০৬. উপন্যাস

ষষ্ঠ অধ্যায় – উপন্যাস

শব্দের নানাপ্রকার ধ্বনির জন্য দাঁতে (Dante) ‘buttered’ ও ‘shaggy’ বলতেন শব্দকে। শব্দ শুধু কোনো বস্তুর প্রতীক নয়, তার ধ্বনি আছে এবং বিশেষ বিশেষ ভাবের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে। এজরা পাউন্ড (Ezra Pound) বলেছেন :

The changing of Language is done in three ways : you receive the language as your race has left it, the words having meanings that have ‘grown into the race’s skin’; the Germans say ‘wie in den schnabel gewachsen’, as it grows in his beak. And the good writer chooses his words for their ‘meaning’, but that meaning is not a set cut-off thing like the move of a knight or pawn on a chess board. It comes up with roots, with associations, with how and where the word is familiarly used, where it has been used brilliantly or memorably…

(Ezra Pound : A.B.C. of Reading)

প্রেমিকার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কোনো কবি বলবেন ‘সোনার বরন’, কেউ বলবেন ‘চাঁপার বরন’। কবির ইচ্ছা তাঁর প্রেমিকার রূপ পাঠক উপলব্ধি করে মনে মনে প্রশংসা করুক। যখন তিনি ‘সোনার বরন’ বা ‘চাঁপার বরন’ বলে সে—রূপ ব্যক্ত করবেন তখন পাঠকের বুঝতে কষ্ট হবে না, কারণ চাঁপা ফুলের রং বা সোনার রঙের সঙ্গে পরিচয় সকলেরই আছে। সুতরাং প্রেমিকার রূপানুভূতিকে ব্যক্ত করবার জন্য কবিকে এখানে এমন শব্দের আশ্রয় নিতে হয়েছে যে—শব্দ বাইরের জগতের কোনো বস্তুর আধারস্বরূপ, অর্থাৎ অন্য সকলের সেই শব্দের আনুষঙ্গিক ভাব বা বস্তুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে। কবি যদি শুধু প্রেমিকার রূপবর্ণনাতে একান্তভাবে ব্যক্তিগত আনন্দ চান, তাহলে তিনি খুশিমতো যেকোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ‘দেখেছিলাম ময়না পাড়ার মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’ বললে ময়নাপাড়ার মাঠে গিয়ে কালো মেয়েটিকে দেখবার প্রয়োজন হয় না, কারণ হরিণের চোখের সৌন্দর্য সম্বন্ধে পাঠকের ধারণা আছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে কবি এমন শব্দ ব্যবহার করেন যা অন্যের কাছে অপরিচিত নয়; এবং শব্দ কোনো ভাব বা বস্তুর প্রতীক বলে সে—ভাব বা সে—বস্তু সাধারণেরও অভিজ্ঞতার সীমানার বাইরে নয়। কবি নিজে যা অনুভব করেন তা—ই ব্যক্ত করেন, সুতরাং কবির অনুভূতিরও বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীর অনুভূতির সঙ্গে সাদৃশ্য থাকবে, কারণ তা না হলে অভিব্যক্তিও সর্বসাধারণের বোধগম্য হবে না। এইভাবে মানবতার সাহজিক সাধারণত্বে পৌঁছোনো হচ্ছে কবির ও কাব্যের লক্ষ্য। এইভাবে কবি অভিযোজিত (adapted) মানুষের অন্তরালবর্তী আপেক্ষিক গণরূপী মানুষের (Genotype) কাছে আবেদন করেন। কাব্যকে সেইজন্য অন্তর্মুখী বলা হয়। কাব্যে ‘আমি’র চারদিকে মানুষের ভাবাভিজ্ঞতা এসে ভিড় করে। কাব্য কোনো একটি বিশেষ কোণ থেকে সংগৃহীত বাস্তবের কতকগুলি সাহজিক পরিপ্রেক্ষিত—সমষ্টি (Instinctive Perspectives) এবং কাব্য দ্ব্যর্থক বলেই তার প্রসারগুণ তরঙ্গের মতো।

উপন্যাসের প্রাথমিক যাত্রারম্ভ বাস্তব জগৎ থেকে। বাস্তব জগৎই উপন্যাসের বিষয়ীভূত অনুভাবের (Subjective Associations) উৎস। সেইজন্য উপন্যাসে বা আখ্যায়িকার মধ্যে আমরা আমির সন্ধান পাই না, উপন্যাসের সৃষ্ট জগতের মধ্যে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করি, ক্বচিৎ নায়কের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম ভেবে তারই সঙ্গে তার প্রতিবেশের ‘অপরত্ব’—এর (otherness) চারদিকে চেয়ে দেখি। সহজ প্রবৃত্তি ও প্রতিবেশের অন্তঃস্থিত বিরোধকে প্রকাশ করা উপন্যাসের উদ্দেশ্য নয়, প্রতিবেশের অর্থাৎ জীবন—অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের জন্য এই বিরোধের যে রূপান্তর ঘটে তাকে ব্যক্ত করাই উপন্যাসের লক্ষ্য। শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে (Class Society) প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে এত বেশি পার্থক্য থাকে যে, উপন্যাস কালক্রমিক না হয়ে পারে না। অর্থাৎ গতিশীল প্রত্যক্ষ বাস্তব উপন্যাসে প্রতিফলিত হবে। উপন্যাসের চরিত্রের ক্রিয়া ও অনুভূতি বহির্জগৎ থেকে বিচার করাই শ্রেয়। উপন্যাস সেইজন্য বাস্তবাশ্রয়ী, জগতের বিভিন্ন কোণ থেকে নায়কের কতকগুলি পরিপ্রেক্ষিতসমষ্টি। সুতরাং উপন্যাস সেই সমাজের মধ্যেই পরিপুষ্ট হতে পারে যে—সমাজে মানুষের অভিজ্ঞতার তারতম্য এত বেশি সুস্পষ্ট যে, বহির্জগৎকে আশ্রয় না করে উপায় নেই। অভিজ্ঞতার এই তারতম্য সমাজের দ্রুত পরিবর্তনের জন্যই সম্ভব এবং এর মূলে রয়েছে মানুষিক বৃত্তির বিভেদ বৃদ্ধি (Increased Differentiation), জীবনের গতি ও দ্বন্দ্বমূলক (Dialectical) ধারা উপলব্ধি। তাই উপন্যাসের প্রকৃত জনপ্রিয়তা হল ধনতান্ত্রিক সমাজ (Capitalist Society)। কডওয়েল বলেন :

Poetry concentrates on the immediate affective associations of the word, instead of going first to the object or entity symbolised by the word and then drawing the affective association from that. Since words are fewer than the objects they symbolise, the affects of poetry are correspondingly condensed but poetry itself is correspondingly couldy and ambiguous. This ambiguity is in fact a by product… It is an approach to the more instinctively common part of man’s consciousness. It is an approach to the secret unchanging core of the genotype in adapted man. Hence the importance of physiological introversion in poetry.

This genotype is undifferentiated because it is relatively unchanging. Hence the timelessness of poetry as compared to the importance of time sequence in the novel. Poetry speaks timelessly for one common ‘I’ round which all experience is orientated. In poetry all the emotional experiences of men are arranged round the instincts, round the ‘I’. Poetry is a bundle of instinctive perspectives of reality taken from one spot. Precisely because it is cloudy and ambiguous, its view is far-reaching, its horizon seems to open and expand…

But the novel goes out first to reality to draw its subjective associations from it. Hence we do not seem to feel the novel ‘in us’, we do not identify our feelings with the feeling-tones of the novel. We stand inside the mock world of the novel and survey it; at the most we identify ourselves with the hero and look round with him at the ‘otherness’ of his environment. The novel does not express the general tension between the instincts and the surroundings, but the changes of tension which take place as a result of change in the surroundings (life-experience). This incursion of the element (reality as a process) so necessary in a differentiated society where men’s time-experiences differ markedly among themselves, means that the novel must particularise and have characters whose actions and feelings are surveyed from without. Poetry is internal—a bundle of ‘I’ perspectives of the world taken from one point, the poet. The story is external—a bundle of perspectives of one ‘I’ (the character) taken from different parts of the world.

Obviously the novel can only evolve in a society where men’s experiences do differ so markedly among themselves as to make this objective approach necessary, and this difference of experience is itself the result of rapid change in society, of an increased differentiation of functions, of an increased realisation of life as process, as dialectic.

(Christopher Caudwell : Illusion and Reality)

উপন্যাস বুর্জোয়া সমাজের (Bourgeois Society) শুধু সাধারণ সৃষ্টি নয়, শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এ—সৃষ্টি শুধু বুর্জোয়া শিল্পীর গৌরব নয়, বুর্জোয়া—যুগোত্তর শিল্পীদের কাছে উপন্যাস অমূল্য সাহিত্য। শিল্পের এই নূতন রূপ যাঁদের সৃজনীশক্তির প্রভাবে একদিন পাপড়ি মেলে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে সেই বুর্জোয়া শ্রেণির ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সে—রূপ কি মলিন হয়ে শুকিয়ে যাবে? উপন্যাস ধনতান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাবের সময় জন্ম নিয়ে, ধনতন্ত্রের যৌবনকালে শিল্পের শিখরে আরোহণ করে আজ ধনতন্ত্রের জরাজীর্ণ বার্ধক্যে কি তার সমস্ত অতীত মহিমা হারাবে? বিরাট শক্তির আহ্বানে একদিন মানুষের সামনে যে বৃহৎ জীবন, বৃহৎ সমাজের সিংহদ্বার উদ্ঘাটিত হয়েছিল, আজ কি আর—এক নূতনতম শক্তির আহ্বানে উন্নততর মানুষের সামনে তদপেক্ষা বৃহত্তর জীবনের, বৃহত্তর সমাজের সম্ভাবনা নেই? তা—ই যদি থাকে, মানুষ যদি আরও শক্তিমান হয়ে থাকে, সমাজ যদি সুন্দরতর হবার দাবি করে, তাহলে যে সমাজান্তর্গত মানুষ একদিন উপন্যাসের উপাদান সরবরাহ করেছিল, আজ কেন সে আরও মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করবে না? অভাব কীসের? শিল্পীর? না, মানুষ ও তার সমাজের? শিল্পীর সেই সৃজনী—প্রতিভা, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি সন্ধানের সেই তীক্ষ্ন দৃষ্টি কোথায়, যে—দৃষ্টি প্রভাত—সূর্যের মতো অন্ধকার ভেদ করে একদিন মাটি স্পর্শ করেছিল?

উপন্যাসের সর্বপ্রধান উপজীবিকা হচ্ছে ব্যক্তি। সমাজের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যক্তির যে—সংগ্রাম তারই কাহিনি উপন্যাসে লিপিবদ্ধ করা হয়। সেই কারণেই মানুষ ও সমাজের মধ্যে সাম্য যখন আর বজায় রইল না, মানুষ যখন নিজেকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সৈনিক হিসাবে আবিষ্কার করল, একমাত্র তখনই সম্ভব হল শিল্পকে এই নূতন রূপে ভূষিত করা, তখনই হল উপন্যাসের জন্ম। উপন্যাসের ঠিকুজি মিলিয়ে দেখলে রেনেসাঁস—এর পূর্বেও যে তার অঙ্কুর—জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু সে—জীবন উল্লেখযোগ্য নয়। শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে যখন মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ ঘনীভূত হল তখন উপন্যাস প্রবেশাধিকার পেল শিল্পের মহাসভায়। পৃথিবীর দুটি শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িক হল ‘ওডেসি’ (Odessey) ও ‘রবিনসন ক্রুসো’ (Robinson Crusoe), কিন্তু দুটির মধ্যে আকাশ—মাটি ব্যবধান নেই কি? ওডেসিউস হল ইতিহাস—বর্জিত সমাজের মানুষ, যে—সমাজে কাল্পনিক ও বাস্তবের মধ্যে কোনো ভেদ নেই, সময় যেখানে বিভীষিকাশূন্য। ঝঞ্ঝাতাড়িত সমুদ্রবক্ষে ভ্রাম্যমাণ ওডেসিউস সেইজন্য নির্ভীক ও নিরাকুল, কারণ ওডেসিউস জানে তার জীবনের নাবিক অমর্ত্যলোকের দেবতা, ঝঞ্ঝা যাঁর ক্রোধ, পোত—দুর্ঘটনা ইথাকায় প্রত্যাবর্তনের পথে যাঁর শেষ পরীক্ষার কৌশল। এসব ওডেসিউস জানে বলেই সে নির্বিকার, নিশ্চিন্ত। মানুষকে পরীক্ষা করছেন দেবতা, শান্তিময় জীবন পুনর্লাভের পূর্বে দেবতার সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ওডেসিউসের কাছে গৌরবের হলেও জয়—পরাজয়ের সংশয় তাতে নেই। রবিনসন ক্রুসো তা নয়। কার্ল মার্কস (Karl Marx) লিখেছেন :

This eighteenth century individual, constituting the joint product of the dissolution of the feudal form of society and of the new forces of production which had developed since the sixteenth century, appears as an ideal whose existence belongs to the past, not as a result of history, but as its starting point.

এই অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষটি হচ্ছে একদিকে ধ্বংসোন্মুখ সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং আর—একদিকে ষোড়শ শতাব্দী থেকে যে নূতন উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি হয়েছে—সেই দুইয়ের সংযুক্ত সৃষ্টি। আদর্শ হিসেবে এই ব্যক্তিটির অস্তিত্ব অতীতে মনে হয় ইতিহাসের প্রতিফল বলে নয়, অতীতে এর যাত্রারম্ভ বলে। ওডেসিউস—এর কোনো ইতিহাস ছিল না। পৃথিবীর শৈশবাবস্থায় ওডেসিউস বাস করত, দেবতাদের সঙ্গে ছিল তার পরিচয়। রবিনসন অতীতকে পরিহার করে নিজের ইতিহাস নিজেই গড়বার জন্য প্রস্তুত হল। রবিনসন হল নূতন মানুষ, যে প্রকৃতির অভিভাবক হতে চায়, শত্রুকে সংগ্রাম করে পরাজিত করতে চায়। জগৎ হচ্ছে বাস্তব জগৎ, বস্তুর মূল্যের বোধশক্তি ও অনুভূতি তার মধ্যে জীবন্ত। ঝড় সেখানে দেবতার ক্রোধের অভিব্যক্তি নয় বলেই রবিনসন জাহাজ ও তার কার্গো নিয়ে বিপন্ন হয়—মানুষ হয় জলদস্যু, বিদ্রোহী, পাশবিক ও দয়ামায়াহীন। কিন্তু ক্রুসোর নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস, অসীম শ্রদ্ধা। তার আশার এই সারল্যের জন্যই সে ভাগ্যের নিষ্ঠুর বিড়ম্বনাকে জয় করে, প্রকৃতির বৈরিতা ও সহযাত্রীদের বিদ্রোহকে দমন করে, সমুদ্রপারে তার আদর্শ উপনিবেশের সন্ধান পেল। নির্বাসিত রুশবাসীর কাছে ক্রুসো তার অভিজ্ঞতা ও দ্বীপবাসীদের অভ্যর্থনার কাহিনি বর্ণনার সময় বলল

They were exceesingly taken with the story, and especially the prince, who told me with a sigh, that the true greatness of life was to be masters of ourselves.

সকলেই আমার কাহিনি শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল, বিশেষ করে রাজকুমার। রাজকুমার দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আমাকে বললেন যে, নিজেদের ভার সম্পূর্ণ নিজেরা গ্রহণ করাই হচ্ছে জীবনে সত্যকার মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া।

ক্রুসোর সমুদ্রযাত্রা শেষ হল ইথাকায় প্রত্যাবর্তনে নয়, বিচক্ষণ টেলিমেকাস বা সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি পেনেলো—এর সাদর অভ্যর্থনাতে নয়, সাইবেরিয়াতে শেষযাত্রায় এবং এলবিতে পুনরাগমনে। সেখানে রবিনসনের লাভ হল কি?

Here my partner and I found a very good sale for our goods, as well those of China as the sables, etc., of Siberia, and dividing the produce, my share amounted to three thousand four hundred and seventy-five pounds seventeen shillings and three pence, including about six hundred pounds’ worth of diamonds which I purchased at Bengal.

এখানে আমি ও আমার অংশীদার দু—জনেই প্রচুর পণ্য বিক্রয়ের সুবিধা পেলাম। যেমন চীনের জিনিস তেমনি সাইবেরিয়ার সেবলও বিক্রি হল। পণ্য বখরা করে আমার অংশে পেলাম মোট ৩৪৭৫ পাউন্ড ১৭ শিলিং ৩ পেন্স এবং এর মধ্যে বাংলা দেশ থেকে কেনা হল প্রায় ৬০০ পাউন্ড মূল্যের ডায়মন্ড ছিল।

ওডেসিউস ও রবিনসন ক্রুসো দু—জনের জীবনই অদ্ভুত ভ্রমণকাহিনি এবং দু—জনেই শেষকালে শান্তিতে অবসর গ্রহণ করল। কিন্তু পার্থক্য এইখানে যে ওডেসিউসের জীবনকাহিনি হল গৃহাভিমুখী, ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের দ্বীপাবাস ইথাকায় প্রত্যাবর্তন, আর রবিনসনের কাহিনি বহির্মুখী, গৃহাভিমুখে নয়, গৃহান্তরে। ক্রুসো হল সাম্রাজ্য—প্রতিষ্ঠাতা, প্রকৃতিকে সংগ্রাম—প্রতিযোগিতায় আহ্বান করে তাই সে জয় করল। ধনতান্ত্রিক সমাজের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে ক্রুসো সাম্রাজ্যবাদের বীজ বপন করল। সে—বীজ আজ বিরাট মহিরুহে পরিণত হয়েছে, পৃথিবীব্যাপী তার শাখাপ্রশাখা। ক্রুসোর একদিন পণ্য বিক্রয়ের যে—মুনাফাতে তার অসমসাহসিক কার্যের জন্য পুরস্কৃত হয়েছিল, ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশপথে সাম্রাজ্যবাদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আজ সেই মুনাফা, সেই টাকা—আনা—পাই, মানুষের পারস্পরিক আন্তরিক সম্বন্ধ ও আত্মীয়তাকে প্রাণহীন আর্থিক সম্বন্ধে পরিণত করেছে। একসময় সেইজন্য ধনতন্ত্রের শৈশবাবস্থায় মানুষের জীবন যখন বিরাট শক্তির আভায় সমুজ্জ্বল ছিল, ধনতন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট নূতন বাস্তব ক্ষেত্রে যখন মানুষকে পরিপূর্ণরূপে দেখা যেত, তখন উপন্যাস মানবচরিত্র সৃষ্টিতে শিল্পরাজ্যে যে—যুগান্তর এনেছিল, বর্তমানে চরিত্র সৃষ্টির সে—শক্তি উপন্যাসে লোপ পেয়েছে। তার কারণ ধনতান্ত্রিক সমাজের আজ বিকৃত রূপ—তার মৃত্যু—মলিন মুখের উপর আজ সাম্রাজ্যবাদের বিভীষিকা। মানুষ আজ তাই বিকৃত, তার পূর্ণরূপের সে—জৌলুস, জীবনের সে—দীপ্তি আজ ম্রিয়মাণ। ধনতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তাহলে উপন্যাসের মৃত্যুও কি অবশ্যম্ভাবী?

উপন্যাসের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী নয়। সমাজতন্ত্র উপন্যাসকে পুনর্জীবন দেবে। সমাজ ও সামাজিক মানুষই যখন উপন্যাসের প্রধান উপাদান, তখন সমাজের উন্নততর অবস্থায় রূপান্তরের ফলে উপন্যাসের উপাদান আরও উন্নীত হবে। একদিন নূতন সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজের বিরাট শক্তির পরিচয় পেয়ে, মানুষের রূপ সমাজের বুকে যতখানি পূর্ণতা লাভ করেছিল আজ আর—এক নূতনতর সমাজের সুমুখে দাঁড়িয়ে, নিজের বিরাটতর শক্তির পরিচয় পেয়ে, মানুষের রূপ সমাজের বুকে কি আরও বেশি পূর্ণতা লাভ করবে না? আজ সেই উন্নততর মানুষ ও সমাজ যখন পৃথিবীর দশমাংশের একাংশ সোভিয়েট ইউনিয়নে তার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং প্রসারলাভের সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে, তখন কেন উপন্যাস তার সেই লুপ্ত গৌরব ফিরে পাবে না, তার উপাদানেরই বা কেন অভাব থাকবে?

উপন্যাসের পুনর্জীবনের জন্য পুনরায় তাকে ঐতিহাসিক ও কাব্যিক গুণে মণ্ডিত করা প্রয়োজন। একদিন যে ঐতিহাসিক (Historical) ও কাব্যিক (Epic) বৈশিষ্ট্যের জন্য তার বিজয়বার্তা ঘোষিত হয়েছিল, আজ সেই ঐতিহাসিক ও কাব্যিক গুণকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। উপন্যাসের এই দুটি গুণ সম্বন্ধে সেইজন্য উদীয়মান ধনতান্ত্রিক যুগের, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপন্যাসিকদের মতামতের ও সাহিত্যের প্রণিধান একান্ত আবশ্যক। ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হেনরি ফিল্ডিং উপন্যাসের এই ঐতিহাসিক ও কাব্যিক গুণের উপর বিশেষ প্রাধান্য আরোপ করেছিলেন। ফিল্ডিং তাঁর ‘The History of Tom Jones—A Founding’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসের একটি অধ্যায়ে বলেছেন :

Though we have properly enough entitled this our work a history and not a life;… yet we intend in it rather to pursue the method of those writers who profess to disclose the revolutions of countries, than to imitate the painful and volumnious historian, who, to preserve the regularity of his series, thinks himself obliged to fill up as much paper with the details of months and years in which nothing remarkable happened, as he employs upon those notable eras when the greatest scenes have been tra sacted on the human stage. Such historians as these do in reality very much resemble a newspaper, which consists of just the same number of words, whether there be any news in it or not.

(Book II Chap.I).

”যদিও এই পুস্তকখানিকে জীবনকাহিনি না বলে ইতিহাস বলা হয়েছে, তাহলেও এর মধ্যে আমরা সেইসব লেখকদেরই অনুসরণ করব যাঁরা দেশের বিপ্লবকে প্রকাশ করতে চান এবং নীরব ঐতিহাসিকের মতো বৎসরের ও মাসের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে, সামান্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তৃপ্তি পান না। এইসব ইতিহাস দৈনিক সংবাদপত্রের মতো শুধু সমান সংখ্যক শব্দে পূর্ণ থাকে, সে—শব্দ সংবাদ হোক না হোক সেদিকে কোনো দৃষ্টি থাকে না।” ফিল্ডিং—এর এই কথার অর্থ হচ্ছে এই যে ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য হবে পরিবর্তন, কার্যকারণ সম্বন্ধ, সংকট (crisis) ও বিরোধ (conflict) শুধু নিছক বিষয়ীভূত বিশ্লেষণ (Subjective Analysis) নয়। উক্ত উপন্যাসের আর—একটি অধ্যায়ে ফিল্ডিং ঔপন্যাসিকের দুটি প্রধান গুণের কথা উল্লেখ করেছেন : (১) প্রতিভা (Genius) (২) বিদ্যা (Learning)। প্রতিভা হচ্ছে দুটি নির্দিষ্ট শক্তির সমন্বয়, উদ্ভাবনশক্তি (Invention) ও বিচারশক্তি (Judgement)—

…I shall here venture to mention some qualifications, every one of which are in a pretty high degree necessary to this order of historians. The first is genius, without a fall vein of which, no study, says Horace, can avail us .By genius I would understand that power, or rather those powers of the mind, which are capable of penetrating into all things within our reach and knowledge, and of distinguishing their essential difference. These are no other than invention and judgement; and they are both called by the collective name of genius, as they are of those gifts of nature which we bring with us into the world; concerning each of which, many seem to have fallen into very great errors; for by invention, I believe, is generally understood a creative faculty, which would indeed prove most romance writers to have the highest pretensions to it; whereas by invention is really meant no more, and so the word signifies, than discovery, or finding out; or to explain it at large, a quick and sagacious penetration into the true essence of all the objects of our contemplation.This I think, can rarely exist without the concomitancy of judgement; for how we can be said to have discovered the true essence of two things, without discerning their difference, seems to me hard to conceive. But… they are not sufficient for our purpose without a good share of learning; for which I could again cite the authority of Horace, and of many others, if any was necessary to prove that tools are of no service to a workman when they are not sharpened by art or when he wants rules to direct him in his work, or has no matter to work upon. All these uses are supplied by learning; for nature can only furnish us with capacity, or, with the tools of our profession : learning must fit them for us, must direct them in it, and lastly, must contribute part at least of the materials.

(Book IX, Chap.I)

”এই শ্রেণির ঐতিহাসিকদের কয়েকটি বিশেষ প্রয়োজনীয় গুণ সম্বন্ধে এইবার আমি কিছু বলব। প্রথম হচ্ছে প্রতিভা, যা ভিন্ন হোরেস বলেন, আমাদের সমস্ত অধ্যয়নই বৃথা। প্রতিভা বলতে আমি সেই শক্তি বা মানসিক শক্তিসমষ্টি বুঝি যা আমাদের যাবতীয় জ্ঞেয় বিষয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে তাদের প্রকৃতিগত পার্থক্যকে বিচার করতে সমর্থ। এই শক্তি হচ্ছে উদ্ভাবন ও বিচারশক্তি এবং এ—দুইয়ের সম্মিলিত শক্তিকে প্রতিভা আখ্যা দেওয়া হয়। এই প্রত্যেকটি শক্তি সম্বন্ধে অনেকের ভুল ধারণা আছে। উদ্ভাবনশক্তি ব্যবহৃত হয় সৃজনীশক্তির অর্থে এবং অনেক রোমান্টিক লেখক এই অর্থের সুযোগ নিয়ে নিজেদের প্রতিভার ভান করেন। কিন্তু উদ্ভাবন বলতে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করা ছাড়া অন্য কিছু বোঝায় বলে আমার ধারণা নেই। অর্থাৎ উদ্ভাবনের অর্থ হচ্ছে আমাদের চিন্তার বিষয়গুলির ভিতর প্রবেশ করে তাদের সারটুকুকে উপলব্ধি করা। বিচার ভিন্ন এই মর্ম—সন্ধান সম্ভব নয়, কারণ দুটি বিষয়ের অন্তঃস্থিত সত্যকে আমরা ‘কেমন করে উপলব্ধি করব দুটির পার্থক্যকে বিচার না করে।… কিন্তু বিদ্যা বা জ্ঞান ভিন্ন এই দুই শক্তিরও কোনো কার্যকারিতা নেই। এ—বিষয়ের সপক্ষে শুধু হোরেস নন, অনেকের মতই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অস্ত্র কোনো কাজে না ব্যবহৃত হলে অথবা অস্ত্র ব্যবহার করবার মতো উপাদান না থাকলে শ্রমিকদের কোনো স্বার্থ নেই। একমাত্র শিক্ষাই এই উপাদান সরবরাহ করতে পারে, কারণ প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা পাই শক্তি বা অস্ত্র এবং শিক্ষা সেই অস্ত্রকে ব্যবহারযোগ্য করে উপাদান সংগ্রহ করে।”

এ—যুগের ঔপন্যাসিক যখন ফিল্ডিং—এর এই দৃষ্টি দিয়ে উপন্যাসকে বিচার করবেন তখন পুনরায় নূতন বাস্তবের জন্ম হবে। বর্তমান জগতের সমস্ত বিষয়গুলির অন্তঃস্থিত সত্য ও বিভেদকে যাচাই করবার এবং মানবতার একত্বকে উপলব্ধি করবার শক্তি ঔপন্যাসিক যেদিন ফিরে পাবেন, সেদিন সত্যই উপন্যাসও তার লুপ্ত গৌরব ফিরে পাবে? এ—কথার অর্থ এই নয় যে, ফিল্ডিং বা অষ্টাদশ শতাব্দীর উপন্যাসই আদর্শ সৃষ্টি। আজকে যদি কোনো ঔপন্যাসিক সমাজের সমগ্রতাকে হৃদয়ঙ্গম করতে চান তাহলে তাঁকে ফিল্ডিং—এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের ও সমাজের যে—পরিবর্তন ঘটেছে তাকে বুঝতে হবে, বিচার করতে হবে। ফিল্ডিং ঔপন্যাসিকের যে—গুণের কথা উল্লেখ করেছেন সেই গুণ আজকের কোনো ঔপন্যাসিককে দাবি করতে হলে তাঁকেও সমাজের অন্তঃস্থলের বৈপ্লবিক স্পন্দনকে প্রকাশ করতে হবে। আধুনিক মনস্তত্ত্ব (Psychology) মানবচরিত্র সম্বন্ধে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছে সত্য, মানুষের গভীরতর অবচেতন মনে ডুব দিয়ে অনেক গুপ্ত মাণিক্যের সন্ধান পেয়েছে, কিন্তু শুধু এর দ্বারা মানবচরিত্রের সম্পূর্ণতাকে বোঝা যায় না, মানুষের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার উপর সুবিচার করা হয় না। আধুনিক মনোবিকলনতত্ত্ব (Psychoanalysis) মানুষের জ্ঞানের সম্ভার যে অনেক বাড়িয়েছে সে—বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই এবং কোনো ঔপন্যাসিক আজ জ্ঞানের এইদিকটিকে উপেক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু শুধু জ্ঞানের সাহায্যেই ব্যক্তির পূর্ণরূপকে বিচার করা যায় না। সামাজিক মানুষকে সমাজের পটভূমিকায় বিচার করতে হবে। সেইজন্য প্রয়োজন সমাজবিজ্ঞান (Sociology) ও ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা (Materialistic Interpretation of History) অধ্যয়ন করা। তাহলেই ব্যক্তিকে সমগ্রভাবে রূপায়িত করা সম্ভব হবে, ব্যক্তিত্বও বিকশিত হয়ে উঠবে। ব্যক্তি সমগ্র সমাজের একটি অংশ এবং এই সমাজের আইনকানুন, প্রিজম—এর ভিতর দিয়ে আলোর রশ্মি যেমনভাবে প্রবেশ করে, ব্যক্তির মনের যন্ত্রপাতিতে ঠিক তেমনিভাবে বিয়োজিত (Decomposed) ও প্রতিসৃত (Refracted) হয়ে তাকে পরিবর্তন করে ও পরিচালনা করে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির রূপ খণ্ডরূপ, বিকৃত রূপ। গতিশীল সমাজের তরঙ্গক্ষুব্ধ বক্ষে নিক্ষিপ্ত ব্যক্তির রূপই পূর্ণ এবং সেই পূর্ণরূপকে প্রস্ফুটিত করাই শিল্পীর লক্ষ্য।

আজ ধনতন্ত্রের যে ক্ষয়িষ্ণু রূপ সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিজম—এর বীভৎসতার মধ্যে মূর্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে মানুষকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে ও হবে। মুমূর্ষু রুগির যেমন নানারকম অসংলগ্ন উপসর্গ দেখা দেয়, তেমনি ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রের শেষ জটিল উপসর্গ আজ সাম্রাজ্যবাদ—বনাম—ফ্যাসিজম—এর শক্তি—প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রকাশ পেয়েছে, সঙ্গে রয়েছে ব্যাধি, বেকার সমস্যা, অত্যাচার, ব্যভিচার, শোষণ। বহির্জগতের এই ক্লিন্ন পরিবেষ্টনের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগ্রাম করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জগতে এর প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হবে। একাধারে এই দুই মোহড়ায় (Fronts) মানুষ আজ সংগ্রামরত অক্লান্ত সৈনিক এবং সংগ্রামে মানুষের জয় অবশ্যম্ভাবী। সত্যতার প্রতিটি স্তর ও সীমান্ত মানুষ অতিক্রম করেছে জয়গৌরবে মহিমান্বিত হয়ে, আজও তা—ই করবে। ধাবমান ইতিহাসের কণ্ঠোচ্চারিত এ—সত্যের পরাজয় নেই। আজ এই সত্যকে উপলব্ধি করলে উপন্যাস পুনর্জীবন লাভ করবে, প্রাণবান চরিত্রের কলধ্বনিতে উপন্যাস পুনরায় মুখর হয়ে উঠবে। ধনতন্ত্রের মৃত্যুতে উপন্যাসের মৃত্যু হবে না, কারণ উপন্যাসের মূল উপাদান মানুষ ও সমাজ পূর্ণতর রূপ গ্রহণ করবে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে। মানুষ তখন মহত্তর হবে, সমাজ তখন সুন্দরতর হবে, উপন্যাসও তখন শিল্পের উন্নততর সোপানে আরোহণ করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *