১. বাংলার বিদ্বৎসমাজ

বাংলার বিদ্বৎসমাজ – বিনয় ঘোষ

পরিমার্জিত সংস্করণ প্রসঙ্গে প্রকাশকের কথা

‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ প্রকাশিত হয় বৈশাখ ১৩৮০, ইংরেজি ১৯৭৩ সালে। প্রকাশ ভবনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৩ থেকে ২০০৬, অর্থাৎ ৩৩ বছরে বইটির পাঁচটি ‘সংস্করণ’ হয়েছে। সম্ভবত পুনর্মুদ্রণকে সংস্করণ বলা হয়েছে। ‘দ্বিতীয়’ সংস্করণের ভূমিকায় বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, অনেক নতুন তথ্য সংযোজন করা হল। পাঠ্যবিষয়ে কিছু কিছু সংশোধনও করা হয়েছে। পরবর্তী ‘সংস্করণ’গুলো হয় লেখকের প্রয়াণের পর। এক্ষেত্রে সংস্করণের সুযোগ ছিল না। হয়ে থাকলেও তার উল্লেখ নেই পরবর্তী তিনটি মুদ্রণে।

নতুন করে প্রকাশ করার সময় আমাদের অবলম্বন করতে হয়েছে প্রকাশ ভবনের ২০০৬-এর মুদ্রণ। কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ লক্ষ করা যায়। সে-সব সাধ্যমতো সংশোধন করা হয়েছে। এবং লেখক ও তাঁর লেখাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা যত্ন নিয়েছি ছাপা ও সামগ্রিক প্রকাশনার বিষয়ে। নির্ঘণ্ট পরিবর্ধিত আকারে প্রস্তুত করেছেন শ্রী সত্যব্রত ঘোষাল। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ দ্বিতীয় সংস্করণ আরও অনেক আগে প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু অন্যান্য বইয়ের কাজের চাপে এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য তা যথাসময়ে করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য আমি দুঃখিত এবং আগ্রহী পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

বর্তমান ‘দ্বিতীয়’ সংস্করণে অনেক নতুন তথ্য সংযোজন করা হল। বিভিন্ন অধ্যায়ের পাঠ্যবিষয়ের কিছু—কিছু সংশোধন করেছি। সংযোজিত তথ্যের কিছুটা অংশ পরিশিষ্ট ২ থেকে ৬—এর মধ্যে দেওয়া হয়েছে।

অসুস্থতার জন্য নিজে ভাল করে প্রুফ পড়তে অথবা সংশোধন করতে পারিনি। সেজন্য কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে গেল, বিশেষ করে বানানে। সেজন্য পাঠকরা মার্জনা করবেন।

 বিনয় ঘোষ

মার্চ ১৯৭৮

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

বাংলার বিদ্বজ্জন ও বিদ্বৎসভা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধের সমষ্টি হল ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ গ্রন্থ। বিশ্বভারতী পত্রিকা, চতুরঙ্গ, এক্ষণ প্রভৃতি পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধগুলির রচনাকাল বাংলা ১৩৬২ সন থেকে ১৩৭৮ সন পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘বিদ্যা বিদ্বান বিদ্যালয় বিদ্যার্থীবিদ্রোহ’ নামে এই গ্রন্থের শেষ রচনাটি ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩৭৮ সনে। দীর্ঘ সতের—আঠার বছরের ব্যবধানে রচিত বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্যে কিছু পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ঐতিহাসিক তথ্যের ও যুক্তির, যদিও প্রত্যেকটি প্রবন্ধ সম্পাদনকালে যথাসম্ভব সেই ত্রুটি সংশোধন করার চেষ্টা করেছি। ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকে আধুনিক যুগের বাঙালী বুদ্ধিজীবীর বিকাশকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাংলার বিদ্বৎসমাজের নানাবিধ সমস্যা, সামাজিক চরিত্র ও ঐতিহাসিক ভূমিকার বিশ্লেষণ করা এই গ্রন্থের লক্ষ্য।

 বিনয় ঘোষ

নববর্ষ ১৩৮০

বাংলার বিদ্বৎসমাজ

রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্বান সর্বত্র হন পূজিত। চাণক্যের নামে প্রচলিত এই লোককথার তাৎপর্য আর—কেউ না বুঝলেও, বাঙালিরা অন্তত মর্মে মর্মে বোঝেন। বাংলার বাইরে, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে, বাঙালিরা সাধারণত ‘বাবু’ ও ‘বিদ্বান’ বলে পরিচিত। ‘বিদ্বান’ বলে বাঙালির অহংকারও আছে। তার জন্য তাঁরা সর্বত্র সম্মানিতও হন। সুতরাং চাণক্যের কথা তাঁদের পক্ষেই সর্বাগ্রে হৃদয়ঙ্গম করা স্বাভাবিক। বিদ্বান যে সর্বত্র পূজিত হন, তার ঐতিহাসিক সাক্ষী সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাচীন বাঙালি সমাজ। কথায় বলে, বাঙালির শ্রেষ্ঠ বল বুদ্ধির বল, বিদ্যার বল,—অর্থের বল নয়। প্রধানত এই বিদ্যাবুদ্ধির বলে বলীয়ান হয়ে, সেকালের দু—একজন পণ্ডিতের মতো, একালের বিদ্বান বাঙালীরা যে দলে—দলে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তা নয়, বাণিজ্যের বলেও অনেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। পরে বংশানুক্রমে পণ্যের বাণিজ্য বিদ্যার বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। সেকালের দু—একজন পণ্ডিতের মতো বলেছি, কারণ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো পণ্ডিত সংখ্যায় খুব বেশি ছিলেন না। একালের শিক্ষিত বাঙালি সংখ্যায় অনেক বেশি। সেকালের বাঙালি পণ্ডিতসমাজ, আর একালের বাঙালি বিদ্বৎসমাজের মধ্যে পার্থক্য দু—দিক থেকেই আছে, গুণের দিক থেকে এবং সংখ্যার দিক থেকে। একালে বাঙালিরাই সর্বপ্রথম আধুনিক ‘বিদ্বান’ হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সবচেয়ে বেশি পান। বিদ্বান বাঙালির সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে এবং কেবল স্বদেশে নয়, বাংলার বাইরেও তাঁরা জয়যাত্রা করেন। চাণক্যের বাক্য তাঁদের জীবনে সত্য হয়ে ওঠে। অবশ্য নবযুগের রাজা ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পোষকতায়।

চাণক্যের বাক্যের চাকচিক্য বাইরে যতটা আছে, অন্তঃসার ততটা নেই। ইতিহাসে অন্তত তার প্রমাণ নেই। ইতিহাসে দেখা যায়, স্বদেশে পূজিত হন রাজা এবং বিদ্বান প্রথমে রাজার পূজা করে পরে দেশপূজ্য হন। রাজা যাঁকে সম্মানিত করেন, প্রজারাও তাঁকে মর্যাদা দেন। রাজসম্মান আগে, প্রজার সম্মান পরে। চাণক্য যে—যুগের কথা বলেছেন, সে—যুগে সাধারণ মানুষের স্বতন্ত্রভাবে কাউকে সম্মানিত করবার অধিকারই ছিল না। বিদ্যা পাণ্ডিত্য প্রতিভা সবই রাজস্বীকৃতির মুখাপেক্ষী ছিল। রাজসভার বাইরে, অথবা রাজার অমাত্য—আমলাগোষ্ঠীর বাইরে তার বিশেষ কোনো মূল্য ছিল না। বিদ্যার অধিকারও ছিল জাতিগত ও কুলগত। সেকালের পণ্ডিতসমাজ এই বিশেষ জাতি ও কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। বিদ্যা বা পাণ্ডিত্যের চেয়ে কুল—কৌলীন্যের মর্যাদা ছিল তাঁদের বেশি। সাধারণ সমাজের কাছ থেকে তাঁরা যে মর্যাদা পেতেন, তা প্রধানত কুলকৌলীন্যের মর্যাদা। ব্রাহ্মণ সকলের পূজ্য এবং সর্বাগ্রে পূজ্য, পণ্ডিত হন বা না হন। পণ্ডিত হলে সকলের তিনি ‘পণ্ডিতমশাই’, কিন্তু প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয় তিনি ব্রাহ্মণ বলে। ব্রাহ্মণপণ্ডিতের বংশধর গণ্ডমূর্খ হলেও প্রণম্য এবং পণ্ডিতের তুল্য পূজনীয়। সুতরাং সেকালের পণ্ডিতসমাজ দেশের ও দশের কাছে যে সমাদর ও সম্মান পেতেন, তার অনেকটাই কুলগত। কেবল পাণ্ডিত্যের খাতিরে সম্মান পাওয়া তখনকার সমাজে সম্ভব ছিল না এবং পণ্ডিত বা বিদ্বান হওয়ারও সুযোগ ছিল না সকলের।

‘কাল বলতে ছিল সেকাল’ এবং ‘সেকালে সবই ভাল ছিল’—এই যাঁদের বদ্ধমূল ধারণা, তাঁরা হয়তো এখনই বেদ উপনিষদ পুরাণ রামায়ণ মহাভারত থেকে দৃষ্টান্ত উদধৃত করে আমার এই যুক্তি খণ্ডন করতে চাইবেন এবং বলবেন যে শূদ্রদেরও সেকালে বিদ্যার অধিকার ছিল, অব্রাহ্মণদের মধ্যেও অনেকে পণ্ডিত ছিলেন, এবং তাঁরা সমাজে সমাদৃতও হতেন। উপনিষদে দেখা যায়, অনেক গূঢ়তত্ত্ব ক্ষত্রিয়দেরই শুধু জানা ছিল এবং ব্রাহ্মণরা তাঁদের শিষ্যত্ব স্বীকার করে সেই সব তত্ত্বজ্ঞান লাভ করতেন। মহাভারতে দেখা যায়, শূদ্রাগর্ভজাত মহামতি বিদূরের জ্ঞানবিদ্যার তুলনা নেই। তিনি সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। সূতজাতীয় লোমহর্ষণ, সঞ্জয় এবং সৌতির জ্ঞানও কম ছিল না। সৌতি মহাভারতের প্রচারক ছিলেন। এরকম বিচ্ছিন্ন অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিন্তু এরকম উদাহরণ কয়েকটি একত্র করে সেযুগের কোনো নির্দিষ্ট সমাজনীতি রচনা করা যায় না। সমাজ—অনুসৃত প্রচলিত প্রথা ও রীতির মধ্যেই প্রত্যেক যুগের সমাজনীতি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। সেই প্রথা অনুযায়ী সেযুগে শূদ্রের শাস্ত্রবিদ্যায় অধিকার ছিল না। মহামতি বিদূরই একথা একবার তত্ত্বালোচনা প্রসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বিদূরের কাছে নানাবিধ নীতিবাক্য শুনে ধৃতরাষ্ট্র মুগ্ধ হয়ে বলেন : ‘আরও যদি কিছু বলবার থাকে, বলো শুনি।’ বিদূর বলেন : ‘রাজন! সনৎকুমার বলেছেন, মৃত্যু বলে কিছু নেই। তিনিই আপনাকে সেই গূঢ়তত্ত্ব বুঝিয়ে দেবেন’। ধৃতরাষ্ট্র বলেন, ‘কেন, তুমি কি জান না? যদি জান তো তুমি বলো।’ বিদূর উত্তর দিলেন : ‘আমি শূদ্রার গর্ভে জন্মেছি, জানলেও আমি প্রকাশ করতে পারব না। ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করে অতি গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ করলেও, দেবতাদের নিন্দনীয় হতে হয় না।’ বিদূর সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বলেই সমাজনীতিজ্ঞও ছিলেন। তাই তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে শূদ্র যদি দৈবক্রমে পণ্ডিতও হয়, তাহলেও সমাজে তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করার কোনো অধিকার নেই। এই ছিল সেকালের সমাজনীতি। সেকালের পণ্ডিতসমাজ বলতে ব্রাহ্মণসমাজকেই বোঝাত এবং পাণ্ডিত্য ও ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। কুলমহিমা থেকে বিচ্ছিন্ন পাণ্ডিত্যের স্বতন্ত্র কোনো মর্যাদা লোকসমাজে স্বীকৃত হত না। কুলকৌলীন্য ছিল মুখ্য, বিদ্যাগৌরব ছিল গৌণ।

মহামতি বিদূরের যুগ থেকে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুগ পর্যন্ত জ্ঞান—বিদ্যার ক্ষেত্রে এই কুলাধিপত্যই প্রায় অপ্রতিহত ছিল বলা চলে। বিদ্যাসাগরের যুগের আগেই অবশ্য এই একচ্ছত্র কুলাধিকারের দুর্গ—প্রাকারে আঘাত হানা আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে সংস্কৃত কলেজ কলকাতা শহরে স্থাপন করেছিলেন, সেখানেও ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানদের ছাড়া অন্য কারও পড়বার অধিকার ছিল না। শাসনশৃঙ্খলার স্বার্থেই চিরাচরিত সামাজিক কুসংস্কারের সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘকাল আপস করে চলেছিলেন। সংস্কৃত—শিক্ষা সম্পর্কিত কুলগত সংস্কার ইংরেজরাও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অবশেষে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকেই এই সংস্কার দূর করতে হল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে কায়স্থদের এবং পরে ১৮৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অন্যান্য জাতির হিন্দুদের সংস্কৃতবিদ্যা শিক্ষার অধিকার দান করেন।* সুতরাং বিদূরের যুগ পর্যন্ত যাবার প্রয়োজন নেই, বিদ্যাসাগরের যুগ পর্যন্তই যথেষ্ট। বিদ্যার ক্ষেত্রে কুলাধিকার ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ভাঙতে আরম্ভ করে বাংলাদেশে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকেও বলা যেতে পারে। বিদ্বৎ—সমাজের সীমানা ব্রাহ্মণবৈদ্যসমাজের বাইরে ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকে। নবযুগের বাংলার নতুন বিদ্বৎসমাজের বিকাশ হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ব্রাহ্মণপ্রধান পণ্ডিতসমাজের সঙ্গে নবযুগের বাংলার এই বিদ্বৎসমাজের চরিত্রগত পার্থক্য ঐতিহাসিক, একথা স্বীকার করতেই হবে।

বাংলার বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ধারা সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ করার আগে আরও একটু অবতরণিকার প্রয়োজন আছে। ইংরেজিতে ‘intelligentsia’ বলে যে কথা আছে, তা রুশদের প্রবর্তিত। ‘ইন্টলিজেনসিয়ার’ বাংলা প্রতিশব্দ আমি ‘বিদ্বৎসমাজ’ করেছি। ‘শ্রেণি’ বলে সূচিত না করার কারণ আছে। সমাজবিজ্ঞানে ‘শ্রেণি’ কথার একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। ‘শ্রেণিচেতনা’ মূলত আর্থনীতিক স্বার্থের একতাবোধ থেকে উদবুদ্ধ হয়। কেবল কার্ল মার্কস নন, একথা তাঁর পরবর্তী ভিন্নমতাবলম্বী সমাজবিজ্ঞানীরাও মোটামুটি স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি। ম্যাক্স হেব্বার (Max Weber) মার্কসীয় সমাজনীতির অনেক সূত্রই অভ্রান্ত বলে মেনে নেননি। ‘শ্রেণি’ সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি  ‘class situation’, ‘status group’ ইত্যাদি অনেক প্রকারের গোষ্ঠীচেতনাবোধের সূক্ষ্ম বিচার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ফলে শেষপর্যন্ত সামাজিক ‘শ্রেণি’ ও আর্থনীতির স্বার্থের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। অবশেষে তিনি ‘শ্রেণির’ সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন এভাবে :

We may speak of a ‘class’ when (1) a number of people have in common a specific causal component of their life chances, in so far as (2) this component is represented exclusively by economic interests in the possession of goods and opportunities for income….

এ—ব্যাখ্যার মধ্যে বাক্যবিন্যাস ও বাচনভঙ্গির কৌশলটাই বড় হয়ে উঠেছে, বক্তব্য তেমন প্রাঞ্জল হয়নি। মার্কস এরকম কোনো কৌশলের আশ্রয় নেবার প্রয়োজনবোধ করেননি। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট লোকের স্বার্থচেতনা দিয়ে তিনি ‘শ্রেণি’ শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অনেক বেশি সহজবোধ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানী নানাবিধ বাক্য প্রয়োগে ‘শ্রেণি’ কথার ব্যাখ্যা করে, এক একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তার কারণ, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণপদ্ধতি ভিন্ন হলেও, যদিও সে—পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তাহলে তার ফলাফল ভিন্ন হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রেও প্রায় তাই হয়েছে। ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ বা বিদ্বানদের কোনো সমাজবিজ্ঞানীই স্বতন্ত্র শ্রেণিমর্যাদা (class-status) দেননি, কেউ ‘গ্রুপ স্টেটাস’ কেউ ‘কমিউনিটি স্টেটাস’ দিয়েছেন। কার্ল মার্কস ‘বিদ্বৎজনদের’ মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে তাঁদের ঐতিহাসিক চরিত্রের সুস্থিরতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সাধারণভাবে ‘মধ্যশ্রেণি’ সম্বন্ধে তিনি গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে গেছেন। অবশ্য তার পরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং মধ্যশ্রেণির বিভিন্ন স্তরের মধ্যে মনোভাবের তারতম্যও সর্বক্ষেত্রে ফুটে উঠেছে। বিদ্বৎজনেরাও এই পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সেকথা পরে বিবেচ্য। আপাতত দেখা যাচ্ছে যে বিদ্বৎজনেরা কোনো স্বতন্ত্র ‘শ্রেণি’ নন এবং এ—সম্বন্ধে সকলমতের সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রায় একমত। আলফ্রেড হেব্বার ‘freischwebende intelligenz’—এর কথা বলেছেন, অর্থাৎ ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ মানে ‘socially unattached free intelligentsia’ এ যুগের আর—একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহাইম ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ সম্পর্কে বলেছেন—‘This unanchored, relatively classless stratum’, রবার্টো মিচেলস বলেছেন—‘intellectuals are the officers and subalterns of all arms and of all armies’ ঐতিহাসিক টয়েনবি কালসমুদ্র মন্থন করে শেষ পর্যন্ত একটি বিষের পাত্র বিদ্বৎজনদের সামনে তুলে ধরে বলেছেন—‘an intelligentsia is born to be unhappy’ এবং কটাক্ষ করে বলেছেন—‘the intelligentsia is a class of liason officers.’

সহজ ভাষায়, বিদ্বৎজনের অবস্থা হল, ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে, যেজন আছে মাঝখানে,’ কতকটা তার মতো সারাজীবন সাধ্যমতো বিদ্যার কেরামতি দেখিয়ে সমাজের কাছ থেকে তিনি যা পান, তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন না। শেষ—জীবনে তাঁর মনে হয়, সমাজের তরী যেন তাঁকে তীরে নিক্ষেপ করে, পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে চলে গেছে। সমাজের মধ্যে থেকেও তিনি যেন এক জনমানবশূন্য দ্বীপে নির্বাসিত। একথা যত মনে হয় তত অতৃপ্তি বাড়ে, আক্রোশ বাড়ে, অভিমান বাড়ে। বিদ্বৎজনদের এই অতৃপ্তিকে টয়েনবি তাই ‘congenital unhappiness’ বলতেও কুণ্ঠিত হননি।

এ—হেন বিদ্বৎজনদের কেবল আর্থনীতিক স্বার্থে শ্রেণিবদ্ধ করা যুক্তিসংগত নয় বলে আমি তাঁদের ‘সমাজ’—বদ্ধ করেছি। ঠিক শ্রেণিচেতনা বলে কিছু না থাকলেও, তাঁদের গোষ্ঠীচেতনা বলে কিছু আছে মনে হয়। সেটা শিক্ষার চেতনা, বিদ্যার্জনের চেতনা। সমাজবদ্ধতার দিক থেকে এই চেতনার অবশ্যই মূল্য আছে। একে একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। বিজ্ঞানীরাও করেননি। কার্ল ম্যানহাইম এই চেতনার বন্ধনশক্তি সম্বন্ধে বলেছেন :

Although they are too differentiated to be regarded as a single class, there is, however, one unifying sociological bond between all groups of intellectuals namely education, which binds them together in a striking way.

‘আমরা কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছি এবং সেই শিক্ষাকে সমাজের কাজে নিয়োগ করেছি’—এ—বোধ সর্বস্তরের বিদ্বানদের মধ্যে আছে। সাধারণ গ্রাম্য স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক সাহিত্যিক সাংবাদিক বৈজ্ঞানিক, একনিষ্ঠ জ্ঞানতপস্বী সকলের প্রধান বিদ্যার্জনের একটা একানুভূতি আছে। এই একানুভূতি থেকে সকল স্তরের বিদ্বৎজনের মধ্যে একটা সহানুভূতির ভাব সঞ্চারিত হয়। এই সহানুভূতি থেকেই তাঁদের মধ্যে ‘সমাজ’—বোধ আছে। ব্রাহ্মণসমাজ বৈদ্যসমাজ কায়স্থসমাজ যেমন ‘কমিউনিটি’—বোধ থেকে গড়ে ওঠে (শ্রেণিবোধ থেকে নয়), বিদ্বৎসমাজেরও কতকটা সেইরকম বিকাশ হয়। ‘সমাজ’ কথার এই অর্থে, বিদ্বৎজনদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ‘বিদ্বৎসমাজের’ কথা ভাবা যেতে পারে। বাংলার বিদ্বৎসমাজের কথা ভাবলেও ভুল হয় না। ‘Officers and Subalterns of all arms and of all armies’-এর মধ্যে শ্রেণিগত ঐক্য না থাকলেও, সমাজগত একতাবোধ থাকতে বাধা নেই। বৈদ্যসমাজে যেমন ‘প্রলেটারিয়েট’ বৈদ্যের প্রতি ‘ক্যাপিটালিস্ট’ বৈদ্যের একটা অদৃশ্য সহানুভূতি থাকে, ব্রাহ্মণসমাজে যেমন সব ব্রাহ্মণের সমান class status না থাকা সত্ত্বেও একটা সমাজবোধ থাকে, বিদ্বৎসমাজেও তেমনি অফিসার ও সাব—অল্টার্ন, ক্যাপ্টেন ও জমাদার, গোলন্দাজ ও পদাতিক, সর্বস্তরের মধ্যে, শ্রেণিবৈষম্য থাকা সত্ত্বেও স্বচ্ছন্দে একটা সমাজবোধের বন্ধন থাকতে পারে এবং আছেও। তবে এই সমাজবোধের বন্ধন যে শ্রেণিবোধের বন্ধনের তুলনায় অনেক বেশি শিথিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এখন প্রশ্ন হল, বিদ্বৎসমাজের অন্তর্ভুক্ত হবেন কারা? কিসের মাপকাঠিতে তাঁদের বিদ্বৎসমাজের মধ্যে গণ্য করা হবে? যে—বিদ্বৎজনদের নিয়ে ‘বিদ্বৎসমাজ’ গঠিত, সেই বিদ্বৎজন কাদের বলব? আলোচনা করতে হলে, ‘বিদ্বৎজন’ সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট নির্দিষ্ট ধারণা থাকা দরকার, কোনো অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায় না। ‘শিক্ষা’ যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে স্বপ্নশিক্ষিত থেকে উচ্চশিক্ষিত সকলেই কি ‘বিদ্বৎজন’? তার চেয়েও বড় কথা, শিক্ষিত বা বিদ্বান ব্যক্তি মাত্রেই বিদ্বৎসমাজভুক্ত হবার যোগ্য কি না?

রবার্টো মিচেলস ‘বিদ্বৎজন’ কথার ব্যাখ্যা করেছেন ঘুরিয়ে। তিনি বলেছেন:

Intellectuals are persons possessing knowledge or in a narrower sense those whose judgement, based on reflection and knowledge, derives less directly and exclusively from sensory perception then in the case of non-intellectuals.

অর্থাৎ, প্রকৃত বিদ্বৎজন তাঁরাই, যাঁরা বিচার—বিশ্লেষণে, চিন্তাশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দেন বেশি, এবং সাধারণ ব্যক্তির তুলনায় প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়গোচর জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল অনেক কম। পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে যাঁরা জ্ঞানলাভ করেন, তাঁরা স্থূল সাধারণ ব্যক্তি। আর যাঁরা ষষ্ঠেন্দ্রিয় ‘মগজের’ সাহায্যে চিন্তা ও মনন করে জ্ঞানবৃদ্ধি করেন, তাঁরাই বিদ্বৎজন। আমাদের ঘরোয়া আটপৌরে কথায় বলা যায়, চোর পালালে যাঁদের বুদ্ধি বাড়ে তাঁরা বুদ্ধিমান নন, চোরের চিন্তায় যাঁদের বুদ্ধি বাড়ে, যাঁরা চুরির দুর্ভোগ ভোগেন না, তাঁরাই প্রকৃত ‘বুদ্ধিমান’। ঠেকে বা ঠকে না শিখে যাঁরা ভেবেচিন্তে শেখেন, মিচেলের মতে, তাঁরাই ‘ইন্টিলেকচ্যুয়াল’ বলে গণ্য হবার যোগ্য। মিচেলের এই ডেফিনিশন, মনে হয়, নিতান্তই ‘টেকনিক্যাল’ এবং অত্যন্ত ‘ফর্মাল’। ব্যাখ্যা ভুল না হলেও, ব্যাখ্যানের ভঙ্গিমায় বিভ্রান্তির সম্ভাবনা বেশি। বরং কার্ল ম্যানহাইম অনেকটা সহজবোধ্য ভাষায় একথার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন :

In every society there are social groups whose special task it is to provide an interpretation of the world for that society. We can these the intelligentsia.’

প্রত্যেক সমাজে নানাগোষ্ঠীভুক্ত এমন কিছু লোক থাকেন, যাঁদের কাজ হল সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি রচনা করা এবং ব্যাখ্যা করা। যাঁরা সমাজের এই জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করেন, তাঁরাই বিদ্বৎসমাজের অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্য। তাঁরাই প্রকৃত বিদ্বৎজন।

এদিক থেকে বিচার করলে কেবল বিদ্যার মানদণ্ড দিয়ে বিদ্বৎজনের বিচার করা যায় না। অ্যাকাডেমিসিয়ান, অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা রত্ন, এঁরা ‘টিপিক্যাল’ বিদ্বৎজন বলে গণ্য হলেও, মিচেলের ভাষায় বলা যায়—‘It would be wrong to define intellectuals in terms of academic examinations.’ পরীক্ষায় কৃতী ছাত্র যদি ডেপুটি বা সিবিলিয়ান হন এবং কেবল চাকরিই করেন, তাহলে তিনি আমাদের এই সংজ্ঞা অনুসারে ‘বিদ্বৎজন’ নন। সিবিলিয়ান ইন্টিলেকচ্যুয়াল নন শুনলে অনেকে হয়তো স্তম্ভিত হবেন। কিন্তু কথাটা পরিষ্কার করে বোঝার প্রয়োজন আছে। সিবিলিয়ান বা ডেপুটি যদি চাকরি করেও বিদ্যাচর্চা করেন, মনন করেন, সামাজিক জীবনে তার প্রয়োগ করেন, তাহলে তিনি ‘বিদ্বৎজন’। অর্থাৎ সামাজিক অর্থে ‘বিদ্বৎজন’। সামান্য একজন স্বল্পবেতনের কেরানি যদি মানসিক সংগ্রামে, আদর্শগত সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাহলে নিষ্ক্রিয় সিবিলিয়ান অথবা অকর্মণ্য ডেপুটির তুলনায় ‘বিদ্বৎজন’ বলে গণ্য হবার দাবি তাঁর অনেক বেশি। ধনবিজ্ঞানের ফার্স্ট—ক্লাস—ফার্স্ট কোনো ছাত্র যদি পরবর্তী জীবনে পাটের ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজ পরিবারে বা পরিচিত মহলে ‘বিদ্বৎজন’ বলে গণ্য হলেও, সমাজের কাছে তিনি ‘বিদ্বৎজন’ বলে গণ্য হবার যোগ্য নন। বিদ্বান হলেই বিদ্বৎসমাজভুক্ত হয় না। পাঠশালা পর্যন্ত পড়েছে এরকম self-educated কোনো সাহিত্যিক অনেক উচ্চশিক্ষিত চিন্তালস অ্যাকাডেমিসিয়ানের চেয়ে দেশের বিদ্বৎসমাজের মধ্যে অগ্রগণ্য প্রভাবশালী ব্যক্তি হতে পারেন। ‘শিক্ষিত’ আর ‘বিদ্বৎজন’ এক নন। ‘বিদ্যার ভুড়ভুড়ি’ বলে একটা কথা আছে আমাদের দেশে। মহাবিদ্বান কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দিয়ে তলিয়ে থাকেন এবং কেবল ভুড়ভুড়ি কাটেন, যদি তাঁকে দেখা না যায়, তাঁর চিন্তা ভাবনার কথা জানা না যায়, তাহলে তিনি জ্ঞানতপস্বী ‘স্কলার’ হলে, সামাজিক অর্থে ‘ইন্টিলেকচ্যুয়াল’ নন। মিচেলস তাই বলেছেন :

…those who have merely accumulated knowledge are not true intellectuals. The scholar must possess priestly qualities and fulfil priestly functions, including political activity. His knowledge, as Fichte says, ‘should be truly applied for society’s use…’

এর মধ্যে ‘priestly qualities’ এবং ‘priestly functions’ কথা দুটির গুরুত্ব খুব বেশি। অধীত ও অর্জিত বিদ্যা নিয়ে ‘স্কলার’ হওয়া যায়, কিন্তু ‘ইন্টিলেকচ্যুয়াল’ হওয়া যায় না। পুরোহিতের গুণ থাকা চাই, পুরোহিতের কর্তব্য করা চাই, তবে বিদ্বৎজন হওয়া হওয়া সম্ভব। পুরোহিতের গুণ কি, কর্তব্যই বা কি? প্রাচীন ও মধ্যযুগের সমাজে পুরোহিতের কাজ ছিল, সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে পরিচালিত করা, তাদের মানব ক্ষুধাতৃষ্ণা (পেটের নয়) পরিতৃপ্ত করা। সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা তখন ধর্মজিজ্ঞাসা ও অধ্যাত্মচিন্তার বাঁধা সড়কে চালিত হত। পুরোহিতের কর্তব্য ছিল, এই বাঁধা সড়কটি পাহারা দেওয়া। তার জন্য তিনি শাস্ত্রবিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যা আয়ত্ত করতেন, এবং সামাজিক চিন্তা গতানুগতিক সড়কটি পাহারা দিয়ে তাঁর কর্তব্য পালন করতেন। গৃহে বসে কেবল শাস্ত্রাধ্যয়ন করে তাঁর কর্তব্য শেষ হত না। একালের বিদ্বৎজনের কর্তব্য সেকালের পুরোহিতের কর্তব্যের অনুরূপ। বিদ্বান হয়ে এই কর্তব্য পালন যদি তিনি না করেন, তাহলে তিনি বিদ্বৎসমাজের একজন বলে গণ্য হবেন না। সমাজের চিন্তাধারাকে যিনি পরিচালিত করতে চেষ্টা করেন, নিজে চিন্তা করে অন্যের চিন্তার উদ্রেক করেন এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানবিদ্যা আয়ত্ত করতে কুণ্ঠিত হন না, তিনিই আদর্শ বিদ্বৎজন। উচ্চশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত আত্মশিক্ষিত ও আজীবন শিক্ষার্থী, সকলেই এই অর্থে বিদ্বৎসমাজের মধ্যে গণ্য হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। মিচেলস—এর মতে এঁরা সকলেই বিদ্বৎজন বা ইন্টিলেকচ্যুয়াল—

In so far as they assimilate the materials of knowledge and employ them in mental labour, in so far as they are vocationally concerned with things of the mind.

শেষ কথাটিই সবচেয়ে সহজ—‘vocationally concerned with things of the mind’ যিনি, তিনিই intellectual হবার যোগ্য। সমাজের হাটে যিনি নিজের মনন ও মানুষের মন নিয়ে কারবার করেন, তিনিই বিদ্বৎজন এবং দেশের বিদ্বৎসমাজের একজন। তা যিনি করেন না, তিনি বিদ্বান হতে পারেন, কিন্তু বিদ্বৎসমাজের একজন বলে গণ্য হবার যোগ্য নন।

বিদ্বৎজনের প্রধান কাজ হল তাহলে, সমাজের চিন্তাধারাকে পরিচালিত করা, সামাজিক নীতি আদর্শ ও জীবনদর্শন ব্যাখ্যা করা, বুঝিয়ে দেওয়া। সমাজ যত স্থিতিশীল হয়, সামাজিক গড়ন যত অচলায়তনের মতো অটল অনড় হয়ে ওঠে, ততই বিদ্বৎজনদের স্তরটি সীমাবদ্ধ ও সুনির্দিষ্ট হতে থাকে এবং ক্রমে বিদ্বৎসমাজ একটি সামাজিক ‘জাতিতে’ পরিণত হয়। আদিম সমাজের জাদুকর থেকে মধ্যযুগের সমাজের পুরোহিত যাজকসম্প্রদায় ও পণ্ডিতসমাজ পর্যন্ত তার ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের দেশে তাই সেকালে ব্রাহ্মণসমাজে ও পণ্ডিতসমাজে কোনো পার্থক্য ছিল না। ‘ব্রাহ্মণ’ বলতে ‘পণ্ডিত’ এবং ‘পণ্ডিত’ বলতে ‘ব্রাহ্মণ’ বোঝাত। বিদ্বৎসমাজ যখন জাতিগত মর্যাদা পেতেন তখন সমাজমানসের উপর তাঁরা সহজেই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারতেন। তাঁদের নিজেদের চিন্তাধারা ও জ্ঞানবিদ্যাও ক্রমে সংকীর্ণ ও প্রাণহীন হয়ে উঠত। প্রত্যক্ষ সমাজ—জীবনের সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও প্রশ্নের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকত না। সমাজবিচ্ছিন্ন চিরায়ত্ত বিদ্যা ‘স্কলাষ্টিক’ ও ‘অ্যাকাডেমিক’ হতে বাধ্য। ম্যানহাইম একে  ‘monopolistic type of thought’ বলেছেন। এর প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, ‘scholasticism’—এ পরিণতি। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, সমাজ—বিচ্ছিন্নতা, ম্যানহাইমের ভাষায়—‘its relative remoteness from the open conflicts of everyday life’. এই কারণেও এই জাতীয় বিদ্যা ও চিন্তাধারা ক্রমে ‘scholastic’ ও ‘academic’ হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে ম্যানহাইমের উক্তি প্রণিধেয় বলে উদ্ধৃত করছি :

This type of thought does not arise primarily from the struggle with concrete problems of life, nor from trial and error, nor from experience in mastering nature and society, but rather much more from its own need for systematisation, which always refers the facts which emerge in the religious as well as in other spheres of life, back to given traditional and intellectually controlled premises.

চিন্তার উদ্রেক হয় প্রত্যক্ষ জীবনসংগ্রাম থেকে। জীবনসংগ্রাম কেবল জীবিকা—সংগ্রাম নয়, একথা মনে রাখা দরকার। জীবনের ও সমাজের নানাবিধ সমস্যার ঘাতপ্রতিঘাতে চিন্তাতরঙ্গের সৃষ্টি হয়। ম্যানহাইম বলেছেন, ‘স্কলাষ্টিক’ চিন্তা এরকম কোনো জীবনসমস্যার প্রত্যক্ষ ঘাতপ্রতিঘাত থেকে সৃষ্টি হয় না। সমাজ—জীবন থেকে সে—চিন্তা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এমনকী প্রাকৃতিক জীবন থেকেও। ভুলভ্রান্তি পরীক্ষা—নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে চিন্তাধারার পুনর্জীবনলাভের সম্ভাবনা থাকে না। প্রধানত নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার খাতিরে সেই চিন্তা ও বিদ্যা ‘শাস্ত্রের’ মধ্যে দৃঢ়বিন্যস্ত করার প্রয়োজন হয় বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে নয়। সেই শাস্ত্রবিদ্যা দিয়ে চিরদিন একভাবে সব সমস্যা ও প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করা হয়। এই কাজই সেকালের পণ্ডিতসমাজ করতেন। সেকালের স্থিতিশীল অচল অটল সমাজের তাঁরা ছিলেন যোগ্য প্রতিনিধি ও মুখপাত্র। পণ্ডিতসমাজের যেমন, পাণ্ডিত্যেরও তেমনি কোনো পরিবর্তন হত না। সমাজ, সমাজের পণ্ডিত, পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য, সবই ছিল স্থিতিশীল গতানুগতিক।

একালের বিদ্বৎসমাজের বিকাশ হল সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক পরিবেশে। ধনদৌলত ও বাণিজ্যের অবাধ মুক্তি—অভিযানের দিনে বিদ্যার ও বিদ্বানের নতুন জয়যাত্রা শুরু হল। অবাধ বাণিজ্য ও ধনতন্ত্রের প্রাথমিক অগ্রগতির সঙ্গে আবির্ভাব হল নতুন প্রগতিশীল বিদ্বৎসমাজের। তাঁরা যে বিদ্যার সাধনা করতে লাগলেন, তার সবচেয়ে বড় আদর্শ হল প্রখর বিচারবুদ্ধি, নির্মল যুক্তি ও উদার মানবমূল্যবোধ।  Nobilitas নয় Humanitas হল নবযুগের আদর্শ। নতুন জ্ঞানবিদ্যাকে বলা হত ‘হিউম্যানিস্ট’ বিদ্যা। এই হিউম্যানিজম কী? অনেকে এই ‘হিউম্যানিজম’ কথার ভুল অর্থ করে থাকেন। ‘মানবতাবোধ’ বলতে আমরা যা বুঝি, ‘হিউম্যানিজম’ ঠিক তা নয়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড ফন মার্টিন এই ‘হিউম্যানিজম’ সম্বন্ধে বলেছেন :

Humanism here represented an ideology which played a closely defined part in the bourgeoisie’s struggle for emancipation and power. The concept of a ‘humanist’ knowledge concerned with truths applicable to humanity in general, with an ethical system based upon personal virtus (i.e., the ability gained by an individual’s own endeavour), implies the negation of all privileges based upon birth and Estate, it implies the negation of the belief in supranatural powers which had been taught by the clergy…

উদীয়মান ধনিক—বণিকশ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ হল ‘হিউম্যানিজম’। হিউম্যানিস্ট জ্ঞান সেই সত্যের জ্ঞান, যা সমগ্র মানবসমাজে প্রযোজ্য। হিউম্যানিজম জন্মগত ও জমিদারিগত কোনো সামাজিক অধিকারে ও ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। ‘জমিদারিগত’ অধিকার আর ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির’ অধিকার অভিন্ন নয়। ‘জমিদারিগত’ কথাটি সেইজন্য আমি ব্যবহার করেছি। জমিদারি স্বোপার্জিত সম্পত্তি নয়, সম্রাটের নিজস্ব স্বার্থে উপহার—দেওয়া সম্পত্তি, লুটতরাজ করা সম্পত্তি। জমিদারির আয় প্রধানত ‘unearned income’, ব্যক্তিগত কায়িক বা মানসিক মেহনতের আয় নয়। বংশানুক্রমে জমিদারি ভোগ করা হয়। জমিদারের মর্যাদা জমিদারির জন্য, ব্যক্তিগত কৃতিত্বের জন্য নয়। ক্যাপিটালিস্ট তা নন। ‘Surplus value’ মুনাফারূপে আত্মসাৎ করে যতই তিনি ধনিক হন না কেন, ‘এনট্রেপ্রেনার’ হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত বুদ্ধি সাহস মেহনত, সবকিছুর মূল্য আছে, অন্তত ধনতন্ত্রের অভ্যুদয়পর্বে। জমিদারের জন্মগত অধিকার ছাড়া কিছু নেই। জমিদারের মতো, সেকালের সমাজে বিদ্যারও জন্মগত ও বংশগত অধিকারটা বড় ছিল। সে যুগে ধনপতি সদাগরদের যেমন কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না, তেমনি কোনো অব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যও স্বীকার হত না। নবযুগের ‘হিউম্যানিজম’ এই বংশগত ও বৃত্তিগত অধিকার অস্বীকার করে, সর্বক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও ক্ষমতাকে খানিকটা অন্তত স্বীকৃতি দিল। হিউম্যানিজমের মূলমন্ত্র হল ব্যক্তিমর্যাদা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। কুলকৌলীন্য নয়, ব্যক্তিগত ‘achievement’ হল নবযুগের সামাজিক মর্যাদার প্রধান মানদণ্ড। বিত্তের ক্ষেত্রে যেমন, বিদ্যার ক্ষেত্রেও তেমনি এই ব্যক্তিগত ‘achievement’ এর মানদণ্ড বড় হয়ে উঠল। পুরাতন পণ্ডিতসমাজ ভেঙে, নানাজাতিবর্ণের বিদ্বানদের নিয়ে নতুন বিদ্বৎসমাজ গড়ে উঠতে থাকল। বাংলাদেশে ঊনবিংশ শতাব্দী হল এই নবযুগের বিদ্বৎসমাজের বিকাশের কাল। ‘হিউম্যানিজম’ এবং ব্যক্তিগত ‘এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘অ্যাচিভমেন্ট’ তাই দেখা যায় নবযুগের বাঙালি বিদ্বৎসমাজেরও মূলমন্ত্র।

নতুন সামাজিক পরিবেশে বিদ্বৎজন বাছাইয়ের এই নতুন মানদণ্ডের আলোচনা প্রসঙ্গে কার্ল ম্যানহাইম বলেছেন যে ইতিহাসে দেখা যায়, প্রধানত তিনটি নীতি অনুসারে, প্রাচীনযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, বিদ্বৎসমাজের বাছাই চলেছে। কুলকৌলীন্যের নীতি, সম্পত্তির মালিকানার নীতি এবং ব্যক্তিগত কৃতিত্বের নীতি। ক্রমে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের উপর জোর দেওয়ার দিকেই আধুনিক গণতন্ত্রের ঝোঁক বেশি। ঝোঁক বেশি বলে সেটাই একমাত্র সত্য বা মানদণ্ড হয়ে ওঠেনি। কুল ও সম্পত্তির জোর গণতন্ত্রের যুগেও আছে, কেবল ব্যক্তির গুণ বা প্রতিভাই সব নয়। ম্যানহাইমের উক্তি উদ্ধৃত করছি :

If one calls to mind the essential methods of selecting elites, which up to the present have appeared on the historical scene, three principles can be distinguished : Selection on the basis of blood, property, and achievement. Aristocratic Society….chose its elites primarily on the blood principle. Bourgeois society gradually introduced as a supplement, the principle of wealth…., It is, of course, true that the principle of achievement was combined with the two other principles in earlier periods, but it is important contribution of modern democracy (as long as it is vigorous) that the achievement principle increasingly tends to become the criterion of social success. Seen as a whole, modern democracy is a selective machinery combining all three principles.

ম্যানহাইম বলেছেন যে অভিজাত সমাজের কৌলীন্যনীতির সঙ্গে বুর্জোয়াসমাজে ‘supplement’ হিসেবে ধনাধিকারের নীতি যোগ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কৃতিত্বের নীতি যে একেবারে যুক্ত ছিল না তা নয়। ধনতান্ত্রিক সমাজের গোড়ার দিকে অন্তত ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের যুগে ক্রমেই তৃতীয় নীতি প্রবল হচ্ছে, এইটাই উল্লেখ্য। গণতন্ত্র সম্বন্ধে একথা বলেও তিনি বন্ধনীর মধ্যে ‘as long as it is vigorous’ কথাটি যোগ করতে ভোলেননি। শেষকালে বলেছেন, গণতন্ত্রের যুগে, বিদ্বৎসমাজের নির্বাচনে তিনটি নীতিরই একত্র প্রয়োগ দেখা যায়। অর্থাৎ আধুনিক যুগের আমরা যেমন বহু প্রাচীন সংস্কার একেবারে বর্জন করতে পারিনি, উত্তরাধিকারসূত্রে সাংস্কৃতিক সম্পদের সঙ্গে অনেক আবর্জনাও বহন করে চলেছি, তেমনি গণতন্ত্রের যুগেও অ্যারিস্টক্রাসির নীতি একেবারে বর্জন করতে পারিনি। আজও উচ্চবংশের ও বিত্তবানের সন্তান বিদ্বৎসমাজে যত সহজে প্রতিষ্ঠা পান, অনভিজাতবংশের দরিদ্রের সন্তান, তার চেয়ে শতগুণ বেশি যোগ্যতা ও প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তা পান না। বাংলার বিদ্বৎসমাজে এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়, বরং প্রকট বলা চলে। তার কারণ, বাংলার সমাজে ‘গণতন্ত্র’ কোনোকালেই ‘vigorous’ ছিল না, আজও নয়। গণতন্ত্রের এই বিকলাঙ্গ নির্জীব অবস্থার অন্যতম কারণ হল, বিদেশি শাসনের ঔপনিবেশিক পরিবেশে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিসদৃশ সংমিশ্রণ। স্বাধীন হবার পরেও এই মিশ্ররূপের তেমন উল্লেখ্য পরিবর্তন হয়নি, এবং গণতন্ত্রও তাতেও সজীব ও সচল হয়নি বরং অনেক নির্জীব হয়েছে এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের বদলে ফ্যাসিস্ট জনতাতন্ত্রের (mobocracy) দিকে ঝোঁক প্রবল হয়েছে।

এ ধরনের সামাজিক অসংগতি থাকা সত্ত্বেও, একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আধুনিক সমাজে ব্যক্তিগত প্রতিভা বুদ্ধি ও উদ্যমের জোরে সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠালাভের যেটুকু সুযোগ বা স্বাধীনতা আছে, আগেকার সমাজে তা একেবারেই ছিল না। প্রাচীন সমাজের বাঁধাধরা গড়ন ভেঙে দিয়ে নতুন যে সমাজবিন্যাস হতে থাকল তা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। সমাজের সমস্ত স্তর থেকে, জাতিবর্ণ—নির্বিশেষে, বিত্তবান ও বিদ্বানরা প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা পেতে থাকলেন। বিদ্বৎসমাজের সামান্য পরিবর্তন নয়, উল্লেখ্য পরিবর্তন হয়ে গেল। বাংলার সমাজে অব্রাহ্মণবংশের উচ্চশিক্ষিত বিদ্বৎজনেরা সামাজিক চিন্তাধারায় প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করলেন। মহামতি বিদুর যদি ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে একালের ধৃতরাষ্ট্রদের তিনি স্বচ্ছন্দে, শূদ্রাগর্ভজাত হয়েও, অতিগূঢ় তত্ত্বজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারতেন। সমাজের দেবতারাও নিন্দা করার সাহস পেতেন না।

এইসব ঐতিহাসিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই এদেশে নবযুগের বিদ্বৎসমাজের আবির্ভাব হল। ইংরেজরা যখন শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন, তখন সমাজে ধীরে ধীরে শাসকশ্রেণির বিদ্যার মর্যাদাই বাড়তে লাগল। মুসলমান আমলে হিন্দুরা ফারসিবিদ্যা আয়ত্ত করতে না পারলে রাজদরবারে সম্মান পেতেন না এবং সম্ভ্রান্ত বলে পরিচিত হতেন না। ইংরেজ আমলেও ক্রমে ইংরেজিবিদ্যা সেই সামাজিক মর্যাদা পেল। এই মর্যাদাদানের জন্য কেবল যে ইংরেজরাই দায়ী, তা নয়। গোড়ার দিকে তাঁরা শাসন—শোষণের চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন, এদেশের লোকের শিক্ষার দিকে তাঁদের কোনো দৃষ্টি ছিল না। দেশের লোকেরাই নিজেদের বাস্তববুদ্ধিতে ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে আরম্ভ করলেন। ইংরেজরা বরং দেশীয় শিক্ষায় প্রচলিত ধারাকে ব্যাহত করতে চাননি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে তাঁরা কাশীতে সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপন করে ছিলেন এই উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য ছিল, আদালতের কাজ চালানোর জন্য পণ্ডিত ও মৌলবি তৈরি করা। শাসনকার্যের জন্য যেটুকু আশু প্রয়োজন, তাই তাঁরা করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষা দিতে তাঁদের সংশয় ও ভয় ছিল বললেও ভুল হয় না। এদেশের লোক এবং খ্রিস্টান পাদরি সাহেবদের উদযোগই ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হতে থাকে। পাদরি সাহেবদের স্বার্থ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পথ পরিষ্কার করা এবং এদেশি লোকের স্বার্থ, ইংরেজদের অধীনে চাকরি বাকরি করা চাকরি বলতে তখন দেওয়ান মুনশি বেনিয়ান মুতসুদ্দি সরকার ইত্যাদির চাকরি বোঝাত এবং তাতে বিলক্ষণ অর্থ—সমাগম হত। ডেপুটি বা সিবিলিয়ানদের যুগ তখনও আসেনি। দেওয়ানি—বেনিয়ানি—মুতসুদ্দিগিরি করবার জন্য যত সামান্য হোক, ইংরেজি শিক্ষার দরকার হত, সংস্কৃত পাণ্ডিত্যে কাজ হত না। ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বে নতুন বাঙালি সম্ভ্রান্ত সমাজ গড়ে ওঠে প্রধানত এই দেওয়ানি—বেনিয়ানি—মুতসুদ্দিগিরি ও চলনসই ইংরেজি বিদ্যার উপর ভিত্তি করে। ইউরোপ ও আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানীরা যাঁদের বর্তমান যুগের Family-Founder বলেছেন, বাংলার সমাজে তাঁরা প্রায় সকলেই এই বৃত্তি অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। পাশ্চাত্য সমাজবিজ্ঞানীরা যেরকম Social Register তৈরি করেছেন, আমাদের দেশের প্রত্যেক পরিবারের ইতিহাস অনুসন্ধান করে যদি সেরকম কোনো রেজিস্টার তৈরি করা যেত (করতে পারলে সামাজিক ইতিহাস রচনার দিক থেকে সুবিধা হত), তাহলে এই সমাজ চিত্র আরও অনেক পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠত চোখের সামনে।১০ ইংলন্ড আমেরিকার আধুনিক যুগের প্রথম পর্বের Family Founder—দের মতো বাঙালি সম্ভ্রান্ত পরিবার—প্রতিষ্ঠাতারা ‘merchant capitalists’ ছিলেন না। শেঠ বসাক শীল মল্লিক লাহাদের মধ্যে ‘ব্যাঙ্কার’ বা ‘বেনিয়া’ ছিলেন অনেকে, কেউ কেউ স্বাধীন ব্যবসায়েও মার্চেন্ট—ক্যাপিটালিস্টদের মতো বিত্তলাভ যে করেননি, তাও নয় (যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে প্রভৃতি) কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি পরিবার ‘সম্ভ্রান্ত’ বলে গণ্য হয়েছেন, দেওয়ানি—বেনিয়ানির অর্থলাভে। সরকারি দলিলপত্র থেকে কয়েকটি পরিবারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল :১১

ঠাকুর পরিবার

বহুবিস্তৃত সমৃদ্ধিশালী পরিবার। প্রধান শাখার আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর হুইলার সাহেবের দেওয়ানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। গোপীমোহন ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি নানারকম ব্যাবসাবাণিজ্য করে সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। বিত্ত ও বিদ্যা, উভয়ক্ষেত্রে এরকম প্রতিপত্তিশালী পরিবার তখন বোধহয় আর ছিল না।

শোভাবাজারের রাজ পরিবার

পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা নবকৃষ্ণ ক্লাইভের দেওয়ান ছিলেন। এই পরিবারের গোপীমোহন দেব, রাধাকান্ত দেব এবং আরও অনেকে কলকাতার বিদ্বৎসমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন।

পাথুরিয়াঘাটার কয়েকটি পরিবার

পাথুরিয়াঘাটায় ঠাকুর—পরিবারের নানাশাখার বাস তো ছিলই, তা ছাড়াও আরও অনেক বিত্তবান পরিবারের বাস ছিল যাঁরা তখনকার বিদ্বৎসমাজে নানাভাবে প্রভুত্ব করতেন। যেমন ঘোষ—পরিবার। ঘোষপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামলোচন ঘোষ হেস্টিংসের সরকার ছিলেন। রাজা সুখময় রায়ের পরিবার। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত ক্লাইভ ও অন্যান্য গভর্নরদের বানিয়া হিসাবে বহু অর্থ উপার্জন করেন। সুখময় তাঁর দৌহিত্র, তিনি স্যার ইলাইজি ইম্পের দেওয়ানি করে প্রচুর ধনসঞ্চয় করেন। বৈদ্যনাথ রায়, শিবচন্দ্র রায়, নরসিংহ রায় প্রভৃতি বিদ্বৎসমাজে নানাভাবে প্রভুত্ব করেছেন। দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরিবার ও খুব প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। এ—ছাড়া মল্লিক শেঠ বসাক পরিবারের অনেকে এখানে বাস করতেন।

হাটখোলার দত্ত—পরিবার

এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের মধ্যে রামচন্দ্র দত্ত, জগৎরাম দত্ত প্রভৃতি কোম্পানির দেওয়ানি ও বেনিয়ানি করেছেন। মদনমোহন দত্ত ‘শিপওনার’ ছিলেন, ব্যবসায়ে যথেষ্ট ধনসঞ্চয় করেন। বাংলার বিদ্বৎসমাজে দত্তপরিবারের বিশেষ প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা ছিল।

কুমোরটুলির মিত্র—পরিবার

এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দরাম প্রাচীন কলকাতার সমাজে tyrant ছিলেন বলা চলে। ”গোবিন্দরামের ছড়ি, বনমালী সরকারের বাড়ি, অঁমিচাঁদের দাড়ি, জগৎশেঠের কড়ি”—লোকে কথায় বলত। গোবিন্দরাম কলকাতার black Deputy ও Native Zamindar বলে পরিচিত ছিলেন। কেমন ধনিকসমাজে নয়, বিদ্বৎসমাজেও মিত্র পরিবারের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। তাঁদের মধ্যে শম্ভুচন্দ্র মিত্র, কাশীশ্বর মিত্র প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।

জোড়াসাঁকোর ঘোষ—পরিবার

দেওয়ান অভয়চরণ ঘোষের পুত্র হরচন্দ্র ঘোষ এই পরিবারের গৌরব ছিলেন। বাংলার বিদ্বৎসমাজে তাঁর মতো উৎসাহী ও কৃতী পুরুষ তখন খুব বেশি ছিলেন না।

জোড়াসাঁকোর সিংহ—পরিবার

এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিরাম সিংহ পাটনার চীফ মিডলটন সাহেব ও টমাস রামবোল্ডের দেওয়ানি করে ধনবান হন। প্রাণকৃষ্ণ ও জয়কৃষ্ণ সিংহ তাঁর পুত্র। প্রাণকৃষ্ণের পুত্র রাজকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এবং জয়কৃষ্ণের পৌত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ কলকাতার বিদ্বৎসমাজে অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন।

পাইকপাড়ার সিংহ—পরিবার

প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ হেস্টিংসের আমলে কৌন্সিল ও বোর্ড অফ রেভিনিউয়ের দেওয়ান ছিলেন। এই পরিবারের অনেক খ্যাতনামা পুরুষ বাংলার বিদ্বৎসমাজে প্রভুত্ব করে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ (লালবাবু), প্রতাপচন্দ্র সিংহ, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। আজও এঁদের প্রতিপত্তি প্রায় অক্ষুণ্ণ আছে।

সিমলার দে—পরিবার

প্রতিষ্ঠাতা রামদুলাল দে ফেরারলি কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন এবং বাণিজ্যসূত্রে আমেরিকার সঙ্গে তাঁর লেনদেন ছিল। কলকাতার ধনকুবেরদের মধ্যে রামদুলাল অন্যতম ছিলেন। রামদুলালের পুত্র আশুতোষ দে বিদ্বৎসমাজে রীতিমতো প্রভুত্ব করতেন। রক্ষণশীল—শিবিরের তিনি একজন প্রধান ছিলেন।

কলুটোলার শীল—পরিবার

প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল কলকাতার বিখ্যাত ধনিক ব্যবসায়ী ছিলেন। শিক্ষার অগ্রগতির জন্য এবং সমাজ—সংস্কারের জন্য তিনি মুক্তহস্তে দান করেছেন। বিদ্বৎসমাজে পরোক্ষ প্রতিপত্তি তাঁরও যথেষ্ট ছিল।

কলুটোলার সেন—পরিবার

প্রতিষ্ঠাতা রামকমল সেন বেঙ্গল ব্যাঙ্কের দেওয়ান ছিলেন। সমসাময়িক বিদ্বৎজনদের মধ্যে তিনি বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। এই পরিবারের হরিমোহন সেন, কেশবচন্দ্র সেন, মাধবচন্দ্র সেন প্রমুখের নাম বাংলার বিদ্বৎসমাজে স্মরণীয় হয়ে আছে।

রামবাগানের দত্ত—পরিবার

বড় বড় সরকারি চাকরি করে এই পরিবার বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন কলকাতার ধনিকসমাজে। বিদ্যা ও বিত্ত উভয়ক্ষেত্রে এই পরিবারের অনেকেই অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রসময় দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দত্ত, দুই বোন তরু দত্ত ও অরু দত্তের নাম উল্লেখযোগ্য।

বহুবাজারের বন্দ্যোপাধ্যায়—পরিবার

প্রতিষ্ঠাতা হিদারাম বন্দ্যোপাধ্যায় হিকি সাহেবের ও অন্যান্য সাহেবের বেনিয়ানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর পুত্র অভয়চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্গাচরণ পিতুড়ীর দৌহিত্র অভয়চরণ এবং ভাগনে বিশ্বনাথ মতিলাল। হৃদয়রামের পৌত্র রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।

মলাঙ্গার দত্ত—পরিবার

বেনিয়ানি ও ব্যবসায়ের দ্বারা এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা অক্রুর দত্ত প্রচুর ধনলাভ করেন। এই পরিবারের রাজেন্দ্র দত্ত বিদ্বৎসমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন এবং বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। এই পরিবারের বধূ, কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী।

এখানে কলকাতা শহরের কয়েকটি বিশিষ্ট সম্ভ্রান্ত পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যে নতুন কলকাতা মহানগরীতে এইসব হিন্দু বাঙালি পরিবার বিত্ত ও বিদ্যা, উভয়ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। কলকাতার এই নতুন সম্ভ্রান্ত—সমাজই তখন বাংলার উচ্চসমাজ। সম্ভ্রান্ত ও আভিজাত্যের নতুন মানদণ্ড বিত্ত, বংশ নয়। নবযুগের এই নতুন সমাজবিন্যাসের অভিনব নিয়ন্ত্রণশক্তির ঐতিহাসিক তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মর্যাদার মূল কথা হল সামাজিক ক্ষমতা। সেকালের সমাজে এই মর্যাদা ও ক্ষমতা ছিল কুলগত, একালে হল বিত্তগত। পুরাতন কুলগত অচল সামাজিক পিরামিড দেওয়ানি—বেনিয়ানি—বাণিজ্য—চাকরিলব্ধ বিত্তের আঘাতে কিছুটা ভাঙতে আরম্ভ করল।

কুলকৌলীন্যের বদলে বিত্তকৌলীন্য বড় হয়ে উঠল সমাজে। দু—এক শতাব্দী আগে বাংলার তন্তুবণিক গন্ধবণিক সুবর্ণবণিক ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ—বৈদ্য—বহির্ভূত জাতির কেউ এরকম সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভের কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। বাণিজ্যলব্ধ বিত্তের তখন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। নতুন বাঙালি সম্ভ্রান্ত সমাজে কলকাতার শেঠ বসাক মল্লিক শীল লাহা আড্ডি সকলেই অগ্রগণ্য হয়ে উঠলেন। তাঁরাও মর্যাদা পেলেন, কারণ বাণিজ্যলব্ধ বিত্তের সামাজিক ক্ষমতা স্বীকৃত হল।

বিত্তের সঙ্গে বিদ্যারও মণিকাঞ্চন যোগ হল। ক্রমে নতুন সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার দুটি প্রধান মানদণ্ড হল বিত্ত ও বিদ্যা। বিত্তের সঙ্গে বিদ্যার এই যোগাযোগের প্রধান কারণ, নবযুগের প্রথম পর্বে বিত্ত না থাকলেও, বিত্তবান পরিবারের সন্তান না হলে বিদ্যার্জন করা সম্ভব হত না। Propertied Class ও Educated Class, একসঙ্গে এই দুই শ্রেণির লোকের নাম সাধারণের মুখে উচ্চারিত হতে লাগল। মধ্যযুগের সমাজের ‘privilege of birth’ ও  ‘sacerdotal consecration’-এর বদলে নতুন সমাজের ক্ষমতা—মর্যাদার মানদণ্ড হল ‘wealth’ ও ‘erudition’ এবং দুয়েরই প্রাণধর্ম হল ‘spirit of enterprise’। সিমেল (Simmel), সম্বার্ট (Sombart) প্রমুখ ধনবিজ্ঞানীরা Money—র সঙ্গে Intellect—এর এই আত্মিক সাদৃশ্যের কথা বলেছেন। নতুন সমাজে টাকা সচল, বিদ্যাও সচল। ঘড়াভরতি টাকা মাটির তলায় পোঁতা থাকে না, থাকলেও এ—যুগে তার কোনো মূল্য নেই। বিদ্যাও কেবল রাজসভায় বন্দি হয়ে থাকে না। দুয়েরই সচলতা যুগধর্ম। বিদ্যা ‘দান’ করলে বাড়ে, অর্থও নিয়োগ করলে বাড়ে। টাকার ‘free market’ আছে, বাজার বিনিময় প্রতিযোগিতা আছে। বিদ্যারও বাজার আছে, বিনিময় আছে। কেবল টাকা নয়, নবযুগে বিদ্যাও ‘ক্যাপিটাল’ বা মূলধন। কমার্স বা বাণিজ্যের জন্য কেবল ‘কমোডিটি’র বেচাকেনা হয় না বাজারে, ‘নলেজ’ বা বিদ্যারও কেনাবেচা হয়। প্রতিযোগিতায় কমবেশি মূল্য পাবার সম্ভাবনা থাকে। মার্টিনের ভাষায় বলা যায়—‘Commerce and knowledge had emancipated themselves : no longer should there be any superior authority, human or otherwise, to keep them in leading strings.’১২

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার সমাজে ‘কমার্স’ ও ‘নলেজের’ এই মুক্ত যুক্ত—অভিযানই প্রধান হয়ে ওঠে। নবযুগের প্রথম পর্বেও বিত্তবান সম্ভ্রান্ত বাঙালিসমাজের সঙ্গে বিদ্বৎসমাজের তাই বিশেষ কোনো স্তরগত পার্থক্য দেখা যায় না। প্রথম যুগের বাঙালি বিদ্বৎসমাজ প্রধানত ধনিক সম্ভ্রান্ত সমাজের মধ্যেই গণ্ডিবদ্ধ রয়ে যায়।

নতুন যুগে যে—বিদ্যার গৌরব ও মর্যাদা বাড়তে লাগল সমাজে, সে হল ইংরেজিবিদ্যা ও পাশ্চাত্যবিদ্যা। ইংরেজিবিদ্যার সঙ্গে প্রথম থেকেই অর্থের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। কারণ বিদেশি রাজার মাতৃভাষা ‘ইংরেজি’। সামান্য ইংরেজি শিখলে বেনিয়ানি করা যায়, সাহেবদের হৌসে চাকরি পাওয়া যায়। সাহেবদের কাছে, কলকাতার ফিরিঙ্গিদের স্কুলে, প্রথমে ইংরেজিশিক্ষা আরম্ভ হল। পাদরি সাহেবরাও কিছু—কিছু শিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। এইসব বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেরবোর্নের স্কুল, অ্যারাটুন পিক্রুসের স্কুল, ড্রামন্ড সাহেবের স্কুল। পরে সংঘবদ্ধভাবে ইংরেজিশিক্ষার জন্য প্রথমে উদযোগী হন সম্ভ্রান্ত ধনী বাঙালিরাই, ইংরেজরা নন। ১৮১৭ সালে যখন ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডোয়ার্ড হাইড ঈস্ট সাহেব অথবা ঘড়িব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার তার মধ্যে প্রধান উদযোগীরূপে থাকলেও সম্ভ্রান্ত বাঙালিসমাজের প্রধানরা তার উদ্বোধক ও সমর্থক ছিলেন। প্রথম হিন্দুকলেজ স্থাপিত হয়, তন্তুবণিক সমাজের গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে, চিৎপুরে। বিচারপতি অনুকূলচন্দ্রের পিতামহ বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় কলেজের দেশীয় সম্পাদক নিযুক্ত হন। গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গানারায়ণ দাস ও হরিমোহন ঠাকুরকে নিয়ে কলেজের প্রধান ম্যানেজিং কমিটি বা অধ্যক্ষসভা গঠিত হয়। কলেজের গভর্নর হন গোপীমোহন ও বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্র। এঁরা সকলেই ধনিক ও সম্ভ্রান্ত গোঁড়া হিন্দুসমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তি। হিন্দু কলেজই নব্যবঙ্গের পাশ্চাত্যবিদ্যা শিক্ষার আদি প্রধানকেন্দ্র। লক্ষণীয় হল, এই নতুন শিক্ষায়তন যখন প্রধানত সম্ভ্রান্ত বাঙালিদের চেষ্টাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনও ইংরেজ শাসকরা, ইংরেজি না সংস্কৃত, পাশ্চাত্য না প্রাচ্য, কোন শিক্ষায় উৎসাহ দেবেন ও পোষকতা করবেন, সে সম্বন্ধে মনস্থির করতে পারেননি। তার সাত বছর পরে, ১৮২৪ সালে, অনেক তর্ক বিতর্কের পর তাঁরা কলকাতায় ‘সংস্কৃত কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করাই সিদ্ধান্ত করেন। তার পরে আরও সাত—আট বছর ধরে Anglicists ও Orientalists, এই দুই দলের তর্কাতর্কি চলতে থাকে। ১৮৩৫ সালে মেকলের প্রস্তাব যখন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ইংরেজি—শিক্ষার পোষকতার পক্ষে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তখন হিন্দুকলেজের বয়স আঠারো বছর হয়েছে। এই আঠারো বছরের মধ্যে হিন্দুকলেজে শিক্ষিতদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, এবং তাঁরা নিজেরা পাশ্চাত্য ও ইংরেজিবিদ্যার প্রসারের জন্য শিক্ষক ও মিশনারির কাজ করে, শিক্ষিতের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন। কলকাতার তরুণ বিদ্বৎসমাজ ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত হয়েছেন। নব্যবঙ্গের বিদ্বৎসমাজের নিশ্চিত বিকাশ হয়েছে। নবযুগের বাংলার বিদ্বৎসমাজ যে কেবল ইংরেজ শাসকদের উদযোগে গড়ে উঠেছে, একথা ইতিহাসের দিক থেকে ঠিক নয়। সম্ভ্রান্ত হিন্দু বাঙালিসমাজের উদযোগ নব্যবঙ্গের বিদ্বৎসমাজের প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে বেশ সক্রিয় ছিল দেখা যায়।

মেকলে ও বেন্টিঙ্কের প্রস্তাবে পাঁচ বছর আগে, ১৮৩০ সালে, আলেকজান্ডার ডাফ যখন কলকাতার আসেন তখন নব্যবঙ্গের তথা নব্যভারতের এই বিদ্বৎসমাজের বিকাশ লক্ষ্য করে, আশায় ও আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে তিনি লেখেন—”…in June 1830, when in the metropolis of British India, we fairly came in contact with a rising body of natives, who had learnt to think and to discuss all subjects with unshackled freedom…we hailed it as heralding the dawn of an auspicious era…”১৩ ডাফ সাহেব অবশ্য শিক্ষার অগ্রগতির জন্য যতটা না উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আশান্বিত হয়েছিলেন, তরুণ শিক্ষিতসমাজের মধ্যে তাঁর খ্রিস্টধর্মের বাণী প্রচারের পথ সুগম হবে ভেবে। খানিকটা যে সে—পথ সুগম হয়নি তা নয়। তিনি ও তাঁর সহযোগী পাদরি সাহেবরা কেবল ‘লেকচার’ দিয়ে এই সময় (১৮৩০—৩১ সালে) কলকাতার শিক্ষিত সমাজে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, লালবিহারী দের মতো নব্যবঙ্গের ইন্টিলেকচ্যুয়ালদের তিনি খ্রিস্টধর্মে আকৃষ্ট করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। আপাতত সে—ইতিহাস আমাদের আলোচ্য নয়। ডাফ সাহেব আসার আগে এবং তাঁর আসার পাঁচ বছর পরে, ইংরেজ শাসকদের নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের আগে, নবযুগের বাঙালি বিদ্বৎসমাজ যে রীতিমতো ‘সাবালক’ হয়ে উঠেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ‘সাবালক’ হয়ে উঠেছিলেন, কারণ প্রথম পর্বের yes-no-very-well-sir-গোছের ইংরেজি দু—চারটে বুলি—জানা ধনী বাঙালি বাবুসন্তানদের মতো তাঁরা কেবল বুলি শেখেননি। পাশ্চাত্য জীবনদর্শন, যুক্তিবাদ, হিউম্যানিজম প্রভৃতি প্রগতিশীল ভাবধারার মর্ম উপলব্ধি করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তার প্রয়োগ—পরীক্ষার জন্যও তাঁরা সাহস করে অগ্রসর হয়েছিলেন। ম্যানহাইমের পূর্বোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, তাঁরা নতুন সমাজের জীবনদর্শনের interpreter হয়ে, নব্যবঙ্গের আদর্শ intelligentsia—তে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু—। কিন্তু নব্যবঙ্গের ইন্টেলিজেনসিয়ার এই বিকাশের ধারাটা সুখের নয়। তার মধ্যে ট্র্যাজেডির উপকরণও ছিল যথেষ্ট। কিসের ট্র্যাজেডি?

বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী

প্রথম ও প্রধান ট্র্যাজেডি হল, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করল এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি—বিদ্বৎসমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তি সংগত; আমরা যখন নব্যবঙ্গের বা নবযুগের বাংলার ইতিহাস আলোচনা করি তখন কতকটা সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমানসমাজের এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাই। কিন্তু কোনো সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তো নয়ই। বাংলার বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ইতিহাস আলোচনাপ্রসঙ্গে তাই বাঙালি মুসলমানসমাজের কথা না বললে আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন বাংলার পুরাতন সমাজবিন্যাসের ভাঙাগড়া আছে এবং ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভ্রান্ত ধনিকসমাজ গড়ে উঠেছে, তখন মুসলমান—সমাজের অবস্থা কী? বাঙালি সম্ভ্রান্ত মুসলমান—পরিবার সেই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছেন। ইংরেজ আমলের নয়, তাঁদের ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য ছিল মুসলমান আমলের। সেই ঐশ্বর্য ও আভিজাত্য দুই—ই যখন তাঁদের লুপ্ত হয়ে গেল, তখন ইংরেজ আমলের নতুন সম্ভ্রান্ত হিন্দুসমাজ গড়ে উঠল। হান্টার সাহেব লিখেছেন : ”During the last seventy-five years the Musalman houses of Bengal have either disappeared from the earth, or at this moment being sub-merged beneath the new strata of society which our rule has developed–”১৪ ১৮৭০—৭১ সালে The Indian Mussalmans গ্রন্থে হান্টার এই কথা লেখেন। অর্থাৎ শোভাবাজার জোড়াসাঁকো পাথুরিয়াঘাটা বাগবাজার শ্যামবাজার কলুটোলা প্রভৃতি অঞ্চলে নতুন রাজধানী কলকাতায় যখন ইংরেজ আমলের সম্ভ্রান্ত—হিন্দু—পরিবার—প্রতিষ্ঠাতারা ধনসমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মুর্শিদাবাদ হুগলি প্রভৃতি পুরাতন মুসলমান শাসনকেন্দ্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের ক্রমবিলুপ্তি ঘটছিল। বাঙালি দেওয়ান—বেনিয়ান—তসুদের মধ্যে মুসলমানের নাম একরকম পাওয়াই যায় না বলা চলে। তার প্রধান কারণ বাঙালি মুসলমানদের ইংরেজ—বিদ্বেষ সেইসময় অনেক বেশি তীব্র ছিল। ইংরেজরা তখনও এদেশ থেকে মুসলমানরাজত্বের symbol গুলি একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সাহস পাননি। পলাশির যুদ্ধের পরে আরও প্রায় একশো বছর পর্যন্ত তাঁরা এদেশের লুণ্ঠিত মুসলমান রাজমুকুটটিকে দূর থেকে ভয় করেছেন এবং কিছুটা মেনেও চলেছেন। মুসলমান সমাজ তাই সর্বক্ষেত্রে, রাজচ্যুতি ও মর্যাদাহানির বিক্ষোভ থেকে, ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছেন। শিক্ষা রাজসম্মান ইত্যাদি কোনোক্ষেত্রেই তাঁরা কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে চাননি, বরং তাঁদের অসহযোগনীতির পূর্ণ সুযোগ ইংরেজরা তাঁদের শাসনস্বার্থে গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজরা সেই সুযোগে, শিক্ষা ও অর্থ উভয়ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভে হিন্দুসমাজকে সাহায্য করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বীজ বপন করে ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের সিংহাসনটিকে অটল করবার চেষ্টা করেছেন।

নতুন ইংরেজিশিক্ষাকে মুসলমানসমাজ প্রথমদিকে ভালো চোখে দেখতেন না। তার দু—একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করলেই তাঁদের মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যাবে। ১৮৩৫ সালে যখন ইংরেজিশিক্ষার পক্ষে বেন্টিঙ্ক—মেকলের নতুন নীতি প্রবর্তিত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে কলকাতার মুসলমানসমাজ তীব্র প্রতিবাদ করেন।১৫ আট হাজার মুসলমানের স্বাক্ষরসহ একটি প্রতিবাদপত্র গবর্নমেন্টের কাছে পাঠানো হয়। ১৮৫০ সালে যখন কলকাতা মাদ্রাসায় একজন ইউরোপীয়ান অধ্যক্ষ নিয়োগ করার প্রস্তাব হয় এবং কৌন্সিলের পরামর্শ ডক্টর স্প্রেঙ্গার নিযুক্ত হন, তখন মাদ্রাসার মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। স্প্রেঙ্গার সাহেব যখন মাদ্রাসার শিক্ষাপদ্ধতি সংস্কার করার চেষ্টা করেন, তখন এই ধূমায়িত অসন্তোষের প্রকাশ হয় বাইরে। মাদ্রাসার মুসলমান ছাত্ররা একদিন ইংরেজ অধ্যক্ষের গায়ে ইটপাটকেল ও পচা ফল ছুঁড়ে আক্রমণ করেন। মুসলমান ছাত্রসমাজের বিক্ষোভ ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠে। পুলিশি নির্যাতনে বিক্ষোভ দমন করা হয় এবং তদন্ত চলতে থাকে।১৬

কলকাতা মাদ্রাসা থেকে হিন্দুকলেজ ও সংস্কৃত কলেজ বেশি দূর নয়। ওয়েলেসলি থেকে গোলদীঘির (কলেজ স্কোয়ার) দূরত্ব। কিন্তু ১৮৩৫ সালে যখন কলকাতা শহরের আটহাজার মুসলমান মেকলের ইংরেজি শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং ১৮৫০ সালে যখন মাদ্রাসার ইংরেজ অধ্যক্ষকে মুসলমান ছাত্ররা ইটপাটকেল ও পচা ফল ছুঁড়ে মেরেছিলেন, তখন ওয়েলেসলি থেকে গোলদীঘির দূরত্ব একটা যুগের দূরত্বে পরিণত হয়েছে বলা চলে। হিন্দুসমাজে ক্রমবর্ধমান একটি শিক্ষিত ও চাকরিজীবী মধ্যশ্রেণির বিকাশ তো একেবারেই হয়নি, পুরাতন অভিজাতসমাজ ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে এবং দরিদ্র ও নিঃস্বশ্রেণির সংখ্যা বেড়েছে। নতুন কোনো বিদ্বৎসমাজেরও বিকাশ হয়নি। গোলদীঘি ও জানবাজারের মধ্যে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান রচিত হয়েছে—বাস্তব অবস্থার ও মানসিক অবস্থার বিরাট ব্যবধান।

১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট লর্ড মেও ভারতীয় মুসলমানসমাজের শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারকে সর্বত্র তদন্ত করতে বলেন। তদন্তের পর বাংলার লেফটেন্যান্ট—গভর্নর মন্তব্য করেন (Letter No. 2918, dated the 17th August, 1872) : ”আমার ভয় হয়, আমরা মুসলমানদের প্রতি শিক্ষার দিক দিয়ে সুবিচার করিনি। আমি বার্নাডের ‘নোট’ থেকে যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে দেখেছি, শিক্ষাবিভাগের ইনস্পেকটিং এজেন্সিতে একজনও মুসলমান কর্মচারী নেই। গভর্নমেন্ট স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একজনও মুসলমান আছেন কি সন্দেহ। বাংলার সরকারি শিক্ষাবিভাগ হিন্দুদের বিভাগ বললেও ভুল হয় না। উপরের স্তর থেকে নিম্নের স্তর পর্যন্ত সমস্ত চাকরিগুলি হিন্দুদের একচেটিয়া দখলে।”১৭ হান্টার সাহেব এই সময়েই তাঁর বিখ্যাত The Indian Mussalmans গ্রন্থ লেখেন, প্রধানত ব্রিটিশনীতির পক্ষে ওকালতি করবার জন্য। তার মধ্যেও তিনি মুসলমানসমাজের যে চিত্র এঁকেছেন তা ভয়াবহ। ১৮৭১ সালে বাংলা দেশে নানাবিভাগের সরকারি চাকরির একটি সম্প্রদায়গত হিসেব দাখিল করেছেন হান্টার সাহেব। তাতে দেখা যায়, সমস্ত বিভাগের সরকারি উচ্চশ্রেণির কর্মচারীদের মোট সংখ্যা ২,১১১ জন, তার মধ্যে ইউরোপীয় ১,৩৩৮ জন, হিন্দু ৬৮১ জন, এবং মুসলমান মাত্র ৯২ জন। এই হিসেব, দাখিল করে হান্টার মন্তব্য করেছেন : A hundred years ago, the Musalmans monopolized all the important officers of State (একথাও সত্য নয়, কারণ সম্ভ্রান্ত হিন্দুসমাজের অনেকে মুসলমান আমলের দায়িত্বশীল রাজকর্মচারী পদে ছিলেন)…. and, in fact, there is now scarcely a Government office in calcutta in which a Muhammadan can hope for any post above the rank of porter, messenger, filler of ink-pots and menders of pens.”১৮ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাংলার মুসলমান সমাজের এই ভয়াবহ চিত্রের কথা মনে করলেই, নব্যবঙ্গের বিদ্বৎসমাজের বিকাশের মধ্যে ‘ট্র্যাজেডি’ কোথায় ও কেন, তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

এই ট্র্যাজেডির রচয়িতা প্রধানত ইংরেজ শাসকেরা, এবং কিছুটা উদীয়মান হিন্দু সম্ভ্রান্ত সমাজ বা বিদ্বৎসমাজ। উচ্চস্তরের হিন্দুসমাজে হিন্দুত্বপ্রীতির আধিক্য ছিল, বিসদৃশ আতিশয্যও ছিল। ‘ধর্মসভার’ পৃষ্ঠপোষকদের কথা বলা, যেতে পারে, যদিও হিন্দুপ্রীতি আর মুসলমানবিদ্বেষ অভিন্ন মনোভাব নয়। ইয়ংবেঙ্গল ও ব্রাহ্মসমাজও প্রধানত হিন্দুসমাজের শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, মুসলমান সমাজের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল না। একথা আমরা আলাপ—আলোচনায় ভুলে গেলেও, ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরেও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তার অর্থ এ নয়, যে ইয়ং বেঙ্গল বা ব্রাহ্মসমাজের কোনো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ মনোভাব ছিল, বা মুসলমানবিদ্বেষ ছিল। আসল ঐতিহাসিক কারণ, নতুন হিন্দু মধ্যশ্রেণির বিকাশ ও বৃদ্ধি। এই মধ্যশ্রেণিই সর্বত্র নবযুগের প্রগতিশীল অর্থাৎ পাশ্চাত্যের আদর্শের বাহক ও প্রচারক। Urban population ও Middle Class—এই দুটিই বর্তমান যুগের সবচেয়ে সক্রিয় প্রগতিশীল শক্তি। ঐতিহাসিক পোলার্ড বলেছেন :১৯

Without these two there would have been little to distinguish between modern from medieval history…where you had no middle class, you had no Renaissance and no Reformation.

হিন্দু মধ্যশ্রেণি ও হিন্দু বিদ্বৎসমাজের বিকাশের ফলেই রিনেস্যান্স (সংকীর্ণ অর্থে) ও রিফর্মেশন আন্দোলন হিন্দুসমাজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ছিল। হিন্দুসমাজ নিজেদের যুগশক্তি ও গতিশীলতার জোরে অগ্রসর হয়েছেন। প্রগতি আন্দোলন বলতে তাই তখন বোঝাত হিন্দুসমাজের সংস্কার ও শিক্ষার প্রগতি। তা ছাড়া, হিন্দুসমাজের সংস্কারের সমস্যাও বোধহয় তখন মুসলমানসমাজের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। সংস্কারের সামাজিক তাগিদও ছিল বেশি। হিন্দুসমাজ তখন অশিক্ষা দুর্নীতি ধর্মব্যভিচার অনাচার কুসংস্কার ইত্যাদির পঙ্ককুণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। মুসলমানসমাজের মধ্যে যেটুকু প্রাণস্পন্দন ছিল, সতেজতা ছিল, হিন্দুসমাজে তা ছিল না। তার ঐতিহাসিক মূল সন্ধান করতে হলে, হিন্দু সেনযুগ পর্যন্ত যেতে হয়। হিন্দুসমাজের সর্বাঙ্গীণ সংস্কারের প্রয়োজনও ছিল যথেষ্ট। নতুন হিন্দুপ্রধান বাঙালি মধ্যশ্রেণি ও বিদ্বৎসমাজ তাই হিন্দুসমাজের শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। তাঁদের নবজাগ্রত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ছিল হিন্দুসমাজ। নবযুগের ‘Enlightenment’ ও ‘Humanism’—এর অগ্রদূত বাংলার ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলও তাই হিন্দুসমাজের বাইরের সমস্যা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে পারেননি। মুসমলমানসমাজের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ছিল না। কিন্তু তাই বলে কৃষ্ণমোহন, দক্ষিণারঞ্জন, তারাচাঁদ রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রভৃতি ইয়ং বেঙ্গলের অগ্রগণ্যদের ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে অভিযুক্ত করা যুক্তিসম্মত নয়। যাঁরা সেই সময় তারুণ্যের চপলতাবশত গোমাংস ভক্ষণ করে, গোঁড়া ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর গৃহে গোহাড় নিক্ষেপ করতেও কুণ্ঠিত হননি (১৮৩১ সালের ঘটনা), হিন্দুসমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মাচরণের মূল পর্যন্ত নাড়া দিয়ে শক্তিশালী হিন্দু সমাজনেতাদের প্রচণ্ড আক্রমণ নির্ভীকচিত্তে প্রতিরোধ করেছেন, তাঁরা আর যাই থাকুন, ‘সাম্প্রদায়িক’ ছিলেন না। নবযুগের অতি—সংকীর্ণ রিনেস্যান্স ও রিফর্মেশন আন্দোলন, ঐতিহাসিক কারণে, হিন্দুসমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার মধ্যে সচেতন ‘সাম্প্রদায়িকতা’ কিছু ছিল বলে মনে হয় না। এই চেতনা পরবর্তীকালে ইংরেজরা কৌশলে জাগিয়ে তুলে ঐতিহাসক ফাঁকটুকু পূরণ করেছেন মাত্র।

১৮৭০—৭১ সালে যখন মুসলমানসমাজের শিক্ষার দিকে ইংরেজ শাসকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, তখন তার মধ্যে কোনো বিশেষ মুসলমানপ্রীতি বা সমবেদনা বলে কিছু ছিল না। এর মধ্যে ক্রমবর্ধমান হিন্দু মধ্যশ্রেণির মনে নানারকমের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের উন্মেষের মধ্যে তার প্রকাশ হচ্ছে একদিকে। হিন্দু মধ্যশ্রেণি তখন পরিণত ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। তাঁদের দাবি—দাওয়া বাড়ছে। রাজনীতির নিষিদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রবেশ করেছেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা অনেক, উচ্চাশা অনেক, কিন্তু তা পূরণ করবার মতো সুযোগ সেই অনুপাতে অনেক কম। এইসময় ইংরেজরা মুসলমানসমাজের দিকে দৃষ্টি দিলেন। তাঁরা দেখলেন যে যদি এইসময় মুসলমানসমাজের মধ্যে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্যশ্রেণি ও বিদ্বৎসমাজের বিকাশের সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে তাঁরা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির উপর দাঁড়িয়ে আরও কিছুকাল রাজত্ব করতে পারেন। মুসলমানসমাজেও এর মধ্যে নতুন চেতনার বিকাশ হচ্ছিল। নতুন সুযোগের অভাব বোধ করেছিলেন তাঁরা। এমন সময় ইংরেজরা তাঁদের সুযোগ করে দিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদ থেকে বাংলার মুসলমানসমাজের মধ্যশ্রেণির ও বিদ্বৎগোষ্ঠীর বিকাশ আরম্ভ হল। ঠিক এইসময় থেকেই হিন্দু মধ্যশ্রেণির ও বিদ্বৎসমাজের ক্রমাবনতি আরম্ভ হল বললে ভুল হয় না। অর্থাৎ অগ্রগতি চুড়োয় পৌঁছে যখন হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বিদ্বৎসমাজের অধোগতি আরম্ভ হল, মুসলমান মধ্যশ্রেণির ও বিদ্বৎসমাজের উত্থান শুরু হল তখন থেকে। বাংলার হিন্দু ও মুসলমানসমাজের পতন—উত্থানের এই যুগসন্ধিক্ষণে, হিন্দুসমাজের উত্থানপর্বের মুসলমানবর্জিত রূপের অন্তর্নিহিত ট্র্যাজেডি প্রকট হয়ে উঠল।

হিন্দুসমাজের উদারতা মানবতা ও সংস্কার—আন্দোলন ধীরে ধীরে হিন্দুধর্মের পুনরভ্যুত্থান (Revival) আন্দোলনে পরিণত হল। ‘হিন্দু’—প্রীতি ক্রমে ‘হিন্দুত্ব’—প্রীতির ভিতর দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতার’ পর্যবসিত হল। রামমোহন—ইয়ংবেঙ্গল—বিদ্যাসাগরের উদারতা ও যুক্তিবাদের যুগ ধীরে ধীরে অস্ত গেল। যুক্তির বদলে এল সেই সনাতন ভক্তি, সংস্কারের বদলে এল কুসংস্কার, উদারতার বদলে সংকীর্ণতা, মানবতার বদলে সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু মধ্যশ্রেণি ও বিদ্বৎসমাজ যে প্রৌঢ় হয়েছেন তা বোঝা গেল। বার্ধক্যের উপসর্গ বিদ্বৎসমাজের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠল। মুসলমানবর্জিত তথাকথিত রিনেস্যান্স ও রিফর্মেশন আন্দোলনের প্রায়শ্চিত্ত করা হল চরম প্রতিক্রিয়াশীল রিভাইভ্যাল আন্দোলনের সূত্রপাত করে, বিদ্যাবুদ্ধি যুক্তি সব বিসর্জন ও বন্ধক দিয়ে। সেই গুরুবাদ ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের অতল অন্ধকারে তলিয়ে গেল ইয়ং বেঙ্গল ও বিদ্যাসাগর যুগের যুক্তিবাদ, স্বাতন্ত্র্যবাদ, যা কিছু ভালো সব। ‘Age of Reason’, ‘Humanism’ ও ‘Philosophy of Enlightenment’—এর উত্তরাধিকারীরা গুরু—অবতারের যুগের পাঁকের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লেন। আজও সেই পাঁক থেকে তাঁরা গাত্রোত্থান করতে পারেননি। বরং ক্রমেই পাঁকের মধ্যে যুক্তিহীনতা ও বুদ্ধিহীনতার অতল অন্ধকারে, তাঁরা আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছেন। বাংলার এই হিন্দু বিদ্বৎ—সমাজের উত্থান—পতনের ধারার দিকে চেয়ে মনে হয়—‘‘The Decline and Fall of Bengali Hindu Intellect’’—সম্বন্ধে যদি কেউ ইতিহাস রচনা করেন, তাহলে গিবনের রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের তুলনায় তা কম ‘মনুমেন্টাল’ হবে না।

১৮৫০—৫৫ থেকে ১৯৫০—৫৫ সাল পর্যন্ত একশো বছরের ইতিহাস। এর মধ্যে বাঙালি শিক্ষিতশ্রেণির সংখ্যা বেড়েছে, বিদ্বৎসমাজের কলেবরও যথেষ্ট স্ফীত হয়েছে। বাঙালির দৈহিক আকৃতির মতো, বাঙালি সমাজেরও আকৃতির অসামঞ্জস্য বেড়েছে। ওপর ও নীচের অংশ ক্রমে শীর্ণ হয়ে গিয়ে, বয়সকালে যেমন মধ্যের পেটটি ফুলে উঠে দেহ থেকে এগিয়ে আসে, বাঙালি সমাজেরও বয়সকালে ঠিক তাই হল। ওপরের ‘ধনিক’ বা ‘ক্যাপিট্যালিস্ট—শ্রেণি’ ক্রমে সংকুচিত হয়েছেন, নীচের কৃষক ও মজুরশ্রেণি ক্রমে শীর্ণ কঙ্কালে পরিণত হয়েছেন, কেমন মধ্যের মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিতশ্রেণির স্ফীতোদরের মতো এগিয়ে এসেছেন। এই স্ফীতির ফলে তাঁদের সমস্যাও বেড়েছে। শিক্ষিতশ্রেণির বেকারত্ব বেড়েছে, বাড়ছে এবং ক্রমেই বাড়বে। কারণ, টয়েনবির ভাষায়,  ‘the process of manufacturing an intelligentsia is more difficult to stop than to start’ । তা ছাড়া, রাষ্ট্রীয় পোষকতাও ক্রমে দলগত (রাজনৈতিক) ও গোষ্ঠীগত হয়ে উঠেছে, আধুনিক বিকৃত গণতন্ত্রের মাহাত্ম্যের গুণে। যোগ্যতার সুবিচার করা হয় না। সুতরাং সবদিক দিয়ে, গণতন্ত্রের যত বয়স বাড়ে বিদ্বৎসমাজের অসন্তোষ তত বাড়তে থাকে, ব্যর্থতাও তীব্রতর হয়। টয়েনবি এ সম্বন্ধে সুন্দর একটি কথা বলেছেন—২০

Indeed, we might almost formulate a ‘social law’ to the effect that an intelligentsia’s congenital unhappiness increases in geometrical ratio with the arithmetical progress of time.

এই বেকার—জীবনে, অবিচারবোধ, ব্যর্থতার গ্লানিবোধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে ক্রমে বিষিয়ে তোলে। ম্যানহাইম বলেছেন, মানুষের যখন ‘life-plan’ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তার ‘personal rationalisation’ বলে কিছু থাকে না এবং ক্রমে সে যাবতীয় ‘miraculous cure-alls’-এর প্রতি আস্থাবান হয়ে ওঠে।২১

বাংলার বিদ্বৎসমাজের বর্তমান অবস্থাও ঠিক তাই হয়েছে। যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ক্রমেই বাঙালি বিদ্বৎসমাজের বড় একটা অংশ গুরুবাদ ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছেন। আর একটা অংশ, যারা বিত্তলোভী ও ক্ষমতালোভী, তাঁরা শাসকশোষকদের অন্ধ স্থাবকতা করছেন, মান্ধাতার আমলের মামুলি বুলি কপচে। দার্শনিক কান্ট বলেছিলেন—‘‘Enlightenment is the liberation of man from his self-caused state of minority.’’ এ—উক্তি চিরস্মরণীয়। বৃহত্তর মানবসমাজ এই সভ্যসমাজে ‘self-caused state of minority’-তে জীবন কাটায়। সারাজীবনে তাঁদের মানসিক নাবালকত্ব ঘোচে না। এই নাবালকত্ব ‘self-caused’ অর্থাৎ তাঁরা নিজেরাই তার জন্য দায়ী। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকার রাজ্য থেকে তাঁরা স্বেচ্ছায় স্বাধীন যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির আলোকরাজ্যে আসতে চান না। কান্টের ‘self-caused’ কথাটি অবশ্য ধোঁয়াটে ও অসত্য, কারণ জ্ঞানের আলোকরাজ্যে সমাজের অধিকাংশ মানুষের আজ প্রবেশাধিকার নেই, শোষণমুখী শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থার জন্য। তবে কান্টের এই উক্তি আমাদের দেশের শিক্ষিতশ্রেণির ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থে প্রযোজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ., এম.এস.সি. ‘ডক্টররা’ যখন মানবাতারের পুজোয় মেতে ওঠেন, অলিগলিতে ‘গুরু’ খুঁজে বেড়ান, অদৃষ্ট ও ভৌতিক cureall-এ বিশ্বাস করেন, একহাতে তাবিচ—মাদুলি আর—একহাতে ফিজিক্স—কেমিস্ট্রি নিয়ে বিদ্বান বলে পরিচয় দেন, তখন তাঁদের মানসিক নাবালকত্ব self-caused ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! আর্থিক সংকট, বেকার জীবন, নানারকম ব্যর্থতার গ্লানি, সব মিলিয়ে যখন লাইফপ্ল্যানটিকে নষ্ট করে দেয়, তখন মানুষ যুক্তিবুদ্ধির হাল ছেড়ে দিয়ে এইভাবে ভরাডুবি হয়। কথাটা ঠিক, কিন্তু কেবল সেই কারণে দেড়শো বছর পরে বাংলার বিদ্বৎসমাজের এ—অবস্থা হবে কেন? আর্থিক সমস্যার বা অবস্থার যত প্রাধান্যই থাক জীবনে, মানুষের বিচারবুদ্ধির উপর তার যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ শক্তি স্বীকার্য নয়।

বিদ্যাসাগর যখন ছাত্রজীবনে ‘বিদ্যা’ সম্বন্ধে লিখেছিলেন—’বিদ্যা দদাতি বিনয়ং বিপুলঞ্চ বিত্তং’ তখন কথাটা অনেকটা সত্য ছিল। বিদ্যাসাগর নিজের জীবনেও তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। আজ একথা অনেকটা মিথ্যা। কিন্তু তাই বলে—

বিদ্যা বিকাশয়তি বুদ্ধিবিবেকবীর্য্যং

একথা মিথ্যা হবে কেন? বিত্তের অভাব বুদ্ধিবিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে, একথা অর্ধসত্য ছাড়া কিছু নয়। তা যদি না হত, তাহলে অসংখ্য বিত্তহীন সাধারণ মানুষের মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেকের সজাগতার পরিচয় পাওয়া যেত না।

অতএব কেবল আর্থনীতিক সংকটের যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে বাংলার বিদ্বৎসমাজের একটা বিরাট অংশের এই বুদ্ধিবিপর্যয় ও বিমূঢ়তা ব্যাখ্যা করা যায় না। তা ছাড়া, আরও গভীর কারণ আছে মনে হয়। যে—পাশ্চাত্যবিদ্যা আমরা যেসময় যে—পদ্ধতিতে আয়ত্ত করেছিলাম, তার মূলে কোথাও মারাত্মক গলদ ছিল। নবযুগের ‘হিউম্যানিস্ট’ শিক্ষা আমরা সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতে পারিনি। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে ও সমাজ তার integration সম্ভব হয়নি। শিক্ষা ও তার সমীকরণের মধ্যে একটা বড় ফাঁক ছিল, তাই আজ বাংলার বিদ্বৎসমাজের জীবনে বিরাট ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলার বিদ্বৎসমাজের উত্থান—পতনের এই ঐতিহাসিক রেখাচিত্রের মধ্যে আশানিরাশার কথা আমি কিছু বলিনি। আজকের অধঃপতনের মধ্যে ভবিষ্যতের পুনরভ্যুত্থানের কোনো বীজ নিহিত আছে কি না, সে সম্বন্ধে গণৎকারী করারও ইচ্ছা আমার নেই। বিদ্বৎসমাজ যে সামাজিক ‘শ্রেণি’ নন এবং শ্রেণি—সংহতি বা চেতনা বলে যে তাঁদের মধ্যে কিছু নেই, একথা গোড়াতেই বলেছি। ম্যানহাইম যে শিক্ষার বন্ধনের কথা বলেছেন, বর্তমান যুগে তার দৃঢ়তা সম্বন্ধে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। বিদ্বৎসমাজ ভবিষ্যতে শ্রেণিসচেতন হতে পারেন বলেই ম্যানহাইম যে ইঙ্গিত করেছেন, তারও কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।২২ শিক্ষা—অর্থে বিত্ত—বিদ্যার যমজ—সম্পর্ক সমাজে ক্রমেই গভীর হচ্ছে। যত গভীর হচ্ছে, তত বিত্তের শ্রেণিবিন্যাস ও বিদ্যার স্তরবিন্যাস ‘কো—রিলেটেড’ হচ্ছে। বিত্তমান মধ্যবিত্ত স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীন—মোটামুটি এই চারশ্রেণির সঙ্গে বিদ্বৎসমাজের স্তরগত সম্পর্ক প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে। বিদ্বান মধ্যবিদ্বান স্বল্পবিদ্বান বিদ্যাহীন, এইভাবে অবশ্য নয়। বিদ্যা মানদণ্ডই নয়, স্বার্থ ও সুযোগই মানদণ্ড। সুতরাং বিদ্বানদের মধ্যে ভাগ্যবান মধ্যভাগ্য স্বল্প ভাগ্য ভাগ্যহীন—এইভাবে স্তরভেদ হচ্ছে বললেই সংগত হয়। ভাগ্য, আর্থিক সাফল্য ও সামাজিক প্রভাব—প্রতিপত্তি, এসমাজে অভিন্ন। তাই বিত্ত বিদ্যা ও সামাজিক প্রভাব ক্রমেই অঙ্গাঙ্গি হয়ে উঠছে। তার ফলে বিদ্বৎসমাজে বিভেদ বৈষম্য বাড়ছে, গোষ্ঠী—পোষকতা ও দলাদলি বাড়ছে, ঠিক রাজনীতিক্ষেত্রের মতো। শিক্ষার বন্ধন আর টিকছে না। শিক্ষার ‘মান’ বলে তো কিছুই নেই। এমনকী সমাজবোধ (‘কমিউনিটি অর্থে) পর্যন্ত লোপ পেয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় তরুণ বিদ্বৎসমাজের পক্ষে হিউম্যানিজম—এর যুগের পুনঃপ্রবর্তন করা, সামাজিক নবজাগরণের পথ আবার আগাছা কেটে তৈরি করা খুবই কঠিন। কারণ এযুগের তরুণ বিদ্বৎসমাজের অধিকাংশই ‘ভাগ্যহীন’ স্তরের। ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের অনেকেই ভাগ্যবান ও বিত্তবানদের সন্তান ছিলেন। সেকথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। বিংশ শতাব্দীর ‘ইয়ং বেঙ্গল’ সাধারণত ‘ভাগ্যহীন’ ও ‘বিত্তহীন’ বাংলার হিন্দু বিদ্বৎ—সমাজের পুনর্জীবন তাই সহজলভ্য বলে মনে হয় না। কারণ পুনর্জীবনের জন্য যাঁরা আজ সংগ্রাম করবেন, তাঁরা নিজেদের প্রাণধারণের সংগ্রামেই ব্যস্ত। বিদ্যাসাধনার বা সুচিন্তার সুযোগ নেই তাঁদের। আগে বিদ্বৎজনের যে ব্যাখ্যা করেছি, অর্থাৎ যাঁরা ‘vocationally concerned with things of the mind’, তাঁরাই যদি প্রকৃত বিদ্বৎজন হন, তাহলে এযুগের বর্ধিষ্ণু শিক্ষিতশ্রেণির মধ্যে কয়জন ‘বিদ্বৎজন’ বলে গণ্য হবেন, সন্দেহ আছে। অন্নচিন্তার মধ্যে, নিরাপত্তার দুর্ভাবনার মধ্যে, বিশুদ্ধ মননের সুযোগ কোথায়? তাই প্রবীণ বিদ্বৎসমাজ গুহামানবের অন্ধকারযুগে পশ্চাদপসরণ করছেন দেখেও নবীন বিদ্বৎসমাজ কিছু করতে পারছেন না, নীরবে অবাক হয়ে সেইদিকে চেয়ে চেয়ে তাঁদের ‘সিলুয়েটেড রিট্রিট’ দেখছেন।

রচনাকাল : ১৩৬২ সন

। Weber, Max : Essays in Sociology, London: Oxford, 1946 Part II, Sec. VII, pp 180-86.

। Toynbee, Arnold : A Study of History, Abridged, London, Oxford, 1951, pp. 393-96.
 ‘‘We can also observe another fact in the life of an intelligentsia which is written large upon its countenance for all to read : an intelligentsia is born to be unhappy’’. (p.394).
 ‘‘This liaison-class suffers from the congenital unhappiness of the hybrid who is an outcaste from both the families that have combined to beget him’’ (p.394).

। Mannheim, Karl; ideology and Utopia,  An Introduction to the Sociology of Knowledge. London: Harcourt Brace 1936 : Chapter III, Sec. 4–‘‘The Sociological Problem of the Intelligentsia’’ (pp. 136-46).

। Encyclopaedia of Social Sciences, Vol. 8– ‘Intellectuals’ by Roberto Michels.

। Ideology and Utopia, p.9.

। Michels, Roberto : ‘Intellectuals’ ibid.

। Mannheim, K. : op. cit. p.10.

। Martin, Alfred Von : Sociology of the Renaissance, London:Oxford, 1945. Chapter I (f)– ‘Functions of Education and Learning’ pp. 27-30).

। Mannheim, Karl : Man and Society London: Kegan Paul 1940, ‘Selection of Elites’’, p.89.

১০। Class Status and Power, A Reader in Social Stratification :  Edited by Reinhard Bendix and Seymour Martin Lipset, London: Free Press 1954, Part II, ‘‘Who’s Who in America and the Social Register : Elite and Upper Class Indexes in Metropolitan America by E. Digby Baltzell, pp. 172-184.
 আমেরিকায় The Register Association আছে। বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করে সংকলন ও প্রকাশ করা তাদের কাজ।

১১। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : (১) সুবর্ণবণিক কথা ও কীর্তি (তিন খণ্ড), নরেন্দ্রনাথ লাহা, ১৯৪০ (২) কলিকাতাস্থ তন্তুবণিক জাতির ইতিহাস : নগেন্দ্রনাথ শেঠ, ১৯৫০ (৩) The Modern History of the Indian Chiefs, Rajas, Zamindars etc., Part II, by Lokenath Ghosh, Calcutta: J.N. Ghosh,1879, charles. t (৪) Buckland : Dictionary of Indian Biography, London: Sonnenschein, 1906 (৫) Kisorichand Mitra : Memoir of Dwarkanath Tagore, Calcutta: Thacker & spink, 1870 (৬) The Tagore Family, (৭) Girish Chandra Ghosh : Ramdulal De.

১২। Martin, Alfred Von. ibid.

১৩। Duff, Alexander, India and India Missions, Edinburgh: Johnston, 1840, Appendix, p. 631.

১৪। Hunter, W. W. : The Indian Musalmans Calcutta: Thacker ,1945): Chapter IV, p.157.

১৫। Huque, M. Azizul : History and Problems of Moslem Education in the Bengal (Calcutta: Thacker & spink 1917).
 ‘‘This period was remarkable for the steady efforts to spread English education among all sections of the people, but the Mussalmans paid no heed to the changing needs of the time. They bitterly opposed the policy of the state laid in the Resolution of 1835, and there was a petition from the Mussalmans of Calcutta signed by 8000 people opposing the Government resolution.’’ (p.20).

১৬। Huque, M. Azizul : op. cit.
 ‘‘All the suggestions of the Council were acceded to and Dr. Aloys Sprenger was appointed to the office of the Principal of the Calcutta and visitor and Director of the Hnghly Madrassahs. He incurred and displeasure of the students in introducing certain reforms. A disturbance took place, he was pelted by brickbats and rotten mangoes and the Police were called in to expell the mutinous boys. A committee of enquiry was appointed…’’ (p.22).

১৭। ‘The Lieutenant-Governor fears that the Mohamadans have not been very fairly treated in regard to our educational mechinery. Mr. Bernard’s note shows that not a single member of the Inspecting agency is a Mahomedan; there is scarcely, if at all, a Mahomedan in the ordinary ranks of schoolmasters of Government School. The Bengal Educational Department may be said to be a Hindu institution. Hindus have monopolised all the place below the highest and all the executive management.’’ (Quoted in Huque’s ‘History’, p.36).

১৮। Hunter, W. W : op. cit. p.161.

১৯। Pollard, A.F. :  Factors in Modern History, New York: G. P. Putnem, 1907. p.43.

২০। Toynbee Arnold : A study of History, op. cit. p. 395.
 ‘‘The candidates increase out of all proportion to the opportunities for employing them, and the original nucleus of the employed intelligentsia becomes swamped by an intellectual proletariat which is idle and destitute as well as outcaste…and the bitterness of the intelligentsia is incomparably greater in the latter state than in the former.

২১। Mannheim Karl : Man and Society.op. cit. Studies in Modern Social structure, Part II, ‘‘Social Causes of the Contemporary Crisis in Culture.’’
 ‘‘The most important negative effect or unemployment consists in the destruction of what may be called the ‘life-plan’ of the individual. The ‘life-plan’ is a very vital form of personal rationalisation, in as much as it restrains the individual’s from responding immediately to every passing stimulus. Its disruption heightens the individual’s susceptibility to suggestions to an extraordinary degree and strenghens belief in miraculous ‘cure-alls’.’’ (p.104, footnote.)

২২। Mannheim Karl :  Ideology and Utopia, op. cit, pp. 141-42.
 ‘‘One of the basic tendencies in the contemporary world is the gradual awakening of class-consciousness in all classes. If this is so, it follows that even the intellectuals will arrive at a consciousness– through not a class-consciousness–of their own general social position and the problems and opportunities involved.’’

* National Genealogical Society, 1903 এ আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের মুদ্রিত ও ডিজিটাল প্রকাশনা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *