গ্লানির্ভবতি ভারত / রুদ্র-প্রিয়ম সিরিজ / দেবারতি মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০
.
অষ্টাদশ শতকের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ বাঙালি,
অসামান্য শ্রুতিধর ও আসমুদ্র হিমাচলখ্যাত
শতায়ু পণ্ডিত শ্রী জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন-এর
স্মৃতির উদ্দেশে।
না। একবিংশ শতকের বাঙালি আপনাকে ভোলেনি।
বিস্মৃত হয়নি আপনার অসাধারণ মেধা,
যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা যুক্তি ও মননকে।
‘গ্লানির্ভবতি ভারত’ আপনাকে ভুলতে দেবে না, এই আশা রাখি।
শতকোটি প্রণাম।।
১
১৫ই জানুয়ারি, ত্রিবেণী
ঘড়ির বড় কাঁটাটা সবেমাত্র নয়ের ঘর পেরিয়েছে। তবু এরই মধ্যে গঙ্গার ধার দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরু পাকা রাস্তাটা আজ শুনশান। শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে বলেই বোধ হয় বেশ কিছুক্ষণ অন্তর দু-একটা বাইক ছাড়া আর তেমন কারুর দেখা নেই।
গঙ্গার ধারে বেশ কিছু পানবিড়িসিগারেটের দোকান। সেগুলোরও ঝাঁপ বন্ধ। অন্যদিন ঘাটের সিঁড়িগুলোতে বসে গুলতানি করে কিছু ফচকে ছেলে। আজ কেন কে জানে, তারাও অনুপস্থিত।
খুব নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকলে নিজেরও শব্দ করে কিছু করার ইচ্ছেটা চলে যায়। শিবনাথ তাই বেশ সাবধানে বলতে গেলে একেবারে নিঃশব্দে কম্পিউটার সেটগুলোর ওপর তোয়ালে ঢাকা দিচ্ছিল। তারগুলো খুলে ভালভাবে মুছে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখে অফ করছিল সুইচ।
এই সবকিছু ওর তিলতিল কষ্ট দিয়ে গড়া, যত্ন তো থাকবেই।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মীবার বলে দোকান বন্ধ থাকবে। অন্যান্য বুধবার শিবনাথের মেজাজ বেশ প্রসন্ন থাকে। তার মেয়ের বয়স সবে সাড়ে চারমাস, সপ্তাহে এই একটা দিনই মেয়েকে সে সারাদিন ধরে দেখতে পায়। যখন হাসপাতাল থেকে ন্যাকড়া জড়িয়ে নিয়ে এসেছিল, তখন সে অ্যাত্তটুকুন, যেন চোখ বোজা একটা নরম বিড়ালছানা।
তাকে প্রথম দেখে শিবনাথ কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কাটছিল বারবার। পরখ করে নিতে চাইছিল, স্বপ্ন দেখছে কিনা। ওর বউ আরতি কাণ্ড দেখে যতই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসুক, শিবনাথের ঘোর কাটছিল না কিছুতেই।
ওর ভাগ্যে এত সুখও লেখা ছিল? যে প্রচণ্ড টালমাটালের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল ওর জীবনটা, যে ভীষণ প্রতিকূলতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুঝতে হয়েছে শৈশবে, সেইসব দিনগুলোর পর যে এমন সোনালি মুহূর্ত অপেক্ষা করছে, তা কি ও কখনো ভাবতে পেরেছিল? তখন তো প্রতি মুহূর্ত কাটত ভয়ে, অস্থির আশঙ্কায়। এই বুঝি কেউ চিনে ফেলল ওকে। এই বুঝি কেউ আবার টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে যেতে লাগল সেই নরক কুণ্ডে।
শিবনাথের নরম বিড়ালছানার মতো সেই মেয়ে এখন দিব্যি এদিক ওদিক তাকায়, ফোকলা দাঁতে লাল টুকটুকে মাড়ি বের করে হেসে দেয়। আর সেই হাসি দেখে শিবনাথের মন খারাপ হয়ে যায়।
মনে হয়, মেয়ের একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠাটা ও দেখতেই পাচ্ছে না।
তাই বৃহস্পতিবারটা মেয়ের বিছানার সঙ্গে প্রায় লেপটে বসে থাকে ও। হিসি করে ভিজিয়ে দেওয়া কাঁথা পালটানো থেকে শুরু করে দুধ গুলে বোতলে করে খাওয়ানো, শীতের বেলায় সর্ষের তেল দলাইমলাই করে গায়ে মাখানো, কিচ্ছু বাদ দেয় না। কখনো কখনো আরতি বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু শিবনাথ পাত্তা দেয়না। ছয়দিনের না পাওয়াটাকে সে একদিনে উশুল করে নিতে চায়।
কিন্তু আজ বুধবার হওয়া সত্ত্বেও শিবনাথের মনটা খিঁচিয়ে রয়েছে। সারাদিন রোজগার প্রায় হয়নি বললেই চলে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা চলছে, যে গুটিকয় বাচ্চা আসত, তারাও গেম খেলতে আসছেনা। কিন্তু কলেজের যে দু-একটা ছেলেমেয়ে সন্ধের দিকে আসত, তারা তো আসতে পারত!
লাইট পাখা অফ করে দরজায় তালা মেরে শাটার নামাতে নামাতে নিজের মনেই শিবনাথ গজগজ করে। সব দোষ ওই ফোরজি প্ল্যানওয়ালাদের। যবে থেকে সস্তায় ইন্টারনেটের প্ল্যান বিক্রি শুরু হয়েছে, তবে থেকে তার সাইবার ক্যাফের ব্যবসায় ভাঁটা পড়েছে।
বারো বছর হতে চলল, ধারদেনা করে এই গঙ্গার ধারের রাস্তায় ও এই দোকানটা খুলেছিল। তখন সবাই বারণ করেছিল। বলেছিল, পয়সা যখন ঢালছেই, আরেকটু বেশি ইনভেস্ট করে বাজারের দিকে খুলতে। কম্পিউটারের দোকান, একটু জমজমাট এলাকায় না থাকলে হয়? এই দিকটায় কে আসবে?
শিবনাথের সেই যুক্তি মনে ধরলেও কিছু করার ছিল না। থাকার বলতে তখন ওর ছিল শুধুমাত্র একটা এস টি ডি বুথ। বাবা মারা যাওয়ার আগে খুলেছিলেন। বাবা ওর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এমন কিছু নেই যে করেননি। ট্রেনে হকারি থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি সাবান বিক্রি। বলতে গেলে মুখে রক্ত তুলে সংসার চালিয়েছেন। এক মুহূর্তের জন্য শিবনাথকে বুঝতে দেননি যে ও বাবা-মায়ের নিজের সন্তান নয়। নিঃসন্তান দম্পতির স্নেহবুভুক্ষ হৃদয় যেন শিবনাথকে ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছিল প্রতিটা দিন।
অনেক রকম ব্যবসা করে একেবারে শেষদিকে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাবা শুরু করেছিলেন ওই এস টি ডি বুথ। সেই বুথ বেশ ভালো চলত। তরুণ শিবনাথ বসত। কখনো কখনো বাবাও।
কিন্তু, কয়েকবছর পর মোবাইল ফোন আসার পর ব্যবসা ধুঁকতে শুরু করল। সারাদিনে একটা টাকাও রোজগার হয় না। পেটটা তো চালাতে হবে। ততদিনে বাবা চলে গিয়েছেন।
শিবনাথ তখন অনেক ভেবেচিন্তে সেই বুথ বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই টাকাটুকুই তখন ওর পুঁজি।
ত্রিবেণী স্টেশন রোড বা বাজার এলাকায় আগুন দাম, ওখানে দোকানঘর ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা ওর ছিল না। শুধু যে দোকানঘর ভাড়ার মোটা সেলামি, তা তো নয়, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল সবই কিনতে হয়েছিল।
তা হরির কৃপায় ওর সেই পরিশ্রম তখন বিফলে যায়নি। মাসছয়েকের মধ্যেই ওর এই ‘শ্রীহরি সাইবার ক্যাফে’ রমরমিয়ে চলতে শুরু করেছিল। গঙ্গার ধারেই ত্রিবেণীর তিনটে সরকারি স্কুল, এছাড়া অনেকগুলো ছোটবড় কোচিং ক্লাস। সেখানকার ছেলেপুলে হুড়মুড়িয়ে ভিড় জমাতে আরম্ভ করেছিল। বাজারের দিকে তখন দুটো সাইবার ক্যাফে ছিল, শিবনাথ ইচ্ছে করেই সেই দুটোর থেকে ঘণ্টাপিছু গেম বা ইন্টারনেট সার্ফিং এর খরচ কিছুটা কম রেখেছিল। আর তাতেই বাজিমাত। বছরদুয়েকের মধ্যেই শিবনাথের ক্যাফেতে তিনটে থেকে বেড়ে হয়েছিল দশটা কম্পিউটার। রাখতে হয়েছিল একটা পাড়ার ছেলেকেও। শিবনাথ তখন শুধু ক্যাশে বসে থাকত। কম্পিউটার খুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সময় পেরিয়ে গেলেই জোর করে খেলায় তন্ময় হয়ে দেওয়া ছেলেটাকে উঠিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো ওই ছেলেটাই করত। এই দোকান থেকেই বাড়ি মেরামত, বিয়ে সব ধীরে ধীরে সেরে ফেলেছিল শিবনাথ।
কিন্তু ব্যবসায় মন্দা এসেছে বছরদুই হল। চারদিকে ফোরজি প্ল্যানের বাড়বাড়ন্তে এখন আর ছেলেমেয়েদের ক্যাফেতে গেম খেলতে আসার বিশেষ দরকার হয়না। নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে ফোনেই তা দিব্যি খেলা যায়। ইন্টারনেট সার্ফিং থেকে শুরু করে বইপত্র, সোশ্যাল মিডিয়া সব চাহিদাই মেটায় ফোন। দৈবাৎ চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ করা কোনো ছাত্র বা ছাত্রী শিবনাথের সাইবার ক্যাফেতে আসে প্রিন্ট আউট নেওয়ার জন্য। কিংবা এখনকার প্রযুক্তিতে একেবারেই অস্বচ্ছন্দ কোনো বয়স্ক ব্যক্তি ট্রেন বা প্লেনের টিকিট কাটতে আসেন।
বাজারের সাইবার ক্যাফেদুটো উঠে সেখানে এখন গেম পার্লার হয়েছে। কিন্তু ভারী ভারী গেম খেলার জন্য শিবনাথকে নিজের কম্পিউটারের অনেক কিছু পালটাতে হবে। কিনতে হবে প্লে-স্টেশন। এখন অত পয়সা তার নেই।
শিবনাথ ছেলেটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেই এখন পুরো ক্যাফেটা দেখে।
আজকের দিনটা একেবারেই মড়া। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ন’টা। একটা খদ্দেরও আসেনি শিবনাথের সাইবার ক্যাফেতে। গোমড়া মুখে দোকানের একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিতে চাবি ঘোরায় শিবনাথ।
শালা একটার পর একটা ব্যবসা কষ্ট করে দাঁড় করাচ্ছে, কয়েকবছর পরই সেগুলোয় লাল বাতি জ্বলে যাচ্ছে। এইভাবে কাঁহাতক চলা যায়?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দোকানের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে স্কুটিতে চেপে বসল শিবনাথ। দোকানের গায়েই গঙ্গার এক পুরোনো ঘাট। সেখান থেকে হু হু করে হাওয়া আসছে।
ত্রিবেণী বহু প্রাচীন জনপদ। এক কালে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী, এই তিন নদী এখানে চুলের বেণীর মতো মিলেমিশে গিয়েছিল। তাই ত্রিবেণী। এখন অবশ্য সেই যমুনাও নেই, সরস্বতী শুকিয়ে খালের চেয়েও সরু। শুধু মা গঙ্গাই নিরবচ্ছিন্ন গতিতে বয়ে চলেছেন।
স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে বেরোতে যাবে, হঠাৎ পাশে যেন ভূতের মতোই উদয় হল একটা মানুষ। পরনে কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। মাথা থেকে পেট অবধি চাদর জড়ানো।
কাছেপিঠে আর কোনো দোকান নেই। শিবনাথ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। লোকটা কি ক্যাফেতে কোনো প্রিন্ট আউট নিতে এসেছে? দেরি হলেও তাহলে ও আবার দোকানের ঝাঁপ খুলবে। অন্তত বউনিটা তো হবে।
কাছাকাছি আসতে শিবনাথ বলল, ”তুমি! এত রাতে? কী ব্যাপার?”
শিবনাথ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। কারণ সে বিস্ফারিত চোখে দেখল, লোকটার চাদরের তলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা ধাতব লম্বা কিছু।
শিবনাথ আত্মরক্ষার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ‘আঁক’ করে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে।
তার স্কুটিটার ইঞ্জিন তখনো চালু। স্কুটির পেছনের চাকার ঠিক পাশে পড়ে থাকা তার পা দুটো কাটামাছের মতো লটপট করতে লাগল।
লোকটা কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা বুঝতে। নিঃসন্দেহ হয়ে চারপাশ দেখল। মিনিটদুয়েক পর নীচে পড়ে থাকা শিবনাথের পকেট থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করল একটা চাবি। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ‘শ্রীহরি সাইবার ক্যাফে’-র দিকে।
লোকটা বেরিয়ে এল প্রায় দশমিনিট পরে। ধীরেসুস্থে শাটার নামাল। তারপর মার্জারপদে চলে গেল গঙ্গার জনহীন ঘাটের দিকে।
ঘাটে একখানা ছোট নৌকো নোঙর করা ছিল। বাতাসে সেটা কাঁপছিল তিরতির করে। লোকটা সন্তর্পণে নৌকোটায় উঠে বসে দাঁড় বইতে শুরু করল।
কালো জলে শব্দ হতে লাগল, ছপছপ।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নৌকোটাকে আর দেখা গেল না। শুধু ঘাট লাগোয়া নদীর জলের মৃদু কম্পন বোঝা যেতে লাগল।
২
সারা রাতের ঘুম যতই গভীর হোক, ভোরবেলা ঘণ্টাখানেকের যে ঘুমটা হয়, তার কোনো তুলনা হয় না। পাশেই নদী। ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসে। সেই আমেজে এই গরমেও একটা আলগা চাদর আলতো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে হয়।
ও বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমের মধ্যে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখছিল। দেখছিল, ও আর ক্ষমা বেড়াতে গিয়েছে দূরের এক পাহাড়ে।
পাহাড়টা কোথাকার, তা ঠিক বুঝতে পারছে না, তবে উঁচু নিচু টিলা দেখে মনে হচ্ছে ছোটনাগপুর মালভূমির দিকে কোথাও। লাল রঙের পথ, এদিক ওদিক কিছু গাছ ছড়ানো ছিটানো।
ক্ষমা আর চলতে পারছে না। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে, ”আর পারব না গো মাসি, খুব কষ্ট হচ্ছে! ওই দ্যাখো, আমার মা বসে পড়েছে।”
ও তাড়া দিচ্ছে, ”এইটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? তোদের বয়সে আমরা কত ছোটাছুটি করতাম! আরেকটু চল। ওই যে, ওই দূরের লম্বা গাছটা …!”
ক্ষমা চোখ বড়ো বড়ো করে বলছে, ‘এখনো অতদূর?’
ও বলছে, ”কোথায় অতদূর? আয় না, গল্প করতে করতে হাঁটি। আচ্ছা, তোর ওই কবিতাটা মনে আছে? আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা?’
‘হ্যাঁ’ ক্ষমা হাঁটতে হাঁটতে বলতে আরম্ভ করল।
‘আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা,
দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা।
কোথা হতে চৈত্রমাসে হাঁসের শ্রেণি উড়ে আসে,
অঘ্রাণেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা
আমরা কিছুই জানিনে কো সেই সুদুরের কথা।’
‘বাহ!’ ও বলল, ‘দেখলি, কবিতা বলতে বলতে কেমন গাছটার কাছে চলে এলাম।’
ক্ষমা দাঁত বের করে বলল, ‘তাই তো!’
একটানা একটা কর্কশ শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল।
স্বপ্নটা বুদ্বুদের মত মিলিয়ে গেল কোথায়। ঘুমের ঘোরটা কাটতেই ও ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর খাটের লাগোয়া টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করল।
—হ্যালো?
—হ্যালো, আপনি কি শ্রীরামপুরের অ্যাডিশনাল এস পি রুদ্রাণী সিংহরায় বলছেন?
রুদ্র একটা হাই তুলল। জড়ানো কণ্ঠে বলল, ”বলছি।”
—গুড মর্নিং ম্যাডাম। আমি চন্দন বলছি। চন্দন শাসমল। হুগলী ডি এম অফিসের এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট।
—বলুন।
—ডি এম আপনার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাইছেন। একটু কনফিডেনসিয়াল। আপনি কি আজ একবার ডি এম অফিসে আসতে পারবেন? আপনার বাংলোয় অফিসরুমে ফোন করছি, বেজে বেজে কেটে গেল। তাই এখানেই করলাম।”
রুদ্রর ঘুমের রেশটা কেটে গেল। জেলাশাসক ওর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, গোটা জেলার প্রশাসনিক প্রধান। ডেকে পাঠাতেই পারেন। কিন্তু এইভাবে টেলিফোনে কেন? অফিশিয়াল চিঠি কই?
চন্দন শাসমল বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝে ফেলল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ”আপনার স্যার মানে শ্রীরামপুরের এস পি সাহেবও থাকবেন মিটিং এ। চাইলে আপনি একবার কথা বলে নিতে পারেন।”
রুদ্র বলল, ”না ঠিক আছে। কখন যাব?”
”ঠিক দশটা।”
চন্দন শাসমল ফোন কেটে দেওয়ার পর রুদ্র ঘড়ি দেখল। সবে পৌনে সাতটা। আরও আধঘণ্টা ঘুমিয়ে নেওয়াই যায়।
ও আবার শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছিল, কিন্তু মোবাইলটা আবার বেজে উঠল।
ফোন অন করতেই প্রিয়মের গলা শুনতে পেল।
”বেরিয়ে পড়েছি।”
”ওমা!” রুদ্র অবাক, ”এত তাড়াতাড়ি?”
প্রিয়ম বলল, ”মা তোমার জন্য অনেক মিষ্টি ভরে দিয়েছে। যা গরম পড়েছে, যদি নষ্ট হয়ে যায়? সকাল সকাল চলে যাওয়াই ভালো।”
”সে ভালোই করেছ। রাস্তাও ফাঁকা থাকবে।”
প্রিয়ম বলল, ”না আজ আর গাড়ি নিয়ে বেরোইনি। ভাবলাম একটু অন্যভাবে ফিরি। বাড়ি থেকে পেরিয়ে জেটিতে চলে এলাম। কল্যাণী থেকে গঙ্গার ওপারে বাঁশবেড়িয়া যাওয়ার স্টিমার ছাড়ছে। উঠে পড়লাম। আহ! নদীতে কি সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে!”
”তারপর? ওখান থেকে কী করবে?”
”কেন, বাঁশবেড়িয়া থেকে একটা অটো করে ব্যান্ডেল স্টেশন। আর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে আমার বউয়ের কাছে। যাওয়ার সময় মাটন নিয়ে যাব। মল্লিকাদি’কে জমিয়ে পাঁঠার ঝোল করতে বলব।” প্রিয়ম হাসল।
রুদ্র আবার একটা হাইতুলে বলল, ”বাবা! লোকে ঘুরিয়ে নাক দেখায় শুনেছিলাম, এই প্রথম সেটা কাউকে করতে দেখলাম। যাইহোক, মাটন আনবে আনো, কিন্তু আমাকে বেরোতে হবে।”
”কেন? আজ তো ছুটি।”
”কিসের ছুটি?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকল।
”আজ তো শনিবার।”
রুদ্র হাসল, ”এসেনশিয়াল সার্ভিসে আবার শনিবার! এ কি তোমাদের মতো ডেস্কজব নাকি? ডি এম ডেকেছেন, যেতে হবে।”
”ধুর!” প্রিয়মের বিরক্তি ফোনের তার বেয়ে এদিকে এসে উপচে পড়ল, ”কী করতে যে তুমি ব্যাঙ্কের চাকরিটা দুম করে ছাড়লে! যত যাইহোক, ঠিকঠাক ছুটিছাটা ছিল। একটা ভদ্র সময়ে আসা যাওয়া ছিল। আর ছাড়লে তো ছাড়লে, রাতদিন পড়ে পরীক্ষা দিয়ে ঢুকলে পুলিশ সার্ভিসে। কেন, আর কোনো ক্যাডার ছিল না?”
রুদ্র হাসল, ”এই প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে এই তিনবছরে অন্তত একশোবার দিয়েছি প্রিয়ম। ব্যাঙ্কের চাকরিতে আমার সম্মান একটু হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। আমার কাছে আত্মসম্মান সবার ওপরে। আর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাডার পেলে কি নিতাম না? জানোই তো, অপশনাল পেপারটা ঝুলে গেল বলে র্যাঙ্কটা পিছিয়ে গেল। বারবার মনে করাও কেন?”
”মনে করাই কারণ আমার ভালো লাগেনা তুমি বাইরে বাইরে থাকো।” প্রিয়ম উষ্মাভরা কণ্ঠে বলল।
”ওমা!” রুদ্র অবাক স্বরে বলল, ”বাইরে বাইরে কোথায়? শ্রীরামপুরের মতো জায়গায় পোস্টিং আমাদের ব্যাচের ক’জন পেয়েছে বলো তো? দিব্যি একসঙ্গে রয়েছি দুজন, তুমি এখান থেকে অফিসও করতে পারছ। এটাকে প্রাইজ পোস্টিং বলে, তা জানো?”
”আরে সে তো মেরেকেটে তিনবছর। একবছর তো হায়দ্রাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে কাটিয়ে এলে, কিছুদিন পরেই আবার কোন বনবাদাড়ে পাঠিয়ে দেবে।” প্রিয়ম বিরক্ত স্বরে বলল, ”যাকগে। আমি ঘাটে নামছি। এখন রাখছি।”
ফোনটা রেখে দিয়ে রুদ্র বাথরুম থেকে ঘুরে এসে বাইরে এল। সকাল সাড়ে সাতটা, রোদ এখনো নরম রয়েছে।
ওর বাংলোর সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে এখন মল্লিকাদি’র নয় বছরের মেয়ে ক্ষমা খেলে বেড়াচ্ছে।
একটা প্রজাপতি উড়ছে, ক্ষমা ছুটে ছুটে সেটাকে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাছাকাছি গেলেই প্রজাপতিটা আবার উড়ে যাচ্ছে।
”কীরে, তোর মা কোথায়?” রুদ্র অলসভাবে এসে বসল লম্বা বারান্দায়।
ওর এই সরকারি বাংলোটা ব্রিটিশ আমলের, ভিক্টোরিয়া ধাঁচের স্থাপত্যে তৈরি। দোতলা হলেও এখনকার আধুনিক বাড়ির উচ্চতায় চারতলারও বেশি। বিশাল বিশাল ঘর, ভারী ভারী মেহগনি কাঠের আসবাবপত্র। বাংলোর চারপাশে বাগান। সেই বাগানের পরিচর্যায় রয়েছে মালি সনাতন। সে অবশ্য এই ক্যাম্পাসে থাকে না। একটু দূরে তার নিজের বাড়ি। সেখান থেকে আসা যাওয়া করে।
বাংলোয় থাকে রাঁধুনি জ্যোৎস্নাদি আর আর্দালি কাম ড্রাইভার পাঁচু। পাঁচু বউকে নিয়ে থাকলেও জ্যোৎস্নাদি বিধবা। সে একাই থাকে। ক্যাম্পাসের মধ্যেই বাংলোর আউটহাউজে ওদের থাকার ব্যবস্থা।
গঙ্গার পাশ দিয়ে সরু পিচের রাস্তা, তার ওপরেই এই বাংলো। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালে নদী দেখা যায় স্পষ্ট। ওপারে ব্যারাকপুর, কখনো কখনো ক্যান্টনমেন্টের গুলির মহড়ার শব্দও কানে আসে।
গত তিনবছরে রুদ্রর জীবনটা অদ্ভুতভাবে বদলে গিয়েছে। প্রথম জীবনে বাবার মতো ইতিহাসের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকলেও স্বপ্ন ছিল আই এ এস অফিসার হওয়ার। প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকলে সমাজের নীচুস্তরের মানুষদের জন্য অনেক কিছু করা যায়। মূলত এই তাগিদেই চেয়েছিল আই এ এস হতে।
কিন্তু প্রথম জীবনের সেই স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিল চটজলদি কেরিয়ার গড়ার জাঁতাকলে। তাই আগ্রায় তাজমহলের সেই ভয়ংকর ঘটনায় ব্যাঙ্ক থেকে শো-কজের পর* যখন দুম করে রিজাইন করেছিল, তখন মনের মধ্যে প্রথম ভাবনা এসেছিল, এখনো তো বয়স রয়েছে। আরেকবার চেষ্টা করতে দোষ কী? না হলে না হবে।
ফলস্বরূপ দেড়বছরের মধ্যে এসেছিল সাফল্য।
না। ওর স্বপ্নের আই এ এস হয়নি। র্যাঙ্ক একটু পিছনে থাকায় আই পি এস ক্যাডার পেয়েছিল ও। তাতে কী? আবার পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ওর আর হয়নি। ততদিনে প্রিয়ম ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। কিন্তু রুদ্র কলকাতায় যেতে পারেনি। পরবর্তী একবছর কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে ওর ট্রেনিং চলেছে হায়দ্রাবাদের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে, তারপর কিছুক্ষণ মুসৌরিতে।
সব মেটার পর প্রথম পোস্টিং হয়েছে হুগলীর শ্রীরামপুরে। অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ। প্রিয়ম তখন ঠিকই বলছিল। এটা প্রোবেশন পিরিয়ডের পোস্টিং। তিনবছরের মধ্যেই ওকে আবার অন্য কোথাও চলে যেতে হবে এস পি হয়ে।
তা হোক। পরিযায়ী জীবনে এই সময়টুকু তো দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারছে। পারছে ছুটিছাটায় কলকাতায় বাবা-মা’র কাছে বা কল্যাণীতে শ্বশুরবাড়িতে যেতেও। এই বা মন্দ কি!
”এই নাও গো।” ক্ষমার কথায় ওর চিন্তার জাল হঠাৎ ছিঁড়ে গেল।
ক্ষমার হাতে একটা খবরের কাগজের ছেঁড়া পাতার ওপর রাখা অনেক ক’টা লাল রঙের তরতাজা ফুল।
রুদ্র কপট চোখ পাকাল, ”তুই আবার ফুল ছিঁড়েছিস? সনাতনকাকার চোখে পড়লে তোকে আর আস্ত রাখবে?”
ক্ষমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফ্রকের কোঁচড় থেকে বের করল আরও পনেরো-কুড়িটা ফুল, ”বকলে বকবে। আমার বুঝি কেষ্টঠাকুরের জন্য মালা গাঁথতে সাধ যায়না?”
রুদ্র বিস্মিত হল না। ন’বছরের একটা শিশু হয়েও ক্ষমার মুখে একটু বয়সছাড়া কথা। নামের মতোই তার কথাগুলোও একটু সেকেলে।
আর মা যেমন, মেয়েও তো তেমনই হবে।
ক্ষমার মা মল্লিকাদি অন্যদের মতো বাংলোর সরকারি কর্মচারী নয়। রুদ্র এখানে পোস্টেড হয়ে এসেছে সাড়ে তিন মাস হল। আসার ঠিক একমাসের মাথায় ভোরবেলা গঙ্গার ধারে মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছিল ও আর প্রিয়ম। তখনই বাংলোর বাইরে গুটিসুটি মেরে ঘুমতে দেখেছিল মল্লিকাদি আর কোলের কাছে শুয়ে থাকা ক্ষমাকে। ক্ষমার তখন গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। রুদ্রর নির্দেশে পাঁচু আর জ্যোৎস্নাদি ধরে ধরে ওদের নিয়ে গিয়েছিল ভেতরে।
দিনদুয়েকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিল ক্ষমা। মল্লিকাদির বাড়ি হুগলীরই কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে আর নিজের কেউ নেই। পেটের দায়ে শ্রীরামপুরে কাজ খুঁজতে এসেছিল। ক্ষমার ভাসা ভাসা আয়ত চোখদুটোর ওপর ভারী মায়া পড়ে গিয়েছিল রুদ্রর। অন্যদের সঙ্গে ওদেরও থাকতে বলে দিয়েছিল আউটহাউজের একটা ঘরে।
তারপর থেকে মা-মেয়ে ভালোই আছে। মল্লিকাদি’র হাতের রান্না খুব ভালো, সে এমনিতে টুকিটাকি কাজ করলেও প্রায়ই প্রিয়মের আবদারে এটা সেটা বানায়। এই নিয়ে স্থায়ী রাঁধুনি জ্যোৎস্নাদি’র সঙ্গে মাঝেমাঝেই তার খটাখটি লেগে যায়।
রুদ্র শুধু দেখে আর উপভোগ করে। মাঝেমাঝে ভাবে, মল্লিকাদি না এলে ও জানতেও পারত না, এখনো গ্রামের মানুষরা কত সেকেলে। কত ধরনের ব্রত, উপবাস, পুজো।
ও এখন গম্ভীরমুখে ক্ষমাকে বলল, ”যা সাধ মেটানোর মিটিয়ে নাও। আর মাসখানেকের মধ্যেই তোমায় স্কুল যেতে হবে। তখন আর দিনরাত খেলে বেড়ানো চলবে না। ছি ছি, এত বড় মেয়ে, পড়তে পারেনা। লোকে বলবে কী?”
ক্ষমা ফিক করে হেসে একছুটে চলে গেল বাগানের দিকে। রুদ্র ওকে আর ডাকল না। শিক্ষিতের হার যতই বাড়ুক দেশে, এমন কত শিশু যে নিরক্ষর রয়ে গিয়েছে এখনো, তার কোনো হিসেব নেই। সরকারের চেষ্টা, বিভিন্ন প্রকল্পই তো সব নয়, এর জন্য দায়ী পরিবারের মানসিকতাও। এই ক্ষমাই প্রথমদিকে বলতো, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে কী হবে? তাই শিখিনি।
এখন আর বলেনা।
ফুলসমেত খবরের কাগজটা পড়ে রইল টেবিলে। সেখানেই ফুল পেরিয়ে খবরের কাগজের একটা খুচরো খবরে চোখ আটকে গেল রুদ্রর। খবরটার শিরোনাম ‘কোন্নগরে ব্যবসায়ী খুন’।
কোন্নগর শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত একটা ছোট মফঃস্বল এলাকা। সেখানে কোন ব্যবসায়ী খুন হল?
রুদ্র ফুলগুলো সরিয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পড়তে শুরু করল:
নিজস্ব সংবাদদাতা, কোন্নগর : গতকাল গভীর রাতে নিজের বাড়িতেই নৃশংসভাবে খুন হলেন গাড়ি ব্যবসায়ী স্বপন সরকার (৪৫)। তিনি একটি গাড়ি প্রস্তুত সংস্থার ডিলার ছিলেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিল্লিরোডে নিজের শো-রুম থেকে ফিরে বুধবার তিনি তাঁর ক্রাইপার রোডের বাড়িতে একাই ছিলেন। আজ ভোর পাঁচটা নাগাদ এক প্রতিবেশী এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় পাড়ার লোকেরা দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে।
রুদ্র একটু অবাক হল। কোন্নগর বেশ শান্তিপূর্ণ এলাকা। সেখানে এইভাবে খুন? আর খুন হয়েছে লেখা রয়েছে, কিন্তু কীভাবে খুন করা হয়েছে, সেই ব্যাপারে কোনো বিশদ নেই। সংবাদপত্রের খবরের মান দিনদিন নেমে যাচ্ছে। কবেকার কাগজ এটা? বোঝার উপায় নেই। ক্ষমা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে এনেছে।
রুদ্র আর কিছু ভাবার অবকাশ পেল না। জ্যোৎস্নাদি এসে বলল, ”আজ অফিসে কী খেয়ে যাবেন দিদিমণি? রুটি?”
রুদ্র হাসল। এখানে আসার পর অনেক কষ্টে ‘ম্যাডাম’ ছাড়াতে পেরেছিল ও, বলেছিল ‘দিদি’ বলতে। দিনরাত যাদের সঙ্গে থাকতে হবে, তাদের মুখ থেকে ‘ম্যাডাম’ শুনলে যেন কেমন হোটেলে থাকার মতো মনে হয়।
কিন্তু এদের এতবছরের অভ্যেস! মাঝে মাঝেই তাই ম্যাডাম, দিদিমণি এইসব বেরিয়ে আসে।
ও বলল, ”নাহ। আজ বরং স্যান্ডউইচ করে দাও। সঙ্গে একটা ওমলেট। একটু তাড়াতাড়ি বেরবো আজ।” জ্যোৎস্নাদি চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই ও পিছু ডাকল, ”ও হ্যাঁ, তোমার দাদা বোধ হয় মাটন আনছে। মল্লিকাদি’কে করতে বোলো দুপুরের জন্য। আমি রাতে ফিরে খাব।”
জ্যোৎস্নাদি’র মুখটা নিভে গেল। স্বাভাবিক। বাড়ির রান্নার দায়িত্ব যার কাঁধে, মাটনের ভার যদি তাকে ছাড়িয়ে অন্য কাউকে দেওয়া হয়, তা তো অপমানই।
রুদ্র বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে হাসল, ”না মানে তুমি তো দারুণ করো। কিন্তু তোমার দিনরাত যা খাটনি যাচ্ছে। মল্লিকাদি তো বলে যে ও খুব ভালো রান্না জানে, তাই প্রিয়ম বলল …!”
”বলতে তো সবাই পারে। বলতে তো আর টাকা লাগেনা।” জ্যোৎস্নাদি মুখ বেঁকাল, ”রান্নার যা ছিরি। চোদ্দোবার খালি মশলা বাটে। গুঁড়ো মশলার প্যাকেট দেখলে যেন আঁতকে ওঠে। আলু দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, যেন জন্মে দেখেনি। আধমিনিট অন্তর ঘোমটা টানে। আর গ্যাস জ্বালাতে জানত নাকি? আমিই তো শেখালাম! কাজেকম্মে নেই, কথার ফুলঝুরি!”
”তা তিনি কোথায়? সকাল থেকে একবারও দেখতে পাইনি।” রুদ্র আলগা ছলে কথা বলতে বলতে প্রস্তুত হতে লাগল স্নানে যাওয়ার জন্য।
বলতে বলতেই এসে উপস্থিত হল মল্লিকাদি। পরনে ডুরে ছাপা শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। অনেক বলেও সেই ঘোমটা সরাতে পারেনি রুদ্র। ঘোমটা সরালে তার নাকি ভীষণ লজ্জা করে।
মল্লিকাদি প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না, ”মটর? মানে কড়াইশুঁটি?”
”আহা মটর নয়, মাটন। মানে পাঁঠার মাংস। রাঁধতে পারো?” রুদ্র নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার আগে বলল।
”মহাপ্রসাদ!” মল্লিকাদি বলল, ”হ্যাঁ মা, পারি।”
জ্যোৎস্নাদি অবাকচোখে তাকাল। বলল, ”আ মরণ! প্রসাদ রাঁধতে তোমায় কে বলেছে? পাঁঠার মাংস রাঁধতে বলছে। পারো কি? না পারলে বলো, আমি করে নেব।”
”পারব।”
রুদ্র বাথরুমে ঢুকল। ওর মনটা কেমন খচখচ করছে। ও হুগলী জেলায় এসেছে সবে কয়েকমাস হল। সেভাবে কাজ কিছু শুরু হয়নি। তাছাড়া জেলার আরও তিনটে মহকুমায় ওর মতো দু’জন করে অ্যাডিশনাল এস পি আছেন।
কী এমন হল যে ছুটির দিনে জেলাশাসক গোপনে ওকেই ডেকে পাঠালেন?
_____
* রুদ্রপ্রিয়ম সিরিজের ৩য় উপন্যাস ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’ দ্রষ্টব্য।
৩
হুগলীর ডি এম অফিসটা চুঁচুড়ায়। শ্রীরামপুরে আসা ইস্তক রুদ্রর কখনো এর আগে ডি এম অফিস আসার প্রয়োজন পড়েনি। ড্রাইভার পাঁচু দিল্লি রোড দিয়ে এসে ডানদিকে বেঁকে বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। রুদ্র বেশ আগ্রহের সঙ্গে দু’পাশ দেখছিল। সঙ্গে রয়েছে ওর দেহরক্ষী জয়ন্ত।
জয়ন্ত পদমর্যাদায় অনেক নীচে হলেও ওর বুদ্ধি এবং বিচক্ষণতা যে কোনো অফিসারকে টেক্কা দিতে পারে। সে ত্রিবেণীর ছেলে। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে, কোনোমতে গ্র্যাজুয়েশন করেই এই চাকরিতে ঢুকেছে। পড়াশুনোতেও ভালো ছিল। রোজকার ডিউটি সামলে সে এখনো বড় চাকরির প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। রুদ্রও ওকে পড়াশুনোয় সাধ্যমতো সাহায্য করে।
রুদ্র একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। কোন জায়গা, তা সে যতই কাছাকাছি বা অকিঞ্চিৎকর হোক, সেখানকার ইতিহাস জেনে নেওয়া ওর বহুদিনের অভ্যাস। জয়েন করার পর হুগলী জেলার সম্পর্কে একটা মোটা বই দেখতে পেয়েছিল অফিসের কেবিনে। বাড়িতে নিয়ে এসে সেখান থেকে কখনো শ্রীরামপুর, কখনো চন্দননগর সম্পর্কে পড়ত।
আজও গাড়িতে সেই বইটাই পড়তে পড়তে যাচ্ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে পাশাপাশি চন্দননগর আর চুঁচুড়া— এই দুটো জনপদ কখনোই ইংরেজ বশ্যতা স্বীকার করেনি। চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ আর চুঁচুড়া ওলন্দাজ। ওদিকে হুগলী আবার ছিল পর্তুগিজদের দখলে। চুঁচুড়াতে বসেই নাকি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন বন্দেমাতরম গান।
প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই চুঁচুড়া শহর। আগে এর নাম ছিল ওলন্দাজনগর।
ড্রাইভার পাঁচু নতুন এ এস পি’কে এই ক’দিনেই বেশ চিনে গিয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে সে বলেছিল, ”এদিকে অনেক কিছু দেখবার আছে ম্যাডাম। ফেরার পথে যাবেন?”
”কী কী দেখার আছে চুঁচুড়ায়?” জানতে চেয়েছিল রুদ্র।
”নদীর ধারে ষণ্ডেশ্বর শিবমন্দির আছে। বড়া ইমামবড়া আছে।” পাঁচু বলেছিল।
”হ্যাঁ, ইমামবড়ার কথা পড়েছিলাম। হাজি মহম্মদ মহসীন বানিয়েছিলেন। এইট্টিন্থ সেঞ্চুরির খুব বড় একজন সমাজসেবী। হুগলী মহসীন কলেজও ওঁরই তৈরি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ও অনেক দানধ্যান করেছিলেন। আর কী কী আছে?”
তখন জয়ন্ত মুখ খুলেছিল, ”বাঁশবেড়িয়ার দিকে এগোলে রয়েছে হংসেশ্বরী মন্দির। রাজা নৃসিংহ দেব রায় বানানো শুরু করেছিলেন, শেষ করেন তাঁর ছোটরানী শঙ্করী দেবী। দেখতে যাবেন ম্যাডাম? আমার বাড়ির কাছেই।”
রুদ্র তখন হাসি চেপে বলেছিল, ”নাহ, আপাতত ডি এম অফিসটাই দেখি চলো। সেটাও তো হেরিটেজ বিল্ডিং। পরে বাকিগুলো দেখা যাবে।”
হুগলীর জেলাশাসক এখন একজন তরুণী। বয়সে রুদ্রর চেয়ে বছরদশেকের বড় হবেন। পাঞ্জাবের মেয়ে। নাম গুরশরণ কৌর। কিন্তু প্রথম থেকেই বেঙ্গল ক্যাডার বলে বাংলাটা খারাপ বলেন না। প্রকাণ্ড ঘরের একেবারে মাঝখানে বিশাল টেবিলের ওই প্রান্তে বসে কথা বলছিলেন তিনি।
রুদ্রর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠছিল।
ইশ! কেন ও আর একটু ভালো করে পড়ল না? তাহলে আই এ এস টা পেয়ে যেত! এইভাবেই একটা গোটা জেলার দায় ভার থাকত ওর ওপরে।
পরক্ষণে নিজের মনেই ও নিজেকে সান্ত্বনা দিল। চাহিদার কোন শেষ নেই। যখন ব্যাঙ্কে চাকরি করতে, কখনো ভেবেছিলে যে আই পি এস হবে? হয়েছ তো? যা হয়েছ, তাতেই খুশি থাকো। দুটোই দেশের সেবা। জনগণের সেবা। সেই কাজে মনোযোগ দাও।
ডি এম ম্যাডাম ভাঙা বাংলায় বললেন, ”মিসেস সিংহরায়, আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি? এটা ভীষণ ডেলিকেট একটা সিচুয়েশন।”
মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এল রুদ্র, ”ইয়েস ম্যাডাম।”
রুদ্রর বস শ্রীরামপুরের এস পি রাধানাথ রায় এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার বললেন, ”রুদ্রাণী, তুমি যদি ভালো করে অ্যানালাইজ করো, দেখবে, এই পাঁচটা খুনই কিন্তু হয়েছে হুগলীতে।”
রুদ্র আবার ঝুঁকে পড়ল সামনে রাখা কাগজটার ওপর।
রুদ্রর আজ সকালেই সেই পুরোনো খবরের কাগজে পড়া খবরটা মনে পড়ে গেল। তার মানে সেই কাগজটা ছিল ১৩ই মে’র দু’দিন পরের। ও মুখ তুলল, ”কিন্তু এই পাঁচটা মার্ডার যে একই সুতোয় বাঁধা, তা আপনি ধরে নিচ্ছেন কী করে?”
”মিঃ রায়, রুদ্রাণীকে প্লিজ এক্সপ্লেইন করুন।” জেলাশাসক ম্যাডাম এস পি রাধানাথ রায়ের দিকে তাকালেন।
রাধানাথ রায় বললেন, ”দ্যাখো রুদ্রাণী। এমন কোনো ক্লিয়ার এভিডেন্স আমরা এখনো পাইনি যা থেকে বলা যেতে পারে যে এই সবকটা খুনের মধ্যে কোনো যোগসূত্র রয়েছে। খুনের ধরনও একরকম নয়। কাউকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করা হয়েছে তো কাউকে ছুরি মেরে। কিন্তু ডি এম ম্যাডামের মতে, লিঙ্ক এটাই, যে প্রত্যেকে ব্যবসায়ী। আর এই পাঁচটা খুনের ক্ষেত্রেই লোকাল পুলিশ সেভাবে কোনো প্রোগ্রেস করে উঠতে পারছেনা। তাই আমরা খুব চিন্তিত। চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট থেকেও চাপ আসছে। আমরা তাই চাইছি লোকাল থানা যেমন তদন্ত করছে করুক, কিন্তু একটা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশান টিম তৈরি করা হোক যেটা বিশেষভাবে এই খুনগুলোর তদন্ত করবে। তুমি নতুন এসেছ, সেভাবে কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার এখনো অ্যালোকেটেড নেই। তাই আমরা চাই, তুমিই এই টিমটা লিড করো। হুগলী জেলার সবকটা থানা তোমায় সহযোগিতা করবে।”
জেলাশাসক শুনছিলেন। এস পি থামতেই বললেন, ”মিসেস সিংহ রায়, এমনিতেও আপনার পুলিশ সার্ভিস জয়েনের আগের কিছু অ্যাচিভমেন্টের রিপোর্ট আছে আমাদের কাছে। ভেরি কমেন্ডেবল। আমার মনে হয়, এই কেসের জন্য আপনি আইডিয়াল হবেন।”
রুদ্র বলল, ”অ্যাজ ইউ অর্ডার ম্যাডাম। আমার টিমে কে কে থাকবেন?”
এস পি রাধানাথ রায় বললেন, ”আমরা তিনজনকে নমিনেট করেছি। প্রত্যেকেই ইয়ং এবং এফিশিয়েন্ট। তবে তুমি চাইলে নিজের মতো কাউকে বেছে নিতে পারো।”
”আমি আর ক’জনকে চিনি?” রুদ্র কাঁধ নাচাল, ”এই ক’মাস তো শুধু অফিসেই বসে রয়েছি। আপনারা যাদের সিলেক্ট করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই স্যুটেবল হবেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
”ভেরি গুড।” রাধানাথ রায় বললেন, ”উত্তরপাড়া থানার এস আই বীরেন শিকদার, শেওড়াফুলি থানার ওসি লোকেশ ব্যানার্জি আর শ্রীরামপুর সাব ডিভিশনের সেকেন্ড অফিসার প্রিয়াঙ্কা চন্দ। এঁরাই তোমার টিম মেম্বার।”
রুদ্র মাথা নাড়ল। এদের মধ্যে ও শুধু প্রিয়াঙ্কাকেই চেনে। বেশ করিৎকর্মা মেয়ে। ও বলল, ”অল রাইট স্যার। শুধু সঙ্গে আমার গার্ড জয়ন্তকেও ইনক্ল্যুড করলে ভালো হয়। হোমগার্ড হলেও ও খুব কমপিটেন্ট।”
”বেশ। কোনো অসুবিধা নেই। বীরেন শিকদার বাইরে অপেক্ষা করছেন।” এস পি বললেন, ”ওঁর কাছে সব ক’টা মার্ডারের ফাইল রয়েছে। তুমি দেখে নিয়ে কাজ শুরু করে দাও।”
”ওকে স্যার!” রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে জেলাশাসক ডাকলেন, ”মিসেস সিংহরায়!”
রুদ্র চমকে তাকাল।
জেলাশাসক বললেন, ”যদিও এটা পুলিশ ম্যাটার, প্রশাসনিক পদে থেকে আমার এতটা সরাসরি ইনভলভ হওয়াটা হয়তো একটু আনইউজুয়াল লাগছে। কিন্তু আমার জেলায় এইভাবে বিজনেসম্যান মার্ডার হওয়া নিয়ে আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গতকাল হোম সেক্রেটারি নিজে ফোন করে ইনভেস্টিগেশনের প্রোগ্রেস জানতে চেয়েছেন। আসলে একদম শেষে যিনি খুন হয়েছেন, ওই কোন্নগরের ব্যবসায়ী বেশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল। আপনি এখনো প্রোবেশনে আছেন। পুলিশ কমিশনার চাইছিলেন অভিজ্ঞ কাউকে এই দায়িত্ব দিতে। কিন্তু আমি এবং এস পি মিঃ রায় একটু ঝুঁকি নিয়েই আপনাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন।”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল।
জেলাশাসক হাসলেন। বললেন, ”অল দ্য বেষ্ট!”
৪
বীরেন শিকদার, লোকেশ ব্যানার্জি, প্রিয়াঙ্কা চন্দ এবং জয়ন্ত সমাদ্দার। এদের মধ্যে লোকেশ ব্যানার্জিকে বাদ দিলে সকলেরই বয়স ত্রিশ বত্রিশের নীচে। লোকেশবাবুর বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু পেটাই চেহারা। ভদ্রলোক বৈষ্ণব, পুলিশ উর্দিতেও দু’চোখের ঠিক মাঝখানে রসকলি আঁকা।
জয়ন্ত আর প্রিয়াঙ্কা একেবারেই অল্পবয়সি। তারুণ্যের নিয়ম মেনে উৎসাহে ভরপুর। জয়ন্ত কাল থেকে বারকয়েক রুদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেলেছে। নিজের পদমর্যাদার চেয়ে অনেক ওপরের এক টিমে ওকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ও রীতিমতো উত্তেজিত। এই কাজ ওর সার্ভিস রিপোর্টে একটা উজ্জ্বল পালক যোগ করবে।
আজ ওরা সবাই এসেছে রুদ্রর বাংলোর অফিসে। নিজের বাংলোতেই ছোট একটা অফিসঘর আছে ওর, জরুরি প্রয়োজনে সেই অফিসঘর ব্যবহার করা হয়।
রুদ্র খুঁটিয়ে সবকটা কেস পড়ছিল। বলল, ”প্রথমেই বলি, এই পাঁচটা মার্ডার হয়েছে পাঁচটা আলাদা জায়গায়। লোকাল থানা তার তদন্ত করছে। আমাদের সেটা কাজ নয়। আমাদের এই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের কাজ হল এই পাঁচটা কেসের মধ্যে কী লিঙ্ক আছে বা আদৌ কোনো লিঙ্ক আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করা। যাতে পুনরাবৃত্তি আটকানো যায়। তাই তো?”
”ইয়েস ম্যাডাম!” বীরেনবাবু বললেন।
”আপনারা আমার আগেই প্রতিটা কেস স্টাডি করেছেন। বীরেনবাবু তো সরাসরি যুক্ত রয়েছেন কোন্নগরের মার্ডারের তদন্তে। তা এই পাঁচটা কেসে কী কী কমন বিষয় খেয়াল করেছেন আপনারা?”
প্রিয়াঙ্কার সবেতে একটু বেশি উৎসাহ। বলল, ”ম্যাডাম! পাঁচজনই বিজনেসম্যান!”
”কারেক্ট! আর?”
”পাঁচজনই পুরুষ।”
”এত তুচ্ছ মিলগুলোই চোখে পড়ছে? আর কিছু নজরে আসছেনা?”
প্রিয়াঙ্কা এবার চুপ করে গিয়ে ভাবতে লাগল।
জয়ন্ত বলল, ”প্রত্যেকটা খুনই হয়েছে রাতের বেলায়।”
”এটা একটা ভালো অজারভেশন।” রুদ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ”আমি যতটুকু নোটিশ করেছি তা থেকে তিনটে পয়েন্ট পেয়েছি। সেগুলো আগে বলি। ত্রিবেণীর শিবনাথ বিশ্বাস খুন হয় শীতকালে। তার ছিল সাইবার ক্যাফের ব্যবসা। পোস্ট মর্টেম বলছে, কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার পেটে একাধিকবার কোপ দেওয়া হয়। সম্ভবত ছুরি। মার্ডার ওয়েপন স্পটে পাওয়া যায়নি। পাশেই গঙ্গা, নদীতে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
”লোকাল থানা তদন্ত করতে গিয়ে দেখে, তার দোকানে পাড়ারই একটি ছেলে কয়েক মাস আগে অবধি কাজ করত। নাম রাজু। কিন্তু তাকে শিবনাথ ছাড়িয়ে দেয়। পুলিশ খুনের আগের দশদিনের কলরেকর্ড ঘেঁটে দেখেছে, তার সঙ্গে শিবনাথের স্ত্রী আরতির নিয়মিত কথা হত। রাজু আরতির সম্ভাব্য প্রেমিক, এবং দুজনে মিলে শিবনাথকে খুন করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রাজুর একটি স্ট্রং অ্যালিবাই রয়েছে। খুনের দু’দিন আগে থেকে পরের পাঁচদিন সে ত্রিবেণীতে ছিল না। একটা ট্যুর এজেন্সির হয়ে লোক নিয়ে গিয়েছিল পুরীতে। প্রপার এভিডেন্সের অভাবে এখনো অবধি তাই আরতি ও রাজুকে গ্রেফতার করা যায়নি।
”এরপর খুন হল বৈদ্যবাটির সুনীল ধাড়া। তার অবস্থা ভালো। বৈদ্যবাটি স্টেশন রোডে চশমার দোকান। ছোট হলেও বেশ চালু। দু-তিনজন ডাক্তারও বসেন। একজন কর্মচারীও রয়েছে। সুনীল যেদিন খুন হয়, সেদিন অবশ্য ওর কর্মচারী দানু দোকানে ছিল না। তার একদিন আগেই দোল গিয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে সে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে গিয়েছিল। সুনীল ধাড়া দোকান বন্ধ করে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। সেইসময়েই একটা অন্ধকার গলির মধ্যে কেউ তাকে পেছন থেকে চেপে ধরে। তারপর পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। সুনীল ধাড়া সাঁতার জানত না। পরেরদিন সকালে তার লাশ পুকুরের জলে ভেসে ওঠে। তার মুখে গামছা বাঁধা ছিল, যাতে চেঁচাতে না পারে।
”চুঁচুড়ার হৃষীকেশ জয়সোয়ালের বাড়ি ঘড়ি মোড়ের পেছনে। তিনি প্রোমোটার। বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। খুন হওয়ার আগে তিনি বানাচ্ছিলেন গঙ্গার ধারে একটা বেশ অভিজাত আবাসন। অনেক টাকা লগ্নি করেছিলেন তাতে। প্রোমোটারদের শত্রু থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জয়সোয়ালেরও নিশ্চয়ই ছিল। যাইহোক সেদিন রাতে তিনি হঠাৎই বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। তাঁর গাড়ির ড্রাইভার বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাই তিনি একটা অটোরিকশা করে পৌঁছন গঙ্গাপাড়ের সেই নির্মীয়মাণ আবাসনে। অটোরিকশা তাঁকে ফেরত চলে যায়। আবাসনটির তখন সবে একতলার গাঁথনি তৈরি হয়েছে। সেই ভিতের মধ্যেই একটা বিমে তাঁকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখা যায়।”
”তবে তো ম্যাডাম, সুইসাইডও হতে পারে!” কথার মাঝখানে বলে উঠলেন লোকেশবাবু।
রুদ্র বলল, ”সুইসাইড করার হলে ভদ্রলোক বাড়িতেই করতে পারতেন। বাড়ি থেকে অতদূরে গিয়ে করবেন কেন? আর তাছাড়া আপনি কি রিপোর্টটা ভালো করে পড়েননি? হৃষীকেশ জয়সোয়ালের হাতদুটো বাঁধা ছিল। বাঁ হাতের পাঞ্জার সঙ্গেও দড়ি বাঁধা ছিল। ডান হাত ছিল দেহের সঙ্গে সমান্তরালে। আত্মহত্যা করলে বাঁধা থাকবে কি করে? আর ফরেনসিক রিপোর্টেও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, শ্বাসরোধ করে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাওয়া যায়নি জয়সোয়ালের মোবাইলটিও। পুলিশ ট্র্যাক করেছিল, তাঁর কাছে আসা শেষ ফোনটা করা হয়েছিল চুঁচুড়া স্টেশনের একটা টেলিফোন বুথ থেকে।”
রুদ্র একটানা কথা বলে একটা লম্বা নিশ্বাস নিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিল, ”আর কোন্নগরে স্বপন সরকার ছিলেন গাড়ির শোরুমের মালিক। যথেষ্ট ধনী ব্যক্তি। গঙ্গার ধারে বিশাল বাড়ি। তাঁকেও একলা বাড়িতে গলার নলি কেটে খুন করা হয়। এক্ষেত্রেও মার্ডার ওয়েপন পাওয়া যায়নি।”
গোটা ঘরটায় বিরাজ করছে থমথমে নিস্তব্ধতা। সবাই চুপ করে শুনছে ঊর্ধ্বতন কর্তীর কথা।
রুদ্র বলল, ”এবার এই কেস স্টাডি থেকে আমি কী কী নোটিশ করেছি বলি।’
”এক, প্রথম দুজনের কাজের জায়গা ভাঙচুর করা হয়েছে। কেস ডিটেইলে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, শিবনাথ বিশ্বাসের সাইবার ক্যাফের একটা কম্পিউটারও আস্ত ছিল না। সাইবার ক্যাফেতে কোনো সিসিটিভি ছিল না। কিন্তু, এটা পরিষ্কার যে, শিবনাথকে খুন করে তার থেকে চাবি নিয়েই দোকানটা খোলা হয়।”
”কেন ম্যাডাম?” এতক্ষণে মুখ খুলল জয়ন্ত, ”এমনও তো হতে পারে, শিবনাথ দোকানে বসে কাজ করছিল। হয়তো কোনো টাকাপয়সা সংক্রান্ত ঝামেলা ছিল কারুর সঙ্গে, সে এসে দোকানের মধ্যেই খুন করে।”
রুদ্র সপ্রশংস চোখে জয়ন্তর দিকে তাকাল। বলল, ”হ্যাঁ তা হতেই পারত। কিন্তু হল না ফাইলে লেখা একটা সেন্টেন্সের জন্য। দ্যাখো। এখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে, ডেডবডি যখন পাড়ার লোকে আইডেন্টিফাই করে, তখনও স্কুটির ইঞ্জিন গরম। এবং কম্পিউটারগুলো ভাঙলেও দোকানের শাটার কিন্তু ভাঙা ছিল না। বন্ধ করা ছিল। এক্ষেত্রে একটাই সম্ভাবনা যে, শিবনাথ বেরিয়েছিল, কিন্তু স্কুটিতে স্টার্ট দেওয়ার সময়েই ওকে আক্রমণ করা হয়। আর তারপর চাবিটা নিয়ে দোকান খোলা হয়।”
জয়ন্ত মাথা নাড়ল।
”নেক্সট দ্যাখো। মহম্মদ তারেকের রিচার্জের গুমটিতে বিক্রি হওয়া মোবাইল চার্জার, হেডফোন সেট সব কিছু ছেঁড়া ভাঙা ছিল। এমনকি, গুমটির দেওয়ালের দরমায় আটকানো রিচার্জ প্ল্যানের অফারগুলো পর্যন্ত কুটিকুটি করা ছিল। এর মানে কী? কেউ বা কারা এদের ব্যবসার ক্ষতি করতে চাইছে।”
”কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই, যে পাঁচটা খুন একই লিঙ্কে যুক্ত, তাহলে সুনীল ধাড়ার চশমার দোকান ভাঙচুর করা হল না কেন? স্বপন সরকার-র গাড়ির শো-রুমই বা বাদ গেল কেন?”
রুদ্র গভীরভাবে ভাবছিল। এমন সময় ঘরে ঢুকল মল্লিকাদি। মাথায় একহাত ঘোমটা। হাতে ট্রে। ট্রে’র ওপর কফি, বিস্কুট। সবাই একে একে কাপ তুলে নিতে মল্লিকাদি চলে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলল, ”দাদাবাবু কাজে বেরোনোর আগে আমায় বলে গেলেন, আজ যেন রাতের রান্নাটা আমিই করি। আপনি একটু জ্যোৎস্নাদি’কে বলে দেবেন দিদিমণি?”
রুদ্র হাসি চেপে বলল, ”জ্যোৎস্নাদি কোথায়?”
”ক্ষমার খাতা শেষ হয়ে গেছে। কিনে আনতে গেছে।” মল্লিকাদি আড়ষ্ট গলায় ঘোমটার ফাঁক দিয়ে বলল।
ক্ষমাকে অনেক কষ্টে অ থেকে ঔ পর্যন্ত শিখিয়েছে প্রিয়ম। এবার সেটার বারবার মহড়া চলছে। খাতা কিনতে যাওয়ার সংবাদে রুদ্র মনে মনে খুশি হল। মেয়েটার মধ্যে পড়াশুনোর প্রতি আগ্রহ গড়ে তোলা খুবই জরুরি।
”আচ্ছা, এলে পাঠিয়ে দিও, বলে দেব। তুমি যাও এখন।” রুদ্র এদিকে ফিরল, ”জয়ন্ত, তুমি জিজ্ঞেস করলে, পেছনে একই ক্রিমিনাল থাকলে সুনীল ধাড়া বা স্বপন সরকারের ব্যবসার ক্ষতি করা হয়নি কেন? যে কোনো চশমার দোকানে সিসিটিভি থাকে আজকাল। আর স্বপন সরকার-র গাড়ির শো-রুমে তো থাকবেই। এটাও তো হতে পারে, সেজন্যই খুনি ঝুঁকি নেয়নি। এদের ক্ষেত্রে টার্গেট করছে অন্য জায়গা। তারেক বা শিবনাথের মামুলি দোকান, তাদেরটাই শুধু ভেঙেছে। একই কথা প্রযোজ্য জয়সোয়ালের ক্ষেত্রেও। তাঁর প্রোমোটারির অফিসেও নিশ্চয়ই গার্ড বা ক্যামেরা আছে। তাই তাঁকে কোনোভাবে ওই ইনকমপ্লিট আবাসনে নিয়ে যেতে হয়েছে।”
জয়ন্ত বলল, ”প্রত্যেকে ব্যবসায়ী হলেও এই পাঁচজন সমাজের নানাস্তরের মানুষ। যেমন, শিবনাথ আর মহম্মদ তারেক বেশ অভাবী। সুনীল ধাড়া মোটামুটি স্বচ্ছল। অন্যদিকে হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর স্বপন সরকার সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ। স্বপন সরকার’র তো এইবারের পুরসভা ভোটে দাঁড়ানোরও কথা ছিল। শাসক দলের হয়ে। তাছাড়া উনি বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠনেরও হর্তাকর্তা ছিলেন।”
বলল, ”স্বপন সরকার বা হৃষীকেশ জয়সোয়ালের শত্রু যে বা যারা হবে, তারা কেন খুচরো ব্যবসায়ী মহম্মদ তারেক বা নির্বিবাদী ওষুধ ব্যবসায়ী সুনীল ধাড়ার শত্রু হবে? এই মোটিভটা খুঁজে বের করাই হবে আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি।”
রুদ্র আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওর টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনে কয়েক সেকেন্ড মাত্র কথা বলে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, ”মাই গড। বলতে বলতেই ছ’নম্বর খুন। আবার ত্রিবেণী। ভট্টাচার্য পাড়ার ব্রিজেশ তিওয়ারি।”
”অ্যাঁ! আমার বাড়ির পাশের গলিতেই তো।” চোখ বড় বড় করে বলল জয়ন্ত, ”লোকটার ইনভার্টারের দোকান। আমি ওর দোকান থেকেই কিনেছিলাম আমার বাড়িরটা।”
রুদ্র বলল, ”হ্যাঁ। আজ সকাল থেকে দোকান খুলছিল না। একটু আগে আশপাশের দোকানদাররা এসে দেখে, শাটার নামানো থাকলেও খোলা। তোলার পর দেখা যায়, ঘরের মধ্যেই পড়ে আছে। সেই একই মোডাস অপারেন্ডি। গলার নলি কাটা। আর আশপাশের তিন-চারটে ইনভার্টারের ব্যাটারি ভাঙা। গতকাল রাতেই মার্ডার হয়েছে। চলুন, আমাদের এখুনি স্পটে যেতে হবে!”
সবাই উঠে বেরোতে যাচ্ছিল, শুধু রুদ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টেবিলে লেটারপ্যাডে কী যেন কাটাকুটি করছিল। মুহূর্তের মধ্যে পিছু ডাকল ও, ”এক সেকেন্ড শুনুন সবাই। আমার তিন নম্বর পয়েন্টটা বলা হয়নি এখনো। ছ’টা খুনের তারিখগুলো দেখুন। ১৫ই জানুয়ারি, ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১১ই মার্চ, ১৫ই এপ্রিল, ১৩ই মে এবং গতকাল ১০ই জুন। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকান। তারিখগুলো দেখে কিছু বুঝতে পারছেন?”
সবাই দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল।
কেউ কিছু বলার আগে প্রথম মুখ খুললেন লোকেশ ব্যানার্জি। সবার আগে তিনি আঙুল উঁচিয়ে অস্ফুটে বললেন, ”প্রতিটা দিনই বুধবার!”
৫
অরণ্যপ্রান্তে এক চতুষ্পাঠী। চতুষ্পাঠী বলতে একটি মৃৎকুটির। বাঁশ-দড়ি -খড় দিয়ে বানানো। মাটির দেওয়াল। সযত্নে নিকনো মেঝে। বাইরে একটি বড় কাপড়ের ওপর জ্বলজ্বল করছে রক্তরঞ্জিত হস্তাক্ষর, ”নারায়ণী চতুষ্পাঠী।’
সেই কুটিরের একেবারে বাইরে দণ্ডায়মান প্রহরীসম দুই আমগাছ।
কুটিরের সামনের অনেকটা জায়গা জুড়ে লম্বা চাটাই বিছনো। সেখানে বসে এখন পাঠ অধ্যয়ন করছে বেশ কয়েকজন ছাত্র। তরুণ শিক্ষক মহাশয় বসে আছেন কুটিরের বাইরে একটি বেদিতে। তিনি এই চতুষ্পাঠীরই বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র। তাঁর কাজ কনিষ্ঠদের বেদ অধ্যয়নপ্রস্তুতির বিদ্যাদান করা। তিনি মৃদুভাষ্যে ছাত্রদের পড়াচ্ছেন। একপাশে পড়ে রয়েছে বেত্রদণ্ড।
শিক্ষক থেকে ছাত্র, প্রত্যেকের মস্তক মুণ্ডিত। মাথার পেছনে ঝুলছে দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা। সকলেরই পরনে ধুতি ও ফতুয়া।
চতুষ্পাঠী অর্থাৎ যেখানে চার বেদের পাঠ দেওয়া হয়। শুধুই চতুর্বেদ নয়, সঙ্গে পড়ানো হয় ষড়ঙ্গ। অর্থাৎ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। পড়ানো হয় ষড়দর্শন। অর্থাৎ, সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, যোগ, পূর্ব মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা। বিভিন্ন উপনিষদ ও সংহিতা। চারটি শ্রেণীতে প্রায় সত্তরটি ছাত্র পড়াশুনো করে।
আজ অবশ্য একটি ব্যতিক্রমী দিন। তরুণ শিক্ষক বললেন, ”আজকের মতো পাঠ এখানেই সমাধা হল বাবা সকল। মধ্যাহ্নভোজ দ্রুত সেরে নাও। আজ গুরুদেব পদধূলি দিয়েছেন এখানে। তিনি স্বয়ং তোমাদের জ্ঞানের পরীক্ষা নেবেন।”
ছাত্ররা সকলেই তেরো-চোদ্দো বছর বা তার নীচের বালক। শিক্ষকের কথা শুনে তাদের মুখে ভয়ের ছাপ পড়ল। নিজেদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন করতে করতে তারা আসন গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সারিবদ্ধভাবে চলল অদূরে অবস্থিত ভোজনশালার দিকে।
ঘন অরণ্য কেটে প্রসারিত করা হয়েছে এই বিস্তৃত প্রাঙ্গণ। চতুষ্পাঠীর পাশেই রন্ধনশালা, ভাণ্ডারঘর। পাচকেরা সেখানে ইতিমধ্যেই সার দিয়ে বিছিয়ে দিচ্ছে কলাপাতা।
আয়োজন সামান্য কিন্তু পুষ্টিকর। ভাত, চালকুমড়োর বড়া, আমড়া-মুকুলের মটর ডাল, লাউসেদ্ধ, জলপাইয়ের মাখা চাটনি। শেষপাতে সামান্য ক্ষীর।
সবই পার্শ্ববর্তী খেতের উৎপন্ন হওয়া ফসল। এছাড়া ভাণ্ডারঘরের পাশেই রয়েছে গোশালা।
আহার প্রারম্ভের আগে সবাই করজোড়ে একসঙ্গে বলতে লাগল, ”ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ। ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ। ওঁ শ্রী জনার্দনায় নমঃ।”
সারিতে একেবারে প্রথমে বসা দ্বাদশবর্ষীয় বালকটি তার সহপাঠীকে অস্ফুটে বলল, ”একিরে দ্বারিকা, আজ নিরামিষ ব্যঞ্জন? ধুর!”
দ্বারিকা নামক বালকটি প্রত্যুত্তর করল, ”এই অচ্যুত! এসব কী বলছিস? আজ না একাদশী? তার ওপর ভরণী নক্ষত্রে অতিগন্ড যোগ। আমিষ খাওয়া যে মহাপাপ রে! উপনয়ন হয়েছে পাঁচমাসও পুরেনি।”
”আমিষ না থাক, একটু আলু দিলেও তো পারে বল!” অচ্যুত ঠোঁট উল্টে বলল।
”আলু?” দ্বারিকা ভ্রূ কুঞ্চিত করল, ”মানে আলো? আতপ চাল?”
”ধুস! আলু এক ধরনের সবজি। তরিতরকারিতে দেওয়া হয়।” অচ্যুত সামান্য গলা নামিয়ে বলল, ”দারুণ খেতে শুনেছি। বাইরে সবাই খায়।”
ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে উঠল দ্বারিকার মুখ, ”বাইরে! সেটা তুই … তুই জানলি কী করে?”
”না জানার কি আছে? মধুসূদনদা’রা গিয়ে মাঝে মাঝেই বাইরের জল বাতাস খেয়ে আসছে, আর আমরা জানলেই দোষ?” অচ্যুত রহস্যময় হাসি হেসে কথাটা গিলে ফেলল, ”ভালো লাগেনা। খেয়েদেয়ে কোথায় একটু শীতলপাটি বিছিয়ে ঘুম দেব, তা না। আবার ওই রোদের মধ্যে গিয়ে বসে থাকো।”
দ্বারিকা এবার ভয়ার্তমুখে এদিক ওদিক তাকাল। চতুষ্পাঠীতে নিয়ম শৃঙ্খলা অতি কঠোর। তার ওপর আজ বুধবার। প্রতি বুধবার গুরুদেব স্বয়ং অধিষ্ঠান করেন এখানে। বয়োজ্যেষ্ঠ শিষ্যরা চারদিকে তাই অতিসতর্ক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনোরকম বেচাল দেখলে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ যাবে গুরুদেবের কাছে।
আর তারপর? দ্বারিকা সেই ভয়ঙ্কর শাস্তিগুলোর কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠল। কথা না বাড়িয়ে সে আহারে মনোনিবেশ করল।
অচ্যুত ওইরকমই, কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু ওর আছে।
ভোজন সারা হলে ওরা গিয়ে আবার বসল কুটিরের সামনের চাতালে।
কিছু পরেই এলেন গুরুদেব। ওদের এই বৈদিক সমাজের প্রধান। যদিও তিনি সর্বক্ষণ এখানে থাকেন না। সমাজের কল্যাণার্থে তাঁকে নানাস্থানে পরিভ্রমণ করতে হয়। সমগ্র বৈদিক সমাজ এই বুধবারের পুণ্যদিবসে তাঁর সাক্ষাৎ পায়। মঙ্গলবার গভীর রাতে তিনি আসেন, আবার বুধবার গভীর রাতে চলে যান। আগে তাঁর আসা অনিয়মিত হলেও গত একবছর ধরে সাপ্তাহিক এই আগমন সুনির্দিষ্ট। তাঁর আগমন ও প্রস্থানলগ্নে উপাসনামন্দির থেকে সজোরে বেজে ওঠে শঙ্খ।
গুরুদেবের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, কিন্তু চেহারা ঋজু। তিনি দীর্ঘাঙ্গী, পুরুষ্টু শ্মশ্রুগুম্ফে লেগেছে শুভ্রতার ছাপ, তবু বয়স এখনো তাঁকে একটুও ন্যুব্জ করতে পারেনি। একটি ধবধবে সাদা ঘোড়ায় তিনি টহল দেন গোটা গ্রাম। সেই ঘোড়ার নাম দেবদত্ত। দেবদত্তকে দেখলে মনে হয় যেন কোন তেজী পক্ষীরাজ স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে মর্ত্যে। দেবদত্ত যখন গুরুদেবকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে বিচরণ করে, তখন গ্রামের প্রতিটি কুটির থেকে মানুষজন বেরিয়ে আসে। দূর থেকে পরমভক্তিতে তারা প্রণাম করে এই সিদ্ধপুরুষকে।
নারায়ণী চতুষ্পাঠীর এই শ্রেণীর ছাত্ররা যখন ছোট ছিল, তখন গুরুদেবের অন্য একটা ঘোড়া ছিল। তার নামও ছিল দেবদত্ত। সে মারা যেতে সমস্ত লক্ষণ মিলিয়ে একে আনা হয়েছিল।
ঘোড়া পালটায়, নাম একই রয়ে যায়।
দেবদত্তর পৃষ্ঠদেশ থেকে লাফিয়ে নামলেন গুরুদেব। গম্ভীর মুখে উঠে এলেন নারায়ণী চতুষ্পাঠীর চাতালে।
ছাত্রদের যিনি নিয়মিত শিক্ষাদান করেন, সেই তরুণ শিক্ষক প্রণাম করলেন গুরুদেবকে। দেখাদেখি ওরাও। গোটা চাতাল নিঃশব্দ।
ওরা সকলে গুরুদেবকে প্রতি বুধবার প্রত্যুষের সূর্যপ্রণামের সময় দেখতে পায়। প্রধান পুষ্করিণীতে স্নান সেরে গুরুদেব পূর্বে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করেন। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন,
ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতি্
ধ্বান্তারিং সর্ব্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।
উষা উদ্ধন্তি সমিধানে অগ্না উদ্যনৎ সূর্য উর্বিয়া জ্যোতিরশ্রেৎ।
দেবো নো অত্র সবিতা ন্বর্যং প্রাসাবীদ্বিপৎত্র চতুষ্পসদিত্যৈ।।
ওদের রোমকূপ শিহরিত হয়ে ওঠে। দূর থেকে সসম্ভ্রমে প্রণাম করে ওরা। শুধু ওরা নয়, ওদের বাবা মা-রাও। ওদের এই সমাজের সকলে দেবজ্ঞানে ভক্তি করে গুরুদেবকে।
সারাবছরে চলা নানা পুণ্য তিথির মধ্যে একমাত্র মহোৎসবেই উপস্থিত থাকেন গুরুদেব। সেইদিন ওরা সকলে তাঁর পবিত্র পদস্পর্শ করার অনুমতি পায়।
গুরুদেব আসনে বসলেন না। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে দেখলেন গোটা শ্রেণীকে। স্মিতমুখে বললেন, ”জয় কৃষ্ণ! কেমন শাস্ত্র অধ্যয়ন হচ্ছে বাবাসকল? মধুসূদন কেমন পড়াচ্ছে তোমাদের?”
ওরা প্রত্যেকে ইতিবাচক মাথা নাড়ল। মধুসূদন নামক তরুণ শিক্ষক আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
গুরুদেব বললেন, ”বেশ। প্রথমে সামান্য পরীক্ষা নিই। তুমি বলো তো বাবা, আগম ও নিগম কী?”
যাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নবাণ, সেই বালক উঠে দাঁড়াল। করজোড়ে প্রণাম করে বলল, ”আগম ও নিগম বেদেরই অন্য দুই নাম, গুরুদেব।”
”হেতু? বেদের সঙ্গে কী এদের সম্পর্ক?”
”আগম অর্থাৎ যা ঐতিহ্যরূপে আমাদের কাছে এসেছে। আর যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে, তাই নিগম। বেদ কথাটির উৎপত্তি ‘বিদ’ ধাতু থেকে। অর্থাৎ জানা।” ছাত্রটি গড়গড় করে বলে গেল।
সে এই শ্রেণীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাত্র। নাম বনমালী।
”বেশ। আরণ্যক কী?”
বনমালী এবারও আলোকিতমুখে বলে গেল, ”বেদ চারপ্রকার। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। এই প্রতিটি বেদ আবার চার অংশে বিভক্ত। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। আরণ্যক অংশে রয়েছে বনবাসী তপস্বীদের যজ্ঞভিত্তিক বিভিন্ন ধ্যানের বর্ণনা।”
”উত্তম। অতি উত্তম!” গুরুদেব একবার প্রশান্তির হাসি হাসলেন, ”তুমি বসো বাবা। মহাপণ্ডিত হও। আচ্ছা, তুমি ওঠো তো।”
অকস্মাৎ আহ্বানে তিরবিদ্ধ পক্ষীর মতো উঠে দাঁড়াল দ্বারিকা। তার মুখ ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছে। কোনোমতে সে করজোড়ে প্রণাম করল।
”বৃহদারণ্যক উপনিষদ কে প্রণয়ন করেন?”
দ্বারিকা প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রইল। সে যেন থমকে গিয়েছে। উপনিষদ রয়েছে দুশোরও বেশি, বিভিন্ন সময়কালে রচনা করেছেন বিভিন্ন ঋষি। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বাইশটি হল প্রাচীনতম। বৃহদারণ্যক উপনিষদও সেই বাইশটির মধ্যে একটি।
ঈশোপনিষদ, কেনোপনিষদ, মান্ডুক্য উপনিষদ, ঐতরেয় উপনিষদ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ, প্রতিটির প্রণেতার নাম মনে পড়ছে দ্বারিকার, কিন্তু এই অতিসহজ প্রশ্নের উত্তরটা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তার জিহ্বা জড়িয়ে যেতে লাগল, হাতের তালু ঘর্মাক্ত হতে শুরু করল।
”কী হল বাবা? বলো?”
”ঋষি … ঋষি বাল্মীকী?” মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এল দ্বারিকার। আর বলামাত্র অনুভব করল, বড় ভুল হয়ে গেল।
গুরুদেব বিস্মিত, ”রামায়ণের প্রণেতা মহাকবি বাল্মীকিকে দিয়ে তুমি উপনিষদ রচনা করাচ্ছ, বাবা?”
লজ্জায় অধোবদন হয়ে দ্বারিকা যুক্তকর গরুড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
”বোসো। আর তুমি?” ব্যথিত গুরুদেব এবার পাশে বসে থাকা অচ্যুতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন, ”তুমি এর কী উত্তর দেবে? ব্যাসদেব?”
অচ্যুত উঠে দাঁড়াল। প্রণাম টণামের বালাই নেই। ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে সে বলল, ”কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কেন লিখতে যাবেন? বৃহদারণ্যক উপনিষদ তো রচনা করেছিলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। যাকে গার্গী জনকরাজার সভায় প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলেন, নেহাত যাজ্ঞবল্ক্য কায়দা করে বেরিয়ে গেলেন তাই!”
”কায়দা করে?” গুরুদেব বিস্মিত হলেন। তাঁর চতুষ্পাঠীতে এইরকম শব্দ কেউ ব্যবহার করার স্পর্ধা দেখায় না।
”তা নয়তো কী?” অচ্যুত বলে যেতে লাগল, ”যেই যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর ব্রহ্ম কোথায় ওতপ্রোত রয়েছে-র উত্তর দিতে পারলেন না, অমনি বলে উঠলেন, ”গার্গী! মা অতিপ্রাক্ষীঃ! অতিপ্রশ্ন করোনা গার্গী। তোমার মাথা খসে পড়বে। একজন নারীর কাছে পরাস্ত হতে আসলে তাঁর পুরুষ অহং বাধা দিচ্ছিল।”
গুরুদেব বিস্মিত হলেন। বালকের অর্বাচীন শব্দ ব্যবহার সত্ত্বেও অবাক হলেন শাস্ত্র অতিক্রম করে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও মতামতের প্রসার দেখে। এমন বালকই সম্পদ। জ্ঞানী অথচ তেজি।
কিন্তু সামান্য ভুলচালনায় বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। নিজস্ব চিন্তাভাবনাই বিপদের উৎস।
তিনি মুখে বললেন, ”উত্তম। বোসো। আমি জানি, গোবর্ধন বা মধুসূদনরা তোমাদের উত্তম শিক্ষা দিচ্ছে। তবু আজ সময় এসেছে আরও বিশদ জানার। আজ থেকে আমাদের আরাধ্য পরমগুরু সম্পর্কে প্রতি বুধবার আমি তোমাদের কিছু কিছু বলব। কলিযুগের এক অত্যন্ত পুণ্যলগ্নে তিনি ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ধন্য করেছিলেন মর্ত্যলোককে। এতদিন তোমরা শুধু তাঁকে উপাসনা করে এসেছ, বিষ্ণু মন্দিরের বাইরে স্থাপিত তাঁর মৃন্ময় মূর্তিকে আরাধনা করেছ। তিনি স্বয়ং ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
”আজ তাঁর মানবরূপ সম্পর্কে বলব তোমাদের। বলব অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম সুপণ্ডিত সম্বন্ধে। বলব, তাঁর অসম্পূর্ণ ক্রিয়ার বিষয়ে। প্রথমেই বলব, পরম গুরুর জাগতিক নাম কী ছিল।”
অচ্যুত বলে উঠল, ”আমি জানি। জগন্নাথ! জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।”
গুরুদেব প্রবল বিস্ময়ে পাশে দণ্ডায়মান তরুণ শিক্ষক মধুসূদনের দিকে তাকালেন, ”একি! পরমগুরুর পার্থিব নাম কি তুমি আগেই বলে দিয়েছ? আমার কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও?”
মধুসূদন সভয়ে মাথা নাড়লেন। আশ্রমের নিয়ম, আশৈশব ছাত্রদের পরম গুরুকে আরাধনা করা শেখানো হবে, তারপর এক শুভতিথিতে গুরুদেব স্বয়ং সব জানাবেন। তার অন্যথা হওয়া যে গুরুতর অপরাধ!
তিনি বললেন, ”না গুরুদেব। আমি একবারও ওই নাম উচ্চারণ করিনি এদের সামনে। প্রত্যয় না হলে আপনি প্রশ্ন করুন অন্য ছাত্রদের।”
মধুসূদনের কথা মিথ্যা নয়। অন্য কোনো ছাত্রই পরম গুরুর নাম আগে শোনেনি।
”তবে তুমি? তুমি কোথা থেকে জানলে?”
অচ্যুত চুপ করে রইল। তারপর বলল, ”উপাসনাগৃহে একদিন আলোচনা হচ্ছিল। আমি পিছনের জানলা দিয়ে শুনেছি। অন্যায় হয়ে গিয়েছে গুরুদেব। আর হবে না।”
গুরুদেব এই কিশোরের স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন। পরক্ষণে তাঁর মনে হল, রাজমণ্ডপে আড়ি পাতার মতো অচিন্ত্যনীয় অপরাধ করার দুঃসাহস দেখিয়েছে এই কিশোর, তাতে এখন সর্বসমক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখালে অন্য বালকদেরও সেই ইচ্ছা হতে পারে। বয়সটাই যে এই। নিষেধ যেদিকে, সেইদিকে পতঙ্গের মতো ছুটে যেতে চায় মন। তার থেকে ব্যবস্থা গোপনে নিতে হবে।
তিনি মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। বললেন, ”আমি গল্পচ্ছলে পরম গুরুর কীর্তি তুলে ধরব তোমাদের কাছে। তবেই তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে তোমাদের সুবিধা হবে। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের নবরত্নসভার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে,
তার ছিল নবরত্ন ইহার সে রূপ
সভাস্থের কিবা কার নিজ বিদ্যাকূপ।।
সাক্ষাৎ বরদাপুত্র নামে জগন্নাথ
তর্কপঞ্চাননরূপে ভুবনবিখ্যাত।।”
কথা শেষ করে কপালে দুই হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন গুরুদেব। চোখ বন্ধ করে বললেন, ”তিনি জগন্নাথ। তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। ঈশ্বর শ্রী শ্রী জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।”
৬
ষষ্ঠ খুনটা হয়েছে ত্রিবেণীর ভট্টাচার্য পাড়ায়। জয়ন্তর চেনা, তাই সটান দোকানের সামনে সরাসরি উপস্থিত হতে অসুবিধা হল না। আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল, ত্রিবেণী থানার ওসি দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকলেন। বললেন, ”কমিশনারেট থেকে ফোন এসেছিল ম্যাডাম। আমি ত্রিবেণী থানার অফিসার ইন চার্জ সুকেশ সান্যাল। এদিকে আসুন।”
ভট্টাচার্যপাড়াটা ছিমছাম একটি পাড়া। পরপর একতলা দোতলা বাড়ি। সামনে পেছনে সবুজ গাছগাছালি। পাতকুয়ো। বাগান। কোনো ফ্ল্যাটবাড়ি তেমন চোখে পড়ছে না। এই দোকানটাও একটা প্রকাণ্ড বাড়ির সামনের অংশে। দোকানের সামনে তিন-চারমিটার ব্যবধানে পুলিশ থেকে ব্যারিকেড দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের এপারে জটলা করেছে পনেরো-কুড়িজন মানুষ। তাঁদের মুখে আতঙ্ক।
জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে সেই জটলায় দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করল, ”কী ব্যাপার, অনুপমদা!”
অনুপম নামক ভদ্রলোক মুখ ফেরালেন। বললেন, ”ওহ, জয়ন্ত। দ্যাখো না, সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি এই কাণ্ড। ব্রিজেশকে কারা খুন করে গেছে। পাড়ার মধ্যে একি সাংঘাতিক ব্যাপার বলো তো! ব্রিজেশ তো লোক ভালো ছিল বলেই জানতাম, কারুর সাতে পাঁচে থাকত না বলো!”
জয়ন্ত কথা বলতে লাগল। রুদ্র ওসি সুকেশ সান্যালের সঙ্গে এগিয়ে গেল দোকানের দিকে।
বডি এর মধ্যেই নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে ময়না তদন্তের জন্য। যেখানটা বডি পড়েছিল, সেখানটা সাদা চক দিয়ে মার্ক করা। কালচে হয়ে শুকিয়ে রয়েছে রক্ত। ছোট বর্গাকৃতি দোকানে যে’কটা ইনভার্টার এবং ব্যাটারি রয়েছে, সেগুলো তোবড়ানো। ধারালো কিছু দিয়ে বারবার আঘাত করা হয়েছে তাদের ওপর।
রুদ্র এগিয়ে গেল। ব্যাটারির ওপর যে আঘাত, তাতে কালচে ছোপ। আশপাশেই কিছু কালচে ছোপ লেগে রয়েছে।
সন্দেহ নেই, আততায়ী যে অস্ত্র দিয়ে ব্রিজেশ তিওয়ারিকে খুন করেছে, সেই অস্ত্র দিয়েই খুনের পর এগুলোর ওপর আঘাত করেছে। ও বলল, ”কোনো শার্প ওয়েপন দিয়ে গলাটা কাটা হয়েছে। এই ব্লাড স্যাম্পলগুলো ফরেনসিকে পাঠান।”
”ওকে ম্যাডাম।” ওসি সুকেশ সান্যাল বললেন, ”মনে হচ্ছে কাল রাত বারোটা নাগাদ মার্ডারটা হয়েছে। আমরা যখন এলাম, রাইগর মর্টিস শুরু হয়ে গিয়েছিল।”
রুদ্র বলল, ”এই বাড়িটা তো বিশাল আর বহু পুরোনো দেখছি। ব্রিজেশ তিওয়ারিরই?”
সুকেশ সান্যাল মাথা নেড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই এগিয়ে এল জয়ন্ত, ”না না। এ তো ত্রিবেণীর বিখ্যাত বাড়ি ম্যাডাম। এখন বহু শরিক থাকে। ব্রিজেশ একটা শরিকের অংশে ভাড়া থাকত। ওর আদি বাড়ি বিহারে, সেখানেই পরিবার থাকে। দোকানের অংশটাও ভাড়া নেওয়া।”
রুদ্র বাড়িটার দিকে তাকাল। প্রকাণ্ড বড় ঠাকুরদালান, তার একদিকে তালাবন্ধ পারিবারিক মন্দির। ঠাকুরদালানকে মধ্যিখানে রেখে প্রায় চার-পাঁচ বিঘার ওপর দানবাকৃতি প্রাসাদ। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এদিক ওদিক মাথা উঁচু করে রয়েছে বট-অশ্বত্থ গাছ।
বাড়িটার মধ্যে দিয়ে ঢুকে গিয়েছে সরু সরু গলি। সেই গলির ভেতরেও প্রসারিত হয়েছে এই প্রাসাদের শাখাপ্রশাখা।
রুদ্র কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারদিকে বাড়িটা দেখল প্রকাণ্ড অট্টালিকা। ঠাকুরদালানের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে যেন গোটা বাড়িটা গিলে খেতে আসছে।
একসময় ও বলল, ”বিখ্যাত বাড়ি কেন?”
জয়ন্ত বলল, ”এটা জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বসতবাড়ি ম্যাডাম। উনিই এই গোটা বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। এখন অবশ্য প্রচুর শরিক। ভেঙে ভেঙে পড়ছে।”
”জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”কে তিনি?”
জয়ন্তের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে উঠল।
”একি ম্যাডাম, জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম শোনেননি?” পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল ও, ”অবশ্য ত্রিবেণীর লোকেরাই তাঁকে ভুলতে বসেছে, আর আপনি বাইরের মানুষ হয়ে জানবেন কী করে! ওইদিকে তাকান।”
বাড়ির দক্ষিণদিকে জয়ন্তর আঙুল বরাবর তাকিয়ে রুদ্র একখানা শ্বেতপাথরের স্ট্যাচু দেখতে পেল। একজন মুণ্ডিত মস্তক ব্যক্তির আবক্ষ স্ট্যাচু। গায়ে উড়নি, মাথায় দীর্ঘ টিকি। নীচে একখানা ফলক।
ও এগিয়ে গিয়ে দেখল,
অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সুপণ্ডিত ও অসামান্য শ্রুতিধর
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন
জন্ম ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ
রুদ্রর একটা স্থানে চোখ আলাদা করে আটকে গেল। জন্ম – ১৬৯৫ সাল। মৃত্যু — ১৮০৭ সাল? মানে এই পণ্ডিত ১১২ বছর বেঁচেছিলেন?
জয়ন্ত রুদ্রর মনের কথাটা বুঝতে পেরে গেল। বলল, ”হ্যাঁ ম্যাডাম। উনি ১১২ বছর বেঁচেছিলেন। শেষেও নাকি মারা যাননি, গঙ্গার ঘাটে স্বেচ্ছায় অন্তর্জলি যাত্রা করেছিলেন। অসম্ভব শ্রুতিধর এবং মহাপণ্ডিত ছিলেন। তখন তো সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান ছিল নবদ্বীপ। কিন্তু ইনি একাই নবদ্বীপের সেই ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিয়েছিলেন। ত্রিবেণীর জগন্নাথ ঘাটও ওঁর নামে। সারা ভারতবর্ষ একডাকে চিনত। গায়ে প্রচুর লোম ছিল। তাই লোকে বলত ত্রিবেণীর লোমশ পণ্ডিত। এঁর সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত মিথ চালু আছে ম্যাডাম। অবিশ্বাস্য অনেক কিংবদন্তী ঘোরে লোকমুখে। জানিনা সেগুলো কতটা সত্যি।”
”কীরকম?” রুদ্র জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, তার আগে সুকেশ সান্যাল এগিয়ে এলেন, ”ম্যাডাম, আপনি কি দোকানের ভেতরটা আর দেখবেন? নাহলে আমরা শাটার নামিয়ে সিজ করে দেব।”
”হ্যাঁ আরেকবার দেখব। চলুন।”
ব্রিজেশ তিওয়ারির দোকানের ভেতরটা ছিমছাম। একদিকে একটা টেবিল, তার ওপরে পুরনো খবরের কাগজ, টেবিলের ড্রয়ারে হিসেবের খাতা। অন্যদিকের দেরাজে কয়েকটা ফাইল, তাতে কোম্পানির ক্যাশমেমো। ইনভার্টার বা ব্যাটারিগুলোর হামলা চললেও খাতাপত্র ফাইলগুলো অবিকৃত রয়েছে।
রুদ্র দেখতে দেখতে বলল, ”জয়ন্ত, দোকানটা কতদিনের পুরোনো?”
জয়ন্ত বলল, ”তিন-চারবছর।”
”ব্রিজেশ তিওয়ারি পাড়ার মধ্যে দোকান করেছিল কেন? এইসব দোকান সাধারণত বাজার তল্লাটে থাকে।”
”হ্যাঁ। আসলে আমাদের এই এলাকাটায় অনেকটা বড় জায়গা জুড়ে কোন ইনভার্টারের দোকান নেই, তাই হয়তো। আর ও বা ওর কর্মচারী খুব হেল্পফুল ছিল। যারা যারা ওর কাছ থেকে কিনেছে, সবার বাড়ি বছরে তিন-চারবার গিয়ে ফ্রিতে সার্ভিসিং বা জল ভরে দিয়ে আসত। তাই অল্পদিনেই বেশ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।”
রুদ্র জিজ্ঞাসুচোখে বলল, ”ওর কর্মচারী? কোথায় সে? তাকে তো দেখিনি এসে থেকে!”
”বাড়ির মধ্যেই আছে। অলোক। ব্রিজেশ এখানে দুটো ঘর নিয়ে একা থাকত। যখন যে ওর দোকানে কাজ করত, সে একটা ঘরে থাকত।” সুকেশ সান্যাল বললেন, ”একটু আগেই আমি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আপনি চাইছেন, আমি আবার ডেকে পাঠাচ্ছি। এই সুজিত, ডেকে আনো তো।”
একজন কনস্টেবল ডাকতে যাচ্ছিল, রুদ্র বাধা দিল, ”না, আমরাই যাচ্ছি। ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরটাও দেখব।”
দোকানের পাশ দিয়েই দু’হাত চওড়া গলি। সেই গলি দিয়ে যেতে যেতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”যে শরিকের অংশে ব্রিজেশ ভাড়া থাকত, তার নাম কী?”
”সোমনাথ। সোমনাথ ভট্টাচার্য।” জয়ন্ত বলল, ”জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের আসল পদবি ছিল ভট্টাচার্য। সোমনাথবাবু থাকেন মালদায়, সেখানে চাকরি করেন। তাই তাঁর অংশটা বরাবরই ভাড়া দেওয়া।”
ব্রিজেশের সহকারীর নাম অলোক। তার বয়স উনিশ-কুড়ি। ঘরের মধ্যে বসেছিল, পুলিশ আসামাত্র পাংশুমুখে এসে দাঁড়াল।
রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”তোমার নাম কী?”
”অলোক যাদব।”
”বাড়ি কোথায়?”
”আসানসোলের কাছে, বার্নপুর।”
”এদিকে কবে এসেছ?”
”ব্রিজেশভাইয়া ডাকার পর, পাঁচ-ছ’মাস হল।”
”ব্রিজেশ তিওয়ারি তোমার আত্মীয় ছিল?”
”হ্যাঁ। আমার মায়ের এক চাচার ছেলে।”
”ব্রিজেশভাইয়া ডাকলেই তুমি চলে এলে কেন? কত টাকা মাইনে দিত তোমায়?”
”আমি বারোক্লাস পাশ করে এদিক ওদিক ধান্দা করছিলাম। ভালো কিছু পাচ্ছিলাম না। এদিকে ব্রিজেশ ভাইয়ের এখানে যে কাম করত, সে হঠাৎ কিছু না বলে চলে গিয়েছিল। তাই ব্রিজেশভাইয়া ডাকতেই চলে এসেছিলাম। থাকা ফ্রি, সঙ্গে মাসে ছ’হাজার।”
”কাল রাতে কী হয়েছিল? যতটুকু জানো, ডিটেইলে বলো।”
অলোকের মুখটা এবার কালো হয়ে গেল। বলল, ”কাল রাতে আমি আর ব্রিজেশভাই একসাথে রাতের খাওয়া সারলাম। আমরা রান্নাবাড়া একসাথেই করতাম। রাতে রোটি পাকাতাম আমি, সবজি বানাত ব্রিজেশভাই। কাল রাতে খাওয়াদাওয়া মিটতে মিটতে সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল। নিজের ঘরে ফিরে আসি সাড়ে এগারোটা নাগাদ। তারপর আর আমি কিছু জানি না।”
”সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা, এই এক ঘণ্টা কী করছিলে?”
”ব্রিজেশভাইয়ার ঘরে বসে দুজনে টিভিতে গানা খাজানা দেখছিলাম। রোজই দেখি। দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা দেড় ঘণ্টা হয়।”
”ব্রিজেশ কখন দোকানে গেল, তুমি টের পাওনি?”
”না। আমাদের দুজনের ঘরের সামনেই তো বারান্দা। ব্রিজেশ ভাইয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে বাইরে গিয়েছে। চাবি ওর কাছেই থাকত। আমি সকালে উঠে ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। তখন দোকানের দিকে যাই। দেখি, শাটার অর্ধেক নামানো। আর …।” অলোকের গলা ধরে এল।
”তুমি রাতে কোন শব্দ পাওনি?” রুদ্র কথা বলতে বলতে অলোকের ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আট বাই আটের খুবই বাহুল্যহীন ঘর। একপাশে একটা বড় ট্রাঙ্ক। দেওয়ালে গণেশের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার।
”না।” অলোক বলল, ”আমি ঘুমিয়েছি বারোটার সময়। কোনো শব্দ পাইনি তখনও অবধি।”
রুদ্র ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে ওসিকে বলল, ”ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরে চলুন। আর এই ছেলেটি যেন এখন স্টেশন লিভ না করে। জয়ন্ত, অলোকের আগে ব্রিজেশ তিওয়ারির কাছে কে কাজ করত?”
জয়ন্ত বলল, ”এটা আমি ঠিক বলতে পারব না, কয়েকমাস এদিকে আসা হয়নি। এক মিনিট।”
মিনিট দুয়েকের মধ্যে আর এক বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন।
”ইনি আরেকজন শরিক। মধুময় ভট্টাচার্য। পাশেই থাকেন।”
মধুময়বাবু বললেন, ”ব্রিজেশের দোকানে অলোকের আগে কাজ করত কানাই। বেশিদিন করেনি। ওই মাসচারেক। কোন এক গ্রাম থেকে দুম করে এসেছিল, আবার দুম করে উধাও হয়ে গেল।”
”দুম করে এসেছিল মানে?”
মধুময়বাবু বললেন, ”আমি একদিন ব্রিজেশের দোকানে বসেছিলাম। দেখি একটা ছেলে সারাদিন সামনের ক্লাবের চাতালে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বিকেলের দিকে ব্রিজেশ ডাকল। চা-বিস্কুট খাওয়াল। নাম বলল কানাই, অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে, বাড়িতে ঝগড়া করে চলে এসেছে। ব্রিজেশ এমনিতেও একটা কাজের ছেলে খুঁজছিল, কিন্তু বেশি পয়সা দিতে পারবে না বলে তেমন কাউকে পাচ্ছিল না। কানাইকে বলতে সে লুফে নিল প্রস্তাব।”
”তারপর?”
”তারপর কানাই কাজ করতে লাগল। এমনিতে খাটিয়ে ছেলে, ঘাড়ে করে ব্যাটারি বওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করত। কিন্তু একটু ক্যাবলা টাইপ। রোজ অন্তত তিনঘণ্টা ধরে পুজো-আচ্চা করত। আজকালকার জোয়ান ছেলে হয়ে ভাবাই যায়না। তারপর কারুর বাড়িতে ইনভার্টার সেট আপ করতে গেলেই গণ্ডগোল পাকাত। ইলেকট্রিকের কাজ করতে পারত না। হাত কাঁপত। বলতো, জন্মে অবধি ওদের গ্রামে এখনো কারেন্ট পৌঁছয়নি। তাই খুব ভয় পায়। এমনকি মোবাইলও ব্যবহার করতে পারত না। বাধ্য হয়ে ব্রিজেশ ওকে দোকানে রাখত, নিজে যেত লোকের বাড়িতে। এরকম করে চারমাস কাজ করল। তারপর একদিন ব্রিজেশ সকালে উঠে দেখে নেই। শেষ মাসের মাইনেটাও নিয়ে যায়নি। খ্যাপাটে হলে যা হয়।”
”কানাইয়ের কোন ছবি আছে? কিংবা ভোটার কার্ড জাতীয় পরিচয়পত্র?”
”আমার কাছে তো নেই। ব্রিজেশের কাছে ছিল কিনা জানিনা। তবে মনে হয় না আছে।”
রুদ্র জয়ন্তকে ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরটা আরও একবার ভালো করে সার্চ করার নির্দেশ দিয়ে এদিকে ফিরল, ”ব্রিজেশ তিওয়ারির সঙ্গে আপনাদের বাড়ির কোনো শরিক বা ত্রিবেণীর কারুর কোনো শত্রুতা ছিল?”
”তেমন তো আমি কিছু জানিনা। এই বাড়িতে আর থাকে কজন। সবই তো প্রায় বাইরে। আমিই যা ভূতের মতো পড়ে রয়েছি! বাকি সব ঘরই প্রায় ভাড়া।”
রুদ্র মন দিয়ে শুনছিল। মধুময়বাবু থামতে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, ”আপনি জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কততম বংশধর?”
”আমি দশম প্রজন্ম।” মধুময়বাবু বললেন, ”ওই যে দেখছেন ঠাকুরদালান, ওখানে এখনো দুর্গাপুজো হয়। শুরু করেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নিজে।”
”তাহলে তো অনেক পুরনো পুজো।”
”তিনশো বছর পুরেছে। শুনেছি, স্যার ওয়ারেন হেস্টিংস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্সও এসেছিলেন এই দুর্গাপুজো দেখতে।”
”হুম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।” রুদ্র আর বাক্যবয় না করে নিহত ব্রিজেশ তিওয়ারির ঘরে ঢুকল। ঘরে টিভি, টেবিল-চেয়ার, আলমারি, মোটামুটি সবই রয়েছে। ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে রাতের এঁটো থালা-বাটি। চারদিক দেখতে দেখতে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”ব্রিজেশ তিওয়ারির মোবাইলটা পেয়েছেন?”
”হ্যাঁ ম্যাডাম।” ওসি বললেন, ”ওটা সিজ করে নিয়েছি।”
”গুড। গতকাল রাতে কার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে, সারাদিন কতক্ষণ কার সঙ্গে কথা হয়েছে, সব ট্র্যাক করুন। কানাইয়ের আইডিটা খুঁজুন।” রুদ্র বিড়বিড় করল, ”রাতের খাওয়ার পর ব্রিজেশ তিওয়ারিকে দোকানে যেতে হল কেন? কেউ কি তাকে ডেকেছিল?”
৭
গুরুদেব বললেন, ”মহাপুরুষের জন্ম যখন সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে, তখন কোনোভাবেই তা আটকানো যায় না। এই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে খাটে পরম গুরুর ক্ষেত্রে। কীভাবে তা বলি। ত্রিবেণীর পণ্ডিত রুদ্রদেব তর্কবাগীশ পাণ্ডিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করলেও মধ্যবয়সে অকস্মাৎ স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। তখন নিত্যানন্দপুরের অদ্বিতীয় জ্যোতিষাচার্য চন্দ্রশেখর বাচস্পতি বসবাস করতেন ত্রিবেণীরই পূর্বপল্লীর বান্দাপাড়ায়। সেখানেই তাঁর চতুষ্পাঠী। রুদ্রদেব তর্কবাগীশ তাঁকে গিয়ে বললেন, সংসারে থেকে অনেক কষ্ট পেলাম, শোকে আকুল হলাম, বংশও লোপ পেল। অধ্যাপনায় আর মনঃসংযোগ করতে পারছি না। কাশীধামে গিয়ে শেষ জীবনটা কাটাতে চাই বাবা বিশ্বনাথের চরণে। আপনি কি বলতে পারেন, আমার অদৃষ্টে শীঘ্রই কাশীযোগ আছে কিনা? নাকি সেখানেও বাধা?”
চন্দ্রশেখর বাচস্পতি দীর্ঘক্ষণ হস্তগণনা করে বললেন, ”কাশীবাস কী, পণ্ডিতমশাই! আপনার ভাগ্যে যে দিগ্বিজয়ী পুত্রলাভ রয়েছে! সেই পুত্র শুধু দেশজোড়া যশ ও প্রতিপত্তির অধিকারীই হবে না, আপনার বংশ দীর্ঘকাল ধরে বহমান হবে।”
গোটা নারায়ণী চতুষ্পাঠীতে সূচিভেদ্য নিস্তব্ধতা। সকলে স্তব্ধ হয়ে শুনছে গুরুদেবের কথা। অদূরে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে গুরুদেবের ঘোড়া। আরও দূর দিয়ে চার-পাঁচজন কৃষক গরু নিয়ে চলেছে শস্যক্ষেতের দিকে। আকাশে দেখা যাচ্ছে এক ঝাঁক পাখি যারা কোনও সীমানা মানে না।
”রুদ্রদেব তর্কবাগীশ এই কথা শুনে বললেন, ”আমার মনে হয়, আপনার তীর্থযাত্রার সময়কাল উপস্থিত হয়েছে জ্যোতিষাচার্য! আপনি নাকি মুর্শিদাবাদে নবাবের নির্ভুল ভাগ্যগণনা করেছিলেন? তা সে-ও কি প্রতারণা করেই? আমার বয়স তেষট্টি বছর। আর আপনি বলছেন, আমি ভবিষ্যতে আবার পুত্রবান হব? রঙ্গরসিকতার একটা মাত্রা থাকা উচিত।”
”ক্রুদ্ধ হয়ে রুদ্রদেব চলে এলেন বটে, কিন্তু হলও তাই। নিকটস্থ গ্রাম রঘুনাথপুর নিবাসী ব্রাহ্মণ বাসুদেব বাচস্পতির কনিষ্ঠা কন্যাটি দশমবর্ষীয়া হয়ে গেলেও উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই বৈবাহিক প্রস্তাবই হঠাৎ এল রুদ্রদেবের কাছে। অকালবৈধব্যের আশঙ্কায় কন্যার মা অমত করলেও তা গ্রহণীয় হল না, রুদ্রদেবের সঙ্গে বিবাহ হল বাসুদেব কন্যা অম্বিকার।”
একটানা বলে গুরুদেব কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। তারপর উজ্জ্বল মুখে বললেন, ”তার একবছর পরেই আশ্বিনের মহাপঞ্চমীতে ভূমিষ্ঠ হল এক অসাধারণ শিশু। ইংরেজি সাল ১৬৯৫। আপ্লুত রুদ্রদেব তাঁর নাম রাখলেন রামরাম। কিন্তু আবার বিধির বিধান। অম্বিকার পিতা বাসুদেব ব্রহ্মচারী তখন সদ্য ফিরেছেন শ্রীক্ষেত্র পুরী থেকে। তাঁর অনুরোধে নাম পরিবর্তন হল। নতুন নাম হল জগন্নাথ। অর্থাৎ কিনা কৃষ্ণ। এ দৈবলীলা ছাড়া আর কী?”
গুরুদেবের গল্প বলায় আচমকা ছেদ পড়ল। তিনি তাকিয়ে দেখলেন, অচ্যুত উঠে দাঁড়িয়েছে।
”কী ব্যাপার, বাবা? তুমি কিছু বলতে চাও?”
”হ্যাঁ, গুরুদেব।” অচ্যুত বলল, ”আমরা জানি, কলিযুগে স্বর্ণকাল হল অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা।”
”ঠিক। পরম গুরুর আবির্ভাবের পুণ্যে সেইসময় উৎকর্ষতা শীর্ষে পৌঁছেছিল।” গুরুদেব প্রশান্ত মুখে মাথা দোলালেন।
অচ্যুত বলল, ”কিন্তু ত্রেতা যুগের রামায়ণে বা দ্বাপর যুগের মহাভারতে তো এমন অসমবিবাহের উল্লেখ ছিল না গুরুদেব।”
”অসমবিবাহ মানে?” ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন গুরুদেব, ”তুমি কী বলতে চাইছ?”
”চৌষট্টি বছরের প্রৌঢ় বিবাহ করছেন দশ বছরের বালিকাকে। কিন্তু, ত্রেতা বা দ্বাপর যুগে তো গৌরীদান ছিল না। পরিণত বয়সে স্বয়ম্বরা হয়ে পাত্রনির্বাচনের স্বাধীনতা নারীদের ছিল। তবে কলিযুগের স্বর্ণকালে এই অধঃপতন কেন?” অচ্যুত ব্যাখ্যা করল।
”অধঃপতন? তোমার দুঃসাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি।” গুরুদেবের মুখ রক্তাভ হয়ে উঠল, ”গৌরীদান শাস্ত্রসিদ্ধ। তাকে অধঃপতন বলার অর্থ তুমি শুধু বৈদিক শাস্ত্রকে নয়, আমাদের সমগ্র বৈদিক সমাজকে তুমি অপমান করছ!”
দ্বারিকা সভয়ে হাত ধরে টেনে নামাতে যাচ্ছিল, কিন্তু অচ্যুত গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ”কিন্তু গুরুদেব, প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যেও তো পরিণত বয়সে মেয়েদের বিবাহের কথা পাওয়া যায়। পাওয়া যায় তাদের বিদ্যাশিক্ষার কথাও। এমনকি সহমরণের …।”
”চুপ করো, অর্বাচীন! গত সপ্তাহেও তোমার আচরণে আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম। তোমার স্পর্ধা দেখছি দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই মধুসূদন আমাকে একাধিকবার তোমার নানা নিয়মলঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে।” গুরুদেব থরথর করে কাঁপছেন। তাঁর দুই চোখ লাল হয়ে গিয়েছে, তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, ”তোমার এই প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যের শাস্তি আজ তোমায় পেতে হবে!”
কয়েক মুহূর্ত কাটল।
তারপরই দ্বারিকা আড়ষ্ট হয়ে দেখল, চাতালের বাইরে উপস্থিত হয়েছে কালু কৈবর্ত আর তার দুই সাঙ্গোপাঙ্গ। নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গ, হাঁটু পর্যন্ত মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, মাথায় লাল ফেটি। হাতে বর্শা।
ওরা সাধারণত এদিকে আসে না। রন্ধনশালার বাইরে এসে গোলাপদীঘি থেকে জাল ফেলে তোলা মাছ ফেলে দেয়। কখনো রুই-কাতলা, কখনো আবার মৌরলা, সরপুঁটি, চাঁদা।
পাচকরা সেই মাছ কৈবর্তদের স্পর্শ বাঁচিয়ে নিয়ে নেয়। পরিবর্তে দেয় জমির কপিটা-মুলোটা, কিংবা তিনদিনের চালের খোরাক। বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য সেরে খুশিমনে আবার চলে যায় ওরা পল্লির দিকে। পল্লিতেও উপুড় করে দেয় মাছের পসরা। বাড়ির বউরা আধহাত ঘোমটা টেনে কেনে সেই মাছ, বিনিময়ে দেয় ক্ষেতের চাল, সবজি কিংবা গোয়াল থেকে দুইয়ে আনা দুধ।
কিন্তু কালু কৈবর্ত যেদিন তার সীমানা ছাড়িয়ে এসে উপস্থিত হয় পূজামণ্ডপে কিংবা ভদ্রপল্লিতে, তার অর্থ ভয়ংকর। এই গোটা সমাজে গুরুদেবকে অসম্মান করা বা রীতিনীতি অমান্য করার শাস্তি হিসেবে কৈবর্তরা জানে অমানুষিক নির্মম কিছু দণ্ড।
দ্বারিকা ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছিল। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল ব্রজেন্দ্রদাদার কথা। বেশিদিন নয়, কয়েক মাস আগের ঘটনা। ব্রজেন্দ্রদাদার সেই দুঃসাহসের কথা কেউই ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি তার সেই চরম শাস্তির কথাও। অরণ্যের পাশেই যে কালোপুকুর, তার একেবারে মাঝখানে, যেখানে থই পাওয়া যায় না জলের, সেখানেই বেঁধে রাখা হয়েছিল ওকে। শুধু মুখটুকু জলের বাইরে ছিল, ঠোঁটের ভেতর ছিল ন্যাকড়া গোঁজা। টানা নয়দিন ওভাবেই অর্ধেক জলে অর্ধেক বাতাসে ভেসে ছিল সে। সম্পূর্ণ নিরন্ন ও নিরম্বু হয়ে।
গোটা সমাজ কাজে যেতে আসতে বিস্ফারিত চোখে দেখত ন্যাকড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসা তার গোঙানির অমানুষিক আর্তনাদ। এও গুরুদেবের নির্দেশ। মানুষের মনে ভয় জিইয়ে রাখার জন্য।
ধীরে ধীরে চেতনাশূন্য হয়ে গিয়েছিল ব্রজেন্দ্রদাদা। শেষের দু’দিন আর কেউ শুনতে পায়নি তার গোঙানি। দশ দিনের দিন নিঃস্পন্দ কেশহীন মাথাটা একদিকে হেলে জলের ওপর ভাসছিল তিরতির করে।
ব্রজেন্দ্রদাদা গুরুতর অপরাধ করেছিল। লঙ্ঘন করেছিল সমাজের নিয়ম। কিন্তু অচ্যুত তো শুধু প্রশ্ন করেছে। তার শাস্তিও কি অতটাই ভয়ানক হবে? ভাবতে ভাবতে দ্বারিকা হিমচোখে দেখল, অচ্যুতের কোনো হেলদোল নেই।
সকলের ভয়ার্ত চাহনির সামনে দিয়ে অচ্যুত দিব্যি চলে গেল কৈবর্তদের সঙ্গে। একবারও পিছু ফিরে দেখল না।
গুরুদেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর একঝলক তাকিয়ে বললেন, ”এটা বৈদিক সম্প্রদায়। আমাদের লক্ষ্য ঐতিহ্যের পথে হেঁটে এক পবিত্র পৃথিবী নির্মাণ। সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকতে প্রয়োজন কঠোর তপস্যার। প্রখর সাধনার। নিরন্তর সংযমের। এখানে অতিরিক্ত কৌতূহল মানে মহাপাপ। এখানে নিয়ম লঙ্ঘন মানে কঠিন শাস্তি।”
কথা শেষ করে তিনি একটু থামলেন তারপর বললেন, ”উপনিষদের সেই বাণী স্মরণ করো।
সহ না ববতু
সহ নৌ ভুনক্তু।
আমরা মিলেমিশে খাব। আমরা একসঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠব। আমরা পরস্পরকে বিদ্বেষ করব না। তাই যে বা যারা আমাদের পবিত্র বৈদিক সমাজে ভাঙন ধরাতে চায়, তাদের একটাই শাস্তি। মৃত্যু।”
কথাটা শেষ করে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। নেমে চলে গেলেন দণ্ডায়মান দেবদত্তর দিকে। দৃপ্তভঙ্গিতে উড্ডীন হলেন অশ্বপৃষ্ঠে, তারপর দ্রুতগতিতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন গ্রামের ভেতরের দিকে।
দ্বারিকা এবং অন্য ছাত্ররা চাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এল। সবাই হাঁটা দিল নিজেদের ঘরের দিকে। সবাই নির্বাক থাকলেও ভয়ে স্তব্ধ। গুরুদেবের ক্রোধ যে অতি সাংঘাতিক, তা কারুর অজানা নয়।
দ্বারিকার বাড়ি পূজামণ্ডপের চাতাল থেকে যেতে লাগে অর্ধেক দণ্ড। প্রধান মন্দিরের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে হয়। পথে পড়ে শস্যক্ষেত, কীর্তনমঞ্চ এবং বিষ্ণুমন্দির। সেই মন্দিরে প্রত্যহ পুজোর সময় জমায়েত হয় তামাম বৈদিক সমাজ।
কোনটা ব্রাহ্মণপাড়া, কোনটা কায়স্থপাড়া, কোনটা আবার নবশায়কপাড়া। নবশায়ক অর্থে নয়টি সম্প্রদায়। তিলি, মালাকার, তাঁতি, সদগোপ, নাপিত, বারুই, কামার, কুম্ভকার ও ময়রা।
আরো দক্ষিণে গেলে শুরু হয়ে যাচ্ছে অরণ্য।
গ্রামের একেবারে উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে কৈবর্ত ও বাগদিদের পাড়া। তারা অচ্ছুৎ, তাই এই ব্যবস্থা। তাদের পাড়ার পাশেই বৈদিক সমাজের শ্মশান।
মৃৎকুটিরগুলোর একটু আগে রয়েছে গোলাপদিঘি। গোটা সমাজের জলের প্রয়োজন মেটানো হয় এই দীঘি থেকেই। সমাজের সব মেয়ে বউরা ভোর হতে না হতেই কলসি কাঁখে বেরিয়ে পড়ে গোলাপদিঘির দিকে।
সমাজের দণ্ডমুণ্ড গুরুদেব স্বয়ং ছাড়াও সমাজপতি আছেন দুইজন। একজন কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ী, অন্যজন গোপাল ব্যানার্জি। তাঁরা গুরুদেবের মতো পরিযায়ী নন, সমাজেই থাকেন। গুরুদেবের অবর্তমানে তাঁরাই চালান সমাজকে। কোনো বাড়ির মেয়ের দশ পুরলেও বিবাহ হয়নি, কার বাড়ির সন্ধ্যাপ্রদীপ ঠিকসময়ে প্রজ্জ্বলিত হয়নি, কোনো বাড়ির বিধবা উঁচু স্বরে কথা বলছে, এই সব বিষয়ে তাঁদের কড়া নজর। স্বয়ং গুরুদেবও তাঁদের মতামতকে বেশ গুরুত্ব দেন। গোটা সমাজে কোনো লেনদেনের মুদ্রা নেই। পুরোটাই চলে বিনিময় প্রথায়।
সকলকে মেনে চলতে হয় কঠিন অনুশাসন। গোটা সমাজে মোট চল্লিশটি ব্রাহ্মণ পরিবার। সেই চল্লিশটি পরিবারকে কুড়ি কুড়ি করে দুইভাবে বিভক্ত করা আছে। এক ভাগের মাথা কৃষ্ণকান্ত, অন্যভাগের হর্তাকর্তা গোপাল ব্যানার্জি। বিবাহাদি সম্পন্ন হয় এক ভাগের সঙ্গে অন্য ভাগের।
এইরকমভাবেই দুই ভাগে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কায়স্থ, নবশায়ক, তিলিদের মধ্যে।
অসবর্ণ প্রথার কোন স্বীকৃতি নেই। নেই অবকাশও। বৈদিক সমাজে তা চরমতম অপরাধ।
অচ্যুতের বাবা-মা নেই। ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছে। ও থাকে ব্রাহ্মণ পল্লিরই এক দুঃসম্পর্কের কাকার পরিবারে। অনাথ বলেই বোধ হয় অচ্যুত কেমন একটু ছন্নছাড়া। এত মেধাবী, অথচ এত অবাধ্য, চঞ্চল। দ্বারিকা সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়েও অচ্যুতের চিন্তাভাবনার কোনো তল পায় না।
দ্বারিকা বাড়ি পৌঁছে দেখল ওর মা উনুনে ভাত চাপিয়েছেন। এই কুঁড়েঘরে মা আর দাদা’র সঙ্গে থাকে ও। ওদের বাবা থাকেন কিছুদূরে। সেখানে কিশোরী স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর নতুন সংসার।
”দাদা কোথায়, মা?”
মা বললেন, ”পুতুর বিয়ে কাল, সেই জোগাড় করতে গিয়েছে।”
পুতুর বিয়ে? দ্বারিকা হাঁ হয়ে গেল। পুতু ওর পাড়াতুতো বোন। সবে আট পেরিয়ে নয়ে পড়েছে। পুতুর বাবা পশুপতিজ্যাঠার দশটা গরু আছে। সেই গরুর দুধ থেকেই সংসার চলে।
আর কিছুদিন পরেই মহোৎসব, পুতু সেইসময় কত আনন্দ করে!
ও বলল, ”কার সঙ্গে বিয়ে?”
”বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের সঙ্গে।”
”মানে?” দ্বারিকার হাঁ মুখ বন্ধ হল না, ”গোপাল ব্যানার্জি?”
”হ্যাঁ।”
”কী বলছ তুমি, মা!” দ্বারিকা বলল, ”উনি তো এই ক’মাস আগে তৃতীয় পক্ষ করলেন!”
”তো কি!” মা বললেন, ”সোনার আংটি আবার বেঁকা! পুতুর বাপের কত দেনা জানিস বাঁড়ুজ্জেমশাইয়ের কাছে? অন্তত পঞ্চাশ সের দুধ বকেয়া আছে। গুরুদেব তাই আদেশ করেছেন পুতুকে বিয়ে দিতে।”
”কিন্তু, বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের বয়স ষাট পুরেছে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে?”
মা চুপ করে যান। কিছুক্ষণ পর বলেন, ”সে’সব হলে পুতুর মন্দকপাল। অন্তত একমাথা সিঁদুর নিয়ে শ্মশানযাত্রা তো করতে পারবে! বাপ-মা’কেও গালমন্দ খেতে হবেনা।”
দ্বারিকা চমকে উঠল। ওর মনে পড়ে গেল সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা। বাচ্চা মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিতার দিকে। সেই চিতায় শয়ান সেই মেয়েটির বৃদ্ধ পতি যদুহরি ঘোষাল। যদুহরি ঘোষাল নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর পাঁচটি পত্নীর মধ্যে যেন কনিষ্ঠাটি অবশ্যই সহমৃতা হয়।
চারদিকে তারস্বরে বাজছে কাঁসরঘণ্টা, ঢাকঢোল। আগুনের লেলিহান শিখা এসে গ্রাস করার আগেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দূরে ব্রজেন্দ্রদাদা পালাচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে! সঙ্গে রয়েছে মেয়েটার মা’ও। নিজের একমাত্র সন্তানটিকে বাঁচাতে সেই মা’ও বদ্ধপরিকর।
গ্রামের মেয়েবউরা স্তম্ভিত। অজানা অভিশাপের ভয়ে থরোথরো। কোনো মা এমন সৃষ্টিছাড়া কাজ করতে পারে? মেয়ে সতী হলে যে কত পুণ্য, তা কি তার জানা নেই?
এই সবের মধ্যেই সবাই লাঠিসোঁটা নিয়ে উন্মত্ত পশুর মতো ছুটছে তার পেছনে। এমনকি অনাচারের ভয়ে মেয়েকে আটকাতে ছুটছে মেয়েটির বাবাও। মেয়ে আর মা অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেও একজনের লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়ছে ব্রজেন্দ্রদাদা। তারপর সবাই মিলে নির্মম পেটাচ্ছে তাকে। তারপর আধমরা করে নিয়ে আসা হচ্ছে কালোপুকুরে।
উফ! দ্বারিকা চোখ বুজে ফেলল। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, কে বলেছে অষ্টাদশ শতক সেরা সময়কাল? হোক পরমগুরুর আবির্ভাব! এইসব কুপ্রথা যে সময়ে থাকে, তাকে কি স্বর্ণকাল বলা যায়? অচ্যুতের প্রশ্ন কি খুব অযৌক্তিক? বাইরের পৃথিবী কি সত্যিই এরে চেয়েও ভয়ংকর?
কী যেন নাম ছিল সেই মেয়েটার? পুতুরই বয়সি হবে।
হ্যাঁ। মনে পড়েছে ওর।
ক্ষমা।
৮
প্রিয়ম লাইব্রেরি রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। ডান হাতে একটা বাটি, তাতে টক ঝাল আচার। অন্য হাতে বই। প্রিয়মের কল্যাণীর বাড়ির বিশাল বইভাণ্ডার সে এই বাংলোয় আসার পরই তুলে নিয়ে এসেছে। ছুটির দিনটা তার এই লাইব্রেরি রুমেই কাটে।
প্রিয়ম এক টুকরো আচার মুখে দিয়ে বলল, ”একি! জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের নাম শুনব না? ত্রিবেণীর দেশবিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন!”
রুদ্র একটু অপ্রতিভ হল। ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়ে ওর চেয়ে প্রিয়মের জ্ঞানের প্রসার বেশি, এটা ও ধারণা করতে পারেনি।
ত্রিবেণী থেকে ফিরে উর্দি ছেড়ে স্নান করে ও ফ্রেশ হয়েছে। প্রিয়ম আজ বাড়ি থেকে কাজ করছে। তাই আজ অনেকদিন পর দুজনে দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে পেরেছে। ও বলল, ”উনি নাকি একশো বারো বছর বেঁচেছিলেন!”
”হ্যাঁ। জানি তো।” প্রিয়ম বলল, ”ইলেভেন টুয়েলভে কল্যাণী থেকে গঙ্গা পেরিয়ে ত্রিবেণীতে জয়েন্টের জন্য ফিজিক্স পড়তে যেতাম, ওই তর্কপঞ্চাননের দৈত্যের মতো বাড়িটার পাশেই। মধ্যযুগের সেরা বাঙালি। গোটা অষ্টাদশ শতকটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণের দাপটে মানুষ এখন ওঁকে একেবারে ভুলে গিয়েছে, এই যা দুঃখের!”
”কী জানো তুমি ওর সম্পর্কে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ”না মানে একজন বিদ্বান পণ্ডিত ছাড়া ওঁর আর কোনো পরিচয় ছিল কি?”
প্রিয়ম বলল, ”অনেক রকম পরিচয় ছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ছিলেন অসম্ভব শ্রুতিধর। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে উনি ত্রিবেণীতে টোল খুলে বসেছিলেন। একটা ঘটনা শুনেছিলাম। একবার তিনি বর্ধমানের মহারাজা ত্রিলোকচন্দ্রের আমন্ত্রণে বর্ধমান গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক পণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে হারানোর পর রাজা বললেন, তর্কপঞ্চাননমহাশয়, ত্রিবেণী থেকে বর্ধমান আসার পথে কী কী দেখেছেন?
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, ”সংক্ষেপে বলব না বিস্তৃত বলব?”
”রাজা বিস্তারিত বলার অনুরোধ করতে তিনি নাকি পরের কয়েকঘণ্টা ধরে গোটা যাত্রাপথের প্রতিটি বাড়ি, বাগান, পুকুর, মন্দির, সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন। রাজা পরে খোঁজ নিয়ে দেখেন, প্রতিটি তথ্য সত্যি।”
”এমনও হয়!” অস্ফুটে বলল রুদ্র, ”আসার সময় জয়ন্তও এইরকমই একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা বলল। একদিন নাকি জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন স্নান করতে। সেইসময় দুজন ইংরেজ একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছে। পরে দুজনের মধ্যে সেই হাতাহাতি আদালত অবধি গড়ালে খবর পাওয়া গেল, সেইসময় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ঘাটে উপস্থিত ছিলেন। কোর্টে ওঁকে সাক্ষ্য দিতে ডেকে পাঠালে তিনি গিয়ে বললেন, দেখুন, আমি ইংরেজি জানিনা। তাই কী নিয়ে ঝগড়া আমি বলতে পারব না। তবে, তারা কী বলেছিল, আমি বলতে পারি। এই বলে উনি একঘণ্টা ধরে গোটা ইংরেজি কথোপকথনটি নাকি বলে গিয়েছিলেন!”
”রাইট!” প্রিয়ম বলল, ”এটাও জানতাম। তোমার কাছে শুনে মনে পড়ল। আসলে তোমরা এদিককার লোক নও তাই জানোনা, এগুলো ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়ার সবাই জানে। আর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ছিলেন আইনের দুঁদে লোক। তখন ইংরেজরা সবে ভারতে এসেছে, এখানকার ভাষাও জানেনা, এখানকার রীতিনীতি সবকিছুই অজানা। তাই তারা পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। নবকৃষ্ণ দেব বা নকু ধরের মতো কিছু সুযোগসন্ধানী দেশীয় লোকদের হাত করে তখন তারা দেশ শাসন করছে। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী দেশীয় বিচারপদ্ধতি আর আইন প্রণয়নের একটা প্রামাণ্য বই তখন তাদের খুব দরকার ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে সেই বই লিখেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। নামটা যেন কী ভুলে গিয়েছি।”
”বিবাদভঙ্গার্ণব।”
”ইয়েস! তখনকার সব দেওয়ানির মামলার বিচার ওই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ দিয়েই করা হত। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন দেশীয়মহলে তো বটেই, ইংরেজ মহলেও খুব প্রভাবশালী ছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ তাঁর কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন। হেস্টিংস, হার্ডিঞ্জের মতো বড়কর্তারা তাঁর কাছ থেকে আইনি বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। উইলিয়াম জোন্সও আসতেন। এমনকি পরে যখন নবকৃষ্ণ খেতাব পেয়ে রাজা হলেন, তাঁর রাজসভাতেও জগন্নাথ পণ্ডিতের উচ্চ আসন ছিল। আর এই নবকৃষ্ণদেবই কিন্তু পলাশির যুদ্ধে সিরাজকে হারাতে ইংরাজদের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, জানো! নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িই হল আজকের শোভাবাজার রাজবাড়ি।”
রুদ্র বলল, ”বাবা! তুমি তো অনেক কিছু জানো দেখছি!”
”জানব না?” প্রিয়ম বলল, ”ত্রিবেণীর ওই জগন্নাথ পণ্ডিতের বাড়ির একজন বংশধর আমার সঙ্গে ওই টিউশনে পড়ত যে! শুভাশিস ভট্টাচার্য। আমার চেয়ে কিছুটা বড়, আমি যখন ইলেভেন, শুভাশিসদা তখন ফিজিক্সে এম এসসি করছে, ফাইনাল ইয়ার। স্যারের কাছে একটা স্পেশাল পেপার পড়তে আসত। এখন আমেরিকায় থাকে। এখনো যোগাযোগ আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছবি-টবি দেখি। মাঝেমধ্যে কথাও হয়। তখন ওর সঙ্গে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাবা ছিলেন খুব গরিব, কিন্তু জগন্নাথ নিজে প্রচুর ধনসম্পদ করেছিলেন। ওঁর বাড়ির একতলাটায় একটা ছোটখাটো কোর্টের কাছারি ছিল, যেখানে উনি স্থানীয় লোকদের মোকদ্দমার বিচার করতেন। একেবারে জীবন্ত কিংবদন্তী যাকে বলে!”
”হুম। সেই লিভিং লিজেন্ডের বাড়িতেই কিনা এমন একটা খুন হল?” রুদ্র বিড়বিড় করল, ”খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। মোট ছ’টা খুন। প্রতিটাই কোনো না কোনো বুধবারে। প্রতিটাই কোনো না কোনো ব্যবসায়ীকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু, কী সেই যোগসূত্র?”
জ্যোৎস্নাদি ঢুকল ঘরে, ”রাতে কী খাবেন দাদাবাবু? চিকেন আছে, করে দেব?”
প্রিয়ম তন্ময় হয়ে শুনছিল রুদ্রর কথা। হঠাৎ এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ”আহ, এই তো দুপুরে খেয়ে উঠলাম। এখনই রাতের খাওয়া কেন জ্যোৎস্নাদি? খাওয়ার চিন্তা ছাড়া দুনিয়ায় আরও কিছু আছে তো নাকি।”
জ্যোৎস্নাদি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”না, আজ গানা খাজানার ফাইনাল। সন্ধে থেকে দেখব তো, তাই ভাবছিলাম এখনই যদি রান্নাটা সেরে রাখি।”
প্রিয়ম বলল, ”ঠিক আছে, তুমি না করতে পারো, মল্লিকাদি করবে। অসুবিধা কী আছে! মল্লিকাদি তো টিভি ফিভি দেখেনা।”
জ্যোৎস্নাদি সঙ্গে সঙ্গে মুখ বেঁকাল, ”ভালো লোককে করতে বলছেন দাদাবাবু। তার তো রোজই কিছু না কিছু লেগেই রয়েছে। আজ কী না কী ষষ্ঠী, উনি পিঁয়াজ রসুন ছোঁবেন না। রান্নাটা হবে কী করে শুনি?”
”আজ ষষ্ঠী?” প্রিয়ম বলল।
”হ্যাঁ।” জ্যোৎস্নাদি ঘরের এক দেওয়ালে অবহেলায় ঝুলতে থাকা বাংলা ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে বলল, ”ওই দেখুন না। আমরা বাপু চৈত্রমাসের অশোক ষষ্ঠী বুঝি, ভাদ্দর মাসের চাপড়া ষষ্ঠী বুঝি, চৈত্রমাসে নীল ষষ্ঠী বুঝি। প্রত্যেক মাসে দু’বার করে এমন ষষ্ঠী করতে কাউকে দেখিনি!”
রুদ্র কী যেন চিন্তা করছিল। বলল, ”গানা খাজানা? পরশুদিন বললে সেমিফাইনাল ছিল? তাহলে গতকালই তো ফাইনাল হয়ে যাওয়ার কথা!”
”গতকাল তো বুধবার ছিল দিদিমণি।” জ্যোৎস্নাদি লম্বা বিনুনি দুলিয়ে বলল, ”বুধবার দিন তো গানা খাজানা হয় না।”
”আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু পরে বলছি। এখন তুমি যাও।” প্রিয়মের ধমকে জ্যোৎস্নাদি চলে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছু ডাকল রুদ্র, ”তুমি শিওর জ্যোৎস্নাদি, বুধবার গানা খাজানা হয় না?”
”ওমা, একবচ্ছর ধরে দেখে আসছি, আর জানব না? সোম থেকে রবি হয়, শুধু ওই বুধবারটা বাদ দিয়ে।”
রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফোন করল ত্রিবেণীর ওসি সুকেশ সান্যালকে, ”হ্যাঁ শুনুন। ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির যে কর্মচারী ছেলেটি, কী যেন নাম, হ্যাঁ, অলোক, ওকে ভালো করে জেরা করুন। ছেলেটা ফলস স্টেটমেন্ট দিয়েছে। ও সকালে আমাদের বলেছে, গতকাল রাত এগারোটা নাগাদ ও আর ব্রিজেশ তিওয়ারি একসঙ্গে গানা খাজানা দেখছিল। অথচ কাল ছিল বুধবার, ওই প্রোগ্রামটা হয়ই না। আপনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিপোর্ট করুন।”
ফোনটা রেখে রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকাল। বলল, ”জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের তার মানে আসল পদবি ছিল ভট্টাচার্য?”
”হ্যাঁ। তর্কপঞ্চানন উপাধি পেয়েছিলেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের হারিয়ে টোল খুলেছিলেন। কলকাতায় যখন প্রথম সুপ্রিম কোর্ট খোলা হয়েছিল, প্রধান জজ পণ্ডিতের পোস্ট অফার করা হয়েছিল ওঁকেই। কিন্তু উনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, ওঁরই নাতি ঘনশ্যাম বাচস্পতি তখন প্রথম জজপণ্ডিত হন। মজার কথা হল, ওঁর নাতি নাকি ওঁর চেয়েও বেশি প্রতিভাধর ছিলেন। কিন্তু মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সেই সেই নাতি উন্মাদ হয়ে যান।” প্রিয়ম বলল, ”তখন শুভাশিসদার কাছে গল্প শুনতাম এইসব। বেশ লাগত। এসব তো আমাদের পাঠ্য ইতিহাসে ছিল না। ত্রিবেণীর প্রথম দুর্গাপুজোও শুরু করেছিলেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। এখনো গঙ্গার ঘাটে ওঁর একটা মূর্তি আছে।”
রুদ্র কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে পাঁচু এসে সেলাম করল, ”ম্যাডাম, লোকেশ স্যার আর প্রিয়াঙ্কা ম্যাডাম এসেছেন। আপনার অফিসে বসতে বলেছি।”
”এখন এই অসময়ে?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকল।
৯
অলোক ছেলেটা ভিতু ধরনের। দুটো রুলের বাড়ি খেয়েই ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে সব বলে দিল।
”বিশ্বাস করুন স্যার, মরা বাপ-মায়ের দিব্যি খেয়ে বলছি, আমি কিছু করিনি। হ্যাঁ, সেদিন রাতে খাওয়ার সময় ব্রিজেশদা’র সঙ্গে আমার একটু ঝামেলা হয়েছিল। ব্রিজেশদা দোকানের হিসেবের খাতায় কিছু গরমিল পাচ্ছিল ক’দিন ধরে। আমাকে সন্দেহ করছিল। মুখে কিছু না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছিল। সেদিন রাতে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। দুজনেই মাথা গরম করে ফেলি। ব্রিজেশদা ওই রাতেই আমাকে দোকানঘরে নিয়ে যায়, খাতা খুলে গরমিল দেখানোর জন্য।”
”তারপর? কত টাকা চুরি করেছিলি তুই?”
”স্যার, আমি গরিব হতে পারি। চোর নই। ব্রিজেশদা একটা কোম্পানির অর্ডারের পেমেন্টে কিছু ভুল করছিল। আমি সকাল হলে বোঝাব বলে চলে আসি ঘরে। ব্রিজেশদা তখন দোকানঘরে রয়ে যায়। তখন রাত সোয়া এগারোটা হবে। বিশ্বাস করুন স্যার! এর বেশি আমি কিছু জানিনা। ব্রিজেশদা আমার মালিক, আমাকে থাকা খাওয়া সব দিয়েছে। আমি তাকে কেন খুন করতে যাব?”
”তবে প্রথমে মিথ্যে বললি কেন?”
অলোক মাথা নীচু করে বলল, ”ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম স্যার। আমি ব্রিজেশদা’র সঙ্গে দোকানে গিয়েছিলাম জেনে যদি আপনারা আমাকেই খুনি ভাবেন।”
রুদ্র টেলিফোনে পুরো কথোপকথনটা শুনছিল। বলল, ”ফরেনসিকের রিপোর্ট কি এসেছে?”
”হ্যাঁ ম্যাডাম। অলোকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে দোকানে।”
রুদ্র বলল, ”অলোক দোকানে কাজ করত। ওর ফিঙ্গার প্রিন্ট তো পাওয়া যাবেই। কোথায় কোথায় ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে?”
”খাতায়, দরজার হাতলে, বডির আঙুলে। কিন্তু ইনভার্টারে বা ব্যাটারিতে নেই ম্যাডাম। অলোক আর ব্রিজেশ তিওয়ারি ছাড়া আরও কিছু অন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে।” সুকেশ সান্যাল হাঁপাতে হাঁপাতে ফোনে বললেন।
”হুম। অলোককে আপাতত অ্যারেস্ট করুন। তারপর দেখছি। ত্রিবেণীতে জানুয়ারি মাসে যে আরেকটা খুন হয়েছিল, সেটাও কী আপনিই দেখছেন?”
”হ্যাঁ ম্যাডাম। ওই সাইবার ক্যাফের শিবনাথ বিশ্বাস তো?” সুকেশ সান্যাল বললেন, ”ওটা তো সিম্পল কেস।”
”কী রকম?”
”বউ আর বউয়ের প্রেমিক খুন করেছে। নেহাত অ্যালিবাইটা স্ট্রং বলে একটু দেরি হচ্ছে। আমরা সবদিক দেখে এগোচ্ছি।”
* * *
প্রিয়াঙ্কা উত্তেজনায় ফুটছিল। এ এস পি ম্যাডামকে ঘরে ঢুকতে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকে বলল, ”ম্যাম, কয়েকটা ইন্টারেস্টিং অবজারভেশন আছে।”
”কী?”
‘বৈদ্যবাটীর সুনীল ধাড়ার দোকানের কর্মচারীকে ইন্টারোগেট করলাম। সে বলল, ঠিক ব্রিজেশেরই মতো সুনীল ধাড়ার দোকানেও বছরখানেক আগে একটা নতুন কর্মচারী ছেলে এসেছিল। কোথা থেকে তা জানে না। তবে একেবারে ক্যাবলা। নাম বলরাম। ঠিক ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির দোকানের কানাইয়ের মতো বলরামও কাউকে কিছু না বলে একদিন ভ্যানিশ হয়ে যায়।”
রুদ্র মাথা নাড়ল, ”এটা আমি প্রথম থেকেই গেস করেছিলাম। বেশিরভাগ খুনই হয়েছে ডেকে নিয়ে গিয়ে। সুনীল ধাড়া যখন খুন হয়, তখন ওর কর্মচারী দানু ছুটি নিয়েছিল। সেইসময় দোকানে ওকে কে হেল্প করত?”
”কেউ না ম্যাডাম। সুনীল ধাড়া একাই সামলাচ্ছিল। বলরাম বলে ছেলেটা এসেছিল প্রায় একবছর আগে। তখন দানু দু’মাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল কোন কাজে।” প্রিয়াঙ্কা বলল।
রুদ্র বলল, ”বলরামকে সুনীল ধাড়ার দোকানে কে কাজে ঢুকিয়েছিল?”
প্রিয়াঙ্কা এবার একটু অপ্রতিভ গলায় বলল, ”সেটা তো খোঁজ করিনি ম্যাডাম!”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”বলেছি না, কখনো অর্ধেক ইন্টারোগেশন করবে না। এতে ফ্লো কেটে যায়, কনফিউশানও বাড়ে। খোঁজ নাও, দানুর অ্যাবসেন্সে বলরামকে কে কাজে ঢুকিয়েছিল।”
লোকেশ ব্যানার্জি এতক্ষণ পর মুখ খুললেন, ”কোন্নগরের স্বপন সরকারের কেসটাও অনেকটা এইরকম। স্বপন সরকার এবার ভোটের টিকিট পেত। পলিটিক্সে ঢোকার পর থেকে তার পেছনে অনেক ফচকে ছেলে জুটেছিল। সেরকম একটা ছেলেরও কোন ট্রেস নেই দু’মাস ধরে। নাম গোবিন্দ।”
”কানাই। বলরাম। গোবিন্দ।” রুদ্র বিড়বিড় করতে লাগল, ”এদের কারুর কোনো ছবি পাওয়া যাচ্ছে না? ভেরি স্ট্রেঞ্জ! কোনো আইডি প্রূফ ছাড়া কী করে এরা কাজে ঢুকল? মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ দিনদিন কমে যাচ্ছে।”
লোকেশ ব্যানার্জি বললেন, ”গোবিন্দ স্বপন সরকারের সঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় গিয়েছিল ম্যাডাম। কোথাও থেকে কোনো ফোটোগ্রাফ বা সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায় কিনা, সেই চেষ্টা করছি।”
”চেষ্টা করলেই শুধু হবেনা মি. ব্যানার্জি, আমাদের এই কেসটা যত দ্রুত সম্ভব সলভ করতে হবে।” রুদ্র বলল, ”হায়ার অথরিটি থেকে কন্সট্যান্ট চাপ আসছে।”
ওর এবার বিরক্ত লাগছিল। ছ’খানা জলজ্যান্ত খুন। অথচ কোন ক্ল্যু পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা থেকে দূরে বলে প্রথমদিকে মিডিয়া সেভাবে মনোযোগ দেয়নি। কিন্তু স্বপন সরকারের কেসটার পর থেকে এদিকে আগ্রহ বাড়ছে। যেহেতু রুদ্র এই তদন্তকমিটির প্রধান, দিনে একটা-দুটো করে ফোন আসছেই কোনো না কোনো নিউজ পোর্টাল থেকে।
আর ঠিকমতো ধরতে গেলে এটা ওর কেরিয়ারের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। প্রথমেই এমন জটিল কেস যদি ও সলভ করতে পারে, নিঃসন্দেহে সেটা ওর কেরিয়ারে অনেকগুলো পালক যোগ করবে। কিন্তু এগোতে পারছে কই?
১০
অচ্যুতের গলা দিয়ে প্রাণপণ আওয়াজ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। নিজের বারোবছরের দেহে যতটুকু শক্তি আছে, গোটাটাকে কণ্ঠনালীর ভরকেন্দ্রে এনে চিৎকার করতে চাইছিল ও। কিন্তু ঠোঁটদুটো উন্মুক্ত করতেই ঢুকে আসছিল জল।
মড়াপোড়া কাঠের ছোট ছোট টুকরোতে ভরতি পচা জল।
সমাজের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে শ্মশান। সেই শ্মশানের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটি প্রশস্ত খাল। লোকে তাকে নদী বলেই চেনে। ওদের কাছে সেই নদীর নাম জরা। কাল কৈবর্তের দল এসে শ্মশান লাগোয়া এই জরা নদীর পাড়ে এক মানুষ পাঁকের মধ্যে অচ্যুতকে পুঁতে দিয়ে গিয়েছে। অচ্যুতের চিবুক পর্যন্ত মাটির নীচে পোঁতা। চিবুকের উপরিভাগে মাঝে মাঝেই ঢুকে আসছে শ্মশানঘাটের দাহ করা মড়ার কাঠের জল।
অচ্যুতের চোখের দুই পাশ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। সেই নোনা জল মিশে যাচ্ছিল নদীর জলের সঙ্গে। পেট থেকে ভাত ঠেলে উঠে আসছিল। ওর হাত পা, গোটা শরীর এমন শক্তভাবে পাঁকে পোঁতা রয়েছে যে চাইলেও কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াতে পারছিল না।
ও কি মরে যাচ্ছে?
কেন? কী অপরাধে এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে ওকে? যুক্তিগ্রাহ্য কোনো প্রশ্ন মনে উদয় হলে কৌতূহল নিরসন করতে চাওয়া কি অপরাধ?
অচ্যুতের মনে পড়ল, কালু কৈবর্তদের ওকে এই চরে টানতে টানতে নিয়ে আসার সময়ে নিজেদের মধ্যে বলা কথাগুলো।
”ই ছোঁড়াটো খুব বাড় বেড়েছে। রাতভর ইটিকে ফেলি রাখতি হবেক চরে। তবে খতম করলি চলব না। তেমনই হুকুম!”
অচ্যুত আবার সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করে উঠল। কিন্তু মুণ্ডু ছাড়া ওর শরীরের কোনো অংশই একচুল নড়ল না।
ও আবার কেঁদে ফেলল। গভীর রাত। নিস্তব্ধ শ্মশানের চর। ভয় ও পায় না। এমন নিশুতি রাতে ও হেলায় বনের মধ্যে কিংবা শ্মশানে ঘুরে বেরিয়েছে আগে। কিন্তু প্রচণ্ড একটা রাগ এসে ওকে এখন আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, ওকে এই সারারাত ধরে প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে রেখে সহবৎ শেখানোটাই গুরুদেবের নির্দেশ।
এখন ওর মনে হচ্ছে, জন্মানো ইস্তক ওর জীবনের গোটাটাই যেন মস্ত বড় এক প্রহসন! আজ পর্যন্ত ও জানেনা ওর বাবা-মার পরিচয়। আর এই যে বৈদিক সমাজ, পুরোটাই একটা ফাঁপা কলসী! আর এই সমাজে জন্মানোর মাশুল ওকে, দ্বারিকাকে, কিংবা বনমালির মতো ছেলেদের দিতে হয় সারাজীবন ধরে। শুধু ছেলেরাই বা কেন? ওরা তবু সামান্য হলেও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।
কিন্তু মেয়েরা?
অচ্যুতের মাঝে মাঝেই চেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। গতকাল দুপুরের সেই আহারের পর থেকে পেটে কিচ্ছু পড়েনি। তার মধ্যে চারপাশের এই ভয়ংকর গন্ধে ওর বিবমিষা জাগছিল।
ছোটবেলা থেকে কী যেন শেখানো হয় ওদের?
অচ্যুত চোখ বন্ধ করে ঘাড় একদিকে হেলিয়ে গোঙাতে গোঙাতে মনে করার চেষ্টা করছিল।
”বাইরের পৃথিবী ক্রমশই পাঁকে অধঃপতিত হচ্ছে। প্রযুক্তি আর যন্ত্র একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে মানুষদের। মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, আন্তরিকতা আজ তলানিতে। দেখনদারি, কৃত্রিমতা আর উচ্ছৃঙ্খলতায় ভরে যাচ্ছে সমাজ। স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় নিমজ্জিত আধুনিক মানুষ ভুলে যাচ্ছে যে সে একদিন সামাজিক জীব ছিল।
”পরিবর্তনকে স্বাগতম তখনই, যখন সে ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু এই পরিবর্তন ক্ষতিসাধন ছাড়া আর কী করছে? লাগামছাড়া স্বাধীনতায় মেয়েদের চরিত্র আর দেবীসম নেই, তারা প্রত্যেকে পরিণত হয়েছে অভিজাত বারাঙ্গনায়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সমাজকে দাঁড় করাচ্ছে বিপজ্জনক খাদের ধারে। সবকিছুই অতি দ্রুত, সবকিছুই অতি তাৎক্ষণিক, সবকিছুই অতি ক্ষণস্থায়ী। আর এই সবকিছুর পেছনেই প্রযুক্তির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
”তাই আমাদের বৈদিক সমাজে আমরা সময়কে এগোতে দিইনি। দেব না। সময়কে আমরা এখানে আটকে রেখেছি অষ্টাদশ শতাব্দীতে। যেখানে এখনো পবিত্রতা আছে, নির্মলতা আছে, শুচি আছে, প্রাণ আছে …!”
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় বহুবার শোনা এই কথাগুলো মনে করতে করতে আবার রাগে কেঁপে উঠল অচ্যুত। কী নির্মলতা আছে ওদের সমাজে? সারাক্ষণ ছোঁয়াছুঁয়ি, আচারবিচার। বাগদি বা নমঃশূদ্রদের ছায়া মাড়ালেই স্নান করতে হয় ব্রাহ্মণদের। বুড়ো স্বামী মারা গেলেই দশ-বারোবছরের মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় এই শ্মশানে।
আর বাইরে? বাইরে যন্ত্র থাক, প্রযুক্তি থাক, তবু তো মানুষের স্বাধীনতা আছে। নীচুজাতে জন্মেও সমানাধিকার আছে!
সংজ্ঞা হারাতে হারাতেও অচ্যুত কেমন যেন ধড়মড় করে জেগে উঠল। মাথার ওপরে নিকষ কালো আকাশ। ওদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আকাশকে বাঁধা যায়নি শৃঙ্খলার বন্ধনে। বৈদিক সমাজের পবিত্র আকাশ প্রসারিত হয়েছে আধুনিক জগতেও।
আকাশে এখন মিটমিট করছে অসংখ্য নক্ষত্র। সেগুলো দেখতে দেখতে অচ্যুতের মনে হল, এমনিতে তো শ্মশান সীমানায় আসা অসম্ভব, কড়া প্রহরা থাকে শ্মশানের বাইরে। কারণ একমাত্র শ্মশানের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে জরা নদী। নদী তো মানুষের অনুশাসন মানেনা, তাই বৈদিক সমাজ হয়ে নদী চলে গিয়েছে আধুনিক জগতের দিকে।
শুধু গুরুদেবের আজ্ঞাপালনে যাদের সেই জগতে যেতেই হবে, একটা ছোট্ট নৌকো করে তারা ভেসে যায় উত্তরদিকে। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা ঘাট। কয়েকমাস পর লক্ষ্যপূরণ করে তারা আবার ফিরে আসে। পূজামণ্ডপে তখন সাদর অভ্যর্থনা করা হয় তাদের। স্বয়ং গুরুদেব এসে তাদের কপালে পরিয়ে দেন জয়টিকা।
এই জরা নদী বেয়েই কয়েকমাস আগে পালিয়েছিল সেই বাচ্চা মেয়েটা আর তার মা। যার জন্য তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ব্রজেন্দ্রদাদাকে।
অচ্যুত অতিকষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে দূরে তাকাল। দূরে, অনেক দূরে আবছা যেন দেখা যাচ্ছে আধুনিক জগতের বৈদ্যুতিন আলো। মাঝে মাঝে যখন ও খুড়োর বাড়ির উঠোনে রাত্রিবেলা একাকী শুয়ে থাকত, হঠাৎ দেখতে পেত, আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিছু একটা।
মিটমিট করে জ্বলছে আলো। কখনো শোনা যেত মৃদু শব্দ।
নারায়ণী চতুষ্পাঠীর আদেশমতো তখন চোখ বুজে কৃষ্ণনাম জপ করতে চাইলেও ও পারতনা। অদম্য কৌতূহল ওর আঁখিপল্লবগুলোকে টেনে রাখত। মনে প্রশ্নের উদয় হত, ওগুলো কী? আধুনিক জগতে কি মানুষ উড়তে পারে?
তবে ওরা কেন পারবে না? কী লাভ এই বৈদিক সমাজে কূপমণ্ডূক হয়ে থেকে? সময় তো পশ্চাৎগামী নয়, তবে ওরা কেন এখানে ঘড়ির বিপরীতমুখে চলছে?
আচ্ছা, ও-ও কি একবার চেষ্টা করে দেখবে? মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য শেষ একটা চেষ্টা? গিয়ে নিজের চোখে একবার দেখবে আধুনিক জগৎটাকে?
ভগবান সকলকেই তো সুযোগ দেন! ওকেও হয়তো দিচ্ছেন। এই সুযোগ হেলায় হারালে হয়তো আর কোনোদিনই আসবে না।
এই তীব্র যন্ত্রণাময় পরিস্থিতির মধ্যেও আকাশপাতাল ভাবছিল অচ্যুত। হঠাৎ একটা জান্তব ডাকে চমকে উঠল। আর পরক্ষণে বালির মধ্যে গেঁথে থাকা ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল।
ওর ঘাড়ে কোনো বন্য পশু জিভ দিয়ে চাটছে।
অচ্যুত দ্রুত হিসেব করতে লাগল। শ্মশানে এসে মিশেছে দূরের অরণ্য। সেই অরণ্যে হিংস্র পশু নেই। তবে শিয়াল আছে প্রচুর। নিজের ঘরে যখন ও রাতে শুয়ে থাকত, তখনও গভীর রাতে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শুনেছে। একবার নিজের চোখে একটা শিয়ালকে ব্যাঙ ধরে খেতেও দেখেছিল।
আচ্ছা, শিয়াল কি জ্যান্ত মানুষের মাংস খায়?
ভাবনাটা মনে আসামাত্র ঘাড়ের কাছে মৃদু কামড় অনুভব করল অচ্যুত। এবার সত্যিই ওর ভয় লাগছে। ভীষণ ভয় লাগছে। কান্নায় ওর গলা বুজে এল।
কী অন্যায় করেছে ও?
ঘাড়ে দাঁতের দংশন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সেই কামড় থেকে ছাড়াতে মাথাটা আপ্রাণ দুদিকে ঝাঁকাচ্ছে অচ্যুত। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। ও বেশ বুঝতে পারছে, এতক্ষণে ওর পেছনে এসে উপস্থিত হয়েছে আরও কয়েকটা শিয়াল।
সবাই মিলে প্রতিযোগিতায় মেতেছে, কে প্রথম নেবে কচি নরমাংসের আস্বাদ!
১১
”আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে, কানাই, বলরাম আর ওই গোবিন্দ —তিনজনের মধ্যে কোন সংযোগ রয়েছে।” রুদ্র বিড়বিড় করল।
জয়ন্ত বলল, ”এরকম মনে হওয়ার কারণ, ম্যাডাম?”
”তুমি নিজেই ভেবে দ্যাখো। তিনজনেই হঠাৎ করে কাজে ঢুকে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছে। তিনজনেরই কোনো পরিচয়পত্র আমাদের কাছে নেই।” রুদ্র বলল, ”আর তিনজনের কাজকর্মে মিলও রয়েছে। যেমন কানাই আর বলরাম পুজো করত, মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না। আর স্বপন সরকারের আন্ডারে কাজ করা গোবিন্দ কিছুতেই কোনো বাইকে বা মোটরগাড়িতে উঠতে চাইত না। এই তিনটে ব্যাপারের মধ্যে কিছু তো একটা যোগসূত্র আছেই!” হয়ত তিনজন আসলে একই ব্যক্তি।
”কিন্তু, তিনজনের চেহারা বা মুখের যা বর্ণনা পেয়েছি, তাতে কিন্তু মিল তেমন পাইনি।” বীরেন শিকদার ফাইলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ”কানাই ছিল ছোটখাটো, রং ফর্সা। বেঁটে হলেও গাঁট্টাগোঁট্টা গড়ন। বলরাম লম্বা চওড়া দশাসই চেহারার, রং কালো, কপালে একটা গভীর কাটা দাগ। আর গোবিন্দ খুবই রোগা, মাঝারি গায়ের রং, উচ্চতাও মাঝারি।”
রুদ্র হাতের পেনটা অন্যমনস্কভাবে চিবুকে ঠেকিয়ে টোকা দিচ্ছিল। বলল, ”হুম। এক লোক না হলেও কিছু লিঙ্ক শিওর আছে। আপনি সুনীল ধাড়ার পড়শি দোকানদার রসিকলাল বিশাইয়ের স্টেটমেন্টটা পড়ুন। বলরাম সারাক্ষণ লুঙ্গি পরে থাকতে পছন্দ করত। সেইজন্য মি. বিশাই সন্দেহ করতেন, ছেলেটা মুসলিম হতে পারে।”
”তো?” বীরেনবাবু বুঝতে পারলেন না।
এবার রুদ্র কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ”আপনি তো স্বপন সরকার মার্ডার কেসের প্রথম থেকেই যুক্ত আছেন, ডিটেইলিং ফাইলে ওঁর স্ত্রী কী বলেছিলেন ভুলে গেলেন? গোবিন্দ মালকোঁচা মেরে লুঙ্গি পরত। এই নিয়ে দলের অনেকে হাসিঠাট্টাও করত।”
বীরেনবাবু এবার জিভ দিয়ে একটা আফসোসের শব্দ করলেন, ”হ্যাঁ। তাই তো! আমি কি আরেকবার স্বপন সরকারের কেসের লোকগুলোকে জেরা করবো, ম্যাডাম?”
রুদ্র টেবিলের ওপর রাখা ভারী পেপারওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ”আপনারা সবাই ফিল্ডে খুব ডেডিকেটেডলি কাজ করছেন আমি জানি। ছ’টা মার্ডার, সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট, মোটিভ খুঁজে বের করা, সাসপেক্টদের জেরা করা এভরিথিং। আপনারা যে নিজেদের একশো শতাংশ দিচ্ছেন, সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু আমাদের এই স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু চেইনটাকে খুঁজে বের করা। তাই লোকাল পুলিশ স্টেশন যেটা করছে, সেই একই কাজ করে আমাদের খুব একটা লাভ নেই”। সবাই চুপ করে বসে আছেন গোলটেবিলটার চারপাশে। একটা ছুঁচ পড়লেও শব্দ হবে, এমনই নিস্তব্ধতা গোটা ঘরে।
রুদ্র একটা সাদা কাগজ টেনে নিল।
”আপাতত আমার কিছু অবজারভেশন বলি। তারপর আপনারাও সেগুলো নিয়ে ব্রেইনস্টর্ম করুন। আগেই বলেছিলাম, এই ছ’টা খুনই হয়েছে কোনো না কোনো বুধবারে, তাই তো?”
”ইয়েস ম্যাডাম!” সবাই সমস্বরে সায় দিলেন।
”মার্ডারের তারিখগুলো থেকে আপনারা কিছু আইডিয়া করতে পারেন?” রুদ্র বলল, ”এমনও তো হতে পারে, সাত নম্বর খুনের ক্ল্যু লুকিয়ে আছে তার মধ্যেই?”
সবাইকে নীরব দেখে ও কাগজে খসখস করে লিখতে লাগল, ”দেখুন।”
প্রথম খুন | ১৫ই জানুয়ারি | বুধবার |
দ্বিতীয় খুন | ১২ই ফেব্রুয়ারি | বুধবার |
তৃতীয় খুন | ১১ই মার্চ | বুধবার |
চতুর্থ খুন | ১৫ই এপ্রিল | বুধবার |
পঞ্চম খুন | ১৩ই মে | বুধবার |
”আপাতদৃষ্টিতে এই তারিখগুলোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে না। কোনটা মাসের দ্বিতীয় বুধবার, কোনটা তৃতীয়।” রুদ্র কাগজে দাগ টানতে টানতে বলল, ”কিন্তু দেখুন, যদি আমরা তারিখগুলো তিথিনক্ষত্রের হিসেবে দেখি?”
রুদ্র লেখা শেষ করে সবার দিকে তাকাল, ”প্রতিটা খুন হয়েছে বাংলামাসের কৃষ্ণপক্ষে। যদি আমার ক্যালকুলেশন ঠিক হয়, তবে সাত নম্বর খুনটাও কৃষ্ণপক্ষেই হবে। অর্থাৎ ৬ই জুলাই থেকে ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে।”
”ও মাই গড!” বীরেন শিকদার বিস্ফারিতচোখে বললেন, ”কিন্তু এই কৃষ্ণপক্ষকে বেছে নেওয়ার কারণ কী, ম্যাডাম?”
”সেটার একটা লজিক আমি ভেবেছি, কিন্তু এখনই বলছি না।” রুদ্র কাঁধ ঝাঁকাল, ”কারণ এটাই যে সত্যি, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমাদের ওই সময়টায় অ্যালার্ট থাকতে হবে।”
প্রিয়াঙ্কা একটা কাগজ টেনে নিয়ে হিসেব কষতে লাগল, ”কিন্তু দিনটা? পঞ্চমী, চতুর্থী, দ্বিতীয়া, তারপর আবার অষ্টমী, ষষ্ঠী, পঞ্চমী …! ধুর! সব গুলিয়ে যাচ্ছে!”
”কোন প্যাটার্ন যে থাকবেই, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু এটা একটা পয়েন্ট।” রুদ্র বলল, ”আপাতত, বীরেনবাবু বৈদ্যবাটি আর কোন্নগরের কেসটা একেবারে গ্রাসরুট লেভেল থেকে রি-ওপেন করুন। আর লোকেশবাবু আপনি টেকওভার করুন চন্দননগর আর চুঁচুড়ার কেসদুটো।”
রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছিল, ”কানাই হোক, বলরাম হোক বা গোবিন্দ, এবারে আমাদের তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর এখন আমি একবার ত্রিবেণী যাব। জয়ন্ত চলো আমার সঙ্গে।”
১২
সাধারণ একটা একতলা বাড়ি। বহুদিনের মেরামতির অভাবে নানা জায়গায় রং খসে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়েছে। সামনের একচিলতে বারান্দায় ঝুলছে বাচ্চার ছোট ছোট জামাকাপড়।
ওসি সুকেশ সান্যাল একজন কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে-ই নিয়ে এল। তার নাম বিমল।
ওরা ডাইনিং এ বসে ছিল, একটা তেলচিটে সোফায়। ডাইনিং অবশ্য নামেই, গোটা বাড়িতে সাকুল্যে দুটো ঘর। একটা এই বসার ঘর, এর মধ্যেই বোধহয় খাওয়াদাওয়া সব কিছু। আর উলটোদিকে শোবার ঘর। এই দুটো ঘর আর রান্নাঘর, বাথরুম ছাড়া তো আর কিছু চোখে পড়ছেনা।
ছোট্ট একটি শিশু গোটা ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে নিজের মনে খেলছে, আ – উ জাতীয় অবোধ্য সব শব্দ করছে। মাঝেমাঝে কোনো কিছুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু টলোমলো পায়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই আবার থেবড়ে বসে পড়ছে মাটিতে। জয়ন্ত তার দিকে চেয়ে মুখ দিয়ে বিচিত্র কিছু আওয়াজ করতে সেও প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করল।
শাড়ি পরা অল্পবয়সি মেয়েটি রুদ্রর চেয়ে বয়সে ছোটই হবে, বড়জোর বাইশ-তেইশ। বিবর্ণ শাড়ি, শুভ্র সিঁথি। রোগা। অতিরিক্ত পরিশ্রমে কেমন ফ্যাকাসে। চুলের খোঁপা এলিয়ে পিঠের ঘামে লেপটে রয়েছে। রান্নাঘরের নুন-হলুদ লেগে থাকা মলিন শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে এসে সে ওদের সামনে গ্লাস বাড়িয়ে দিল।
”এই নিন, গরমে এসেছেন, একটু শরবত খান।”
”আমি অন ডিউটি কিছু খাই না, থ্যাঙ্ক ইউ।” বিব্রত রুদ্র বলে ওঠে। কিন্তু ততক্ষণে সুকেশ সান্যালের কনস্টেবল বিমল হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিয়েছে গ্লাসটা। সবে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় ম্যাডামের এমন উলটোকথা শুনে জয়ন্ত তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল।
বিমল দ্বিধাগ্রস্ত মুখে গ্লাসটা ধরে বসে রইল। এই ম্যাডাম ওসি সাহেবের থেকেও উঁচুতে, তিনি না খেলে সে খাবে কি করে!
মেয়েটা ম্লান হাসে, ”এটা তেমন কিছু না দিদি। একটু নুন – চিনির শরবত। রোদে তেতেপুড়ে এসেছেন, তাই। আর কীই বা আছে ঘরে, যে দেব! বাড়িতে অতিথি এলে এইটুকু তো দিতেই হয়।”
রুদ্রর অস্বস্তি হয়। খানিকটা দোনোমনা করে গ্লাসটা তুলে নেয় ও।
সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির সঙ্গে বিমলও ঠোঁটে গ্লাস ছোঁয়ায়।
রুদ্র ইচ্ছে করেই ‘আপনি’ না বলে সরাসরি ‘তুমি’তে নেমে আসে, ”এখন কীভাবে চলছে তোমাদের?”
মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ”কীভাবে আর চলবে। আমাদের মানে তো আমি আর আমার মেয়ে। আমি এখানেই একটা ছোট অফিসে রান্নার কাজ নিয়েছি। তিন হাজার টাকা পাই। ওতেই মোটামুটি চালিয়ে নিতে হয়। মেয়েটার দুধ নিয়ে একটু যা টানাটানি হয়। সবে তো দশমাস বয়স।”
জয়ন্ত বলল, ”শিবনাথ বিশ্বাসের দোকানটা?”
”সেটা পড়েই আছে। বাজারে ওর বেশ কিছু ধার ছিল। কম্পিউটারগুলো বেচে সেই ধার শোধ করলাম। তাও ভেঙে গিয়েছিল বলে খুব কম দাম পেয়েছি। দোকানটা আর খুলিনি। ওই গঙ্গার ধারে ফাঁকা রাস্তায় কিসেরই বা দোকান করব? আর আমি একা চালাবই বা কী করে! মেয়েটাকে পাশের বাড়িতে রেখে কোনোরকমে গিয়ে দু-তিনঘণ্টায় রান্না সেরে আসি।” মেয়েটার গলা বলতে বলতে ধরে আসে, ”আপনি বিশ্বাস করুন দিদি, আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমি … আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। আমি কিচ্ছু করিনি।”
”তোমার নাম কী?” রুদ্র নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।
”আরতি।”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জয়ন্ত গাড়িতে আসতে আসতে বলছিল, ”খুব স্ট্রেঞ্জ কেস। ওসি সুকেশ সান্যাল যতই বউ আর পাড়ার ওই ছেলেটাকে অ্যাকিউজ করুক, প্রুফ কোথায়? শিবনাথের দোকান শ্রীহরি সাইবার ক্যাফের লোকেশনটা একদম ফাঁকা জায়গায়। দুদিক থেকে দুটো বড় রাস্তা দিয়ে ওই গলিতে আসা যায়। সেই দুটো রাস্তাতেই বড়বড় দুটো মিষ্টির দোকান। তাদের দোকানের সামনে সিসিটিভি লাগানো আছে। কিন্তু ফুটেজ চেক করে ওইসময়ের দু-তিনঘণ্টা আগে পর্যন্ত এমন কাউকে পাওয়া যায়নি যে সন্দেহ করা যেতে পারে।”
রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল, ”ওর ক্যাফেতে সেদিন যারা এসেছিল?”
”সেদিন গোটা দিনে কোনো কাস্টমারই আসেনি ওর সাইবার ক্যাফেতে। দোকান থেকে বেরোনোর কিছুক্ষণ আগেই নিজের স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিল শিবনাথ। আর ওর দোকানে যেই যাক, দুদিকের দুটো মিষ্টির দোকানের যে কোনো একটার সামনে দিয়ে যেতে হবে। তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। জায়গাটা খুবই নির্জন।”
”এমনও তো হতে পারে, মিষ্টির দোকান আর শিবনাথের ক্যাফে, দুটোর মাঝখানের কোন বাড়িতে কেউ লুকিয়েছিল।”
”হুম, তা পারে।” জয়ন্ত বলেছিল, ”সেইজন্যই ইনভেস্টিগেশন ফাইলে দেখবেন, লোকাল পুলিশ অফিসার কাছাকাছি সব বাড়িতে জেরা করেছিলেন। কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছুই পাননি।”
রুদ্র বর্তমানে ফিরে এল। বলল, ”আরতি, আমরা তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এও জানি যে তুমি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। তবু, তোমার কাছে এসেছি কিছু বিষয় জানতে।”
আরতি চুপ করে রইল।
”তোমার নিজের বাড়ি কোথায়?”
”নিজের বাড়ি মানে?” আরতি সামান্য থমকাল, ”ওহ, বাপের বাড়ি? বারুইপুর। বাবা-মা কেউ নেই। ছোটবেলাতেই মারা গেছে। আমি মামার বাড়িতে মানুষ। ওই বারুইপুরেই। মামারাই সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছিল।”
”১৫ই জানুয়ারি শেষ কখন তোমার সঙ্গে শিবনাথের কথা হয়েছিল?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”সাড়ে আটটার সময়।” একটুও না ভেবে উত্তর দিল আরতি, ”ও খুব মনমরা হয়ে কথা বলছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। বলল, সারাদিনে একটাও খদ্দের আসেনি। আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি বাড়ি চলে এসো।”
”কারুর আসার কথা আছে, এমন কিছু কি বলেছিল তোমায়?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
”নাতো। আসলে শিবুর বন্ধুবান্ধব তেমন ছিল না। ঘরে থাকতেই বেশি ভালোবাসত। দোকানে যেত, দোকান বন্ধ করেই আবার ঘরে চলে আসত।” আরতির গলাটা বুজে এল।
”কেউই কি ছিল না যে শিবনাথের দোকানে আড্ডা মারতে যেত?”
আরতি একটু ভেবে বলল, সে’রকম তো আমি কাউকে চিনি না।”
রুদ্র বলল, ”দোকানে রাজু বলে যে ছেলেটি আগে কাজ করত …।”
আরতি বোধ হয় এতক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটারই প্রতীক্ষা করছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল, ”বিশ্বাস করুন দিদি, রাজু আমার ভাইয়ের মতো। আমি এখানে এসে থেকে ওকে রাখি পরাই। হ্যাঁ, এটা ঠিক ওইসময় কয়েকদিন ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলতাম। কিন্তু তার কারণ আপনারা যেটা ভাবছেন সেটা নয়। তখন বান্ধবীর সঙ্গে রাজুর ঝগড়া হয়েছিল। বেচারা মন খারাপ নিয়েই ট্যুর নিয়ে গিয়েছিল পুরীতে। আমি তাই ওকে ফোনে বোঝাচ্ছিলাম। দিদির মতো।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আরতির চোখের দিকে। তারপর বলল, ”রাজু এখন কোথায়?”
”ওকে পুলিশ বেশ কয়েকবার থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছে। মারধোরও করেছে। এখন কোথায় আমি জানি না। আমার বাড়িতে অনেকদিন আসেনি।”
রুদ্র উঠে দাঁড়াল। একেবারেই ছন্নছাড়া বাড়ি। এখানে ঝাঁটা পড়ে রয়েছে, ওখানে হাড়ি-খুন্তি, এদিকে কিছু ময়লা জামাকাপড়, ওদিকে বাচ্চার দুধের টিন। বোঝাই যাচ্ছে, আরতি একা পেরে ওঠে না। একটা কাঠের টেবিল, তার ওপর স্তূপাকৃতি করা বইপত্র।
বইপত্রের ওপরের দেওয়ালে তিনটি বড় বড় বাঁধানো ছবি। মাঝেরটা শিশু গোপালের হামাগুড়ি দেওয়া ছবি। দুদিকের ছবিদুটো এক পুরুষ ও এক মহিলার। তাতে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া।
”এঁরা কারা?”
আরতি বলল, ”আমার শ্বশুর শাশুড়ি। দুজনেই মারা গিয়েছেন, অনেকদিন হল। আমার বিয়ের অনেক আগে।”
রুদ্র টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। বেশিরভাগই বাজারচলতি পত্রপত্রিকার পুজোসংখ্যা। একেবারে নীচে একটা ল্যাপটপ। ধুলোর পুরু আস্তরণ তার ওপর। ও ওপরের বইগুলো সাবধানে ধরে ল্যাপটপটা বের করল। কিন্তু সেটা অন হল না। চার্জ নেই।
”এটা কার ল্যাপটপ?”
আরতি ম্লান গলায় বলল, ”ওরই ছিল। বাড়ির কাজে ব্যবহার করত। আমাকে মাঝেমাঝে সিনেমাও দেখাত। এখন অনেকদিন খোলা হয় না।”
১৩
এস পি স্যার রাধানাথ রায় বসেছিলেন তাঁর বাংলোর বাগানে। রুদ্রর বাংলোর চেয়ে আকারে আয়তনে অন্তত আড়াইগুণ বড় শ্রীরামপুরের এই পুলিশ সুপারের বাংলো। বিশাল বাগান, তাতে নানারকম গাছ। আজ সকালে বেশ একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাই গাছের পাতাগুলো ভিজে আরও ঝকঝকে দেখাচ্ছে।
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এগিয়ে এল, তারপর স্যালুট ঠুকে বলল, ”গুড মর্নিং, স্যার!”
”মর্নিং, রুদ্রাণী! বোসো।” রাধানাথ রায় একটা ছুরি দিয়ে নিজেই আপেল কাটছিলেন। পরনে ধোপদুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি। এই সকালেই স্নান টান করে একেবারে পরিপাটি।
টেবিলে রাখা একটা দুধসাদা প্লেট, তাতে নানারকমের ফল। আপেল, মুসুম্বি, কলা, আঙুর, আম, কিছু বাকি নেই। পাশে আরেকটা প্লেটে থাক থাক সাজানো পাউরুটি। রয়েছে মাখন আর জ্যামের শিশিও। সব মিলিয়ে প্রাতঃরাশের এলাহি আয়োজন।
”এই নাও। আপেল খাও। সকাল সকাল আপেল শরীরের জন্য খুব উপকারী।” এস পি স্যার দুটো আপেলের টুকরো এগিয়ে দিলেন রুদ্রর দিকে।
”থ্যাংক ইউ স্যার!” রুদ্র একটু আগে পেট ভরে রুটি আলু চচ্চড়ি খেয়ে এলেও এখন আপেল খেতে ‘না’ করল না। স্যারের উলটোদিকের লোহার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল।
পাশেই গঙ্গা। হু হু করে ভেসে আসছে ঠান্ডা নদীর হাওয়া। এস পি রাধানাথ রায় একজন সিনিয়র আই পি এস অফিসার হলেও উনি কর্মজীবনে কোনো প্রোমোশন নেননি। বেশ কয়েকবছর তিনি এই জেলাতেই আছেন। রুদ্র এসেই শুনেছিল, ওঁর চেয়ে অনেক জুনিয়র অফিসাররা এখন অনেক ওপরে উঠে গিয়েছেন, কিন্তু পদে অধস্তন হয়েও রাধানাথ রায়কে সকলে খুব মানেন।
স্যারের রেকর্ড নাকি ঈর্ষণীয়। প্রথম জীবনে দারুণ কিছু কেস উনি একাই সলভ করেছিলেন। উনি নাকি এমন কাজপাগল, যে কেরিয়ারের জন্য বিয়েই করেননি। তবে বেশ খামখেয়ালি মানুষ, নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার জন্য অনেকবার অপ্রীতিকর শো-কজেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি এখনো অত্যন্ত সুদর্শন ও দীর্ঘকায়।
”তারপর? কেমন কাজ করছে তোমার টিম?” স্যার বললেন।
রুদ্র বলল, ”স্যার, আমি তো প্রতিদিন রাতেই আপনাকে ইমেলে ডিটেইল প্রোগ্রেস পাঠাচ্ছি।”
এস পি স্যার বললেন, ”আহা সে তো আমি পড়েছি। কাকে কী ইন্টারোগেশন করলে, কোথায় ইনভেস্টিগেট করতে গেলে, এইসব ফর্ম্যাল প্রোগ্রেস রিপোর্ট নয়, আমি তোমার থেকে শুনতে চাইছি, তুমি এমনিতে কতটা এগিয়েছ বা কোনদিকে ভাবছ। মানে আদৌ কি ডি এমের অনুমান ঠিক? আদৌ কি কোনো লিঙ্ক আছে সবকটা খুনের মধ্যে? নাকি প্রতিটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট!”
রুদ্র একটু চুপ করে রইল।
রাধানাথ রায় বিরক্তমুখে বললেন, ”ডি এম তো কোনো কথাই শুনতে চাইছেন না। ওঁর এই আজগুবি থিয়োরি আবার জানিয়েছেন কমিশনারকে, তিনিও নাচছেন। আমার হয়েছে যত জ্বালা! গোটা রিজিয়ন সামলাব, না এই মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করব? রিটায়ারমেন্টের আর পাঁচ মাস বাকি, এইসময়ে এত ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগেনা।”
রুদ্র বলল, ”কিন্তু স্যার, আমার কিন্তু ম্যাডামের ধারণাটা একেবারে অযৌক্তিক লাগছেনা। আপনাকে রিপোর্টে কানাই, বলরাম, গোবিন্দর ব্যাপারটা তো লিখেইছিলাম, আরও কিছু ইন্টারেস্টিং লিঙ্ক রয়েছে।”
”তাই? কীরকম শুনি?” রাধানাথ স্যার কৌতূহলী চোখে তাকালেন।
রুদ্র সংক্ষেপে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বুধবারের সাদৃশ্যের কথা বলল। প্রতিটা খুনই যে ঘটছে কৃষ্ণপক্ষে, সেটাও বোঝাল।
রাধানাথ রায় বললেন, ”কৃষ্ণপক্ষ! প্রোফেশনাল রাইভ্যালরির জন্য ব্যবসাদারদের খুন করছে যদি ধরেও নিই, শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষ বেছে বেছে কেন খুন করতে যাবে?”
”সেটাই এখনো বুঝতে পারছিনা, স্যার!” রুদ্র ম্লানমুখে বলল, ”হতে পারে এটা আমার ভুল অনুমান।”
রাধানাথ রায় পাউরুটিতে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বললেন, ”দ্যাখো রুদ্রাণী, তুমি একেবারেই জুনিয়র। কোনো প্রোবেশনারকে এই রকম কেস লিড করতে দেওয়ার কথাই নয়। হায়দ্রাবাদে শুধু ট্রেনিং করে এলেই তো হয়না, চাই ফিল্ড লেভেলে অভিজ্ঞতা। কিন্তু তবু আমি ডি এম এর সঙ্গে ডিসকাস করে তোমায় ভার দিয়েছি। কারণ আমার মনে হয়েছে তুমি পারবে। কিন্তু আমিও তো অনেকের কাছে আন্সারেবল, তাই না! গোটা সার্ভিস লাইফ সুনামের সঙ্গে কাজ করে এসেছি। শেষ সময়ে এসে সেটায় আমি দাগ লাগাতে দিতে পারিনা।”
”সে তো অবশ্যই, স্যার!” রুদ্র বলল, ”তবে তর্কপঞ্চাননের বাড়ির ভিক্টিমের কর্মচারী কিছু ফলস স্টেটমেন্ট দিয়েছে। আমরা তাকে আরও ভালো করে ইন্টারোগেট করছি।”
”তর্কপঞ্চানন?” এস পি ভ্রূ কুঁচকোলেন, ”মানে?”
রুদ্র হেসে সঙ্গে সঙ্গে ভুলটা শুধরে নিল, ”স্যরি স্যার। আমি ওই ব্রিজেশ তিওয়ারির কথা বলছি। উনি যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেটা এইট্টিন্থ সেঞ্চুরির লেজেন্ডারি পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাড়ি। আমিও জানতাম না, কিন্তু জানা ইস্তক ইতিহাসের অনেক ঘটনা জানতে পারছি। হি হ্যাড ইনক্রেডিবল ট্যালেন্টস।”
রাধানাথ স্যার একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”ইতিহাস ছেড়ে এবার বর্তমানে ফিরে এসো রুদ্রাণী। বুঝতেই তো পারছ। স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়ালের জন্য পলিটিক্যাল পার্টি থেকেও বেশ প্রেশার আসছে। ইতিহাস দেখলেই তুমি নেচে ওঠো তা আমি জানি। কিন্তু এখন এ’সব ঘাঁটার সময় নয়।”
রুদ্র বকুনি খেয়ে চুপ করে গেল। বলল, ”রাইট স্যার।”
এস পি বললেন, ”নিজেকে অ্যামেচার গোয়েন্দা না ভেবে পুলিশ ভাবো। ফরেনসিক রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে পড়ো। প্রতিটা ওসির সঙ্গে কথা বলে সেই লোকালিটির দাগি ক্রিমিনালদের ম্যারাথন ইন্টারোগেট করতে বলো। প্রয়োজনে ইনফর্মার লাগাও। জয়ন্ত, প্রিয়াঙ্কা, লোকেশ, বীরেন, এদের একেকটা ভাগের দায়িত্ব দাও। দেখবে কিছু না কিছু ঠিক বেরিয়ে আসবে। কয়েকদিন পরেই একটা মিটিং থাকবে, সেখানে একটা উল্লেখযোগ্য প্রোগ্রেস যেন থাকে!”
কথা শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে স্যার একটা ডায়েরি বের করলেন। সেটা খুলে মেলে ধরলেন রুদ্রর দিকে। পরপর সব খুনগুলোর ডিটেইল লেখা রয়েছে তালিকার আকারে।
হুগলী সিরিয়াল কিলিং কেস :
রুদ্র অন্যমনস্কভাবে দেখছিল লিস্টটা। এটাই ওকে প্রথমদিন ডি এম অফিসে রাধানাথ স্যার দেখিয়েছিলেন।
স্যার বললেন, ”এই লিস্টে যেন আর একটাও না রো অ্যাড হয়, মেক শিওর অ্যাবাউট দ্যাট, রুদ্রাণী!”
১৪
গুরুদেব নারায়ণী চতুষ্পাঠীর উচ্চবেদিতে পদ্মাসনে বসেছিলেন। অনুরূপ ভঙ্গিতে বসে ছিল চারটি প্রাথমিক শ্রেণীর ছাত্রেরাও। মধুসূদন, গোবর্ধন ও বংশীধরের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা বসে ছিলেন অদূরে।
গুরুদেব একটা সুদীর্ঘ প্রশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, ”আমি বুঝতে পারছি, তোমাদের খুব পরিশ্রম হচ্ছে। তোমরা হয়তো ভাবতে পারো এত কঠিন নিয়মশৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে কেন তোমাদের যেতে হচ্ছে। তার কারণ, যে মহৎ উদ্দেশ্যে বৈদিক সমাজের সূচনা ঘটেছিল, তা চরিতার্থের মাহেন্দ্রক্ষণ ক্রমেই উপস্থিত হচ্ছে। গত কয়েকমাসে গোবর্ধনের মতো উচ্চশ্রেণীর ছাত্রেরা করে দিয়েছে তার শুভারম্ভ। অন্তিম লক্ষ্যপূরণের জন্য আমার প্রয়োজন তোমাদের সকলকে। তার আগে তোমাদের কিছু ঘটনা জানা প্রয়োজন।
গুরুদেব থামলেন। তাঁর ইশারায় বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্রদের একজন দ্রুতপদে চলে গেলেন। অনতিবিলম্ব পরেই ফিরে এলেন বিষ্ণুমন্দিরের প্রসাদ নিয়ে। পরমগুরুর প্রসাদ। সকলকে একটু করে হাতে দিতে লাগলেন তিনি।
প্রসাদপর্ব মিটলে গুরুদেব আবার শুরু করলেন।
”ভগবান বিষ্ণু তিনি প্রতিটি যুগে নানা অবতারে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর প্রথম অবতার মৎস্য। তোমরা কি মৎস্য অবতারের কাহিনী জানো?”
”না গুরুদেব।”
”সত্যযুগে সত্যব্রত নামে এক ধার্মিক রাজা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে পৃথিবীতে হঠাৎ নানারকম অন্যায় ও অত্যাচার দেখা দেয়। রাজা তখন জগতের সার্বিক কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করেন। একদিন সত্যব্রত জলাশয়ে স্নান করছেন। একটি অতিক্ষুদ্র পুঁটিমাছ এসে তাঁর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়।
”অনুগ্রহ করে আমাকে রক্ষা করুন হে রাজন। নাহলে অচিরেই জলাশয়ের বৃহৎ মাছেরা আমায় খেয়ে ফেলবে।”
রাজা সত্যব্রতর দয়া হল। তিনি একটি কমণ্ডলুতে করে মাছটাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু পুঁটিমাছটির আকার ভীষণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। কমণ্ডলু ছাড়িয়ে বড় পাত্র, পাত্র ছাড়িয়ে স্নানাগারের জলাধার, জলাধার ছাড়িয়ে পুকুর, সরবর, নদী, যেখানেই তাকে রাখা হয়, আয়তনে ধরে না।
রাজা বুঝতে পারলেন, ইনি নিশ্চয়ই ভগবান বিষ্ণু তাঁর কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে মৎস্যরূপে পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁর স্তবে তুষ্ট হয়ে তখন মৎস্যরূপী বিষ্ণু বললেন, ”গোটা বিশ্ব অনাচারে ভরে গেছে। তাই সাতদিনের মধ্যেই শুরু হবে মহাপ্রলয়। বিনষ্ট হবে বর্তমান সমস্ত কিছু। নতুন করে সবকিছু শুরু হবে ধরাধামে। প্রলয় শুরুর আগে একটি স্বর্ণতরী এসে তোমার ঘাটে ভিড়বে। তুমি সবরকমের প্রাণীযুগল ও সবপ্রকারের খাদ্যশস্য, বৃক্ষবীজ নিয়ে সেই স্বর্ণতরীতে আরোহণ করবে। আমি শৃঙ্গরূপী মৎস্য হয়ে প্রলয় শুরু করব। আমার শৃঙ্গের সঙ্গে তুমি তোমার তরীখানি বেঁধে রাখবে। প্রলয়শেষে যখন সব শান্ত হয়ে যাবে, অন্যায়মুক্ত পৃথিবীতে তোমার নৌকোয় থাকা সব প্রাণের আবার নবোন্মেষ ঘটবে।”
দ্বারিকার মন টিকছিল না। গুরুদেবের রক্তহিম চাহনি ওর ওপর বর্ষিত হতে পারে জেনেও ওর মন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। আজ দুদিন হয়ে গেল অচ্যুতের কোনো সন্ধান নেই। কালু কৈবর্তের দল কোথায় নিয়ে গেল ওকে?
এই প্রশ্নটা যতবার ওর মনের মধ্যে আসছে, ততবার ওর গলায় একটা চাপা কষ্ট দলা পাকাচ্ছে। অচ্যুতের আপনার বলতে এই গোটা সমাজে কেউ নেই, তাই ওর নিরুদ্দেশ নিয়ে কেউ বিচলিতও নয়।
কিন্তু দ্বারিকা? দ্বারিকা যে অচ্যুতকে বড় ভালোবাসত! এই দমবন্ধ করা সমাজে অচ্যুতই ছিল একমাত্র মানুষ, যার কথা শুনলে ভয় করত, কিন্তু একইসঙ্গে শিহরণ জাগত গোটা শরীরে। সব ভয় সরিয়ে ইচ্ছে হত স্বপ্ন দেখার।
দ্বারিকা এমনিতে ভিতু হলেও অসীম সাহসে ভর করে গতকাল বিকেলে গিয়েছিল কৈবর্তদের পাড়ায়। কালু কৈবর্তের দলে একটা ছেলে আছে, তার নাম নিশাদ। নিশাদ ওদেরই বয়সি, জরা নদীতে মাছ ধরে। ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করেছিল দ্বারিকা। কলাপাতায় মুড়ে অনেকটা ক্ষীরও নিয়ে গিয়েছিল লুকিয়ে।
ছেলেটা ক্ষীরটা চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছিল, তারপর বলেছিল, ”উসব আমি জানেক লাই রে। উ ছিলাডারে শ্মশানপানে লিয়ে গেছল, ইটুকু শুধু জানি।”
শ্মশান? দ্বারিকার বুক কেঁপে উঠেছিল। শ্মশানে কেন? অচ্যুতকে কি পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে? লঘু পাপে গুরু দণ্ড নয় কি? শ্মশানের ওদিকে তো যাওয়া অসম্ভব, কীভাবে ও জানবে ওর প্রিয়বন্ধুর পরিণতি?
গুরুদেবের গুরুগম্ভীর কণ্ঠে দ্বারিকা আবার বর্তমানে ফিরে এল।
”ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
অহং সর্বস্যপ্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।
ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধাভাবসমন্বিতাঃ।।*
শ্লোকটা উচ্চারণ করে গুরুদেব বনমালীকে ইঙ্গিত করলেন, ”এর মর্মার্থ প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করো তো বাবা।”
বনমালী উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য গলা পরিষ্কার করে বলল, ”আমি জড় এবং চেতন— দুই জগতেরই সমস্ত কিছুর উৎস। সমস্ত কিছুই আমার থেকে প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে যারা শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন, তাঁরাই যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী।”
”বাহ, অতি উত্তম।” গুরুদেব বললেন, ”বাবাসকল, একটা কথা ভালো করে বোঝো, ভাগবতপুরাণে বলা হয়েছে, কৃষ্ণস্তু ভগবানস্বয়ম শ্রীকৃষ্ণই বিষ্ণু বিষ্ণুই শ্রীকৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, ভগবান বিষ্ণু শিব—ব্রহ্মা—আদি সকলের উৎস।
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ।
অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষিনাং চ সর্বশঃ।”*
”বুঝতেই পারছ, যখনই মর্ত্যলোক পাপিষ্ঠ ও অশুভ লোকে ভরে গিয়েছে, ভগবান বিষ্ণু তখনই কখনো মৎস্য, কখনো বরাহ, কখনো কূর্ম অবতারে আবির্ভূত হয়েছেন। বিনাশ করেছেন সমস্ত দুষ্ট শক্তিকে। কখনো তিনি পরশুরাম, কখনো তিনিই রাম। আবার কখনো তিনি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।” গুরুদেবের মেঘমন্দ্র স্বর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা চাতালে।
____
* ভগবদগীতা ১০/৮
* দেবতারা বা মহর্ষিরাও আমার উৎপত্তি সম্পর্কে অবগত হতে পারেন না। কারণ আমি দেবতা ও মহর্ষিদের আদি কারণ। – ভগবদগীতা — ১০/২
১৫
শিবনাথের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর প্রায় দশদিন কেটে গিয়েছে। রুদ্র তদন্তে একচুলও এগোতে পারেনি। প্রতিদিন নিয়ম মাফিক এস পি স্যারকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট পাঠাচ্ছে বটে, কিন্তু ও বেশ বুঝতে পারছে, কিচ্ছু এগোচ্ছে না। বরং যতদিন যাচ্ছে, একটা হতাশা এসে গ্রাস করছে ওকে।
এ কী হল। যখন ব্যাঙ্কে চাকরি করত, হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়ত নানারকম সমস্যায়। প্রথমবার বাবাকে খুঁজতে ভুটানে গিয়ে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল।১ দ্বিতীয়বার প্রিয়মের কাছে লন্ডনে ছুটি কাটাতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল নাৎসী জার্মানির এক লুপ্ত পরিকল্পনার ওপর গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক এক ষড়যন্ত্রে।২ আর আগ্রায় পোস্টেড থাকার সময় তো সাম্প্রদায়িক বীজবপনের আঙ্গিকে এক ভয়ঙ্কর নাশকতা হামলার প্রস্তুতির খোঁজ পেয়েছিল।৩
এই প্রতিটা ঘটনাতেই ও পুলিশকে যতটুকু সাহায্য করতে পেরেছিল, তা একজন সাধারণ যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। এই তিনটি ঘটনা হয়তো ওকে ভেতরে ভেতরে অনেক সাহসী ও আত্মবিশ্বাসীও করে তুলেছিল। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বের ইন্টারভিউ প্যানেলে এই কাজ নিয়ে ও অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছিল।
কিন্তু আজ যখন ও নিজেই পুলিশ দপ্তরের একজন? পরোক্ষভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবে এক সিরিয়াল কিলিং তদন্তের জাল গুটিয়ে আনার ভার যখন তুলে দেওয়া হয়েছে ওর ওপর? কী করতে পারছে ও?
রুদ্র চুপচাপ খোলা ব্যালকনিতে বসে ভাবছিল। সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ।
অন্যদিন এইসময় ক্ষমা বাগানে খেলে। কিন্তু কাল থেকে কী হয়েছে মেয়েটার, কিছুতেই ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। জ্যোৎস্নাদি, পাঁচু এমনকী প্রিয়মও চকোলেটের লোভ দেখিয়ে ওকে বাইরে বের করতে পারেনি। ওর মা মল্লিকাদি একটু আগে চায়ের কাপ নিয়ে এসেছিল রুদ্রর কাছে। মুখে কেমন ভয়ের ছাপ।
”কী হয়েছে ক্ষমার?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চেয়েছিল রুদ্র।
মল্লিকাদি বলেছিল, ”জানিনা দিদিমণি। কেমন খিঁচিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে।”
”জ্বর আছে গায়ে?”
”হ্যাঁ। অল্প।”
রুদ্র বলেছিল, ”গরম দুধ খাওয়াও বারবার। বিকেলের মধ্যে না ঠিক হলে ডাক্তারকে কল দেব।”
মল্লিকাদি মৃদু ঘাড় নেড়ে চলে গিয়েছিল। রুদ্র আবার ডুবে গিয়েছিল নিজের ভাবনায়।
সত্যি বলতে কী, নিজের প্রতি ওর এখন খুব লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে, যে বাহবা ও ইন্টারভিউ বোর্ডে কুড়িয়েছিল, অতীতের যে কার্যকলাপ হয়তো ওর ইন্টারভিউয়ের নম্বরকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল, তা প্রতারণা মাত্র। ও আসলে এইসব কাজের যোগ্যই নয়।
এই ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন সপ্তাহ দু’বার জেলাশাসক ফোন করছেন। আশাভরা কণ্ঠে বলছেন, রুদ্রাণী সিংহরায় পারবে এ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।
ওদিকে এস পি রাধানাথ স্যার প্রতিদিনের মতো ওকে অফিস যেতে বারণ করেছেন। বলেছেন, বাংলোর অফিস থেকেই কাজ চালাতে।
কিন্তু কী কাজ চালাচ্ছে ও? বিক্ষিপ্তভাবে একেকটা হত্যার একেকরকম দিক খুঁজে পাচ্ছে। যেন প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা ধাঁধাঁ। কিন্তু এভাবে প্রতিটা ধাঁধাঁর উত্তর খোঁজা তো ওর কাজ নয়, ওর কাজ হল, প্রতিটা ধাঁধাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা শক্ত সুতোটা খুঁজে বের করা। তারপর সেটাকে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলা।
কিন্তু আদৌ কি তেমন কোন সুতো আছে? নাকি, প্রতিটা খুনই বিচ্ছিন্ন, এই বুধবার আর কৃষ্ণপক্ষের ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয়! ফরেনসিকের রিপোর্টগুলো থেকেও কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন সময় গেট দিয়ে ঢুকল একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে সোজা গটগট করে ঢুকে এলেন বীরেন শিকদার। সামনে এসে স্যালুট ঠুকে বললেন, ”গুডমর্নিং ম্যাডাম!”
”মর্নিং। বসুন।” রুদ্র বলল, ”বলুন। কী আপডেট?”
”আপনি আমাকে স্বপন সরকার আর সুনীল ধাড়ার কেসটা প্রথম থেকে শুরু করতে বলেছিলেন। স্বপন সরকার প্রথমে সাধারণ ঠিকাদারির কাজ করত, তারপর বছরকয়েকের মধ্যেই বেশ পয়সা করে ফেলে। লোকাল পলিটিক্সে বেশ দ্রুত উঠতে থাকে। তাছাড়া, ও বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিল।”
”এটা ফাইলেও লেখা ছিল। কী ধরনের ধর্মীয় সংগঠন?”
”এমনি গ্রামগঞ্জের দিকে যে ছোটখাটো আশ্রম থাকে না, সেইরকম বেশ কিছু জায়গায় নিয়মিত অনুদান দিত। তো আমি ওসিসায়েবের সঙ্গে বাড়ি গিয়ে আরও একবার ভালো করে সার্চ করলাম। আর তখনই এই ছবিটা পেলাম।” বীরেন শিকদার একটা ফোটোগ্রাফ বাড়িয়ে দিলেন।
রুদ্র হাতে নিয়ে দেখল, একটা অনুষ্ঠানমঞ্চের ছবি। মঞ্চে বসে আছেন চারপাঁচজন মানুষ। একজনের পেছনে ঝুঁকে পড়ে কিছু বলছে একটা রোগা চেহারার ছেলে। পাশের ভদ্রলোকও তা বেশ উৎসাহের সঙ্গে শুনছেন। একটি বাচ্চা মেয়ে শাড়ি পরে স্টেজে উঠছে হাতে ফুলের স্তবক নিয়ে।
সবার পেছনে নীল শামিয়ানার ওপর থার্মোকোল কেটে লেখা:
শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজের ৯৯ তম জন্মবার্ষিকী
উদযাপন
বাগডাঙা সরলাশ্রম, বাগডাঙা।
রুদ্র বলল, ”এই বসে থাকা দুজন ভদ্রলোক স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়াল না?”
”একদম ঠিক বলেছেন ম্যাডাম। কেস ফাইলের ছবির সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। আর আমি এই ছবি স্বপন সরকারের কাছের লোকদেরও দেখিয়েছি।” বীরেন শিকদার বললেন, ”আর ওই ঝুঁকে কিছু বলা ছেলেটা কে বলুন তো?”
রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বিস্ফারিত চোখে বলল, ”গোবিন্দ?”
”একদম ঠিক ধরেছেন। হৃষীকেশ জয়সোয়াল আর স্বপন সরকার এই আশ্রমে নিয়মিত যেতেন। দুজনের মধ্যে পরিচয়ও ছিল।”
”এক্সেলেন্ট! বীরেন বাবু, আপনি জিনিয়াস!” রুদ্র প্রায় লাফিয়ে উঠল, ”এই বাগডাঙা জায়গাটা কোথায়?”
”চন্দননগর সাবডিভিশনে, ম্যাডাম।” বীরেনবাবু বললেন, ”খুবই প্রত্যন্ত একটা গ্রাম।”
”চলুন, এখুনি যেতে হবে আমাদের।”
_____
১ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ঈশ্বর যখন বন্দি’ দ্রষ্টব্য।
২ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নরক সংকেত’ দ্রষ্টব্য।
৩ রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের তৃতীয় উপন্যাস ‘অঘোরে ঘুমিয়ে শিব’ দ্রষ্টব্য।
১৬
বাগডাঙা গ্রামটা নামেই চন্দননগর মহকুমায়, আসলে একটা গণ্ডগ্রাম। চন্দননগর থেকে গঙ্গার উলটোদিকে প্রায় একঘণ্টা গাড়ি ছুটিয়ে তবে পৌঁছনো যায়। সবুজ খেত আর গাছগাছালিতে ভরা এলাকা, সরলাশ্রম জিজ্ঞেস করতেই একজন দেখিয়ে দিল দূরে।
রুদ্র আজ ইচ্ছে করেই অফিসের গাড়ি নেয়নি। সাধারণ গাড়িতে এসেছে। সঙ্গে রয়েছেন বীরেনবাবু।
আশ্রমটা অনেকটা জায়গা জুড়ে খোলা খেত, তার মাঝখানে। রাস্তা থেকে পায়ে চলা সরু পথ চলে গেছে আলের ওপর দিয়ে। রুদ্র আর বীরেনবাবু সেই আলপথের ওপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছলেন।
ছিমছাম আশ্রম। তরিতরকারির চাষ হচ্ছে একপাশে। অন্যদিকে চার-পাঁচটা একতলা বাড়ি। বাড়িগুলোর ছাদ টালির, সেই টালির ওপর বিছিয়ে রয়েছে কুমড়োলতা। সামনে অনেকটা করে খোলা জায়গা। সেখানে ফুটে আছে কিছু মরশুমি ফুল।
ওদের দেখে একজন বেরিয়ে এলেন। পরনে সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা, ঊর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়া। লম্বা দাড়ি প্রায় বুক ছুঁয়েছে।
”হরে কৃষ্ণ। কী চাই আপনাদের?” দুই হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকে ঠেকিয়ে তিনি স্মিতমুখে জিজ্ঞেস করলেন।
রুদ্রও হাতজোড় করল, ”নমস্কার। আপনার পরিচয়?”
”আমি ভর্তৃহরি মহারাজ। এই আশ্রমের দেখাশোনা করি। বলুন মা, কী প্রয়োজন?”
”আমি রুদ্রাণী সিংহরায়, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছি। একটা খুনের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার ছিল। এই আশ্রমের প্রধান কে?”
”খুন?” ভর্তৃহরি মহারাজের ভ্রূ দুটো কিছুটা ওপরে উঠেই আবার ঠিক হয়ে গেল, ”প্রধান হলেন শ্রী বিষ্ণুপদ মহারাজ। কিন্তু তিনি তো নেই, হিমালয়ে তীর্থে গিয়েছেন। তার পরিবর্তে আপাতত আমিই সব দেখাশোনা করছি। আপনি আমাকে বলতে পারেন। আসুন। ভেতরে আসুন।”
ছবিটা দেখে ভর্তৃহরি মহারাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ”হ্যাঁ, এটা আমাদের আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী গোপালমহারাজের জন্মবার্ষিকীতে তোলা। স্বপন সরকার আমাদের আশ্রমের নিয়মিত অনুগামী ছিলেন।”
”আর পাশের ভদ্রলোক?”
ভর্তৃহরি কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে বললেন, ”সম্ভবত ওঁকে স্বপন সরকারের কথায় আমরা আমন্ত্রণ করে এনেছিলাম। ওঁর একটি বড় অঙ্কের টাকা আমাদের তহবিলে দান করার কথা ছিল। কিন্তু তারপর উনি আর আসেননি।”
”আচ্ছা,” রুদ্র ঝুঁকে পড়ল, ”এই যে ছেলেটি স্বপন সরকারকে কিছু বলছে, এ তো মনে হচ্ছে আপনাদের আশ্রমের কেউ, কারণ বুকে ব্যাজ রয়েছে।”
”নানা।” ভর্তৃহরি মহারাজ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন, ”আমাদের আশ্রমে এমন কেউ নেই মা। উনি স্বপন সরকার মহাশয়ের সঙ্গেই আসতেন। সম্ভবত সহকারী। আমাদের আশ্রমে মূলত আট থেকে চোদ্দো বছরের অনাথ বালকদের শিক্ষা ও ভরণপোষণের ভার নেওয়া হয়। এখানে আমি ছাড়া আমারই বয়সি চারজন মহারাজ আছেন।”
রুদ্রর মুখটা নিভে গেল। অনেক আশা করে ও এসেছিল। ভেবেছিল, গোবিন্দকে এবার ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু এখন দেখছে গোবিন্দর সঙ্গে এই আশ্রমের কোনো সম্পর্কই নেই। স্বপন সরকারের সঙ্গে ও এসেছিল, এই যা।
হতাশ চোখে ও চারদিকে তাকাল। এটা একটা সাধারণ উপাসনাকক্ষ। মাটিতে নরম শতরঞ্জি পাতা। চারপাশের দেওয়ালে ঠাসা বই। যতদূর দেখতে পাচ্ছে, বেশিরভাগই সাধনা ও অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কিত বই। এত বই থাকার জন্য গোটা ঘরে কেমন একটা পুরোনো খবরের কাগজের মতো গন্ধ।
চারপাশ বড় শান্ত, নিঝুম।
সামনের বেদিতে একটি সাদাকালো পুরোনো ফটোফ্রেম। ছবিতে একজন বৃদ্ধ সাধক বসে আছেন ধ্যানের ভঙ্গিতে। একটি মেঝের চাতালে। পেছনে জানলা। জানলার ওপাশে গাছ ডালপালা মেলেছে।
ছবির সামনে জ্বলছে ধূপ।
গোটা আশ্রমে বিরাজ করছে কী অদ্ভুত শান্তি। বাইরের চাতাল দিয়ে মাঝে মাঝে নতমস্তকে হেঁটে যাচ্ছে কিছু কিশোর। তাদের এদিকে কোনো কৌতূহলই নেই।
”ইনি কে?” প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে রুদ্র ছবির দিকে নির্দেশ করল।
ভর্তৃহরি মহারাজ কপালে দু-হাত তুলে নমস্কার করলেন, ”আমাদের পরম পূজনীয় গুরুদেব। শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজ। উনিই এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন।”
রুদ্র চোখ সরু করে দেখছিল। ছবিটির নীচে লেখা রয়েছে :
শ্রী শ্রী গোপালকৃষ্ণ মহারাজ
আবির্ভাব : গোকুলাষ্টমী তিথি, ১৩২৭ বঙ্গাব্দ।
১৩২৭ বঙ্গাব্দ মানে … রুদ্র মনে মনে হিসেব করল। প্রায় একশো বছর আগের কথা।
”ইনি কি এখনো জীবিত?”
”জীবিত শব্দের অর্থ যদি এই নশ্বর তুচ্ছ দেহধারণকে বলেন, তবে আপনার প্রশ্নের উত্তর হবে ‘না’। কিন্তু আমাদের কাছে আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার মৃত্যু নেই। তাই দৈহিক তিরোভাব হলেও আমাদের কাছে তিনি জীবিত। তাই তিরোধানের তারিখ লেখা নেই। আমরা কারুরই তিরোধানে বিশ্বাস করি না, তাই সেই তিথি পালনও করিনা।” ভর্তৃহরি মহারাজ চোখ বন্ধ করে হাসিমুখে একটানা বলে গেলেন।
রুদ্র হাতজোড় করে প্রণাম করল। দেখাদেখি বীরেন শিকদারও।
”অনেক ধন্যবাদ মহারাজ।” রুদ্র উঠে দাঁড়াল, ”আপনি হয়তো জানেন না, স্বপন সরকার ও তাঁর পরিচিত এই হৃষীকেশ জয়সোয়াল দুজনেই খুন হয়েছেন।”
”অ্যাঁ!” ভর্তৃহরি মহারাজ মুহূর্তে বিস্মিত, ”সেকি!”
”হ্যাঁ। আমরা সেই হত্যার তদন্ত করছি। এই ছেলেটি যদি আশ্রমে আসে, অবশ্যই আমাদের জানাবেন। এই আমার কার্ড। এতে নম্বর লেখা রয়েছে।” রুদ্র বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
”নিশ্চয়ই। হরে কৃষ্ণ। পরমগুরু আপনাদের মঙ্গল করুন।”
রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সত্যি, ওরা সাধারণ মানুষরা নিজেদের সুখ দুঃখ নিয়েই মগ্ন, চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশে ব্যস্ত। অথচ এই সন্ন্যাসীরা কেমন নিঃস্বার্থভাবে প্রচারের অন্তরালে সমাজের কল্যাণ করে চলেছেন। রুদ্রর মাথা শ্রদ্ধায় নুয়ে এল।
আবারও করজোড়ে নমস্কার করে ও বেরিয়ে এল।
১৭
”যদা যদা হি ধর্মস্য
গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য
তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং
বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।।
ধর্মসংস্থাপনার্থায়
সম্ভবামি যুগে যুগে।।”
পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ শ্লোকপাঠ শেষ করে মৃদু হাসলেন, ”শ্রীমদ্ভগবদগীতা। চতুর্থ অধ্যায়। সপ্তম ও অষ্টম শ্লোক। শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলছেন অর্জুনকে।”
উইলিয়াম জোন্স বাইরের চাতালের একপাশে হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন। ভ্রূ কিছুটা কুঞ্চিত করে তিনি বললেন, ”এখানে ভারত অর্থে কি ভারতবর্ষ, পণ্ডিত?”
”না। অর্জুন ভরতবংশীয়, তাই তাঁকেই ভারত বলে সম্বোধন করেছেন শ্রীকৃষ্ণ।”
”গোটা শ্লোকটির অর্থ, পণ্ডিত?”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বললেন, ”অর্থাৎ, ধর্ম যখনই গ্লানিযুক্ত হয়, অধর্মের যখন অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি দেহধারণ করি। দুষ্কৃতিদের বিনাশ করে সাধুদের রক্ষা করার জন্য এবং অধর্মকে উচ্ছেদ করে আবার ধর্মকে সংস্থাপন করতে আমি যুগে যুগে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হই।”
জোন্স হেসে ফেললেন। ভাঙা বাংলায় বললেন, ”কিন্তু ইহা তো আমাদের আইনের উলটোপথে হাঁটে, পণ্ডিত!”
”কেন?”
”এই শ্লোক মানতে হলে কোনো দুষ্ট লোককে যদি হত্যা করা হয়, তবে হত্যাকারীকে কোনো শাস্তি প্রদান করা যাইবে না।” উইলিয়াম জোন্স স্মিতমুখে বললেন, ”তা তো হয়না। আমাদের কোম্পানি কোনো বাছবিচার করে না, পণ্ডিত। কোনো লোক যদি খুব খারাপ কাউকে হত্যা করে, তবুও তার শাস্তি হইবে। কারণ, আইন নিজের হস্তে কেউ লইতে পারেনা। শাস্তি দেবে আদালত, মানুষ নিজে নয়। তাই তুমি ইহা তোমার বইতে লিখো না।”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন। দীর্ঘ ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে বললেন, ”তুমি এতদিন আমার কাছে পড়ে সাধুচলিত মেশানো ভয়ঙ্কর গুরুচণ্ডালী দোষসমৃদ্ধ বাংলা বলতে শিখেছ, সাহেব। সংস্কৃতভাষার আক্ষরিক অর্থও উদ্ধার করতে শিখেছ। কিন্তু অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উদ্ধার করার বিদ্যা এখনো আয়ত্ত করতে পারোনি। এই শ্লোক কোনো সাধারণ মানুষ বলছেন না। বলছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুনকে। হিন্দুশাস্ত্রমতে যে চারটি যুগ, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই প্রতিটি যুগের একেবারে অন্তে এসে অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। অশুভশক্তিকে পরাস্ত করে পুনরায় শুভশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই মর্ত্যলোকে। অবতাররূপে। কখনো তিনি মৎস্য, কখনো তিনি কূর্ম, কখনো তিনি নৃসিংহ, আবার কখনো বামন অবতাররূপে। একমাত্র তাঁরই অধিকার, অশুভের বিনাশসাধন করা। সাধারণ মানুষের এই কর্ম নয়, সাহেব!”
”এবার বুঝিলাম।” জোন্স বললেন, ”আচ্ছা, এই যে তোমাদের চারটি যুগ। এগুলোর ব্যাপ্তি কতদিনের?”
তর্কপঞ্চানন চিন্তা করে বললেন, ”পুরাণ অনুযায়ী একেকটি যুগের সময়কাল তার আগের যুগের চেয়ে এক গুণ কম। যেমন সত্যযুগ ছিল ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর ধরে। বর্তমান কলিযুগের প্রায় চারগুণ। ত্রেতাযুগ ছিল কলি যুগের তিন গুণ, ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার বছর ধরে। দ্বাপর যুগ কলিযুগের মাত্র দ্বিগুণ ছিল, তার সময়কাল ছিল ৮ লক্ষ ৬৪ হাজার বছর। কলিযুগের একেবারে অন্তে আবির্ভূত হবেন দশম অবতার কল্কি। তিনিই বিনাশ করবেন সবকিছু।”
”দ্বাপরের ঠিক অর্ধেক। অর্থাৎ ৪ লক্ষ ৩২ হাজার বছর।” তর্কপঞ্চানন বললেন।
”তো সেই কলিকালের কতদিন ইতিমধ্যে অতিবাহিত হইয়াছে, পণ্ডিত?” জোন্স ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করলেন।
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন, ”কলিযুগের শেষ প্রায় আসন্ন, সাহেব!”
”সেকী! তবে আমাদের এত পরিশ্রম?” উইলিয়াম জোন্স ভীত হওয়ার ভান করে বললেন, ”সবকিছুরই যদি বিনাশ ঘটে যায়, কী হবে দেশীয় লোকেদের জন্য আইনের বই লিখে? তুমিই বা তোমার ‘দশানন বধ’ করে কী করবে?”
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন হাসলেন। বললেন, ‘দশানন বধ’ আমার মনের তাগিদ। দশানন অর্থে রাবণ। তাঁর দশটি মুখ হলেও আমার লক্ষ্য আটটি অসুরবধ। চারপাশে প্রচুর স্মার্ত পণ্ডিত। তাঁরা আদি বেদকে না মেনে নিজেদের মতো করে অপভ্রংশে ভরিয়ে দিচ্ছেন আমাদের শাস্ত্রকে। প্রতি কৃষ্ণপক্ষে আমি যে এই দশাননবধের সংকল্প নিয়েছি, এতে একে একে আটটি সভায় এই জাতীয় পণ্ডিতদের আমি তর্কযুদ্ধে পরাজিত করব। এতে সাধারণ মানুষের কাছেও সত্যটা ছড়িয়ে পড়বে। সাতটি ইতিমধ্যেই সমাপ্ত করেছি।”
”তোমার এই সংকল্পের মধ্যেই যদি কল্কি অবতার চলিয়া আসেন?” জোন্স কৃত্রিম ভয়ের ভাব ফুটিয়ে তুললেন মুখের অভিব্যক্তিতে।
জগন্নাথ সহাস্যে বললেন, ”মহাজাগতিক হিসেব অনেক প্রসারিত, সাহেব। আমাদের একসহস্র সৌরবর্ষ হয়তো প্রজাপতি ব্রহ্মার এক নিশ্বাসের সমতুল। কাজেই অত দুশ্চিন্তা কোর না।”
জগন্নাথ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রঙ্গালাপে ছেদ পড়ল।
চাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে চতুষ্পাঠীর এক উঁচু শ্রেণীর ছাত্র। নীরবে এসে গুরুকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল সে।
”জয়তু।” তর্কপঞ্চানন আশীর্বাদ করলেন, ”নদীয়া থেকে কখন এলে, কৃষ্ণদাস?”
”কয়েক দণ্ড পূর্বে, গুরুদেব।”
”উত্তম। যাও, গিয়ে বিশ্রাম নাও। আহারাদি হয়েছে?”
কৃষ্ণদাস মাথা হেলাল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সুবিশাল চতুষ্পাঠীর সে আবাসিক ছাত্র। এখানে প্রায় আটশো ছাত্র থেকে পড়াশুনো করে। সব মিলিয়ে একখানা বৃহৎপল্লি প্রায়।
সে কিছু সংকোচে বলল, ”অভয় দিলে একখানা কথা জানাই, গুরুদেব।”
”কী, বলো?”
”শুনে এলাম, নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র এক বিশাল বাজপেয় যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। সমগ্র বঙ্গের খ্যাতনামা পণ্ডিতবর্গ তো বটেই, সুদূর কাশী, মিথিলা, কান্যকুব্জ এমনকি দ্রাবিড় থেকেও বিখ্যাত পণ্ডিতরা নিমন্ত্রিত হয়েছেন সেই যজ্ঞে।”*
”বেশ।” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”তো?”
কৃষ্ণদাস কিছুক্ষণ মৌন থেকে উষ্মাভরা কণ্ঠে বলল, ”আপনি ত্রিবেণীর সূর্য, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। আপনাকে নিমন্ত্রণ না করাটা কি ভয়ংকর অপমান হল না, গুরুদেব?”
তর্কপঞ্চানন মৃদু হাসলেন। তারপর উইলিয়াম জোন্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”কী বুঝছ, সাহেব?”
উইলিয়াম জোন্স বললেন, ”রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর দেখি তোমার ওপর রাগ কিছুতেই যাইতেছে না। তুমি গত একবছরে বড় বড় সব পণ্ডিতকে পরাস্ত করেছ বাকযুদ্ধে। তারপরেও তোমাকে এমন গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ কী, পণ্ডিত?”
তর্কপঞ্চানন বললেন, ”ক্রোধ বিষয়টি এক্ষেত্রে একমুখী নয়, সাহেব, দ্বিমুখী।”
”অর্থাৎ শুধু রাজার তোমার প্রতি নয়, তোমারও রাজার প্রতি রাগ। কিন্তু কেন?”
”কারণ অতি জটিল, সাহেব। বলতে গেলে আজকের সন্ধ্যা নিঃশেষ হয়ে যাবে, তোমার অধ্যয়ন হবে না।”
”রোজই তো অধ্যয়ন করছি পণ্ডিত। কিন্তু আজ যে বড় জানতে ইচ্ছা যাচ্ছে, কী কারণে আপনার প্রতি তিনি এত অসন্তুষ্ট। যেখানে তাঁর বিদ্যোৎসাহের কথা সর্বজনবিদিত। অগণিত পণ্ডিতকে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া থাকেন। সেখানে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের প্রতি তাঁর এই রোষ কেন?”
তর্কপঞ্চানন তিক্তস্বরে বললেন, ”তোমরা সাহেবরা তো এই প্রশ্ন করবেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যে তোমাদের বড় সুহৃদ মনে করেন। কিন্তু নবকৃষ্ণ মুন্সী আর ওই কৃষ্ণচন্দ্র রায় যতই তোমাদের পা চাটুক, আমার চোখে তারা বিশ্বাসঘাতক। প্রবঞ্চক।”
”বিশ্বাসঘাতক?” উইলিয়াম জোন্স শব্দটির মর্মার্থ কিছু সময় নিয়ে উদ্ধার করলেন এবং হতবাক হয়ে গেলেন, কিন্তু এ’কথা তোমার কেন মনে হচ্ছে পণ্ডিত?”
_____
* নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুবর্ষ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন ১৭৮২, কেউ ১৭৮৩। উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় আসেন ১৭৮৩ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সঙ্গে তাঁর দিনের পর দিন নানা বিষয়ে আলোচনা চললেও তাতে ‘জীবিত’ কৃষ্ণচন্দ্র না আসাটাই তাই স্বাভাবিক। উপন্যাসের স্বার্থে তাই এখানে লেখকের সজ্ঞান Anacronism অধিকার প্রয়োগ করে তর্কপঞ্চানন—জোন্স প্রসঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রকে বর্তমান রাখা হল।। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ও উইলিয়াম জোন্স সম্পর্কিত বাকি ঘটনাবলি অবশ্যই ইতিহাস আধারিত।
১৮
জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন অনেকক্ষণ মৌন রইলেন। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে প্রায়। চতুষ্পাঠী সংলগ্ন তাঁর বসতবাটী থেকে সন্ধ্যাবেলার শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাঁকে এবার উঠতে হবে।
”বলো না পণ্ডিত! আজ যে বড় জানতে ইচ্ছে করছে, তোমাদের দুজনের এই শীতলযুদ্ধের কারণ কী!” উইলিয়াম জোন্স অনুনয় করলেন। তাঁরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। গার্ডেনরিচের বাড়িতে একাকী রয়েছেন স্ত্রী অ্যানা মারিয়া শিপলি। আগামীকাল প্রত্যুষের মধ্যে পৌঁছতেই হবে।
জোন্স যখন আটত্রিশ বছরের তরুণ, বিবাহের মাত্র কুড়িদিনের মধ্যে নবপরিণীতা অ্যানাকে নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে চেপে বসেছিলেন ভারতগামী জাহাজে। প্রাচ্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ আশৈশব, অ্যানা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর এই ইচ্ছাকে।
তারপর থেকে জোন্স ক্রমশই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব সামলে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন বেদ, সংস্কৃতশিক্ষায়। উপলব্ধি করেছেন, ভারতবর্ষকে চিনতে গেলে জানতেই হবে আদিভাষা। তাই তো তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে ঘুরে বেড়ান কখনো নদীয়া, কখনো ত্রিবেণী, কখনো মুর্শিদাবাদে। পেতে চান তর্কপঞ্চাননের মতো পণ্ডিতদের সাহচর্য। ওদিকে অ্যানা এই বিদেশবিভুঁইয়ে ক্রমশই বোধ হয় আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন।
”এইসব বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে সাহেব।” তর্কপঞ্চানন চোখ বন্ধ করলেন, ”তা তোমার ভালো নাও লাগতে পারে। তোমরা ভাবো আমি পণ্ডিত মানুষ, লেখাপড়া নিয়ে থাকি, দেশের খবর রাখিনা। জগন্নাথ পণ্ডিতকে তোমরা অন্ধ পাওনি সাহেব। প্রথমে বর্গীরা এসে দেশটা ছারখার করল, এখন ফিরিঙ্গিরা। আলিবর্দি খা’র নাতি সিরাজকে তোমরা যেভাবে অন্যায়ভাবে সিংহাসন থেকে সরালে, তা তোমাদের উপযুক্ত আচরণ নয়। সিরাজ ছোকরার চরিত্রের দোষ যতই থাক, সে কিন্তু এতগুলো পাকা মাথার ষড়যন্ত্রেও মাথা না নুইয়ে শেষ অবধি লড়ে প্রাণ দিয়েছে। নবকৃষ্ণ মুন্সী আর কৃষ্ণচন্দ্র রায় ক্লাইভের সঙ্গে যোগ দিয়ে দল ভাঙিয়ে সিরাজকে হারানোটা যতই ‘হিন্দুর জয়’ বলে গৌরবান্বিত করুক, দেশ কিন্তু বিদেশিদের হাতে গেল ওদের জন্যই। তবে হ্যাঁ, ওদের ওই বিশ্বাসঘাতকতার উপহারমূল্য তোমাদের ক্লাইভ দিয়েছে। মীর জাফর, রামচাঁদ রায়ের সঙ্গে মিলে সিরাজের কোষাগার লুঠ করে নবকৃষ্ণ এখন রাতারাতি রাজার ধন পেয়ে গিয়েছে। আর কৃষ্ণচন্দ্র তো আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে।”
”মিরজাফরকে সরিয়ে তারপর তো নবাব হয়েছিল তাঁর জামাতা মিরকাশিম।”
”সরিয়ে বলো না।” তর্কপঞ্চানন তিক্তমুখে বললেন, ”বলো সরানো হয়েছিল। তোমাদের ক্লাইভের খিদে আর কত মেটাত মিরজাফর? কোষাগার তলানিতে, এদিকে ক্লাইভের হুকুম, প্রজাদের মেরেধরে যাহোক করে খাজনা দিতেই হবে। এত দিয়েও মিরজাফর খিদে মেটাতে পারল না, মসনদে তাই বসানো হল মিরকাশিমকে। মীর কাশিম যদিও শ্বশুরের মতো অমেরুদণ্ডী প্রবঞ্চক ছিল না, কিন্তু সে তো ছিল পরিস্থিতির শিকার, ফিরিঙ্গিদের ক্রীড়নক মাত্র। তার হাতে ক্ষমতা কিছুই ছিলনা, এদিকে খাজনা আদায়ের পাহাড়প্রমাণ চাপ। কী-বা করত সে!”
উইলিয়াম জোন্স অনেকক্ষণ নির্বাক রইলেন। তারপর বললেন, ”আমাদের ওপর তোমার এত রাগ, পণ্ডিত? আগে তো কখনো বুঝিনি!”
”আগে তো কখনো এ’সব নিয়ে কথা বলোনি সাহেব!” তর্কপঞ্চানন হাসলেন, ”লেখাপড়ার দিকে তুমি অবশ্যই আমার বন্ধু। আছে এবং থাকবেও। কিন্তু তাই বলে সত্যটা মিথ্যা হয়ে যায়না। নদীয়াধীশ্বরের ওপর আমার আরও একটি কারণে রাগ। তুমি ঢাকার রাজবল্লভ সেনের নাম শুনেছ তো? প্রথমে মুর্শিদাবাদের জগত শেঠদের কর্মচারী হয়ে জীবন শুরু করলেও লোকে তাঁকে রাজা বলেই চিনত ও মানত।”
”শুনেছি। কিন্তু তিনিও তো শুনেছিলাম সিরাজকে তাড়াতে ষড়যন্ত্র করেছিলেন।”
”ভুল কিছু শোননি। সে আমার কোনো প্রিয়পাত্রও ছিল না। কিন্তু এই ঘটনাটি ভিন্ন। বেশ কয়েকবছর আগের কথা। রাজবল্লভের কন্যা মাত্র আটবছর বয়সে বিধবা হয়েছিল। কন্যার অকালদুর্দশায় শোকে কাতর হয়ে সে ঠিক করল কন্যার বিধবা বিবাহ দেবে। তাঁর রাজ্যের সব পণ্ডিতদের বিধান জানতে চাইল। তা তাঁরা তো ভয়েই অস্থির। কেউ ঠিক করে কিছু বলতে পারল না। অবশেষে সে লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে।”
”বিধবা বিবাহ! হিন্দু নারীদের! সে তো কল্পনার বাইরে! পণ্ডিত, তুমি নিশ্চয়ই অমত করলে?”
তর্কপঞ্চানন খরচোখে তাকালেন, ”অমত করতে যাব কেন সাহেব? তোমাকে যে দিনরাত অবসরে সংহিতা ও উপনিষদগুলো পড়তে বলছি, তা একেবারেই অগ্রাহ্য করছ?”
উইলিয়াম জোন্স অপ্রতিভ হলেন। বললেন, ”পড়ছি তো। বেদের চারটি ভাগ। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, ও উপনিষদ। জানি তো!”
”তো জানো যখন, পরাশর সংহিতার সেই শ্লোকটা কি আমি তোমাকে বলিনি?” তর্কপঞ্চানন আদর্শ শিক্ষকের ভঙ্গিতে তিরস্কার করে উঠলেন।
”কোন শ্লোক?”
”নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”পতি নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক বা পতিত হলে স্ত্রী আবার বিবাহ করতে পারে।”
”সেকি!” উইলিয়াম জোন্স চমকে উঠলেন, ”পরাশর সংহিতায় রয়েছে এই শ্লোক?”
”হ্যাঁ। পরাশর মুনি স্বয়ং নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। আমি বলার কে! আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্মতি রাজবল্লভের দূতকে জানিয়ে দিলাম। জগন্নাথ পণ্ডিতের নিদান বলে কথা, কাশী থেকে বৃন্দাবন, কনৌজ থেকে বাংলা, দেশের সব পণ্ডিত অমনি বলতে শুরু করল, ঠিক ঠিক! আমরাও রাজি!”
”তারপর?”
”বিবাহের আয়োজন যখন প্রায় সম্পূর্ণ, সেইসময় রুখে দাঁড়ালেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র। তোমরা ওঁকে যতই বিদ্যানুরাগী হিসেবে চেনো, ওঁর মতো রক্ষণশীল, ধর্মের অনুশাসনের নামে অন্ধ শাসক খুব কম রয়েছে। তিনি তাঁর নবদ্বীপের সব পণ্ডিতকে এককাট্টা করলেন। বললেন, এই বিবাহ ভয়ঙ্কর পাপের সমতুল্য। রাজবল্লভ তার দূতকে দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে বলে পাঠাল, পরাশর সংহিতা অনুযায়ী এই বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ। তখন কৃষ্ণচন্দ্র কী করলেন জানো?”
”কী?”
”দূতকে দিয়ে তিনি নানা সৌজন্যমূলক উপহারের সঙ্গে পাঠালেন একটি গো শাবক। বললেন, বিধবাবিবাহের পর যেন রাজবল্লভ সেই গো শাবকটির মাংস ভক্ষণ করেন। বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসিদ্ধ হলেও তা নাকি লোকাচারবিরুদ্ধ, দেশাচারের পরিপন্থী, তাই তা মহা পাপ।”
”তারপর?”
”রাজবল্লভ এমনিতে মহা সাহসী হলেও এইসব বিষয়ে ছিল ভীষণ ভিতু।” তর্কপঞ্চানন তিক্ত কণ্ঠে বললেন, ”গোটা নবদ্বীপের চক্ষুশূল হতে সে চাইল না। বিবাহের আয়োজন বন্ধ হয়ে গেল।”
উইলিয়াম জোন্স অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। বললেন, ”সত্যি পণ্ডিত! তোমার এক নতুন রূপ আজ আমি দেখতে পাচ্ছি। হিন্দু পণ্ডিত হয়েও তুমি যে এত যুক্তিবাদী, এত মুক্তমনা, আমি জানতাম না।”
”মন তো মুক্ত রাখতেই হবে সাহেব!” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”মন বন্ধ রাখলে আমি শিক্ষা আহরণ করব কী করে?”
”ঠিকই।” উইলিয়াম জোন্স বললেন, ”তবে আমার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর এখনো পেলাম না। তুমি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি অপ্রসন্ন তা তো বুঝলাম। কিন্তু তিনি তোমার ওপর এত কূপিত কেন?”
তর্কপঞ্চানন বললেন, ”ওহ! সে আবার অন্য এক প্রসঙ্গ। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারকে একবার বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন ভাবের কবিতা রচনা করতে পারলে একশো বিঘা নিষ্কর ভূমি ও একশো রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার দেবেন। কিন্তু বাণেশ্বর যাই রচনা করতে যান, তারই প্রতিচ্ছবি ইতিহাস বা পুরাণে পান। অবশেষে অন্তিম দিনে তিনি একটি কবিতা রাজদরবারে পাঠ করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন অন্যান্য সমস্ত পণ্ডিতকে বাণেশ্বরের কবিতার অনুরূপ কোনো ভাব ইতিমধ্যেই আছে কিনা, তা সন্ধান করতে বলেন। পুরস্কারের লোভে একমাস ধরে অত্যুৎসাহে পণ্ডিতরা প্রচুর অনুসন্ধান করলেও বাণেশ্বরের সঙ্গে পুরোনো কোনো কাব্যের মিল পেলেন না।”
”তারপর?”
তর্কপঞ্চানন বলতে যাচ্ছিলেন, কৃষ্ণদাস সোৎসাহে বলল, ”আমি বলব, গুরুদেব?”
গুরুর গর্বে গর্বিত শিষ্যের উৎসাহ তর্কপঞ্চানন স্তিমিত করতে চাইলেন না। বললেন, ”বেশ। বলো।”
কৃষ্ণদাস বলতে লাগল, ”রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন কবি বাণেশ্বরকে পুরস্কৃত করতে যাবেন, ঠিক তখনই বিশেষ কাজে আমাদের পূজনীয় গুরুদেব কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে উপস্থিত হলেন। রাজা তখন গুরুদেবকে অনুরোধ করলেন, কবিতাটি একবার শুনতে। গুরুদেব শোনামাত্র স্মিতহাস্যে বললেন, এই কবিতার অনুরূপ সংস্কৃতে না থাকলেও তুলসীদাসের একটি দোঁহার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায়।
জগ্মে তোম যব আয়া, সব হাঁসা, তোম্ রোয়।
এয়সা কাম করো পিছে হাঁসি না হোয়।।
গুরুদেব দোঁহা আবৃত্তি শেষ করলে বাণেশ্বর লজ্জিতমুখে নিজের দোষ স্বীকার করলেন। তিনি সম্ভবত কল্পনাও করতে পারেননি, সংস্কৃত বা প্রাকৃত কাব্য ছেড়ে কেউ দোঁহাতেও খোঁজ করতে পারেন।”
”গ্রেট পণ্ডিত!” উইলিয়াম জোন্স বললেন, ”অসাধারণ তোমার স্মরণশক্তি। যত শুনি, যত দেখি, ততই অবাক হইয়া যাই। কিন্তু এতে রাজা তোমার ওপর রেগে গেলেন কেন?”
”বলছি।” তর্কপঞ্চানন বললেন, ”নদীয়াধিপতি তখন খুশি হয়ে আমায় তাঁর রাজ্যে বসতি স্থাপনে আহ্বান করেন। কিন্তু আমি বলি, বর্ধমানরাজ ও আঞ্চলিক শূদ্রমণি জমিদারদের কৃপায় আমি ত্রিবেণীতেই ভালো আছি, আমি কোথাও যাব না।”
”সেকি! বর্ধমানের রাজা তো শুনেছি কৃষ্ণচন্দ্রের পরম শত্রু!”
”ঠিকই শুনেছ। আমি বর্ধমানরাজের প্রশংসা করায় তিনি কুপিত হন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিদ্যোৎসাহী, কাব্যানুরাগী, মহান দাতা ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে অতি অহংকারী ও দাম্ভিক। এরপর থেকেই তিনি নানা উপায়ে আমাকে হেনস্থা করতে শুরু করেন, কিন্তু প্রতিবারই নিজেই অপমানিত হন।”
”যেমন?”
”একবার তিনি আমাকে বললেন, আপনি তো বহুল শাস্ত্রদর্শী, বলুন তো, কার প্রতারণায় উন্মার্গগামী মূর্খেরা দু-হাত তুলে ভ্রমণ করে?
আমি জানতাম, রাজা শক্তির উপাসক। শ্রীচৈতন্যের ঘোর বিরোধী। বৈষ্ণবদের তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারেননা। আমি হেসে বললাম, আজ বিশ্বাস হল, শ্রীচৈতন্যদেব প্রকৃতই অবতার ছিলেন।
রাজা বললেন, কীভাবে?
আমি বললাম, ”ভগবান বিষ্ণুর প্রত্যেক অবতারকালেই অসুরসম এক দুরন্ত রাজা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেমন, হিরণ্যাক্ষ, হিরণ্যকশিপু, বলি, রাবণ, কংস। আমাদের শ্রীচৈতন্য অবতারের প্রায় সমসাময়িক অসুর রাজাটিকে আজ চাক্ষুষ করলুম।
ভরা রাজসভায় এই অপমানে কৃষ্ণচন্দ্র আরও রেগে গেলেন। এরপরও নানা ছোটখাটো শাস্ত্রানুসারী আচারবিচারে প্রথমে আমার বিরুদ্ধাচরণ করেও পরে অজ্ঞতার কারণে পরাস্ত হয়েছেন। এইজন্যই তিনি আমার ওপর সন্তুষ্ট নন।”
অনেকক্ষণ বলার পর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন থামলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, ”তবে হ্যাঁ। নিমন্ত্রিত হই না হই, ওই বাজপেয় যজ্ঞে আমি আমার ছাত্রসহযোগে উপস্থিত হব।”
”সেকী? বিনা নিমন্ত্রণে?”
”উপায় নেই, সাহেব।” জগন্নাথ স্বভাবসিদ্ধভঙ্গিতে মৃদু হাসলেন, ”আমি না গেলে ওই মিথিলা, কান্যকুব্জের পণ্ডিতরা যে বঙ্গের পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে ধরাশায়ী করে চলে যাবেন। সে যে বড় লজ্জার বিষয় হবে, সাহেব! তাঁরাও ভাববেন, জগন্নাথ পণ্ডিত বুঝি তর্কের ভয়ে আসেননি। কৃষ্ণদাস, তুমি আমার সহকারীকে প্রেরণ করো, দ্রুত নদীয়া যাত্রার আয়োজন করতে হবে। আমার দশানন বধের অন্তিম পর্বে বধিত হবেন স্বয়ং এই যুগের রাজা হিরণ্যকশিপু।”
১৯
গুরুদেব ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, ”এ’সব কী হচ্ছে কৃষ্ণকান্ত, বংশীধর, গোপাল? সমাজের এতবছরের ইতিহাসে খুব কম জনই এভাবে বিনা অনুমতিতে বাইরে বেরোতে পেরেছে। আর যারা পেরেছে, তারা কেউ বেশিদিন বেঁচে থাকেনি। আর সেখানে এতগুলো মাস কেটে গেল, থাকো গোপালের বৌ-মেয়ের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না?”
কৃষ্ণকান্ত লাহিড়ী ও গোপাল ব্যানার্জি নির্বাক হয়ে হুঁকা টানছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র বংশীধর, গোবর্ধন ও মধুসূদন নতমস্তকে বসে রয়েছেন অদূরে। প্রতি বুধবারের মতো আজও গোধূলিলগ্নে গুরুদেবের বাসকুটিরের অদূরে উপাসনামন্দিরে চলছে আলোচনা। অতি গোপন এই আলোচনাসভা, তাই বাইরে দণ্ডায়মান দুই অতন্দ্র প্রহরী।
উপাসনামন্দিরের পাশ দিয়েই শুরু হয়েছে বিস্তৃত অরণ্য। সেদিক এতই ঘন, যে বাইরের আলোও তেমন ঢোকেনা। অল্প আলোয় সবার মুখই কেমন ছমছমে লাগছে।
বংশীধর অনুদাত্ত স্বরে বললেন, ”সন্ধান পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব। কিছুটা আকস্মিকভাবেই। যে নারী হরিসাধনের সন্ধানে আশ্রমে গিয়েছিলেন, তাঁর গৃহেই রয়েছে মা-মেয়ে।”
”হরিসাধনের সন্ধানে বলতে?”
”কনেনগরের স্বপন সরকারের বিষয়টি যে সামলেছিল, সেই হরিসাধন। তার একটা যান্ত্রিক ছবি নিয়ে ওই নারী গিয়েছিলেন সরলাশ্রমে।”
”তো? একজন ব্যক্তি বিশেষত এক তুচ্ছ নারীর কাছ থেকে কেড়ে আনতে এত ভয়?” গুরুদেব তিরস্কারের সুরে বললেন, ”তবে তো যে যুদ্ধের আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাতে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাই বাতুলতা।”
”আমাদের ছেলেরা চেষ্টা করছে গুরুদেব। বেশিদিন লাগবে না।” গোপাল ব্যানার্জি হুঁকা নামিয়ে বললেন, ”এই সামান্য বিষয় নিয়ে মনে হয় এত উতলা না হওয়াই ভালো। মা ও কন্যা দুজনেই অতি নিরীহ। জানাজানি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই গুরুদেব। এখন এমনিতেই অতি অনুসন্ধানে অন্য আশঙ্কা রয়েছে। বংশীধর, মধুসূদন বা গোবর্ধন, ওরা প্রত্যেকেই গিয়েছে। ধরা পড়ে যেতে পারে।”
”আচ্ছা, মা-মেয়ের বিষয়টা আমি দেখছি।” গুরুদেব অন্যদিকে মুখ ঘোরালেন, ”ওদিকের কী অবস্থা, মধুসূদন?”
মধুসূদন বললেন, ”সব কুশল গুরুদেব। ভর্তৃহরি অতি কৌশলে গোটা বিষয়টি সামলাচ্ছে। প্রতিটি সপ্তাহে দশজন করে গোপনে চলে যাচ্ছে ওখানে। কিছুজন গোশালায় নিযুক্ত হচ্ছে। কিছুজন অন্যান্য কাজে।”
”হুম।” গুরুদেব বললেন, ”বহুপ্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্র মহোৎসবের আর বেশি বিলম্ব নেই। তার আগে সমস্ত কন্টক আমাদের উৎকীর্ণ করতেই হবে। আগে যে দু’বার ব্যর্থতা এসেছে, তার পুনরাবৃত্তি আর কিছুতেই হতে দেওয়া যাবেনা। বারবার তিনবার।”
গোবর্ধন বললেন, ” গুরুদেব, যদি অভয় দেন তো একটি কথা বলি।”
”বলো গোবর্ধন।”
”যে অবাধ্য বালকটিকে আপনি কয়েকদিন আগে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকে কিন্তু পাওয়া যায়নি।”
”কী!” প্রচণ্ড বিস্ময়ে চমকে উঠলেন গুরুদেব, ”পাওয়া যায়নি মানে? আমি তো বলেছিলাম পরের দিন প্রত্যুষেই যেন তাকে উদ্ধার করা হয়। অতি বুদ্ধিদীপ্ত হলেও সে জেদী। জেত কমানোর জন্য সারারাত্রি ব্যাপী ওই আতঙ্কই তার শাস্তি।”
”উদ্ধার করতে গিয়েছিল কৈবর্তরা।” গোবর্ধন আড়ষ্টভাবে বললেন, ”কিন্তু জরা নদীর চরে তাকে পাওয়া যায়নি। ভয়ে এই কথা আপনাকে কালু বলতে সাহস পায়নি গুরুদেব!”
”একী সাংঘাতিক কথা। তোমরা কী জানো ওর ইতিহাস? ওর পিতার নাম ছিল দীনবন্ধু। সে ভয়ংকর অপরাধ করেছিল প্রায় দুইযুগ আগে। এক কৈবর্তকন্যাকে বিবাহ করেছিল সে। তখনও প্রথম গুরু জীবিত। সেইসময়ে সমাজের সবচেয়ে শ্রুতিধর ও মেধাবী ছাত্র ছিল দীনবন্ধু। অস্পৃশ্য বিবাহের মতো ঘোরতর অপরাধেও প্রথম গুরু ওকে তেমন শাস্তি দেননি। বিবাহের পর এক পুত্র জন্মায়। সেই পুত্র শুদ্রগর্ভে জন্মালেও ব্রাহ্মণপল্লিতেই বড় করার নিদান দেন তিনি।”
মধুসূদন অস্ফুটে বললেন, ”মনে আছে। আর অচ্যুত নামের এই ছেলেটি দীনবন্ধুখুড়োর দ্বিতীয় পুত্র। দীনবন্ধু মারা যাওয়ার পর শ্মশানঘাট থেকে প্রথম পুত্রটি পালায়। সে আমার বাল্যবন্ধু ছিল। আর তাকেই আমি…।”
”নির্ভুল বলেছ, মধুসূদন!”
মধুসূদন বললেন, ”মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে ও আমাকে কিন্তু শনাক্ত করতে পারছিল, জানেন গুরুদেব! বাল্যবন্ধুর সঙ্গে পরিণত বয়সের নতুন বন্ধুর অদ্ভুত সাদৃশ্য ওকে সন্দিগ্ধ করে তুলছিল। তাই মৃত্যুর সময়ে ও খুব একটা বিস্মিত বোধ হয় হয়নি। শুধু বলেছিল, তুমি এত রাতে এখানে?”
গুরুদেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, ”তুমি কি নরম হয়ে পড়ছ, মধুসূদন?”
”না গুরুদেব!” সচকিত হয়ে উঠলেন মধুসূদন।
”হ্যাঁ, নরম না হওয়াই উচিত। এই বিষয়ে মনকে একেবারেই প্রশ্রয় দেবে না।” গুরুদেব বললেন, ”প্রথম গুরুর নরম মনোভাবের অপব্যবহার করেছে অনেকে। তাই গত কয়েকমাসে আগে এই বিনাশ অভিযান চালিয়েছি আমি। সমস্ত কন্টক নির্মূল হলেই আমাদের মহা অভিযান শুরু করার মনোবল পাব আমরা। কিন্তু আগে এই ছেলেটির সন্ধান করো। ছেলেটির অবাধ্যতা তার রক্তেই রয়েছে।”
”হ্যাঁ গুরুদেব।” মধুসূদন বললেন।
”ওপারে গিয়েছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?” গুরুদেব চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
”না। আজই লোক পাঠাব।”
গুরুদেব উঠে দাঁড়ানো মাত্র দ্বারিকা মাথা নীচু করে বসে পড়ল।
ওর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। মনে হচ্ছে, উত্তেজনায় হৃদপিণ্ডটা মুখ দিয়ে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে।
অচ্যুতকে পাওয়া যায়নি?
তার মানে … তার মানে অচ্যুত পালিয়েছে!
গুরুদেবের কুটিরের পেছনেই অনেকটা বনবাদাড়। সামনের দিকে প্রহরী থাকলেও এদিকে সাপখোপের উৎপাতে কেউ থাকেনা।
দ্বারিকা সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছিল। ওপরে বিশাল বিশাল গাছের ছায়া ঢেকে রেখেছিল ওকে। সেই ছায়ার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ওর গায়ে পড়ছিল সূর্যের আলো।
মাহেন্দ্র মহোৎসব কী? মহোৎসব তো বার্ষিক অনুষ্ঠান, ওদের এই বৈদিক সমাজের পবিত্রতম দিবস। অষ্টম অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পালিত হয় সেই মহোৎসব। কিন্তু এবারে তার আগে ‘মাহেন্দ্র’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে কেন?
অচ্যুতের পিতার নাম নাকি ছিল দীনবন্ধু। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান। বোঝাই যাচ্ছে, অচ্যুত পিতার গুণ পেয়েছে। কিন্তু অচ্যুতের মা? তিনি কোথায়? তিনি কি স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হয়েছিলেন? তাই যদি হয়, অচ্যুতের দাদা পালিয়েছিল কেন? মায়ের পরিণতিতে তীব্র আক্রোশেই কি?
তরুণ শিক্ষক মধুসূদনের কথাটা আবার মনে পড়ে গেল ওর।
”সে আমার বাল্যবন্ধু ছিল। মৃত্যুর আগে আমাকে শনাক্ত করতে পেরেছিল।”
অচ্যুতের দাদাকেও কি ব্রজেন্দ্রদাদার মতো হত্যা করা হয়েছে?
দ্বারিকা দরদর করে ঘামছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে ও বসে পড়ল। ছোট থেকে ওদের তিন গুরুর কথা বলা হয়েছে। শেখানো হয়েছে, বৈদিক সমাজের দিশারী তাঁরাই।
প্রথমজন সাক্ষাৎ ঈশ্বর, শ্রীকৃষ্ণের নবরূপ। স্বয়ং পরম গুরু। যার পার্থিব নাম ওরা মাত্র কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছে। জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন।
পরের জন ঈশ্বর নন, তবে অবতার। যিনি ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সেতুর কাজ করেন, তিনিই অবতার। প্রথম গুরু। যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই সমাজ।
কিন্তু দ্বিতীয় গুরু অর্থাৎ বর্তমান গুরুদেব? যিনি কোনো অজানা অভীষ্টপূরণের লক্ষ্যে কিছু মানুষকে বিনাশ করার অভিযান চালাচ্ছেন?
যিনি ব্রজেন্দ্রদাদা থেকে শুরু করে অচ্যুতকে এমন অমানুষিক শাস্তির মুখে ফেলছেন?
যিনি ক্ষমার মতো একটি শিশুকে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত হচ্ছেন?
তিনি কে? কী তাঁর পরিচয়?
Leave a Reply