৬. বিদ্যা বিদ্বান বিদ্যালয় বিদ্যার্থীবিদ্রোহ

বিদ্যা বিদ্বান বিদ্যালয় বিদ্যার্থীবিদ্রোহ

বাংলার লোককবি রূপচাঁদ পক্ষী তাঁর ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বিবাহবর্ণন’ কাব্যে বিদ্যা বিদ্বান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু বিবাহের বর্ণনায় বিদ্যার বিবরণ কেন? বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের কথা কেন? এনট্রান্স, এল.এ., বি.এ., এম.এ. পাশের কথাই বা কেন? ‘ছেলে’ হলে গুণবন্ত, এক রাত্রে হতেম ভাগ্যবন্ত’, কিন্তু ভাগ্য মন্দ তাই ‘পোড়াকপালী’ (অর্থাৎ সহধর্মিনী) ‘ভ্যাড়াকান্ত ধল্পে গর্ভেতে’। কেন এই আক্ষেপ। কারণ কবি রূপচাঁদ পক্ষী একশো বছর আগেই সমাজে বিদ্যার সঙ্গে টাকার অঙ্গাঙ্গিতার সম্পর্ক দেখেছিলেন। ব্রিটিশ আমলের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞানবিদ্যার পাঠ তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে বলা চলে। তার মধ্যেই তিনি পাশ—করা বিদ্বানদের বাজারদর দেখে শঙ্কিত হয়েছিলেন। বিদ্যার বাজারদর আছে, যেমন চাকরির বাজারে, তেমনি বিবাহের বাজারে। ‘একপেশে (এনট্রান্স), ‘দোপেশে’ (এল.এ.) ‘তেপেশে’ (বি.এ.), ‘চারপেশে’ (এম.এ.)—যার যে রকম বিদ্যা এবং যে—যে রকম বিদ্বান, সেই অনুপাতে তার বাজারদর। তখন ‘চারপেশে’র বাজারদর ছিল তেজী, যেমন আজকাল আই.এ.এস. আর এঞ্জিনিয়ারদের। তাই রূপচাঁদ বলেছেন, বিবাহবাজারে ‘চারপেশে কর্ত্তাপক্ষ, ঠিক যেন সর্ব্বভক্ষ’।*

কেবল জ্ঞানের কথা নয়, রূপচাঁদ বিজ্ঞানের কথাও কিছু বলেছেন, সমাজবিজ্ঞানের কথা। যেমন সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন বলেছেন :

Priest and fendal noble were displaced from their hegemony by the new economic power of money and the indirect beneficiary of the power of money, the independent intellect.

ধনতান্ত্রিক যুগের আবির্ভাবে নতুন বুর্জোয়াশ্রেণির মতো নতুন বিদ্বানশ্রেণি (স্বাধীন!) টাকার অর্থনৈতিক আধিপত্যে লাভবান হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। টাকা ও বিদ্যার এই অঙ্গাঙ্গিভাবের কথা আরও অনেক সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন (যেমন সিমেল, ভেবলেন, হেব্বার, ম্যানহাইম)। আমাদের সামন্ততান্ত্রিক উপনিবেশে ব্রিটিশ রাজত্বকালে কমপ্রাডোর বুর্জোয়াশ্রেণির সঙ্গে নব্যবিদ্বানশ্রেণিও অর্থনীতিক্ষেত্রে বেশ প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন, এমনকী অনেক বিদ্বান ব্যক্তি ইংরেজতোষণের জোরে অর্থলাভের দিক থেকে মুতসুদ্দি বেনিয়ানদেরও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের বাংলাদেশে বিশেষ করে, বিদ্বান দুটি বাজার রীতিমতো জমজমাট হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমলে, .একটি চাকরির বাজার, আর একটি বিবাহের বাজার। ইংরেজরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পরীক্ষা—পাশ’ ও ‘ডিগ্রি’ বিদ্যার মাপকাঠি বলে ঘোষণা করলেন এবং তার দ্বারা চাকরির বাজারদরও নির্ধারিত হতে থাকল, তখন আমাদের পণপ্রথাবদ্ধ ফিউডাল সমাজে বিয়ের বাজারে ও বিদ্বানপাত্রের দর চড়ে গেল। তার উপর বিদ্বান যদি সরকারি চাকরে হন তাহলে তাঁর দর আরও বেশি। ব্রিটিশ আমলের পর ভারতীয়দের রাজত্বে বিদ্বানদের চাকরির বাজার হালে মন্দা হলেও, বিবাহের বাজার যে বিশেষ মন্দা হয়নি তা আজকের দিনেও খবরের কাগজে ‘পাত্রপাত্রী’র বিজ্ঞাপনের বাইশহাত বহর দেখলে বোঝা যায়। আজকাল অনেক সময় বিদ্বানদের অবশ্য বিবাহের বাজারের ভিতর দিয়েও চাকরির বাজারে পৌঁছতে হয়। বেকার শিক্ষিত যুবকের ভাগ্যে যদি নিরাকার ব্রহ্মের মতো মহাশক্তিমান শ্বশুরলাভ ঘটে, তাহলে চাকরির ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে উচ্চপদাভিষিক্ত হওয়ার আর কোনো সমস্যা থাকে না।

কিন্তু কবি খগপতি ‘বল্লালি বাঁধা কুল, প্রায় হল নির্মূল, বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল সুরু যে হতে’ বলে যে ‘inter-caste mobility’-র ইঙ্গিত করেছেন, তার সামান্য লক্ষণ বাঙালি সমাজে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে দেখা গেলেও, সেটা সামাজিক বাস্তব সত্যে কদাচ পরিণত হয়নি, আজ পর্যন্ত না। খুব সংগত ঐতিহাসিক কারণেই হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনে আমাদের দেশের ফিউডাল সমাজের মূল অর্থনৈতিক ও সামাজিক গঠনের পরিবর্তন হয়নি, ধনতান্ত্রিক যুগের নতুন ‘economic power of money’—র ভিত্তির ওপর কেবল তা পুনর্গঠিত ও পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। অতএব ফিউডাল সমাজের মূল্যবোধ ভালোমন্দবোধ নীতিবোধ বিচারবোধ জাতিবর্ণভেদ ধর্মবৈষম্য প্রভৃতি সমস্ত সামাজিক সাংস্থানিক শক্তির উৎস আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়েছে, দুর্বল নিষ্ক্রিয় হয়নি। অন্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই, পূর্বোক্ত ‘পাত্রপাত্রী’র বিজ্ঞাপনই বড় প্রমাণ। যত বড় ডিগ্রিধারী বিদ্বান পাত্র বা পাত্রী হন না কেন, আজকের দিনেও বিজ্ঞাপনে জাতিবর্ণের উল্লেখ থাকে প্রথমে, তারপর বিদ্যা চাকরি ও পণ্যের প্রলোভন। উনিশ শতকের রূপচাঁদের কালের কথা নয়, বিশ শতকের একাত্তরের কথা। কাজেই টাকা ও বিদ্যা পাশ্চাত্য সমাজে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণকালে যে ব্যাপক ভাঙাগড়ার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, আমাদের ভারতীয় সমাজে তা করতে পারেনি। তার প্রথম কারণ পাশ্চাত্য সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের পার্থক্য আছে, এবং দ্বিতীয় কারণ বৈদেশিক পরাধীনতার ফলে আমাদের অর্থনৈতিক সমাজের অগ্রগতির স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দধারা ব্যাহত হয়েছে। তার জন্য ‘টাকা ও বিদ্যা’ ব্রিটিশ রাজত্বকালে ধনতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয়কালের ভাঙাগড়ার শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হলেও, আমাদের সমাজে কোনো মৌল রূপান্তর ঘটাতে পারেনি, পুরাতন ফিউডাল গড়নের মধ্যে নতুন বিভেদ বৈষম্য সৃষ্টি করেছে মাত্র। অর্থাৎ টাকা ও বিদ্যা দুই—ই একধরনের নতুন শ্রেণিবৈষম্য (class-hierarchy) রচনা করেছে পুরাতন জাতি—বর্ণ—সম্প্রদায়ের বৈষম্যের (caste-community-hierarchy) মধ্যে। বিত্তবান ও বিদ্বান ব্রাহ্মণ কায়স্থ বণিক সদগোপ মাহিষ্য এবং দরিদ্র ও অশিক্ষিত সমবর্ণের মধ্যে শুধু জাতিবর্ণগত বৈষম্য নয়, এক নতুন ধরনের বিত্তগত ও বিদ্যাগত শ্রেণিবৈষম্যও রচিত হয়েছে। তেমনি হয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে। বিত্তের মধ্যে বিদ্যাও শ্রেণিগত বৈষম্যের মানদণ্ড হয়েছে, পুরাতন সামাজিক কাঠামোর মধ্যে। তার ফলে আমাদের সমাজ আরও বেশি খণ্ডিত বিভক্ত ও বৈষম্য ভারাক্রান্ত হয়েছে, যেহেতু বিদ্বানদের সঙ্গে বিত্তবানদের অঙ্গাঙ্গিতা ক্রমেই দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে ও হচ্ছে।

মোটকথা টাকা মহত্তর সত্য জ্ঞানবিদ্যা টাকার উপাসক। প্রসঙ্গত আমেরিকান লেখক এডগার স্নো—র সঙ্গে নব্যচীনের ছাত্রীদের কথোপকথনের কথা মনে পড়ছে :

ছাত্রীরা : আপনাদের দেশে গরিব চাষিরা কি কলেজে পড়ে?

স্নো : না, গরিব চাষিরা পড়ার তেমন সুযোগ পায় না, কারণ কলেজে পড়তে টাকা লাগে তো!

ছাত্রীরা : ওইখানেই তফাত। আমাদের দেশে শিক্ষার জন্য টাকা লাগে না, এবং শ্রমিক ও চাষিরা সর্বপ্রথম শিক্ষার সুযোগ পায়। আমেরিকায় কলেজের শিক্ষা হল ধনিকদের ছেলেদের জন্য, এবং তার লক্ষ্য হল টাকা রোজগার করা।

স্নো : ঠিক ওইভাবে না বলে, বরং বলতে পার যে আমেরিকায় কলেজ চালানো হয় ছাত্রদের টাকা রোজগারের কৌশল শেখাবার জন্য—‘It’s more accurate to say they are run to teach students how to make money.’

সোজা কথাবার্তা, সহজবোধ্য, কোনো টীকার প্রয়োজন নাই। তাই দেখা যায় আজকাল ধনতান্ত্রিক দেশে শিক্ষার ধনবিজ্ঞানই অন্যতম গবেষণার বিষয়। শিক্ষার সাইকোলজির কথা অনেকদিন ধরেই আমরা জানি। বিদ্বানরা অনেক বড় বড় বই শিক্ষার মনস্বত্ত্ব সম্বন্ধে লিখেছেন, মানুষের বুদ্ধি (I.Q.) মাপা থেকে আরম্ভ করে অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খল বিচ্ছুদ্রোহী ছাত্রদের মনোরাজ্যে সার্চলাইট ফেলে তাঁরা অনেককিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন। অবশ্য তাতে মানুষের বুদ্ধি বাড়েওনি কমেওনি, শুধু বোঝা গেছে যে আই.কিউ. টেস্ট হল শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্য বজায় রাখার একটা কৌশল বিশেষ। তাছাড়া মনোবিজ্ঞানীদের মহাসমুদ্রবৎ গভীর জ্ঞানদান সত্ত্বেও দেখা যায় যে পৃথিবীর কোনো দেশে (ধনতান্ত্রিক) অবাধ্য অশান্ত বিদ্রোহী ছাত্ররা শান্তশিষ্ঠ গোপাল হয়ে যায়নি, বরং তাদের বিদ্রোহ ক্রমেই ব্যাপক ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে এবং ভোগের স্বর্গরাজ্য আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি। পরে সেকথা বলছি। কাজেই কেবল সাইকোলোজিতে আর কুলোচ্ছে না। এখন শিক্ষার সোসিওলজি, শিক্ষার টেকনোলজি প্রভৃতি অনেক নতুন বিদ্যার আমদানি হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান তার যুক্তি এই :

The costs of schooling and the money returns resulting from investment in schooling are currently receiving more and more attention by economists, not only because of their possible implications for economic growth, but also because they may help individuals to determine how much they should invest in the development of their own human capital.

আধুনিক ধনতান্ত্রিক টেকনালজিকাল সমাজ, যার মডেল আমেরিকা, তার অগ্রগতির সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে শিক্ষার মনস্তত্ত্ব সমাজতত্ত্ব টেকনোলজি এবং সবার উপরে শিক্ষার অর্থনীতি। তার কারণ বর্তমানের বিশাল ধনতান্ত্রিক সমাজের জটিল টেকনোস্ট্রাকচার চলমান রাখার জন্য বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত বিচিত্র রকমের বিদ্বান উৎপাদনের প্রয়োজন হয়েছে আজ এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামরিক কারণে এতরকম বিষয়ে গবেষণার তাগিদ বেড়েছে যে শিক্ষার দর্শন (Philosophy) ও আদর্শনীতির (Ideology) চেয়ে শিক্ষার লাভলোকসানগত অর্থনীতিই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। রিসার্চের ইনস্টিট্যুট ধনতান্ত্রিক ও তার আশ্রিত দেশগুলিতে (যেমন ভারতবর্ষ) গড়ে উঠেছে। প্রধানত আমেরিকার শিক্ষাটেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা এই সমস্ত সংস্থার ফিলজফার ও গাইড। এঁরা সমাজের সমস্ত মানুষকে ‘মূলধন’ মনে করেন, একেবারে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ‘capital’ অর্থে এবং বলেনও ‘human capital’।এই human capital-এর investment dimension’, consumption dimension’ এবং ‘social demand’ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তাঁরা অনুসন্ধান অনুশীলন করেন এবং সেই অনুসন্ধানের ফলাফলের উপর রাষ্ট্রনায়কদের শিক্ষানীতি (educational policy) এবং শিক্ষাপ্রকল্প (educational planning) অনেকটা নির্ভর করে। অর্থনীতির সূত্রের মতো শিক্ষানীতির কয়েকটি সূত্রও গবেষকরা রচনা করেছেন। যেমন একটি সূত্র হল, কোনো দেশে শিক্ষার সামাজিক চাহিদা যদি অর্থনৈতিক গতির manpower-এর প্রয়োজনের চেয়ে বেড়ে যায়, তাহলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পায়। বিষয়টাকে সাধারণ অর্থনীতির ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের সূত্র অনুযায়ী বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নপরিকল্পনার শিক্ষিত বা বিদ্বান কর্মীদের যে চাহিদা থাকে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারখানা থেকে বিদ্বানদের উৎপাদন হতে থাকে, তাহলে কর্মের বাজারে বিদ্বানদের দর কমে যায়, এমনকী অত্যধিক সাপ্লাই হলে বিদ্বানরা বেকার অবস্থায় অবিক্রীত পণ্যের মতো গুদামজাত হয়েও থাকতে পারেন। ভারতের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বর্তমানে গুরুতর আকারে দেখা দিয়েছে। সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বিদ্যার অর্থনীতিটাই প্রধান, ইডিওলজি (বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্থে) নয়। বিদ্যাব্যবস্থার সঙ্গে প্রচলিত সমাজরাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক ইতিহাসে চিরদিনই ছিল, বর্তমানে শুধু তার জটিলতা বেড়েছে। সেই জটিলতার ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে বিদ্যা—বিদ্বান—বিদ্যালয়ের সম্পর্ক অনেক সময় পরিষ্কার দেখা যায় না, তাই তাদের ‘স্বাধীন’ অস্তিত্ব সম্বন্ধে মধ্যে মধ্যে রজ্জুতে সর্পজ্ঞানের মতো অধ্যাসের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাভাবনার উদ্ভট মিশ্রসমাজে বিদ্বানমহলে এই বিভ্রমের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে অনেকে আজও মুনিঋষি ও মনীষীদের বচন আবৃত্তি করে বিদ্যাকে তপোবনের পরিবেশে স্থাপন করতে চান। বিদ্যাবিদ্যালয় সম্বন্ধে তাঁদের এই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহদের আমলে ধ্যানধারণা বিশেষ যে বদলায়নি তা আচার্য উপাচার্য অধ্যাপকদের নিয়মিত ভাষণ থেকে এবং মহাজ্ঞানীদের একঘেয়ে জ্ঞানদানের ঘ্যানঘ্যানানি থেকে বোঝা যায়। তবু বিদ্বানদের মধ্যে মুষ্টিমেয় সুবুদ্ধিমান যাঁরা আছেন তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে বর্তমানের বিদ্যাসংকট বিদ্যানসংকট বিদ্যালয়সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন বিষফোড়া নয়, ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের শিরায় শিরায় বিষাক্ত রক্তপ্রবাহের বাহ্যপ্রকাশ। কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান করে তাঁরা ধোঁয়াটে কথার অন্তরালে আত্মগোপন করে থাকেন, হয়তো তাঁদের বিদ্যাভিমান সামাজিক সত্যের স্বীকৃতি ও বলিষ্ঠ প্রকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যাভিমান ছাড়াও টাকার স্বার্থ, অর্থাৎ চাকরির স্বার্থও বড় বাধা হতে পারে। তাই বলে তাঁদের খাতিরে একথা স্বীকার করতে বাধে যে বর্তমানে বিদ্যা বিশুদ্ধ, জ্ঞান নিরপেক্ষ, বিদ্বান সর্বজনপুজ্য এবং বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় পবিত্র দেবমন্দির।

‘Date to know’। দার্শনিক কান্টের উক্তি এবং ‘know’ থেকে ‘knowledge’। জানবার জন্য অর্থাৎ জ্ঞানের জন্য দুঃসাহসী হও। সর্বনাশ! যেখানে নোটবই পড়লে, সাজেসনস মুখস্থ করলে, কোচিংক্লাসে ঠিকেদার মাস্টারদের টাকা দিলে শিক্ষক অধ্যাপকদের মোসাহেবি করলে পরীক্ষায় পাশ করে যা জানবার সবই জানা যায়, সমস্ত জ্ঞান ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলা যায়, তখন জ্ঞানের জন্য দুঃসাহসী হওয়াটা আবার কি। আসলে ব্যুরোক্রাসির পেষণে dare to know-এর যুগ শেষ হয়ে গেছে। ব্যুরোক্রাসির প্রতাপ সর্বত্র সমান, শ্মশান থেকে কর্পোরেশন, সরকারি অফিস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও কমবেশি নেই। জ্ঞান বিদ্যার শোচনীয় অপমৃত্যু ঘটেছে এই আমলাতান্ত্রিক জগদ্দলের চাপে। বিদ্বানদের ব্যুরোক্রাসি প্রশাসনিক ব্যুরোক্রাসির চেয়ে আরও বেশি মারাত্মক। বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগারে ও শিক্ষা সংস্থায় জরদগব বিদ্বান—ব্যুরোক্রাটদের কুটিল চক্রান্তে কত বলিষ্ঠ চিন্তাশীল মনীষা ও প্রতিভার যে অপমৃত্যু ঘটেছে ও ঘটছে তার হিসেব নেই। নতুন চিন্তা ভাবনা, নতুন গবেষণা, নতুন জ্ঞানলাভের অভিযান, বিদ্বানদের আমলাতন্ত্রে নিষিদ্ধ। এই বিদ্বান ব্যুরোক্রাটরা সমাজের শাসক শ্রেণির আদর্শ ও চিন্তাভাবনার ধারক বাহক। অতএব তাঁদের সেই চিন্তা ও আদর্শের গণ্ডির মধ্যে যাঁরা বিচরণ করতে পারবেন না, তাঁরা যতবড় জ্ঞানীগুণী হন না কেন, সমাজে তাঁরা প্রত্যাখ্যাত ও অবহেলিত হতে বাধ্য। আর তাঁরা যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে তাঁদের পদোন্নতির চেয়ে পদচ্যুতির সম্ভাবনাই বেশি।

এর মধ্যে ‘free intellect’? যেমন আমেরিকার ‘ফ্রি সোসাইটি’—যেখানে দুস্তর শ্রেণিবৈষম্য থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক যাদুবলে নাকি শ্রেণিসংঘাত বিলীয়মান এবং জনসন নিকসনের মতে সাম্য ও স্বাধীনতা ভোগসুখের স্বর্গরাজ্যে সতত বিরাজমান, এবং যে—সাম্য ও স্বাধীনতা উপঢৌকন দেবার জন্য আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমিক শাসকদের ভিয়েতমান পর্যন্ত সামরিক অভিযান—ঠিক তেমনি ‘ফ্রি ইনটিলেকট’, অর্থাৎ ‘ফ্রি’ যদি বিদ্বান বুদ্ধিমানরা তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি বন্ধক দিয়ে এই ‘ফ্রি সোসাইটি’র উপজীব্য জোগান, সেবা করেন, নচেৎ ফ্রি নয়।

অতএব বিদ্যা বিদ্বান অথবা তার উৎপাদনকেন্দ্র বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় কেউ স্বাধীন নয়, স্বতন্ত্র নয়, পবিত্র নয়, সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। যেমন সমাজ তেমনি বিদ্যা। যেরকম সমাজের চেহারা, ঠিক সেইরকম বিদ্বানের চেহারা। যে রকম সমাজের গড়ন, সমাজের নীতি, ঠিক সেইরকম বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ন ও নীতি। সমাজের বাজার বা মার্কেট আছে, বাজারি অর্থনীতি বা ‘মার্কেট ইকনমি’ আছে, বিদ্যারও বাজার আছে, বিদ্বানদেরও বাজারি অর্থনীতি আছে। পণ্যের বাজারে যেমন বিজ্ঞাপননির্ভর প্রতিযোগিতা আছে যার বিক্রয়কৌশল যত আকর্ষণীয় তার তত বেশি কাটতি, তেমনি বিদ্যার বাজারেও প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু তা যত গুণনির্ভর নয়, তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞাপননির্ভর, অর্থাৎ বিদ্যাবেচার ও বিদ্যাকেনার কৌশল বা অপকৌশল যার যত বেশি আয়ত্তে, সেই বিদ্বানের ভাগ্য বাজারে তত বেশি উঠতি। বিদ্যাবেচার কৌশল সর্বজনবিদিত। বিদ্যাকেনার কৌশলের কথা শুনে অন্তত আমাদের দেশের লোক বিস্মিত হবেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে (যেমন বিহারের), শিক্ষাসমস্যার সেমিনারে, টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কেনার পর্যন্ত অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, ডিগ্রি অনুপাতে টাকা। যেমন ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে :

Institutes and colleges affiliated to Bhagalpur University carry a bad reputation and the University itself has in the past been a convenient place for persons to buy a degree at Rs. 175 ot more.

যেখানে টাকার লেনদেন কম, অথবা পরোক্ষ, সেখানে বিদ্বানদের মোসাহেবি না করে বিদ্যার্থীদের উপায় নেই। আর ফলে গবেষণা ও তার ডিগ্রি পর্যন্ত ক্রমেই সারশূন্য হয়ে গেছে। একথা আমাদের ভারতসরকার নিযুক্ত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টও (১৯৬৬) বলা হয়েছে। পরে এসব কথা আসবে। আপাতত একথা মানতেই হবে যে সমাজের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক অত্যন্ত প্রত্যক্ষও অঙ্গাঙ্গি। যে—সমাজের শিকড় পর্যন্ত পচে গেছে, যার প্রতিটি অঙ্গে বিষাক্ত বিস্ফোট, তাকে যেমন কোনো সংস্কার—চিকিৎসায় (reform) সুস্থ—সবল করা যায় না, তেমনি তার দেহলগ্ন বিদ্যাব্যবস্থার বাহ্যসংস্কারেও কোনো সুফল ফলে না। জীর্ণ বস্ত্রের মতো জীর্ণ সমাজ পরিত্যাজ্য, দক্ষতম দর্জির রিপুকর্মেও তা ব্যবহার্য নয়। তেমনি তার বিদ্যাব্যবস্থাও আমূল পরিবর্তনীয়, যা সমাজের আমূল পরিবর্তন ছাড়া কখনো সম্ভব নয়।

এবার বিদ্যাসংকটের প্রকৃত রূপটা কীরকম দেখা যাক। প্রথমেই বলা দরকার যে এই বিদ্যাসংকট হল প্রধানত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের সমস্যা, যেমন আমেরিকা ইংলন্ড ফ্রান্স ইত্যাদি, এবং অনুন্নত ও উন্নতিশীল দেশ যারা উন্নয়নের পথে এই সমস্ত ধনতান্ত্রিক দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে তাদের সমস্যা। সমাজতান্ত্রিক দেশে এই সমস্যা বা সংকট নেই, যে সমস্যা আছে তার স্বরূপই আলাদা—সোভিয়েট রাশিয়াতেও নেই, চীনেও নেই, দুটি বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যে বর্তমানে নীতিগত পার্থক্য যাই থাকুক না কেন। লক্ষণীয় হল, অত্যুন্নত ও অনুন্নত অথবা উন্নতিশীল ধনতান্ত্রিক সমাজে এই শিক্ষা—সংকটের মূল পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই তো বটেই, উপরন্তু সেই সংকটের বিরুদ্ধে তরুণ ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের চেহারাও প্রায় একরকম। যেমন আমেরিকায় ইংলন্ডে ফ্রান্সে, তেমনি আমাদের ভারতবর্ষে, বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের মধ্যে হিংসাত্মক নাশকর্মই বেশি। তাই কেউ কেউ বলেছেন, ‘This is a world educational crisis’ এবং যে—কোনো ‘food crisis’ অথবা ‘military crisis’-এর চেয়ে তা কম বিপজ্জনক নয়।

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে, অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাগের গোড়া থেকে সারা পৃথিবীব্যাপী শিক্ষায় এত দ্রুত প্রসার হতে থাকে যা ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। অনেক দেশে বিদ্যার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়, শিক্ষাখাতে খরচ দ্রুতহারে বাড়তে থাকে এবং ক্রমে শিক্ষা রীতিমতো একটা বড় ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রসারের গতি কমেই বাড়তে থাকে। কিন্তু শিক্ষার এই প্রসার্যমান আলোকরাজ্যের পাশে অশিক্ষার অন্ধকারও ক্রমে বিস্তীর্ণ জনসমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। জনসংখ্যার যত বৃদ্ধি হতে থাকে, তত দেখা যায় অশিক্ষিত নিরক্ষর, লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে (ধনতান্ত্রিক) বেড়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর সদস্যরাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেখা যায় ৪৬ কোটির বেশি লোক (adult) অশিক্ষিত ও নিরক্ষর যা তাদের মোট কর্মক্ষম লোকসংখ্যার শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ (১৯৬৮—৬৯)। ধনতান্ত্রিক জগতের শিক্ষার এই রেখাচিত্রের মধ্যে শিক্ষাসঙ্কটের রূপটিও পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। সেই রূপটা কী? একদিকে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার, আর একদিকে অশিক্ষার ব্যাপকতর প্রসার। যদি শ্রেণিগতভাবে বলা যায় তাহলে বলতে হয় যে ধনতান্ত্রিক সমাজ আর বিদ্যার দিক থেকেও দুটি সুস্পষ্ট শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, একটি বিদ্বানশ্রেণি, আর একটি মূর্খশ্রেণি এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আগেই বলেছি, যেমন সমাজের চেহারা, তেমনি হবে তার শিক্ষার চেহারা। ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী সমাজের বর্তমান রূপের সঙ্গে তার এই শিক্ষারূপের সাদৃশ্য অত্যন্ত প্রকট। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির আশ্চর্য উন্নতির ফলে ধনতান্ত্রিক সমাজে অপরিমিত ভোগের মধ্যেও ধনবৈষম্য অনেক বেশি বেড়েছে ও বাড়ছে। অর্থাৎ ধনিকশ্রেণির মধ্যে যেমন অতিধনিক মধ্যধনিক ও ধনিকদের স্তরবিন্যাস হচ্ছে, বিত্তশালী মধ্যবিত্তের প্রসার হচ্ছে, তেমনি দরিদ্রশ্রেণিরও ক্রমবিস্তার হচ্ছে। বিদ্যার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হচ্ছে। বিদ্যার প্রসার ও বিদ্বানের সংখ্যাবৈচিত্র্য যেমন বাড়ছে, কতরকমের টেকনোলজিস্ট বৈজ্ঞানিক স্কলার এক্সপার্ট ও বিদ্বান তার হিসেব নেই, অথচ অন্যদিকে তেমনি অশিক্ষিত নিরক্ষরের সংখ্যাও দ্রুতহারে বাড়ছে। অর্থনীতিক্ষেত্রের মতো বিদ্যাবিদ্বানের ক্ষেত্রেও শ্রেণি—বিভাজনের এই সাদৃশ্য বাস্তবিক বিস্ময়কর।

ভারতবর্ষ শিল্পোন্নতিশীল (developing) দেশ, যদিও তার বেশি কৃতিত্ব বৈদেশিক সাহায্যের (Foreign Aid) প্রাপ্য, স্বদেশি প্রয়াসের নয়। এই foreign aid হলো বর্তমানকালের একটি মুখোশ, যা ধনিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি নিজেদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব বিস্তারের জন্য ব্যবহার করে। বৈদেশিক সাহায্যদানের কত বিচিত্র সংস্থা, কতরকমের তার নাম ও নামের সংক্ষেপ (abbreviations)। এহেন বৈদেশিক সাহায্য ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মাহাত্ম্য ঘোষণার জন্য ভারত সরকারের প্রয়োজন হয় নয়াদিল্লিতে মধ্যে মধ্যে রাজসূয়যজ্ঞ অনুষ্ঠানের। যদিও প্রেসিডেন্ট কেনেডি এই ‘মাহাত্ম্য’ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ১৯৬১ সালেই ঘোষণা করে বলেছিলেন :

foreign aid is a method by which the United States maintains a position of influence and control around the world, and sustains a good many countries which would definitly collapse or pass into the Communist bloc.

‘ফরেন এড’ প্রসঙ্গে এই কয়েকটি কথা বলার প্রয়োজন হল ভারতের মতো ডেভালাপিং ইকনমির প্রকৃত স্বরূপ বোঝার জন্য। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবপুষ্ট এ এক নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি। সাহায্যদাতা এই বিদেশি হাতের বিস্তার শিল্পবাণিজ্য ও যান্ত্রিক কৌশলের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। তার মধ্যে প্রধান হল শিক্ষাসংস্কৃতিক্ষেত্র। আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও প্রশাসনিক টেকনোলজিনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষাপ্রসার (বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা) ও বিভিন্ন বিদ্যাকুশলতার সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ যে ‘ফরেন এড’ ও শিক্ষাভিমুখী হয়ে উঠেছে। শুধু ইকনমি নয়, ডেভালাপিং দেশের ইডিওলজিও সাহায্যদাতা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা আবশ্যক, তা না হলে কেনেডির কমিউনিজমের বিভীষিকা বাস্তব সত্য হবার সম্ভাবনা। তাই দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যোন্মুখ বিশাল একটি থাবা আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রেও অনেকদূর পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। গত পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মধ্যে এদেশীয় বিদ্বানদের বিদেশে আনাগোনা কতগুণ যে বেড়ে গেছে তার ঠিক নেই। কত রকমের বিদ্যার এক্সপার্ট হবার জন্য এবং কতরকমের গবেষণার জন্য যে বিদেশে যেতে হয়, বিশেষ করে আমেরিকায়, তারও হিসেব নেই। ‘ফরেন এড’ এসব ক্ষেত্রে স্কলারশিপ গ্র্যান্ট, ভিজিটিং প্রফেসরশিপ প্রভৃতির বেশ ধারণা করে আসে এবং তাতে আমাদের দেশের বিদ্যাবিদ্বানবিদ্যালয় সকলেরই উপকার হয়। বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও গত দুই দশকের মধ্যে আমাদের দেশে যত রকমের শিক্ষা—সংস্থা বা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে, যাদের উপর বৈদেশিক সাহায্যের মুদ্রার অবিরাম ধারাবর্ষণ হচ্ছে, তার তালিকাও অনেক দীর্ঘ হবে। যেমন ম্যানপাওয়ার ম্যানেজমেণ্ট (নানা রকমের ম্যানেজেরিয়াল বিদ্যা) বিজ্ঞান, ফলিতবিজ্ঞান, শিল্পবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রশাসনবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণার ইনস্টিটিউট। এই সমস্ত সংস্থার উপদেষ্টা পরামর্শদাতা ও এক্সপার্টদের মধ্যে অনেক বিদেশি বিদ্বান আছেন এবং তাঁরা প্রধানত আমেরিকান। আমাদের নয়া ঔপনিবেশিক উন্নতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে গতিশীল শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক যে কত অঙ্গাঙ্গি তা এই কয়েকটি দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়। সেই কারণে আমাদের দেশের শিক্ষাসংকটের সঙ্গে আমেরিকার মধ্যে শিল্পোন্নত দেশের শিক্ষাসংকটের মূল পার্থক্য বিশেষ নেই। শুধু শিক্ষাসংকটের সাদৃশ্য নয়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের রূপও প্রায় একরকম এবং তার হিংসাত্মক প্রকাশ উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মক। কাজেই ‘ডেভালাপিং’ ভারতের বিদ্যাসংকট অনিবার্য কারণে শিল্পবিজ্ঞানোন্নত দেশের মতোই ‘ডেভালাপ’ করেছে এবং ‘ডেভালাপিং’ বলে তার উপসর্গগুলি অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

চতুর্থ অর্থনৈতিক প্রকল্পের প্রান্তে পৌঁছে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতীয় অর্থনীতির তথাকথিত ‘সোশ্যালিস্ট প্যাটার্ন’ কীভাবে বর্তমান ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্যাটার্নের সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতীয় সমাজে অতিধনিক, মধ্যধনিক ও সচ্ছল মধ্যবিত্তশ্রেণি (প্রধানত ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত এলিটশ্রেণি) মুদ্রাস্ফীতির সুবর্ণ সুযোগে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন। মহলানবীশ, হাজারী ও আরও কয়েকজনের অনুসন্ধানের ফলে জানা গেছে, কীভাবে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি মুষ্টিমেয় মনোপলিস্ট ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংহত হচ্ছে। তার পাশাপাশি যেন দ্রুতহারে ভারতের জনসংখ্যা বাড়ছে, তেমনি দীর্ঘতর ও গভীরতর হচ্ছে তার গণদারিদ্র্যের সীমারেখা।

সমাজের আকৃতিটা হচ্ছে মিশরীয় পিরামিডের মতো। পিরামিডের শিখরে অর্বুদপতিদের অবস্থান, তার নিচে কোটিপতি ও লক্ষপতিরা স্তরে স্তরে বিন্যস্ত এবং তার সুবিস্তৃত পাদদেশে বিশাল জনসমাজ নিশ্ছিদ্র দারিদ্র্যের অন্ধকারে যাবজ্জীবন নির্বাসিত। এই হল বর্তমানে ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের সমাজতন্ত্রের প্যাটার্ন। শিক্ষাক্ষেত্রেও অবিকল এই প্যাটার্নের প্রতিফলন দেখা যায়।

১৮৫৭ সালে ‘সিপাহি বিদ্রোহে’র সময় ব্রিটিশ শাসকরা এদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, কলকাতা বোঝাই ও মাদ্রাজে। সময়ের এরকম শুভমিলন সচরাচর ঘটে না এবং মনে হয় না এটা কোনো আকস্মিক ঘটনার মিলন। বিদেশি শাসকবিরোধী বিদ্রোহ দমন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ শাসকরা একই সময়ে করেছেন, এই গূঢ় উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ বিদেশি শাসক ও এদেশি শাসিতদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করার জন্য এদেশি একদল বিদ্বানশ্রেণি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। ১৮৩৫ সালে এদেশে ইংরেজিবিদ্যা প্রচলনের সময় মেকলে বলেছিলেন :

We must at present do our best to form a class who may be interpreter between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect.

এই বিদ্বানশ্রেণি সুনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় এবং তার মহৎ উদ্দেশ্য শিক্ষাদান নয়, চাকরিদান, ব্রিটিশ শাসনযন্ত্র চালনার জন্য চাকরি এবং বিভিন্ন স্তরের চাকরির জন্য বিভিন্ন স্তরের বিদ্যার ‘ডিগ্রি’র ছাপ দেওয়া। এই ছাপ ও মার্কা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ববিদ্যালয়’। এদেশের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ব্রিটিশ শাসকরা এই উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন১০

The whole system was determined by the fact that degrees were the passports to government service.

শাসকশ্রেণির অনুগত এদেশের বিদ্বানদের সরকারি চাকরি দেবার জন্যই ডিগ্রি এবং সেই ডিগ্রি দেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়। বিশুদ্ধ জ্ঞানদান বা প্রকৃত শিক্ষাদানের জন্য এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি, যদিও দেশের প্রকৃত শ্রদ্ধেয় জ্ঞানীগুণী ও বিদ্বানদের মধ্যে অনেককে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই গণ্ডি বাধ্য হয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। ইংরেজোত্তর ভারতীয়দের শাসনকালে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে, একরকম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকারই বহন করা হচ্ছে বলা চলে। ভারতীয় শাসকরা মেকলের আদর্শকে অনেক বেশি নিষ্ঠার সঙ্গে আজও অনুসরণ করে চলেছেন, সজ্ঞানে না হলেও অজ্ঞানে, এবং মেকলের মতো বিদ্বান উৎপাদন নীতি সম্বন্ধে তাঁরাও বলতে পারেন :

We must a present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern.

কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে মেকলে—নীতি তাঁরা অনুসরণ করেছেন?

ইংরেজোত্তর যুগে ভারতের শিক্ষার প্রসার অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে, বিশেষ করে বিদ্বান বিদ্যালয় ও বিদ্যার্থীদের সংখ্যার দিক থেকে। একাধিককারণে এই সংখ্যাগত প্রসার হয়েছে, তার মধ্যে জনসংখ্যাস্ফীতি অন্যতম। অন্যান্য কারণ পরে আলোচ্য। আপাত শিক্ষার এই সংখ্যাগত প্রসার কিভাবে হয়েছে দেখা যাক :১১

ক. প্রাথমিক স্তর ক্লাস ১—৫ বয়স ৬—১১ ছাত্রসংখ্যা

 (১৯৫০—৫১) (১৯৬৮—৬৯) (১৯৭৩—৭৪, সম্ভাব্য)

 ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৫ কোটি ৬০ লক্ষ ৬ কোটি ৯০ লক্ষ

খ. মাধ্যমিক স্তর ক্লাস ৬—৮ বয়স ১১—১৪ ছাত্রসংখ্যা

 (১৯৫০—৫১) (১৯৬৮—৬৯)

 ৩ কোটি ১২ কোটি ৩০ লক্ষ

গ. উচ্চমাধ্যমিক স্তর ক্লাস ৯—১১ বয়স ১৬—১৭ ছাত্রসংখ্যা

 (১৮৫০—৫১) (১৯৬৮—৬৯) (১৯৭৩—৭৪, সম্ভাব্য)

 ১২ লক্ষ ৬৬ লক্ষ ৯৭ লক্ষ

ঘ. বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর বয়স ১৮—২৪ ছাত্রসংখ্যা

 (১৯৫০—৫১) (১৯৬৮—৬৯) (১৯৭৩—৭৪, সম্ভাব্য)

 ৩ লক্ষ ৬০ হাজার। ১৬ লক্ষ ৯০ হাজার। ২৬ লক্ষ ৬০ হাজার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯৫০—৫১ সালে ছিল ২৭, ১৯৬৯—৭০ সালে হয়েছে ৭৬।

ঙ. টেকনিক্যাল শিক্ষা

ডিগ্রি. কলেজ : ৪৯ (১৯৫০—৫১), ১৩৮ (১৯৬৮—৬৯)

ডিপ্লোমা বিদ্যালয় : ৮৬ (১৯৫০—৫১), ২৮৪ (১৯৬৮—৬৯)

টেকনিক্যাল ডিগ্রি কলেজ ১৯৫০—৫১ সালে ৪০০০ ছাত্র থেকে ১৯৬৮—৬৯ সালে ২৫,০০০ ছাত্রের শিক্ষাব্যবস্থা এবং ডিপ্লোমা বিদ্যালয়ে এই সময়ের মধ্যে ৫৯০০ থেকে ৪৮,৬০০ ছাত্রের শিক্ষার সুযোগ করা হয়।

ভারতবর্ষে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের এই সংখ্যাগত বিস্তারের গতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় (১৯৭০ পর্যন্ত)—প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় তিনগুণ, মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় চারগুণ, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় ছয়গুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় পাঁচগুণ, টেকনিক্যাল ডিগ্রিস্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় চারগুণ এবং টেকনিক্যাল ডিপ্লোমা স্তরে বিস্তার হয়েছে প্রায় আটগুণ।

শিক্ষার প্রসারের পাশে অশিক্ষার প্রসার লক্ষণীয়। এই সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৫০—৫১ থেকে ১৯৬৮—৬৯ সালের মধ্যে ভারতে অশিক্ষিত নিরক্ষরের (illiterates) সংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি, এবং অক্ষরজ্ঞানের (literates) সংখ্যা বেড়েছে মোট লোকসংখ্যার ১৭% থেকে ৩৩%।১২ ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সের নিরক্ষর লোকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২১ কোটি। ভারতে জনসংখ্যার প্রসার হচ্ছে বাৎসরিক ২.৫% হারে, কিন্তু অক্ষরজ্ঞানের সংখ্যা বাড়ছে ০.৭৫% করে।১৩ অর্থাৎ ১.৩০% করে (লোকবৃদ্ধি অনুপাতে) নিরক্ষরের সংখ্যা প্রতি বছরে বেড়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে ভারতের জনসংখ্যা হয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি, কাজেই নিরক্ষরের সংখ্যাও হয়েছে প্রায় ৪০ কোটির মতো। অর্থাৎ স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের শিক্ষাবিস্তারনীতির ফলে আজ প্রায় শতকরা ৭৫ জন নিরক্ষর ও অশিক্ষিত।

অর্থনীতিক্ষেত্রে ভারতের গণদারিদ্র্যরেখা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতের গণ—নিরক্ষরতারেখা, দৈর্ঘ্যে ও গভীরতায় একই রকম রূপ ধারণ করেছে। ইংরেজোত্তর ভারতের অর্থনৈতিক শ্রেণিসমাজের যে মিশরীয় পিরামিডসদৃশ গড়নের কথা আগে বলেছি, তার সঙ্গে বিদ্বানশ্রেণিসমাজের তুলনা করলে অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে দেখা যায়। উভয়ের আকৃতির সাদৃশ্য যমজের মতো, যেমন বিত্তশালী সমাজের, তেমনি বিদ্বানসমাজের। এই সাদৃশ্য এমনিতে গড়ে ওঠেনি, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নীতি অনুযায়ী গড়ে উঠেছে। ‘ফরেন এড’ আশ্রিত ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্বানশ্রেণির এইরকম বিন্যাসই সম্ভব, অন্যরকম বিন্যাস সম্ভব নয়, কারণ বিদ্বানশ্রেণি এই অর্থনৈতিক যন্ত্রের আসল কুশলী যন্ত্রী, এই বৈষম্যপ্রধান শ্রেণিসমাজের ও রাষ্ট্রের ধারক বাহক প্রচারক, মেকলের ‘ইন্টারপ্রেটার’ শ্রেণি। কাজেই বিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিকল্পনা ও নীতির মিল থাকা ভারতের বর্তমান শাসকশ্রেণির স্বার্থের দিক থেকে একান্ত আবশ্যক। সেই পরিকল্পনা ও নীতির জন্য আজ ভারতীয় সমাজের যে ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে তা এই :

সামাজিক পিরামিডের পাদদেশে শতকরা প্রায় ৭৫ জন অতিদরিদ্র ও

নিরক্ষর মানুষ, যাদের বর্তমান ভয়াবহ, ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

তার উপরে বাকি শতকরা ২৫ জনের স্তরবিন্যাস, কতকটা এইরকম—সর্বোচ্চ শিখরে মুষ্টিমেয় কয়েকজন অতিধনিক।

তার নিচে ধনিকের বিভিন্ন স্তর সচ্ছল মধ্যবিত্তের প্রান্ত পর্যন্ত।

তার নিচে বিপুল নিম্নমধ্যবিত্ত, আশানিরাশায় আন্দোলিত।

ঠিক তেমনি বিদ্বানদের বুরোক্রাসির শ্রেণিবিন্যাস।

তফাত শুধু এই যে যাঁর যত বিত্ত তিনি তত প্রভাবশালী, কিন্তু যাঁর যত পাসকরা বিদ্যা তিনি তত বিদ্বান বা প্রভাবশালী সাধারণত নন। যাঁর বিদ্যা যত বেশি বর্তমান শাসকশ্রেণির পৌরোহিত্যে উৎসৃষ্ট, তিনি তত বেশি ‘বিদ্বান’ বলে ঢক্কানিনাদিত ও সম্মানিত এবং তত বড় বিদ্বান—ব্যুরোক্রাট, আর স্বভাবতই বিত্তবান। তিনি সাধারণ বিদ্যালয়ের অনেক সশিক্ষিত শিক্ষকের চেয়ে অনেক কম বিদ্বান হয়েও হয়তো দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পুরোহিত হতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেন, বড় বড় ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হতে পারেন। ব্রিটিশ শাসকরাও তাঁদের রাজত্বকালে, নিজেদের শাসনশোষণের স্বার্থে, শিক্ষাক্ষেত্রে এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু বিদেশি শাসক বলে তাঁদের যেটুকু বাইরের মুখোশের প্রয়োজন ছিল, মনে হয় বর্তমান ‘স্বদেশি’ শাসকদের কাছে সেই মুখোশটুকুরও কোনো প্রয়োজন নেই। অতএব তাঁদের নীতির নগ্নমূর্তিটাই স্বাভাবিক. এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রকাশ অর্থনীতিক্ষেত্রের মতোই নির্মম।

ব্রিটিশ শাসকদের উত্তরাধিকার ভারতীয় শাসকরা কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বহন করেছেন, তা পূর্বোক্ত শিক্ষাবিস্তারের প্যাটার্ন ও ডিজাইন থেকেই বোঝা যায়। ডিজাইনটা হল : প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের বিস্তার তিনগুণ, মাধ্যমিক স্তরের চারগুণ, উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছয়গুণ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঁচগুণ, টেকনিক্যাল ডিগ্রির স্তরের চারগুণ, ডিপ্লোমা স্তরের আটগুণ। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের বিস্তার সবচেয়ে কম, তার পর থেকে উচ্চস্তরের শিক্ষাবিস্তার আনুপাতিক হারে অনেক বেশি। যে—কারণে দরিদ্র লোকের মতো নিরক্ষর লোকের সংখ্যা ভারতে সবচেয়ে বেশি। অথচ বিচক্ষণ শিক্ষাবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা বলেন যে উন্নয়নপন্থী দেশে প্রাধান্যটা ঠিক বিপরীতমুখী হওয়া উচিত অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সর্বাধিক গুরুত্ব ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে করা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়নি। হয়নি তার কারণ, আমরা প্রধানত সেই শ্রেণির শিক্ষাতত্ত্ববিদদের সদুপদেশ শিরোধার্য করেছি যাঁরা ‘ফরেন এড’—ছদ্মবেশী নয়াসাম্রাজ্যবাদী দেশের শিক্ষানীতির অন্ধ স্তাবক। এরকম একজন বিদেশি শিক্ষাবিদ বলেন যে উন্নয়নমুখী দেশে (যেমন ভারতে) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অর্থব্যয় করার ফল হল :

it almost inevitably takes money from other more crucial forms of educational growth.

(সম্প্রতি ‘growth’ কথাটি যেমন অর্থনীতিক্ষেত্রে, তেমনি বিদ্যার ক্ষেত্রে পৃথক ‘concept’ হিসেবে বেশি প্রয়োগ করা হচ্ছে, ‘development’ ও  ‘progress’ কথার বদলে)। শিক্ষার এই ‘more crucial forms’ কি, এই শিক্ষাবিদের মতে? তিনি বলেন :১৪

Most authorities are agreed that the best way of reconciling economic expency with the technical requirements of a country is a sound growth of secondary education, providing the army of trained…persons who are so greatly needed as technicians, clerks, nurses, agricultural assistants, supervisors, foremen and businessmen, who also in all these capacities form the basis of solid citizenry. (বাঁকা হরফ লেখকের)।

প্রাথমিক শিক্ষার বদলে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন অর্থনৈতিক অগ্রগতির কাজকর্মের দিক থেকে অনেক বেশি, কারণ এই শিক্ষা দিলে তবে টেকনিসিয়ান কেরানি নার্স কৃষিসহকারী সুপারভাইজার ফোরম্যান ব্যবসায়ী ইত্যাদির ‘সাপ্লাই’ পাওয়া যাবে এবং এই শ্রেণির শিক্ষিতরা ‘solid citizenry’—র পাকা ভিত হিসেবে গড়ে উঠবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় শক্তির সুসংহত সমর্থকশ্রেণি হবে। ভারত সরকার শিক্ষাপ্রসারের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রায় বর্ণে বর্ণে পালন করে মেকলের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন, কারণ এই শিক্ষানীতি, মিরডালের ভাষায়১৫

conforms rather closely to the old colonial pattern of building up a highly educated elite with an attached lower rank of technical personnel functioning as subalterns while leaving the population at large in a state of ignorance.’ (বাঁকা হরফ লেখকের)।

মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়স্তর পর্যন্ত বিদ্যার্থীদের বিপুল সংখ্যাবৃদ্ধি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে আমাদের দেশে শিক্ষার সামাজিক চাহিদা যথেষ্ট বেড়েছে। এই চাহিদা কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী বেড়েছে। এটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে বিশেষ উল্লেখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। এর কারণ জনসংখ্যাস্ফীতি নয় শুধু, অন্যান্য কারণও আছে। যেমন ১৯০০ থেকে আজ পর্যন্ত (১৯৬৯—৭০) আমেরিকার জনসংখ্যা বেড়েছে মোট আড়াইগুণ, কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে ১৯০০ সালের ১২% থেকে ১৯৬৭ সাল ৯০% পর্যন্ত, প্রায় আটগুণ এবং উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে ৪% থেকে ৪৪%, প্রায় এগারোগুণ। এরকম অন্যান্য দেশেও বেড়েছে। শিক্ষাসমাজতত্ত্ববিদরা বলেন যে এই চাহিদাবৃদ্ধি কারণ তিনটি। প্রথম কারণ, আধুনিক পিতামাতার ও ছেলেমেয়েদের আকাঙ্ক্ষাবৃদ্ধি; দ্বিতীয় কারণ, জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সরকার শিক্ষা প্রসার নীতির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক; তৃতীয় কারণ, লোকসংখ্যাবৃদ্ধি শিক্ষাচাহিদার উপর যার প্রতিক্রিয়া ‘quantitative multiplier’-এর মতো।১৬

এই তিনটি কারণই আমাদের দেশ অত্যন্ত সক্রিয়। গত একপুরুষকালের মধ্যে শ্রেণিনির্বিশেষে পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যধিক সজাগ হয়েছেন, এবং মধ্যবিত্তশ্রেণির বিভিন্ন স্তরে এই সজাগতা অত্যন্ত প্রবল। বরং অনেকক্ষেত্রে বিসদৃশভাবে প্রকট বলা চলে। পিতামাতা উভয়েই চাকরিজীবী, সাধারণ গৃহস্থ মধ্যবিত্ত, কিন্তু ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষাতে যা খরচ করেন তা একপুরুষ আগে দ্বিগুণ বিত্তবান পরিবারেও করা হত না। চতুর্গুণ বেতন দিয়ে কোনো ইংরেজিমিডিয়াম স্কুলে পড়ানো, একাধিক বিষয়ের জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ, টিফিন পোশাক যাতায়াত ইত্যাদি বাবদ খরচ হিসেব করলে দেখা যায় একটি ছেলেকে শিক্ষা দেওয়া প্রায় হাতি পোষার মতো ব্যাপার। যাঁরা বিত্তবান তাঁরা যদি হাতি পোষার মতো ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করেন তো বলার কিছু নেই, কিন্তু উপসর্গটি অত সরল নয়। মধ্যবিত্তের মধ্যে একশ্রেণির ভদ্রলোক, যাঁদের সংগতি নেই, তাঁরা অর্থের জন্য প্রাণপণ খেটেও, পিতামাতা উভয়েই, ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য এই খরচ বহন করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছেলেমেয়ের প্রকৃত শিক্ষালাভ যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি শিক্ষালগ্ন সামাজিক মর্যাদালাভ এবং উচ্চবেতনে কোনো চাকরি লাভ। তাই ইংরেজিমিডিয়াম স্কুলের ‘প্রাইভেট’ বাণিজ্যের এত প্রসার এদেশে, বিশেষ করে কলকাতার মতো বড় বড় শহরে, কারণ আমরা ‘স্বাধীন’ হলেও এবং জ্ঞানবৃদ্ধ দেশপ্রেমিকরা জাতীয় মাতৃভাষায় শিক্ষার উন্নতি সম্বন্ধে সদিচ্ছা পোষণ করলেও, ইংরেজিবিদ্যার কদর ইংরেজ আমলের চেয়ে স্বাধীন ভারতে অনেক বেশি বেড়েছে, সমাজে ও চাকরির ক্ষেত্রে। পরাধীন ঔপনিবেশিক যুগের উত্তরাধিকার শিক্ষাক্ষেত্রে যে আমরা কীভাবে বহন করে চলেছি, এবং অনেকটা অন্ধের মতো, এটা তার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এর সামাজিক প্রতিফল দূরপ্রসারী এবং স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়বস্তু। সংক্ষেপে বলা যায়, কর্মব্যস্ত পিতামাতার অন্তরঙ্গ সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত অথচ বিচিত্র এক ধরনের আহ্লাদী সোহাগে প্রতিপালিত এই ছেলেরা শিক্ষালাভ করে যৌবনে কর্মজীবনে উন্নাসিক হয়ে ওঠে, অর্থাৎ চলতি বাংলায় পুরো ‘ট্যাঁটোনে’ পরিণত হয়। বিদ্যার ‘ভাঁড়ে মা—ভবানী’ অথচ ইংরেজি বুকনিতে জবরদস্ত’ (চোখবুজে কথা শুনলে মনে হয় যেন ট্যাঁসফিরিঙ্গির বাচ্চা সব) এই semiliterate শ্রেণি, ডিগ্রি ও ইংরেজির জোরে সরকারি বেসরকারি বড় বড় চাকরিলাভও করেন এবং দেশের বিদ্বান—ব্যুরোক্রাসির শীর্ষস্থান দখল করে বসেন। কর্মস্থলে এই বিদ্বানদের ‘স্পোকেন ইংলিশ’ (‘স্পোকেন ইংলিশের কতরকমের ক্লাস, কত ইনস্টিটিউশন, এবং সেখানে চাকরিক্ষেত্রে মর্যাদালোভী শিক্ষিতদের ভিড়।) ও পদমর্যাদার দাপটে, তাঁদের অধীন বিদ্বানরা (ব্যুরোক্রাসির নিম্নস্তরের) সর্বদা থরহরিকম্পমান অবস্থায় দিন কাটান। আর পিতামাতারা যাঁরা সাধ্যের অতিরিক্ত করে, আহ্লাদে সোহাগে, ছেলেদের এরকম বিদ্বান করে গড়ে তোলেন, তাঁদের প্রতিদান হলো পুত্রপালনকর্তব্যান্তে নির্বাসন। বিদ্বান হাজারি—দু—হাজারি পুত্ররা তখন স্বাধীন ‘ব্যক্তি’তে রূপান্তরিত, তাদের পৃথক পরিবার, পৃথক সংসার, পিতামাতারা জীর্ণবস্ত্রের মতো পরিত্যক্ত অবজ্ঞাত, কারণ এই স্বাতন্ত্র্যই আধুনিকতা ও সভ্যতার লক্ষণ, বিশেষ করে ধনতান্ত্রিক শিল্পোন্নত দেশে, অতএব ‘ডেভালাপিং’ দেশেও।

শিক্ষার সামাজিক চাহিদা এই মধ্যবিত্তের স্তর থেকে আরও অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, শহর থেকে গ্রামে। যেমন শহরে তেমনি গ্রামেও। জমিদার পত্তনিদার তালুকদারদের স্তর থেকে মধ্যবিত্ত চাষির স্তর পর্যন্ত একদিকে, অন্যদিকে সমাদৃত উচ্চজাতিবর্ণের একচেটে অধিকার থেকে আজ অনাদৃত অবহেলিত জাতিবর্ণের স্তর পর্যন্ত (কিছুটা অন্তত) শিক্ষার অধিকার প্রসারিত। তার ফলে গ্রাম্য—সমাজেও এক নতুন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। গ্রাম্য শিক্ষিতরা শহর—গ্রামের সেতুস্বরূপ হয়ে উঠছেন, গ্রাম্য পরিবারে পিতার বংশগত জাতিগত পেশার সঙ্গে (চাষি কর্মকার চর্মকার বণিক প্রভৃতি) নব্যশিক্ষিত পুত্রের চাকরিগতও বিদ্যাগত পেশার অসংগতি ও বিরোধ বাড়ছে, নতুন পেশাগত মর্যাদার চেতনা যত প্রখর হচ্ছে তত পারিবারিক সংকট দেখা দিচ্ছে গ্রামে। শহরের শিক্ষাক্ষেত্রেও তার প্রতিক্রিয়া কম হচ্ছে না। শহরের উচ্চবিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাজাতির নানাবর্ণের নানাবৃত্তির গ্রাম্য ছাত্রদের সমাগমের ফলে (এবং শহরের নানাস্তরের শ্রমিকশ্রেণিরও) বিদ্যার্থীদের সামাজিক শ্রেণিগত রূপের (social class composition) পূর্বেকার বিন্যাস ভেঙে যাচ্ছে। বিদ্যার্থীদের এই শ্রেণিগত বিন্যাসভঙ্গের ফলে শহরের শিক্ষায়তনের নানারকমের ‘tension’ দেখা দিচ্ছে। বিদ্যার্থীদের মনোভঙ্গি ও মূল্যবোধের পার্থক্যের সংঘাত বাড়ছে, দাবিদাওয়ার বিরোধ বাড়ছে এবং তার ফলে প্রতিবাদ—বিদ্রোহের স্বরগ্রামেরও তফাত হচ্ছে। শিক্ষার সামাজিক চাহিদাবৃদ্ধি ও শিক্ষাপ্রসারের এই সমস্ত সামাজিক ফলাফল প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু এবং এগুলি সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ববিভাগের কাজ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সামান্য কাজ করা হয়েছে, অধিকাংশই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, আরও অনেক সরেজমিনে অনুসন্ধানসাপেক্ষ কাজ করার আছে। আমরা ফলাফলের ইঙ্গিত করেছি মাত্র। কথা হল, শিক্ষার চাহিদা যখন এই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন কীভাবে তা মেটানো সম্ভব? দু—রকম উপায়ে মেটানো যায়। প্রথম উপায় হল, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সমস্ত দরজা (বিদ্যালয়ের) উন্মুক্ত করে দিয়ে বিদ্যার্থীদের যত সংখ্যায় খুশি প্রবেশের অবাধ অধিকার দেওয়া যায়। দ্বিতীয় উপায় হল, একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত (যেমন প্রাথমিক বা মাধ্যমিক) প্রবেশের অবাধ অধিকার দিয়ে, পরবর্তী উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে অধিকার ক্রমেই সংকুচিত করা যায়, অর্থাৎ চাহিদা খানিকটা মিটিয়ে বলা যায়, আর দরকার নেই, এবার অন্য কিছু কর। প্রথম উপায়কে বলা হয় ‘wide open system’, দ্বিতীয় উপায়কে বলা হয় ‘selective system’। আমাদের দেশে কোন উপায়টি অবলম্বন করা হয়েছে? স্বভাবতই দ্বিতীয় উপায়, কারণ জনসংখ্যানুপাতে শিক্ষার চাহিদা অবাধে মেটাতে হলে অনেক বিদ্যালয়, অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার সরঞ্জাম ইত্যাদি প্রয়োজন, তার জন্য অর্থের ও সংগঠনের প্রয়োজন। সেই আর্থিক শক্তি অথবা সংগঠনের সদিচ্ছা কোনোটাই আমাদের দেশীয় সরকারের নেই, কারণ ‘ফরেন এড’ শিক্ষাক্ষেত্রে বেশিদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে অনিচ্ছুক, এবং ডেভালপিং দেশের জন্য সাহায্যদাতা বিদেশি ধনিক দেশের শিক্ষাকৌশল কী, তাও আগে বলেছি। সেই স্ট্যাটেজি কার্যকর করতে হলে শিক্ষাধিকার ও শিক্ষার চাহিদা যাচাই পদ্ধতিতে (selective process) নির্মমভাবে সংকুচিত করতে হয়। ব্রিটিশযুগে মেকলেনীতিও ছিল তাই।

যাচাইয়ের গতানুগতিক টেকনিক হল examination, পরীক্ষা। ‘competitive examination’ তার গলাভরা নাম। বিদ্যালয়ে প্রবেশকালে পরীক্ষা। প্রবেশের পর পরীক্ষার—পর—পরীক্ষা, ছাত্রজীবনের আগাগোড়াই পরীক্ষা প্রবেশকালে পরীক্ষার প্রথম কারণ বিদ্যালয়ে ও ক্লাসে স্থানাভাব, দ্বিতীয় কারণ ‘মেরিট’ ও ‘আই.কিউ’ অনুযায়ী বিদ্যার্থীরা প্রবেশাধিকার পাবে। যে বিদ্যালয় যত অভিজাত—যেমন দেশি বিদেশি মিশনস্কুল—কলেজ, সরকারি স্কুল—কলেজ—সেখানে প্রবেশ পরীক্ষা অথবা মার্কশিট টেস্ট তত কঠিন। পরীক্ষার বাহ্য ভড়ং দেখলে মনে হয় কত গণতান্ত্রিক, কিন্তু আসলে পরীক্ষা আদৌ গণতান্ত্রিক নয়, প্রভাবতান্ত্রিক।১৭ আমাদের দেশে ফিউডালযুগের প্রভাবতন্ত্রের ঐতিহ্য আজও অত্যন্ত সজীব বলে, শিক্ষাক্ষেত্রে ‘পরীক্ষা’ ‘মেরিট’ ইত্যাদি নামে গণতন্ত্রের মুখোশগুলো অত্যন্ত হাস্যোদ্দীপক। উপমন্ত্র থেকে রাজনৈতিক শাসক বা পার্টিবসের চিঠি থাকলে বহু অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়, যদিও গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার খাতিরে পরীক্ষার রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করা প্রয়োজন। এদেশের এই প্রবেশপথের নাম backdoor, খিড়কি দরজা। খিড়কি দরজা হাটখোলা করে সদর দরজা একটু ফাঁক করে রাখা হয় গণতন্ত্রের নামে। তারপর বিদ্যালয়ে, অর্থাৎ বিদ্যার কসাইখানায় বলিদান দেওয়ার তান্ত্রিক উৎসব চলতে থাকে, প্রভাব—তান্ত্রিক উৎসব। প্রতিযোগিতার পরীক্ষার ব্যর্থ হয়ে বিষণ্ণ তরুণ যুবক যারা ঘরে ফিরে আসে, গণতন্ত্রের কিঞ্চিৎ—ফাঁক দরজায় মাথা ঠুকে, তারা সকলেই প্রায় অসহায় দরিদ্র প্রভাবপ্রতিপত্তিহীন পরিবারের সন্তান। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, উচ্চ উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে তারা অবাঞ্ছনীয় বস্তুকারণ তাদের merit ও I.Q. গণতান্ত্রিক পরীক্ষা—প্রতিযোগিতায় অচল। তাহলে তারা কী করবে? এবং তাদের কিছু করা না করার দায়িত্ব কার? দায়িত্ব যারই থাক না কেন, আমাদের রাষ্ট্রের অন্তত আপাতত কোনো দায়িত্ব নেই। তা হলে তারা কি হবে? অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার ভিতর দিয়ে ‘solid citizenry’—র স্তরভুক্ত যখন তারা হতে পারল না, তখন তারা কি হবে? নিশ্চয় liquid অর্থাৎ fluid citizenry-র অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ drifter, dropout, যেভাবে হক তার ভেসে বেড়াবে, এবং তারা খাবে কি না খাবে, বাঁচবে কি না—বাঁচবে সে দায়িত্বও রাষ্ট্রের নেই।

আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণের ধারা ও ভাষা অনুসরণ করে বলা যায় যে বিদ্যার দুটো দিক আছে—একটা তার উপভোগ বা consumption-এর দিক (consumption dimension), আর একটা বিনিয়োগ বা investment-এর দিক (investment dimension)। বিদ্যার্থীরা যখন বিদ্যালয়ে যা তখন আশা করা হয় যে পারিবারিক পরিবেশের সীমানার বাইরে একটি বৃহত্তর সুস্থ সামাজিক পরিবেশে শিক্ষালাভ করে তারা ক্রমে পরিপূর্ণ নাগরিক ও মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে এবং বিদ্যা ও জ্ঞান তাদের জীবনসংগ্রামে (শুধু জীবিকাসংগ্রামে নয়) শক্তি জোগাবে, তাদের সুপ্ত বিচারবুদ্ধি জাগ্রত করবে। এইটাই জ্ঞানবিদ্যার প্রকৃত উপভোগের দিক। এটা বিদ্যার আদর্শের দিক, অপূর্ণ আংশিক মানুষকে পরিপূর্ণ অখণ্ড মানুষ করে গড়ে তোলা। অখণ্ড মানুষের আত্মশক্তি সমাজবোধ ও বিশ্ববোধ অমূল্য সম্পদ, যে—সম্পদ সে সারাজীবন নিজে ভোগ করতে পারে, যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কিন্তু বিদ্যার আদর্শ প্রাচীন সমাজে অনেকটা অনুসৃত হলেও, ধনতান্ত্রিক সমাজে হয় না, বিদ্যার্থীদের সেখানে কোনো সুযোগ সম্ভাবনা নেই ‘to enjoy the humanistic aspect of education as an end in itself.’ এই সমাজে বিদ্যার ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগের দিকটাই প্রধান, কারণ মানুষ ঠিক টাকার মতো মূলধন তো বটেই, টাকা ছাড়া বিদ্যালাভও সম্ভব নয়। কাজেই বিদ্যার জন্য যে টাকা ব্যয় করা হয়, এবং যে সংখ্যায় মানুষকে নানারকমের বিদ্বান তৈরি করা হয়, উভয়ই ‘ইনভেস্টমেন্ট’। প্রথমটা ‘পারিবারিক’ ইনভেস্টমেন্ট, দ্বিতীয়টা ‘জাতীয়’ ইনভেস্টমেন্ট। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অনুযায়ী তার কর্মীলোকসংখ্যা (manpower) পরিমাপ করা হয়—যেমন কত কেরানি, কত এঞ্জিনিয়ার টেকনিশিয়ান, কত বিজ্ঞানী, কত প্রশাসনকর্মী ইত্যাদি—এবং তদনুযায়ী শিক্ষাপ্রসারেরও পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিরাট শিক্ষাযন্ত্র থেকে সেই সমস্ত কাজের উপযোগী নানাশ্রেণির বিদ্বান উৎপন্ন হতে থাকে। অতএব ‘investment in human capital’ নির্ভর করে আসল অর্থনৈতিক মূলধনের জাতীয় বিনিয়োগনীতি এবং জাতীয় উন্নয়নের ধারা ও লক্ষ্যের উপর। আমাদের দেশের জাতীয় উন্নয়নের ধারা যে পুরোপুরি ধনতান্ত্রিক তা বোঝার জন্য বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না, জাতীয় গভর্নমেন্ট নিযুক্ত বিভিন্ন কমিশনের অনুসন্ধান—রিপোর্ট পড়লেই জানা যায়। তার ফলে গত কুড়ি বছরে দেশের অর্থনৈতিক শক্তি চূড়ান্তভাবে সংহত হয়েছে মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণির হাতে এবং বৃহত্তম জনসংখ্যার চরম দারিদ্র্যের বিনিময়ে ধনিক ও উচ্চবিত্তের স্তরায়ন হয়েছে সমাজের উপর তলায়। বিদ্যাবিদ্বানের ক্ষেত্রেও বিশাল ব্যুরোক্রাসির বিকাশ হয়েছে এবং সেখানেও প্রভূত ক্ষমতাশালী বিদ্বানদের স্তরায়ন হয়েছে সমাজের উপর তলার, এবং অর্ধবিদ্বান অবিদ্বান নিরক্ষরদের নিয়ে গঠিত বৃহৎ জনস্তর ক্রমেই বৃহত্তর হয়েছে। যেমন প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে (২ জানুয়ারি, ১৯৭১) শ্রীআত্মারাম, কতকটা ভূতের মুখে রাম—নামের মতো, ব্যাঙ্গালোরে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কাছে এক ভাষণে বলেছিলেন যে ভারতবর্ষে উদ্ভূত হয়েছে, যাঁরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি একথাও বলেছেন যে, এই ‘বুর্জোয়া’ বিজ্ঞানীরা—(‘বুর্জোয়া’ কথা শ্রীআত্মারাম—ব্যবহৃত)১৮

have never worked in a laboratory outside their degree career এবং they have drifted into new and attractive realms which make them important and influential…

তাহলেই তো হল, শ্রীআত্মারাম নিজেও তা জানেন, ‘important’ ও ‘influential’ হওয়াই আসল কথা, জ্ঞানবিদ্যার চর্চা বা গবেষণা কোনোদিন আমলাতন্ত্রের মই বেয়ে উপরে উঠতে (attractive realm’—এ) কাজে লাগে না। বিজ্ঞানের মতো অন্যান্য বিদ্যা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও এই একই অবস্থা। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র কমিটি সিন্ডিকেট অধ্যক্ষ উপাচার্য ডীন প্রভৃতিদের নিয়ে দুর্ভেদ্য আমলাতান্ত্রিক চক্র এবং প্রধানত অযোগ্য অপদার্থ ব্যক্তিদের (অবশ্যই বিদ্বান) সর্বময় প্রভুত্ব। ডিগ্রি গবেষণা চাকরি সবই এই বিদ্বান—আমলাতন্ত্রের পোষকতানির্ভর। যেমন অধিকাংশ বিজ্ঞানী যাঁরা আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিচালক, পাঠজীবনে ল্যাবরেটারি দেখার পর আর কখনো সেখানে প্রবেশ করেননি, অন্যান্য বিদ্বানপ্রভুরাও ঠিক তাই। তিরিশ বছর আগে যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের স্ট্যাটিষ্টিক্স সংগ্রহ করে ‘ডক্টর’ শ্রেণির বিদ্বান হয়েছিলেন, তিনি হয়তো আজও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি কলেজে অর্থনীতির প্রধান অধ্যাপক। যেমন ব্যাঙ্কিং কারেন্সির গবেষণা করে একদা যিনি ‘ডক্টর’ হয়েছিলেন, তিনি প্রকাণ্ড অর্থনীতিবিদ। যিনি হয়তো ইতিহাসে ‘মহাবীর সিং’ সম্বন্ধে গবেষণা করেছিলেন, তিনি বিরাট ঐতিহাসিক। তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দর্শনে ও অন্যান্য বিদ্বায়। এঁরা ‘influential’ ও ‘important’, অন্য কেউ যত বড় প্রতিভাবান ও শক্তিমান হন না কেন, ইচ্ছা করলে ডিগ্রি—চাকরির ক্ষেত্রে এঁরা তাঁদের খতম করে দিতে পারেন, কারণ বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে এঁরা এক—একটা strategic position দখল করে বসে আছেন ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। শুধু আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার জৌলুসের জন্যই এঁরা লালায়িত, বিদ্যার জন্য কদাচ নয়।

আমাদের শিক্ষানীতির এই হয়েছে পরিণাম, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলাফলের মতো। অর্থনৈতিক মূলধনের বিনিয়োগে বিভিন্ন প্রকল্পে যেমন ভুল হয়েছে অনেক, তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রে মানবিক মূলধন বিনিয়োগেও মারাত্মক ভুল হয়েছে। ভুলটা নীতিগত, লক্ষ্যগত। নিরক্ষরতাদূর ও প্রাথমিক শিক্ষা উপেক্ষিত তো হয়েছে—ই, উচ্চশিক্ষার প্রসারও যতটুকু হয়েছে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ও চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে হয়নি। অর্থাৎ কর্মীলোকের (manpower) জাতীয় চাহিদা অনুপাতে উচ্চশিক্ষারও প্রসার হয়নি। দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক চাহিদা থেকে বেশি পরিমাণে ‘বিদ্বান’ নামক সামগ্রীর সাপ্লাই হয়েছে উচ্চবিদ্যার উৎপাদনসংস্থা থেকে। তার কারণ, অর্থনৈতিক চাহিদা—‘growth’ ও ‘planning’—নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বৈদেশিক সাহায্যদাতাদের উপদেশ ও আদর্শ অনুযায়ী, তাই বিদ্বান—সরবরাহ অতিরিক্ত হয়ে গেছে। তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ দেশে আজ বিদ্বানদের বেকারসমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিদ্যাগবেষকরা বলেছেন :১৯

After all, employed manpower with matriculate and graduate qualifications amounts to less than 4 per cent of the entire labour force of India : it is only the small apex of a vast pyramid and yet even at this apex the unemployment rate exceeds anything experienced in advanced countries since the Great Depression.

ভারতের মোট শ্রমনিযুক্ত লোকসংখ্যার শতকরা মোট চারজন ম্যাট্রিকুলেট থেকে গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু শতকরা এই মাত্র চারজন, বিশাল পিরামিডের চুড়োয় যাঁদের অবস্থান, তাঁদের মধ্যেও বেকারসমস্যা আজ এত প্রকট হয়ে উঠেছে যা উন্নত দেশেও সেই ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কখনো হয়নি। এই গবেষকরা অবাক হয়ে গেছেন, এই কথা ভেবে, যে—দেশে (ভারতে) বাৎসরিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার, গত পনেরো বছর ধরে ৩.৫ করে দাবি করা হয়, সেই দেশ তার পনেরো জন উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে গড়ে একজনকেও ঠিকমতো কাজ দিতে পারেনি।* তা সত্ত্বেও ডিগ্রির প্রতি এত মোহই বা কেন, আর কোথায় তার আকর্ষণ? একথা ঠিক যে ‘ব্যাচিলার অফ আর্টস’ ডিগ্রির চেয়ে ‘ব্যাচিলার অফ এঞ্জিনিয়ারিং’ ডিগ্রির চাকরিমূল্য (এবং বিবাহমূল্যও) বেশি, কিন্তু তাহলেও ভারতীয় অবস্থায় দেখা যায় যে বি এ. ডিগ্রিরও চাকরিমূল্য আছে, অন্তত ম্যাট্রিকুলেটের চেয়ে (বর্তমান স্কুল ফাইনাল বা হায়ার সেকেন্ডারি) বেশি—‘his degree does increase his chances of finding employment’—তাই মোহ ও আকর্ষণ।২০ অবশেষে উক্ত গবেষকরা বলেছেন—‘To be sure, there is more education than economic growth–’ এবং এই প্রসঙ্গে একথাও স্বীকার করেছেন—

that too much of the educational budget has gone to the higher levels and too little to the lower levels of the educational system.

আর উচ্চশিক্ষার অবস্থা হয়েছে কি?

the quality of Indian higher education is now among the lowest in the world’ (বাঁকা হরফ লেখকের)২১

ভারতের উচ্চশিক্ষার মান আজ পৃথিবীর মধ্যে নিম্নতম, ডিগ্রি গবেষণা সবই অন্তঃসারশূন্য চটকদার প্যাকেজের মতো এবং তার কারণ পরীক্ষা দুর্নীতি স্বজন—মোসাহেবপোষণ ইত্যাদি কৌশল অবলম্বনে অপদার্থ বিদ্বানব্যুরোক্রাটদের বিদ্বৎসমাজের উপরতলায় একনায়কত্ব। বিকৃত বিলাসবাসনা চরিতার্থতার জন্য অনাবশ্যক ভোগদ্রব্যের উৎপাদনে, যৌনবেদনপ্রধান মালকাটতির বিজ্ঞাপনে, রংবেরঙের বাহারে কনটেনার প্যাকেজের বন্যায় যেমন আমাদের দেশ আজ ভেসে গেছে, অথচ জীবনধারণের উপযোগী অত্যাবশ্যক জিনিসের উৎপাদন সেই অনুপাতে বাড়েনি এবং তার ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনোরকমে খেয়ে পরে বেঁচে থাকায় দায় হয়ে উঠেছে, ঠিক তেমনি বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে অনাবশ্যক উচ্চশিক্ষার প্রসার হয়েছে (অনেকাংশে যা অন্তঃসারশূন্য), চটকদার প্যাকেজতুল্য ডিগ্রির আকর্ষণ বেড়েছে, কিন্তু অত্যাবশ্যক প্রাথমিক শিক্ষার বা অক্ষরজ্ঞানের অথবা প্রকৃত শিক্ষার বিশেষ প্রসার হয়নি। অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষানীতির এরকম গভীর অঙ্গাঙ্গিতা বাস্তবিকই বিরল।

এইবার যদি সেই তরুণ বিষণ্ণ বিদ্যার্থীদের দিকে ফিরে তাকাই যারা বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে ‘মেরিট’ ও ‘আই.কিউ.’ টেস্টের মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় অনুত্তীর্ণ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে—কোনো স্বামীজী, ফাদার, উপমন্ত্রী, সেক্রেটারি, কমিটিমেম্বার কাউকে যথাচারে তৈলমর্দনের সুযোগ পায়নি—অথবা পিতার ইনকাম—কলামে এমন সংখ্যা বসিয়েছে যাতে বিদ্যার ব্যয়সংকুলান হয় না—তাহলে তাদের জীবনসম্যার সমগ্ররূপটি আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাব। কেউ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, কেউ মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, কেউ উচ্চমাধ্যমিক থেকে কলেজে, কেউ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে চায়। কেন চায়? কারণ উচ্চ থেকে উচ্চতর ডিগ্রির পাসপোর্ট পেলে তাদের চাকরিলাভের সম্ভাবনা (chance) বেশি। কিন্তু প্রবেশ করতে পারল না, ‘গণতান্ত্রিক’ প্রতিযোগিতায় হেরে গেল, প্রমাণ হয়ে গেল যে তাদের ‘মেরিট’ কম, ‘আই.কিউ’, কম, আসলে খিড়কিদরজা দিয়ে ঢুকে উপযুক্ত পাত্রের পদযুগলে তৈলদানের সামর্থ্যের অভাব। তাহলে তারা কী হল? কী হতে পারে? বা কী হবে?

মালতৈরির কারখানায় গেলে দেখা যায়, অসম্পূর্ণ মাল, ভাঙাচোরা ছেঁড়া—ছোটা ‘ড্যামেজড’ মাল (‘D’ quality) পরিত্যক্ত অবস্থায় স্তূপাকার করা রয়েছে। এই অনির্বাচিত প্রবেশাধিকারবঞ্চিত বিষণ্ণ বিদ্যার্থীরা হল বিদ্যা কারখানার ‘unfinished products’,প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী যে—কোনো স্তরে যাচাইয়ের পরীক্ষায় বাতিল হয়ে গেছে। তাদের বাজারমূল্য ‘finished products’—এর চেয়ে অনেক কম, সেই জন্য ‘finished’ এবং ‘unfinished’ বিদ্বানদের মধ্যে (‘finishers’ ও ‘nonfinishers’ ও বলা যায়) পার্থক্যও যথেষ্ট, যেহেতু ‘educational systems themselves make a sharp distinction between finished and unfinished product.’।২২ যে—বিদ্বানরা তৈরি মাল ও যাঁরা আধাতৈরি মাল, তাঁদের মধ্যে ব্যবধান প্রায় শ্রেণিগত ব্যবধানের মতো। আবার তৈরি ও আধাতৈরিদের মধ্যেও, ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটের ‘ভ্যালু’ অনুযায়ী, শ্রেণিসদৃশ পার্থক্য বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, এমনকী জীবনধারণের তাৎপর্য পর্যন্ত তাই পরীক্ষায় (examination) উত্তীর্ণ হওয়ার উপর নির্ভর করে, যেহেতু পরীক্ষালব্ধ ডিগ্রি সার্টিফিকেটই ইহজীবনে চলার পথে প্রধান অবলম্বন, ব্রহ্মনাম হরিনাম সততা দৃঢ়তা নিষ্ঠা অথবা স্বোপার্জিত (অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহরাঙ্কিত নয়) অগাধ পাণ্ডিত্যও তার তুলনায় অচল ও অক্ষম। তাই পরীক্ষাকালে এত উদ্বেগ, এত ভয়, এত জীবনমরণ সমস্যার মতো পরীক্ষার্থীর দুশ্চিন্তা—

And, in a society where educational attainments symbolized by certificates and degrees, are closely linked to preferred categories of employment and social status, the student who finishes has much more promising career pro-spects. The one who drops out or fails, on the other hand, burns important bridges to the future. When so much is at stake, including the whole family’s social status, there is little reason to wonder why anxieties mount high as examination and admission times approach..।২৩

একদা ছিল সবার উপরে ‘মানুষ’ সত্য, সবার উপরে আদর্শ সত্য, সততা সত্য, অন্তত কিছুটা হয়তো ছিল, কিন্তু এখন পরীক্ষাই যখন জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য, কৈশোর যৌবনের সবচেয়ে উৎকট বিভীষিকা, পরীক্ষাই যখন জীবনমৃত্যুর পরওয়ানা, সামাজিক সম্মান অসম্মানের মানদণ্ড, তখন পরীক্ষার ভীতি ও দুশ্চিন্তা তরুণ ছাত্রদের মধ্যে থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এবং যখন ‘so much is it stake’, এবং ‘for what’, অন্তত প্রকৃত জ্ঞানবিদ্যার জন্য কখনোই নয়, কেবল চাকরির একটি ছাড়পত্র লাভের জন্য, বেঁচে থাকার একটা ‘chance’ পাওয়ার জন্য, অন্তত মানুষের মতো না হলেও, জ্যান্ত জীবের মতো, তখন পরীক্ষাকালে ছাত্রদের তথাকথিত দুর্নীতি (যেমন mass copying ইত্যাদি) যে কতখানি তাদের নৈতিক চারিত্রিক অবনতির পরিচায়ক, আর কতখানি হাড়িকাঠের সামনে কম্পমান জীবের আত্মরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে যা ইচ্ছা করার মনোভাবের প্রকাশ, তা মনোবিজ্ঞানীরা, এবং প্রাজ্ঞ উপাচার্যরাও ভেবে দেখবেন, অন্তত বিদ্যালয়ে পুলিশক্যাম্প স্থাপনের আগে। তা ছাড়া, বয়স অনুপাতে নীতি—দুর্নীতিপ্রবণতার তুলনা করে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে বর্তমান সমাজের দুর্নীতিপ্রবণতা মধ্যবয়সির ও প্রবীণদের মধ্যে যতটা প্রবল, তরুণ কিশোর যুবকদের মধ্যে ততটা নয়। সামাজিক সর্বরকমের দুর্নীতির ক্ষেত্রে পরিপক্ক ঝানু ব্যক্তিদেরই একাধিপত্য, তরুণদের নয়, এমনকী দুর্নীতির শিক্ষানবীশ হিসেবেও নয়।২৪

পরীক্ষার সিঁড়ি অতিক্রম করে উঠবার সময় যে—কোনো ধাপে পরীক্ষার্থীর পতন হতে পারে এবং পতন যাদের হয় তাদের রণাঙ্গনের আহত নিহত সৈনিকদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিদ্যার রণক্ষেত্রে পরীক্ষার ‘অ্যাম্বুশে’ পর্যুদস্ত এই সমস্ত তরুণ ‘বিকলাঙ্গ’ বিদ্যার্থীদের বলা dropouts, failures, repeaters, nonfinishers ইত্যাদি। বিদ্যার কারখানার এই সমস্ত ড্যামেজড মাল দেশের কর্মীমানবশক্তির বিপুল অপচয়, একথা যে—কোনো মতবাদের শিক্ষা—বিজ্ঞানী স্বীকার করেন। আমাদের দেশে মানবশক্তির এই অপচয় বর্তমানে পর্বতপ্রমাণ আকার ধারণ করেছে, যেদিকে তাকালে রীতিমতো ভয় করে। বিদ্যাবিকলাঙ্গদের এই পর্বত শান্ত সুস্থির পর্বত নয়, বিস্ফোরণের অপেক্ষায় অস্থির অশান্ত পর্বত, ক্রোধ ও অসন্তোষের বহ্নি সর্বদা তার গহ্বরে ধূমায়মান। দমননীতি অথবা বয়োবৃদ্ধদের দাম্ভিক অভিভাবকত্ব তাতে অগ্নিসংযোগ করে মাত্র।

গবেষকরা বলেছেন যে আমাদের দেশে ব্যর্থবিদ্যার্থীর সংখ্যা শিক্ষার নিম্নস্তরের দিকে সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের অপচয় প্রায় ৭৮.৩৫%।২৫ পরবর্তী উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে অপচয়ের পরিমাণ ক্রমে কমতে থাকে দেখা যায়। এটা নাকি ভারতের মতো অনুন্নত ও ডেভালাপিং দেশের বৈশিষ্ট্য। তাই বোধহয় এদেশে রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির ঝোঁক উচ্চবিদ্যার দিকে, প্রাথমিক বিদ্যার দিকে নয়। মিরডাল ঠিকই বলেছেন যে একথা অর্ধসত্য মাত্র, কারণ ‘‘large scale waste exists in secondary and tertiary schools as well.”।২৬ শিক্ষার সর্বস্তরেই আমাদের দেশে অপচয় সমান শোচনীয়, প্রাথমিক স্তরে দরিদ্রদের খানিকটা ভিড় বেশি বলে অপচয়ের অঙ্কটা বেশি মনে হয়। প্রাথমিক স্তরের অপচয়ের আরও একটি বড় কারণ হল যোগ্য শিক্ষকের সমস্যা খুব গুরুতর সমস্যা, প্রাথমিক স্তরের তুলনায় উচ্চশিক্ষার স্তরেও কিছু কম নয়। সেকথা শিক্ষকদের প্রসঙ্গে বলব।

কিন্তু প্রশাসনিক বৈজ্ঞানিক টেকনিক্যাল এলিটশ্রেণি গড়ে তোলার জন্য যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতসরকার বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, সেখানেও দেখা যায় যে বাইরের জনসমাজের মতো এই শিক্ষিতসমাজের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য ক্রমে দৃঢ়তর হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের এই নতুন এলিটশ্রেণি নতুন ধনিকশ্রেণির পরিবারের ভেতর থেকেই প্রধানত গড়ে উঠেছে। যা হবার কথা, একই সীমানায় টাকা ও বিদ্যার মিলন, তাই হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের (I.I.T.) একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে এই উচ্চশিক্ষার গতি কোনদিকে তা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ১৯৬০—এর মাঝামাঝি পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় স্তরের মধ্যে ছেলেদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ বেশ প্রবল ছিল। তার ফলে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরাও (যাঁদের মাসিক আয় ৫০০ টাকার মধ্যে) ইঞ্জিনিয়ারিং—এর বিভিন্ন বিভাগে বেশ কিছু সংখ্যায় ভরতি হত। কিন্তু পরে যখন ক্রমে ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির সম্ভাবনা কমতে থাকল, তাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন দেখা গেল যে সাধারণ মধ্যবিত্তরা আর তাঁদের ছেলেদের ব্যয়সাধ্য ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা দিতে ঝুঁকছেন না, যে—কোনো চাকরি পাওয়ার মতো শিক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ১৯৭০—এর দিকে দেখা যায়, উচ্চমধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা ক্রমে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যায় :২৭

১. মাসিক ২৫০ টাকা আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা I.I.T.-তে ১৯৬৬—৬৯—এর ৫—৬% থেকে ১৯৭০—এ ২% হয়েছে।

২. ২৫১—৫০১ টাকা আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা ১৯৬৬ সালের ৩৪% থেকে ১৯৬৮ সালে ১৪% হয়েছে এবং তার পর থেকে প্রায় একইরকম আছে।

৩. মাসিক ৫০০ টাকার বেশি আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে। তার মধ্যে ৫০১—১০০০ টাকা মাসিক আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যার বিশেষ হ্রাসবৃদ্ধি হয়নি, কিন্তু ১০০০—এর বেশি টাকা আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা অনেক বেশি বেড়েছে।

৪. ১০০১—১৬০০ টাকা আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা ১৬% (১৯৬৮) থেকে ২৮% (১৯৭০) হয়েছে।

৫. মাসিক ২০০০ টাকা বেশি আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা ৪% (১৯৬৬) থেকে ১৬% (১৯৭০) হয়েছে। তার মধ্যে ৩০০০ টাকার বেশি আয়ের পরিবারে ছাত্রসংখ্যা ২% থেকে ৬% হয়েছে।

অর্থাৎ I.I.T.—তে মাসিক ২০০০ টাকার বেশি আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, প্রায় চারগুণ। তার মধ্যে ৩০০০ টাকার বেশি আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ১০০০—১৬০০ টাকা মাসিক আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা দ্বিগুণের কিছু কম বেড়েছে, ৫০০—১০০০ টাকা মাসিক আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা প্রায় একরকমই আছে, এবং তার চেয়ে কম আয়ের পরিবারের ছাত্রসংখ্যা ক্রমে কমেছে। ঠিক এই ধরনের শ্রেণিরূপায়ণ সাধারণ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে (আর্টস ও সায়েন্স) হয়নি, কারণ I.I.T.-র ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার মতো সেগুলি তেমন ব্যয়বহুল নয়, যদিও বর্তমানে তাও নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শ্রেণিবিন্যাসের প্যাটার্ন একরকম, কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির ক্ষেত্রে যতটা উচ্চশ্রেণিমুখী, সাধারণ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ততটা নয়। কাজেই ব্রিটিশযুগের মেকলের শিক্ষানীতি যে স্বাধীন ভারতে কীভাবে অনুসৃত হচ্ছে কার্যক্ষেত্রে, তা আর বেশি ব্যাখ্যা করে বলার বোধহয় প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রের শ্রেণিরূপায়ণের সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। ভারতীয় শাসকশ্রেণি ও বিশাল ভারতীয় জনসমাজের (দরিদ্র ও নিরক্ষর) মধ্যে যে বিদ্বান দোভাষীশ্রেণি তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, তার প্রধানত উচ্চমধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। ‘পরীক্ষা’ ‘মেরিট আই. কিউ. টেস্ট’ ইত্যাদির মাহাত্ম্যও এই আলোকে বিচার্য। এইজন্য শ্রেণিগত অথবা জাতিবর্ণগত গতিশীলতা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ বাড়েনি, অনুন্নত জাতিবর্ণ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য যেটুকু বেড়েছে তা উল্লেখ্যই নয়।

শিক্ষক পাঠ্যবই সিলেবাস বিদ্যালয় প্রভৃতিও বর্তমান বিদ্যাসংকট প্রসঙ্গে আলোচ্য। কিন্তু প্রত্যেকটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পৃথক প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। আমরা সংক্ষেপে শুধু সমস্যার স্বরূপটি উন্মোচন করব। শিক্ষার্থীদের পরেই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা হলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং যত কম বেতনই তাঁরা পান না কেন, তাঁরাই হলেন সবচেয়ে বেশি ব্যয়সাপেক্ষ উপাদান:২৮

Teachers, next to students, are the largest, most crucial inputs of an educational system. They are also, by all odds, the most expensive inputs, even when they are underpaid.

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকরা বিশেষ গুরুদায়িত্ব পালন করেন, অথচ অন্যান্য লোভনীয় কর্মক্ষেত্রের বিদ্বানদের মতো তাঁরা মোটা বেতন ভাতা উপরি ইত্যাদি পান না বলে তাঁরা নিজেদের অবহেলিত মনে করেন। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করা প্রাইভেট বা পাবলিক সেক্টারে মোটা মাইনের কাজ পেয়ে যদি চলে যান, এবং ডেভালাপড দেশে যাবার সুযোগও থাকে যথেষ্ট, তাহলে ক্ষীণ জোনাকিরা শুধু নিরুপায় হয়ে পড়ে থাকেন, বিদ্যালয়ে জ্ঞানের সলতেটি জ্বালিয়ে রাখার জন্য। সেইজন্য শিক্ষকতা অধ্যাপনার ক্ষেত্রে ‘high proportion of “second choice” candidates’-এর ভিড় বেশি দেখা যায় এবং তার সঙ্গে ‘widespread decline in teacher, qualifications’-ও গুরুতর সমস্যা হয়ে ওঠে।২৯ আমাদের দেশে এই সমস্যা যে কত ভয়াবহরূপে দেখা দিয়েছে, কোঠারি কমিশনের রিপোর্ট (Report of the Education Commission 1964-66, Govt of India, New Delhi 1966. এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন ডি. এস. কোঠারি) তা নানাভাবে বিবিধ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন :

In many of the weaker colleges and universities, a majority of teachers teach mechanically and listlessly.

… Whatever research is done is usually of unconvincing quality.

The hierarchical concentration of authority within the departments and colleges, the atmosphere of distruct between senior and junior teachers the unseemly conflicts about offices and positions, and the attitude of envy towords persons of superior attainments….ইত্যাদি।

আরও অনেক মন্তব্য আছে। এই কয়েকটিই আপাতত যথেষ্ট। অধিকাংশ ‘দুর্বল’ বিদ্যালয়ে, (অর্থাৎ বেসরকারি বা প্রাইভেট সেক্টারের বিদ্যালয়ে) কোঠারি কমিশন বলেছেন, শিক্ষকেরা যন্ত্রের মতো শিক্ষা দেন। অতএব ছাত্ররা এই যন্ত্রের নির্যাতন সহ্য করে। কোনো শিক্ষক আরিস্ততল প্লেটো, কেউ ইতিহাস (হিন্দুযুগ), কেউ ক্যালকুলাস বা কেমিস্ট্রি বা ফিজিক্স, কেউ দর্শন, কেউ অর্থনীতির মার্শাল পিগু কীনসের তত্ত্বকথা বা ব্যাঙ্কিং কারেন্সি, কেউ অ্যালজাব্রা, কেউ সাহিত্যে ভারতচন্দ্র মঙ্গলকাব্য বা রবীন্দ্রনাথ, কেউ ভূগোল, কেউ শেক্সপিয়র, হয়তো কুড়ি—পঁচিশ বছর ধরে পড়াচ্ছেন, প্রায় একপুরুষ ধরে, কেউ লেকচারের বদলে নোট ডিকটেট করছেন (বংশপরম্পরায় রক্ষিত নোটখাতাটি তাঁর শিক্ষকতা ব্যবসায়ের মূলধন)—আর প্রতি বছরে নতুন নতুন টাটকা কিশোর যুবকরা এই সমস্ত বিদ্যার ব্যাখ্যান শুনছে। কী যে ঐশ্বরিক ধৈর্য তাদের তা সত্যিই কল্পনা করা যায় না! যদি তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তাহলে নিয়মানুগত্য ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে প্রবীণরা মুখর হয়ে ওঠেন, এমনকী তাদের নৈতিক চারিত্রিক অধঃপতনের কথা ঘোষণা করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু যদি অতিমধুর রবীন্দ্রসংগীতও চব্বিশঘণ্টা কুর্ণকুহরে ধ্বনিত হতে থাকে তাহলে তা কি শ্রুতিকটু ও কর্ণপীড়াদায়ক মনে হয় না? শিক্ষক অধ্যাপকদের বিদ্যাদানের লেকচারও তাই মনে হয়। কোঠারি কমিশন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ছাত্রদের কথা উল্লেখ করে :

…learning for them is mainly a matter of memorization… their main duty is considered to be to attend uninteresting lectures…

সারা দুনিয়ার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, সমাজে রাষ্ট্রে জ্ঞানবিদ্যায় বিজ্ঞানে, কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই কোথাও বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য—বিষয়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই স্যার গুরুদাস স্যার আশুতোষের যুগে অবস্থান করে আজও এদেশীয় বিদ্বানরা ভাইস—চ্যান্সেলারি ও অধ্যাপনা করছেন। অপ্রচলিত বিদ্যার বেসাতি করছেন শিক্ষকরা, বছরের—পর—বছর একসুরে একভঙ্গিতে একই কথা ঘ্যানঘ্যান করছেন। অবশ্য শিক্ষক—অধ্যাপকদের কোনো অপরাধ নেই, কারণ তাঁরা চাকরির জন্য তা করতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সিলেবাস বা সিস্টেম বদলাবার ক্ষমতাও তাঁদের নেই। কাজেই তাঁরা নিরুপায়।৩০

পাঠ্যবিষয়ের অধিকাংশই ‘অপাঠ্য’। এই কারণে অপাঠ্য যে যা দু—বছরে পড়ানো হয় তা দু—মাসে পড়ানো উচিত। আরিস্ততল প্লেটো নিয়ে দু—বছর ধরে বক্তৃতা দেওয়া, বুদ্ধ ও অশোকের বাণী শিলালেখ মুখস্থ করানো, মার্শাল কীনসের অর্থতত্ত্বের চার বছর ধরে ব্যাখ্যা করা, অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির কলাকৌশল বিশ্লেষণ করা, অধ্যাত্মবাদী দর্শনের সূক্ষ্মতা বছরের—পর—বছর বোঝানো, বিশুদ্ধ নন্দনতত্ত্ব ও সাহিত্যশিল্পতত্ত্ব গলাধঃকরণ করানো, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামে আমেরিকা ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের কনস্টিটিউশনাল ইতিহাস পড়ানো, ইন্টারন্যাশনাল ও কূটনৈতিক ইতিহাসের রহস্য উদঘাটন করা—এরকম আরও অনেক বিষয়ের কথা বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ধরে আলোচনা করলে আরও পরিষ্কার করে বলা যেত, কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন নেই এখানে। প্রসঙ্গত যা পাঠ্য নয় আমাদের দেশের বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এরকম একটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করছি। যেমন মার্কসবাদ (Marxism), অর্থাৎ মার্কসীয় দর্শন, মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব, মার্কসীয় ইতিহাসতত্ত্ব, মার্কসীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মার্কসীয় অর্থবিজ্ঞান, মার্কসীয় শিল্প—সাহিত্যতত্ত্ব। আমাদের বিদ্যালয়ে বিষয়টি banned, নিষিদ্ধ, মুখে উচ্চারণ করাও taboo, হারাম। অথচ জাঁ—পল সার্ত্রের ভাষায় বলা যায় :৩১

Marxism is the philosophy of our epoch… Our whole thinking can grow only on this soil; thinking must stay within this framework, or be lost in a vacuum or become retrograde.

মার্কসবাদবিরোধী অনেক ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরাও মার্কসবাদের এই যুগান্তকারী গুরুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। যেমন একজন প্রসিদ্ধ আমেরিকান ঐতিহাসিক ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’তেই লিখেছেন যে “the whole science of dynamic sociology rests upon the postulate of Marx”.৩২ একজন বিখ্যাত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ স্বীকার করেছেন যে মার্কসীয় ইতিহাসতত্ত্ব “one of the greatest individual achievements of sociology to this day.”৩৩ আর একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন যে গত একশো বছর ধরে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে তত্ত্ববিচার ও অনুশীলন হয়েছে তা প্রধানত মার্কসীয় প্রেতাত্মার সঙ্গে বাকযুদ্ধের মতো—“the debate with Marx’s ghost”.৩৪ এ বিষয়ে আরও অনেক কথা বলেছেন বিখ্যাত আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রাইট—মিলস তাঁর The Marxists বইতে।৩৫ তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবিষয়ে মার্কসবাদের প্রবেশাধিকার নেই। প্রবীণ ভারতীয় মহাবিদ্বানরা অনেকে মার্কসাবদকে ‘বিদেশি মতবাদ বা আদর্শ’ (foreign ideology) বলে মনে করেন। যেন বাকি সব মতবাদ ও আদর্শ যা পাঠ্যবিষয়ে ঠাসা রয়েছে তা সবই এদেশীয়। তা ছাড়া, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় সীমান্তের প্রশ্ন! তাই আমাদের শিক্ষার সিলেবাস বিদ্যাসাগর যুগ থেকেই প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে, মধ্যে মধ্যে কিছু সংস্কার করা হয়েছে, যেমন পোড়ো বাড়ি সংস্কার করা হয়নি তেমনি। আসলে গোড়ায় গলদ বলেই মার্কসবাদের মতো বিষয় আমাদের মতো দেশে পাঠ্য হতে পার না, অন্যান্য বিদেশি জ্ঞানবিদ্যা সহজেই পাঠ্য হতে পারে। তার কারণ দেশের কিশোর যুবকশ্রেণি যদি মার্কসবাদী দর্শনে সমাজতত্ত্বে ইতিহাসতত্ত্বে শিক্ষালাভ করে, তাহলে এই সমাজরাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তাদের মনোভাব কী হবে এবং কোন পথে তারা এর প্রতিকার সন্ধান করবে, তা দেশের রাষ্ট্রনায়করা ও তাঁদের দোভাষী শ্রেণি (বিদ্বানরা) বিলক্ষণ জানেন। কাজেই বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা আজ—

for all too familiar reasons, inevitably become purveyors of obsolete knowledge.৩৬

দোষ শিক্ষকদের নয়, শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষকরা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বেদিমূলে উৎসৃষ্ট। তাঁরা obsolete বিদ্যার বিক্রেতা হতে বাধ্য। কিন্তু বাধ্যতাই কি শেষ কথা? শুধু নৈতিক প্রশ্ন নয়, সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত। স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সংগঠন আছে, মধ্যে মধ্যে তাঁরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশ দাবিই হল বেতন—ভাতাবৃদ্ধির দাবি অথবা অন্য কোনো সুখসুবিধার। ট্রেড ইউনিয়নের গতি যেমন রাজনৈতিক চেতনাবর্জিত ‘ইকনমিজমে’র দিকে শিক্ষকদের আন্দোলনের গতিও তাই। জীবিকার সংগ্রাম শিক্ষকরা নিশ্চয় করবেন, বিশেষ করে আর্থিক অনটন যখন তাঁদের বাস্তবিকই আছে, কিন্তু তবু আশ্চর্য লাগে এই কথা ভেবে যে শিক্ষাসংক্রান্ত মুখ্য বা গৌণ কোনো সমস্যা নিয়েই তাঁরা কখনো আন্দোলন করেন না। যে—শিক্ষা বা বিদ্যা দান করে তাঁরা জীবিকা অর্জন করছেন, ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন, সেই শিক্ষার গুণাগুণ সম্বন্ধে তাঁদেরও অন্তত আংশিক দায়িত্ব আছে। শিক্ষকরা কি সংঘবদ্ধভাবে দাবি করতে পারেন না যে obsolete বিদ্যা তাঁরা পরিবেশন করবেন না, পাঠ্যবিষয়ের যুগোপযোগী পরিবর্তন না হলে তাঁরা শিক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন? খানিকটা পারেন, এবং এক্ষেত্রে ছাত্রদের চেয়ে শিক্ষকদের সম্মিলিত দাবি অনেক বেশি জোরালোও হতে পারে। কিন্তু এরকম আন্দোলনের পথে বাধা আছে অনেক। প্রথম বাধা নতুন জ্ঞানবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার অধিকার তাঁদের নেই। যতদিন না বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যবিষয়ের পরিবর্তন হয় ততদিন তাঁরা ‘obsolete’ বিদ্যা শিক্ষা দিতে বাধ্য। নতুন জ্ঞানবিদ্যার গতিধারা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ হয়েও, অধিকাংশ শিক্ষক, অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধেও, অচল বিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার যান্ত্রিক কর্তব্য পালন করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয় বাধা, তাঁদের মধ্যবিত্ত মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভয়ভাবনা, অর্থাৎ চাকরির ভাবনা, পদোন্নতির ভাবনা ইত্যাদি। এরকম সংগ্রাম যেহেতু Establishment-এর সোজাসুজি confrontation-এর মতো শিক্ষার মূলনীতিগত ও লক্ষ্যগত সংগ্রাম, তাই অনেক প্রকারের ভয় শিক্ষকদের মনে জমা হবার কথা। প্রধানত এই দু’রকম বাধার জন্য শিক্ষকরা গতানুগতিক বিদ্যা বেচে জীবনধারণ করাই নিরাপদ মনে করেন।

প্রশ্ন হল, এই সংকটের তাহলে শেষ কোথায়? সমাধানই বা কি? বর্তমানে আমেরিকান সমাজের একজন শিক্ষক লিখেছেন :৩৭

“Students can change things if they want to because they have the power to say No.

বিদ্যার্থীবিদ্রোহের মধ্যে আজ আমাদের দেশেও এই ‘No’ কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে। উচ্চারণের ভঙ্গির মধ্যে তফাৎ আছে, এবং মধ্যে মধ্যে সহিংস ভঙ্গিরও প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু ভঙ্গি নিয়ে বিতর্কের আগে প্রকৃত ব্যাধির বীজাণুটি সন্ধান করা অনেক বেশি প্রয়োজন। কারণ সহিংস ও অহিংস গণতান্ত্রিক ও অ—গণতান্ত্রিক ইত্যাদি নানারকমের বিক্ষোভভঙ্গি চিন্তার বিষয় হলেও, আমাদের মনে রাখা উচিত যে ইতিহাসে কোনো বিদ্রোহই কোনকালে নিয়মশৃঙ্খলা সংযম সাবধানতার উপদেশ মেনে চালিত হয়নি, যুববিদ্রোহ তো হতেই পারে না, কারণ যৌবনের ধর্ম প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করা। তাই দেখা যায়, আজকের পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধনতান্ত্রিক দেশে, আমেরিকায় ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, বিদ্যার্থীবিদ্রোহ ও যুব বিদ্রোহ তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ পন্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমে অগণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। এই সমস্ত দেশে বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজের ‘campus violence’ কি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এখানকার পত্রিকাদিতে সেইসব সংবাদ প্রকাশ করা হয় না বলেই আমাদের দেশের ( যেমন পশ্চিমবঙ্গের) বিদ্যালয় বিদ্বানবিরোধী বিদ্রোহের উচ্ছৃঙ্খল প্রকাশে আমরা অবাক হয়ে যাই। আমেরিকায় ছাত্রদের সহিংস প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ এমন চূড়ান্ত সীমায় আজ পৌঁচেছে যে প্রেসিডেন্ট নিকসন বিপুল জাতীয় ধনৈশ্বর্য টেকনোলজি ও সামরিক শক্তির শিখরে বসেও চোখে অন্ধকার দেখছেন। কেন চোখে অন্ধকার দেখেছেন তা তাঁরই নিয়োজিত, এ বিষয়ে তদন্তের জন্য, স্ত্রানটন কমিশনের রিপোর্টের (১৯৭০) এই উক্তি থেকে বোঝা যায় :৩৮

A nation driven to use the weapons of war upon its youth is a nation on the edge of chaos. A nation that has lost the allegiance of part of its youth is a nation that has lost part of its future. A nation whose young have become intolerant of diversity, intolerant of the rest of its citizenry and intolerant of all traditional values ….has no gereration worthy or capable of assuming leadership in the years to come.(বাঁকা হরফ লেখকের)।

উদ্ধৃত তিনটি বাক্যের মধ্যে প্রথম দুটি বাক্যের (বাঁকা হরফ) তাৎপর্য বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের শাসকরা গভীরভাবে চিন্তা করবেন। তৃতীয় বাক্যটি একটি অর্থহীন উক্তিবিশেষ, কারণ যে আমেরিকান সমাজের দায়িত্ব নিকসন স্ত্র্যানটনের মতো একদা—যুবকরা আজ এইভাবে পালন করছেন, সেই সমাজের ‘ভবিষ্যৎ’ দায়িত্ব আজকের ‘intolerant’ যুবকরা শতগুণ বেশি সুন্দরভাবে নিঃসন্দেহে পালন করতে পারবে।

বিদ্যাসংকট বিদ্বানসংকট এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিদ্যার্থীবিদ্রোহ কোনো অসংলগ্ন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষানীতি বা যুববিক্ষোভের প্রকাশ নয়, বর্তমান সমাজের সুগভীর সামগ্রিক সংকটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি সংযুক্ত। সমাজের বহুবিধ ইনস্টিটিউশনের মধ্যে বিদ্যালয় অন্যতম। সমস্ত ইনস্টিটিউশনের যখন ভগ্নদশা, তখন বিদ্যালয়ে চুনবালির প্রলেপ লাগিয়ে, বিদ্বানদের খেতাব দিয়ে এবং উপনিষদযুগের বিদ্যা বিদ্যার্থী ও গুরুর মহান আদর্শ প্রচার করে, অথবা বিদ্যার্থীবিদ্রোহ দমন করে সংকটের সমাধান হবে না। এই সমাজে বুদ্ধিজীবীর স্বাতন্ত্র্য, বিদ্যার বিশুদ্ধতা, বিদ্যালয়ের দেবমন্দিরতুল্য পবিত্রতা প্রভৃতির কথা বলাও অর্থহীন প্রলাপ ও প্রগলভতা ছাড়া কিছু নয়। সমাজের গড়ন আগাগোড়া বদলাতে হবে, কারণ বিদ্বানদের

A society that drives its members to desperate solutions is a non-viable society, a society to be replaced.৩৯

সেমিনার সম্মেলন, বিদ্বৎসভার ঘনঘন বৈঠকেও কিছু হবে না, কারণ এই সমস্ত সেমিনার সম্মেলন বৈঠক হল হোটেল ম্যানেজার ও প্ল্যাম্বিং কনট্র্যাক্টরদের সম্মেলনের মতো, যেখানে বিদ্বানরা পরস্পর স্বার্থান্বেষণে মিলিত হন ও সংযোগ স্থাপন করেন :৪০

…the conferences of learned societies are, in structure and intention, indentical with trade conventions, like those, let us say, of the Association of Plumbing Contractors or the, Association of Hotel Managers. At those conferences…. Old friends get together, and valuable commercial contacts are made.

সমাধান সম্ভব শতমুখী শোষণপীড়নের সোপানবিন্যস্ত সমাজের আমূল পুনর্বিন্যাসে, এবং বহুযুগের শ্রেণিদাসত্ব থেকে বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীর পরিপূর্ণ মুক্তিতে। বিদ্যা বিদ্বান বিদ্যালয় ও বিদ্যার্থীদের মুক্তি তখনই সম্ভব, তার আগে নয়।

রচনাকাল : ১৩৭৮ সন

১. Martin, Alfred von : Sociology of the Renaissance, London, reprint, 1945, p.37.

২. Snow, Edger : Red China Today, New Orleans: Pelican 1970, p.254.

৩. Blaug, Mark edited : Economics of Education I, Penguin Modern Economics, 1968, p.137

৪. Institute of Applied Manpower Research (সংক্ষেপে IAMR), New Delhi, এই সংস্থার  Working Papers এবং মুখপত্র Manpower Journal থেকে শিক্ষাসংক্রান্ত (প্রধানত ভারতবর্ষের) এই ধরনের গবেষণার ফলাফল জানা যায়। এই প্রবন্ধের বিষয়ালোচনা প্রসঙ্গে আমরা এই সংস্থার অনেক গবেষণাপত্রের ফলাফল ব্যবহার করেছি।

। Economics of Education, Harmondsworth: Penguine, 1968. 1 : ‘The Concept of Human Capital pp.13-64. Economics of Education  2. ‘The International Comparisons Approach to Deucation Planning : Developing Countries’, pp. 11-97. Mark Blaug এই গ্রন্থমালা সম্পাদনা করেছেন। সম্প্রতি Blaug (Layard ও Woodhall-এর সহযোগিতায় ) The Causes of Graduate Unemployment in India (London 1969) নামে বই লিখেছেন।

। Coombs, Philip H. : The World Educational Crisis – A system Analysis; N. Y., Oxford 1968, p.4.

৭. Hayter Teresa : Aid as Imperialism, New orleans: Pelican 1971, Foreword, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব বিস্তারের বর্তমান কৌশল বৈদেশিক সাহায্যের ভূমিকা সম্বন্ধে একাধিক বই আছে, কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রীমতী হেটারের তথ্যবহুল বইখানি এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রচনা।

। Dandekar, V. M. et. at, ‘Proverty in India’ in Economic and Political Weekly vol. VI, Nos, 1, 2, January 2, 9, 1971.‘A configuration of Indian Poverty, Inequality and Levels of Living’ by P.D. Ojha in Reserve Bank of India Bulletin, January 1970.

৯. Young G. M. : Speeches by Lord Macaulay with His Minute on Indian Education, London: Oxford, 1935, p.369.

১০. Myrdal, Gunnar: Asian Drama, vol, III, Pelican edition, p. 1941.

১১. ভারত সরকারের পরিকল্পনা—দপ্তরের মুখপত্র Yojana, September 6, 1970, বিশেষ শিক্ষাসংখ্যা থেকে গৃহীত তথ্য।

১২. ‘Some 349 million Indians are illiterate, even though literacy has incraesed from 17% in 1951 to 33% in 1968-69, according to the Union Education Ministry, reports PTI’,–The Statesman, April 21, 1969. সেইজন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের আহ্বান করে বলেন, ‘আপনারা এই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ করুন।’ শোনা যাচ্ছে, ১৯৫৭ সালের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগরের সার্ধজন্মশতবর্ষ থেকে নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযানের পবিত্র সংকল্প গ্রহণ করেছেন ও তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম থেকেই তার আনুষ্ঠানিক পদযাত্রা আরম্ভ হয়েছে।

১৩। Yojana, October 19, 1969; ‘Report on the National Conferance on Functional Literacy’ (Calcutta, Sept, 1969) ‘Functional literacy’ আর ‘literacy’ এক নয়। শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, তার সঙ্গে হিসাবনিকাশের কাজ চালানোর মতো অন্তত অঙ্কজ্ঞান থাকা দরকার। সেইজন্য ‘functional literacy’-কে কেউ কেউ ‘arithmetical literacy’ বলেন।

১৪। Curle, Adam : Educational Strategy for Developing Societies, London: Tavistock 1963, p.86.

১৫. Myrdal, Gunnar : Asian Drama, vol. III, Harmondsworth: Penguine, 1968 1968, p.1669. এই নীতি সম্বন্ধে মন্তব্য করে মিরডাল বলেছেন, ‘We think that this approach is wrong’.

১৬. Coombs, Philips H. The World Educational Crisis, A System Analysis :London: Oxford 1968, pp. 18-19.

১৭. Coombs বলেছেন, ‘a highly selective system, entailing, open competitive examinations, only seems to be democratic. In practice it is not, because of the inherent social bias of the academic system…’ (বাঁকা হরফ লেখকের) of, cit., 32.

১৮. Anniversary Address of Dr. Atma Ram. Director General of the Council of Scientific and Industrial Research, at the Indian National Science Academy January 2, 1971, Bangalore.

১৯. Blaug, Mark, Layard Richard, Woodhall Maureen: The Causes of Graduate Unemployment in India, London: Allen Lane 1969,

২০. Blaug, Mark et all : op. cit, p.4.

২১. Blaug, Mark et al : op. cit, pp. 241-44.

২২. Coombs, P. H: op, cit, pp.64-65.

২৩. Coombs, P. H: op. cit., p.65.

২৪. Peak, R.F. and Havighurst, R.J. : The Psychology of Character Development, N. Y. 1960.

২৫. Sapra, C.L. : Educational Wastage and Stagnation in India, National Council of Educational Research and Training, New Delhi 1967.Gore, Desai and Chituis edites : Papers on The Sociology of Education in India; N.C.E.R.T. New Delhi 1967.

২৬. Myrdal : op cit, vol III, ch.83 secs, and 3. p.1669.

২৭. King, A. D.: ‘Elite Education and the Economy– I.I.T. Entrance 1965-70’– Economic and Political Weekly, August 29, 1970. p.p. 1463-72.

২৮. Coombs, P. H: op cit, pp.32-34.

২৯. Coombs, P. H: op. cit., pp. 35-36.

৩০. “In theory, the class rooms of the world should have ready access to the great and growing stockpile of human knowledge. In fact, however, a barrier stands between them and knowledge”–Coombs, ap. cit., p.109.

৩১. Quoted in Ernst Fisher’s Art Against Ideology, Pehguin, Allen Lane 1969, p.50

৩২. Encyclopadia Britannica, 13th ed., XIII, p. 532.

৩৩. Schumpeter Joseph : Capitalism  Socialism and Democracy, N.Y.: Harper & Brothers,1962, p.10.

৩৪. Zeitlin, Irving M. : Idelogy and the Development of sociological theory, E.Cliffs: Prentice Hall, 1968.

৩৫. Mills, C. Wright: The Marxists, N.Y.:Dell Pub 1962.

৩৬. Coombs, P H : op. cit., p. 109.

৩৭. Farber, Jerry: The Student As Nigger, N.Y.: Pocket Books 1970, p.17.

৩৮. Seranton Report (1970) মূল সংস্করণ দেখার সুযোগ হয়নি। Newsweek (October 5, 1970) পত্রিকায় প্রকাশিত এই রিপোর্টের অংশ থেকে গৃহীত।

৩৯. Fanon’s Frantz Resignation letter to the Resident Minister of France in Algeria, 1956. [In, Toward the African Revolution, N.Y:Grove Press, 1988 p. 52-54]

৪০. Roszak Theodore edited : The Dissenting Academy, N. Y. Vintage: 1968, p.16. আমেরিকান সমাজে ধনপতি, শিল্পপতি, প্রশাসনিক ও সামরিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান ও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ যে কত ঘনিষ্ঠ, সে সম্বন্ধে তথ্যবহুল অনেক বই ও রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে এই বইখানি বিশেষ উল্লেখযোগ্য—James Ridgeway : The Closed Corporation : American Universities in Crisis, N. Y. 1968

* বিনয় ঘোষ, ‘সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজ চিত্র—৪’; রূপচাঁদ পক্ষী : সঙ্গীত রসকল্লোল।

* ১৯৭০ সালে ভারতের মোট বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল manpower ছিল ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারদের নিয়ে—মোট ১১ লক্ষ ৯০ হাজার। তার মধ্যে সায়েন্স গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৮০ হাজার এবং সায়েন্স পোস্ট—গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ১ লক্ষ ৫০ হাজার। ১৯৫০ সালে পোস্ট—গ্র্যাজুয়েট বিজ্ঞানীর সংখ্যা ছিল ১৭,০০০, গত কুড়ি বছরে (১৯৫০—৭০) এই সংখ্যা ন—গুণ বেড়েছে। এই বিপুলসংখ্যক ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানীর মধ্যে শতকরা ৩ জনের মতো বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রীর সঙ্গে রিসার্চের কাজে নিযুক্ত। বাকি সকলে বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানদান করছেন, অথবা এমন সমস্ত বিষয়ে গবেষণা করছেন যার সঙ্গে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নতির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের ‘সোস্যালিস্ট প্যাটার্নে’র অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ফলে দেশে যে কি পরিমাণ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর অপচয় হচ্ছে তা এই শোচনীয় অবস্থা থেকে বোঝা যায় (P. N. Chowdhury and R. K. Nandy : Towards Better Utilisation of Scientific Manpower’ in Economic and Political Weekly, June 19, 1971.)

গ্রন্থপঞ্জি

পাদটীকায় উল্লেখিত গ্রন্থগুলি ছাড়া আরও কয়েকটি গ্রন্থ, ১৯৬১—৭১—এর মধ্যে প্রকাশিত :

Eric, Ashby: Technology and the Academic N.Y. St. Martin Press, 1958.

Barzun, Jacques: The American University N.Y.: Harper & Row, 1968

Erikson, Erik H. (ed.), Connecticut: Pranges, Youth: Change and Challenge, N. Y.: Basic 1963

Toffler, Alvin (ed.) : The Schoolhouse in the City, 1968

Brosan, George and others : Pattern and Policies in Higher Education Harmondsworth: Penguine,1971

Halsey, A. H., and Trow M. : The British Academics, London: Faber, 1970

Layard, King and Moser : The Impact of Robbins, Harmondsworth: Penguin 1969

Philips, C.M.: Changes in Subject Choice in School and University London 1969

Burgess and Pratt : Policy and Practice : The Colleges and Advanced Technology Harmondsworth: Penguin, 1970

Becker, G. S.: Human Capital Princeton The University, 1964

Baldridge, J. Victor: Power and Conflict in the University N. Y.: John Wiley, 1971

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *