২০. রেজিগনেশন উইথড্র

২০

অতন্দ্র নিজের রেজিগনেশন উইথড্র করার ঠিক পনেরো দিনের মাথায় দুটো আঘাত পেল। দুটো আঘাতই বেশ বড়োসড়ো।

এক, জিনিয়ার কাছ থেকে পোস্ট অফিস মারফত ওর কাছে ডিভোর্স পেপার এসে পৌঁছোল।

দুই, অতন্দ্রদের প্রোজেক্টে রেটিং বেরোল। এবং অতন্দ্রর মতো দক্ষ ও একনিষ্ঠ সিনিয়র কর্মী একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে চার নম্বর অর্থাৎ সবচেয়ে বাজে রেটিং পেল।

জিনিয়া যে কাগজগুলো পাঠিয়েছে সেটা মিউচুয়াল ডিভোর্সের। জিনিয়া কোনো অ্যালিমনি অর্থাৎ খোরপোশ দাবি করেনি। লেকটাউনে যে ফ্ল্যাটটা ওদের দু-জনের নামে রয়েছে, সেটা যেহেতু মর্টগেজ দিয়ে লোন নেওয়া হয়েছে, সেই লোন শোধ করার দায়িত্ব জিনিয়া নিজে নিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর লোন শোধ হয়ে গেলে ফ্ল্যাটটা যেকোনো একজন কিনেও নিতে পারে, কিংবা দু-জনে মিলে কাউকে বিক্রিও করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে অতন্দ্রর মতামতই জিনিয়া মেনে নেবে। এ ছাড়া যৌথ সম্পত্তি বলতে ব্যাঙ্কের একটা ফিক্সড ডিপোজিট। সেই ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জিনিয়া অতন্দ্রর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে। চাইলে এখনই গিয়ে দু-জনে সই করে ভেঙে ফেলতে পারে। কিংবা ম্যাচিওরের পরও নিতে পারে।

অতন্দ্র লেখাপড়ায় বরাবর ভালো হলেও ইংরেজিতে পণ্ডিত বলা চলে না। দুর্গাপুর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওদের গ্রাম ছিল। ও মাধ্যমিক পর্যন্ত সেই গ্রামের স্কুলেই পড়েছে। ও ইলেভেনে ওঠার পর বাবা দুর্গাপুরে বাড়ি কেনেন। অঙ্ক বা অন্যান্য বিষয়ে খুব ভালো হওয়ায় রেজাল্ট ভালো হত বরাবর। কিন্তু ছোটোবেলায় ইংরেজির ভিতটা তেমন ভালোভাবে তৈরি না হওয়ায় আর পাঁচটা গ্রামের ছেলের মতো ও-ও শক্ত ইংরেজি বই কিংবা প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে হোঁচট খায়। আইটি সেক্টরে এত বছর হয়ে গেল, তবু এখানে সেই হাই, হ্যালো, কনগ্র্যাচুলেশনস, ওয়ার্নিং দিয়েই কাজ চলে যায়।

ইংরেজিতে পোক্ত ছিল জিনিয়া। এতটাই যে, যেকোনো লেখার ব্যাপারে অতন্দ্র জিনিয়াকে একবার দেখিয়ে নিত। জিনিয়ার যেমন শব্দের ভাণ্ডার, তেমনই বাক্যগঠনের ক্ষমতা।

আর সেইসব ক্ষমতাকে ঢেলে সাজিয়েই বোধ হয় ও এই এগ্রিমেন্টটা লিখেছে। অন্য কিছু হলে অতন্দ্র সাড়ে সতেরো পাতার এই বিশাল ইংরেজি ডকুমেন্টটা পড়তই না।

কিন্তু আজ পড়ল। ওদের অফিসে কুরিয়ার এলে একদম বাইরের গেটে বেরিয়ে এসে নিতে হয়। ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ও এসেছিল। কুরিয়ারের ছেলেটা সই করিয়ে খামটা হাতে ধরিয়ে চলে যেতে প্রেরকের নাম দেখে উত্তেজনায়, কৌতূহলে তখনই খামটা ছিঁড়ে ফেলেছিল।

ভেবেছিল জিনিয়ার রাগ বুঝি কমেছে। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর শুরু হতে বাকি আর মাত্র তিন সপ্তাহ, তার আগে সব মিটমাট করে ফেলতে চায় ও।

হ্যাঁ, মিটিয়ে নেবেই ভেবেছিল অতন্দ্র। সেদিন রাতে জিনিয়ার অন্যায় তখন যতটা মারাত্মক লেগেছিল, সময়ের সঙ্গে তার তীব্রতা এখন অনেকটাই থিতিয়ে গেছে। দিনের পর দিন ফ্ল্যাটের ঘরে একা একা শুয়ে নানারকমভাবে ভেবেছে ও, কখনো নিজের দিক থেকে, কখনো জিনিয়ার দিক থেকে। প্রচণ্ড রাগও স্তিমিত হয়েছে। একেকসময় ও নিজে উপলব্ধি করেছে, জিনিয়াকে সেদিন রাত আড়াইটের সময় বেরিয়ে যাওয়া থেকে আটকানো ওর উচিত ছিল।

গীতিকা বুদ্ধিমতী মেয়ে, এই নিয়ে সে অন্যদের সঙ্গে তো দূর, অতন্দ্রর সঙ্গেও একটা শব্দও খরচ করেনি। শুধু ওর সেই পাগলামি, হইহুল্লোড়টা কমে গেছে অফিসে। সেটা হয়তো শুধুই জিনিয়ার জন্য নয়, বিবস্বান বলে সেই কুলাঙ্গারটার জন্যও। দু-জনে পাশাপাশি বসে দিনের একটা বড়ো সময় কাজ করে, এমনি না বললেও কাজের ব্যাপারে টিম মেম্বাররা সবাই একে অন্যের সঙ্গে লিঙ্কড, তাই কথা বলতেই হবে। আর সেভাবেই ধীরে ধীরে অতন্দ্রর আড়ষ্টতা কেটেছে। স্বাভাবিক হয়েছে।

ভেবেছে, জিনিয়া যদি সত্যিই এগিয়ে আসে, আবার রিজাইন করবে ও। তখন আর তিন মাস নোটিশ পিরিয়ডেও থাকবে না, নিয়মমাফিক তিন মাসের মাইনে কোম্পানিকে মিটিয়ে দিয়ে প্রথম টুরে চলে যাবে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে।

আর সত্যিই তো। নিজের স্ত্রী যখন পছন্দ করছে না, তবু ও কেন এত বেশি ঘনিষ্ঠতা করছে গীতিকার সঙ্গে। জিনিয়া তো আগে কখনো এমনটা করেনি, অতন্দ্রর অনেক পুরোনো নতুন মহিলা সহকর্মী বা জুনিয়রকে ও চেনে।

শুধু গীতিকার বেলাতেই ও এমন করছিল মানে নিশ্চয়ই অতন্দ্রর দিক থেকে কিছু একটা ভুল হয়েছে। সে অতন্দ্র যতই নিজে জানুক যে গীতিকাকে ও একজন ভালো বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবে না, জিনিয়া সেটা না-ও ভাবতে পারে। কী দরকার তৃতীয় ব্যক্তির জন্য নিজেদের মধ্যে অশান্তি করার?

এইসব ভেবে করবে না করবে না করেও প্রথমে ও ফোন করেছিল ঋতুপর্ণাকে। ঋতুপর্ণা জিনিয়ার সহকর্মী আর এই মুহূর্তে বলতে গেলে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সারাদিন ওরা একই উইং-এ কাজ করে, আর জিনিয়ার ব্যবসাতেও ঋতুপর্ণা আর ওর স্বামী নানাভাবে সাহায্য করেছে।

ঋতুপর্ণা ফোন ধরেছিল। কী হয়েছে কেন হয়েছে সেসব বিশদে না গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল যা হয়েছে হয়েছে, অতন্দ্র এখন কী চাইছে।

অতন্দ্র প্রথমে একটু ইতস্তত করছিল। নিজে ছোটো হবে ভেবে কেমন যেন লাগছিল। তারপর বলেছিল, ‘আমি জিনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি একটু।’

‘ওকে কি তুমি ফোন করেছিলে একবারও?’ ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করেছিল।

‘না মানে …।’ অতন্দ্র বলেছিল, ‘সামনাসামনি কথা বললে ভালো হয়।’

ঋতুপর্ণা তখন ‘দেখছি’ বলে কেটে দিয়েছিল। আবার ফোন করেছিল দু-দিন পর। বলেছিল, ‘কিছু মনে কোরো না অতন্দ্র, আমি অনেক বোঝালাম। কিন্তু ও দেখা করতে চাইছে না কিছুতেই।’

ঝগড়ার পর মনে মনে বিরহে স্মৃতিতে জর্জরিত হলেও নিজেকে নত করতে প্রথমে কেমন লজ্জা লাগে। কিন্তু তারপর যখন দেখা অপরপক্ষ একেবারেই মিটমাট করতে রাজি নয়, তখন শত চেষ্টাতেও নিজেকে স্থির রাখার সংকল্প কীভাবে যেও খসে পড়ে যায়। তখন আর ইগো কাজ করে না। মনে হয় নিজেকে ধুলোয় মিশিয়েও মানুষটাকে নাহয় ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা হোক।

অতন্দ্ররও সেটাই হয়েছিল। ও দুমদাম রেগে যায়, কিন্তু রাগ পড়ে গেলে তখন খুব অস্থির লাগে। মনে হয় যেকোনো মূল্যে বিষিয়ে যাওয়া সম্পর্কটা যেন স্বাভাবিক করে। সেই ভেবেই ও ওসব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে অনেকদিন পর ফোন করেছিল জিনিয়াকে।

ওপারে রিং হতে শুরু করামাত্র ওর বুকের ভেতরটা দপদপ করতে শুরু করেছিল। কি বলবে ও?

ভাবতে ভাবতেই কেটে গিয়েছিল ফোনটা। তারপর ও আবার ডায়াল করেছিল। সেটাও বেজে বেজে কেটে গিয়েছিল।

তারপর পাঁচবার ফোন করেও জিনিয়ার গলা শুনতে পায়নি ও। জিনিয়া ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না, নাকি কোনো কারণে ফোনটা সাইলেন্ট রয়েছে, এইসব দোলাচলে ভুগতে ভুগতে ও তখন ওর জুনিয়র সায়কের ফোন থেকে একবার করেছিল।

একবার রিং হতেই জিনিয়ার গলা শুনতে পেয়েছিল অতন্দ্র, ‘হ্যালো?’

বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল ওর। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে অব্যক্ত একটা অস্বস্তি ওকে বাড়িতে, অফিসে, বন্ধুদের মেসে, দুর্গাপুরে কোথাও সুস্থির হয়ে থাকতে দিচ্ছিল না, যত হাসির প্রসঙ্গই উঠুক, বুকের মধ্যে কী একটা চিনচিনে বিরক্তি মেশানো ফাঁকা ভাব কাজ করছিল, সেটা যেন একলহমায় উবে গেছিল জিনিয়ার কণ্ঠস্বরটা শোনামাত্র।

নিজের গলাটা প্রাণপণ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে ও বলেছিল, ‘জিনি, আ-আমি বলছি। শুনতে পাচ্ছ?’

কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র। তারপরই খট করে কেটে গেছিল ফোনটা। অতন্দ্র তখন ভেবেছিল নেটওয়ার্কের গোলমাল, তড়িঘড়ি আবার ফোন করেছিল ও। কিন্তু জিনিয়া আর ফোন তোলেনি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অতন্দ্রর অস্থিরতা আরও বাড়ছিল। যে জিনিয়া যত রাগই হোক, ওর সঙ্গে কথা না বলে একদিনও থাকতে পারত না, সে কী করে পারছে এভাবে দিনের পর দিন থাকতে?

পরশুদিন অফিস থেকে ফিরে ও আর পারেনি, অনেক সংকোচ কাটিয়ে ফোন করেছিল জিনিয়ার মাকে।

শাশুড়ির সঙ্গে বরাবরই বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল অতন্দ্রর। তিনিই ফোনে বলেছিলেন জিনিয়া অফিস ছেড়ে দেওয়ার পর নিয়ম করে রোজ সল্টলেকের ওই গ্যারাজে গিয়ে অফিস খুলছে। প্রথম টুরের জন্য কাস্টমারও হয়েছে বেশ কয়েকজন। সঞ্জিতও খুব সাহায্য করছে।

অতন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সঞ্জিত কে? যে ইনডোরে স্টলের দায়িত্বে ছিল? ওর নাম তো বিকাশ!’

‘না না। বিকাশকে তো চিনি।’ জিনিয়ার মা ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বলেছিলেন, ‘সঞ্জিত হাজরা তো লখনৌ থেকে এসেছে। ফুলুদের কোম্পানির বড় পোস্টে ছিল। ও-ই সব ব্যবস্থা করছে।’

অতন্দ্র চুপ করে ছিল কয়েক মুহূর্ত। ও যে নেই, তাতে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কিছুই আটকাচ্ছে না তাহলে! ফুলু মানে জিনিয়ার মামা অম্বিকেশ সান্যাল। তিনিই তার মানে সব সাহায্য করছেন। ভালো।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে জিনিয়ার মা বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি অনেকবার ফোন করেছিলাম, অতন্দ্র। যেদিন ভোরবেলা জিনি দুম করে বাড়ি চলে এল, সেদিন থেকেই করেছিলাম। কিন্তু তুমি ফোন ধরনি।’

অতন্দ্র একটু লজ্জিত হয়ে নির্জলা মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘হ্যাঁ মা। আমি শুনতে পাইনি।’

‘তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে বলো তো?’ জিনিয়ার মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘জিনি তো জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলছে না। আরে বাবা, ঝগড়াঝাঁটি কোন স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে হয় না? তাই বলে দিনের পর দিন কথা বন্ধ রাখলে হবে? দেখাও করছ না, কথাও বলছ না, এভাবে তো দূরত্ব বাড়তে থাকবে। না অতন্দ্র, তুমি তো জানোই, জিনি চিরকালের মাথাগরম মেয়ে। দুমদাম কাজ করে, ভাবে না। ভাবলে অত ভালো চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নামতে পারত না। কিন্তু তুমি তো তা নও।’

অতন্দ্র একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ‘সামনের শনিবার ও থাকবে তো?’

‘তুমি কখন আসবে বলো?’ জিনিয়ার মা উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

অতন্দ্র বলেছিল, ‘সকাল বেলা।’

‘বেশ। আমি ওকে থাকতে বলব, কিন্তু এটা বলব না যে তুমি আসবে।’ জিনিয়ার মা বলেছিলেন, ‘তুমি আসার পর মিটমাট করে নিয়ো। আমি জানিনা কী হয়েছে, কিন্তু ব্যবসা যখন তোমরা শুরুই করেছ, নিজেদের মধ্যে ঝামেলা কোরো না। তোমরা এরকম করলে আমরা কী করে ভালো থাকি?’

আগামীকাল ছিল শনিবার। এই ক-টা দিন অতন্দ্র খালি ভেবেছে জিনিয়ার সামনে গিয়ে কী বলবে, কীভাবে কথা শুরু করবে। একটু নার্ভাসও ছিল ও।

কিন্তু তার আগে এটা কী!

অতন্দ্র অনেকক্ষণ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। চড়া রোদ এসে পুড়িয়ে দিচ্ছিল ওর গাল, হাত। কিন্তু ও ভ্রূক্ষেপ করছিল না।

ডেস্কে একটা কাজ অসমাপ্ত রেখে কুরিয়ার বয়ের ফোনে তড়িঘড়ি এসেছিল, এখুনি ওর ফিরে যাওয়া দরকার।

কিন্তু অতন্দ্র গেট থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। কার্ড পাঞ্চ করে একেবারে বাইরে গিয়ে রাস্তা টপকে ঢুকে গেল পার্কে। গ্রীষ্মকালের দুপুর একটায় পার্কে ভাজা ভাজা হতে কেউই আসেনা, গার্ডের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে ও গিয়ে বসে পড়ল একটা বেঞ্চে।

তারপর হাতে গোল করে পাকানো স্ট্যাম্পপেপারটা চোখের সামনে মেলে ধরল।

জিনিয়া ডিভোর্স চাইছে? অতন্দ্রর থেকে? ওদের এত বছরের সম্পর্ক একটা কালির আঁচড়ে শেষ করে দিতে চাইছে ও?

শুধু টাকাপয়সা, সম্পতি ভাগ হলেই হল? আর মন? কয়েক গিগাবাইট স্মৃতি? অজস্র মুহূর্তের অনুভূতি? সেগুলোকে কীভাবে টেনে দু-ভাগ করবে জিনিয়া?

ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারের একটা ভোকেশনাল ট্রেনিং নিতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল জিনিয়ার সঙ্গে। সল্টলেকের সেই ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ট্রেনিং এর জন্য দুর্গাপুরের ছেলে অতন্দ্রকে এক মাসের জন্য মেস ভাড়া নিতে হয়েছিল। জিনিয়া বাড়ি থেকেই আসত। প্রথমে ও জিনিয়াকে একদম সহ্য করতে পারত না। জিনিয়ার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে নেতৃত্বের। যেকোনো পরিবেশে, যত অচেনা মানুষের মধ্যেই হোক, আচমকা ঢুকে গিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই মধ্যমণি হয়ে পড়ত ও। ওখানেও তেমনই হয়েছিল। মোটা টাকা দিয়ে ওদের ট্রেনিংটা করানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও ঠিকমতো শেখাচ্ছিল না সংস্থাটা। প্রায়ই ট্রেনার থাকত না, কখনো সার্ভার গণ্ডগোল করত, কখনো হঠাৎ হঠাৎ ক্লাস বাতিল হয়ে যেত।

এই নিয়ে ওদের কুড়ি-পঁচিশজনের ব্যাচে সবাই অসন্তুষ্ট হত, কিন্তু সবাই আড়ালে আবডালে। একেকজন একেকটা কলেজ থেকে এসেছে, দু-দিনের আলাপে কেই-বা দল তৈরি করতে পারে?

কিন্তু জিনিয়া করেছিল। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে রীতিমতো বিক্ষোভ দেখিয়েছিল, তারপর সেই সংস্থার ডিরেক্টরকে হুমকি দিয়েছিল ঠিকমতো শেখানো না হলে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখবে বলে।

তাতে কাজ হয়েছিল। সবাই জিনিয়ার ওপর খুশি হলেও অতন্দ্রর তখন বিরক্তই লাগত। মনে হত এই মেয়েটা একটু বেশিই বাচাল প্রকৃতির। ও ইচ্ছে করেই জিনিয়াকে এড়িয়ে যেত তখন।

কিন্তু ট্রেনিং-এর শেষ সপ্তাহে হঠাৎই করেই একদিন কলকাতায় বাস ধর্মঘট ডেকেছিল বাস ইউনিয়ন। সেদিন অতন্দ্র দুর্গাপুরে ফিরছিল। জিনিয়া আর ও সেদিন একসঙ্গে ট্যাক্সি করে স্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিল। তখনই ও আবিষ্কার করেছিল মেয়েটার মধ্যে একটা অন্যরকম মন আছে।

জিনিয়ার সবচেয়ে বেশি যেটা ওর ভালো লেগেছিল, সেটা হল ওর উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষমতা আর প্রচণ্ড একটা উদ্যমী মন। সবসময় নতুন কিছু করতে চাইত জিনিয়া। আর সেইজন্য ঝুঁকি নিতে একটুও ভয় পেত না মেয়েটা।

পার্কের বেঞ্চে অতন্দ্র এমনভাবে বসেছিল যে রোদটা একদম সরাসরি ওর মুখে পড়ছিল। নিতান্ত উন্মাদ না হলে কেউ এই খটখটে রোদে এইভাবে খোলা জায়গায় বসে থাকে না। দূরে টেকি ওয়ার্ল্ডের যেসব কর্মচারীরা বাইরে কোনো কাজে এসেছিল, তারা ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল।

কিন্তু অতন্দ্র সেসবে ভ্রূক্ষেপ করল না। গোল করে পাকানো কাগজটা হাতের মুঠোয় জোরে চেপে ধরে হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে ও হু-হু করে কেঁদে ফেলল।

এসব কোথা থেকে কী হয়ে গেল? ওর জীবনে তো জিনিয়ার আগে পরে কোনো নারীই আসেনি। জীবনে একজনকেই ও ভালোবেসেছিল। জিনিয়ার সঙ্গে আলাপের আগে কলেজ আর খেলা নিয়েই থাকত ও। জিনিয়া ধীরে ধীরে ওর জীবনে জায়গা করে নিচ্ছিল, আর ও-ও ততই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল জিনিয়ার প্রতি। জিনিয়া চলে যাওয়ার পর এই ক-দিনেই ওর সবকিছু ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। ফ্ল্যাটের বিছানাপত্র, জামাকাপড়ের কোনো ছিরিছাঁদ নেই, মঙ্গলাদিও তারপর থেকে আসেনি, দুবেলা হোটেলের খাবার খেয়ে খেয়ে মুখ ও পেট দুটোই খারাপ হচ্ছে ওর।

আগে কখনো এত ঘন ঘন দুর্গাপুর যেত না, বিয়ের পর তো একা কোনোদিনও যায়নি। কয়েক সপ্তাহ পরপর যাওয়ার পর ওর নিজের বাবা-মা-ও সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মা-ও দু-বার জিজ্ঞেস করেছে জিনিয়া আসছে না কেন।

অতন্দ্র অসহায় চোখে বেঞ্চে হেলান দিল। ও কী করবে এখন? পালটা রাগ দেখিয়ে কাগজটায় সই করে পাঠিয়ে দেবে? নাকি সব মিটমাট করে নেবে?

সাদা চোখে ও কতক্ষণ যে তাকিয়েছিল, ও নিজেই জানে না, রোদের তাপে ওর মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছিল। এমন সময় ফোন বাজল।

কৌশিকদা ফোন করছে। কৌশিকদা ওদের প্রোজেক্টের ম্যানেজার। কৌশিকদার আন্ডারে অতন্দ্রর মত তিনজন সিনিয়র স্টাফ রয়েছে। তাদের নীচে রয়েছে গীতিকা, সায়কদের মতো জুনিয়ররা।

অতন্দ্র ফোনটা রিসিভ করল। কৌশিকদা সম্ভবত ওর কিউবিকলে গিয়েছে কোনো প্রয়োজনে, ওকে না পেয়ে ফোন করছে। ও বলল, ‘হ্যাঁ, বলো।’

কৌশিকদা বলল, ‘তুই কোথায়?’

‘আমি একটু বাইরে এসেছি। দশ-পনেরো মিনিট পরে ফিরব।’ অতন্দ্র বলল, ‘কিছু দরকার আছে? থাকলে দৃপ্তকে বলো। আমি আসছি একটু পরেই।’

‘তুই এখুনি আয়।’ কৌশিকদা একটু থেমে বলল, ‘রেটিং বেরিয়েছে। একটা গোলমাল হয়ে গেছে।’

‘কী গোলমাল?’ অতন্দ্র তখনও বুঝতে পারেনি। এটা তো বছরের রেটিং বেরনোরই সময়। প্রতিটা প্রোজেক্টেই এক এক করে রেটিং বেরোচ্ছে। ওদের প্রোজেক্টেও হয়তো আজ বেরিয়েছে। তাতে গোলমালের কী আছে? কৌশিকদা ওর ম্যানেজার, কৌশিকদাই ওর সারাবছরের কাজের ভিত্তিতে রেটিং দেবে। ম্যানেজার হলেও কৌশিকদার সঙ্গে ওর সম্পর্ক খুবই বন্ধুর মতো। সারাবছর ও নিজে তো ভালো কাজ করেইছে, কৌশিকদার ম্যানেজারিয়াল কাজও করে দিয়েছে অনেক।

অন্যদিকে ও রেটিং দিয়েছে সায়ক আর নবনীতাকে। ওর আন্ডারে গীতিকাকে নিয়ে এই তিনজন জুনিয়র, কিন্তু গীতিকা ঢুকেছে মাত্র কয়েকমাস, তাই ওর এই বছর কোনো রেটিং হবে না।

 অতন্দ্র নিজেকে সামলে নিয়ে অফিসের ভেতর ঢুকল। নিজের কিউবিকলে গিয়ে বসতে-না-বসতে উলটোদিকের ডেস্ক থেকে সায়ক আর নবনীতা ওর দিকে উজ্জ্বল মুখে তাকাল, ‘রেটিং বেরিয়েছে অতন্দ্রদা। দুই পেয়েছি দুজনেই। থ্যাঙ্ক ইউ!’

অতন্দ্র কিছু না বলে মৃদু হাসল। ওর মনের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে, কিন্তু এখন সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না।

সায়ক, নবনীতা, দু-জনেরই এটা প্রথম রেটিং, একটা অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে এইসময়। ভালো রেটিং পেলে কাজ করার উৎসাহও বেড়ে যায় অনেকগুণ। তাই দু-জনকেই অতন্দ্র ‘এক’ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মারাত্মক পরিমাণে কাজ না করলে ‘এক’ দিলেও ওপরমহল সেটা কমিয়ে দেয়।

আর অতন্দ্ররা হল পুরোনো পাপী, সারাবছর কাজ করে, আর প্রতিবার সেই রুটিনমাফিক ‘দুই’ পেয়ে আসে। দৈবাৎ কোনো বছর ‘এক’ পেয়ে গেলে আরও চাপ। সেই কুমিরছানা দেখিয়ে পরের বছর আরও কাজ ঠেলে দেয় ম্যানেজমেন্ট। তাই এখন মনে হয় ‘এক’ না পেলেই ভালো।

এখন আর ওদের জীবনে আর কোনো উত্তেজনা নেই, টিকে থাকা নিয়ে কথা।

অতন্দ্র ডেস্কে রাখা ফাঁকা জলের বোতলটা নিয়ে কৌশিকদার কিউবিকলের দিকে পা বাড়াল। ওখানেই জলের লাইন রয়েছে, অতন্দ্র একেবারে জল ভরে নিয়ে আসবে।

শুধু আই টি সেক্টর নয়, কর্পোরেট জগতের প্রতিটা অফিসই পাশ্চাত্য ঘরানায় তৈরি। পুরোনো দিনের সরকারি অফিসের মতো এখানে কোনো চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থাকে না, যারা টেবিলে টেবিলে জল বা ফাইল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। হ্যাঁ, গোটা অফিস পরিষ্কার করা, বাথরুম পরিষ্কার করা, বাগান পরিচর্যা এই প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা এজেন্সিকে কনট্র্যাক্ট দেওয়া আছে, তারাই গোটা অফিসকে ঝকঝকে রাখে। আর অতন্দ্রর মতো কর্মীদের নিজের কাজ নিজেকেই করে নিতে হয়।

কৌশিকদা ওকে দেখেই কেমন গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বোস।’

‘আমি এখনও মেল খুলিনি। রেটিং বেরিয়েছে শুনলাম।’ অতন্দ্র বলল, ‘আমার দুই তো?’

কৌশিকদা বলল, ‘ওই ব্যাপারেই তোর সঙ্গে কথা বলব বলে ডেকেছি। আমি তোরটা আর টেস্টিং টিমের মৈনাকেরটা ‘এক’ দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এবার একটা নিয়ম হয়েছে। প্রতিটা প্রোজেক্টে বড়জোর একজনকে ‘এক’ দেওয়া যাবে।’

‘বুঝেছি। মৈনাকেরটা ‘এক’ রেখেছে আর আমারটা কমিয়ে ‘দুই’ করে দিয়েছে তো?’ অতন্দ্র হাসল, ‘ধুস! এত বছর চাকরি হয়ে গেল, এক আর দুই-এ কী যায় আসে বলো তো? ওসব ছাড়ো। নতুন টাস্ক কিছু এল অনসাইট থেকে?’

কৌশিকদা একটু থামল। তারপর বলল, ‘পুরোটা শোন। সঙ্গে এটাও নিয়ম করেছে যে প্রোজেক্টের একজনকে ”চার” দিতেই হবে।’

‘এটা আবার কীরকম হল? কেউ যদি বাজে না কাজ করে, তাহলেও ”চার” দিতে হবে?’ অতন্দ্র বলল।

‘হ্যাঁ।’ কৌশিকদা বলল, ‘এবারের ফিনানশিয়াল ইয়ারে টেকি ওয়ার্ল্ড কয়েকশো কোটি টাকা লস করেছে। তাই হেড অফিস থেকে সার্কুলার এসেছে কিছু কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। আর সেটা সিনিয়র লেভেল থেকে। জুনিয়ার লেভেলে মাইনে কম, ওদের নিয়ে কোম্পানির অত মাথাব্যথা নেই। সিনিয়র লেভেলে মাইনে বেড়ে গেছে, একটা সিনিয়র ছেঁটে দিয়ে ওই একই মাইনেতে দুটো বা তিনটে জুনিয়রকে দিয়ে কাজ গোছানোটাই এখন এইচ আর স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে। তাই ইচ্ছে করে প্রতি প্রোজেক্টে একটা-না-একটা সিনিয়রকে দেখছি ‘চার’ দিয়েছে। তোরটাও তাই।’

অতন্দ্র অলসভাবে কৌশিকদার কথাগুলো শুনছিল, কিন্তু মনে মনে ভাবছিল জিনিয়ার পাঠানো কাগজটার কথা। কিন্তু কৌশিকদার বলা শেষ দুটো শব্দে ও হাঁ হয়ে গেল, ‘আমাকে ”চার” দিয়েছে? মানে? কেন?’

অতন্দ্রর অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘এক’ পাওয়া যেমন শক্ত, ‘চার’ পাওয়াও তেমনই শক্ত। কেউ ভালোভাবে কাজ না করলেও তাকে ‘তিন’ দেওয়া হয়, ‘তিন’টাই বলতে গেলে সবচেয়ে বাজে রেটিং। ওপরমহলের সঙ্গে ঝামেলা, ক্লায়েন্টের সঙ্গে তর্কাতর্কি এই জাতীয় কিছু মারাত্মক গণ্ডগোল, কিংবা বহুদিন ধরে কোনো প্রোজেক্টে না ঢুকে বেঞ্চে থাকা, এইসব না করলে কেউ ‘চার’ পায় না।

সেখানে ও এত বছর রয়েছে এই ব্যাঙ্কিং প্রোজেক্টে, ওর টেকনিক্যাল স্কিল গোটা ডোমেনে সুবিদিত। ওকে কী করে ‘চার’ দেওয়া হল?

অতন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে কৌশিকদা বলল, ‘আসলে তুই যেসময় রিজাইন করেছিলি, নোটিশ পিরিয়ডে ছিলি, সেইসময়েই আমি তোর ‘এক’ রেটিং পাঠিয়েছিলাম। আমার ওপরে যে এইচ আর ম্যানেজার বসে আছে, তাকে তো এবারের নিয়ম অনুযায়ী প্রোজেক্টের একজনকে ‘চার’ দিতেই হবে। তুই তো বেরিয়েই যাচ্ছিস, সেই ভেবে ও তোরটা ‘চার’ করে দিয়েছে। তারপর তুই রেজিগনেশন উইথড্র করেছিস, কিন্তু রেটিং তো তার আগেই চলে গেছে। সিস্টেমে আর মডিফাই করা যায়নি। তাই এই গণ্ডগোল।’

অতন্দ্রর মাথায় আর কোনো কথা ঢুকছিল না। আজ ও কার মুখ দেখে উঠেছিল? একদিকে জিনিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ডিভোর্সের চিঠি, অন্যদিকে টেকি ওয়ার্ল্ড থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার খবর। ও কী করবে এবার?

কয়েক সপ্তাহ আগেও এই ‘চার’ পাওয়ার খবর পেলে ওর কিছুই মনে হত না। আই টি জগৎ থেকেই ও বিদায় নেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছিল, কে কী রেটিং দিচ্ছে তা নিয়ে ও আর কী করত?

কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত!

কেউ ‘চার’ পেলেই যে তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হয়, তা নয়। সেই বছরে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে পুরোটা। কিন্তু এবারে টেকি ওয়ার্ল্ডের অত টাকা ক্ষতির খবর তো সবাই জানে, মার্কিন শেয়ার বাজারেও হু-হু করে দাম পড়ছে টেকি ওয়ার্ল্ডের, এবার তো ‘চার’ পাওয়াদের আর থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

ও আকাশ-পাতাল ভাবছে, এমন সময় কৌশিকদা বলল, ‘তোর ব্যাপারটা আমাদের ব্যাঙ্কিং ডোমেইনের ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ বসুকে আমি একটু আগেই বলেছি। তুই টেকি ওয়ার্ল্ডের অ্যাসেট, তোর মতো টেকনোলজির স্কিল খুব কম লোকের আছে। তুই কোম্পানি ছেড়ে দিবি শুনে তাই সবাই দুঃখই পেয়েছিল। সময়ের গণ্ডগোলের জন্য একটা ভুল হয়ে গেছে, সেটার মাশুল তুই দিবি, সেটা তো হতে পারে না।

অতন্দ্র শূন্যদৃষ্টিতে কৌশিকদার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, ‘তাহলে?’

‘অনিরুদ্ধ স্যার একটা উপায় বাতলেছেন। সেই ব্যাপারেই তোকে ডেকেছি।’ কৌশিকদা বলল, ‘আমার সঙ্গে চল ওঁর কেবিনে।’

২১

ঋতুপর্ণা বলল, ‘ভদ্রলোকের নাম আকবর আলি। ইমরানের যে চাচা এই গ্যারাজের মালিক, তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্ত্রী মারা গিয়েছেন, ছেলেমেয়ে নেই। হাওড়ার দিকে বড়ো হার্ডওয়্যারের দোকান আছে দুটো। ঘুরতে ভালোবাসেন। তোদের এই প্যাকেজ শুনে ইমরানকে ফোন করেছিলেন। নিয়ে যাবি?’

জিনিয়া উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘অবশ্যই। নাহ, ইমরানদাকে আমায় একদিন খাওয়াতেই হবে। আমার অনেক উপকার করছে রে।’

‘আর আমি?’ চোখ পাকাল ঋতুপর্ণা, ‘আমি বুঝি কিছুই উপকার করছি না? আমি বাদ?’

জিনিয়া মুখ টিপে হাসল, ‘অবশ্যই বাদ। উপকার তো করিসইনি, উলটে অপকার করছিস।’

‘কীরকম?’ ঋতুপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

জিনিয়া হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, ‘সেটা তুই খুব ভালো করে জানিস।’

ঋতুপর্ণা ইচ্ছে করেই জিনিয়ার মুখ খোলাতে চাইল, ‘না। সত্যিই জানিনা, তুই কী বলতে চাইছিস।’

‘কিছু না। ছাড়। লোকজনের হয়ে ওকালতি করাটা বন্ধ কর। আর ভদ্রলোকের নম্বরটা দিয়ে দিস, আমি কথা বলে নেব।’ জিনিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে কথাটা বলে চেয়ারে হেলান দিল। কোমরের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। সেইজন্যই একরকম বাধ্য হয়ে এক সপ্তাহ হল একটু আরামদায়ক এই চেয়ারটা কিনেছে ও। আর সব সহ্য করলেও কোমরের পুরোনো ব্যথাটার জন্য চাইলেও বেশিক্ষণ ওই প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

এই চেয়ারে বসলে বেশ আরাম হয়, কোমরের ব্যথাটা একটু কম মনে হয়। ওর হঠাৎ মনে পড়ে গেল, অফিস থেকে ফিরে যেদিন কোমরের ব্যথা ওর ভীষণ বাড়ত, রাতের বিছানায় অতন্দ্র মালিশ করে দিত। তাতে যে জিনিয়ার খুব আরাম হত তা নয়। অতন্দ্র তো মালিশের কায়দাকানুন জানত না, বরং ওর হাতের প্রচণ্ড চাপে বেশ ব্যথাই লাগত জিনিয়ার। বার বার বলত আস্তে করে মালিশ করার জন্য। তাতেও হত না, শেষে রেগেমেগে ও বলত, ‘যাও, মালিশ করতে হবে না তোমায়। হাত তো নয় যেন লোহা। ইচ্ছে করে এত জোরে দিচ্ছ!’

আজ সেই কথাগুলো মনে পড়তে জিনিয়ার কেমন যেন মনে হল পূর্বজন্মের কোনো চিত্রনাট্য ঘটনা সেটা। স্থান, কাল সবই এক আছে, শুধু পাত্রপাত্রী আর নেই। তাই চিত্রনাট্য আমূল বদলে গেছে।

ঋতুপর্ণা আজ জিনিয়ার গ্যারাজ অফিসে এসেছে। ওর স্বামী ইমরানের এদিকে কিছু কাজ রয়েছে, ঋতুপর্ণাকে নামিয়ে দিয়ে সে চলে গেছে। আসার সময় আসবে।

আজ সকাল থেকে জিনিয়া একমনে কাজ করছিল। যে কয়েকজন যাত্রী হয়েছে, তাঁদের ভিসাগুলো একবার প্রসেস করতে হবে। সেইজন্য ফুলুমামা ওর সঙ্গে এক এজেন্টের কথা বলিয়ে দিয়েছেন।

অফিসের পালা এখন চুকেছে, এখন ও পুরোপুরি ব্যবসায় মন দিতে পারছে। বিশেষ কোথাও যাওয়ার না থাকলে নিয়মিত অফিসও খুলে বসছে। পার্ক স্ট্রিটে লিফলেট বিতরণ আর খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর বেশ ভাল রেসপন্সও পেয়েছে। নামি কোম্পানির অফিস থেকে বেরনোমাত্র এত কম টাকায় ভ্রমণের হ্যান্ডবিল পেয়ে অনেকেই ফোন করে জানতে শুরু করেছে। অন্য কোম্পানির চেয়ে ওদের টাকাটা অনেকটাই কম, আর তা ছাড়া মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়ে ঘুরে আসার ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অভিনব। ওর এই অফিসেও টুকটাক লোক আসছে।

যত দিন যাচ্ছে ও যেন আরও বেশি করে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের মধ্যে ঢুকে পড়ছে।

একটা ব্যাপারে জিনিয়ার আন্দাজ একদম ঠিক ছিল। মানুষের প্রকৃতি বড়ো অদ্ভুত। সাধ্য বা সামর্থ্য থাকলেও সবকিছু সে ফ্রি-তে পেতে চায়। এই ফ্রি-তে পাওয়ার ইচ্ছে বড়ো সাংঘাতিক, এই প্রবণতাই জন্ম দেয় মাইনের বাইরেও উৎকোচে প্রলোভন বা পণের মতো লোভগুলোকে।

তা ছাড়া এখনকার নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। বিলাসিতায় গা ভাসাতে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ জনই সব কিছু ইএমআই তে কিনতে চায়। তারা ভাবে পরে যত টাকা মাসে মাসে কাটে কাটুক, সে পরে দেখা যাবে। তাই দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের এই ইএমআই-তে ঘোরার সুযোগ ওদের আরও আকর্ষণ করেছে। বিদেশ ভ্রমণ অনেকের কাছেই এখন ঘোরার চেয়েও স্টেটাস দেখানোর উপায়। তাই আপাতত দশ হাজার টাকা দিয়ে ঘুরে এসে পরে টাকা শোধ করার প্রস্তাবে অনেকেই উৎসাহিত হয়েছে।

ওর পাশের আরেকটা টেবিলে কাজ করছে বিকাশ। আপাতত সব লিফলেট গুছিয়ে নিচ্ছে সে। একটু পরেই ও রোজকার মত বেরিয়ে যাবে বড় বড় টুর এজেন্সির অফিসের সামনে লিফলেট বিতরণে।

জিনিয়া বলল, ‘বিকাশ, যাওয়ার আগে তুই আমাদের জন্য একটু চা নিয়ে আসিস সামনের দোকান থেকে।’

‘না না, এখন কি!’ ঋতুপর্ণা বাধা দিল, ‘এই তো বললি তোর মামা আর কে একজন আসবে। তাঁরা এলে একসঙ্গেই না হয় …।’

‘আচ্ছা বেশ।’ জিনিয়া সম্মতি দিল।

আজ ফুলুমামা আর সঞ্জিত গিয়েছেন ইটালির হাইকমিশন অফিসে। যেকোনো একটা দেশের ভিসা করালেই ইংল্যান্ড বাদে বাকি সবকটা দেশ ঘোরার অনুমতি পাওয়া যাবে। ফুলুমামা বলছিলেন, টুর প্যাকেজ অনুযায়ী ইংল্যান্ড থেকে ওঁরা ফ্রান্সে ঢুকবেন প্রথমে, তাই ফ্রান্সের ভিসা করানোই ভালো।

কিন্তু সঞ্জিতই বলেছিলেন ইটালির ভিসা করানোর কথা। ওঁর নাকি ইটালি হাইকমিশনে বেশ কিছু চেনাজানা আছে, কোনো অসুবিধা হবে না ইন্টারভিউয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে।

সঞ্জিত হাজরা লোকটাকে যত দেখছে, ততই অবাক হয়ে পড়ছে জিনিয়া। অত ভালো চাকরি এক মুহূর্তে চলে গেলে মানুষের অবসাদের চূড়ায় উঠে যাওয়ার কথা, কিন্তু সঞ্জিতের মনে তা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। প্রথম প্রথম যখন ইন্টারনেটে জিনিয়ার সঙ্গে কথা হত, তখন বলতেন, ‘আমার চাকরি চলে গেছে বলে আমি আপনার বিজনেসে যোগ দিচ্ছি, তা কিন্তু নয়, জিনিয়া। গ্লোবাল টুরস ছাড়ার পরের দিন থেকে দেশের প্রথম সারির টুর এজেন্সিগুলো থেকে অন্তত পাঁচখানা অফার পেয়েছি আমি। তবুও সেগুলোকে নাকচ করে কেন আপনার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছি, জানেন?’

জিনিয়া বলত, ‘না। জানি না। আমি তো আপনাকে অসংখ্যবার বলেছি, আপনাকে রাখার ক্ষমতা আমার কোম্পানির এখনো হয়নি…।’

‘জানি। আমি স্বেচ্ছায় আপনার কোম্পানিতে যোগ দিচ্ছি। তার দুটো কারণ আছে। আমি গ্লোবাল টুরসে চাকরি করতাম টাকার জন্য নয়, নিজের খুশির জন্য। আমার নিজের যা সম্পত্তি আছে, খুব বিলাসিতার মধ্যে থাকলেও তা আমার শেষ করতে পারার কথা নয়। আমি নিজে বিয়ে করিনি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমার কোনো সাংসারিক দায় নেই। গ্লোবাল টুরস যে প্রতারণাগুলো কাস্টমারদের সঙ্গে করে, সেটা প্রতিটা নামি কোম্পানিই করে। এটা প্রথম কারণ। আর দ্বিতীয় কারণটা শুনলে আপনি হাসবেন। তাই এখন বলছি না। কলকাতায় তো যাচ্ছি, গিয়েই বলব নাহয়।’

সঞ্জিত হাজরা যখন কলকাতায় এসেছিলেন, ততদিনে জিনিয়া খড়দার বাড়িতে আলাদা থাকতে শুরু করেছে। সঞ্জিত উঠেছিলেন এয়ারপোর্ট সংলগ্ন একটা দামি হোটেলে। জিনিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সেই হোটেলের পাশেই একটা ছোটো কফিশপে।

সঞ্জিত হাজরার বয়স আন্দাজ বিয়াল্লিশ, সুঠাম দোহারা চেহারা, সুন্দর মুখশ্রী। ধূসর রঙের একটা জিনসের সঙ্গে তিনি একটা হালকা বেগুনি রঙের টি শার্ট পরে বসেছিলেন। হাতে ছিল একটা বই।

প্রথম দেখাতেই সঞ্জিত বেশ অবাক হয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেখলেও জিনিয়া যে এত অল্পবয়সি, তা নাকি উনি ধারণা করতে পারেননি। সেদিনই বলেছিলেন দ্বিতীয় কারণটা। ওঁর বাবা ছিলেন কলকাতার ছেলে, কিন্তু মা বাঙালি হলেও জন্ম বেড়ে ওঠা ছিল লখনৌতেই। সঞ্জিতের মা লখনৌর খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন, কলকাতায় কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে এসে দেখা হয়েছিল সঞ্জিতের বাবার সঙ্গে।

 সঞ্জিতের বাবা ছিলেন সাধারণ পরিবারের ছেলে, শিক্ষকতা করতেন একটা সরকারি স্কুলে। সঞ্জিতের মা ক্ষণিকের আবেগে ভালোবেসে বিয়েটা করলেও তাঁর মায়ের উচ্চবিত্ত বাবা কোনোদিনই ওই বিয়েটা মানতে পারেননি। বিয়ের বছর দশেক পর দু-জনের বিয়েটাও ভেঙে যায়, সঞ্জিতের মা সঞ্জিতকে নিয়ে ফিরে যান লখনৌতে তাঁর বাবার কাছে।

এই পুরো ঘটনাটা বলে সঞ্জিত সেদিন বলেছিলেন, ‘জানেন জিনিয়া, কলকাতায় একটা সরু গলিতে অন্ধকার একটা বাড়ির একটামাত্র ঘরে আমরা ভাড়া থাকতাম। টিনের বাক্স হাতে করে সামনের স্কুলে যেতাম। বাবা রোজ স্কুল থেকে ফিরে আমায় পড়াতেন, দেশ-বিদেশের গল্প শোনাতেন। লখনৌতে গিয়ে আমাকে বিশাল দামি একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হল ক্লাস ফাইভে। এক লহমায় যেন আমার জীবনে বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছিল তখন। ছিলাম সাধারণ গরিব ঘরের একটা ছেলে, হঠাৎ করে হয়ে গেলাম ধনী পরিবারের সদস্য। বাবা তার পরেও একবার নিতে এসেছিলেন আমাদের, কিন্তু মা যাননি। পরে দু-জনের ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর থেকে বাবাকে আর কোনোদিনও দেখিনি। কোনো যোগাযোগও ছিল না।’ এক মুহূর্ত থেমেছিলেন সঞ্জিত, ‘কিন্তু যোগাযোগ না থাকলেও জীবনের ওই প্রথম দশ বছরে আমার মধ্যে অনেক কিছুর বীজ রোপণ করে দিয়েছিলেন বাবা। শিখিয়েছিলেন বাংলা ভাষা, গল্পের বই পড়া, শিখিয়েছিলেন কী করে মাটির কাছাকাছি থাকতে হয়। আর ওই শেখানোর জন্যই পরবর্তী জীবনে বিলাস বৈভবের মধ্যে থাকলেও আমার চরিত্র থেকে সেই মধ্যবিত্তসুলভ মূল্যবোধ, সততাগুলো কিছুতেই চলে যায়নি। মাঝে মাঝেই এগুলো আমাকে জর্জরিত করতে থাকে। তখনই কোথাও কোনো প্রতারণা বা প্রতিবাদ হচ্ছে দেখলে আমি খেপে যাই। আপনি ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছিলেন, আপনার কথার মধ্যে আমি সততা খুঁজে পেয়েছিলাম। তা ছাড়া লখনৌতে গিয়ে আর বাংলা পড়ার আর সুযোগ না হলেও আমি ভাষাটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আপনার পুরো টুর বাংলায় গাইড করার পরিকল্পনাটাও আমার খুব ভালো লেগেছিল।’

জিনিয়া বলেছিলেন, ‘আপনার বাবা কলকাতার কোথায় থাকেন?’

সঞ্জিত হাজরা একটা নিশ্বাস ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জানি না। কোনো যোগাযোগই তো নেই। আমার লখনৌয়ের বাড়িতেও কেউ নেই। বিয়ে করিনি। মা-ও জীবিত নেই। তাই এতদিন জীবনের সবটুকু গ্লোবাল টুরসেই ঢেলে দিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে আলাপ হতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, লখনৌ ছাড়ব। মা যা রেখে গিয়েছেন, টাকার প্রয়োজন আমার নেই। বরং কলকাতায় থেকে বাংলাটা শিখব।’

‘কেন বাংলা তো আপনি ভালই জানেন দেখছি!’ জিনিয়া হেসেছিল।

‘সে তো এমনি কথা চালানোর মতো জানা।’ সঞ্জিত বলেছিলেন, ‘আমি বাংলা ভাষাটা ভালো করে শিখতে চাই। ছোটোবেলায় বাবা আমাকে সুকুমার রায়, লীলা মজুমদারের গল্প শোনাতেন। সেগুলো নিজে আরও একবার পড়তে চাই আমি। আর আরও একটা ইচ্ছে আছে। বাবার সন্ধান করা। দেখি, যদি পাই।’

‘কি নাম আপনার বাবার?’ জিনিয়া জিজ্ঞেস করেছিল।

‘উদয় হাজরা। শেষ খবর অনুযায়ী, উনি থাকতেন আহিরিটোলায়। পড়াতেন সাউথের দিকের কোনো স্কুলে। মা আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর স্কুল ছাড়াও বাবা বাড়িতে টিউশনি পড়াতেন। সবাই ওঁকে উদয় স্যার নামে চিনত। মায়ের এক ভাইয়ের সঙ্গে ওঁর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু শেষ কুড়ি বছর আর কোনো চিঠি চালাচালি হয়নি।’ সঞ্জিত হঠাৎই প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাই দ্য ওয়ে, আমার এসব পুরোনো কাসুন্দি ছাড়ুন। আপনার পুরো প্ল্যানটা আরেকবার বলুন তো।’

সেদিন জিনিয়া বাড়ি ফিরেছিল খুব খুশি মনে। এতদিন ও যেভাবে পুরো পরিকল্পনাটা করেছিল, সঞ্জিত সেটাকে অনেক পরিণত একটা রূপ দিয়েছেন। কিছু পয়েন্টের প্রশংসা করেছে, কিছু পয়েন্ট নাকচ করে দিয়েছেন যুক্তি দেখিয়ে। জিনিয়ার মনে হয়েছিল, ব্যক্তিগত জীবনে ও এখন যতই রক্তাক্ত হোক না কেন, ফুলুমামা আর সঞ্জিত হাজরার মতো দু-জন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা পাওয়াটা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। ফুলুমামা অফিস সম্পর্কিত ব্যাপারে আর সঞ্জিত টুরের বিষয়ে ওকে প্রচুর সাহায্য করছেন।

এক মুহূর্তের জন্য অতন্দ্রর সঙ্গে শেষ কথা হওয়ার দিনটা ওর মনে পড়েছিল। অতন্দ্র ওকে গালাগাল দিতে দিতে বলেছিল অতন্দ্রকে ছাড়া ও নাকি দাশগুপ্ত ট্রাভেলস চালাতেই পারবে না, রীতিমতো হুমকি দিয়েছিল যে জিনিয়া এবার মুখ থুবড়ে পড়বে।

কথাটা মনে হওয়ামাত্র দাঁতে দাঁত চেপেছিল জিনিয়া। সেই উপহাস করে বলা কথাগুলোর জবাব ও দেবে ওর কাজ দিয়েই। দেখিয়ে দেবে ও। প্রমাণ করে দেবে যে, ও গীতিকা বলে মেয়েটার মতো নয়, যে দিনের মধ্যে চল্লিশবার মানুষকে ফোন করে করে সাহায্য চায়।

ও পরজীবী নয়। কারুর ওপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় না। অতন্দ্রর মতো বিশ্বাসঘাতকের ওপর তো নয়ই।

এখন ও নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। প্রথমদিকে একটা একটা করে দিন যেত, আর সারাদিন ওর কেমন যেন অস্থির লাগত। হঠাৎ হঠাৎ পুরোনো একেকটা বিচ্ছিন্ন সুখস্মৃতি মনে পড়ে যেত, আর শরীরে কাঁপুনি দিত। এক লহমার জন্য মনে হত সব অভিমান, সব ইগো মুছে ফেলে ফোন করে অতন্দ্রকে, অন্তত ওর গলাটা শোনে।

কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে প্রাণপণ সংবরণ করত জিনিয়া। অভিমান, ইগো সব সরিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু শেষদিনে অতন্দ্রর বলা কথাগুলোকে মুছে ফেলা যায় না। কোথায় যেন একবার পড়েছিল ও, রাগের সময় মানুষের মনের অবচেতনের কথাগুলো বেরিয়ে আসে।

এতবছর অতন্দ্রর সঙ্গে ও থেকেছে, সংসার করেছে, ওর বিরুদ্ধে অতন্দ্রর যে প্রচণ্ড রাগ, ঘৃণা পুঞ্জীভুত হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে, তা টেরই পায়নি ও।

অতন্দ্রর কথা, ওর সাড়ে তিন বছরের সংসারের কথা কাজের ফাঁকে মনে পড়লেই কেমন দুর্বল হয়ে পড়ে ও, মনে হয় এই কর্মোদ্যম কোথায় কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে। তাই যতটা সম্ভব ও কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চায়।

বাড়িতে বাবা-মা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। বুঝে গিয়েছে যে, জিনিয়া কিছুতেই সমস্যাটা খুলে বলবে না। অম্বিকেশও এখন অতন্দ্রর প্রসঙ্গ তুলে ওকে বিব্রত করেন না।

জিনিয়া টাকাপয়সার ব্যাপারে বরাবর স্বচ্ছ থাকতে পছন্দ করে। সকলের কাছে। তাই ওদের যৌথ সম্পত্তি ও ফ্ল্যাটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানিয়ে ও ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল অতন্দ্রকে। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। সেটার কোনো উত্তর আসেনি।

জিনিয়া অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ভেতরে ভেতরে আনমনা হয়ে পড়ছিল। ওর রকমসকম দেখে ঋতুপর্ণাও নিজের ফোন ঘাঁটছিল।

এমন সময় দরজা দিয়ে অম্বিকেশ আর সঞ্জিত ঢুকলেন।

অম্বিকেশ ঢুকে বললেন, ‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুই তোর কাস্টমারদের ডকুমেন্ট কাল কিষাণ বলে ওই এজেন্টটার কাছে পাঠিয়ে দিবি। ও-ই ফ্লাইটের টিকিট আর ভিসার প্রসেসিং করে দেবে। তবে প্রতিটা কাস্টমারকে ভিসার বায়োমেট্রিকের জন্য যেতে হবে ওখানে। দিনক্ষণ বলে দেবে।’

জিনিয়া মাথা নাড়ল, ‘ঋতুপর্ণা আরও একজনের খোঁজ এনেছে। উনি কনফার্ম করলে মোট ষোলোজন হচ্ছে ফুলুমামা। আমি একবারে সকলেরটা পাঠাব বিকাশকে দিয়ে।’

ঋতুপর্ণা মাথা নাড়ল, ‘না না, ওঁরা দু-জন যাবেন। উনি আর ওঁর সেক্রেটারি। তোকে বলতে ভুলে গিয়েছি।’

‘ওহ। তাহলে সতেরোজন।’ জিনিয়া বলল।

‘এ কী, বিজোড় সংখ্যা হচ্ছে কেন?’ অম্বিকেশ ভ্রূ কুঁচকলেন, ‘একা কেউ আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ। একজন আছেন।’ জিনিয়া ল্যাপটপে লিস্টটা খুলল, ‘রৌণক সাধুখাঁ। বয়স তেতাল্লিশ। উনি একা যাবেন।’

অতন্দ্র যে কয়েকজন কাস্টমারকে সবচেয়ে আগে বুক করিয়েছিল, ইনিও তাঁদেরই একজন। জিনিয়া দেখতে পেল, এই ভদ্রলোকও পুরো টাকাটা আগেই দিয়ে দিয়েছেন। জিনিয়া ভদ্রলোকের নামটা লাল রঙে হাইলাইট করে রাখল। পুরো টাকা দিয়ে বুক করছে মানে অবস্থা ভালো। এঁদের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে ট্রিপে।

সঞ্জিত হাজরা এতক্ষণ বাদে মুখ খুললেন, ‘প্যাকেজের কস্ট তো ডাবল শেয়ারিং হিসেবে ঠিক করা হয়েছিল, তাই তো জিনিয়া? ইনি হোটেলের রুমে একা থাকবেন, তার মানে এঁর কস্ট তো বেশি হওয়া উচিত।’

জিনিয়া মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ইনি পুরোটাই আগে পে করে দিয়েছেন বলে এক্সট্রা আর কিছু নিইনি। প্রথম টুর, এইটুকু ছাড় তো দেওয়াই যায়।’

সঞ্জিত আর কিছু না বলে অম্বিকেশের পাশের টুলটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। অম্বিকেশ আগেই বসে পড়ে বিকাশের হাত থেকে ফাইলগুলো নিয়ে নানারকমের হিসেব দেখছিলেন।’

জিনিয়া ঋতুপর্ণার সঙ্গে ওঁদের দুজনের আলাপ করিয়ে দিল, ‘ঋতুপর্ণা, আমার মামা, অম্বিকেশ সান্যাল। অফিসে পুজোর দিন এসেছিলেন, তোর সঙ্গে আলাপ করানো হয়নি। আর ইনি সঞ্জিত হাজরা। লখনৌয়ের লোক। আপাতত দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে কাজ করবেন। দু-জনেই আগে গ্লোবাল টুরসে ছিলেন।’

‘গ্লোবাল টুরস?’ ঋতুপর্ণা একটু আগ্রহের সঙ্গে জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ। খুব নামকরা টুর কোম্পানি।’ জিনিয়া বলল।

‘হ্যাঁ, জানি।’ ঋতুপর্ণা মাথা নেড়েই সঞ্জিত হাজরা আর অম্বিকেশের দিকে তাকাল, ‘নমস্কার। আমি ঋতুপর্ণা লাহিড়ী। জিনিয়ার প্রাক্তন অফিস কলিগ।’

প্রাথমিক আলাপচারিতা মেটার পর অম্বিকেশ ফাইলে চোখ বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘সতেরোজন কাস্টমার, সঞ্জিত আর তুই। মোট উনিশজন হচ্ছে, তাই তো? কিষাণকে বলে রাখব আমি।’

‘কুড়ি।’ চোখ পিটপিট করল জিনিয়া, ‘তুমিও যাবে সঙ্গে।’

‘আমি? আমি কেন যাব?’ অম্বিকেশ অবাক হয়ে গেলেন, ‘আমরা সবাই গেলে আমাদের খরচাতেই তো অর্ধেক কস্টিং বেড়ে যাবে। আমি নাহয় এদিকে অফিস সামলাব।’

‘প্রথমবার তো, এবার চলো। পরেরবার থেকে তো আর আমিও যাব না। সঞ্জিতবাবুর ওপরেই তখন পুরো দায়িত্ব থাকবে। এবারে একেবারে ইনিশিয়াল ফেজ, যেসব হোটেলের সঙ্গে ই-মেলে এগ্রিমেন্ট করা আছে, তাদের সঙ্গে গিয়ে আমি আর তুমি কথা বলে আসব।’

জিনিয়া এক মুহূর্ত থামল। ওর বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন চিনচিন করে উঠল। কিছুদিন আগে হলেও অতন্দ্র যেত ওর সঙ্গে। কিন্তু এখন সেই প্রশ্নই ওঠে না। অতন্দ্রর ক্রমাগত বাজে ব্যবহারে নির্মম হাতে সম্পর্কটাকে গলা টিপে শেষ করেছে জিনিয়া নিজে। ওর যত কষ্টই হোক, আর চেষ্টা করবে না জোড়াতালি লাগানোর। অতন্দ্র ওর মতো করে ভালো থাকুক, যদি চায়, গীতিকাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করুক। জিনিয়া বাধা হবে না। সেইজন্যই ও নিজে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। বাড়িতে বলেওনি।

ওর হঠাৎ মনে হল, ও খালি অতন্দ্রকে ভুলে থাকার ভানই করছে। ভুলতে আর পারছে না। নাহলে প্রতিটা প্রসঙ্গে ওর কথা মাথায় আসছে কেন?

নিজের মনকে কড়া একটা ধমক দিল ও, তারপর বলল, ‘আমরা তিনজন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের শুভাকাঙ্ক্ষী, ফুলুমামা। আমরা একটা টিম। আর আমি চাই, দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুরে আমরা গোটা টিমটাই একসঙ্গে যাই। গিয়ে প্রতিটা কাস্টমারের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখি।’

সঞ্জিত এই কথা শুনে বুড়ো আঙুল উঁচু করে তুলে ‘অল দ্য বেস্ট’ জানালেন, কিন্তু অম্বিকেশ বললেন, ‘কিন্তু এই অফিসে? অফিস তো ফাঁকা রেখে যাওয়া যাবে না। অফিসে কাকে রাখবি?’

জিনিয়া বলল, ‘সেটা চিন্তা করছি। দেখি, বিকাশকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারি কি না!’

অম্বিকেশ কী চিন্তা করতে করতে বললেন, ‘একটা মেয়েকে রাখবি? খুব এক্সপিরিয়েন্সড সেলস এক্সিকিউটিভ, এই লাইনেরই। আমাদের গ্লোবাল টুরসের মেয়ে। হঠাৎ চাকরিটা চলে গিয়েছে। বাড়ির অবস্থা একদম ভালো নয়। বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ। আমাকে কাল ফোন করেছিল।’

‘গ্লোবাল টুরস এইবার আমার নামে মামলা করবে ফুলুমামা, ওদের ডিরেক্টর থেকে শুরু করে টুর ম্যানেজার, সেলস এক্সিকিউটিভ সবই তো আমি হাতিয়ে নিচ্ছি!’ জিনিয়া নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলল, তারপর বলল, ‘বেশি মাইনে দিতে পারব না, তুমি তো জানোই!’

‘আপাতত যা দিবি, দে না।’ অম্বিকেশ বললেন, ‘ও টুরিজম ম্যানেজমেন্ট পাশ করা মেয়ে, তোর এখানে তো আর পড়ে থাকবে না। যদ্দিন থাকে থাকুক, তার মধ্যে আমাদের এই ট্রিপটাও হয়ে যাবে। আর ও কাজে পাকাপোক্ত, বিকাশের চেয়ে অনেক ভালোভাবে কাস্টমারদের সঙ্গে ডিল করতে পারবে।’

‘বেশ। আসতে বোলো।’ জিনিয়া বলল, ‘কী নাম? কোথায় বাড়ি?’

‘আলোকপর্ণা লাহিড়ী। বাড়ি হিন্দমোটরে। বেশ কাজের মেয়ে। তুই নিয়ে দেখ। উপকার পাবি।’ অম্বিকেশ বললেন।

ঋতুপর্ণা পাশেই বসে ওর স্বামী ইমরানকে ফোন করছিল, কখন আসবে জানতে। কিন্তু নেটওয়ার্কের গোলমালের জন্য ফোন কিছুতেই যাচ্ছিল না।

অম্বিকেশের কথা শুনে ও ঝট করে মুখ ঘোরাল এদিকে।

২২

টেকি ওয়ার্ল্ডের ব্যাঙ্কিং ডোমেনের ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ বসু এক আজব লোক। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, মাথা ভরতি চুলের সামনেটা বেশ ফ্যাশনের মতো করে পেকে গিয়েছে। চোখে দামি ব্র্যান্ডের রিমলেস চশমা। মধ্যচল্লিশ হলেও শরীরের গঠন খুব মজবুত, একেবারে দোহারা বলা যায়। পরনে সবসময় ফর্মাল পোশাক, কালো মিশমিশে সুট-টাই। প্রায় দশ ফুট তফাতেও পাওয়া যায় বিদেশি পারফিউমের হালকা অথচ মিষ্টি গন্ধ।

গোটা টেকি ওয়ার্ল্ডের কলকাতা রিজিয়নে মোট কর্মীর সংখ্যা প্রায় পনেরো হাজার। আর ডিরেক্টর আছেন নয় জন। কিন্তু তাঁদের সবাই চল্লিশেই বুড়িয়ে গিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কাউকে যদি দিনের চোদ্দো থেকে পনেরো ঘণ্টা অফিসের ডেস্কে কাটাতে হয়, তবে তাঁর শরীরের আর কী থাকে? অন্যান্য সব বহুজাতিক আই টি কোম্পানির মতো টেকি ওয়ার্ল্ডেও রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ জিম। অবশ্যই বিনামূল্যে নয়, তবে এই ধরনের উচ্চমানের জিমের বাজারে যেমন ফি হয়, কোম্পানির কর্মীদের জন্য সেই ফি এখানে অনেকটাই কম।

দিনের অধিকাংশ সময়েই সেই জিম ফাঁকা পড়ে থাকে। প্রতিটি কর্মীকে ন্যূনতম নঘণ্টা অফিসে থাকতেই হবে প্রতিদিন, বায়োমেট্রিক আইডি দিয়ে সেই সময়ের হিসেব রাখে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। সেই ন-ঘণ্টা লোকে কাজ করে শেষ করতে পারে না, জিমে আসবে কখন? তবু কিছু অল্পবয়সি জুনিয়র ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে জিমে এনরোল করে। প্রথম প্রথম উত্তেজনায় কাজ সামলে আসেও কয়েক দিন। ব্যস, ওইটুকুই। তারপর আসা বন্ধ হয়ে যায়। আর সিনিয়ররা তো এদিকে পা-ই মাড়ায় না। সারাদিন কাজ, অনসাইটের সঙ্গে কল। ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এই তারা ব্যস্ত। কিছুটা গা-ছাড়া ভাবও চলে আসে।

কিন্তু ব্যতিক্রম এই অনিরুদ্ধ বসু। তিনিও অন্য ডিরেক্টরদের মতোই প্রায় পনেরো ঘণ্টা টেকি ওয়ার্ল্ডে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বিশাল কেবিনে থাকেন, কিন্তু সন্ধে সাতটা বাজলেই তিনি ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দেন জিমের দিকে। সেখানে গিয়ে ধড়াচুড়ো খুলে ফেলে পরে নেন শর্টস আর টি-শার্ট। তার পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে চলে তাঁর শরীরচর্চা। পুল আপ, পুল ডাউন, স্কোয়াট, রোয়িং, স্টেয়ার ক্লাইম্বিং, কার্ডিয়ো, কিছুই বাদ যায়না সেই তালিকা থেকে।

প্রায় এক ঘণ্টা পর ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে তিনি জিমসংলগ্ন স্নানঘরে ফ্রেশ হন। তারপর আবার সুট চাপিয়ে বন্ধ থাকা মোবাইল অন করে মুখে সীমিত হাসি ঝুলিয়ে সোজা পায়ে হেঁটে যান নিজের কেবিনের দিকে।

নতুন ছেলেমেয়েদের অনিরুদ্ধ বসুকে নিয়ে বেশ আগ্রহ। অনেক জুনিয়ারই লাঞ্চের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারে কিংবা আড়চোখে তাকায় ব্যাঙ্কিং-এর ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ বসুর দিকে। মেয়েদেরই আগ্রহ বেশি। মধ্যবয়সি এই সুপুরুষকে কাজে ব্যস্ত দেখতে বেশ ভালো লাগে তাদের। টেকি ওয়ার্ল্ডের আকাশে বাতাসে অনেকরকম কথাও ভেসে বেড়ায়। জুনিয়াররা তো বটেই, সিনিয়র লেভেলের অনেক মহিলা ম্যানেজাররাও আকৃষ্ট ছিলেন অনিরুদ্ধ বসুর প্রতি। কিন্তু তিনি নাকি কাউকেই পাত্তা দেন না। সবার জন্যই ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখেন মিষ্টি হাসি। কাজের শেষে হাত মেলান পেশার খাতিরে। ওইটুকুই।

জুনিয়ার ছেলেমেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনিরুদ্ধ বসুকে খোঁজে। সেখানে তিনি নিয়মিত নন, তবু অনেক খুঁজলে পাওয়া যায় স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে সুখী পরিবারের ছবি। মেয়েরা তাঁর স্ত্রী-র সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়। কানাঘুসো শোনা যায়, অনিরুদ্ধ বসু-র স্ত্রীও আগে আই টি-তেই ছিলেন, এখন পুরোদস্তুর গৃহবধূ।

অতন্দ্র অবশ্য আসল ব্যাপারটা জানে। অতন্দ্র যখন প্রথম টেকি ওয়ার্ল্ডে ঢুকেছিল, অনিরুদ্ধ স্যারের স্ত্রী মধুরিমাদি ছিল ওদেরই প্রোজেক্টের একজন সিনিয়র মেম্বার।

আই টি সেক্টরের কর্মীদের পিরামিডটা লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে বড়োই দৃষ্টিকটু। সদ্য কলেজ পাশ করে আসা জুনিয়ারদের জন্য রাখা পিরামিডের একদম নীচের চওড়া ভাগটায় ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান, কখনো কখনো মেয়েরাই বেশি। তারপর পিরামিডের উচ্চতা যত বেড়েছে, প্রস্থ সরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে মহিলা কর্মীর সংখ্যা। ম্যানেজার লেভেলে গিয়ে মহিলা কোথায়, সেটা রীতিমতো নাকের ওপর চশমা এঁটে খুঁজতে হবে। আর ম্যানেজারের ওপর লেভেল অর্থাৎ, সিনিয়র ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও ডিরেক্টর পোস্টে কোনো মেয়েই নেই।

প্রথম প্রথম অতন্দ্র আর জিনিয়া এগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত। জুনিয়ার লেভেলে এত যে মেয়ে থাকে, পরে তারা সব যায় কোথায়? এই প্রসঙ্গেই একদিন উঠে এসেছিল মধুরিমাদির কথা।

অতন্দ্র বলত, ‘কোথায় আবার যাবে! অন্য কোম্পানিতে সুইচ মারে। প্যাকেজও বেশি, সিভিতেও অ্যাড অন হয়।’

‘আরে বাবা, সে তো লোকজন যেমন অন্য কোম্পানিতে সুইচ মারছে, তেমনই অন্য কোম্পানি থেকে তো আসছেও।’ জিনিয়া একমত না হয়ে পালটা যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘যেমন ধর, তোদের টেকি ওয়ার্ল্ড থেকে দু-জন এল আমাদের প্রাইমা ইনফোটেকে, তেমনই প্রাইমা ইনফোটেক ছেড়েও তো বেশি প্যাকেজ পেয়ে লোকে টেকি ওয়ার্ল্ডে যাচ্ছে, নাকি! আর শুধু মেয়েরাই তো সুইচ করে না, ছেলেরাও করে। তাহলে ছেলেগুলো সব থাকছে, মেয়েগুলো কোথায় উবে যাচ্ছে বল তো!’

‘উবে যাবে কেন!’ অতন্দ্র সিগারেটে টান দিয়ে বলেছিল, ‘সব পাতা ফেলে দিচ্ছে। কম বয়সে ক্যাম্পাসিং-এ চাকরি পেয়ে ঢুকছে, তারপর এত খাটনি দেখে কিছু বছর কান্নাকাটি করে থাকছে, তারপর বয়স বাড়লেই ছেড়ে পালাচ্ছে।’

তখন মাস ছয়েক হয়েছে দু-জনে ঢুকেছে চাকরিতে, প্রেম করছে চুটিয়ে, বিয়ে তখনও অনেক দূর। জিনিয়া অতন্দ্রর সিগারেট খাওয়া একদম সহ্য করতে পারত না। ওর জ্বালাতেই দিনের পর দিন সিগারেট কমিয়ে আনতে হয়েছিল অতন্দ্রকে।

জিনিয়া ঝুঁকে পড়ে সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নিয়ে দূরের ঝোপে ফেলে দিয়েছিল, ‘এইভাবে বলিস না। মেয়েরা কি ফাঁকিবাজ নাকি? বিয়ের পর সংসারে দায়দায়িত্ব বাড়লে প্রতিদিন ন-দশ ঘণ্টা অফিসে থাকাটা কি সবার পক্ষে সম্ভব? কেন তুই-ই তো সেদিন বললি, তোদের অফিসের কোন একটা দিদি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে বাচ্চা মানুষ করার জন্য!’

‘বাচ্চা মানুষ করার জন্য নয়। কেসটা তার চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস।’ অতন্দ্র বলেছিল, ‘মধুরিমাদি ম্যানেজার, ওর বর সিনিয়র ম্যানেজার। দু-জনে মিলে মাসে তিন লাখ টাকার মতো কামায়। ভাবতে পারিস? কিন্তু ওর ছেলেটার চার বছর বয়স হযে গেছে, অথচ কোনো কথা বলে না। ওরা তো অমুক ডাক্তার তমুক ডাক্তার করে কিছুই করতে পারে না। না আছে ভোকাল কর্ডে কোনো সমস্যা, না আছে কোনো জেনেটিক ডিজঅর্ডার। শেষে এক ইএনটি-র পরামর্শে দু-জনে মিলে ছেলেকে চেন্নাইতে নিয়ে গেল এক বিখ্যাত স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে। সে সব দেখেশুনে বলে, ছেলেটার কথা বলার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ও তো কথা শেখেইনি, বলবে কী করে!’

‘কথা শেখেনি মানে?’ জিনিয়া আশ্চর্য হয়েছিল, ‘কথা শেখেনি কেন?’

‘কী করে শিখবে? বাবা-মা দু-জনেই সকাল হতে না হতে বেরিয়ে যাচ্ছে, ছেলে তখন ঘুমোচ্ছে। অনেক রাতে বাবা-মা যখন ফিরছে, ছেলে তখন ঘুমিয়ে কাদা। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, ছেলে আয়ার কাছে মানুষ হচ্ছে। তা সে আয়া কোনোমতে নিজের কাজটুকু করেই নিজের মতো থাকে, মোবাইলে সিনেমা দেখে। বাচ্চাটা তো কাউকে কথা বলতেই দেখছে না।’

‘কী অবস্থা!’ জিনিয়া বলেছিল।

‘এখন সেই স্পিচ থেরাপিস্ট বলেছে বাবা অথবা মা যেকোনো একজন সারাক্ষণ যেন বাচ্চাটার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে কথা বলে, তাকে অ্যাটেনশন দেয়। নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ অতন্দ্র বলেছিল, ‘অগত্যা মধুরিমাদিকেই রিজাইন করতে হচ্ছে! মায়ের সঙ্গেই নাকি ছোটোবেলায় বাচ্চার ইনভলভমেন্ট বেশি থাকে।’

জিনিয়া বলেছিল, ‘তাহলে দেখেছিস, মেয়েরাই সবসময় সংসারের ব্যাপারে স্যাক্রিফাইসটা করে? এইজন্যই এই সেক্টরে ওপরের দিকে মেয়েদের সংখ্যা এত কম। সরকারি চাকরি কিংবা কোনো দশটা পাঁচটার চাকরি হলে এটা হত না। সংসারে পুরোদস্তুর ঢুকে গেলে কী করে কোনো মেয়ে এতটা সময় দেবে বল তো অফিসে? একেবারেই যে সম্ভব নয়, তা বলছি না, কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েই মন থেকে তখন চাইবে ছেলেমেয়েকে ঠিকঠাক বড়ো করতে।’

অতন্দ্র চোখ বড়ো বড়ো করে সিরিয়াস গলায় বলেছিল, ‘তুইও কি সেইসব করার ধান্দায় আছিস নাকি? দেখিস বাবা, এখন থেকে বলে দে। তখন দুম করে ফ্রাস্ট্রু খেয়ে হাউজওয়াইফ হয়ে গেলে আমি একা হাতে পেরে উঠব না।’

জিনিয়া হাসতে হাসতে ওর গায়ে গড়িয়ে পড়েছিল, ‘আহা, কী বয়ফ্রেন্ডের ছিরি আমার! শোন, এই চাকরি তো আমি ছাড়বই, আই টি-তে সারাটা জীবন ঘষে ঘষে বুড়োবয়সে আফশোস করতে আমি রাজি নই। কিন্তু তাই বলে ভাবিস না, চাকরি ছেড়ে তোর ঘাড়ে বসে খাব। আমি ব্যবসা করব, ব্যবসা। দেখবি এত পয়সা কামাব, যে তুই-ই চাকরি ছেড়ে দিবি।’

‘ওহ, তাহলে তো দারুণ হবে! বাড়ি বসে ছেলেপিলে মানুষ করব, বাংলা সিরিয়াল দেখব আর দুপুরে ভাতঘুম দেব।’ অতন্দ্র আরও রাগিয়ে দিতে চেয়েছিল জিনিয়াকে, ‘বাঙালির ব্যবসা অভিযান বলে কথা! তা কীসের ব্যবসা করবি? সিগারেটের? তাহলে আমি হব তোর প্রথম খদ্দের।’

জিনিয়া রেগে গিয়ে তখন অতন্দ্রর পিঠে জোরে কিল বসিয়ে দিয়েছিল।

কৌশিকদার সঙ্গে অর্ধস্বচ্ছ সুইং ডোর ঠেলে অনিরুদ্ধ বসুর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল অতন্দ্রর। মধুরিমাদিকে ওর ভালোই মনে আছে। বেশ হাসিখুশি ছিল, কারণে অকারণে ওদের মতো জুনিয়রদের প্রায়ই খাওয়াত ক্যাফেটেরিয়ায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধুরিমাদির তখনকার সিনিয়র ম্যানেজার স্বামী অনিরুদ্ধ বসু এখন গোটা ব্যাঙ্কিং-এর ডিরেক্টর।

সত্যি, মানুষের মন বড়ো বিচিত্র। সময়ে অসময়ে স্মৃতির অতল থেকে বলা নেই, কওয়া নেই, উঁকি দিয়ে যায় একখণ্ড চিত্রনাট্য। পরিস্থিতির সম্পূর্ণ পরিবর্তনে তখন মনে হয়, সেই চিত্রনাট্য কতযুগ আগের।

ব্যাঙ্কিং ডোমেনের ডিরেক্টর অনিরুদ্ধ বসু নিজের মাথার চেয়ে অনেক বেশি লম্বা একটা গদিওয়ালা চেয়ারে বসে সামনে খোলা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ম্যানেজার কৌশিকদার পেছন পেছন অতন্দ্র ঢুকতেই নিজের সিগনেচার স্টাইলে ঠোঁটটা অল্প ফাঁক করে হাসলেন, ‘হ্যাঁ এসো। বোসো।’

অতন্দ্র ভাবলেশহীন মুখে বসল। নিজের ডোমেনের সর্বোচ্চ বস হিসেবে অনিরুদ্ধ বসুকে নানা ডিপার্টমেন্টাল মিটিং বা কনফারেন্সে ও অনেকবার দেখেছে, বেশ কয়েকবার ভালো কাজের জন্য সার্টিফিকেটও নিয়েছে হাত থেকে। কিন্তু এইভাবে আলাদা করে কথা এই প্রথম।

কৌশিকদা বলল, ‘স্যার, এর ব্যাপারটাই আপনাকে সকালে বলছিলাম। অতন্দ্র খুব ভালো রিসোর্স, কিন্তু মাঝে রিজাইন করার জন্য এবারের পলিসি অনুযায়ী ওর রেটিংটা চার হয়ে গেছে।’

অনিরুদ্ধ বসু অতন্দ্রর দিকে একঝলক তাকিয়ে বললেন, ‘হুম। সেটা কোনো সমস্যা ছিল না। ওর তো আগের সবকটা রেটিং-ই ভালো, সেই রেফারেন্সে রিলিজটা আটকানো যেত। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মিত্র প্রেশারাইজ করছে রিলিজের জন্য।’

‘কোন মিত্র স্যার?’ কৌশিকদা জিজ্ঞেস করেছিল।

অনিরুদ্ধ বসু চেয়ারে হেলান দিতেই সেটা প্লেনের চেয়ারের মতো অনেকটা হেলে গেল। অতন্দ্র লক্ষ করল, অনিরুদ্ধ বসুর হাতে একটা ট্যাটু, ঠিক ট্যাটু বলা যায় না, কোনোরকম আঁকিবুঁকি নেই তাতে। শুধু রোমান হরফে লেখা ‘ডেস্টিনি ইজ গড’। অর্থাৎ ভাগ্যই ঈশ্বর।

অনিরুদ্ধ বসু-র মতো একজন কর্মযোগী মানুষ ভাগ্যকে এত গুরুত্ব দেন দেখে ও বেশ আশ্চর্য হল। তার পরমুহূর্তে ভাবল, ঈশ্বর না হলেও ভাগ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তো বটেই, নাহলে ওর রিজাইন করা, সেই রেজিগনেশন তুলে নেওয়া, এত ভালো কাজ করে সবচেয়ে বাজে রেটিং পাওয়া, সর্বোপরি এরপর ওর কপালে কী আছে, সেইসবই নিয়ন্ত্রণ করছে ওর ভাগ্য বা নিয়তি। ওর কাজ নয়। কয়েক মাস আগেও ও যার জীবনসঙ্গী ছিল, যার সঙ্গে শুরু করতে যাচ্ছিল নতুন উদ্যোগ, সে-ও কয়েক ঘণ্টা আগেই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে তাকে।

এও কি নিয়তি নয়?

‘সুমিত মিত্র। আগের সপ্তাহে চেন্নাই অফিস থেকে এসে জয়েন করেছে। এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর।’ অনিরুদ্ধ বসু অতন্দ্র-র দিকে তাকালেন, ‘রেটিং এর লাস্ট মিনিট রিশাফলটা মিত্রই করেছে। ওর বক্তব্য অনুযায়ী তুমি সিনিয়র হলেও রিলায়েবল রিসোর্স নও। যখন-তখন রিজাইন করলে ক্লায়েন্ট বিলিং-এ প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হয়, এটা জানা আছে নিশ্চয়ই? এইটুকু কমিটমেন্ট তোমার মতো সিনিয়রদের থেকে আশা করাই যায়।’

অতন্দ্র ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে কিছু প্রকাশ করল না। সেই সুমিত মিত্র, যার সঙ্গে কেরিয়ারের প্রথম দিকে বেশীক্ষণ থাকা নিয়ে অতন্দ্র প্রকাশ্য উইং-এ ঝামেলা করেছিল। তখন লোকটা ছিল ম্যানেজার। অতন্দ্রকে সে-বছর যথেষ্ট বাঁশ দিয়েছিল সে। তারপর সিনিয়র ম্যানেজার হয়ে চলে গিয়েছিল চেন্নাই রিজিয়নে।

এত বছর পরে ঠিক এইসময়েই আরও এক ধাপ প্রোমোশন নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হল? তাও আবার ওর ডোমেনেরই এ ডি হয়ে?

অতন্দ্রর চকিতে চোখ চলে গেল অনিরুদ্ধ বসু-র সেই ট্যাটুর দিকে।

ঠিকই। নিয়তিই সব।

ও সামান্য গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমি তো বার বার এমন করিনি। আর তা ছাড়া আমি অন্য কোনো কোম্পানিতে সুইচ করার জন্যেও কিন্তু রিজাইন করিনি। একটা পার্সোনাল ইস্যুতে …।’

‘দ্যাটস ওকে, অতন্দ্র।’ অনিরুদ্ধ বসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন, ‘আমি অলরেডি তোমার সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েছি। তুমি যে টেকনিক্যালি সাউন্ড সেটা আমি জানি। তোমার লিডারশিপও ভালো। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, আমি চাই না তোমার মতো রিসোর্স আমার ডোমেন থেকে রিলিজ হয়ে যাক।’

অতন্দ্র কিছু না বলে চুপচাপ শুনছিল। ব্যাঙ্কিং ডোমেনে ও প্রথম থেকে কাজ করছে, সেখান থেকে রিলিজ করে দেওয়ার পর কোম্পানি থেকেই রিলিজ হয়ে যাওয়াটা শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

টেকি ওয়ার্ল্ডের মতো সব আই টি কোম্পানিতেই অনেকগুলো ডোমেন থাকে। ডোমেন ব্যাপারটা অনেকটা স্কুলের সেকশনের মতো। ব্যাঙ্কিং, রিটেল, ইন্সিয়োরেন্স, অ্যাভিয়েশন এরকম আরও অনেক ডোমেন রয়েছে। একেকটা ডোমেনের আন্ডারে রয়েছে সেই বিষয়ের সমস্ত প্রোজেক্ট। যেমন ধরা যাক, ব্যাঙ্কিং। প্রচুর বিদেশি ও দেশি ব্যাঙ্কের সফটওয়্যারের দিকটা দেখে টেকি ওয়ার্ন্ড। এইসব ব্যাঙ্কগুলো হল টেকি ওয়ার্ল্ডের কাছে ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্টের থেকে মোটা ডলারের বিনিময়ে টেকি ওয়ার্ল্ড কাজ করে। তেমনই, নানারকম এয়ারলাইন্সের প্রোজেক্ট রয়েছে অ্যাভিয়েশন ডোমেনের আন্ডারে, অনেক ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানি রয়েছে ইন্সিয়োরেন্স ডোমেনের আন্ডারে।

এইসব ডোমেনের আন্ডারে থাকা প্রোজেক্টগুলো একেকটা ক্লায়েন্টের, আর সেই প্রোজেক্টগুলোয় কাজ করে অতন্দ্র-র মতো সিনিয়র থেকে শুরু করে সায়ক, নবনীতা, গীতিকাদের মতো জুনিয়ররা। একই ডোমেনের মধ্যে এই প্রোজেক্ট থেকে ওই প্রোজেক্টে রিসোর্স চালাচালি প্রায়ই হয়, কিন্তু একেবারে ডোমেন থেকে বের করে দেওয়া মানে ও চলে যাবে সোজা গ্লোবাল পুলের বেঞ্চে। সেখান থেকে কোনো ডোমেনের কোনো প্রোজেক্টে কল পেলে ভালো, নাহলে কিছুদিন পর ওকে ডেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে। কৌশিকদা-র কথা অনুযায়ী, এই বছরের লসের জন্য টেকি ওয়ার্ল্ড বেশ কিছু কর্মী ছাঁটাই করবে। আর ছাঁটাই বেশিরভাগ সময়ে এভাবেই হয়।

অনিরুদ্ধ বসু আবার বললেন, ‘কিন্তু আমার আন্ডারে যে তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর আছে, তাঁদের মতামতও আমাকে শুনতে হবে।’

সারা ঘরটায় নিস্তব্ধতা।

অতন্দ্র এবার ক্লান্ত চোখে তাকাল। আজ সকাল থেকে ও অনেক চাপ নিয়েছে, একটার পর একটা। আর ওর ভালো লাগছে না। রিলিজ দিতে হলে দিয়ে দিক, এত হ্যাজানো ওর সত্যিই পোষাচ্ছে না।

অনিরুদ্ধ বসু এবার সরাসরি অতন্দ্রর দিকে তাকালেন, ‘ব্রিটলস ব্যাঙ্কের প্রোজেক্টটার কোনো আপডেট আছে তোমার কাছে? হলই-বা অন্য প্রোজেক্ট, ডোমেন তো একই।’

অতন্দ্র মাথা নাড়ল। দু-দিন আগেই ক্যাফেটেরিয়ায় এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। ব্রিটলস ব্যাঙ্ক ইংল্যান্ডের নামকরা ব্যাঙ্ক, যার হেড কোয়ার্টার লন্ডনেই। এই ব্রিটলস ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটের যাবতীয় দায়িত্ব টেকি ওয়ার্ল্ড নিজের দখলে রেখেছে প্রায় আটবছর ধরে। এতদিন সাধারণত একই কোম্পানির কাছে ক্লায়েন্ট থাকে না, প্রতিবছর কনট্র্যাক্ট রিনিউ করার সময় যে বিড হয়, তাতে কোম্পানি বদলে যায়। কিন্তু ব্রিটলস ব্যাঙ্ক ব্যতিক্রম। টেকি ওয়ার্ল্ডের কাজের গুণেই হয়তো এতদিন ধরে তারা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কনট্র্যাক্ট রিনিউ করে আসছিল।

এত পুরনো অ্যাকাউন্ট হওয়ার ফলে ব্রিটলস ব্যাঙ্ক টেকি ওয়ার্ল্ডের অনেক পুরোনো আর বড়ো প্রোজেক্ট। অন্তত দু-শো জন রিসোর্স রয়েছে ওই প্রোজেক্টে। কিন্তু সম্প্রতি কানাঘুসোয় খবর শোনা যাচ্ছে যে এবার নাকি আর ব্রিটলস ব্যাঙ্ক কনট্র্যাক্ট রিনিউ করবে না। টেকি ওয়ার্ল্ডের থেকেও কম দামে আরও ভালো সার্ভিস দেওয়ার অঙ্গীকার করে সেখানে থাবা বসানোর চেষ্টা করছে আরেক আই টি জায়েন্ট ওমনিসফট।

এটা নতুন কিছু নয়। সব বড়ো ক্লায়েন্টের টেন্ডারেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সব বড়ো বড়ো কোম্পানি। এইভাবে টেকি ওয়ার্ল্ডও যেমন মাঝপথে ছিনিয়ে এনেছে অনেক নতুন ক্লায়েন্টকে, হাতছাড়াও হয়েছে বেশ কিছু। আই টি সেক্টরের এই নিয়ম। এভাবেই চলতে থাকে।

কিন্তু ব্রিটলস ব্যাঙ্ক প্রোজেক্ট হাতছাড়া হলে আচমকা রিলিজ হয়ে যাবে প্রায় দু-শো জন কর্মচারী। এই নিয়ে ওই প্রোজেক্টের সবাই বেশ চিন্তিত। একেই টেকি ওয়ার্ল্ডের এই বছর অবস্থা খারাপ, এইসময়ে বেঞ্চে যাওয়াটা মোটেই ভালো ব্যাপার নয়।

অতন্দ্র ঘাড়টা অল্প হেলাল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি স্যার। ওমনিসফট ব্রিটলস নেওয়ার চেষ্টা করছে।’

‘ইয়েস। আর সেটা হলে গোটা ব্যাঙ্কিং ডোমেনেই খুব বাজে ইমপ্যাক্ট পড়বে। আমাদের কারুরই ইমেজ ভালো থাকবে না হেডকোয়ার্টারের কাছে।’ অনিরুদ্ধ বসু এবার অতন্দ্রর দিকে ঝুঁকে পড়লেন, ‘টেকি ওয়ার্ল্ডে থেকে যাওয়ার একটা শেষ সুযোগ তোমায় দিতে পারি। তুমি কি ব্রিটলসের চলে যাওয়াটা রুখতে পার?’

অতন্দ্র এবার অবাকচোখে কৌশিকদার দিকে তাকাল। হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। বছরে একবার ক্লায়েন্টের তরফ থেকে কোনো প্রতিনিধি ওদের কাজকর্ম ভিজিট করতে আসে ঠিকই, কিন্তু সেই প্রতিনিধি অনেক নীচু লেভেলের কেউ হয়। তবু সেদিন সবাইকে নিজের পোশাক-আশাকের দিকে কিংবা কিউবিকলের দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। আর এইসব কোটি কোটি ডলার বা ইউরোর ডিল দু-তরফেরই একদম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সাক্ষরিত হয়। সেখানে অতন্দ্র কেন, কৌশিকদাও কলকে পায়না।

ব্রিটলসকে আটকে রাখার নিশ্চয়ই সবরকম চেষ্টাই করা হচ্ছে উঁচু লেভেল থেকে, তাতেও যখন কিছু হচ্ছে না, তখন ও একজন সামান্য সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কী করতে পারে?

২৩

অম্বিকেশ আর সঞ্জিত চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। সল্টলেকের ভেতরের এই শান্ত পাড়ায় ঝুপ করে সন্ধে নেমে এসেছে। রাস্তার আলোও একে একে জ্বলে উঠেছে। সামনের গলি দিয়ে স্কুটার, বাইক, কিংবা চারচাকা গাড়ি চলে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই।

জিনিয়া তখন একমনে কাজ করছিল। ঋতুপর্ণার বর ইমরানদা ফোন করেছিল একটু আগে। কী-একটা কাজে সে আটকে গেছে। তাই ঋতুপর্ণা এখানেই অপেক্ষা করছে।

জিনিয়া এমন মনোযোগের সঙ্গে কাজ করছিল যে পাশেই ঋতুপর্ণা কী করছে সেটা ও খেয়াল করেনি। অনেকক্ষণ পর হুঁশ হতে ও পাশে তাকিয়ে দেখল, ঋতুপর্ণা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। চোখ উদাস, কিছুই দেখছে না আসলে। ওকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, ও নিবিষ্ট হয়ে কিছু একটা ভাবছে।

জিনিয়া মৃদু ঠেলা দিল, ‘কী রে, কী হয়েছে তোর?’

ঋতুপর্ণা উত্তর দিল না। ও প্রায় পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে রয়েছে। ওর চুলগুলো পেছন থেকে টেনে বাঁধা হলেও সামনের দিকের দু-একটা কুচো চুল উড়ে এসে পড়েছে কপালে, গালে। ওর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।

জিনিয়া এবার আর একটু জোরে ঠেলল, ‘কি রে, কী ভাবছিস তুই!’

এইবার ঋতুপর্ণা ওর দিকে ফিরে তাকাল। জিনিয়া লক্ষ করল ঋতুপর্ণার মুখটা থমথম করছে। চোখের কোণে টলটল করছে অশ্রুবিন্দু। ঠোঁট দুটোও যেন কাঁপছে ঈষৎ। দেখলেই মনে হচ্ছে, এখুনি কান্নায় ভেঙে পড়বে ও।

জিনিয়া এবার বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল। ঋতুপর্ণা এমনিতে ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত মেয়ে, তার ওপর ফুলুমামারা থাকা পর্যন্তও ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে। হঠাৎ ওর কী হল?

জিনিয়া এবার আর না ঠেলে নরম হাতে ঋতুপর্ণার কাঁধে হাত দিল, ‘কী হয়েছে তোর? বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?’

জিনিয়ার এই প্রশ্নটা অমূলক নয়। ঋতুপর্ণা ওর বাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে অনেকদিন হয়ে গেল। সেই ঘটনার পর থেকেই থেকেই উচ্ছল হাসিখুশি মেয়েটা থেকে থেকে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়, ভিড়ের মধ্যে থেকে নিজেকে সরিয়ে হয়ে যায় একা।

প্রথম প্রথম জিনিয়া অতটা লক্ষ করত না। তারপর দেখত, প্রোজেক্ট থেকে কোনো টিম লাঞ্চে গিয়ে এই মুহূর্তে ঋতুপর্ণা হাহা-হিহি করে সবাইকে মাতিয়ে রাখছে, পরক্ষণেই একটা মকটেলের গ্লাস নিয়ে সরে যাচ্ছে অন্ধকার কোনো কোণে। তখন হাজার চেষ্টাতেও কিছুতেই মুখ খুলত না, স্বাভাবিকও হত না।

একদিন কি দু-দিন পরে জিনিয়া পীড়াপীড়ি করলে বলত, ‘বাড়িতে বাবা-মা-বোন কী খাচ্ছে জানি না রে। ভালো ভালো এইসব খাবার খেতে গেলেই আমার ওদের কথা মনে পড়ে।’

জিনিয়া প্রথমদিকে বলত, ‘তুই বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলি বলে তোর বাবা-মা রেগে গেছিলেন। এখন তো অনেক দিন হয়ে গেল ঋতুপর্ণা, তুই আর ইমরানদা তো একদিন গিয়ে সব মিটিয়ে নিতেই পারিস। প্রথমে রেগে গেলেও পরে দেখবি ঠিক মেনে নেবেন ওঁরা। সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে বেশিদিন থাকা যায় নাকি?’

কিন্তু জিনিয়াও তারপর ধীরে ধীরে বুঝেছে সামাজিক চাপ, লোকলজ্জা অনেক সময় অপত্যস্নেহের চেয়েও বড়ো হয়ে ওঠে। নিজের মেয়েকে দেখতে পাওয়ার আকুতির চেয়েও তখন বেশি প্রাধান্য পায় লোকে কী বলবে, সেই ভয়। ভিন্ন জাতে বিয়ে মানতে পারলেও ভিন্ন ধর্মে বিয়েটা অনেকেই এখনও মানতে পারে না।

ঋতুপর্ণা আর ইমরানদা নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল বাবা-মাকে মানাতে। কিন্তু ঋতুপর্ণার বাবা-মা বিশ্রী অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। শুধু তাই নয়, ইমরানদা ভালোভাবে ওদের বাড়িতে বোঝাতে গিয়েছিল একদিন, পাড়ার ক্লাব থেকে এসে গায়ে পর্যন্ত হাত তোলা হয়েছিল ওর। তারপরই ঋতুপর্ণা বাড়ি ছাড়ে।

জিনিয়া আবার নরম গলায় বলল, ‘কী হয়েছে বলবি কি?’

ঋতুপর্ণা এবার ধরা গলায় বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবি জিনিয়া?’

‘কী কথা?’

‘আগে বল রাখবি।’

‘কী মুশকিল, শুনলামই না …।’ জিনিয়া একটু বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না, ‘আচ্ছা বল। রাখব, কথা দিচ্ছি।’

ততক্ষণে ঋতুপর্ণার গাল বেয়ে জলের ধারা নামতে শুরু করেছে, ‘নতুন যে মেয়েটাকে তোর মামা এখানে জয়েন করতে বলেছে, তাকে তুই কত টাকা মাইনে দিবি জিনিয়া?’

এইরকম অদ্ভুত অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে জিনিয়া হাঁ হয়ে গেল, তারপর কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, ‘কেন, হঠাৎ? এখনও কিছু ঠিক করিনি।’

‘না, তাও একটা আন্দাজ বল না।’ ঋতুপর্ণা অধীর গলায় জিজ্ঞেস করল।

জিনিয়া বলল, ‘দেখ, আমার কোম্পানির তো তুই সবই জানিস, পুরোটাই এখনও ধারের ওপর দাঁড়িয়ে। আট-দশ হাজারের বেশি দিতে পারব বলে মনে হয় না। বিকাশকে পাঁচ দিই, ওই মেয়েটাকে আট দেব ধরে নে।’

ঋতুপর্ণা এবার একটা কাণ্ড করল। জিনিয়ার হাত দুটো ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল ও, ‘তুই আমার একটা উপকার কর জিনিয়া। আমি তোকে প্রতিমাসে ত্রিশ হাজার টাকা করে দেব। তুই মোট আটত্রিশ হাজার টাকা মাইনে দিবি মেয়েটাকে।’

‘সে আবার কী! কেন?’ জিনিয়া হতবাক হয়ে গেল, ‘তুই কেন টাকা দিবি? মেয়েটা কে ঋতু?’

ঋতুপর্ণা উত্তর না দিয়ে টেবিলের ওপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের সযত্নে লাগানো কাজল গলে পড়তে লাগল টেবিলে।

জিনিয়া হঠাৎ মেয়েটার নামটা খেয়াল করল। ফুলুমামাই বলে গিয়েছে, মেয়েটার নাম আলোকপর্ণা লাহিড়ী। পদবি আর নামের মিলটা খেয়াল করামাত্র ও চমকে উঠে ঋতুপর্ণার পিঠে হাত রাখল, ‘মেয়েটা তোর বোন ঋতু?’

এই কথায় ঋতুপর্ণার কান্না আর কয়েক গুণ বেড়ে গেল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ও বলল, ‘হিন্দমোটর ফ্যাক্টরি উঠে যাওয়ার পর থেকে আমাদের অবস্থা একদম পড়ে গিয়েছিল রে। আমি চলে আসার পর বোন হয়তো কষ্টেসৃষ্টে চালাত। এখন ওরা কীভাবে রয়েছে বল তো! আমি তো কল্পনাই করতে পারছি না। বোনের চাকরি চলে গেছে, বাবারও কোনো আয় নেই। আর … আর আমি গিয়ে পায়ে পড়লেও আমার টাকা ওরা নেবে না। তুই-ই বল জিনিয়া, ইমরান তো একটা মানুষ, দুজন মানুষ নিজে ভালোবেসে বিয়ে করেছে এটা এত বড়ো অপরাধ? আমিও তো ওদের মেয়ে, বল। তুই আমায় কথা দে জিনিয়া, আমার টাকাটা প্রতিমাসে ওকে মাইনের সঙ্গে দিবি। এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। প্রতি মাসে মায়ের মোটা টাকার ওষুধ লাগে। ওই আট হাজার টাকায় কিচ্ছু হবে না।’

জিনিয়া এবার ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘আচ্ছা তাই হবে। তুই এখন শান্ত হ।’

‘তুই জানিস, ছোটু, মানে আমার বোন আলোকপর্ণা আমাদের কত আদরের? কত কষ্টই না করতে হচ্ছে ওকে। কী দেখতে ইচ্ছে করে ওকে! কিন্তু বাবা বলে দিয়েছেন, আমি যেন গোপনেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ না করি।’ ঋতুপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছিল।

একটু পরে ইমরানদা যখন এল, তখনও ঋতুপর্ণা স্বাভাবিক হতে পারেনি, গুম হয়ে বসেছিল।

ওরা চলে যেতে জিনিয়ারও খুব অবাক লাগছিল। ভালোবাসার চেয়ে ধর্ম কী করে বড়ো হয়?

বাবা-মা তিলতিল করে কত আত্মত্যাগ করে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান, বড়ো করেন। জগতের সবচেয়ে নিঃস্বার্থ নিঃশর্ত ভালোবাসা সেটা।

সেই টান কী করে ধর্মের মতো একটা বাহ্যিক প্রভাবে নষ্ট হতে পারে? সন্তান তো বাবা-মায়েরই রক্ত, বাবা-মায়েরই অংশ, কী করে সমাজের ভ্রূকুটির চাপে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পাবেন বাবা-মা।

আসলে কোনো সম্পর্কই বোধ হয় অঙ্কের মতো কোনো নিয়মে বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের অভিমান, ইগো কোনো ফর্মূলাতেই চলে না। ঋতুপর্ণা এখানে যেমন কষ্ট পাচ্ছে, ওর বাবা-মা-বোনও হয়তো তেমনই ওর কথা ভেবে রাতের অন্ধকারে চোখের জল ফেলেন।

গ্যারাজের দরজার সামনে এসে এক ভদ্রলোক উঁকি মারলেন, ‘আচ্ছা, এটাই কি দাশগুপ্ত ট্রাভেলস?’

বাইরে সাইনবোর্ড টাঙানোই আছে, ভদ্রলোক তা দেখেই এসেছেন। এখন সম্ভবত যাচাই করে নিতে চাইছেন। ভদ্রলোকের পেছনে আর একটি যুবক রয়েছে, জিনিয়ারই বয়সি। সে গলা বাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ইতিউতি তাকাচ্ছে। বোধ হয় বুঝতে চাইছে টুর কোম্পানিটির ওজন।

জিনিয়া চমক ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে হাসল, ‘হ্যাঁ। নমস্কার। আসুন। বসুন এখানে।’

বিকাশও এসে পৌঁছেছে প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই।

জিনিয়া তড়িঘড়ি নিজের টেবিলের সামনে দুটো চেয়ারকে ঠিক করে দিল। বিকাশের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল দু-কাপ চা নিয়ে আসতে।

‘আমি ফোন করেছিলাম মানকড় থেকে … আপনার সঙ্গেই বোধ হয় কথা হয়েছিল। আমার নাম যাদবচন্দ্র লাহিড়ী।’ বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন।

জিনিয়া বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। সামনের মাসের ইউরোপ টুরের ব্যাপারে তো?’

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

জিনিয়া সামনের একটা বান্ডিল থেকে একটা কাগজ বের করল। বলল, ‘ওটাই আমাদের প্রথম ট্রিপ। তবে চিন্তার কিছু নেই জেঠু, আমরা আপনাদের সবাইকে খুব যত্নের সঙ্গেই ঘোরাব। আমার কোম্পানি নতুন হতে পারে, কিন্তু এই লাইনের বেশ কিছু অভিজ্ঞ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন।’

কর্পোরেট অফিসের ক্লিশে ‘স্যার’ শুনতে শুনতে ক্লান্ত যাদবচন্দ্র ‘জেঠু’ শব্দটা শুনে একটু সহজ হলেন। পার্ক স্ট্রিটের সেই অফিসটার মতো ঝাঁ চকচকে ব্যাপার এখানে নেই, মেয়েটার ব্যবহারটাও বেশ আন্তরিক। তিনি বললেন, ‘আসলে কী জানেন, বিশেষ প্রয়োজনে আমরা শুধু প্যারিসটাই যেতে চাই। কিন্তু সব টুর কোম্পানির প্যাকেজেই অনেকগুলো করে দেশ রয়েছে। ফলে টাকাটাও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমার স্ত্রী অসুস্থ, অতগুলো দেশের ভিসা করতে যাওয়াটাও ওঁর পক্ষে একটু অসুবিধা।’

জিনিয়া মাথা নাড়ল, ‘বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা ব্যাপার আপনি ভুল করছেন জেঠু। ধরুন আপনি ফ্রান্স, ইটালি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস এইসব দেশগুলো ঘুরতে যাবেন। এই প্রতিটা দেশের জন্য কিন্তু আপনাকে আলাদা আলাদা ভিসা করতে হবে। একটা ভিসা করলেই আপনি এই সব কটা দেশে ঘুরতে যেতে পারবেন। সেটাকে বলে শেনজেন ভিসা। শুধু ইংল্যান্ড যেতে গেলে আপনাকে সেখানকার ভিসা করতে হবে। মানে, আপনি দুটো ভিসা করলেই সবগুলো ঘুরতে পারবেন। আর দেখুন, আপনি-আমি, আমরা হলাম মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তদের ঘোরার ইচ্ছেটাকে মাথায় রেখেই দাশগুপ্ত ট্রাভেলস কাজ শুরু করছে। মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে কি বারবার ইউরোপ ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। প্যাসেজ মানি আছে, অন্যান্য খরচ আছে। তাই আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব একটা টুরে দেখিয়ে দিতে। আর ইউরোপের প্রতিটি দেশের মধ্যে দূরত্ব খুব কম, কিছু কিছু দেশ থেকে অন্য দেশে ট্রেনে যেতে এক ঘণ্টা মতো সময় লাগে। মানে ধরুন, হাওড়া থেকে বর্ধমান। এত কাছাকাছি যাবেন, অথচ বাকিগুলো ঘুরে যাবেন না?’

যাদবচন্দ্র ঈষৎ মাথা হেলালেন, তারপর বললেন, ‘বুঝতে পারছি। কিন্তু কী বলুন তো, তাতে খরচও তো বাড়বে। আমার পক্ষে এখন অত টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। এমনিতেই আমি রিটায়ার করেছি। আর আমার স্ত্রীর চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা …!’

জিনিয়া বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনি আগে পুরোটা শুনুন, জেঠু। আমাদের প্রথম ট্রিপ শুরু হচ্ছে সামনের মাসের উনিশ তারিখ। প্যাকেজটার নাম ‘বারো দিন ছয় দেশ—ইউরোপে ঘোরা বেশ।’ আপনি এই বারো দিনে ছ-টা দেশ ঘুরতে পারবেন।’

‘তার মধ্যে ফ্রান্সের প্যারিস শহর আছে তো? আসলে আমাদের ওই শহরে একটু কাজ রয়েছে। দু-একদিন মতো থাকলে সেই কাজটা হবে।’

যাদবচন্দ্র কথাটা বলতে বলতে একটু দম নিলেন। তিনি আজ সব সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছেন। যদি এই নতুন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে পোষায় ভালো, নাহলে একাই আরতিকে নিয়ে চলে যাবেন ফ্রান্সে। সেদিন সাইবার ক্যাফেতে গিয়েছিলেন রাজুর কলেজের ওয়েবসাইট থেকে তার ঠিকানা যদি পাওয়া যায়, জানতে।

ছেলেটা বের করে দিয়েছিল। বাড়ির নয়, কলেজের। তা হোক, আরতির শেষ ইচ্ছে তিনি পূরণ করবেন, এমন কথা দিয়ে ফেলেছেন তাই, ছেলেকে শুধু একবার দেখা নিয়ে কথা তাঁর।

তো, সেই ছেলেটাই বলল যে চাইলে সে ইন্টারনেটে প্যারিসের টিকিট কেটে দিতে পারে। হয়তো সরাসরি হবেনা, ঘুরে যেতে হবে। তা হোক। যাদবচন্দ্র এই কয়েকদিন অনেক ভেবেছেন। আর যাই হোক, তিনি তো মূর্খ নন। পড়াশুনো জানেন, সবচেয়ে বড়ো কথা ইংরেজি বলতে, লিখতে পড়তেও পারেন। স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে পারবেন না? আর বিপদ হলে হবে। বিপদের বাকিটাই-বা কী আছে তাঁর জীবনে? সামনের বছর এইসময় আরতি আর পৃথিবীতে থাকবেন কি না তাও যাদবচন্দ্র জানেন না। তাই আজ সাহস করে পুতোকে নিয়ে আবার কলকাতা এসেছেন ভালো করে পুরোটা জানতে।

জীবনে অনেক ঝুঁকিই তো নিয়েছেন সন্তানের স্বার্থে। আরতিকে কিছুই দেওয়া হয়নি। এই অন্তিম সময়ে এসে স্ত্রীর জন্য এইটুকু ঝুঁকি নাহয় নিলেন।

জিনিয়া মিষ্টি করে হাসল, বলল, ‘অবশ্যই জেঠু। ইউরোপ টুর, আর প্যারিস থাকবে না? আর আপনার যে কাজ আছে, তার জন্য আমরা দু-দিন ওখানে স্টে করব, কোনো অসুবিধা নেই।’

‘কিন্তু ছ-টা দেশ? অনেক খরচ পড়বে তো!’ যাদবচন্দ্র কিন্তু কিন্তু করে কথাটা বলেই ফেললেন, ‘আচ্ছা, যদিও এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়, তবু করে ফেলছি। আমি যদি নিজেই প্যারিস চলে যাই, হবে না? খুব অসুবিধেয় পড়ব কি?’

জিনিয়া বলল, ‘নাহ, অসুবিধের আর কী আছে। কিন্তু আপনি আগে আমাদের খরচটা দেখুন।’

বলতে বলতে যাদবচন্দ্রের দিকে ও একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল, ‘গোটা টুরটা করতে হলে প্রথমে আপনাকে দু-জনের জন্য দিতে হবে মাত্র কুড়ি হাজার টাকা। এই টাকাটা দিলেই আপনি ঘুরে আসতে পারবেন। ভিসার খরচটা অবশ্য আলাদা।’

‘কুড়ি হাজার?’ যাদবচন্দ্র বিস্মিত হয়ে পড়লেন, ‘মাত্র কুড়ি হাজার। সে কী করে সম্ভব! আমি যে শুনলাম প্লেন ভাড়াই প্রায় পঞ্চাশ হাজার মতো!’

‘ঠিকই শুনেছেন জেঠু।’ জিনিয়া বলল, ‘আমাদের পুরো প্যাকেজের খরচ এক লক্ষ আশি হাজার। কিন্তু প্রথমে আপনি দশ হাজার টাকা দিলেই ঘুরতে যেতে পারবেন। ফিরে এসে পরের ত্রিশ মাস আপনাকে দিতে হবে পাঁচ হাজার সাতশো টাকা করে।’

পাশে বসে থাকা পুতো এবার বলল, ‘অ্যাঁ! ইনস্টলমেন্টের ঘুরতে যেতেও এখন কিস্তি?’

‘হ্যাঁ।’ জিনিয়া বলল, ‘আর এই ইনস্টলমেন্টের জন্য আপনাকে কোনো অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে না। আপনি হিসেব করে দেখুন, ত্রিশ মাসেও ওই একই টাকা দাঁড়াচ্ছে। যেখানে দিন দিন মূল্যবৃদ্ধিও হচ্ছে।’

বিকাশ এসে সবার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিতে যাদবচন্দ্র তাতে এক চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বুঝলাম। বেশ নতুন ভাবনা। কিন্তু এতে তো আপনার ঝুঁকি অনেক বেশি। কেউ যদি ঘুরে এসে বাকি টাকা না দেয়?’

জিনিয়া হাসল। তার অনেক ভেবেচিন্তে বের করা চমকটা মানুষ পছন্দ করতে শুরু করেছে।

ও বলল, ‘দেখুন, আপনি আমাদের ওপর বিশ্বাস করে আমাদের সঙ্গে ঘুরতে যাবেন। আর আমরা আপনাদের এইটুকু বিশ্বাস করব না?’

যাদবচন্দ্র এবার একটু থেমে বললেন, ‘আসলে কী বলুন তো, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। ক্যান্সারের রুগি। যদিও ওষুধের ওপর থেকে এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। উনি কি এই ধকল নিতে পারবেন? সেটাই ভাবছি।’

‘ধকল কীসের, জেঠু?’ জিনিয়া বলল, ‘এটা তো কোনো দুর্গম টুর নয়। আমরা প্রথমে নিয়ে যাব লন্ডন। সেখান থেকে বড়ো বাসে করে ঘোরাব বাকি সব দেশ। প্রতিদিন রাতে হোটেলে থাকা, খাওয়া। কোনো ধকল তো নেই!’

‘একটা বাসেই সব দেশ ঘুরতে পারব?’ জিজ্ঞেস করলেন যাদবচন্দ্র।

‘হ্যাঁ।’ জিনিয়া বলল। ইউরোপ টুরের জন্য সঞ্জিত হাজরা ইতিমধ্যেই বাস কোম্পানির কনট্র্যাক্ট করিয়ে দিয়েছেন ইন্টারনেটে।

প্রায় আধঘণ্টা পর যাদবচন্দ্র আর পুতো উঠলেন।

যাদবচন্দ্রের মুখে একটা নিশ্চিন্ত ভাব খেলা করছে। আপাতত তিনি নিজে যাওয়ার পরিকল্পনাটা বাদ দিচ্ছেন। এই অল্পবয়সি মেয়েটার কাছ থেকে তিনি একটা উৎসাহ পেয়েছেন। মোটামুটি স্থির করে ফেলেছেন যে এঁদের সঙ্গেই তিনি আরতিকে নিয়ে যাবেন।

জিনিয়া ফর্ম ফিল আপ করে যাদবচন্দ্রকে দিয়ে প্রয়োজনীয় সইসাবুদ করিয়ে নিল।

পুতোকে নিয়ে যাদবচন্দ্র বেরিয়ে গেলে বিকাশ বলল, ‘তোমার জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে, দিদি। তোমার মামার কথাই ঠিক।’

জিনিয়া মুখ টিপে হাসল। ইদানীং বিকাশ ফুলুমামার দেখাদেখি ওর সঙ্গে হালকা মজা করছে। তা করুক, তাতে ওর ভালোই লাগে। এই কর্মব্যস্ত জীবনে একটু হাসতে পারে। ও হালকা গলায় বলল, ‘কেন, আবার কী হল রে?’

বিকাশ বলল, ‘তোমার বুদ্ধিটা কখনো কখনো বেশ ধারালো থাকে, কখনো আবার একেবারে ভোঁতা হয়ে যায় দিদি। এই যে তুমি ভালো করে বুঝিয়ে দুটো কাস্টমার পেলে খুব ভালো কথা, কিন্তু তুমি এদের থেকেও ইনস্টলমেন্টে টাকা নেবে কি করে বললে?’

‘কেন ইন্সটলমেন্ট তো সব কাস্টমারের জন্যই থাকছে।’

‘রাখা উচিত নয়।’ সজোরে মাথা নাড়ল বিকাশ, ‘তোমার ব্যবসার জন্যই বলছি। একটা বয়সের সীমা রাখো অন্তত। এদের দেখো, বউ ভুগছে ক্যান্সারে। ঘুরে এসেই কোনদিন টুপ করে মরে যাবে। তখন মরার আগে বউ কবে কোথায় ঘুরে এসেছে সেই টাকা বুড়ো দেবে ভেবেছ? আর বুড়োরও তো বয়স হয়েছে। সে-ও যদি পটল তোলে? তখন কী করবে তুমি? স্বর্গ থেকে টাকা নিয়ে আসবে?’

জিনিয়া কিছু না বলে হাসল। কেউ টাকা না দিলে সেই দায় যে জিনিয়ার নয়, ব্যাঙ্কের, সেই সিক্রেট ফুলুমামা আর সঞ্জিত হাজরা ছাড়া কারুর সঙ্গেই শেয়ার করেনি। আর করবেই-বা কেন। কিছু ট্রেড সিক্রেট তো থাকেই।

‘ওসব ছাড়।’ ও জ্বলজ্বলে মুখে বিকাশের দিকে তাকাল, ‘আমার প্রথম ট্রিপে লোক বেড়ে উনিশ হল।’

২৪

অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘তুমি আগের কোয়ার্টারে একটা টুল বানিয়েছিলে তোমাদের প্রোজেক্টের জন্য, যেটা টেকমিটে প্রেজেন্ট করেছিলে। মনে আছে?’

‘হ্যাঁ।’ অতন্দ্র মাথা নাড়ল, ‘আমাদের প্রোজেক্টের জন্য একধরনের নেভিগেশন টুল। সেটা দিয়ে ব্যাঙ্কের কাস্টমাররা খুব সহজেই ডেট বা ইকুইটি ফান্ডে ইনভেস্ট করতে পারেন।’

কথাটা বলে ওর মনে পড়ে গেল, ওই টুলটা টেকমিটে প্রেজেন্ট করার সময় স্টেজে অনিরুদ্ধ বসু উপস্থিত ছিলেন। টেকমিট ওদের অফিসের আভ্যন্তরীণ একটা ইভেন্ট। বিভিন্ন প্রোজেক্টের রিসোর্সরা নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে ছোটো ছোটো টেকনিক্যাল টুল সেখানে প্রেজেন্ট করে। টেকনোলজিতে খুব ভালো দখল না থাকলে এই ধরনের ইনোভেশন সম্ভব নয়। অতন্দ্রর মনে পড়ল, সেই কোয়ার্টারে ‘বেস্ট ইনোভেটর’ অ্যাওয়ার্ডটা ও-ই পেয়েছিল।

ভারতীয় ব্যাঙ্কের কাজকর্ম এখনও যেমন বেশিরভাগটাই মান্ধাতার আমলের ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং এইসবে আটকে আছে, বিদেশি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে সেটা ঠিক উলটো। ওখানে মানি মার্কেট, ক্যাপিটাল মার্কেট ভীষণভাবে চালু, কাস্টমাররা হরদম মিউচুয়াল ফান্ড, ডেট ফান্ড কিংবা ইকুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু তাতে ঝুঁকিও রয়েছে। যিনি মার্কেট ওঠাপড়ার কিছুই বোঝেন না, তিনি প্রায়ই ভুল ফান্ডে টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেন, আর পরে লস করেন।

অতন্দ্রর বানানো টুল অজ্ঞ কাস্টমারকে তাঁর পছন্দমাফিক কোন ফান্ডে ইনভেস্ট করা আদর্শ হবে, সেই ব্যাপারে সাহায্য করবে। কাস্টমার কিছু না বুঝলেও সহজেই সেই টুলের সাহায্যে তাঁর জন্য উপযুক্ত ফান্ডটায় লগ্নি করতে পারবেন।

সেবার টেকমিটে অতন্দ্র এইজন্য পুরস্কার ছাড়াও অনেক হাততালি পেয়েছিল।

তবে আইটি-র দুনিয়ায় আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। সেরা উদ্ভাবকের এখন চাকরি বাঁচানোই দায় হয়ে উঠেছে।

অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘আরেকবার ওই টুলটা সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে বলো।’

অতন্দ্র বলল, ‘অনেক ব্যাঙ্কেই এখন সেভিংস, ফিক্সড বা রেকারিং ডিপোজিট ছাড়াও ইনভেস্টমেন্টের দিকে হাঁটছে। গ্রাহকদের বিভিন্ন ফান্ডে লগ্নি করতে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রাহকের সেই সম্বন্ধে কোনো ধারণা থাকে না। বিশেষত ভারতীয় গ্রাহকরা। তাই তার শেয়ার বাজারে কোনোরকম মার্কেট স্টাডি না করে ব্রোকারের কথায় প্রভাবিত হয়ে ইনভেস্ট করে ফেলেন। কিংবা যে মিউচুয়াল ফান্ড আদৌ প্রফিট দেবে না, তার ইউনিট কিনে ফেলেন। ব্রেকার ঠিকই কমিশন পেয়ে যায়, কিন্তু আখেরে ক্ষতি হয় গ্রাহকদের। আমার টুলে একটা চ্যাটবট থাকবে যে সহজ ভাষায় গ্রাহককে এইসব বোঝাবে। ডেটা ফান্ড কী, ইকুইটি ফান্ড কী, কীসে ইনভেস্ট করলে ভালো রিটার্ন পাওয়া যাবে, এইসব। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গ্রাহকের পার্সোনাল ডেটা ও গোলের ওপর ভিত্তি করে কোন ফান্ড তাঁর জন্য উপযুক্ত হবে, সেটাও বলে দেবে আমার টুল।’

‘তুমি কি ওই টুলটা ব্রিটলস ব্যাঙ্কের জন্য বানাতে পারবে?’ অনিরুদ্ধ বসু আগ্রহ সহকারে ওর দিকে তাকালেন।

অতন্দ্র একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘ব্রিটলস তো অনেক বড়ো ব্যাঙ্ক। আমাদের ব্যাঙ্ক সেই তুলনায় ছোটো। ব্রিটলসের জন্য ওই টুল বানাতে গেলে লজিক এক থাকলেও ব্যাক এন্ডের ডেটাবেসকে অনেক এক্সটেন্ড করতে হবে, ব্লক চেইন অ্যালগরিদম ব্যবহার করতে হবে। তবে পারব না কেন। নিশ্চয়ই পারব।’

‘ভেরি গুড!’ অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘অতন্দ্র, তুমি ব্রিটলসে ওই টুল ব্যবহার হলে কাস্টমারদের কী সুবিধা হবে, কীভাবে ওই টুল কাজ করবে, তুমি তার একটা প্রেজেন্টেশন বানিয়ে ফেলো। যেহেতু তুমিই টুলটা ডেভেলপ করেছ, ক্লায়েন্টদের সবচেয়ে ভালো কনভিন্স করতে তুমিই পারবে।’

অতন্দ্র বলল, ‘কিন্তু ব্রিটলস তো লন্ডনের ব্যাঙ্ক। ওখানকার কাস্টমাররা এইগলো সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। ওদের কি এই টুল আদৌ কোনো কাজে লাগবে?’

অনিরুদ্ধ বসু বললেন, ‘আমার কাছে ইনফরমেশন আছে, ব্রিটলস খুব শিগগির ভারতে পা রাখবে। আমরা যদি তার আগেই ওদের এই টুলটা প্রেজেন্ট করতেপারি, সেটা নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবে।’

অতন্দ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেইসময় ফোন বেজে উঠল। ফেলো স্ক্রিনে নামটা দেখেও বিরক্ত হয়ে উঠল। গীতিকা। দিন কয়েক হল গীতিকা অফিসেও ঠিকমতো আসছে না, এদিকে যখন-তখন ওকে ফোন করে বিরক্ত করছে।

এতবার ফোনে অতন্দ্রর বেশ বিরক্তিই লাগছে। একে তো এই মেয়েটার জন্য ওর সংসারটা ভেঙে গেল। প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে তো গীতিকাই দায়ী এইজন্য! কী প্রয়োজন ছিল ওর অত ইয়ার্কি মারার? অত ঘন ঘন মেসেজ, ফোন করার?

বিরক্তমুখে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল অতন্দ্র। নিজেকে কে দেখে তার নেই ঠিক, ও আর পারছে না অন্যের পাশে দাঁড়াতে। অনিরুদ্ধ বসু-র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্রিটলসে ক্লায়েন্ট ভিজিট তো এই হয়ে গেল আগের মাসে। আমার কয়েকজন বন্ধু আছে ওই প্রোজেক্টে, ওরাই বলেছিল। আবার আসছে?’

‘যারা আসে, তারা মিডল ম্যানেজমেন্টের লোক, তারা এইসব দেখছে না। তুমি ডেমো দেবে ব্রিটলসের খোদ এগজিকিউটিভ বোর্ড মেম্বারদের সামনে। তাতে ওদের ভাইস প্রেসিডেন্ট লেভেলের লোকেরা থাকবে।’

অতন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ব্রিটলসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বোর্ড মেম্বার এরা সব ভারতে আসছে?’

‘তারা কেন আসতে যাবে! তুমি যাবে।’ অনিরুদ্ধ বসু কথাটা বলে ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ দেবাশিসদা, আমি অতন্দ্রকেই পাঠাচ্ছি। অ্যাঁ? হ্যাঁ, আমার মনে হয় হি ইজ দ্য বেস্ট। আরে মিত্রর কথা ছাড়ুন, ও এখন কলকাতায় এসে একটু বেশিই মাতব্বরি করছে … দেখা যাক না, বল তো হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে আমরা ধরেই নিচ্ছি, সো হোয়াই নট টেক আ রিস্ক?’

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে অনিরুদ্ধ বসু ফোন রাখলেন। অতন্দ্রর জানতে ইচ্ছে হল, ফোনের ওপ্রান্তে কি গোটা কলকাতা রিজিয়নের সর্বময় কর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য?

কৌশিকদার মনেও বোধ হয় একই প্রশ্নের উদয় হয়েছিল, সে একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘দেবাশিসদা মানে কি ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যার?’

‘হ্যাঁ।’ অনিরুদ্ধ বসু মাথা নাড়লেন, ‘দেবাশিসদা আর আমি দু-জনেই খুব হোপফুল যে অতন্দ্রই পারবে ওদের কনভিন্স করতে। ব্রিটলস চলে যাওয়া মানে টেকি ওয়ার্ল্ডের লসের পরিমাণ আরও বাড়বে, আর সেটার প্রভাব পড়বে প্রতিটা রিসোর্সের ওপর। শেষ চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। অতন্দ্র, তুমি রেডি হও। আমি ওদের সঙ্গে তোমার মিটিং শিডিউল করছি।’

অতন্দ্র হতবাক হয়ে শুনছিল। দেবাশিস ভট্টাচার্যকে ও দেখেছে মাত্র একবার। কোন এক বছরের অ্যানুয়াল ফাংশানে। নামেই তিনি গোটা কলকাতার হেড, বছরের বেশিরভাগ সময়েই থাকেন নিউইয়র্কে টেকি ওয়ার্ল্ডের হেড অফিসে। এখানে এলে তাঁর সঙ্গে মিটিং-এর সুযোগ পায় সিনিয়র ম্যানেজার বা তার ওপরের পদের লোকেরা। সেই দেবাশিস ভট্টাচার্য ওকে এক নামে চিনছেন?

ও একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু লন্ডন যেতে গেলে তো ভিসা লাগবে। আমার ওয়ার্ক ভিসা নেই।’

‘ওহো, ওয়ার্ক ভিসায় তুমি যাবেই-বা কেন! তুমি তো যাবে মিটিং-এ, আমি এখুনি তোমার বিজনেস ভিসা প্রসেস করতে বলছি।’ কথাটা শেষ করেই অনিরুদ্ধ বসু আবার কাকে ফোন করলেন, ‘সোফিয়া, একটা বিজনেস ভিসা করতে হবে আর্জেন্ট বেসিসে, ডিটেইলস পাঠাচ্ছি। প্রসেস করে একেবারে টিকিট কেটে পাঠাও।’

অতন্দ্র ঢোঁক গিলল। এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যাচ্ছে যে ও কিছু বুঝেই উঠতে পারছেনা। ও কৌশিকদার দিকে তাকাল। কৌশিকদা-র অবস্থাও তথৈবচ। সেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে।

অনিরুদ্ধ বসু কথা শেষ করে অতন্দ্রর দিকে স্থির চোখে তাকালেন, ‘বিজনেস ভিসার মেয়াদ তিন মাস। কিন্তু আমাদের কনট্রাক্ট শেষ হচ্ছে আর একমাস পরেই। তার আগেই তোমাকে ওদের কনভিন্স করতে হবে অতন্দ্র। আর আমি জানি, তুমি পারবে। তোমাকে প্রোজেক্ট থেকে রিলিজ করে দেওয়া হলেও ডোমেন থেকে এই মুহূর্তে রিলিজ যাতে না করা হয়, আমি সেই ব্যাপারে কথা বলছি।’

অনিরুদ্ধ বসু এবার টিম লিডারদের মতো ওকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন, মনে মনে ভাবল অতন্দ্র। এসব ওর দরকার নেই। ও যখন কোনো কাজ করে, সেটা মন দিয়েই করে। সে কোনো কোডিং-ই হোক, কিংবা কারুর ব্যবসার খদ্দের টেনে আনা।

সব জায়গাতেই স্বার্থ। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই অতন্দ্রর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। আজ এই ডামাডোলটা যদি না হত, তাহলে ওর মতো রিসোর্স কেন চার রেটিং পেল, তাই নিয়ে কি অনিরুদ্ধ বসু-র মতো ডিরেক্টর পোস্ট মর্টেম করার সময় পেতেন? ও যদি তখন অফিসের কাজে ঢিলে দিয়ে, ছুটি নিয়ে নানারকমের ট্রাভেল ফেয়ার ঘুরে, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বলে অতগুলো কাস্টমার জোগাড় না করত, জিনিয়ার ব্যবসা শুরু করার রাস্তাটা কি ততটা মসৃণ হত?

নাহ, ঘুরেফিরে ওই বাক্যটাই মনে পড়ে যাচ্ছে অতন্দ্রর। ডেস্টিনি ইজ গড। ভাগ্যের পরিহাসে সেই লন্ডনেই যেতে হচ্ছে ওকে, শুধু যেখানে যাওয়ার কথা ছিল একগাদা টুরিস্ট নিয়ে, সেখানে যেতে হচ্ছে কোম্পানির হয়ে ডিল ফিক্স করতে।

‘অতন্দ্র।’ অনিরুদ্ধ বসু নিজের চেয়ার ছেড়ে কখন উঠে এসেছেন এদিকে, ওর কাঁধে আলতো হাত রেখে বললেন, ‘মনে করো, এটা তোমার নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। আর আমি জানি, এই লড়াইয়ে তুমি জিতবে। আমি জানি, মিত্রকে তুমি ভুল প্রমাণক করবে। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট!’

২৫

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।

কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে।।

প্রভাতে পথিক ডেকে যায়, অবসর পাইনে আমি হায়—

বাইরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক’রে।।

জিনিয়া নিজের মনে গুনগুন করছিল

যত টানাপোড়েনই আসুক, যত ঝড়ঝাপটাই বয়ে যাক, সময় কারুর জন্যই থেমে থাকে না। সে সর্বদা বহমান। তার গতিবেগের হার চিরকালীনভাবে এক হলেও মানুষের মনে হতে থাকে, ব্যস্ততার সঙ্গে সময়ও ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। ছোটোবেলায় কিংবা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে পর্যন্ত যেন সময় অনেক স্থিতিশীল থাকে, কিন্তু জীবনে যখনই দায়িত্ব আসে, কিংবা মুখোমুখি হতে হয় কোনো চ্যালেঞ্জের, যে চ্যালেঞ্জের ওপারে অপেক্ষা করছে কোনো সযত্নলালিত স্বপ্ন, সময় যেন তখন পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে।

জিনিয়ার জীবনেও সময় এখন ভীষণ তাড়ায় রয়েছে। প্রায় উল্কার গতিতে দিন কেটে যাচ্ছে, চোখের পলক না পড়তেই শেষ হচ্ছে একেকটা ঘণ্টা। ঘন ঘন মিটিং, ভিডিয়ো কনফারেন্স, ই-মেলের চক্করে ও যেন নিশ্বাস ফেলারও সময় পাচ্ছে না।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর ‘বারো দিন ছয় দেশ-ইউরোপে ঘোরা বেশ’ শুরু হতে আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। জিনিয়া, সঞ্জিত হাজরা ও অম্বিকেশ সান্যালকে নিয়ে মোট বাইশ জনের দল তিন দিন বাদেই মধ্যরাতে উড়ে যাবে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ওরা সবাই এখন অসম্ভব ব্যস্ত।

এর মধ্যে প্রত্যেকের ইংল্যান্ড ও শেনজেন দুটো ভিসাই ঠিকমতো প্রসেসিং হয়ে গেছে। অম্বিকেশের চেনা সেই এজেন্ট কিষাণ সাউ প্রত্যেকের প্লেনের টিকিট ও ভিসার ব্যাপারটা সামলেছে। সঞ্জিত হাজরা গোটা টুরের বিশদ প্রোগ্রাম বানিয়েছেন, যাকে ইংরেজিতে বলে আইটিনেরারি। কবে কোন সময়ে কোথা থেকে কোথায় যাওয়া হবে, কী কী দেখা হবে, কোন হোটেলে লাঞ্চ সারা হবে, সেখান থেকে কোথায় যাওয়া হবে, রাতে কোন হোটেলে থাকা হবে, এই সমস্ত কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লেখা রয়েছে সেই আইটিনেরারিতে।

অম্বিকেশ দায়িত্ব নিয়েছেন বিদেশি মুদ্রার। গোটা টুরের জন্য বেশ ভালো পরিমাণে পাউন্ড ও ইউরো সংগ্রহ করেছেন ডালহৌসির ফরেক্স অর্থাৎ ফরেন এক্সচেঞ্জ কেনাবেচার দোকান থেকে। এক্ষেত্রেও তাঁর গ্লোবাল টুরসের কনট্যাক্টস খুবই কাজে লেগেছে। ডালহৌসি চত্বরের অনেকগুলো ফরেক্সের অফিসই গ্লোবাল টুরসের সঙ্গে ব্যবসা করত। তারা অম্বিকেশকে যথেষ্ট খাতির করেছে।

আলোকপর্ণা লাহিড়ী দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে যোগ দেওয়ার পর থেকে জিনিয়ার অনেক সুবিধা হয়েছে। আলোকপর্ণা এত বছর একটা নামি কোম্পানিতে কাজ করেছে, তার কাজের ধরন অনেক গোছানো আর শৃঙ্খলাবদ্ধ। ওর পরামর্শেই জিনিয়া অ্যাকাউন্টসের হিসেব সামলানোর জন্য ও কাস্টমারদের ডেটাবেসের জন্য একটা সফটওয়্যার কিনেছে। তাতেই কাজ অর্ধেক কমে গেছে আর অনেক সুচারু হয়েছে।

তা ছাড়া ঢোকার এক সপ্তাহের মধ্যেই আলোকপর্ণা একটা কাস্টমার এনেছিল। তিনিও ইউরোপ টুরে যাচ্ছেন।

যাওয়ার ঠিক তিনদিন আগে জিনিয়া বাড়ি বসে শেষ মুহূর্তের হিসেব মেলাচ্ছিল। গোটা টুরে অনেকগুলো হোটেলে উঠতে হবে। আর প্রতিটাতেই অনেকগুলো করে রুম লাগবে। সব হোটেলের সঙ্গে কথা বলা, কনফার্মেশন, পেমেন্ট সব ইন্টারনেটেই হয়ে গেছে, আর সেসব সামলেছেন সঞ্জিত। সঞ্জিত ওই প্রতিটা হোটেলেই আগে অসংখ্যবার টুর নিয়ে গিয়েছেন, তাই তাঁর সঙ্গে হোটেল কর্তৃপক্ষের অসম্ভব ভালো চেনাশোনা।

তবু জিনিয়া প্রতিটি হোটেল থেকে ই-মেলে আসা কনফার্মেশনগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। ফুলুমামা বা সঞ্জিত যতই সাহায্য করুন, খাতায়-কলমে ফুলুমামা কোম্পানির অ্যাডভাইসর আর সঞ্জিত কিছু ইনভেস্ট করলেও একজন কর্মচারী। দাশগুপ্ত ট্রাভেলস এখনও প্রাইভেট লিমিটেড কনসার্ন নয়, অতন্দ্র ছেড়ে দেওয়ার পর জিনিয়াই এর সর্বময় কর্ত্রী। আর সেই হিসেবে কোম্পানির প্রতিটি খুঁটিনাটি ও নিজের নজরে রাখতে চায়।

কিন্তু ওর মনঃসংযোগে বারবার ছেদ পড়ছিল। সকাল থেকে টুং টাং শব্দে মেসেজ এসেই চলেছে ওর ফোনে। প্রতিটা মেসেজই করছেন সঞ্জিত। সঞ্জিত এখন এয়ারপোর্টের কাছেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। সকাল দশটা হলেই তিনি চলে যান লেকটাউনের গ্যারাজ অফিসে, তারপর সেখান থেকে নানা প্রয়োজনীয় জায়গায় গিয়ে ফেরত চলে যান ফ্ল্যাটে। জিনিয়ার সঙ্গে সারাদিনই ফোনে যোগাযোগ থাকে।

কিন্তু ইদানীং একটু অকারণেই যেন সারাদিন মেসেজ করে চলেছেন সঞ্জিত। যেমন এখন।

জিনিয়া ফোন খুলে দেখল, তেমন কোনো কারণই নেই, সুপ্রভাতমার্কা মেসেজ পাঠিয়েছেন সঞ্জিত। প্রথমে ও ভাবত সঞ্জিত বুঝি সবাইকে একসঙ্গে এই মেসেজগুলো ফরোয়ার্ড করেন। কিন্তু পরে বুঝেছে তিনি ওগুলো শুধু জিনিয়াকেই পাঠান।

একবার হালকাভাবে ও এই প্রসঙ্গে কথাও বলেছিল, ‘আপনি অবান্তর মেসেজ করবেন না, সঞ্জিত। আমি কাজের মধ্যে থাকি। আপনার নাম, দেখে ভাবি বুঝি প্রয়োজনীয় কিছু। কিন্তু দেখি তা নয়। এরকম পাঠালে আমি আর মেসেজ খুলবোই না, তখন দরকারি কিছু পাঠালে সেটা মিস হয়ে যাবে।’

ওর কথা শুনে সঞ্জিত প্রথমে কিছু উত্তর দেননি। তারপর অন্যদিকে ফিরে হেসে বলেছেন, ‘দরকার শব্দটাই তো রিলেটিভ, জিনিয়া। কারুর কাছে কোনো কিছু দরকারি, কারুর কাছে সেটার কোনো গুরুত্বই নেই। বাই দ্য ওয়ে, রিলেটিভকে আপনারা বাংলায় কী বলেন?’

‘আপেক্ষিক।’ ভেবে বলেছিল জিনিয়া।

‘ইয়েস। আপেক্ষিক।’ সঞ্জিত সিগারেটে হালকা একটা টান দিয়ে হেসেছিলেন, ‘দরকারি জিনিসটা আপেক্ষিক, ম্যাডাম।’

মা এসে ডাকতে জিনিয়ার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল।

মা বলল, ‘কোন ট্রলিটা নিবি? আমাদের পুরোনোটা না তোর বিয়েরটা?’

জিনিয়া বুঝতে পারল, ‘বিয়ের’ শব্দটা ইচ্ছে করে ব্যবহার করল মা। যত দিন যাচ্ছে, বাবা-মা ওদের সম্পর্কের পরিণতির ব্যাপারে প্রচণ্ড অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। বলতে গেলে, ও এখন বাড়িতে প্রায় একঘরে হয়ে রয়েছে। কেউ ওর সঙ্গে কথা বলে না তেমন। বললেও নানারকম ইঙ্গিত থাকে তাতে। ও ঠিক করেই রেখেছে, ফিরে এসে একটু সামলে উঠেই ও আলাদা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে। এই বাড়িতে সবসময় একটা শ্রাদ্ধের পরিবেশ বিরাজ করছে ইদানীং। ভাবখানা এমন, জিনিয়া ভয়ানক অন্যায় করে ফেলেছে এখানে এসে।

এও হতে পারে মায়ের সঙ্গে অতন্দ্রর যোগাযোগ রয়েছে। ওদিকে অতন্দ্রর বাবা-মা-ও পিছিয়ে নেই। তাঁদের সঙ্গেও বাবা-মা প্রায়ই কথা বলে ফিসফিস করে, জিনিয়া এলেই চুপ করে যায়।

বিরক্ত লাগে মাঝেমধ্যে জিনিয়ার। ও নিজে জীবনের একটা সন্ধিক্ষণে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে মনে বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখলেও কোনোদিনও ভাবেনি দাশগুপ্ত ট্রাভেলস তার উড়ান শুরু করতে পারবে। হাজারো মিটিং, ব্যাঙ্কের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট, পুঁজি জোগাড় করা, বিজ্ঞাপন, অফিসঘর ভাড়া নেওয়া, এই এতরকম ধাপ পেরিয়ে ও যখন সত্যিই সেই স্বপ্ন সত্যি করতে যাচ্ছে, বাবা-মা কোথায় মেয়ের এই সাফল্যে গর্বিত হবে, ওকে উৎসাহ যোগাবে, তা নয়, চোখাচোখি হলেই এমন একটা ভাব করে, যেন জিনিয়া বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। যেন জিনিয়া যেটা করছে সেটা ভয়ংকর দোষের কিছু। দুজনেই রীতিমতো উদগ্রীব হয়ে থাকে, কী হয়েছে জানার জন্য। নেহাত জিনিয়া আজকাল বাড়িতে কোনো কথাই বলে না বলে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না।

আশ্চর্য ব্যাপার! জিনিয়া ছেলে হলেও বাবা-মা কি এমনটাই করত? ছেলের ব্যবসা শুরুর সময়েও সম্পূর্ণ নির্বিকার হয়ে থাকত? তখনও কি ব্যক্তিগত সমস্যাটার ওপরই বেশি আলোকপাত করত?

আর সমস্যাই-বা কীসের? জিনিয়া না এসে বাড়িতে কান্নাকাটি করলে, আগেকার দিনের অবলা নারী হয়ে রইলে বুঝি বাবা-মা বেশি শান্তি পেত? তখন সেই আদ্যিকাল থেকে চলে আসা রুটিন সংলাপ ‘মানিয়ে নে মা’ বলে বুঝিয়ে- সুঝিয়ে দিয়ে আসত স্বামীর কাছে? বিবাহিতা মেয়ে সব সহ্য করেও শ্বশুরবাড়িতে থাকছে, এটা ভাবার মধ্যে মনে হয় এখনও মানুষ বেশ তৃপ্তি পায়, মেয়ে মানেই ধৈর্য ও সহ্যের প্রতিমূর্তি, এইটা কল্পনা করে তাদের তৃপ্তিও আসে।

জিনিয়ার বাবা-মা-ও বোধ হয় তার ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু এই কয়েক দিনে জিনিয়া অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছে। ও মানুষটাই এরকম। প্রথমে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু একবার যদি কারুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, জীবনেও আর তার দিকে ফিরে তাকায় না। অতন্দ্র যখন প্রথম গীতিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু করেছিল, জিনিয়া অনেক বুঝিয়েছিল। অতন্দ্র তখনও একটুতেই রেগে যাচ্ছিল, দুর্ব্যবহার করছিল। জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলছিল ঘরের এদিক-ওদিক। জিনিয়া সেগুলো গায়ে না মেখে নিরন্তর বুঝিয়ে গেছে।

কিন্তু সব কিছুর একটা সীমা আছে। ও অতন্দ্রর স্ত্রী মানে এই নয় যে অতন্দ্র ওকে যা ইচ্ছে তাই বলবে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেয়েও অনেক বেশি উচিত আত্মসম্মান বজায় রাখা। তাই জিনিয়া এবারে সরে এসেছে। অতন্দ্র যদি ওর কাছে এসে হাঁটু মুড়েও ক্ষমা চায়, ও কোনোদিন ওকে ক্ষমা করবে না। অতন্দ্রর দিকে তাকালেই ওর সারাজীবন মনে পড়বে, কীভাবে রাত আড়াইটের সময় ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ও।

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জিনিয়া মুখ তুলল না। কাজ করতে করতেই বলল, ‘ লাগবে না।’

‘লাগবে না কেন?’ আশ্চর্য হল মা, ‘ বাড়িতে এত ভালো ট্রলি থাকতে কিনবি নাকি নতুন?’

জিনিয়া বলল, ‘আপাতত পঞ্চাশ পিস ট্রলি কেনা হয়েছে, সেগুলোয় কোম্পানির লোগো আর এমব্লেম ছাপানো হচ্ছে। প্রতিটা কাস্টমারকে একটা করে ট্রলি গিফট করেছি। আমরা নিজেরাও ওই ট্রলিই নিয়ে যাব।’

‘বাবা!’ মা এবার একটু থমকাল। বোধ হয় মনে মনে হিসেব করছে পঞ্চাশ পিস ট্রলির কেমন দাম হতে পারে। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘প্রথমে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘কেন?’ জিনিয়া বলল, ‘ ফুলুমামা বলেনি তোমায়?’

‘ফুলু এসেছে কই যে কথা হবে?’ মা যেন আচমকা খিঁচিয়ে উঠল, ‘সারাক্ষণই তো তোর অফিস আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। চাকরিটা ছেড়ে ভাবলাম একটু ফাঁকা হবে, তা তো হলই না, উলটে দেখি ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেল।’

‘অফিস ছেড়ে ফুলুমামা তো আর বাড়িতে বেকার হয়ে বসে নেই, আরেকটা কোম্পানি জয়েন করেছে। তাই ব্যস্ততা তো থাকবেই, মা।’ জিনিয়া নরম গলায় বলল, ‘প্রথমে আমরা কলকাতা থেকে যাব লন্ডন।’

‘কতজন হল তাহলে?’ মা বহুকাল পরে সহজ গলায় যেন কথা বলল ওর সঙ্গে।

জিনিয়া বলল, ‘আমি, ফুলুমামা আর সঞ্জিতবাবু ছাড়া আঠারো জন। বেশিরভাগই বয়স্ক।’

মা বলল, ‘অতন্দ্র যাবে না?’

জিনিয়া এবার ক্লান্তচোখে তাকাল মায়ের দিকে। বিরক্ত বোধ করতেও যেন ওর বিরক্ত লাগছিল। ও বলল, ‘তোমাদের আর কোনো কথা নেই, না মা? ভালো লাগে এই এক জিনিস নিয়ে পড়ে থাকতে?’

আশ্চর্যের ব্যাপার, অন্য সময়ের মতো মা এখন আর খিঁচিয়ে উঠল না। একটু থেমে বলল, ‘জিনি, তুই হয়তো ভাবছিস তোর এই ব্যবসায় আমরা খুশি নই, তাই না? ভাবছিস, তুই এত পরিশ্রম করে ব্যবসাটাকে দাঁড় করাচ্ছিস, এদিকে বাবা-মা খালি বিয়ে-সংসার নিয়েই পড়ে আছে। কিন্তু তুই নিজে মা হলে বুঝতে পারবি, সন্তানের সাফল্যের চেয়েও প্রতি বাবা-মা চায় তাকে শান্তিতে থাকতে দেখতে। তুই এই টুর কোম্পানির ব্যবসা করে একদিন হয়তো এত টাকা রোজগার করবি যে চাকরি ছেড়ে দেওয়াটা তোর গায়েই লাগবে না। তোর কোম্পানি সেদিন অনেক বড়ো হবে। তোর নাম হবে। মা হিসেবে সেদিন কি আমার গর্ব হবে না? অবশ্যই হবে। কিন্তু গর্ব আলাদা, তৃপ্তি আলাদা, জিনি। আমাদের বয়স হয়েছে। তোকে এভাবে হঠাৎ একা হয়ে যেতে দেখলে আমরা কখনো শান্তি পেতে পারি, বল তো? তোর কাজের জন্য গর্বটা তাই বার বার চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে। এত হইহই করে নিজে দেখেশুনে বিয়ে করলি, দু-জনে প্ল্যান করে ব্যবসায় ঢোকার কথা ভাবলি, এদিকে দুম করে হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে চলে এলি, একাই ব্যবসা শুরু করলি। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের চিন্তা হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? আমরা চলে গেলে এই এত বড়ো পৃথিবীতে তুই একা একা থাকবি?’

জিনিয়া থমকে গিয়ে শুনছিল। সত্যি, ও খালি নিজের দিকটাই ভাবছিল, মায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে একবারও দেখার চেষ্টা করেনি। সন্তান দুঃখে থাকলে তার সাফল্য বাবা-মার কাছে ম্লান হয়ে যায়।

কথা বলতে বলতে মায়ের চোখের কোণ দুটো ভিজে উঠেছে। গলাটা ধরে আসছে। আঁচলের এক প্রান্ত দিয়ে কোনোমতে চোখদুটো মুছছে মা।

ও শুধু বলতে পারল, ‘মা, বিশ্বাস করো …!’

মা ওকে বাধা দিয়ে ধরা গলায় বলে উঠল, ‘তুই কী ভাবিস? আমরা তোর শত্রু? অতন্দ্রর সঙ্গে তোর যা-ই হয়ে থাকুক, তার জন্য আমরা তোকে দোষারোপ করছি? একেবারেই নয়। অতন্দ্র আমাদের জামাই বটে, কিন্তু তুই আমাদের মেয়ে। এটা ভুলে যাস না। তোদের মধ্যে কী হয়েছে না হয়েছে সেসবও আমাদের জানার ইচ্ছে নেই। আমরা শুধু এইটুকু চাই যে তুই শান্তিতে থাক। আনন্দে থাক।’

‘মা আমি আনন্দে আছি এটা বিশ্বাস করো।’ জিনিয়া বিছানায় বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়ে খাটের কোনায় এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল ও, ‘তোমাদের কাছে রয়েছি, আবার আগের মতো সবসময় তোমাদের দেখতে পাচ্ছি, কথা বলতে পারছি। তোমার করে দেওয়া টিফিন দুপুরবেলা কাজ করতে করতে খেতে পারছি, এরপরও তোমরা কী করে বলছ যে আমি ভালো নেই?’

‘আচ্ছা, বেশ!’ মা এবার আর ওকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল না। উলটে ওর মাথাটাকে বুকের কাছে টেনে নিল। বহুদিন পর ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তুই এত বয়স্ক মানুষদের নিয়ে যাচ্ছিস, কই আমাকে তো একবারও বললি না যাওয়ার জন্য!’

জিনিয়া মুহূর্তে বিস্মিত, ও মায়ের দিকে মাথা তুলে বলল, ‘তুমি যেতে মা!’

‘তুই বললে তবে তো যেতাম!’ মায়ের ঠোঁট অভিমানে ফুলে উঠেছে, ‘বিয়ের পর থেকে তোর বাবা পার্টি পার্টি করে কোথাও নিয়ে গিয়েছে? আমার বাবা এত গয়না দিয়েছিলেন বিয়েতে, তুই তো পরিস না, সোনার গয়না পছন্দও করিস না। আমি মনে করেছিলাম তুই একবার বললেই আমার কিছু গয়না বেচে … কোথায় কী! তুই একবারও বললিই না!’

‘মা, আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে তুমি যাবে!’ জিনিয়া অসহায়ভাবে ছটফটিয়ে উঠে বলল, ‘আমি … আমি ভেবেছি, আমার কোম্পানির কথা উঠলেই তুমি বিরক্ত হও, তোমার ঘুরতে যেতে কোনো আগ্রহই নেই। ফুলুমামার সঙ্গে আমি একা একাই ট্রেকে যেতাম। আমি কি করে বুঝব বলো! এখন তো আর কিছু করাও যাবে না। তোমার তো পাসপোর্টই নেই।’

মা কোনো উত্তর না দিয়ে একমনে জিনিয়ার জামাকাপড় ভাঁজ করতে লাগল।

জিনিয়া অস্থির হয়ে মা-র হাত দুটো জড়িয়ে ধরল, ‘আচ্ছা মা, আমি প্রমিস করছি। পরেরবার ট্রিপে তোমাকে ঠিক নিয়ে যাব। এবার একটু হাসো। কতদিন তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসোনি বলো তো মা! তোমার এই চণ্ডীমূর্তি আর ভালো লাগছে না!’

মা এবার আর মুখ ভার করে থাকতে পারল না। জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে হেসে ফেলল। আর অস্ফুটে বলল, ‘সাবধানে যাস। আর সবাইকে যত্ন করে নিয়ে যাস। ওঁরা সকলে তোর ভরসাতেই যাচ্ছেন।’

২৬

ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন মধ্যরাত, কিন্তু তা দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে এলে বোঝার উপায় নেই। এখানে চারদিক ঝলমল করছে আলোয়, একটার পর একটা এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারগুলোয় গ্রাউন্ড ক্রু-রা সুসজ্জিত হয়ে বসে হাসিমুখে কথা বলছেন যাত্রীদের সঙ্গে। ক্রমাগত ঘোষণা হয়ে চলেছে সেখান থেকে। সামনে যাত্রীদের ভিড়ও রয়েছে প্রায় প্রতিটি কাউন্টারেই। একেকজন করে যাত্রী গ্রাউন্ড ক্রু-দের মুখোমুখি হচ্ছেন, টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করছেন, তারপর নিজেদের লাগেজ তুলে দিচ্ছেন পাশের লাগেজ বেল্টে। বিশাল বিশাল সুটকেস বা ট্রলিগুলো অমনি গোঁত্তা খেতে খেতে চলে যাচ্ছে ভেতরের দিকে।

সেগুলো সব একে একে উঠে পড়বে ক্যারেজ ভ্যানে। তারপর যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও প্লেনের পেটে করে পাড়ি দেবে দেশে-বিদেশে।

বোর্ডিং পাস হাতে পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক সফরের যাত্রীরা চলে যাচ্ছেন ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে। সেখানেও লাইন। একজন একজন করে মুখোমুখি হচ্ছেন কাউন্টারের কর্মীর, পাসপোর্ট দেখাচ্ছেন, রুটিন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, তারপর ঝপাং করে পাসপোর্টের ভিসার পাতায় পড়ে যাচ্ছে স্ট্যাম্প।

তারপর পালা সিকিউরিটি চেকিং-এর। সবকিছু মিটে গেলে নির্দিষ্ট গেটের সামনে পরপর এসে দাঁড়াচ্ছে এয়ারলাইন্সের ঝকঝকে বাস। তাতে চড়ে যাত্রীরা চলে যাচ্ছেন প্লেনে উঠতে।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের তরফে আলোকপর্ণা হাতে একখানা বড়ো প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আন্তর্জাতিক প্রবেশের একদম বাইরে। সে যেহেতু যাত্রী নয়, তার ভেতরে ঢোকার অনুমতি মেলেনি। আলোকপর্ণার চারপাশে থিকথিক করছিল এয়ারপোর্টের ভেতরে মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাতে ঠেলা ট্রলি। চওড়া রাস্তা দিয়ে প্রতি মিনিটে দশটা করে গাড়ি ঢুকছে, সেখান থেকে নামছে দল দল লোক। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে ট্রলিতে চাপিয়েই তাঁরা পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর ‘বারো দিন — ছয় দেশ, ইউরোপে ঘোরা বেশ’-এর উনিশজন যাত্রীর মধ্যে এর মধ্যে এখনো পর্যন্ত এসে পৌঁছেছেন ছ-জন। আলোকপর্ণা তাঁদের পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেতরে চেক ইন কাউন্টারের পাশে রয়েছে তার বস জিনিয়া দাশগুপ্ত। ফোনে ক্রমাগত কথা চলছে দু-জনের মধ্যে।

যে এয়ারলাইন্সের টিকিট কাটা হয়েছে, তার চেক ইন কাউন্টারের পাশে জিনিয়া হাতে যাত্রীদের তালিকা এবং প্রত্যেকের টিকিটের কপি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। চিন্তায় ও উত্তেজনায় বার বার ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কাঁধে ঝোলানো ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর ছাপ মারা জলের বোতল থেকে জল খাচ্ছে ঢক ঢক করে। আলোকপর্ণা, ফুলুমামা ও সঞ্জিতের সঙ্গে ফোনে ঘন ঘন কথা বলছে, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে, কথা বলছে টুরের যাত্রীদের সঙ্গেও, তবু একটু ফাঁক পেলেই ও যেন চলে যাচ্ছে অতীতের স্মৃতিচারণে।

গত কয়েক বছর ধরে প্রাইমা ইনফোটেকে কাজের মাঝে, রাত করে বাড়ি ফেরার ফাঁকে, অবসরে, যে স্বপ্নটা ও মনের মধ্যে লালন করে এসেছে, তা এবার সত্যি হতে চলেছে। ওর সন্তানসম দাশগুপ্ত ট্রাভেলস আজ শুরু করতে চলেছে তার প্রথম উড়ান।

এই দিনটার জন্য ও কবে থেকে যে অপেক্ষা করে ছিল! কত ছুটির দিন কেটেছে কাগজের সাদা পাতায় আঁকিবুঁকি কেটে নিজের পরিকল্পনা সাজিয়ে, ফুলুমামার সঙ্গে আলোচনায়, কত বিনিদ্র রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়েছে অতন্দ্রর সঙ্গে তর্কেবিতর্কে।

অথচ আজ, ওর জীবনের এত বড়ো গুরুত্বপূর্ণ দিনে সেইসব সঙ্গীসাথিদের মধ্যে একজনই নেই। জিনিয়া ভাববে না ভাববে না করেও একটা নিশ্বাস ফেলল। শেষ এক মাস এত ব্যস্ততায় কেটেছে যে অতন্দ্রর কোনো খোঁজই রাখেনি। ওর পাঠানো সেই ডিভোর্স পেপারের কোনো উত্তর আসেনি। জিনিয়ারও শেষ সময়ের ব্যস্ততায় মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সব।

আজ এই ব্যস্ত এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে একাকী দাঁড়িয়ে ওর এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, সত্যিই কি ও ভুলে গেছে অতন্দ্রকে? ভুলে গেছে ওর দশ বছরের ভালোবাসাকে? ভুলে গেছে সাড়ে তিন বছরের বিবাহিত জীবনের কয়েক গিগাবাইট স্মৃতিকে?

না, কিছুই ভোলেনি। কিছু জিনিস কখনোই ভোলা যায় না। প্রাপ্তবয়সে এসে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল যাকে, যাকে বিশ্বাস করেছিল নিজের চেয়েও বেশি, তাকে জিনিয়ার সবসময়েই মনে পড়ে, আর মনে পড়লেই মুচড়ে ওঠে মন। অন্য কোনো কাজ বা ভাবনা দিয়ে দমিয়ে রাখতে হয় সেই মনকেমনকে, যদিও ছাইচাপা আগুনের মতো তা ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে মনের অতল গভীরে।

কিন্তু মনের ভেতর সারাক্ষণ ব্যথায় জর্জরিত হয়েও জিনিয়া অতন্দ্রর খোঁজ নেয়নি। যাকে ফোন করলেই ওর খবর পাওয়া যেত, সেই শুভ্রদীপকেও ও ফোন করেনি একবারও। বরং শুভ্রদীপই করেছিল।

জিনিয়া রিসিভ করেনি। তৃতীয় ব্যক্তির মুখ থেকে আর নিজের একান্ত কাছের মানুষের খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে না। কেমন ছোটো মনে হয় নিজেকে। হতে পারে ওর সংসার ভেঙে গেছে, তাই বলে অতন্দ্রর সঙ্গে ভালোবাসায় মোড়া গোটা পরিচ্ছেদটা ও সুখস্মৃতি হিসেবেই মনে রাখতে চায়, শেষ কয়েক মাসের তিক্ততা দিয়ে নয়। আজ যদি ও খবরও পায় যে অতন্দ্র গীতিকার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে, ভেতরে যত কষ্টই হোক, জিনিয়া ওদের ভালোই চাইবে।

ও মাঝে মাঝে বেশ টের পায়, ওর মনের মধ্যে দুটো সত্তা আছে। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সত্তা। মাঝে মাঝেই সেই দু-জন মনের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। এই যেমন, অতন্দ্র-গীতিকার প্রতি ওর নরম মনোভাবটা পরিস্ফুট হতেই অন্য সত্তাটা তড়বড়িয়ে উঠে বলল, ‘এত ভালো চাওয়ার কী আছে? যে তোমায় ঠকিয়েছে, এত বছর সম্পর্কে থাকার পরেও প্রতারণা করেছে, তার প্রতি এমন গান্ধীগিরি কি না দেখালেই নয়?’

প্রথম সত্তাটা নরমসরম, সে বলল, ‘প্রতারণাটা কিন্তু প্রমাণিত নয়। সেদিনের মেসেজটাকে অন্যভাবে নেওয়াটা তোমারই ভুল। যত যাই হোক, ওর জুনিয়ার সহকর্মীর সঙ্গে তুমি ওইরকম ব্যবহার করেছিলে সেই রাতে, সেটা কি তোমার উচিত হয়েছিল? একবারও ভাবলে না যে অফিসে ওর কী অবস্থা হবে?’

‘থাম!’ দ্বিতীয় সত্তা চিৎকার করে উঠল মনের মধ্যে, ‘মেসেজটাই সব নাকি? তার আগের দু-মাস ধরে সারাদিন ফোন, মেসেজ, ডাকনাম ধরে ইয়ার্কি, এগুলো কিচ্ছু নয়? অফিস কলিগকে ঝাড়া হয়েছে বলে গোটা ফ্ল্যাটের সবকিছু ভেঙেচুরে শ্মশান বানিয়ে দিল আর মাঝরাতে ফ্ল্যাট থেকে বউ বেরিয়ে যাচ্ছে দেখেও চুপ করে থাকল। প্রায়োরিটি কার বেশি তাহলে?’

‘প্রায়োরিটির প্রশ্ন এটা নয়। বাড়ির লোকের কাছে চক্ষুলজ্জা অতটা হয় না, কিন্তু বাইরের লোকের কাছে …!’ প্রথম সত্তা মিনমিন করে কী সাফাই দিতে যাচ্ছিল, কাঁধে কার একটা টোকা পেয়ে জিনিয়া চমকে উঠল।

পেছনে তাকিয়ে সঞ্জিত হাজরাকে দেখে ও আশ্চর্য হয়ে গেল। না, সঞ্জিতের এয়ারপোর্টে আসা দেখে নয়, হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই, গায়ে হাত দেওয়া দেখে।

সঞ্জিত নাটকীয় ভঙ্গিতে কোমর ঝুঁকিয়ে মাথা নীচু করে ছোট্ট নড করে বললেন, ‘সঞ্জিত হাজরা অ্যাট ইয়োর সার্ভিস, ম্যাডাম!’

জিনিয়ার প্রচণ্ড রাগ হল। গত কয়েক সপ্তাহে যাওয়ার দিনক্ষণ যত এগিয়ে এসেছে, সঞ্জিতও ততই বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। এখন আর অপ্রয়োজনীয় মেসেজ নয়, কারণে অকারণে গভীর রাতে ফোন করেন। জিনিয়া বারণ করলে রেখে দেন। কিন্তু পরের রাতে সেই একই পুনরাবৃত্তি। না, অশালীন কিছু বলেন না। কিন্তু সেই নিজের ছোটোবেলার একই কথা বলে যান। বাবাকে খোঁজার কথা, নিজের অবসাদের কথা।

আর থেকে থেকে জিনিয়ার প্রশংসা আর স্তুতির বন্যা ঝরে পড়ে সঞ্জিতের মুখ থেকে। জিনিয়া কত উদ্যমী, কীভাবে একা এই ব্যবসা দাঁড় করাচ্ছে, এত আত্মপ্রত্যয় বিরল ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথম প্রথম শুনতে ভাল লাগলেও ক্রমশ সেগুলো অসহ্য হয়ে উঠছে ওর কাছে।

হতে পারে সঞ্জিত একা মানুষ, কলকাতাতে কাউকেই চেনেন না, কিন্তু ওঁর এটা মাথায় রাখা উচিত, জিনিয়ার ওঁর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে যেতে ভালো না-ই লাগতে পারে।

জিনিয়া হাবভাবে যতটা সম্ভব নিজের অসন্তোষ, বিরক্তি দেখিয়েছে, কিন্তু সঞ্জিত যেন নির্বিকার। জিনিয়াও এই ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়েছে। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের পুঁজির একটা অংশ লোন ছাড়াও এসেছে সঞ্জিতের পকেট থেকে। উনি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের একজন স্টেকহোল্ডার। একমাত্র টুর ম্যানেজারও। কোম্পানির যাত্রা সবে শুরু হচ্ছে, এই টলোমলো অবস্থায় সঞ্জিত হাত উঠিয়ে নিলে জিনিয়া মুখ থুবড়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, কোনোদিনই আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ওদিকে লোন পরিশোধ, যাত্রীদের বিক্ষোভ সব মিলিয়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

জিনিয়ার হঠাৎ চোখে জল চলে এল।

কাগজে-কলমে না হলেও সঞ্জিত থেকে শুরু করে আলোকপর্ণা, বিকাশ, এরা সবাই এখন জেনে গেছে তার বিয়ে ভেঙে গেছে। গায়ে ‘ডিভোর্সি’ তকমা লেগে গেছে বলেই কি সঞ্জিতের মতো লোকেদের স্পর্ধা এতটা বেড়ে চলেছে? জিনিয়াকে সহজলভ্য ভেবে ফেলেছেন সঞ্জিত?

জিনিয়া বলবে না বলবে না করেও এবার আর সামলাতে পারল না। একটু কড়া গলাতেই বলে ফেলল, ‘আপনি এসে পড়েছেন তো ডাকলেই পারতেন। গায়ে হাত দেওয়ার কী আছে?’

সঞ্জিত থতোমতো খেয়ে গেলেন। ওঁর মুখ দেখে মনে হল, জিনিয়ার কাছ থেকে এই কথা উনি একেবারেই আশা করেননি।

জিনিয়া পাত্তা দিল না। সঞ্জিত ওর ব্যবসার জন্য যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, এইভাবে ও কারুর কাছে নিজেকে সস্তা করতে পারবে না। তাতে ওকে যদি রাস্তায় ভিক্ষা করতে হয়, প্রয়োজন হলে তাই করবে। আত্মসম্মান সকলের আগে।

‘সরি জিনিয়া। আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেব ভেবেছিলাম!’ সঞ্জিত অপ্রস্তুত ভাবটা সামলাতে সামলাতে হাতের ঢাউস প্যাকেটটা দেখালেন, ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর। তাই একটা বড়ো কেক বানিয়ে এনেছি। সব প্যাসেঞ্জার এলে ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেক মিটে গেলে টেক অফ-এর আগে লাউঞ্জে কাটা হবে।’

‘আমার মামার সঙ্গে কথা হয়েছে?’ জিনিয়া বলল।

‘হ্যাঁ।’ সঞ্জিত বললেন, ‘মি সান্যাল অন দ্য ওয়ে। এখুনি এসে পড়বেন।’

জিনিয়া সঞ্জিতের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের পরনে পুরোদস্তুর ফর্মাল পোশাক। কালো রঙের একটা দামি সুট, খয়েরি রঙের টাই, পায়ে কালচে বুট। বুকের বাঁ-দিকে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ এর ছোট্ট ব্যাজ। গোঁফ দাড়ি পরিপাটি করে শেভ করা, ডান হাতে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর ট্রলি, বাঁ-হাতে কেকের বিরাট একটা প্যাকেট।

ও একটু অস্বস্তিতে পড়ল। সঞ্জিতের উদ্দেশ্য হয়তো খারাপ ছিল না। ও একটু বেশিই ভেবে ফেলেছে। আসলে অতন্দ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ওর মনটা প্রচণ্ড সংবেদনশীল হয়ে রয়েছে। একটুতেই কেমন যেন ব্যথা পেয়ে ককিয়ে উঠছে। নাহলে ও এতদিন আই টি সেক্টরে কাজ করেছে, সহকর্মীদের মধ্যে কাঁধে টোকা দিয়ে কথা বলাটা কোনো ব্যাপারই নয়।

জিনিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, সঞ্জিত হাসিমুখে থামিয়ে দিলেন, ‘আমি আবার এমন কাজপাগল, আইডিয়োলজির চোটে ভুলেই যাই কে ছেলে কে মেয়ে। সবাইকে সহযোদ্ধা মনে হয় তো, তাই একভাবেই দেখি। গ্লোবাল টুরস ছেড়ে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম থেকে জড়িয়ে পড়েছি ওই আইডিয়োলজির ভূতের চোটেই। হা হা!’

জিনিয়া নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাতে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আলোকপর্ণা ফোন করল, ‘দিদি, উনিশজনই এসে গেছেন। সবাইকে কি পাঠিয়ে দেব?’

আলোকপর্ণাকে জিনিয়া প্রথম দিনই বলে দিয়েছিল ম্যাডাম না বলে দিদি বলে ডাকতে। গ্লোবাল টুরসের মতো কর্পোরেট কোম্পানিতে কাজ করে আসা আলোকপর্ণা একটু বিস্মিত হয়েছিল। তবে, সেই বিস্ময়ের মাত্রা তার মাইনের অঙ্ক শোনার চেয়ে বেশি নয়। সে ভাবতেও পারেনি, গ্লোবাল টুরসের চেয়েও বেশি মাইনে সে এত ছোটো, এত নতুন একটা কোম্পানিতে পাবে। জিনিয়ার সঙ্গে প্রথম দিন ইন্টারভিউয়ের পর জিনিয়া যখন বলেছিল আটত্রিশ হাজার টাকা মাইনের কথা, ও চমকে তাকিয়েছিল।

জিনিয়া বলেছিল, ‘কী হল? নট হ্যাপি? কিন্তু এর চেয়ে বেশি অফার করা আমার পক্ষে …!’

‘নো, ম্যাডাম!’ তড়িঘড়ি বলে উঠেছিল আলোকপর্ণা, ‘আই অ্যাম টোট্যালি স্যাটিসফায়েড। প্লিজ কন্টিনিউ!’ ওর মুখ-চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছিল খুশির ফোঁটা।

ঋতুপর্ণার বোন বলে নয়, এমনিতেই আলোকপর্ণাকে এই কয়েক দিনে জিনিয়া বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। মেয়েটা কাজে অত্যন্ত মনোযোগী, একটুও ফাঁকি তো দেয়ই না, উপরন্তু নিজের টুরিজম ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি ও গ্লোবাল টুরসে কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সে অনেক ভালো ভালো পরামর্শ দিয়েছে জিনিয়াকে। কিন্তু সমস্যা একটাই। রোজ রাতে আলোকপর্ণা বেরিয়ে গেলেই ঋতুপর্ণাকে ফোন করে পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে হয়, আজ আলোকপর্ণা বাড়ির সম্পর্কে কী বলল।

প্রথমদিকে জিনিয়া একটু বিরক্ত হত, ‘কী মুশকিল! আমি কি রোজ ওকে বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করব নাকি? আমি তো ওর বস, নাকি! এক-আধদিন জিজ্ঞেস করলাম ঠিক আছে, কিন্তু প্রত্যেকদিন বাবা কেমন আছেন, মায়ের কোমরের ব্যথা কেমন আছে, এটা খুব অড লাগবে, ঋতু!’

ঋতুপর্ণা কিছু বলেনি সেদিন। তারপর দু-দিন ফোনও করেনি। অগত্যা জিনিয়াই সেদিন ফোন করেছিল। বলেছিল, আলোকপর্ণার সেদিন অফিস থেকে ফিরে মাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা। ঋতুপর্ণার উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ফলে সেদিন রাতে জিনিয়াকে ফোন করে খবর নিয়ে জানাতেও হয়েছিল।

ঋতুপর্ণা আর আলোকপর্ণার মাঝে জিনিয়ার এই সেতু হয়ে থাকার ফলে আরেকটা ব্যাপার হয়েছে। মেয়েটা ওর দিদির মতোই আবেগপ্রবণ। ওর কাছ থেকে এত আন্তরিকতা পেয়ে আলোকপর্ণা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে পৃথিবীতে এমন বসও হয়। যে প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা-মায়ের খোঁজ নেয়, একটু কোনো অসুবিধে হলেই বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে। আলোকপর্ণা এখন জিনিয়াকে অনেক কাছের ভেবে ফেলেছে। জিনিয়াদি বলেও সে আর ডাকেনা, তার কাছে সে এখন শুধুই ‘দিদি’।

আলোকপর্ণার ফোন পেয়ে জিনিয়া বলল, ‘হ্যাঁ। সবাইকে পাঠিয়ে দাও। আমি সঞ্জিতবাবুকে গেটের সামনে পাঠাচ্ছি।’

ফোনটা রেখে ও সঞ্জিতের দিকে তাকাল, ‘আপনি যদি একবার তিন নম্বর গেটের দিকে যান। আলোকপর্ণা পরপর সবাইকে আসতে বলেছে।’

সঞ্জিত তৎক্ষণাৎ হাসিমুখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস। আপনি শুধু এই কেকের প্যাকেটটা রাখুন। বেশি নাড়াচাড়া করলে ঘেঁটে যেতে পারে। আমাদের পাড়ার নতুন বেকারির কেক। নামকরা ব্র্যান্ডদের বলে বলে গোল দেবে, খেয়ে দেখলে বুঝবেন। এখন বেশ কয়েকটা ফাইভ স্টার হোটেলে সাপ্লাই করে।’

সঞ্জিতের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে জিনিয়া একটা নিশ্বাস ফেলল। একা থাকার সত্যিই অনেক জ্বালা। ও যেমন এখন একা বলে বিশ্বসুদ্ধ সব লোককেই একটা সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে, সঞ্জিত হাজরাও একা বলেই তাঁর অভিব্যক্তিটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।

জিনিয়া উপলব্ধি করল, সঞ্জিত লোকটা সত্যিই ভালো। যদি সত্যিই জিনিয়ার প্রতি ওঁর কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকত, তাহলে এতটা লজ্জিত হতেন না উনি। আসলে মানুষটা কাজপাগল। সেই কাজ সার্থক হওয়ার তাগিদেই জিনিয়ার প্রতি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। ওর অনেক সৌভাগ্য যে ব্যবসায় ঢুকেই এমন একজন পার্টনার পেয়েছে।

একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে ও কেকের প্যাকেটটা পাশে সার দিয়ে থাকা চেয়ারে রাখল। বহুদিন পর আজ ও শাড়ি পরেছে। প্রথমে ভেবেছিল ট্রাউজারস আর শার্ট পরবে। সেইমতো জামা বেরও করে রেখেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মমত পালটেছে।

মা দেখে অবাক হয়েছিল, ‘এতদূর যাবি, শাড়ি পরলি! সামলাতে পারবি তো?’

‘কেন পারব না!’ জিনিয়া মৃদু হেসে সদর দরজায় এগিয়ে দিতে আসা বাবাকে প্রণাম করেছিল। বাবা চিরকালই চুপচাপ, শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘সাবধানে যাস।’

তারপর মা-কে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল, ‘জিনিয়া দাশগুপ্ত ট্রাভেলস বাঙালির স্বপ্ন সত্যি করবে মা। সেখানে প্রথম টুরটা নাহয় শাড়ি দিয়েই শুরু করলাম!’

মা বলেছিল, ‘সাবধানে যাস। আর আমরা তো তোকে ফোনে পাব না। প্রত্যেকটা জায়গায় গিয়েই কিন্তু ফোন করিস।’

 জিনিয়া নিজের দিকে তাকাল। হালকা বেগুনি রঙের একটা সুতির শাড়ি পরেছে ও। সঙ্গে মানানসই কলমকারি ব্লাউজ। চোখে সামান্য কাজল, বাঁ-হাতে ঘড়ি আর কানে দুটো মাটির দুল। ব্যস, আর কোনো প্রসাধনই করেনি। হাত আর গলায় কিছু নেই।

একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক মুহূর্তের জন্য স্মৃতির রকেটে চেপে মন না চাইতেও চলে গেল অতীতের কোনো এক বিকেলে, খাবলা করে তুলে নিল একটা কথোপকথন।

সেদিন ভিক্টোরিয়ার সবুজ মাঠে বসে অতন্দ্র বলেছিল, ‘তোকে শাড়ি আর কাজল পরলে কী যে ভালো লাগে! মনে হয় গল্পের পাতা থেকে উঠে এসেছিস!’

তখনও ওরা তুইতোকারি করত। জিনিয়া বলেছিল, ‘বাবা! আর পারি না!’ একটা মাটির হার কিনেছিলাম আগের সপ্তাহে ট্রেনে, কোথায় যে রাখি, খুঁজেই পেলাম না। সেটা পরলে সাজটা কমপ্লিট হত।’

‘না।’ মুহূর্তে অতন্দ্র ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল, ‘ওসব হার-টার পরবি না একদম। তোকে এরকমই ভালো লাগে!’

জোর করে মনকে অতীতের সেই পড়ন্ত রোদের বিকেল থেকে যখন জিনিয়া সরিয়ে আনল, ততক্ষণে ওর চোখ নিজের অজান্তেই জলে ভরে উঠেছে। কেমন অসহায়ভাবে ও তাকাল চারপাশে। এয়ারপোর্টের তিনতলা সমান কাচ পেরিয়ে ওর চোখ হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে খুঁজতে লাগল দূরের আলোগুলোকে। কল্পনা করে নিতে লাগল ওদের সেই লেকটাউনের ফ্ল্যাট, যেখানে একা বিছানায় এখন অতন্দ্র অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

ও কি জানে, আজ জিনিয়া ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস-কে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে? একাই? যে লড়াইটা দু-জনে মিলে লড়ার কথা ছিল, সেটা ওকে একাই লড়তে হচ্ছে?

মুহূর্তের দুর্বলতায় কী যে হল, জিনিয়া হঠাৎ অনুভব করল, ওর এখুনি অতন্দ্রর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

ভীষণ ইচ্ছে করছে।

বেশি কিছু না ভেবে ও অধীর হয়ে ফোনে অতন্দ্রর নম্বর টিপল। ব্যস্ত এয়ারপোর্টের মাঝে চারপাশের লোকজনের চলাফেরার মাঝে ওর বুকে যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে জোরে জোরে ঠুকছে। উত্তেজনায় মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

কতদিন পর ও অতন্দ্রর গলা শুনবে। কতদিন পর! আচ্ছা, সব কিছু ভুলে আবার শুরু করলে হয় না? একদম প্রথম থেকে? ওদের সেই লেকটাউনের ফ্ল্যাট, সেই বিছানা, আলমারির নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, ছোট্ট একফালি ব্যালকনি, আর তাতে অতন্দ্রর হাতে লাগানো জিনিয়া ফুলের গাছ!

কিন্তু অতন্দ্রকে পাঠানো ডিভোর্স পেপার? ধুস, ছিঁড়ে কুচিকুচি করে নাহয় উড়িয়ে দেবে হাওয়ায়?

এতদিন যেন এইসব হাজার হাজার স্মৃতির আগ্নেয়গিরিটাকে পাথরচাপা দিয়ে আটকে রেখেছিল জিনিয়া, ক্ষণিকের ইন্ধনে সেই পাথর সরে গিয়ে যেন লাভার মতো বেরিয়ে আসতে লাগল আরও অনেক স্মৃতি, কথা, আনন্দের সময়!

কিন্তু অতন্দ্রর ফোন পাওয়া গেল না। কিছুতেই না। জিনিয়া পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগল। একবার, দু-বার, তিনবার। অজস্রবার।

কিন্তু প্রত্যেকবারই সুইচড অফ বলে চলল যান্ত্রিক টেলিফোনিক কণ্ঠ। একঘেয়েভাবে।

জিনিয়ার চোখ ফেটে জল চলে এল হু-হু করে। অতন্দ্র কি নম্বর পালটে ফেলেছে? ওদের দু-জনের নম্বর একদম পরপর, বিয়ের আগে আগে একসঙ্গে গিয়ে কিনেছিল দুটো সিম।

সেই নম্বর পালটে ফেলল অতন্দ্র? জিনিয়ার কোনো স্মৃতিই ও রাখতে চায় না তাহলে? এই মনকেমন, পুরোনো দিনের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়া, এগুলো কি একমাত্র জিনিয়ারই হচ্ছে?

টেলিফোন অপারেটরের গলায় যত ‘সুইচড অফ’ শুনতে পাচ্ছিল জিনিয়া, ততই যেন ও অস্থির হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, এখুনি যে করে হোক ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এক্ষুনি।

মাঝেমধ্যে এমন একেকটা সময় আসে, যে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ওরও সেটাই হল। অতন্দ্র নম্বর পালটে ফেলেছে তো কী হয়েছে, ও তো চাইলেই অতন্দ্রর নম্বর জোগাড় করতে পারে। আচ্ছা, ও যেমন সেদিন অতন্দ্রর গলা শুনেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল, অতন্দ্রও কি তাই করবে?

নিশ্চয়ই না। অতন্দ্র এমন করতেই পারে না ওর সঙ্গে। জিনিয়া ঘড়ির কাঁটা দেখতে ভুলে গেল। এই মাঝরাতেই ফোন করল শুভ্রদীপকে। শুভ্রদীপ নিশ্চয়ই অতন্দ্রর নতুন নম্বর জানবে।

কিন্তু না। শুভ্রদীপের ফোনে রিং হলেও ও তুলল না। বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে ফোন।

বিরক্তির চূড়ান্তে পৌঁছে যাচ্ছে জিনিয়া। মনে হচ্ছে ছুড়ে ফোনটা ফেলে দেয় এয়ারপোর্টের এই পিছলে যাওয়া মেঝেতে।

কী করবে ও এবার? অতন্দ্রর সঙ্গে কথা যে ওকে বলতেই হবে!

আর কাকে ফোন করা যেতে পারে? শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে করা যাবে না, এখুনি একগাদা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া ও জানেও না অতন্দ্র ও বাবা-মাকে কী বলে রেখেছে ইতিমধ্যে।

তাহলে? তাহলে কাকে ফোন করবে জিনিয়া?

হঠাৎ ওর মনে হল, আর কেউ জানুক না জানুক, একজন অতন্দ্রর নতুন নম্বর জানবেই। গীতিকা।

কিন্তু গীতিকার নামটা মনে আসামাত্র ওর মনের রাগী দিকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘সেদিন অত বাজেভাবে অপমান করলে, তারপর আবার তাকেই ফোন করবে? বলি লজ্জাশরমের কি মাথা খেয়েছ নাকি?’

আরও কিছু শোনার আগেই জিনিয়া দাবিয়ে দিল সেটাকে। হ্যাঁ, ও গীতিকাকেই ফোন করবে। গীতিকা এখন অতন্দ্রর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সে হতেই পারে। অতন্দ্রর জীবনে গীতিকার আরও কী কী ভূমিকা রয়েছে তা জিনিয়ার জানার দরকার নেই। কিন্তু আইনত ও এখনও অতন্দ্রর স্ত্রী। তাই, ও গীতিকাকে ফোন করে অতন্দ্রর নম্বর জিজ্ঞেস করতেই পারে। তাতে গীতিকাকে কী ভাবল না ভাবল, তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ওর নিজের সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, এরপর কে কী ভাবল, তাতে ওর কী এল গেল?

কিন্তু, গীতিকার ফোনও বেজে বেজে কেটে গেল। একবার, দু-বার, তিনবার।

জিনিয়ার গলার ভেতরে কী-একটা দলা পাকাচ্ছে। নাহ, চাইলেও ও আজ অতন্দ্রর সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। সেই সুযোগ আর নেই।

ব্যস্ত এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে একটা জলের ফোঁটা ওর চোখ দিয়ে নেমে এল। মনে মনে বলল, ‘অতন্দ্র, তুমি যখন আমার কোনোকিছুই আর সঙ্গে রাখতে চাও না, আমিও তোমায় বিরক্ত করব না। তোমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছি অতন্দ্র। ভালো থেকো!’

২৭

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুর সবদিক থেকেই যেন ব্যতিক্রম। অম্বিকেশ একঝলকে গোটা গ্রুপটার ওপর চোখ বুলিয়ে ভাবলেন।

শুধু টাকাপয়সা বা ঘোরার বৈচিত্র্যের জন্য নয়, এই উনিশ জনের গ্রুপে সব বয়সের যাত্রী আছেন। অশীতিপর এক দম্পতিও চোখে পড়ছে, আবার এক কোণে দাঁড়িয়ে মোবাইলে খুটখাট করছে দুই তরুণ-তরুণীও। স্বামী-স্ত্রী-বাচ্চা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে একাকী মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক কিংবা দুই বান্ধবী। সব নিয়মকানুন মিটে গেছে, প্লেনে ওঠার আগে লাউঞ্জে বসে এখন অপেক্ষা করছে সবাই।

পাশেই গোটা দেওয়াল জোড়া কাচ। সেই কাচের ওপারে তাকালেই দেখা যাচ্ছে প্লেনগুলোকে। তিনটে প্লেন পর পর দাঁড়িয়ে রয়েছে টেক অফের অপেক্ষায়। প্লেনগুলোর একপাশ দিয়ে নেমে গেছে এয়ারলাইন্সের খোলা সিঁড়ি। তার আশেপাশে চলাফেরা করছে এয়ারলাইন্সের বিভিন্ন স্টাফ।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম টুরের বেশিরভাগ যাত্রীই মুগ্ধচোখে তাকিয়ে আছে কাচের ওপাশে।

জিনিয়া প্রত্যেকের সঙ্গে গিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করছে, দুতিন মিনিট ধরে হাসিমুখে কথা বলছে, সবশেষে হাতে গুঁজে দিচ্ছে সুদৃশ্য একধরনের চামড়ার নোটবুক, তার ওপর সোনালি হরফে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’ খোদাই করা। সঙ্গে রয়েছে পেনও। মিষ্টি করে বলছে, ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে আপনাদের এই প্রথম ভ্রমণ। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের নিজেরও এটা প্রথম। সেই উপলক্ষ্যে গোটা ভ্রমণটা আপনার মতো করে বাংলায় লিখে রাখবেন এই নোটবুকে। কোথায় কোথায় ঘুরলেন, কী খেলেন, কেমন লাগল এইসব।’

অম্বিকেশ লক্ষ করলেন, সবাই শুনতে হয় শুনছিল, কিন্তু একজন অল্পবয়সি মহিলা, যিনি তাঁর স্বামীর পাশে এতক্ষণ চুপচাপ কলের পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি প্রশ্ন করেই ফেললেন, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, কীভাবে লিখতে হবে? খুব ভালো ভাষা দিয়ে?’

জিনিয়া বলল, ‘না না। আমরা তো এখানে সাহিত্য করছি না, দিদি। আপনার নিজের যা মনে হচ্ছে, একদম সহজ সরল ভাষায় সেই অনুভূতিটাই সারাদিনের শেষে হোটেলের ঘরে বসে অল্প কয়েক বাক্যে লিখে রাখবেন। আমরা সবাই মিলে সেগুলোই শুনব। আর আপনাদের সবাইকে আবারও বলছি, আপনাদের প্রায় সবার থেকেই আমি ছোটো। তাই আমায় জিনিয়া বলে ডাকলে বেশি ভালো লাগবে। আগামী কয়েকদিনের জন্য আমরা একটা গোটা পরিবার। একসঙ্গে থাকব, ঘুরব, খাব, আনন্দ করব। তাই পরিবারের মধ্যে কোনো ম্যাডাম-স্যার নয়।’

মহিলা বেশ খুশি খুশি চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। তবে তাঁর স্বামী ভাবলেশহীন, বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁদের ছোটোছেলে চঞ্চলচোখে চারপাশে দেখছে। জিনিয়া হাতে ধরা কাগজে কী-একটা লিখল।

অম্বিকেশ মনে মনে একটা ব্যাপার তারিফ না করে পারলেন না। মোটা মাইনে দিয়ে গাদা গাদা মার্কেটিং-এর ছেলে পুষেও গ্লোবাল টুরসে সেই এক গতে বাঁধা ট্রলি, ব্যাগ, রেইনকোট উপহার দেওয়ার বাইরে তিনি কখনোই কিছু করতে পারেননি। মোটামুটি সব প্রথম সারির টুর কোম্পানিই কাস্টমারকে ঘোরার সময় কমপ্লিমেন্টারি কী দেয়, তার খবর তিনি রাখতেন। টুর ম্যানেজাররাও অত্যন্ত ফর্মাল থাকেন, তাঁদের ব্যবহারে পেশাদারিত্ব থাকলেও আন্তরিকতা থাকে না। কিন্তু জিনিয়া তেমন নয়। ওর মতো এমন অন্যরকমভাবে কাস্টমারকে খুশি করতে অম্বিকেশ কখনো দেখেননি।

অম্বিকেশ কিছুক্ষণ আগে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছেন। গেট দিয়ে ঢোকার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আলোকপর্ণার। চোখাচোখি হতেই মেয়েটা হেসে বলেছিল, ‘হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ট্রিপ স্যার!’

‘আবার স্যার?’ অম্বিকেশ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, ‘আমি তো এখন আর গ্লোবাল টুরসের কেউ নই আলোকপর্ণা। তোমাকে বলেছি না, ওইসব স্যার-ট্যার বলবে না?’

আলোকপর্ণা মজা করে বলেছিল, ‘গ্লোবাল টুরসের কেউ না হলেও আপনি এখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে তো আমার বসই স্যার! স্যার না বললে যদি আপনি দিদিকে কমপ্লেইন করে দেন?’

‘হা! হা! জিনিয়া এই ক-দিনেই তোমার দিদি হয়ে গেল, আর আমার স্যার থেকে ডিমোশন হল না?’ অম্বিকেশ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘বেশ বেশ। তা তোমার সেই টুরিস্টের কী খবর? ভেতরে ঢুকে গেছেন?’

আলোকপর্ণা ঘড়ি দেখে বলেছিল, ‘না, স্যার। মাসিমা এইমাত্র ফোন করেছিলেন। বললেন, দক্ষিণেশ্বরের ওখানে বালি ব্রিজের ওপর খুব জ্যাম ছিল। তবে এখন ছেড়ে গেছে। এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।’

সত্যিই, যে আলোকপর্ণাকে গ্লোবাল টুরস থেকে বের করে দেওয়া হল শেষ কয়েক মাসে ভালো সেল করতে না পারার জন্য, সেই আলোকপর্ণাই যে জিনিয়ার কাছে এসে একটা কাস্টমার এনে দেবে, কে ভেবেছিল! অথচ গ্লোবাল টুরসের মতো এখানে না ছিল টার্গেটের কড়াকড়ি, না ছিল চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। কিন্তু, এখানে এসে ওর যেন কাজের ইচ্ছে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। জিনিয়াকে ও এখন ‘দিদি’ বলতে অজ্ঞান। সত্যি, ভালোবাসায় কী না হয়!

‘তোমার মাসি একা যাচ্ছেন, কোনো অসুবিধে হবে না তো? না মানে, আমরা তো থাকবই, কিন্তু বয়স্ক মানুষ, এমনি শক্তসমর্থ তো?’ অম্বিকেশ জিজ্ঞেস করেছিলেন।

আলোকপর্ণা বলেছিল, ‘মাসি বলতে উনি আমার নিজের কেউ নন স্যার। উনি হিন্দমোটরেই থাকেন। আর শক্তসমর্থ কী বলছেন! উনি যে কতরকম সমাজমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, বললে বিশ্বাস করবেন না।’

‘তা ওঁর স্বামী …?’ অম্বিকেশ জিজ্ঞেস করেছিলেন।

‘উনি অনেক আগেই মারা গেছেন। এখন মাসিমা ওঁর ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ওঁর ছেলেই এই প্যাকেজটা মাকে জন্মদিনে গিফট করছে স্যার!’ আলোকপর্ণা গড়গড় করে বলে গেছিল, ‘আর চিন্তা কীসের? দিদি এত যত্ন করে সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই খুব স্যাটিসফায়েড হবেন, দেখবেন স্যার!’

এসব কথা মনে পড়তে অম্বিকেশ একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ওঁদের দলের সবারই চেক-ইন, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেক হয়ে গিয়েছে। অথচ আলোকপর্ণার সেই মাসির কোনো পাত্তা নেই। মুশকিল হল! জিনিয়া তো এইসব করতে ব্যস্ত, ওদিকে ফাইনাল কলের সময় হয়ে এল প্রায়।

অম্বিকেশ চিন্তিত মুখে জিনিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করলেন, ‘সবাই এসে গেছে?’

জিনিয়া হাতে ধরে থাকা লিস্টের দিকে তাকাল, ‘একজন বাকি। ওই যাকে আলোকপর্ণা এনেছিল। ওহ, তুমি তো সেদিন অফিসে আসোনি। উনি অন দ্য ওয়ে।’

‘এখনও অন দ্য ওয়ে থাকলে এবার তো সেখান থেকেই বাড়ি চলে যেতে হবে।’ অম্বিকেশ বিরক্তমুখে বললেন, ‘পইপই করে তোকে বলেছিলাম সবাইকে এগারোটার মধ্যে ইন করতে বলবি। আর এখন সেখানে রাত সাড়ে বারোটা বাজে।’

জিনিয়া বলল, ‘আরে বলেছিলাম, রাস্তায় খুব জ্যাম। চাপ নিয়ো না, উনি চলে এসেছেন, ঢুকে গেছেন এয়ারপোর্টে।’

অম্বিকেশ বললেন, ‘আমরা সবাই এদিকে চলে এলাম, উনি একা একা ঢুকে চেক-ইন, ইমিগ্রেশন করতে পারবেন?’

‘আমি তো ওইজন্যই সঞ্জিতকে ওদিকে থাকতে বললাম। সঞ্জিতই নিয়ে আসছেন ওঁকে। ওঁরা এসে পড়লে তারপর কেকটা কাটব।’ জিনিয়া সবাইকে নোটবুক বিতরণ শেষ করে পাশের ফাঁকা চেয়ারে রাখা কেকের প্যাকেটটা খুলতে উদ্যত হল।

অম্বিকেশ বাধা দিলেন, ‘এটা রেস্ট্রিকটেড এরিয়া। এইভাবে এখানে কেক কাটিস না, সিকিউরিটির লোকেরা এসে অবজেকশন দিতে পারে। তখন এদের সামনে অপ্রস্তুতে পড়বি।’

জিনিয়া কেকের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে মাথা নাড়ল, ‘না না। সেরকমভাবে হইহই করে কিছু কাটব না তো। এমনিই ছোটো ছোটো টুকরো করে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো আর কি! করতাম না, কিন্তু সঞ্জিত নিয়ে এসেছেন।’ কথাটা শেষ করেই ও প্যাকেট থেকে কেকের বাক্সটা বের করে চমকে উঠল, ‘আরে!’

‘কি হল?’ অম্বিকেশ জিজ্ঞাসা করলেন।

জিনিয়া বলল, ‘ বাইরের প্যাকেটে কিছু লেখা ছিল না দেখে বুঝতে পারিনি। দেখো মামা, কেকের ওপর লেখা রয়েছে অল্পা’জ বেকারি। প্রাইমা ইনফোটেকে আমাদের প্রোজেক্টে অল্পাদি ছিল, কেক বানাত। এটা কি ওর বানানো নাকি?’

জিনিয়া তাড়াতাড়ি নিজের ফোন খুলল। কেকের বাক্সর ওপর লেখা অল্পা’স বেকারির ফোন নম্বরের সঙ্গে নিজের ফোনে থাকা ফোন নম্বরটা মেলাতে পেরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘যা ভেবেছি, তাই। অল্পাদিকে অন্যায়ভাবে বাজে রেটিং দিয়ে কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছিল, জানো ফুলুমামা! তারপর বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই, কী করছে তাও জানতাম না! সঞ্জিত বললেন এই বেকারির কেক নাকি ফাইভ স্টার হোটেলেও সাপ্লাই হয়!’

অম্বিকেশ বললেন, ‘তোকে চেনে?’

‘চেনে মানে!’ জিনিয়া বলল, ‘আমার কিউবিকলে তো অল্পাদিই আগে বসত! এত ভালো ছিল, প্রত্যেকের জন্মদিনে কেক বানিয়ে আনত, অথচ তারাই ওর নামে আজেবাজে বলে বেড়াত। দাঁড়াও অল্পাদিকে এখুনি একবার ফোন …।’

জিনিয়া কথাটা শেষ করতে পারল না, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বিরক্তমুখে এগিয়ে এলেন, ‘আচ্ছা আপনাদের কী ব্যাপার বলুন তো। তখন থেকে আমরা এখানে বসে রয়েছি আর আপনারা নিজেদের মধ্যে গল্প করে যাচ্ছেন। কে এখনও আসেনি, তাই জন্য আমরা কেন সাফার করব? অতন্দ্র থাকলে ভালো হত দেখছি! ছেলেটা কাজের ছিল।’

জিনিয়া থমকে গিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল, ‘না, না, এখনও তো সময় আছে জেঠু। আমরা ফাইনাল কলের আগেই আপনাদের ঠিক নিয়ে যাব। আর একজনই বাকি আছে, তিনি চলে এসেছেন, সব প্রোটোকল হয়ে গেলেই এখানে চলে আসবেন।’

ভদ্রলোক জিনিয়ার কথায় তেমন কিছু শান্ত হলেন না, ব্যাজারমুখে কী সব বিড়বিড় করতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী বার বার স্বামীকে নীচু গলায় বোঝাতে লাগলেন, ‘আহ। তুমি সবেতে এমন করো না। ওদের একটা দায়িত্ব নেই নাকি! চুপ করে বোসো না! আর কেউ তো এমন করছে না…!’

জিনিয়া আড়চোখে হাতে ধরা লিস্ট দেখল। এই দম্পতিকে এনেছিল অতন্দ্র। ওর কোন এক বন্ধুর বাবা-মা। শেষের দিকে একবার অতন্দ্র বোধ হয় এর কথাই বলেছিল, খুব বিরক্ত করেন বলে। জিনিয়া ভদ্রলোকের নামের পাশে লাল কালিতে ‘মেজাজি’ লিখে রাখল। ঠিক করল, এঁর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

ও অম্বিকেশের হাতে লিস্টটা ধরিয়ে বলল, ‘তুমি একটু এঁদের দেখো তো মামা, আমি চট করে সিকিউরিটির দিকটা দেখে আসি। সঞ্জিতকে ফোনেও পাচ্ছি না!’

জিনিয়া চলে যেতে অম্বিকেশ কাগজটার দিকে তাকালেন। কাগজে শুধুই যাত্রীদের নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা নেই, সঙ্গে রয়েছে বয়স, পেশা ও দু-এক লাইনের বক্তব্য। লেখার ধরনটাও বেশ আকর্ষণীয়। বোঝাই যাচ্ছে, জিনিয়া এমনভাবে এই তালিকাটা বানিয়েছে, যাতে সবসময় সব যাত্রীদের পছন্দ অপছন্দের দিকে ও নজর দিতে পারে।

অম্বিকেশ আগ্রহসহকারে লিস্টের প্রথম থেকে পড়তে শুরু করলেন।

 অম্বিকেশ পড়তে পড়তে বেশ অবাক হলেন। আগে তিনি ভেবেছিলেন যাত্রীদের মধ্যে শুধু বয়সের বৈচিত্র্য রয়েছে। কিন্তু এখন দেখছেন লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, বাসস্থান, পেশা সবকিছুরই বৈচিত্র্য রয়েছে। হাল আমলের আইটি কর্মী যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বুটিকের মালকিন। বেশ ইন্টারেস্টিং, মানতেই হবে।

কাগজটা আলগোছে দেখে নিয়ে ভাঁজ করতে যাবেন, এমন সময় তিনি দূর থেকে জিনিয়াকে আসতে দেখলেন।

আর সেদিকে দেখামাত্র তাঁর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হিম হয়ে এল।

কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যে অম্বিকেশ অনুভব করলেন, তাঁর শরীরে প্রচণ্ড জ্বর এসে গেছে। সেই জ্বরের তীব্রতা এতটাই, মৃদু কাঁপতে শুরু করেছে গোটা শরীর।

জিনিয়ার ডান পাশে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে সঞ্জিত। কিন্তু জিনিয়ার বাঁ-পাশের মহিলাটি কে? মধ্যবয়স্কা সামান্য পৃথুলা, হালকা গোলাপি তাঁতের শাড়ি পরিপাটি করে পরা, ডান কাঁধে ছোটো ভ্যানিটি ব্যাগ ঝোলানো মহিলাটির মুখটা যে বড্ড চেনা লাগছে অম্বিকেশের!

ছোট্ট একফালি পাতলা ঠোঁট। ঠোঁটের নীচে ফর্সা চিবুকে সরষেদানার মতো একচিলতে তিল। সেই তিল, যেটার দিকে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকতেন অম্বিকেশ!

সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, যে একবারও বইয়ের পাতার দিকে না তাকিয়ে অবলীলায় আবৃত্তি করে যেত কিটস কিংবা বায়রনের কবিতা! সেই হাসি, যার দিকে তাকালে কিশোর কিংবা সদ্যযুবা হয়ে ওঠা অম্বিকেশের মনের মধ্যে কয়েকশো প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ত।

জিনিয়ারা আরো এগিয়ে আসছে।

হ্যাঁ। কোনো সন্দেহই নেই। জিনিয়ার পাশের মহিলা আর কেউ নয়, অম্বিকেশের চল্লিশ বছর আগেকার কোন্নগরের বাড়ির প্রতিবেশী, মিনু।

সেই মিনু, যাকে তিনি খুঁজেছেন কলকাতার অলিতেগলিতে। যাকে দেখার জন্য নিজেদের একফালি ঘর থেকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থেকেছেন ওদের বিশাল বাড়ির দিকে। যার জন্য ইচ্ছে করে খারাপ খেলে হেরে যেতেন কবাডি খেলায়। যার সঙ্গে কয়েক পা একসঙ্গে ফেরার জন্য নিজের স্কুল ছুটির পরও অপেক্ষা করতেন দিনের পর দিন।

অম্বিকেশ স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন বিস্ময়ে। এভাবে যে কোনোদিনও মিনুর দেখা পাবেন, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

জিনিয়া কাছে সে বলল, ‘আলোকপর্ণার মাসিমা এসে পড়েছেন, মামা। চলো। সবাই মিলে কেকটা কেটে ফেলা যাক। এখুনি ফাইনাল কল করবে।’

হতভম্ব অম্বিকেশের অজান্তেই চোখ চলে গেল হাতে ধরা কাগজের দিকে। মিনতি গঙ্গোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, হিন্দমোটর। মিনু তার মানে আলোকপর্ণার প্রতিবেশী। মিনু আগে ছিল চক্রবর্তী, বিয়ের পরে ‘গাঙ্গুলী’ হয়েছে। একটু আগে বলা আলোকপর্ণার কথাগুলো মনে পড়ে গেল অম্বিকেশের।

‘ওঁর স্বামী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। এখন মাসিমা ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ওঁর ছেলেই এই প্যাকেজটা মা-কে জন্মদিনে গিফট করছে স্যার!’ আলোকপর্ণা বলেছিল।

তখনও অম্বিকেশ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি তাঁর জন্য এত বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছে! পৃথিবীটা সত্যিই এত ছোটো?

জিনিয়া একপাশে একটা চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়ে কেক কাটছে, সঙ্গে আনা কাগজের প্লেটে করে ছোটো ছোটো টুকরো তুলে দিচ্ছে একেকজন যাত্রীর হাতে। পরেশনাথ কুণ্ডু নামক যে ব্যবসায়ীটি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর ছ-সাত বছরের ছেলেটা এক টুকরো খেয়ে উচ্ছ্বসিত, আরও চাইছে।

জিনিয়ার মুখের হাসি মেলাচ্ছে না, সে সবাইকেই আরেক টুকরো করে দিচ্ছে।

মিনতিও অম্বিকেশকে দেখে থমকেছেন।

একটা প্লেট নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন অম্বিকেশের দিকে। চোখে সামান্য দ্বিধা। কিন্তু কিন্তু করে বললেন, ‘আপনাকে কি আগে কোথাও দেখেছি?’

জিনিয়া পাশ থেকে শুনতে পেয়ে কাছে সে বলল, ‘মাসিমা, ইনি আমার মামা। অম্বিকেশ সান্যাল। ফুলুমামা, ইনিই আলোকপর্ণার মাসিমা, যিনি হিন্দমোটরে থাকেন।’

অম্বিকেশ সান্যাল স্পষ্ট লক্ষ করলেন, ‘ফুলুমামা’ ডাকটা শুনে মিনতির চোখের দ্বিধা আরো বেড়ে গেল। মিনতি এবার অম্বিকেশকে ভাল করে দেখছেন।

কিছু বলার আগেই অম্বিকেশ সামান্য হেসে বললেন, ‘আমায় চিনতে পারছিস না মিনু?’

২৮

সঞ্জিতবাবু মিনতি মাসিমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পরও আলোকপর্ণা ঠায় দাঁড়িয়েছিল গেটের এককোণে। পাশ দিয়ে একের পর এক যাত্রী ঢুকে যাচ্ছে, তবু ওর কোনো হুঁশ ছিল না। একভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কী যে ভাবছিল কে জানে!

এখন কয়েকদিন একরকম বলতে গেলে ওর ছুটি। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের লেকটাউনের অফিসে রোজ গিয়ে বসতে হবে ঠিকই, কিন্তু কাজের চাপ বলে তেমন কিছু থাকবে না। শুধু কোনো নতুন কাস্টমার এলে তাকে প্যাকেজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোমোশন করা আর বিকাশকে দিয়ে লিফলেট বিলি করতে পাঠানো। কাজ বলতে এইটুকুই।

গত পনেরোদিন প্রচণ্ড চাপ গেছে। এতজন যাত্রীর টিকিট, ভিসা এজেন্টের থেকে নেওয়া, ফরেক্সের ব্যবস্থা করা, প্রতিটা শহরে বুক করা হোটেলগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা, যে বাসে করে ঘোরানো হবে, সেই বাসের অপারেটরকে আপডেট দেওয়া, এইসব করতে করতে ঘড়ির কাঁটা প্রায়দিনই রাত আটটা পেরিয়ে যেত। তারপর বাস-ট্রেন পেরিয়ে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে ন-টা দশটা।

তাই এখন হালকা থাকার সময় আসায় আলোকপর্ণার মেজাজ ফুরফুরে হওয়ারই কথা। কিন্তু কেন কে জানে, ও ঠিক খুশি হতে পারছে না। মনের মধ্যে কেমন যেন হচ্ছে। কী যে হচ্ছে সেটা আলোকপর্ণা নিজেও বুঝতে পারছে না। নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একমনে ভেবেই চলেছে ও।

সম্বিৎ ফিরল জিনিয়ার ফোনে।

‘আলোকপর্ণা, সব ঠিকঠাক মিটে গেছে। আমরা প্লেনের ভেতরে ঢুকে বসে আছি এখন। বাইশজন মোটামুটি কাছাকাছিই পেয়েছি। এরপর তো নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না, আমি তোমাকে পৌঁছে ফোন করব।’

‘হ্যাঁ দিদি।’ বলতে বলতে আলোকপর্ণা টের পেল ওর গলার কাছটা কী একটা যেন দলা পাকাচ্ছে ধীরে ধীরে।

‘তোমার বাড়ি পৌঁছোতে আর কত দেরি? গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছ তো? এইজন্য তোমাকে আমি আসতে বারণ করেছিলাম। বিকাশ এলেই তো চলত। এই মাঝরাতে বাড়ি ফেরাটা খুবই দুশ্চিন্তার।’

আলোকপর্ণা বলল না যে গাড়িতে ওঠা তো দূর, ও এখনো গেটের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানলে জিনিয়াদি ভীষণ রাগ করবে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কথাগুলো শুনতে শুনতে আলোকপর্ণা হঠাৎ উপলব্ধি করল, ওর চোখদুটো কেমন জ্বালা করছে। কোনোমতে ও বলতে পারল, ‘তুমি সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে যেও দিদি।’ কিন্তু বলতে বলতে ওর চোখদুটো জলে ভরে গেল, বড়োবড়ো দুটো জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।

‘হ্যাঁ। তুমিও ভালো থেকো। আর অফিসে বিকাশ ঠিকঠাক কাজ করছে কি না খেয়াল রেখো।’

ফোনটা কেটে যাওয়ার পর আলোকপর্ণা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। গেটের থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। ওর মনের এমন পরিবর্তনে ও নিজেই অবাক। কিন্তু কোনো কিছু করেই ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। খালি এটা অনুভব করছে যে, জিনিয়াদি চলে গেল বলে ওর কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। এমন কষ্ট ঠিক দু-বছর আগে হয়েছিল।

যখন দিদি একবস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

ও ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ-মুখ মুছতে লাগল। এই কয়েক দিনে জিনিয়াদি যে ওর এতটা কাছের হয়ে উঠেছে, সেটা ও ধারণাও করতে পারেনি। শুধু অমন অবিশ্বাস্য মাইনের জন্যই নয়, জিনিয়াদি সব ব্যাপারে ওর এত খেয়াল রাখে, যে এখন মা নিজেও অতটা খেয়াল করে না। অথচ জিনিয়াদি ওর কেউই হয় না।

এই তো আগের সপ্তাহেই শুধুমাত্র আলোকপর্ণার কষ্ট হচ্ছিল বলে এয়ারকুলার মেশিন লাগিয়েছে জিনিয়াদি। ছোটো থেকেই ও একটুও গরম সহ্য করতে পারে না। গরমে কিছুক্ষণ বসলেই দরদর করে ঘামতে থাকে, তার সঙ্গে শুরু হয় মাথা যন্ত্রণা। সেই ঘাম শরীরে বসে চলে আসে জ্বর। এইজন্য ওর আর দিদির ঘরে বাবা খসখসের পর্দা ঝুঁলিয়েছিল দরজায়, জানলায়। সেই খসখস মা গরমের দিনে ভিজিয়ে দিলেই ঘর একদম এয়ারকন্ডিশনড হয়ে যেত।

লেকটাউনে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর অফিসঘরটা আসলে একটা গ্যারাজ। যেমন ছোটো, তেমনই বদ্ধ। আলোকপর্ণার মনে আছে, প্রথম দিন অম্বিকেশ স্যারের বলে দেওয়ামতো কথা বলতে গিয়ে ও প্রথমে খুঁজেই পায়নি অফিসটা। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে লেকটাউনের নানা গলির মধ্যে ঘুরেছিল। তারপর শেষমেশ যখন খুঁজে পেয়েছিল, বিস্ময়ে ও হতবাক হয়ে গিয়েছিল। গ্লোবাল টুরসের মত ঝাঁ চকচকে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডে কাজ করে এসে শেষে ওঁকে এখানে কাজ করতে হবে? ওর মনে পড়েছিল বহ্নিশিখা-র ‘পায়ে পায়ে ভ্রমণ’ কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার প্রস্তাবটা।

এক মুহূর্তের জন্য ওর খুব রাগ হয়েছিল অম্বিকেশ স্যারের প্রতি। এ কী! স্যার তো ওর মাইনে থেকে শুরু করে অভিজ্ঞতা, প্রোফাইল সবই জানেন, কী করে এমন একটা মুদির দোকান টাইপের কাজের কথা বললেন?

বিরস মুখে ও ঢুকেছিল অফিসের ভেতর। জিনিয়াদি তখন একাই বসে কাজ করছিল। ও বুঝতেও পারেনি যে জিনিয়াদি-ই এই কোম্পানির মালিক। ভেবেছিল এ-ও বুঝি কোনো কর্মচারী।

কিন্তু ভুল ভেঙেছিল কিছুক্ষণ পরেই। ওর পরিচয় পেয়েই জিনিয়াদি ওকে হাসিমুখে বসিয়েছিল সামনের চেয়ারে। তারপর একদম গল্পের কায়দায় ওর সঙ্গে কাজের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছিল।

তখনও আলোকপর্ণা দায়সারাভাবে উত্তর দিচ্ছিল। ও খালি মনে মনে হিসেব করছিল, এইরকম যার অফিসঘরের দশা, সে খুব বেশি হলে ছ-সাত হাজার টাকা মাইনে দিতে পারবে। আর সেই মাইনেতে ওর আসা-যাওয়ার খরচা বাদ দিলে তিনটে প্রাণীর সংসার কিছুতেই চলবে না। তাই এই মাইনেতে এতদূর উজিয়ে কাজ করতে আসার থেকে ঘরে বসে দুটো টিউশনি করা ভালো। তাই জিনিয়াদির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ায় ওর খুব একটা মনোযোগ ছিল না। টাকার ওপর ভিত্তি করে এই অনাসক্তিতে কেউ কিছু মনে করলেও ওর যায় আসে না, ওর পারিবারিক পরিস্থিতি সত্যিই খুব খারাপ অবস্থায়।

অবসাদগ্রস্ত স্বরে জিনিয়াদি-র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আলোকপর্ণা ভাবছিল, কখন টাকার কথা উঠবে, আর ও রাজি না হয়ে এই বিকট বদ্ধ ঘরটা থেকে বেরোতে পারবে।

একথা সেকথার পর জিনিয়াদি হাসিমুখে ওকে বলেছিল, ‘তোমার ডিগ্রি আছে, অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু বুঝতেই তো পারছ, আমার একদম নতুন কোম্পানি। এখনও একটাকাও প্রফিট করিনি। তবু তোমার যোগ্যতার কথা ভেবে আমি তোমাকে উপযুক্ত প্যাকেজই দেব আলোকপর্ণা।’

আলোকপর্ণা ক্লান্ত চোখে শুনে যাচ্ছিল। ও অনেক ঘাটের জল খেয়েছে, বেসরকারি ফার্মের কর্তাদের মাইনে বলার আগে এইসব ধানাইপানাই শুনতেও ও অভ্যস্ত।

আর ঠিক তখনই জিনিয়াদি বলেছিল, ‘তোমাকে আমি আপাতত মাসে আটত্রিশ হাজার টাকা করে দেব। বছরে একবার ইনক্রিমেন্ট হবে দশ পার সেন্ট হারে।’

আলোকপর্ণা এমন চমকে উঠেছিল যে গলায় আচমকা বিষম লেগে গিয়েছিল। কাশতে কাশতে বড়ো বড়ো চোখে ও তাকিয়েছিল জিনিয়াদির দিকে।

জিনিয়াদি সঙ্গেসঙ্গে পাশে রাখা নিজের জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিয়েছিল, ‘এই নাও। জল খাও।’

ও কোনোমতে জল খেয়ে ধাতস্থ হয়েছিল কিন্তু বিস্ময় ভাবটা তখনও যাচ্ছিল না। ও কি ঠিক শুনেছে? আটত্রিশ হাজার টাকা মাইনে? গ্লোবাল টুরসের মতো কোম্পানিতে তিন বছর পরেও ওর মাইনে বেড়ে বেড়ে হয়েছিল আঠেরো হাজার। সেখানে এইরকম একটা পুঁচকে কোম্পানিতে …।

ওকে হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে দেখে জিনিয়াদি বলেছিল, ‘কী হল? তুমি কি আরও বেশি এক্সপেক্ট করছ? কিন্তু এর চেয়ে বেশি আমার পক্ষে এই মুহূর্তে…।’

‘না না ম্যাডাম!’ আলোকপর্ণা যেন মহাসাগরের মাঝে ভাসতে ভাসতে একটা জাহাজের ভেঁপু শুনতে পেয়েছে, এইভাবে তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, ‘একদম ঠিক আছে। কাল থেকেই জয়েন করব ম্যাডাম?’

সেই শুরু। তার কিছুদিনের মধ্যেই ম্যাডাম থেকে ও নেমে এসেছিল ‘দিদি’ তে আর জিনিয়াদি ওকে দেখতে শুরু করেছিল বোনের চোখে। সেই দেখার মধ্যে কোনো দেখানেপনা ছিল না। ছিল সত্যিকারের স্নেহ। এই ক-দিনে জিনিয়াদি যে কতরকমভাবে ওর আর ওর বাড়ির খেয়াল রেখেছে, ও হিসেব করে উঠতে পারবে না।

গাল বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা মুছে আলোকপর্ণা পেছন ফিরল। ঈশ্বর সত্যিই আছেন। ওর নিজের দিদি চলে গেছে দু-বছর হল। কোনো সাহায্য তো দূর, ভুলেও সে কোনো খোঁজ নেয় না। অথচ অনাত্মীয় হয়ে জিনিয়াদি ওকে কত ভালোবাসে।

ও মনে মনে ঠিক করল, জিনিয়াদি আসার মধ্যে এই ক-টা দিনে ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর জন্য অন্তত দশজন কাস্টমার নিয়ে আসবে। পরের দুটো টুর আপাতত ঠিক হয়ে রয়েছে। মিশর আর ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া। মিশর বাঙালির চিরাচরিত ভালোলাগার জায়গা, সেটার জন্য টুরিস্ট পেতে সমস্যা হবেনা। কিন্তু ভিয়েতনাম- কম্বোডিয়া তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয়। কিন্তু আলোকপর্ণা সেটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে। সোশ্যাল মিডিয়া, হ্যান্ডবিল, ডিজিটাল মার্কেটিং কিচ্ছু বাদ রাখবে না। টুর শেষে জিনিয়াদি যখন এয়ারপোর্টে নামবে, তখন সারপ্রাইজটা দেবে।

সেটা শুনে জিনিয়াদির মুখটা কেমন আলোকিত হয়ে উঠবে ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল আলোকপর্ণা, হঠাৎ নিজের নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে পেছনে তাকাতে ও অবাক হয়ে গেল।

মিনতি মাসিমার ছেলে পিকলুদা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কী আশ্চর্য! আলোকপর্ণা ঘড়িতে দেখল রাত পৌনে দুটো বাজে। এত রাত যখন হয়েই গেছে ও ঠিক করেছিল ভোর না হওয়া পর্যন্ত এয়ারপোর্টের বাইরে এভাবেই কাটিয়ে দেবে। তারপর রাতজাগা চোখে রওনা দেবে বাড়ির দিকে। কিন্তু পিকলুদা তো এসেছিল মিনতি মাসিমাকে পৌঁছে দিতে। মিনতি মাসিমাকে নিয়ে সঞ্জিত হাজরা ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন তা প্রায় দু-ঘণ্টা হল। এতক্ষণে ওদের প্লেন মাঝ আকাশে থাকার কথা।

পিকলুদা এতক্ষণ এখানে কী করছে?

আলোকপর্ণা বলল, ‘এ কী! আপনি এখনও যাননি?’

আধ ইঞ্চি পুরু লেন্সের চশমার ফাঁক দিয়ে পিকলুদা হাসল। মুখে কয়েক দিনের না কাটা দাড়ি। পরনে জিন্স আর পাঞ্জাবি। চুল উসকোখুসকো। বলল, ‘আপনি তো দেখছি তখন থেকে এখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভাবলাম আপনি এতরাতে একা কী করে হিন্দমোটর ফিরবেন, তার চেয়ে আমি তো গাড়ি ভাড়া করে এসেছি, একটু নাহয় দাঁড়িয়ে যাই। তো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেল, আপনার তবু ধ্যানভঙ্গ হল না!’

‘আপনি বলবেন তো যে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তো আপনাকে দেখতেই পাইনি!’ আলোকপর্ণা লজ্জিত মুখে পা বাড়াল, ‘চলুন। অনেক রাত হল।’

‘ওরা কখন লন্ডন পৌঁছবে?’ পিকলুদা গাড়ির কাছে গিয়ে আলোকপর্ণাকে পেছনের সিটে বসতে সাহায্য করল, তারপর নিজে বসল।

‘প্রথমে তো যাবে দোহাতে। দোহাতে চার ঘণ্টার স্টপ ওভার রয়েছে। তারপর ওখান থেকে লন্ডন।’ আলোকপর্ণা হঠাৎ কী মনে পড়তে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিল, ‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব করব করে করা হয়নি। মিনতি মাসিমা তো জানতেনই না আপনি এই টুরটা বুক করেছেন। ভিসা করতে গিয়ে সব জেনে অবাক হয়ে যাননি?’

‘অবাক হওয়ার চেয়ে রেগে গেছিলেন মা।’ পিকলুদা হেসে বলল, ‘যখন জানলেন যে আমি ওঁর একার ট্রিপ বুক করেছি। রেগে গিয়ে বলছিলেন ভিসা না করিয়েই চলে আসবেন। শেষমেশ পুরো টাকা নষ্ট হওয়ার ভয় দেখিয়ে রাজি করিয়েছি।’

‘এটা কিন্তু ঠিকই।’ আলোকপর্ণা সায় দিল, ‘আপনি যখন মায়েরটাই বুক করলেন, আপনি সঙ্গে তো যেতেই পারতেন! কেন গেলেন না আমি বুঝলাম না। মাসিমা কত খুশি হতেন দু-জনে ঘুরলে।’

‘সে হয়তো খুশি হতেন। কিন্তু আমি সচেতনভাবেই ঠিক করেছিলাম মাকে একা পাঠাব।’ পিকলুদা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল, ‘আসলে কী জানেন, আমাকে নিয়ে সংগ্রাম করতে করতে মায়ের জীবন থেকে নিজস্ব সব কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মা এককালে খুব ভালো ছাত্রী ছিলেন, ভালো গান গাইতেন, আরও অনেক গুণ ছিল। কিন্তু একা লড়তে লড়তে মায়ের সব শেষ হয়ে গেছে। তাই মায়ের ষাট বছরের জন্মদিনের মধেই যখন আপনাদের এই টুরের শিডিউলটা রয়েছে বলে জানলাম, তখন মনে হল, মা তো অনেক করেছেন আমার জন্য। আমি নাহয় মাকে এই ক-টা দিন সম্পূর্ণ নিজের মতো করে কাটাবার উপহার দিই। ছোট থেকে মা আমাকে দেশ-বিদেশের গল্প শোনাতেন। গ্রিমভাইদের রূপকথা, প্যারিসের নোৎরদাম গির্জার সেই কোয়াসিমোদো, কিংবা সিন্ডারেলা। ছোটোবেলায় গল্প বলার সময় মায়ের নিখুঁত বর্ণনা শুনতে শুনতে ভাবতাম আমার মা বুঝি অনেকবার ওইসব দেশে গিয়েছেন। অনেকবার ঢুকেছেন নোৎরদাম গির্জার প্রার্থনাঘরে, ঘুরে বেড়িয়েছেন রোমের কলোসিয়ামের অলিন্দে অলিন্দে। বড়ো হয়ে বুঝি, মা কোথাওই যাননি, কিন্তু বই পড়ে পড়ে এমন প্রাঞ্জলভাবে নিজের কল্পনার মিশেলে গল্পটাকে ফুটিয়ে তুলতেন, যে, আমি শুনতে শুনতে ওখানেই চলে যেতাম। আপনাদের এই অল্প টাকা মাসে মাসে দিয়ে টুরটার কথা জেনে তাই ঠিক করে ফেলি, মা-কে এই ভ্রমণ-প্যাকেজ গিফট করে চমকে দেব।’

আলোকপর্ণা আগ্রহ-সহকারে শুনছিল। মিনতি মাসিমার সঙ্গে এই ক-দিনে ও এমন মিশে গেছে যে এখন মিনতি মাসিমাকে দূরের কেউ বলে মনে হয় না। মনে হয়, বহু যুগ আগে থেকে চেনা। এখন অফিস ফেরত ও স্বচ্ছন্দে ঢুকে যায় মিনতি মাসিমার বাড়িতে। বারান্দায় বাবু হয়ে বসে অবলীলায় তারিয়ে তারিয়ে খায় তেঁতুলের আচার।

মাঝে মাঝে আলোকপর্ণা নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে ও আশ্চর্য হয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ আগেও তীব্র অবসাদ এসে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে ফেলেছিল। বাড়িতে তো গত দু-বছর ধরেই শ্মশানের মতো পরিবেশ, অফিসেও টার্গেটের চাপ ও অপমানিত হওয়ার ভয় এসে ওকে জবুথবু করে রেখেছিল। অফিস থেকে ফেরার সময় স্টেশনে নেমে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করত না। আবার বাড়ি থেকে অফিস যেতেও মন চাইত না। মনে হত উদ্দেশ্যহীনভাবে চুপচাপ বসে থাকে।

অথচ দুটো মানুষের সংস্পর্শ ওকে এই ক-দিনেই অনেক বদলে দিয়েছে। একদিকে জিনিয়াদি শিখিয়েছে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করেও কীভাবে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে হয়, হাজার বাধাবিপদেও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে হয়।

অন্যদিকে মিনতি মাসিমা ওকে বুঝিয়েছেন কীভাবে হাল না ছেড়ে লড়তে হয়। ওর গ্লোবাল টুরসের চাকরি চলে যাওয়ার খবরে বলেছিলেন, ‘জীবনে মোক্ষ বলে কিছু হয় না আলোকপর্ণা। এই যে মানুষ বলে অমুক গোল অ্যাচিভ করব, তমুক কিছু করাটাই আমার অ্যাম্বিশন। ভুল বলে। খেয়াল করে দেখবে, সেই গোল অ্যাচিভ করার পরেও কিন্তু সে পরের গোলকে পাখির চোখ করে। যে চিত্রশিল্পীর জীবনের লক্ষ্য ছিল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে জিনের একক প্রদর্শনী করার, সেই লক্ষ্য সফল হলেও সে কিন্তু থেমে যায় না। নিজের মত করে ঠিক করে নেয় আরেকটা কোনো লক্ষ্য। যে অভিনেতা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার স্বপ্ন দেখত, সে সেই পুরস্কার পেয়েও প্রস্তুতি নিতে থাকে পরবর্তী কোন দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য জীবন আসলে একটা জার্নি, আলোকপর্ণা। তাতে চড়াই আসবে, উতরাই আসবে, তুমি হাঁপিয়ে পড়বে, কখনো আবার প্রচণ্ড উদ্যমে ছুটতে চাইবে। কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। দ্য শো মাস্ট গো অন।’

আলোকপর্ণা তখন প্রশ্ন করেছিল, ‘কিন্তু মাসিমা, কেউ যদি পরের পর ব্যর্থ হতেই থাকে? সব জায়গা থেকেই যদি পায় আঘাত আর দুঃখ? তার কি তখন গোলের পেছনে ছোটার ক্ষমতা একইরকম থাকে?’

মিনতি মাসিমা হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘গীতাতে কী লেখা আছে জানো? আলোকপর্ণা দু-পাশে মাথা নেড়েছিল।

‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।

কর্মে তোমার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কর্মফলের চিন্তায় কর্ম করা ছেড়ে দেওয়া কখনোই উচিত নয়।’ মিনতি মাসিমা বলেছিলেন, ‘আলোকপর্ণা, তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজের কাজ করে যাও। দেখবে একদিন তুমি সফল হবেই।’

‘আপনি কিছু খাবেন?’ পিকলুদা হঠাৎ বলল, ‘আসলে আমি তো হাওড়া স্টেশন থেকে গাড়িটা ভাড়া করেছিলাম। হাওড়া ঢুকছে। ফার্স্ট ট্রেনের এখনও দেরি আছে। হাওড়া স্টেশনে তো এখন অনেক রেস্টুরেন্ট হয়েছে, আপনি যদি বলেন তাহলে সেখানে কিছু খেয়ে নেওয়া যেতে পারে।’

পিকলুদা-র কথায় আলোকপর্ণা বাস্তবে ফিরে এল। দেখল, অন্ধকার রাতে বিন্দু বিন্দু জোনাকির মতো আলো জ্বলতে থাকা হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে গাড়ি। ও মাথা নেড়ে ‘না’ বলতে গিয়ে টের পেল, এতক্ষণ চিন্তায় ডুবে থাকায় ও বুঝতে পারেনি, এখন ওর বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। ও বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন।’

গাড়ি থেকে নেমে হাওড়া স্টেশনে ঢুকতে যাচ্ছিল দু-জনে, পেছন থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার ডাকল, ‘ম্যাডাম, শুনিয়ে!’

আলোকপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে পেছনে তাকাতেই দেখল, ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে কিছু একটা এগিয়ে দিচ্ছে, ‘এটা বোধ হয় আপনার পার্স থেকে পড়ে গেছে ম্যাডাম।’

পিকলুদা বলল, ‘আমি যাব?’

‘না না আপনি একটু সাইড করে দাঁড়ান। আমি আসছি।’ আলোকপর্ণা ট্যাক্সির কাছে গিয়ে দেখল ‘দাশগুপ্ত ট্রাভেলস’-এর একটা ভিজিটিং কার্ড কোনোভাবে হয়তো ট্যাক্সিতে পড়ে গিয়েছে।

ধন্যবাদ জানিয়ে কার্ডটা নিয়ে ও চলে আসছে, এমন সময় ড্রাইভার পেছন থেকে পিছু ডাকল, ‘এই কোম্পানির মালকিন মেমসাবকে আমি চিনি, ম্যাডাম।’

আলোকপর্ণা অবাক চোখে পেছনে ফিরল, ‘চেনেন? কী করে?’

ড্রাইভার তার খইনি খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হাসল, ‘একদিন উনি আমার গাড়িতে করে নেতাজি ইনডোর গিয়েছিলেন।’

‘ওহ! আমি ওখানে চাকরি করি। উনি আমার বস।’ আলোকপর্ণা কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘আপনার গাড়িতে কত প্যাসেঞ্জার ওঠে, আপনার সবাইকে মনে থাকে?’

ড্রাইভার দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘না। সবাইকে নয়। কিছু কিছু মনে থাকে। আসলে ওই ম্যাডামকে আমার একটা জিনিস দেওয়ার আছে। খুব শিগগির আপনাদের অফিসে যাব।’

আলোকপর্ণা বিস্মিত হল। একজন ট্যাক্সিচালকের জিনিয়াদিকে কী দেওয়ার থাকতে পারে, ও ভেবে পাচ্ছিল না। আজ যেন সব কিছুই অন্যরকম হচ্ছে।

পিকলুদা দূরে দাঁড়িয়েছিল। অস্পষ্ট ঝাপসা চোখে সম্ভবত দেখতে চেষ্টা করছিল আলোকপর্ণাকে।

আলোকপর্ণা সেদিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘উনি তো এখন নেই। টুর নিয়ে গিয়েছেন। আপনি দশ তারিখের পরে যেকোনোদিন অফিস টাইমে আসবেন আমাদের অফিসে।’

২৯

কলকাতা থেকে দোহা। দোহা থেকে লন্ডন। প্রায় পনেরো ঘণ্টার এই সফরটা বলতে গেলে প্রত্যেকেরই পরিশ্রান্ত ও বিস্রস্তভাবে কাটল। কেউ খুব একটা কথাবার্তাও বলেননি।

শুধু অতন্দ্রর বাল্যবন্ধু পুষ্পমের বাবা উৎপল বিশ্বাস দোহা থেকে লন্ডনের ফ্লাইটে জানলার ধারে সিট পাননি বলে গজগজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাল দিচ্ছিলেন পরেশনাথ কুণ্ডু বলে আরেকজন যাত্রী। সিমেন্ট সংস্থার ডিরেক্টর রৌণক সাধুখাঁ নামের ভদ্রলোক তাঁদের তখন ভালোভাবে বোঝালেন যে, এটার সঙ্গে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কোনো সম্পর্ক নেই, উৎপলবাবু নিজেই কলকাতায় চেক ইন কাউন্টারে উইন্ডো সিট চান উল্লেখ করেননি বলে তাঁকে জানলার পাশের সিট দেওয়া হয়নি। রৌণক সাধুখাঁর বোঝানোতে দুই ভদ্রলোক ব্যাজার মুখে চুপ করে গেলেন।

সবাই ক্লান্ত ছিল। অধিকাংশেরই এটা প্রথম বিদেশসফর। একে এতদূর বেড়াতে আসার টেনশন, তার ওপর মাঝরাতে প্লেন ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি। ফলে প্লেনের খাবার দেওয়ার সময় ছাড়া তেমন কেউই জেগে থাকেনি। লম্বা জার্নি বলে দোহা থেকে লন্ডনের ফ্লাইটে এয়ারহোস্টেসরা হালকা নীলচে অন্ধকার মাখানো একটা মিষ্টি আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে প্লেনের ভেতরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আবহাওয়ায় গরম চাদর জড়িয়ে চেয়ারকে যতদূর সম্ভব হেলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই।

জেগে ছিল একমাত্র জিনিয়া। প্লেনের নীলচে আলোয় সে একা বসে ছিল নিজের সিটে। প্লেনে ওঠার কিছুক্ষণ আগে ওর মধ্যে আকস্মিক যে দুর্বলতা এসে গ্রাস করেছিল, সেটা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। ও আবার ফিরে এসেছে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে। বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, যা যায়, একেবারেই যায়। ফিরে আসে না।

ও নিজের মোবাইলে একটার পর একটা পয়েন্ট লিখছিল, কোন কোন দিকে খেয়াল রাখতে হবে সেই ব্যাপারে। লন্ডনের সময় অনুযায়ী বিকেল পাঁচটায় প্লেন পৌঁছোবে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশনের লম্বা কিউ পেরিয়ে বাইরে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে ছ-টা। বাইরে জিনিয়ার ই-মেল মারফত হওয়া চুক্তিমতো দাঁড়িয়ে থাকবে ছোটো পঁচিশ সিটের ছোটো একখানা বাস। সেই বাসই নিয়ে যাবে হোটেলে। হোটেলে পৌঁছে সবাইকে নিজের নিজের রুমে পৌঁছে দিতে দিতে সন্ধে হয়ে যাবে। সবাই ক্লান্ত থাকবে, তাই ওইদিনটা পুরোটাই বিশ্রাম।

টুর শুরু হবে পরের দিন সকাল থেকে।

লিখতে লিখতে জিনিয়ার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তখন তাড়াহুড়োয় অল্পাদি-র সঙ্গে কথাই বলা হল না। সত্যি, মানুষের কীভাবে বিবর্তন হয়। অল্পাদি ছিল প্রাইমা ইনফোটেকের খুব ভাল টেকনিক্যাল স্কিল থাকা একজন ইঞ্জিনিয়ার। আর হয়ে গেল বেকারির মালিক।

জিনিয়া ফোনে ওয়াই-ফাই অন করল। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো প্রায় সব প্লেনেই এখন আকাশেও ওয়াই-ফাই পরিষেবা দিচ্ছে। ওর খুব ইচ্ছে হল অল্পাদি-র সঙ্গে কথা বলতে বলতে। কিন্তু প্লেনের ভেতর থেকে ডেটা কলে তেমন কিছু হয়তো শোনা যাবে না। এদিক-ওদিক আঙুল ঘষতে ঘষতে ও ইন্টারনেটে সার্চ করল অল্পা’জ বেকারি নামে। যদি ঠিকানা বা কোনো ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

কিছুক্ষণ পরেই ও চমকে উঠল। ইন্টারনেটে অল্পা’জ বেকারির প্রচুর ছবি, অজস্র প্রশংসা। রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইটও। জিনিয়া ওয়েবসাইটের লিঙ্কে ক্লিক করল।

এই তো, অল্পাদি দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসিমুখে। প্রায় বছর দুয়েক পর দেখছে, সামান্য মুটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাল লাগছে দেখতে। মাথায় পেশাদার শেফদের মত লম্বা সাদা টুপি, গায়ে দুধসাদা অ্যাপ্রন জড়িয়ে হাসিমুখে একটা বিশাল বড়ো কেকের ওপর অদ্ভুত সাবলীল আর দ্রুতগতিতে এঁকে চলেছে নানাধরনের ডিজাইন।

কোনো ছবিতে পরিতৃপ্ত ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছে পছন্দমাফিক কেক, কোনো ছবিতে কমবয়সি দু-তিনটে ছেলেমেয়েকে বেকিং শেখাচ্ছে অল্পাদি। একটা ছবিতে নিজের ছোট্ট অথচ ছিমছাম পরিচ্ছন্ন রিসেপশনে মিষ্টিমুখে অল্পাদি বসে রয়েছে। আরেকটা ছবি সম্ভবত বেকারি উদবোধনের দিন। দরজার বাইরে গাঁদাফুলের মালা ঝুলছে, দরজার দুপাশে ডাব। অল্পাদি হাসি হাসি মুখে ফিতে কাটছে, দু-পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অল্পাদি-র ছেলে আর সেনাবাহিনীতে থাকা স্বামী।

দেখতে দেখতে জিনিয়ার মনটা অদ্ভুত এক সুখকর অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। মোটা মাইনের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে যখন ও সবার আপত্তি সত্ত্বেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজের স্বপ্নপূরণের কর্মযজ্ঞে, মাথার ওপর পাহাড়প্রমাণ চাপ থাকলেও মনের মধ্যে ছিল প্রচ্ছন্ন অহমিকা বোধ। সামান্য হলেও ছিল। মনে হয়েছিল, ক্ষমতা আর আত্মপ্রত্যয় আছে বলেই তো এই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পেরেছে! ব্যবসা করার ইচ্ছে অনেকেরই থাকে, কিন্তু বাস্তবে সব ছেড়েছুড়ে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করার উদ্যোগ? সেই সাহস ক-জনের থাকে?

বছর কয়েক হল, একটা ফরাসি প্রতিশব্দ বাজারে এসেছে এই উদ্যোগপতিদের বোঝানোর জন্য। আন্ত্রেপ্রেনিয়রশিপ। এক কথায়, আর্থিক ঝুঁকি সত্ত্বেও নিজের ব্যবসা শুরু করাকেই বলে আন্ত্রেপ্রেনিয়রশিপ।

আই টি-তে বেশ কিছু বছর কাজ করার পর অভিজ্ঞতা আর অর্থ দুই-ই সম্বল করে অনেকেই ছোটো আইটি কোম্পানি খুলে বসে। সেগুলোকে আই টি-র পরিভাষায় বলে স্টার্ট আপ। ভারতবর্ষের আইটি নগরী বেঙ্গালুরুতে আই টি-র বড়ো বড়ো বহুজাতিক সংস্থা যত আছে, এই ধরনের স্টার্ট আপও কিছু কম নেই। একটা কথা তো চালুই আছে। বেঙ্গালুরুতে প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির গ্যারাজ ঘরেতেই রয়েছে কোন-না-কোনো স্টার্ট আপ। কলকাতায় সংখ্যাটা অত বেশি না হলেও খুব একটা কমও নেই।

তো, আই টি ছেড়ে স্টার্ট আপ খোলার মতো আন্ত্রেপ্রেনিয়র অনেক আছে। কিন্তু কেরিয়ারের প্রথমদিকে, আর্থিক বল ততটা না থাকতেও নিজস্ব কমফর্ট জোন ছেড়ে বেরিয়ে সম্পূর্ণ অন্য এক ব্যবসা খোলার মতো সাহস জিনিয়া ভাবত শুধু ওরই আছে।

কিন্তু আজ ও বুঝতে পারছে, ওরও আগে সেটা করে দেখিয়েছে অল্পাদি। অল্পাদি ওর চেয়েও বড়ো লাজুক। ওর একটু অপরাধবোধও হল। অল্পাদি প্রোজেক্টের সবাইকে ভালোবাসত, সবার জন্যই যথাসাধ্য করত। তার প্রতিদান সে পেয়েছিল চাকরি খুইয়ে। যোগিতাদি, প্রমিতাদি, নিলয়দা, বিধানদারা সরাসরি যুক্ত ছিল সেই কাজে। জিনিয়ার কোনো দোষ ছিল না ঠিকই, কিন্তু সে কি একবারও খবর রেখেছে চাকরি হারানোর পর অল্পাদি কী করছে?

নাহ, নিজের লক্ষ্যে ছুটতে ছুটতে জিনিয়া বড়ো স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনের বাইরে কারুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই ভুলে গেছে। চোখের বাইরে চলে গেলেই কি মনের বাইরে চলে যায় কেউ?

জিনিয়া একটু ইতস্তত করল। তারপর অল্পাদিকে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে একটা মেসেজ করল।

—হাই অল্পাদি, আমি জিনিয়া। কেমন আছ?

মেসেজটা করে ও ভাবল, এখন হয়তো অল্পাদি কাজে ব্যস্ত। ভারতে এখন সকাল ন-টা দশটা বাজে। উত্তর হয়তো এখুনিই মিলবে না।

কিন্তু জিনিয়াকে আশ্চর্য করে দিয়ে একটু পরেই অল্পাদিকে ‘অনলাইন’ দেখাল।

জিনিয়া উত্তেজিত হয়ে সোজা হয়ে বসল। অল্পাদি-র নামের পাশে এখন ‘টাইপিং’ দেখাচ্ছে। মুখে একচিলতে হাসি ধরে রেখে জিনিয়া ভাবতে লাগল কীভাবে ও বলবে যে ওর ট্রাভেল এজেন্সির প্রথম টুরের সঙ্গে কীভাবে অল্পাদি জড়িয়ে গিয়েছে!

—আরে জিনিয়া! তুই কেমন আছিস? কতদিন কথা হয় না।

—ভালো আছি গো। অল্পাদি, তুমি কি জানো, আমি চাকরি ছেড়ে একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছি?

—সে কী রে! প্রাইমা ইনফোটেক ছেড়ে দিয়েছিস?

—হ্যাঁ। এখন আমি আমার নিজের ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছি অল্পাদি। আর আজ আমার কোম্পানির প্রথম ট্রিপে উনিশজন যাত্রীকে নিয়ে ইউরোপ টুরে যাচ্ছি। আমি তোমার সঙ্গে প্লেনে বসে এখন চ্যাট করছি।

—কী বলছিস তুই! এ যে দারুণ ব্যাপার!

—হ্যাঁ। আমার কোম্পানির নাম দাশগুপ্ত ট্রাভেলস। আর আজ দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের প্রথম যাত্রা উপলক্ষ্যে যে দারুণ সুন্দর কেকটা আমরা কাটলাম, সেটা বানিয়েছ তুমি।

—ওমা, তাই তো! আজই তো দাশগুপ্ত ট্রাভেলস লেখা কেকের অর্ডার ছিল রে। ভদ্রলোক আমাদের পাড়াতেই থাকেন। উনিই ডেলিভারি নিয়েছেন।

—হ্যাঁ। উনি আমার কোম্পানিরই একজন। অল্পাদি, আমি জানতামই না যে তুমি অবশেষে তোমার সবচেয়ে ভালোলাগার কাজটাকেই পেশা করেছ। আজ হঠাৎ দেখে এত ভালো লাগল যে আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে এখনই মেসেজ করছি। আমার তোমার জন্য ভীষণ গর্ব হচ্ছে অল্পাদি।

—থাম তো। গর্ব করার মতো কী করেছি আমি? যেটা পারতাম, সেটাই করছি। নিজের মতো করে। তোর মতো অত বড়ো কিছু করার ক্ষমতা আমার আছে নাকি? তবে কী জানিস জিনিয়া, এখন আমি ভীষণ সুখী। আগে বাড়ির একতলাতেই শুরু করেছিলাম, কয়েক মাস হল এয়ারপোর্টের কাছে নতুন দোকানঘর নিয়েছি। কী জানিস, টাকাটাই সব নয়। কাস্টমারের মনোমতো কেক বানিয়ে তার হাতে যখন তুলে দিই, তখন তার চোখে যে প্রচণ্ড আনন্দ দেখতে পাই, তাতেই আমার আসল তৃপ্তি হয় রে। এই স্বাদ অনেক বড় চাকরিতেও নেই।

—একদম ঠিক বলেছ অল্পাদি। তুমিই আমাকে একবার বলেছিলে, নেশাকে কখনো পেশা করতে নেই। আমার কিন্তু সেটা মনে হয়নি, জানো। নেশাকে পেশা করার মতো ভাগ্যবান আসলে খুব কম জন হয়। আর যারা সেই ভাগ্যবান, তাদের কাজটা অনেক সুন্দর হয়।

—ঠিক তাই রে। তখন ভাবতাম, বেক করতে আমি ভালোবাসি। সেই ভালোবাসাকে টাকা দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে নিয়ে এলে ভালোবাসা উবে গিয়ে পেশাদারিত্ব চলে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। যত অর্ডার পাই, ততই আমার ভালো লাগে। শিল্পী যেমন রং তুলির আঁচড়ে আস্তে আস্তে একটা ছবিকে পূর্ণতা দেন কিংবা মাটির তালকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে বানানো মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন, আমিও ময়দা, দুধ, বেকিং পাউডার, ডিম দিয়ে যখনই কেক বানাই, সেই কেকের ওপর যখন ক্রিম দিয়ে একের পর এক ডিজাইন করি, মনে হয় কিছু সৃষ্টি করছি আমি। সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা!

—একদম ঠিক। তোমার ছেলে কেমন আছে অল্পাদি? আর বিশ্বজিৎদা?

—ছেলে ভালো আছে রে। এবার ক্লাস ফোর হল। খুব দুষ্টু হয়েছে। আর আমার বর তো এখন আসামে পোস্টেড। তবে আগের থেকে ঘনঘন আসে। আমার কথা অনেক হল। এবার তোর কথা বল তো! অতন্দ্র কেমন আছে? ও কি এখনও টেকি ওয়ার্ল্ডেই আছে?

জিনিয়া এতক্ষণ একটা ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে ছিল, এবার হঠাৎ নিষ্ঠুর বাস্তবে ফিরে এল। অল্পাদি অতন্দ্রর কথা জিজ্ঞেস করছে। ও কী বলবে?

সত্যিটা বলে দেবে? বলে দেবে যে অতন্দ্রর সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? জিনিয়া এখন সম্পূর্ণ একা? নাকি, পাশ কাটিয়ে যাবে!

ওর হঠাৎ মনে হল, অল্পাদিও নিজের মতো করে ব্যবসা করছে, ও-ও তাই। কিন্তু দু-জনের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য আছে। অল্পাদি-র পাশে ওর স্বামী আছে। আর ওর পাশে স্বামী নেই। শুধু স্বামী নেই বললে ভুল হবে। নিজের স্বপ্ন সত্যি করার এই পথে হাঁটার প্রথম কয়েক কদম পদক্ষেপের মধ্যেই সে চলে গেছে। শুধু চলেই যে গেছে তাই নয়, যোগাযোগের সব পথ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ও মোবাইলের ওয়াই-ফাই কানেকশনটা বন্ধ করে দিল। মাঝপথে অফলাইন হয়ে যাওয়ায় অল্পাদি যা ভাবে ভাবুক। পরে ফোন করবে নাহয়।

সব কিছু লেখা যায় না। সব কথা আঙুলের ঘষায় অক্ষর করে ফোটানো যায় না। জোর করে বাক্য সাজাতে গেলে মনের মধ্যে খুব কষ্ট হয়।

সেই কষ্ট এখন জিনিয়ার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে।

অন্ধকার প্লেন। পেছনে ওর টুরের যাত্রীরা, ফুলুমামা, সঞ্জিত হাজরা, এ ছাড়া অন্যান্য যাত্রীরা সব অকাতরে ঘুমোচ্ছে।

ও জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। প্লেনটা কতজোরে যাচ্ছে, কীসের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, কিছুই বোঝার উপায় নেই।

হঠাৎ ওর ফোনে একটা রিমাইন্ডার বেজে উঠল মৃদু শব্দে। আর সেটা বেজে ওঠামাত্র জিনিয়া সন্তর্পণে সিট ছেড়ে উঠল, যাতে পাশে অঘোরে ঘুমনো বিদেশি যাত্রীটির কোনো অসুবিধা না হয়।

দূরে ল্যাট্রিনের কাছটা সবুজ নীল আলো জ্বলছে, সেখানে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু-জন বিমানসেবিকা। জিনিয়া সরু করিডোর দিয়ে হেঁটে দু-তিনটে সারি পার হয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল এক যাত্রীর সামনে।

মানকড় থেকে আসা যাদবচন্দ্র সরকার ও তাঁর স্ত্রী আরতি দেবী। দু-জনেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। প্লেনের আলো-আঁধারির রঙিন অস্পষ্ট আলো এসে পড়েছে আরতিদেবীর মুখের বলিরেখাগুলোর ওপরে। কেমোর জন্যই সম্ভবত মাথায় চুল প্রায় নেই-ই। শুধু মধ্যে মধ্যে কিছু কাঁচাপাকা লম্বা চুল চলে গিয়েছে পেছনের দিকের খোঁপায়।

পাশেই বসা যাদবচন্দ্র ঘুমের মধ্যেও আলতো করে ধরে রেখেছেন স্ত্রীর হাত।

জিনিয়া ডাকতে গিয়ে একটু থমকে গেল। এই বয়সেও ভদ্রলোকের স্ত্রীর প্রতি কী অপার ভালোবাসা। প্রথমদিন এসে জানিয়েছিলেন স্ত্রী ক্যান্সারে ভুগছেন, নিজেও সাধারণ মধ্যবিত্ত। তবু স্ত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্যই নাকি এই বিদেশভ্রমণের আয়োজন।

জিনিয়া একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর আরতিদেবীর গায়ে আলতো করে হাত রাখল, ‘জেঠিমা! ও জেঠিমা!’

দু-একবার নীচুস্বরে ডাকতেই পাশে ঘুমিয়ে থাকা যাদবচন্দ্র ধড়মড় করে উঠে বসলেন। জিনিয়াকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘ক-কী হয়েছে? আমরা কি পৌঁছে গেছি?’

জিনিয়া হাসল, ‘না, না।’

‘তবে?’ আরতি দেবী ঘুমে জড়িয়ে আসা প্রায় কোটরাগত চোখ দুটো তুলে তাকালেন ওর দিকে।

জিনিয়া বলল, ‘এখন কলকাতায় সকাল বেলা। এই সময় আপনার দুটো ওষুধ খাওয়ার থাকে তো, জেঠিমা। আপনি পাশের ওই বোতামটা টিপুন, ছোটো আলো জ্বলে উঠবে। ওষুধ দুটো খেয়ে নিন।’

আরতি আর যাদবচন্দ্র অবাক হয়ে তাকালেন জিনিয়ার দিকে।

জিনিয়া বলল, ‘জল আছে তো? নাকি দিতে বলব?’

‘না, না, আছে।’ যাদবচন্দ্র তাড়াতাড়ি হাতে রাখা ব্যাগ থেকে ওষুধের প্যাকেট বের করতে লাগলেন, ‘তোমার মনে আছে জিনিয়া! আমিই তো ভুলে গেছিলাম।’

জিনিয়া হাসল, ‘আসলে সময়টা পালটে যাচ্ছে তো, তাই আপনার গোলমাল হয়ে গেছে। চিন্তার কিছু নেই। আমি মনে করিয়ে দেব।’

জিনিয়া মৃদু হেসে ফিরে আসতে লাগল নিজের সিটে।

পেছন ফিরে না তাকালেও ও জানে, যাদবচন্দ্র আর আরতি এখন মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। ভাবছেন ও এত খেয়াল রাখছে!

এই তো সবে শুরু। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল জিনিয়ার ঠোঁটের এক কোণে, সবাই যাতে অসম্ভব পরিতৃপ্তি নিয়ে দেশে ফেরে, সেটা দেখাই ওর প্রধান লক্ষ্য।

দাশগুপ্ত ট্রাভেলস ওর হৃৎপিণ্ড, আর সেই হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িয়ে পড়েছে, তাদের একমুহূর্তের জন্যও কোনো অসুবিধে ও হতে দেবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *