০১. ডায়লেকটিক্স

প্রথম অধ্যায় – ডায়লেকটিক্স

মার্কসীয় দর্শনকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism) বলা হয় কারণ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলিকে বিচার ও বিশ্লেষণ করবার মার্কসীয় রীতি হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক (Dialectical), এবং সেইসব ঘটনার বিশ্লেষণ—পদ্ধতি হচ্ছে বাস্তবপন্থী (Materialistic)। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক জীবন, সামাজিক ঘটনা ও সামাজিক ইতিহাস অধ্যয়ন করাকে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)।

এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস ও এঙ্গেলস দার্শনিক হেগেলের নাম উল্লেখ করে বলেছেন যে এই দর্শনের মূল কাঠামোটি তিনিই গড়েছিলেন। তা—ই বলে এ মনে করা ভুল যে মার্কস—এঙ্গেলসের ডায়লেকটিকস এবং হেগেলের ডায়লেকটিকস—এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মার্কস ও এঙ্গেলস হেগেলীয় ডায়লেকটিকস—এর উপরের আদর্শপ্রধান খোলসটিকে বাদ দিয়ে ভিতরের সার পদার্থটুকু ছেঁকে নিয়ে তাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিবর্ধিত করেছিলেন। মার্কস বলেছেন—

My dialectic method is fundamentally not only different from the Hegelian, but is its direct opposite. To Hegel, the process of thinking, which, under the name of ‘the idea’, he even transforms into an independent subject, is the demiurge of the real world, and the real world is only the external, phenomenal form of /‘the idea’. With me, on the contrary, the ideal is nothing else than the material world reflected by the human mind, and translated into forms of thought.

”আমার ডায়লেকটিক পদ্ধতি ও হেগেলীয় ডায়লেকটিকস—এর মধ্যে শুধু যে বিরাট ব্যবধান আছে তা নয়, দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। হেগেল বলেন যে দৃশ্যমান জগৎ হচ্ছে ‘ভাব’—জাত, এই ভাবের স্বতন্ত্র সত্তা আছে এবং বাইরের জগৎ হচ্ছে ‘ভাব’—এর বহিরাকৃতি। আমি মনে করি ঠিক বিপরীত। আমার মতে ‘ভাব’ হচ্ছে মানুষের মনে বহির্জগতের প্রতিফলন এবং পরে এই ভাব চিন্তাতে রূপ পরিগ্রহ করে।”

হেগেল বলেন মূল চৈতন্য থেকে অভিব্যক্ত এই জগৎ আমাদের ক্ষুদ্র চৈতন্যের দ্বারা জ্ঞাত হচ্ছে। ‘মনে করুন, আমার হাতে যে ফলটি আছে, তার রং, রূপ, গন্ধ, আকৃতি প্রভৃতি কতকগুলি গুণমাত্র আমার মন ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করে বাইরে ফলের অস্তিত্বকে অনুভব করছে। এই কয়েকটি গুণ ভিন্ন আমি ফলের অন্য কিছু গ্রহণ করছি না। আর—একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে এদের আমার মন গ্রহণ করছে বলে আমার কাছে এই ফলের অস্তিত্ব আছে। এই ফলের অস্তিত্ব আমার কাছে আমার মনের উপর নির্ভর করে। আমার মন না থাকলে এর অস্তিত্ব আমার কাছে থাকত না। সুতরাং এই ফল আমার মন দ্বারা সৃষ্ট। কিন্তু অন্যদিকে এই ফলের একটি বাস্তব অস্তিত্ব বাইরে আছে। আমি ভাবতে পারি যে আমার মন থাকুক বা না থাকুক, ফল থাকে ও থাকবে। সুতরাং এই ফল সম্বন্ধে আমার জ্ঞান = আমার মনঃসৃষ্ট ফলের কতকগুলি গুণ + ফল ‘বাইরে আছে’ এই জ্ঞান। এইরকম সমস্ত বস্তুজগৎ আমার মতো চৈতন্যযুক্ত জীবদের মনোগ্রাহ্য; তবে মনের বাইরে অস্তিত্বযুক্ত ধারণার বিলোপ আমাদের কারও হয় না। এখন আমার মনে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে মনঃসৃষ্ট হয়েও আমার মনের ‘বাইরে আছে’ এ—ভাব কোথা থেকে আসে? এর একমাত্র মীমাংসা হেগেল এইভাবে করেছেন যে মনঃসৃষ্ট সত্য কথা, কিন্তু শুধু আমাদের মনঃসৃষ্ট নয়, এক অনন্ত নিরপেক্ষ মনের সৃষ্ট। এইজন্যই মনের সৃষ্ট হলেও আমাদের কাছে মনের ‘বাইরে আছে’ মনে হয়। এই নিত্য অনন্ত মনোময়ই পরমেশ্বর। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে হেগেলের এই একমাত্র যুক্তিযুক্ত প্রমাণ।

বস্তুত স্বভাব কী? আমরা দেখতে পাই যার ক্রিয়াকারিত্ব নেই তা বস্তুই নয়। আমার সামনের চেয়ারটি একটি বস্তু, কারণ এর ক্রিয়াপ্রকাশ আমার মনে হয়েছে। কোনো ক্রিয়াগুণ নেই এমন বস্তুর ধারণাই আমাদের নেই। বস্তু হলেই ক্রিয়াগুণ থাকবে। কিন্তু জ্ঞানের স্বভাব কী? কোনো জ্ঞান তার বিরুদ্ধে জ্ঞান না হলে সম্ভব হয় না, যেমন এই চেয়ারের জ্ঞান ‘চেয়ার না’ এই জ্ঞান সঙ্গে না থাকলে সম্ভব নয়। ‘আমি’ এই জ্ঞান ‘আমি না’ এইরকম জ্ঞানের সঙ্গে সম্ভব। সুতরাং জ্ঞান কখনো তার বিপরীত জ্ঞানের জন্ম না দিয়ে জ্ঞানরূপে গণ্য হয় না। তা ছাড়া জ্ঞান ও সত্তা মূলত এক জিনিস। জ্ঞানের শুদ্ধাবস্থা বা জ্ঞান মাত্র ও সত্তার শুদ্ধাবস্থা বা সত্তা মাত্র অভিন্ন। একেই হেগেল বলেন জ্ঞান ও সত্তার একত্ববাদ (Identity of Thinking and Being)।

তাহলে দেখতে পাচ্ছি যে, (১) সত্তার নিয়ম তার ক্রিয়াকারিত্ব বা পরিবর্তনশীলতা; (২) জ্ঞানের নিয়ম বিরুদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে জড়িত থাকা; (৩) শুদ্ধ জ্ঞান ও শুদ্ধ সত্তা অভিন্ন। সুতরাং সত্তা ও জ্ঞান একবস্তু হলে, সেই একবস্তু সত্তার নিয়মানুসারে অন্য বস্তুতে পরিণত হবে এবং জ্ঞানের নিয়মানুসারে সেই পরিণত বস্তু হবে তার বিরুদ্ধ ভাব। আবার এই দুইয়ে মিলে নতুন সত্তাতে পরিণত হবে। হেগেলের ভাষায় বিশুদ্ধ সত্তা (Pure Being) তার বিরুদ্ধ অ—সত্তাকে (Non-Being) বিক্ষিপ্ত করে, পরে দুটিতে মিলে তৃতীয় বস্তু—ভাব—এ (Becoming) রূপান্তরিত হয়। তারপর পুনরায় এই নিয়মে পরিণত হয়। এই ক্রমপরিণতিতে দেশ, কাল ও দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশিত হয়। জ্ঞান বিকাশের এই তিন স্তরকে হেগেল যথাক্রমে স্থিতি (Thesis), প্রতি—স্থিতি (anti-Thesis), ও সমন্বিত—স্থিতি (Synthesis) আখ্যা দিয়েছেন। এ শুধু জ্ঞান বিকাশের নিয়ম নয়, জগৎ সৃষ্টিরও নিয়ম। দেশ, কাল এই ক্রমপরিণতির অন্তর্ভুক্ত মাত্র, মূলে নয়। মূল দেশ ও কালের অতীতে। আদিকারণ চৈতন্য কখনো সৃষ্টি ভিন্ন নয়, কারণ হেগেল বলেন আদিকারণ অর্থাৎ চৈতন্য ও তার বিক্ষিপ্ত সৃষ্টি, দুটিতে মিলে একটি পূর্ণ সত্তা। আদিচৈতন্য এই সৃষ্টিতেই সত্তাবান, উপলব্ধ (realised)। এই নিত্য সত্তাবান চৈতন্যই দার্শনিক হেগেলের পরমেশ্বর এবং তাঁর এই যৌক্তিক ভিত্তির উপরেই তাঁর আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠিত।

হেগেলের এই ঐশ্বরিক কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দিলেন লাডউইগ ফোয়েরবাখ। ‘‘Feuerbach belongs to Hegel as much as the beaker of hemlock to Socrates”—সক্রেটিসের কাছে তাঁর বিষের পাত্র যেমন ছিল, হেগেলর কাছে ফোয়েরবাখ ঠিক তেমনি ছিলেন। ফোয়েরবাখ বললেন—

It is a question today you say, no longer of the existence or the non-existence of God but of the existence or the non-existence of man; not whether God is a creature whose nature is the same as ours but whether we human beings are to be equal among ourselves, not whether and how we can partake of the Lord by eating bread but whether we have enough bread for our own bodies; not whether we are christians or heathens, theists or atheists, but whether we are or can become men, healthy in soul and body, free, active, and full of vitality…I deny God. But that means for me that I deny the negation of man.

”আজকের প্রশ্ন হচ্ছে দেবতা আছে কি নেই তা নয়, মানুষের অস্তিত্ব আছে কি নেই সেই প্রশ্ন; এ—প্রশ্ন নয় যে দেবতা এমন কোনো জীব কিনা যাঁর স্বভাব আমাদেরই মতো, প্রশ্ন হচ্ছে আমরা আমাদের মধ্যে সমান হব কি না; রুটি খেয়ে দেবতার মতো শরীর পাব কেমন করে তা নয়, আমাদের শরীরের জন্য প্রচুর রুটি মিলবে কি না… আমরা খ্রিস্টান বা পৌত্তলিক, ঈশ্বরবাদী বা নিরীশ্বরবাদী সেসব প্রশ্ন নয়, আমরা সত্য মানুষ কি না বা মানুষ হতে পারি কি না, সুন্দর, কর্মঠ, জীবন্ত মানুষ…আমি দেবতাকে অস্বীকার করি কারণ আমি মানুষের অস্তিত্বকে অস্বীকার করি না।”

এই প্রকার তেজোদ্দীপ্ত ভাষায় ফোয়েরবাখ হেগেলের ঐশী ভাবকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষের জয়গান গাইলেন, মানবতাকে অভিনন্দন জানালেন। তাঁর “Essence of Christianity” নামক পুস্তকের মধ্যে তিনি বললেন সব ধর্মের মধ্যে কিছু সত্য আছে তবে সে—সত্য কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে, এবং ঈশ্বর—দর্শনের (Theology) উদ্দেশ্য সেই কুয়াশাকে, সেই অলৌকিকত্বের আস্তরণকে যুক্তি দিয়ে সত্যরূপে প্রতিপন্ন করা। ফোয়েরবাখ বললেন—

Religion is the dream of the human mind. But even in dreams we do not find ourselves in emptiness or in heaven, but on earth, in the realm of reality; we only see real things in the entrancing splendour of imagination and caprice, instead of in the simple daylight of reality and necessity.

”ধর্ম মানুষের মনের স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নেও আমরা শূন্যে বা স্বর্গে বিচরণ করি না, এই পৃথিবীতে, বাস্তব রাজ্যেই আমরা থাকি, আমরা সত্য জিনিসকে দেখি কল্পনার জ্যোতিতে সমাধিস্থ হয়ে, বিমুগ্ধ হয়ে, প্রয়োজনের বা বাস্তবের স্বচ্ছ দিবালোকে নয়।” ধর্ম মানুষের ব্যাহত ও ব্যর্থ মনোভাবের প্রকাশ। এ—পৃথিবীতে যখন মানুষ তার ভাব চরিতার্থতা সম্বন্ধে নিরুপায় হয়ে যায় তখন Miracle, Mythology ও Theology—র মধ্যে তার সেই মানসিক অভাবকে সে পূরণ করে।

হেগেল ও ফোয়েরবাখ এই দু—জনের দ্বারাই মার্কস যথেষ্ট প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন, কিন্তু দু—জনের ভুল তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। ব্রুনো বয়ার, রুজ, মাক্স, স্টার্নার প্রমুখ Young Hegelian—রা হেগেলের ডায়লেকটিকসকে বিকৃত করে যেখানে যেমনভাবে খুশি প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মার্কস তা করেননি। মার্কস ছিলেন হেগেলের প্রকৃত শিষ্য। ফোয়েরবাখের ‘কাল্পনিক মানুষ’, তাঁর ইতিহাস—অতীত মানবতা, মার্কসকে আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু সে শুধু মানুষ বলে, আধিদৈবিক স্বর্গ থেকে ফোয়েরবাখ প্রাকৃতিক জগতে নেমে এসেছিলেন বলে। ইতিহাসের ক্ষেত্রে ভিন্ন মার্কসের কাছে ডায়লেকটিকস—এর কোনো অর্থ নেই। মার্কস বলেন যে শ্রেণিসচেতন হয়ে সমাজ আত্মসচেতন হয়। সচেতনতার অর্থ ক্রিয়াশীলতা এবং এই শ্রেণিসচেতনতার ক্রিয়াশীলতার জন্য ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়াজড়িত সমগ্র সমাজ নূতন নূতন রূপ ধারণ করে। এই ঐতিহাসিক প্রণালির (Process) কর্তা (Subject) হচ্ছে শ্রেণি, সমাজের এই রূপান্তর এই শ্রেণির উপর নির্ভর করে, এবং সামাজিক প্রতিবেশ হচ্ছে কর্ম, যাকে রূপান্তরিত করা হয়। মার্কস বলেন যে মানুষ এই সামাজিক পরিবেষ্টনকে পরিবর্তন করে এবং নিজেও সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়—‘‘By acting on the external world and changing it, man changes his own nature.” ইতিহাসের মানুষ সেইজন্য ধ্রুবক (constant) নয়, মানুষ পরিবর্তনশীল—‘‘All history is the progressive modification of human nature.”—সমাজের উৎপাদনশক্তির ক্রমবিকাশের ফলে মানুষের ক্রমিক পরিবর্তন হয় এবং তার ফলে হয় সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই সামাজিক রূপান্তর একমাত্র বিপ্লবেই সম্ভব কারণ শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে বিপ্লব ভিন্ন সমাজের রূপান্তর সম্ভব নয়। এই হচ্ছে মার্কসের মূলকথা।

হেগেলীয় ডায়লেকটিকস—এর সারমর্মটুকু মার্কস বুঝেছিলেন। প্রুধোঁ (Proudhon) ‘The System of Economic Contradictions’ নামক পুস্তক লিখে তার দ্বিতীয় নাম দিলেন ‘The philosophy of poverty’ এবং মার্কস প্রুধোঁকে জবাব দিলেন ‘The poverty of philosoph’র মধ্যে। এই উত্তরের মধ্যে মার্কস তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন। বইখানি দু—ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে মার্কস রিকার্ডো (Ricardo) থেকে ‘সোশ্যালিস্ট’ হয়েছেন এবং দ্বিতীয় ভাগে হেগেল থেকে ‘ইকনমিস্ট’ হয়েছেন। রিকার্ডো প্রমাণ করেছেন যে ধনতান্ত্রিক সমাজে দ্রব্যের আদানপ্রদান নির্ভর করে দ্রব্য উৎপাদনের শ্রম—সময়ের উপর। প্রুধোঁ বলেন যে দ্রব্যের এমনভাবে বিনিময় হওয়া উচিত যাতে উভয়ের শ্রমের সময় ঠিক থাকে, অর্থাৎ এক দ্রব্যের সঙ্গে বিনিময় অন্য দ্রব্যের হবে যদি উভয়েরই উৎপাদন সময়ের তারতম্য না হয়। সমাজের এমনভাবে সংস্কার প্রয়োজন যাতে সকলেই শ্রমিক হয় এবং সকলেই সমশ্রমোৎপন্ন দ্রব্য বিনিময় করতে পারে। মার্কস প্রুধোঁর এই পেটি—বুর্জোয়া কল্পনাকে তীব্র সমালোচনা করে বললেন যে শ্রেণিবিরোধ ভিন্ন ব্যক্তিগত বিনিময় আজগুবি স্বপ্ন মাত্র। মার্কস বললেন—

With the beginning of civilisation production begins to build itself up on the anti-thesis of occupation, social position of class, and finally on the anti-thesis of accumulated and direct labour. Without anti-thesis there can be no progress : civilisation has acknowledged this law down to the present day. Up to the present the productive forces have been developed on the basis of this dominance of class contradiction.

”সভ্যতার প্রারম্ভ থেকে শ্রেণির সামাজিক অবস্থা ও প্রতি—স্থিতির উপর উৎপাদন গড়ে উঠেছে এবং শেষে বর্ধিত হয়েছে সঞ্চিত ও প্রত্যক্ষ শ্রমের প্রতি—স্থিতির উপর। প্রতি—স্থিতি ভিন্ন প্রগতি সম্ভব নয় এবং সভ্যতা এই নিয়মে বর্তমান পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। উৎপাদনশক্তিগুলি বৃদ্ধি পেয়েছে শ্রেণিবিরোধের আধিপত্যের উপর।”

মার্কস দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন যে ১৭৭০ সালে ইংল্যান্ডের শ্রমিকেরা যা উৎপাদন করত, ১৮৪০ সালে তার চাইতে সাতাশগুণ বেশি করেছে এবং এই উৎপাদনশক্তি শ্রেণিবিরোধের বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থার জন্য সম্ভব হয়েছে।

মার্কস এই পুস্তকের দ্বিতীয় অধ্যায়ে হেগেল সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে প্রুধোঁ ভুল বুঝেছেন হেগেলকে। হেগেলীয় দর্শনের প্রতিক্রিয়াশীল অংশটি অর্থাৎ বস্তুজগৎ যে ভাবজগৎ থেকে উদ্ভূত—এইদিকটিকে প্রুধোঁ আঁকড়ে ধরেছিলেন, তার বৈপ্লবিক মর্ম তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। এই বৈপ্লবিক মর্মটুকু হচ্ছে ভাবের স্বতঃক্রিয়াশীলতা, যা স্থিতি ও প্রতি—স্থিতির সৃষ্টি করে এ—দুইয়ের পারস্পরিক বিরোধকে বিলোপ করে উচ্চতর সমন্বিত স্থিতিতে উন্নীত হয়। হেগেলের ডায়লেকটিকসকে প্রুধোঁ দু—ভাগে ভাগ করেছেন, ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ দিক, এবং বলছেন যে মন্দ দিক ধ্বংস করে ভালোকে প্রতিষ্ঠিত করা সত্যকার ‘সোশ্যালিস্ট’—এর কর্তব্য। হেগেলের উপযুক্ত ছাত্র হিসাবে মার্কস—এর প্রুধোঁকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে প্রুধোঁ ব্যাকুল হয়ে যে ‘মন্দ’ দিকটিকে বিনাশ করতে চান, সেইদিকটির জন্যই সংগ্রামের ভিতর দিয়ে ঐতিহাসিক সম্ভব হয়েছে। যদি কেউ সামন্ততন্ত্রের শুধু ভালো দিকগুলিকে অর্থাৎ শহরের প্যাট্রিয়ার্কাল জীবন, গৃহশিল্পের উন্নতি, নগরশিল্পের ক্রমবিকাশ প্রভৃতিকে রক্ষা করে অন্য মন্দ দিকগুলিকে, যথা দাসত্ব, সুবিধাবাদ, স্বেচ্ছাচার প্রভৃতিকে নষ্ট করতে চেষ্টা করতেন, তাহলে সংগ্রামের প্রকৃত শক্তিগুলিকে ধ্বংস করা হত এবং বুর্জোয়া শ্রেণির অভ্যুত্থানকে ভ্রূণহত্যা করা হত। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসে তা কোনোদিন ঘটেনি, ঘটা সম্ভবও না।

মার্কসের ভাষায় এর সমাধান এইভাবে হওয়া উচিত।

If one wishes to estimate feudal production correctly one must regard it as a mode of production based on contradiction. One must show how riches were produced within this contradiction, how the productive forces developed simultaneously with the struggle of the classes, and how one of these classes, the bad side, the social evil, grew ceaselessly until the material conditions for its emancipation had ripened.

”সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদনের সঠিক বিচার করতে হলে এই উৎপাদন—প্রণালিকে বিরোধের উপর প্রতিষ্ঠিত স্বীকার করতে হবে। দেখতে হবে কেমনভাবে এই বিরোধের মধ্যেই ধর্মোৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, কেমনভাবে শ্রেণিসংগ্রামের ভিতরেই উৎপাদনশক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমে কী উপায়ে এই দুই শ্রেণির এক শ্রেণি, অর্থাৎ সামাজিক দোষত্রুটি, স্বেচ্ছাচার প্রভৃতি খারাপ দিকগুলি, ক্রমে শক্তিশালী হয়ে এমন বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি করছে যাতে তার মুক্তি সম্ভব হচ্ছে।” বুর্জোয়া শ্রেণির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশও মার্কস এইভাবে বিচার করেছেন। সেইজন্যই জর্জ স্যান্ড থেকে কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করে মার্কস প্রুধোঁর এই উত্তর শেষ করেছেন : “Victory or death! Bloody war or nothing! This is the pitiless formulation of the question.” ”হয় জয়, না হয় মৃত্যু। রুধির—প্লাবিত সংগ্রাম, না হয় একেবারেই কিছু না। এইরকম নির্মমভাবেই এই সমস্যার মীমাংসা সম্ভব।”

প্রুধোঁকে লিখিত এই উত্তরের মধ্যেই মার্কস জার্মান দর্শনের সঙ্গে তাঁর হিসাবনিকাশ চুকিয়ে দিলেন। মার্কস হেগেলীয় দর্শনে ফিরে এসে ফোয়েরবাখকে ছাড়িয়ে গেলেন। হেগেলীয় স্কুলের অন্তঃসারশূন্যতা ও অবনতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ করে মার্কস হেগেলীয় ডায়লেকটিকস—এর সারটুকু নিংড়ে নিয়ে সকলের কাছে প্রকাশ করলেন। মার্কস বুঝেছিলেন যে হেগেলিয়ানরা আর যা—ই হোন, হেগেল নন। হেগেলীয় দর্শনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, যার জন্য হেগেল বিশাল প্রচ্ছদপটে ইতিহাসকে দেখেছিলেন, যদিও অবশ্য তিনি ছিলেন আদর্শবাদী এবং সমস্ত বিষয়কে ও ইতিহাসকে তিনি অবতল আয়নার (concave mirror) ভিতর দিয়ে দেখেছিলেন, যেজন্য পৃথিবীর ইতিহাস তাঁর কাছে ভাববিকাশের দৃষ্টান্তস্বরূপ ছিল। গোঁড়া হেগেলিয়ানরা হেগেলীয় দর্শনের এই মর্মটুকু পরিত্যাগ করেছিলেন এবং ফোয়েরবাখও তার ন্যায্য মূল্য দেননি। মার্কস ভাবরাজ্য থেকে নিজেকে নির্বাসিত করে নির্মম বাস্তব জগৎ থেকে ইতিহাসের বিচার করে বস্তুবাদের ঐতিহাসিক ডায়লেকটিক্যাল পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠিত করলেন, এবং ফোয়েরবাখের মধ্যে যে ‘energising principle’—এর অভাব ছিল তাকে পূরণ করে শুধু সমাজের বিশ্লেষণ করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে সমাজকে রূপান্তরিত করবার পথটিরও নির্দেশ দিলেন।

কার্ল মার্কস ও ফোয়েরবাখের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হলে ফোয়েরবাখ সম্বন্ধে মার্কসের এগারোটি থিসিস বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রত্যেকটি থিসিস নিয়ে এখানে আমি আলোচনা করব না, বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটিকে বিশ্লেষণ করব।*

প্রথম থিসিস : ”পূর্বেকার সমস্ত বস্তুবাদের, এমনকী ফোয়েরবাখেরও, প্রধান ত্রুটি হচ্ছে যে বিষয়, বাস্তব, সংবেদন—এর প্রত্যেকটিকে প্রত্যয়ী হিসাবে ভাবা হয়, এবং মানুষের সংজ্ঞাক্রিয়া ও ব্যবহার হিসাবে বা এককথায় বিষয়ীভূতভাবে বিচার করা হয় না। সেইজন্য বস্তুবাদ—বিরোধী উপায়ে বিষয়ের সক্রিয় দিকটি আদর্শবাদ কর্তৃক ব্যাখ্যাত হয়েছিল, কিন্তু তা—ও বিমূর্তভাবে, কারণ বস্তু বা সংজ্ঞাক্রিয়া কী তা আদর্শবাদের অজ্ঞাত। চিন্তার বিষয় থেকে বিভিন্ন সংজ্ঞাক্রিয়াকে ফোয়েরবাখ স্বীকার করতে চান কিন্তু তিনি মানুষিক ক্রিয়াকে বিষয়ভূত ক্রিয়ার মধ্যে গণনা করেন না। ফলে তাঁর ‘এসেন্স অফ ক্রিশ্চানিটি’র মধ্যে তিনি অধীত মনোভাবকে মানুষিক বলেছেন, এবং ফলিত মনোভাবকে উপেক্ষা করেছেন। ফোয়েরবাখ সেইজন্য বৈপ্লবিক ও ফলিত ক্রিয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি।”

প্রথম থিসিস—এর মধ্যে মার্কসের দুটি মন্তব্য লক্ষণীয়। প্রথম হচ্ছে ডেমক্রিটাসে থেকে ফোয়েরবাখ পর্যন্ত সমস্ত বস্তুবাদের সমালোচনা; দ্বিতীয় হচ্ছে ফোয়েরবাখীয় সমাধানের সমালোচনা। প্রথমটির প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ জ্ঞানলাভের জন্য কত দূর সক্রিয় থাকে; দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যবহারের (Praxis) মার্কসীয় ব্যাখ্যা। মার্কস বললেন যে ইতিহাসের জ্ঞানের জন্য মানুষ থেকে আরম্ভ করবার অর্থ হচ্ছে মানুষের চাহিদা (Needs) থেকে অনুসন্ধান শুরু করা। ফোয়েরবাখের বিমূর্ত চাহিদা নয়, মানুষের প্রাথমিক উৎপাদন, প্রজনন ও জ্ঞাপনের চাহিদা। এই চাহিদার পরিতৃপ্তির জন্য যন্ত্রাদির উদ্ভাবন আবশ্যক এবং এর ফলে সমাজে শ্রমবিভাগ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই পুরাতন চাহিদা (old needs) মেটানোর প্রচেষ্টার মধ্যেই নূতন চাহিদার সৃষ্টি হয়। ইতিহাসের গতি কোনো নিরপেক্ষ মনের উপর নির্ভরশীল নয়, মানুষের প্রাকৃতিক ও সামাজিক চাহিদা—তৃপ্তির প্রচেষ্টা ও ক্রিয়া হচ্ছে ইতিহাসের প্রাণ। মানুষের চাহিদার প্রকৃতি ও গুণ এবং সেই চাহিদা—তৃপ্তির উপায়ের বা পদ্ধতির পরিবর্তনের জন্য শুধু যে ইতিহাসের পরিবর্তন হয় তা নয়, মানুষের স্বভাবেরও রূপাবর্তন হয়। মার্কসের মতে প্রকৃতি (Nature) ও ইতিহাসের মধ্যে হেতু (middle term) হচ্ছে মানুষের মূর্ত চাহিদা (concrete needs)। চাহিদা ও তার সন্তুষ্টির সম্ভাব্যতার (possibility) কারণ হচ্ছে মানুষের পরিবেষ্টন ও শরীরের জৈব গঠন। মনের ও ইন্দ্রিয়ের এই চাহিদা কোনো বিশেষ উপায়ে পরিতৃপ্ত হয় এবং চাহিদা বৃদ্ধিও হয় সঙ্গে সঙ্গে। এ দুইয়েরই কারণ হচ্ছে বিশেষ সমাজব্যবস্থা। শারীরিক অবস্থা ও সমাজব্যবস্থার অন্তঃক্রিয়ার প্রতিফল হচ্ছে ইতিহাস। দর্শনও কোনো সামাজিক চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য ঐতিহাসিক ক্রিয়া। যেহেতু মানুষ পরিবেষ্টনসাপেক্ষ, পরিবেষ্টনকে সে রক্ষা করতে পারে, কারণ মানুষের ক্রিয়া হচ্ছে (যার মধ্যে চিন্তাও একটি) বিষয়ভূত ক্রিয়া, যার বিষয়ভূত ফলাফল আছে।

মার্কসীয় প্র্যাক্সিস (Praxis) কী? মানুষ, বিষয়, সমাজ ও চাহিদা ও সাম্যবাদ সম্বন্ধে ফোয়েরবাখের ইতিহাস—বর্জিত (Unhistorical), বিমূর্ত ধারণা থাকার জন্য তিনি আদর্শবাদের স্বখাতসলিলে নিমজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের কী হওয়া উচিত, মানুষ সকল অবস্থায় ও সময়ে কী হতে পারত অর্থাৎ ‘আসল মানুষ’—এর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফোয়েরবাখের আদর্শের সঙ্গে যেহেতু মানুষের কোনো মূর্ত চাহিদা ও সমাজের কোনো মূর্ত ব্যবস্থার সংযোগ নেই, সেইজন্য সে আদর্শ সমাজের পরিবর্তন হিসাবে শক্তিহীন। তাঁর আদর্শকে কোনো বৈপ্লবিক ব্যবহারে রূপ দিতে না পেরে, ফোয়েরবাখ তাকে রূপ দিলেন ধর্মে। মার্কস ফোয়েরবাখের অধ্যয়ন (theory) ও ব্যবহার (Praxis)—উভয় ধারণারই বিরোধী ছিলেন। অধ্যয়ন হচ্ছে কর্মনিয়ন্তা, ব্যবহার হচ্ছে সেইসব বিশেষ ক্রিয়া (specific activities) যার দ্বারা অধ্যয়নকে যাচাই করা হবে।

Thesis III—The materialistic doctrine that men are the products of circumstances and education, and that changed men are therefore the products of other circumstances and a changed education, forgets that circumstances are changed by men, and that the educator must himself be educated. Consequently materialism necessarily leads to a division of Society into two parts, of which one is elevated above Society (e.g. in Robert Owen).

The coincidence of the transformation of circumstances and of human activity can only be conceived and rationally understood as revolutionising practice (Praxis).

তৃতীয় থিসিস : ”যে বস্তুবাদী নীতি প্রতিপন্ন করে যে মানুষ শিক্ষা ও পরিবেষ্টনসঞ্জাত এবং পরিবর্তিত মানুষ অন্য পরিবেষ্টন ও শিক্ষার সৃষ্টি, তার প্রধান গলদ হচ্ছে এই যে মানুষের দ্বারাও যে পরিবেষ্টন পরিবর্তিত হয় এবং শিক্ষকের যে নিজেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে—এই দুটি বিষয়কেই প্রত্যাখ্যান করে। ফলে সে—বস্তুবাদ সমাজকে দু—ভাগে ভাগ করে এবং এক ভাগ সমাজের উপরে উন্নীত হয় (যেমন রবার্ট ওয়েনের)।

পরিবেষ্টন ও মানুষিক ক্রিয়ার রূপান্তরের মিলন একমাত্র বৈপ্লবিক ব্যবহার হিসাবেই বোধগম্য।”

মার্কস এখানে কল্পনাপ্রবণ সমাজতান্ত্রিকদের প্রশ্ন তুলেছেন কারণ ফোয়েরবাখকে তিনি এই স্কুলেরই দার্শনিক মনে করেন। মার্কস ফোয়েরবাখ সম্বন্ধে বলেন যে “in so far as he is a materialist, history does not exist for him, and in so far as he treats of history he is no materialist”—ফোয়েরবাখ যখন বস্তুবাদী তখন তাঁর কাছে ইতিহাসের অস্তিত্ব নেই এবং তিনি যখন ঐতিহাসিক তখন তিনি বস্তুবাদী নন। এই ভাবপ্রবণ সমাজতান্ত্রিকদের (Utopian Socialists) সমালোচনা প্রসঙ্গে মার্কস যে বিদ্রুপ ও শ্লেষ করেছেন তা সত্যই উপভোগ্য। এই ভাবুকবৃন্দ মনে করেন যে অন্য সকলের শিক্ষা ও দর্শন পরিবেষ্টনজাত, শুধু তাঁরাই ‘ব্যতিরেক’—এর মধ্যে গণ্য। সেইজন্য এঁদের বস্তুবাদ প্রয়োগ করলে সমাজ দ্বিখণ্ডিত হয়—একশ্রেণির অর্থাৎ সাধারণ শ্রেণির ভাব পরিবেষ্টন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং আর—একশ্রেণি অর্থাৎ এই ভাবুক গোষ্ঠীর ভাব তাঁদের মর্জির উপর নির্ভর করে। এঁরা ভাবেন যে এঁদের আদর্শের সমর্থনলাভের জন্য কপর্দকশূন্য ভিক্ষুক থেকে মহারাজাধিরাজের কাছে পর্যন্ত অপ্রতিহত আবেদন করা চলতে পারে, কারণ সমাজের মঙ্গল ও উন্নতি নির্ভর করে এই মুষ্টিমেয় দেবতার বরপুত্রদের উপর। সুচিন্তার উপর এঁদের চিরস্থায়ী মালিকানা। মার্কস যে এসব বিশ্বাস করেন না তা আমি পূর্বেই বলেছি। মার্কস বলেন, মানুষ, প্রকৃতি ও সমাজ, এদের পারস্পরিক ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষের স্বভাবের ও সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে।

Thesis XI—Philosophers have only interpreted the world differently : the point is, however, to change it.

একাদশ থিসিস :—দার্শনিকেরা বিভিন্নভাবে এ পৃথিবীর ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু প্রয়োজন হচ্ছে তাকে পরিবর্তন করা।

মানবতা ও সাম্যবাদ সম্বন্ধে ফোয়েরবাখ ভাবপ্রবণ ব্যবহার করলেও মার্কস তাঁর তীব্র সমালোচনা করতে পশ্চাৎপদ হননি। স্বাস্থ্যবান, ধনী একশ্রেণি মানুষের সঙ্গে বুভুক্ষু, রুগণ, ক্লিষ্ট আর—একশ্রেণির মানুষের মধ্যে যে মূর্ত পার্থক্য আছে তাকে ফোয়েরবাখ বিশেষ গ্রাহ্য করেন না। তাদের মধ্যে যে মনুষ্যজীবগত সাধারণ বিশেষত্ব আছে তা—ই হচ্ছে ফোয়েরবাখের কাছে বেশি মূল্যবান। ফোয়েরবাখ নিজেকে সাম্যবাদী বলে ঘোষণা করতেন সত্য, এবং এমন জোর গলায় বলতেন যে পুলিশে তাঁর বাসস্থান পর্যন্ত খানাতল্লাশ করেছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে সাম্যবাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণ ছিল ভাষাগত (Philological), রাজনৈতিক নয়। মাক্স স্টার্নার লিখিত ফোয়েরবাখের মানবধর্ম সম্বন্ধে একখানি প্রশংসামুখর পুস্তকের সমালোচনা প্রসঙ্গে ফোয়েরবাখ নিজেই নিজের সম্বন্ধে লিখেছিলেন :

Feuerbach is not a materialist, idealist or a believer in the philosophy of identity. Well, then, what is he? He is in thought as in deed, in spirit as in flesh, in essence as in feeling—man; or rather, since for him the essence of man is given only in society, communal man, communist.

”ফোয়েরবাখ বস্তুবাদী নন, একত্ব—বাদেও বিশ্বাসী নন। তার ফোয়েরবাখ কী? কর্মে, চিন্তায়, দেহে, মনে, ভাবে, ফোয়েরবাখ মানুষ; এবং প্রকৃত মানুষ হচ্ছে সামাজিক মানুষ, কমিউনাল মানুষ, সাম্যবাদী।”

মার্কস এই উক্তিকে নির্দেশ করে ফোয়েরবাখের চিন্তার জটিলতা ও অসারত্ব প্রমাণ করলেন। ফোয়েরবাখের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য হল যে—বস্তুর অস্তিত্ব আছে তাকে চেতনার রাজ্যে আনা, কিন্তু মার্কস বললেন, “The real communist aims at the revolutionising of the existing order.” ফোয়েরবাখের ‘সাম্যবাদ’ ও ‘বস্তুবাদ’—এর সঙ্গে মার্কসীয় সাম্যবাদ ও বস্তুবাদের এই হল ব্যবধান।

মার্কসীয় ডায়লেকটিকস আদর্শবাদীর মনোরাজ্যের আদি কারণত্বকে ভুল প্রতিপন্ন করে দৃশ্যমান বাস্তব জগৎকে চেতনা ও ভাবের উৎস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল। এ—জগৎ আদি কারণ চৈতন্যের প্রতিবিম্ব নয়, অধ্যাস নয়। কোনো বাস্তব ঘটনা বা প্রাকৃতিক অভিব্যক্তি অজ্ঞেয় নয়, বলতে পারা যায় এখনও অজ্ঞাত, কিন্তু জ্ঞেয় সবকিছুই। মার্কসীয় ডায়লেকটিকস—এর আঘাতে তাই অমর্ত্যলোকের সর্বশক্তিমান ভাগ্যনিয়ন্তা লীলাময় পরমেশ্বরের জ্যোতিঃস্নাত মর্তলোকে মাটির উপর খসে পড়ল সে—মুকুটের অধিকারী হল মানুষ। মানুষের কণ্ঠ থেকে বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হল যে এ—পৃথিবীর কিছুই তার কাছে অলৌকিক বা অতিপার্থিব নয়, সবই ব্যাখ্যানযোগ্য ও জ্ঞেয়। সমাজ, সমাজের আদর্শ, মানুষের চিন্তা, ক্রিয়া, প্রকৃতির ভ্রূকুটি—সকলেরই বাস্তবের বীক্ষণাগারে প্রবেশাধিকার আছে। বাস্তবের বীক্ষণাগারের পরীক্ষায় দেখা যায় যে সামাজিক বাস্তব পরিবেষ্টনই হচ্ছে মানুষের ক্রিয়া, চিন্তা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি সবকিছুর প্রধান উৎস।

এখন প্রশ্ন হল সমাজের এই বাস্তব পরিবেষ্টন কী? মার্কসীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুযায়ী এ—প্রশ্নের উত্তর হল এই যে মানুষের প্রাণধারণের জন্য জীবিকা অর্জনের উপায় ও উপজীব্য উৎপাদন—প্রণালিই সমাজের বাস্তব রূপ। উৎপাদনের যন্ত্রপাতি, যার সাহায্যে বস্তুকে জীবিকাযোগ্য করা হয়, এবং শ্রমিকের শ্রমদক্ষতা ও উৎপাদন—অভিজ্ঞতা হল সমাজের উৎপাদনশক্তি। কিন্তু উৎপাদনের শুধু একটি দিক হল এই উৎপাদনশক্তি (Productive force), এ ছাড়া আরও একটি দিক আছে। সেইদিকটি হচ্ছে মানুষের উৎপাদনকালীন পারস্পরিক সম্বন্ধ (Productive relations)। প্রকৃতির বিরুদ্ধে জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষ একক অবস্থায় সংগ্রাম করে না, দলবদ্ধ হয়ে বা সমাজবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে। সুতরাং উৎপাদনের সময় এবং বিশেষ অবস্থায় মানুষের কোনো বিশেষ সম্বন্ধ থাকা স্বাভাবিক। সে—সম্বন্ধ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্যের সম্বন্ধ হতে পারে, প্রভুত্ব ও শোষণের সম্বন্ধও হতে পারে। সুতরাং উৎপাদন বা উৎপাদন—পদ্ধতি (mode of production) বলতে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদন—সম্বন্ধ দুইই বোঝায়।

উৎপাদনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে উৎপাদনশক্তি দীর্ঘস্থায়ী নয়, সর্বদাই পরিবর্তনশীল ও বিবর্ধমান। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সমাজব্যবস্থা, সামাজিক ভাব, রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়। উৎপাদনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে উৎপাদনশক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে প্রথমে উৎপাদনযন্ত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, উৎপাদনের পরিবর্তন আরম্ভ হয়। প্রথমে এইভাবে উৎপানশক্তির পরিবর্তন ও বৃদ্ধি হয়, সঙ্গে সঙ্গে তার উপর নির্ভর করে ও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন—সম্বন্ধও পরিবর্তিত হয়। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে উৎপাদন—সম্বন্ধের উপর উৎপাদনশক্তি নির্ভরশীল নয় এবং প্রথমটি দ্বিতীয়টির উপর প্রভাব বিস্তার করে না। উৎপাদন—সম্বন্ধ যেমন উৎপাদনশক্তির উপর নির্ভরশীল, তেমনি আবার উৎপাদন—সম্বন্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলে উৎপাদনশক্তির হ্রাসবৃদ্ধি নির্ভর করে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত যে উৎপাদন—সম্বন্ধ কখনো উৎপাদনশক্তির খুব পিছনে পড়ে থাকে না, কারণ তাতে বিবর্ধমান উৎপাদন—শক্তির সঙ্গে তার বিরোধ বাড়ে। পশ্চাৎগামী উৎপাদন—সম্বন্ধের সঙ্গে অগ্রগামী উৎপাদনশক্তির বিরোধ বিপ্লবের আঘাতে বিলীন হয়ে যায় এবং এ—দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়।

সমাজের ক্রমবিকাশ লক্ষ করলেই এর দৃষ্টান্ত মিলবে। আজ পর্যন্ত সমাজের পাঁচটি রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে—আদিম সাধারণ সমাজ (Primitive Communal Society), দাসসমাজ (Slave Society), সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (Feudal Society), ধনতান্ত্রিক সমাজ (Capitalist Society) ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ (Socialist Society)। আদিম সাধারণ সমাজে উৎপাদন—সম্বন্ধের ভিত্তি ছিল উৎপাদন—পদ্ধতির সামাজিক স্বত্বের উপর। এই সম্বন্ধের তাৎকালিক উৎপাদনশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য ছিল। পাথরের অস্ত্র, তিরধনুক প্রভৃতি ছিল উৎপাদনশক্তি এবং সেইজন্য মানুষের পক্ষে একা একা অরণ্যে ঘুরে বন্য জন্তু শিকার করা, বাসগৃহ নির্মাণ করা সম্ভব হত না, একসঙ্গে কাজ করতে তারা বাধ্য হত। একত্রে শ্রম করবার জন্য শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের উপর সকলের সমানাধিকার ছিল। উৎপাদনশক্তির বা উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যক্তিগত মালিকানা তখনও ছিল না। আদিম সাধারণ সমাজ ছিল শ্রেণিশূন্য ও শোষণবর্জিত। দাসসমাজে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। দাসপ্রভুরা ছিলেন উৎপাদনশক্তির মালিক, কারণ খুশিমতো তাঁরা দাস কেনাবেচা করতে পারতেন। এই উৎপাদনসম্বন্ধের তৎকালের উৎপাদনশক্তির সঙ্গে সংগতি ছিল। মানুষ প্রস্তর—অস্ত্র ছেড়ে ধাতুনির্মিত অস্ত্র আয়ত্তে আনল, শিকার ছেড়ে কৃষি ও গৃহশিল্পে মন দিল। এই শ্রমবিভাগের ফলে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের দ্রব্যবিনিময় এবং একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর দ্বারা সঞ্চয় সম্ভব হল। ফলে এই সংখ্যালঘু প্রভুগোষ্ঠীর সুবিধা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ দাসদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবার এবং স্বেচ্ছাচারিতা সীমা অতিক্রম করল। ক্রীতদাসের জীবন মনিবের করুণার মুখাপেক্ষী হল। ক্রীতদাস—সমাজের রূপ হল ধনী—নির্ধন, শোষক ও শোষিতের মধ্যে শ্রেণিসংগ্রামের রূপ। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সামন্তপ্রভু হলেন উৎপাদনশক্তির মালিক, তবে শ্রমিকের পূর্ণ কর্তৃ,ত্ব তাঁর উপর রইল না, শ্রমিক বেচাকেনা তিনি করতে পারেন, হত্যা করতে পারেন না। পাশাপাশি কৃষক ও গৃহশিল্পীদের কিছু—কিছু মালিকানা রইল উৎপাদনযন্ত্রের উপর। এই উৎপাদন—সম্বন্ধেরও তৎকালের উৎপাদনশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে। কৃষির ও কর্ষণ অস্ত্রের উন্নতি হয়েছে, পশুপালন, উদ্যানরক্ষা প্রভৃতি আরম্ভ হয়েছে, যন্ত্রশিল্পও সামান্যরূপে দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমিকের দিক থেকে শ্রমের প্রতি অনুরাগ থাকা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং সামন্তপ্রভুরা ক্রীতদাসপ্রথা তুলে দিয়ে শ্রমিকদের একটু স্বাধীনতা দিলেন। সামন্তযুগে ব্যক্তিগত মালিকানা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শোষণ ও অত্যাচার ভীষণতর আকার ধারণ করল, শ্রেণিসংগ্রামও তীব্রতর হল। ধনতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন—সম্বন্ধের ভিত্তি ধনিকগোষ্ঠীর উৎপাদনশক্তির মালিকানা এবং শ্রমিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উপর নির্ভরশীল। শ্রমিকেরা উৎপাদনশক্তির স্বত্ব থেকে বঞ্চিত এবং জীবনধারণের জন্য ধনিকগোষ্ঠীর কাছে তাদের শ্রম বিক্রয় করতে হয়। নূতন উৎপাদনশক্তির তাগিদে শ্রমিকদের সামান্য কিছু শিক্ষা দিতে হয়, কারণ যন্ত্র পরিচালনার জন্য বুদ্ধির ও শিক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু এই উৎপাদনশক্তির এত দূর বৃদ্ধি পেয়েছে যে ধনতন্ত্র অভ্যন্তরীণ বিরোধের জালে জড়িয়ে গিয়েছে। বৃহৎ পরিমাণে দ্রব্য উৎপাদন করে ধনতন্ত্র প্রতিযোগিতাকে তীব্রতর করেছে, ক্ষুদ্র মালিকদের ধ্বংস করে, ক্রয়শক্তি কমিয়ে দিয়ে শ্রমজীবীর স্তরে এনেছে। ফলে উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রয়ের অসুবিধা ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শোষণের ফলেও এ—বিরোধ দূর হচ্ছে না। উৎপাদনশক্তি যখন বহু দূর অগ্রসর হয়েছে, উৎপাদন—সম্বন্ধ তখন এত পিছিয়ে থাকতে পারে না এবং এ—বিরোধের অবসান একমাত্র বিপ্লবেই সম্ভব। ধনতান্ত্রিক দেশগুলি আজ এই বিপ্লবের প্রতীক্ষা করছে, কারণ বিপ্লবই হচ্ছে নূতন সমাজের গর্ভধারিণী প্রাক্তন সমাজের ধাত্রী। এই বিপ্লবের ফলে আজ সোভিয়েট ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে আজ শোষণ নেই, অত্যাচার নেই, সমাজ কর্তৃক উৎপাদন—শক্তি অধিকারের ফলে উৎপাদন—শক্তির সঙ্গে উৎপাদন—সম্বন্ধের সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়েছে। সোভিয়েট য়্যুনিয়নের এই নূতন সমাজতান্ত্রিক সমাজই আজ পৃথিবীর আদর্শ সমাজ।

সংক্ষেপে এই হল মার্কসীয় ডায়লেকটিকস এবং এইভাবে এই দ্বন্দ্বমূলক বাস্তুবাদী পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক জীবন ও সামাজিক ইতিহাস অধ্যয়ন করাকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।

…….

* যাঁরা এ—সম্বন্ধে বিশদভাবে জানতে চান তাঁরা F. Engels-এর “Feuerbach” এবং Sydney Hook-এর “From Hegel to Marx”– (Chapter VIII) পড়তে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *