২৬. উপসংহার

বেতাল কহিল, মহারাজ! আমি তোমার সাহস ও অধ্যবসায় দর্শনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তোমায় কিছু উপদেশ দিতেছি, অবধানপূর্বক শ্রবণ কর।

যে যোগী তোমায় শবানয়নে নিযুক্ত করিয়াছে, সে কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন; তাহার নাম শান্তশীল। আর, যে শব লইতে আসিয়াছ, উহা ভোগবতীর অধিপতি রাজা চন্দ্ৰভানুর মৃতদেহ। শান্তশীল, যোগসিদ্ধির নিমিত্ত, অনেক কৌশলে, চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়া, প্রায় কৃতকাৰ্য হইয়া আছে; এক্ষণে, তোমার প্রাণসংহার করিতে পারিলেই, উহার মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এজন্য, আমি তোমায় সাবধান করিয়া দিতেছি; যোগী পূজাসমাপন করিয়া তোমায় বলিবেক, মহারাজ! সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত কর। তদনুসারে তুমি যেমন দণ্ডবৎ পতিত হইবে, অমনই সে খড়্গপ্রহার দ্বারা তোমার প্রাণসংহার করিবেক। অতএব, তুমি, কোনও ক্রমে, সেরূপ প্ৰণাম না করিয়া বলিবে, আমি কোনও কালে সাষ্টাঙ্গপ্ৰণাম করি নাই; এবং, কেমন করিয়া সেরূপ প্ৰণাম করিতে হয়, তাহাও জানি না; আপনি কৃপা করিয়া দেখাইয়া দিলে, আপনকার আজ্ঞাপ্রতিপালন করিতে পারি। অনন্তর, তোমায় দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত, সে যেমন দণ্ডবৎ পতিত হইয়া প্ৰণাম করিবেক, অমনি তুমি, খড়্গপ্রহার দ্বারা, তাহার মস্তকচ্ছেদনপূর্বক, তাহার ও চন্দ্ৰভানুর মৃতদেহ সন্নিহিত জ্বলন্ত মহানসের উপরিস্থিত তৈলকটাহে নিক্ষিপ্ত করিবে; এবং, তাহা হইলেই, তদীয় সম্পূর্ণ যোগফল প্রাপ্ত হইয়া, অখণ্ড ভূমণ্ডলে অবিচল সাম্রাজ্যস্থাপন করিতে পরিবে। সে ব্যক্তি আততায়ী; আততায়ীর বধে পাতক নাই।

এইরূপে বিক্রমাদিত্যকে সতর্ক করিয়া দিয়া, বেতাল, সেই মৃত শরীর হইতে বহির্নিঃসরণ। পুরঃসর, স্বস্থানে প্রস্থান করিল। রাজা, সেই শব লইয়া, সন্ন্যাসীর সন্নিধানে উপস্থিত হইলে, তিনি সাতিশয় সন্তোষপ্ৰদৰ্শন ও রাজার অশেষপ্রকার প্রশংসাকীর্তন করিতে লাগিলেন; অনন্তর, চন্দ্ৰভানুর মৃত দেহে জীবনদানপূর্বক, বলিপ্ৰদান করিলেন; এবং, পূজার অন্যান্য অঙ্গ যথাবৎ সমাপ্ত করিয়া, রাজাকে বলিলেন, মহারাজ! সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম, কর; তোমার প্রতাপবৃদ্ধি ও অভীষ্টসিদ্ধি হইবেক। রাজা, বেতালদত্ত উপদেশ অনুসারে, কৃতাঞ্জলি হইয়া, অতি বিনীতভাবে আবেদন করিলেন, মহাশয়! আমি সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম করিতে জানি না; আপনি গুরু; কি প্রকারে ওরূপ প্ৰণাম করিতে হয়, কৃপা করিয়া দেখাইয়া দিউন। যোগী, রাজাকে সাষ্টাঙ্গপ্ৰণাম শিখাইবার নিমিত্ত, যেমন ভূতলে দণ্ডবৎ পতিত হইলেন, অমনি রাজা, বেতালের উপদেশ অনুসারে, খড়্গাঘাত দ্বারা, তাহার শিরশ্ছেদন করিলেন।

দেবতারা, এই ব্যাপার দর্শনে সাতিশয় পরিতুষ্ট হইয়া, দুন্দভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। দেবরাজ, দেবলোক হইতে অবতরণপূর্বক, রাজাকে দর্শন দিয়া কহিলেন, মহারাজ! আমি তোমার সৌভাগ্যদর্শনে সাতিশয় প্রীত হইয়াছি, বরপ্রার্থনা কর। রাজা, অনিমিষ সহস্র নয়নে অলঙ্কৃত কলেবর দর্শনে, দেবরাজ স্থির করিয়া, আপনাকে চরিতার্থ বোধ করিলেন; এবং বলিলেন, আপনকার প্ৰসাদে, পৃথিবীতে আমার কোনও প্রার্থয়িতব্য নাই। এক্ষণে, এইমাত্র প্রার্থনা করি, যেন আমার এই বৃত্তান্ত সমস্ত সংসারে প্রসিদ্ধ হয়। ইন্দ্ৰ কহিলেন, মহারাজ! যাবৎ চন্দ্র, সূৰ্য, পৃথিবী, ও আকাশমণ্ডল বিদ্যমান থাকিবেক, তাবৎকাল পর্যন্ত, তোমার এই বৃত্তান্ত ধরাতালে প্ৰসিদ্ধ থাকিবেক।

 

এই রূপে রাজাকে বরপ্ৰদান করিয়া, দেবরাজ দেবালোকে প্ৰতিগমন করিলেন। অনন্তর রাজা, মন্ত্রপ্রয়োগপূর্বক, দুই মৃতদেহ তৈলকটাহে নিক্ষিপ্ত করিবামাত্র, দুই বিকটাকার বীরপুরুষ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল; এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন, আমি যখন যখন স্মরণ করিব, তোমরা আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। তাহারা, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, প্রস্থান করিল। রাজা বিক্রমাদিত্যও, সর্বপ্রকারে চরিতার্থ হইয়া, নিরতিশয় হৃষ্ট চিত্তে, রাজধানী প্রতিগমনপূর্বক, অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন ও প্রজাপলিন করিতে লাগিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *