২. বাঙালি বিদ্বৎসমাজের সমস্যা

বাঙালি বিদ্বৎসমাজের সমস্যা

অবশেষে সত্যিই যেদিন রাখালের পালে বাঘ পড়েছিল, সেদিন তার চিৎকারে কেউ কর্ণপাত করেনি। বাঙালি বিদ্বৎসমাজের সমস্যার কথা অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই তার গুঞ্জন আরম্ভ হয়েছিল। শেষপাদ থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকাল পর্যন্ত গুঞ্জনের গাম্ভীর্য বেড়েছে। অতঃপর রীতিমতো তা কোলাহলে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে কোলাহল রূপ নিয়েছে সোরগোলে। কিন্তু সেদিনের গুঞ্জনের সুরে যারা সাড়া দিয়েছিল, আজকের কোলাহলে ও সোরগোলে তারা কালা হয়ে বসে আছে। অর্থাৎ রাখালের পালে বাঘ যখন সত্যিই পড়েছে তখন কালা হয়ে বসে আছে। অর্থাৎ রাখালের পালে বাঘ যখন সত্যিই পড়েছে তখন কারও দেখা নেই, প্রতিবেশীরাও উদাসীন। সমস্যা অস্বীকার করার আগ্রহ যাঁদের মধ্যে প্রবল, তাঁদের মানসিক অবস্থা কতকটা অসহায় রোগীর ব্যাধি অস্বীকার করার মতো। সংকটের সেটাও একটা উপসর্গ। সমাহিতি সবসময় স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। নিজেরাই যখন সজাগ নই, তখন প্রতিবেশীদের কথা স্বতন্ত্র। তা ছাড়া, প্রতিবেশীদের নাবালকত্বের কাল যে উত্তীর্ণ হয়েছে সে—বিষয়েও আমরা অচেতন। আজ তারা সাবালক হয়েছে। সম্মুখ—প্রতিদ্বন্দ্বিতার জীবন—রণাঙ্গনে রাখালের চিৎকারে আজ কর্ণপাত করার অবকাশ নেই কারও। বাঙালির অভিমান বেশি। অল্প আঘাতে অভিভূত হয়ে পড়াও কতকটা তার জাতীয় স্বভাব। বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের কণ্টকিত পথে চলার চেয়ে হৃদয়বৃত্তি ও ভাবালুতার পুষ্পিত পথেই চলতে সে অভ্যস্ত। তাই সংকটের দিনেও কাব্য—কথাসাহিত্যের মনোহর বাগিচা রচনাতেই তার আত্মতৃপ্তি। কিন্তু গৃহকোণের নিভৃত বাগিচায় বৃহত্তর সমাজের ল্যান্ডস্কেপের সামান্য অভ্যাস ছাড়া আর কিছু নেই। সমাজের জীবনপ্রবাহচিত্র তাতে বিশেষ প্রতিবিম্বিত হয় না। যেটুকু হয় তারও সবটুকু বাস্তব কিনা বিচার্য।

যত দিন কাটছে দেখা যাচ্ছে, হাত ঘুরিয়ে নাড়ু দেখিয়ে আর বুদ্ধিমানের মন ভুলিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো দেশেই হচ্ছে না। বাঙালির ক্ষেত্রে যেটুকু হচ্ছে তা তার বিশ্লেষণবিমুখ ভাবালু মনের বিশিষ্ট গড়নের জন্য। তাই সমস্যার বা সংকটের অনুধ্যানের চেয়ে, বাঙালি বিদ্বৎসমাজের মনে অভিমান ও অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে বেশি। কিন্তু ব্যক্তি ও বহির্জীবনকে সংযুক্ত করার কাজে মনের পেশা কেবল ঘটকগিরি করা নয়। মনটাকে যাঁরা অনুঘটক বা ‘ক্যাটালিটিক এজেন্ট’ মনে করেন তারা অন্যের তো দূরের কথা, নিজেদের মনের কথাই জানেন না। মানুষের মন আর যাই হোক, ঘটন নয়। মনেরও গড়ন বদলায়, জীবনতরঙ্গের ঘাত—প্রতিঘাতে। নৈয়ায়িক বাঙালি একদিন ভাবালুতার পিচ্ছিল পথে যেমন আছাড় খেয়ে পড়েছিল, তেমনি আবার জীবনের নতুন স্রোতের টানে ন্যায় ও আবেগের সমন্বয় ঘটিয়ে সোজা হয়েও সে দাঁড়াতে পেরেছিল। ভবিষ্যতের সেই ‘একদিনের’ কথা আপাতত আলোচ্য নয়। বর্তমানের সমস্যাই বিচার্য।

বিদ্বৎসমাজের সমস্যা অনেক, সংকটের কারণও একাধিক। প্রথম সমস্যা বহু পুরাতন অন্নসমস্যা বা জীবিকার সমস্যা। বুদ্ধিতে যখন পেট ভরে না এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় যখন দেখা যায় যে পেট না ভরলে বুদ্ধিও পুষ্টিলাভ করে না, তখন বাধ্য হয়ে বুদ্ধিজীবীকেও অন্যান্য সূক্ষ্মচিন্তার সঙ্গে অন্নের স্থূলচিন্তা করতে হয়। সে—চিন্তা সাধারণত বুদ্ধি বা প্রতিভার অনুশীলনে সাহায্য করে না। কথাটা সত্য হিসেবে খুব স্থূল হলেও অনেকসময় এই স্থূল সত্যটাকেও বুদ্ধির সূক্ষ্ম জাল বিস্তার করে এমনভাবে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করা হয় যে বুদ্ধিজীবীও যে অন্নজীবী মানুষ তা বিশিষ্ট বুদ্ধিমানদেরও খেয়াল থাকে না। দ্বিতীয় সমস্যা হল, সামাজিক বিরোধের সমস্যা। দুর্ধর্ষগতি যন্ত্রবিজ্ঞানের যুগে সমাজে সর্বাঙ্গীন গড়ন যত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, মানুষের মনের গড়ন তত দ্রুত বদলাচ্ছে না, বদলাতে পারেও না। সমাজের গতি যতটা যান্ত্রিক হতে পারে, মানুষের মনের গতি কখনোই তা হতে পারে না। বুদ্ধিজীবীদের মন সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ বলে, বিশ্বাস—অবিশ্বাস ধ্যানধারণার নোঙর খুলতে তাঁদের আরও বেশি দ্বিধা হয়। সামাজিক শ্রেণি বলে তাঁরা গণ্য হন বা না—ই হন, তাঁদের আত্মচেতনার প্রাখর্য শ্রেণিচেতনার তুলনায় বেশি ছাড়া কম উগ্র নয়। এই কারণেই বুদ্ধিজীবীর মনের স্থিতি বেশি, অর্থাৎ চিন্তাধারার নির্দিষ্ট খাতের প্রতি আসক্তি বেশি। সমাজসাধনের সঙ্গে ব্যক্তি মানসের বিরোধও এইজন্য অন্যান্য জনস্তরের তুলনায় বুদ্ধিজীবীর স্তরে তীব্রতর। সমাজের পরিবর্তন—শীলতার গতিবৃদ্ধির ফলে এই বিরোধ ক্রমেই আরও তীব্রতর হতে থাকে। রাজনীতি ও অর্থনীতিক্ষেত্রের গণরূপায়ণ বা ডেমক্র্যাটাইজেশন সংস্কৃতিক্ষেত্রে যত প্রতিভাত হচ্ছে তত আধুনিক বুদ্ধিজীবীর দীর্ঘকালের চিন্তাসংস্কারাচ্ছন্ন আড়ষ্ট মনের দ্বন্দ্ব—সংশয় বাড়ছে। তার ফলে তৃতীয় সমস্যা মননসংকট (crisis of intellect) দেখা দিচ্ছে।

অন্নচিন্তায় অথবা অর্থচিন্তায় অনন্যমনা যিনি তাঁকে হয়ত বুদ্ধিজীবীর মর্যাদা দিতে অনেকেই কুণ্ঠিত হবেন। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে একালের বুদ্ধিজীবীরা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এই সংস্কার নিয়ে। বিদ্যাবুদ্ধির চর্চার সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই, টাকাকড়ির স্পর্শ থেকে তাকে মুক্ত রাখাই বাঞ্ছনীয়। বুদ্ধিজীবীরা এমন এক উচ্চমার্গের ধ্যানমগ্ন সাধক, যেখানে সামাজিক জীবনস্রোতের কোনোরকম কদর্যতার প্রভাব পৌঁছতে পারে না। বহুদিন তাই আইনজীবী ও চিকিৎসা—বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিজীবীর পবিত্র পঙক্তিতে ঠাঁই পাননি। কবি—সাহিত্যিকরাও অনেকদিন পর্যন্ত নিজেদের রচনার অর্থমূল্য গ্রহণ করতে সংকোচবোধ করতেন এবং সেইজন্য গোড়ার দিকে তাঁরা মুদ্রণেরও বিরোধী ছিলেন। সংস্কার যে অনেকটা সহজাত তা আধুনিক বুদ্ধিজীবীর এই মনোভাব থেকেই বোঝা যায়। রাজসভার নিরুপদ্রব পরিবেশে যাদের অতীত জীবন কেটেছে, হঠাৎ জনসমাজের দিকে অগ্রসর হতে তাঁরা স্বভাবতই বাধাবোধ করেছেন। তা ছাড়া মান মর্যাদা হারাবার ভয় তখনও প্রবল হয়নি। মধ্যযুগের সমাজে মানমর্যাদার মানদণ্ড স্থির ছিল এবং প্রধানত তা ছিল কুলবংশানুক্রমিক। অর্থের প্রভাবে তার পরিবর্তন হত না, পুরোহিত যাজকদের মতো বুদ্ধিজীবীরাও মানমর্যাদার দিকে স্পর্শাতীত ছিলেন। যে—সমাজে মর্যাদার কোনো ‘মোবিলিটি’ ছিল না, সে—সমাজের বুদ্ধিজীবীরা যে বুদ্ধি শুচিতার বড়াই করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অর্থের ছোঁয়াচ থেকে বিদ্যাচর্চাকে মুক্ত রাখার সংকল্পও তখন অবাস্তব ছিল না। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই নতুন ধনতান্ত্রিক সমাজের চলার গতিতে বুদ্ধিজীবীর এই দম্ভের স্তম্ভ চূর্ণ হয়ে গেল।

নতুন সমাজে মানমর্যাদা কীর্তি—কৃতিত্বের প্রায় একক মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল অর্থ (Money)। অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের সাধনা ও সাফল্যকে অতিক্রম করে আর্থিক সাফল্যের প্রতিপত্তি স্বীকৃত হল সমাজে। তা যখন হল তখন অর্থ—মোহমুক্ত সাধনার উচ্চমার্গ থেকে বিদ্যাবুদ্ধিকে মর্ত্যের জীবনদ্বন্দ্বের মধ্যে টেনে নামানো ছাড়া বুদ্ধিজীবীদের গত্যন্তর রইল না। অতীত আদর্শের কুশপুত্তলি দাহ করে তাঁরা যুগোপযোগী আদর্শের নতুন প্রতিমা গড়ে তুললেন। এই প্রতিমার বাঁশখড়ের কাঠামোটি হল অর্থ তার উপর রংচঙের সযত্ন প্রলেপটি হল বুদ্ধিজীবীদের নতুন কৃত্রিম আভিজাত্যের চেকনাই। এর প্রথম প্রকাশ হল রিনেস্যান্সের যুগের হিউম্যানিস্ট বিদ্যাকে বাজারের পণ্য করবার চেষ্টা। অর্জিত বিদ্যাও যে—কোনো উৎপন্ন পণ্যের মতো আর্থিক বিনিময়মূল্য দাবি করতে পারে, হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীরা দৃঢ়কণ্ঠে একথা ঘোষণা করলেন। তার জন্য বিদ্বানকে প্রথমে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হল বটে, কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধির কেনাবেচায় সেই দেবত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াল না। ইনিয়াস সিলভিয়াস বললেন, দেবতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের যা পার্থক্য বিদ্বানের সঙ্গে মূর্খের পার্থক্য তাই। একথা বলেও, হিউম্যানিস্টরা তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধির মূলধন খাটিয়ে (ক্যাপিটালিস্টদের আর্থিক মূলধনের মতো) মুনাফালাভের জন্য তৎপর হলেন। ‘মুনাফা’ কথাটাই এখানে প্রযোজ্য, কারণ খোলাবাজারে সর্বাধিক চড়ামূল্যে বিদ্যার বিনিময় করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হননি। বাজার হল নগর বা টাউন, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষায়তন, সরকারি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মার্টিন বলেছেন, অনেকক্ষেত্রে হিউম্যানিস্টদের এই প্রচেষ্টাকে ‘ব্ল্যাক—মেইল’ ছাড়া কিছু বলা যায় না এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি পিয়েত্রো আরেতিনোর নাম উল্লেখ করেছেন। আরেতিনোকে তিনি বলেছেন, রিনেস্যান্সের যুগের ‘সাহিত্যিক দুর্বৃত্ত ও দস্যু’, কারণ তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজের রচনা বিক্রি করে এবং অন্যকে অগ্নিমূল্যে তা কিনতে বাধ্য করা, প্রচুর অর্থ উপার্জন করা। মার্টিনের উক্তি আরেতিনো সম্পর্কে স্মরণীয় :

He already represented the type of ‘literary highwayman’ (V. Bezold); his one wish was to make money by selling or forcing others to buy his pen. Yet this cynic, this professional literary blackmailer, represented the last ‘refinement’ of the type which was using its intellect for financil ends, the ‘philosopher of money’, tearing down the last barriers of traditional morality, of literary decency and the corporate fecling of the literasi.

অর্থলোভী সমাজের কোলাহল থেকে বিদ্যাবুদ্ধিকে কুলবধূর মতো অবগুণ্ঠিত রাখার জন্য বুদ্ধিজীবীদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা এইভাবে অবস্থাচক্রে ব্যর্থ হয়। বুদ্ধি ও বিদ্যা এত বেশি পণ্যময় হয়ে ওঠে যে সিমেলের মতো বুদ্ধিমানরা টাকার সঙ্গে ‘ইন্টিলেক্টের’ স্টাইলিষ্টিক সম্পর্কের কথা পরিষ্কার করে ব্যক্ত করেন সিমেল বলেন, আধুনিক যুগের বিদ্যাবুদ্ধি হল টাকার মতো নীতিবহির্ভূত বা ‘অ্যামরাল’ এবং নিরপেক্ষ বা ‘নিউট্রাল’। টাকার যেমন নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই, কোনো নীতি বা আদর্শ নেই, আধুনিক মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিরও তেমনি কোনো চরিত্র বা নীতি নেই। ঠিক ম্যানুফ্যাকচার্ড কমোডিটির মতো বাজারে তা কেনাবেচার জন্য লভ্য বা ডিমান্ড—সাপ্লাইয়ের হ্রাসবৃদ্ধি অনুপাতে তার বিনিময়মূল্য নিধার্য।

বিদ্যাবুদ্ধি ও টাকার প্রকৃতিগত ঐক্য অনস্বীকার্য হলেও দুই মূলধনের মধ্যে বিরোধও ছিল গোড়া থেকে। বিদ্বান—বুদ্ধিমানের সঙ্গে বিত্তবানদের বিরোধ। এই বিরোধ পরবর্তীকালে ক্রমেই কিভাবে তীব্র হয়ে ওঠে এবং সেই তীব্রতার কি মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তা পরে যথাস্থানে আলোচনা করব। আপাতত আলোচ্য হল, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পূর্বোক্ত যুগলক্ষণ প্রকাশের বৈশিষ্ট্য কী এবং রিনেস্যান্সের পরিণতির সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য আছে কি না।

প্রকৃতিগত কোনো পার্থক্য নেই। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আধুনিক বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাবকাল থেকেই ছিল না। বাংলার ও ইয়োরোপের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থাগত যে পার্থক্য ছিল তার জন্য এদেশের বুদ্ধিজীবীর অগ্রগতির পথ খানিকটা ভিন্ন হয়েছিল বটে, কিন্তু চারিত্রিক ভিন্নতা তেমন কিছু ঘটেনি। বরং এদেশের শাসক হয়ে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের সংস্পর্শে আরও দ্রুত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের যুগোপযোগী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছিল। বাংলার হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের আদর্শস্থানীয় রামমোহন ও বিদ্যাসাগরও এই যুগপ্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন না। বিদ্যা ও বাণিজ্যের মধ্যে যে প্রকৃতিগত ঐক্য আছে, তা তাঁরা গোড়া থেকেই বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। সেকালের বিদ্বৎজনের মতো বিদ্যাবুদ্ধির অপার্থিব শুচিতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো সংস্কার ছিল না। কেবল হিন্দুকলেজে নয়, সংস্কৃত কলেজেও যাঁরা শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁরা বিদ্যার পণ্যময়তায় বীতশ্রদ্ধ হননি। ইংরেজ শাসকরা শুরু থেকেই চাকরি ও টাকার সঙ্গে বিদ্যবুদ্ধিকে এমনভাবে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিলেন যে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা করে তা আবিষ্কার করতে হয়নি। ইংরেজ শাসকদের কৃপায় এ যুগের বিদ্যা ও বিত্তের দাম্পত্য—সম্পর্ক কতকটা যুগসত্যের মতো তাঁদের উন্মীলিত বুদ্ধির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। তাই কথায় কথায় জনপ্রবাদের মতো শোনা গেছে—’লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’। সেকালের রাজসভার প্রসাদপুষ্ট পণ্ডিতেরা এমন লোভনীয় কথা তাঁদের টোল—চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের বলতে পারতেন না। কিন্তু আধুনিকযুগে লেখাপড়ার সঙ্গে গাড়ি—ঘোড়াকে এমনভাবে যুতে দেওয়া হল যে অধিকাংশ বিদ্বানের অদৃষ্টে তা ছ্যাকরা গাড়ি অথবা ঠ্যালাগাড়ি হলেও তার অবিশ্রান্ত ঘড়ঘড়ানি থামেনি।

আধুনিক যুগের প্রায় প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে বিদ্যাবুদ্ধির আবশ্যকতা যে আছে এবং অনেক বেড়েছে তা কেউ অস্বীকার করবেন না। বিদ্যার বহুরকমের স্তরভেদ ও শ্রেণিভেদ আছে। ব্যাবহারিক বিদ্যার সঙ্গে অর্থের সম্পর্কও প্রত্যক্ষ হতে বাধ্য। তা ছাড়া, বিদ্যাবুদ্ধিজীবী অন্নজীবী হলে বিদ্যার উচ্চস্তরেও তা বায়ুর্ভুখ হতে পারে না এবং অর্থচিন্তা থেকে তার নিষ্কৃতিও সম্ভব নয়। রাজা—জমিদাররা যখন আর ভূমিদান বা প্রসাদ বিতরণ করেন না, তখন উচ্চমার্গের ইন্টেলেক্টের সাধকরাও যদি বর্তমান রাষ্ট্রীক বা সামাজিক পোষকতাপ্রার্থী হন, তাতেও দোষ নেই। বিদ্যার একনিষ্ঠ চর্চাকে অব্যাহত রেখে এবং বুদ্ধিজীবীর স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করেও এসব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতে কোনো বাধা হত না। কিন্তু তা হয়নি, বাধা হয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজেও হয়েছে আমাদের সমাজেও হয়েছে। সমাজের সঙ্গে সমাজের, দেশের সঙ্গে দেশের, মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যে—যুগে অতিদ্রুত ঘুচে গিয়েছে, সে যুগে বিচ্ছিন্নতার অন্তরালে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এযুগে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জাত বাঁচিয়ে চলাও কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব। তাই দেখা যায়, ইউরোপে যেমন আধুনিক যুগে বিদ্যাবুদ্ধির বাণিজ্যিক রূপায়ণ ঘটেছে, আমাদের দেশেও তা ঘটতে বিলম্ব হয়নি। বিদেশের তত্ত্ববধানে বিদ্বান হবার জন্য এবং বিদেশি শাসকের প্রসাদপুষ্টির জন্য, বাঙালির বিদ্যাবুদ্ধির এই পরিণতি আরও অনেক বেশি দ্রুত ঘটেছে। তার কারণ, বিদেশির স্বার্থের চাপে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের স্বাতন্ত্র্য একেবারে বিসর্জন না দিলেও, তার অনেকটা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাতন্ত্র্যের যেটুকু ধারা প্রথম যুগে ছিল, তা ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে পরবর্তীকালের অবস্থাগতিকে। বর্তমানের ভিন্ন পরিবেশেও সেই ধারার কোনো চিহ্ন তাই খুঁজে পাওয়া যায় না।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীর দেড়শত বছরের এই ইতিহাস নিয়ে একটা ট্র্যাজিডি রচনা করা যেতে পারে। প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত শতবর্ষের ইতিহাস (১৮১৭ সালে হিন্দুকলেজের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত) প্রায় একই খাতে প্রবাহিত হয়েছে। সেই খাত বা খাল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী ইঞ্জিনিয়াররাই কেটেছিলেন।। সেইখাত বা খাল দিয়ে শিক্ষার দাঁড় বেয়ে চলবার সময় আমরা বিদ্যার তরণীতে যে পাল তুলে দিয়েছিলাম তাতে স্পষ্টাক্ষরে লেখা ছিল—’লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ (অবশ্যই ইংরেজ প্রভুর সেবা করে)। কিন্তু খাল কোনো নদীতে এবং নদী কোনো সমুদ্রে গিয়ে মিশল না। খাল বদ্ধ নালা হয়ে শেষপর্যন্ত মজে গেল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে সামাজিক সংকট যখন গভীর হতে থাল তখন বুদ্ধিজীবীর মুখেই নতুন শিক্ষানীতির প্রবচন প্রহসনে পরিণত হয়ে হল—’লেখাপড়া করে যে, গাড়িচাপা পড়ে সে’। দেখা গেল, গাড়ি যারা সত্যিই চড়ে বেড়াচ্ছে তাদের অনেকেই লেখাপড়া করেনি এবং সমাজের রাজপথে, এমনকী অলিগলিতে পর্যন্ত যারা তার তলায় দলিত হচ্ছে তাদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা অল্প নয়। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যে সকলের অগোচরে নিঃশব্দে যে সামাজিক ও নৈতিক বিপ্লব ঘটে গেল, আজ পর্যন্ত বিশ্বের বুদ্ধিজীবীরা তার দিকে নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। তার ফলে যে মানসিক বিভ্রান্তি, জটিলতা ও সংকট দেখা দিয়েছে, অন্নবস্ত্র ও গাড়ি—ঘোড়ার সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, তা থেকে সর্বদেশের বুদ্ধিজীবীদের মতো বাংলার বুদ্ধিজীবীরাও মুক্তি পাননি।

খালকাটার কাল থেকে আরম্ভ করি। উনিশ শতকের তৃতীয় দশকে অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে শিক্ষানীতি নিয়ে যে বাকযুদ্ধ চলছিল, লর্ড মেকলে তার মীমাংসা করে দিয়ে তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাবে বললেন : বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে সমাজে, যাঁরা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবেন। তাঁরা রক্তমাংসের গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবেন বটে, কিন্তু রুচি মতামত নীতিবোধ ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবেন খাঁটি ইংরেজ।

We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.

বাঙালি কেন, ব্রিটিশ আমলের ইংরেজিশিক্ষিত শহুরে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীশ্রেণির ঐতিহাসিক চরিত্র মেকলের এই উক্তির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠে উঠেছে। বাঙালিদের মধ্যে আরও স্পষ্টতর হয়ে ফুটে উঠেছে, কারণ আধুনিক কালোপযোগী বিদ্যাবুদ্ধি অর্জনের পথে সোৎসাহে যাত্রা করার সুযোগ তাঁরাই পেয়েছিলেন সর্বাগ্রে। এই দোভাষী বুদ্ধিজীবীদেরই ঐতিহাসিক টয়েনবি বলেছেন ‘লিয়াজোঁ অফিসারশ্রেণি’।

সভ্যতার পতনের ছন্দ সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে টয়েনবি এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে বলেছেন পাশ্চাত্য জগতের ‘ইন্টারনাল প্রলেটারিয়েট’। এই সভ্যতার সংঘাতকালে বিজয়ী উদবোধক সভ্যতার রীতিনীতি ও কলাকৌশল দ্রুত আয়ত্ত করে বুদ্ধিজীবীরা নতুন সামাজিক পরিবেশ উদবর্তনের যোগ্যতা অর্জন করেন এবং মনে ভাবেন যে দুই সভ্যতার উৎকৃষ্ট ফল তাঁরা। স্বদেশের ও বিদেশের উভয়সমাজের মানুষের কাছে তাঁরা অপরিত্যাজ্য। কিন্তু যত দিন যায় তত দেখা যায়, তাঁদের এই সামান্য সান্ত্বনাটুকুরও ঠাঁই নেই সমাজে। মানুষ নিজেই যে—সমাজে পণ্যতুল্য বা কমোডিটির মতো সেখানে তার ডিম্যান্ড—সাপ্লাইয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করা সাধনাতীত ব্যাপার। সুতরাং আধুনিক বিদ্যাযন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারখানায়, যখন পূর্ণবেগে বুদ্ধিজীবী ম্যানুফ্যাকচার্ড হতে থাকে তখন অল্পদিনের মধ্যেই বাজারের ডিম্যান্ড ছাড়িয়ে যায় সাপ্লাই এবং অত্যুৎপাদনের উপসর্গ হিসেবে বেকার সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে থাকে। তোড়জোড় করে উৎপাদন আরম্ভ করা যত শক্ত, বন্ধ করা তত সহজ নয়, বিশেষ করে মানুষ—পণ্যের উৎপাদন। তার উপর বিদ্বান ও বুদ্ধিমান মানুষ যে—যন্ত্রে কমোডিটির মতো তৈরি হয়, সে যন্ত্রের আবর্তন বন্ধ করা খুবই কঠিন। তার কারণ, ইনস্টিটিউশনগুলি সমাজের সবচেয়ে মজবুত যন্ত্র, একবার গড়ে উঠলে সহজে ভাঙতে চায় না। এই ইনস্টিটিউশন যন্ত্রেই মানুষপণ্য তৈরি হয় সব সমাজে, বুদ্ধিজীবীরাও তৈরি হন। বাংলার সমাজেও ইংরেজ আমলে তা হয়েছে। প্রথম যুগের কয়েকশত ইংরেজি ভাঙা—বুলিসর্বস্ব বাঙালি ‘বাবু’ পরবর্তীকালে হাজার হাজার বি এ. পাশ এম এ পাশ, বি এ ফেল এম এ ফেল বুদ্ধিজীবীদের দলবৃদ্ধি করেছেন।

টয়েনবির এই উক্তির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি বিখ্যাত গল্পের অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। গল্পটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। একবার এক ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞাসা করেন—বিদ্যাসাগর মশাই, আপনি তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র ফেলো, কিন্তু কেন এমন হয় বলুন দেখি? যে ছেলেটি সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে সেও যা লেখে, যে এনট্রান্স পাশ করে সেও তাই লেখে, যে এল.এ. পাশ করে সেও তাই লেখে, যারা বি এ, এম এ পাশ করে তারাও তাই লেখে। কেন এমন হয় বলতে পারেন? এর কি কিছু প্রতিকার নেই? আপনারাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের মা—বাপ, এর কি কিছু বিহিত করা যায় না? যে—সময়ের কথা হচ্ছে, তখন লাহোর ছাড়া উত্তরভারতে আর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আগ্রা থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল, নাগপুরও ছিল, লঙ্কাও ছিল। বিদ্যাসাগর মশায় দুটি গল্প বলে এ কথার উত্তর দেন। তার মধ্যে প্রথম গল্পটি উল্লেখযোগ্য।

বিদ্যাসাগর বলেন—’সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দুকলেজ একই হাতার মধ্যে ছিল। হিন্দুকলেজের ছেলেরা প্রায়ই বড়মানুষের ছেলে, তারা মদ খেত। আমরা দেখতাম, আমাদের পয়সা ছিল না, মদ খেতে পারতাম না। কিন্তু দেখতে দেখতে যখন নেশা করার ঝোঁক প্রবল হল তখন আমরা কতকগুলি উঁচুক্লাসের ছেলে বাধ্য হয়ে সস্তায় ছিটে ধরলাম। অল্প খরচে বেশ নেশা হত। ক্রমে যখন একটু পেকে উঠলাম, আট—দশ ছিটে পর্যন্ত একটানে খাওয়া অভ্যাস হল, তখন আমাদের শখ হল যে বাগবাজারের বড় বড় গুলিখোরদের সঙ্গে টক্কর দেব। একদিন বাগবাজারের আড্ডায় গিয়ে দেখি, হলঘরে বসে সকলেই বেশ মৌজ হয়ে গুলি টানছে। হলঘরের পুবদিকে সবাই মাটিতে বসে খাচ্ছে, উত্তরদিকেও তাই, পশ্চিমদিকেও তাই। কেবল দক্ষিণদিকে যারা গুলি খাচ্ছে তারা সকলে সাজানো ইটের উপর বসে আছে। ব্যাপার কী, আডডাধারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওরা সব ইটের উপর বসে খাচ্ছে কেন? আড্ডাধারী বললে, আমাদের এ আড্ডার নিয়ম এই যে, যে—কেউ একটানে ১০৮টা ছিটে খেতে পারবে, তাকে একখানা ইট দেওয়া হবে বসতে। এই কথা শোনা মাত্রই আমাদের টক্কর দেবার ইচ্ছা উবে গেল। একজন আটখানা ইটের উপর বসে আছে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ও তাহলে কত ছিটে খেতে পারে? আড্ডাধারী বললে, একটানে ৮৬৪ ছিটে। শুনে আমাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টক্করের আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা গুলিখোরদের গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হলাম। দেখলাম, হাত—পা নেড়ে ফিসফিস করে তারা কি সব গল্প করছে। কাছে বসে গল্প শুনলাম। যে একখানা ইটের উপর বসেছিল সে বলছে—চাণক চাণক, গোল করাত, মস্ত বড় গোল। তার উপর কাঠ ফেলে দিচ্ছে, ফরফর করে কাঠ চিরে যাচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কড়িবরগা, কোথাও দরজা জানলা, কোথাও কোচ—কেদারা বেরিয়ে যাচ্ছে। যে দু—খানা ইটের উপর বসেছিল সে হাত নেড়ে বলল—ও আর এমন কী কল। কল হল গরফের কল। একখানা পাথরের বারকোশ, মস্ত বড় বারকোশ ঘরজোড়া, তার উপর দু—খানা মোটা পাথরের চাকা আড়ে ঘুরছে। সাহেবরা তার মধ্যে বস্তা—বস্তা মসিনা ফেলে দিচ্ছে। কলের দুটো মুখ, একটা দিয়ে পিপে—পিপে তেল বেরুচ্ছে, আর একটা দিয়ে থান—থান খোল। অবশেষে যে আটখানা ইটের উপর বসেছিল সে হাত নেড়ে বলল—ওসব কল কোনো কাজের নয়। আমার বাড়ি ফরাসডাঙায়। বাড়ি গিয়ে দেখি একদিন, কোথাও ঘরবাড়ি পুকুর গাছপালা কিছু নেই, সব মাঠ হয়ে গেছে। শ্রীরামপুর থেকে চুঁচুড়ো পর্যন্ত কেবল ধু ধু করছে মাঠ। শ্রীরামপুরের গঙ্গার ধার থেকে একটা সুড়ঙ্গ, আর চুঁচুড়োর গঙ্গার ধার থেকে আর একটা সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে। একটা দিয়ে পালে—পালে গোরু যাচ্ছে, আর একটা দিয়ে গাড়ি গাড়ি আখ যাচ্ছে। মাটির ভেতর কোথায় যায়, কিছুই বুঝতে পারলাম না। অনেক খোঁজখবর করে বুঝলাম, মাটির ভেতর কল আছে, কলের একশোটা মুখ তারকেশ্বরের কাছে গিয়ে বেরিয়েছে। কোনোটা দিয়ে বাতাবি লেবু, কোনোটা দিয়ে মনোহারা, কোনোটা দিয়ে রসগোল্লা, কোনোটা দিয়ে ছানাবড়া, কোনোটা দিয়ে পানতুয়া বেরুচ্ছে। কিন্তু ভাই, খেয়ে দেখলাম, সবই একরকম তার। মানে, একপাকের তৈরি কিনা!’

গল্পটি শেষ করে বিদ্যাসাগর বললেন : ‘আমাদের যেসব ছেলে আছে, তাদের কাছ থেকে আমরা মাইনে নিই, পাঙ্খা—ফি নিই, পরীক্ষার ফি নিই। সবরকমের ফি নিয়ে কলের দরজা খুলে দিই। দেখিয়ে দিই, এইখানে মাস্টার আছে, এইখানে পণ্ডিত আছে, এইখানে বই আছে, এইখানে বেঞ্চি আছে, কালিকলম আছে। দেখিয়ে দিয়ে কলের ভেতর ফেলে দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দিই। কল ঘুরতে থাকে, আর তার কোনো মুখ দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস, কোনো মুখ দিয়ে এল এ বি এ এম এ বেরুতে থাকে। কিন্তু টেস্ট করে দেখ, সকলেরই একরকম তার। মানে, একপাকের তৈরি কিনা!’

গল্পটি আধুনিক শিক্ষানীতির চমৎকার রূপক। একই গল্পের মধ্যে একাধিক রূপকের সমাবেশ হয়েছে। গুলিখোরদের ইটগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সঙ্গে তুলনা করা চলে। সব ডিগ্রিধারী কলের গল্প বলে। যার যত বেশি ডিগ্রি তার কল তত বেশি তাজ্জব তিনি তত বেশি ছিটে একটানে খেয়ে পরীক্ষার উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরে মাস্টারমশায় হয়ে তিনিই আবার ছাত্রদের ছিটে ধরতে শেখান এবং ধীরে ধীরে একটানে বহু ছিটে টানবার কলাকৌশলটি শিখিয়ে দেন। এও রূপক, আবার শতমুখী কলটিও রূপক। টয়েনবি যে বুদ্ধিজীবীর ম্যানুফ্যাকচারিঙের কথা বলেছেন, বিদ্যাসাগরের রূপক গল্পের মধ্যে তার ‘প্রসেসটি’ সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকের চতুর্থ পাদেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাযন্ত্রে বুদ্ধিজীবীর উৎপাদনের হার বাজারের (প্রধানত বাঁধা—মাইনের চাকরির) চাহিদা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, তা বিদ্যাসাগরের গল্পের নীতি থেকে বোঝা যায়।

বাঁধা মাইনের চাকরির ক্ষেত্র এমনিতেই সংকীর্ণ। তবু যে—সমাজে ধনতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ হয়েছে স্বচ্ছন্দগতিতে, সেখানে আপিস—ইনস্টিটিউশনের আধিক্যের জন্য চাকরিজীবী জীবিকার সমস্যার সমাধান অনেকটা সম্ভব। আমাদের সমাজে আর্থিক বিকাশের সেরকম কোনো সুযোগ ঐতিহাসিক কারণেই ঘটেনি বলে বুদ্ধিজীবীর চাকরির ক্ষেত্র বরাবরই সংকীর্ণ ছিল। তার উপর, সরকারি চাকরির প্রতি এদেশের বুদ্ধিজীবীদের আকর্ষণ ছিল গোড়া থেকেই বেশি। কারণ তার নিশ্চিন্ততা বেশি। সেইজন্য তার সামাজিক মূল্য একসময় খুব বেশি ছিল। তিনশো টাকা মাইনের ডেপুটির সামাজিক কদর ছ—শো টাকা মাইনের সওদাগরি প্রতিষ্ঠানের অফিসারের চেয়ে অনেক বেশি। বিবাহ বাজারের পাত্র নির্বাচনকালে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যেত। সরকারি পোষকতার এই সামাজিক মর্যাদা অনগ্রসর সমাজ—জীবনের লক্ষণ। ধনতন্ত্রের অবরুদ্ধ গতির ফলে আমাদের সমাজে পশ্চিমের মতো ‘ম্যানেজেরিয়াল’ শ্রেণির বিকাশ হয়নি এবং বেসরকারি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের চাকরির পদমর্যাদাও বাড়েনি। কেবল সরকারি বন্দরে সবরকমের বুদ্ধিজীবীর ভিড় বেড়েছে। বাংলার অনেক বেশি বেড়েছে তার কারণ বাঙালিরা স্বাধীন শিল্প বাণিজ্যের কর্মক্ষেত্র থেকে, উদ্যম ও ধৈর্যের অভাবে, ক্রমেই অবাঙালিদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়েছেন। তার ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালির আন্তরিক সম্পর্ক বিশেষ গড়ে ওঠেনি। ক্রমেই তাঁদের জীবন সরকার—মুখাপেক্ষী চাকরিনির্ভর হয়ে উঠেছে। উড সাহেব তাঁর ১৮৫৪ সালের বিখ্যাত শিক্ষাসংক্রান্ত ডেসপ্যাচে সরকারি চাকরির প্রতি শিক্ষিতশ্রেণির এই মোহের কথা মনে করেই বোধহয় সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন :

However large the number of appointments under Government may be, the views of the natives of India should be directed to the far wider and more important sphere of usefulness and advantage which as liberal education lays open to them.

উড সাহেবের হুঁশিয়ারিতে বাংলায় অন্তত কোনো কাজ হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সংস্কারকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিশিষ্ট ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ হেনরি শার্প আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রসঙ্গে বিলেতের একটি বিদ্বৎ—জনসভায় বলেছেন (১৯২৫) :

Its buildings serve as prominent adornment for the cities, its councils as convenient platform for the budding politician and its organisation as a subject of keen debate for the legislatures. Above all, it is the pride and darling of the middle class. The lad of this class in Bengal learns from his cradle to look towards the Senate House of Calcutta as a Mecca which will secure him his passport to Paradise. Paradise may mean in the end of thriving practice in law or medicine, a High Court Judgeship or a responsible post in the administration of the country. (Italics  লেখকের)

–H. Sharp : ‘The Development of Indian Universities’ in Journal of the Royal Society of Arts, April 17, 1925.

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কেবল তখনকার বাংলাদেশে নয়, সারা ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাকেন্দ্র। নবযুগের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দানও কম নয়। আধুনিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবী (বাঙালি তো বটেই) কয়েক পুরুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচর্যাতেই মানুষ হয়েছেন বলা চলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ও যে আধুনিক যুগের সমাজের একটি দৃঢ়মূল ‘ইনস্টিটিউশন’, সেকথা সামাজিক সমস্যার আলোচনাকালে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যে—সমাজে যে ইনস্টিটিউশন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, তার মধ্যে সেই সমাজের ভালো মন্দ দোষগুণ দুই—ই থাকে। গুণের চেয়ে ক্রমে দোষগুলি মারাত্মক হয়ে ওঠে, কারণ প্রতিষ্ঠানের দেহে ব্যাধির বীজাণুর মতো তার ক্রিয়া হতে থাকে। সামান্য একটি বিষাক্ত সংক্রমণে যেমন অতিসুস্থ মানুষও ব্যাধিগ্রস্ত পঙ্গু হয়ে যায় এবং তার সর্বাঙ্গে সেই বিষ ছড়িয়ে পড়ে, সামাজিক ইনস্টিটিউশনের ক্ষেত্রে দোষের ক্রিয়াও ঠিক সেইভাবে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ও যেহেতু এই ধরনের একটি ইনস্টিটিউশন, এই সংক্রমণ থেকে তাই তার পক্ষেও আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়, অপর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেও তা হয়নি। অল্পকালের মধ্যেই তার সর্বাঙ্গে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, সিন্ডিকেট সিনেট থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেকটি বিভাগ পর্যন্ত। শিক্ষার ক্ষেত্র চাকরি ও গোষ্ঠিগত—ব্যক্তিগত প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বাংলার আরও ব্যাপকভাবে হয়েছে, তার কারণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী সংখ্যায় বেশি, তাঁদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি এবং তার চেয়েও বড় কথা, কেবল সরকারি চাকরি ছাড়া সমাজের অন্যান্য স্বাধীন কর্মক্ষেত্র থেকে (যেমন আর্থিক) তাঁরা প্রায় বিচ্ছিন্ন। আধা—সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাই তাঁদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠে এবং তার সঙ্গে যতরকমের চারিত্রিক নীচতাদীনতা সবকিছুর লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে সেই প্রতিষ্ঠান। আজ তারই পুঞ্জীভূত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বাংলার বিদ্বৎসমাজে।

আজ থেকে পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই কীভাবে এই অসন্তোষ বাঙালি বিদ্বৎসমাজের মনে ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাসংক্রান্ত কয়েকশত সমসাময়িক পুস্তকপুস্তিকা থেকে তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। একজন লিখছেন (১৯০১), সিনেটে ও সিন্ডিকেটে এমন সব লোক ধীরে ধীরে ক্ষমতা দখল করে বসেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। সমস্ত ব্যাপারটাই কেবল প্রভুত্বের ব্যাপার হয়ে ওঠে এবং সিন্ডিকেটের মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি সর্বব্যাপারে ও বিভাগে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করেন। যত কমিটি, যত বোর্ড, সব তাঁদের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি ও প্রভুত্বরক্ষার স্বার্থে গঠিত হয়। একথা বর্তমানে আরও শতগুণ বেশি সত্য। কলকাতা কর্পোরেশনের চাইতেও নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য প্রতিষ্ঠান হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। আর একজন লিখেছেন (১৯০১) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তখনকার বিদ্বানদের সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দু—চারজন কৃতীদের বাদ দিলে, অধিকাংশ শিক্ষিতেরই স্ট্যান্ডার্ডের অনেক অবনতি হয়েছে দেখা যায়। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমযুগে যাঁরা শিক্ষা পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে পরবর্তীকালের শিক্ষিতদের অনুন্নতস্তরের কোনো তুলনাই হয় না। তার মানে কি এই যে বাংলায় প্রকৃত প্রতিভাবানের অভাব ঘটেছে? তা নয়, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই কোথাও মারাত্মক গলদ আছে নিশ্চয়। অন্য একজন এ সম্বন্ধে লিখেছেন (১৯০১), ক্রমেই দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি বিদ্বানদের মধ্যে প্রকৃত চিন্তাশীল মনীষার বিকাশ হচ্ছে না। মৌল চিন্তার শক্তি শিক্ষিত বাঙালির কমে যাচ্ছে, প্রতিভাবানের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরা, যাঁরা অধ্যাপনা শিক্ষকতা করেন, তাঁরাও লেখাপড়ার চর্চা করেন না। যা মুখস্থ করে তাঁরা একবার ডিগ্রি পেয়েছেন তাই তাঁদের সারাজীবনের মূলধন। তাতেও গলদ অনেক। কেবল মুখস্থেও কাজ হয় না, পরীক্ষক—অধ্যাপকের প্রিয়পাত্র ও মোসাহেব হওয়া চাই। একজন ব্যক্তি ঘুরে ফিরে প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক হন, এবং তাঁদের খেয়ালখুশি মতামত, এমনকী বিদ্যার দৌড় কতদূর সে—সম্বন্ধে অবহিত না হলে কোনো পরীক্ষার্থীর কৃতিত্ব দেখানো সম্ভব নয়। শিক্ষার এই ব্যবস্থার জন্যই আমাদের দেশের সংস্কৃতি ক্রমে একটি যান্ত্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।

এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে এরকম সমালোচনা সাম্প্রতিককালে শিক্ষাবিদরা প্রকাশ্যে অনেক করছেন। এবিষয়ে তদন্ত কম হয়নি। কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগেও যে এরকম সমালোচনা বিদ্বৎজনমহলে হত, এগুলি তার প্রমাণ। ইংরেজরা যে শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাকে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইনস্টিটিউশন গড়ে তুলেছিলেন, তার পরিণাম ‘শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ার’ মতো হয়েছে। সমাজের জন্য আর যেকোনো পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের মতো, এবং তাঁর চেয়েও কদর্ষ হয়েছে তার অবস্থা। শিক্ষায়তনের সঙ্গে কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠানের কোনো পার্থক্য নেই। শিক্ষার লক্ষ্য যখন চাকরি (অধ্যাপনাও চাকরি) তখন বিদ্যার যেটুকু মূলধন সম্বল করে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব তার বেশি বিদ্যা অনাবশ্যক। এ সমাজে যেমন কয়েকশত বা কয়েক হাজার টাকা মাত্র মূলধন নিয়ে লক্ষপতি—কোটিপতি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে এবং হয়েছেনও অনেকে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোসাহেবিলব্ধ ডিগ্রিচিহ্নিত সামান্য বিদ্যার মূলধন নিয়ে মহাবিদ্বানের স্তরেও রাজপোষকতায় অথবা বিদ্বানদের আমলাচক্রের পোষকতায় অনেকে উন্নীত হয়েছেন। সাধারণভাবে অধ্যাপকশ্রেণি শিক্ষকশ্রেণির অর্জিত বিদ্যার স্থিতিশীলতা দেখলেই তা বোঝা যায়। গণিতের উত্তম স্কলার সারাজীবন ধরে ছাত্রদের কাছে একই ফরমুলা যন্ত্রের মতো আবৃত্তি করেছেন, ইতিহাসের রত্ন পঁচিশ বছর ধরে পড়াচ্ছেন অশোকের ও আকবরের কীর্তিকথা, আর বিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিজিক্স—কেমিস্ট্রির সূত্র আওড়াচ্ছেন। পরিবর্তনশীল জ্ঞানজগতের সঙ্গে তাঁদের কোনো সুদূর সম্পর্কও নেই, কারণ তা সিলেবাসে নেই এবং চাকরি বজায় রাখার জন্য তার দরকার হয় না, উন্নতির জন্যও না। নিজেদের জ্ঞানবিদ্যার ক্ষেত্রেই তাঁরা অল্পকালের মধ্যে কূপমণ্ডূক হয়ে যান। অন্যান্য বিদ্যার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক থাকে না, এবং সম্পর্ক রাখাও তাঁরা তাঁদের স্কলারশিপও—বিরোধী ব্যাপার বলে মনে করেন। গণিতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী যিনি তিনি ইতিহাস ও সাহিত্য সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক যিনি তিনি বিজ্ঞানের যুগে বাস করেও তার সাধারণ সূত্রগুলিও জানেন না। এইখানেই শেষ নয়। গ্রিক ইতিহাসে বিশেষজ্ঞ যিনি তিনি ভারতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ অজ্ঞতার ব্যাপারে আদৌ লজ্জিত নন। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসের এক্সপার্ট যিনি তিনি উনিশ শতক সম্বন্ধে কৌতূহলীও নন। চূড়ান্ত হল, অষ্টাদশ শতাব্দীর ‘ইকনমিক’ ইতিহাসে যিনি ‘ডক্টর’ উপাধি পেয়েছেন, তিনি সেই শতাব্দীরই রাজনৈতিক বা সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানেন না বলে গর্ববোধ করেন, কারণ ওগুলি তাঁর ‘স্পেশ্যালাইজেশন’—এর বিষয়বহির্ভূত।

আধুনিক যন্ত্রকানা ধনমত্ত সভ্যতায় বিদ্যার হাল হয়েছে এই। হাল সম্বন্ধে এতদিন চিন্তাশীল শিক্ষাবিদরা সচেতন হয়েও উদাসীন ছিলেন, একেবারে হালে তাঁদের সেই উদাসীনতার ঘোর সামান্য কেটেছে। সম্প্রতি তাঁরা ‘হিউম্যানিটিজ’ ‘সায়েন্স’ ও ‘টেকনলজি’র জ্ঞানের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য স্থাপনের সংকল্প করেছেন। কারণ বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ণ সমাজচেতন স্থিতপ্রাজ্ঞ মানুষ তৈরি হয় না, তার বদলে আধা—মানুষ সিকি—মানুষ একপেশে ও একচোখো মানুষ তৈরি হয় দেখে তাঁরা সন্ত্রস্ত হয়েছেন। আধুনিক শিক্ষার ফলে জ্ঞানের তৃতীয় চক্ষু তো খোলেই না, ঈশ্বরদত্ত দুই চক্ষুর মধ্যে একটি কিছুটা খোলে, অন্যটি বন্ধই থাকে। একচক্ষু হরিণের মতো অবস্থা হয় বিদ্বৎসমাজের। যন্ত্রযুগের খণ্ডিত—বিখণ্ডিত শ্রমের মতো শিক্ষা ও বিদ্যাবুদ্ধিও খণ্ডিত—বিখণ্ডিত হয়েছে এবং যন্ত্রের এক্সপার্ট ও টেকসিয়ানের মতো বিদ্যারও এক্সপার্ট বেড়েছে। কোনো বিরাট শিল্পকারখানার মজুরদের মতো অবস্থা হয়েছে এযুগের সমাজ—কারখানার বিদ্বৎজনদের। বিদ্যার ও বিদ্বৎজনের এই যান্ত্রিকতা বা মেকানাইজেশন এবং অতিবিভাজ্যতা বা ডিপার্টমেন্টালাইজেশন, আধুনিক বিদ্বৎসমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা ও সংকট। এ—সম্বন্ধে বর্তমান যুগের দুজন বিখ্যাত মনীষীর মতামতের কথা মনে পড়ছে, একজন সমাজবিজ্ঞানী, আর একজন কবি—শিল্পী। সমাজবিজ্ঞানী ম্যানহাইম এযুগের বিদ্বৎজনদের এই খণ্ডিত রূপের কথা স্মরণ করেই তাঁদের কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেছেন, যেমন ‘পলিটিক্যাল’, ‘অর্গ্যানাইজিং’, ‘ইন্টিলেকচ্যুয়াল’, ‘আর্টিস্টিক’, ‘মর‍্যাল’ ও ‘রিলিজিয়াস’। কবি টি.এস. এলিয়ট আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর একটি রচনায় প্রধানত ম্যানহাইমের মতামতের সমালোচনা করে বলেছেন যে এ যুগের বিদ্বৎসমাজে ওই বিভাজ্যতার সমস্যা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার সবটুকুই নিন্দনীয় নয়। বিভাজনের খানিকটা প্রয়োজন আছে, ভালোর জন্যই। তবে যেভাবে বা যেরূপে তা বর্তমান সমাজে দেখা যায়, তার সবটুকু সমর্থনীয় বা প্রশংসনীয় নয়। এযুগের সংস্কৃতির একটা প্রধান দুর্বলতা হল, বুদ্ধিজীবীদের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা। রাজনৈতিক দার্শনিক শিল্পী ও বৈজ্ঞানিক, কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই এবং তার জন্য ক্ষতি সকলেরই হয়। সমাজের দিক থেকেও তা কল্যাণকর নয়। বুদ্ধিজীবীদের ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতা এবং সজ্ঞানস্তরে ভাবের আদানপ্রদানের অভাব, বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা।১০

এ—সমস্যা বাংলার বিদ্বৎসমাজেও প্রকট। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার পরিণতি হয়েছে কেরানি—কর্মচারী ও আমলাবাহিনী উৎপাদনে। সংস্কৃতিক্ষেত্রেও তার মর্মান্তিক ব্যর্থতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ শিক্ষানীতির এই পরিণাম সম্বন্ধে একজন লিখেছেন :১১

…….they have aimed at the production of government officials, lawyears, doctors and commercial clerks and, within this narrow range, they have succeeded remarkably well. Where they have failed, almost completely, is on the cultural side.

এমনকী, মেকলের দম্ভোক্তিরও বহ্বাড়ম্বর সার হয়েছে শুধু। তিনি যে ভারতীয় মেটেরঙের চামড়ার অন্তরালে ইংরেজের সংযমী ও বিজ্ঞানী মনটি গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিলেন, তাও ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর উদ্দেশ্যের আংশিক সাফল্য হয়েছে শাসক ও শাসিতের মধ্যে একটি দোভাষীশ্রেণির বিকাশের মধ্যে। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার কোনো আদর্শ, যুক্তিবাদ বা বৈজ্ঞানিক হিউম্যানিজম কোনো কিছুই, শেষপর্যন্ত স্থায়ী ও ব্যাপকভাবে বাঙালি বা ভারতীয় বিদ্বৎসমাজের চরিত্রে বাসা বাঁধতে পারেনি। তার প্রধান কারণ, দেশের জলবায়ুমাটির গুণ বদলায়নি। পাশ্চাত্ত্য আদর্শের বীজ ছড়ানো হয়েছে এদেশের বর্ধিষ্ণু নাগরিক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। কেবল বীজের গুণে প্রথমদিকে উনিশ শতকে তার কয়েকটি বিস্ময়কর অঙ্কুরোদগমে আমরা ধাঁধিয়ে গিয়েছি। ভেবেছি, তথাকথিত নবজাগরণের সেই তরঙ্গের জোয়ার আসবে ভবিষ্যতে। তাও আসেনি। কারণ পুরোনো মাটিতে নতুন বীজের পরিপূর্ণ উদগম সম্ভব হয়নি। সমাজের আর্থিক স্তরের মৌল কাঠামো খানিকটা বদলেছিল ঠিকই। তার ফলে সমাজের গড়নও যে কিছুটা বদলায়নি তা নয়। কিন্তু মধ্যপথেই এই পুরাতনে ভাঙন এবং নতুনের গড়নের পথ অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরাধীন উপনিবেশের অদৃষ্টে যা হওয়া সম্ভব তাই হয়েছিল। অঙ্কুরেই তাই পাশ্চাত্যশিক্ষার আদর্শ ও নীতি শুকিয়ে যায়। মেকলে খুব বড়াই করে একদা বলেছিলেন :১২

It is my firm belief that if our plans of education are followed up, there will not be a single idolater among the respectable classes in Bengal thirty years hence. And this will be effected without any efforts to proselytise: without the smallest interference in their religious liberty; merely by the natural operation of knowledge and reflection.

অতিবিশ্বাসের কি মোলায়েম আত্মসন্তোষ! লর্ড মেকলে কতকটা ‘লর্ডলি’ ভঙ্গিতে বলেছেন : আমার দৃঢ়বিশ্বাস, যদি আমাদের শিক্ষানীতি কার্যকর হয় তাহলে আজ থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বাঙালি সমাজে কোনো মূর্তিপূজকের অস্তিত্ব থাকবে না। এবং আমাদের তরফ থেকে কোনোরকমের ধর্মান্তরের চেষ্টা না করেও এই ধরনের সামাজিক রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হবে। ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করারও দরকার হবে না। কেবল নতুন শিক্ষালয় জ্ঞান ও চিন্তার ক্রিয়াতেই এই অসাধ্য সাধন করা যাবে।

কূটনীতিজ্ঞ বা শিক্ষাবিদ হিসেবে মেকলে হয়ত ধুরন্ধর ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তাঁর এই বালকোচিত উক্তি শুনেই বোঝা যায়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্র সম্বন্ধে তাঁর কোনো জ্ঞান ছিল না। কী ধরনের উপাদানের ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়ায় সমাজের ও সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় তা তাঁর অজানা ছিল। তাই ব্যক্তিগত পত্রে তাঁর এরকম মনখোলা উক্তি করতে দ্বিধা হয়নি। কোনো নীতি বা আদর্শ বা পরিকল্পনা, তা যত বড় অতিমানবেরই উত্তপ্ত মস্তিষ্কপ্রসূত হোক না কেন, উপর থেকে উপলখণ্ডের মতো সমাজের বুকে নিক্ষেপ করলে তাতে সামান্য জলতরঙ্গের সৃষ্টি হতে পারে হয়ত, কিন্তু সমাজের অন্তঃস্থল পর্যন্ত আলোড়িত হয়ে ওঠে না। সেরকম আলোড়ন ছাড়া সমাজের উল্লেখ্য পরিবর্তনও হয় না। মেকলের ত্রিশ বছরের হিসেবের কথা উপেক্ষা করাই বাঞ্ছনীয়। একশো—ত্রিশ বছর পরেও আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, মেকলের রোপিত আমগাছে আমড়া ফলেছে। বাংলার সম্ভ্রান্ত বিদ্বৎসমাজে আজ বরং এমন একটি লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন যিনি যাবতীয় ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারে বিশ্বাসী নন। যাবতীয় মৃত cult-এর কঙ্কালকে মহাসমারোহে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহ আজ তাঁদের মধ্যে প্রবল। জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ব্যর্থতার প্রকাশ বলে এই উপসর্গ ব্যাখ্যা করা যায় এবং করলে ভুলও হয় না। কিন্তু ব্যর্থতার বেদনা অন্য উপায়েও আত্মপ্রকাশ করতে পারত, মৃত কাণ্টের শ্মশানে ঘুরপাক না খেয়ে। আত্মভিমান অভিযোগ অবিশ্বাস ও নিঃসঙ্গতা হয়তো তাঁদের কাম্য হত। অতি—চেতন সজাগবুদ্ধি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর হয়তো আজ কাম্য তাই। কিন্তু অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই অতীতের মৃত আদর্শের শ্মশানের পথে যাত্রী, বর্তমানের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, ভবিষ্যতের প্রতি আস্থাহীন।

যে—কোনো ব্যবহার্য পণ্যের বাজারদর একটা নিয়ম মেনে ওঠানামা করে, অর্থনীতির ছাত্ররা তা বিলক্ষণ জানেন। প্রতিযোগিতার মোটামুটি সুস্থ ও স্বাধীন পরিবেশে এই বাজারদরের নিয়মের ব্যতিক্রম হত না সাধারণত। ক্যাপিটালিজমের যৌবনকালে অর্থতত্ত্ববিদরা এই সমস্ত নিয়ম রচনা করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ক্যাপিটালিজমের এমন কতকগুলি পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে ক্লাসিকাল যুগের কোনো নিয়মই অবধারিত সত্য বলে টিকে থাকতে পারছে না। প্রতিযোগিতা বা কম্পিটিশনের সেই স্বাধীন সুস্থ পরিবেশও আজ আর নেই। আজ তার বিচিত্র সব স্ববিরোধী নাম—মেনোপোলিস্টিক কম্পিটিশন, ডুয়োপোলি, ওলিগোপোলি ইত্যাদি। খোলা বাজারে ক্রেতাদের কোনো স্বাধীনতা নেই বাজারদর নির্ধারণে, বিক্রেতার উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতাও তার সীমাবদ্ধ। দুজন তিনজন বা চারপাঁচজন উৎপাদক—বিক্রেতা পরোক্ষ বা অপরোক্ষ চুক্তি অনুযায়ী পণ্যের বাজারদর নির্ধারণ করেন। ক্রেতার স্বাধীনতা নেই, জিনিসের সত্যিকারের মূল্য যাচাইয়ের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ, কারণ ‘ফ্রি মার্কেট’ বা ‘ফ্রি কম্পিটিশন’ বলে কিছু আর নেই। ক্যাপিটালিজমের চরিত্রের এই পরিবর্তন ঘটেছে, এ সম্বন্ধে আমাদের সম্যক চেতনারই বিকাশ হয়নি।১৩ সমাজের বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে স্পষ্টভাবে। বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রেও স্বাধীন প্রতিযোগিতার দিন চলে গেছে, তার একটা লোকদেখানো খোলস আছে শুধু। সরকারি বা বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রকাশ্য পরীক্ষার বহর যতই বাড়ুক, তার অন্তরালবর্তী অদৃশ্য বিচারকমণ্ডলীর প্রভাব যে কতখানি তা সমাজের কারও আজ অজানা নেই। এযুগের জিনিসের মূল্য যেমন বিজ্ঞাপনের বাহারে নির্ধারিত হয় এবং বাইরের প্যাকেটের চটকে তার কাটতি বাড়ে, তেমনি বিদ্যাবুদ্ধি ও প্রতিভারও যাচাই হয় বিজ্ঞাপনে ও বাইরের খেতাবের চটকে। এর মধ্যেও যে দু—চারজন প্রকৃত বিদ্বান ও প্রতিভাবান যোগ্য সমাদর পান না তা নয় (দু—চারটে চমকলাগানো প্যাকেটের মধ্যেও যেমন ভালো জিনিস থাকতে পারে তেমনি), কিন্তু সেটা দৈবচক্রের ব্যাপার ও ব্যতিক্রম। আমাদের আলোচ্য সামাজিক ‘ব্যতিক্রম’ নয়, সাধারণ সামাজিক গতি ও প্রকৃতি। সাহিত্য শিক্ষা জ্ঞানবিদ্যা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে আজ তাই প্যাকেট লেবেল ও বিজ্ঞাপনের বাহাদুরির যুগ এসেছে। বর্তমান যুগের শিক্ষা ও বিদ্যার ক্ষেত্র সম্বন্ধে ম্যানহাইম বলেছেন :১৪

Education is one of the major areas in which the spirit of inquiry is on the decline… The retailing of knowledge in standard packages paralyses the impulse to question and to inquire. Knowledge acquired without he scarching effort becomes quickly obsolescent, and a civil service or a profession which depends on a personnel whose ciritical impulse is benumbed becomes rapidly inert and incapable of remaining attuned to changing circumstances.

শিক্ষা ও বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্র থেকে অনুসন্ধিৎসা প্রায় অন্তর্ধান করেছে। স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেট আঁটা লেবেলমারা বিদ্যা ক্রমে বিদ্যার্থীর কৌতূহল ও সন্ধানী মনকে অসাড় অচৈতন্য করে দিচ্ছে। যে—বিদ্যার পদ্ধতির মধ্যে সন্ধানী মনের ক্ষুধানিবৃত্তির কোনো সুযোগ নেই, খানিকটা মুখস্থ এবং অনেকটা পরীক্ষক তোষণের উপর যা নির্ভরশীল, সেই বিদ্যা অর্জন করে যাঁরা বিদ্বান হন তাঁরা জীবনের যে—কোনো কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করুন সেখানেও যন্ত্রবৎ কাজ করবেন। তাঁদের নিজস্ব কোনো বিচারবুদ্ধি বিবেচনাশক্তি বলে কিছু থাকবে না, বিরাট যন্ত্রের নাটবলটুর মতো অবস্থা হবে তাঁদের এবং যুগের যা সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখেও তাঁরা চলতে পারবেন না।

শিক্ষা ও জ্ঞানবিদ্যার যখন এই অবস্থা তখন জনশিক্ষার প্রসার হচ্ছে প্রতিদিন এবং শিক্ষিতের সংখ্যাবৃদ্ধিও হচ্ছে দ্রুতহারে। সেটা নিঃসন্দেহে সামাজিক শুভলক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রগতির প্রমাণ। তার ফলাফলও শুভ হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল বলছি কারণ কোনো দেশের বিদ্বৎসমাজে (বা যে—কোনো সামাজিক শ্রেণিতে) যত নতুন তরুণ শিক্ষিত ও বিদ্বান—বুদ্ধিমানের আমদানি হয় ততই মঙ্গল। তাতে বিদ্বৎসমাজের স্থিতিশীলতা বা কূপমণ্ডূকতা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা থাকে। নতুন যাঁরা তাঁরা যদি সত্যিই নতুন মন, নতুন দৃষ্টি নিয়ে আসেন, তাহলে তাঁরা পূর্বের বদ্ধ চিন্তাধারার ও কর্মধারার পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের বর্তমান যুগের সমাজের মতো যে—সমাজ অত্যন্ত বেশিমাত্রায় ‘ইনস্টিটিউশানালাইজড’ সেখানে নতুনের উপর পুরাতনরা তাঁদের নিজেদের ছাপ মেরে দেবার সুযোগ খুব বেশি পান। অর্থাৎ যেমন গুরু তেমনি শিষ্য, যেমন শিক্ষক তেমনি ছাত্র তৈরি হয়। যে অধ্যাপক বা শিক্ষকদের নিজেদের অনুসন্ধিৎসা লোপ পেয়ে গিয়েছে, নিছক চাকরির স্বার্থে চর্বিত বিদ্যার চর্বণে যাঁরা দিনগত পাপক্ষয় করেন, যে বিদ্বান ব্যক্তি অর্জিত বিদ্যার সামান্য পুঁজি নিয়ে দু—তিনহাজারি মনসবদারের গদিতে বসে আছেন, যাঁদের জ্ঞানার্জনের সমস্ত আগ্রহ স্বার্থবাদ ও সুবিধাবাদের অনলে ভস্মীভূত এবং যাঁরা ইনস্টিটিউশনের বৃহৎ ছত্রছায়ায় নিশ্চিন্তে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা কখনও তাঁদের ছাত্রদের চিন্তাশীল কৌতূহলী বা অনুসন্ধানী হবার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন না

Large and well-trenched organisations are usually able to assimilate and indoctrinate the newcomer and paralyse his will to dissent and innovate. It is in this sense that the large-scale organisation is a factor of intellectual dessication.১৫

বাংলার বিদ্বৎসমাজও আজ এই সমস্যার সম্মুখীন। তার জীবিকা—সমস্যা অনস্বীকার্য নয়। উপেক্ষণীয় তো নয়ই। চাকরি লক্ষ্য করে, বিশেষ করে সরকারি চাকরি, যাঁদের আধুনিক শিক্ষার পথে যাত্রা শুরু হয়েছে এবং ক্রমে যাঁরা কারখানার যন্ত্রোৎপন্ন পণ্যের মতো বিদ্বানে পরিণত হয়েছেন, জীবিকার সমস্যা দেড়শো বছরের মধ্যে তাঁদের ক্রমে জটিল হওয়া স্বাভাবিক। কারণ ক্রমেই তাঁদের সংখ্যা বাংলাদেশে দ্রুতহারে বেড়েছে এবং মধ্যবিত্তের বড় একটা অংশ যেমন বাংলা দেশে ‘শিক্ষিত’ পদবাচ্য তেমন ভারতবর্ষের আর অন্য কোনো প্রদেশে নয়। এই ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের (যাঁদের নিয়ে ‘বিদ্বৎসমাজ’ গড়ে উঠেছে) সংখ্যানুপাতে সরকারি বা বেসরকারি কোনো চাকরির সংখ্যা বাড়েনি। তার উপর বাংলার বাইরের প্রদেশেও শিক্ষিত বাঙালির প্রতিপত্তির যুগ নিশ্চিত অস্তাচলে। কারণ ইংরেজের আমলে যেসব প্রদেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রসার নানা কারণে ঘটেনি, আজ তার দ্রুত বিকাশ হচ্ছে। সুতরাং বাঙালির চাকরির ক্ষেত্র এবং সরকারি পোষকতার ক্ষেত্র ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে বাধ্য। সমস্যা এক্ষেত্রে থাকবেই এবং ক্রমেই তার ফলে অসন্তোষও বিদ্বৎসমাজে ধূমায়িত হয়ে উঠবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ‘intellectual dessication’-এর সমস্যা। হয়তো এ—সমস্যা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাও। ম্যানহাইমের মতে বুদ্ধিজীবীর এ—সমস্যা বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক ও আন্তসামাজিক সমস্যা। বর্তমান সমাজ ও তার ভেতরকার সব দৃঢ়মূল ইনষ্টিটিউশনের গড়ন না বদল করলে হয়ত এ সমস্যার প্রতিকার সম্ভব নয়। সেই গড়নও বদলাচ্ছে আজ, সমাজের দ্রুত গণরূপায়নে (democratisation)। তার ফলে আবার নতুন করে সব সমস্যা দেখা দিচেছ, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের সামনে। তার জটিলতাও কম নয়। আপাতত সমস্যা—সমাধানের কোনো রেডিমেড ফরমুলা কিছু দেখা যাচ্ছে না। সামাজিক গণরূপায়ণের ধারা কীরকম হবে এবং তার ফলে নতুন কী ধরনের সব সমস্যা দেখা দেবে, তার আভাস যেটুকু পাওয়া যায়, সোশ্যালিস্ট ডেমক্রেসির পরীক্ষা থেকে, তাতেও উল্লসিত হয়ে বলা যায় না যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জীবিকার চেয়ে যে জীবন আরও বৃহত্তর এবং উদরের চেয়ে মগজের স্বাধীন চিন্তা বুদ্ধি ও মননের প্রতি যে মানুষের সহজাত অনুরাগ কম নয়, তা আজ নতুন সমাজতন্ত্রের পরীক্ষাক্ষেত্রেও পদে পদে সংকটের আঘাতে বোঝা যাচ্ছে। সামাজিক গণরূপায়ণে বুদ্ধিজীবীর স্তরস্বাতন্ত্র্য নিশ্চিহ্ন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তা যদি হয় তাহলে তা বুদ্ধিজীবীর বা ‘বিদ্বৎসমাজের সমস্যা’ বলে কোনো সমস্যার স্বতন্ত্র অস্তিত্বই থাকবে না। তা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর ও প্রয়োজন হবে না। কিন্তু কি হবে না হবে আপাতত বলা যাচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানীরা কেবল ‘ট্রেন্ড’ বা গতির কথা বলতে পারেন, রাজনৈতিক জ্যোতিষীদের মতো কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব।

রচনাকাল : ১৩৬৪ সন

। Martin, Alfred Von : Sociology of the Renaissance p.39.

। Woodrow, H. : Macaulay’s Minutes on Education in India Calcutta: Baptist Mission Press, 1862, p .115.

। ‘The intelligentsia is a class of liaison officers who have learnt the tricks of the intrusive civilisation’s trade’… (p.394).‘The handful of chinovniks is reinforced by a legion of ‘Nihilists’, the handful of quill-driving babus by a legion of ‘failed B.A.s’; and the bitterness of the intelligentsia is incomparably greater in the latter state than in the former.’ Arnold Toynbee : A Study of History. p.295

। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভূমিকা।

। Wood’s Educational Despatch of 1854.

। Roy, Krishna Ch. : Education in India (1901). pp. 3-4.

। Ghosh, N N. : Higher Education in Bengal as influenced by the Calcutta University, The University, 1901, pp. 1-2.

। The Calcutta University as it is and as it should be : The Editor, Pratibasi (Cal. 1901), pp. 9 -10.

। Mannheim Karl : Man and Society. op. cit. p.82.

১০। Eliot, T.S. : Notes towords the Definition of Culture, op. cit. p.38.পরে ম্যানহাইম বুদ্ধিজীবীদের বিবিধ সমস্যা সম্বন্ধে আরও বিস্তৃত অনুশীলন করেছেন তাঁর The Sociology of Culture গ্রন্থে এবং তাতে পূর্বের মতামত (Man and Society Ideology and Utopia রচনাকালের) অনেক পরিবর্তন করেছেন। তাতে অবশ্য এলিয়টের আসল বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ আছে বলে মনে হয় না।

১১। Mayhew, Arthur : The education in India, London: Faber and Gwyer, 1926, p. 149.

১২। Trevelyan, G.O. :  Life and Letters of Lord Macaulay, London: Long´mans 1878. Vol. I. p. 455.

১৩। Strachey, John, Contemporary Capitalism, London: Gollanez 1956, pp. 20 – 21.

১৪। Mannheim, Karl : Essays on the Sociology of Culture, London: Routledge, 1956, p. 167.

১৫। Mannheim, Karl : op. cit.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *