১০. সংস্কৃতি-সংকটের রূপ

দশম অধ্যায় – সংস্কৃতি-সংকটের রূপ

—হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী
ভয়ঙ্করী! দয়াহীন সভ্যতা—নাগিনী
তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে,
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি’ তীব্র বিষে,
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত,—লোভে লোভে
 ঘটেছে সংগ্রাম;—প্রলয়—মন্থন—ক্ষোভে
 ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি’
 পঙ্কশয্যা হ’তে। লজ্জা সরম তেয়াগি
 জাতিপ্রেম নাম ধরি’ প্রচণ্ড অন্যায়,
 ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।
 কবিদল চীৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি
 শ্মশান—কুক্কুরদের কাড়াকাড়ি—গীতি।
 —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শতাব্দীর সূর্যাস্ত

এই হচ্ছে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার রূপ। নাগিনির মতো কুটিল ফণা তুলে বুর্জোয়া সভ্যতা আজ দংশনোদ্যত। চারদিকে চলেছে স্বার্থে স্বার্থে, লোভে লোভে সংঘাত। বর্বরতা ভদ্রতার মুখোশ পরে প্রভুত্ব করছে। জাতিপ্রেমের অন্তরালে মুষ্টিমেয় রাজ্যলোভাতুরের অন্যায় আত্মগোপন করে আছে। হিংসার এই নরমেধযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে, বোমা—বিস্ফোরণ ও কামান—গর্জনের মধ্যে। মনুষ্যত্ব, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের নহবতের ঐকতান আজ আর শোনা যায় না। কবিও তাই আজ শ্মশান—কুকুরের মতো শব—কাড়াকাড়ির চিৎকার করছেন। চারদিকে শুধু ফাঁপা মানুষ প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মুমূর্ষু পৃথিবীর কাতরানি নেড়িকুকুরের নাকিকান্নার মতো কবির কানে ভেসে আসছে। তাতেও স্বস্তি নেই। উদ্ধৃত কণ্ঠে কেউ ঘোষণা করছেন যে জীবন, মৃত্যু, সভ্যতা, বর্বরতা চক্রবৎ ঘুরে ঘুরে আসে। শিল্প, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের চিরস্থায়ী যোগাযোগ নেই। অনেকদিন সভ্যতাকে মানুষ উপভোগ করেছে, আজ তাই বর্বরতার যুগে ফিরে যেতেই হবে। বর্বরতাই মানুষের মুক্তির পথ।

হঠাৎ মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের এই বৈরাগ্যের কারণ কী? যে—সভ্যতার এক—একটি স্তম্ভ মানুষ যুগে যুগে নিজের সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধি ব্যয় করে তৈরি করেছে, তাকে আজ কেন সেই মানুষই অট্টহাস্যে তাসের ঘরের মতো ধূলিসাৎ করে দিয়ে শান্তি পেতে চায়? এতদিন মানুষের কণ্ঠ থেকে বেঁচে থাকার যে রুদ্র সুর ধ্বনিত হয়েছে, আজ কেন সেখান থেকে মৃত্যুর করুণ রাগিণী, নীড়হারা পাখির বিলাপের মতো উৎসারিত হচ্ছে। আজ জীবন মিথ্যা, সভ্যতা মিথ্যা, শিল্প মিথ্যা, সংস্কৃতি মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা, সত্য শুধু মৃত্যু, সত্য শুধু অন্যায়, অবিচার, গর্বোদ্ধত স্বেচ্ছাচারিতা, পাশবিকতা। কেন? ধনতান্ত্রিক সভ্যতা নিজের গড়া শৃঙ্খলে নিজে আবদ্ধ হয়ে মহাযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে ভস্মীভূত করেছে। মানুষকে আজ তাই প্রাণহীন, ফাঁপা মনে হয়।

”…মহাযুদ্ধ এসে অকস্মাৎ পাশ্চাত্য ইতিহাসের একটা পরদা তুলে দিল। যেন কোন মাতালের আবরু গেল ঘুচে। এত মিথ্যা, এত বীভৎস হিংস্রতা নিবিড় হয়ে বহু পূর্বকার অন্ধ যুগে ক্ষণকালের জন্যে হয়তো মাঝে মাঝে উৎপাত করেছে, কিন্তু এমন ভীষণ উদগ্র মূর্তিতে আপনাকে প্রকাশ করেনি। তারা আসত কালো আঁধির মতো ধুলায়, আপনাকে আবৃত করে, কিন্তু এ এসেছে যেন আগ্নেয়গিরির আগ্নেয়স্রাব, অবরুদ্ধ পাপের বাধামুক্ত উৎস উচ্ছ্বাসে দিগদিগন্তকে রাঙিয়ে তুলে, দগ্ধ করে দিয়ে দূরদূরান্তে পৃথিবীর শ্যামলতাকে। তারপর থেকে দেখছি ইয়োরোপের শুভবুদ্ধি আপনার পরে বিশ্বাস হারিয়েছে, আজ সে স্পর্ধা করে কল্যাণের আদর্শকে উপহাস করতে উদ্ধত। আজ তার লজ্জা গেছে ভেঙে;…আজকাল দেখছি আপনাকে ভদ্র প্রমাণ করবার জন্যে সভ্যতার দায়িত্ববোধ যাচ্ছে চলে। অমানবিক নিষ্ঠুরতা দেখা দিচ্ছে প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালান্তর)

যখন যুদ্ধক্ষেত্রে চারদিকে বিকলাঙ্গ মানুষের মৃতদেহ ছড়িয়ে রয়েছে তখন মনোরাজ্যেও যে অনুরূপ বীভৎসতার সৃষ্টি হবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। নরমুণ্ডের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অপব্যবহার ও তার শোচনীয় পরিণামের কথা স্মরণ করে বৈজ্ঞানিকের মন আর বীক্ষণাগারের দিকে না ঝুঁকে দিব্যজ্যোতির সন্ধানে রহস্যাবৃত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে ঘুরে বেড়াবে, এ তো খুব স্বাভাবিক। স্বাধীনতা ও মানবতার বন্দনাগান গেয়ে গেয়ে যে—শিল্পীর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি এসেছে, সে—স্বাধীনতা ও মানবতার রূপ যখন নির্মম পাশবিকতা ও হিংস্রতার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে, তখন সে—শিল্পীর পক্ষে নৈরাশ্য, অবসাদ ও মৃত্যুর প্রশান্তি গাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। যে—ইয়োরোপ একদিন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বড়াই করেছে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির কাছে, এবং সত্যই যে ইয়োরোপের একদিন উদ্দেশ্য ছিল সভ্যতার মশাল জ্বেলে মানুষের চলার পথ আলোকিত করা, আজ তারই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যখন ফ্যাসিজম—এর নির্বিচার অমানবিকতা প্রকাশ পেয়েছে, মানুষের সভ্যতার, সংস্কৃতির উচ্চাদর্শকে অশ্রদ্ধা করে নির্লজ্জ রাহাজানির ইন্ধন জোগানো হচ্ছে, যখন শিল্পীকে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে সম্মানিত করা হচ্ছে, তখন মানুষ আতঙ্কে অবিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরতে যাবে। মানুষের মন চেতনার রাজসিংহাসন থেকে বিচ্যুত হয়ে অবচেতনার অন্ধকার প্রেতপুরীর মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। সেই ভয়ংকর আদিম অন্ধকার বন্যজন্তুর মতো আরণ্যক হিংস্রতায় যখন মানুষের দিকে লকলকে জিব বার করে চেয়ে থাকে, তখন মানুষের কণ্ঠ থেকে অসহায় মৃত্যুর যন্ত্রণা ও আর্তনাদ ভিন্ন অন্য কীশোনবার প্রত্যাশা আমরা করতে পারি? ‘জয়, বর্বরতার জয়!’ ‘জয়, নরহত্যার জয়!’ ‘জয়, কৃতঘ্নতার জয়!’ ‘স্বেচ্ছাচার দীর্ঘজীবী হোক!’—চারদিকে যখন এই মন্ত্র উচ্চারিত হয় তখন জীবন বা সভ্যতা অর্থহীন হয়ে যায়, মানুষ মিথ্যা হয়ে যায়, সত্য হয় শুধু মৃত্যু আর উচ্ছৃঙ্খল পাশবিকতার অবসাদ। মনে হয় মানুষের সভ্যতা আজ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেই আগুন চারদিকে পরিব্যাপ্ত হয়ে সবকিছু আত্মসাৎ করে নিচ্ছে, কোনো কিছুরই শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত থাকবে না। মানুষের মঙ্গলসাধনের যে—ব্রত নিয়ে বিজ্ঞান সভ্যতার জন্মদিনে জয়যাত্রা করেছিল, সে—ব্রত আজ মানবজাতির অকল্যাণকর স্তোত্রপাঠে পরিণত হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্যকে বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞান আজ হয়েছে বারবনিতার মতো ধনতান্ত্রিক সমাজরক্ষকদের রক্ষিতা এবং শিল্পেরও সেই একই শোচনীয় পরিণাম। বহির্জগতের বিরাট ওলটপালটের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ও শিল্পীর এই মানসিক বিপর্যয়, সংস্কৃতি—সংকটের রূপোপলব্ধির জন্য তা—ই বিশেষভাবে প্রণিধেয়।

মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করবার জন্য যে—বিজ্ঞান সর্বাপেক্ষা বেশি দায়ী, প্রথমে সেই মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে আলোচনা করা উচিত। যে—বিজ্ঞান বহির্জগতের প্রতি মানুষের উদাসীনতার ইন্ধন জুগিয়েছে, আর মানুষকে তার প্রত্যক্ষ প্রতিবেশ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্তরাভিমুখী করেছে, মৃত্যুকে দিয়েছে জীবনের চাইতে বেশি সম্মান, তার সর্বপ্রধান নায়ক হলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud)। ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানের সাধনা করে মানুষের সংস্কৃতিসম্ভার যে অনেক বাড়িয়েছেন তাতে কারও এতটুকুও সন্দেহ নেই। সাংস্কৃতিক দানের মধ্যে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনতত্ত্ব বুর্জোয়া শ্রেণির গর্বের বিষয়। কিন্তু বুর্জোয়া অধ্যাসের মধ্যে পরিপুষ্ট হয়ে ফ্রয়েডীয় প্রতিভা মানুষের ততখানি কল্যাণ করেনি, যতখানি তার করা উচিত ছিল। বুর্জোয়া শ্রেণির সেই সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে ফ্রয়েডীয় প্রতিভা বন্দি হয়ে আত্মহত্যা করেছে। তবু মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, মানুষের কামনা, বাসনা প্রভৃতি চরিতার্থতার জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষের যে অক্লান্ত প্রয়াস, বহির্জগতের কঠিন প্রস্তরভূমিতে আহত হয়ে যেসব দুর্দমনীয় অভিপ্রায় চেতনার রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে অন্তরের নিভৃততম মণিকোঠায় আত্মগোপন করে থাকে, তাদের প্রতি ফ্রয়েডের অসীম শ্রদ্ধা এ—যুগের এবং পরবর্তী যুগের মানুষের কাছেও স্মরণীয় থাকবে। ফ্রয়েড সেইজন্য অবশ্যই আমাদের নমস্য।

প্রাক—সামরিক যুগে মনোবিজ্ঞান মানুষের মনে যে ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, সমরোত্তরকালে অর্থনীতি তার স্থান দখল করেছে। ধনতান্ত্রিক সংকটের ফলে মানুষের মন মনোবিজ্ঞানের মোহময় রাজ্য ছেড়ে অর্থনীতির নির্মম জগতের দিকে ফিরে চেয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণির বিজয়পতাকা যখন উড়ছে, ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস যখন ভাঙেনি, জীবনের উপর অধিকার যখন ক্ষুণ্ণ হয়নি, তখন মনোবিজ্ঞানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল তাদের কাছে। মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা তখন মহাসমারোহে আরম্ভ হয়ে ফ্রয়েডের জয়বার্তাই ঘোষণা করেছিল। তারপর ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক সংকটের গুঁতো আর ঝাঁকুনি খেয়ে মনোবিজ্ঞান তার স্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আজ ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞান সেইজন্যই টলটলায়মান।

তাই মানুষ যখন আজ যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তাক্ত দেহে মৃত্যুকে বরণ করছে, যন্ত্রের উন্নতি ও উৎপন্ন পণ্যের প্রাচুর্যের দিনে আজ আর্থিক সংকট যখন বুভুক্ষু মানুষের বুক থেকে শেষ রক্তবিন্দুটুক পর্যন্ত শুষে নিচ্ছে, তখন মনোবিজ্ঞান গর্ব করে মানুষকে মুক্তির পথের সন্ধান দিচ্ছে এই বলে যে :

Even in the most material field, that of economics, psycho-analysis has shown that it is rare for anyone to think freely and behave ‘normally’ where money is concerned. One of the most surprising discoveries of psychoanalysis was that the idea of money is frequently a direct symbol of that of bodily dirt in the unconscious, and that the various complicated reactipons to do with the latter idea constantly influence conscious judgements about money matters… Free association of ideas takes us to the subject of war itself, certainly one of the gravest sociological problems. Here psychoanalytic investigations have shown the complexity of the factors concerned and the impossibility of radically coping with them unless their unconscious roots are thoroughly examined and understood. Compared with comprehensive study of this kind, the present vague propaganda exhortations to denounce war are but pitiful fumblings, about the efficacy of which few serious thinkers are deceived.

 —Ernest Jones : Psychoanalysis

”মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেখানে অর্থের সম্বন্ধ আছে সেখানে মানুষের কাছ থেকে স্বাধীন চিন্তা বা স্বাভাবিক ব্যবহার প্রত্যাশা করা যায় না। অর্থ প্রায়ই অবচেতন মনে শরীরী অপরিচ্ছন্নতার প্রত্যক্ষ প্রতীকস্বরূপ এবং এই ধারণার অভ্যন্তরীণ জটিলতা অর্থ সম্বন্ধে সচেতন বিচার—বিশ্লেষণের উপর প্রভাব বিস্তার করে। মুক্ত ভাবানুষঙ্গের ফলে আমরা প্রায়ই যুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হই, এবং এ—ব্যাপারে যে একটি গভীর সমাজনৈতিক সমস্যা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে এই সমস্যার মূল অবচেতন কারণগুলিকে যতক্ষণ না বিশ্লেষণ করা হবে ততক্ষণ এর সমাধান অসম্ভব। মনোবিজ্ঞানের এই গবেষণামূলক অধ্যয়নের কাছে যাঁরা যুদ্ধবিরোধী প্রচারকার্যে নিযুক্ত থাকেন তাঁদের সাফল্য হাস্যকর বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।”

বহির্মুখী বিপ্লবী গতিশীল মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে অন্তর্মুখী স্থাণু ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানের এই হল পার্থক্য। ফ্রয়েডীয় থেরাপি কোনো নিউরটিক ব্যক্তিকে বিশ্লেষণ করে পরীক্ষায় সফল হতে পারে, কিন্তু সাম্প্রতিক সভ্যতার নিউরটিক ও সাইকোটিক দিকগুলিকে বিচার করে তাকে ব্যাধিমুক্ত করতে হলে ফ্রয়েডীয় ব্যক্তিক বিশ্লেষণে কৃতকার্য হওয়া সম্ভব নয়। কার্ল মার্কস বলেন যে উৎপাদনক্রিয়ার এমন বৈশিষ্ট্য যে উৎপাদন—প্রণালীর মধ্যে মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়, এবং সেই সম্বন্ধ অনুযায়ী মানুষের অভ্যাস, রুচি, চিন্তা ও কার্যধারা, এককথায় মানুষের স্বভাব গড়ে ওঠে। সুতরাং মানুষের স্বভাব দ্বারা ঐতিহাসিক সত্যকে ব্যাখ্যা করা যায় না, ঐতিহাসিক গতির মধ্যে মানুষের স্বভাব বিভিন্নভাবে গঠিত হয়। কোনো বৈজ্ঞানিকই এই গতিশীল ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করেননি, এবং ফ্রয়েডও উৎপাদন—প্রণালীকে উপেক্ষা করে জনন—প্রণালীর (Reproductive Process) উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ফ্রয়েডীয় পদ্ধতির দুটি প্রধান গলদ হচ্ছে—(১) সমাজের উৎপাদন—প্রণালীকে অগ্রাহ্য করেও সভ্য মানুষের জনন—প্রণালী সুন্দরভাবে অধ্যয়ন করা সম্ভব, এবং (২) যৌন—প্রণালীর উপসর্গগুলি বিশ্লেষণ করলে মানুষের স্বভাবের অন্তর্নিহিত অভাবগুলির যে—পরিচয় পাওয়া যায় তার দ্বারাই আধুনিক সভ্যতার দূরবস্থার কারণ উল্লেখ করা সম্ভব হতে পারে। নীচে থেকে উপরে না দেখে এইভাবে উপর থেকে দৃষ্টি দিয়ে মানুষ ও সভ্যতাকে বিচার করবার ফলে ফ্রয়েড অনেকদিন পরেও প্রকৃতপক্ষে ধনতন্ত্রের জয়গানই গেয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে ফ্রয়েড লিখেছেন :

‘I cannot enquire into whether the abolition of private property is advantageous and expedient. But I am able to recognize that psychologically it is founded on an untenable illusion. By abolishing private property one deprives the human love of aggression of one of its instruments, a strong one undoubtedly, but assuredly not the strongest. It in no way alters the individual differences in power and influence which are turned by aggressiveness to its own use, nor does it change the nature of instinct in any way.”

—Sigmund Freud : Civilisation and its Discontents

”ব্যক্তিগত মালিকানাপ্রথা উচ্ছেদের ফলে কোনো সুবিধা বা উপকার হবে কি না আমি বলতে পারি না। তবে এই প্রথা তুলে দিলে মানুষের হিংসা—কাতরতার একটি অস্ত্র থেকে যে মানুষকে বঞ্চিত করা হবে তাতে ভুল নেই, কিন্তু সে—অস্ত্র সর্বপ্রধান অস্ত্র নয়। প্রভাবে ও শক্তিতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পার্থক্য তাতে বদলাবে না, এবং মানুষের সাহসিক বৃত্তিরও কোনো পরিবর্তন হবে না।”

এইভাবে ফ্রয়েড মানুষিক বৃত্তির প্রতিচ্ছবি হিসাবে জগৎ ও সভ্যতাকে বিচার করেছেন, যেমন করেছিলেন হেগেল জগৎকে মনের প্রতিবিম্ব হিসাবে। কোনো উন্মাদ ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ স্নায়বিক ছন্দপতন ও বিপর্যয়ের কারণকে ফ্রয়েড পরিবর্ধিত করে সভ্যতা ও সংস্কৃতি—সংকটের রূপ বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। অথচ এই মনোবিজ্ঞানকে কীভাবে সাম্যবাদী সমাজে প্রয়োগ করা হচ্ছে দেখলে বোঝা যাবে ফ্রয়েড তাঁর সমস্ত বৈপ্লবিক আবিষ্কার সত্ত্বেও ভুল দৃষ্টিকোণের জন্য তাঁর বিজ্ঞানকে যথেষ্ট মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারেননি। রোজেনস্টাইন সাম্যবাদী মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে বলেছেন :

We seek to make an environment that will allow of mental health, to end conditions that create conflicts. The old psychiatry shut itself up in the hospital or clinic. Doctors had no opportunity to study patients at work. Today our psychiatrists go out to shop, school, factory, field and farm, and not only study the workers and the conditions of their work but try to see that these are such as will not create nervous troubles.

 —Quoted in Samuel. D. Schmalhausen’s

 “The New Road to Progress”

”আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের উপযোগী প্রতিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করি, এবং যাবতীয় বিরোধ দূর করা আমাদের লক্ষ্য। প্রাচীন মনোবৈজ্ঞানিক হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিজেকে বন্দি করে রাখতেন রুগিকে স্বাভাবিক অবস্থায় পরীক্ষা করবার সুযোগ তাঁদের ঘটত না। আমাদের মনোবৈজ্ঞানিকেরা আজ দোকানে, স্কুলে, কারখানায়, সর্বত্রই শ্রমিকদের অবস্থা প্রত্যক্ষভাবে বিচার করবার জন্য যান, এবং চেষ্টা করেন যাতে তাদের কোনোরকম মানসিক গণ্ডগোল না ঘটে এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে।” এইখানে ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মার্কসীয় মনোবিজ্ঞানের প্রভেদ। ফ্রয়েড প্রত্যক্ষ প্রতিবেশ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মানুষের অন্ধকার অন্তর্দেশে প্রবেশ করেন, এবং নানারকম স্নায়ু ও ইন্দ্রিয়ের অলিগলির ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করে শেষকালে মানুষের আদিম সহজ বৃত্তি বা যৌনাকাঙ্ক্ষার পরিত্যক্ত নির্জন শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং আদিম অন্ধকারকে সত্য প্রতিপন্ন করে মৃত্যুর জয়ডঙ্কা বাজান। মার্কসীয় মনোবিজ্ঞান বহির্জগৎ থেকে অভিযান শুরু করে, মানুষের সৃষ্ট পরিবেষ্টনের মধ্যে মানুষের মনের প্রতিক্রিয়ার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে, সভ্যতার প্রশস্ত পথের উপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে আলোকের সন্ধান পায়; সভ্যতার অগ্রগতি সেইজন্য সত্য হয়ে ওঠে, মানুষ জীবন্ত হয়ে, এবং যা কিছু সাংস্কৃতিক বিকার তার পূর্ণ আরোগ্যলাভেও আস্থা রাখে। ফ্রয়েড সেইজন্য বলেন :

An instinct would be a tendency in living organic matter impelling it towards reinstatement of an earlier condition, one which it had abandoned under the influence of external disturbing forces—a kind of organic elasticity, or to put it another way, the manifestation of inertia in organic life… Through a long period of time the living substance may have…had death within easy reach… until decisive external influences altered in such a way as to compel the still living substance to ever greater deviations from the original path of life, and to ever more complicated and circuitous routes to the attainment of the goal of death. These circuitous ways to death, faithfully retained by the conservative instincts, would be neither more nor less than the phenomena of life as we know it. If the exclusively conservative nature of the instincts is accepted as true, it is impossible to arrive at any other suppositions with regard to the origin and goal of life.

 —Sigmund Freud : Beyond the Pleasure Principle

জীবন্ত জৈব পদার্থের যে—গুণ আদিম অবস্থার দিকে তাকে আকর্ষণ করে, ফ্রয়েড তাকে সহজ বৃত্তি বলেছেন। বাইরের প্রভাবে এই জীবন্ত পদার্থ জীবনের প্রধান পথ থেকে দিগভ্রষ্ট হয়ে বহু সর্পিল পথের উপর দিয়ে মৃত্যুতীর্থের দিকে অগ্রসর হয়। সহজ বৃত্তির এই স্বাভাবিক ধর্মে বিশ্বাস করলে জীবনের উৎপত্তি ও পরিণতি একমাত্র মৃত্যু ভিন্ন অন্য কিছু ভাবা যায় না। মৃত্যুচিন্তায় অবশ হয়ে ফ্রয়েড বাইরের প্রভাবকে শেষ পর্যন্ত একেবারে অস্বীকার করে ঘোষণা করলেন : “The goal of all life is death.” অসাধারণ প্রতিভাশালী ফ্রয়েড সেইজন্য নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতাকে স্বীকার করে গিয়েছেন, এবং সাম্প্রতিক ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অবনমিত পরিবেষ্টনে পুষ্ট বিপন্ন ও বিপর্যস্ত মানুষকে তিনি কোনো আশা দিতে পারেননি।

“My courage fails me, therefore, at the thought of rising up as a prophet before my fellowmen, and I bow to their reproach that I have no consolation to offer…..”

 —Sigmund Freud : Civilisation and its Discontents

দীর্ঘদিন মানুষের মনোরাজ্যের পথে পথে ভ্রমণ করে ফ্রয়েড বললেন যে মানুষ সহজ বৃত্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ, মানুষ নির্মম সাদি (Sadist), মানুষের অন্তরের জিঘাংসা ও যৌনবৃত্তির বহ্নি অনির্বাণ, মানুষ উন্মাদ এবং আদিমতার কারাগারে চিরযুগ বন্দি, মানুষের জীবন মৃত্যুর গোলাম। সুতরাং মানুষের কোনো মুক্তি নেই, যে—পরিবেশ মানুষকে আজ শুষে নিচ্ছে, মানুষের মজ্জা পর্যন্ত নিঙড়ে নিচ্ছে, তাকে সুন্দরতর পরিবেশে রূপান্তরিত করা মানুষের সাধ্য নয়, কারণ পিছনে রয়েছে আদিমের প্রচণ্ড আহ্বান, চিরজাগ্রত বর্বর মানুষের হুমকি, সেই যৌনক্ষুধার তাড়না, সেই অত্যাচারী, হিংসাত্মক মনোবৃত্তির হাতছানি। মানুষের মুক্তি নেই, জীবনের পরিত্রাণ নেই। মৃত্যুই জীবনের শ্রেষ্ঠ ও শেষ লক্ষ্য। যুগ যুগ ধরে সেই অচঞ্চল লক্ষ্যের দিকে মানুষ ছুটে চলেছে, বাইরের প্রভাব শুধু ঘূর্ণায়মান পথের দূরত্ব বাড়াতে পারে, কিন্তু মানুষের গতি সেইদিকেই রয়েছে, সেই নিবিড় অন্ধকার, আদিম অন্ধকার, মৃত্যুর দিকে।

এরপরে স্পেংলার—এর নৈরাশ্যবাদ ও প্রগতিবাদ—বিমুখতার কারণ বুঝতে আর কষ্ট হয় না, মুমূর্ষু ধনতান্ত্রিক সভ্যতার শেষ সংগীত স্পেংলার—এর মারফত আমাদের কানে ভেসে আসে :

Already the danger is so great, for every individual, every class, every people, that to cherish any illusion whatever is deplorable. Only dreamers believe that there is a way out. Optimism is cowardice. We are born into this time and must bravely follow the path to the destined end. There is no other way…. The honourable end is the only thing that cannot be taken from a man.

বিপদ ক্রমেই এমন ঘনীভূত হয়ে উঠছে, যে প্রত্যেক মানুষকে ও শ্রেণিকে সমস্ত আশা—আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিতে হবে। ওসব মিথ্যা, ভ্রম। একমাত্র স্বপ্নবিলাসীই বিশ্বাস করতে পারে যে এ—অবস্থায় মুক্তি সম্ভব। আশাবাদ এখন কাপুরুষতারই নামান্তর। যখন এই সময়েই আমরা জন্মেছি, তখন সাহস করে নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যাব, তা ভিন্ন আর অন্য কোনো উপায় নেই। স্পেংলার মনে ভাবেন যে সভ্যতা একটা বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ, কোনো কিছুরই অগ্রগতি হয় না।

এজরা পাউন্ড ও টি. এস. এলিয়টও প্রগতিবিমুখ। পাউন্ডের দার্শনিক দৃষ্টি স্পেংলার—এর অনুবর্তী, তিনিও বিশ্বাস করেন সভ্যতা বৃত্তবদ্ধ—ব্যক্তি তারই বুকে সমধর্মী বুদবুদ। পাউন্ড তাঁর Cantos—এর মধ্যে সেইজন্য কোনো ঐতিহাসিক পারম্পর্য গ্রাহ্য করেননি, কোনো নায়ক নেই, এমনকী দেশকালের কোনো বিচার পর্যন্ত নেই। মহাযুদ্ধ ও এলিয়ট অর্থনৈতিক সংকট ও অডেন, পিপলস ফ্রন্ট ও স্পেন্ডার ও ডে ল্যুইস, মোটামুটি সমরোত্তর ইংরেজি কাব্য এইভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এলিয়টের ‘Gerontion’ বৃদ্ধ, তার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, যাবতীয় কাজ তার শেষ হয়ে গিয়েছে, রয়েছে শুধু “Thoughts of a dry brain in a dry season”।

My house is a decayed house,
And the jew squats on the window still, the owner,
Spawned in some estaminet of Antwerp,
Blistered in Brussels, patched and peeled in London
The goat coughts at night in the field overhead;
Rocks, moss, stone crop, iron, merds.
The woman keeps the kitchen, makes tea,
Sneezes at evening, poking the peevish gutter,
 I an old man.
A dull head among windy spaces,

 —Gerontion.

বৃদ্ধ শুধু গৌরবময় অতীতের স্বপ্ন দেখে

…in the juvenesence of the year
Came Christ the tiger.

এ হচ্ছে ১৯২০ সালের কথা। দু বৎসরের মধ্যে বৃদ্ধ Gerontion হয়েছে Tiresias, এবং The Waste Land—এর মধ্যে কতকগুলি টুকরো প্রতিরূপ একত্রে গ্রথিত করা হয়েছে।

What are the roots that clutch, what branches grow
Out of this stony rubbish? Son of man,
You cannot say, or guess, for you know only
A heap of broken images…
 —The Burial of the Dead

ওয়েস্টল্যান্ড ক্যাথলিক গির্জার স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়; ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’ হচ্ছে তার ভিত্তি। সাম্প্রতিক সভ্যতার বিপর্যস্ত পরিবেশের অন্তরালে মানুষের আদিম ধর্মবিশ্বাস শিকড় গেড়ে রয়েছে। এখানে ফ্রয়েডের সঙ্গে এলিয়টের মতৈক্য আছে। রিচার্ডস বলেছেন যে ওয়েস্টল্যান্ড—এ এলিয়টের ‘Severance between his poetry and all belief’—এর পরিচয় পাওয়া যায়—In the destructive element immerse. That is the way”—কিন্তু “The Fire Sermon”—এর মধ্যে।

O Lord Thou Pluckest me out
O Lord Thou Pluckest
burning

—এলিয়টের বিশ্বাসের সাক্ষ্য মেলে। ধ্বংসের মধ্যে যে—নৈরাশ্য ‘What the Thunder Said’—এ তা—ই অভিব্যক্ত হয়েছে।

What is that sound high in the air
Murmur of maternal lamentation
Who are those hooded hordes swarming
Over endless plains, stumbling in cracked earth
Ringed by the flat horizon only
What is the city over the mountains
Cracks and reforms and bursts in the violet air
Falling towers
Jerusalem Athens Alexandria
Veinna London
Unreal

প্রতিকূল প্রতিবেশের মধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে এলিয়ট শেষ পর্যন্ত মধ্যযুগের সুন্দর সংহত শান্তির মধ্যে ফিরে যাওয়াই স্থির করলেন। মধ্যযুগের শিল্প ও জীবন প্রাথমিক অবস্থায় থাকার ফলে ধর্ম ছিল তাদের উপর পক্ষ বিস্তার করে। গির্জার অতি—প্রাধান্যের জন্য তাদের প্রসার সম্ভব হয়নি। ধর্মকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগ সংস্কৃতির বিচিত্র ধারাকে একটি সমন্বয়ের প্রবাহে মিলিত করতে সক্ষম হয়েছিল, এবং এলিয়ট বর্তমান সভ্যতার বিরোধ, হীনতা ও দীনতার মধ্যে জীবনের পূর্ণতার কোনো হদিশ না পেয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিতৃপ্তির জন্য সেই সমন্বয় ফিরে চান। গির্জার অভিভাবকত্বে মধ্যযুগীয় সাংস্কৃতিক সমন্বয় এলিয়টের কাম্য। ‘Choruses from the Rock’—এর মধ্যে সেই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হয়েছে :

Men have left GOD not for other gods, they say, but for no god, and this has never happened before

That men both deny gods and worship gods, professing first Reason

And then Money, and Power, and what they call Life, or Race, or Dialectic.

The Church disowned, the tower overthrown, the bells up-turned, what have we to do

But stand with empty hands and palms turned upwards

In an age which advances progressively backwards?

ড্রয়িং রুমে প্রুফ্রকের সাহচর্য ছেড়ে ওয়েস্টল্যান্ড পার হয়ে এলিয়ট শেষকালে পৌঁছোলেন সৃষ্টি ও সমালোচনার তীর্থসংগমে। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার তাঁর কাছে কোনো মূল্য নেই। জীবন ও সভ্যতার একমাত্র মানদণ্ড হল শাশ্বত ধর্ম, ক্যাথলিক গির্জা।

সভ্যতার পূতিগন্ধ শহরের দৈনন্দিন জীবনের বাইরে পল্লি অঞ্চলেরপ্রতিবেশ পর্যন্ত কলুষিত করেছে। সেখানেও আর সেই প্রশান্ত জীবন নেই, জীবনের ছন্দপতন ঘটেছে।

Here too corruption spreads its peculiar and emphatic odours.

And life lurks, evil, out of epoch.

অডেন ও ইশারউড ‘The Dog Beneath the Skin, or where is Francis?’ নামক গীতিনাট্যের মধ্যে ইয়োরোপের সামাজিক ও নৈতিক জীবনের শোচনীয় অবনতিকে বিদ্রুপ করেছেন। ইয়োরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আজ শুধু বিরাট ধাপ্পা ভিন্ন আর কিছু নয়, এবং ধাপ্পাবাজ শাসনকর্তারা ভদ্রতার মুখোশ পরে অন্তরালে লম্পট ও বর্বরের মতো একশ্রেণিকে শোষণ করে ফাঁপছেন। সেইজন্য জীবনে কোথাও শান্তি নেই, চারদিকে অশান্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতা। অডেন ও ইশারউডও ওয়েস্টল্যান্ড অতিক্রম করে যেতে পারেননি, তবে নূতন কোনো গ্রেলের সুদূর ইঙ্গিত তাঁরা দিয়েছেন।

মরণোন্মুখ ধনতান্ত্রিক সমাজ কত দূর পর্যন্ত যে তার কদর্য প্রভাব বিস্তার করতে পারে; ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী এইচ জি. ওয়েলস (H. G. Wells) তার প্রমাণ। ওয়েলস তাঁর আত্মজীবনীর মধ্যে ‘হা অদৃষ্ট’! বলে আক্ষেপ করে বলেছেন যে আজীবন তিনি তাঁর মস্তিষ্ককে যথাসাধ্য ঝাঁকুনি দিয়ে বিপন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে উদ্ধার করবার জন্য চেষ্টা করেছেন, কীসে মানুষের মঙ্গল হবে, জাতির কল্যাণ হবে, পৃথিবীতে আবার শান্তিরাজ্য স্থাপিত হবে তার জন্য বেতার, গ্রামোফোন, যৌনতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, উপন্যাস, গল্প, রূপকথা প্রভৃতি এমন কিছু নেই যা তিনি চর্চা করেননি, কিন্তু পদেপদে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, পরাজিত হয়েছেন, ঠকেছেন, তাঁর উপদেশ তাঁর প্রভুরা হেলায় অগ্রাহ্য করেছে, তিনি উন্মত্ত বৃষের মতো দ্বারে দ্বারে প্রাণপণ চিৎকার করে ঘুরেছেন তবু কেউ তাঁর মূল্যবান উপদেশ, তত্ত্বকথা ও বাণী শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করেননি, পিঠ থাবড়ে, ”বহুত আচ্ছা” বলে গা—ঢাকা দিয়েছেন। ওয়েলসের বিশ্বাস যে তাঁর মতো অসাধারণ প্রতিভাশালী বুদ্ধিবাদী বা জীবীরা মানুষের জীবনকে ভেঙেচুরে নূতন ভিত্তির উপর গড়বার চেষ্টা করছেন, এবং যদি কেউ, সমাজের কোনো শ্রেণি, মানবসভ্যতাকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন তাহলে একমাত্র বুদ্ধিজীবীরাই হবেন। ওয়েলস বলেন : “We originative intellectual workers are reconditioning human life.” কিন্তু দুঃখের বিষয় শাসকশ্রেণির জঘন্য একগুঁয়েমির জন্য “We had… in plain English to be outwitted, cheated, discredited, and frustrated…” তিতিবিরক্ত হয়ে ওয়েলস সেইজন্য বলেছেন যে : “It made me waver towards the dogma of the class war.” শাসকশ্রেণির উপর অভিমান করে মহাপণ্ডিত ওয়েলস শেষ পর্যন্ত শ্রেণিসংগ্রামের সংস্কারের দিকে আকৃষ্ট হননি। মনিবেরা জানেন ওয়েলসের মতো বুদ্ধিমান নোকরদের কীভাবে খুশি রাখতে হয়। ওয়েলসের অভিমান দূর করতে তাঁদের বেগ পেতে হয়নি। ওয়েলস তারপরেই মস্তিষ্ক হেলিয়ে শান্তির দিনে শ্রমিকদের আনুগত্য দেখে বিদ্রুপ করে বলেছেন :

‘And this’, thought I, ‘is the reality of democracy; this is the proletariat of dear old Marx in being. This is the real people. This seething multitude of vague kindly uncritical brains is the stuff that old dogmatist counted upon for his dictatorship of the proletariat, to direct the novel and complex organisation of a better world’ The thought suddenly made me laugh aloud.

—H. G. Wells : Experiment in Autobiography

ওয়েলসের এই মতের সঙ্গে ‘Intellectual hooligan’—স্পেংলার—এর বক্তব্য তুলনা করা চলে :

No good retainer dreams of regarding peasants as his equals, and every foreman who knows his job refuses to allow unskilled labourers to address him on terms of equality. This is the natural feeling in human relations Equal rights are contrary to nature…..

 —Osward Spengler : The Hour of Decision

ওয়েলসের ধূমায়মান মগজপ্রসূত সর্বশেষ থিসিস (The New World Order) হচ্ছে : “Waste no more time on the spectacle of the Marxist putting the cart in front of the horse and tying himself up with the harness.” এবং মার্কসীয় দর্শন অনুসারে “to suggest that all people of wealth and capacity living in a community in which unco-ordinated private enterprise plays a large part are necessarily demoralised by the advantages they enjoy and that they must be dispossessed by the worker and the peasant….”—ওয়েলস—এর মতে নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত। অর্থাৎ ওয়েলস বলেন যে বুর্জোয়া শ্রেণি বা ধনিকগোষ্ঠী যে অনিষ্টকর হবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। নির্বোধ কৃষক ও শ্রমিকদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই সমস্ত জটিল সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাবে এ—কথা প্রতিপন্ন করা মূর্খতা। ধনিকগোষ্ঠী সভ্যতার কল্যাণকামী এখনও রয়েছেন, প্রয়োজন শুধু ওয়েলসের মতো অসাধারণ মগজের। ওয়েলসের বদ্ধমূল ধারণা তাঁর মতো কয়েকজন ব্যক্তি পর্বত—পাণ্ডিত্য নিয়ে মানুষের সবকিছু বিপদ—আপদ জয় করতে পারবেন, নিরেট মূর্খ শ্রমজীবীদের কোনো শক্তি নেই। শ্রমিকদের উপর মস্তিষ্কের প্রভুত্ব করা তাঁদেরই ন্যায্য অধিকার, সে—অধিকার থেকে তাঁদের যেসব উন্মাদ মার্কসপন্থীরা বঞ্চিত করতে চান তাঁরা পৃথিবীর অমঙ্গলকে আহ্বান করে আনেন। ওয়েলসের এই কাল্পনিক বুদ্ধিবাদীর রাজ্য গঠনের প্রস্তাবে স্ট্যালিন উত্তর দিয়েছিলেন :

The technical intelligentsia can, under certain conditions, perform miracles and greatly benefit mankind. But it can also cause great harm. We Soviet people have got a little experience of the technical intelligentsia. After the October Revolution a certain section of the technical intelligentsia refused to take part in the work of construction the new society, they opposed this work of construction and sabotaged it…Of course things would be different if it were possible at one stroke spiritually to tear the technical intelligentsia away from the capitalist world. But that is Utopia. Are there many of the technical intelligentsia who would dare break away from the bourgeois world and set to work to reconstruct society? Do you think there are many people of this kind, say, in England or in France? No; there are few who would be willing to break away from employers and begin reconstructing the world.

 —Stalin-Wells Talk

”বুদ্ধিজীবীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ও অবস্থায় বিস্ময়কর কিছু করতেও পারেন এবং তাতে মানুষের উপকারও হতে পারে। কিন্তু তাঁরা অনেক সময় ক্ষতিও করে থাকেন। আমরা, সোভিয়েট জনসাধারণ, আমাদের এই বুদ্ধিজীবী সম্বন্ধে বিশেষ কম অভিজ্ঞতা নেই। অক্টোবর বিপ্লবের পর বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একদল আমাদের নূতন সমাজ গঠনকার্যে সহায়তা করতে আপত্তি করেছিলেন, এমনকী আমাদের কাজের ক্ষতি করতেও কুণ্ঠিত হননি। … অবশ্য যদি কোনো ভৌতিক উপায়ে তাঁদের ধনিকগোষ্ঠীর কবল থেকে উদ্ধার করে আনা যায়, তাহলে হয়তো অন্য কিছু তাজ্জব ব্যাপার ঘটতে পারে। কিন্তু তা হয় না, ও—আশা কল্পনাবিলাস ভিন্ন কিছু না। কজন বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা তাঁদের ধনিক প্রভুদের আওতা ছেড়ে নূতন সমাজগঠনে সাহায্য করবেন? আপনি কি ভাবেন যে ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে সেরকম বুদ্ধিজীবী অনেকেই আছেন? নেই, থাকতে পারে না, কারণ প্রভুর ছায়াতল ছেড়ে নূতন সমাজগঠনের কাজে কোনো বুদ্ধিজীবীই নিযুক্ত হতে সম্মত হবেন না।”

ওয়েলসের মতো বহু পণ্ডিত, এমনকী মনীষী রাসেল পর্যন্ত কাল্পনিক রাজ্যে বাস করেন। কিন্তু রাসেল যে—সংযম ও প্রজ্ঞা—নিষ্ঠার জন্য আমাদের শ্রদ্ধা দাবি করতে পারেন, ওয়েলস তার পরিবর্তে পেতে পারেন তাচ্ছিল্য—মিশ্রিত করুণা, এবং শ্রেণিনির্বিশেষে সকলের অশ্রদ্ধা। রাসেল সাম্যবাদের অধিবক্তা না হলেও তার গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলি স্বীকার করবার মতো সৎসাহস তাঁর আছে। রাসেল আধুনিক শিক্ষার সমস্যা সম্বন্ধে বলেছেন :

Communism offers a solution of the difficult problem of the family and sex equality… It gives children an education from which the anti-social idea of competition has been almost entirely eliminated. It creates an economic system which appears… to be the only practicable alternative to one of masters and slaves. It destroys that separation of the school from life which the school owes to its monkish origin, and owing to which intellectual, in the West, is becoming an increasingly useless member of society. It offers to young men and women a hope which is not chimerical and an activity in the usefulness of which they feel no doubt. And if it conquers the world as it may do, it will solve most of the major evils of our time. On grounds, in spite of reservations, it deserves support.

—Bertrand Russell : Education and the Modern World

এখানে রাসেল সাম্যবাদের সব গুণগুলিকে স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি। পরিবার ও যৌন—সমস্যার সমাধান একমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই সম্ভব। সাম্যবাদী শিক্ষার ফলে শিশুদের মন থেকে সমাজবিরোধী প্রতিযোগিতার ভাব দূর হয়ে যায় এবং এমন অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয় যেখানে প্রভু ও ক্রীতদাসের ব্যবধান থাকে না। সাম্যবাদী সমাজে জীবন থেকে শিক্ষালয় বিচ্ছিন্ন করা হয় না, পশ্চিমে যে—বিচ্ছেদের ফলে বুদ্ধিজীবীরা সমাজের কাছে অকর্মণ্য হয়ে রয়েছে। সাম্যবাদ আধুনিক তরুণ—তরুণীদের মনে যে—আশার সঞ্চার করে সে—আশার আলো আলেয়ার মতো মিথ্যা নয়। সাম্যবাদ যদি পৃথিবীতে জয়ী হয়, এবং জয়ের সম্ভাবনা তার আছে, তাহলে এ—যুগের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। এই কারণে, কিছু ত্রুটি থাকলেও, রাসেল বলেন সাম্যবাদ সমর্থনযোগ্য।

মনীষী রাসেলের এই সৎসাহসের চিহ্ন ওয়েলসের কেতাবের স্তূপ হাতড়ালে কোথাও পাওয়া যাবে না। ওয়েলসের আকাশস্পর্শী পাণ্ডিত্যাভিমান থেকে তাঁর নিজস্ব শ্রেণিধর্মের প্রতি আনুগত্যই প্রমাণিত হয়। পণ্ডিতগর্দভ ওয়েলস নিজের পেটি—বুর্জোয়া আদর্শের পিছনে চিরদিন ছুটেছেন, এবং মরীচিকা অনুসরণ করে নিজের বিদ্যার অহংকারে অন্ধ হয়ে তিনি মার্কসকে বিদ্রুপ করতেও ছাড়েননি। ওয়েলসের প্রত্যেক তথাকথিত গবেষণামূলক রচনার মধ্যে মার্কসকে নির্মমভাবে শ্লেষ করবার যে অমার্জনীয় ধৃষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে, তা তাঁর মতো প্রায় সব ত্রিশঙ্কু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অধুনা শিল্পীরা যে নৈরাশ্যবাদ ও মৃত্যুযন্ত্রণার নরকের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, সেখান থেকে তাঁদের মুক্তি নেই যতদিন না তাঁরা সমাজের প্রত্যক্ষ ঐতিহাসিক বাস্তবকে অন্তরের সহিত উপলব্ধি করতে পারবেন। সে—উপলব্ধি একমাত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিরলম্ব মঞ্চ ত্যাগ করাতেই সম্ভব। স্পেংলার ও ওয়েলস আজ সেই নিরলম্ব মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কালাপাহাড়ি তাল ঠুকে রাসভের মতো চিৎকার করে ধ্বংসোন্মুখ ধনতান্ত্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির দীর্ঘায়ু কামনা করছেন। আজ সংস্কৃতির বিচিত্র ধারাকে ভবিষ্যতের সমন্বয়ের প্রবাহে মিলিত করবার দায়িত্ব একমাত্র সাম্যবাদীদের।

সংকট কোথায়? আবর্জনাকীর্ণ এ—পৃথিবীর মরুপ্রান্তরের কোণ থেকে বৃদ্ধ জিরনশানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—’আমার গৃহ ধ্বংসোন্মুখ’—‘‘My house is a decayed house”—আকাশে—বাতাসে প্রাসাদ ভাঙার শব্দ, জেরুজালেম, এথেন্স, আলেকজান্ড্রিয়া, ভিয়েনা, লন্ডন ধসে পড়ছে, সব অবাস্তব, অত্যাচারী, স্বার্থপর, অর্থপিশাচ মানুষের চলাচল চারদিকে, পঙ্গু জীবনের গতির ছন্দ শিথিল হয়ে এসেছে, মানুষের দুর্গন্ধে বাতাস কলুষিত—মুক্তি কোথায়? মুক্তির কথা, স্পেংলার বলেন, উন্মাদের প্রলাপ ভিন্ন কিছু না,—‘‘Everything-become is mortal, not only peoples, languages, races but Cultures are transient”—সুতরাং ধ্বংস অনিবার্য; আজ সেই অদৃষ্টকে হাসিমুখে মানুষের বরণ করা উচিত। বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির যে—সংগ্রাম সেই সংগ্রামের জয়ে যে নূতন সমন্বিত সভ্যতার সৃষ্টি হবে তার মধ্যে মানুষ আবার নূতন মুক্ত জীবনের আস্বাদ পাবে। ওয়েলস বলেন মার্কসের এই গোঁয়ারতুমি অর্থহীন, মূর্খ শ্রমজীবীদের দ্বারা মুক্তি সম্ভব নয়, তাঁর মতো ভোজবাজি থেকে যৌনতত্ত্ব ও রাজনীতি পর্যন্ত সর্ববিদ্যাবিশারদদের দ্বারা সভ্যতার ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব।

সংকট এইখানে। ওয়েলস ও স্পেংলার—এর এই শূন্যগর্ভ দর্শনের মূল কোথায় সন্ধান করলেই সংকটের কারণ বোঝা যাবে, এবং এ—সংকট যে সংগ্রামের দ্বারা জ্ঞেয় তা—ও বিশ্বাস্য হবে। পরের অধ্যায়ে এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে আলোচ্য বিষয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *