০৭. উপন্যাসের ঐতিহাসিক ধারা

সপ্তম অধ্যায় – উপন্যাসের ঐতিহাসিক ধারা

বুর্জোয়া সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ দান হল উপন্যাস। বুর্জোয়া শ্রেণির অহংকার, বুর্জোয়া শ্রেণির গৌরব শিল্পের এই নূতন রাজ্য আবিষ্কারে। মানবরাজ্যের একটি নিভৃত কোণের স্বপ্নপুরীতে যে উপেক্ষিতা শিল্পকন্যা ঘুমে অবচেতন ছিল, নূতন বুর্জোয়া সমাজের আলোকোদ্ভাসিত জীবনের উন্মাদনায় অনুপ্রাণিত শিল্পী তাঁর শক্তিমান কল্পনার সোনার কাঠির স্পর্শে তাকে জাগিয়ে তুললেন। ঘুমন্ত স্বপ্নপুরীতে প্রাণস্পন্দন অনুভূত হল, নূতন সৌন্দর্যে মানবজীবনের এক নূতন দ্বার উদঘাটিত হল। উপন্যাস সেই জাগ্রত শিল্পকন্যা, সেই নূতন রাজ্য।

মধ্যযুগের অবসানের সময় ইতালি ও ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়গুলি প্রথম গাল্পিকের জন্ম দিয়েছিল সত্য, চসার (Chaucer) ও বোকাচ্চোর (poccacio) মধ্যে ঔপন্যাসিকের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল মানবচরিত্রের প্রতি তাঁদের কৌতূহলী দৃষ্টিতে। তখনই আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে শিল্পের একটি নূতন জগৎ আবিষ্কৃত হবে যেখানকার সিংহাসনে মানুষ উপবেশন করবে রাজমুকুট মাথায় দিয়ে, মানুষের জীবন, মানুষের সুখ—দুঃখ যেখানে রূপায়িত হয়ে মানুষকে আরও মহিমামণ্ডিত করবে। মধ্যযুগের অবসানের পর সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনো উপন্যাস রচিত না হলেও, সে—শতাব্দীতে দর্শনের বিকাশের ফলে পরবর্তী শতাব্দীতে উপন্যাসের জয়বার্তা ঘোষিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দী ইংরেজি উপন্যাসের গৌরবময় কাল, কারণ তার পশ্চাতে ছিল ইংরেজি দর্শনের গৌরবময় যুগ। বুর্জোয়া বিপ্লবের সৃষ্টি এই ইংরেজি দর্শন ছিল গভীরভাবে বস্তুতান্ত্রিক।

মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে যখন নূতন ধনতান্ত্রিক সভ্যতা তার প্রভাতরশ্মি বিকীর্ণ করে উদীয়মান, তখন সেই যুগসন্ধিক্ষণে রাবেলেয়াস (Rabelais) ও সার্ভানটিসের (Cervantes) কাছে উপন্যাস নূতন জীবনে দীক্ষিত হল। একদিকে নূতন যুগের বৈপ্লবিক ঝঞ্ঝার আবর্তে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, বিবর্ণ বিশীর্ণ সামন্ততন্ত্র নবজাত ধনতন্ত্রের কাছে পরাজয় স্বীকার করে বিদায় গ্রহণ করছে, আর একদিকে নূতন ভাব, নূতন চিন্তা, নূতন আদর্শের জয়ধ্বনি, মানুষের ও সভ্যতার নবজীবনের শঙ্খধ্বনি। রাবেলেয়াস ও সার্ভানটিস সেইজন্য একদিকে পুরাতন দিনের প্রতি যেমন বিদ্রুপবাণ নিক্ষেপ করেছেন, তেমনি নূতনকেও বিচার করে শ্রদ্ধার সহিত আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। শেক্সপিয়রও তা—ই করেছেন, এবং রেনেসাঁস—এর যুগের শিল্পীদের কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্য সেইখানেই। এ—যুগের শিল্পীরা অনুরূপ যুগসন্ধিক্ষণে জন্ম—নিয়েছেন, প্রতিপালিত হয়েছেন। আজও ঠিক তেমনি আর—এক ক্ষুব্ধ বৈপ্লবিক ঝঞ্ঝার মঞ্জরি পায়ে বেঁধে সভ্যতার ও সংস্কৃতির নৃত্য শুরু হয়েছে, যার আবর্তে ও আঘাতে পুরাতন ধনতন্ত্রের জরাজীর্ণ কাঠামোটি ভেঙে পড়ছে এবং সমাজতন্ত্রের আগমনি মন্দ্রিত হচ্ছে, অথচ শিল্পীরা শুধু সমরক্ষেত্রের পৈশাচিক ধ্বংসলীলাই দেখছেন, মানুষের প্রকৃতি তাঁদের কাছে অশ্রদ্ধেয় মনে হচ্ছে।

সার্ভানটিসের সৃষ্টির বৈপ্লবিক প্রকৃতি অন্তর্নিহিত। জীবনের প্রতি সার্ভানটিসের মনোভাব তাঁর সৃষ্ট কুইকসোট ও সাঞ্চোর চরিত্রের পারস্পরিক সম্বন্ধের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, এবং এই দুটি চরিত্রের বহির্জগতের সঙ্গে সম্বন্ধের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। এইদিক থেকে বিচার করলে সার্ভানটিসের উপন্যাস রাবেলেয়াসের আর—এক ধাপ উপরে, কিন্তু দু—জনেই একত্রে ঔপন্যাসিকের প্রয়োজনীয় হাতিয়ার গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। রাবেলেয়াস দিয়ে গিয়েছিলেন ভাষার কাব্য ও হাস্যরস, সার্ভানটিস দিয়ে গিয়েছিলেন অনুভূতির কাব্য ও ব্যঙ্গরস। দু—জনে শুধু শিল্পীই ছিলেন না, কর্মীও ছিলেন এবং ‘খাঁটি শিল্পী’র যে করুণ আর্তনাদে আজকের পরিবেশ কলুষিত হয়েছে সে—সম্বন্ধে তাঁদের কোনো ধারণাও ছিল না।

অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকেরা যে—সম্পদ পেয়েছিলেন, তা সত্যই সহজলভ্য নয়। রাবেলেয়াস ও সার্ভানটিসের পরবর্তী যুগের ঔপন্যাসিকেরা সে—সম্পদের কীভাবে সদব্যবহার করেছেন দেখা উচিত। এই সম্পদের মর্যাদা ইংল্যান্ডের ঔপন্যাসিকেরা অর্ধশতাব্দী যাবৎ অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন, যদিও ফরাসি বা স্পেনীয় শিল্পীদের মতো উৎকর্ষের দিক দিয়ে সমশিখরে তাঁরা আরোহণ করতে পারেননি। উপন্যাস প্রধান অস্ত্র হলেও রাজনৈতিক প্রচারপত্র ছিল না। স্বাস্থ্যকর প্রতিবেশের মধ্যে বর্ধিত হয়ে উপন্যাস বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রেষ্ঠ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন প্রতিনিধিদের কাছে কার্যকরী অস্ত্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। ঔপন্যাসিক তাঁর পারিপার্শ্বিক নরনারীর চরিত্র অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকদের সম্বন্ধে এইটিই একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিষয়। মানুষ দেখে আতঙ্কে তাঁরা আত্মগোপন করেননি, মানুষের সাহচর্য তাঁদের কাছে অশ্রদ্ধেয় মনে হয়নি, মানুষের শক্তিতে তাঁদের গভীর বিশ্বাস ছিল, যদিও তাঁরা সমসাময়িক অন্যায়, অবিচার, নিষ্ঠুরতার প্রতি অন্যমনস্কতা দেখাননি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ড্যানিয়েল ডেফো (Daniel Defoe), স্যামুয়েল রিচার্ডসন (Samuel Richardson), হেনরি ফিল্ডিং (Henry Fielding), জর্জ স্মলে (Tobais George Smollett), লরেন্স স্টার্ন (Laurence Sterne) প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ওঁদের সকলেরই বৈশিষ্ট্য হল চরিত্রের জীবন্ত বিশ্লেষণ ও সুসংবদ্ধ ঘটনা—গ্রন্থন। ডেফো, ফিল্ডিং ও স্মলেট বিষয়ভূত শিল্পী, এবং রিচার্ডসন ও স্টার্ন বিষয়ীভূত শিল্পী।

সমালোচকেরা হেনরি ফিল্ডিং সম্বন্ধে বিদ্রুপ করে বলে থাকেন যে তিনি উপন্যাসের মধ্যে ‘sermon’ প্রচার করেছেন, এবং সেইজন্য তাঁর রসসৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। অবশ্য যেকোনো শিল্পের মধ্যে উপদেশ প্রচার করা বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ ঢাক পেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পী শিল্প সৃষ্টি করেন না। কিন্তু ফিল্ডিং—এর উপদেশ বাতিল করে দিলেও তাঁর উপন্যাসের মধ্যে যে সামাজিক সমালোচনা আছে, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে যে—বিচার ও বিশ্লেষণ আছে তাকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। ফ্লোবের ও হেনরি জেমসের পূর্বে শিল্পসেবা করে সৌভাগ্যবশত ফিল্ডিং জানতেন না যে উপন্যাস রচনা করবার জন্য কৃত্রিম সাহিত্যিক সমাজের কতকগুলি নিয়ম পালন করতে হয়। বোধহয় হেনরি ফিল্ডিংই সর্বপ্রথম ইংরেজ ঔপন্যাসিক, যিনি মানবজীবনের সত্যকে নির্ভীকভাবে প্রকাশ করা উপন্যাসের আদর্শ বলে জানতেন, এবং জানতেন বলেই নিজের মতো করে সেই সত্যেরই বর্ণনা করে গিয়েছেন। তিনি ‘Jonathan Wild’—এর জীবনকাহিনির মধ্যে নির্মমভাবে সেই সত্যকে প্রকাশ করেছেন, যার বিষণ্ণ বিদ্রুপ ও তীক্ষ্ন শ্লেষের কাছে সুইফটও মাথা হেঁট করতে সম্মত হবেন। তাঁর ক্রোধ নির্মম ও ভয়ংকর, কারণ সে হচ্ছে মানুষের অবনতির প্রতি জীবন্ত মানুষের ক্রোধ।

আর—এক শ্রেণির সমালোচক ফিল্ডিং—এর কল্পনাশক্তির অভাব সম্বন্ধে কটূক্তি করেছেন। ফিল্ডিং আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মতো মানবচরিত্রের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ করেননি সত্য, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট কোনো চরিত্রই সেজন্য পাণ্ডুর হয়নি। ঔপন্যাসিক বলতে ফিল্ডিং প্রধানত ঐতিহাসিকই বুঝতেন, এবং বহির্জগৎই ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর রচিত নায়ক—নায়িকা প্রতিবেশের ঘাতপ্রতিঘাতে জীবন্ত ও মুখর। তিনি যে—যুগে বাস করতেন, সে—যুগ নিষ্ঠুর যুগ, বিজয়ী ধনতন্ত্রের সংগ্রামকাতর যুগ, শিল্প—বিপ্লবের পূর্ববর্তী লুণ্ঠিত ধনসঞ্চয়ের যুগ। সুতরাং বিদ্রুপের কর্কশ বাণী যা তাঁর কণ্ঠ থেকে মধ্যে মধ্যে উৎসারিত হয়েছে, তা একেবারে অসমর্থনীয় ও তিরস্কারযোগ্য নয়। কিন্তু তিনি কখনো নিজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, অর্থাৎ শিল্পী হয়ে কোনোদিন মানুষকে বা জীবনকে অবজ্ঞা করেননি। এখানেই তাঁর শিল্পজীবনের, ঔপন্যাসিক জীবনের চরম সার্থকতা।*

রিচার্ডসন মানুষের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে সেখানকার অনেক গভীর অনুভূতিকে আবিষ্কার করলেন। সংবেদ্য উপন্যাস সৃষ্টির তিনিই হলেন অগ্রদূত। বাল্যকালে তরুণী প্রতিবেশিনীদের প্রেমপত্র লিখলেও পরে ঔপন্যাসিক জীবনে তিনি কৃতিত্ব কিছু কম দেখাননি। ‘Pamela Clarissa’ ও ‘Sir Charles Grandison’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলির নায়ক—নায়িকার চরিত্র জীবন্ত ও স্বচ্ছ। ক্লেরিসার করুণ কাহিনি ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে একদিন চোখে জল এনেছিল। ফিল্ডিং—এর মতো রিচার্ডসন যদি বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে সচেতন হতেন তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তিনিও একটি আসন দখল করে থাকতেন। রিচার্ডসন ইতিমধ্যে বাস্তবকে উপেক্ষা করতে আরম্ভ করেছেন, এবং পরে স্টার্নের মধ্যে এই মনোবৃত্তি আরও সুস্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নায়ক—নায়িকার মনোরাজ্যের প্রতি রিচার্ডসনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলেও তিনি গল্প বলতে পারতেন ভালো, কিন্তু স্টার্নের কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। শক্তিশালী ঔপন্যাসিক হবার সমস্ত গুণই স্টার্নের ছিল। স্টার্নের শ্লেষ—জ্ঞান ছিল, বুদ্ধি ছিল, কল্পনা ছিল, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল, সবই ছিল, শুধু ছিল না বাস্তব জগতের পটভূমিকার উপর নায়ক—নায়িকার চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলবার ক্ষমতা। স্টার্ন নিজেকে রাবেলেয়াস ও সার্ভানটিসের সমতুল্য মনে করতেন, কিন্তু তাঁর রচনারীতি ও ভাষার নূতনত্ব থাকা সত্ত্বেও তিনি রাবেলেয়াস বা সার্ভানটিসের সর্বশক্তিমান শিল্পী হতে পারেননি। বায়রন বলতেন যে স্টার্ন “preferred whining over a dead ass to relieving a living mother” এবং অধ্যাপক ক্রস* স্টার্নের রচনারীতি, ভাষা, শ্লেষ প্রভৃতি সম্বন্ধে উচ্চপ্রশংসা করেও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে “a man of finger grain”—এর পক্ষে আরও অনেক মূল্যবান সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব হত।

ফিল্ডিং বা রিচার্ডসন ও স্টার্ন কেউ বাস্তবের পরিপূর্ণ রূপ উপলব্ধি করতে পারেননি। দৃষ্টি শুধু বহির্মুখী হলে চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয় না, মানুষের অন্তরলোকে প্রবেশ করবার জন্য যে—কল্পনাশক্তির প্রয়োজন তার অভাব হয়। আবার দৃষ্টি যদি শুধু অন্তর্মুখী হয় তাহলে উপন্যাসের মহাকাব্যিক গুণ নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র এ দুইয়ের সমন্বয়ে বাস্তবের পূর্ণ রূপ উপলব্ধি করা যেতে পারে। সার্ভানটিস এই ধরনের বিভেদ কল্পনাও করতে পারতেন না। ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের পথে এই দৃষ্টিভেদ ঘটেছে, ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবার প্রচেষ্টা চলেছে শিল্পীদের মধ্যে। এই প্রচেষ্টা পরবর্তী দু—শতাব্দীর মধ্যে ভিক্টোরীয় যুগ পার হয়ে বিংশ শতাব্দীতে ভয়ংকর মূর্তিতে প্রকট হয়ে উঠেছে। একদিকে শ্রমবিভাগ যত জটিলতর হয়েছে, শিল্পীও তত ব্যক্তিত্বের সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণের দিকে নজর দিয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর সত্যকার বিপ্লবী শিল্পী ছিলেন রুশো। রুশো ঔপন্যাসিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন কল্পনাপ্রবণ গদ্যলেখক। রুশো ফরাসি বস্তুতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষা মানুষের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারে। রুশো বলতেন যে প্রকৃতিই একমাত্র মানুষকে পরিবর্তন করে তার উন্নতিসাধন করতে পারে। রুশোর এ—ধারণা ভুল হলেও তিনি এই ভ্রমসাধনা করে শিল্পের উপেক্ষিতা প্রকৃতিকে আবার সসম্মানে শিল্পের রাজ্যে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। রুশোর এই দান শিল্পীরা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করবে।

অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল উপন্যাসের স্বর্ণযুগ। সাভানটিস বা রাবেলেয়াসের মতো শিল্পের উচ্চশিখরে আরোহণ করতে না পারলেও, এবং কল্পনার প্রচণ্ড শক্তির সাহায্যে বাস্তবকে রূপান্তরিত করা সাধনাতীত হলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকেরা জীবন ও মানুষ সম্বন্ধে নির্ভয়ে, দৃঢ়কণ্ঠে সত্য কথা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে হাস্যরস ছিল, শ্লেষ—জ্ঞান ছিল, এবং তাঁরা মানুষকে অনুভব করতে বাধ্য করেছিলেন যে প্রত্যেক ব্যক্তির যেমন বহির্জগৎ আছে, পারিপার্শ্বিকতা আছে, তেমনি অন্তর্জগৎ আছে, অন্তঃপরিবেশ আছে। কোনো জগৎ উপেক্ষণীয় নয়। একটি জগৎ অস্বীকার করে আর—একটিকে স্বীকার করা যায় না। দুই জগতের অধিবাসী হল শিল্পী। পরিবর্তনশীল বহির্জগৎ যেমন সত্য, তেমনি তার ঘাতপ্রতিঘাতে অন্তর্জগতের ভাঙাগড়াও সত্য। এই দুই জগতের প্রভাব প্রতি—প্রভাবে গঠিত মানুষ হচ্ছে জীবন্ত মানুষ, সত্য মানুষ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঔপন্যাসিকের মনে মানুষ সম্বন্ধে, জগৎ সম্বন্ধে শঙ্কা জাগে, সন্দেহ দোলা দিয়ে যায়, তিনি এ—জগৎ ছেড়ে উধাও হবার পথ অনুসন্ধান করেন। মেদস্ফীত ধনতন্ত্রের সর্বগ্রাসী নিষ্পেষণ শুরু হয়েছে, অতএব চারদিকে ‘ত্রাহি’ ‘ত্রাহি’ রব ক্ষীণসুরে ধ্বনিত হল। আজ তারই হট্টগোল, হেনরি জেমসের নৈরাশ্যবাদ ও ত্রাহিবৃত্তির জারজ সন্তান হলেন এ—যুগের অল্ডাস হাক্সলে ও এইচ. জি. ওয়েলস।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে স্কট (Walter Scott) এবং দ্বিতীয়ার্ধে চার্লস ডিকেনস (Charles Dickens) ইংল্যান্ডের প্রধান ঔপন্যাসিক ছিলেন। স্কট শিল্পযুগের অবনমিত আবহাওয়া থেকে নির্মুক্ত হয়ে কাল্পনিক, স্বপ্নময় অতীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। একদিক থেকে স্কট যুগান্তর এনেছিলেন উপন্যাসে, কারণ তিনিই প্রথম মানুষকে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বিচার করবার আবশ্যকতা অনুভব করেন। তিনি বুঝেছিলেন যে মানুষের যেমন বর্তমান আছে, তেমনি তার অতীতও আছে, এবং এ—দুইয়ের সমন্বয় করবার তিনি চেষ্টা করেছিলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে—চেষ্টা সম্ভব হয়নি। জীবনের কাব্য ও গদ্য উভয়েরই সমন্বয় হবে উপন্যাসে, রুশোর নৈসর্গিক প্রেমের সঙ্গে ফিল্ডিং—এর বিষয়ভূত বলিষ্ঠতা ও স্টার্নের সংবেদন মিলিত হবে—এই ছিল স্কটের আদর্শ। স্কটের এ—উদ্দেশ্য সফল হয়নি, কিন্তু তাহলেও তাঁর ব্যর্থতায় গৌরব আছে। স্কট কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন?

স্কট প্রতিভাবান শিল্পী হলেও তাঁর গভীর দৃষ্টিশক্তি ছিল না। ফলে তাঁর সৃষ্ট নরনারী ইতিহাসের চরিত্র না হয়ে, তাঁর নিজেরই কাল্পনিক সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াকার উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি ও ব্যবসায়ী অভিজাত—গোষ্ঠীর চরিত্রের উপর নিজে কল্পনার রং ফলিয়েছিলেন। স্কটের উপন্যাসের চরিত্রগুলি সেইজন্য কাল্পনিক, কিন্তু ফিল্ডিং করেছিলেন টাইপ—চরিত্র সৃষ্টি। দু—জনের মধ্যে প্রভেদ অনেকখানি। প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকের পক্ষে মানুষের চরিত্রকে সত্যভাবে বিচার করা কঠিন হয়েছিল। থ্যাকারে (Thackeray) বুর্জোয়া শ্রেণিকে ঘৃণা করতেন, এবং তাদের বিদ্রুপ করতে ছাড়েননি। কিন্তু কেউ বাস্তব জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে সুস্থিরভাবে বিচার করে তাকে পরিপূর্ণভাবে উপন্যাসে রূপায়িত করেননি।

এই অক্ষমতার কারণ হচ্ছে এই যে ভিক্টোরীয় যুগের শিল্পীরা মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্বন্ধের উপরের মুখোশটি ছিঁড়ে না ফেলে তাদের চরিত্র আলোচনা করতে পারতেন না। ভিক্টোরীয় যুগ চারদিক থেকে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার যুগ, চার্টিস্ট আন্দোলনের স্পর্শে সমগ্র দেশ বিপ্লবমুখর, সশস্ত্র বিদ্রোহের আশঙ্কায় প্রতিবেশ কম্পমান। অর্থের হীন পূজারি বুর্জোয়া শ্রেণির সাফল্য, কারখানার চিমনির ধোঁয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মলিনতা, ব্যক্তিগত জীবনের দানবীয় বস্তুপ্রীতিকে আদর্শবাদের আভরণে গোপন রাখবার কৃতঘ্ন প্রবৃত্তি—এই হচ্ছে ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের রূপ। কিন্তু এত দূর প্রতিকূল প্রতিবেশের মধ্যেও এ—কথা বলা যায় না যে ভিক্টোরীয় যুগের ঔপন্যাসিকেরা মানুষকে সম্যকরূপে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেননি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইংরেজি উপন্যাসের যে—অবনতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, তাকে ভিক্টোরীয় যুগের ঔপন্যাসিকেরা উদ্ধার করবার চেষ্টা করেছিলেন, এবং সার্থকও হয়েছিলেন। চার্লস ডিকেন্স উপন্যাসের মহাকাব্যিক গুণ ফিরিয়ে আনেন, এবং নিজের প্রতিভাবলে জীবনের মর্মস্থলে প্রবেশ করে মানুষকে আবার সত্য, জীবন্ত রূপে চিত্রিত করেন।

ডিকেন্স যে তাঁর যুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী ছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখকষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি জীবনের প্রতি আশা বা শ্রদ্ধা হারাননি। তাঁর গভীর দৃষ্টি সমাজের অন্তঃস্থল পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল, এবং সেইজন্যই দুর্বলের প্রতি তাঁর ছিল মানুষিক সহানুভূতি, অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ও প্রতিবাদ ছিল সুস্পষ্ট ও নির্মম। তাঁর উপন্যাসে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির চিত্রই ফুটে উঠেছে। ডিকেন্সের রসিকতা মধ্যে মধ্যে কর্কশ হলেও তাঁর হাস্যরসবোধ সত্যই প্রশংসনীয়। স্যাম ওয়েলার (Sam Weller), বেটসি ট্রটউড (Betsy Trotwood) বা জো গার্গারি (Goe Gargery), এঁরা সকলেই ইংরেজি সাহিত্যে অবিনশ্বর। ডিকেন্সের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য চেস্টারটন (G.K Chesterton) বলেছেন ‘‘In England… the poor people are the most motley and amusing creatures in the world, full of humurous affections and prejudices and twists of irony… the democracy is really composed of Dickens characters; for the simple reason that Dickens himself was one of democracy”, কিন্তু ডিকেন্সের দান অন্যদিক থেকেও কম মূল্যবান নয়। ডিকেন্সের সাহিত্য তৎকালীন মানুষের মনে যে শুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল তাকে উপেক্ষা করা যায় না। শ্রেণিবৈষম্য ভুলে গিয়ে শ্রেণি—নির্বিশেষে সকল মানুষের সততায় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করবার গুরুভার ডিকেন্স গ্রহণ করেছিলেন। সমসাময়িক সমাজের দোষত্রুটি, ব্যভিচার, কুসংস্কার প্রভৃতির প্রতি তাঁর প্রখর সতর্ক দৃষ্টি কখনো চঞ্চল হয়নি। তিনি উদ্দেশ্যমূলক উপন্যাসও রচনা করেছিলেন। ‘Oliver Twist’—এর ‘Poor Law’ ব্যবস্থা, ‘Little Dorrit’-এর ‘red-tapism’, ‘Nicholes Nicklaby’—র “Private School”  ব্যবস্থা প্রভৃতির মধ্যে তিনি সমসাময়িক সমাজের ক্ষতস্থানের উপর সোজা অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলেন, তার জন্য সমাজকে কশাঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

সর্বশ্রেণির নরনারীর অদ্ভুত চরিত্রচিত্রণ, অসংখ্য ঘটনা—গ্রন্থন, কল্পনাশক্তি ও কাব্য প্রভৃতি হচ্ছে ডিকেন্সের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তবু ডিকেন্স ও স্কট উভয়েরই সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে যেন কীসের অভাব আমরা অনুভব করি। নায়ক—নায়িকার মধ্যে মহানুভবতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মহৎ চরিত্রসৃষ্টি কেন তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়নি? কারণ তাঁদের যুগকে তাঁরা গতিশীল মনে করেননি, এবং সেইজন্য কালের প্রবহমান ধারায় নায়ক—নায়িকার চরিত্রও অখণ্ডরূপে প্রকাশিত হয়নি। বিজয়ী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে তাঁরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তাদের শূন্যগর্ভ জীবনকে লোকচক্ষুর সামনে ব্যক্ত করতেও তাঁরা ভয় পাননি, কিন্তু এসবের অন্তর্নিহিত বৃহত্তর শক্তির ক্রিয়া তাঁদের দৃষ্টিগোচর হয়নি, ধনতান্ত্রিক সমাজের হীনতা ও দৈন্যকে তাঁরা পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। এইদিক থেকে ফরাসি ঔপন্যাসিকরা নিষ্ঠাবান, অর্থাৎ সমসাময়িক যুগকে তাঁরা অকপটভাবে রূপায়িত করবার চেষ্টা করেছিলেন।

১৮৫৪ সালের New York Tribune পত্রিকায় কার্ল মার্কস ভিক্টোরীয় যুগের ঔপন্যাসিকদের উল্লেখ করে লিখেছিলেন :*

The present brilliant school of novelists in England, whose graphic and eloquent descriptions have revealed more political and social truths to the world than have all the politicians, publicists and moralists added together, has pictured all sections of the middle class, beginning with the ‘respectable’ rentier and owner of government stocks, who looks down on all kinds of ‘business’ as being vulgar, and finishing with the small shop-keeper and lawyer’s clerk. How have they been described by Dickens, Thackeray, Charlotte Bronte and Mrs. Gaskell? As full of self-conceit prudishness, petty tyranny and ignorance. And the civilised world has confirmed their verdict in a damning epigram which it has pinned on that class, that it is servile to its social superiors and despotic to it inferiors.

রাজনৈতিক প্রচারক বা নীতিবাগীশদের চাইতে অনেক বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্য ভিক্টোরীয় যুগের ঔপন্যাসিকদের সুন্দর বর্ণনা ও চরিত্রচিত্রণের সাহায্যে প্রকাশিত হয়েছে। এইসব ঔপন্যাসিকেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছবি এঁকেছেন, গভর্নমেন্টের স্টক—মালিক থেকে শুরু করে খুদে দোকানদার ও উকিলের কেরানি পর্যন্ত কেউ বাদ যায়নি। এই শ্রেণির অজ্ঞতা, উৎপীড়ন, আত্মম্ভরিতা প্রভৃতির জীবন্ত বর্ণনা ভিক্টোরীয় ঔপন্যাসিকদের বৈশিষ্ট্য। সভ্যজগৎ আজ তাঁদের মত সমর্থন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ওই একই অপবাদবিদ্ধ করে রেখেছে যে তারা উচ্চতর শ্রেণির দাস এবং নিম্নশ্রেণির উৎপীড়ক। অর্থাৎ মার্কস বলেছেন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের উচ্চস্তরের বুর্জোয়া শ্রেণির অনুচর, তাদের সেবা করাই মধ্যবিত্তদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এবং এক মিথ্যা অহংকার ও আত্মমর্যাদায় অন্ধ হয়ে তারা নিম্নের শ্রমজীবী শ্রেণিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে। মার্কসের এই উক্তি স্মরণীয়।

এই সময় ফ্রান্সের শিল্পীদের মধ্যে ব্যালজাকই (Balzac) ছিলেন একমাত্র বিপ্লবী শিল্পী। ব্যালজাক তাঁর “Comedie Humaine”—এর মধ্যে তাঁর যুগের মানুষের জীবনের সুবৃহৎ পটভূমিকার উপর যে বৈপ্লবিক চিত্র এঁকেছেন, তা যেমন গভীর, তেমনি ব্যাপক, চিত্রাত্মক, চিত্তাকর্ষক ও জীবন্ত। ১৮১৬ সাল থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত ফরাসি সমাজের ইতিহাস এমন নিখুঁতভাবে কোনো ঐতিহাসিকের পক্ষেও আঁকা সম্ভব নয়। ব্যালজাক—এর রাজনৈতিক মত ছিল প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক ফ্রান্সের পক্ষে, কিন্তু মানুষের প্রতি মনোভাব, মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ধারণা, সবই বিপ্লব—জাত—জেকোবিনরা যখন নির্মমভাবে ফরাসি সমাজের বন্ধন ছিন্ন করেছিল, ইউরোপে যখন নেপোলিয়নের শৌর্য ও জয়গৌরব ধ্বনিত হয়েছিল তখনকার মনোভাব। নেপোলিয়ন যেমন সামন্ততন্ত্র ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন, তেমনি ফ্রান্সের ‘Literary Napoleon’ ব্যালজাক সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব ধ্বংস করেছিলেন। ব্যালজ্যাক সেইজন্য বাধ্য হয়েছিলেন নিজের রাজনৈতিক ও শ্রেণি—সহানুভূতির বিরুদ্ধে অভিজাত গোষ্ঠীর পতনকে সমর্থন করতে এবং নূতন যুগের মানুষকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে। এইখানেই বাস্তবের জয় এবং বিপ্লবী রূপকার ব্যালজাকের বৈশিষ্ট্য। মার্গারেকে হার্কনেসকে লিখিত একখানি চিঠির মধ্যে ফ্রিড্রিশ এঙ্গেলস ব্যালজাকের শিল্পপ্রতিভা সম্বন্ধে এই কথাই বলেছিলেন। এঙ্গেলস লিখেছিলেন :

Balzac, whom I consider a far greater master of realism than all the Zolas, in his ‘Comedie Humaine’ give us a most wonderfully realistic history of French society, describing in chronicle fashion, almost year by year, from 1816 to 1848, the progressive inroads of the rising burgeoisie upon the society of nobles that reconstituted itself after 1815, and that set up again as far as it could the standard of la vieille politesse francaise. He describes how the last remnants of this, to him, model society, gradually succumbed before the intrusion of the vulgur, moneyed upstart, or were corrupted by him, how the grande dame, whose conjugal infidelities were but a mode of asserting itself, in perfect accordance with the way she had been disposed of in marriage, gave way to the bourgeoisie who gains her husband for cash or customers; and around this central picture he groups a complete history of French society, from which, even in economic details, , for instance, the rearrangement of real and personal property after the Revolution, I have learnt more than form all the professed historians, economists and satisticians of the peroid together. Well, Balzac was politically a legitimist; his great work is a constant elegy unto the irreparable decay of good society; his sympathy is with the class that is doomed to extinctions. But for all that his satire is never more cutting, his irony more biting than when he sets in motion the very men and women with whom he sympathises most deeply– the nobles. And the only men of whom he speaks with undisguised admiration are his bitterest political antagonists, the Republican heroes of the Cloitre-Saint-Merri, the men who at that time (1830-36), were indeed the representatives of the pupular masses. That Balzac was thus compelled to go against his own class sympathies and political prejudices, that he saw the necessity of the downfall of his favourite nobles and described them as people deserving no better fate; that he saw the real men of the future where, for the time being, they alone could be found– that I consider one of the greatest triumphs of Realism, one of the greatest features in old Balzac.

ব্যালজাকের সঙ্গে গুস্ত্যাভ ফ্লোবেরের (Gustav Flaubert) পার্থক্য অনেক। বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি ফ্লোবেরের অমানুষিক ঘৃণা ছিল। একাবার তাঁর দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে তিনি তাঁর বন্ধু ল্যুই ব্যুইলেটকে একখানি চিঠিতে লিখেছিলেন : “Laxatives, purgatives, derivatives, leaches, fever diarrohea, three nights without any sleep, a gigantic annoyance at the bourgeois…” এবং এই উক্তি থেকেই তাঁর মনোভাব সুস্পষ্ট বোঝা যায়। “I would drown humanity in my vomit”—ফ্লোবের লিখেছিলেন। তিনি সমগ্র মানবজাতির উপর এই ঘৃণা উদ্গিরণ করেননি। ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন—এর পর ঊনবিংশ শতাব্দীর ধনতান্ত্রিক সমাজকে লক্ষ করেই ফ্লোবের এই কথা লিখেছিলেন। বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি ফ্লোবেরের অসাধারণ ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও তিনি গণতন্ত্রকে আদৌ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন না। জনসাধারণের প্রতি তাঁর অনুরূপ ঘৃণাই ছিল। জনতাকে তিনি ভীষণ ভয় করতেন, এবং সেইজন্য ফ্লোবের শিল্পসাধনা করেছেন নিজের গজদন্ত মিনারে বসে ক্রুদ্ধ জনতার পাশবিক চিৎকার থেকে বহু দূরে, ক্লিন্ন পারিপার্শ্বিকতার আবিলতার স্পর্শ যেখানে নেই, শুধু আত্মতৃপ্তির বিলাসিতা আছে। এইভাবে নিজের মনোরাজ্যে বন্দি হয়ে আত্মাভিমানী ফ্লোবের শিল্পের নিছক বহিরাশ্রয়িতাতে মনোনিবেশ করেছিলেন। ‘Madame Bovary’—র ট্যাভার্ন—এর দৃশ্যটি ফুটিয়ে তুলতে তাঁর তিন মাস সময় লেগেছিল, উপন্যাসের মধ্যে যেটুকু পাঠকের পড়তে মাত্র তিন ঘণ্টা সময় লাগে। অনেকে বলবেন ফ্লোবের স্টাইল—এর উৎকর্ষে পক্ষপাতী ছিলেন। এ—কথা সত্য হলেও রচনারীতির এমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই যার জন্য আজ তাঁকে স্মরণ করা যেতে পারে।

যে—ফ্রান্সের শিল্পী ফ্লোবের, সে—ফ্রান্স হচ্ছে জুন ১৮৪৮ সালের ফ্রান্স, থার্ড এম্পায়ারের ফ্রান্স, ফ্রাঙ্কো—প্রাশিয়ান যুদ্ধের ফ্রান্স, প্যারিস কমিউন—এর ফ্রান্স। সেইজন্য নিষ্ঠুর ফ্রান্সকে বর্জন করে ফ্লোবের সংগ্রাম থেকে দূরে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জীবনকে। জীবনকে প্রকাশ করবার জন্য, যুগসত্যকে ব্যক্ত করবার জন্য ফ্লোবের অত্যন্ত উদগ্রীব হলেও, তিনি শেষ পর্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন, জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষকে, সত্যকে, বাস্তবকে তিনি বরণ করতে পারেননি। উন্নাসিক বিশুদ্ধ শিল্পী হয়েই তিনি জীবন কাটিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ শিল্পীরা ফ্লোবেরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিল্পের সঙ্গে জীবনের ও সমাজের যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন বললে ভুল হয় না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আর—একজন বিখ্যাত শিল্পী ধনতান্ত্রিক সমাজের ঘাতপ্রতিঘাতে মর্মাহত হয়ে নিজের মনোজগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন হেনরি জেমস (Henry James)। ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক সমাজ যে ধ্বংসোন্মুখ এবং সেখানে শিল্পীর যে কোনো নূতন কিছু সৃষ্টি করবার শক্তি নেই; সে—বিষয়ে জেমস সচেতন ছিলেন। তারপর আত্মশক্তির উপর শ্রদ্ধাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতীতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন, সভ্যতার অতীত গৌরব তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। জেমস নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস—অবিশ্বাসের মাপকাঠি দিয়ে তদানীন্তন জগতের সবকিছুর মূল্য নির্ধারণ করতেন। জেমসের রচনার মধ্যে সেইজন্য বিরোধ বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল, যে—বিরোধ আধুনিক প্রায় সমস্ত লেখকদের রচনার বৈশিষ্ট্য। একদিকে তিনি ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবিলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, আর—একদিকে অলঙ্ঘনীয় আত্মাভিমানের বশে ব্যক্তির খণ্ডরাজ্য গড়েছিলেন, এবং পারিপার্শ্বিকতাকে অস্বীকার করে স্নবের মতো সেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই পরোক্ষে সমর্থন করেছিলেন। জেমসের এই মনোভাব এ—যুগের জেমস জয়েস (James Joyce), উইন্ডহাম (Wyndham Lewis) প্রমুখ শিল্পীদের মধ্যে স্পষ্টতরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপ ব্যালজাকের ‘Comedie Humaine’ থেকে বহু দূরে দ্বীপান্তরিত হয়েছে, জেমসের ‘The Ambassadors’, ‘The Golden Bowl’—এর যাত্রাশেষে জয়স—এর ‘Ulysses’—এর জঘন্য ডাবলিন শহর অতিক্রম করে, উইন্ডহাম—এর ‘The Apes of God—এর ভিতর দিয়ে স্পেংলার, পাউন্ড, এমনকী ‘গাজায় চক্ষুহীন’ হাক্সলে পর্যন্ত।

কবে এ—যুগের শিল্পীর ও ঔপন্যাসিকের ‘এই গাজায় চক্ষুহীন’ অবস্থা কেটে যাবে কবে তাঁরা মুক্ত জীবনাস্বাদে অনুপ্রাণিত হয়ে, মানুষ ও জীবনকে শ্রদ্ধেয় মনে করবেন? আজ জেমসীয় বা ফ্লোবেরীয় শিল্পের পচা ডিমে তা দিয়ে লাভ কী?

…………

* হেনরি ফিল্ডিং ‘‘Joseph Andrews” (1742), ‘‘Jonathan Wild’’ (1743), ‘‘Tom Jones’’ (1749), ‘‘Amelia’’ (1751) প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করেছেন। ফিল্ডিং-এর ঔপন্যাসিক প্রতিভা সম্বন্ধে Frederic T. Blanchard-এর “Fielding, the Novelist” (Oxford Univ. Press) নামক পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে।

* লরেন্স স্টার্নের বিস্তারিত সমালোচনার জন্য Wilbur L. Cross-এর ‘‘The Life and Times of Lalurence Sterne” দ্রষ্টব্য।

* মার্কস-এর এই সমালোচনার সত্যতা প্রমাণিত হবে তাঁর উল্লিখিত ঔপন্যাসিকদের রচনা পাঠ করলে। থ্যাকারের ‘’Vamity Fair”, ‘’The History of Henry Esmond’’, ‘‘The Virginians”, ডিকেন্সের “Oliver Twist”, ‘‘The Pickwick Papers’’. ‘‘Bleak House.’’ ‘‘Hard Times’’. ‘‘A Tale of Two Cities’’, ‘‘Great Expectations’’. ব্রন্ত-এর ‘‘Jane Eyre’’. এমিলির ‘‘Wuthering Heights’’, -গ্যাসকেলের ‘‘Marry Barton’’. ‘’Ruth, North and South’’. ‘‘Sylvia’s Lovers’’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলি পাঠিতব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *