৩০. দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম সফর

৩০

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম সফরের যাত্রীরা যখন লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁল, ঘটনাচক্রে ঠিক সেদিনই অতন্দ্র এয়ারপোর্টে এসেছিল একজন সহকর্মীকে রিসিভ করতে। কিন্তু জিনিয়াদের প্লেন যে টার্মিনালে ল্যান্ড করল, সেখান থেকে অতন্দ্র ছিল অনেকদূরে। তাই দেখা তো হলই না, নিজেদের মধ্যে এতটা কম দূরত্বের কথা দু-জনের কেউই জানতে পারল না।

জগৎ সংসার বড়োই বিচিত্র। স্বদেশ থেকে এত দূরে একই এয়ারপোর্টে দু-জনে এল, কিন্তু দেখা হল না।

হিথরো গোটা বিশ্বের অন্যতম বড়ো এয়ারপোর্ট। সারাদিন কয়েকশো প্লেন ওঠানামা করে এই এয়ারপোর্ট থেকে। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে অনেকটা পশ্চিমে হলেও ব্যস্ততার নিরিখে তালিকার একেবারে ওপরের দিকে রয়েছে এই এয়ারপোর্ট।

অতন্দ্র নির্দিষ্ট টার্মিনালের বাইরে অপেক্ষা করছিল। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড, তাতে লেখা ‘রবি বিশ্বকর্মা’।

অতন্দ্র লন্ডনে এসেছে প্রায় দু-সপ্তাহ হল। সেদিন অনিরুদ্ধ বসু-র সঙ্গে সেই মিটিং-এর পর আর্জেন্ট বেসিসে ওর বিজনেস ভিসা থেকে শুরু করে ফ্লাইটের টিকিট সবই প্রসেস করে দেওয়া হয়। তার ঠিক চারদিনের মাথায় কলকাতা থেকে প্লেনে চড়ে ও।

গোটা ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে একবার দুর্গাপুরের বাড়িতে দেখা করে আসার সময়টুকু অবধি পায়নি। এমনিতেই ইদানীং বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা অনেক কমিয়ে দিয়েছে, কথা হলেই জিনিয়ার প্রসঙ্গ আর ভালো লাগে না। তার ওপর এতদূর চলে যাচ্ছে তবু বাড়ি না যাওয়ায় মা বেশ অভিমান করেছে ওর ওপর। ফোন করলেই মুখ ভার করে কথা বলছে। অতন্দ্র ঠিক করে রেখেছে, দেশে ফিরেই আগে দুর্গাপুরে এক সপ্তাহের নিখাদ ছুটি কাটিয়ে আসবে।

লন্ডনে পা রাখার পর কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ও মাত্র দু-দিন কোম্পানির পয়সায় হোটেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিল। তার মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে খুঁজতে হয়েছিল থাকার জায়গা। বিজনেস ভিসায় কোম্পানির কাজে আসার জন্য দেশে ওর বরাদ্দ মাইনে ছাড়াও এই দেশের জন্য ওকে দৈনিক ভিত্তিতে ডিএ দেওয়া হবে। সেই ডি এ-তেই ওকে এদেশে থাকা-খাওয়া ইত্যাদি চালাতে হবে। বিশাল কিছু অঙ্কের না হলেও লন্ডনে মাঝারি মানের ঘর তাতে ভাড়া নেওয়াই যেত। কিন্তু ও ইচ্ছে করেই ব্যস্ত লন্ডনের বুকে ঘর খোঁজেনি।

টেকি ওয়ার্ল্ডের ওর এক সহকর্মী থাকত রিচমন্ডের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। তার নাম অরিত্র। অরিত্রর অন্য প্রোজেক্ট হলেও কলকাতায় অতন্দ্রর সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল বেশ। ভাগ্যক্রমে অতন্দ্র আসার আগে আগেই অরিত্রর এখানকার কাজ মিটিয়ে দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছিল। অতন্দ্র আগে থেকেই ফোনে অরিত্রর থেকে রিচমন্ড জায়গাটার অনেক প্রশংসা শুনেছিল। তাই আর বেশি কিছু না ভেবে ও এসে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে অরিত্রর ঘরটাই দখল করেছিল। ঘরটায় খাট, ফ্রিজ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে, ফলে সেগুলো নিয়েও কোনো ঝক্কি পোহাতে হয়নি ওকে।

রিচমন্ড খোদ লন্ডনে নয়, লন্ডন থেকে ট্রেনে প্রায় চল্লিশ মিনিট দূরের এক মফস্সল। অতন্দ্র রিচমন্ডে প্রথম দিন এসেই বুঝেছিল অরিত্রর একটা কথাও অতিশয়োক্তি নয়। চারপাশে সবুজের সমারোহে ফুসফুস যেন সতেজ হয়ে ওঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

টেমস নদী রিচমন্ডের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে। ফলে এখানে জন্ম নিয়েছে প্রচুর পার্ক, খোলা জায়গা আর চোখ জুড়োনো লেক। এমনকি রয়েছে রিচমন্ড হিল নামের ছোট্ট পাহাড়ও। সেই ঘন সবুজে ঢাকা পাহাড় গিয়ে নিশ্বাস ফেলছে রাজপ্রাসাদের গায়ে।

রাজা সপ্তম হেনরি ষোড়শ শতাব্দীতে এই জায়গার অপরূপ নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য তৈরি করেছিলেন রিচমন্ড প্যালেস। সেই প্রাসাদের নামেই নামকরণ হয় এই অঞ্চলের। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তো বটেই, এখানকার জনসাধারণও রিচমন্ডের সৌন্দর্য অব্যাহত রাখতে অত্যন্ত সচেতন। রিচমন্ডের ছোটো বড়ো সবরকম রাস্তাই ঝকঝকে, কোথাও এককণা আবর্জনা অতন্দ্র এসে থেকে পড়ে থাকতে দেখেনি।

এখানে আসার পর থেকে অতন্দ্রর জীবন এই কয়েক দিনেই আমূল বদলে গেছে। এখানে না আছে মঙ্গলাদি-র রান্না, না আছে অন্য কোনো কাজের লোক। সকাল থেকে উঠে ওয়াশিং মেশিনে জামা কাচা থেকে শুরু করে ব্রেকফাস্ট বানানো, সব একা হাতে করতে হয় ওকেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিয়ের পরের এই কয়েক বছর জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিলে ও যেন আবার সেই মেসে থাকার জীবনেই ফিরে গেছে। ব্রেকফাস্ট সেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে লন্ডন যাওয়ার ট্রেন ধরে ও। পৌঁছে যায় চল্লিশ মিনিটেই।

অফিস থেকে বেরোয় ঠিক বিকেল পাঁচটায়। তারপর কোনোদিন শহরেরই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, কোনোদিন আবার কিছুই ভালো লাগে না, তাড়াতাড়ি ফিরে আসে রিচমন্ডের ঘরে। শান্ত নির্জন ঘরে একা শুয়ে শুয়ে ভাবে, এখানে ওদের দু-জনের আসার কথা ছিল, অথচ ও চলে এল।

আর এল সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে।

যেদিন জিনিয়াকে ভীষণ মনে পড়ে, সেদিন আবার কিছুই ভালো লাগে না। ইন্টারনেটে খেলা দেখা, কিংবা কোনো মুভি, ওয়েব সিরিজ দেখা, সবই বিরক্ত লাগে। মনে হয়, একজন মানুষের জীবনে সুখী হতে গেলে অর্থ ছাড়াও লাগে ভালোবাসা। সেটা ওর জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

ব্রিটলস ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর লন্ডন শহরের একদম প্রাণকেন্দ্রে, সেখানে আপাতত ওর সঙ্গে ব্যাঙ্কের শীর্ষস্থানীয় কর্তাদের মিটিং শিডিউল করা হয়েছে।

কিন্তু সেই মিটিং-এর এখনও এক সপ্তাহ দেরি। আপাতত অতন্দ্রর নিজের ডেভেলপ করা টুলটা ব্যাঙ্কের নিজস্ব সফটওয়্যারে ইন্টিগ্রেট করার জন্য ওকে রোজই যেতে হচ্ছে ব্রিটলস ব্যাঙ্কের হেড কোয়ার্টারে। ইন্টিগ্রেশন ঠিকমতো হওয়ার পর কয়েকদিন ইউজার অ্যাক্সেপ্ট্যান্স টেস্ট করতে হবে, তারপর বিটা ভার্সনে রান করিয়ে দেখতে হবে ঠিক আছে কি না।

অনিরুদ্ধ স্যার গোটা বিষয়টা নিয়ে যে প্রচণ্ড টেনশনে রয়েছেন, তা অতন্দ্র বুঝতে পারে। দিনে দু-বার উনি ফোন করেন, ব্রিটলসের সফটওয়্যারে অতন্দ্রর টুল কেমন রেসপন্ড করছে জিজ্ঞাসা করেন। বার বার বলেন, অতন্দ্রর ওপর অত বড়ো প্রোজেক্টটার ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে।

টেনশনে রয়েছে অতন্দ্রও। মানসিক টানাপোড়েনের মাঝে নিজের ভালো মাইনের চাকরি বাঁচাতে এটাই শেষ রাস্তা ওর। জিনিয়া জীবন থেকে চলে গেলেও তো ওর জীবন থেমে থাকছে না। এখন চাকরি চলে গেলে ও অকল্পনীয় বিপর্যয়ে পড়বে।

অতন্দ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে প্ল্যাকার্ড থাকলেও সেটার খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। রবি বিশ্বকর্মার সঙ্গে আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর পরিচয় হয়ে গেছে। আইটি সেক্টরে কেউ কাউকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতেও আসে না। কিন্তু আজ ছুটির দিন। অতন্দ্র ফাঁকাই ছিল। কী মনে হল, তাই চলে এসেছে।

হঠাৎ অজানা একটা নম্বর থেকে অতন্দ্রর ফোনে কল ঢুকতে লাগল। ভারতবর্ষের নম্বর। অতন্দ্র বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে গীতিকার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘অতন্দ্রদা!’

অতন্দ্র অবাক হয়ে বলল, ‘গীতিকা? বল। কেমন আছিস?’

‘চলে যাচ্ছে।’ গীতিকা বলল, ‘তুমি কেমন আছ? কেমন লাগছে নতুন দেশ, নতুন শহর?’

অতন্দ্রর হঠাৎ মনে পড়ল, শেষ কয়েকদিন এমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সবকিছু ঘটে গেল, ব্রিটলস ব্যাঙ্কের সফটওয়্যারে টুলটা সেট আপ করার জন্য ব্রিটলস ব্যাঙ্কের প্রোজেক্ট থেকে কেটি নেওয়া থেকে শুরু করে ভিসা অফিসে বায়োমেট্রিক, সবকিছুর ডামাডোলে ও চলে আসার আগে গীতিকার কোনো খোঁজই নিয়ে উঠতে পারেনি কারুর কাছে।

আর নিজের জীবনে চূড়ান্ত টানাপোড়েনের জন্যই হয়তো গীতিকা সেই ব্যাপারটার পর থেকে অফিসে বেশ অনিয়মিত ও দায়সারা হয়ে পড়েছিল। উচ্ছল প্রাণবন্ত ভাবটা তো চলে গেছিলই, কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব এসে গেছিল ওর মধ্যে। অতন্দ্র প্রোজেক্ট থেকে রিলিজ হয়ে যাওয়ার ফলে এখন সায়ক, নবনীতা আর গীতিকার সুপারভাইজারও পালটে গেছে। আই টি-র দুনিয়ায় সবাই এত ব্যস্ত থাকে যে রিলিজ হয়ে গেলে খুব কমই যোগাযোগ থাকে।

তবু গীতিকার কণ্ঠস্বর শোনামাত্র অতন্দ্রর মনে একটা অপরাধবোধ এসে গ্রাস করল। ওর মনে হল, গীতিকার সেই প্রচণ্ড বিপর্যয় ও মানসিক চাপের সময়ে জিনিয়ার ওইসব বলাতে পরোক্ষভাবে তারও একটা ভূমিকা থেকে যায়। মাঝে বেশ কয়েকবার ও ফোন করলেও অতন্দ্র রিসিভ করেনি।

আসার আগে অন্তত একবার গীতিকার খবর নেওয়া উচিত ছিল।

অতন্দ্র বলল, ‘ওই চলে যাচ্ছে। দেশ দেখার এখনও তেমন সময় পাইনি। ব্রিটলস থাকবে, না ওমনিসফট নিয়ে চলে যাবে, তাই নিয়ে দিনরাত টেনশনে রয়েছি।’

‘হুম। শুনলাম।’ গীতিকা ফোনের মধ্যেই হাই তুলল, ‘সেদিন নবনীতা ফোন করেছিল। তখনই বলল।’

‘ফোনে বলল মানে?’ অতন্দ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘তুই অফিস যাচ্ছিস না?’

গীতিকা আবার একটা বিশাল হাই তুলল। তারপর বলল, ‘ইচ্ছে হলে যাই। ওই ধরো, সপ্তাহে একদিন। তাও ক্যাফেটেরিয়াতেই থাকি। কফি খাই।’

‘এ আবার কী! নতুন সুপারভাইজার এসেছে, এরকম করলে সে তো দু-দিনের মধ্যেই ম্যানেজারকে রিপোর্ট করবে।’

‘অলরেডি করেছে। তবে তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না।’ গীতিকা বলল, ‘আমার অফিস যেতে ইচ্ছেই করেনা অতন্দ্রদা।’

অতন্দ্র বলল, ‘এরকম করলে কী করে চলবে! তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু কাজের মধ্যে থাকলে বরং ভাল থাকবি। এভাবে …!’

‘আমার কথা ছাড়ো।’ গীতিকা তড়িঘড়ি কথা ঘুরিয়ে দিল, ‘আমি তো তোমার লন্ডনের এই নম্বরটা জানতাম না, কৌশিকদাকে ফোন করে জোগাড় করলাম। একটা কথা বলতে তোমায় ফোন করেছি।’

‘কী, বল?’ অতন্দ্র বলল।

গীতিকা একটু থেমে বলল, ‘কাল আমাকে মাঝরাতে জিনিয়াদি ফোন করেছিল।’

‘ক-কে ফোন করেছিল? জিনিয়া?’ অতন্দ্রর মনে হল, ওর হৃৎপিণ্ডটা ধক করে লাফিয়ে উঠল। জিনিয়া এতদিন পর আবার গীতিকাকে ফোন করেছিল? কিন্তু কেন? একবার অপমান করে মিথ্যা দোষারোপ করেও ওর কি আশ মেটেনি?

‘হ্যাঁ। জিনিয়াদি।’ গীতিকা ভাবলেশহীন গলায় বলে গেল, ‘আমি ঘুমোচ্ছিলাম তখন। শুনতে পাইনি। সকালে উঠে রিংব্যাক করছি। কিন্তু ফোনে আর পাচ্ছি না। বলছে সুইচড অফ। তাই ভাবলাম তোমাকে একবার জানাই।’

হতভম্ব অবস্থায় টুকটাক কথা বলে ফোন রাখতে-না-রাখতেই ছোটোখাটো, মিষ্টি মুখের কালো ছেলেটাকে করিডর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখল অতন্দ্র।

দেখেই চিনতে পারল ও। রবি বিশ্বকর্মা এসে গেছে। এই ছেলেটা চেন্নাই ব্যাঙ্কিং ডোমেনের নাকি খুব ভালো একজন টেস্টার। কোনো নতুন টুল একটা সফটওয়্যারে ইন্টিগ্রেট করার পর সফটওয়্যারটা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, কোনো ভুল ত্রুটি হচ্ছে কি না, সেগুলো টেস্ট করে ডিফেক্ট বা বাগ বের করাই টেস্টারের কাজ। অনিরুদ্ধ স্যার গ্লোবাল টিমের সঙ্গে কথা বলে রবিকে এখানে পাঠিয়েছেন অতন্দ্রর টুলটা বিটা ভার্সনে টেস্টিং-এর জন্য। লাইভে যাওয়ার আগে যে ভার্সনে শেষ মুহূর্তের ভুল ত্রুটি দেখে নেওয়া হয়, সেটাই বিটা ভার্সন।

রবিও অতন্দ্রকে চিনতে পেরেছে। হাসিমুখে এসে ওর সঙ্গে করমর্দন করে দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারণের ইংরেজিতে বলল, ‘হাই অতন্দ্র! আমি রবি।’

‘হ্যালো।’ অতন্দ্র স্বাভাবিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল রবিকে, ‘লন্ডনে স্বাগত। অবশ্য আমি এখানে তোমার থেকে মাত্র ষোলোদিনের পুরোনো।’

রবি বলল, ‘হা হা! তাহলে আমিই তোমাকে নাহয় ওয়েলকাম করি। আমি কয়েকমাস আগেই এখান থেকে দেশে ফিরেছি। তার আগে পাক্কা দু-বছর ছিলাম।’

‘ও বাবা।’ অতন্দ্র পা চালাতে চালাতে বলল, ‘তাহলে তো তুমি এখানকার সবকিছুই চেনো।’

‘বলতে পারো। তখন এখানে ফ্যামিলি নিয়ে ছিলাম তো, ভালোই ঘুরেছি।’ রবি বলল, ‘বাই দ্য ওয়ে, বাসু স্যার বললেন, তোমার টুলটা নাকি খুব এফিশিয়েন্ট?’

‘সেটা আমি কী করে বলি বলো তো। লজিক্যালি এফিশিয়েন্ট, কিন্তু শেষ কথা বলবে ব্রিটলসের কাস্টমাররা।’

রবি মাথা দোলায়, ‘হুম। তুমি এখানে কোথায় থাকছ?’

অতন্দ্র বলল, ‘আমি লন্ডনে থাকি না। রিচমন্ডে থাকি।’

‘অত দূরে?’ রবি চোখ কপালে তুলল, ‘কেন? শুধুশুধু এই কয়েক দিনের জন্য এতক্ষণ ধরে যাতায়াত করো কেন?’

অতন্দ্র সামান্য হাসল, ‘আমার ওইদিকটা ভালো লাগে। ফাঁকাফাঁকা, সবুজে ঢাকা, পাহাড়, লেক, সব মিলিয়ে খুব সুন্দর জায়গা। ট্রেনে চলে আসি রোজ। অসুবিধা হয় না খুব একটা।’

রবি বলল, ‘তুমি তো বেশ প্রকৃতিপ্রেমিক দেখছি! কবিতা-টবিতাও লেখো নাকি?’

অতন্দ্র হেসে চুপ করে গেল। প্রত্যেক বাঙালি ছেলেই কবি হোক না হোক, জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ার সময় কবিতা লিখেছে। অতন্দ্রও ব্যতিক্রম নয়। জিনিয়ার সঙ্গে প্রথম দেখার দিনগুলোতে তখনও মোবাইল ফোন এত সুলভ ছিল না। প্রতিটা বাড়িতে তখন ছিল একটা করে ফোন। তখন সারা সপ্তাহ শেষে শনিবার অতন্দ্র ফিরত দুর্গাপুরে নিজের বাড়িতে। আর শনিবার রাতে সেই পারিবারিক মোবাইল ফোন থেকে মেসেজ পাঠাত জিনিয়াকে।

তখন একটা মেসেজে কাটত মোটা টাকা, তখনও যথেচ্ছ ফোন, মেসেজের রমরমা শুরু হয়নি। তাই রাত জেগে কথা বলার উপকরণ আর অর্থ কোনোটাই ছিল না।

অতন্দ্র সেই মেসেজে একটা করে কবিতা লিখে পাঠাত জিনিয়াকে। খুবই মোটা দাগের কবিতা। ছন্দের মাথামুন্ডু থাকত না, তবে যাহোক তাহোক করে অন্ত্যমিল করে ফেলত। আর মিলে গেলেই ভাবত বিশাল কিছু লিখে ফেলেছে।

এখন সেই লাইনগুলো ভাবলে হাসি পায়।

অথচ পরে জিনিয়া বলেছে সেই সাপ্তাহিক অণুকবিতার জন্যই নাকি ও অপেক্ষা করে থাকত সারাটা সপ্তাহ।

জিনিয়া কেন ফোন করেছিল গীতিকাকে? কী উদ্দেশ্য ছিল ওর? আজ কতদিন হল জিনিয়াকে ও দেখেনি, তবু সারাক্ষণ ওর ছবিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেন?

রবির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই অতন্দ্রর মনে বহু বছর পর একটা স্বভাবকবিতা গুনগুনিয়ে উঠল।

পোড়া মনে, মনে পড়ে

তোকে বারেবারে

সব পুড়ে হয়েছে ছাই

তবু ফিরে পেতে চাই

হারিয়েছি যা

আজ আর করিনা লজ্জা

চেয়েছি তোকে মন থেকে

পোড়া মনে, মনে পড়ে তাই তোকে!

৩১

অম্বিকেশ সকলের আগে এয়ারপোর্টের একেবারে বাইরে বেরিয়ে এলেন। জিনিয়া কলকাতা থেকে যে বাস কোম্পানির সঙ্গে ইমেলে কনট্র্যাক্ট করেছিল, তারা জানিয়েছিল হিথরো এয়ারপোর্টের বাইরে পার্কিং-এর জায়গায় বাস দাঁড়িয়ে থাকবে। বাসের নম্বর, বাসচালকের নাম, নম্বর সব তারা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল।

জিনিয়া যেহেতু সমস্ত যাত্রীদের ইমিগ্রেশনে সাহায্য করছিল, ও বলেছিল, ‘ফুলুমামা, তুমি আগে বেরিয়ে গিয়ে বাসটাকে দ্যাখো তো পাও কি না!’

অম্বিকেশ যুবক বয়সে গ্লোবাল ট্যুরসে বেশ কয়েকটা টুরে টুর ম্যানেজারকে সাহায্য করলেও এতদিন পরে আসার জন্যই বোধ হয় কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। তা ছাড়া গ্লোবাল টুরসে এত বছর ধরে খালি অফিসটাই সামলে এসেছিলেন। আমতা আমতা করে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে, যদি না আসে, এতজনকে নিয়ে কী করবি?’

জিনিয়া হেসে বলেছিল, ‘কী যে বল। ফিফটি পারসেন্ট আগেই অ্যাডভান্স করে দিয়েছি। বাকিটা দিতে হবে টুর শুরুর তিনদিনের মধ্যে। আসবে না মানে!’

অম্বিকেশকে বেশি খুঁজতে হল না। পার্কিং লটে অসংখ্য গাড়ি পিঁপড়ের মতো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাস বারো পনেরোটার বেশি ছিল না। আর প্রতিটা বাসের সামনেই কোনো-না-কোনো ট্রাভেল এজেন্সিরর নাম, টুর ম্যানেজারের নাম ও হেড অফিসের সংক্ষিপ্ত ঠিকানা বড়ো করে লাগানো।

অম্বিকেশ বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, সেগুলোর মধ্যে প্রায় সত্তর ভাগই ভারতীয় টুর কোম্পানি। কোনোটা মুম্বাইয়ের, কোনোটা দিল্লির, কোনোটা আবার পুনের। সেগুলো ছাড়া যে ক-টা অন্য দেশের টুর এজেন্সির নাম রয়েছে, সেগুলোর সবকটাই প্রায় চীন দেশের।

এই চিত্র থেকে কি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে ভারতীয় আর চীনারাই সবচেয়ে বেশি বিদেশ ঘোরে? অম্বিকেশ মনে মনে ভাবলেন। সার দিয়ে দাঁড়ানো বাসগুলোর মধ্যে পাঁচ নম্বর স্থানে জ্বলজ্বল করছে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস, সঞ্জিত হাজরার নাম আর জিনিয়ার লেকটাউনের অফিসের ঠিকানা। দেখে অম্বিকেশের মনের ভেতরটা একমুহূর্তের জন্য গর্বে ভরে গেল।

কথায় আছে বাঙালির পায়ের তলায় সরষে, কিন্তু সেটা বোধহয় বিদেশ ভ্রমনের জন্য এখনও অতটা প্রযোজ্য নয়। দেশের মাটিতে রাজস্থান থেকে কেরালা, কাশ্মীর থেকে ত্রিপুরা, বাঙালি যতই ঘুরুক, গ্লোবাল টুরসের এত বছরের অভিজ্ঞতায় অম্বিকেশ দেখেছেন, কলকাতা শহর থেকে যারা বিদেশ ভ্রমণের প্যাকেজ যারা বুক করতেন, তাঁরা হয় অবাঙালি, অথবা সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ। অথচ গ্লোবাল টুরসের মুম্বাই বা নাগপুর শাখায় কিন্তু অনেক চাকরি করা মধ্যবিত্ত কাস্টমারও পাওয়া যেত।

অম্বিকেশ ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ লেখা বাসের দিকে এগিয়ে গেলেন। অত্যন্ত সুদৃশ্য ঝকঝকে একখানা বাস। অবশ্য এসব দেশের সবই মনে হয় ঝকঝকে, ছবির মতো।

একজন অন্তত সাড়ে ছ-ফুট লম্বা, টকটকে ফর্সা লোক বাসের প্রথম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। চওড়া বুকের ছাতি, পেটানো শরীর, মাথা সম্পূর্ণ তেলা, একটাও চুল নেই। এই ঠান্ডাতেও গায়ে সাধারণ একটা সাদা টি শার্ট আর নিম্নাঙ্গে জিনস। হাত দুটোকে সামনের দিকে জড়ো করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চুইং গাম চিবোচ্ছিল সে। গলায় ঝুলছিল বাস কোম্পানির পরিচয়পত্র।

জিনিয়া ই-মেলের একটা কপি দিয়ে দিয়েছিল, অম্বিকেশ সেটা দেখাতেই লোকটা মাথা নেড়ে হাত বাড়িয়ে দিল।

মিনিট দশেক পরে জিনিয়া আর সঞ্জিত যখন উনিশজন যাত্রীকে নিয়ে বাসের সামনে এসে পৌঁছোলেন, ততক্ষণে বাসচালকের সঙ্গে অম্বিকেশের আলাপ পরিচয় হয়ে গেছে। লোকটার নাম ক্লিমেন্ট। ক্লিমেন্টের আসল বাড়ি ইটালির মোদেনা শহরে। যে বাস কোম্পানির সে ড্রাইভার, সেই কোম্পানি গোটা ইউরোপে পর্যটকদের ঘোরানোর ব্যবস্থা করে। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের মতো বিভিন্ন টুর কোম্পানি এদের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট করে নিজেদের যাত্রীদের ঘোরায়। টুর চলাকালীন ক্লিমেন্টের খাওয়া-দাওয়া, রাতে হোটেলে থাকার দায়ভার বহন করে ট্রাভেল এজেন্সিই। মাসে এইরকম দুটো টুর করে ক্লিমেন্ট। যে পাঁচ ছ-দিন ছুটি পায়, তাতে বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে তার সঙ্গিনী আছে। সে কলসেন্টারে কাজ করে।

অম্বিকেশ বেশ আগ্রহ সহকারে ক্লিমেন্টের সঙ্গে গল্প করছিলেন। ক্লিমেন্টের ইংরেজি উচ্চারণ ভালোই বোঝা যায়। তা ছাড়া ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ানদের ইংরেজি অ্যাক্সেন্ট আমেরিকানদের মতো অতটা জড়ানো নয়। কথা বলতে বলতে জিনিয়াদের আসতে দেখে নিজের অজান্তেই অম্বিকেশ কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন।

জিনিয়া হাঁটছে। তার পাশেই হেঁটে আসছে মিনু। অম্বিকেশ একঝলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন।

কলকাতা এয়ারপোর্টে যখন থেকে মিনুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখন থেকে যখনই ভাবছেন, অপার বিস্ময় এসে গ্রাস করছে অম্বিকেশকে। সত্যি, এমনও হয়? চল্লিশ বছর ধরে যে মুখটা দেখার জন্য কারণে অকারণে ছুটে গেছেন কোন্নগরে, কতবার কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় কিংবা শ্যামবাজারের ব্যস্ত ফুটপাথে কোনো মেয়েকে পেছন থেকে বা পাশ থেকে দেখে ছুটে গিয়ে নিরাশ হয়েছেন, সেই মিনুর সঙ্গে এইভাবে দেখা হবে, অম্বিকেশ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন?

মিনু কিন্তু খুব সহজভাবেই এগিয়ে এসেছিল। একসময়ে ওর যে ভ্রূ দুটো সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো আঁকা থাকত, কালের নিয়মে সে-দুটো এখন অনেক পাতলা। কিন্তু তবু মিনু যখন সেই ভ্রূ দুটো অনেকটা উঁচু করে তুলে বলেছিল, ‘এ কী! ফুলু তুই!’ অস্বীকার করে লাভ নেই, সেই বয়ঃসন্ধির সময়ের মতো আজও অম্বিকেশের বুকটা কেমন কেঁপে উঠেছিল।

প্লেনে চড়ার কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত মিনু সহজ গলায় অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে গেছে। অম্বিকেশের বাবা-মা। বুড়িদি-র বাবা-মা কালীচরণ মেসোমশাই আর গোপা মাসিমা। কেউই আর বেঁচে নেই শুনে দুঃখ প্রকাশও করেছে। জিনিয়া বুড়িদির মেয়ে জেনে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিতও হয়েছে।

অম্বিকেশ তখনও আড়ষ্টতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবু বলেছিলেন, ‘তোর বর যে … মানে আমি জানতামই না দুর্ঘটনার খবর!’

‘ওসব ছাড়।’ মিনু সামান্য হেসে বলেছিল, ‘অনেকদিন হয়ে গেল। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। তোর ছেলেমেয়ে ক-টা?’

অম্বিকেশ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছেন, স্কুলজীবনে মিনু যখন স্কুলের টিউনিকে দু-কাঁধে বিনুনি দুলিয়ে ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করত, তখন উত্তর দিতে গিয়ে অম্বিকেশের জিভ যেমন জড়িয়ে যেত, এখন ততটা না হলেও অম্বিকেশ থেকে থেকে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। মিনুর প্রশ্নের উত্তরে অপ্রতিভভাবে বলেছিলেন, ‘ছেলেমেয়ে? ছেলেমেয়ে তো নেই। বিয়েই তো করিনি!’

 মিনু অবাক হয়ে বলেছিল, ‘ ওমা! বিয়ে করিসনি?’

এরপর আর কথা এগোয়নি। প্লেনে অম্বিকেশের সিট ছিল একেবারে প্রথমদিকে, আর মিনুর সিট ছিল অনেকটা পেছনে। অম্বিকেশ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। সারাটাজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করে শেষ বয়সে এসে এ কী উৎপাত!

কিন্তু আগামী ন-টা দিন মিনুর সঙ্গে যে শুধু কাটাতে হবে তাই নয়, ওর সুবিধা-অসুবিধা সব কিছুর দিকে সতর্ক খেয়াল রাখতে হবে অম্বিকেশকে। এটা ভেবেই ভেতর ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়ছেন তিনি।

ক্লিমেন্ট বাসের দরজা খুলে দিয়েছে। বাসে ওঠার আগে সঞ্জিত সবাইকে দরজার চারপাশে গোল করে দাঁড় করিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন এই বাসের সিস্টেম। ইউরোপের এই ধরনের বাসে সামনে আর পেছনে দুটো দরজা থাকে। মাঝখানের অনেকটা অংশ অর্থাৎ বাসের খোলটা আড়াআড়ি খুলে ফেলা যায়। সেখানে একসঙ্গে সব যাত্রীর মালপত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।

সবাই মন দিয়ে শুনছিলেন। সঞ্জিত দম নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামতেই চল্লিশ বিয়াল্লিশের একজন ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘বাস আধ ঘণ্টা অন্তর থামবে তো? আসলে আমার ছোটো বাচ্চা আছে তো।’

‘আধ ঘন্টা অন্তর?’ সঞ্জিত বিস্মিতচোখে বললেন, ‘অত ঘন ঘন দাঁড়ালে তো সব জায়গা কভার করা যাবে না। শুধু দুপুরের খাওয়ার সময় দাঁড়াবে।’

‘ও মা এ আবার কী!’ পাশ থেকে অমনি উৎপল বিশ্বাস বলে উঠলেন, ‘আমরা এতজন সিনিয়র সিটিজেন রয়েছি, একবার দাঁড়ালে হয় নাকি! একটা সুবিধে অসুবিধে বলে কথা আছে তো নাকি! আমার স্ত্রী এমনিতেই ডায়াবেটিসের পেশেন্ট, ওঁকে বারবার টয়লেট যেতে হয়।’

সঞ্জিত হাসিমুখে ডান হাত তুলে বরাভয়ের ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্যার, এত উতলা হবেন না। বাসের মধ্যে বায়ো-টয়লেট আছে। ছোটো হলেও পরিষ্কার আর সমস্তরকম সুবিধেযুক্ত। আপনারা ভাবলেন কী করে যে আমরা আপনাদের কোনোরকম ট্রাবলের মধ্যে ফেলব? আমরা আপনাদের নিয়ে এসেছি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে এতগুলো দেশ ঘুরিয়ে দেখাতে। কোনো অসুবিধের মধ্যে ফেলতে নয়।’

উৎপল বিশ্বাস গাঁইগুঁই করতে করতে চুপ করে গেলেন।

জিনিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে ক্লিমেন্টের কাছ থেকে রোজকার শিডিউল বুঝে নিচ্ছিল। এবার এগিয়ে এসে বলল, ‘আর দেরি করে লাভ নেই। একটু পরেই সন্ধে নেমে যাবে। তখন ঠান্ডা আরও বাড়বে। সবাই লাগেজ তুলে দিয়ে একে একে বাসে উঠে পড়ুন।’

উৎপল বিশ্বাস অমনি বললেন, ‘আমাকে কিন্তু এবারে উইন্ডো সিট দিতেই হবে ম্যাডাম। গোটা প্লেনে আমি কিচ্ছু দেখতে পাইনি।’

জিনিয়ার হাতে হোটেল, বাস সব কিছু মিলিয়ে একগাদা কাগজ। অন্য হাতে পেন দিয়ে হিসেব করতে করতে ও বলল, ‘এইসব প্রভিশনই রাখিনি আমি জেঠু। আপনারা সবাই আগে পরে যেভাবে বুক করেছেন, সেইভাবেই সিট পাবেন। আপনি আর আপনার ওয়াইফ যেহেতু একদম প্রথমে বুক করেছিলেন, আপনাদের গোটা টুরেই এক আর দুই নম্বর সিট অ্যালোকেট হয়েছে। এক উইন্ডো সিট আর তার পাশেরটা হল দুই।’

উৎপল বিশ্বাস বললেন, ‘বাহ, হাওয়া-টাওয়া ভালো পাওয়া যাবে তো?’

জিনিয়া উৎপল বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গোটা বাসটাই এয়ারকন্ডিশনড জেঠু।’

উৎপল বিশ্বাস জিনিয়ার কথা শুনে সন্তুষ্ট চিত্তে সকলের সঙ্গে বাসে উঠে যেতে জিনিয়া চাপা গলায় সঞ্জিতকে বলল, ‘এই ভদ্রলোককে একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করবেন। ঝামেলাবাজ টাইপ আছেন।’

‘সে দেখেই বুঝেছি।’ সঞ্জিত দু-হাত কোমরে দিয়ে হাসলেন, ‘এসব পাবলিকের গায়ে আলাদা একটা গন্ধ থাকে। আমরা কাছে এলেই সেই গন্ধ পেয়ে যাই। নিন। উঠে পড়ুন।’

জিনিয়া মুগ্ধচোখে সঞ্জিতের দিকে তাকিয়েছিল। না, সঞ্জিতকে দেখছিল না ও। দেখছিল সঞ্জিতের ব্লেজারটাকে। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর সময় জিনিয়া, ফুলুমামা আর সঞ্জিত তিনজনেই গায়ে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ লেখা ব্লেজার চড়িয়েছেন। ওরা তিনজনেই ঠিক করেছে, প্রতিদিন যাই পরুক, জামাকাপড়ের ওপর এই ব্লেজার চড়িয়েই ওরা গোটা গ্রুপটাকে ঘোরাবে।

দেখতে দেখতে ও আবেগে কেঁপে উঠল। মাত্র কয়েক মাস হল ওর স্বপ্নসন্তান ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ তার ডানা মেলেছে বাস্তবের আকাশে। এরমধ্যেই তার ছাপ পড়ে গেল লন্ডন শহরে।

কী অসম্ভব তৃপ্তি! আবেগে এক মুহূর্তের জন্য ওর চোখে জল এসে গেল। মনে মনে বলল, এই টুর যেন সবদিক থেকে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়, তারই খেয়াল রাখবে ও আগামী কয়েক দিন।

৩২

আলোকপর্ণা এসে যখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের গ্যারাজ অফিসের শাটার হিড়হিড় করে টেনে তুলল, তখন ঘড়িতে ঠিক সকাল ন-টা। অন্যদিন এত তাড়াতাড়ি ও আসে না, হিন্দমোটর থেকে হাওড়া, সেখান থেকে বাসে সল্টলেক আসতে আসতে ওর প্রায় দশটা বেজে যায়। কিন্তু অন্যদিন জিনিয়াদি থাকে। জিনিয়াদি সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস খুলে ফেলে। এখন যেহেতু জিনিয়াদি নেই, অফিস খোলাটা আলোকপর্ণারই দায়িত্ব।

না, জিনিয়াদি ওকে মোটেই এমন কোনো নির্দেশ দিয়ে যায়নি যে সকাল ন-টার মধ্যে অফিস খুলে ফেলতে হবে। কিন্তু এই অফিসে যোগ দেওয়ার পর আলোকপর্ণার মধ্যে দায়িত্ববোধ নিজে থেকেই অনেক বেড়ে গেছে। তার মানে এটা নয় যে গ্লোবাল টুরসে ও ফাঁকিবাজি করত। ওখানেও ও মন দিয়েই কাজ করত, কিন্তু সেই কাজের মধ্যে যতটা না প্রাণ ছিল, যতটা না ভালোবাসা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল চাপ আর চাকরি টিকিয়ে রাখার দুশ্চিন্তা।

কিন্তু এখানে এসব কিছুই নেই।

আলোকপর্ণা অফিসের ভেতরে ঢুকে আলো, পাখা, কুলার সব চালাল, তারপর জিনিয়াদির মতো করে গোটা ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দিল। প্রথমদিন এসে অফিসের মালকিন নিজেই ঘর পরিষ্কার করছে দেখে ও খুবই অবাক হয়েছিল। কিন্তু পরে জিনিয়াদিই ওকে বুঝিয়েছে ছোটো কাজ বড়ো কাজ এইসব শ্রমবিভাজনগুলো কতটা অর্থহীন। বলেছে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশেই এই ট্যাবুগুলো রয়েছে। কোনো উন্নত দেশে কাজ ছোটো বড়ো বলে কিছু হয় না। নিজের কাজতা সবাই সেখানে নিজেই করতে পছন্দ করে।

মাঝে মাঝে ভাবলে অবাক হয়ে যায় আলোকপর্ণা, মাত্র দু-মাস হল ও দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে কাজ করছে। কিন্তু এর মধ্যেই জিনিয়াদি যেন ওকে পুরো মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

ও কোনোদিনই খুব ভালো ছাত্রী ছিল না, ওর মধ্যমেধার পাশে দিদি অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় ছোটো থেকেই ও শুনে এসেছে দিদির প্রশংসা। দিদি একদিন গোটা লাহিড়ী পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে, ছোটোবোন হয়ে দিদির এককণাও ও পেলে বর্তে যাবে, এই জাতীয় কথা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনতে হয়েছে ওকে। তাতে যে ওর কোনো রাগ হত, তা কিন্তু নয়। বরং ওর দিদি যে সকলের সেরা, এটা ভাবতে ভীষণ গর্ব হত ওর। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থেকে দিদির বিভিন্ন বিভাগে পাওয়া মেডেলগুলো এমনভাবে গলায় দোলাতে দোলাতে দিদিকে জড়িয়ে ও বাড়ি ফিরত, মনে হত বুঝি ও-ই মেডেলগুলো জিতেছে।

সবাই হেসে বলত, ‘ওগুলো তো দিদির? তোর কী?’

ও অমনি দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘দিদি মেডেলগুলো পেয়েছে। আর দিদিটাই তো আমার। তাহলে তো মেডেলগুলো আমারই হল, নাকি?’

সবাই ওর বলার ভঙ্গি দেখে হেসে কুটোপাটি হত।

তারপর দিদি যখন অত ভালো চাকরিটা পেল, সে কী আনন্দ ওর! পাড়ার বন্ধুদের কাছে গিয়ে এমন হাবভাব দেখাত, যেন চাকরিটা ও-ই পেয়েছে। চাকরি পাওয়ার কয়েক মাস পরেই ওকে একটা স্কুটি কিনে দিয়েছিল দিদি। সেই স্কুটি নিয়ে ও যখন কলেজ যেত, মনে হত রাস্তায় সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দিদির স্নেহ, আদর স্কুটি চালাতে চালাতে অনুভব করত ও।

সেই দিদি, আলোকপর্ণার প্রাণের চেয়েও প্রিয় দিদি, কোথায় চলে গেল। মাঝে এতদিনের শূন্যতা, তারপর একদিন জিনিয়াদি এসে ওর মন এমনভাবে দখল করে নিল, এখন দিদির কথা মনে পড়লেই জিনিয়াদি-র কথা মনে পড়ে যায়।

আশ্চর্য! কে আপন কে পর মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায় যেন।

‘পর্ণাদি, তুমি এসে গেছ?’ বিকাশ অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বলে।

আলোকপর্ণা তৎক্ষণাৎ গাম্ভীর্যের বর্ম চড়িয়ে নেয় কণ্ঠে। বলে, ‘এই যে, এতক্ষণ পরে বাবুর আসার সময় হল?’

‘মানে? আমি তো এমনই আসি!’ বিকাশ অবাকচোখে তাকায়।

‘সে তো জিনিয়াদি থাকার সময়। সে থাকলে কাউকে আর কিছু দেখতে হয় নাকি?’ আলোকপর্ণা চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তোকে আগের দিন বললাম না, দিদি ফিরে আসার আগে অনেকগুলো বুকিং করে আমরা দেখিয়ে দেব?’

‘হ্যাঁ, সে বলেছিলে বটে।’ বিকাশ মাথা চুলকে বলল।

আলোকপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘তবে? যা শীগগির, দু-কাপ চা নিয়ে আয়। তারপর সোজা চলে যাবি সেক্টর ফাইভে।’

বিকাশ চোখ তুলে বলল, ‘সেক্টর ফাইভ? সেখানে গিয়ে কী করব? সে তো অফিস পাড়া। আই টি কোম্পানি গিজগিজ করছে! তার চেয়ে পার্ক স্ট্রিট যাই।’

‘তোমার মোটা মাথায় এর চেয়ে বেশি আর কী বুদ্ধি হবে?’ আলোকপর্ণা রেগেমেগে বলল, ‘ওরে বাবা, একই জায়গায় দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করলে লোকে কি নেবে নাকি? তার চেয়ে আজ সেক্টর ফাইভে যা। দেখলি না, ইউরোপ টুরে কতগুলো আই টি-র লোক রয়েছে? ওখানে মাইনেপত্র বেশি, লোকজন বছরে এক-আধবার কেঁদে ককিয়ে ছুটি পেলে তখন বিদেশ টুরে যেতেই পছন্দ করবে।’

বিকাশ কাঁধ নাচিয়ে বলল, ‘ ঠিক আছে। বলছ যখন ওখানেই যাচ্ছি।’

‘শুধু গেলি আর চোখ বন্ধ করে বিলি করলি, লোকজন সেটা পড়ল না দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল, সেসব না দেখেই চলে এলি, ওইরকম করলে কিন্তু হবে না।’ চোখ পাকিয়ে বলল আলোকপর্ণা, ‘আমাকে জিনিয়াদি পাসনি বুঝলি? সপ্তাহে অন্তত দুটো কাস্টমার আমার চাই-ই!’

‘যাহ বাবা, এ যে দেখি বাঁশের চেয়ে …!’ বিকাশ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আলোকপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে দাবড়ানি দেওয়ার আগেই মোবাইল বেজে উঠল। ওর নিজস্ব মোবাইল নয়, অফিসের মোবাইল। এই ঘরেই রাখা থাকে, সকালে এসে অন করা হয়।

আলোকপর্ণা দু-তিনবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করল, কিন্তু ওপ্রান্ত থেকে কোনো উত্তর নেই। ও রেগে গিয়ে ফোনটা কেটে বলল, ‘ এই এক উৎপাত শুরু হয়েছে সকাল থেকে। কার এই সাতসকালে মশকরা করতে ইচ্ছে হয়েছে কে জানে! কাজকর্ম না থাকলে যা হয়!’

বলতে বলতে বিপ বিপ শব্দে মেসেজ ঢুকল ওর নিজের ফোনে। ও ঝুঁকে দেখল পিকলুদা।

—গুড মর্নিং আলোকপর্ণা। মায়েরা কি পৌঁছে গেছেন এতক্ষণে?

আলোকপর্ণা ঘড়ি দেখে উত্তর দিল,

—হ্যাঁ, পিকলুদা। লন্ডনে ল্যান্ড করে যাওয়ার কথা এতক্ষণে। মাসিমা কি ফোন করেননি। আচ্ছা দাঁড়াও, আমি দেখছি।

—তুমি কি অফিস চলে গেছ?

হ্যাঁ, আমি এই ঢুকলাম।

এবার আর বেশ কিছুক্ষণ কোনো মেসেজ নেই, অথচ পিকলুদা-র নামের পাশে সবুজ আলোটা জ্বলজ্বল করছে।

আলোকপর্ণা চুপচাপ তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিছু মানুষ কত সাধারণভাবে থাকে, অথচ ভেতরে ভেতরে কতটা অসাধারণ। পিকলুদাকে একঝলক দেখলে অত্যন্ত সাধারণ মনে হয়, কিন্তু তার যে অমন সুন্দর আঁকার হাত, অত সুন্দর বেহালা বাজায়, সুরের সূক্ষ্ম কম্পনে কেমন ঘোর লাগিয়ে দিতে পারে মনের মধ্যে, তা ক-জন জানে? অথচ দেখো, এতটুকু অহংকার নেই।

পিকলুদা-র মেসেজ আবার ঢুকল,

—আজ আমি একটু সল্টলেকের দিকে যাব, একটা কাজ আছে। যদি বলো, তোমার অফিসে যেতে পারি। একসঙ্গেই ফিরব নাহয়!

পিকলুদা উত্তরপাড়ার একটা স্কুলের শিক্ষক। সল্টলেকে তার কী কাজ থাকতে পারে? কিন্তু আলোকপর্ণা কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু লিখল,

—আচ্ছা। তুমি এসে ফোন কোরো। কীভাবে আসবে আমি বলে দেব।

ফোন বন্ধ করে কাজ শুরু করতেই একটু পরেই ফোন আবার বেজে উঠল। ওর নিজস্ব মোবাইল ফোন। স্ক্রিনে জিনিয়াদির ওখানকার নম্বর দেখেই আলোকপর্ণা উল্লসিত হয়ে ফোন রিসিভ করল, ‘হ্যাঁ দিদি, বলো। কেমন রয়েছ?’

‘ভালো আছি, আলোকপর্ণা।’ ওপাশ থেকে জিনিয়াদির সতেজ গলা শোনা গেল, ‘আমরা কিছুক্ষণ হল হিথরোতে নেমেছি, এখন বাইরে রয়েছি। তুমি এত সকালে অফিসে চলে গেছ?’

আলোকপর্ণা একটু আশ্চর্য হল। ও যে অফিসে এসে গেছে, জিনিয়াদি তা কেমন করে জানল? বিস্ময় চেপে রেখে ও বলল, ‘এই একটু আগে এলাম, দিদি। তুমি কিছু চিন্তা কোরো না, সব ঠিক আছে। আমি সব সামলে নেব।’

‘তা আমি জানি, আলোকপর্ণা। তোমার হাতে ভার দিয়ে এসে আমি নিশ্চিন্ত।’ জিনিয়াদি বলল, ‘আচ্ছা শোনো, তোমাকে যে কারণে ফোন করলাম। আজ তো মাসের এক তারিখ, তাড়াহুড়োয় তোমার স্যালারিটা দিয়ে আসতে ভুলে গেছি আমি।’

‘না, না, সে ঠিক আছে দিদি।’ আলোকপর্ণা তাড়াতাড়ি বলল, ‘ তুমি তো আর ক-দিন পরে চলেই আসছ। তখনই এসে দেবে নাহয়!’

জিনিয়াদি বলল, ‘না না, তা হয় না, আলোকপর্ণা। তুমি বলেছিলে না এই সপ্তাহে কাকিমার কোমরে একটা এমআরআই করাতে হবে? সে তো অনেক খরচ। আমি তো সবে এলাম, আমার ফিরতে এখনও দেরি আছে। ততদিন তুমি চালাবে কী করে? সংসারেরও খরচ আছে!’

আবেগপ্রবণ বলে স্কুলে কলেজে দুর্নাম ছিল আলোকপর্ণার। সিনেমা দেখতে বসে সামান্য আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হলেই কোথা থেকে যে ওর দু-চোখ জলে ভরে উঠত, তাই নিয়ে বন্ধুবান্ধবরা তো বটেই, বাড়িতে দিদিও প্রচুর পেছনে লাগত। বলত, ‘তোর চোখে টালার ট্যাঙ্কের পাইপ ফিট করা আছে নাকি রে? একটু দোলালেই জল গড়ায়!’

জিনিয়াদি-র কথাতেও সেটাই হল। টালার ট্যাঙ্কের পাইপের মুখ খুলে হু-হু করে এমন স্রোতে জল বেরোতে থাকল, আলোকপর্ণা কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারল না।

এমনও হয়! ওর ভাগ্যে এমন সুখও লেখা ছিল! গত কিছুদিন ধরে এত ভালো ভালো মানুষের সংস্পর্শে এসে ওর মনের সমস্ত সংকীর্ণতা যেন দূর হয়ে যাচ্ছে। মিনতি মাসিমা, জিনিয়াদি, পিকলুদা! সবাই কত ভালো।

জিনিয়াদি ওর জন্য এতটা চিন্তা করে? চোখটা এত জ্বালা করছিল, কোনোমতে বিকাশের সামনে নিজেকে সামলে ধরা গলায় ও বলল, ‘তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, তাই না দিদি? আমার ঠিক তোমার মতোই একজন দিদি ছিল জানো!’

ওপাশে নীরবতা।

ফোনটা কি কেটে গেল?

ও তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যালো দিদি, শুনতে পাচ্ছ?’

জিনিয়াদি বলল, ‘হ্যাঁ পাচ্ছি। শোনো আলোকপর্ণা, তোমাকে তো এইমাসে চেক দিতে পারব না, সই করে আসিনি আমি। আমি এখান থেকে অনলাইনে তোমার টাকাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা, দিদি।’ সজল চোখে বলল আলোকপর্ণা।

‘আর শোনো।’ জিনিয়াদি বলল, ‘আজ দরকার নেই, কাল পরশু করে একবার ব্যাঙ্কে গিয়ে কোম্পানি অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টটা নিয়ে এসে ফাইলে রেখো তো। মাসের প্রথমে নিয়ে আসাই ভালো। দেরি হলে ওরা আবার গাঁইগুঁই করে। পরে ট্যাক্সের ব্যাপারে ঝামেলা হবে।’

‘কিন্তু আমাকে কি দেবে?’ জিজ্ঞেস করল আলোকপর্ণা। ব্যাঙ্কের কাজটা পুরোপুরি জিনিয়াদিই দেখে।

‘হ্যাঁ দেবে।’ জিনিয়া রাখার আগে বলল, ‘আমি এখান থেকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে ই-মেল করে দিচ্ছি। তুমি শুধু আমাদের লেটারপ্যাডটা নিয়ে গিয়ে দেখাবে, তাহলেই হবে।’

ফোনটা রেখে আলোকপর্ণার বুকের ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠল। ভালো লাগা, ভীষণ একটা ভালো লাগা মন থেকে বুদবুদের মতো বেরিয়ে সারা শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ছে যেন!

কে বলে পৃথিবীতে ভালো মানুষ কমে যাচ্ছে? ভুল। ভালো মানুষ, ভালো চাওয়ার মানুষ এখনও আছে পৃথিবীতে। আর সেইজন্যই এখনও গাছে গাছে ফুল হয়, পাখি গান গায়।

সবাই সেই রাস্তার অন্ধকারের নোংরা লোকটার মতো নয়।

চোয়াল শক্ত করে আলোকপর্ণা ভাবল, সবাই ওর নিজের দিদির মতোও নয়, যে নতুন সংসার পেতে নিজের বোনকে পুরো ভুলে যাবে।

৩৩

বাসে উঠে সবাই নিজের নিজের সিটে বসতেই বাস চলতে শুরু করল। মাটির থেকে অনেকটা উঁচুতে এই বাসের সিটগুলো, আর কোমরসমান উচ্চতার ওপর থেকে পুরোটাই কাচ। সবাই মুগ্ধচোখে বাইরেটা দেখছিল। এতক্ষণের প্লেন জার্নিতে সবাই প্রায় অনভ্যস্ত, তাই ক্লান্তির চিহ্ন সবারই চোখে-মুখে, কিন্তু অভিব্যক্তি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। অন্যরা তো বটেই, যাদবচন্দ্রের স্ত্রী আরতিও উৎসাহের চোখে বাইরে তাকিয়ে আছেন।

বাসে ড্রাইভার যেখানে বসে, সেই জায়গাটা যে কতটা প্রশস্ত, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ক্লিমেন্টের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই যেন সেখানটা বানানো হয়েছে। বিরাট চাকার মত স্টিয়ারিং-এর পাশেই রয়েছে মাঝারি মাপের কম্পিউটার স্ক্রিন, সেখানে জিও পজিশনিং সিস্টেমের সাহায্যে সামনের রাস্তার ম্যাপ, কোন পথে গেলে সময় কম লাগবে, কোন পথে গেলে জ্যাম আছে, সব দেখা যাবে। এই জিনিস দেশে কিছু দামি গাড়িতে এখন আছে, কিন্তু বাসে চিন্তাই করা যায় না, মনে মনে ভাবল জিনিয়া।

গোটা বাসটায় দু-দিকে দুটো করে মোট চল্লিশটা সিট। এক থেকে উনিশ পর্যন্ত যাত্রীরা বসে পড়েছেন। অম্বিকেশ, জিনিয়া আর সঞ্জিত আপাতত বসে রয়েছে ড্রাইভারের পাশের বিশাল চওড়া সিটে।

হিথরোয় পা দেওয়ার পর থেকে যাত্রীদের ভার অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন সঞ্জিত হাজরা, লক্ষ করছে জিনিয়া। গ্লোবাল টুরসে যে পেশাদার চোস্ত টুর ম্যানেজার বছরের পর বছর সারা পৃথিবীর অসংখ্য জায়গায় টুর করিয়ে বেরিয়েছেন, সেই পুরোনো সঞ্জিত হাজরা ফিরে এসেছেন যেন।

সঞ্জিতের পরামর্শে একটা মাইক্রোফোন নিয়ে এসেছিল জিনিয়া, কী কাজে লাগবে সেটা তখনও পর্যন্ত ওর মাথায় ছিল না।

হিথরো এয়ারপোর্ট ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে বাস বিশাল চওড়া রাস্তা দিয়ে হু-হু করে ছুটতে শুরু করতেই সঞ্জিত উঠে দাঁড়িয়ে মুখের সামনে সেই মাইক্রোফোন ধরে পরিষ্কার বাংলায় বলতে শুরু করলেন।

‘নমস্কার। আপনাদের সকলকে অনেক শুভেচ্ছা। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম সফরের অংশ হয়েছেন আপনারা। তাই আমরা মনে করি আপনারাও দাশগুপ্ত ট্রাভেলস পরিবারের সদস্য। আপনারা প্রায় সবাই নিশ্চয়ই ইউরোপের মাটিতে এই প্রথম পা রেখেছেন, তাই আপনাদের সকলের উত্তেজনাটা আমরা অনুভব করতে পারছি। প্রথমে আমি আপনাদের গোটা টুর সম্পর্কে সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয় বলব। আচ্ছা, আগে আমার পরিচয় দিয়ে দিই।’ সঞ্জিত নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘আমি সঞ্জিত হাজরা। আপনাদের টুর ম্যানেজার। আমরা এখন চলেছি আমাদের হোটেলের দিকে। আপনারা দু-দিকে দেখতে পাচ্ছেন লন্ডনের বাড়িঘর। এটা ঠিক প্রপার লন্ডন শহর নয়, শহরের মূল প্রাণকেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে। আমরা জানি এতক্ষণের জার্নির পর আপনারা সবাই ক্লান্ত আছেন, তাই সবার সুবিধের জন্য এয়ারপোর্ট থেকে কাছাকাছি হোটেলে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনারা আর দশ মিনিটের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে যাবেন। রিসেপশন লবিতে আমরা এক এক করে রুমের চাবি আপনাদের দিয়ে দেব। আপনারা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন। আজ আমাদের কোনো প্রোগ্রাম নেই। ঠিক রাত আটটায় চলে আসবেন নীচের ডাইনিং হলে। সেখানে আপনাদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা থাকবে। ক্লিয়ার?’

বেশ কিছুজন সম্মতির ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন।

সঞ্জিত বললেন, ‘আচ্ছা। এবার কয়েকটা পয়েন্ট বলে দিই। এক নম্বর পয়েন্ট, আপনারা এখন যে বাসে করে হোটেলে চলেছেন, এই বাসই কিন্তু আপনাদের গোটা টুরে সঙ্গে থাকবে। বাস চালাচ্ছে ক্লিমেন্ট। ও-ও আপনাদের সঙ্গে ঘুরবে, সব জায়গায় নিয়ে যাবে। এই যে এত সুন্দর ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন বাস, এটা কিন্তু টুর শেষের পর একেবারে পরিষ্কার করা হবে। তাই এই বাস পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আপনাদের। শুকনো খাবার খেয়ে ভেতরে ফেলবেন না। বাইরে বেরিয়েও ডাস্টবিন ছাড়া ফেলবেন না। এইসব দেশে রাস্তা নোংরা করলে মোটা জরিমানা। বাসে যে ছোট্ট বায়ো-টয়লেট রয়েছে, খুব প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করবেন না। নোংরা হয়ে গেলে সেই অবস্থাতেই বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। এমনিতে দূরপাল্লার রাস্তাগুলোয় বাস প্রতি দেড় ঘণ্টা অন্তর ফ্রেশ হওয়ার জন্য গ্যাস স্টেশনগুলোয় দাঁড়াবে। সেখানকার টয়লেটই ইউজ করবেন।

‘দু-নম্বর পয়েন্ট, আমরা যে ছ-খানা দেশ ঘুরব, সেখানকার প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক সবাই কিন্তু অত্যন্ত সচেতন। আমাদের দেশে মানুষ আইন ভেঙে কিছু করে আনন্দ পায়, নিজেকে হিরো ভাবে। কিন্তু এইসব উন্নত দেশের নাগরিকদের কাছে আইন মেনে চলাটাই বীরত্বের। তাই, আমরা কোথাও এমন কিছু করব না যাতে কোন রুল ব্রেক হয়। বোঝা গেল?

‘তিন নম্বর পয়েন্ট। ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশেই টিপস একটা অলিখিত কনভেনশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার, যেখানে যে রেস্টুরেন্টেই করুন না কেন, মোটামুটি মাথা পিছু এক ইউরো টিপস দিতেই হবে। লন্ডনে যেহেতু পাউন্ড চলে, তাই এখানে মাথাপিছু এক পাউন্ড।’

‘সে আবার কী!’ উৎপল বিশ্বাস একেবারের সামনের সিটে বসে সঞ্জিত হাজরার কথার মাঝে বাধা দিয়ে উঠলেন, ‘খাওয়ার খরচ তো দেবেন আপনারা, এরমধ্যে বকশিশ আসছে কোত্থেকে? এ আবার কী? কেন রেস্টুরেন্টের ওয়েটাররা মাইনে পায় না? রোজ একেকজনের তিন ইউরো মানে দু-জনের চুয়ান্ন ইউরো এই কয়েক দিনে মুফতে বেরিয়ে যাবে! চুয়ান্ন ইউরো মানে হল গিয়ে ইয়ে, প্রায় চার-সাড়ে চার হাজার টাকা। পাগল নাকি? পয়সা কি গাছে ফলে? না না, আমি জীবনে কাউকে এক পয়সাও বকশিশ দিইনি। এখানেও দেব না।’

সঞ্জিত কিছুক্ষণ উৎপল বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে গলায় অত্যধিক মিষ্টতা চড়িয়ে বললেন, ‘আমি কি আমার কথার মাঝে একবারও বলেছি যে এই টিপস আপনাদের দিতে হবে? বলুন, বলেছি কি?’

‘না। বলেননি।’ পেছন থেকে একজন মহিলা বলে উঠলেন।

‘তবে?’ সঞ্জিত উৎপল বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমরা আপনাদের হয়ে সেই টিপসগুলো দেব মি বিশ্বাস। আপনি এত উতলা হবেন না। আমাদের কোনো লুকোনো খরচ নেই। রাস্তার মাঝে টয়লেট যাওয়া আর নিজেদের শপিং ছাড়া কোনো কিছুর জন্য আপনাদের খরচ করতে হবে না।’

উৎপল বিশ্বাসের স্ত্রী মৃদুলা বিরক্তমুখে স্বামীকে চাপাগলায় কী বললেন। উৎপল বিশ্বাস ব্যাজার মুখে কী বিড়বিড় করতে করতে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

‘চার নম্বর পয়েন্ট। পেট্রোল পাম্পকে ইউরোপে বলা হয় গ্যাস স্টেশন। আমরা যখন হাইওয়ে দিয়ে যাব, এক-দেড় ঘণ্টা অন্তর রাস্তার ধারের গ্যাস স্টেশনে বাস দাঁড়াবে। প্রতিটা গ্যাস স্টেশনের সঙ্গেই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থাকে, আপনারা সেখানে শুকনো খাবার আর টুকিটাকি কিনতে পারেন। যদিও প্রতিদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাত্রা শুরুর সময় আমরা একটা করে শুকনো খাবারের প্যাকেট দেব। আর গ্যাস স্টেশনে থাকে পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট। এক থেকে দেড় ইউরো করে লাগে সেখানে।’

‘শেষ পয়েন্ট। প্রতিদিন ভোরে আপনাদের রুমে ওয়েক আপ কল যাবে। যেদিন যেমন প্রোগ্রাম সেই বুঝে আপনাদের সকালে উঠে রেডি হয়ে নিতে হবে। পরের দিন কোথায় কোথায় ঘুরব, কেমন আবহাওয়া তাও আমি বলে দেব। আপনাদের প্রত্যেককে ট্রলি, ছোটো ব্যাগ, রেইনকোট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেওয়া হয়েছে নোটবুক। আপনারা তাতে অভিজ্ঞতা লিখবেন। শেষদিন আমরা সবাই শুনব।’ সঞ্জিত বাইরের দিকে তাকালেন, ‘হোটেল এসে গেছে। আপনারা একে একে নেমে রিসেপশন লবিতে চলুন। লাগেজ নিয়ে চিন্তা করবেন না। হোটেলের বয়রাই আপনাদের লাগেজ বাস থেকে রিসেপশনে নিয়ে যাবে। রুমে রেস্ট নিয়ে ঠিক রাত আটটায় ডিনারে চলে আসবেন। আপনাদের ভ্রমণ আনন্দময় হোক। ধন্যবাদ।’

সঞ্জিত থেমে যেতে জিনিয়া হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল, ‘সঞ্জিতবাবু অত্যন্ত অভিজ্ঞ টুর ম্যানেজার। আপনাদের যেকোনো সমস্যা নিঃসংকোচে ওঁকে বলতে পারেন। আর বাকি সব কিছুর জন্য আমি তো আছিই।’

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের পক্ষ থেকে বাইশজন যখন হোটেলের সামনে গিয়ে বাস থেকে নামল, ঘড়িতে তখন সন্ধে প্রায় সাতটা। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, তখনও পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবুডুবু, কমলা আভায় আলোকিত হয়ে রয়েছে সেদিকটা।

সঞ্জিত কাজের সময় একটুও সময় নষ্ট করছিলেন না। রিসেপশনে গিয়ে বুকিং-এর কাগজপত্র দেখিয়ে একে একে চাবি তুলে দিচ্ছিলেন যাত্রীদের হাতে। যাত্রীরা চাবি পেয়ে লাগেজ হাতে চলে যাচ্ছিলেন লিফট লবিতে।

অম্বিকেশ ক্লিমেন্টের কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছিলেন বাস যখন এক দেশের সীমানা অতিক্রম করে অন্য দেশে ঢুকবে, তখন কী কী কাগজপত্র দেখাতে হবে। ক্লিমেন্টের সঙ্গে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ক্লিমেন্ট মোবাইলের স্ক্রিনে তার প্রেমিকার ছবি দেখিয়েছে অম্বিকেশকে। তারপর প্রশ্ন করেছে অম্বিকেশের প্রেমিকার ছবি কই?

অম্বিকেশ একটু গুটিয়ে গেছিলেন। ভারতে ষাট বছর বয়সটাকে যতটা বুড়ো বলে ভাবা হয়, এইসব দেশে ষাট বছরটা কোনো বয়সই নয়। এখানে ষাট বছরে লোকে নির্দ্বিধায় নতুন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে জীবন শুরু করে, কিংবা চলে যায় দুর্গম কোনো টুরে। অম্বিকেশ একটু হেসে বলেছেন, ‘আই অ্যাম আনম্যারেড ক্লিমেন্ট!’

‘সো হোয়াট?’ ক্লিমেন্ট তার ফর্সা টকটকে কানের লতি চুলকোতে চুলকোতে বলেছে, ‘মি টু। ইউ আর স্ট্রেইট, রাইট? শো ইয়োর গার্লফ্রেন্ড দেন!’

আহ কি জ্বালা! অম্বিকেশ সমকামী কি না ক্লিমেন্ট সেই প্রশ্ন করছে। বিয়ে না করলেই সমকামী হতে হবে? আর এইসব লালমুখো লোকগুলো এটাও বোঝে না যে আমাদের দেশে বিয়ে না করে ওই একসঙ্গে থাকা-টাকা খুবই বিরল ব্যাপার, মনে মনে ভাবলেন অম্বিকেশ। ইদানীং তবু অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের লিভ-ইন করার কথা শোনা যায়। তাতে অম্বিকেশের কোনো আপত্তিও নেই। দু-জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজেরা একসঙ্গে থাকতে চাওয়াটা, থাকাটাই বড়ো কথা, সে বিয়ে করে হোক কিংবা না করে। তাই বলে অম্বিকেশের বয়সের কোনো বুড়ো-বুড়ি লিভ-ইন করছে, এটা কেউ কল্পনা করতে পারবে?

অম্বিকেশ তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, ‘ইয়েস ইয়েস। আই অ্যাম স্ট্রেইট। বাট আই নেভার হ্যাভ এনি গার্লফ্রেন্ড।’

ক্লিমেন্ট বিস্মিতচোখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেইসময়েই মিনু এসে ডেকেছিল অম্বিকেশকে, ‘ফুলু, একটা সাহায্য করবি রে?’

মিনুর দিকে তাকাতেই ক্লিমেন্টের প্রশ্নটা মনে পড়ে গেছিল অম্বিকেশের। মনে করতে না চাইলেও মস্তিষ্কের কোনো একটা সূক্ষ্ম কোষ ওঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, চল্লিশ বছর আগে সামান্য সাহস সঞ্চয় করে নিজের মনের কথাটা বললে আজ হয়তো ক্লিমেন্টের প্রশ্নের উত্তরে চুপ করে থাকতে হত না। মুখে বললেন, ‘কী হয়েছে?’

‘দেখ না, আমার ছেলেকে একটা ফোন করব, জানাব যে পৌঁছে গেছি। এখানে তো দেশের নম্বর কাজই করবে না। ও আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল, যে ওয়াই-ফাই কানেকশন দিয়ে কীভাবে ফোন করতে হয়। কিন্তু আমি কিছুতেই পারছি না। অথচ দেখো, রিসেপশনে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে যে এখানে ওয়াই-ফাই আছে। একটু দেখবি?’ মিনু অসহায় মুখে ফোনটা বাড়িয়ে দিল।

অম্বিকেশ নিজে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে পারলেন না। প্রযুক্তিগত বিষয়ে তিনি একেবারে অজ্ঞ না হলেও খুব পোক্তও নন। সম্ভবত এই হোটেলে ওয়াই-ফাই কানেক্ট করতে গেলে কোনো পাসওয়ার্ড প্রয়োজন। তিনি এগিয়ে গেলেন জিনিয়ার দিকে।

জিনিয়া তখন রিসেপশনে বসে পরের দিনের সব প্রয়োজনীয় নথিপত্র গোছাতে গোছাতে কথা বলছিল যাদবচন্দ্রের সঙ্গে। বেশিরভাগ যাত্রীই নিজের নিজের ঘরে চলে গেছেন। রাত আটটা বাজতে ঘণ্টাখানেক মতো বাকি। তখন আবার ডাইনিং হলে দেখা হবে সকলের। মিনতি মাসিমার ফোনে ওয়াই-ফাই সেট করে দিয়ে ও ফিরে তাকাল যাদবচন্দ্রর দিকে।

যাদবচন্দ্র স্ত্রীকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আবার নেমে এসেছেন নীচের লবিতে। একটা দলামলা করা চিরকুট দেখে তিনি বলছেন, ‘সোরবোন্নে। সোরবোন্নে ইউনিভার্সিটি। প্যারিস, ফ্রান্স। কীভাবে যাব জিনিয়া?’

জিনিয়া ঝুঁকে একঝলক কাগজটা দেখে বলল, ‘এটা প্যারিসের একটা ইউনিভার্সিটি, তাই তো? কীভাবে যাওয়া যায়, সেটা তো ইন্টারনেটেই পাওয়া যাবে জেঠু! কিন্তু ক্লিমেন্ট বলছিল, প্যারিসে একদিনের বেশি থাকলে শেষের দিকে পুরো টুর কভার করতে সমস্যা হয়ে যাবে।’

যাদবচন্দ্রের মুখ অমনি সাদা হয়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, ‘সে কী! তোমাকে তো আমিই বলেইছিলাম জিনিয়া, প্যারিসে আমার একটা কাজ আছে। সেই কাজের জন্যই আসা। তখন তুমি বললে কোনো অসুবিধে হবে না, আর এখন বলছ সমস্যা হবে?’

 ‘না না জেঠু, আমি ঠিক সেটা বলতে চাইনি। এক মিনিট দাঁড়ান।’ জিনিয়া নোটবুক থেকে দেখে দেখে একটা নম্বর ডায়াল করল মোবাইল থেকে। বহুবার ইউরোপ যাতায়াতের সুবাদে সঞ্জিত হাজরার কাছে এখানকার কয়েকটা সিম ছিল। সেই সিমগুলোই ও, ফুলুমামা আর সঞ্জিত এখন ব্যবহার করছে। যাত্রীদের কাছে থাকুক-না-থাকুক, ওদের কাছে তো ফোন থাকতেই হবে। ওপ্রান্তে সম্ভাষণ শুনতে পেয়েই জিনিয়া বলল, ‘ইয়েস, গুড ইভনিং, দিজ ইস ফ্রম দাশগুপ্ত ট্রাভেলস, ইন্ডিয়া। আই হ্যাভ বুকড …!’

জিনিয়া যতক্ষণ ফোনে কথা বলতে লাগল, যাদবচন্দ্র চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর চোয়াল শক্ত, ঠোঁটের কোণে হাসি তো নেই-ই, বরং মুখে থমথম করছে রাগ। তাঁর বুকের ওপর ধীরে ধীরে যেন একটা পাঁচ মণ ওজনের পাথর চেপে বসছে। আরতির চিকিৎসার খরচ বিপুল, তা সত্ত্বেও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ছুটে এসেছেন এত দূর, অন্য এক মহাদেশে। অন্যরা হয়তো শুধুমাত্র ঘুরতেই এসেছে, উপভোগ করতে এসেছে প্রথম বিশ্বের আভিজাত্য, ইউরোপের নান্দনিক সৌন্দর্যকে।

কিন্তু তিনি তো সেইজন্য আসেননি। আরতি এই পৃথিবীতে আছেন আর বড়োজোর ছ-মাস, এই অবস্থায় তাঁর অন্তত ভ্রমণ উপভোগ করার মানসিকতা নেই। রাজুকে আরতির একবার দেখার অন্তিম বাসনা পূরণ করতেই যাদবচন্দ্র এত কাণ্ড করেছেন। নিজেরা এলে সবচেয়ে ভালো হত, কিন্তু একেবারেই অনভিজ্ঞ হওয়ায় সাহসে কুলোয়নি, সেইজন্য এই গ্রুপের সঙ্গে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অস্বীকার করে লাভ নেই, জিনিয়ার আন্তরিক ব্যবহারও তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল।

কিন্তু এত কিছু করে এসে যদি রাজুকে আরতি দেখতে না-ই পেলেন, তাহলে যেদিনগুলোয় আরতি পাশে থাকবেন না, তখন যে যাদবচন্দ্র কিছুতেই শান্তি পাবেন না, অপরাধবোধ কুড়ের কুড়ের খাবে তাঁকে।

জিনিয়া ফোন রেখে দেখল, যাদবচন্দ্র ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন। ও একটু বিস্মিত হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে, জেঠু?’

যাদবচন্দ্র আশেপাশে তাকালেন। প্রকাণ্ড বড়ো রিসেপশনের লবি। একপাশে কাউন্টারে বসে রয়েছে হাস্যমুখ দুই শ্বেতাঙ্গ রমণী। অন্যপাশে একজন অল্পবয়সি ছেলে বসে টুং টাং লয়ে বাজিয়ে চলেছেন গিটারের মতো দেখতে কোনো বাদ্যযন্ত্র।

গোটা লবিটাই আবছা হলদেটে আলোয় ঢাকা, আলোগুলো এমনই, মনে হয় যেন দেওয়ালের বহুমূল্য পেইন্টিং থেকে শুরু করে এক কোণে রাখা পিয়ানো, সবকিছুর ওপরেই একটা আলো-আঁধারি চাদর জড়িয়ে রাখা আছে। বাইরে খুব ঠান্ডা হলেও রুম হিটারের ফলে ভেতরে সেই শৈত্যপ্রবাহ নেই। তবু কেন কে জানে, যাদবচন্দ্র সোয়েটার পরেও ঠান্ডায় কেঁপে উঠছিলেন।

জিনিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বললেন না? এতটা রাস্তা এসেছেন বলে কোনো অসুবিধা হয়েছে? জেঠিমা ঠিক আছেন তো?’

যাদবচন্দ্র ঢোঁক গিললেন। একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জিনিয়া। তোমাকে আমাদের আসার আসল কারণটা আমি জানাতে পারিনি। কিছুটা সংকোচ আর লজ্জা থেকেই বলতে পারো।’

জিনিয়া আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সংকোচের কী আছে জেঠু?’

‘জিনিয়া, তুমি তো জানো তোমার জেঠিমা ক্যান্সারের রুগি। অনেকগুলো কেমোর সেশন হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, ও বড়োজোর আর ছ-সাত মাস …!’ বলতে বলতে যাদবচন্দ্রের গলাটা ঈষৎ কেঁপে গেল, ‘ও চলে গেলে আমার পৃথিবীটা পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। তাই অনেক অসুবিধে সত্ত্বেও শুধু ওর শেষ ইচ্ছেপূরণের জন্য আমি ওকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি তোমাদের সঙ্গে।’

 ‘খুব ভালো করেছেন। আপনাদের ভালোবাসা দেখে এখনকার প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে জেঠু। আমরা যেখানে একটুতেই অধৈর্য হয়ে পড়ি, একটুতেই হাত ছেড়ে দিই সঙ্গীর, অল্পতেই ভেঙে যায় সম্পর্ক…’ জিনিয়ার বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল, আলতো করে ও হাত রাখল যাদবচন্দ্রের শীর্ণ শিরা ওঠা হাতের ওপর, ‘সেখানে আপনাদের এই অদম্য মনের জোর আর ভালোবাসার বন্ধন যে কতটা শিক্ষণীয়, বলে বোঝাতে পারব না। জেঠিমার ইচ্ছা পূরণের জন্য আপনি …!’

‘আরতির শেষ ইচ্ছে কিন্তু বিদেশ ঘোরা নয়, জিনিয়া!’ যাদবচন্দ্র জিনিয়াকে মাঝপথে বাধা দিলেন, ‘মরার আগে ও শুধু ওর ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখে যেতে চায়!’

জিনিয়া থমকে গেল, ‘ছেলেকে দেখা মানে?’

৩৪

অনিরুদ্ধ বসু মাথাটা স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘রবি কি ইউএটি চালাচ্ছে অতন্দ্র?’

‘ইয়েস স্যার!’ অতন্দ্র ঘাড় নেড়ে বলল, ‘চারটে প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে ইউজার অ্যাক্সেপট্যান্স টেস্টিং চালাচ্ছে রবি। প্রায় আড়াইশোর ওপর টেস্ট কেস রান করিয়েছে এই কয়েক দিনে।’

‘গুড! যে ডিফেক্টগুলো লগ করছে সেগুলো আমি এখানে প্রনীলকে বলেছি ইমিডিয়েট বেসিসে রিজলভ করতে। শোনো অতন্দ্র, এটা আমাদের ডু অর ডাই সিচুয়েশন। একেই এই বছর টেকি ওয়ার্ল্ডের এত লস হয়ে গেছে, ব্রিটলস চলে গেলে কলকাতায় প্রায় দু-শোর ওপর ছাঁটাই হবে সব লেভেল থেকে।’

অতন্দ্র চুপ করে তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। এ আর নতুন কথা কী! কয়েকদিন আগে সে নিজে ছাঁটাই হতে চলেছিল। ভুল বলল, এখনও যে ছাঁটাই হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আসলে বেসরকারি চাকরি মানেই তো তাই। মাসের শেষে যতই কাঁড়ি কাঁড়ি মাইনে পাক সবাই, রোজ রাতে যখন বিছানায় ঘুমোতে যায় লোকে, তখন এটাও জানে না যে পরের দিন সকালে চাকরিটা থাকবে না যাবে।

সারাদিনের কাজ শেষে রোজকার মতো আজও অনিরুদ্ধ বসু-র সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করতে বসেছে অতন্দ্র। রিচমন্ডের এই বাড়িতে ওর ছোট্ট ঘরে কোনো বিছানা নেই। মোটা গদিকেই মেঝেতে ফেলে বিছানা হিসেবে ব্যবহার করছে ও। সারা ঘরে তেমন কোনো আসবাব নেই। শুধু এই প্রমাণ সাইজের গদি আর একটু দূরে একটা ছোটো ওয়ার্ডরোব। সেই ওয়ার্ডরোবের পাশেই অগোছালোভাবে রাখা ওর দু-খানা ট্রলি। অতন্দ্র গদির ওপর বাবু হয়ে বসে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল। ল্যাপটপের তার, ইন্টারনেট কানেকশনের ডঙ্গল, এইসব ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে।

উলটোদিকে অনিরুদ্ধ বসু বসে আছেন তাঁর প্রায় ফুটবল খেলার মাঠের সাইজের ড্রয়িং রুমে। অতন্দ্র এইটুকু স্ক্রিনেই বুঝতে পারছে এত বড়ো ড্রয়িং রুম যে ওদের লেকটাউনের গোটা ফ্ল্যাটটা অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে ওর মধ্যে।

অতন্দ্র ঘড়ির দিকে তাকাল। সন্ধে সাড়ে সাতটা। তার মানে ভারতে এখন রাত প্রায় একটা। এত রাতেও কাজের বিরাম নেই। অনিরুদ্ধ বসু বাড়ির জামায় বসে আছেন ল্যাপটপের সামনে। ভেতরের ঘরে নিশ্চয়ই মধুরিমাদি ঘুমিয়ে রয়েছে ওদের সেই বাচ্চাকে নিয়ে।

অতন্দ্র একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল। এই জীবন তারও হতে পারত। ঠিক এইভাবেই মধ্যবয়সে পৌঁছে ও, জিনিয়া আর ওদের সন্তান এমনভাবেই জীবন কাটাতে পারত। কিন্তু ভবিতব্য খণ্ডাবে কে? সে সব কিছুই হল না।

ব্রিটলসের হেড অফিসে বিটা ভার্সনে অতন্দ্রর টুল ইন্টিগ্রেশন প্রায় শেষের দিকে, এখন রবি দিনরাত এক করে টেস্ট করে চলেছে। যাতে কোনোভাবেই কোনো ভুল ত্রুটি ধরা না পড়ে। অতন্দ্রর প্রেজেন্টেশনের আর মাত্র দু-দিন বাকি। দিন যত এগিয়ে আসছে, ওর তো টেনশন বাড়ছেই, তবে বোঝাই যাচ্ছে, ওর চেয়ে অনেক বেশি টেনশনে আছেন অনিরুদ্ধ বসু নিজে। এত বড়ো একটা প্রোজেক্ট হাতছাড়া হয়ে গেলে সেই দায় যে ডিরেক্টরেরই।

ও বলল, ‘জানি স্যার। আমি আমার বেস্ট এফর্টটা দিচ্ছি। আশা করি পরশু দিনের মিটিং এ ওঁরা ইমপ্রেসড হবেন।’

‘আই নো। আসলে সমস্যাটা কী বলো তো,’ অনিরুদ্ধ বসুর কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে, ‘ব্রিটলসের টপ লেভেলের একজনের সঙ্গে আমার একটু ইনফর্মাল সম্পর্ক আছে। তার নাম অ্যান্ড্রু। লন্ডনের ওই অফিসেই আছে। পরশু তোমার প্রেজেন্টেশনের সময়েও ও প্যানেলে থাকবে। অ্যান্ড্রু আমাকে জানিয়েছে, ওমনিসফট নাকি আমাদের থেকে অনেকটাই কম বিড করেছে। যে কারণে ব্রিটলস টেকি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে টাই আপটা রিনিউ না করার কথা চিন্তা করছে। তবে অ্যান্ড্রু চেষ্টা করবে। যদিও কৃষ্ণমূর্তি নামে আরেকজন ডিরেক্টর ওমনিসফটের হয়ে কথা চালাবে।’

অতন্দ্র বলল, ‘তাহলে তো স্যার, আমাদের রেটটাও কমিয়ে দিলেই হয়। আমরা যদি ওমনিসফটের চেয়েও কম বিড করি, তাহলেই ব্রিটলস থাকবে আমাদের কাছে।’

ল্যাপটপের স্ক্রিনে এবার অনিরুদ্ধ বসুর হাসিমুখ দেখতে পেল অতন্দ্র, ‘তুমি কি ভাবছ আমরা কত ডলার বিড করব সেটা আমার হাতে থাকে? আমার হাতে তো দূর, গোটা কলকাতা রিজিয়নের ভিপি দেবাশিস ভট্টাচার্যর হাতেও নেই। তবে আমার কথা শুনে দেবাশিসদা রমেশ নায়ারকে বলেছিল। কিন্তু রমেশ নায়ার রাজি হয়নি।’

রমেশ নায়ার টেকি ওয়ার্ল্ডের ভারতবর্ষের কান্ট্রিহেড। গোটা দেশের সর্বময় কর্তা। সে বসে চেন্নাইয়ের হেড অফিসে। তার ছবি বা ভিডিয়ো ক্লিপিং নানা মিটিং-এর সময় দেখেছে অতন্দ্র। ইদানীং অনিরুদ্ধ স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ও অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করল, ‘নায়ার স্যার কেন রাজি হচ্ছেন না?’

অনিরুদ্ধ বসু ঘাড় নাচালেন, ‘ঈশ্বর জানেন। নায়ারের বক্তব্য, আমরা কোয়ালিটি দিয়ে ক্লায়েন্টকে আটকে রাখব, নিজেদেরকে সস্তা করে নয়। একেই ফিনানশিয়াল লসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে টেকি ওয়ার্ল্ড, তার মধ্যে বিড কম করতে নায়ার চাইছে না। তাই আমাদের কিছু করার নেই।’

অনিরুদ্ধ বসু-র সঙ্গে চ্যাট যখন শেষ হল, তখন প্রায় আটটা বেজে গেছে। একেই ঠান্ডার জায়গা, তার ওপর অতন্দ্র একা মানুষ, সব কাজ ওকে একাই করতে হয়। তাই বেশি দেরি করে না ও। ল্যাপটপ গুটিয়ে রেখে অলস পায়ে ও রান্নাঘরের দিকে গেল।

রান্নাঘর বলে আলাদা কোনো ঘর অবশ্য নেই, ফ্ল্যাটের ওপেন কিচেনের কায়দায় এখানেও ঘরের সঙ্গে রান্নার জায়গাটা খোলা ক্যাবিনেটে রয়েছে। যে অতন্দ্র আগে ভাতপাগল ছিল, জিনিয়া মজা করে ভেতো বাঙালি বলে ডাকত, দায়ে পড়ে সেই অতন্দ্রকেই এখন দিনের বেশিরভাগ সময় স্যান্ডউইচ আর পাউরুটি-জ্যাম খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। কী করবে? সারাদিন অফিসে সময় কেটে যায়। রবি বা অনিরুদ্ধ স্যারের সঙ্গে ফোনালাপ চলতেই থাকে। তারপর আর ভাত করতে ইচ্ছে করে?

আর শুধু চারটি ভাত-ডাল ফুটিয়ে নিলেই তো হল না, সঙ্গে অন্তত একটা তরকারি বা ভাজাভুজিও করতে হবে। কে করবে অত?

কয়েক মিনিটের মধ্যে শসা টমেটো ক্যাপসিকাম কুচি কুচি করে কেটে ফেলল অতন্দ্র। দুটো আলু আর ডিম ঝপ করে সেদ্ধ করতে দিয়ে দিল ইনডাকশন ওভেনে। এরপর দুটো পাঁউরুটির মধ্যে সেগুলো ঠেসে ঢুকিয়ে একটু চিজ ছড়িয়ে স্যান্ডউইচ মেকারে ঢুকিয়ে দিলেই, ব্যস! আজকের মতো ডিনার তৈরি হয়ে যাবে।

নিজের মনেই হেসে ফেললো অতন্দ্র। খাওয়া নিয়ে ও বরাবর খুব খুঁতখুঁতে ছিল। পারতপক্ষে বাইরের খাবার ও খেতে চাইত না, বেশ তেলঝাল দিয়ে বাড়ির রান্না ছিল ওর বরাবরের পছন্দ। মঙ্গলাদি ভালোই রাঁধত, তবে শনি-রবিবারটা একটা পদ জিনিয়া রান্না করত। ওর হাতের কষা মাংস ছিল অতন্দ্রর সবচেয়ে প্রিয়।

কোথা থেকে কী হয়ে গেল, সেসব এখন অতীত।

অতন্দ্রর ভাগ্যে এখন শুধুই পাঁউরুটি।

তবে মনে শান্তি না থাকলে পাঁউরুটিই খাওয়া হোক কি বিরিয়ানি, কিছুই যেন ভালো লাগে না। অতন্দ্র সরে এসে কাচের জানলায় চোখ রাখে। লোকে যে কেন লন্ডন, আমেরিকা যাওয়ার জন্য ছটফট করে, সেটাও ও বোঝে না। প্রথম বিশ্বের ঝাঁ চকচকে পরিকাঠামো, ছবির মতো ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট দেখে আর কদ্দিন সময় কাটে? একাকীত্ব যেন এখানে কুরে কুরে খায়।

অতন্দ্রর ঘরের সামনে দিয়েই চলে গেছে বেশ চওড়া একটা রাস্তা। মূল চওড়া রাজপথের একটা শাখা এই রাস্তা। মূল রাজপথের আলোর কিছুটা এই ঘর থেকে দেখাও যায়। বোঝা যায়, সেখান দিয়ে উল্কার গতিতে চলে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি।

বাড়ির সামনেই যে রাস্তা, তার দু-পাশে পরিচ্ছন্ন ফুটপাথ, ফুটপাথ পেরিয়েই ছবির মতো একেকটা বাড়ি। কোন বাড়ি হাল আমলের, কোনো বাড়ি পুরোনো গথিক প্যাটার্নের। রাস্তার দু-পাশে সার দিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হরেক মডেলের সব গাড়ি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, রাস্তায় কোনো লোক নেই। অথচ রিচমন্ড বেশ বড়ো একটা টাউন, লন্ডন থেকেও কাছে। ভারতবর্ষে এইরকম জায়গার মতো কোনো রাস্তায় রাত আটটার সময় একটাও লোক নেই চিন্তা করা যায়?

প্রথম প্রথম এসে এদেশের এত ফাঁকা রাস্তা দেখে খুব ভালো লাগত, কিন্তু যতদিন যাচ্ছে অতন্দ্র অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলার লোক পেলে ভালোই হত। অতন্দ্রর বাড়ির মালিক গুজরাটি, সেও সদালাপী নয়। দৈবাৎ কাজে বেরনো বা ঘরে ফেরার সময় দেখা হলে গুড মর্নিং, গুড ইভনিং, ওইটুকুই।

কাজ, খাওয়া, ঘুম, নিঃসঙ্গ এই চক্রাকার জীবনযাপনে ও হাঁপিয়ে উঠছে।

হঠাৎ একটা ফোন বেজে উঠল। অতন্দ্র সচকিত হয়ে উঠল। এখন কে ফোন করছে? রবি বা অনিরুদ্ধ বসু-র সঙ্গে আজকের মতো কথা মিটে গেছে। অতন্দ্রই রোজ অফিস থেকে বেরিয়ে কথা সেরে নেয়।

তবে?

ফোন রিসিভ করেই জিনিয়ার মায়ের গলা শুনল অতন্দ্র, ‘হ্যালো অতন্দ্র, আমি মা বলছি। খড়দা থেকে!’

অতন্দ্র টের পেল সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দটা ফিরে এল। ও বলল, ‘হ্যাঁ মা, বলুন।’

জিনিয়ার মা স্মৃতি একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন, ‘কেমন আছ?’

‘ভাল।’ অতন্দ্র বলল, ‘আপনি আমার এই নম্বর কোথা থেকে পেলেন, মা?’

স্মৃতি বললেন, ‘দুর্গাপুরে ফোন করেছিলাম। দিদি দিলেন। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে অতন্দ্র। আচ্ছা তোমাকে যে আমি ফোন করছি, এতে কি আমার প্রচুর টাকা কাটছে?’

অতন্দ্র হাসি চেপে বলল, ‘হ্যাঁ। আপনি রাখুন, মা। আমি আপনাকে ঘুরিয়ে ফোন করছি।’

অতন্দ্র ফোনটা কেটে দিয়ে রিংব্যাক করল, ‘হ্যাঁ মা। বলুন। আপনারা কেমন আছেন?’

‘আমরা আর কেমন থাকব অতন্দ্র? এই বয়সে ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকি, তাই না?’ স্মৃতি বললেন, ‘শোনো, তুমি যে সেই একটা শনিবার আসবে বললে, তারপর তো এলে না। জিনির সামনে তোমাকে সাহস করে ফোন করতেও পারতাম না, আর এদিকে এই কয়েকদিন তো তোমাকে ফোনেও পাচ্ছিলাম না। তারপর তোমার মাকে ফোন করতে দিদি বললেন তুমিও লন্ডন গেছ!’

অতন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁ। অফিসের একটা আর্জেন্ট কাজে কয়েক দিনের জন্য আসতে হয়েছে, মা।’

বাক্যটা শেষ করেই ওর ইচ্ছে করল জিজ্ঞেস করতে, জিনিয়া কোথায়? কিন্তু কেন কে জানে, কোথা থেকে একরাশ আড়ষ্টতা এসে গ্রাস করল ওকে। ও বলতেও পারল না, যে শনিবার ও ঠিক করেছিল খড়দা যাবে, তার আগেই ওর কাছে এসে পৌঁছেছিল জিনিয়ার ডিভোর্স পেপার। যে কাগজগুলো এখন লেকটাউনের ফ্ল্যাটের আলমারিতে রাখা রয়েছে। ও বুঝতে পারল না, ডিভোর্সের কাগজ পাঠানোর বিষয়টা জিনিয়ার বাবা-মা আদৌ জানেন কি না।

স্মৃতি একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ জিনিয়ার সঙ্গে কথা হয় তোমার?’

‘না।’ অতন্দ্র ছোট্ট করে জবাব দিল।

স্মৃতি এবার নরম গলায় বললেন, ‘দেখো অতন্দ্র, তোমাদের মধ্যে হঠাৎ কী হল, কেন হল, তুমি কেন আবার চাকরিতে ফিরে গেলে, এসব আমি জানতে চাই না। আমি, জিনিয়ার বাবা বলো, কিংবা তোমার বাবা-মা-ই বলো, আমরা সবাই চাই তোমরা ভালো থাকো। ঝগড়া মান-অভিমান কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয় না, অতন্দ্র? আমাদের মধ্যে হয়নি? নাকি তোমার বাবা-মা-র মধ্যে হয়নি? তাই বলে কি আমরা আলাদা হয়ে গেছি? তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা সবেতেই বড়ো হঠকারিতার পরিচয় দাও। এভাবে দুমদাম সিদ্ধান্ত নিলে এখন না হলেও পরে একসময় বুঝতে পারবে, এগুলো ঠিক নয়।’

পরে নয়, এখনই উপলব্ধি করছি সেটা। মনে মনে ভাবল অতন্দ্র। কিন্তু ওর একার মনে পড়ায় কী হবে? ওদিক থেকে তো ন্যূনতম কোনো রেসপন্স নেই।

স্মৃতি বললেন, ‘শোনো, যা হয়েছে হয়েছে। আমি বলছি তোমরা এবার ঝামেলাটা মিটিয়ে নাও। ভগবানও তাই চান। নাহলে জিনিয়াও লন্ডনে গেছে, আর তুমিও এইসময় যেতে না।’

অতন্দ্র কম্পিত গলায় বলল, ‘জি-জিনিয়া এখন কোথায় মা?’

‘জিনিয়া টুর নিয়ে লন্ডন গেছে, যেমনটা ঠিক ছিল। সেখান থেকে আরও কী কী সব দেশ ঘুরবে।’ স্মৃতি বললেন, ‘ শোনো অতন্দ্র, তোমাকে আমি ফুলুর ওখানকার নম্বরটা দিচ্ছি। ফুলুও সঙ্গে গেছে। তুমি ফুলুর সঙ্গে কথা বলে জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করো। সব মিটিয়ে নাও। এইভাবে আর নিজেকেও কষ্ট দিয়ো না, আমাদেরও অশান্তির মধ্যে রেখো না। আমার মেয়ে যে জেদি, সে তো তুমি জানোই, এত বছর ধরে ওকে দেখছ। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও তো মানবে, ও তোমায় ভীষণ ভালোবাসে।’

ফোনটা রেখে, অতন্দ্র কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। তারপর কী খেয়াল হতে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের পেজটা খুলল ও। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারটা আজকাল বিপণনের একটা বিরাট অংশ, এইসব ভেবে এই পেজটা ও-ই জিনিয়াকে খুলে দিয়েছিল। এখন কি জিনিয়া সেখানে কিছু আপডেট দিয়েছে?

পেজটা খুলে ও চমকে উঠল। দাশগুপ্ত ট্রাভেলস তার প্রথম ভ্রমণের প্রতিটা খুঁটিনাটি আপডেট পেজে দিয়ে চলেছে। এই তো, হিথরো এয়ারপোর্টের বাইরে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ লেখা বাসের সামনে কোম্পানির টি- শার্ট গায়ে হাতে ছোট্ট লোগো পতাকা নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিনিয়া, ফুলুমামা আর আরেকটা লোক। পেছনে বাসে উঠছে সব যাত্রীরা। বেশ অনেকজন। অতন্দ্র গোটা পাঁচেক বুকিং করে তারপর দাশগুপ্ত ট্রাভেলস ছেড়েছিল, তার মানে তারপরে অনেকজনকেই জোগাড় করেছে।

আরেকটা ছবিতে অতন্দ্র পুষ্পমের বাবা উৎপল বিশ্বাসকে দেখতে পেল। ভদ্রলোক গোমড়া মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা সম্ভবত দমদমেই। লাউঞ্জে কেকের টুকরো জিনিয়া এক এক করে সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছে পরপর ছবিতে। নীচে ক্যাপশন, ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম উড়ান শুরু হল আজ। সেই উপলক্ষ্যে একটু মিষ্টিমুখ। সৌজন্যে অল্পা’জ বেকারি।’

একগুচ্ছ ছবি এই ক্যাপশনে। কোনোটায় ফুলুমামা কেক খাইয়ে দিচ্ছেন জিনিয়াকে, কোনোটায় জিনিয়া খাইয়ে দিচ্ছে কাউকে। দেখতে দেখতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল অতন্দ্রর। হিথরো-র বাইরে ফুলুমামা আর জিনিয়া ছাড়া আরেকজন যে কোম্পানির টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়েছিল, সে কেক খাওয়াচ্ছে জিনিয়াকে। জিনিয়াও হাসি হাসিমুখে খাচ্ছে সেই কেক।

অতন্দ্র লোকটাকে চিনতে পারল না। ও ছেড়ে দেওয়ার পর জিনিয়া কি নতুন কাউকে কাজে নিয়েছে? নাকি, এও এক যাত্রী। না না, যাত্রী হলে সে কোম্পানির টি-শার্ট পরবে কেন!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ও শেষ পোস্টটায় এল। সেটা করা হয়েছে একটু আগে।

‘আগামীকাল আমাদের লন্ডন শহর ঘুরে দেখার পালা।’

অতন্দ্র তন্নতন্ন করে ঘেঁটে ফেলল পেজটা। কোন হোটেলে উঠেছে, কতদিন এখানে থাকবে, কিছুই লেখা নেই। শুধু একটাই বাক্য।

ফোনটা বন্ধ করে অতন্দ্র চুপ করে ভাবতে লাগল। জিনিয়া আর ও এখন এত কাছে রয়েছে, তবু কী আশ্চর্য, কোনো যোগাযোগ নেই। ও জিনিয়ার মায়ের পাঠানো ফুলুমামার এখানকার নম্বরটা সেভ করে নিল। এখনই কি ফোন করবে? নাহ, থাক।

হঠাৎই জিনিয়ার জন্য ওর মনটা গর্বে ভরে উঠল। হোক জিনিয়া ওকে আর স্বামী বলে স্বীকৃতি দেয় না, হোক জিনিয়া ওকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে, কিন্তু আইনত তো এখনও ও জিনিয়ার স্বামী। আর আইন চুলোয় যাক, মনের দিক থেকে জিনিয়াকে ও এখনও প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যগে জিনিয়া যে ওর এতদিনের স্বপ্নটাকে সত্যি করতে পেরেছে, এতে কি স্বামী হিসেবে ওর গর্ব হওয়াটা অধিকারের মধ্যে পড়ে না? অবশ্যই পড়ে। ছবিগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে অতন্দ্রর। স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে, কিন্তু ক-জনের হিম্মত হয় নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সেই স্বপ্নকে সত্যি করার?

ওর বউয়ের সেই ক্ষমতা আছে।

কোথায় গেল অতন্দ্রর জিনিয়ার প্রতি সেই রাগ, কোথায় গেল ওকে গীতিকার সামনে কিংবা শুভ্রদীপের কাছে অপদস্থ করার অপমান বোধ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব ফিকে হতে হতে প্রায় ঝাপসা।

শান্ত রিচমন্ডের এই ঘরের এক কোণে একা একা পাঁউরুটি খেতে খেতে বহুদিন পরে একটা হাসি ফুটে উঠল অতন্দ্রর ঠোঁটের কোণে। ও মোটেই এখন আর এত বড়ো দেশে একা নেই। ও আর জিনিয়া এখন কাছাকাছিই আছে। এই-বা কি কম শান্তির!

৩৫

হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসটা একটা ছোট্ট বাঁক নিয়ে চলতে শুরু করল ঝকঝকে পিচের রাস্তায় আর সঙ্গেসঙ্গে বাসের সব যাত্রীদের মুখে খুশি খুশি ভাব ফুটে উঠল।

সেটাই স্বাভাবিক। কাল সন্ধে নাগাদ হোটেলের ঘরে ঢুকে পড়তে হয়েছিল, ক্লান্তিতে তেমন কিছুই দেখা যায়নি। কিন্তু এখন এই সকাল ন-টার সময় এলাহি ব্রেকফাস্ট করে ঠান্ডার মধ্যে বাইরে ঘুরতে বেরোলে কার না ভালো লাগে!

গ্রীষ্মকাল। কিন্তু ঠান্ডা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দু-পাশে ছবির মতো একেকটা বাড়ি, মাঝখানে চওড়া পিচের রাস্তা। এতটাই পরিষ্কার, যে চাইলে শুয়েও পড়া যায় বিনা দ্বিধায়। কিছু কিছু বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগান। তাতে ফুটে রয়েছে রংবেরঙের আইরিশ বা ব্লু বেলফুলের গাছ। জলবায়ুর জন্যই হোক, বা অন্য যেকোনো কারণে, মানুষ এখানে নিজের কাজটা নিজে করে নিতেই অভ্যস্ত। কোথাও বাড়ির সামনে গৃহকর্তা গাড়ি পরিষ্কার করছেন, কোথাও আবার ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা স্কুল যাওয়ার আগে হুটোপুটি করছে বাড়ির সামনে।

কিছুটা এগোতেই সঞ্জিত আবার মাইক্রোফোন হাতে বাসে বনেটের সামনেটা দাঁড়ালেন, ‘সবাইকে সুপ্রভাত। রাতে ঘুম ঠিকঠাক হয়েছিল তো?’

যাত্রীদের বেশিরভাগই মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল। জিনিয়া নিজের নোটবুকে চোখ বোলাচ্ছিল। আজকের দিনের মধ্যে গোটা লন্ডন শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। কাল ভোরে বাস রওনা দেবে প্যারিসের উদ্দেশ্যে। লন্ডনের কোন জায়গায় কতক্ষণের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে সব যাত্রীকে বাসে ওঠাতে হবে, তার একটা হিসেব ও প্রাথমিকভাবে করে রাখছিল। ক্লিমেন্ট বলে রেখেছে, সন্ধের মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবে। নাহলে, তাপমাত্রা হঠাৎ অনেকটা কমে যেতে পারে।

সঞ্জিত বললেন, ‘খুব ভালো। আপনারা সবাই জানেন, আজ আমাদের ভ্রমণের প্রথম দিনে আমরা গোটা লন্ডন শহরটা ঘুরব। ইউনাইটেড কিংডমের রাজধানী এই লন্ডন শহর গড়ে উঠেছে টেমস নদীর পারে। প্রায় দু-হাজার বছর আগেও লন্ডন শহরের অস্তিত্ব ছিল, ‘লন্ডিনিয়াম’ থেকে এসেছে লন্ডনের নাম। একসময় এই শহর ছিল গোটা পৃথিবীর মধ্যে প্রধান। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার মতো ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো লন্ডনে বসে শাসন করেছেন ব্রিটিশ রাজবংশ। আভিজাত্যে ও সৌন্দর্যে লন্ডন শহরের জুড়ি মেলা ভার। আমরা আজ সব দেখব। দেখব বিগ বেন, দেখব বাকিংহাম প্যালেস, দেখব লন্ডন আই, পিকাডেলি সার্কাস, ট্রাফালগার স্কোয়্যার। কিন্তু তার আগে এই যাতায়াতের সময়টুকুতে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচয় করে নেব। যাতে টুরের বাকি দিনগুলো আমরা বন্ধুর মত কাটাতে পারি। বোঝা গেল?’

সবাই ঘাড় নাড়ল। অম্বিকেশ চুপচাপ বসে ছিলেন, জিনিয়া তাঁকে বলল, ‘ফুলুমামা, যাও তো, যাদববাবুকে ওঁর স্ত্রীকে ওষুধ খাওয়ানোর রিমাইন্ডারটা দিয়ে এসো। আমি এই এস্টিমেটটা একটু সেরে নিচ্ছি।’

সঞ্জিত বললেন, ‘তো, আমি আপনাদের অনুরোধ করব, আপনারা একে একে এখানে উঠে আসুন, মাইক হাতে সবাইকে নিজের পরিচয় দিন। বেশি নয়, দু-তিনটি বাক্যে বলুন আপনি কী ভালোবাসেন, কী করেন ইত্যাদি। যাতে অন্যদের বুঝতে সুবিধে হয় আপনি মানুষটা কেমন।’

সঞ্জিত কথা থামিয়ে প্রথম সিটের দিকে তাকালেন। সেখানে বসে আছেন সস্ত্রীক উৎপল বিশ্বাস। সঞ্জিত তাঁর দিকে তাকিয়ে নীচুগলায় আরেকবার আসতে অনুরোধ করতেই তিনি ব্যাজার মুখে উঠে এলেন।

‘আমার নাম উৎপল বিশ্বাস। বাড়ি দুর্গাপুর। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। বছর কয়েক হল রিটায়ার করেছি। ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। ঝাড়া হাত-পা। ঘুরতে ভালোবাসি। মেইনলি নামকরা টুর কোম্পানিগুলোর সঙ্গেই ঘুরি। তাতে ঝক্কি পোয়াতে হয় না কিছুই। কিন্তু এবার আমার ছেলেকে অতন্দ্র এমন ধরল, তাই না করতে পারলাম না! বউ নিয়ে চলেই এলাম।’

‘না করতে পারলেন না, না ছাই!’ সঞ্জিত বিড়বিড় করে বললেন জিনিয়াকে, ‘দশ হাজার টাকা ক্যাশ দিয়ে এই টুর তোমায় ঘোরার সুবিধা কে দেবে চাঁদু? খুঁত ধরা বুড়ো একটা!’

জিনিয়া হাসি চেপে না শুনতে পাওয়ার ভান করে অন্যদিকে তাকাল। কী ভাগ্যি, উৎপল বিশ্বাস কথাটা শুনতে পাননি। কথা শেষ করে উৎপলবাবু গিয়ে বসলেন নিজের সিটে।

সঞ্জিত বললেন, ‘ধন্যবাদ। এবার মিসেস বিশ্বাস, আপনি আসুন।’

উৎপল বিশ্বাসের স্ত্রী মৃদুলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, হঠাৎ মাইক্রোফোনে নিজের নাম শুনে চমকে তাকালেন এদিকে।

উৎপল বিশ্বাস ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘আমি তো যা বলার বলেই দিলাম। ও আবার কী বলবে! ওর কিছু বলার নেই।’

সঞ্জিত হাজরা তাকালেন পেছনের সিটের দিকে। সেখানে বসে আছে সদ্যবিবাহিত এক দম্পতি। তাঁরা দু-জনে একসঙ্গে উঠে এসে নিজেদের সম্পর্কে দু-চার কথা বললেন। তাঁদের বিয়ে হয়েছে মাত্র চার মাস হল। দু-জনেই নামি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন আই টি সেক্টরে রয়েছে। সৌম্যজিৎ ভালোবাসে ক্যামেরায় ভালো ভালো ছবি তুলতে আর মধুছন্দা দেশ-বিদেশের নতুন খাবারের স্বাদ নিতে খুবই পছন্দ করে।

এরপর একে একে উঠে আসতে লাগলেন যাত্রীরা। বহুজাতিক সিমেন্ট সংস্থার ডিরেক্টর রৌণক সাধুখাঁ একা মানুষ। থাকেন গলফ গ্রিনে। অফিসের চাপ সামলে তিনি একাই এসেছেন ঘুরতে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে সামান্য হেসে তিনি জানালেন তাঁর দুর্বলতা বলতে ভালো স্কচ।

পৌলমীর বর ইমরানের কাকার যে বন্ধু তাঁর সেক্রেটারিকে নিয়ে এসেছিলেন, এরপর এলেন তিনি। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। পরনে কুর্তা পাজামা, মাথায় ফেজ টুপি। হাত মাথায় ঠেকিয়ে আদাবের ভঙ্গিতে সবাইকে অভিবাদন করলেন তিনি।

‘সালাম আলেইকুম, আমার নাম আকবর আলি। পার্কসার্কাসে থাকি, ওখানে আমার ফার্নিচারের ফ্যাক্টরি আছে। আমার দুই ছেলে, দু-জনেই ব্যবসা দেখে। বিবি চার বছর হল মারা গেছেন। আমার এক দোস্তের ভাতিজা বলল এই টুরের কথা। ইউরোপ দেখার শখ ছিল বহুদিন ধরে। তাই চলে এলাম। সঙ্গে রয়েছে আমার সেক্রেটারি উইশি।’ আকবর আলি তাঁর পাশের সিটে বসে থাকা রঙিন চুলের মেয়েটার দিকে আঙুল দেখালেন, ‘উইশিও ঘুরতে ভালোবাসে। সঙ্গে আমার ব্যবসার ই-মেল-টিমেলও করতে পারবে। আল্লাহ হাফিজ!’

জিনিয়া লক্ষ করল, আকবর আলির বক্তব্য শোনার পরই উৎপল বিশ্বাসের মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে কী যেন বললেন তিনি। স্ত্রী মৃদুলা অমনি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে বাইরের দিকে তাকালেন।

এরপর সকলের দৃষ্টি গেল দুই বান্ধবীর দিকে। তাঁরা দুজনেই প্রবাসী বাঙালি। মধুমিতা সিকদারের জামশেদপুরে কাপড়ের ব্যবসা আর পিয়াসা ব্যানার্জি গিরিডির এক কলেজে পড়ান। দু-জনেই মধ্য ত্রিশ, কেউই বিয়ে করেননি।

এরপরে এল চার বন্ধু। অভীক, অনিরুদ্ধ, সৈকত, মৃগাঙ্ক। চারজনই হইহুল্লোড়ে আমুদে। তাদের মধ্যে একজন মাইকের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘হ্যালো সব্বাইকে। আমি অনিরুদ্ধ, অনিরুদ্ধ বর্মণ। বাড়ি কুচবিহার, পেটের দায়ে পড়ে থাকি কলকাতায়। আর এ হল সৈকত, বজবজের প্রোডাক্ট। আর ইনি হলেন মৃগাঙ্ক চট্টরাজ। আমাদের সবার দাদা। বিয়ে-থা করেননি, আমাদের ফ্ল্যাটের মালিক। ঘোরেন বেড়ান। কাজ করেন ইলেকট্রিসিটি অফিসে। আর এই যে দেখছেন গোলগাল ভালোমানুষ গোছের ছেলেটিকে? এর নাম অভীক। বাড়ি সন্তোষপুর। আমরা দেদার আড্ডাবাজ, আর অবশ্যই সর্বভুক। শ্রীমান অভীকের বিয়ে দু-মাস পরেই। সেই আনন্দে বা দুঃখে আমরা সবাই ঘুরতে এসেছি।’

রৌণক সাধুখাঁ হাসতে হাসতে সিট থেকে বললেন, ‘সে কী! দুঃখ আবার কীসের! বিয়ে তো আনন্দের ব্যাপার হে!’

‘ঠিকই বলেছেন। আসলে বিয়ে হল দিল্লিকা লাড্ডু। খেলেও চাপ, আবার না খেলেও। হা হা!’ চার বন্ধু হইহই করতে করতে ফিরে গেল নিজেদের আসনে।

ধীরে ধীরে যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে সহজ হয়ে উঠছেন, রঙ্গরসিকতা করছেন নিজেদের মধ্যে।

পরেশনাথ কুণ্ডু বেসরকারি এক ব্যাঙ্কের উঁচু পদে আছেন, তিনি এসেছেন তাঁর স্ত্রী পামেলা ও আট বছরের ছেলে রোদ্দুরকে নিয়ে। তিনিও কিছুটা উৎপল বিশ্বাসের মতো, দু-এক কথা বলেই ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘নতুন টুর কোম্পানি হিসেবে এখনও পর্যন্ত ঠিকই আছে, কিন্তু প্রোফেশনালিজমের দিকে আরও জোর দেওয়া উচিত!’

এরপর এলেন যাদবচন্দ্র। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে নিজের ও স্ত্রীর সম্পর্কে দু-এক কথা বললেন। তবে জিনিয়া লক্ষ করল, স্ত্রীর রোগ বা ঘুরতে আসার কারণ সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না তিনি।

কাল পর্যন্ত মানুষটা সম্পর্কে একটা ভালোলাগা ছিল জিনিয়ার, যিনি অসুস্থ স্ত্রী-র মন রাখতে এই বয়সে এতদূর ঘোরাতে নিয়ে আসতে পারেন, তাঁর ভালোবাসা প্রশংসনীয় ও শিক্ষণীয়। কিন্তু কাল যাদবচন্দ্রের মুখে আসল ব্যাপারটা শোনার পর ওঁর প্রতি সম্ভ্রম বোধ বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে জিনিয়ার। শ্রদ্ধা হয়েছে আরতি দেবীর প্রতিও। যে মা শরীরের এই অবস্থায় কোনো যোগাযোগ না রাখা ছেলেকে দেখতে এতদূর আসতে পারেন, তাঁকে শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই।

পুরোটা শুনে ও প্রথমে কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসেছিল। তারপর যাদবচন্দ্রের হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল, আরতি দেবীর শেষ ইচ্ছে ও পূরণ করবেই।

এমনিতে সেটা অসুবিধের কিছু নয়। যাদবচন্দ্র ছেলের যে ডিটেইল ওকে দিয়েছেন, তাতে লেখা রয়েছে ড রাজীবচন্দ্র সরকার প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। কাল অনেক রাত পর্যন্ত হোটেলের রুমে বসে ইন্টারনেটে খুঁজেছে জিনিয়া। সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় প্যারিসের বহু প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একবার সার্চ করতেই ড রাজীবচন্দ্র সরকারের অফিসের ঠিকানা ও বাড়ির ঠিকানা দুটোই পেয়ে গেছিল ও। রাজীবচন্দ্র সরকারের গোল মুখটাও ভেসে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। একেবারে আরতি দেবীর মুখ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসম্ভব রাগ হয়েছিল জিনিয়ার। কথায় বলে, মাতৃমুখী ছেলে নাকি জীবনে সুখী হয়। রাজীবচন্দ্র সরকার নিজে সুখী হয়েছেন। কিন্তু যে বাবা-মা এত কষ্ট করে তাঁকে বড়ো করলেন, তাঁদেরকে কী প্রতিদান দিলেন তিনি?

প্যারিসে ওর থাকার কথা দু-দিন। দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের পরই সবাইকে হোটেলে ফিরিয়ে আনা হবে, কারণ পরের দিন অনেক ভোরে ওদের বাস রওনা দেবে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে। তো, সেই দ্বিতীয়দিন লাঞ্চের পর জিনিয়া যাদবচন্দ্র ও আরতিকে নিয়ে যেতেই পারে তাঁদের ছেলের সঙ্গে দেখা করাতে।

তাতে উৎপল বিশ্বাস বা পরেশনাথ কুণ্ডুর মতো ছিদ্রান্বেষী যাত্রীদের কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আর এদিকটা সামলানোর জন্য সঞ্জিত হাজরা নাহয় রইলেন।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। জিনিয়ার হাতে সময় কম, অফিস না বাড়ি, কোথায় গেলে রাজীবচন্দ্রের দেখা পাওয়া যাবে, সেটা জানতে না পারলে মুশকিল। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নম্বর খুঁজে ও ফোন করেছিল রাজীবচন্দ্রকে।

ফোনটা প্রথমে একবার বেজে বেজে কেটে গেছিল। পরেরবার রিং হতেই একটা পুরুষকণ্ঠ সেটা রিসিভ করে বলেছিলেন, ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো, আপনি কি ড রাজীবচন্দ্র সরকার বলছেন?’ জিনিয়া বলেছিল।

ভদ্রলোক সম্ভবত বেশ কিছুকাল পরে পরিষ্কার বাংলায় নিজের নাম শুনেছিলেন। একটু থেমে অবাক গলায় বলেছিলেন, ‘কে বলছেন?’

জিনিয়া কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই নিজের পরিচয় দিয়েছিল, ‘আমি জিনিয়া দাশগুপ্ত। দাশগুপ্ত ট্রাভেলস বলে আমার একটা টুর কোম্পানি আছে। কলকাতা থেকে টুর নিয়ে এসেছি ইউরোপে। এখন রয়েছি লন্ডনে।’

ড সরকার বলেছিলেন, ‘তো?’

জিনিয়া স্থিরকণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার গ্রুপে দু-জন ট্রাভেলার আছেন। যাদবচন্দ্র সরকার আর আরতি সরকার। বাড়ি পশিমবঙ্গের মানকড়। আরতি সরকার টার্মিনাল পেশেন্ট, ক্যান্সারে ভুগছেন, আর কয়েকমাস আয়ু। তিনি দেশ থেকে এখানে এসেছেন তাঁর ছেলেকে একবার চোখের দেখা দেখতে।’

ওপাশে তখন থমথম করছিল নিস্তব্ধতা।

জিনিয়া একটু অপেক্ষা করে বলেছিল, ‘হ্যালো?’

‘ক্যান্সার!’ ওপাশ থেকে একটা বুক ফাঁকা করা গলা শোনা গেছিল। একটু আগের সেই স্বাভাবিক কণ্ঠের সঙ্গে এর আকাশ-পাতাল তফাত।

জিনিয়া বলেছিল, ‘হ্যাঁ। উনি ক্যান্সারে ভুগছেন। এরমধ্যেই অনেক কেমো নেওয়া হয়ে গেছে।’

রাজীব সরকার বলেছিলেন, ‘আমরা তো কিছুই জানি না!’

জিনিয়া নিজেকে এতক্ষণ প্রাণপণে সংবরণ করে রেখে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল। বাপ-ছেলের অভিমানের মধ্যে ওর না ঢোকাই ভালো। সত্যি বলতে কী, অন্য কোনো ট্রাভেল এজেন্সি এই ব্যাপারে কিছু করত বলে মনে হয় না। তারা যাত্রীদের ঘোরাতে নিয়ে এসেছে, সেটাই তাদের কাজ। কারুর আত্মীয় বা হারানো সম্পর্ক খুঁজে দেওয়া নয়। কিন্তু জিনিয়া প্রথম থেকেই সবার সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে চেয়েছে, পেশাদার টুর অপারেটরের বাইরে গিয়ে রাখতে চেয়েছে আন্তরিকতার ছোঁয়া। তাই যে ছেলের জন্য বাবা-মা এই অবস্থায় এতদূর ছুটে এসেছেন, তাঁর এইরকম অজ্ঞতায় ওর ভীষণ রাগ হল। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে সংবরণ করতে ভুলে গেল ও। বলল, ‘জানতে গেলে তো বুড়ো বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, রাজীববাবু? আপনি তো সেটুকুও করেননি। এমনকী, তাঁরা ই-মেল করলেও উত্তর দেননি। ভাবতে অবাক লাগছে, আপনি নাকি আবার শিক্ষক! কী শিক্ষা দেন আপনি?’

রাজীববাবু তখন একটা আশ্চর্য কথা বলেছিলেন, ‘কী অদ্ভুত! আপনি কিছু না জেনেশুনে এরকম বলছেন কেন? বহুদিন হয়ে গেল রাজীব তার মেলবক্স খোলে না। কম্পিউটারেই হাত দেয় না তো মেইলবক্স। এমনকী কোনো ফোনও ব্যবহার করেনা ও।’

জিনিয়া অবাক হয়ে বলেছিল, ‘রাজীব মেলবক্স খোলে না মানে? আপনি তাহলে কে কথা বলছেন?’

ভদ্রলোক একটু থেমে বলেছিলেন, ‘ফোনে সব কথা হয় না। আপনি একবার দেখা করতে পারবেন? ইনফ্যাক্ট রাজীবের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলার আমরা অনেকরকম চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওর থেকে কোনো নম্বরই পাইনি!’

জিনিয়া দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলেছিল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কার সঙ্গে কথা বলছি? সোরবোন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ড রাজীব সরকারের পাশে তো এই নম্বরটাই দেওয়া আছে!’

‘আমার নাম ওবায়েদ হক। রাজীব নিজের কাছে কোনো ফোন রাখে না, তাই এই নম্বরটা আমার কাছে রয়ে গেছে।’ ভদ্রলোক এরপর ওঁর ঠিকানাটা এক নিশ্বাসে বলে গিয়েছিলেন, ‘আপনি প্যারিসে পৌঁছে আমার সঙ্গে দেখা করুন প্লিজ! যেকোনো সময়ে আসতে পারেন। আমি বাড়িতেই থাকি।’

 ফোন রেখে জিনিয়া আবার ভালো করে দেখেছিল সোরবোন ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট। তখনই ওর চোখে পড়েছিল সেই লেখাটা। ড রাজীব সরকার ওই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু এখন আর নেই। তাঁর নামের পাশে তাঁর কর্মজীবনের যে টেনিয়োরটা দেওয়া রয়েছে, সেটা বলছে দুবছর আগেই সোরবোনে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছেন রাজীববাবু।

কিন্তু কেন? কোথায় উনি?

আর এই ওবায়েদ হকই-বা কে?

৩৬

রবি বলল, ‘খুব টেনশন হচ্ছে?’

অতন্দ্র সামান্য হেসে বলল, ‘নাহ, টেনশন আর কী। যা হওয়ার তাই হবে।’

‘সেটাই।’ রবি বলল, ‘ তুমি তোমার সেরাটা দিয়েছ, ব্যস!’

‘তা ছাড়া আবার কী!’ অতন্দ্র বলল।

রবি ভ্রূ উঁচিয়ে বলল, ‘আজকের প্রেজেন্টেশনের জন্য চিন্তায়? বাপ রে, তুমি তো বিশাল সিরিয়াস দেখছি!’

‘ধুর!’ অতন্দ্র কাঁধ নাচাল, ‘বাচ্চা নাকি আমি? অনিরুদ্ধ স্যার বার বার ফোন করছিলেন, কথা বলতে হচ্ছিল, তাই। স্যার সত্যিই টেনশনে ছিলেন।’

রবি আর অতন্দ্র ব্রিটলসের প্রকাণ্ড দৈত্যের মতো সদর অফিসের ক্যাফেটেরিয়ার বিশাল লাউঞ্জে বসেছিল। গোটা লাউঞ্জটা প্রায় তিনতলা সমান কাচ দিয়ে মোড়া। কাচের এপাশে বসে ওপাশের চওড়া গ্রেস্যাম স্ট্রিটটা পুরোটাই দেখতে পাচ্ছিল অতন্দ্র। হাজার হাজার গাড়ি এই অত্যন্ত কর্মব্যস্ত রাজপথ দিয়ে একটুও না থেমে শুধুমাত্র সিগনাল মেনে কেমন উল্কার গতিতে ছুটে চলেছে। পথচারীরা হনহনিয়ে হাঁটছে দু-পাশের চওড়া ফুটপাথ দিয়ে।

ও আলগোছে একবার ঘড়িটা দেখল, ‘চলো। আর পাঁচ মিনিট। মিটিং রুমের দিকে এগনো যাক!’

ব্রিটলসের ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে দু-জনে এগিয়ে চলল লিফট লবির দিকে। মুখে যতই অস্বীকার করুক, অতন্দ্রর বেশ নার্ভাস লাগছে। টেকি ওয়ার্ল্ডকে যে প্রোজেক্ট বছরে একটা বিরাট রেভেনিউ দেয়, সেই প্রোজেক্টকে ধরে রাখার দায়িত্ব বলতে গেলে পুরোপুরি ওরই ওপর এসে বর্তেছে। রবি টেস্টিং-এর দিকটা দেখলেও টুলটা ওরই মস্তিষ্কপ্রসূত। সুতরাং দায়ভারও ওরই।

গত দু-সপ্তাহ ধরে ব্রিটলসের বিটা ভার্সনে টুলটাকে ইন্টিগ্রেট করার পর আজ কোম্পানির কিছু বড়োকর্তাদের সঙ্গে অতন্দ্রর মিটিং শিডিউল করেছে অনিরুদ্ধ বসু। খাতায় কলমে এটা নেহাতই হাই লেভেল ক্লায়েন্ট মিটিং, কিন্তু আসলে এই মিটিং-এর ওপর নির্ভর করছে ব্রিটলসের টেকি ওয়ার্ল্ডে থাকার ভবিষ্যৎ।

অনিরুদ্ধ বসু কালও বলেছেন, ‘মোটামুটি পাকা খবর যে আর দশদিনের মধ্যে ব্রিটলসের ম্যানেজমেন্ট যা ডিসিশন নেবার নিয়ে নেবে। ওমনিসফট এতটাই কম বিড করেছে যে ওরা সম্ভবত আমাদের সেটা জানাবেও না, শুধু কনট্র্যাক্ট রিনিউ করবে না। তাই এই দশ দিনের মধ্যে যা করার করতে হবে। অ্যান্ড্রুর সঙ্গে কথা বলে তাই কালকেই তোমার প্রেজেন্টেশনটা শিডিউল করলাম। ও ডিরেক্টর লেভেলে আছে, সাধ্যমতো চেষ্টা করবে সব মেম্বারকে কনভিন্স করার।’

অতন্দ্র বলেছিল, ‘দ্যাট’স ফাইন, কিন্তু আপনার এই অ্যান্ড্রুর সঙ্গে তো কোনো পরিচয়ই হল না এই কয়েকদিনে। আগে থেকে চেনাশোনা হয়ে থাকলে হয়তো সুবিধে হত। আপনি তো বলছেন উনি টেকি ওয়ার্ল্ডের পক্ষেই আছেন।’

অনিরুদ্ধ বসু তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, ‘না না। সেসবের প্রয়োজন নেই। তাতে অ্যান্ড্রু ওর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলতে পারে ম্যানেজমেন্টে। কালকে তোমার প্রেজেন্টেশনে তো ও একা থাকবে না, ওর মতো পাঁচজন ডিরেক্টর থাকবে। তার সঙ্গে থাকবে ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিস। এ ছাড়া আরও কিছু ডিপার্টমেন্টাল হেড থাকবে। তুমি যেন কোনো সময়েই নার্ভাস হোয়ো না। আমি জানি তুমি পারবে, অতন্দ্র! গোটা টেকি ওয়ার্ল্ড তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।’

ব্রিটলসের এলিভেটর দিয়ে পঁয়ত্রিশ তলার মিটিং রুমে উঠতে উঠতে কালকের সেই কথাগুলো মনে পড়তেই অতন্দ্রর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। এত চাপ আর ভালো লাগে না। ও ওর নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে একটা টুল ডেভেলপ করেছে। সেটা পাবলিককে খাওয়ানোও কি ওর দায়িত্ব? আইনস্টাইন রিলেটিভিটি থিওরি আবিষ্কার করার পর তাঁকে যদি বলা হত স্কুল-কলেজে গিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে আসতে! সেটা ভালো লাগত আইনস্টাইনের? সৃষ্টি করাটাই কি যথেষ্ট নয়? সেখানে শুধু বোঝানো নয়, বুঝিয়ে কনট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে হবে অতন্দ্রকে। রবি তো নীরব সহায়ক হয়ে বসে থাকবে ল্যাপটপে। প্রোজেক্টর দিয়ে গোটা বিষয়টাকে বোঝাতে হবে অতন্দ্রকেই।

মিটিং রুমে ঢুকতেই যাচ্ছিল অতন্দ্র, হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে ওর বুকের ভেতরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেমন কেঁপে উঠল। তারপরই অনুভব করল, না, মেয়েটা জিনিয়া নয়। জিনিয়া লন্ডনে এলেও কঠোর নিরপত্তার বেষ্টনীতে ঘেরা ব্রিটলস ব্যাঙ্কের সদর দপ্তরে ঢোকা জিনিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাঙ্কের সিকিউরিটির কথা মাথায় রেখে এখানে একটা মাছিও গলতে দেওয়া হয় না, এমনই কঠোর প্রহরা। বহিরাগত হিসেবে কাজ করতে আসার জন্য অতন্দ্র আর রবিকে ইসু করা হয়েছে সাময়িক বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র। হাতের ছাপ মিললে তবেই তারা ভেতরে ঢুকতে পারে।

আশ্চর্য! মেয়েটাকে একপাশ থেকে জিনিয়ার মতো লাগলেও কাছে যেতেই পার্থক্যটা প্রকট হয়ে উঠল। অতন্দ্র দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কী যে হয়েছে ওর! যে অতন্দ্র কখনোই কুসংস্কার বলে কিছু মানত না, তারও কাল রাত থেকে মনে হচ্ছে জীবনের এই প্রচণ্ড চাপের মুহূর্তে জিনিয়ার শুভেচ্ছা পেলে হয়তো ভালোই হত!

সেদিন জিনিয়ার মা ফোন করার পর থেকে অনেকবার ও ভেবেছে ফুলুমামাকে ফোন করবে, কিন্তু সংকোচে গুটিয়ে গেছে। আসলে ঝামেলার প্রথম দিকে জিনিয়ার ওপর রাগটা পরোক্ষভাবে ফুলুমামা কিংবা অন্যদের ওপর দেখিয়েছিল অতন্দ্র। ফুলুমামা বিয়ের আগে থেকে ওকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। অথচ জিনিয়ার সঙ্গে ঝামেলার পর ফুলুমামা যখন অতন্দ্র কেন কোম্পানির গ্যারাজ অফিসে আসছে না জানতে বার বার ফোন করছিলেন, ও বেশ অভব্যতার সঙ্গেই রূঢ় কণ্ঠে ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন রেখে দিয়েছিল।

তখন মাথাও গরম ছিল, ওই কাণ্ডের জন্য জিনিয়াদের দিকের সবাইকেই মনে হচ্ছিল শত্রু। অথচ ও তো জানে, ফুলুমামা মানুষটা কত ভালো। জিনিয়ার কাছেও শুনেছে, ও নিজে দেখেছে, কোনো রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মানুষটার নিঃস্বার্থভাবে করেন ওদের সকলের জন্য।

মনে পড়তেই অতন্দ্র ভেতর থেকে অপরাধবোধে আরও গুটিয়ে গেল। এইসব গুরুত্বপূর্ণ সময়েই কি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গগুলো মনে পড়তে হয়? ও জোর করে মনটা সরিয়ে আনল বর্তমানে।

প্রকাণ্ড বড়ো কনফারেন্স রুম। ইংরেজি ‘ও’-এর কায়দায় লম্বাটে ডিম্বাকৃতি টেবিল। তার চারপাশে বসে আছেন আটজন ব্যক্তি। একজন ছাড়া সবাই শ্বেতাঙ্গ। প্রত্যেকের সামনে মাইক, জলের বোতল, নোটবুক ও পেন। রবি ল্যাপটপে প্রেজেন্টেশন ঠিক করছে।

অতন্দ্র আর রবি ঢুকতেই সবাই এদিকে তাকালেন। শ্বেতাঙ্গ নন যে ভদ্রলোক, তিনি এবার উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে, হাসিমুখে ইংরেজিতে শুরু করলেন, ‘গুডমর্নিং জেন্টলমেন, মাইসেলফ পি কৃষ্ণমূর্তি।’

অতন্দ্রর মনে পড়ে গেল, এঁর কথাই একদিন অনিরুদ্ধ বসু কথাচ্ছলে বলেছিলেন। ইনিই নাকি টেকি ওয়ার্ল্ড থেকে প্রোজেক্ট সরিয়ে ওমনিসফটকে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছেন।

কৃষ্ণমূর্তি একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন সকলের সঙ্গে। ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিস থেকে শুরু করে বাকিদের সঙ্গে ফর্মাল আলাপ পর্ব মিটতে লাগল কয়েক মিনিট।

তারপর মরিস সাহেব অতন্দ্রকে প্রেজেন্টেশন শুরু করতে বললেন।

অতন্দ্রর হঠাৎ মনে হল, মাত্র কয়েক মাসে কোথা থেকে কোথায় চলে এল ও। আসার কথা ছিল স্বাধীনভাবে কয়েকজনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ইউরোপ ঘোরাতে আসার, বদলে ওকে আসত হল কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে ইজ্জত বাঁচাবার প্রেজেন্টেশন দিতে।

আচ্ছা, জিনিয়া কি এখনও আছে লন্ডনে? নাকি, লন্ডন ঘুরে দেখা ওর শেষ!

যে বাকিংহ্যাম প্যালেসে ওরা দু-জনে মিলে যাবে ঠিক করেছিল, যে হুড খোলা বাসে চেপে ওরা ঘুরে বেড়াবে ভেবেছিল বিগ বেন, টেমস নদীর ধার, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে চার্চ, সেইসব কি জিনিয়া কি একাই দেখে ফেলেছে? কই, অতন্দ্র তো এতদিন লন্ডনে থেকেও সেসব জায়গায় যেতে পারল না! দেখতে পারল না টেমসের নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কমলা রঙে মাখামাখি হয়ে যাওয়া সূর্যাস্ত!

ইচ্ছে থাকলেও লন্ডন আই-তে চড়ে টেমস নদীর ওপর উঠে আকাশ থেকে চোখ ভরে দেখতে পারল না গোটা লন্ডন শহরটাকে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গুটিগুটি চলে যেতে পারল না মাদাম তুসোয়, কিংবা ঢুঁ মারতে পারল না বেকার স্ট্রিটের শার্লক হোমসের সেই মিউজিয়ামে!

অতন্দ্র কি সত্যিই ব্যাকডেটেড? নাহলে জিনিয়া ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও ও কেন ভুলতে পারছে না জিনিয়াকে!

আচ্ছা, জিনিয়া তো এত বছর ধরে ওকে দেখছে। ও কি জানে না অতন্দ্র রাগের মাথায় যাই বলুক, জিনিয়াকে ছাড়া কতটা অসহায়!

ঠান্ডা কনফারেন্স রুম, চারপাশে উজ্জ্বল আলো, এতগুলো অচেনা মানুষের সামনে হঠাৎ সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে দাঁড়িয়ে চোখে জল চলে এল অতন্দ্রর। মনে হল, ও কিচ্ছু চায় না। টেকি ওয়ার্ল্ডের চাকরি না থাকুক, শুধু জিনিয়া ফিরে আসুক ওর জীবনে!

চাই না লন্ডনে এই নির্বাসন। লেকটাউনের সেই ছোট ফ্ল্যাটে সারাটা জীবন ও জিনিয়ার সঙ্গে আটপৌরে জীবন কাটাতে চায়!

‘হ্যালো, ইয়ং ম্যান! ইউ ক্যান স্টার্ট দ্য প্রেজেন্টেশন। উই অল আর ওয়েটিং!’

ব্রিটলসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি মরিসের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় অতন্দ্র।

তাকিয়ে দেখে সবাই চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে। রবিও ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে রয়েছে এদিকেই।

মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয় অতন্দ্র, পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় স্ক্রিনের সামনে। রবিকে নির্দেশ দিতেই সেখানে ফুটে ওঠে ওর প্রেজেন্টেশনের প্রথম স্লাইড। অকম্পিত, প্রত্যয়ী স্বরে ও ইংরেজিতে শুরু করে প্রেজেন্টেশন, ‘হ্যালো স্যার। আজ আমি আমার ডেভেলপ করা টুল সম্পর্কে আপনাদের জানাব। এই টুল এর মধ্যেই আমরা বিটা ভার্সনে ইনকর্পোরেট করেছি ও ভালো রেজাল্ট পেয়েছি। এটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে কাজে লাগিয়ে কাস্টমারকে তাঁর পক্ষে উপযুক্ত ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বাছতে সাহায্য করবে।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ মি মরিসের পাশে বসা আরেক শ্বেতাঙ্গ ডিরেক্টর মি নর্থ প্রশ্ন করেন, ‘কী নাম এই টুলের?’

অতন্দ্র এক মুহূর্ত থামে। তারপর মুখে হাসি টেনে এনে বলে, ‘জিনি।’

‘জিনি?’ একজন বললেন, ‘নাইস নেম!’

‘ইয়েস স্যার!’ অতন্দ্র চওড়া করে হাসল, ‘আলাদিনের জিনের মতোই আমার এই জিনি কাস্টমারদের ঠিক জায়গায় লগ্নি করিয়ে লাভবান করে তুলবে স্যার! লেটস স্টার্ট!’

৩৭

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘আর কদ্দূর, অ্যাঁ? আর কদ্দূর, ভাই? এবার তো হাঁটতে হাঁটতে আমি ভ্যানিশ হয়ে যাব মনে হচ্ছে! তখন হাইড অ্যান্ড সিক কার সঙ্গে খেলবে তোমরা, শুনি?’

অনমিত্র মৃগাঙ্ক চট্টরাজের কাঁধে হাত রেখে ফুরফুরে মেজাজে বলল, ‘আরে মৃগাঙ্কদা, শুনলে না, সঞ্জিতবাবু কী বললেন? এটা কি কোনো মামুলি পার্ক নাকি? এটা হল গিয়ে হাইড পার্ক, গোটা লন্ডনে যে চারখানা রয়্যাল পার্ক রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। অষ্টম হেনরি প্রায় পাঁচশো বছর আগে নিজের শিকার করার জন্য এই পার্কটা বানিয়েছিলেন। রাজারাজড়ার ব্যাপার, তোমার-আমার মতো লোক যদি চক্কর কাটতে গিয়ে না-ই হাঁপাল, তবে কি আর ইজ্জত থাকে নাকি রাজারাণীদের, অ্যাঁ?’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ অবশ্য অনমিত্র-র কথায় মোটেই প্রভাবিত হলেন না, মুখ কুঁচকে বললেন, ‘আরে রাখো তোমাদের রাজারাজড়া! সাদা চামড়া দেখেই জিভ দিয়ে লালা ঝরার সেই পুরোনো স্বভাব ভারতীয়দের আর যাবে না। আরে ভাই, একটা কথা ভুলে যেও না, আমরা এসেছি আসল রাজার দেশ থেকে, বুঝলে? আমাদের দেশের ধনসম্পত্তি, সে কোহিনুরই বলো আর অন্য কিছু, সেইসব লুঠ করে এনে বড়োলোক হয়েছে এখানকার রাজা-রানি। তোমরা এসব দেখে গলে যেতে পারো, আমি গলি না। নেভার!’

সৈকত বলল, ‘তা মৃগাঙ্কদা, এখানে তো রানি এখনও বেঁচেবর্তে রয়েছেন। লাইনে আছেন তাঁর ছেলে, নাতি-নাতনি অনেকেই। তাঁদের আমরা টিভিতে দেখি, তাঁদের খবর পাই। কিন্তু আমাদের দেশে আসল রাজা তুমি দেখেছ নাকি কখনো? নাকি তাঁরা সব দেশ স্বাধীনের পরপরই উবে গেছেন!’

‘কেন উবে যেতে যাবেন কেন?’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ চটে উঠলেন, ‘তাঁরা কি কর্পূর নাকি অ্যাঁ, যে উবে যাবেন? শোনো, যা জান না তাই নিয়ে কথা বোলো না, বুঝলে! তোমাদের পাল্লায় পড়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে এইসব দেশে আসা, নাহলে আমাদের ভারতের মতো দেশ আছে নাকি কোথাও? কথাতেই তো আছে, যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে! আমি নিজেই একবার একজন রাজাকে দেখেছিলাম। পা পর্যন্ত সিল্কের আলখাল্লা, গলায় একটা মোটা মুক্তোর হার, মাথায় মুকুট, আহা! দেখলেই ভক্তি হয়!’

‘কোথায় গো?’ অভীক, সৈকত আর অনমিত্র নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, ‘স্বপ্নে নাকি?’

‘কেন, স্বপ্নে হতে যাবে কেন?’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ খেঁকিয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘রাজস্থানে। বয়স প্রায় আশির ওপর হবে, কিন্তু আহা! সেকি তেজ! দেখলেই আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে!’

‘অ! বুঝেছি!’ অভীক মৃগাঙ্ক চট্টরাজকে আরও রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, ‘কোনো নাটক-ফাটকে কি?’

‘যাহ যাহ!’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ এবার সত্যিই রেগে গেলেন, ‘নিজের দেশের রাজারানিদের নিয়ে মশকরা কোরো না বুঝলে! আর একবার এমন শুনলে দেশে ফিরেই ফ্ল্যাট থেকে স্ট্রেট আউট করে দেব, তখন দেখব লন্ডনের রানি কত তোমাদের জায়গা দেন, হুঁহ!’

জিনিয়া সবার সঙ্গে পা মেলাতে মেলাতে এই ছোটো দলটির কথোপকথন শুনছিল আর মিটিমিটি হাসছিল। এই মৃগাঙ্ক চট্টরাজ লোকটা বেশ আমুদে, সোজাসরল। মধ্যবয়স্ক, অবিবাহিত। নামেই অভীক, সৈকত আর অনমিত্রর ফ্ল্যাটের মালিক, আসলে ভদ্রলোক এদের সবার দাদার মতো। অভীকরা মৃগাঙ্কবাবুর পেছনে লেগে বেশ মজা পায়।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের পুরো দলটা হাইড পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছিল। সবুজে ঢাকা অভাবনীয় সুন্দর এই পার্কটায় ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অজানা সমস্ত গাছ। কোথাও রয়েছে ছোট্ট সুন্দর লেক। কোথাও মৃদুমন্দ গতিতে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে চলেছে কেউ। হাইড পার্কের উত্তর-পশ্চিম দিকেই রয়েছে ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদ বাকিংহ্যাম প্যালেস।

দলের একদম প্রথমে ছিলেন সঞ্জিত, পেশাদার টুর ম্যানেজারের আদলে তাঁর হাতে সবসময় একটা পতাকা, পতাকাটার কাণ্ডটা অনেক উঁচু, সেই উঁচুতে পতপত করে উড়ছে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের লোগো। সঞ্জিত হাজরা প্রথম দিনেই বলে দিয়েছেন, সবসময় স্কুলের বাচ্চাদের মতো লাইন দিয়ে চলার প্রয়োজন নেই, কোথাও পৌঁছে নিজেদের মতো ঘুরলেই হবে, শুধু এই পতাকার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সকাল থেকে লন্ডন শহরের অনেকগুলো টুরিস্ট স্পট দেখা হয়ে গেছে। লন্ডন আই থেকে শুরু করে ট্রাফালগার স্কোয়্যার, পিকাডেলি সার্কাস, ঘোরা হয়ে গেছে অনেকগুলো জায়গা।

সঞ্জিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছিলেন রৌণক সাধুখাঁ, ভদ্রলোক নিজের স্যুটেড বুটেড ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলে আজ একেবারে বোহেমিয়ান লুকে। এই ঠান্ডাতেও সাহেবদের ধাঁচে তাঁর পরনে হাঁটু অবধি প্যান্ট আর রংচঙে একটা টি-শার্ট। সঞ্জিতের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে তিনি এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে।

তার পেছনের সারিতে রয়েছে পরেশনাথ কুণ্ডুর পরিবার ও সস্ত্রীক উৎপল বিশ্বাস। দু-জনেরই স্ত্রী মৌনব্রত পালন করছেন। উৎপলবাবুর স্ত্রী মৃদুলাই হোক কিংবা পরেশনাথ কুণ্ডুর স্ত্রী পামেলা, মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁদের কেমন লাগছে। চুপচাপ রোবটের মতো তাঁরা হেঁটে চলেছেন স্বামীদের পেছন পেছন। উৎপল আর পরেশনাথ বাঙালি জাতির অবক্ষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত, লন্ডনের হাইড পার্কে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা দেশটা কীভাবে অধঃপাতে যাচ্ছে, তাই নিয়ে গূঢ় আলোচনায় মগ্ন। মাঝেমাঝেই পেছনে ফিরে স্ত্রীদের তাড়া লাগাচ্ছেন, তারপর আবার হাঁটছেন নিজেদের মতো। পরেশনাথের ছেলে রোদ্দুর বাবার হাত ধরে হেঁটে চলেছে চুপচাপ।

নবদম্পতি সৌম্যজিৎ আর মধুছন্দা হেঁটে চলেছে নিজেদের মতো। মধুছন্দা আজ দারুণ সুন্দর একটা ওভারকোট পড়েছে। সকালের উজ্জ্বল নরম রোদ এসে পড়েছে হাইড পার্কে, সেই রোদে তার ওভারকোটটা আরও ঝলমলে দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝেই সে দাঁড়িয়ে পড়ছে, আর তার স্বামী টুক করে ছবি তুলে নিচ্ছে নিজের ঢাউস ক্যামেরায়।

তবে মধুছন্দা যতই সাজুক, দলের সবারই থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে আকবর আলির সেক্রেটারি উইশি-র ওপর।

উইশি যতটা না সুন্দরী, তার চেয়ে অনেক বেশি চটকদার। মুখশ্রী যেমনই হোক, তার গায়ের রঙ অত্যন্ত ফর্সা। আর ভারতবর্ষের মতো দেশে নাক-চোখ-মুখ থাকুক আর থাকুক, রং ফর্সা হলেই সে-মেয়ের কদর একলাফে অনেকগুণ বেড়ে যায়। তা ছাড়া উইশিকে দেখলেই বোঝা যায় সে শরীর ও রূপ সম্পর্কে খুবই সচেতন। তার চুল নাসিকাদের মতো স্ট্রেইট করা, তার ওপর ঝকঝক করছে নানা রঙের হাইলাইট।

এই ঠান্ডাতেও হাঁটু পর্যন্ত আঁটোসাঁটো চামড়ার স্কার্ট আর জ্যাকেট পরে রয়েছে সে। পেনসিল হিল জুতো, হাতের লম্বা লম্বা নখের টকটকে লাল নেলপালিশ আর গাঢ় খয়েরি লিপস্টিকে তাঁকে এতটাই আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে যে দলের একদম প্রথম দিকে থাকা রৌণক থেকে শুরু করে অভীকদের চারজন, সবারই চোখ নিজেদের অজান্তেই মাঝেমধ্যে চলে যাচ্ছে উইশি-র দিকে। তুলনায় তার পাশে হাঁটতে থাকা আকবর আলি একেবারেই সাদামাটা। সাধারণ একটা সুট পরে চারপাশ দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছেন তিনি। উইশি মাঝে মাঝেই আলতো করে ধরছে তাঁর হাত।

এর পরই রয়েছে মৃগাঙ্ক চট্টরাজ ও তিন বন্ধুর সেই আমুদে দল। অভীক, অনমিত্র ও সৈকত যথারীতি দেশভক্ত মৃগাঙ্কবাবুর পেছনে লাগতে লাগতে চলেছে।

অনমিত্র বলল, ‘এত বয়স হয়ে গেল, জীবনে কী করলেন বলুন তো মৃগাঙ্কদা! সারাটা জীবন খালি আমার দেশ, আমার দেশ করে হেদিয়ে মরলেন। এরকম একজন কাউকে জোগাড় করতে পারলেও নাহয় বুঝতুম!’ কথাটা বলেই উইশির দিকে ইশারা করে একবার চোখ টিপল অনমিত্র।

সৈকত অমনি কপট রাগে বলল, ‘আহ অনমিত্র, কাকে কী বলছিস, জানিস? আমাদের মৃগাঙ্কদা-র কি কিছু কমতি আছে নাকি? নেহাত উনি এসব পছন্দ করেন না তাই, নাহলে যৌবনকালে কতজন যে মৃগাঙ্কদার জন্য পাগল ছিল…!’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আহ, ফাজলামি বন্ধ করো। সঞ্জিতবাবুকে জিজ্ঞেস করো আমরা কি ইনফাইনাইট লুপের মতো এই পার্কে হেঁটেই চলব নাকি!’

জিনিয়া কথাটা শুনতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘না মৃগাঙ্কদা। এবার আমরা এখান থেকে চলে যাব বাকিংহ্যাম প্যালেসে।’

‘বাকিংহ্যাম প্যালেস!’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ চোখ পিটপিট করলেন, ‘ আচ্ছা, রানি কি এই মুহূর্তে রাজপ্রাসাদে রয়েছেন?’

‘এই রে!’ জিনিয়া কাঁধ নাচাল, ‘সেটা তো বলতে পারব না, মৃগাঙ্কদা। উনি আমায় কোনো খবর দেননি!’

মৃগাঙ্ক চট্টরাজ জিনিয়ার রসিকতাটা ধরতে পারলেন না, মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘ হুম। জানলে খুব ভালো হত!’

‘কেন গো?’ পাশ থেকে ফুট কাটল অভীক, ‘উনি থাকলে কি তুমি গিয়ে কোহিনুরটা নিয়ে আসবে? নাকি রানির সঙ্গে লাঞ্চটা সেরে নেবে?’

‘ইয়ার্কি মেরো না সবেতে।’ মৃগাঙ্ক চট্টরাজ রেগে গেলেন পলকেই।

জিনিয়া হাসি চেপে ইচ্ছে করেই পিছিয়ে গেল। কোনো গ্রুপের প্রাইভেসি ও নষ্ট করতে চায় না। সবার সঙ্গেই কথা বলবে, অথচ প্রত্যেকেই যেন নিজে স্পেস পায়।

হাঁটার গতি মন্থর করতেই ও মধুমিতা আর পিয়াসার পাশাপাশি চলে এল। জিনিয়া লক্ষ করেছে এঁরা দু-জনই খুব চুপচাপ, কিছুটা বেরসিকও বটে। অম্বিকেশ, সঞ্জিত তো বটেই, ও নিজে দু-একবার যেচে কথা বলতে গিয়ে খুব একটা কলকে পায়নি। এঁরা দু-জনে একেবারেই মিশুকে নন, নিজেদের নিয়েই থাকতে ভালোবাসেন। যাকগে, যে যেভাবে থাকতে চায়, সেভাবেই থাকুক!

জিনিয়া একবার আলগোছে মাথা নেড়ে বলল, ‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো দিদি?’

মধুমিতা আর পিয়াসা নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় কী যেন আলোচনা করছিলেন, জিনিয়ার ডাকে এমনভাবে চমকে উঠলেন, জিনিয়া অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এত সুন্দর পরিবেশের মধ্য দিয়ে হেঁটে চললেও প্রকৃতির রসাস্বাদনে কারুরই যেন কোনো মন নেই, নিজেদের মধ্যে নীচু স্বরে কথা বলতে ব্যস্ত।

জিনিয়া অপ্রস্তুতভাবটা কাটিয়ে বলল, ‘সব ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ!’ গিরিডি কলেজের অধ্যাপিকা পিয়াসা ব্যানার্জি তাড়াতাড়ি উত্তর দিলেন, ‘কোন অসুবিধা হচ্ছে না জিনিয়া! থ্যাংক ইউ!’

জিনিয়া হেসে আরও পিছিয়ে গেল। আরতি দেবী হুইলচেয়ারে বসে আছেন, আর যাদবচন্দ্র হুইলচেয়ারটা ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছেন ধীরে ধীরে। দু-জনের মুখই প্রসন্ন।

আজ সকালে সবাই যখন হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে বেরোচ্ছিলেন, যাদবচন্দ্র এসে নীচুগলায় বলেছিলেন, ‘আমি বরং তোমার জেঠিমাকে নিয়ে হোটেলেই রয়ে যাই, বুঝলে!’

‘এ কী কেন?’ জিনিয়া নিজে তখন সবার সঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট করছিল, যাদবচন্দ্রের কথায় ও বিস্মিত হয়ে বলেছিল, ‘আপনি যাবেন না কেন?’

যাদবচন্দ্র একটু ‘কিন্তু কিন্তু’ করে বলেছিলেন, ‘তুমি তো সবই জানো জিনিয়া, আরতির শরীরটা তো ভালো নেই, যদি ঘুরতে বেরিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে? সবাই এখানে ঘুরতে এসেছেন, তখন আমাদের জন্য সবার ঘোরার অসুবিধে হবে। সেটা আমার একদমই ভালো লাগবে না। আর প্যারিসে পৌঁছে তো এমনিতেও একটু হাঁটাহাঁটি হয়েই যাবে রাজুর কলেজে গিয়ে। এতটা ধকল ও নিতে পারবে না।’

‘আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না জেঠু।’ জিনিয়া আশ্বস্ত করেছিল যাদবচন্দ্রকে, ‘বাসে বাসেই তো ঘুরব, তবু যেখানটা একটু হাঁটতে হবে, সেসব জায়গার জন্য আমি আগে থেকেই একটা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছি জেঠিমার জন্য। বাসে তুলেও দিয়েছি সেটা। এতদূর এসে বিশ্ববিখ্যাত সব জায়গা দেখবেন না, তা আবার হয় নাকি!’

যাদবচন্দ্র হুইলচেয়ারের হ্যান্ডল ধরে এগোতে এগোতে জিনিয়াকে দেখতে পেয়ে হাসলেন, দু-দিকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে না জিনিয়া! আরতিরও ভালোই লাগছে।’

‘আমি তো বলেইছিলাম।’ ঝকঝকে হাসল জিনিয়া, ‘এতদূর এসে কি কেউ হোটেলে বসে থাকে?’

যাদবচন্দ্র বললেন, ‘সেটাই। আরতি তো ছেলেকে দেখবে বলে আনন্দে ফুটছে। বাড়ি থেকে লঙ্কার আচার করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এয়ারপোর্টে সিকিউরিটির লোকেরা বের করে নিয়েছে বলে খুব দুঃখ।’

‘লঙ্কার আচার?’ জিনিয়া চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ইস! আমিও দারুণ ভালোবাসি খেতে!’

‘রাজুও খুব ভালবাসে।’ আরতি হাসিমুখে ওর দিকে তাকালেন, ‘বেশ। রাজুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তুমি লঙ্কা কিনে দিয়ো, হোটেলেই বানানোর চেষ্টা করব।’

‘একদম, জেঠিমা!’ জিনিয়া বলল।

যাদবচন্দ্র বললেন, ‘ভালো কথা, রাজুর কলেজে কী খবর নিয়েছিলে?’

জিনিয়া চুপ করে গেল। ও এখনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছে না যে যাদবচন্দ্রকে এখনই সব কিছু বলে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না। ফোনে ওবায়েদ হক নামক লোকটির কথা শুনে ওরও খটকা কিছু কম লাগেনি। রাজীব সরকারের কোনো হদিশও ও এখনও পায়নি। ভালোমন্দ কিছুই জানে না, এখন এইসব বললে অসুস্থ শরীরে আরতি টেনশন করা শুরু করবেন। তার চেয়ে এখন কিছু না বলাই ভালো, প্যারিসে পৌঁছে ও নিজে আগে ওই ওবায়েদ হকের সঙ্গে দেখা করে পুরো ব্যাপারটা জানবে, তারপর যা বলার বলবে।

ও বলল, ‘হ্যাঁ, খবর নিয়েছিলাম জেঠু।’

‘কিছু খোঁজ পেলে ওর? কথা হয়েছে কি?’ আরতি দেবীর কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখটা অস্বাভাবিকরকম জ্বলজ্বল করে উঠল।

জিনিয়া সপ্রতিভ ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, খোঁজ পেয়েছি। কথা হয়নি, তবে হয়ে যাবে, আপনি চিন্তা করবেন না জেঠিমা, আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা হবেই।’

কথাটা বলে ইচ্ছে করেই ও সরে এল। এই নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো।

সঞ্জিত অনেকটা সামনে থেকে গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আমরা এখন পৌঁছে গেছি বাকিংহ্যাম প্যালেসের সামনে। বন্ধুরা, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, কী অসাধারণ এক স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। ব্রিটেনের রানি স্বয়ং এই প্রাসাদে থাকেন। ১৭০৩ সালে ডিউক অফ বাকিংহ্যামের জন্য এই প্রাসাদ তৈরি করা হয়। পরে রাজা তৃতীয় জর্জ এই প্রাসাদকে রানি শার্লটের বাসস্থান করেন। রানি ভিক্টোরিয়ার সময় থেকে এই প্রাসাদ পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশ রাজপ্রধানের বাসস্থান হয়।’

সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল। সামনে অনেকটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, তারপরে ওই প্রায় গোটা আকাশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে বিশাল অট্টালিকা, তাকে এতকাল ছবিতেই দেখেছে সবাই। হলদেটে পাথরের তৈরি গোটা প্রাসাদটার কোথাও যেন এককণা মালিন্য নেই। প্রাসাদের বাইরের গেটের চারপাশে থিকথিক করছে অজস্র পর্যটক, সবাই এই প্রাসাদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত।

প্রাসাদের বাইরে লাল নীল ফুলের বাগানের সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে সবার। তারই মাঝে জ্বলজ্বল করছে সোনালি রঙের এক স্ট্যাচু।

সঞ্জিত বলে চলেছিলেন, ‘এই স্ট্যাচুটির নামও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্যার থমাস ব্রুক এই মনুমেন্টটি বানান। সামনে দেখুন, মার্চ করতে করতে এগিয়ে আসছে একদল গার্ড। এঁরা সবাই রানির নিজস্ব গার্ড। দিনের কয়েকটা সময় এই গার্ড চেঞ্জ করা হয়। আমরা ভাগ্যবান, এক্ষুনি গার্ড চেঞ্জিং সেরেমনি আরম্ভ হবে।’

বলতে বলতেই জিনিয়া সবিস্ময় লক্ষ করল একদল লোক, যাদের মুখের প্রায় অর্ধেকটা একধরনের টুপিতে ঢাকা, গায়ে লাল রঙের কোট ও কালো প্যান্ট, মার্চ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একটা পাশ্চাত্য মিউজিক বেজে চলেছে। তারা সবাই ডান হাত আগুপিছু করে মার্চ করতে করতে এসে ঢুকে যাচ্ছে বাকিংহ্যাম প্যালেসের গেট দিয়ে। গেতের বাইরে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীরা তখন ফটো তুলতে আর ভিডিয়োগ্রাফি করতে ব্যস্ত।

চারদিকে যেন উৎসবের মেজাজ। প্রসন্ন কৌতূহলী চোখে দেখতে দেখতে জিনিয়ার বুকের ভেতর থেকে কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। এই যে হাইড পার্ক, এই বাকিংহ্যাম প্যালেস, এই গার্ড চেঞ্জিং, এসব কি ওর একা দেখার কথা ছিল?

না। এই ম্যাপল পাতা ভরা রঙিন ক্যাম্পাসে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর পতাকা দুলিয়ে ওর একা হেঁটে চলার কথা ছিল না।

মনে হওয়ামাত্র ও জোর করে সেই ভাবনাটাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য মনটা অন্যদিকে ঘোরাল। তখনই ও আবিষ্কার করল, দলের মধ্যে ফুলুমামা নেই। নেই মিনতি মাসিমাও।

হাইড পার্কে থাকার সময় থেকেই জিনিয়া ওঁদের দেখতে পায়নি। কোথায় গেলেন ওঁরা। রাস্তা হারিয়ে ফেলেননি তো? ও এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু করল। শেষে যখন ভাবছে এই বাজনাটা থেমে গেলেই মামাকে ফোন করবে, ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ল দৃশ্যটা।

বাকিংহ্যাম প্যালেসের যেদিকটা ভিড়ে ভিড়াক্কার, তার সম্পূর্ণ উলটোদিকের একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে আছেন ফুলুমামা আর মিনতি মাসিমা।

সামনে যে এমন সুন্দর ঘটনা ঘটছে, সেদিকে তাঁদের দৃষ্টি নেই। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন গল্পে একেবারে বিভোর।

৩৮

আলোকপর্ণা হেসে বলল, ‘মাসিমা আসবেন প্রায় দিন দশেক পর। এই ক-দিন কি তুমি তাহলে এই বিরিয়ানিই খাবে নাকি? পেটের তো বারোটা বেজে যাবে তাহলে!’

পিকলুদা হাসল। ঢাউস চশমাটার কাচের এপার থেকে ওর চোখ দুটোকে দেখাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কাচের মতো অস্পষ্ট। গায়ের সবুজ রঙের সুতির পাঞ্জাবিটা ঘেমে উঠেছে, এখন এসিতে ঢুকতে একটু একটু করে শুকোচ্ছে।

পিকলুদা বলল, ‘তাই কি আর হয়? মা লতাদিদিকে কড়া ইনস্ট্রাকশন দিয়ে গেছে। আজকের দিনটা কোনোমতে ম্যানেজ করেছি।’

আলোকপর্ণা হাসল। ‘মাসিমাকে তুমি খুব ভয় পাও বুঝি?’

পিকলুদা এবার চোখ কুঁচকোল, বলল, ‘ভয় ঠিক নয়, আলোকপর্ণা। মা আমার পৃথিবী। বাবাকে অস্পষ্ট মনে পড়ে। বাবার বাড়ির লোকজনকে আরও কম। ভাবতে বসলে মনে হয় সেটা যেন পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি। বাবা চলে যাওয়ার পর হিন্দমোটরে গিয়ে মা যেভাবে একার লড়াইয়ে আমাকে দিনের পর দিন বড়ো করে তুলেছেন, আমার চোখের জন্য বারবার চেন্নাই নিয়ে গেছেন, নিজের স্কুল সামলে আমার শখ পূরণ করেছেন, আমার সেগুলোই মনে আছে। তাই ভয় পাই বললে ভুল হবে। মাকে আমি খুব ভালোবাসি। বলতে পারো, মা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। অসম্ভব মনের জোর মায়ের। মায়ের থেকে আমি প্রতিনিয়ত শিখি।’

ওরা দুজনে সল্টলেকের একটা রেস্টুরেন্টে বসেছিল। বিকেলবেলা আলোকপর্ণার কাজ যখন প্রায় শেষ, পিকলুদা এসে উপস্থিত হয়েছিল গ্যারাজঘরের অফিসে। বিকাশও তার মধ্যে এসে পড়েছিল, ওকে ছুটি দিয়ে গ্যারাজে তালা দিয়ে আলোকপর্ণা বেরিয়ে পড়েছিল পিকলুদা-র সঙ্গে।

জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এদিকে কোথায় এসেছিলে?’

‘এই, এক বন্ধুর বাড়িতে।’ পিকলুদা একটু থেমে গিয়ে বলেছিল।

আলোকপর্ণা আবার বলেছিল, ‘এভাবে ভিড় রাস্তায় এতটা একা একা আসা তোমার উচিত হয়নি পিকলুদা। মাসিমা শুনলে খুব রাগ করবেন। রাস্তাঘাটে মানুষ এখন এমন নির্দয়, কেউ পড়ে গেলে ভুলেও তাকে তোলে না।’

পিকলুদা হেসে বলেছিল, ‘আমি পঙ্গু হতে পারি, কিন্তু বেরোলেই পড়ে যাব, এটা ভাবলে কী করে! আমি এরকম মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ি আলোকপর্ণা। কখনো কখনো নিজের সঙ্গে সময় কাটানোটা খুব দরকার। আর তার জন্য কলকাতার ব্যস্ত রাজপথ ছাড়া ভালো জায়গা আর কিছুই হতে পারে না।’

‘পঙ্গু’ কথাটা খট করে কানে লেগেছিল আলোকপর্ণা। ওর মনে হয়েছিল, পিকলুদা কি ভাবল, ও পিকলুদাকে পঙ্গু বলতে চেয়েছে? কিন্তু ও সেসব ভেবে বলেনি, পিকলুদা-র নিরাপত্তার কথা ভেবেই মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেছে।

যাদের কোনো একটি ইন্দ্রিয় কমজোরি, ঈশ্বর তাঁদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোকে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী করেন, কোথায় একটা পড়েছিল ও।

পিকলুদা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেছিল,

”শুনি পূর্ণিমা নাকি খুব উজ্জ্বল?

আমাকে সে ছোঁয়? আমি বুঝিনি।

আপন আমার অমাবস্যা,

বেশ আছি। আর কিছু খুঁজিনি।”

আলোকপর্ণা বলেছিল, ‘আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করতে চাইনি পিকলুদা।’

পিকলুদার মুখে হাসিটা লেগেই ছিল, ‘তুমি বুঝি ভাবলে, আমি তোমার কথায় দুঃখ পেয়েছি? তা নয়, আলোকপর্ণা। কবিতাটা এমনিই বললাম। আসলে কী জানো, আমি তো একটা চোখে তবু আবছা দেখতে পাই। এই যে তোমাকে খুব ভালোমতো বুঝতে না পারলেও তোমার অবয়বটা আমি বেশ ভালোই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি যে স্কুলে পড়াই, সেখানে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের চোখে দৃষ্টি বলে কিছুই নেই, নিকষ কালো অন্ধকার সবসময় তাদেরকে ছেয়ে রাখে। তাই বলে আমরা কিন্তু তাদের ঘরের মধ্যে বসে থাকতে বলি না। বলি, চোখ নেই তো কী! স্পর্শ পাওয়ার জন্য ত্বক আছে, গন্ধ পাওয়ার জন্য নাক আছে, শুনতে পাওয়ার জন্য কান আছে। পৃথিবীকে জয় করার জন্য এত কিছুই কী যথেষ্ট নয়? হেলেন কেলারকে কী বলবে তাহলে?’

আলোকপর্ণা চুপচাপ শুনছিল। ও সোজাসরল মেয়ে, কোনো কিছুকে বেশি তলিয়ে ভাবে না। দিদির মতো অত মেধাও ওর কোনোকালে ছিল না যে এইসব দার্শনিক তত্ত্ব ও পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। তবু যেন ওর শুনতে খুব ভাল লাগছিল

ও বলল, ‘মাসিমা সেদিন বলছিলেন, তুমি খুব ভালো কবিতা লেখো।’

পিকলুদা দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে সামান্য হেসেছিল, বলেছিল, ‘ওই একটু-আধটু। তবে তোমরা দুই বোনই খুব কেয়ারিং। আমার মনে আছে, ঋতুও পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যেই আমাকে বলত হাত ধরে রাস্তা পার করে দেবে কি না!’

আলোকপর্ণা চোখ নামিয়ে নিল। এতক্ষণ চারদিক বেশ স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। মনে হচ্ছিল বিনা বসন্তে ফুটেছে এখানে লাল পলাশ, রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পিচের রাস্তা কল্পনায় হয়ে উঠেছেআকন্দ ফুলে ভরা কোনো নরম মাটির রাস্তা।

কিন্তু আকস্মিক পিকলুদার মুখে দিদির নাম শুনে ও হঠাৎ করে আছড়ে পড়ল বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে। মনে পড়ে গেল বাড়িতে বাবা আজও রোজ সন্ধেবেলা বারান্দায় পাথর হয়ে বসে থাকে, আজও মা পাড়ার মধ্যে বাড়িটাকে লুকিয়ে রাখার জন্য খুব প্রয়োজন ছাড়া আলো জ্বালতে চায় না। ও যখন পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দিতে যায় বা পাড়ার দোকানে টুকটাক কিছু কিনতে যায়, কিছু অত্যুৎসাহী কাকিমা আজও ওকে দেখে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘এই তো! এর দিদিটাই তো মুসলমান একটা ছেলের সঙ্গে …!’

রাগ হয় আলোকপর্ণার। খুব রাগ হয়। মনে হয় তছনছ করে দেয় চারপাশ। মনে হয় চিৎকার করে বলে, ‘ছেলের বিশেষণ মুসলমান কী করে হয়? ছেলের বিশেষণ হওয়া উচিত ভালো কিংবা খারাপ!’

কিন্তু ওর ভেতরের চিৎকার কেউ শুনতে পায় না। সবাই ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে হাসে, হেসে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যের কাঁধে।

‘ওই যে, ওর দিদিটাই তো মুসলমানের সঙ্গে পালিয়েছে …!’

যে দিদিকে নিয়ে ছোটো থেকে শুধু গর্বিতই হয়ে এসেছিল, তাকে নিয়ে সারাক্ষণ এইসব আলোচনা শুনতে পারে না আলোকপর্ণা। মনে হয় এলোপাথাড়ি হাত চালায় চারপাশে।

আর তখনই, ঠিক তখনই জগতের প্রতি ওর সব রাগ, সব আক্রোশ গিয়ে পড়ে দুইবছরেরও ওপর না দেখা সেই মানুষটার ওপর। মনে হয়, যার জন্য ওকে এত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে নীরবে, সে কী করে ওর জীবন থেকে উবে গেল!

‘কী ভাবছ আলোকপর্ণা?’ পিকলুদা-র প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পায় আলোকপর্ণা। যথারীতি ভাবতে ভাবতে ওর চোখ ছলছল করছে।

তবু ও বিশ্বাস করে, স্পষ্ট কথায় কষ্ট কম। রুমালে চোখ মুছে নিয়ে সোজা তাকায় ও পিকলুদা-র দিকে, ‘দিদি আমাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না পিকলুদা। ওর কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না।’

পিকলুদা অবাক চোখে তাকায় ওর দিকে।

‘তুমি হয়তো জানো না।’ নিজেকে প্রাণপণ শক্ত করতে করতে বলে আলোকপর্ণা, ‘দিদি যাকে বিয়ে করেছে, সে মুসলমান। এই কারণে আমাদের পরিবারের কেউ দিদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। দিদিও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। তাই দিদির কথা প্লিজ তুলো না আমার কাছে!’ বলতে বলতে ও আর নিজেকে সামলাতে পারেনা, কান্নায় ভেঙে পড়ে।

পিকলুদা বলে, ‘আমি সবই জানি আলোকপর্ণা, তুমি শান্ত হও!’

আলোকপর্ণা চোখ মুছে সামনের দিকে তাকায়। মিনতি মাসিমাকে ও এসব বলেছিল ঠিকই, কিন্তু পিকলুদাকে তো কোনোদিন … তবে কি মাসিমাই পিকলুদাকে এসব বলেছেন?

পিকলুদা বোধ হয় আলোকপর্ণার মুখ দেখে বুঝতে পারে ও কী ভাবছে। পিকলুদা বলে, ‘আমাকে তোমাদের পাড়ারই একজন সব বলেছেন। ঋতুর সঙ্গে আমার তো কোনো যোগাযোগই ছিল না, তাই আমি এসব কিছুই জানতাম না।’

আলোকপর্ণা জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়ে, তারপর বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলে, ‘আমার জীবনে অনেক চাপান-উতোরের পর এখন একটু সুদিন এসেছে, পিকলুদা। ওসব এখন ভুলে যেতে চাই আমি!’

‘তুমি কাউকে ভালোবাসো আলোকপর্ণা?’ পিকলুদা হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করল।

আলোকপর্ণা থমকে গেল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘নাহ। আমার মতো মেয়েদের ওইসব বিলাসিতার সময়ও নেই, যোগ্যতাও নেই। তা ছাড়া, ছেলেরা কি মেয়েদের মাংসের তাল ছাড়া কিছু ভাবে, পিকলুদা?’

পিকলুদা ভ্রূ কুঁচকে বলেছিল, ‘কেন ভাববে না? শরীরটা তো একটা খোলস, আলোকপর্ণা। মনটাই তো আসল।’

‘সেটা ক-জন বোঝে জানি না।’ আলোকপর্ণার হঠাৎই অপ্রাসঙ্গিকভাবে কয়েক সপ্তাহ আগের সেই বিকৃতকাম লোকটার মুখ মনে পড়ে গিয়েছিল।

পিকলুদা আর কিছু বলেনি। ঢাউস চশমার ওপাশের চোখ দুটো যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল আলোকপর্ণাকে।

৩৯

রবি বিশ্বকর্মা কাঁধ ঝাঁকিয়ে স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘কিছু করার নেই। উই হ্যাভ ট্রায়েড আওয়ার বেস্ট! রেস্ট ইজ আপন গড!’

অনিরুদ্ধ বসু মাথা নেড়ে বললেন, ‘নো দ্যাট ইজ ফাইন। আসলে একটু আগেই অ্যান্ড্রুর সঙ্গে আমার কথা হল। ভাইস প্রেসিডেন্ট মি মরিস নাকি বেশ ইমপ্রেসড হয়েছেন অতন্দ্রর প্রেজেন্টেশনে। টুলটা বিটা ভার্সনে ভালো রেসপন্ডও করেছে।’

‘তবে?’ অতন্দ্র অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তবে হোয়াই দিজ পোস্টপোনমেন্ট?’

অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘আসলে কী বলো তো, গোটা প্যানেলটা একরকম ডিসিশন নিয়েই নিয়েছিল কন্ট্রাক্ট এবার ওমনিসফটকে দেওয়া হবে। বিশেষ করে ওই কৃষ্ণমূর্তি, ও খুবই ইনফ্লুয়েনশিয়াল। এবার আমরা যে মাঝখান থেকে একটা ডেভেলপমেন্ট দেখাব, সেটা তো ওদের প্ল্যানিং-এ ছিল না। তাই এই ক-দিন সময় চাইছে।’

‘নিজেদের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সাতদিন ঝুলিয়ে রাখবে?’ অতন্দ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘ হোয়াট ইজ দিস!’

‘শুধু সিদ্ধান্ত নেবে, তা নয়।’ অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘এই সাতদিন ওদের ইন্টারনাল টিম দিয়ে বিটা ভার্সনে ওই টুলটা অপারেট করবে ওরা, বিভিন্নরকম প্ল্যাটফর্মে, বিভিন্নরকম ইউজার ইন্টারফেসে টেস্ট করবে সম্ভবত!’

‘সেটা তো রবি অলরেডি করে দিয়েছে!’ অতন্দ্র বিরক্ত মুখে পাশে বসা রবির দিকে তাকিয়ে বলে।

রবিও ঘাড় নাড়ে, ‘ইয়েস স্যার! আই হ্যাভ ডান অল কাইন্ড অফ রিকোয়ারড টেস্টিং। প্রায় পাঁচশোর ওপর টেস্ট কেস লিখেছিলাম।’

অনিরুদ্ধ বসু স্ক্রিন থেকে বলে ওঠেন, ‘আরে সেটা তো তোমরা জানো, আমি জানি। ওরা তো অতটা কনফিডেন্ট হতে পারছেনা দেখতেই পাচ্ছ। সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কোনো রাস্তা নেই।’

কথা হচ্ছিল রিচমন্ডে অতন্দ্রর ঘরে বসে। রবি আজ ট্রেন ধরে চলে এসেছে এখানে। তিনজনে তিন প্রান্তে বসে ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলার চেয়ে অতন্দ্র আর রবি একজায়গায় বসে অনিরুদ্ধ স্যারের সঙ্গে কথা বলাতে বেশি সুবিধে। তাই অতন্দ্রই আজ আসতে বলেছিল রবিকে। আজ থেকে মোটামুটি ওরা অনেকটাই ফাঁকা, ব্রিটলসের ম্যানেজমেন্টে প্রেজেন্টেশন দেওয়া হয়ে গেছে, এবার কন্ট্রাক্ট রিনিউ হবে কি না সেটাই দেখার।

তবে প্যানেলের সবাই-ই বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন অতন্দ্রর ‘জিনি’ নামক টুলের কার্যকারিতা। ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজেও একবার টেস্ট করে দেখেছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কাজে লাগিয়ে কীভাবে ‘জিনি’ কাস্টমারকে সাহায্য করছে অজস্র ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের মধ্যে তার জন্য যেটা উপযুক্ত, সেটা বেছে নিতে। অনেকটা ছোটোখাটো ফিনানশিয়াল অ্যাডভাইসরের কাজ করে দিচ্ছে ‘জিনি’, তাও একেবারে বিনামূল্যে।

অতন্দ্র স্ক্রিনের দিকে তাকাল, ‘তাহলে আমাদের তো আর কোনো কাজ নেই, আমরা কি তাহলে ফিরে যাব?’

‘একসপ্তাহ অপেক্ষা করে যাও।’ অনিরুদ্ধ বসু আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘তুমি তো এমনিতেও এসে বেঞ্চে চলে যাবে, তার চেয়ে ওখানেই থাকো, ওদের ফাইনাল ডিসিশন কী হয় দেখি। যদি তখন আরেকবার ডেমো দিতে বলে, তখন তো আবার তোমাকে দরকার পড়বে। এই কয়েকদিন বরং ঘুরে নাও। এর আগে তো কখনো যাওনি, নাকি?’

‘রবি আগে এখানে ছিল।’ অতন্দ্র রবির দিকে তাকিয়ে নিয়ে সামান্য হাসল, ‘আমার প্রথমবার।’

‘তবে আবার কী? কোম্পানি যেমন ডিএ দিচ্ছে দিক, তুমি রবির সঙ্গে ঘুরে নাও এই ক-দিনে।’ অনিরুদ্ধ বসু হাসলেন, ‘আমি বিয়ের পর হানিমুনে গেছিলাম লন্ডনে। শুধু হানিমুনের জন্য বললে ভুল হবে। কাজে যাওয়া হয়েছিল, মাঝখান থেকে হানিমুনটাও হয়ে গেছিল। পরে যে কতবার গেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই, কিন্তু সেই প্রথম ঘোরার অনুভূতিই আলাদা। হা হা!’

অতন্দ্র হেসে চুপ করে গেল। মধুরিমাদি বলেছিল ওকে ঘটনাটা। বিয়ের পর পরই সৌভাগ্যক্রমে মধুরিমাদি-র একটা কাজ পড়ে গেছিল লন্ডনে। মধুরিমাদি-র প্রোজেক্টের অনসাইট ছিল এখানেই। বিজনেস ভিসায় এখানে আসতেই হত মধুরিমাদিকে, সঙ্গে অনিরুদ্ধ বসুও এসেছিলেন। কাজের ফাঁকে ঘুরে বেরিয়ে ফিরেছিলেন দু-জনে।

অতন্দ্র লক্ষ করল, অনিরুদ্ধ বসু কথাটা বলার সময় শব্দের বিন্যাস এমনভাবে ভাববাচ্যে করলেন, যাতে নতুন কেউ শুনলে ভাববে বুঝি বিয়ের পর লন্ডনে কাজটা অনিরুদ্ধ বসুর-ই পড়েছিল, মধুরিমাদি-র নয়। এই ব্যাপারটা ও আগেও খেয়াল করেছে। অনিরুদ্ধ বসুকে কাজ শুরুর প্রথম দিকেই ও বলেছিল যে মধুরিমাদি ওর প্রথম প্রোজেক্টে সিনিয়র ছিল। অনিরুদ্ধ বসু শুধু হুঁ-হাঁ করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছিলেন।

অথচ এতদিন ধরে ও ভিডিয়ো চ্যাট করছে, অধিকাংশ দিনই রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ড্রয়িং রুম থেকে অনলাইন হন অনিরুদ্ধ বসু, কতবার দেখেছে মধুরিমাদি পাশের টেবিল থেকে কিছু জিনিস নিতে এসেছে, কিংবা কোনো কাজ করতে ঢুকেছে ঘরে। অনিরুদ্ধ বসু অতন্দ্র মধুরিমাদি-র জুনিয়র জেনেও কখনো স্ত্রীকে স্ক্রিনের সামনে ডেকে নিয়ে এসে কথা বলাননি। মধুরিমাদিও নজর করেনি।

ছেলে কথা শিখছে না বলে যখন মধুরিমাদি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়, তখন ওদের প্রোজেক্টে বেশ হইহই পড়ে গেছিল ক-দিন। শুধু ম্যানেজার বলেই নয়, মধুরিমাদি-র টেকনিক্যাল নলেজ, লিডারশিপ স্কিল, ক্লায়েন্টের থেকে বড়োসড়ো এসক্যালেশন খেয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা, এইসবই ছিল খুব উঁচুদরের। সেইসময় যিনি ব্যাঙ্কিং ডোমেনের ডিরেক্টর ছিলেন, তিনি নাকি একেবারে চাকরি ছেড়ে না দিয়ে কয়েক মাস ছুটিতে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন মধুরিমাদিকে। হলই-বা বিনাবেতন ছুটি, চাকরিটা তো থাকবে! কিন্তু মধুরিমাদি তাতে রাজি হয়নি, একেবারেই রিজাইন করেছিল।

তখন প্রোজেক্টের অনেকের কাছেই কানাঘুসোয় অতন্দ্র শুনেছিল মধুরিমাদির স্বামী নাকি চান না তাঁর স্ত্রী অফিসে এতক্ষণ সময় দিক। শুধু তাই নয়, অফিসে স্ত্রী-র এত ভালো রেপুটেশন তিনি নাকি ঠিক হজম করতে পারেন না। স্ত্রী যতই উন্নতির মই বেয়ে চড়চড়িয়ে ওঠেন, স্বামীর মধ্যে ততই জীবনসঙ্গীর চেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে সহকর্মী সত্তা।

এতদিন পরে সেই কথাগুলো মনে পড়তে অতন্দ্র মেলাতে পারল পরিস্থিতির সঙ্গে। অত ভালো একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়েও পরিস্থিতির চাপে মধুরিমাদির পরিচয় এখন শুধুই গৃহবধূ। এটাই সম্ভবত অনিরুদ্ধ বসু দেখতে চেয়েছিলেন। তাই মধুরিমাদি-র চাকরিজীবন শেষ হওয়ার এত বছর পরেও স্ত্রী-র কাজে তিনি প্রথম লন্ডনে এসেছিলেন বলতে সংকোচ বোধ করেন।

নিজে একজন পুরুষ হয়েও অতন্দ্র অনুভব করল, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, পুরুষালি ইগো কীভাবে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চাকরি না ছাড়লে কত ওপরে উঠতে পারত, তা জেনেও মধুরিমাদিকে সংসারের শান্তির জন্য সব জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। আজ যখন সে ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করে, খাবার বানায়, দুপুর বেলা একলা বসে পার করে অলস সময়, কখনো-সখনো হয়তো তার স্মৃতির অতল থেকে উঁকি মেরে যায় পুরোনো সেই দিনগুলো। নিজের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সময়গুলো।

আচ্ছা, এত কিছুর পরেও মধুরিমাদি তো অনিরুদ্ধ বসুকে ছেড়ে চলে যায়নি, বরং এক ছাদের তলায় সংসার করছে সব মেনে নিয়ে। আর সেখানে অতন্দ্র চিরকাল জিনিয়ার সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষায় শুধু পাশেই থাকেনি, নিজেও একজন সহযোদ্ধা হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবু ওকে ছেড়ে জিনিয়া চলে গেল কেন?

ও কি এতটাই খারাপ মানুষ, যে ওর সঙ্গে থাকা যায় না?

‘এই অতন্দ্র!’ রবি হঠাৎ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘কী ভাবছ!’

অতন্দ্র মুহূর্তে ফিরে আসে বর্তমানে। মাথা নেড়ে বলে, ‘ না। কিছু না। কল তো শেষ হয়ে গেছে। তুমি বোসো, আমি রান্নাটা টুক করে সেরে নিই।’

রবি হাসল, ‘আরে দু-জন তো লোক। আমি এখানে একা বসে কী করব! চলো, আমিও তোমাকে কিচেনে হেল্প করব।’

‘না না। তা হয় নাকি!’ অতন্দ্র বাধা দিল, ‘তুমি হলে গিয়ে আমার গেস্ট। তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি এখানে বসে রেস্ট নাও। চাইলে একটু হেঁটেও আসতে পারো। একটু দূরেই রিচমন্ড পাহাড়।’

রবি ওর কথায় কর্ণপাত করল না, ওকে ঠেলে কিচেনের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ ধুস! এখানে আবার গেস্ট হোস্ট কী হে! চলো তো! দু-জনে মিলে হাতে হাতে করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’

অতন্দ্র এর আগে অনেক বছর মেসে বা হোস্টেলে থাকলেও রান্নায় ও তেমন দড় নয়, একা থাকলে ভাতেভাত ফুটিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। কিন্তু রবি বেশ পোক্ত, মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে বেশ কিছু সবজি ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল। তারপর ফ্রিজে রাখা ঠান্ডা মাংসটা বের করে ধুয়ে-টুয়ে রান্না চাপিয়ে দিল।

অতন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। বলল, ‘বাবা! তুমি তো দেখছি এসব ব্যাপারে একদম এক্সপার্ট!’

‘কী করব!’ রবি বলল, ‘প্রায়ই তো শর্ট টার্মে চলে আসতে হয়। প্রত্যেকবার তো বউ সঙ্গে আসবে না! তোমার বউ কি রান্না করতে পারে? নাকি সেও তোমার মতোই!’

অতন্দ্র চুপ করে গেল। আলাপের প্রথম দিকেই রবি ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল। ও দায়সারা উত্তর দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল।

কথা ঘোরাতে অতন্দ্র বলল, ‘তাহলে কী করব এই সাতদিন? তোমার তো লন্ডন অনেকবার ঘোরা, আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে?’

‘যা বলবে।’ রবি মাংস কষতে কষতে বলল, ‘আমার কোনোকিছুতেই আপত্তি নেই।’

হঠাৎ অতন্দ্রর কী মনে হল, বিদ্যুৎগতিতে ও ফোনে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সোশ্যাল মিডিয়া পেজটা খুলে ফেলল। প্রেজেন্টেশনের ডামাডোলে ফলো করা হয়নি ক-দিন।

এই তো, শেষ স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে আজকে,

‘আজ সকালে লন্ডন থেকে আমরা প্যারিসে এসে পৌঁছেছি। আজ এবং কাল আমরা ঘুরে বেড়াব প্রেমের শহর প্যারিসে।’

সঙ্গে গোটা দলের একটা ছবি। একেবারে সামনে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস লেখা পতাকা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিনিয়া।

উত্তেজনায় অতন্দ্রর বুকটা কেঁপে উঠল। এখন সকাল সাড়ে দশটা। এখনই যদি ওরা রওনা দেয়, তাহলে প্যারিস পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?

অতন্দ্র বলল, ‘এক কাজ করা যাক, রবি। লন্ডন তো যেকোনো সময়ে ঘুরলেই হবে। চলো, আমরা ইউরোপ টুরটা করে আসি।’

রবি মাংস কষা থামিয়ে ওর দিকে অবাক চোখে তাকাল, ‘গোটা ইউরোপ? অত পয়সা কথায় ভাই? আমরা কি লংটার্মে এসেছি নাকি? কামাই টাকায়, খরচ করব ইউরোতে? খেপলে নাকি?’

অতন্দ্র ততক্ষণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ওর মনে হচ্ছে এটাও একটা সুযোগ। সম্ভবত শেষ সুযোগ জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করার! নাহলে হঠাৎ করে ব্রিটলসের কাজে এসেই-বা এমন একটা ছুটি মিলছে কেন?

ও বলল, ‘আরে, তুমিও যেমন, রবি। ইউরোপ মানে কি গোটা ইউরোপ নাকি? ওই একটু প্যারিস যাওয়ার কথা বলছিলাম।’

‘তাই বলো!’ রবি এতক্ষণে স্বাভাবিক হল, ‘প্যারিস তো যাওয়াই যায়। এখান থেকে বাস আছে, ট্রেনে আছে। তবে ট্রেনে যাওয়াই ভাল। ঘণ্টা আড়াই লাগে ইউরোস্টারে। হু-হু করে পৌঁছে যাওয়া যায়।’

‘তবে আর দেরি করে লাভ কী?’ অতন্দ্র বলল, ‘চলো, এখনই বেরিয়ে পড়ি।’

ওর আর তর সইছিল না। মনে হচ্ছিল ট্রেন, বাস কিচ্ছু দরকার নেই, একছুটে চলে যায় প্যারিসে। সেখানে জিনিয়া আছে।

রবি হতবাক হয়ে যায় অতন্দ্রর কথায়, ‘এখনই? মানে এক্ষুনি? তা কী করে হয়? এখন তো রান্না করছি দেখতেই পাচ্ছ!’

‘আরে, রান্না পরে করবে’খন।’ অতন্দ্র অধৈর্য হয়ে ওঠে, ‘আমরা ওখানে গিয়েও খেয়ে নিতে পারি তেমন হলে। যতটা রান্না হয়েছে, ওই অবস্থাতেই প্যাক করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও। আমি রেডি হচ্ছি। এখন বাজে বেলা বারোটা। এইসময় ট্রেন ক-টায় রয়েছে?’

রবি কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘তোমার হল কী, হ্যাঁ? আমার পাসপোর্ট তো লন্ডনের ঘরে পড়ে রয়েছে।’

‘ওহো!’ অতন্দ্র মুষড়ে পড়লেও হাল ছাড়ে না, বলে, ‘তাড়াতাড়ি চলে যাও। রিচমন্ড স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে গিয়ে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে মাংসটা রেডি করে ফেলি। যাও যাও।’ বলতে বলতে একরকম রবিকে সরিয়ে দিয়ে বার্নারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে অতন্দ্র।

ওর বুকের মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে। যে করেই হোক, ওকে প্যারিসে পৌঁছতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *