• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১০. সুব্রত তার হাতঘড়িটা

লাইব্রেরি » নীহাররঞ্জন গুপ্ত » কিরীটী অমনিবাস (কিরীটী রায়) » অবগুণ্ঠিতা » ১০. সুব্রত তার হাতঘড়িটা

সুব্রত তার হাতঘড়িটা বালিশের তলা থেকে নিয়ে দেখলে তখন রাত্রি প্রায় দেড়টা। কী এখন করে সে? কী তার করা উচিত?

ও দেখলে, মেঝেতে তখন খানিকটা রক্ত জমে আছে। ও বুঝতে পারল লোক দুটোর মধ্যে একজন নিশ্চয়ই তার পিস্তলের গুলিতে আহত হয়েছে।

হয়তো গুরুতরভাবে আহত হয়নি, পালিয়ে যেতে পেরেছে যখন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই।

কিন্তু চিঠির মধ্যে ঐ ডট্‌-গুলোর অর্থ কী? চকিতে ওর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তবে কী—হ্যাঁ, তিনটে ডট মানে চিঠিটা। চিঠিটা ও ড্রয়ারেই রেখেছিল দুপুরের দিকে।

তাড়াতাড়ি ও ড্রয়ারের কাগজপত্রগুলো ঘাঁটতে শুরু করল। না, চিঠিটা নেই। চিঠিটা খুনী চুরি করলে কেন?

প্রমাণ—তার বিরুদ্ধে এটা একটা প্রমাণ। তাই চিঠিটা সরাবার প্রয়োজন হয়েছিল?

কিন্তু কেন সে তখন সাবধান হল না? কেন সে এই ড্রয়ারের মধ্যে চিঠিটা রেখেছিল?

কিন্তু চিঠির মধ্যে ছয়টি ডটের মানে কী? নিশ্চয়ই কোন লোকের নাম হবে যার নিকট হতে পত্রবাহক মানকে ও গোবরাকে তার ফ্ল্যাটে ঢুকতে না পারলে সাহায্য নিতে বলেছে? চাবির ড়ুপলিকেটও তার কাছেই পাওয়া যাবে। কিন্তু কার কাছ হতে তার এই ফ্ল্যাটের চাবির ড়ুপলিকেট পাওয়া সম্ভব?

একমাত্র হোটেলের ম্যানেজারের। কী তার নাম? ঠিক। তার নাম কামতাপ্রসাদ! হ্যাঁ, ছয়টি ডট! তাহলে মিলে যাচ্ছে। হুঁ, কামতাপ্রদাসই তাহলে তার শত্রুদলকে সাহায্য করেছে!

একটা ব্যাপার কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, প্রকাণ্ড একটা ষড়যন্ত্র আছে মিঃ সরকারের এই খুনের ব্যাপারে। কোন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি টাকার সাহায্যে অন্য লোকের দ্বারা এইসব কাজ চালাচ্ছে। একটা দল সঙ্বদ্ধভাবে কাজ করছে। তাছাড়া চিঠির প্রথম তিনটি ডট যদি চিঠিটা বলে ধরা যায়, চিঠির শেষ তিনটি ডটয়েরও একই বিশ্লেষণ দাঁড় করানো যেতে পারে। কিন্তু আর এখানে বসে থাকলে তো হবে না। এখুনি একবার চিৎপুরে খালসা হোটেলে যেতে হবে। দেখা যাক, সেখানে যদি কিছুর সন্ধান মেলে।

সুব্রত চটপট জামা বদলে সাধারণ লোকের মত সাজসজ্জা করে নিল।

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের কোলে কালি। মাথার চুল রুক্ষু, গায়ে সাধারণ একটা ছেড়া ডোরাকাটা টুইলের শার্ট।

পরিধানে মলিন একখানা ধুতি। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো।

সুব্রত তার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে হোটেল থেকে বের হয়ে নীচের রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

মাথার উপরে রাত্রির কালো আকাশ। অসংখ্য তারার মিটিমিটি চাউনি যেন। সমগ্র বিশ্বচরাচর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছে।

 

কেউ কোথাও নেই।

ধর্মতলার মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে ড্রাইভার নির্জন রাস্তা পেয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটালে।

সুব্রত চলমান গাড়ির মধ্যে ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজল।

চিৎপুরের রাস্তাটা বিডন স্ট্রীটের সঙ্গে যেখানে এসে মিলেছে, তারই সামনে খালসা কেবিন।

খালসা কেবিনের সামনে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে সুব্রত ভাড়া মিটিয়ে দিল এবং তাকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বললে।

কেবিনের মধ্যে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে।

মস্তবড় উনুনটা গল্প করে জ্বলছে। উনুনের ওপরে শিক কাবাব তৈরি হচ্ছে। পাশেই একটা মস্তবড় লোহার কেলিতে বোধ করি চায়ের জল ফুটছে।

ভেতরে কতকগুলো টেবিল ও টিনের চেয়ার পাতা।

দশ-বারোজন নিম্নশ্রেণীর কুলী, মজুর ও গাড়োয়ান বসে চা পান করছে।

ঘরের দেওয়ালে কতকগুলি কুৎসিত ছবি টাঙানো।

কাউন্টারের একপাশে দাড়িগোঁফওয়ালা একজন মোটামত লুঙ্গি পরা মুসলমান বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে।

একটা গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজছে।

তুমকো মোবারক হো
উঁচে মাহলিয়া—
হামকো হায় পিয়াসী
হামারি গলিঁয়া।

পাশেই একটা কাঁচের আলমারিতে ডিশে সাজানো ডিমসিদ্ধ, ডিমের কারি, মাংসের কারি আর পরোটা।

সুব্রত এসে হোটলে প্রবেশ করে এক কাপ চা দিতে বলে। তারপর একটা লোহার চেয়ারে বসে একটা বিড়ি ধরালো।

একটা ছোকরা এসে ময়লা কাপে এক কাপ চা দিয়ে গেল।

সুব্রত চা খেতে খেতে ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদেই ও দেখলে, দুজন লোক এসে কেবিনে প্রবেশ করল। একজন একটু লম্বা। অন্যজন একটু বেঁটে। দুজনের দেহই বেশ গাঁট্টাগোট্টা, বেঁটে লোকটার হাতে একটা পট্টি বাঁধা। পউিটার খানিকটা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।

দুজনেরই পরিধানে ময়লা পাতলুন ও হাতকাটা হাফশার্ট। দুজনকে দেখলেই মনে হয়, নিম্নশ্রেণীর লোক ওরা।

লোক দুটো কেবিনে প্রবেশ করে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিল। এবং সুব্রতরই পাশের একটা টেবিল অধিকার করে বসল।

সুব্রত কান খাড়া করে সজাগ হয়ে রইল।

দুকাপ গরম চা দোকানের ছোকরাটা এনে ওদের সামনে রাখলে।

লোক দুটো চা খেতে খেতে ঘন ঘন রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে।

সুব্রতর চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে আর এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল, ইধার আউর এক কাপ চা।

এমন সময় ওদের মধ্যে একজন দেওয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললে, রাত্রি প্রায় পৌনে তিনটে যে!

অন্যজন বলে, এখনও আসবার নামটি নেই। বেটাদের আকেল দেখলে প্রাণ জল হয়ে যায়।–বেটাদের টাকা আছে, তাই ভাবে যতক্ষণ ইচ্ছে আমাদের বসিয়ে রাখতে পারে!

ব্যস্ত হোস নে মানকে, বেশ তো বসে আছি এখানে। দোকান তো আর বন্ধ হচ্ছে না। কালু মিঞার খালসা কেবিন। আহা বেঁচে থাক। কিন্তু তুই ভাল করে ক্লোরোফরম্ দিনি মানকে, নইলে বেটা জেগে ওঠে।

আমার বাবা কোন দিন ক্লোরোফরম্ দিয়েছে? তুলোটা নাকের ওপরে রেখে চলে এসেছিলাম। বেটা যে ক্লোরোফরম্ পেয়েও চাংগা হয়ে উঠবে অমন করে, কে জান তো বল? হাতটা এখনও টনটন করছে।

ভাগ্যে প্রাণে বেঁচে গেছিস! গোবরা বললে।

ঠিক এমন সময় একজন এসে হোটেলে প্রবেশ করল।

লোকটা লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফিট হবে। বলিষ্ঠ পেশল গঠন।

পরিধানে সুট, গ্রে কালারের। চোখে গগলস্।

লোকটাকে কেবিনে ঢুকতে দেখেই গোবরা ও মানকে উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে।

দুজনারই মুখে অদ্ভুত একপ্রকার হাসি জেগে ওঠে। সুটপরা লোকটা এগিয়ে কোণের একটা টেবিল অধিকার করে বসল। সঙ্গে সঙ্গে গোবরা ও মানকে লোকটার পাশে গিয়ে দুখানা চেয়ার অধিকার করে বসল।

লোকটার দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো। কিন্তু বেশ পাকানো গোঁফ আছে। কপালের দুপাশে একটু করে কাটা।

সুব্রত অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারল না, লোকটাকে কোথাও দেখেছে কিনা।

সেই লম্বা লোকটি এবং গোবরা ও মানকে কী সব ফিস ফিস করে কথাবার্তা শুরু করে। দিয়েছে ততক্ষণে।

সুব্রত তাদের কথাগুলো ঠিক বুঝতে না পারলেও গোবরা ও মানকের মুখ ও হাতনাড়া দেখে বুঝতে পারলে, কোন বিষয় নিয়ে তাদের দুজনের সঙ্গে লোকটার মতের গোলমাল হচ্ছে।

হঠাৎ মানকে বেশ চড়া গলাতেই বললে, কেন? এখনই এখানে দিয়ে দিলেই তো লেঠা চুকে যায়।

গোবরা চড়া চলায় বললে, কী আমার কুটুম্বিতে! দশ জায়গায় দাঁড় করিয়ে হয়রান করা।

লম্বা চশমা পরা লোকটিও ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। গম্ভীর চাপা গলায় ঘরের দিকে তাকিয়ে বললে, অবুঝের মত চেঁচামেচি করে কোনই লাভ নেই মানকে। আমার সঙ্গে চল। আসল মালিকের হাতে মালটা পৌঁছে দিলেই তোমাদের পাওনা তোমরা তখুনিই পেয়ে যাবে। এক মিনিটও দেরি হবে না, এসো।

বলতে বলতে লম্বা লোকটি কেবিনের বাইরে চলে গেল। ওরাও লোকটাকে অনুসরণ করল।

ওরা খালসা কেবিন থেকে বের হয়ে যেতেই সুব্রত উঠে পড়ে কাউন্টারে এসে চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রাস্তার অপর পাশে একটা বড় বটগাছের নীচে অন্ধকারে একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। লোকগুলো গাড়িটার দিকেই যাচ্ছে দেখা গেল।

লোকগুলো গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিতেই, সুব্রত একটু দূরে যেখানে তার ট্যাক্সিওয়ালা দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে দেখলে ট্যাক্সিওয়ালা সামনের সিটে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে।

সুব্রত ট্যাক্সিওয়ালাকে ডেকে তুলে অগ্রগামী গাড়িটাকে অনুসরণ করতে বলে গাড়িতে উঠে বসল।

ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিল।

 

আগের গাড়িটা চিৎপুর রোড ধরে বাগবাজারের দিকে চলেছে।

প্রায় হাত দশ-পনেরো ব্যবধান রেখে সুব্রতর ট্যাক্সিও আগের চলমান গাড়িটাকে অনুসরণ করে চলল। আগের গাড়িটা বরাবর চলতে চলতে এসে ঠিক চিৎপুর ও বাগবাজারের মোড়ে একটা প্রকাণ্ড চারতলা পুরাতন বাড়ির অল্পদূরে এসে থামল।

সুব্রতও ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ি থামাতে বললে।

সুব্রত গাড়ির মধ্যে বসে-বসেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, বাড়িটার সামনে একটা লোহার গেট। গেটের সামনেই ডানদিকে একটা গ্যাস লাইটপোস্ট–

গ্যাসলাইটের আলো নীচের রাস্তার আশেপাশে এসে পড়েছে। তাতেই চারপাশ বেশ দেখা যায়।

বাড়িটার দোতলা, তিনতলা, চারতলার সমস্ত জানালাই বন্ধ। মানুষের বসতি আছে বলে মনে হয় না। পুরানো পোড়ড়া বাড়ি বলেই মনে হয়।

মানকে, গোবরা ও লম্বা লোকটা তিনজনে গাড়ি থেকে নামে। আগে আগে লম্বা লোকটা ও তার পিছনে মানকে ও গোবরা গেটের মধ্যে প্রবেশ করল।

সুব্রত গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে।

ওরা তিনজন এগিয়ে চলেছে।

সুব্রত বেশ একটু ব্যবধান রেখে ওদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলল।

গেট পার হলেই একটা ভোলা জমি। জমিটার দুপাশে টিনের শেড্‌ ঘর।

কতকগুলো লরী দেখা যায়। জমিটা পার হয়েই একটা ভেজানো দরজা ঠেলে লোক তিনটে বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সুব্রত দরজার সামনে এসে দরজাটা ঠেলে দেখলে, ওরা দরজাটা বন্ধ করেনি, খুলেই রেখে গেছে।

মিনিট দুতিন অপেক্ষা করে সুব্রত দরজার ভিতর দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। নিকষকালো অন্ধকারে সহসা যেন ওর চোখ দুটো অন্ধ হয়ে গেল। পকেটে যদিও পেনসিল টর্চ আছে, তবু আলো জ্বালবার ভরসা হল না। ক্রমে একটু একটু করে অন্ধকারটা চোখে কতকটা যেন সয়ে গেল। সুব্রত পায়ে পায়ে এগুতে লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ করে রাখল, কোন শব্দ শোনা যায় কিনা।

এগিয়ে যেতে যেতে ওর মনে হল, মাথার ওপরে কার যেন পায়ের চলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ও বুঝলে, লোকগুলো দোতলাতেই গেছে।

কিন্তু দোতলায় যাবার সিঁড়ি কোথায়? যতদূর মনে হচ্ছে নীচের তলায় কেউ নেই। ও পকেট থেকে টর্চটা বের করে বোম টিপে আলোটা জ্বালাতেই দেখতে পেল, যেখানে ও দাঁড়িয়ে আছে সেটা লম্বা একটা বারান্দা।

সামনেই একটা প্রশস্ত জঙ্গলাকীর্ণ আবর্জনাপূর্ণ আঙিনা। বারান্দার মেঝেতে এক ইঞ্চি পরিমাণ ধুলোবালি জমে আছে। বেশ বোঝা যায় যে, বাড়িটায় কেউ বাস করে না। আর বসবাস করলেও এমনভাবেই বাস করে যে, বসবাসের তারা কোন চিহ্নই রাখতে চায় না। নীচের তলায় প্রায় সাত-আটটা ঘর। প্রত্যেকটা ঘরই খালি, আবর্জনাপূর্ণ। দরজাগুলোতে শিকল দেওয়া।

আলো ফেলে ফেলে ঘুরতেই ও দেখতে পেল, উপরে উঠবার সিঁড়ি। আর কালবিলম্ব না করে টর্চটা নিভিয়ে অন্ধকারেই টিপে টিপে নিঃশব্দে ও উপরে উঠতে লাগল।

উপরের তলাতেও ঠিক এমনি একটা বারান্দা। কোণের একটা ঘরের আধ-ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আলো এসে বারান্দায় পড়েছে। সুব্রত পা টিপে টিপে দরজাটা দিকে এগিয়ে গেল।

কাদের কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে যেন।

সুব্রত যে ঘরটা থেকে আলো আসছিল, তার পাশের ঘরটাতে গিয়ে প্রবেশ করল।

ঘরটার এক কোণে একটা সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। ঘরটা খালি! কেউ নেই ঘরে। ভাগ্যক্রমে ও দেখলে, যে-ঘরে লোকগুলো কথাবার্তা বলছিল, সেই ঘর থেকে এই ঘরে আসা-যাওয়ার একটা প্রবেশদ্বার আছে। সেখানে ভারী একটা পর্দা টাঙানো।

সর্বাগ্রে সুব্রত চট্‌ করে ঘরটার চারপাশে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।

একপাশে একটা লোহার খাটে শয্যা বিছানো। একটা কাঠের আলমারি এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। এককোণে একটা কুঁজো। কুঁজোর মুখে একটা গ্লাস উপুড় করা।

আর এক কোণে একটা লোহার সিন্দুক। একটা আলনায় গোটাকতক কাপড়ও ঝুলছে। সুব্রত আস্তে আস্তে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজার ঝুলন্ত পর্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

পাশের ঘরের লোকগুলো বেশ জোরে-জোরেই কথা বলছে।

একজনের গলা শোনা গেল, একটু কর্কশ গলার স্বর, তাহলে তোমরা চিঠিটা সত্যি উদ্ধার করে এনেছ?

হ্যাঁ, সর্দার। কিন্তু বেটা গোয়েন্দাটা আর একটু হলেই পিস্তলের গুলি চালিয়ে মানকের প্রাণটা নিয়েছিল আর কি!

আগের লোকটি ঐ কথায় কর্কশ গলায় হেসে উঠল।

চিঠিটা যদি আজ তোরা না আনতে পারতিস—লোকটা বলতে লাগল, তবে আজ বহু টাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেত। সাবাস! খুব বাহাদুর!

গোবরা জবাব দিলে, তাতে আর সন্দেহ কি সর্দার। তা চিঠির মালিক সেই টাকা দেনেওয়ালা আজ এখানে এসেছিল কি?

না, আমিই সন্ধ্যার সময় তাজ হোটেলে দেখা করেছি। বলেছে, চিঠিটা উদ্ধার হলে কাল এসে সে নিয়ে যাবে।

কিন্তু আমাদের দেনাপাওনার কি হবে সর্দার?

কুছ পরোয়া নেই। টাকা সে আগাম দিয়ে গেছে।

এমন সময় সেই লম্বা লোকটার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তবে এদের টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও সর্দার।

হ্যাঁ, টাকা পাশের ঘরের সিন্দুকে আছে। এখুনি এনে দিচ্ছি। ব্যস্ত কেন?

সুব্রত বুঝলে, এখুনি হয়তো সর্দার এ ঘরে আসবে। ও চটপট বড় আলমারিটার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল এবং লুকাবার আগেই সে দেখে রেখেছিল ঘরের আলোর সুইচটা কোথায়।

যেখানে লুকিয়েছে তারই পাশে, অনায়াসেই হাত বাড়িয়ে সুইচটা পাওয়া যায়। আর আলমারির পাশেই সিন্দুকটা। একটু পরেই কে যেন এসে ঘরে ঢুকল। সুব্রত আলমারির পিছনে দাঁড়িয়ে পায়ের শব্দ শুনতে পেল।

আগন্তুক এসে সবে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুলতে যাবে, সহসা সুব্রত এসে তার সামনে দাঁড়াল। হাতে তার উদ্যত পিস্তল।

লোকটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। মোটাসোটা গড়ন। মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল। নাকটা চ্যাপটা। চোখ দুটো ছোট ঘোট কুতকুতে। মুখে বিশ্রী বসন্তের দাগ। কুৎসিত।

লোকটা হঠাৎ সুব্রতকে সামনে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যেন। কিন্তু যেমন সে দাঁড়িয়েছিল তেমনই নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

 

টু শব্দটি করেছ কী পিস্তলের গুলি তোমার বুকে গিয়ে তোমাকে যমের বাড়ি পাঠাবে।

একটা কুৎসিত হাসির রেখা লোকটার মুখে যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই খেলে গেল।

সুব্রত জানত না যে, যার সামনে সে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই লোকটা কত বড় দুঃসাহসী, নৃশংস ও ভয়ংকর! এর চাইতেও সংকটাপন্ন ভয়ংকর মুহূর্তেও সে তার উপস্থিত বিবেচনা, শক্তি ও সাহস হারায়নি। লোকটা তার কুকুতে ভয়ংকর ধারাল ছুরির ফলার মত দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর হঠাৎ হ্যাঁ  হ্যাঁ  করে কর্কশ হাসি হেসে উঠল!

সুব্রত চমকে উঠল, চুপ!

লোকটার কিন্তু ভ্রূক্ষেপও নেই। তেমনিই হা হা করে হাসছে।

সুব্রত আলোটার ওপরে লক্ষ্য করে একটা গুলি চালাল।

ঝন্‌ঝন্ শব্দ করে মুহূর্তে ঘরটা নিচ্ছিদ্র আঁধারে ভরে গেল।

ইতিমধ্যে ওর হাসি শুনে পাশের ঘরের লোকগুলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে ছুটে এসেছে, সর্দার—সর্দার কী হল?

একটা লোক ঘরের মধ্যে!

লোক ঘরের মধ্যে? কোথা থেকে এল? মানকের গলা।

হ্যাঁ, আলমারির দিকে…

সুব্রত ততক্ষণে আলমারির দিক থেকে অন্ধকারে শিকারী বিড়ালের মত দেওয়াল ঘেঁষে এগুচ্ছে দরজার দিকে।

মানকে গম্ভীর গলায় বললে, ওরে শয়তান, শীঘ্র বের হয়ে আয়! সিংহের গুহায় পা দিয়েছিস! বলতে বলতে অন্ধকার তা করে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারল মানকে!

ছুরিটা এসে সাঁ করে সুব্রতর ডান হাতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা ওর হাত থেকে ঠন্‌ করে মাটিতে পড়ে গেল।

সুব্রত পিস্তলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নেবার আগেই কে একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ঘাড়ের উপর। সুব্রত এক ঝাকানি দিয়ে লোকটাকে ফেলে দিতেই লোকটা অন্ধকারে সুব্রতর পা চেপে ধরল।

সুব্রত আবার পড়ে গেল।

ততক্ষণে আরও একজন এসে সুব্রতর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল সেই অন্ধকারেই।

সুব্রত একজনের পেটে একটা প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল। লোকটা গ্যাক করে শব্দ করে ছিটকে পড়ল।

সুব্রত সবে উঠে দাঁড়িয়েছে, সহসা কে তার মাথার ওপরে অন্ধকারেই একটা প্রচণ্ড আঘাত হানল।

সুব্রত চোখে অন্ধকার দেখে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

 

কতক্ষণ যে সুব্রত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল তা ও বলতে পারে না। ক্রমে এক সময় একটু একটু করে ওর জ্ঞান ফিরে এল।

মাথাটা তখনও বেশ ভারী। ঝিমঝিম্ একটা ভাব। শরীরটা বরফের মত জমাট বেঁধে গেছে। রক্ত চলাচল একেবারে বন্ধ।

চোখের পাতা দুটো খুলতে তখনও বেশ কষ্ট হয়। কোথায় আছে সে?

কী অন্ধকার! কালো বাদুড়ের ডানার মত অন্ধকার চাপ বেঁধে উঠেছে যেন।

একটা ধুলোবালির সোঁদা গন্ধে নাক জ্বালা করে।

পাশ ফিরতে গেল, সমস্ত শরীরটা যেন একই সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠল। ও বুঝতে পারলে, ওর হাত-পা সব বাঁধা শক্ত দড়ি দিয়ে।

হাত দুটো রাঁধা অবস্থাতেই চোখের কাছে নিয়ে এল। হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা, পৃথক করবার উপায় নেই।

অন্ধকার ঘরের মধ্যে ও চেয়ে দেখতে লাগল, ওই মাথার ওপরে দেওয়ালের গায়ে ঘুলঘুলি দিয়ে একটু যেন ক্ষীণ আলোর আভাস পাওয়া যায়।

ও বুঝতে পারলে, ওকে হাত-পা বেঁধে একটা ধূলিমলিন তক্তপোষের ওপরে ফেলে রেখে গেছে ওরা।

এই বদ্ধ ঘরের অন্ধকার থেকে কে তাকে মুক্তি দেবে? বেঁকের মাথায় সহসা অমনভাবে। একটা মাত্র পিস্তলের ওপরে নির্ভর করে চারজন শত্রুর সম্মুখীন হওয়া তার কোনমতেই উচিত হয়নি।

কপালের দুপাশের রগ দুটো যেন বেদনায় দপদপ করছে।

শরীরের সর্বত্র একটা ক্লান্তি, বেদনা।

উঃ, কী অন্ধকার।

চোখের দৃষ্টি বুঝি অন্ধ হয়েই যাবে।

কিছুক্ষণ একান্ত নিঃসহায় ভাবেই ও কান পেতে যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল। যদি কোন শব্দ শোনা যায়।

কিন্তু কোন শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না।

মৃত্যুর মতোই জমাট শীতল অন্ধকার যেন অক্টোপাশের মত অষ্ট মৃত্যুবাহু বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

ঘরের মধ্যে বদ্ধবায়ু—যেন শ্বাস নিতেই কষ্টবোধ হয়।

সহসা পাগলের মত সে একবার হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করলে, কিন্তু সবই বৃথা। সরু শক্ত দড়িতে এমনভাবে বাঁধা যে, সাধ্য কি তার ছিঁড়ে ফেলে সে বাঁধন? দড়িটা খুলবার চেষ্টা করতে গিয়ে ফল এই হল যে, হাতের ওপরে বাঁধনটা চামড়া ও মাংস কেটে আরও শক্ত হয়ে বসে গেল।

উপায় নেই। এমনি ভাবেই বদ্ধ অবস্থায় এই অন্ধকার বায়ুলেশহীন ধূলিমলিন ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাইরে থেকে কেউ এসে তাকে মুক্তি দেয়।

কিন্তু কেইবা তাকে মুক্তি দিতে আসবে এই অন্ধকার কারাগুহা থেকে? কেইবা জানতে পারবে?

সে কোথায় আছে তা তো সেও জানে না।

এখনও কি সেই চিৎপুরের বাড়িটারই কোন ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে সে? এখন কি রাত্রি, না দিন হয়েছে?

হয়তো এমন কোন পোড়ো বাড়ির এক কুঠুরির মধ্যে তাকে বন্দী করে রেখেছে যার। আশেপাশে মাইলখানেকের মধ্যে হয়তো মানুষের চিহ্নও নেই। মানুষ হয়তো সেখানে মোটেই আসে না।

হয়তো তিলতিল করে তাকে এই বদ্ধ বায়ুলেশহীন অন্ধকার ঘরের মধ্যে এমনি হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে মরে যেতে হবে। কেউ জানবে না, কেউ শুনবে না তার আর্ত-কাতর চিৎকার।

আর যদি কেউ আসে, সে হয়তো শত্রুপক্ষেরই কেউ হবে। যে তার দুর্দশা দেখে নেকড়ের মত দাঁত বের করে হ্যাঁ  হ্যাঁ  করে নিষ্ঠুর হাসি হাসবে।

কিন্তু না, এসব কি পাগলের মত ভাবছে ও! যেমন করেই হোক তাকে মুক্তি পেতেই হবে।

মনে পড়ল বহুদিন আগে একবার সে এমনি এক ঘরে বিখ্যাত দস্যু কালো ভ্রমরের চক্রান্তে বন্দী হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে তো সে পালিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে যেন আশার একটা জোয়ার এসে ঝাপটা দিল।

ওর সমগ্র অন্তর যেন বাঁচবার একটা অদম্য প্রেরণায় সহসা আবার নবীন বলে বলীয়ান হয়ে উঠল।

বাঁচতে তাকে হবেই। বিপদে সাহস হারালে চলবে না।

ধীরে ধীরে বহু কষ্টে ও কোনমতে ঐ বাঁধা অবস্থাতেই উঠে বসল।

হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার ডান পায়ের জংঘার নীচে একটা তীক্ষ্ণ জাপানী ছুরি বাঁধা আছে।

কিন্তু সে ছুরিটা সে বের করবে কী করে?

নিচু হয়ে দাঁত দিয়ে ও হাঁটুর উপরে কাপড়টা ছিঁড়ে ফেললে। তারপর কোনমতে বাঁধা হাতের আঙুল দিয়ে ছুরিটা টেনে বের করল। তখন তার বাঁধন কাটতে বেশী দেরি হল না।

ছুরিটা দাঁতে চেপে ধরে প্রথমেই হাতের বাঁধন একটু একটু করে সে কেটে ফেললে। তারপর পায়ের ও শরীরের।

সে এখন মুক্ত।

আনন্দে ওর মুখের ওপরে হাসি ফুটে উঠল।

বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ও খাটের উপর থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল।

পকেট হাতড়ে দেখলে তার পেনসিলটর্চটা আছে কিনা?

ধন্যবাদ! ভগবানকে অশেষ ধন্যবাদ, টর্চটা তখনও তার পকেটের ক্লিপে আঁটা আছে। শত্রুরা নিয়ে নেয়নি।

বোতাম টিপতেই একটা সরু আলোর রেখা অন্ধকারের বুক চিরে জেগে উঠল—যেন তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী একটা দৃষ্টি।

প্রথমেই আলো দিয়ে ও খুঁজতে লাগল ঘরে কোন দরজা আছে কিনা।

একদিককার দেওয়ালে একটা বন্ধ দরজা ওর নজরে পড়ল। কিন্তু দরজাতে ধাক্কা দিতে দেখলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তাছাড়া, দরজাটা শক্ত সেগুন কাঠের। সাধ্য কী ওর দরজাটা ভেঙে ফেলে পায়ের জোরে!

লোহার মতই শক্ত। তবু একবার ও দেহের সমগ্র শক্তি একত্রিত করে দরজাটার ওপরে চাপ– দিল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা।

তখন কতকটা হতাশ হয়েই সে ঘরের দেওয়ালগুলা পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

নিরেট ইট ও সিমেন্টের তৈরি দেওয়াল। কোথাও একটুকু ফাঁক নেই।

দেওয়ালে দেওয়ালে ও টোকা মেরে দেখলে, যদি কোথাও ফাপা থাকে। কিন্তু না, শক্ত। নিরেট দেওয়াল।

পরিশ্রমে ও ক্লান্তিতে ওর কপালের ওপরে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।

ধুপ করে সুব্রত তখন ধূলিমলিন মেঝের ওপরে বসে পড়ে দুহাতে মাথাটা টিপে ধরল।

না, কোন আশাই নাই। কিন্তু কী করবে ও এখন?

Category: অবগুণ্ঠিতা
পূর্ববর্তী:
« ০৯. নিজের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায়
পরবর্তী:
১১. কিন্তু এমনি করে বসে থাকলে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑