১২. আমাদের কর্তব্য

দ্বাদশ অধ্যায় – আমাদের কর্তব্য

তাহলে আমাদের কর্তব্য কী?

সংস্কৃতি ও শিল্প—সংকটের যে বিকৃত রূপ আজ প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই রূপই কি মানব—সংস্কৃতির সত্যকার রূপ? নৈরাশ্য ও মৃত্যুচিন্তার পঙ্ককুণ্ডের মধ্যে আমরা কি ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ব, আর বুর্জোয়া শ্রেণির অকর্মণ্যতা ও অশুভবুদ্ধির জন্য বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীকে অভিসম্পাত দেব? সংখ্যালঘু একটি শ্রেণির অন্যায়, অত্যাচার, অমানুষিকতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির আশা, আকাঙ্ক্ষার উপর কী কারণে, কোন শক্তির সাহায্যে শ্রেষ্ঠত্ব বা সত্যতা দাবি করতে পারে? দাবি করলেও সে—দাবিকে গ্রাহ্য করবার কি যুক্তিসংগত মানবিক কারণ আছে?

আমাদের মনে, পৃথিবীর প্রত্যেক জীবন্ত মানুষের মনে আজ এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। যে—সংকট, যে—বিপদ ভয়ংকর দানবীয় মূর্তিতে আজ আমাদের গ্রাস করতে উদ্যত, সে—সংকটের পিছনে রয়েছে চিরপ্রবহমান ইতিহাস—স্রোতস্বিনীর কল্লোল। সেই ঐতিহাসিক ধারার প্রবাহপথে যে সাময়িক ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়, এ হচ্ছে সেই সাময়িক ঘূর্ণাবর্ত। আজ তাই সেই ঐতিহাসিক ধারার দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। গতিশীল ঐতিহাসিক ধারাকে সম্যকরূপে উপলব্ধি করাই আজ আমাদের নৈতিক কর্তব্য।

বুর্জোয়া সভ্যতার জন্ম থেকে এই মৃত্যুর সময় পর্যন্ত যে—আবর্জনা পুঞ্জীভূত হয়েছে পৃথিবীর বুকের উপর, পর্বতপ্রমাণ সেই আবর্জনাস্তূপের সামনে আজ শিল্পীর হতবাক হয়ে থাকবার দিন নয়। নীচে যে—মাটি রয়েছে, তার প্রাণশক্তি আজও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সূর্যকিরণের অন্তরালেও মাটির বুক থেকে রস নিংড়ে পান করে সেখানে যেসব বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, সূর্যকিরণের স্পর্শের জন্য তাদের সামনের আবর্জনা—প্রাচীর ধূলিসাৎ করা কর্তব্য। সভ্যতার সাময়িক দুর্যোগান্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শিল্পীর উচিত নয় মানুষের চিরস্পন্দমান প্রাণশক্তিগুলিকে অবজ্ঞা করা। এই বিপুল প্রাণশক্তিকে শিল্পী যখন উপলব্ধি করতে পারবেন, তখন নৈরাশ্যের মসিলিপ্ত জীবনের পশ্চাতে তিনি গতিশীল চির—অগ্রাভিমুখী মানবজীবন ও মানবসভ্যতার সন্ধান পাবেন। আজ জীবনের সেই স্পন্দমান প্রাণশক্তিগুলিকে (Elemental Forces of Life) উপলব্ধি করতে চেষ্টা করাই হবে আমাদের অবশ্যপালনীয় সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য।

জীবনের এই গতিশীল প্রাণশক্তিগুলির সঙ্গে সভ্যতার, শিল্পের ও সংস্কৃতির অগ্রগতির অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ নির্ণয় করবার জন্য আমি টলস্টয় সম্বন্ধে লেনিনের সমালোচনা এবং রোম্যাঁ রোলাঁ কর্তৃক লেনিনের সমালোচনার সমালোচনা উদ্ধৃত করব। শিল্পীর আদর্শ, শিল্পীর কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে এত গভীরভাবে বিশ্লেষণ আমি আর কোথাও পাইনি। শিল্পী টলস্টয় সম্বন্ধে লেনিন বলেছিলেন :

It may seem at the first glance strange and artificial to link the name of Tolstoi with that of the Revolution, from which he very evidently turned away. But our Revolution (of 1905) was an extremely complicated phenomenon, in the rank and the file of its participants and leaders there were many social elements which did not understand what was happening and averted themselves from the real historical tasks posed by the development of events. In this sense, the divergent ideas of Tolstoi are a veritable mirror of the contradictory situation in which the historic activity of the peasantry of our revolution found itself. The originality of Tolstoi and his ideas in general express justly the varied phases of our revolution in as much as they reflect the revolution of the peasant bourgeoise and the revolt of the critics of capitalist exploitation. The denunciation of the violences of the state and the comedy of the courts, the glaring contrast between the increase of riches which go hand in hand with the conquests of civilisation and the increase of misery and barbarism which grow with the tortures of the working masses. And surmounting this we have the preching of the ‘Saint-Idiot’ for non-resistance of evil by violence… Tolstoi reflected the hate born from sufferances, the ripened desire for a better future. the desire to liberate himself from the immaturity of dreams, the lack of political education, and the weakness of the revolutionary desire. These historic-economic conditions show the preparation necessary for the struggles of the revolutionary masses and their lack of preparation for such a struggle. The Tolstoi doctrine of non-resistance to evil was the most serious of the causes which led to the defeat of the revolutionary campaign.—Lenin on Leon Tolstoi

”বিপ্লবের সঙ্গে টলস্টয়ের নাম একত্রে উচ্চারণ করলে প্রথমে একটু আশ্চর্য মনে হতে পারে। কিন্তু ১৯০৫ সালের বিপ্লব অত্যন্ত জটিল ব্যাপার ছিল। সে—বিপ্লবে যেসব জনসাধারণ ও নেতৃবর্গ যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই যা ঘটেছে সে—সম্বন্ধে আদৌ সচেতন ছিল না, এবং সেইজন্য পরিবেষ্টনের নির্দেশ অনুসারে তারা সত্যকার বিপ্লবী ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করতে পারেনি। এইদিক থেকে টলস্টয়ের বিভিন্নমুখী ভাবধারাকে বিপ্লবের বিরোধী পরিবেশের মধ্যে নিক্ষিপ্ত কৃষকশ্রেণির ঐতিহাসিক ক্রিয়ার প্রতিবিম্বস্বরূপ বলা যেতে পারে। টলস্টয়ের অভিনব ভাবধারার মধ্যে বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরের আন্তরিক রূপ অভিব্যক্ত হয়েছে, এবং তার মধ্যে, বুর্জোয়া—কৃষকশ্রেণির বিপ্লব ও ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পর্যন্ত রূপায়িত হয়েছে। রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে, একত্রে ধনবৃদ্ধির সঙ্গে সভ্যতার জয় এবং জনগণের অভাব—অভিযোগ—দুটি দিকই টলস্টয় প্রকাশ করেছিলেন। সব প্রকাশের উপর ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ ও প্রতিরোধের প্রতি ‘নির্বুদ্ধি—সাধু’ টলস্টয়ের বিতৃষ্ণা। উৎপীড়নজাত ঘৃণা, সুন্দরতর ভবিষ্যতের প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নময় তন্দ্রালুতা, রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব, বিপ্লবী মনোভাবের দুর্বলতা—এইসব ছিল টলস্টয়ের বৈশিষ্ট্য। এই ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রামের আবশ্যকতা উপলব্ধি করা যায়, এবং সে—সংগ্রামের প্রস্তুতির অভাবও পরিলক্ষিত হয়। বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরাজয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ ছিল টলস্টয়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিবাদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা।”

শিল্পী টলস্টয়ের উপর লেনিনের এই সমালোচনা সম্বন্ধে বিশ্ববরেণ্য ফরাসি শিল্পী ও মনীষী রোম্যাঁ রোলাঁ বলেছেন :

The judgment of Lenin which applies to a great artist of a definite epoch can be verified with other masters of other epochs, especially the pre-revolutionary epoch of our 18th century France. It is exactly that which happened… Not more than Tolstoi, did Montesquieu, Voltaire, Rousseau, Diderot, and the Encyclopedists understand what was going to happen and of which they were nevertheless the heralds. They have done nothing more that to translate (not without errors) in a striking form… the people of their time, and follow with them, confusedly the slope over which all of the 18th century was dragged. But they were far from suspecting where this slope was to lead them and if they perceived it… they all (with the exception of the adventurous Diderot) would have dropped to the rear. The 19th century Frenchmen did not clearly see the next stage where the entire development of history would change its course and set out fatally, as Lenin perceived it. For the historian of literature the interest should be to precisely discern that which the Rousseaus, the Diderots, and the Voltaires were aware of without thoroughly understanding. It is the sketch which Lenin with his brusque and comradely frankness drew of a writer whom he loved which exposed how Leon Tolstoi genially denounced the lies and the offenses of the social state, but how in the face of revolutionary action, which was the inequitable consequence, protested with fear and anger, shouting ‘No’, taking refuge in mysticism which wished to stop the progress of the sun by denying it.

”একটি বিশিষ্ট যুগের একজন মহৎ শিল্পী সম্বন্ধে লেনিনের এই সমালোচনা অন্য যুগের শিল্পী সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যেতে পারে, বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সের প্রাক—বৈপ্লবিক যুগের শিল্পীদের সম্বন্ধে। তাঁদের ক্ষেত্রেও ঠিক ওই একই ব্যাপার ঘটেছিল। মোঁতেসকো ভলটেয়ার, রুশো, ডিডেরট বা এনসাইক্লোপিডিস্টরা, কেউই টলস্টয়ের চেয়ে বেশি বুঝতে পারেননি ভবিষ্যতে কী ঘটবে, অথচ তাঁরাই ছিলেন তার অগ্রদূত। তাঁরা নিখুঁতভাবে তৎকালীন মানুষের বর্ণনা করে গিয়েছেন (তা—ও ভুল করে), এবং যে পথে অষ্টাদশ শতাব্দী অগ্রসর হয়েছিল সেই পথই অনুসরণ করেছিলেন, তা—ও সম্পূর্ণ সজ্ঞানে নয়। যদি তাঁরা বুঝতে পারতেন যে সে—পথের শেষ কোথায়, তাহলে হয়তো অনেক পিছনে তাঁরা পড়ে থাকতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসিরাও জানতেন না, ঐতিহাসিক বিকাশের পরবর্তী স্তর কী, এবং সেইজন্য লেনিনের কথানুযায়ী তাঁরাও বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের পরিষ্কারভাবে বিচার করে দেখা উচিত যে রুশো ও ভলটেয়ার যা জানতেন অথচ উপলব্ধি করতে পারেননি, তা কী? লেনিন অতি সরলভাবে তাঁর প্রিয় শিল্পী টলস্টয় সম্বন্ধে বলেছেন যে সমাজের মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু সেই প্রতিবাদের ন্যায্য পরিণতি বিপ্লবের কথা উঠলেই ভয়ে ও ক্রোধে বলেছেন ‘না’ এবং গূঢ়ত্ব ও রহস্যের মধ্যে আত্মগোপন করে প্রগতিকে অস্বীকার করেছেন।”

রোলাঁ বলেছেন যে শিল্প ও শিল্পী সম্বন্ধে লেনিনের এই বিশ্লেষণ আধুনিক শিল্পীদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। তিনি বলেছেন :

This phenomenon is found in a smaller degree and with less passion in the large majority of artists who see the pit, the abyss which it is necessary to jump, but who from this perspective grow dizzy and sever their allegiance. To re-establish their fragile, shaken equilibrium, they bend backward out of the wave which sweeps the epoch, into the ‘moral’ order, the established bourgeois order which reassures them against that which they have seen and which they did not wish to see,—into the conventional and ordered life.

আধুনিক শিল্পীদের মধ্যেও লেনিনের উল্লিখিত টলস্টয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ শিল্পী সামনের গহ্বর দেখতে পান স্পষ্ট, বুঝতেও পারেন যে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রয়োজন, কিন্তু সে—প্রয়োজনীয়তার চিন্তাতেই তাঁরা অবশ হয়ে পড়েন এবং দায়িত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করে শান্তি পান। তারপর সেই অবসন্ন, পঙ্গু মনের সাম্য বজায় রাখবার জন্য, যুগের বুকের উপর দিয়ে যে—ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার উপর থেকে পিছন ফিরে তাকান, প্রাক্তন বুর্জোয়াজীবনের শৃঙ্খলা, বিশ্বাস ও শান্তি ফিরে পেতে চান। এলিয়ট, পাউন্ড, লরেন্স, হাক্সলে, প্রুস্ত, জয়েস, সকলেই এই গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু লেনিনের মতো ‘Master of action’ যাঁরা, যুগধারার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের এক ভাবেন, এবং সেইজন্য তার অন্তর্লীন চিরজীবন্ত প্রাণশক্তিগুলিকে উপলব্ধি করে ভবিষ্যৎ যুগের পথ সুগম করেন। শিল্পী হিসাবে রোলাঁ ও গোর্কি কর্মী লেনিনের সমপর্যায়ভুক্ত।

বিপ্লবের আতঙ্কে সন্ত্রস্ত একজন কমরেড একবার লেনিনকে বলেছিলেন : “After the Revolution, the normal order ought to be established”—বিপ্লবের পরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা উচিত। লেনিন বিদ্রুপ করে এ—কথার জবাব দিয়েছিলেন : “It is unfortunate when people who pretend to be revolutionaries forget that the most normal order of history is the order of Revolution.”—সত্যই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে যাঁরা নিজেদের বিপ্লবী বলে পরিচয় দেন তাঁরা ভুলে যান যে ইতিহাসের স্বাভাবিক অবস্থাই হচ্ছে বৈপ্লবিক অবস্থা। লেনিনের এই ইতিহাসের জ্ঞান সম্বন্ধে স্ট্যালিন বলেছেন : “This profound faith in the elemental forces, which was characteristic of Lenin, gave him the power to control these forces and direct their into the channels of the great Proletarian revolution.” প্রাণশক্তির উপর এই প্রগাঢ় বিশ্বাসই ছিল লেনিনের বৈশিষ্ট্য, এবং এরই জন্য তিনি সেই শক্তিগুলিকে আয়ত্তে এনে তাদের শ্রমজীবী বিপ্লবের পথে নিয়োগ করতে পেরেছিলেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কর্মী ও জননায়কদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তাঁরা প্রত্যেক বিষয়ের মর্মস্থলে প্রবেশ করতে পারেন এবং সেখান থেকে গুপ্ত শক্তিগুলিকে আবিষ্কার করে মানবকল্যাণের জন্য তাদের নিয়োগ করেন। লেনিন বলেন যে শিল্পীরও সেই একই শক্তি থাকা উচিত। রোম্যাঁ রোলাঁ বলেছেন : “Thus the great artists, the Leonardos and the Tolstois espoused the living forms of nature. And the masters of action, the Lenins, correlated the laws of society and its rhythm, the vital elan which directs and supports the everlastingly onwards march of humanity.” লেনিন—নির্দিষ্ট শিল্পের এই ‘Supreme rule’, রোলাঁ বলেন, “If the majority of artists have been too weak to accept it, the great ones have always unconsciously practised it.”

আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সমাজের ও মানুষের এই ‘elemental force’—গুলিকে উপলব্ধি করে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করা। সামাজিক সমস্যাগুলির বাহ্যিক রূপই আসল রূপ নয়, সেই বাহ্যিক রূপের অন্তরালে যে—প্রাণশক্তি আছে, স্পন্দমান প্রাণের যে গতিশীল জীবন্ত রূপ আছে, তা—ই হচ্ছে আসল রূপ, বাস্তব তাকে বলে, তাকে বলে সত্য। ভাসমান সমস্যার মর্মস্থলে প্রবেশ করে সেই প্রাণশক্তির সন্ধান করা, এবং তাকে অন্তরে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করে রূপায়িত করাই শিল্পীর কর্তব্য। সেই রূপায়ণকে বলে বাস্তব—সৃষ্টি, সত্য—সৃষ্টি, এবং শিল্পী হচ্ছেন সেই বাস্তব ও সত্যের স্রষ্টা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ—যুগের ‘elemental forces’ কী? আধুনিক শিল্পীদের নৈরাশ্য ও অবিশ্বাসের মধ্যে কি গুপ্ত শক্তির ক্রিয়া দেখতে পাই? কোনো শিল্পী শান্তি চান, এবং বর্তমান সংকটের মধ্যে শান্তির আশা না পেয়ে তিনি ফিরে যেতে চান মধ্যযুগের সংকীর্ণতার মধ্যে। কেউ ভাবেন অবিশ্বাসই সকল অনিষ্টের মূল, মানুষ আজ বিশ্বাস হারিয়েছে বলে তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়েছে, এবং এ—যুগে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবার মতো কিছু নেই, তাই তিনি গির্জার অভ্যন্তরে যেতে চান। কেউ চান শান্তিতে থেকে নিজের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপভোগ করতে, নিজের প্রতিভা বিকাশের পথ সুগম করতে, এ—যুগের জঘন্য পরিবেষ্টনে তা সম্ভব নয়, তাই তিনি কল্পনায় আইভরি মিনারে প্রত্যাবর্তন করে আত্মতৃপ্তির বিলাসিতায় মগ্ন হতে চান। কেউ এ যুগের অত্যাচার, ব্যভিচার ও অনাচারকে ঘৃণা করেন মনেপ্রাণে, এবং মুক্তির কোনো পথ না পেয়ে শুধু নির্মম কশাঘাত করেন, আর না হয় ভীষণ নৈরাশ্যের অন্ধকারে আত্মগোপন করে মৃত্যু—কামনা করেন।

এই পরাভব ও পরিত্রাণের মনোভাবের পিছনে যে—শক্তি সক্রিয় রয়েছে, সে হচ্ছে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করবার আকাঙ্ক্ষা। শান্তি, সৌন্দর্য, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, সকলের কাম্য। এ—যুগে সে—কামনা পরিতৃপ্তির সম্ভাবনা নেই বলে কেউ ক্যাথলিক গির্জায়, কেউ মধ্যযুগে, কেউ মৃত্যুতে, কেউ কল্পনার আইভরি মিনারে তার সার্থকতা সন্ধান করেন। এ—যুগেই সে—কামনা চরিতার্থতার জন্য যে বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র গড়ে রয়েছে, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ তার জন্য যে প্রাণপণ সংগ্রাম করেছে, এবং আজও করছে, আজ শিল্পীর দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হয়নি বলেই এই মানসিক বিপর্যয়। অর্থাৎ শিল্পীর অন্তরের সুপ্ত প্রাণশক্তিই যে বাইরে পৃথিবীর বুকে ক্রিয়াশীল, তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি যে—শান্তি চান, যে—সৌন্দর্য, যে—স্বাধীনতা, যে—বিশ্বাস, যে—নিরাপত্তা কামনা করেন, এ—যুগের সংকটের মধ্যে আজ তারই জন্য সংগ্রাম শুরু হয়েছে, এ—যুগের বৃহত্তম মানবগোষ্ঠী শ্রমজীবী শ্রেণি আজ সেই একই দাবি নিয়ে সমাজতন্ত্রের মধ্যে তার পরিতৃপ্তির জন্য বিপুল বিশ্বাসে অগ্রসর হয়েছে। মধ্যযুগে, ক্যাথলিক গির্জায় বা আইভরি মিনারে প্রত্যাবর্তনে প্রয়োজন কী?

ধনতান্ত্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজ ধ্বংসোন্মুখ সত্য, কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর কিনারে—কিনারে যে—বিপ্লবের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল, যে নূতন সমাজতান্ত্রিক জীবনের নূতন সভ্যতার, নূতন সংস্কৃতির বজ্রবাণী পৃথিবীর রুদ্ধ দ্বারে দ্বারে আঘাত করল, সে কি আরও বৃহত্তম সত্য নয়? যে—সত্যের আহ্বানে মুষ্টিমেয় ধনিকগোষ্ঠীকে সমাজের জাদুঘরে পরিত্যাগ করে, পৃথিবীর বৃহত্তম মানবগোষ্ঠী বেরিয়ে এল প্রাচীন সমাজের লৌহপ্রাচীর ধূলিসাৎ করে নূতন সমাজগঠনের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, সে—বাণী কি আরও জীবন্ত ও সত্য নয়? সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও ফ্যাসিজম—এর নির্লজ্জ উদ্ধত অমানুষিকতার মধ্যে যে ধনিক সভ্যতা সাম্য, শান্তি, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা প্রভৃতিকে নির্মূল করতে সংকুচিত হল না, এবং তারই সামনে যখন নূতন সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা মুখোমুখি এসে দাঁড়াল তাকে ধুলায় লুণ্ঠিত করে মানুষের ন্যায্য দাবির যোগ্য সম্মান দেবার জন্য, তখন মানবসভ্যতাকে ‘বিনিপাত’ কেন বলব, কেন এক দুর্বল শ্রেণির দুষ্কর্মের জন্য দায়ী করব সবল, সজীব, সংখ্যাগরিষ্ঠ আর—এক শ্রেণিকে বরং বিশ্বাসঘাতক যে, অত্যাচারী যে, সেই ধনিক সভ্যতাকে পথের ধুলায় গুঁড়িয়ে ফেলে, যে মানব—সেনাবাহিনী আজ সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার ভিত্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করেছে, তাদেরই উৎসাহ দেব আমরা, তাদেরই সহযাত্রী হব। আমাদের কণ্ঠে সেই সুরে বিপ্লবের সংগীত ধ্বনিত হবে, সাম্যবাদের মহাতীর্থের পথে আমরাও অগ্রগামী গণবাহিনীর অনুগামী হব।

সাম্য, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা—এইগুলি হচ্ছে বর্তমান সমাজের ‘elemental forces’, এবং উপরের পরাধীনতা, বৈষম্য, অবিশ্বাস, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার খোলসটিকে বাদ দিয়ে ভিতরের এই গুপ্ত শক্তিগুলিকে প্রকাশ করাই হবে বর্তমান যুগের শিল্পীর কর্তব্য। এই গুপ্ত শক্তির বিকাশ ধনতান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার আবির্ভাবেই সম্ভব। এ—যুগের শিল্পীকে তাই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হতেই হবে।

বিগত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পঁচিশ বছর পর আজ যে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে, তার মধ্যে আমরা একদিকে অনুভব করেছি বিপুল সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক শক্তির প্রাণস্পন্দন, আর—একদিকে শুনেছি ধনিক সভ্যতার প্রাচীন ইমারত ধসে পড়ার শব্দ। রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারতন্ত্রে ধ্বংসলীলার পাশাপশি দেখলাম বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের বিজয় অভিযান। ইয়োরোপ সে—বিপ্লবের প্রচণ্ড আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পেল না। ইতালি ও জার্মানিতে দেখলাম নপুংসক, শান্তিবাদী সমাজতান্ত্রিকদের বিপ্লব—বিরোধী পরাভব—মনোবৃত্তির জন্য ফ্যাসিজম ও নাতসিজম প্রতিষ্ঠিত হল। তারপর দেখলাম ফ্যাসিজম—এর সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্যক্ষুধা, আর সেই ক্ষুধার প্রতি তার বৈমাত্রেয় ভাই সাম্রাজ্যবাদের বিপ্লবাতঙ্কজাত সহানুভূতি। আজ দেখছি ভাইয়ে ভাইয়ে প্রাণসংহারের কলহ বেধেছে, সুতরাং ধনিক পরিবারের যে—ভাঙন ধরেছে, তার ধ্বংস যে অনিবার্য, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়? ধনিকগোষ্ঠী যে বিপ্লবাতঙ্কে আজ জর্জরিত, সেই বিপ্লবাকাঙ্ক্ষাই তো এ—যুগের প্রাণশক্তি। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী শ্রেণি ও প্রগতিশীল বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীকে যে—শক্তি আজ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অদম্য সাহস ও অফুরন্ত অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, এ—যুগের সেই ‘elemental force’—কে নির্ভয়ে প্রকাশ করা ভিন্ন মহৎ শিল্পীর আর কী শ্রেষ্ঠ দায়িত্ব থাকতে পারে?

ভারতবর্ষের মতো পরাধীন দেশে আজ সেই একই শক্তি অন্তরালে সক্রিয় রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সোনার মসনদ যখন কম্পমান, তখন শ্রেণি—নির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারী সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশীয় রাজ্যের নিপীড়িত প্রজাবৃন্দের সংগ্রাম, জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকশ্রেণির বৈপ্লবিক আন্দোলন এবং ধনিকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শ্রমজীবী শ্রেণির সংগ্রাম প্রবল হয়ে উঠেছে। জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সমগ্র ভারতবাসীর সংগ্রামের মধ্যে ভারতের কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য বৈপ্লবিক প্রস্তুতি হচ্ছে বর্তমান ভারতবর্ষের ‘elemental force’, এবং এই প্রাণশক্তি ভারতের সামাজিক জীবনেও মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রাচীন সংস্কারের ও ধর্মের নাগপাশ ছিন্ন করে, ভারতীয় সমাজের অন্তরে আজ যে—মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগেছে, তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রাচীন সামাজিক জীবনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে। ভারতের এই ‘elemental force’—গুলিকে রূপায়িত করাই হবে এ—যুগের ভারতীয় শিল্পী ও সাহিত্যিকের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য। ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার তোরণ অতিক্রম করে, সমাজতন্ত্রের দিকে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির সহযাত্রী হতে হবে বর্তমান ভারতের শিল্পীকে।

এই হল শিল্পীর কর্তব্য, বাস্তবকে উপলব্ধি করে যিনি বাস্তব সৃষ্টি করবেন, চিরস্পন্দমান প্রাণশক্তিকে অনুভব করে যিনি মানবসভ্যতার অগ্রগতির সহায়তা করবেন। আর যাঁরা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে, দিনের অন্যায়, দিনের অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, প্রত্যেকটি দিন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে, মানুষের সংগ্রামে সাহায্য করেন, সেই সাংবাদিকদেরও আজ কম দায়িত্ব নেই। লেখনীর কিরিচ নিয়ে যাঁরা সৌন্দর্যের ও স্বাধীনতার সিংহদ্বার আজ আগলে থাকবেন, তাঁদেরও আজ আংশিকভাবে এই দৈনন্দিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। শিল্পীর চেয়ে সাংবাদিকের দায়িত্ব আজ কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

শত্রুপক্ষ ধনিকগোষ্ঠী যখন বহুদিনের সুসজ্জিত সমরোপকরণ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে, তখন সেই সংগ্রামে জয়ী হবার জন্য আমাদের শক্তিকেও সংহত করতে হবে। বিচ্ছিন্ন ছত্রভঙ্গ সংগ্রামে শুধু হতাশাই বাড়বে। একদিকের প্রচার—বিভাগ যখন কঠিন সতর্কতার সহিত কাজে ব্যস্ত, বুর্জোয়া শ্রেণির রক্ষিত ভাড়াটিয়া সাংবাদিকেরা যখন অবিশ্রান্ত সংগ্রাম করছে, তখন আমরাও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকব না। আমাদের প্রতিবেশী চীন থেকেই এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পেতে পারি। চীনে সাম্রাজ্যবাদী জাপান যে উন্মত্ত ধ্বংসলীলায় মত্ত হয়েছে, চীনের সমস্ত জনগণ শ্রেণিনির্বিশেষে একত্রীভূত গণমহড়া গঠন করে শুধু যে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে তা নয়, চীনের লেখকরাও সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য একত্রে সংগ্রাম করছে। আজ চীনের লেখকরা চীনের সংগ্রামরত জনগণের অনুপ্রেরণার উৎসস্বরূপ।

ইয়োরোপের প্রগতিশীল শিল্পীরাও জনগণের সঙ্গে একত্রে ফ্যাসিজম—বিরোধী মহড়ায় সংগ্রাম করেছে। ভারতের শিল্পী ও সাংবাদিকদেরও আজ অনুরূপ দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ভারতীয় জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্য। সাম্রাজ্যবাদ—বিরোধী মহড়ায়, ভারতীয় লেখকদেরও উচিত, যোগ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শক্তিশালী করা এবং সঙ্গে সঙ্গে গুপ্ত সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে প্রকাশ করা। এ—দায়িত্বকে অবহেলা করলে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

বর্তমানে এই হচ্ছে আমাদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *