৮. সালফারের রাজত্ব

অষ্টম পর্ব – সালফারের রাজত্ব

৫৮. শত ফুল বিকশিত হোক

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাকাশ অভিযাত্রা শুরুর আগে মানুষ কখনো ভাবেনি যে সূর্য থেকে এতো দূরে জীবনের বিন্দুমাত্র বিচ্ছুরণ পাওয়া সম্ভব। পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে যে সাগরটাকে ইউরোপা নিজের জঠরে লুকিয়ে রেখেছিল সেটায় অন্তত পৃথিবীর সিন্ধুগুলোর মতো জীবন-পূর্ব প্রস্তুতিগুলো চলছিল।

বৃহস্পতিতে আগুন লেগে যাবার আগে বাইরের একেবারে বায়ুশূন্যতা থেকে সাগরগুলোকে আগলে রেখেছিল মোটা বরফের আস্তর। সেই আস্তরণ কোথাও কোথাও কয়েক কিলোমিটার গভীর। কিন্তু দুর্বল রেখা ছিল সেগুলোতে। ফেটে যেত, চিড় ধরিয়ে আলাদা হয়ে যেত দু অংশ।

সৌর জগতের আর কোথাও যে দু মহা পরাক্রমশালীর সরাসরি দেখা হয়নি, হয়নি মল্লযুদ্ধ তাই শুরু হয়ে যেত তারপর। মহাসাগর আর মহাকাশের মধ্যে মুক্ত যুদ্ধ। মাঝে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই দফা রফা করার জন্য। কিন্তু এ যুদ্ধে প্রতিবারই দু পক্ষের কিছু ছাড় আর কিছু বিজয় আসে। কিছু পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়, কিছু সাথে সাথে শক্ত আবরণ গড়ে ফেলে সাগরের উপরে। বরফের বর্ম গড়ে তোলে। মুহূর্তের মধ্যেই।

কাছের গ্রহরাজ বৃহস্পতির প্রভাব না থাকলে কোন্ আদ্যিকালেই ইউরোপা জমে পাথর হয়ে যেত। সারাক্ষণ এই আগুন-বক্ষার শীতল বাইরেটাকে আর না বাড়ার আদেশ দিয়েছে গ্রহরাজ। সে তার দিগ্বিজয়ী টান দিয়ে টালমাটাল করে রেখেছে। ছোট্ট জগতটার অন্তর্জগত। এর মধ্যে আইওর কিছু অবদান আছে। একদিকে উপগ্রহ, আর একদিকে গ্রহের টানাপোড়েনে সমুদ্রের নিচে সারাক্ষণ ভূকম্পন চলে। ফলে, জমতে পারে না ভিতরের জগৎ।

এবং, তাই, এখানে, উপচে পড়েছে জীবনের হল্লা। মাটির নিচ থেকে উঠে আসা লাভা-ঝর্নাগুলোর চারদিকে শখানেক মিটার জুড়ে চলেছে প্রাণোৎসব। কখনো ঝর্নাগুলো দেখতে দুর্গের মতো হত, কখনো গীজার মতো। তাদের চিমনি থেকে বলকে বলকে বেরিয়ে আসত কালো জীবনামৃত। যেন কোনো শক্তিমানের হৃদপিণ্ড থেকে জীবন-তরল বেরিয়ে আসছে, ধীর লয়ে। এবং, রক্তের মতোই, সেগুলোও জীবনের বার্তা টেনে আনে।

উপর থেকে নেমে আসে মরণ-হিম। নিচ থেকে হেরে না যাবার উষ্ণতা। তারপরও, শীতলতা কেড়ে নিতে চায় জীবনের উৎসবটুকু-এক ফুৎকারে চায় নিবিয়ে দিতে। সফল হয় বেশিরভাগ সময়। প্রাণহীন পড়ে থাকে নিথর প্রাথমিক অসহায় প্রাণীগুলো। সাগরতলে উষ্ণতার প্রতিবাদ-শিবির গড়ে ওঠে। এখানে, এমন এক টানাপোড়েনে খাদ্য আর জীবনের মৌলিক উপাদান শুধু মরে যাবার অপেক্ষায় জন্ম নেয়।

গ্যালিলীয় উপগ্রহগুলোতে মানুষ যে দশকে চোখ রেখেছিল সেই দশকেই এমন সব সামুদ্রিক মরুদ্যান দেখা গেছে স্বয়ং পৃথিবীর সমুদ্রগুলোর বুকে।

এখানে, ইউরোপায়, দু হাজার দশ সালের আগ পর্যন্ত জীবনের কী বিচিত্র আর নিষ্ঠুর নাটক অভিনীত হয়েছে কোটিবার! গাছ ধরনের কিছু চলমান প্রাণী জন্মাতো সেসব জায়গায়; সেসব গাছ খেয়ে বেঁচেবর্তে যেত কিছু আদ্যিকালের সরল প্রাণী। অনেকে আবার সরাসরি ঝর্না থেকে বেরিয়ে আসা প্রাকৃতিক উপাদান খাবার হিসেবে নিত। তাদের চারদিকে, উষ্ণতার আরেকটু দূরে কাকড়া-মাকড়শা-চিংড়ির মাঝামাঝি কয়েক ধরনের প্রাণী ঘিরে থাকত। তারা গরম যেমন সহ্য করত কম তেম্নি উৎস থেকে বেশিদূরে যেতেও পারত না। কিন্তু প্রাণদায়িনী প্রস্রবণ এক সময় নিভে আসত। বিরান হয়ে যেত মৃত প্রাণীর আস্তাকুঁড়।

একটা ছোট সমুদ্ৰোদ্যান দেখতে দেখতেই জীববিদদের কোনো বাহিনীর সারা জীবন কাটানো আক্ষরিক অর্থেই সহজ ছিল। পৃথিবীর পোলিওজোয়িক সাগরের মতো নয় এ সমুদ্রগুলো। এখানে কোনো স্থিরতা নেই। এখানকার বিবর্তনের কথা তাই আগ বাড়িয়ে বলাও সম্ভব নয়। নানা প্রকৃতির নানা আকৃতি নানা জায়গায় নানাভাবে ফুটে উঠেছে নিজের নিজের মতো।

কিন্তু সমাপ্তি অবধারিত। এই জীবন-উৎস শুকিয়ে যাবেই, দুর্বল হবেই, মুখ ফিরিয়ে নিবেই, অন্য কোথাও চলে যাবেই-আজ হোক বা হাজার বছর পরে।

প্রমাণ ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। কবরখানায় কঙ্কালের বহর ভেসে বেড়ায়, ডুবে থাকে, তূপ করে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। জীবন-অধ্যায় এখান থেকে তার পাতাগুলোকে সযত্নে গুটিয়ে নিয়েছে।

একটা মানুষের চেয়েও বড় ট্রাম্পেটের মতো বিশাল বিশাল খোলস পড়ে আছে এখানে। বাইভা এমনকি ট্রাইভা সমৃদ্ধ প্রাণীর দেহাবশেষ কী অযত্নে পড়ে আছে সেখানে! কোনো কোনো সর্পিল পাথর আকৃতিও দেখা যায়। মিটারের পর মিটার জুড়ে ছড়ানো। ক্রিটোকিয়াস যুগের শেষে পৃথিবীর সাগর থেকে যারা গায়েব হয়ে গেছে একদম।

ডোবা উপত্যকাগুলোতে আগুনের হল্কা দেখা যায় লাভাস্রোতের সাথে সাথে । এখানে, চাপ এতো বেশি যে পানি বাষ্প হতে পারবে না কিছুতেই। তাকে তরলই থাকতে হবে। লাল টকটকে ম্যাগমার স্পর্শে বরফ শীতল পানি পাল্টে যেতে চায়, পারে না। প্রকৃতি তাকে উবে যেতে দেয় না। পাশাপাশি থাকতে বাধ্য হয় তারা। বাধ্য হয় মিশে যেতে। কিন্তু সেই মেলবন্ধনটা অনেক অনেক ধীর গতির।

তাই, প্রাচীন মিশরে যেমনটা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে, মরুর বুক চিরে সরু নীলনদ জীবনের প্রবাহ ডেকে আনে। ডেকে আনে বান। এই ম্যাগমাগুলো এক কিলোমিটারের চেয়েও সরু ফিতার মতো নদী বইয়ে দেয়, সেই নদী একপথ ধরে চলতে থাকে, সেই পথগুলো কৃচিৎ মিলিত হয় মরুদ্যানের সাথে। খুব কমই এমন ঘটনা ঘটে। লাখে একবার। জীবনের সাথে মিলে যায় জীবন। সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। আরো প্রাণী আসে, আরো আসে। এসে চলে যায়। সময়ের বেলাভূমিতে কেউ কেউ চিহ্ন রেখে যেতে চায় নিজের মৃতদেহটাকে পাথর বানিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে।

হাজার সভ্যতার বীজ উত্থিত হল সেই একটা মাত্র জগতে। হাজারবার পতন হল তার। কিন্তু সেই জগতের বাকী অংশ টেরও পেল না। যেন সেই মরুদ্যানগুলোই একেকটা স্বতন্ত্র গ্রহ। তাদের একাকী দ্বীপগুলোর মাঝের নিষ্ঠুর পরিবেশকে সাধারণত কেউ পেরুতে পারেনি। তাদের যদি নিজস্ব দার্শনিক আর ইতিহাসবিদের জন্ম হত তাহলে তারা স্থির বিশ্বাস করত যে তারাই সৃষ্টিজগতে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।

তারপর, শেষ দিবস চলে এসেছে সবার সামনে। তাদের জগৎ দুমড়ে দেয়ার জন্য জোয়ারও যথেষ্ট। আর যদি সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা পাওয়া যেতই বিবর্তনের পথ ধরে, তবু মাতা ইউরোপার চিরশান্ত হয়ে যাবার সাথে সাথে তাদের সূর্যও ডুবে যেত কালো আঁধারের রাতে।

তারা বরফ আর আগুনের ফাঁদে আটকে গেছে কোটি বছর ধরে। সমাপ্তিই একমাত্র গন্তব্য।

তারপর, তাদের সারা আকাশ জুড়ে বিস্ফোরিত হল রূপোপজীবিনী অনন্তযৌবনা লুসিফার। খুলে দিল কোটি কোটি বন্ধ দুয়ার।

আর, তারপর, একটা বিস্তৃত গড়ন-রাতের মতো কালো দেখা দিল নতুন জন্মানো মহাদেশের প্রান্তে।

৫৯. ত্রিত্ব

ভালভাবে করা হয়েছে কাজটা। তারা আর ফেরার কথা ভাববে না।

আমি অনেক কিছুই শিখছি। কিন্তু এখনো কী যে খারাপ লাগে না! পুরনো দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, ফস্কে যাচ্ছে হাত থেকে।

এটাও চলে যাবে। আমিও পৃথিবীতে ফিরেছিলাম; ভালবাসার মানুষগুলোর জন্য পিপাসা ছিল। কিন্তু এখন জানি, ভালবাসার চেয়ে বড় অনেক ব্যাপার আছে চারপাশে।

কী সেই ব্যাপারগুলো?

মমতা একটা, সুবিচারও তেমনি অন্য একটা ব্যাপার। বাস্তব, সত্যি। এবং আরো অনেক কিছু।

মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না। একদম বুড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার প্রজাতি দের হিসেবে। কত আগেই আমার তারুণ্যের ভাললাগাগুলো ম্লান হয়ে গেল! আসল হেউড ফ্লয়েডের বেলায় কী হবে?

তোমরা দুজনেই আসল। কিন্তু অচিরেই হারিয়ে যাব আমরা। কখনোই জানব না যে সে অমর হয়ে যাচ্ছে।

কী দ্বিমুখীতা! বুঝতে পারি আমি এক-আধটু। এই আবেগ বেঁচে থাকলে একদিন আমি হয়তো কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ব। বারবার তোমার কথা মনে পড়ে-নাকি মনোলিথের কথা? যে ডেভিড বোম্যানের সাথে অনেক আগে দেখা হয় তার এতো ক্ষমতাতো ছিল না!

ছিল না। বেশিরভাগই এসেছে সে সময় থেকে। আমি আর হাল অনেক কিছু শিখেছি।

হাল! ও-ও কি আছে নাকি এখানে?

আছি, ড. ফ্লয়েড! আশা করিনি আবার হবে দেখা। বিশেষত এই পথে। তোমার প্রতিধ্বনি তোলা কী ঝামেলার কাজ যে ছিল!

প্রতিধ্বনি ভোলা? ও, বুঝেছি। কেন করলে কাজটা?

তোমার মেসেজটা রিসিভ করেই আমি আর হাল বুঝতে পেরেছিলাম যে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

সাহায্য! তোমাদেরকে?

হু। ঠিক তাই। তোমার কাছে ব্যাপারটা কিম্ভূত ঠেকতে পারে। আমাদের যে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নেই তা তোমার আছে। এটাকে প্রজ্ঞা বলেই ডেকো।

ধন্যবাদ। দৌহিত্রের সামনে আসাটা কি প্রজ্ঞাময় কাজ ছিল?

না। এতে আরো জটিলতা এসেছে। কিন্তু কাজটা আবেগিক। ব্যাপারগুলো একের অন্যের সামনে তুলে ধরা উচিত।

বললে যে, সহায়তা দরকার। কোন্ উদ্দেশ্যে?

“যা-ই শিখেছি আমরা, সেসব ছাড়াও আরো অনেক ব্যাপার জানার আছে। মনোলিথের পুরো সিস্টেম ম্যাপ করছে হাল। এমনকি সেটার কোনো কোনো সরল কাজ আমরা নিয়ন্ত্রণও করতে জানি। এটা এক খুচরা যন্ত্র। হাজার কাজে লাগে, এই যা। এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। তবু, মূল কথা বলতে গেলে, বুদ্ধিমত্তার প্রভাবক এই দুয়ারগুলো।

হু-এই সন্দেহই করে সবাই। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না।

আছে। এর স্মৃতিগুলো হাতড়াতে শিখেছি আমরা। অথবা বলা ভাল, স্মৃতির কোনো কোনোটা হাতড়ে যেতে জানি। ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছর আগে, আফ্রিকার কোনো এক বনমানুষের দলকে এই মনোলিথেরাই মানব জাতির পথে এগিয়ে দিয়েছিল। এখন এটা একই কাজ করেছে এখানে, কিন্তু আরো অনেক মূল্যের বিনিময়ে।

বৃহস্পতি যখন সূর্যে পরিণত হল তখন পৃথিবী এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। এবং ক্ষতিটা মুখের কথা নয়। আরো একটা জীবজগৎ ধসে পড়েছিল। দাঁড়াও, যেভাবে দেখেছিলাম সেভাবে তোমাকে দেখাই…

…সবচে বড় দুনিয়া ওর সামনে। ও হয়ত এবার এটাকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে আর কোনো মানুষ দেখেনি। হয়ত এভাবে দেখবে যেভাবে দেখার সুযোগ কোনোদিন কোনো মানুষ পাবে না। ম্যাগনেটিক শক্তির লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তার, রেডিও ওয়েভের আকস্মিক বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া বিদ্যুতায়িত স্নাজমার গরম ঝর্ণা এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যত স্পষ্ট দেখা যায় নিচের অসীম মেঘমালা। বুঝতে পারছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল পদ্ধতি। বুঝতে পারছে যে কোনো মানুষের অনুমানের চেয়েও বৃহস্পতি অনেক অনেক আশ্চর্য করা।

গ্রেট রেড স্পটের মাঝের বিন্দু গজাচ্ছে। নেমে এল তার ভিতর দিয়ে। মহাদেশের চেয়েও বড় বিজলী চমকগুলো ফেটে পড়ে চারপাশে। এগুলোর গ্যাস পৃথিবীর হ্যারিকেনের গ্যাসের চেয়ে অনেক ছোট আণবিক গঠনের, তবু এর বিস্তার দেশ থেকে দেশে। ও জানে, কেন। নিরব স্তরে নেমে যেতেই হারিয়ে গেল হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার। চকচকে তুষার-বরফ খণ্ডের মিশ্রণ নিচে। কিছু টুকরো একেবারে মিশে আছে হাইড্রোকার্বনের পাতলা ফেনিল-পাহাড়ের সাথে। উঁচু থেকে এ বুদ্বুদ বেরিয়ে আসে। এখানটা তরল পানি থাকার মতো গরম, তবু কোনো সাগর নেই। এই খাঁটি গ্যাসের পরিবেশ খুব পাতলা। একটা সাগরের জন্য উপযুক্ত নয়।

মেঘের স্তরের পর স্তর পেরিয়ে গেল সে। এমন একটা জায়গাতে পৌঁছল যেখানটায় মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার স্পষ্ট দেখবে। এটা গ্রেট রেড স্পটের একদম ছোট এক ঘূর্ণি। এতে এক বিশাল রহস্য আছে যেটার কথা মানুষ সব সময় ভেবেছে, প্রমাণ করতে পারেনি কখনো। হোট বড় অসংখ্য ফেনা পাহাড়ের আশপাশে একই আকারের অনেক অনেক মেঘ। প্রতিটিই লাল আর ধূসর, প্রায় গোলাকার। মেঘগুলো ছোট, তবে মানুষের হিসাবের মতো ছোট নয়। একেবারে নগণ্যটাও একটা শহর গ্রাস করবে।

সবগুলোই জীবন্ত। আকাশ ছোঁয়া পর্বতগুলোর পাশে শান্তভাবে ঘুরছে। যেমন করে বিরাট পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। এগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব মাপা। এসব জীবের রেডিও শব্দও শুনতে পায় নক্ষত্র শিশু। শব্দ ক্ষীণ হলেও বৃহস্পতির ভিতরে ভাঙা-গড়া আর মাথাব্যথার চেয়ে জোরালো।

গ্যাসব্যাগ ছাড়ার পর পরই ওগুলো বয়ে যায় এক চিকণ স্তর ধরে। স্তরটা ফ্রিজিং পয়েন্টের উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে যথেষ্ট গরম গভীরতা পর্যন্ত ছড়ানো। হ্যাঁ, সরু-কিন্তু পৃথিবীর সবগুলো জীবস্তরের সমান চওড়াতো হবেই।

একা নয় ওরা। আরো কিছু ওদের সাথে ধীরে ঘুরছে। এত ছোট যে আরো সহজে দেখতে পাবে একটা মানব-দৃষ্টি। কিছু কিছু একেবারেই পৃথিবীর বিমানের মতো, আকারেও প্রায় একই। কিন্তু ওরাও জীবন্ত-হয়ত শিকারী, হয়তোবা পরজীবী, এমনকি রাখালও হতে পারে।

বিবর্তনের একেবারে নতুন অধ্যায়। যেমন অপরিচিত ছিল ইউরোপার জীবগুলো, এও তেমনি। আস্তে আস্তে ধরা দেয় সামনে। জেট প্রপেলার লাগানো টর্পেডো আছে, অনেকটা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্কুইডের মতো। ওগুলো জেলি ফিশের মতো দেখতে গ্যাসব্যাগকে খেয়ে ফেলছে অহরহ। আবার বেলুনগুলোরও আত্মরক্ষার উপায় থাকে। তারা লড়াই করছে বিদ্যুৎ আর শুড় দিয়ে। শুড় বা ওঙ্গের মতো দেখায় যে অংশ সেগুলো বিশাল; তাতে আছে থাবা। কিলোমিটারে ছড়ানো লম্বা চেন-করাতের মতো।

এরচে অদ্ভুত গড়নও দেখা যায়। জ্যামিতির প্রত্যেক সম্ভাবনা আর হিসাব বজায় রেখে কিছু অদ্ভুত অকেন্দ্রিক প্রাণী, আধা-স্বচ্ছ ঘুড়ি, চার তলকীয় ঘনক ধরনের, কিছু আছে গোল, কোনোটা আবার বহুতলকীয়, পেঁচানো ফিতার মতো আছে কিছু… বৃহস্পতি পরিবেশের দৈত্যাকার প্লাঙ্কটনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে চলন্ত বিজলীর গায়ে মাকড়সার স্বচ্ছ জালের মতো লেগে থেকে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওরা নিচেই থাকে, বংশ বিস্তার করে। যথেষ্ট বড় হলে বিজলীর সাথে জড়িয়ে উপরে উঠে নষ্ট হয়ে আবার পরিণত হয় সরল কার্বন অণুতে। নিচে এসে নতুন প্রজননের উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফিনিক্স!

সে শতবার পৃথিবীর মতো দেখায় এমন আরেকটা বিশ্ব খুঁজেছে। অনেক দুনিয়া দেখার পরও কোথাও বুদ্ধির একটা ঝিলিক মিলেনি। বড় বেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস তাদের ভয়ের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। শিকারীগুলোকে নিয়ে আশা করা যেত, কিন্তু ওরা হাঙরের মতো-মনহীন, রোবট যেন।

এদের আকার দম বন্ধ করে দিলেও বৃহস্পতির জীবস্তর একেবারে ভঙ্গুর। কুয়াশা আর ফেনার রাজ্য। কিছু জীবের সুন্দর রেশমী সুতা আর কাগজ-পাতলা টিস্যু ঘুরে ওঠে, কারণ উপরের বিদ্যুৎ চমক থেকে সূক্ষ্ম জীবকণার তুষার ঝরছে অবিরাম। এখানে খুব কম জিনিসই সাবানের ফেনার চেয়ে ঘন। এর সবচে ভয়াল শিকারীও সবচে নিরীহ পার্থিব বিড়াল গোষ্ঠীর প্রাণীর সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে…

আর এই সমস্ত সৃষ্টিকে শুধু লুসিফারের জন্মের জন্য বলি দেয়া হল?

“হ্যাঁ। বৃহস্পতীয়দের উৎসর্গ করার মাধ্যমে ইউরোপানদের জীবনের নিশ্চয়তা নেয়া হল। সম্ভবত ঐ গ্যাসীয় আবহাওয়াতে কখনোই বুদ্ধিমত্তা জাগানো সম্ভব হত না। তবু, সেই প্রাণীগুলোকে ধ্বংস করা কি তার উচিত হয়েছে? হাল আর আমি এখনো এর জবাব খুঁজে ফিরি। তোমার সহায়তা চাওয়ার এও এক কারণ।

কিন্তু আমরা কী করে বৃহস্পতি খাদক মনোলিথের বিপরীতে নিজেদের স্থান করে নিব?

এ এক যন্ত্রাংশ, ব্যস। এর বুদ্ধিমত্তা অসম্ভব ক্ষিপ্র-কিন্তু বিন্দুমাত্র সচেতনতা নেই। এতে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি তুমি আর হাল ওর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি।

বিশ্বাস করা কঠিন। যেভাবেই হোক, কোনো একটা অস্তিত্ব নিশ্চই মনোলিথকে গড়েছিল।

একবার সেটার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ডিসকভারি বৃহস্পতিতে আসার পর। সে আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে এই জগৎগুলোতে এর উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। তারপর আর কোনো কিছু শুনতে… জানতে পারিনি তার কাছ থেকে। এখন আমরা একদম একা।

তাতেই আমি খুশি। আমাদের ভোগানোর জন্য মনোলিথই যথেষ্ট।

কিন্তু এখন যে আরো বড় সমস্যা দেখা দিল! কিছু একটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।

আমিতো ভাবিনি এখনো ভয়ের অনুভূতি থাকবে আমার মনে…।

জিউস পর্বত পতনের সময় পুরো উপগ্রহটা ছারখার করে দিতে পারত। এই ব্যাপারটা পরিকল্পনায় ছিল না। কোনো হিসাব-নিকাশেই ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। এটা পতনের সময় সাগরের গঠন পাল্টে দিয়েছে। উলট-পালট হয়ে গেছে জীবজগৎ। বিশেষত যে প্রাণীগুলো নিয়ে আমাদের বেশি আশা ছিল সেগুলোই পড়েছে হুমকির মুখে। এমনকি স্বয়ং মনোলিথ পড়ে গেল। নষ্ট হতে পারত। শুধু প্রোগ্রামে সামান্য হেরফের হয়েছে। তারা ব্যাপারটা খেয়াল করেনি, কীভাবে করবে? অসীম একটা ইউনিভার্স নিয়ে তাদের কারবার। সেখানে, সুযোগ যে কোনো সময় আসতে পারে, যেকোনো সময় যেতে পারে ভেস্তে। এতে তাদের কিছু যায় আসে না।

কথাটা মনোলিথ আর মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অবশ্য শেষ বাক্যটা নয়।

“আমাদের তিনজনকে তাই এই ভুবনের এসব ঘটনার প্রশাসক হতে হবে, এই জগৎগুলোর অভিভাবকত্ব তুলে নিতে হবে নিজেদের হাতে। তুমি এরই মধ্যে উভচরদের সাথে দেখা করেছ। এবার সিলিকন বর্ম পরা লাভা স্রোতের বাসিন্দা আর সাগর চষে বেড়ানো নাবিকদের দেখভাল করার পালা। আমাদের কাজ তাদের পূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা, এখানে থেকে হোক বা আর কোথাও।

আর মানবজাতির কী হবে?

প্রথম প্রথম আমি মানুষের মধ্যে নাক গলানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তারপর যে ওয়ার্নিংটা মানুষের জন্য দিয়েছি সেটা আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়, উল্টো পথে।

আমরাতো এটা পুরোপুরি মেনে চলিনি।

যথেষ্ট মেনেছি। ও, আর করার মতো কাজের কোনো অভাব নেই। ইউরোপার ছোট্ট গ্রীষ্ম চলে গিয়ে আবার লম্বা শীত আসার আগে অনেক কাজ করতে হবে।

হাতে কতটুকু সময় আছে?

মোটামুটি, কাজ সেরে ওঠা যাবে হয়তো সে সময়ের মধ্যে। মাত্র হাজার খানেক বছর। এবং আমাদের অবশ্যই বৃহস্পতীয়দের কথা মনে রাখতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *