১০. অফিস থেকে বেরোই

দশ

অন্যদিন অফিস থেকে বেরোই পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। বেরিয়ে দেড়ঘণ্টা ধরে বাসে হেজিয়ে হাওড়া স্টেশন পৌঁছনো, তারপর সেখান থেকে মেন লাইনের ট্রেন ধরে উত্তরপাড়া। সেখান থেকে আবার সাইকেল। মোটামুটি সাড়ে সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাই। কিন্তু আজ ফিরতে দেরি হবে। দুপুরে লাঞ্চের পরই চলে এসেছি কাছের এক হাইস্কুলে।

রাজ্যসরকারি দপ্তরে আমার পদটার নাম বেশ ওজনদার। ব্লক ইয়ুথ অফিসার। ব্লকের যুবকল্যাণসংক্রান্ত নানা কাজ দেখা আমার কাজ। জেলাশাসকের নির্দেশ এসেছে, এখন থেকে অফিসের কাজের সঙ্গে সঙ্গে কাছের স্কুলগুলোতেও মাঝেমধ্যে ভিজিট করতে হবে, উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে তাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা, প্রশাসন থেকে তারা কি সহায়তা পেতে চাইছে এইসব। স্কুল পাশ করে বেরনোর পর সরকারি কী কী প্রকল্পের সুবিধা তারা পেতে পারে, সেই ব্যাপারে সম্যক ধারণা দিতে হবে তাদের।

সেইমতো সপ্তাহে একদিন দুপুরের পর বেরিয়ে পড়ি কোনো একটা স্কুলে। স্কুলের পড়াশুনো, পানীয় জল, শৌচাগার, সবকিছু দেখে এসে রিপোর্ট দিই বিডিও সাহেবকে। আগে এই কাজ স্কুল ইনস্পেক্টরের থাকলেও অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও আজকাল এইসব দেখছে।

আজ এসেছিলাম মানকুর বলে একটা গ্রামে। আমার পোস্টিং হাওড়ার বাগনান এক নম্বর ব্লকে। চাকরি পাওয়ার আগে যখন হাওড়া স্টেশন হয়ে কলেজ যেতাম, হাওড়া মানেই চোখের সামনে একটা ঘিঞ্জি ব্যস্ত দোকানপাট, রাস্তাঘাট ভেসে উঠত। এই চাকরিটা না পেলে জানতেই পারতাম না হাওড়া জেলার ভেতরে কত সব প্রত্যন্ত গ্রাম আছে। আমাদের এই বাগনান এক নম্বর ব্লকেই তো মোট একচল্লিশটা গ্রাম। কিছু কিছু গ্রামে গেলে মনে হবে কলকাতা থেকে এইটুকু নয়, পুরুলিয়া বা বীরভূমের কোনো গ্রামে চলে এসেছি যেন।

এই মানকুর গ্রামটাও তেমনই। যতদূর চোখ যায় মাটির রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। কিছুদূর এগোলেই নদী। মানকুর গ্রামের একমাত্র স্কুল এই দেউলগ্রাম মানকুর বাকসি উচ্চ বিদ্যালয়টাও বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে। নিজস্ব পুকুর, খেলার মাঠ সব রয়েছে। আসলে মানকুর, দেউলগ্রাম আর বাকসি, এই তিনটে ছোট ছোট গ্রামের এই একটাই স্কুল।

আমার সব রিপোর্ট মোটামুটি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। হেডমাস্টারের ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম ক্লাস টুয়েলভের প্র্যাকটিকাল শেষ হওয়ার জন্য। বিডিও স্যার বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন রিপোর্টে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বক্তব্যও থাকতে হবে।

হেডমাস্টার মানুষটা বেশ অমায়িক মানুষ, নাম জয়ন্ত কর্মকার। এসে থেকে বেশ খাতির যত্ন করছেন, আমাকে ভেবেছেন বুঝি কোনো হোমরাচোমরা। চা-র সঙ্গে দুটো মিষ্টিও দিয়েছেন, যদিও আমি সেটা খাইনি।

”এখানে যে এত কাছে নদী আছে আমি জানতামই না!” আমি বললাম। এখন লোডশেডিং চলছে। কিন্তু পাখা না চললেও দিব্যি বিকেলের ঠান্ডা হাওয়া দূর থেকে ভেসে আসছে।

”রূপনারায়ণ নদী ম্যাডাম। আর একটু আগে বললে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসতাম আপনাকে।” হেডমাস্টার হাসলেন, ”ভারী সুন্দর জায়গা। শীতকালে তো শহর থেকে দলে দলে পিকনিকেও আসে, তখন বোটিংও হয়।” জয়ন্তবাবু তাঁর চশমার ফাঁক দিয়ে হাসলেন।

”নৌকো চলে না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

”হ্যাঁ, তাও চলে। কাছেই দুধকুমড়ো বলে একটা গ্রাম আছে, আমাদের এই মানকুর থেকে ওই দুধকুমড়োয় নৌকো চলে।”

”দুধকুমড়ো! কী সুন্দর নাম!” আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

সত্যি, জন্মে থেকে মাখলার ওই গলিতে থেকে থেকে না চিনলাম বড় শহর, না চিনলাম সবুজ শ্যামল গ্রাম। না ঘরকা না ঘাটকা!

ইশ! এমন গ্রামে যদি আমার একটা বাড়ি থাকত! আমি ঠিক পয়সা জমিয়ে একটা নৌকো কিনতাম, তারপর দাঁড় উজিয়ে ঘুরে বেড়াতাম ওই রূপনারায়ণ নদীতে।

একজন বেয়ারা এসে খবর দিল, ওদের ল্যাবের কাজ প্রায় শেষের দিকে, আমি চাইলে গিয়ে কথা বলতে পারি।

জয়ন্তবাবু আমার দিকে তাকালেন, ”আপনি কি ওদের সঙ্গে ক্লাসরুমে কথা বলবেন? নাকি কেমিস্ট্রি ল্যাবেই? ওরা আসলে প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করছে তো।”

”না না চলুন, আপনাদের ল্যাবোরেটরিটা দেখে আসি।” আমি পা বাড়ালাম।

এখনকার উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অনেক সপ্রতিভ। আমি রুটিন প্রশ্নগুলো আগে করে নিচ্ছিলাম, সবাই সরকারি প্রকল্পের টাকা ঠিকঠাক পাচ্ছে কিনা, ক্লাস ঠিকমতো হয় কিনা, ল্যাবের যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কিনা।

একপাশে কয়েকটা ছেলেমেয়ে একটা জারের মধ্যে ফিতের মতো সরু কাগজ ডোবাচ্ছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলাম, ”এই কাগজটার নাম কী?”

”লিটমাস কাগজ।” একদম সামনের চশমা পরা ছেলেটা উত্তর দিল। বাকি ছেলেমেয়েগুলোও আমার দিকে দেখছে।

”রাইট।” আমি হেসে বললাম, ”কী করা হয় এটা দিয়ে?”

”কোনো মিশ্রণ, তাতে অ্যাসিড রয়েছে না ক্ষার, সেটা বের করা হয় এই কাগজ দিয়ে। অ্যাসিড হলে নীল রঙের লিটমাস কাগজটা লাল হয়ে যায়। আর ক্ষার থাকলে লাল রঙের কাগজটা নীল হয়ে যায়।” ছেলেটা মোটা পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে স্মার্টলি উত্তর দিল।

গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার মান বেশ খারাপ। বেশিরভাগই মাধ্যমিক পাশ করে গেলেও সামান্য জ্ঞান পর্যন্ত নেই। তাই ছেলেটার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে বেশ চমৎকৃত হলাম, ”একদম ঠিক বলেছ। অ্যাসিড আর ক্ষার এইদুটো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী পদার্থ, এদের মাঝে সেতুর মতো কাজ করে এই লিটমাস কাগজ।” আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম, ”তোমার নাম কী?”

”অমিয়রঞ্জন কুণ্ডু।” ছেলেটা একটু থেমে বলল, ”আমি আপনাকে চিনি।”

এবার আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম।

আমি মানকুর গ্রামে এই প্রথম এসেছি, আমাকে চেনার তো কথা নয়। বললাম, ”আমাকে চেনো? কী করে?”

”কাগজে ছবি দেখেছি। আপনার নাম দিওতিমা বিশ্বাস তো?” অমিয় বলল, ”আপনাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খুব গন্ডগোল হচ্ছে রোজ।”

আমি ফেরার জন্য দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিলাম, ছেলেটা যে কাগজে আমার ছবি দেখে চিনতে পেরেছে তা আন্দাজ করেছিলাম।

কিন্তু শেষ বাক্যটা শুনে আমি অবাক হয়ে পেছনে ফিরলাম, ”মানে? আমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে রোজ অশান্তি হচ্ছে! কেন?”

অমিয় ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল, ”আমি তো হাওড়ার চণ্ডীবাড়িতে থাকি। আমার বাবা ওঁদের বাজার দোকান করেন। জ্যাঠামশাই মানে বসন্ত ভট্টাচার্য হলেন সব পুরোহিতদের হেডস্যার, জানেন তো? হেব্বি খচা আপনার ওপর। কাল রাতেও রূপদাদার সঙ্গে ঝামেলা হল এই নিয়ে।”

মুহূর্তে আমার মুখটা শক্ত হয়ে যেতে দেখে জয়ন্তবাবু এগিয়ে এলেন, ”ম্যাডাম চলুন। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে। এরপর হাওড়া ফেরার বাস পেতে মুশকিল হবে।” তারপর অমিয়র দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, ”অ্যাই, ক্লাসে যা সব!”

”একটু দাঁড়ান জয়ন্তবাবু।” আমি এগিয়ে গেলাম অমিয়র দিকে, ”ঝামেলা হয়েছে কেন?”

”কাল তো রূপদাদা আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল? সেই নিয়ে জ্যাঠামশাই রূপদাদাকে অপদার্থ বলেছেন। রূপদাদাও না খেয়ে উঠে চলে গেছে ঘরে, তাতে জ্যাঠামশাই আরও রেগে গিয়েছিলেন। এইসব নিয়ে একচোট হল আর কী! রাতে রূপদাদা আর খায়নি। জেঠিমা’ও কান্নাকাটি করছিল।” ছেলেটা গড়গড় করে বলে গেল।

স্কুল থেকে বেরিয়ে সহজে বাস পাওয়া গেল না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাদুয়েক যুদ্ধের পর যখন হাওড়া স্টেশনে নামলাম, তখন আকাশে ছোপ ছোপ অন্ধকার নেমে এসেছে।

কয়েকদিনের গুমোট গরমের পর গাছের পাতাগুলো বেশ জোরে জোরে দুলছে, সঙ্গে বেশ ঠান্ডা হাওয়া। কোথাও নির্ঘাত বৃষ্টি হচ্ছে।

আমি সাবওয়ে দিয়ে নেমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছিলাম, বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বৃষ্টি নেমে গেলে আরেক ঝামেলা, সঙ্গে ছাতাও নেই আমার।

ছুটতে ছুটতে অমিয় বলে ছেলেটার কথা মনে পড়তে আশ্চর্য লাগছিল। মঙ্গলরূপ আর ওর বাবা-র মধ্যে শেষে আমাকে নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে?

কেন, ছেলেটা কী বলছে ওর বাবাকে?

এমনিতে আমি যখন অফিস থেকে ফিরি, ওই বিকেল সাড়ে পাঁচটা ছ-টা নাগাদ, ভিড়ের চাপে সাবওয়েতে ঠিকমতো হাঁটা যায় না। সবাই ছোটে। কিন্তু আজ একটু বেশি রাত হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় বেশ ফাঁকা।

একটা পাতি লেবুওয়ালা রোজ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসে লেবু বিক্রি করে, আমি ওর বাঁধা খদ্দের। লোকটার কাছ থেকে কয়েকটা লেবু কিনে সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পারলাম না।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমার ঠিক ওপরের ধাপে এসে দাঁড়াল ঝন্টু। হাতে একটা বড়ো চাবির রিং বনবন করে ঘোরাচ্ছে, মুখে বিশ্রীভাবে চিবোচ্ছে কিছু একটা। আগের দিনের দুটো ছেলের মধ্যে একজনও আজ সঙ্গে নেই।

হলদে দাঁতগুলো বের করে বলল, ”উত্তরটা কিন্তু এখনো পেলাম না ম্যাডাম!”

আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক তাকালাম। লোকজন বেশ কম হলেও আছে। কিন্তু সবাই নিজের মতো সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, নামছে। বিপদে বাঁচাবার দায় কারুর নেই।

আমার গোটা সালোয়ারটা এতক্ষণ বাসে চিঁড়েচ্যাপটা হতে হতে ঘামে ভিজে উঠেছে, মুখটাও জবজবে। চুলগুলো লেপ্টে রয়েছে গালের দুপাশে, আমি রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললাম, ”কিসের উত্তর?”

”ওই দেখুন!” ঝন্টু আমার কাছে ঝুঁকে এসে ঘাড় দোলাল, ওর মুখের বিকট গন্ধ অমনি ভক করে আমার নাকে এসে ঝাপটা লাগল।

বদ দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল আমার, কিন্তু তাতে ওর কোনো হেলদোল নেই। একই লয়ে বলে যেতে লাগল, ”সেদিন যে এত করে বোঝালাম, সব ভুলে মেরে দিলেন? মালকড়ি কত নেবেন বলুন? কেসটা তুলতে হবে তো, নাকি?”

আমি এক ধাপ পিছিয়ে সাবওয়ের সমতল জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। ডানপাশে টিকিট কাউন্টার, কিন্তু সেখানে সব কটা কাউন্টারই বন্ধ। লেবুওয়ালাও উঠে চলে গেছে। দূরে একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে।

একটা লোক এক্ষুনি চলে গেল আমার পাশ দিয়ে, সিঁড়িতে ওঠার আগে একদলা থুতু ফেলে দিয়ে গেল পাশে।

অন্য কেউ হলে আমি তাকে এতক্ষণে চড়থাপ্পড় কষিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতাম, কিন্তু এই ঝন্টু ছেলেটার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এ একেবারে নির্মম গুন্ডা। আর সব জায়গায় হম্বিতম্বি করার ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করাটা বোকামি, এটা ছবিদাদু আমাকে অনেকবার বুঝিয়েছেন।

এইসব পরিস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় কাজ গোটাতে হবে। তাই কিছুতেই মাথাগরম করা যাবে না।

আমি মিষ্টি হেসে ঝন্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ”দেখুন ভাই। আপনাকে আমি পরিষ্কার বলছি। আমি কোনো টাকাকড়ির বিনিময়েই কেসটা তুলব না। সুদেববাবু বলে একজন ফোন করেছিলেন, তাকেও একই কথা বলেছি। আমার পুজো করার ইচ্ছে ছোট থেকে।”

”আরে ম্যাডাম, আপনার পুজো করার ইচ্ছে। কি হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে, সেসব করতে কেউ মানা করেনি। কিন্তু এইভাবে যারা বছরের পর বছর পুরুতগিরি করে খাচ্ছে, তাদের পেছনে আছোলা বাঁশ দিচ্ছেন কেন? তারা আপনার কোন পাকাধানে মই দিয়েছে?” ঝন্টু তেরিয়া হয়ে উঠল।

এবার আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, ওকে পাশ কাটিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কেটে কেটে বললাম, ”যোগ্য লোকেরা পুজো করবে, ওকে? অযোগ্যরা নয়।”

আমি চলে যাচ্ছি দেখে ঝন্টু এগিয়ে এসে দুম করে আমার হাতটা ধরে ফেলল, ”আরে আরে দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন!”

আমি আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলাম না।

গায়ে অবাঞ্ছিত স্পর্শ আমার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। চুলোয় যাক ছবিদাদুর উপদেশ, এত বড় স্পর্ধা একটা লোফার আমার গায়ে হাত দেয়?

আমি ঘুরে সটান এক চড় কসালাম ঝন্টুর গালে, ”অসভ্য লোফার! রাস্তাঘাটে মেয়েদের গায়ে হাত দিতে লজ্জা করে না? আরপিএফ-কে ডাকব? কেরদানি বেরিয়ে যাবে।”

ঝন্টু চড়টা খেয়ে এতটাই হতভম্ব হয়ে গেল যে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না।

আশপাশে যে দু-তিনজন লোক আসা যাওয়া করছিল, তারাও এবার কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল এদিকে।

আমি আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না। ট্রেন ছাড়তে আর এক মিনিটও বাকি নেই, আমি রুদ্ধশ্বাসে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দেওয়া মেন লাইনের আপ লোকালে উঠে পড়লাম। উঠে বসতে না বসতে সাইরেন বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।

উত্তেজনায়, ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছিল, ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল। তবু মাথাটা আগুনের মতো গরম হয়ে রয়েছে।

ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে প্রায় আধবোতল জল খেলাম। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলছে। উলটোদিকের সিটে বসা বাচ্চা মেয়েটা হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

কিন্তু আমার দোষ হল, মাথা একবার গরম হয়ে গেলে সহজে ঠান্ডা হতে চায় না। রাগটা বেরনোর জন্য কাউকে আচ্ছা করে ঝাড়া দরকার। আশেপাশে তাকিয়ে কী করব বুঝতে পারলাম না। বোতলটা ব্যাগে ঢোকাতে যেতেই ব্যাগের ভেতর চোখে পড়ল লিটমাস কাগজগুলো। আসার সময় আমি নিজেই হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম কয়েকটা কাগজ।

ইলেভেন টুয়েলভে আমার সায়েন্স ছিল না, তবু কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে এই কাগজগুলো মাঝেমাঝেই বাড়িতে নিয়ে আসতাম, কখনো বাথরুমের অ্যাসিডে চুবিয়ে, কখনো কাপড় কাচার ক্ষারে ডুবিয়ে রং পরিবর্তন দেখাটা ছিল আমার নেশা।

লাল নীল লিটমাস কাগজগুলো দেখতে দেখতে ধাঁ করে একটা মুখ মনে পড়ে গেল।

মনের মধ্যে কথাগুলো সাজিয়ে নিতে নিতে ফোন বের করে ঝটিতি ডায়াল করলাম আমি।

এগারো

আমি আর জিষ্ণু অফিস থেকে ফিরছিলাম। এসি বাস। রোজই এসি বাসে ফিরি। কিন্তু আজ কেমন যেন কাঁপুনি দিচ্ছে।

জিষ্ণু কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। আমি ওর হাতে মৃদু টোকা দিতেই চোখ খুলে বলল, ”কি? এর মধ্যেই এসে গেল নাকি?”

”না না! এখনো দেরি আছে।” আমি আশ্বস্ত করে বললাম, ”তোর ঠান্ডা লাগছে না?”

”ঠান্ডা?” জিষ্ণু কান থেকে একটা হেডফোন খুলে আমার দিকে তাকাল, ”এই পচা গরমে একটু শান্তির জন্য চল্লিশ টাকা খরচা করে এসি বাসে যাচ্ছি আর তোর ঠান্ডা লাগছে? ফোনটা অন করেছিস? কাকিমা কিন্তু আমাকে একটু আগেও ফোন করেছিলেন।”

আমি চুপ করে গেলাম। এখনো হাওড়া আসতে প্রায় কুড়ি মিনিট মতো দেরি। জিষ্ণু হাওড়ায় নেমে আবার ট্রেন ধরবে। আর আমি অটো। ঠিকমতো গেলে আর আধঘণ্টার মধ্যে আমি বাড়ি চলে যাব।

কিন্তু আজ আমার বাড়ি যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না! একে সেদিন রাতে বাবার বলা কথাগুলো শেলের মতো বুকে বিঁধছে, তার ওপর বলা নেই কওয়া নেই, কাল সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করে দিওতিমার ফোন পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম, কোনো দরকারে ফোন করছে বুঝি। কিন্তু ‘হ্যালো’ বলামাত্র ওপাশ থেকে শুরু হয়েছিল গোলাবর্ষণ।

মেয়েটা আমাকে কোনো কথা বলারই সুযোগ দেয়নি। আমি, আমার বাবা এবং ওই পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশন নাকি ওর জীবনটা ধ্বংস করে দিচ্ছি, আদতে পুরোহিত ব্রাহ্মণের আড়ালে আমরা সবাই এক একটা গুন্ডা, ইতর … দিনেদুপুরে মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করি … কিচ্ছু বলতে বাকি রাখেনি ও।

একনাগাড়ে সাত মিনিট একুশ সেকেন্ড চোখা চোখা অপমান করে খট করে কেটে দিয়েছিল ফোনটা।

গোটা ঘটনাটা মনে পড়তেই হাওড়া ব্রিজের ওপর থেকে নীচের গঙ্গা নদীর অন্ধকার জলের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেটে জল এল। কিছু মানুষ আছে, যাদের বিনা কারণে বিনা দোষে অপমানিত হতে হয়। লাঞ্ছিত হতে হয়। যেমন আমি। কখনো মনে পড়ে না কারুর সজ্ঞানে কোনো ক্ষতি করেছি, কাউকে ইচ্ছাকৃত আঘাত দিয়েছি। নিজের মনে থাকি। বিশাল কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, নিজের ছোট ছোট খুশিগুলো নিয়ে বাঁচতে চাই। কেউ খারাপ ব্যবহার করলে পালটা জবাব চট করে দিতে পারি না। ভাবি, আহা কষ্ট পাবে! কিন্তু আমার এই অতিভদ্রতাবোধই লোকের কাছে আমার দুর্বলতা বলে প্রতিভাত হচ্ছে। নিজের কেউ হোক বা পর। বহুদিনের চেনা হোক বা দুদিনের। সবাই আমাকে হেয় করে মজা পেতে চায়।

কনুইয়ে সামান্য স্পর্শ পেয়ে দেখি জিষ্ণু ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে দেখছে, ওর হাতে আমার ফোন, কখন হাত থেকে নিয়ে নিয়েছে বুঝতেই পারিনি। বলল, ”কী ব্যাপার বল তো তোর! চোখদুটো ছলছল করছে, ফোনটা সকাল থেকে অফ করে রেখেছিস, কোনো কথাবার্তা বলছিস না, দুপুরেও কিছু খেলি না। কী হয়েছে তোর?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলাম। জিষ্ণু আর আমি আর্ট কলেজের সময়কার বন্ধু, যখন থেকে শিয়ালদা স্টেশনে বসে লাইভ পোরট্রেইট করতাম। পাশ করে একই অফিসে দুজন চাকরি পেয়েছি। তাই চাকরি খুব বেশিদিনের না হলেও জিষ্ণু আমার পুরোনো বন্ধু।

জিষ্ণু মনে হয় কিছুটা আন্দাজ করতে পারল। বলল, ”ভাই তুই তোর বাবাকে বোঝা। ওইসব সংগঠন চালানো তোর কাজ নয়। এখানে বস তোর ওপর খুশি আছে, ঠিকমতো মুম্বাইয়ের অফিসের চোখে পড়ে যেতে পারলে বছর দুয়েকের মধ্যে তোর প্রোমোশন পাক্কা। আরে যার যেদিকে নেশা। জোরাজুরিতে হয় নাকি! এখন যদি তোর বাবাকে বলিস তোর মতো আঁকতে, পারবে?”

”সেটা তুই আমার বাবাকে গিয়ে বোঝা না! যদি সত্যিই বোঝাতে পারিস আরসালানের বিরিয়ানি খাওয়াব।” আমি বললাম।

কথায় কথায় হাওড়া এসে গেছে। আমি বাস থেকে নেমে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে অটো ধরার দিকে রওনা দিলাম।

জিষ্ণুও হাত নেড়ে ছুটল ট্রেন ধরতে।

ভাগ্য ভালো, অটোর লাইনে আজ তেমন ভিড় নেই। অন্যদিন সামনে ড্রাইভারের কনুইয়ের গুঁতো খেতে খেতে ঝুলতে ঝুলতে যাই, আজ ভেতরে ঢুকে বসলাম।

ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলের ওপর রাখতেই পাশ থেকে মেয়েলি গলায় কে বলে উঠল, ”আরে রূপদা! তুমি এখানে?”

তাকিয়ে দেখি সুরবীণা। টিকলির বান্ধবী। হেসে বললাম, ”বিনি তুই! কেমন আছিস?”

”ভালো আছি রূপদা। তোমরা সবাই কেমন আছ?” সুরবীণা হেসে বলল।

টিকলির কলেজ জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এই সুরবীণা। ডাক নাম বিনি। কলেজে পড়তে কতবার যে আমাদের বাড়িতে এসেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। থাকে উত্তরপাড়ার দিকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”

”একটু মেজোমাসির বাড়ি যাচ্ছি গো, সালকিয়ায়।” বিনি বলল।

আমার মনে পড়ে গেল, বিনির এক আত্মীয়র বাড়ি এদিকেই ছিল বটে। আমি বললাম, ”তারপর? কী খবর? কী করছিস আজকাল? আসিসই তো না আর আমাদের বাড়ি!”

বিনি হাসল, ”ওই সকাল বিকেল ক-টা বাচ্চাকে পড়াতে গিয়েই দিন কাবার হয়ে যায় গো, আর কোথাও বেরনো হয়না। আজ একটা কাজে যাচ্ছি মাসির বাড়ি, তাই!”

বিনির পাশে একটা মোটা লোক বসে রয়েছে। অটোওয়ালার অটো ছাড়ার আর নাম নেই। মোটা লোকটা অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল, এবার আমাদের দুজনের খোশগল্পে বোধ হয় আরও অধৈর্য হয়ে খিঁচিয়ে উঠল, ”কি ভাই, কখন ছাড়বে? পনেরো মিনিট হয়ে গেল বসে আছি।”

অটোচালক ছেলেটা সামনের সিটে বসেছিল, নির্বিকারভাবে উত্তর দিল, ”সামনে তিনজন চাই। হলেই ছেড়ে দেব কাকা। চিল্লাবেন না। চিল্লিয়ে কোনো লাভ নেই।”

”কী? আমি চিল্লাচ্ছি?” লোকটা গরমে তেতেপুড়ে এমনিতেই ভিসুভিয়াস হয়ে ছিল, এবার গলগল করে লাভা বের করতে শুরু করল, ”চিল্লানোর কী জানো হে তুমি ফচকে ছেলে! বলি চিল্লানো কাকে বলে তুমি দেখেছ? আমি কি তোমাকে আজেবাজে কিছু বলেছি? রুটে গাড়ি নামিয়েছ, কোনো টাইম বলে কিছু মানবে না?”

অটোর ছেলেটাও তেরিয়া ধরনের, সে বলল, ”আরে কাকা আপনি আরও তিনজনের ভাড়া দিন না, এখুনি স্টার্ট করে দিচ্ছি। নাহলে ঘুমিয়ে যান, ময়দান এলে ডেকে দেব।”

”কেন?” লোকটা এবার নেমে সামনে গিয়ে ছেলেটাকে ধমকে উঠল, ”আমি বেশি ভাড়া দেব কেন? এটা কী নিয়ম? তোমরা সবকিছু জোরজবরদস্তি করে নিয়ম চালু করবে তাই না?”

”আরে দূর মশাই, তাহলে ফালতু লাফরা করছেন কেন? চুপচাপ বসুন তো নাহলে ফুটুন এখান থেকে।” ছেলেটা এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল।

”ফুটুন মানে? ফুটুন কী ভাষা অ্যাঁ?” লোকটা রাগে বেগুনি হয়ে গেল, ”জানিস আমি কে?”

ছেলেটা ঘাড় দুলিয়ে বলল, ”না। জানতে চাইও না।”

আমি বিরক্ত হয়ে বিনিকে বললাম, ”চল। একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাই। তোকে নামিয়ে দেব।”

বিনি সায় দিয়ে নেমে এল। অটোর ছেলেটা আর মোটা লোকটার ঝগড়া তখনও চলে যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাকলাম।

গাড়ি চলতে শুরু করতে বিনি বলল, ”রূপদা, তোমার সঙ্গে আজ দেখা হয়ে গিয়ে ভালোই হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম টিকলিকে ফোন করে তোমার নম্বরটা চাইব, একটা দরকার ছিল।”

”কী দরকার বল?” আমি বাইরেটা দেখছিলাম। আমাদের এই হাওড়া জেলাটা দিনকে দিন কেমন অচেনা হয়ে উঠছে, অবাঙালি লোকজন এত বেড়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছি কোথায় বাস করছি। না, আমি এটা খারাপ বলছি না, বিশ্বায়ন সব শহরেই হচ্ছে, তবু খাস হাওড়ার বুকে হিন্দি সাইনবোর্ড দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়।

বিনি একটু গলাটা নামিয়ে বলল, ”তুমি রাজতিলক বলে কাউকে চেনো?”

”রাজতিলক?” আমি ভ্রূ কুঁচকে ফেললাম, ”রাজতিলক নামে তো কাউকে চিনি না বিনি।”

”কিন্তু রূপদা, তুমি যে সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছ, ও-ও ওই সালেই পাশ করেছে তোমাদের স্কুল থেকে। রাজতিলক চোঙদার।”

”চোঙদার? আমাদের স্কুলের ছেলে?” আমি আরও ভালো করে মনে করার চেষ্টা করলাম। মিনিট পাঁচেক বাদে প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে বললাম, ”নারে। আমি শিওর। ওই নামে, সবচেয়ে বড় কথা, ওই সারনেমে কেউ নেই। আমার কোনো চোঙদার বন্ধু নেই। কোনোদিনও ছিল না।”

”তুমি তো ফেসবুকে নেই, না? খুঁজেছি তোমায়, পাইনি।”

”না রে, আমার ফেসবুক পাসবুক কিছুই নেই।” আমি হাসলাম।

বিনি এবার ওর ফোনে কিছু টেপাটেপি করতে শুরু করল। মিনিট খানেক পরে একটা ছেলের ছবি ঢাউস স্ক্রিনে ফুটে উঠতেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, ”এই দ্যাখো। এই ছেলেটা। মাধ্যমিক পাশ করেছে অন্য স্কুল থেকে, কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক তোমাদের স্কুল, তোমার ব্যাচ। তারপর কলেজ বঙ্গবাসী কলেজ অফ কমার্স।”

”ওহ তাই বল!” আমি ভালো করে ছেলেটার ছবিটা এবার দেখলাম, ”আমাদের স্কুলে শুধু দু-বছর পড়েছে, তাও কমার্সে। তাই চিনি না। আসলে ওই দু-বছর অনেকে বাইরের স্কুল থেকে আসত তো, সবাইকে চিনতাম না। তার ওপর আমার আর্টস ছিল।”

বিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, ”তোমার তো নিশ্চয়ই কমার্সের বন্ধুবান্ধব আছে। কাউকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারবে ওকে চেনে কিনা?”

”হ্যাঁ সে কেন পারব না। কমার্সে আমার অনেক বন্ধু আছে। কী ব্যাপার বল তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”বিয়ে টিয়ের ব্যাপার বুঝি?”

বিনি উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে ফেলল।

আমি আরও কনফিউজড হয়ে গেলাম।

এমনিতেই মেয়েদের ভাবগতিক আমি খুব একটা বুঝি না। কখন কাঁদে, কখন হাসে, কখন কী বলতে চায়, সেই ব্যাপারে আমার ধারণা খুবই কম। কোনোদিন আমার তেমন মেয়েবন্ধু ছিলও না। আমি ভ্যাবলার মতো চেয়ে থেকে বললাম, ”কী হয়েছে রে বিনি?”

বিনি এবার একটা কাণ্ড করল। আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সামনেই ফোঁপাতে শুরু করল, ”রূপদা! তুমি প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করো। আ-আমার খুব বিপদ!”

কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল ওর শরীর।

বারো

অরূপ কাঞ্জিলাল কাপ থেকে কিছুটা করে চা প্লেটে ঢালছিলেন, তারপর সেই প্লেট থেকে ঠোঁটটা ছুঁচলো করে সুড়ুত সুড়ুত করে খাচ্ছিলেন।

ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পঞ্চান্ন, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, পরনে ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা সাদা রুমাল ঘাড়ের ওপর ফেলে রাখা, সম্ভবত ঘাম আর ময়লা থেকে পাঞ্জাবিটাকে বাঁচাতে।

একেবারে শ্বেতস্বচ্ছ ভাবমূর্তি !

আমি লক্ষ্য করছিলাম ভদ্রলোক যখনই একটু করে চা খাচ্ছিলেন, পাল্লা দিয়ে তাঁর ভুড়িটাও ওঠানামা করে যোগ্য সংগত করছিল।

আমাকে অরূপ কাঞ্জিলালের ভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোকের পাশে বসে থাকা নন্দকাকা গলা ঝেড়ে বলল, ”ইয়ে … দিও, স্যার আসলে তোর সঙ্গে একটা দরকারি কথা বলতে এসেছেন।”

আমার পাশেই খাটের একটা ছত্রী ধরে মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারছি মায়ের মনে প্রবল আশঙ্কা আর ভয় গিজগিজ করছে।

মায়ের চিন্তা হওয়াটা খুব একটা অমূলক কিছু নয়। আমাদের মতো ছাপোষা নিম্নবিত্ত বাড়িতে ছুটির দিন সকালবেলা যদি বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে এলাকার এম এল এ’র আবির্ভাব ঘটে, যে কেউই থমকে যাবে।

আমি যতই সাদা হাতিটাকে দেখছিলাম, ততই আমার মাথার ভেতরটা গরম হচ্ছিল। ফ্ল্যাশব্যাকে মনে পড়ে যাচ্ছিল সরস্বতী পুজোর দিনের সেই লাঞ্ছনা।

এর আস্কারাতেই, এর আদেশেই সেদিন ওই কাজ করেছিল ছেলেগুলো।

আসার পর থেকে আমি একবারও হাসিনি, শক্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছি লোকটার দিকে।

নন্দকাকা আমাদের এই তেইশ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। সে-ই রাস্তা চিনিয়ে বিধায়কবাবুকে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে আরও দুজন পার্টির লোক রয়েছে। তারা জুলজুল করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে।

অরূপ কাঞ্জিলাল ধীরেসুস্থে চা-টা শেষ করলেন, তারপর কাপ আর ডিশটা নামিয়ে রাখতে গেলেন মাটিতে, কিন্তু তার আগেই মা প্রায় ছুটে গিয়ে হাত থেকে সেগুলো নিয়ে নিল, ”আমাকে দিন স্যার!”

অরূপ কাঞ্জিলাল পকেট থেকে সাদা একটা রুমাল বের করে মুখ আর গোঁফ মুছলেন, তারপর সোজা তাকালেন আমার দিকে, ”কোন কলেজ থেকে পড়াশুনো করেছ তুমি?”

”লেডি ব্র্যাবোর্ন। সংস্কৃত অনার্স।”

”বাহ।” অরূপ কাঞ্জিলাল মন্তব্য করলেন, ”কোন সালে পাশ করেছ?”

”দু-বছর আগে।” আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।

”এম এ পড়লে না কেন?”

”মা আর টানতে পারছিল না। এম এ’র ভালো খরচ ছিল। টিউশনি করতাম, একটা কোচিং সেন্টারেও পড়াতাম।” আমি নিঃস্পৃহ গলায় উত্তর দিচ্ছিলাম।

”দু-বছরের মধ্যেই সরকারি চাকরি পেয়ে গেলে? ভেরি গুড! কোথায় পোস্টিং?”

”হাওড়াতে। বাগনান এক নম্বর ব্লক।”

”বাঃ! কপালটাও ভালো।” অরূপ কাঞ্জিলাল মাথা দোলালেন, ”বাড়ি থেকে যাতায়াত করতে পারছ। এই যদি দুম করে মালদা কিংবা বীরভূম ঠেলে দিত, গ্রামগঞ্জে গিয়ে একা থাকতে হত। তাতে খরচও বাড়ত, ঝক্কিও। এখানে মা-মেয়ে কেমন একসঙ্গেই রয়েছ।”

আমি ঠোঁট কামড়ালাম, কিছু বললাম না। এর আসল উদ্দেশ্য কী এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

সাতসকালে লোকটা নিশ্চয়ই আমার প্রশংসা করার জন্য ছুটে আসেনি।

”তা মা এতদিন খাটলেন, এবার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, মা একটু বিশ্রাম করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সব মা-ই তাই চান। কী মাসিমা তাই তো?”

মা আর অরূপ কাঞ্জিলাল সমবয়সি হবে, কিংবা মা হয়তো একটু ছোটই হবে, আকস্মিক ‘মাসিমা’ ডাকে মা থতমত খেয়ে লম্বা করে সায় দিল, ”সেই তো! সেই তো স্যার, আ-আমি তো সবসময়েই তাই বলি …!”

”তা চাকরি করে টাকা জমাও, বাড়ি সারাও, তারপর পাড়ার দাদারা, এই তো নন্দ, ভোলা এরা তো রয়েইছে, ভালো পাত্র দেখে বিয়ে থা দেবে, সুখে ঘরসংসার করবে, বুড়ো মা-কে দেখবে।” অরূপ কাঞ্জিলাল বলে যেতে লাগলেন, ”হঠাৎ করে পুজোর ভূত চাপল কেন?”

এইবার পথে এসেছ চাঁদু! এতক্ষণের ধানাই পানাই শেষ করে লাইনে এসেছ। আমি মনে মনে বললাম।

মুখে নিরাসক্তভাবে বললাম, ”পুজো করতে আমার ভালো লাগে। আমার সব মন্ত্র, রীতিনীতি জানা। বেদও পড়েছি। আমি পুজো করতে চাই।”

”আরে চাই বললেই তো হল না, সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। সিস্টেম আছে। পুজো করবে ব্রাহ্মণ ছেলেরা, এটাই সমাজের রীতি, যুগে যুগে চলে আসছে, সবাই সেটাকে মেনে আসছে। তোমার ইচ্ছে হলেই তুমি সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পারো না। মেয়েরা কখনো পুরোহিত হতে পারেনা হিন্দু শাস্ত্রে।” অরূপ কাঞ্জিলাল নিজের রুমালটাকে সরু করে কানে ঢুকিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বিজ্ঞের মতো বললেন, ”সরস্বতী পুজোর দিনেও তুমি এইরকম একটা কাণ্ড করেছিলে। সেদিনও লোক পাঠিয়ে আটকেছিলাম। তারপর আবার এতবড় কীর্তি। থেকে থেকে কি ভীমরতি হচ্ছে নাকি তোমার? মেয়েমানুষ হয়ে পুজো করার শখ কেন?”

”কিন্তু শুধু ঋগ্বেদেই ত্রিশ জনেরও বেশি মহিলা ঋষির নাম উল্লেখ করা আছে।” আমি বললাম, ”অদিতি, গোধা, লোপামুদ্রা, ইন্দ্রাণী …।”

”আরে তোমার এই জ্ঞান তুমি অন্য জায়গায় ঝেড়ো, আমার সামনে নয়। আদৌ সেগুলো সত্যি কিনা তার প্রমাণ কী?” অরূপ কাঞ্জিলাল মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আমাকে, ”আর তা ছাড়া তাঁরা ব্রাহ্মণকন্যা।”

”পুরোহিত যে কেউ হতে পারেন, এই ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের রায় আছে।” আমার রাগের পারদ ক্রমশ চড়ছিল।

আমি কি আদৌ একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক?

”আরে দূর!” অরূপ কাঞ্জিলাল এবার ভদ্রতা ভুলে প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন, ”তুমি তো বড়ো টেঁটিয়া মেয়ে দেখছি। আইনে অনেক কিছুই থাকে, সেগুলো বাস্তবে হয় না। পুজো আমরা, মানে ব্রাহ্মণরাই করে থাকি, আর সেটাই শুদ্ধ নিয়ম।”

”আপনি এভাবে কথা বলবেন না আমার সঙ্গে।” আমি কেটে কেটে বললাম।

নন্দকাকা ভয়ার্ত চোখে তাকাল আমার দিকে।

নন্দকাকা লোকটা খারাপ না, পাড়ায় থাকে, কারুর আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ায়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।

তুলনায় এই অরূপ কাঞ্জিলাল লোকটার অনেক দুর্নাম শুনেছি। আগে নাকি কোনো নেতার পোষা গুন্ডা ছিল, পরে নিজেই হর্তাকর্তা হয়েছে। আর নিজের পোষা গুন্ডাগুলোকে দিয়ে এলাকা তটস্থ করে রেখেছে।

আমার কাঁধে মায়ের মুহুর্মুহু ইশারাস্বরূপ চিমটিকে আমি ভ্রূক্ষেপ করলাম না। বললাম, ”খবরের কাগজ পড়েন? বাংলা নয়। ইংরেজি সর্বভারতীয় কাগজ?”

অরূপ কাঞ্জিলালের মুখটা কেমন ঝুলে গেল।

”যদি পড়েন, তাহলে পাঁচ ছ-মাস আগে নিশ্চয়ই পড়েছিলেন যে কেরালায় বিয়াল্লিশজন অব্রাহ্মণকে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করেছে সেখানকার সরকার? তাদের মধ্যে ছত্রিশজন অব্রাহ্মণ আর ছ-জন আবার দলিত। কেরালা সরকারের অধীনে একটা বোর্ড আছে। দেবোস্বম বোর্ড। তারাই গোটা রাজ্যের প্রায় তিন হাজার মন্দিরের পুরোহিত ঠিক করে। দেবোস্বম রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, দুটো ধাপ পেরিয়ে তারা পুরোহিত হয়েছে। বংশপরম্পরায় ব্রাহ্মণ পদবি পেয়ে নয়।”

মা এবার পাশ থেকে গর্জে উঠল, ”বড়ো বেশি কথা বলছিস তুই! চুপ কর এবার। স্যার, ওর কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না দয়া করে। এমনিতে আমার মেয়েটা ভালো, কিন্তু কে যে ওর মাথায় এই সব …! ”

রাগে আমার গলা উত্তরোত্তর চড়ছিল। তবু মার কথামত আমি ভল্যুম কমালাম, কিন্তু থামলাম না, ”উত্তরপ্রদেশের গোরখনাথ মন্দিরের নাম শুনেছেন? ওখানে পুরোহিত হবার জন্য জাতপাত দেখা হয় না, জানেন কি? ওদের মতে হিন্দু ধর্মে শুধু চারটে জাত হয়। সৎ – শিক্ষিত, সৎ – অশিক্ষিত, অসৎ – অশিক্ষিত আর অসৎ কিন্তু শিক্ষিত। এইভাবে ওরা সমাজে উঁচু নীচু ঠিক করে।”

নন্দকাকা এবার আমার দিকে সরে এল। আমার মেজাজ কাকা ভালো করেই জানে, চোখের ইঙ্গিতে চুপ করতে বলল।

অরূপ কাঞ্জিলাল মাতব্বরি সুরে বললেন, ”বটে? তার মানে একটা মেথরকেও এবার পুরুত ঠিক করতে হবে বলছ?”

আমি চিৎকার করে বললাম, ”আপনারা পুরোহিত ঠিক করার কে? পুরোহিত হবে নিজের যোগ্যতায়। কোনো পার্টির দালাল ধরে নয়। কাশ্মীরে একটা মন্দির আছে, মামালকা মন্দির। লীডার নদীর পাড়ে। নয়শো বছরের পুরোনো মন্দির। জানেন সেখানে পুজো করেন দুজন মুসলিম পুরোহিত?”

‘পার্টির দালাল’ কথাটা শুনে অরূপ কাঞ্জিলালের মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল, এবার একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

আমি থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভেতরের ঘরে যাওয়ার আগে বললাম, ”যারা যোগ্য, যারা শুভ বুদ্ধির অধিকারী, তারাই ঈশ্বরের দূত হিসেবে কাজ করবে। পৈত্রিক অধিকারে বা ছেলে হয়ে জন্মানোর অধিকারে নয়। পার্টির গুন্ডা হওয়ার সুবাদেও নয়।”

আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে পেছন থেকে অরূপ কাঞ্জিলালের হিশহিশে গলা শুনতে পেলাম, ”আমাদের পার্টির ছেলে ঝন্টুকে তুমি হাওড়া স্টেশনে চড় মেরেছ তাই না? দলের ওপরমহল তোমার ওপর ভয়ংকর রেগে রয়েছে। তোমাকে আমি সাবধান করতে এসেছিলাম! ভেবেছিলাম বাচ্চা মেয়ে, এর পরিণাম কী হবে ধারণা নেই বলে উত্তেজনার বশে করে ফেলেছ। কিন্তু এখন দেখছি তোমার মতো ডেঁপো মেয়ের ভালো চাওয়াটা বোকামি। লাইসেন্স! হুঁ! কে উনি এলেন, পুরোহিতদের লাইসেন্স চালু করবেন! এর আগে অল্প ডোজ দিয়েছিলাম, শিক্ষা হয়নি দেখছি …!”

আমি উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। এখন বাড়িতে থাকলেই মায়ের অগ্নিবর্ষণ শুরু হবে। খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। রাগে মাথা বনবন করে ঘুরছে।

একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলাম। যাব কোথায় জানিনা। আপাতত উত্তরপাড়া স্টেশন। তারপর সেখান থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া। একটা ভালো উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা খুবই দরকার। একা একা মিডিয়ার সঙ্গে আর পারা যাচ্ছে না।

আমি রিকশায় উঠে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলাম। সময়টা এত খারাপ যাচ্ছে, বলার নয়। একদিকে বিনির সঙ্গে এত ছোটবেলার বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে গেল, অন্যদিকে ওই অ্যাসোসিয়েশনের লোকেদের হম্বিতম্বি, আজ আবার শুরু হল পার্টির হুমকি।

তেরো

অফিসে এসে সবে কাজে বসেছি, এমন সময় আবীরের ফোন এল।

আমি একহাতে ফোন, অন্য হাতে কফির কাপ হাতে বাইরের লবিতে চলে এলাম। ঘড়িতে সবে ন-টা দশ। এত তাড়াতাড়ি আমাদের বস তো দূর, কেউই অফিসে আসেনি। আমিও সাধারণত পৌনে দশটার আগে অফিস ঢুকিনা, কিন্তু এই সপ্তাহটা তাড়াতাড়ি চলে আসছি।

সেদিন ডিনার টেবিলে ঝামেলার পর থেকে বাড়িতে কারুর সঙ্গে বিশেষ কথা বলছি না। বাবার সঙ্গে তো দূর, মা, কাকিমা, টিকলির সঙ্গেও নয়।

রাতে দেরি করে ঢুকছি, সকাল হতেই কোনোমতে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসছি। খাচ্ছিও না, মা দুবার সাধাসাধি করেছিল, এখন আর কিছু বলছে না। অফিসে ঢোকার আগে স্যান্ডউইচ বা কেক টেক খেয়ে নিচ্ছি।

মনটা এমনিতেই বিক্ষিপ্ত, ভার ভার। তাই কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছি প্রাণপণ। আমার বস দিব্যেন্দুদা নতুন একটা প্রোজেক্টের ভার দিয়েছে আমার উপর। মুম্বাইয়ের ক্লায়েন্ট, অনেকরকম বিজনেস আছে। দিব্যেন্দুদা সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিল, ”তোর ওপর ভরসা করি বলেই পুরো গ্রাফিক্সের কাজটা তোকে দিচ্ছি। ক্লায়েন্ট একবার স্যাটিসফায়েড হয়ে গেলে আমরা ওদের আরো অনেক প্রোজেক্ট পাব।”

আমি ফোন রিসিভ করে বললাম, ”বল। খোঁজ পেলি?”

আবীর বলল, ”বিলক্ষণ! বাবা, এ তো একদম গঙ্গারামের মতো সুপাত্র!”

”কেন?”

”আরে ইলেভেন টুয়েলভেই ছেলের পাখনা গজিয়ে গিয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিকের টেস্টে টুকতে গিয়ে ধরা পড়ে, তারপর হাতে পায়ে ধরে ফাইনাল পরীক্ষায় বসার অনুমতি পায়। তারপর মার্কামারা ছাত্র।”

”হু। সেটাই আশা করেছিলাম।” আমি চিন্তিত মুখে বলে ফোন রেখে দিলাম।

কফিটা শেষ করে ফোন করলাম বিনিকে। আবীর যা বলেছে, পুরোটা ওকে রিলে করে বললাম, ”আমার মনে হয়, পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিত তোর। এমনিতেই বদ ছেলে, উচিত শিক্ষা দিতে কোনো সমস্যাই হবে না।”

ওপাশ থেকে বিনির ধরা ধরা গলা ভেসে এল, ”না না রূপদা! খবরদার তুমি পুলিশে খবর দিও না যেন! আমার বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

আবীর আমার ছোটবেলার বন্ধু, মাধ্যমিক পাশ করার পরে ও কমার্স নিয়েছিল। তাই সেদিন ট্যাক্সিতে বিনির কথাগুলো শোনার পরে আবীরের কথাই মনে পড়েছিল।

বিনি মেয়েটাকে অনেকদিন ধরে দেখছি। একটু ভীতু, লাজুক কিন্তু স্বভাব ভালোই। সেদিন দুম করে ট্যাক্সির মধ্যে ওকে কাঁদতে দেখে আমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। ট্যাক্সিওয়ালাও আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল পেছন দিকে। কী যে ভাবছিল কে জানে!

আমি যতটা সম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম, ট্যাক্সিওয়ালা দুমদাম কিছু ভেবে বসলে আমি কেস খেয়ে যাব।

যদি আমাকে মেয়েপাচারকারী ভেবে বসে? যদি ভাবে আমি বিনিকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছি? তারপর জনতার হাতে গণধোলাই দিতে তুলে দেয়? বোনের বান্ধবীকে পৌঁছে দিতে ট্যাক্সিতে উঠে একি বিপদে পড়লাম রে বাবা!

আমি বিনিকে মিনতি করে বলেছিলাম, ”ইয়ে বিনি, কী হয়েছে খুলে বল। এ-এইভাবে কান্নাকাটি করিস না, বুঝতেই পারছিস। লোকে আমাকে …!”

বিনি আমার কথায় একটু সামলে উঠেছিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, ”বিশ্বাস করো রূপদা, আমি খারাপ মেয়ে নই! কলেজে ঢুকেই একদম প্রথমদিকে কী যে হয়েছিল! ওই বাজে ছেলেটার পাল্লায় পড়ে …!” কান্নায় ধেবড়ে যাচ্ছিল বিনির চোখের কাজল, ”কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি সরে এসেছিলাম। রাজতিলক প্রথম প্রথম চেষ্টা করলেও পরে খুব একটা বিরক্ত করেনি। পরে ও কলেজও ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমার এই বিয়েটা ঠিক হওয়ার পরই …!”

আমি চিন্তিতমুখে বলেছিলাম, ”কিন্তু, ব্ল্যাকমেল যে করছে, কিসের বেসিসে? কী আছে ওর কাছে?” একটু ইতস্তত করে বলেছিলাম, ”কোনো ছবি টবি?”

বিনি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল, ”আমাদের কলেজ লাইফে তো ক্যামেরা মোবাইল খুব একটা কারুর কাছে ছিল না। একবার ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে, কিন্তু সকালে গিয়েই রাতে ফিরে এসেছিলাম, কোথাও থাকিনি। তবু কীভাবে যে …!”

পরের আধঘণ্টা ধরে বিনি পুরো ব্যাপারটা খুলে বলেছিল।

রাজতিলক বলে ছেলেটা ছিল ওদের কলেজের সিনিয়র, কলেজে ঢোকার পর বিনি প্রথম এক-দেড় বছর জড়িয়ে পড়েছিল ওর সঙ্গে। কিন্তু সেই সময়টুকুর মধ্যেও রাজতিলক সম্পর্কে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ, কলেজের বন্ধুদের সাবধানবাণী, আর নিজেদের মধ্যে প্রায়শই ঝগড়ার জন্য বিনি সরে আসে। তারপর রাজতিলক কলেজ ছেড়ে দেয়।

কিন্তু গন্ডগোলটা শুরু হয়েছে মাসখানেক আগে। বিনির জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। উলুবেড়িয়ার ছেলে, বেশ ভালো অবস্থা। বাড়িতে তেলের কল আছে, সঙ্গে গ্যাসের ডিলারশিপ, রেশনশপ সব মিলিয়ে আরও তিন-চাররকম ব্যবসা। পাত্র নিজে রাজনীতি করে, সমাজসেবাও করে। বিনিকে ওদের বেশ পছন্দ, বাড়ির সবাই এসে দেখে গেছে। বিনির বাবার শরীর ভালো নয়, তাই তিনিও দেরি করতে চাইছিলেন না। বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে দু-মাস পর।

কিন্তু তারপর থেকেই শুরু হয়েছে সমস্যা। সেই রাজতিলক চোঙদার, যার সাথে গত চারবছর বিনির কোনো যোগাযোগই নেই, সে ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। রাজতিলকের কাছে নাকি কিছু অন্তরঙ্গ ছবি আছে, সেগুলো সে বিনির হবু বরকে পাঠিয়ে দেবে।

কিন্তু কীভাবে সেই ছবি উঠল, তা নিয়ে বিনি নিজেও ধোঁয়াশায়।

”হুমকি দিচ্ছে কিসের জন্য? মানে ওই রাজতিলক কী চাইছে?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

”সেটা এখনো বুঝতে পারছি না রূপদা!” বিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, ”বাবা আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন। বাবার শরীরও ভালো নয়। আমার বিয়ে হয়ে গেলে বোনেরটাও দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইছেন। সুপ্রতিম নিজে পার্টি করে, ওদের বাড়ি থেকে কিছু দাবিদাওয়াও নেই, সেইজন্য …!”

নিজের ডেস্কে বসে সেদিনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিলাম। হুঁশ ফিরল জিষ্ণুর ডাকে, ”কী ব্যাপার, তুই কি আজকাল অফিসেই রাত কাটাচ্ছিস নাকি?”

”না না, বল।” আমি বর্তমানে ফিরে এলাম, ”এই একটু আগে এসেছি।”

”খেয়েছিস না উপোস করে আছিস?” জিষ্ণু ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল।

”খেয়েছি।” আমি হাসলাম।

”সত্যি বস, প্রেমিকার জন্য দেবদাস হতে অনেককে দেখেছি, কিন্তু তোর মতো বাপের ওপর রাগ করে দেবদাস একটাও দেখিনি।” কাঁধ ঝাঁকাল জিষ্ণু।

আমি কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, ”এই নে। বিস্কুট খা।”

”আমি ভাত খেয়ে এসেছি, তুই খা। তোকে যেটা বলতে এলাম, বুধ বৃহস্পতি শুক্র, এই তিন দিন ছুটি নিয়ে নিবি। শনি রবি মিলিয়ে পাঁচদিন হয়ে যাচ্ছে। দিব্যেন্দুদাকে বলে রেখেছি। তোর ক্লায়েন্টকে সুমনা এই ক-দিন সামলে নেবে।”

”মানে?” আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম, ”তিনদিন ছুটি নিয়ে কী করব! পুজোর আর বেশি দেরি নেই। ”

”কেন তুমি ক-টা পুজোর ঠেকনা নিয়ে রেখেছ মামা?” জিষ্ণু এবার গলা চড়াল।

চটে গেলেই ওর মুখে আমি ‘মামা’ ডাক শুনতে পাই।

”পুজোর প্রশ্ন নয়।” আমি কথা গোছাচ্ছিলাম, ”তিনদিন কী করব সেটা তো বল?”

”সান্দাকফু যাব।” জিষ্ণু সংক্ষেপে বলল।

”কোথায়?” আমি হকচকিয়ে গেলাম।

”সান্দাকফু সান্দাকফু। ভূগোলে পড়িসনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু?” জিষ্ণু বলল।

”ও বাবা! সে—সে তো এভারেস্টে—ইয়ে মানে—হিমালয়ে! ওখানে কী করে যাব?” আমি হকচকিয়ে গেলাম।

ছোট থেকে রক্ষণশীল একান্নবর্তী পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাইরে ঘুরতে যাওয়া খুব একটা হয়নি আমার। খুব ছোটবেলায় একবার সবাই মিলে গিয়েছিলাম পুরী, আবছা মনে আছে। তারপর বছরকয়েক আগে একবার শান্তিনিকেতন, পৌষমেলায়। ব্যস!

জিষ্ণুর কথায় আমার মনে হল, সত্যিই, এত বড় হয়ে গেলাম, এখনো পাহাড় দেখলাম না!

”যেভাবে সবাই যায়। এখান থেকে ট্রেনে চড়ে নিউ জলপাইগুড়ি, ওখান থেকে জিপে মানেভঞ্জন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে।” জিষ্ণু এবার সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়াল, ”দ্যাখ রূপ, আমি কিন্তু তোর টিকিট কেটে ফেলেছি। সবাই বারণ করছিল কাটতে। বলছিল তুই যাবি না, ঠিক বাগড়া দিবি। আমি কিন্তু বড় মুখ করে কেটেছি। এবার তুই যদি ঝোলাস, সত্যি বলছি মাইরি, পিটিয়ে কিন্তু তোর গালের চামড়া হাতে দিয়ে দেব।”

”সে হাতে দিয়ে দিবি কি আবার সেলাই করে গালেই লাগাবি তুই বুঝবি।” আমি কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ ফেরালাম, কথায় কথায় কিছু কাজই শুরু করা হল না সকাল থেকে।

বললাম, ”আমি যেতে পারব না।”

”মানে?” জিষ্ণু স্পষ্টতই বিরক্ত, ”কেন?”

আমি সত্যিটা বলতে গিয়ে চেপে গেলাম। পঁচিশ বছরের একটা দামড়া ছেলে হয়ে যদি বলি বাবা ছাড়বে না, বলা যায় না জিষ্ণু হয়তো এখানেই পেটাতে শুরু করবে আমায়।

মুখে বললাম, ”বাড়িতে এখন এমনিই অনেক কিছু নিয়ে ঝামেলা চলছে। অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং লেগেই আছে। পুজোও এসে গেল বলে। এইসময় আমি পাঁচদিন বাইরে থাকলে সব কিছু বিগড়ে যাবে।”

”মামদোবাজির একটা লিমিট আছে রূপ!” জিষ্ণু খিঁচিয়ে উঠল, ”তোদের ওই টিকিওলা ক্লাব তুই না থাকলে নাকি বিগড়ে যাবে! হু! ফালতু ধানাইপানাই পোষায় না জানিস তো! তুই যাবি ব্যস! চারদিন থাকব, সোমবার ভোরে এসে অফিস জয়েন করব।” কথাক’টা বলেই জিষ্ণু বেরিয়ে গেল আমার কিউবিকল থেকে।

আমি করুণমুখে বসে রইলাম। মনটা এমনিতেই মেঘলা হয়ে ছিল, এখন রীতিমতো কালো মেঘে ভরে উঠতে লাগল।

এই যে জিষ্ণু, আবীর, রাঘব, এদের মতো সাধারণ জীবন আমার নয় কেন? সারাক্ষণ খালি নজরদারি, এটা করবে না, ওটা করা ভটচায বাড়ির ছেলের মানায় না। এত নিয়মের বেড়াজাল কেন?

আর্ট কলেজের ফাইনাল ইয়ারের শেষে সব বন্ধুরা মিলে একবার চাঁদিপুর যাওয়ার প্ল্যান হয়েছিল। বাবা কিছুতেই যেতে দিলেন না। কতদিন আগের কথা, তবু মনে পড়লেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আমার!

বাবা শুনে বলেছিলেন, ”ওইসব চ্যাংড়া ছেলেদের সঙ্গে তুমি ঘুরতে যাবে? বলতে মুখে বাধছে না? গিয়ে সন্ধ্যাহ্নিক করবে কীভাবে? সমুদ্রের ওই নোংরা জলে?”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুরা সবাই ভদ্রবাড়ির ছেলে, চ্যাংড়া বা অসভ্য ধরনের কেউই নয়। কিন্তু সেকথা বাবাকে কে বোঝাবে? আন্দুলের ভট্টাচার্য বাড়ির রক্ষণশীলতা তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে গেঁথে রয়েছে যে সহজভাবে হাসতে, আনন্দ করতে তিনি ভুলে গেছেন।

আর পরিবারের অন্যদেরও সেটা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন।

এমন হাস্যকর কথা কবে কে শুনেছে যে সন্ধ্যাহ্নিক করতে হলে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যাবে না?

অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো শুনতই না, তর্ক করত, ঠিক চলে যেত। কিন্তু কী করব, আমি যে ওরকম নই। আর সেই সুযোগটাই সবাই নেয়। কথায় বলে না, নরম মাটিতে আঁচড় কাটা সহজ! আর আমার এই নরম স্বভাবকেই সবাই, দুর্বলতা ভেবে নেয়।

সারাটাদিন কী যে হল, কাজে মন বসাতে পারলাম না।

এক একদিন এমন হয়। কিছুই করতে ইচ্ছে করেনা, খালি মনে হয় চুপ করে বসে আকাশ পাতাল ভাবি।

জিষ্ণুও তারপর থেকে আমাকে বিশেষ ঘাঁটায়নি, ও বোধ হয় ধরেই নিয়েছে আমি যাব।

দুপুর তিনটে সাড়ে তিনটের দিকে আর ভালো লাগল না, বসকে গিয়ে বললাম, ”দিব্যেন্দুদা, আমি আজ বেরিয়ে যাচ্ছি একটু।”

দিব্যেন্দুদা ঘাড় গুঁজে কিছু টাইপ করছিল, মাথা তুলে বলল, ”এখন? শরীর টরীর খারাপ নাকি?”

”হ্যাঁ, ওই আর কী। ভালো লাগছে না খুব একটা।” আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম। মানুষকে কোনো অনুরোধ বা মিনতি করার সময় তো দূর, আমি কিছুতেই তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না।

এইতো, আজ বাসে পাশের এক ভদ্রলোক অন্যায়ভাবে আমার পায়ের ওপর তাঁর ঢাউস ব্যাগটা বেমালুম রেখে পুরো রাস্তাটা চলে এলেন, আমি একবার বললাম, ”দাদা ব্যাগটা লাগছে পায়ে।”

ভদ্রলোক এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, আমি তারপর আর কিছু বলতে পারলাম না। অথচ বাস বেশ ফাঁকা ছিল, উনি চাইলেই অন্য দিকে ব্যাগটা রাখতে পারতেন।

দিব্যেন্দুদা কী বুঝল কে জানে, বেশি ঘাঁটাল না, বলল, ”ওকে। চলে যা তাহলে। আমাকে আজকের আপডেটটা মেল করে দিয়ে যা, আমি ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলে নেব।”

আমি সায় দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করল না, কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে চলে এলাম কলেজ স্ট্রিটে।

বহুদিন বইপাড়ায় আসা হয়না। আগে কলেজ জীবনে ফাঁক পেলেই চলে আসতাম, প্রেসিডেন্সির দু-পাশের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াতাম।

আজকেও তেমনই ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, এমন সময় হঠাৎ পার্বণীকে দেখতে পেলাম।

যেদিন এমনিই মন ভারী হয়ে থাকে, সেদিন কি আরও বেশি করে মনকেমন করার কারণগুলো সামনে চলে আসতে থাকে?

ঘন নীল রঙের জিন্স আর একটা লম্বা গোলাপী কুর্তি পরে কফিহাউজের সামনের মোড়ে রাস্তা ক্রস করার চেষ্টা করছে পার্বণী। হাতে বেশ মোটাসোটা একটা প্যাকেট, চুলগুলো ছড়ানো রয়েছে সামনের দিকে।

পাশে একটা ছেলে।

দেখেই আমার হৃদপিণ্ডটা ধক করে উঠল। আমি আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম উলটোদিকে।

পার্বণী কলকাতায়?

মানুষের স্বভাব হল যা কিছু নিষিদ্ধ, যা কিছু এড়িয়ে যাওয়ার মতো, সেদিকেই বার বার মন চলে যায়, আর মনকে তাড়া করে চোখের দৃষ্টিও। তাই মুখ ঘুরিয়ে নিলেও আমি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার তাকালাম ওদিকে।

পার্বণী এখনো রাস্তা পার হতে পারেনি।

ওদিক থেকে একটা ট্রাম ঢং ঢং করে ছুটে আসছে, এদিক থেকে একটা হলুদ ট্যাক্সি, মাঝখানে আবার একটা হাতে টানা রিকশা ঢুকে পড়েছে। পার্বণী শক্ত করে ধরল পাশের ছেলেটার হাত।

ছেলেটার চাপ দাড়ি, চোখে রিমলেস।

পার্বণী এবার রাস্তা পেরোচ্ছে, দুদিকে তাকিয়ে ছেলেটার হাত ধরে পরম নির্ভরতায় এদিকে আসছে।

এসেই কী একটা কথা বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে ছেলেটার কাঁধে, ছেলেটাও হেসে ওর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিচ্ছে।

আমার দুম করে মনে পড়ে গেল সাড়ে পাঁচ বছর আগের পার্বণীর ছলছলে চোখে বলা কথাগুলো, ”আমি ভাবতেও পারিনি রূপ, তুই … তোরা এইরকম! আমার বাবা এতটা অপমানিত কোনোদিনও হননি!”

মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই সন্ধের কথা, যখন পার্বণী আমাকে ফোন করে বলেছিল কীভাবে আমার বাবা ওর বাবার অফিসে গিয়ে অপমান করে এসেছিলেন, অব্রাহ্মণ হয়ে আমার মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেকে ভালোবেসেছে বলে। অথচ সত্যি বলতে কী, ভালোবাসা তো দূর, আমাদের সম্পর্কটা তখনও ঠিকমতো শুরুই হয়নি।

আসলে পার্বণীর সঙ্গে প্রেমটা ঠিকমতো শুরু হওয়ার আগেই সেটাকে ভ্রূণ দশাতে নির্মমভাবে শেষ করে দিয়েছিলেন বাবা।

আমাদের আর্ট কলেজে ফাইনাল ইয়ারে একটা ওয়ার্কশপ করতে হত, সেখানেই তিনমাসের জন্য অন্য কলেজ থেকে এসেছিল পার্বণী। পার্বণী মাইতি। খুব শান্ত, ধীরস্থির মেয়ে। ওয়ার্কশপের প্রায় শেষের দিকে কোনো একটা ক্লাসে আলাপ হয়েছিল।

দুজন মুখচোরার বন্ধুত্ব হলে বেশ ভালোই এগোয়। আমাদেরও এগিয়েছিল। কিন্তু ঠিক যে সময়টায় দুজনেই মনের কথা বলব বলব করছি, কিন্তু কেউই কিছু বলে উঠতে পারছি না, ঠিক সেই সময়েই একদিন ওয়ার্কশপ সেরে বাড়ি ফেরার পথে আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন জগদীশকাকা।

আমি মনটাকে অন্যদিকে ফেরালাম। চোখ সরু করে দেখলাম পার্বণী ছেলেটার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিকোণের বাইরে।

মনে আছে, শেষদিন ও সবুজ রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছিল, সঙ্গে কাঁচা হলুদ রঙের ওড়না। আমার দিকে অপরিসীম ঘৃণা আর করুণা নিয়ে বলেছিল, ”যারা কিছু না বুঝেই নিজেদের ঠুনকো বংশমর্যাদার দোহাই দিয়ে অন্যদের অপদস্থ করতে পারে, তাদের আমি মানুষ বলে মনে করি না।” একটু থেমে বলেছিল, ”আর যারা এই অন্যায়গুলো মেনে নেয়, তারা হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কাপুরুষ। জীবনে নিজের মেরুদণ্ডে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাই তাদের নেই। রূপ, তুই একটা কাপুরুষ!”

সেদিন ওর বিদ্বেষভরা শব্দগুলোর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নড়ছিল ওর কানের সবুজ রঙের ঝুমকো দুলটা।

কতক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানিনা, চটকা ভাঙল পেছনের গুমটির দোকানদারের কথায়, ”ও ভাই, দোকানের সামনেটা ছাড়ো, একটু সরে দাঁড়াও!”

আমি চমকে পেছন ফিরলাম। দূরে তাকিয়ে দেখলাম পার্বণী কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে।

দোকানদার জুলজুল করে দেখল আমায়, ”মেডিকেল, আই আইটির কোর্স মেটেরিয়াল আছে, মাত্র দু-বছর আগের। লাগবে নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে সরে এলাম।

মাথায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। পার্বণী ঠিকই বলেছিল, আমি একটা কাপুরুষ। আমার মেরুদণ্ড নেই। হয়তো বাবা-ই আমার মেরুদণ্ডটা ছোটো থেকে সোজা হতে দেননি।

সেদিনের ওই দিওতিমা বলে মেয়েটাও ঠিকই বলেছিল, আমি একটা ক্যাবলা।

কোনোমতে একটা বাসে উঠলাম। ভাগ্য ভালো, বসার সিটও পেয়ে গেলাম।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বইপাড়ায় এসেছিলাম, পাকেচক্রে সেই ভার চতুর্গুণ হয়ে গেল।

জানলার ধারের সিটে বসে পাশ থেকে পেছন দিকে চলে যাওয়া দোকানগুলো দেখছিলাম। পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ এসে পড়ছিল গালে।

স্মৃতি যেন ক্রমশ রক্তাক্ত করে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা আমার। কর্কশ হাতে ছেঁচে রগড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে নরম অনুভূতিগুলো।

চোখ বন্ধ করে সেই নির্মম ওম অনুভব করতে করতে আমি ঠিক করে ফেললাম, সান্দাকফু আমি যাবই।

মেরুদণ্ড সোজা করার সুযোগ বারবার আসেনা।

বাবা যতই আপত্তি করুন। জিষ্ণু, রাঘব এদের কাছেও আমার সময় এসেছে নিজেকে প্রমাণ করার। বাড়িতে যা ঝড় বয়ে যায় যাক, তবু আমি কিছুতেই এই ট্যুরটা ক্যানসেল করব না। কিছুতেই না।

চোদ্দো

হাওড়া স্টেশনে নেমে আজ আর সাবওয়ের দিকে ছুটলাম না, বাঃ, আবার বাস ধরার জন্য স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম।

শরীর আর চলছে না। আজ অফিসে খুব খাটনি গেছে। সরকারের দুটো নতুন প্রকল্পের নোটিশ ইতিমধ্যেই এসে গেছে, সেগুলোর অফিস অর্ডার বের করে প্রতিটা স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, হেডমাস্টারদের সঙ্গে ফোনে মিটিং করা, স্থানীয় আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলা। আজ ঠিকমতো খাওয়ার সময়ও পাইনি।

ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। তবু কিছু করার নেই। ছবিদাদুর পরিচিত এক উকিল থাকেন পোস্তায়, সেখানে আজ দেখা করতে যেতে হবে।

সেদিন রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বুঝেছিলাম বড় বড় উকিল ধরার ক্ষমতা আমার নেই। আর শুধু বড়ই বা বলি কেন, বড়, মেজো, ছোট, কোনোরকম উকিল ধরার সাধ্যই আমার নেই। তখন একটা ঝোঁকের মাথায় ছিলাম, ইন্টারনেট খুঁজে প্রথমে নামকরা উকিলদের ফোন করেছিলাম খুব উৎসাহ নিয়ে। কিন্তু তাঁদের প্রাথমিক কনসাল্টেশন ফি শুনেই আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। তারপরে কী করব বুঝতে না পেরে ফেরত এসেছিলাম আমার অগতির গতি ছবিজেঠুর বাড়িতে।

জেঠু শুনে মাথা নেড়েছিলেন, ”ধুর! ওইসব তাবড় তাবড় উকিলের কাছে গিয়ে সর্বস্বান্ত হবি নাকি? আর তা ছাড়া এখানে উকিল আসছেই বা কোথা থেকে? তুই তো অলরেডি জনস্বার্থ মামলা করেছিস!”

”সেটা তো অন্য কারণে।” আমি রেগেমেগে বলেছিলাম, ”ওটা পুজোর ব্যাপারে, লাইসেন্সের দাবিতে। কিন্তু আমাকে যে রাস্তাঘাটে থ্রেট করছে, হুমকি দিচ্ছে, গায়ে হাত দিচ্ছে, এসব দেখে শুনেও আমি চুপ করে থাকব?”

”কেন চুপ করে থাকবি?” ছবিজেঠু বলেছিলেন, ”তোকে কি বলেছি চুপ করে থাকতে?”

”তো কি করব তাহলে?” আমি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলাম, অরূপ কাঞ্জিলালের লাল ফুলকপির মতো মুখটা বারবার মনে পড়ছিল।

এই সব পার্টির গুন্ডাদের এত সাহস কি শুধু আমাদের দেশেই হয়?

ছবিদাদু বললেন, ”তুই থানায় যাবি। থানায় গিয়ে নিজের প্রোটেকশন চাইবি। এর মধ্যে উকিল-মোক্তার আসছে কোত্থেকে!”

আমি যেন হালে পানে পেয়েছিলাম।

ছবিদাদু কথাটা ঠিকই বলেছেন। থানায় গিয়েই কাজ হবে, উকিলের তো এই ব্যাপারে কিছু করার নেই।

”ঠিক আছে। আমি তবে থানায় চললাম।” আমি সোৎসাহে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, ”এসে জানাব কী হল।”

”দাঁড়া।” ছবিজেঠুর একটা গম্ভীর গলা আছে, যেটা খুব কম শুনতে পাই। সেই কণ্ঠস্বর পেয়ে আমি পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম।

”তোর এই সব ব্যাপারে তড়বড়ানির রোগটা যতদিন না ছাড়তে পারছিস, জীবনে সফল হওয়া কিন্তু খুব মুশকিল।” ছবিদাদু গম্ভীরভাবে বললেন, ”তোকে আগেও বহুবার বলেছি। মাথা ঠান্ডা কর। এখন তুই রেগে আছিস। রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না। আর খুব খুশি মনে কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিবি না।”

আমি বললাম, ”তুমি বুঝতে পারছ না। সেদিন হাওড়া স্টেশনে ওই পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের গুন্ডাটা আমার গায়ে হাত দিল, আমি এক চড় কষিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এই এম এল এ বলল, আমি নাকি ওদের ঝন্টুকে চড় মেরেছি। তার মানে কি গুন্ডাটা ওই পুরোহিত অ্যাসোসিয়েশনের লোক নয়, পার্টির লোক?”

ছবিদাদু উঠে দাড়িয়েছিলেন, ”আমি তোর সঙ্গে থানায় যাব চল। তুই বেশি কথা বলবি না। যা বলার আমি বলব।”

কিন্তু সেদিন ছবিদাদু থানায় গিয়ে ভালোভাবে সব বুঝিয়ে বলেও কোনো লাভ হয়নি। থানায় গিয়ে প্রথমে তো পাত্তাই দিচ্ছিল না, তারপর অরূপ কাঞ্জিলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে বলা হল, ওসি সায়েব তো নেই, উনি এলে কথা বলবেন, এখন বসুন।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা বসে থাকার পর ওসি এলেন। সব শুনেটুনে পাত্তাই দিলেন না, ”আরে এতে এত চাপ নেওয়ার কি আছে? আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোনোকিছু সিরিয়াসলি নিতে পারেনা, সত্যি!” ওসি বিরক্তমুখে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, ”আরে বাপের বয়সি একটা লোক এসে আপনার ভালর জন্য বকাবকি করছে, উপদেশ দিয়েছে, এতেও আপনার সমস্যা?”

আমি কাটাকাটা গলায় বলেছিলাম, ”ভালোর জন্য হাওড়া স্টেশনে গায়ে হুমকি দিচ্ছে?”

”আহা, সে তো অন্য লোক! আর আপনিই তো উলটে তাকে চড় মেরেছেন, তিনি তো কিছু করেননি!” ওসি মাছি তাড়ানোর মতো করে হাতটা নাড়ালেন, ”তবু আমরা ব্যাপারটা দেখছি।”

আসলে কিছুই দেখলেন না। ছবিদাদুও অনেকবার অনেকভাবে বোঝালেন, কিন্তু ওসি গুরুত্বই দিলেন না ব্যাপারটায়।

এখন এই ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে গরমে সেদ্ধ হতে হতে মনে হল, ধুর! এইসব না শুরু করলেই ভালো হত। আমরা একটা সিস্টেমের জাঁতাকলে আটকে গেছি। দুর্নীতি, শোষণ আর তোষণের সিস্টেম। এই সিস্টেমের বাইরে কিছু করতে গেলেই সবাই নখ দাঁত বের করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, পিষে মারতে চাইবে অন্ধকার বাস্তুতন্ত্রের বাইরে শ্বাস নিতে চাওয়া মানুষটাকে।

মনটা আসলে দিনদিন খুব খারাপ হয়ে পড়ছে। নিজের অবচেতনেই আস্তে আস্তে যেন অবসাদের গহ্বরে ঢুকে পড়ছি। পুজো করতে চেয়েছিলাম মনের একটা খুশিতে, চিরাচরিত ধারণাগুলোকে ভেঙে ব্যতিক্রমী কিছু একটা করতে পারার উৎসাহে, লাইসেন্সের মতো একটা যোগ্যতার মাপকাঠি চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষের মনে পুরোহিত সম্পর্কে শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার জন্য।

কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ক্রমশই সেটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

একটা এসি বাস আসছিল, তাতেই উঠে পড়লাম। সাধারণত আমি এসি বাসে উঠি না। কিছুসময়ের আরামের জন্য চারগুণ কী পাঁচগুণ খরচ করার মতো বিলাসিতা আমার সাজে না। মায়ের বুকের যন্ত্রণাটা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে, পুজোর পর একবার ভেলোর নিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু আজ এত অন্যমনস্ক ছিলাম যে ওঠার আগে খেয়ালই করিনি, যখন ঠান্ডা হাওয়া অনুভব করলাম, তখন বাস চলতে শুরু করেছে।

বাসে বেশ ভিড়। কনডাক্টর ইশারায় বলল, ”দিদি একদম পেছনে চলে যান। সিট ফাঁকা আছে।”

বড় বড় হাতল ধরে করিডর দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে একদম পেছনের সিটে বসতেই পাশ থেকে কে বলে উঠল, ”ভালো আছেন?”

আমি কণ্ঠস্বরটা শুনেই চমকে গেলাম।

তাকিয়ে দেখি, ঠিক ধরেছি, মঙ্গলরূপ বলে ছেলেটা।

ঈশ! কী অস্বস্তিকর ব্যাপার! আমি মুহূর্তে গুটিয়ে গেলাম।

এই বাসেই ওকে থাকতে হল?

সেদিন ঝন্টুর ওইরকম অসভ্যতার পর মাথার ঠিক ছিল না, ফোন করে যাচ্ছেতাই বলেছিলাম মঙ্গলরূপকে। মঙ্গলরূপ কোনো উত্তর দেয়নি, প্রথমে দু-একবার মৃদু আপত্তি করছিল, শেষের দিকে চুপ করে গিয়েছিল।

পরে মাথা ঠান্ডা হতে খুব খারাপ লাগছিল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল।

ছবিদাদু ঠিকই বলেন, দুমদাম করে কোনো হঠকারী কাজ করতে নেই।

মাঝে ভেবেছিলাম একদিন ফোনও করব, কিন্তু এতকিছুর ডামাডোলে ভুলে গেছি।

আমি অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললাম, ”আরে আপনি! হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

মঙ্গলরূপ হাসল, ”ভালো।”

পেছনের সিটে বসলে ঝাঁকুনি বড়ো বেশি হয়। হাওড়া ব্রিজে ওঠার আগেই ক’টা বড়োসড়ো ঝাঁকুনিতে আমি প্রায় ঢলে পড়লাম ওর গায়ে।

তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ”ইয়ে, দেখুন, সেদিন আপনাকে ফোনে অনেক কিছু আজেবাজে বলে ফেলেছিলাম। আসলে তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। পরে ভেবেছিলাম আপনাকে ফোনও করব, আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি খুব লজ্জিত।”

মঙ্গলরূপ হাসল।

এত কাছ থেকে ওকে আগে দেখিনি। আজ লক্ষ্য করলাম, ছেলেটার চোখগুলো খুব বড় বড়, চোখের পাতাগুলো এত ঘন যে মনে হয় সরু কোনো কাজল পরেছে হয়তো।

আমি আবার বললাম, ”আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

মঙ্গলরূপ বলল, ”আমি কিছু মনে করিনি ম্যাডাম। আপনার ওপর দিয়ে কী ঝড় যাচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি।” কনডাক্টর আসতেই পকেট থেকে নোট বাড়িয়ে ধরল ও, ”তিনটে।”

”এমা না না!” আমি বাধা দিয়ে উঠলাম, ”আপনি কাটছেন কেন? আপনার কাছে খুচরো আছে।”

মঙ্গলরূপ স্মিত হাসল, ”খুচরো আপনার কাছেই রেখে দিন, পরে দরকার পড়বে। আমার সঙ্গে এমনিতেই একজন আছে, সামনের লেডিজ সিটে বসেছে, আমি একবারে কেটে নিচ্ছি।”

আমি হাসলাম। হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে বাস। নিস্তরঙ্গ গঙ্গার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে বিশাল বিশাল ভেসেল, স্টিমার। দূরের অফিসপাড়ার উঁচু উঁচু বাড়িগুলোতে একে একে জ্বলে উঠছে আলো। অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় হুগলি সেতু।

এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরের ঘামটা আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যাচ্ছিল, আরামে বন্ধ হয়ে আসছিল চোখের পাতা।

আমি বললাম, ”আপনি কী করেন? মানে চাকরি না অন্য কিছু?”

মঙ্গলরূপ হেসে বলল, ”আপনি আগের দিন যাকে কমল মিত্র বললেন, সেই বসন্ত ভট্টাচার্য, মানে আমার বাবার তো হার্ডওয়্যারের ব্যবসা, আমাদের দোকান আছে হাওড়া ময়দানে। কিন্তু আমি ব্যবসাট্যাবসা কিছু দেখি না।”

”তাহলে? চাকরি করেন?” আমি প্রশ্ন করলাম, ”কোথায়?”

মঙ্গলরূপ এবার হাসল, ”আমি একটা অ্যাড এজেন্সিতে আছি, আর্টিস্ট। চাকরিটা কিছুদিন হল করছি। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আগে একটা ফাইন আর্টস গ্যালারিতে ইন্টার্নশিপ করেছিলাম, এখন এখানে আছি।”

আমি অবাক হলাম, ”আর্টিস্ট! মানে আপনি আঁকেন?”

মঙ্গলরূপ এবার লজ্জায় চোখ নামাল, ”ওই আর কি! ছোটখাটো চাকরি, আপনার মতো সরকারি ছাপ নেই।”

আমি ছেলেটার লজ্জায় বেশ মজা পাচ্ছিলাম, ”আমি আপনার মতো অত গুণী নই মোটেই, সংস্কৃত নিয়ে কোনোমতে বিএ পাশটুকু করেছি।”

মঙ্গলরূপ ভ্রূ দুটো পড়ে তুলে কপট ভয়ের ভঙ্গি করল, ”ও বাবা! সংস্কৃত! সে তো ভারী শক্ত বিষয়! সেই নরঃ নরৌ নরাঃ। আমি জীবনে কোনোদিন ষাটের বেশি পাইনি সংস্কৃতে।”

”কিছুই শক্ত নয় সেরকম।” আমি হেসে বললাম। অনেকদিন পর দুশ্চিন্তা, অবসাদ সব ভুলে নিছক হাসছিলাম, ছেলেটা সংস্কৃত শুনে এমন মুখভঙ্গি করল! বললাম, ”এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?”

”আমার এক বন্ধুর বাড়ি। একটা দরকার আছে।” মঙ্গলরূপ বলল, ”আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

”আমিও একটা কাজেই যাচ্ছি।” আমি বললাম, ”আচ্ছা, আপনাদের ওই অ্যাসোসিয়েশনে সবাই তো পুরোহিত, মানে পুজোর সঙ্গে যুক্ত?”

”হ্যাঁ। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রায় চল্লিশ হাজার পুরোহিত আমাদের সদস্য।” মঙ্গলরূপ বলতে শুরু করল, ”আসলে আমাদের বাড়ি আন্দুলে। সেখানকার চণ্ডীবাড়ির পুজো শুধু হাওড়া জেলা নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পুজো। প্রায় বারো পুরুষ ধরে চলে আসছে ঐ পুজো। এছাড়া হাওড়াতে আমাদের এখনকার বাড়িতেও পুজো হয়। আমার বাবা পুরো ব্যাপারটা দেখেন। তার সঙ্গে ওই অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট পদও সামলান। তবে, আমি কিছুই করি না বলতে গেলে।” মঙ্গলরূপ হাসল, ”আমি আঁকাজোকা নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি।”

”ওই অ্যাসোসিয়েশনের কাজটা কী?” আমি প্রশ্ন করলাম।

মঙ্গলরূপ বলল, ”প্রধান কাজ হল যাদের প্রধান জীবিকা পৌরোহিত্য, তাঁদের হয়ে কথা বলা। গ্রামে গঞ্জে প্রচুর পুরোহিত আছেন, যাদের সারাবছরের প্রধান রোজগার হল দুর্গাপুজোর সময়, এবার ধরুন কোনো ক্লাব পুজো করিয়ে ন্যায্য প্রণামী দিল না। সেক্ষেত্রে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন কথা বলবে, এইরকম আর কী। প্রতিটা জেলায় আমাদের লোক আছেন। তারা সবার খেয়াল রাখেন। বছরে দু-বার সম্মেলন হয়।”

আমি মাথা নাড়লাম, ”বুঝলাম। কিন্তু ওই ঝন্টু মল্লিক আপনাদের সংগঠনের সদস্য, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। ও ও কি পুজো করে?”

মঙ্গলরূপ এবার চুপ করে গেল।

”আচ্ছা,” আমি আবার বললাম, ”আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন তো, মতের অমিল হওয়ার জন্য একটা মেয়ের সঙ্গে রাস্তাঘাটে অশালীন আচরণ করা, হুমকি দেওয়া, এগুলো কি ঠিক?”

”অশালীন আচরণ?” মঙ্গলরূপ যেন সত্যি অবাক হয়ে গেল, ”মানে? কে অশালীন আচরণ করেছে? কার কথা বলছেন?”

”আপনাদের ওই ঝন্টু। সেদিন হাওড়া স্টেশনে আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল।” আমি ঠোঁট কামড়ালাম, ”তারপরেই তো আমি আপনাকে ফোন করে আজেবাজে বললাম। আপনি কিছু জানতেনই না?”

মঙ্গলরূপের চোখমুখ যেন আচমকাই শক্ত হয়ে উঠল, আমি খেয়াল করলাম। ও বলল, ”আমি কিচ্ছু জানিনা তো! বাবাও জানেননা।”

আমি বললাম, ”তবে আমিও ছাড়িনি। দিয়েছি ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড়। তাই নিয়েও আমাকে পার্টির লোকেদের কাছে হুমকি শুনতে হচ্ছে। আপনি সত্যি করে বলুন তো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনার বাবা কি ঝন্টুর কাজকারবার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন?”

মঙ্গলরূপ মাথা নাড়ল। একটু গম্ভীর হয়ে গেল, মুখে কিছু বলছে না, কিন্তু কিছু একটা চিন্তা করছে।

ওদিকে লাস্ট স্টপেজ এসে গেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম, ”যাই হোক আসি। ভালো থাকবেন। আর সেদিনের ব্যাপারটার জন্য আরও একবার ক্ষমা চাইছি।”

মঙ্গলরূপ সচকিত হয়ে বলল, ”নানা ঠিক আছে।” তারপর এগিয়ে এসে লেডিজ সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, ”আলাপ করিয়ে দিই। এ হল সুরবীণা। ওর সঙ্গেই আমি একটা কাজে যাচ্ছি। সুরবীণা, ইনি দিওতিমা।”

এই আকস্মিক ঘটনার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। ততক্ষণে আমি বিনিকে দেখতে পেয়ে গেছি।

বিনিও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে।

আমি পরিস্থিতি হালকা করতে বিনির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও নিমেষের মধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে বাস থেকে নামতে নামতে মঙ্গলরূপের দিকে তাকিয়ে একটু রুক্ষস্বরে ও কথা ছুঁড়ে দিল, ”তুমি কি আসবে?”

মঙ্গলরূপ বিনির এমন অপ্রত্যাশিত ব্যবহারে সম্ভবত একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ”আচ্ছা আসি। আবার দেখা হবে।”

ওরা চলে যেতে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার হাসিখুশি মেজাজটা আবার মেঘলা হয়ে গেছে।

কিসের জন্য জানিনা, বিষাদে ভরে যাচ্ছে ভেতরটা।

সেদিনের বিনির মুখে শোনা সেই সম্বন্ধের পাত্র তাহলে এই মঙ্গলরূপ? বিরক্তিতে আমার মুখটা কেমন সিঁটকে গেল, পরক্ষণেই আমি নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম, আশ্চর্য! কে কাকে বিয়ে করছে, তাই নিয়ে আমার কি?

সত্যিই তো।

আমি নিজেই নিজেকে উত্তর দিলাম, বিয়ে করছে করুক না। কিন্তু আমার ছোটবেলার বন্ধু হয়ে বিনি কী ব্যবহারটা করল আজ আমার সঙ্গে? সেদিন ওরও হয়তো মেজাজ খারাপ ছিল, আমারও, ও-ও দুটো কথা বলেছে, আমিও বলেছি।

তাই জন্য আজ এমন অপমান করল?

আমি নিজের মনেই একটা অবজ্ঞার হাসি হাসলাম। ভালো তো! মঙ্গলরূপদের নিশ্চয়ই অনেক পয়সা, বনেদি বংশ যখন। আর বিনিদের বাড়িও তাই, ওদের তিন-চারটে বাস চলে রুটে। যদিও শিক্ষা নেই একফোঁটাও। যাই হোক, বিনি বড়বাড়ির বউ হবে, সব বড়বড় ব্যাপার। আমার মতো গরিব মেয়েকে পাত্তা দিতে যাবে কেন?

মঙ্গলরূপ ছেলেটা খারাপ নয়, আমি নিজের মনেই স্বীকার করলাম। সভ্যভদ্র, শিষ্টাচার বোধও আছে।

কিন্তু আজকের পর বিনি নিশ্চয়ই ওকে আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখতে বারণ করে দেবে, আর মঙ্গলরূপও নিশ্চয়ই একটা সামান্য পরিচয় হওয়া মেয়ের জন্য নিজের ভাবী স্ত্রীকে চটাতে চাইবে না।

মরুক গে যাক! একটা ইটের ঢেলায় পা-টা বেকায়দায় পড়তেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম। তারপর শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে লাথি কষালাম ওই ঢেলাটায়।

একটু দূরে লাফিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা।

পনেরো

আবীর মুখ থেকে একটা লম্বা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ”দ্যাখ ভাই, এই সুরবীণা হল রূপের বোন। তার মানে হল গিয়ে আমাদেরও বোন। তোর বোনের সঙ্গে যদি কোনো শালা এরকম করত, তুই তাকে ছেড়ে দিতিস?”

মন্টে ওর হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসল, ”প্রশ্নই ওঠে না। তোরা ভালো ছেলে ছিলিস, আমাদের সঙ্গে তেমন মিশতিস না। কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, আমি যতদূর তিলককে জানি, ও কিন্তু এমন ছেলে নয়।”

আমি এবার মুখ করলাম, ”এমন ছেলে নয় তো এইরকম হুমকি দিচ্ছে কেন? কত টাকা চেয়েছে জানিস? ত্রিশ লাখ।”

মন্টে এবার মাথা চুলকোল, ”আজব লাগছে মাইরি শুনে। আমার সঙ্গে সেদিনও দেখা হল, কিচ্ছু বলল না।”

পোস্তার যে বিবেকানন্দ ফ্লাইওভার বছরকয়েক আগে ভেঙে পড়েছিল, মারা গিয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ, সেই ফ্লাইওভারের সামনেই একটা দোকানে বসে আমরা কথা বলছিলাম।

আমরা মানে, আমি, বিনি আর আবীর।

আমি আর বিনি একটু আগে বাস থেকে নেমে এখানে এসেছি, আবীর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, ও-ই রাস্তা চিনিয়ে মন্টের দোকানে নিয়ে এসেছে।

মন্টেও আমাদের স্কুলে ইলেভেন টুয়েলভ পড়েছিল কমার্স নিয়ে। বিনিকে রাজতিলক বলে যে ছেলেটা হুমকি দিচ্ছে, মন্টে তার বন্ধু। এখনো নাকি ওদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ আছে।

মন্টে ছেলেটাকে স্কুলে কোনোদিনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমাদের হাওড়া জেলা স্কুলে অনেক দূরদূরান্ত থেকেও ছাত্র পড়তে আসত, মাধ্যমিকের পর আরও বেশি। আসলে অনেক রকমের সাবজেক্ট কম্বিনেশন নেওয়া যেত আমাদের স্কুলে। এই মন্টে, রাজতিলক এরাও ছিল তেমনই সব পরিযায়ী পাখি। মন্টের বাবার এই শাল রিপেয়ারিং এর বহু পুরোনো দোকান এখন মন্টেই চালায়।

বিক্রিবাটা যে তেমন নেই, তা দোকানের হাল দেখলেই বোঝা যায়। তাই মন্টে আবার দোকানে ফোনের রিচার্জও করে।

আবীর চিরকালই একটু নেতা গোছের, ও বলল, ”শোন মন্টে, তুই তোর ওই তিলককে বোঝা। যে মেয়ের সাথে ওর ঠিক করে কোনো রিলেশনই হয়নি, তাকে এরকম ব্ল্যাকমেল করছে। আমরা এখনো অল্পেতে মিটিয়ে ফেলতে চাইছি, এরপর থানা পুলিশ হলে কিন্তু কোমরে দড়ি দিয়ে জেলে নিয়ে যাবে।”

মন্টে বলল, ”তোরা বলছিস কোনো রিলেশনই হয়নি ওদের মধ্যে। তা কিছুই যখন নেই, তখন এত ভয়ের কী আছে আমি তো বুঝছি না। পাত্তা না দিলেই হল। কিছুই করতে পারবে না।”

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বিনি মুখ খুলল। একটু ইতস্তত করে বলল, ”দেখুন মন্টেদা, আমি নিজেও জানি, রাজতিলকও জানে। আমাদের মধ্যে ছ’-সাত মাসের একটা হালকা সম্পর্ক ছিল।” সামান্য থামল বিনি, ”হ্যাঁ, আমরা একবার ডায়মন্ড হারবার গেছিলাম। কিন্তু কোথাও থাকিনি, ভোরে গিয়ে রাতে ফিরেছি।”

”তাহলে প্রবলেমটা কী?” মন্টে রীতিমতো বিভ্রান্ত।

বিনি এবার একটু ইতস্তত করল, তারপর বলল, ”আ-আমাকে কিছু ছবি ইমেল করেছে তিলক, যেগুলো আমার ছবি, কিন্তু আমার নয়।”

”তোর ছবি কিন্তু তোর নয় মানে?” আমি অবাক হলাম এবার। এই ব্যাপারে বিনি আমাকে কিছু বলেনি আগে।

”মানে মুখটা আমার, শরীরটা নয়।” বিনির চোখদুটো জলে ভরে গেছে, ”আমার মুখটা একটা নোংরা ছবির ওপর বসানো হয়েছে। মেলে লেখা আছে, সুপ্রতিমের ঠিকানা, ফোন নম্বর সব ও জানে, টাকাটা না দিলেই ছবিটা পাঠিয়ে দেবে।”

”এটা তো সাইবার ক্রাইম!” আবীর একবার উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে তাকাল, ”এখুনি থানায় রিপোর্ট করা উচিত!”

আমিও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লাম। ব্যাপারটা যে আর লঘু নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে। প্রায়ই কাগজে পড়া খবরগুলো চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠতে দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। এতক্ষণ অতটা গুরুত্ব দিইনি, রাজতিলক বলে ছেলেটার কথাগুলোকে ফাঁকা আওয়াজ মনে হচ্ছিল। বিনি আমার বোনের বন্ধু, ও আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল, সেই ব্যাপারে আমি ওকে হেল্প করছিলাম।

ভেবেছিলাম বন্ধুদের দিয়ে ছেলেটার সঙ্গে কথা বললেই ব্যাপারটা মিটে যাবে।

কিন্তু এবার মনে হচ্ছে বিনির সামনে সত্যিই বিপদ।

আমি বিনিকে বললাম, ”থানাতেই তো যাওয়া উচিত মনে হয় রে বিনি। এগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া একদম ঠিক নয়।”

আবীর থানার নাম উল্লেখ করা অবধি বিনির মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল। এবার ও পরিষ্কার ককিয়ে উঠল, ”না! থা-থানায় গেলে সুপ্রতিমের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা আর টিকবে না। বিয়েটাও ভেঙে যাবে। ওদের পরিবার এমনিই গোঁড়া।”

”কেটে যাবে তো যাবে।” আবির ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”তাই বলে তো আর একটা ক্রিমিন্যালকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না!”

”আপনি বুঝতে পারছেন না আবির দা।” বিনি এবার খুব কিন্তু কিন্তু করতে লাগল, ”আমার বাবার শরীর ভালো নয়। আমাদের পরিবারও একটু গোঁড়া, মেয়েদের বেশিদিন রাখা হয় না বাড়িতে। আর আমার বিয়ে না হলে বোনের বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই সম্বন্ধটা চলে এলে আর ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। বাবা পুরো ভেঙে পড়বেন।”

”ওফ সেই মান্ধাতার আমলের কথাবার্তা!” আবির বিরক্ত হয়ে বলল, ”মেয়ে মানেই বোঝা, এই কনসেপ্টটা এই যুগের মেয়ে হয়েও মাথা থেকে বের করতে পারছ না কেন? বিয়েটাই কি সব নাকি? চাকরি বাকরি করো, নিজের পায়ে দাঁড়াও। তারপর নিজের পছন্দমতো বিয়ে করবে। এখনকার মেয়েরা কত এডভান্সড, আর তোমরা বিয়ে বিয়ে করে হেদিয়ে মরছ।”

”আমাদের বাড়িতে মেয়েদের চাকরি করার নিয়ম নেই। আর ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়।” বিনি এতক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।

”কেন সহজ নয়? আবির তো ঠিকই বলছে।” এবার মন্টে নাক গলাল, ”আপনি তিলকের ফালতু হুমকিতে পাত্তাই দেবেন না। এই সম্বন্ধ টেকার হলে টিকবে, নাহলে পরে আরও ভালো সম্বন্ধ আসবে, মিটে গেল।”

বিনি এবার আমাদের সবার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে নিল, তারপর একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল, ”আমরা দু-বোন। মা ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। আমি আর আমার বোন রিনি। আমাদের ট্রান্সপোর্টের বিজনেস, বাবাই পুরোটা দেখতেন। এখন অত্যধিক হাঁপানির জন্য দিনরাত কষ্ট পান বলে খুড়তুতো দাদারা দেখে। আমার প্রায় তিন বছর ধরে অনেক সম্বন্ধ আসছিল, কিন্তু সবই একে একে ভেঙে যাচ্ছে। বোনেরও বিয়ে হচ্ছে না এই জন্য।”

”কেন?” মন্টে উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো, ”মানে, কারণটা কী? আপনাকে দেখতে তো ভালোই, শিক্ষিতা ভদ্র পরিবারের মেয়ে!”

বিনি এবার মাথাটা নামিয়ে নিল, তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ”আমার সারা শরীরটাই আস্তে আস্তে শ্বেতীতে ভরে যাচ্ছে। শুধু মুখটাই কোনো কারণে বাকি আছে।” গলায় মাফলারের মতো পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা খুলে দিল ও।

সঙ্গে সঙ্গে ধবধবে বিনির গলার রক্তহীন ফ্যাসফেসে সাদা চামড়াটা যেন ওকে নির্মম উপহাস করে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল।

আমার মনটা এমনিতেই নরম, তার ওপর বিনির অসহায়ভাবে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মনটা আর্দ্র হয়ে উঠছিল।

এইজন্য মেয়েটা সবসময় গলাটা ঢেকে, ফুল হাতা জামা পরে থাকে?

বিনি বলে যাচ্ছিল, ”আমার বিয়ে না হলে রিনিরও হবে না। তাই বাবা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছেন। এর আগে দু-একজন পছন্দ করেছিল। কিন্তু তারা সবাই দোজবরে পাত্র, তার ওপর মোটা টাকা পণ চায়। তাদের আসল লোভ বাবার টাকার ওপরে।” বিনি মাথা নীচু করল, ”এই সুপ্রতিমদের বাড়িই একমাত্র ব্যতিক্রম। ওরা একটু পুরোনোপন্থী হলেও সুপ্রতিম নিজে সমাজের ভালো কাজে যুক্ত থাকে। ওরা একটা টাকাও চায়নি।”

”বুঝলাম।” আবীর বলল, ”আর এই রাজতিলক মালটা সুপ্রতিমের ডিটেইল জোগাড় করে তোমার কাছে টাকা চাইছে, নাহলে তোমার ওই মর্ফ করা ছবিগুলো সুপ্রতিমের কাছে পাঠিয়ে দেবে তাই তো?”

”হ্যাঁ।” বিনি ফোঁপাচ্ছিল, ”বাবা অত কিছু বুঝবেন না, ভাববেন আমারই সব দোষ। এই সম্বন্ধটাও ভেঙে গেলে বাবাকে আর বাঁচানো যাবে না। এর আগে একবার স্ট্রোক হয়ে গেছে।”

”পুলিশ যদি তোর পরিচয় গোপন রেখে রাজতিলককে ধরে?” আমি জিজ্ঞস করলাম।

”পুলিশে জানাজানি হলে সুপ্রতিম তো জানবেই, তাহলে এই বিয়েটাও ভেঙে যাবে।” বিনি কাতর স্বরে বলল, ”আমি দু-দিন ধরে অনেক কিছু ভেবেছি। রাজতিলক ত্রিশ লাখ টাকা না দিলে বলছে সুপ্রতিমকে সব জানিয়ে দেবে। সুপ্রতিমদের তেলের কল আছে, এ ছাড়া প্রোমোটারিও করে। বলেছে বিয়ের পর বাবার চিকিৎসার জন্য সব দৌড়ঝাঁপ ও-ই করবে। তাই এই বিয়েটা হলে আমাদের আর কোনো চিন্তা থাকবে না।” বিনি এবার মন্টের দিকে তাকাল, ”মন্টেদা, আপনি তিলককে বলুন, ত্রিশ লাখ টাকা পারব না, কিন্তু কুড়ি লাখ টাকা আমি ওকে দেব। ও যেন প্লিজ ছবিগুলো মুছে ফেলে!”

আবীর এবার কড়া গলায় বলল, ”মানেটা কী? এটাতে তো ও মজা পেয়ে যাবে, আবার কোনো মেয়ের সঙ্গে এমন করবে।”

আমি আবীরের কোথায় সায় দিয়ে বললাম, ”ঠিকই তো! আর তা ছাড়া কুড়ি লাখ টাকাই বা তুই কোথায় পাবি? কাকাবাবুকে তো জানাতেই হবে তোকে।”

”আমাদের দু-বোনের নামে বাবা কুড়ি লাখ টাকা করে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছেন ব্যাঙ্কে, সেটা আমি একাই তুলতে পারব। ওটাকেই ভাবছি …!” বিনি বলল, ”আপনি প্লিজ কুড়ি লাখে রাজি করান ওকে মন্টেদা!”

আধঘণ্টা বাদে মন্টের দোকান থেকে বেরিয়ে বিনি বলল, ”আমার সুপ্রতিমের সঙ্গে দেখা করার আছে রূপদা। তুমি চলে যাও বরং।”

আমার বিরক্ত লাগছিল। বললাম, ”আচ্ছা। কী হল তোকে মন্টে জানিয়ে দেবে।”

বিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইল, তারপর বলল, ”তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানিনা রূপদা! আমার জন্য এত কিছু করছ!”

”না না, কিই আর করতে পারলাম!” আমি তেতো মনে বললাম, ”তুই মেনে নিচ্ছিস ব্যাপারটা, এটাই খারাপ লাগছে। ছেলেটার একটা কড়া শাস্তির দরকার ছিল।”

”ছাড়ো। কিন্তু টিকলিকে কিছু বোলো না রূপদা। ওর চোখে নিজেকে আর ছোটো করতে চাই না।” তারপর কী একটা মনে পড়তেই বলল, ”আচ্ছা, দিওতিমাকে তুমি কীভাবে চিনলে?”

”ওই, পুজো নিয়ে ও মামলা করেছে না? সেই ব্যাপারে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একটু খটাখটি …।” আমি বললাম।

”বুঝেছি।” মুখ বেঁকাল বিনি, ”সস্তা প্রচারের জন্য পাগল হয়ে গেছে। হু! যাই হোক, আমি যাই।”

বিনি চলে যাওয়ার পর আমি আনমনে হাঁটছিলাম।

রাজতিলকের পুরো ঘটনাটাতেই কেমন যেন আশ্চর্য লাগছে। আমাদের জেলা স্কুলের একটা ছেলে এতটা খারাপ ভাবতেই নিজের ওপরও কেমন যেন লজ্জা হচ্ছে।

কী মনে হতে আবীরকে একটা ফোন করার জন্য মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতে তার আগেই একটা ফোন এল।

স্ক্রিনে দেখি জিষ্ণুর মুখ। রিসিভ করে বললাম, ”বল।”

”শোন, তোর ভোটার কার্ড, আধার কার্ড সব কিছু নিয়ে নিবি। ওখানে পারমিট করতে হবে, তখন লাগবে।”

”সে না হয় হল।” আমি বললাম, ”কিন্তু আমরা শেষপর্যন্ত কে কে যাচ্ছি? রাঘব তো বললি যেতে পারবে না, ওর কী কাজ পড়ে গেছে।”

জিষ্ণু কেজো গলায় বলল, ”হ্যাঁ। ওটা তোরই মতো, চিরকালের ঝোলানো পার্টি। চারজন যাচ্ছি। আমি তুই গৈরিক আর চিরন্তন। মঙ্গলবার রাতে ট্রেনে উঠব। তুই একটু কাকিমাকে বলিস তো, সেই ডুমো ডুমো করে কেটে সাদা আলুর চচ্চড়িটা যেন বানিয়ে দেয়। লুচিটা আমার বাড়ি থেকে নিয়ে যাব।”

ফোনটা রেখে দিয়ে আমার মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল। জীবনে প্রথমবার পাহাড় দেখব, জীবনে প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাব। দূরের গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আজ বাসে দেখা হওয়া দিওতিমাকে মনে পড়ে গেল।

সত্যিই, আজ মেয়েটা যেন পুরো অন্যরকমভাবে কথা বলছিল। আগের দিন হাইকোর্টের সেই রণচণ্ডী মূর্তির সঙ্গে যেন কোনো মিলই নেই।

আমার মনের আনন্দের সাথে তাল মিলিয়েই বোধ হয়, হঠাৎ দেখলাম এই ভ্যাপসা গরমের মাঝে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। যাক, পুজোর আগে বৃষ্টিটা হয়ে যাক বাবা, পুজোটা বরবাদ না করলেই হল।

আমার সঙ্গে ছাতা নেই, তবু থামলাম না।

বাসেও উঠলাম না।

হাওড়া ব্রিজের ফুটপাথ দিয়ে হালকা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলাম আমি।

ষোলো

মা যখন কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন করল, তখন আমি অফিস থেকে সবে বেরিয়েছি।

মা আমার ‘হ্যালো’ শুনেই বলল, ”তুই কোথায়?”

”এই তো অফিস থেকে বেরোলাম। হাঁটছি। বাস ধরব।” আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ”বলো।”

মা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ”অলোকদা ফোন করেছিল আমায়।”

আমি চুপ করে গেলাম। তার মানে মা-র কাছে আর কিছুই অজানা নেই। অলোকমামা ইতিমধ্যেই খবরটা জানিয়ে দিয়েছে মা-কে।

অবশ্য জানানোটাই স্বাভাবিক। আমার এই সব ঝামেলা শুরু হওয়ার সময় থেকেই মা অলোকমামাকে বলে রেখেছে সব খবর জানাতে। আর আজ তো অফিসে সারাদিন এই আলোচনাতেই ব্যস্ত ছিল সকলে।

আমাদের বাগনান এক নম্বর ব্লকের অফিসেই পিওনের কাজ করে অলোকমামা। খন্যানে মা-দের বাড়ির পাশেই থাকত অলোকমামা। মা-র ছোটবেলার পাড়াতুতো দাদা। এখানে আমি জয়েন করার পর কথায় কথায় যখন সম্পর্কটা বেরিয়ে গিয়েছিল, তারপর একদিন গিয়েছিল আমাদের বাড়ি।

তারপর থেকেই পুরোনো দাদা-বোনের সম্পর্ক জেগে উঠেছে এখন মা-র সাথে প্রায়ই অলোকমামার টুকটাক ফোনে কথা হয়।

আমি বললাম, ”আচ্ছা। কী বলল অলোকমামা? আমি তো যখন বেরোলাম, তখন দেখলাম খবরের কাগজ পড়ছে।”

মা খিঁচিয়ে উঠল, ”কী বলল বুঝতে পারছিস না? খবরটা কি সত্যি? তোর … তোর ট্রান্সফারের চিঠি এসেছে?”

বাস এসে গিয়েছিল, আমি এক হাতে মোবাইলটা সাবধানে ধরে বাসে উঠে পড়লাম।

চোখটা হঠাৎ কেমন জ্বালা করে উঠল।

আর এই রুটে যাতায়াত করতে হবে না, আর ছুটতে ছুটতে হাওড়া থেকে ট্রেনও ধরতে হবে না।

প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিল কোনো গণ্ডগ্রামে চলে এসেছি। কিন্তু আজ … মনটা খুব খারাপ লাগছে, নস্ট্যালজিয়ায় ভরে উঠছে ভেতরটা।

গলার কাছে কী একটা দলা পাকাচ্ছে।

শান্তভাবে মা-কে বললাম, ”হ্যাঁ মা। আমার দার্জিলিঙে ট্রান্সফার হয়েছে। আজই চিঠি এসেছে।”

মা প্রায় চিৎকার করে উঠল, ”কী বলছিস তুই? দার্জিলিং? এত দূরে …এরকম হঠাৎ করে … তোদের তো চার-পাঁচবছরের আগে ট্রান্সফার হয় না বলেছিলি!”

”বাড়ি যাই। গিয়ে কথা বলছি।” আমি ফোন রেখে দিলাম।

মা-র বলা কথাগুলো মনে করতে করতে নিজের অজান্তেই আমার মুখে একটা ম্লান হাসি জেগে উঠল।

মা কথাটা ভুল কিছু বলেনি। আমার বাগনানে মাত্র এগারো মাস চাকরি হয়েছে, এত তাড়াতাড়ি কারুর ট্রান্সফার হয় না। তার ওপর মেয়েদের তো এতদূরে কখনোই পাঠায় না।

তাই অফিসে কাজের মাঝে আজ বেলা এগারোটা নাগাদ ট্রান্সফার অর্ডারটা আসতে সত্যিই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।

আমাকে তিনদিনের মধ্যে দার্জিলিঙের পুলবাজার ব্লকে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল অর্ডারে। আমি তখন রীতিমতো দিশেহারা।

অফিসের মদনদা, তপোজ্যোতিদা, অলোকমামা প্রত্যেকেই অবাক। সবার মুখেই এক কথা, ”এরকম তো হয় না জেনারেলি! বিশেষ করে মেয়েদের তো …!”

‘জেনারেলি’ শব্দটা যে আমার জন্য প্রযোজ্য নয়, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। ঝন্টু আর অরূপ কাঞ্জিলালের কেসটার পর থেকে বিপদের আশঙ্কা তো করছিলামই, তবে আঘাতটা যে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে, আমার চাকরির দিক দিয়ে আসবে এটা আমি আন্দাজ করতে পারিনি।

আধঘণ্টার মধ্যেই ফোনটা এসেছিল। ওপাশ থেকে অরূপ কাঞ্জিলাল বলেছিল, ”তোমাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তোমার ভালোর জন্যই কোনো স্টেপ নেওয়ার আগে গিয়েছিলাম তোমার বাড়ি। কিন্তু নিজের দোষে তুমি সেই মর্যাদাটা রাখলে না।”

আমি একটা উত্তরও দিইনি। ঘৃণায় জ্বলছিল মন। যারা সম্মুখসমরে সুবিধা করতে না পেরে পেছন থেকে ছুরি মারে, তাদের কী বলব?

অরূপ কাঞ্জিলাল সম্ভবত আমার অনুনয় বিনয় আশা করেছিল। কিন্তু এপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে তখন গলাটা সামান্য নরম করেছিল, ”এখনো সময় আছে দিওতিমা। তোমার মতো এমন অনেক ছেলেমেয়ে আমি দেখেছি। যদি কেসটা সময়মতো তুলে নাও, যদি আর মিডিয়ার সামনে মুখ না খোল, একমাসের মধ্যে পুলবাজার থেকে নিয়ে আসব। নাহলে ওই গন্ডগোলের জায়গায় কিন্তু পচতে হবে। দু-দিন অন্তর ওখানে গোর্খাদের আন্দোলন লেগেই আছে।”

”শুনুন মি. কাঞ্জিলাল।” আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়েছিলাম, তারপর বলেছিলাম, ”আমি সরকারের কর্মচারী, আপনার নই। আমার অফিস আমাকে যেখানে ট্রান্সফার করবে, আমি সেখানেই যাব। আপনার আর কিছু বলার না থাকলে ফোনটা রাখতে পারেন। আমার কাজ আছে।”

কনডাক্টর টিকিট চাইতে আমি বর্তমানে ফিরে এলাম। মা-র সামনে যতই নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে চেষ্টা করি, বুকের ভেতরটা থেকে থেকেই কেমন শিউড়ে উঠছিল, ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। জীবনে অনেক লড়াই করেছি, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকতে হয়নি।

তার ওপর এত দূর!

ছবিদাদু ফোনে সব শুনে মৃদু হাসলেন, বললেন, ”দুনিয়ার আদিমতম নোংরা রাজনীতি। সেই রাজারাজড়ার আমল থেকে চলে আসছে। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুঝতে না পারলেই তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দাও।”

এদিকের রাস্তা খুব খারাপ, অন্যদিন ঝাঁকুনিতে সিটের সঙ্গে লাফাতে লাফাতে বিরক্তিতে কুঁচকে যায় আমার মুখ, কিন্তু আজ আর ততটা খারাপ লাগছিল না ঝাঁকুনিগুলো।

হাতল ধরে নিজেকে ব্যালান্স করতে করতে ফোনটা কানে চেপে ধরে বললাম, ”কী হবে তাহলে দাদু? আমার পুজো করার ব্যাপারটা তো পুরো শেষ হয়ে গেল।”

”কেন শেষ হয়ে যাবে?” দাদু যেন অবাক হলেন আমার কথায়, ”দার্জিলিং কি বাংলার বাইরে নাকি? তুই তোর চেষ্টা চালিয়ে যাবি। কোর্টে শুনানি চলুক, শনি রবিবার বাড়ি চলে আসবি। তা ছাড়া আমি তো আছিই।”

সারাটা রাস্তা আর কাউকে ফোন করলাম না। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।

দুম করে একরকম অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্মৃতিতে ফিরে এল সেদিন পোস্তায় ছবিদাদুর চেনা উকিলের কাছে যাওয়ার সময়টা।

মঙ্গলরূপ ছেলেটাকে আগের দিন ফোনে ওরকম বলেছিলাম বলে বেশ খারাপ লাগছিল, তাই সেদিন বাসে বেশ মন খুলে কথা বলছিলাম। ছেলেটার সম্পর্কে ওদের দলের লোকেরা যতই ক্যাবলা, গোবর এইসব বলুক, মানুষ হিসেবে যতদূর মনে হয়েছে ভালোই।

কিন্তু বিনির সঙ্গে যে ওরই বিয়ের ঠিক হয়েছে, এটা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি।

যেদিন বিনির সঙ্গে ঝগড়া হল, বিনি কথায় কথায় বলেছিল, ওর শ্বশুরবাড়ির লোক নাকি এসে ওকে রুটি গোল হয় কিনা জিজ্ঞেস করেছে। হতেই পারে। মঙ্গলরূপের বাড়ি তার মানে খুব প্রাচীনপন্থী। ভালোই মিল হবে, যেমন দ্যাবা তেমন দেবী।

বিনিদের বাড়িও তো ওইরকমই।

আমার হঠাৎ করে কেন জানিনা, বিনির ওপর খুব রাগ হতে লাগল। বাড়ি ঢুকেও সেই রাগ কমল না।

তার মধ্যে মা রীতিমতো বাংলা সিরিয়ালের মতো ডায়লগ বলতে শুরু করে দিল, ”আমি জানতাম! আমি জানতাম এমনই কিছু একটা হবে। এতগুলো বছর মুখে রক্ত তুলে কষ্ট করলাম, কি না করেছি! বাপের বাড়িতে কখনো এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খেতাম না। সেই আমি লোকের বাড়ি রান্না থেকে শুরু করে হাসপাতালে আয়াগিরি … তবু মেয়েকে পড়াশুনো ছাড়াইনি, কারুর কাছে হাত পাতিনি। যত কষ্টই হোক, মেয়েকে সংসারের কাজে হাত লাগাতে দিইনি। এতবছর পরে ভাবলাম মেয়ে সরকারি চাকরি পেল, ভগবান মুখ তুলে তাকালেন। ও বাবা, কোথায় কী!”

আমি কোনো প্রতিবাদ করছিলাম না। মা যদি এইসব বলে নিজের কষ্ট লাঘব করতে পারে তো করুক।

”একা একটা সোমত্থ মেয়ে গিয়ে একা থাকা …!” মা এবার হাউ মাউ করে উঠল, ”যেতে হবে না তোকে। এই চাকরি তুই ছেড়ে দে। আমি যেভাবে চালাচ্ছিলাম সেভাবেই চালাব। আমার অদৃষ্টে সুখ নেই কী আর করা যাবে।”

মায়ের ভাবভঙ্গি দেখে অজান্তেই এবার আমার ঠোঁটের একপাশে হাসি খেলে গেল, ”মা, তুমি এমন করছ যেন আমাকে কাশ্মীরের বর্ডারে পাঠাচ্ছে। পুলবাজার দার্জিলিঙের একটা সাধারণ ব্লক। সেখানে স্কুল কলেজ, অফিস কাছারি, দোকানপাট সবই আছে। আমার কোনো অসুবিধেই হবে না।”

”কী দরকার ছিল তোর এইসব করার?” মা এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, ”কী দরকার ছিল তোর পুজো পুজো করে বড় বড় লোকেদের চটানোর? সেলিব্রিটি হয়েছ, তাই না? কই, এখন তোমার খবরের কাগজওয়ালারা এসে বাঁচাচ্ছে তোমায়?” মা পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতেই বোধ হয় দুম করে ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে উঠে গেল।

”বাঁচানোর প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?” আমার এবার বিরক্ত লাগল, ”আমার কী এমন বিপদ হয়েছে যে বাঁচাতে হবে? আমি একটা চাকরি করি, তাতে ট্রান্সফারড হয়েছি। তাতে কী হয়েছে?”

মা এবার রোদন থামিয়ে আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল, ”তার মানে এর পরেও তুই ওইসব কাণ্ড চালিয়ে যাবি?”

”ওইসব কাণ্ড মানে?” আমি বললাম, ”আমি তো বলেইছি, পশ্চিমবঙ্গে আমি পুরোহিতদের জন্য লাইসেন্স আনবোই। তার জন্য যা করতে হয় করব।”

মা আর একটা কথাও বলল না। গুম হয়ে ভেতরে চলে গেল। এবার কিছুক্ষণ মৌনপর্ব চলবে। তারপর রান্নাঘর থেকে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার শব্দ ভেসে আসবে।

আমিও আর সময় নষ্ট না করে কাগজ পেন নিয়ে বসলাম। পোস্তার উকিলের নাম রাজেন সমাদ্দার। সে ছবিদাদুর প্রাক্তন ছাত্র। সেই রেফারেন্সে সত্যিই সে প্রায় বিনাপয়সায় মামলা লড়বে বলেছে। শুধু হুমকি নয়, আমার আগের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলাটাও সে দেখছে। শুধু আমাকে পুরো ঘটনার একটা ব্রিফ করে দিতে হবে। তারপর সেই অনুযায়ী উকিলমশাই কেস সাজাবেন।

সেইমতো ব্রিফ লিখছিলাম। যাওয়ার আগে সব কাজ গুছিয়ে শেষ করে যেতে চাই যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। হঠাৎ মোবাইলে টুং টাং শব্দে আমার মনোযোগ ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখলাম যা ভেবেছি তাই।

মঙ্গলরূপ ফোন করছে। সেদিন পোস্তার বাসে বিনি ওরকম অভদ্র ব্যবহার করার পরে হুড়মুড় করে ও নেমে গিয়েছিল হবু বউয়ের পেছন পেছন।

এখন থেকেই স্ত্রৈণ হয়ে গেছে। বিয়ের পর কী হবে কে জানে? মুখ বেঁকিয়ে ভাবলাম আমি।

সেদিন রাতেও মঙ্গলরূপের কাছ থেকে ফোন এসেছিল। আমি ধরিনি। ইচ্ছে করেনি। বিনি আমার ছোটবেলার বন্ধু, তার সঙ্গে সেদিনের একটা সামান্য বাদানুবাদের পর যখন ও এতদিন ধরে জের চালাতে পারে, আমারই বা ওর ভাবী স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর কি দরকার?

তারপর গতকাল একটা মেসেজ পেয়েছিলাম, ”আমি মঙ্গলরূপ ভট্টাচার্য। কেমন আছেন? সেদিন বাসে কথা হয়ে খুব ভালো লাগল। আপনি কোর্টে আবার কবে যাবেন?”

আমি সেটারও কোনো রিপ্লাই করিনি। যে মন নিয়ে বাসে অতক্ষণ কথা বলেছিলাম, সেটা যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটার ওপর সেই আগের রাগ আবার ফিরে আসছিল।

অথচ মঙ্গলরূপ কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি আমার সঙ্গে।

ফোনটা কেটে গিয়েছিল, আবার বাজছে।

বিরক্তির একটা শব্দ করে ফোনটাকে সাইলেন্ট করে দিলাম আমি।

সতেরো

মন্টের পেছন পেছন আমরা যখন দাশনগর স্টেশনে নামলাম, তখন বিকেল হয়ে গেছে। আমার বাড়ি হাওড়াতে হলেও এই দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের দিকে লোকাল ট্রেনে আগে কখনো আসিনি। এই পথে শুধু পুরী গেছি ছোটবেলায়। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে আগে পড়ল টিকিয়াপাড়া স্টেশন, তারপর দাশনগর।

দাশনগর স্টেশনটা বেশ ফাঁকা, একটা করে ট্রেন এলে সামান্য চাঞ্চল্য, তারপরেই নির্জন।

মন্টে একটা বিড়ি ধরাল। হাত বাড়িয়ে আমাদের হাতে একটা করে গুঁজে দিতে আমি আড়ষ্ট হয়ে বললাম, ”নানা! আমি এসব খাইনা রে। দাশনগরে আমাদের দোকানের একগাদা কর্মচারী থাকে, কেউ দেখে ফেললে বাজে ব্যাপার হবে।”

মন্টে ওর হলুদ ছোপধরা দাঁতগুলো বের করে হাসল, তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ”আচ্ছা বেশ। চল।”

আবীর মন্টেকে বলল, ”রাজতিলকের বাড়ি কি দাশনগরে নাকি? এখানে আমার মামার বাড়ি।”

”তিলকের বাড়িটা ঠিক কোথায় আমি জানিনা ভাই।” মন্টে বলল, ”ওর বাপের দোকান কদমতলায়। বাপটা বছর দুয়েক হল টেঁসে গেছে, আমরা ওর দোকানে মাল্লু টানতে যাই। এদিকে আয়।”

আমি একপলক আবীরের মুখে দিকে চেয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেছে আজ প্রায় দশ বছর। এই দশ বছরে আমি যেমন আপাদমস্তক ভালো ছেলের তকমাটা সযত্নে বয়ে নিয়ে চলেছি, তেমনই মন্টে, রাজতিলক, এইসব ছেলেরা নিজেদের মতো করে জীবনের মূলস্রোতে ছড়িয়ে পড়েছে।

কে ঠিক কে ভুল, সেই দাঁড়িপাল্লার মাপ আমার কাছে নেই, আমি সেটা বিচার করারও কেউ নই, কিন্তু এই মুহূর্তে মন্টেকে দেখে আমার নিজের চেয়ে ওকে অনেক বেশি স্বাধীন মনে হল। ও যা চায় মুহূর্তেই করতে পারে। আমার মতো কে কী ভাববে সেই ভেবে নিজের ইচ্ছেগুলো ওকে দমিয়ে রাখতে হয়না।

আবীর আবার মাঝামাঝি, একেবারে গোল্লায় যাওয়া ছেলেও নয়, আবার আমার মতো অতি বশংবদও নয়। মাঝেমধ্যে সিগারেট ফোঁকে। এখন দিব্যি বিড়িতে টান দিল।

দাশনগর স্টেশনটা রাস্তা থেকে উঁচুতে। ফুটব্রিজ দিয়ে নীচে নেমে মন্টে হাত দেখিয়ে একটা টোটো দাঁড় করাল, ”যাবে নাকি ভাই?”

”কোথায়?” টোটোওয়ালা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল।

”কদমতলা যাব।”

”উঠে পড়ুন। দশ টাকা করে লাগবে।”

আবীর বলল, ”তুই কি আগে থেকে তিলককে কিছু বলে রেখেছিস?”

মন্টে বলল, ”না না। তারপর থেকে আমার সঙ্গে ওর আর কথা হয়নি। মালটা এখন বেজায় ব্যস্ত, সামনে ভোট না!”

”ভোট তো ওর কি?” আবীর বলল, ”ওর তো বাইকের দোকান বললি!”

”বাইক মানে পুরোনো বাইক। লোকজন পুরোনো গাড়ি বেচে দিয়ে যায়, সেটাই আবার রংচঙ করে বিক্রি করে।” মন্টে বলল, ”ইদানীং আবার সঙ্গে পার্টির কাজকর্ম করছে দেখছি। কে জানে কী ব্যাপার!”

টোটোওয়ালা যেখানে নামাল, সেখানে বেশ চওড়া রাস্তা। মাঝখান দিয়ে ডিভাইডার চলে গেছে। দু-পাশে লোহালক্কড়ের দোকান। মন্টে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ”তোরা আগে কিছু বলিস না। আমিই যা বলার বলব।” পিচ করে একদলা থুতু ফেলল ও, ”এখন শালা আর উটকো ঝামেলায় জড়াতে ইচ্ছে করে না, কোত্থেকে কী কিচাইন হয়ে যাবে, তখন আরেক ঝক্কি। নেহাত মেয়েটা আমাদের রূপের বোন, আর অমন করে বলল তাই!”

আমি লক্ষ্য করলাম, মন্টে এমনভাবে ‘আমাদের রূপের বোন’ কথাটা বলল, যেন আমি ওর কতদিনের চেনা। অথচ স্কুলে পড়লে ওর সঙ্গে আমি কখনো বন্ধুত্ব তো দূর, কথাও বলিনি।

এইসব তথাকথিত খারাপ ছেলেরাই কি বিপদেআপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়? কোনো ইগো থাকে না বলেই কি চট করে মানুষকে আপন করে নিতে পারে?

নাহ, তার কোনো মানে নেই। সবাই সমান নয়। মন্টে ভালো, তেমনই রাজতিলক তো কত খারাপ একটা ছেলে।

দু-পাশে দুটো বিশাল বিশাল হার্ডওয়ারের স্টোর, তার মাঝখানে স্যান্ডউইচের মতো চেপটে আছে একটা ছোট দোকান। দোকানের সামনে ভাঙাচোরা কয়েকটা মোটর সাইকেল পড়ে আছে। কোনোটার ইঞ্জিন খোলা, কোনোটার আবার টায়ার লাগানো নেই।

মন্টে এগিয়ে গিয়ে দোকানটার ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন আমরাও। আজ সকাল থেকে মেঘ ডাকছে, কিন্তু বৃষ্টির নাম নেই। ফলে গুমোট হয়ে আছে। দোকানে ঢোকামাত্র ভ্যাপসা গরম নাকেমুখে এসে ঝাপটা মারল। ভেতরে আলোও খুব একটা নেই, হ্যালোজেন বাল্ব জ্বলছে একটা।

আমাদেরই বয়সি একটা ছেলে সাদা হাতকাটা গেঞ্জি পরে উবু হয়ে বসে রয়েছে। হাত কালিমাখা, বুকেও কালির ছোপ লেগেছে। হাতে একটা বাইকের খোলা হ্যান্ডল আর অন্যহাতে ন্যাকড়া।

মন্টেকে দেখে ছেলেটা মাথা তুলল, ”কিরে তুই? এখন?” বলতে বলতে আমাদের দুজনের দিকেও তাকিয়ে নিল এক ঝলক।

চিনতে পারেনি। সেটাই স্বাভাবিক।

মন্টে বলল, ”তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে তিলক।” কথাটা বলে আমাদের দিকে তাকাল, ”এদেরকে চিনতে পারছিস? এ হল মঙ্গলরূপ। আর ও আবীর। এগারো বারো ক্লাসে জেলা স্কুলে পড়ত আমাদের সঙ্গে।”

”না। চিনতে পারছি না।” রাজতিলক একগাল হাসল, ”কী নাম তোদের? তুই-ই বলছি। কোথায় থাকিস?”

আমি নিশ্চুপভাবে দেখে যাচ্ছিলাম। এত বড় একটা অপরাধ করেও কোনো বিকার নেই, দিব্যি হাসি হাসিমুখে কথা বলে চলেছে, যেন কত ভালো ছেলে।

এমনভাবেই হয়তো ভালোমানুষের খোলস পরে কত অপরাধী এইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের সমাজে!

আবীর সংক্ষেপে আমাদের দুজনের পরিচয় দিয়ে গলা খাঁকারি দিল, ”ইয়ে রাজতিলক, তোর কাছে আমরা খুব দরকারি একটা ব্যাপার নিয়ে এসেছি।”

”দাঁড়া।” রাজতিলক পেছন দিকে হেলে হাঁক দিল, ”অ বউদি, বউদিইইই!”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দোকানের পেছন দিক থেকে খনখনে গলায় আওয়াজ এল, ”কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাস কেন?”

রাজতিলক আবার পেছনদিকে হেলল, ”চারকাপ চা পাঠাও না গো। ইয়ে…তোমাকে পরে সব বুঝিয়ে বলছি।”

”পরে আর কিচ্ছু বোঝাতে হবে না তোকে।” খনখনে গলা বলে চলল, ”বুঝে বুঝে বোঝাই হয়ে গিয়েছি। সব মিলিয়ে আড়াই মাসের চা বাবদ সাড়ে পাঁচশো টাকা বাকি আছে, আগে সেটার হিসেব মেটা রে ড্যাকরা!”

আবীর তাড়াতাড়ি বলল, ”না না, চা-টা কিছু লাগবে না। একটা দরকারি কাজে আমরা এসেছি, এখুনি চলে যাব।”

”আরে চা এসে যাবে। চাপ নেই।” রাজতিলক আমাদের দিকে চেয়ে একগাল হাসল, ”মেনকাবউদি। আমার দোকানের পেছনেই ওর চায়ের গুমটি। মেজাজটা গরম, কিন্তু হাত সরেস। চা-টা যা বানায় না, খেলে পুরো ছিটকে যাবি।”

মন্টে এইসময় বলল, ”তিলক, তুই সুরবেণু বলে কাউকে চিনিস?”

মন্টে বিনির নামটা ভুল বলেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি দোকানের হ্যালোজেন আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম রাজতিলকের চোয়ালটা কেমন ঝুলে পড়ল।

আমি বললাম, ”সুরবেণু নয়, সুরবীণা।”

আবীর এবার একটু কড়া গলায় বলল, ”দ্যাখ রাজতিলক, তুই আমাদের স্কুলে পড়তিস। আমাদের ব্যাচেরই ছেলে। আমরা শুধু এইজন্য থানাপুলিশ করার আগে তোর কাছে এসেছি। নাহলে বুঝতেই পারছিস পুলিশের কাছে গেলে তুই কতটা ফাঁসবি?”

”ক-কী হয়েছে?” রাজতিলকের হাসি হাসি মুখটা নিভে গিয়ে একটা ধূসর ছোপ পড়ল মুখের ওপর।

”কী হয়েছে সেটা তো তুই বলবি তিলক!” মন্টে বলল, ”আমি তো শুনে থেকে অবধি বিশ্বাস করতে পারছিনা! আমরা পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়া বখে যাওয়া ছেলে হতে পারি, কিন্তু এইরকম খারাপ কাজ …!”

রাজতিলক এবার গুম হয়ে গেল।

”তুই শালা এইসব মেয়েদের ছবি নিয়ে নোংরামো কবে শুরু করলি? ব্যবসা কি একেবারেই চলছে না? তেমন হলে বল আমরা নাহয় তোকে ধার-টার …।” মন্টে বলল, ”পুলিশ তো কেলিয়ে কাঁঠাল করে দেবে রে!”

”সুরবীণাকে তোরা কী করে চিনলি?” রাজতিলক মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল।

”বলব। তার আগে তুই বল কী করে তুই এই কাজটা করতে পারছিস? মেয়েটার নিজের অনেক প্রবলেম রয়েছে। অনেক কষ্টে একটা বিয়ে ঠিক হয়েছে, আর তুই সেখানে এইরকমভাবে বাগড়া দিচ্ছিস? ত্রিশলাখ টাকার জন্য? এত টাকা মেয়েটা কোথায় পাবে?” মন্টে সত্যিই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল।

”ওদের অনেক টাকা।” রাজতিলক বলল, ”মেয়েটার বাপ মহা কঞ্জুষ।”

মন্টে এবার প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজতিলকের ঘাড়ে, ”শালা তাতে তোর কী?”

রাজতিলক ঢোঁক গিলল। একটু থেমে বলল, ”সুরবীণা আমার কলেজের জুনিয়র ছিল। প্রথমদিকে আমাদের মধ্যে একটা রিলেশন তৈরি হয়েছিল। ব্যস ওইটুকুই!”

আবীর চিরকালের মাথাগরম, ও এবার আর চুপ করে বসে থাকতে পারল না, এগিয়ে গিয়ে রাজতিলকের কলার চেপে ধরল, একটা বিশ্রী গালাগাল দিয়ে বলল, ”ওইটুকু যখন, তখন তুই মেয়েটার পেছনে এমন লেগেছিস কেন কুত্তার বাচ্চা? তোকে আমাদের স্কুলের ছেলে ভাবতে ঘেন্না করছে!”

রাজতিলক নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। কিন্তু কোনো উত্তরও দিল না। গোঁজ হয়ে তাকিয়ে রইল নীচের দিকে। আবীর আবার কিছু বলতে যাবে, এমন সময় পেছনের দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে ঢুকল একজন দশাসই চেহারার মহিলা। হাতে একটা কেটলি আর কয়েকটা মাটির ভাঁড়।

সশব্দে কেটলিটাকে মেঝেতে বসিয়ে ভাঁড়গুলোতে একে একে চা ঢেলে দিল, তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে কোমরে হাত দিয়ে রাজতিলকের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ”পাঁচশো সত্তর হল কিন্তু!”

”চা খা তোরা।” রাজতিলক বলল।

আবির আবার তেড়ে গেল, ”তোর বাপকে চা খাওয়াব শালা!” তারপর আমার দিকে তাকাল, ”চল রূপ, পুলিশেই যাই, হারামিটা ভাবছে মুখ টিপে বসে থেকে পার পেয়ে যাবে।”

আমি কিছু বলার আগেই রাজতিলক মুখ খুলল, ”যেতে পারিস। কোনো লাভ হবে না। সব সেট করা আছে।”

”মানে?” আবির হাঁ হয়ে গেল।

”গিয়ে দ্যাখ না। কিছুতেই ডায়রি নেবে না। পাশের ব্যাঁটরা থানা, ওদিকে হাওড়া সদর থানা, যেখানে খুশি যেতে পারিস।” রাজতিলক একটা লম্বা নিশ্বাস নিল, ”সুপ্রতিম লাহিড়ীকে সবাই সমঝে চলে।”

আমি এবার থমকে গেলাম, ”সুপ্রতিম লাহিড়ী? কে সে?”

রাজতিলক আমার চোখের দিকে তাকাল, ”সুরবীণার যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে। সুপ্রতিম লাহিড়ী। উলুবেড়িয়ার নেতা।”

আমি এবার কিছু বুঝতে না পেরে আবিরের দিকে তাকালাম, দেখি ও-ও আমার দিকে একইভাবে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে।

আমি বললাম, ”বিনির বর এর মধ্যে কোথা থেকে এল?”

”সুপ্রতিমদা-ই তো আমাকে এটা করতে বলেছে। আমি কি কম্পিউটারে ওসব ছবি বানাতে পারি?” রাজতিলক মন্টের দিকে তাকিয়ে বলল।

আঠেরো

ব্লকের নাম পুলবাজার হলেও আমাদের অফিসটা বিজনবাড়িতে। এই চত্ত্বরে তিনখানা থানা আছে, লোধমা, দার্জিলিং আর পুলিশবাজার। কাছেই রয়েছে পাট্টাবং বলে একটা মনোরম সুন্দর চা-বাগান।

মিথ্যে বলব না, শিলিগুড়ি থেকে বাসে আসার সময় মনটা প্রথমে খারাপ ছিল, কিন্তু তারপর যখন বাস থেকে দূরের পাহাড়টা দেখতে পেলাম, আনন্দে বুকের ভেতরটা কেমন নেচে উঠেছিল।

তারপর দার্জিলিং বাসস্ট্যান্ডে নেমে ট্রলি হাতে কিছুদূর হেঁটে এগিয়ে আসতেই মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। যতই হোক, উত্তরবঙ্গের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। সরু রাস্তা, দু-পাশে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে ছবির মতো সাজানো রংবাহারি ফুলের টব।

ভালো করে খেয়াল করছিলাম, আমাদের মতো মাটির টব নয়, পলিথিনের এক ধরনের টব, থরে থরে বসানো রয়েছে বাড়িগুলোর সামনের রাস্তায়, ঝুলছে কার্নিশে।

প্রতিটা টবেই অজস্র রংবেরঙের নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে। একটু আগেই বোধ হয় একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, সেই বৃষ্টির জলের ফোঁটায় আরও সতেজ দেখাচ্ছে চারপাশ।

উলটোদিক থেকে কলকল করতে করতে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে আসছে, স্কুলের পোশাকে। আমি এই একটা জিনিস আগেও খেয়াল করেছি। সমতলেও সবাই স্কুলে যায়, কিন্তু পাহাড়ি বাচ্চাদের মতো তাদের দেখতে অত সুন্দর লাগে না,

মাথার ওপরের একটা গাছ থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল আমার গায়ে পড়তেই শরীর থেকে ক্লান্তি মুছে গিয়ে মনটা কেমন তাজা হয়ে উঠল।

মনে হল, এটাই তো জীবন! নতুন জায়গা, নতুন বাসস্থান, নতুন লোকজন। পরিবর্তনই জীবন।

ব্লক অফিসে যার কাছে জয়েন করলাম, তার নাম সসীম বটব্যাল। বয়স্ক মানুষ, রিটায়ারের আর বছর দুই বাকি। আমি এতদূর থেকে এসেছি শুনে একটু বিস্মিত হলেন, কিন্তু খুব বেশি প্রশ্ন করলেন না। এ-কথা সে-কথার পর জিজ্ঞেস করলাম, ”এখানে কোথায় থাকবেন কিছু ঠিক করেছেন?”

”না এখনো তেমন কিছু ভাবিনি।” আমি উত্তর দিলাম, ”আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন সসীমদা, আমি আপনার মেয়ের বয়সি।” আমি প্রাণপণ হাই চাপতে চাপতে বললাম।

রাতে ট্রেনে একদম ঘুম হয়নি। একে একা আসছি, সঙ্গের মালপত্রের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে, তার ওপর ট্রেন শিয়ালদা ছাড়তে মনটা সত্যিই হু হু করে উঠেছিল। বাড়িতে নিজেকে ইচ্ছে করেই এই কয়েকদিন ভাবলেশহীন রেখেছিলাম, মা এমনিতেই থেকে থেকে বিলাপ করছিল, আমি তাতে ইন্ধন দিলে মা হয়তো আমাকে আর আসতেই দিত না, বলত, ”তোকে আর এই চাকরি করতে হবে না, ছেড়ে দে!”

মা স্টেশনেও আমাকে ছাড়তে আসতে চেয়েছিল, আমিই আসতে দিইনি। কী হবে! মায়া যখন কাটাতেই হবে, সেটাকে টেনে নিয়ে না চলাই ভালো।

আসার আগের দিন কী করে জানিনা, দুটো টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার ঠিক খবর পেয়ে গিয়েছিল, খুঁজে খুঁজে চলে এসেছিল বাড়ি। তখন আমি শেষমুহূর্তের গোছগাছ করছিলাম, তখন আচমকা আগমনে বিরক্তই হয়েছিলাম।

এই কয়েকদিনের ঘটনায় একটা কথা আমি বুঝেছি, মিডিয়া সুবিধা যেমন করে, অসুবিধাও কিছু কম করে না। যেটা আমি বলিইনি, সেটাও আমার মুখে বসিয়ে দিয়ে এক্সক্ল্যুসিভ করে দেয় বেমালুম।

”ভাবিনি বললে কী করে হবে!” সসীমদা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ”একা মেয়ে থাকবে, ভালো দেখে একটা ঘর দেখতে হবে তো! কোয়ার্টার তো প্রথম কয়েকদিনের বেশি পাবে না, আর সেখানকার অবস্থাও তথৈবচ।” কথাটা বলেই সসীমদা হাঁক দিলেন, ”স্বপন, অ্যাই স্বপন, কোথায় গেলি রে। এসেই কি ফুঁকতে গেছিস নাকি?”

আরও কয়েকবার হাঁকডাকের পর স্বপন এসে উপস্থিত হল, একহাতে চায়ের কেটলি, অন্যহাতে প্লাস্টিকের কাপ, কাঁধে গামছা, ”ফুঁকতে যাব কেন বাবু? এসে আপনাদের জন্য চা-টা করব না নাকি? স্বপন গুছাইত কাজে ফাঁকি দেয় না, এটা জেনে রাখুন।” গজগজ করতে করতে চা ঢালে স্বপন।

”সেতো ঠিকই! তুই যে কত কাজ করিস, তা কী আমি জানিনা!” ব্যঙ্গের সুরে কথাটা বলে আমার দিকে দেখালেন, ”এই দ্যাখ, নতুন দিদিমণি এসেছে কলকাতা থেকে। চা দে।”

স্বপন একগাল হাসল, ”কলকাতা থেকে? নমস্কার দিদিমণি!”

আমি হাসলাম। স্বপনদার থেকে চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চুমুক দিলাম। খিদে পেয়েছে খুব, সকালে ট্রেনে শুধু দুটো বিস্কুট খেয়েছিলাম। এখন প্রায় বেলা বারোটা।

গরম চা পেটে পড়তেই খিদেটা আরো চনমনিয়ে উঠল।

সসীমদা বললেন, ”শুধু নমস্কার করলে হবে না স্বপন, দিদিমণির জন্য একটা ভালো ঘর দেখে দিতে হবে তোকে। ভালো পাড়া দেখে দ্যাখ দিকিনি একটা!”

”আচ্ছা। আজই দেখছি।” কথাটা বলে স্বপন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

”এই অফিসে কি সব স্টাফ বাঙালি নাকি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি আশা করেছিলাম এসে গোর্খাদেরই দেখতে পাব।

”না না। এই আমি আর স্বপনই যা বাঙালি। বাকিরা সব আসবে। এলে তোমার সাথে আলাপ করিয়ে দেব। বাড়িতে কে কে আছে তোমার?” সসীমদা জিজ্ঞেস করলেন।

”মা আর আমি, ব্যাস! বাবা অনেকদিন আগে মারা গেছেন। আপনার বাড়ি কি এখানেই?”

”আমার বাড়ি ঠিক এখানে নয়, তবে উত্তরবঙ্গেই।” সসীমদা হাসলেন, ”শিলিগুড়ির নকশালবাড়িতে। নাম শুনেছ নকশালবাড়ির?”

”হ্যাঁ।” আমি বললাম, ”নকশালবাড়ি থেকেই তো নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাই না!”

সসীমদা একটু অবাক হলেন, বললেন, ”তুমি নকশাল আন্দোলন জানো? তখন তো তুমি জন্মাওনি বোধহয়!”

”বাঃ, জানব না? জন্মাইনি তো কি, বইতে পড়েছি, চারু মজুমদার, কানু সান্যাল!” আমি বললাম।

”ঠিক বলেছ।” সসীমদা একটু উদাস হয়ে গেলেন, পাশের জানলা দিয়ে দূরে তাকালেন, ”আমাদের নকশালবাড়ির পশ্চিমদিকে সোজা চলে গেলে পড়বে মেচি নদী। সেই নদী চলে এসেছে এদিকে নেপালের সীমান্ত বরাবর। সেই নদীর পাশের একটা ছোট্ট গ্রামে আমি জন্মেছিলাম।”

”তারপর বড়ো হয়ে এদিকে চলে এসেছেন বুঝি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সসীমদা যেন শুনতেই পেলেন না। বললেন, ”নকশালবাড়ির পুরোটাই ছিল প্রায় চা-বাগান আর চাষের জমি। আমার বাবা কাজ করতেন ওখানকার একটা টি এস্টেটে। আমাদের কিছু জমিও ছিল, কিন্তু সেগুলোর ভাগ পেতাম না।”

”নিজেদের জমি, তবু ভাগ পেতেন না কেন?”

সসীমদা এবার আমার দিকে তাকালেন, ”১৯৬৭ সালের ২৫ মে বাবা এবং আরও কয়েকজন গ্রামবাসী মিলে সেই ধানের জমির ভাগ পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছিলেন। সারাদিন নেগোশিয়েশনের পর বাবা আর আরো আটজনকে পুলিশ গুলি করে খুন করে। সঙ্গে আমার দিদিও ছিল, তখন ও অবশ্য একদম বাচ্চা। ওকেও পুলিশ ছাড়েনি। গুলি করে শেষ করে দিয়েছিল।” সসীমদার গলাটা সামান্য কেঁপে গেল।

”তারপর?” সসীমদা থামতেই আমি বলে উঠলাম।

এই ঘটনাটা আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম!

”আমার তখন তিন-চার বছর বয়স। পুলিশি জুলুম থেকে বাঁচতে রাতারাতি মা আমাকে পাঠিয়ে দিল মালদায়, মামাদের কাছে। সেখানেই মানুষ হয়েছি, লেখাপড়া শিখেছি, চাকরি জুটিয়েছি। তারপর এই কিছু বছর আগে ইচ্ছে করেই এদিকে ট্রান্সফার নিলাম, নিজেদের ভিটের জন্য মন কেমন করছিল। নকশালবাড়িতে পেলাম না, তবে শনি রবিবার ওখানেই চলে যাই।” সসীমদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ”তোমারও নিশ্চয়ই এখনো খুব মন খারাপ করছে মায়ের জন্য।”

আমি কিছু না বলে মুখটা নামিয়ে নিলাম।

”আমি কিন্তু তোমাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। রোজই তো ছবি দেখছিলাম কাগজে। তুমি কিন্তু ভেঙে পড়বে না একদম। সারাজীবন প্রতিবাদী মানুষদের কষ্ট সহ্য করতে হয়, সেই কষ্ট দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করতে পারলে তারাই জেতে, বুঝলে?” সসীমদা বললেন।

উনিশ

বিনি থরথর করে কাঁপছিল, ”তার মানে?”

আবীর বলল, ”তোমার হবু বড় সুপ্রতিম লাহিড়ীর টাকার লোভ বিশাল। কিন্তু সে নিজে পার্টি করে, জনদরদি নেতা। সমাজের আপদে বিপদে, মানুষের সুখ দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে কি করে নিজের মুখে টাকা চাইবে? পাড়ার লোক কী বলবে? পার্টি কী বলবে?”

বিনি সাদা চোখে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে, ”এটা কী করে সম্ভব!”

আবীর বলে চলল, ”সুপ্রতিমের পরিবার বেশ পুরোনোপন্থী। বিনির গায়ে শ্বেতী হয়েছে জানার পর তারা সম্বন্ধ করতে চায়নি। কিন্তু সুপ্রতিম উদারতা দেখিয়ে বলেছিল যে সে বিনিকে ভালোবেসেছে, ওকেই বিয়ে করবে। কারণ ও কোনোভাবে জানতে পেরেছিল রাজতিলকের সঙ্গে বিনির পুরোনো সম্পর্কের কথা।”

বিনির ঠোঁটটা ঈষৎ কেঁপে উঠল।

”সুপ্রতিম পাকা মাথার খেলোয়াড়। রাজতিলকের এমনিই ব্যবসা চলছে না, তার ওপর দোকানের প্রপার্টি নিয়েও শরিকি ঝামেলা রয়েছে। রাজতিলককে সেই ঝামেলা সামাল দেওয়া, পার্টির বড় পোস্ট আর আধাআধি বখরার লোভ দেখিয়ে বিনিকে ব্ল্যাকমেল করার বুদ্ধি দিল সুপ্রতিম। বিনি, তুমি মনে হয় কখনো কথায় কথায় সুপ্রতিমকে বলেছিলে যে বাবা তোমার নামে একটা বড়সড়ো অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্কে রেখেছেন?

বিনি বিমূঢ়ভাবে বলল, ”হ্যাঁ। একদিন গল্পচ্ছলে বলেছিলাম। বাবা ওই টাকাটা আমার বিপদ আপদের জন্য রেখেছেন।”

”ব্যাস, সুপ্রতিম জব্বর ফন্দি কষল। ও জানত ত্রিশ লাখ টাকা চাইলে তুমি দরাদরি করে সেই কুড়ি লাখই দেবে। আর এটা এমন একটা প্ল্যান যাতে এক ঢিলে তিনটে পাখি মারা যাবে। একদিকে লক্ষ্মীলাভ, একদিকে পার্টি এবং মানুষের কাছে নিজেকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা, আর অন্যদিকে বিনির কাছে স্বামী হিসেবে নিজের ইমেজ আকাশপ্রমাণ করে তোলা।” আবীর থামল।

বিনি এবার দু-হাতে মুখ ঢেকে জোরে কেঁদে ফেলল।

আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম এমন একটা কিছু ঘটবে। আমি বললাম, ”দ্যাখ বিনি, এখন কাঁদার সময় নয়। তুই আমাদের সঙ্গে চল এখন।”

বিনি কাঁদতে কাঁদতে দু-পাশে মাথা নাড়ল, ”আমি কোথাও যাব না। তোমরা আমার অনেক উপকার করেছ, এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না। তোমরা এখন চলে যাও।”

”চলে যাওয়ার জন্য তো এত কাণ্ড করিনি বিনি!” আবীরের হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে আসছিল, ওটাকে এককোণে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ও বলল, ”তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। অপরাধীকে শাস্তিটা দিতে হবে না?”

”কী শাস্তি?” বিনি জলভরা চোখে তাকাল, ”কোথায় যাব?”

”থানায়। রাজতিলক সব সত্যি কথা বলতে রাজি হয়েছে, কারণ এমনিই ও ধরা পড়বে, বরং সত্যিটা বললে ওর শাস্তি অনেক কমে যাবে। সুপ্রতিম লাহিড়ী উলুবেড়িয়ার নেতা, হাওড়ার থানাগুলো হয়তো ডায়রি পেয়েও কিছু করবে না। তুমি উত্তরপাড়ার মেয়ে, তুমি উত্তরপাড়ায় ডায়রি করবে। তেমন হলে আরও দূর যাব, তবু ওই মুখোশপরা শয়তানটাকে ছাড়ব না। চলো আমাদের সঙ্গে।” আবীর বলল।

বিনি আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ কেঁদে গেল।

তারপর রুমালে চোখমুখ মুছে বলল, ”ছেড়ে দাও তোমরা। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমার কপালের দোষ এটা। নাহলে সব প্রতারণা আমার সঙ্গেই কেন হয়! এমনিতেই জানিনা এই বিয়ে ভাঙার খবর শুনিয়ে বাবাকে বাঁচাতে পারব কিনা! তার ওপর থানাপুলিশ করলে সারা পাড়া জানাজানি হয়ে যাবে, ঢি ঢি পড়ে যাবে। আমার জীবনটা তো শেষ হবেই, বোনেরও বিয়ে হবে না।”

”তা বললে তো হয় না!” আবীর কড়া গলায় বলে উঠল, ”আগেকার দিনের মেয়েদের মতো কথা বোলো না বিনি! আধুনিক হও একটু। লোকে কী বলবে সেইজন্য তুমি একটা ক্রিমিন্যালকে ছেড়ে দেবে? সুপ্রতিম নিজে ওই বিকৃত ছবিগুলো বানিয়ে রাজতিলককে পাঠিয়েছিল। পুলিশ আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করলেই ধরা পড়বে, রাজতিলকও সব খুলে বলবে। এইরকম জঘন্য একটা লোককে ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। আজ তোমার সঙ্গে এমন করেছে, শাস্তি না পেলে পরে আরও কোনো মেয়ের সঙ্গে করবে।” আবীর এবার এগিয়ে এসে আলতোভাবে হাত রাখল বিনির কাঁধে।

নরম গলায় বলল, ”আর … আমি, মানে আমরা সবাই তো রয়েছি তোমার সাথে। ভয় কিসের?”

আমি এবার অপরাধীর গলায় বললাম, ”আমার খুব খারাপ লাগছে রে, কাল সকালে যেতে পারব না বলে। বিনি, তুই কিছু ভাবিস না। আবির আছে, ও-ও তোর দাদার মতো, ও তোর পাশে থাকবে।”

আজ রাতেই আমাদের দার্জিলিং মেল। রাজতিলককে আগে থেকেই বলা ছিল, পরের দিন সকালে সবাই মিলে উত্তরপাড়া থানায় যাওয়া হবে। প্রথমেই সব স্বীকার করতে রাজতিলক গাঁইগুই করছিল, কিন্তু মন্টের দাবড়ানিতে রাজি হয়েছে, তা ছাড়া ওর নিজের মনেও ভয় আছে। বেচারা টাকা আর ওই সব ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসার লোভে করে ফেলেছিল কাজটা, কিন্তু বুঝতে তো পেরেছে কত বড়ো বাজে কাজ এটা!

আবির আমার কাঁধে হাত রাখল, ”ভাই তুই চলে যা তাহলে!”

আমি অবাক হলাম। দুজনেই নিজের নিজের অফিস থেকে এসেছি, বিনিকে হাওড়া থেকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরব এমনই কথা ছিল।

বললাম, ”তুই যাবি না?”

আবীর আমার দিকে সরে এসে চাপাগলায় ফিসফিস করল, ”মেয়েটা এত ভেঙে পড়েছে, ওকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি, বুঝলি! তুই যা ভাই, দেরি করিস না।”

আমার একটু খারাপ হচ্ছিলো, আসল সময়টাতে থাকতে পারব না বলে, আমি আমতা আমতা করে বললাম, ”কাল থাকলে ভালো হত। তোর ওপর পুরোটা এসে …!”

”আরে না না ঠিক আছে।” আবীর আলতো চাপড় দিল কাঁধে, ”তুই ভালো করে ঘুরে আয়, কোনো চিন্তা করিস না। আমি কাল সকালে ফোন করে তোকে আপডেট দেব।”

আমি মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলাম। আবীরের আমার চেয়ে একটু বেশিই উৎসাহ লক্ষ করছি দুদিন ধরে।

কিন্তু চিরকালই আমি চাপা গোছের, চট করে মুখে কোনো উত্তর আসে না।

দূর থেকে দেখলাম আবির আর বিনি পাশাপাশি হাওড়া ব্রিজের দিকে চলে যাচ্ছে।

আমার হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হল, আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল দিওতিমার কোনো খোঁজ পেলাম না।

না মানে, খোঁজ যে পেতেই হবে তেমন কোনো ব্যাপার নেই, তবু এমনি মনে হল আর কী! সেই যে সেদিন বাসে দেখা হল, তারপর থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি, মেসেজ করেছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। বিনিকে একবার জিজ্ঞেস করলে হত, ওদিকেই তো থাকে! যদিও বিনি ওকে তেমন পছন্দ করে না বলেই মনে হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে আবার মনে হল, ধুর, বিনিকে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করতে যাব কেন! একে বেচারি এতবড় ধাক্কা খেয়েছে, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবু ভালো যে টাকাটা বেঁচে গেছে, আর তা ছাড়া যে বিয়ের আগেই এতবড় ক্রাইম করতে পারে বিয়ের পর বিনির জন্য আরও কী কী সব অপেক্ষা করছিল কে জানে!

আমি মনে মনে মা মঙ্গলচণ্ডীকে ধন্যবাদ দিলাম।

একটু পরেই জিষ্ণু ফোন করল, ”কি ভাই, সব গোছগাছ কমপ্লিট?”

”ওই মোটামুটি। টুকটাক কিছু বাকি আছে, গিয়েই গুছিয়ে নেব। আজ এলি না কেন?” আমি বললাম।

জিষ্ণু আজ অফিস আসেনি। আমিও বিনির সঙ্গে দেখা করব বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি। ও বলল, ”আর বলিস না। একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল। আমি সোজা স্টেশন চলে যাব। তুই বেশি লাগেজ করিসনি তো? মানেভঞ্জন থেকে পুরোটা ট্রেক করে উঠব তো তাই বলছি।”

”না না! আমার একটাই রুকস্যাক, পিঠে নিয়ে নেব।” আমি বললাম। আজ রাতে আমাদের ট্রেন। বাড়িতে এখনো অবধি শুধু মা-কে বলেছি, বাবা যে বারণ করলেও আমি এবার আর শুনব না সেটাও বলে দিয়েছি।

মা কিছু বলেননি, গুম হয়েছিলেন।

অনেকক্ষণ বাদে বলেছিলেন, ”এখন ওদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষার সময় পাহাড়ে …!”

”বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই, গরমে পচছে সবাই আর তুমি বলছ বৃষ্টি!” আমি বলেছিলাম।

মা তখন সেদিনের কাগজটা নিয়ে এসে চোখের সামনে মেলে ধরেছিলেন, ”এই দ্যাখ, এখানে বৃষ্টি হচ্ছে না তো কী হয়েছে, পাহাড়ে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে।” তারপর মা একটু থেমে বলেছিলেন, ”পুজোর পর গেলে হয় না? তোর বাবারও চাপটা একটু কমবে আর ওয়েদারটাও…!”

আমি কাকুতির ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ”মা! এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি। প্লিজ তুমিও বাধা দিও না।”

মা চুপ করে গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে বলেছিলেন, ”সাবধানে যাস।”

এখন মা-র কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ গেল ঈশান কোণের দিকে, কালচে মেঘ জমাট বেঁধেছে। ঢালুক একটু, এই বিশ্রী গরম থেকে বাঁচা যাবে। আমার সঙ্গে ছাতা নেই, জলদি পা চালালাম।

মনে বেশ আনন্দ হচ্ছে, এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি।

ঠিক করলাম, বেরনোর সময় বাবাকে বলে বেরিয়ে যাব।

আচ্ছা, একবার দিওতিমাকে ফোন করে জানালে কেমন হয়? চিন্তাটা মাথায় আসতেই আশ্চর্য লাগল, কী মুশকিল, খামোখা অজানা অচেনা দুদিনের আলাপ একটা মেয়েকে ফোন করে আমি আমার ঘুরতে যাওয়ার কথা জানাতে যাব কেন?

সব কেন-র কোনো উত্তর হয় না।

আমি দিওতিমাকে ফোন করলাম। আর এবারেও সেই একই ব্যাপার। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল।

কী ব্যাপার? ফোন টোন ধরে না কেন? কোনো সমস্যা হয়নি তো? বিনিকেও জিজ্ঞেস করা হল না।

আর কে জানতে পারে ওর খবর?

মিনিট দশেক বাদে কী মনে হল, ঝন্টুকে ফোনটা করেই ফেললাম। যদিও ওই ছেলেটাকে আমার একদম পোষায় না। এমনিতেই সেই ঘটনার পর থেকে বাবার সঙ্গে আমার একবারও আর কোনো কথা হয়নি, তার ওপর জগদীশকাকা সব ব্যাপারে এই বাজে ছেলেটাকে ইনভলভ করছেন। পুজো, সংগঠন, কোথাও বাদ দিচ্ছেন না।

বাবাও প্রথমে আমাকে দিওতিমার ওপর নজরদারি চালানোর ভার দিলেও পরে ওই ঝামেলার পর ঝন্টুই সব দিক সামাল দিচ্ছে।

আমার কেমন জানিনা মনে হচ্ছে, রাগের বশে বাবা খাল কেটে কুমির ঢোকাচ্ছেন ঘরে। জগদীশকাকা-কে আমার কোনোদিনই সুবিধের মনে হয় না, আমি সক্রিয়ভাবে ব্যবসা বা সংগঠন কোনোটাই করিনা ঠিকই, কিন্তু যেটুকু খবর রাখি, আমার মনে হয়, মেজোকাকার চেয়েও যাতে বাবা জগদীশকাকাকে বেশি প্রাধান্য দেন, জগদীশকাকা সারাক্ষণ সেই চেষ্টাই করেন। গত দশবছরে সকলের অগোচরে ব্যবসা এবং সংগঠন, দুটোরই কান্ডারি যেন হয়ে উঠছেন জগদীশকাকা, বাবা সবার ওপরে থাকলেও দোকানের প্রতিটা কর্মচারী থেকে শুরু করে সংগঠনের জেলাস্তরের নেতারাও জানে যে জগদীশকাকার কথাই শেষ কথা।

এই যে ঝন্টু মল্লিকের মতো রাজনীতির লোকগুলোকে ঢোকানো হচ্ছে, এর পেছনেও জগদীশকাকা।

আমি আগে দু-একবার বাবাকে বলেছিলাম, বাবা যে একেবারে গুরুত্ব দেননি তা নয়, কিন্তু ওই পর্যন্ত। কাজের কাজ কিছু কি হচ্ছে? দিনের পর দিন কচুরিপানার মতো দলে ঢুকে পড়ছে ঝন্টুর সাকরেদরা, তা কি বাবা দেখতে পাচ্ছেন না?

যাই হোক, ঝন্টু ফোনটা রিসিভ করতেই আমি বললাম, ”কে ঝন্টু? আমি মঙ্গলরূপ বলছি, ভটচাজবাড়ি থেকে।”

”আরে রূপদা, বলুন কী খবর!” আমি ফোনের এপাশ থেকেও যেন ঝন্টুর হলদে দাঁতগুলো দেখতে পেলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল, এই ঝন্টুই সম্ভবত দিওতিমার কাছে আমার গোবর নামটা ফাঁস করেছিল।

আমি গম্ভীরগলায় বললাম, ”ওদিকের খবর কদ্দুর?”

”কোনদিকের বলুন তো?” ঝন্টু বুঝতে পারল না।

”আরে ওই যে মেয়েটা, পুজো পুজো করে লাফাচ্ছিল, আমি কোর্টে গিয়ে কথা বললাম!” আমি যতদূর সম্ভব নিজেকে নিরাসক্ত দেখানোর চেষ্টা করলাম।

”ওহ ওই দিওতিমা!” বাস-ট্রামের হর্ন ছাপিয়ে ঝন্টু চেঁচাল, ”আর কোনো চিন্তা নেই রূপদা, কেস একদম সাল্টে দিয়েছি। আরে ঝন্টু কোনো কাজের ভার একবার নিলে আর কোন টেনশন নেবেন না দাদা। জমিয়ে পুজো করবেন এবারে, কোনো লাফড়া নেই।”

আমি বললাম, ”কেস সাল্টে দিয়েছ মানে? দিওতিমা কেস তুলে নিয়েছে?”

”আরে নানা, ওই ডেঁপো মেয়েটাকেই হাপিশ করে দিয়েছি রূপদা! হে হে!” ঝন্টুর ষাঁড়ের মতো গলা ভেসে এল।

নিজের অজান্তেই আমার গলাটা কেমন তুতলে গেল, ”মা-মানে? হাপিশ করে দিয়েছ মানে? কী করেছ মেয়েটার?”

ওপাশ থেকে ঝন্টু কী বলল বুঝলাম না, চার-পাঁচবার হ্যালো হ্যালো করেও কিছু শুনতে পেলাম না।

এইসময়েই নেটওয়ার্কটা চলে যেতে হল?

রাগে, হতাশায় আমার মনে হল হাওড়া ব্রিজ থেকে ফোনটাকে ছুঁড়ে নদীতে ফেলে দিই!

দূরে আর্মেনিয়ান ঘাটের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, কোথায় গেল দিওতিমা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *