১. রাজসভার সাহিত্য – পেট্রনের যুগ

জনসভার সাহিত্যবিনয় ঘোষ প্রথম প্রকাশ : ১৫ আশ্বিন ১৩৬২

বাংলার তরুণ লেখকদের ও উদ্যোগী প্রকাশকদের বইখানি উৎসর্গ করলাম

—গ্রন্থকার

পরিমার্জিত সংস্করণ প্রসঙ্গে প্রকাশকের কথা

 ‘জনসভার সাহিত্য’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৬২ সালের আশ্বিন মাসে, সারস্বত লাইব্রেরি থেকে। পরিবর্ধিত সংস্করণ বেরয় কার্তিক ১৩৮৫, ইংরেজি ১৯৭৮ সালে। বিনয় ঘোষের নতুন ভূমিকাসহ।

সেই পরিবর্ধিত সংস্করণ অবলম্বনে আমাদের পরিমার্জিত সংস্করণ। পুরোনো কপিতে থাকা মুদ্রণপ্রমাদ এবং পাঠ্যবিষয়ে অনবধানবশত থেকে যাওয়া কিছু ভুল এই সংস্করণে সংশোধন করা হয়েছে। কোথাও নোট বা টীকা দেওয়া হয়েছে। সংযোজিত হয়েছে নির্ঘণ্ট। সমগ্রত সম্পাদনার কাজটি করেছেন শ্রী সত্যব্রত ঘোষাল। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

*

‘জনসভার সাহিত্য’ পাঠ্যপুস্তক—শ্রেণির ‘সাহিত্যের ইতিহাস’ নয়। বরং একে সাহিত্যিকের ইতিহাস, তাঁর সমাজের ইতিহাস এবং তাঁর পেট্রন রাজা—রাজড়া, মুদ্রক প্রকাশক ও পাঠকদের ইতিহাস বলা যায়। এঁদের সকলের ব্যক্তিগত জীবন থেকে অনেক কাহিনিরও অবতারণা করেছি বইয়ের মধ্যে, আলোচ্য বিষয়টিকে জীবন্ত করবার জন্য। তথ্যের মতন কাহিনিগুলিও ঐতিহাসিক সত্য। আসল কথা যা বলতে চেয়েছি তা খুবই সহজ কথা। প্রাচীন ও মধ্যযুগে যে—সাহিত্য রাজসভায় বন্দী ছিল, সেই সাহিত্য কীভাবে ধীরে ধীরে মুদ্রক ও প্রকাশকদের সাহায্যে, নবযুগের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকদের তাগিদে, জনসভামুখী হচ্ছে, এই হল বইখানির আসল আলোচ্য বিষয়। ‘জনসভার সাহিত্য’ এ ছাড়া আর কোনো বিষয়ের ইতিহাস নয়।

বিনয় ঘোষ

রাজসভার সাহিত্য – পেট্রনের যুগ

 প্রথম প্রস্তাব

“Customers are our patrons”

বড় বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর্স ও দোকানে ঢুকলে দেখা যায়, অনেক ভালো ভালো বাণীর সঙ্গে এই বাণীটিও দেয়ালের গায়ে লটকানো আছে। অন্যান্য বাণীর চেয়ে এর যে বিশেষ কোনো আকর্ষণ বা মূল্য আছে, ক্রেতা—তথা—পেট্রনদের কাছে তা মনে হয় না। থাকবেই বা কেন? ও রকম কত বাণীই তো অহরহ আমাদের চোখে পড়ছে, এমনকী আজকাল ঝলসে উঠছে পর্যন্ত বৈদ্যুতিক আলোর অক্ষরে, তবু তার একটি অক্ষরও আমাদের মনে থাকে না। তার উপর আবার দোকানদারের বাণী। কাশীরাম দাস কথিত মহাভারতের কথা পুণ্যবানরা ‘অমৃত সমান’ মনে করতে পারেন, কিন্তু দোকানদারের কথা স্বয়ং বেদব্যাস বর্ণিত হলেও কোনো ভাগ্যবান ক্রেতাও তাকে অমৃতবৎ মনে করবেন না। কেনই বা করবেন? উঠতে—বসতে চলতে—ফিরতে যাঁরা চালাকির দ্বারাই সমস্ত কাজ সারাজীবন ধরে করছেন, তাঁদের দোকানে যদি ”চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য হয় না”—এই মহাপুরুষোক্ত বাণী দেয়ালে লটকানো থাকে, তাহলে নগদ মূল্য দিয়ে যাঁরা কেনাকাটা করেন তাঁদের কাছে অন্তত তার কোনো মূল্যই থাকে না। তাই ”ক্রেতারাই যে বিক্রেতাদের পৃষ্ঠপোষক”—এ কথার তাৎপর্য কোনো ক্রেতাই বোধহয় আজ পর্যন্ত ভেবে দেখেননি, দেখা প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু একথার যুগান্তকারী ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে, সেই কথাই এখানে বলছি।

এমন এক যুগ ছিল যখন দোকানদাররা একথা দেয়ালের গায়ে লিখে রাখতেন না। সেটা মধ্যযুগ। প্রাচীন যুগে তো রাখতেনই না, মধ্যযুগেও না। ‘কাস্টমার’ বা ক্রেতা কথার তখন উৎপত্তি হয়নি। ব্যবসায়ী ও কারিগররা পণ্যদ্রব্য তৈরি করতেন প্রধানত রাজা—বাদশাহ, আমির—ওমরাহদের সন্তুষ্ট করবার জন্য, সাধারণ ক্রেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। আমাদের দেশের এই অবস্থা মাত্র একশো বছর আগেও ছিল, অর্থাৎ ব্রিটিশ যুগেও দীর্ঘকাল ছিল। ব্রিটিশ যুগের ঠিক আগে, মোগল যুগের শেষে এই দোকানদারি ও কারিগরির অবস্থা কী ছিল তা সম্রাট ঔরঙ্গজীবের অন্যতম বিদেশি চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের তাঁর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। মঁশিয়ে দ্য লা ভেয়ারের কাছে ”দিল্লী ও আগ্রা” সম্বন্ধে লিখিত পত্রে বার্নিয়ের বলেছেন যে, মোগল রাজধানী দিল্লির দোকানে জিনিসপত্র সাজানো থাকে না বিশেষ। দিল্লির শিল্পী ও কারিগরদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সাধারণ মানুষ ও ক্রেতার সঙ্গে দোকানদার বা কারিগরের যেন কোনো সম্পর্কই নেই মনে হয়। না থাকবারই কথা, কারণ বার্নিয়ের বলেছেন যে, রাজা—বাদশাহ, আমির—ওমরাহ ও বড় বড় রাজকর্মচারীরা কখনো দোকানে গিয়ে জিনিসপত্তর কেনেন না। তাঁদের যখন যে জিনিসের দরকার হয়, তখন সেপাই—সামন্ত পাঠিয়ে তাঁরা শিল্পী—কারিগরদের বাড়িতে ধরে নিয়ে আসেন এবং তাদের বরাত দিয়ে বাড়িতে জিনিস তৈরি করিয়ে নেন। জিনিস তৈরি হবার পর প্রভু যদি তুষ্ট হন, তাহলে কারিগররা যৎসামান্য কিছু দক্ষিণা পায়। দক্ষিণা নিয়ে মুখ বুজে শিল্পীদের চলে যেতে হয়, কারণ বিড়—বিড় করে বিক্ষোভ প্রকাশ করলে প্রভুরা বেত্রাঘাত দক্ষিণা দিতেও কুণ্ঠিত হন না। এই হল সাধারণ অবস্থা। খুব উচ্চস্তরের দু—চারজন আমির—ওমরাহ বাঁধা বেতনে খোরপোষ দিয়ে কারিগর রাখেন। আর খোদ সম্রাটের বেতনভুক শিল্পী যাঁরা তাঁরা অবশ্য অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি তোয়াজে থাকেন। এই হল মধ্যযুগের কারিগরি ও ব্যবসাদারির কথা। প্রভুরাই তখন ছিলেন পেট্রন এবং ব্যবসায়ী ও শিল্পীরা ছিলেন তাঁদের আজ্ঞাধীন অনুচর মাত্র। শিল্পী—ব্যবসায়ীর কোনো স্বাধীনতা ছিল না এবং স্বাধীনতা না থাকলে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদাবোধও থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনের কোনো বৈচিত্র্য ছিল না

একালের মতন। সরল সহজ একঘেয়ে জীবন বাঁধাধরা মোটা জিনিসেই তৃপ্ত হত। দুমুঠো ভাত আর দুখানা মোটা কাপড়ের (আধুনিক দশ হাত কাপড় নয়) জন্য ব্যবসায়ীদের দোকান সাজাবার দরকার হত না। ধান হত মাঠে, আর কাপড় হত তাঁতশালে। দোকানের প্রয়োজন কোথায়? জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা যাঁদের প্রধানতঃ ভাত—কাপড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আধুনিক অর্থে তাঁরা ‘কাস্টমার’ বা ক্রেতা—পদবাচ্যও ছিলেন না। সুতরাং তাঁদের জন্য দোকানে দেয়ালবাণী লটকানো তো দূরের কথা, দোকান খোলারই বিশেষ প্রয়োজন হত না। জানি না, সেই রাজা—রাজড়ার যুগে কোনো দুঃসাহসী ব্যবসায়ী বা দোকানদার তাঁর দোকানের সামনে “Customers are our Patrons” কথাটা লটকে রেখেছিলেন কি না। যদি রেখে থাকেন তাহলে আমির—অমাত্যরা তাঁর ঔদ্ধত্যের জন্য যে তাঁকে কোনো গাছের ডালে প্রকাশ্যে লটকে দিয়েছিলেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। চক্ষু রক্তবর্ণ করে নিশ্চয় তিনি বলেছিলেন : ‘কাস্টমার? ক্রেতা? ক্রেতারা পেট্রন? এত বড় স্পর্ধা”। সাধারণ মানুষ যে শিল্পী—ব্যবসায়ীদের ‘পেট্রন’, একথা উচ্চারণ করার পর্যন্ত ক্ষমতা ছিল না কারও। ফিউডাল যুগের সর্বময় কর্তা রাজা—বাদশাহ আমির—অমাত্য—সামন্ত প্রভুরা এবং তাঁরাই সব কিছু একমাত্র ‘পেট্রন’। ক্রেতা ও বিক্রেতা নয়, ভৃত্য ও প্রভু, এই হল সে—যুগের অন্যতম সামাজিক সম্বন্ধ। সুতরাং সাধারণকে ক্রেতা বা বিক্রেতা মনে করাটাই অমার্জনীয় অপরাধ এবং ক্রেতাদের ‘পেট্রন’ বলা রাজদ্রোহিতার নামান্তর মাত্র। ‘Free Market’ বা ‘খোলা বাজার’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না মধ্যযুগে। কেনারও যেমন স্বাধীনতা ছিল না, বেচারও তেমনি স্বাধিকার ছিল না। কেনা—বেচা নিয়ন্ত্রণের সর্বময় কর্তা ছিলেন ফিউডাল লর্ডরা। সর্বপ্রকারের লেনদেন ও বেচা—কেনা নিয়ন্ত্রিত করে তাঁরা মানুষের সামাজিক জীবনটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই ছিল প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের অবস্থা। অতএব এ—যুগের দোকানে লটকানো যে বাণীকে আমরা অবজ্ঞা করি, উপেক্ষা করে চলি, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়। সামান্য কাষ্ঠফলকে লটকানো কৃত্রিম বিবর্ণ একটা বাণী—“Customers are our Patrons”—কিন্তু কি ভয়ানক তাৎপর্য তার! যুগ—যুগান্তের কত অলিখিত ইতিহাসই না ওই কয়েকটা কথার মধ্যে লেখা রয়েছে। কল্পনা করা যায় না।

আমাদের কথা বলি। অনেকেই জানেন, ট্রেনযাত্রী রবীন্দ্রনাথকে জনৈক সহযাত্রী একদা জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ”মহাশয়ের কী করা হয়?” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ”লিখি”। উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করেন : ”তা তো বিলক্ষণ বুঝলাম, কিন্তু করা হয় কি?” রবীন্দ্রনাথ আবার স্থিরভাবেই উত্তর দেন : ”শুধু লিখি, আর কিছু করি না।” ভদ্রলোক নিশ্চয় সন্তুষ্ট হন নি এবং ‘শুধু লিখি’ এই কথা রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনে তাঁর মুখের চেহারা যে কীরকম হয়েছিল তা রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় দেখেছিলেন, কিন্তু আমাদের কল্পনা করা ছাড়া উপায় নেই। লেখাটা যে কোনো ভদ্রলোকের জীবনের একমাত্র পেশা হতে পারে, একথা তো আজও অনেক ভদ্রলোক ভাবতে পারেন না। ‘কী করেন’ কথার উত্তরে কেউ যদি বলেন ‘ধূমপান করি’, তাহলে যে রকম অবস্থা হয়, কতকটা সেইরকম। তাই নিজেদের ”লেখক” বলতে আমি অন্তত ভরসা পাই না, সাধু ভাষায় ‘সাহিত্যিক’ তো নয়ই। যে কথা আধুনিক বাণিজ্যের যুগে, বেচাকেনার যুগে, সকলে বিনা টীকায় বুঝবেন, তাই বলাই ভালো। অর্থাৎ আমরা লেখক বা সাহিত্যিক নই, কেবল ‘বাক্য—ব্যবসায়ী’। ব্যবসায়ী যখন তখন প্রশ্ন ওঠে, আমাদের পৃষ্ঠপোষক বা ‘পেট্রন’ কারা? প্রকাশকরা, না পাঠকরা? প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। কোনো লেখকই বোধ হয় কথাটা আজ পর্যন্ত ভালো করে ভেবে দেখেন নি। গ্রন্থাকারে বাক্যের পশরা সাজিয়ে আমরা প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ফিরি করি, প্রকাশকরা দরদস্তুর করে কিনে নেন। কিন্তু বইয়ের ব্যাপারে বেচাকেনার পালাটা এইখানেই শেষ হয়ে যায় না। প্রকাশকরা নিজেদের জন্য কেনেন না, কেনেন পাঠকদের জন্য। বই প্রকাশিত হবার পর পাঠকরা যখন কেনেন, তখন বই বেচা—কেনার পালা শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রথমে আমরা যারা বাক্য—ব্যবসায়ী, তারা বই বিক্রি করি, প্রকাশকরা কেনেন। প্রথম পর্বে, লেখক বিক্রেতা বা ব্যবসায়ী, এবং প্রকাশক কাস্টমার বা ক্রেতা। পরে প্রকাশকরা বই বিক্রি করেন, কেনেন পাঠকরা। অর্থাৎ দ্বিতীয় বা শেষ পর্বে বিক্রেতা ও ব্যবসায়ী হলেন প্রকাশকরা এবং কাস্টমার বা ক্রেতা হলেন পাঠকরা। ব্যবসায়ের বাজারে ক্রেতারা যদি পেট্রন হন তাহলে বাক্য—ব্যবসায়ী লেখকদের ঘরের দেয়ালে “Publishers are our Patrons” এবং প্রকাশকদের দোকানে “Readers are our Patrons” কথাটা লটকে রাখতে হয়। বই প্রসঙ্গে কথাটা স্ববিরোধী হয়ে যায় না কি? লেখকদের দিক থেকেও প্রশ্নটা অমীমাংসিত থেকে যায়। বাস্তবিকই পেট্রন তাহলে কারা? প্রকাশকরা, না পাঠকরা? প্রকাশকরা বই কিনলেন লেখকদের কাছ থেকে, কিন্তু পাঠকরা সেই বই তেমন কিনলেন না। নীট ফলাফল কী হল? পরে প্রকাশকও আর সেই লেখকের বই সহজে কিনতে চাইবেন না। তাহলে লেখকদের পোষকতা কে করছেন? পাঠক, না প্রকাশক? নিশ্চয় শেষ পর্যন্ত—পাঠক। পাঠকই তাহলে লেখকের পেট্রন—নয় কি? কিন্তু আরও একটু প্রশ্ন আছে। লেখক ভালো, বইও ভালো লেখেন, পাঠকরাও তাঁর বই কিনতে ও পড়তে চান। যে—কোনো কারণেই হোক, প্রকাশকরা হয়তো তাঁর বই কিনে ছাপতে চান না। একাধিক কারণে অনেক লেখকের এ রকম অবস্থাসংকট দেখা দিতে পারে। তাহলে প্রকাশকরাই কি লেখকদের একমাত্র বা অন্যতম পোষক হচ্ছেন না? সমস্যাটা জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জটিলতার আরও একটু বাকি আছে। এখনও সব বলা হয়নি। প্রকাশক বই ছাপলেন লেখকের, সমালোচকরা তার বিরূপ সমালোচনা করলেন, অথবা তার উল্লেখই করলেন না। পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়ে সে—বই কিনে পড়লেন না, অথবা অনেকে হয়তো জানতেও পারলেন না। লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই এলিট—ক্রিটিকগোষ্ঠী নাকচ করে দিলেন। বর্তমান সমাজে এ—সমস্যা উপেক্ষণীয় নয়। এলিট—ক্রিটিকগোষ্ঠীর উপর যাঁদের (লেখক ও প্রকাশক) ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রভাব নেই বিশেষ, তাঁরা মাঠে মারা গেলেন। একেবারে চিরকালের মতন মারা না গেলেও, দীর্ঘকালের মতন যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এলিট—ক্রিটিকগোষ্ঠী এইভাবে তাঁদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত বিদ্বেষ ও পক্ষপাতিত্ব থেকে অনেক প্রতিভাবান লেখককেও দীর্ঘকালের জন্য ঘায়েল করে রাখতে পারেন। বর্তমান সমাজে তো অবশ্যই পারেন। তাহলে পেট্রন কারা? এলিট—ক্রিটিকগোষ্ঠীই পেট্রন নয় কি? লেখক ও প্রকাশক উভয়েই এই কথা লিখে দেয়ালে লটকে রাখতে পারেন :

“Critics are our patrons”

তাহলে সমস্যাটা শেষ পর্যন্ত খুবই জটিল হয়ে যাচ্ছে না কি? পেট্রন কারা? প্রকাশকরা? পাঠকরা? না, সমালোচক—সমঝদাররা? বইয়ের বাজারে তিনটি বাণীই লটকানো থাকতে পারে—

“Publishers are our Patrons”—(লেখকের ঘরে)।

“Readers are our Patrons”—(প্রকাশকের দোকানে)।

“Critics are our Patrons”—(লেখক ও প্রকাশক উভয়ের ঘরে)।

প্রশ্ন হল—কোনটি সত্য? সত্য হলে কতটা সত্য, আর কতটা মিথ্যা? সত্য মিথ্যা যাই হোক—যুগে যুগে এইটাই সত্য ছিল কি না? তাই বিচার্য। এই প্রশ্নের উপরেই নির্ভর করছে—’কাস্টমার কারা’—তার উত্তর। লেখক—পাঠক—প্রকাশক প্রসঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অতীতের অনেকদিনের ইতিহাসের জীর্ণ পাতা ধরে টান দিতে হয়। চমকপ্রদ ইতিহাস।

দ্বিতীয় প্রস্তাব

“….the history of literature is in large part the history of the beneficence of individual princes and aristocrats…. In the Middle Ages much of the principal art kept entirely within the general outlook of the bread-giver…. The world is seen through the spectacles of the feudal lord…” ––Schucking.

চমকপ্রদ ইতিহাস এই পেট্রন, প্রকাশক ও পাঠকের। সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। সমাজের একদিকে লেখক, অন্যদিকে তাঁর পেট্রন, প্রকাশক ও পাঠক—এই হল সাহিত্যের একটা অন্যতম প্রধান দিক। সাহিত্যের ভাবধারা, সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গি ও ভাষা ইত্যাদি নিয়ে যে সাহিত্যের ইতিহাস, তার সঙ্গে লেখক ও পেট্রন—পাঠক—প্রকাশকের এই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে। যুগে যুগে পেট্রনের মর্জি অনুযায়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের রাজা—বাদশাহ পেট্রনরা যখন আধুনিক যুগের প্রকাশক—পেট্রনে পরিণত হয়েছেন, তখন প্রকাশকরাও নানাভাবে সাহিত্য ও সাহিত্যিকের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বর্তমানে প্রকাশক—পেট্রনের যুগ থেকে আমরা ধীরে ধীরে পাঠক—পেট্রনদের যুগে উত্তীর্ণ হচ্ছি এবং সাহিত্যের ধারারও যুগোপযোগী পরিবর্তন হচ্ছে। পেট্রনদের মর্জি, প্রকাশকের রুচি থেকে আমরা পাঠকের দাবির যুগে পৌঁছেচি। সাহিত্যের ইতিহাসের এও একটা দিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশ্ব—সাহিত্যের যেমন, আমাদের বাংলা—সাহিত্যেরও তেমনি।

ডাঃ শুশকিং বলেছেন যে, অতীত যুগের সাহিত্যের ইতিহাস হল প্রধানত রাজা—রাজড়া ও অভিজাত ‘এ্যারিস্তোক্রাটদের’ কৃপা ও পোষকতার ইতিহাস। রুটি জোগাতেন যিনি, রুচিরও কর্তা ছিলেন তিনি—সাহিত্যের রুচি, শিক্ষার রুচি, শিল্পকলার রুচি। সমাজ বলতে তাঁদেরই বোঝাত, রাজা—বাদশাহদের, সামন্ত—প্রভুদের, জমিদার—জায়গিরদারদের, আমির—অমাত্যদের সমাজ। সাহিত্যিকদের দুনিয়াটাকে দেখতেন, বাদশাহি চশমার ভিতর দিয়ে। সাধারণ মানুষ সিলুয়েট মূর্তির মতন দিগন্ত রেখায় ভেসে উঠত উদাসীন ও নিষ্ঠুর মধ্যযুগের আকাশের তলায়। কোনো মমতাবোধ ছিল না মানুষের প্রতি বা জীবনের প্রতি। সংগীত ও অন্যান্য শিল্পকলার মতন সাহিত্যও ছিল দরবারি সাহিত্য, প্রধানত দরবারি মেজাজ ও রুচি পরিতৃপ্তির জন্য।

ঐতিহ্য সহজে মরে না, দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে, মানুষের অজ্ঞাতসারে। মানুষের মতন সমাজেরও একটা অবচেতন সত্তা আছে। সেই অবচেতন সত্তার আলো—অন্ধকারে অতীতের সব মৃত অভ্যাস ও আচার উঁকিঝুঁকি মারে, নিয়মিত হানা দেয় গোরস্থানের প্রেতাত্মাদের মতন। দীর্ঘকাল যে আমরা, সাহিত্যিকরা ও শিল্পীরা, রাজদরবারের বদান্যতার ছায়াতলে মানুষ হয়েছি, তা আজও আমরা ভুলতে পারিনি। টিউটন যুগের সূতরা (Court singer) আজও ‘লরিয়েট কবি’র মধ্যে বেঁচে রয়েছেন। রাজকীয় সম্মান, পদবি ও পুরস্কারে আজও যেসব সাহিত্যিক ও শিল্পীকে ভূষিত করা হয়, তাঁরা তাঁদের রচিত সাহিত্যে—শিল্পে প্রজার চেয়ে রাজার রুচির খোরাক জোগান বেশি। তর্ক করে একথা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।

টিউটন যুগের দরবারি গীতকারদের ‘স্কপ’ (Scop) বলা হত; স্কপরা রাজারাজড়াদের গুণগান করতেন, কীর্তিকাহিনি বর্ণনা করতেন আবৃত্তি করে। আমাদের দেশের এই কবি—গায়কদের ‘সূত’ বলত। বাহ্যতঃ তাঁরা আইরিশ ‘ফাইল’ (File) ও টিউটন ‘স্কপদের’ মতন ছিলেন। মনে হয় যেন ওডেসিউসের ফিমিওসের মতন, আলকিনুসের কোর্টের ডিমোডোকাসের মতন, তাঁদের সঙ্গে পেট্রনদের সম্পর্ক ছিল। আগামেমনন একবার তাঁর রাণিকে পর্যন্ত কোর্ট গায়কের অভিভাবকত্বে রেখে গিয়েছিলেন এবং ডিমোডোকাসকে এক স্থানে ‘লর্ড’ পর্যন্ত বলা হয়েছে। টিউটন স্কপরাও রাজার কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন এবং পেট্রনরা তাঁদের একেবারে দাসানুদাস মনে করতেন না। ভারতীয় সূতরাও বৃত্তি পেতেন, রাজদরবারে সম্মানও পেতেন, কিন্তু তবু তাঁদের পদমর্যাদা অতটা উন্নত ছিল কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শ্রীসিদ্ধান্ত এ—সম্বন্ধে বলেছেন :

“The Indian Suta, as we find him, is a much humbler Individual, Whatever he might Originally have been, we see him reduced to the position of an underling, one who is no better than a professional flatterer or clown.”

ভারতীয় সূতরা অনেকটা পেশাদার স্তাবক ও ক্লাউনের মতন ছিলেন। ইয়োরোপীয় সূতরা যে তা ছিলেন না তা নয়। তাঁরাও তাই ছিলেন, তবে স্বতন্ত্র পরিবেশে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অবস্থা হয়তো অপেক্ষাকৃত কিছু উন্নত ছিল। সাধারণত বীরগাথা ও কীর্তি কাহিনি সূতরা গাইতেন। ঋগ্বেদেও এ রকম কাহিনি আছে। ত্রিৎসু রাজা সুদাসের দশজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করার কাহিনি আছে (ঋগ্বেদ—সপ্তম, ১৮), দিবোদাস কর্তৃক সম্বরের পরাজয়ের কথা আছে (প্রথম ১১২, ১১৬, ১১৯ ইত্যাদি)। এগুলিকে বীরগাথা বলা যায়। সূতরাই মুখে মুখে গাইতেন নিশ্চয়। ”শতপথ ব্রাহ্মণে” আরও ভালোভাবে আছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের এক বর্ণনাপ্রসঙ্গে সেখানে বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণরা গান করবেন দিনে, রাজন্যরা রাতে (শতপথ ব্রাহ্মণ—ত্রয়োদশ, ১, ৫, ৬) ব্রাহ্মণ গায়করা দানধ্যানের গুণগান করবেন, রাজন্যরা যুদ্ধবিগ্রহ ও জয়ের গান করবেন। রাজা ও পুরোহিত যখন যজ্ঞাসনে বসবেন তখন অধবর্ষু আহ্বান করবেন হোতাকে আবৃত্তি করতে। সূতদের জাতি ও মর্যাদার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’। ব্রাহ্মণ সূত ও ক্ষত্রিয় সূতের কর্তব্যও পৃথকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ সূত দানধ্যানের ফিরিস্তি দিয়ে দাতার মহিমা কীর্তন করবেন, আর ক্ষত্রিয় সূত বীরগাথা গেয়ে বীরের গুণগান করবেন। প্রত্যেকে নিজের পেশায় গুণকীর্তন করতেন, পরিষ্কার বোঝা যায়। বৈদিক যুগের প্রথম পর্বের সামাজিক অবস্থায় তাই বোধ হয় স্বাভাবিক ছিল, সূতদের স্বতন্ত্র কোনো শ্রেণি তখনও গড়ে ওঠেনি। ভারতের আদি কবিরা তখনও রাজদরবারের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠেননি। ব্রাহ্মণ সূতদের দানমাহাত্ম্য কীর্তনের মধ্যে রাজন্যদের স্তাবকতা কতটা থাকত তা অবশ্য বলা যায় না। তবে রাজন্যরা নিজেরাই যখন নিজেদের বীরত্বের কাহিনি আবৃত্তি করতেন, তখন কারও মুখাপেক্ষী হওয়ার তাঁদের প্রয়োজন হত না। কিন্তু ক্ষত্রিয় মাত্রই রাজা ছিলেন না, একথা মনে রাখা উচিত। সুতরাং ক্ষত্রিয়েরা বীরগাথা গাইতেন মানে রাজন্যরাই যে গাইতেন, তা নাও হতে পারে।

মহাভারতের যুগে সূত ও মাগধদের পেশাদার স্বতন্ত্রশ্রেণি গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। পেশা ও বৃত্তিভেদে সামাজিক জাতিবিন্যাস তখন ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহাভারতে বলা হয়েছে যে ব্রাহ্মণীর গর্ভে ক্ষত্রিয় সন্তানই সূত বলে পরিচিত হবে এবং তার পেশা হবে, রাজারাজড়া ও মহাপুরুষদের কীর্তিগাথা গান করা। বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়দের মিলনে মাগধের জন্ম এবং মাগধের কর্তব্য হল, উচ্চকণ্ঠে স্তুতিগান গাওয়া। সূত ও মাগধের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে মহাভারতে বলা হয়েছে যে পৃথু রাজার দুজন স্তুতিগায়ক ছিলেন—একজন সূত, অন্যজন মাগধ। পৃথু তাঁদের প্রচুর জায়গা—জমি বৃত্তি দিয়েছিলেন। সূতদের দিয়েছিলেন সমুদ্র তীরবর্তী স্থান, মাগধদের দিয়েছিলেন মগধ দেশ। একথা পরবর্তীকালের সংযোজন বলে মনে হয়। সংযোজন হলেও, স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসেবে স্তুতিগায়কদের যে বিকাশ হয়েছিল মহাভারতের যুগে, তার আভাষ পাওয়া যায় এর মধ্যে। সূতরা সকলেই যে রাজবৃত্তি পেতেন তা নয়, রাজকবি ও রাজসূতরা পেতেন। ভোরবেলা রাজকক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে স্তুতিগান গেয়ে যাঁরা সেকালের রাজা—মহারাজদের রাজকীয় ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেন (পাখির গানে রাজাদের ঘুম ভাঙত না, প্রজাদের ঘুম ভাঙত), তাঁরা যে ভাতা বা বৃত্তি পেতেন না, তা নয়। পেতেন এবং কোনো কোনো ভাগ্যবান রাজকবি যথেষ্ট পরিমাণেই পেতেন। কিন্তু সূত বা পেশাদার কবি ও স্তুতিগায়ক মাত্রই যে পেতেন, তা নয়। কজন কবি ও গায়ককে রাজারা পোষণ করতেন? রাজারা ছাড়াও অমাত্যরা কবি পুষতেন, জমিদার—জায়গিরদাররাও সভাকবি রাখতেন। এইভাবে যাঁদের পেট্রন ছিল, পেট্রনভেদে তাঁদের নিজেদের মধ্যেও স্তরভেদ ও মর্যাদাভেদ ছিল। সম্রাটের সভাকবি আর প্রাদেশিক শাসনকর্তার সভাকবি, অথবা স্থানীয় জমিদারের সভাকবির বৃত্তি বা মর্যাদা ‘এক’ ছিল না। তবু এঁরা সকলেই পেট্রন—পালিত ছিলেন, পেট্রনের দৃষ্টিতে বাইরের জগৎটাকে দেখতেন, পেট্রনের মেজাজ ও রুচি অনুযায়ী গাথা ও কাব্য রচনা করতেন এবং তার বদলে পেট্রনের দেওয়া বৃত্তিভোগ করে জীবনধারণ করতেন। গাথা ও কাব্য তখন গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হত না, বইয়ের দোকানে দোকানে বিক্রিও হত না। প্রকাশকরা তখন ছিলেন না, লেখক বা কবিরা তখন ‘রয়াল্টি’ও পেতেন না। ‘রয়াল’ যুগে ‘রয়াল্টি’ বলে কিছু ছিল না, ছিল একমাত্র ‘লয়াল্টি’।

সূত, স্তুতিগায়ক বা কবি মাত্রই রাজসভায় স্থান পেতেন না। রাজসভায় স্থান পাওয়া সহজ ছিল না। তার জন্য অনেক ঠেলাঠেলি করার প্রয়োজন হত। যাঁরা স্থান পেতেন তাঁরা ভাগ্যবান, তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। যাঁরা স্থান পেতেন না, তাঁদের সংখ্যাই ছিল বেশি। তাঁরা কী করতেন? বাইরের লোকসমাজে তাঁরা ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রামে গ্রামে উৎসবপার্বণে, মেলায় মেলায় তাঁরা কবি গান করে বেড়াতেন। কিসের গান? ওই রাজসভার কবিদের রচিত গান। নিজেদের রচিত গান হলেও, তার মধ্যেও রাজস্তুতি ছাড়া অন্য কিছু থাকার উপায় ছিল না। ভাঁড়ের মতন একটু—আধটু সামাজিক ব্যঙ্গ—বিদ্রুপ করার, তামাশা—রসিকতা করার হয়তো সুযোগ তাঁরা কিছু পেতেন এবং তার মধ্যে সমাজের যৎসামান্য বাস্তবরূপও প্রতিফলিত হত। রাজসভার কবিদের কাব্যেও যে হত না, তা নয়। ভারতচন্দ্রের কাব্য প্রধানত কৃষ্ণচন্দ্রের মনোরঞ্জনের জন্য রচিত হলেও, তার মধ্যে তখনকার সমাজের আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, ধ্যান—ধর্মাদির পরিচয়ও কম নেই। কিন্তু সে কথা স্বতন্ত্র। বাইরের লোকসমাজে যাঁরা কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন, তাঁরাও রাজসভার পরিবেশ থেকে একেবারে মুক্ত ছিলেন না। রাজস্তুতি প্রাণের দায়ে তাঁদেরও করতে হত, যদিও রাজবৃত্তি হয়তো তাঁরা পেতেন না সকলে। কারণ যে রাজার বা যে জমিদারের রাজ্যে তাঁরা বাস করতেন এবং যে যুগে বাস করতেন তাতে স্বাধীন মনোভাবের বিকাশ হতে পারে না। বিকাশের সুদূর সম্ভাবনাও ছিল না তখন। স্বাধীন লেখক বা স্বাধীন কবি তখন কল্পনাতীত ব্যক্তি ছিলেন। কথায় কথায় রাজদ্রোহিতার অভিযোগে যখন রাজদণ্ড দেওয়া হত, তখন গ্রাম্য কবির স্বাতন্ত্র্য জাহির করার কোনো স্পর্ধা থাকা সম্ভবপর নয়। পেট্রনের যুগের এই হল প্রকৃত রূপ। সেইজন্যই বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডা. শুশকিং বলেছেন যে, “The World is seen through the spectacles of the feudal lord; there is no feeling for the little man and no respect for physical labour.” ফিউডাল লর্ডরাই সেদিন পর্যন্ত লেখক—কবি—শিল্পীদের প্রধান পেট্রন ছিলেন এবং তাই ফিউডাল যুগের সাহিত্য ও শিল্পকলায় তাঁদেরই রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ পড়েছে বেশি। বাংলাদেশে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও মহারাজা নবকৃষ্ণের সভাকবিদের যুগ সেদিন শেষ হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমরা তার জের টেনে চলেছি। প্রকাশকরা আমাদের পেট্রনরূপে তখনও সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হননি। প্রকাশক—যুগের আগের যুগ আসল পেট্রনদের যুগ, অর্থাৎ রাজ—রাজড়ার যুগ, রাজসভার যুগ ও সভাকবিদের যুগ। বাংলাদেশের সেই পেট্রনযুগের কথা ছিল না বললে, প্রকাশক—যুগের ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভবপর নয়।

তৃতীয় প্রস্তাব

সাহিত্যের ইতিহাসকে তাহলে আমরা তিনটি যুগে ভাগ করতে পারি—(ক) পেট্রনের যুগ, (খ) প্রকাশকের যুগ এবং (গ) পাঠকের যুগ। প্রাচীন ও মধ্যযুগ হল পেট্রনের যুগ। আধুনিক যুগ হল প্রকাশক ও পাঠকের যুগ। প্রকাশকের যুগ থেকে আধুনিক যুগে আমরা সবেমাত্র উত্তীর্ণ হচ্ছি। সামন্ততন্ত্রের যুগ থেকে আধুনিক গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগে উত্তরণকালে প্রকাশক—ব্যবসায়ীরা একটা যুগান্তকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সাহিত্য ও সাহিত্যিককে পেট্রনযুগের অচলায়তন থেকে মুক্ত করে বৃহত্তর লোকসমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছেন প্রকাশকরা সর্বপ্রথম। সে—কথা পরে বলব। তার আগে বাংলা সাহিত্যের পেট্রনযুগের সামান্য একটু পরিচয় দিই।

পালযুগ থেকে আরম্ভ করছি। কবি সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ কাব্য রচনা করেছিলেন। পালবংশের রাজা রামপালের কীর্তিকথাই রামচরিতে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু কবি সাধারণভাবে গুণগান করেননি। রঘুপতি রামচন্দ্রের চরিতকথা ও গৌড়পতি রামপালের চরিতকথা যে একই, এই কথাটুকু বলবার জন্য তিনি শ্লেষ অলংকারের সাহায্যে একটি দ্ব্যর্থবাচক দুর্বোধ্য কাব্য রচনা করেছিলেন। কথাবস্তুর দিক দিয়ে রামচরিততুল্য কাব্য ভারতীয় সাহিত্যে আরও অনেক আছে—যেমন দণ্ডীর দশকুমারচরিত, বাণের হর্ষচরিত, পদ্মগুপ্তের নবসাহসাঙ্কচরিত, বিহ্লাণের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত, হেমচন্দ্রের কুমারপালচরিত, কহ্লাণের রাজতরঙ্গিনী ইত্যাদি। সবই পেট্রন—যুগের অপূর্ব নিদর্শন এবং পেট্রনের মহিমাকীর্তন। কিন্তু বাঙালি কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বোধ হয় সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। কেবল মহিমাকীর্তনে তিনি খুশি হননি, রঘুপতি রামের সঙ্গে পালরাজা রামপালের তুলনা করতে গিয়ে তিনি এক কঠিন আঙ্গিকের আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি শ্লোকের দুরকম অর্থ হয়—একটিতে রামায়ণ—কথা, দ্বিতীয়টিতে রামপাল—কথা বোঝা যায়। তা ছাড়া পেট্রনের প্রশস্তির তো তুলনাই হয় না। কবি প্রশস্তির শেষে রামপালপ্রসঙ্গে সন্ধ্যাকর নন্দী বলছেন—

যোয়ং গদিত্যে নাগস্কন্ধক্ষিতিভৃন্ময়া বিদিতগোসারঃ।

পরমবিলাসিনমেনং হরিমিব হরিকেতনং কথমিব স্তৌমি।।

এই হস্তিস্কন্ধ ও জ্ঞাতপৃথ্বীসার যে নরপতি রামপাল আমার দ্বারা বর্ণিত হল, বিষ্ণুর ন্যায় পরম বিলাসী সেই বিষ্ণুনিবাসভূত রাজ্যকে কেমন করে আমি স্তব করব? রাজা রামপালের উপর অজস্র স্তুতিবর্ষণ করেও কবি শেষপর্যন্ত বিহ্বল হয়ে বলছেন, কথমিব স্তৌমি। পেট্রনযুগের এমনিই মাহাত্ম্য। রামপাল—পুত্র মদনপালকে কবি বলছেন—

শুচিরুচিবক্রিমকলাময়মিদমুদিতং গবামধিপ তে রত্নম্।

শব্দগুণভূষণাদ্ভূতমুত্তংসয়তে সতে গিরীশায় নমঃ।।

অর্থ হল : হে ভূমিশ্বর (মদনপাল), পণ্ডিত ও বাগবিশারদ, তোমাকে নমস্কার করি; কারণ তুমি শুদ্ধ, মনোজ্ঞ ও বক্রিমকলাবিশিষ্ট, এবং শব্দগুণ ও অলংকারে অদ্ভুত আমার এই প্রশংসিত রত্ন (কাব্য) তুমি কর্ণভূষণ করেছ। পেট্রনের মহিমা কীর্তনপ্রসঙ্গে কবি আত্মমহিমা প্রচারে মশগুল। পেট্রনযুগের এও এক বৈশিষ্ট্য।

সেনযুগের কথাও তাই। অনেকেই জানেন, লক্ষ্মণসেনের সভাকবিদের মধ্যে জয়দেব মিশ্র, ধোয়ী, উমাপতি ধর, গোবর্ধন আচার্য প্রভৃতি বিখ্যাত ছিলেন। প্রধানত রাজার চিত্তবিনোদনের জন্য তাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভা উৎসর্গ করেছিলেন বলা যায়। জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের রাজসভার কালিদাস। তিনি গীতগোবিন্দের সুললিত পদ গাইতেন, আর পদ্মাবতী নাকি তালে তালে নাচতেন। এই হল জনশ্রুতি। অর্বাচীন নয় জনশ্রুতি। তার কারণ, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের ভ্রাতা শুক্লধ্বজের সভাকবি রাম সরস্বতী তাঁর জয়দেব কাব্যে এই জনশ্রুতিকে স্বীকার করেছেন—

জয়দেব মাধবর স্তুতিক বর্ণাবে।

পদ্মাবতী আগত নাচন্ত ভঙ্গিভাবে।।

কৃষ্ণর গীতক জয়দেব নিগদতি।

রূপক তালর চেবে নাচে পদ্মাবতী।।

জয়দেব গীতগোবিন্দের পদ গাইছেন, পদ্মাবতী নাচছেন, আর পেট্রন লক্ষ্মণসেন শুনছেন ও দেখছেন। দৃশ্যটি কল্পনা করতেও তন্দ্রা আসে। মদিরার মতন গীতিগোবিন্দের ভাব এবং মৃদঙ্গ ও নূপুরশিঞ্জনের মতন তার ভাষা ও ছন্দ। পেট্রনকে পটাবার অমোঘ অস্ত্র এর চেয়ে আর কি হতে পারে? তার উপর, রাজসভায় পেট্রনকে সম্ভাষণ করার ভাষা কী?

লক্ষ্মীকেলিভুজঙ্গ জঙ্গমহরে সংকল্প কল্পদ্রুম

শ্রেয়ঃ সাধকসঙ্গ সঙ্গরকলাগাঙ্গেয় বঙ্গপ্রিয়।

গৌড়েন্দ্র প্রতিরাজরাজক সভালঙ্কার কারার্পিত

প্রত্যর্থিক্ষিতিপাল পালক সতাং দৃষ্টোহোসি তুষ্টা বয়ম।

অর্থাৎ পরম পেট্রন রাজা লক্ষ্মণসেনকে সম্ভাষণ করে কবি বলছেন :”হে লক্ষ্মীর কেলিনায়ক, হে জঙ্গমহরি, হে যাচকের কল্পদ্রুম, হে মুক্তিসাধকের সহায়ক, হে যুদ্ধবিদ্যায় ভীষ্ম, হে বঙ্গের প্রিয়, হে গৌড়েন্দ্র, হে রাজপ্রতিনিধিসামন্তমণ্ডিত সভামণ্ডপের অলঙ্কার, হে বন্দীকৃত অরিরাজমণ্ডল, হে সজজনের পালক, তোমাকে যে দর্শন করলাম, তাতেই আমরা তুষ্ট।” ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, কবি জয়দেব এখানে যতগুলি ‘বিশেষণ’ প্রয়োগ করেছেন তার ক’টির যোগ্যতা লক্ষ্মণসেনের ছিল। ‘লক্ষ্মীর কেলিনায়ক’ তিনি ছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু ‘যুদ্ধবিদ্যার ভীষ্ম’ ছিলেন কি? মুসলমানরা যখন রাজ্যের সীমান্তে হানা দিচ্ছে, বাংলার সৌভাগ্যরবি যখন ডুবুডুবু, তখন যিনি দৈবাচার্য ডেকে ভাগ্যগণনা করাচ্ছিলেন, তিনি যে কত বড় বীর ছিলেন, তা না বলাই ভালো। যাই হোক, ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের অবতারণা করে লাভ নেই। জয়দেবের মতন কবিও যে কীভাবে রাজসভায় উপস্থিত হতেন, পূর্বোক্ত সম্ভাষণ থেকে তার আভাষ পাওয়া যায়। পেট্রনযুগের এই হল বিশেষত্ব।

লক্ষ্মণসেন ধোয়ীকে ‘কবি—ক্ষ্নাপতি’ বা কবিরাজ উপাধি দিয়েছিলেন। পুরস্কারস্বরূপ ও প্রতীকরূপে দিয়েছিলেন স্বর্ণাভরণমণ্ডিত হস্তিব্যূহ ও হেমদণ্ডযুক্ত দুই চামর। উমাপতি ধর বলে গেছেন যে চন্দ্রচূড়চরিত—কাব্য রচনার জন্য রাজা চাণক্যচন্দ্র অন্তরঙ্গ কবিকে নানারকম রত্নালঙ্কার, বহু স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং একশত গ্রাম দান করেছিলেন। বাংলার পাঠান—রাজারাও অনেকে এই প্রথা অনুসরণ করতেন। সে কথা পরে বলব। রাজসভায় কবিদের ইহজীবনের চরম আদর্শ কী ছিল, সে কথা স্বয়ং ধোয়ী চমৎকারভাবে তাঁর আত্মকথায় বলেছেন :

গোষ্ঠীবদ্ধঃ সরসকবির্ভিবাচি বৈদর্ভরীতিম

বাসো—গঙ্গাপরিসরভুবি স্নিগ্ধভোগ্যা বিভূতিঃ।

সৎসু স্নেহঃ সদসি কবিতাচার্যকং ভূভুজাং মে

ভক্তির্লক্ষ্মীপতিচরণয়োরন্তু জন্মান্তবেহোপি।।

অর্থাৎ ধোয়ী বলছেন : ”সহৃদয় কবিদের সঙ্গে সৌহার্দ, বৈদর্ভী রীতিতে কাব্যরচনা, গঙ্গাতীরভূমিতে বাস, ধনৈশ্বর্য আত্মীয়স্বজনের ভোগে লাগানো, সজজনের সঙ্গে মৈত্রী, রাজসভায় সভাকবির সম্মান এবং লক্ষ্মীপতির চরণকমলে ভক্তি যেন জন্মান্তরেও লব্ধ হয়।”

ধোয়ীর এই কামনা—বাসনার তালিকাটি আধুনিক কবিরাও একবার স্মরণ করতে পারেন, চরিতার্থ হোক—না—হোক। ‘সহৃদয় কবিদের সঙ্গে সৌহার্দ’ সকলেই চান। কিন্তু সত্যিই চান কি? শব্দমাধুর্য ও বাকচাতুর্য হল বৈদর্ভী রীতির বৈশিষ্ট্য। সুতরাং বৈদর্ভী রীতিতে কাব্যরচনা করতে চাওয়াও ধোয়ীর পক্ষে আশ্চর্য নয়। পেট্রন রাজার কথা মনে থাকলে, বৈদর্ভী রীতিতে রচনার কথাও ভোলা যায় না। কাব্যরীতির উপর, কাব্যের আঙ্গিকের উপর পর্যন্ত পেট্রনের রীতিমতো প্রভাব দেখা যায়, শুধু কাব্যবস্তুর উপর নয়। ‘গঙ্গাতীরভূমিতে বাস’ ধোয়ীর মতন সভাকবিদের বাসনা হওয়াও বিচিত্র নয়। পেট্রনযুগের কবিরা রাজানুগ্রহে অনেকেই শৈলশিখরে বা গঙ্গাতীরে বাস করার সুযোগ পেতেন। প্রকাশক ও পাঠকের যুগে এ—বাসনা চরিতার্থ হওয়া সহজে সম্ভবপর নয়। ‘ধনৈশ্বর্য আত্মীয়স্বজনদের ভোগে লাগানোর’ সদিচ্ছাও সেকালের সভাকবিদের থাকা সম্ভবপর। প্রকাশক ও পাঠকের যুগে ‘ধনৈশ্বর্য’ কবিদের ভাগ্যে জোটাও সহজ নয় এবং জুটলেও আত্মীয়স্বজনের ভোগে লাগানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ পেট্রনের যুগের আত্মীয়স্বজনও এখন আর নেই। অন্যদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, প্রকাশক ও পাঠকের যুগের ধনৈশ্বর্য বরং বেশি করে আত্মীয়স্বজনেরই ভোগে লাগে, কবি বা লেখকের ভোগে লাগুক বা না লাগুক। এ—যুগের অধিকাংশ কবি ও সাহিত্যিকের অদৃষ্টে তাই হয়। জীবন—সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যখন ইহলোক ত্যাগ করেন, তখন তাঁর সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা হয়, রঙ্গমঞ্চ ছায়াচিত্র থেকে সাধারণ পাঠক পর্যন্ত তাঁর সমাদর ও চাহিদা বাড়ে, এবং তার ফলে প্রচুর অর্থ—সমাগম হয়। প্রকাশক ও আত্মীয়স্বজনরা সেই ঐশ্বর্য ভোগ করেন।* সুতরাং ধোয়ীর এ—কথাটি এ যুগেই বেশি প্রযোজ্য বলে মনে হয়। ”সজজনের সঙ্গে মৈত্রী” সব যুগে সকলেই চান, যদি অবশ্য সজজন ব্যক্তি সহজলভ্য হয় সমাজে।

‘রাজসভায় সভাকবির সম্মান’ পাওয়া পেট্রনযুগের কবির জীবনের চরম কাম্য ছিল। ধোয়ী সে কথা পরিষ্কার করে বলেছেন। শুধু ইহজীবনে নয়, তিনি বলেছেন—জন্মান্তরেও তাঁর সেই কামনা যেন চরিতার্থ হয়। আধুনিক প্রকাশক ও পাঠকের যুগে, বিশেষ করে পাঠকের যুগে, এই কামনার কথা বাইরে প্রকাশ করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু তাই বা নয় কেন? রাজা ও রাজ্যের উপর সেটা নির্ভর করে এবং সেই রাজা ও রাজ্য সম্বন্ধে পাঠকগোষ্ঠীর—তথা জনসাধারণের ধারণার উপর। রাজা ও রাজ্যের প্রতি পাঠকগোষ্ঠী, অর্থাৎ জনসাধারণ যদি কোনো কারণে বিমুখ হন এবং কোন কবি বা সাহিত্যিক যদি সেই রাজ্যের সভাকবি বা রাজকবির সম্মানলাভের বাসনা প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি খেতাই পাবেন, খ্যাতি নয়। কিন্তু রাজা ও রাজ্যের প্রতি কোনো কারণে জনসাধারণের যদি সহানুভূতি থাকে, তাহলে কবি—সাহিত্যিকরা প্রাণপণে সেখানে রাজকবির সম্মান পাবার চেষ্টা করেন। আজও যে করেন, তার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ‘নোবেল প্রাইজ’ থেকে ‘স্ট্যালিন প্রাইজ’ পর্যন্ত তার উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং ধোয়ীর কথার তাৎপর্য বদলেছে মাত্র, কথাটা বদলায়নি। অবশ্য তাৎপর্য বদলানোও কম কথা নয়। পেট্রন—রাজার যুগ আর পেট্রন—প্রকাশক ও পেট্রন—পাঠকের যুগের মধ্যে ব্যবধান অনেকখানি। পেট্রন—রাজার যুগে সভাকবি হওয়া আর প্রকাশক—পাঠক—রাজার যুগে সভাকবির সম্মান পাওয়া এক কথা নয়। পার্থক্য অনেক।

চতুর্থ প্রস্তাব

 কীত্তির্লব্ধা সদসি বিদুষাং শীলিতাঃ ক্ষৌণীপালা

 বাক্সন্দর্ভাঃ কতিচিদমৃতস্যন্দিনো নির্মিতাশ্চ।

 তীরে সম্প্রত্যমরসরিতঃ ক্বাপি শৈলোপকণ্ঠে

 ব্রহ্ম্যাভ্যাসপ্রবণমনসা নেতুমীহে দিনানি।

 —ধোয়ী

”পবনদূত” কাব্যের শেষ শ্লোকে ধোয়ী তাঁর শেষ জীবনের কামনা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন—”বিদ্বৎসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছি, রাজার সেবা করেছি, কতিপয় অমৃত—নির্ঝর কাব্য ও কবিতা রচনা করেছি। এখন চাই ভাগীরথীতীরে কোন শৈলোপকণ্ঠে ব্রহ্মচিন্তাপরায়ণ মন নিয়ে বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দিতে।”

কে না চায়? কিন্তু তার জন্য লক্ষ্মণসেনের যুগে, অথবা সেকালের কোনো রাজাবাদশাহের যুগে জন্মগ্রহণ করা দরকার। রাজসভার সভাকবি হয়ে রাজার সেবা করতে না পারলে তখন বিদ্বৎসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করা যেত না। সেকালের সেই প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আজকের প্রতিষ্ঠার পার্থক্য অনেক। বিদ্বৎসমাজ বলতে যা বোঝায়, তারও রূপ আজ একেবারে বদলে গেছে। তখন কয়েকজন আমলা—অমাত্য, পণ্ডিত—বৈদ্যদের নিয়েই বিদ্বৎসমাজ গঠিত ছিল। সুতরাং রাজসভার কবিদের পক্ষে বিদ্বৎসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করা আদৌ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল না। রাজসভার সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরে, বৃহত্তর লোকসমাজে বিদ্বজ্জনের অস্তিত্বও বিশেষ ছিল না। সুতরাং রাজার সভাকবি হওয়া, আর বিদ্বৎসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করা প্রায় একই ব্যাপার ছিল। তা ছাড়া, কবির আত্মপ্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম যে কাব্য, সেই কাব্যের সঙ্গে লোকসমাজের যোগাযোগেরও কোনো উপায় ছিল না তখন। কবি যে কাব্য রচনা করতেন, তা তাঁর পাণ্ডুলিপির মধ্যেই বন্দি হয়ে থাকত। লিপিকররা পাণ্ডুলিপি নকল করতেন, কিন্তু তাও ধনী জমিদার ও অমাত্যদের জন্য—সাধারণের জন্য নয়। সুতরাং কাব্য বা প্রতিভার গুণে কবির প্রতিষ্ঠা হত না। তাই বলে, সেকালের সভা—কবিদের যে কাব্যপ্রতিভা ছিল না, এমন কথা কেউ বলবেন না। নিশ্চয়ই ছিল এবং শক্তিশালী কবিরাই সভাকবির মর্যাদালাভের সুযোগ পেতেন। কিন্তু যতই প্রতিভা নিয়ে কোনো কবি জন্মান না কেন, তাঁর স্বীকৃতি নির্ভর করত রাজা ও তাঁর সভাসদদের মর্জি ও রুচির উপর। রাজস্বীকৃতি না পেলে কোনো প্রতিভাই প্রতিভা বলে গণ্য হত না, গণ্য হবার মতন সুযোগও ছিল না। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ধোয়ী যে কতিপয় অমৃতস্যন্দী কাব্য ও কবিতা রচনা করেছিলেন, তার রসাস্বাদন করবার সৌভাগ্য হয়েছিল কজনের? সংস্কৃত ভাষায় বৈদর্ভীরীতিতে কাব্যরচনা করতেন ধোয়ী। তখন তো দূরের কথা, এখনই বা কজন তার অমৃতরস আস্বাদন করতে পারেন? রসাস্বাদন করতেন সভ্যপণ্ডিতরা—আর তাঁদের ইশারায় রাজা ঘাড় নাড়তেন এবং তাঁর পারিষদরাও ‘আহা মরি’ করতেন। এই ছিল ধোয়ীর যুগ, উমাপতি ধর ও জয়দেব মিশ্রের যুগ। বাংলা সাহিত্যের পেট্রনযুগ।

হিন্দুযুগের পর মুসলমানযুগেও এই রাজা—পেট্রনদের প্রভাব অপ্রতিহত ছিল। থাকাই স্বাভাবিক। কারণ মুসলমানযুগে শুধু রাজসিংহাসন বদল হয়েছিল, রাজ্যের বা সমাজের আভ্যন্তরিক অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ সমাজের গড়ন বদলায়নি এবং এমন কোনো শক্তি বা আদর্শ সমাজজীবনে সঞ্চারিত হয়নি, যার ফলে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। ব্রিটিশযুগে নতুন শক্তি ও নতুন আদর্শের প্রভাবে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছিল সমাজে। তাও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে পেট্রনযুগের প্রভাব দীর্ঘকাল অক্ষুণ্ণ ছিল ব্রিটিশযুগেও। সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। তারপর—প্রকাশকের যুগ। সে কথা পরে বলছি। তার আগে পেট্রনযুগ—প্রসঙ্গে মুসলমানযুগ সম্বন্ধে যৎসামান্য কিছু বলা প্রয়োজন। সাহিত্য ও সাহিত্যিকের ইতিহাসে পেট্রনের মাহাত্ম্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করা তা না হলে সম্ভব নয়।

যদিও লক্ষ্মণসেনের সভাকবিরা তাঁর বীরত্বের খুব প্রশস্তি গেয়েছেন, যদিও কবি শরণ বলেছেন—

”ভ্রূক্ষেপাদ গৌড়লক্ষ্মীং জয়তি বিজয়তে কেলিমাত্রাৎ কলিঙ্গান্”

যিনি ভ্রূক্ষেপমাদ গৌড়লক্ষ্মীকে জয় করেছেন, ক্রীড়াচ্ছলে কলিঙ্গদেশ বিজয় করেছেন এবং ”স্বেচ্ছা ম্লেচ্ছান বিনাশং”—স্বেচ্ছায় ম্লেচ্ছদের বিনাশ করেছেন!! যদিও উমাপতি ধর বলেছেন—

সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র সাধু ভবতো মাতৈব বীরপ্রসূর

নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ত্ততে—

”ম্লেচ্ছরাজ, সাধু সাধু! আপনার মাতাই যথার্থ বীরপ্রসবিনী। নীচবংশজাত হলেও আপনার মতন লোকের জন্য এখন পৃথিবী সুক্ষত্রিয় রয়েছে”, কারণ—

দেবে কুট্যতি যস্য বৈরিপরিষন্মারাঙ্কমল্লে পুরঃ

শন্ত্রং শস্ত্রমিতিস্ফুরন্তি রসনাপত্রান্তরালে গিরঃ।

”মারাঙ্কমল্লদেব (বীর লক্ষ্মণসেন) যখন সাক্ষাৎভাবে শত্রুসৈন্য ধ্বংস করছিলেন তখন জিহ্বারূপ পত্রান্তরাল থেকে শস্ত্র, শস্ত্র—আপনার এই বাক্য ঘন ঘন নির্গত হচ্ছিল”—তাহলেও ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যাতে লক্ষ্মণসেনের সভাকবিদের এই নির্জলা প্রশস্তি সমর্থন করা যায়। পেট্রনপ্রশস্তি ভিন্ন পেট্রন—যুগের কবি ও পণ্ডিতদের বাঁচার উপায় ছিল না। ক্ষাত্র বাহুবল যে তখন কী পরিমাণে দৈববলের উপর নির্ভরশীল ছিল, তা মন্ত্র—তুক—তাকের সাহায্যে যুদ্ধে জয়ী হবার নীতি প্রচার থেকেই বোঝা যায়। গণৎকাররা ও দৈবাচার্যরা যখন রণনীতি রচনা করতেন, তখন ওই ভাবে লক্ষ্মণসেনের গুণগান করা এবং ক্ষাত্রবলের প্রশংসা করা পেট্রন—পালিত সভাপণ্ডিত ও সভাকবিদের দ্বারাই সম্ভবপর ছিল। তখনকার তথাকথিত রণনীতির কোনো বই থেকে বীরত্বের একটু নিদর্শন দিচ্ছি। বইয়ে বলা হয়েছে যে, যদি চারদিক থেকে শত্রুসৈন্য ঘিরে দাঁড়ায়, ত হলে, শ্মশানের ছাই কয়েকটি বিশেষ গাছের ছাল ও মূলের সঙ্গে বেটে তূর্যের গায়ে ভালো করে মাখিয়ে এই মন্ত্র পড়ে বাজাতে হবে—

ওং অং হং হলিয়া হে মহেলি বিহঞ্জহি সাহিণেহি

মশাণেহি খাহি লুঞ্চহি কিলি কালি হুং ফট্ স্বাহা।

—আর শ্বেত অপরাজিতার মূল ধুতরাপাতার রসে বেটে নিজের কপালে তিলক এঁকে সর্বজ্ঞোদয় মন্ত্র জপ করতে হবে। তা হলে সেই তূর্যের শব্দ শুনে ”ভবতি পরচক্রভঙ্গঃ স্বসৈন্যবিজয়ঃ”। দৈবাচার্যরা যে—যুগে কম্যান্ডার—ইন—চিফ হয়ে বসেছেন, মশানের ছাই গাছের ছাল—মূলের সঙ্গে বেটে তূর্যের গায়ে মাখিয়ে যে—যুগে ‘হুং ফট্ স্বাহা’ বলে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই যুগের রাজার বীরত্ব ও ক্ষাত্রবলের প্রশংসা করা নির্জলা পেট্রনপ্রশস্তি ছাড়া আর কিছু নয়। পেট্রনযুগের এই হল অন্যতম বিশেষত্ব।

পাঠান—মোগল যুগে, মুসলমান শাসনকর্তাদের পোষকতায় বাংলা সাহিত্যের যে রীতিমতো শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল, তা সকলেই জানেন। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীচৈতন্য জন্মগ্রহণ করেন, আর হোসেন শাহ ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে গৌড় সিংহাসন অধিকার করেন। চৈতন্যযুগ বা ষোড়শ শতাব্দীকেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। ”কবিচক্রবর্তী—রাজপণ্ডিত—পণ্ডিত সার্বভৌম—কবি পণ্ডিত চূড়ামণি—মহাচার্য—রায়—মুকুটমণি” বৃহস্পতি মিশ্রের মনীষা সুলতান জালালউদদীনের কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল, অনেকেই জানেন। ”গৌড়াধিপাদুপচিত প্রচুর প্রতিষ্ঠঃ”—তিনি গৌড়াধিপের কাছে প্রচুর প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। বৃহস্পতি মিশ্রের পর নাম করতে হয় সনাতন ও রূপের। সকলেই জানেন, এই দুই মহাপণ্ডিত ও মহাকবি ভাই ছিলেন সুলতান হোসেন শাহের ডান—হাত, বাঁ—হাত। একজন ছিলেন ”দবীর—খাস” বা প্রাইভেট সেক্রেটারি, আর একজন ছিলেন ”সাকর—মল্লিক” বা চিফ—সেক্রেটারি। এই দুজন মহাকবি ছাড়াও হোসেন শাহের কর্মচারীদের মধ্যে আরও অনেক কবি—পণ্ডিত ছিলেন, যেমন কেশব খান ছত্রী, রামচন্দ্র খাঁ, যশোরাজ খাঁ ইত্যাদি। হোসেন শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরাত শাহের অনুগত ছিলেন ‘কবিশেখর’ উপাধিধারী দেবকীনন্দন সিংহ। নসরৎ শাহের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ শ্রীধর ব্রাহ্মণকে দিয়ে বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন। হোসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগলখান এবং তাঁর পুত্র ছুটি খানও বাঙালি কবিদের পেট্রন ছিলেন। মুসলমান ভূস্বামীরাও নিজের নিজের সভায় কবি—পণ্ডিত পোষণ করতেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় মথুরেশের ‘শব্দরত্নাবলীতে’। ‘শব্দরত্নাবলী’ অভিধানের বই। মথুরেশ ছিলেন সুলেমান খানের পৌত্র, ইশা খানের পুত্র মুসা খান মসনদআলির সভাপণ্ডিত। শব্দরত্নাবলীর উপক্রমে ও উপসংহারে মথুরেশ যেভাবে তাঁর পেট্রন মুসা খানের ও তাঁর ভাইদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, তা উদ্ধৃত করবার মতন। যেমন—

যল্লক্ষ্মীর্বরবৈরিণাং কুলবধূসিন্দুর বিধ্বংসিনী

যদ্বাণী ললিতা সতাং গুণবতামানন্দকল্লোলিনী।

যদ্বব্রহ্মোত্তরকল্পনা বিজয়িনী কর্ণাদিপৃথ্বীভুজং

সোহয়ং শ্রীমশনন্দ এল্লিনৃপতির্জীয়াচ চিরৎ ভূতলে।

”যাঁর সৌভাগ্যে প্রধান শত্রুবর্গের কুলবধূদের সিঁদুর মুছে যায়, যাঁর ললিতবাণী সৎ ও গুণবান লোকের হৃদয়ে আনন্দনদী বইয়ে দেয় যাঁর দান—প্রাচুর্য কর্ণ প্রভৃতি রাজাদের (যশ) পরাজিত করেছে, এই সেই মসনদ আলি নৃপতি, পৃথিবীতে চিরজীবী হোন।” একেই বলে সভাপণ্ডিত ও সভাকবির পেট্রন—প্রশস্তি এবং পেট্রনপোষ্য সাহিত্যের এই হ’ল মাহাত্ম্য। শুধু মসনদ আলির মহিমাকীর্তন নয়, তাঁর অনুজ মহম্মদ খান ও আবদুল্লা খানের গুণগান করতেও মথুরেশ কুণ্ঠিত হননি। মহম্মদ খান সম্বন্ধে মথুরেশ বলেছেন—

শ্রীমৎখান মহম্মদস্তনুজো মধ্যাহ্নচণ্ডদ্যুতি—

বৈরিপ্রৌঢ়িঘনান্ধকারশমনো গাম্ভীর্যধৈর্যোন্নতিঃ—

 —ইত্যাদি।

অর্থাৎ ”তাঁর অনুজ শ্রীমহম্মদ খান হচ্ছেন মধ্যাহ্ন সূর্যের মতন প্রচণ্ড এবং শত্রুবর্গরূপ ঘনান্ধকারে শমনস্বরূপ। গাম্ভীর্যে ও ধৈর্যে তিনি উন্নত।” তারপরই মথুরেশ তাঁর অনুজ আবদুল্লা খান সম্বন্ধে বলছেন—

এতাস্মাদনুজশ্চিরং বিজয়তাং বীরেন্দ্রচূড়ামণিঃ

শ্রীমৎকামসহোদরোহোতিরসিকঃ খানাবতুল্লাহ্বয়ঃ।

—”চিরকাল বিজয়ী হোন তাঁর অনুজ আবদুল্লা খান যিনি বীরেন্দ্র চূড়ামণি, কন্দর্প—সহোদর, অতি রসিক।”

বাংলাদেশের রাজসভায় মহাভারত পাঠ অনেকদিন ধরে চলে আসছিল। রাজসভায় যাঁরা মহাভারত—পুরাণাদি পাঠ করতেন তাঁরাই ”পাঠক” নামে পরিচিত হতেন। প্রাচীন সাহিত্যে ভারত—পাচালীর উদ্ভব ও প্রসার প্রধানত রাজদরবারের পোষকতাতেই হয়েছিল। পরমেশ্বর দাস, শ্রীকর নন্দী, রামচন্দ্র খান, কাশীরাম সকলেই এই পেট্রন—পোষকতার কথা লিখে গেছেন। গ্রন্থারম্ভে পরমেশ্বর দাস বলেছেন :

ভূপতি হোসেন শাহা হএ মহামতি

পঞ্চম গৌড়ে ত যার পরম যে খ্যাতি

অস্ত্রেশস্ত্রে বিশারদ প্রতাপে অপার

কলিযুগে এই ভেল পৃথিবীর সার।

ভণিতায় কবি অনেকবার পরাগল খানের ভারত—কাহিনির প্রিয়তার কথা ও মুক্তহস্তে দানের কথা বলেছেন—

লস্কর পরাগল গুণের নিধান

অষ্টাদশ ভারথে যাহার অবধান।

দানে কল্পতরু সে যে মহাগুণশালী

কতূহলে করাইল ভারত—পাঞ্চালী।

শ্রীকর নন্দীও তাঁর পেট্রন নসরৎ খাঁ ওরফে ছুটি খাঁ সম্বন্ধে লিখেছেন—

নৃপতি হোসেন শাহা হয় ক্ষিতিপতি

সাম—দান—দণ্ড—ভেদে পালে বসুমতী।

তান এক সেনাপতি লস্কর ছুটি খান

ত্রিপুরা গড়েতে গিয়া কৈল সম্বিধান।

কাব্যরচনার ইতিহাস এই—

অশ্বমেধ কথা শুনি প্রসন্ন হৃদয়

সভা খণ্ডে আদেশিল খান মহাশয়।

তাহান আদেশমাল্য মাথে আরোপিয়া

… … … …

শ্রীকর নন্দী এ কহে পাঞ্চালী রচিয়া।

রাজসভার পোষকতায় সাহিত্যের চর্চা ও উন্নতি যে কীভাবে হয়েছিল, এগুলি তার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। পেট্রনের পোষকতা ছাড়া সাহিত্যচর্চা সম্ভব হত না এবং পেট্রনের অনুগ্রহজীবী হওয়া ছাড়া কবি—পণ্ডিতদের উপায়ও ছিল না।

পঞ্চম প্রস্তাব

বাংলাদেশের প্রান্তীয় রাজসভাতেও পৌরাণিক ও রোমান্টিক কাব্যের চর্চা অব্যাহতগতিতে চলত। কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ ও তাঁর বীর ভাই শুক্লধ্বজ বা ”চিলা রায়” কবি—পণ্ডিতদের বিশেষভাবে সমাদর করতেন। সাহিত্যের পেট্রনযুগে কোচবিহারের রাজাদের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শুক্লধ্বজের আগ্রহে ও উৎসাহে কবি অনিরুদ্ধ মহাভারত—পাঁচালী রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। অনিরুদ্ধের উপাধি ছিল ”রামসরস্বতী”। তাঁর অগ্রজের নাম ছিল (বা উপাধি) ‘কবিচন্দ্র’। অনিরুদ্ধ শুক্লধ্বজের সভায় পুরাণ পাঠক ছিলেন, কবিচন্দ্র সম্ভবতঃ নরনারায়ণের সভাকবি বা পাঠক ছিলেন। নরনারায়ণের বিদ্বৎপ্রীতি বর্ণনা করে রাম সরস্বতী লিখেছেন—

জয় নরনারায়ণ নৃপতিপ্রধান

যাহার সমান রাজা নাহিক যে আন।

ধর্মনীতি পুরাণ ভারত শাস্ত্র যত

অহোরাত্রি বিচারন্ত করিয়ে সতত।

নরনারায়ণের অনুজ শুক্লধ্বজ সম্বন্ধে রাম সরস্বতী বলেছেন—

শুক্লধ্বজ অনুজ যাহার যুবরাজ

পরমগহন অতি অদ্ভুত—কাজ।

তেঁহো মোক বুলিলপ্ত মহাহর্ষ মনে

ভারত—পয়ার তুমি করিয়ো যতনে।

আমার ঘরত আছে ভারত প্রশস্ত

নিয়োক আপন গৃহে দিলোহোঁ সমস্ত।

এহা বুলি রাজা পাছে বলধি যোড়াই

পঠাইল পুস্তক আমাসাক ঠাঁই।

খাইবার সকল দ্রব্য দিলন্ত অপার

দাস—দাসী দিলা নাম করাইলা আমার।

এতেক তাহান আজ্ঞা ধরিয়া শিরত

কৃষ্ণের যুগলপদ ধরি হৃদয়ত।

বিরচিলো পদ ইতো অতি অনুপাম—

শুক্লধ্বজ মহাহর্ষমনে রাম সরস্বতীকে বলেছিলেন—”ভারত—পয়ার তুমি করিয়ো যতনে।” শুধু বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বইপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, খাদ্যদ্রব্য ও দাসদাসী দিয়েছিলেন কবিকে। তবেই কাব্যরচনা করা সম্ভব হয়েছিল। পেট্রনযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লক্ষণীয় হল, সভাকবি প্রথমে রাজার আজ্ঞা শিরোধার্য করে, পরে কৃষ্ণের যুগলপদ হৃদয়ে ধারণ করেছেন। অর্থাৎ পেট্রন রাজার আদেশ আগে, তারপর দেবতা পতিভক্তি—ভালোবাসা ইত্যাদি। আগে শুক্লধ্বজের আদেশ, তারপর কৃষ্ণের যুগলপদ। সর্বাগ্রে পেট্রন—বন্দনা, তারপর দেবতা—বন্দনা। পেট্রনের চেয়ে বড় দেবতা পেট্রনযুগে আর কেউ ছিলেন না। তাই সবার আগে, সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত ভাষায় ও ছন্দে সভাকবিরা পেট্রন—বন্দনা করে গেছেন। রাম সরস্বতীকে প্রথমে বলতে হয়েছে—’এতেক তাহান আজ্ঞা ধরিয়া শিরত’—তারপর ‘কৃষ্ণের যুগলপদ ধরি হৃদয়ত।’ শির বড়, না হৃদয় বড়, এখানে তা নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। বাস্তব সমাজে বিগলিত হৃদয়ের তুলনায় উন্নত শিরের মর্যাদাই যখন বেশি, তখন শিরই বড়, হৃদয় তুচ্ছ।

কামরূপ রাজ্যে বা কাঙুর কামতায় রাজসভার পোষকতায় সাহিত্যের রীতিমতো চর্চা হয়েছিল একসময়। কামরূপ সাহিত্যের গোষ্ঠীপতি ছিলেন শঙ্করদেব (শঙ্করাচার্য নন)। শঙ্করদেব ও তাঁর শিষ্য—উপশিষ্যরা এক বিচিত্র বৈষ্ণব সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন। পেট্রন নরনারায়ণ ও শুক্লধ্বজের প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য নিবেদন করার জন্য শঙ্করদেব মল্লরাজের (মল্লভূমের রাজা নন) উদ্দেশে একাধিক ‘ভটিমা’ পদ রচনা করেছিলেন। যেমন—

হাসি সুভাষিত করোঁ বহু ধীর

মল্ল—নৃপতি সম নাহি—কয় বীর।

কাশী—বারাণসী গৌড় পর্যন্তে

মল্ল—নৃপতিকে সব মহিমা কহন্তে।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে বারাণসীর পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ ‘প্রাণাভরণ’ কাব্য লিখে মহারাজ প্রাণনারায়ণের প্রশস্তি গেয়েছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা যখন পরম বৈষ্ণব হয়ে পড়েন এবং সাহিত্যচর্চার পোষকতা করতে থাকেন, তখন থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ—পশ্চিম রাঢ়ে এমন কোনো কবি ছিলেন না যিনি মল্লরাজবংশের (বাঁকুড়া—বিষ্ণুপুরের) প্রশস্তি গাননি। বাংলার পূর্ব—দক্ষিণ প্রান্তে ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যদেব নিজে সুকবি ছিলেন বলে শোনা যায়। ইনি ‘সৎকাব্য—রত্নাকর’ নামে কাব্যসংকলন করেছিলেন। ভুলুয়ার রাজসভায় ন্যায়শাস্ত্রেরও খুব চর্চা হত। লক্ষ্মণমাণিক্যদেবের সভাকবি ‘কবিতার্কিক’ তাঁর ‘কৌতুকরত্নাকর’ প্রহসনের প্রারম্ভে ভুলুয়া রাজধানীর ও রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যদেবের প্রশংসা করেছেন। মঙ্গলকাব্যের কবিরা অনেকে বর্ধমানের রাজবংশের প্রশস্তি গেয়েছেন নানাভাবে।

রাজা—মহারাজা বা ভূস্বামীদের বেশ শাঁসাল পেট্রনরূপে না পেলে কবিদের যে কি দুর্গতি হত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জীবনালেখ্য থেকে। বাংলাদেশে পাঠান রাজশক্তি তখন অস্তগামী। দেশের মধ্যে জায়গিরদার ও জমিদাররা প্রায় অরাজকতার সৃষ্টি করছেন। রাজকর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতার সীমা নেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ। ন্যায়বিচার নেই, নিরাপত্তা নেই, শান্তি—শৃঙ্খলা নেই। এই অবস্থায় মুকুন্দরামের পূর্বপুরুষরা যাঁর তালুকে ছয়সাত পুরুষ ধরে বাস করেছিলেন, সেই দামিন্যার তালুকদার গোপীনাথ নন্দীও বকেয়া রাজস্বের দায়ে বন্দি হলেন—

 প্রভু গোপীনাথ নন্দী বিপাকে হইলা বন্দী

 কোন হেতু নাহি পরিত্রাণে।

মুকুন্দরামও খাজনার দায়ে পড়ে স্ত্রীপুত্র—ভাই সঙ্গে করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। ভেলিয়া গাঁয়ে পৌঁছে দুষ্টুলোকের পাল্লায় পড়ে যখন তাঁর সর্বস্ব খোয়া গেল তখন যদু কুণ্ডু তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কবি লিখেছেন—

 ভাল্যায়েতে উপনীত রূপরায় নিল বিত্ত

 যদু কুণ্ডু তেলি কৈল রক্ষা।

 দিয়া আপনার ঘর নিবারণ কৈল ডর

 তিন দিবসের দিল ভিক্ষা।।

মুড়াই নদী (মুণ্ডেশ্বরী) বেয়ে মুকুন্দরাম ভেঙট্যা (বা কেঁউটা) গ্রামে উপস্থিত হলেন। তারপর দ্বারকেশ্বর উত্তীর্ণ হয়ে পাতুল গ্রামে পৌঁছলেন। সেখানে কবির মাতুলপুত্র গঙ্গাদাস তাঁকে খুব সাহায্য করেছিলেন। তারপর তাঁরা দামোদর পার হয়ে গোচড়্যা গ্রামে গেলেন। সেখানে কবির জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। কবির মায়ের রূপ ধরে দেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে কৃতার্থ করলেন। তারপর—

 চণ্ডীর আদেশ পাই শিলাই পারাইয়া যাই

 আরড়াতে হৈলাম উপসন্নে।

আরড়া ব্রাহ্মণভূমি।* স্থানীয় ভূস্বামীও ব্রাহ্মণ। নাম বাঁকুড়া রায়। তাঁর দ্বারস্থ হয়ে কবি যখন আত্মপরিচয় দিলেন তখন খুশি হয়ে রাজা বাঁকুড়া রায় অবিলম্বে দশ আড়া ধান মেপে দিয়ে তাঁকে ছেলেদের শিক্ষক নিযুক্ত করলেন। কবি লিখেছেন—

 সুধন্য বাঁকুড়া রায় আঙ্গিল সকল দায়

 সুত—পাঠে কৈল নিয়োজিত

 তাঁর সুত রঘুনাথ দ্বিজকুলে অবদাত

 গুরু করি পূজিল বিহিত।

তারপর সুখে—দুঃখে কবির দিন কাটতে লাগল। বাঁকুড়া রায়ের পর রঘুনাথ রায় রাজা হ’লেন। কবিরও সুদিন দেখা দিল। কবি কিন্তু স্বপ্নের কথা ইতিমধ্যে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন, যদিও ডামাল নন্দী তাঁকে প্রায়ই সেকথা মনে করিয়ে দিত—

 সঙ্গে ছিল ডামাল নন্দী সে জানে স্বপন—সন্ধি

 অনুদিন করয়ে যতন।

অবশেষে পুত্রের মৃত্যু কবিকে সচেতন করল। দুঃখ করে একদিন তিনি রাজাকে বললেন—

 কি আর কহিব কাজ কহিতে বড়ই লাজ

 গীত না করিয়া মৈল ছাল্যা

 শুন রঘু নরপতি দুঃখে কর অবগতি

 অকালে বিকাইল মোর হাল্যা।

শুনে রঘুনাথ অবিলম্বে ”চণ্ডীমঙ্গল” রচনা করতে অনুরোধ করলেন। তারপর সম্পূর্ণ কাব্য রচিত হয়ে যখন গীত হল, তখন প্রচলিত প্রথানুসারে রাজা কবিকে ও গায়েনকে যথোচিত পুরস্কার দিলেন—

 কানে সোনা করে বালা গলে দিল কণ্ঠমালা

 গায়েনের দিলেন ভূষণ।

পেট্রনযুগের আসল রূপটি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের জীবনে যেমনভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, এরকম আর কারও জীবনে বোধ হয় হয়নি। তাঁর জীবনের প্রতি পর্বে এই কথাই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পেট্রনপ্রধান যুগে কাব্যচর্চা বা সাহিত্যচর্চা পেট্রনের পক্ষপুটে না থেকে করা সম্ভব নয়। ”প্রভু গোপীনাথ নন্দীর” তালুক দামিন্যায় (বর্ধমানে) যখন মুকুন্দরাম বাস করতেন তখন তাঁর কাব্যশক্তির বিকাশ তেমন হয়নি। প্রভুর তালুক যখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল তখন প্রভুহীন মুকুন্দরাম নোঙরহীন নৌকার মতন জীবন—সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে চললেন। কোথায় কিনারা, তার কোনো ইশারাও পেলেন না কোথাও। রূপরায়ের বিত্তহরণের পর যদু কুণ্ডুর কাছে আশ্রয় পেলেন বটে, কিন্তু মাত্র তিনদিনের জন্য। পাতুল গ্রামে মাতুলপুত্রের সাহায্যও বিশেষ কাজে লাগেনি। গোচড়া গ্রামে দেবীকে স্বপ্ন দেখলেন, কিন্তু তাতেও কিছু হল না। পেট্রনযুগের মাহাত্ম্যের দিক থেকে কবিকঙ্কণের জীবনের এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পেট্রনের মাহাত্ম্যের কাছে স্বয়ং দেবদেবীর মাহাত্ম্যও যে কিছু নয়, মুকুন্দরামের জীবনের এই ঘটনা তার ঐতিহাসিক প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়। স্বপ্নে দেবীদর্শনের পরেও কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সম্ভব হল না, কারণ তখনও হতভাগ্য কবির জীবনে পেট্রনদর্শনে ঘটেনি। দেবী স্বপ্নে তাঁকে পেট্রনের সন্ধান দিয়ে দিলেন, তবে তিনি আরড়াতে গিয়ে বাঁকুড়া রায়ের দেখা পেলেন। কবির জীবনে দেবী চণ্ডীর চেয়ে ভূস্বামী বাঁকুড়া রায়ের প্রাধান্য অনেক বেশি, কারণ তিনি পেট্রনের কবি। তাও আবার বাঁকুড়া রায় তাঁকে দশ আড়ি ধান মেপে দিয়ে পুত্রের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন। কবি হবার সুযোগ তখনও পেলেন না মুকুন্দরাম, প্রাইভেট টিউটর হয়ে রইলেন। মাস্টারি করতে করতে দেবীর স্বপ্নের কথা তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। তারপর রঘুনাথ রায় যখন রাজা হলেন এবং রাজা হয়ে তাঁকে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনার আদেশ দিলেন, তখন তাঁর কাব্যপ্রতিভার বিকাশ হল, প্রায় শেষ জীবনে। অর্থাৎ পেট্রনের যখন সত্যিই আবির্ভাব হল জীবনে, তখন তিনি ‘প্রাইভেট টিউটর’ থেকে ‘পোয়েট’ হবার সুযোগ পেলেন এবং কাব্য রচনা করে রাজার কাছ থেকে ‘কানে সোনা, করে বালা’, ‘গলে কণ্ঠমালা’, ‘করাঙ্গুলি রতনভূষণ’ ইত্যাদি উপহার পেলেন।

পেট্রনযুগের এই নিয়ম। পেট্রন দেবতা, পেট্রন দেবতা, পেট্রনই হর্তাকর্তাবিধাতা। পেট্রনই সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উৎসাহদাতা, অন্যতম শ্রোতা ও পাঠক। বাইরের সবকিছুর সম্রাট যিনি, সব কিছুর পেট্রন যিনি, তিনি সাহিত্যেরও সম্রাট, সাহিত্যেরও পেট্রন। তাঁর কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে কবি—পণ্ডিতদের একপাও চলবার উপায় নেই, একটি কবিতা বা একটি শ্লোক পর্যন্ত রচনা করার শক্তি নেই। যদু কুণ্ডু আর গঙ্গাদাসদের সাধ্য কি কবিকে প্রেরণা দেন? রূপরায়ের মতন দুষ্টু লোক মুকুন্দরামের বিত্তহরণ করেছিলেন বলেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ তার কাছে মুকুন্দরাম আর যে—কোনো—রাম একই কথা। আধুনিক যুগেও কি তাই নয়? পকেটমার ও চোর—ডাকাতরা এ যুগের কবি—সাহিত্যিকদের যে খাতির করে চলে, তার কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং এ বৈশিষ্ট্য শুধু পেট্রনযুগের নয়, প্রকাশক ও পাঠকের যুগেরও।

ষষ্ঠ প্রস্তাব

”…পরের মনোরঞ্জন করতে গেলে সরস্বতীর বরপুত্রও যে নটবিটের দলভুক্ত হয়ে পড়েন, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ স্বয়ং ভারতচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্রের মনোরঞ্জন করতে বাধ্য না হলে তিনি বিদ্যাসুন্দর রচনা করতেন না, কিন্তু তাঁর হাতে বিদ্যা ও সুন্দরের অপূর্ব মিলন সঙ্ঘটিত হত, কেন না knowledge এবং Art উভয়ই তাঁর সম্পূর্ণ করায়ত্ত ছিল। ‘বিদ্যাসুন্দর’ খেলনা হলেও রাজার বিলাসভবনের পাঞ্চালিকা—সুবর্ণে গঠিত, সুগঠিত এবং মণিমুক্তায় অলঙ্কৃত, তাই আজও তার যথেষ্ট মূল্য আছে—অন্ততঃ জহুরীর কাছে।” কথাগুলো কথাশিল্পী প্রমথ চৌধুরীর। কথার মতন কথা।

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের কাব্যজীবনের কাহিনি বর্ণনা করেছি। বর্ণনাপ্রসঙ্গে বলেছি, পেট্রন—কৃপাবঞ্চিত মুকুন্দরাম কীভাবে ভেলার মতন ভেসে বেড়িয়েছিলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। স্বয়ং দেবীর স্বপ্নাদেশেও তাঁর কাব্যশক্তির স্ফূরণ হয়নি। বাঁকুড়া রায়ের গৃহশিক্ষক মুকুন্দরাম কাব্যরচনার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন একরকম বলা চলে। যতদিন না রঘুনাথ রায় তাঁর জীবনে পেট্রনরূপে আবির্ভূত হন এবং তাঁকে কাব্যরচনার আদেশ দেন, ততদিন তাঁর পক্ষে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনা করা সম্ভব হয়নি। পেট্রনযুগের এই হল ঐতিহাসিক বিশেষত্ব। পেট্রনযুগ থেকে প্রকাশকের যুগে অবতীর্ণ হবার আগে সন্ধিক্ষণের কবিদের কথাও বলা প্রয়োজন। আধুনিক যুগের কবির সমস্ত গুণ থাকা সত্ত্বেও ভারতচন্দ্রের মতন প্রতিভাবান কবি পেট্রনের মনোরঞ্জনের জন্য যে কীভাবে আত্মবিক্রয় করেছিলেন এবং শিক্ষা ও রুচি বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেকথা প্রমথ চৌধুরী মশাই তাঁর ‘বীরবলের হালখাতা’র মধ্যে উল্লেখ করেছেন। আগেই তাঁর সেই উক্তি উদ্ধৃত করেছি। ভারতচন্দ্রের পরবর্তী কবিদের মধ্যে পেট্রনযুগের হতভাগ্য নায়কস্বরূপ বাংলাদেশের কবিয়ালদের নাম করতে হয় সর্বাগ্রে। বনেদি পেট্রন তখন বাংলা সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চ থেকে একে একে বিদায় নিচ্ছেন—ঐতিহাসিক বিদায়। উদীয়মান ব্রিটিশযুগ আর বিলীয়মান নবাবি আমলের সন্ধিক্ষণে বনেদি রাজা—মহারাজা, নবাব—বাদশাহ, জমিদার জায়গিরদারদের বদলে নতুন নতুন সব ভুঁইফোঁড় হঠাৎ—রাজা ও হঠাৎ—নবাবের দল গজিয়ে উঠছে দেশের মাটিতে। তাঁদের শিক্ষা—দীক্ষা বদলাচ্ছে, রুচি ও প্রবৃত্তিও বদলাচ্ছে। সেই নব্যযুগের হঠাৎ—নবাবদের বিকৃত রুচি পরিতৃপ্তির জন্য ডাক পড়ল বাংলাদেশের কবিয়ালদের। পেট্রনযুগের শেষ বংশধরদের বিকৃত বাসনা ও রুচি চরিতার্থ করে বাঙালি কবিয়ালরা সাহিত্যক্ষেত্র থেকে বিদায় নিলেন। কমবেশি নানাস্তরের কবিত্বশক্তি নিয়েও যে বাংলাদেশের কবিয়ালরা সাহিত্যমঞ্চে ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নব্যযুগের বিকৃতরুচি ভুঁড়িয়াল পেট্রনরাই যে তাঁদের ভাঁড় তৈরি করেছিলেন, সে—কথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

ভারতচন্দ্র ও কবিয়ালদের কথা বলে পেট্রনযুগের কাহিনি শেষ করব। প্রথমে ভারতচন্দ্রের কথা বলি। হাওড়া জেলার ভুরসুট পরগনার অন্তর্ভুক্ত পেঁড়োর জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতচন্দ্র যে কষ্টভোগ করেছিলেন যথেষ্ট, তা অনেকেই জানেন। দ্বার থেকে দ্বারান্তরে তাঁকে কাঙালের মতন ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল আশ্রয়ের জন্য। বর্ধমানের মহারাজা তাঁদের গ্রাস করেছিলেন এবং পরে রাজকর্মচারীদের চক্রান্তে ভারতচন্দ্র কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। বর্ধমানের কারাগার থেকে পালিয়ে তিনি কটকে গিয়ে শিবভট্ট নামে এক সুবাদারের আশ্রয় নেন। তাজপুরের আচার্য পরিবারে বিবাহ করেন এবং দেবানন্দপুরে রামচন্দ্র মুন্সীর কাছে ফারসি ভাষা শেখেন। তখনই তিনি সত্যপিরের কথা অবলম্বনে দুখানা কাব্য রচনা করেন, ত্রিপদী ও চৌপদী ছন্দে। কিন্তু প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও পেট্রনাভাবে তাঁর কাব্যশক্তির প্রকৃত বিকাশ হল না। ঘুরতে ঘুরতে তিনি ফরাসডাঙ্গায় আসেন এবং ফরাসি গভর্নমেন্টের ধনাঢ্য দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করে বলেন,—”মশায়! আমি আপনার আশ্রয় নিলাম, শরণাগত হলাম। যে রকম করেই হোক, আমাকে আশ্রয় দিয়ে প্রতিপালন করুন।” ইন্দ্রনারায়ণ তাঁকে আশ্রয় দিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন : ”এতদ্রূপ করুণাকর অনুকূল বচনে ভারতচন্দ্রের মানসমুকুল আনন্দকরন্দভরে প্রফুল্ল হইল”। হবারই কথা। পেট্রনযুগের এমনই মাহাত্ম্য! চৌধুরী মশায়ের জাতিঘটিত কোনো অপবাদ থাকাতে ভারতচন্দ্র তাঁর বাসায় না থেকে ডাচ গভর্নমেন্টের দেওয়ান গোন্দলপাড়া নিবাসী রামেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে থেকে আহারাদি করতেন। আহার করলেও ভারতচন্দ্র প্রতিদিন সকাল—সন্ধ্যায় চৌধুরীবাবুর কাছে হাজরে দিতে এবং উমেদারি করতে ভুলতেন না। পেট্রনযুগের কবিদের যেন অস্থিবিন্যাসই ছিল অন্যরকম। মেরুদণ্ড তাঁদের সব সময় বেঁকেই থাকত হেঁট হয়ে। কাব্যচর্চার চেয়ে মোসাহেবি ও ভাঁড়ামির চর্চাতেই তাঁরা পটু ছিলেন বেশি। পটুতা তাঁদের অর্জন করতে হয়েছিল, কারণ তা না হলে পেট্রন মনিবের মনোরঞ্জন করা সম্ভব হত না। যাইহোক, তখনও অবশ্য ভারতচন্দ্রের ভাগ্যে আসল পেট্রনদর্শন ঘটেনি।

নবদ্বীপ—কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ইন্দ্রনারায়ণের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। দুচার লক্ষ টাকা ঋণের দরকার হলে তিনি প্রায় চৌধুরীবাবুর শরণাপন্ন হতেন। একদিন তিনি ভারতচন্দ্রকে বললেন যে, কৃষ্ণচন্দ্র এলে তিনি তাঁকে তাঁর কথা বলবেন। শুনে ভারতচন্দ্রের মনে কীরকম ভাবের উদয় হয়েছিল, সে সম্বন্ধে ঈশ্বর গুপ্ত যা বলেছেন তা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। গুপ্ত কবি বলেছেন : ”এই বচনে ভারতচন্দ্র বারিষ—বদন—বিনির্গত—বারিবিন্দু পতনপ্রত্যাশী চাতকের ন্যায় মহারাজের আগমনের প্রতি প্রতিক্ষণ প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।” চাতকপক্ষীর ন্যায় মহারাজার অনুগ্রহবারিবিন্দুর প্রত্যাশায় ভারতচন্দ্র দিন গুনতে লাগলেন। অতঃপর একদিন কৃষ্ণচন্দ্র এলেন। চৌধুরী মশায় তাঁকে বললেন : ”মহারাজ! আমার একটি নিবেদন আছে। এই ভারতচন্দ্র আমার অতি আত্মীয় ব্যক্তি, অমুকের সন্তান, ভালো সংস্কৃত জানেন, ফারসি জানেন, কবিত্বশক্তি ভালো আছে। বর্তমানে দীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁকে অনুগ্রহ করে প্রতিপালন করার ব্যবস্থা করতে হবে।” মহারাজা উত্তর দিলেন : ”আমি এখন কলকাতায় চললাম। কালী দর্শন করে কালীঘাট থেকে কৃষ্ণনগরে ফিরলে উনি যেন একদিন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।”

ভারতচন্দ্র একদিন কৃষ্ণনগরে মহারাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। মহারাজা তাঁকে ৪০ টাকা মাসিক বেতন ও বাসা দিয়ে বললেন, ”প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।” মহারাজের আজ্ঞানুসারে ভারতচন্দ্র প্রতিদিন সকাল—সন্ধ্যায় রাজসভায় উপস্থিত হতেন এবং মহারাজকে ছোট ছোট স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। কৃষ্ণচন্দ্র খুশি হয়ে তাঁকে ‘গুণাকর’ উপাধি দিলেন এবং বললেন : ”ভারত! তোমার কবিতা শুনে আমি প্রীত হয়েছি। কিন্তু এরকম ছোট ছোট পদ্য শুনতে ইচ্ছা করে না।” ভারতচন্দ্র বলেন : ”যেরকম শুনতে ইচ্ছা হয়, আদেশ করুন।” তখন কৃষ্ণচন্দ্র বলেন, ”মুকুন্দরাম চক্রবর্তী যেভাবে ও ভাষায় ‘চণ্ডী’ রচনা করেছিলেন, তুমিও সেই পদ্ধতিতে ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনা কর। ভারতচন্দ্র তারপর ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনা করতে আরম্ভ করলেন। এই হল তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনার ইতিহাস।

 ভুরিশিটে মহাকায় ভূপতি নরেন্দ্র রায়

 তাঁর সুত ভারত ব্রাহ্মণ।

 কৃষ্ণচন্দ্র নৃপাজ্ঞায় অন্নদামঙ্গল গায়

 নীলমণি প্রথম গায়ন।

একদিন ব্রাহ্মণ লেখক নিযুক্ত করে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল রচনা করতে আরম্ভ করলেন। কাব্যরচনা করে গান করে শোনানো ছাড়া তখন আর অন্য কোনো উপায় ছিল না। এক—একটি পালা ভারতচন্দ্র রচনা করতেন, ব্রাহ্মণ লেখক পুঁথিতে লিখতেন এবং নীলমণি সমাদার নামক জনৈক গায়ক সেই সব পালাভুক্ত কবিতা সুর—রাগ সহযোগে পাঁচালীর মতন গান করে শোনাতেন। শুনতেন প্রধানত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কারণ তিনিই পেট্রন। আর শুনতেন অন্যান্য সভাসদরা। শুনতে শুনতে একদিন মহারাজা বললেন, ”বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান সংক্ষেপে সরলভাবে বর্ণনা ক’রে এর সঙ্গে জুড়ে দাও।” কেবল সভা বর্ণনায় মহারাজার মন উঠছিল না—

চন্দ্রে সবে ষোল কলা হ্রাস বৃদ্ধি তায়।

কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।।

পদ্মিনী মুদয়ে আঁখি চন্দ্রেরে দেখিলে।

কৃষ্ণচন্দ্রে দেখিতে পদ্মিনী আঁখি মিলে।।

চন্দ্রের হৃদয়ে কালি কলঙ্ক কেবল।

কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সর্বদা উজ্জ্বল।।

দুই পক্ষ চন্দ্রের অসিত সিত হয়।

কৃষ্ণচন্দ্রে দুই পক্ষ সদা জ্যোৎস্নাময়।।

এত স্তুতিগানেও কৃষ্ণচন্দ্র যেন আনন্দে মশগুল হতে পারছিলেন না। কারণ সভাকবির কাছ থেকে পেট্রনরূপে এই স্তবস্তুতি যে তিনি না চাইতেও পাবেন, তা তিনি জানতেন। তাঁর মনটা উসখুস করত অন্যরকম রসাস্বাদনের জন্য এবং সে—রস যে আদিরস তা বলাই বাহুল্য। তাই বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান বর্ণনার হুকুম দেওয়া হল অন্নদামঙ্গলের মধ্যে। হলই বা অন্নদামঙ্গল, তাতে কি? তার সঙ্গে ‘বিদ্যাসুন্দর’ জুড়ে দিতে ক্ষতি কি? বিশেষ করে পেট্রনের বাসনা যখন। কথাপ্রসঙ্গে একালের সিনেমার কথা মনে পড়ে। সিনেমার ডিরেক্টর যেমন প্রডিউসারের কথা বা আদেশ অনুযায়ী কাজ করেন, কোনো মহাপুরুষের জীবনচরিত অথবা কোনো আধ্যাত্মিক ও পৌরাণিক কাহিনির সিনেমার মধ্যে যেমন প্রডিউসারের খেয়াল ও রুচির জন্য হঠাৎ খেমটাওয়ালির ”বিবিজান”—গোছের নাচের দৃশ্য সংযোজন করে দিতে বাধ্য হন, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রও তেমনি তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের মধ্যে পেট্রন কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান যোগ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই প্রমথ চৌধুরী মশায় পরিহাস করে বলেছেন : ”কৃষ্ণচন্দ্রের মনোরঞ্জন ক’রতে বাধ্য না হ’লে তিনি বিদ্যাসুন্দর রচনা করতেন না, কিন্তু তাঁর হাতে বিদ্যা ও সুন্দরের অপূর্ব মিলন সংঘটিত হত।” উদার ও মহানুভব পেট্রন হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্রের যতই খ্যাতি থাকুক না কেন, নবদ্বীপাধিপতির রাজসভায় নৈতিক পরিবেশ যে কতখানি কদর্য ছিল, তার কিছু—কিছু আভাস দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের ‘আত্ম—জীবনচরিতে’ পাওয়া যায়। শিবনাথ শাস্ত্রী মশায় তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন। কৃষ্ণনগরের রাজসভার এক রাত্রির বিবরণ দিচ্ছি :

”এক রাত্রিতে রাজবাটীতে এক অপূর্ব রূপসী ও অসাধারণ সুকণ্ঠা তয়ফাওয়ালীর নৃত্যগীতে সকলেই বিমোহিত হইলেন। কেহ প্রস্তাব করিলেন যে এই রমণী সুন্দর খ্যামটা নাচিতে পারে। তখন সুরাপানে সকলেরই হৃদয় প্রফুল্লিত ছিল; সুতরাং এ—প্রস্তাবে দ্বিমত হইল না। ওই সুন্দরী যখন পেশওয়াজ ছাড়িয়া একখানি কালাপেড়ে সূক্ষ্ম ধুতি পরিয়া গৃহে প্রবেশ করিল, তখন যেন স্বর্গ—বিদ্যাধরী অবতীর্ণা হইলেন, এইরূপ দর্শকবৃন্দের ঢুলু ঢুলু নয়নে দৃষ্ট হইল। নিমন্ত্রিত মহাশয়দিগের মধ্যে কি প্রধান, কি বিজ্ঞ, কি পদস্থ, প্রায় সকলেই তাহার নৃত্যে বিমোহিত হইলেন। প্রথমে কয়েক অবিজ্ঞ যুবা আপন আপন চরণ নিজ বশে রাখিতে পারিলেন না। তাঁহারা ওই সঙ্গে নৃত্য আরম্ভ করিলেন। প্রাচীন ও পদস্থ একজনও দণ্ডায়মান হইলেন। এক বিজ্ঞবর প্রথমাবধি গম্ভীরভাবে ছিলেন, তাঁহার পদও শেষে অস্থির হইয়া উঠিল। তিনি উক্ত প্রাচীনকে নাচাইবার ছলে আপনি নাচিতে লাগিলেন।”

এই যখন রাজসভার পরিবেশ, তখন রাজার আদেশে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে যে বিদ্যাসুন্দরের উপাখ্যান এমন সরস ভঙ্গিতে যোজনা করবেন, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।* ভারতচন্দ্রের মতন প্রতিভাবান কবিকেও এইভাবে পেট্রনযুগের যূপকাষ্ঠে আত্মবলি দিতে হয়েছে। পেট্রনযুগের এই ঐতিহাসিক নিয়মের ব্যতিক্রম যেমন কোনো কবির ক্ষেত্রেই ঘটেনি, তেমনি ‘অন্নদামঙ্গলের’ কবির ক্ষেত্রেও ঘটেনি। পরবর্তীযুগের কবিয়ালদের ওই একই ট্রাজিক ইতিহাস। এইবার তাঁদের কথা বলব।

সপ্তম প্রস্তাব

”ইংরেজদের নূতন সৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না। তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি এবং সেই হঠাৎ—রাজার সভায় উপযুক্ত গান হইল কবির দলের গান। তখন যথার্থ সাহিত্যরস আলোচনার অবসর, যোগ্যতা এবং ইচ্ছা কয়জনের ছিল? তখন নূতন রাজধানীর নূতন সমৃদ্ধিশালী কর্মশ্রান্ত বণিক সম্প্রদায় সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকে বসিয়া দুই খণ্ড আমাদের উত্তেজনা চাহিত, তাহারা সাহিত্যরস চাহিত না। কবির দল তাহাদের এই অভাব পূর্ণ করিতে আসরে অবতীর্ণ হইল।” রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যবান উক্তি থেকে বাংলার কবিয়ালদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা পরিষ্কার বোঝা যায়। হান্টার সাহেব বলেছেন যে ১৭৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের প্রাচীন বনেদি জমিদারবংশের প্রায় তিনভাগের দু—ভাগ ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনভাগের একভাগ কৃষক নির্বংশ হয়ে যায়। এই সময় নতুন যুগের বিকৃতরুচি হঠাৎ—অভিজাতরাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পেট্রনরূপে অবতীর্ণ হন। তাঁদের কুরুচি ও কুশিক্ষার হাড়িকাঠে প্রথম যাঁরা আত্মবলি দেন, তাঁরাই হলেন বাংলাদেশের কবিয়াল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় একশতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাস হল প্রধানত বাংলার কবিয়ালদের ইতিহাস। এই সময় ইংরেজদের প্রয়োজনে বাংলার নতুন রাজধানীরূপে কলকাতা শহর গড়ে উঠছে। তার সঙ্গে ইংরেজের অনুগ্রহে নতুন একশ্রেণির বাঙালি ধনিক বাংলার সমাজে দেখা দিচ্ছেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ”সর্বসাধারণ নামক এক অপরিণত স্থূলায়তন ব্যক্তি” নন। আসলে ‘সর্বসাধারণ’ তখনও সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চের অন্তরালেই বিরাজ করছে। সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক, পাঠক বা শ্রোতারূপে তখনও সর্বসাধারণ সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়নি। পেট্রনের যুগ তখন অস্তাচলে গেলেও একেবারে অস্ত যায়নি। প্রাচীন অভিজাত পেট্রনগোষ্ঠী অর্থাৎ রাজা—বাদশাহ ও জমিদার জায়গিরদাররা তখন ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী নীতির চাপে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছেন। তাঁদের বদলে নতুন এক শ্রেণির ধনিক বাংলার সমাজে পেট্রনরূপে দেখা দিয়েছেন। তাঁরা ইংরেজের কৃপাজীবী দালাল, গোমস্তা, বেনিয়ান, মুতসুদ্দি, মুনশি ইত্যাদি। লাটে—ওঠা জমিদারি কিনে তাঁরা নব্যযুগের অভিজাতশ্রেণিতে রূপান্তরিত হচ্ছেন। এক বিচিত্র শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে বাংলার সমাজে, পুরাতন শ্রেণিবিন্যাসকে ভেঙেচুরে দিয়ে। ধীরে ধীরে হলেও, বাংলার সমাজে এক নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। অশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত ইংরেজ প্রভুদের আচার—ব্যবহার, রুচি—নীতির সঙ্গে এদেশি ঐতিহ্যের যা কিছু কদর্য তলানি তার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তাকে আত্মসাৎ করলেন তাঁরা। নব্যযুগের প্রথম পর্বের বাঙালি মধ্যবিত্তের এই হল অন্যতম চারিত্রিক বিশেষত্ব। তখনও প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হয়নি। প্রকৃত সামাজিক আদর্শ একটা সুসমন্বিত রূপ ধারণ করেনি। নতুন যুগের বিকট নতুনত্ব তখন চারিদিক থেকে কদর্যভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। বাঙালি কবিয়ালরা কিছুটা পরিমাণে প্রথম পর্বের এই উদীয়মান ছিন্নমূল মধ্যবিত্তশ্রেণির অপরিণত, অশিক্ষিত ও অমার্জিত মনের খোরাক জুগিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ঠিক ‘সর্বসাধারণের’ কোঠায় ফেলা যায় না। তাঁরা সর্বসাধারণ নন। এ যুগের শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির বিপুল কলেবর ও বিচিত্র রুচি দেখে সে—যুগের মুষ্টিমেয় অর্ধশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত স্থূলরুচি মধ্যবিত্তের স্বরূপ সঠিকভাবে উপলব্ধি করা বাস্তবিকই কঠিন। এই মুষ্টিমেয় স্থূলরুচি মধ্যবিত্তশ্রেণি তখনও ঠিক একটা সামাজিক শ্রেণিরূপে স্বাতন্ত্র্যে লাভ করেনি। সে—রকম ঐতিহাসিক চেতনাও তার তখন ছিল না, অন্তত অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। নতুন অভিজাতশ্রেণির অবিচ্ছেদ্য লেজুড়ের মতন ছিলেন তাঁরা। নতুন অভিজাত ধনিকরা পুরাতন রাজা নন, হঠাৎ—রাজা। তাঁদের কোনো বনেদি ঐতিহ্য নেই। কোনো শিক্ষাদীক্ষা, কোনো নীতি বা রুচির বালাই নেই। ভুঁইফোড় অভিজাতদের থাকেও না কোনোদিন। এই ভুঁইফোড় বাঙালি হঠাৎ রাজারাই হলেন সেকাল—একালের সন্ধিক্ষণের পেট্রন। বাংলার কবিয়ালরা প্রধানত তাঁদেরই অনুগ্রহজীবী ছিলেন।

সেকাল আর একালের সন্ধিক্ষণের কবি হলেন কবিয়ালরা। এই কবিয়ালদের কবিসংগীতের ধারাতেই বাংলার সন্ধিক্ষণের শ্রেষ্ঠ কবি ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল বাংলা সাহিত্যের আসরে আর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিভা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। এই সময় কবিয়ালরাই সাহিত্যের ফাঁকা আসর জাঁকিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিভার চিরস্থায়ী স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেননি কেউ। ড. সুশীলকুমার দে তাঁর ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসগ্রন্থে এই কবিয়ালদের চমৎকার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর আগে আর কেউ এইভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের বিশ্লেষণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। ড. দে বলেছেন :

“Between the death of Bharatchandra in 1760 and the first appearance of Iswar Gupta in ‘Sambadprabhakar’ of 1830, there came an interregnum of more than half a centrury during which there was no man who had been strong enough to seize the unclaimed sceptre. The only Pretenders were the Kabiwallahs, but they never rose to that level of artistic merit and sustainded literary composition which would have enables them to strike a commanding figure on the empty stage. Who would think of placing Haru Thakur or Ram Basu side by side with Bharatchandra or Ramprasad?”

কবিয়ালদের মধ্যে প্রতিভার লক্ষণ যে আদৌ ছিল না তা নয়। কবিত্বশক্তিসম্পন্ন কবিয়াল অনেকে ছিলেন। হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, রাম বসু, ভোলা ময়রা প্রভৃতির স্বাভাবিক কাব্যশক্তির অভাব ছিল না। কিন্তু নব্যযুগের হঠাৎ—রাজাদের কুরুচি চরিতার্থ করার জন্যই প্রধানত তাঁরা তাঁদের স্বকীয় প্রতিভা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষাদীক্ষারও তাঁদের অভাব ছিল। তাই কেউ তেমনভাবে নিজের প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

”তাহারা পূর্ববর্তী গুণীদের গানে অনেক পরিমাণে জল এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণে চটক মিশাইয়া, তাহাদের ছন্দোবদ্ধ সৌন্দর্য সমস্ত ভাঙিয়া নিতান্ত সুলভ করিয়া দিয়া অত্যন্ত লঘু স্বরে উচ্চৈস্বরে চারি জোড়া ঢোল ও চারিখানি কাঁসি সহযোগে সদলে সবলে চীৎকার করিয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে লাগিল।”

গুণীদের গানের সঙ্গে অনেকটা জল এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণে চটক মেশাতে কবিয়ালরা বাধ্য হয়েছিলেন, বাঙালি হঠাৎ—রাজাদের মেজাজ ও রুচি পরিতৃপ্তির জন্য। হঠাৎ—রাজারাই ছিলেন নব্যযুগের প্রধান পেট্রন। প্রাচীন বনেদি রাজাদের সভাকবিরা যেমনভাবে তাঁদের পেট্রনদের বাসনা ও কামনা চরিতার্থ করতেন। হুকুম মাফিক কাব্য রচনা করে, নব্যযুগের কবিয়ালরাও তাই করতেন হঠাৎ—রাজাদের খুশি করবার জন্য। প্রাচীন রাজসভার আশ্রয় অনেক বেশি আরামের ছিল। নিশ্চিন্ততাও ছিল সভাকবির অনেক বেশি। কিন্তু হঠাৎ—রাজাদের সে রকম কোনো রাজসভা ছিল না। মহারাজা নবকৃষ্ণের মতন দু—একজনের রাজসভা ছিল অবশ্য এবং তাঁরা হরু ঠাকুরের মতন দু—একজন কবিয়ালকে পোষণও করতেন। কিন্তু সকলের রাজসভা ছিল না মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতন, কোচবিহারের রাজার মতন, বর্ধমানের মহারাজার মতন, বিষ্ণুপুরের রাজার মতন অথবা লক্ষ্মণসেনের রাজসভার মতন। সুতরাং ধোয়ী বা উমাপতি ধরের মতন, বা ভারতচন্দ্রের মতন, এমনকী মুকুন্দরামের মতন কবিয়ালদের সকলের ভাগ্যে রাজামহারাজা অথবা ভূস্বামী পেট্রন জোটেনি। তাঁরা নব্যযুগের ধনিক বাবুদের বৈঠকখানা থেকে বৈঠকখানায়, বারোয়ারিতলা থেকে বারোয়ারিতলায় ভেলার মতন ভেসে ভেসে বেড়িয়েছেন, কোনো রাজসভার স্থায়ী পোষকতা পাননি। বাবুদের বিচিত্র মর্জি, নানারকমের রুচি ও কুরুচির খোরাক জুগিয়েছেন তাঁরা। দরজায় দরজায় কাব্যের পসরা নিয়ে তাঁদের ফিরি করে বেড়াতে হয়েছে। বড় বড় রাজা—মহারাজারা নবকৃষ্ণের মতন পূজা—পার্বণে, বিবাহে, উৎসবে, শ্রাদ্ধে, অন্নপ্রাশনে নিজেদের গৃহে এই কবিয়ালদের ডেকে কবির গান শুনতেন। হুকুম দিয়ে নিজেদের রুচি মাফিক গান রচনা করতে বলতেন তাঁদের অধিকাংশ সময়। গানের শেষে তাঁদের দক্ষিণা ও পারিতোষিক দিয়ে বিদায় করতেন। এইভাবে অধিকাংশ কবিয়ালের জীবিকা অর্জন করতে হত। একজন প্রভুর আশ্রয়ে থেকে অথবা একজন ধনিক পেট্রনের রুচি পরিতৃপ্ত করে তাঁদের দিন কাটত না। বাংলার কবিয়ালরা ছিলেন কাব্যের ফিরিওয়ালা। এইদিক থেকে বিচার করলে কবিয়ালদের ইতিহাস সত্যিই যুগান্তকারী ইতিহাস। তাঁরা সাহিত্যের এক নবযুগের প্রবর্তক অথবা এক অভিনব নবযুগের প্রতিনিধি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁদের নিয়েই শুরু। আমরা আধুনিক প্রকাশক ও সাধারণ পাঠকযুগের সাহিত্যিকরা বাংলার এই কবিয়ালদেরই বংশধর। প্রাচীন পেট্রনযুগের রাজসভা আর নেই, রাজাও নেই। প্রাচীন যুগের সভাকবির নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার পর্বও শেষ হয়েছে বলা চলে। ইংরেজ আমলে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়েছে—আধুনিক পেট্রনের যুগ, অর্থাৎ নতুন ধনিক শ্রেণির ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুগ। একজন রাজা নয়, একাধিক রাজা ও পেট্রনগোষ্ঠীর যুগ রাজসভার বদলে জনসভার যুগ। রাজসভা থেকে জনসভায় যাত্রাকালে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা এই বাঙালি কবিয়ালদের দেখতে পাই। যুগসন্ধিক্ষণে প্রতিনিধিরূপে কবিয়ালরা তাই স্মরণীয়।

পেট্রনের যুগ থেকে প্রকাশক ও পাঠকের যুগে আমরা অবতীর্ণ হচ্ছি। তারই সন্ধিক্ষণে এই কবিয়ালদের আবির্ভাব হল বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে। নবযুগের হঠাৎ—রাজাদের বিকৃত রুচি চরিতার্থ করেছেন কবিয়ালরা ঠিকই, কিন্তু কোনো রাজার কেনা গোলাম যে তাঁরা নন তাও তাঁরা প্রমাণ করেছেন। ধনিক শৌখীন বাবুরা সখের কবিদল, যাত্রার দল, আখড়াই গানের দল ইত্যাদি গঠন করেছেন ঠিকই এবং এ রকম অনেক দলের পোষকতাও যে করেছেন তাতেও কোনো ভুল নেই। দুএকজন হঠাৎ—রাজা সখ করে কবিয়াল পোষণও করতেন শোভাবাজারের রাজাদের মতন। এ সবই সত্য। কিন্তু সব সত্যের মধ্যেও সবচেয়ে বড় সত্য হল এই যে, প্রাচীন রাজসভার সভাকবিদের মতন কবিয়ালরা তাঁদের পেট্রনদের উপর একান্ত নির্ভরশীল ছিলেন না। তাঁরা কারও আশ্রিত বা কারও পোষা ক্রীতদাস ছিলেন না। হঠাৎ—রাজার রুচি চরিতার্থ করলেও তাঁর স্তাবকতা করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। কবিয়ালদের একটা স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা ছিল। এইটাই সবচেয়ে বড় কথা। সেই স্বাতন্ত্র্য যে সব সময় তাঁরা জলাঞ্জলি দিতেন, তাও সত্য নয়। নব্যযুগের হঠাৎ—রাজাদের ও ধনিক বাবুদের কুরুচি তাঁরা যেমন চরিতার্থ করেছেন, তেমনি আবার তীব্র বিদ্রুপবাণে তাঁদের আচার—ব্যবহার, রুচি—নীতিকে জর্জরিতও করেছেন তাঁরা। কোনো রাজসভার আশ্রিত কবির কোনোকালেই তা করার সাহস হত না। ধোয়ী, উমাপতি থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত কেউ করবার সাহস পাননি। অথচ কাব্যপ্রতিভা তাঁদের অনেক বেশি ছিল, শক্তিশালী কবিও ছিলেন তাঁরা যথেষ্ট। কিন্তু কবির আত্মমর্যাদাবোধ তাঁদের ছিল না, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধও ছিল না। কবিয়ালরা তাঁদের তুলনায় নিকৃষ্ট—প্রতিভা ঠিকই, কিন্তু এইদিক থেকে তাঁরা নবযুগের পথ—প্রদর্শক। নব্যযুগের ধর্ম যে ব্যক্তি—স্বাতন্ত্র্যবোধ, তা কবিয়ালরা প্রথম উপলব্ধি করে তাঁদের কাব্যজীবনে তার পরিচয় দিয়ে গেছেন। ভারতচন্দ্রের সঙ্গে ভোলা ময়রাদের প্রতিভার তুলনা হয় না ঠিকই, কিন্তু ভোলা ময়রাদের সৎসাহস ও স্বাতন্ত্র্যবোধের শতাংশের একাংশও ভারতচন্দ্রের ছিল না। ভোলা ময়রা ও তাঁর সমসাময়িক কবিয়ালরাই এই কারণে আধুনিক যুগের প্রবর্তক, ভারতচন্দ্র নন। কবিয়ালদের প্রসঙ্গে এইটুকু স্বীকার না করলে ইতিহাসকে বিকৃত দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করা হয় এবং কবিয়ালদের প্রতিও অবিচার করা হয়।

কবিয়ালদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। উত্তর মেদিনীপুরে জাড়া গ্রামের জমিদারবাবুদের বাড়ি উৎসব—পার্বণ উপলক্ষে প্রায় কবিগান হত। একবার এক গানের আসরে বাবুদের পোষ্য কবি জাড়াগ্রামটিকে গোলকবৃন্দাবন বলে বর্ণনা করেন। উত্তরে প্রতিপক্ষ কবি বলেন :

 কেমন করে বললি জগা,

 জাড়া গোলকবৃন্দাবন!

 ওরে বেটা কবি গাবি, পয়সা লবি,

 খোশামদি কি কারণ?

উত্তরটি কেবল কবিগানের ঢঙ নয়, পরিহাসও নয়। ”কবি গাবি, পয়সা লবি, খোশামোদ কি কারণ”—এই কথার মধ্যে কবিগায়ক নিজের অজ্ঞাতসারে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকাটি ব্যক্ত করেছেন। বোঝা যায়, যুগ থেকে যুগান্তরে যাত্রা করার পথে এ এক নতুন পর্ব। এই সন্ধিক্ষণে কবিগান গেয়ে কতকটা স্বাধীনভাবে পয়সা রোজগার করা সম্ভব হয়েছে এবং কবিগায়করা বুঝতে আরম্ভ করেছেন যে কেবল বড়লোকের খোশামোদি না করলেও তাঁদের চলতে পারে। এ—চেতনা ঐতিহাসিক চেতনা। রাজসভা থেকে জনসভার দিকে সবেমাত্র যাত্রা শুরু হয়েছে। দ্বিধা শঙ্কা নিয়ে সেই পথের প্রথম যাত্রী হয়েছেন বাংলার কবিয়ালরা। তাঁদের ভিতর থেকেই আমরা কবি ঈশ্বর গুপ্তকে পেয়েছি। কবিয়াল থেকে তিনিই প্রথম স্বাধীন কবি ও সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন। নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা তিনি অবাধে প্রকাশ করেছেন তাঁর কাব্যে এবং নিজের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে সমসাময়িক সমাজের সমালোচনা করেছেন তাঁর সংবাদপত্রে (সংবাদ প্রভাকর)। ভারতচন্দ্রের যুগ পর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি। ঈশ্বর গুপ্তই বাংলার প্রথম কবি যিনি রাজসভার পোষকতার মোহ ত্যাগ করে, জনসভার দিকে সাহস করে পা বাড়িয়েছিলেন। নতুন শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ও বাবুসমাজ নিয়ে সেই জনসভা গঠিত ছিল। হয়তো খুব উঁচুদরের সাহিত্যিক রুচি তার ছিল না, বিচারবুদ্ধিও ছিল না। তা না থাক, তবু একজন রাজার রাজসভা থেকে বহুজন হঠাৎ—রাজাদের জনসভার দিকে এগিয়ে যাওয়াই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। সাহিত্যের ইতিহাসে এটা অগ্রগতি।

………

১. Francois Bernier : Travels in the Mogul Empire, A.D. 1656-1658. (Oxford, 2nd Edition, 1914) : Revised by V.A. Smith : pp. 248-249, pp. 254-256.

১. Dr. L. L. Schucking : The Sociology of Literary Taste (London, 1945 ed.) : Ch. 2.

২. N. K. Siddhanta : The Heroic Age of India (London, 1929) : p. 65.

১. ডাঃ রাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত ও অনূদিত ”রামচরিত” (কলিকাতা, ১৩৬০) পৃষ্ঠা ১৪২—১৫২।

২. ডাঃ সুকুমার সেন : প্রাচীন বাংলা ও বাঙালি : পৃষ্ঠা ১৭—২১।

* যেমন সুসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুকবি জীবনানন্দ দাশ যদি ইহ—জগৎ থেকে বিদায় না নিতেন তাহ’লে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ বা ‘একাডেমি পুরস্কার’ কোনটাই তাঁরা এত সহজে পেতেন না। তাঁদের দুঃখকষ্টজর্জরিত জীবনে এ—পুরস্কার কোন উপকারেই লাগেনি। আত্মীয়স্বজনেরা হয়তো কিছু উপকৃত হয়েছেন।

১. সুকুমার সেন : মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী : পৃষ্ঠা ১৪—২২।

 সুকুমার সেন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : প্রথম খণ্ড : দ্বিতীয় পর্ব, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

২. সুকুমার সেন : ঐ, তৃতীয় পর্ব, দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

১. ডাঃ সুকুমার সেন : মধ্যযুগের বাংলা ও বাঙালী : পৃষ্ঠা ১৮—১৯।

২. উদ্ধৃতিগুলি অধ্যাপক সুকুমার সেনের ”বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস” ১ম খণ্ড, ১৮ পরিচ্ছেদ থেকে গ্রহণ করেছি।

৩. এ—সম্বন্ধে অম্বিকাচরণ গুপ্ত লিখিত মূল্যবান প্রবন্ধ ”কবিকঙ্কণ ও তাঁহার চণ্ডীকাব্য” দ্রষ্টব্য (প্রদীপ, অগ্রহায়ণ ১৩১২)।

* ‘ব্রাহ্মণভূমি’ উত্তর মেদিনীপুরে।

১. ‘সংবাদ প্রভাকর’ : ১২৬২ সন, ১লা জ্যৈষ্ঠ। ঈশ্বর গুপ্ত : কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত (১২৬২, আষাঢ়)।

২. স্বর্গীয় দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের আত্মজীবনীচরিত : পৃষ্ঠা ১১০—১১১।

* কৃষ্ণচন্দ্রের পরবর্তীকালের রাজসভার বর্ণনা হ’লেও, কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে এর চেয়ে বেশি উন্নত পরিবেশ ছিল না।

১. “Before the commencement of 1771, one-third of a generation of peasants had been swept from the face of the earth and a whole generation of once rich families had been reduced to indigence… From the year 1770 the ruin of two-thirds of the old aristocracy of lower Bengal dates.” (W.W. Hunter. The Annals of Rural Bengal : London, 1868 : p.56-57).

২. S. K. Dey : Hist. of Bengali Literature in the Nineteenth Cent. p. 38.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *