৫০. ঘড়ির কাঁটা

৫০

ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর ছুঁয়েছে। এই মাঝরাতে বাইরে আবার বরফ পড়া শুরু হয়েছে। এবার তীব্রতা বেশ বেশি, গুঁড়ো গুঁড়ো বরফে ঢেকে যাচ্ছে আশপাশের সমস্ত গাছ। দূরে লুসার্ন লেকটা কালো মিশমিশে হয়ে জেগে রয়েছে।

জানলার কাচ দিয়ে বাইরে তাকালে মনে হয় কোথাও কোনো প্রাণ নেই এ তল্লাটে। সুইজারল্যান্ড শান্তির দেশ, এখানে অপরাধের হার বেশ কম। নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্য, সুখ সবই বেশি। সমস্যাও তৃতীয় বিশ্বের তুলনায় অনেক কম।

তবু এই মাঝরাতে বিছানার এক কোণে শুয়ে থাকতে থাকতে অতন্দ্রর মনে হল, কলকাতার ঘিঞ্জি গলিই বোধ হয় ভালো। সেখানে চিৎকার করে হালকা হওয়া যেত। নিজের রাগকে যেভাবে হোক প্রকাশ করলেও কেউ ফিরে তাকাত না।

আর এই জনশূন্য প্রান্তরে একটা নিশ্বাস ফেললেও বুঝি কেউ চমকে তাকাবে!

ওর পাশে শুয়ে আছেন ফুলুমামা। পাশের ছোটো টি টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্পের আবছা আলোয় ফুলুমামার মুখের ভাঁজগুলোর দ্রুত ওঠাপড়া এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছে অতন্দ্র। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে টিকটিক শব্দে।

অতন্দ্রর শরীরের প্রতিটা অঙ্গ প্রচণ্ড ক্লান্তিতে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে, যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে হাত-পা। এই মুহূর্তে ওর অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। কিন্তু মাথাব্যথায় টাটিয়ে গেলেও ও ঘুমতে পারছে না কিছুতেই।

অথচ গত দু-দিন ধরে ও অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছে। পরশু রাতে লুসার্নে এসে পৌঁছোনোর পর থেকেই।

অম্বিকেশ অনেক চেষ্টা করেছিলেন গতকাল রাতে। নীচুগলায় বলে চলছিলেন, ‘জিনি, তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। দেখ, যা হয়েছে হয়েছে। ছেলেটাকে তো কম দিন আমরা দেখছি না। তোকে সত্যিই ভালোবাসে। সেই প্যারিস থেকে ছুটছে তোর পেছনে।’

জিনিয়ার মুখে কোনো ভাবান্তর হয়নি, সেদিন লক্ষ করেছিল অতন্দ্র। প্রাথমিকভাবে ভেবেছিল, জিনিয়া হয়তো মনে মনে প্রচণ্ড অবাক হয়ে পড়েছে। ভাবছে সুইজারল্যান্ডের এই হোটেলে অতন্দ্র কী করছে?

কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বুঝেছে, জিনিয়ার সত্যিই কোনো প্রতিক্রিয়া নেই অতন্দ্র-র আগমনে। আজ সারাটা দিন একরকম বলতে গেলে অনাহূত অবাঞ্ছিত অতিথির মতো কেটেছে ওর। একরকম পুতুলের মতো দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রতিটি যাত্রীর পিছু পিছু ও ঘুরেছে মাউন্ট টিটলিস, চ্যাপেল ব্রিজ। তারপর যন্ত্রমানবের মতো লুসার্ন লেকে ভাসমান ক্রুজে ডিনার করেছে।

সবাই যখন হিন্দি গানের সঙ্গে ডেকে মনের আনন্দে নাচ্ছিলেন, তখন ও চুপচাপ ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুজের এক কোণে। আড়চোখে দেখছিল, জিনিয়া একবারও ওর দিকে না তাকিয়ে নিজের কর্তব্য করে চলেছে।

ওর ইচ্ছে হচ্ছিল ঝাঁপ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে লুসার্ন লেকে।

ও এসে পড়াতে জিনিয়ার না আছে রাগ, না আছে দুঃখ, না আছে কোনো অভিমান, না আছে আনন্দ। কোনো অভিব্যক্তিই নেই।

জিনিয়ার জীবনে কি অতন্দ্র-র আর কোনো অস্তিত্বই নেই?

এই কথাটা যতবার উপলব্ধি করছে, ততবার শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওর চোখ ভিজে যাচ্ছে জলে। এভাবে শেষ কবে ও কেঁদেছে, মনে করতে পারছে না অতন্দ্র।

আসার আগে পর্যন্ত রবি বিশ্বকর্মা বেশ উত্তেজিত ছিল, ভেবেছিল স্বাভাবিক দম্পতির মতো একটা মান অভিমানের পালা চলবে কিছুক্ষণ। তারপর সব ঝামেলা মিটে যাবে। কিন্তু রকমসকম দেখে সে বেচারা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কেবলমাত্র একবার ওকে আড়ালে ডেকে বলেছে, ‘এই গুপ্ত, তুমি কী অপকর্ম করেছিলে ঠিক করে বলো তো? তোমার বউ এত রেগে আছে কেন?’

অতন্দ্র কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি রবিকে। লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে পারেনি যে, তেমন কিছুই হয়নি ওদের মধ্যে। কিন্তু আগুনে অল্প ঘি পড়লে তেমন কিছু হয় না, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ঘি ঢেলে দিলে আগুনের লেলিহান শিখা লকলকিয়ে উঠে আশপাশের সবাইকে পুড়িয়ে মারে।

ওদেরও হয়েছে সেই দশা।

প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা করে সেই রাতে ফুলুমামা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। জিনিয়া পাথরের প্রতিমার মতো শক্ত হয়ে বসে ছিল। অতন্দ্র জড়সড় হয়ে বসে ছিল দূরের একটা চেয়ারে।

শেষে ফুলুমামা ওঠার সময় বলেছিলেন, ‘আমি শুতে যাচ্ছি। কাল ভোরে ওঠা আছে। গুড নাইট।’

তখন জিনিয়া মুখ খুলেছিল। কারুর দিকে একবারও না তাকিয়ে বলেছিল, ‘মামা, আমি এই ঘরে একা রয়েছি। একাই থাকতে চাই।’

ইঙ্গিত বুঝে অতন্দ্র আর কথা বাড়ায়নি, ফুলুমামার পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। তারপর এই দু-দিন রাতে ওর থাকার জায়গা হয়েছে ফুলুমামার ঘরে। আর রবি স্থান পেয়েছে সঞ্জিত হাজরার ঘরে।

গত কয়েকদিন ওদের পাগলের মতো এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছুটে বেড়ানোর পর্ব অবশেষে শেষ হয়েছে। সঞ্জিত হাজরা ওকে অনেক সাহায্য করেছেন। ফুলুমামা শেষ পর্যন্ত ঠিক করে বলতেই পারছিলেন না, লুসার্নের ঠিক কোন জায়গায় রয়েছেন তাঁরা। শেষমেশ সঞ্জিত ফোনে ওদের সাহায্য করেন।

কিন্তু এত কাণ্ড করে কিছু লাভ হল কি?

তবে কি জিনিয়ার সেই ডিভোর্স পেপার পাঠানোটাই সত্যি?

ভাবামাত্র ওর শরীরের ভেতর যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায়। একটা মিথ্যে কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ওদের এতদিনের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে? বাকি জীবনটা বিনা দোষে অপরাধীর তকমা নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে ওকে?

জিনিয়া ওর প্রতিদিনের অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, কী করে অতন্দ্র কাটাবে বাকিটা জীবন?

হঠাৎ ওর ফোনে পিঁ পিঁ শব্দে মেসেজ ঢোকে।

অনিরুদ্ধ বসু।

‘তোমাদের দু-জনের তো কোনো খবরই নেই হে। ঘোরাঘুরি ভালোই হচ্ছে নিশ্চয়ই। নো প্রবলেম, ইউ গাইজ ট্রায়েড আ লট, নাউ এনজয় ইয়োর ভ্যাকেশন। রিগার্ডস, অনিরুদ্ধ।’

অতন্দ্র ফোনটা বন্ধ করে। ওর মনে পড়ে যায়, এবার ব্রিটলস ব্যাঙ্ক অ্যানাউন্স করবে তাদের সিদ্ধান্ত। বোঝা যাবে ওমনিসফট টেকি ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে ব্রিটলস ছিনিয়ে নিতে পারল কি না। বোঝা যাবে অতন্দ্র-রও টেকি ওয়ার্ল্ডে থাকার মেয়াদ ফুরোলো কি না!

জীবনের এই বাঁকে এসে ওর আর কিছুই যায় আসেনা। সংসার ভেঙে গেছে, আইনের পাঁচিল উঠতে শুরু করেছে। চাকরিও চলে যাওয়ার মুখে। পেছোতে পেছোতে দেওয়ালে যখন কোনো মানুষের পিঠ ঠেকে যায়, তখন তার আর কিছু করার থাকে না। সেই মুহূর্তে খুব ভীতু মানুষেরও মনে একটা বেপরোয়া ভাব এসে যায়। মনে হয়, ধুর, আর তো কিছু খারাপ হওয়ার নেই। যা হওয়ার হোক। শেষ দেখেই না হয় ছাড়ব।

কী যে হয় অতন্দ্রর, হঠাৎ ও বিছানায় উঠে বসে। তারপর ঘুমন্ত ফুলুমামার নিদ্রায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ও সন্তর্পণে উঠে যায়।

ঘর থেকে বেরিয়ে লবি দিয়ে হেঁটে সোজা চলে যায় জিনিয়ার রুমের দিকে।

যা হয় হোক, জিনিয়া যা বলে বলুক, তবু সেই কথাগুলোই ও শুনতে চায় এখন। যদি রাগের বশে হাত-টাতও চালিয়ে দেয় দিক, তবু কথা হোক ওদের মধ্যে। হোক প্রচণ্ড ঝগড়া, তবু কথা হোক।

এতদিনের কথাবন্ধের মাঝে বাসা বেঁধেছে বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝি, বেশ কিছু মধ্যস্থতাকারী। নিজেরা বসে কথা বলাটা খুবই প্রয়োজন। তারপর জিনিয়া যা সিদ্ধান্ত নেবে নিক। অতন্দ্র আর ওকে কোনোদিনও বিরক্ত করবে না। নিঃসাড়ে ওর জীবন থেকে চিরকালের মতো সরে যাবে।

বেল বাজানোর প্রায় পাঁচ মিনিট পর দরজা খোলে জিনিয়া। চোখ লাল, ফুলে আছে অল্প। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে ও ঘুমোচ্ছিল না। অতন্দ্র মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এভাবে কি ওদের জীবন থেকে একটু একটু করে সময় চলে যাচ্ছে না?

জিনিয়া ওকে দেখেই যেন একটা বেড়াল দেখেছে, এইভাবে ভাবলেশহীন মুখে দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু অতন্দ্র আজ মরিয়া, ও জোরে আটকাল দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা, বলল, আমার কিছু কথা শোনো, জিনি। তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে।’

জিনিয়ার কানে যেন কোনো কথাই ঢুকছিল না, ওর চোখের দিকে একবারও না তাকিয়ে দরজাটা প্রাণপণে বন্ধ করার চেষ্টা করছিল ও, কিন্তু গায়ের জোরে পেরে উঠছিল না।

অতন্দ্রও হাল ছাড়ছিল না। নাউ ওর নেভার! অনেক হয়েছে মান অভিমান বিরহ বিচ্ছেদ! আজ সব কথা ওকে খুলে বলতেই হবে।

লবি দিয়ে হেঁটে আসছিল দু-জন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। জিনিয়ার রুমের সামনে দরজা নিয়ে এমন ধস্তাধস্তি দেখে তারা থমকে দাঁড়াল। একজন অবোধ্য ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করল।

সুইজারল্যান্ডের অধিকাংশ বসবাসকারী ফ্রেঞ্চ অথবা জার্মান ভাষায় কথা বলেন। অতন্দ্র তেমনই অনুমান করে ইংরেজিতে কেটে কেটে বলল, ‘নান অফ ইয়োর বিজনেস। হাজব্যান্ড ওয়াইফ ম্যাটার।’

লোক দুটো কী বুঝল কে জানে, একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

মুহূর্তের অসতর্কতায় দরজাটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল জিনিয়া, অতন্দ্র চেপে ধরল, ‘জিনিয়া! তুমি গোটা ব্যাপারটা ভুলভাবে ইন্টারপ্রিট করেছ! প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন!’

জিনিয়া শুনছিল না, ওর হাতের চাপে দরজাটা চেপে বসছিল অতন্দ্রর হাতে, বাধ্য হয়ে ওর মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে গেল, ‘গীতিকা আর নেই জিনিয়া! ও সুইসাইড করেছে!’

জিনিয়া মুখ-চোখ শক্ত করে দরজাটা টানছিল, হঠাৎ অতন্দ্র-র কথাটা শুনে কেমন শিথিল হয়ে গেল। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

৫১

সুইজারল্যান্ডের ইনসব্রুক থেকে ইটালির ভেনিস আসতে বাসে লাগল প্রায় দশ ঘণ্টা। এমনিতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। এখানকার রাস্তাগুলো শুধু প্রকাণ্ড চওড়াই নয়, এত পরিষ্কার যে চাইলে অবলীলায় শুয়ে পড়া যায়। বাসের সিটগুলোও অত্যন্ত আরামপ্রদ, হেলিয়ে প্রায় শুয়ে পড়া যায়। কিন্তু তবু এতক্ষণ একভাবে শুয়ে বসে থাকলে একটা ক্লান্তি তো শরীরে এসে বাসা বাঁধেই।

তার ওপর দেড় ঘন্টা অন্তর বাস হাইওয়ের ধারে থামে কোনো একটা গ্যাস স্টেশনে। সেখানে টয়লেট ব্যবহার করা থেকে শুরু করে লাগোয়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে টুকটাক কেনাকাটাও করতে পারে সবাই।

এই নিয়েই আজ বেশ বিপত্তি বাঁধল। গতকাল রাতে ইনসব্রুকের হোটেলের ডিনারে মশলার পরিমাণ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, তাতে অন্যদের একটু অম্বলের সমস্যা হলেও মৃগাঙ্ক চট্টরাজের বেশ ভালোমতো পেটখারাপ হয়েছে। তিনি গোটা বাসযাত্রায় থেকে থেকেই ককিয়ে উঠছিলেন আর পেট চেপে ধরছিলেন।

অন্যদিন লম্বা সফরগুলোয় জিনিয়া, সঞ্জিত আর ফুলুমামা চেষ্টা করেন মাঝেমধ্যে অন্ত্যাক্ষরী জাতীয় কিছু খেলাতে। এই কয়েক দিনেই সবার জানা হয়ে গেছে, উৎপল বিশ্বাসের স্ত্রী মৃদুলা বেশ ভালো রবীন্দ্রসংগীত গান। এই দলে বেশ কিছু সংগীতপ্রিয় মানুষ আছেন। তাঁরা মৃদুলাকে উৎসাহ দেন। কিন্তু মৃগাঙ্ক চট্টরাজ আবার রবীন্দ্রসংগীত একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি ডাকেন মধুছন্দাকে, সে হিন্দি গান গায়। অন্ত্যাক্ষরী খেলা ছাড়াও মাঝেমধ্যেই অন্যান্যরা মৃদুলা আর মধুছন্দাকে অনুরোধ করেন, উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে। সঞ্জিত হাজরার মাইক্রোফোন তো রয়েছেই।

জিনিয়া বসেছিল বাসের একেবারে সামনে, ক্লিমেন্টের আসনের বাঁ-দিকে। সঞ্জিত অতন্দ্র আর রবির সঙ্গে একেবারে পেছনের দিকে বসেছিলেন। তিনজনের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা হয়েছে।

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ জিনিয়ার কাছে গিয়ে করুণ সুরে বললেন, ‘প্লিজ, দিদিমণি! এইখানে, এইখানে এট্টু দাঁড়ান! আর কিছুই পারছি না।’

জিনিয়া মুশকিলে পড়ল। একটু আগেও মৃগাঙ্ক চট্টরাজ এসে এই একই অনুরোধ করেছিলেন, তখনই ক্লিমেন্ট সাফ জানিয়ে দিয়েছে এভাবে যেখানে সেখানে সে কিছুতেই দাঁড়াতে পারবে না। ইউরোপের পুলিশ অত্যন্ত কঠোর, মোটা জরিমানা তো হবেই, পারমিট নিয়েও টানাটানি হতে পারে। পরবর্তী গ্যাস স্টেশন আসতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো বাকি, ততক্ষণ মৃগাঙ্ক চট্টরাজকে ধৈর্য ধরতেই হবে। এমনিতেও এখনো পর্যন্ত বাস যতবার গ্যাস স্টেশনে দাঁড়িয়েছে, মৃগাঙ্ক চট্টরাজ টয়লেটে গেছেন। শুধুমাত্র প্রথমবার বাসের ভেতরের বায়োটয়লেটে গেছিলেন, কিন্তু ক্লিমেন্ট যেই আন্দাজ করেছে মৃগাঙ্কবাবুর পেটের গোলমাল হয়েছে, ও কিছুতেই আর বাসের টয়লেট ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।

জিনিয়া, ফুলুমামা আর সঞ্জিত তো বটেই, বাকিরাও অনেকবার ক্লিমেন্টকে অনুরোধ করেছে, কিন্তু ক্লিমেন্ট নারাজ। ওর বক্তব্য, ওই টয়লেটটা একেবারেই এমারজেন্সির জন্য, বারবার গেলে নোংরা হয়ে যাবে। আর বাস নোংরা হতে ও কিছুতেই দেবে না। আরও কয়েকবার অনুরোধে ও কোনো কথা না বলে চুক্তির কাগজপত্র খুলে শর্তাবলি দেখিয়ে দিয়েছে জিনিয়াকে।

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ আবার ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘ও দিদিমণি। একবারটি থামতে বলুন না!’

জিনিয়া বিব্রতমুখে বলল, ‘ওইভাবে তো থামানো যাবে না মৃগাঙ্কবাবু। আপনি আর কিছুক্ষণ সহ্য করুন। এখানে তো রাস্তার ধারে কোনো টয়লেট নেই।’

‘আরে, টয়লেট-ফয়লেট ওসব কিচ্ছু লাগবে না আমার! সকাল থেকে আটবার ওই টয়লেটগুলোয় গিয়েছি দিদিমণি। প্রত্যেকবার দেড় ইউরো করে, মানে হল গিয়ে প্রায় হাজার টাকা আমি শুধু হে …।’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ কোঁত করে কথাটা গিলে নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘কী সাংঘাতিক! এভাবে চললে আমি তো ফতুর হয়ে যাব দিদিমণি!’

পেছন থেকে অনমিত্র ফুট কাটল, ‘কাল রাতে পইপই করে বলেছিলাম, মৃগাঙ্কদা মাঞ্চুরিয়ানটা অত খেয়ো না, শুনলে? কি না, বুফেতে যত খুশি দিচ্ছে, খাব না? নাও, এখন ঠ্যালা সামলাও!’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ কাঁচুমাচু মুখে পেছন ফিরে বললেন, ‘আরে দেখ না ভাই, তার ওপর এখানকার টয়লেটগুলো এমন বিচ্ছিরি, জলও থাকে না। ওই টিসু কাগজ দিয়ে কিপোষায় বল? জল না হলে বাঙালির চলে?’

বাসের সবাই হা হা করে হেসে উঠল কথা শুনে। সঞ্জিত হাজরা বললেন, ‘কী আশ্চর্য। আমি তো আসার দিনই বলে দিয়েছিলাম এইসব দেশে আমাদের মতো জল অপচয় হয় না। যস্মিন দেশে যদাচার! এই যে এতগুলো দেশে এতগুলো হোটেলে উঠলেন, দেখলেন না, খাবার জলও বাথরুমের বেসিন থেকে নিয়ে খেতে হচ্ছে?’

‘দেখিনি আবার!’ মুখ বেঁকিয়ে বললেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ, ‘ছ্যা ছ্যা। খাবার গ্লাস কিনা রাখা রয়েছে বাথরুমের বেসিনে।’

‘আরে এখানে বাথরুমের জলই খাওয়ার উপযুক্ত!’

‘ওসব উপযুক্ত-টুপযুক্ত বুঝি না মশাই।’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আমি হলাম গিয়ে খাঁটি বাঙালি। খাওয়ার পর রান্নাঘর থেকে জল নিয়ে ঢকঢক করে খাব, বাথরুমে গিয়ে চারপাশে শুধু জল দেখতে পাব, এটাই আমার ইচ্ছে। হ্যাঁ।’

‘তা, এখানে তো বাথরুমে জলের ছড়াছড়ি নেই। শুধুই শুকনো টয়লেট পেপার।’ আকবর আলি হেসে বললেন, ‘আপনি কী করছেন তাহলে?’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ এবার রহস্যময়ভাবে হেসে বললেন, ‘কে বলল জল নেই আলিসাহেব? দেখার চোখ থাকতে হয় বুঝলেন? কমোডের ভেতরে জল নেই?’

‘ইশ!’ মুহূর্তে ঘেন্নায় সবার নাক কুঁচকে গেল, ‘আপনি ওই জল দিয়ে…এহ রাম!’

‘ওসব রামলক্ষণ ছাড়ুন, আপনি ওই হুমদোটাকে একবার দাঁড় করাতে বলুন দিদিমণি। আমি আর পারছি না।’ ক্লিমেন্টের দিকে একবার তাকিয়ে গজগজ করলেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ, ‘আমি রাস্তার ধারেই ঠিক ম্যানেজ করে নেব। নাহলে কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাবে এবার!’

‘পাগল নাকি আপনি?’ জিনিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘এটা কি ভারতবর্ষ পেয়েছেন নাকি? এখানকার পুলিশকে তো চেনেন না, তুলে নিয়ে গিয়ে সোজা হাজতে পুরে দেবে আপনাকে। পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করবে। আমরা তো চলে যাব, আপনি তখন কী করবেন?’

‘তাহলে?’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, ‘কী করব আমি, দিদিমণি? আমি আর পারছি না। সব ওই লালমুখো নচ্ছারটার জন্য। টয়লেট থাকা সত্ত্বেও যেতে দিচ্ছে না আমায়।’

সৈকত বলল, ‘তুমি একটা কাজ কোরো মৃগাঙ্কদা, এবার গ্যাস স্টেশন থেকে কয়েকটা ডায়াপার কিনে নাও। পরে থাকলে আর কোনো চাপ হবে না তোমার।’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ জ্বলন্ত চোখে তাকালেন, ‘মর্কটের দল সব! ঝাড়ে নির্বংশ হবি, দেখ না!’

সৈকত, অভীক, অনমিত্র এইসব আদরের বিশেষণগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত, ওরা একে অন্যের গায়ে খোঁচা দিয়ে হাসতে লাগল।

গ্যাস স্টেশন যখন এসে পৌঁছোল, তখন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ প্রায় নেতিয়ে পড়েছেন। তবু বাস থামতে তিনি তিরের বেগে ছুটলেন টয়লেটের দিকে। কলকাতার মেট্রো স্টেশনের কায়দায় এখানে টয়লেটেও একটা করে কয়েন ফেললে সামনের লম্ব অবস্থানে থাকা চাকাটি একপাক ঘুরে গিয়ে পথ করে দেয় ভেতরে একজনের যাওয়ার। আশ্চর্যের ব্যাপার, নজর রাখার জন্য একজনও মোতায়েন নেই। তবু মানুষ সুসংবদ্ধ কিউতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, একজন করে কয়েন ফেলে ঢুকে যাচ্ছেন ভেতরে। কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই।

প্রথম বিশ্ব শুধু নিজেদের সম্পত্তির জোরেই উন্নত নয়, নাগরিকদের সচেতনতাটাও একটা কারণ। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ হলে লোকজন ওই চাকার বেমালুম ওপর দিয়ে টপকে ভেতরে চলে যেত। কিংবা ওই কয়েন ভেন্ডিং মেশিনটার ওপর হামলা চালাত। মনে মনে ভাবল জিনিয়া। টুরের প্রথম দিনে সঞ্জিত হাজরার বলা কথাটা মনে পড়ে গেল ওর।

এখানকার মানুষ রুল ভেঙে হিরো হওয়ার চেষ্টা করেন না। রুল মেনে হিরো হতে চান।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের বাস এখানে দাঁড়াবে ঠিক আধ ঘণ্টা। জিনিয়া ঘড়ি দেখল। আর ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় ভেনিস ঢুকবে ওরা। তারপর ছোটো বোটে করে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের বুক চিরে গ্র্যান্ড ক্যানালের ওপর দিয়ে পাড়ি জমাবে ভেনিসের হৃৎস্পন্দন সান মার্কোর দিকে।

তারপর ওখানে সারা বেলাটা কাটিয়ে ভেনিসেরই একটা রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজ সারার কথা। জিনিয়া গোটা টুরটায় চেষ্টা করেছে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। সঞ্জিত প্রথমদিকে দু-একবার অনুযোগ করেছিলেন, ‘ইউরোপে এসে শেষে আমাদের লোকেরা পরোটা, ছোলাবাটোরে, ভাত, বিরিয়ানি এইসব খাবে? এটা কীরকম হবে ম্যাডাম? যে জায়গার যেটা সিগনেচার ডিশ, সেটাই তো খাওয়া ভালো।’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার দলে বয়স্ক মানুষই বেশি। তাঁরা রোজ ওই কন্টিনেন্টাল খেলে মুখ সিঁটকোতে শুরু করবেন। ওই বয়সে গিয়ে খাওয়ার ব্যাপারে এক্সপেরিমেন্ট করতে ইচ্ছে হয় না মি হাজরা। তার চেয়ে মাঝেমধ্যে এক একদিন লোকাল খাবার খাওয়ানো হবে। কিন্তু রোজ নয়।’

তো, আজ তেমনই একটা স্থানীয় খাবার খাওয়ার দিন। ভেনিসের একটা রেস্টুরেন্টে পিৎজা দিয়েই সারা হবে আজকের লাঞ্চ।

না চাইতেও জিনিয়ার চোখ চলে গেল দূরে অতন্দ্রর দিকে। অতন্দ্র আর ওর ওই রবি নামক দক্ষিণ ভারতীয় সহকর্মীটি সঞ্জিতের সঙ্গে হেসে হেসে কী আলোচনা করছে। একটু আগেই আরতিকে ধরে ধরে বাস থেকে নামিয়েছে অতন্দ্র, তারপর হাত ধরে নিয়ে গিয়েছে টয়লেটের দিকে, সেটাও খেয়াল করেছে ও।

জিনিয়া একটা নিশ্বাস ফেলল। বিধাতার ইচ্ছা বড়ো আশ্চর্য। পাকেচক্রে যে মানুষটার দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের যাত্রীদের খেয়াল রাখার কথা ছিল, ওর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কাজ করার কথা ছিল, সে আজ সত্যিই জড়িয়ে পড়েছে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে।

না। এটা জিনিয়া একেবারেই চায়নি। অতন্দ্র যেদিন নির্দয়ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের হাত, সেদিনই ও প্রতিজ্ঞা করেছিল, অতন্দ্রকে ছাড়াই দুর্গম পথ চলার কথা।

কিন্তু গতকাল রাতে গীতিকার আত্মহত্যার খবরটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছিল ও। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ওর সেই ক্ষণিকের নীরবতার সুযোগে অতন্দ্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সব খুলে বলেছিল ওকে।

জিনিয়া প্রথমবারের জন্য শুনেছিল, গীতিকার বাবা-মা কেউ ছিল না। সেই প্রথম জেনেছিল, বিবস্বান বলে একটা ছেলে কীভাবে প্রতারণা করেছে ওর সঙ্গে, ওর শরীরমন তছনছ করে ছেড়ে দিয়েছে হাত। শুনতে শুনতে ওর মনের ভেতরটা অনুতাপে অপরাধবোধে পুড়ে যাচ্ছিল। যে মেয়েটা একলা এত সংগ্রাম করছিল, তাকে ওইসময়েই সে অত কটূ কথা বলেছে?

গীতিকার এই পরিণতির জন্য একটু হলেও কি ও নিজে দায়ী নয়?

ভাবা ইস্তক প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে মন। নিজেকে বড়ো স্বার্থপর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ভার ওই মেয়েটার কাঁধে সেদিন অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিয়ে যে অন্যায় করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত ও কীভাবে করবে?

কাল সারারাত ঘুমোয়নি ওরা দু-জনেই। অতন্দ্র চুপ করে বসেছিল ওর ঘরের সোফায়। আর ও বিছানায় হেলান দিয়ে ভাবছিল। তারপর কাকভোরে বাস নিয়ে বেরিয়ে এসেছে হোটেল থেকে।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ও আবার তাকাল দূরে। এবার অতন্দ্রদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে অভীক আর অনমিত্র। মৃগাঙ্ক চট্টরাজের এখনও টয়লেট থেকে বেরোনোর কোনো চিহ্ন নেই।

সঞ্জিত জিনিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিলেন, ‘ভেনিসের হোটেলটায় ই-মেল করে দিয়েছেন ম্যাডাম?’

‘হ্যাঁ।’ জিনিয়া মাথা নাড়ল। এই মানুষটার দিকে তাকালেই ও ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে গুটিয়ে যাচ্ছে।

উফ, চারপাশ থেকে ওর জীবনটা যেন ভয়ংকর জটিল হয়ে উঠেছে। এতটাই জটিল, যে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। কাকে সোজাভাবে নেবে, কাকে সন্দেহ করবে, সব যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে ওর কাছে।

ও একটু থেমে বলল, ‘আচ্ছা মি হাজরা, অতন্দ্র আর ওর বন্ধুরা কি এখন আমাদের সঙ্গেই বাকি টুরটা করবে?’

‘হ্যাঁ, প্রবলেম তো কিছু নেই!’ সঞ্জিত বললেন, ‘রৌণক সাধুখাঁর জন্য রুম থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই আমাদের বুকিং ছিল, সেই রুমেই নাহয় থাকবেন ওঁরা দু-জন।’

জিনিয়া বলল, ‘তাতে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কী প্রফিট হবে মি হাজরা? আমরা তো নিজেদের গাঁটের পয়সা থেকে লোককে ইউরোপ ভ্রমণ করাতে নিয়ে আসিনি।’

‘সব জায়গায় কি টাকা রোজগারটাই প্রফিট ম্যাডাম? সেটা হলে তো আপনিও গ্লোবাল টুরসের মতো ফাঁকিবাজি করে ঘোরাতে পারতেন। আপনি তো বলেছিলেন, প্রথম টুরে আমি লাভ করব না, মানুষের মন জিতব।’ সঞ্জিত একটু হাসলেন, তারপর বললেন, ‘আপনার নিজের মনটারও তো যেতা প্রয়োজন। তাই না?’

জিনিয়া চোখ সরিয়ে নিল। বোঝাই যাচ্ছে ওর আর অতন্দ্রর বিচ্ছেদের কথা সঞ্জিতের অজানা নেই। অতন্দ্রই নিশ্চয়ই বলেছে ব্যাপারটা। যে অতন্দ্র বাইরের কারুর কাছে নিজেদের সমস্যা নেই বললে প্রচণ্ড রাগ করত, সে-ই আজ মাত্র দু-দিনের পরিচিত সঞ্জিতকে এসব বলেছে?

ওর আবার চোখে চলে গেল ওদিকে।

প্রাণপণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর হৃদয় ওকে জানান দিল, ‘অতন্দ্র অনেক রোগা হয়ে গেছে জিনি! চোখের কোণে কালি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অতন্দ্র ভালো নেই, জিনি। ঠিক যেমন নেই তুমি।’

৫২

আলোকপর্ণা উদাস চোখে তাকিয়েছিল দূরের গঙ্গার দিকে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশ গাঢ় কমলা রঙে যেন কেউ রাঙিয়ে দিয়েছে। সেই কমলার সঙ্গে কাঁচা সোনার মতো রং মিশে গঙ্গার জলকে দেখাচ্ছে ঘন ক্ষীরের মতো। কাছাকাছি কোনো বাড়িতে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। শাঁখ বাজছে জোরে জোরে।

দিদিদের এই ফ্ল্যাট থেকে গঙ্গা এত ভালোভাবে দেখা যায় ওর জানা ছিল না।

ঋতুপর্ণা কফি নিয়ে এসে ওর দিকে এক কাপ বাড়িয়ে দিল, ‘নে। ধর।’

আলোকপর্ণা চুপচাপ কাপটা হাতে নিল। তারপর গঙ্গার দিকে আবার তাকিয়ে বলল, ‘ইমরানদা কোথায়?’

ঋতুপর্ণা বলল, ‘ও আসছে। এখানে খুব ভালো চিংড়ি মাছের পকোড়া করে একটা দোকানে। নিয়ে আসতে গেছে। এখুনি এসে পড়বে।’

আলোকপর্ণা এক সেকেন্ডের জন্য দিদির দিকে তাকিয়েই আবার চোখ সরিয়ে নিল, ‘তোর মনে আছে চিংড়ি মাছ খেতে আমি ভালোবাসি?’

ঋতুপর্ণা হেসে ফেলল, ‘ছোটো থেকে এই নিয়ে দিনের পর দিন বঞ্চিত লাঞ্ছিত হয়ে এসেছি, আমাকে অন্যদিকে কিছু একটা দেখতে বলেই টুক করে আমার থালা থেকে চিংড়ি মাছগুলো নিয়ে টপাটপ মুখে পুরে দিতিস, আর আমার মনে থাকবে না?’

আলোকপর্ণা হেসে ফেলল। ওর বুকের ভেতরটা কেমন করছে। প্রচণ্ড আনন্দ হলে এমন হয় হয়তো।

সকালে দিদির বকাবকিতে ও ফোন অন করে মা-কে জানাতে যাচ্ছিল, দিদি ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিল। তারপর ওপাশে ‘হ্যালো’ শুনতেই শান্তস্বরে বলেছিল, ‘ঋতু বলছি মা। ছোটু আমার কাছে আছে। তোমরা চিন্তা কোরো না। এখানে দু-একদিন থাকুক, তারপর ও হিন্দমোটর যাবে।’

মা কী বলেছিল, তা শুনতে পায়নি আলোকপর্ণা। তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে ওর আর ইচ্ছেও হয়নি। মা যদি দিদিকে আবারও কোনো বাজে কথা বলে থাকে, তবে সেটা মায়েরই ভুল। মায়ের জানা উচিত, গত দু-মাস ধরে ওদের সংসারের সিংহভাগ খরচ চালিয়ে আসছে দিদিই।

জিনিয়াদি-র ওপর যে প্রচণ্ড রাগটা ওর হয়েছিল, সেটা আর নেই। রাগের মাথায় ও সবকিছুকেই ভুলভাবে ধরছিল। জিনিয়াদি বন্ধুর কথামত ওকে সাহায্যই তো করছিল। দিদির থেকে টাকা নিয়ে বাড়িয়ে মাইনে দেওয়া, দিদির কিনে দেওয়া কুলার লাগানো সেসব করলেও আলোকপর্ণার প্রতি ভালোবাসাটা তো মিথ্যে নয়!

ও বলল, ‘আচ্ছা, মন্দার গাঙ্গুলি বলে একজন তোর সঙ্গে ইলেভেন টুয়েলভে কোচিং-এ পড়ত। তোর মনে আছে?’

‘মন্দার গাঙ্গুলি?’ ঋতুপর্ণা ভাবতে ভাবতে বলল, ‘কেমন দেখতে বল তো?’

‘এমনিই, নর্মাল।’ আলোকপর্ণা আবার গঙ্গার দিকে তাকাল। সূর্য একেবারে ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। তবু পশ্চিমদিকটায় সামান্য আলোর ছোপ লেগে আছে।

ও আবার বলল, ‘চোখে ভালো দেখতে পায় না।’

‘ওহ! পিকলু?’ ঋতুপর্ণা বলল, ‘ভালো নাম বলেছিলি বলে প্রথমে বুঝতে পারিনি। হ্যাঁ, মনে আছে তো। নতুনপল্লির দিকে বাড়ি ছিল। খুব সুন্দর ছবি আঁকত। ওর মা-ও খুব ভালো ছিলেন। স্কুলে পড়াতেন। তুই কী করে চিনলি?’

আলোকপর্ণা ঢোঁক গিলল। পুরোনো দিনের মতো ওর ভীষণ ইচ্ছে করছে দিদিকে সবকিছু খুলে বলতে। আগে সামান্য থেকে সামান্যতম, এমন কোনো কথা ছিল না যেটা ও দিদিকে বলার আগে কোনোরকম ইতস্তত বোধ করত। মনে হত, দিদি যেন ওরই আরেকটা সত্তা। দিদিকে আবার কিছু লুকোনো যায় নাকি। আর এমনিতেও দিদির গরবে গরবিনি আলোকপর্ণা বরাবরই দিদির বুদ্ধিতে ভীষণ আস্থা রাখত।

কিন্তু মাঝের এই দু-বছরে যেন অদৃশ্য একটা প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে দু-জনের মধ্যে। দিদি ওর এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তবু মনের দিক থেকে যেন অনেক দূরে।

ও বলল, ‘একদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম। আলাপ হয়েছিল। পিকলুদা-র মা মিনতি মাসিমা তো জিনিয়াদির সঙ্গে টুরে গেছেন।’

‘ওহ! উনি গেছেন?’ ঋতুপর্ণা বলল, ‘জিনিয়া বলল তুই লোকাল একজন কাস্টমার জোগাড় করেছিস। আমি ভাবলাম কে না কে!’

আলোকপর্ণা ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ওর খুব ইচ্ছে করছে দিদির গলা জড়িয়ে সব কিছু খুলে বলতে। কোনোদিনই দিদি ছাড়া ওর কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না। এই দুটো বছর কত কী যে কাউকে না বলতে পেরে ও গুমরেছে।

আচ্ছা, দিদিকে এখন জোর করে বাড়ি নিয়ে গেলে হয় না? ছোটোমেয়ে দু-দিন ধরে নিখোঁজ, তারপরও কি বড়োমেয়ে এলে বাবা-মা আগের মতোই দুর্ব্যবহার করবেন? মনে হয় না।

যদি সত্যিই দিদি যায়, সেই আগের মতো রাত জেগে বিছানায় শুয়ে গল্প করবে ওরা দু-জন। সেই আগের মতো ছুটির দিন দুপুরে চালিয়ে দেবে পুরোনো কোনো বাংলা সিনেমা। সেই আগের মতো দুই বোনে রান্না করবে নতুন কোনো পদ।

ওর ভাবনার মাঝেই টুংটাং শব্দে একটা মেসেজ ঢুকল। ও কাঁপা চোখে দেখল পিকলুদা।

সকালে পিকলুদা অনেক দীর্ঘ একটা মেসেজ লিখেছিল। কাল বিকেলে আলোকপর্ণার অফিসে গিয়ে কেন ওকে পায়নি, তা জানিয়ে।

ও কোনো উত্তর দেয়নি।

তবে এবার অন্য মেসেজ।

পা ফেলি আঁধারের খাদে, সামলাই, বেঁচে উঠি রোজ।

লড়াইয়ের প্রত্যেক বাঁকে, শুধু তুমি নিয়ে যেয়ো খোঁজ।

‘আমার জীবনের আলো হবে, আলোকপর্ণা? কথা দিচ্ছি, জীবনে কোনোদিন ওই আলো ম্লান হতে দেব না। মন্দার।’

একঝলকে পড়ে নিয়েই আলোকপর্ণার শরীরের প্রতিটা রোমকূপ কেঁপে উঠল। চোখ বুজে এল অসম্ভব ভালোলাগার এক আবেশে। মনে হল, রাস্তায় বেরিয়ে যেতে, ইচ্ছে হল হেঁটে চলতে অনন্ত পথ! কিংবা চলে যেতে সামনে বেয়ে চলা ওই গঙ্গায়। নদীর পারে বসে থাকে অনন্তকাল।

পিকলুদা-র মতো ছেলে ওকে জীবনপথে পাশে চাইছে? আহ, কে বলেছে ওর ভাগ্য ভালো নয়? কত সুন্দর, কত অমূল্য এই জীবন!

আনন্দে ওর চোখে জল চলে এল। হঠাৎ ওর মাথায় যেন কবিতা ভর করল। একটুও না ভেবে ও মেসেজের উত্তর লিখতে লাগল,

ভেবে নিয়েছি পিকলুদা! ওই ওটাই আমার বৃত্ত।

হয় তুমি, নয় তোমার হাতে আমার শেষকৃত্য।

ঋতুপর্ণা আলতো ঠোকা মারল ওর কাঁধে, ‘কী রে ছোটু? কী ভাবছিস?’

আলোকপর্ণা দিদির দিকে তাকাল। ওর প্রাণের চেয়েও প্রিয় দিদি। ছোটোবেলা থেকে কত কিছুতে পাশে দাঁড়িয়েছে ওর, ওর ইচ্ছেপূরণ করতে বুঝিয়েছে বাবা মাকে।

ও একটু থেমে পরিষ্কার উচ্চারণে বলল ‘আমি পিকলুদাকে বিয়ে করতে চাই দিদি! তুই মা-বাবাকে রাজি করাবি, প্লিজ?’

৫৩

গ্র্যান্ড ক্যানালের ওপর দিয়ে স্পিডবোটে ভেনিসের হৃৎপিণ্ড পিয়াজা সান মার্কোতে যখন পৌঁছোনো হল, তখন মাথার ওপর সূর্য বেশ অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। পিয়াজা সান মার্কোর বিরাট চত্বরে লোক গিজগিজ করছে।

লোকমুখে অবশ্য এটা সেন্ট মার্কস স্কোয়্যার নামেই বেশি পরিচিত। সঞ্জিত বলছিলেন, এমন কথাও প্রচলিত আছে, সম্রাট নেপোলিয়ন নাকি এই জায়গাটাকে ইউরোপের ড্রয়িং রুম বলেছিলেন। কোনো প্রমাণ নেই যদিও।

বিশাল একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। পূর্বদিকে রয়েছে ইউরোপের বিখ্যাত গির্জা সেন্ট মার্ক ক্যাথিড্রাল। প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো এই গির্জা প্রাচীন বাইজানটাইন স্থাপত্যের একটা আদর্শ উদাহরণ। দু-পাশে দুটো করে আর্চ শেপের প্রকোষ্ঠ, মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড প্রকোষ্ঠ, সেটার ওপরে সেন্ট মার্কের নিখুঁত প্রস্তরমূর্তি। সেন্ট মার্কের আশেপাশে রয়েছে বেশ কিছু অ্যাঞ্জেল। তার নীচে রয়েছে সোনালি একটা সিংহ মূর্তি যার পিঠে দুটো ডানা।

সঞ্জিত মুখস্থর মতো বলে চলেছিলেন, ‘ওই যে ডানাওলা সিংহটা দেখছেন, ওটাই ছিল প্রাচীনকালে ভেনেশিয়া সাম্রাজ্যের প্রতীক। সেন্ট মার্ক ক্যাথিড্রালের পাশেই দেখুন রয়েছে একটা ক্লক টাওয়ার। ক্লক টাওয়ারের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সেটা সোজা চলে গেছে …।’

সবাই যত না শুনছিল সঞ্জিতের কথা, তার চেয়ে বেশি দেখছিল চারপাশ। গোটা জায়গাটায় যেন কোনো উৎসব চলছে। নানা ধরনের পর্যটকের ভিড়ে জায়গাটা ভরতি। তারই মধ্যে কোথাও বসে একটা ছেলে তার বেহালায় সুর তুলছে, চারপাশে গোল হয়ে সেই বাজনা শুনছে কিছু মানুষ, কোথাও আবার বৃদ্ধ এক শিল্পী আপন খেয়ালে এঁকে চলেছেন। সামনে টাঙিয়ে রেখেছেন পোস্টার, কয়েক ইউরো দিলেই তার বিনিময়ে তিনি এঁকে দেবেন নিখুঁত পোট্রেইট।

কোথাও কোনো তরুণী বাজনার তালে তালে জিমনাস্টিক্সের কসরত করছে, কোথাও তারই পাশে বিক্রি হচ্ছে ভেনিসের বিখ্যাত মুখোশ।

মিনতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন। জিনিয়া এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই জায়গাটা বড্ড ঘিঞ্জি, না মাসিমা?’

মিনতি হেসে বললেন, ‘একটু হয়তো ঘিঞ্জি। কিন্তু এই শহরটায় একটা আলাদা জীবন আছে, জিনিয়া। এখানে সবাই কেমন প্রতি মুহূর্তকে উপভোগ করছে দেখো! এরা অতীতে নয়, ভবিষ্যতে নয়। বর্তমানে বাঁচে।’

সঞ্জিত আসার সময়েই সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘এতদিন আপনারা ইউরোপের যত দেশ দেখেছেন, তাদের থেকে ইটালি কিন্তু আলাদা। ইটালিতে জনসংখ্যা অনেক বেশি আর রোম, ভেনিস বা পিসার মতো শহরগুলোয় পকেটমার বা ছিনতাইবাজ গিজগিজ করে। সুতরাং সবাই নিজের হ্যান্ডব্যাগ, পার্স, পাসপোর্ট এগুলো সাবধানে রাখবেন।’

শুধু এই কারণেই নয়, ইটালি অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। ইংল্যান্ডের লন্ডন থেকে সফর শুরু করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, অ্যামস্টারডাম, সুইজারল্যান্ড প্রতিটি দেশেই এই এপ্রিল মাসেও বেশ ভালো ঠান্ডা ছিল। কিন্তু ইটালির তাপমাত্রা অনেকটাই বেশি। এই রোদ্দুরে বেশ হাঁসফাঁস লাগছে। তবু কারুরই উৎসাহে কোনো খামতি নেই।

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ এখন ওষুধ খেয়ে অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। তিনি থেকে থেকেই বলছেন, ‘আরে সেই যে অমিতাভ বচ্চন নৌকোয় চড়ে গান গেয়েছিল। দো লবজো কি হ্যায় দিল কি কাহানি। সেটা কোথায়?’

‘সব হবে। একটু ধৈর্য ধরুন।’ হাসিমুখে বরাভয় দিয়েছেন সঞ্জিত হাজরা, ‘এখান থেকে আমরা কিছুটা এগিয়ে গিয়েই গন্ডোলায় চাপব। তারপর ঘুরে বেড়াব এখানকার ক্যানালগুলোয়। ওই গানটার মতোই।’

‘আরে মৃগাঙ্কদা, তুমি গন্ডোলায় চড়বে, তোমার জিনাত আমন কোথায়?’ ফুট কাটে সৈকত।

‘জিনাত আমন মানে?’ কটমট করে তাকান মৃগাঙ্ক চট্টরাজ।

অভীক অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে হাত উলটে বলল, ‘যাহ বাবা, অমিতাভ বচ্চন তো গানটা গেয়েছিল জিনাত আমনের গলা জড়িয়ে। তোমারও তো তেমন কাউকে লাগবে, নাকি?’

আশপাশের সবার মধ্যে হাসির রোল ওঠে। পিয়াসা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কী মৃগাঙ্কদা, এখানে তো কত মেয়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনার সঙ্গে গন্ডোলা রাইডে যাওয়ার জন্য কাউকে প্রোপোজাল দিয়ে দেখব নাকি?’

‘না না, খবরদার না!’ রসিকতা বুঝতে না পেরে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ, ‘শেষে আমার হালও কি ওই রৌণক সাধুখাঁ-র মতো করবেন নাকি আপনারা? আমাকে জিনিয়া দিদিমণি তাড়িয়ে দিলে তো আমি নিজে নিজে দেশেও ফিরতে পারব না। এখানেই সারাজীবন ভিক্ষে করে কাটাতে হবে।’

হাঁটতে হাঁটতে হাসি, মজা, হইহুল্লোড়। অতন্দ্র পরেশনাথ কুণ্ডুর ছেলে রোদ্দুরকে কাঁধে চাপিয়ে এগোচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে এটা ওটা দেখছিল। অতন্দ্রর সহকর্মী রবি হাঁটছিল তার পাশে পাশেই।

গোটা দলটা আশপাশের চোখধাঁধানো স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছিল। মধুছন্দা আর উইশি একটু আগেই দরদাম করে দুটো ভেনেশিয়া মুখোশ কিনেছে। তারা এখন সেগুলো পরে সবার সঙ্গে পা মেলাচ্ছে।

পুরোনো দিনের সম্রাজ্ঞীদের আদলে শুধু চোখ ঢাকা আঁকাবাঁকা ডিজাইনের রঙিন সেই মুখোশে আর লাল টকটকে গাউনে সুন্দরী উইশিকে মনে হচ্ছে যেন মিশরের রানি ক্লিওপেট্রা। খোদ ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে।

উইশিকে যে আগুনের গোলার মতো সুন্দর লাগছে, সে-ব্যাপারে আকবর আলি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা-র মতোই এই ভিড়েও তিনি প্রেমিকার হাত সযত্নে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।

সামনেই একটা স্ট্যান্ড। সেখান থেকে একটার পর একটা গন্ডোলা ছাড়ছে।

গন্ডোলা হল ভেনিসের বিশেষ ধরনের এক নৌকো। লম্বা লম্বা সরু সরু, অনেকটা মোচার খোলার মতো আকৃতি। ভেনিসের অসংখ্য ক্যানাল বা খাঁড়িতে তারা রূপকথার জলরথের মত ভেসে বেড়ায়।

সঞ্জিত একটু আগেই বলছিলেন, এক-শো আঠারোটা ছোটো ছোটো দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ভেনিস নগরী। এই এতগুলো দ্বীপের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোটো বড়ো খাঁড়ি, খাঁড়িগুলোর ওপর রয়েছে চারশোরও বেশি ছোটো ছোটো সুদৃশ্য সেতু। দেড় হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো এই প্রাচীন শহরের সময় যেন থমকে রয়েছে মধ্যযুগেই। ইচ্ছে করেই ক্যানালের পাশের বাড়িগুলোয় আনা হয়নি আধুনিকতার ছাপ।

জিনিয়া ফোন করছিল সেই নম্বরে, যেটা ড ওবায়েদ হক দিয়েছিলেন।

লোকটার নাম আনসার মিয়াঁ। ফোন ধরতেই জিনিয়া বলল, ‘হ্যালো, আনসার মিয়াঁ বলছেন?’

‘স্লামালেইকুম। বলতাসি। আপনি কে আপু?’ ওপাশ থেকে একটা পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসে।

বাংলাদেশে দিদিকে যে আপু বলা হয়, সেটা জিনিয়ার অজানা নয়। ও বলল, ‘দাদা, আমার নাম জিনিয়া দাশগুপ্ত। কলকাতা থেকে ইটালি এসেছি। প্যারিসের ড ওবায়েদ হক আমাকে আপনার নম্বরটা দিয়েছেন। ড রাজীব সরকারের …।’

আনসার মিয়াঁ কথার মাঝেই বলে ওঠেন, ‘জানি। হক স্যার আমাকে ফোন করে সব জানিয়েছেন। তা আপনারা কি পিসা এসে গিয়েসেন আপু?’

‘না না।’ তাড়াতাড়ি বলল জিনিয়া, ‘আমরা এখন ভেনিসে। এখান থেকে আজ রাতে পৌঁছোব পাদোভা। কাল সকালে পাদোভা থেকে পিসার দিকে রওনা দেব।’

‘ঠিক আসে। আপনি পিসা এসে আমায় একটা কল দিবেন, আপু। আমি আপনার সাথে মিট করে নেব। তারপর গিয়ে রাজীবকে দেখিয়ে দিব।’

জিনিয়া পেছন ফিরে দেখল। দলের একেবারে শেষে হুইলচেয়ারে চড়ে আসছেন আরতি। হুইলচেয়ারের হাতল ধরে এগোচ্ছেন যাদবচন্দ্র। দু-জনেই চোখ তুলে আশপাশ দেখছেন বটে, কিন্তু জিনিয়া জানে, দু-জনের কারুর মনেই আনন্দ নেই। ভদ্রতাবশত গত কয়েক দিনে যাদবচন্দ্র জিনিয়াকে এই বিষয়ে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেননি। হয়তো উনি ধরেই নিয়েছেন যে জিনিয়া রাজীবকে খুঁজে পায়নি।

জিনিয়াও ইচ্ছে করেই কিছু বলেনি। আগে থেকে বলে রেখে বৃদ্ধ দম্পতির বুকে আশার আলো জ্বালিয়ে পরে যদি সত্যিই কথা রাখতে না পারে?

ও একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা জানতে চাইছি।’

‘বলেন আপু।’

‘ড রাজীব সরকার প্যারিসের অত ভালো চাকরি ছেড়ে পিসাতে যে রয়েছেন, ওখানে উনি কী করেন?’

আনসার মিয়াঁ কিছু খোলসা করলেন না। ফোন রাখার আগে বললেন, ‘আপনি আসেন। এলেই দেখবেন অবস্থা।’

জিনিয়া অন্যমনস্কভাবে ফোনটা রাখল। ও বুঝতে পারছে না আগে থেকে যাদবচন্দ্র আরতিকে কিছু জানিয়ে রাখা উচিত হবে কি না। ওখানে গিয়ে যদি রাজীব সরকারের কোনো করুণ পরিণতি দেখা যায়, সেটা কি ওঁরা সহ্য করতে পারবেন? সেরকম কিছু দেখার থেকে তো না দেখাই ভালো। ওঁরা কষ্ট হলেও বুকে পাথর চেপে জানবেন যে, তাঁদের ছেলে ভালো আছে।

জিনিয়া স্থির করল, এখন ও কাউকেই কিছু জানাবে না। পিসায় গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে এগনো যাবে।

‘কী ব্যাপার? সবাই উঠে পড়ল, আপনি কি এপারে একা বসে থাকবেন নাকি?’

সঞ্জিত হাজরা ওর দিকে এগিয়ে এসে কথাগুলো বলতেই ও চমকে উঠে দেখল, দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের যাত্রীরা দুই থেকে তিনজনের ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে একেকটা গন্ডোলায় উঠছেন। সেই ব্যাপারে তদারক করছেন ফুলুমামা।

‘ না না চলুন।’ জিনিয়া এগিয়ে গেল।

গোটা পৃথিবীর পর্যটক এসে এক হয়েছেন এখানে। গন্ডোলাগুলোর দাঁড় টানছে যে চালকেরা, তাদের পরনে একরকম পোশাক। বাজছে মিউজিক। সেই মিউজিকের তালে তালে একেকটা গন্ডোলা পর্যটকদের নিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন খাঁড়িতে। আগামী এক ঘণ্টা তারা এখন ঘুরে বেড়াবে ভেনিসের জলের গলিগুলোতে।

জিনিয়া বলল, ‘আপনারা উঠবেন না? বাকিরা সবাই উঠে গেছে তো?’

‘হ্যাঁ।’ সঞ্জিত ইশারায় বললেন, ‘আপনি সামনেরটায় উঠুন। আমি আর অম্বিকেশবাবু পরেরটায় আসছি।’

জিনিয়া গন্ডোলায় উঠে বলতে যাচ্ছিল, ‘এটাতেই তো দু-জন হয়ে যাবে। আপনারা চলে আসুন।’

কিন্তু তার আগেই একটা কাণ্ড হল। অতন্দ্র কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণ ও দেখতে পায়নি। গন্ডোলাটা পার ছেড়ে চলতে শুরু করার মুহূর্তে সঞ্জিত হাজরা অতন্দ্রকে এগিয়ে দিলেন গন্ডোলাটার দিকে। অতন্দ্র কোনোরকমে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বসে পড়ল জিনিয়ার পাশে।

জিনিয়া ভ্রূ কুঁচকে তাকাল পারে দাঁড়িয়ে থাকা সঞ্জিতের দিকে।

গোটা ব্যাপারটাই পূর্বপরিকল্পিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু সঞ্জিত নন, ফুলুমামাও আছেন এই ষড়যন্ত্রে। আগেভাগেই তাই ফুলুমামা জিনিয়ার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছেন অন্যদিকে ফিরে।

জিনিয়া দ্রুত গতিতে গন্ডোলা থেকে উঠে পারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল, গন্ডোলার চারপাশে থইথই করছে জল।

অতন্দ্র জোরে টেনে ধরল ওকে।

গন্ডোলার চালক বিজাতীয় ভাষায় কিছু একটা চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল। বোঝাই যাচ্ছে, জিনিয়ার আচমকা এই কাজে সে বেশ রেগে গেছে।

পাড় থেকে অম্বিকেশ চেঁচিয়ে উঠলেন অম্বিকেশ, ‘এসব কী হচ্ছে জিনি? এখানে জল কত গভীর জানিস?’

জিনিয়া উত্তর দিল না। প্রচণ্ড রাগে মাথাটা দপদপ করছে ওর।

এরা ওর আর অতন্দ্র-র ব্যাপারটাকে লঘু করে দিতে চাইছে। গন্ডোলাটা এদিক- ওদিক দুলতে দুলতে একটা ক্যনালের মধ্যে প্রবেশ করতেই ঝুপ করে যেন আলো পড়ে এল। চারপাশের জলে বেশ শীত শীত করতে লাগল ওর। আলো- আঁধারি আর জলের সোঁদা গন্ধের মধ্যে ও গোঁজ হয়ে বসে রইল।

অতন্দ্র চুপ করে দেখছিল জিনিয়াকে।

এই কয়েক দিনের পরিশ্রমে, দায়িত্বে চোখ দুটো বসে গিয়েছে, ছোটো ছোটো ব্রণ গজিয়ে উঠেছে মুখে। তবে কী অপরূপা দেখাচ্ছে ওকে। টলটলে মুখে ব্রণগুলোকে কেমন ছোটবেলায় ছাদে ঠাকুমার দেওয়া গয়নাবড়ির মতো দেখাচ্ছে।

অতন্দ্র-র বুকের ভেতরটা কেমন হালকা লাগছিল। গন্ডোলাটা বেশ ছোটো, বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে তবেই দু-জন বসা যায়।

বহুদিন পর, যেন গোটা একজন্ম পর জিনিয়ার নিশ্বাসের উত্তাপ এসে লাগছিল ওর গায়ে। বহুদিন পর জিনিয়ার গায়ের সেই চেনা গন্ধটা এসে ঝাপটা মারছিল ওর নাকে। ওর মনে হচ্ছিল, এই কি সেই জিনিয়া, যার সঙ্গে ও এক ছাদের তলায় কাটিয়েছিল শেষ কয়েকটা বছর? যার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল আনন্দ, দুঃখ, হতাশা, বিরক্তি?

জিনিয়া দূরের বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে উদাসচোখে বলল, ‘তুমি তো লন্ডনে গেছিলে কাজে, সেদিন রাতে বললে। লন্ডনে ফিরবে না?’

অতন্দ্রর চিন্তাটা ছিঁড়ে গেল। ও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘ফিরব। এখন কয়েকদিন কাজ নেই। তাই ভাবলাম এই টুরটার সঙ্গে ঘুরে নিই। সঞ্জিতবাবু আর ফুলুমামাও জোর করলেন।’

জিনিয়া নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। ঝোঁকের মাথায় ও যেভাবে গন্ডোলার মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল, অতন্দ্র না ধরলে বোধ হয় জলেই পড়ে যেত আজ।

অদৃষ্ট যে কেন ওর সঙ্গে বারবার পরিহাস করে। যাকে ভুলতে চায়, যার স্মৃতি জোর করে ঠেলে সরিয়ে রাখে দূরে, সে কেন এসে দাঁড়ায় সামনে। কেন বার বার এই অগ্নিপরীক্ষায় বসতে হয় ওকে?

গন্ডোলায় বাজছে রোম্যান্টিক মিউজিক। ওরা বসে আছে গাঢ় লাল রঙের ভেলভেটের একটা রাজকীয় সোফায়।

স্বপ্নের নগরী ভেনিসের রূপকথার গন্ডোলা সফরে বসে থাকতে থাকতে জিনিয়ার মনে হল, আরো একবার প্রথম থেকে শুরু করলে কি খারাপ হয়?

একেবারেই অসম্ভব কি সেটা?

মুহূর্তেই ওর মনে পড়ে গেল টেলিফোনে বলা অতন্দ্র-র উপহাসবাক্যগুলো।

অমানুষিক মনের জোরে নিজেকে কঠিন করে তুলল জিনিয়া। তারপর অতন্দ্র-র চোখের দিকে তাকিয়ে সমস্ত আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে হাসল। বলল, ‘তুমি চলে যাওয়ার পরেও দাশগুপ্ত ট্রাভেলস ভালোই চলছে। দেখতে পাচ্ছ তো?’

৫৪

মিনতি গাঙ্গুলি বললেন, ‘যাকে ভালোবাসো, তার কাছ থেকে আঘাত পেয়েও কষ্ট, আঘাত করেও কষ্ট। তাই কী লাভ নিজেদের মধ্যে মনকষাকষি বাড়িয়ে?’

জিনিয়া উত্তর দিল না। ওর মনটা খুব ভারী হয়ে আছে, কেন ও নিজেই জানে না। অতন্দ্রর জন্য? নাকি প্রথম টুর শেষ হয়ে আসছে সেইজন্য?

তবে এই কয়েকদিনে জিনিয়ার মনে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এত দেশ, তাদের কতরকম বিচিত্র প্রথা, মানুষজন এইসবের মাঝে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো যেন বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে এখন।

মিনতি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এই যে তোমরা দু-জনে এভাবে আলাদা রয়েছ, কেউ ভালো থাকছ কি?’

জিনিয়া চুপ করে রইল। ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু-জন মানুষ। তাঁদের পরনে বিচিত্র সাজপোশাক।

প্রাচীন রোমে ক্রীতদাসদের হিংস্র বাঘের মুখে ঠেলে দেওয়া হত, কিংবা বাধ্য করা হত নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে। তাদের বলা হত গ্ল্যাডিয়েটর। এই গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই দেখা ছিল তৎকালীন উচ্চশ্রেণির মানুষদের কাছে বিনোদন। আর এই গ্ল্যাডিয়েটরদের সাজপোশাকেই এখন রোমের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর বাইরে ঘুরে বেড়ায় বেশ কিছু মানুষ। তাদের কাজ নেহাতই এই সাজ দেখিয়ে লোকের থেকে পয়সা পাওয়া।

জিনিয়া ওর একদম পাশেই দাঁড়ানো গ্ল্যাডিয়েটর সেজে থাকা লোকটাকে দেখছিল। মাথায় অদ্ভুত এক শিরস্ত্রাণ, সামনের দিকটা সোনালি রঙের এক ধাতব বর্মে ঢাকা হলেও শিরস্থাণের পেছনদিকটা মোরগের লাল ঝুঁটির মতো। শিরস্ত্রাণটা শুধু মাথাতেই আটকে নেই, কানের সামনে দিয়ে গাল বরাবর সেই ধাতব বর্ম নেমে এসেছে থুতনিতে। শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গেও সোনালি বর্ম, নীচে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি জাতীয় একটা পোশাক। হাঁটু থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত অনাবৃত। এক হাতে তরোয়াল, অন্য হাতে ঢাল।

জিনিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হতে লোকটা রাস্তার ধারের একটা বড়ো পাথরে বসে পড়ল। তারপর পকেট থেকে হাতড়ে হাতড়ে একটা সিগারেট বের করে ফস করে ধরাল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, ‘হে! এনজয় কলোসিয়াম!’

জিনিয়া মাথা নেড়ে সৌজন্যের হাসি হাসল। তারপর মিনতি গাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওদের মনে হচ্ছে আসতে ভালোই দেরি হবে। চলুন, সামনের ওই কফিশপটায় গিয়ে বসি।’

‘একেবারে বাসে উঠে বসে থাকলে হয় না?’ মিনতি বললেন।

জিনিয়া মাথা নাড়ল, ‘ক্লিমেন্ট বাসের দরজা বন্ধ করে কাছেপিঠেই ঘুরছে। এগারোটায় আসবে বলা আছে। চলুন, এক কাপ করে কফি খাওয়া যাক।’

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের গোটা দলটাই এখন কলোসিয়ামের ভেতরে। সঞ্জিত তাঁদের ঘুরিয়ে নিয়ে সব দেখাচ্ছেন। গোটা ইউরোপ টুরে অসাধারণ সমস্ত জায়গা দেখলেও দু-হাজার বছরের পুরোনো প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের এই অ্যাম্ফিথিয়েটার কলোসিয়ামের সামনে এসে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

সঞ্জিত বলছিলেন, ‘পঞ্চাশ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসতে পারতেন এই অ্যাম্ফিথিয়েটারে।’

‘আচ্ছা, কোন রাজার সময়ে এটা বানানো হয়েছিল, সঞ্জিতদা?’ অভিক প্রশ্ন করেছিল।

‘বানানো শুরু হয় সম্রাট ভেসপাসিয়ানের সময়ে। সেটা বাহাত্তর সাল। পরে এটাকে সম্পূর্ণ করেন সম্রাট টাইটাস। এখানে বসে তখন মানুষ গ্ল্যাডিয়েটরদের নানারকম বিপজ্জনক খেলা দেখতেন।’ সঞ্জিত চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলে চলেছিলেন, ‘চারপাশটা দেখুন। সবই রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য বহন করছে।’

সত্যিই তাই। রোম শহরের যাবতীয় আধুনিকতার মধ্যেও, ব্যস্ত রাজপথ, উঁচু আধুনিক বাড়িগুলোর মাঝেও এই গোটা এলাকাটা যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই সেই কয়েক হাজার বছর আগের রোমান সাম্রাজ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, চারপাশটা এগিয়ে চললেও ঘড়ি এখানে স্তব্ধ।

সবাইকে নিয়ে তারপর সঞ্জিত কলোসিয়ামের ভেতরে ঢুকলেও জিনিয়ার মাথাটা কেমন যন্ত্রণা করছিল বলে ও আর ঢোকেনি।

ঢোকেননি মিনতি গাঙ্গুলিও।

ছোট্ট সুন্দর কফিশপটায় বসে দু-কাপ কফি অর্ডার দিল জিনিয়া। তারপর তাকাল সামনের প্রকাণ্ড কলোসিয়ামের দিকে। কলোসিয়ামের পশ্চিমদিকে রয়েছে প্রাচীন রোমান ফোরামের আয়তাকার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ।

সঞ্জিত ভেতরে ঢোকার আগে বলছিলেন, রোমান ফোরামকে যে উঁচুনীচু অট্টালিকার ভগ্নাবশেষগুলো ঘিরে রেখেছে, সেগুলো সবই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কার্যালয়।

জিনিয়া মনে করার চেষ্টা করল। টেম্পল অফ স্যাটার্ন, ট্যাবুলারিয়াম, গেমোনিয়ান সিঁড়ি, ব্যাসিলিকা অ্যামিলিয়া, আরও কতরকম সব নাম সেইসব ভগ্নস্তূপের। কোনোটা একেবারেই হারিয়ে গেছে কালের অমোঘ গর্ভে, কোনোটা ভগ্নাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারদিকটা দেখতে দেখতে যে কেউ হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অলিন্দে।

‘কী ভাবছ জিনিয়া?’ ওর চমক ভাঙিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিনতি গাঙ্গুলি।

জিনিয়া চমকে উঠল। মুহূর্তে ওর মুখে ফিরে এল সেই পেশাদার হাসিটা, ‘কিছু না, মাসিমা। বলুন। আপনি আমাদের সঙ্গে একা ঘুরতে এসেছিলেন। টুর তো শেষ হয়েই এল। কেমন লাগল, বলুন। কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’

মিনতি বললেন, ‘প্রসঙ্গ পালটে দিলেই তোমার মনের চিন্তাটা পালটে যাবে না জিনিয়া। তুমি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলে না।’

জিনিয়া মুখ নীচু করে ফেলল। ফুলুমামা কি মিনতি গাঙ্গুলিকে বলেছেন জিনিয়াকে বোঝাতে? হতেই পারে। টুরের সবার কাছেই অতন্দ্র এক সহানুভূতি পাচ্ছে। কালও ডিনার টেবিলে ওর কানে এসেছে, মধুছন্দা ওর স্বামীকে বলছিল, অতন্দ্রকে দেখে শেখা উচিত, বউয়ের অভিমান ভাঙাতে কীভাবে কত কষ্ট করে এতগুলো দেশ পার হয়ে এসেছে।

জিনিয়া মিনতি গাঙ্গুলির চোখে চোখে রাখল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘আমি ভালো আছি, মাসিমা। আমার লক্ষ্য এখন শুধুমাত্র দাশগুপ্ত ট্রাভেলসকে দাঁড় করানো। আমার কোনো কষ্ট নেই।’

‘কষ্টের প্রশ্ন নয়, জিনিয়া।’ মিনতি কফির কাপে চুমুক দিলেন, ‘তোমার মধ্যে কাজের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে সততা, আত্মবিশ্বাস আর জেদ। এতগুলো গুণ যার মধ্যে থাকে, সে যুদ্ধে জয়ী হবেই। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছ, তোমার এই জেদ যেমন তোমাকে এত বড়ো ব্যবসা দাঁড় করাতে সাহায্য করছে, তেমনই অনেক কিছু কেড়েও নিচ্ছে? তুমি কি বুঝতে পারছ, শুধুমাত্র ইগোর জন্য কিছু জায়গায় হেরে যাচ্ছ তুমি?’

জিনিয়া ভ্রূ কুঁচকোল। হতে পারে মিনতি গাঙ্গুলি ফুলুমামার ছোটোবেলার বিশেষ বান্ধবী, হতে পারে উনি আলোকপর্ণার খুব কাছের একজন, কিন্তু ওর কাছে মিনতি গাঙ্গুলি শুধুই একজন কাস্টমার। আর যার সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ রয়েছে, যার সঙ্গে রয়েছে আর্থিক লেনদেন, তার সঙ্গে কোনোরকম ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও রাখতে চায় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ‘ইগো ঝেড়ে ফেলে, ইগো সরিয়ে রেখে নিজেকে ছোটো করাটা, অপমানিত হওয়াটাই তার মানে আপনার কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত?’

‘তুমি আবার ভুল করছ জিনিয়া!’ মিনতি গাঙ্গুলি থেমে থেমে বললেন, ‘ইগো ঝেড়ে ফেলা মানেই কিন্তু আত্মসম্মান হারানো নয়। তুমি অনেক ছোটো। আমার মেয়ের মতো। সেই সুবাদেই বলছি। তোমাদের মধ্যে যা-ই হয়ে থাক, অতন্দ্র যা-ই করে থাকুক, যা-ই বলে থাকুক, এখন তো সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরে তোমাকে পাশে চাইছে। আবার নতুন করে সব শুরু করতে চাইছে। সেখানে তুমি যদি নিজের জেদ নিয়ে বসে থাকো, জীবনের একটা সময়ে দেখবে তুমিই অনুশোচনা করবে। এগোতে এগোতে জীবনে কোনো এক সময় এক পা পিছোতেও হয়, তাহলে পরে হোঁচট খেতে হয় না।’

মিনতি আবার একটু থামলেন। তারপর বললেন, ‘কী জানো তো, সময় কারুর জন্যই থেমে থাকে না। যেদিন তোমার সেই আফশোসটা হবে, সেদিন আর সময় থাকবে না। এই দিনগুলো চলে যাবে। তোমার ফুলুমামাকেই দ্যাখো না! সারাটা জীবন একলা কাটিয়ে দিলেন।’

জিনিয়া তাকাল মিনতি গাঙ্গুলির দিকে। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। হয়তো ইনি ঠিকই বলছেন।

নিজের জেদের বশে ও-ও কি ফুলুমামার মতো একসময় একা হয়ে পড়বে?

জিনিয়া আবার একটু দূরে মৃত পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রাচীন রোমের ধ্বংসাবশেষগুলোর দিকে তাকাল। আজ থেকে দু-হাজার বছর তো দূর, একশো বছর পরেও ও বা অতন্দ্র কেউই বেঁচে থাকবে না। যদি সত্যিই আত্মার অস্তিত্ব বলে কিছু থেকে থাকে, তখন কি সত্যিই এইসময়গুলো এভাবে নষ্ট করার জন্য ওর অনুতাপ হবে?

ও নিজের মনে ভাবছিল। মিনতি গাঙ্গুলি কোনো কথা বলছিলেন না। সম্ভবত ওকে ভাবতে দিচ্ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোনের শব্দে জিনিয়া বাস্তবে ফিরে এল।

আলোকপর্ণা ফোন করছে।

সেদিনের পর থেকে আলোকপর্ণা ঋতুপর্ণার কাছেই আছে। গোটা ঘটনাটা ও শুনেছে ঋতুপর্ণার মুখেই। ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট দেখে আলোকপর্ণা সাময়িক যে ভুল বুঝেছিল, সেসব মিটেছে। মধুরেণ সমাপয়েতের মতো ওদের দুই বোনে আবার মিল হয়ে গেছে। দু-জনকেই কাছ থেকে দেখেছে জিনিয়া, তাই আর কেউ না জানুক, ও জানে, বোনে বোনে এমন ভালোবাসা বিরল। দু-জনেই মাঝের সময়টা অনেক কষ্ট পেয়েছে।

একটু আগে মিনতি গাঙ্গুলির শোনা কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, মিল হলেও মাঝের এই দুটো বছর তো ওদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল। চাইলেও ওরা সেটা আর ফিরে পাবে না।

বোন হোক বা জীবনসঙ্গী, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে এই ক-বছরের মানবজীবনে কিছু সময় কম কাটানোর কোনো যুক্তি আছে?

জিনিয়া ফোন রিসিভ করে বলল, ‘হ্যাঁ, বলো।’

‘দিদি, তুমি পাপ্পু সিং বলে কাউকে চেনো?’ আলোকপর্ণার গলা ভেসে এল।

‘পাপ্পু সিং?’ জিনিয়া অবাক হল। এই নাম ও কোনোদিনও শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না।

‘হ্যাঁ। ট্যাক্সি চালান। একদিন তুমি ওঁর গাড়িতে নেতাজি ইনডোরে গেছিলে মেলা কভার করতে।’

জিনিয়ার এবার আবছা মনে পড়ল। হ্যাঁ, একটা ট্যাক্সিতে করে সেদিন গেছিল বটে। ও বলল, ‘হবে হয়তো। কী হয়েছে?’

আলোকপর্ণা বলল, ‘উনি আমাদের অফিসে এসেছেন। তোমার একটা ছবি এঁকেছেন উনি। সেটাই নিয়ে এসেছেন। তোমাকে ছবি তুলে পাঠাচ্ছি, দেখো। দেখলে অবাক হয়ে যাবে।’

৫৫

পিসায় গিয়ে সঞ্জিতের সঙ্গে সবাইকে একসঙ্গে ঘুরতে পাঠিয়ে দিল জিনিয়া। ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে পিসার বিখ্যাত মির‌্যাকল স্কোয়্যার। মির‌্যাকল স্কোয়্যারে পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে পিসা ব্যাপটিস্ট্রি, পিসা ক্যাথিড্রাল আর হেলানো টাওয়ার।

প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকার সময়েও ওপরের দিকে তাকালেই সেগুলোর চূড়ো চোখে পড়ছে প্রত্যেকের। হাজার হাজার পর্যটকের মুগ্ধতা যেন কাটতেই চাইছে না। প্রায় আটশো বছরের পুরোনো তিনটি স্থাপত্য, অথচ কী অসাধারণ সূক্ষ্ম আর সুনিপুণ কাজ। দেখলেই বোঝা যায়, সেইসময় রোমান সভ্যতা কোন উৎকর্ষে পৌঁছেছিল।

জিনিয়ার অবশ্য অত কিছু দেখার মতো মনের অবস্থা ছিল না। আনসার মিয়াঁর ফোন পেয়ে ও দলছুট হয়ে ঘোরাফেরা করছিল মির‌্যাকল স্কোয়্যারের বাইরে।

মির‌্যাকল স্কোয়্যারের বাইরের টিকিট কাউন্টার থেকে সোজা বেরিয়ে এলে যে গলি দিয়ে হাঁটতে হয়, সেটার সঙ্গে কলকাতার বড়োবাজারের গলি কিংবা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পৌঁছোনোর আগে দু-পাশে দোকানপাট সমৃদ্ধ যে গলি ছিল, তাদের খুব একটা পার্থক্য নেই।

কলকাতার মতো এখানেও গিজগিজ করছে হকাররা। বেশিরভাগই বিক্রি করছে পিসার হেলানো টাওয়ার কিংবা রোমের কলোসিয়ামের ছোটো রেপ্লিকা, এ ছাড়া হাজারো রকমের টুকিটাকি জিনিস।

অপেক্ষা করতে করতে ও অবাক হচ্ছিল এই দেখে, যে মির‌্যাকল স্কোয়্যারের বাইরের এই হকারদের সিংহভাগই বাংলাভাষী। আরও বিশদে বলতে গেলে বাংলাদেশি। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু আফ্রিকান মানুষ। গোটা জায়গাটা এদের সবার হাঁকাহাঁকিতে সরগরম হয়ে রয়েছে। পর্যটকরা এলেই ছেঁকে ধরছে তাদের।

জিনিয়াকে দেখে সেই বাংলাদেশি হকাররা আন্দাজ করল যে ও হয় ভারতীয় নাহয় বাংলাদেশি। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি আর বাংলায় ডাকাডাকি শুরু করল ওরা।

ও সরে এল সেখান থেকে। মূল রাস্তা ছেড়ে একটা ছোটো গলিতে ঢুকতে যেতেই ও পাঠানো ছবি অনুযায়ী আনসার মিয়াঁকে দেখতে পেল।

আনসার মিয়াঁ লোকটার গলা শুনে মনে হয়েছিল যুবক, কিন্তু এখন জিনিয়া লক্ষ করল তার বয়স পঁয়তাল্লিশ তো হবেই। গোলগাল চেহারা, মাথায় টুপি, পরনে সাদা জোব্বা। মুখটা বেশ হাসি হাসি। জিনিয়াকে দেখে সে হাত মাথার সামনে কিছুটা তুলে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বলল, ‘আসেন আপু।’

‘আপনি এখানে কী করেন?’ ব্যস্ত রাস্তায় আনসার মিয়াঁর পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল জিনিয়া।

আনসার মিয়াঁ হাসল, ‘আমার এখানে ছোট্ট একটা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে আপু। সেদিকেই আপনাকে লইয়া যাইতাসি।’

জিনিয়া বলল, ‘কিন্তু ড রাজীব সরকার? তিনি কোথায়?’

‘আমার সাথে চলেন। দেখতে পাবেন ঠিক সময়ে।’ আনসার মিয়াঁ বলল, ‘ভয় নাই।’

ভয় আবার কীসের? মনে মনে ভাবল জিনিয়া। উৎকণ্ঠায় ওর বুকের ভেতরটা এখন ঢিপঢিপ করছে। নিজের অজান্তেই ও যেন জড়িয়ে গেছে যাদবচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রীপুত্রর সঙ্গে।

আনসার মিয়াঁ ওর কৌতূহলের পারদ আরো বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ে এল সেই জায়গার কাছাকাছি, যেখানে ওদের বাসটা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। ওই তো ক্লিমেন্ট বসে আছে একটা বেঞ্চে। ওকে দেখে ভ্রূ নাচাল।

কী আশ্চর্য। এই পথ দিয়েই তো একটু আগে ওরা সবাই মিলে হেঁটে গেছে মির‌্যাকল স্কোয়্যারের দিকে।

এখানে রাজীব সরকার কোথায় আছেন?

মিনিট খানেকের মধ্যেই ওর কৌতূহল নিবৃত্ত হল। ক্লিমেন্ট যে বেঞ্চে বসে ছিল, তার পাশ থেকে পর পর বসে ছিল কিছু গেরুয়া পোশাক পরিহিত লোক।

প্রত্যেকের পোশাক অদ্ভুত। ভারতীয় যোগীদের আদলে গেরুয়া বসন, এদিকে চোখে সানগ্লাস। সবাই কোনো-না-কোনো কসরত দেখাচ্ছে। কেউ একটা প্রমাণ সাইজের বাথটব আদলের পাত্রের মধ্যে টইটম্বুর করে বালি রেখে তার মধ্যে ডুবে শুয়ে আছে। তার পায়ের পাতাদুটো শুধু বাইরে দৃশ্যমান। বালির মধ্যে পুরো শরীরটা রেখে কীভাবে সে নিশ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে, সেই কৌতূহলে পথচারী পর্যটকরা দাঁড়িয়ে পড়ছেন। তারপর সামনের ক্যাশবাক্সে গুঁজে দিচ্ছেন এক বা দুই ইউরো।

কেউ আবার আরও অদ্ভুত। একজন পদ্মাসনে বসে সামনে একটা লাঠি উঁচিয়ে রেখেছে। সেই লাঠির একেবারে ডগায় বসে রয়েছে আরও এক গেরুয়া বসন যোগী। এর সামনে ভিড় আরও বেশি। ক্যাশবাক্স ভরে উঠছে দ্রুত।

এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সঞ্জিত এদের কথা বলছিলেন। প্রাচ্যের তন্ত্রমন্ত্র, জাদুবিদ্যাতে পশ্চিমের এই দেশগুলোর আগ্রহ চিরকালই। সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ হাতসাফাই দেখিয়ে এখানে এইসব লোকেরা যোগী সেজে বসে থাকে।

জিনিয়া মনে মনে ভাবল, কী কাণ্ড! রাজীব সরকার শেষে এই সাধারণ হাতসাফাই দেখানো যোগী হয়েছেন নাকি?

কিন্তু না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর কৌতূহলের নিরসন ঘটল।

যোগীদের লাইন যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানে এক কোণে বসে ছিল এক বৃদ্ধ। দেখে একঝলকে বয়স্ক মনে হলেও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এর বয়স নেহাতই অল্প, কিন্তু দীর্ঘকালের অযত্নে, কাঁধ পর্যন্ত নেমে যাওয়া জটা পাকানো অবিন্যস্ত ধূলিধূসরিত চুলের জন্য, ফুটিফাটা হয়ে যাওয়া ত্বকের জন্য এর বয়স যেন অনেকটাই বেড়ে গেছে।

এই গরমেও লোকটার গায়ে একটা ময়লা কোট, সেটাও অনেক জায়গায় ছেঁড়া। চোখ বন্ধ, ঠোঁট কাঁপছে তিরতির করে। চারপাশে এই জনসমুদ্র, লোকটার তাতে কোনো খেয়াল নেই।

আনসার মিয়াঁ একটু থামল। তারপর লোকটার সামনে গিয়ে ইঙ্গিতে জানাল, এই লোকটাই রাজীব সরকার।

জিনিয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। চোখধাঁধানো ছাত্র, সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড রাজীব সরকার এখানে এইভাবে থাকেন!

না, উনি ভিক্ষা করছেন না। সামনে রাখা রয়েছে ম্যান্ডোলিনের মতো কোনো একটা বাদ্যযন্ত্র। মাঝে মাঝে নিজের খেয়ালে সেটা তুলে নিচ্ছেন হাতে, বাজাচ্ছেন টুং টাং। পর্যটকরা যাওয়ার সময় হাতে গুঁজে দিয়ে যাচ্ছেন দক্ষিণা।

জিনিয়া বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে ঝুঁকল লোকটার দিকে। বলল, ‘রাজীববাবু! রাজীববাবু! কেমন আছেন?’

লোকটা ফ্যালফ্যালিয়ে তাকাল ওর দিকে। শূন্য সে-দৃষ্টি। ঠোঁটের কম্পনটা যেন আরো দ্রুত হল সামান্যক্ষণের জন্য। কিন্তু ওইটুকুই। লোকটা আবার মাথা নামিয়ে চোখ বুজে ফেলল।

আনসার মিয়াঁ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘খুব বড়ো প্রতিভাবান আর পাগলের মধ্যে ডিফারেন্সটা অনেক সূক্ষ্ম, জানেন তো আপু? ব্রেনের সূক্ষ্ম নার্ভগুলো একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রতিভাবানরা সেইজন্য পাগল হয়্যা যায়। দেখেসেন কি?’

জিনিয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল। যাদবচন্দ্র আর আরতি এখন পিসার হেলানো টাওয়ার দেখছেন সবার সঙ্গে। অথচ তাঁরা জানতেও পারছেন না তাঁদের থেকে হাঁটাপথে এখানে এভাবে বসে রয়েছে তাঁদের একমাত্র সন্তান। কল্পনাতেও আনতে পারছেন না, নিজের ছেলের পাশ দিয়ে একটু আগেই হেঁটে গেছেন তাঁরা।

আনসার মিয়াঁ চাপা গলায় বলল, ‘মাথাটা গোলমাল হয়েছে অনেকদিনই। কখনো ঠিক থাকে, তখন বাজনা বাজায়, লোকে পয়সা দেয়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বিগড়ে যায়। আর যখন বিগড়োয়, তখন প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। বাজনাটা ছুড়ে ভেঙে ফেলে, কেউ বোঝাতে গেলে তাকেও মারধর করে। চোখ দুটো পুরো উলটে যায়, সে এক ভয়ংকর দৃশ্য, আপু। তখন আমি হক স্যারকে কল দিয়ে সব জানাই। উনি আমায় টাকা পাঠান, সেই দিয়ে চিকিৎসা করাই, নতুন বাজনা কিনে দিই। এভাবেই চলতাসে।’

জিনিয়ার মাথা কাজ করছিল না। এত প্রচেষ্টার পর ও যে এখানে এসে এই দৃশ্য দেখবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি। অন্তসত্ত্বা স্ত্রী শেহনাজের অকালমৃত্যুতে রাজীব সরকার এতটা ভেঙে পড়েছিলেন যে মানসিক ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে গেছে?

ও কোনোমতে বলল, ‘এখান থেকে ওঁকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে হয় না?’

‘আপনি কি পাগল হইসেন নাকি, আপু!’ আনসার মিয়াঁ দাঁত বের করে হাসল, ‘হক স্যার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিছুই হয় নাই। দু-বার জোর করে প্যারিস নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, রাতের বেলা ভাঙচুর শুরু করেছিল। ডাক্তারবদ্যিও কম হয়নি। সবকিছুর পর দেখা গেছে, উনি এখানে, এই পিসার ফুটপাথেই ভালো থাকেন। হক স্যার মাসে মাসে আমায় টাকা পাঠান। দুপুরে আর রাতে আমার কাছেই খায়। আর রাতে শোয় আমার রেস্টুরেন্টের সামনের ঘরটায়। কষ্ট হয় লোকটার জন্য। শুনেছি অনেক লেখাপড়া করসিল। কিন্তু কী আর করা। আল্লাহর ইচ্ছা।’

জিনিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর হঠাৎ খেয়াল হল, প্রতিদিন সকালে যাত্রীদের সবাইকে যে শুকনো খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়, তেমন একটা প্যাকেট ওর ব্যাগে রয়েছে। মনে হতেই প্যাকেটটা বের করল। ভেতর থেকে একটা কেক বের করে এগিয়ে দিল রাজীব সরকারের দিকে।

লোকটা নিল না। হাতে দু-বার টোকা দিতে হঠাৎ চোখ খুলে কর্কশ গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, ‘কী ভেবেছ তুমি, শেহনাজ? আমি কিছু বুঝি না? নিজে না খেয়ে আমাকে দেওয়া হচ্ছে এগুলো? এসব আমি পছন্দ করি না। এখন তোমার ভালোমন্দ খাওয়া উচিত।’

আনসার মিয়াঁ বলল, ‘আর দেরি করবেন না, আপু। সরে আসুন। শেহনাজের নাম করা শুরু করলেই আস্তে আস্তে খেপে উঠতে থাকে। তখন সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। চলেন চলেন! উনার বাপ-মা কোথায়? নিয়ে আসবেন চলেন।’

 জিনিয়া কেঁপে উঠল।

না না! একমাত্র পুত্রের এই ভয়ংকর পরিণতি কীভাবে দেখাবে ও বৃদ্ধ বাবা মা যাদবচন্দ্র আরতিকে?

মৃত্যুপ্রহর গুনতে থাকা আরতি কীভাবে সহ্য করবেন এই দৃশ্য? নিজের ছেলে ভালো আছে, বাবা-মায়ের খোঁজ না নিলেও সে নিজে সুখে আছে, এই ভাবনাটা বাবা-মাকে অনেক নিশ্চিন্ত করে।

জিনিয়ার মনের মধ্যে দুটো দ্বন্দ্বের প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। একপক্ষ বলছিল, যাদবচন্দ্র আরতিকে রাজীব সরকারের সন্ধান দেওয়া উচিত, কারণ দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের মালকিন হিসেবে জিনিয়া তেমন প্রতিশ্রুতিই তাদের দেশ থেকে দিয়ে এসেছে। রাজীবকে খুঁজে পেয়েও তাঁদের না জানালে ওঁরা এত ভালো ঘুরেও তৃপ্ত হবেন না।

কিন্তু আরেক পক্ষ বলছিল সম্পূর্ণ বিপরীত কথা।

‘একজন মৃত্যুপথযাত্রী ক্যান্সার আক্রান্ত মা, তাঁকে কি আরও যন্ত্রণা না দিলেই নয়? রাজীবকে না দেখলে তাঁরা মনে কষ্ট চেপে দেশে ফিরবেন। সেই কষ্ট তো তাঁরা অনেক বছর ধরেই পাচ্ছেন। সেটা তাঁদের সয়েও গিয়েছে। কিন্তু ছেলে যে বিদেশের রাজপথে এইভাবে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে রয়েছে, সেই দৃশ্য দেখে তাঁরা কিছু করতেও পারবেন না, উলটে অবশিষ্ট জীবন সেই কষ্টে দগ্ধ হবেন। বেদনায় জর্জরিত হয়ে কাটবে তাঁদের বাকি জীবন।’

আনসার মিয়াঁ ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, ‘কী হল আপু? চলেন? আমার দোকানে আবার এইসময় ভিড় হয়ে থাকে।’

‘না, আপনি চলে যান মিয়াঁসাহেব।’ সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলল জিনিয়া, ‘দেখা করাতে হবে না।’

‘দেখা করাতে হবেনা কেন?’ আনসার মিয়াঁ বিস্মিত। গত কয়েক দিন জিনিয়া ওকে অনেকবার ফোন করেছে, এদিকে এখন পুরো উলটো কথা বলছে।

কিন্তু জিনিয়া মন স্থির করে ফেলেছে। এই দৃশ্য কিছুতেই যাদবচন্দ্র আরতিকে দেখাবে না ও। তার চেয়ে ওঁরা বরং ভালো স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরুক!

আনসার মিয়াঁকে বিদায় দিয়ে ও দ্রুতপায়ে ফিরে আসছিল মির‌্যাকল স্কোয়্যারের দিকে। বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল বড্ড।

নিজের ব্যক্তিগত টানাপোড়েন, পেশাগত দায়দায়িত্ব, সব কিছুকে ছাপিয়ে জীবন মাঝে মাঝে এমন কিছুর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যাতে মনে হয় মান, অভিমান, আবেগ এসব বড়ো ক্ষুদ্র।

 ‘দাঁড়াও, জিনি।’

হঠাৎ পেছন থেকে অতন্দ্রর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও। ফিরে দেখল, অতন্দ্র এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

অতন্দ্র কি তাহলে এতক্ষণ ওর আশেপাশেই ছিল? প্রত্যক্ষ করেছে সব কিছু?

৫৬

‘আপনি লন্ডনে?’ কখন এলেন?’ অতন্দ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ। মি মরিসের ই-মেলে ইমিডিয়েট বেসিসে আসতে হল।’ অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘আজ সকালে এসে পৌঁছেছি। বেলা এগারোটায় ব্রিটলস ম্যানেজমেন্ট ওদের অফিসে একটা হাই এন্ড মিটিং শিডিউল করেছে। সম্ভবত সেখানেই তারা ওমনিসফটের ব্যাপারটা ডিজক্লোজ করবে।’

‘ওমনিসফটের ব্যাপার মানে?’ আঁতকে উঠল অতন্দ্র, ‘আপনি কী শিয়োর হয়ে গিয়েছেন ব্রিটলস টেকি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট রিনিউ করছে না?’

অনিরুদ্ধ বসু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘শিয়োর বলতে, অ্যান্ড্রু তো সেরকমই মিন করছে। ওই কৃষ্ণমূর্তি লোকটাই কনস্ট্যান্ট বাগড়া দিচ্ছে। ওমনিসফট থেকে বোধ হয় মোটা টাকা খেয়েছে।’

অতন্দ্র চুপ করে রইল।

অনিরুদ্ধ বসু আবার বললেন, ‘তোমার আর এই নিয়ে চাপ নিয়ে লাভ নেই। ইউ গেভ ইয়োর বেস্ট এফর্ট, অতন্দ্র। আমি আপডেট দেব একটু পরে। তুমি আর রবি কালকের মধ্যে লন্ডন ফিরে এসো। ফেরার টিকিট আমি সোফিয়াকে বলে করিয়ে রাখছি। দেশে ফিরে যাও। স্পেন্ড টাইম উইথ ফ্যামিলি।’

অতন্দ্র হতাশ মুখে সামনের সিটে বসে থাকা রবির দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকাল। সে বাসের সিটে এমন নিশ্চিন্তমুখে ঘুমোচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন ইউরোপে এসেছে সে।

ও চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বাস ঢুকবে রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে আর তিন ঘণ্টা পরে ছাড়বে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কলকাতা ফেরার প্লেন।

জিনিয়া সফলভাবে তার সমস্ত যাত্রীদের নিয়ে উড়ে যাবে কলকাতার দিকে। শুরু করবে পরের টুরের পরিকল্পনা। ডুবে যাবে নিজের কাজের জগতে।

আর অতন্দ্র? অতন্দ্র কী করবে? আর ঘণ্টাকয়েক পরেই নির্ধারিত হয়ে যাবে ওর ভবিষ্যৎ।

ব্রিটলস টেকি ওয়ার্ল্ডের হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে এবারে সবচেয়ে বাজে রেটিং পাওয়া অতন্দ্রর চাকরিটাও চলে যাওয়া, সেটা ও ভালো করেই জানে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সুমিত মিত্র-র রোষ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ অনিরুদ্ধ বসু করে দিলেও সেটা ও কাজে লাগাতে পারল না।

নাহ, ওর বানানো টুল ‘জিনি’ ওর সাথ দিল না। ঠিক যেমন সাথ দিচ্ছে না জিনিয়া নিজে।

ও বসে রয়েছে বাসের একদম পেছনের সিটে। সামনে রীতিমতো হুল্লোড় চলছে। আজ ওদের টুরের শেষ দিন। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের ইউরোপ টুরের মানুষগুলো যেন চেটেপুটে উপভোগ করছে শেষ মুহূর্তগুলো।

সবাই একে একে উঠে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, সামনে, গোটা টুর সম্পর্কে বলছেন কিছু কথা, তারপর আবার ফিরে আসছেন।

এর মধ্যেই মৃদুলা বিশ্বাস তিনটে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ফেলেছেন। মধুছন্দা গেয়েছে দুটো হিন্দি গান।

এরপর কাকে ডাকে যায় তাই নিয়ে সবার মধ্যে যখন আলোচনা চলছে, তখন গিরিডি থেকে আসা অধ্যাপিকা পিয়াসা ব্যানার্জি লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাত তুলে বললেন, ‘আচ্ছা আমি কি একটা গান গাইতে পারি? প্রথাগতভাবে শিখিনি তেমন, তবে আমার মা খুব ভালো গাইতেন। তাঁর থেকেই সামান্য শিখেছিলাম।’

‘আরে দুর দিদি, আমরা এখানে কি বেগম আখতারের গজল শুনতে এসেছি নাকি?’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘এখানে সবাই কমোড সিঙ্গার। যান যান, গিয়ে মাইক নিন।’

‘কমোড সিঙ্গার আবার কী কথা! কী বিশ্রী শুনতে।’ ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন পরেশনাথ কুণ্ডু, ‘বাথরুম সিঙ্গার বলুন।’

‘ওই একই হল মশাই। স্নান করতে করতে গান গাইলে সেটা তো জলের আওয়াজে বাইরে থেকে শুনতে পাওয়া যায় না, কমোডে বসে গলা ছাড়লে তবেই বাইরে থেকে শোনা যায়। তাই কমোড সিঙ্গার বলাটাই বেশি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।’ ভ্রূ নাচিয়ে নিজের বক্তব্য রাখলেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ। তারপর পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হল, আপনি আবার বসে রইলেন কেন? যান যান!’

পিয়াসা গিয়ে সঞ্জিতের হাত থেকে মাইকটা নিলেন। তারপর বললেন, ‘গান গাওয়ার আগে কয়েকটা কথা একটু বলি। আমি জন্মেছি গিরিডিতেই। কলকাতায় খুব বেশি আসিনি। ওই দু-একবার কোনো সেমিনারে আসা, ব্যস। কিন্তু এবার আমি আর মধুমিতা ঠিকই করেছিলাম ইউরোপ ঘুরতে গেলে কলকাতা থেকেই যাব। গিরিডির কোনো এজেন্সির সঙ্গে নয়।’

পিয়াসা একটু থামলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনারা হয়তো অনেকেই বুঝতে পেরেছেন, আমি আর মধুমিতা শুধুই বন্ধু নই।’

কেউ কিছু বললেন না।

পিয়াসা আবার বললেন, ‘গিরিডি ছোটো শহর। ওখানে এমনিতেই আমাদের নিয়ে অনেক কথা হয়। আমরা দু-জনেই স্বাবলম্বী। আমি কলেজে পড়াই। মধু মানে মধুমিতা কাপড়ের বুটিক চালায়। আমরা কারুর কোনো অসুবিধা না করে একসঙ্গে থাকি, তাতেও অনেক লোকের অসুবিধে। অথচ আমরা দু-জনেই ঘোরাপাগল। সারা ভারতই বলতে গেলে ঘোরা। কিন্তু বিদেশে প্রথমবার নিজেরা একা আসার সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই আমরা চেয়েছিলাম, বাইরের কোনো এজেন্সির সঙ্গে আমাদের এই স্বপ্নের টুরটা করতে, যাতে কোনো অস্বস্তির সম্মুখীন হতে না হয়। এই টুরের প্রথম দিকগুলো তাই নিজেদের গুটিয়েই রাখতাম। পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের কারুর সঙ্গেই তেমন মিশিনি।’

‘কিন্তু আস্তে আস্তে আপনারাই আমাদের সেই আড়ষ্টতা মুছে দিয়েছেন, টেনে নিয়েছে নিজেদের কাছে। আজ বলতে বাধা নেই, দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে আমাদের এই ইউরোপ ঘোরাটা আমাদের কাছে সারাজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই টুরে আমরা কাছে পেলাম জিনিয়ার মতো একজন বাচ্চা মেয়েকে, যার প্যাশন কতদূর গেলে এইভাবে প্রতিটা মানুষের ছোটো বড়ো সমস্ত অসুবিধের দিকে খেয়াল রাখতে পারে। কতটা চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকলে উইশি-র ওই ঘটনার পর ও ওইভাবে মি. সাধুখাঁকে দল থেকে বের করে দিতে পারে।’

জিনিয়া হেসে ফেললো।

অতন্দ্র পেছনের সিটে বসে অনিরুদ্ধ বসুর বলা কথাগুলো একমনে ভাবছিল, কিন্তু আচমকাই ওর কানে ভেসে আসতে লাগল পিয়াসা ব্যানার্জি-র কথাগুলো।

ওর হঠাৎ খুব গর্ব হল। প্রচণ্ড ভালোলাগায় ওর বুকটা ভরে গেল এই ভেবে যে জিনিয়া ওর স্ত্রী। ক-জন পারে এইভাবে অনিশ্চয়তার সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সমস্ত কাস্টমারকে প্রথম টুরেই খুশি করতে?

ও নিজে কি পারল ব্রিটলস ব্যাঙ্কের প্রোজেক্টে? পারেনি।

কিন্তু ওর বউ পেরেছে!

‘পেলাম মিনতি গাঙ্গুলির মতো শ্রদ্ধেয় মানুষকে, পেলাম যাদবচন্দ্র সরকার ও তাঁর স্ত্রী-র মতো দম্পতিকে, যারা জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছেও আমাদের শেখান ভালোবাসা কতটা নিঃশর্ত হতে পারে। তাই এই কয়েকটা দিনে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস শুধু যে এতোগুলো দেশ দেখিয়েছে তাই নয়, আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আপনাদের কার কী পরিবর্তন হয়েছে জানি না, তবে আমার তো দৃষ্টিটা অনেক প্রসারিত হয়েছে।’ পিয়াসা বললেন।

সামনে বসা উৎপল বিশ্বাস হাততালি দিয়ে উঠলেন জোরে। ধীরে ধীরে সবাই যোগ দিল সেই হাততালিতে।

অতন্দ্র দেখল, সবার মুখে হাসি। আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেল।

হোক ঝামেলা, দাশগুপ্ত ট্রাভেলস তো তারও সন্তান! আর সন্তানের সাফল্যে কোন বাবা-মা না খুশি হয়?

পিয়াসা এবার হাসলেন, ‘ মা আমাকে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান শিখিয়েছিলেন। সেটাই গাইছি।’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ অমনি বিড়বিড় বললেন, ‘এই মরেছে। এই তো মিসেস বিশ্বাস গেয়ে গেলেন। আবার রবীন্দ্রসংগীত?’

পিয়াসা হেসে শুরু করলেন,

‘সজনি সজনি রাধিকা লো, দেখ অবহুঁ চাহিয়া
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে, মৃদুল গান গাহিয়া।।’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ অবাক হয়ে বললেন, ‘ওমা! এটা রবীন্দ্রসংগীত?’

সামনে থেকে উৎপল বিশ্বাস গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ। ভানুসিংহের পদাবলী।’

‘পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া।
সুন্দরী সিন্দূর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া।।
সহচরী সব নাচ নাচ মিলনগীত গাও রে,
চঞ্চল মঞ্জীররাব কুঞ্জগগন ছাও রে।
সজনি, অব উজার’ মদির কনকদ্বীপ জ্বালিয়া,
সুরভি করহ কুঞ্জভবন গন্ধসলিল ঢালিয়া।।

‘রবীন্দ্রনাথ হিন্দিতেও গান লিখেছেন?’ ফিসফিস করে বললেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ।

‘আহ, হিন্দি নয়, এটা ব্রজবুলী। বড়ো দরদ দিয়ে গাইছেন মিস ব্যানার্জি।’ উৎপল বিশ্বাস বললেন, ‘চুপ করে শুনুন তো!’

অতন্দ্র গানটা শুনতে শুনতে জিনিয়ার দিকে তাকাল। জিনিয়ার মুখে পেশাদার হাসি ঠিক লেগে রয়েছে ঠোঁটের এক কোনায়, বাসের করিডর দিয়ে সে এগিয়ে আসছে এদিকে। হাতে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট। অনেক সকালে রোমের হোটেল থেকে বেরনো হয়েছে। এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই হয়তো এই ব্যবস্থা। যত হাসিঠাট্টা, গান-বাজনাই হোক, জিনিয়া কিছুতেই ওর কর্তব্যগুলো ভোলে না।

দিতে দিতে জিনিয়া এসে থমকে দাঁড়াল অতন্দ্র-র সিটের সামনে। না চাইতেও জিনিয়া-র চোখ চলে গেল অতন্দ্র-র চোখের দিকে। হঠাৎই যেন ওর মনে পড়ে গেল গতকাল রোমের কলোসিয়ামের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মিনতি গাঙ্গুলির বলা কথাগুলো।

এগোতে এগোতে জীবনে কোনো একসময় এক পা পিছোতেও হয়, তাহলে পরে হোঁচট খেতে হয় না।

অতন্দ্রর চোখ ছলছল করছিল। অনিরুদ্ধ বসু-র ফোন, তায় জিনিয়া এখুনি চলে যাবে ওর ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেই ভাবনা ওকে যেন অস্থির করে তুলছিল।

জিনিয়াও একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, অতন্দ্রকে দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে একটা খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিতেই অতন্দ্র আর দু-বার ভাবল না। জিনিয়ার হাতটা জড়িয়ে ধরল ও, ধরা গলায় বলল, ‘অনেকদূর থেকে তোমার কাছে এসেছিলাম, জিনি। আমাকে ক্ষমা করো। সবকিছুর জন্য। আমি আর পারছি না!’

‘মল্লিকা চমেলি বেলি কুসুম তুলহ বালিকা,
গাঁথ যূথি গাঁথ জাতি, গাঁথ বকুলমালিকা
তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ কুঞ্জপথম চাহিয়া —
মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে, মৃদুল গান গাহিয়া।।’

জিনিয়া এবার আর হাতটা সরিয়ে নিতে পারল না। পারল না প্রতিবারের মত মুখে সেই কর্কশ কাঠিন্যের বর্ম পরে সরে যেতে।

ওর ভেতরটা মনকেমনের কুয়াশার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়ছে। অজস্র সুখস্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ।

ইচ্ছে করছে সব ভুলে গিয়ে অতন্দ্র-র বুকে মাথা রাখতে।

পিয়াসার গান শেষের পর সবাই যখন হাততালি দিচ্ছেন, জিনিয়া তখন অতন্দ্র-র হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

৫৭

ফুলুমামা এয়ারপোর্টেই ছিলেন, তবে জিনিয়ার থেকে অনেকটা দূরে। দূর থেকে ইশারায় বললেন, ‘সবার বোর্ডিং পাস হয়ে গেছে। তোরটা হলেই …!’

‘আসছি।’ জিনিয়া ক্লিমেন্টের সঙ্গে হাত মেলাল। টাকাপয়সার হিসেবপত্র মিটিয়ে দেওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল। ও হাসিমুখে বলল, ‘সব কিছুর জন্য অনেক ধন্যবাদ ক্লিমেন্ট! খুব শিগগিরই আবার টুর পাঠাব।’

‘থ্যাংক ইউ।’ ক্লিমেন্ট চুইং গাম চিবোতে চিবোতে ডান হাত তুলল, তারপর বলল, ‘হ্যাভ আ সেফ জার্নি, জিনিয়া!’

তারপর এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চলে যেতে লাগল ওর বাসের দিকে। একটু পরেই ও মিলিয়ে গেল দৃষ্টি থেকে।

জিনিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।

ক্লিমেন্টের বাস হয়তো আবার একদল নতুন যাত্রীকে নিয়ে শুরু করবে ইউরোপ টুর। নতুন গল্প, নতুন মানুষে ভরে উঠবে বাসটা।

রয়ে যাবে শুধু স্মৃতি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও সামনে ফিরতেই দেখল, অতন্দ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সামনে।

ও একটু হেসে স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘আসছি। তুমি তো এখন লন্ডনে ফিরে যাবে।’

অতন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁ। রবি বাইরে ওয়েট করছে। ও আর আমি ফিরে যাব লন্ডনে। তারপর ব্যাক টু ইন্ডিয়া। চাকরিটা তো আর থাকবে না। গিয়ে আবার নতুন করে কোম্পানিগুলোয় সিভি ড্রপ করা। নতুন করে ইন্টারভিউ। তারপর নতুন করে গম পেষা।’

জিনিয়া সামান্য হাসল। অতন্দ্র-র অ্যাপ্রেইজালে বাজে রেটিং পাওয়া, চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্রিটলসে প্রেজেন্টেশন দিতে আসা, সবই শুনেছে রবির মুখে। ও চুপ করে রইল।

অথচ ওর কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘কীসের চাকরি অতন্দ্র গুপ্ত? দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের মধ্যেই যে গুপ্ত রয়েছে সেটা কি তুমি ভুলে গেছ?’

কিন্তু ভাবনাটা শব্দ হয়ে ওর ঠোঁট দিয়ে বেরোচ্ছিল না। কীসের এক জড়তা এসে গ্রাস করছিল ওকে। ভয় করছিল, যদি অতন্দ্র না বলে দেয়? তখন কী করে ও সহ্য করবে সেটা?

ফুট দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে অতন্দ্রও সেই কথাই ভাবছিল।

জিনিয়া কি একবারও বলতে পারছে না ওর সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেওয়ার কথা? আবার সেই আগের মতো মাঝরাত অবধি জেগে দু-জনে মিলে প্ল্যান করা? ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা? জিনিয়া নিজে না বললে ও কী করে বলবে!

যদি জিনিয়া রাজি না হয়? যদি ভাবে, অতন্দ্র সুখের পায়রা? ছি ছি, কী লজ্জাজনকই না হবে ব্যাপারটা।

ভাবতে ভাবতে ওর ফোন বাজতে থাকে।

রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলার সাথে সাথে অনিরুদ্ধ বসু-র উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পায় ও, ‘উই হিট দ্য হোম রান’, অতন্দ্র! উই ওন দ্য ব্যাটল!’

অতন্দ্র মূক হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য। কানে যেন তালা লেগে যায় ওর। লন্ডনে আসার পর থেকে সাধকের মতো সঙ্গবর্জিত জীবন কাটিয়েছে ও, ওই ক-টা দিন ব্রিটলসের অফিসে বসে নিজের সব যত্ন দিয়ে বানাতে চেয়েছে ‘জিনি’ বলে সেই টুলটা।

ওর অত পরিশ্রম কি তবে সার্থক হল?

অনিরুদ্ধ বসু উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘কৃষ্ণমূর্তি ট্রায়েড আ লট। ওমনিসফটের কোর্টে বল ফেলার জন্য অনেক এফর্ট দিয়েছে লোকটা। কিন্তু ভিপি মি মরিস আর বাকিরা তোমার ওই টুল দেখে খুবই প্লিজড!’

‘সিরিয়াসলি?’ দুর্বল কণ্ঠে বলল অতন্দ্র।

 ‘ইয়েস অতন্দ্র। অ্যান্ড্রু বলল, এই কয়েক দিন ইচ্ছে করে ওরা মিটিং ডিলে করেছে। কৃষ্ণমূর্তি ওদের নিজেদের টেস্টিং টিম দিয়ে পারফরম্যান্স টেস্ট করিয়েছে। লোড টেস্ট, স্ট্রেস টেস্ট কিচ্ছু বাদ দেয়নি। কিন্তু সবেতেই জিনি পাসড সাকসেসফুলি। মি. মরিস আমাকে বললেন, এত ফাইন কমপ্লেক্সিটির টুল নাকি খুবই রেয়ার। কিছু স্পেসিফিক কাস্টমারকে দিয়ে বিটা ভার্সনে ফিডব্যাকও নিয়েছে ওরা।’

আবেগে অতন্দ্রর কথা বন্ধ হয়ে আসছিল। চাকরিটা বেঁচে যাওয়ার থেকেও ওর নিজের বানানো একটা সৃষ্টি সবার কাছে সাদরে গৃহীত হয়েছে সেই কথা ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল ওর।

‘সেইজন্য ওঁরা টেকি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট কন্টিনিউ করতে চাইছেন। ইউ আর আ জেম অতন্দ্র! তোমার জন্যই গোটা ব্যাঙ্কিং ডোমেন আজ ইনসিকিয়োরিটির হাত থেকে বেঁচে গেল!’ অনিরুদ্ধ বসু বলে চলেছিলেন, ‘জেলাস সুমিত মিত্র গট আ পারফেক্ট আনসার!’

ওদিকে জিনিয়া অতন্দ্রকে স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখে থমকে যায়।

মুহূর্তের দুর্বলতায় কী যে হয়, সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে জিনিয়া বলে ওঠে, ‘আমার সঙ্গে কাজ করবে অতন্দ্র?’ বলতে বলতে গলাটা কেঁপে যায় ওর, ‘আবার আগের মতো?’

অতন্দ্র অপলক চোখে জিনিয়াকে দেখছিল। অনেকদিন পরে এমন নিঃসংকোচে দেখছিল ওর জিনিকে।

জিনিয়া আবার ব্যগ্রভাবে বলে, ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস নিডস ইউ, অতন্দ্র!’ তারপর একটু থেমে, একটু ইতস্তত করে আবার বলে, ‘আই নিড ইউ।’

অতন্দ্র কী বলবে বুঝতে পারে না। ওর বুকের ভেতর একশোটা ক্যানেস্তারা বাজতে থাকে একসঙ্গে। মনে হয় দুই কাঁধের নীচ থেকে জন্ম নিয়েছে দুটো বলিষ্ঠ ডানা।

সেই ডানায় ভর দিয়ে সে এখুনি উড়ে যাবে আকাশে।

৫৮

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর ‘বারো দিন — ছয় দেশ, ইউরোপে ঘোরা বেশ’— এর পর কেটে গেছে প্রায় দেড় বছর।

এই দেড় বছরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। জিনিয়াও আরও বেশি করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দাশগুপ্ত ট্রাভেলস প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য, দু-দিকেই বেড়েছে অনেকটা। এখন প্রতিমাসেই দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রায় পাঁচ থেকে ছ-টা টুর থাকে। প্রতিটা টুরেই থাকে নিখাদ বাঙালিয়ানা আর আন্তরিকতার স্নেহপরশ।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সুনাম হু-হু করে ছড়িয়ে পড়েছে। এত কম টাকা অগ্রিম দিয়ে যে এত ভালোভাবে কোনো কৃত্রিমতা ছাড়া বিদেশ ঘোরা সম্ভব, বাঙালিকে সেটাই বিশ্বাস করতে শেখাচ্ছে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস। এই টুর এজেন্সি যে অন্যগুলোর থেকে কতটা ব্যতিক্রমী, তাই নিয়ে আলোচনা হয় কলকাতার গোটা টুরিজম সেক্টরেই।

অনেকে নামিদামি টুর কোম্পানির খোঁচড় হয়ে জানতে এসেছে জিনিয়ার ট্রেড সিক্রেট, কিন্তু কিছুই বের করতে পারেনি। আসলে, ভালোবাসা জিনিসটা এমন, সেটা কাউকে শেখানো যায় না। তার কোনো মূল্যও হয় না।

ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জিনিয়ার ব্যস্ততা। আলোকপর্ণা, বিকাশ তো আছেই, সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও চারটে ছেলেমেয়ে। যোগ দিয়েছে গ্লোবাল টুরসে আলোকপর্ণার সহকর্মী অতীশ মজুমদার। অতীশও আলোকপর্ণার মতো পিআইপি থেকে আর ফিরতে পারেনি, গ্লোবাল টুরসের চাকরিটা খুইয়ে যোগ দিয়েছে এখানে। আলোকপর্ণাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

 বিকাশ যেমন প্রোমোশনের দিকটা দেখত, তেমনই দেখছে, তবে ওই ব্যাপারে এখন ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আলোকপর্ণার বাবাও। বহুদিন বাড়িতে অলস বসে ছিলেন তিনি, কর্মহীন হওয়ায় অবসাদ আরো তীব্রভাবে গ্রাস করছিল তাঁকে। ঋতু আর আলো, দুই মেয়ের কথায় তাই তিনিও এখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের একজন সদস্য।

ঋতুপর্ণা আপাতত অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। খুব শিগগির ও আর ইমরান বাবা-মা হতে চলেছে। সেই খবর পাওয়ামাত্র ওর মা ওকে নিয়ে চলে গেছেন হিন্দমোটরের বাড়িতে।

না। সমাজ বা আত্মীয়স্বজন, কোনোকিছুর পরোয়া আর করেননি তিনি। সেবার ঋতুর জন্যই তিনি আলোকে ফিরে পেয়েছেন, একথা মনে পড়লে আজও তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।

যত দিন যাচ্ছে, অম্বিকেশ আরও বেশি উদ্যমী হয়ে উঠছেন। খুব শিগগিরই সল্টলেকের গ্যারাজঘর থেকে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের ঠিকানা বদল হতে চলেছে পার্ক স্ট্রিটের দিকে। দোকানঘর নেওয়া হয়ে গেছে, এখন চলছে চূড়ান্ত পর্যায়ের সাজগোজ। তা ছাড়া, হাওড়া ও দক্ষিণ কলকাতায় দুটো ব্রাঞ্চ খোলার জন্যও খুব ছোটাছুটি করছেন তিনি।

অতন্দ্র এখনো টেকি ওয়ার্ল্ডেই রয়েছে। ব্রিটলস ব্যাঙ্কের প্রোজেক্টকে ওইভাবে একা কাঁধে করে ফেরত নিয়ে আসায় ওকে ব্রিটলস প্রোজেক্টের একটা টিমের লিডার করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ও এখন টেকি ওয়ার্ল্ডের কলকাতা ক্যাম্পাসের ইনোভেশন দেখে। যেসব নতুন ছেলেমেয়ে আইটি সেক্টরে ঢুকছে, নিজেদের রুটিন কাজের বাইরেও নতুন নতুন ইনভেন্ট করা, নতুন কোনো টুল ডেভেলপ করতে ও তাদের সাহায্য করে।

নিন্দুকেরা বলে, ব্যাঙ্কিং ডোমেনের ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ বসু তাঁর ডান হাত অতন্দ্র গুপ্ত-র কথায় ওঠেন বসেন।

মাঝে মাঝে অতন্দ্রর খুব মনে পড়ে গীতিকাকে। কথায় কথায় মজা করা মেয়েটার কণ্ঠস্বর কানে বাজতে থাকে যেন। লাঞ্চের সময় খেতে যেতে হলেই মনে হয়, কেউ একজন পাশ থেকে এসে বলবে, ‘চলো অতন্দ্রদা, লাঞ্চ সেরে আসি!’

সেদিন বড়ো অস্থির লাগে অতন্দ্রর। মানুষ প্রথমেই তো আত্মহত্যা করে না, আত্মহত্যা করার কিছুদিন আগে থেকে তার জাগতিক কামনা বাসনা উবে যেতে থাকে। তখন যদি তার সঙ্গে বারবার কথা বলা যায়, সে যে একা নয়, তার পাশে যে সবাই রয়েছে এমন বার্তা দেওয়া যায়, তবে হয়তো সে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দেয় না।

সেখানে গীতিকা নিজেই তো ওইসময়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। এই পৃথিবীতে আত্মীয়পরিজন বর্জিত মেয়েটা হয়তো অতন্দ্রকে বন্ধুর মতো পাশে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সময়েই ব্রিটলসের সেই ডামাডোলে অতন্দ্র ওকে সময় দিতে পারেনি। সেই অপরাধবোধ এখনো ওকে মাঝে মাঝেই কুড়ে কুড়ে খায়।

এমনিতে অফিসে সিংহভাগ সময় কাটালেও অতন্দ্রর মন পড়ে থাকে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসেই। শনি রবিবার সারাদিন সে এখানেই কাটায়, বাকি দিনগুলোও অবসরে চেষ্টা করে নানারকম আইডিয়া দিতে, কিংবা কোনো নতুন প্রোগ্রাম বানাতে। দিনরাত কাজ করে ছুটি জমায়, তারপর ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় নানারকম পর্যটন মেলায়, কিংবা সরকার আয়োজিত কোনো কনফারেন্সে। সেখানে তুলে ধরে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ কে।

আরতি আর নেই। ইউরোপ থেকে ফেরার ছ-মাসের মধ্যেই অবস্থার অত্যন্ত অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভরতি করা হয়েছিল হাসপাতালে। তাঁর সেই জ্ঞান আর কোনোদিনও ফিরে আসেনি।

অতন্দ্র আর জিনিয়া খবর পেয়ে গেছিল মানকড়ে। যাদবচন্দ্র শুকনোমুখে বসেছিলেন বিছানায়, পাশে ছিল সেই পুতো। জানলা দিয়ে বাইরের বাগানে দেখা যাচ্ছিল আরতির লাগানো গাছগুলো। অজস্র ফুল ফুটেছিল তাতে।

যাদবচন্দ্র সেদিকে উদাসচোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বামী হিসেবে কেমন ছিলাম, সেটার মূল্যায়ন যে করতে পারত, সে আজ নেই। তবে কি জানো জিনিয়া, একটাই আফশোস হয়। আরতির শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারলাম না! এমনকী, ও চলে যাওয়ার পর ই-মেল করলাম, রাজু কোনো যোগাযোগ করল না। যাকগে! ও ভালো থাক, বাবা হিসেবে এটুকুই চাইব।’

জিনিয়া নতমুখে শুনেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। শোকস্তব্ধ এই বৃদ্ধ আর ক-দিনই-বা বাঁচবেন। এমনিতেই সামনের দিনগুলো ওঁর কাটবে স্ত্রীবিহনে, তার ওপর আরও একটা কষ্ট তার ওপর চাপাতে চায়নি জিনিয়া। বলেছিল, ‘আপনার যখন যা প্রয়োজন হবে, কোনোরকম দ্বিধা ছাড়া আমাকে জানাবেন জেঠু। আমি সবসময় চেষ্টা করব আপনার পাশে থাকতে।’

যাদবচন্দ্র তখন একটা ছোটো কৌটো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওর দিকে, ‘এই নাও। তুমি তো ঝাল খেতে ভালোবাসো, আরতি ফেরার পর এই লঙ্কার আচারটা করে রেখেছিল তোমার জন্য। বলেছিল, ছেলেকে তো খাওয়ানো হল না, যে মেয়ে এত আদর করে আমাদের এত দেশ ঘোরাল, সে অন্তত খাক!’

শুনতে শুনতে জিনিয়ার চোখ সেদিন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।

উপলব্ধি করেছিল, শুধু রক্তের সম্পর্কেই মানুষ আপনজন হয় না, হয় আত্মিক টানে, ভালোবাসায়। ও তো যাদবচন্দ্র আরতির কেউই হয় না, তবু এই স্নেহ, এই ভালোবাসা পাওয়া যেন মস্ত বড়ো এক আশীর্বাদ!

আলোকপর্ণা আর পিকলু সামনের বছর বিয়ে করবে। আলোকপর্ণা ঠিক করেছে, বিয়েতে সে কোনোরকম জাঁকজমক করবে না। শুধু নিজেদের সাধ্যমতো বেশ কিছু গরিব ছেলেমেয়েকে পেটভরে খাওয়াবে একদিন। মিনতি গাঙ্গুলিরও তাই ইচ্ছে। অসম্মতি নেই আলোকপর্ণার বাবা-মায়েরও। পিকলুর দৃষ্টিশক্তির প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সম্পর্কে।

অম্বিকেশের সঙ্গে মিনতির এখন সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। জীবনের এই পর্বে এসে দু-জন একা মানুষ দু-জনের সুখে অসুখে পাশে দাঁড়ান নিয়মিত। একজন উল্টোডাঙা, অন্যজন হিন্দমোটরে থাকলেও টেলিফোনে তাঁদের মধ্যে নিয়মিত কথা হয়। মিনতির কোনো প্রয়োজনে অম্বিকেশ বিনা দ্বিধায় ছুটে যান। মিনতিও তাই। শর্তহীন, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব ভোলা, নামহীন একটা সুন্দর সম্পর্কে জড়িয়ে থাকেন তাঁরা।

সঞ্জিত হাজরা এখনও এয়ারপোর্টের কাছেই থাকেন। নিজের আদর্শ, মূল্যবোধ দিয়ে তিনি ঢেলে সাজান দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রতিটি টুর। যাত্রীরা ঘুরে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে থাকে। ঘোরা, বেড়ানোর চেয়েও এই টুর এজেন্সির আন্তরিকতা, সততা মুগ্ধ করে তাদের।

তবে একটু ফাঁক পেলেই সঞ্জিত চলে যান আহিরিটোলার দিকে। প্রাচীন কলকাতার অলিতেগলিতে তিনি খুঁজে বেড়ান তাঁর বাবা উদয় হাজরাকে।

নিজের জীবনের স্তম্ভ, ছোটোবেলায় হারিয়ে ফেলা বাবাকে তিনি খুঁজে বের করবেনই, সঞ্জিত হাজরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন নিজের ওপর।

মাসকয়েক হল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতে হয়েছে জিনিয়াকে। কেনার ইচ্ছে তেমন ছিল না। কিন্তু ঘনঘন মিটিং থাকে আজকাল। রাজ্য সরকার তো বটেই, অন্য রাজ্যের পর্যটন দপ্তরের কাছেও নিজের কোম্পানিকে পৌঁছোনোর চেষ্টা করছে জিনিয়া, সেই ব্যাপারে এত ছোটাছুটি করতে হয়, নিজের গাড়ি না থাকায় খুব মুশকিলে পড়তে হচ্ছিল ওকে। তাই কিনেই ফেলল।

ওর গাড়ি এখন পাপ্পু সিং চালায়। পাপ্পু সিং-এর টাকার প্রয়োজন কোনোদিনই খুব বেশি ছিল না, তার ওপর মাস কয়েক আগে ওর ট্যাক্সিটা একটা দুর্ঘটনায় পড়ে। ওর নিজের কিছু না হলেও গাড়িটার বেশ কিছু পার্টস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর থেকে সে আর ট্যাক্সিটা সারায়নি। জিনিয়ার প্রস্তাবে ও এখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের ড্রাইভার। নিজের ট্যাক্সির মতো জিনিয়ার এই গাড়িরও সারা শরীরে সে ফুটিয়ে তুলেছে সূক্ষ্ম নকশার কাজ।

এ ছাড়া ফাঁক পেলেই সে চলে যায় ছবি প্রদর্শনী দেখতে। জিনিয়া ওকে কলকাতার কয়েকটা আর্ট গ্যালারির মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে ওর দুটো ছবি সেই গ্যালারিতে স্থানও পেয়েছে।

আর ওর উপহার দেওয়া সেই পোর্ট্রেইটটা এখন শোভা পায় অতন্দ্র জিনিয়ার বেডরুমে।

সেদিন জিনিয়া হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ফিরছিল গাড়িতে।

দুর্গাপুজো শুরু হতে আর মাত্র দু-দিন বাকি। আজ মহাচতুর্থী। রাস্তায় রাস্তায় প্যান্ডেল সেজে উঠেছে, গানও বাজছে। মা এসেই গেলেন প্রায়!

পাপ্পু সিং বলল, ‘দিদিমণি, এবার নাকি সুতৃপ্তি সমিতি আপনার মতো দুর্গাঠাকুর করেছে। দুর্গামায়ের এক হাতে ট্রলি, অন্য হাতে একগাদা ওষুধপত্র, ব্যাগ। পেছনে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিকরা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে অনেক বুঢঢা আদমি।’

‘তাই নাকি?’ হেসে ফেলে জিনিয়া।

মাসকয়েক আগে কলকাতার এক বৃদ্ধাশ্রমের কিছু বয়স্ক মানুষদের নিয়ে ও খুব কম খরচে একটা অস্ট্রেলিয়া টুর করায়। রাজ্যের একটা প্রথম সারির দৈনিক সেই সময় ওকে নিয়ে একটা বড়ো স্টোরি করে। বয়স্ক মানুষরা সমাজে চিরকালই প্রান্তিক হয়ে থাকেন, তাঁদের নিয়ে অমন আনন্দদায়ক ভ্রমণের চিন্তাভাবনা তখন বেশ সাড়া ফেলেছিল মানুষের মনে।

জিনিয়ার লড়াইয়ের কথাও উঠে এসেছিল তখন। শুধু অর্থোপার্জন নয়, আন্তরিকতার সঙ্গে ঘোরানো, তায় পর্যটনের মতো পুরুষপ্রধান সেক্টরে একজন মহিলার এইভাবে ব্যবসা দাঁড় করানোর দৃষ্টান্ত বেশ ব্যতিক্রমী মনে হয়েছিল সবার।

তার পরেও ও এইরকম টুর করিয়েছে। একবার সোনাগাছির বয়স্ক যৌনকর্মীদের নিয়ে, আর একবার বীরভূমের এক অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের নিয়ে। এই দুটো টুরেই ও স্পনসরশিপ পেয়েছিল সংবাদপত্রের ওই স্টোরির জন্যই।

জিনিয়া হাসিমুখে একটা নিশ্বাস ফেলল।

মনটা ওর বেশ খুশি খুশি রয়েছে। ব্যবসা শুরুর পর দ্বিতীয় বছরেই নিজের অফিসের কর্মীদের সে যৎসামান্য হলেও পুজোর বোনাস দিতে পেরেছে। তাতে সবাই খুশি। ওরও ভালো লাগছে। ও সবসময় বিশ্বাস করে, ফুলুমামা, সঞ্জিত, অতন্দ্র, ও নিজে তো পরিশ্রম করছেই। কিন্তু আসল সৈন্য হল আলোকপর্ণা, পাপ্পু সিং, বিকাশরা। সম্মুখে থাকে এরাই। তাই এদের ভালোবাসা না দিলে এরাই- বা কী করে ভালোবাসবে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসকে?

ভাবতে ভাবতে পিঁ পিঁ শব্দে মেসেজ ঢোকে। অল্পাদি।

‘কেক রেডি। বিকাশকে পাঠিয়ে দে। নিয়ে যাক।’

জিনিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুরে যেটা শুরু হয়েছিল, সেটা এখনো চলছে। টুর শুরুর দিন দলের সব যাত্রীকে একসঙ্গে নিয়ে একটা বড়ো কেক কাটা। প্রথম দিনেই সবাই মিলে হইহই করে কেক খাওয়ায় যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে আড়ষ্টতাটা ভেঙে যায়, প্রথম থেকেই পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁরা।

আর প্রতিটি টুরের প্রথম দিনের সেই কেক আসে অল্পা-জ বেকারি থেকে। তাছাড়া গোটা টুরে প্রতিদিন যে শুকনো খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়, সেটারও কুকি, কাপকেকগুলো সাপ্লাই করে অল্পাদিই।

গ্যারাজ অফিসে ঢুকতেই আলোকপর্ণা বলল, ‘এই তো! এসে গেছ। চলো চলো। আর দেরি করলে সব বানচাল হয়ে যাবে!’

‘ওমা কোথায় আবার যাব?’ জিনিয়া অবাক চোখে তাকায়।

‘আরে তুমি তো দেখছি সব ভুলে মেরে দিয়েছ!’ চোখ পাকায় আলোকপর্ণা, ‘আজ আমাদের প্যান্ডেল হপিং তো। দিদি আর ইমরানদা বেরিয়ে পড়েছে। মন্দারও আসছে। অতন্দ্রদা কদ্দূর?’

‘যাহ আমি তো ভুলেই গেছি!’ জিভ কাটল জিনিয়া, ‘ও তো অফিসে।’

আলোকপর্ণা চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি যে কী কর না। এতবার করে কাল বলে দিলাম যে আজ সবাই ঠাকুর দেখতে বেরোব, আর তুমি ভুলে গেলে?’

‘মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিল।’ জিনিয়া করুণ মুখে বলল, ‘ আর চতুর্থীতে কে ঠাকুর দেখতে বেরোয় রে?’

‘দেখো জিনিয়াদি, ড্যামেজ কন্ট্রোল কোরো না তো। শিগগির অতন্দ্রদা-কে ফোন করে আসতে বলো।’ আলোকপর্ণা বলল, ‘আজ না দেখে নিলে কাল থেকে ভিড়ে চিঁড়েচ্যাপটা হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’

জিনিয়া হাসতে হাসতে অতন্দ্রকে ফোন করে।

অতন্দ্র ফোন রিসিভ করেই রেগেমেগে বলে, ‘আর বোলো না, শুভ্রদীপ জ্বালিয়ে মারছে! পুজোরদিন, কোথায় তাড়াতাড়ি কাজ সেরে অফিস থেকে বেরোব তা নয়, ক্যান্টিনে এতক্ষণ বকে বকে আমার মাথা খেয়ে নিল।’

‘ওফ, তুমি আর তোমার এই শুভ্রদীপ!’

জিনিয়া আলোকপর্ণার দিকে তাকায়, ‘আজ রাতের টুরের সব রেডি তো?’

‘এভরিথিং বস!’ আলোকপর্ণা ঝকঝকে মুখে তাকায়, ‘সবার ভিসা হয়ে গিয়েছে, টিকিট ই-মেল করে দিয়েছি। ক্যানিং স্কুলের যে হেডমাস্টার যাচ্ছেন, তাঁর তো ই-মেল টি-মেল নেই। বিকাশ কাল বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসেছে।’

‘ভেরি গুড!’ জিনিয়া চোখ টিপে বলে, ‘তোর শ্বাশুড়িকেও প্যান্ডেল হপিং-এর সঙ্গে নিবি নাকি?’

‘মাসিমাকে?’ আলোকপর্ণা অবাক, ‘ কেন?’

‘না, তাহলে ফুলুমামাকেও যেতে বলতাম!’ জিনিয়া মুখ টিপে হাসে।

আলোকপর্ণা উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে, ‘দারুণ হবে। ওহ, সান্যাল স্যার মাসিমাকে দেখে যা ক্রাশ খায়। দেখতে হেব্বি লাগে।’

‘খুব পেকেছিস না! বড়োদের নিয়ে ফাজলামি?’ জিনিয়া গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করেও হেসে ফেলে।

আলোকপর্ণা হাসতে হাসতে বলে, ‘ওহ, ভুলেই গেছি তালেগোলে। এই দেখো, স্পিডপোস্টে তোমার একটা চিঠি এসেছে আজ সকালে।’

‘দেখছি।’ জিনিয়া চিঠির শক্ত মোড়ক খুলতে খুলতে বলে, ‘বিজয়া সম্মিলনীর কতদূর?’

‘প্রায় শেষ।’ আলোকপর্ণা বলল, ‘সবার কাছে আমন্ত্রণপত্র চলে গেছে।’

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে যত যাত্রী কোনো-না-কোনো টুরে গিয়েছেন, সবাইকে নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী করার কথা ভেবেছে জিনিয়া। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ প্রথম টুরের সেই উৎপল বিশ্বাসের। ভদ্রলোক পরেও আরও দু-বার ঘুরতে গিয়েছেন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে। একবার অমরনাথ, আর আরেকবার শ্রীলঙ্কা।

উৎপল বিশ্বাস প্রায়ই ফোন করেন জিনিয়াকে। একরকম বলতে গেলে তিনি আর তাঁর স্ত্রী মৃদুলাই অনুষ্ঠানটার মূল হোতা। মৃদুলা তো গাইবেনই, ঝাড়খণ্ডের পিয়াসা ব্যানার্জিও গান গাইবেন। তিনি ও তাঁর বান্ধবী মধুমিতা শিকদার দু-জনেই আসবেন এই রি-ইউনিয়নে যোগ দিতে।

সব মিলিয়ে প্রায় তিনশোজনকে আমন্ত্রণ করা হচ্ছে।

দূরে দরজার সামনে চেয়ারে বসেছিল বিকাশ, সে বলে, ‘আমি ঠাকুর দেখতে যাব না?’

‘না, তুই গেলে অফিসে থাকবে কে?’ চোখ পাকিয়ে ধমক দিল আলোকপর্ণা, ‘চুপচাপ কাজ কর। বিকেলে পাঁচটার আগে বেরোবি না।’

বিকাশ কাঁচুমাচু মুখে কাজে মন দিতেই আলোকপর্ণা বলে, ‘কীসের চিঠি জিনিয়াদি?’

জিনিয়া বিভ্রান্ত গলায় বলে, ‘ভারত সরকার আমাকে এই বছরের সেরা আন্ত্রেপ্রেনিয়রশিপ অ্যাওয়ার্ডের জন্য সিলেক্ট করেছেন। পুরস্কার দেওয়া হবে দিল্লিতে।’

‘কী বলছ তুমি!’ আলোকপর্ণা এসে জিনিয়ার হাত চেপে ধরে, ‘ও মাই গড! আমি তো ভাবতেই পারছি না জিনিয়াদি!’

জিনিয়াও ভাবতে পারছিল না। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার আকস্মিকতায় ও হতচকিত হয়ে পড়েছিল। চোখ ছলছল করছিল অজান্তেই।

চিঠিটা দেখতে দেখতে ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল একদম প্রথম দিকের সেই রাতগুলো। যখন রাত জেগে ও হিসেব করত কীভাবে শুরু করবে। খসড়া আঁকত দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের। এ ব্যাঙ্ক থেকে ও ব্যাঙ্কে ছুটত লোনের আশায়, ক্যাশ ক্রেডিট পাইয়ে দেওয়ার জন্য ধরত দালালদের।

পর্যটন মেলায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকত। অস্থির হয়ে ছটফট করত।

মনে পড়ে যাচ্ছিল নেতাজি ইনডোরের মেলায় তিনদিন ধরে মাছি তাড়ানোর কথা। মনে পড়ে যাচ্ছিল কত ব্যঙ্গ, কত বিদ্রূপ, কত অপমান!

জীবন সুন্দর! সততা আর পরিশ্রম করার সদিচ্ছা থাকলে আরো বেশি সুন্দর!

তবে এখানেই থামবে না ও। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসকে ও নিয়ে যাবে জাতীয় স্তরে। আন্তর্জাতিক স্তরে। যে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোকে ও বহু বছর ধরে পাখির চোখ করেছিল, সেই লক্ষ্য আজ আরও বড়ো, আরও প্রসারিত!

বাইরে ঝলমল করছে শরতের আকাশ।

অস্ত্রে অলংকারে সেজে উঠছেন উমা।

মৃদুস্বরে রবীন্দ্রসংগীত বেজে চলেছে প্যান্ডেলে। বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে।
সব গগন উদবেলিয়া—মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে—চঞ্চল একি আনন্দ—তরঙ্গ।।
তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র তারা,
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,
আকুল চঞ্চল নাচে সংসার, কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *