খ. গোলিয়াথ

খ. গোলিয়াথ

১৪. বিদায়, পৃথিবী

যাই আপনি চান না কেন, কারণ থাকলে চলবে শুনেছিল সে কিছুদিন আগে। এখনো নিশ্চিত নয়, বৃহস্পতির এলাকায় ফিরে যেতে চাওয়ার পিছনে খুব শক্ত কোনো কারণ দাঁড় করাতে পারবে। অন্যান্য চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভিতরে।

পোল এর মধ্যেই আগামী বেশ কয়েক সপ্তাহের কাজ আর এ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছে। বেশিরভাগ মিস হয়ে গেলে হাপ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু বাকি কয়েকটা কাজ বাদ পড়ে গেলে আসলে কষ্ট হবে।

ইন্দ্রা আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ভেটো না দিয়ে বরং উৎসাহিত হয়ে উঠলে বেশ অবাক হল সে। বোঝা যায়, তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা, পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারলে ওষুধের কাজ দিবে ব্যাপারটা।

সর্বোপরি ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার তো আহ্লাদে আটখানা। আপনি আমার কেবিন জুড়ে বসতে পারেন, আমি ফাস্ট মেটকে তারটা থেকে লাথি মেরে বের করে দিব।

সিদ্ধান্তটা একবার নিয়ে নেয়ার পর ঘটনার গতি বেড়ে গেল। খুব সামান্য জিনিসপত্র ছিল, নেয়ার দরকার আরো কম। তার ইস্ট্রেনিক অটার ইগো ও সেক্রেটারি মিস প্রিঙ্গল সবচে গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কয়েক টেরাবাইট তথ্য।

তার যুগের হ্যান্ডহোল্ড এ্যাসিস্ট্যান্টের চেয়ে খুব একটা বড় নয় মিস প্রিঙ্গল। আগের দিনের কোল্ট ফোর্টিফাইভের মতোই, কোমর থেকে যখন খুশি ড্র করা যায়। মেয়েটা তার সাথে যোগাযোগ করে অডিও বা ব্রেইনক্যাপের মাধ্যমে। মূল কাজ ইনফরমেশন ফিল্টার হিসাবে থাকা, বাইরের পৃথিবী থেকে পোলকে সরিয়ে রাখা। দক্ষ সেক্রেটারির মতো সব সময় সাবধানে কাজ করে সে। কখনো বলে, পরে যোগাযোগের কথাটা জানাব’ অথবা, দুঃখিত, মিস্টার পোল এখন ব্যস্ত আছেন, কোনো মেসেজ থাকলে জানিয়ে দিতে পারেন।

মাত্র কয়েকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। রিয়েলটাইম যোগাযোগ সম্ভব হলেও কথাবার্তা চালাবে দুজন প্রকৃত বন্ধুর সাথে জো আর ইন্দ্রা।

পোল অবাক হয়ে দেখে আসলেই সে গৃহপরিচারককে মিস করবে- প্রতিদিনের নানা টুকিটাকি কাজ ভালই সামলে নিতে পারত দানিল- এখন এসব করতে হবে নিজে নিজে। আলাদা হয়ে যাবার সময় ভদ্রভাবে বো করল দানিল, কোনো বাড়তি আবেগ দেখাল না মধ্য আফ্রিকার ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার উপরে, পৃথিবী ঘিরে রাখা চাকাটার কাছে।

.

‘ঠিক জানি না আমার তুলনাটা বেখাপ্পা মনে হবে কিনা, দিম, তুমি কি জান গোলিয়াথ শব্দটা কোন স্মৃতি জাগিয়ে তোলে মনে?

এখনো এতটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়নি যে পোল ক্যাপ্টেনের ডাকনাম ব্যবহার করবে, কিন্তু আশপাশে কেউ না থাকলে চলে।

‘খুব খুশি হবার মতো কিছু নয় নিশ্চয়ই।

‘ঠিক তা না। ছেলেবেলার কথা, আমার চাচার কাছে একগাদা সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা ছিল। তখনকার দিনে ‘পাল্প বলা হত সেগুলোকে, সস্তা যে কাগজে ছাপা হত সেই নামে নাম। আর কী বিচিত্র যে তার কভার! আজব আজব গ্রহ-নক্ষত্র, বুক কাঁপানো জও-জানোয়ার আর ছিল স্পেসশিপ।

‘আস্তে আস্তে বড় হলাম। বুঝতে শিখলাম স্পেসশিপগুলো একেবারে বিদঘুঁটে। সাধারণত রকেট চালিত ছিল স্পেসশিপ, কি প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কের নাম গন্ধও নেই। কোন কোনটায় আগাগোড়া জানালার সারি, সাগরের বড় বড় জাহাজের মতো। একটা বেশ ভাল লাগত আমার। বিশাল কাঁচের গম্বুজ ছিল ওটায়। মহাকাশে পাড়ি দেয়া কনজার্ভেটরি…।

কিন্তু শেষ হাসিটা মনে হয় সেই বিদঘুঁটে আর অযৌক্তিক চিত্রগুলোর আঁকিয়েরাই হাসল। এখন সত্যি সত্যি গোলিয়াথে কোনো প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক নেই, নেই সীমিত গতি। শুধু এগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমিই স্বপ্ন দেখছি।

হাসল চ্যাভলার, বাইরে আঙুল নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করল, এটাকে কি স্বপ্ন বলে মনে হয়?

স্টার সিটিতে আসার পর এই প্রথমবারের মতো পোল তাকায় সত্যিকার উপরে, যতটা আশা করেছিল তত দূরে নয়। হাজার হলেও, সে এমন এক চক্রের বাইরের রিমে বসে আছে যার ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে সাতগুণ বড়। এ কৃত্রিম স্বচ্ছ ছাদের উপরে দৃষ্টি চলে যাবে অন্তত কয়েকশ কিলোমিটার দূরে…

মনে মনে অঙ্ক কষে ফেলার কাজে তার সময়েই জিনিয়াস ছিল পোল, এখনকার দিনে তো এমন পাওয়া যাবে না। উপরের দূরত্ব মেপে নেয়ার সূত্র খুব সরল।

হিসাব করে ফেলল পোল, পঁচিশ কিলোমিটার… হম! পঁচিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা স্পেসপোর্টের

বুকেও ভাবা প্রায় অসম্ভব। এখানে, ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার দূরের জিওস্টেশনারি অর্বিটে ওজন টের পাওয়া যায়। বাইরে ভেসে ভেসে কাজ করছে বেশ কয়েকটা রোবট আর স্পেসস্যট পর মানুষ। কিন্তু ভিতরে, গোলিয়াথে মঙ্গলের মাপে ওজন।

মন বদলে নিতে চাও না তো, ফ্র্যাঙ্ক ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার, এখনো পাক্কা দশটা মিনিট বাকি আছে।

বদলে ফেললে আর জনপ্রিয়তা থাকবে না, কী বল? আগের দিনে কী বলত জান? প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি। প্রস্তুত থাকি আর না থাকি, আসছি চলে।

সব মিলিয়ে মাত্র সাতজন ক্রু। কুরা বেশ শ্রদ্ধা করে তাকে। হাজার বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে সে পৃথিবী ছেড়ে। এবারো লক্ষ্য অজানা।

বৃহস্পতি- লুসিফার সূর্যের অন্য প্রান্তে, গোলিয়াথ যাবার সময় শুক্রের খুব কাছ দিয়ে যাবে।

কয়েক হাজার কিলোমিটার উপর থেকে স্টারসিটিকে পৃথিবীর বিষুবরেখার উপর দানবীয় ধাতব ব্যান্ডের মতো দেখায়। গ্যান্ট্রি, প্রেসার ডোম, আধা তৈরি হওয়া বিশাল বিশাল সব মহাকাশতী দেখায় বিন্দুর মতো। দ্রুত সরে যাচ্ছে দৃশ্য। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে তারা সূর্যের কাছাকাছি এলাকায়। পৃথিবী ঘিরে থাকা এ বলয় এখনো সম্পূর্ণ নয়, শুধু ধাতব কঙ্কাল আছে বিশাল এলাকা জুড়ে। কখনো কি সেগুলো পুরোপুরি শেষ করা যাবে।

আমেরিকান আর এশিয়ান টাওয়ার দেখা যায়। দেখা যায় প্রকৃতির নীলাভ বর্ণ। বিন মহাকাশ থেকে সূর্যের দিকে ধেয়ে আসা যে কোনো ধূমকেতুর চেয়ে বেশি গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতি পল-অনুপলে গতিবৃদ্ধি করা গোলিয়াথ। এখনো দৃষ্টিসীমা জুড়ে আছে পৃথিবী। নীল পৃথিবী। দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা টাওয়ারের পুরোটা। এটাই দ্বিতীয় জীবনে তার বসতবাড়ি। কে জানে, বাকি জীবনটাও হয়ত এখানেই কাটিয়ে দিতে হবে।

পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দুরে যাবার পর স্টারসিটির পুরোটা চোখে পড়ে। যেন পৃথিবী ঘিরে থাকা ক্ষীণ নতুন চাঁদ। শেষ প্রান্তগুলো তারার রাজ্যে হারানো যেন, এক চিলতে, চুলের রেখার মতো, রূপালি। ভাবতে বিবশ লাগে, মানবজাতি স্বর্গের দেশে কৃত্রিম সর্গ তৈরি করে ফেলেছে।

শনির বলয়ের কথা মনে পড়ে যায় পোলের, আরো বেশি পরিপূর্ণ, আরো মহিমাময়। এ্যাস্ট্রোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে প্রকৃতির অর্জনের সাথে পাল্প দিতে হলে।

প্রকৃতি, নাকি… শব্দটা যেন কী? ডিউস।

১৫. শুক্রের পথে

‘পরদিন সকাল। শুক্রের সাম্রাজ্যে চলে এসেছে তারা। মেঘে ঢাকা চিকণ চাঁদের মতো গ্রহটাই শুধু আগ্রহের বস্তু নয়, গোলিয়াথ ভেসে আছে এক বিশাল সিলভার ফয়েলে মোড়া আকৃতির উপর। উড়ে যাচ্ছে গোলিয়াথ এবড়োথেবড়ো গড়নটার উপর দিয়ে, প্রতি মুহূর্তে সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে।

পোলের মনে পড়ে যায় যে তার সময়েই এমন এক শিল্পী ছিল, পুরো বিল্ডিংকে প্লাস্টিক শিট দিয়ে মুড়ে দেয়া ছিল তার শখ। একটা ঝকমকে খামের ভিতরে ভরে রাখা মিলিয়ন মিলিয়ন টন বরফ দেখে তার কীরকম অনুভূতি হত। শুধু এ পদ্ধতিতেই সূর্যের পথে বছরের পর বছর ধরে আসতে থাকা ধূমকেতুর শরীরটাকে রক্ষা করা যায়। রক্ষা করা যায় বাষ্প হয়ে যাবার হাত থেকে।

‘তোমার কপাল ভাল, ফ্র্যাঙ্ক, এমন দৃশ্য আমিও কখনো দেখিনি। এক ঘন্টার মধ্যে ইম্প্যাক্ট হবে। আমরা একে মৃদু একটা ধাক্কা দিতে যাচ্ছি যেন সময় মতো নেমে যায়। কাউকে আহত করতে চাই না।’

অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকায় পোল।

ইউ মিন শুক্রের বুকে এমন প্রলয়ঙ্করী মহুর্তেও মানুষ আছে?

‘জনা পঞ্চাশেক আধ পাগলা বিজ্ঞানী। দক্ষিণ মেরুর কাছে। অবশ্যই, খুঁড়ে কেটে ভিতরে ঢোকানো হয়েছে তাদের, কিন্তু আমরা তাদের একটু কাঁপিয়ে দিব, যদিও গ্রাউন্ড জিরো গ্রহের অন্য প্রান্তে। হয়ত বলা ভাল ‘এ্যাটমোস্ফিয়ার জিরো’। কারণ মাটির নিচে শকওয়েভ ছাড়া আর কিছু যেতে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে।

মহাজাগতিক হিমবাহ শুক্রের এলাকায় চলে আসার ব্যাপারটা দেখার পর পোলের মনে অন্য এক চিন্তা ঘুরপাক খায়। ছেলেবেলায় ক্রিসমাস ট্রিতে রঙ বেরঙের বাতি আর ঝকঝকে রূপালি জিনিস সাজিয়ে দেয়া হত। তারপর চলত উপহার দেয়া-নেয়ার পালা। এমনি একটা মোড়কে সাজানো উপহার নিয়ে আসছে গোলিয়াথ। পৃথিবীতে পানির কোনো মূল্য নাও থাকতে পারে, এমন ভুবনে, সূর্যের কাছের গ্রহ শুক্রে ফয়েলে মোড়ানো বরফের দাম খুব বেশি।

অত্যাচারিত শুক্রের চিত্র ফুটে ওঠে রাডারে। তারে ঘের জ্বালামুখ, প্যানকেক ডোম, সরু গিরিখাদ, এবড়োথেবড়ো ভূমি। এসবের চেয়ে নিজের চোখকেই বেশি প্রাধান্য দেয় পোল। বিধি বাম, নিচের কোনো দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে না মেঘের সাগর ভেদ করে। ধূমকেতু গ্ৰহটার বুকে নেমে আসার সাথে সাথে কী হবে তা দেখার খুব শখ ছিল তার। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের মধ্যে নেপচুনের এলাকা থেকে চুরি করে আনা বরফের তালটা সমস্ত শক্তি নিংড়ে দিয়ে প্রলয়কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে…

মুহূর্তের ফ্ল্যাশটা আরো ঘটনাবহুল। বরফের মিসাইল কী করে হাজার হাজার ডিগ্রি বাড়িয়ে দেয় তাপমাত্রা, ভাবাও কষ্টকর। ভয়ানক সব তরঙ্গদৈর্ঘ শুষে নিবে ভিউপোর্টের ফিল্টার, এটাই স্বাভাবিক, তবু নীল আলোর ঝলক দাবি করে যে তাপমাত্রাটা সূর্যের কাছাকাছি।

শান্ত হয়ে যাচ্ছে ছড়ানোর সাথে সাথে হলুদ, কমলা, লাল… শকওয়েভের গতি এখন শব্দের চেয়েও বেশি। আর এ শব্দটা কেমন হবো- মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুক্রের আনাচে কানাচে ছড়ানোর সময় কেমন হবে চিত্রটা!

এইতো, দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট এক কালো রঙের বৃত্ত যেন ধোয়ার পাফ… দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কেমন নরক নেমে এসেছে সেখানে, কেমন করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাইক্লোন। ছড়ানোর ব্যাপারটা খুব বেশি বোঝা যায় না, মিনিটখানেক অপেক্ষা করে বুঝতে হয়।

মিনিট পনের পর গ্রহের বুকে সবচে বড় ক্ষত রূপে দেখা দিল বৃত্তটা। মিইয়ে আসছে একটু একটু করে এখন ধূলিধূসর। হাজার কিলোমিটার এর ব্যাস। নিচের বিশাল বিশাল পর্বতমালা পেরিয়ে যাবার সময় আকৃতি বদলে যাচ্ছে, নিখুঁত বৃত্তে তৈরি হচ্ছে খুত।

শিপের এ্যাড্রেস সিস্টেম দিয়ে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের কষ্ঠ খসখসে শোনায়।

‘আপনাদের আফ্রোদিতি বেসের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। কপাল ভাল বলতে হয়, তারা সাহায্যের জন্য হাত পা ছুঁড়ছে না’

‘-একটু কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমাদের, কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম ততটুকুই। মনিটর দেখাচ্ছে এর মধ্যেই নকোমিস পর্বতমালার উপর বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা; শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে জলদি, কিন্তু এ হল রু। হেক্যাট ক্যাজমে ঝটিকা বন্যা হয়েছিল বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, চেক করে দেখছি। শেষ ডেলিভারির পর সেখানে ফুটন্ত পানির একটা হ্রদ তৈরি হয়েছিল—’

আমি তাদের হিংসা করি না মোটেও, নিজেকে বলল পোল, কিন্তু অবশ্যই প্রশংসা করি। এই অতি আরামদায়ক, সুবিধার জগতে এখনো যে এ্যাডভেঞ্চারের অবকাশ আছে তা প্রমাণ করে ছাড়ছে তারা।

‘–আর জায়গামত এই ছোট্ট তালটাকে নামিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ। কপাল ভাল থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা কয়েকটা স্থায়ী সাগর পেয়ে যাব। এরপর কোরাল রিফ বসানোর পালা। লাইম বানাব, বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে নিব পরিবেশ থেকে… আহা, ততদিন যদি বাঁচতে পারি।’

আশা করি বেঁচে থাকবেন ততদিন, প্রশংসার সুরে মনে মনে বলে পোল। পৃথিবীর ট্রপিক্যাল সমুদ্রগুলোয় ঝাপাঝাপি করেছে সে, এত বিচিত্র সব প্রাণি দেখেছে, সৃষ্টির এত রূপ দেখতে পেয়েছে চোখে যে মাঝে মাঝে মনে প্র আর সব সূর্যের অযুত নিযুত গ্রহে এমন প্রাণির দেখা মিলবে তো।

সময় মতো প্যাকেজ ডেলিভার করা হয়েছে। পেয়েছি প্রাপ্তিস্বীকারোক্তি। প্রশান্ত সুর ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের কণ্ঠে, বিদায়, শুক্র… এইতো, আসছি, গ্যানিমিড।

.

মিস প্রিঙ্গল
ফাইল-ওয়ালেস

হ্যালো, ইন্দ্রা। হ্যাঁ, তোমার কথাটা ঠিক। তোমার সাথে তর্কাতর্কিটাকে সামান্য মিস করছি। চ্যান্ডলারের সাথে সম্পর্ক ভালই, আর শুনে অবাক হবে, ক্রুরা আমাকে অবতারের মতো শ্রদ্ধা করে। আমাকে মেনে নেয়া শুরু করেছে আস্তে আস্তে, শুরু করেছে আমার লেগ পুল করা (এ ইডিয়মটা জান নাকি?)।

সত্যিকার সরাসরি কথা বলতে না পারাটা বেশ বিরক্তিকর মঙ্গলের অটি পেরিয়ে এসেছি আমরা। এর মধ্যেই রেডিও ট্রিপ ঘন্টার উপরে চলে যাবে। কিন্তু এখানে একটা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি, তুমি আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না…

বৃহস্পতিতে যেতে মাত্র সপ্তাখানেক লাগলেও মনে হয় আমার হাতে রিল্যাক্স করার মতো সময় থাকবে। আবার স্কুলে ফিরে যাবার ইচ্ছা ঠেকাই কী করে বল। সুতরাং নেমে পড় কাজে। আমি গোলিয়াথের মিনি শাটলে চড়া শুরু করেছি। শুরু করেছি শিখে নেয়া। কে জানে দিম আমাকে একা কিছু করতে দিবে কিনা… ।

এটা ডিসকভারির পোডগুলো থেকে খুব একটা বড় নয় কিন্তু কী পার্থক্য। প্রথমেই বলতে হয়, এর কোনো রকেট নেই, অসীম দূরত্ব আর ভিতরের আরাম আয়েশের সাথে এখনো মানিয়ে নিতে পারিনি। চাইলেই এটা দিয়ে একেবারে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসতে পারি কিন্তু লোকে আমাকে বদ্ধ পাগল বলবে। বন্ধ পাগল এর মানে বোঝ তোর

সবচে বড় পার্থক্য কন্ট্রোল সিস্টেমে। হ্যান্ডসফ্রি কন্ট্রোল শিখতে কষ্ট হয়। আর আমার ভয়েজ রিকগনিশন শিখতে হচ্ছে কম্পিউটারটাকে। প্রথমে প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার করে প্রশ্ন তুলল, ডু ইউ রিয়েলি মিন দ্যাট? ব্রেইনক্যাপ ব্যবহার করলেই বোধহয় ভাল হয়। আমি মানিয়ে নিতে পারিনি মোটেও। জানি না মনকে পুরোপুরি পড়ে ফেলছে এমন কোনো যন্ত্রের সাথে মানিয়ে নিতে পারব কিনা কোনদিন…

বাই দ্য ওয়ে, শাটলটাকে ফ্যালকন নামে ডাকে ওরা। অবাক ব্যাপার, নামটার সাথে যে এ্যাপোলো মিশনের সংযুক্তি আছে সেটা জানে না কেউ, আমরা যখন প্রথম বারের মতো চাঁদে যাই…

উঁ… হ্যাঁ, আরো অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু স্কিপার ডাকছে। আবার ক্লাসরুমে ফিরে যাও! লাভ এ্যান্ড আউট।

স্টোর
ট্রান্সমিট

হ্যালো ফ্র্যাঙ্ক- ইন্দ্রা কলিং- যদি শব্দটা বেমানান না হয়। আমার নতুন থটরাইটার দিয়ে কল করছি- পুরনোটার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে, হা হা হা হাজারটা ভুল করে বসে পাঠানোর আগে যে একটু এডিট করে নিব সে উপায় নেই। আশা করি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা।

কমসেট। চ্যানেল ওয়ান, ও থ্রি- সাড়ে বারোটা থেকে রেকর্ড কর কারেকশন- সাড়ে তেটা। স্যরি…।

পুরনো ইউনিটটা সারিয়ে নিতে পারব আশা করি- সেটায় আমার সব শর্টকাট আর এ্যাব্রিভ ছিল- সম্ভবত তোমাদের আমলের মতো করে সাইকো এ্যানালাইজ করতে হবে। জানি না কী করে ফ্রাউডিয়… মানে ফ্রয়েডিয় পদ্ধতিটা কাজ করে। কখনো বুঝতে পারিনি।

গন্ডগোল হচ্ছে থটরাইটারে- স্যরি এ্যাগেইন… আসল পয়েন্টে থাকা কঠিন

এক্স জেড ১২ এল ডব্লিউ ৮৮৮ ৮***** জে এস ৯৮১২ ওয়াই ই বি ডি সি ড্যাম… স্টপ… ব্যাকআপ

তখন কি কোনো ভুল করে ফেলেছিলাম? আবার ট্রাই করছি।

তুমি দানিলের কথা তুলেছিলে… আমরা কোনো গুরুত্ব দেইনি। কারণ আছে। একবার ননপার্সন বলেছিলে না? একেবারে খাঁটি কথা!

আজকের দিনে কী ধরনের অপরাধ হয় জিজ্ঞেস করেছিলে একবার- সাইকিক ব্যাপার স্যাপার। তোমাদের আমলে সাইকো এ্যানালিস্ট টিভি প্রোগ্রামগুলো মাঝে মাঝে গিলার চেষ্টা করে উগলে দিতে হয়েছিল। কয়েক মিনিটের বেশি হজম করতে পারিনি… ডিজগাস্টিং

দরজা- একনলেজ!- ও, হ্যালো মেলিন্ডা- মাফ করো- বস- এইতো, শেষ পর্যায়ে…

কী যেন বলছিলাম? ক্রাইম। কিছু না কিছু তো আছেই সব সমাজে। কমিয়ে এনেছি হারটা, এই আর কী!

তোমাদের সমাধান ছিল- কারাদন্ড। রাষ্ট্রের অর্ধে প্রিভেনশন ফ্যাক্টরি- একজন ইনমেটকে ধরে রাখতে দশটা পরিবারের গড় আয়ের চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায়। একেবারে পাগলাটে, কী বল… কেউ কেউ আরো বেশি জেলখানার জন্য চিৎকার করে সব সময় তাদেরই বরং মনোবিশ্লেষণ করা দরকার। আচ্ছা, ভোলা মনে কথা বলা যাক- ইলেক্ট্রনিক মনিটরিং এ্যান্ড কন্ট্রোল সবার নজরে আসার আগ পর্যন্ত কোনো বিকল্প ছিল না- লোকজন সোৎসাহে জেলখানার দেয়াল ভাঙছে দেখলে তোমারও ভাল লাগত।

হ্যাঁ- দানিল। জানি না তার ক্রাইমটা কী ছিল- জানলেও তোমাকে জানাতাম না– কিন্তু সাইক প্রোফাইল দেখে জানা গেল সে কী বলে শব্দটাকে?- ভাল গৃহপরিচারক হতে পারবে। মানুষকে কোনো না কোনো কাজে লাগানো সহজ কথা নয়। অপরাধের মাত্রা শূন্যে নেমে এলে কেমন হবে কে জানে! যাই হোক, আশা করি সে দ্রুত ডিকন্ট্রোন্ড হয়ে সমাজে ফিরে যাবে।

স্যরি মেলিন্ডা- এইতো শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এই সব, ফ্র্যাঙ্ক দিমিত্রির জন্য শুভকামনা- তোমরা নিশ্চয়ই গ্যানিমিডের পথে অর্ধেকটা চলে গেছ কে জানে কখনো তোমরা সময় পেরিয়ে আইনস্টাইনের নিয়ম ভেঙে কথা বলতে পারবে কিনা সরাসরি।

আশা করি মেশিনগুলো আমার সাথে মানিয়ে নিবে দ্রুত- নাহলে বিংশ শতাব্দির আসল এ্যান্টিক ওয়ার্ড প্রসেসরের শরণাপন্ন হতে হবে।

লাভ এ্যান্ড গুডবাই।

.

হ্যালো ফ্র্যাঙ্ক- আবার আমি। শেষটার জবাবের আশায় আছি। অন্তত প্রাপ্তিস্বীকার হলেও চলে…

ভাবতে অবাক লাগে, তুমি গ্যানিমিডে যাচ্ছ, সেখানে আমার পুরনো বন্ধু টেড় খানের সাথে দেখা হবে তোমার। কিন্তু এতে বিচিত্র কিছু নেই, তুমি যে রহস্যের টানে যাচ্ছ সেও একই কারণে গিয়েছিল…

প্রথমেই তার ব্যাপারে কিছু বলে নেয়া ভাল। বাবা মা বিশ্রি একটা ট্রিক্স খাঁটিয়েছিল। নাম দিয়েছিল থিওডোর। কখনো ভুলেও ঐ নামে ডেকো না। কী বলছি বুঝতে পারছ তো?

হয়ত এ নামই তাকে ঐ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে ধর্মে আগ্রহী এমন পাগলাটে মানুষ আর দেখিনি। আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, সে কিন্তু একটু বোরিং হয়ে যেতে পারে।

বাই দ্য ওয়ে, এখন কেমন হচ্ছে? মনে হয় নতুন থটরাইটারটা কাজে লাগছে ভালই। এখন পর্যন্ত কোনো ভুল করেনি, তাই না?

আমি টেডকে কী নামে ডাকি জান? ‘শেষ জেসাইট।‘ তোমাদের সময়ে এ শ্রেণীর অনেক মানুষ ছিল।

অবাক ব্যাপার, সাজাতিক সাতিক সব লোক চমৎকার সব আবিষ্কারের জনক দারুণ স্কলাররা মাঝে মাঝে কী করে যে-কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বুঝি না…

এইউইডিএন২কেজেএন প্রিয় ২১ ইআইডিজে ডিডব্লিউপিপি।

ড্যাম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক, দুই, তিন, চার… মানুষ কল্যাণের পথে আসছে, এইতো, ঠিক হয়ে যাবে।

যাই হোক, টেডের মনেও তেমনি উঁচু ইচ্ছা। তার সাথে ভুলেও তর্কে নেমো না– স্টিমরোলারের মতো পিষে ফেলবে তাহলে… দৈহিকভাবে নয়, মানসিকভাবে।

বাই দ্য ওয়ে, স্টিমরোলার জিনিসটা কী? জামাকাপড়ে চাপ দেয়ার যন্ত্র ট?

থটরাইটার তোমার সমস্ত চিন্তা লিখে নিবে, ব্যাপারটা একটু বিদঘুঁটে, সন্দেহ নেই। নিজেকে সামলানোর পদ্ধতিটা শিখে নিতে হয় এক্ষেত্রে… এর আগেও কথাটা বলেছিলাম…

টেড খান… টেড খান… টেড খান।

সে এখনো পৃথিবীতে জনপ্রিয়। তার দুইটা কথাতো বিখ্যাত বলা চলে, সভ্যতা থেকে ধর্মকে আলাদা করা অসম্ভব। আর বিশ্বাস হল এমন কিছুকে মেনে নেয়া যা তুমি সত্যি বলে মনে কর না। আমার মনে হয় না শেষের কথাটা তার নিজের। কারণ কখনো ঠাট্টা তামাশার এতটা কাছে যায় না সে। হাজার চেষ্টা করেও মুখে একটা হাসির রেখা তুলে আনতে পারিনি আমি…

ডিন তার ফ্যাকাল্টিতে অভিযোগ তুলছে, আপনারা সায়েন্টিস্টরা এত বেশি দামের ইকুইপমেন্ট চান কেন? কেন আপনারা ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের মতো হতে পারেন না, যাদের প্রয়োজন শুধু একটা ব্ল্যাকবোর্ড আর ওয়েস্টপেপার বাস্কেট যাক, দর্শন বিভাগটা এখনো আমার ভাল্লাগে। তাদের একটা নষ্ট কাগজের বাক্সেরও প্রয়োজন নেই…’ আশা করি টেড কথাটা শুনেছিল। বেশিরভাগ দার্শনিকেরই জানা থাকার কথা….

যাই হোক, তাকে আমার শুভেচ্ছা জানিও, আর, ভালভাবে বলে রাখছি, নো যুক্তিতর্ক।

আফ্রিকা টাওয়ার থেকে ভালবাসা আর শুভকামনা।

ট্রান্সক্রাইব। স্টোর।

ট্রান্সমিট পোল।

১৬. কাপ্তানের টেবিল

গোলিয়াথের ছোট্ট পৃথিবীতে এমন দামি এক লোকের আবির্ভাবে প্রথম দিকে খুব আলোড়ন হলেও আস্তে আস্তে ক্রুরা ভাল রসবোধের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন ১৮.০০ টায় সব পার্সোনেল একত্র হয় ডিনারের জন্য, ওয়ার্ডরুমে। ঘরটা বেশ বড়, জিরো জি-তে কম করে হলেও ঘরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ত্রিশজনকে ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু এখানে বেশিরভাগ সময়েই চাঁদের অভিকর্ষ থাকে, তাই সবাই হেসেখেলে থাকতে পারে। আটজনের বেশি হলে একটু ঝামেলা হবে।

অর্ধবৃত্তাকার টেবিল বেরিয়ে এসেছে অটোশেফ থেকে। সেখানে সাতজন বসে পড়তে পারে সহজে। সমস্যা অন্য কোথাও, এখানে সাতজন ক্রু থাকার কথা। আছে আরো একজন। তাই একজনকে অন্য কোথাও খেতে হয়। এখানে বিচিত্র নাম আছে জিনিসপত্রের। অভ্যস্ত হতে সমস্যা হয়। ‘বোল্টস’ মানে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ‘চিপস’ মানে কম্পিউটার্স এ্যান্ড কম্যুনিকেশনস, ফাস্ট মানে ফার্স্ট মেট, ‘লাইফ’- লাইফ সাপোর্ট এ্যান্ড মেডিক্যাল সিস্টেম, ‘প্রপ’- প্রপালশন আর পাওয়ার, ‘স্টার’ মানে অর্বিট ও নেভিগেশন।

অভিযানের দশদিন কেটে গেছে। এ কদিনে প্রচলিত জোকগুলো বুঝতে শিখছে, চিনছে প্রচলিত গালগল্পের ধারা, পৃথিবীর বুকে থাকতে বর্তমান সৌরজগত সম্পর্কে যতটা জেনেছিল তার তুলনায় জেনেছে অনেক বেশি। নিশ্চুপ আর আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে তারা খুশি হলেও পোল তাদের রঙ চড়ানো কাহিনীগুলোর সারসংক্ষেপ ঠিকই। বুঝতে পারে।

চতুর্বিংশ শতাব্দির আলোড়ন তোলা গোল্ডেন এ্যাস্টেরয়েডের গুজব এখন আর নেই। কিন্তু গত পাঁচশ বছরে অন্তত জনা বারো নির্ভযোগ্য লোকের কাছ থেকে যে মাকুরিয়ান প্লাজমোয়িডের কথা এসেছে তার কী হবে?

সব চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা হল, সেগুলো বল লাইটনিঙের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবী আর মঙ্গলের বুকে ইউ এফ ও’র রিপোর্ট এসেছে এদের কারণেই। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করে সেসবে উদ্দেশ্যবহুলতা দেখা যায়। বোকামি, বলত স্কেপটিকরা সামান্য ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক এ্যাট্রাকশন।

সব সময় এসব নিয়ে শক্ত মনোভাব আছে পোলর। এলিয়েনরা আছে আমাদের মাঝেই পাগলামি চূড়ান্তে পৌঁছেছিল তার বাল্যকালে। পরে ২০২০ সাল পর্যন্ত মহাকাশ বিষয় পাগলাটে লোকদের মুখোমুখি হয়। অনেকে দাবি তোলে তারা এলিয়েনদের দেখেছে বা ভিনগ্রহের প্রাণির মুখোমুখি হয়েছে, করেছে যোগাযোগ। কেউ কেউ বিশ্বাস করত। পরে চিকিৎসা সাহিত্যে এ ধরনের মনোভাবের নাম দেয়া হয় ‘এ্যাডামস্কি রোগ।

টি এম এ-এক এর আবিষ্কার এর মুখে কুলুপ এঁটে দিল। মানুষ বিশ্বাস করল, বুদ্ধিমত্তা আছে মহাকাশে, কিন্তু তারা মিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের ধারেকাছে আসেনি। একই সাথে কুলুপ এঁটে দিল সেসব বিজ্ঞানির মুখে যারা ফণা তুলে বলত ব্যাকটেরিয়ার কাছাকাছি প্রাণ ছাড়া আর কিছু এ গ্যালাক্সিতে পাওয়া সম্ভব নয়, হয়ত পুরো কসমসেও পাওয়া যাবে না।

পোলের আমলের রাজনীতি আর অর্থনীতির ঘোড়াই পরোয়া করে গোলিয়াথের জুরা। তাদের সমস্ত আগ্রহ সে সময়কার টেকনোলজির ব্যাপারে। তার জীবদ্দশায় বিজ্ঞানে যে অকল্পনীয় পরিবর্তন চলে এল হঠাৎ করে, সেসব নিয়ে খুব আগ্রহী। হারিয়ে গেল ফসিল ফুয়েলের যুগ। তেল যুগের মানব সভ্যতা কী করে হাজার হাজার প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে, কী করে পরিবেশকে নরকে পরিণত করে তা এখনো তাদের কাছে ঠিক বিশ্বাস্য নয়।

‘আমাকে দোষ দিওনা,’ উত্তপ্ত মনোভাব দেখে আৎকে ওঠে পোল, যাই হোক, বরং দেখ একবিংশ শতাব্দি কী ভয়ানক গন্ডগোল পাকিয়েছিল।’

সাথে সাথে টেবিলের চারপাশ থেকে শোর উঠল, মানে?

‘আসলে, তথাকথিত অসীম ক্ষমতার যুগ যখন থেকে শুরু হয়, প্রত্যেকের হাতে হাতে চলে আসে হাজার হাজার কিলোওয়াটের চিপ, নিখাদ এনার্জি নিয়ে খেলার মাতলামি ভর করে, তখন থেকে কী শুরু হয় বুঝতেই পারছ।

‘ও, তুমি থার্মাল ক্রাইসিসের কথা তুলছ তো? সেটা ঠিক করা হয় তার পরই।

ফলে- তোমরা পৃথিবীর অর্ধেকটা ঢেকে দিলে রিফ্লেক্টর দিয়ে। সূর্যের আলো ফেরৎ পাঠালে স্পেসে। নাহলে এতদিনে পৃথিবীটা শুক্রের মতো হয়ে যেত। ফুটন্ত।

ত্রয়োবিংশ শতাব্দির ব্যাপারে কুদের জ্ঞান এত কম যে গোলিয়াথের বুকে বসে বসে নিজের সময়ের কয়েক শতাব্দি পরের ঘটনা জানিয়ে তাক লাগিয়ে দিল পোল, প্রকাশ করতে থাকল স্টার সিটি থেকে অর্জিত জ্ঞান। ডিসকভারির কাহিনী চিরায়ত স্পেস এজের এক বিস্ময়। তারা এ ঘটনা এমন মন দিয়ে দেখে যেমন মন দিয়ে সে ভাইকিংদের কাহিনী পড়ত।

‘তোমাদের ছিয়াশিতম দিনে, বলল স্টারস, এক বিকালে, তোমরা গ্রহাণু ৭৭৯৪ এর দু হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছিলে। ছুঁড়ে দিয়েছিলে একটা পোব। মনে আছে নাকি?

‘অবশ্যই।’ একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল পোল, ‘আমার কাছে ঘটনাটা এক বছর আগেরও নয়।

‘উমস্যরি। কালকে আমরা ১৩,৪৪৫ এর আরো কাছে চলে যাব। দেখতে চাও নাকি? অটোগাইডেন্স আর ফ্রিজ ফ্রেমের সাহায্যে দশ মিলিসেকেন্ড চওড়া একটা ফ্রেম পাব।

এক সেকেন্ডের শতভাগের একভাগ। ডিসকভারির ঐ কয়েক মিনিটই অনেক মূল্যবান মনে হয়েছিল আর এখন সব ঘটনা ঘটবে পঞ্চাশগুণ দ্রুত…

কতবড় জিনিসটা?’ প্রশ্ন তুলল পোল।

“ত্রিশ বাই বিশ বাই পনের মিটার,’ জবাব দিল স্টারস, ‘অমসৃণ ইটের মতো দেখাবে।

“স্যরি, এটার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার মতো কোনো শামুক নেই আমাদের হাতে, বলল প্রপস, কখনো ভেবেছ ৭৭৯৪ তোমাদের দিকেও কিছু ছুঁড়ে দিতে পারত, সেকথা?

আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এ্যাস্ট্রোনোমারদের অনেক তথ্য দিয়েছিল। এটুকু ঝুঁকি নিয়ে লাভ হয়েছে দেদার… যাই হোক, এক সেকেন্ডের

একশ ভাগের একভাগ সময়ে কী আর দেখতে পাব, থ্যাঙ্কস।

বুঝতে পারছি। একটাকে যখন দেখেই ফেলেছ, বাকিদের দেখার বাকি নেই তেমন

কথা সত্যি নয়, চিপস। আমি যখন ইরোসে ছিলাম—

‘অন্তত বারোবার বলেছ কথাটা—’

হাজার বছর আগে চলে গেছে পোলের মন। ডিসকভারির শেষ দূর্ঘটনার আগে, শেষ উত্তেজনার কথা মনে পড়ে যায়। যদিও সে আর ডেভ বোম্যান ভালভাবেই জানত যে ৭৭৯৪ একেবারে বিদঘুঁটে প্রাণহীন একটা জিনিস, তবু অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বৃহস্পতির এলাকায় এতদিনে শুধু এ জিনিসটার সাথেই তার যোগাযোগ হবার সম্ভাবনা ছিল। যেন কোনো অকুল পাথারে চলতে থাকা নাবিকের দল পাথুরে কোনো দ্বীপের দেখা পেয়েছে যেখানে তাদের নামার কোনো সম্ভাবনা নেই। না থাক সম্ভাবনা। মাটির দেখাতে পাওয়া যাচ্ছে।

পাশ থেকে পাশে ঘুরছিল জিনিসটা। সূর্যের ক্ষীণ আলো পড়ছিল গায়ে…।

টার্গেটে আঘাত করে কিনা ভোব তাও একটা উত্তেজনার বিষয়। দু হাজার কিলোমিটার দুরে ঘুরতে থাকা, সেকেন্ডে বিশ কিলোমিটার আপেক্ষিক গতিতে চলতে থাকা তে আঘাত দেয়াও মুখের কথা নয়।

এরপর অন্ধকারাচ্ছন্ন পিঠে হঠাৎ আলোর ঝলক দেখা দেয়। খাঁটি ইউরেনিয়াম ২৩৮ এর সবটুকু তীরবেগে আঘাত হানে গ্রহাণুর গায়ে। সবটুকু পরিণত হয় তাপশক্তিতে। গ্যাসের সামান্য অংশ স্পেসে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকা বর্ণালির রেখাগুলো ধরে রাখে ডিসকভারির ক্যামেরাগুলো। পৃথিবীর বুকে বসে থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই এ্যাস্ট্রোনোমাররা জানতে পারে গ্রহাণুর গঠন সম্পর্কে। প্রথমবারের মতো খুব বেশি চমক ছিল না, কি কয়েক বোতল শ্যাম্পেন হাতবদল হয়।

খাবার সময় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার। শুধু একটাই অঘোষিত নিয়ম চালু আছে। খাবার টেবিলে কোনো সিরিয়াস কাজের কথা নয়। কোনো টেকনিক্যাল বা অপারেশনাল সমস্যা থাকলে সেগুলোর সুরাহা করতে হবে অন্য কোথাও। এখানে নয়।

একটা ব্যাপার বেশ ব্যথিত করে পোলকে। গোলিয়াথের নাড়ি নক্ষত্রের ব্যাপারে কুরা খুব বেশি কিছু জানে না। তার সময়ে পুরো স্পেসশিপ সম্পর্কে যেটুকু জ্ঞান রাখত তারা, তার কানাকড়িও রাখা সম্ভব নয়। সবাই রেফার করে লাইব্রেরির কাছে। প্রতিটা সিস্টেম অসম্ভব জটিল আকার ধারণ করেছে আজকের দিনে।

মাস্টাররা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের যন্ত্রগুলোর কাজ জানে, কাজটা কী করে হয় তা জানে না। সব চেক করতে হয় অটোম্যাটিক, মানুষের হাত পড়লে ভাল হবে না।

সাধারণ এক যাত্রায় পরিণত হয়েছে এখন সৌরজগতের একপাশ থেকে আরেক পাশে যাবার ব্যাপারটা। ড্রাইভার যেমন শুধু তার গাড়ির কাজের ধরন জানে, ধারা জানে না, সেভাবেই চলে এখানকার মানুষেরা।

বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়াই লুসিফার আস্তে আস্তে তার প্রতাপ নিয়ে দেখা দিল আকাশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *