৩. জনসভার সাহিত্য

জনসভার সাহিত্য

প্রকাশকের যুগ

প্রথম প্রস্তাব

ষোড়শ শতাব্দী ছিল প্রধানত মুদ্রকের যুগ। প্রকাশক তাঁরাই ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে লেখকও। মুদ্রকরাই নানারকমের হরফ তৈরি করেছেন, বই ছেপেছেন, প্রকাশ করেছেন, বই বিক্রি করেছেন, লিখিয়েছেন এবং মধ্যে মধ্যে নিজেরাও লিখেছেন। প্রকাশক বা পাবলিশার নামে আজকাল যে স্বতন্ত্র বইব্যবসায়ীদের দেখা যায়, ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত তাঁদের বিশেষ কোনো অস্তিত্ব ছিল না বলা চলে। থাকলেও তা গণ্য করার মতন নয়। সপ্তদশ শতকে প্রকাশকদের আবির্ভাব হল গ্রন্থজগতে। বৈপ্লবিক আবির্ভাব। বইয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় ও যুগান্তকারী।

ষোড়শ শতাব্দীতে অনেক বড় বড় মুদ্রক জন্মেছিলেন। তার পরেও অবশ্য অনেক মুদ্রক জন্মেছেন এবং মুদ্রণকলার নানাদিকে যথেষ্ট উন্নতি সাধন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে বইয়ের ইতিহাস প্রধানত যাঁদের কেন্দ্র করে রোমাঞ্চকর কাহিনি হয়ে উঠেছে, তাঁরা হলেন প্রকাশক। নব্যযুগের নায়কদের মধ্যে প্রকাশকরাও অন্যতম। আধুনিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রকাশকরা মুদ্রকদের সঙ্গে বিরাট একটি অধ্যায় জুড়ে আছেন, অথচ ইতিহাস—লেখকরা তাঁদের সম্বন্ধে অনেকটা উদাসীন। আশ্চর্য মনে হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানারকমের উৎপাদনযন্ত্র যে বিপ্লব এনেছে, সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফলন হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু সংস্কৃতিক্ষেত্রে তার ঘাত—প্রতিঘাত হয়েছে প্রধানত মুদ্রণযন্ত্র, মুদ্রক ও প্রকাশকদের মাধ্যমে। সংস্কৃতির সর্বোচ্চ উপরতলায় যে বৈপ্লবিক আলোড়ন হয়েছে নতুন বিজ্ঞান ও যন্ত্রশিল্পের যুগে, তা ছাপাখানা ও ছাপা বই না থাকলে সহজে হত না এবং আদৌ হত কিনা সন্দেহ। নতুন যুগে বৈপ্লবিক বাণী যাঁরা মানুষের কানে পৌঁছে দিয়েছেন, সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের দিকে যাঁরা মানুষকে চোখ মেলে দেখতে সাহায্য করেছেন, নতুন যুক্তি ও বুদ্ধির সাহায্যে যাঁরা মানুষকে মধ্যযুগের কূপমন্ডুক সমাজের হাজার রকমের কুসংস্কার, জড়তা ও স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন—এককথায় যাঁরা মানুষের মুখে কথা ফুটিয়েছেন, স্বাধীনভাবে মানুষের মতন মানুষকে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন, তাঁরাই হলেন মুদ্রক ও প্রকাশক। কে না জানেন যে গোলাবারুদ কামানের চেয়ে হাজারগুণ শক্তিশালী হল মুদ্রিত কথা (Printed word)। মুদ্রিত কথা হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে অনায়াসে পৌঁছায়, তার ঘাত—প্রতিঘাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে, দেশ থেকে দেশান্তরে, চিন্তার আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গোলাবারুদের শক্তি স্থানকালপাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ, মুদ্রিত কথার কোনো ভৌগোলিক সীমানা নেই। সুতরাং কথাকে যাঁরা মুদ্রিত রূপ দেন, সেই মুদ্রকরা, এবং মুদ্রিত কথাকে যাঁরা স্থানকালপাত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে পৌঁছে দেবার পথ পরিষ্কার করে দেন, সেই প্রকাশকরা, আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন, তা কল্পনা করা যায় না। অথচ সংস্কৃতির ইতিহাসে মুদ্রক ও প্রকাশকদের তেমন উল্লেখযোগ্য বা যথাযোগ্য স্থান কোনো ঐতিহাসিকই দেননি। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের উচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে এবং খুব সংগতভাবেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁদের আবির্ভাব ও বিকাশের পথ যাঁরা তৈরি করেছেন, সেই মুদ্রক ও প্রকাশকদের অপাংক্তেয় বলে অবহেলা করা হয়েছে। কারিগর ও কারুশিল্পীরা যেমন বিনা অপরাধে চিত্রশিল্পীদের (পেইন্টরি) তুলনায় সামাজিক মর্যাদার অনেক নিম্নস্তরে নেমে এসেছেন, মুদ্রক ও প্রকাশকরাও তেমনি সাহিত্যিকদের মর্যাদার স্তরে পৌঁছতে পারেননি। ধনতান্ত্রিক যুগে প্রতিভার সংজ্ঞা বদলেছে এবং প্রতিভা অহমসর্বস্ব হয়েছে। নবযুগের সংস্কৃতির প্রধান আর্কিটেক্টদের তাই আমরা আজও যথাযোগ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠিত হই। ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে আমাদের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিই তার জন্য দায়ী। দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত না হলে সাহিত্যের ও সংস্কৃতির ইতিহাসের অনেকটা অংশ মুদ্রক ও প্রকাশকরা যে দখল করতেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

যাই হোক, ষোড়শ শতাব্দীতে শুধু ইংলন্ডে বা ইটালিতে নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং তার বাইরেও অনেক বিখ্যাত মুদ্রকের আবির্ভাব হয়েছিল। ফ্রান্সে জিওফ্রে টোরি (Geoffrey Tory) ছিলেন সে যুগের খ্যাতনামা মুদ্রক। তিনি প্রথম থেকেই মুদ্রিত গ্রন্থকে সর্বাঙ্গসুন্দর করবার চেষ্টা করেছিলেন। মুদ্রণ প্রকাশনের ইতিহাসে নেদারল্যান্ডের নামও উল্লেখযোগ্য। নেদারল্যান্ডের এলজেভির (Elzevir)—পরিবার ও ক্রিস্টোফ প্ল্যান্টিনের কথা ভুলবার নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে এলজেভিররা মুদ্রিত বইয়ের পকেট সংস্করণের (Pocket Edition) প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতার কথা বুঝেছিলেন। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের কথা। ক্রাইষ্টোফার প্ল্যান্টিনের (Christopher Plantin) নাম প্রথমযুগের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মুদ্রক বলে ইতিহাসে খোদাই করা রয়েছে। জার্মান গুতেনবার্গ ও ইটালীয়ান অলডাস মানুটিয়াসের সঙ্গে নেদারল্যান্ডের প্ল্যান্টিনের নাম মুদ্রণ—জগতে সমানভাবে স্মরণীয়। প্ল্যান্টিন একজন ফরাসি হলেও ফ্রান্স ছেড়ে তিনি আন্তওয়ার্পে (Antwerp) গিয়ে বসবাস করেন এবং সেখানেই মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ আরম্ভ করেন। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি খুব ছোট একটি ছাপাখানায় বই ছাপতে শুরু করে মাত্র পনের বছরের মধ্যে তখনকার দিনের বৃহত্তম মুদ্রণ—প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। ম্যাকমূর্ত্রি বলেছেন :

“Plantin’s ambition was to make his the greatest printing office in the world, and he certainly realised his ambition. By 1570 the institution was one of the show places of Europe. Twenty two presses were working continually and ––as one writer recorded with considerable awe–– 2,200 crows daily were paid as wages to the workmen. The plant outgrew the four houses it occupied.”

পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড় মুদ্রণ—প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, এই ছিল প্ল্যান্টিনের লক্ষ্য। লক্ষ্যে তিনি পৌঁছেছিলেন এবং অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে। আজকের দিনে অনেকে কল্পনা করতেও পারবেন না। মাত্র পনেরো বছরের মধ্যে প্ল্যান্টিনের মুদ্রণ—প্রতিষ্ঠান সারা ইয়োরোপের মধ্যে প্রধান দ্রষ্টব্য স্থানরূপে গণ্য হয়। দেশ—বিদেশ থেকে অনেকে প্ল্যান্টিনের ছাপাখানা দেখতে যেতেন। বাইশটা ছাপাখানার কাজ তিনি একসঙ্গে চালাতেন। ছাপাখানার কর্মীদের ২২০০ ক্রাউন করে প্রতিদিন মজুরি দিতেন। প্রতিষ্ঠানটি কত বড় হতে পারে তা দৈনন্দিন মজুরির এই পরিমাণ থেকে বোঝা যায়। চারটি বড় বড় বাড়ি নিয়ে ছিল তাঁর ছাপাখানা। তাতেও স্থান সঙ্কুলান হত না। নতুন বাড়ি ও সম্পত্তি কিনেছিলেন প্ল্যান্টিন তাঁর ছাপাখানার জন্য। তাঁর সেই বাড়িতে এখন প্ল্যান্টিন—মোরটাস মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—প্রাচীন ছাপাখানা ও ছাপার সাজসরঞ্জামাদির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইয়োরোপীয় মিউজিয়াম। পৃথিবীর প্রিন্টাররা এখন এই প্ল্যান্টিন মিউজিয়ামে প্রথমযুগের ছাপাখানার যাবতীয় যন্ত্রপাতি, কলাকৌশল, হরফ মুদ্রণ ইত্যাদির নিদর্শন দেখবার জন্য যান। প্রথমযুগের ছাপাখানা সংক্রান্ত এ রকম বিশাল মিউজিয়াম পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার দর্শক এই মিউজিয়াম দেখতে দেশ—বিদেশ থেকে আসেন। ম্যাকমূর্ত্রি প্ল্যান্টিন মিউজিয়ম সম্বন্ধে বলেছেন :

“To this museum printers from all over the world make pilgrimage, for nowhere else is to be seen to comprehensive an exhibit of early printing method. The museum is also visited annually by thousands of sightseers who find the ancient workrooms of compelling human interest.”

ইয়োরোপের মধ্যে মুদ্রণের প্রসার সীমাবদ্ধ ছিল না। অতলান্তিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নবাবিষ্কৃত মহাদেশেও ছাপাখানা পৌঁছেছিল ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যেই। স্পেনের বিখ্যাত প্রিন্টার জুয়ান ক্রমবার্গার (Juan Cromberger) তাঁরই দেশের বাসিন্দা একজন ইটালিয়ান প্রিন্টার জুয়ান প্যাবলোসে মেক্সিকোতে পাঠিয়েছিলেন ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৫৩৯ সালের কথা। মুদ্রক প্যাবলোর মহাসাগর পারে এই অভিযান কলম্বাসের অভিযানের তুলনায় কম যুগান্তকারী নয়। ইয়োরোপের মধ্যেই যখন সব দেশে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তখন অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে মুদ্রণ—যন্ত্রের লটবহর নিয়ে সুদূর মেক্সিকোতে যাওয়া শুধু দুঃসাহসিক নয়, যুগান্তকারী ব্যাপার। মেক্সিকোর প্রথম মুদ্রক হয়তো মার্টিন নামে কোনো ব্যক্তি ছিলেন। কেউ কেউ তাই অনুমান করেন। কিন্তু প্যাবলোক মেক্সিকোর প্রথম যুগের মুদ্রক হন বা নাই হন, তিনি যে প্রথম যুগের মুদ্রকদের মধ্যে প্রথম মিশনারি ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাপাখানার ইতিহাসে তিনি একজন রোমান্টিক নায়ক হয়ে আছেন। হয়তো প্রথমে তিনি ধর্মপুস্তক ছাপতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তবু পাদরি সাহেবদের মতন বাইবেল হাতে করে তিনি বিদেশে সমুদ্রযাত্রা করেননি। মহাসাগরের বিক্ষুব্ধ বুকে জীবন বিপন্ন করে সপরিবারে প্যাবলো অনির্দিষ্ট অপরিচিত দেশের উদ্দেশ্যে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন ছাপাখানার যন্ত্রপাতি নিয়ে। ছাপাখানার ইতিহাসে এ রকম একাধিক রোমান্টিক নায়ক আছেন, যাঁরা কোনো উপন্যাসের বা কাব্যের নায়ক হননি বিশেষ। তবু ইতিহাসে তাঁরা অবিস্মরণীয়। নবযুগের ইতিহাসের তাঁরাই রোমান্টিক নায়ক। ছাপাখানার আদিযুগের এই নায়করা মুদ্রক ও প্রকাশক দুই—ই। অন্তত ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত তাই ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে প্রকাশকরা তাঁদের স্বাতন্ত্র্য ও যুগান্তকারী ভূমিকা নিয়ে গ্রন্থ—জগতে পদার্পণ করেন। তার পরের ইতিহাস আরও রোমান্টিক।

দ্বিতীয় প্রস্তাব

ষোড়শ শতাব্দী থেকে সাহিত্যিক ব্যবসায়ে প্রকাশকদের আবির্ভাবের পথ সুগম হয়েছিল। বিখ্যাত মুদ্রকরা প্রায় প্রত্যেকেই বই প্রকাশ করে বিক্রি করতে আরম্ভ করেছিলেন। মুদ্রণ ও প্রকাশনের বিকাশ হচ্ছিল পাশাপাশি। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে প্রকাশকরা স্বতন্ত্রভাবে সাহিত্য—ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। মুদ্রণের ইতিহাস মোটামুটি পাঁচশো বছর হলে, প্রকাশনের ইতিহাস প্রায় তিনশো বছরের ইতিহাস।

যুগটা ছিল নতুন বাণিজ্যিক অভিযানের যুগ, “Commercial Piracy”র যুগ। সাহিত্যক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। প্রকাশকরা প্রথম স্বাধীন ব্যবসায়ীরূপে সাহিত্যক্ষেত্রেও অবতীর্ণ হচ্ছেন। ব্যবসায়ের রূপ তখন অন্যরকম ছিল, এখনকার মতন ছিল না। আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুগের তখন পূর্ণ বিকাশ হয়নি। তার জন্ম হচ্ছে বলা চলে। অভিযাত্রীর মনোভাব, লুন্ঠন ও দস্যুবৃত্তি (ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের মতন) তখন প্রবল ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতন বণিক অভিযাত্রীদের যুগ। নিয়ম—নীতির বিশেষ বালাই ছিল না তখন, তার বিকাশও হয়নি বিশেষ। বিভিন্ন দেশের পণ্যদ্রব্যকে অভিযাত্রী বণিকরা লুটের মাল মনে করতেন। এই অর্থনৈতিক মনোবৃত্তির প্রভাব রীতিমতো পড়েছিল সাহিত্যক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রথম যুগের প্রকাশকদের উপর। প্রকাশকরাই সাহিত্যক্ষেত্রের নতুন ব্যবসায়ী, স্বাধীন ব্যবসায়ী। সুতরাং অন্যান্য ক্ষেত্রের তাৎকালিক ব্যবসায়ীদের মতনই তাঁদের মনোবৃত্তি হওয়া স্বাভাবিক। কাঁচামালের সন্ধানে অবশ্য তাঁদের বিদেশযাত্রার প্রয়োজন হয়নি বিশেষ। কারণ প্রকাশকদের কাঁচামাল লেখক ও তাঁর পাণ্ডুলিপি এবং পণ্য হল বই। লেখকদের লুন্ঠন করাই প্রথম যুগের প্রকাশকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। সেইজন্য প্রকাশকদের প্রথম যুগটাকে অনেকে “literary piracy”র যুগ বলেছেন। ”কমার্শিয়াল পাইরেসির” মতন ”লিটারারি পাইরেসি” ছিল প্রকাশকদের নীতি। যৎকিঞ্চিৎ দক্ষিণা দিয়ে প্রকাশকরা লেখকদের পাণ্ডুলিপির সর্বস্বত্ব কিনে নিতেন, ”লভ্যাংশ” বা ”রয়াল্টি” দিয়ে নয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে যেসব সাহিত্যিক এইভাবে প্রকাশকদের লুন্ঠন—নীতির দৌরাত্ম্য সহ্য করেন, তাঁদের মধ্যে সেক্সপিয়রও ছিলেন। অনেক নাটক সেক্সপিয়র এইভাবে প্রকাশকদের হাতে সমর্পণ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যে কয়েকজন প্রকাশক বইয়ের ব্যবসা করে নাম করেছিলেন ইংলন্ডে, তাঁদের মধ্যে হামফ্রে মোসলের (Humphrey Mosley) নাম উল্লেখযোগ্য। ১৬৪৬ সালে মিল্টনের (Milton) প্রথম কাব্যসংকলন প্রকাশ করেন মোসলে। শুধু মিল্টনের নয়, আরও অনেক নতুন সাহিত্যিক ও কবির বই তিনি প্রকাশ করেন। সাধারণত লেখকদের কাছ থেকে বইয়ের স্বত্ব কিনে নিয়ে তিনি প্রকাশ করতেন। এইভাবে বইয়ের ব্যবসায়ে হামফ্রে অনেক মুনাফা করেছেন। কিন্তু তাহলেও ইংরেজি সাহিত্যে হামফ্রের বিশিষ্ট দান আছে। সাহিত্য বা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার মতন দূরদর্শী ও সাহসী প্রকাশক তখন ইংলন্ডে দু—চারজন ছিলেন কি—না সন্দেহ। সেই অবস্থায় হামফ্রে মোসলের মতন প্রকাশক না থাকলে ইংরেজ সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনার কোনো উৎসাহই হয়তো পেতেন না এবং ইংরেজি সাহিত্যের দারিদ্র্যও দূর হত কি না সন্দেহ।

সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে দু—একজন আরও দূরদর্শী ও বিচক্ষণ প্রকাশক সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ বাইরের সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের চাহিদা যেমন বাড়ছিল, পাঠকের সংখ্যা যেমন বাড়ছিল, তেমনি প্রকাশকদেরও পরিবর্তন হচ্ছিল। অবশ্য খুব দ্রুত নয়, ধীরে ধীরে। এই সময় বইয়ের ব্যবসায় প্রকাশনক্ষেত্রে যাঁরা খ্যাতিলাভ করছিলেন, তাঁদের মধ্যে জেকব টনসনের (Jacob Tonson) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে, সাহিত্যিক না হয়েও, প্রকাশকরূপে জেকব টনসন একটা নির্দিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। দরিদ্র পিতার কাছ থেকে মাত্র ১০০ পাউন্ড উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন টনসন। এই সামান্য পুঁজি ছাড়া বালক টনসনের আর কিছু সম্বল ছিল না, অথচ ছেলেবেলা থেকে তাঁর প্রকাশক হবার তীব্র বাসনা ছিল। ১৪ বছর বয়সে লন্ডনের এক পুস্তক—বিক্রেতার দোকানে টনসন শিক্ষানবীশ হয়ে কাজ শিখতে আরম্ভ করেন। সাত বছর অন্যের বইয়ের দোকানে এইভাবে কাজ করার পর ১৬৭৭ সালে, ২১ বছর বয়সে টনসন নিজে নতুন বইয়ের দোকান খোলেন চ্যান্সারী লেনে, ওই সামান্য ১০০ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে। প্রথমে তিনি পুরানো বই কিনে বিক্রি করতে আরম্ভ করেন এবং তার সঙ্গে ধীরে ধীরে নতুন বইও বিক্রি করতে থাকেন। কিন্তু কেবল বই বিক্রি করে তাঁর আশ মিটল না। স্বাধীন প্রকাশক হবার ইচ্ছা ক্রমেই তাঁর মধ্যে প্রবল হচ্ছিল। অথচ প্রকাশন ব্যবসায় আরম্ভ করার জন্য যে মূলধন প্রয়োজন, তা তাঁর ছিল না। তবু অন্যের প্রকাশিত বই বিক্রি করেও তাঁর তৃপ্তি হচ্ছিল না। সুতরাং সংগতি না থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত করলেন। অটওয়ে ও টেটের (Otway & Tate) নাটক নিয়ে তিনি শুরু করলেন। তার চেয়ে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নাটক প্রকাশ করে খুব লাভও হল না, লোকসানও হল না, কোনোরকমে পুষিয়ে গেল। এমন সময়ে টনসন লোকমুখে কাণাঘুষা শুনলেন যে, কবি ড্রাইডেনের (Dryden) সঙ্গে তাঁর প্রকাশক হেরিংম্যানের কি গন্ডগোল হয়েছে। শোনা মাত্রই তিনি দেরি না করে, ড্রাইডেনের সঙ্গে দেখা করলেন এবং তাঁর পরবর্তী নাটক ”ট্রয়লাস ও ক্লেসিডা” (Troilus and Cressida) প্রকাশ করার জন্য চুক্তি করে ফেললেন। ড্রাইডেন ২০ পাউন্ড দক্ষিণা চান তাঁর নাটকের জন্য। টনসনের দেবার মতন সংগতি ছিল না তখন কুড়ি পাউন্ড। তবু দিতেই হবে, কারণ ড্রাইডেনের মতন কবিকে তাঁর লেখক হিসেবে ছাড়তে তিনি কিছুতেই রাজি নন। নিরুপায় হয়ে টনসন অন্য একজন পুস্তক—বিক্রেতার কাছ থেকে তাকে মুনাফার ভাগ দেবার অঙ্গীকারে কিছু টাকা নিলেন। ১৬৭৯ সালে ড্রাইডেনের বইটি ছাপা হল। তারপর থেকে সারাজীবন টনসনের সঙ্গে ড্রাইডেনের প্রকাশক—লেখকের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ১৭০০ সালে ড্রাইডেনের মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল। কোনোদিন তাঁদের মধ্যে কোনো মতান্তর বা মনোমালিন্য হয়নি। ড্রাইডেনের অন্যতম প্রকাশকরূপে টনসন সকলের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাঁর খ্যাতিও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ইংরেজ প্রকাশকদের মধ্যে টনসনই সর্বপ্রথম বিভিন্ন লেখকের রচনার সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর আগে আর কোনো প্রকাশক “Literary Miscellany” গ্রন্থের পরিকল্পনা করতে পারেননি। ১৬৮৪ সালে টনসন যখন তাঁর সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন, তখনকার খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের রচনা নিয়ে, তখন পাঠক ও প্রকাশক উভয় মহলেই হই চই পড়ে যায়। তাঁর এই সংকলনগ্রন্থের নাম ছিল : “Miscellany–– Poems wirtten by the most Eminent Hands” (1684) সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন লেখকের রচনার এই প্রথম মুদ্রিত সংকলনগ্রন্থ। টনসনই এর প্রবর্তক। এইভাবে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর এবং একাধিক লেখকের চাহিদা ও ইচ্ছা পূরণ করার যে পন্থা থাকতে পারে, টনসনের আগে আর কোনো প্রকাশক তা চিন্তা করতে পারেননি। ১৬৮৫ সালে, টনসন এই সংকলনের ‘দ্বিতীয় খণ্ড’ প্রকাশ করেন। ১৬৯৩ সালে তৃতীয় খণ্ড। সংকলনগ্রন্থের এই পরিকল্পনা ব্যবসায়ী পরিকল্পনারূপে আশাতীতভাবে সফল হয়। বহু বই বিক্রি হয়, বইয়ের চাহিদা বাড়ে এবং টনসন যথেষ্ট মুনাফাও করেন। অন্যান্য প্রকাশকরাও টনসনকে অনুকরণ করে সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন। সংকলনগ্রন্থের একটা ঢেউ এনে দেন সাহিত্যজগতে প্রকাশক টনসন। স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে যে সব লেখকের রচনা প্রকাশিত হয়নি, অথচ যাঁরা প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছেন হয়তো কয়েকটি মাত্র রচনায়, তাঁদের রচনাও যে এইভাবে গ্রন্থের মধ্যে সন্নিবেশিত করে পাঠকদের কাছে পরিবেশন করা যায়, একথা সপ্তদশ শতাব্দীতে চিন্তা করা এবং তাকে কার্যে পরিণত করা, প্রকাশকের দিক থেকে যে কতটা অভিনব ছিল, আজ তা অনেকেই হয়তো কল্পনা করতে পারবেন না।

১৬৯৭ সালে টনসন ড্রাইডেনের ভার্জিল অনুবাদ প্রকাশ করে ইংরেজিভাষী পাঠকদের উপহার দেন। গ্রন্থজগতে টনসনের নাম অমর হয়ে যায়। তিন বছর ধরে অগ্রিম গ্রাহক সংগ্রহ করে তিনি ভার্জিলের অনুবাদ প্রকাশ করেন। প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বই বিক্রি হয়ে যায়।

প্রকাশক টনসনের নাম আরও একটি কারণে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে যায়। মিল্টনের বিশ্ববিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ প্যারাডাইজ লস্ট (Paradise Lost) টনসন প্রকাশ করেন। তাঁর আগে প্রকাশক সিমন্সের কাছে (Simmons) মিল্টন তাঁর ”প্যারাডাইজ লস্টের” সর্বস্বত্ব বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সিমেন্স তাঁর স্বত্ব ২৫ পাউন্ড মূল্যে অন্য একজনের (Brabazon Aylmer) কাছে বিক্রি করেন এবং তিনি টনসনকে ১৬৮৩ সালে বিক্রি করে দেন।

টনসন খুব হুঁশিয়ার প্রকাশক ছিলেন। তখন ড্রাইডেন জীবিত এবং টনসনের সঙ্গে ড্রাইডেনের প্রকাশক—লেখকের সম্পর্ক মধুর। বই প্রকাশের ব্যাপারে টনসন পদে পদে ড্রাইডেনের পরামর্শ নিতেন। মিল্টনের ”প্যারাডাইজ লস্টে”র স্বত্ব কেনার সময় টনসন পরামর্শ করেন ড্রাইডেনের সঙ্গে। ড্রাইডেন মুক্তকণ্ঠে মিল্টনের এই মহাকাব্যের প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, ইংরেজি সাহিত্যে এই কাব্যে বিরাট অবদান বলে গ্রাহ্য হবে। টনসন উৎসাহিত হন এবং ১৬৮৩ সালে তিনি অর্ধেক স্বত্ব কিনে নেন। বাকি অর্ধেক কেনেন সাত বছর পরে। ১৬৮৮ সালে ”প্যারাডাইজ লস্ট” প্রকাশিত হয় গ্রন্থাকারে, প্রকাশক টনসন। প্রকাশের পরই তার সুখ্যাতি হয়, বিক্রিও হয় যথেষ্ট। পর পর কয়েকটি সংস্করণ ছাপেন টনসন এবং এই একখানি কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনি কয়েক হাজার পাউন্ড মুনাফা করেন। অবশ্য কবি মিল্টন তাতে বিশেষ লাভবান হননি।

তারপর টনসন আর একটি বৃহৎ কাজে হাত দেন, সাত খণ্ডে সেক্সপিয়রের সচিত্র গ্রন্থাবলি তিনি প্রকাশ করেন। তিনিই সেক্সপিয়রের গ্রন্থাবলির সচিত্র সংস্করণের প্রথম প্রকাশক। ১৭০৯—১৭১০ সালে প্রকাশিত হয়। এইবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে পৌঁছেচি আমরা। বড় বড় প্রকাশকদের যুগে।

তৃতীয় প্রস্তাব

সপ্তদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বৃটিশ প্রকাশক টনসনের কথা বলেছি। দূরদর্শী টনসন বইয়ের ব্যবসায়ে অনেক দিক থেকে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। বিভিন্ন লেখকের রচনার সংকলনগ্রন্থ তার মধ্যে অন্যতম। লেখক ও প্রকাশকের সম্পর্ক যে সেকালের সাহিত্যিক বোম্বেটেগিরির যুগেও কতখানি অন্তরঙ্গ হতে পারে, টনসন ও ড্রাইডেন তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। লেখকরা যে কেবল উকিলদের ক্লায়েন্টের মতন শোষণের মক্কেল নন, একথা প্রমাণ করা তখনকার দিনে সহজ ছিল না। ড্রাইডেনের প্রকাশক টনসন সম্পর্কে আর একটি কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। টনসন আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে বুঝেছিলেন যে, সাহিত্যিকদের আড্ডায় যোগদান না করলে ভালো প্রকাশক হওয়া যায় না। এখনও যে ক—জন প্রকাশক একথা বোঝেন তা জানি না, বিশেষ করে আমাদের দেশে। এ—প্রসঙ্গ নিয়ে পরে সবিস্তারে আলোচনা করব। তখনকার দিনে ইংলন্ডের একটি বিখ্যাত সাহিত্যিক চক্র বা আড্ডার নাম ছিল কিট—ক্যাট—ক্লাব (Kit-Kat-Club)। সাহিত্যিক ও পাঠকদের এই বৈঠকি আড্ডায় টনসন নিয়মিতভাবে যোগদান করতেন। সাহিত্যিক, শিল্পী রাজনীতিক সকলেই এই ক্লাবের সভ্য ছিলেন। টনসন প্রকাশক হয়েও যে এই ক্লাবের সেক্রেটারি হয়েছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায়, ক্লাবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ ছিল। সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষেত্র ছিল এই ক্লাব। টনসন তার সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তা না হলে প্রায় তিন শতাব্দী আগে তিনি প্রকাশনক্ষেত্রে যে আশ্চর্য আর্থিক সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, তা করা কোনোমতেই সম্ভব হত না। ১৭৩৬ সাল টনসনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বইয়ের ব্যবসায়ে প্রকাশকদের দ্রুত অগ্রগতি তিনি নিজের চোখে দেখে গিয়েছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রকাশকরা আরও অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। বইয়ের জগতে অনেক অভিনব পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করার সুযোগ পেলেন তাঁরা। বইছাপা, বই বাঁধাই, বই রূপায়ণ ইত্যাদির দ্রুত উন্নতি হল। ক্ষেত্র প্রস্তুত হল তার জন্য। মুদ্রণ জগতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফলে প্রকাশকদের সুবিধা হল। নতুন উপাদান, নতুন কলা—কৌশলের উদ্ভব হল। যেমন—

১৭১৯ সালে রোমার (Reaumur) কাঠ থেকে কাগজ তৈরি করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন;

১৭২২ সালে লা ব্লোঁ (Le Blon) কোলোরিটো (Colorito) নামে বই প্রকাশ করেন এবং তার মধ্যে রঙিন ছাপার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। নয়টি রঙিন মুদ্রণের প্রতিলিপি তাঁর বইতে ছিল;

১৭৩৪ সালে ক্যাসলন (Caslon) তাঁর বিখ্যাত মুদ্রণ হরফের নমুনা প্রকাশ করেন;

১৭৩৯ সালে গেড (Ged) স্টিরিওটাইপের পরীক্ষায় কৃতকার্য হন;

১৭৪৪ সালে সাদবি (Sotheby) তাঁর নিলাম—ঘর স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে সর্বপ্রথম কেবল বই বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন;

১৭৫৭ সালে বাস্কারভিল (Baskerville) তাঁর নতুন ছাপার হরফ তৈরি করেন; হোরেস ওয়ালপোল নিজের প্রাইভেট প্রেস স্থাপন করেন;

*১৭৬৮ সালে পার্মার বোদেনি (Bodoni) বিখ্যাত ”এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা” (Encyclopaedia Brittanica) প্রথম ছাপতে আরম্ভ করেন এবং তার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়;

১৭৬৯ সালে গ্র্যাংজারের “Biographical History of England” প্রকাশিত হয় এবং চিত্র বইয়ের প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠে;

১৭৭০ সালে রোজার পেইন (Roger Payne) বই বাঁধাই আরম্ভ করেন নতুনভাবে;

১৭৭৪ সালে শীল (Scheele) ন্যাকড়াকানি থেকে কাগজ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন;

১৭৮৪ সালে হউই (Hauy) অন্ধদের জন্য সর্বপ্রথম উঁচু অক্ষরে বই ছাপেন;

১৭৯৬ সালে সেনেফেল্ডার (Senefelder) লিথোগ্রাফির কৌশল উদ্ভাবন করে বই ছাপার ইতিহাসে যুগান্তর আনেন।

মুদ্রণ ও প্রকাশনক্ষেত্রে এগুলি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এগুলি ঘটেছিল। বই বাঁধাই, বই ছাপা, রঙিন ছাপা, বই চিত্রণ, লিথোগ্রাফি ইত্যাদির আবিষ্কার ও উন্নতির ফলে প্রকাশকরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলেন। তার জন্যই তাঁরা প্রকাশিত বইয়ের চেহারা এক শতাব্দীর মধ্যে আমূল বদলে ফেলতে পেরেছিলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকের বড় প্রকাশকদের মধ্যে বার্ণাড লিনটট (Bernard Lintot) ছিলেন অন্যতম। পোপের প্রকাশকরূপে তিনি বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। লিনটট যখন প্রকাশন ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, তখনও টনসন জীবিত ছিলেন। টনসনের প্রকাশন—নীতি ও ধারা লিনটটকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। গোড়া থেকেই তিনি টনসনের পরীক্ষিত পথ ধরে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেছিলেন। টনসনের মতন তিনি তখনকার সাহিত্যিকদের আড্ডায় ঘুরে বেড়াতেন এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করতেন। লিনটট প্রথমে একটি বইয়ের দোকান খোলেন এবং দোকানটিকে রীতিমতো সাহিত্যিকদের আড্ডায় পরিণত করেন। এই আড্ডা থেকেই তাঁর প্রকাশক হবার সুযোগ হয়। বিনস বলেছেন (Norman E. Binns) লিনটট সম্বন্ধে : “He contrived to make his shop a meeting place for the leading writers of the day”। খ্যাতনামা সাহিত্যিক সকলেই প্রায় লিনটটের দোকানে আড্ডা দিতে আসতেন। সেই সুযোগ পেয়েই টনসনের মতন তাঁর রচনা—সংকলন প্রকাশ করার ইচ্ছা হয়। প্রথমে তিনি টনসনের অনুসরণ করে বিভিন্ন লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৭১২ সালে তাঁর “Miscellany” প্রকাশিত হয় এবং তাতে গ্রে’র কবিতা (Gray), সুইফটের (Swift) রচনা এবং পোপের “Rape of the Lock” ছাপা হয়। সংকলন প্রকাশিত হবার পর যথেষ্ট সুনাম হয় তাঁর এবং খ্যাতনামা লেখকদের কাছেও তাঁর মর্যাদা বাড়ে।

১৭১২ সালেই পোপ তাঁর হোমার অনুবাদ আরম্ভ করেন। বিরাট পরিকল্পনা। প্রকাশক পাওয়াও কঠিন। কিন্তু নতুন প্রকাশক হয়েও লিনটট এই বিরাট কাজের দায়িত্ব নেবার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে যান। প্রতি খণ্ড অনুবাদের জন্য তিনি পোপকে ২০০ পাউণ্ড করে পারিশ্রমিক দেবেন প্রতিশ্রুতি দেন। ছয়টি খণ্ডে অনুবাদ প্রকাশ করার কথা হয়, প্রতি খণ্ডের দাম ঠিক হয় এক গিনি করে। হোমারের অনুবাদ, কি হবে না হবে তার ঠিক নেই, বিক্রির কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা সত্ত্বেও লিনটট এইভাবে পোপের সঙ্গে বিরাট অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশের চুক্তি করে ফেলেন এবং তাঁকে যে টাকা দিতে রাজি হন, তাও তখনকার দিনে যথেষ্ট। বিশেষ করে বই প্রকাশের আগেই অনুবাদের প্রতি খণ্ডের জন্য ২০০ পাউন্ড করে দেবার অঙ্গীকার করা সহজ নয়। হোমার অনুবাদ করার জন্য পোপ মোট প্রায় ৫০০০ পাউন্ড পেয়েছিলেন (প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশ হাজার টাকা)।

পোপের অনুবাদ প্রকাশ করার পরিকল্পনা যখন লিনটট করেন, তখন টনসন বেঁচে ছিলেন। পোপের ”ইলিয়াডের” অনুবাদ প্রকাশিত হবার পর টনসন তিনদিনের মধ্যে অন্য একটি ইলিয়াডের অনুবাদ (টিকেলের) প্রকাশ করেন। লিনটট সংকলন প্রকাশ করে টনসনের অনুকরণ করেছিলেন, টনসন শেষ জীবনে তার জবাব দিলেন। প্রকাশকদের মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রেষারেষি গোড়া থেকেই ছিল দেখা যায়। যাই হোক, টনসনই ব্যর্থ হলেন, লিনটটের প্রতিষ্ঠা হল।

১৭২৫ সালে ”ওডেসির” অনুবাদ প্রকাশিত হল এবং পোপ প্রায় ৩০০০ পাউন্ড পেলেন অনুবাদের জন্য। এই সময় প্রকাশক লিনটটের সঙ্গে কবি পোপের মনান্তর ঘটল। যেভাবেই হোক, প্রকাশকের ধারণা হল যে কবি পোপ তাঁর মেহনতের যে মূল্য পাচ্ছেন, প্রকাশক তা পাচ্ছেন না। চুক্তির উদারতার জন্য লিনটট বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য থেকে। চুক্তির মধ্যে ত্রুটি সন্ধান করতে লাগলেন প্রকাশক। লিখিত চুক্তির মধ্যে খুঁজে খুঁজে লিনটট খুঁত বার করে কবি পোপের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করলেন। কবি হলেও পোপ ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। তিনি কোমর বেঁধে প্রকাশকের সঙ্গে আদালতে মোকদ্দমা লড়লেন। অবশেষে প্রকাশক লিনটটের সঙ্গে কবি পোপের এই মনোমালিন্যের ফলে বিচ্ছেদ হয়ে গেল। আদালতে নালিশ করলেও লিনটট অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করে পোপের কল্যাণে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ১৭৩০ সালে লিনটট প্রকাশকের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অবসর গ্রহণ করেন এবং তার পাঁচ বছর পরে মারা যান। পোপ কিন্তু প্রকাশকের এই আচরণে রীতিমতো দুঃখিত হয়েছিলেন এবং তার জন্য লিনটটকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারেন নি। তিনি এ—ব্যাপারে রীতিমতো প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন। পরে পোপ তাঁর “The Dunciad”—এর মধ্যে প্রকাশকের বিরুদ্ধে অনেক কটূক্তি করেছেন। প্রকাশক ও লেখকের ইতিহাসে পোপ ও লিনটটের এই কাহিনি অনেক দিক থেকে মূল্যবান। এই কাহিনি থেকে আধুনিক প্রকাশক ও লেখকদেরও অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে।

……..

* প্রকৃত নাম জিয়ামবাতিস্তা বোদোনি (১৭৪০—১৮১৩) উত্তর ইতালির পার্মা শহরে বেশি দিন কাটিয়ে ছিলেন। তিনি কোনোদিনই ইতালির বাইরে যাননি—এ কারণে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মুদ্রক হওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়।

কলিন ম্যাকফারকুহার (১৭৪৪—১৭৯৩) তক্ষণ শিল্পী অ্যান্ড্রু বেল (১৭২৬—১৮০৯)—এর সহযোগিতায় এডিনবার্গের নিকলসন স্ট্রিট—এর ছাপাখানা থেকে ১৭৬৮ সালে ১০ ডিসেম্বর প্রথম সংস্করণ এনসাইক্লোপিডিয়া মুদ্রণ ও বিপনণের ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণের প্রকাশনায় তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।

সূত্র : Encyclopaedia Britannica, 11th ed., 1910.

সেক্সপিয়রের যুগ

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রকাশকদের কথা বলেছি। কিন্তু বলা সম্পূর্ণ হয় না, মহাকবি সেক্সপিয়রের প্রকাশকদের কথা কিছু না বললে। প্রত্যেক লেখক ও পাঠক নিশ্চয় অসীম আগ্রহ নিয়ে সেক্সপিয়র ও তাঁর প্রকাশকদের কথা জানতে চাইবেন। অতকাল আগে সেক্সপিয়র প্রকাশক পেলেন কেমন করে? প্রথমেই তো তিনি মহাকবি খ্যাতি অর্জন করেননি! লেখার জন্য কত টাকা পেতেন সেক্সপিয়র? প্রকাশকরা কী রকম ব্যবহার করতেন তাঁর সঙ্গে? লেখক ও প্রকাশক উভয়েরই এ সব কথা জানা উচিত।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বইয়ের ব্যবসায় প্রকাশকদের আদৌ ভিড় ছিল না, প্রতিযোগিতার ঠেলাঠেলিও ছিল না তাঁদের মধ্যে। দু—চার জন, যাঁরা বইয়ের ব্যবসা করতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের পক্ষে সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন করা খুব কঠিন ছিল না তখন। ব্যবসাটা প্রায় একচেটে ছিল তাঁদের। সাধারণ লোক ব্যবসাক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারত না। স্টার চেম্বার বা স্টেশনার্স কোম্পানির শিলমোহর পাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না। দু—চারজন ভাগ্যবান মুদ্রক ও প্রকাশক পেতেন। সাধারণ কৌতূহলীরা দূর থেকে তাঁদের দেখতেন এবং নিশ্চয় মনে মনে হিংসা করতেন। প্রকাশনের যখন এ রকম অবস্থা, তখন সাধু উপায় ছেড়ে দিয়ে অসাধু উপায়ে, ছলচাতুরির সাহায্যে, কেউ কেউ যে বই ছাপিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করবেন, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বরং না করাটাই অস্বাভাবিক। কোথা থেকে বই পেতেন তাঁরা? অবশ্যই লেখকদের কাছ থেকে। চুপিসাড়ে, গোপনে লেখকদের কাছে ঘুরে ঘুরে, বাড়িতে ধরনা দিয়ে তাঁরা নতুন নতুন অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতেন এবং ঠিক তেমনি চুপিসাড়ে কোনো ছাপাখানা থেকে ছেপে খুব সস্তা দামে এগুলি বিক্রি করতেন। অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিই তাঁরা লেখকদের কাছ থেকে একসঙ্গে কিছু থোক টাকা দিয়ে কিনে নিতেন, কোনো শর্ত বা চুক্তির মধ্যে মাথা গলাতেন না। লেখকরাও তখন নিজেদের স্বার্থ সম্বন্ধে খুব যে সচেতন ছিলেন তা নয়। সবেমাত্র পাণ্ডুলিপির অন্ধকার যুগ থেকে তাঁর মুদ্রিত গ্রন্থের আলোকোজ্জ্বল যুগে পদার্পণ করছেন। বই ছাপা নিয়ে তাঁদের কথা। তাও আবার সকলে পছন্দ করতেন না। এমন অনেক লেখক ছিলেন (সেক্সপিয়রও তাঁদের মধ্যে একজন), যাঁদের হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির কৌলীন্য সম্পর্কে একটা মিথ্যা ধারণা ছিল। সেক্সপিয়রেরও সেই ধারণা ছিল। তাঁরা মনে করতেন, রচনা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হলেই তার আভিজাত্য নষ্ট হয়ে যায়। শুধু পাণ্ডুলিপির পেট্রনরা নন, লেখকরাও প্রথমে বই ছাপার বিরোধী ছিলেন। কথাটা লেখকদের কাছে আজ তাজ্জব মনে হবে নিশ্চয়। লেখকদেরই যখন এই রকম ধারণা ছিল, তখন যে—কোনো মূল্যে তাঁদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি কেনাটা খুব কঠিন ছিল না। অনেকে তাই করতেন এবং সস্তায় ছোট ছোট বই ছেপে বিক্রিও করতেন। এই সময় অশ্লীল যৌন—সাহিত্যেরও প্রচলন হয় খুব বেশি। গোপনে এই অশ্লীল বই ছেপে বিক্রি করে অনেক প্রকাশক পয়সা রোজগার করতেন। লেখকদের দিয়ে লিখিয়েও নিতেন। এই শ্রেণির গ্রন্থ—ব্যবসায়ীদের “pirate book-seller” বলা হত। পাইরেটই তো! কারণ এঁদের কোনো নীতির বালাই ছিল না, যা পেতেন তাই ছাপতেন এবং এইভাবে লুকিয়ে ব্যবসা করে মুনাফা করতেন। বড় প্রকাশক বা লেখকদের বইয়ের সস্তা সংস্করণ লুকিয়ে ছেপে বিক্রি করতেও তাঁদের বাধত না। জেল—জরিমানা তাঁরা পরোয়া করতেন না। এই ‘পাইরেট’ বই—ব্যবসায়ীদের কথা আগেও উল্লেখ করেছি। এইরকম একজন দস্যু ব্যবসায়ীই মহাকবি সেক্সপিয়রের গ্রন্থের প্রথম প্রকাশক হয়েছিলেন। তাঁর নাম জন ড্যান্টার (John Danter) এবং ১৫৯৪ সালে তিনি প্রথমে সেক্সপিয়রের নাটক টাইটাস এন্ড্রনিকাস (Titus Andronicus) প্রকাশ করেন। ফ্র্যাঙ্ক মাম্বি বলেছেন—

“It was a pirate who, in the year 1594, first paid Shakespeare the compliment of publishing one of his plays. The pirate was John Danter, the play ‘Titus Andronicus’… Three years later Danter followed this up with his surreptitions first edition of ‘Romeo and Juliet”, printed in quarto from an imperfect copy, and published anonymously.”

১৫৯৪ সালে ‘টাইটাস এন্ড্রনিকাস’ প্রকাশ করার পর পাইরেট ড্যান্টার ১৫৯৭ সালে গোপনে বিখ্যাত রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন। মাম্বি মন্তব্য করেছেন : “A more ignoble beginning to a series destined to immortality could searcely be imagined.” বাস্তবিকই তাই—কল্পনা করা যায় না। রূপকথা মনে হয়, অথচ বইয়ের কথা এবং সেক্সপিয়রের বইয়ের কথা। এই হল সাহিত্যের আসল ইতিহাস, যা সাহিত্যিকরা বা পাঠকরা জানেন না হয়তো। সেক্সপিয়র সম্বন্ধে অনেক সমালোচনা ও ইতিহাস পড়েও যদি সেক্সপিয়রের গ্রন্থের এই অন্তরালবর্তী ইতিহাসটুকু না জানা যায়, তাহলে সেক্সপিয়র ও তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকে না কি? কুখ্যাত প্রকাশক জন ড্যান্টারের প্রতি পাঠকরা, বিশেষ করে লেখকরা, হয়তো ক্রুদ্ধ হবেন। হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাসে ড্যান্টার চিরদিন সেক্সপিয়রের প্রথম প্রকাশকরূপে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাহিত্যিক ও সাহিত্যের ছাত্রদের আরও একটি কথা এই প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত। এলিজাবেথ ও প্রথম জেমসের যুগের ইংরেজি নাট্যসাহিত্য, যা বিশ্বসাহিত্য যুগ যুগ ধরে আদরণীয় হয়ে আছে—তার অধিকাংশই লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকত, যদি ড্যান্টার পাইরেটদের মতন ইংলন্ডের বটতলার প্রকাশকরা না থাকতেন। নিজে কুখ্যাতি বরণ করেও ড্যান্টার সেযুগে সেক্সপিয়রের মতন মহাকবির সুখ্যাতির পথ সুগম করেছিলেন। এর চেয়ে মহত্তর কর্তব্য প্রকাশকের আর কি থাকতে পারে?

শুধু ড্যান্টার নন সেক্সপিয়রের প্রকাশকদের মধ্যে অনেকেই ড্যান্টারের সমগোত্র ছিলেন। ড্যান্টরকে রঙ্গনাট্যে কুৎসিতরূপে চিত্রিত করা হয়েছিল। দি রিটার্ন ফ্রম পার্ণাসাস নাটকে দেখা যায়, সেন্ট পল গির্জা প্রাঙ্গণে ড্যান্টার একখানি অশ্লীল বই প্রকাশ করা সম্পর্কে ইনজেনিওসো নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ইনজেনিওসো বইখানির পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে ড্যান্টারকে নগদ দক্ষিণায় গছিয়ে দিতে এসেছেন। ইংরেজি কথোপকথনের মর্মানুবাদ করে দিচ্ছি বাংলায়—

ইনজেনিওসো : খুব ভালো একখানা বই এনেছি ড্যান্টার। ছাপলেই একেবারে বাজার মাৎ হয়ে যাবে। বুঝলে? এতদিন যেসব বই ছেপেছ, সব কানা হয়ে যাবে।

ড্যান্টার : তাই নাকি? কিন্তু তোমার আগের বইটা ছেপে আমার লোকসান হয়ে গেছে। ছাপতে বিশেষ ভরসা হয় না আর, যদি অল্পেস্বল্পে দাও তো দেখতে পারি। গোটা চল্লিশ শিলিং নগদ পাবে, আর এক বোতল মদ। দেখ, রাজি আছ?

ইনজেনিওসো : চল্লিশ শিলিং মাত্র? বলছ কী? কিছু বেশি দাও, অন্তত একটা নতুন ‘সুট’ কিনতে পারি যাতে।

ড্যান্টার : বইখানা কী?

ইনজেনিওসো : ”এ ক্রণিকেল অফ কেম্ব্রিজ কাকোল্ডস।”

ড্যান্টার : বেশ, বেশ! তাহলে রাজি আছি ছাপতে। যা চাও তুমি, তাই দেব। চলো, একটু বসে মদ্যপান করতে করতে কথাবার্তা বলা যাবে। চলো, চলো!

ইনজেনিওসো : চলো, মদে আপত্তি নেই—

ড্যান্টারকে এইভাবে সমসাময়িক সাহিত্যে চিত্রিত করা হয়েছে। কে বলবে এই ড্যান্টারই সেক্সপিয়রের আদি প্রকাশক ছিলেন?

তখনকার কালের অন্যান্য লেখকদের মতন বই ছাপা সম্বন্ধে সেক্সপিয়রেরও যথেষ্ট আভিজাত্যবোধ ছিল। ছাপিয়ে বই প্রকাশ করা সম্বন্ধে তিনি খুব সচেতন ছিলেন না। তা ছাড়া, প্রথমে তিনি কবি বলেই পরিচিত ছিলেন। নাটকের আগে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ছাপা হয়। ভেনাস এ্যান্ড এডোনিস ছাপা হয় ১৫৯৩ সালে। নাটক লেখার সময় রঙ্গমঞ্চের পরিচালকরাই তার স্বত্বাধিকারী হতেন। কারণ নাটক অভিনয় করার জন্যই প্রধানত লেখা হত এবং তার জন্য মঞ্চাধ্যক্ষদের দ্বারস্থ হতে হত সর্বাগ্রে, প্রকাশকদের নয়। একই নাটক মঞ্চাধ্যক্ষ ও প্রকাশক উভয়ের কাছে বিক্রি করা সম্ভব হত না, কেউ করতে সাহসও পেতেন না। করবার রীতিও ছিল না। তাহলে ড্যান্টারের মতন প্রকাশকরা নাটক ছাপতেন কী দেখে এবং কী ভাবে? চুরি করে, গোপনে। চুরি করে লুকিয়ে হয়তো নাটক বা যে—কোনো বই ছাপানো সম্ভবপর, কিন্তু ‘কপি’ কোথা থেকে পাওয়া যাবে? নাটক অভিনয় হত রঙ্গালয়ে, দর্শকরা দেখতে ও শুনতে যেতেন। পাইরেট প্রকাশকরা ‘কপি’ সংগ্রহ করার এক অভিনব পরিকল্পনা করেন। দর্শকের টিকিট কেটে স্টেনোগ্রাফার পাঠিয়ে তাঁরা অভিনয়কালে নাটক লিখিয়ে নেবার বন্দোবস্ত করেন। পাত্রপাত্রীরা যখন অভিনয় করতেন, প্রকাশকের স্টেনোগ্রাফাররা তখন তাঁদের কথোপকথন, দৃশবর্ণনা সব লিখে নিতেন। এইভাবে লেখক নাট্যকার ও মঞ্চাধ্যক্ষের অগোচরে ও অজ্ঞাতে নাটকের কবি সংগ্রহ করা শেষ হত। ভুলভ্রান্তি যাই থাকুক, সেই কপি থেকেই প্রকাশকরা বই ছাপতেন। এইভাবে কপি সংগ্রহের পদ্ধতি সম্বন্ধে নাট্যকার হেউড (Heywood) তাঁর কুইন এলিজাবেথ নাটকের প্রস্তাবনায় বলেছেন :

“That some by stenography drew
The plot : put it in print :
 Scarce one word trew”

সেক্সপিয়রের রোমিও জুলিয়েট নাটক ড্যান্টার এইভাবে কপি সংগ্রহ করে ছেপেছিলেন। পরে আর্থার জনসনও ঠিক ওই একই পদ্ধতিতে দি মেরী ওয়াইভস অফ উইন্ডসর ছাপেন (১৬০২ সালে)।* এ সব নিয়ে প্রতিবাদ করতে লেখকদের আত্মমর্যাদায় বাধত তখন। সেক্সপিয়রও প্রতিবাদ করেননি। পাইরেট প্রকাশকরা তার সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাতে সাহিত্যের কল্যাণ কি অকল্যাণ হয়েছিল, এককথায় বলা যায় না। মনে হয় কল্যাণই হয়েছিল।

…….

* প্রকাশনার সময়কাল দেওয়া আছে ১৬১৯। পাইরেট সংস্করণ। বইটি প্রকাশিত হয় ১৬০২ সালে।

জনসনের যুগ

অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রকাশকরা সাবালক হয়ে ওঠেন। তার আগে পর্যন্ত তাঁরা নাবালক ছিলেন বললে ভুল হয় না, কারণ সাহিত্যের মধ্যযুগীয় পেট্রনরা তখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকাশকদের উপর কর্তৃত্ব করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সাহিত্যের সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর বিকাশ হয় এবং পাঠকরাই ক্রমে লেখক ও প্রকাশকদের পেট্রন হয়ে ওঠেন। প্রকাশকরা আত্মনির্ভর হয়ে পেট্রনদের প্রভাবমুক্ত হন এবং লেখকরাও ক্রমে তাঁদের রুজিরোজগারের ব্যাপারে প্রকাশকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন।

পেট্রন—প্রভাবমুক্ত প্রকাশক ও পাঠকগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে অলিভার গোল্ডস্মিথ এই সময় লেখেন :

“At present the few poets of England no longer depend on the great Patrons for subsistence; they have now no other patrons than the public.”

ফ্রাঙ্ক মাম্বি কবি গোল্ডস্মিথের এই উক্তিপ্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : “And the publisher, at the same time, had superseded the patron as the author’s paymaster.” অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সত্যিকার প্রকাশকদের আবির্ভাব হল সাহিত্যক্ষেত্রে। এই সময় থেকেই পেট্রনরা একরকম বিদায় নিলেন। সাধারণ পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হল এবং তাঁরাই প্রকাশক ও লেখকদের পেট্রন হলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়াতে বইয়ের ব্যবসায়ে একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। লাইসেন্স—প্রথা একরকম বাতিল হয়ে যাবার ফলে বইয়ের বাজারে মন্দা আসে। স্টেশনার্স রেজিস্টারে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়, বইয়ের বাজারে কতখানি মন্দা এসেছিল—

১৭০১ সাল : … … ৩ খানা বই

১৭০২ সাল : … … ২ খানা বই

১৭০৩ সাল : … … ৪ খানা বই

১৭০৪ সাল : … … ৫ খানা বই

১৭০৫ সাল : … … ৫ খানা বই

১৭০৬ সাল : … … ২ খানা বই

১৭০৭ সাল : … … ৩ খানা বই

১৭০৮ সাল : … … ২ খানা বই

লন্ডনের প্রকাশক ও বই—ব্যবসায়ীরা তাঁদের স্বার্থরক্ষার অন্য কোনো উপায় না দেখে ১৭০৩ সালে একবার, ১৭০৬ সালে দ্বিতীয়বার এবং ১৭০৯ সালে তৃতীয়বার পার্লামেন্টে আবেদন করেন লাইসেন্স অ্যাক্ট—এর জন্য। তৃতীয়বার তাঁদের আবেদনের ফলে রাণী এ্যানের বিখ্যাত কপিরাইট অ্যাক্ট (Copyright Act) ১৭০৯ সালে সর্বপ্রথম পাশ করা হয়। সাহিত্য—জগতে এই সর্বপ্রথম কপিরাইট আইন পাশ করা হল। লেখক বা প্রকাশকদের কী সুবিধা হল, না হল সেটা বড় কথা নয়। একটা বিশৃঙ্খলা অবস্থাকে মোটামুটি বিধিবদ্ধ শৃঙ্খলার মধ্যে আনবার চেষ্টা করা হল। তার আগে লেখক বা প্রকাশকের বিশেষ কোনো বিধিসম্মত পদমর্যাদাই ছিল না। অন্যান্য ব্যবসার মতন বইয়ের ব্যবসাও চলত এবং প্রকাশক ও লেখকের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্পর্ক। প্রকাশকরা ছিলেন ক্রেতা আর লেখকরা ছিলেন বই বা পাণ্ডুলিপির বিক্রেতা। কপিরাইট আইনে লেখক প্রথমে লেখকের মর্যাদা পেলেন এবং প্রকাশক প্রকাশকের। লেখক হয়তো লাভবান হননি, তাঁর স্বার্থের ক্ষতিই হয়েছিল। তবু লেখক যে কেবল পাণ্ডুলিপির ফিরিওয়ালা নন এবং পাণ্ডুলিপিটা যে রুটি—মাখনের মতন কোনো জিনিস নয়, একথা কপিরাইট আইনে প্রথম বুঝিয়ে দেওয়া হল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বইপ্রকাশের চেষ্টা করা হয় প্রথম। প্রত্যেকটি বইয়ের জন্য ‘শেয়ার’ বিক্রি করা হত এবং নিজেদের শেয়ার অনুযায়ী অংশীদাররাও প্রকাশের জন্য মূলধন যোগাতেন। বই প্রকাশিত হবার পর যা খরচ পড়ত, সেই দামে অংশীদারদের নিয়োজিত মূলধন অনুযায়ী বই দিয়ে দেওয়া হত। এইভাবে জনসনের “Lives of the Poets” প্রথম প্রকাশিত হয়। চ্যাপটার কফিহাউস নামে একটি সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের ক্লাব থেকে এই কো—অপারেটিভ প্রকাশনের পরিকল্পনা হয় বলে, এই পদ্ধতিতে প্রকাশিত বইগুলিকে “Chapter Books” বলা হত। পরবর্তীকালের “Trade Books”—এর ইতিহাসও তাই।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বইয়ের ব্যবসায়ের ক্রমিক অগ্রগতির ফলে বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের বিভিন্ন ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। এক—একটি অঞ্চলে এক—এক বিষয়ের গ্রন্থ—ব্যবসায়ী কেন্দ্রীভূত হতে থাকেন। যেমন সমস্ত ভাষার প্রাচীন গ্রন্থাদির ব্যবসাকেন্দ্র হয় লিটল ব্রিটেন ও পেটারনস্টার রো; ক্লাসিক ও ধর্মগ্রন্থের কেন্দ্র হয় সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল; আইন, ইতিহাস ও নাট্যগ্রন্থের কেন্দ্র হয় টেম্পল বার; এবং স্ট্রান্ডে ফরাসি ব্যবসায়ীরা দোকান খোলেন। কতকটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের ব্যবসাবাণিজ্যের আঞ্চলিক সমৃদ্ধির মতন সাহিত্যক্ষেত্রেও গ্রন্থব্যবসায়ের বিকাশ হতে থাকে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দেখা যায়, দুই শ্রেণিরই প্রকাশক ছিলেন ইংলণ্ডে। একশ্রেণির প্রকাশক পূর্বোক্ত পাইরেট প্রকাশকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছিলেন। তাঁদের বিবেক বা বিবেচনা বলে কোনো পদার্থ ছিল না, সাহিত্যানুরাগও বিশেষ ছিল না। দু—একজন ড্যান্টার দৈবাৎ সেক্সপিয়রের মতন প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রকাশক হয়ে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। কিন্তু সাধারণত সাহিত্যিকরা এই শ্রেণির প্রকাশকদের কি চোখে দেখতেন তার আভাষ পাওয়া যায় অ্যাডিসনের (Addison) কঠোর মন্তব্য থেকে। অ্যাডিসন বলেছেন :

“They were the set of wretches we authors call pirates who pirnt any book, poem or sermon as soon as it appears in the world, in smaller volume, and sell it, as all other thieves do stolen goods, at a cheaper rate.” (Addison : Tatler)

অন্য আর একশ্রেণির প্রকাশক ছিলেন জেকব টনসন ও বার্নাড লিনটটের মতন (আগে এঁদের কথা বলেছি), যাঁদের শ্রদ্ধা ছিল সাহিত্যিকদের প্রতি এবং বইয়ের ব্যবসাকে যাঁরা অন্য চোখে দেখতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আরও কয়েকজন বিখ্যাত প্রকাশকের আবির্ভাব হয়, যাঁরা সাহিত্য ভালোবাসতেন এবং সাহিত্যিকদের প্রতি যাঁদের শ্রদ্ধাও ছিল যথেষ্ট। এই প্রকাশকদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে রবার্ট ডডসলের (Robert Dodsley) নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

বড়োলোকের বাড়ির একজন নগণ্য ভৃত্য ছিলেন ডডসলে। লর্ড—লেডি যখন কৌচগাড়িতে বেড়াতে বেরুতেন তখন তিনি তাঁদের গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দৌড়তেন। বাড়ি ফিরে আস্তাবলের ঘোড়া ও গাড়ির সেবাযত্ন করে তাঁর দিন কাটত। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সাহিত্য—প্রীতি ছিল এবং কবিতা লিখতেন তিনি লুকিয়ে। আস্তাবলে বসে তিনি যে কাব্যরচনা করেন তা ১৭২৯ সালে “Servitude” নামে এবং ১৭৩২ সালে “The Footman’s Miscellany” নামে প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশিত হবার পর সমসাময়িক লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনেক সাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হবার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়। যাঁদের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় তাঁদের মধ্যে ডানিয়েল ডিফো (Daniel Defoe) ও আলেকাজান্ডার পোপ (Alexander Pope) অন্যতম। ডিফোর বয়স তখন ৬৮ বছর। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ডডসলের কবিতা সংশোধন করে দিতেন এবং তাঁকে উৎসাহ দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। নিজের লেখা বই থেকে কিছু টাকা সঞ্চয় করে এবং সহানুভূতিশীল সাহিত্যিকদের কাছ থেকে সামান্য সাহায্য নিয়ে ডডসলেকে টাকা দিয়ে প্রথমে সাহায্য করেন, তাঁদের মধ্যে পোপ একজন। ১৭৩৫ সালে ডডসলে প্রকাশকের ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং পলমলে তাঁর দোকান খোলেন। পলমলে ডডসলের এই বইয়ের দোকান অল্পদিনের মধ্যেই সমসাময়িক সাহিত্যিকদের আড্ডার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। প্রকাশক হিসেবে লেখকদের সঙ্গে ডডসলের যে কোনোদিন কোনো কারণে মতান্তর ও মনান্তর হয়নি, তা নয়। অনেকবার হয়েছে, কিন্তু তবু তখনকার অন্যান্য প্রকাশকদের সঙ্গে তার তুলনা করা যায় না। নিজে সাহিত্যিক হওয়ার জন্য ডডসলের যে সাহিত্য—প্রীতি ছিল তা খাঁটি, তার মধ্যে ব্যবসায়ীর চাল বা ভেজাল ছিল না। লেখকদের সঙ্গে ব্যবসা সম্পর্কে মতান্তর হলেও, তিনি কোনোদিন গভীর মনান্তরে তা পরিণত হতে দেননি। ডডসলের বিশেষ বন্ধু ছিলেন হোরেস ওয়ালপোল (Horace Walpole)। একবার জর্জ মন্টেগুকে একটি চিঠিতে ওয়ালপোল লিখেছিলেন ডডসলে সম্বন্ধে : “You know how decent, humble, inoffensive a creature Dodsley is; how little apt to forget or disguise his having been a footman.” সত্যিই তাই। এইজন্যই ডডসলের চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রবীণ ও নবীন, সকল শ্রেণির সাহিত্যিক তাঁর কাছে যেতেন। রীতিমতো সাহিত্যিকদের সমাবেশ হত তাঁর বইয়ের দোকানে। এইরকম সমাবেশে ডক্টর স্যামুয়েল জনসনও তখন যাতায়াত করতেন। কেউ তখন তাঁর নাম জানত না। বড় বড় সাহিত্যিকদের আড্ডা হত ডডসলের দোকানে। জনসন তাতে যোগ দিতেন, রঙ্গরসিকতা করতেন, টিপ্পুনি কাটতেন। জনসন নিজে ছিলেন পুস্তক—ব্যবসায়ীর সন্তান। তিনি জানতেন, বইয়ের ব্যবসায় দায়িত্ব কতখানি। তাই তাঁর ”লন্ডন’ রচনাটি নিয়ে তিনি ছদ্মবেশে ডডসলের কাছে প্রথমে যান, নিজের পরিচয় দেননি। ডডসলে যখন রচনাটির বিলক্ষণ তারিফ করেন এবং খুশি হয়ে প্রকাশ করতে রাজি হন, তখন জনসনের আনন্দের আর সীমা রইল না। যাঁর কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে তিনি ডডসলের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁকে তিনি জানালেন—

“I was today with Mr. Dodsley, who declares very warmly in favour of the paper you sent him, which he desires to have a share in…”

ডক্টর জনসনের ”লন্ডন” প্রকাশ করে ডডসলে লাভবানই হয়েছিলেন। তারপর আর ন’ দশ বছরের মধ্যে তিনি জনসনের কোনো বই প্রকাশ করেননি। ডডসলের পরবর্তী কীর্তি হল জনসনকে দিয়ে ডিকশনারি লেখানো। বসওয়েল (Boswell) লিখেছেন যে, ডডসলে ১৫৭৫ পাউন্ড দিয়ে জনসনের সঙ্গে ”ডিকশনারির” চুক্তি করেন। কিন্তু ১৫৭৫ পাউন্ডও অভিধান রচনা শেষ হবার আগে জনসন খরচ করে ফেলেন। একবার বসওয়েল এ সম্বন্ধে ডা. জনসনকে বলেন—

“I am sorry, sir, you did not get more for your Dictionary.”

উত্তরে জনসন বলেন—

“I am sorry too. But it was very well. The book-sellers are generous, liberal-minded men.”

বসওয়েল লিখেছেন যে ডক্টর জনসনের যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল প্রকাশকদের উপর। নিজে পুস্তক—ব্যবসায়ীর পুত্র বলে নয়, ডডসলের মতন শ্রদ্ধেয় প্রকাশকদের সংস্পর্শে আসার জন্য তাঁর মনে এ ধারণা হয়েছিল। বসওয়েল বলেছেন জনসন সম্বন্ধে :

“He considered them (প্রকাশকদের) as the patrons of literature; and indeed, although they have eventually been considerable gainers by his ‘Dictionary’, it is to them that we owe its having been undertaken and carried through at the risk of great expense…”

ডিকশনারি ছাড়াও ডডসলে ডক্টর জনসনের অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন। প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি করার সময় জনসন একটি বিচিত্র শর্ত সবসময় করে নিতেন চুক্তিপত্রে। তাঁর গ্রন্থের অন্তত একটি সংস্করণ প্রকাশের অধিকার তাঁর নিজের থাকবে এবং তিনি যে—কোনো সময় তা প্রকাশ করতে পারবেন। এ সম্বন্ধে বসওয়েল মন্তব্য করেছেন যে, জনসনের ইচ্ছা ছিল, তাঁর সমস্ত গ্রন্থের একটি সংস্করণ নিজে প্রকাশ করে তার সম্পূর্ণ মুনাফাটি তিনি ভোগ করেন :

“It being his fixed intention to publish at some period, for his own profit, a complete collection of his works.’’

ডক্টর জনসনের গ্রন্থাবলি ছাড়াও ডডসলে অন্যান্য আরও অনেক মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে গ্রে’র “Elegy”, স্টার্নের (Sterne) “Tristram Shandy” ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া ডডসলে সম্পূর্ণ একা পরিশ্রম করে দ্বাদশ খণ্ডে ইংরেজি “Old plays” এবং তিনখণ্ডে “Poems by Several Hands” প্রকাশ করেন। তিনি নিজেই এই পনের খণ্ড বই সম্পাদন করে প্রকাশ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে কেবল ডক্টর জনসনের অন্যতম প্রধান প্রকাশক হিসেবে নয়, এই কয়েক খণ্ড গ্রন্থের জন্যও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রকাশক যে সাহিত্যের উন্নতিসাধন কতখানি করতে পারেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ প্রকাশক ডডসলে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।*

……..

* ডক্টর জনসনের যুগ সম্বন্ধে বিখ্যাত ঐতিহাসিক G.M. Trevelyan—এর English Social History (1948, London) গ্রন্থের একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অধ্যায় (Dr. Johnson’s England, I, II & III) এবং A.S. Turberville—এ সম্পাদিত Johnson’s England. An Account of the Life and Manners of his Age গ্রন্থ (দুইখণ্ড) পঠিতব্য। সাহিত্যের ইতিহাসের অনেক মূল্যবান সামাজিক উপকরণ এই বইগুলিতে আছে।

একটা যুগ শেষ হল

ডক্টর জনসনের যুগের পর বইয়ের ইতিহাসের একটা যুগ শেষ হয়ে গেল বলা চলে। ভালো—মন্দ মিশিয়ে একটা যুগ। পাইরেট প্রকাশকের যুগ, উদার সাহিত্যানুরাগী প্রকাশকের যুগ। ড্যান্টার ও ডডসলের যুগ। ১৭৮৪ সালে ডক্টর জনসন যখন মারা গেলেন তখন একটা মন্দের ভালো যুগও অস্তাচলে গেল। মারি, কনস্টেবল, লংমান প্রভৃতি বড় বড় প্রকাশকদের যুগ হল ঊনবিংশ শতাব্দী। মধ্যে কিছু দিন আবার সেই মন্দার ইতিহাস।

বইয়ের জগতে লংম্যানরা (Longmans) তখনও প্রায় শিক্ষানবিশী করছেন। দ্বিতীয় জন মারে (John Murray), যিনি মারিদের গৌরব, তখন মাত্র ছ—বছরের শিশু, ব্যবসায়ের কিছুই জানেন না ও বোঝেন না। কবি বাইরন তখনও জন্মাননি। কনস্টেবল (Archibald Constable) হয়তো তখন মারির চেয়ে বছর চারেকের বড় হবেন। একজন কবি শুধু দূরে পাহাড়ের কোলে বসে জীবনের কি গভীর তাৎপর্যের হদিশ পেয়েছিলেন, তা তিনিই জানেন। নিজেরই কল্পিত যন্ত্রণায় তিনি অস্বস্তি বোধ করছিলেন। প্রকাশকের সঙ্গে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করছিলেন, কবিখ্যাতি অর্জন করার জন্য নয়, বাইরে কোথাও চলে যাবার জন্য। প্রকাশক যদি সামান্য কিছু দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করেন, তাহলে তিনিও ভাগ্যের অন্বেষণে কোথাও বিদায় হতে পারেন, এই মনে করে কথাবার্তা চলছিল কবির সঙ্গে প্রকাশকের। প্রকাশক হলেন জন উইলসন (John Wilson), কবি হলেন রবার্ট বার্নস (Robert Burns)। কবি বার্নস মনস্থ করেছিলেন, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে তিনি যা দক্ষিণা পাবেন, তাই নিয়ে বুককিপারের চাকরি করতে চলে যাবেন। ১৮৭৬ সালে, তিন শিলিং করে চাঁদা নিয়ে তাঁর বই ছেপে বাজারে বেরুল। রবার্ট বার্নসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণ। এ—বইয়ের একখানা কপিও আজও পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করতে পারেননি। বার্নসের ‘কটেজ মিউজিয়ামের’ (Cottage Museum) জন্য ট্রাস্টিরা একটি কপি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছিলেন, এক হাজার পাউন্ড মূল্য দিয়ে। আর একটি কপি ভাগ্যবান কোনো ব্যক্তি ১৯২৫ সালে কিনেছিলেন ১৭৫০ পাউন্ড মূল্যে। প্রথম বইখানি ৬০০ কবি ছাপা হয়েছিল এবং খরচ—খরচা বাদ দিয়ে বার্নস পেয়েছিলেন কুড়ি পাউন্ড। তাতেই তিনি খুশি হয়েছিলেন। পরে তিনি এসম্বন্ধে লিখেছিলেন :

“I threw off six hundred copies for which I got subscriptions for about three hundred and fifty. My vanity was highly gratified by the reception I met with from the public; and besides I pocketed, all expenses deducted, nearly twenty pounds. This came very reasonably, as I was thinking of indenting myself, for want of money to procure my passage. As soon as I was master of nine guineas, the price of wafting me to the torrid zone, I took a steerage passage in the first ship that was to sail from the Clyde; for

 Hungry ruin had me

 in the wind.”

নয় গিনি পকেটে নিয়ে, কবিতা বেচে, বার্নস সাগর পাড়ি দিলেন। কিসের সন্ধানে? কাব্যের প্রেরণার সন্ধানে নয়, জীবিকার অন্বেষণে। এডিনবরায় গিয়ে বার্নস ‘literary lion of the day’ হলেন বটে, কিন্তু তাতে তাঁর ভাগ্য বিশেষ সুপ্রসন্ন হল না। তাঁর কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণ শেষ হবার পর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য তিনি যখন তাঁর প্রকাশক উইলসনকে অনুরোধ করলেন, তখন উইলসন তা পরোক্ষে প্রত্যাখ্যান করলেন। পরোক্ষে বলার কারণ, উইলসন বললেন যে, কবি বার্নস যদি তাঁর বইয়ের জন্য কাগজ কিনে দেন তাহলে কষ্ট করে ছেপে দেওয়ার দায়িত্ব তিনি নিতে পারেন। বার্নসের টাকা ছিল না কাগজ কিনে দেওয়ার মতন। স্কটল্যান্ডের অন্য একজন প্রকাশক উইলিয়াম ক্রিচ (William Creech) রাজি হলেন বই ছাপতে, কিন্তু তাও চাঁদা তুলে। স্কটিশ অভিজাতশ্রেণির উপর বার্নসের প্রভাব ছিল যথেষ্ট। বড় বড় লর্ডরা তাঁকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হলেন। লর্ড এগলিটন (আর্চিবল্ড মন্টগেমারি) নিজে বিয়াল্লিশ কপি বই কিনতে স্বীকৃত হলেন। প্রকাশকের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বার্নস বন্ধুবান্ধবদের কাছে অনেক চিঠিপত্র লিখেছিলেন এই সময়। অবশেষে তিনি বইখানার লভ্যাংশ থেকে যখন ৫০০ পাউন্ড পান তখন খুশি হন মোটামুটি।

সারাজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে বার্নসকে। দারিদ্র্যের পীড়ন যত বেড়েছে, তত তাঁর জিদও বেড়েছে। দেশবাসী বা প্রকাশক কেউ তাঁর বিরাট প্রতিভার বিশেষ সমাদর করেননি সেদিন। শেষে স্কটল্যান্ডবাসী তাঁর পরিবার—পরিজনের জন্য ৭০০ পাউন্ড চাঁদা তুলে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এইটাই তাঁদের ঔদাসীন্যের একমাত্র সান্ত্বনা ও ক্ষতিপূরণ। তাঁর কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৮০০ সালে তিনি ১৪০০ পাউন্ড পান।

বার্নস ছাড়াও আরও একজন কবি এই সময় তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটা দিন প্রকাশের সন্ধানে কাটাচ্ছিলেন। তিনি উইলিয়াম কাউপার (William Cowper)। খ্যাতনামা প্রকাশক জোসেফ জনসন ছিলেন কুপারের প্রকাশক। বার্নসের মতন কুপারের অদৃষ্ট অতটা মন্দ ছিল না। প্রকাশকের কাছ থেকে তিনি ততটা দুর্ব্যবহার পাননি, যতটা বার্নস পেয়েছিলেন। লেডি হেসকেথ (Lady Hesketh) একখানি পত্রে কুপার লিখেছিলেন—

“Johnson behaves very handsomely in the affairs of my two volumes. He acts with a liberality not often found in person of his occupation, and to mention it when occasion calls me to it is a justice due to him.”

সাহিত্যিক ও কবিমাত্রই একটু বেশি ভাবপ্রবণ। তাই সামান্য উপকৃত হলেই উচ্ছ্বাসের টানে তাঁরা অনেক কথা বলে ফেলেন। কুপারও তাই বলেছেন। তাই দিয়ে প্রকাশকের চরিত্র সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। জনসন বাজারের অনেক প্রকাশকের চেয়ে হয়তো সৎ ও উদার ছিলেন। তবে তার জন্য কুপারের স্তুতি তাঁর প্রাপ্য কি না বলা যায় না। স্তুতি উচ্চারিত হবার পর অল্পদিনের মধ্যেই এই জনসনের সঙ্গে কুপারের বিরোধ বাধল হোমারের অনুবাদ নিয়ে। তারপর ওই মহিলাকেই তিনি আবার জনসন সম্বন্ধে যা লেখেন, তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। কুপার লেখেন :

“I am not much better pleased with the dealers in authors than yourself… It would be calling Johnson a knave, and telling the public that I think him one. Now, though I do not perhaps think so highly of his liberality… as I was once… disposed to think, yet I have no reason at present to charge him with dishonesty… if I wronged, must comfort myself with dishonesty… if I am wronged, must comfort myself with what somebody has said–– that authors are the natural prey of booksellers.”

কুপার অবশ্য পরে পোপের মতন টাকা—পয়সা ও নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে খুব বেশি মাত্রায় সজাগ হয়েছিলেন। সুতরাং গোড়াতে যে—দৃষ্টিতে তিনি তাঁর প্রকাশককে দেখতেন, পরে আর তা দেখতেন না। জনসন সম্বন্ধে তাঁর শ্রদ্ধাও তেমন ছিল না পরে। জনসন হয়তো বিরাট আদর্শ—পুরুষ ছিলেন না ঠিকই। প্রকাশক হিসেবেও তিনি যে খুব উদার, মহানুভব ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন তা নয়। প্রধানত তিনি ব্যবসায়ীই ছিলেন। কিন্তু তাহলেও প্রকাশক হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর দান অল্প নয়। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত অনেক লেখকের লেখা তিনি সাহস করে প্রকাশ করেছিলেন তখন, যা অন্য অনেকে করেননি। শুধু যে তিনি বই প্রকাশ করেছিলেন তা নয়, নিজেও তিনি বিপ্লবীদের মতামত পোষণ করতেন। তার জন্য তিনি অনেক কষ্টও সহ্য করেছেন। গিলবার্ট ওয়েকফিল্ডের (Gilbert Wakefield) বই ছেপে জনসন ন’ মাস কারাদণ্ডও ভোগ করেছিলেন। তখনকার দিনে এটা একটা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ ছাড়া, জনসনের সঙ্গে উইলিয়াম ব্লেকের (William Blake) সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য। ব্লেকের The French Revolution বই তিনি প্রকাশ করেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকের আর একটি প্রকাশন—প্রতিষ্ঠানের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য—”ক্যাডেল ও স্ট্রাহান” (Cadell & Strahan)। ক্যাডেল ও স্ট্রাহান দুজনেই জনসনের Lives of the Poets—এর অংশীদার প্রকাশক ছিলেন। পরে তাঁরা দুজন লন্ডনের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় প্রকাশক হয়েছিলেন। হিউম (Hume), গিবন (Gibbon), অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) প্রমুখ বিখ্যাত মনীষীদের বড় বড় গ্রন্থ প্রকাশ করার দায়িত্ব তাঁরাই নিয়েছিলেন। সমগ্র ইংরেজ জাতি সেজন্য আজ তাঁদের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। প্রকাশক হিসেবে তাঁরা যে সুধী—সমাজে কতখানি শ্রদ্ধেয় ছিলেন তা দার্শনিক হিউমের একটি উক্তি থেকেই বোঝা যায়। গিবনের বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ “Decline and Fall of Roman Empire” প্রকাশক হবার পর একটি কপি তাঁরা হিউমকে উপহার দেন। গিবনের বই পেয়ে প্রকাশককে হিউম লেখেন—

“There will be no book of importance now printed in London, but througth your hands and Mr. Cadell’s.”

গিবন, হিউম, এ্যাডাম স্মিথ প্রমুখ মনীষীদের গ্রন্থ প্রকাশ করে ‘ক্যাডেল ও স্ট্রাহান’ অমর হয়ে আছেন। কী রকম ব্যবহার করতেন তাঁরা লেখকদের সঙ্গে, গিবনের একটি দৃষ্টান্ত থেকে তার পরিচয় পাওয়া যাবে। গিবনের ‘Roman Empire’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয় মাত্র একহাজার কপি। অল্পদিনের মধ্যে সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয় দেড় হাজার কপি এবং তৃতীয় সংস্করণ আরও হাজার কপি। এই তৃতীয় সংস্করণের দেনা—পাওনার একটি হিসেব প্রকাশকদের পুরানো হিসেবপত্রের দপ্তরে খুঁজে পাওয়া গেছে। তাই থেকে দেখা যায় যে লেখক অর্থাৎ গিবন নিজে মুনাফার তিনভাগের দুইভাগ নিয়েছিলেন এবং প্রকাশক দু—জন বাকি একভাগ দু—ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। গিবনের Decline & Fall of Roman Empire (প্রথম খণ্ড, ৩য় সং) গ্রন্থের হিসেব এখানে উদ্ধৃত ক—রে দিচ্ছি :

Decline & Fall of Roman Empire

এই হিসাবটি সাহিত্যের ইতিহাসের একটি মূল্যবান ”ডকুমেন্ট” হয়ে আছে। প্রকাশক যে কত উঁচুস্তরের হতে পারেন এটা তার ঐতিহাসিক প্রমাণ। ইতিহাসের বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ লেখক এই মুনাফা ভোগ করছেন এবং প্রকাশকরা বইয়ের লোকপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে বেশি লাভ করতে চাইছেন না। হলেনই বা তিনি গিবন, তাতে ক্ষতি কি? আমাদের দেশে কোনো গিবনের সেরকম সৌভাগ্য হয়নি এবং কবে হবে তারও ঠিক নেই। ক্যাডেল ও স্ট্রাহানের মতন প্রকাশকের ইতিহাস পাঠ করলে বোঝা যায়, ইংরেজ জাতি ও ইংরেজি সাহিত্য অকারণে এত বড় হয়নি। ইংরেজি সাহিত্যের বৈচিত্র্য, ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির প্রধান কারণ, যুগোপযোগী বড় বড় প্রকাশকদের পোষকতা। রাজসভার পোষকতা না পেলে বহু রাজকবির প্রতিভার যেমন অকালমৃত্যু হত, দূরদর্শী ও উদযোগী প্রকাশকদের সহযোগিতা না পেলে তেমনি আধুনিক যুগের ইংরেজি সাহিত্যের অনেক শক্তিশালী সাহিত্যিকের প্রতিভার সম্যক বিকাশ হত না।

স্বর্ণযুগের সূচনা

লেখক ও প্রকাশকের স্বর্ণযুগ বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার’ বাণী নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছিল লেখকদের মনে। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক পুনর্জীবনের মধ্যে সেই নতুন প্রেরণা আত্মপ্রকাশ করেছিল। সেযুগের মুখপত্র ছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, স্কট, বাইরন, শেলী, কীটস। লেখকদের মতন একই বিক্রেতার মতন ফিলিপসও তখনকার দিনে বইপত্রের সঙ্গে পেটেন্ট ওষুধ ও সাহিত্যকে তাঁরা প্রকাশ করে প্রচার করেছিলেন।

মারে (Murray), কনস্টেবল (Constable), লংম্যান (Longman) প্রভৃতি বড় বড় প্রকাশকরা এই সময় বইয়ের জগতে যুগান্তর এনেছিলেন। তাঁদের কথা বলার আগে একজন স্বল্পখ্যাত প্রকাশকের কথা সর্বাগ্রে বলতে হয়, তাঁর নাম রিচার্ড ফিলিপস (Richard Phillips)। অন্যান্য অনেক পুস্তকবিক্রেতার মতন ফিলিপসও তখনকার দিনে বইপত্রের সঙ্গে পেটেন্ট ওষুধ ও নানারকম জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। ব্যবসা ছেড়ে তিনি সাহিত্যের ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হলেন এবং ”লিসেস্টার হেরাল্ড” পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। হোসিয়ারি, পেটেন্ট ওষুধ ও সাহিত্যের ব্যবসায়ী হলেও, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত প্রগতিশীল। বিপ্লবের আদর্শ অনুসরণ করার জন্য তিনি দুঃখও বরণ করেছেন যথেষ্ট। টম পেইনের ‘Rights of Man’ বিক্রি করার জন্য ১৭৯২ সালে তিনি দেড় বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ডা. প্রিষ্টলের সাহায্যে তিনি জেলখানা থেকেই ”হেরাল্ড” পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকেন। পরে ‘মিউজিয়াম’ বলে একটি পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করেন। ভালো ভালো বই সুলভ মূল্যে প্রকাশ করার দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি; কিন্তু প্রকাশক হিসেবে শেষপর্যন্ত তিনি খুব কৃতকার্য হতে পারেননি, তাঁর আদর্শপ্রীতির আতিশয্যের জন্য।

ঊনবিংশ শতাব্দী হল, মারে, লংম্যান ও কনস্টেবলের যুগ। মারে পরিবার প্রায় ত্রিশ বছর আগে থেকেই বইয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল তখন ”ম্যাকমারে” (MacMurry)। পরে তিনি ”ম্যাক” কথাটি বর্জন করে শুধু ‘মারে’ হন এবং নৌ—বিভাগের চাকরি থেকে অর্ধেক বেতনে অবসর গ্রহণ করে ১৭৬৮ সালে ফ্লিট স্ট্রিটে ‘উইলিয়াম স্যান্ডবির’ পুরানো প্রতিষ্ঠানটি কিনে ফেলে ব্যবসা আরম্ভ করেন। নৌ—বিভাগের ‘চলন্ত জাহাজ’ মারে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের প্রতীকরূপে গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাতা মারে ১৭৯৩ সালে যখন মারা যান, তখন তাঁর দোকানের সেলসম্যান স্যামুয়েল হাইলেকে (Samuel Highley) তিনি তাঁর উইলের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করে যান। দ্বিতীয় জন মারে ফ্লিট স্ট্রিটে ব্যবসা আরম্ভ করেন এই অংশীদারকে নিয়ে।

হাইলে বই বিক্রির ব্যাপারেই বেশি উৎসাহী ছিলেন, কারণ অন্যের প্রকাশিত বই বিক্রি করে কমিশন পাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ, তার মধ্যে কোনো দায়িত্ব নেই। দ্বিতীয় জন মারে তখন কিশোর বালক, তাই মনে মনে ইচ্ছা থাকলেও তিনি হাইলের এই গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি। পরে তিনি যখন সাবালক হন, তখন ১৮০১ সালে তিনি এ সম্বন্ধে একজন নাট্যকারকে লিখেছিলেন : “The truth is that during my minority I have been shackled to a drone of a partner.’’

দু—বছর পরে মারের সঙ্গে সেলসম্যান অংশীদার হাইলের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় মারে ছিলেন রোমান্টিক যুগের আদর্শ প্রতিনিধি, অত্যন্ত দুঃসাহসিক ও প্রগতিশীল। তিনি স্বপ্ন দেখতেন যে, ইংলন্ডের আদর্শ শ্রেষ্ঠ প্রকাশক হবেন এবং প্রতিভাবান লেখকরা তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেই পাঠকচিত্তে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন। হাইলের সঙ্গে তাঁর মতভেদ হওয়া খুব স্বাভাবিক। মারে প্রকাশনক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন বিরাট আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। পরে তাঁর উদ্দেশ্য যে কতখানি সার্থক হয় তা বাইরন ও স্কটের মন্তব্য থেকেই যে কেউ বুঝতে পারবেন। মারেদের সম্বন্ধে বাইরন বলেছিলেন—‘Anak of Publishers’ স্কট বলেছিলেন ‘Emperor of the West’। সত্যিই তাই।

লেখক ও প্রকাশকরা শুধু যে লন্ডনেই আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, তা নয়, লন্ডনই অবশ্য প্রধান কেন্দ্র ছিল; কিন্তু এই সময় একজন প্রকাশক অন্তত লন্ডন থেকে অনেক দূরে অন্য একটি কেন্দ্রে সাহিত্যগ্রন্থ প্রকাশের প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আর্চিবল্ড কনস্টেবল (Archibald Constable)। এডিনবরাতে কনস্টেবল ব্যবসা আরম্ভ করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। লন্ডনের একচেটিয়া আধিপত্য তিনিই প্রথম খর্ব করেন। মাম্বি বলেছেন কনস্টেবল সম্বন্ধে : “A man of rare sagacity and enterprise, Constable gauged the public taste to a nicety, and paid generously for his books. Gradually collecting the best authors about him, he raised the prestige of the publishing trade throughout Scotland, and made Edinburgh a centre of scholarship and literature.” ১৮০২ সালে কনস্টেবল ”এডিনবরা রিভিউ” পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন এবং ওয়াল্টার স্কট ও অন্যান্য সাহিত্যিকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা লাভ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্কটের “Sir Tristram” এবং “Lay of the last Minstrel” প্রকাশ করেন। অল্পদিনের মধ্যেই কনস্টেবল লন্ডনের প্রকাশক—মহলেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। লেখক—মহলে তাঁর প্রতিপত্তি সম্বন্ধে সকলেই সজাগ হন। ”এডিনবরা পত্রিকা” বিক্রির জন্য লন্ডনে লংম্যানরা (Longmans) দায়িত্ব নেন। কনস্টেবলের সঙ্গে লংম্যানের একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরে মতভেদের জন্য তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং মারি হন এডিনবরা পত্রিকার লন্ডন প্রকাশক। কিন্তু মারির সঙ্গেও পরে লংম্যানের মনোমালিন্য হয় এবং মারি স্বতন্ত্রভাবে ‘Quarterly’ পত্রিকা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন।

লংম্যানের সঙ্গে কনস্টেবলের যখন ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন টমাস নর্টন লংম্যান ব্যবসায়ের মালিক। তিনি হলেন দ্বিতীয় লংম্যান। ১৭৭৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তৃতীয় লংম্যান প্রতিষ্ঠানের কর্তা হন। এই তৃতীয় টমাস লংম্যানই তাঁদের প্রতিষ্ঠানটির গৌরব বৃদ্ধি করেন। সাহিত্যজগতে যে নতুন আদর্শ ও প্রেরণার সঞ্চার হয় ফরাসি বিপ্লবের পর, তার বিকাশ হয় প্রধানত ইংরেজি রোমান্টিক কাব্যে। লংম্যান সেই কাব্য—সাহিত্য প্রকাশ করে যেমন ইংরেজি সাহিত্যের প্রগতির পথ পরিষ্কার করে দেন, তেমনি কবিদেরও আত্মপ্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করেন। শুধু তাই নয়—ইংলন্ডের পাঠকগোষ্ঠীর মনে তাঁরা নতুন সাহিত্যের রুচি জাগিয়ে তোলেন। শুধু বই প্রকাশ করা নয়, লেখক তৈরি করা এবং সুস্থ রুচিসম্পন্ন পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তোলা যে প্রকাশকদের অন্যতম কর্তব্য, একথা লংম্যান, মারি প্রভৃতি সকলেই জানতেন। প্রকাশকের সেই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করার জন্য তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছেন। বাইরন, স্কট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ সকলের সঙ্গে গভীর সৌহার্দের সম্পর্ক লংম্যানরা স্বচ্ছন্দে স্থাপন করতে পারতেন যদি না তাঁরা “English Bards and Scotch Reviewers” গ্রন্থখানি প্রকাশ করতে গররাজি হতেন। গররাজি হবার কারণ, বইখানির মধ্যে এমন কয়েকজন কবি সম্বন্ধে বাইরন কটু মন্তব্য করেছিলেন, যাঁদের সঙ্গে লংম্যানের সম্পর্ক ছিল। বাইরনের বদলে টম মুরের (Tom Moore)* সঙ্গে লংম্যানের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং মুরের সমস্ত বই লংম্যান প্রকাশ করেন, কেবল ‘বাইরনের জীবনী ছাড়া। মুরের বিখ্যাত “Lalla Rookh” গ্রন্থের জন্য লংম্যান ৩০০০ পাউন্ড অগ্রিম দিয়ে চুক্তি করেন। বই লিখতে মুরের অনেক দেরি হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকাশকরা তাঁকে তার জন্য কোনোদিন বিব্রত করেননি। এ সম্বন্ধে মুর নিজেই মন্তব্য করেছিলেন : “There has seldom occurred any transaction in which trade and poetry have shone so satisfactorily in each other’s eyes”। ব্যবসা ও কবিতার এত সুন্দর যুগপৎ বিকাশ যে সম্ভবপর, মুরও তা কল্পনা করতে পারেননি। তিন হাজার পাউন্ড অগ্রিম দেওয়া এবং দিয়ে ধৈর্য ধরে পাণ্ডুলিপির প্রতীক্ষায় বসে থাকা, কজন প্রকাশকের পক্ষে সম্ভব, ভাববার কথা। সংগতির দিক দিয়ে কেউ কেউ পারলেও, সে রকম মনোবৃত্তি কজনের থাকে? লংম্যানদের ছিল এবং তার জন্যই তাঁরা প্রকাশনক্ষেত্রে অত বড়ো হতে পেরেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত জন মারেদের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মারেরা পরে ফ্লিট স্ট্রিট থেকে আলবার মার্লে স্ট্রিটে চলে গিয়েছিলেন। মারে যৌবনে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে তিনি সার্থক করে তুলেছিলেন প্রকাশক—জীবনে। মারেদের মতন উদারচিত্ত, প্রগতিশীল ও দূরদর্শী প্রকাশক তখনকার দিকে কেউ ছিলেন কি না সন্দেহ। বাইরন স্কট প্রমুখ কবি ও সাহিত্যিকদের জনচিত্তে প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক জন মারে।

১৮১২ সালে মারে বাইরনের ‘চাইল্ড হেরল্ড’ (Childe Harold) প্রকাশ করেন। আলবার স্ট্রিটে তাঁরা যখন উইলিয়াম মিলারের গৃহ কিনে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে সেখানে স্থানান্তরিত করেন, তখন তার ড্রয়িংরুমটিকে তাঁরা সাহিত্যের বিখ্যাত আড্ডাখানা করে তোলেন। তখনকার দিনের অধিকাংশ খ্যাতনামা কবি ও সাহিত্যিকদের আড্ডাখানা ছিল প্রকাশক মারের এই ড্রয়িংরুমটি। সেখানে যাতায়াত ছিল না, এমন কোনো গণ্যমান্য সাহিত্যিক তখন ছিলেন না। বাইরন যেতেন, স্কট যেতেন, সাদে যেতেন ক্যাম্পবেল যেতেন। প্রকাশক মারেও তাঁদের সঙ্গে সাহিত্যের আড্ডায় যোগ দিতেন। এ সম্বন্ধে জন মারে তাঁর এক আত্মীয়কে একবার লিখেছিলেন :

“I am in the habit of seeing persons of the highest rank in literature and talent, such as Canning, Erere, Mackintosh, Southey, Campbell, Walter Scott, Madame Stael, Giffard, Croker, Barrow, Lord Byron and others; thus leading the most delightful life, with means of prosecuting my business is the highest honour and emolument.”

মারের নিজের এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীকে প্রকাশক ও লেখকের সম্পর্ক কত বদলে গিয়েছিল। সাহিত্যকেশরী যিনি, তাঁর পিছনে প্রকাশকরা এখন আর এজেন্টের মতন ঘুরে বেড়ান না। ডা. জনসনের যুগ পর্যন্ত সেইটাই অন্যতম প্রথা ছিল। এখন প্রকাশকদের আত্মমর্যাদাবোধ অনেক বেড়েছে। তাঁরা কেবল ব্যবসায়ী নন, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ও পরিবেশক। প্রকাশক ও লেখকের মর্যাদার কোনো পার্থক্য নেই। লেখক সাহিত্য সৃষ্টি করেন, প্রকাশক তার পোষকতা করেন সব দিক দিয়ে। তিনি সাহিত্যিকের বন্ধু ও সহযাত্রী। এই সহযাত্রিত্বের বোধ, প্রকাশক ও লেখকের মধ্যে আগে ছিল না। তাই প্রকাশকের ড্রয়িংরুমে এখন খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের আনাগোনা করতে বা আড্ডা দিতে বাধা নেই। মাম্বির ভাষায় : “The Publisher’s drawing-room was now the centre of an appreciative crowd of authors.”

ফরাসি বিপ্লবের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও শিল্পবিপ্লবের গতিশীলতা একত্রে যুক্ত হয়ে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানবসমাজে যখন নবজীবনের পথে জয়যাত্রা শুরু হল, তখন তারই পতাকা উড়িয়ে একসঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে লাগলেন লেখক ও প্রকাশক। জ্ঞানরাজ্যের সমস্ত দরজা সর্বসাধারণের সামনে খুলে দেবার ব্রত গ্রহণ করলেন তাঁরা। রাজসভা থেকে এগিয়ে যাবার পথে অনেক চড়াই—উতরাই পার হয়ে, দৃঢ়পদে ও স্থিরচিত্তে তাঁরা জনসভার দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরের সমাজে যেমন, সাহিত্যেরও ইতিহাসেও তেমনি, এক নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা হল।

এই স্বর্ণযুগই হল পাঠকের যুগ। ধীরে ধীরে এই নতুন যুগের বিকাশ হচ্ছে, পৃথিবীর সর্বত্র, এমনকী বাংলাদেশেও। প্রকাশকদের একচ্ছত্র সাহিত্য নিয়ন্ত্রণের যুগ এখনও সম্পূর্ণ শেষ হয়নি অবশ্য। সমাজের গড়ন বদলাবার আগে, তা হওয়াও সম্ভব নয়। তবু তাঁদের সর্বময় কর্তৃত্ব যে যুগ—সচেতন সুরুচিবান পাঠকগোষ্ঠী অনেকটা খর্ব করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই সচেতন পাঠকগোষ্ঠী সাহিত্যক্ষেত্রে যে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করেছেন, সাহিত্যের ইতিহাসে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আজও রুচিবান বিচারশীল পাঠকের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়েনি বলে, সাহিত্যক্ষেত্রে প্রকৃত ডেমক্র্যাটিক স্বর্ণযুগের প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে সূচনা যে হয়েছে এবং সাহিত্যের নিশ্চিত গতি যে সেইদিকে, তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

……..

১. F. Mumby : Publishing and Bookselling : p. 254

* টম মুর নয় থমাস মুর (১৭৭৯—১৮৫২) লর্ড বাইরন (১৭৮৮—১৮২৪) এর সমকালীন কবি। লংম্যান ১৮১৭ সালে ‘লালা রুক’ বইয়ের জন্য ৩ হাজার পাউন্ড সাম্মানিক দিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *