আবার মায়ানেকড়ে

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১০৯/২ – আবার মায়ানেকড়ে – কাহিনি রচনা : রকিব হাসান / রূপান্তর : শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০০৯

এক

এখন মধ্যরাত।

বনের ভিতরে হেঁটে চলেছি আমি আর বাবা।

রবিন, আস্তে, এত শব্দ কোরো না! বাবা বলল। ওরা শুনে। ফেলবে তো!

আমিও শব্দ না করেই চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু বনতলে শুকনো। ঝরা পাতা এড়িয়ে চলা খুব কঠিন। পা পড়বেই, আর পড়লেই শব্দ হয়।

আমি রবিন, রবিন মিলফোর্ড। হাই স্কুলে পড়ি। গ্রীনহিলসে থাকি।

আমার বাবার নাম রজার মিলফোর্ড। সাংবাদিক। মোটামুটি প্রভাবশালী লোক।

মাঝে মাঝেই নানা উদ্ভট খেয়াল চাপে বাবার মাথায়। এই যে, এবার যেমন মায়ানেকড়ে চেপেছে ঘাড়ে। ধরার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর তাই, ব্র্যাটভিয়ায় মায়ানেকড়ে আছে খবর পেয়ে এক মুহূর্তও দেরি করেনি, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে।

বার্ষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি পেয়েছি। ভেবেছিলাম গ্রামের বাড়িতে দাদুর কাছে বেড়াতে যাব। কিন্তু বাবা আমাকে ধরে নিয়ে। এসেছে ব্র্যাটভিয়ায়। আমার আসার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। মায়ানেকড়েতে আর আমার কোন আগ্রহ নেই, বরং ভয় পাই। ওগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে পারলে খুশি হই। কিন্তু কী আর করা। বাবা নিয়ে এসেছে।

গাছের ডালপালা কাঁপিয়ে বয়ে গেল ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা বাতাস। কেঁপে উঠলাম।

গাছপালাগুলো অতিরিক্ত ঘন এখানে। গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করে আছে। মায়ানেকড়ে লুকানোর উপযুক্ত জায়গা। সাবধান না হলে যে কোন মুহূর্তে আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এসে ঘাড়ে পড়বে। তারপর ধারাল দাঁত আর নখ দিয়ে কীভাবে আমার দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করবে, কল্পনা করে শিউরে উঠলাম।

মায়ানেকড়ে বড় ভয়ঙ্কর! অভিশপ্ত এদের জীবন। দিনে সাধারণ। মানুষ থাকে, স্বাভাবিক কাজকর্ম করে, রাতে হয়ে ওঠে রক্তলোলুপ পিশাচ। লোকে বলে, ভাল মানুষকে মায়ানেকড়েতে কামড়ালে নাকি সেই মানুষটাও মায়ানেকড়ে হয়ে যায়। পূর্ণিমার আগে শুরু হয় এদের উৎপাত। কারও কারও মতে, পূর্ণিমার রাতসহ আগের দুরাতে চাঁদ উঠলে মানুষ থেকে এরা মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়। বেরিয়ে পড়ে তাজা মাংসের সন্ধানে। সারারাত শিকার ধরে বেড়ায়। ভোরের আলো ফুটলে আবার মানুষ হয়ে যায়। তার আগেই কেউ যদি ওটার নাম ধরে ডাকে, কিংবা মাথায় তিনবার চাপড় দেয়, তাহলেও নাকি মানুষ হয়ে যায়।

মুখ তুলে তাকালাম আকাশের দিকে। গোল চাঁদটা কেমন ঝুলে রয়েছে। জ্যোৎস্নার রূপালী আলো যেন ধুয়ে দিচ্ছে গাছগুলোর মাথা। ভূতুড়ে পরিবেশ বনের ভিতরে। বাবার ধারণা, এই পরিবেশে। মায়ানেকড়ে বেরোবেই। তাজা মাংসের জন্য জানোয়ার শিকার করবে। বাগে পেলে মানুষকেও ছাড়বে না।

ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল আমার। দাঁড়িয়ে গেলাম। বাতাসে ভেসে আসছে নানারকম বুনো জানোয়ারের ডাক। বিলাপের মত আর্তনাদ কোনওটার। কোনওটা চাপা কুঁই কুঁই করছে। কোনওটা আবার ভয়ানক গর্জনে বন কাঁপাচ্ছে।

রবিন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বাবা বলল। ওভাবে থাকলে তো ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।

ঝট করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর বড় কোনও ডাল আছে কিনা, আর সে-ডালে মায়মায়ানেকড়ে ঘাপটি মেরে আছে কিনা।

তারপর মরা পাতা এড়িয়ে বাবার পিছন পিছন যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোনোর চেষ্টা করলাম।

দ্রুত এগোচ্ছে বাবা।

বাবা, আস্তে! তোমার সঙ্গে হেঁটে পারছি না তো! কিন্তু গতি কমাল না বাবা। রীতিমত দৌড়াচ্ছে।

বাবা, প্লিজ! চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিলাম বাবার পিছন পিছন।

আশ্চর্য। হঠাৎ কী হলো বাবার? আমি বলা সত্ত্বেও আমার জন্য। অপেক্ষা করছে না। গতিও কমাচ্ছে না।

বাবা! দাঁড়াও! আমি আর পারছি না! হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।

পা ব্যথা করছে আমার। একটা গাছের শিকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম। খসখসে বাকলে ঘষা লেগে গাল কেটে রক্ত বেরিয়ে এল।

কোনমতে উঠে আবার দৌড়ানো শুরু করলাম।

কিন্তু আমি যত দৌড়াই, বাবা তারচেয়েও জোরে ছোটে। আমাকে কাছে যেতে দেয় না। এটা কী রকম হচ্ছে! এমন করছে কেন?

বাবা! আবার ডেকে বললাম, থামো! দাঁড়াও!

অবশেষে থামল বাবা। ঘুরে তাকাল আমার দিকে। চিৎকার করে উঠলাম। আতঙ্কে।

দুই

বাবার মুখে বড় বড় লোম গজাচ্ছে। মানুষের মুখ বদলে গিয়ে নেকড়ের আদল তৈরি হচ্ছে। মায়ানেকড়ে হয়ে যাচ্ছে বাবা!

আমার দিকে তাকিয়ে জিভ চাটল। বড় বড় দাঁত দেখলাম। এখনও দুই পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে ভূতুড়ে প্রাণীটা। মাথা হেলিয়ে মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল।

চিৎকার করতে চাইলাম। স্বর বেরোল না। দৌড় দিতে চাইলাম। পা কথা শুনল না।

সারা গা লোমে ভরে গেল প্রাণীটার। হাত দুটোও রূপান্তরিত হলো। পায়ে।

চারপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ওটা। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তারপর গর্জন করে উঠল। আত্মা কাঁপিয়ে দিল আমার।

স্বপ্ন! স্বপ্ন! নিজেকে বললাম। দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি!

আর স্বপ্নের কথা ভাবতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। এত ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে গেছি। কাত হয়ে শুলাম। একটা তাঁবুতে রয়েছি আমি। ক্যাম্প খাটে শোয়া। হঠাৎ আঁচড়ের শব্দ কানে এল। তবু কাটার চেষ্টা করছে যেন কোন জানোয়ার। তাঁবুতে ঢুকতে চায় নাকি? আবার কী ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি? দম আটকে ফেললাম। আঁচড়ের শব্দ বাড়ছে। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। হাতে চিমটি কাটলাম। ব্যথা লাগল। কই, স্বপ্ন তো দেখছি না! জেগেই রয়েছি! আগেরটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এটা একদম বাস্তব! ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। আঁচড়ের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বুকের কাঁপুনিও বেড়ে যাচ্ছে।

তিন

আর থাকতে না পেরে, কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম। শার্ট-প্যান্ট পরাই আছে। পায়ে মোজা। অন্ধকারে হাতড়ে ক্যাম্প, খাটের পাশে মাটিতে রাখা জুতো জোড়া বের করে পরলাম।

কীসে আঁচড় কাটছে দেখতে যেতে ভয় লাগছে। মায়ানেকড়ে না।

এই, যা যা! ধমক দিলাম। যা, পালা! আমাকে একটু ঘুমোতে কিন্তু গেল না ওটা! হাঁটু কাঁপছে আমার।

শান্ত হও, রবিন, নিজেকে বোঝালাম। কীসে কাটছে, দেখো আগে। মায়ানেকড়ে না-ও হতে পারে। হয়তো অন্য কিছু। বনে তো জন্তু-জানোয়ারের অভাব নেই।

ঘেমে গেছে হাতের তালু। শার্টে ডলে মুছলাম। ভারী দম নিলাম। উঠে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই আঁচড়ের শব্দ থেমে গেল। চলে গেল নাকি ওটা? দরজার দিকে এগোলাম। পর্দা ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিলাম। আঁচড়ের শব্দটা যেখানে হচ্ছিল, সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখলাম না।

ঘন গাছপালায় ছাওয়া বন। অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে লম্বা গাছগুলোকে কালো দেখাচ্ছে। তিন দিন আগে এই বনে এসেছি বাবার সঙ্গে। আর প্রতি রাতেই মায়ানেকড়ের ভয়ানক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে আমাকে।

সত্যিই কী মায়ানেকড়ে আছে এই বনে?

তাঁবুর পর্দা আরেকটু ফাঁক করলাম। মাথা আরেকটু বের করলাম বাইরে। চারপাশে তাকালাম। নাহ্। কোন প্রাণী চোখে পড়ল না। নিশ্চয় আমার ওঠার শব্দ শুনে চলে গেছে।

ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গায় তাঁবু ফেলেছে বাবা। সন্ধ্যাবেলা তাঁবুর সামনে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলেছিল। ছাইয়ের নীচে ধিকিধিকি আগুন রয়ে। গেছে বোধহয় এখনও। সাদা ধোয়ার ফিতে সাপের মত এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে।

বাবার তাঁবুটার দিকে তাকালাম। কোন শব্দ নেই ভিতরে। আঁচড়ের শব্দও সেই যে থেমেছে, আর হচ্ছে না। বাইরে পা রাখলাম।

গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু সরসর ছাড়া পুরো বনটাই নীরব। কনকনে ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠলাম। মুখ তুলে তাকালাম চাঁদের দিকে।

আমার তাঁবুর কাছ থেকে আরেকটু সরে এলাম। কান পেতে আছি।

কোন শব্দ নেই আর। নিশাচর জানোয়ার, পেঁচার ডাক, কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

ভূতুড়ে নীরবতা। আবার লাফানো শুরু করল হৃৎপিণ্ডটা।

বাবা বলেছে, এই অভিযানে আসার দুটো কারণ। এক, একটা মায়ানেকড়ে ধরা। আর দুই, মায়ানেকড়ে সম্পর্কে আমার ভয় দূর করা। বাবা মনে করে, ছেলেদের এত ভীতু হওয়া উচিত নয়।

যাই হোক, বাবার একটা উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। মায়ানেকড়েও ধরতে পারেনি, আর আমারও ভয় দূর হয়নি। বরং এখন এই বন। থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।

আবার তাকালাম চাঁদের দিকে। বাবা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, একা একা রাতে কখনও বাইরে বেরোবে না। এই বনে

মায়ানেকড়ে আছেই। তা ছাড়া এখন শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় মায়ানেকড়েরা শিকার ধরতে বেরোবেই।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আবার লাফানো শুরু করেছে হৃৎপিণ্ডটা। আমার বুকের খাঁচায় যেন হাতুড়ি পিটানোর শব্দ করছে।

নিজের তাঁবুতে যেতে ভয় লাগছে। একা একা আর ঘুমাতে পারব না। বাবার তাঁবুতে থাকব ঠিক করলাম। তবে ভয় পেয়েছি, এ-কথা বলা যাবে না। বলতে হবে আমার পেটে ব্যথা।

বাবার তাঁবুর কাছে এসে আস্তে পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম। বাবা? বাবা!

জবাব নেই। তাঁবুতে নেই বাবা।

চার

পিছনে খসখস শব্দ হলো। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকালাম। কান পেতে শুনছি।

বনের মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। ভারি পায়ের শব্দ।

নিশ্চয় বাবা আসছে! ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, কাছাকাছিই রয়েছে বাবা। হাঁটতে লাগলাম শব্দ লক্ষ্য করে।

ছোট্ট খোলা জায়গাটা থেকে এসে বনে ঢুকলাম। একটা সরু পায়েচলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললাম। চাঁদের আলো পথ দেখাচ্ছে। আমাকে।

বাবাকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না। কাছাকাছি মায়ানেকড়ে থাকলে আমার ডাক শুনে চলে আসবে। ভালুকও আসতে পারে। শুনেছি, মানুষের মাংসেও অরুচি নেই ব্র্যাটভিয়ার ভালুকের।

শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না ঠিক কোনখান থেকে আসছে শব্দটা।

একটা দো-রাস্তার মুখে এসে পড়লাম। কোনদিকে যাব এখন? সোজা সামনে, যেটা দিয়ে এগোচ্ছি? নাকি পাশেরটা?

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। দূরে চলে যাচ্ছে। মনে হলো, পাশের রাস্তাটা ধরেই যাচ্ছে।

সেটা ধরে দৌড়ানো শুরু করলাম। ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লাম বনের আরও গভীরে। গাছপালা অনেক ঘন এখানে। কালো পর্দা তৈরি করে যেন আকাশ আড়াল করে দিয়েছে গাছের মাথা। চাঁদের আলো ঢুকতে দিচ্ছে না।

অন্ধকারে পথ না দেখায়, হোঁচট খাচ্ছি। গাছের ডাল সড়াৎ সড়াৎ বাড়ি খাচ্ছে নাকেমুখে। আর না ডেকে পারলাম। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তুমি কোথায়?

সাড়া এল না। থেমে গিয়ে কান পাতলাম। কোথাও কোন শব্দ নেই আর এখন।

এত নীরব হয়ে গেল কেন বনটা? গায়ে কাঁটা দিল আমার। মনে হচ্ছে সব অবাস্তব, একটা মস্ত দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছি।

হঠাৎ মট করে শুকনো কুটো ভাঙার শব্দ হলো। নিশ্চয় বাবা!

শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিলাম। মোড় নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। রাস্তা। গাছের বড় বড় ডাল এসে পড়েছে রাস্তার ওপর, অনেক নিচুতে, সেগুলো পার হতে গিয়ে বার বার মাথা নিচু করতে হচ্ছে আমাকে। গাছের পাতা থেকে কুয়াশা পানি হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে মাথায়।

দম নিতে, থামলাম আবার। নাহ্, বাবাকে আর খুঁজে পাব না! এত অন্ধকার, কিছুই দেখা যায়। কোথায় চলেছি, তা-ও জানি না।

বাবা! বাবা! কোথায় তুমি? মায়ানেকড়ের কানে যাবার ঝুঁকি নিয়েও চিৎকার করে ডাকলাম।

আরেকটা ডাল ভাঙার শব্দ হলো। আমার মাথার ওপর। বরফের মত জমে গেলাম। মৃদু গর্জন কানে এল। তারপর আবার আরেকটা ডাল ভাঙার শব্দ।

ওপর দিকে তাকালাম। একজোড়া জ্বলন্ত চোখের দিকে চোখ। পড়ল আমার।

কি ওটা? জানোয়ার?

না অন্য কিছু? ভালমত দেখার সময় পেলাম না। গাছ থেকে লাফিয়ে নামল ওটা। সরে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠলাম। চিৎকার করতে মুখ খুললাম। স্বর বেরোল না।

অর্ধেক মায়ানেকড়ে, অর্ধেক মানুষ

একটা জন্তু চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গা-ভর্তি লোমগুলো চাঁদের আলোয় চকচক করছে।

আমার দিকে তাকিয়ে চাপা গরগর করতে লাগল। মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে।

আতঙ্কে নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল আমার। এক পা পিছিয়ে গেলাম।

প্রাণীটার মুখ মায়ানেকড়ের মত। দেহটা মানুষের। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বড় বড় দাঁত।

আতঙ্কিত হয়ে ঘুরে দৌড় দিতে যাব, ভয়ঙ্কর এক গর্জন করে আমার ওপর লাফিয়ে পড়ল ওটা।

কাঁধে তীক্ষ্ণ ব্যথা লাগতে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। আমার কাঁধে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে ওটা। মাথা চক্কর দিচ্ছে আমার।

কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখের সামনে আঁধার হয়ে আসছে। সবকিছু।

মনে হলো, অন্ধকারে নীচে পড়ে যাচ্ছি। পড়ছি…পড়ছি…

পাঁচ

গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ে লাগতে ভূতুড়ে প্রাণীটা ফিরে এসেছে ভেবে চেঁচিয়ে। উঠলাম, অ্যাই, যা! ভাগ! ভাগ! বাবা, বাঁচাও!

আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। না না, হাত না, থাবা! নিশ্চয় মায়ানেকড়ের থাবা!

বাঁচাও, বাঁচাও! বলে চেঁচিয়ে উঠলাম আবার।

রবিন, কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখছিলে? ওঠো, ওঠো।

খুলে গেল আমার চোখের পাতা। আমার ক্যাম্প খাটের কিনারে বসে আছে বাবা। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। একটা হাত আমার কাঁধে।

রবিন, কী হয়েছে তোমার? বাবার চোখ উদ্বেগে ভরা।

উঠে বসলাম। ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছি! আশ্চর্য!

তাঁবুতে এলাম কীভাবে? কিছুই মনে করতে পারলাম না। তবে কী বেরোইনি? কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, আঁচড়ের শব্দ পেয়ে আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

পায়ের শব্দ শুনে বনের ভিতর দিয়ে গেছি। মায়ানেকড়ে দেখেছি। আমার কাঁধে কামড়ে দিয়েছে।

ঘটনাটা যে বাস্তব ছিল, কাঁধের দপদপে ব্যথাই সেটা বুঝিয়ে দিল। না। ওটা দুঃস্বপ্ন ছিল না। সত্যি সত্যি মায়ানেকড়ের খপ্পরেই পড়েছিলাম।

তাঁবুতে ফিরলাম কী করে? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমি তুলে এনেছি, বাবা বলল। জানোয়ারটাকে তোমার গায়ের ওপর চেপে থাকতে দেখলাম। তাড়িয়ে দিয়েছি। বাবার মুখ উত্তেজনায় লাল।

সত্যিই চলে গেছে? তুমি শিওর? জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বালিশে হেলান দিলাম।

হ্যাঁ, সত্যিই চলে গেছে। আজকের রাতটা কোনমতে পার করতে পারলেই আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

দুশ্চিন্তার কিছু নেই মানে? শুক্লপক্ষ শেষ হতে তো এখনও অনেক দেরি। পূর্ণিমা হবে। তার পরদিন কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে মানুষটা আর মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হবে না, তাই না?

হ্যাঁ।

তাহলে আসবে না কেন?

অনেকখানি এগিয়েছি। কাল রাতের আগেই ওটাকে খুঁজে বের করে ধরে ফেলব আমি।

কিন্তু আমি ধরতে যেতে চাই না! চেঁচিয়ে উঠলাম। আমি কাল বাড়ি যেতে চাই!

এবার সত্যি সত্যি একটা মায়ানেকড়ে ধরতে পারব আমি! আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি বাবার।

কাজটা খুবই বিপজ্জনক, বাবা, আমি বললাম।

বিপজ্জনক? মাথা নাড়ল বাবা। দিনের বেলা মায়ানেকড়ের কোন ক্ষমতা থাকে না, রবিন। আমাদের মতই স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়।

বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমার তাঁবুতে খুঁজে পাইনি। তারপর পায়ের শব্দ শুনে তুমি ভেবে পিছু নিয়েছিলাম।

ঘুম আসছিল না। গড়াগড়ি করতে করতে বার বার মনে হচ্ছিল, চাঁদ উঠেছে। নিশ্চয় এখন শিকারের সন্ধানে বেরিয়েছে মায়ানেকড়ে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। যাকগে, দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি এখন। ঘুমোও।

খাট থেকে উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে তাঁবুর বাইরে পা রাখল বাবা। ফিরে তাকিয়ে বলল, ভালমত একটা ঘুম দাও, সকালে দেখবে ঝরঝরে হয়ে গেছে শরীর। আগামীকাল অনেক কাজ, পরিশ্রম করতে হবে। আমার ধারণা, একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে আমাদের জন্য।

বাবা পর্দাটা ছেড়ে দিতেই ঝাঁকি দিয়ে সরে এসে আবার ঝুলতে লাগল ওটা।

শুয়ে পড়লাম। কম্বলটা টেনে দিলাম গলার কাছে। জোরাল বাতাস টান দিয়ে দিয়ে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে দিতে চাইছে।

দুলন্ত পর্দাটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তাঁবুটা তাঁবু না হয়ে ঘর, আর পর্দাটা পর্দা না হয়ে দরজা হলে ভাল হতো, তালা লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।

ধূর, এরচেয়ে যদি গ্রামে দাদুর বাড়ি যেতাম, কত ভাল হত! চোখ বুজলাম।

গ্রীনহিলসে বাসায় থাকলেও ভাল হতো। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারতাম।

ঘুম ঘুম লাগছে এখন।

স্কুলের এই ছুটিটা শেষ হয়ে গেলেও বাঁচতাম! আমার স্কুল কামাই হবে ভেবে বাধ্য হয়ে মায়ানেকড়ে খোঁজা বাদ দিয়ে বাসায় চলে যেত বাবা।

এ রকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

তবে ঘুমটা গাঢ় হলো না। বিছানায় ছটফট, গড়াগড়ি করতে করতে আবার দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

পালাচ্ছি…অন্ধকারে আমি পালাচ্ছি, একটা হিমশীতল বনের ভিতর দিয়ে।

রাস্তায় এসে পড়া ডালের নীচ দিয়ে ছুটছি।

আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জানোয়ারের মত চারপায়ে ভর দিয়ে ছুটে। চলেছি আমি।

মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতায় পা পড়ে মর্মর ধ্বনি উঠছে। ভেজা মাটির গন্ধ লাগছে নাকে। একটানা দৌড়ে চলেছি আমি। কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপাচ্ছি।

নাহ্! এই দুঃস্বপ্ন দেখাটা বন্ধ করতে হবে স্বপ্নের মধ্যেই বললাম।

জোর করে জেগে উঠলাম। চোখ মেলোম। বাতাসের জন্য হাঁসফাস করছি। বিড়বিড় করলাম, এটা দুঃস্বপ্নই ছিল। ভয়ঙ্কর আরেকটা দুঃস্বপ্ন।

তাঁবুর ভিতর অন্ধকার। এখনও রাত, বুঝতে অসুবিধে হলো না। বিছানায় উঠে বসলাম। হাঁপাচ্ছি। এই সময় চোখ পড়ল পায়ের দিকে। চমকে উঠলাম।

বিছানার পায়ের কাছে দুটো কালো চোখ অন্ধকারেও চকচক করছে।

নিশ্চয় মায়ানেকড়ে!

ছয়

আমাকে মেরো না, প্লিজ! ফিসফিস করে বললাম। জোরে বলার সাহস পাচ্ছি না।

মায়ানেকড়েটা নড়ল না।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। চকচকে চোখজোড়া দিয়ে যেন সম্মোহিত করার চেষ্টা করছে আমাকে।

ধড়াস ধড়াস করছে আমার বুক। চোখ সরাতে পারছি না। যেন আঠা দিয়ে ওই দুটো চোখের সঙ্গে আমার চোখ সেঁটে দেয়া হয়েছে।

চেঁচাও, রবিন, চেঁচাও! চেঁচাও! বাবাকে ডাকো! নিজেকে বলতে লাগলাম।

বাবা! আচমকা চিৎকারটা যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে। বাবা!

ঝটকা দিয়ে চোখ দুটো অন্যদিকে ঘুরে গেল। তাঁবুর পর্দাটা দেখল। একটা থাবা উঁচু করল। আমার ক্যাম্প খাটে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

আশ্চর্য! মানুষের মত দুই পায়ে ছুটে পালিয়েছে, ছায়ামূর্তিটা। পলকের জন্য গায়ের ঢোলা আলখেল্লাও দেখেছি। নেকড়ে নয়, মানুষ! কে লোকটা?

বাবা!

কী হয়েছে, রবিন? বাবার তাঁবু থেকে জবাব শোনা গেল। আমি তাঁবুতেই আছি, তোমার কাছাকাছি। ভয় নেই।

লাফ দিয়ে নামার সময় এত তাড়াহুড়ো করলাম, টান লেগে কাত হয়ে গেল ক্যাম্প খাটটা। তাঁবুর দেয়ালে আছড়ে পড়ে আরেকটু হলেই ভাবুটা ধসিয়ে দিয়েছিল।

কী? তাঁবুতে ঢুকল বাবা। রবিন, কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?

বাবা, একজন লোক এসেছিল! গলা কাঁপছে আমার। হাত তুলে দেখালাম লোকটা কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল।

তোমাকে কিছু করেনি তো?

না, কিছু করেনি।

কিন্তু এতরাতে কে? বিড়বিড় করল বাবা। নিশ্চয় মায়ানেকড়েটাই মানুষের রূপ ধরে তোমার কাছে এসেছিল। ঘুরে দাঁড়াল বাবা। দেখি তো, কোথায় গেল!

কিন্তু… আমি কথা শেষ করার আগেই বেরিয়ে গেল বাবা।

খাটটা তুলে সোজা করলাম। গায়ের কাঁপুনি এখনও থামেনি আমার। খাটে বসলাম। বিড়বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করলাম: মায়ানেকড়েই যদি হয়ে থাকে, তাঁবুতে ঢুকল কেন ওটা?

জবাব পেলাম না। বসে আছি তো আছিই। বাবা আর আসে না। উদ্বেগ বাড়ছে আমার। মনে এলোমেলো ভাবনা। শেষে ডাক দিলাম, বাবা? জবাব এল না। বাবা, তুমি কোথায়?

এবারও জবাব নেই। ভয়টা বাড়ল আমার। বাবার কিছু ঘটেনি তো? সাংঘাতিক কিছু?

মায়ানেকড়েটা তাকে ধরার জন্য ঘাপটি মেরে ছিল না তো? যেই বাগে পেয়েছে, অমনি খপ করে ধরেছে!

গেলে ভাল করতাম! ভেবে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একজনের জায়গায় দুজন থাকলে সুবিধে।

বাইরে বেরোতে গিয়ে মেঝেতে চোখ পড়ল। থমকে দাঁড়ালাম। সাদা চকচকে কী একটা যেন পড়ে রয়েছে তাঁবুর কোণে।

কি ওটা? এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম।

একটা দাঁত। বেশ বড়। নিশ্চয় হিংস্র কোন মাংসাশী জানোয়ারের। মোটা, শক্ত সুতোয় দাঁতটা হারের লকেটের মত করে বাঁধা।

বিচিত্র জিনিসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম।

এল কোথা থেকে এটা?

মায়ানেকড়ে! হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে। আমার খাটে ছুঁড়ে দিয়েছিল। খাটটা উল্টে গিয়েছিল। তখন এটা মাটিতে পড়ে গেছে।

হারের সুতো ধরে উঁচু করলাম। মনে হলো, মায়ানেকড়ের দাঁত নইলে এতবড় দাঁত আর কোন প্রাণীর হবে?

বাবাকে খুঁজে বের করা দরকার। মায়ানেকড়েতে যেহেতু ছুঁড়ে দিয়ে গেছে, নিশ্চয় এটার কোন ক্ষমতা আছে। কী ক্ষমতা, বাবা দেখলে বলতে পারবে।

ছুটে বাইরে বেরোলাম। পড়লাম একেবারে বাবার সামনে। দরজার ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।

তোমাকে না দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বাবা, তাই দেখতে যাচ্ছিলাম।

ওটাকে পেলাম না, রবিন। কুটি করল বাবা। রাতে ওদের নাগাল পাওয়া খুবই কঠিন। কাল দিনের বেলা চেষ্টা করতে হবে।

দেখো, বাবা। দাঁতটা উঁচু করে দেখালাম। তাঁবুতে ঢুকে এটা আমার বিছানায় ছুঁড়ে দিয়েছিল মায়ানেকড়েটা। মায়ানেকড়ের দাঁত না তো?

হাতে নিল বাবা। দেখতে দেখতে বলল, আশ্চর্য! মায়ানেকড়ে এটা তোমাকে দিল কেন?

এটার কোন ক্ষমতা আছে?

মাথা নাড়ল বাবা। জানি না। তবে দিয়ে গেছে যখন, নিশ্চয় কোনও রহস্যময় কারণে বিপদ-আপদ থেকে তোমাকে মুক্ত রাখতে চায় ॥ হারটা আবার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, নাও, গলায় পরে ফেলো।

মাথা গলিয়ে হারটা গলায় নামিয়ে আনলাম। আমার বুকের কাছে চামড়ায় অদ্ভুত দাঁতটার স্পর্শ লাগতে গায়ে কাঁটা দিল। শিউরে উঠলাম। বোধহয়, ঠাণ্ডায়।

তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম তাঁবুতে। খাটে শুয়ে কম্বল টেনে দিলাম মাথার ওপর।

সাত

রবিন! রবিন! জলদি এসো! পরদিন বাবার চিৎকারে ঘুম ভাঙল আমার।

তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামলাম।

জলদি এসো তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল আবার বাবা। নিশ্চয় মায়ানেকড়ে দেখেছে। দৌড়ে বেরোলাম তাঁবু থেকে।

পাগলের মত চারপাশে তাকালাম। মায়ানেকড়ে দেখলাম না।

বাবা কড়াইয়ের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। নীল জিনসের প্যান্ট আর লাল রঙের শার্ট পরেছে। মাথায় দিয়েছে একটা নীল রঙের ক্যাপ।

কী হয়েছে, বাবা? জিজ্ঞেস করলাম। চেঁচাচ্ছ কেন?

ডিম ঠাণ্ডা হয়ে গেল, হেসে জবাব দিল বাবা।

ধুর, হেসো না তো, হতাশ হয়ে বললাম।

তুমি কী ভেবেছিলে মায়ানেকড়ে দেখে ডেকেছি? কড়াই থেকে হাতা দিয়ে দুটো প্লেটে ডিম তুলল বাবা। একটা আমাকে দিল। চিন্তা নেই, আজ একটাকে ধরবই আমি।

চামচে করে খানিকটা ডিম তুলে মুখে পুরলাম। কিন্তু গিলতে পারলাম না। বিস্বাদ লাগছে। কারণটা বুঝলাম না।

বাবা কাপে কফি ঢালছে।

তার অলক্ষে মুখের ডিমটা ফেলে দিলাম। সত্যিই কোন বিপদ হবে না তো?

তা তো হতেই পারে, বাবা জবাব দিল। তাই বলে কী পিছিয়ে থাকব? তবে ভয় নেই, আগেই বলেছি, দিনের বেলা মায়ানেকড়ের কোন ক্ষমতা থাকে না।

হয়তো থাকে, তুমি জানো না।

উঁহু, থাকে না।

এত শিওর হচ্ছ কী করে?

তোমার কী ধারণা, ভালমত খোঁজ-খবর না নিয়েই আমি এসেছি?

বাবার কথায় শঙ্কামুক্ত না হলেও আর কিছু বললাম না।

নাস্তা শেষ করে বাবা বলল, তাঁবু গোটাও।

আমার তাঁবুটা গোটালাম। বাবার তাঁবুটা বাবা গোটাল। বড় বড় দুটো সবুজ ব্যাকপ্যাকে সমস্ত জিনিসপত্র ভরলাম। তারপর পিঠে বেঁধে রওনা হলাম গভীর বনের দিকে।

কোনদিকে যেতে হবে কী করে বুঝছ? বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।

এই যে, ছাপ অনুসরণ করে। নরম কাদামাটিতে গভীরভাবে বসা মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ দেখাল বাবা।

দেখে কেঁপে উঠলাম।

ঘন বনের ভিতর দিয়ে চলেছি। গাছপালা সূর্য ঢেকে দিয়েছে। কাঁধের ব্যাকপ্যাক অন্য কাঁধে সরানোর জন্য থামলাম। চারপাশে তাকিয়ে ভাবলাম, এত অন্ধকার কেন বনটা? এত বিষণ্ণ!

বাবা! দাঁড়াও! ব্যাকপ্যাকটা কাঁধ বদল করলাম।

কিন্তু বাবা থামল না। জোর কদমে এগিয়ে চলেছে। লাফাতে লাফাতে

পায়ে যেন স্প্রিং লাগানো। মায়ানেকড়ে ধরার জন্য অস্থির। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।

দৌড়ে এলাম বাবার কাছে।

ওই যে! ফিসফিস করে বাবা বলল। আমি ওটাকে দেখতে পাচ্ছি! উত্তেজনায় গলা কাঁপছে তার।

আঁকাবাঁকা, মোচড় খাওয়া পথটা ধরে দৌড়াতে শুরু করল বাবা।

আমিও ছুটতে লাগলাম তার পিছন পিছন। বুকের ভিতর ধড়াস। ধড়াস বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা।

আরও জোরে দৌড়াতে লাগল বাবা। রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটল।

সামনে একঝলক বাদামী রঙ দেখলাম। আবার দাঁড়িয়ে গেলাম।

ওই যে! ধূর! আমি ভেবেছিলাম মায়ানেকড়ে! প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে বাবা।

আমিও দেখেছি।

ভীত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট একটা বাদামী রঙের শিয়াল।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল বাবা। নাহ্, এখন যে সকাল, দিন, মায়ানেকড়েরা মানুষের রূপ নিয়ে আছে, ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি আমার। যাক, একবার করেছি, আর ভুল করব না।

ফিরে এসে আবার রাস্তায় উঠল বাবা। আবার এগিয়ে চলার পালা।

বনের ভিতরে পাখির কোলাহল। এত পাখি, আর এভাবে কখনও ডাকতে শুনিনি। বিচিত্র চিৎকারে কান ঝালাপালা করছে।

আরেকটু এগিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে চমকে গেলাম। কালো রঙের পাখিতে বোঝাই গাছের ডালগুলো। শত শত। পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসেছে। পাখিগুলোর চোখ টকটকে লাল। লম্বা, চোখা ঠোঁট খুলছে আর বন্ধ করছে কট কট শব্দে।

এই পাখি আর আগে কখনও দেখিনি।

পাখিগুলোর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে হাজার হাজার লাল ভূতুড়ে চোখ যেন কুটিল দৃষ্টিতে আমাদের দেখছে। বার বার ঠোঁট খুলে, বন্ধ করে আমাদেরকে যেন কোনও ভয়ঙ্করের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ওরা কী রেগে গেছে? পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।

না, ওগুলোর খিদে পেয়েছে।

তাকিয়ে আছি পাখিগুলোর দিকে। মানুষখেকো?

বাবা জবাব দিল না।

ওগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হতে থাকল, যে-কোন মুহূর্তে ঝাক বেঁধে আমাদের ঠোকরাতে আসবে। এত পাখি একসঙ্গে হামলা চালালে কিছুই করতে পারব না। এ ভয় পেলেও পাখিগুলোর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। যেন আঠা দিয়ে ওগুলোর গায়ে আমার দৃষ্টিটা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাবা, বলো না, ওরা মানুষখেকো নাকি? জবাব না পেয়ে জোর করে চোখ সরালাম পাখিগুলোর দিক থেকে।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।

শূন্য রাস্তা। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না।

বাবা, কোথায় তুমি? চিৎকার করে ডাকলাম।

জবাব নেই। আবার চিৎকার করলাম। সাড়া এল না।

গাছপালার ভিতর দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে। কিন্তু কোথাও দেখলাম না তাকে।

ইস, কেন যে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম? গুঙিয়ে উঠলাম।

বনের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মরিয়া দৃষ্টি।

আমি এখন কোথায়? নিজেকে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললাম। গাছগুলো তো সব প্রায় একই রকম লাগছে! এই বন থেকে আমি আর কোনদিন বেরোতে পারব না! আমাকেও কেউ খুঁজে পাবে না এখানে! বাবা! বাবা! কোথায় তুমি?

আট

চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ডাকতে বুনোপথ দিয়ে ছুটলাম।

আমার তীক্ষ্ণ ডাক প্রতিধ্বনি তুলল বনের গাছে গাছে। কিন্তু কোন জবাব পেলাম না। বাবার কোন চিহ্নই দেখলাম না।

জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার গলা শুকিয়ে। কাঠ। চিৎকার করে করে কণ্ঠনালী খসখসে হয়ে গেছে।

ধীরে হাঁটছি এখন। নীরবে এগিয়ে চললাম বনের ভিতর দিয়ে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে চলেছি, গাছপালার মধ্যে বাবাকে খুঁজছে আমার চোখ। তার লাল শার্ট, সবুজ ব্যাকপ্যাক দেখতে চাইছে।

নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রতিটি শব্দ–সেটা যত সামান্যই হোক–তার সরসরানি, মটু করে শুকনো কুটো ভাঙা, বুনো প্রাণী কিংবা পাখির ডাক চমকে দিচ্ছে আমাকে, লাফিয়ে উঠছে হৃৎপিণ্ড, ভয়ে।

সামনে ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে রাস্তাটা। দুপাশে গাছপালা কমে আসছে। রোদের আলো বাড়ছে।

তারপর, হঠাৎ করেই বেরিয়ে এলাম একটা খোলা জায়গায়।

রোদ ঝলমল করছে গোলাকার জায়গাটুকুতে। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম।

খোলা জায়গার একপ্রান্তে একটা ছোট কাঠের তৈরি কেবিন। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উঠছে।

পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। ঠেলা দিতেই ফাঁক হয়ে গেল পাল্লাটা। ভিতরে উঁকি দিলাম। ঘরে একটা চারপায়া, পুরানো একটা টেবিল, আর নড়বড়ে দুটো চেয়ার। একপাশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। একধারে বেড়া ঘেষে রাখা কতগুলো কাঠের বাক্স।

ঘরে আর কী কী আছে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ বাজখাই কণ্ঠে পিছন থেকে হাক শোনা গেল, কী চাই?

এমন এক লাফ মারল কলজেটা, মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাব।

ফিরে তাকিয়ে দেখি, একজন বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে। চুলে কতকাল যে তেল-সাবান আর চিরুনি পড়েনি কে জানে। মস্ত গোঁফ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাংসহীন তোবড়ানো চোয়ালের ফাঁকে বসে গেছে গালের কুঁচকানো চামড়া। লম্বা নাকটা ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা হয়ে নেমে এসেছে মস্ত গোঁফের ওপর। চোখের মণি দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল আর চকচকে। কাঁধে ঝুলছে একটা লম্বা মোটা কাপড়ের ঝোলা। নীচের দিকটা ঝুলে রয়েছে। কিছু আছে ভিতরে।

কী চাও, খোকা? আবার জিজ্ঞেস করল বুড়ো।

আমি…আমি পথ হারিয়েছি, কোনমতে বললাম।

এসো, ভিতরে এসো। ধাক্কা দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে ঘরে ঢুকে গেল বুড়ো।

আমিও ঢুকলাম। দরজার খিল লাগিয়ে দিল বুড়ো। এ-সব জায়গায় দরজা খোলা রাখা ঠিক না। কখন আবার কী এসে হাজির হবে, কে জানে!

এসো। বসো। হাড়সর্বস্ব আঙুল দিয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরে চেয়ারের কাছে ঠেলে নিয়ে এল লোকটা। চাপ দিয়ে বসিয়ে দিল। তার মত একজন বুড়ো মানুষের গায়ের জোর অবাক করল আমাকে।

এ রকম ভয়ানক জায়গায় এলে কেন? বুড়োর বরফশীতল চাহনি। দেখে ঠাণ্ডা শিহরণ নেমে গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে।

আমি যাই! উঠে দাঁড়াতে গেলাম।

বসো! কড়া আদেশ যেন শপাং করে উঠল চাবুকের মত। এই বন বড় ভয়ানক জায়গা। বুঝতে পারছি তুমি শহুরে ছেলে। এখনও যে ভালুকের পেটে যাওনি সেটাই আশ্চর্য! খানিকটা নরম হলো বুড়োর স্বর। বনের ভিতর একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলে কেন?

একা ছিলাম না, বাবার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, জবাব দিলাম। পিছনে চলতে চলতে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি বাবা নেই।

চিন্তার কথা! গম্ভীর হয়ে গেল লোকটা।

ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আপনি বলতে চান, আমার বাবাকে মায়ানেকড়েতে ধরে নিয়ে গেছে?

যতদূর জানি, দিনের বেলা মায়ানেকড়েরা বেরোয় না। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লোকটা বলল, কী হয়েছিল, সব খুলে বলো তো আমাকে।

কেন আমরা ব্র্যাটভিয়ায় এসেছি, বললাম তাকে। শুনে আরও গম্ভীর হয়ে গেল বুড়ো। বলল, মায়ানেকড়ে কিন্তু এখানে সত্যিই আছে।

আছে?

আছে। লোকের কথা তো আর মিথ্যে না। তুমি বসো। চা খাও। ততক্ষণে যদি তোমার বাবা তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে না আসেন, আমি তোমার সঙ্গে তাকে খুঁজতে বেরোব।

প্রথমে ঝোলা থেকে একটা বড় সাপ বের করে দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বাক্সে ঢোকাল বুড়ো। তারপর স্টোভ জ্বেলে একটা পুরানো কেটলিতে চায়ের পানি চাপাল। ফিরে এসে আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

আপনি নিশ্চয় সাপ ধরেন?

কী করে বুঝলে?

এই যে, ঝোলা থেকে সাপ বের করে রাখলেন, দেখলাম তো। সবগুলো বাক্সেই কি সাপ আছে?

না। বাক্সগুলো সব ভরে গেলে প্রথমে সাপের বিষ বের করে নেব। তারপর বিষসহ সে-সব সাপ শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়ে আসব। এটাই আমার পেশা।

পানি গরম হলে দুটো তোবড়ানো টিনের কাপে চা বানিয়ে এনে একটা আমাকে দিল বুড়ো, আরেকটা নিজে নিল। কাপে চুমুক দিয়ে বলল, কয়েক বছর আগের কথা। আমি আসার আগে এই কেবিনে একজন সন্ন্যাসী থাকতেন। একদিন শহর থেকে এল সেই অহঙ্কারী লোকটা। সব ছারখার করে দিল।

অহঙ্কারী লোক?

হ্যাঁ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বুড়ো। বনে শিকার করতে এসে সন্ন্যাসীর কেবিনে ঢুকেছিল। তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। সন্ন্যাসী ওকে কি করেছিলেন, কেউ জানে না। তবে কেবিন থেকে বেরিয়ে টলতে টলতে গভীর বনের দিকে চলে যায় লোকটা।

সন্ন্যাসী?

হ্যাঁ, সন্ন্যাসী। কেন?

না, এমনি। তাঁবুতে ঢুকে যে লোকটা ওকে মায়ানেকড়ের দাঁতটা দিয়েছেন, তিনিই সেই সন্ন্যাসী কি না ভাবছে রবিন। জিজ্ঞেস করল, সন্ন্যাসী এখন কোথায়?

তা তো বলতে পারব না। অহঙ্কারী লোকটা মায়ানেকড়ে হয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর এই কেবিন ছেড়ে চলে গেছেন। তবে গাঁয়ের লোকে মাঝে মাঝে দেখে ওঁকে। বনে ঢোকেন। কোথা থেকে আসেন, কোথায় যান, কেউ জানে না।

হুঁ! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল রবিন। তারপর বলল, হ্যাঁ, বলুন, অহঙ্কারী লোকটার কী হলো?

লোকটা যেদিন বনে ঢুকল, তার দুদিন পর ছিল পূর্ণিমা। গোল হয়ে এসেছিল চাঁদ। সারারাত নেকড়ের অস্থির ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল বনের মধ্যে। বনের বাইরে গ্রাম থেকে অনেকেই শুনেছে সেই ডাক।

পরদিন সূর্য ওঠার পর থেমে গেল ডাকাডাকি। গ্রামের কয়েকজন দুঃসাহসী, লোক বনে ঢুকল, রাতে কী ঘটেছিল জানার জন্যে। বনের মধ্যে অনেক প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখল ওরা। ভয়ঙ্কর আক্রোশে যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে দেহগুলো। কোনটা খাওয়া, কোনটা আধখাওয়া।

আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল ওদের, নেকড়ের পায়ের ছাপ। ব্যাপারটা খুব রহস্যময় লাগল ওদের কাছে।

পরের রাতেও শোনা গেল নেকড়ের ডাক। তারপর দিন বনে ঢুকে সেই একই রকম বীভৎস দৃশ্য দেখল ওরা। ঠিক করল, রাতে বনের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দেখবে, এ-সব কার কাজ।

তৃতীয় পূর্ণিমা। সন্ধ্যাবেলায়ই গাছে উঠে লুকিয়ে রইল ওরা। রাত বাড়ল। চাঁদের আলো উজ্জ্বল হলে ওরা দেখল, একটা বড় গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে নামল একজন মানুষ। ওকে চিনতে পারল ওরা। সেই অহঙ্কারী লোকটা। সন্ন্যাসীর কেবিনে ঢোকার আগে ওদের গ্রাম হয়েই এসেছিল। যাই হোক, ওদের চোখের সামনে নেকড়ে হয়ে লোকটা। চাঁদের দিকে মুখ তুলে হাঁক ছাড়ল।

একটা খরগোশ পালাচ্ছিল সামনে দিয়ে। চোখের পলকে ওটাকে ধরে আস্তই চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।

আর বনে থাকতে সাহস হলো না গ্রামবাসীদের। টপাটপ গাছ থেকে নেমে দৌড়ে পালাল। গাঁয়ে ঢোকার আগে আর থামল না কেউ।

ওদের ভাগ্য ভাল ছিল, তাই পালাতে পেরেছিল।

তারপর, আরও কিছু লোক ওই আজব প্রাণীটাকে ধরতে বনে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা আর ফেরেনি। জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ল বুড়ো।

তারপর থেকে রাতের বেলা এই বনে কেউ ঢোকে না।

বাবাকে কিছু করবে না তো? শঙ্কিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রবিন।

না মনে হয়। এখন তো দিন। রোদ ওঠার পর আর কোন ক্ষতি করে না মায়ানেকড়েরা! দিনে কোন ক্ষমতা থাকে না। টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার একটা হাত ধরল বুড়ো। হেসে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাত দেখে ভাগ্য বলে দেব?

জবাব না দিয়ে হাতের তালু মেলে দিলাম।

এই যে তোমার ভাগ্যরেখা। লম্বা একটা হাড়সর্বস্ব আঙুলের ডগা আলতো করে ঠেলে দিল বুড়ো আমার হাতের তালুতে

ভাল করে দেখার জন্য সামনে ঝুঁকলাম। শার্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঝুলতে লাগল আমার গলায় পরা দাঁতটা।

দেখে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো। মায়ানেকড়ের চিহ্ন! কোথায়। পেলে? কোথায় পেলে ওটা? বেরোও! বেরোও আমার ঘর থেকে!

নয়

চিৎকার করতে করতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল বুড়ো।

ফায়ারপ্লেসের পাশ থেকে একটা কয়লা খোঁচানোর সিক তুলে নিল।

চারপায়া থেকে লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটলাম।

ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গাটা ধরে দৌড় দিলাম। একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে ধুড়স করে পড়ে গেলাম।

পিছনে আসছে বুড়ো। হাতে সিক। মায়ানেকড়ের চিহ্ন! ভাগো! ভাগো এখান থেকে! একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছে ও।

হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লেংচাতে লেংচাতে একদৌড়ে বনে ঢুকে পড়লাম। রাস্তাটা কোনদিকে আছে জানি না। দেখার সময়ও নেই।

গাছপালার ভিতর দিয়ে অন্ধের মত ছুটলাম। গাছের শিকড়ে পা বেধে যাচ্ছে। হাতে-মুখে লাগছে গাছের ডাল। সড়াৎ সড়াৎ বাড়ি খাচ্ছি। কিন্তু কোন কিছুর পরোয়া করলাম না।

ছুটতেই থাকলাম যতক্ষণ না বুড়োর চিৎকার ক্ষীণ হয়ে এল।

দৌড়াতে দৌড়াতে পা ব্যথা করছে, তবু থামলাম না। আরও কিছুদূর এগিয়ে তারপর থামলাম।

এতক্ষণে চিন্তা করার সুযোগ পেলাম। বুঝলাম না, দাঁতটাকে এত ভয় পেল কেন বুড়ো।

পিছনে কুকুরের ডাক শোনা গেল। উত্তেজিতস্বরে ডাকছে কুকুরগুলো।

মায়ানেকড়ে দেখল! চমকে গেলাম।

পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।

না, মায়ানেকড়ে দেখেনি। তবে তাতে আমার উৎসাহিত হবার কিছু নেই। ভয়ঙ্কর বুনো কুকুর ওগুলো। দশ-বারোটা হবে। কুৎসিত চেহারা। কাদামটি লেগে থাকা নোংরা লোম। হলদে চোখের দৃষ্টি দেখলে অতিবড় দুঃসাহসীরও প্রাণ কেঁপে যাবে। ঝুলে পড়া নীচের চোয়াল থেকে লালা গড়াচ্ছে।

চাপা গরগর করে হাড্ডিসার মাথাগুলো নামাল ওরা। আমাকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করল। কট কটু করে যেন বাতাসে কামড় দিচ্ছে।

যে-কোন মুহূর্তে এই কামড়টা আমার পায়ে পড়বে।

একটা গাছের দিকে দৌড় দিলাম। পাগলের মত গাছটাকে জড়িয়ে ধরে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম।

প্রচণ্ড জোরে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল কুকুরগুলো। লাফিয়ে উঠল। থাবা মারতে লাগল গাছের গায়ে।

একটা কুকুর লাফিয়ে উঠে আমার জুতো কামড়ে ধরল। মাথা ঝাঁকি দিয়ে আমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল।

চেঁচিয়ে উঠে হ্যাঁচকা টান মারলাম। পা থেকে জুতো খুলে গেল। জুতোটা মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল কুকুরটা।

আরেকটা কুকুর আমার মোজা কামড়ে ধরল।

লাথি মেরে ফেলে দিলাম ওটাকে। হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে, তোলার চেষ্টা করলাম।

হঠাৎ পিছলে গেল হাত। চেঁচিয়ে উঠলাম। চিত হয়ে পড়লাম। মাটিতে। একেবারে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোর মাঝখানে।

দশ

আমাকে ওভাবে পড়তে দেখে থমকে গেল কুকুরগুলো।

জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখছে আমাকে। যেন আমার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে।

যখন বুঝল, কিছু করার সাধ্য নেই আমার, ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু করল আবার।

আমি জানি, উঠে বসতে গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।

চাপা গরগর করে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছে ওগুলো। মায়ানেকড়ের দাঁতটার কথা মনে পড়ল আমার।

সাপুড়ে বুড়ো দাঁতটা দেখে ভয় পেয়েছিল। কুকুরগুলোও পেতে পারে।

আস্তে করে একটা হাত তুলে আনলাম গলার কাছে।

আরও কাছে এসেছে কুকুরগুলো। ওগুলোর দুর্গন্ধে ভরা গরম নিঃশ্বাস লাগছে আমার মুখে।

শার্টের ভিতরে হাত ঢোকালাম। কাঁপা হাতে গলায় পরা সুতোটা ধরলাম। আরও কাছে চলে এসেছে কুকুরগুলো। সুতোয় বাঁধা দাঁতটা খুঁজে বেড়াল আমার আঙুল। কোথায় ওটা? কোথায়? গরগরানি বেড়েছে কুকুরগুলোর। যে কোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মরিয়া হয়ে দাঁতটা খুঁজতে লাগলাম। সুতোটাকে টানছি। টানছি। কিন্তু দাঁতটা পেলাম না।

এগারো

মাথা উঁচু করলাম। জোরে এক টান দিলাম সুতো ধরে।

অবশেষে পেলাম ওটা। আমার গায়ের নীচে চাপা পড়ে ছিল। দুই আঙুলে টিপে ধরলাম। কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তে এল। দাঁতটা উঁচু করে ধরলাম।

মাঝপথে যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল কুকুরগুলো। পাথরের মূর্তির মত স্থির।

চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে দাঁতটার দিকে।

তারপর, হঠাৎ নড়ে উঠল। ভয়ার্ত কুঁই কুঁই শব্দ করে লেজ গুটিয়ে পিছিয়ে গেল। সরে গেল আমার কাছ থেকে। দৌড়ে পালাল। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। বড় বাঁচা বেঁচেছি! সত্যি চলে গেছে কুকুরগুলো? সত্যি? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।

প্রচণ্ড ক্ষমতা এই দাঁতটার! হাতের তালুতে চেপে ধরলাম।

আমার জীবন বাঁচিয়েছে! এখন থেকে যত্ন করে রাখতে হবে এটাকে!

আবার শার্টের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। খুলে যাওয়া জুতোটা তুলে নিয়ে পরলাম আবার। তারপর বাবাকে খুঁজতে চললাম।

বনের ভিতর ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একটা পায়েচলা পথের ওপর এসে পড়লাম।

বনটা এখন নীরব। কালো রঙের ওই পাখিগুলোকে আর দেখতে পাচ্ছি না। কট কট শব্দও নেই।

একটা কাঠবিড়ালী কিংবা খরগোশও চোখে পড়ছে না। কোনও প্রাণী দেখছি না। কোনও শব্দই নেই।

তবে এখন আর ভয় পাচ্ছি না আমি।

শার্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দাঁতটা ছুঁয়ে দেখলাম। অদ্ভুত এক নিরাপত্তাবোধ এনে দিয়েছে আমাকে ওটা।

কতক্ষণ হাঁটলাম বলতে পারব না।

বনের নতুন কোনও অংশে চলে এসেছি, না আগের বনটাতেই রয়েছি, বুঝতে পারলাম না।

বাবা! অ্যাই বাবা! গাছপালার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে চিৎকার করে ডাকলাম। আমার ডাক ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

কিন্তু বাবা জবাব দিল না।

অস্বস্তিতে ভুগছি। নাড়ির গতি বাড়ছে। আবার চিৎকার করে ডাকলাম, বাবা, শুনতে পাচ্ছ? জবাব নেই।

বাবা! কোথায় তুমি?

রবিন, তুমি কোথায়? জবাব এল এবার। কথাগুলো যেন শান্তির পরশ বোলাল আমার কানে।

বাবা! এই যে, এখানে! চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমি কোথায়?

ওপরে তাকাও, রবিন। এখানকার সবচেয়ে উঁচু গাছটা খুঁজে বের করো।

ওপরে তাকিয়ে গাছের মাথা দেখলাম। করেছি, বাবা! আমি আসছি!

জলদি করো! বাবার কণ্ঠ উত্তেজনায় ভরা। আমি ওটাকে পেয়েছি, রবিন! মায়ানেকড়েটাকে ধরেছি!

দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে এগোচ্ছি। আসলে আমি পিছনে ফিরে পালাতে পারলে খুশি হতাম। মায়ানেকড়েটাকে আর দেখতে চাই না আমি। ইতিমধ্যেই দুবার দেখেছি। রাতের বেলা। গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে যখন আমার কাঁধ কামড়ে দিয়েছিল, তখন একবার, আর তাঁবুর ভিতরে খাটের পায়ের কাছে দ্বিতীয়বার, যখন আমাকে দাঁতটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। তৃতীবার আর ওটার দিকে তাকাতে চাই না।

উঁচু একটা গাছের ফাঁকে বাবার লাল শার্ট দেখতে পেলাম। আমার কপাল থেকে ঘাম বেয়ে মুখে পড়ছে। ছুটে বেরোলাম একটা খোলা জায়গায়। বিস্ময়ে চমকে উঠলাম। বাবার মায়ানেকড়ে দেখে চেঁচিয়ে বললাম, বাবা, তোমার কী মাথা খারাপ হলো?

বারো

বাবা, তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ, তাই না? আবার বললাম।

গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। গর্বিত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে তার শিকারের দিকে। অতি সাধারণ চেহারার, বিষণ্ণ, টাকমাথা এক মধ্যবয়েসী মানুষকে শিকল দিয়ে বেঁধেছে। হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়ে কড়া লাগানো। তাতেও মোটা শিকল।

সামান্য কুঁজো হয়ে আছে মানুষটা। পরনে সাদামাঠা প্যান্ট ও শার্ট। চোখে চশমা।

মায়ানেকড়ে কোথায়, বাবা? জিজ্ঞেস করলাম। হাসিমুখে হাত তুলে মানুষটাকে দেখাল বাবা।

মাথা নাড়লাম। একে তুমি মায়ানেকড়ে বলছ? এ তো একটা মাছি মারতে পারবে না।

আমার কথায় সাহস পেয়ে যেন বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হাঁচি দিল।

সর্দি লেগেছে, দেখো! বাবাকে বললাম। মনে হচ্ছে লোকটা অসুস্থ। অকারণে বেঁধেছ ওকে। খুলে দাও, বাবা।

রুমাল আছে? নাক টানতে টানতে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

এই যে! পকেট থেকে রুমাল বের করে দিলাম।

রবিন, দিয়ো না! চেঁচিয়ে উঠল বাবা। থাবা দিয়ে আমার হাত সরিয়ে দিল। ও চালাকি করছে!

বনে এসে মায়ানেকড়ের খোঁজ করতে করতে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ভাবলাম।

আবার হাঁচি দিল লোকটা।

বাবা, ও মায়ানেকড়ে, শিওর হলে কী করে? ছোটখাট মানুষটার অসহায়ত্ব দেখে মায়াই লাগছে আমার।

মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়েছি। ওর ঘরের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে ছাপ। তারপর আর কোন চিহ্ন নেই। হঠাৎ করেই পায়ের ছাপ উধাও। ভুরু নাচাল বাবা। ও মায়ানেকড়ে নয় তো কী?

কিন্তু গতরাতে আমি মায়ানেকড়েটাকে দেখেছি। এর সঙ্গে কোন মিলই নেই।

মায়ানেকড়ে হয়ে যাবার পর মানুষের সঙ্গে আর কোন মিল থাকে না ওদের।

হ্যাঁ, আপনার ছেলে ঠিকই বলছে-আপনি যা ভাবছেন তা আমি নই, মিনতি করে বলল লোটা। আমাকে ছেড়ে দিন।

চুপ! ধমকে উঠল বাবা। তুমি বললেই আমি ছাড়ি! আমাকে গাধা পেয়েছ?

মস্ত ভুল করছেন আপনি! গুঙিয়ে উঠল লোকটা। আমি মায়ানেকড়ে নই। আমার কথা বিশ্বাস করুন।

আমার মনে হয় ও ঠিকই বলছে, লোকটার সঙ্গে সুর মেলালাম।

ওর কথায় কান দিয়ো না, রবিন।

বাবার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। ভুল সাধারণত করে না বাবা। কিন্তু এবার নিশ্চয় করেছে। এই নিরীহ, অতি সাধারণ লোকটা মায়ানেকড়ে, রাতের বেলা রোমশ, বিশাল ভয়ঙ্কর প্রাণীতে পরিণত হয়, এ কথা কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারলাম না।

বিকেলের রোদ গায়ে পড়েছে লোকটার। চকচকে টাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

আমি মায়ানেকড়ে নই! আমার দিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে উঠল লোকটা। বিশ্বাস করো। আমি মাছ-মাংসও খাই না, শুধু নিরামিষ।

যখন মানুষ থাকো তখন খাও না, কিন্তু মায়ানেকডে হয়ে গেলে কাঁচা মাংসই গপ গপ করে খাও! এখন চুপ থাকো! বেশি কথা বোলো না! হাত মুঠো করে বাতাসে নাচাল বাবা। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমিই প্রথম একটা জ্যান্ত মায়ানেকড়ে ধরেছি।

চোখ চকচক করছে বাবার। কখনও তাকে এত খুশি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

ওকে আমরা বাড়ি নিয়ে যাব, বাবা বলল, টিভিতে হাজির করব। সারা দুনিয়াকে দেখাব। আমার কাঁধে হাত রাখল বাবা। আমরা অসাধ্য সাধন করেছি, রবিন। এখানকার কাজ শেষ। চলোএখন, যাই।

শিস দিতে দিতে মাটিতে নামিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল বাবা।

তুমি আগে আগে হাঁটো, বাবা বলল আমাকে। আমি পিছনে থাকব। আর এই জানোয়ারটা মাঝে হাঁটবে। পায়ে শিকল বাঁধা আছে। দৌড়ে পালাতে পারবে না। লোকটার পিঠে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে বাবা বলল, হটো।

বাবার গায়ে যা জোর, এক হাতে উঁচু করে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে যেতে পারে লোকটাকে। প্রচণ্ড ধাক্কায় উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল লোকটা। পায়ে শিকল থাকায় ফুটখানেকের বেশি ফাঁক করতে পারছে না পা। চিৎকার করে বলল, আপনি ভুল করেছেন, মস্ত ভুল! আমি আপনাকে বলেছি, আমি মায়ানেকড়ে নই, আমি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। আমার নাম হিউগ রেন। আমি ফার শিকারি। ফাঁদ পেতে জন্তু-জানোয়ার ধরি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বটেই তো, ব্যঙ্গ করে বাবা বলল। তুমি ফার শিকারি হলে আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

আপনি আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করতে পারেন না, তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল লোকটা। আমি পুলিশকে বললে আপনি ভীষণ বিপদে পড়বেন।

পুলিশকে জানালে আমি বিপদে পড়ব না, তুমি পড়বে।

কিন্তু আমার মনে হলো, ভুলটা বাবাই করছে। পুলিশকে জানালে বাবাই বিপদে পড়বে। নিরপরাধ একজন মানুষকে ধরে শিকল দিয়ে বাধার অপরাধে জেলেও যেতে হতে পারে তাকে।

তেরো

কয়েক দিন পর, জাহাজে করে বাড়ি ফিরে চললাম আমরা। জাহাজটা মালবাহী, কার্গো শিপ। যাত্রী বলতে আমি, বাবা, আর হিউগ রেন।

ব্র্যাটভিয়ার ভয়াল বন থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাড়ি ফিরছি। আমার খুশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পারছি না। কেন, ঠিক বুঝলাম না।

হাতকড়া পরা রেনকে দেখে সন্দেহ দেখা দিল ক্যাপ্টেনের চোখে। খালাসিরা ভিড় করে এল।

বাবা ওদের বোঝাল, এই লোকটা ভয়ানক খুনী।

ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে পুলিশে দিচ্ছেন না কেন?

লোকটা মায়ানেকড়ে বললে, ভয়ে হয়তো ক্যাপ্টেন বাবাকে জাহাজেই উঠতে দেবেন না। পুলিশের কাছেই তো নিয়ে যাচ্ছি, বলে বাবা তার আইডেনটিটি কার্ড বের করে দেখাল। খবরের কাগজের লোক জেনে আর কিছু বললেন না ক্যাপ্টেন।

জাহাজের খোলে কার্গো হোল্ডে অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে রাখা হলো রেনকে।

বেচারা! অন্ধকার, ভাপসা গন্ধে ভরা কার্গো হোল্ডে থাকতে হবে ওকে পুরো সাতটা দিন আর রাত।

একটা কেবিন দেয়া হয়েছে আমাকে আর বাবাকে। নরম বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে রেনের কথা ভাবছি।

কার্গো হোল্ডে ওকে নামানোর সময় ওর আতঙ্কিত, জড়সড় হয়ে যাওয়া চেহারাটা চোখে ভাসছে।

সর্দি আরও বেড়েছে বেচারার। চোখ লাল। নাক দিয়ে অনবরত পানি গড়াচ্ছে। বড়ই করুণ দৃশ্য।

লোকটার জন্য মায়া হচ্ছে আমার।

বাবার দিকে তাকালাম। ডেস্কে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। তার এক সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে। মায়ানেকড়েটাকে নিয়ে বড় বড় পরিকল্পনা করছে দুজনে।

খোলা সাগরে পড়তে প্রচণ্ড দুলতে লাগল জাহাজ। মাথা ঘুরছে আমার। সি-সিক হয়ে পড়ছি। গা গোলাচ্ছে।

লম্বা দম নিতে লাগলাম। ঢোক গিলোম। বমি ঠেকানোর চেষ্টা করলাম।

সাগর উত্তাল হয়ে উঠবে, বড় বড় ঢেউ হবে, সারাটা পথই এমন ৫ থাকবে, সাবধান করেছিলেন ক্যাপ্টেন। ঝড়ও আসতে পারে।

এখন যা অবস্থা, সারাপথ এমন হলে বেঁচে আর বাড়ি ফিরতে পারব বলে মনে হয় না!

খবরের কাগজকে তো অবশ্যই জানাতে হবে, তবে পরে, ফোনে বলছে বাবা। টিভিতে লাইভ শো? অস্থির ভঙ্গিতে চুলে আঙুল চালাল বাবা। তা তো হবেই। মায়ানেকড়েটা কীভাবে মানুষ থেকে মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়, দেখাব না? সেটাই তো আসল। তবে আগামী পূর্ণিমাটা যাক। আমরা আগে দেখি। দেখে শিওর হই। তারপর।

উত্তেজনা সইতে না পেরেই বোধহয়, উঠে দাঁড়াল বাবা। ছোট্ট ঘরটায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি শুরু করল। কানে ফোনটা লাগানোই আছে। ক্রমে জোরাল হচ্ছে তার কণ্ঠস্বর।

একপাশে অনেকখানি কাত হয়ে গেল জাহাজ। যখন মনে হলো, উল্টে যাবে, আবার সোজা হলো। তারপর অন্যপাশে কাত হলো।

জাহাজের সঙ্গে যেন দুলছে আমার পাকস্থলীটা। মাথা ঘুরছে। বমি পাচ্ছে।

একটু ধরুন তো, আমার দিকে তাকিয়ে আছে বাবা। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বলল, রবিন, কী হয়েছে? অসুস্থ লাগছে? তোমার চেহারা এমন হয়েছে কেন?

আমার ভাল লাগছে না, বাবা, গুঙিয়ে উঠলাম। এই দুলুনি সহ্য করতে পারছি না।

সি-সিকনেস, বাবা বলল। জাহাজে ওঠার অভ্যাস না থাকলে প্রথম প্রথম সবাই এ রকম অসুস্থ হয়ে পড়ে। দু-একদিন গেলেই ঠিক হয়ে যায়। ডেকে চলে যাও, খোলা বাতাসে। ভাল লাগবে। আমি ফোনটা শেষ করে আসছি।

টলতে টলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। ডেকটা ওপরে।

প্রচণ্ড দোল খাচ্ছে জাহাজ। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় গোঙানি ঠেকাতে পারলাম না। ডেকে বেরিয়ে আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলাম।

বাইরে খুব ঠাণ্ডা। সেইসঙ্গে বাতাস। তবে আমার গরম হয়ে ওঠা গায়ে লাগতে অনেকটা আরাম পেলাম।

লম্বা দম নিলাম। বাতাসে নোনা গন্ধ। পেটের ভিতরের পাক দেয়া কমে এল। মাথা ঘোরাও কমছে। রেলিঙে হেলান দিয়ে অন্ধকার সাগরের দিকে তাকালাম।

রাতের আকাশের সঙ্গে সাগরের পানি যে ঠিক কোনখানটায় মিলেছে, দেখা যায় না।

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে নিশ্চয়। তবে মেঘে ঢাকা। তারাও দেখা যাচ্ছে না।

বাবার অপেক্ষা করছি। জোরাল বাতাস এসে গায়ে আছড়ে পড়ল। প্রচণ্ড দোল খেল জাহাজ।

রেলিং চেপে ধরলাম। বাতাস যে এভাবে ধাক্কা দিতে পারে, জানতাম না।

ঝড় আসছে! দূর থেকে ভেসে এল একজন খালাসির চিৎকার।

আরেক দফা জোরাল বাতাস এসে আছড়ে পড়ল জাহাজের গায়ে। সেইসঙ্গে নিয়ে এল ঢেউ। পাহাড়ের সমান।

পাগলের মত দুলছে জাহাজটা।

ডেকের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউভাঙা পানি। আমার জুতো ভিজিয়ে দিল।

দুহাতে রেলিং চেপে ধরে বাঁচাও! বাঁচাও! বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। বাতাসের গর্জনে চাপা পড়ল আমার চিৎকার।

আরেকটা কালো পানির ঢেউ ভাঙল জাহাজের গায়ে। প্রাণপণে রেলিং আঁকড়ে রেখেছি। চেঁচিয়ে চলেছি একনাগাড়ে। আরও একটা ঢেউ ভাঙল ঠিক আমার সামনে।

পানি বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। নাকেমুখে ঢুকে গিয়ে খকখক করে কেশে উঠলাম।

পানি ভীষণ ঠাণ্ডা। আর কেমন ভারি ভারি। মনে হলো অন্ধকারের তলায় চাপা পড়েছি। রেলিংটা উধাও। হাত ছুটে গেছে। ডেকটাও অদৃশ্য হলো।

ঢেউ আমাকে টেনে নিয়ে চলল খোলা সাগরের দিকে। যেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে কালো পানি, তাণ্ডবনৃত্য জুড়েছে।

চোদ্দ

চেঁচাতে চাইলাম। স্বর বেরোচ্ছে না আর।

সাঁতার কাটার চেষ্টা করলাম। হাত-পা অসাড়।

ঢেউ আমাকে উঁচু করে তুলে রেলিঙের ওপর দিয়ে সাগরে টেনে নিতে চাইছে।

হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। অন্ধকার ঢেউয়ের হাতে সঁপে দিলাম নিজেকে।

কীসে যেন টেনে ধরল আমাকে। অক্টোপাসের কথা মনে পড়ল! আমার গোড়ালি চেপে ধরেছে!

টানছে আমাকে। ঢেউয়ের প্রচণ্ড টানের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে আটকে রাখতে চাইছে।

ধীরে ধীরে টেনে সরিয়ে নিতে লাগল আমাকে।

আবার কাশলাম। মুখ থেকে নোনা পানি ছিটালাম। ডেকে মুখ ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি।

থরথর করে কাঁপছি ঠাণ্ডা আর আতঙ্কে।

ঘন ঘন দম নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলাম। গড়িয়ে চিত হলাম। কে আমাকে বাঁচিয়েছে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ কি!

কেমন আছো? হাঁটু গেড়ে বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে হিউগ রেন।

আ-আপনি বেরোলেন কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম।

হাতকড়াটা ঠিকমত লাগেনি। খুলে ফেললাম। বদ্ধ জায়গায় দম নিতে পারছিলাম না। তাই খোলা হাওয়ায় বেরিয়েছি। চশমা খুলে

ভেজা কাপড়ে মুছতে লাগল রেন। চশমা ছাড়া কিছু দেখি না।

আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন! তোমার ভাগ্য ভাল, ঢেউ যখন তোমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় আমি চলে এসেছিলাম, রেন বলল। পা চেপে ধরলাম। টানাটানিতে একবার তো মনে হচ্ছিল আমাকে সুদ্ধ নিয়ে যাবে। সময়মত জাহাজটা অন্যপাশে কাত হয়ে গেল, তাই বাঁচলাম।

অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই লোক মায়ানেকড়ে হয় কীভাবে? বনে থাকতেও বিশ্বাস হয়নি, এখন তো আরও হচ্ছে না।

ওর বিষণ্ণ চোখ দুটোর দিকে তাকালাম। মায়ানেকড়ের চোখের সঙ্গে কোন মিলই নেই। চশমা ছাড়া দেখতেও পায় না। ওকে ধরে ভুল করেছে বাবা…

রবিন, তোমার কী হয়েছে? আমার দিকে ছুটে এল বাবা। রেনকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল, আরে, তুমি! ছুটলে কী করে? খপ করে তার হাত চেপে ধরল।

বাবা, ওকে ছেড়ে দাও, আমি বললাম। ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

ও ভয়ানক বিপজ্জনক! বাবা বলল। ওর কাছাকাছি থাকাও ঠিক না তোমার।

কিন্তু বাবা, বললাম তো ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ঢেউ আমাকে, টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ও টেনে না ধরলে এতক্ষণে সাগরে হারিয়ে যেতাম। তাকিয়ে দেখো এখন? সত্যিই কী ওকে খারাপ মনে হয়?

মায়ানেকড়ে যখন মানুষের রূপে থাকে, তখন কিছুই বোঝা যায় না, রবিন, বাবা বলল। তুমি এখন যেমন আছে, ঠিক তেমনই দেখাবে তোমাকেও যদি মায়ানেকড়ে হয়ে যাও। আমি বলে দিচ্ছি, ওর ব্যাপারে সাবধান না হলে ভয়ানক বিপদে পড়বে। মনে রেখো কথাটা।

আপনি ভুল করছেন, রেন বলল। বাবার থাবা থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য মোড়ামুড়ি করছে। আমাকে ছেড়ে দিন। বাড়ি যেতে দিন। কথা দিচ্ছি, কাউকে কিছু বলব না। পুলিশের কাছে নালিশ করব না। যা ঘটেছে, সব ভুলে যাব।

ওর কথা কানেই তুলল না বাবা। তাঁচকা টানে সরিয়ে নিল আমার কাছ থেকে। চেঁচিয়ে খালাসিদের ডাকতে লাগল।

বাবা আর খালাসিরা মিলে রেনকে আবার কার্গো হোন্ডে নিয়ে গেল। একটু পরে ফিরে এসে আমাকে কেবিনে নিয়ে চলল বাবা। যেতে যেতে বলল, এবার ভালমত টেনেটুনে দেখেছি। আর হাতকড়া খুলতে পারবে না।

কিন্তু হাতকড়া খুলে যাওয়ার ঘটনাটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার। মায়ানেকড়ের দাঁতটার কথা মনে পড়ল। এবারও এটাই আমাকে বাঁচায়নি তো? কোনও অলৌকিক ক্ষমতাবলে হাতকড়া খুলে দিয়ে রেনকে পাঠিয়ে দেয়নি তো আমার কাছে?

আমাকে কেবিনে রেখে চলে গেল বাবা। নিশ্চয় কোনও কাজে।

ভেজা জামাকাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরলাম। তারপর বিছানায় বসে ছোট্ট গোল জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। না, সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখছি। জাহাজের গায়ে বিপুল গতিতে ক্রমাগত বাড়ি মেরে চলেছে।

আবার পাক দিচ্ছে পেটের ভিতর। বমি আসতে চাইছে।

রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। ভারি মেঘ কেটে যাচ্ছে। মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ

আবার মাথা ঘুরছে আমার। কাঁধে দপদপে ব্যথা।

আমাকে মায়ানেকড়েতে কামড়ানোর কথা বাবাকে বলিনি এখনও। তাকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলতে চাইনি। তবে এখন এমন ব্যথা করছে, না বলে বোধহয় আর পারব না।

শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলাম। কাঁধের কাছে আহত জায়গাটা ডলতে গিয়ে আঁউ করে উঠলাম।

বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিলাম বাথরুমে।

একটানে শার্ট খুলে ফেললাম। আয়নায় তাকালাম নিজের দিকে।

এ কি!-আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম।

কাঁধের জখমটা লাল হয়ে আছে। কিন্তু চেঁচিয়েছি অন্য কারণে। কুৎসিত এক গোছা লোম গজিয়েছে জায়গাটায়।

পনেরো

মরিয়া হয়ে ডলতে শুরু করলাম জায়গাটা। তুলে ফেলতে চাইলাম চুলগুলো।

লাভ হলো না। বরং প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম।

এই চুল কীসের? এত কুৎসিত! চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার শার্টটা গায়ে দিয়ে ঢেকে ফেললাম চুলগুলো।

বাথরুম থেকে বেরোতেই দেখি কেবিনে ঢুকছে বাবা।

বাবা, একটা জিনিস দেখাব তোমাকে।

এক সেকেণ্ড। গায়ের ভেজা হলুদ রেইনকোটটা খুলল বাবা। বাথরুমের হুকে ঝোলাল।

বাবা… আবার বলতে চাইলাম।

এক মিনিট, রবিন! ডেস্কের সামনে গিয়ে চেয়ারে বসল বাবা। মোবাইল ফোন বের করল। একটা জরুরি কথা সেরে নিই।

বিশ মিনিট পরও বাবার জরুরি কথা শেষ হলো না। আবার। অফুরন্ত কথা বলে চলেছে তার উকিলের সঙ্গে।

আমার কাঁধের চুলগজানো জায়গাটা জ্বলছে, সেইসঙ্গে প্রচণ্ড চুলকানি।

বাবা, আমার কথাটা শোনো! প্রায় ফিসফিস করে বললাম।

শুনব। শুনব। আমার দিকে তাকালও না বাবা। আবার গিয়ে বিছানায় উঠলাম।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বালিশে মাথা রেখে চিত হলাম। চাদরটা টেনে দিলাম গলার কাছে। তাকিয়ে আছি বাবার দিকে। টেলিফোনে কথা বলছে। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই। এত খুশি বহুকাল দেখিনি তাকে।

বাবার এই আনন্দটা নষ্ট করতে চাইলাম না। কাঁধের কথাটা বললেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে।

থাক, বলব না। ব্যথা আর কয়েক গাছা চুলই তো। বেশি তো না।

তাই আমার গোপন কথাটা তখনকার মত চেপে গেলাম। বাবাকে জানালাম না। তবে জানানো উচিত ছিল। তাহলে অনেক ঝামেলা আর সমস্যা থেকে বাঁচতে পারতাম।

ষোলো

নিরাপদেই রেনকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছলাম আমরা। জাহাজঘাটা থেকে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত সারাক্ষণ সঙ্গে ছিলেন বাবার সাংবাদিক বন্ধু। গাড়ি থেকে শুরু করে, সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাই কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাদের।

বাড়ি ফিরে দেখি, মা নেই। বাবা আর আমার জন্য একটা নোট রেখে গেছে। তার এক অসুস্থ বোনকে দেখতে গেছে আটলান্টায়। কবে ফিরবে ঠিক নেই।

বাবার সাংবাদিক বন্ধু আমাদের বসার ঘরের মাঝখানে মজবুত একটা লোহার খাঁচা এনে রেখেছেন। তাতে ভরা হলো রেনকে।

এখনও আমার বিশ্বাস হয় না, ছোটখাট ওই অসুস্থ মানুষটা মায়ানেকড়ে।

আমার আশঙ্কা, ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে বাবা। পূর্ণিমার সময় রেন মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত না হলে ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। বাবা। ও গিয়ে তখন পুলিশকে জানাবে। পুলিশ বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে। পাগলাগারদেও পাঠাতে পারে।

আগামীকাল রাতে ত্রয়োদশী। মোটামুটি গোল হয়ে যাবে চাঁদটা। আরও দুদিন পর পূর্ণিমা। সাপুড়ে বুড়ো বলেছিল, এই তিনটে রাতই খুব খারাপ। মানুষ মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হয়।

পরদিন বিকেলে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুসার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিশোরের কোন খবর আছে কি না। ও জানাল, কয়েক দিন আগে চিঠি দিয়েছে কিশোর। ওদেরও স্কুল ছুটি। তবে এবার গ্রীনহিলসে আসতে পারবে না। ওর চাচা রাশেদ পাশা ওকে আর মেরিচাচীকে নিয়ে অন্যখানে বেড়াতে যাবেন। হতাশ হলাম। কিশোর থাকলে ভাল হতো। রেনকে নিয়ে কী করব, আলোচনা করতে পারতাম।

মায়ানেকড়েটার কথা মুসাকে জানালাম।

লাফিয়ে উঠল মুসা, চলো, দেখব!

কিন্তু বাবা তো এখুনি কাউকে দেখাতে নিষেধ করেছেন।

আমাকে দেখালে কিছু বলবেন না।

তা অবশ্য ঠিক। ভেবে নিয়ে বললাম, চলো।

এই সময় ঘরে ঢুকল মুসার কুকুর ড্যানি। কুকুরটাকে নতুন জোগাড় করেছে ও। বিদেশী একটা ছোট জাতের কুকুর।

উহ্-হুঁ! তোর কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম রে, ড্যানি। রবিন, তুমি বাড়ি যাও। আমি আসছি।

কোথায় যাবে?

ড্যানিকে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে আসি। হ্যাঁনসবেরিতে ডগ শো হবে। ভাবছি, ওকে নিয়ে যাব। এবার ফাস্ট প্রাইজটা বাগাতেই হবে। তাই ওর পিছনে খাটতে হচ্ছে।

বাড়ি ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়ি এল মুসা।

ওকে বসার ঘরে রাখা খাঁচাটা দেখালাম। ওই যে।

খাঁচার চারপাশে ঘুরতে লাগল মুসা। রেনকে খুঁটিয়ে দেখল। চোখে হতাশা।

খাঁচার মেঝেতে আসনপিড়ি হয়ে বসেছে রেন। বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে মাথা। বাঁকা হয়ে আছে কাঁধ।

মুসাকে ঘুরতে দেখে মাথা তুলল ও। মুখে মলিন হাসি ফুটল। তারপর আবার মাথা নিচু করল।

কিন্তু, রবিন, এ তো একজন মানুষ। স্বাভাবিক মানুষ। ওকে আটকে রেখেছ কেন? এ তো অন্যায়…

আমি কী করব? ভোতাস্বরে জবাব দিলাম। বাবা ওকে ধরে এনেছে। ও নাকি মায়ানেকড়ে।

জোর দিয়ে একই কথা বলল মুসা, এ লোক মায়ানেকড়ে হতেই পারে না।

কী বলব?

রেন যে মায়ানেকড়ে নয়, এটা তো আমিও জানি।

নাহ, এ লোকটাকে মোটেও মায়ানেকড়ে মনে হচ্ছে না আমার।

খাঁচা ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা।

ও কী করছে আমি বুঝে ওঠার আগেই শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রেন।

মুসা, খাঁচার কাছ থেকে সরো! চেঁচিয়ে উঠলাম।

সতেরো

ভয় নেই, চকলেট দিলাম, মুসা বলল এমনভাবে নিল, যেন কতকাল খাবার পায় না। খেতে দাও না নাকি?

নিশ্চয়, বিড়বিড় করলাম। সকালেও তো পেট ভরে খাইয়েছে। ওকে বাবা।

চকলেট নিয়ে মুসাকে ধন্যবাদ দিল রেন। মোড়ক খুলতে খুলতে বলল, আমার নাম হিউগ রেন। আমি মায়ানেকড়ে নই, বুঝলে। ওরা ভুল করছে। বার বার বলছি। শুনছে না।

চোখের পাতা সরু করে আমার দিকে তাকাল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, তোমার বাবা পাগল হয়ে গেছেন! বদ্ধ উন্মাদ!

আহ, আস্তে বলো!

আস্তে বলব কেন? তোমার বাবা তো সত্যি সত্যি পাগল। নেহায়েত তোমাকে কথা দিয়েছি, কাউকে বলব না। নইলে এখুনি। গিয়ে পুলিশকে জানাতাম।

আর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল মুসা।

রেনের দিকে তাকালাম। আবার আসনপিড়ি হয়ে বসেছে খাঁচার কোণে। কামড় দিয়ে চকলেটের একটা কোণা ভেঙে মুখে পুরল।

খুবই করুণ অবস্থা ওর। ওর জন্য খারাপ লাগছে আমার।

ভাবছি, কিছু একটা করা দরকার। এভাবে আটকে রাখাটা ঠিক, হচ্ছে না।

কিন্তু কী করব? কী করতে পারি আমি?

.

পরদিন কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে বাজারে গেলাম। বাজার সেরে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না আমার। রেনের দিকে তাকানোর ভয়ে। তাকালেই মায়া লাগে। ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। বাবাকেও বোঝাতে পারি না, আমিও সহ্য করতে পারি না। বিপদেই পড়া গেছে! ওর বিষণ চোখ দুটোর দিকে তাকালে রীতিমত কষ্ট হতে থাকে আমার। খাঁচার ভিতর বন্দি জানোয়ারের মত যখন অসহায় ভঙ্গিতে পায়চারি করে, তখন আরও খারাপ লাগে।

কিন্তু বাড়ি তো ফিরতেই হবে। ভাবলাম, যাব, কিন্তু রেনের দিকে। তাকাব না।

ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা লাগালাম। কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছি, কানে এল রেনের মোলায়েম কণ্ঠ, রবিন, এলে?

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। হ্যাঁ, এলাম।

একবার এদিকে আসবে?

কি আর করব? খাঁচার দিকে এগোলাম।

রবিন, বাবা, আমার কথা শোনো। উঠে দাঁড়িয়েছে রেন। খাঁচার শিকে গাল চেপে ধরে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মায়ানেকড়ে নই। আমাকে ধরে আনার আগে বন বিভাগের লোকের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল তোমার বাবার। ওরা তাকে বোঝাতে পারত। আমার নাম সত্যিই হিউগ রেন। বন বিভাগের অনুমতি নিয়েই আমি বনে জানোয়ার। শিকার করি।

আমি দুঃখিত, মাথা নেড়ে বললাম। আমি কিছুই করতে পারব না।

ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলাম। ব্যাগের পকেট হাতড়ে বত সাইজের একটা চকলেট বের করে বাড়িয়ে দিলাম।

কোথায় পেলে ওটা? আমি সোজা হতেই জিজ্ঞেস করল রেন

দোকান থেকে কিনেছি।

চকলেট না, আমি ওটার কথা বলছি। আমার গলার দিকে তাকিয়ে আছে ও। মায়ানেকড়ের দাঁত!

সেটা তো আপনিই ভাল বলতে পারবেন, অন্ধকারে ছিল ছুঁড়লাম। রেনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছি। বনের ভিতর মায়ানেকড়ে হয়ে, আমার তাঁবুতে ঢুকে আপনি দেননি?

দাঁতটার দিকে তাকিয়ে আছে রেন। চেহারায় পরিবর্তন ঘটল না

আমি মায়ানেকড়ে নই। আমি একজন ফার শিকারি।

তাহলে এটার কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন? জিজ্ঞেস করলাম।

অদ্ভুত একটা জিনিস গলায় ঝুলিয়ে রেখেছ তো, তাই।

খাঁচার শিকের ফাঁক দিয়ে চকলেটটা বাড়িয়ে ধরলাম।

আমাকে তুমি সাহায্য করো, রবিন, রেন বলল।

সরি, মাথা নাড়লাম। সত্যিই আপনাকে সাহায্য করতে ইচ্ছে। করছে। কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দিলে বাবা ভীষণ রেগে যাবে।

কিন্তু তুমি কী চাও, তোমার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে ভরুক পুলিশ? লোকে হাসুক? বন্ধুদের ইয়ার্কির যন্ত্রণায় রাস্তায় বেরোতে পারবে না তুমি, স্কুলে যেতে পারবে না। তোমার জীবনটাও নরক হয়ে যাবে।

তো?

আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, রবিন, আমাকে ছেড়ে দেয়ার কথা কাউকে কিছু বলব না। আমাকে ছেড়ে দাও। তাতে তোমার বাবার উপকারই করা হবে।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি লোকটার দিকে। ওর চোখের আকুতি দেখছি।

ছেড়ে দেব? সত্যিই দেব ছেড়ে?

প্রশ্নটা প্রচণ্ড গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মগজে।

ভাবলাম, জাহাজে আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও। ওর কাছে এমনিতেই ঋণী হয়ে আছি। তা ছাড়া বাবাকে ভুল করা থেকে

নোটাও আমার কর্তব্য। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রেনকে ছেড়ে দেব। বাবা কোন ড্রয়ারে চাবি রাখে জানি। ড্রয়ার থেকে চাবিটা বের করলাম। খুলে দিলাম খাঁচার তালা।

আঠারো

খাঁচা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল রেন। থ্যাংক ইউ, রবিন! থ্যাংক ইউ! তোমার কথা আমার মনে থাকবে!

আমার ডান হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ও। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ঘণ্টাখানেক পর, ড্রাইভওয়েতে বাবার গাড়ি ঢোকার শব্দ শুনলাম।

ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল বাবা, কি, এত উত্তেজিত কেন? আজ রাতে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে রেন, সেটা দেখার জন্যে?

না, বাবা, আমতা আমতা করে বললাম। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

চলো, বসার ঘরে।

না, দাঁড়াও, আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরলাম। ওখানে এখন যেয়ো না।

কেন? কী হয়েছে? আমার চোখে স্থির হলো বাবার দৃষ্টি।

আমি…আমি রেনকে ছেড়ে দিয়েছি।

কী করেছ?ঝাড়া দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বসার ঘর ঢুকল বাবা। শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে অবিশ্বাস। কী করে পারলে? চেঁচিয়ে উঠল বাবা। ইশশ! কী করে করতে পারলে এমন একটা কাজ! ঘরের ভিতর পায়চারি শুরু করল বাবা।

লোকটার জন্য আমার মায়া হচ্ছিল, বাবা, মিনমিন করে বললাম। তা ছাড়া, আমি…আমি তোমাকে ভয়ানক একটা ভুল করতে দিতে চাইনি। সবাই তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, বাবা।

তুমি জানো, তুমি কী করেছ? পায়চারি থামিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল বাবা। তুমি একটা মায়ানেকড়েকে ছেড়ে দিয়েছ! এত জোরে, চেঁচিয়ে বলল বাবা, গলার দুই পাশের রগ ফুলে উঠল। আজ রাতে ওটা কী করবে, জানো তুমি? মায়ানেকড়েতে পরিণত হবে, তারপর নিরীহ মানুষ মারতে শুরু করবে। আর তারজন্য দায়ী থাকবে তুমি।

কিন্তু বাবা…

আর একটা কথাও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই না আমি! চিৎকার করে বলল বাবা। তোমার মুখ দেখতে চাই না। তুমি এখন তোমার ঘরে যাও।

নিজের ঘরে এসে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমি জানি,। ঠিক কাজই করেছি, নিজেকে বোঝালাম।

কিন্তু বাবা কী আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবে?

হ্যাঁ, বাবার চিৎকার কানে এল। ফোনে তার সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। তুমি ব্যবস্থা করো। দরকার হয় পুলিশের কাছে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলো। সূর্য ডোবার আগেই ওটাকে ধরতে না পারলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।

আবারও ভুল করতে যাচ্ছে বাবা। রেন মায়ানেকড়ে হতেই পারে না।

কিন্তু হঠাৎ এ রকম অসুস্থ বোধ করছি কেন?

মাথা ব্যথা করছে। কেমন শূন্য লাগছে মাথার ভিতরটা।

চোখ বুজলাম।

আবার যখন চোখ মেলোম, দেখি, বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

বিছানায় উঠে বসলাম। বনবন করে ঘুরতে শুরু করল যেন ঘরটা।

কী হয়েছে আমার? পেট খালি বলেই বোধহয় এমন লাগছে। খেলেই ঠিক হয়ে যাবে, ভাবলাম।

বিছানা থেকে নামলাম। দেয়ালে লাগানো আয়নার দিকে চোখ পড়তে চিৎকার করে উঠলাম।

নাকের নীচে বড় বড় গোঁফ গজাতে শুরু করেছে আমার। হাতে, পায়ে, বড় বড় লোম। মানুষের মুখ মিলিয়ে গিয়ে সেখানে একটা জানোয়ারের মুখ দেখা দিচ্ছে।

হাঁ করলাম। বড় বড় দাঁত বেরোচ্ছে মাঢ়ী থেকে।

সর্বনাশ! মায়ানেকড়ে হয়ে যাচ্ছি আমি! গুঙিয়ে উঠলাম।

জানালার দিকে দৌড় দিলাম। ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম বাইরে। মাটিতে নামলাম চারপায়ে ভর দিয়ে। হাতের জায়গায় দুটো পা-ও

মাটিতে পড়েই ছুটতে আরম্ভ করলাম। আমাদের পিছনের আঙিনা দিয়ে দৌড়ে চললাম। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।

দৌড়… দৌড়… আমার তপ্ত চামড়ায় আরামের পরশ বোলাচ্ছে ঠাণ্ডা বাতাস…

উনিশ

চোখ মেললাম।

চোখে রোদ পড়তে ঝট করে বন্ধ করে ফেললাম আবার।

আমি কোথায়?

ভঙ্গিতে চারপাশে তাকালাম।

আমার বেডরুমের মেঝেতে পড়ে আছি কেন? বিছানা থেকে পড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাত-পা টান টান করলাম। বড় করে হাই তুললাম।

এত ক্লান্তি। যেন সারারাত ঘুমাইনি।

ঘুমানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু পারব না। এখন বিছানায় পড়ে থাকলে রেগে যাবে বাবা। হাই তুলতে তুলতে নাস্তা করার জন্য খাবারঘরের দিকে চললাম।

এক গ্লাস কমলার রস, দুই টুকরো রুটি, আর মাখন বের নিয়ে খেতে বসলাম। একটা তাকে রাখা ছোট টেলিভিশনটা চালু করা। বাবা রেখেছে। খেতে বসে বাবা টেলিভিশন দেখতে পছন্দ করে।

কাল রাতে দুই মহিলা আর একজন পুরুষের ওপর ভয়ঙ্কর হামলা চালিয়েছে একটা অজানা প্রাণী, টেলিভিশনের খবরে বলল।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুই মহিলাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

অজানা প্রাণীর ভয়ঙ্কর হামলা? আমাদের এই ছোট্ট শহরে?

ঘটনাটা কী? অবাক হয়ে ভাবলাম। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি।

একজন ভদ্রমহিলা সব দেখেছেন। তিনি এখন আমাদের সঙ্গে আছেন। কী দেখেছেন, আমাদের জানাবেন। ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেল সাতাশ-আটাশ বছর বয়েসের এক মহিলার দিকে।

একটা মায়ানেকড়ের মত বুনো জানোয়ার! বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে মহিলার। জীবনে এ রকম জানোয়ার দেখিনি আমি। ভয়ানক! ভয়ানক!

মায়ানেকড়ের মত দেখতে! খোদা! গুঙিয়ে উঠলাম।

চিবানো বন্ধ করে তাকিয়ে আছি টেলিভিশনের দিকে। তৃতীয় লোকটির কী হলো, বলুন? প্লিজ! চিৎকার করে উঠলাম। বলুন! ও কী। মারা গেছে?

তৃতীয় লোকটি…

দম আটকে ফেললাম।

…কয়েকটা আঁচড় লেগেছে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাকে।

ফোঁস করে বের করে দিলাম ফুসফুসে আটকানো দমটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস।

কয়েকটা কুকুরকেও আক্রমণ করেছে ভয়ানক প্রাণীটা, রিপোর্টার বলছে। ছোট একটা বিদেশী কুকুরকে খেয়ে ফেলেছে।

খোদা! এ কী করলাম আমি? একা একাই চেঁচিয়ে বললাম। সব আমার দোষ। মায়ানেকড়েটাকে ছেড়ে দিয়েছি আমি। রেন আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে।

টেলিভিশন বন্ধ করে দিলাম। আর শুনতে চাই না।

রেন সত্যিই একটা মায়ানেকড়ে, গুঙিয়ে উঠে বিড়বিড় করলাম। বাবার কথাই ঠিক! তার কথায় সন্দেহ করা উচিত হয়নি আমার।

পেটের ভিতর পাক দিয়ে উঠল। সারা শরীর কাঁপতে লাগল।

বাবা আমাকে কোনদিন, কোনওদিন ক্ষমা করবে না।

সারা দুনিয়া আমাকে ক্ষমা করবে না।

টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। চিরকাল এখানে লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

মেঝেতে চোখ পড়ল। আমার কিছু কাপড়চোপড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। এখানে কেন?

সরিয়ে রাখার জন্য তুলে নিলাম। ভাল করে তাকাতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে গেল আপনাআপনি।

আমার একটা শার্ট আর প্যান্ট। গতকাল যেগুলো পরেছিলাম। ছিঁড়ে ফালা ফালা। রক্তের দাগ লাগা।

বিশ

আমার কাপড়ে রক্ত কেন? কী করেছি? গায়ে তো কোথাও জখম নেই।

চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করলাম, গতরাতে কোথায় ছিলাম? কী করেছি?

মনে পড়ল, শরীর খারাপ লাগছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

সর্বনাশ! হঠাৎ সব কথা মনে পড়ে গেল আমার। আয়নার দিকে তাকিয়েছিলাম। তাতে একটা রোমশ প্রাণীকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। জানালা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়েছিলাম।

ঝট করে চোখ চলে গেল জানালার দিকে।

হ্যাঁ, এখনও খোলা।

সব মনে পড়েছে। মায়ানেকড়ে হয়ে গিয়েছিলাম। চার পায়ে ছুটছিলাম।

মায়ানেকড়ে হয়ে গিয়েছিলাম! হাত-পা প্রবলবেগে কাঁপতে শুরু করেছে আমার। কাল রাতে আমিই তা হলে হামলা চালিয়েছি ওই মানুষ আর কুকুরগুলোর ওপর!

বিছানায় বসে ভাবতে লাগলাম। কাঁধে মায়ানেকড়ের কামড় খেয়ে আমিও মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি। হতাশ ভঙ্গিতে জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলাম।

এই কারণেই আমাকে দাঁতটা দিয়েছিল, বুঝতে পারছি এখন। স্বজাতি হিসেবে আমাকে ক্ষমতাবান করেছিল, বনের ভিতর আমাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, যেহেতু আমি ছোট।

পেটের ভিতর খামচে ধরা অনুভূতি হচ্ছে।

গতরাতে ওই ভয়ানক কাণ্ডগুলো আমিই ঘটিয়েছি, রেন নয়। তারমানে আমাকে ফাঁকি দিয়ে বেরোয়নি। মিথ্যে কথা বলেনি।

উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।

এখন আর লোম নেই মুখে।

ডোরাকাটা দাগ নেই।

থাবা নেই।

হাঁ করলাম। শ্বদন্ত নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপরই মনে পড়ল চাঁদের কথা।

আজকে পূর্ণিমার আগের দিন। আজও চাঁদ উঠবে। গোল চাঁদ। আর চাঁদ উঠলেই মায়ানেকড়েতে পরিণত হব।

উহ্, এখন আমি কী করব?

কেউ যদি আমাকে বাঁচাত!

আমাকে সাহায্য করত!

ঘরে বন্দি করে রাখত আমাকে! যাতে আমি বেরোতে না পারি।

আর কাউকে জখম করতে চাই না আমি!

বাবা! বাবা! বেডরুম থেকে ছুটে বেরোলাম। বসার ঘরে চিলাম। বাবা, আমিই মায়ানেকড়ে! রেন নয়!

একুশ

কিন্তু বসার ঘরে বাবা নেই।

বাবা! কোথায় তুমি?

জবাব এল না।

ছোট টেবিলে একটুকরো কাগজ দেখলাম। ফ্লাওয়ার ভাস চাপা দেয়া।

এগিয়ে গিয়ে ভাস সরিয়ে কাগজটা তুলে নিলাম। বাবা লিখে রেখে গেছে:

রবিন,

গতরাতে মায়ানেকড়েটা হামলা চালিয়েছে। থানায় যাচ্ছি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে! কখন ফিরব জানি না। স্কুল থেকে সোজা বাড়ি ফিরবে। রাতে শক্ত করে দরজা-জানালা আটকে রাখবে। কোন কারণেই বেরোবে না।

-বাবা।

এখন আমি কী করব? গুঙিয়ে উঠলাম।

নিজের বেডরুমে নিজেকে আটকে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় দেখলাম না। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বেরোতে না পারি। আর বেরোতে না পারলে কাউকে জখমও করতে পারব না।

স্কুলে আজ যাব না। রাতের জন্য তৈরি হতে হবে। তাতে সময় লাগবে।

তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে বাড়ি থেকে বেরোলাম। বাজারের একটা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে বেশ কিছু বড় বড় পেরেক, মোটা দড়ি, আর কাঠের দোকান থেকে শক্ত তক্তা কিনলাম।

দোকানদাররা আমাকে চেনে। এ-সব দিয়ে কী হবে, জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাবা নিতে বলেছে। কী করবে জানি না। জিনিসগুলো নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। দেরি না করে কাজে লাগলাম।

প্রথমেই জানালার পাল্লাগুলো পেরেক গেঁথে এমনভাবে বন্ধ করলাম, যাতে টানাটানিতে না খোলে। শেষ পেরেকটাতে হাতুড়ির শেষ বাড়িটা দিয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বাজল। ধরলাম। মুসা করেছে।

রবিন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! ছোট্ট ওই মানুষটা মায়ানেকড়েতে পরিণত হয়েছে!

সত্যি কথাটা মুসাকে বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, আমিই মায়ানেকড়ে।

ওই দানবটা বেরোল কীভাবে? মুসা জানতে চাইল।

আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।

তুমি ছেড়ে দিয়েছিলে? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। পাগল হয়ে গিয়েছিলে, না কী?

কেন, পাগল হব কেন? আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমিই তো বলছিলে, রেন মায়ানেকড়ে হতে পারে না। আমার বাবা পাগলামি করছে। রেনকে ছেড়ে দিতে চাপাচাপি করেছিলে।

কিন্তু সেটা তো কুকুরটাকে খাওয়ার আগে! মুসা বলল। আমার ড্যানিকে খেয়ে ফেলার আগে!

মোলায়েম গোঙানি বেরোল আমার মুখ থেকে।

গতরাতে আমি ড্যানিকে খেয়েছি! আমার বন্ধুর কুকুরটাকে খেয়ে। ফেলেছি!

মুসা, এখন রাখি। আমার শরীর ভাল নেই। শুতে যাচ্ছি। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিসিভার রেখে দিলাম।

পেটের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। বমি আসছে।

বহু কষ্টে ঠেকালাম। টলতে টলতে নিজের ঘরে ফিরলাম। জানালাগুলো টেনেটুনে দেখলাম। পেরেকগুলো ঠিকমত লেগেছে কী না দেখে নিশ্চিত হলাম।

তারপর দরজার পাল্লা লাগালাম। তাতে আড়াআড়ি তক্তা বসিয়ে পেরেক ঠুকে আটকে দিতে লাগলাম। সবশেষে কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে এমন গিঁট দিলাম, যাতে কোনমতেই খুলতে না পারি। দড়ির আরেকমাথা বাঁধলাম ভারি ড্রেসিং টেবিলটার সঙ্গে।

টান দিয়ে দেখলাম। না, খুব শক্ত হয়েছে। আজ রাতে আর বেরোতে পারব না। এই দড়ি আর পেরেক আমাকে আটকে রাখবে।

বাইশ

বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি।

ধীরে ধীরে অস্ত যেতে দেখলাম সূর্যটাকে।

গোধূলি থেকে রাত। আকাশে গোল চাঁদ। শিরশিরানি শুরু হয়েছে আমার চামড়ায়।

আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হাতে, মুখে, সারাদেহে, লোম গজাতে আরম্ভ করেছে।

আমার পিঠ আর বুকে দপদপানি ব্যথা। চামড়ায় জ্বলুনি। ফুলতে শুরু করেছে পেশি। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। পেশির চাপে ছিঁড়ে যাচ্ছে পরনের কাপড়।

মুখটা বদলে গিয়ে মায়ানেকড়ের মুখ হয়ে যাচ্ছে।

মাঢ়ী ফুড়ে বড় বড় দাঁত বেরোনোর সময় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম।

হাত-পায়ে যেন আগুন ধরে গেছে। আঙুল মিলিয়ে গিয়ে থাবা তৈরি হচ্ছে। তীক্ষ্ণধার নখ বেরোচ্ছে সেগুলো থেকে।

জ্বরে পুড়ছে যেন গা। পেটে রাজ্যের খিদে।

কুৎসিত, ভয়ঙ্কর হাঁক ছেড়ে কামড়াতে লাগলাম দড়িটা। কিছুটা কেটে হ্যাঁচকা টান দিতেই পট করে ছিঁড়ে গেল।

বুনো চিৎকার দিয়ে থাবা মারলাম দরজায় আটকানো তক্তায়। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খুলে পড়ল ওটা।

ছুটে বেরোলাম দরজার বাইরে। বাড়ির বাইরে এলাম।

ছুটতে শুরু করলাম চারপায়ে ভর দিয়ে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস পরশ বোলাচ্ছে তপ্ত চামড়ায়।

ছুটছি, ছুটছি। রক্তলালসায় দৌড়ে চলেছি রাস্তা দিয়ে। মাংস দরকার এখন আমার। কাঁচা মাংস।

তেইশ

মায়ানেকড়ের চোখ দিয়ে অন্ধকারে দিনের মত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। দুটো ছেলেকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখলাম।

ওদের আমি চিনি। আমার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ে। তীব্র খিদেয় মোচড় খেতে লাগল যেন পাকস্থলীটা।

ওদের ঘামের গন্ধ নাকে আসছে। নরম, তাজা মাংসের সুগন্ধ। পাচ্ছি। লম্বা জিভ বের করে ঠোঁট চাটলাম।

ছায়ায় গা ঢেকে চুপি চুপি এগোলাম ওদের দিকে।

কীসের শব্দ? আচমকা থেমে গেল একটা ছেলে। মুখ ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল আমার দিকে।

তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম।

এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, সন্দেহজনক কিছু চোখে না পড়ায় আবার এগিয়ে চলল ওরা। গতি বাড়িয়ে দিয়েছে এখন।

ওদের ঘামের গন্ধ পাচ্ছি। ওরা যে ভয় পেয়েছে, তা-ও বুঝতে পারছি।

খিদে যেন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। খেতে হবে আমাকে। খেতেই হবে। এখুনি।

আবার দাঁড়িয়ে গেল ওরা। ফিরে তাকাল।

কেউ আমাদের অনুসরণ করছে, প্রথম ছেলেটা বলল।

জানি, দ্বিতীয় ছেলেটা বলল। আমারও একই ধরনের অনুভূতি হচ্ছে। গা ছমছম করছে। কেঁপে উঠল ও।

এত আস্তে হাঁটলে হবে না। দৌড়াও।

ছুটতে শুরু করল ওরা।

ছায়া থেকে বেরিয়ে আমিও ছুটলাম। ভারি, চাপা গরগর শব্দ, বেরিয়ে এল গলার গভীর থেকে।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল ওরা। আতঙ্কে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। চেঁচিয়ে উঠল মেয়েটা।

মায়ানেকড়ে! ছেলেটা বলল। আবার মেয়েটার হাত চেপে ধরে টান দিল। ছুটতে শুরু করল ওরা।

চার পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আমিও ছুটলাম।

ওই যে! ওই যে মায়ানেকড়ে! ধরো, ধরো! আমার পিছনে হট্টগোল শুনলাম।

ঘুরে দাঁড়ালাম। একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছেন একজন পুলিশ অফিসার।

পিছনের জানালা দিয়ে আরেকটা মুখ বেরোতে দেখলাম। বাবা!

জলদি থানায় ফোন করুন। আরও লোক আসতে বলুন। উত্তেজিতকণ্ঠে বাবা বলল।

গাড়িটা ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে।

ওটাকে দেখেছি। পিছু নিয়েছি। ওয়্যারলেসে কথা বলছেন অফিসার। থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন।

জোরে দৌড়াতে শুরু করলাম।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গাড়ির দরজা। লাফিয়ে নেমে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলেন দুজন পুলিশ অফিসার।

পালাচ্ছে!

ধরো!

আমার কানে বাজতে থাকল যেন তাদের চিৎকার।

চারপায়ে ছুটছি। হাঁপাচ্ছি। বুকের ভিতর লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। তবে গতি কমালাম না। বরং আরও জোরে দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম।

একটা মোড়ের কাছে পৌঁছলাম। ছুটে রাস্তা পেরোলাম। পিছনে। সাইরেনের শব্দ। ফিরে তাকালাম। লাল-নীল আলোগুলো তীব্র ঝিলিক দিয়ে দিয়ে ঘুরছে।

জোরে! আরও জোরে! দৌড়াও! থেমো না! নিজেকে বললাম।

পিছনে দুপদাপ পায়ের শব্দ। ছুটে আসছে আমার দিকে।

স্কুলের দিকে ছুটলাম। মাঠে ঢুকে পড়লাম।

কিছুতেই পালাতে দেবেন না! বাবার চিৎকার কানে এল। ঝনঝন করে খুলল আর বন্ধ হলো লোহার গেটটা।

মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালাম। গেটের কাছে ভিতরের দিকে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ।

কয়েকটা গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়ানোর শব্দ হলো। ওগুলোর হেডলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ল মাঠে।

চোখ মিটমিট করলাম। সামনে এগিয়ে আসছে বাবা। ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোচ্ছে।

তোমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আর পালাতে পারবে না, বাবা বলল। তোমার জারিজুরি খতম।

চব্বিশ

হ্যাঁ, নোড়ো না। ওভাবেই থাকো। আমার দিকে এগোতে এগোতে আবার বলল বাবা।

গেটের কাছে দাঁড়ানো পুলিশেরা নড়ছে না। নীরবে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

হেডলাইটের আলোয় আমিও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাবার দিকে তাকিয়ে।

নিঃশ্বাসের শব্দ কানে এল। আমার পিছন থেকে।

পাক খেয়ে ঘুরলাম। দেরি হয়ে গেছে। আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন পুলিশ।

একজন বিশালদেহী দুঃসাহসী পুলিশ অফিসার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দুই হাতে আমার পেট পেঁচিয়ে ধরলেন। ধস্তাধস্তি করতে করতে মাটিতে ফেলে দিলেন। অসম্ভব জোর তার গায়ে।

কিন্তু আমি এখন মায়ানেকড়ে। যত জোরই থাক, একজন মানুষ আমার সঙ্গে শক্তিতে পারার কথা নয়।

বিকট চিৎকার দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তার হাতে কামড় বসানোর চেষ্টা করলাম।

ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন অফিসার। তবে আমাকে ছাড়লেন না। বাকি পুলিশেরা তাঁকে সাহায্য করতে এগোল। সবার হাতে বড় বড় লাঠি। আমাকে বাড়ি মারার জন্য উঁচু করে ধরল।

মরিয়া হয়ে ডানে, বাঁয়ে তাকালাম।

কোন পথ নেই।

চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে আমাকে। একটাই উপায়, গায়ের লোকটাকে সরিয়ে ফেলে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পালানো।

প্রচণ্ড গর্জন করে উঠে ঝাড়া মারলাম। গায়ের ওপর থেকে ফেলে দিলাম অফিসারকে। তারপর ছুটলাম বেড়ার দিকে।

ছুটতেই ছুটতেই লাফ দিলাম।

কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারলাম না। আটকে গেলাম বেড়ার ওপরে। আরও জোরে লাফ দেয়া উচিত ছিল। বেরিয়ে যেতে পারতাম তাহলে। পিছনের দুই পা কাটাতারে বেধে গেল। পেটের ওপর ঝুলে রইলাম।

আমার ভারে ডেবে গেল বেড়ার ওপরের দিকটা।

কয়েকজন পুলিশ এসে বেড়া ঝাঁকাতে শুরু করল। কয়েকজন লাঠি দিয়ে দমাদম বাড়ি মারতে লাগল আমার দেহের পিছনে। বেড়াটাও আমার ভার রাখতে পারছে না। প্রায় উল্টে পড়লাম মাটিতে। বেড়ার ভিতর দিকে।

লাফিয়ে উঠলাম পরক্ষণে। দৌড় দিলাম স্কুল বাড়িটার দিকে।

সিঁড়ির কাছে পৌঁছলাম। গেটটা খোলা। আর কোন উপায় না দেখে সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে গেলাম।

দল বেঁধে ছাতে উঠে এল পুলিশ।

কোণঠাসা করে ফেলতে চাইল আমাকে। ওরা জানে, মায়ানেকড়ে হই আর যা-ই হই, দোতলার ছাত থেকে লাফিয়ে পড়লে বাঁচব না। আর বাঁচলেও হাড়গোড় ভেঙে অকেজো হয়ে যাব। অনেক উঁচু।

আমাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ।

সিঁড়ির কাছ থেকে বাবার চিৎকার কানে এল, ছাড়বেন না! ওকে ছাড়বেন না!

কিন্তু আমি দমলাম না। দৌড় দিলাম। আমাকে ছুটে আসতে দেখে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল কয়েকজন পুলিশ। ওদের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসার সময় আরও দু-তিন ঘা লাঠির বাড়ি খেলাম।

ছাতের কিনারে এসে লাফিয়ে পড়লাম পাশের বাড়িটার ছাতে। সেখান থেকে অন্য ছাতে।

অনেকটা নিরাপদ আমি এখানে। ওরা আমাকে ধরতে পারবে না। বুঝে বিশ্রাম নিতে বসলাম। কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় পুলিশ। মাথার ওপরে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলাম।

মুখ তুলে তাকালাম। সোজা আমার ওপর নেমে আসছে পুলিশের হেলিকপ্টার। ওটার তীব্র উজ্জ্বল সার্চলাইটের আলো নীচের দিকে ফেলে ছাতে ছাতে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে।

গর্জন করে উঠলাম। একতলার ছাতে রয়েছি এখন। নীচে একবার মাটির দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করলাম। তারপর লাফ দিলাম। বিড়ালের মত চারপায়ে ভর দিয়ে নিরাপদেই নামলাম মাটিতে। সরে এলাম বাড়ির ছায়ায়।

পাগলের মত কর্কশ চিৎকার করে চলেছে সাইরেন। মানুষের কলরব। টায়ারের আর্তনাদ, আর গাড়ির ইঞ্জিনের ভারি গোঁ-গোঁ শব্দ। দমকলের একটা গাড়ি আর বড় কয়েকটা লরি এসে ঘিরে ফেলেছে। আমাকে।

পিছনের আঙিনায় ঢুকে পড়লাম।

বাড়ির সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। সাইরেন বেজেই চলেছে। বাড়ির লোকেরা হট্টগোল শুরু করেছে।

দিলাম দৌড়। কিন্তু এত পরিশ্রম সইতে পারছে না আমার ফুসফুস। মনে হলো পুড়ে যাচ্ছে।

থামো! নিজেকে বললাম।

বিশ্রাম নাও।

লুকানোর ভাল জায়গা খোঁজো।

আঙিনার একপ্রান্তে একটা ছাউনি ঘর দেখলাম। পুরোপুরি অন্ধকার।

পা টিপে টিপে নিঃশব্দে চলে এলাম ওটার কাছে। মাথা দিয়ে দরজায় ঠেলা দিলাম। তালা কিংবা খিলটিল কিছু লাগানো নেই। খুলে গেল পাল্লা।

ভিতরে ঢুকে পড়লাম। তারপর আবার মাথা দিয়ে ঠেলে লাগিয়ে দিলাম পাল্লা। প্রচুর খড় রয়েছে ঘরে। একটা সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা একজায়গায়। ওটার কাছে দুটো খড়ের গাদার ফাঁকে ঢুকে পড়লাম।

পা কাঁপছে আমার। ব্যথা করছে।

বুকটা ওঠানামা করছে জোরে জোরে। লম্বা দম নিয়ে শান্ত করতে চাইলাম ফুসফুসটাকে।

ধীরে ধীরে কমে আসছে আমার হৃৎপিণ্ডের লাফানি।

সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজেকে বোঝালাম। এখানে তুমি নিরাপদ। ভোর হতে দেরি নেই। আলো ফুটলেই মানুষে রূপ নেবে। তখন এক ফাঁকে এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে।

লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ মুদলাম। আর ঠিক তখুনি ঝটকা দিয়ে খুলে। বেড়ার গায়ে দড়াম করে বাড়ি খেল দরজার পাল্লা।

বড় টর্চের তীব্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল আমার।

এই যে এখানে! চিৎকার করলেন একজন অফিসার। ঘরের। বাইরে দাঁড়ানো ঊর্ধ্বতন অফিসারের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললেন, সার, এই যে এখানে ও!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। দ্রুত একবার সারা ঘরে ঘুরে বেড়াল আমার দৃষ্টি।

একটা জানালাও নেই। একটা ছাড়া আর কোন দরজাও নেই। বেরিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা দেলাম না।

দরজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে ভয়। দেখানোর চেষ্টা করলাম অফিসারকে।

এবং ভুলটা করলাম।

কোমরের খাপ থেকে পিস্তল খুলে আমার দিকে তাক করলেন। অফিসার। সার, জলদি আসুন! একা আটকাতে পারব না। আবার পালাবে।

পা বাড়ালাম।

থামো! আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন অফিসার। দাঁড়াও ওখানে। নইলে গুলি করব!

পিস্তলের ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করল তার আঙুল।

পঁচিশ

গুলি করবেন না! গুলি করবেন না! ও আমার ছেলে! বাবার চিৎকার শুনতে পেলাম। দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে।

অবাক কাণ্ড! বাবা কী করে বুঝল, আমি?

অফিসারকে ঠেলে সরিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল বাবা। আমাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, আমি ভাল আছি কী না। দরজা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, আলো ফুটতে আর কত দেরি। আমাকে বলল, ভোর হয়ে গেছে। বসে থাকো এখানে। আলো ফুটলেই তুমি নিরাপদ।

অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাবা। বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

কিন্তু ও খুনী! বাইরে থেকে অফিসারের রাগত কণ্ঠ কানে এল আমার।

ওকে শেষ করে দেয়া দরকার! বলল আরেকটা কণ্ঠ।

নিজের দেহের দিকে তাকালাম। এখনও মায়ানেকড়েই আছি আমি। মানুষ হতে আর ঠিক কতক্ষণ লাগবে, জানি না।

বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম। এখনও অন্ধকার।

সূর্য ওঠার অপেক্ষায় রইলাম। বুকের ভিতর জোরে জোরে লাফাচ্ছে উত্তেজিত হৃৎপিণ্ডটা।

মিস্টার মিলফোর্ড, আপনি ভুল করছেন, তৃতীয় আরেকটা ভারি কণ্ঠ বলল, ওই ভয়ানক প্রাণীটা আপনার ছেলে হতে পারে না!

ধাক্কা লাগল দরজার পাল্লায়। খুলে গেল আবার ঝটকা দিয়ে। ওকে মেরে ফেলাই ভাল!

কাঁপতে কাঁপতে একটা খড়ের গাদার আড়ালে লুকালাম।

না না; বললাম তো, ও আমার ছেলে! বাবা বলল। আবার টান দিয়ে লাগিয়ে দিল পাল্লাটা।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। চামড়ায় শিরশিরে অনুভূতি।

তর্কাতর্কি শুরু হলো বাইরে। পুলিশরাও একমত হতে পারছে না। কেউ বলছে, মেরে ফেলো। কেউ বলছে, থাক না, দেখা যাক।

বাইরে উত্তেজনা বাড়ছে। এদিকে আমার দেহটা আবার রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে।

ধূর, মেরেই ফেলা ভাল। এ-সব শয়তান বাঁচিয়ে রাখা উচিত না। লোকের হট্টগোলের সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়ছে।

জলদি! জলদি! তাড়াতাড়ি বদলে যাও! নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে বললাম। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।

আমার পায়ের চামড়া পুড়ছে। মাথা ব্যথা করছে। চামড়ার জ্বলুনিতে মনে হচ্ছে, গা থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ব্যথা হয়ে গেল।

ওই যে, শুনুন, কেমন চিৎকার করছে! ও আপনার ছেলে হতেই পারে না, মিস্টার মিলফোর্ড। ওটা একটা ভূত! শয়তান! নরকের ইবলিস!

গুলি করছেন না কেন? আরেকটা কণ্ঠ বলল।

আবার খুলে গেল দরজার পাল্লা। ঘরে ঢুকলেন একজন পুলিশ অফিসার। হাতে পিস্তল।

বাবা! দুর্বলকণ্ঠে ডাকলাম।

পিছন থেকে দৌড়ে এল বাবা। ঠেলা দিয়ে অফিসারকে সরিয়ে ছুটে এল আমার দিকে। রবিন! রবিন! আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভেবো না! সব ঠিক হয়ে যাবে!

আমার দেহের দিকে তাকালাম। আমার মানবদেহ। পুরো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ওনার ছেলেই তো! সত্যিই রবিন! চাপা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম চারপাশ থেকে।

বাবা, কী করে বুঝলে তুমি? আমার কণ্ঠ এখনও দুর্বল। কী করে বুঝলে আমি মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি?

ওটা। আমার গলায় ঝোলানো দাঁতটা দেখাল বাবা। ওটা দেখেই বুঝেছি, তুমি। তবে অনেক দেরিতে দেখেছি, তুমি ছাউনির দিকে দৌড়ে যাবার সময়। ইস্, আরও আগে দেখলে ভাল হত। অনেক ঝামেলা কমত।

হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম দাঁতটা।

আবার এটা আমার জীবন বাঁচাল।

চলো, বাড়ি চলো, বাবা বলল।

ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলাম। সকালের রোদ যেন হুল ফোঁটাল আমার চোখে। তাড়াতাড়ি বুজে ফেললাম। আবার যখন মেলোম, দেখি, অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ আমাকে দেখছে।

আমাদের হাতে দিন, থানায় নিয়ে যাই, বাবাকে বললেন একজন অফিসার। কঠিন হাতে আমার হাত চেপে ধরলেন।

ওকে ছেড়ে দিন, প্লিজ, অনুরোধের সুরে বাবা বলল।

কিন্তু মিস্টার মিলফোর্ড, আপনি তো বুঝতেই পারছেন না, ওকে ছেড়ে রাখাটা উচিত হবে না। বলে সহকর্মীদের দিকে তাকালেন। তিনি।

মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানাল সবাই।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল।

বাবা! দুর্বলকণ্ঠে ককিয়ে উঠলাম। আমাকে থানায় নিয়ে কী করবে?

ছাব্বিশ

ছেড়ে দিন ওকে, প্লিজ! আবার বলল বাবা। বাড়ি নিয়ে যাই। ও ইচ্ছে করে কারও ক্ষতি করেনি। ওর চিকিৎসা দরকার।

কিন্তু রাতে আবার যখন চাঁদ উঠবে, তখন? অফিসার বললেন। আবার তো মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। বুঝলাম, নিজের ইচ্ছেয় ক্ষতি করে না। কিন্তু যেভাবেই হোক, করে তো।

আর পারবে না, বাবা বলল। আমি কথা দিচ্ছি, ও আর বেরোতে পারবে না। কারও ক্ষতি করতে পারবে না। সব দায়-দায়িত্ব আমার।

চুপ করে থেকে একটা মুহূর্ত ভাবলেন অফিসার-ইন-চার্জ। তারপর পিছিয়ে গেলেন।বেশ, নিয়ে যান। একটা সুযোগ দিলাম।

আরেকটা কথা, বাবা বলল। দয়া করে এ কথাটা ফাস করবেন না। আমার ছেলে মায়ানেকড়ে হয়ে যায়, এটা জেনে গেলে ও আর শহরে টিকতে পারবে না।

মাথা ঝাঁকালেন পুলিশ অফিসার।

পুলিশের গাড়িতে করেই আমাকেসহ বাবাকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। সারারাতের ছোটাছুটিতে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, গাড়ির সিটে নেতিয়ে পড়লাম।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে অনেকটা ভাল বোধ করলাম। বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরের দিকে এগোনোর সময় বললাম, আরও আগেই তোমাকে জানাতাম। তুমি দুঃখ পাবে বলে জানাইনি।

কখন ঘটল এটা? কীভাবে? আঙুল চালিয়ে চুল সমান করল বাবা। চোখে বিষণ্ণতা। চেয়ারে বসে শার্টের ওপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে দিল। তার চওড়া কাধ সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে।

বনের মধ্যে সেরাতে যখন আমার ওপর মায়ানেকড়েটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বাবাকে জানালাম। আমার কাঁধে কামড়ে দিয়েছিল। তখনই তোমাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, তুমি দুঃখ পাবে বলে জানাইনি।

হুঁ! বিষণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল বাবা। দোষটা আমারই। মায়ানেকড়ে ধরার জন্য এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম! তোমার দিকে নজর রাখা উচিত ছিল আমার। এটা ঘটতে দেয়াই ঠিক হয়নি।

দুই হাতের তালুতে মাথা চেপে ধরল বাবা। বিড়বিড় করে বলল, তবে তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার, রবিন।

ধন্যবাদ? কীসের জন্য, বাবা?

রেনকে ছেড়ে দেয়ার জন্য। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল বাবা। ও মায়ানেকড়ে নয়। তুমি ঠিকই বলেছিলে। সারা দুনিয়ার সামনে, আমি খেলো হয়ে যেতাম, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, গাধা বনে যেতাম।

উঠে দাঁড়াল বাবা। পায়চারি শুরু করল।

ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দৃঢ়কণ্ঠে বাবা বলল।

তোমাকে ভাল করার জন্য সবরকম চেষ্টা আমি করব। সবচেয়ে বড় ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাব। দরকার হলে ওঝা, কবিরাজ, ফকির, সবার কাছে নিয়ে যাব। মায়ানেকড়েকে ভাল করার কোন না কোন উপায় নিশ্চয় আছে…

ফোন বাজল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল বাবা।

অন্যপ্রান্তের কথা শুনতে শুনতে সরু হয়ে এল চোখের পাতা। শক্ত হলো মুখের পেশি। বলল, অসম্ভব! এ হতেই পারে না!

তারপর আরও কিছুক্ষণ শোনার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল।

কী হয়েছে, বাবা? কোনও সমস্যা?

থানা থেকে ফোন করেছিল। ভারি দম নিল বাবা। ছয়জন মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে একটা মায়ানেকড়ে।

আমি কিছু করিনি! করার সুযোগই পাইনি! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার থেকে। তুমি তো জানো!

হ্যাঁ, জানি, বাবা বলল। তুমি নও। সারারাত তোমাকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে। তোমাকে যখন স্কুলের মাঠে আটকে ফেলা হয়েছে, ঠিক সে-সময় শহরের আরেকদিকে ঘটনাটা ঘটেছে।

তাহলে কে, বাবা? অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি।

রেন। এ ছাড়া আর কে? প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল বাবা।

ও আমাদের মিথ্যে কথা বলেছে। ও সত্যিই মায়ানেকড়ে। তোমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে।

রেনের চেহারাটা কল্পনা করলাম। এ রকম একজন মানুষ মায়া নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়, বিশ্বাস হচ্ছে না আমার এখনও। কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। মানুষগুলো জখম হয়েছে, সেটা তো ঠিক।

আজ রাতে তো পূর্ণিমা, তাই না, বাবা? গলা কাঁপছে আমার।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল, বাবা। কাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ। আগামী শুক্লপক্ষের আগে আর মায়ানেকড়েতে পরিণত হবে না। ততদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। শুধু আজকের রাতটা ভালয় ভালয় কাটাতে পারলেই হয়।

চোখ বুজে ভাবতে লাগল বাবা। কী করবে? জিজ্ঞেস করলাম।

আচমকা চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল বাবা। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। আজ রাতে পুলিশ নিয়ে রেনকে খুঁজতে বেরোব। সবাইকে রাইফেল নিতে বলব। ভাবতে কষ্টই হচ্ছে, রবিন, অন্যদিকে চোখ ফেরাল বাবা। রেনকে দেখামাত্র গুলি করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

সাতাশ

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাবা তৈরি হচ্ছে। বসে বসে দেখছি আমি।

আলমারি থেকে তার রাইফেলটা বের করল বাবা।

ম্যাগাজিনের চেম্বারে রূপার তৈরি বুলেট ভরল। আগেই তৈরি করিয়ে রেখেছিল। ব্র্যাটভিয়ায়ও এই বুলেট নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে করে।

মায়ানেকড়ে মারতে কী সত্যিই রূপার বুলেট লাগে, বাবা? গায়ে। কাঁটা দিল আমার।

লোকে তো তাই বলে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। কিন্তু ঝুঁকি নেব কেন?

এখন আমরা নিশ্চিত, হিউগ রেন সত্যিই মায়ানেকড়ে।

সময় হয়েছে, বাবা বলল। চলো।

বসার ঘরে নিয়ে এসে বাবা আমাকে খাঁচায় ঢুকতে বাধ্য করল।

এখানেই তুমি নিরাপদ, খাঁচার দরজার মস্ত তালাটা লাগিয়ে দিল। বাবা।

বসার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে।

রেনের কথা ভাবলাম। ভাবলাম, জাহাজে আমাকে বাঁচানোর কথা।

গলায় ঝোলানো মায়ানেকড়ের দাতাটা চেপে ধরলাম। রেনই এ জিনিসটা আমাকে দিয়েছে।

আসলে, দুবার আমার জীবন বাঁচিয়েছে ও। একবার নিজে, আরেকবার এ জিনিসটার সাহায্যে-বনের ভিতর বুনো কুকুরের দল এটা দেখেই আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়।

সুতরাং ওকে আমার বাঁচানোর চেষ্টা করা দরকার। অন্তত সাবধান করাটা তো জরুরি।

খাঁচার শিক চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চেঁচিয়ে বললাম, কে আমাকে মুক্ত করবে? কে ছেড়ে দেবে খাঁচা থেকে?

দরজার ঘণ্টা বাজল।

এসো! এসো! চেঁচিয়ে ডাকলাম। জলদি এসো!

দরজা খুলে উঁকি দিল মুসা।

খাঁচায় ঢুকে কী করছ, রবিন? মজা করছ নাকি?

না, মজা করছি না, বিড়বিড় করলাম। একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। মায়ানেকড়েটা আমার সঙ্গে চালাকি করেছে। মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলিয়ে আমাকে দিয়ে তালা খুলিয়েছে। তারপর আমাকে খাঁচায় আটকে রেখে চলে গেছে। জলদি, আমাকে বের করো। বাবাকে সাবধান করতে হবে।

ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল ও। চাবিটা কই?

তাই তো! চাবিটা কোথায়?

আমাকে তালা দিয়ে চাবি কোথায় রাখছে বাবা, খেয়াল করিনি। চাবি কোথায় রেখেছে দেখিনি।

ডেস্কের ড্রয়ারে দেখো তো! মুসাকে বললাম।

ড্রয়ার হাতড়ে দেখে মুসা বলল, এখানে নেই।

কিন্তু চাবিটা তো খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের!

মাথা ঠাণ্ডা করো, রবিন, মুসা বলল। আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে…

কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই!

আরে শোনো না, চাবির দরকার হবে না আমাদের।

হবে না?

না। আমি গিয়ে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করে রেনের চালাকির কথা বলব। আঙ্কেল এসে খুলে দেবেন তোমাকে।

উঁহু, আমার পছন্দ হলো না।

কেন হলো না?

কেন হলো না? কেন হলো না?

কি জবাব দেব?

কারণ… জানালার বাইরে তাকালাম। ওখানে তোমাকে এখন যেতে দিতে চাই না আমি। চাঁদ উঠেছে। এখন বাইরে যাওয়াটা বিপজ্জনক।

হ্যাঁ, তা ঠিক। দ্বিধা করছে মুসা।

ঠিক আছে, চাবিটাই খুঁজে বের করি।

বাড়ির ভিতর খুঁজতে গেল ও। এদিকে শিরশিরানি শুরু হয়ে গেছে। আমার চামড়ায়।

কিন্তু আমি যে মায়ানেকড়েতে রূপান্তরিত হচ্ছি, মুসাকে দেখতে দিতে চাই না। কী করব? কী করব তাহলে?

জলদি করো, মুসা। জলদি! চেঁচিয়ে বললাম। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারছি না।

চামড়া জ্বলতে শুরু করেছে আমার।

মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।

চাবিটা বাবা কোথায় রাখল? সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি তো? গুঙিয়ে উঠলাম।

তারপর মনে পড়ল বিস্কুটের টিনটার কথা। বাড়ির সমস্ত বাড়তি চাবি ওই খালি টিনে রাখে মা-বাবা।

মুসা, রান্নাঘরের তাকে বিস্কুটের একটা খালি টিন আছে, ওটায় দেখো! চেঁচিয়ে বললাম।

পেয়েছি! একটু পরেই দৌড়ে এসে বসার ঘরে ঢুকল মুসা। উল্লসিত ভঙ্গিতে চাবিটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল।

জলদি করো! খোলো! খোলো!

খুলছি তো। অস্থির হচ্ছ কেন? খাঁচার তালাটা খুলে দিল ও।

এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাও! খাঁচা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। এখুনি। দেরি কোরো না।

টের পাচ্ছি পিঠে লোম গজাতে শুরু করেছে।

পাগল নাকি! এইমাত্র তো বললে, চাঁদ উঠেছে, এখন বাইরে বেরোনো ঠিক না!

কিন্তু এখানে থাকাও উচিত হবে না তোমার। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম। মায়ানেকড়েটা এখানে ফিরে আসতে পারে…অনেকদিন খাঁচাটায় থেকেছে…মায়ানেকড়েরা পুরানো জায়গায় ফিরতে ভালবাসে।

তাই নাকি?

ও, তুমি জানো না। কিন্তু আমি জানি। বাবা বলেছে। দৌড় দাও। জলদি!.

দরজার দিকে ছুটল মুসা।

পেশিতে ব্যথা করছে আমার।

দরজার নবে হাত দিয়েছে মুসা।

হাতের দিকে তাকালাম। হলুদ আর কালো লোম গজানো শুরু হয়ে গেছে।

মনে মনে বললাম, ফিরে তাকিয়ো না, মুসা! বেরিয়ে যাও! এদিকে তাকিয়ো না, প্লিজ!

আটাশ

নব ঘোরাল মুসা। গুড লাক, রবিন। আমাকে বলল ও।

জবাব দিলাম না। দাঁড়িয়ে আছি। আতঙ্কে যেন অবশ হয়ে গিয়ে।

দরজা খুলল ও।

ডানে তাকাল, বাঁয়ে দেখল। কিন্তু পিছনে আমার দিকে তাকাল না। একবারও। বিড়বিড় করে বলল, এখন বেরোনো বোধহয় নিরাপদ।

জবাব দিলাম না।

চাঁদটা দেখছে ও।

মাথা ব্যথা করছে আমার। আধা মানুষ আধা জন্তুতে পরিণত হয়ে গেছি।

আমি যাচ্ছি, রবিন, মুসা বলল। ফোন কোরো।

যাও, মুসা, বেরিয়ে যাও। মনে মনে বললাম। ঘুরো না এদিকে। চলে যাও, প্লিজ!

সাবধানে থেকো। বলে বেরিয়ে গেল মুসা। দরজাটা লাগিয়ে দিল।

ছুটে এলাম জানালার কাছে। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তা। দিয়ে দৌড়াচ্ছে মুসা।

পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। দাঁত বেরোনোর প্রচণ্ড ব্যথা মাঢ়ীতে। যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলাম। শেষ হয়েছে রূপান্তর। পুরোপুরি মায়ানেকড়ে হয়ে গেছি। আমাদের বাড়ির ছায়ায় জড়সড় হয়ে দাঁড়ালাম। ভাবছি। কোথায় যাব? কোথায় আছে রেন? সময়মত কী খুঁজে বের করতে পারব ওকে? ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভিতর।

মায়ানেকড়ে! মায়ানেকড়ে! মহিলাকণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল।

বরফের মত জমে গেলাম।

বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে মেরে ফেলল! আবার শোনা গেল।

আমিও দেখতে পেলাম মায়ানেকড়েটাকে। আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আরেকটা বাড়ির পিছনে।

মহিলার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচে গরগর করছে ওটা। এক পা। এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। বাড়ির দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। মহিলার। কোণঠাসা করে ফেলেছে তাকে মায়ানেকড়েটা।

গর্জন করে দৌড় দিলাম।

এক লাফে নিচু দেয়াল ডিঙিয়ে ছুটলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম মায়ানেকড়েটার গায়ে।

গর্জে উঠে কাত হয়ে পড়ে গেল মায়ানেকড়েটা। চমকে গেছে। সামলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল পরক্ষণে।

চোখ বড় বড় করে দেখছে মহিলা। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে, পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে দৌড় দিল।

মায়ানেকড়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমাকে ঘিরে। চক্কর দিতে শুরু করল ওটা।

ধারাল দাঁত বের করে মুখ ভেঙচাল। হুমকি দিল আমাকে।

আমিও একইভাবে পাল্টা হুমকি দিলাম।

ঊনত্রিশ

এদিকে! এই রাস্তায়! একজন পুলিশ অফিসারের চিৎকার শোনা গেল। মায়ানেকড়ের ডাক শুনলাম বলে মনে হলো।

মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার পিছন থেকে আসছে! বাবার গলা। শুনলাম। কোনমতেই যেন পালাতে না পারে!

এসে গেছে পুলিশ। ঘিরে ফেলবে এখন, বুঝতে পারলাম।

মায়ানেকড়েটার দিকে তাকালাম। কান খাড়া করে ফেলেছে। ওটা জ্বলন্ত চোখ ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে। লুকানোর জায়গা খুঁজছে।

এখন ওকে সাহায্য করব কী করে?

কী করে বাঁচাব?

আবার মানুষরূপে ফিরে এলেই কেবল বাঁচতে পারবে ও। ছোট্ট একজন টাকমাথা মানুষকে দেখলে কেউ ভয়ঙ্কর প্রাণী ভেবে গুলি চালাবে না।

রাইফেলে বাবার গুলি ভরার দৃশ্যটা কল্পনা করলাম। সত্যি কী রূপার বুলেট মায়ানেকড়ে মেরে ফেলে?

মায়ানেকড়ে থেকে মানুষ হওয়ার উপায় কী?

ভাবো! ভাবো! নিজেকে তাগাদা দিলাম।

হ্যাঁ! মনে পড়েছে।

মায়ানেকড়েকে মানুষরূপে ফিরিয়ে আনতে চাইলে তার নাম ধরে ডাকতে হয়।

সেটা করতে পারি।

ওর নাম আমি জানি।

কাজ হবে তো? পরীক্ষা করে দেখা যাক।

মায়ানেকড়েটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমিও ওটার জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রেন! চেঁচিয়ে উঠলাম। হিউগ রেন!

কিন্তু আমার মায়ানেকড়ের মুখ দিয়ে শব্দগুলো শুধু ঘোঁতঘোত হয়ে বেরোল।

কিছুই ঘটল না।

দুজন দুজন করে যাও, অফিসার-ইন-চার্জের গলা শোনা গেল। ভালমত খোজো।

মায়ানেকড়েকে মানুষে রূপান্তরিত করার আরও একটা উপায়। আছে। সেটা কী?

রাতের আকাশকে চিরে দিল সাইরেনের শব্দ।

ঠিকমত ভাবতে পারছি না।

ভাবো, রবিন! ভাবো!

হ্যাঁ! পেয়েছি!

মায়ানেকড়ের মাথায় তিনবার থাবা দিলে ওটা মানুষ হয়ে যায়।

কিন্তু থাবা দেব কীভাবে? এক জায়গায় তো স্থির থাকছে না।

শব্দ শুনলাম মনে হলো! একজন অফিসারের গলা কানে এল। কাছাকাছিই আছে!

আর সময় নেই।

লাফ দিয়ে এগিয়ে গেলাম মায়ানেকড়েটার কাছে।

ওটা কিছু বোঝার আগেই পা উঁচু করে মাথায় থাবা মারতে লাগলাম।

একবার। দুবার। তিনবার। তারপর লাফিয়ে সরে গেলাম। কই? কিছুই তো ঘটল না। গর্জে উঠল মায়ানেকড়েটা। জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমার দিকে।

এদিকে, মিস্টার মিলফোর্ড! একটা উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল। ঠিকই বলেছেন, ওই বাড়িটার পিছনে!

ভারি জুতোর শব্দ ছুটে এল রাস্তা দিয়ে। কী করা যায়? কী করা যায়? হঠাৎ মাথায় এল বুদ্ধিটা।

আমার গলায় ঝোলানো দাঁতটা থাবার সাহায্যে খুলে আনলাম। আঙুল নেই, তাই থাবা থেকে ফসকে পড়ে গেল মাটিতে।

নখ দিয়ে বহু কষ্টে তুলে নিয়ে মায়ানেকড়েটার গলায় ঝুলিয়ে দিলাম।

ঠিক এই সময় সেখানে এসে হাজির হলেন একজন পুলিশ অফিসার।

চোখের পলকে একটা ঝোপে ঢুকে পড়লাম। অফিসারের চিৎকারে তার দলবল এসে হাজির হলো।

বরফের মত জমে গিয়ে যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ানেকড়েটা। আতঙ্কিত। কোণঠাসা। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে।

রাইফেল তুলল পুলিশেরা।

আমি গুলি করছি! একজন অফিসার বললেন।

আতঙ্কে পাথর হয়ে যেন তাকিয়ে আছি। ট্রিগারে চেপে বসল অফিসারের আঙুল। তারপর গুলি ফোঁটার প্রচণ্ড শব্দ।

ত্রিশ

ঝটকা দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল রাইফেলের নল। অফিসার ট্রিগার টেপার আগের মুহূর্তে ঠেলা দিয়ে নৃলটা ওপরের দিকে তুলে দিয়েছে বাবা। কারও কোন ক্ষতি না করে শূন্যে উঠে গেল বুলেট।

গুলি করবেন না! পরক্ষণে শোনা গেল বাবার চিৎকার। ওটা আমার ছেলে!

ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। আমার মায়ানেকড়ের মুখে হাসিটা কেমন দেখাল জানি না। দাঁত বদলের বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। বাবা ভাবছে ওটা আমি। রেনের জীবন বাঁচল।

মায়ানেকড়েটাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। জাল ছুঁড়ে আটকে ফেলল। কয়েকজনে মিলে চেপে ধরল মাটিতে। একনাগাড়ে গর্জন। করছে মায়ানেকড়েটা। কামড়ানোর চেষ্টা করছে। জালের ভিতরে শরীর মোচড়াচ্ছে।

আড়ালে থেকে আমি সবই দেখছি। মনে মনে প্রার্থনা করছি, প্লিজ, ওর কোন ক্ষতি করবেন না, ক্ষতি করবেন না!

পা ছুঁড়ছে মায়ানেকড়েটা। ধস্তাধস্তি বন্ধ করছে না। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু জালে আটক থেকে এত লোকের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না।

জালের মধ্যে রেখেই মোটা দড়ি দিয়ে ওটার পা বেঁধে ফেলা হলো। ছটফট করছে শুধু এখন মায়ানেকড়েটা। চাপা গোঙানি বেরোচ্ছে গলা দিয়ে।

আমার মায়ানেকড়ের চোখ দিয়ে অন্ধকারেও ওর চোখের বিষণ্ণতা দেখতে পাচ্ছি। ও বুঝে গেছে, পরাজিত হয়েছে। তবু শেষবারের মত নিজেকে মুক্ত করার জন্য মস্ত হাঁ করে কামড়ে দিতে চাইল একজন পুলিশের হাতে।

জালের ফাঁক দিয়ে ওর হাঁ করা মুখে লাঠি ঢুকিয়ে দিল একজন। লাঠির দুই মাথা ধরে মাথাটাকে মাটিতে চেপে ধরল।

সাবধান, ব্যথা দেবেন না! উদ্বেগে কাঁপছে বাবার গলা। পরাজিত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী করে আবার খাঁচা থেকে বেরোল ও, বুঝতে পারছি না। আমি কথা দিচ্ছি, আর এমন ঘটনা ঘটবে না।

আবারও বাবার অনুরোধ রাখল পুলিশ। মায়ানেকড়েটাকেসহ বাবাকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিল।

পুলিশ চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর সাবধানে, ছায়ায় গা ঢেকে বাড়ি ফিরে এলাম।

বসার ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম।

এটা তোমার দোষ নয়, রবিন। তুমি তো আর ইচ্ছে করে মায়ানেকড়ে হতে যাওনি। মোলায়েম- স্বরে বলতে বলতে মায়ানেকড়েটাকে খাঁচায় ভরছে বাবা। তাকে সহায়তা করছে কয়েকজন পুলিশ।

মায়ানেকড়ের মুখ থেকে লাঠিটা সরিয়ে আনল একজন। জালটা। সরাল আরেকজন। খাঁচার মেঝেতে পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। মায়ানেকড়েরূপী মানুষটা। আবার মানুষ হয়ে গেলে দড়ি খুলে দেয়ার কথা ভাবছে নিশ্চয় বাবা।

আরও শক্ত একটা খাঁচা জোগাড় করতে হবে তোমার জন্য, রবিন। দরজা লাগিয়ে তালা আটকে দিল বাবা। ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

পুলিশ চলে গেলে আমি ঘরে ঢুকলাম।

রেন, তুমি! হাঁ হয়ে গেছে বাবা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দুটো মায়ানেকড়ে! এতদিন একটা ধরতে পারছিলাম না, আর এখন আমার বসার ঘরে দু-দুটো মায়ানেকড়ে! আমি কী জেগে আছি?

লাফ দিয়ে আমার কাছ থেকে সরে গেল বাবা।

মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। মৃদু গরগর করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমি তার কোন ক্ষতি করব না।

গুড, মোলায়েম স্বরে বাবা বলল। এ রকম শান্ত হয়ে থাকো। তাহলে কিছু করব না।

চেয়ারে বসল বাবা। আমার দিকে তাকাল আবার। খাঁচার মায়ানেকড়েটার দিকে তাকাল। আবার আমার দিকে ফিরল।

সরি, বিড়বিড় করল বাবা। আর কোন উপায় নেই আমার। তোমাদের দুজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে।

ঝট করে মাথা উঁচু করলাম। বলে কী বাবা? যা বলছে, সত্যি সত্যি করবে সেটা?

সারা শহরে মানুষ, এতজনের জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি না আমি। একজনকে সামাল দেয়াই কঠিন, দুজনের দায়িত্ব নিতে পারব না।

না! পুলিশের হাতে ধরা দেব না! কিছুতেই না! ভাবলাম।

আমি সত্যি দুঃখিত, বাবা বলল। সারাটা জীবন একটা মায়ানেকড়ে ধরার স্বপ্ন দেখেছি আমি। এ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারিনি। ভুল করেছি, মস্ত ভুল। তার খেসারত এখন দিতেই হবে আমাকে। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল বাবা।

মত বদলেছে বাবা। আমাদের নিজের কাছে রাখতে চাইছে না আর। কিন্তু আমি তার ছেলে। নিজের ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চায়। মানতে পারছি না কোনমতে মত তাকে বদলাতেই হবে।

লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল বারা। পায়চারি করতে করতে বলল, কী করতে হবে বুঝে গেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে! কথাটা বলে যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিতে চাইল। যত বড় বড় ডাক্তার আছে, সবার কাছে যাব। ওঝার কাছে যাব। পীর-ফকির-দরবেশ, সবার হাতেপায়ে ধরব।

হ্যাঁ! আমি জানি! বাবা যে একটা উপায় বের করবেই, জানি। নিজের ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে না।

এ-সব কিছুর জন্য আমি দায়ী, বাবা বলছে। সব দোষ আমার। আমি মায়ানেকড়ে ধরতে না গেলেই আর এই বিপদে পড়তে হত না। তবে এক হিসেবে ভালই হলো। তোমার সঙ্গে সঙ্গে রেনকেও হয়তো ভাল করতে পারব। দুজনকে জেলের ভিতর বন্দি করে রেখে ডাক্তার-বৈদ্যের খোঁজে দুনিয়া চষে ফেলব আমি! তোমাদের সুস্থ করে তারপর আমার শান্তি।

টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বাবা। থাবা দিয়ে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। হ্যালো! থানা? আমি, রজার মিলফোর্ড। আমার ঘরে এখন দুটো মায়ানেকড়ে। লোক পাঠান। এখুনি নিয়ে যাক।

একত্রিশ

কোন ডাক্তার আমাদের ভাল করতে পারবে কিনা, নিশ্চিত নই। করতে না পারলে অকারণেই সারাটা জীবন জেলের ভিতর কাটাতে হবে। সেটা আমি পারব না। সারাজীবন খাঁচায় আটকে থাকতে রাজি নই আমি। তারচেয়ে বাবাকে ঠেকাই, যাতে আমাদেরকে পুলিশের হাতে দিতে না পারে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ও এখানেই আছে, টেলিফোনে বাবা বলছে।

রেনের দিকে তাকালাম। পা ছুঁড়ে দড়ি খোলার চেষ্টা করছে। বাবার কথা সে-ও শুনেছে। আমার মতই নিশ্চয় সারাজীবন খাঁচায় আটকে থাকতে রাজি নয়। গর্জন করে উঠল। হাঁ করা মুখের ফাঁকে লালা লেগে থাকা বড় বড় দাঁতগুলো চকচক করে উঠল।

ওর দাঁতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুদ্ধিটা মাথায় এল। কী করতে হবে বুঝে গেছি।

যা করার এখুনি করতে হবে। আমাদের দুজনের সমস্যার। সমাধান।

বাবার সাহায্য আমাদের দরকার হবে। তাকে দিয়েই খাঁচার তালাটা খোলাতে হবে।

আর সেটা করাতে হলে বাবাকেও আমাদের দলে আনতে হবে। মায়ানেকড়ে বানাতে হবে।

লাফ দিয়ে বাবার গায়ে পড়তে যা, ঠিক এই সময় দরজার কলিং বেল বাজল।

খুলে দিল বাবা।

বাইরে থেকে শোনা গেল, এটা কি মিস্টার রজার মিলফোর্ডের বাড়ি?

আমি রজার মিলফোর্ড, বাবা বলল। আপনি?

আমি সেক্সটন ব্র্যাডম্যান, জবাব শোনা গেল। ভিতরে আসতে পারি? জরুরি কথা আছে।

আসুন, সরে পথ করে দিল বাবা।

একটা কালো ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলেন একজন মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক। গায়ে আলখেল্লা। চোখ দুটো কালো, চকচকে। লম্বা লম্বা। পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে।

চেনা চেনা লাগল তাঁকে। ওই আলখেল্লা, ওই চোখ, কোথায় দেখেছি?

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। বনের ভিতর! ব্র্যাটভিয়ার বনে তাঁবুতে ঢুকে যে মানুষটা আমাকে অলৌকিক ক্ষমতাশালী দাঁত দিয়েছিলেন, ইনি সেই লোক, কোন সন্দেহ নেই।

আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন, দাঁতটা গলা থেকে খুললে কেন? বেনকে বাঁচাতে? সেজন্যেই তো অশুভ চিন্তা মাথায় ঢুকছে। এক্ষুনি তো তোমার বাবাকে কামড়ে দিতে যাচ্ছিলে।

আপনি…আপনি…বাবা বলল।

নাম তো বললামই। আমি একজন অকালটিস্ট। ভূতপ্রেত, ভ্যাম্পায়ার, মায়ানেকড়ে নিয়ে কারবার আমার, ওদের নিয়ে গবেষণা করি। ব্র্যাটভিয়ার বনে অনেক দিন থেকেছি। রবিন যে সাপুড়ের কেবিনে ঢুকেছিল, ওটা আমিই বানিয়েছিলাম।

তারমানে…তারমানে আপনিই সেই সন্ন্যাসী, যিনি অহঙ্কারী লোকটাকে মায়ানেকড়ে বানিয়েছিলেন? মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম।

মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালেন ব্র্যাডম্যান। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন আমার না-বলা প্রশ্ন। বললেন, পরে আবার সারিয়েও তুলেছি। প্রচুর শাস্তি হয়েছে ওর। পূর্ণিমার পর এসে আমার হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করল। অনেক করে ক্ষমা চাইবার পর ওকে ওই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছি।

এগিয়ে এসে ব্র্যাডম্যানের দুই হাত চেপে ধরলেন মিস্টার মিলফোর্ড। প্লিজ, আপনি আমার ছেলেকে ভাল করে দিন! প্লিজ!

ভূতপ্রেত নিয়ে কারবার করা খুব বিপজ্জনক, মিস্টার মিলফোর্ড। কোনমতেই মায়ানেকড়ে ধরতে যাওয়া উচিত হয়নি আপনার। ভাগ্যিস, রবিনকে আমি বনে দেখে ফেলেছিলাম। ওকে ভাল লেগে গিয়েছিল। আমার চোখে না পড়লে মস্ত ক্ষতি হয়ে যেত ওর। যাই হোক, ওকে আর রেনকে আমি সারিয়ে তুলব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

কিন্তু গ্রীনহিলসে যে মায়ানেকড়ের উৎপাত হচ্ছে আপনি জানলেন কী করে?

টেলিভিশনে দেখে, ব্র্যাডম্যান জবাব দিলেন। খবরটা দেখে আর। এক সেকেন্ডও দেরি করিনি। পরের প্লেনটাই ধরেছি।

কাজটা করতে কোনও উপকরণ লাগবে?

সব আছে। শুরু করছি, তবে তার আগে কথা দিতে হবে আপনাকে, জীবনে আর এ-সব বিপজ্জনক কাজ করতে যাবেন না।

আরও করি? একবারে শিক্ষা হয়নি?

বেশ, আসুন এখন। আমাকে হেল্প করুন। মেঝেতেই বসে পড়লেন ব্র্যাডম্যান। কালো ব্যাগ খুলে তা থেকে তার জিনিসপত্র বের করতে শুরু করলেন।

প্রথমে তিন রঙের তিনটে চক দিয়ে চক্র আঁকলেন তিনি। তাতে বড় একটা তারা আঁকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, রবিন, এসো। বোসো এই চক্রের ভিতর।

আমার ভিতর কোথায় যেন একটা আক্রোশ মতো তৈরি হচ্ছে। বিদ্রোহ করতে চাইছে মগজ।

ঝট করে একটা শিকড়ের টুকরো আমার দিকে উঁচু করে ধরলেন অকালটিস্ট। কঠিন দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন, জলদি এসো! শয়তানি করে লাভ হবে না! এসো! এসো বলছি!

সেই চোখের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। শিকড়ের টুকরোটা যেন চুম্বকের মত টেনে নিয়ে চলল আমাকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। চক্রটার ভিতর ঢুকে তারাটার ওপর দাঁড়ালাম।

আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে কীসব পড়তে শুরু করলেন ব্র্যাডম্যান।

ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি…

হঠাৎ দেখি, ব্র্যাডম্যান ঘরে নেই। আমি সেই আগের মত বসার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। রেন খাঁচায় আটকানো। বাবা আমার দিকে পিছন ফিরে কাকে ফোন করছে। বোধহয় পুলিশকে।

উঁহু, আর সুযোগ হাতছাড়া করব না। আঁপিয়ে পড়লাম বাবার কাঁধে।

চমকে উঠল বাবা। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। হাত থেকে খসে পড়ল রিসিভার।

তারপর দেখি, রাস্তা দিয়ে চারপায়ে দৌড়ে চলেছি আমি আর রেন। বাবা পিছন পিছন আসছে। মানুষই আছে। মায়ানেকড়ে হয়নি এখনও।

দুটো মায়ানেকড়ের গর্জনে জেগে উঠল আমাদের প্রতিবেশীরা। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আতঙ্কিত হয়ে তারা দেখল, রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে দুটো মায়ানেকড়ে আর একজন মানুষ। ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন মানুষটা।

থেকে থেকেই গর্জে উঠছে মায়ানেকড়ে দুটো।

রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে দৌড়ে চলেছে।

দৌড়ে চলেছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার মধ্যে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাবাও মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে।

এভাবেই সমস্যাটার সমাধান করেছি আমি। জেলে যাওয়া ঠেকিয়েছি।

শহরের পাশে যে বন আছে, সেই বনটাই এখন আস্তানা হবে আমাদের।

তবে খুব বেশিদিন আমাদেরকে লুকিয়ে থাকতে হবে না, জানি। খুব শীঘ্রি আমাদের তিনজনের কামড়ে আরও অনেকে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। তারাও কামড়াবে। মানুষ, পশু, যাকে পাবে তাকেই। সারা শহরে একটা প্রাণীও আর স্বাভাবিক থাকবে না। পুলিশও না।

দেখতে দেখতে এক আজব শহরে পরিণত হবে আমাদের শহরটা।

মায়ানেকড়ের শহর!

বনে ঢুকলাম। দেখি, নেকড়েতে গিজগিজ করছে বন। কিন্তু ওরা কেউ আমাদের বন্ধু হলো না। আমাদের দেখেই কামড়াতে এল।

আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম।

শীত করতে লাগল। ভীষণ ঠাণ্ডা। কাঁপুনি উঠে গেছে…

ঘোর কেটে গেল। চোখ মেলে দেখি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছি। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছেন মিস্টার ব্র্যাডম্যান। আমাকে চোখ মেলতে দেখে হাসলেন। ফিরে তাকালেন পাশে বসা বাবার উদ্বিগ্ন। মুখের দিকে। বললেন, মিস্টার মিলফোর্ড, ও ভাল হয়ে গেছে। নিয়ে গিয়ে ওকে ওর ঘরে শুইয়ে দিন। কম্বল দিয়ে ভালমত ঢেকে দেবেন। তাহলেই কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যাবে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। নাস্তার টেবিলে বাবা জানাল, ব্র্যাডম্যান চলে গেছেন। রেনকে সুস্থ করে নিয়ে গেছেন ব্র্যাটভিয়ায়। বলে গেছেন, ভয় নেই, আর কখনও মায়ানেকড়ে হব না আমি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *