২০. ছবিদাদু ফোনের ওপার

কুড়ি

ছবিদাদু ফোনের ওপার থেকে বললেন, ”অত উতলা হোসনা। রাজেন সমাদ্দার লড়ে যাচ্ছে।”

আমি হতাশ গলায় বললাম, ”সমাদ্দার লড়লে কী হবে। আমিই তো চলে এলাম!”

”চলে গিয়েছিস তো কী হয়েছে? ঝড়টা তো তুলে দিয়ে গিয়েছিস, সেটাই যথেষ্ট। কাল বিধানসভা অধিবেশন চলার সময় একটা দলিত সংগঠন প্রতিবাদসভা আয়োজন করেছিল তোকে সমর্থন করে। বলেছে মেধার ভিত্তিতে পুজো করার লাইসেন্স চালু করতে হবে।” ছবিদাদু বললেন।

”তাই?” আমি উৎসাহভরে জিজ্ঞেস করলাম।

”তবে আর বলছি কী! সব জায়গা থেকেই চাপ বাড়ছে। একটা কাগজ আবার তোর এই ট্রান্সফার নিয়েও লিখেছে, যে অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে তোকে। এখানে আয়, সব বলছি। তোর ট্রেন ক-টায়?” ছবিদাদু গলার স্বর পালটে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি সসীমদার দিকে তাকালাম। একটা খবরের কাগজে মুখ গুঁজে বসে আছেন সসীমদা, চোখাচোখি হতেই বলে উঠলেন, ”আর দেরি কোরো না, ওদিকের রাস্তা একদম ভালো নয়। কাল রাত থেকে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সেবক রোড বন্ধ হয়ে গেলে মুশকিলে পড়বে। এইবেলা বেরিয়ে যাও।”

আজ শুক্রবার। একটু পরেই আমি বেরিয়ে যাব, আজ রাতের ট্রেনে যাব কলকাতা। আগের সপ্তাহেই এসেছি সবে, তবু মনে হচ্ছে যেন কতদিন বাড়ি ছেড়ে রয়েছি এখানে!

এমনিতে এখানে জীবনযাত্রা খুব শান্ত। আমার ওপর কাজ এখনো তেমনভাবে অ্যালট হয়নি, ফলে অফিসে হালকাই থাকি বেশ। বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছি সঙ্গে। ছবিদাদুও কিছু বই কিনে দিয়েছিলেন। সেগুলো পড়ি।

থাকার ঘর একটা ভালোই পেয়েছি। ব্লক অফিস থেকে খুব দূরে নয়। স্বপনই ঠিক করে দিয়েছে। দোতলা বাড়ি, ওপরে বাড়িওয়ালি ভদ্রমহিলা থাকেন। তিনি গোর্খা, কিন্তু ভাঙা ভাঙা বাংলাও বলতে পারেন। আমাদের অফিসে আগে যত বাঙালি কর্মচারী আসতেন, ওঁর বাড়িতেই নাকি ভাড়া থাকতেন। সেই থেকেই বাংলা শেখা। মহিলা একাই থাকেন, স্বামী বহুদিন হল গত হয়েছেন, নিঃসন্তান। নীচে আমি। রোজকার ঠিকে কাজের জন্যও একটা মেয়ে পেয়েছি, নীচের দিকে একটা গ্রামে থাকে।

সব জায়গাতেই থিতু হয়ে বসতে একটু সময় লাগে, আমারও লাগছে। কিন্তু এখানকার প্রকৃতি এত সুন্দর লাগলেও অফিস থেকে ফেরার পর মনটা ভারী হয়ে থাকছে। যাদের ভুলেও ফোন করতাম না, তাদের ফোন করছি, এটা সেটা কথা বলছি।

একদিন বিনিকেও ফোন করেছিলাম। ও যতই মুখ ফিরিয়ে থাকুক, আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার ওপর ক-দিন বাদেই বিয়ে হয়ে যাবে, ভেবেছিলাম মিটিয়ে নেব ঝগড়াটা।

সত্যিই তো, আমাদের ঝগড়াটার তো কোনো গুরুতর কারণ ছিল না, এমনিই মাথাগরমের মনোমালিন্য।

কিন্তু বিনি আমার ফোনই তোলেনি।

দু-একবার ভেবেছি মঙ্গলরূপকেও ফোন করি। ছেলেটা আমাকে অনেকবার ফোন করেছিল। কিন্তু, শেষপর্যন্ত বিনির এড়িয়ে চলার জন্যই আর করলাম না।

রাতে যখন একলা ঘরে শুয়ে থাকি, চট করে ঘুম আসতে চায় না, তখন কখনো কখনো আচমকা মনের গভীরে মঙ্গলরূপের ছবি ভেসে ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে বিনির ওপর রাগ ওঠে, কেন জানিনা।

এই নিয়ে নিজের মনকে অনেক প্রশ্ন করেছি। অদ্ভুত তো! বিনি কোথাকার কোন ছেলেকে বিয়ে করছে তা নিয়ে আমার রাগ উঠছে কেন?

মন তক্ষুনি বলেছে, ”বিনি কেন মঙ্গলরূপকে বিয়ে করবে?”

”কেন করবে না?” আমি আরও অবাক হয়ে মনকে প্রশ্ন করি, ”বিনির বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে মঙ্গলরূপের সঙ্গে। দুজনেই ব্রাহ্মণ, তার ওপর গোঁড়া পুরোনোপন্থী অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়ে। বেশ মিল হবে। ওই বসন্ত ভটচাজের বাড়ির অন্দরমহলে ঘোমটা টেনে বিনি বসে থাকবে। ওটাই তো ওদের মতো ভীতু মেয়েদের জীবন!”

মন বলেছে, ”কিন্তু মঙ্গলরূপ তো তোমার প্রশংসা করেছিল। বলেছিল তুমি প্রশংসনীয় কাজ করছ। কই, ও তো তেমন প্রাচীনপন্থী নয়!”

”আলবাত প্রাচীনপন্থী! ও নিজে যাই হোক, ওর বাবার জন্য ওর নিজের কোনো ভয়েস আছে নাকি বাড়িতে? ওদের বাড়িতে বাবা যা বলেন সবাই তাই করে। প্রশংসা করতে হয় সে এমনিই করেছিল। নাহলে কোনো অব্রাহ্মণ কায়স্থ মেয়েকে বিয়ে করার সাহস ওর হত কোনোদিন?”

”অব্রাহ্মণ মেয়ে!” মন অবাক, ”কার কথা বলছ!”

”কারুর কথাই বলছি না।” আমি নিঃশব্দে উত্তর দিয়েছিলাম, ”সেই তো জাত, বংশ দেখে বিয়ে করতে যাচ্ছে!”

নীচের একটা স্ট্যান্ড থেকে বাস চলে টানা শিলিগুড়ি টাউন অবধি, সময় লাগে ঘণ্টাতিনেক। আমি হাতে অনেকটা সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বলা যাচ্ছে না। এদিকে বেশ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

দার্জিলিং জায়গাটাই যেন কেমন মনকেমন করা। চুপচাপ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবছিলাম। এই কয়েকদিনে কিছুই ঘোরা হয়নি, শুধু অফিসের পরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন ম্যাল পেরিয়ে গভর্নর রোডের দিকে গিয়েছিলাম। ওই দিকটা তুলনামূলকভাবে বেশ নির্জন।

শিলিগুড়ির দিকে কাল রাত থেকে টানা বৃষ্টি হলেও এখানে ভোরের দিকে এক পশলা হয়েই থেমে গেছে। কিন্তু সেই বৃষ্টির গুঁড়ো এখনো লেগে আছে গাছের সবুজ পাতাগুলোয়।

যতদূর চোখ যায় সরু মাখন পিচের রাস্তা এঁকেবঁকে চলে গেছে দূরে, নীল আকাশ এসে মিশেছে সেই দূরের দিগন্তে। বন্ধ দোকনগুলো নরম রোদে ঝকঝক করছে, আর রাস্তার দু-পাশের নাম না জানান হরেক রকমের বুনো গাছের পাতাগুলো অল্প হাওয়ায় দুলছে তিরতির করে।

আমি এক হাতে ট্রলিটাকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। সকাল থেকে মা তিনবার ফোন করেছে। প্রতিবার একই কথা, ”কিরে কখনো বেরোচ্ছিস? সাবধানে আসবি কিন্তু! খবরে দেখাচ্ছে উত্তরবঙ্গে নাকি খুব বৃষ্টি হচ্ছে। মালদা পুরো ভেসে যাচ্ছে।”

আমি হেসে বলেছি, ”হ্যাঁ রে বাবা, সাবধানেই আসব। আমি তো আর মালদায় থাকি না। আমাদের এদিকে নো বৃষ্টি। তুমি কাল সকালে ওই কুমড়োর ছক্কাটা কোরো কিন্তু আমি দশটার মধ্যে ঢুকে যাব!”

এখন মায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। সত্যি, মা যতই আমাকে বকুনি দিক, এখানে আসার পর থেকে মায়ের অভাবটা যেন খুব বেশি করে বুঝতে পারছি। অফিস থেকে তেতেপুড়ে এসে ঘরের সব কাজ আমাকেই করতে হচ্ছে, জামাকাপড় ভাঁজ করা, ধুয়ে যাওয়া বাসনকোসন রান্নাঘরে তুলে রাখা, মনে করে জলের বোতল ভরা, সব।

মা ছাড়া জীবন কেমন যেন নুন ছাড়া আলুমাখার মতো। পেট ভরছে, কিন্তু মন ভরছে না।

আমি মনে মনে ঠিক করলাম, আর কিছুদিন থিতু হই, তারপর মা-কে নিয়ে চলে আসব এখানে। অরূপ কাঞ্জিলাল এখনো আশায় আশায় আছে, আমি বুঝি গিয়ে ওর পায়ে পড়ব এখান থেকে সরানোর জন্য। হুহ! আমাকে তো চেনে না, লাইসেন্স চালু হোক আর না হোক, কিছুতেই মাথা নোয়াবো না আমি। দরকার হলে এই পুলবাজারেই সারাজীবন কাটাব, তবু ভালো!

চিন্তা ভাঙল আচমকা ফোনে। দেখি ছবিদাদু ফোন করছেন। এই তো একটু আগেই কথা হল, এখন আবার কী হল!

ফোন রিসিভ করে কানে দিতে না দিতেই দাদুর গলা শুনতে পেলাম, ”বসন্ত ভট্টাচার্যের গুন্ডাটার কী নাম রে?’

”ওই তো, ঝন্টু না কী নাম যেন!” আমি বললাম, ”কেন, কী হয়েছে?”

”আরে ছেলেটা অতি বদ জানিস তো! কাল রাতে সমাদ্দার উকিলের বাড়িতে ঢিল মেরে জানলার কাচ ফাটিয়েছে, সমাদ্দার নাকি তখন বাথরুমে, দেখতেও পেয়েছে চার-পাঁচটা ছেলেকে গুন্ডামি করতে।”

”সেকি!” আমি বললাম, ”কী করে বুঝল যে ওরাই ছিল? সমাদ্দার কি ঝন্টুকে চেনে নাকি? অন্য কেউও তো হতে পারে! মানে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে!”

”ঢিলগুলো চিরকুট দিয়ে মোড়ানো ছিল। সেই চিরকুটে লিখেছে, পুজোর ব্যাপারে মাতব্বরি বন্ধ কর, নাহলে বুল্টুর লাশ দেখার জন্য তৈরি হ’ রাজেন সমাদ্দার!”

”এই বুল্টুটা কে?” আমি বললাম। এই নামটা কখনো শুনিনি আগে।

”সমাদ্দারের পাঁচ বছরের ছেলে।” ছবিদাদু একটু থেমে বললেন, ”সমাদ্দার চিরকুটগুলো নিয়ে থানায় গেছে।”

”ঠিক করেছে!” আমি বলতে বলতে শূন্যে একটা ঘুষি ছুঁড়লাম, ”ওই ঝন্টু মস্তানটার বাঁদরামি না চাবকে সোজা করে দিতে হয়!”

”আরে পুরোটা শোন।” দাদু বললেন, ”সমাদ্দার থানায় গেছে ঠিকই, কিন্তু এই কেস আর লড়বে না বলছে।”

”অ্যাঁ! কেস লড়বে না!” আমি হতাশ গলায় বললাম, ”কেন? আ-আমি তো আসার আগেই পুরো ফিজ দিয়ে এলাম!”

”তোর ফিজ ফেরত দিয়ে দেবে বলেছে।”

”সেটা কথা নয়।” আমার এবার গলা চড়ে গেল, ”উকিলদের তো অনেকেই হুমকি টুমকি দেয়, তাই বলেই অমনি ভিতুর মতো ছেড়ে দিতে হবে? এ এবার কেমন লোক!”

”ওরে, এ তো তেমন বাঘা উকিল নয়, এমনি গোবেচারা লোক, কিন্তু কাজটা ভালোই করছিল। ছোটবেলায় আমি ওকে পড়াতাম, খুব গরিব ছিল, আমি হেল্প করতাম বলে এখনো খুব শ্রদ্ধাভক্তি করে, তাই এত কম ফিজে রাজি হয়েছিল। আসলে ছেলেকে নিয়ে ভয় দেখিয়েছে তো, ভয় পেয়ে গেছে।” ছবিদাদু চিন্তিত স্বরে বললেন, ”যাকগে, তুই আগে আয়, তারপর দেখছি কী করা যায়!”

একুশ

ট্রেন শিয়ালদা ছাড়া মাত্র মনটা কেমন দুলে উঠল ভেতরে, আনন্দের মাঝেও মেঘের মতো মনখারাপটা ফিনকি দিয়ে উঠে আসতে শুরু করল গলা দিয়ে।

এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছি।

শুধু তাই নয়, এই প্রথম বাবার আদেশ অমান্য করলাম আমি।

আসার সময় রুকস্যাক কাঁধে বাবাকে বলতে গিয়েছিলাম। বাবা তখন যথারীতি আমাদের ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাহ্নিকে ব্যস্ত ছিলেন।

আমি মৃদু স্বরে বলেছিলাম, ”বাবা, আসছি।”

বাবা মুখে একটাও কথা না বলে আমার দিকে চেয়েছিলেন। আমি মিনিটদুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসতেই বৈঠকখানা ঘরে আমাকে চেপে ধরেছিলেন জগদীশকাকা, ”ছি ছি বাবা রূপ, তোমার কাছে এটা আমি আশা করিনি!”

আমি থেমে গিয়েছিলাম, ”কি আশা করেননি?”

”পুজোর আর দশদিনও বাকি নেই। কাল মহালয়া। এই সময় বাড়িতে এত কাজ, সংগঠনের দায়িত্ব, তার ওপর সদস্যদের বিপদ, এইসময়ে কোথায় তুমি উপযুক্ত পুত্র হিসেবে বাবার কাঁধে কাঁধ মেলাবে, তা নয়, তুমি কিনা ঘুরতে যাচ্ছ!”

জগদীশকাকার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমি বোধ হয় কাকার কিডনি বিক্রি করতে যাচ্ছি।

আমার ইচ্ছে হল বলি, তা আমাকে কোন কাজে ঠিকমতো ইনভলভ করা হয়েছে জগদীশকাকা? যখন যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি পালন করেছি। তা সত্ত্বেও অহেতুক অপমান, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হয়েছে আমায়।

আমি বাবাকে বলেছিলাম যাতে ঝন্টুর মতো ছেলেদের পুরোহিত সংগঠন থেকে দূরে রাখেন। এই তো আজকের কাগজেই পড়লাম দিওতিমার ওই উকিলের বাড়ি ঢিল মেরে হামলা করেছে ওরা, উকিলটা থানায় গিয়ে নালিশ করেছে। মেয়েটার ব্যাপারে তো কোনো আপডেটই নেই। এই ধরনের অসভ্যতা আমাদের লোকেদের পক্ষে সাজে কি? ওরা কি এইসব করে আমাদের ভাবমূর্তিটাই নষ্ট করছে না?

বাবা সে-কথা তো শোনেনই নি, উলটে আমার চেয়ে বেশি ওদের ওপর ভরসা করেছেন। আমার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল কি?

শুধু ঝন্টুকেই বা দোষ দিই কেন, এই যে জগদীশকাকা, ইনিই যে আস্তে আস্তে বাবার ডানহাত হওয়ার সুযোগ নিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠনটার মধ্যে পার্টির লোক ঢুকিয়ে চলেছেন, সেটা কি আর আমি বুঝি না?

আর তা ছাড়া আমার নিজের একটা জীবন আছে, সেটা আমাকে কাটাতে দেওয়া হোক।

কিন্তু এত কথা জিভের ডগায় এলেও আমি কিছুই বলতে পারিনি। শুধু নতমুখে কিছুক্ষণ অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

মা আর মেজকাকিমা ওপরের বারান্দা থেকে বলেছিলেন, ”সাবধানে যাস!”

ট্রেনে জানলার ধারে বসে আনমনে এই সবই ভাবছিলাম, হঠাৎ গৈরিক কাঁধে চাপড় মারল, ”কি ভাই, তুই কি কলকাতা ছাড়ছিস বলে সাধু হয়ে গেলি নাকি? তখন থেকে পুরো মিউট মোডে রয়েছিস! কথাবার্তা বল! এই নে, চা খা।” গৈরিক চায়ের কাপ এগিয়ে দিল আমার দিকে।

শেষমেশ আমরা চারজনই যাচ্ছি। আমি জিষ্ণু গৈরিক আর চিরন্তন। গৈরিক আর চিরন্তন জিষ্ণুর বন্ধু হলেও আমার সঙ্গে আগে থেকে আলাপ ছিল। দুজনেই হুল্লোড়বাজ ছেলে, জিষ্ণুরই মতো।

চিরন্তন হাত উলটে বলল, ”ওহ, অবশেষে আমার একটা স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। হাতে ক্যাম্পিং ম্যালেট আর বরফ ভাঙার কুড়ুল, মাথায় হেলমেট, সঙ্গে হারনেস, র‌্যাপেল ডিভাইস …!”

”কী সব বকছিস বলতো তুই!” জিষ্ণু ভ্রূ কুঁচকে বলল।

”আরে মাউন্টেনিয়ারিং এ এগুলো তো সব লাগবে। দেখবি বেস ক্যাম্পেই দেবে। ওহ কবে থেকে ইচ্ছে ছিল মাইরি, ছন্দা গায়েনের মতো একটা শৃঙ্গ জয় করতে যাব!” চিরন্তন চোখ বুজে মাথা দোলাল।

”বেস ক্যাম্প! শৃঙ্গ! আরে আমরা কী এভারেস্ট জয় করতে যাচ্ছি নাকি!” গৈরিক এক দাবড়ানি দিল, ”সান্দাকফু যেতে গেলে শুধু পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হয় বস! ওর থেকে অমরনাথ যাওয়া সোজা। হু!”

চিরন্তনের মুখটা মুহূর্তে চুপসে গেল, ”অ্যাঁ! ওইসব ওসব কিছু লাগবে না?”

”না।” গৈরিক বলল, ”পেট খারাপের ওষুধ নিয়েছিস তো? ওইটে লাগতে পারে। পাহাড়ি রাস্তা, দুমদাম পেট গোলমাল শুরু করে দেয়। আর কিচ্ছু লাগবে না চাঁদ!”

সবাই হাসছিলাম। জিষ্ণু গম্ভীর হয়ে গেল, ”নাহ! আমার পুরো ইটিনেরারিটা বিশদে আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল তোদের!” পাক্কা নেতার মতো মাথা দুলিয়ে ও বলতে শুরু করল, ”শোন। আমরা তো মাউন্টেনিয়ারিং করতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি পাহাড়ের কোল বেয়ে ট্রেক করতে। ট্রেন থেকে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে প্রথমে আমরা চলে যাব মানেভঞ্জন। সেখান থেকে সান্দাকফু প্রায় বত্রিশ কিলোমিটার। চিত্রে, লামাইধুরা, টুমলিং, গৈরিবাস এইসব ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামের মধ্যে দিয়ে আমরা আস্তে আস্তে উঠব, বুঝলি?”

চিরন্তন মাথা নাড়ল এবার। বুঝেছে ও।

ট্রেন এখন ঝড়ের গতিতে দক্ষিণেশ্বর পেরোচ্ছে। আমি আবিরকে একবার ফোন করলাম, ”ভাই আমি তো চলে যাচ্ছি। খারাপও লাগছে, কালকের দিনটায় থাকতে পারছি না …।”

”আরে এত ফরম্যালিটির কিছু নেই।” বাস-অটোর আওয়াজের মধ্যে আবীরের গলা শুনতে পেলাম, ”আমি কাল সব সামলে নেব। মন্টে তিলককে নিয়ে আসবে। আমি যাব বিনিকে নিয়ে। তুই ভালোভাবে ঘুরে আয়!”

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের দিকে চোখ পড়তেই অভ্যেসমতো হাতদুটো কপালে উঠে গেল আমার। অনেকদিন হয়ে গেল দক্ষিণেশ্বর আসিনি। আগে মা আর মেজোকাকিমা-কে নিয়ে বছরে দু-একবার ঠিক আসতাম। আসলে অফিস শুরু হওয়ার পর থেকে বড্ড বেশি যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সারাক্ষণ যে অফিসেরই কাজ তা ঠিক নয়, ভেতরে ভেতরেও যেন একটা অলসতা ঘিরে ধরছে আমায়। অফিস আর অফিসের কাজ ছাড়া কিছু করার উদ্যমটা যেন চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

অথচ সবাই কতকিছু করছে। এই যে দিওতিমা বলে মেয়েটা, অভাবের সংসার শুনেছিলাম, সেই দায়িত্ব পালন করছে, চাকরি করছে, আবার এমন একটা ব্যতিক্রমী আন্দোলনে একা লড়ে যাচ্ছে। সফল হবে কিনা সেটা পরের ব্যাপার, কিন্তু সমাজের একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে, এত বড়ো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়াটা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? অনেক জোর লাগে মনের।

দূরে বোধ হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে আমার চোখে মুখে। চোখ বন্ধ করে সেই বাতাস অনুভব করতে করতে আমি ভাবলাম, কতদিন দিওতিমার কোনো খোঁজ নেই!

ফোনেও পাওয়া যায় না, কাগজেও ওকে নিয়ে কিছু লেখা নেই। ঝন্টুকেও তারপর থেকে ফোনে পেলাম না।

মেয়েটা ভালো আছে তো?

আমি ঠিক করলাম, সান্দাকফু থেকে ফিরে একদিন উত্তরপাড়া যাব। সে দিওতিমা যা ভাবে ভাবুক!

বাইশ

বাসটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে বেশ চলছিল, কিন্তু করোনেশন ব্রিজে ওঠার আগে আচমকা একটা কর্কশ শব্দ করে থেমে গেল। আমি উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম করোনেশন ব্রিজে ওঠার আগে প্রচুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিছু গন্ডগোল হয়েছে নাকি?

আমি বুঝতে পারলাম না।

বাস ভর্তি লোক ঠায় বসে রয়েছে, কিন্তু কারুর কোনো বিরক্তি নেই। এইসব পাহাড়ি লোকেদের অসীম ধৈর্য, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এরা অপেক্ষা করতে পারে, কোনো বিরক্তি নেই। আর আমরা সমতলের লোকেরা একটু কিছু হলেই চেঁচিয়ে মেচিয়ে মাথায় তুলি চারদিক।

কিন্তু এক্ষেত্রে চাইলেও শান্ত হয়ে বসে থাকার উপায় নেই আমার। ট্রেনের আর বেশি দেরি নেই। এর মধ্যেই প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে। সবকিছু মিটিয়ে বেরোতে দেরি হয়েছিল, তার ওপর ঠিকমতো বাস পেতেও অনেকক্ষণ সময় লাগল। শিলিগুড়িতে খুব বৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেক বাস এদিকে আসতে পারছে না।

আমি আরও কিছুক্ষণ উশখুশ করে ট্রলিটা সাবধানে ধরে বাস থেকে নেমে এলাম। অজস্র গাড়ি পেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে। এদিকে ইতস্তত বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি ছাতা আর খুললাম না, ভিজতে ভিজতেই চললাম।

তিস্তা নদীর ওপর এই করোনেশন ব্রিজ ব্রিটিশ আমলে দার্জিলিং আর জলপাইগুড়ি এই দুটো জেলাকে কানেক্ট করার জন্য বানানো হয়েছিল। তখন ইংল্যান্ডের কোনো এক রাজার নাকি রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, সেই করোনেশনকে স্মরণীয় রাখতে এই ব্রিজের নাম দেওয়া হয়েছিল করোনেশন ব্রিজ। আমি এত কিছু জানতাম না, সেদিন ফোনে ছবিদাদু বলছিলেন। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলে বাঘপুল।

এই অঞ্চলটির নাম সেভক। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে একটা প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভারকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ”কী হয়েছে ভাইয়া? সব গাড়ি দাঁড়িয়ে কেন?”

ড্রাইভারটা বলল, ”ম্যাডামজি, সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে বৃষ্টিতে। কার্শিয়াঙ- এর কাছে সিপাইধুরাতে বিরাট ধস নেমেছে, পঞ্চান্ন নম্বর জাতীয় সড়ক বন্ধ।”

”সেকি!” আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পঞ্চান্ন নম্বর জাতীয় সড়ক ছাড়া এদিক থেকে শিলিগুড়ি ঢোকার কোনো রাস্তাই নেই।

বেশি সময়ও তো নেই হাতে।

ড্রাইভারটাকে বললাম, ”কিন্তু আমার তো ট্রেন আছে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আজ রাতে!”

”আরে কিসের ট্রেন ম্যাডামজি?” ড্রাইভার অবাক হল, ”সব ট্রেন বন্ধ। সকালের দার্জিলিং মেল চারঘণ্টা লেটে ঢুকেছে। আর কোনো ট্রেন যাবে না। লাইন সব জলের তলায়। আলুবাড়িতে দুজন মারা গেছে। আপনি হোটেলে ফিরে যান।”

”হোটেল নয়, আমি এখানেই থাকি, পুলবাজারে চাকরি করি। কলকাতায় বাড়ি ফিরতে হবে আজ।” আমি অসহায়ভাবে ককিয়ে উঠি।

”তো ফিরতেই পারবেন না। কী করে ফিরবেন! শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলে তবু বাগডোগরা থেকে প্লেনে যেতে পারতেন। সব ট্যুরিস্ট এখন ওদিকেই ছুটছে। কুড়ি হাজারের ওপর টিকিট যাচ্ছে। কিন্তু আপনি তো পৌঁছতেই পারবেন না ওদিকে। মহানন্দা, রায়ডাক, জলঢাকা সব নদীর জল ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে ডেরায় ফিরে যান।” ড্রাইভারটা নিজের মনেই স্বগতোক্তি করল, ”এমন হঠাৎ করে বন্যা বহুবছর হয়নি এদিকে।”

আমি অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ফোনে কথা বলার সময় মা সকালে মনে করিয়ে দিয়েছিল, আজ মহালয়া।

পুজোর সময়েও বাড়ি ফিরতে পারব না? এবারে পুজোর আগে এত কিছু করলাম বলেই কি মা দুর্গা আমার ওপর রেগে গেলেন? বাড়িও ফিরতে দিচ্ছেন না?

ড্রাইভারটা আমার দিকে দেখছিল, বলল, ”পুলবাজারে ফিরতে চাইলে আপনাকে আমি পৌঁছে দিতে পারি। আমিও ওদিকেই যাব। যাবেন নাকি?”

আমি চুপ করে রইলাম। ড্রাইভারটা গোর্খা, এমনিতে গোর্খা ড্রাইভাররা ভালোই হয়। পাহাড়ি রাস্তায় লিফট নেওয়াটা বেশ কমন ব্যাপার। কিন্তু পাহাড়ে বন্যা একবার শুরু হয়ে গেলে এখানেই আটকে থাকতে হবে। আর একবার আটকে গেলে যদি পুজোতেও না যেতে পারি? আমার এতদিনের প্রচেষ্টা, ইচ্ছে সবই বিফলে যাবে।

লাইসেন্স চালু হোক বা না হোক, পুজো দেখব না নিজের চোখে? শুনব না ছবিদাদুর মন্ত্রোচ্চারণ?

আনমনে ভাবতে ভাবতে আমি করোনেশন ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ড্রাইভারটা আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে দেখেও আমি ভ্রূক্ষেপ করলাম না। পৌঁছতে পারি বা না পারি, পুলবাজার আমি এখন কিছুতেই ফিরে যাব না।

হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পার হলাম। শিলিগুড়ির দিকটায় এসে দেখি এদিকে দশগুণ বেশি ভিড়। হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে এসে এখানে আটকা পড়েছেন। ব্রিজের নীচে খরস্রোতা তিস্তা যেন উন্মত্ত সিংহের মতো ফুঁসছে। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে দু-তরফের পুলিশ।

মানুষ এক আশ্চর্য জীব। যখন প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো ঠিক থাকে, তখন সে ব্যাপৃত হয় পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, দুঃখবিলাসের মতো নিজের তৈরি অসূয়াতে, সমুদ্রে ঝিনুক খোঁজার মতো করে সন্ধান চালায় অসন্তোষের। অথচ যখনই অন্ন, বস্ত্র বাসস্থানের মতো চাহিদাগুলোয় কোন বাধা পড়ে, আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে টান পড়ে তার নিরবচ্ছিন্ন সুখে, তখন সে দিব্যি বিস্মৃত হয় তার নিজেরই তৈরি করা অকিঞ্চিৎকর দুঃখগুলোকে।

এখানেও তাই। একটু আগেও যারা দিব্যি হাসিখুশি ছিলেন, ঘুরতে যাওয়ার আতিশয্যে মেতেছিলেন, তাঁদের মুখ থেকে সব আনন্দ উধাও হয়ে গেছে, পরিবর্তে বিরক্তি, উৎকণ্ঠা এসে জায়গা করে নিয়েছে। দুশ্চিন্তায় ছটফট করছেন অধিকাংশ ট্যুরিস্ট।

বাঙালি পর্যটকদেরই আধিক্য বেশি। রাস্তা ছেড়ে ব্রিজে ওঠার মুখ থেকে সার দিয়ে দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রচুর মানুষজন গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন, গাড়িচালকদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলছেন।

একজন মোটাসোটা বাঙালি ভদ্রলোক একটা ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করছেন, ”ও ভাই, গাড়ি কব চলেগা?”

এখানকার মানুষজন কম কথার মানুষ, ড্রাইভারটা সংক্ষেপে উত্তর দেয়, ”নেহি চলেগা।”

”অ্যাঁ?” ভদ্রলোক যেন অজ্ঞান হয়ে যাবেন উত্তরটা শুনে, ”কিউ নেহি চলেগা ভাই? ইয়ে ক্যায়সা বাত হুয়া? ইতনা পাহাড়মে বিবি-বাচ্চা লে কর কিধার জাউঙ্গা? জয় মা তারা, একি হল গো ঘুরতে এসে!”

শেষ কথাটা অবশ্য নিজের মনেই বললেন, ড্রাইভারকে নয়। গাড়ি থেকে ততক্ষণে উঁকি দিচ্ছে দু-তিনটে ছোট ছোট বাচ্চা। একটু বড় যে, সে বলছে, ”দার্জিলিং কখন পৌঁছব বাবা?”

”আরে দাঁড়া তো, তখন থেকে জেনারেটরের মতো বকবক করেই চলেছে!” ভদ্রলোক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন।

আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ”দার্জিলিং এখন যেতে পারবেন না। ব্রিজই তো বন্ধ করে দিয়েছে।”

ভদ্রলোক বললেন, ”কি কাণ্ড বলুন দেখি ঘুরতে এসে, অ্যাঁ? ভাবলাম পুজোর আগে একটু ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে আসব, তা না …। কী করব এখন?”

আমি বললাম, ”আপাতত তো কিছু করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ওদিকে বৃষ্টি একনাগাড়ে হয়েই চলেছে। এই সেভকেই আপনাদের থেকে যেতে হবে আজ রাতটা। ছোটখাট হোটেল পেয়ে যাবেন। তারপর কাল সকালে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”

ভদ্রলোক আমার আশেপাশে আর কাউকে না দেখে এবার বললেন, ”আপনি কি একাই ঘুরতে এসেছিলেন নাকি?”

”না। ঘুরতে আসিনি।” আমি বললাম, ”আমি দার্জিলিঙে চাকরি করি। ওখানেই পোস্টেড। বাড়ি ফিরছিলাম আজ, হঠাৎ এই বিপত্তি। আপনি আর দেরি করবেন না। সবে আটকে পড়েছেন, এই বেলা কাছাকাছি হোটেলগুলোয় গিয়ে খোঁজ নিন। অর্ধেক ট্যুরিস্ট এখনো গাড়িতেই বসে আছে, ভাবছে রাস্তা খুলে যাবে একটু পরে। আরও কিছুক্ষণ পরে হোটেলগুলোয় আর জায়গা পাওয়া যাবে না।”

”হ্যাঁ। এই যাচ্ছি। দেখুন দিকি, বাচ্চাদের নিয়ে কী ঝামেলায় পড়লাম।”

ভদ্রলোক গাড়ির দিকে এগোতে উদ্যত হলে আমিও হাঁটা লাগালাম।

গোটা এলাকাটা গিজগিজ করছে লোক। করোনেশন ব্রিজে ওঠার আগের রাস্তাটায় থরেথরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়ি।

আমি গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে হাঁটছিলাম। কোথায় যাব, কীভাবে যাব, কিছুই জানিনা। এখান থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে হয়তো শিলিগুড়ি পৌঁছনোর গাড়ি মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু তারপর কী করব? ট্রেন তো বন্ধ!

বৃষ্টি একনাগাড়ে হয়েই চলেছে, বরং বাড়ছে। আমি বাস থেকে নামার আগে বুদ্ধি করে একটা কাজ করেছিলাম। রেনকোটটা পরে নিয়েছিলাম। ফলে, এক হাতে ট্রলি নিয়ে হাঁটতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই-আড়াই কিলোমিটার চলে আসার পরে গাড়ির ভিড়টা যেন একটু কমল। তবে মিনিটে প্রায় তিন-চারটে করে গাড়ি আমার পাশ দিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে।

আমি একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্যও একটা চায়ের দোকানে থামলাম। দোকানদারকে এক কাপ চা দিতে বললাম। ঘড়িতে দেখি প্রায় ছ-টা। আজ রাতে কপালে কী আছে জানিনা।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ”আর একটু এগিয়ে গিয়ে শিলিগুড়ি ফেরার গাড়ি পাব আঙ্কল?”

”পাওয়ার তো কথা।” দোকানদার জবাব দিল, ”তবে যা খবর পাচ্ছি, কোনো গাড়ি শিলিগুড়ি থেকে এদিকে আসতে চাইছে না। যদি সকালে চলে আসা কোনো গাড়ি এখন ফেরে, তাহলে পাবে।”

”হুম।” আমি চায়ের দাম মিটিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি।

পশ্চিমদিকে সূর্য অনেকক্ষণ হল ঢলে পড়েছে। পাহাড়ি জায়গা, এতক্ষণ শীত না করলেও এইবার হালকা গা শিরশির করছে কেমন যেন। রাস্তার পাশের খাদে প্রায় কুড়ি মানুষ উঁচু গাছগুলো যেন প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি উঁচু হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের চাদর গায়ে মেখে।

আমার গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল।

চা-ওয়ালা কাছেই একটা জিপগাড়ির স্ট্যান্ড আছে বলেছিল, আমি জলদি পা চালালাম সেদিকে। যেভাবেই হোক, শিলিগুড়ি আমাকে পৌঁছতেই হবে।

তারপর ওখান থেকে কী করব, সে দেখা যাবে। এমনিতে মহিলা হিসেবে আমার তেমন ভয় নেই। হাঁটা শুরু করার আগেই রেনকোট, জ্যাকেট দিয়ে এমনভাবে নিজেকে মুড়ে ফেলেছি, কেউ খুব ভালো করে মুখের সামনে এসে খুঁটিয়ে না দেখলে ধরতেই পারবেনা যে আমি মেয়ে। আর এমনিতেও মা থেকে শুরু করে পাড়ার সবাই বলতো আমার হাঁটাটা নাকি খুব পুরুষালী, কোনো লক্ষ্মীশ্রী নেই হাঁটার মধ্যে।

কাজেই সেদিক থেকেও এখন সোনায় সোহাগা।

তেইশ

কথায় বলে অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। এই বন্ধ গাড়ির মধ্যে বসে তুমুল বৃষ্টির তোড়ে সাদা হয়ে যাওয়া জানলার কাচ দেখতে দেখতে সেটাই ভাবছিলাম আমি।

বাইরে প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভারটা ছেলেমানুষ, বড়োজোর কুড়ি বছর বয়স হবে। ছেলেটা কীভাবে যে গাড়ি চালাচ্ছে, এটা একটা আশ্চর্যের বিষয়। কারণ গাড়ির সামনেটা কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। উইন্ডগার্ডদুটো যে কাজ করছে না তা নয়, কিন্তু বৃষ্টির তোড় ও প্রাবল্যের সঙ্গে ওইদুটো একই গতিতে ছুটতে পারছে না। ফলে, চারপাশ পুরো ঝাপসা হয়ে আসছে।

জিষ্ণু ড্রাইভারের পাশেই বসেছিল, ভিতু গলায় এরমধ্যেই অন্তত পাঁচবার বলা কথাটা আবার পুনরাবৃত্তি করল ও, ”ও ভাই, গাড়িটা নিয়ে সাইড হয়ে যাও। এইরকম বৃষ্টিতে, পাহাড়ি রাস্তায় … কী দরকার!”

প্রত্যুত্তরে ছেলেটা বিড়বিড় করে কী বলল, কিচ্ছু শোনা গেল না, তবে এইটুকু বোঝা গেল, তার গাড়ি থামানোর আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই।

আমি বেশ জোরে বললাম, ”খাদে টাদে পড়ে যাব না তো রে?”

আমার ডান পাশ থেকে গৈরিক জোর একটা ঠ্যালা দিল, ”শালা, অলক্ষুণে কথাগুলো না বললেই নয়?”

গৈরিকের কথাটা শেষ হতে না হতেই প্রচণ্ড জোরে কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে একটা বাজ পড়ল খুব কাছেই কোথাও। সেই ঝলকানিতে আমি এক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেলাম দূরে পাহাড়ের মতো উঁচু গাছগুলো ভীষণ জোরে জোরে দুলছে।

কী আছে আমাদের কপালে, সত্যিই জানিনা।

অথচ ঘণ্টাতিনেক আগেও যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেছিলাম, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এমন অবস্থায় পড়তে হবে। আমাদের ট্রেন অনেক লেটে ঢুকলেও ওখানে তখন বৃষ্টি সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। কলকাতার গুমোট গরম ছেড়ে এসে টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্টেশন থেকে বেরোতে মন্দ লাগেনি।

জিষ্ণুর মতো একটা জিপগাড়ি ভাড়া নিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে।

প্রথমে ভালোই লাগছিল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনেই পেটপুরে জলখাবার খেয়ে নিয়েছিলাম, গল্পগুজব করতে করতে চলছিল আমাদের গাড়ি।

আমাদের, বিশেষ করে আমার তো খুবই আনন্দ হচ্ছিলো। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে যে কতটা খোলা মনে থাকা যায়, সেটাকে বারবার অনুভব করছিলাম।

তার মধ্যেই আবির ফোন করে জানিয়েছিল, উত্তরপাড়া থানা ডায়রি নিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজতিলক সব খুলে বলেছে ওদের। ওসি আশ্বাস দিয়েছেন সুপ্রতিমের বিরুদ্ধে শীগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার।

বিনির এতবড় বিপদ থেকে বাঁচার ঘটনায় অত্যন্ত সামান্য হলেও যে আমারও কিছু ভূমিকা আছে, এটা ভাবতেই মনটা আরও খুশি হয়ে উঠছিল।

জিষ্ণু ওর পকেট নোটবুক বের করে আমাদের প্ল্যানটা পড়ে পড়ে শোনাচ্ছিল, ”শোন মানেভঞ্জন থেকে ট্রেক করে কাল পৌঁছব টংলু বলে একটা গ্রামে।”

”টংলু?” আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ”কী সুন্দর নাম রে!”

জিষ্ণু চোখ নাচিয়েছিল, ”জায়গাটা আরও সুন্দর রূপ। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা ছবির মতো গ্রাম। মেরেকেটে কুড়ি পঁচিশটা পরিবার থাকে। হোটেল টোটেল কিস্যু নেই, ওই বাড়িগুলোর লোকেরাই দু-একটা ঘর ট্যুরিস্টদের জন্যও হোম স্টে করে রেখেছে। দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা, মন ভুলে যাবে, বুঝলি!”

”বাঃ।” চিরন্তন বলেছিল, ”টংলুতে তাহলে কয়েকদিন স্টে’ করে ক-টা ভালো ল্যান্ডস্কেপ নামাব।”

”ধুর!” জিষ্ণু হাত নেড়েছিল, ”পাগল হলি নাকি তুই? টংলুতে আমরা শুধু একটা রাত কাটাব, পরের দিন ভোরে উঠেই সান্দাকফুর জন্য রওনা দিতে হবে না?”

এইভাবে গল্পগুজবে কেটে যাচ্ছিল বেশ, কিন্তু বিপত্তিটা বেধেছিল কিছুক্ষণ পরেই।

সকাল থেকে হওয়া টিপটিপ বৃষ্টি কিছুতেই কমছিল না, অবশেষে মুষলধারে পড়তে শুরু করল। ক্রমশ আকাশের চেহারা পালটে যেতে লাগল, কালো কুচকুচে রঙা মেঘগুলো যেন পাহাড়ের মধ্যে এসে গিলে ফেলতে চাইছিল আমাদের।

চিরন্তন ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলল, ”এ কী ওয়েদার হল। মানেভঞ্জন পৌঁছতে পারব তো?”

”আরে হ্যাঁ।” জিষ্ণু বলেছিল, ”পাহাড়ের বৃষ্টি। এখুনি কমে যাবে দেখ না!”

কিন্তু আস্তে আস্তে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে লাগল। এত জোরে জোরে বাজ পড়ছিল, মনে হচ্ছিলো যেন আমাদের গাড়ির ওপরেই পড়ছে। কমার কোনো লক্ষণই নেই।

তখনও নেটওয়ার্ক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ করছিল। জিষ্ণু অনেকক্ষণের চেষ্টায় খবর জোগাড় করল যে কাল রাত থেকেই এই অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে, এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

রেগেমেগে ও ড্রাইভার ছেলেটাকে বলল, ”আমাদের বলোনি কেন এদিকে এত বৃষ্টি হচ্ছে?”

ছেলেটা সংক্ষেপে জবাব দিয়েছিল, ”মুঝে ভি পতা নেহি থা।”

অতঃপর এখন এই দু-ঘণ্টায় আমাদের মুখের হাসি মুছে গিয়ে ক্রমে বিরক্তি, উদ্বেগ, শেষে ভয় এসে জমা হয়েছে। এই প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ের ওপর দিয়ে গাড়ি করে যাওয়ার অর্থ যেচে মৃত্যুর দিকে পা বাড়ানো। কোনোভাবে একবার যদি চাকা স্লিপ করে যায়, মুহূর্তে হাজার হাজার ফুট নীচের খাদে ভবলীলা সাঙ্গ হবে আমাদের।

আমি জিষ্ণুর কাঁধে টোকা দিলাম, ”কী ব্যাপার বলতো? ছেলেটা গাড়ি থামাচ্ছে না কেন? আমাদের মারার তাল টাল করছে নাকি?”

জিষ্ণু ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ”ও ভাই, গাড়িটা থামাচ্ছ না কেন? সবাই মিলে মরব তো এবার!”

জিষ্ণুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

ছেলেটা হিন্দিতে বলল, ”এখানে থামিয়ে কী করব? এইসব রাস্তা একবার ভেসে গেলে কোথায় দাঁড়াবেন? রাতে এদিকে কোনো থাকার জায়গাও তো নেই। বৃষ্টিতে যদি ধস নামতে শুরু করে?”

জিষ্ণু সাদা চোখে বলল, ”তাহলে? তুমি কোথায় যাচ্ছ ভাই?”

ছেলেটা বলল, ”যতক্ষণ পারছি চালাচ্ছি। বাঘপুল একবার পেরিয়ে গেলে আর তেমন টেনশন নেই। ওদিকে রাতে কোথাও একটা থাকার জায়গা হয়ে যাবে ঠিক।”

”বাঘপুল আবার কোথায়?” আমি ফিসফিস করলাম।

জিষ্ণু বলল, ”আরে করোনেশন ব্রিজ। শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং-এর কানেক্টর। ওটাকেই ওরা বাঘপুল বলে।”

”তো সেই ব্রিজ আসতে কতক্ষণ লাগবে ভাই?” আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম।

ছেলেটা চ্যুইং গাম চিবোচ্ছিল, বৃষ্টির ছাঁটে বেচারার মুখে বিন্দু বিন্দু জলভরে উঠেছে, ”আরও এক ঘণ্টা।”

”শালা এই সাইক্লোনের মধ্যে দিয়ে এক ঘণ্টা যেতে হলে বেঁচে থাকব তো? টেঁসে যাব না তো ভাই!” বিড়বিড় করল গৈরিক।

দলের পান্ডা হিসেবে মুখ শুকিয়ে গেলেও জিষ্ণু সঙ্গে সঙ্গে বরাভয় দিল, ”এই ছেলেটা লোকাল। ও ঠিকই বলছে। কোনোমতে করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে গেলে হয়তো আর চিন্তা নেই।”

গৈরিক আবার চিরকালের কল্পনাপ্রবণ, ও বলল, ”ধর এই ছেলেটা যদি কোনো ডাকাত দলের চ্যালা হয়? হয়তো এইভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের?”

আমি বললাম, ”অ্যাঁ! ডাকাত দলের? এইদিকে ডাকাত আছে নাকি?”

”বাঃ! ডাকাত থাকবে না? জঙ্গল আছে, তার মানেই ডাকাত আছে।” বিজ্ঞের মতো বলল গৈরিক।

জিষ্ণু সামনের সিট থেকে পেছনে ঝুঁকে এসে প্লাস্টিকের জলের বোতলটা তুলে আছাড় মারল গৈরিকের মাথায়, ”তোর এই গল্প বানানোর অভ্যেসটা বন্ধ কর। এখানে খামোখা ডাকাত কোত্থেকে আসবে! শালা একে ওয়েদার নিয়ে চিন্তায় মরছি, ইনি এলেন ডাকাতদল নিয়ে।”

জিষ্ণুর কথা শেষ হল না, তার মধ্যেই ছেলেটা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে থামিয়ে দিল গাড়িটা।

”কী হল কী হল? থামল কেন? কোনো লোকজন ঘিরে ধরেছে …?” গৈরিক বলে উঠল।

না, কেউ আমাদের ঘিরে ধরেনি। উলটোদিক থেকে একটা গাড়ি আসছিল, তার ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু একটা কথা জানলা নিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলছে আমাদের ড্রাইভারটা।

ওদের ভাষা কিছু বুঝতে না পারলেও এটা আন্দাজ করতে পারছি যে সামনের রাস্তার কথাই বলছে ওই গাড়ির চালক।

আগেই বলেছি, যেহেতু আমাদের এই ট্যুরটা জিষ্ণুই অ্যারেঞ্জ করেছে, আমাদের সবার নেতা হিসেবে অঘোষিত পদটা ও নিজের কাঁধে এসে থেকেই তুলে নিয়েছে।

সবেতেই সবজান্তা ভাব দেখাতে গিয়ে ও এবার একটা কাণ্ড করে বসল। দুটো গাড়ি থেমে গেছে, সেই উৎসাহে ওর পাশের জানলার কাচটা নামাতেই একটা প্রায় আধখানা ইটের আয়তনের শিল এসে লাগল মাথায়।

জানলা বন্ধ থাকায় শিলাবৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারলেও সেটার তীব্রতা যে এতটা, সেটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।

মুহূর্তের মধ্যে সেই শিল ভেঙে বরফ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, আর জিষ্ণুর মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে শুরু করল।

চব্বিশ

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হেঁটেও যখন কোনো গাড়ির দেখা পেলাম না, আমার তখন অল্প অল্প টেনশন হওয়া শুর করল। সন্ধে প্রায় নেমে গেছে। এই অন্ধকার ঝড়বৃষ্টির রাতে পাহাড়ের রাস্তায় একা একা হাঁটাটা যে কতটা বিপজ্জনক ব্যাপার, সেটা এবার বুঝতে পারছিলাম।

যতই ছেলে সেজে থাকি, কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে এলেই বুঝে যাবে যে আমি আসলে মেয়ে।

নিজের মনেই আফশোস করতে লাগলাম। সেই গোর্খা ড্রাইভারটা বলেছিল পুলবাজারে নামিয়ে দেবে, এর চেয়ে ওর সঙ্গে চলে গেলেই ভালো হত। এমনিতে যা আবহাওয়া, কলকাতা পৌঁছনোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সেখানে আমার এই ঝোঁকের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্ত এখন হঠকারিতা মনে হতে লাগল।

আরও কিছুক্ষণ হেঁটে একটা গুমটি দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি এখন অল্প থামলেও এই গোটা উপত্যকার ওপর দিয়ে যে একটা ঝড় বয়ে গেছে তা একঝলক দেখলেই বোঝা যায়। কাছের গাছগুলো সব দুমড়ে মুচড়ে এর ওর গায়ে হেলে পড়েছে, এই গুমটির তেরপলের ছাউনিটা উড়ে গিয়ে বিশ্রী হাঁ হয়ে রয়েছে দোকানের সামনের দিকটা।

গুমটির সামনেটা বসে আছে একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা, আর কেউ নেই। আমি বললাম, ”কী ব্যাপার, কোনো গাড়িই তো দেখতে পাচ্ছি না শিলিগুড়ি যাওয়ার!”

”ওদিকে তো শিল পড়ছে খুব।” মহিলা বলল, ”একটু দাঁড়াও, কোনো গাড়ি যদি এদিক দিয়ে যায়, তাহলে উঠে পড়বে।”

”আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, এত গাড়ি যে ব্রিজে আটকে আছে, সেগুলো তো নিশ্চয়ই ব্যাক করছে। কোন দিক দিয়ে ব্যাক করছে সেগুলো? একটাকেও তো দেখা যাচ্ছে না!” আমি হাতদুটোকে জড়ো করে জোরে জোরে ঘষছিলাম। এবার ঠান্ডা লাগছে বেশ।

”বেশিরভাগ গাড়িই অন্য রাস্তা দিয়ে নেমে যাচ্ছে। এদিকে বৃষ্টিটা বেশি হচ্ছে তো, তাই আসছে না।” মহিলা এবার আমার দিকে ভালো করে অবাক চোখে দেখল, ”তুমি কি একাই নাকি?”

”হ্যাঁ। এখানেই থাকি, কলকাতায় ফেরার ট্রেন আছে আজ রাতে।” আমি বললাম।

”ট্রেন তো বন্ধ। এই তো একটা গাড়ির ড্রাইভার বলে গেল।” মহিলা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ”রাত নেমে আসছে, একা একা কোথায় ঘুরবে? আমার ঘরে থেকে যাও আজ। কাল সকাল হলে নেমে যাবে শিলিগুড়ি।”

আমি ইতস্তত করলাম। এইভাবে দুম করে চেনা নেই জানা নেই, কারুর বাড়িতে থাকিনি কখনো।

তবে, পাহাড়ে এই চলটা আছে। প্রকৃতির রোষ বা বিপর্যয় এদের ওপর এমনভাবেই পড়ে, যে এরা সাধারণত বিপদের সময় একে অপরকে সাহায্যই করে থাকে। সমতলের মানুষের মতো কু-অভিসন্ধি অতটা নেই এদের।

তা ছাড়া আমি কতক্ষণই বা এমন উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটব? পাহাড়ি লোকেরা বেশিরভাগই হয়তো ভালো, কিন্তু খারাপ লোক তো সব জায়গাতেই থাকে। কেউ যে বদমতলবে কোনো ক্ষতি করবে না, তাই বা কে বলতে পারে? তা ছাড়া দুমদাম যেকোনো গাড়িতে লিফট নিয়েও তো ওঠা যায় না। ঝোঁকের মাথায় হাঁটতে শুরু করে বোকামিটা যখন করেই ফেলেছি, তখন সেটাকে ম্যানেজ তো করতে হবে।

আমি হাসলাম, ”ঠিক আছে মাসি। তোমার ঘর কোথায়?”

মাসি পেছনদিকে আঙুল দেখালো, ”দোকানের পেছনে। বোসো, চা খাও। তুমি পুলবাজারে থাকো তো?”

আমি এবার অবাক হয়ে বললাম, ”হ্যাঁ। কী করে জানলে?”

এর আগে যেদিন শিলিগুড়ি থেকে যাচ্ছিলে, আমার ছেলের গাড়িতেই তো গিয়েছিলে। মনে নেই, আমার ছেলে গাড়ি চালাতে চালাতে আমার দোকানে থামল, তুমি বিস্কুট কিনলে!”

আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম। বাহ, নিরাপদ আশ্রয়ই পেয়েছি মোটামুটি। আজ রাতটা কোনো উপায় নেই, এর কাছে থেকে যাই। থাকা খাওয়া বাবদ কিছু টাকা দিয়ে দিলেই হল। তারপর কাল সকালে উঠে যেভাবে হোক শিলিগুড়ি চলে যাব।

”এবার মনে হচ্ছে বন্যা হয়ে যাবে।” মাসি চা করতে করতে বলল, ”ছেলে আটকে পড়েছে কার্শিয়াঙে, ফোন করে বলল। ওদিকে খুব ধস নামছে।”

আমি গুমটির সামনের একটা পাথরের ঢিবির ওপর বসে বৃষ্টি দেখছিলাম, বললাম, ”হ্যাঁ। কবে ট্রেন চালু হবে কে জানে!”

মাসির এই গুমটিটা রাস্তার একটা বাঁকের ধারে হওয়ায় অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। বৃষ্টি অনেকটা কমে এলেও আলো-আঁধারিতে অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তায় ক্রমাগত পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে পাচ্ছিলাম।

তার মধ্যেই লক্ষ করলাম দূর থেকে যেন একটা আলো এদিকে আসছে।

আর একটু কাছাকাছি আসতে বুঝলাম, একটা গাড়ি আসছে।

আমি আলগোছে মাসিকে বললাম, ”চা বসাও। তোমার খদ্দের আসছে মনে হয়।”

মাসি বলল, ”আর কিছুক্ষণ পরেই ঝাঁপ বন্ধ করে দেব। যা হাওয়া দিচ্ছে, এরপর আর বসা যাবে না।”

গাড়িটা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রায় তিরের গতিতে আসছিল। তারপর এই গুমটির কাছাকাছি আসতেই কর্কশ শব্দে একটা ব্রেক কষে দাঁড়াল।

আলো বেশ পড়ে এসেছে, মাসি একটু আগেই টিমটিমে একটা হ্যালোজেন বাল্ব জ্বালিয়েছিল।

সেই আলোয় আমি দেখলাম, গাড়িটা থামতেই মাঝের সিট থেকে একটা ছেলে লাফিয়ে নামল। তারপর প্রায় ছুটে আসতে লাগল আমাদের দিকে।

”কী হয়েছে, এরকম ভাবে দৌড়ে আসছে কেন?” আমি মাসির দিকে তাকিয়ে বললাম।

এইরকম বেচাল কিছু দেখলেই অজান্তেই মনের ভেতরটা কেমন দুলে ওঠে অজানা আশঙ্কায়।

মাসি কিছু বলার আগেই ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাস্যকর হিন্দিতে বলল, ”তুলো আছে, তুলো? বা কোন ন্যাকড়া? আমাদের এক বন্ধুর মাথা ফেটে গেছে, খুব রক্ত পড়ছে।”

আমি নিস্পলক তাকিয়ে দেখছিলাম।

যারা সত্যিকারের ক্যাবলা হয়, খাঁটি গোবর হয়, তাদের একঝলক দেখলেই বোঝা যায়, ভয়ে একদম নার্ভাস হয়ে পড়েছে।

এও তাই।

যেদিন হাইকোর্টে প্রথম আমার সঙ্গে তর্ক করতে এসেছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম, আজও বুঝলাম।

বন্ধুর মাথা ফেটে যাওয়ায় মঙ্গলরূপ বোধ হয় এমনিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ওপর কলকাতা থেকে প্রায় সাতশো কিলোমিটার দূরে উত্তরবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে এসে আমাকে এই গুমটির সামনে বসে থাকতে দেখে ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

পঁচিশ

দিওতিমা মুখ তুলে বলল, ”কাঁচি আছে মাসি?”

দিওতিমার মাসি, মানে ওই গুমটিতে বসে থাকা নেপালি মহিলা হাত উলটে কী বিড়বিড় করল, তারপর ঘরের এককোণে রাখা একটা ছোট্ট দেরাজে গিয়ে কিছুক্ষণ আঁতিপাঁতি করে খুঁজে এনে দিল একটা আধখানা ব্লেড। মহিলার পরনে একধরনের পাহাড়ি গাউন, ওপরে ফুল হাতা জামা, মাথায় একটা ফেট্টি বাঁধা। একটু পরে গাউনের পকেট হাতড়ে বের করল আরেকটা নতুন ব্লেড।

দিওতিমা ব্লেডটা দিয়ে সাবধানে ব্যান্ডেজের একটা দিক কাটল, তারপর নিজের চুল থেকে একটা ক্লিপ খুলে আটকে দিল ব্যান্ডেজের একদম শেষে।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”আর রক্ত বেরোবে না আপনার বন্ধুর মাথা থেকে। একটু গরম দুধ খাওয়াতে পারলে ভালো হত, দেখুন জোগাড় করতে পারেন কিনা!”

আমি ভ্যাবলার মতো গৈরিকের দিকে তাকালাম। এই বৃষ্টিবাদলার রাতে পাহাড়ের মাথায় দুধ কোত্থেকে পাব?

গৈরিক মাথা চুলকে বলল, ”ইয়ে, গুঁড়ো দুধ চলবে? কফি-র জন্য এনেছিলাম।”

দিওতিমা আমার আর গৈরিকের দিকে কটমট করে একবার তাকিয়ে আবার তাকাল ওর মাসির দিকে, ”দুধ পাওয়া যাবে মাসি?”

নাহ, স্বীকার করতেই হবে, দিওতিমার মাসি প্রায় কল্পতরু টাইপের।

সামান্য ঘাড় নেড়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, নিশ্চয়ই দুধের খোঁজে।

ঘরে এবার আমরা পাঁচজন প্রাণী। তার মধ্যে জিষ্ণু বিছানায় চোখ উলটে পড়ে এখনো গোঁ গোঁ করছে।

হতভাগার সহ্যশক্তি বলে কিচ্ছু নেই, সামান্য কিছু হলেই চোখে সর্ষেফুল দেখে, আবার লিডার হয়েছে! হুহ!

গৈরিক আর চিরন্তন বসে আছে একটা ছোট বেঞ্চে, আড়ষ্ট হয়ে।

স্বাভাবিক, জানা নেই শোনা নেই, একটা অচেনা বাড়িতে ঢুকে পড়লে কেমন অপ্রতিভ লাগে না নিজেকে?

বাকি রইলাম আমি আর দিওতিমা। দিওতিমা বসে আছে জিষ্ণুর বিছানার ঠিক পাশেই একটা চেয়ারে।

আর আমি কী করব বুঝতে না পেরে একটু দূরে ঘরের একমাত্র জানলার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের নখ খাচ্ছি।

ঘরটা ছোট কিন্তু ঘুপচি নয়। একপাশে টিউব লাইট জ্বলছে, অন্যপাশে বিছানা, চেয়ার এবং ইতিউতি আসবাব ছড়ানো।

জিষ্ণুর মাথায় আচমকা একটা শিলাপাথর লেগে যখন দরদর করে রক্ত পড়তে শুরু করল, তখন আমি গৈরিক আর চিরন্তন তিনজনেই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়িতে কিচ্ছু ছিল না, যা দিয়ে ওর ক্ষতস্থানটাকে চেপে ধরব। ড্রাইভার ছেলেটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিল, যতটা দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালাতে শুরু করেছিল। রাস্তার ধারের দোকানটা দেখতে পেয়েই নেমে এসেছিলাম আমি।

আর তখনই দেখতে পেয়েছিলাম দিওতিমাকে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, ও আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢেকে চুপ করে বসেছিল। কিন্তু মুখের দিকে চোখ পড়তেই আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

নিজের অজান্তেই কখন জানিনা বুকের মধ্যে বুড়বুড় কাটতে শুরু করেছিল।

হাওড়ায় চাকরি করা, উত্তরপাড়ার মেয়ে দিওতিমা এইখানে, এই পাহাড়ের মধ্যে?

একা একা এখানে ও কী করছে?

তারপর জিষ্ণুর এই অবস্থা দেখে দিওতিমা-ই উদ্যোগ নিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে পেছনের এই দোকান লাগোয়া ঘরটাতে। দোকানের মালকিন সম্ভবত দিওতিমার পূর্বপরিচিত।

আমি যখন এইসব আকাশপাতাল ভাবছি, তখন দেখি দিওতিমা আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পা নাচাচ্ছে। আর ওর ভিজে যাওয়া প্যান্টটা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে কাঠের মেঝের ওপর।

”এইখানে আপনি কী করে এলেন?” বুলেটের মতো প্রশ্ন ধেয়ে এল আমার দিকে।

আমি দিওতিমাকে দেখছিলাম। খুব বেশিদিন হয়নি, আমাদের শেষ দেখা হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতি এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে যেন কতযুগ পরে দেখা হচ্ছে!

মিথ্যে বলব না, কাল সন্ধেবেলা ঝন্টুর কাছে ‘হাপিশ করে দিয়েছি’ শোনার পর থেকে শরীরের মধ্যে কেমন একটা আনচান করছিল, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজবের মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ কেমন বোলতার মতো মনের গভীরে ভনভন করছিল ঝন্টুর বলা কথাটা।

তাই বলে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারনি যে দিওতিমাকে এখানে এইভাবে দেখতে পাব।

”হাঁ করে তাকিয়ে আছেন কেন?” দিওতিমা ধমকে উঠল, ”আশ্চর্য তো! শুনতে পাচ্ছেন না নাকি?”

আমি থতমত খেয়ে বললাম, ”অ্যাঁ? হ্যাঁ, মানে আ-আমরা সান্দাকফু যাচ্ছিলাম তো! রাস্তায় এত বৃষ্টি … গাড়ি চলছিল, হঠাৎ একটা শিল লেগে জিষ্ণুর মাথাটা …।”

”বুঝেছি।” দিওতিমা ঠোঁটের ডানপাশটা বেঁকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল, ”বিয়ের আগে বন্ধুদের সঙ্গে শেষ ট্রিপ, তাই তো?”

কলেজে পড়ার সময় ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’-র আঁকা মোনালিসা ছবির হাসি আর ঠোঁটের কৌণিক পারস্পেক্টিভ নিয়ে আমাদের আলাদা একটা অধ্যায় ছিল। সেটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার।

দিওতিমাকেও ডানপাশ চেপে হাসলে বেশ অন্যরকম দেখায়।

”কী অদ্ভুত তো। উত্তর দেন না কেন কথার?” এবার মেয়েটা ঝাঁঝিয়ে উঠল।

”অ্যাঁ?” আমি চমকে উঠলাম, ”কী বলছেন?”

নেপালি মহিলাটি একটা বাটিতে করে কিছুটা দুধ নিয়ে এলে দিওতিমা প্রসঙ্গ পালটে বলল, ”দেখেছেন, এখানকার লোকেরা কত উপকারী হয়? আপনার বাড়ির পাশে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে আপনি তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে দুধ খাওয়াতেন? রাতে থাকতে দিতেন?”

”উনি আপনাকে চেনেন বলে তবু ভালো, নাহলে হয়তো এতটা সাহায্য পাওয়া যেত না।” আমি বললাম।

”চেনেন আবার কি?” খর চোখে তাকাল দিওতিমা, ”আপনারা আসার আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ। আমি আজ রাতটা এখানেই থাকব, তারপর কাল সকালে শিলিগুড়ি ফিরব। চেনা জানা কিছুই নেই। পাহাড়ের লোকেরা এমনই। এরা আমাদের মতো অত প্যাঁচালো নয়।”

দিওতিমা যে এখানে চাকরি করতে এসেছে, আমি জানতামই না। কীভাবে ওপরমহলে ঘুঁটি সাজিয়ে ওকে রাতারাতি এইরকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ট্রান্সফার করা হয়েছে, সেটা শুনেও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

ঝন্টু তাহলে ‘হাপিশ করা’ বলতে এটাই বুঝিয়েছিল!

আমি বললাম, ”আপনি এখানে কীভাবে থাকেন? মানে, সম্পূর্ণ একা?”

”দোকা কোথায় পাব?” দিওতিমা কাষ্ঠ হাসল, ”যদি আপনাদের সান্দাকফু ট্যুর না থাকতো, তাহলে পুলবাজারে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম। ক-দিন থাকতেন তারপর কলকাতা ফিরে আপনার বাবাকে বলতেন যে, দ্যাখো, তোমাদের পেছনে লাগার জন্য মেয়েটাকে কীভাবে কষ্ট করে এখানে থাকতে হচ্ছে।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। বাবা কি সত্যিই জানেন যে দিওতিমাকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে? নাকি পুরোটাই জগদীশকাকা আর ঝন্টুর রাজনৈতিক দলের চাল? আমার কেন জানিনা আবার মনে হল, জগদীশকাকার ওপর বাবার যতই নির্ভরশীলতা বেড়ে উঠছে, কালবৈশাখীর কালো মেঘের মতো আড়ালে ঘনিয়ে আসছে বিপদ।

”বিনি কেমন আছে?” হঠাৎ বলল দিওতিমা।

বিনির ব্যাপারটা কি দিওতিমা জানে? কিন্তু বিনি যে বলেছিল কাউকে জানাবে না? নাকি দিওতিমা কিছু জানেনা, এমনিই কুশলজিজ্ঞাসা করছে।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাকে কেন? বিনি-র খবর আমাকে জিজ্ঞেস করার মানে কী?

আমি দিওতিমার একটা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে হাজারখানা সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করছিলাম।

মুখে বললাম, ”ভালো। ও তো আপনার ছোটবেলার বন্ধু, তাই না?”

”হ্যাঁ।” দিওতিমা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই জিষ্ণু বিড়বিড় করতে শুরু করল, ”ও বাবা গো, মরে গেলাম গো! কী যন্ত্রণা, উফ!”

দিওতিমা ঝুঁকে পড়ে বলল, ”অত জোরে নড়বেন না, ব্যান্ডেজটা খুলে যাবে। আরেকটু দুধ খাবেন?”

জিষ্ণু এবার চোখ মেলে অনেক কষ্টে দিওতিমার দিকে চাইল, কাগজে ছবি দেখার সূত্রে চিনতে পারল কিনা বুঝলাম না, কিন্তু ওর ছটফটানি একটু যেন কমল। বলল, ”আপনি কে?”

দিওতিমা বলল, ”আমি এখানেই থাকি। আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন, বেশি নড়াচড়া করবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন। ভালো করে একটা ঘুম হলেই দেখবেন ঠিক হয়ে গেছে।”

”আমি কি আদৌ বাঁচব?” জিষ্ণু বলল।

দিওতিমা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল, ”মানে? বাঁচামরা আবার কোত্থেকে আসছে! সামান্য একটু ফেটেছে!”

জিষ্ণু এবার কাতরাতে কাতরাতে আমার দিকে তাকাল, ”ক-টা স্টিচ পড়েছে রে আমার মাথায়?”

আমি বললাম, ”একটাও পড়েনি। তেমন কোনো গভীর ক্ষত হয়নি যে স্টিচ করতে হবে। তুই ভয়টা একটু কম পা। উনি ভালো করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন, রক্ত পড়া থেমে গেছে। চুপচাপ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়।”

চিরন্তন এবার বলল, ”ঘুমিয়ে পড়লেই তো হল না, সন্ধে নেমে গেছে। আমরা রাতটা থাকব কোথায়? কোনো হোটেল-টোটেল তো খুঁজতে হবে।”

”এক কাজ করা যাক।” গৈরিক দিওতিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”আপনি একটু জিষ্ণুকে দেখুন, আমরা তিনজন বেরিয়ে কোনো হোটেল ঠিক করে এসে ওকে নিয়ে যাচ্ছি, বুঝলেন?”

দিওতিমা এবার উঠে দাঁড়াল, হেসে বলল, ”এই চত্বরে হোটেল? কাছেপিঠে কেন, তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যেও কোনো হোটেল পাবেন না।”

”যাহ! তাহলে?” গৈরিক চিন্তান্বিতভাবে আমার দিকে তাকাল। আমাদের ড্রাইভার ছেলেটা আগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এই অবস্থায় সে আর গাড়ি চালাতে পারবে না। আজ জিষ্ণুর কপালে লেগেছে তবু একরকম, যদি ওর কপালে লাগত? তাহলে আমরা এতক্ষণে হয়তো সবাই ওপরে চলে যেতাম।

আমি কিছু বলার আগে দিওতিমা ওই নেপালি মহিলাকে হিন্দিতে বলল, ”এদের কোথায় রাখা যায় বলুন তো? বাইরে তো সাংঘাতিক অবস্থা!”

মহিলা দিওতিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”আমার এখানে দুটো ঘর। একটা ঘরে আমি আর তুমি শুয়ে পড়লে ওই ঘরটায় ওরা থাকতে পারে। ড্রাইভার নিয়ে চিন্তা নেই, ওরা গাড়িতেই শুয়ে পড়ে। তবে ওই ঘরটা অবশ্য ছোট, একটু কষ্ট করে থাকতে হবে।”

”নানা, আমাদের কোনো অসুবিধে নেই।” আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম। দুর্যোগের এই রাতে পাহাড়ের মধ্যে যে থাকতে পারছি, এই ঢের!

দিওতিমা মহিলাকে বলল, ”কিন্তু আপনার ছেলে? সে আসবে তো?”

মহিলা মাথা নাড়ল, ”না, ও তো কার্শিয়াঙে আটকে পড়েছে, রাস্তা ধস পড়ে বন্ধ। আজ ওখানেই কোথাও থেকে যাবে।”

”তাহলে আবার কী!” কাঁধ ঝাঁকাল দিওতিমা, ”আপনারা এখানেই থেকে যান। রাতও হয়ে গেছে। কাল সকালে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে’খন। আমি চলে যাব শিলিগুড়ি, আর আপনারা কী করবেন ভেবে দেখবেন।”

দিওতিমা’-র ‘রাত হয়ে গেছে’ কথাটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল, আজ সন্ধেবেলা নানা তালেগোলে সন্ধ্যাহ্নিকটা আর করা হল না।

নিমেষে আমার মনে হল, দিওতিমা নয়, সামনে যেন বাবা’-ই দাঁড়িয়ে চোখ পাকাচ্ছেন আমায়।

”লজ্জা করে না তোমার? ভট্টাচার্য বাড়ির ছেলে হয়ে তুমি কিনা……..।”

”হাঁ করে কি দেখছেন বলুন তো?” দিওতিমা ভ্রূ কুঁচকে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

আমি চটকা ভেঙে বললাম, ”না না কিছু না।”

ছাব্বিশ

যে পরিস্থিতি থেকে, যাদের থেকে পালাতে চাই, ঈশ্বর বারবার তাদের মুখোমুখি, সেইসমস্ত অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাকে আচম্বিতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কী পান?

যার সংশ্রব ত্যাগ করব বলে গত কয়েকদিন ফোন পর্যন্ত রিসিভ করিনি, কেন হঠাৎ তার সামনাসামনিই হতে হল আমায়?

সত্যি বলতে কী, সন্ধেবেলা গুমটির সামনে বসে যখন মঙ্গলরূপকে দেখতে পেয়েছিলাম, কোনো অ্যালার্ম সিগন্যাল ছাড়াই মনের ভেতরটা কেমন ভাল হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু পরের মুহূর্তেই বিনির কথা মনে পড়তে মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মঙ্গলরূপের ফোন ধরিনি, কোনো যোগাযোগ রাখিনি, এমনকী কলকাতা ছাড়ার আগে সৌজন্যমূলক বিদায়ও জানাইনি সচেতনভাবেই, আর মঙ্গলরূপ নিজেই এখানে হাজির হয়ে গেল?

এইসময়েই মঙ্গলরূপকে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে আসতে হল, আবার এই একই জায়গায়, একই রাস্তায় গাড়িও থামাতে হল!

তবে একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগছে, মঙ্গলরূপের মতো ছেলেও বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে আসে! এটা মনে করেই আমার হাসি পাচ্ছে। গৈরিক বলে ফরসা মোটা ছেলেটা তো একবার বলেই ফেলল, ”প্রথমবার বাইরে এসে কী বিপদে পড়লি বল তো রূপ!”

এও হতে পারে, বিনিই হয়তো বিয়ের আগে স্বামীকে একটু হলেও স্বাবলম্বী হতে বলছে। ও-ই হয়তো বোঝাচ্ছে, বাবার ভয়টা কাটিয়ে একটু নিজের মতো ঘুরে এসো, নাহলে পরে আমাকে নিয়ে বেড়াবে কী করে?

ধুর, কী সব আবোলতাবোল ভাবছি আমি? কে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে, কেন এসেছে, সেসব শুনে আমি কী করব? হঠাৎ দেখা হয়েছে, ওদের বন্ধুর একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমি সাধ্যমতো সাহায্য করেছি, ব্যাস এইটুকু! কোনোমতে আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে নীচে নামতে পারলে বাঁচি!

আমি আর মাসি রান্নাঘরে রুটি তৈরি করছিলাম। রান্নাঘর বললে অবশ্য ভুল হবে, রাস্তার ওপর যে ছোট্ট দোকানটা রয়েছে, তারই পেছনদিকে দুটো ছোট ছোট ঘর, একচিলতে রান্নার জায়গা আর বাথরুম। মাসির স্বামী মারা গেছেন অনেকদিন আগে, তিনিও শিলিগুড়ি দার্জিলিং রুটে গাড়ি চালাতেন। ছেলেও তাই চালায়। মাসি সকাল সকাল ঘরের কাজকর্ম সেরে গুমটিতে বসে। পথচলতি পর্যটকদের জন্য চা-কফি বানায়, মোমো-ও বানায়।

এত সীমিত সম্পদের মধ্যেও যে মানুষ কতটা আন্তরিক হতে পারে, নিজেদের অসুবিধা উপেক্ষা করে বিপদে পড়া মানুষগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তা হয়তো এই মাসিকে না দেখলে বোঝা যেত না।

রাতের মেনু একদম সামান্য, মোটা মোটা রুটি আর আলু-ফুলকপির তরকারি। তাতেই সবাই প্রায় চেটেপুটে খেয়ে নিল।

রূপের যে বন্ধুটার মাথায় চোট লেগেছে, ব্যাটা বেজায় হ্যাংলা, এই অবস্থাতেও খান দশেক রুটি, সঙ্গে এখানকার ঝাল ঝাল আচার খেয়ে তারপরও বলে কী, ”একটু মিষ্টিজাতীয় কিছু হলে ভালো হত!”

রূপ অবশ্য অমন নয়, বারবারই এত সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছিল মাসিকে। আমাদের রান্নায় সাহায্য করতেও এসেছিল, আমিই বারণ করলাম।

চিরন্তন বলে ছেলেটা বলছিল, ”আপনি এই পাহাড়ে একা একা থাকেন? ভয় করেনা?”

”ভয় করলে কী করব? চাকরিটা তো করতে হবে!” আমি বলেছিলাম, ”আমার কাছে চাকরিটা বিলাসিতা নয়, দরকারি।”

”তার মানে আপনি যে ওই আন্দোলনটা করছিলেন, সেটা মাঝপথেই বন্ধ করে দিলেন?” ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল গৈরিক।

খবরের কাগজের কল্যাণে আমি এখন এদের কাছে পরিচিত মুখ, অন্তত কিছুদিনের জন্য। তবে এমনিতেই কলকাতা ছেড়ে চলে আসার জন্য ফিকে হতে চলেছে আমার খবর, তার ওপর একজিনিস নিয়ে মিডিয়া বেশিদিন কচলায় না, ওদের নিত্যনতুন টপিক চাই। রূপও হয়তো আমার সম্পর্কে ওদের কিছু বলেছে।

”আন্দোলন আবার কী করলাম!” ভ্রূ ওপরে তুলেছিলাম আমি, ”আমি একটা জনস্বার্থ মামলা করেছিলাম, একটা সাম্যনীতির জন্য, একটা সমান অধিকারের জন্য। সেটা আন্দোলন হতে যাবে কেন! আমি কোনো দলেও ভিড়িনি, বা কোনো রাজনৈতিক ঝান্ডাও ওড়াইনি। যদিও অনেকেই রাজনীতির হাত ধরে আমার ক্ষতি করেছে।” রূপের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম আমি।

রূপ বুঝতে পেরেই পলকে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল।

কিন্তু টিউবলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখেছিলাম ওর মুখটা এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রতিবাদ করেনি।

জিষ্ণু ছেলেটা খালি এক কথা ঘ্যানঘ্যান করছিল, ”সব ভেস্তে গেল। সব। এত কাণ্ড করে, অফিসে ছুটি ম্যানেজ করে এলাম, শালা ওয়েদারটা এমন বিট্রে করল!”

আমি খেয়ে নিয়ে ছবিদাদুকে ফোন করে সব বললাম, শুধু পুরোহিত সংগঠনের নেতার একমাত্র পুত্রের সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাতের ব্যাপারটা ছাড়া।

ছবিদাদু বললেন, ”হুঁ। টিভিতে দেখাচ্ছে। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর আর মালদাতেও অবস্থা খুব শোচনীয়। তোর্সা আর রায়ডাক উপচে পড়েছে। এর মধ্যেই প্রায় ত্রিশজন মারা গেছে। ষাট হাজারের ওপর বাড়ি ডুবে গেছে জলে। মুখ্যমন্ত্রী জরুরি ভিত্তিতে রিলিফ ক্যাম্প খুলতে নির্দেশ দিয়েছেন।”

আমি অবাক হলাম, ”এত কিছু হয়ে গেছে! এসব তো কিছুই জানিনা।”

”জানবি কী করে? তোদের দার্জিলিং জেলায় তো ক্ষয়ক্ষতি এখনো তেমন হয়নি। কিন্তু মাঝখানের ওই জায়গাগুলোয় বন্যা হয়ে যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন ট্রেন কবে চলবে কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না।”

”তাহলে?” আমি ঠোঁট কামড়ালাম, ”কী করে ফিরব তাহলে? এখানেও তো আজ থেকে তুমুল বৃষ্টি। সেভক বন্ধ।”

”শিলিগুড়ি থেকে বাস ধরেও মনে হয় না কোনো লাভ হবে। কিষানগঞ্জের পর থেকে রাস্তা, ট্রেনলাইন সবই প্রায় জলের তলায়।” দাদু চিন্তা করছিলেন, ”এক যদি বাগডোগরা থেকে প্লেন ধরতে পারিস!”

আমি বুঝলাম দার্জিলিঙে এসে প্রথম মাসের মাইনের সিংহভাগই আমার প্লেনভাড়ায় চলে যাবে। বললাম, ”কাল সকালে উঠে কেমন অবস্থা থাকে দেখি। সমাদ্দার উকিলের কী খবর?”

”খবর ভালো। সমাদ্দারকে কাল অনেক করে বুঝিয়েছি। সে আজ একটা কাজের কাজ করেছে, মিডিয়া ডেকে প্রেস কনফারেন্স করে পুরো ব্যাপারটা জানিয়েছে। আজ সন্ধে থেকে তোর নিউজটা তাই আবার দেখাচ্ছে টিভিতে।”

ছবিদাদুর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মা-কে ফোন করলাম। মা রীতিমতো উদ্বিগ্ন, অনেক কষ্টে শান্ত করলাম।

এই বাড়ির একদম পেছনদিকটায় রয়েছে একটা ছোট্ট ঝোলা বারান্দা, প্রায় খাদের গায়ে। খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, ওরা সব শুয়েও পড়েছে। আমি বারান্দার দিকে যেতেই দেখতে পেলাম রূপকে।

ঝোলা একটা পাঞ্জাবি পরে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দাটায়।

এই ঠান্ডায় খোলা জায়গায় এভাবে দাঁড়িয়ে, ঠান্ডা লাগছে না?

আমার পায়ের শব্দে রূপ চমকে পেছন ফিরল, ”ওহ আপনি!”

আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, ”শুতে যাবেন না?”

”হ্যাঁ। এই যাব।” ছেলেটা উদাস ভঙ্গিতে আবার সামনের দিকে তাকাল।

সামনে নিকষকালো অন্ধকার পাহাড়, একঝলক দেখলে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। মনে হয় এই পড়ে যাব হাজার হাজার ফুট নীচে। দূরের উঁচু উঁচু গাছগুলোর ওপর আবছা চাঁদের আলো পড়ে কেমন যেন মায়াময় দেখাচ্ছে চারদিক। কোনো একটা নাম না জানা পাখি একটা অদ্ভুত করুণ সুরে ডাকছে।

”আমার ভাগ্যটা খুব খারাপ জানেন!” সহসা নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল রূপ।

”কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”ভাগ্য আবার আপনার সঙ্গে কী করল?”

”এই যে, জীবনে কোনোদিনও পাহাড়ে আসিনি। এই প্রথম বাড়ির একরকম অমতে বন্ধুদের সঙ্গে এলাম, ভাবলাম প্রকৃতিকে চেটেপুটে উপভোগ করব, কোথায় কী! কালই হয়তো ফিরে যেতে হবে বাড়ি।” রূপ হতাশ গলায় বলল, ”তারপর আবার সেই একঘেয়ে জীবন।”

আমি কিছু বলার আগেই রূপের ফোন বেজে উঠল। ও ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল, ”হ্যাঁ আবীর বল …আচ্ছা, অ্যারেস্ট করেছে? বাহ, খুব ভালো কথা। কী বলছে লোকটা? … ওহ, তোদের উকিল তো বেশ দুঁদে তাহলে … যাক বিশাল একটা ফাঁড়া কাটল। কী বলে যে তোকে থ্যাঙ্কস দেব ভাই … বিনি এখন ঠিক আছে তো? … ওর বাড়ির লোককে কিছু বলছে…?…”

ছেঁড়া ছেঁড়া কথায় আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বেশি আগ্রহ দেখানোটাও সমীচীন নয়, তবু বিনি-র নামটা শুনে কিছুতেই যেন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।

রূপ ফোনটা বন্ধ করতেই আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, ”কী হয়েছে? বিনি ঠিক আছে?”

”হ্যাঁ।” রূপ ইতস্তত করে বলল, ”একটা সমস্যা হয়েছিল আর কী! এখন মিটে গেছে। আসলে বিনির …।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম, ”আপনাদের জন্য আমার অনেক শুভেচ্ছা রইল।”

রূপ এবার মনে হল কিছু বুঝতে পারছে না, আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ”শুভেচ্ছা? কিসের শুভেচ্ছা?”

যেসব লোকজন সব বুঝতে পেরেও কিছু না বোঝার ভান করে ন্যাকামো করে, তাদের দেখলে আমার গা-পিত্তি জ্বলে যায়।

রূপকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ভুল বুঝেছিলাম। এ-ও বিনির মতোই মিটমিটে।

আমি কৃত্রিম হেসে বললাম, ”বাহ! কিসের আবার। আপনাদের বিবাহিত জীবনের।”

”মানে?” রূপ দেখছি এখনো হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে, ”কার বিয়ে? কাদের বিবাহিত জীবন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

এবার আমার বিরক্ত লাগল। এই ছেলেটা কি ইচ্ছে করে আমার সামনে এমন ভান করছে? এদিকে সেদিন বাসে ভাবী স্ত্রীর ডাকে তো আমার সামনে থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল।

আমি একটু কড়া গলায় বললাম, ”অদ্ভুত তো! এইরকম বোকা সাজছেন কেন? বিনির সঙ্গে আপনার বিয়ে ঠিক হয়নি?”

সাতাশ

আমি বিশেষ রোম্যান্টিক কিনা জানিনা, কারণ কোনোদিনও রোম্যান্স করার সুযোগ হয়নি। পার্বণীর সঙ্গে যেটুকু হয়েছিল, সেটাকে আর যাই হোক, রোম্যান্স বলা চলে না।

কিন্তু এই অন্ধকার নিশুতি রাতে পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে বাঁকা চাঁদের নরম আলো গায়ে এসে পড়লে সবাই একটু ভাবুক হয়ে পড়ে। এমনিতেই এত গভীর রাতে একাকী কোনো অচেনা স্বল্পপরিচিত মেয়ের সঙ্গে এভাবে কোনোদিনও আগে কথা বলিনি।

তার ওপর যতই হোক, আমি আঁকিয়ে মানুষ, একটু কেমন হয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু দিওতিমার মুখে আমার আর বিনির বিয়ের কথা শুনে আমার ভাব তো কেটে গেলই, আমি কী বলব বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

”চুপ করে রয়েছেন কেন?” দিওতিমা ধমকে উঠল, ”আপনারা ছেলেরা কী অদ্ভুত, একজনকে জীবনসঙ্গিনী করবেন, তা স্বীকার করতে এত কুণ্ঠা কিসের?”

”কুণ্ঠা থাকতে যাবে কেন!” আমি খাবি খেতে খেতে কোনোমতে বললাম, ”আ-আপনি ভুল করছেন। বিনির সঙ্গে আমার কেন বিয়ের ঠিক হতে যাবে। বিনি তো আমার বোন টিকলির বন্ধু। ও সম্প্রতি একটা বিপদে পড়েছিল, তাই আমরা কয়েকজন ওকে একটু হেল্প করছিলাম …!”

দিওতিমার মুখ দেখে মনে হল, ও এবার সত্যিই অবাক হয়েছে, ”ওমা! বিনি যে বলল ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেদিন বাসে আপনাকে আর ওকে দেখে আমি …!”

”না না।” আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ”বিনির বিয়ে ঠিক হয়েছিল একটা বাজে ছেলের সঙ্গে। সে এক লম্বা গল্প, পরে সময় করে বলব’খন। বিয়েটা ভেঙে গেছে, এটাই যা ভালো ব্যাপার। নাহলে পরে ওর কপালে অশেষ দুর্গতি ছিল।”

”ওহ! এদিকে আমি কি না কি …!” দিওতিমা এখনো ওর মুহ্যমান ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ”ও ঠিক আছে তো?”

”হ্যাঁ হ্যাঁ বিনি এখন ঠিক আছে।” আমি বললাম, ”আপনাকে তো সেদিনের পর থেকে আমি অনেকবার ফোন করেছিলাম, মেসেজও করেছিলাম। কোনো রেসপন্স পাইনি। আমি তো জানতামই না আপনি এখানে রয়েছেন! ট্রান্সফারের ব্যাপারে কিছুই খবর পাইনি।”

দিওতিমা কী যেন ভাবছে, আমার কথায় চমক ভেঙে বলল, ”হ্যাঁ? হ্যাঁ … মানে আর ফোনটা আর কী … আসলে ট্রান্সফার অর্ডারটা হঠাৎ করেই এসেছিল … দু-দিনের মধ্যেই চলে আসতে হল … কাউকে জানাতে পারিনি।”

আমি বললাম, ”আপনাকে ওই ব্যাপারটার জন্যই তড়িঘড়ি কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল, তাই না!”

”হ্যাঁ। একদিন লোকাল এম এল এ বাড়ি এসে হম্বিতম্বি করল। বলল কেসটা উইথড্র করে নিতে। উলটোপালটা বলছিল, আমারও মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, দিয়েছিলাম দু-কথা শুনিয়ে। তারপরেই অর্ডারটা এল। আপনাদের ওই ঝন্টুও তো পার্টির লোক। সে-ও একদিন হাওড়া স্টেশনে হাত ধরে …।” দিওতিমা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল, ”ধুর! ভাবছি কোনোমতে কলকাতা পৌঁছতে পারলে কেসটা তুলেই নেব। এত হাঙ্গামা আর পোষাচ্ছে না!”

”সেকি!” আমি বলে উঠলাম, ”কেন? এতদূর এগিয়ে এসে পিছু হটবেন কেন? ক-জনের সাহস হয় আপনার মতো একা লড়ে যাওয়ার?”

”কি করতে পারলাম লড়ে? আমি আমার বাজে ট্রান্সফারের কথা বলছি না, সে নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমার উকিল, রাজেন সমাদ্দার, তাকে পর্যন্ত হ্যারাস করছে, তার বাচ্চা ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এসব কী বলুন তো!”

”কারা এসব করছে?”

”কারা আবার? আপনাদের ওই ঝন্টুর দল! পেছন থেকে ওদের মদত দিচ্ছে অরূপ কাঞ্জিলালের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত পার্টির নেতারা। আসলে আমাদের সিস্টেমটাই এমন হয়ে গেছে, যে পালটানোর সদিচ্ছা থাকলেও কেউ পালটাতে পারবে না। সবাই আপনাকে নীচ থেকে প্রাণপণ টেনে ধরবে, আটকে দেবে আপনার চলন। আপনি যতই চেষ্টা করুন, ওরা সোজাপথে না পেরে বাঁকাপথে আপনার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করবে।” দিওতিমার গলায় তীব্র হতাশা ঝরে পড়ছিল, ”একা একা বিপ্লব করা যায় না, বুঝলেন!”

”কিন্তু। আপনি যেভাবে আঁচড় কেটেছেন, তাতে পুরোহিত সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ প্রতিবাদ করলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু আপনার স্বপক্ষেই আছে। আমি কয়েকদিন আগেও এই নিয়ে একটা সভার খবর পড়েছি। সাধারণ জনতা কিন্তু চাইছে যে পুরোহিতদের কোনো একটা গুণমান যাচাইয়ের পরীক্ষা নেওয়া হোক।”

”জানিনা!” কাঁধ নাচাল দিওতিমা, ”আমার মধ্যে আস্তে আস্তে একটা উদাসীনতা চলে আসছে। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যে স্বপ্ন থেকে তখন মামলাটা করেছিলাম, সেটা কেমন যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোকেরও কোনো সমর্থন নেই। মা-ও বারণ করছেন।”

”দেখুন, স্রোতের উলটোদিকে হাঁটতে গেলে আপনাকে তো হোঁচট খেতেই হবে। তবু আপনি যে কনভেনশনের সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত না করে পালটানোর দিকে এগিয়েছেন, এতে যে যাই বলুক, আমার কাছে কিন্তু আপনি একজন সাহসী মেরুদণ্ডী মানুষ হিসেবে অনেক উঁচুতে অবস্থান করছেন।” ঝোঁকের মুখে কথাগুলো বলে ফেলে আমি দিওতিমার দিকে থতমত মুখে তাকালাম।

ও-ও বেশ অবাক চোখে আমাকে দেখছে। হয়তো আশা করেনি, আমার মতো ক্যাবলা ছেলে এইরকম কথাবার্তা বলতে পারে।

আমি একটু দম নিয়ে আবার বললাম, ”আর বিশ্বাস করুন, আমাদের সংগঠনে আমার কোনো ভূমিকা নেই। তবু আপনার প্রতি ঝন্টুর এই সব কাজকর্ম শুনে আমার নিজেরই ছোটো লাগছে। ঝন্টু কিন্তু আমাদের সংগঠনের কেউ নয়, আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার বাবাও এইসব নোংরা কাজকে সাপোর্ট করেন না। কিন্তু কিছু মাঝখানের লোকজনের মাতব্বরির জন্য ঝন্টুর মতো বেনোজল ঢুলে পড়ছে আমাদের সংগঠনে। আমি জানি ওদের উদ্দেশ্যটাই অসৎ, কিন্তু কী করব!” মাথা নীচু করে ফেললাম আমি, ”আমার কথার কোনো দাম নেই দলে।”

”আচ্ছা, আপনি আমাকে আঁকতে পারবেন?” হঠাৎ বলল দিওতিমা।

এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম।

এইজন্যই জিষ্ণু বলে, মেয়েদের কথাবার্তার কোনো তল পাওয়া যায় না।

ঠিকই বলে।

এভাবে দুমদাম ট্র্যাক চেঞ্জ করলে কতক্ষণ নিজেকে স্মার্ট দেখাতে পারব আমি?

বললাম, ”আপনাকে আঁকতে … মানে?”

”না মানে আপনি তো আঁকেন।” দিওতিমা ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল, ”আগের দিন বলেছিলেন যে? তাই ভাবছিলাম কেউ তো কখনো আমার ছবি আঁকেনি, কেমন লাগবে একটা কৌতূহল হচ্ছিলো আর কী! অবশ্য আপনারা শিল্পীরা তো সুন্দর মেয়েদেরই আঁকেন!”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, এমন সময় ওর একটা ফোন ঢুকল, তাতে ও বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে লাগল, ”সেকি … কখন? … তারপর? পুলিশ কী বলছে? …?”

চিরকাল দেখেছি মোবাইল ফোন আমার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। এই সুন্দর মুহূর্তেও তাই হল।

দিওতিমা ইশারায় আমাকে বিদায় জানিয়ে কথা বলতে বলতে উদ্ভ্রান্তভাবে ঘরে চলে গেল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি আবিষ্কার করলাম, ফিনফিনে একটা পাঞ্জাবি পরে এই খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছে। এতটাই শীত করছে যে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

অদ্ভুত, এতক্ষণ কিছু মনেই হয়নি!

ভাবতে ভাবতে ঘরে গেলাম আমি।

আঠাশ

”কী বলছ তুমি?” আমি শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, ”কতবড় পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে ঝন্টুর মতো চ্যাংড়া ছেলেরা এতটা সাহস পেতে পারে!”

”যা বলছি, চুপচাপ শুনে যা।” ছবিদাদু বলে যাচ্ছিলেন, ”প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়ার আগেই বাড়িতে এরকম হামলা হওয়ার খবর পেয়ে সমাদ্দার তো উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। চিরকুটে ছেলের ক্ষতি করার হুমকি থাকলেও ভরদুপুরবেলা আট-দশটা ষণ্ডা গুন্ডা ছেলে যে লোহার রড, লাঠি নিয়ে বাড়িতে চড়াও হবে, এটা কে-ই বা কল্পনা করতে পারে!”

”তারপর? সমাদ্দার বাড়ি চলে গেল?”

”সমাদ্দার আমাকে ফোন করেছিল, কী করবে জানতে চেয়ে। আমি বললাম তুমি ইমিডিয়েটলি প্রেসের রিপোর্টারদের নিয়ে বাড়িতে যাও। তাতে কভারেজটা আরও জোরদার হবে। কতটা কাঁচা কাজ ভাব, একবার তো খবর নেবে যে সমাদ্দার তখন কী করছিল।”

”তারপর কী হল?” আমি টেনশনে নখ খেতে শুরু করলাম।

আড়চোখে দেখলাম রূপ আমার দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রয়েছে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

অন্যসময় ঝন্টুর বাঁদরামির খবর পেলেই আমি রূপের ওপর রাগ দেখিয়েছি। কিন্তু এখন তো বুঝছি, এতে রূপের কোনো দোষ নেই।

বেচারা ঠান্ডার মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? তার চেয়ে আমি ঘরে চলে যাই বরং।

আমি ইশারায় ওকে বিদায় জানিয়ে ঘরে আসতে আসতে ছবিদাদু বলে চলেছিলেন, ”তারপর আবার কী? সমাদ্দারের বাড়ি গিয়ে গুন্ডাগুলো ওর বউয়ের ঘাড়ে রদ্দা মেরেছিল। সঙ্গে শাসানি। ভাঙচুর। ওর বউ পরে সব বলেছে মিডিয়াকে, দেখিয়েছে কোথায় কী কী করেছে। সন্ধে থেকে এখন সব চ্যানেলে দেখাচ্ছে খবরটা। মিডিয়া থেকে ক্রমাগত চাপ খেয়ে লোকাল থানায় তদন্তের নির্দেশ এসেছে ওপরমহল থেকে। এখন একটা চ্যানেলে পুরোটা এক্সক্ল্যুসিভ হিসেবে দেখাচ্ছে, কীভাবে তোকে দিনের পর দিন হ্যারাসড হতে হয়েছে, কীভাবে তোর উকিল সমাদ্দারকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তুই একদম চাপ নিস না। আমাকেও দুটো চ্যানেল থেকে ফোন করেছিল। আমি সব বলেছি গুছিয়ে।”

”মা ঠিক আছে তো দাদু? তুমি মা-র খোঁজখবর নিচ্ছ তো?” আমি কাতরভাবে বললাম। যারা সমাদ্দারের মতো উকিলের বাড়িতে ভরদুপুরে হামলা করতে পারে, তারা মা-র মতো একা থাকা একজন মহিলাকে যে কী করবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

”তোর মা আমারে বাড়িতে রয়েছে। তুই চিন্তা করিস না। তোর আসাটা আটকে গিয়েই আরও গোলমাল হল।”

দাদু ফোনটা কেটে দিতে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কী জানি কী হবে। রূপ যতই ভরসা জোগাক, আমি নিজেই বুঝতে পারছি, মনের দিক থেকে যেন আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছি আমি। মনে হচ্ছে কী লাভ এসব করে!

মা-ই ঠিক বলত। আর সত্যিই তো, মা এতদিন খেটে খুটে আমাকে বড়ো করল, কোথায় আমি এখন তার পাশে থাকব, তা নয়, বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে আমাকে এখন থাকতে হচ্ছে কত দূরে!

এভাবে সম্পূর্ণ অপরিচিত কারুর বাড়িতে কখনো থাকিনি। তবু পরিস্থিতির চাপে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়।

মাসি মহিলাটি খুবই ভালো, আমার জন্য একটা ছোট ক্যাম্পখাটে বিছানা করে দিয়ে নিজে শুয়েছে একটা গদিতে। আমার শত আপত্তিতেও শোনেনি। কিছু মানুষ আছে অন্যের অসুবিধা হওয়ার চেয়ে নিজে অ্যাডজাস্ট করতে ভালোবাসে। ইনিও তেমনই।

আর আমি? ঠিক উলটো। নিজের একটা জেদ বজায় রাখার জন্য মা, ছবিদাদু, রাজেন সমাদ্দার, প্রত্যেককে সমস্যায় ফেলছি। এমনকী, ওই মানকুর স্কুলের ছেলেটা তো বলল, আমার জন্য রূপের সঙ্গে ওর বাবারও মনোমালিন্য হচ্ছে।

বিছানার পাশেই জানলা, যদিও বা সেটা বন্ধ, ঘষা কাচের এপার থেকে দূরের আকাশটা দেখতে দেখতে আমি ভাবলাম, সত্যিই কি আমি এতটাই স্বার্থপর? মা-র যদি কিছু হয়ে যায়? নিজে দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করে, পুরোহিতদের লাইসেন্স চালু করে পারব তো মা হারানোর সেই দুঃখ সামলাতে?

কতক্ষণ এইভাবে আকাশপাতাল ভাবছিলাম জানিনা। হঠাৎ দরজার কাছে একটা মৃদু আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। কেউ একটা দরজার কাছে শব্দ করছে খুট খুট করে।

আমি চমকে মাসির দিকে তাকালাম। ভদ্রমহিলা ঘুমোচ্ছেন। একে আমাদের মতো এতজন অনাহূত অতিথি আজ ওর ঘর দখল করেছি, তার ওপর এই মাঝরাতে ঘুম থেকে তোলাটা ঠিক হবে? তার চেয়ে আমিই বরং গিয়ে দেখি।

বিড়াল টিড়াল কি? হতে পারে। এদিকের লোকেরা খুব বিড়াল পোষে।

আমি সাবধানে পা ফেলে দরজার কাছে যেতেই দেখি রূপ দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে।

”আপনি? এত রাতে? কী করছেন বাইরে?” হাই তুলে বলি আমি।

রূপ ফিসফিস করে বলল, ”আপনি তো এখুনি আসছি বলে চলে এলেন, আমি তো অপেক্ষা করেই যাচ্ছি! এই ঠান্ডায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না যে! জ্যাকেট তো সব ট্রলিতে, বেরও করা হয়নি।”

আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম, তবু যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলি, ”মানে? আপনি এতক্ষণ ওই বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন নাকি?”

”হ্যাঁ তো।”

রূপ অসহায় গলায় এমনভাবে কথাটা বলল যে আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়।

 ”আচ্ছা পাগল লোক তো আপনি?” আমি হাত নেড়ে বললাম, ”আমি তো ঘুমোতে যাচ্ছি ইশারায় বলে গেলাম।”

”বুঝতে পারিনি।” রূপ বোকা বোকা হাসল।

”আপনাকে যে আপনাদের দলের লোকেরাই কেন ক্যাবলা বলে সেটা এতদিনে বুঝলাম।” আমি ছদ্মরাগে বললাম, ”আচ্ছা, আপনি এত ভিতু কেন বলুন তো?”

রূপ এবার একটু থেমে বলল, ”ভিতু? না, আমি ঠিক ভিতু নই। কিন্তু কাউকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে না। মনে হয়, মনোমতো কাজ না করলেই সামনের মানুষটা কী ভাববে!”

আমি হাসলাম, ”আপনি এত বড় ধার্মিক পরিবারের ছেলে। এত গুণের। আর এটা বোঝেন না যে সবাইকে খুশি করা কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি যদি সবসময় নিজের ইচ্ছে বা নিজের চাহিদাটাকে চেপে রেখে উলটোদিকের মানুষটাকে খুশি করতে যান, তাহলে সেটা সে আপনার মহত্ত্ব নয়, দুর্বলতা ভাবতে শুরু করবে। সে আপনার কাছ থেকে উপকারও নেবে, আবার আপনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করবে। আপনার চরিত্রের দৃঢ়তা কি তাতে ম্লান হবে না?”

রূপ মন দিয়ে শুনছিল। আমি থামতেই বলে উঠল, ”কিন্তু কাউকে আঘাত করতে আমি কিছুতেই পারি না জানেন, এইজন্য অনেক ঠকতে হয়েছে আমাকে।”

আমি বললাম, ”আঘাত কেন? ‘না’ বলতে শেখাটা কিন্তু খুব জরুরি। আর কাউকে ‘না’ বলা মানেই আঘাত করা নয়। আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে না গিয়ে আপনি সেক্ষেত্রে নিজের কথাই কিন্তু শুনলেন। এতে যাকে আপনি ‘না’ বলছেন, তিনি সাময়িক ক্ষুণ্ণ হলেও এটুকু বুঝবেন আপনার একটা নিজস্ব আবর্ত আছে। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে।”

রূপ দ্বিধাগ্রস্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ”আমি মুখের ওপর কিছু বলতে পারি না বলে সবাই সেটার অ্যাডভান্টেজ নেয়।”

”সে তো নেবেই।” আমি হেসে বললাম, ”অধিকাংশ মানুষই তো সেটাকে দুর্বলতা ভাবে। শুনুন মঙ্গলরূপ, ভাগবতগীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ”জীবন আসলে একটা যুদ্ধক্ষেত্র। আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। নিজেদের দাবীগুলো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করাটাই কিন্তু বেঁচে থাকা। সেই অনুযায়ী, অন্যকে খুশি করতে করতে আপনি নিজের জীবনটা কি আদৌ বাঁচছেন?”

রূপ কোনো কথা বলছিল না।

আমি বললাম, ”আগে নিজের মনের কথা শুনুন। তবেই দেখবেন অন্যরাও আপনাকে সমাদর করবে। আর কেউ যদি আপনাকে সম্মান না দিতে চায়, সম্মান কেড়ে আদায় করে নেবেন। সেটাই হবে আপনার জয়।” আমি একটা হাই তুললাম ”যাই হোক, অনেক ভারী ভারী জ্ঞান দিয়ে ফেললাম। এবার বলুন তো, কী বলতে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনলেন?”

রূপ যেন ঘোর ভেঙে জেগে উঠল। তারপর লজ্জা লজ্জা মুখে একটু হাসল, পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।

”কী এটা?” আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। এই বারান্দায় কোনো আলো নেই। দূরের একফালি চাঁদের আলোয় কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

আমি মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে কাগজটা চোখের সামনে ধরলাম। আর বিস্ময়ে প্রায় বোবা হয়ে গেলাম।

একটা লেটারপ্যাডের ছেঁড়া পাতা, ওপরে সান্দাকফুর মতো বেশ কিছু জায়গার নাম হিজিবিজি করে লেখা। বোঝাই যাচ্ছে এই কাগজে রাফভাবে ঘোরার খসড়া হয়েছে।

কিন্তু কাগজটার নীচের দিকে সাধারণ ডট পেনে আঁকা একটা ছবি।

ব্যস্তসমস্ত একটা পুরোনো দিনের অফিস ঘর। ছাদে কড়িবরগা, গোল গোল জানলা। চারপাশে প্রচুর মানুষের ভিড়, কেউ মাটিতেই বসে পড়েছে, কেউ আবার ঝোলা কাঁধে অপেক্ষায়।

তারই মধ্যে সামনের টেবিলে বসে রয়েছে একটা মেয়ে। মেয়েটা এক হাতে আঙুল নেড়ে কিছু বলছে, একইসঙ্গে অন্য হাতে একটা কাঁটাচামচ পুরছে মুখে, সেই কাঁটাচামচের ডগায় একটা ওমলেটের টুকরো।

সামান্য পেন দিয়ে আঁকা কি অসম্ভব ডিটেইলড একটা ছবি!

ছবির আঁকাটা যে আমি, সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও বলতে পারবে। আমার চুলটা ঠিক সেইভাবে ছবিতে বাঁধা, যেভাবে হাইকোর্টে মঙ্গলরূপের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিন আমি বেঁধেছিলাম।

আমি অবাকমুখে রূপের দিকে তাকালাম।

যা ভেবেছি ঠিক তাই।

রূপ যথারীতি লজ্জাবতী লতা হয়ে মুখ নীচু করে ফেলেছে, অস্পষ্ট স্বরে বলছে, ”ইয়ে মানে ঘুম আসছিল না … তাই মনে হল আপনি একটা ছবি এঁকে দিতে বলেছেন। হাতের কাছে তো কিছু নেই, আলোও জ্বালাতে পারছি না, ওরা জেগে যাবে। তাই মোবাইলের আলোতেই এমনি পেন দিয়ে …।”

”দারুণ হয়েছে! সিরিয়াসলি! আপনি দুর্দান্ত আঁকেন।” আমি কী বলব কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

”না।” রূপ এবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, ”অবজেক্ট সুন্দর হলে আঁকিয়ে এমনিই ভালো আঁকবে।”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে গেলাম। কোনোদিক থেকেই আমি সুন্দরী নই। ছোট থেকে অনেক সংগ্রাম করে বড়ো হয়েছি আমি, লজ্জাটজ্জা পাওয়াও আমার ধাতে নেই। তবু এই পাহাড়ের ওপর নিশুতি রাতে রূপের কথা শুনে আমার মুখে যেন চাপ চাপ রক্ত এসে জমা হল।

আমি ইতস্তত করে বললাম, ”আমি শুতে যাচ্ছি।”

”ইয়ে … মানে আরেকটু গল্প করলে হয় না?” রূপ কাতরস্বরে বলল, ”আমি তো ঘর থেকে কম্বল জড়িয়ে এলাম ওইজন্য।”

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে এবার আমার হেসে গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হল।

খেয়ালই করিনি, ছেলেটা একটা আস্ত কম্বল জড়িয়ে চলে এসেছে।

সোয়েটার ট্রলিতে আছে বলে শেষমেশ কম্বল?

আমি এবার মনে মনে কিছুক্ষণ ভাবলাম।

আমার ভেতরের সেই মন সুযোগ পেয়েই বলে উঠল, ”এ যে ধরনের ছেলে, আমি যদি আগামী একশো বছর ওর সঙ্গে এভাবেই ‘আপনি-আজ্ঞে’ করে যাই, ও-ও তাই করে যাবে। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস ওর হবে না। তাই সে আশায় থেকে কিন্তু কোনো লাভ নেই।”

আমি নীরবে মনকে বললাম, ”মানে? কিসের আশা? রূপ আমার বিপক্ষ দলের নেতার ছেলে।”

”তো কী?” মন খনখনিয়ে উঠল, ”ও তো আর তোমার শত্রু নয়! কি ভালো ছেলে দেখেছ? কি ভদ্র, কি গুণের? তোমার মতো বেগুন নয়।”

আরও কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি রূপের দিকে তাকালাম, ”এইরকম পেনে আঁকা হলে হবে না। ভালো করে একটা বড় পোর্ট্রেট এঁকে দিতে হবে।” তারপর সামান্য থেমে বললাম, ”কলকাতায় ফিরে দেবে তো?”

আমার মুখে ‘দেবে’ শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম রূপ পুরো ভেবলে গেছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

কম্বলের তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বের করে আনছে একটা রুমাল। তা দিয়ে মুখ মুছছে।

আমি হাসি চাপছি অন্যদিকে তাকিয়ে। জানিনা যেটা করছি সেটা ঠিক কিনা, বা এর জন্য আমাকে পরবর্তীকালে বড় কোনো মাশুল দিতে হবে কিনা, কিন্তু যুক্তির মই বেয়ে সবসময় তো মন ওঠে না।

আমার বুকের ভেতরটা যেন হাজার প্রজাপতি গুনগুন করছে।

”দেব। আমরা তো কাল প্লেনে করে ফিরব কলকাতা।” রূপ আমতা আমতা করে বলল, ”আপনি … মানে তু-তুমিও কি আমাদের সঙ্গে ফিরবে?”

আমি বললাম, ”এখন তো প্লেনের ভাড়া আকাশছোঁয়া হবে। দেখি কী করি .. বাসের দিকটা একবার …।”

”না মানে ইয়ে …।” রূপ আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। কী একটা যেন প্রাণপণ দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে ও, বলল, ”একসঙ্গে ফিরলে হয়না?”

উনত্রিশ

প্লেন কলকাতার মাটি ছুঁতে না ছুঁতেই ফোন আসা শুরু হল। তখনও লাগেজ নিতে পারিনি আমরা। প্রচণ্ড ভিড়। সবাই ঠেলাঠেলি করছে, কে আগে নিজের লাগেজ নিয়ে বেরোবে। এয়ারপোর্টও আস্তে আস্তে রেলস্টেশনে পরিণত হচ্ছে।

দিওতিমা আমাদের সঙ্গেই ছিল। কাল রাতের পর থেকে মেয়েটা একটু চুপচাপ হয়ে গেছে, খেয়াল করছিলাম আমি। সকালে উঠে যখন আমরা একটা গাড়ি ঠিক করে রওনা দিলাম শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে, তখনও কথা বলেনি বিশেষ। নেপালি ওই ভদ্রমহিলা সত্যিই ভালো, এতবার অনুরোধের পরেও একটা টাকাও নিলেন না আমাদের থেকে।

ওঁর সাফ কথা, এমনি ভাড়া দিলে টাকা নেওয়া যেত, কিন্তু যেহেতু বিপদের সময় আমরা থেকেছি, উনি কিছুতেই টাকা নেবেন না।

সত্যিই, আমাদের সান্দাকফু ঘোরা হল না ঠিকই, কিন্তু সামান্য একজন পাহাড়ি মহিলার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখলাম।

জানলাম কীভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।

আমি আড়চোখে দেখলাম, দিওতিমা লাগেজ বেল্টের সামনে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে, কী একটা চিন্তা করছে গভীরভাবে।

গৈরিক আর চিরন্তনও অন্য ট্যুরিস্টদের মতো হুড়োহুড়ি করছে নিজেদের মালপত্র এল কিনা দেখার জন্য।

ওদিকে জিষ্ণু এখনো ককিয়ে যাচ্ছে, দূরে একটা সিটে বসে অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে, ”এইটা কর, ওদিকে গিয়ে দ্যাখ।” ইত্যাদি ইত্যাদি।

এত গোলমালে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি ফোনটায় হাত চাপা দিয়ে একটু সরে এলাম।

মা ফোন করেছেন, ”তুই কোথায়?”

বাগডোগরা ছাড়ার আগেই মা-কে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমরা আজই ফিরছি। আমি বললাম, ”এই তো দমদমে নামলাম।”

”একটু তাড়াতাড়ি আয়।” মা উদ্বিগ্ন গলায় বলল।

”কেন কী হয়েছে?”

”জগদীশকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। কাল কোন উকিলের বাড়ি নাকি ওরই নির্দেশে হামলা চালিয়েছিল ঝন্টুর দল। ঝন্টু ওঁর নাম বলেছে। পুলিশ বাড়ি এসে গ্রেপ্তার করেছে ওদের। তোর বাবা খুব ভেঙে পড়েছেন।”

মা-র কথা শুনতে শুনতে আমি টের পাচ্ছিলাম বন্যার মতো মেসেজ ঢুকছে ফোনে, বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের আপডেট।

প্রতিটা চ্যানেলের ফ্ল্যাশ নিউজ প্রায় একইরকম।

”মহাদ্বিতীয়ার পুণ্য লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী এক যুগান্তকারী ঘোষণা করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন এবার থেকে পাঁচ হাজার বা তার চেয়ে বেশি বাজেটের যেকোনো পুজো করতে গেলেই লাইসেন্সড পুরোহিত লাগবে। সেই লাইসেন্স নেওয়ার জন্য দিতে হবে পরীক্ষা। প্রত্যেক মাসে একবার করে এই পরীক্ষা নেওয়া হবে। বয়স, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ সেই পরীক্ষায় পাশ করে পৌরোহিত্য করতে পারবেন। এবারের দুর্গাপুজোর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে মহাচতুর্থীর দিন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মাস কয়েক আগে দিওতিমা বিশ্বাস নামে এক তরুণী এই নিয়ে একটি জনস্বার্থ …।”

পড়তে পড়তে কখন আমি কাঁপতে শুরু করেছিলাম, নিজেও জানিনা।

মুখ্যমন্ত্রী এও জানিয়েছেন, আজকের এই সাম্যের দিনে শুধু ব্রাহ্মণরাই, শুধু পুরুষরাই পুজো করার অধিকারী হবেন এ সত্যিই অতি পুরোনো চিন্তাভাবনা। জাতে নয়, মনে, চরিত্রে ব্রাহ্মণ অর্থাৎ সর্বোত্তম হতে হবে।

প্রতিটা চ্যানেলে দিওতিমার ছবি জ্বলজ্বল করছে, সব প্রতিকূলতার মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে দিওতিমা আজ জয়ী!

কিন্তু আমি যেন দিওতিমাকে ছাড়াও আরও একজনের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম সেই ছবিগুলোর মধ্যে।

সেই মুখটা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কৌতুকমাখা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটমিট করে। বলছে, ”কেমন মজা!”

তিনি আমার ছোটকাকা।

আমি দৌড়ে গেলাম দিওতিমার দিকে।

 ******

বাবা বৈঠকখানা ঘরে মাথা টিপে ধরে বসেছিলেন। বাবাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও প্রায় কুড়ি পঁচিশজন লোক। সবার মুখেই শোকের ছায়া। যেন কেউ মারা গেছে এই বাড়িতে।

আমি দরজা দিয়ে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। মা-র কাছে আগেই শুনেছি জগদীশকাকাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, সঙ্গে ঝন্টুকেও। ঝন্টুর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ আমাদের সংগঠনে না থাকলেও এই কয়েকদিনে বাবার বিভ্রান্তি আর জগদীশকাকার প্রশ্রয়ের সুযোগ নিয়ে ও অনেকদূর পৌঁছে গিয়েছিল।

বাবার ঠিক পাশেই বসে আছেন রঘুবীরজ্যাঠা। আত্মারামদার বাবা। এই মানুষটা শিক্ষিত নয় ঠিকই, তথাকথিত প্রজ্ঞা নেই, কিন্তু মানুষ হিসেবে অন্তত খারাপ নয়। অন্তত আত্মারামের থেকে অনেক ভালো।

শোকসন্তপ্ত মুখে তিনি সান্ত্বনা জানাচ্ছেন বাবাকে।

সুদেবদা বরাবরই মাতব্বরি করে, ইদানীং ঝন্টুর আবির্ভাবে একটু গুটিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার বেশ হম্বিতম্বি করছে চারদিকে।

ফোনে কাকে একটা উচ্চগ্রামে বলে চলেছে, ”হ্যাঁ হ্যাঁ, যত টাকা লাগে দেওয়া হবে। তুই শুধু লোকজন নিয়ে চলে যা উত্তরপাড়া … বুঝিয়ে দে আমাদের কতটা জোর।”

অন্যসময় হলে দিওতিমার বাড়িতে হামলা চালানোর কথা শুনে আমি হয়তো অস্থির হয়ে উঠতাম, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারতাম না। মুখ ফুটে কাউকে বারণটুকু অবধি করে উঠতে পারতাম না।

কিন্তু আমার কাল রাতে বলা দিওতিমা-র কথাগুলো মনে পড়ল।

জীবন একটা যুদ্ধ, সেখানে নিজের অধিকার নিজেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়। নাহলে সবাই সেটাকে অযোগ্যতা ভাবে।

আমি স্থিরপায়ে এগিয়ে গেলাম বাবার দিকে, বাবাকে শান্তস্বরে ডাকলাম, ”বাবা, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।”

সুদেবদা এদিকে তাকাল। আগে থেকেই ও আমাকে পাত্তা দিত না বিশেষ, এখন জগদীশকাকার অনুপস্থিতিতে সেই ভূমিকাটা যেন ও নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিল, দৌড়ে এসে আমাকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ”আরে রূপ, তুমি এখন যাও। আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তায় আছি সবাই। এখন জ্যাঠামশাইকে বিরক্ত কোর না।”

আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবার সামনেই সদস্যদের আমার প্রতি এমন ব্যবহার নতুন কিছু নয়।

সুদেবের কথাতে বাবা বারণ করা তো দূর, কোনো ভ্রূক্ষেপও করলেন না। একইভাবে পাথরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাটির দিকে।

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে সরে এলাম। ততক্ষণে সুদেব বাবাকে গিয়ে বলতে শুরু করেছে, ”জ্যাঠামশাই, মেদিনীপুর থেকে ওখানকার সেক্রেটারি অবিনাশকাকা ফোন করেছিলেন। ওখানকার মেম্বাররা খুব ঝামেলা শুরু করেছে। বলছে এই আইন মানবে না।”

আত্মারামদা পাশেই ঘুরঘুর করছিল, বলল, ”ঝামেলা করতে বলো সুদেবদা। ঝামেলা করলে দেখবে সব সুড়সুড় করে পুজোর সময় আমাদের দিয়েই …।”

”আরে সে আমি বলেই দিয়েছি। সুদেব লাহিড়ী আছে, কোনো চিন্তা নেই। আর ক-টা লাইসেন্স ওলা পুরোহিত জোগাড় করতে পারবে সব ক্লাব? এই ক-দিনে? যারা লাইসেন্স পাবে, তারা তো আকাশছোঁয়া রেট চাইবে, তখন কী করবে? সেই তখন আমাদের কাছেই ফিরে আসতে হবে।” সুদেবদা বলল, ”তবে তার আগে উত্তরপাড়ায় গিয়ে নাটের গুরুটাকে শিক্ষা দিতে হবে। আজকেই বাড়ি ফিরেছে বললি না?”

সুদেবদা বাবাকে একদম গার্ড করে দাঁড়িয়েছিল, ফলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমাকে সুদেবদাকে সরাতেই হবে।

আমি হাত দিয়ে সুদেবদাকে আলতো করে ঠেলতেই সুদেবদা সবার সামনেই খেঁকিয়ে উঠল, ”আরে, তোমাকে বললাম না জ্যাঠামশাইকে এখন বিরক্ত কোরো না। কথা কানে যায়নি নাকি?”

”ঠিকভাবে কথা বলো সুদেবদা।” আমি শান্তস্বরে কথাটা বলে সুদেবদার চোখে চোখ রাখলাম।

উত্তেজনার বশে কথাটা বলে আমার স্নায়ু কাঁপছে, কিন্তু তবু আমি চোখ সরালাম না। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে পার্বণীর বহুদিন আগের সেই তেতো মুখটা মনে পড়ে গেল আমার।

”মানে?” সুদেবদা রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

অন্যান্যরাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

আমি বললাম, ”বাবার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। পার্সোনাল। তোমরা বাইরে যাও। বাইরের দালানে অপেক্ষা করো। কথা হয়ে গেলে আমি ডেকে নেব।”

সুদেবদা হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর সমর্থনের আশায় তাকাল আমার বাবার দিকে।

বাবা ও আমার দিকে তাকিয়েছেন, চোখে একরাশ প্রশ্ন। কিন্তু কেন জানি না, আজ কিছু বললেন না।

আমার বুকের ভেতরটা কেউ যেন হাতুড়ি পিটছিল।

তবু আমি বলে চললাম, ”আর শোনো। অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশন একটা ধর্মীয় সংগঠন। আমার ঠাকুরদা এই সংগঠনটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রামেগঞ্জে গরিব পুরোহিতদের বঞ্চনা থেকে বাঁচাবার জন্য, তাদের প্রাপ্য প্রণামীর ব্যাপারে কথা বলার ঢাল তৈরির জন্য।” আমি সুদেবদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ”পার্টির লোকেদের হাত ধরে গুন্ডামি করার জন্য নয়। এটা কোনো সাধারণ সংগঠন নয় যে, তোমাদের মতামতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বা করলে তাকে গুন্ডা দিয়ে শায়েস্তা করবে, রাস্তাঘাটে মেয়েদের সঙ্গে অভব্যতা করবে।”

”এসব তুই কী বলছিস!” বাবা এতক্ষণে কথা বললেন, ”আমাদের দলের কে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা, গুন্ডামি করেছে!”

আমি এবার বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ”ঝন্টু। জগদীশকাকার ভাইপো ঝন্টু ক্রমাগত ওর কাকার মদতে দিওতিমা বলে মেয়েটার সঙ্গে অসভ্যতা করে গেছে। হাওড়া স্টেশনে সবার সামনে হাত ধরে টানাটানি, রাস্তাঘাটে বিশ্রী ভাষায় হুমকি, পার্টির নেতাদের দিয়ে মেয়েটার চাকরিতে ট্রান্সফার করানো, কিচ্ছু বাদ দেয়নি। সুদেবদা দিওতিমাকে ক্যাশ অফার করেছে। আমি তোমাকে আগে অনেকবার বলতে চেষ্টা করেছি বাবা, কিন্তু তুমি গুরুত্বই দাও নি আমার কথায়। সত্যিই কি আমাদের সংগঠনের এইসব করা শোভা পায়? ঝন্টু আর জগদীশকাকা দিওতিমার উকিলের বাড়িতে গিয়ে ওর স্ত্রীর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। এতে কার সম্মান ধুলোয় লুটোচ্ছে বাবা?”

বাবা একটাও কথা বললেন না। শুধু বিস্মিতচোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

আমি ধিক্কার জানিয়ে বললাম, ”এর চেয়ে যোগ্যরাই পৌরোহিত্য করবে, এই নিয়ম মেনে নিয়ে আমরা যদি আমাদের মেম্বারদের সেই শিক্ষাদান করি, যেটুকু মিনিমাম যোগ্যতা না থাকলে, যে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণই করা উচিত নয়, সেই বোধটুকু তৈরি করি, সেটাই কি ভালো নয়?”

আত্মারামদা তেরিয়া হয়ে উঠে বলল, ”অনেকেই আছে যারা কোনোমতে বাংলাটুকু পড়তে পারে। তাদের কী শেখাবি তুই?”

আমি বললাম, ”কেন? সংগঠনের প্রায় চল্লিশ হাজার মেম্বার, বার্ষিক যে সামান্য চাঁদা সবাই অ্যাসোসিয়েশন ফান্ডে দেয়, তা তো বেশিরভাগই খরচ হয় অ্যানুয়াল সভাতে। সেখান থেকে খরচ কিছুটা কমিয়ে আমরা যদি একটা মাসিক পত্রিকা চালু করি, যেখানে বাবা-র মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সহজসরল বাংলায় লিখবেন হিন্দু ধর্ম, প্রাচীন বৈদিক রীতি? প্রত্যেক মাসে সেই পত্রিকা যদি আমরা পৌঁছে দিই গ্রামবাংলার প্রতিটি সদস্যের ঘরে, আপনারা কী মনে করেন, এরপরেও আমাদের মেম্বাররা লাইসেন্স পেতে পারবেন না? নিজেদের পেশার জন্য এইটুকু আপডেট করতে পারবেন না নিজেদের?”

আমি নয়, যেন দিওতিমাও কথা বলছিল আমার হয়ে।

আমাদের বৈঠকখানা ঘরটা এতটাই বিশাল যে ছোটখাটো একটা টেনিস কোর্ট ধরে যেতে পারে এতে। ঘরে এইমুহূর্তে রয়েছে প্রায় চল্লিশজন মানুষ।

তবু সবাই এত নিস্তব্ধ হয়ে শুনছে আমার কথা যে একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে!

আমি কোনোদিন যা করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, তাই করে ফেললাম। বাবার কাছে গিয়ে বাবার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলাম, ”তুমি ভেঙে পড়ো না বাবা। চলো, এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আমরা উঠে দাঁড়াই। দেখিয়ে দিই, আমাদের সংগঠনের প্রতিটা সদস্য পৈতৃক অধিকারেই শুধু নয়, তাঁদের নিজেদের যোগ্যতায় ঈশ্বর আরাধনার জন্য উপযুক্ত!”

চার মাস পর …

হাইকোর্টে যেদিন দিওতিমার সামনে আমি ক্যাবলা হয়ে বসেছিলাম, তার ঠিক পাক্কা চারমাস পরে আজও আমি ওর সামনে বসে আছি।

তবে আজ আর হাইকোর্টে নয়, গড়ের মাঠে। আমাদের সঙ্গে বিনি আর আবিরও রয়েছে।

সান্দাকফু যাওয়ার সময়েই আন্দাজ করেছিলাম বিনি আর আবিরের সম্পর্কটা আর নিছক বন্ধুত্বে আটকে নেই। আমার আন্দাজকে সঠিক প্রমাণ করে খুব শীগগিরই বিয়ে করছে ওরা।

দিওতিমার সঙ্গে বিনির সামান্য কারণে ভুল বোঝাবুঝি আমি আর আবির দায়িত্ব নিয়ে মিটিয়ে দিয়েছি। মেয়েদের সত্যিই আমি আজও বুঝলাম না! ঝগড়ার কারণ শুনে আমি আর আবির দুজনেই থ হয়ে গিয়েছিলাম। এত তুচ্ছ কারণেও কেউ কথা বন্ধ করতে পারে?

 দিওতিমা আজ একটা সাদা কুর্তি আর আকাশ নীল জিনস পরে এসেছে। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল এতদিনে বেড়ে কাঁধ ছুঁয়েছে। সাদা নীল পোশাকে ওকে যেন মনে হচ্ছে একটা পাহাড়ি নদী, আকাশ এসে যেখানে মিশে গেছে।

”যাই বল ভাই! সবই হল।” আবির বিনির একটা হাত মুঠোয় নিয়ে চিনেবাদাম খেতে খেতে বলল, ”দিওতিমা দেখিয়ে দিল। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো এমনকী জগদ্ধাত্রী পুজোতেও ওর মন্ত্রোচ্চারণ দেখে সবাই অবাক হল। তোদের ক-অক্ষর গোমাংস পুরুতগুলো প্রত্যেক মাসে টপাটপ পাশও করতে শুরু করল। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই এগোল না।” কৃত্রিম আফশোসে মাথা নাড়াল আবির।

আমি হাসছিলাম। সত্যিই, মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণার পর পুরোহিতের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, কিন্তু পুজোর মান উন্নীত হয়েছে অনেক। হ্যাঁ, এবারের পুজোটায় পুরোহিত পাওয়া নিয়ে খুব অসুবিধায় পড়তে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পালটাচ্ছে।

অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা একটা ম্যাগাজিন চালু করেছি, ‘নির্মাল্য’ নামের সেই ম্যাগাজিন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে, গৃহীত হচ্ছে আমাদের সদস্যদের মধ্যে।

প্রতি মাসেই টুকটাক পাশ করছেন আমাদের সদস্যরা। জগদীশকাকা জামিনে ছাড়া পেলেও বাবা তাঁকে আর সংগঠনের কাজে ঢুকতে দেননি। কাকা এখন শুধু ব্যবসা-ই দেখেন।

বাবা মেজোকাকা আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে শক্তহাতে সামলাচ্ছেন সংগঠনের কাজ। শুধুই পুরোহিতদের ওপর বঞ্চনা, তা নয়, পুরোহিতরাও যেন কোথাও অন্যায্য প্রণামী না নেন, সেই ব্যাপারেও প্রতিটা জেলার নেতাকে সতর্ক থাকতে বলেছেন বাবা।

সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের চোখে পুরোহিতদের প্রতি সেই হারিয়ে যাওয়া শ্রদ্ধাটা আবার ফিরে আসছে যেন।

না, বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আমার আর হাঁটু কাঁপে না। আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছি আমি বাবার সঙ্গে। বাবা-ও কখন থেকে জানিনা, কোনো সিদ্ধান্ত, কোনো মতামতের ব্যাপারে নির্ভর করতে শুরু করেছেন আমার ওপর।

মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, খুব শিগগীরই বাবা আর মা-কে নিয়ে গড়ের মাঠে বেড়াতে আসব আমি।

আমি হাসতে হাসতেই বললাম, ”কোন ব্যাপার এগোল না?”

”এই যে, মহারানি দিওতিমা বিশ্বাসকে ভটচাজ বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে অধিষ্ঠিত করার ব্যাপারটা।’ আবির নাটকীয়ভাবে বলল।

বিনি হেসে বলল, ”সত্যি রূপদা! তোমার হবু বউ যেমন জাঁদরেল, বাবাও তেমনই। দুজনেই আবার শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত। এই শ্বশুর বউমার টাগ অফ ওয়্যারে তোমার অবস্থা বড়ই সঙ্গিন!”

দিওতিমা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার মুখ খুলল, ”না, রূপের বাবা আমাকে দুর্গাপুজোর পর নিজে ফোন করেছিলেন। অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সুষ্ঠুভাবে পুজো সম্পন্ন করার জন্য।”

দিওতিমা পুজো করেছিল দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম বড় একটা ক্লাবের প্রধান পুরোহিত হিসেবে। ক্লাবের উদ্যোক্তা কমিটি এতটাই ইতিবাচকভাবে দিওতিমাকে নিয়েছিলেন যে সঙ্গে সহকারী পুরোহিত হিসেবেও তাঁরা নিয়োগ করেছিলেন সেই মাসে প্রথম লাইসেন্স পাওয়া কয়েকজনকে, যাদের বেশিরভাগই অব্রাহ্মণ।

না, কোনো অসুবিধা হয়নি। দিওতিমা এবং তাঁরা সবাই ভক্তিভরে পুজো সম্পন্ন করেছিলেন।

এলাকার অধিবাসীরাও তৃপ্ত হয়েছিলেন ওদের পুজোয়। সত্যি বলতে কী, এবারের পুজোয় মা দুর্গার চেয়ে বেশি খবরের শিরোনামে ছিল দিওতিমা-ই।

আর সত্যিই তো, প্রাচীন বৈদিক যুগের ঋষিকাদের নস্যাৎ করে মধ্যযুগ থেকে মেয়েদের অন্য সবকিছুর মতো শাস্ত্রেও ঢুকতে না দেওয়ার যে ভণ্ড রেওয়াজ চালু হয়েছিল, সেই অশুভ মহিষাসুরসম শক্তিকে দিওতিমা একা-ই তো হারিয়ে দিল।

ঝন্টুর মতো কত লোক বাধা দিতে চেয়েছে, পিষে ফেলতে চেয়েছে দিওতিমার অনমনীয় মনোবলকে, কিন্তু দিওতিমা একা প্রচুর প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে থেকেছে অবিচল ভঙ্গিতে।

দার্জিলিং থেকে ওকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আগেই এসেছিল। দিওতিমা এখন হাওড়া সদর দপ্তরে পোস্টেড। আমার বাড়ি থেকে মাত্র দশ মিনিট। অফিস ফেরত আমাদের রোজ দেখা করতে কোনো অসুবিধেই হয় না।

ব্যস্ত রাজপথের পাশ দিয়ে, দূরের জাহাজগুলো ভেঁপু শুনতে শুনতে হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। দিওতিমা আপন খেয়ালে বকে যায়।

আমি কথা বলি কম, শুনি বেশি। আর ওর শত আপত্তি সত্ত্বেও ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। মুগ্ধ হই ওর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বে।

”তুই শালা একটা গোবর সত্যিই!” আবীর আমার চমক ভেঙে দিয়ে বলল, ”চারমাস হয়ে গেল, এখনো বাড়িতে কিচ্ছু জানাতে পারলি না! আরে বাড়িতে বল, আমরা একটু নিমন্ত্রণ খাই!”

‘গোবর’ শুনলে আমার মাথাটা বরাবর ধাঁ করে গরম হয়ে যেত, দিওতিমার শেখানো মতো ইদানীং রেগে গেলে আমি আর চুপ করে থাকি না, দৃঢ় ভঙ্গিতে নিজের আপত্তিটা জানাই।

কিন্তু এখন কোনো কথা বললাম না। আবীরের দিকে একবার ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে নিলাম।

তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে কিছুটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে বাঁ-হাতের তালুতে রেখে ডান হাত দিয়ে সেটাকে চাপা দিলাম, তারপর ডান হাঁটু মাটিতে পেতে উত্তরদিকে মুখ করে বসলাম।

 ”কী করছিস তুই?” আবীর অবাক।

 দিওতিমাও বিস্মিত চোখে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে।

 আমি গলা কাঁপিয়ে বললাম,

 ”ওঁ যা গুর যা সিনীবালী যা রাকা যা সরস্বতী।

 ওঁ অয়মারম্ভঃ শুভায় ভবতু !”

 ”পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি?” আবীর অবাক হয়ে তাকাল দিওতিমার দিকে।

দিওতিমা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আমি মিটিমিটি হাসলাম, ”পাগল কেন হব বন্ধু! দিওতিমা পুজো করা পুরোহিত হতে পারে, কিন্তু আমিও আমাদের ‘নির্মাল্য’ পত্রিকার সম্পাদক। এটা সংকল্প স্তোত্র। কোনো কঠিন কাজ করতে যাওয়ার আগে ঋগবেদের এই সংকল্প স্তোত্র পাঠ করতে হয়। তুই আর কী বুঝবি!” আমি তড়াক করে উঠে পড়ে দিওতিমার হাত ধরে টান দিলাম, ”চলো!”

”কোথায়?” দিওতিমা হতবাক।

বিনি আর আবীর কিছুই বুঝতে পারছে না, অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

”হিটলা … ইয়ে মানে আমার বাবার কাছে। সব কথা বলব বাবাকে। সংকল্প মন্ত্র পড়ে ফেলেছি, এবার গিয়ে স্ট্রেট বলে দেব। আজই। এক্ষুনি।”

”কী বলে দেবে?” দিওতিমা হাঁ।

”বলব যে বাবা, তোমার উত্তরসূরি তোমার ছেলে নয়, বউমা। আমাদের অল বেঙ্গল পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের নেক্সট প্রেসিডেন্ট! প্রথম অব্রাহ্মণ কিন্তু সবচেয়ে সুযোগ্য প্রেসিডেন্ট! এখুনি চলো আমার সঙ্গে।”

দিওতিমার মুখে ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে হাজার ওয়াটের হাসি। যে হাসির কাছে ম্লান হয়ে যাবে বিশ্বের তাবড় তাবড় স্থাপত্যও।

হাসতে হাসতে ও আমার হাত ধরল।

সঙ্গে সঙ্গে যেন ডানা ঝাপটে আমার পাশ দিয়ে উড়ে যেতে লাগল হাজার হাজার পাখি। তাদের মিষ্টি কলকাকলিতে ভরে যেতে লাগল গোটা জায়গাটা, গড়ের মাঠের দুবলা ঘোড়াগুলো যেন নিমেষে হয়ে গেল একেকটা পক্ষীরাজ।

টগবগিয়ে তারা ছুটতে শুরু করল আমার খুশির সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

আমি দিওতিমার হাতটা আমার মুঠোয় শক্ত করে ধরে সামনে পা বাড়ালাম।

*** শেষ ***

1 Comment
Collapse Comments
ABHIK KUMAR CHAUDHURI July 26, 2023 at 11:39 am

অনেকদিন পরে একটানা পড়ে একটা গল্প শেষ করলাম। টানটান উত্তেজনায় ভরা লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো সত্যি যেন কোনো জীবনকাহিনী শুনছি দিওতিমা আর রূপের যৌথ জবানবন্দিতে। খুব নিখুঁত বর্ণনায় আর চরিত্রদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে এক সুখময় আবেশে পূর্ণ হলো অন্তর। আহা! মানুষের অধিকাংশ লড়াই যদি এভাবেই জিততে পারতো !
লেখকের মুন্সিয়ানা সত্যি তারিফযোগ্য।

অভীক কুমার চৌধুরী
শিবপুর , হাওড়া
২৬ জুলাই , ২০২৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *