২. রাজসভা থেকে জনসভা

রাজসভা থেকে জনসভা

মুদ্রক, প্রকাশক ও লেখক

প্রথম প্রস্তাব

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাস হল ”পেট্রন ও লেখকের” ইতিহাস। আধুনিক যুগের ইতিহাস হল ”প্রকাশক ও লেখকের” ইতিহাস। মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলেই পেট্রন—যুগের অবসান এবং প্রকাশক—যুগের আবির্ভাব সম্ভব হয়। মুদ্রকই সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগের প্রবর্তন করেন। পেট্রন—যুগে ছিলেন লিপিকার, প্রকাশক—যুগে এলেন মুদ্রক। প্রকাশকের ইতিহাসের সঙ্গে তাই মুদ্রকের কাহিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

সাহিত্যের ইতিহাস আমরা পড়েছি, কিন্তু প্রকাশকের ইতিহাস পড়িনি। সাহিত্যিকের ইতিবৃত্তও জানি, কিন্তু মুদ্রকের কথা কিছুই জানি না। অথচ সাহিত্যের বাস্তব পশ্চাদভূমি হল মুদ্রক ও প্রকাশকদের ইতিহাস। দেহ বাদ দিয়ে যেমন মুণ্ডের ইতিহাস রচনা করা অর্থহীন, প্রকাশককে বাদ দিয়ে তেমনি সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করা যুক্তিহীন। ইতিহাস তাতে সম্পূর্ণ হয় না, তার অঙ্গহানি হয়। মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশের ইতিহাসই প্রধানত মানুষের ইতিহাস, কিন্তু দেহকাণ্ডটিকে বাদ দিয়ে মস্তিষ্কটি স্কন্ধের উপর হঠাৎ বৌদ্ধস্তূপের মতন গজিয়ে ওঠেনি। সাহিত্যের ইতিহাসও তাই। কাব্য, নাটক, উপন্যাসের ইতিহাসই প্রধানত সাহিত্যের ইতিহাস, অন্তত যে—ইতিহাস হঠাৎ আকাশ থেকে রচনা করে যাননি। তাঁরা এই সমাজেই রচনা করেছেন এবং প্রকাশকরা সেই রচনা প্রকাশ করেছেন ও প্রচার করেছেন বলেই সামাজিক জীব হিসেবে পাঠকরা সেগুলি পাঠ করার সুযোগ পেয়েছেন। সুতরাং প্রকাশকের সঙ্গে সাহিত্যের একটা ঘনিষ্ঠ ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। প্রকাশক যে—রচনা নির্বাচন করেছেন, সেই রচনাই পাঠক—সমাজে পরিবেশিত হয়েছে এবং তিনিই লেখক ও সাহিত্যিক বলে পরিচিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তাহলে প্রকাশকের নির্বাচনের, বিচারবুদ্ধির ও রুচির, সহানুভূতির ও পৃষ্ঠপোষকতার যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে সাহিত্যের ইতিহাসে, তা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। প্রকাশকের পোষকতা থেকে বঞ্চিত আধুনিক যুগের কত সাহিত্য—প্রতিভা যে অনাদৃত ও অবজ্ঞাত অবস্থায় অপমৃত্যু বরণ করে নিয়েছে লোক—সমাজের অগোচরে, কোনো স্টাটিস্টিশিয়ান আজ পর্যন্ত তার সংখ্যা গণনা করার প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ খ্যাত—অখ্যাত সকল সাহিত্যিকই হাড়ে—হাড়ে জানেন যে, প্রকাশকের পোষকতা তাঁদের জীবনে কতখানি প্রয়োজন হয়েছে, সেই পোষকতার অভাবে পদে—পদে কত লাঞ্ছনা তাঁরা ভোগ করেছেন এবং তার প্রাচুর্য কীভাবে তাঁদের সাহিত্যিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভে সহায়তা করেছে। তাই যদি হয়, তাহলে প্রকাশককে বাদ দিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস—রচনা সম্পূর্ণ হয় কি করে? দেহ বাদ দিয়ে মুণ্ডের ইতিহাস লেখা হয় না কি তাহলে? সাহিত্যের ধারা সাহিত্যিকরাই সৃষ্টি করেছেন, তাঁরাই তাকে সমৃদ্ধ করেছেন, কিন্তু প্রকাশককে পাশ কাটিয়ে নয়। পাশ কাটাবার কোনো উপায় নেই। সাহিত্যের ধারা প্রকাশকরাও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, বিভিন্ন পথে পরিচালনা করেছেন। সুতরাং সাহিত্যের ইতিহাসে প্রকাশকদের দান আছে। সেই দান অস্বীকার করে সাহিত্যের ইতিহাস লেখা যায় না। সাহিত্যিকরা যদি সাহিত্য সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে আধুনিক যুগে প্রকাশকরা সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যিকদের—একথা বললে বিশেষ ভুল বলা হয় না। প্রকাশকদের ইতিহাস তাই জানা দরকার—সাহিত্যের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে।

প্রকাশকের ইতিহাস জানতে হলে আগে মুদ্রকের ইতিহাস জানা দরকার, কারণ সাহিত্যের ইতিহাসে মুদ্রকের অনুগমন করেছেন প্রকাশক। মুদ্রক না থাকলে, ছাপাখানা না থাকলে প্রকাশকের অস্তিত্ব থাকত না। ”প্রকাশক” কথার অর্থ যিনি প্রকাশ করেন। ইংরেজি ”পাবলিশার” কথার অর্থও তাই, যিনি পাবলিশ করেন। কী প্রকাশ করেন, কী পাবলিশ করেন? লেখকদের লেখা নানা রকমের বই। বই কীভাবে প্রকাশ করা সম্ভবপর? হাতে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ‘প্রকাশ’ করার অর্থও তা নয়। বহু লোকের কাছে প্রকাশ করাই হল প্রকাশকের কাজ। হাতে লিখে কোনো বই বহু লোকের কাছে প্রকাশ করা যায় না। একেবারে যায় না যে তা নয়। দু—দশ পঞ্চাশ কপি হয়তো বা যায়, কিন্তু তাতে প্রকাশ করা বলে না। সুতরাং বই প্রকাশ করার আগে ছাপাখানা চাই, মুদ্রক চাই, তবেই বই প্রকাশ করা এবং প্রকাশক হওয়া সম্ভবপর। প্রকাশকের আগে ছাপাখানা ও মুদ্রক। ছাপাখানা যখন ছিল না তখন প্রকাশক ছিলেন না, পেট্রন ছিলেন। মুদ্রক যখন ছিলেন না, পেশাদার লিপিকর ছিলেন। মধ্যযুগের সায়াহ্নে সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চ থেকে লিপিকর বা ‘কপিস্ট’ বিদায় নিলেন, মুদ্রক আবির্ভূত হলেন। প্রকাশক এলেন প্রায় মুদ্রকের সঙ্গেই। লিপিকরের সঙ্গে তাঁদের পেট্রনরাও বিদায় নিলেন। মধ্যযুগের ইতিহাস—বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মায়ার্স ছাপাখানা ও মুদ্রকের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে বলেছেন—

“The invention of printing meant that there was far more reading matter than there had ever been before, and though it was not at first unorthodox it helped to form a lay public opinion not dependent for its information on the pulpit and cloister… A revolutionary influence in religion and education was the art of printing, which made it possible to multiply books with a speed, an accuracy, and a cheapness hitherto inconceivable.”

ছাপিয়ে প্রকাশ করা যদি ছাপানো হয় (আধুনিক শাড়ি ছাপানোর মতন) তাহলে ছাপানো বইয়ের ইতিহাস ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরম্ভ হয়েছে বলতে হয়। কাঠে খোদাই করা অক্ষরের উপর কালি লাগিয়ে ছাপ দিলেই ছাপানো হতে পারে। কিন্তু এইভাবে ছাপানোর জন্য দুটি জিনিস চাই। প্রথমত চাই কাগজ, দ্বিতীয়ত চাই ছাপার কালি। কাগজ, ছাপার কালি ও প্রিন্টিং কোনোটাই কিন্তু ইয়োরোপে আবিষ্কৃত হয়নি প্রথমে, এশিয়ায় হয়েছে। চীনদেশই এসবের আদি জন্মস্থান। কাগজ তৈরি হয়েছে ১০৫ খ্রিস্টাব্দে, ছাপার কালি হয়েছে ৪০০ খ্রিস্টাব্দে, এবং ছাপা হয়েছে ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে। চীনদেশে হয়েছে, ইংলন্ডে বা জার্মানিতে নয়। চৈনিক তথা এশিয়াটিক সভ্যতা সম্বন্ধে ইয়োরোপের তখন কোনো ধারণাই ছিল না। ইয়োরোপবাসী যে কতখানি অজ্ঞ ছিল তা মার্কো পোলোর কাহিনি থেকেই বোঝা যায়। মার্কো পোলোর বিবরণ কেউ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেননি।

যাইহোক, ইয়োরোপে ছাপাখানা আবিষ্কৃত হয় চীনের ছাপাখানা সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে। ঐতিহাসিকরা অন্তত তাই বলেন। ইয়োরোপীয়রা চীনের ছাপাখানার প্রাচীনত্বের ইতিহাসটুকুও সেদিন পর্যন্ত জানতেন না। কিছু না জেনেই তাঁরা নতুন করে আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কার করেছিলেন। কে করেছিলেন এবং কোথায় করেছিলেন তাই নিয়ে মতভেদ আছে। সাধারণত দুজন ছাপাখানার আবিষ্কর্তা বলে দাবি করেন। একজন কস্টার (Coster), আর একজন গুতেনবার্গ (Gutenberg)। কস্টার হলেন ডাচ, গুতেনবার্গ জার্মান। ঐতিহাসিকরা সাধারণত গুতেনবার্গকেই ছাপাখানার আবিষ্কর্তার সম্মান দিয়ে থাকেন এবং কস্টারের দাবিকে মিথ্যা রূপকথা বলে উপহাস করে থাকেন। কিন্তু হালে কেউ কেউ কস্টারের দাবিকে একেবারে অগ্রাহ্য করতে রাজি নন দেখা যায়। সুতরাং ছাপাখানার আবিষ্কার নিয়ে হল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দ্বন্দ্বের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনোরকম রায় না দিয়েই বলা যায় যে, দু—জনেই ছাপাখানার আবিষ্কর্তা হতে পারেন। আধুনিক অনুসন্ধানের ফলে দেখা গিয়েছে যে, বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হঠাৎ কোনো মহাপুরুষ রাতারাতি করেননি। যা কিছু আবিষ্কার করা হয়েছে, প্রথমে তার একটা সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ও তাগিদ এসেছে মানুষের মধ্যে। সেই সামাজিক তাগিদ সকলে অনুভব করেছেন, অন্তত একাধিক ব্যক্তি যে করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। সেই একাধিক ব্যক্তি প্রত্যেকে তাই নিয়ে চিন্তা করেছেন, অনুসন্ধান করেছেন এবং তারপর হয়তো একাধিক আবিষ্কর্তা যুগপৎ সেটা আবিষ্কার করেছেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে যা আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে তা দুশো বছর আগে সম্ভব হয়নি কেন? তখন করা সম্ভব ছিল না, কারণ তখন বর্তমানের প্রয়োজনবোধ বা তাগিদ ছিল না। সুতরাং আবিষ্কারের আগে সামাজিক প্রয়োজনবোধ ও তাগিদ চাই। তাগিদের চাপে একাধিক ব্যক্তি যুগপৎ কোনো নতুন যন্ত্র বা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেন। ছাপাখানাও হয়তো সেইভাবেই গুতেনবার্গ ও কস্টার যুগপৎ আবিষ্কার করেছিলেন।

কিন্তু আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কারের পিছনে সামাজিক তাগিদটা কী ছিল? সাধারণ মানুষের জ্ঞানার্জন—স্পৃহার তাগিদ। তার আগে ধর্মযাজক, পাদরি, মোল্লা ও পুরোহিতরা সেটা একচেটিয়া করে রেখেছিলেন। ধর্মই অবশ্য তখন জ্ঞানের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু ধর্ম তখন যাজক ও পুরোহিতদের মুখ থেকে শুনে শিখতে হত। কোনো ধর্মগ্রন্থ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের পড়বার অধিকার ছিল না। যাজক ও পুরোহিতদের রক্ষক ও আশ্রয়দাতা পেট্রনরা শুধু পড়বার সুযোগ পেতেন মধ্যে মধ্যে। তবে তাঁদের সেই সুযোগের বিশেষ দরকার হত না, কারণ মধ্যযুগের রাজা—বাদশাহরা নিজেরা বিশেষ ধার্মিক ছিলেন না কেউ এবং ধর্মাচরণ করার জন্য উদগ্রীবও ছিলেন না। ছাপাখানার প্রথম যুগে দেখা যায় যে, ধর্মগ্রন্থই বেশি ছাপা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে ধর্মযাজক, পুরোহিত ও তাঁদের পেট্রনরা ”সর্বনাশ হয়ে গেল” বলে হই—চই করেছেন। সব জেনে ফেলবে লোকে, এই হল তাঁদের আতঙ্ক। এতদিন হাতে—লেখা পুঁথির পাতায় বাইবেল, বেদ—উপনিষদ গীতা, কোরাণের বাণী বন্দি হয়েছিল। লিপিকররা নিভৃতে পুরোহিতের বা পেট্রনের পক্ষপুটে বসে সেগুলি কপি করতেন এবং পুঁথির মালিকরা সেইসব পুঁথি চালের বাতায়, সিন্দুকে, মন্দিরে, গির্জায় ও মসজিদের কোণে লুকিয়ে রাখতেন। বাইবেলের ব্যাখ্যা যাজকে যা করতেন তাই অভ্রান্ত বলে মেনে নিতে হত। ”সকলের পিতা যীশু” কী বলেছেন না বলেছেন তা বাইবেল পাঠ করে জানবার উপায় ছিল না। মোল্লার মুখেই আল্লার বাণী শুনে নাচতে হত। ”সবই ব্যাদে আছে” বলে পুরোহিতরা যা ব্যাখ্যা করতেন তাই ভক্তিভরে কানে শুনে ঘরে ফিরতে হত। ”গীতার” ব্যাখ্যা বা টীকা করারও অধিকার ছিল না কারও।

পেট্রন ও পুরোহিত—যাজক—মোল্লা শ্রেণির এই মনোপলির বিরুদ্ধে বৃহত্তর লোকসমাজে একটা বিক্ষোভ অনেককাল ধরে যে ধূমায়িত হচ্ছিল তাতে সন্দেহ নেই। সাধারণ মানুষ একটা নিদারুণ অভাব মর্মে মর্মে অনুভব করছিলেন। জ্ঞানার্জনের সুযোগের অভাব। লিপিকরের লেখা পুঁথিতে সেই অভাব কোনোমতেই মিটছিল না। একখানি আসল পুঁথির কত কপি কতজন লিপিকর দিয়ে নকল করানো সম্ভবপর, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রত্যেক পাঠক যদি লিপিকর হন নিজে, তাহলে তাঁর নিজের লেখা পুঁথি তিনি নিজে পাঠ করার সুযোগ পেতে পারেন। সুতরাং মুদ্রক ও ছাপাখানা ছাড়া সত্যকারের জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। মুদ্রকই জ্ঞানের অধিকার ও শিক্ষার অধিকার সর্বসাধারণের অধিকারে পরিণত করলেন। শত শত, হাজার হাজার বই ছেপে প্রকাশ করে অনেক অল্প মূল্যে সাধারণ লোকের মধ্যে প্রচার করা ও পরিবেশন করা হল। গির্জার গণ্ডী থেকে, মসজিদের কার্ণিস থেকে, মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে হাতে—লেখা পুঁথি কারামুক্ত হয়ে যখন মুদ্রিত পুস্তকে পরিণত হল, তখন এক বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটে গেল পৃথিবীতে। ছাপাখানাই হল এই বিপ্লবের অগ্রদূত। যাজক মোল্লা ও পুরোহিতের দেওয়া ঠুলি চোখে পরে আর জীবন ও সমাজকে দেখতে হবে না। পুরোহিতের মুখে বেদের বা গীতার ব্যাখ্যা শুনে আর নিশ্চিন্ত থাকতে হবে না। সেদিন চলে গেছে, যেদিন থেকে ছাপাখানা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মুদ্রক বই ছাপতে আরম্ভ করেছেন। পৃথিবীতে অনেক যন্ত্র অনেক বিপ্লব এসেছে, কিন্তু ছাপাখানার মতন এ—রকম যুগান্তকারী বিপ্লব ইতিহাসে আর কোনো যন্ত্র এসেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু এ—হেন মুদ্রাযন্ত্রকেও ইয়োরোপের একদল পণ্ডিত বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলে মনে করেননি। পণ্ডিতমণ্ডলী বলতে অবশ্য আমি তথাকথিত ‘Brains Trust’- এর কথা বলছি।

বড়ো বড়ো ব্রেন নিয়ে কিছুদিন আগে ইয়োরোপে একটি ‘ট্রাস্ট’ গঠিত হয়েছিল, অনেকেই জানেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, ইতিহাসে যে—সব আবিষ্কার বৈপ্লবিক যুগান্তর এনেছে, তাদের নাম করতে। তাঁরা একটি বিরাট তালিকা দিয়েছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে ছাপাখানার নাম ছিল না। তাতে অবশ্য ‘ব্রেন ট্রাস্ট’ যে আসলে কতখানি ‘ব্রেনলেস’, সেই কথাই সকলে বুঝেছেন। ছাপাখানা, প্রকাশক ও পুস্তকের ইতিহাস—রচয়িতাদের মধ্যে অন্যতম মিঃ মুইর (P. H. Muir) তাঁর ‘Book-Collecting’ বইয়ে এ—সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন—

“When the Brains Trust was recently asked to name inventions that had most affected the history of the human race, it struck me as odd that, although nearly all the members were authors, not one of them mentioned printing. And yet there are few inventions that have more radically affected the outlook and the daily lives of every one of us, and almost every invention since owes a great deal to printing.”

তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অদ্বিতীয় পণ্ডিতরা মধ্যে মধ্যে অদ্বিতীয় মূর্খদের মতন কথাবার্তা বলেন। তাঁদের অভিমতের জন্য ছাপাখানার ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক গুরুত্ব কমে যায় নি। ছাপাখানা ও মুদ্রক বর্ত্তমান যুগে প্রকাশক বা পাবলিশারের আবির্ভাবের পথ সুগম করে দিয়েছেন।

দ্বিতীয় প্রস্তাব

“Printing was form the beginning a completly mechanical achievement. Not merely that : it was the type for all future instruments of reproduction : for the printed sheet, even before the military uniform, was the first completely standardised product, manufactured in series, and the movable types themselves were the first example of completely standardised and interchangeable parts. Truly a revolutionary invention in every department.”––Lewis Mumford.

বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী লুইস মামফোর্ড মুদ্রণশিল্প সম্বন্ধে চমৎকার কথা বলেছেন। বর্তমানে যন্ত্রসভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তার ”ইউনিফর্মিটি” ও ”স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন।” বাইরে সেনাবাহিনীর সাজসজ্জায়, কারখানার পণ্যদ্রব্যের একরকমের স্ট্যান্ডার্ড চেহারায়, যন্ত্রসভ্যতার এই রূপ প্রতিফলিত হয়। কিন্তু অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের আগে যন্ত্রসভ্যতার এই ইউনিফর্ম রূপ সর্বপ্রথম প্রতিফলিত হয় ছাপাখানার মুদ্রিত পৃষ্ঠায়, মুদ্রিত সারিবদ্ধ অক্ষরের মধ্যে। সেনাবাহিনীর সাজসজ্জায় যান্ত্রিক রূপান্তর তখনও হয়নি। কলকারখানার স্ট্যান্ডার্ড এক ছাঁচের পণ্যদ্রব্য তখনও তৈরি হয়নি। তার আগে মুদ্রণের টাইপ বা অক্ষর তৈরি হয়েছে এবং মুদ্রিত পৃষ্ঠার সুন্দর অক্ষর বিন্যাসের মধ্যে যন্ত্রসভ্যতার ছাঁচেঢালা রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। এইজন্য ছাপাখানাকে বাস্তবিকই বর্তমানে বৈজ্ঞানিক সভ্যতার অগ্রদূত বলা যায়। মুদ্রকের চোখেই প্রথম বর্তমান সভ্যতার আসল রূপটি ভেসে ওঠে, যখন তিনি প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার কোনো ছোট ছাপাখানায় বসে একটি পৃষ্ঠায় টাইপ সেট করেছিলেন এবং মুদ্রণযন্ত্রে সেটি ছাপিয়ে লোকচক্ষুর সামনে তুলে ধরেছিলেন। হাতে লেখা পুঁথিরও একটা সুদৃশ্য রূপবিন্যাস আছে। বিশেষ করে সে লিপিকররা পুঁথিলেখা পেশা হিসেবে গ্রহণ করতেন তাঁদের হাতে লেখা বেশ সুদৃশ্য। কিন্তু তবু হাতের লেখার তারতম্য থাকতে বাধ্য এবং হাতে লেখা দুটি অক্ষরের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। যন্ত্রের লেখা অর্থাৎ ছাপা আর পাণ্ডুলিপির ইউনিফর্মিটি এক নয়। অক্ষরের ছাঁদ, অক্ষরের দৈর্ঘ্য—প্রস্থ বা ‘পয়েন্ট’ সর্বাঙ্গসুন্দর পাণ্ডুলিপিতেও একরকম হয় না, হতে পারে না।

এ—হেন ছাপাখানার বৈপ্লবিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করতে যদি ‘ব্রেন ট্রাস্টের’ সভ্যরা ভুলে যান, তাহলে সেটা আফশোসের কথা। মুইর সাহেব দুঃখ করে লিখেছেন যে, অধিকাংশ সভ্য নিজেরা লেখক হওয়া সত্ত্বেও ছাপাখানার কথা উল্লেখ করেননি। দুঃখের কথা ঠিকই, কিন্তু আশ্চর্য হবার কিছু নেই। লেখকরা সব দেশেরই প্রায় সমান দেখা যায়। লেখকদের কৌলীন্যবোধ এত উগ্র যে তাঁরা মুদ্রকদের মনে মনে অবজ্ঞা করেন এবং তাঁদের পেট্রন—প্রকাশকদেরও অর্থলোলুপ ব্যবসাদার ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। এমন অনেক লেখক আজও আছেন, রীতিমতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ বহু গ্রন্থের লেখক, যিনি বই কী করে ছাপা হয় জানেন না। আমাদের দেশে তো আছেনই, ওদেশেও দু—চারজন নেই যে তা নয়। বই লেখা লেখকের কর্তব্য, তিনি পাণ্ডুলিপির মালিক, কিন্তু মুদ্রিত বইয়ের মালিক যেহেতু প্রকাশক, সেইহেতু বই ছাপার সমস্ত দায়িত্ব প্রকাশকের উপর দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন। কী ছাপা হল, কেমন করে ছাপা হল তা জানবার দরকার হয় না তাঁর। এমন লেখকও দেখেছি, যিনি তাঁর নিজেরই ছাপা বই কোনোদিন আর পড়বার প্রয়োজনবোধ করেননি। অসংখ্য ছাপার ভুলের কথা, এমনকী পাণ্ডুলিপির দু—একপৃষ্ঠা বা অনুচ্ছেদ বাদ চলে যাওয়ার কথাও তিনি অনেক সময় জানেন না, জানতেও পারেন না। ছাপাখানার টাইপ, বিভিন্ন টাইপের নাম বা ‘পয়েন্ট’ ইত্যাদি সম্বন্ধে চলনসই ধারণা আছে, এরকম লেখকের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। ছাপানো অক্ষর কী করে সংশোধন করতে হয় বা কীভাবে ‘প্রুফ’ দেখতে হয়, তাও বহু লেখকের জানা নেই। ছাপানোর টেকনিকের কথা না তোলাই ভালো। কী করে ভালো ছাপা হয়, দু—তিন রকমের রঙিন কালিতে ছাপা হয়, ছবি ছাপা হয়, ব্লক করা হয়, ‘স্টিরিও’ বা ‘ম্যাট’ করে লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়, এত সব কথা লেখকদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা দিশাহারা হয়ে বলবেন, ”আমরা প্রিন্টার নই, পাবলিশারও নই, লেখক। ওসব ব্যাপার আমাদের জানার দরকার নেই।” এই যখন লেখকদের অবস্থা তখন ‘ব্রেন ট্রাস্টের’ লেখক—সদস্যরাও যে ছাপাখানার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করবেন না, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ছাপাখানা কী বস্তু তাই যখন তাঁরা জানেন না, তখন তার গুরুত্ব বুঝবেন কী করে? অধিকাংশ লেখকদের কাছে ছাপাখানাও যা, মুদিখানাও তাই। অন্তত সেদিন পর্যন্ত তাই ছিল।

লেখকরা অনেকে ছাপাখানার ইতিহাস জানেন না বলে ছাপাখানার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমে যায়নি। এখানে অবশ্য সে ইতিহাস আলোচনা করব না। তবু টমাস কার্টার তাঁর “The Invention of Printing in China and its Spread Westward” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ছাপাখানার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের যে তথ্যসমৃদ্ধ ইতিহাস রচনা করেছেন, তা থেকে সামান্য অংশ এখানে উদ্ধৃত না করে পারছি না। কার্টার বলেছেন :

“Of all the world’s great inventions that of printing is the most cosmopolitan ana international. China invented paper and first experimented with block-printing and movable type. Japan produced the earliest block prints that are now extant. Korea first printed with type of metal, cast from a mould. India furnished the language and religion of the earliest block prints.”

এই কথা বলে কার্টার বলেছেন যে, আরবরা কাগজ তৈরির ব্যাপার চীন থেকে ইউরোপে নিয়ে যায়। ফ্লোরেন্স ও ইটালিতে প্রথম কাগজ তৈরি হয় ইউরোপে। ব্লক প্রিন্টিং ইউরোপে প্রথম হয় রুশিয়ায় এবং ইটালিতে—হল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি প্রথমে টাইপ নিয়ে পরীক্ষা করে। জার্মানিতেই পরীক্ষা কৃতকার্য হয় এবং জার্মানি থেকেই টাইপে ছাপার রীতি সারা ইউরোপময় ছড়িয়ে পড়ে।

আজকের এই কাগজ—সভ্যতার দিনে, চারিদিকের কাগজের স্তূপের মধ্যে বসে, আমরা কাগজের মূল্য কী তা উপলব্ধি করতে পারি না। এক বিচিত্র কাগজের সভ্যতা আমরা সৃষ্টি করেছি। তাই কাগজের বৈপ্লবিক ভূমিকার কথা নিশ্চিন্তে ভুলে গেছি। শুধু ছাপাখানার জন্য জ্ঞান—জগতের বিপ্লব সম্ভব হত না, যদি কাগজ না থাকত। মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখোমুখি দেখা না হলে, কোনো ভাবের আদান—প্রদান যখন সম্ভব ছিল না, তখন কাগজের আবিষ্কর্তা সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। কাগজের উপর লিখে মনের কথা অন্যকে জানানো যায়। ‘স্মৃতি’ ও ‘প্রথার’ বদলে কাগজে লেখা ”ডকুমেন্টের” ও ”রেকর্ডের” যুগ এল। ফিউডাল যুগের সবচেয়ে মজবুত

স্তম্ভটি তার ফলে অনেকটা শিথিল হয়ে গেল। বাকি যেটুকু ছিল তা মুদ্রক এসে অপসারিত করে দিলেন। কাগজের এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাটি চমৎকার ভাষায় মামফোর্ড ব্যাখ্যা করেছেন :

“Paper removed the necessity for face to face contact : debts, deeds, contracts, news, were all committed to paper, so that while feudal society existed by virtue of customs that that were rigorously maintained from generation to generation, the last elements of feudal society were abolished in England by the simple device of asking peasants who had always had a customary share in the common lands for some documentary proof that they had ever owned it. Custom and memory now played second fiddle to the written word: reality meant ‘established on paper’… A paper world came into existence, and putting a thing on paper became the first stage in thought and action : unfortunately also often the last.”

এত সুন্দর ভাষায় কাগজের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আর কেউ ব্যাখ্যা করেছেন কিনা আমার জানা নেই। কাগজ ও মুদ্রণের আবিষ্কারের জন্যই জ্ঞানজগতের বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। ধীরে ধীরে তার ফলে একটা সামাজিক বিপ্লবের পথও সুগম হয়েছে।

ছাপাখানার আগে লিপিকররা পাণ্ডুলিপি নকল করতেন এবং শিল্পীরা তার রূপসজ্জা করতেন। তার খরচ পড়ত অনেক বেশি। ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবের যাজক চতুর্দশ শতাব্দীতে একটি রোমান ক্যাথলিক ধর্মসংহিতা কিনেছিলেন, হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপি। তার মূল্য ছিল ৩৫ পাউন্ড। বর্তমান পাউন্ডের অর্থমূল্য প্রায় ৫০০ পাউন্ডের সমান। ৩৫ পাউন্ডের মধ্যে চিত্রকরদের রূপায়ণের জন্য মজুরি দিতে হয়েছিল ২২ পাউন্ড এবং লিপিকরদের নকল করার জন্য ১৩ পাউন্ড। আমাদের বাংলাদেশেরও যে পুঁথি নকল করার পারিশ্রমিকের হার অত্যন্ত বেশি ছিল, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তা রেভারেন্ড ওয়ার্ড প্রমুখ ব্যক্তি উল্লেখ করে গেছেন। বত্রিশ হাজার অক্ষর নকল করার মজুরি ছিল প্রায় এক টাকা। তাহলে মহাভারত কি রামায়ণের মতন বিশাল গ্রন্থ নকল করতে কত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হওয়া সম্ভব তা সহজেই অনুমান করা যায়। এশিয়াটিক সোসাইটির (বাংলাদেশের) ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের কার্যবিবরণে প্রকাশিত রাজেন্দ্রলাল মিত্রের উক্তি থেকে জানা যায় যে, তখন কপি করার হার ছিল হাজার শ্লোক প্রতি চার টাকা। এই পারিশ্রমিকের কথা সেকালের অনেক পুঁথিতে লিপিকররা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যেমন ১১২৪ বঙ্গাব্দে নকল—করা মহাভারতের কোনো লিপিকর লিখেছেন :

”ইহার দক্ষিণা সামান্যতা ক্রমে অন্নসত্রে পরিপাল্য হইয়া সশ্রদ্ধা হইয়া পুস্তক লেখিয়া দিলাম নগদ দক্ষিণাহ পাইলাম তারপর রোজকারহ বৎসর ব্যাপিয়া পাইবার আগ্যা হইল।”

প্রায় আড়াইশো বছর আগেকার কথা। লিপিকররা তখন নগদ দক্ষিণা ও ভাতা তো পেতেনই, সারাজীবনের জন্য বৃত্তিও পেতেন। লিপিকর দর্পনারায়ণ দাস মজুমদার ১১৩৫ সালে চারকাণ্ড রামায়ণ নকল করে কি রকম পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার বিস্তৃত বিবরণ তিনি লঙ্কাকাণ্ডের পুথির শেষে লিপিবদ্ধ করে গেছেন:

সেইমত আনন্দেতে রাখ গুরুচরণ দাসে।
কোন প্রকারে পুস্তক লইলে আমার পাশে।।
দাসবাবু আমাকে দিলেন সাত টাকা।
সেইমত দাসের পাপ খণ্ডাহ প্রভু একা।।
পুস্তক লেখাইয়া আমার কৈলেন উপগার।
অনেক জঞ্জালে ত্রাণ করিলে বাবু কর্মকার।।
কর্মকার বাবুরে রাম তুমি কর দয়া।
পুস্তকসাঙ্গতে বাবু দিবেন বস্ত্র মোয়া।।
আমাকে গামছা দিবেন বহুবাদ ঘুষি।
অতএব রাম দয়া কর সগোষ্ঠী পরিবারে আসি।।
বালিট্যা গ্রামবাসী আমি জাতি যে কায়স্থ।
চারিকাণ্ড রামায়ণ লিখিলাম সমস্ত।।

(বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ”চিত্তরঞ্জন সংগ্রহ” পুথি ৩০৩)

সভাকবিরা যেমন রাজার গুণগান করা তাঁদের কর্তব্য বলে মনে করতেন, লিপিকররাও তেমনি পুথির মালিকের গুণগান বা মঙ্গল কামনা না করে পুঁথি নকল করতেন না। পেট্রনের যুগে পেট্রন ছাড়া একপাও নড়বার উপায় ছিল না। কবির কাব্যরচনা যেমন পেট্রনের অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেই কাব্যের পাণ্ডুলিপি নকল করার জন্যও লিপিকরদের তেমনি ধনী ব্যক্তিদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত! মুদ্রকের যুগে তা’ হয় না। মুদ্রক ও লিপিকরের সামাজিক অবস্থার মধ্যে আকাশ—মাটি ব্যবধান। লিপিকরের নিজেদের এইসব স্বীকারোক্তি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, লিপিকররা সকলে প্রায় সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের অনুগ্রহজীবী ছিলেন। ধনীরা পুথি নিজেরা সংগ্রহ করতেন অন্যান্য নানা জিনিসের মতন, অথবা পুণ্য অর্জনের জন্য পণ্ডিত—ব্রাহ্মণদের দানও করতেন। তার জন্য তাঁরা অর্থ ব্যয় করে পুথি নকল করাতেন এবং লিপিকর নিয়োগ করতেন। সাধারণ লোকের দ্বারা পুথি নকল করানো বা লিপিকর নিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। পুথির যুগে লিপিকর ও পেট্রনের যুগে পাঠকগোষ্ঠী বলে বিশেষ কিছু ছিল না। একথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। দু—একজন ধনী জমিদার বা ব্যবসাদার, যাঁরা লিপিকর রেখে পুথি কপি করাতেন, তাঁদের জ্ঞানার্জনস্পৃহার চেয়ে পুণ্যার্জনস্পৃহাই প্রবল ছিল। বিদ্যার চর্চা বা শিক্ষার প্রসার হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির মাধ্যমে কখনো হতে পারে না। মুষ্টিমেয় রাজপুত্র বা জমিদারনন্দন কয়েকজন গুরুগৃহে বা আশ্রমে থেকে যে বিদ্যাভ্যাস করতেন, তাকে ফলাও করে সেকালের শিক্ষার মাহাত্ম্য বা ব্যাপকতা প্রচার করা হাস্যকর। বৌদ্ধযুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ইতিহাসও তাই। রাজপুত্র, মন্ত্রিপুত্র বা সামন্তনন্দন ছাড়া কোনো বিদ্যালয়েই কারও স্থান হত না। তার অন্যতম কারণ, পণ্ডিতরাই বিদ্যার ব্যাপক প্রসারের বিরোধী ছিলেন। সমস্ত জ্ঞানবিদ্যাকে তাঁরা নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে চাইতেন এবং পাণ্ডুলিপির যুগে তা করা অত্যন্ত সহজ ছিল। মুদ্রকের যুগে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। ছাপাখানার যুগে জ্ঞানবিদ্যাকে কোনো সংকীর্ণ গোষ্ঠী বা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হল না। তাই ছাপাখানার বিরুদ্ধে সেকালের ধনিক ও পণ্ডিত—পুরোহিত অনেকেই বিষোদগার করেছেন দেখা যায়।

প্রকাশক বলতে আমরা আজকাল যা বুঝি, তা হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির যুগে ছিল না। থাকা সম্ভবও ছিল না। পেশাদার লিপিকারদের মধ্যে এমন অনেকে হয়তো ছিলেন, যাঁরা নিজেরা কালি—কাগজ সংগ্রহ করে, একাধিক পুথি নকল করে, বাজারে বাজারে ও মেলায় মেলায় ঘুরে বিক্রি করতেন। কয়েকজন লিপিকর মিলিত হয়ে একটি ‘গিল্ড’ জাতীয় কিছু গঠন করে, হাতে—লেখা পুথির ব্যবসা যে করতেন না এমন কথা বলা যায় না। মেলায় মেলায় ঘুরে এই জাতীয় পুথি সাজিয়ে বিক্রি করাও আশ্চর্য নয়। কল্পনার রং চড়িয়ে এরকম পুথির দোকানের কথাও ভাবা যেতে পারে। কিন্তু ততদূর হয়তো কল্পনা করা সংগত হবে না। কারণ বিক্রির প্রশ্ন ওঠে চাহিদা বা ‘ডিমান্ড’ থেকে। লিপিকররা ব্যক্তিগতভাবে বা সঙ্ঘবদ্ধভাবে পুথির ব্যবসা করতে পারতেন, যদি পুথি পড়ার লোক থাকত সমাজে এবং পুথির চাহিদা থাকত। মাত্র একশ বছর আগেও যেদেশে শতকরা একজন লোকেরও অক্ষর পরিচয় ছিল না, সেদেশে পুথির যুগে যে পাঠকসংখ্যা কী রকম ছিল তা সহজেই কল্পনা করা যায়। পুথি পড়ার আগ্রহ এবং কিনে পড়ার আগ্রহ এক লক্ষের মধ্যেও একজনের ছিল কিনা সন্দেহ। ছাপাখানা ও প্রকাশকের যুগে সেদিন পর্যন্ত বই পড়ার আগ্রহই বা ক—জনের ছিল? সুতরাং পুথির ব্যবসাদার পাণ্ডুলিপির যুগে ‘থিয়োরোটিকালিই এই পুথির ব্যবসাদার ও লিপিকর ব্যবসায়ীদেরই আধুনিক প্রকাশকদের পূর্বপুরুষ বলা যায়।*

কিন্তু আধুনিক প্রকাশকরা সত্যিই এক বৈপ্লবিক যুগের প্রবর্তক। তাঁদের সঙ্গে সেকালের পুথি—বিক্রেতা বা লিপিকর ব্যবসায়ীদের কোনো তুলনাই হয় না। আধুনিক প্রকাশকদের ইতিহাস খুব বেশি হলেও তিনশো কি সাড়ে তিনশো বছরের ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সেই ইতিহাসের সূচনা, প্রকাশক—যুগের বৈপ্লবিক ইতিহাসের। ম্যুইর সেই জন্যই বলেছেন :

“But the greatest revolution in book history in the Seventeenth Century, the one entirely new feature that was to affect it fundamentally, was the emergence of the publisher.”

বইয়ের ইতিহাসে প্রকাশকরা হলেন মুদ্রকদের অনুগামী। মুদ্রকরা অন্তত আরও দুশো বছর আগে (পঞ্চদশ শতাব্দীতে) যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, প্রকাশকরা সেই বিপ্লবকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করেন। বিপ্লবটা জ্ঞানজগতের ও গ্রন্থজগতের বিপ্লব।

To the reader of our histories of literature it might well seem as if the works with which they deal automatically gained the eye and the ear of the public, as if they took the place in public opinion that was due to them as a matter of course, much as the heir ascends the throne. But the cases in which a man has awakened one morning to find himself famous are few and far between. The mere admission for the first time past the guards at the entrance to the temple of literary fame is dependent on definite conditions. Such guards are the theatrical directors and the publishers.–– Schucking.

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ডা. শুশকিং প্রকাশকদের কথা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন : ”সাহিত্যের ইতিহাস যাঁরা পড়েন তাঁরা হয়তো মনে করেন যে, সাহিত্যিকদের রচিত গ্রন্থ সাধারণের দৃষ্টিগোচর ও কর্ণগোচর হয়েছে আপনা থেকেই। সাধারণ পাঠকের কাছে সেইসব রচনা নিজগুণেই প্রশংসা অর্জন করেছে এবং স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্রাটের উত্তরাধিকারী যেমন স্বাভাবিকভাবেই সিংহাসনে বসেন, তেমনি লেখকের রচনাও নিজস্ব গুণে খ্যাতি অর্জন করে। কিন্তু সত্যকার ইতিহাস বাস্তবিকই তা নয়। হঠাৎ একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজেকে স্বনামধন্য বলে আবিষ্কার করেছেন, এরকম ভাগ্যবান কেউ ছিলেন কিনা কোনোদিন সন্দেহ। সাহিত্যিক খ্যাতির মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে দ্বারপথের প্রহরীর অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়, তা তিনি যত বড় প্রতিভাবানই হন না কেন। এই দ্বারপথের প্রহরীদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হলেন থিয়েটারের ডিরেক্টররা এবং প্রকাশকরা।”

ডা. শুশকিঙের এই কথাগুলি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। পাঁকের মধ্যে পদ্মফুল ফোটে বলে, দারিদ্র ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ‘প্রতিভার’ বিকাশ হয়, একথা যাঁরা বলেন তাঁদের কথার দার্শনিক মূল্য যাই থাকুক, ঐতিহাসিক মূল্য কিছুমাত্র নেই। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকেও যাঁরা প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন সাহিত্যের ইতিহাসে, সুস্থ ও অনুকূল পরিবেশে মানুষ হলে তাঁরা আরও কত বেশি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যেতে পারতেন, সেকথা সাহিত্যের একাডেমিক ঐতিহাসিকদের বিবেচ্য নয়। এক শ্রেণির দার্শনিক আছে যাঁরা প্রতিভার অঙ্কুরে রসসঞ্চার করে বলে, দারিদ্র ও দুরবস্থার রোমান্স রচনা করতে ভালোবাসেন। তাঁরা জীবনের দার্শনিক নন, মৃত্যুর বিকারগ্রস্ত দার্শনিক। আমরা যে সব সাহিত্যের ইতিহাসগ্রন্থ পড়ি তা কেবল ”সাহিত্যের” ইতিহাস, ”সাহিত্যিকের” ইতিহাস নয়, অথবা ”গ্রন্থেরও” ইতিহাস নয়। সাহিত্যিকের জীবনেতিহাস এবং তাঁর গ্রন্থ রচনার ও গ্রন্থ—প্রকাশের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে গণ্য হওয়া উচিত। তা হয় না বলে অধিকাংশ সাহিত্যের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হয় না। একজন বিরাট প্রতিভাবান ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক প্রথম জীবনে কীভাবে সাহিত্যের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার পান, কেমন করে ধীরে ধীরে অথবা হঠাৎ লাফ দিয়ে দিয়ে খ্যাতির ও স্বীকৃতির সোপানগুলি উত্তীর্ণ হয়ে যান, তার ইতিহাস বাদ দিয়ে কেবল গ্রন্থের গুণাগুণ বিচার করে সারগর্ভ নিবন্ধ রচনা করলে ইতিহাস লেখা হয় না। অথচ সাহিত্যের ইতিহাস আজ পর্যন্ত সেইভাবেই লেখা হয়েছে, তাই তার মধ্যে প্রাণহীন অবাস্তব কৃত্রিমতার গন্ধ যত বেশি পাওয়া যায়, বাস্তবতার স্পর্শ বা প্রাণের স্পন্দন তার শতাংশের একাংশও পাওয়া যায় না।

কোনো সাহিত্যিককে যদি তাঁর সাহিত্যজীবনের ইতিহাস জিজ্ঞাসা করা যায় তাহলে তিনি যে ইতিহাস বলবেন, তা হল প্রকাশকের ইতিহাস অথবা থিয়েটারের পরিচালকের ইতিহাস। কেন বলবেন? যিনি কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন, সমালোচনা ইত্যাদি রচনা করেন, তিনি প্রধানত ”প্রকাশকের” কাহিনি বলবেন এবং যিনি নাট্যকার, তিনি বলবেন মঞ্চ পরিচালকের কাহিনি। কারণ প্রকাশকের সহানুভূতি ও সহযোগিতা না পেলে কবি ও সাহিত্যিকরা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকতেন। প্রকাশকই তাঁদের গ্রন্থ নির্বাচন করে প্রকাশ করেন এবং বাইরের বৃহত্তর পাঠক—সমাজের কাছে বিচারের জন্য পৌঁছে দেন। খ্যাতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা লেখকের পক্ষে তার পরেই সম্ভব হয়, তার আগে নয়। তার আগে, অর্থাৎ প্রকাশকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হওয়ার আগে পর্যন্ত লেখকরা পাণ্ডুলিপির অন্ধকার রাজ্যেই বাস করেন। তবু তাকে আসল ”পাণ্ডুলিপির” যুগের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কারণ পাণ্ডুলিপির যুগে পেট্রনরা ছিলেন, তাঁদের রাজসভা ছিল এবং সভাকবিরা তখন রাজসভায় অন্তত সম্মান পেতেন। খ্যাতি তখন রাজসভার বাইরে রাজার অনুগ্রহের জোরে কিছুটা অন্তত জনসভায় ছড়িয়ে পড়বার সুযোগ পেত। সেটা ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজা ও নিরীহ প্রজার যুগ। রাজা ছিলেন সাহিত্যের প্রধান পেট্রন। সুতরাং সভাকবিরা সেই রাজপোষকতার জোরেই কিছুটা খ্যাতি অর্জন করতেন। যে যুগে রাজার বদলে প্রকাশক পেট্রন হলেন, সে যুগের সামাজিক রূপ অন্যরকম হয়ে গেল। সভাকবি হবার সুযোগ আর রইল না, এবং রাজারাজড়ার অনুগ্রহলাভেই খ্যাতির পথ পরিষ্কার হল না। অনুগ্রহ এখন প্রকাশকের কাছ থেকেই লাভ করতে হবে। অনুগ্রহই বলা চলে, কারণ সাহিত্যিকের প্রথম জীবনে কোনো লোকখ্যাতি যখন থাকে না, প্রকাশকের তরফ থেকেও তখন সেই খ্যাতির বেসাতি করে অর্থোপার্জন করার সুযোগ থাকে না। সুতরাং প্রকাশক লেখকের দ্বারস্থ হন না, লেখকরাই প্রকাশকের দ্বারস্থ হন। সাহিত্যের পণ্য নিয়ে তাঁরা প্রকাশকের দরজায় দরজায় ফিরি করে বেড়ান। প্রকাশকদের যদি অনুগ্রহ হয় তাহলে দরদস্তুর করে তাঁরা তা কেনেন এবং প্রকাশ করেন। যেমন পণ্য, অর্থাৎ বাজারে যেমন তার চাহিদা ও কাটতি, তেমনি তার দাম। এইভাবে প্রকাশক যখন বই প্রকাশ করেন, লেখকও তখন অজ্ঞাত অখ্যাত পাণ্ডুলিপির জগৎ থেকে বাইরের জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রিন্টার ও প্রকাশক ভিন্ন বর্তমান যুগে লেখকের আত্মপ্রকাশের কোনো সুযোগ বা পন্থা নেই এবং আত্মপ্রকাশ ভিন্ন আত্মপ্রতিষ্ঠা বা খ্যাতি অর্জন সম্ভবপর নয়। আধুনিক ধনিক, বণিক ও মধ্যবিত্তশ্রেণির যুগে রাজসভা নেই, ড্রয়িংরুম আছে, আর আছে কফিহাউস, সঙ্ঘ, সমিতি ইত্যাদি। ড্রয়িংরুমের গুঞ্জন, পোষকতা বা স্তাবকতা যতই অভিজাত হোক না কেন, ”এলিটগন্ধী” হোক না কেন, তার কোনো মূল্য নেই বাইরের লোকসমাজে। সেখানে মূল্য পেতে হলে পাঠকের কাছে যাচাইয়ের জন্য উপস্থিত হতে হবে। উপস্থিত হতে হলে প্রকাশকের অথবা মঞ্চাধ্যক্ষের সাহায্য ভিন্ন উপায় নেই। ডা. শুশকিঙের কথার তাৎপর্য তাই।

একথা অস্বীকার করবেন, এমন কোনো লেখক বা পাঠক নেই বলেই মনে হয়। এ যুগের পেট্রন যে প্রকাশক, একথা স্বীকার না করার অর্থ, সাহিত্যের ইতিহাসকে অস্বীকার করা। প্রকাশকের পোষকতা ভিন্ন এ যুগের লোকসমাজে বা পাঠকসমাজে স্বীকৃতিলাভের কোনো উপায় নেই। প্রকাশকরা প্রধানত যে ব্যবসায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবসায়েরও তারতম্য আছে, ইতরবিশেষ আছে। মুদিখানার দোকান চালান যিনি তিনিও ব্যবসায়ী। বইয়ের দোকান চালান যিনি তিনিও ব্যবসায়ী। মূল উদ্দেশ্য যে মুনাফালাভ, তা উভয়েরই এক। সাধারণ ব্যবসায়ীর মতন নিছক ব্যবসায়ী প্রকাশক যে নেই তা নয়, অনেক আছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন প্রকাশক থাকেন যাঁরা গ্রন্থ—নির্বাচনের জন্য প্রকাশনক্ষেত্রে বিশিষ্টতা অর্জন করেন। কেউ কাব্যগ্রন্থে, কেউ গল্প—উপন্যাসে, কেউ দর্শন—ইতিহাস—সমালোচনায়, সাহিত্যের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। গ্রন্থ নির্বাচনে তাঁরা যে নিরপেক্ষ সাহিত্যিক সুবিচারবোধ ও সুরুচির পরিচয় দেন, তাতে তাঁদের প্রকাশিত গ্রন্থ ক্রমে ক্রমে পাঠকদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে এবং সমালোচকের প্রশস্তির লেবেল আঁটার তাঁদের প্রয়োজন হয় না। প্রকাশকরাই অনেকটা সমালোচকের কাজ করেন। এই শ্রেণীর প্রকাশকদের সাহিত্যক্ষেত্রে ও পাঠক—সমাজে রীতিমতো প্রতিপত্তি থাকে, কারণ তাঁরা শুধু ব্যবসায়ী বলে নন, সাহিত্যের বিচারক বলেও লোকসমাজে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ডা. শুশকিং এই কথাটি পরিষ্কার করে বলেছেন :

“Historically regarded, the publisher begins to play a part at the stage at which the patron disappears, in the eighteenth century. Who could conceive the English literature of that century without a Dodsley, or the German of the following century without a Cotta? Such publishing firms gradually become a sort of authority.”

প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বলা চলে, পেট্রনরা যখন অন্তর্ধান করলেন তখন প্রকাশকদের আবির্ভাব হল সাহিত্যক্ষেত্রে এবং প্রকাশকরাই পেট্রনদের স্থান দখল করলেন। ডডসলের মতন প্রকাশক না থাকলে ইংরেজি সাহিত্যের অবস্থা তখন কী হত বলা যায় না। আর কোট্টার মতন প্রকাশক না থাকলে ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসও হয়তো অন্যরকম হত। ডা. শুশকিং ইংরেজি সাহিত্য প্রসঙ্গে ডডসলে এবং জার্মান সাহিত্য প্রসঙ্গে কোট্টার কথা উল্লেখ করে বলেছেন—“Such publishing firms gradually become a sort of authority.” এই ধরনের প্রকাশন—প্রতিষ্ঠানই ধীরে ধীরে সাহিত্যের ”বিচারক” ব’লে গণ্য হয়। কথাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জার্মান প্রকাশক ”কোট্টার” কথাই বলা যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর জার্মান প্রকাশকদের মধ্যে ”কোট্টার” নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কোট্টার বৈশিষ্ট্য ছিল ”ক্লাসিক” গ্রন্থ প্রকাশে। এই বিশিষ্টতা এমনভাবে কোট্টা অর্জন করেছিল যে, প্রত্যেক ‘ক্লাসিক’ লেখক কোট্টা থেকে বই প্রকাশ করতে চাইতেন। যত বড় লেখকই হন না কেন, অন্তত একখানা বই কোট্টার শিলমোহরসহ প্রকাশিত না হলে তিনি পাঠকগোষ্ঠীর কাছে যোগ্য মর্যাদা পেতেন না এবং তাঁর নিজেরও বাসনা চরিতার্থ হত না। এইরকম সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল কোট্টার এবং পাঠকদের বিশ্বাস ছিল কোট্টার উপর অগাধ। গ্রন্থ সুনির্বাচনের জন্য এবং সেই নির্বাচনের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কোট্টা এই খ্যাতি ও মর্যাদা অর্জন করেছিল।

এরকম প্রকাশকের সংখ্যা অবশ্য খুবই কম, আমাদের দেশে একেবারে নগণ্য বলা চলে। ব্যবসায়ের স্বার্থে প্রকাশকরা দীর্ঘকাল কোনো আদর্শ বা নির্বাচনপদ্ধতির ধারা শেষপর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন না। তবু দেখা যায়, এই ব্যবসা ও মুনাফার যুগেও যে সব প্রকাশকের নিজেদের একটা প্রকাশন—নীতি, আদর্শ বা মতামত আছে, তাঁরা পাঠকসমাজের একটা বিশেষ অংশের উপর রীতিমতো প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। একালের রাজনৈতিক গ্রন্থের অথবা বিশেষ ভাবাদর্শের প্রকাশকরা তার অন্যতম দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। দু—চারজন তথাকথিত ”অভিজাত” প্রকাশকও পাঠকগোষ্ঠীর একাংশের উপর এইরকম প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। শুশকিং তাই বলেছেন

“…Publishers with pronounces views of their own still exert real influence over the taste of the day. Past successes have brought these latter firms into the confidence of the public, which in taking new works from them feels a certain guarantee of their literary merit.”

এই প্রকাশকদের প্রথম শ্রেণির প্রকাশক বলা যায়। এই প্রথম শ্রেণির প্রকাশকরা তাঁদের গ্রন্থনির্বাচনের অতীত সাফল্যের জন্য ক্রমে পাঠকসমাজের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। প্রতিষ্ঠান হলেও এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পাঠক ও লেখক উভয়েরই কাছ থেকে একটা সাহিত্যিক মর্যাদা পান। সেটা সাহিত্য—বিচারকের মর্যাদা। আমাদের বাংলাদেশে এই শ্রেণির প্রকাশক সবেমাত্র সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হচ্ছেন বলা চলে। যতদিন না এই জাতীয় প্রকাশকের সংখ্যা বাড়বে, ততদিন বাংলা সাহিত্যের যুগোপযোগী সমৃদ্ধি, উন্নতি, প্রসার ও প্রচার সম্ভব হবে না। তার কারণ, পাঠক ও লেখকরা মনে করেন যে, এই সব প্রকাশকের সাহিত্যিক বিচারবুদ্ধি আছে এবং তাঁরা যে—সব বই প্রকাশ করেন তারও একটা ন্যূনতম সাহিত্যিক মূল্য আছে। এইজন্য এই শ্রেণির প্রকাশকরা একেবারে নতুন শক্তিশালী লেখকদের বই প্রকাশ করতে পারেন এবং করলে নতুন লেখকরাও সহজে পাঠকসমাজে পরিচিত হন ও স্বীকৃতি পান। অর্থাৎ প্রকাশকের সাহিত্যিক মর্যাদা ও খ্যাতি নতুন লেখকরা লাভ করে নিজেরা খ্যাতিমান হন, অন্তত খ্যাত হবার সুযোগ পান। সাহিত্যের ইতিহাসে প্রকাশকদের এই দান নিশ্চয় স্মরণীয়। কোনো সাহিত্যের ইতিহাসই প্রকাশকদের এই ইতিহাস বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হতে পারে না।

……..

১. A.R. Myers : England in the Late middle Ages : (Lond. 1952) : p. 226, p. 232.

২. P. H. Muir : Book-Collecting (Lond. 1945) : p. 81-82.

১. Lewis Mumford : Technics and Civilisation (Lond. 1934) : p. 135

১. Lewis Mumford : ঐ : ১৩৪—১৩৫ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

১. Mumford : ঐ : ১৩৭ পৃষ্ঠা।

২. সুকুমার সেন : বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ৪৬৫ পৃষ্ঠার টীকা।

১. সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা : ৫৭ বর্ষ।

* বিনয় ঘোষ : কলকাতা কালচার : ”পাণ্ডুলিপির রোমান্স” নামক অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১. Book Collecting : p. 88.

১. Schucking : The Sociology of Literary Taste : p. 42.

১. শুশকিং : ঐ, ৪২ পৃষ্ঠা।

১. শুশকিং : ঐ : ৪৩ পৃষ্ঠা।

বই-প্রকাশের আদিপর্ব

প্রথম প্রস্তাব

“The ordinary histories of Kings and Courtiers were well exchanged against the tenth part of one good history of Book-sellers.––Carlyle

পাণ্ডুলিপির যুগের প্রাচীন পুথির ‘কোলোফোন’ এবং ছাপাখানার যুগের ছাপা—বইয়ের টাইটেল—পৃষ্ঠার উদ্দেশ্য একই। আধুনিক যুগের টাইটেল—পৃষ্ঠার আবির্ভাব হয় ১৪৭০ সালে সর্বপ্রথম, অর্থাৎ পঁচিশ’ বছর আগে। তারপর বইয়ের পাতার (Leaf) নম্বর ও পৃষ্ঠার (Page) নম্বর ছাপা হয়। বড়ো বড়ো ফোলিও আকারের ছাপা বই আধুনিক ক্ষুদ্রায়তন বইয়ের আকার ধারণ করে ষোড়শ শতাব্দীর গোড়াতে। সর্বক্ষণ ব্যবহারের উপযোগী ক্ষুদ্রাকারের বই ছাপানো ও প্রকাশ করা সম্ভব হয় প্রধানত ছাপার হরফ সংস্কারের ফলে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে মুদ্রকদের প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়।

এই কারণে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রধানত মুদ্রকের যুগ বলা যায়। ”প্রকাশক” বলতে আমরা আজকাল যা বুঝি তখনও তার আবির্ভাব হয়নি। আধুনিক যুগের মুদ্রক ও প্রকাশক সাধারণত এক ব্যক্তি নন। মুদ্রক ব’লে ছাপা বইয়ে আজকাল যাঁদের নাম থাকে, টাইটেল—পৃষ্ঠার পিছনে, তাঁরা অধিকাংশই আবার ছাপাখানার মালিক নন, মজুর মাত্র। ছাপাখানার মালিক, মুদ্রক ও প্রকাশকের মধ্যে একটা ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তীকালে। প্রকাশন ও মুদ্রণের প্রথম যুগে এ—রকম কোনো ব্যবধান বিশেষ ছিল না। যিনি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করতেন তিনিই মুদ্রক হতেন এবং এই মুদ্রকরাই ছিলেন প্রথম যুগের প্রকাশক। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মুদ্রক ও প্রকাশকের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে পরে। যিনি ছাপাখানার কাজ করেন, কাজ বোঝেন এবং ছাপাই যাঁর ব্যবসা, তিনি মুদ্রক। প্রকাশক কেবল বই—প্রকাশের ব্যবসা করেন এবং তার জন্য খরচ দিয়ে প্রেস থেকে বই ছাপিয়ে নেন। আধুনিক যুগে মুদ্রকও ব্যবসায়ী এবং প্রকাশকও ব্যবসায়ী। দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাও থাকে পারে, এবং দুজনেই স্বতন্ত্রভাবে বড় ব্যবসায়ী হতে পারেন। তবে অনেক বড়ো বড়ো প্রকাশন—প্রতিষ্ঠানের নিজেদের ছাপাখানা থেকে। সেখানেও ‘মুদ্রক’ বলে যাঁর নাম থাকে তিনি প্রিন্টার মাত্র। ‘প্রকাশক’ বলে নাম থাকে অন্যের। প্রকাশকরা ব্যবসায়ীশ্রেণি হিসেবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও কৌলীন্য বজায় রাখতে বেশ সচেতন বলেই মনে হয়। আর্থিক স্বার্থ ছাড়াও এই মনোভাবের সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বার্থও যে জড়িত আছে, তাতে সন্দেহ নেই। বড় বড় প্রকাশকদের মতন বড় বড় মুদ্রকরাও তাঁদের বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক বিশেষত্ব স্বতন্ত্রভাবে বজায় রাখতে চান। আধুনিক ফিনান্স ক্যাপিটালিজম ও টেকনোলজির যুগে এই বাণিজ্যিক শ্রেণিগত স্বাতন্ত্র্য স্বাভাবিক পরিণতি। যুগশক্তির প্রভাবে প্রকাশক ও মুদ্রক একসঙ্গে ইতিহাসের রাজপথে যাত্রা করেও পরে দুই পথে দুজন এগিয়ে গেছেন। একজন (প্রকাশক) গেছেন ‘কালচারের’ পথে, অন্তত সেই ধারণা নিয়ে, আর একজন (মুদ্রক) গেছেন ‘টেকনিকের’ পথে। দুজনেই মূলত ব্যবসাদার, তবে একজনের মনে ”কালচারাল” আভিজাত্যের ভাব, আর একজনের মনে ”টেকনিক্যাল” আভিজাত্যের।

জার্মানিতে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর ইংলন্ডে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন যিনি, তাঁর নাম উইলিয়ম ক্যাক্সটন। পঞ্চদশ শতাব্দী মাঝামাঝি ছাপাখানার ছাপা আরম্ভ হয় জার্মানিতে। ক্যাক্সটন প্রথমে ইউরোপেই ছাপাখানার কাজ শেখেন, কলোনে। ১৪৭২ সালে তিনি কলোন থেকে একখানি বই ছাপিয়ে প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। তারপর ইংলন্ডে এসে ১৪৭৬ সালে তিনি প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংলন্ডে ছাপাখানার প্রবর্তক বলে ক্যাক্সটনের নামই স্মরণীয় হয়ে আছে।

ক্যাক্সটন পেশাদার লিপিকরও ছিলেন না, হিউম্যানিস্টও ছিলেন না। অথচ সমসাময়িক সাহিত্যিক রুচি সম্বন্ধে তাঁর বেশ চেতনা ও জ্ঞান ছিল। বই ছাপানোর খেয়াল তাঁর মাথায় আসে যখন তিনি ফ্ল্যান্ডার্সে ছিলেন তখন। ইংলন্ডে এসে যেখানে তিনি প্রথম ছাপাখানা করেন, সেই স্থানটিও উল্লেখযোগ্য। ক্যাক্সটন প্রথমে একটি গির্জার সীমানার মধ্যেই তাঁর ছাপাখানা গড়ে তোলেন। গির্জার নাম ”ওয়েস্টমিনিস্টার এ্যাবে”। পেট্রনদের যুগ অস্তাচলে গেলেও তখনও পেট্রনরা সাহিত্যের অভিজাত মঞ্চ থেকে একেবারে পর্দার অন্তরালে চলে যাননি। লিপিকর—মুদ্রক, পেট্রন—প্রকাশকের যুগসন্ধিক্ষণের গোধূলি অন্ধকারে তখনও তাঁরা সাহিত্য—সংস্কৃতির রঙ্গমঞ্চে আনাগোনা করছিলেন এবং হোমরাচোমরা লর্ডদের মতন রীতিমতো থিয়েটারি ভঙ্গিতে। ছাপাখানার প্রথম যুগেও তাঁদের মধ্যে অনেকেই পেট্রনরূপে অবতীর্ণ হলেন। যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রার পথে ইতিহাসের যোগসূত্র ও প্রবাহ এইভাবেই অবিচ্ছিন্ন থাকে।

ক্যাক্সটন যখন গির্জা—প্রাঙ্গণে ইংলন্ডের প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করলেন এবং পুঁথি—পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাকারে ছাপিয়ে প্রকাশ করার পরিকল্পনা তাঁর মাথায় এল, তখন তিনিও সেকালের লিপিকরদের মতন, রাজসভার কবি ও পণ্ডিতদের মতন পেট্রনের মুখাপেক্ষী হলেন। রাজারাজড়া ও লর্ডদের মধ্যে চতুর্থ এডওয়ার্ড, আর্ল রিভার্স, আর্ল এরানডেল প্রভৃতি। লক্ষণীয় হল, প্রিন্টার বা পেট্রন বা তাঁদের যে নতুন পাঠকগোষ্ঠী তাঁরা কেউ বিশেষ রিনেস্যাঁন্সযুগের আদর্শানুরাগী ছিলেন না। হাতে—লেখা পুঁথি—পাণ্ডুলিপিতে যে পাঠ্যবস্তু পরিবেশন করা সম্ভবপর, তার চেয়ে বেশি পাঠ্যবস্তুর একটা চাহিদা ছিল এবং চাহিদা ক্রমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছিল। প্রথম যুগের মুদ্রক—প্রকাশক ও তাঁদের পেট্রনরা শুধু এইটুকুই বুঝেছিলেন। গ্রিক ও লাতিন ক্লাসিক—সাহিত্যের মুষ্টিমেয় পাঠকরা তাঁদের চরিতার্থ করতেন তখন প্রধানত ফরাসি ও ইটালির প্রেস থেকে। ক্যাক্সটন ও তাঁর পেট্রনরা তা জানতেন। তাই রিনেস্যাঁন্স—যুগের আদর্শ অনুযায়ী তাঁরা ক্লাসিক—সাহিত্য ছেপে প্রকাশ করার দিকে দৃষ্টি দেননি প্রথমে। আদর্শের চেয়ে ব্যবসাটাই তাঁরা ভালো করে বুঝেছিলেন। ক্যাক্সটন তাই প্রথমে অনুবাদ—গ্রন্থ ছাপতে আরম্ভ করেন। নানা—বিষয়ের বই তিনি প্রধানত ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করতে লাগলেন। আদর্শের দিকে নজর রেখে নয়, সমসাময়িক পাঠকগোষ্ঠীর রুচির দিকে নজর রেখে। পাঠকদের সমসাময়িক সাহিত্যিক রুচিই ছিল ক্যাক্সটনের বই—প্রকাশের প্রধান প্রেরণা ও মানদণ্ড। পাঠক—সাধারণ যে রিনেস্যাঁন্স—যুগের রুচিপ্রিয় বা আদর্শানুরাগী ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দীতে ইংলন্ড বা ইয়োরোপের সাধারণ পাঠকরা ছিলেন প্রধানতঃ ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্রগ্রন্থ ও নীতিগ্রন্থের পাঠক। ধর্ম ও নীতির আদর্শই ছিল তাঁদের জীবনের প্রধান আদর্শ। নবযুগের ”হিউম্যানিজমের” আদর্শ তখনও তাঁদের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। ক্যাক্সটন তাই প্রথমে যে সব বই ছেপে প্রকাশ করেন তা সবই প্রায় ধর্মগ্রন্থ বা উপদেশপ্রধান নীতিগ্রন্থ। তার মধ্যে গোল্ডেন লেজেন্ড বইখানির নাম উল্লেখযোগ্য। লেজেন্ড অফ সেন্টস গ্রন্থের মধ্যে ক্যাক্সটন নিজে মুদ্রক—প্রকাশকরূপে তাঁর অবস্থার কথা সুন্দরভাবে বলেছেন। তাঁর ভাষাতেই বক্তব্যটুকু উদ্ধৃত করছি :

“I have submysed (submitted) myself to translate into English the ‘Legend of Saints’, called “Legenda Aurea’ In Latin, and William, Earl of Arundel, desired me–– and promised to take a reasonable quantity of them and sent me a worshipful gentleman promising that my said Lord should during my life give and grant me a yearly fee…”

ক্যাক্সটনের এই স্বীকারোক্তির ঐতিহাসিক মূল্য অসাধারণ। প্রধানত তিনি যে তাঁর পেট্রন আর্ল উইলিয়মের ইচ্ছাক্রমেই লেজেন্ড অফ সেন্টস ছাপতে আরম্ভ করেন, সেকথা ক্যাক্সটন স্বীকার করেছেন। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন যে তাঁর পেট্রন “promised to take a reasonable quantity of them” —অর্থাৎ আর্ল উইলিয়ম একথাও তাঁকে বলেছিলেন যে, বই ছাপা হলে তিনি নিজে বেশ কিছু বই কিনবেন। পেট্রনের এই প্রতিশ্রুতিটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য—একাধিক কারণে। পেট্রনের ইচ্ছাতে প্রিন্টার বই ছাপলেন। কিন্তু কেবল ইচ্ছাতেই ছাপা সম্ভব হত না, যদি—না পেট্রন বেশ কিছু ছাপা—বই নিজে কেনার প্রতিশ্রুতি দিতেন। প্রতিশ্রুতি দেবার কারণ কী, এবং প্রিন্টার ক্যাক্সটনের এই প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন ছিল কেন? কারণ বই ছাপার খরচ তখন খুব বেশি ছিল এবং ছাপা বই কিনে পড়ার মতন পাঠকও তখন তৈরি হয়নি। ধর্মকথা ও নীতিকথা তাঁরা ধর্মযাজক ও কথকদের মুখে শুনেই তৃপ্ত হতেন। ধর্মগ্রন্থ হলেও তা পয়সা দিয়ে কিনে পড়বার মতন মনোভাব তাঁদের তখন ছিল না। তা ছাড়া পাঠকের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না, বিশেষ করে সমাজের সাধারণ স্তরের মানুষের মধ্যে। প্রধানত রাজা—রাজড়া, আর্ল—কাউন্ট, ডিউক—ডাচেস, লর্ড—লেডিরাই ছাপা বইয়ের পাঠক ছিলেন। ছাপানো বই কিনে পড়াটা প্রথম যুগে রীতিমতো বিলাসিতাই নামান্তর ছিল। সুতরাং লর্ড—লেডি তথা পেট্রনদের বই—কেনার প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন ছিল। পেট্রনরা এই সব বই কিনে পার্শ্বচর ও বন্ধুবান্ধবদের বিতরণ করতেন, উপহার দিতেন। তার জন্য মুদ্রক—প্রকাশকদের তাঁরা পুরস্কৃত করতেন। ক্যাক্সটন নিজে লেজেন্ড ছাপার জন্য তাঁর পেট্রনের কাছ থেকে বছরে একটি করে হরিণ এবং একটি করে হরিণী পেতেন বলে স্বীকার করেছেন। বেশ বোঝা যায়, আধুনিক ছাপাখানার যুগে প্রকাশক—মুদ্রকরা প্রথম পুঁথি—পাণ্ডুলিপি—পেট্রনের যুগের সমস্ত উত্তরাধিকার নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। সংস্কৃতির ইতিহাসে জীব—বিজ্ঞানের নিয়ম এইভাবেই কাজ করে বলে মনে হয়।

দ্বিতীয় প্রস্তাব

বই—প্রকাশের আদিপর্ব সম্বন্ধে আরও একটু বিস্তৃত আলোচনা করা কর্তব্য। কারণ মুদ্রক, প্রকাশক ও লেখকদের স্বাতন্ত্র্য কখনো গ্রন্থ—জগতে প্রকাশ পায়নি। প্রথম যুগে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, প্রিন্টার বা মুদ্রকই প্রকাশক ছিলেন, এবং কেবল মুদ্রক—প্রকাশক—লেখক প্রকাশনের আদিপর্বে অনেক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিই ছিলেন। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর বইয়ের ইতিহাস অনেকটা তাই। বাংলাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার ইতিহাসেও তাই দেখা যায়। সেকথা পরে বলব।

ইংলন্ডে ছাপাখানার প্রবর্তক, আদি মুদ্রক উইলিয়াম ক্যাক্সটন নিজেই তাই ছিলেন। ক্যাক্সটন একাই ছিলেন তিনজন। তিনি প্রিন্টার বা মুদ্রক ছিলেন, প্রকাশক ছিলেন এবং লেখকও ছিলেন। ব্যবসায়ী বুদ্ধি তাঁর যথেষ্ট ছিল, তাই তদানীন্তন সংকীর্ণ পাঠকগোষ্ঠীর রুচি মাফিক তিনি বই ছাপতে আরম্ভ করেছিলেন, ইংলন্ডের লর্ড—লেডিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। জনপ্রিয় হয় এইরকম বই—ই বেশি প্রকাশ করেছিলেন ক্যাক্টটন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কবি চসারের ক্যান্টারবেরি টেলস—প্রায় ৩৭৪ পৃষ্ঠার বিশাল একখানি বই ছাপা হয় ১৪৭৮ সালে। ক্যাক্টটন পরে চসারের অন্যান্য আরও কয়েকখানি বই প্রকাশ করেছিলেন। চসারের বই ছাপা মেলোরির মর্ট—ডার্থারও ক্যাক্সটনের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ক্যাক্টটন হিউম্যানিস্ট ছিলেন না, রিনেস্যাঁন্সের নবীন আদর্শে উদ্বুদ্ধও হননি। একথা পূর্বে বলেছি। মধ্যযুগীয় লোকরুচি চরিতার্থ করার দিকেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। সেই জন্য ক্যাক্সটনকে প্রগতিশীল প্রকাশক বা মুদ্রক বলা যায় না। তিনি এমন সব বই প্রকাশ করেছিলেন, যার মধ্যে নবযুগের নবীন আদর্শের কোনো পরিচয় ছিল না। মধ্যযুগীয় রুচি ও ভাবধারাকে এইভাবে তিনি অনেকটা দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করেছিলেন বলা চলে। তা হলেও, প্রথম মুদ্রক—প্রকাশকরূপে ইংরেজি সাহিত্যে ক্যাক্টটনের যে বিশেষ দান আছে, তা অস্বীকার করা অন্যায়। প্রায় একশত বই ক্যাক্টটন ছেপেছিলেন, তার মধ্যে প্রায় কুড়িখানা বইয়ের অনুবাদ তিনি নিজেই করেছিলেন। নিজের ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য যে ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তিনি, তা ইংলন্ডের বই—প্রকাশের আদিপর্বে বিশেষ স্মরণীয়। অনুবাদকালে তিনি ইংরেজি ভাষার সংস্কারও করেছেন। ঈনীড নামক অনূদিত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি এ—সম্বন্ধে নিজের ভাষায় যা বলেছেন তা উল্লেখযোগ্য। পঞ্চদশ শতাব্দীর ইংরেজি ভাষা ও বানান উপেক্ষা করে কৌতূহলীরা ক্যাক্সটনের বক্তব্যটুকু পাঠ করবেন:

“I confess me not lerned not knowing the arte of retharyke, ne of suche gaye termes… And when I had advysed me in this saydboke. I delybered & concluded to translate it in to Englysshe. And forthwyth toke a penne & ynke and wrote a leef or twenye, whyche I oversawe agayn to correcte it. And whan I sawe the fayr and straunge termes therein I doubted that it sholde not please some gentylmen whiche late blamed me,… & desired me to use olde and homely termes… and so to do toke and olde boke and redde therin, and certaynly the Englysshe was so rude and broad that I coude not wele understande it.”

ক্যাক্সটনের এই বক্তব্য পাঠ করলে দেখা যায় যে, তিনি ভাষার সংস্কারের জন্য রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে রীতিমতো আন্দোলন করেছিলেন। অনুবাদে পুরানো ইংরেজি ভাষা ও ঘরোয়া ভাষা ব্যবহার করার জন্য অনেকেই তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা রক্ষা করেননি, কারণ তিনি নিজে পুরানো ভাষায় লেখা বই প’ড়ে দেখেছিলেন যে তা দুর্বোধ্য। সেইজন্য তিনি ভাষাকে ক্রমে আধুনিক সহজবোধ্য রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন এবং… “Certaynly it is harde to playse every man bycause of dyversite & chunge of language.”—এই কথা ব’লে তিনি শেষ পর্যন্ত পুরানো ভাষা—প্রয়োগের স্বপক্ষে যুক্তি বর্জন করেছিলেন। ক্যাক্সটনের মতন ইংলণ্ডের একজন সাধারণ প্রিন্টার—প্রকাশকের পক্ষে, (আদি—প্রিন্টার হলেও), ভাষা সম্বন্ধে এ—রকম উদারপন্থী হওয়া নিশ্চয় প্রশংসনীয়। এই হ’ল ক্যাক্সটনের শ্রেষ্ঠ দান। ম্যাকমূর্ত্রি বলেছেন যে, মুদ্রকরূপে ক্যাক্সটন খুব বেশি কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি, মুদ্রণকলায় বা প্রকাশনশিল্পে তাঁর দানও এমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। ম্যাকমূর্ত্রি তাই মন্তব্য করেছেন যে—“Caxton could not by any stretch of the imagination be regarded as a fine printer.” মুদ্রণজগতের তুলনায় সাহিত্য—জগতে ক্যাক্সটনের দান অনেক বেশি

ক্যাক্সটনের পর উইনকিন ডি ওয়ার্ড (Wynkyn de Worde) প্রিন্টার হন। ক্যাক্সটনের ফোরম্যান ছিলেন ওয়ার্ড এবং ১৪৯১ সালে ক্যাক্সটনের মৃত্যুর পর তিনি বই—প্রকাশের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইংলন্ডের তৈরি কাগজে প্রথম বই ছাপেন ওয়ার্ড এবং ইংলন্ডে প্রথম কাগজ তৈরি করেন জন টেট (John Tate)। পরে ইনি লন্ডনের লর্ড মেয়র হন। ইংলন্ডের তৈরি কাগজে প্রথম যে বই ছাপা হয় তার নাম De Proprietatibus Rerum, ১৪৯৫—৯৬ সালে ছাপা হয়। জন টেটের নাম এই বইতেই প্রকাশিত হয় এবং তিনি যে ইংলন্ডে প্রথম কাগজ তৈরি করেছিলেন, সে কথাও স্বীকার করা হয় এইভাবে :

And John Tate the younger,

Joy mote he broke,

Which late hath in England

Doo make this paper thynne

That now in owre Englisshe

This boke is prynted Lnne.

পঞ্চদশ শতাব্দীতে ক্যাক্সটন ও ওয়ার্ড ছাড়া আরও কয়েকজন মুদ্রক—প্রকাশক

ছিলেন, কিন্তু তাঁরা তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ নন। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংলন্ডে আরও বিখ্যাত কয়েকজন প্রিন্টার—প্রকাশকের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁদের কথা পরে বলব।

বই—প্রকাশের আদিপর্বের ইতিহাস—প্রসঙ্গে অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের কথা না বললেও, ইতালির কথা বলতেই হয়, বিশেষ করে ভেনিসের প্রিন্টারদের কথা। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, এই সময় রিনেস্যাঁন্স (Renaisance) আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল ইতালি, বিশেষ করে ভেনিস। নবযুগের ও নবজীবনের আদর্শ, হিউম্যানিজমের আদর্শ যে—দেশে জন্মলাভ ও পুষ্টিলাভ করেছে, সেই দেশে ছাপাখানার ও বই—ছাপার মূল্যবোধ ও প্রয়োজনবোধ সবচেয়ে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। আধুনিক নবযুগের সমস্ত বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক আবিষ্কারের মধ্যে ছাপাখানার বৈপ্লবিক গুরুত্ব যে কত বেশি, তা বাস্তবিকই ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নতুন আদর্শ, নতুন জ্ঞান—বিজ্ঞানের সমাচার সমাজের সাধারণ স্তরের মানুষের মধ্যে বহন করে নিয়ে যাওয়া বা পৌঁছে দেওয়া ও প্রচার করা সম্ভব হত না, যদি না ছাপাখানার আবিষ্কার হত এবং গ্রন্থাকারে ছেপে তা প্রকাশ ও প্রচার করা হত। ইতালিতে তাই আদিযুগের মুদ্রক—প্রকাশকরা, ঐতিহাসিক কারণেই ছাপাখানার গুরুত্ব বোধহয় সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করেছিলেন। লিপিকরের হাতে—লেখা কথার চেয়ে যে মুদ্রকের মুদ্রিত কথার হাজারগুণ, লক্ষগুণ শক্তি ও গতি বেশি, এ—কথা ইতালির মুদ্রক—প্রকাশকরা যেভাবে বুঝেছিলেন এবং বুঝে তাকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন, বোধ হয় আর কোনো দেশের মুদ্রকরা তা করেননি।

আদিযুগের অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালির মুদ্রক—প্রকাশকদের মধ্যে নিকলাস জেনসন (Nicolas Jenson) ও অলডাস ম্যানুটিয়াস (Aldus Manutius) অন্যতম। শুধু ইতালির বা ইউরোপের নয়, পৃথিবীর মুদ্রণেতিহাসে জেনসন ও অলডাসের নাম জার্মানির গুতেনবার্গের মতন চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। একাধিক কারণে এই দুজন মুদ্রণ—জগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। নবযুগের আদর্শ অনুযায়ী জেনসন অক্ষরের সংস্কার করেছিলেন এবং জেনসন যে ছাপার হরফ নির্মাণ করেছিলেন, নবযুগের উপযোগী বলে তার নামই হয়েছিল—‘humanistic script’। পণ্ডিত ও শিক্ষিত সমাজ গথিক অক্ষরকে বর্বর ও কদর্য বলে বর্জন করেছিলেন এবং জেনসনের হরফকে নবযুগের সুসভ্য হরফ বলে গ্রহণ করেছিলেন। তখন এমন একটা রীতিরই প্রবর্তন হয়েছিল যে, লাতিন ক্লাসিক সাহিত্য, কাব্য বা রম্যরচনা নতুন হরফে ছাপা হত, এবং শাস্ত্রগ্রন্থাদি ছাপা হত গথিক হরফে। জেনসন শুধু মুদ্রক বা হরফ—নির্মাতা ছিলেন না, প্রকাশকও ছিলেন। উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিতদের সাহায্যে তিনি অনেক ভালো ভালো বই সম্পাদনা করিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। নতুন যুগের আদর্শ, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী রিনেস্যান্স আন্দোলনের প্রতি পর্বের মানসিক খোরাক জুগিয়েছিলেন জেনসন। ক্যাক্সটনের সঙ্গে জেনসনের পার্থক্য এইখানে এবং বিরাট পার্থক্য।

অলডাস ম্যানুটিয়াস নিজে ছিলেন পণ্ডিত, তাই ছাপাখানাকে তিনি নবযুগের আদর্শ সাধনের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন গোড়া থেকে। লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে প্রকাশন ও মুদ্রণক্ষেত্রে তখনকার কালে অলডাসের মতন আর কেউ অবতীর্ণ হয়েছিলেন কি না সন্দেহ। নবযুগের আদর্শের তিনি একজন অনুরাগী ধারক, বাহক, ও প্রচারক ছিলেন। নতুন আদর্শের প্রতি এই অনুরাগের জন্য তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুদ্রিত বই যদি সাধারণের ক্রয়যোগ্য ও ব্যবহারযোগ্য না হয়, তাহলে মুদ্রণের যে যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ভূমিকা তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই তিনি অক্ষর সংস্কারের দিকেও মন দিয়েছিলেন, শুধু ছাপা বা বই প্রকাশের দিকে নয়। অলডাসই ছোটো ছাপার হরফ এবং ইটালিক হরফের প্রবর্তক। এই ছাপার হরফে তিনি পাঠকের ব্যবহারযোগ্য বই প্রথম প্রকাশ করেন এবং অনেক সুলভ মূল্যে তা বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার হোক, বইয়ের বহুল প্রচার হোক, এই ছিল অলডাসের জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আজও ক—জন প্রকাশক এই লক্ষ্য নিয়ে বইয়ের ব্যবসা করেন, বলা কঠিন। কিন্তু পাঁচশো বছর আগে, ছাপা বইপ্রকাশের আদিযুগে, ইতালির মুদ্রক প্রকাশক—পণ্ডিত অলডাস এই মহান আদর্শ নিয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তখনকার যুগাদর্শ ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আজকের দিনেও ক—জন প্রকাশকের আছে? বইয়ের জগতে অলডাস তাই অদ্বিতীয় আসন অধিকার করে আছেন।

তৃতীয় প্রস্তাব

“During the reign of Elizabeth it was still considered beneath the dignity of an English gentleman to have commercial dealings with a publisher, and it was customary for courttiers to circulate manuiscript copies of their works among their friends.”––Norman E. Binns.

ইংলন্ডে এলিজাবেথের রাজত্বকালেও ইংরেজ ভদ্রলোক সাহিত্যিকরা মনে করতেন যে প্রকাশকের সঙ্গে সাহিত্য সম্পর্কে বাণিজ্যিক লেনদেন করলে তাঁদের মর্যাদার হানি হবে। সেইজন তাঁরা পাণ্ডুলিপি নকল করিয়ে নিজেদের বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার করতেন, তবু বই ছাপিয়ে প্রকাশ করা বাঞ্ছনীয় মনে করতেন না। ছাপাখানা ও ছাপা বই সম্বন্ধে ইংরেজদের মনোভাব গোড়ার দিকে ইতালির ও জার্মানদের তুলনায় অনেক বেশি রক্ষণশীল ছিল। নবযুগের রিনেস্যাঁন্স আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ইতালিতে ছাপাখানার ও ছাপা বইয়ের যেরকম সমাদর হয়েছিল গোড়াতে, ইংলন্ডে বা অন্য কোথাও তেমন হয়নি, এমনকী জার্মানিতেও না। তার প্রধান কারণ, নবযুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জ্ঞানার্জনস্পৃহা ইতালিতে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জীবনের প্রেরণা সঞ্চার করেছিল, জার্মানিতে বা ইংলন্ডে বা ইউরোপের অন্য কোথাও তা করেনি। অন্তত পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত তো নয়ই। একমাত্র সংস্কারমুক্ত বাধাবন্ধনহীন পরিবেশের মধ্যেই তখনকার দিনে ছাপাখানা ও ছাপা বইয়ের প্রসার ও প্রচার সম্ভব ছিল। এখনও কি তাই নয়? ইংলন্ডে পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সেরকম মুক্ত সামাজিক পরিবেশের অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, প্রথম যুগের মুদ্রক ও প্রকাশকদের। ইতালিতে তা হয়নি। ইংরেজরা স্বভাবতই রক্ষণশীল। ধীরেসুস্থে বিচার—বিবেচনা করে নতুনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া হল ইংরেজদের জাতীয় চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

হঠাৎ এক—ধাক্কায় কোনো কিছু বর্জন করা বা গ্রহণ করা তাঁদের স্বভাব নয়। সেইজন্যই জ্ঞান—বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয় কেবল, বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ইংরেজরা পৃথিবীর মধ্যে এরকম প্রতিপত্তিশালী হতে পেরেছেন।

নবযুগের রিনেস্যাঁন্সের আদর্শ ইতালিকে যেমন নাড়া দিয়েছিল, ইংলন্ডকে তেমন দেয়নি, বা দিতে পারেনি। ইংলন্ডে তাই ছাপাখানার বা ছাপা বইয়ের তেমন কদর হয়নি প্রথম যুগে, যেমন ভেনিসে ও ফ্লান্ডার্সে হয়েছিল। ইংলন্ডের ক্যাক্সটন আর ইতালির জেনসন ও অলডাসের মধ্যে মুদ্রণ—প্রকাশনক্ষেত্রে তাই এতটা আদর্শের ব্যবধান দেখা যায়। ইতালির এলিটগোষ্ঠী যখন ছাপা হরফের ছিমছাম সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা ও আধুনিকতা নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাচ্ছিলেন, তখনও ইংলন্ডের বুদ্ধিজীবীরা হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির রোমান্টিক মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দীতে ইংলন্ডের সুধীসমাজ মনে করতেন, ছাপা বইয়ের তুলনায় হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির আভিজাত্য বেশি, এমনকী লেখকরাও তাই ভাবতেন। লিপিকরকে দিয়ে পাণ্ডুলিপি নকল করিয়ে তাঁরা মোসাহেব—মহলে বিতরণ করে গর্ব অনুভব করতেন। বই ছাপানোর জন্য বা ছাপিয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করার জন্য তাঁদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। মুদ্রণ ব্যাপারটাকেই তাঁরা তাঁদের শ্রেণিগত কৌলীন্যের বিরোধী বলে মনে করতেন। এরকম বন্ধ্যা মানসক্ষেত্রে কখন মুদ্রণ বা প্রকাশনশিল্পের বিকাশ হতে পারে না। ইতালিতে হয়েছিল, কারণ সমাজমানসের প্রসারতা ছিল সেখানে। ইতালিতে যখন অলডাস ভাবছেন, কী করে ছোটো হরফে ও আকারে সুদৃশ্য বই ছেপে সুলভে সাধারণের মধ্যে প্রচার করা যায়, ইংলন্ডের পণ্ডিতেরা তখন পাণ্ডিত্যের অভিমানে অন্ধ হয়ে পাণ্ডুলিপি আঁকড়ে ধরে আছেন এবং ক্যাক্সটন ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা কদাকার দুর্বোধ্য হরফে কিছু কিছু অনুবাদগ্রন্থ ছেপে প্রকাশ করছেন। তাঁদের ছাপার হরফও যেমন বিসদৃশ, ছাপা বইও তেমনি কদাকার।

সামাজিক মনোভাবের সঙ্গে ইংলন্ডের রাষ্ট্রীয় মনোভাবও ছাপাখানার প্রসারের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। ইতালিতে ও ফ্রান্সে, প্রথম যুগের মুদ্রক—প্রকাশকরা যেরকম রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও প্রেরণা পেয়েছিলেন, ইংলন্ডের মুদ্রক বা প্রকাশকরা তা পাননি। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ভিন্ন প্রথম যুগে মুদ্রণ ও প্রকাশনের প্রসারতা যে কোনোমতেই সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দীতে ইংলন্ডে মুদ্রণ ও প্রকাশন সম্বন্ধে এমন সব আইনকানুন পাশ করা হয়, যার ফলে তার স্বচ্ছন্দ অগ্রগতি রীতিমতো ব্যাহত হয়। ক্রমান্বয়ে ঘোষিত একাধিক বিধিনিষেধের শৃঙ্খলে জড়িত হয়ে ইংলন্ডের মুদ্রক—প্রকাশকরা আত্মপ্রসারের সমস্ত প্রেরণা ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং গ্রন্থজগতে অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে থাকেন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে, ১৪৮৪ সালে এ্যাক্ট পাশ করে বিদেশিদের বইয়ের ব্যবসা করার অধিকার দেওয়া হয় ইংলন্ডে, কয়েকটি শর্তে। শর্তগুলি তেমন কঠোর ছিল না বলে বিদেশিরা অনেকে ইংলন্ডে বইয়ের ব্যবসা করতে আসেন। ১৫২০ সালের মধ্যে দেখা যায়, ইংলন্ডের মোট বই—ব্যবসায়ীর মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাই প্রায় তিন ভাগের দু—ভাগ। প্রকাশনক্ষেত্রে বিদেশিদের এই আধিপত্যের ফলে স্বভাবতই ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। প্রতিযোগিতায় পদে পদে পরাজিত হয়ে তাঁরা এই বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের ফলে সম্রাট অষ্টম হেনরি কয়েকটি আইন পাশ করে দেশীয় ইংরেজ ব্যবসায়ীদের আশ্রয় ও উৎসাহ দেন। ১৫২৩ সালের এ্যাক্ট অনুযায়ী বিদেশি ব্যবসায়ীদের ইংরেজ শিক্ষানবীশ নিযুক্ত করতে বাধ্য করা হয়, কোনো বিদেশিকে দুজনের বেশি মজুর নিয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয় না। ”স্টেশনার্স কোম্পানির” (Stationer’s Company) ওয়ার্ডেনদের উপর মুদ্রণ—ব্যবসায়ীদের তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হয়। ১৫২৯ সালে আর একটি এ্যাক্ট পাশ করে মুদ্রণ—প্রকাশনের স্বাধীন বাণিজ্যের অধিকার অনেকটা কেড়ে নেওয়া হয়। ১৫৩৪ সালে আবার আইন জারি করে অবাধ বাণিজ্য একরকম প্রায় বন্ধই করে দেওয়া হয় এবং বইয়ের ব্যবসায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চালু করার চেষ্টা হয়।

যে ”স্টেশনার্স কোম্পানির” কথা বলা হয়েছে এখানে, তার সঠিক উৎপত্তির ইতিহাস আজও ঠিক বলা যায় না, তবে ইংলন্ডের বইয়ের ইতিহাসে এই কোম্পানির যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সে কথা সকলেই স্বীকার করেন। মনে হয়, চতুর্দশ শতাব্দীর কোনো সময় এই কোম্পানির প্রথম গোড়াপত্তন হয়। তখন এটা অনেকটা লিপিকরদের গিল্ডের মতন ছিল। ছাপাখানা প্রবর্তিত হবার প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ইংলন্ডে এই কোম্পানিটি যে গড়ে উঠেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়াতে ১৪০৩ সালের সনদ অনুযায়ী এই কোম্পানির নামকরণ হয়—”স্টেশনার্স কোম্পানি” এবং তার কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান খোলা হয় লন্ডনের ”স্টেশনার্স হলে।” ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ১৫৫৭ সালের সনদ অনুযায়ী এই কোম্পানির সদস্যদেরই কেবল মুদ্রণ—প্রকাশনের অধিকার দেওয়া হয় ইংলন্ডে। কোম্পানির সদস্য ছাড়া অন্য কারও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার বা বই ছাপার ক্ষমতা ছিল না তখন শুধু তাই নয়, স্টেশনার্স কোম্পানির ‘মাস্টার’ ও ‘ওয়ার্ডেনদের’ মুদ্রণজগতের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। যে—কোনো প্রিন্টার ও বই—ব্যবসায়ীর অফিস ও দোকান তাঁরা তল্লাশ করতে পারবেন, এবং অপাঠ্য মনে হলে যে—কোনো ছাপা বই ও কাগজ—পত্র তাঁরা পুড়িয়ে ফেলতে পারবেন। গোঁড়া ক্যাথলিক টমাস (Thomas Dockwray) হন কোম্পানির প্রথম ‘মাস্টার’ এবং ক্যাথলিক উদ্যমে তিনি তাঁর ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। ১৫৮৬ সালে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়। বই ছাপার অধিকার একরকম অন্য সকলের কাছ থেকে অপহরণ করে কেবল লন্ডনের মধ্যে এবং অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। অর্থাৎ মুদ্রণ ও প্রকাশনের আঞ্চলিক সীমারেখাও টেনে দেওয়া হয় ইংলন্ডে। লন্ডন শহরের বাইরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা ও বই ছাপা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেবল অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিকার দেওয়া হয় বই ছাপার।

পঞ্চদশ—ষোড়শ শতাব্দীর এই ইতিহাস থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যায় যে, এই সংকুচিত পরিবেশে কখনো ছাপাখানার বা বই ছাপার সুস্থ বিকাশ হতে পারে না। ইউরোপের অন্য কোনো দেশে, বিশেষ করে ইটালিতে ও ফ্রান্সে মুদ্রক ও প্রকাশকদের এ রকম রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি করা হয়নি। এর চেয়ে অনেক বেশি মুক্ত পরিবেশের মধ্যে ইটালি ও ফ্রান্সে বই প্রকাশের কাজ আরম্ভ হয়েছিল। মুদ্রক ও প্রকাশকরাও সেখানে অনেক আগে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনভাবে বই প্রকাশ করার জন্য উদযোগী হয়েছিলেন প্রকাশকরা, একাধারে নিজেরা মুদ্রক না হয়েও। বইয়ের জগতে প্রকাশকরা স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইংলন্ডে তা হতে অনেক দেরি হয়েছিল। মুদ্রক ও প্রকাশক স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে ইংলন্ডে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি, ছাপা বইয়ের তেমন মর্যাদা ছিল না বলে। বইয়ের ইতিহাসে এটা বিশেষ লক্ষণীয় ঘটনা—প্রকাশক ও মুদ্রকের ব্যবসায়ীরূপে স্বাতন্ত্র্য অর্জন। ছাপা বইয়ের লোকপ্রিয়তা বাড়লে বইয়ের চাহিদা বাড়ে, পাঠকের সংখ্যা বাড়ে এবং বই প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। তার ফলে ধীরে ধীরে বই প্রকাশ করা একটা স্বতন্ত্র ব্যবসা হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ হয়। মুদ্রক না হয়েও, ছাপাখানার টেকনিকাল বিদ্যায় পারদর্শী না হয়েও অনেকে বই প্রকাশ করতে পারেন। সুতরাং মুদ্রণ—প্রকাশনের প্রথম পর্বের শেষে মুদ্রণের অগ্রগতির ফলে, ছাপা বইয়ের প্রচার ও জনপ্রিয়তার জন্যই প্রকাশকরা স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছিলেন। প্রথম যুগের অভিন্ন প্রিন্টার—পাবলিশার, দ্বিতীয় যুগের প্রিন্টার ও পাবলিশার হিসেবে ভিন্ন হয়ে যান। বইয়ের যুগের অগ্রগতির ফলেই এই বিচ্ছেদ ঘটে। অনেকটা পথ হাত ধরাধরি করে এসে তাঁরা দুজনে চলে যান। ইটালি ও ফ্রান্সে অনেক আগেই যান, নবযুগের আদর্শের প্রবল টানে, বইয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদার জোরে। ইংলন্ডে তাঁরা পৃথক হন অনেক পরে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষে প্রায়।

মুদ্রক ও প্রকাশকদের আদিপর্বের এই ইতিহাস থেকে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে জ্ঞানজগতে যে যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে নবজাগরণের কলরব শোনা গিয়েছিল, আদিযুগের পাইওনিয়ার প্রিন্টার বা মুদ্রকরা সকলেই প্রায় তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বিস্ময়কর হল, লেখকরা পর্যন্ত যখন মধ্যযুগের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি ত্যাগ করতে পারেননি, রাজা—মহারাজার পোষকতার মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেননি, মিথ্যা কৌলীন্যবোধে অন্ধ হয়ে হাতে—লেখা পাণ্ডুলিপির সীমাবদ্ধ প্রচারেই সন্তুষ্ট ছিলেন—তখন আদিপর্বের মুদ্রকরা সকলেই প্রায় নবযুগের প্রগতিশীল আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জ্ঞানমন্দিরের রুদ্ধদ্বার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। সনাতনপন্থীদের ছাপাখানার বিরুদ্ধে সমস্ত চক্রান্ত তাঁরা ব্যর্থ করেছিলেন। ছাপার হরফ সংস্কার করে, মুদ্রিত বইয়ের আকার সর্বজনের ব্যবহারোপযোগী করেছিলেন তাঁরা। নবযুগের মানবাদর্শের উপযোগী হরফ বলে, তার নাম হয়েছিল হিউম্যানিস্টিক স্ক্রিপট। যুগোপযোগী ভাষারও সংস্কার করেছিলেন তাঁরা। প্রথম পর্বে শুধু মুদ্রক নয়, তাঁদের প্রকাশকও হতে হয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁরা লেখকও হয়েছিলেন। কতকটা নিরুপায় হয়েই তাঁরা লেখক হয়েছিলেন। কারণ লেখকরা তখনও পাণ্ডুলিপির পক্ষপাতী। প্রকাশক ও মুদ্রকরা তাঁদের লেখা ছেপে প্রকাশ করুন এবং মুদ্রিত লেখা বহুজনের পাঠ্য হোক, এ তাঁরা চাইতেন না। তাঁদের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হত বই ছাপতে। সুতরাং আদিপর্বের মুদ্রকরা বইও লিখেছিলেন। লেখক মুদ্রক ও প্রকাশক, একজনই ছিলেন তিনজন। মানবসভ্যতার এক বৈপ্লবিক যুগসন্ধিক্ষণে—যাঁরা এইভাবে ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব স্কন্ধে বহন করে নবযুগের জয়যাত্রার পথ সুগম করেছেন, আজ তাঁরা সামাজিক বিধির চক্রান্তে (নিয়তির চক্রান্তে নয়) সাধারণ মজুরশ্রেণিতে পরিণত হয়েছেন। যা কিছু সামাজিক মর্যাদা তার প্রধান অংশীদার হয়েছেন লেখকরা, এবং কিছুটা প্রকাশকরা। নবযুগের আদর্শসৌধের বনিয়াদ গড়েছেন যাঁরা, তাঁরা আজ উপেক্ষিত ও অনাদৃত। এমনকী, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পর্যন্ত তাঁদের যোগ্য ও প্রাপ্য স্থানটুকু দিতে আমরা কুণ্ঠিত হই।

……….

১. Frank Mumby : Publishing and Bookselling (London, revised edition 1949) : p. 38.

১. Douglas C. MeMurtrie : The Book : p. 226.

১. McMurtrie : The Book : p. 222

১. Norman E. Binns : An Introduction to Historical Bibliography (London, 1953): p. 321

২. Havelock Ellis : The Genius of Europe (London, 1950) : এই গ্রন্থের “The Genius of England” অধ্যায়ে এলিস সুন্দরভাবে ইংরেজদের জাতীয় চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *