ঘ. সালফারের রাজত্ব

ঘ. সালফারের রাজত্ব

২৩. ফ্যালকন

‘এ মুহূর্তে গ্যানিমিড থেকে ইউরোপার দূরত্ব চার হাজার কে, ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার জানিয়ে দিল পোলকে, তুমি যদি গ্যাস প্যাডালে ঠিকমত চাপ দিতে পার- ফ্রেজটা শিখানোর জন্য ধন্যবাদ পৌঁছে যাবে এক ঘন্টার মধ্যে। কিন্তু আমি এতটা গতি চাই না। এত দ্রুত কিছু আসতে দেখে পুরনো বন্ধু ভড়কে গেলে সব ভেস্তে যাবে।’

মানলাম। আমাকে আরো একটু ভাবতে হবে। অত কয়েক ঘন্টা বেশি সময় নিব। এখনো আশা করি…’নিরবতায় হারিয়ে গেল পোলের কণ্ঠ।

কী আশা কর?

‘যে ডেভের সাথে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হবে। নামার আগেই।

‘দাওয়াত ছাড়া কোথাও যাওয়া খারাপ। সব সময় খারাপ- তা পরিচিত মানুষের বাসায় হোক আর অপরিচিত… কিছু উপহার নিয়ে গেলে কেমন হয়? আদ্যিকালের সমুদ্রচারীরা কী নিয়ে যেত নতুন নতুন এলাকায়? আয়না আর গয়না?

হাল্কা কথাবার্তা চ্যান্ডলারের মনের উদ্বেগ ঢাকতে পারছে না। পোলের জন্য উদ্বেগ, দামি যানটার জন্য উদ্বেগ।

‘এখনো ভেবে পাচ্ছি না। তুমি ফিরে এলে তো মস্ত বীর, তোমার আলোয় আমার গায়েও একটু ছাট টাট লাগবে। আর যদি ফিরে না আস? ফ্যালকন আর তোমার জীবন গেলে আমার কী হবে? কেউ এ কাহিনী কিনবে না। গ্যানিমিডের ট্রাফিক কন্ট্রোল খুব কড়া- এমনি হবার কথা, তাই না? যদি উড়তে শুরু কর, এক মাইক্রোসেকের মধ্যে- বলা ভাল মিলিসেকের মধ্যে পিছু নিবে। সময়ের আগে ফ্লাইটপ্ল্যান না করলে কোনো উপায় নেই।

তাই এখন পর্যন্ত এটুকু অফার করতে পারি।

‘তুমি ফ্যালকন নিয়ে যাচ্ছ ফাইনাল কোয়ালিফিকেশন টেস্টের জন্য সবাই জানে, এর মধ্যেই সলো করে ফেলেছ। তুমি ইউরোপার দু হাজার কিলোমিটার উপরে যাবে। এখানে কোনো আপত্তি নেই। মানুষ এসব করছে অহরহ, লোকাল অথরিটির নাকের ডগা দিয়েই।

‘পুরো ফ্লাইট টাইম পাঁচ ঘন্টার দশ মিনিট আগে-পরে। তুমি যদি ফিরে আসার সময় এদিক সেদিক কর, কারো কিছু করার নেই। অন্তত গ্যানিমিডে কেউ কিছু করতে পারবে না। অবশ্যই, আমি একটু চেঁচামেচি করব। চিৎকার করে বলব এমন অপারেশনাল সমস্যার কথা আগে ভাবিনি ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোর্ট অব ইনকোয়ারিতে কাজে দিবে।

কাজ হবেতো? আমি তোমাকে কোনো বিপদে ফেলতে চাই না।’

‘বাদ দাও। এখানে খানিকটা উত্তেজনা চেখে দেখা যাবে। কিন্তু ভুলেও আর সব কুর কথা ভোলা যাবে না। তারা একেবারে চোখ কান বাধা অবস্থায় আছে।

“থ্যাঙ্কস, দিম। তোমার কাজের প্রশংসা করছি, সত্যি সত্যি। আমাকে গোলিয়াথে ফিরিয়ে আনতে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।’

.

সন্দেহ দূর করতে পারল না পোল। ফ্যালকনকে ঠিকঠাক করার সময় ক্রুরা একটু আধটু গন্ধ পায়। চেপে রাখে পোল আর চ্যান্ডলার।

হাজার হলেও, হাজার বছর আগে সে আর ডেভ বোম্যান যেমন একেবারে অজানার উদ্দেশ্যে পাল তুলে দিয়েছিল তেমনটা হবে না এবার। শাটলের মেমোরিতে ইউরোপার হাই রেজুলেশন ম্যাপ আছে। মাত্র কয়েক মিটারের ডিটেইলও পাওয়া যাবে সেখানে। সে জানে কোথায় যেতে হবে। আশা একটাই, হাজার বছরের কোয়ারেন্টাইন যেন ভাঙা যায়।

২৪. এস্কেপ

‘ম্যানুয়াল কন্ট্রোল, প্লিজ।‘

‘তুমি নিশ্চিত তো, ফ্র্যাঙ্ক?’

‘পুরোপুরি, ফ্যালকন… ধন্যবাদ।‘

অযৌক্তিক হলেও সত্যি মানবজাতির বেশিরভাগ মানুষ তাদের তৈরি কৃত্রিম যান্ত্রিক সন্তানদের সাথে নিজের অজান্তে দ্র ব্যবহার করে। সাইকোলজির বড় বড় বইগুলো (কী করে আপনার কম্পিউটারের অনুভূতিতে আঘাত দেয়া থেকে বিরত থাকবেন; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স- রিয়েল ইরিটেশন টাইপের নাম দেয়া হয় এসব বইয়ের) এখন লেখা হয় মানুষ-যন্ত্র যোগাযোগের ব্যাপারে। আগেই ধরে নেয়া হয়েছিল, রোবটের সাথে খারাপ ব্যবহার যা ফলই বয়ে আনুক না কেন, ব্যাপারটাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

অর্বিটে চলে এসেছে ফ্যালকন। ফ্লাইট প্ল্যান অনুযায়ী, ইউরোপার দু হাজার কিলোমিটার উপরে। সামনের আকাশ জুড়ে আছে দানবীয় চাঁদের চিকণ গড়ন। সব দেখা যায়, স্পষ্ট। পরিকল্পনার জায়গাটা দেখা সরাসরি। কোনো বাড়তি জিনিসের সহায়তা নিতে হবে না। গ্যালিলি সাগরের পাড় এখনো বরফ ছোঁয়া। এখানে নামা প্রথম স্পেসক্র্যাফটের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। চৈনিক যানটার সব ধাতু তুলে নিয়েছে তারা। ইউরোপানরা। কঙ্কালটা পড়ে আছে নিঃসাড়। এর চারপাশে গড়ে ওঠে সৌর জগতের প্রথম এ্যালিয়েন নগরী। জিয়াংভিল।

পোল প্রথমে নেমে আসবে সমুদ্রের উপর। তারপর ধীরে ধীরে উড়ে যাবে জিয়াংভিলের দিকে। কারো কাছে যেন এগ্রিসিভ না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কাজটা যে খুব বেশি ভাল হবে তা না। কিন্তু এর চেয়ে ভাল কোনো উপায় ভেবে বের করতে পারেনি সে।

তারপর, হাজারখানেক কিলোমিটার নামার পরই, বাধা এল। যেমন আশা করেছিল, তেমনি।

‘দিস ইজ গ্যানিমিড কন্ট্রোল, কলিং ফ্যালকন। আপনি ফ্লাইট প্ল্যানের বাইরে চলে গেছেন। কী হচ্ছে জানিয়ে এ্যাডভাইস পাঠান দ্রুত।

এমন জরুরি ভঙ্গিতে আসা মেসেজ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু পোল এড়িয়ে গেল।

ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড পর, ইউরোপার একশ কিলোমিটারে আসার সাথে সাথে আবার সেই মেসেজ। অবহেলা করল পোল, কি জবাব দিল ফ্যালকন।

তুমি নিশ্চিত তো, ফ্র্যাঙ্ক’ শাটল প্রশ্ন তুলল। সে জানে না ঠিক শুনেছে কিনা, ফ্যালকনের কঠে যেন উদ্বেগের ছোঁয়া।

‘একেবারে নিশ্চিত, ফ্যালকন। আমি ভাল করেই জানি কী করছি।’

কথাটা সত্যি নয়। সবটুকু সে জানে না।

কন্ট্রোল বোর্ডের পাশে ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলছে। স্বস্তির হাসি পোলের মুখে। সব চলছে পরিকনামাফিক।

দিস ইজ গ্যানিমিড কন্ট্রোল! আমাকে রিসিভ করছেন, ফ্যালকন? আপনি ম্যানুয়াল ওভাররাইডে অপারেট করছেন, আপনাকে চালাতে পারছি না আমি। হচ্ছেটা কী? এখনো নেমে যাচ্ছেন ইউরোপার দিকে। মেসেজ প্রাপ্তি স্বীকার করুত, প্লিজ।

মহিলার কষ্ঠ চিনতে পারছে পোল। আনুবিস আসার পর পর মেয়রের দেয়া এক সংবর্ধনায় তার সাথে দেখা হয়েছিল। মহিলা নিশ্চয়ই অথৈ সাগরে পড়েছে।

হঠাৎ সে বুঝতে পারল, তার উদ্বেগ দূর করা যায় সহজে। চেষ্টা করে দেখা যাক, ক্ষতি নেই কোনো কাজ হলেও হতে পারে।

‘দিস ইজ ফ্র্যাঙ্ক পোল, কলিংফ্রম ফ্যালকন, আমি ঠিক আছি পুরোপুরি ঠিক আছি। মনে হয় কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছে অন্য কেউ। শাটলটাকে নামিয়ে আনছে ইউরোপার বুকে। আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। যতদূর সম্ভব মেসেজ দিয়ে যাব।

কন্ট্রোলারের সাথে মিথ্যা কথা বলছে না সে। কোনো একদিন হয়ত সৰ ব্যাখ্যা করে বলার সময় আসবে।

নিয়মিত যোগাযোগ করে গেল সে, যেন কোনো ভুল করছে না, ভুল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।

আবার বলছি, দিস ইজ ফ্র্যাঙ্ক পোল এ্যাবোর্ড দ্য শাটল ফ্যালকন, নেমে যাচ্ছি। ইউরোপার দিকে। মনে হয় বাইরের কোনো শক্তি আমার শাটলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। নিরাপদে ল্যান্ড হতে পারে।

‘ডেভ- আমি তোমার পুরনো শিপমেট ফ্র্যাঙ্ক। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করা অস্তিত্ব কি তুমিই? তুমি ইউরোপায় সেটা বিশ্বাস করার কারণ আছে।

তা হয়ে থাকলে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাই, যেখানে, যেভাবেই থাক না কেন?

প্রথমে কয়েক মুহূর্ত আর কোনো আওয়াজ নেই। এমনকি গ্যানিমিড কন্ট্রোলও স্তব্ধ হয়ে গেছে।

অন্য দিক দিয়ে সে একটা জবাব পেয়ে যায়। এখনো গ্যালিলি সাগরে নেমে যাচ্ছে ফ্যালকন।

ইউরোপা মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার নিচে। কালো লম্বা জিনিসটা, সব মনোলিথের চেয়ে বড় মনোলিথ, পড়ে আছে জিয়াংভিলের পাশেই। শুয়ে আছে।

হাজার বছরে আর কোনো মানুষকে এতটা কাছে আসতে দেয়া হয়নি।

২৫. ছাইচাপা আগুন

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এটা পানির রাজ্য। নিচে পানি, উপরে শূন্যতা, মাঝখানে শক্ত বরফের প্রাচীর। বেশিরভাগ জায়গায় বরফের আস্তরণটা কিলোমিটারের চেয়ে বেশি পুরু। কয়েক কিলোমিটার পুরু। কোথাও কোথাও ভাঙা অঞ্চল ছিল, বরফের বিশাল ফাটল উন্মুক্ত করে দিত পানি আর শূন্যতার মাঝের বরফকে। সৌরজগতের আর কোথাও দু বিপরীত অস্তিত্ব একত্রিত হয়নি এখানকার মতো। এ যুদ্ধে সব সময় দু পক্ষই জিতে যেত। বাপীভূত হত কিছুটা পানি, বাকিটা জমে গিয়ে পার্থক্য রচনা করত।

বৃহস্পতির টান না থাকলে পুরো ইউরোপার অনেক আগেই জমে বরফ হয়ে যাবার কথা। এহরাজের টান সব সময় হোট এ ভুবনের মধ্যবিন্দুতে টালমাটাল করে রাখে। আইওকে অগ্নিকুন্ড করে ফেলা শক্তি এখানেও কাজ করে, অনেক কম বল নিয়ে। গভীরে, সর্বত্র এ মহাগ্রহ-উপগ্রহ টানাপোড়েনের চিহ্ন। মাটির নিচে ভয়ানক সব ভূমিকম্প চলছে। এসবের গুরুগুরু আওয়াজ উঠে আসে উপরে। ভিতর থেকে উথলে ওঠে গ্যাসের প্রবাহ। ইউরোপার সমুদ্রের সাথে তুলনা করলে পৃথিবীর জীবন সঙ্গীত গাওয়া সমুদ্রগুলোও বোবা।

এখানে সেখানে, সাগরের তলায়, জন্ম নেয় মরুদ্যানেরা। যে কোনো পার্থিব জীববিদকে টানবে এ জগৎ। নিচ থেকে উঠে আসা তাপ আর মিনারেলে ভরা চিমনি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। কখনো কখনো দুর্গের মতো গড়ন গড়ে ওঠে আপনা-আপনি। সেখান থেকে দমকে দমকে বের হয় কালো স্রোত। ধীর, কালো স্রোত। যেন কোনো শক্তিমানের হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে। রক্তের মতো সেগুলোই জীবনের বার্তাবাহী তরল।

উপর থেকে আসছে শিতলতা, পানি তাই একেবারে ঠান্ডা। নিচ থেকে আসছে উত্তাপ, উঠে আসা তরল তাই ফুটন্ত। ফলে এসব জায়গায়, সাগরতলে, তাপমাত্রার বিচিত্র ভারসাম্য থাকে।

নিচ থেকে উঠে আসছে তির প্রাণ-রসায়নের সমস্ত উপাদান। এমন সব উর্বর মরুদ্যানে খাবার আর উত্তাপের কোনো অভাব নেই। বিংশ শতাব্দির অভিযাত্রীরা পৃথিবীর সমুদ্রের বুকেও এমন সব পানির তলার দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিল। এখানে এগুলোর আকার অনেক বেশি বড়, বৈচিত্রও বেশি।

গাছের মতো গড়ন নিয়ে, মাকড়শার মতো গড়ন নিয়ে উদ্ভিদ জাতীয় জীবেরা জন্ম নেয় জ্বালামুখের কাছাকাছি। এমন ছোট ছোট বন দাপড়ে বেড়ায় আরো বিচিত্র পোকামাকড়। কোনো কোনোটা গাছ থেকে খাদ্য নিচ্ছে, কোনো কোনোটা নিচ্ছে সরাসরি খনিজ দ্রব্য থেকে। আরো একটু দূরে বসত করে কাকড়ার মতো প্রাণিরা।

একটা ছোট মরুদ্যান দেখতে দেখতে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে জীববিজ্ঞানীর বাহিনী। পোলিওজোয়িক পার্থিব সমুদ্রের মতো এখানকার মরুদ্যানগুলো সুস্থির ও চিরস্থায়ী নয়। বিবর্তন এখানে বিদ্যুৎ গতিতে বয়ে চলে। অকল্পনীয় সব গড়ন জন্ম নেয়। তারপর, তারা সবাই, আজ অথবা কাল, হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতল তলে, কারণ মাতা ইউরোপা তার ইচ্ছামত উদগিরণের পথ সরিয়ে আনে, স্তিমিত করে ফেলে প্রাণ-তরলের উৎসগুলোকে। থিতিয়ে পড়ে ফোয়ার, স্তিমিত হয়ে যায় প্রাণের খেলা। ইউরোপার সাগরতলে, সর্বত্র এ নিদর্শন দেখা যায়। গোলাকার এলাকা ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র, ছড়িয়ে আছে মৃত ঝর্ণা, ছড়িয়ে আছে বিচিত্র সব প্রাণি আর উদ্ভিদের কঙ্কাল, বিবর্তনবিদ্যার এক একটা মূল্যবান অধ্যায় একেবারে অপঠিত থেকে যায়, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। কোথাও পড়ে আছে মানুষের চেয়েও বড় আকৃতির অস্থিময় গড়ন, বাইভালভ এমনকি ট্রাইভালভও চোখে পড়ে চোখে পড়ে কয়েক মিটার লম্বা সর্পিল পাথুরে গঠন যারা ক্রিটেশিয়াস যুগে পৃথিবীর বুক থেকে আচমকা বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল।

ইউরোপান জগতের আরেক বিস্ময় আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভার নদী। সাগরের এত নিচে প্রচন্ড চাপের কারণে লাভার স্পর্শ পাবার সাথে সাথে পানিগুলো বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। দুইটা বিপরীত অস্তিত্ব বয়ে চলে পাশাপাশি।

সেখানে, অন্য এক পৃথিবীতে মিশরের মতো কাহিনী রচিত, অভিনীত হয় ভিনগ্রহী অভিনেতাদের দ্বারা মানুষের জন্মের অনেক আগেই। সরু নীলনদ যেমন উষর মরুর বুকে জীবনের জয়গান নিয়ে আসে, তেমনি ইউরোপার গহীনে এ নদীগুলো কাজ করে চলে অবিরত। নদীর দু পাড়ে, মাত্র কয়েক কিলোমিটার পুরুত্ব নিয়ে, প্রাণের বীজতলা গড়ে ওঠে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানা রকম প্রাণি জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, উন্নয়ন ঘটায়, তারপর থিতিয়ে পড়ে নদীর প্রাণ যাবার সাথে সাথে। কেউ কেউ রেখে যায় স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ- তাদেরই অস্থি দিয়ে।

কেউ কেউ এমন স্থাপত্য রাখে যা দেখলে বুদ্ধিমত্তার কথা মনে পড়তে পারে।

এ সরু সরু নদীর দু পাড়ে, লম্বা এলাকা জুড়ে কত সমাজ আর সভ্যতার বীজ বুনে দেয়া হয়েছিল, কতগুলোর চারা গজিয়েছে, কত সাম্রাজ্যের উত্থান পতন হয়েছে তা এখন আর জানা যাবে না। হয়ত ইউরোপান ট্যামারলেন আর নেপোলিয়ানরা দাপটের সাথে মার্চ করিয়েছে- সাঁতার কাটিয়েছে সেনাবাহিনীকে। নদীর দু পাড়ের এলাকা বাদ দিলে পুরো বনের বাকিরা সেসবের কোনো সন্ধান পায় না। কারণ এখানে উষ্ণতা আছে শুধু আশপাশের এলাকায়। মরুদ্যান বা নদীর বাইরে চলে গেলে শীতলতা জীবনকে গ্রাস করে নিবে। এক একটা পানির তলার দ্বীপ যেন ভিন্ন। ভিন্ন গ্রহ, ভিন্ন দুনিয়া। তাদের ইতিহাসবেত্তা বা দার্শনিক থেকে থাকতে পারে, তারা হয়ত মনে করেছে সৃষ্টি জগতে আর কেউ নেই।

মরুদ্যানগুলোর মাঝের এলাকা একেবারে বিরান নয়। ইউরোপান সাগর আর পার্থিব সমুদ্রের মাছের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাদের কোনো ফুলকা নেই, কারণ অক্সিজেনের নাম-নিশানাও পাওয়া যাবে না বরফের নিচের এ সাগরে। পৃথিবীর জিওথার্মাল ভেন্টের মতো এরাও সালফার-যৌগ-নির্ভর প্রাণি।

সবার চোখ ছিল না। খুব কম দেখা যায়। এত গভীরে আলোর কোনো চিহ্ন নেই। তাই চোখেরও প্রশ্ন ওঠে না। শুধু উন্নত ধরনের জীবেরা সঙ্গী বা শিকারের খোঁজে মৃদু আলোর রেখা দেখায়।

ভিতরের উদ্‌গিরণ সব সময় থাকবে না, আস্তে আস্তে জোয়ারের টানও কমে আসছে। বুদ্ধিমত্তার উন্মেষ ঘটলেও তারা ফাঁদের বাইরে বেরুতে পারত না। জীবন আটকে পড়েছে বরফ আর আগুনের মাঝামাঝি।

কোন অলৌকিকের ছোঁয়া না পেলে টিকে থাকার উপায় নেই।

লুসিফার সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ল।

২৬. জিয়াংভিল

শেষ মুহূর্তে সমুদ্রের উপর দিয়ে চলতে থাকে সে, মাত্র একশ কিলোমিটার গতিতে। তীরে এসে তরী ডুবে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত পোল। কিন্তু কিছুই হল না। এমনকি কালো, নিষিদ্ধ দেয়ালের উপর দিয়ে যাবার সময়ও কিছু হয় না।

স্বাভাবিকভাবে এর নাম দেয়া হয়েছিল ইউরোপান মনোলিথ। চাঁদ বা পৃথিবীর মনোলিধের মতো এটা দাঁড়িয়ে নেই। দেয়ালের মতো করে শোয়ানো। লম্বায় বিশ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি। টি এম এ-জিরো ও টি এম এ-ওয়ানের তুলনায় বিলিয়ন গুণ বড় হলেও অনুপাতে কোনো ভুল নেই। ১:৪:৯। হাজার বছর ধরে এ মৌলিক অনুপাত নিয়ে মানুষ প্রাণপাত করেছে।

মাটি থেকে উচ্চতায় প্রায় দশ কিলোমিটার হওয়ায় এটা জিয়াহুভ্যালিকে গ্যালিলি সাগরের দুর্দান্ত জলরাশির হাত থেকে রক্ষা করে। রক্ষা করে মাতাল বাতাসের হাত থেকে। এখন সাগর আর তেমন সর্বগ্রাসী নয়, কিন্তু লুসিফারের জন্মের পর পর, নতুন ইউরোপার আবহাওয়া অস্থির থাকার সময় বছরের পর বছর ধরে এ ভূমি সাগর থেকে উঠে আসা প্রাণের অনুকূলে ছিল না।

প্রায় সর্বজয়ী মহাকাশচারী ফ্যাৰু পোল স্বচক্ষে কখনো কোনো টি এম এ দেখেনি। যখন সে বৃহস্পতির পথে পা বাড়ায় তখনো চাঁদের বুকের টি এম এ ওয়ান ছিল টপ সিক্রেট, সেটার কথা জানত শুধু ডিসকভারিতে শীতস্তম্ভে ঘুমিয়ে থাকা অভিযাত্রীরা, সে বা ডেভ বোম্যান, যে দুজন জেগে ছিল, তারা জানত না। পরে যখন বোম্যান তখনকার বৃহস্পতির বাইরে পাক খেতে থাকা বৃহস্পতিয় টি এম এর দেখা পায়, (লিওনভের যাত্রিরা পরে, দু হাজার দশ সালে যার নাম দিয়েছিল বিগ ব্রাদার) ততদিনে পোল চলে গেছে ডিসকভারির বাইরে, মৃত অবস্থায় চলে যাচ্ছে শনির দিকে। কয়েক শতাব্দি পর, পৃথিবীর বুকে আবিস্কৃত হল টি এম এ জিরো। ফিরে এল পোল, কিন্তু হাজার বছর জমে থাকার কারণে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ সহ্য করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পৃথিবীর এত কাছে থাকা সত্ত্বেও দেখতে পায়নি পৃথিবীর বিস্ময়কে। এই প্রথম, সে কোনো টি এম এ দেখছে। দেখছে অচিন মহাকাশচারীদের বানানো বিস্ময়-বস্তু।

টি এম এ নিয়ে কম পাগলাটে তত্ত্ব আসেনি। এক মতবাদ অনুসারে, সত্যিকার মনোলিথ আছে মাত্র একটা, বাকিগুলোর আকার আকৃতি যেমনি হোক না কেন, সেগুলো শুধু প্রথমটার ইমেজ প্রজেকশন। মহাপ্রাচীরের মসৃণ, দাগহীন, চিত্রহীন, মিষকালো আকৃতি দেখতে দেখতে স্থাণুর মতো হয়ে যায় সে। এত শতাব্দির ধকল পেরিয়ে এসে এখনো এটা চিরযুবা। যেন ইউন্ডোক্লিনারের বাহিনী সব সময় প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ধুয়ে মুছে যত্ন করে পালিশ করে রেখেছে।

টি এম এ-ওয়ান আর জিরো দেখতে আসা সব মানুষের মতো তার মনেও একই অনুভূতি জন্মে। একবার ছুঁয়ে দেখতে হবে। কেউ কখনো পারেনি। তবু একবার দেখতে হবে। আঙুল, হিরার ছুরি, লেজার- সব ফস্কে ফস্কে যায় এখানে। কোনো চিহ্ন পড়ে না। অথবা, আরেক বিখ্যাত থিওরি মেনে নিতে হয়- এগুলো এ ব্রহ্মান্ডের বস্তু নয়। এক বিন্দুও ছুঁয়ে দেখা যাবে না।

একবার ধীর গতিতে সে পাক খায় গ্রেট ওয়ালের চারপাশে। এরপর, এখনো ম্যানুয়াল কন্ট্রোলে রেখে, জিয়াংভিলের প্রাক্তসীমায় নামানোর চেষ্টা করে শাটলটাকে। অটো কন্ট্রোল রাখতে সাহস হয় না। গ্যানিমিড যদি উদ্ধারের চেষ্টা করে তাহলে সব ভেস্তে যাবে।

সামনে, ফ্যালকনের ল, প্যানারমিক জানালা দিয়ে তাকায় সে। গ্যানিমিডে বসে বসে এ চিত্র অনেকবার দেখেছে। কখনো ভাবেনি সত্যি সত্যি এসে পড়বে। মনে হচ্ছে ইউরোপাদের নগরবিদ্যার কোনো ধারণা নেই। ধার ধারে না তারা সেসবের। ইগলুর মতো ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে শত শত। মোটামুটি এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়ানো। কোনো কোনোটা এত ছোট যে বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও অস্বস্তি বোধ করবে। কোনো কোনোটা বড়সড় পরিবার ধরে রাখতে পারবে। উচ্চতা পাঁচ মিটারের বেশি নয়।

সবগুলো এক জিনিস দিয়েই তৈরি। দুই সূর্যের আলোয় সাত দিনে ভূতুড়ে সাদা দেখায় সেগুলোকে। মেরুদেশে এস্কিমোরা জমে যাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য জমাট জিনিসই বেছে নিয়েছিল, ইউরোপানরাও তাদের ইগলুর জন্য একই জিনিসের আশ্রয় নেয়। বরফ।

কোন পথ নেই, রাস্তা নেই। আছে খাল। এখানকার প্রাণিরা এখনো আংশিক উভচর। সম্ভবত ঘুমানোর জন্য পানিতে ফিরে যায়। হয়ত খাবার জন্য, একত্রিত হবার জন্য সেখানেই যেতে হয় তাদের। এর চেয়ে ভাল কোনো হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায়নি।

জিয়াংভিলকে বরফঘেরা ভেনিস নামে ডাকে অনেকে। একটাই অমিল, আশপাশে কোনো ভেনেশিয়ানের চিহ্ন নেই। যেন এ নগরী প্রাণহীন অনেক বছর ধরে।

আরো এক রহস্য ধরা দেয় এখানে লুসিফার দূরের সূর্যের তুলনায় পঞ্চাশগুণ উজ্জ্বল হলেও, আকাশের এক কোণায় সব সময় প্রতাপ নিয়ে টিকে থাকলেও ইউরোপারা দিন আর রাতের চক্রকে অনেক মূল্য দেয়। আংশিক দিন-রাত হওয়ার এলাকায় সূর্যাস্তের সময় নেমে যায় সমুদ্রে, তারপর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফিরে আসে। অথচ আলোর উজ্জ্বলতা মাত্র কয়েক শতাংশ বাড়ে-কমে। পৃথিবীর অনেক প্রাণির মতোই তারা, সেখানেও অনেক প্রাণি চাঁদের উপর নির্ভ করে, তাদের দৈহিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত হয় চাঁদ দ্বারা, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সূর্য সেখানে সামান্য এক নিয়ামক।

এক ঘন্টার মধ্যে সূর্যোদয় হবে। ফিরে আসবে ইউরোপারা। আলসে ভঙ্গিতে দৈনন্দিন কাজে নেমে পড়বে। ইউরোপার সালফার ভিত্তিক জৈবরসায়ন পৃথিবীর বিশাল ক্ষেত্রে জন্ম নেয়া অক্সিজেন ভিত্তিক জীববিজ্ঞানের সাথে মিলবে না। এমনকি ধীর গতির একটা সুথও ইউনোপাদের ভড়কে দিতে পারবে, কারণ তাদের কাছে সেটাও ভয়ঙ্কর। খবরটা ভাল হলেও, খারাপ দিক আছে, যে কোনো যোগাযোগের চেষ্টা কষ্টকর হবে, সন্দেহ নেই।

সময় এসেছে, এবার গ্যানিমিডে রিপোর্ট করা যায়। তারা নিশ্চয়ই অকূল পাথারে পড়েছে- এখন ষড়যন্ত্রের আরেক মন্ত্রণাদাতা ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার কী করে সামলায় তা দেখতে হবে।

ফ্যালকন কলিং গ্যানিমিড। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি- মানে আমাকে টেনে আনা হয়েছে জিয়াংভিলের উপরে। কোনো সহিংসতার চিহ্ন নেই। এখনো এখানে সৌররাত। ইউরোপারা পানির নিচে। মাটিতে নামার সাথে সাথে কল করব।

দিম নিশ্চয়ই পোলকে নিয়ে গর্বিত হবে, কারণ সে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলে থেকেও বরফের উপর আলতো করে নামতে পেরেছে। এখন ফ্যালকনকে রাখতে হবে এভাবে, যেন ওজনের কারণে বরফ ভেঙে পড়ে না যায়, আবার একটু উড্ডীন থাকার কারণে বাতাসে ভেসে না যায়। সে সমস্যাও মিটে গেল।

সে এখন ইউরোপার বুকে। হাজার বছরে প্রথম মানব। আর্মস্ট্রং আর অনি কি এমনি অনুভব করেছিল ঈগল চাঁদের বুকে নামার পর? সম্ভবত তারা তাদের যানের প্রাচীণ ও নির্বোধ অংশগুলো খতিয়ে দেখার কাজে বিডোর ছিল।

এসব কাজের ভার ফ্যালকনের উপর। ইঞ্জিনের প্রায় অক্ষত গুঞ্জন ছাড়া পুরো কেবিন স্তব্ধ। হঠাৎ চ্যান্ডলারের রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর সচকিত করে দেয় তাকে।

‘তাহলে পারলে শেষ পর্যন্ত। কগ্রাচুলেশন্স! তুমিতো জান, আগামি সপ্তাহে আবার উড়ছি। সে পর্যন্ত সময় দেয়া যায়।

‘পাঁচদিন পর, ফ্যালকন জানে কী করতে হবে। সে বাসায় ফিরে আসবে, তোমাকে নিয়ে, অথবা তোমাকে ছাড়াই। গুডলাক।’

মিস প্রিঙ্গল
এ্যাক্টিভেট ক্রিপ্টো প্রোগ্রাম
স্টোর

হ্যালো, দিম- মেসেজের জন্য ধন্যবাদ। এ প্রোগ্রাম ব্যবহার করার জন্য একটু খারাপ লাগছে। আমার জন্মের আগে দারুণ জনপ্রিয় সব স্পাই থ্রিলারের গোপন মিশনে আমি যেন এক গুচর। এখনো আমি কিছু প্রাইভেসি রাখব, ব্যাপারটা খুব দরকার। আশা করি মিস প্রিন্সল ঠিকমত ডাউনলোড করেছে. অবশ্যই, মিস পি, আমি ঠাট্টা করছি।

বাই দ্য ওয়ে, সারা সৌরজগতের নিউজ মিডিয়ার কল্যাণে জেরবার হয়ে যাব একটু পরই। তাদের সবাইকে ডক্টর টেডের কাছে ডাইভার্ট করে দাও, সে বেশ উপভোগ করবে ব্যাপারটা….

গ্যানিমিড ক্যামেরায় সব দেখছে। কী হয় না হয় সেসব বলে আর দম নষ্ট করছি না। নাটকের আসল দৃশ্য অভিনয় হবে আর একটু পরই। ইউরোপারা উঠে আসবে। আমাকে এখানে শান্তিতে বসে থাকতে দেখবে। তারপর দেখা যাবে আমাদের অভিযানটা ভুল ছিল, নাকি সঠিক…

যাই ঘটুক, হাজার বছর আগে আসা ডক্টর চ্যাং আর তার কলিগদের মতো বিমূঢ় হয়ে যাব না মোটেও! গ্যানিমিড ছাড়ার আগ মুহূর্তে তার সেই বিখ্যাত মেসেটা আবার চালিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, তখনি আমার মাথায় বোমা পড়েছিল, ভাবতে বসেছিলাম আবার তেমন কিছু দেখতে হয় কিনা… বেচারা চ্যাং যেভাবে নিজেকে অমর করেছিল সেভাবে আমার অমর হবার কোনো শখ নেই… ।

অবশ্যই, অঘটন ঘটতে নিলে আমি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলব… দারুণ একটা চিন্তা এইমাত্র মাথায় এল… কে জানে, ইউরোপাদের কোনো ইতিহাস আছে কিনা যে কোনো ধরনের রেকর্ড হতে পারে… এখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার নিচে হাজার বছর আগে কী হচ্ছিল তার কোনো স্মৃতি থাকলে ব্যাপারটা দারুণ হয়, তাই না?

২৭. শূন্যতায় জমাট জল

‘…দিস ইজ ডক্টর চ্যাং কলিং ফ্রম ইউরোপা, আশা করি আপনারা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন, বিশেষত ডক্টর ফ্লয়েড- আশা করি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা… জানি আপনি লিওনভে… বেশি সময় নেই হয়ত… আমার স্যুট এন্টেনা দেখে মনে হয়…’

‘…প্লিজ এ তথ্য পৃথিবীতে রিলে করবেন। জিয়াং তিন ঘন্টা আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই জীবিত। আমার স্যুট রেডিও ব্যবহার করছি জানি না এটার যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কি না কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে নুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আমি আবার বলি, ইউরোপার জীবনের অস্তিত্ব আছে…’

‘…স্থানীয় মধ্যরাতের ঠিক পরে। আমরা নিয়মিত পাম্প করছিলাম। প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে ট্যাংকগুলো। ডক্টর লি আর আমি পাইপ ইনসুলেশন চেক করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে- দাঁড়িয়ে ছিল- এ্যান্ড ক্যানেলের সীমানার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপগুলো সরাসরি এখান থেকে নেমে নিচের বরফের মধ্যে ঢোকে। বরফ আবার খুব পাতলা হাঁটার মতো নিরাপদ নয়। পাইপের পানি অবশ্য গরম…’।

..কোন ব্যাপার না- পাঁচ কিলোওয়াট আলো জ্বালিয়ে জাহাজের উপর টানালাম। ক্রিস্টমাস ট্রির মতো সুন্দর চককে আলো ঠিক বরফের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল নিচের পানিতে। চমৎকার রঙ। লি-ই প্রথম দেখে-এক বিশাল কালো পিন্ড গভীর থেকে উঠছে উপরের দিকে। প্রথম প্রথম আমরা মনে করেছিলাম মাছের বিরাট কোনো ঝাক হবে- একক প্রাণিসত্তার হিসেবে খুব বড় তো- তারপর জিনিসটা এগিয়ে এল বরফের ভিতরে দিয়ে জোর করে পথ বানিয়ে নিয়ে।

‘ডক্টর ফয়েড, আশা করি আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি প্রফেসর চ্যাং-আমরা মিট করেছিলাম দু হাজার দু সালে, বোস্টন আই. এ. ইউ. কনফারেলে।

‘…ভেজা সমুদ্রশৈবালের চুলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিল বরফের উপর। লি ক্যামেরা আনার জন্যে জাহাজের পেছনে যায়- আমি লক্ষ্য করছি, একই সাথে রিপোর্ট কহি রেডিওতে। জিনিসটা এত আস্তে আস্তে চলছিল যে আমি দৌড়ে একে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম সহজে। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণি আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড় সামুদ্রিক গুলু বনের ছবি আমার দেখা কি আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল।

‘… প্রাণিটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অস । সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল- ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো। কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মহর মনে হয়।

‘আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…’

‘…জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।’

‘…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও এন্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সৰ কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।

শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।’

‘সম্ভবত প্রাণিটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…’

‘তারপর ভেঙে গেল শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লৰালৰিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দু মিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকি সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।’

‘জানি না কী হল এর পর। আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তূপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূন্স ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ। এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।’

‘চারাগাছটা- আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি। জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।

‘তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাভটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে সেটা আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল। দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো।

‘একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, কোনো বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা- আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।’

তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম আকৃতির কথা। এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়। কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্পি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।

চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর… জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমত দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না- যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।’

‘বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাজ ভাঙার খাজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র শুয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল- ডানায় ভাজ ভাজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ- আমি কমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।’

মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে এগুলো কনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না- জলজপ্রাণির ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটাত্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সগর্তে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।

‘ছোট্ট প্রাণির একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামি রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়ে গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?’

তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো… এ নামেইতো ডেকেছিলাম- এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো সেগুলো আবার আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…’

‘ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।

‘জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। হ্যাঁচকা টান দেয়ার পর লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয় পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।

ধীরে ধীরে প্রাণিটা শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দু উপগ্রহ গ্যানিমিড আর ক্যালিটো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফিরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই জীবটার পিছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ… ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে… এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুইটা অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা প্রাণীটাকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।

আর… ডক্টর… প্লিজ… পরের শিপ আসার সময় তাদের একটু বলে দেখবেন- আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশো পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর… আমার বাসায় আছে ছোট্ট… না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দিবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব- অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।

ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…’

২৮. ছোট্ট সূর্যোদয়

মিস লিঙ্গল

রেকর্ড

সূর্য আসছে উঠে। অবাক ব্যাপার কী দ্রুত এ উঠে আসা ধীর গতির স্বনে। অবশ্যই, এ ছোট দুনিয়ায় সূর্য দ্রুত উঠবে… আপনারা এদিকে তাকিয়ে আছেন বলেই অন্যদিকে আলো দেখতে পান না, নাহলে বোঝা যেত, আলোর তেমন হেরফের নেই।

আশা করি ইউরোপারা টের পায়। ছোই সূর্যোদয়ের পর এগিয়ে আসতে সময় নেয় তারা মোটামুটি মিনিট পাঁচেক। কে জানে আমার উপস্থিতি ধরা পড়ে গেছে কিনা- তারা আসতে ভয় পাচ্ছে কিনা…

না- হয়ত অন্য পথ ধরেছে। আগন্তককে দেখার ইচ্ছা জেগেছে মনে… আশা করি আর কী!

আসছে তারা! আসছে। আপনাদের স্পাইস্যাট দেখছে তো? ফ্যালকনস ক্যামেরা রেকর্ডিং..

কী ধীর তাদের গতি। আমি নিশ্চিত, তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাটা অনেক বিরক্তিকর হবে, আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও….

জিয়াকে মুড়ে দেয়া প্রাণিটার মতোই, আকারে অনেক ছোট,.. ঠিকই, ছোট গাছের কথা মনে পড়ে যায়। আধ ডজন ছোট কান্ড দিয়ে এগিয়ে আসছে। শত শত শাখা। আরো বিভক্ত, আরো বিভক্ত… আরো। আমাদের জেনারেল পারপাস রোবটের মতো বলা চলে…

মানুষের আকৃতি নকল করা যে অকার্যকর তা ভেবে বের করতে আমাদের কত সময় লাগল। কাজের গতি পেতে হলে অনেক অনেক হোট প্রত্যঙ্গ লাগবে। আমরা যখনি কোনো কিছু আবিষ্কার করে গর্বিত হই, তখনি দেখতে পাই প্রকৃতি মাতা আগেই তা করে রেখেছে….

হোটগুলো কী কিউট, তাই না? ঝাঁকড়া ঝোঁপের মতো। কীভাবে প্রজনন করে? বাডিংয়ের মাধ্যমে আগে বুঝিনি, কী সুন্দর তারা। কোরাল রিফের মাছের মতোই বর্ণিল, রঙিন। সম্ভবত একই কারণে… সঙ্গীর খোঁজে, অথবা ক্ষুধার তাড়নায়…

বলেছিলাম নাকি, তারা ঝোঁপের মতো দেখতে? কথাটাকে বদলে নিন, গোলাপের ঝাড়। গায়ে কাঁটার মতো অংশ আছে, কারণও আছে এর পিছনে, আমরা জানি না…

হতাশ হলাম। আমাকে খোঁড়াই পরোয়া করছে তারা। সবাই চলছে নগরীর দিকে, যেন স্পেসক্রাফট দেখে দেখে চোখ বিষিয়ে গেছে, আর দেখে কী হবে… একটু বামে… হয়ত এবার কাজে লাগবে… আশা করি শব্দতরঙ্গ চিনতে পারে বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রাণিই পারে- কে জানে, এ পাতলা বায়ুমন্ডল আমার কণ্ঠকে বেশিদূর নিয়ে যাবে কিনা…

ফ্যালকন- এ্যাটারনাল স্পিকার…

.

হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ আমাকে? নাম আমার ফ্র্যাঙ্ক পোল… উহ.. আমি শাক্তি নিয়ে এসেছি সমগ্র মানবজাতির পক্ষ থেকে…

আমি কি বোকা বনে গেলাম? এর চেয়ে ভাল আর কোনো পথ পাচ্ছি না। যোগাযোগের। রেকর্ডের জন্য ব্যাপারটা ভালই…

কারো কোনো উত্তেজনা নেই। বড়-ছোট সবাই এগিয়ে যাচ্ছে ইগলুর দিকে। সেখানে গিয়ে কী কর্মটা করে কে জানে! সম্ভবত ফলো করতে হবে আমাকে সম্ভবত কোনো ভয় নেই, আমি তাদের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল

হঠাৎ স্মৃতি এল মনের গহিন থেকে। সব দায়িত্ব ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে নেয়ার আগের কথা মনে পড়ে। সব প্রাণি এক দিকে যাচ্ছে- অফিস-বাসা অফিস-বাসা করা ছকবাঁধা জীবনের মানুষের মতো লাগছে তাদের।

সবাই হারিয়ে যাবার আগে আরেকবার চেষ্টা করা যাক…

.

হ্যালো দেয়ার-ফ্র্যাঙ্ক পোল বলছি, পৃথিবী নামের এক সবুজ গ্রহ থেকে এসেছি আমি। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?

আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি, ফ্র্যাঙ্ক। দিস ইজ ডেভ।

২৯. মেশিনে ভূত

প্রথম মুহূর্তে ফ্র্যাঙ্ক পোল বিস্ময়ে থ বনে যায়। তারপরই শিহরণ বয়ে যায় শরীরে। আসলে যোগাযোগের ব্যাপারে মনে কখনো নিশ্চয়তা ছিল না। ইউরোপাদের সাথে, মনোলিথের সাথে বা ডেভ বোম্যানের সাথে যোগাযোগের কোনো আশাই ছিল না। কিছুক্ষণ আগেও আক্ষেপের সাথে চিৎকার করেছিল মহাপ্রাচীরের দিকে তাকিয়ে, বাড়িতে কেউ আছেন?

হ্যাঁ, এত অবাক হবার f, কোনো না কোনো বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই তার গ্যানিমিড থেকে আসার ব্যাপারটা টের পায়। এখানে নামার অনুমতি দেয়। টেড খানের কথা আরো সিরিয়াসভাবে নেয়া উচিৎ ছিল।

‘ডেত, ধীরলয়ে বলে সে, সত্যি তুমি?

আর কে হবে? মনের এক অংশ প্রতিবাদ করে। তবু, প্রশ্নটা একেবারে বোকার মতো করা হয়নি। কণ্ঠে একটু যান্ত্রিকতার সুর, যেন কোনো মানুষের কথা নয়,

অর্পিত ব্যাপার। আসছে ফ্যালকনের ছোট কন্ট্রোল বোর্ভ স্পিকার থেকে।

হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্ক, আমি ডেভ।

একটু নিরবতা। তারপর একই কষ্ঠ কথা বলে ওঠে।

হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক। আমি হাল।

* * *

মিস প্রিঙ্গল

রেকর্ড

আসলে- ইন্দ্রা, দিম- আমার ভাল লাগছে, সব রেকর্ড করেছিলাম, নাহলে কখনোই আমার কথা বিশ্বাস করতে না…

মনে হয় এখনো ধাতে সয়নি ব্যাপারটা। হাজার হলেও, আমি কী করে এমন কাউকে বন্ধু ভেবে নিই যে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল প্রায় সফলভাবে, হোক হাজার বছর আগে…এখন বুঝতে পারি, হালকে দোষ দেয়া যায় না। দোষ দেয়া যায় না কাউকে। ভাল ধরনের এক উপদেশ আমি সব সময় মনে রাখি, ‘অসম্পূর্ণতাকে কখনো দোষ দিওনা।

আমি কী করে অজানা অচেনা প্রোগ্রামারদের দোষ দিই?

ঠিক ধাতস্থ হতে পারিনি। কিছুক্ষণের জন্য ডেকে চলে যেতে বলেছিলাম, তার সাথে দেখা করার জন্য এত অন্যায়, ষড়যন্ত্র আর কষ্ট করার পরও। মনে হয় না আঘাত দিয়েছি, ভিন্ন কিছুতে পরিণত হবার পর তার ভিতরে ফিলিংস বলে কিছু আছে, তা হতে পারে না…

সে কী- ভাল প্রশ্ন। সে আসলেই ডেভ বোম্যান- কি অনেকটা বইয়ের সারাংশের মতো। তুমি জান একটা এ্যাবস্ট্রাক্ট কী করে সব তথ্য বহন করতে পারে কিন্তু লেখকের মনোভাবের বিন্দুমাত্র চিহ্ন বহন করে না। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়েছে। পুরনো ডেভের ছিটাফোঁটা মনে হয় আছে তার ভিতরে। আমার সাথে দেখা হওয়ায় তার ভাল লেগেছে কিনা তা বলতে পারব না, একেই বলে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। একটু সন্তুষ্ট… এটুকু বোঝা যায়। আর আমার কথা বলতে গেলে? আমি এখনো কনফিউজড। একবার ভেবে দেখ, অনেকদিন পর দেখা হল পুরনো বন্ধুর সাথে, তারপর উপলব্ধি করলে, সে আর সেই মানুষটা নেই। বদলে গেছে। আমাদের সময় পার্থক্যওতো হিসাবে ধরতে হবে- হাজার বছর। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামান্য সামান্য অংশ নিয়ে কথা বলেছে। আমার মাথা গুলিয়ে গেছে আরো।

আর হাল- সেও এখানে ছিল, সন্দেহের প্রশ্ন ঠে না। বেশিরভাগ সময় আমি ধরতে পারিনি কে কথা বলছে। কোনো কোনো মেডিক্যাল রেকর্ডে মাল্টিপল পার্সোনালিটির কথা থাকে না? ব্যাপারটা তেমন।

প্রশ্ন করেছিলাম কী করে এমন হল- আর সে- তারা- ড্যামইট। হালম্যান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আগেই বলে রাখি, ভুল হতে পারে, কিন্তু এ হাইপোথিসিসে এসে পৌঁছেছি।

অবশ্যই- এ মনোলিথগুলোই চাবি। না ভুল বললাম, শুধু চাবি না। তাদের কাজ আরো ব্যাপক। কে যেন বলেছিল, এরা কসমিক সুইস আর্মি নাইফ? সকল কাজের কাজি? তোমরা এখনো এগুলো ব্যবহার কর, আমি দেখেছি, যদিও সুইজারল্যান্ড আর তার সেনাবাহিনী অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এ হল জেনারেল পারপাস ডিভাইস। যা দরকার তার সবই করতে পারে। অথবা যা করার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে তার সবই…।

আফ্রিকায় ফিরে যাও, মোটামুটি চল্লিশ লাখ বছর আগে, এটাই আমাদের কোমরে বিবর্তনের সাথি কষিয়েছিল, তা কাজটা ভাল হয়ে থাক আর খারাপ… তারপর আমরা দোলনা থেকে বেরিয়ে আসব, এসে চাঁদে তার সঙ্গীকে খুঁড়ে বের করব, সে আসায় ঘাপটি মেরে বসে ছিল। আন্দাজ করেছি আগেই, পরে ডেভ স্বীকার করল আর কী!

বলেছি না, মানবিক অনুভূতিগুলো তেমন আর নেই, তোতা হয়ে গেছে একটা ব্যাপার কিন্তু এখনো নষ্ট হয়নি, বরং বেড়েছে- সে শিখতে চায়। অনেক শিখতে চায়। শিক্ষার কী বিচিত্র সুযোগ এখন তার হাতে।

বৃহস্পতির মনোলিথ তাকে শুষে নেয়ার পর ভাল কোনো শব্দ পেলাম না, শুষে নেয়াই থাক অনেক কিছু পেয়ে গেল। এটা তাকে ব্যবহার করেছিল দখল করা জিনিসের মতো–পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করার উপায় হিসাবে। সেও এটা ব্যবহার করছে। হালের সহায়তা নিচ্ছে। হাল ছাড়া সুপার কম্পিউটারের ধারা আর কে ভালভাবে বুঝবে? দুজনে মিলে মনোলিথের সমস্ত স্মৃতি চষে ফেলছে, উদ্দেশ্য খুঁজে বের করবে। বের করবে লক্ষ্য।

এখন, একটা ব্যাপার বিশ্বাস করা কষ্টকর। মনোলিথ অসম্ভব শক্তিমান যন্ত্র বৃহস্পতির কী হাল করেছে একবার ভেবে দেখ!- কিন্তু এই সব। চলছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কোনো চেতনা নেই। নেই কোনো জৈব অস্তিত্ব আমরা যাকে মন বলি আর কী- তা নেই। আমি যে গ্রেট ওয়ালকে কষে লাথি দেয়ার চিন্তা রেখে বলতে চাই, কেউ আছে এখানে।

আসল জবাব হল, কেউ ছিল না। হাল আর ডেভ ছাড়া কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে…

আরো খারাপ খবর হল, এর কিছু কিছু সিস্টেম বিগড়ে যাওয়া শুরু করেছিল; ডেভ সিদ্ধান্তে পৌঁছে, জিনিসটা অকাটমূর্থে পরিণত হচ্ছে। কারণ, চার মিলিয়ন বছর মুখের কথা নয়, এখন একবার সার্ভিস চেক করা উচিৎ।

তার সিদ্ধান্ড, মনোলিথ একবার হলেও ভুল কাজ করেছে। শব্দটী জুতসই নয়, হয়ত তার বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তে সামান্য হেরফের হয়ে গেছে…

যে হিসাবেই দেখ না কেন, খবরটা ভীতিকর। হাজার বছর আগের কথায় আবার ফিরে যাই। লিওনভ উড়ে গেল বৃহস্পতির এলাকায়। এত সময়ের মধ্যে কেউ ধারণাও করেনি…

আমাকে ব্রেইনক্যাপের সাথে যুক্ত করে দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যই, জিনিসটা অমূল্য, এ ছাড়া জীবনের কথা এখন ভাবা যায় না। কিন্তু এখন, এটা এমন এক কাজ করছে যা করার কথা ছিল না, যা করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। কিন্তু কাজটা করছে ভালভাবেই।

হালম্যানের দশ মিনিট সময় লেগে গেল এর কাজের ধারা বের করে একটা ইন্টারফেস যোগ করতে। এখন আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে মন থেকে মনে। এখন কাজের গতি বেড়ে গেল, বেড়ে গেল বোঝার গতি। সেই সাথে বেড়ে গেল তাদের কথার গতি। বারবার থামিয়ে থামিয়ে আমি মনে করিয়ে দিলাম, আরো ধীরে কথা বলতে হবে…

এখানেই আসল ব্যাপার। আমার মনের মধ্যে ডেভ ঢুকিয়ে দিল মনোলিথের সেই স্মৃতি যখন সে ডেভকে গ্রাস করছে। মনোলিথের সমস্ত চিন্তা-চেতনা কর্মপদ্ধতি চলে এল। আবার জিজ্ঞেস করোনা কী করে করল তারা কাজটা! পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার ব্রেইনক্যাপে, পাঠিয়ে দিয়েছি গ্যানিমিডে। এবার তোমরা সেসব নিয়ে ভেবে মরা ডাউনলোড করতে গিয়ে আবার বিষম খেয়োনা।

ওভার টু ডেভ বোম্যান এট জুপিটার, আর্লি টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি…

৩০. তাসের ঘর

লাখ কিলোমিটার লম্বা চৌম্বক শক্তির রেখা, বেতার তরঙ্গের আচমকা বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া ইলেক্টিফাইড প্লাজমার ঝর্ণা- এসবই তার কাছে এত স্পষ্ট যতটা স্পষ্ট দেখা যায় নানা রঙে বর্ণিল মেঘে ঢাকা গ্রহের আকাশ। জটিল গড়নগুলো বুঝতে পারে সে, বুঝতে পারে এদের মধ্যকার সম্পর্ক। কেউ কখনো ভাবেনি এতটা সুন্দর আর বিচিত্র হতে পারে বৃহস্পতি।

গ্রেট রেড স্পটের গর্জন করতে থাকা হৃদয়ের ভিতরে চলে যায়। চারপাশে পাক খাচ্ছে মহা লাল বিন্দু সৌরজগতের বৃহত্তম ঝড়, যার ভিতরে তিনটা পৃথিবী রেখে দেয়া যায়। ভিতরে মহাদেশের মতো বিশাল বিশাল সব আলোর ঝলক খেলে যাচ্ছে। জানে, কেন এটা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে তান্ডব চালাচ্ছে, কেন পৃথিবীর হ্যারিকেনগুলোর মতো থিতিয়ে পড়ে না। হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার হারিয়ে যায় সে আরো নিচে নামার সাথে সাথে। সেখানে হাইড্রোকার্বনের মোমের মতো, ফাপা বিশাল বিশাল সব পর্বত। উপর থেকে ভারি জৈবযৌগ নেমে আসে। থিতু হয় এসব পর্বতমালার গায়ে। তরল পানি থাকার মতো উত্তাপ আছে, কিন্তু সমুদ্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরো গ্যাসিয় জগন্টায় পানির জন্য নেই কোনো স্থান।

একের পর এক মেঘস্তর পেরিয়ে যাচ্ছে সে। নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। এরপর এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার চষে ফেলতে পারবে। এটাই গ্রেট রেড স্পটের গভীরতম বিন্দু। মানুষ ধারণা করেছে, কিন্তু জানতে পারেনি কী আছে এখানে।

পাহাড়ের পাদদেশে চড়ে বেড়ায় মোটামুটি এক আকৃতির, ছোটখাট মেঘখন্ড। লাল আর ধূসর রঙ তাদের। বৃহস্পতিয় হিসাবে একেবারে ছোটছোট। এক একটা ছোট নগরীর আকারের।

তারা জীবন্ত। দেখেই বোঝা যায়। এগিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছন্দ্যে সামনে যাচ্ছে ধীরলয়ে। বৃহস্পতির ভাঙ্গাগড়ার আওয়াজ ছাপিয়ে মিটার ব্যান্ডে পরস্পরের ডাকাডাকি টের পাওয়া যায়।

জীবন্ত গ্যাসব্যাগ। এরা উড়ার মতো উচ্চতায় থাকতে পারে, সীমার বাইরে না আবার নামতে পারে কিছুটা নিচে, বেশি নামলে ওজনের চাপে প্রাণ হারাবে। কিন্তু এ সামান্য এলাকাই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের চেয়ে বড়।

শুধু তারাই নেই এখানে। তাদেরই মাঝে চড়ে বেড়াচ্ছে দ্রুতগামী আরেক ধরনের জীব। আকারে অনেক ছোট। পৃথিবীর বিমানের মতো হবে। তারাও জীবন্ত। সম্ভবত শিকারী, হয়ত পরজীবী, হয়ত নিয়ম্ভা- কে জানে।

ইউরোপার বিস্ময় যেমন নতুন, তেমনি বিবর্তনের একেবারে নতুন এক অধ্যায় খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। পার্থিব সমুদ্রের স্কুইডের মতো জেট প্রোপেন্ড টর্পেডো আছে, ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে বিশাল বিশাল গ্যাসব্যাগগুলোকে। কিন্তু বেলুনগুলোও অসহায় নয়, তাদের কারো কারো আছে ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার ক্ষমতা, কিলোমিটার লম্বা চেইনস’র অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে।

জ্যামিতির প্রতিটা সম্ভাবনা অনুসারে আছে আরো বিচিত্র সব আকৃতি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ গড়ন, ঘুড়ি, চতুর্ভুজ, ছ-তলকীয়, বহুতলকীয়, ভজ খাওয়া ফিতা… বৃহস্পতিয় বায়ুমন্ডলের দানবীয় প্যাটনগুলো উপরে উঠতে থাকা বিদ্যুতের প্রবাহের সাথে উঠে যায়। সেখানেই প্রজন্মান্তর ঘটে, তারপর নেমে আসে কখনো কখনন, মৃত্যুর সময় হলে। বিভাজিত হয়ে যায়, মিশে যায় প্রকৃতির সাথে, তারপর আবার কাজে লাগে প্রাণ সৃষ্টিতে।

পৃথিবীর এলাকার চেয়ে শতগুণ বিস্তৃত এক জগত দেখছিল সে। অনেক বিস্ময় থাকলেও বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক নেই কোথাও। বিশালবপু গ্যাসবেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস ভয় আর সতর্কতা বহন করে, এর চেয়ে বেশি কিছু না। এমনকি শিকারিগুলোর আরো উন্নত হবার কথা থাকলেও আদতে তারা পৃথিবীর হাঙরগুলোর মতোই। মাথাহীন শিকারী।

শ্বাসরুদ্ধকর বিশালতা থাকলেও বৃহস্পতিয় জগতের সবকিছুই একেবারে ভজুর। কুয়াশা আর ফোমের আধিপত্য এখানে। সিল্কের মতো জৈববস্তু, কাগজের মতো পাতলা টিস্যু পাওয়া যাবে এখানে অনেকটাই তৈরি হয় উপরের বজ্রের কারণে। বেশিরভাগই সাবানের ফেনার মতো। পার্থিব মাংসাশির এক থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মুহূর্তে।

ইউরোপার মতো এটাও একই সাথে জন্মভূমি আবার কবরখানা। কখনো সভ্যতার উন্মেষ দেখা যাবে না। একেবারে খাঁটি বায়বীয় সংস্কৃতি জন্ম নিতে পারে, কিন্তু যেখানে আগুন জ্বলে ওঠা অসম্ভব, যেখানে কঠিন বস্তু থাকবে না, সেখানে সভ্যতা দূরের কথা, প্রস্তর যুগও আসবে না কখনো।

৩১. নার্সারি

মিস প্রিঙ্গল

রেকর্ড

আসলে, ইন্দ্রা- দিম- আমি জানি না এখনো কী ভাবতে হবে। বিশ্বাস করা এখনো কষ্টকর। কী বিচিত্র প্রাণি ছিল সেগুলো। আমরা তাদের দেখা পেতাম কোনো

কোনো কালে। অন্তত রেডিও ভয়েস ধরতে পারতাম একবিংশ শতাব্দিতেই বুঝতে পারি আর না পারি। বৃহস্পতিকে একটা সূর্যে পরিণত করার জন্য সব ঝেড়েমুছে সাফ করে দেয়া হল।

এখন আমরা জানি, কেন। ইউরোপাদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কী বিচিত্র যুক্তি বুদ্ধিমত্তাই কি একমাত্র আরাধ্য? আমি দেখতেই পাচ্ছি, টেড খানের সাথে অনেক যুক্তিতর্ক হবে এসব নিয়ে

পরের প্রশ্ন হল, ইউরোপারা কি জাতে উঠতে পারবে? নাকি বাকি সময়টা কাটিয়ে দিবে কিন্ডারগার্টেনে- বলা ভাল নার্সারিতে হাজার বছর খুব বেশি সময় না হলেও মানুষ কিছু না কিছু উন্নয়ন আশা করতেই পারে। কিন্তু ডেভের কথা অনুসারে এখনো তারা সমুদ্র ছাড়ার সময়ের পর্যায়েই পড়ে আছে। সম্ভবত এটাই সমস্যা, এখনো সমুদ্রে একটা পা- থুড়ি, একটা গুঁড়ি দিয়ে বসে আছে।

আরো একটা ব্যাপারে খটকা লাগে। আমরা মনে করেছিলাম তারা সমুদ্রে যায় ঘুমানোর জন্য। উল্টো ব্যাপার। সেখানে যায় খাবার জন্য। ভূমি শুধু ঘুমানোর জায়গা। সেই খালের নেটওয়ার্কগুলো আর কিছুই না, প্ল্যাঙ্কটন ফিডার…

ডেভকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে ইগলুগুলো যে বানাল সেগুলো কি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না?

জবাব এল, ঠিক তা না। সাগরের বুকে যে গড়ন গড়ে সেটারই অনুকরণ। নানা শিকারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় মাত্র। বিশেষত উড়ন্ত কার্পেটের মতো একটা প্রাণি আছে, আকারে ফুটবল মাঠের সমান, সেগুলো খুব সমস্যা করে…

মাত্র একটা ক্ষেত্রে তারা কাজের কাজ দেখিয়েছে, আমরা সেগুলোকে সৃষ্টিশীলতাও বলতে পারি। তারা ধাতব বস্তুর প্রতি আগ্রহী। কারণ হয়ত এই যে এগুলো সাগরের বুকে চোখেও দেখে না। এজন্যই জিয়াং কালে পরিণত হয়েছে। একই হাল হয় মনুষ্যবিহীন যানগুলোর।

যোগাড় করা তামা, টাইটানিয়াম, বেরিলিয়াম দিয়ে কী করে? কাজের কাজ কিছুই না। সবটুকু তূপ করে রাখে এক জায়গায়। চমৎকার এক গোল আকৃতি বানায়, সেটার গড়ন বারবার বদলাতে থাকে। সম্ভবত শিল্পসম্মত সৌন্দর্যজ্ঞান বিকশিত হচ্ছে তাদের ভিতরে। মডার্ন আর্টের মিউজিয়ামে এমন দেখেছিলাম আমি… আরো একটা তত্ত্ব মাথায় উঁকি দেয়। কার্গো কান্টের কথা কখনো শুনেছ? বিংশ শতাব্দিতে কিছু কিছু আদিম গোত্র নিজেদের নিজস্বতা বজায় রেখে টিকে ছিল। তারা বাঁশ দিয়ে বিমানের আকৃতি তৈরি করত। একটাই আশা, আকাশ থেকে যে বিচিত্র গর্জনশীল পাখি তাদের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে উপহার পাঠায় সেগুলোকে আকৃষ্ট করা যাবে। সম্ভবত ইউরোপাদের মধ্যে এ ধারণাই দানা বাঁধছে।

এখন, যে প্রশ্ন করছ তোমরা সর্বক্ষণ… ডেভ কী? আর কী করে সে এবং হাল এমন হল?

আমার সহজ উত্তর, তারা দুজনেই মনোলিথের দানবীয় স্মৃতিতে ডেভ বোম্যান আর হালের সিমুলেশন। বেশিরভাগ সময়ই তারা অকার্যকর থাকে। তার ভাষায়, ঘুমিয়ে থাকে। রূপান্তরিত হবার পর থেকে হাজার বছরের মধ্যে মাত্র বছর পঞ্চাশেক জেগে ছিল।

যখন আমি জিজ্ঞেস করি, এ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয় কিনা। জবাব দেয়, ‘কেন বীতশ্রদ্ধ হব? আমি আমার কাজ একেবারে ঠিকমত করছি। জবাবটা হালকে মানায়, ডেভ বোম্যানকে নয়, তাই না?

সুইস আর্মি নাইফের সাথে তুলনার কথা মনে আছে তোমাদের? এ মহাজাগতিক ছুরির অসংখ্য অংশের একাংশ এই হালম্যান।

কিন্তু সে একেবারে অকেজো যন্ত্র নয়- জেগে থাকলে, কিছু কিছু নিজস্বতা দেখা দেয়, দেখা যায় স্বাধীনতা- সম্ভবত মনোলিথের নিয়ন্ত্রণের রাশ একটু হাল্কা হয়। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সে বৃহস্পতি-বিশ্লেষণের যন্ত্রাংশ হিসাবে কাজ করছে। নজর রাখছে গ্যানিমিডের উপর, সর্বোপরি পৃথিবীর উপর। ডেভের পুরনো গার্লফ্রেন্ড, তার মা আর নানাজনের রিপোর্টের ভিত্তি এটাই। আনুবিসেও সেই ঘটনা ঘটিয়েছে।

আরো একটা রহস্যের সুরাহা হয়ে যায় কিন্তু। আমি ডেভকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম, বাকি সবাইকে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সরিয়ে রাখা হলেও আমাকে ইউরোপায় নামতে দেয়া হল কেন? আমি কিন্তু এটাই আশা করছিলাম।

জবাবটা বোকাটে, একেবারে সরল। মনোলিথ ব্যবহার করেছে ডেভকে হালম্যানকে সময়ে সময়ে। ব্যবহার করেছে আমাদের উপর চোখ রাখার জন্য। আমার উদ্ধারের ব্যাপারটা জানত ডেভ- এমনকি পৃথিবী আর গ্যানিমিড়ে দেয়া আমার মিডিয়া ইন্টারভিউর কিছু কিছু দেখেছে। সত্যি বলছি, আমি এখনো একটু আহত, সে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করেনি! যাক, আমি আসার পর লালগালিচা তো বিছিয়ে দিয়েছে…

দিম- ফ্যালকন আমাকে নিয়ে বা ছেড়ে উড়ে যাবার আগে আমার হাতে আরো আটচল্লিশ ঘন্টা আছে। আমার মনে হয় না সে সময়ের প্রয়োজন আছে, আমি হালম্যানের সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছি; আমরা যে কোনো জায়গায় দেখা করতে পারি। যোগাযোগ করতে পারি আনুবিসে বসেও… সে যদি চায়।

যত দ্রুত সম্ভব গ্যানিমিডে ফিরে যেতে চাই। ফ্যালকন ভাল যান, কিন্তু ভিতরে এর মধ্যেই একটু একটু গন্ধ আসছে, আমার শরীরও চুলকাচ্ছে একটা শাওয়ার নেয়ার জন্য।

আশা করি দেখা হবে তোমাদের সাথে, অচিরেই- বিশেষত টেড খানের সাথে। পৃথিবীতে ফিরে যাবার আগে অনেক কথা বলতে হবে আমাদের।

স্টোর

ট্রান্সমিট

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *