২০
রুদ্র ম্লানমুখে ঘরে ঢুকতেই প্রিয়ম বলল, ”এসে গেছ? দাঁড়াও, শুভাশিসদাকে ফোন করি।”
”কে শুভাশিসদা?” ক্লান্ত শরীরে রুদ্র বসে পড়ল সোফায়।
”আরে, সেই যে, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশধর। আমার ছোটবেলার বন্ধু। তোমায় বলেছিলাম না? এখন আমেরিকায় থাকে। তুমি যে ওর কাছ থেকে কিছু জানতে চাও, সেটা ওকে বলেছি।” প্রিয়ম মোবাইলে নম্বর টিপছিল, ”ওকে ডেটা কল করছি দাঁড়াও।”
”আর করে কোনো লাভ নেই।” রুদ্র হাত তুলল, ”ডি এম আর এস পি জয়েন্ট মিটিং এ আজ আমাদের মিশনটা ক্যানসেল করে দিলেন।”
”ক্যানসেল করে দিলেন?” প্রিয়ম হাঁ, ”কেন?”
রুদ্র বলল, ”এস পি স্যার তো প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, এখন ডি এম ও বলছেন, তেমন কোনো প্রোগ্রেস যখন নেই, তখন সম্ভবত সব কটা কেসই ডিসটিংক্ট। কোনো লিঙ্ক নেই। তো লোক্যাল থানা যেমন তদন্ত চালাচ্ছে চালাক। আমাদের আর রেখে কী হবে। বরং সামনে পুরসভা ভোট, সেইদিকে নজর দিতে বললেন।”
”যাব্বাবা!” প্রিয়ম বলল, ”তবে যে তুমি রাত জেগে এত পড়াশুনো করলে, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা মুখস্থ করে ফেললে?”
”ওই তিথিনক্ষত্রের মিলটা হয়তো নেহাতই কাকতালীয়।”
”আর প্রত্যেকটা দোকানে ভাঙচুর?”
”সেটাও হয়তো ক্ষতি করার জন্য। সব দোকানে তো হয়নি।” রুদ্র বলল, ”আর কিছু অপশন তো দেখছি না। সিরিয়াল কিলিং এর সম্ভাবনাটা আস্তে আস্তে ফেডেড আউট হয়ে যাচ্ছে। হায়ার অথরিটি যখন আর ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না, আমি আর কী করতে পারি! যাকগে বাদ দাও, ক্ষমা’র কী খবর?”
”এখন একটু বেটার। কোনো কারণে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মা মেয়ে দুটোই ভিতুর ডিম। সবেতেই ভয়।” প্রিয়ম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ওর ফোনে একটা কল ঢুকতে লাগল।
”শুভাশিসদা ভিডিও কল করছে।” প্রিয়ম বলল, ”আচ্ছা, তবু একবার ওর সাথে কথাটুকু বলে নাও। আমি বলে রেখেছি, বেচারা খারাপ ভাববে।”
রুদ্র হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করল, ”হ্যালো, নমস্কার শুভাশিসবাবু।”
স্ক্রিনে একজন ফর্সা গোলগাল টাকমাথা চেহারার ভদ্রলোক দেখা গেল। পরনে লাল টি শার্ট, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট। মুখখানা হাসি হাসি।
”হ্যাঁ নমস্কার। আসলে প্রিয়ম বলল, আমাদের বাড়িতে একটা মার্ডার হয়েছে, আর আপনি তার তদন্ত করছেন?”
রুদ্র বক্রচোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। ভ্রূ কুঁচকে স্ক্রিন থেকে সরে ফিসফিস করে চোখ পাকিয়ে বলল, ”আমি লোকের বাড়ি বাড়ি মামুলি খুনের তদন্ত করি?”
প্রিয়ম হাত উলটে কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র ওকে থামিয়ে দিয়ে স্ক্রিনের সামনে এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ”হ্যাঁ, মানে ওইরকমই। সোমনাথ ভট্টাচার্য বলে একজন শরিকের ভাড়াটে যিনি বাড়ির একদিকে দোকান চালাতেন, তিনি খুন হয়েছেন।”
”হ্যাঁ, আমি খবর পেয়েছি।”
”আচ্ছা, আপনি কোন শরিকের বংশধর?”
”আমি কোনো শরিক বললে ঠিক বুঝতে পারবেন না। আসলে আমাদের বাড়ির হায়ারার্কিটা এত জট পাকানো। সময় থাকলে বলতে পারি।” শুভাশিসবাবু আবার হাসলেন।
”হ্যাঁ বলুন না।” রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল।
”আপনি নিশ্চয়ই জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কথা শুনেছেন। উনি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা। উনি প্রায় একশো বারো বছর বেঁচেছিলেন, জানেন নিশ্চয়ই। নিজের নাতির নাতিকেও দেখে গিয়েছেন। তো, বংশের ডালপালা এত বিস্তার করেছে যে ওই বিশাল জগদ্দলের মতো বাড়ির বাসিন্দা হয়েও আমরা সবাই সবাইকে চিনি না।”
”মানে আপনি সোমনাথবাবুকে চেনেন না?”
”না। সম্ভবত উনি নকলদাদুর বংশধর। নকলদাদুর বাড়ির কাউকেই আমি চিনিনা। কারণ আমি যখন আমেরিকায় চলে আসি, তা ধরুন, প্রায় দশবছর হল, নানা ঝামেলায় আমাদের সঙ্গে ওদের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।”
”মাফ করবেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” রুদ্র বলল, ”নকলদাদু মানে?”
শুভাশিসবাবু বললেন, ”আপনার না বোঝারই কথা। আমাদেরই মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়। আসলে আমার ঠাকুরদার বাবা শ্রী রমণীমোহন ভট্টাচার্যর ছিল একটিমাত্র পুত্র। কিন্তু কোনো কারণে সেই পুত্রর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। তখনকার দিনের ব্যাপার, তিনি ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। এদিকে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশ বলে কথা, বংশরক্ষা তো করতেই হবে। তখন তিনি দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের পুত্রকে দত্তক নেন। সেই দত্তক পুত্র বাড়ির ছেলে হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর আগে রমণীমোহন নিজের ছেলেকে ক্ষমা করেন ও বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। উইলও পরিবর্তন করেন। এইভাবে আমাদের বংশের দুটো ধারা হয়ে যায়। রমণীমোহন ভট্টাচার্যের আসল পুত্রকে আমরা বলতাম আসল দাদু। আর দত্তক পুত্রকে নকল দাদু। এইভাবেই চলতে থাকে। আমি হলাম আসল দাদুর বংশধর। নকল দাদুর সঙ্গে আসলে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।”
”বুঝলাম। আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মধুময় ভট্টাচার্য, উনিও কি নকলদাদুরই বংশধর?”
”ঠিক বলেছেন। মধুময়কাকাকে মনে আছে। উনিও ওই তরফের। নকলদাদু নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর ওদের ছেলেমেয়েরা এখন ওই দিকটাতেই থাকে। আমরা থাকি পেছনদিকটায়। তাও থাকি বলতে, ঘরগুলো পড়ে আছে তালাবন্ধ হয়ে। বেশিরভাগই বাইরে। তবু আমরাই উদ্যোগ নিয়ে দুর্গাপুজোটা করি।”
”নকল দাদু নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন? কেন?”
”সে অনেক ব্যাপার! বহু বছর আমেরিকায় ছিলেন, তারপর দেশে ফিরে… আসলে রক্তের সম্পর্ক নেই তো, ওরা বরাবরই একটু অন্যরকম। রমণীমোহনের সাময়িক হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য এত জটিলতা।” শুভাশিসবাবুর ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল, ”বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।”
”ও আচ্ছা!” রুদ্র অন্যমনস্কভাবে বলল, ”ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আমার একটা ফোন ঢুকছে, আপনি একটু প্রিয়মের সঙ্গে কথা বলুন।”
ফোনটা প্রিয়মের হাতে দিয়ে রুদ্র বাইরের বাগানে নেমে এল। লোকেশবাবু ফোন করছেন।
”হ্যাঁ বলুন।”
”ম্যাডাম, একটা ব্যাপার বলার ছিল।”
”কী?”
”ওই যে চন্দননগরের মহম্মদ তারেক, ওর দেশের বাড়ি সুগন্ধার দিকের এক গ্রামে। মানে ওর বউ তাই বলেছিল জেরায়। সুগন্ধা জানেন তো? চুঁচুড়া মহকুমাতেই, পোলবা দাদপুর ব্লক।”
”জানি। তো?”
”আপনি সেদিন আমাকে হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর মহম্মদ তারেকের কেসদুটো নতুন করে ইনভেস্টিগেট করতে বললেন, তাই আমি খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। তো, সুগন্ধায় গিয়ে সবকটা গ্রামে ঘুরলাম, কিন্তু কেউ মহম্মদ তারেকের বাড়ির কোনো খোঁজ দিতে পারল না। আমি ফেরত এসে ওর বউকে জিজ্ঞেস করলাম। তো আমিনা বিবি বলল, ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’মাস। ও নিজেও কোনোদিন তারেকের দেশের বাড়িতে যায়নি। দুজনে চুঁচুড়া স্টেশন চত্বরের বস্তিতে থাকত, সেখান থেকেই পরিচয়। তারেক সেখানে একাই থাকত, পরিবার পরিজন বলতে কেউ ছিলনা।”
”তারপর?” রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল। দূরে দেখতে পাচ্ছিল ক্ষমাকে।
আজ ক্ষমার ভয়টা একটু কেটেছে। সে আবার বাগানের একদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
”তারপর আমি তারেকের ছবি নিয়ে সুগন্ধায় গেলাম। সেখানকার ব্লক অফিসের সাহায্য নিয়ে সব গ্রামগুলোয় ঘুরলাম। তো একটা গ্রামের নাম বদনপুর। খুব রিমোট গ্রাম। বাঁশবেড়িয়ার গঙ্গা থেকে একটা খাল বয়ে গিয়েছে পশ্চিমমুখে, সেই খালের ধারে। তো বদনপুর গ্রামের একটা লোক তারেকের ছবি দেখতে চিনতে পারল। কিন্তু বলল, ওর নাম তারেক নয়।”
”তারেক নয়? তবে কী?”
”তা মনে করতে পারল না ম্যাডাম। তবে বলল, তারেক মুসলিম নয়। হিন্দু। কয়েকবছর আগে কোথা থেকে যেন হঠাৎ এসেছিল, আবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। যে ক’দিন ছিল, গ্রামের মন্দিরের বাইরে শুয়ে থাকত, মুড়ি-চিঁড়ে এইসব খেত। আর চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোত। লোকটা আমাকে ওই মন্দিরের পূজারির কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সেও কিছু বলতে পারলনা।”
”হুম। রিয়েলি কমেন্ডেবল জব, লোকেশবাবু! কিন্তু আনফরচুনেটলি আমাদের মিশনটা অ্যাবর্ট করা হয়েছে। আপনি হয়তো আজকের মধ্যেই অফিশিয়াল লেটার পেয়ে যাবেন রুটিন ডিউটিতে ফিরে যাওয়ার জন্য। তাই এ’সব জেনে আর কোনো লাভ নেই।” রুদ্র ম্লানস্বরে কথাগুলো বলল। তারপর ফোনটা রেখে এগিয়ে গেল ক্ষমার দিকে।
মেয়েটাকে কাল থেকে সময় দেওয়া হয়নি।
২১
”ক্ষমা?” রুদ্র এগিয়ে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল।
”উঁ?” মেয়েটা যেন ভূত দেখেছে, এইভাবে চমকে উঠল আকস্মিক ডাকে, ভয়ার্তচোখে একবার তাকাল ওর দিকে, তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ে মাটির মধ্যে কী করতে লাগল।
ভেজা মাটি। আজ ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। মালি সনাতন কয়েকদিন হল আসেনি। ক্ষমা একটা খুরপি নিয়ে একটা জায়গায় বেশ কিছুটা মাটি খুঁড়েছে, এখন সেই মাটির মধ্যে থেকে কাঁকড় বাছছে। এর মধ্যেই সে এত কাঁকড় বেছেছে, যে ছোটখাটো একটা কাঁকড়ের পাহাড় হয়ে গেছে।
”কী করছিস তুই?”
ক্ষমা বলল, ”গাছ লাগাব।”
”কী গাছ?”
ক্ষমা বলল, ”তুলসী গাছ। তোমার এত বড় বাড়ি, অথচ তুলসীমঞ্চ নেই কোথাও। ঠাকুর পাপ দেবেন না?”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ”ক্ষমা, তুই কাকে দেখে অত ভয় পেলি সেদিন?”
ক্ষমার মুখটা আবার বিবর্ণ হয়ে গেল। ফ্যাকাসে চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে, তারপর বলল, ”উঁকি মারছিল। আমার … আমার ভাশুরপো।”
”ভাশুরপো মানে?” রুদ্র বলল, ”কীসব উলটোপালটা বকছিস তুই?”
”ঠিকই বলছি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে গো। আমি না গেলেও জোর করে নিয়ে যাবে। তারপর … তারপর জোর করে …!”
”তারপর? তারপর কী?” রুদ্র ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করে।
ক্ষমার চোখদুটো যেন ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, গলাটা কেমন ফ্যাসফেসে শোনায়। ঢোঁক গিলে বলে, ”তারপর পরম গুরুর চরণামৃত খাইয়ে…।”
”অ্যাই ক্ষমা, কী সব বকছিস তুই?”
রুদ্র চমকে তাকায়। দেখে, মল্লিকাদি কখন এসে দাঁড়িয়েছে পায়ে পায়ে। মল্লিকাদি যেন ওকে দেখতেই পায়না, দ্রুতপায়ে এসে ক্ষমাকে টেনে হিঁচড়ে কোলে তুলে নেয়। তারপর রুদ্রর কিছু বলার অপেক্ষা না করেই সোজা চলে যায় বাড়ির ভেতরে।
রুদ্র কিছু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। পাঁচু এর মধ্যে বাগান ও বাইরের সব আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আলো- আঁধারির মধ্যে সবকিছু ওর কেমন রহস্যময় ঠেকতে লাগল।
ওর হঠাৎ মনে হল, এই যে মল্লিকাদি আর ওর মেয়ে ক্ষমা গত কয়েকমাস ধরে ওর বাংলোয় রয়েছে, ওদের পরিচয় সম্পর্কে ও কী জানে? এইভাবে অজ্ঞাতপরিচয় কাউকে দিনের পর দিন নিজের সরকারি বাসস্থানে থাকতে দিয়ে ও কি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে?
আচ্ছা, মল্লিকাদি কি সত্যিই ক্ষমার মা? নাকি ক্ষমার মতো একটা বাচ্চামেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে চলে এসেছে? শিশুপাচার জাতীয় কোনো ব্যাপার নেই তো? কিন্তু, মল্লিকাদি যদি কোনো অপরাধই করে থাকে, তবে সে মেয়েকে নিয়ে খোদ পুলিশ বাংলোর সামনে বসে থাকবে কেন?
রুদ্র কী করবে বুঝতে পারেনা, বাগানেরই একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ভাবতে থাকে আকাশপাতাল।
প্রিয়ম রাতে সব শুনে বলল, ”ধুস, ওসব কিছু নয়। তবে, এটা ঠিক, ওদের কিছু একটা গন্ডগোলের ব্যাপার আছে। আমিও কয়েকটা ব্যাপার নোটিস করেছি, তোমায় এতদিন বলিনি।”
”কী?”
”একদিন আমি একটা এমনি কারণ দেখিয়ে মল্লিকাদি’র কাছ থেকে আইডি চেয়েছিলাম। ভোটার আধার, যা হোক কিছু। ও কিছুই দিতে পারেনি। যেটা খুবই অস্বাভাবিক। রুদ্র, তোমার ওদের শেল্টার দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।”
”তাহলে এখন কী করবো?” রুদ্র খেতে খেতে বলল, ”ওদের কোনো কারণ ছাড়া তাড়িয়ে দেওয়া যায় নাকি? মেয়েটা পড়াশুনো শিখছে, মল্লিকাদি’ও যাহোক একটা আশ্রয় পেয়েছে, কিছুতেই এখন চলে যেতে বলা যায় না।”
”সে নাহয় বললে না। কিন্তু ওদের আসল পরিচয় জানার রাইট নিশ্চয়ই তোমার রয়েছে।” প্রিয়ম বলল, ”সরকারি বাংলোয় রয়েছ, নিজেও একটা দায়িত্বপূর্ণ পোস্ট হোল্ড করছ, কিছু গন্ডগোল হলে তুমিই কিন্তু ফাঁসবে, এটা মনে রেখো!”
২২
প্রিয়মের সাবধানবাণী অদ্ভুতভাবে ফলে গেল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রুদ্রদের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করা বন্ধ করলেও হুগলী জেলায় হত্যালীলা বন্ধ হল না।
৬ জুলাই থেকে ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে দুটো চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল।
এক, হুগলী জেলার অন্যতম বড় বেসরকারি নার্সিংহোম ‘বাসুদেব ভবন’ এর একচ্ছত্র মালিক ড. সুবল ভট্টাচার্য খুন হলেন। ৮ই জুলাই গভীর রাতে। বাঁশবেড়িয়ায়।
দুই, মল্লিকাদি বাংলো চত্বরেই ভয়ংকর ভাবে খুন হল।
ঘটনার সূত্রপাত বেলা বারোটা নাগাদ। সেদিন রুদ্র বা প্রিয়ম কেউই ছিল না। মল্লিকাদি ক্ষমার হাত ধরে গঙ্গার পাশের রাস্তা ধরে গিয়েছিল কাছের একটা দোকানে টুকিটাকি জিনিস কিনতে। পুলিশ বাংলোর দিকটা এমনিতেই বেশ নির্জন থাকে, তার ওপর গ্রীষ্মের দুপুর।
জ্যোৎস্নাদি রান্নাঘরে ব্যস্ত, এমন সময় মল্লিকাদি ছুটতে ছুটতে এল। তার ঘোমটা খসে পড়েছে। চোখ উদ্ভ্রান্ত, মুখে আতঙ্ক উপচে পড়ছে। হাউমাউ করে বলল, ”আমার ক্ষমাকে … আমার ক্ষমাকে ওরা ধরে নিয়ে গেল গো!”
”কারা ধরে নিয়ে গেল? কোথায় ধরে নিয়ে গেল?” বলতে বলতে জ্যোৎস্নাদি যখন বেরিয়ে এল, যখন বাংলোর সামনে প্রহরারত দুই গার্ডকে নিয়ে ছুটল নদীর দিকে, ততক্ষণে সব শুনশান। ক্ষমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। শুধু রাস্তার এককোণে পড়ে রয়েছে ক্ষমার বেগুনি রঙের ফ্রকের একটা অংশ। ধস্তাধস্তিতে ছিঁড়ে গেছে সেটা।
এ এস পি বাংলো থেকে মাত্র একশো মিটার দূরত্বে এমন কাণ্ডে সবাই হতভম্ব। মল্লিকাদি কাঁপছে থরথর করে। গ্রামের সহজ সরল অশিক্ষিত মহিলা সে। জ্যোৎস্নাদি’কে খবর দেওয়ার আগে যে বাংলোর বাইরের গার্ডদুটোকে ডাকা উচিত ছিল কিংবা উচিত ছিল তারস্বরে চিৎকার করার, সে’সব মাথায় আসেনি তার।
কিন্তু আসল ঘটনার তখনও বাকি ছিল।
রুদ্র সেদিন এস পি রাধানাথ স্যারের অফিসে একটা মিটিং এ ছিল। আসন্ন পুরসভা ভোটের ব্যাপারে কোর্স অফ অ্যাকশন সংক্রান্ত একটা আর্জেন্ট মিটিং ডেকেছিলেন স্যার। খবর পেয়ে যখন প্রায় আধঘণ্টা পরে এল, তখন জ্যোৎস্নাদি হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে। মল্লিকাদি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে বাগানের মাঝখানের লবিতে। যেখানে ক্ষমা খেলে বেড়াত।
রুদ্র প্রথমেই সঙ্গে আসা পুলিশদের পড়ে থাকা ফ্রকটা কালেক্ট করতে বলল। তারপর জয়ন্তকে ওদিকটা দেখতে বলে শক্ত হাতে মল্লিকাদি’কে নিয়ে গিয়ে ঢুকল ওদের ঘরে।
মল্লিকাদি নিজের ঘরে ঢোকামাত্র থেবড়ে বসে পড়ল। তার চুল আলুথালু। আঁচলের প্রান্ত এলিয়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। চোখ দিয়ে ঝরছে জল। বিড়বিড় করে কী যেন বকে চলেছিল নিজের মনে।
রুদ্র দরজা বন্ধ করে তীক্ষ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ”দ্যাখো মল্লিকাদি, তুমি যদি সত্যি কথা বলো, আমি কিছু বলব না। তোমরা কারা? ক্ষমাকে কারা ধরে নিয়ে গেল? কেন ধরে নিয়ে গেল? কী করেছ তোমরা?”
মল্লিকাদি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, সে এবার মুখে আঁচলচাপা দিয়ে কাঁদতে লাগল। পাশেই জানলা, উঠে দাঁড়িয়ে জানলার রেলিং ধরে সে ফোঁপাতে থাকল। কান্না চাপার প্রাণপণ চেষ্টায় তার ছোটখাটো শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছিল।
”মল্লিকাদি!” কিছুটা অস্থির হয়ে বলল রুদ্র, ”তুমি বললে ভালো, নাহলে আমি বাধ্য হব তোমাকে বাংলো থেকে বের করে দিতে। শুধু তাই নয়, তোমার বিরুদ্ধে আমি অ্যাকশনও নেব।”
”না দিদি! আপনার পায়ে পড়ি।” মল্লিকাদি এবার কেঁদে ফেলল, ”আপনি আমায় বন্দি করে রেখে দিন তাও ভালো, কিন্তু বাংলোর বাইরে ছাড়বেন না। বাংলোর বাইরে গেলে ও-ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!”
”ওরা মানে কারা? কারা তোমায় মেরে ফেলবে?” রুদ্র চোখ সরু করল।
”বলছি। কিন্তু আপনি আমায় ঠিক বাঁচাবেন তো দিদি?” মল্লিকাদির মুখেচোখে আতঙ্ক, ”ওরা কিন্তু ভয়ঙ্কর!”
”আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা মল্লিকাদি!” রুদ্র বলল, তুমি বলো, এই ওরা কারা?”
মল্লিকাদি কোনোমতে নিজেকে সামলে কী যেন একটা বিড়বিড় করতে শুরু করল, কিন্তু বলতে পারল না। হঠাৎ কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল সামনের দিকে।
রুদ্র ছুটে এগিয়ে গিয়ে দেখল, ওর ঘাড়ের পেছনে ফুটে রয়েছে অনেকটা লম্বা একটা তির।
মল্লিকাদির মুখ যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে। তবু তার মধ্যেই ও যেন আপ্রাণ চেষ্টায় কী বলতে চাইল। কিন্তু বলতে পারল না। কয়েকবারের চেষ্টার পর চোখের পাতাগুলো নিঃস্পন্দ হয়ে থেমে গেল। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল একদিকে।
রুদ্র দ্রুত গতিতে বাইরে বেরিয়ে এল। জয়ন্ত দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের নিয়ে ও ছুটতে লাগল বাংলোর পেছন দিকের বাঁশবাগানে। মল্লিকাদির ঘরের জানলার বাইরে রয়েছে সেই জঙ্গল।
বাংলো থেকে বেরিয়ে পেছনদিকে ঘুরে পৌঁছতে হয় সেই বাঁশবাগানে। রুদ্ররা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন বিশাল বাঁশবাগান পুরো শুনশান।
”কিন্তু এদিকটায় ঢুকল কীভাবে!” জয়ন্ত বলল।
”পার্থ আর তিমির, তোমরা ভালো করে সার্চ করো। এখনো হয়তো এখানেই লুকিয়ে রয়েছে।” রুদ্র চাপাস্বরে দুজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিল।
প্রচণ্ড ঘন বাঁশবাগান। মাঝেমাঝে মাথা চাড়া দিয়েছে অন্যান্য গাছ। যত্নের অভাবে এতটাই দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছে যে দিনের আলোটুকুও ভালো করে ঢুকছেনা।
রুদ্র পুলিশ ইউনিফর্মেই ছিল। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ও সন্তর্পণে এগোচ্ছিল একেকটা গাছের পাশ দিয়ে। ওপর দিকে দেখছিল মাঝে মাঝে। যদিও গাছের ওপর লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা কম। মল্লিকাদির ঘাড়ে যে তিরটা এসে ফুটেছে, সেটা নীচ থেকে ওপরদিকে গেঁথে রয়েছে। কেউ নীচু জায়গা থেকে ধনুকের জ্যা টেনেছে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রায় আধঘণ্টা খোঁজার পর রুদ্র হাল ছেড়ে দিল। পার্থ আর তিমিরও ফিরে এসেছে হতাশ মুখে।
ক্লান্ত দেহে ওরা যখন বাংলোয় ফিরে এল, তখন জ্যোৎস্নাদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইতিমধ্যেই এ এস পি বাংলো ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছে আরও বেশ কিছু পুলিশ। রাধানাথ স্যার সব শুনে নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাদের।
মল্লিকাদির নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে রয়েছে মাটিতে। ঘাড়ের নীচ দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত।
কেউ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে পুলিশ বাংলোর মধ্যে কেউ খুন হতে পারে!
রুদ্র চোখ সরু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে বসে দেখতে লাগল গেঁথে থাকা তিরটা। খুব সরু করে ছুঁলে তৈরি করা বাঁশের তির, কিন্তু ফলাটা ধাতব। নিশ্চয়ই ফলায় বিষ জাতীয় কিছু মাখানো রয়েছে, নাহলে মল্লিকাদির এত দ্রুত মৃত্যু হত না। ফরেনসিক টেস্টেই বোঝা যাবে।
ওর কানে বাজছিল মল্লিকাদি’র বলা শেষ কথাগুলো!
আপনি আমায় ঠিক বাঁচাবেন তো দিদি?
২৩
এস পি রাধানাথ রায় থমথমে মুখে বললেন, ”সেই জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। সাতখানা বিজনেসম্যান মার্ডার। ‘বাসুদেব ভবন’ এর মতো বড় নার্সিং হোমের মালিক বলে কথা! এবার আমাদের প্রত্যেকের বদলি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আর রুদ্রাণী, তোমাকে আর কী বলব! শ্রীরামপুর পুলিশের এতবছরের ইতিহাসে যা কখনো হয়নি, তুমি তা করে দেখালে। প্রতিটা নিউজপেপারের ফ্রন্ট স্টোরি, শ্রীরামপুর এ এস পি বাংলোয় খুন। পুলিশ বাংলোয় সবার নাকের ডগা দিয়ে একটা জলজ্যান্ত মার্ডার। হোপলেস! আমার আর কিছু বলার নেই।”
বিশাল ঘরের গোল কনফারেন্স টেবিলের একেকটা আসনে বসে রয়েছে সবাই। প্রত্যেকের সামনে বাধ্যতামূলক জলের বোতল। গোটা ঘরটায় এমন এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, যে ঘরের একপাশে দাঁড় করানো বিশাল গ্র্যান্ডফাদার’স ক্লকটার পেন্ডুলামের শব্দটা বড় কর্কশভাবে কানে লাগছে।
রুদ্রর মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। সবার সামনে এত বড় অপমানে ওর কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কিন্তু এস পি স্যারের কথাগুলো অপ্রিয় হলেও মিথ্যে তো নয়!
আজ আবার চুঁচুড়ায় ডি এম অফিসে হাই এন্ড মিটিং ডাকা হয়েছে। জেলাশাসক ছাড়াও এসেছেন চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার মি. সুনীত বসু এবং প্রতিটি মহকুমার পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। যেহেতু রুদ্র ওই ইনভেস্টিগেশন টিমের হেড ছিল, সবার চেয়ে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাকেও রাখা হয়েছে মিটিং এ।
”দাঁড়ান মিঃ রায়।” পুলিশ কমিশনার সুনীত বসু অভিজ্ঞ আই পি এস, তিনি বোধ হয় একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাতে চাইলেন এই তরুণী অফিসারটিকে। বললেন, ”মিসেস সিংহরায়, আপনাদের টিমটার প্রোগ্রেস কতদূর হয়েছিল?”
রুদ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ”আমরা তো প্রতিটা কেসই আলাদাভাবে ইনভেস্টিগেট করা শুরু করেছিলাম স্যার। বেশ কিছু ক্ল্যুও পেয়েছিলাম যাতে করে লিঙ্ক করা যায়। কিন্তু তারপরই ডি এম ম্যাডাম কাজটা পোস্টপোন করতে বললেন …।”
”হুম।” সুনীত বসু শ্রীরামপুরের এস পি’র দিকে তাকালেন, ”আমার মনে হয়, একটা স্পেশাল টিম যখন কাজ শুরু করেইছিল, ওরাই আবার রেজিউম করুক, সেটাই বেটার হবে।”
এস পি রাধানাথ রায় তখনও বিরক্ত। বললেন, ”কিন্তু স্যার, রুদ্রাণী নিজের বাংলোয় এতদিন দুজন অচেনা মানুষকে রেখে দিল, তাদের কোন আইডি পর্যন্ত না দেখে। তাদের মধ্যে একজন কিডন্যাপড, অন্যজন মার্ডারড। দুজনেরই কোনো পরিচয় জানা নেই। এতটা নেগলিজেন্স কি কোনো পুলিশ অফিসারের সাজে? তাও আবার আই পি এস ক্যাডার?”
রুদ্র পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। হায়ারার্কি অনুযায়ী ওর ইমিডিয়েট বস এস পি রাধানাথ রায়। তার ওপরে কমিশনার সাহেব। অন্য কোনো এস পি হলে ওকে বোধ হয় এতক্ষণে সাসপেন্ড করে দিতেন। ওদের এই পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কথায় কথায় সাসপেনশন অর্ডার বেরোয়। রাধানাথ স্যার মানুষটা সত্যিই ভালো, মুখে হম্বিতম্বি করেন, কিন্তু অধস্তনদের ক্ষতি করেন না। সেদিন বাংলোয় ওই ঝামেলার সময় উনিই ফোর্স পাঠিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য।
কিন্তু তবু ওর চোখ ফেটে জল আসছিল।
কমিশনার বললেন, ”ইটস ওকে। শি ইজ স্টিল অন হার প্রোবেশন। আমার মনে হয়, পুরোনো টিমটাকেই অপারেশনাল করা হোক, কী বলেন ম্যাডাম?”
জেলাশাসক গুরশরণ কৌর আগেরবার রুদ্রর ওপর অনেক বেশি ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু এবার বোধহয় তাঁরও বিশ্বাস টলে গিয়েছে। তিনি বললেন, ”আপনাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার, কাকে দায়িত্ব দেবেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমার রেজাল্ট চাই। ব্যাপারটা এবার মিনিস্টার লেভেলে পৌঁছে গিয়েছে। ওই ডাক্তারবাবুর স্টেট লেভেলে ভালো জানাশোনা রয়েছে।”
কমিশনার বললেন, ”তাহলে পুরোনো টিমটাতে একজন সিনিয়র অফিসারকে লিড করতে দেওয়া হোক। মিসেস সিংহরায় তাঁকে অ্যাসিস্ট করবেন। কেমন হয়?”
রুদ্রর মুখটা কালো হয়ে গেল। নতুন তৈরি হওয়া কোন টিমে একজনের আণ্ডারে থাকা অন্য কথা, কিন্তু পুরনো টিমে যেখানে ও এতদিন নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, সেখানে ওর মাথার ওপর একজনকে বসানো মানে ওর কর্মদক্ষতাকে সরাসরি সন্দেহ করা। সেক্ষেত্রে টিমের বাকি সদস্যদের কাছে ওর সম্মান অনেক নীচে নেমে যাবে।
এবারেও ওকে বাঁচালেন রাধানাথ স্যার। বললেন, ”না, আমার মনে হয়, রুদ্রাণীর টিমটাকেই আরেকবার কাজটা করতে দেওয়া হোক। নতুন কাউকে ঢোকালে তার ডিরেকশন অফ ইনভেস্টিগেশন এতদিনের প্রোগ্রেসের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। সেক্ষত্রে আরও দেরি হবে।”
কমিশনার সুনীত বসু সায় দিলেন, ”বেশ। তাই হোক।”
রুদ্র কৃতজ্ঞ চিত্তে তাকাল রাধানাথ স্যারের দিকে। এত দুঃখের মধ্যেও ওর মনে হল, রাধানাথ স্যার এই পুলিশ সার্ভিসে ওর অভিভাবক। এমন অভিভাবক যিনি বাবার মতো প্রয়োজনে বকতেও পারেন, আবার দরকারে বটগাছের মতো আগলে রাখতেও পারেন।
ও অস্ফুটে বলল, ”থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!”
রাধানাথ স্যার যেন শুনতেই পেলেন না রুদ্রর কথা। কড়া কণ্ঠে বললেন, ”দিজ ইজ ইয়োর লাস্ট চান্স রুদ্রাণী! এরপর কিন্তু আমরা টিমটা লিড করার জন্য অন্য কাউকে দিতে বাধ্য হব।”
২৪
বীরেনবাবু বললেন, ”ডঃ সুবল ভট্টাচার্য খুব নামকরা গাইনোকোলজিস্ট ছিলেন। বাঁশবেড়িয়ার মানুষ বলে নার্সিং হোমটা ওখানে করেছিলেন, কিন্তু মাসে অনেকবার চেন্নাই, মুম্বাই আর দিল্লির সব বড় বড় হসপিটালে রুগি দেখতে যেতেন। আর তিনি শুধুই ‘বাসুদেব ভবন’ এর মালিক ছিলেন না, ওঁর কিন্তু আরও অনেকরকম পরিচয় ছিল।”
”যেমন?” রুদ্র গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল। ওর কোলে শিবনাথ বিশ্বাসের ল্যাপটপ। তাতে বিশেষ কিছু নেই। লোকটা আদ্যন্ত ঘরোয়া ছিল। মেয়ের বলতে গেলে প্রতি মুহূর্তের ছবি তুলে ষ্টোর করেছে ল্যাপটপে।
আহা! সেই মেয়ে কোনোদিন বাবাকে চিনলই না।
গাড়ির পেছনে রয়েছে জয়ন্ত আর বীরেনবাবু। গাড়ি চালাচ্ছিল পাঁচু।
বীরেনবাবু বললেন, ”আমি এই তিনদিন ধরে ইনফরমেশন কালেক্ট করছি। ড. ভট্টাচার্য বাসুদেব ভবনে সমস্ত গরিব মানুষদের জন্য একেবারে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কলকাতার অনেক বড় বড় ডাক্তার সেখানে চ্যারিটেবল সার্ভিস দিতেন। তাছাড়া উনি মায়াপুরের ইসকন মন্দিরের গভর্নিং বডিতেও ছিলেন। মায়াপুরে ইসকনের যে নিজস্ব দাতব্য নার্সিং হোম, তাতেও উনি বছরে দু-তিনবার গিয়ে ফ্রিতে রুগি দেখতেন, অপারেশন করতেন। ভালো লোক ছিলেন। আমাদের লোকেশবাবু তো ইসকনের ভক্ত, উনি আরও ভালো বলতে পারবেন।”
”মার্ডার কীভাবে করা হয়েছে?” রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল।
”ওই একইরকমভাবে। রাত একটার সময় গিয়ে বাড়িতে বেল বাজিয়ে কাকুতিমিনতি করেছে একটা লোক। তার স্ত্রী নাকি প্রেগন্যান্ট, আট মাস চলছে। হঠাৎ ব্লিডিং হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী লোকটাকে প্রথমে বলেছেন হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তখন সে হাতে পায়ে ধরেছে। সে নাকি রিকশা চালায়। এই মাঝরাতে গাড়ি করে বউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। তখন ডাক্তারবাবু তার সঙ্গে বেরিয়েছেন। সেই লোকটার রিকশা চেপেই। আর ফেরেননি। তারপর থেকে কোনো ট্রেস নেই। ফোনও বন্ধ। পরেরদিন বিকেলে গঙ্গার ঘাটে বসে থাকা অবস্থায় বডি মিলেছে। গলায় গামছা জাতীয় কিছু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে।” বীরেনবাবু মুখ দিয়ে আপসোসের শব্দ করলেন, ”মানুষ কী নির্মম। লোকটা সাহায্য করতে গেল, আর তাকেই কিনা …!”
”এসব কী হচ্ছে?” রুদ্র বিরক্তিতে হাতের তালুতে ঘুষি মারল, ”পরপর একরকমভাবে খুন … অথচ কোনো ক্ল্যু নেই। কোনো উইটনেস নেই। কোনো সিসিটিভি নেই।”
”ডাক্তারের স্ত্রী, সেক্রেটারি, নার্সিং হোমের অনেককে ইন্টারোগেট করা হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। ফোনটা ভাঙা অবস্থায় মিলেছে অনেক দূরের এক ঘাটে। রিকশা’টা মিলেছে অন্য একটা পাড়ায়। রিকশার যে মালিক সে দিশি মদ খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল রাস্তার পাশে।”
রুদ্র কী বলতে যাচ্ছিল, জয়ন্ত মাঝখানে বলে উঠল, ”বীরেনদা, আপনি ডাক্তারবাবুর আরেকটা পরিচয় তাহলে জানতে পারেননি।”
”কী ভাই?”
”হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়, কিন্তু এই ড. সুবল ভট্টাচার্যও কিন্তু ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বংশধর!” জয়ন্ত বলল।
”অ্যাঁ?” চমকে উঠল রুদ্র, ”তুমি কী করে জানলে?”
”আজ সকালে ডিউটিতে আসছি, মধুময়দা’র সঙ্গে দেখা। তিনিই বললেন। ওই ডাক্তারবাবু অবশ্য জন্মেছিলেন বাঁশবেড়িয়াতেই। ওঁর ঠাকুরদাই ত্রিবেণীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে আলাদা বাড়ি করেছিলেন। তাই আমরা জানতাম না।”
জয়ন্ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র বলল, ”এই দাঁড়াও। গাড়ি দাঁড় করাও।”
”কী হল?” পাঁচু অবাক। গাড়ি জিটি রোড দিয়ে ছুটছে বাঁশবেড়িয়ার উদ্দেশ্যে।
রুদ্র গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ”তোমরা বেরিয়ে যাও। সব ভালো করে দেখে এসো। আমি অন্য একটা কাজে যাচ্ছি।”
জয়ন্ত আর বীরেনবাবু বিস্মিত হলেও ঊর্ধ্বতন ম্যাডামের ওপর কোনো প্রশ্ন করলেন না। গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল।
জিটি রোড থেকে কিছুক্ষণ অন্তরই সরু গলি চলে গিয়েছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। তেমনই একটা গলি দিয়ে রুদ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল।
গঙ্গার ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফোন বের করে কল করল।
এখন ক’টা বাজে? সকাল ন’টা। তার সামনে ওয়াশিংটনে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। এত রাতে ফোন করা কি ঠিক হবে?
বেশি কিছু না ভেবে ও ফোন করেই ফেলল।
দু-দু’বার ডেটা কল কেটে গেল। তিনবারের বার কল রিসিভড হল।
”হ্যালো?”
”হ্যালো, শুভাশিসবাবু? আমি … আমি প্রিয়মের স্ত্রী রুদ্রাণী বলছি।”
”আরে হ্যাঁ, বলুন। কী ব্যাপার?”
”আচ্ছা, আপনি সেদিন কী বলতে চাইছিলেন? নকল দাদুরা কেন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন?”
ওপাশে কিছুক্ষণের নীরবতা।
”হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
”মি. ভট্টাচার্য, প্লিজ আমাকে একটু খুলে বলুন!” রুদ্রর গলা থেকে আকুতি ঝরে পড়ছিল।
শুভাশিসবাবু আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ”আপনি আমীশ কমিউনিটির নাম শুনেছেন?”
২৫
”মানে! এরকম লোকজন সত্যিই আমেরিকাতে আছে?” হতভম্বমুখে বলল প্রিয়ম।
রুদ্র ল্যাপটপে হুমড়ি খেয়ে কী দেখছিল আর একটা খাতায় নোট নিচ্ছিল, ”আছে কী বলছ! শুভাশিসবাবু না বললে জানতেই পারতাম না! প্রায় দু’লাখের ওপর আমীশ লোক আছে আমেরিকায়। যারা মনে করে, আধুনিক সভ্যতা সমাজের জন্য অভিশাপ। তাই তারা প্রায় মধ্যযুগের মতো থাকে। কোনো মোটরগাড়ি ব্যবহার করেনা, ভিক্টোরিয়ান যুগে যেমন ঘোড়ার গাড়ি চলত, তাতে করে যাওয়া আসা করে। ছেলেরা পুরনোদিনের স্টাইলের লম্বা ওভারকোট আর টুপি পরে, মেয়েরা পরে সর্বাঙ্গ ঢাকা গাউন। ফোন বা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার তো দূর, এরা দেশের কারেন্সিও ব্যবহার করে না।”
”মানেটা কী!” প্রিয়ম হাঁ করে শুনছিল, ”খাওয়াদাওয়া পায় কোত্থেকে? বেঁচে থাকে কী করে?”
”এরা বিশাল কোনো অঞ্চল জুড়ে থাকে। সেখানে নিজেরাই চাষবাস করে, গরু পোষে, ভেড়া পোষে। নিজের ক্যাটল, নিজেদের ফার্ম। কেউ ঘোড়ার নাল তৈরি করে, কেউ পোশাক তৈরি করে। টাকাপয়সার কোনো ব্যাপার নেই, পুরোটাই চলে বিনিময় প্রথায়। অর্থাৎ তুমি আমাকে দুধ দাও, আমি তোমায় জামা দেব, এইরকম আর কী। বাচ্চাদের জন্য ওই অঞ্চলের মধ্যেই স্কুল আছে। তাতে প্রধানত পড়ানো হয় বাইবেল। ধর্মীয় পাঠ দেওয়া হয়। তাও তেরো-চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর আর পড়িয়ে কি হবে, সবাই তো নিজেদের মধ্যেই থাকবে।”
প্রিয়ম বলল, ”কী অদ্ভুত! কেন, এরা কেন করে এরকম?”
রুদ্র নোটবুকে কী লিখতে লিখতে বলল, ”এরা মনে করে, সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে, প্রযুক্তি, যান্ত্রিকতা তত বেশি গিলে খাচ্ছে মানুষকে। পারিবারিক সময় কমে যাচ্ছে। তাই এরা কম্পিউটার তো দূর, টেলিফোনও ব্যবহার করে না। এমনকি ইলেক্ট্রিসিটিও নয়। আর একটা আধটা জায়গা নয়, আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়া, নিউ ইয়র্ক, ওহিও, মেরিল্যান্ড, মিশিগান এরকম বহু জায়গায় নিজেদের ক্লোজড এরিয়ায় বাস করে এই আমীশরা। এদের বার্থ রেটও ভীষণভাবে বেশি। একটা আমীশ দম্পতির গড়ে ছ’ থেকে সাতটা করে সন্তান। গোঁড়া ক্যাথলিক বলে এরা গর্ভপাতকেও পাপ মনে করে। আর নিজেদের মধ্যেই বিয়ে হয় বলে এদের মধ্যে বামন বা ওইজাতীয় জিনগত সমস্যা অনেক বেশি। এরা আধুনিক কোনো ওষুধও ব্যবহার করে না। কোনো মানুষের আয়ু শেষ হওয়ার সময় এলেও ওষুধ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখাকে এরা তীব্র পাপ মনে করে। শারীরিক কোনো অসুস্থতায় কষ্ট পাওয়াটাও এদের কাছে পুণ্য। একবার এক ডাক্তারের ওপর ওরা হামলাও চালিয়েছিল। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আমীশ সমাজে বিনা চিকিৎসায় একেকজনকে মেরে ফেলার খবর নিয়ে গোটা আমেরিকায় অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। এখন সরকারও এদের বেশি ঘাঁটায় না। ওদের জন্য অনেকরকম ছাড়ও রয়েছে। গোটা সমাজের দণ্ডমুণ্ড কর্তা হয় চার্চের ধর্মযাজক। তাঁর কথাই একটা আমীশ সম্প্রদায়ে শেষ কথা।”
প্রিয়ম ততক্ষণে নিজের ফোন ঘাঁটতে শুরু করেছিল, ”সত্যিই তো। এই তো আমীশদের ছবি। মাঝে মাঝে দেখছি তাদের দু-একজন আধুনিক সমাজে পালিয়েও আসে। খুব অদ্ভুত!”
”অদ্ভুত হতে পারে।” রুদ্র বিড়বিড় করল, ”কিন্তু এই অদ্ভুত বিষয় ধরেই আমি অনেকটা আলো দেখতে পাচ্ছি, প্রিয়ম! তোমার ওই শুভাশিসবাবু আমাকে যে সাহায্য করলেন, তা বলে বোঝাবার নয়।”
”কীভাবে?” প্রিয়ম বলল, ”আমেরিকার আমীশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তোমার এই সিরিয়াল কিলিং এর কী সম্পর্ক?”
রুদ্র বলল, ”তর্কপঞ্চাননের ফ্যামিলিতে তিন প্রজন্ম আগে একজনকে দত্তক নেওয়া হয়। শুভাশিসবাবুরা তাঁকে ডাকতেন নকল দাদু বলে। সেই দত্তকপুত্র অল্প বয়সেই আমেরিকায় চলে যান। পড়াশুনো করতে। সেখানে গিয়ে কোনভাবে একটা আমীশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সাধারণত আমীশরা বাইরের জগতের সঙ্গে তেমন মিশতে চায় না, কিন্তু ইনি কোনোভাবে তাদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। বলা ভালো, আমীশদের জীবনযাত্রায় তিনি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এটা গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।”
”ইন্টারেস্টিং!” প্রিয়ম মন দিয়ে শুনছিল। রুদ্র থামতেই বলে উঠল, ”তারপর? তিনি কি ক্যাথলিক ধর্মগ্রহণ করেছিলেন?”
”সেই ব্যাপারে শুভাশিসবাবু আর কিছু বলতে পারলেন না। তবে বললেন, একবার দেশে এসে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তাও প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। তারপর তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে গিয়েছেন, না কী করেছেন, কেউ জানে না।”
”তো? তার সঙ্গে তোমার এই খুনগুলোর কি সম্পর্ক?”
”সম্পর্ক আমি একটা পেয়েছি। কিন্তু, সেটা কতটা জোরালো, তা বুঝতে সময় লাগবে। বাসুদেব ভবন নার্সিং হোমের মালিক ড. সুবল ভট্টাচার্য খুন হওয়ার পরই সেটা আরও বেশি করে মাথায় এল। বোঝাচ্ছি, দ্যাখো।” রুদ্র টেবিল থেকে একটা খাতা টেনে নিল।
”এই যে সাতজন খুন হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যোগসূত্রটা কী জানো প্রিয়ম? আমাদের চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে, অথচ আমরা কেউ ধরতে পারিনি! কখনো হুগলী, কখনো ব্যবসায়ী এইসব উলটোপালটা লিঙ্কে বিভ্রান্ত হয়েছি।” রুদ্র বলল।
”কী?”
”এরা প্রত্যেকেই এমন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, যেগুলো আধুনিক সভ্যতার অঙ্গ। তুমি দ্যাখো। সাইবার ক্যাফে, মোবাইল, ইনভার্টার, চশমা, রিয়েল এস্টেট। সব! এমনকি হাসপাতালও। যেখানে অসুস্থকে সুস্থ করে তোলা হয়। যেখানে অপারেশন করে কৃত্রিমভাবে সারিয়ে তোলা হয়। আমীশরা এইসবকিছুকে ঘৃণা করে। এই সব ক’টাকে জিনিসকে তারা মনে করে প্রাকৃতিক নিয়মের পরিপন্থী!”
প্রিয়ম মন দিয়ে দেখছিল। তারপর বলল, ”তার মানে তুমি বলছ, শুভাশিসদা’র ওই নকলদাদু এখানে এসে আমীশ সমাজের শাখা খুলেছেন?”
”সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি, প্রিয়ম।” রুদ্র বলল, ”তবে আমার মনে হচ্ছে, এদের মধ্যে একটা বিরাট সুতো রয়েছে। সেই সুতোটাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তার জন্য আমায় আবার যেতে হবে বাগডাঙার ওই আশ্রমে। যেতে হবে বদনপুর বলে একটা গ্রামেও।”
”বাগডাঙার আশ্রম মানে যেখানে ওই স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়াল একসঙ্গে যেতেন?” প্রিয়ম বলল, ”সেটা আবার পিকচারে আসছে কী করে!”
”পিকচারে আসছে কারণ, বাগডাঙার সেই আশ্রমের বইয়ের তাকে আমি একটা বহু পুরনো বই দেখতে পেয়েছিলাম।” রুদ্র বিড়বিড় করল, ”বিবাদভঙ্গার্ণব! আমি নিঃসন্দেহ, এই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বিরাটভাবে জড়িয়ে আছেন। দেখি, সব শুনে এস পি স্যার কী বলেন!”
২৬
বদনপুর গ্রামের একেবারে নদীর ধারে যে চণ্ডীমন্দিরটা রয়েছে, তা কতকালের পুরনো কেউ জানেনা। মন্দিরের একদিক ভেঙে ভেতরের হাড়পাঁজরা বেরিয়ে এসেছে। সেই গর্তের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বট অশ্বত্থের ঝুরি। মন্দিরের চূড়াটা এককালে বেশ উঁচু ছিল বোঝা যায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাঝে মাঝেই ইট খসে পড়ে সেখান থেকে।
ভেতরের গর্ভগৃহের মাঝখানে থাকা মা চণ্ডীর বিগ্রহটি পাথরের। পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাবে মা সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
যে গ্রামে মানুষই পেট পুরে খেতে পায় না, সেই গ্রামে আবার মন্দিরের সংস্কার কে করে?
অথচ বছর পঞ্চাশ আগেও বদনপুর গ্রাম বেশ সচ্ছল ছিল। চৌধুরীরা ছিল উচ্চবংশজাত পরিবার। এখানকার সাবেক ভূম্যধিকারী, তাদের প্রচুর জমিজমার ওপর ভিত্তি করে মূলত চলত বদনপুরের গরিব কৃষিজীবী পরিবারগুলো। চৌধুরীদের ঠাটবাট, দুর্গাপুজোর আশনাই গোটা হুগলীর লোকেদের চোখ ট্যাঁরা করে দিত। ছোটবড় জমিদাররা তো বটেই, শোনা যায়, সাহেবসুবোরাও নাকি নিয়মিত আসত চৌধুরীবাড়ির নাচমহলের আসরে।
কিন্তু চৌধুরীরা এখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছে বহুবছর হল। তারপর থেকেই গ্রামটা আস্তে আস্তে শ্মশান হয়ে যাচ্ছে।
এখন গ্রামে সাকুল্যে ত্রিশ ঘর লোক বাস করে। অধিকাংশই দিন আনে দিন খায়। আর যারা একটু পয়সার মুখ দেখে, চলে যায় চুঁচুড়া বা চন্দননগরের দিকে। এইভাবেই গত অর্ধশতকে বদনপুর প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু একটা মানুষ শতকষ্টেও বদনপুর ছাড়ার কথা ভাবতে পারে না।
সে হল চণ্ডী মন্দিরের বংশপরম্পরায় পুরোহিত কানু চক্রবর্তী। প্রায় ছয় প্রজন্ম ধরে কানু চক্রবর্তীর পরিবার চণ্ডী মন্দিরের পুজো করে আসছে। চৌধুরীরা গ্রামে থাকাকালীন তারাই এই মন্দিরের সেবাইত ছিল, তাদেরই বেতনভুক পুরোহিত হিসেবে কানু চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষরা চণ্ডী মন্দির দেখভাল করত।
কিন্তু এখন আর ওসবের কোনো পাট নেই। কানু চক্রবর্তী নিজেও ওসবের পরোয়া করেনা। সে একটু খ্যাপাটে গোছের লোক, বিয়ে থা করেনি। বয়স ষাটের ঘরে হলেও খিটখিটে স্বভাবের জন্য তাকে আরও অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। মন্দির থেকে কয়েক গজ হাঁটা পথে তার বাপঠাকুরদার আমলের একচিলতে কুঁড়েঘর। সেখানে অবশ্য সে শুধু রাতটুকু থাকে। দিনের বাকি সময়টা পুরোটাই সে কাটায় চণ্ডী মন্দিরে আর নদীর ধারে। সপ্তাহে শুধু একদিন ঢোকে গ্রামের ভেতরে। গরিবগুর্বো মানুষরা এই ‘ক্ষ্যাপা পুরুত’কে চালডাল যেটুকু সামান্য পারে, দেয়। কানু চক্রবর্তী একাহারী, ওতেই হয়ে যায়।
সবসময় সপ্তমে চড়ে থাকে তার মেজাজ। গ্রামের লোকেরা তার সেই তিরিক্ষি মেজাজের ভয়ে পারতপক্ষে এদিকে আসেনা, দুষ্টু ছেলেছোকরারা কেউ কখনো এসে চণ্ডী মন্দির তল্লাটে খেলতে চেষ্টা করলে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে অকথ্য গালাগালি করে তাদের পালাতে বাধ্য করে কানু চক্রবর্তী।
গ্রামের লোকেরাও তাই তাকে ঘাঁটায় না। একেই সব দীনদরিদ্র, রোজ মন্দিরে আসার সময় কোথায়? তার ওপর নামেই চণ্ডী মন্দির, এতকালের অযত্নে যেন পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়েছে মন্দিরটা। পাশেই সরু নদী, সেই নদীর হাওয়া গায়ে মেখে এক প্রাচীন আত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
গোটা চত্বরটাই যেন কেমন ভূতুড়ে!
গ্রামের সবাই জানে, কানু চক্রবর্তী মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই মন্দিরও মরে যাবে।
কানু চক্রবর্তী নিজের মনেই থাকে। ভোরবেলা উঠেই সে চলে আসে মন্দিরে। তারপরের কয়েকঘণ্টা ধরে চলে পুজোর আয়োজন, উপাচার। সে নিজেই পূজারি, নিজেই দর্শক, নিজেই ভক্ত। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহে একাকী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সে কী করে জানে!
দিনান্তে সব মিটে গেলে কিছু মুখে দেয়, তারপর চুপচাপ গিয়ে বসে থাকে নদীর পাড়ে।
গ্রামের সবাই নদী বলে বটে, আসলে এটা একটা খাল। গঙ্গা থেকে পশ্চিমমুখে বয়ে এসেছে। তবে গভীর, গ্রীষ্মকালেও বেশ জল থাকে। খালের একটা দিক আবার গিয়ে মিশেছে রুগণ সরস্বতী নদীতে।
সূর্য পশ্চিমে ধীরে ধীরে হেলতে থাকে, পাখিরা ক্লান্ত দেহে ঝাঁক বেঁধে ফেরে বাসায়, কানু চক্রবর্তী একা উদাস মুখে বসে থাকে। বসে বসে সে কী যে ভাবে! তার কাঁচাপাকা দাড়ি নেমে এসেছে গলার নীচ পর্যন্ত, ঘাড় পর্যন্ত চুল আর সাদা ধুতি ফতুয়ায় তাকে কেমন যেন অরণ্যের প্রাচীন ঋষি বলে মনে হয়। তারপর একসময় ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যা। অন্ধকার গভীর হলে কানু চক্রবর্তী ধীর পায়ে ফিরে যায় নিজের বাসস্থানে। তার চোখদুটো তখন থাকে অন্যমনস্ক।
সেদিনও সে এইভাবে বসে ছিল নদীর চরে। বসে বসে কত কী ভাবছিল। তার গোটা শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিতে উজ্জ্বলভাবে রয়েছে গ্রামের আলোকিত ছবি। চৌধুরীবাড়ির দুর্গাপুজো, নদীর চরে মায়ের বিসর্জন, নানারকমের পুজোপার্বণ।
সব মুছে গিয়েছে। শুধু সে একা বেঁচে রয়েছে অতীতের গৌরবের জীবাশ্ম হয়ে। হাজার ঘটনা বুকে চেপে। তার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সেইসব স্মৃতি। বিলুপ্ত হয়ে যাবে অনেক ঘটনা।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কাতড়ানোর শব্দে বর্তমানে ফিরে এসেছিল কানু চক্রবর্তী। এই নির্জন নদীর চরে হঠাৎই যেন শুনতে পেয়েছিল কারুর গুমড়নোর আওয়াজ।
প্রচণ্ড জ্বরে ছেলেটা বেহুঁশ, ওই অবস্থাতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে যন্ত্রনার গোঙানি।
কান পেতে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা যায়।
”উঃ মাগো কী কষ্ট! … ওকে ছেড়ে দাও … বাইরে … বাইরে চলে যাওয়াই ভাল … আহ! লাগছে … আমাকে ছাড়ো!”
কানু চক্রবর্তী কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে সরিয়ে আনতে যেতেই থমকে গিয়েছিল।
ছেলেটার ঘাড়ের কাছটায় দগদগে ঘা, অনেকটা জায়গা যেন খুবলে খেয়েছে কোনো বন্য জন্তু! রক্ত আর মাংস ডেলা পাকিয়ে আছে সেখানটায়।
কানু চক্রবর্তী সাময়িক থমকালেও অবাক হয়নি।
কারণ কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকলেও ছেলেটার মুণ্ডিত মস্তক ও পেছনের লম্বা টিকিটা ততক্ষণে ওর চোখে পড়ে গিয়েছিল।
২৭
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে এদিকে। চারপাশের সবুজ গাছপালা, শস্যখেত ভিজে গিয়ে ঝকঝক করছে। ভিজে মাটিতে সোঁদা গন্ধ। পাখির কিচিরমিচির। বাগডাঙা গ্রামের হাট, বসতি এলাকা একটু দূরে। এদিকটা শুধুই বিঘের পর বিঘে খেত। তারই মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরলাশ্রম। নিস্তব্ধ, নীরব হয়ে।
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে সোজা এগিয়ে গেল আশ্রমটার দিকে। সঙ্গে এসেছেন লোকেশ ব্যানার্জি আর জয়ন্ত। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আল বরাবর হাঁটছিল ওঁরা।
আগেরদিন গাড়ির শব্দ পেয়েই যেমন বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন সেই ভর্তৃহরি মহারাজ, আজ তেমন কেউ এল না। বাইরে একটা সাধারণ কচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা গেট। রুদ্ররা সেটা খুলে ঢুকল আশ্রমের মধ্যে।
আগেরদিন সামনের দালান দিয়ে মাঝে মাঝেই হেঁটে যাচ্ছিল ধুতি ফতুয়া পরিহিত মুণ্ডিত মস্তক আবাসিক ছাত্ররা। আজ তারাও কেউ নেই।
জয়ন্ত ফিসফিস করল, ”কোনদিকে যাবেন ম্যাডাম?”
রুদ্র উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল সেইদিকে, যেদিকে আগের দিন ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন মহারাজ। চাতাল পেরিয়ে সেই উপাসনাগৃহ। কিন্তু বাইরে বড় তালা ঝুলছে।
”ভাঙব?” জয়ন্ত বলল।
”না।” রুদ্র চাপাস্বরে বলল। ওয়্যারান্ট ছাড়া এভাবে প্রাইভেট প্রপার্টি ভেঙে ঢুকে সার্চ করা যায় না, সেটা আইনবহির্ভূত। ও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে গোটা আশ্রমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।
আশ্রমের আয়তন খুব বড় না হলেও ভেতরে বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। একদিকে উপাসনাঘর, অন্যদিকে দুটো ছোট ছোট একতলা বাড়ি। বোধ হয় ছাত্রদের থাকার আবাস। মাঝখানটা বেশ কিছুটা খোলা জায়গা, তাতে বেশ যত্ন করে ফুলের চাষ করা হয়েছে।
”অদ্ভুত ব্যাপার!” লোকেশবাবু বললেন, ”গোটা আশ্রম পড়ে রয়েছে, সব গেল কোথায়?”
আশ্রমের একেবারে পেছনদিকে চলে গেল রুদ্র। সেদিকে একটা ঘাট। সামনে সরু একটা খাল।
”এই খালটা কোথায় গিয়ে মিশেছে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”কী জানি, বুঝতে পারছি না।” জয়ন্ত ঠোঁট উলটোল। দশমিনিটের মধ্যে ও আশ্রমের বাইরে গিয়ে রাস্তায় পৌঁছে একটা স্থানীয় লোককে ডেকে আনল।
রুদ্র তখন হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে ঘাটে। ঘাটটা বাঁধানো হলেও বেশ ভগ্নদশা। সিঁড়ির ধাপের ওপর আশপাশের নারকেল গাছের ডালপালা পড়ে রয়েছে।
প্রায় আটটা ধাপের পর ছলাত ছলাত এসে পড়ছে খালের জল।
স্থানীয় লোকটির নাম পরেশ। সে বাগডাঙা হাটের দিকে থাকে।
রুদ্রর প্রশ্নের উত্তরে বলল, ”এই আশ্রম অনেক পুরোনো দিদিমণি। তা প্রায় বছর পঁচিশ তো হবেই। কিন্তু আমরা বিশেষ আসি না। আসলে আশ্রমের সন্ন্যাসীরা কারুর সঙ্গে মেশেন না। নিজেদের মতো থাকেন।”
”বাইরে থেকে যারা আসেন, তাঁরা?”
পরেশ হকচকিয়ে বলল, ”সবাই তো আশ্রমের নৌকোতে করেই আসেন, দিদি। খুব কমই গাড়িতে করে আসেন।”
”আশ্রমের নৌকো?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”কোথায় সেই নৌকো?”
পরেশ আঙুল তুলে বলল, ”এখানেই বাঁধা থাকে। আজ তো দেখছি না।”
”এই খাল কোথায় গিয়েছে?”
”আজ্ঞে, এঁকেবেঁকে অনেকটা গিয়েছে, তারপর গিয়ে মিশেছে সরস্বতী নদীর সঙ্গে। সেই নদীও এখন সরু, অ্যাত্তটুকুন।” লোকটা হাত দিয়ে দেখাল, ”সেই সরস্বতী বরাবর গেলেই গঙ্গা।”
”গঙ্গা!” বিড়বিড় করল রুদ্র। তারপর বলল, ”এদিক থেকে সুগন্ধা কতদূর?”
”সুগন্ধা?” লোকটা মাথা চুলকোল, ”বলতে পারব না দিদি। এদিক থেকে পুবদিক বরাবর গেলে পরপর অনেকগুলো গ্রাম পড়বে। জারুরা, ভুশনারা, বদনপুর …।”
লোকেশবাবু রুদ্রর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাতেই রুদ্র চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল।
২৮
নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় গুণগ্রাহী যুবাপুরুষ। তিনি নিজে সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত, সুযোদ্ধা এবং সংগীতজ্ঞ। মুঘল সম্রাট আকবরের মতো তাঁর রাজসভাতেও নবরত্নের সমাহার।
নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক শঙ্কর তর্কবাগীশ, পণ্ডিত গোস্বামীপাদ গোপালকৃষ্ণ বিদ্যাবাচস্পতি, কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, হরিরাম তর্কালঙ্কার ছাড়াও তাঁর রাজসভার শোভাবর্ধন করে থাকেন কালীভক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। এছাড়া ছায়ার মতো সভা আলোকিত করেন ঘূর্ণি গ্রামের গোপাল চন্দ্র ভণ্ড।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দ্বৈত চরিত্রের সমাহার। একদিকে তিনি প্রজাবৎসল, বিদ্যা ও শিল্পকলার পরম পৃষ্ঠপোষক, সমগ্র রাঢ়বাংলার অসংখ্য পণ্ডিত তাঁর বৃত্তিভোগী। অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী, কূটকৌশলী ও আদিরসাত্মক রচনায় উদগ্রীব। নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কারুর সম্পত্তি গ্রাসে তাঁর হৃদয় কাঁপে না। অন্নদামঙ্গলের মতো অনন্য রচনার পর তাঁরই প্ররোচনায় ভারতচন্দ্র লিখেছেন বিদ্যাসুন্দর। যার ছত্রে ছত্রে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি আহত করেছে পাঠককুলকে।
আজ কৃষ্ণচন্দ্রের আয়োজিত সুবিশাল বাজপেয় যজ্ঞের অন্তিম দিবস। বিদেশের সমস্ত স্বনামধন্য পণ্ডিতদের উপযুক্ত পারিতোষিকসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করানো হচ্ছে। তাঁর যজ্ঞ সার্থক হয়েছে। যজ্ঞের আয়োজনে হৃষ্টচিত্ত হয়ে তামাম পণ্ডিতকুল তাঁকে ভূষিত করেছেন বহুকাঙ্ক্ষিত ও অতিসম্মানীয় উপাধি ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী’তে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো অজ্ঞাত কারণে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিমর্ষ চিত্তে বসেছিলেন নিজের রাজসভায়। তাঁর মুখমণ্ডল থেকে ঝড়ে পড়ছিল হতাশা।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার দুটি ভাগ। প্রথমার্ধে তিনি শুধুই রাজকার্যে ব্যস্ত থাকেন। থাকেন মন্ত্রী, দেওয়ান, সেনাপতি ও অন্যান্য অমাত্যরা। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শোনা, আদেশনামা জারি করা, দলিলে স্বাক্ষর করা এইসব প্রশাসনিক কাজ চলে। সেইসব কাজ সমাপ্ত হলে একদণ্ডের বিরতি। রাজা তখন পার্শ্ববর্তী কক্ষে প্রাতঃরাশ সারেন। প্রশাসনিক কর্মচারীরা প্রস্থান করেন, আগমন হয় পণ্ডিত, সংগীতজ্ঞ ও কবিদের।
আজ অবশ্য দ্বিতীয়ার্ধে রাজসভা প্রায় জনশূন্য। সভাসদরা সকলেই গিয়েছেন বাজপেয় যজ্ঞে অভ্যাগতদের বিদায় জানাতে। কয়েকদিন সভা বন্ধ থাকার পর আজই খুলেছে, কাজ বিশেষ নেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ, কবি বাণেশ্বর বিদ্যালংকার ও রামপ্রসাদ ছাড়া কেউ নেই সভায়। তিনজনে আলোচনা করছিলেন যজ্ঞ উপলক্ষ্যে সংঘটিত হওয়া সাম্প্রতিক নানা শাস্ত্রবিচার সম্পর্কে।
কৃষ্ণচন্দ্রের মুখ যদিও ম্লান। কাশী, মিথিলা, কান্যকুব্জ, এমনকি সুদূর দ্রাবিড় থেকে বহু অর্থব্যয়ে তিনি একাধিক পণ্ডিতকে সমাদরে নিয়ে এসেছিলেন নবদ্বীপে। সমানে সমানে হওয়া তর্কযুদ্ধ দেখার বাসনায়।
কিন্তু তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ হয়নি বললেই চলে। যজ্ঞের প্রথম চারদিন সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু তাঁকে স্তম্ভিত করে পঞ্চম দিনে এসে প্রায় একশো ছাত্র নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বিনা আমন্ত্রণে আগমনে রাজা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও সৌজন্যবশত তিনি আতিথেয়তা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন পণ্ডিতের আহারাদি-বাসস্থানেরও। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে দুটি বিশাল ইমারত গড়ে তোলা হয়েছে পণ্ডিতদের জন্য। সেখানে আরো একজন পণ্ডিতের ব্যবস্থা করা একেবারেই কঠিন নয়।
কিন্তু রোমশ পণ্ডিত সেসবের ধার মাড়াননি। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কোনরকম বাক্যবিনিময় না করে তিনি সটান উপনীত হয়েছিলেন শাস্ত্রবিচার মণ্ডপে। স্মৃতি থেকে ন্যায়, বেদান্ত থেকে অদ্বৈতবাদ, সভামণ্ডপে একের পর এক অনুষ্ঠিত হওয়া তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করতে শুরু করেছিলেন দেশ বিদেশের সমস্ত পণ্ডিতকে। জগন্নাথতোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন আসমুদ্রহিমাচলের সব পণ্ডিত।
তাঁর পাণ্ডিত্যপ্রতিভার সামনে, অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির সামনে কেউ সেভাবে দাঁড়াতেই পারেননি। দর্শকমণ্ডলী পর্যন্ত ক্রমাগত জগন্নাথ পণ্ডিতের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। দিনান্তে কৃষ্ণচন্দ্র আবার গলবস্ত্রে আতিথেয়তা গ্রহণ করার অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তর থেকে সেই ইচ্ছা না থাকলেও লোকনিন্দার ভয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছিলেন অনেক কায়ক্লেশে বাজপেয় যজ্ঞ করছেন, পণ্ডিতও তাতে যোগদান করলে রাজা আহ্লাদিত হবেন।
আর তখন পণ্ডিত কী বললেন?
ভাবলেই এখনো শরীরে রক্তসঞ্চালন দ্রুত হয়ে উঠছে কৃষ্ণচন্দ্রের। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। স্তম্ভিত হচ্ছেন একজন ব্রাহ্মণের ঔদ্ধত্যে।
জগন্নাথ পণ্ডিত প্রকাশ্য সভায় রাজার কাতর অনুরোধে শ্লেষসূচক হেসে বলেছিলেন, ”বাজপেয় যজ্ঞ? হাসালেন রাজা। যে যজ্ঞে স্বয়ং জগন্নাথ রবাহূত, সে আবার কীসের যজ্ঞ?”
কথাটা বলে সদর্পে প্রস্থান করেছিলেন রাজমণ্ডপ থেকে। অদূরে কোন এক ব্রাহ্মণ আবাসে তিনি নিজেই সশিষ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তারপর যজ্ঞের অবশিষ্ট প্রতিটি দিন এসেছেন, সমস্ত অতিথি পণ্ডিতের দর্পচূর্ণ করেছেন, আবার ফিরে গিয়েছেন।
এইভাবে গোটা যজ্ঞের পরিবেশ পণ্ড করার পর অবশেষে জগন্নাথ পণ্ডিত কাল নদীয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত করে দিয়ে গিয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মান। এক কলসি দুগ্ধে একফোঁটা গোমূত্রের মতোই।
এত দম্ভ? এত দার্ঢ্য? কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং নদীয়াধিপতি, হিন্দুকুলপতি, শাস্ত্রচূড়ামণি তাঁর প্রতি কোনো সম্মান প্রদর্শন নেই?
পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ বললেন, ”আর বিমর্ষ হয়ে থাকবেন না রাজামশাই। অতিথিরা একে একে প্রস্থান করছেন, তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ করার জন্য আপনার সেখানে উপস্থিতি একান্তই প্রয়োজন। অন্যথায় বড় দৃষ্টিকটু দেখায়।”
কৃষ্ণচন্দ্র রক্তাভ চোখে তাকালেন। এখনো অবধি এই প্রসঙ্গে সভাসদদের সকলেই তাঁকে সমর্থন করেছেন, একযোগ হয়ে প্রত্যেকে নিন্দা করেছেন তর্কপঞ্চাননের এই মাত্রাহীন ঔদ্ধত্যের।
ব্যতিক্রম শুধু একজন। রামপ্রসাদ সেন একটি মাত্রও কথা বলেননি। সেই কারণটিও তাঁর জানা।
রাজা ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললেন, ”আপনারা সবাই যতই সমালোচনা করুন, সাধক রামপ্রসাদ যে কিছুতেই রোমশ পণ্ডিতের সমালোচনা নিতে পারেন না! তাই তিনি মৌন। তাঁর কালী মায়ের গাত্রবর্ণের সঙ্গে পণ্ডিতের বড় মিল কিনা, হা হা!”
রামপ্রসাদ কী যেন ভাবছিলেন। রাজার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ”না তা নয়, রাজামশায়। তবে এটা তো মানবেন, জগন্নাথ পণ্ডিত একাই বাংলার মান রক্ষা করল। নাহলে আমাদের রাঢ়বাংলার পণ্ডিতরা তো বিদেশিদের যুক্তির সামনে দাঁড়াতেই পারছিলেন না! আমার মনে হয়, আপনি আর উনি, দুজনেই সমান বিদ্বান, নিজেদের মধ্যে আর এমন কলহ করে আমাদের বেদনার উদ্রেক করবেন না।”
”তুমি ভোলাভালা মানুষ, রামপ্রসাদ!” কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার বলে উঠলেন। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের জন্য তাঁর সেই হেনস্থার কথা তিনি এখনো বিস্মৃত হননি। উষ্মাভরা কণ্ঠে বললেন, ”ত্রিবেণীর জগন্নাথ পণ্ডিত অত সোজা মানুষ নয়। সে রাজার যজ্ঞে নিমন্ত্রণ না পাওয়ার অপমান এত সহজে ভুলবে বলে মনে হয় না। দেখবে, এর প্রতিশোধ সে নেবেই!”
”প্রতিশোধ?” শঙ্কর তর্কবাগীশ ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন, ”নদীয়াধিপতির প্রতি?”
”অসম্ভব কিছু নয়।” বাণেশ্বর স্বগতোক্তি করলেন, ”ইংরেজরা বলুন কিংবা মুর্শিদাবাদের নবাব সকলেই তর্কপঞ্চাননের পরম অনুরাগী। তার ওপর মুর্শিদাবাদের দেওয়ান নন্দকুমার জগন্নাথ পণ্ডিতের পরম সুহৃদ। আর নবাব নিজে নন্দকুমারের কথায় অন্ধ আস্থা রাখেন। ক্ষতি করতে চাইলে রোমশ পণ্ডিতকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।”
২৯
লোকেশবাবু সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ”ম্যাডাম, আমাকে এক সপ্তাহ ছুটি দিতে হবে।”
রুদ্র সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছিল। ওদের গাড়ি প্রায় দেড়ঘণ্টা ছোটার পর এখন বদনপুরের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।
চুঁচুড়া মহকুমার পোলবা দাদপুর ব্লকের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বদনপুর। অজ পাড়া গাঁ বললেও অত্যুক্তি হয়না। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে রুদ্র অবাক হয়ে ভাবছিল, সরকারের এত ধরনের প্রকল্পের পরেও এখনো এত মাটির বাড়ি এই গ্রামে?
একদিকে যতদূর চোখ যায়, সবুজ চোখ জুড়নো খেত। অন্যদিকে ছোটবেলায় আঁকা ছবির মতো মাটির কুঁড়েঘর, বড় বড় নারকেল গাছ। গরু ছাগলের নির্বিচারে আনাগোনা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।
লোকেশবাবুর কথায় রুদ্র ঘাড় ঘোরাল। বলল, ”এক সপ্তাহ! এই ডেলিকেট সময়ে? কী ব্যাপার, লোকেশবাবু? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?”
জয়ন্ত একদিন কথায় কথায় বলেছিল, লোকেশবাবুর স্ত্রী ক্যানসার আক্রান্ত। নিঃসন্তান দম্পতি। লোকেশবাবুকে প্রায়ই স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ছুটি নিতে হয়।
কিন্তু লোকেশবাবু একদিকে ঘাড় হেলিয়ে বললেন, ”হ্যাঁ। আসলে সামনের সপ্তাহে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। আমরা বৈষ্ণব, এইসময়টা মায়াপুরে যাই। খুব ধুমধাম করে পালন হয় ওখানে। তিনদিন ধরে উৎসব চলে। আমরা গোটা সময়টায় ওখানে ভলান্টারি সার্ভিস দিই।”
রুদ্র কিছু বলার আগেই প্রিয়াঙ্কা ঈষৎ প্রগলভ সুরে বলল, ”আচ্ছা লোকেশদা, কী হয় এইসময় মায়াপুরে? সবাই মিলে দু-হাত তুলে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে করে নেচে বেড়ান?”
লোকেশবাবু বিরক্তস্বরে বললেন, ”নেচে বেড়াব কেন? জন্মাষ্টমীতে ওখানে অনেকরকম অনুষ্ঠান হয়। সারা পৃথিবী থেকে ভক্তরা আসেন। কোনোদিনও তো যাওনি, একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। শুধু জন্মাষ্টমী কেন, দোলপূর্ণিমা, রথযাত্রা। দোলে তো একবার আমার সঙ্গে এস পি সাহেবের দেখা হয়েছিল, জানো!”
প্রিয়াঙ্কা বলল, ”তাই নাকি?”
”হ্যাঁ। এস পি সাহেব ওখানকার কমিটিতেও আছেন। উনি তো খুব বনেদি বংশের ছেলে।” লোকেশবাবু বলে চলেছিলেন, ”নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা ডোনেট করেন। একেবারে প্রথম সারিতে বসেছিলেন। আমি আর ডাকিনি। একবার তো যেতে পারো ঘুরতে। বাড়ির এত কাছে।”
”আচ্ছা, সে না হয় যাব।” প্রিয়াঙ্কা বলল, ”আপনি আগে বলুন না, কী হয় ওখানে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”
লোকেশবাবু এবার একটু নরম গলায় বললেন, ”তিনদিন ধরে উৎসব চলে। জন্মাষ্টমীর আগের দিনকে বলা হয় অধিবাস, পরের দিনটা নন্দোৎসব। প্রথমদিন কীর্তনমেলা চলে, তারপর মধ্যরাতে রাধামাধব মন্দিরে মহা অভিষেক হয়। জন্মাষ্টমীর দিন ভোর থেকে একে একে চলে মঙ্গল আরতি, নানারকম যজ্ঞ, ভজন কীর্তন। তারপর অনুকল্প প্রসাদ বিতরণ। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। হাজার হাজার লোক একসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নাম করছে, ভজন করছে, বিশাল চত্বরে একসঙ্গে খাচ্ছে। এত ভালো লাগে! গায়ে কাঁটা দেয়। ওই যে খুন হলেন ড. সুবল ভট্টাচার্য, উনি তো প্রতিবছর থাকতেন, মহারাজদের সঙ্গে মিলে সব তদারক করতেন। তোমার বউদি তো অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিবছর ছোটেন, মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায়।”
রুদ্র এবার মাঝপথে গলাখাঁকারি দিল, ”বদনপুর ঢুকে গেছি। মন্দিরটা কোনদিকে লোকেশবাবু? পাঁচুকে একটু গাইড করুন।”
পরম বৈষ্ণব লোকেশবাবু মায়াপুরের উৎসবের কথা বলতে বলতে কেমন ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ আদেশে একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, ”সোজা গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। একেবারে শেষ প্রান্তে, নদীর ধারে।”
মন্দিরের সামনে গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ানো মাত্র একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। পরনে ধুতি, ফতুয়া। কাঁচাপাকা দাড়ি গলা ছাড়িয়ে প্রায় বুক পর্যন্ত নেমেছে। মাথার চুলও সাদা। রোগাটে গড়ন। কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে জরিপ করার চেষ্টা করলেন রুদ্রদের।
লোকেশবাবু চাপাগলায় বললেন, ”ইনি মন্দিরের পূজারি। কী যেন চক্রবর্তী নাম। পল্টু বলে গ্রামের একটা ছেলে তারেকের ছবি দেখে চিনতে পেরেছিল, তারপর সে-ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল।”
”পল্টুকে আসতে বলুন এখানে।” চাপা গলায় বলল রুদ্র।
লোকেশ বাবু বললেন, ”বলেছিলাম। কিন্তু সে এখন শহরে গেছে কাজ করতে।”
”আমার নাম কানু চক্রবর্তী।” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ।
রুদ্র বলল, ”আপনি কি এখানেই একাই থাকেন?”
”হ্যাঁ।” কিছুটা রুক্ষস্বরে বললেন কানু চক্রবর্তী, ”আমি তো আগের দিনও বলেছি, পল্টু যখন নিয়ে এল ওঁকে। সেই ছেলেটা কয়েকদিন এই মন্দিরে ছিল, তা প্রায় দু’বছর আগে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।”
রুদ্র বলল, ”এই মন্দিরটা কতদিনের পুরোনো?”
এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে কানু চক্রবর্তী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, ”একশো বছরের বেশিই হবে। এই গ্রামের জমিদার চৌধুরীরা বানিয়েছিল।”
কানু চক্রবর্তী আর লোকেশবাবু নীচে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রিয়াঙ্কা রুদ্রর পেছন পেছন উঠে এসেছিল মন্দিরের ওপরে। গর্ভগৃহের ভিতরটা একেবারে অন্ধকার। বিগ্রহ বোঝা যাচ্ছে, তবে খুব অস্পষ্ট। রুদ্র চারপাশ জরিপ করতে করতে বলল, ”আপনি থাকেন কোথায়?”
”পাশেই।” কানু চক্রবর্তী এবারেও বিরস গলায় বললেন।
”পাশে বলতে?”
কানু চক্রবর্তী এবারে খুবই অনিচ্ছার ভঙ্গিতে হাত তুলে দূরের একটি কুঁড়েঘরের দিকে নির্দেশ করলেন।
”দু’বছর আগে হলেও আপনার নিশ্চয়ই ঘটনাটা মনে আছে।” রুদ্র পায়ে পায়ে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে, ”আরেকবার একটু বলুন না! ছেলেটি খুন হয়েছে।”
কানু চক্রবর্তীর চোখের পাতা একবার সামান্য কেঁপেই স্থির হয়ে গেল। বললেন, ”একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ছেলেটা এই চাতালে ঘুমোচ্ছে। গা বেশ গরম। তিনদিন ওইভাবে ছিল। তারপর একদিন হাওয়া।”
লোকেশবাবু এবার একটু রুষ্টগলায় বললেন, ”আপনি পুরোটা কেন খুলে বলছেন না কানুবাবু? আগেরদিন তো পল্টু বলল, ছেলেটা এই সিঁড়িতে বসে কৃষ্ণনাম জপ করত। আর আপনি তাই নিয়ে রেগে যেতেন? বলতেন, চণ্ডী মন্দিরে বসে কৃষ্ণের নাম করা মহা পাপ?”
কানু চক্রবর্তী হঠাৎ ক্ষেপে উঠল। বলল, ”অতদিন আগের কথা, আমার ভাল করে মনে নেই। পল্টুর যখন সব মনে আছে, তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করুন না। আমায় কেন করছেন?”
লোকেশবাবু পুলিশসুলভ ধমকানি দিলেন এবার, ”বেশি তড়পাবেন না একদম। পুলিশ কাকে কী জিজ্ঞেস করবে, তার জন্য কি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, উত্তর দিন। নাহলে সোজা লক আপে পুরে দেব।”
”পুরে দিলে দিন। কানু চক্কোত্তি কোনো জেলখানা বা পুলিশকে ডরায় না।”
লোকটা ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বলল বটে, কিন্তু রুদ্র লক্ষ্য করল, তারপর কেমন যেন মিইয়ে গেল। শুকনো ঠোঁটটা কিছু দুর্বোধ্য শব্দ বিড়বিড় করতে লাগল। চোখদুটোও বুজে গেল ধীরে ধীরে।
লোকেশবাবু কড়াগলায় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রুদ্র ইশারায় থামিয়ে দিল। চুপচাপ ও ফিরে যেতে লাগল গাড়ির দিকে।
গাড়িতে উঠেই প্রিয়াঙ্কা উত্তেজিত গলায় বলল, ”ম্যাডাম, লোকটা বলল বটে একা থাকে, কিন্তু …!”
”দেখেছি।” রুদ্র বলল, ”লোকেশবাবু, লোকাল থানার সঙ্গে কথা বলে এই কানু চক্রবর্তীর পেছনে লোক লাগান। ওরা সারাদিন ফলো আপ করুক। লোকটার সঙ্গে আরও কেউ রয়েছে এখন। কানুবাবু তো ধুতি ফতুয়া পরেন দেখছি, কিন্তু ওর কুঁড়েঘরের সামনের তারে দুটো হাফপ্যান্ট ঝুলছে।”
৩০
জ্যোৎস্নাদি এসে খুব নীচুগলায় বলল, ”দাদাবাবু, আজকের মাটনটা আমি রান্না করতে পারব না।”
প্রিয়ম বসার ঘরে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিল। রুদ্র বসে ছিল অদূরের বিশাল কাঠের টেবিল চেয়ারে। ওরও সামনে ল্যাপটপ। সেখানে খোলা পরপর খুনগুলোর বিবরণ। হাতে একটা ছোট নোটবুক আর পেন। সবে সকাল সাড়ে সাতটা। একটু পরেই দুজনে তৈরি হবে অফিসের জন্য।
জ্যোৎস্নাদি’র এত ম্রিয়মাণ গলায় ওরা অবাক হল না। মল্লিকাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই জ্যোৎস্নাদি এমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। নীচে মল্লিকাদি আর ক্ষমার ঘরটা তারপর থেকে তালাবন্ধ রয়েছে। পুলিশি তরফে প্রথমে কিছুদিন সিল করা থাকলেও পরে খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তবু ওই ঘরে পারতপক্ষে কেউ যায় না।
মল্লিকাদি আর ক্ষমা যেন এই বাড়িতে একটা অসম্পূর্ণ অধ্যায়। যা শেষ হওয়ার আগেই টেনে হিঁচড়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
প্রিয়ম মুখ তুলে বলল, ”রান্না করতে পারবে না? কেন?”
জ্যোৎস্নাদি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর চোখদুটো ছলছল করছিল। তারপর বলল, ”মল্লিকাদি কী ভালো পাঁঠার মাংসটা রাঁধত, বলুন? আমাদের মতো ফাঁকিবাজি করে বাজার থেকে কেনা গুঁড়ো মশলা দিয়ে নয়। বসে বসে ধৈর্য ধরে ধনে, জিরে বাটত, আদা, রসুন, সব। কী ভালো খেতে হত! আবার ভক্তি করে বলত, মহাপ্রসাদ! কেন কে জানে। রাঁধতে গেলে ওর মুখটা বড্ড মনে পড়বে। আমাকে রাঁধতে বলবেন না দাদাবাবু।”
প্রিয়ম কী বলতে যাচ্ছিল, রুদ্র বাধা দিয়ে বলল, ”আচ্ছা বেশ। তোমাকে মাটন রান্না করতে হবে না। থাক, আমরা দুজনে মিলে করে নেব। ঠিক আছে? তুমি যাও, জ্যোৎস্নাদি।”
জ্যোৎস্নাদি যেতে উদ্যত হয়েও পেছন ফিরল। ধরা গলায় বলল, ”কাল ওদের ঘরটা পরিষ্কার করতে ঢুকেছিলাম দিদিমণি। সেই জানলাটা, যেখান দিয়ে মল্লিকাদিকে … এত কষ্ট হচ্ছিল! বেরিয়ে এলাম। ক্ষমাটাই বা কোথায় গেল? মল্লিকাদির খুনের কি কোনো কিনারা হবেনা, দিদিমণি?”
রুদ্র চুপ করে রইল। জ্যোৎস্নাদি বেরিয়ে যেতে কপালের দু’পাশের রগদুটো টিপে ধরল ও। মাথায় যেন কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো বিষয় বিষাক্ত সাপের মতো কিলবিল করছে, যে ও কোনো খেই পাচ্ছে না।
প্রিয়ম বলল, ”সত্যিই। মল্লিকাদি কে, ক্ষমা কে, কোথা থেকেই বা এসেছিল, কেনই বা এসেছিল, কেন ক্ষমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল, কেন মল্লিকাদি’কে খুন করা হল, কোনো হদিশ নেই! এতগুলো দিন চলে এল, কোনো প্রোগ্রেসও নেই। কী করছে বলো তো তোমাদের ডিপার্টমেন্ট?”
”জানি না। এই কেসটা শ্রীরামপুর থানাকে দেওয়া হয়েছে।” ক্লান্তগলায় বলল রুদ্র।
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ”নাহ, হুগলীর পুলিশ সত্যিই কোনো কম্মের নয়। এখন তো মনে হচ্ছে, মল্লিকাদি আর ক্ষমাও ওই আমীশ সমাজ না কী, তার বাংলা সংস্করণ।”
”মানে?” খাতা থেকে মুখ তুলল রুদ্র।
”তুমি নিজেই দ্যাখো না। আমীশ সমাজ নাকি সবসময় মধ্যযুগে বাস করে। মল্লিকাদি বা ক্ষমাও কি তাই নয়? ক্ষমা কখনো আজকালকার মেয়েদের নাম হয়? যখন মানুষ কন্যাসন্তান চাইত না, তখন এইসব নাম রাখত। আমার মায়ের মাসতুতো বোনের নাম সমাপ্তি। কেন? না, আগে তিনটে মেয়ে আছে, আর চাইনা ঠাকুর, এবার সমাপ্ত করো। তেমনই ইতি, ক্ষমা এইগুলো। চায়না বলে যে নামটা, সেটাও চাই না থেকে এসেছে।” প্রিয়ম বলে যাচ্ছিল, ”তার ওপর, পাঁঠার মাংসকে মহাপ্রসাদ! আগেকার দিনের লোকেরা বলত শুনেছি। মা চণ্ডীর প্রসাদ, তাই মহাপ্রসাদ। বহু পুরোনো গল্প উপন্যাসে পড়েছি। কিন্তু এখন কে বলে ভাই? তারপর ওইটুকু মেয়ে মালা গাঁথছে, পুজো করছে, মা অতবড় ঘোমটা টানছে। কেমন সেকেলে ব্যাপার না? পার্থক্য এটাই যে, আমেরিকার আমীশরা সেইযুগের ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, গাউন পরে, আর এরা দুশো বছর আগেকার বাংলার মতো রীতিনীতি পালন করে।”
রুদ্র বিস্ফারিত চোখে শুনছিল। প্রিয়ম থামতেই বলল, ”ব্রিলিয়ান্ট! প্রিয়ম, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট! সত্যিই তো! আমার তো একেবারে মাথায় আসেনি। আমি এদিক ওদিক ঘুরে মরছি। আমার বাড়িতেই দুজন রয়েছে। আড়াইশো-তিনশো বছর আগে বাঙালি আলু কী, তা জানত না। মল্লিকাদিও প্রথমদিকে আলু দেখে অবাক হত, জ্যোৎস্নাদি বলত। মল্লিকাদি’কে তির ছুঁড়ে মারা হয়েছে। সেটাও তো প্রাচীন পদ্ধতি!”
প্রিয়ম এবার অবাক, ”তুমি কি সিরিয়াসলি নিলে নাকি? আমি তো মজা করছিলাম। অতগুলো খুনের সঙ্গে মল্লিকাদি’র খুনের কী সম্পর্ক? মল্লিকাদি তো কোনো ব্যবসাদার নয়।”
”ব্যবসাদার নয় তো কি হয়েছে!” রুদ্র উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করল, ”ওরা সারাক্ষণ খুব ভয়ে থাকত। বিশেষ করে ক্ষমা। মাঝেমাঝেই বলত, ওকে কেউ ধরে নিয়ে যাবে। ওহ, কী করে এত বড় ক্ল্যু মিস করে গেলাম আমি! ক্ষমা যেদিন ভয় পেল? তারপরে পরেই আমায় বলেছিল, ও নাকি ওর ভাশুরপো’কে দেখে অত ভয় পেয়েছিল। ওকে নাকি ধরে নিয়ে যাবে। ইশ, আমি তখনো গুরুত্ব দিলাম না? আমার … আমার এক্ষুনি রিজাইন করা উচিত। আমি এই চাকরির যোগ্যই নই।”
”সে তো যোগ্য নও বুঝলাম।” প্রিয়ম বলল, ”কিন্তু ভাশুরপো মানে? ভাশুরপো মানে তো বরের দাদার ছেলে। তাহলে ভাশুরপো থাকতে গেলে তো আগে একটা বর থাকতে হবে। ওইটুকু মেয়ের বর কি করে হবে? গাঁজাখুরির কোনো সীমা নেই। কথাটা কি মল্লিকাদি বলেছে?”
”না। ক্ষমা বলেছে।” রুদ্র বলল, ”বাংলার আমীশরা যদি দু-আড়াইশো বছর পিছিয়ে থাকে, তবে ন’দশবছরের মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা কি খুব অ্যাবনর্মাল, প্রিয়ম? তখন তো ওইরকমই হত।”
”তাই তো! কিন্তু এখন তো আঠেরো বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া অপরাধ। যদিও গ্রামের দিকে লুকিয়ে চুরিয়ে আকছার চলে এসব।” প্রিয়ম বলল, ”তবে কি অত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল বলে ক্ষমা আর মল্লিকাদি পালিয়ে এসেছিল শহরে? ওদের গ্রাম কোথায়, আমরা তো এখনো জানি না!”
রুদ্র কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকেশ ব্যানার্জি ফোন করলেন।
”কী ব্যাপার, কেমন উৎসব করছেন মায়াপুরে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”ভালো। এখন তো প্রস্তুতি চলছে ম্যাডাম, এখনো শুরু হয়নি। ম্যাডাম, একটা কথা জানানোর জন্য ফোন করছি। গত দুদিন ধরে আপনার আদেশমতো আমাদের ইনফর্মার মিন্টু কানু চক্রবর্তীকে চোখে চোখে রাখছিল। ও কয়েকটা ইন্টারেস্টিং অবজারভেশন আমাকে ফোনে জানাল। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে একটা ছেলে থাকছে। গ্রামের এক মহিলা দেখেছে, প্রথম দু’দিন ছেলেটা ধুতিফতুয়া পরেছিল। ন্যাড়া মাথা, পেছনে টিকি। তারপর থেকে সে গেঞ্জি প্যান্ট পরে থাকে। টিকি কেটে ফেলেছে। মাথায় অল্প চুল গজিয়েছে। চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা কানু চক্রবর্তীকে বদনপুর থেকে একটু দূরের এক বাজারে অল্পবয়সি ছেলের জামাপ্যান্ট কিনতে দেখা গেছে।”
”হুম।” রুদ্র বলল, ”ছেলেটাকে কি মহিলা চিনতে পেরেছেন?”
”না।”
রুদ্র বলল, ”ইমিডিয়েটলি ওই ছেলেটার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করুন। ছেলেটার জীবন সংশয়ের মধ্যে রয়েছে।”
”আচ্ছা। তবে কানু চক্রবর্তী লোকটা ভালো, ম্যাডাম। লোকটার পাস্ট হিস্ট্রি বেশ ইন্টারেস্টিং।”
”কীরকম?”
লোকেশবাবু কিছু বলতে শুরু করলেন, কিন্তু পাশ থেকে বেশ জোরে খোলতাল সংকীর্তনের আওয়াজ ভেসে আসায় রুদ্র কিছু শুনতে পেল না। ও বলল, ”একটু দূরে গিয়ে কথা বলুন, লোকেশবাবু। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা।”
লোকেশবাবুর গলা আবার শোনা গেল মিনিট দুয়েক পর, ”হ্যাঁ ম্যাডাম। বলছি, কানু চক্রবর্তী লোকটা একটু অদ্ভুত। ওর বাবা বদনপুর গ্রামের জমিদার চৌধুরীদের বাড়ি পুরোহিতের কাজ করত। চৌধুরীরা ছিল শক্তির উপাসক, মা চণ্ডীর সেবাইত। কিন্তু কানু ছোটবেলা থেকে ছিল কৃষ্ণভক্ত। এই নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বাবা অসুস্থ হয়ে কোনো একদিন মন্দিরে পুজো করতে যেতে না পারলেও কিছুতেই একমাত্র ছেলে কানুকে রাজি করানো যেত না। দেবীর নাম শুনলেই কানু ক্ষেপে উঠত। বলতো, চণ্ডী আবার কিসের ঠাকুর? আর এই ব্যাপারে ওর এক সঙ্গী ছিল। সে ওই চৌধুরীবাড়িরই এক শরিকের ছেলে। দু’জনেই কৃষ্ণঠাকুরের ভক্ত ছিল।”
রুদ্র বলল, ”কিন্তু এখন তো কানু চক্রবর্তী চণ্ডী মন্দিরেই পুজো করে!”
”পুরোটা শুনুন আগে, ম্যাডাম।” লোকেশবাবু বললেন, ”চোদ্দো পনেরো বছর বয়সে কানু আর ওর সেই বন্ধুটা গ্রাম ছেড়ে পালায়। তারপরের কয়েক বছর তাদের আর কোনো খোঁজ ছিল না। চৌধুরীবাড়ি থেকে অনেক খোঁজখবর করেও পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে সবাই হাল ছেড়ে দেয়।”
”তারপর?”
”কানু একা আবার গ্রামে ফিরে আসে আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে। ততদিনে তার বাবা মারা গিয়েছে। চৌধুরীরাও গ্রামের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছে শহরে। চণ্ডী মন্দিরটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। কানু চক্রবর্তী এসে আবার পুজো আচ্চা শুরু করে। অদ্ভুতভাবে তার কৃষ্ণভক্তি উবে গিয়ে সে চণ্ডীর উপাসক হয়ে যায়। তারপর থেকে ওভাবেই আছে। যদিও গ্রামের কারুর সঙ্গে সেভাবে মেশে না।”
”তা কানু চক্রবর্তী লোকটা যে ভালো, সেটা আপনি কী করে বুঝলেন?”
লোকেশবাবু এবার একটু হেঁহেঁ করে বললেন, ”না মানে ইয়ে, এককালে কৃষ্ণের ভক্ত ছিল, সে কি কখনো খারাপ হতে পারে? গ্রামের একজন নাকি একবার আমাদের এই মায়াপুরের মন্দিরে কানু চক্রবর্তীকে দেখতেও পেয়েছিল। পরনে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসীর পোশাক ছিল। যদিও কানু চক্রবর্তী চিনেও না চেনার ভান করেছিল। পরে গ্রামে আসতে ওই কথা জিজ্ঞেস করতে লোকটাকে দূরদূর করে তাড়িয়েও দিয়েছিল।”
”আর কানুর ওই বন্ধু?”
”তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, ম্যাডাম।”
রুদ্র কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রইল। এতগুলো বিচ্ছিন্ন বিষয় এত দ্রুতগতিতে চলে আসছে, যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতিটা বিষয়ই একে অন্যের চেয়ে এত আলাদা, দিশেহারা লাগছে।
ও বলল, ”চৌধুরীরা কলকাতার কোথায় থাকে, তার বিশদ জোগাড় করুন।”
লোকেশবাবু একটু কাঁচুমাচু গলায় বললেন, ”এখনই? ম্যাডাম, এখন তো এখানে আছি, চারদিন পরেই পুজো। ফিরে করলে হবেনা?”
”না।” কঠিন গলায় বলল রুদ্র, ”আপনাকে তো চলে এসে করতে বলছি না। লোক মারফত ফোনে খবর জোগাড় করতে বলছি। সেটুকু করুন অ্যাটলিস্ট! আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে পৌঁছচ্ছি। ওখানেই জানান।”
৩১
অচ্যুত চলে যাওয়ার পর থেকে দ্বারিকা কেমন যেন পালটে গিয়েছে। আগে ও মেধার পরিচয় ততটা না দিলেও চতুষ্পাঠীতে সবাই ওকে খুব শান্ত ও বাধ্য ছাত্র বলে চিনত। যে কারণে বনমালী বা রাখহরির মতো পড়ুয়ারা থাকতেও শিক্ষকরা দ্বারিকাকে আলাদা করে পছন্দ করতেন।
কিন্তু দ্বারিকা এখন আর তাঁদের সেই পছন্দের তালিকায় নেই। দ্বারিকা অবাধ্য বা দুর্বিনীত না হলেও নিয়মিত পাঠঘরে উপস্থিত থাকে না। প্রায়ই সে অনুপস্থিত থেকে অন্য কোথাও ঘুরে বেড়ায়।
প্রথম প্রথম বংশীধর বা মধুসূদনের মতো তরুণ শিক্ষকেরা খেয়াল করেননি। কিন্তু যেদিন ধরতে পারলেন, সেদিন সদগোপদের দুজনকে পাঠালেন দ্বারিকাকে খুঁজে আনতে।
দ্বারিকা তখন বসেছিল জরা নদীর পাড়ে। মাথার ওপরে তপ্ত আকাশ। বসে বসে ভাবছিল, ও যেমন এই আকাশের নীচে বসে রয়েছে, অচ্যুতও তেমনই এই আকাশেরই নীচে কোথাও একটা রয়েছে।
‘রয়েছে’ তো এখনো?
নিশ্চয়ই রয়েছে। মনকে সাহস জোগাল দ্বারিকা। অচ্যুত তার বন্ধু, ভাবলেই গর্বে বুক ফুলে ওঠে এখন ওর। কালু কৈবর্তের গ্রাস থেকে পালানো মুখের কথা নয়।
আচ্ছা, অচ্যুত একবার কী একটা খাবারের নাম বলেছিল। আলো চালের মতো শুনতে। বলেছিল, যে কোনো তরকারিতে সেই সবজীটা নাকি দিয়ে খায় আধুনিক সমাজের মানুষরা। তাতে নাকি স্বাদই পালটে যায়। সেই সবজির চাষ এই বৈদিক সমাজে করা হয় না কেন?
আর অচ্যুত কী করে জানল? অচ্যুত কি তাহলে আগেও গিয়েছিল বাইরে? না শুনেছিল কারুর কাছে!
অচ্যুত কি এখন দিনরাত তাহলে ওই খাবারটা খাচ্ছে?
যতদিন যাচ্ছে, দ্বারিকারও বড় খেতে ইচ্ছা করছে। সমস্ত শৃঙ্খল ভয় সংকোচকে উপেক্ষা করে চলে যেতে ইচ্ছা করছে আধুনিক পৃথিবীতে, যেখানে গুরুদেবের মতে চলছে অকল্পনীয় অনাচার।
আধুনিক পৃথিবীতে না হয় অনাচার চলছে, কিন্তু ওদের এই সমাজে? এখানে যা চলছে, তা কি অনাচার নয়?
ওর পাশের বাড়ির বোন পুতুর বিয়ে দেওয়া হল বুড়ো গোপাল ব্যানার্জির সঙ্গে। তিন সতীনের সঙ্গে পুতু একমাথা সিঁদুর নিয়ে শুরু করেছে সংসার।
দশ বছরের মেয়ের সঙ্গে সহবাস কি বিকৃতি নয়? শুধুমাত্র বর্ণের প্রেক্ষিতে কাজ ভাগ করে দেওয়াটাও কি অন্যায় নয়? কে বলতে পারে, কালু কৈবর্তের ঘরে এমন কোনো ছেলে নেই, যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অসম্ভব মেধা? নিজের জাতের জন্য যে কোনোদিনই জানতে পারবে না নিজের প্রতিভা?
শিক্ষা বা অন্যান্য অধিকার জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য হবে না কেন?
দ্বারিকা বেশ বুঝতে পারে, ও ধীরে ধীরে অচ্যুতের মতো হয়ে যাচ্ছে। আগে যেমন অন্ধভাবে সবকিছু মেনে নিত, বিনা প্রশ্নে পালন করত অনুশাসন, এখন যেন তা হচ্ছে না। জলের মধ্যে বড় মাছ যেমন ঘাই মারে, সেভাবেই মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে হাজারো প্রশ্ন।
যেমন সেদিন। যদুহরি ঘোষালের বিধবা স্ত্রী সেই ক্ষমা বলে মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল গ্রামে। গোটা গ্রাম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদুহরি ঘোষালের ভাই কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা সেদিন সদর্পে বলছিল, ক্ষমার মা’কে নাকি হত্যা করা হয়েছে। মা হয়ে শ্মশানঘাট থেকে সতী হতে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে পালানোর মতো জঘন্য পাপ যে করে, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ব্রজেন্দ্রদাদার মতোই।
ক্ষমা মেয়েটা পুরোপুরি পালটে গিয়েছে। এখন শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। সাদা থান পরে। একবেলা খায়। ওর অত সুন্দর মেঘের মতো চুল নাকি কেটে দেওয়া হয়েছে। দ্বারিকার মা একদিন ভারী মুখে বলছিলেন।
যদুহরি ঘোষালের ভাই কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা সম্পর্কে জ্যাঠাইমা ক্ষমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তারা নাকি উঠে বসতে লাঞ্ছনা গঞ্জনায় অতিষ্ঠ করে তুলছে বাচ্চা মেয়েটিকে। যে বিধবা স্বামীর সঙ্গে সহমরণে না গিয়ে পালায়, সে তো মহাপাপিষ্ঠা! তাকে ঘরে আশ্রয় দেওয়া মানে সংসারেরও অকল্যাণ। এমনকী ক্ষমার জন্মদাতা পিতা থাকোগোপালেরও তাই মত।
পরম গুরু জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নাকি ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। তাঁর লেখা বইয়ের রীতিনীতিই নাকি অনুসরণ করা হয় বৈদিক সমাজে। অন্তত বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা তাই বলেন।
কিন্তু দ্বারিকার বিশ্বাস হয় না। সত্যিই কি পরম গুরু ওইসব লিখে গিয়েছিলেন? সত্যিই কি তাঁর লেখা গ্রন্থে ছিল স্বামীর প্রয়াণে স্ত্রীর সহমৃতা হওয়ার নির্দেশ?
এইবছরের মহোৎসবের দিন এগিয়ে আসছে দ্রুত। আর যত এগিয়ে আসছে, ওদের সমাজের প্রতিটি লোক যেন কেমন পালটে যাচ্ছে, লক্ষ্য করেছে দ্বারিকা। ওদের গ্রামের পুরুষদের মধ্যে থেকে বেশ কিছুজন করে একসঙ্গে উধাও হয়ে যাচ্ছে। ঘোষালবাড়ির তিন ছেলে, বাগচি বাড়ির চার ছেলেকে প্রায় দুইসপ্তাহ হয়ে গেল দেখেনি ও।
কী চলছে এখানে?
হঠাৎ একটা কর্কশ ডাকে দ্বারিকা চমকে পেছনে তাকাল। দেখল, দুজন বল্লমধারী প্রহরী ডাকছে তাকে। যেতে বলছে নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে।
বিনাবাক্যবয়ে তাদের অনুসরণ করে নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে গেল দ্বারিকা। গিয়ে অবাক হয়ে গেল। ওদের শ্রেণীর সব ছাত্র তো বটেই, বাকি শ্রেণীরও সব ছাত্র সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে চাতালের সামনে। সব মিলিয়ে প্রায় সত্তরজন।
ওকে সেই সারিতে ঢুকিয়ে দিয়েই ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেল দুই প্রহরী। দ্বারিকা এগিয়ে গিয়ে বনমালীকে জিজ্ঞেস করল, ”এখানে কী হচ্ছে ভায়া?”
বনমালী তার স্বভাবসুলভ দাম্ভিক স্বরে উত্তর দিল, ”তুই অ্যাদ্দিন কোন গর্তে ঢুকে বসেছিলি দ্বারিকা? জানিস না, কাল বাদে পরশু মাহেন্দ্রমহোৎসব?”
”মহোৎসব জানি।” দ্বারিকা কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু শব্দটা যে ও আগে কোথাও শুনেছে সেটা মনে করতে পারল। বলল, ”মাহেন্দ্রমহোৎসব কী?”
বনমালীর পাশ থেকে ব্যাঙ্গের সুরে হাসল রাখহরি, ”কী ব্যাপার বল তো? তোর প্রাণসখার প্রাণবায়ু ফুরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দেখছি, তুই যাও বা বেগুন ছিলি, এখনো একেবারে কানা বেগুন হয়ে উঠেছিস দ্বারিকা! গত চার পাঁচদিন তো মুখও দেখাসনি চতুষ্পাঠীতে!”
রাখহরির কথায় বনমালী তো বটেই, আশপাশের আরও দু-তিনটে ছেলে হেসে উঠল।
রাগে দ্বারিকার নাকের পাটা ফুলে উঠল। এরা সবাই ভেবেছে অচ্যুত মরে গিয়েছে। কিন্তু ও একেবারে নিশ্চিত, অচ্যুত বেঁচে রয়েছে। বেঁচে রয়েছে গুরুদেবের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। জানাজানি হলে তা গুরুদেবের অপমান তো বটেই। তাই প্রচার করে দেওয়া হয়েছে, অচ্যুত মরে গেছে।
উহ! কী নিষ্ঠুর এরা!
দ্বারিকা সারির একেবারে পিছনে চলে গেল। আপাত নিরীহ গোছের এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করল, ”কী ব্যাপার রে? আমি তো ক’দিন আসতে পারিনি, তাই জানি না।”
ছাত্রটির নাম শ্রীহরি। চতুষ্পাঠীতে তার খ্যাতি মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী হিসেবে।
শ্রীহরি গড়গড় করে যান্ত্রিকভাবে বলে গেল, ”আমাদের বৈদিক সমাজের সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ডের দিন এই মাহেন্দ্রমহোৎসব। ওই দিনেই গুরুদেব আবির্ভূত হবেন কল্কি অবতার রূপে। গুরুদেবের মধ্যে সেদিন প্রকট হবেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, পরম গুরু ও প্রথম গুরু তিনজনেই। আর আমরা সবাই তাঁর হয়ে লড়াই করবো যুদ্ধক্ষেত্রে।”
শ্রীকৃষ্ণ (ভগবান বিষ্ণু�)
।
পরম গুরু (জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন)
।
প্রথম গুরু
।
বর্তমান গুরুদেব (কল্কি অবতার)
”যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই? মানে?” দ্বারিকা কিছু বুঝতে পারল না। কল্কি অবতার? অর্থাৎ যে অবতারের এখনো মর্ত্যে আগমন হয়নি?
দ্বারিকা দ্রুত রোমন্থন করতে চেষ্টা করছিল কিছুদিন আগে চতুষ্পাঠীতে বলা গুরুদেবের কথাগুলো।
”সত্যযুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন চারজন অবতার। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ। ভালো করে লক্ষ করো, কীভাবে পৃথিবীর বিবর্তনের ক্রমবিকাশ মূর্ত করে তুলেছেন অবতাররা। প্রথম যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়, তার তিনভাগ জল ও একভাগ স্থলে প্রথম আবির্ভাব ঘটে জলচর প্রাণী মৎস্যের। তারপর জল ও স্থল, দুই স্থানেই প্রাণীর বসবাস শুরু হয়। তাই পরবর্তী অবতার কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপ। উভচর প্রাণী। তৃতীয় অবতার বরাহ, অর্থাৎ শূকর। তার মতোই জগতের প্রাণীরাও প্রধানত স্থলেই বসবাস করতে শেখে। সত্য যুগের চতুর্থ ও শেষ অবতার ছিলেন নৃসিংহ। পশু ও মানুষের সংমিশ্রণ। মানবজাতির পূর্বতন অবস্থাও ছিল পশুসুলভই। তখনো মানবদেহ পুরোপুরি পূর্ণতা পায়নি।”
দ্বারিকার স্পষ্ট মনে পড়ছে গুরুদেবের সেদিনের বলা কথাগুলো। মনে পড়ছে, এরপরই বনমালী উঠে প্রশ্ন করেছিল, ”কিন্তু আমরা তাঁকে কীভাবে চিনতে পারব, গুরুদেব?”
গুরুদেব তখন স্মিতমুখে বলেছিলেন, ”ভাগবত পুরাণে স্পষ্ট লেখা রয়েছে। কলিযুগের অন্তিম ও সত্যযুগের প্রারম্ভের সন্ধিক্ষণে জন্ম নেবেন শ্রীকৃষ্ণের শেষ অবতার কল্কি। ওইসময় পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শাসক আসক্ত হবে অসততায়, শাসকরাই অধঃপতিত হয়ে নেমে আসবে সাধারণ ডাকাতের পর্যায়ে।
”গোটা পৃথিবী জুড়ে চলবে হত্যালীলা, দরিদ্র, নারী ও শিশুর প্রতি অকল্পনীয় অত্যাচার। সাধারণ মানুষের দুঃখ শোক ও ক্লেশের কোনো সীমা থাকবে না। দুষ্টরা হয়ে উঠবে দেশের রাজা, সৎরা হবে নির্যাতিত।
”কল্কি অবতার তখন আসবেন তাঁর বাহন পক্ষীরাজ দেবদত্তয় উড্ডীন হয়ে। তিনি সবাইকে বিনাশ করবেন। সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে ধ্বংস হবে সবকিছু। সত্যযুগের পুনরারম্ভে বেঁচে থাকবে খুব কম সংখ্যক লোক, যারা সৎ ও ধার্মিক।”
দ্বারিকার মাথা ঝিমঝিম করছিল। ওদের এই বৈদিক সমাজের মুখ্য ব্যক্তি গুরুদেব নিজেই কল্কি অবতার? তিনি নিজে বিনাশ করবেন পৃথিবীর সব খারাপ মানুষদের? কলিযুগের অবসান ঘটিয়ে শুরু হবে সত্যযুগ?
তাহলে ওরা কে? কেনই বা এইভাবে জমায়েত হয়েছে সবাই ক্রীড়াঙ্গনে?
ও ফিসফিস করে শ্রীহরিকে জিজ্ঞেস করল, ”আমরা এখন কোথায় যাব রে?”
শ্রীহরি চোখ বন্ধ করে বলল, ”সেই অভিশপ্ত পুণ্যধামে, যেখানে চলে যথেচ্ছ পাপলীলা। যেখানে কৃষ্ণের উপাসনা হলেও নিরন্তর চলে আধুনিক সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।”
৩২
জ্যোৎস্নাদি নিভে যাওয়া মুখে বলল, ”এমা! আমি এত তরিবৎ করে বানালাম, দিদিমণি খাবে না?”
”না।” প্রিয়ম আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়িতে রাত পৌনে বারোটা। অফিস থেকে এসে রুদ্র একতলায় লাইব্রেরি ঘরে ঢুকেছে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। তারপর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
জয়ন্ত আর ড্রাইভার পাঁচু এসেছিল চাবি রাখতে। বলছিল, আজ সারাদিন নাকি রুদ্র ত্রিবেণী থেকে বৈদ্যবাটী, চন্দননগর থেকে আদিসপ্তগ্রাম ছুটে বেরিয়েছে। এই থানা থেকে অমুক স্টাফকে তুলেছে, ওই থানা থেকে তমুক স্টাফকে। নানা জায়গায় ঘুরেছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়াই করেনি। শুকনো কিছু ফল খেয়ে কাটিয়েছে।
প্রিয়ম তাই তারপর থেকে আর বিরক্ত করেনি। ও বুঝতে পারছিল, এই কেসটা সলভ করা রুদ্রর কেরিয়ারের জন্য কতটা প্রয়োজন। এখন মিডিয়াগুলো রীতিমতো কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। প্রতি মাসে যদি এই অদ্ভুত হত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, সেটা রুদ্রর জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের।
আর গোটা বিষয়টা এত জটিল হয়ে উঠেছে যে রুদ্রকে একা থেকে নিজের মতো ভাবতে দেওয়াটা খুবই দরকার।
প্রিয়ম একটা পুরোনো ইংরেজি সিনেমা দেখছিল। ষাটের দশকের এই অ্যাকশনধর্মী ছবির প্রেক্ষাপট অবশ্য অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেন। ওর প্রিয় অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো রয়েছেন মুখ্য ভূমিকায়। ওদের দুজনেরই একটা শখ হল পুরোনো ছবি দেখা। বিশেষত ঐতিহাসিক ঘরানায়। পুরোনো দিনের পটভূমিকায় সিনেমা দেখতে দেখতে তখনকার মানুষদের চালচলন সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যায়। টাইম ট্রাভেল করছে ভেবে রোমাঞ্চ জাগে বেশ।
আজ অবশ্যি সিনেমাটা দেখতে দেখতে প্রিয়মের বারবার মনে পড়ছিল গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমীশ সম্প্রদায়ের কথা।
কী অদ্ভুত! এই সিনেমায় ও যেরকম পোশাক পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা দেখছে, তা যে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বেও কেউ বা কারা একইরকম রেখেছে, ভাবলেই অবাক লাগে।
জ্যোৎস্নাদি বলল, ”তাহলে আপনি খেয়ে নিন এবার?”
প্রিয়ম ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে বলল, ”আমিও খাব না। তুমি খেয়ে নাও। খেয়ে শুয়ে পড়ো।”
জ্যোৎস্নাদি ছাড়ার পাত্রী নয়। সে বকে যেতে লাগল, ”কোনো মানে হয়? এত ভালো করে রাঁধলুম, আর দুজনেই খাবে না? আবার বলে কিনা, তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো। আরে আপনারা খেলেন না, আর আমি খেয়ে শুয়ে পড়ব? জ্যোৎস্না সরখেল কি অমানুষ নাকি?”
জ্যোৎস্নাদি বহুবছর হল এই এ এস পি বাংলোয় কাজ করছে। অনেক এ এস পি গেছেন এসেছেন, কিন্তু রুদ্রর মতো আন্তরিকভাবে কেউ মেশেনি বলেই বোধ হয় ও-ও নিজের বাড়ির মতোই এতদিনে ভাবতে শুরু করেছে এই বাংলোটাকে।
প্রিয়ম একটু বিরক্ত হয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল রুদ্র। মুখচোখ বিধ্বস্ত, চুল উসকোখুসকো।
ঘরে ঢুকে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল, ”তোমার ডিনার হয়ে গেছে?”
”না।” প্রিয়ম বলল, ”আমি ভাবছিলাম, তুমি কখন বেরোবে, তাই …।”
”তাহলে জ্যোৎস্নাদি, জলদি খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে। রাতও হয়েছে অনেক।”
জ্যোৎস্নাদি’র মুখটা এবার ঝলমল করে উঠল। সে দ্রুত পায়ে ছুট লাগাল রান্নাঘরের দিকে।
রুদ্র একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সোফায় বসতেই প্রিয়ম বলল, ”কি? কিছু ক্লিয়ার হল?”
”অনেককিছু ভাবার অবকাশ পেলাম। এস পি স্যারকে ফোন করছি বারবার বলব বলে, কিন্তু স্যারের ফোন বন্ধ।” রুদ্র ওর হাউজকোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। তারপর বলল, ”তুমি শুনবে?”
”বলো। ক্ষতি কী?”
”পয়েন্ট ওয়াইজ পড়ছি শোনো।
”একনম্বর। প্রথম খুন হয়েছিল ত্রিবেণীর সাইবার ক্যাফের মালিক শিবনাথ বিশ্বাস (৩৮)। লোকাল থানা প্রথমে স্ত্রী আরতি ও পাড়ার এক ছেলে রাজুকে প্রেমঘটিত কারণে সন্দেহ করলেও কোনো প্রুফ নেই। আজ রাজুকে ত্রিবেণী গিয়ে আমি নিজে ইন্টারোগেট করে এসেছি। সে জানিয়েছে, সম্প্রতি শিবনাথের এক নতুন বন্ধু হয়েছিল। নাম শ্যামসুন্দর। শিবনাথেরই বয়সি। কোথায় থাকত বা কী করত, রাজু কিছুই জানেনা। কিন্তু মাঝে দু’বার ওদিক দিয়ে যেতে গিয়ে শিবনাথের দোকানে দেখা করেছিল, দু’বারই দেখেছিল, শ্যামসুন্দর বসে আছে। শিবনাথই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। লোকটা নাকি বাইরে কাজ করে, ছুটিতে ত্রিবেণী এসেছে। যদিও কী কাজ, রাজু জানে না।”
”হুম!” প্রিয়ম বলল, ”তার মানে এখানেও উটকো একটা লোকের সন্ধান পাওয়া গেল অ্যাট লাস্ট!”
”তার থেকেও বড় আরেকটা তথ্য জানতে পেরেছি প্রিয়ম।” রুদ্র বলল, ”রাজুর কাছ থেকে ফেরার সময় আমি আবার গিয়েছিলাম শিবনাথের বাড়ি। আমার আগেরবার একটা সামান্য খটকা লেগেছিল, যখন শিবনাথ বিশ্বাসের টেবিলে ওর বাবা-মায়ের ছবি দেখেছিলাম।”
”কী খটকা?”
”শিবনাথের ছবি দেখেছি, গায়ের রং খুবই ফর্সা। কিন্তু ওর বাবা-মা খুব কালো।”
”তো?” প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”তাতে কী হয়েছে? হয়তো শিবনাথ ওর দাদু বা ঠাকুমা-দিদিমার গায়ের রং পেয়েছে। মেন্ডেলের বংশগতির সেই প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য তো পড়েছিলে নাকি!”
রুদ্র বলল, ”পড়লেও এক্ষেত্রে আমার খটকাটাই সত্যি হয়েছে, প্রিয়ম। শিবনাথের স্ত্রী আরতি জিজ্ঞাসাবাদে আমায় জানিয়েছে, শিবনাথকে ছোট বেলায় গঙ্গার ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন ওর বাবা। তাঁদের নিজেদের কোনো সন্তান ছিল না, তাই শিবনাথকেই মানুষ করেছিলেন ছেলের মতো। তখন শিবনাথের দশ-বারো বছর বয়স।
”দু’নম্বর, চন্দননগরের মহম্মদ তারেক। তার আসল পরিচয় কেউ জানে না। বদনপুর গ্রামের পল্টু এবং কানু চক্রবর্তীর কথা অনুযায়ী সে এসেছিল কোনো অন্য জায়গা থেকে। মন্দিরে পুজো করত, অর্থাৎ সে ছিল হিন্দু। কিছুদিন থেকে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নতুন জীবন শুরু করে চন্দননগর রেলস্টেশনের গায়ে। নতুন নাম নেয়, মহম্মদ তারেক। অর্থাৎ মুসলমান। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন? কেন তাঁকে এইভাবে নিজের পরিচয় পুরোপুরি পালটে ফেলতে হল?”
প্রিয়ম বলল, ”নিশ্চয়ই সে কারুর থেকে লুকনোর চেষ্টা করছিল।”
রুদ্র বলল, ”হ্যাঁ। এটা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না। আরেকটা ব্যাপার, ঠিক তারেকেরই মতো আরেকজন ছেলে এখন কানু চক্রবর্তীর কাছে রয়েছে, যার সম্বন্ধেও গ্রামের মানুষ পুরো অন্ধকারে। এখানে তাহলে আরেকটা প্রশ্ন হল, কানু চক্রবর্তীর কাছেই এরা আসে কেন? আর কানু চক্রবর্তী বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ছিল কৃষ্ণভক্ত, ফিরে এসে শৈব হয়ে গেল কি করে? মাঝের কয়েকটা বছরই বা সে কোথায় ছিল? সে যখন বদনপুর গ্রামে ফিরে এল, তার সঙ্গী বন্ধুটি কোথায় গেল?”
প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ”কানু চক্রবর্তীর ব্যাপারটার সঙ্গে কি এই সিরিয়াল কিলিং এর আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে? লোকটা হয়তো এমনিই ক্ষ্যাপা প্রকৃতির। তুমিই তো বললে!”
রুদ্র উত্তর দিল না। বলল, ”তিন নম্বর খুনের ঘটনায় আসি। পরের কৃষ্ণপক্ষে খুন হল বৈদ্যবাটির চশমাব্যবসায়ী সুনীল ধাড়া। বছরখানেক আগে তার দোকানে কয়েকদিনের জন্য কর্মচারী ছিল বলরাম। তাকে কাজে ঢুকিয়েছিল কে, কিছুতেই জানা যায়নি।
”পাঁচ নম্বর খুন স্বপন সরকার, তার খুন হওয়ার আগে নতুন ঢুকেছিল গোবিন্দ। ছ’নম্বর খুন ব্রিজেশ তিওয়ারি, তার কাছে কিছুদিনের জন্য কাজ করেছিল কানাই। আমি আজ এই প্রত্যেকের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে গিয়ে নিজে কথা বলেছি। সুনীল ধাড়ার বাড়ির লোক বা স্বপন সরকারের অন্যান্য সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রত্যেকেই জানিয়েছে, বলরাম আর গোবিন্দ দেখতে আলাদা হলেও দুজনেই ছিল পরিশ্রমী। কারেন্ট বা ওই জাতীয় জিনিসকে খুব ভয় পেত। পুজোআচ্চা করত। মানে ব্রিজেশ তিওয়ারির কাছে কিছুদিন কাজ করা কানাইয়ের ব্যাপারে ভট্টাচার্য বাড়ির মধুময়বাবু যা বলেছিলেন, সব মিলে যায়।”
৩৩
প্রিয়ম বলল, ”চার নম্বর খুনটা বাদ দিয়ে গেলে তো!”
রুদ্র বলল, ”বাদ দিইনি। চার নম্বর হৃষীকেশ জয়সোয়ালকে নিয়ে স্বপন সরকার গিয়েছিল বাগডাঙার সরলাশ্রমে। সেখানে দুজনের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় কানাইয়ের ছবি আছে।”
প্রিয়ম গভীরভাবে চিন্তা করছিল, ”অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, এই কানাই, বলরাম, গোবিন্দ, এরা একই গ্রুপের লোক। এবং এরা কোনো না কোনোভাবে তর্কপঞ্চাননের বংশের সেই দত্তক নেওয়া লোকটার সঙ্গে যুক্ত।”
রুদ্র বলল, ”শুধু তাই নয়। শুভাশিসবাবু বলেছিলেন, তাঁদের সেই নকলদাদু আমেরিকায় আমীশদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তিনি ভারতে ফিরে এসেছিলেন, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমেরিকায় যে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন, তেমনও কোনো হদিশ নেই। উনি আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতেন, আমি সেখানেও খোঁজ নিয়েছি। কোর্স কমপ্লিট করার পর আর কোনো আপডেট ইউনিভার্সিটির কাছে নেই। কলকাতার ইউ এস এমব্যাসির কাছে পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ট্র্যাক করতেও পাঠিয়েছি। এটা খুবই সম্ভব যে, এই বাংলারই কোথাও সেই আমীশ সম্প্রদায় এখনো রয়েছে, যেখান থেকে আধুনিক পৃথিবীতে পালিয়ে আসার অপরাধে মল্লিকাদি’কে খুন হতে হয়েছে।”
”খুন হতে হয়েছে কেন?” প্রিয়ম ভ্রূ কুঁচকল।
রুদ্র বলল, ”যদি তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চায়, তবে সেখান থেকে যারা পালাবে, তাদের তারা মুখ বন্ধ করতে খুন করতেই পারে। মল্লিকাদিকে বিষ মাখানো তির ছোঁড়াটাও আমীশদের দিকেই ইঙ্গিত করছে। এইদিক দিয়ে চিন্তা করলে একইভাবে জাস্টিফাই করা যায় ছোটবেলায় পালিয়ে আসা শিবনাথ বা কয়েকবছর আগে পালিয়ে আসা আইডেন্টিটি পুরো বদলে ফেলা মহম্মদ তারেকের খুনকেও।”
”তাহলে ক্ষমাকেও ওরকম কিছু না করে ধরে নিয়ে যাওয়া হল কেন?”
রুদ্র এবার চুপ করে রইল। তারপর বিড়বিড় করতে লাগল, ”ক্ষমা ভয় পেত ওর ভাশুরপো নাকি ওকে ধরে নিয়ে যাবে। ভাশুরপো ধরে নিয়ে যাবে কেন? তার মানে ক্ষমা শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছে। কিন্তু কেন পালিয়েছে?”
প্রিয়ম বলল, ”ক্ষমা যদি বিবাহিতই হয়ে থাকে, তাহলে ওর মাথায় সিঁদুর বা হাতে শাঁখাপলা কিছু ছিল না কেন? পুরনো দিনের মতো জীবনযাপন করলে সেগুলো থাকা উচিত ছিল।”
”হয়তো সেগুলো আগেই মুছে ফেলেছিল।” রুদ্র একটু ভেবে বলল, ”তুমি আর আমি ভোরবেলা বাংলোর বাইরে যখন ওদের রেসকিউ করি, তখন বেশ ঠান্ডা ছিল। দুজনেই চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল।”
প্রিয়ম বলল, ”তোমার যুক্তি যদি মেনেও নিই, সেখানেও অনেকগুলো কোয়েশ্চেন অ্যারাইজ করছে। শিবনাথ আর তারেক ছাড়া বাকিরা অন্য কোথাও থেকে আসেনি। সবাই নিজেদের বাড়িতেই জন্মেছে, বড় হয়েছে। রাইট? তবে তাদের মারা হল কেন?”
রুদ্র বলল, ”এমনিতে তো এরা সবাই এমন এমন পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যেগুলো ওই আমীশ সম্প্রদায়ের চোখে পাপ। শিবনাথ আর তারেক ওখান থেকে এসে হয়ত কাকতালীয়ভাবেই সাইবার ক্যাফে আর মোবাইল রিচার্জের ব্যবসা শুরু করে। তাতে তারা আমীশ সমাজের কাছে আরও বেশি করে অপরাধী হয়ে ওঠে। তাই ওদের দোকানও ভাঙচুর করা হয়েছে। আর সুনীল ধাড়ার চশমার দোকান। যার যা স্বাভাবিক আয়ু বা কোনো রোগজনিত যন্ত্রণাভোগ, সেটাকে চশমা বা কৃত্রিম কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে লঙ্ঘন করাটা আমীশ সমাজের কাছে অপরাধ।”
”সে তো হাজার হাজার চশমার দোকান আছে, গুচ্ছের নার্সিং হোম আছে। ওই আমীশ ব্যাটারা সুনীল ধাড়া আর ড. সুবল ভট্টাচার্যকেই টার্গেট করল কেন?” প্রিয়ম বুলেটের মত পরপর প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছিল।
রুদ্র বিব্রত মুখে বলল, ”সেটার উত্তর আমি এখনো পাইনি প্রিয়ম। আমীশ সমাজ বাংলায় কোথাও লুকিয়ে থাকলেও তাদের প্রতিনিধি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে আধুনিক জগতে আসে। তারা হয়তো কোনোভাবে এইসব লোকগুলোর সঙ্গেই মিশেছে। সুনীল ধাড়ার দোকানের স্থায়ী কর্মচারী দানু জানিয়েছে, সে একবার লম্বা ছুটি নিয়েছিল, তখনই বলরামকে দোকানে রাখা হয়।”
প্রিয়ম না মানার ভঙ্গিতে দু’পাশে মাথা নাড়াল, ”তোমার মোটিভ একদমই কনভিন্সিং লাগছে না। যাইহোক, তারপর বলো।”
রুদ্রর মুখটা নিভে গেল। ম্লান গলায় ও বলল, ”নেক্সট হল বাগডাঙ্গার সরলাশ্রম। ওই আশ্রমের সঙ্গে আমীশ সমাজের ডেফিনিটলি কোন সরাসরি যোগাযোগ আছে। হয়ত ওই আশ্রমের মধ্যে দিয়েই বাংলার ওই আমীশ সম্প্রদায় আধুনিক জগতের সঙ্গে কানেকশন রাখে।”
প্রিয়ম বলল, ”এটা আবার কোথা থেকে ইনফার করলে? শুধু ওই আশ্রমে তর্কপঞ্চাননের বই দেখে?”
”না।” রুদ্র বলল, ”বাগডাঙা সরলাশ্রমে যে মহারাজের ছবি রয়েছে, তাঁর নামও গোপালকৃষ্ণ মহারাজ। এটাও তো হতে পারে, শুভাশিসবাবুর নকলদাদুই ওখানে ওই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর পাঁচনম্বর যিনি খুন হয়েছেন, সেই স্বপন সরকার প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন ওই সরলাশ্রমের সঙ্গে। হৃষীকেশ আগরওয়ালকেও তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন। গোবিন্দ বলে ছেলেটা ছিল তাঁর সহকারী। হতেই পারে যে স্বপন সরকারকে মারার জন্যই জড়ানো হয়েছিল সরলাশ্রমের সঙ্গে। যেহেতু তিনিও আধুনিক সভ্যতার অনিবার্য অঙ্গ গাড়ির ব্যবসা করেন। হৃষীকেশ আগরওয়ালও তাই। প্রোমোটারি।”
প্রিয়ম অদ্ভুত মুখব্যাদান করে বলল, ”মারুতি, টাটা এইসব কোম্পানিকে ছেড়ে তোমার এই বাঙালী আমীশদের এত ছেঁদো দিকে নজর কেন সেটাই বুঝতে পারছিনা। যাইহোক, বাকি দুজন?”
রুদ্র অপ্রতিভ মুখে বলল, ”ব্রিজেশ তেওয়ারি তো খোদ তর্কপঞ্চাননের বাড়িতেই ইনভার্টারের দোকান করেছিল। ওকে মারবে না? আর সুবল ভট্টাচার্য ডাক্তার, মানে রুগিকে বাঁচিয়ে …।”
”বুঝেছি বুঝেছি।” প্রিয়ম হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিল। জোর গলায় বলল, ”ভাবো ভাবো। এগুলো একটাও আমার ঠিকঠাক লাগছে না। হয়তো তুমি ঠিক দিকেই এগোচ্ছ, নাহলে এতগুলো ঘটনা সেইম ডিরেকশনে ওভারল্যাপ করত না। কিন্তু আরও জোরালো মোটিভ আছে পেছনে। আগে বুঝতে হবে আমীশ সমাজের উদ্দেশ্যটা কী। কীভাবেই বা তুমি ধরে নিচ্ছ, বাগডাঙার ওই আশ্রম দিয়ে ওরা কানেকশন রাখে এদিকের সঙ্গে?”
রুদ্র বলল, ”সেটা বুঝলাম আশ্রমটার ভৌগোলিক অবস্থান দেখে। অফিস থেকে হুগলীর ডিটেইলড ম্যাপ চেয়ে আনলাম পাঁচুকে দিয়ে। আশ্রমের একেবারে সামনে দিয়ে যে সরু নদীটা বয়ে গিয়েছে, সেটা আসলে খাল। খালের অন্যদিকে কিছুদিন উজানে গেলেই বদনপুর। আর সেই খাল গিয়ে মিশেছে মৃতপ্রায় সরস্বতী নদীতে। আর সেই সরস্বতী নদী অনেকটা এঁকেবেঁকে গিয়ে পড়েছে গঙ্গায়, ত্রিবেণীর যাত্রাশুদি বলে একটা জায়গায়।”
”মানে?” প্রিয়মের ভ্রূ এবার কুঞ্চিত।
”মানেটা পরিষ্কার।” রুদ্র হাতে রোল করে পাকানো ম্যাপটা এবার বড় করে মেলে ধরল, ”আমরা ভেবে মরছিলাম, শিবনাথের দোকানে যাওয়ার রাস্তায় সিসিটিভি ফুটেজে কাউকে দেখা যায়নি কেন। কারণটা আর কিছুই নয়, আততায়ী এসেছিল গঙ্গা দিয়ে, নৌকো করে। শিবনাথের দোকান গঙ্গার ধারেই। শুধু শিবনাথ নয়, প্রতিটা খুনই এমনভাবে হয়েছে, যেখান থেকে নদীপথে পালানো খুব সহজ। হুগলীর এই পুরো অঞ্চলটার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গা। বা আরো নির্ভুল বলতে গেলে আমাদের হুগলী নদী। আমরা গঙ্গা বলি তাই, আসল নাম তো হুগলী।”
”তার মানে তুমি বলছ ওই বাংলা আমীশ সমাজ এই গঙ্গার ওপরেই কোথাও না কোথাও রয়েছে?” প্রিয়ম হুমড়ি খেয়ে পড়ে হুগলী জেলার ম্যাপটা দেখছিল।
”হতে পারে।” রুদ্র ম্যাপটার ওপর পেনসিল বোলাচ্ছিল, ”আবার লক্ষ্য করে দ্যাখো, গঙ্গা থেকে মাঝে মাঝেই অনেক সরু সরু খাল বেরিয়েছে, যেগুলো অনেকদূর প্রবাহিত হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়েছে। যেমন এই সরস্বতী নদীটা। কিংবা আরও একটু উত্তরে গেলে গঙ্গা নদীতে মুর্শিদাবাদ থেকে এসে মিশেছে জলঙ্গী নদী। কোথাও আবার গঙ্গা থেকে একটা সরু শাখা বেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার গঙ্গাতেই মিশে গেছে। আমীশ সমাজ যেখানেই বাস করুক, নদীপথেই তারা যাতায়াত করে বাগডাঙা আশ্রম বা অন্য জায়গাগুলোয়। আর বদনপুর গ্রামটায় তারেক বা নতুন ছেলেটি পালিয়ে এসেছে কারণ নিশ্চয়ই সেটা জলপথে আমীশ সমাজ থেকে কাছে।”
”হুম।” প্রিয়ম বলল, ”এইটা এতক্ষণে একটা সলিড পয়েন্ট বলেছ। এটা যদি হয়, তবে বেশ জটিল ব্যাপার। এবার কী করবে ভাবছ?”
রুদ্র বলল, ”আপাতত বদনপুর গ্রামে একজন ইনফর্মার লাগিয়েছি। যে কানু চক্রবর্তী আর নদীর দিকটাকে ভালো করে অবজার্ভ করবে। একই জিনিস করেছি বাগডাঙা সরলাশ্রমে। আমি যখন গিয়েছিলাম আশ্রম ছিল ফাঁকা। নিশ্চয়ই তারা আবার আসবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে খবর পাব।”
প্রিয়ম বলল, ”এত জটিলতার কী আছে? ওই কানু চক্রবর্তী আর ওই কী মহারাজ, তাদের থানায় তুলে এনে একটু কড়কালেই অনেক কিছু জানা যাবে।”
রুদ্র এবার জিভ দিয়ে আফশোসের আওয়াজ করে বলল, ”সেটা করতে পারলে তো হয়েই যেত। কিন্তু এস পি রাধানাথ স্যারের স্ট্রিক্ট অর্ডার, শিবনাথ বিশ্বাসের কেসে ওই রাজুকে থানায় বারবার ডাকার জন্য লোকাল পার্টি থেকে অনেক ঝামেলা হয়েছে। কোনো প্রমাণ ছাড়া কাউকে যেন না কড়কানো হয়। তাই আপাতত এভিডেন্স জোগাড় করার জন্য ইনফর্মার ছাড়া আমার গতি নেই।”
”কিন্তু এইসব গ্রামগুলোয় তো একেবারেই কম লোকজন থাকে। বাইরের লোক দেখে যদি অ্যালার্ট হয়ে যায়?”
রুদ্র বলল, ”প্রতিটা গ্রামেই পুলিশের কিছু নিজেদের লোক থাকে। আমরা তাদের বলি খোচর। এরা নিজেরা ছিঁচকে চুরি-টুরি করে। উপরি বকশিশের আশায় লোকাল থানায় ইনফর্মারের কাজও করে।”
”তাই বলো! সাধে কি লোকে বলে চোর আর পুলিশ একই গোত্রের?”
রুদ্র প্রিয়মের রসিকতায় অল্প হেসে বলল, ”কিন্তু যতক্ষণ না আমি আমীশ সমাজের লোকেশনটা ট্র্যাক করতে পারছি, কিছুতেই বুঝতে পারছি না, ওদের পরবর্তী টার্গেট কে। আর এর শেষ কোথায়!”
৩৪
উপবীতধারী অতিথি একটি ছাত্রের পিছু পিছু এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, ”আহ, আজ আমার চক্ষু সার্থক হল। দেশের জীবন্ত কিংবদন্তীকে নিজচোখে দেখার সৌভাগ্য হল। প্রণাম নেবেন, পণ্ডিতমশায়!”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন গড়গড়ায় তামাক সেবন করছিলেন। পাশে বসেছিলেন তাঁর বৈকালিক সঙ্গী বাসুদেব বাচস্পতি। অদূরেই তর্কপঞ্চাননের চতুষ্পাঠী সমাপনান্তে ছাত্ররা ফিরে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ছাত্রাবাসে। সম্প্রতি তাঁর চতুষ্পাঠীতে ছাত্রসংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করেছে। তাঁর উঁচুশ্রেণীর ছাত্ররাই মূলত শিক্ষাদান করেন। তর্কপঞ্চানন নিজে পড়ান একেবারে বয়োজ্যেষ্ঠ শ্রেণীকে। তবে চতুষ্পাঠীর ভাণ্ডারঘর থেকে রন্ধনশালা, ছাত্রাবাস থেকে অতিথিশালা, সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ থাকে তাঁর নখদর্পণে। বয়স হয়েছে অনেক, কিন্তু তাঁর শরীরে বা মনে কোথাওই বার্ধক্যের কোনো চিহ্ন এখনো নেই।
”শুভমস্তু। আসন গ্রহণ করতে আজ্ঞা হোক।” জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দক্ষিণ হস্ত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর পাশে দণ্ডায়মান ছাত্রটিকে কিছু মিষ্টান্ন নিয়ে আসার ইঙ্গিত করে বললেন, ”আপনার পরিচয়?”
ব্রাহ্মণ তর্কপঞ্চাননের বিপরীতের চাটাইয়ে বসে পড়ে বললেন, ”আমি এক সাধারণ ব্রাহ্মণ। আবাস বর্ধমানের কাটোয়া। শিক্ষা ও পেশা দুইয়েরই প্রয়োজনে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেছি। সঙ্গে আরবি, ফারসিও শিখেছি কর্মে অগ্রাধিকার পাওয়ার জন্য।”
”বাহ, অতি উত্তম।” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”তা আমার কাছে কী অভিপ্রায়ে আগমন?”
”আজ্ঞে আমি হিন্দু ধর্মে অতিশয় শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে একটি সংশয়ের ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছি। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের আশায় ছুটে গিয়েছি নবদ্বীপেও। কিন্তু খ্যাতনামা বা অখ্যাত কোনো পণ্ডিতই আমার কৌতূহল নিরসন করতে পারেননি। তাঁরা কেউ কেউ দুরূহ সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছেন। আজ তাই ছুটে এসেছি ত্রিবেণীতে, সাক্ষাৎ জগন্নাথের কাছে। যদি তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রাঞ্জলভাবে ব্যখ্যা করেন।” ব্রাহ্মণ করজোড়ে বলে চলেছিলেন।
বাসুদেব বাচস্পতি এবার তাঁর দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে বললেন, ”অ্যাদ্দিনে ঠিক লোকের কাছে এসেছেন।”
জগন্নাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ”কী প্রশ্ন?”
”ঈশ্বর কী? ব্রহ্ম কী? তিনি কি এক না অনেক?”
এমন আকস্মিক প্রশ্নে বাসুদেব বাচস্পতি বিব্রত চোখে তাকালেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের দিকে। এই প্রকার স্পর্শকাতর বিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর অধিকাংশ পণ্ডিতই এড়িয়ে যান।
কিন্তু তর্কপঞ্চানন একটুও না ইতস্তত করে বললেন, ”ঈশ্বর এক।”
ব্রাহ্মণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ”তবে শিব কে? বিষ্ণুকে? গণেশ কে? শক্তি কে?”
”এঁরা সকলেই ঈশ্বরের প্রকারভেদ। নামহীন কায়াহীন ঈশ্বরের উপাসনা সহজ নয়। তাই কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। বস্তুত শিব, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক সব একই।”
বাসুদেব বাচস্পতি অস্ফুটে বললেন, ”এসব কী বলছ ভায়া! প্রকাশ্যে এ’সব বোলো না, তীব্র নিন্দার শিকার হবে।”
তর্কপঞ্চাননের কর্ণকুহরে কথাটা প্রবেশ করল বলে মনে হল না। তিনি নির্বিকার চিত্তে গড়গড়া টানতে লাগলেন।
ব্রাহ্মণ জিজ্ঞেস করলেন, ”সকলে যদি অভিন্ন হন, তবে প্রত্যেকের পূজার ধরণ পৃথক কেন, পণ্ডিতমশাই? শিবঠাকুরকে পুজো করতে লাগে বেলপাতা, বিষ্ণুর জন্য তুলসীপাতা, আবার মা শক্তির জন্য রক্তজবা। কেন? যদি সকলেই এক হন, তবে এই ভিন্ন উপাচারের কারণ কী?”
তর্কপঞ্চানন এবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ”একনটী যাত্রাপালা দেখেছেন কখনো?”
”হ্যাঁ।” ব্রাহ্মণ উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, ”আমাদের গ্রামে গতবছরই এসেছিল। একটিই লোক প্রথমে মা যশোদা সেজে গান গাইল। তারপর কেষ্টঠাকুর সেজে দুটো পালা গাইল। সবশেষে সাজল নারদ। আহা! খাসা করেছিল।”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, ”সেই লোকটি আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য কখনো বাউটি, মল, চেলি পরে যশোদা সাজল, কখনো পাকা দাড়ি লাগিয়ে নারদ কিংবা বাঁশি হাতে কৃষ্ণ হল। ঈশ্বরও তাই। আমরা মানুষরা নিজেদের সন্তোষের জন্য ঈশ্বরকে নানা বেশ ধারণ করাই। কখনো জবা-মাংসে কালী আরাধনা করি, কখনো বেল ধুতরোয় ভোলানাথকে। আর কিছু নয়। সব আসলে একই জায়গায় যায়।”
ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বোধ হয় নিজের যুক্তির যন্ত্রে যাচাই করে নিতে চাইলেন পণ্ডিতশ্রেষ্ঠর মতবাদ। সংকোচের সঙ্গে বললেন, ”আর মোছলমানদের আল্লা বা ফিরিঙ্গিদের খ্রিস্টান?”
বাসুদেব বাচস্পতি শিহরিত চোখে তাকালেন, কিন্তু তর্কপঞ্চানন নির্বিকার। গড়গড়া টানতে টানতে সহাস্যে বললেন, ”বললাম তো, সব আসলে একই জায়গায় যায়। কেষ্ট আর খ্রিস্ট, আল্লা আর কমলা একই। সব আমাদের মনের সন্তুষ্টির জন্য। আমরাই গড়েছি এদের।”
”তবে এই পুজো আচ্চা, যজ্ঞ, উপাচার?”
তর্কপঞ্চানন বললেন, ”বেদে যেমন স্থূল দ্রব্যযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, আলোচিত হয়েছে প্রতীকী যজ্ঞও। যজ্ঞ না পুজো যেমন বাইরের উপাচার দিয়ে হয়, তেমনই হয় অন্তরের ভাব দিয়েও। কৌষিতকী আরণ্যক স্মরণ করুন।
”শ্রদ্ধা পয়ো বাক্ সমিৎ।
সত্যম্ আহুতিঃ প্রজ্ঞাত্মা স রসোঃ।
শ্রদ্ধাই দুগ্ধ, বাক্যই সমিৎ, সত্যই আহুতি, প্রজ্ঞাই আত্মা। এগুলো থাকলে আর কিচ্ছু লাগে না যে!”
ব্রাহ্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। বললেন, ”সাধু! সাধু! ধন্য জগন্নাথ পণ্ডিত! এইজন্যই বলে, ত্রিবেণীতে সাক্ষাৎ মা সরস্বতীর বাস! এমন সহজভাবে কেউ তো বুঝিয়ে দেয়নি!”
তর্কপঞ্চানন এবার অট্টহাস্য করে বললেন, ”তা ত্রিবেণীতে সরস্বতীর বাস তো বটেই, সরস্বতী নদী তো ত্রিবেণী দিয়েই বয়ে গিয়েছে!”
”সরস্বতী তো এখন মৃতপ্রায় পণ্ডিতমশাই।” ব্রাহ্মণ বললেন, ”সপ্তগ্রাম বন্দর তো ওইজন্যই বন্ধ হল। এখন আসল নদী হল গিয়ে আমাদের গঙ্গা। উত্তরে আপনাদের এই ত্রিবেণী, গুপ্তিপাড়া, অগ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, খাগড়াঘাট, মুর্শিদাবাদ হয়ে পাটনা, কাশী। আর দক্ষিণে তো ফিরিঙ্গিদের নতুন বন্দর কলকাতা। কত হাজার হাজার মণের বাণিজ্য চলে এই পথে! দিবারাত্রি মহাজনী নৌকোর সারি।”
তর্কপঞ্চানন বললেন, ”মৃতপ্রায় আপাতদৃষ্টিতে। সরস্বতী অনন্তসলিলা। ঋগ্বেদেও এই নদীর উল্লেখ রয়েছে। যদিও তা অন্য নদী। যাইহোক, পরিচয় হয়ে ভালো লাগল। আবার আসবেন।”
ইতিমধ্যেই এক ছাত্র কিছু মিষ্টান্ন এনে দিয়েছে। ব্রাহ্মণ সেগুলো সেবন করে আরও অনেক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রস্থান করলেন।
৩৫
বাসুদেব বাচস্পতি গম্ভীরমুখে বললেন, ”যাই বলো জগন্নাথ, তোমার এইসব আলটপকা মন্তব্য একেবারেই করা উচিত নয়। ওইজন্যই তোমার ওপর নবদ্বীপের পণ্ডিতরা খাপ্পা। এইজন্যেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র …।”
”তাতে আমার কিছু যায় আসেনা বাসুদেব।” জগন্নাথ হুঁকায় একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ”সনাতন ধর্মের মতো প্রগতিশীল উদার শাস্ত্র বিরল। বৈদিক সাহিত্য পড়লেই তার উদারমনস্কতা বা যুক্তিবোধ বোঝা যায়। কিন্তু তার পরবর্তী হাজার হাজার বছর ধরে পণ্ডিতরা নিজেদের মতো করে নিজেদের স্বার্থ কায়েম করতে ইচ্ছেমতো নিয়ম বসিয়েছেন কিংবা সরিয়েছেন। আসল হিন্দু ধর্ম চাপা পড়ে গিয়েছে সেই পূতিগন্ধময় পুরু আস্তরণের নীচে।”
”তাই তুমি সেই আস্তরণ সরানোর দায়িত্ব নিয়েছ?” বাসুদেব বাচস্পতি শ্লেষযুক্ত স্বরে বললেন।
”নাহ! আমি আর কতটুকু পারব বাসুদেব। বয়স হচ্ছে। নেহাত আমার ওপর কেউ কথা বলার স্পর্ধা দেখায় না তাই, কিন্তু আমার এই চিন্তাধারাগুলো তো সকলের হজম হবে না।” তর্কপঞ্চানন ভারী গলায় বললেন, ”তবে আমি স্বপ্ন দেখি।”
”কী স্বপ্ন দ্যাখো?”
”একদিন নিশ্চয়ই কেউ আমাদের এই বাংলায় আসবে। একদিন নিশ্চয়ই কেউ এইসব অর্ধশিক্ষিত স্মার্ত পণ্ডিতদের কবল থেকে টেনে বের করে আনবে সত্যিকারের সনাতন দর্শনকে। বন্ধ হবে সহমরণ। রাজবল্লভের কন্যার মতো মেয়েরা বিধবা হলেও আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারবে। বৈদিক যুগের লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী, গার্গীরা আবার বাংলার ঘরে ঘরে জন্মাবে। সেদিন আমি হয়ত এই ধরাধামে থাকব না। কিন্তু যেখানেই থাক, মনেপ্রাণে আশীর্বাদ করব সেই যুগপুরুষকে। যে টান মেরে সরিয়ে দেবে এই মিথ্যে পুরু আস্তরণ।”
বাসুদেব বাচস্পতি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন উইলিয়াম জোন্স।
তাঁর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ উত্তেজিত। বিস্ফারিত চোখে নিজের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসে বললেন, ”সংবাদ শ্রবণ করেছ, পণ্ডিত?”
তর্কপঞ্চানন শান্তস্বরে বললেন, ”কোন সংবাদের কথা বলছ? চারপাশে তো অনেক কিছুই ঘটে চলেছে। নবাবের মসনদ থেকে শুরু করে বাংলার রাজধানী, পট পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুত।”
জোন্স বললেন, ”রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে নবাব কারাগারে পুরেছেন। এই নবাব মিরকাশিম যে কী শুরু করলেন! কোম্পানির গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট নবাব মিরজাফরকে অকর্মণ্য অপদার্থ বলে সরিয়ে দিয়ে মিরকাশিমকে বসিয়ে খাল কেটে কুমীর আনলেন। মিরকাশিম তো দেখছি ইংরেজদের ওপর হাড়ে চটা। একদিকে রাজধানী বদলাল মুঙ্গেরে, অন্যদিকে পলাশির চক্রান্তের সবার ওপর একে একে প্রতিশোধ নিচ্ছেন। জগৎ শেঠ মহতাবচাঁদ, স্বরূপচন্দের পর এবার কৃষ্ণচন্দ্র! কারণ অতি বিচিত্র। কৃষ্ণচন্দ্র নাকি বহুদিনের রাজস্ব নবাবের তহবিলে বকেয়া রেখেছিলেন।”
”নবাবকে তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব না দিলে তো কয়েদ করবেই।” বাসুদেব বাচস্পতি মন্তব্য করলেন।
উইলিয়াম জোন্স একটু বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ”এ তো আর কোনো ছোটখাটো জমিদার নয়, যে তুলে নিয়ে যাবে সটান। গোটা নদীয়ার অধিপতি, তামাম নবদ্বীপের পণ্ডিতুলের পৃষ্ঠপোষক, ন্যূনতম সম্মান তো তাঁর প্রাপ্য! রাতারাতি রাজা আর যুবরাজ শিবচন্দ্রকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে মুঙ্গেরের কয়েদখানায় পোরা, এ তো চরম অন্যায়!”
”অন্যায়!” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”ন্যায় অন্যায় তুমি কাকে দেখাচ্ছ, সাহেব! আলিবর্দি খাঁ যখন নবাব ছিলেন, তখন এই কৃষ্ণচন্দ্রই এক অসহায় বিধবার সম্পত্তি গাপ করেছিলেন, তা কি জানো? ত্রিবেণীর পাশেই যে বংশবাটীর রাজা গোবিন্দদেবের মৃত্যুকালে তাঁর মহিষী গর্ভবতী ছিলেন, এত বড় সত্য জানা সত্ত্বেও তিনি নবাবের কাছে দরবার করেছিলেন বংশবাটির জমিদারি বাজেয়াপ্ত করতে। গোবিন্দদেবের বিধবা জানতেও পারেননি, কখন তাঁদের জমিদারি নবাব বাজেয়াপ্ত করে নয়া ব্যবস্থা করলেন কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে। যখন সংবাদ পেলেন, তড়িঘড়ি দূত পাঠালেন নবাব দরবারে। কিন্তু কৃষচন্দ্র লোক লাগিয়ে তাঁর সেই দূতের এত্তেলা হাজারদুয়ারির আমদরবার পেরোতে দিলেন না। আরও মোটা খাজনা ও নজরানা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নবাবের মুখবন্ধ করলেন। গোবিন্দদেবের সেই পুত্র এখন সদ্যযুবা। নাম নৃসিংহদেব। হন্যে হয়ে সে ঘুরছে জমিদারি পুনরুদ্ধারের আশায়। জানো তো, পাপ বাপকেও ছাড়ে না? যে রাজস্বের লোভে কৃষ্ণচন্দ্র এত জমিদারি বাড়িয়েছিলেন, সেই রাজস্ব অনাদায়েই তিনি কয়েদ হলেন।”
উইলিয়াম জোন্স কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এক ছাত্র এসে বলল, ”কাল প্রত্যুষে একেবারে প্রথম প্রহরে বজরা ছাড়বে, পণ্ডিতমশাই। খাজাঞ্চিমশাই আপনাকে জানাতে বললেন।”
”বেশ।” তর্কপঞ্চানন বললেন।
”আগামীকাল কি কোথাও যাচ্ছ নাকি, পণ্ডিত?”
তর্কপঞ্চানন কিছু বলার আগেই বাসুদেব বাচস্পতি বললেন, ”হ্যাঁ। কাল উনি মুর্শিদাবাদ যাবেন।”
”হঠাৎ?”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ”রায় রায়ান নন্দকুমারের সঙ্গে কিছু কথা আছে, তাই যেতে হচ্ছে। বিশেষ জরুরি প্রয়োজন।”
”কী প্রয়োজন?” উইলিয়াম জোন্স সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর ও তর্কপঞ্চাননের যতই মতবিরোধ হোক, তাঁরা পরম বন্ধু। এই বন্ধুত্ব এমন, যে দুজনেই দুজনকে নিঃসংকোচে সবকিছু বলতে পারেন।
জগন্নাথ পণ্ডিত সামান্য ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন, ”নন্দকুমারকে অনুরোধ করব, যাতে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেন।”
”অর্থাৎ?” উইলিয়াম জোন্সের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ”খুব যদি ভ্রম না করি, তুমিই তো কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি প্রতিশোধ নিতে তাঁকে কয়েদ করেছ। দেওয়ান নন্দকুমার যে তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমি জানি।”
তর্কপঞ্চানন বললেন, ”আমাদের শাস্ত্রে কী বলে জানো? অপরাধীকে তাঁর দোষের শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু তাঁকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাও কর্তব্য। তবেই তো ভ্রম সংশোধনের সুযোগ পাবে। কৃষ্ণচন্দ্র জগন্নাথ পণ্ডিতকে অপমান করেছিল, উপেক্ষা করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। তাই সে শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু এবার তাকে যে ক্ষমা করতেই হবে!”
উইলিয়াম জোন্স অভিভূত কণ্ঠে বললেন, ”সত্যি পণ্ডিত! তোমাকে এতবছর দেখছি, তবু যেন মাঝেমাঝে অচেনা লাগে। তুমি ধন্য!”
৩৬
ভবানীপুরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘চৌধুরীভিলা’ যেমন বিশাল, তেমনই সুন্দরভাবে সাজানো। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে কেয়ারি করা ফুলের বাগান, তার পাশ দিয়ে সবুজ লন ঢুকে গিয়েছে গাড়িবারান্দা পেরিয়ে।
রুদ্র আর প্রিয়াঙ্কা ইচ্ছে করেই পুলিশ উর্দি পরেনি। সাধারণ পোশাকে বাড়ির পরিচারকের পিছুপিছু গিয়ে ওরা প্রকাণ্ড ড্রয়িং রুমে বসে হাঁ হয়ে গেল।
প্রিয়াঙ্কা চাপাস্বরে বলল, ”এ’কোথায় এলাম ম্যাডাম! কোন মিউজিয়াম মনে হচ্ছে।”
রুদ্রও বেশ অবাক হয়ে দেখছিল। গোটা ড্রয়িং রুমটাই নানারকম বহুমূল্য আসবাবপত্র ও শৌখিন জিনিসপত্রে সুসজ্জিত। দুর্মূল্য ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে অ্যান্টিক ভাস্কর্য, কী নেই! দেওয়ালের একেবারে ওপরদিকে রয়েছে বেশ কিছু স্টাফ করা প্রাণীর মুখ। বোঝাই যাচ্ছে, এই পরিবার যেমন বনেদি, তেমনই বিত্তশালী।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। পরনে দামি পাজামা-পাঞ্জাবি। বয়স আন্দাজ পঁচাত্তর, পরিবারের ধারা মেনেই গৌরকান্তি ও অসম্ভব সুপুরুষ। রুদ্রর উলটোদিকে বসে নমস্কার করলেন, ”আমি শেখর চৌধুরী। আমিই আপনার ফোন ধরেছিলাম।”
”নমস্কার।” রুদ্র বলল, ”আমাদের হাতে সময় এতটাই কম যে আমি সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। আপনাদের আদি নিবাস তো হুগলীর বদনপুর গ্রামে ছিল?”
”হ্যাঁ।” শেখর চৌধুরী সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন, ”অনেক বছর আগে আমার বাবা ওখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। তখন আমি বাইশ বছরের যুবক, লন্ডনে পড়াশুনো করছি। আমাদের অন্যান্য শরিকেরা তারও আগে গ্রাম ছেড়েছিল। আমরাই অতদিন ছিলাম। তবে ওই গ্রামে আমাদের নাটমন্দির, জমিদারবাড়ি, সেসব এখনো আছে। মানে থাকার কথা।”
”আর আপনাদের মন্দির?” রুদ্র জিজ্ঞাসা করল।
শেখর চৌধুরী মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ”ও হ্যাঁ। নদীর ধারে আমাদের পারিবারিক চণ্ডীমন্দির ছিল। পারিবারিক হলেও গোটা গ্রামই তার প্রসাদ পেত। পাশের দুর্গাদালানে দুর্গাপুজোও হত। আমাদের বংশ ঘোরতরভাবে শক্তির উপাসক।”
”সেই মন্দিরের পুরোহিত কে ছিলেন, মনে আছে?”
শেখর চৌধুরী মনে করার চেষ্টা করে বললেন, ”না, মানে আমি তো স্কুলের পাট শেষ করেই বিলেতে পড়তে চলে যাই। আমার ঠিক মনে নেই।”
রুদ্র বলল, ”আপনার কানু চক্রবর্তী বলে কাউকে মনে আছে? আপনাদের ওই চণ্ডীমন্দিরের পুরোহিতের ছেলে। আপনাদেরই বাড়ির এক ছেলের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালায়?”
”আমাদের বাড়ির ছেলে?” শেখর চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন, ”আমি তো আমার বাবার একমাত্র পুত্র। আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সেইসময় তো এরকম কিছু ঘটেনি! আর কোনো শরিকও সেইসময় গ্রামে থাকত না।”
রুদ্রর মুখটা কালো হয়ে গেল। অনেক আশা করে ও এসেছিল আজ। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে পালানো ওই ছেলেটির সঙ্গে এই ঘটনার কিছু যোগাযোগ আছে।
কিন্তু ইনি বলছেন, তেমন কিছু ঘটেইনি। তবে কি লোকেশবাবুকে কেউ ভুল তথ্য দিয়েছে?
ভদ্রলোক তখন তাকিয়ে আছেন দেখে ও জিজ্ঞেস করল, ”আপনি কী করেন?”
শেখর চৌধুরী বললেন, ”আমার বাবা গ্রামে থাকার সময়েই কলকাতায় গার্মেন্টের ব্যবসায় লগ্নি শুরু করেছিলেন। আমি বিলেত থেকে ফিরে সেটাকেই বাড়িয়েছি। এখন হাওড়া, কলকাতা মিলিয়ে মোট তিনটে ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি আমাদের। আমার ছেলেই সবকিছুর দেখাশোনা করে। স্ত্রী গত হয়েছেন।”
”আপনার ছেলেও এখানেই থাকে?”
শেখর চৌধুরী বললেন, ”না। ও বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট কিনেছে। সেখানেই স্ত্রীকন্যা নিয়ে থাকে। আমিই বলেছিলাম বিয়ের পর আলাদা থাকতে। দূরে থাকলে সম্পর্ক ভালো থাকে। ভালোই আছি। আর সে তো খুব ব্যস্ত, ব্যবসার নানা ডিলের জন্য দেশবিদেশ ট্যুর করতে হয়। তবে যতই ব্যস্ত হোক, এক দেড়মাস অন্তর বউ-মেয়েকে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।”
”কী নাম আপনাদের কোম্পানির?”
”মৃন্ময়ী টেক্সটাইলস।”
রুদ্রর চোখ চলে গেল অদূরে রাখা একটা বিশাল শো-পিসের দিকে। কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলনে বানানো একটি আবক্ষ দুর্গামূর্তি। নিপুণ হাতের কাজ। মূর্তির নীচে লেখা ‘গোল্ডেন জুবিলি সেলিব্রেশন— মৃন্ময়ী টেক্সটাইলস পরিবার।’ কোম্পানির লোগোটিও দুর্গার ধাঁচের।
রুদ্রর মনে পড়ে গেল, চৌধুরীরা বংশানুক্রমে মা চণ্ডীর সেবাইত। মৃন্ময়ী মানেও তো দুর্গা।
ও আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে শেখর চৌধুরী বললেন, ”আমাদের কারখানা একটা আস্ত পরিবার। আমাদের কর্মচারীরা একেবারে নিজেদের মতো।”
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”আপনি এত বড় বাড়িতে একাই থাকেন?”
শেখর চৌধুরী হাসলেন। বললেন, ”হ্যাঁ। একাকীত্ব আমি বেশ পছন্দ করি। ঠিকে কাজের লোক আছে কয়েকজন, তবে তারা আসে চলে যায়।”
রুদ্র নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়ল। এখানে আর সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে প্রিয়াঙ্কা বলল, ”কী হবে বলুন তো, ম্যাডাম! এদিকে একটা একটা করে দিন কমছে।”
”কীসের দিন?”
প্রিয়াঙ্কা বলল, ”আপনার ওই কৃষ্ণপক্ষ থিওরিটা ঠিক হলে এই মাসের কৃষ্ণপক্ষ তো শুরু হয়ে গিয়েছে। এই আগস্ট মাসের ৪ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ, যে কোনোদিন আবার খুন হবে।”
মাথায় যখন দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ একসঙ্গে কাজ করা শুরু করে, তখন একটা অসম্ভব বিরক্তি এসে জাপটে ধরে। রুদ্ররও সেটাই হচ্ছিল। প্রিয়াঙ্কার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ও একটা নম্বরে ফোন করল।
নম্বরটা মিন্টু বলে একটা ছেলের। সে বদনপুর গ্রামে থাকে। পুলিশের ইনফর্মারের কাজ করে। লোকাল থানার ওসি আশুতোষ তরফদার, তিনিই খোঁজ দিয়েছেন। আজ সকালে কলকাতা আসার আগেও মিন্টুর সঙ্গে রুদ্রর কথা হয়েছে। রুদ্র তাকে যতটা সম্ভব খুলে বলেছে, যাতে ছেলেটার কাজ করতে সুবিধা হয়।
মিন্টু ফোন রিসিভ করে বলল, ”আরে ম্যাডাম, আমি আপনাকেই কল করতে যাচ্ছিলাম। হেব্বি খবর আছে।”
”কী খবর?”
”কানু চক্রবর্তী যতই মুখ বুজে থাকুক, লোকটা অনেক কিছু জানে। রাতবিরেতে কার সঙ্গে ফোনে তর্কাতর্কি করে। হাউহাউ করে কাঁদে। আবার চিৎকারও করে।”
”কানু চক্রবর্তীর নম্বরটা আশুতোষবাবুকে দিয়েছ?”
”হ্যাঁ ম্যাডাম। দিয়েছি। উনি খোঁজ নিচ্ছেন। আপনি কী জানতে পারলেন?”
”বিশেষ কিছুই নয়। শেখর চৌধুরী বললেন, ওরকম কোনো ঘটনাই নাকি ঘটেনি। কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে চৌধুরীবাড়ির কেউ পালায়নি।”
”সে আবার কি!” গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেরিয়ে মিন্টুর গলা শোনা গেল, ”বললেই হল? মামদোবাজি নাকি! আমাদের এই গ্রামে তিনপুরুষের বাস। আমার ঠাকুমা এখনো বেঁচে, তিনি সব জানেন। ওই শেখর চৌধুরীর ভাইয়ের নাম ছিল শঙ্কর চৌধুরী। দুই ভাইয়ের বয়সের পনেরো ষোলো বছরের তফাত। শঙ্করের সঙ্গে ছোট থেকে বাড়ির লোকদের লাফড়া। কানু আর শঙ্কর ছিল গলায় গলায় বন্ধু, ওরা যখন পালায়, তখন বয়স তেরো কি চোদ্দো। কানু চক্রবর্তী গ্রামে ফিরে আসে প্রায় দশবছর পর। কিন্তু শঙ্কর হাওয়া হয়ে যায়।”
”শেখর চৌধুরী তাহলে জেনেশুনে মিথ্যা বললেন?” নিজের মনে ফিসফিস করল রুদ্র, ”কিন্তু কেন?”
”আরও শুনুন। শেখর আর শঙ্করের মা ছিলেন আপনাদের সেই ত্রিবেণীর ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে।”
”অ্যাঁ?” রুদ্র অবাক।
”ইয়েস ম্যাডাম। মৃন্ময়ী চৌধুরী। লেট নীলকণ্ঠ চৌধুরীর স্ত্রী। তাঁদের বিয়ের সময় হেব্বি ঝামেলা হয়েছিল।”
”কেন? ঝামেলা হয়েছিল কেন?”
”বাহ, চৌধুরীরা তো চণ্ডীর উপাসক। আর ওই ত্রিবেণীর ভটচায বাড়ি যে ঘোর বৈষ্ণব! ক্যাচাল হবে না? তবে নীলকণ্ঠ চৌধুরী ঠিক করেছিলেন, বিয়ে করলে তিনি ওই মৃন্ময়ীকেই করবেন।”
”ঠিক আছে আমি রাখছি। আর কিছু জানতে পারলে জানিও।”
রুদ্র বিহ্বল হয়ে ফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বাজল।
”হ্যাঁ স্যার বলুন।”
ওপাশ থেকে রাধানাথ রায়ের রাগত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ”তুমি কোথায় রয়েছ, রুদ্রাণী?”
রুদ্র বলল, ”ভবানীপুরে। ওই বদনপুর গ্রাম থেকে একটা ক্ল্যু পেয়েছিলাম, সেইজন্য ইন্টারো …।”
রাধানাথ রায় এবার প্রায় চিৎকার করে বললেন, ”তুমি নিজেকে কী মনে করছ? একটা ইনভেস্টিগেশন টিমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তুমি কোনো প্রোটোকল মানবে না? যাকে যখন ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা জেরা করতে চলে যাবে? লিসন রুদ্রাণী, তোমাকে আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। তোমার এইসব কাজের জন্য আমাকে অ্যাকাউন্টেবল হতে হয়। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট?”
”কী হয়েছে স্যার?” রুদ্র থতমত খেয়ে গেল। বলল, ”আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
”তুমি একটু আগে যাকে তোমার তদন্তের জন্য জেরা করতে গিয়েছিলে, সেই ভদ্রলোকের অনেক উঁচুমহলে রেফারেন্স রয়েছে। উনি ফোন করে হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ জানিয়েছেন। তোমার জন্য কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে আমাকে কথা শুনতে হচ্ছে। তুমি জানো না, যে অন্য জুরিসডিকশনে ইনভেস্টিগেট করতে গেলে সেখানকার পুলিশের সঙ্গে আগে কথা বলতে হয়? যতই ক্ষমতা থাকুক রুদ্রাণী, আসলে আমাদের হাতপাগুলো বাঁধা। তুমি কি নিজেকে একজন গোয়েন্দা ভাবছ? তুমি জানো আমি ছুটিতে রয়েছি, এই সময়েও তোমার জন্য আমাকে এইসব পরিস্থিতি ফেস করতে হচ্ছে। বারবার তুমি আমাকে ইনসিস্ট করছ তোমার বিরুদ্ধে কোনো পিউনিটিভ অ্যাকশন নেওয়ার জন্য।”
রুদ্রর মেজাজটা তেতো হয়ে আসছিল। একটু আগে মিন্টুর মুখে শোনা চৌধুরীবাড়ি আর তর্কপঞ্চাননের বাড়ির যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে যতটা উত্তেজনা হচ্ছিল, তা এখন প্রায় পুরোটাই স্তিমিত হয়ে আসছে।
মনে হচ্ছে, কাজটা যেন এখানে গৌণ, অফিসিয়াল নিয়মকানুনগুলোই মুখ্য। শেখর চৌধুরী যত ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোকই হোন, তাঁর যত ওপরমহলেই চেনাজানা থাকুক, রুদ্র তো তাঁকে কোনরকম অসম্মান করেনি। শুধু কয়েকটা তথ্য জানতে গিয়েছিল মাত্র!
হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ ওঠে কি করে! এত দ্রুত ওর যাওয়ার কথাটা স্যারের কাছে পৌঁছলই বা কী করে!
কিন্তু এত কথা ওর এই মুহূর্তে এস পি স্যারকে বলতে ইচ্ছে হল না। স্যার আরও কী সব বলে যাচ্ছিলেন, আওয়াজে ও ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছিল না। ও ম্লানগলায় বলল, ”স্যরি স্যার। এরকম আর হবে না।”
এস পি স্যার বললেন, ”তোমাকে যতটুকু কাজ দেওয়া হয়েছে, ততটুকুই করবে। আপাতত তোমার কাজ হল ডেইলি বেসিসে প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাঠানো। আমি জয়েন করলে নেক্সট স্টেপ ভাবা যাবে। রিমেম্বার, দিজ ইজ মাই ফাইনাল ওয়ার্নিং।”
”ওকে স্যার!” রুদ্র অন্ধকার মুখে ফোন রেখে দিল। স্যার খুব রেগে গিয়েছেন।
প্রিয়াঙ্কা বলল, ”এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি, ম্যাডাম?”
”পার্কস্ট্রিট। এশিয়াটিক সোসাইটি।” রুদ্র খুব আস্তে করে উত্তর দিল। ওর মনের মধ্যে কী যেন একটা খচখচ করছে। কিন্তু সেটা কি, তা ও কিছুতেই বুঝতে পারছেনা।
শেখর চৌধুরী নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে এত বড় মিথ্যা বললেন কেন?
৩৭
দ্বারিকা মনে মনে হিসাব করছিল। ওদের বৈদিক সমাজের ব্রাহ্মণপল্লির মোট জনসংখ্যা হাজার দেড়েক হবে। তার মধ্যে পুরুষ আট-ন’শো। তার মধ্যে জনা আড়াইশো লোক কিছুদিন ধরেই ধাপে ধাপে উধাও হয়েছে সমাজ থেকে। তারা কোথায় গিয়েছে দ্বারিকা জানে না।
যত মানুষকে ও এখন দেখতে পাচ্ছে, তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ওর মনে প্রশ্ন জাগছে, বৈদিক সমাজের সমস্ত পুরুষই কি আজ বাইরে বেরিয়ে এসেছে?
ওর প্রশ্নটা অমূলক নয়। গোলাপদীঘির পার্শ্ববর্তী বিস্তৃত শস্যখেত, খেলাধুলার জন্য যে সবুজ মাঠ, প্রধান পুষ্করিণীর ওপারের আরেকটি শস্যখেত, সমস্ত স্থানেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাতাতে কাতারে মানুষ। কোনো সারি ব্রাহ্মণের, কোনো সারি তাঁতিদের, কোনো সারি আবার তিলি বা কামারদের।
একেবারে দক্ষিণের সারিগুলোতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কৈবর্ত ও বাগদিরা।
এখানে দ্বারিকার নিজের বাবা, দাদারাও কি রয়েছে? নিশ্চয়ই রয়েছে। বৈদিক সমাজের কঠোর নিয়ম, দশবছর বয়সে নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে শিক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মানসিকভাবে দূরত্ব বৃদ্ধি করতে হবে পরিবারের সঙ্গে। তাতে নাকি কিশোর বয়সে মনঃসংযোগের অভাব হয়। তাই এখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয়না কোনরকম ঘনিষ্ঠতা। বাবা পৃথক সংসার পাতলেও দাদা আর সে তো এক ছাদের তলাতেই থাকে। কিন্তু তবু তেমন কথাবার্তা হয় না।
এতদিন ও যেন চোখ থাকতেও ছিল অন্ধ, সবকিছুকেই শাস্ত্রের অনুশাসন বলে মেনে নিত। সেই মেনে নেওয়ার অনেকটা স্থান জুড়ে থাকত ভয়। ওর সেই ভয় নিয়ে অচ্যুত মজা করত, হাসত।
অচ্যুত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি দ্বারিকার ভেতর বছরের পর বছর ধরে জাঁকিয়ে বসা ভয়টাকেও টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে?
নাহলে এত খোলামনে ভাবতে কবে থেকে শুরু করল ও?
হঠাৎ এক প্রচণ্ড শঙ্খধ্বনিতে দ্বারিকার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। দেখল, দূরে বিষ্ণু মন্দির আর কীর্তন মঞ্চের দালান থেকে শাখে ফুঁ দিচ্ছে সমাজের মহিলারা। যেমন তেমন করে নয়, প্রত্যেকে যেন একই তরঙ্গে বাজিয়ে চলেছে শঙ্খ। অনেকক্ষণ ধরে একটানা, তারপর সামান্য থেমে দু’বার ছাড়া ছাড়া। তারপর আবার একটানা। এভাবেই চক্রাকারে গোটা বৈদিক সমাজে আবর্তিত হতে শুরু করল শঙ্খধ্বনি।
নিরবচ্ছিন্ন সেই ধ্বনি শুনতে শুনতে যেন ঘোর লেগে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন দেবলোকে পৌঁছে গিয়েছে।
প্রায় এক দণ্ড এইভাবে চলল। তারপর হঠাৎ একসময় থেমে গেল শঙ্খ। সকলেই যেন উঁকিঝুঁকি মেরে প্রণাম জানাতে লাগল একেবারে সামনে এসে দাঁড়ানো কাউকে উদ্দেশ্য করে।
গুরুদেব। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য স্নান করে উঠে এসেছেন প্রধান পুষ্করিণী থেকে। পরনে শ্বেতশুভ্র ধুতি। নিরাবরণ ঊর্ধাঙ্গে শোভা পাচ্ছে সামবেদী উপবীত। গুরুদেবের দুই পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ী, গোপাল ব্যানার্জি এবং তরুণ শিক্ষক বংশীধর।
দ্বারিকা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়েও ওদের শ্রেণীশিক্ষক মধুসূদনকে দেখতে পেল না।
ও মনে করতে চেষ্টা করল। আজ কী বার? গুরুদেব তো প্রতি বুধবার উপস্থিত থাকেন এখানে। আজ কি বুধবার?
হঠাৎ সমস্ত নৈঃশব্দকে খান খান করে দিয়ে গুরুদেবের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
”শুভমস্তু। আজ পবিত্র বৈদিক সমাজের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। আগামীকাল মাহেন্দ্র মহোৎসব। মহোৎসব অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুণ্যজন্মতিথি। আর মাহেন্দ্রযোগ শুধু এইবছরেই রয়েছে। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণ পক্ষের এই অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্র তার প্রাধান্য বিস্তার করছিল, তখনই দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ। দ্বাপর যুগে কুরুক্ষেত্রের যুগে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। যিনি আদতে সমগ্র মহাভারতের মহানায়ক ও প্রাণপুরুষ। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, দুর্বাসার আতিথ্য থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্রে বারবার অর্জুনকে প্রতিটি মুহূর্তে কূটনৈতিক পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন কৃষ্ণ। বলেছেন,
”যদা যদা হি ধর্মস্য
গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য
তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং
বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।।
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।।”
গুরুদেব কিছুক্ষণ থামলেন। একঝলক চোখ বুলিয়ে নিলেন সকলের ওপর। তারপর ইঙ্গিত করলেন গোপাল ব্যানার্জিকে।
গোপাল ব্যানার্জি সামান্য গলা পরিষ্কার করে এগিয়ে এলেন। বললেন, ”বাবাসকল! আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশবছর আগের এক পুণ্যলগ্নে পাপে নিমজ্জিত আধুনিক সমাজ ত্যাগ করে এসে আমাদের বৈদিক সমাজ শুরু হয়েছিল। তখন আমরা যে কয়েকজন মিলে আমাদের প্রথম গুরু ও বর্তমান গুরুদেবের সঙ্গলাভের সুযোগ পেয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই। থাকলে তাঁরা হয়তো সাক্ষী হতেন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। যে মুহূর্তে শুরু হবে যুগাবসানের মহৎ প্রক্রিয়া। শুভসূচনা হবে মাহেন্দ্রমহোৎসবের।”
দ্বারিকা যত শুনছিল, ওর মনের ভেতর রাগ উত্তরোত্তর বাড়ছিল। পুতুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই গোপাল ব্যানার্জিকে দেখলেই ওর অসম্ভব রাগ হয়। পুতুর মতো একটা শিশুকে যে প্রৌঢ় বিবাহ করতে পারেন, সে বিকৃতকাম ছাড়া আর কি? দ্বারিকার মনে পড়ে যায় অচ্যুতের কথাগুলো।
”শোন দ্বারিকা, আমাদের এই সমাজের নাম বৈদিক সমাজ বটে, কিন্তু আসলে বৈদিক কোনো রীতিনীতিই এখানে অনুসরণ করা হয় না। বৈদিক যুগে মেয়েরা অনেকেই বিবাহ করতেন না। তাঁরা বেদ পড়তেন, পড়াতেন এবং জ্ঞানার্জনের জন্য নানা দেশে যেতেন। নিয়মিত দর্শন ও ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনায় অংশ নিতেন। তাঁদের বলা হত ব্রহ্মবাদিনী। এমনকি তাঁদের উপনয়নও হত। গরুড়পুরাণ পড়ার সময় মিনা ও বৈতরণী নামে দুজন ব্রহ্মবাদিনীর কথা পেয়েছিলি, মনে করে দ্যাখ। এছাড়াও গার্গী, অপালাদের নাম তো শুনেইছিস।”
”কোনো মেয়েই বিবাহ করত না? তা কী করে হয়?” দ্বারিকা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল।
অচ্যুত বলেছিল, ”যারা বিবাহ করতেন, তাঁরা উত্তমরূপে শিক্ষিত হয়ে যুবতীদশায় বিবাহ করতেন। তাঁদের বলা হত সদ্যোদ্বাহা। বৈদিকযুগে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাও নিষেধ ছিল না, এইসব বাচ্চাবয়সে তাঁদের বিবাহ দেওয়াও হত না। পরের কয়েকশো বছরে নানা অপভ্রংশে এইসব কুসংস্কার জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের সমাজে।”
”সে কিরে!” দ্বারিকা অবাক হয়ে বলেছিল, ”তবে ক্ষমাকে জোর করে ওর বরের সাথে সহমরণে পাঠানো হচ্ছিল কেন? ব্রজেন্দ্রদাদা তো তবে কোনো অন্যায় করেনি ক্ষমাকে বাঁচাতে চেয়ে?”
অচ্যুত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দাঁতে দাঁত চিপেছিল, ”আমাদের এই সমাজ অনেকগুলো মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, দ্বারিকা! এখানে সবাই অন্ধ। কেউ জেনে অন্ধ। কেউ না জেনে।”
৩৮
তরুণ শিক্ষক বংশীধরের উদাত্ত কণ্ঠে দ্বারিকা আবার বাস্তবের মাটিতে ফিরে এল।
”কলিযুগের শেষ ঘনিয়ে এসেছে দুশো বছর পূর্বেই। পরম গুরুর জন্ম হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যেই। পিতার প্রায় বার্ধক্যে দৈব নির্দেশেই ভগবান বিষ্ণু ধরাধামে এসেছিলেন ‘জগন্নাথ’ নাম নিয়ে।
”কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, পরম গুরু তাঁর সেই কাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। সেই কাজকে সফল করতে পরবর্তীকালে আমাদের যুগপুরুষ প্রথম গুরু চেষ্টা করেছিলেন। সফল না হলেও আজকের এই পথ সুগম করে দিয়ে গিয়েছেন তিনিই।
”কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের বর্তমান গুরুদেবই কল্কি অবতার। যিনি তাঁর দেবদত্ত অশ্বে আরোহণ করে এসেছেন গোটা কলিযুগের অবসান ঘটাতে। যিনি ভগবান বিষ্ণুর অন্তিম অবতার। পৃথিবী এখন পাপের পাঁকে নিমজ্জিত। অপরাধ ও নির্মমতা মানুষের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে পড়েছে। আধুনিক সভ্যতার অভিশাপে মানুষ এখন যন্ত্র, তার মধ্যে নেই কোনো মনুষ্যত্ব, মমত্ব। শাসক এখন দুরাচারী, দুষ্কৃতিরা আজ সমাজপতি। কল্কি অবতার তাই অবসান ঘটাবেন এই কলঙ্কিত কলিযুগের। তাঁর হাত ধরে পুনরাগমন ঘটবে সত্য যুগের।
”এই কাজের শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। আমাদের নারায়ণী সেনারা সকলের অলক্ষ্যে ছড়িয়ে গিয়েছেন কলুষিত পৃথিবীর সেই ভরকেন্দ্রে, যেখানে পাপে নিমজ্জিত হয়ে আরাধনা করা হচ্ছে ভগবানের। এবং তা দ্বিগুণ অপরাধ।”
পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চাপা কন্ঠস্বরের কথোপকথনে দ্বারিকার শ্রবণে বারবার বাধা পড়ছিল।
”আজ রাতেই সারতে হবে।”
”আমরা কি তাহলে যাব না?”
”না। আমরা গেলে এই কাজটা করবে কে? গুরুদেব জানলে মত দেবেন না। হাজার হোক, স্বামীর চিতা ছাড়া সতীদাহ করা যায় না। পরে প্রজ্বলনের কোনো গুরুত্ব নেই। পুণ্যও নেই।”
”তাহলে পরে শুনলে তো রেগে যাবেন!”
”রাগলেও তা সাময়িক। গেরস্থবাড়িতে এত বড় পাপ রয়েছে, তাতে আমাদেরও তো পাপ হচ্ছে। পরজন্মে গিয়ে সেগুলোর হিসেব কে দেবে শুনি? ভয় পাস না। এখন তো আর ব্রজেন্দ্র নেই।”
দ্বারিকা আড়চোখে ঘাড় ঘোরাল। কেষ্টহরি ঘোষালের দুই ছেলে নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করছে।
পুরো বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করতে কয়েক মুহূর্ত লাগল দ্বারিকার। সতীদাহ, পাপ, ব্রজেন্দ্র, এইসব টুকরো টুকরো শব্দগুলো নিজের মতো করে জোড়া লাগানো মাত্র কেঁপে উঠল ও। আগে হলে হয়তো ভয়ে কাঁপত, কিন্তু অচ্যুত চলে গিয়ে ওকে সাহস জুগিয়ে দিয়ে গিয়েছে বলেই বোধ হয় ও রাগে কাঁপতে লাগল।
গ্রামে ফিরে আসা ক্ষমার সরল নিষ্পাপ মুখটা ওর আবার মনে পড়ে গেল। মা কথায় কথায় বলেছিলেন, মেয়েটাকে নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির সকলে কতটা অসন্তুষ্ট, বিরক্ত। এমনকি মেয়েটার নিজের বাবা থাকোগোপালও পাপের ভয়ে রুষ্ট।
আজ রাতে তার মানে ক্ষমাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে? ওকে মারার জন্যই ধরে নিয়ে এসেছে কেষ্টহরি ঘোষালের ছেলেরা?
বংশীধর বলে চলেছিলেন, ”এখানে যারা ব্রাহ্মণ, প্রত্যেকে কোনো না কোনো সময় শিক্ষালাভ করেছেন আমাদের নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে। তাই প্রবীণ থেকে নবীন, সকলেই আপনারা নারায়ণী সেনা। নিশ্চয়ই বিস্মৃত হননি, শ্রীকৃষ্ণের নিজস্ব একটি অসম শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল, যার নাম নারায়ণী সেনা। দুর্ধর্ষ সেই সংসপ্তক সেনাবাহিনী শ্রীকৃষ্ণ গড়ে তুলেছিলেন নিজরাজ্যকে প্রতিরক্ষায়। আমরাও কল্কি অবতারের, আমাদের গুরুদেবের নারায়ণী সেনা। তাই আমরা, এই বৈদিক সমাজের প্রতিটি ব্রাহ্মণ বহন করে চলেছি শ্রীকৃষ্ণের একেকটি নাম। নির্ভীকভাবে আমরা লড়াই করবো আমৃত্যু।
”কুরুক্ষেত্রের মতো এখানেও লড়তে লড়তে মৃত্যু হলে আমরা স্বর্গেই যাব। আমরা নেতৃত্ব দেব কায়স্থ, নবশায়ক ও তিলিকৈবর্তদের। শ্রদ্ধেয় প্রথম গুরুর জন্মশতবর্ষে এই অর্ঘ্যই দেব আমরা।”
ভগবান বিষ্ণু
পরম গুরু জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন
।
প্রথম গুরু গোপালকৃষ্ণ মহারাজ
।
বর্তমান গুরুদেব (কল্কি অবতার)
দ্বারিকা শুনছিল বংশীধরের কথা। ওরা সকলে নারায়ণী সেনা? সত্যিই গুরুদেব নিজে ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার?
নারায়ণী সেনারা কুরুক্ষেত্রে লড়েছিল, ওরা কোথায় লড়বে? আর কেনই বা লড়বে? এই পঙ্কিল সমাজের জন্য?
যেখানে প্রতি মুহূর্তে সংঘটিত হচ্ছে পাপ, অন্যায়, অবিচার?
৩৯
পার্কস্ট্রিটের একনম্বর বাড়িটাই হল এশিয়াটিক সোসাইটি। ব্যস্ত রাজপথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একভাবে। সকাল এগারোটা। সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অজস্র গাড়ি। অদূরেই পার্ক স্ট্রিটের নামীদামি সব রেস্তোরাঁ। তাদের দিন সবে শুরু হচ্ছে। ঝাঁপ খুলছে একে একে।
প্রিয়াঙ্কা রুদ্রর পিছন পিছন ঢুকছিল। সামনে লাগানো প্রস্তরফলকটা দেখে বলল, ”বাপরে! ১৭৮৪ সালে তৈরি হয়েছিল। এখানে কী থাকে, ম্যাডাম? বই?”
রুদ্র উত্তর দিল, ”বই ঠিক নয়। এখানে বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আছে। অধিকাংশই সংস্কৃত। তাছাড়াও বহু দুষ্প্রাপ্য বই, মানচিত্র …।”
রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসেছেন একজন কর্মচারী। বাইরে পুলিশের গাড়ি দেখে বোধ হয় দ্বাররক্ষক গিয়ে খবর দিয়েছে তাঁকে।
রুদ্রর কাঁধে দুটি তারা সহযোগে ‘আই পি এস’ এমব্লেম দেখে তিনি সসম্ভ্রমে বললেন, ”নমস্কার ম্যাডাম।”
”নমস্কার। চন্দননগর কমিশনারেট থেকে আসছি, আমি এ এস পি রুদ্রাণী সিংহরায়।” রুদ্র হাতজোড় করে নমস্কার করল, ”আপনাদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলা যাবে?”
”হ্যাঁ। নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু উনি তো একটু পরে আসেন। আমি চিফ লাইব্রেরিয়ান। আমার নাম সমর বসু। আপনারা আমার চেম্বারে এসে বসতে পারেন।” ভদ্রলোক বললেন।
”ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।” রুদ্র পা বাড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ”ততক্ষণ না হয় আপনার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলি। এইট্টিন্থ সেঞ্চুরির বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন? আইনের বই লিখেছিলেন। এখানে তাঁর কোনো ম্যানুস্ক্রিপ্ট আছে?”
সমর বসু খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললেন, ”অবশ্যই। আমাদের এই এশিয়াটিক সোসাইটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জানেন তো? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্স। তিনি ছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওই আইন জাতীয় বই লেখার সুবাদেই দুজনের হৃদ্যতা বাড়ে। আটানব্বই বছর বয়সে তর্কপঞ্চানন আটশো পৃষ্ঠার বিবাদভঙ্গার্ণব বইটি লেখা শেষ করেছিলেন।”
* * *
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বেরোতে বেরোতে বিকেল চারটে বেজে গেল। রুদ্র যতক্ষণ ম্যানুস্ক্রিপ্ট ডিভিশনে সমরবাবুর সঙ্গে এদিক ওদিক ঘাঁটছিল, প্রিয়াঙ্কা ততক্ষণ বাইরে বসেছিল।
সব কাজ শেষে রুদ্র বাইরে বেরোতে বেরোতে সমরবাবুর দিকে ফিরে বলল, ”হ্যাঁ, আপনি যা বলছিলেন। এইরকম মাইক্রোফিশ আপনাদের সংগ্রহে কত আছে, সমরবাবু?”
সমর বসু উত্তর দিলেন, ”প্রায় পঞ্চাশ হাজার।”
রুদ্র বলল, ”আপনি ওই ম্যাপটা আর ওই ক’টা মাইক্রোফিশ আমাকে তাহলে স্ক্যান করে …।”
”হ্যাঁ, সে বলতে হবেনা।” সমরবাবু বললেন, ”আমি আপনাকে ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই সব পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
”থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ!”
প্রিয়াঙ্কা রুদ্রকে দেখতে পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”ম্যাডাম, সুগন্ধা থানার ওসি আশুতোষ তরফদার ফোন করেছিলেন। আপনাকে না পেয়ে আমাকে। ওই কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা ছেলেটা আজ ভোরে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।”
”হোয়াট!” রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে গেল।
”ইয়েস ম্যাডাম।” প্রিয়াঙ্কা বলল, ”ভোরবেলা সে নাকি মন্দিরের পেছনের জঙ্গলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”
”ভোরবেলা সে জঙ্গলে গিয়েছিলই বা কেন?”
”বলতে পারব না ম্যাডাম। থানা থেকে আশপাশের সব জায়গা সার্চ করা হয়েছে। কানু চক্রবর্তীকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে গেছে। আপনি কি এখন একবার যাবেন?”
রুদ্র উত্তর না দিয়ে ফোন করল লোকেশবাবুকে। রাগে ওর কপালের রগদুটো দপদপ করছিল। লোকেশবাবু ‘হ্যালো’ বলামাত্র ও স্থান কাল ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ”আপনাকে বলেছিলাম, কানু চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা ছেলেটাকে টাইট সিকিউরিটি দিতে। প্রয়োজনে কোনো ক্লজ দেখিয়ে কয়েকদিনের জন্য থানায় নিয়ে গিয়ে লক আপে পুরে রাখতে। আপনি সেই ব্যবস্থা করেননি?”
যথারীতি সেই খোলকরতালের আওয়াজ। তার মধ্যেই লোকেশবাবুর অপরাধী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ”স্যরি ম্যাডাম, একদম ভুলে গিয়েছি। আসলে এখানে দিনরাত এত কাজে ব্যস্ত …!”
”রাবিশ!” রুদ্র দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ”ওখান থেকে ফিরে এসে আর ডিউটিতে জয়েন করবেন না। আমার অফিসে এসে সাসপেনশন অর্ডার নিয়ে যাবেন।”
”এত চেষ্টা করেও ছেলেটাকে আটকাতে পারলাম না। ঠিক ক্ষমার মতোই …!” ফোনটা রেখে ও আফসোসের ভঙ্গিতে কয়েক মুহূর্ত দীর্ঘশ্বাস নিল। তারপর নিজেকে কিছুটা সংযত করে গাড়িতে উঠে বসল।
”এখন কোথায় যাবেন ম্যাডাম।”
”সুগন্ধা।” রুদ্র ছোট্ট করে উত্তর দিল। নিজের মনে একের পর এক ঘটনাগুলো ও সাজাচ্ছিল।
১। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের এক দত্তক নেওয়া বংশধর গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আমেরিকার আমীশ সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে এসে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাতেও এমনই কোন আমীশ সমাজ গড়ে তোলার চিন্তা করেন।
২। দেশে ফিরে তিনি বাংলার কোথাও, সম্ভবত গঙ্গা নদীর তীরে সেই সমাজ গড়ে তোলেন। সেই সমাজ থেকে পালিয়ে আসা শিবনাথ বিশ্বাস বা মহম্মদ তারেককে একে একে খুন করা হয়েছে। প্রতিটি কৃষ্ণপক্ষে। যে সাতটি মানুষ খুন হয়েছে, প্রত্যেকেই এমন পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল, যেটা আমীশ সমাজের কাছে পাপ।
হত্যার কারণ কি শুধুই তাই?
কী চাইছে তারা?
৩। বাংলার সেই আমীশ সমাজের সঙ্গে কি বাগডাঙার ওই সরলাশ্রমের কোনো যোগ আছে? সরলাশ্রমের সেই বইয়ের আলমারিতে বিবাদভঙ্গার্ণব কেন? কেনই বা শেষ দিন আশ্রম সুনসান ছিল? স্বপন সরকার ওই আশ্রমে কেন যেতেন?
৪। কানাই, বলরাম, গোবিন্দ, শ্যামসুন্দর। এদেরকে কি আধুনিক জগতে পাঠানো হয়েছিল শুধুমাত্র ভিক্টিমের সঙ্গে সখ্যতা করে পৃথিবী থেকে সরানোর জন্য? তাই যদি হয়, তবে এই মাসের ৪ থেকে ১৯ কৃষ্ণপক্ষ, এইসময় কোথায় খুন হবে? কে খুন হবে?
৫। প্রতিটি খুন নদীর পাশের টাউনে হয়েছে। তারা যদি খুনের জন্য নদীপথ ব্যবহার করে থাকে, তবে তারা থাকে কোথায়? বদনপুরে একে একে পালিয়ে এসেছে মহম্মদ তারেক ও এখনকার কানু চক্রবর্তীর কাছে থাকা ছেলেটি। তবে কি বদনপুর গ্রামের কাছাকাছি কোথাও তাদের আস্তানা?
Leave a Reply