০৯. বিজ্ঞান মানুষ ও সমাজ

নবম অধ্যায় – বিজ্ঞান মানুষ ও সমাজ

বিজ্ঞান মানুষের প্রয়াস। যেদিন জন্ম নিল সমাজ, সেদিন বিজ্ঞানও জন্ম নিল। বিজ্ঞানের সমাপ্তি নেই, কারণ মানবতার আয়ু অফুরন্ত। যুগের মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির রহস্যের অবগুণ্ঠন অনাবৃত করে হয় যুগান্তকারী। যুগের পর যুগ মানুষ এইভাবেই এগিয়ে চলেছে, চলছে, চলবে। নিত্য সব সমস্যার আবির্ভাবের সঙ্গে নূতনতর প্রতিভার উন্মেষ, শক্তির প্রকাশ, সমস্যার আর শক্তিতে সংগ্রাম, সমস্যার প্রতিভূ প্রকৃতির পরাজয় আর শক্তির প্রতিভূ মানুষের জয়—এই হল মানুষের ইতিহাস, সমাজের ইতিহাস, সুতরাং বিজ্ঞানের ইতিহাস। গ্রাম্য গীতি গেয়ে লাঙল আর গোরু নিয়ে আমরা আজ তাই খেত চষি না, আজ গ্যাসোলিনে ট্র্যাক্টর চলে মাটির বুকে। তিরধনুক নিয়ে বল্কল পরে বনেজঙ্গলে আমরা আজ পশুশিকার করি না, ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য যন্ত্রে আমাদের খাবার তৈরি হয়, হাজারজনের খাবার কয়েক মিনিটে। গুহা ছেড়ে আজ যেখানে আমরা বাস করি তার স্বচ্ছ সরল আভিজাত্যে বিশ্বকর্মাকে মাথা হেঁট করতে হবে। যন্ত্রে কাজ করে, আমরা পরিদর্শন করি। আমাদের এই যে কাহিনি, এই তো মানুষের ইতিহাস, মানুষের আর বিজ্ঞানের। অথচ নিখিলের তুলনায় আমাদের এই পৃথিবীর আয়তন, আর পৃথিবীর তুলনায় আমাদের সত্তার স্বাতন্ত্র্যের কথা ভাবতেও আমরা হতবাক হয়ে যাই। হবারই কথা। কয়েকটিমাত্র নক্ষত্রের বিষয় আমরা জানি, এ—পৃথিবীর চেয়ে সেগুলি সামান্য বড়ো, কিন্তু অধিক সংখ্যক নক্ষত্র এত বড়ো যে এ—পৃথিবীর মতো লক্ষ পৃথিবীকে তাদের প্রত্যেকটির মধ্যে স্থান দিয়েও পূরণ হয় না, এবং এই শ্রেণির নক্ষত্রের সংখ্যা এ—পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রকূলের বালুকাসমষ্টির সমান। আমাদের আবাসগৃহ এ—পৃথিবীর সামান্যতা সহজেই অনুমেয়, আর আমাদের অর্থাৎ মানুষের ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্রতাও সহজবোধ্য। সেজন্য নিখিলেশ অধীশ্বর দেবতার সুমুখে শ্রদ্ধানত শিরে এ—পৃথিবীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মানুষ অপরাধীর মতো তার নগণ্যতার জন্য সংকুচিত হবে না, বলবে না এ—যুগের বৈজ্ঞানিক জীনসের মতো যে এই নিখিলের শিল্পী হচ্ছেন একজন খাঁটি গণিতশাস্ত্রবিদ, তিনশো বছর আগে কেপলার যা বলে গিয়েছিলেন—এ—পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টির আঙ্কিক ঐক্যের ও পরিপূর্ণতার প্রতীক—বলবে না এ—যুগের কবি এলিয়টের মতো যে এ—পৃথিবীর মুখে আঁধারের ছায়া নামে, এ—পৃথিবীর শূন্য ও অর্থহীন, বলবে না এ—যুগের রাজনীতিকদের মতো ‘ওঁ—শান্তিঃ! ওঁ শান্তিঃ! ওঁ শান্তিঃ।’ শান্তি নেই, সংগ্রাম আছে, আর সংগ্রামের জয়ে আছে সাম্যাবস্থা। বিশ্রাম নেই, গতি আছে, দ্বন্দ্বমুখর গতি, বিকাশ যার সমন্বিত সভ্যতায়, পুনরায় আবর্তনের আঘাতে বা দ্বিধাবিভক্ত ও গতিশীল। এই তো মানুষের কাহিনি, সমাজ ও সভ্যতার ক্রমাবর্তন, বিজ্ঞানের ইতিকথা।

আরিস্ততল থেকে স্কলাস্টিক দর্শন অ্যাক্যুইনাস, রজার ও ফ্রান্সিস বেকন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিসদৃশ সমাবেশ আমরা লক্ষ করলাম। বিজ্ঞানের বিস্তৃতি ক্রমেই সংকুচিত হতে লাগল এবং বিজ্ঞান ও দর্শনের পারস্পরিক বিরোধ হয়ে উঠল তীব্রতর। দর্শনের ক্ষেত্রের সম্প্রসারণই হচ্ছিল, কারণ মর্তলোকের প্রতিবেশে তখন তার বিরক্তির ভাব স্ফুটতর, অমর্ত্যলোকে দেবতার পরিপার্শ্বে তার পরিতৃপ্তি। তারপর এল মধ্যযুগের বিজ্ঞান ব্যবহারিক জীবনের পারিপাট্য নিয়ে। সে—যুগের ‘খ্যাপা’ বৈজ্ঞানিকেরা হল ‘পরশপাথর’—এর সন্ধানে উন্মাদ। নিকৃষ্ট ধাতুকে কেমনভাবে সোনাতে রূপান্তরিত করা যাবে তারই সাধনায় তাঁরা মগ্ন হলেন। অধ্যাত্মলোকের প্রহরীরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন, খোদার উপর খোদকারিকে তাঁদের কাছে বৈজ্ঞানিকের অমার্জনীয় ধৃষ্টতা বলে মনে হল। তারপর এল রেনেসাঁস—এর যুগ। কয়েকটি যন্ত্র আবিষ্কৃত হল এবং বৈজ্ঞানিকও তাঁর অলীক সাধনমার্গ ছেড়ে বীক্ষণাগারে নিজের অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রবেশ করলেন। কক্ষ অবরুদ্ধ আত্মিক উল্লাস বর্জন করে দার্শনিকও বাইরের মুক্ত আলো—বাতাসের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। দুইয়ের মধ্যে বিরোধ ক্রমেই ঘনীভূত হতে লাগল। নব নব শতাব্দীতে নব নব আবিষ্কৃত যন্ত্রের ভিড় জমতে লাগল। পর্যবেক্ষণ ও ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রের বিস্তার গেল আশাতীতভাবে বেড়ে। তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ের ভিত্তি দৃঢ়তর হতে লাগল। অভিজাত বংশজাত দার্শনিক মুষড়ে পড়লেন। পৃথিবী—সম্পর্কিত আদি—অন্ত সমস্যার, অতীন্দ্রিয়তা ও আধ্যাত্মিকতার সম্মোহিত ‘চম্পা’র দেশ থেকে দ্বীপান্তরিত হয়ে বিজ্ঞান ফিরে এল ভূমিতে, পর্যবেক্ষণবাদের (Empiricism) প্রাসাদ ধসে পড়ার শব্দ শোনা গেল। মানুষের মননশক্তি পর্যবেক্ষণের কারাপ্রাচীরের অন্তরালে বন্দি হয়ে মুক্ত জীবনাস্বাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। আজ তাই বৈজ্ঞানিকের মনে সংশয় জেগেছে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট আসন নিয়ে। সৌরজগৎকে কেন্দ্র করে যে বিশাল প্রশ্নসমষ্টি, অণু—পরমাণু থেকে শুরু করে সংখ্যাতীত নীহারিকাপুঞ্জের মধ্যে যে অনন্ত অনুসন্ধিৎসার ধূম্রকুণ্ডলী তাকে মানুষিক বুদ্ধি দিয়ে অপসারিত করবার দাবির মধ্যে বিজ্ঞানের দান কী—তা—ই নিয়ে বৈজ্ঞানিকের আজ বিপুল চিন্তা। বীক্ষণাগারের সূচিশ্রান্ত জীবনের ক্লিষ্ট আবহাওয়া তাঁদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। পারিপার্শ্বিকতার মূল্য নির্ধারণের যে—হুকুম জারি হয়েছে তাতে তাঁরা ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। প্ল্যাঙ্ক (Planck), জিনস (Jeans), এডিংটন (Eddington), হোয়াইটহেড (Whitehead), লজ (Lodge), হ্যালডেন (Haldane) প্রভৃতি এই ব্যাকুলতার প্রতীক। সরীসৃপের মতো বিবেক আজ বৈজ্ঞানিকের মন বেষ্টন করে নিষ্পেষণ করছে। বৈজ্ঞানিকের মধ্যে আজ দংশনোদ্যত বিবেক। সম্মুখে বিরাট প্রশ্ন—”?”

বিজ্ঞানের দুটি দিক আছে এবং প্রত্যেকটি পরীক্ষার যোগ্য। একটিতে বৈজ্ঞানিকের স্বার্থ ব্যক্তি হিসেবে, অপরটিতে সমাজের সভ্য হিসাবে। একটিতে প্রকৃতির শক্তিগুলির অধ্যয়ন, পরীক্ষার ও বিশ্লেষণের নব পদ্ধতি আবিষ্কার এবং অধীত (Theoretical) ও ফলিতের (Practical) মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন করে সর্বসাধারণের সম্মতিলাভ। অপরটির মধ্যে বিজ্ঞানের সামাজিক বিকাশের স্বীকৃতি আছে, সুতরাং সেই অনুপাতে তার ব্যাখ্যানও আবশ্যক। প্রথমটির উদ্দেশ্য নৈতিক বা ব্যক্তিক সংস্কার থেকে অধ্যয়নবস্তুর নির্মুক্তিকামনা হলেও দ্বিতীয়টির এর কবল থেকে নিষ্কৃতি নেই। সমাজে যতদিন নীতিগত ও সমাজগত স্তরবিন্যাস (Ideological and Social Stratification) থাকবে, ততদিন প্রত্যেকটি শ্রেণির অন্তর্লীন ঐতিহ্যের প্রভাবদুষ্ট বিজ্ঞান হবেই। বিজ্ঞানের এই দুটি দিকের একটি বৈজ্ঞানিক আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ব্যাপার, অর্থাৎ তার ‘isolate’—দের সংযোগস্থাপনের উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত। অপরটি তার বাহ্যিক সম্বন্ধের, অর্থাৎ সমাজের বিন্যস্ত শ্রেণিগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গে তার সম্বন্ধের ব্যাপার, যেখানে ‘isolate’ সে নিজেই। বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে প্রথম দিকটিতেই বিজ্ঞানের প্রগতি সম্ভব হয়েছে। জ্যোতির্বিদ্যা ও জাদুবিদ্যা থেকে শুরু করে ঐতিহ্য, ব্যবহার ও ব্যক্তিসর্বস্বতার ভিতর দিয়ে—বিজ্ঞান যত খাঁটি পরীক্ষার দিকে অগ্রসর হয়েছে, তত অভিজ্ঞতাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নের জন্য নির্দিষ্ট ‘criteria’ আবির্ভুত হয়েছে। নিজেদের কর্মফলের মধ্যে বৈজ্ঞানিকদের একতা দূষ্ট হলেও তাঁরা কিন্তু এক অদ্ভুত প্রহেলিকার পরিচয় দেন। অর্থাৎ বুঝতে হবে যে বিজ্ঞানের ‘internal function’ এবং তার সত্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে। সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের এই মতবিরোধ প্রণিধানযোগ্য।

অধ্যাপক হোয়াইটহেড বলেছেন : “Our problem is to fit the world to our perceptions and not perceptions to the world.” এখানে হোয়াইটহেড আদর্শবাদী। তাঁর নিজের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা তা—ইই তাঁর কাছে প্রধান সত্য এবং পৃথিবীকে তিনি তার মধ্যে জুড়তে চান। হোয়াইটহেডেরর কাছে বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন হচ্ছে ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার (Sense perception) বিশ্লেষণ। আর্থার এডিংটন (Arthur Eddington) বলেন : “Science aims at constructing a world that shall be symbolic of the world of commonplace experience.” এ—মতেরও তাঁর সংগতি নেই। তিনি তাঁর ‘Nature of the Physical World’ আরম্ভ করেছেন তাঁর দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত টেবলের সঙ্গে (Whitehead—এর ভাষায় ‘Common-sense notion’ টেবল) বৈজ্ঞানিক টেবলের পার্থক্য দেখিয়ে। তাঁর দৈনন্দিন টেবলে তিনি লেখেন, পড়েন, কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক টেবলের বিশাল শূন্যতার মধ্যে অসংখ্য পরমাণু বিদ্যুৎবেগে ছুটোছুটি করছে এবং যার “combined bulk amounts to less than a milionth part of the table itself.” তাঁর মতামতের অসঙ্গতি তখনই পরিলক্ষিত হয় যখন তিনি পরে বলেন : ‘‘Modern physics had by delicate test and remorseless ligic assured me that my second scientific table is the only one that is really there”—এবং এই সমস্ত সূক্ষ্ম পরীক্ষা যা তাঁর বৈজ্ঞানিক টেবলের ‘তত্রত্ব’ (Thereness) প্রমাণ করছে অথচ দৈনন্দিন টেবলের ‘তত্রত্ব’—এ বিশ্বাস করছে না, তাদের তিনি কোনো উল্লেখই করেন না। আমাদের যত দূর মনে হয় বৈজ্ঞানিকের এই প্রকার কোনো ‘সূক্ষ্ম পরীক্ষার’ সুযোগ নেই। এই অবস্থায় ‘রূপক’ (Symbolic) বৈজ্ঞানিক টেবলকে দৈনন্দিন টেবল অপেক্ষা বেশি ‘বাস্তব’ ভাবার মধ্যে মনের যে অদ্ভুত কল্পনা—ক্রীড়া আছে তাতে আমাদের চিত্ত আদৌ সাড়া দেয় না। বারট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel) বলেছেন যে চেতন বা অচেতনভাবেই হোক, পদার্থবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর কারণ—কাঠামো (Causal Skeleton) আবিষ্কার করা। অন্যত্র তাঁর ‘The Analysis of Matter’ নামক পুস্তকের মধ্যে তিনি বলেছেন : “It is obvious that a man who can see, knows things that a blind man cannot know; but a blind man can know the whole of physics. Thus the knowledge that other men have and he has not is not part of physics.” এ—প্রশ্ন অবশ্যই অর্থহীন যে সমস্ত বিজ্ঞান বোঝা কোনো ব্যক্তির পক্ষে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে সম্ভব কি না। প্রশ্ন হতে পারে, তার জন্য কী কী ইন্দ্রিয়ের আবশ্যকতা আছে? যদি কোনো ব্যক্তির কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় বাস্তব জগতের সঙ্গে সংযোগের জন্য, তাহলে সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য একটি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অপরটির পার্থক্য কীভাবে বিচার করব? রাসেলের বক্তব্য হচ্ছে যে দৃশ্যমান জগৎ থেকে বৈজ্ঞানিক প্রতিচ্ছবির এককীকরণ (isolation) সম্ভব, তাতে কিছুই ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। অধ্যাপক লেভি (H. Levy) বলেছেন : ‘‘This is surely an unsubstantiated assertion”—সূর্যের বর্ণালির (Spectrum) মধ্যে একটি আইন আছে যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১৫৯,০০০,০০০ সেন্টিমিটার, এ—কথা বললে অন্ধে যা বুঝবে তা শুধু ওই সংখ্যা ও পরিমাপ। কিন্তু এই বোঝার সঙ্গে ওই বর্ণালির কমলা রঙের (orange) অংশটুকু যে ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটি লাইন দ্বারা অতিক্রান্ত, এ—বোঝার অনেক পার্থক্য আছে। দ্বিতীয় কথার মধ্যে পৃথিবীর যে একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আছে তা অপরটিতে উপেক্ষিত হচ্ছে এবং এই দুই বোধের মধ্যে ব্যবধান আকাশ—মাটি। রাসেলের বক্তব্য সেইজন্যই গ্রহণীয় নয়।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও লেখকদের বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এইসব হচ্ছে মতামত। এর মূল কারণের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। বৈজ্ঞানিকের অচলায়তনে পূর্বদিকের কপাট আজ উন্মুক্ত। অধীত (Theoretical) বিজ্ঞান তার সীমান্তে এসে ভাবছে ‘অতঃপর’? ফলিত (Practical) বিজ্ঞানের এসেছে বিবেক—বৃশ্চিক দংশন। বাইরে যে—সমাজ, মানবগোষ্ঠীর যে বৃহৎ সমাজ, তার সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্বন্ধ কী, আত্মীয়তা কিছু আছে কি না এবং তা কী রকমের? বাইরের সমাজের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্বন্ধ—নির্ণয় করবার আহ্বান আজ বীক্ষণাগারের প্রশান্ত প্রতিবেশকে চঞ্চল করেছে। সামাজিক পটভূমির উপর নিজেকে প্রক্ষিপ্ত না করে আজ আর বৈজ্ঞানিকের স্বস্তি নেই। কিছুদিন পূর্বে ব্ল্যাকপুলে ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিকদের এক সভায় এই সম্বন্ধ—নির্ণয়ের যে প্রচেষ্টা হয়েছিল তাতে শুধু বোঝা গিয়েছিল যে বিজ্ঞানের প্রগতি সম্ভব হচ্ছে মানুষের প্রয়োজনকে স্বীকার করে। সমাজজীবনের ভাবস্রোত বিজ্ঞানের পথ কেটে চলেছে সামনে এবং বিজ্ঞানের রূপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দেশ, কাল ও পাত্রসাপেক্ষ বস্তুর সমাবেশে। নিউটন, ফ্যারাডে, ম্যাক্সওয়েল, পাস্তুর, প্যাভলভ, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা না করলেও, এ—কথা অস্বীকার্য নয় যে সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সমাজনীতি অথবা মানুষের ব্যাবহারিক জগৎ এঁদের চিন্তাধারা ও কর্মধারাকে অনেকখানি প্রভাবান্বিত করেছে। মানবকল্যাণের শুভেচ্ছাতেই চিরদিন বৈজ্ঞানিকের অন্তর অনুরণিত। বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে যে মধ্যযুগীয় কল্পনা—বিলাসিতার পুনরাবির্ভাব হয়েছে তার কারণ বর্তমান সমাজ ও ভাবী সমাজ উভয় সম্পর্কেই তাঁদের নৈরাশ্য ও পরাভব মনোবৃত্তি। কিন্তু বিজ্ঞান সম্বন্ধে বড়ো সত্য হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞান সমাজজীবনের ফল, এবং সমাজজীবনের কল্যাণসাধনই বিজ্ঞানের লক্ষ্য।

আজ লজ বলছেন : (Oliver Lodge) : “There is evidence of mind at work, beneficient and contriving mind, actuated by purpose”—জিনস বলছেন : “The universe begins to look more like a great thought than a great machine. The universe can be best pictured as consisting of pure thought of a mathematical thinker….,”—বার্গসঁ (Bergson) বলছেন, “Elan Vital” জবন্তকে “more and more complex forms”—এর ভিতর দিয়ে “higher and higher destinies”—এতে নিয়ে যায়। এসবের অর্থ কী? এঁরা এবং এঁদের অনুচরবৃন্দ বলবেন, এই তো বিজ্ঞান, প্রজ্ঞানের সঙ্গে যার অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তা, ‘বিশ্বেশ্বর’ যার সর্বময় প্রভু। এখানে আবার বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজের প্রশ্ন আসে। এঁরা হচ্ছেন ধ্বংসোন্মুখ ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি। সীমাহীন নৈরাশ্যের অন্ধকারের মধ্যে এঁরা দিকভ্রষ্ট হয়ে বিপজ্জনক ভাসমান আইসবার্গকে আঁকড়ে ধরতে চান। তাই আজ পৃথিবীর পশ্চাতে ‘নিগূঢ় নিয়তি’র (Purpose) ব্যাখ্যা চলছে, পৃথিবী আজ তাই মনোহর অলস ভাবের (Thought) পর্যায়ে, এবং ‘Elan Vital’, ‘Supra Conscious’ প্রভৃতির অবতারণা। আজ তাই ধ্বংসোন্মুখ ধনতান্ত্রিক সমাজের ক্ষয়িষ্ণু দুর্গন্ধি কলেবরের দিকে চেয়ে কবি T. S. Eliot বিলাপ করেছেন, “Waste and Void. Waste and Void.” আর বৈজ্ঞানিক প্রাচীন প্রফেট ও পয়গম্বরের শূন্যাসনে বসে ইষ্টনাম জপ করছেন। কিন্তু যেখানে এই মৃত্যুযন্ত্রণা নেই, এই নৈরাশ্য নেই, যেখানে সমাজের পচাগলা আবর্জনা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, সেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নের বলশেভিকদের আদর্শ হচ্ছে : “No one can be a member of the party or even a probationary….who does not wholeheartedly and out-spokenly declare himself an atheist, and a complete denier of the existence of every form or kind of the supernatural.” বলশেভিক রাশিয়ার বিজ্ঞান আজ আস্তিক্য প্রজ্ঞাসম্পন্ন না হয়ে, কল্পলোকের পরমেশ্বরের শরণাপন্ন না হয়ে, নাস্তিক্যগন্ধী বিজ্ঞান হয়েছে, কারণ সেখানে শ্রেণি—শাসন বা শ্রেণি—শোষণ নেই, ক্ষয়িষ্ণু সমাজগর্ভজাত অবসাদের সোঁদা গন্ধ নেই, বর্ধিষ্ণু সমাজতান্ত্রিক সমাজের অপূর্ব লাবণ্য আছে। সেখানকার বৈজ্ঞানিকের একমাত্র সত্য মানুষ ও সমাজ, তার উপরে কোনো কিছুর অস্তিত্বে আস্থা নেই। সেখানকার বৈজ্ঞানিকের একমাত্র সত্য মানুষ ও সমাজ। তার উপরে কোনো কিছুর অস্তিত্বে আস্থা নেই। সেখানকার বৈজ্ঞানিকের লক্ষ্য তাই প্রাচুর্য ও আন্তর্জাতিক মৈত্রী, তার মধ্যে বৈরীভাব বা তস্করপ্রবৃত্তির আবিল স্পর্শ নেই। সমাজ যেদিন শ্রেণিমুক্ত হবে, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ যেদিন বিলুপ্ত হবে, সেদিন বিজ্ঞান মুক্তকণ্ঠে তার আদর্শের জয়গান গেয়ে মানুষকে নিঃসংকোচে আহ্বান করবে। তাই বৈজ্ঞানিকের নিরাশায় আমরা বিজ্ঞানের উপর শ্রদ্ধা বা আশা ত্যাগ করিনি। বিজ্ঞান চিরদিনই মানুষের সামনে শঙ্খধ্বনি করে এগিয়ে যাবে, সমতলে অনুগামী হবে মানুষ ও মানুষের সমাজ। বৈজ্ঞানিক চিরদিন মানুষের নমস্য থাকবেন সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *