তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তোমার ভাল লেগেছে, অথচ ওরা কী বলছে জানো? বলছে আমি নাকি বাড়ি থেকে মুখস্থ করে এসেছি–

গাঙ্গুলীবাবু দৌড়ে এলেন। বললেন–চলে যাবেন না যেন, জলখাবার আছে। হৃদয়-চাপরাশীকে দিয়ে ভাল মাংসের চপ করিয়েছি–

খাওয়ার জন্য ওদিকে তখন সবাই ব্যস্ত। নৃপেনবাবু সাহেবদের কাছেই ঘোরাঘুরি করছেন। সোনার বোতামটা একটা কেসের মধ্যে সিল্কের ফিতে দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, একটা ছাপানো ফ্রেমবাঁধা মান-পত্রও আছে। সেটা এক বগলে রয়েছে। আর এক হাতে ফুলের মালাটা।

দীপঙ্কর বললে–আমি বাড়ি যাই গাঙ্গুলীবাবু, বাড়িতে আমার মার বড় অসুখ—

তাহলে একটা সিঙারা অন্তত খেয়ে যান—

.

রাস্তায় আসতে আসতে দীপঙ্কর সেই কথাগুলোই ভাবছিল। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা মিথ্যে! বক্তৃতাও মিথ্যে, সিঙারা রসগোল্লাও মিথ্যে, ওই মানপত্রটাও মিথ্যেতে ভর্তি! লোকগুলোও মিথ্যে!

জলখাবারের জায়গাটায় ভীষণ ভিড় হয়েছিল। ফেয়ারওয়েলে জলখাবারের ব্যবস্থা আছে জানা ছিল, তাই কেউ আর টিফিন করেনি সেদিন! টিফিনের পয়সাটা বাঁচিয়েছে। দীপঙ্কর চলে আসছিল। কিন্তু গাঙ্গুলীবাবু কিছুতেই ছাড়লেন না বললেন–চমৎকার ফুয়েন্ট লেকচার হয়েছে আপনার। কে-জি-দাশবাবু খুব প্রশংসা করছিলেন, আপনি কখন মুখস্থ করলেন?

পাশের একটা কোণের দিকে তখন কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু আরো কয়েকজন খুব ফিসফিস করে আলোচনা করছেন।

কে-জি-দাশবাবু বললেন–শালা, শুয়োরের বাচ্চা, আবার রবিনস সাহেবের কাছে এক্সটেনশনের দরখাস্ত করেছে!–শুনেছেন?

–সে কি?

রামলিঙ্গমবাবু খবরটা জানতেন না। বললেন–সে কি? তাহলে ভেকেন্সিটা হলো?

ওই ভেকেন্সিটার জন্যেই সবাই হাঁ করে বসেছিল এতদিন। নৃপেনবাবু রিটায়ার করলেই একটা ভেকেন্সি হবে! হয় কে-জি-দাশবাবু, নয় রামলিঙ্গমবাবু, নয়তো আর কেউ চান্সটা পেত! কিন্তু খবরটা শোনার পর সবাই মিইয়ে গেল। তাহলে লেকচারে এত প্রশংসা না করলেই তো! সব আনন্দটা যেন মাটি হয়ে গেল দু’জনের!

–আস্তে মশাই আস্তে কথা বলুন!

–কেন?

–ওই যে সেনবাবু দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, ও আবার নৃপেনবাবুর লোক, সব শুনতে পাবে!

অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি আসার পথে কেমন মনে এলো–এই তো কাছেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। আর দু’পা গেলেই বাড়িটা দেখা যায়। কিন্তু থাক্। আর কোনও অবলম্বনের দরকার নেই তার।

হঠাৎ একটা নতুন গাড়ি পাশ দিয়ে একেবারে গা ঘেঁষে চলে গেল। আর একটু হলেই চাপা দিত। গাড়িটার ভেতরে কে একজন মেয়ে বসে আছে। অনেকটা সতীর মত দেখতে। ফরসা, লাল শাড়ী পরা, কোঁকড়ানো চুল। গাড়িটা সামনে গিয়েই থেমে গেল। সতী নাকি? বিয়ের পরই গাড়ি করে বেড়াতে বেরিয়েছে! হয়ত চিনতে পেরেছে।

দীপঙ্কর সামনে যেতেই ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করলে–নিউ রোডটা কোন দিকে বলতে পারেন?

–নিউ রোড!

–হ্যাঁ, নিউ রোড। আলিপুরে

দীপঙ্কর বললে–এ তো কালীঘাট, আপনি সোজা এই রাস্তা ধরে ওদিকে যান, পুলের ওপারে আলিপুর

কী মিষ্টি গলা! গাড়িটা চলে যাবার পর দীপঙ্কর আবার চলতে লাগলো। আশ্চর্য ভুল তো! সতীর বিয়ে হয়ে গেছে, এখনও সতীর কথা কী বলে ভাবছে সে!

তারপর হঠাৎ কথাটা আবার মনে মনে আওড়াতে লাগলো। নিউ রোড! নিউ রোড! নতুন পথ! সত্যিই তো দীপঙ্করেরও তো নুতন পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। এ-পথে কেউ তার সঙ্গী নেই। এই নতুন পথ ধরে এবার থেকে তাকে একলাই চলতে হবে। কী আশ্চর্য! নিউ রোড, নিউ রোড! মেয়েটা তার কাছে নতুন পথের নিশানা চাইতে এসেছিল। অথচ দীপঙ্করেরই তো নতুন পথের নিশানা দরকার।

নিউ রোড! নিউ রোড! নতুন পথ!

২৯

সত্যিই এবার থেকে এক নতুন পথে চলতে হবে তাকে। যখন সবাই একে একে ছেড়ে গেল দীপঙ্করকে, তখন তার নিশ্চয়ই একটা নতুন পথ আবিষ্কার করতে হবে। লক্ষ্মীদিরও তাকে আর প্রয়োজন নেই। সতীর প্রয়োজনও ফুরিয়ে গিয়েছে। কিরণ তাকে ত্যাগ করেছে। সকলের সব চাওয়ার সব পাওয়ার ভেতরকার চাওয়া-পাওয়ার পরিচয় সে পেয়েছে। সবাই বলছে–এই বিচ্ছেদ থেকে আমাকে উত্তীর্ণ করো। অথচ তাদেরই মতন দীপঙ্করও তো একদিন মিশতে চেয়েছিল সকলের সঙ্গে। সেই ছোটবেলাকার লক্ষ্মণ সরকার থেকে শুরু করে সকলের সঙ্গেই সে মিশতে চেয়েছে। কিন্তু এমন মেলা-মেশা তো সে চায়নি। যেখানে যার সঙ্গেই সে মিশতে চেয়েছে, সেখান থেকেই এসেছে বিচ্ছেদ। এমন মিল কি তার হয় না, যা পেতে হলে বিচ্ছেদের মূল্য লাগে না।

মোটরটা চলে গেল।

দীপঙ্কর খানিকক্ষণ চেয়ে রইল সেই দিকে। মহিলাটির লিপস্টিক মাখা ঠোঁট। কাঁধ কাটা ব্লাউজ। একা-একা সে ড্রাইভারের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েছে। ছোটবেলায় কিন্তু এরকম দেখা যেত না। আগে ঘোড়ার গাড়ির জানালা দরজা বন্ধ করে বেরোত মেয়েরা। পুজোর সময় কালীঘাটে যারা বাজি-পোড়ানো দেখতে যেত তারা পাশের হালদারদের বাড়ির দিকের আড়াল থেকে দেখতে। এ-রকম হলো কবে থেকে! বালিগঞ্জের দিকে অনেকগুলো নতুন পাড়া হয়েছে, হয়ত সেখানকার মেয়ে। আশ্চর্য একেই কিনা সতী বলে ভুল করেছিল দীপঙ্কর! বাঁ পাশেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। কালকে এইখানেই এসেছিল দীপঙ্কর। বিরাট ম্যারাপ বাঁধা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে কালকেই অদ্ভুত সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিল মনে মনে। ভালো, ভালো, বিচ্ছেদ হওয়াই ভালো; পাওয়া মানেই তো থেমে যাওয়া। দীপঙ্করকে তো এখানে থামলে চলবে না। দীপঙ্করকে যে আরো অনেক দূরে যেতে হবে, সতীর কাছ থেকে দূরে গেলেই তো তার মুক্তি।

অনেকদিন লক্ষ্মীদির সঙ্গে দেখা হয়নি। সেই বৌবাজারের সরু গলিটার মধ্যে লক্ষ্মীদির দিনগুলো কেমন করে কাটছে কে জানে! সেই দাতারবাবু, দাতারবাবুরই বা কী অবস্থা! হয়ত এতদিন বাড়িভাড়া দিতে পারেন নি বলে তাড়িয়েই দিয়েছে বাড়িওয়ালা। হয়ত দাতারবাবু ধরা পড়েছে। হয়ত লক্ষ্মীদি আবার নিরাশ্রয়। আবার কোথাও ভেসে গেছে–ভেসে তলিয়ে গেছে। সমস্ত কলকাতা শহরে এতটুকু আঁকড়ে ধরবার মত আশ্রয়ই তার আর নেই। লক্ষ্মীদি যা মেয়ে, সে কি আর ভুবনেশ্বরবাবুর কাছে এসেছে। আর ভুবনেশ্বরবাবু! ভুবনেশ্বর মিত্র! তারই বা কী খবর! সতীর বিয়ের পর তিনি হয়ত সতীকে নিয়ে ফিরে যাবেন বর্মায়। এখন এই মুহূর্তে হয়ত ভুবনেশ্বরবাবু কলকাতাতেই আছেন। আর কাকাবাবু? কাকীমা?

সমস্ত বাড়িটা বড় ফাঁকা লেগেছিল দীপঙ্করের। মা’র অসুখ, মা’কে পাখার বাতাস করতে করতে কতবার চেয়ে দেখেছিল বাড়িটার দিকে। যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে বাড়িটা। এখন এতদিনের পুরোন বাড়িটার দিকে যেন চেয়ে দেখতেই ইচ্ছে করে না আর।

ইলিশিয়াম রো’র এ-এ-আই শান্তিবাবুকে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা, শচীশবাবুকে চেনেন।

–কে শচীশবাবু?

–আমাদের বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন, সি-আই-ডি, আমরা কাকাবাবু বলে ডাকতুম–

শান্তিবাবু বললেন–তিনি তো ছুটিতে–তিনি এস-বি-ব্রাঞ্চের লোক–আর আমরা আই-বি-ব্রাঞ্চ

–তা তিনি ছুটিতে কেন? তিনি আমাকে খুব ভালো করে জানেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেই আমার সম্বন্ধে সব খবর পাবেন

শান্তিবাবু বললেন–তিনি বোধহয় আর কলকাতায় থাকবেন না,

–কেন থাকবেন না? তিনি তো বার্মা থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছিলেন।

–তা এসেছিলেন, এখন আবার শুনছি ট্রান্সফারের জন্যে দরখাস্ত করেছেন

তা হবে। স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে কিছু নেই। আর লক্ষ্মীদি ছিল, লক্ষ্মীদি চলে গেল। আর ছিল সতী, তারও বিয়ে হয়ে গেল। তাই আর হয়ত কলকাতায় থাকবার ইচ্ছে নেই।

একটা ট্রাম আসছিল। দীপঙ্করের হঠাৎ মনে হলো বৌবাজারে হয়ে একবার দেখে আসে লক্ষ্মীদিকে। হঠাৎ মনটা বড় ছটফট করে উঠলো লক্ষ্মীদির জন্যে সতীর তবু নতুন বিয়ে হয়েছে, তার শ্বশুর-শাশুড়ী আছে, স্বামী আছে, বিরাট বাড়ি-গাড়ি-টাকা সব আছে। তার কিসের ভাবনা! দুদিন বাদে সমস্ত কিছু ভুলে যাবে। ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই মেয়েটার মত ঘাড়ের চুল ছোট করে ছাঁটবে, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখবে, একলা-একলা ড্রাইভারের সঙ্গেই হয়ত নিউ রোডের ঠিকানায় গাড়ি চালিয়ে যাবে। রাস্তার ছেলেদের দাঁড় করিয়ে ঠিকানার নির্দেশ জানতে চাইবে। হয়ত দীপঙ্করের গায়ে গাড়ির কাদা ছিটিয়ে যাবে। হয়ত কেন, সত্যিই তাই। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার আগেই হয়ত বিছানার মাথার কাছে চা এসে যাবে। বয় বাবুর্চি খানসামারা হয়ত তটস্থ হয়ে থাকবে মিসেস ঘোষের হুকুমের ভয়ে। সতী এখন আর সতী মিত্র নয়, সতী ঘোষ! গ্রীষ্মকালে দার্জিলিং যাবে, সী-সাইডে যাবে। আর শীতের দিনে? শীতের দিনে যদি ইচ্ছে হয় তো থাকতে পারে কলকাতায়। আর কলকাতায় যদি থাকতে ইচ্ছে না-করে তো যাবে নিশ্চয়ই কোথাও। কত জায়গা আছে যাবার। ভালো না লাগলে এক-একদিন দু’জনে চলে যাবে হোটেলে। চৌরঙ্গীর হোটেলের টেরাসের ওপর বসে বসে চা খাবে। কফি খাবে। বিকেলের ছুটির আলস্য তখন সামনের ময়দানের ওপর পাখা বিস্তার করেছে। সেই টেরাসের ওপর বসে বসে দু’জনে দেখবে বাইরের চলন্ত পৃথিবীকে। ট্রাম আর বাস, গতি আর বিশ্রাম, কল্পনা আর সম্ভাবনার পৃথিবী। তারপর যখন ফোর্ট উইলিয়ামের মাথার লম্বা পোস্টটার ওপর লাল আলোটা জ্বলে উঠবে, তখন নামবে দু’জনে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে হোটেলের লাউঞ্জ পেরিয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে উঠবে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে ঘুরবে গাড়ির চাকা। তারপর প্রিন্সেপ ঘাট, আউটরাম ঘাট, কিম্বা যশোর রোডের নিরিবিলি, গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোডের হাতছানি।

আর ওদিকে তখন রেলের আপিসে জাপান-ট্রাফিকের ফাইল পাতলা থেকে মোটা হচ্ছে ক্রমাগত। চেয়ারের ছারপোকাগুলোর পেট ভরে গিয়ে টইটম্বুর। দীপঙ্কর সেন তিনটে স্পেশালের হিসেব মেলাতে গিয়ে গলদঘর্ম। জার্নাল সেকশনে গাঙ্গুলীবাবু একগ্লাস চা চার ভাগ করে কে-জি-দাশবাবুকে তুষ্ট রাখছেন। রামলিঙ্গমবাবুর টেবিলে ফাইলের পাহাড়। স্টোরস্ সেকশনে নতুন ইভেন্ট নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলেছে। হৃদয় চাপরাশী অ্যালুমিনিয়ামের ডেচিতে পাঁঠার চপ বিক্রি করতে চলেছে। ধুলো, গোলমাল, ঝগড়া, ছারপোকা, কাজ সব মিলিয়ে তখন ছত্রখান করে দেবে সেই দু’জনের বিকেল বেলার আলস্য। সেখান থেকে সেই জাপান-ট্রাফিকের ফাইলের কাজ করতে করতেই দীপঙ্কর কানে শুনতে পাবে দুজনের আলগা কথার টুকরো

–আজকে কোন্ দিকে যাবে সতী?

–চলো না যশোর রোড ধরে যাই, যতদূর চোখ যায়!

–যদি বৃষ্টি নামে?

–তা কি নামবে? তাহলে তো আরো কাছাকাছি হবো, আরো হারিয়ে যাবো আমরা।

–খুব।

–কিন্তু তুমি হারিয়ে গেলে আমার যে কষ্ট হবে? আমি তখন কী করবো?

–তুমি আমায় খুঁজে বের করবে। তুমি খুঁজে পাবে বলেই তো আমি হারাবো। নইলে হারিয়ে গিয়ে লাভ কী?

তারপর হাসবে দুজনে। সেই সন্ধ্যেবেলা, যখন দীপঙ্করস জাপান ট্র্যাফিকের শেষ ফিগারটা মিলিয়ে ড্রয়ার বন্ধ করে কান্ত পায়ে আপিসের গেটের সামনে একেবারে রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে, গুর্খা সেপাইটা ভারী বুট পরে লোহার গেটটা শেষবারের মত বন্ধ করে দেবে, তখন যশোর রোডের গাড়িটা সত্যিই হারিয়ে গেছে চাঁদনী রাতের আলোয়। একটা ঝাঁকড়া-মাথা বিরাট আম গাছের তলায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, আর কিছু দেখা যায় না। শুধু দু’জনের ভাঙা-ভাঙা হাসির শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট হয়ে।

ট্রামটা সামনে এসে দাঁড়াল, আবার চলেও গেল।

না থাক, আজকে লক্ষ্মীদির কাছে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বরং কালই যাবে দীপঙ্কর। অবশ্য মার শরীরটা যদি ভাল থাকে।

মা’র কথা মনে পড়তেই দীপঙ্কর পা চালিয়ে চলতে লাগলো। কালীঘাটের বাজারের রাস্তাটা দিয়ে আর নয়। হয়ত ছিটে কি ফোঁটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। হয়ত কালকের মত আবার টানাটানি করবে। আশ্চর্য! চন্নুনীকে এতদিন ধরে দেখে দেখেও তো এমন করে চিনতে পারেনি আগে! অনেকদিন গালাগালি দিয়েছে চন্নুনী, অকারণে গালাগালি দিয়েছে। আকাশের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, সংসারের স্থাবর-জঙ্গম, জড়-জীব সকলের সঙ্গে ঝগড়া করেছে সে। কিন্তু এতদিন পরে প্রথম তার ঝগড়ার কারণটা ধরতে পারলে দীপঙ্কর। দুটি মেয়েলোটন লক্কা। হয়ত দেখে ফেলেছিল অঘোরদাদু। তাই তারপরেই দূর করে দিয়েছে ছিটে-ফোঁটাকে। একেবারে সংসারের বার করে দিয়েছে।

সেই চন্নুনীর সঙ্গেই সদর দরজার সামনে দেখা হয়ে গেল।

চন্ননী তখন বোধহয় সদর দরজা বন্ধ করতেই এসেছিল।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলো গো চন্নুনী, মা এখন কেমন আছে?

চন্ননীকে আর উত্তর দিতে হলো না। দীপঙ্কর দেখলে সোজা সামনের দাওয়ার ওপরে মা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কোনও দিকে যেন মার দৃষ্টি নেই। যেন নিজস্ব দুর্ভাবনায় মা থই পাচ্ছে না।

দীপঙ্কর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে-এখন কেমন আছো মা?

মা বেশি কথা বললে না। শুধু বললে—ভালো–

দীপঙ্কর মা’র পাশে গিয়ে বসে পড়লো। বললে–এখানে তুমি বসে আছ কেন? যদি আবার শরীর খারাপ হয়? ঘরে গিয়ে শুলে ভালো হতো না? ওষুধ খেয়েছিলে তো?

মা যেন দীপঙ্করের কথাগুলো শুনতে পেলে না। স্থির শান্ত দৃষ্টিতে সামনের ভাঙা পাঁচিলটার দিকে চেয়ে রইল একভাবে।

দীপঙ্কর বললে–খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো মা, আপিস যাবার আগে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ক’দিন যাইনি। এদিকে হুলুস্থুল কাণ্ড বেধে গিয়েছে তাই নিয়ে। কেউ ফাইল খুঁজে পায় না-শেষকালে রবিনসন সাহেব অর্ডার দিয়ে দিলে এবার থেকে তার পাশের কামরায় বসতে হবে।

চন্ননী একটা বাটিতে মুড়ি এনে দিলে সামনে।

মা আস্তে আস্তে বললে–কী খেয়েছিলি আজ?

দীপঙ্কর বললে–এখুনি আসছি মা, জামা-কাপড়টা ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে আসি–

খানিক পরে ফিরে এসে মুড়ি খেতে খেতে দীপঙ্কর বললে–আমার লেচ্চার শুনে রবিন্স সাহেব তো খুব খুশী। জানো মা! নৃপেনবাবুও খুব খুশী। ওঁরা সবাই মুখস্থ করে এসেছিল, মুখস্থ করে গেলে অবশ্য ভালোই হতো কিন্তু আমি তো আগে জানতাম না যে আজই নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েল হবে–

তখনও মার মুখটা গম্ভীর-গম্ভীর।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে আবার–পান্না ডাক্তারকে আর একবার ডাকবো মা? খবর দিয়ে আসবো যে এখন তুমি ভালো আছো?

মা তেমনি গম্ভীর ভাবেই বললে–না।

–কিন্তু যদি তোমার অসুখটা আবার বাড়ে! তখন কী হবে বলো তো? কাল সারাদিন খাওয়া নেই, ঘুম নেই, আর এখন কি উঠে হেঁটে বেড়ানো ভালো? চন্নুনী তো রান্না-বান্না করছেই, তুমি আবার মিছিমিছি উঠলে কেন বিছানা থেকে, বলো তো?

এতক্ষণে যেন মা মুখ ফেরালে দীপঙ্করের দিকে।

বললে–দীপু!

দীপঙ্কর মা’র গলার গাম্ভীর্য দেখে ভয় পেয়ে গেল।

বললে–কী মা?

মা কিছু উত্তর দিলে না।

দীপঙ্কর বললে–কী মা, কী হলো? ঘরে যাবে? তোমাকে ধরবো?

মা বললে–না, ঘরে যাবো না, তুই আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর…

দীপঙ্কর মার মুখের দিকে চেয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠলো। মা’র এমন মূর্তি তো দেখেনি সে কখনও।

–তুই আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, আর স্বদেশী করবি না–

দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল মার কথাগুলো শুনে। হঠাৎ যেন তার বিশ্বাস হলো না। মনে হলো ভুল শুনেছে সে!

–কর তুই প্রতিজ্ঞা। আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর–।

–কিন্তু মা…

–আমি কোনও কথা শুনতে চাই না, তুই আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে, আর জীবনে কখনও স্বদেশী করবি না।

দীপঙ্কর মা’র দিকে সোজা চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।

তারপর বললে–কিন্তু কখন আমি স্বদেশী করলুম? কখন তুমি স্বদেশী করতে দেখলে আমায়?

মা বললে–কিন্তু স্বদেশী না-করলে পুলিসে তোকে ধরলে কেন?

দীপঙ্কর এর কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না।

মা আবার বললে–বল, কেন তোকে পুলিস ধরে নিয়ে গিয়েছিল, বল? তুই যদি স্বদেশী ব্যাপারে না থাকবি তোকে কেন ধরবে তারা? তাহলে বল, তুই কি করেছিলি?

–বিশ্বাস করো মা, আমি কিছ্‌ছু করিনি। আমি ছোটবেলায় কিরণের সঙ্গে শুধু লাইব্রেরী করেছিলুম, কিন্তু যেদিন থেকে কাকাবাবু বারণ করে দিয়েছিলেন সেইদিন থেকেই লাইব্রেরীতে আর যাইনি আমি–

–তাহলে কি ওরা তোকে মিছিমিছি ধরে নিয়ে গেল বলতে চাস?

মা’র যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। মা হাঁফাচ্ছিল কথাগুলো বলতে বলতে।

দীপঙ্কর বললে–তা তুমি এখন একটু চুপ করে থাকো না মা, তোমার শরীর খারাপ, এই সময়ে, তুমি কেন ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো?

মা যেন আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

–মাথা ঘামাবো না? তোমার জন্যে ভেবে ভেবে আমার রাত্তিরে ঘুম আসে না, দিনে খেতে পারি না। আমি তোমার মা হয়ে কী অপরাধ করেছি বলো তো? কী এমন শত্রুতা ছিল তোমার সঙ্গে আমার যে তুমি আমাকে এমন করে দগ্ধে মারবে? বলতে পারো, আমি তোমার কী সর্বনাশটা করেছি?

অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বলতে লাগলো মা। ঝর ঝর করে দুচোখ দিয়ে কান্না ঝরতে লাগলো। দীপঙ্কর চুপ করে কান পেতে শুনলে সব। যেন তার আর কিছু বলবার নেই, তার আর কিছু করবারও নেই–

অনেকক্ষণ পরে দীপঙ্কর বললে–মা, সব শুনলুম এবার ঘরে চলো–

–না, আমি ঘরে যাবো না, আমি মরলে কার কী এসে যায়! আমি মরে গেলেই তো তোমার নিশ্চিন্তি!

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু নিজের অসুখ হলে তুমি নিজেও তো কষ্ট পাবে।

–তুই বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে বেরিয়ে যা। আমার কষ্টের কথা তোকে ভাবতে হবে না

দীপঙ্কর হাসলো। বললে সে তুমি যাই বলো না, তোমার কষ্ট হলে আমি ভাববোই, তুমি বারণ করলেও ভাববো।

মা আঁচল দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলে।

দীপঙ্কর বললে–তুমি আমার ওপর মিথ্যে রাগ করছো মা, সত্যি বলছি আমি স্বদেশী করিনি

স্বদেশী করিস আর না-করিস, তুই আমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, জীবনে কখনও স্বদেশী করবি নে! এই পা ছুঁয়ে বল আমার–ছে পা–

দীপঙ্কর মার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। হঠাৎ মনে হলো মা যেন তাকে দিয়ে এক ভীষণ দাসখত সই করিয়ে নিতে চায়। চিরজন্মের মত যেন আত্মঅবমাননার মূল্যে তার নিজের জীবনটাকে ফিরে পেতে হবে।

–তুই যতক্ষণ না পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছিস, ততক্ষণ আমি উঠবো না, খাবোও না, ঘুমবোও না! আমি মাথা খুঁড়ে মরবো এখানে।

মার মুখের দিকে চেয়ে সত্যিই ভয় পেয়ে গেল দীপঙ্কর। মার জেদ বড় ভীষণ! দীপঙ্কর মা’কে চেনে।

চনী এতক্ষণ শুনছিল সব কথা। বললে–তুমি পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাও না বাছা,

মায়ের পায়ে হাত দিতেও লজ্জাবলিহারি লজ্জার বালাই বাছা তোমার, ছিঃ

চন্নুনীর কথায় কেউ কান দিলে না। মা যেন অচল-অটল হয়ে রইল নিজের জিদের কাছে। দীপঙ্করও সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্বিধায়-দ্বন্দ্বে অটল হয়ে রইল।

কিন্তু হঠাৎ মা এক তুমুল কাণ্ড করে বসলো। বলা নেই কওয়া নেই মা হঠাৎ সরে গিয়ে সামনে ইটের থামে ঠাই ঠাই করে মাথা ঠুকতে লাগলো

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি ধরে ফেলেছে।

–মা, মা, এ কী করলে তুমি? এ কী করলে মা?

চন্নুনীও দৌড়ে এসেছে। বিন্তিদিও শব্দ শুনে দৌড়ে এসেছে কাছে।

মা’র কপালটা ততক্ষণে ফুলে উঠেছে। দীপঙ্কর বললে–বিন্তিদি, এক ঘটি জল দাও না–

মা’র মাথায় জলটা থাবড়াতে থাবড়াতে দীপঙ্করের কান্না পেতে লাগলো। একে এ কদিন শরীর খারাপ ছিল। এ কদিন দীপঙ্করের জন্যে ভেবে ভেবে ঘুম হয়নি, তার ওপর এই অত্যাচার!

মা তখনও বলছে–তুই ছাড় আমাকে দীপু, ছাড় তুই-তোর সামনেই আমি মাথা খুঁড়ে মরবো

দীপঙ্কর বললে–এই তোমার পা ছুঁচ্ছি–

–তা হলে কর প্রতিজ্ঞা, জীবনে কখনও স্বদেশী করবি না, কর প্রতিজ্ঞা।

–এই প্রতিজ্ঞা করছি মা, আমি জীবনে কখনও স্বদেশী করবো না, এই তোমার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলুম, এবার ওঠো, এবার ঘরে চলো তুমি–

মা তখন একটু শান্ত হয়েছে। নিজের মনেই বলতে শুরু করেছে–ওই কিরণ ছোঁড়াই আমার দীপুকে এমন খারাপ করেছে, ওই কিরণটাই যত নষ্টের গোড়া–

চন্নুনী বললো দিদি, ঠিক বলেছ, তোমার দীপুকে ওই কিরণ ছোঁড়াই গোল্লায় দিয়েছে–আমি দেখেছি যে ছোট্টবেলা থেকে, দেখি সারা দুপুর, সারা বিকেল দু’জনে ফিস্-ফিস্ গুজু-গুজু করছে, বলি দুই বেটাছেলে মিলে এত কিসের গুজুগুজু বাছা বেটাছেলের সঙ্গে এত পীরিত কেন গা!

–থাম তুমি চন্নুনী।

দীপঙ্কর হঠাৎ থম্‌কে উঠলো। বললে–যত কিছু বলি না বলে তোমার বড় বড় হয়েছে, না?

হঠাৎ দীপঙ্করের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে চন্নুনীও থমকে গেল। সেও যেন দীপঙ্করের কাছ থেকে এমন কথা আশা করে নি! কিন্তু দীপঙ্করের মা হঠাৎ বাধা দিলে। বললে–কেন? চন্নুনী অন্যায়টা কি বলেছে শুনি? আমিও তো দেখেছি তোকে কিরণের সঙ্গে মিশতে। মিশিস না তুই?

তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–চল, চল তুই আমার সঙ্গে-আমি কিরণের মা’কে গিয়ে বলছি-তোমার ছেলের জন্যেই, তো আমার এই সর্বনাশ, তোমার ছেলেই

তো দীপুকে এমন খারাপ করে দিয়েছে–চ তুই, চল্ আমার সঙ্গে-এখুনি চল–

বলে সত্যি সত্যিই মা পা বাড়ালে কিরণদের বাড়ি যাবার জন্যে।

–কিন্তু মা, কী পাগলামি করছো তুমি!

–পাগলামি নয়, আমি যাবোই, আমি এখুনি গিয়ে বলে আসবো কিরণের মাকে, যত সব ছোটলোক জুটেছে পাড়ায়, তাদের সঙ্গে মিশেই এই ফল হয়েছে আমার, তাদের জন্যে আমার কপাল ভেঙেছে

সত্যি সত্যিই মা সেই অবস্থাতেই উঠোনে নামলো। মা তখনও টলছে। দীপঙ্কর গিয়ে মাকে ধরলে। বললে–মা কেন মিছিমিছি কিরণের মা’কে কষ্ট দেবে, কিরণ নেই বাড়িতে, সে বাড়িতে থাকে না

–না থাক, আমি তার মাকে বলে আসবো।

–কিন্তু তার মা’র যে বড় কষ্ট, তার বাবার অসুখ, সংসার চলছে না, তুমি গিয়ে মিছিমিছি তাদের কষ্ট আরো বাড়াবে।

–তাদের কষ্ট, আর আমার কষ্টটা বুঝি তুই দেখছিস না? আমার কষ্টটা কষ্ট নয়? বিন্তিদিও এসে মাকে অনেক বোঝালো। বললে–দিদি, তুমি যেও না এই শরীর নিয়ে, পড়ে যাবে মুখ থুবড়ে

কিন্তু মার যখন যা জিদ চাপবে, তখন কারো ক্ষমতা নেই তা ভাঙায়। দীপঙ্কর মাকে ধরে চলতে লাগলো। তখন বেশ ভালো করে সন্ধ্যে হয়েছে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়ে নেপাল ভট্টাচার্য লেনের রাস্তাটা খারাপ। মা যেন ধুকছে। এতদিনের উদ্বেগ, অনাহার–সব যেন মা’কে সহ্যের শেষ সীমায় এনে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কোন কথা নেই মা’র মুখে। সরু রাস্তাটা দিয়ে যেন এক অটুট প্রতিজ্ঞা নিয়ে মা চলেছে। দীপঙ্করকে ভাল করতেই হবে। দীপঙ্করকে সমস্ত পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দিতেই হবে। দীপঙ্কর বড় হবে, মানুষ হবে। দীপঙ্কর অন্যায় অনিয়ম থেকে মুক্তি পাবে। সৎ মানুষ হয়ে সংসারী হবে–তবেই যেন মা’র আশা পূর্ণ হবে। আশে-পাশের বাড়ি থেকে উনুনের কয়লার ধোঁয়া উঠে বাতাসে ভাসছে। মা আস্তে আস্তে সন্তর্পণে নর্দমাগুলো পেরিয়ে গেল। তারপর একেবারে কাঁচা রাস্তা। এবড়ো-খেবড়ো-অসমান। প্রতি পদে হোঁচট খাবার ভয়। একবার পড়ে গেলে আর বাঁচানো যাবে না মা’কে।

দীপঙ্করের তখন সব ভাবনা যেন লোপ পেয়েছে।

সেই বালিশ বুকে বুড়ো মানুষটা! তিনি কানে শুনতে পাবেন সব, কিন্তু বলতে পারবেন না কিছু। শুধু ঘড়-ঘড় করে শব্দ হবে একরকম। তখন হয়ত একটু গরম জল দিলে ঠাণ্ডা হবে। কিরণের মা হয়ত কিছু বলবে না, হয়ত মার কথা শুনে কাঁদবে।

কিন্তু গলিটার সামনে গিয়ে হঠাৎ একটা আর্তনাদ কানে যেতেই দীপঙ্কর চমকে উঠলো।

মা’ও চমকে উঠেছে।

–ও কে কাঁদছে রে?

দীপঙ্করের যেন কী সন্দেহ হলো। বললো–কিরণের মা’র গলা মনে হচ্ছে মা!

কিরণের মা! ততক্ষণে কিরণদের বাড়ির একেবারে দরজার সামনে এসে গেছে। দরজাটা খোলা ছিল। দীপঙ্কর উঁকি মেরে দেখলে। মা-ও দেখলে। কিরণের বাবা সেই বালিশের ওপরেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাথাটা দাওয়ার নিচে ঝুলছে। আর কিরণের মা একলা কিরণের বাবার সেই প্রাণহীন বিরাট শরীরটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে অসহায়ের মত চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। সেই আর্তনাদে সমস্ত কালীঘাট যেন হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো এক নিমেষে। মৃত্যুর কাছাকাছি এলে সব জীবন্ত মানুষই বোধহয় ঝিমিয়ে আসে। মাও যেন কেমন হয়ে গেছে। সেই নোংরা বিছানা-বালিশ থুথু-দুর্গন্ধের মধ্যে মৃত্যু কেন যে আসতে সঙ্কোচ বোধ করলে না, তাই একটা বিস্ময়। কত দিন কত বার মনে মনে মৃত্যু কামনা করেছে কিরণের বাবা, বাইরে ভাষাতেই শুধু তা প্রকাশ করতে পারেনি। আজ সেই মৃত্যুই এল। কিন্তু যেন বড় মর্মান্তিক ভাবে এল। আজ কিরণ নেই, কেউ নেই। সহায়-সম্বলহীন পরিবার। ধৈর্যের সীমান্তে যেখানে জীবন-মৃত্যু একাকার হয়ে যায়, যেখানে আনন্দ-বেদনায় তারতম্য-বোধ আর থাকে না, সেইখানেই বুঝি পৌঁছে গিয়েছিল সেই নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের অসহায় পরিবারটি! কিন্তু মৃত্যুর কাছে বোধহয় উচ্চ-নীচ নেই, সুখী-দুঃখী নেই, অসহায়, আতুর, অনাথ কোনও বিচারই নেই। মৃত্যু বোধহয় বিচার-অবিচারের উর্ধ্বে। চারিদিকের সেই জঘন্য দুর্গন্ধের মধ্যে দীপঙ্করেরও যেন কেমন ঘেন্না করছিল। মা’কে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়েই আবার চলে এসেছে।

কিরণের মা হঠাৎ সেই অবস্থায় দীপঙ্করকে দেখে যেন একটু অবাক হলো।

–আপনি সরুন মাসীমা!

–তুমি মাকে বলে এসেছ তো বাবা?

একদিন মা’র অনুমতি ছাড়া এ-বাড়িতে আসবার অধিকার ছিল না দীপঙ্করের সেকথা যেন কিরণের মা এখনও ভুলে যায়নি। ছোটবেলায় কিরণের বাবার কাছে অঙ্ক বুঝে নিয়ে গেছে দু’জনে। কতদিনের অসুখ কিরণের বাবার। কতদিন ধরে বোধহয় মৃত্যুকামনা করেছে কিরণের বাবা, কিন্তু তখন মৃত্যু আসেনি। তখন মৃত্যু হলেই হয়ত ভালো হতো। তা হলে কিরণের বাবার এই অপমৃত্যুর সংবাদ তাকে কান দিয়ে শুনতে হতো না। তা হলে হয়ত এমন করে কিরণের মা’কে অনাথ করবার পুরোপুরি দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত। কিন্তু আজ যখন নিঃসহায় নিঃসম্বল নিঃশেষ হয়ে এসে দারিদ্র্যের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার পরিবার, তখনই সব শেষ হয়ে গেল। নিজের ভাষাহীন চোখ দিয়ে দেখে যেতে হলো কিরণ গৃহত্যাগী, স্ত্রী অনাথা! একটা কপর্দকের জন্যে প্রতিবেশীর কাছেই হাত পাততে হতো ইদানীং। সেই চরম দুঃসহ দৃশ্যের মূক সাক্ষী হয়ে প্রতি পলের বেঁচে থাকার চেয়ে এই মৃত্যু ঢের ভালো। শান্তি পেয়েছে কিরণের বাবা! কিরণের মা’ও বোধহয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলো।

সেদিন সেই সন্ধ্যেবেলাই লোকজনের চেষ্টা করতে হয়েছিল দীপঙ্করকে। কাছেই শ্মশান। তবু কুষ্ঠরোগী তো। বড় ছোঁয়াচে রোগ। কালীঘাট ব্যায়াম সমিতি’র দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল একবার দীপঙ্কর। দরজায় তালা লাগানো। টেগার্ট সাহেব সেদিন নিজে এসে তালা বন্ধ করে দিয়েছে। আশে-পাশের পাড়ার লোক-জন ছেলে-ছোকরা ক’জন এসে দাঁড়াল। একটু আহা-উঁহু করলো। সমবেদনা দেখাল সবাই। কিরণের জন্যে দুঃখও প্রকাশ করলে। ছেলেটা অকালে বখে গেল বলে হা-হুঁতাশ করলে। লেখাপড়া করলো না, বাপ-মাকেও দেখলে না, এমন ছেলে থাকলেই বা কী আর মরে গেলেই বা কী! স্বদেশী আমরাও করি, খদ্দর পরি, বিলিতি কুমড়োটাও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি গান্ধীর কথা মত-কিন্তু এটা কী? বাপ-মা হলো আসল, বিপদের সময় তাদেরই যদি না-দেখলুম তো সে আবার করবে দেশসেবা, সে আবার ইংরেজ তাড়াতে চায় দেশ থেকে! এইটেই কি তোর দেশসেবা করার সময় রে বাপু?

দীপঙ্কর ঘরে এল আবার।

মাসীমা তখনও মৃতদেহের পাশে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ময়লা বিছানার আণ্ডিল। সেই নোংরা ময়লার ওপরেই মূর্তিমান মৃত্যু তার সস্তা শিকার পেয়েছে। কিন্তু মাসীমার যেন কিছুতেই আর বিকার নেই। আশেপাশের বাড়ির দু’একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে তখন উঠোনে। মুখে-নাকে আঁচল দিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে দল বেঁধে। তাদেরও বোধহয় আজকের দিনে পাশে এসে দাঁড়ানো একটা কর্তব্যের সামিল।

পাথরপটির গলির ভেতর ফটিকদের বাড়ি। ফটিকের নাম ধরে ডাকতেই তার মা বেরিয়ে এল। বুড়ি মা। তাদের অবস্থায় কিরণের মত। ফটিকের মা বললে–কিন্তু ফটিক তো নেই বাবা!

–কখন আসবে?

–তার কি আসবার ঠিক আছে বাবা! সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত পয়সার ধান্ধাতেই ঘুরছে কেবল

একবার চণ্ডীবাবুদের বাড়িতে গেলেও হয়। রাখাল তাদেরই দলের। বাড়ি থেকে চুরি করে তাদের লাইব্রেরীতে বই দিয়েছিল একদিন। কিন্তু তার আগে পথে পড়ে মধুসূদনের বাড়িটা। মধুসূদনের বাড়ির রোয়াকের আড্ডা ভেঙে গিয়েছে। দুনিকাকাও আসে না, পঞ্চাদাও আসে না। গরম গরম তর্কের ঝড় বয়ে যায় না আর খবরের কাগজ নিয়ে।

মধুসূদনকে ডাকতেই খানিক পরে বেরিয়ে এল। বললে–কী রে দীপু? কী খবর তোর? কবে ছাড়া পেলি?

দীপঙ্কর বললে–কিরণের বাবা মারা গেছে, জানিস?

–সে কী রে! কখন?

–এই এক ঘণ্টা আগে, একটু শোনে যেতে পারবি? কেউ নেই ওদের, জানিস তো-তুই, আমি আরও দু’জন দরকার, ডেকে নেব’খন আমি

মধুসূদনের মুখ দেখে মনে হলো যেন বড় বিপদে পড়েছে। খানিক কী যেন ভেবে বললে–দ্যাখ, যেতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আসলে কী জানিস ভাই, বড়দা ভয়ানক আপত্তি করবে, দেখেছিস তো আমাদের রোয়াকের আড্ডা পর্যন্ত তুলে দিয়েছে–যা কাণ্ড সব হচ্ছে পাড়ায়, কারোর সঙ্গে ভয়ে মিশতেই ভাই বারণ করে দিয়েছে বড়দা

তারপর একটু থেমে বললে–তা যাকগে, তোকে ধরেছিল কেন রে? কী করেছিলিস্ তুই?

দীপঙ্কর তাড়াতাড়িতে সে-কথার উত্তর না দিয়ে চলতে লাগলো। বললে–সে-সব কথা বলবার সময় নেই এখন–আমি অন্য জায়গায় দেখি

অন্য জায়গায় মানে যে কোথায় তা তখনও ঠিক ছিল না। রাখাল! রাখাল কি যাবে? বড়লোকের ছেলে, সে কী করতে শ্মশানে যাবে? তার কিসের দায় পড়েছে? তবু রাখালের বাড়ির সামনে গিয়েও একবার দাঁড়াল দীপঙ্কর। রামধনি দরোয়ান তখনও আছে। গেটের পাশেই ছোট ঘরখানায় বসে আটা মাখছিল। দীপঙ্কর খানিক দাঁড়াল। এদিক-ওদিক চাইতে লাগলো। অনেক বড় বাড়ি। বিরাট বাড়ি, কে কোথায় থাকে, কখন থাকে, তার হদিস রাখা শক্ত। দীপঙ্কর ফিরে এল আবার। এত বড় পৃথিবী, এত বিরাট কালীঘাট–অথচ সেদিন দীপঙ্করের মনে হয়েছিল যেন কোথাও কেউ নেই! এমন কেউ নেই যার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারে সে!

হতাশ হয়ে আবার নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের দিকে ফিরেই আসছিল দীপঙ্কর, হঠাৎ মনে পড়লো ছিটে-ফোঁটার কথা।

কালীঘাট বাজারের উত্তর গায়ে হিন্দু হোটেল। তারই পেছনে টিনের পাকা বাড়ি। আর কোনও উপায় না দেখে দীপঙ্কর সেই দিকেই গেল। বেশ রাত হয়ে আসছে তখন। কিন্তু ও-পাড়া তখনও জমেনি ভালো করে। জমবে আরো অনেক রাত্রে। রাত আর একটু গম্ভীর হলে। অনেক অবাঞ্ছিত লোক ঘোরাফেরা করছে এদিকে ওদিকে। সরু একটা পাঁচ ফুট চওড়া গলি। খোয়া বাঁধানো। গলির দু’পাশে একটা নয়, অনেকগুলো টিনের পাকা বাড়ি। ভেতরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে এক-জায়গায় গান হচ্ছিল। ফেরিওয়ালারা গলির মধ্যেও কারবার করতে ঢুকেছে।

–চাই পাঁঠার ঘুগনি! গরম আলুর চপ, পেঁয়াজি—

আরো অনেক রকম ফেরিওয়ালা। মালাই বরফ, বেলফুল! পায়ে ঘুঙুর বাজিয়ে সখী সেজে চানাচুর বিক্রি করছে একজন। দু’পাশে অনেক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাজগোজ করে। হাসি-মস্করা করছে। পানের পিচ ফেলছে শব্দ করে। দীপঙ্কর মাথা নীচু করে হিন্দু হোটেলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

–ওদিকে নয় গো, ওদিকে নয়, ওটা বাঁধা ঘর!

দীপঙ্কর পেছন ফিরে কথাটা কে বলছে দেখতেই একপাল মেয়ে কিল-বিল করে উঠলো। হেসে গড়িয়ে পড়লো সবাই।

যেন মরীয়া হয়েই দীপঙ্কর ডাকলে—লোটন–

লোটন বলেই ডাকতে বলেছিল ফোঁটা। লোটনকে দেখতে কেমন, মানুষ কেমন তাও জানতো না দীপঙ্কর। ডাকতে একটু সঙ্কোচ হলো। কিন্তু না-ডাকলেও উপায় নেই। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দীপঙ্কর আবার বাড়িটার সদর-দরজা লক্ষ্য করে ডাকলে–লোটন–

–কে গা?

একজন মেয়ে বেরিয়ে এসেছে হাসতে হাসতে। এক মুখ পান। কিন্তু দীপঙ্করকে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেছে। দীপঙ্করও চিনতে পারলে যেন। যেন চেনা-চেনা মুখ।

অঘোরদাদুর বাড়িতেই দেখেছে–চন্নুনীর কাছেই দেখেছে।

–এসে গেছিস? আয়, আয়, ভেতরে আয়—

খালি-গায়ে লুঙ্গী-পরা ফোঁটা বেরিয়ে এসেই টানতে আরম্ভ করেছে হাত ধরে। বললে–আরে, এ যে সে তোক নয়, বি-এ পাশ গ্র্যাজুয়েট, রেলের অফিসার মানুষ

দীপঙ্কর বললে–আমি ভীষণ বিপদে পড়ে এসেছি তোমার কাছে–কিরণের বাবা মারা গেছে, শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে, কেউ নেই সাহায্য করবার, যার কাছে গেলাম সে ই ফিরিয়ে দিলে, অথচ কিরণও নেই, শেষে কোনও উপায় না পেয়ে এখানে এলাম তোমার কাছে, তোমাকে সাহায্য করতেই হবে–

ফোঁটা যে ফোঁটা সে-ও মন দিয়ে শুনলে কথাগুলো। তারপর কী যেন ভাবতে লাগলো।

দীপঙ্কর আবার বললে–খরচপত্রও কিছু দিতে হবে তোমায়, ওদের কিছু নেই অন্তত দশটা টাকা লাগবেই

ফোঁটা খানিক ভেবে চিন্তে বললে–দশ টাকায় হবে না–

দীপঙ্কর বললে–দশ টাকাও লাগবে না হয়, তবে সঙ্গে থাকা ভালো–

ফোঁটা বললে–না, আমি অনেকবার গেছি, মাল-টাল খেতে হয়, কুড়ি টাকা নেওয়াই ভালো

তারপর লোটনের দিকে ফিরে বললে–কুড়িটা টাকা দাও তো গো, আর গামছাটা–

তারপর দীপঙ্করকে জিজ্ঞেস করলে–আর কে যাচ্ছে? আর কাউকে যোগাড় করতে পেরেছিস?

–আর কেউ নেই, শুধু আমি আর তুমি। যদি আর কাউকে যোগাড় করতে পারো তো বড় ভালো হয়।

–যোগাড় করতে পারবো না মানে? আমি বললে এ-পাড়ায় কারোর বাবার ক্ষমতা আছে না’ বলে?-বলে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল ফোঁটা।

সত্যিই শেষ পর্যন্ত সেদিন ফোঁটা ছিল বলে কোনও অসুবিধাই হয়নি। কোথা থেকে আরো তিন-চারজন লোক যোগাড় করেছিল। সবাই যেন দেবতার মতন ভক্তি করতে লাগলো ফোঁটাকে। সবাই ‘দেবতা” বলে ডাকতে লাগলো ফোঁটাকে। দীপঙ্করকে কিছু করতে হয়নি। ছিটেও ছিল সঙ্গে।

একজন বললে—দেব্‌তা, কিছু মাল-টালের ব্যবস্থা নেই?

ক্যাওড়াতলার শ্মশানের মধ্যেও ফোঁটার রাজত্ব। ডোমরাও সসম্ভ্রমে প্রণাম করতে লাগলো ছিটে-ফোঁটাকে। দীপঙ্কর দেখে অবাক হয়ে গেল ছিটে-ফোঁটার প্রতিপত্তি। ব্রাহ্মণ-পুরুত, কাঠওয়ালা থেকে শুরু করে সাধু-সন্নিসী সবার ওপরেই সমান প্রতিপত্তি। তার এক ডাকে মুহূর্তে কার্য সমাধা হয়ে যায়। এক ঘঁকে শ্মশানসুদ্ধ লোক তটস্থ হয়ে থাকে। যাকে যা হুকুম করে সে-ই এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।

পুরুত বললে–মুখাগ্নি করবে কে?

সত্যি তো, মুখাগ্নি করবে কে?

ফোঁটা বললে–দীপু করবে, আবার কে করবে–আমি তো পাষণ্ড একটা–বলে বিড়িটায় লম্বা টান দিলে একটা।

দীপঙ্কর তখন গঙ্গার ঘাটের ওপর অন্ধকারে চুপ করে বসে ছিল। সমস্ত মনটা তার আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সমস্ত দিন। আর শুধু সমস্ত দিনই বা কেন? কদিন ধরেই একটার পর একটা ভাবনার ঝড়ে যেন একেবারে ভেঙে দিয়েছে তাকে। সেই আপিস, আপিসের চাকরি। কাকাবাবুর বাড়িতে হৈ চৈ, লক্-আপ, ছিটে-ফোঁটা, চন্নুনী, কিরণ, মার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা আর তারপর এই কিরণের বাবার মৃত্যু!

গঙ্গার ঘাটের একেবারে শেষ ধাপে জলের ধার ঘেঁষে একটা লোক চুপ করে বসে আছে অনেকক্ষণ। চারদিক অন্ধকার। ছিটে-ফোঁটারা কাঠ কিনে চিতের যোগাড় করছে। মাঝে-মাঝে হরি-ধ্বনি কানে আসছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে শ্মশানের ভেতরটা। চোখ জ্বালা করে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে। কিন্তু এখানটা নির্জন। ওপারে আলো জ্বলছে চেতলার রাস্তায়। কে একজন ওপারে গঙ্গার ধারে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে একমনে।

হঠাৎ পাশে কে একজন এসে ডাকলে। বললে–দেবৃতা আপনাকে একবার ডাকছেন, দীপুবাবু

–কেন?

–আজ্ঞে আপনিই তো মুখাগ্নি করবেন!

মুখাগ্নি করতে হবে দীপঙ্করকেই। সত্যিই তো, কেউ নেই তো ওদের। ছেলে। থেকেও নেই। আশ্চর্য! এতদিন পরে বুঝি কিরণের দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হলো। সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে হলো। গরমে যেন মাথাটা পুড়ে যাবে এত হক্কা লাগছে। চোখে-মুখে।

ফোঁটা কাছে এল। বললে–যা দীপু, তোকে কিছু ভাবতে হবে না, আমরা সব করছি, তুই ঘাটে গিয়ে ঠাণ্ডায় বসগে যা

ঘাটে আসতেই মাথাটা আবার ঠাণ্ডা হলো। রাত হচ্ছে। আটটার সময় চড়ানো হয়েছে, রাত এগারোটার আগে আর শেষ হবে না। অনেকক্ষণ এমনি চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে হবে। ওরা ততক্ষণ খাবার খাবে, আরো যা খুশি ওদের সব খাবে। টাকা-কড়ি সব কিছুর খরচা ওদের। দীপঙ্করকে কিছু ভাববার দরকার নেই।

হঠাৎ যেন টিপি টিপি পায়ে কে কাছে এসে দাঁড়াল। সেই ছেলেটা! অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না। সেই বহুদিন আগে কিরণের খবর এনে দিয়েছিল। ম্যাডক্স-স্কোয়ারে ভজুদার খবরও এনে দিয়েছিল! দীপঙ্কর ভূত দেখবার মত করে চমকে উঠেছে। বললে

–আপনি, এখানে?

ছেলেটি বললে–আমি আপনার কাছেই এসেছি, কিরণ পাঠিয়েছে।

–কিরণ? কিরণ কোথায়? কিরণের বাবা যে আজ মারা গেলেন?

ছেলেটি আস্তে আস্তে বললে–জানি–

দীপঙ্কর যেন হঠাৎ রেগে গেল। বললে–কিন্তু আপনাদের কিরণ এত ছোট করলে কেন নিজেকে? আমার নাম-ধাম ঠিকানা, সব বলে দিলে এমন করে? জানেন, তার জন্যে আমাকেও ক’দিন লক্-আপে আটকে রেখেছিল? কালই তো ছাড়া পেলাম! নিজে ধরা পড়লো, আবার আমাকেও জড়ালে? আমি সেদিন কিরণের সঙ্গে ম্যাডক্স-স্কোয়ারে গিয়েছিলাম, তাও বলে দিয়েছে ওদের! যদি কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা না থাকে তো, কেন স্বদেশী করতে যাওয়া?

ছেলেটি কিছু বললে না। চুপ করে রইল। চারদিক দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বার করে এগিয়ে দিলে। বললে–কিরণদা আপনাকে লিখেছে

–কিরণ, কিরণ কোথায়? ছাড়া পেয়ে গেছে?

ছেলেটি বললে–চিঠিটা পড়লেই বুঝতে পারবেন—

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলো।

“আমি এইমাত্র খবর পেলাম। কিন্তু ভাই, আমার কিছুই করবার নেই। চারদিক থেকে জাল ফেলা হচ্ছে আমাদের ধরবার জন্যে। যদি কোনওদিন সুযোগ পাই তো তোকে সব বলবো। শয়তানদের শেষ না-করা পর্যন্ত আমাদের আহার-নিদ্রা নেই বাড়ি-ঘর নেই, বাবা-মা নেই। তোকে এই সঙ্গে যে-কাগজটা দিলুম সেটা পড়ে সই করে দিস্তারপরে যা করবার আমরা করবো।”

চিঠির ওপরে বা নিচে কারোর নাম লেখা নেই। তবু কিরণের হাতের লেখা দীপঙ্করের চেনা।

দীপঙ্কর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলে–এটা কী?

ছেলেটি বললে–পড়েই দেখুন না—

আলোর তলায় গিয়ে দীপঙ্কর কাগজটা পড়তে লাগলো। তাতে লেখা রয়েছে–

ওঁ বন্দে মাতরম

‘আমাদের কর্তব্য কী? আমাদের কর্তব্য খুব পরিষ্কার। রাউন্ড টেবল কনফারেন্স সম্বন্ধে আমাদের কোনও মাথা-ব্যথা নাই। রাউন্ড টেবল কনফারেন্স সফল হউক বা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হউক তাহা জানিবার আগ্রহও আমাদের নাই কিন্তু আমাদের প্রথম ও শেষ কথা আতঙ্ক সৃষ্টি করিতে হইবে। এই অন্যায় গভর্নমেন্ট অচল করিয়া তুলিতে হইবে, মৃত্যুদূতের মতন আত্মগোপন করিয়া থাকিতে হইবে এবং আমলাতন্ত্রের মাথায় মৃত্যু বর্ষণ করিতে হইবে। মনে রাখিও, আমাদের ভ্রাতারা জেলে এবং গ্রামে অন্তরীণে পচিতেছে। যাহারা মরিয়াছে বা উন্মাদ হইয়া গিয়াছে তাহাদের ভুলিও না। ঈশ্বর ও দেশের নামে ভাইরা আবার তোমাদের বলিতেছি বালক, বদ্ধ, ধনী, দরিদ, হিন্দ, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দাও, রক্ত দাও, ধন দাও। আমরা যে-স্বাধীনতার জন্য লড়াই করিতেছি তা ভারতবর্ষের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার স্বাধীনতা। সে-স্বাধীনতা কয়েকজন মুষ্টিমেয় অর্থপিশাচ বিদেশী বণিকদের কুক্ষিগত স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা আসিলে সেদিন আমরা সবাই তাহা একযোগে ভোগ করিব। সেই দিনের সুখ-সমৃদ্ধির আদর্শ সামনে রাখিয়া আমরা আজ কুকুর-বিড়ালের মত প্রাণ দিতেছি, এবং প্রয়োজন হইলে আরো দিব। তোমাদেরও প্রাণ দিতে আহ্বান করিতেছি। ওই শোন জননীর আহ্বান ও পথ-নির্দেশনান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”

সঙ্গে আরও একটা কাগজ। তাতেও লেখা রয়েছে অনেক কিছু।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–এটা কী?

ওটাই প্রতিজ্ঞা-পত্র, ওইটেতেই আপনাকে সই করতে হবে–

দীপঙ্কর পড়তে লাগলো-”ঈশ্বর, জননী, পিতা, গুরু নেতা ও সর্বশক্তিমানকে সাক্ষী রাখিয়া শপথ করিতেছি-(১) উদ্দেশ্য পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চক্র ত্যাগ করিব না। স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকিব না। নেতার আদেশে চক্রের কাজ বিনা প্রতিবাদে করিয়া যাইব। (২) যদি এই শপথ পালনে অক্ষম হই তবে পিতা, মাতা, ব্রাহ্মণ ও সর্বদেশের দেশপ্রেমিকদের অভিশাপ যেন আমাকে ভস্ম কগিরয়া ফেলে।”…..ইত্যাদি ইত্যাদি

অনেক বড় লেখা। এক দুই করে অনেকগুলো শর্ত। অল্প আলোয় সবগুলো পড়াও যায় না।

ছেলেটি বললে–এই কাগজটাতেই সই করতে হবে-কিরণদা বলে দিয়েছে।

দীপঙ্কর কাগজটা হাতে নিয়ে ভাবলে খানিকক্ষণ। তারপর বললে–কিন্তু আমি তো এখন সই করতে পারবো না

–তাহলে কখন করবেন?

–সে আমি কিরণকে বলবোখন।

–কিন্তু কিরণদার সঙ্গে তো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে না, আজকেই কলকাতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি যে আর সই করতে পারি না, আমি যে আজকেই মা’র পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি, এসব আর জীবনে করবো না

কথাগুলো বলতে গিয়ে দীপঙ্করের মাথা যেন লজ্জায় নুয়ে এল হঠাৎ। আর যেন মাথা তুলে তাকাবারও সাহস নেই তার। সে যেন বড় হীন প্রতিপন্ন হয়ে গেল পৃথিবীর সকলের সামনে। মনে হলো সকলে যেন তার দিকে আঙুল নির্দেশ করে ছি-ছি করে উঠলো সেই নির্জন শ্মশানভূমির নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে।

–তাহলে ওগুলো দিন—

দীপঙ্কর কাগজগুলো দিয়ে দিলে ছেলেটির হাতে।

ছেলেটি বললে–আর কিরণদার চিঠিটা, ওটাও দিন–

কিরণের চিঠিটা নিয়ে ছেলেটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নিশ্চিহ্ন করে ছাইগাদার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তারপরে আর কিছু না বলে তাড়াতাড়ি অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

তখনও শ্মশানের মধ্যে বিকট হরিধ্বনির শব্দ উঠছে। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে ভেতরটা। বিরাট শিরীষ গাছটার মাথায় কয়েকটা শকুনি অদ্ভুত একটা কিছু-কিছু শব্দ করছে মাঝে-মাঝে। রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। ওপারে চেতলার রাস্তায় ধান গোলার সামনে লোক-চলাচল পাতলা হয়ে এল। যে-লোকটা এতক্ষণ বাঁশি বাজাচ্ছিল, সেও থেমে গেছে খানিকক্ষণ আগে।

দীপঙ্কর আবার এসে বসলো ঘাটের ওপর।

ঘাটের একেবারে শেষ-ধাপে যে-লোকটা বসেছিল, হঠাৎ যেন সে একটু নড়তে চড়তে লাগলো। অন্ধকারে হাব-ভাব, চেহারা, পোশাক কিছুই দেখা যায় না স্পষ্ট করে। লোকটা দাঁড়িয়ে উঠে জলে পা দিলে, তারপর এগিয়ে যেতে লাগলো। তারপর আরো একটু….

দীপঙ্করের কেমন যেন সন্দেহ হলো। লোকটা কে? এখানে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন। কী মতলব ওর?

এবার আর চুপ করে বসে থাকা গেল না।

লোকটা আরো এগোচ্ছে…..

দীপঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে টপ টপ করে নামতে লাগলো। বললে–কে ওখানে? কে আপনি?

লোকটা এবার পিছন ফিরলো। দীপঙ্করকে দেখেই লোকটা ওপর উঠে আসতে লাগলো। তারপর আরো একটু কাছে আসতেই দীপঙ্কর চিনতে পেরেছে। দাতারবাবু!

–দাতারবাবু না? আপনি এখানে?

কোন সন্দেহ নেই। আরো রোগা হয়ে গেছে চেহারা। ফিকে কঙ্কালসার চেহারা দাতারবাবুর। দীপঙ্করের কথার কোনও উত্তর নেই দাতারবাবুর মুখে। যেন হঠাৎ ধরা পড়ে গেছেন।

দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে–লক্ষ্মীদি কেমন আছে?

দাতারবাবু বললেন—ভালো–

বলেই আর কোনও কথা না বলে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যেতে লাগলেন। খুব জোরে জোরে চলতে লাগলেন। যেন দীপঙ্করকে এড়িয়ে যাবার মতলব। পাশের মাইশোর ঘাটের নির্জন অন্ধকারের মধ্যেই আত্মগোপন করতে চাইলেন।

দীপঙ্করও পেছন-পেছন ছুটলো–

–দাতারবাবু, দাতারবাবু–

দাতারবাবু ততক্ষণে অনেকদূর চলে গেছেন। আরো জোরে জোরে পা চালাচ্ছেন। দীপঙ্করও সরু গলিটা দিয়ে দক্ষিণের মাইশোর ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল।

হঠাৎ পেছন থেকে ফোঁটার গলার আওয়াজ শোনা গেল।

–কীরে দীপু, কোথায় যাচ্ছিস ওদিকে! দীপঙ্কর কাছে এল। দেখলে ফোঁটা কাঁধে গামচা নিয়ে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বললে–কীরে, অন্ধকারের মধ্যে ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলিস? আমাদের কাজ সব ফতে! এখন নাই-কুণ্ডলীটা তোকেই গঙ্গায় ফেলতে হবে-চল

ফোঁটার মুখ দিয়ে তখন ভরু-ভর করে দেশী মদের বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে।

দীপঙ্কর আবার শুশানের মধ্যে এসে ঢুকলো। তখন কলসী করে জল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে চিতার ওপর। সব শেষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *