৪০. রিসেপশনে সইসাবুদ

৪০

সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ সবাই হোটেলে ঢুকলেও জিনিয়া রিসেপশনে সইসাবুদ করেই বেরিয়ে এল।

অম্বিকেশ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন আবার কোথায় চললি?’

‘একটা কাজ আছে ফুলুমামা।’ জিনিয়া বলল, ‘তুমি কারুর কোনো অসুবিধা হলে, দেখো। আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।’

প্যারিসের এই হোটেলটা প্রকাণ্ড বড়ো। মনে মনে একটা ব্যাপার ভেবে বেশ ভালো লাগছে জিনিয়ার, ভারতে বসে যে যে হোটেলগুলোয় ও অনলাইন বুক করেছিল, তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত যে দুটো দেখেছে, লন্ডন আর প্যারিস, দুটোই যথেষ্ট ভালো মানের হোটেল। হোটেলের ঘর থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সমস্ত পরিষেবাই রয়েছে। যাত্রীরাও যথেষ্ট খুশি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও এরা কিছু ভারতীয় পদ রাখছে, যেটা জিনিয়া বারবার ই-মেলে উল্লেখ করেছিল।

মোগলাই খানা পেয়ে উৎপল বিশ্বাসের মতো লোকেরও মুখটা বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠেছিল, খেয়াল করেছে জিনিয়া।

আজ ভোরে লন্ডনের হোটেল থেকে বেরিয়ে সকাল দশটা নাগাদ ওরা প্যারিস শহরে ঢুকেছিল। তখন আর হোটেলে ঢোকেনি, বাসের খোলের মধ্যে সবার লাগেজ ঢোকানোই ছিল, সেই নিয়েই প্রথম দিনের প্যারিস সফর সেরে ফেলা হয়েছে। আজ দেখা হয়েছে লুভর মিউজিয়াম।

ছোটোবেলা থেকেই পৃথিবীর বৃহত্তম এই আর্ট মিউজিয়ামটা দেখার ইচ্ছে ছিল জিনিয়ার। স্কুলের ইতিহাসে পড়া লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সেই বিখ্যাত আঁকা মোনালিসার কথাই হোক, সম্রাট নেপোলিয়নের করোনেশনের ছবিই হোক, কিংবা লুভরে ঢোকার প্রবেশপথের সেই কাচের পিরামিড, যতবার ছবিতে দেখেছে, ততবারই ভীষণভাবে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে ওর।

ভেবেছে যে কি অসম্ভব আভিজাত্যে মোড়া এই লুভর মিউজিয়াম!

অথচ লুভর মিউজিয়াম যে মধ্যযুগীয় বিশাল প্রাসাদে অবস্থিত, সেই প্রাসাদ কিন্তু রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ বানিয়েছিলেন দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। সে প্রায় আটশো বছর আগের কথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আড়াইশো বছরে শিল্পকর্মের সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে কুড়ি হাজারেরও বেশি।

এত কিছু ও জানতই না, জানার কথা নয়। কিন্তু আজ গোটা মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখানোর সময় সঞ্জিত হাজরা এত প্রাঞ্জলভাবে গল্পের মতো গোটা ইতিহাসটা শুনিয়েছেন, ও নিজে তো বটেই, উৎপল বিশ্বাসের মতোমানুষও চুপ করে শুনেছেন।

সব ঘুরে বেড়িয়ে বাসে উঠে অবশ্য উৎপল বিশ্বাস আর পরেশনাথ কুণ্ডু নিজেদের মধ্যে গজগজ করছিলেন, ‘ধুস! প্যারিস বলতে লোকে বলে আইফেল টাওয়ার। তা নয়, সারাদিন খালি ছবি দেখে গেলাম। আরে আমরা কি অত আঁকাজোকা বুঝি নাকি? এক-আধটা ভালো লাগে! তাই বলে সারাদিন?’

‘যা বলেছেন।’ পরেশনাথ কুণ্ডু সায় দিয়ে বলেছিলেন, ‘তার ওপর ওইসব রগরগে ছবি, এইটুকু ছেলে নিয়ে আমার তো করিডোরে ঘুরে বেড়াতেই লজ্জা করছিল! ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলাম, এই বুঝি কিছু প্রশ্ন করে বসে।’

জিনিয়া তখন ওঁদের সামনের দিকে সিটে বসেছিল, ফলে সবই শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। গ্র্যান্ড ওডালিস্কের সেই কিংবদন্তি নারীমূর্তির ছবিকে যারা শুধুমাত্র নগ্নতার দৃষ্টিতে দেখে, তাদের সঙ্গে তর্ক করাটাই মূর্খামি।

কিন্তু পেছন থেকে অভীকদের দলটা শুনতে পেয়েছিল এই কথোপকথন। ওরা ছাড়েনি। বলেছিল, ‘ও পরেশদা, ছবি নিয়ে আপনার এত লজ্জা? বলি, প্যারিস তো ভালোবাসার শহর, মাঝে মাঝেই দেখবেন রাস্তায় চুমু খাওয়া চলছে, তখন ছেলেকে কী করে বাঁচাবেন? সানগ্লাস পরিয়ে?’

পরেশনাথ কুণ্ডু পেছন ফিরে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, ‘বাজে কথা বোলো না। ভদ্র পাড়া দিয়ে বাস নিয়ে গেলেই সেসব দেখতে হবে না!’

অভীক, সৈকত, অনমিত্র হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিল প্রায়, ‘ ভদ্র পাড়া অভদ্র পাড়া আবার কী! এখানে সব জায়গাতেই দেখতে পাবেন। এসব ওদের কাছে খারাপ কিছু নয়। আচ্ছা, আমাদের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? কাল আইফেল টাওয়ারে চলুন, দেখিয়ে দেব চোখে আঙুল দিয়ে। এসব ভাবলে আপনার ছেলেকে নিয়ে সৌদি আরবে ঘুরতে যাওয়া উচিত ছিল। হা হা!’

এখন সেই কথাগুলো মনে পড়তে হাঁটতে হাঁটতে জিনিয়ার হাসি পেয়ে গেল। সত্যি ওদের এই দলে কিছু মহিলাকে ও লক্ষ করছে, যাদের নিজস্ব কোনো ভালোলাগা নেই, থাকলে সেই ভাললাগার কোনো প্রকাশ নেই, কোনো মতামত নেই, কোনো অভিব্যক্তিও নেই। মনে হচ্ছে তাঁরা যেন কলের পুতুলের মতো স্বামীর সঙ্গে আসতে হয়, এসেছেন। এই পরেশনাথ কুণ্ডুর স্ত্রী পামেলা কিংবা উৎপল বিশ্বাসের স্ত্রী মৃদুলা এইরকম। অথচ এঁদের চেয়ে অনেক বেশি বয়সের আরতি দেবী কিন্তু শরীরের এই অবস্থাতেও প্রতিটি দ্রষ্টব্য স্থান দেখে চলেছেন, দেখে আনন্দ প্রকাশ করছেন।

আসলে ভাবনাচিন্তার স্বাধীনতা বোধটা বয়স নয়, মানসিকতার ওপর নির্ভর করে।

লবি পেরিয়ে পার্কিং এর সামনে আসতেই জিনিয়া ক্লিমেন্টকে দেখতে পেল। লোকটাকে দেখলে বেশ মজা লাগে ওর। কোনো সাজগোজ নেই, কোনো বাহুল্য নেই, স্রেফ একটা সাদা গেঞ্জি আর জিনস পরে গোটা ইউরোপ ঘুরে চলেছে।

চোখাচোখি হতেই জিনিয়া হাসল, ‘হাই!’

‘হে জিনিয়া!’ ক্লিমেন্টের মুখে সম্ভবত চুইং গাম। চিবোতে চিবোতে ইংরেজিতে বলল, ‘এই সন্ধ্যাবেলা চললে কোথায়?’

জিনিয়া বলল, ‘একটু আসছি।’ তারপরই কি খেয়াল হতে ও হাতের চিরকুটে লেখা ঠিকানাটা পড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, রুয়ে দে রিভোলি বলে একটা বড়ো রাস্তা আছে প্যারিসে?’

‘হ্যাঁ আছে তো।’ ক্লিমেন্ট ওর চকচকে টাক দুলিয়ে বলল, ‘আজ যে লুভর মিউজিয়ামে গেলাম, তার পাশেই যে চওড়া রাস্তাটা চলে গেছে, সেটাই তো রুয়ে দে রিভোলি। রিভোলির যুদ্ধে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়াকে হারিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধজয়ের পরে তৈরি হয়েছিল রাস্তাটা।’ ফ্রেঞ্চ ভাষায় রুয়ে মানে রাস্তা।’

‘ওহ! ওকে। এটাই জানার ছিল। থ্যাঙ্ক ইউ।’ জিনিয়া আর কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। সামনেই বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাস ধরবে। লুভর মিউজিউয়ামের পাশে যখন, ফোনে লোকেশন দেখে ও ঠিক চলে যাবে। ওবায়েদ হক নাসের লোকটি যে ঠিকানা দিয়েছেন, তাতে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে লেখা রয়েছে, রুয়ে দে রিভোলির রাস্তায় একটা কিউরিয়ো-র দোকান আছে। সেই দোকানের পাশের সরু গলি দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে ওই বাড়িতে পৌঁছোনো যাবে।

নির্দিষ্ট বাসে উঠে জিনিয়া গুটিসুটি মেরে বসল। হোটেলের ভেতরে ও বুঝতে পারেনি, বাইরে যথেষ্ট ঠান্ডা। ওর জ্যাকেট আর ট্রাউজারে সেই হাওয়া আটকাচ্ছে না। দরকার ছিল একটা মোটা ওভারকোটের। কিন্তু তাড়াহুড়োয় সেটা পরে আসতে ও ভুলে গেছে।

আসলে যাদবচন্দ্র ও আরতি দেবীর ছেলে ড রাজীব সরকারের ব্যাপারটা ওর কাছে বেশ রহস্যজনক ঠেকছে। বলব বলব করেও ও যাদবচন্দ্রকে বলতে পারেনি, যে ওঁর ছেলে এখন আর সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান না। অধ্যাপনার মতো চাকরি উনি কেন ছেড়ে দিলেন, তার চেয়েও বড়ো কথা, তাঁর নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন কেন অন্য একজনের জিম্মায়, সেটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ওর। একেই আরতি দেবী অসুস্থ, এই অবস্থায় নিজের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আগে থেকে কিছু বলে ওঁদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেওয়াটা সমীচীন বলে মনে হয়নি ওর।

 রুয়ে দে রিভোলিতে নেমে নির্দেশমতো হেঁটে যেতেই বাড়িটা দেখতে পেয়ে গেল ও। ওবায়েদ হক যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই। লালচে ইটরঙা একতলা ছিমছাম বাড়ি, সামনে একদিকে গ্যারাজ, অন্যদিকে বাগান। ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে ছ-টা হলেও আকাশে এখনও সামান্য দিনের আলো রয়েছে।

সেই আলোয় জিনিয়ার বাড়ির গেট খুলে ভেতরে গিয়ে দরজার বাইরের বেল বাজাতে কোনো অসুবিধে হল না।

বেল বাজানোর প্রায় দু-মিনিট পর যিনি দরজা খুললেন, তিনি জিনিয়াকে দেখে অবাক হলেন না, জিনিয়া বুঝতে পারল, ওর আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। ও বলল, ‘আপনিই কি মি ওবায়েদ হক?’

‘জ্বি’। বললেন ভদ্রলোক, ‘ভেতরে আসুন।’

ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ফোনে শুনে অতটা বুঝতে পারেনি জিনিয়া, কিন্তু এখন মুখের বলিরেখা দেখে আন্দাজ করল ওঁর বয়স সত্তর কিংবা তারও বেশি। তবে শরীরের গঠন এখনও সুঠাম, পরে আছেন একটা গেঞ্জি আর ট্রাউজার। গায়ের রং বেশ চাপা, চোখে চশমা। চুল কালো হলেও তাতে সাদা ছোপ লেগেছে অনেক জায়গাতেই।

ড্রয়িং রুমে পৌঁছে সোফায় বসল জিনিয়া। চারপাশে থমথম করছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ও হঠাৎ অনুভব করল, রুয়ে দে রিভোলির মতো ব্যস্ত রাজপথের এত কাছে হয়েও বাড়িটা যেন বড্ড বেশি চুপচাপ। এখানে কি এই ভদ্রলোক ছাড়া আর কেউই থাকেন না?

‘আপনি একটু কফি খাবেন তো?’ ভদ্রলোক ওর উলটোদিকে সোফায় এসে বসলেন।

‘না।’ জিনিয়া আর দেরি করল না, হোটেলে ফিরে অনেক কাজ আছে, ও সোজা কাজের কথায় চলে এল, ‘আপনাকে ফোনে বলেছিলাম আমি কলকাতা থেকে গ্রুপ নিয়ে ইউরোপ টুরে এসেছি। ড রাজীবচন্দ্র সরকারের বাবা মা এসেছেন আমার সঙ্গে…!’

‘জ্বি, বলেছিলেন।’ ভদ্রলোক সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

‘তো, সে-ব্যাপারেই ড সরকারের নম্বরটায় ফোন করতে আপনি ধরলেন।’ জিনিয়া গলাখাঁকারি দিয়ে বলল।

ওবায়েদ হক এবার বললেন, ‘হ্যাঁ। রাজীব সোরবোনে পড়াত। ভারত থেকে এসে ওখানেই ডক্টরেট করেছিল। আমিই রেকমেন্ড করেছিলাম। তারপর ওখানেই টিচিং স্টাফ হিসেবে জয়েন করে। দু-জনেই।’

জিনিয়া কিছুই বুঝতে পারছিল না। এই ভদ্রলোকের পরিচয় কী? কেনই-বা রাজীব সরকারের ফোন এঁর কাছে? দু-জন কোথা থেকে এল? কৌতূহল তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই ওর এখন নেই। একটা মানবিকতার তাগিদে ও এসেছে। কোনো রহস্যের জট খুলতে নয়।

জিনিয়াকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে ওবায়েদ হক বোধ হয় বুঝতে পারলেন যে ও কিছু বুঝতে পারছে না। তিনি এবার একটু থেমে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি এই দেশে আছি পঁয়তাল্লিশ বছর হয়ে গেল। এখন ফ্রান্সের নাগরিক হলেও আমার আসল বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে লন্ডনে উচ্চতর শিক্ষার জন্য এসেছিলাম। তারপর যখন ফেরার সময় উপস্থিত হল, আমার দেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে সবে বাংলাদেশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে মরছে লাখে লাখে মানুষ, খানসেনাদের অত্যাচারে তটস্থ সদ্যোজাত বাংলাদেশ। বাড়ির সবাই পরামর্শ দিল, এই অবস্থায় তোকে আর ফিরতে হবে না, তুই ওখানেই আপাতত কাজের চেষ্টা কর।’

বৃদ্ধ বলে চললেন, ‘তাই হল। চাকরি নিয়ে চলে এলাম এই দেশে। ঠিক সেইসময় প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে রেসিডেন্ট ডাক্তারের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, অ্যাপ্লাই করতে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। আর সেই যে থিতু হয়ে গেলাম, আর ফিরতে পারলাম না দেশে। দেশ ছাড়ার আগেই বিয়ে করে এসেছিলাম। বউ আমিনা ছিল ময়মনসিংহের মেয়ে, কিন্তু তার সব আত্মীয় তখন কলকাতায়। সে কিছুতেই এদেশে আসবে না, আমারও তখন আর দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই। অবশেষে ঠিক হল, আমিনা কলকাতায় গিয়ে তার নিজের লোকেদের সঙ্গে থাকুক, আমি টাকা তো পাঠাবই, দু-বছরে একবার যাব।

‘ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এইভাবে আমরা ত্রিশ বছর বিবাহিত জীবন পার করে দিলাম। খুব যে খারাপ লাগত তা নয়, বরং আমি আর আমিনা ভালোই ছিলাম। আমি ছিলাম কাজপাগল মানুষ, ডিউটি ছাড়াও অনেকজায়গায় রুগি দেখতাম, একা লাগার অবকাশই হত না। ওদিকে আমিনাও তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে বেশ জড়িয়ে থাকত।

‘বিয়ের চার বছর পরে আমাদের একটা মেয়ে হল। ভারি ফুটফুটে। নাম রাখলাম শেহনাজ। শেহনাজ শব্দের অর্থ গর্ব। সত্যিই ও আমাদের গর্বিত করেছিল। প্রতি চিঠিতে খবর পেতাম যত বড়ো হচ্ছে, লেখাপড়ায় তুখোড় হচ্ছে শেহনাজ। একটু বড়ো হতেই আমাকে চিঠি লিখত শেহনাজ, আমিও উত্তর দিতাম। তখন আর দু-বছর অন্তর নয়, প্রতি বছরেই কলকাতা যাওয়ার চেষ্টা করতাম। যাওয়ার সময় ওর জন্য নিয়ে যেতাম বই, খেলনা, অনেকরকম জামা।’

জিনিয়া চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এখনও পর্যন্ত ভদ্রলোক কেন ওকে এই কথাগুলো শোনাচ্ছেন, সেটা ও বুঝে উঠতে পারছিল না। তবে শুনতে খারাপ লাগছিল না। বিশেষত ওই মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ হাতে করে কাঁটাতার পেরিয়ে পালিয়ে আসার গল্প মা আর ফুলুমামার কাছে ও এত শুনেছে যে এই প্রসঙ্গ উঠলেই ও কেমন একাত্ম বোধ করে।

ড ওবায়েদ হক এবার বললেন, ‘তুমি বোধ হয় ভাবছ তোমাকে কেন আমি আমার জীবনের গল্প শোনাতে বসলাম। বলছি। আর একটু সবুর করো। শেহনাজ কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তে শুরু করল। মাস্টার্স পড়তে গিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ হল রাজীবের। দু-জনেই মাস্টার্সের পর এদেশে পিএইচডি-র জন্য অ্যাপ্লাই করল। ভালো নম্বর, পরীক্ষায় পাশ করা ছাড়াও এসব দেশে কোনো রেকমেন্ডেশন থাকলে অনেক সহজ হয় ব্যাপারটা। আমি দু-জনকেই রেকমেন্ড করলাম। দু-জনে চলে এল এই দেশে। এসে বিয়ে করল। ওর মায়ের তেমন মত না থাকলেও আমি বাধা দিলাম না। গোটা জীবন এদেশে কাটিয়ে বুঝেছি ধর্মের বাড়াবাড়ি মানুষকে পেছনদিকে হাঁটায়। মানুষটা ভালো কি না সেটাই আমার কাছে ছিল একমাত্র বিচার্য।’

জিনিয়া এবার নড়েচড়ে বসল। ড ওবায়েদ হক নামক এই বৃদ্ধ তার মানে রাজীব সরকারের শ্বশুরমশাই!

‘আমি ওদের বিয়ের আগে রাজীবকে অনেকবার বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে জানাতে। কিন্তু রাজীব রাজি হয়নি। ওর বক্তব্য ছিল, ওর বাবা মা কিছুতেই এই ভিন্ন ধর্মে বিয়ে মেনে নেবেন না, উলটে হয়তো ভয়ংকর শোক পাবেন। রাজীব বিয়ের কথা জানানো তো দূর, বাবা-মা-র সঙ্গে যোগাযোগই বলতে গেলে বন্ধ করে দিল। আমার মোটেই ভালো লাগত না ব্যাপারটা। মনে হত রাজীবের অনুপস্থিতিতে যেভাবে হোক ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু রাজীবের বাবার নাকি হার্ট ভালো নয়, কী থেকে কী হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে শেহনাজ আমাকে নিরস্ত করত।’

জিনিয়া একটা নিশ্বাস ফেলল। আর কত সম্পর্ক, আর কতগুলো পরিবারের সুতো যে এই ধর্মের জন্য ছিঁড়ে যাবে, সেটাই ও ভেবে পায় না। শুনতে শুনতে ওর ঋতুপর্ণার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মহাদেশ, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পটভূমি, অথচ তবুও কতটা সাদৃশ্য। ইমরানদাকে বিয়ে করার অপরাধে ঋতুপর্ণাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাটাতে হচ্ছে। ওর বাবা-মায়ের আর্থিক সংগতি না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না।

আলোকপর্ণাকে জিনিয়ার মাধ্যমে বেশি টাকা দিয়ে ঋতুপর্ণা সাহায্য করছে বটে, কিন্তু ওর বুকটা কি তাতে ফেটে যাচ্ছে না? ওর কি ইচ্ছে হয় না ক্লান্ত দিনের শেষে কী মায়ের কোলে মাথাটা রাখতে? কিংবা বাবার সঙ্গে গল্প করতে? অথচ চীনের প্রাচীরের মতো মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে ধর্ম।

এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।

‘ওরা দু-জনে সোরবোনেই পড়াতে শুরু করল। বাড়ি ভাড়া নিল ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি। চার পাঁচ বছর পর বাড়িও কিনল একটা। মাঝেমধ্যে আমার এখানে আসত, আমার সঙ্গে ছুটির দিন লাঞ্চ করত।’ ওবায়েদ হক একটু থামলেন।

তারপর স্থিরকণ্ঠে বললেন, ‘শেহনাজ মারা যাওয়ার দিনও এখান থেকেই লাঞ্চ করে ওরা বেরিয়েছিল। যাচ্ছিল চ্যান্টিলি বলে একটা ছোট্ট শহরে। সেখানে খুব সুন্দর একটা জঙ্গল রয়েছে, আর রয়েছে বড়ো বড়ো দুর্গ, লেক। কিন্তু পৌঁছোতে পারেনি। যাওয়ার পথেই গাড়ি খুব বড়ো একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে। শেহনাজ প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই মারা যায়।’

জিনিয়া চমকে উঠল। ঘটনার এই পরিণতি ও কল্পনাও করতে পারেনি।

এতক্ষণ ও লক্ষ করেনি, এখন দেখল, সোফার পাশেই একটা টেবিলে রাখা দু-জন তরুণ তরুণীর হাসিমুখের ছবিটি ওবায়েদ হক হাতে তুলে নিয়েছেন। ছবির মেয়েটির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আমি যখন খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছোলাম, ততক্ষণে শেহনাজকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে মর্গে। আর রাজীব জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভরতি।’

‘তারপর?’ জিনিয়া অস্ফুটে বলল।

ওবায়েদ হক নিশ্বাস ফেললেন, ‘রাজীব গাড়ি চালাচ্ছিল। আর শেহনাজ ছিল তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক লহমায় সব শেষ হয়ে গেল। রাজীবের জ্ঞান ফিরল বটে, কিন্তু প্রচণ্ড অপরাধবোধে আর শোকে ওর চেতনা আর কোনোদিনও ফিরল না।

‘আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে এলাম। আমিনাও কলকাতা থেকে এল। নিজেদের দুঃখ বুকে পাথর চেপে ভুলে ওকে সুস্থ করতে চেষ্টা করলাম। চাইলাম ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। কিন্তু তা হল না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বকত, মাঝরাতে দেখতাম প্রচণ্ড ঠান্ডায় বাইরের বাগানে গিয়ে বসে আছে। কখনো কখনো প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে উঠত। চিৎকার করে বলত, ‘আমি খুনি! আমিই মেরেছি শেহনাজকে।’ তখন হাতের সামনে যা পেত, তাই দিয়ে নিজেকে আঘাত করত। কিছু না পেলে দেওয়ালেই মাথা ঠুকে রক্তারক্তি করত। আমার সঙ্গে এখানকার অনেক নামিদামি ডাক্তারদের পরিচয় রয়েছে। সেই সূত্র ধরেই বেশ কিছু সায়কিয়াট্রিস্ট দেখালাম। কোনো লাভ হল না। কলেজেও যেত না ঠিকঠাক। জোর করে পাঠালে ক্লাস নেওয়ার মাঝেই হিংস্র হয়ে উঠত। দু-তিনবার এইরকম ঘটার পর কর্তৃপক্ষ ওকে সাসপেন্ড করল। চাকরিটা চলেই যেত, নেহাত আমার রেফারেন্সে সেটা খাতায়-কলমে রয়ে গেল। দিনে দিনে ওর অবস্থার এতই অবনতি হল যে ডাক্তারের পরামর্শে আমরা বাধ্য হলাম ওকে একটা মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে।

‘এখানকার মানসিক হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভারত বা বাংলাদেশের মতো তথৈবচ নয়। এখানে সত্যিই রুগিদের সুস্থ করার চেষ্টা করা হয়, নানারকম থেরাপি চলে, কাউন্সেলিং হয়। প্রায় দু-বছর ওখানে থাকার পর রাজীব অনেকটা ঠিক হল। ওখান থেকে ছাড়াও পেল।’ ড হক দম নিতে থামলেন, ‘কিন্তু চাকরিতে আর জয়েন করল না।’

‘তাহলে?’ জিনিয়া বলল, ‘উনি এখন কোথায়?’

ড. হক বললেন, ‘ইটালির পিসা শহরের নাম শুনেছ?’

‘হ্যাঁ। হেলানো টাওয়ার …।’ জিনিয়া বলল।

‘শুধু টাওয়ার নয়। পিসাতে গেলে দেখতে পাবে একটা ক্যাম্পাসের মধ্যে পিসা ব্যাপ্টিস্ট্রি, পিসা ক্যাথিড্রাল আর ওই হেলানো টাওয়ার রয়েছে। শেহনাজ আর রাজীব বিয়ের পরে ওখানেই বেড়াতে গিয়েছিল।’ ড. হক বললেন, ‘রাজীব এখন ওখানেই থাকে।’

‘ওখানে থাকেন বলতে …,’ জিনিয়া বলল, ‘কী করেন সেখানে?’

ড হক কাঁধ ঝাঁকালেন, ‘সেরকম কিছু না। আমি দু-বার গেছি ফেরত নিয়ে আসতে। ও আসেনি। ওর সায়কিয়াট্রিস্টের কথা অনুযায়ী বেশি জোরাজুরিও করিনি। সেরে ওঠার পর ওর মধ্যে আগের সেই উগ্রতা বা হিংস্রতা নেই, কিন্তু অসম্ভব চুপচাপ হয়ে গেছে। পাঁচটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা কথার উত্তর দেয়। কখনো তাও দেয় না। সঙ্গে ফোন রাখে না। ওর অর্থকষ্ট নেই, ব্যাঙ্কে ভালো টাকা আছে। আমিই সেগুলো এখান থেকে খেপে খেপে পাঠাই। সেইসব দিয়েই চলে যায়। ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ওরা দু-জনেই চাকরি পাওয়ার পর পরই পেয়ে গেছিল, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে হওয়ায় ইটালিতে থাকতে কোনো সমস্যাও হয় না।’

জিনিয়া চুপ করে রইল। কী বলা উচিত সেটাই ও বুঝে উঠতে পারছে না। যাদবচন্দ্র লন্ডনে পা রেখে হোটেলের রিসেপশন লবিতে যেদিন ওকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলেছিলেন, সেদিন অজানা অচেনা রাজীব সরকারের ওপর ওর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল ছেলে হয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা-র খোঁজ টুকু পর্যন্ত রাখে না, এ কেমন ছেলে!

কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে, পুরোটা না জেনেই কারুর সম্বন্ধে কিছু ধারণা করে নেওয়াটা ঠিক নয়। রাজীব সরকারের মতো মেধাবী একজন মানুষের যে এই হাল হতে পারে, সেটা কি কেউ কল্পনা করতে পারে?

বাইরের কোথাও ঢং ঢং করে আটটা বেজে উঠল। জিনিয়া সচকিত হয়ে পাশের জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখল, বাইরে অন্ধকার নেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ হল। রাত আটটা বাজে মানে ওদের হোটেলের ডাইনিং-এ এবার ডিনার সার্ভ করা শুরু হবে। এইসময় হোস্ট হিসেবে জিনিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। সারাদিন গাইডের কাজ করে সঞ্জিত তখন একটু বিশ্রাম নেন, অন্যদের সঙ্গে তিনিও খেয়ে নেন। ফুলুমামা আর জিনিয়াই তদারক করে সবার খাওয়ার, তারপর হোটেল কর্তৃপক্ষের খাতায় প্রয়োজনীয় সইসাবুদ করে। সবার খাওয়া হয়ে গেলে প্লেট নেয় ও আর ফুলুমামা। এখান থেকে হোটেলে ফিরতে কম করে লাগবে আধ ঘণ্টা। এখনই না বেরোলে ও সময়ের মধ্যে পৌঁছতে পারবে না।

 ‘আমার স্ত্রী আমিনা এখনও কলকাতাতেই। আমি বুড়ো বয়সে এখানে পড়ে আছি শুধুমাত্র নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। কয়েকটা ক্লিনিকে ফ্রি সার্ভিস দিই। এইসব ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে আমি অনেক চেষ্টা করেছি রাজীবের বাবা-মা-র সঙ্গে যোগাযোগ করার। নানা কারণে পারিনি। তবে ওঁরাই যে ছেলের খোঁজে এতদূর আসবেন, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি!’ ওবায়েদ হক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

৪১

‘আমরা এখন যার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমি হলফ করে বলতে পারি, তাকে আপনারা সকলেই চেনেন, ছবি দেখেছেন অনেকবার।’ সঞ্জিত হাজরা বলে চলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এই হল প্যারিসের কেন্দ্রবিন্দু, গোটা ফ্রান্সের অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ আইফেল টাওয়ার। প্রায় ৩২৪ মিটার অর্থাৎ প্রায় একাশি তলা সমান উঁচু বাড়ির সমান এই আইফেল টাওয়ার দাঁড়িয়ে রয়েছে যে বিশাল সবুজ বাগানটার ওপর, সেটার নাম চ্যাম্প দে মার্স।

‘১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্যারিসে একটা বিশ্বমানের মেলা হয়েছিল। সেই মেলার প্রবেশতোরণ হিসেবে এটা তৈরি করেন গুস্তাভ আইফেল নামের এক ইঞ্জিনিয়ারের কোম্পানি। তাঁর নামেই আইফেল টাওয়ার। গোটা টাওয়ারটা পুডলড আয়রন। সেই দিয়ে তৈরি।’

প্যারিসে আইফেল টাওয়ার এমন একটা জায়গায় অবস্থিত যে কাছাকাছি যেকোনো জায়গা থেকে টাওয়ারটা চোখে পড়বে। তাই আজ সকালে বাস যখন সবাইকে নিয়ে এদিকে আসছিল, অনেক দূর থেকে আইফেল টাওয়ারের চূড়াটা জানলা দিয়ে চোখে পড়ছিল। তবু এখানে পৌঁছে বাস থেকে নেমে সবাই যখন আইফেল টাওয়ারের সামনে দাঁড়াল, অবাক হয়ে গেল।

একটা বিশাল বড়ো চাতাল, একপাশে টিকিট কাউন্টার, অন্য পাশে খাবারের দোকান। এগিয়ে যাওয়ার আগে হাতে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর পতাকা নিয়ে সবাইকে জড়ো করে সঞ্জিত হাজরা বলে যাচ্ছিলেন আইফেল টাওয়ারের ইতিহাস ভূগোল।

‘ম্যাগনিফিশেন্ট!’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ চোখ বড়ো বড়ো করে ওপরের দিকে তাকিয়েছিলেন, ‘টিভিতে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু এত বড়ো ধারণাই করতে পারিনি ভাই!’

অভীক, সৈকত, অনমিত্র অন্য সময় মৃগাঙ্কদার কোনো কথাতেই রসিকতা করতে ছাড়ে না। কিন্তু এখন তারাও চোখ ভরে দেখছে। মুগ্ধতার আবেশ পাশে দাঁড়ানো মধুমিতা, পিয়াসার চোখেও।

অধ্যাপিকা পিয়াসা অস্ফুটে বললেন, ‘মধু, আমরা আধুনিক যুগের সপ্তম আশ্চর্যের একটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!’

মধুমিতা পিয়াসার হাত চেপে ধরে বলল, ‘তোমার সঙ্গে মিশন ওয়ান কমপ্লিট পিয়া!’

দু-জনের কেউই জানতে পারল না, ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলা উৎপল বিশ্বাস বিরক্ত চোখে তাকালেন।

পরেশনাথ কুণ্ডুর ছেলে রোদ্দুর আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘বাবা, ওই রডের ভেতরে যাওয়া যায়?’

পরেশনাথও অবাক হয়ে দেখছিলেন। এতদিন জানতেন আইফেল টাওয়ারের নকশাটাও হাওড়া ব্রিজের মতো, কিন্তু এই টাওয়ার বেয়ে যে ওপরে ওঠা যায়, তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল। অথচ এখন তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন, পিঁপড়ের সারির মতো লোক গিজগিজ করছে ওপরে।

সৌম্যজিৎ-মধুছন্দা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে এদিক ওদিক বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিল। রোদ্দুরের প্রশ্নে মধুছন্দা হেসে বলল, ‘যাওয়া যায় তো। আমরাই যাব এবার দ্যাখো না।’

‘কী মজা!’ রোদ্দুর তার মায়ের হাত ধরে বলল, ‘ মা, তুমি আমার হাত ধরে ধরে উঠবে। দেখো, পড়ে যেয়ো না যেন!’

মধুছন্দা মুচকি হেসে পরেশনাথের স্ত্রী পামেলার দিকে তাকাল। পামেলা এসে থেকেই বেশ জড়োসড়ো। লন্ডন হোক বা প্যারিস, সামনে যত সুন্দর দৃশ্যই থাক, কিছুতেই যেন কোনো তাপ উত্তাপ নেই। না আছে তার দেখার কোনো ইচ্ছে, না আছে কোনো সাজগোজ। একটা সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরে, যেমন তেমন করে চুল বেঁধে, সম্পূর্ণ প্রসাধনহীন অবস্থায় রোজ বেরোয় পামেলা।

এমন মানুষকে এত খরচ করে ঘুরতে আনার কী দরকার, যার কোনো অনুভূতিই নেই!

মধুছন্দার সঙ্গে চোখাচোখি হতে ফ্যাকাশে হেসেই সে চোখ সরিয়ে নিল। অথচ মধুছন্দার চেয়ে তার বয়স দু-তিন বছরের বেশি কিছুতেই নয়।

মধুছন্দা রোদ্দুরের গাল টিপে বলল, ‘এ কী, পড়বেন কেন তোমার মা?’

রোদ্দুর বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলল, ‘মা তো ধাক্কা দিলেই পড়ে যায়। এই তো, ঘুরতে আসার আগের দিন রাতে বাবা জোরে ধাক্কা দিল, মা অমনি পড়ে গেল।’

মধুছন্দা হতচকিত হয়ে পামেলার দিকে তাকাল। এমন উত্তর সে একদমই আশা করেনি। পামেলা তার ছেলের কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে অন্যদিকে তাকাল, তারপর আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল সঞ্জিত হাজরাকে ঘিরে থাকা জটলার দিকে। ভীতু পায়ে হেঁটে গিয়ে সে দাঁড়াল ঠিক উইশির পাশে।

উইশি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে আকবর আলির পাশে, আজ সে পরেছে কাঁচা হলুদ রঙের একটা প্যান্ট আর ধপধপে সাদা একটা ট্যাঙ্ক টপ। ডিমের অমলেটের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তাকে দেখলে।

‘মজার ব্যাপার হল, ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৯, এই দু-বছর ধরে আইফেল টাওয়ার তৈরি হওয়ার পর ফ্রান্সের প্রচুর মানুষ, বিশেষত শিল্পী, সাহিত্যিক এই জাতীয় বুদ্ধিজীবীরা এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ”আর্টিস্টস এগেইন্সট দি আইফেল টাওয়ার” নামে একটা জয়েন্ট পিটিশনও পাঠিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, প্যারিসের ঐতিহ্য, প্রায় হাজার বছরের স্থাপত্যের সঙ্গে এইরকম একটা ধাতব টাওয়ার কোনোমতেই খাপ খায় না। নোৎরদাম ক্যাথিড্রাল, আর্ক দ্য ট্রিয়াম্ফ, লুভরের মতো চোখধাঁধানো সূক্ষ্ম স্থাপত্য, কারুকার্যর পাশে এই বেমানান টাওয়ারটা শুধু যে প্যারিসের সৌন্দর্যকে ভীষণভাবে ম্লান করে দিচ্ছে তাই নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেখাপ্পা লম্বা বানিয়ে বাকি স্থাপত্যগুলোকে হেয়ও করা হয়েছে।

‘গুস্তাভ আইফেলকেও অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। অথচ এখন প্যারিস শহর বলতেই আইফেল টাওয়ারের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’ সঞ্জিত হাজরা হেসে বললেন, ‘যাই হোক, আমরা এখন টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট নেব, তারপর একটা করে ফ্লোরে উঠব। গোটা টাওয়ারটায় তিনটে ফ্লোর আছে। ওঠার জন্য সিঁড়ি রয়েছে, রয়েছে লিফটও। একদম ওপরে উঠে আমরা একদম পাখির চোখে দেখতে পাব গোটা প্যারিস শহরটাকে। সবাই আমার সঙ্গে আসুন।’

প্যারিসে আজ দ্বিতীয় ও শেষ দিন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের। আজ প্রথমে আইফেল টাওয়ার পর্বের পর পাশেই বয়ে চলা ছবির মতো শেইন নদীতে ক্রুজের ব্যবস্থা করেছে জিনিয়া।

মাত্র দু-দিন থাকার সুযোগ হলেও এই শহরের রাজকীয়তা, আভিজাত্য ও সৌন্দর্য দেখে সবাই যেন মুগ্ধ হয়ে গেছে। প্যারিস যেন সত্যিই প্রেমের শহর, প্রতিটা গলির বাঁকে, প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালে, শেইন নদীর দুই পারে বয়ে চলেছে প্রেমের বার্তা।

জিনিয়া সবার চেয়ে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল। একদিকে গতকাল সন্ধেতে ড ওবায়েদ হকের কথাগুলো, অন্যদিকে বহুদিনের স্বপ্ন প্যারিস শহরে পা দেওয়ার অনুভূতি। কিন্তু নানা ডামাডোলে আনন্দটা ভালো করে উপভোগ করতে পারছিল না ও। খালি মনে হচ্ছিল, এবার ওর কী করা উচিত? ড ওবায়েদ হক যা বললেন, সেগুলো কি যাদবচন্দ্র এবং আরতিকে বলে দেবে ও?

ওর ভাবনাকে আরও উসকে দিয়ে সঞ্জিত হাজরার চারপাশে ভিড় করা জটলা থেকে বেরিয়ে এলেন যাদবচন্দ্র। আইফেল টাওয়ার দেখার সুখ তাঁর মুখের কোনো রেখায় দেখা যাচ্ছে না, বরং তাঁর চোখে ভেসে উঠেছে অসহায় এক আকুতি।

জিনিয়ার কাছে এসে তিনি বললেন, ‘আজ তাহলে আমরা যাব তো জিনিয়া? ওর কলেজেই যাব তো?’

জিনিয়া কী বলবে বুঝতে না পেরে যাদবচন্দ্রের মুখের দিকে তাকাল। অশীতিপর বৃদ্ধর মুখে তপতপ করছে একবিন্দু আশার আলো। দূরে আরতি হুইলচেয়ারে বসে আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর চোখও এদিকে, জিনিয়া আর যাদবচন্দ্রের মুখের অভিব্যক্তি থেকে আন্দাজ করতে চাইছেন কথাবার্তার স্রোত কোনদিকে যাচ্ছে।

জিনিয়া একটু থেমে বলল, ‘জেঠু। আমি ওঁর খোঁজে কালই গিয়েছিলাম। কিন্তু … একটা সমস্যা হয়েছে আসলে!’

‘সমস্যা?’ যাদবচন্দ্রের মুখ-চোখ পালটে গেল নিমেষে, কপালের ওপর বলিরেখাগুলো চিন্তার ভাঁজ পড়ে আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, ‘কী ব্যাপার বলো তো? রাজু কী বলল?’

 তারপর জিনিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই কেমন একটা ভাঙ্গাগলায় বললেন, ‘ও কি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়না? ওর মা এসেছে, তবু দেখা করবে না?’

‘না না, তা নয়।’ জিনিয়া তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আসলে উনি এখন প্যারিসেই নেই। উনি রয়েছেন ইটালিতে।’ যাদবচন্দ্রকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ও বলল, ‘জেঠু, আমি আপনাকে যখন কথা দিয়েছি যে আপনাদের ছেলের সঙ্গে আপনাদের দেখা করাব, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব। আপনারা শুধু একটু ধৈর্য ধরুন, প্লিজ!’

কথাটা বলেই প্রসঙ্গটা চাপা দেওয়ার জন্য ও দ্রুতপায়ে হেঁটে গেল সঞ্জিতের দিকে। প্যাকড আপ টুর, কোনো জায়গায় বেশি সময় নষ্ট করলে গোটা রুটিনটাই ঘেঁটে যাবে। তা ছাড়া কাল ওবায়েদ হকের কাছ থেকে ড রাজীব সরকারের ঘটনাটা শুনে ইস্তক ও নিজে বিচলিত হয়ে রয়েছে।

মাঝে মাঝে একরকম অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মনে পড়ে যায় অতন্দ্রকে। কাল যখন ওবায়েদ হকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে ফিরছিল হোটেলে, অদ্ভুত এক দোলাচলের সমুদ্রে ডুবে ছিল ওর মন। মনে হচ্ছিল, রাজীব যখন শেহনাজের সঙ্গে একজোট হয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন অনাগত শিশুর, সেইসময় যে অমন ভয়ংকর বিপদ তাঁদের মাথার ওপর নেমে আসবে, সেটা কি তাঁরা ভাবতে পেরেছিলেন?

মনে হয়, জীবন কতটুকু? কতদিন বাঁচবে ও? সত্তর বছর? পঁচাত্তর বছর? কিংবা আশি বছর? তারপর কেউ পুড়ে ছাই হবে, কেউ-বা ঘুম দেবে মাটির তলায়। এই সত্তর পঁচাত্তর বছরের মানবজন্ম কত মূল্যবান, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ!

অথচ এর মধ্যে কত শত ঘণ্টা মানুষ পার করে দেয় কাছের লোকদের সঙ্গে কলহ, অভিমান, তিক্ততায় ব্যস্ত থেকে। জীবন শেষে তারা যখন শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে মাটির তলায়, কিংবা বিলীন হয়ে যায় পঞ্চভূতে, একবারও কি তাদের মনে হয়, জীবনের অমুক সময়ের ছ-ছ-টা দিন আমরা ঝগড়া করে কথা না বলে থেকে নষ্ট করেছি, ওই সময়টুকু জীবন থেকে কমে গেছে! তখন কি আফশোস হয় না? তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয়না মন? অবশ্য, পরপারে যদি মন বলে আদৌ কিছু থেকে থাকে!

অতন্দ্রর সঙ্গে শেষ কবে কথা বলেছে ও? কবে শেষ শুনেছে ওর গলা? জিনিয়া স্মৃতির বাক্স হাতড়ায়। অতন্দ্র ফোন করেছিল। আর জিনিয়া ওর গলা শোনামাত্র কেটে দিয়েছিল কলটা। আর ধরেনি।

আচ্ছা, ও-ও কি মৃত্যুর পর এইসময়গুলো নিয়ে অনুতাপে ভুগবে?

জিনিয়া এইসব ভাবতে ভাবতে সবার সঙ্গে আইফেল টাওয়ারের এক একটা করে তলায় উঠছিল। আইফেল টাওয়ারের মধ্যে ক্রমশ উচ্চতায় উঠতে উঠতে কেমন নিজেকে লোহার খাঁচায় বন্দি বলে মনে হচ্ছিল ওর।

হঠাৎ ওর চোখ চলে গেল দূরে। দেখল মধুমিতা আর পিয়াসা দল থেকে অনেকটাই সরে গেছেন। টাওয়ারের এক কোনায় সরে গিয়ে ছবি তুলছেন তাঁরা। কখনো একে অন্যের গলা জড়িয়ে, কখনো আরও ঘনিষ্ঠভাবে।

ও দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। দু-জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কীভাবে আনন্দ উপভোগ করছেন, তা দেখাটা ওর ঠিক শোভন মনে হল না। ও দাঁড়িয়ে না থেকে ওপরে উঠতে লাগল।

যত ওপরে উঠছে, ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে আইফেল টাওয়ারের নীচের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন। নীচে পিঁপড়ের মতো থিকথিক করছে তাদের কালো কালো মাথা।

জিনিয়ার খেয়াল হল, ফুলুমামাকে ও অনেকক্ষণ দেখেনি। বাস থেকে নামার পর থেকেই সম্ভবত। সঞ্জিত হাজরার সঙ্গে সামনে পেছনে একসঙ্গে ওদের গোটা দলটা আইফেল টাওয়ারের ওপরে উঠছিল। জিনিয়া একটু দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে সঞ্জিতকে বলল, ‘মামা কোথায়?’

সঞ্জিত হাজরা তখন অভীকদের দলটাকে মন দিয়ে কী একটা বোঝাচ্ছিলেন, জিনিয়ার প্রশ্নে তাকিয়ে বললেন, ‘উনি তো উঠলেন না। ওই মিসেস গাঙ্গুলির ভার্টিগো আছে বলে নীচে রয়ে গেলেন, অম্বিকেশবাবুও ওঁর সঙ্গেই রয়ে যাবেন বললেন।’

জিনিয়া একটু আশ্চর্য হল। এয়ারপোর্টে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত ও জানত না আলোকপর্ণা যাকে টুরে পাঠাচ্ছে, সেই মিসেস মিনতি গাঙ্গুলি মা এবং ফুলুমামার প্রতিবেশী, ছোটোবেলায় কোন্নগরে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন। আলোকপর্ণা শুধু এইটুকুই বলেছিল, ভদ্রমহিলার ষাট বছরের জন্মদিনে এই টুরটা তাঁর ছেলে তাঁকে উপহার হিসেবে দিচ্ছে।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক ফুলুমামাকে অফিস আর ঘুরে বেড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে জিনিয়া। বন্ধুবান্ধব বলতে কিছুই চোখে পড়েনি। ফুলুমামার বন্ধুমহলই হোক আর আত্মীয়, সব ছিল খড়দায় জিনিয়াদের বাড়িটাই। সেই ফুলুমামা ছোটোবেলার বন্ধুকে এতদিন পর খুঁজে পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই খুব খুশি হয়ে পড়েছেন।

লন্ডনে পৌঁছে মাকে যখন ফোন করেছিল, কথায় কথায় বলেছিল মামার সঙ্গে ওই মিনতি গাঙ্গুলির দেখা হওয়ার ঘটনাটা। মা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেছিল, তারপর আর কিছু না বলে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছিল।

জিনিয়া যখন আইফেল টাওয়ারের একেবারে ওপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে এসব কথা ভাবছিল, ঠিক সেইসময় একেবারে নীচে আইফেল টাওয়ারের যে রাস্তাটা শেইন নদীর ঘাটের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তা দিয়ে ধীরগতিতে হাঁটছিলেন অম্বিকেশ আর মিনতি।

মিনতি বললেন, ‘কী সুন্দর নদীটা, না রে? ছোটোবেলা থেকে কত ইচ্ছে ছিল এখানে আসার। হ্যাঁ রে ফুলু, নদীতে যে নৌকোগুলো ভেসে চলেছে, আমরা ওগুলোয় চড়ব না?’

‘চড়ব তো, শেইন নদীর ক্রুজ তো আছেই প্রোগ্রামে।’ অম্বিকেশ বললেন, ‘ওরা ওপর থেকে নেমে আসুক, তারপর এই ক্রুজে করে এক ঘণ্টা ঘোরাবে আমাদের। ক্লিমেন্ট আসতে আসতে ক্লিমেন্ট আমাকে বলছিল, শেইন নদীর দু-পাশে যত প্রাচীন স্থাপত্য, সব দেখতে পাওয়া যায় ক্রুজ থেকে। শেইন নদী প্যারিসের প্রায় মাঝবরাবর বয়ে গিয়েছে। ওরসে মিউজিয়াম, লুভর, মধ্যযুগের অনেকগুলো প্রাসাদ …।’

মিনতি নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ নোৎরদাম ক্যাথিড্রাল দেখতে পাব? জিনিয়া তো বলল ওখানে নিয়ে যাওয়ার সময় হবে না!’

অম্বিকেশ মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ, পাবি।’

মিনতি শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, হাত দুটোকে ঘষতে ঘষতে বললেন ‘উফ! সেই ভিক্টোর হুগোর হাঞ্চব্যাক অফ নোৎরদাম! সেই ছাগল চরানো এসমেরেলদা আর কোয়াসিমোদো! ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! সেই ক্লাস সিক্সে পড়েছিলাম। তোর মনে আছে ফুলু? স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি আর তুই লাইব্রেরি থেকে এইসব বিদেশি বইয়ের অনুবাদগুলো নিয়ে আসতাম?’

‘মনে আছে।’ ছোট্ট করে বললেন অম্বিকেশ, ‘কোনো বই ভালো লাগলেই তুই সেটা নিয়ে পাড়ার মঞ্চে নাটক করতে চাইতিস। হাঞ্চব্যাক অফ নোৎরদামে তুই হয়েছিলি এসমেরেলদা। আর আমি কোয়াসিমোদো। আর ধর্মযাজক ক্লদ ফ্রোলো হয়েছিল বিল্টুদা।’

‘ঠিক বলেছিস। আমাদের নাটক করাতো গণেশদা। বিল্টুদা মাঝপথে গিয়ে ডায়ালগ ভুলে গিয়েছিল বলে নাটক করানো গণেশ কাকার সে কী বকুনি!’ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন মিনতি, ‘কী সুন্দর ছিল সেসব দিনগুলো!’

‘হ্যাঁ। বড্ড সুন্দর। বড্ড পবিত্র।’ উদাসচোখে সামনের দিকে তাকালেন অম্বিকেশ। ঠান্ডা হাওয়া বইছে, ঝকঝকে নীল আকাশে ভেসে চলেছে সাদা সাদা মেঘ। এপ্রিলের প্যারিস সত্যিই মনোরম। শেইন নদীর এপার থেকে ওপারটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওপারের বাঁধানো ঘাটে ইতস্তত বসে আছে কিছু মানুষ। বেশিরভাগেরই পিঠে ব্যাগ, যুবক যুবতী। তারা নিজেদের মধ্যে হাসছে, কথা বলছে, ব্যাগ থেকে কিছু বের করে এ ওকে খাইয়ে দিচ্ছে, ইচ্ছে হলে বিনা দ্বিধায় নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে অন্যের ঠোঁটে।

অম্বিকেশের মনে হল, পারিপার্শ্বিক মানুষ আর স্থাপত্যগুলো বাদ দিলে এই জায়গাটা যেন অনেকটা দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার মতো। এপারে দক্ষিণেশ্বরের বাঁধানো ঘাট, ওপারে উত্তরপাড়া। ওখানে বসে এইভাবে অবলীলায় সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে চুমু খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারবে কেউ?

অম্বিকেশ হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, তিনি আর মিনতি যদি এদেশে, এই প্যারিসের বুকে জন্মাতেন, তাহলে হয়ত অম্বিকেশের মনের কথা ব্যক্ত করতে সেদিন কোনো সংকোচ হত না, বুকে পাথর চেপে এতগুলো বছর একা কাটাতেও হত না। আসলে এইসব দেশে প্রেমিক আর প্রেমিকা দু-জন দু-জনকে ভালোবাসে, সংসার করে। আর ভারতের মতো দেশে সেই ভালোবাসার সঙ্গে ফাউ হিসেবে এসে জোটে পরিবারের মতামত, স্টেটাসের মাপকাঠি, হাজারো সংস্কার, বাধানিষেধ।

‘তুই-ই আমাকে কোয়াসিমোদো সাজিয়েছিলি।’ ভাবতে ভাবতে বললেন অম্বিকেশ, ‘কোয়াসিমোদোর পিঠের কুঁজটা বানিয়েছিলি তোর ভাইয়ের ছোটোবেলার বালিশ দিয়ে।’

‘বাবা! তোর তো সবই মনে আছে ফুলু!’ মিনতি অবাক চোখে তাকালেন, ‘জীবনে এত চাপানউতোর, এত ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে এসে সেইসব দিনগুলো মনে পড়লে কেমন যেন অবাক লাগে। মনে হয় ওটা শুধুই একটা কাল্পনিক চিত্রনাট্য, কিংবা ধোঁয়া হয়ে যাওয়া স্মৃতি! তাই না, বল?’

অম্বিকেশ উত্তর দিলেন না। কী বলবেন? মিনুকে তিনি কী করে বোঝাবেন যে সেইসব দিন নয়, আজকের, এই মুহূর্তটাই তাঁর কাছে অলীক স্বপ্ন মনে হচ্ছে? কোনোদিনও ভেবেছিলেন মিনুর সঙ্গে তিনি এইভাবে হাঁটবেন, তাও আবার প্যারিসের নদীর ধারে? হোক না আজ মিনু সেই তেরো-চোদ্দোর কিশোরীটি নেই, হোক না আজ দু-জনেরই চুলে ধরেছে রুপোলি পাক, হোক না জীবনযুদ্ধে লড়ে লড়তে দু-জনেই ক্লান্ত, তবু পথ ধরে এই হেঁটে চলাটা তো মিথ্যে নয়।

জীবন সত্যিই বড়ো অপ্রত্যাশিত বাঁকে এনে দাঁড় করায় মাঝে মাঝে!

মিনতি আবার বললেন, ‘তুই কেন ওদের সঙ্গে ওপরে গেলি না ফুলু? ভার্টিগোর জন্য আমার তো একটু ওপরে গেলেই মাথা ঘোরে, বুক ধড়ফড় করে, তাই জন্যই যেতে পারলাম না। সঞ্জিতবাবু বলছিলেন, ওপর থেকে গোটা প্যারিস শহরটা নাকি দেখা যায়!’

‘জানি।’ অম্বিকেশ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমারও ঠিক ভালো লাগল না এতটা সিঁড়ি ভাঙতে, ওই আর কি!’

‘লিফট আছে তো!’ মিনতি বললেন।

মিনুর চোখে এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠল যে অম্বিকেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে মিনু নীচে একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে, সেটা তিনি চাননি, তাই ওপরে না গিয়ে রয়ে গেছেন।

সেইজন্য মিনু আবার বাজে কিছু ভাবছে না তো! ছি ছি। বড়ো লজ্জার ব্যাপার হবে তাহলে।

অম্বিকেশ তাড়াতাড়ি কী একটা বলতে গেলেন, কিন্তু তাঁকে স্বস্তি দেওয়ার জন্যই বোধ হয়, ফোনটা বেজে উঠল।

অম্বিকেশ তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই যে গলাটা শুনলেন, সেটার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।

‘মামা, আ-আমি অতন্দ্র কথা বলছি!’

অম্বিকেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘ অতন্দ্র তুমি! বলো!’

‘আপনারা এখন কোথায়?’

‘আমরা তো ইউরোপ টুর নিয়ে এসেছি।’

‘সে জানি। এখন কোথায় রয়েছেন?’

‘এখন তো প্যারিসে।’

‘ফুলুমামা, আমিও প্যারিসে এসেছি। আপনারা কোথায় রয়েছন একটু বলবেন? কোন হোটেলে?’

অম্বিকেশ অতন্দ্রর অস্থির গলা শুনে বিস্মিত হয়ে পড়ছিলেন, ‘হোটেল থেকে তো আমরা চেক আউট করে বেরিয়ে এসেছি অতন্দ্র, এখন প্যারিসের বাকি জায়গাগুলো ঘুরছি, ঘোরা শেষে বাসে চেপে প্যারিস ছেড়ে চলে যাব আমরা। এখন রয়েছি আইফেল টাওয়ারে।’

‘আমি আসছি মামা। আপনারা দাঁড়ান। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোচ্ছি ওখানে। আর প্লিজ, জিনিয়াকে কিছু বলবেন না!’

অম্বিকেশ কিছু বলার আগেই ফোনটা পিঁ পিঁ শব্দে কেটে গেল। অম্বিকেশ অস্থির হয়ে অতন্দ্র-র নম্বরে ডায়াল করতে শুরু করলেন, কিন্তু লাইন পেলেন না। একবার দু’বার তিনবার। কিছুতেই রিং হল না।

মিনতি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেইন নদী থেকে উড়ে আসা হাওয়ায় তাঁর সামনের পাতলা হয়ে আসা চুলগুলো উড়ছিল। ফ্রান্সে বেড়াতে এলেও তিনি শাড়িই পরেছেন। কোনো সংকীর্ণতা বা রক্ষণশীলতার জন্য নয়, শাড়ি পরতে তাঁর ভালো লাগে। শাড়ির ওপরে রয়েছে একটা লম্বা সোয়েটার, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। পিকলু আসার আগে কিনে দিয়েছে।

অম্বিকেশকে উদ্ভ্রান্ত দেখে মিনতি ফিরে তাকালেন, ‘কী হয়েছে?’

‘অতন্দ্র আসছে। জিনির সঙ্গে দেখা করতে।’ অম্বিকেশ হতভম্ব মুখে বললেন, ‘কিন্তু ও যতক্ষণে আসবে, ততক্ষণে তো আমরা ক্রুজে চেপে ওদিকে চলে যাব। আর সেখান থেকে বাসে চেপে প্যারিস ছেড়ে বেলজিয়ামের দিকে রওনা হয়ে যাব আমরা! ওকে যে কথাটা বলব, কিছুতেই আর ফোনে পাচ্ছি না।’

কী করবেন এখন অম্বিকেশ? জীবন যে সত্যিই বড়ো অপ্রত্যাশিত বাঁকে এনে দাঁড় করায় মাঝে মাঝে!

৪২

আলোকপর্ণা ব্যাঙ্ক থেকে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট জোগাড় করে যখন গ্যারাজ অফিসে ফিরল, তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপর, দুপুর আড়াইটে বাজে। বৈশাখ মাসের গরমে ভেপসে যাচ্ছে শরীর, যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথা।

দরদর করে ঘামতে ঘামতে ও অফিসে ঢুকল, তারপর ধপাস করে চেয়ারে বসে বিকাশকে বলল, ‘ ওই! যা তো, একটু ঠান্ডা জল নিয়ে আয়!’

বিকাশ মাটিতে বসে বসে একটা ডায়েরি থেকে অন্য একটা কাগজে কী লিখছিল, আলোকপর্ণার কথায় মুখও তুলল না, সাড়াও দিল না। যেমন কাজ করছিল, তেমনই করে যেতে লাগল।

আলোকপর্ণা চেয়ারে বসে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বাইরের দিকে তাকাল। বাইরের তাত ভেতরে এসে ঝলসে দিচ্ছে যেন। কুলার চলছে বটে, কিন্তু তাতে আর কতটুকু ঠান্ডা হয়। একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালে একটু ঠান্ডা হাওয়া আসে। ও ভ্রূ কুঁচকে বিকাশের দিকে তাকাল, ‘কীরে, কথা কানে গেল না, নাকি?’

বিকাশ এবার মুখ তুলে ব্যাজার গলায় খেঁকিয়ে উঠল, ‘পয়সা দিয়েছ আমায়? ক্যাশবাক্স তো তালাবন্ধ। সকাল থেকে এসে অফিস খুলে বসে আছি। না পারছি বেরোতে, না পারছি একটু চা কিনে আনতে! এত দেরি করে এলে কেন?’

‘আহা!’ আলোকপর্ণা তেড়ে গেল প্রায়, ‘তুই আমার নীচে না আমি তোর, শুনি? আমি কখন আসব না আসব, সেই কৈফিয়ত কি তোকে দেব নাকি? আমি ব্যাঙ্কে গেছিলাম, দিদি বলেছিল। আর তুই কুড়ি টাকা বাসভাড়ার জন্য বসে রয়েছিস? কেন, একবেলা নিজের টাকা দিয়ে যেতে পারছিস না, আমি এসে তো দিয়েই দেব! কী আজব লোক!’

‘না, পারছি না। আমি গরিব মানুষ, অত পয়সা নেই আমার। দাও, টাকা দাও।’ বিকাশ উঠে এসে হাত বাড়াল।

আলোকপর্ণা গজগজ করতে করতে ড্রয়ারের তালা খুলল, ‘যাওয়ার আগে আমাকে একটা ঠান্ডা বোতল দিয়ে যা।’

বিকাশ জল নিয়ে এসে বেরিয়ে যেতে আলোকপর্ণা তড়িঘড়ি ফোন খুলল। ঠিক যা ভেবেছে তাই। পিকলুদার দুটো মেসেজ ইনবক্সে এসে পড়ে রয়েছে। আর পিকলুদা কখনো সংক্ষিপ্ত মেসেজ লেখে না, একটা পরিপূর্ণ চিঠির মতো সম্বোধন করে আকারে আয়তনে বিরাট মেসেজ পাঠায়।

‘আলোকপর্ণা, অফিস কি পৌঁছে গেছ? ওহো, তোমার তো আজ ব্যাঙ্কে যাওয়ার কথা। জানো আলোকপর্ণা, আজ আমার ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়েছে। এত দেরি হয়েছে যে, খাওয়ার সময় পাইনি, কোনোমতে রেডি হয়ে ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেন ধরেছি। এখন ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে কোনোরকমে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে লিখছি তোমাকে।

আসলে কী জানো, মা না থাকলে বাড়িটা যেন বাড়ি মনে হয় না। কেমন যেন মেসের মতো মনে হয়। কেউ খেয়াল রাখার নেই, দেখার নেই, মাথায় হাত বুলিয়ে ”খেয়েছিস?” জিজ্ঞেস করার নেই। অনেকটা সমুদ্রে দিক হারানো অগোছালো নাবিকের মতো লাগে নিজেকে, যে নিজেই জানে না জীবনের উদ্দেশ্য কী। ভালো লাগে না।

তবে আজ সকালে একটা কবিতা লিখেছি। বহুদিন পর। তুমি সেদিন বললে বলে। ভালো লিখি কি খারাপ লিখি সেই তর্কে যাব না, কিন্তু আজ সকালে সত্যিই যেন কয়েকটা শব্দ পরপর সেজে ধরা দিল পেনের ডগায়।

তাই ভাবলাম, তোমাকেই তাদের প্রথম আনাগোনাটা লিখে পাঠাই।

যদি কখনো সুযোগ পাই তোমায় ছোঁয়ার,

ছুঁয়ে দেখব শুধুই তোমার আঙুলডগা।

লোভী হাতে এদিক সেদিক ছোঁয়ার চেয়ে,

ছোঁয়াচে হয়ে রয়ে যাওয়াটাই ভালোলাগা।

আলোকপর্ণা থরথর করে কেঁপে উঠল। এই কবিতা কি নিছকই কবিতা? নাকি সেদিন আবেগের বশে ও নিজের মনের যে গভীর ক্ষতর কথা প্রকাশ করে ফেলেছিল, এই কবিতা তারই বহিঃপ্রকাশ?

ও পরের মেসেজটা খুলল।

‘তুমি যখন এই মেসেজটা পড়বে, ততক্ষণে আমি ক্লাস নিতে শুরু করে দেব। আজ আমার ফার্স্ট পিরিয়ড ক্লাস এইটে। ইতিহাস। যার নাম শুনলেই তুমি ভয় পেয়ে যাও। হা হা। জানি না স্কুলে কীভাবে ইতিহাস পড়তে তুমি, সুযোগ হলে একবার আমার ক্লাস করতে বলতাম তোমায়, ভীতিটা হয়তো দূর হত।

‘চেষ্টা করব আজ বিকেলে সল্টলেকের দিকে যেতে। তুমি অফিসে ফিরে মন দিয়ে কাজ করো। মা সেদিন ফোনে বলছিলেন, তোমার জিনিয়াদি সত্যিই সবার ভীষণ খেয়াল রাখছেন। আসলে কী জানো, এই ট্রাভেল এজেন্সি ওঁর প্যাশন। তাই নিজের অর্থ, মন, প্রাণ সবকিছু উনি ঢেলে দিয়েছেন এতে। যাইহোক, তুমি মন দিয়ে কাজ করো। এখানেই শেষ করলাম। মন্দার।’

আলোকপর্ণা মেসেজটা বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেললো। পিকলুদা-র ভালো নাম ‘মন্দার’ সেটা ও জানত না, কিন্তু এই মেসেজগুলোর প্রতিটাতে শেষে নামটা লেখা থাকে। পুরোনো দিনের চিঠির মতো।

ও অন্যমনস্কভাবে ব্যাগ থেকে ব্যাঙ্কের কাগজপত্র বের করতে লাগল। সেদিন রাতে মিনতি মাসিমার বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকে পড়াটা যেন ওর জীবনকে সব দিক থেকেই আমূল বদলে দিয়েছে। পেয়েছে মাসিমার মতো দৃঢ় চরিত্রের এক শুভাকাঙ্ক্ষীকে, যিনি মাঝে মাঝেই ভেঙে পড়া আলোকপর্ণাকে হার না মানতে শিখিয়েছেন।

আর পেয়েছে পিকলুদা-কে।

আলোকপর্ণা বোকা নয়। ও জানে, এই কয়েক দিনে ওর প্রতি পিকলুদা-র একটা বিশেষ আগ্রহ জন্ম নিয়েছে। একটা ছেলে বিনা কারণে স্কুল শেষে এতদূর আসে না। বিনা কারণে এমন কবিতা লেখে না। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, নিজের মাকে হঠাৎ এই ইউরোপ টুরে পাঠানোর পেছনেও হয়তো পিকলুদা-র মনে দুটো উদ্দেশ্য কাজ করেছে। এক, মাকে ভালো লাগানো। দুই, গ্লোবাল টুরসের চাকরিটা খোয়ানো আলোকপর্ণার নতুন চাকরিতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করানো।

মাঝে মাঝে ওর এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, ওর এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে সে-অর্থে কোনো পুরুষই আসেনি। স্কুলজীবনের হালকা হাসি বা চোরাচাউনির ছেলেমানুষিগুলো বাদ দিলে এতগুলো বছর ও একাই থেকেছে। আর প্রেম করার সময়ই-বা পেয়েছে কোথায়! নিম্নবিত্ত পরিবার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর একটু শখ আহ্লাদের সুযোগ যখন এল, ঠিক তখনই দিদি হাত তুলে নিল, স্বার্থপরের মতো চলে গেল নিজের সংসারে।

আর এখন? এখন এমন একটা সময় এসেছে ওর জীবনে, যেখানে সব কিছুই ভালো হয়ে চলেছে। নিজের যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি, আশাতীত মাইনে পাচ্ছে সে। বাবা-মা দিদির শোক এখনও না সামলে উঠলেও ও ঠিক করে রেখেছে এবার ও সর্বতোভাবে দু-জনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। অর্থবল বিশাল বল। আলোকপর্ণা ভেবে রেখেছে, জিনিয়াদি ফিরলেই তিন-চারদিন ছুটি নেবে। তারপর বাবা-মা-কে নিয়ে বেরিয়ে আসবে কোথাও।

পিকলুদা-কে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? মনের মধ্যে সম্ভাবনাটা আসামাত্র উড়িয়ে দিল আলোকপর্ণা। ধুর, তা আবার হয় নাকি! বাবা-মা-ই বা কী ভাববে!

আচ্ছা, পিকলুদা-র চোখের সমস্যার জন্য বাবা-মা আবার কোনো আপত্তি করবে না তো?

পরমুহূর্তে ফাঁকা অফিসে বসে নিজেকে তিরস্কার করে ও, কী আবোলতাবোল ভাবছে ও? গাছে না উঠতেই এক কাঁদি!

কতটুকু চেনে ও পিকলুদাকে? কতটুকু জানে? ভালো কবিতা লিখতে জানলে আর ভালো আঁকলেই মানুষের ভিতরটা ভালো হয়ে যায়?

না, নিজের স্বভাবগত অতি-আবেগপ্রবণ দিকটার জন্য আর হঠকারী কল্পনার জগতে জাল বুনে নিজেকে রক্তাক্ত করবে না ও। বাস্তব ওর মনের মতো কোনও রূপকথা নয়।

ভাবতে ভাবতে আলোকপর্ণা দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্টটা খুলল। ওর নিজের দেখার কিছুই নেই, জিনিয়াদি বলেছে ভালোভাবে ফাইলে ঢুকিয়ে রাখতে। তবু ও আলগোছে চোখ বোলাতে লাগল।

যতজন টুরে গেছেন, তার মধ্যে পুরো টাকা পেমেন্ট করেছেন মাত্র তিনজন। রৌণক সাধুখাঁ, আকবর আলি ও উইশি ফার্নান্ডেজ। বাকি সবাই কিস্তিতে।

দেখতে দেখতে ও আবার ভাবল, আচ্ছা, বাবা-মাকে নিয়ে কোথায় যাবে? পাহাড়ে না সমুদ্রে? ওরা চারজন সেভাবে বলতে গেলে বেড়াতে কোথাওই যায়নি, শুধু অনেক ছোটোবেলায় দিঘা গিয়েছিল। আর দিদি চাকরি পাওয়ার পর নিয়ে গিয়েছিল পুরী।

নাহ, এবার আর সমুদ্র নয়। বাবা-মাকে নিয়ে ও পাহাড়ে যাবে। ও দেখিয়ে দেবে, দিদির মতো চিরকালের ফার্স্ট গার্ল না হলেও ও স্বার্থপর নয়।

সিকিম গেলে কেমন হয়? এখন অনেকেই সিকিম যাচ্ছে।

স্টেটমেন্টের দিকে তাকিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা ট্রানজ্যাকশনে আলোকপর্ণার চোখ আটকে গেল।

এই মাসের ছাব্বিশ তারিখে ত্রিশ হাজার টাকার একটা অ্যামাউন্ট ঢুকেছে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে। বিবরণে লেখা আছে আলোকপর্ণার মাইনে।

ব্যাপারটা কী হল? আলোকপর্ণার ভ্রূ কুঁচকে গেল। ওর মাইনে অ্যাকাউন্ট থেকে বেরোনোর কথা, আর সেটার অঙ্ক ত্রিশ হাজার নয়, আটত্রিশ হাজার টাকা।

কৌতূহলে ও আবার খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। না, ওর মাইনে আটত্রিশ হাজার টাকা যেমন বেরোবার বেরিয়ে গিয়েছে তার পরেরদিনই। বেরিয়ে সেটা চলে এসেছে ওর নিজের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু আগের মাস ও এই মাস দুটো মাসেই তার ঠিক আগের দিন ‘আলোকপর্ণার মাইনে’ নামে ত্রিশ হাজার টাকা ঢুকেছে।

আলোকপর্ণা অনেকক্ষণ ভাল করে দেখেও কিছু বুঝতে পারল না। ব্যাঙ্কিং টার্মিনোলজির মধ্যে থেকে শুধু ও প্রেরকের ব্যাঙ্কের নাম আর ট্রানজ্যাকশন নম্বরটা উদ্ধার করতে পারল।

কিন্তু তাতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

যদিও এটা একেবারেই ওর অনধিকারচর্চা, তবু প্রচণ্ড এক কৌতূহল ওকে পেয়ে বসল। ওর মনে হল, ওকে জানতেই হবে এই ব্যাপারটা।

আচ্ছা, ব্যাঙ্কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলবে না? ফোন করলেও তো বলতে পারে!

ভাবামাত্র ও কোম্পানির মোবাইল ফোন থেকে ব্যাঙ্কের নম্বর ডায়াল করল। এখন বিকেল চারটে, গ্রাহকদের জন্য ব্যাঙ্কের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও ভেতরে নিশ্চয়ই কাজ চলছে। জিনিয়াদি তো বলত, কোনোকিছুর জানার জন্য চারটের পর ফোন করবি। তখন ওরা হালকা থাকে।

কেউ একজন ব্যস্ত গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ও মিষ্টি করে বলল, ‘হ্যাঁ নমস্কার দাদা, আমি দাশগুপ্ত ট্রাভেলস থেকে বলছি।’

‘হ্যাঁ, বলুন।’ ওপাশে কী-বোর্ডের খটখট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আর শোনা যাচ্ছে কিছু লোকজনের গল্পগুজবের শব্দ। ব্যাঙ্কে এখন ইন্টারনাল কাজকর্ম চলছে।

‘আচ্ছা, স্টেটমেন্টে একটা টাকা কোথা থেকে এসেছে ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু বলবেন, প্লিজ?’

‘কোম্পানির অ্যাকাউন্ট নম্বর বলুন।’ ব্যস্ত গলা বলল, ‘ আর টাকা আসার তারিখ বলুন। কত টাকা?’

আলোকপর্ণা গড়গড় করে স্টেটমেন্ট দেখে সব বলে গেল।

‘অন্য ব্যাঙ্ক হলে বলতে পারব না। আমাদেরই ব্যাঙ্ক হলে বলছি। একটু ধরুন।’ গলাটা বলল।

‘আচ্ছা।’ আলোকপর্ণা অপেক্ষা করতে লাগল। জিনিয়াদি-র স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে এখন। সেটা ও অফিস জয়েন করেই শুনেছে। কিন্তু জিনিয়াদির স্বামী নাকি আগে এই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিই কি ওর মাইনের সিংহভাগ পাঠাচ্ছেন? কিন্তু কেন?

জিনিয়াদিরই বা ওকে বাজারদরের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি এই মাইনে দেওয়ার তাগিদ কেন?

গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময়!

‘হ্যাঁ, টাকাটা এসেছে আমাদের কসবা ব্র্যাঞ্চের একটা অ্যাকাউন্ট থেকে। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম ঋতুপর্ণা লাহিড়ী।’

আলোকপর্ণা এমন চমকে গেল, ফোনটা হাত থেকে খসে ছিটকে গেল মাটিতে। অমনি ব্যাটারি খুলে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। বিশ্রী একটা শব্দে গোটা ঘরটা যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল।

এটা কী শুনল ও? কার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাটা এসেছে?

ঋতুপর্ণা লাহিড়ী? দিদি?

ওর নিজের দিদি?

যে গত দু-বছর ধরে ওদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না, সে ওর মাইনের টাকা পাঠাচ্ছে জিনিয়াদিকে? কিন্তু কেন?

আলোকপর্ণার হঠাৎ গা গুলোতে শুরু করল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। টেবিলের ওপরই হড়হড় করে বমি করে ফেলল ও।

হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিয়ে খাওয়ার বদলে রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বোতলটাকে ও ছুড়ে মারল গ্যারাজের দেওয়ালে। সস্তার প্লাস্টিকের বোতল ফেটে হুড়মুড়িয়ে জল বেরিয়ে এল। থইথই করতে লাগল চারপাশ।

ও চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। এগুলো কি ওর সঙ্গেই বার বার হতে হয়? ও নিজে অতিরিক্ত সরল বলেই কি? মানুষকে চটজলদি বিশ্বাস করে ফেলে, দ্রুত আপন করে নেয় বলেই কি? যে মাইনে পেয়ে ও এতদিন সপ্তম স্বর্গে বাস করছিল, সেটাও কিনা দিদির করুণার দান?

দিদি ওকে, বাবাকে, মাকে নিজের টাকা ভিক্ষা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছে?

আর জিনিয়াদি? যাকে ও এই কয়েক দিনেই বড্ড নিজের করে ফেলেছিল? বড্ড ভালোবেসেছিল? তার লজ্জা করছে না এই প্রতারণার অংশ হতে?

আসলে বোকা আলোকপর্ণা নিজে। ওর প্রথমেই মাথায় আসা উচিত ছিল, জিনিয়াদি ব্যবসা করতে এসেছে। নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে সমাজসেবা করতে নয়। যে কোম্পানির আয়ই এখনও বলার মতো নয়, সেই কোম্পানিতে আটত্রিশ হাজার টাকা মাইনে অবিশ্বাস্য শুধু নয়, অস্বাভাবিক। তার মানে জিনিয়াদি ওকে মাইনে দিচ্ছে আট হাজার টাকা। আর বাকি ত্রিশ হাজার টাকা দিদি হাতে ভিক্ষা দেওয়ার মতো করে ছুড়ে দিচ্ছে!

ও হাউ হাউ করে কাঁদছিল। কান্নার দমকে ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্ষণিকের উত্তেজনায় ও তাড়াতাড়ি ফোনটায় ব্যাটারি লাগিয়ে অন করল, তারপর জিনিয়াদি-র ওখানকার নম্বরে ডায়াল করল।

ছেড়ে দেবে। ছেড়ে দেবে ও এই চাকরি। এই মুহূর্তে ছেড়ে দেবে। দরকার হলে ভিক্ষে করে খাবে, লোকের বাড়ি কাজ করে খাবে, তবু যে নিজের বোনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না, তার দয়া ও নেবে না।

ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। তবু আলোকপর্ণা উন্মত্তের মতো চেষ্টা করে যেতে লাগল। মাঝপথে পিঁ পিঁ শব্দে ঢুকল আরও একটা মেসেজ।

‘ঠিক সাড়ে চারটেয় ঢুকছি তোমার অফিসে। দেখা হবে। মন্দার।’

আলোকপর্ণা ঘোলাটে চোখে মেসেজটা পড়তে লাগল। বার বার। এখন ঘড়িতে চারটে দশ। পিকলুদা চলে আসবে একটু পরেই।

ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এই পিকলুদাকেও ওকে চেনে ঋতুপর্ণার বোন বলেই। ঋতুপর্ণার বোন বলেই কি ওর এত সমাদর পিকলুদা আর মিনতি মাসিমার কাছে?

চাইনা পিকলুদা-র ভালোবাসা। অনুকম্পায় মাখানো ছদ্মপ্রেম কারুর থেকে চায় না ও।

যাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসা যায়, একমাত্র তাকেই বুঝি পারা যায় মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করতে।

ফুলে ওঠা, কাজলে ধেবড়ে যাওয়া চোখ মুখ মুছতে মুছতে আলোকপর্ণা উঠে দাঁড়াল। দিদির অনুকম্পায় বেঁচে থাকতে চায় না ও। দিদির অনুকম্পায় চাকরি, দিদির অনুকম্পায় ভালোবাসা! নিজের যোগ্যতায় কি কিছু করারই ক্ষমতা ওর নেই?

এই অনুকম্পায় ভরা জীবন রাখার কোনো অর্থ হয়।

নিজের প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় মুখ-চোখ কুঁচকে উঠল ওর। দু-হাতে মুখ ঢেকে আবার হু-হু করে কেঁদে ফেলল ও।

৪৩

রবি বিশ্বকর্মা হাঁটছিল। এত জোরে যে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে ওর পিঠের রুকস্যাকের একটা স্ট্রিপ পিঠে ক্রমাগত ঠুকছিল আর শব্দ করছিল। এইবার থমকে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এই গুপ্ত, তোমার মতলবটা কী বলো তো? আমাকে কী চরকির মতো পাক খাইয়ে মারতে চাও? নাকি চাও না যে ব্রিটলস থাকল না কি ওমনিসফটের জিম্মায় গেল, তা দেখে যেতে পারি আমি!’

‘কী যে বকো, রবি!’ অতন্দ্র হাসতে হাসতে হালকা চাপড় মারল রবির কাঁধে, ‘আমার পাল্লায় পড়ে সাত দিনের এই ফোকটে পাওয়া ছুটিতে ইউরোপের যে এতগুলো দেশ দেখা হয়ে যাচ্ছে, এ কি কম সৌভাগ্য ভাই?’

‘সত্যি দেখা হলে বুঝতাম, গুপ্ত!’ রবি বিশ্বকর্মা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘এটা কি দেখা হচ্ছে নাকি? শুধু ছোটা হচ্ছে। লন্ডন থেকে নাকে-মুখে গুঁজে ছুটিয়ে নিয়ে গেলে প্যারিস, সেখানে পৌঁছেই রুদ্ধশ্বাসে ছুটলাম আইফেল টাওয়ার। গিয়ে কিছু দেখলামও না, পরক্ষণেই বললে এখুনি হোটেলে চলো, বেলজিয়াম যেতে হবে। পরের দিন ভোরে বেলজিয়ামের ট্রেন ধরে ব্রাসেলস পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতেই এখন বলছ অ্যামস্টারডাম যাবে। খোলসা করে বলো তো, তোমার মতলবটা কী! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

অতন্দ্র ব্যাজার মুখে হাসে। রবির রাগের যে শুধু ন্যায্য কারণ আছে তাই নয়, রবির জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে মারামারি করে ফেলত। কিন্তু অতন্দ্রই-বা কী করবে?

জিনিয়া যেন মরীচিকা হয়ে গেছে। যাকে দেখা যায়, যার কথা শোনা যায়, কিন্তু কিছুতেই ছোঁয়া যায় না।

সত্যিই তো তাই! নিয়মিত দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের আপডেট সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছে অতন্দ্র, নিয়মিত শুনতে পাচ্ছে ওদের ঘোরার ভিডিয়োতে জিনিয়ার উচ্ছল প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর। অথচ যেই সেই আপডেট অনুসরণ করে ও যাচ্ছে, আলেয়ার মতো যেন দূরে সরে যাচ্ছে জিনিয়া!

আর যতই সরে যাচ্ছে, ততই যেন অতন্দ্র-র অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। ও এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। মাঝের এই কয়েকটা মাসের রাগ, অভিমান, ক্ষোভ সব যেন উবে গেছে ওর মন থেকে।

সেদিন কিছুক্ষণের জন্য ফসকে গেল দেখা হওয়াটা। ফুলুমামার কথা শেষ পর্যন্ত না শুনেই ও ফোনটা কেটে দিয়েছিল। সবেমাত্র প্যারিসে একটা হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হচ্ছিল ও আর রবি। সেই অবস্থাতেই ছুটেছিল আইফেল টাওয়ারে। কিন্তু হা হতোস্মি! পরে শুনেছে, ওরা যাওয়ার একটু আগেই দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের বাস রওনা হয়ে গেছে বেলজিয়ামের দিকে।

অতএব আবার ছুট। হতভম্ব রবিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হোটেলে একদিনের ভাড়া গচ্চা দিয়ে সন্ধের ট্রেনে পৌঁছেছে ব্রাসেলস। কিন্তু সেখান গিয়ে শোনে, ব্রাসেলসে জিনিয়া থাকেইনি, একবেলার মধ্যে ব্রাসেলসের কয়েকটা দ্রষ্টব্য স্থান দেখিয়ে বাস সোজা ছুটিয়ে নিয়ে গিয়েছে নেদারল্যান্ডসের রটরডাম শহরের দিকে।

‘আপনি ঠিক করে কেন বলছেন না ফুলুমামা!’ গতকাল রাতে ব্রাসেলসের হোটেল থেকে অতন্দ্র রীতিমতো রেগে ফোন করেছিল, ‘কালকে অত কাণ্ড করে গেলাম, গিয়ে শুনি আপনারা প্যারিস ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। আজকে ভোরে বললেন ব্রাসেলস আসছেন। তা, আমি ভাবলাম এখানে এসে একদিন স্টে করবেন। আপনারা যে সারাদিন ব্রাসেলস দেখে রটরডাম চলে যাবেন, এটা বলবেন না আমাকে?’

‘আরে আমি কী করে জানব বলো তো?’ কাঁচুমাচু গলায় বলেছিলেন অম্বিকেশ, ‘আমার কাছে কি টুর প্ল্যান আছে নাকি? কোন দেশের পর কোন দেশ যাওয়া হবে, সেখানে কী কী দেখা হবে, সেসব তো দেখছে জিনি আর সঞ্জিত! আমি রয়েছি যাত্রীদের হোটেলে থাকার সময় সুবিধা অসুবিধে দেখার দায়িত্বে।’

সঞ্জিত আর সঞ্জিত। অতন্দ্র মনে মনে ওই সঞ্জিতকে উদ্দেশ্য করে দু-চারটে গালাগাল দিয়েছিল সঙ্গেসঙ্গে। শালা সব ছবিতে জিনিয়ার গা ঘেঁষে বত্রিশপাটি বের করে দাঁড়িয়ে আছে!

‘আপনারা কালও কি রটরডামে থাকবেন? ঠিক করে বলুন, আমি কাল ভোরেই তাহলে চলে যাব।’ বিরক্তগলায় অতন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল।

‘দাঁড়াও।’ অম্বিকেশ পাশে কার সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত কথা বলে আবার ফোনে ফিরেছিলেন, ‘হ্যাঁ শোনো। কাল আমরা রটরডাম থেকে বাসে করে যাব লিসে বলে একটা গ্রামে। ওখানে কিউকেনহফ টিউলিপ গার্ডেন রয়েছে। বিশাল বড়ো ফুলের বাগান। এই সময়ে হাজার হাজার ফুল ফোটে সেখানে।’

‘জানি।’ অতন্দ্র বলেছিল, ‘আপনি এইমাত্র কথাগুলো কাকে জিজ্ঞেস করলেন? জিনিকে?’

‘জিনিকে করলে তো সবচেয়ে ভাল হত, কিন্তু তুমি তো বারণ করছ। সঞ্জিত বলল।’ অম্বিকেশ অম্লানবদনে জানিয়েছিলেন, ‘তুমি কাল সকালে ওই লিসেতে চলে এসো বরং। ওই বাগানে নাকি আমরা অনেকক্ষণ থাকব। সঞ্জিত সেটাই বলল। তারপর ওখান থেকে চলে যাব অ্যামস্টারডাম।’

সেইমতো অতন্দ্র ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় ঘুম থেকে তুলেছে রবিকে, তারপর হোটেলের বিল মিটিয়ে বাস ধরে দেড়শো কিলোমিটার জার্নি করে ছুটতে ছুটতে এসেছে রটরডামে। সেখান থেকে বাস পালটে আরও এক ঘণ্টা উজিয়ে এসেছে লিসে গ্রামে।

আসার সময় অবশ্য সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে যাত্রাপথের সৌন্দর্য দেখে। দু-পাশে সবুজ হলুদ খেত, মাঝখান দিয়ে মাখনের মতো মসৃণ প্রশস্ত রাস্তা। দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একের পর এক উইন্ডমিল। প্রতিটায় তিনটে করে শলাকার মতো ব্লেড, ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘগুলোর মাঝে সেগুলো নিজের মনে ঘুরে যাচ্ছিল।

মাঝে মাঝেই সবুজ খেতে চোখে পড়ছিল ধপধপে সাদা ঘোড়া। তাদের সিল্কের মতো শরীরে সূর্যের নরম রোদ পড়ে ঝকঝক করছিল। মাঝে মাঝেই পড়ছিল নাম-না-জানা বিশাল বিশাল গাছ। তাদের ছায়ায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঢেকেছিল বাসের জানলাগুলো।

লিসে গ্রামে পৌঁছে বাস থেকে নেমে কয়েক মুহূর্ত জিরিয়ে নিল অতন্দ্র। এবার ও আর কোনো ঝুঁকি নিতে চায়না। জিনিয়া যদি এর মধ্যেই এখান থেকে বেরিয়ে চলে যায়, তাহলে ও আর একগাদা ইউরো খরচ করে ভেতরে ঢুকবে না। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ও ফোন করল অম্বিকেশকে।

কিন্তু যথারীতি ফোনে পেল না। এবার আর নেটওয়ার্কের সমস্যা নয়। ফুলুমামার ফোনই সুইচড অফ। অতন্দ্রর মনে পড়ে গেল, ফুলুমামার ফোন বন্ধ করে রাখার কুখ্যাতি রয়েছে। সময়ে চার্জ দিতে মামা প্রায়ই ভুলে যান।

বিরক্তিতে ও এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, এমন সময় রবি বলল, ‘এবার কি টিউলিপ গার্ডেনটাও ঢুকেই বেরিয়ে আসবে?’

‘রাগ কোরো না।’ অতন্দ্র একটু থেমে বলল, ‘আমি তো তোমায় বলেছি রবি, এই টুরটা আমি স্পসর করছি।’

রবি ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘স্পনসর করাটাই সব নয়, গুপ্ত। সিরিয়াসলি আমি তোমার মতলবটা বুঝতে পারছি না। এত খরচ করে আমরা একটা করে জায়গায় যাচ্ছি, কিচ্ছু না দেখে পরেরটায় চলে যাচ্ছি। এটা কীরকম ব্যাপার তুমি ভেবে বলো তো? আমারও তো ইউরোপটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল!’

অতন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একেকটা সময় এমন আসে, কোনোভাবেই আর ভেতরের আবেগটা লুকিয়ে রাখা যায়না। বলতেই হয়। এখনও তেমনই একটা অবস্থা।

লিসে আরও পশ্চিম নেদারল্যান্ডের একটা ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম, কিন্তু এই ফুলবাগানের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে এই গ্রামের। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে, কিউকেনহফ নামের সেই ফুলবাগানের গেট। আসার সময় রবি বলছিল, বছরে প্রায় সত্তর লক্ষ ফুল ফোটানো হয়, নেদারল্যান্ড নাকি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ফুল রপ্তানি করে।

কিউকেনহফ বাগানের গেটের দিকে তাকিয়ে ধূসর চোখে অতন্দ্র বলল, ‘আমি একজনকে খুঁজছি রবি।’

‘খুঁজছ?’ রবি হাতের জলের বোতলটা থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে বলল, ‘কাকে?’

‘আমার স্ত্রীকে।’ অতন্দ্র অস্ফুটে বলল।

‘মানে?’ রবি মুহূর্তে জল খাওয়া থামিয়েছে, এবার গোল গোল চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে, ‘তুমি বলেছিলে তোমার ওয়াইফ কলকাতায়, রাইট?’

‘মিথ্যে বলেছিলাম। আমরা এখন সেপারেশনে আছি। ও একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছে। টুর নিয়ে এসেছে ইউরোপে।’ অতন্দ্র গোমরামুখে বলল, ‘ এখানে এসে থেকে আমার মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু যেখানেই যাচ্ছি, একটুর জন্য হচ্ছে না।’

‘ও মাই গড!’ রবি উত্তেজিত চোখে তাকাল, ‘ এটা তো বলিউডি ফিল্মের স্ক্রিপ্ট, গুপ্ত! হোয়্যার ইজ শি নাউ?’

অতন্দ্র আঙুল দিয়ে কিউকেনহফের দিকে ইশারা করল, ‘ইনসাইড দ্য গার্ডেন। অলরেডি অনেকটা লেট হয়ে গেছে। ওরা বোধ হয় এবার এগজিট দিয়ে বেরিয়ে যাবে।’

‘তাহলে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছি?’ রবি যেন ভীষণ মজা পেয়েছে এবার, ‘লেটস গো!’

অতন্দ্র উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠল। ভারতের নম্বর। ধরবে না ধরবে না করেও কোনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হতে পারে ভেবে ফোনটা রিসিভ করল ও।

আর ধরামাত্র ওর আগের প্রোজেক্টের ম্যানেজার কৌশিকদার গলা শুনতে পেল ও, ‘খবরটা শুনেছিস?’

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবার। দূরে কিউকেনহফের ভেতরে লাল, বেগুনি, হলুদ রঙের টিউলিপ, হায়াসিন্থ আর ড্যাফোডিল ফুলগুলোর মাথা দোলানো দেখা যাচ্ছে। এতদূর থেকে দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ওর মধ্যে জিনিয়া রয়েছে।

অতন্দ্র সেদিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘না তো! কীশুনব?’

‘গীতিকা ইজ নো মোর। কাল রাতে সুইসাইড করেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে।’

বছর কুড়ি আগেও বাড়ির ছাদে লাগানো টিভির অ্যান্টেনায় পাখি এসে বসলে টিভির চ্যানেল সরে গিয়ে ঝিরঝির করত। সিনেমা, গান বা খবর, যাই চলুক, নিমেষে থেমে যেত। চলন্ত চরিত্র কথা বলতে বলতে থেমে যেত।

অতন্দ্ররও তাই হল। একটা আলতো ঝাঁকুনি খেয়ে ও কেমন স্থির হয়ে গেল।

‘কী রে শুনতে পাচ্ছিস? মেয়েটা বেশ কয়েকদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিল। অফিসও আসছিল না ঠিকমতো। এলেও কারুর সঙ্গে কথা বলত না।’ কৌশিকদা একটুও না থেমে বলে চলেছিল।

অতন্দ্রর কানে কথাগুলো ঢুকছিল কি না কে জানে, ওর চোখ দুটো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। শূন্যতা ভরা সে-চাহনি।

অনেক দিন ছিলাম প্রতিবেশী,

দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।

প্রভাত হয়ে এসেছে রাতি, নিবিয়া গেল কোণের বাতি —

পড়েছে ডাক, চলেছি আমি তাই।।

৪৪

উৎপল বিশ্বাস এসে বেশ রাগত স্বরে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি টাকার জন্য কোনো ডেকোরামই মানেন না? যেভাবে হোক, যাকে দিয়ে হোক, টাকা ইনকাম করলেই হল?’

জিনিয়া কিউকেনহফ বাগানের টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ছিল বাকি সবার সঙ্গে। এখানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির তোড় এতই বেশি যে সামান্য দূরে ফুটে থাকা হলুদ টিউলিপগুলোকেও দেখা যাচ্ছিল না। সাদা হয়ে আসছিল চারপাশ।

জিনিয়া ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। এই কয়েকটা দিনের মধ্যে এতগুলো শহর, এতোগুলো জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো, একেবারে আঁটোসাঁটো শিডিউল। এই টিউলিপ বাগানে সময় বরাদ্দ ছিল দেড় ঘণ্টা, তারপর এখান থেকেই সোজা চলে যাওয়ার কথা অ্যামস্টারডাম শহরে।

কিন্তু অসময়ের এই বৃষ্টি এসে সব বরবাদ করে দিতে চলেছে। জিনিয়া হতাশমুখে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল ঘন ঘন। টিকিট কাউন্টারের আশেপাশে যে যেখানে পেরেছে শেডের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে।

এই সময় উৎপল বিশ্বাসের এমন কথায় ও অবাক হয়ে গেল। উৎপল বিশ্বাস একা আসেননি, সঙ্গে এনেছেন পরেশনাথ কুণ্ডুকেও। পরেশনাথ কুণ্ডু বাগানে ঢুকেই নিজের মোবাইলে ভিডিয়ো করে যাচ্ছিলেন আশপাশের ফুলের এখন রাগতভাবে তাকিয়ে রয়েছেন।

জিনিয়া বলল, ‘মানে? কীসের টাকা ইনকাম?’

উৎপল বিশ্বাস বললেন, ‘আপনি তো যাকে পেরেছেন তাঁকে তুলে এনেছেন দেখছি। মুখে আল্লা হাফিজ করছে, এদিকে এখানে চলে এসেছে তার খ্রিস্টান সেক্রেটারির সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে। ওদিকে দুটো আইবুড়ো মেয়েছেলে অসভ্যের মতো একসঙ্গে রয়েছে। আজকাল এইসব নোংরামির কথা খবরের কাগজে পড়ি, টিভিতে দেখি। আপনি তো একেবারে চোখের সামনে নিয়ে এসে হাজির করলেন। ছি ছি, বলি আমরা তো ফ্যামিলি নিয়ে এসে লজ্জায় মরছি!’

‘একদমই তাই মি বিশ্বাস।’ পরেশনাথ কুণ্ডু মাথা নেড়ে ভিডিয়ো করা বন্ধ করে বললেন, ‘ আমার ছেলে আজ সকালে জিজ্ঞেস করছে, পাপা ওই দুটো আন্টি কি আনম্যারেড? ওদের হাজব্যান্ড কোথায়? ওরা আইফেল টাওয়ারের সামনে জড়িয়ে ছবি তুলছিল কেন? কী জবাব দেব বলুন তো!’

এতক্ষণ জিনিয়ার কুঁচকে থাকা ভ্রূ এবার সোজা হয়ে গেল। ও আড়চোখে দূরের দিকে তাকাল। দেখল, একটা গাছের তলায় মধুমিতা আর পিয়াসা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একজনের হাত অন্যজনের হাতে। আকবর আলি আর উইশিকে দেখা যাচ্ছে না কাছেপিঠে।

ওর প্রচণ্ড বিরক্ত লাগল। কিন্তু নিজের অবস্থানের কথা ভেবে অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল ও। নরম গলায় বলল, ‘দেখুন, কে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কী করছেন, সেটা তো আমাদের দেখার দায়িত্ব নয়। আমাদের কাজ হল আপনাদের সবাইকে শর্ত মতো প্রতিটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো।’

তা বললে তো হল না, মিসেস দাশগুপ্ত!’ পরেশনাথ উষ্ণ গলায় বললেন, ‘এটা একটা ফ্যামিলি টুর। আপনার কাস্টমারের ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল।’

‘কী মুশকিল!’ জিনিয়া এবার সত্যিই নিজের বিরক্তিটা চাপতে পারল না, ‘এই ব্যাপারে আমি কী সচেতন হব আমি তো বুঝতে পারছি না। আপনাদের থাকা, খাওয়া, ঘোরার ব্যাপারেই কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে? যদি বিন্দুমাত্র সমস্যা এই তিনটে বিষয়ে আপনারা ফেস করেন, নির্দ্বিধায় আমাকে জানান। বাকি, কে কোথায় কী করছেন, সে-ব্যাপারে আমি সত্যিই কিছু করতে পারব না। সরি।’

বৃষ্টিটা এই সময়ে ধরে আসতে কথা আর এগোল না। উৎপল বিশ্বাস আর পরেশনাথ কুণ্ডু দু-জনেই গজগজ করতে করতে চলে গেলেন নিজেদের পরিবারের কাছে, তারপর বেরিয়ে পড়লেন বাগান দেখতে।

নেদারল্যান্ডের এই লিসে টাউনের কিউকেনহফ টিউলিপ গার্ডেনে এলে শরীরের বয়স যেন নিমেষে দশ বছর কমে যায়। এত সবুজ। এত রঙিন ফুল, প্রকৃতির এত অনন্য রূপের মাঝে মনে হয়, সত্যিই, প্রকৃতিকে একটু যত্ন করলে প্রকৃতি কত হাজার গুণই না ফিরিয়ে দেয় মানুষকে। অথচ সেইটুকু যত্নেরই আজকাল বড় অভাব।

সারা বছরে মাত্র একটা মাস, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি এখানে টিউলিপ ফোটে। হলুদ, গোলাপি, লাল, বেগুনি, নানারকমের বিচিত্র সমস্ত ফুল এখানকার নির্মল বাতাসে যখন একসঙ্গে দেহ আন্দোলিত করতে থাকে, পাশের লেকে যখন বয়ে যায় স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল, হাঁটার পথের মধ্যে মধ্যে যখন গায়ে এসে লাগে ফোয়ারার জলের ছাঁট, তখন মনে হয়, আহা! স্বর্গ এখানেই।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রতিটা সদস্যই যেন এখানে এসে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। দলের সঙ্গে না থেকে নিজেরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ইতিউতি। সঞ্জিত হাজরাও তেমনটাই বলেছিলেন। বলেছিলেন ঠিক এক ঘণ্টা পরে বাইরের গেটে গিয়ে জড়ো হতে।

সারা পৃথিবী থেকে পর্যটক আসেন এখানে। সাধে কি একে গোটা ইউরোপের বাগান বলা হয়? সাপের মতো আঁকাবাঁকা সরু পথ এখানে নিপুণভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। পথের দু-পাশে ফুটে রয়েছে চোখধাঁধানো ফুল। ফাঁকে ফাঁকে আকাশছোঁয়া লম্বা গাছগুলো আকাশকে অল্প ঢেকে কেমন এক মায়াময় আলো- আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এখানে।

সবাই এখানে এসে অত্যন্ত খুশি হলেও জিনিয়ার বিরক্ত লাগছিল।

আরতির জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে যাদবচন্দ্রও সবার শেষে বাগান ঘুরতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, যাওয়ার আগে উজ্জ্বল চোখে বললেন, ‘আচ্ছা, রাজুর সঙ্গে সত্যিই দেখা হবে তো জিনিয়া?’

‘হবে।’ জিনিয়া নিজের মনের বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘আপনারা ভালো করে ঘুরুন, জেঠু। দেখা হবেই।’

সবাই একে একে চলে যেতে জিনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে বেরোল।

মানুষ সত্যিই কি অদ্ভুত হয়। হ্যাঁ, মধুমিতা আর পিয়াসা যে সমকামী জুটি সেটা জিনিয়া টুর শুরু হওয়ার পরে পরেই অনুমান করেছিল। এও বুঝেছিল যে, এই কারণেই তাঁরা তাঁদের স্থানীয় কোনো টুর এজেন্সির সঙ্গে না এসে যোগাযোগ করেছেন ওর সঙ্গে।

কিন্তু এতে সমস্যাটা কোথায়? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে থাকা। এতে তো কারুর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। মধুমিতা আর পিয়াসা হয়তো এক সঙ্গেই থাকেন যেকোনো স্বাভাবিক দম্পতির মতো। তাঁরা যে একে অন্যকে খুবই ভালোবাসেন, সেটাও ও আগেই দেখেছে।

বেলজিয়ামের গ্র্যান্ড প্লেসে প্রত্যেকের জন্য আইসক্রিমের ব্যবস্থা করেছিল ও। পিয়াসাকে দেওয়া হয়নি কারণ জিনিয়া আগে থেকেই জানত উনি ডায়াবেটিসের রুগি। কিন্তু মধুমিতাকে আইসক্রিম দিতে গেলে তিনি সামান্য হেসে বলেছিলেন, ‘ ও খাচ্ছে না, আমি কী করে খাব জিনিয়া? তুমি আমারটা বরং পরেশনাথবাবুর ছেলেকে দিয়ে দাও।’

জিনিয়া কিছুতেই বোঝে না। কিছুতেই ওর মাথায় ঢোকেনা, মানুষের কীসের এত সমস্যা। ও সত্যিই বুঝতে পারে না, বিপত্নীক আকবর আলি যদি শেষ বয়সে সব কর্তব্য পালন করে সেক্রেটারির সঙ্গে বিদেশভ্রমণে আসেন, কীসের এত অসুবিধা। ও সত্যিই বুঝতে পারে না, ঋতুপর্ণা ইমরানকে ভালোবাসলে কেন সমাজে শোরগোল পড়ে যায়। ও সত্যিই বুঝতে পারে না, উপযুক্ত প্রেমিকাকে বিয়ে করেও কেন যাদবচন্দ্রের ছেলে রাজুকে ভয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয় বাবা-মা-র সঙ্গে।

চারপাশে খালি ভেদাভেদ। খালি বিভাজন। ওর ভালো লাগে না। ও নিজে চেয়েছিল দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের টুর নিছক কোনো ভ্রমণ হবে না, প্রতিটা মানুষ এই ক-টা দিন মিলেমিশে থাকবেন, হয়ে যাবেন এক পরিবার।

কিন্তু কোথায় কী। এই কয়েকটামাত্র দিনেও এখানে বাসা বেঁধেছে হিংসা, নিন্দা আর অসূয়া।

ভাবতে ভাবতে জিনিয়া ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একটা পুতুলের মতো বাচ্চা মেয়ে তার বাবা-মা-র সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাগানে। তার বাবা-মা হাঁটছিলেন একটু আগে আগে, সে এদিক-ওদিক খেলতে খেলতে চলেছিল। জিনিয়াকে কাছে পেয়েই সে আবদার করল তার একটা ছবি তুলে দিতে।

জিনিয়া হেসে নীচু হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আগে বলো, তোমার নাম কী? তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘আমার নাম লিন্ডা। আমার বাড়ি স্কটল্যান্ডে।’ মেয়েটা ঝুঁটি দুলিয়ে বলল। তার সোনালি চুল এই বৃষ্টিস্নাত আলোয় ঝকঝক করছিল।

জিনিয়া মেয়েটার গাল টিপে তার হাতের মোবাইল ফোনটা নিয়ে ক্যামেরায় ফোকাস করল। মেয়েটা নানা ভঙ্গিতে একের পর এক পোজ দিয়ে যাচ্ছিল।

 জিনিয়া ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ খেয়াল করল অম্বিকেশ আর মিনতি মাসিমাকে।

দূরে দু-জনে হেঁটে চলেছেন পাশাপাশি। মাঝে মাঝেই গাছের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আবার দেখা যাচ্ছে। মিনতি মাসিমার পরনে একটা তাঁতের শাড়ি। আর ফুলুমামা শার্ট প্যান্টের ওপর পরে আছেন একটা লাল ওয়াটারপ্রূফ জ্যাকেট।

জিনিয়া এতদূর থেকেও জ্যাকেটটা চিনতে পারল। ওটা মিনতি মাসিমার জ্যাকেট। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে কাল যখন ওরা ঘুরছিল, বিশ্বখ্যাত মানেকেন পিস স্ট্যাচু দেখার সময়ে মাসিমার গায়ে এই জ্যাকেটটাই ছিল।

ফুলুমামার খুব সর্দির ধাত। বৃষ্টিতে ঠান্ডা যাতে না লাগে, সেইজন্যই কি মিনতি মাসিমা তাঁর জ্যাকেট পরিয়ে দিয়েছেন ফুলুমামাকে?

জিনিয়া অবাক হল না। গতকালই মা ফোনে ওকে সব বলেছে।

ও নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ আচ্ছা মা, ফুলুমামা আর এই মিনতি গাঙ্গুলি কি খুব বন্ধু ছিলেন?’

‘কেন এমন প্রশ্ন?’ মা অবাক হয়েছিলেন, ‘ আমি তো সেদিনই বললাম, মিনু আমাদের কোন্নগরের বাড়ির পাশেই থাকত।’

‘না, সে ঠিক আছে, আসলে ওঁরা দুজন সবসময়েই একসঙ্গে ঘুরছেন।’ জিনিয়া একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘এত বন্ধুত্ব, অথচ আগে কোনোদিনও এঁকে দেখিনি কেন মা?’

মা একটু চুপ করে ছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ‘ফুলু মিনুকে খুব ভালোবাসত জিনি। নানা কারণে ওদের বিয়েটা হয়নি। ফুলু তারপর জেদ করে আর কোনোদিন বিয়েই করল না। আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম। কিছুতেই শোনেনি। তুই কিছু বলতে যাস না। ফুলু খুব চাপা ছেলে। লজ্জা পাবে। এতদিন পর দু-জনের দেখা হয়েছে, —সময় একটু কাটাল না হয়!’ ঘুরুক না।’

জিনিয়া অন্যমনস্কভাবে দূরে তাকিয়ে ছিল। দু-জনকে দেখতে দেখতে ওর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠেছিল। একটু আগেই ও ভাবছিল, দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের যাত্রীদের মধ্যে নাকি খালি হিংসা, নিন্দা। কই! এই যে এত বছর আগের একটা ভালোবাসা দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে এসে আবার প্রাণ পেল, ফুলুমামা আর তার মিনুর মধ্যে আবার দেখা হল, এটা কি জিনিয়ার সাফল্য নয়?

ও তো টাকাপয়সা, লাভক্ষতির চেয়েও বেশি এগুলোই চেয়েছিল। এগুলোই যে পরম আনন্দ দেয় ওকে। মনে হয় এগুলোই মানুষ হয়ে জন্মানোর উদ্দেশ্য। আর শুধু বাকি একটা কাজ। রাজুকে খুঁজে বের করা। যাদবচন্দ্র আর আরতির সঙ্গে ওঁদের ছেলের দেখা করাতে পারলেই ওর সবদিক থেকে তৃপ্তি হবে।

কতক্ষণ এভাবে নিজের মনে ও ভেবে চলেছিল জানেনা, সংবিৎ ফিরল কানের পাশেই একটা কান্না মেশানো চিৎকারে।

উইশি। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে বেশ কিছুটা ছুটতে ছুটতে ও জিনিয়ার কাছে এসেছে।

‘আপনাকে এতদিন বলিনি মিসেস দাশগুপ্ত, কিন্তু আজ না বলে পারছি না।’ উইশির চোখ-মুখ লাল। ওর কথায় বাগানের নিস্তব্ধতা এক লহমায় খান খান হয়ে যাচ্ছে, ‘ওই রৌণক সাধুখাঁ কিন্তু আমার সঙ্গে খুব অসভ্যতা করছেন। আইফেল টাওয়ারে ওঠার সময় ইচ্ছে করে আমার পেটে হাত দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যেই চোখ দিয়ে কুৎসিত ইশারা করেন। আমি তবু কিছু বলিনি। অ্যাভয়েড করছিলাম। কিন্তু এখন আলি স্যার একটু ওদিকে গেছিলেন, আমি একপাশে দাঁড়িয়ে ফুল দেখছিলাম, উনি পেছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। এগুলো কীরকম অভব্যতা মিসেস দাশগুপ্ত?’

৪৫

‘আপনি বুঝতে পারছেন না সান্যালবাবু, উইশি এই কয়েক দিন ধরেই আনকমফর্টেবল ফিল করছে, তবু আমায় বলেনি। কয়েকজন মিলে আমরা বেড়াতে এসেছি, কোথায় একসঙ্গে ঘুরব, হইহুল্লোড় করব, ছবি তুলব, তা নয়, কনস্ট্যান্ট একজন মহিলাকে হ্যারাস করা, আলহামদুলিল্লাহ, এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?’ আকবর আলি ভ্রূ কুঁচকে বলে চলেছিলেন।

আকবর আলি যতই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন, অম্বিকেশ ততই শান্তভাবে ওঁকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, ‘জিনিয়া আর সঞ্জিত কথা বলছে রৌণকবাবুর সঙ্গে। আপনি একটু ঠান্ডা হোন প্লিজ!’

আকবর আলির পাশেই একটা বেঞ্চে বসে আছে উইশি। তার টকটকে লাল রঙের পা পর্যন্ত গাউনের সঙ্গে গাঢ় খয়েরি রং করা চুল আর মুখচোখ লাল হয়ে উঠে কেমন ভয়ের সিনেমার নায়িকার মতো লাগছে। চোখের কাজলও এতক্ষণের কান্নায় ধেবড়ে গেছে ভালোমতো।

একটু দূরে জিনিয়া আর সঞ্জিত কথা বলছে রৌণক সাধুখাঁ-র সঙ্গে। রৌণকের মুখে একটাই কথা, ‘আমি কোনো অসভ্যতা করিনি।’

‘দেখুন রৌণকবাবু, আপনার বিরুদ্ধে আগেও কিছু অভিযোগ আমাদের কানে এসেছে।’ সঞ্জিত বললেন, ‘আপনি লন্ডনের হোটেলে রাতে ড্রিঙ্ক করে ওয়েটারের ওপর চিৎকার করছিলেন। হোটেল ম্যানেজমেন্ট আমাদের কমপ্লেইন করেছিল, তবু আমরা কিছু বলিনি। কিন্তু গ্রুপের মধ্যে এসব কী!’

‘দেখুন, একটা থার্ড ক্লাস ট্রাভেল এজেন্ট হয়ে আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না।’ রৌণক তেরিয়া হয়ে উঠলেন, তার মুখ দিয়ে ভকভক করে বেরিয়ে এল হুইস্কির গন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে, আজও হোটেল থেকে বেরোনোর সময় মদ্যপান করে এসেছেন তিনি, ‘আমি এই গ্রুপের অন্যদের মতো প্রথমবার বিদেশ টুর করছি না, যে আদেখলাপনা করব। আমার অফিসের কাজে বহুবার ইউরোপ এসেছি আমি। এখানকার এটিকেট আপনাদের সবার চেয়ে আমি অনেক ভালো জানি। আর আমি আমার পয়সায় ড্রিঙ্ক করেছি, তাতে কার বাপের কী?’

কিউকেনহফ টিউলিপ গার্ডেন ঘোরা মোটামুটি মাথায় উঠেছে। বাগানেরই একদিকের এই ফাঁকা জায়গার বেঞ্চে এখন শুরু করতে হয়েছে সালিশি পর্ব। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পর্যটকরা যেতে যেতে কৌতূহলী চোখে এদিকে তাকাচ্ছে, তারপর আবার চলে যাচ্ছে।

উৎপল বিশ্বাস, পরেশনাথ কুণ্ডুরা ঘোরা ব্যাহত হচ্ছে বলে বিরক্তিতে ফেটে পড়ছেন।

‘ছি ছি! আমি আগেই বলেছিলাম!’ উৎপল বিশ্বাস থেকে থেকে গর্জে উঠছিলেন, ‘কোন বাছবিচার না করে যেখান সেখান থেকে লোক তুলে এনে জায়গা ভরালে এই হয়! একটা স্ট্যান্ডার্ড নেই, কিছু নেই।’

অভীকদের দলটা একটু আগে কাছেপিঠে ঘুরছিল। সৌম্যজিৎ মধুছন্দাও ফটো তুলছিল, কিন্তু তারা সবাই এখন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

জিনিয়ার অসহ্য লাগছিল। ব্যবসায়িক দিক থেকে রৌণক স্পেশাল কাস্টমার, কারণ তিনি পুরো টাকা পেমেন্ট করে এই ট্রিপে এসেছেন। সেখানে যে এইরকম অভিযোগ উঠতে পারে ও ভাবতেও পারেনি। রৌণক যে উইশিকে নিরালায় পেয়েই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সেটা প্রমাণিত, কারণ মধুছন্দা আর সৌম্যজিৎ দু-জনেই ওদের একটু পেছনে ছিল। ওরা সব দেখেছে।

ওর ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে রৌণক সাধুখাঁকে গলাধাক্কা দিয়ে দল থেকে বের করে দিতে।

কিন্তু সঞ্জিত ওকে বুঝিয়েছেন, এইরকম করাটা ব্যবসার জন্য অত্যন্ত হঠকারিতা হবে। রৌণক সাধুখাঁ যে শুধু ফুল পেমেন্ট করেছেন তাই নয়, একটা নামি সিমেন্ট কোম্পানির উনি ডিরেক্টর। কলকাতায় ওঁর যথেষ্ট প্রতিপত্তি। ছোটো বড়ো রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ওঠাবসা। চাইলে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর মতো সদ্যোজাত কোম্পানিকে উনি ফিরে গিয়ে ধুলোয় লুটিয়ে দিতে পারেন। তাই মন অন্য কিছু চাইলেও কোম্পানির স্বার্থে নরম হয়ে কথা বলতেই হবে।

রৌণক তখনও মাতালের মতো সঞ্জিতের উদ্দেশে বকে চলেছিলেন, ‘শালা দু-দিনের একটা ফুটো কোম্পানির এজেন্ট! আমাকে তো চেনে না, পেছনে লাথি মারলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে। জ্ঞান দিতে আসছে! ট্রেড ফেয়ারে ওই ছেলেটার কথায় বুক করে যে কী ভুল করেছিলাম! কোনো ক্লাস নেই। সাবস্ট্যান্ডার্ড সব হোটেল বুক করেছে।’

জিনিয়া রাগ চেপে রেখে রৌণক সাধুখাঁকে বলল, ‘আপনি উইশির সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেননি?’

‘যেটা করেছি, সেটা বাজে কিছু নয়।’ রৌণকের উদ্ধত হেলদোলহীন জবাব, ‘ওই ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু ফ্লার্ট বা মজা করাটা কোনো অপরাধ নয়। ও যে এখন এইরকম সিন ক্রিয়েট করছে, তার কারণ হল, আমি প্রোফেশনালি এগোইনি। মাথায় ঢুকল ম্যাডাম?’

‘প্রোফেশনালি এগোননি মানে?’ জিনিয়ার রাগের পারদ উত্তরোত্তর চড়ছিল। পাশ থেকে সঞ্জিত ওকে শান্ত হতে বলছিলেন। কিন্তু ওর পক্ষে আর মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ‘কীসের প্রফেশনালি এগোনোর কথা বলছেন আপনি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

 ‘বুঝতে সবই পারছেন। টুর নিয়ে এসেছেন, এদিকে এত সোজা কথা বুঝতে পারছেন না?’ রৌণক তির্যক সুরে বললেন, ‘শুনুন, ওইরকম অসংখ্য মেয়েকে রৌণক সাধুখাঁ ডিল করেছে। মোটা একটা চেক নাকের সামনে দোলালেই সুড়সুড় করে ওই বুড়ো মোল্লাকে ছেড়ে দিয়ে মালটা এসে আমার সঙ্গে জামা খুলে শুয়ে পড়বে।’

 ‘শাট আপ!’ জিনিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারল না, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক লোকজনকে অগ্রাহ্য করে ঠাস করে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল রৌণকের গালে, ‘বেরিয়ে যান। আউট! এই মুহূর্তে আপনাকে আমি এই গ্রুপ থেকে বের করে দিলাম।’

চড় খেয়ে রৌণক সাধুখাঁ এতটাই অবাক হয়ে গেলেন যে কথা বলতেও ভুলে গেলেন কিছুক্ষণ। তিনি সম্ভবত কল্পনাও করে উঠতে পারেননি যে সবার সামনে কেউ এভাবে ওঁর গায়ে হাত তুলতে পারে।

অম্বিকেশ সঙ্গেসঙ্গে সামলাতে গেলেন রৌণককে, কিন্তু জিনিয়া অম্বিকেশকে আটকে দিল, ‘দাঁড়াও ফুলুমামা। কোনো কথা বলবে না তুমি। যা বলার আমি বলব। টাকা দিয়ে উনি মাথা কিনে নেননি, যে আমারই গ্রুপের পরিবেশ নষ্ট করবেন, মেয়েদের হ্যারাস করবেন, অপমান করবেন, আবার বড়ো বড়ো কথা বলবেন। রৌণকবাবু, আপনি যা টাকা আমায় পেমেন্ট করেছিলেন, আমি এখুনি সেটার চেক আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি। এই ক-দিনের ঘোরার টাকাও নিচ্ছি না। আপনি বাইরে চলুন, বাস থেকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যান এক্ষুণি।’

রৌণক সাধুখাঁ এতক্ষণ কথা বলছিলেন বেঞ্চে আধশোয়া হয়ে বসে, এবার তিনি উঠে বসেছেন।

তাঁর মুখ-চোখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। উত্তেজনায় ঠোঁটদুটো কাঁপছে। নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত। অ্যালকোহলের জন্যই হোক বা অন্য কিছু, হাতের আঙুলগুলোও নড়ছে।

দাঁতে দাঁত চিপে তিনি জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই অপমানের বদলা আমি নেব। কলকাতায় ফিরে যদি তোর এই এজেন্সির মুখে আমি চুনকালি লাগাতে না পারি, তাহলে আমার নাম রৌণক সাধুখাঁ নয়। শালি বরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে এখানে এসেছিস ফুর্তি করতে …।’

‘এই চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথা বললে জিভ উপড়ে নেব একদম!’

রৌণক সাধুখাঁ-র মুখের ভাষা শুনে অপমানে কাঁপছিল জিনিয়া, কিন্তু তার মধ্যে যাকে এগিয়ে আসতে দেখল, তাঁকে দেখে ও অবাক হয়ে গেল।

উৎপল বিশ্বাস এগিয়ে এসে হাত-পা নেড়ে তখনও চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, ‘বড্ড বড়ো বড়ো কথা বলা হচ্ছে, না? আমাদের হাঁটুর বয়সি একটা বাচ্চা মেয়ে সবাইকে নিয়ে চারদিক এত সুন্দরভাবে খেয়াল রেখে ঘোরাচ্ছে, কোনোদিকে একটু অযত্ন হতে দিচ্ছে না, মুখে সবসময় হাসি লেগে রয়েছে, তার মুখে তুই চুনকালি লাগাবি? কলকাতায় ফিরে দ্যাখ না কে কার মুখে চুনকালি মাখায়। পরেশনাথ ওর মোবাইলে তোর আজকের নোংরামি ভিডিয়ো করেছে। তুই যেরকমভাবে পেছন থেকে চুপিচুপি গিয়ে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেছিস, দেখলেই লাথি মারতে ইচ্ছে হয় তোর পেছনে। তোর কোম্পানিতে ভিডিওটা পাঠাব, তারপর দেখব, কে কার মুখে চুনকালি লাগায়।’

জিনিয়া বিস্মিতচোখে দেখছিল সারাক্ষণ সব ব্যাপারে খুঁত বের করা উৎপল বিশ্বাসকে। এতদিন পর্যন্ত ভদ্রলোকের ছিদ্রান্বেষী চেহারাটাই প্রকট হয়েছিল ওর কাছে, এই দিকটা সত্যিই অজানা ছিল।

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ বললেন, ‘ঠিক বলেছেন উৎপলবাবু। চোরের মায়ের বড়ো গলা। মাতাল চামচিকে একটা!’

অভীক আর অনমিত্র এগিয়ে এসে বলল, ‘কলকাতা অবধি অপেক্ষা করার কী দরকার, নোংরামিটা হয়েছে তো এখানে। এখানকার পুলিশের কাছে গিয়ে জমা দিলেই তো হয়, বাছাধন এতবার বিদেশে এসেছে, এবার নাহয় একটু বিদেশের জেল খাটবে।’

সবাই একবাক্যে সায় দিয়ে হইহই করে উঠল। সৌম্যজিৎ মধুছন্দা থেকে শুরু করে মৃগাঙ্ক চট্টরাজ, পরেশনাথ, সবাই একমত। এখুনি রৌণককে এখানকার পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হোক।

রৌণক সাধুখাঁ-র মুখের সেই তেজ পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। এখন সেখানে ভয়ের ছাপ পড়েছে। নেশা ছুটে গিয়েছে পুরোপুরি, এখন ভয়ার্তচোখে তাকিয়ে আছেন তিনি।

‘না। তার দরকার নেই।’ হাত তুলে সবাইকে থামাল জিনিয়া। উৎপল বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জেঠু, আপনি শান্ত হন। এখানে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার দরকার নেই। তাতে আমরা সবাই আটকে পড়ব, যেহেতু উনি এই দলের সঙ্গে এসেছেন। আমাদের বাকি শিডিউলটাও বানচাল হয়ে যাবে। তার চেয়ে আমরা যা করার কলকাতায় গিয়েই করবো। আপাতত ওঁকে আমাদের দল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।’

‘না।’ রৌণক যেন অনেকদিনের ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে ওই ভিডিয়ো কোথাও পাঠাবেন না। প্লিজ! আমার অফিসে ওই ভিডিয়ো পৌঁছোলে আ-আমি মুখ দেখাতে পারব না। আমি … আমি ক্ষমা চাইছি। আমি ক্ষমা চাইছি সবার আছে। এমন কাজ আর করব না আমি। কথা দিচ্ছি!’

অনমিত্র বলল, ‘আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে কী হবে? যার সঙ্গে অসভ্যতা করেছেন, তার কাছে ক্ষমা চান।’

‘হ্যাঁ, তাই তো, উইশি-র কাছে ক্ষমা চান আপনি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন পরেশনাথ।

‘চাইছি, চাইছি।’ রৌণক গুটিয়ে থাকার কেন্নোর মতো হয়ে গেছেন। একটু দূরে বসে থাকা উইশি-র দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন, ‘আ-আমাকে ক্ষমা করো, ইয়ে করুন!’

এবার সবাই চলুন। বাস দাঁড়িয়ে আছে।’ জিনিয়া আঙুল তুলল, ‘রৌণকবাবু, আপনাকে অ্যামস্টারডাম এয়ারপোর্টে ছেড়ে দেব আমরা। বাস থেকে লাগেজ নিয়ে নেবেন। আর আপনার সমস্ত টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিচ্ছি।’

রৌণক একটু দম নিলেন। উত্তেজনায়, অপমানে তাঁর মুখ লাল হয়ে গেছে। কী-একটা বলতে গিয়েই বললেন না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হনহন করে উঠে চলে গেলেন বাইরের দিকে।

৪৬

জিনিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় হয়তো এতটা ভৌগোলিক দূরত্বের কারণেই কথা একটু পরে শুনতে পাওয়া যায়। যে কারণে নিজের কথা শেষ করে কয়েক সেকেন্ড থামতে হয়।

কিন্তু সেটা জানা সত্ত্বেও ঋতুপর্ণা ধৈর্য ধরতে পারছিল না। ভয়ে, দুশ্চিন্তায় ওর শরীর অবশ হয়ে আসছিল। ও চিৎকার করে বলছিল, ‘কখন থেকে?’

জিনিয়া বলল, ‘তোদের ওখানকার কাল রাত থেকে। আমার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল গত পরশু। কাল সারাদিন কোনো কথা হয়নি। আমাকে একটু আগে বিকাশ ফোন করে বলছে সকালবেলা আলোকপর্ণা অফিস আসেনি। অফিসের ফোন ক্রমাগত বেজে চলেছিল, ও রিসিভ করতে দেখে আলোকপর্ণার বাবা। ওঁরা প্রচণ্ড আতঙ্কিত।’

ঋতুপর্ণার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কাল রাত থেকে ছোটু বাড়ি ফেরেনি?

ইমরান অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ওর অভিব্যক্তি দেখে সেও হাতের কাজ থামিয়ে চেয়ে রইল ঋতুপর্ণার দিকে।

ও বলল, ‘তুই পুরো ব্যাপারটা আমাকে খুলে বল, জিনিয়া। ছোটুর সঙ্গে শেষ তোর কখন কী কথা হয়েছে, বিকাশ তোকে কী বলল, সব।’

জিনিয়া ওপার থেকে বলল, ‘আলোকপর্ণার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল পরশুদিন। ওর স্যালারিটা ট্রান্সফার করে দেব, সেটাই বলেছিলাম। আর তো কোনো কথা হয়নি! তারপর কাল সারাদিন রটরডাম আর অ্যামস্টারডামে খুব হেকটিক শিডিউল গিয়েছে। আরও নানা ঝামেলা হয়েছিল। সেসব পরে বলব। অত ডামাডোলে ওর সঙ্গে কথা বলার আর সময় পাইনি। আজ একটু আগে আমাকে বিকাশ ফোন করে বলছে, অফিসে ও তালা খুলে ঢুকে দেখে, অফিসের ফোনে তোর বাবা ফোন করে যাচ্ছেন। তারপরই বিকাশ আমাকে ফোন করে জানাল।’

‘তুই বিকাশের নম্বরটা দে আমায়। আমি এখুনি কথা বলছি ওর সঙ্গে।’

‘সে দিচ্ছি।’ জিনিয়া বলল, ‘কিন্তু কী হল আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে। ফোনটাই-বা বন্ধ কেন?’

‘কাল তোর অফিস থেকে ও কখন বেরিয়েছিল? ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করল।

জিনিয়া বলল, ‘ সেটা বিকাশ বলতে পারল না। কারণ ও আগেই বেরিয়ে গেছিল কাজে। কথা ছিল আলোকপর্ণাই অফিস বন্ধ করে বাড়ি চলে যাবে। তবে আমি ওকে বলেছিলাম এই ক-দিন বেশি দেরি না করতে, পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে যেতে।’

ঋতুপর্ণার মাথা কাজ করছিল না। জিনিয়ার অফিস সল্টলেকে, ছোটু অফিস থেকে বিকেল পাঁচটায় বেরোলে হিন্দমোটরের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া উচিত গতকাল সন্ধে সাতটার মধ্যে। সেখানে এখন বেলা এগারোটা। ছোটু কোথায় গেল?

ও অস্থির গলায় বলল, ‘ অফিসে দুপুরের পর থেকে একা ছিল, কেউ ওকে জোর করে কোথাও নিয়ে চলে যায়নি তো?’

‘না না, সেরকম কিছু হলে তো অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ডের চোখে পড়ত। সে-ই আটকাত।’ জিনিয়া বলল, ‘এরকম কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না।’

‘তোর সঙ্গে শেষ যখন কথা হয়েছিল, ও কি আর কিছু বলেছিল?’

‘না তো! কেমন আছি, কেমন ঘুরছি জিজ্ঞেস করেছিল। আমি স্যালারি এখান থেকে পাঠাচ্ছি শুনে বলেছিল ফিরে দিলেও চলবে।’ জিনিয়া মনে করতে করতে বলল, ‘আমি বলেছিলাম ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে একবার মেসেজ করতে। সেটা যদিও করেনি। আমারও মনে ছিল না।’

ইমরান বারবার জানতে চাইছে কী হয়েছে, ঋতুপর্ণা ইশারায় ইমরানকে বলল, আলোকপর্ণাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর ফোনে বলল, ‘ও কখন ব্যাঙ্কে গিয়েছিল?’

‘কালই তো যাওয়ার কথা ছিল। মান্থলি স্টেটমেন্টটা আনতে। অন্যবার আমিই তুলে আনি, এবার আমি নেই তাই।’ জিনিয়া বলল।

‘কী হবে জিনিয়া? ছোটুর খারাপ কিছু হয়নি তো? হিন্দমোটর স্টেশন থেকে আমাদের বাড়িটা বেশ দূরে, গলিগুলোও নির্জন।’ ঋতুপর্ণার গলাটা কাঁপছিল, ‘আমি কি থানায় খবর দেব?’

জিনিয়া একটু ভেবে বলল, ‘তুই কি একবার আমার অফিসে যেতে পারবি? ওখানে তো সিকিউরিটি গার্ড আছে, সে যদি কিছু বলতে পারে কাল শেষ কখন ওকে দেখেছে!’

‘হ্যাঁ, এখুনি যাচ্ছি।’ ঋতুপর্ণা উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় ফোন রেখে দিল। ইমরানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আজ অফিস যাব না। তুমি বেরিয়ে যাও। ছোটু কাল রাত থেকে নিখোঁজ।’

‘নিখোঁজ মানে?’ ইমরান হতভম্ব হয়ে গেল।

ঋতুপর্ণা বিকাশকে ফোন করল। কিন্তু বিকাশও তেমন কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল ছোটুর টেবিলে কিছু কাগজপত্র এলোমেলো হয়ে পড়েছিল।

ইমরান ভাবতে ভাবতে বলল, ‘এত টেনশন কোরো না, ঋতু। প্রথমেই খারাপ কিছু হয়েছে ভেবে নিচ্ছ কেন? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে তোমাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছে ও?’

‘কার বাড়ি আর যাবে!’ মুখ শক্ত করে বলল ঋতুপর্ণা, ‘আমি চলে আসার পর ওরা বলতে গেলে একরকম একঘরে হয়ে গিয়েছে। আত্মীয়মহলেও, পাড়াতেও। আর তা ছাড়া, তেমন হলে ফোন বন্ধ থাকবে কেন?’

ইমরান মাথা নাড়ল। ঋতুপর্ণার যুক্তি অকাট্য।

ঋতুপর্ণা ছটফটিয়ে উঠল, ‘আর দেরি করা যায় না। বাড়িতে না জানি বাবামা-র কী অবস্থা! আমাকে এখুনি যেতে হবে।’

‘তুমি হিন্দমোটরে যাবে?’ ইমরান তাকাল, ‘যদি ওঁরা কিছু বলেন?’

‘যা বলবে মাথা পেতে শুনব।’ ঋতুপর্ণা দ্রুত প্রস্তুত হচ্ছিল, ‘বাবা-মা কী বলবে সেই ভয়ে তো আর এত বড়ো বিপদে বাড়ি বসে থাকতে পারি না?’

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরি হয়ে ও দরজা খুলতে যাবে, পেছন থেকে ইমরান ডাকল, ‘দাঁড়াও ঋতু!’

ঋতুপর্ণা পেছন ফিরতেই ইমরান ইতস্তত করে বলল, ‘আমি যাব তোমার সঙ্গে।’

‘তুমি যাবে?’ ঋতুপর্ণা বলল, ‘ কিন্তু আবার যদি ওরা তোমায় অপমান করে?’

ইমরান শিশুর মত হাসল, ‘করলে তোমার পলিসিই নেব। মাথা পেতে শুনব। আমি না গেলে তুমি একা সবদিক সামলে উঠতে পারবে না ঋতু। বাবা-মা-র শরীর এমনিতেই ভালো নয়।’

এই অবস্থাতেও ঋতুপর্ণা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ছুটে ইমরানের বুকে মুখ গুঁজল। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

ইমরান যেটা এই বয়সেই বুঝে গেছে, বাবা-মা কেন সেটা এখনও বুঝতে চাইছে না? সমাজ যে সংস্কার, যে ধর্মের মায়াকাজল পরিয়ে রেখেছে তাদের চোখে, সেগুলো কবে মুছে যাবে?

আগে তো মানুষ, আগে তো মানবিকতা। তার অনেক পরে ধর্ম!

ইমরান ওর পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বলল, ‘আর দেরি করা ঠিক হবে না। চলো। আমি নীচে গাড়ি বের করছি। তুমি তালা লাগিয়ে নেমে এসো।’

৪৭

ইমরান বেরিয়ে যাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।

গিয়ে দরজাটা খুলতেই বিস্ময়ে বরফের মতো জমে গেল ঋতুপর্ণা।

দরজার সামনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলোকপর্ণা। ওর আদরের ছোটু। ওর নিজের বোন।

দাঁড়িয়ে রয়েছে বলাটা ভুল হবে, নিজেকে একরকম ছেড়ে দিয়েছে দেওয়ালের কোণে। মনে হচ্ছে, সামান্য টোকা দিলে সে গড়িয়ে পড়ে যাবে।

ঋতুপর্ণা আবেগে থরথর করে কাঁপছিল। দু-বছর, পাক্কা দু-বছর পর ছোটুকে দেখল ও। কত রোগা হয়ে গেছে। ছোটোবেলায় ওর গালগুলো খুব ফোলা ছিল বলে ঋতুপর্ণা ওকে ফুলকো লুচি বলে খেপাত। সেই ফোলা গাল এখন অতিরিক্ত পরিশ্রমে তুবড়ে গেছে প্রায়। চুলগুলো অবিন্যস্ত। পরনের সালোয়ার কামিজটাও অপরিষ্কার, ওড়নাটা যেমন তেমন করে ফেলা রয়েছে পিঠের ওপর।

আলোকপর্ণার চোখ টকটকে লাল। ক্লান্তিতে কিংবা উত্তেজনায় বেশ হাঁপাচ্ছে সে। ওই অবস্থায় দরজার বাইরে থেকেই ও স্থির পাথরের মূর্তির মতো শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুই আমাকে ভিক্ষে দিচ্ছিস কেন?’

ঋতুপর্ণা চোখের জল সামলাতে সামলাতে বলল, ‘ভেতরে আয় ছোটু!’

‘না।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল আলোকপর্ণা, ‘তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে। আমি কি তোর কাছে ভিক্ষা চেয়েছিলাম? বলেছিলাম যে তুই যোগাযোগ না রাখলেও দূর থেকে কারুর হাত দিয়ে করুণা করবি? বলিনি তো! তবু তুই কেন এভাবে আমাকে, শুধু আমাকে নয়, বাবা-মা-কে অপমান করলি? বল। উত্তর তোকে দিতেই হবে।’

ঋতুপর্ণা কান্নায় ভেঙে পড়ল, ‘আমি তোদের অপমান কেন করব ছোটু! তুই কী করে ভাবলি সেটা! জিনিয়ার মামা বললেন তোর কাজ চলে গেছে সেইজন্য…!’

‘সেইজন্য তুই ভাবলি ভিক্ষা দেওয়ার এ এক মস্ত সুযোগ, তাই না!’ হিম গলায় বলে চলেছিল আলোকপর্ণা, ‘তোর এত বড়ো স্পর্ধা কী করে হল? জানি তুই খুব বড়ো চাকরি করিস, জানি তুই এক মাসে যত টাকা ওড়াস, তাতে আমাদের বছর চলে যায়। তো? তোর কাছে আমি চেয়েছি কখনো? বলেছি যে তুই যোগাযোগ না রাখলেও সময়মতো ভিক্ষাটা পাঠিয়ে দিস?’

‘তুই ভুল করছিস ছোটু!’ ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল ঋতুপর্ণা। কান্নার দমকে ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তবু ও বলে চলেছিল, ‘তুই ভুল করছিস! আমি আর ইমরান সেবার যেতে বাবা-মা যেভাবে অপমান …।’

‘বাবা মাকে শিখণ্ডী করে আর কতদিন নিজেকে ভালো দেখাবি তুই? রাতে যখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের অফিসের কথা বলতিস, মাঝে মাঝে চূড়ান্ত ফ্রাস্ট্রেশনে পড়েও চাকরি ছাড়তে না পারার যে কষ্টটা তখন ফিসফিস করে উগড়ে দিতিস, সেটা কি বাবা মাকে বলতিস?’ বলতে বলতে নিজের অজান্তেই গলাটা থরথর করে কাঁপতে থাকে আলোকপর্ণার।

অমানুষিক সংযম করে শক্ত গলায় কথা বলে চলেছে ও। কিন্তু মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সেই বাঁধ ভেঙে যাবে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দিদি। ওর নিজের দিদি। যে দিদির সঙ্গে ওর কেটেছে শৈশব, কৈশোর। যে দিদির সঙ্গে আদর ঝগড়া ভালোবাসা মাখামাখি করে বড়ো হয়েছে আলোকপর্ণা। যে দিদির সঙ্গে সামান্য কোনো কোথাও না ভাগ করে নিলে খাবার হজম হত না ওর। যে দিদির একের পর এক কৃতিত্বে ওর বুকের ভেতর এত আনন্দ হত, মনে হত সেই গৌরবের ভাগীদার ও নিজেও।

সেই দিদিকে ও দেখছে প্রায় দু-বছর পর।

ঋতুপর্ণা এবার জোর করে ভেতরে টেনে আনে ওকে। আলোকপর্ণা স্থিরচোখে ফ্ল্যাটটা দেখতে থাকে। সুন্দর, রুচিসম্পন্ন আসবাবে ভরতি ফ্ল্যাট। কোথাও এতটুকু মালিন্য নেই। কোথাও এতটুকু আতিশয্য নেই। অথচ ওয়াশিং মেশিন, এসি থেকে শুরু করে মাইক্রোওভেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, উপস্থিত রয়েছে সমস্ত রকম আধুনিক ও অত্যাধুনিক জিনিস।

ঋতুপর্ণা চেপে ধরে ওকে বসায় সোফায়। নরম গদিতে প্রায় ডুবে যেতে যেতে আলোকপর্ণা ভাবে, দিদি চাকরি পাওয়ার পর একবার ওদের সবাইকে কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই হোটেলের লবির সোফাগুলোও ছিল এইরকম। দুই বোনে তখন আলোচনা করে ঠিক করেছিল, এমন সোফা বাড়ির জন্য কিনবে।

হ্যাঁ। সত্যিই দিদি বাড়ির জন্য কিনেছে। কিন্তু এই বাড়ি সেই বাড়ি নয়। এটা দিদির বাড়ি। এখানে ওর কোনো জায়গা নেই।

ছোটোবেলায় মাঝে মাঝে মা বিরক্ত হয়ে বলত, ‘সারাক্ষণ দিদির গায়ে লেপটে বসে আছে। দিদি যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তখন কী করবি?’

‘দিদির শ্বশুরবাড়ি মানে আমারও শ্বশুরবাড়ি।’ অবোধ আলোকপর্ণা তখন ভাবত, দিদির সব সম্পত্তিই ওর। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিত, ‘আমিও দিদির সঙ্গে চলে যাব।’

দিদি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে এবার। কাঁদতে কাঁদতে কী বিড়বিড় করছে ও বুঝতে পারছে না। বোঝার ইচ্ছেও নেই। কাল অফিসে বসে যখন আবিষ্কার করেছিল, প্রতি মাসে ওর মাইনের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা দিদি দেয় জিনিয়াদিকে, সেই মুহূর্তে চারদিক অন্ধকার লেগেছিল ওর। মনে হয়েছিল তীব্র আক্রোশে সবকিছু তছনছ করে দিতে। নিজেকে মনে হচ্ছিল একটা অপদার্থ, একটা আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকা ভিখারি।

তারপর রাত পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে ও। কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। ট্রেন ধরতে হাওড়া এসেও শেষ মুহূর্তে ওঠেনি, বসে থেকেছে চুপচাপ। একভাবে ঠায় বসে থেকে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে হাওড়া স্টেশনেরই ওয়েটিং রুমে। নানা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভেবেছে আকাশ-পাতাল, কখনো যুক্তির কাছে হার মেনেছে আবেগ, কখনো আবেগ, দুঃখ, রাগ নিয়েছে সিংহাসন।

‘ছোটু, আমার দিকে তাকা!’ ঋতুপর্ণা চোখের জল মুছে জোর করে আলোকপর্ণার মুখটা চেপে নিজের দিকে নিয়ে আসে, ‘শোন। আমি তোর সঙ্গে অনেকবার কথা বলতে চেয়েছি ছোটু! বিশ্বাস কর। কিন্তু বাবা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন কোনোভাবেই তোর সাথে কোনো যোগাযোগ না রাখি। আমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে তোর নাকি বিয়ে হবে না।’

আলোকপর্ণা চমকে তাকায় দিদির দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।

‘আমার প্রচুর কষ্ট হত, ছোটু। বিশ্বাস কর। কতদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জেগে বসে থেকেছি, মনে হয়েছে কতদিন তোকে দেখিনি! কিন্তু বাবার ওই কথার জন্য চাইলেও তোর সঙ্গে কথা বলতে পারিনি ছোটু। তুই আমাকে ক্ষমা কর!’ ঋতুপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাচ্ছিল।

আলোকপর্ণা মনে মনে নিজেকে ধ্যানস্থ ঋষি ভাবতে থাকে। যে সব সংযম, জাগতিক সমস্ত আবেগ, ক্রোধ, শোকের ঊর্ধ্বে।

কিন্তু শত চেষ্টাতেও পারে না।

জীবনে সবচেয়ে যাকে ভালবাসত, এতদিন পরে সেই মানুষটার হাতের স্পর্শ ওকে সব ভুলিয়ে দেয়। সংযমের বাঁধন শিথিল হতে হতে ভেঙে পড়ে।

দমকা হাওয়ার মতো কেঁদে উঠে আলোকপর্ণা জড়িয়ে ধরে দিদিকে। কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলে, ‘আমাকে তো একবার ফোন করতে পারতিস? দেখতিস আমি কী বলি। বাবা-মা-ই তোর সব? আমি কেউ নই বুঝি?’

বাঁধ ভেঙে যায়। স্রোত এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় দু-জনকে।

নীচে গাড়ি বের করে ওপরে এসে এই দৃশ্য দেখে স্থবির হয়ে যায় ইমরান।

কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের উপস্থিতি জানান না দিয়েই সরে যায় ও।

৪৮

টুর শেষ হওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। গতকাল রাতে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের বাস এসে পৌঁছেছে সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন শহরে। মাঝের তিনদিন কেটে গিয়েছে ঝড়ের গতিতে। অ্যামস্টারডাম শহরে ক্যানাল ক্রুজ থেকে শুরু করে বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্য দিয়ে প্রায় দশ ঘণ্টা জার্নি। মাঝখানে বাস থেমেছিল জার্মানির কোলন শহরের বিখ্যাত কোলন ক্যাথিড্রালের সামনে।

সঞ্চিত বলেছিলেন জার্মানির এই বৃহত্তম ক্যাথিড্রাল গির্জাটি বানানো শুরু হয়েছিল ১২৪৮ সালে। শেষ হয় ১৮৮০ সালে। ছ-শো বত্রিশ বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে এই আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় গির্জা। গোটা জার্মানিতে বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বাবা-মায়েরা একটা গল্প বলে থাকেন। যে বাচ্চারা দুষ্টুমি করে, তাদের সান্টা ক্লজ এই কোলন ক্যাথিড্রালে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়ে আসে, তারপর এর দক্ষিণ দিকের স্তম্ভ থেকে নীচে ফেলে দেয়।

দুটো প্রকাণ্ড উঁচু স্তম্ভের একটা সারানো হচ্ছিল। তাই দেখে সঞ্জিত হেসেছিলেন, ‘আমি এই নিয়ে ত্রিশ বত্রিশবার এলাম লোন ক্যাথিড্রালে। সবসময়েই দেখেছি এর কোনো না কোনো অংশ সারানো হচ্ছে। স্বাভাবিক। যে গির্জা বানাতে ছ-শো বছর লাগে, তার মেরামতি তো সবসময়েই করতে হবে।’

আটশো বছরের পুরোনো অতিকায় ওই ক্যাথলিক গির্জায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাস আবার রওনা দিয়েছিল।

অবশেষে এসে পৌঁছেছে সবারই স্বপ্নের দেশ সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন শহরে।

এতক্ষণের ধকলে ক্লান্ত হলেও সবাই বেশ হৃষ্টচিত্তে রয়েছে।

অভীক, অনমিত্র, সৈকত, মৃগাঙ্ক চট্টরাজ থেকে শুরু করে সৌম্যজিত- মধুছন্দা, মধুমিতা-পিয়াসা, পরেশনাথ কুণ্ডু ও তার পরিবার, এমনকী উৎপল বিশ্বাসও অত্যন্ত খুশি। টুর শুরু হওয়ার সময় থেকেই প্রত্যেকের মনে একটা ভয়মিশ্রিত খটকা ছিল যে, এত কম টাকা অগ্রিম দিয়ে এতগুলো দেশ এত কম দিনে কভার করা কি সম্ভব?

খবরের কাগজে প্রায়ই চোখে পড়ে, কোনো অনামি ট্রাভেল এজেন্সি বিদেশ টুর করানোর নাম করে টাকা নিয়ে জালিয়াতি করেছে। এমনকী, বিদেশে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্ট হাতিয়ে কেটে পড়ার দৃষ্টান্তও কম নেই। তাই জিনিয়া প্রথম থেকে সবাইকে যতই আশ্বস্ত করুক, মনে একটা আশঙ্কা সকলের ছিলই। কিন্তু সব সন্দেহ হেলায় নিরসন করে দিয়েছে জিনিয়া ও তার দাশগুপ্ত ট্রাভেলস। হোটেল থেকে শুরু করে খাবারদাবার, যত্ন করে ঘরানো, এমনকী কার কখন ওষুধ, সেটাও মনে করিয়ে দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছে জিনিয়া।

তাই সবার মনে খুব আনন্দ। কেবল দু-জনের ছাড়া।

যাদবচন্দ্র ও আরতি।

দু-জনেই অতি ভদ্র, বারবার জিনিয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। সকলের সঙ্গেই ঘোরেন, বেড়ান, কিন্তু দু-জনের মুখেই খেলা করে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা। জিনিয়া বুঝতে পারে। কিন্তু বুঝতে পেরেও কিছু বলার থাকে না তার। ড ওবায়েদ হকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রয়েছে। তিনি একটা লোকের ফোন নম্বর দিয়েছেন। যার আশেপাশেই রাজীব সরকার এখন থাকে। জিনিয়া ঠিক করে রেখেছে ইটালিতে পৌঁছেই সেই নম্বরে ফোন করবে।

কিন্তু ওর টুর প্রোগ্রামে ইটালি রয়েছে একেবারে শেষে। ইটালির পিসা, ভেনিস, রোম দেখার পর রোম এয়ারপোর্ট থেকেই কলকাতার প্লেন ধরার কথা ওদের। তাই যাদবচন্দ্র ও আরতির জন্য যতই খারাপ লাগুক, ধৈর্য ওকে ধরতেই হবে।

সেদিন ওই ঝামেলার পর রৌণক এতবার ক্ষমা চেয়েছিলেন, সবাই বলেছিল এই যাত্রায় ওঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হোক। ফুলুমামা এমনকী সঞ্জিত হাজরাও ওকে বুঝিয়েছিলেন, অত বড়ো মানুষ যখন বারবার ক্ষমা চাইছেন, তাঁর যখন অনুশোচনা হয়েছে, তখন তাঁকে এই টুরের মাঝপথে বের করে দেওয়াটা ঠিক নয়। এতে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসেরই নাম খারাপ হবে।

কিন্তু জিনিয়া শোনেনি। ওর যুক্তি ছিল, কিছু অপরাধের কোনো ক্ষমা হয়না। রৌণক সাধুখাঁ কোনো বাচ্চা ছেলে নন, একজন মধ্যবয়সি উচ্চপদস্থ ব্যক্তি হিসেবে এইরকম জৈবিক কামনা তিনি নিশ্চয়ই আরও অনেক ক্ষেত্রেই চরিতার্থ করে থাকেন। হয়তো তাঁর অফিসেও অনেক মেয়ে এর শিকার হয়েছে। এই ধরনের স্বভাবলম্পট মানুষদের অনুশোচনাবোধ এত সহজে আসে না। রৌণক সাধুখাঁ-রও আসেনি, পরেশনাথ কুণ্ডু-র ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিতে তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন।

এই ধরনের মানুষদের দলে রাখা শুধু বিপজ্জনকই নয়, গোটা দলের পরিবেশটাকে খারাপ করে দেওয়া। নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা চিন্তা করেও তাই জিনিয়া কিছুতেই নরম হয়নি। অ্যামস্টারডামে পৌঁছে এয়ারপোর্টে মালপত্রসমেত নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল রৌণককে। সেখান থেকে তাঁর দেশের ফেরার টিকিট ও অন্যান্য কিছুর ব্যবস্থা জিনিয়ার নির্দেশে করেছিলেন সঞ্জিত হাজরা।

রৌণক আর একটাও কথা বলেননি। গম্ভীরমুখে চলে গেছিলেন।

জিনিয়া হোটেলে নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল।

বাইরে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। সাদা পালকের মতো অল্প অল্প বরফ পড়ছে। লুসার্ন শহরে এই হোটেলটা একটা বিশাল লেকের পাশে। লেকটার নামও লুসার্ন, লেকের নামেই শহরের নাম। লেকের ওপাশে পাহাড়, সবুজে ঘেরা চারদিক। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।

তিনতলা থেকে জিনিয়া দেখল, রাস্তায় একটাও লোক নেই। এমনিতে এই দেশের জনসংখ্যা খুবই কম, তার ওপর তুষারপাত হলে আনাগোনা আরও কমে যায়। দোকানপাট যে দুয়েকটা আছে, সেগুলোরও ঝাঁপ পড়ে গেছে। গোটা রাস্তার ওপর ধীরে ধীরে ঝিরিঝিরি সাদা বরফগুঁড়োর প্রলেপ পড়ে যাচ্ছে।

গোটা সুইজারল্যান্ড দেশটাতেই ছড়িয়ে রয়েছে শ্বাস বন্ধ করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আল্পস পর্বতের কোলের এই দেশে লেক রয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি। এই প্রতিটি লেকই পার্বত্য উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত, লেকের ধার বেয়ে উঠে গেছে পর্বত বা সবুজের সারি। এ ছাড়া আল্পস পর্বতের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হওয়া রাইন না ইনের মতো নদী পাহাড়ি গ্রাম বা শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে।

এই দেশের সবচেয়ে বড়ো লেকের নাম লেক জেনেভা, তারই পারে গড়ে ওঠা জেনেভা শহরে বছরের বেশিরভাগ সময় অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রসংঘ ও অন্যান্য নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার অধিবেশন। কিন্তু দাশগুপ্ত ট্রাভেলস জেনেভার দিকে যাবে না।

জিনিয়া নোটবুকে প্ল্যানের ওপর কলম চালাতে চালাতে ভাবছিল। সুইজারল্যান্ডে থাকার কথা দু-রাত। এই দুটো দিনে অনেক কিছু তাকে দেখাতে হবে। প্রথমেই কাল সকালে এখান থেকে বাস রওনা দেবে অ্যাঞ্জেলবার্গের দিকে। সেখান থেকে যাবে আল্পসের একটা উঁচু পর্বত মাউন্ট টিটলিসে। সেখানে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম রোপওয়ে চালু হয়েছিল। সেই রোপওয়ে করে যাত্রীদের নিয়ে যেতে হবে হিমবাহের কাছে।

টিটলিস ঘোরা হয়ে গেলে তার কাছেই একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্ট বুক করা রয়েছে, সেখান লাঞ্চ সেরে ফিরে আসবে লুসার্ন শহরে। এক এক করে দেখাবে লায়ন’স মনুমেন্ট, চ্যাপেল ব্রিজ।

তারপর সঞ্জিতের পরামর্শে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে লুসার্ন লেকে ভাসমান ক্রুজে।

লন্ডনে এসে ক্লিমেন্টের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা চলার সময়েই সঞ্জিত বলেছিলেন, ‘রোজই তো কোনো-না-কোনো রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ ডিনার করানো হবে ম্যাডাম, সুইজারল্যান্ডে বরং একটা ক্রুজ ডিনার রাখুন। কাস্টমাররা ক্রুজে বসে বাইরের বিউটি দেখবে, দূরের পাহাড় দেখবে, টেবিলেই সার্ভ করা হবে ডিনার। তারপর ক্রুজের ডেকেই চলবে সুইস মিউজিক, সেই সুরের তালে তালে নাহয় একটু কোমর নাচাবে লোকেরা। আহ! দেখবেন, পুরো জমে যাবে। আর এটা খুব ইউনিকও হবে।’

তা, সেই ‘ইউনিক’ করতে গিয়েই অনেকগুলো ইউরো বেরিয়ে যাচ্ছে। জিনিয়া ভাবতে ভাবতে ঠোঁট উলটোল।

যাকগে! আজকের দিনটায় আর এইসব টাকাপয়সার কচকচি করে লাভ নেই।

গতকাল গভীর রাতে মায়ের ঘন ঘন মিসড কল দেখে ও যখন উৎকণ্ঠিত হয়ে ফোন করেছিল, তখন মা ভার গলায় বলেছিল, ‘জন্মের পর এতগুলো বছর কেটে গেল। এই প্রথম জন্মদিনে তোকে পায়েস দিতে পারলাম না। পইপই করে বলেছিলাম, এই দিনটা পার করে টুরের ডেটটা ফ্যাল। শুনলি না এখনও। অবশ্য মায়ের কথা আর কোন যুগেই-বা শুনেছিস তুই!’

জিনিয়া হাসতে হাসতে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, ‘এখনও তো আমার জন্মদিন এখানে শুরু হয়নি, মা। রাত বারোটা বাজতে এখনো কিছুক্ষণ বাকি।’

‘তা তো জানিনা, বাপু!’ মা বলেছিল, ‘আমাদের এখানে সূর্য উঠে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। আমি এই স্নান করে বেরোবে তোর নামে মন্দিরে পুজো দিতে। যাইহোক, সাবধানে থাকিস। তাড়াতাড়ি সব মিটিয়ে ফিরে আয়।’

জিনিয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। সত্যি, সন্তান তার দায়িত্ব পালন করুক বা না করুক, বাবা-মা-র ভালোবাসা, স্নেহ সবসময় শর্তহীনভাবে বইতে থাকে। পৃথিবীশুদ্ধু কারুর মনে থাকুক আর না থাকুক, মায়ের কিন্তু ঠিক ওর জন্মদিন মনে আছে।

ওর হঠাৎ করে খুব মা-কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হল। মনে হল, কতদিন যেন মাকে ছেড়ে রয়েছে। ও বলল, ‘আমার প্রণাম নিয়ো মা। বাবাকেও দিয়ো। পায়েসটা বাড়ি গিয়ে খাব। রাখছি।’

ফোনটা রেখে ওর পরপর একগাদা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। গত বছরের জন্মদিনটা কেটেছিল খুব হইহই করে। অতন্দ্র আর ও, আর দুজনের বাবা-মা, সবাই মিলে চলে গেছিল পুরীতে। কোনো নামিদামি হোটেলে ইচ্ছে করেই ওঠেনি, সমুদ্রের কাছেই একটা হলিডে হোম নিয়েছিল, তাতে রান্নাবান্না করার ব্যবস্থা ছিল। সকালে হইহই করে বাজার করা হত, তারপর জমিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়া হত। তারপর সন্ধেবেলা কিছুক্ষণ সমুদ্রতীরে বসে থাকা বা জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়া। তারই মধ্যে ওর জন্য পায়েস বানিয়েছিল মা। আর অতন্দ্র এনেছিল কেক। ছিল মাত্র তিনদিন। কিন্তু আনন্দ হয়েছিল নিখাদ।

এক বছরে কত কী পালটে যায়। গতবছর ও চাকরি করত, এখন ব্যবসা। গতবছর সবাই একসঙ্গে মিলে কাটিয়েছিল জন্মদিন। আজ জিনিয়া একা।

না চাইতেও জিনিয়ার মনের কোনো গুপ্ত প্রকোষ্ঠ ওকে মনে করিয়ে দিল, গতবছর অতন্দ্র ওর জীবনে ছিল। ওরা দু-জন ছিল পাশাপাশি। আর এই বছর অতন্দ্র নেই।

ওদের দু-জনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে। চিরকালের জন্য।

জোর করে নিজের মনকে সরিয়ে আনল জিনিয়া। কাজে মন বসাতেই হবে ওকে। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসই এখন ওর সব। আচ্ছা ও অন্যভাবে কেন ভাবছে না? আগের বছর দাশগুপ্ত ট্রাভেলস ছিল না ওর সঙ্গে। কিন্তু এই বছর আছে। এ বছর থেকে ওর প্রতিটা জন্মদিনে, ওর নিশ্বাস প্রশ্বাসে জড়িয়ে থাকবে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস।

তাই যেন হয়। কর্মই মুক্তি।

ও কলমের আঁচড় টানল। সুইজারল্যান্ডে দ্বিতীয় দিনের সফরে ওরা এখান থেকে সোজা চলে যাবে ইনসব্রুক। কালকের দিনটা ইনসব্রুকে ঘুরে পরেরদিন ঢুকবে ইটালিতে।

প্রোগ্রামের প্রায় শেষে রয়েছে ইটালির পিসা শহর। যেখানে কিনা এখন যাদবচন্দ্র, আরতির সন্তান রাজীব সরকার রয়েছেন। জিনিয়া একটা নিশ্বাস ফেলল। কিছু করার নেই। গোটা টুরটাই ওঁদের এভাবেই বিষাদে কাটবে। তারপরেও যে সেই বিষাদ কাটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে জিনিয়া চেষ্টা করবে। মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করবে।

চিন্তার তাল কেটে গেল আকস্মিক ঘরের ইন্টারকম বেজে ওঠায়। জিনিয়া ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে সঞ্জিত হাজরার সহাস্য কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হ্যালো মালকিন, কী করা হচ্ছে একা একা রুমে বসে?’

জিনিয়া বলল, ‘কী ব্যাপার বলুন?’

‘ব্যাপার আর আমার কী ম্যাডাম!’ সঞ্জিত ওপাশ থেকে গদগদ কণ্ঠে বললেন, ‘ব্যাপার তো আপনার। বাস থেকে নেমে সেই যে নিজের রুমে ঢুকেছেন, আর পাত্তা নেই।’

জিনিয়া একটু বিরক্ত হল। এই সময়টা নিভৃতে ও একলা থাকতে চাইছিল। শুধুমাত্র নিজের জন্মদিন বলে নয়, টুরের সিংহভাগ সমাপ্ত, একটু হিসেবপত্রটা মিলিয়ে নিতে চাইছিল। দেশে ফিরে ব্যাঙ্কের অনেক কাজ রয়েছে।

কিন্তু সঞ্জিত আবার মনে হচ্ছে খেজুরে আলাপ শুরু করেছেন। কলকাতা ছাড়ার দিন এয়ারপোর্টে জিনিয়ার অমন কড়া কথার পর থেকে আর বেচাল কিছু করেননি। আসলে মানুষটাকে এখনও বুঝে উঠতে পারে না জিনিয়া। কখনো মনে হয় লোকটা শুধুই আদর্শে গড়া, নাহলে অত ভালো চাকরি প্রতিবাদ করে হেলায় ছেড়ে দিয়ে জিনিয়ার দু-দিনের কোম্পানিতে ইনভেস্ট করবেন কেন! ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে কাটানো সময়ের নস্টালজিয়ায় ডুবে এত বছর পর লখনৌ থেকে কলকাতা ফিরবেনই-বা কেন!

আবার কখনো মনে হয় এইসবের পেছনে অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই তো? তখন ওঁর সাধারণ কথাকেও বাঁকা মনে হয় জিনিয়ার। রসিকতার ঢঙে বলা কোনো লঘু কথাকে জটিলভাবে নিয়ে নেয় ও। আর তখনই ও নিজের ভেতরের টানাপোড়েনে জেরবার হতে থাকে।

জিনিয়া বলল, ‘আমি একটু ব্যস্ত আছি। মাথাটাও ধরেছে। ডিনার টাইমে নীচে যাচ্ছি। ওখানেই দেখা হবে।’

‘আরে, ডিনার তো এখনও অনেক বাকি ম্যাডাম!’ সঞ্জিত আজ যেন একটু বেশিই প্রগলভ হয়ে পড়েছেন, ‘সবে তো সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা। এতক্ষণ আপনার অপেক্ষায় থাকব কী করে! আপনি একবার আসুন না আমার রুমে। খুব জরুরি কথা আছে।’

‘এক্সকিউজ মি?’ জিনিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল। সঞ্জিত কি মদ্যপান করেছেন? সম্ভবত তাই, নাহলে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা হত না। একমুহূর্তের জন্য প্রচণ্ড রাগে ওর শরীর মন অবশ হয়ে এল।

রৌণক সাধুখাঁ হোক, অতন্দ্র গুপ্ত হোক কি সঞ্জিত হাজরা। সব পুরুষই কি সমান?

হয় লম্পট, নয় প্রতারক?

ও স্থিরগলায় বলল, ‘কী সব আবোল-তাবোল বকছেন? যা বলার আছে ডিনারে গিয়ে বলবেন। আমি এখন ব্যস্ত আছি।’

‘আমি অতক্ষণ ওয়েট করতে পারব না ম্যাডাম।’ অবুঝ শিশুর মতো বললেন সঞ্জিত হাজরা, ‘আমার আপনাকে খুব আর্জেন্ট একটা জিনিস বলার আছে। আপনি যদি একান্তই না আমার রুমে আসতে চান, আধ ঘণ্টার মধ্যে ডিনার রুমে আসুন। আর হ্যাঁ, প্লিজ কাম আলোন। ইট’স মাই হাম্বল রিকোয়েস্ট!’

জিনিয়া দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইল।

সঞ্জিত হাজরা আবার গাঢ় গলায় বললেন, ‘যদি না আসেন, বুঝব ইউ ডোন্ট কনসিডার মি অ্যাজ আ টিম!’

৪৯

বাইরে তুষারপাত থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। আকাশে তারাদের মিটমিট করে জ্বলতেও দেখা যাচ্ছে। তবে এরই মধ্যে রাস্তার ওপর পড়ে গেছে বরফের পুরু স্তর।

অন্ধকার রাতে দূরে যেখানে লুসার্ন হ্রদ গিয়ে মিশেছে রিউস নদীতে, তার ওপাশে দেখা যাচ্ছে চ্যাপেল ব্রিজের চূড়াটা। প্রায় সাতশো বছরের পুরোনো কাঠের সেতু, অথচ এখনও কতটা সুন্দর।

জিনিয়া তিনতলার ব্যালকনি থেকে সজলচোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরের রাস্তায় হোক, আশপাশের হোটেল, কোথাও কোনো মানুষ চোখে পড়ছে না। এই কনকনে ঠান্ডায় নেহাত পাগল ছাড়া কেউ খোলা ব্যালকনিতে বসে থাকে না। একটা হালকা সোয়েটার পরে বসে থাকতে থাকতে জিনিয়ার মনে হচ্ছিল, শৈত্যপ্রবাহ যেন ওর শরীর ভেদ করে ঢুকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে হাড়গোড়কে।

তবু ও নড়ছিল না।

সামনেই একটা ছোটো গির্জা। সন্ধে সাতটা বাজার ঢং ঢং আওয়াজ ভেসে আসছে সেই গির্জা থেকে।

ও হেরে যাচ্ছে। পুরোপুরি হেরে যাচ্ছে।

যেদিন বাবা-মা একজোট হয়ে বলেছিল চাকরি না ছাড়তে, সেদিন হারেনি। যখন একের পর এক ব্যাঙ্কে লোনের আবেদন বাতিল হচ্ছিল, তখনও হারেনি। এমনকী যখন অতন্দ্র ফোনে কেটে কেটে হুমকি দিয়েছিল, ওকে ছাড়া নাকি জিনিয়া এক পা-ও এগোতে পারবে না, সেদিনও হাল ছাড়েনি। বরং ওকে উচিত জবাব দেওয়ার জেদ চেপে বসেছিল মনের মধ্যে।

রৌণক সাধুখাঁর ওই কাণ্ডের পরও শান্ত অবিচল থেকেছিল নিজের লক্ষ্যে।

কিন্তু আজ ও উপলব্ধি করছে যে ও সত্যিই হেরে যাচ্ছে। হারতে হারতে তলিয়ে যাচ্ছে খাদের অতলে।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের আসল টিম ও, ফুলুমামা আর সঞ্জিত হাজরা। সেই টিমের একজন হয়েও যখন সঞ্জিত ওকে একটা রক্তমাংসের নারী ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেন না, জিনিয়া কি তবে ব্যর্থ নয়? পুরোপুরি ব্যর্থ। ব্যর্থ নিজের ইমেজ গড়ে তুলতে, ব্যর্থ নিজেকে ছেলে বা মেয়ের চেয়েও ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

লোকটার স্পর্ধা ভেবে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে জিনিয়া। তবে পরক্ষণেই ভাবছে, অবাক হওয়ারই-বা কী আছে। এগুলোই তো আসল মুখ। বরং দিনরাত যে সৌজন্যের মুখোশ পরে থাকে এই ধরনের পুরুষগুলো, সেটাই মিথ্যে।

তখন ফোন কেটে দেওয়ার পরেও সঞ্জিত বারদুয়েক ফোন করেছেন ইন্টারকমে। জিনিয়া ধরেনি, রিসিভার তুলে নামিয়ে রেখেছে পাশে। উন্মত্তের মতো সঞ্জিত এখন ফোন করে যাচ্ছেন ওর মোবাইলে।

‘বিবাহবিচ্ছিন্না’-র তকমা গায়ে লেগে গিয়েছে বলে কি ও এতই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে? কী করবে এখন ও? কী করা উচিত? ফুলুমামাকে ব্যাপারটা জানাবে?

পরমুহূর্তেই একটা অস্থির জেদ পেয়ে বসে ওকে। আর কত বছর মেয়েরা এইভাবে পুরুষের লালসার হাত থেকে বাঁচার জন্য পুরুষদেরই সাহায্যের অপেক্ষায় থাকবে? আর কবে পুরুষরা ভাবতে পারবে যে ছেলে মেয়ে এইসব বিভাজনের আগে প্রত্যেকে এক একটা মানুষ?

মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তোলপাড় হতে থাকে জিনিয়ার। ভাবনার এক পর্যায়ে এসে ও সব অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে। না, সঞ্জিত হাজরা যদি কোনো অসভ্যতা করেন, সেটার মোকাবিলা ও একাই করবে। তার জন্য ফুলুমামা বা অন্য কারুর প্রয়োজন নেই। রৌণক সাধুখাঁ ছিলেন ওর একমাত্র প্রিমিয়াম কাস্টমার, রৌণকের পেমেন্টটা ওর পুঁজির অনেকটা হিসেবে কাজ করেছিল। তেমন কাস্টমারকেও যখন এক তুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সঞ্জিত হাজরা তো অনেক দূরের ব্যাপার! চাই না ওর অভিজ্ঞ টুর ম্যানেজার। চাই না স্টেকহোল্ডার হতে এসে একটা কামুক প্রাণীর সাহচর্য। সবার আগে আত্মসম্মান।

শান্তভাবে ও নিজের ফোন থেকে সঞ্জিত হাজরাকে ফোন করে, ‘কী ব্যাপার! বারবার ফোন করছেন কেন আপনি?’

সঞ্জিত লঘু গলায় বলেন, ‘ফোন করছি কেন আপনি জানেন না, ম্যাডাম? কখন থেকে আপনাকে আসতে বলছি আমার রুমে! সাড়ে সাতটা বাজতে চলল। এরপর তো ডিনারের ডাক এসে যাবে।’

‘আসছি।’ স্থিরগলায় বলে জিনিয়া।

ফোনটা রেখে ও উঠে দাঁড়ায়। সোয়েটারের আস্তিনে মুছে নেয় চোখের জল। আজ দেখাই যাক না, সঞ্জিত হাজরার দৌড় কত পর্যন্ত। প্রয়োজন হলে ও আজ শেষ দেখে ছাড়বে।

সঞ্জিতের রুম পাঁচতলায়। লিফট থেকে নেমে লবি দিয়ে হাঁটতে থাকে ও। বুকের ভেতর দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ হচ্ছে ওর। সঞ্জিত যদি সত্যিই ওর সঙ্গে অশালীন কিছু করেন, ও তার উচিত শাস্তি দেবে। এইসব পাষণ্ডদের হাত থেকে বাঁচতে মেয়েদের বলা হয় রাতে বাড়ি থেকে একলা না বেরোতে।

কেন? অন্য কারুর অসুস্থতার দায় মেয়েরা নেবে কেন?

সঞ্জিতের রুমে পৌঁছোনোর ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে আবার ফোন করলেন সঞ্জিত, ‘শুনুন না, ম্যাডাম! এত ঠান্ডা, আমি লেপের তলা থেকে উঠতে পারছি না। দরজা খোলাই আছে। কাইন্ডলি নব ঘুরিয়ে চলে আসুন। বেল বাজাতে হবে না।’

লোকটার সাহস দেখে জিনিয়া হতবাক হয়ে যাচ্ছিল। আর ততই আসন্ন অজানা ভয়কে ছাপিয়ে প্রচণ্ড রাগ আর বিরক্তি এসে গ্রাস করছিল ওকে। মনে হচ্ছিল শরীরের সব শক্তি এক করে দুটো থাপ্পড় ওই লোকটার গালে কষাতে পারলে হয়তো ও একটু শান্তি পাবে।

ছি! মানুষ চিনতে কী ভুলই না করল ও। এই লোকটাকে ও কিনা আদর্শবাদী ভেবেছিল! ভেবেছিল সততার পরাকাষ্ঠা!

দাঁতে দাঁত চেপে নব ঘুরিয়ে সঞ্জিতের রুমে ঢোকে জিনিয়া। ভেতরটা নিকষ কালো অন্ধকার। বাইরের লবিতে খুব নীচু লয়ে বেজে চলা মিউজিক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

কী ব্যাপার? সঞ্জিত কি অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মদ্যপান করছেন?

জিনিয়া এক পা এগোয়, তারপর শান্তস্বরে বলে, ‘মি হাজরা, আপনি কোথায়?’

রাগ, বিরক্তি, দুঃখ সব মিলিয়ে একটা বিচিত্র বিষাদ এসে জড়ো হচ্ছিল ওর মনে। নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে আলো জ্বালাতে যাব, এমন সময় গোটা ঘরে এক উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল।

আর সমস্বরে সবাই গান গেয়ে উঠল, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, জিনিয়া!’

জিনিয়া এতটাই অবাক হয়ে গেল, যে মুহূর্তের অসতর্কতায় ফোনটা হাত থেকে খসে পড়ল মাটিতে।

এ কী! সঞ্জিত হাজরার গোটা ঘরটাই লোকে লোকারণ্য। মৃগাঙ্কবাবু থেকে শুরু করে উৎপল বিশ্বাস, পরেশনাথ কুণ্ডু, মধুছন্দা, মধুমিতা-পিয়াসা, মিনতি মাসিমা, ফুলুমামা, আকবর আলি কে নেই সেখানে!

ঘরের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় সাজানো হয়েছে একটা টেবিল, তার ওপর রয়েছে একটা বিশাল বড়ো কেক। গোলাকার কেকটার ওপরে ক্রিম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটা মেয়েকে। তার পরনে শাড়ি, হাতে ট্রলি। কেকের গায়ে লেখা রয়েছে ‘শুভ জন্মদিন’।

কেকের চারপাশে রাখা রয়েছে অজস্র মোমবাতি। সেগুলো একে একে লাগাচ্ছে উইশি। দূরে অভীক, অনমিত্র, সৈকত আর সৌম্যজিত মিলে বেলুন সাজাচ্ছে। ছোট্ট রোদ্দুরের ঠোঁটে বাঁশি, মাথায় রঙিন টুপি।

তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে বেলুনে ফুঁ দিচ্ছেন উৎপল বিশ্বাস। একটা করে বেলুন ফুলিয়ে রোদ্দুরের হাতে দিচ্ছেন, রোদ্দুর আবার চটজলদি সেটা সাপ্লাই করছে অভীকদের দিকে।

মিনতি মাসিমা, পরেশনাথ কুণ্ডুর স্ত্রী পামেলা আর পিয়াসা কাগজের ছোটো ছোটোপ্লেটগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন টেবিলে।

ঘরের বিছানায় হাসি হাসি মুখে বসে আছেন আরতি। যাদবচন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর পাশেই।

ফুলুমামা কেকের সামনে দাঁড়িয়ে কী-একটা করছিলেন, আর সঞ্জিত দাঁড়িয়েছিলেন সুইচবোর্ডের সামনে। বোঝাই যাচ্ছে, তিনিই আলোটা নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করা ও আবার আলো জ্বালানোর দায়িত্বে ছিলেন।

জিনিয়া নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এতসব আয়োজন ওর জন্য? ওর জন্মদিন বলে সারাদিন এত পরিশ্রম করে এসে সবাই মিলে এত কাণ্ড করেছেন? কিন্তু ও তো কাউকে বলেনি আজকের দিনটার কথা!

‘ধন্যি মশাই, আপনি!’ সঞ্জিত সামনে এসে হাত নাড়লেন, ‘একটু মজা করে আপনাকে ডাকছিলাম সারপ্রাইজ দেব বলে, আপনি এমন করছিলেন যেন আমি মাফিয়া গোছের কেউ, কিডন্যাপ-ফিডন্যাপ করে ফেলব। আপনার জন্য এতক্ষণ আমরা এই ঘরের মধ্যে কিলবিল করছি!’

জিনিয়া লজ্জায় সঞ্জিত হাজরার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ছি ছি, সঞ্জিত ওঁকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে এতবার ডাকছিলেন আর ও কী না কী ভেবে চলেছিল এতক্ষণ ধরে।

ও হতচকিতভাবে বলল, ‘আমি তো বুঝতেই পারিনি, আপনারা এইসব করছেন!’

‘আরে বুঝতে গেলে তো আসতে হবে, জিনিয়াদি।’ সৈকতের হাতে দুম করে একটা বেলুন ফেটে গেল, ‘তুমি তো আসতেই চাইছিলে না!’

উৎপল বিশ্বাস বেলুন ফোলাতে ফোলাতে বললেন, ‘আচ্ছা, জিনিয়া তো এসেই গেছে। এবার তাহলে কেকটা কেটে ফেলা হোক। তারপর ডিনার।’

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান!’ সঞ্জিত হাত তুলে থামালেন, ‘আগে গিফটটা দেওয়া হবে!’

‘আবার গিফট কেন!’ জিনিয়ার এবার বেশ লজ্জা লাগছিল। নিজের দেশ থেকে, নিজের কাছের মানুষগুলোর থেকে এত দূরে বসেও ও যে জন্মদিনে এত উষ্ণতা, এত ভালোবাসা পাচ্ছে, সেটা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

সঞ্জিত পিছিয়ে গেলেন। তারপর ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড পোশাক পরিবর্তনের যে ছোট্ট একটা রুম আছে, তার সামনে গিয়ে কাউকে ইশারা করলেন।

এরপর যে ঘটনাটা ঘটল, তার জন্য জিনিয়া একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। আকস্মিকতায় ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হল ও স্নায়ুর চাপ আর নিতে না পেরে পড়ে যাবে মাথা ঘুরে।

সঞ্জিতের ডাকে সাড়া দিয়ে কয়েক দিনের না কাটা দাড়ি আর অগোছালো চুল নিয়ে যে মানুষটা বেরিয়ে এল, তার স্ট্রাইপড কালো লাল ফুল হাতা টি-শার্টটা জিনিয়ার বড্ড চেনা।

গত বছর বিবাহবার্ষিকীর আগে এই টি-শার্টটাই ও নিজে পছন্দ করে কিনেছিল।

জিনিয়াকে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অতন্দ্র খুব কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করল। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। কোথা থেকে যেন ওর মতো শক্ত মনের ছেলের চোখে জল ছুটে আসছিল বর্ষায় বাঁধ ভেঙে যাওয়া নদীর স্রোতের মতো।

অনেক শহর, অনেক দেশ ঘুরে, অনেক পথ ছুটে অবশেষে এখানে এসে পৌঁছেছে ও। আনন্দে এইসময় ওর মাতোয়ারা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এক অব্যক্ত কষ্ট যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের শিরায় শিরায়।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া। সেই মেয়েটা, যাকে ও প্রথম দেখেছিল কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। সেই মেয়েটা, যার তাকানোতে হঠাৎই চারপাশে ফুটে ওঠে একশোটা গোলাপ।

যে হাসলে বাঁ-দিকে দেখা যায় একটা সাদা হিরের মতো গজদাঁত!

ক্লান্ত চোখ মেলে অতন্দ্র অস্ফুটে বলল, ‘কে-কেমন আছ জিনি?’

গত পাঁচ মিনিটে যে ভালোলাগাটা জিনিয়াকে আবিষ্ট করে ফেলেছিল, দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম ট্রিপের সকলে ওর জন্য যে এত কিছু করেছেন, সেটা ভেবে এক প্রচণ্ড বিস্ময়সুখে ও ডুবে যাচ্ছিল, তার বাঁধনটা যেন কেউ কর্কশহাতে টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

জিনিয়ার নিজের অজান্তেই হাসিটা মুখ থেকে উবে গেল। সেখানে জমা হতে লাগল রক্ত। কত কয়েক মাসের অপমানগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে রূপ নিল দলা দলা রাগের।

কঠিন মুখে ও বলল, ‘তুমি এখানে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *