৬. স্বর্গ

ষষ্ঠ পর্ব – স্বর্গ

৪৩. ডোবা জাহাজের সম্পদ উদ্ধার

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের গোছানোর বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ক্রুদের গুছিয়ে নেয়ার কথা। তার কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল এলোপাথাড়ি পড়ছে পুরো শিপের উপর। কোথায় যেন সুর কেটে যাচ্ছে বারবার। গ্যালাক্সির সবকিছুই ভুল পথে চলছিল।

স্পেসশিপ দুভাবে চালানোর জন্য ডিজাইন করা হয়। হয় একেবারে ওজনশূন্যতায়, নয়তো ইঞ্জিন ব্রাস্টিংয়ের সময়। অক্ষের উপর-নিচে ব্যাপারটা সাজানো থাকার কথা। কিন্তু এখন শিপ পুরোপুরি উলম্ব হয়ে আছে। কাজেই ফ্লোরগুলো পরিণত হল দেয়ালে। ব্যাপারটা এমন, কোনো শুয়েপড়া বাতিঘরে যেন বসবাস করার চেষ্টা করছে কর্মচারীরা। শোয়া লাইটহাউস যেমন বেমানান, তেম্নি খাড়া গ্যালাক্সিও মানায় না। প্রতিটি আসবাব সরাতে হয়েছে, যন্ত্রপাতির অর্ধেকই কোনো কাজে আসছে না।

তারপরও, এ যেন ছদ্মবেশী আশীর্বাদ। আশীর্বাদটা যেন যোগাড় করেছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস নিজে। গ্যালাক্সির ভেতরটা ঠিক করতে করতেই জুরা গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছিল। কাজের চাপে জান বেরিয়ে যাবার দশা, আত্মবিশ্বাসের মতো বায়বীয় কোনো ব্যাপারে ভাবার ফুরসতই মিলছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তরীর গা অক্ষত আছে, মিওন ড্রাইভ শক্তির যোগান দিয়ে যাচ্ছে অবিরত, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তাৎক্ষণিক বিপদের ভয় নেই। আর মাত্র দিন বিশেক গুনে গুনে কাটিয়ে দিতে হবে, ব্যস। তারপর ভাগ্য-শশী রূপে আকাশে আবির্ভূত হবে ইউনিভার্স।

কেউ কথাটা তুলল না। যে অদৃশ্য শক্তি ইউরোপাকে রক্ষা করছে সে এখানে দ্বিতীয় কোনো অবতরণে বাধা দিতে পারে। তারা বোধহয় শেষপর্যন্ত নাক গলাবে না। একটা ক্ষমার মিশনে তাদের নাক গলিয়ে মানুষের নাকে আবারও খত দেয়ানোতে লাভটা কী…।

ইউরোপা নিজে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় অবতরণের ঘটনায়।

সাগরের বুকে ভাসার সময় গ্যালাক্সিতে তার অসন্তুষ্টির নমুনা দেখিয়েছে ঝড় তুলে। আর এখন মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসার পর ভূমিকম্প সমস্যা করছে সারাক্ষণ। ফলে আত্মবিশ্বাসের উচ্চতাকে খাটো করে ফেলছে এই গাঠনিক চিরায়ত ভূকম্পন। কাপ ধরিয়ে দিচ্ছে কারো কারো অন্তরাত্মায়।

মাটির ঝাঁকাঝাঁকিটা যতনা ক্ষতিকর তারচে ঢের বেশি ভয় পাইয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা টোকিও ৩৩ বা লসএঞ্জেলস ৪৫ আর্থ কোয়েকের শিকার তাদের কথাতো বলাই বাহুল্য।

এখন তারা জানে আইও এ উপগ্রহের ভিতরের দিকের অর্বিটে এলে কাঁপুনিটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়, তারপর আবার কমে, ঠিক ঢেউয়ের মতো-কিন্তু জানাটা ভয় কমাতে পারছে না। এই জানাটাও স্বস্তি দেয় না যে ইউরোপার নিজস্ব আকর্ষণ ক্ষেত্র আইওতেও সমান ক্ষতি করতে পারে।

ছদিনের মাথা খারাপ করা কাজের পর ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস মোটামুটি সন্তুষ্ট হল; শিপকে একটা গড়পড়তা নিরাপদ আকৃতি দেয়া গেছে। গ্যানিমিডের লোকজন যে রাডার ম্যাপ পাঠিয়েছে সে অনুযায়ী দ্বীপটা লম্বায় পনের কিলোমিটার, প্রস্থে পাঁচ; এর গাঠনিক বিবর্তন বড়জোর একশ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এরচে ভিতরে চলে গেলেই নিরাপদ। কিন্তু খুব একটা উঁচু নয় দ্বীপটা। যে কেউ হঠাৎ আসা সুনামির ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে পারে।

এ জায়গাটা একেতো নিষিদ্ধ অঞ্চলে জেগে উঠেছে, তার উপর ন্যাড়া দ্বীপের অর্ধেকই আগ্নেয় শিলায় গঠিত। লাভার স্রোত এখনো পথ এঁকে রেখেছে পাথরের বুকে। এক কথায় নামকরণের কথা কারো মাথায় আসেনি অর্ধশত বছরেও; কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। এখন এটাই তাদের বাড়ি; আর বাড়িটা যেমনই হোক কেন-সুন্দর একটা নাম চাই-ই চাই।

মনমরা নামগুলো সরাসরি ভেটো দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন- পাতালপুরী, নরক, কবর টাইপের নাম চলবে না। উৎসাহব্যঞ্জক কিছু চাই।

কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না ক্রুদের। বত্রিশটা নাম ফিরিয়ে দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসও।

ক্যাপ্টেন, আপনি নিশ্চই আশা করেন না স্বর্গের বুকে কোনো গোলাপ-বাগানে হাঁটাহাঁটি করছেন? নামটা নিশ্চই গোলাপ-বাগান রাখবেন না? কেউ একজন খোঁচা দিল, না পেরে।

গোলাপ বাগান বানানো যায় কিনা তা পরের কথা, তারচে বড় কথা, রোজ শব্দটার কথা মনে পড়ে যায় এমন কোনো নাম রাখা সম্ভবই না! বরং “স্বর্গ টাই ভাল। গোলাপ নাহয় পরেই ফুটল।

৪৪. ধৈর্য

ইতিহাস কখনো নিজের পুনরাবৃত্তি করে না-কিন্তু ঐতিহাসিক অবস্থা বারবার o ফিরে আসতে পারে।

গ্যানিমিডে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কথাটা নিয়ে ভাবছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। ইউনিভার্স থেকে কোট করে বলেছিল ম্যাগি মবালা। এখন প্রতি সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি গতিতে তাদের কাছে আসছে ইউনিভার্স, তাদের জন্যই।

“মিস ম্যাগিকে বলবেন, তার ছোট্ট ইতিহাস-শিক্ষাটা মনোবলের জন্য দারুণ ওষুধের কাজ দিয়েছে। এরচে সুন্দর কোনো কথা তিনি আমাদের জন্য পাঠাতে পারতেন না…

“আমরা দেয়াল আর মেঝেগুলোকে ঘুরিয়ে টুরিয়ে নিয়ে এমন হাল করেছি যে এখন দেখে যে কেউ থাকাটাকে বিলাস বলতে পারে। ঠিক যেন মেরুদেশে শখের অভিযানে বেরুনো পুরনোদিনের মানুষজন। আমাদের কেউ কেউ আর্নেস্ট শ্যাকলটনের নাম শুনে থাকলেও তার ধৈর্য মহাকাব্যের নাম জানে না। বরফ প্রবাহে এক বছরেরও বেশি সময় আটকে থেকে মেরুতে একটা হাড় জমানো শীত কোনোমতে বরফ-গুহায় আটকে থেকে কাটিয়ে দেয়া; তারপর খোলা নৌকায় করে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অচিহ্নিত পর্বত চিনে নিয়ে সবচে কাছের লোকালয়ে ফিরে যাওয়া!

“কিন্তু এতো মাত্র শুরু। সবচে অবিশ্বাস্য এবং উৎসাহজনক কথা হল, শ্যাকলটন সেই বিরানে ফিরে গেলেন চার-চারবার এবং স-ব লোকজনকে উদ্ধার করলেন নির্দ্বিধায়। বুঝতেই পারছেন বইটা আমাদের মনে কী প্রভাব ফেলে! আশা করি পরের ট্রান্সমিশনে ফ্যাক্স করে দিবেন; আমরা সবাই পড়ার আশায় মরে যাচ্ছি।

“তারপর তার কপালে কী হল! চিন্তা করতেও কষ্ট হয়। আমরাতো এখন তাদের চেয়ে অনেক অনেক ভাল আছি। পুরনোদিনেরর অভিযাত্রীরা কী কষ্টই না করতো! গত শতাব্দী পর্যন্ত, তারা একবার পাহাড়ের আড়ালে গেলেই হল, যোগাযোগের উর্ধ্বে; কী অবিশ্বাস্য কষ্ট! আর, আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত যে সারক্ষণ হা-পিত্যেশ করে মরছি-কেন আলোর গতি আরেকটু বেশি হল না! কেন আমরা বন্ধু-বান্ধবের সাথে রিয়েল টাইমে কথা বলতে পারি না! যত্তোসব! আর তাদের মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও মনুষ্য-পৃথিবীর সাথে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ থাকত না। আর আমরা পৃথিবী থেকে জবাব পেতে দু ঘণ্টা দেরি হচ্ছে বলে গলা শুকিয়ে মরে যাই। আবারও, মিস মবালা আর বিজ্ঞানীদলকে অশেষ ধন্যবাদ।

“অবশ্যই, পৃথিবীর সব অভিযাত্রী আমাদের চেয়ে একদিক দিয়ে বেশি সুবিধা পেতেন-অন্তত শ্বাস নেয়া যেত খোলা বাতাসে। বিজ্ঞানীদল একেবারে হন্যে হয়ে বাইরে যাবার উপায় খুঁজছে; আর স্পেসস্যুটগুলোও ছঘণ্টা বাইরে থাকার উপযোগী করে ফেলেছি।

আর, এই হল দুদিনের আবহাওয়া বার্তা। প্রেশার আড়াইশো বার, তাপমাত্রা পঁচিশ ডিগ্রিতে স্থায়ী, বাতাস পশ্চিম থেকে বেশ জোরেই বয়, মুক্ত-প্রান্তের রিখটার স্কেলে এক থেকে তিন মাত্রার কম্পন হয় সাধারণত…

“জানেন, আমি ঠিক মুক্ত-প্রান্তের কথাটাকে পছন্দ করি না-বিশেষত যখন আইও আবার এগিয়ে আসছে তখন…

৪৫. মিশন

ঘণ্টার পর ঘণ্টা তরুণ ফ্লয়েড আর সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ গুজগুজ করে ভ্যান ডার বার্গের সাথে। কী এতো কথা কে জানে! ভাবল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস; কিন্তু কী নিয়ে এতো কথা তা সে জানে।

মাউন্ট জিউসে যেতে চাও তোমরা! কীভাবে-একটা ভোলা নৌকায় করে? শ্যাকলটন বইগুলো কি তোমাদের মাথা খেয়ে বসল?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল ফ্লয়েড। ক্যাপ্টেনের কথাই সত্যি, আর সব দিকেরচে দক্ষিণ বেশি উৎসাহ দেয়। কিন্তু দমবার পাত্র নয় ক্রিস।

যদি কোনো নৌকা বানিয়েও বসি, স্যার, তবু অনেক সময় লেগে যাবে… বিশেষত এমন সময়ে। আর দিন দশেকের মধ্যে ইউনিভার্স চলে আসবে না?

তার উপর আমি নিশ্চিত নই,যোগ করল ভ্যান ডার বার্গ, এখনো নিশ্চিত নই যে এই গ্যালিলির সমুদ্রে নৌভ্রমণ করা কলজেয় কুলাবে কিনা, আমি ঠিক চাই কিনা তাও জানি না। সম্ভবত এর সব বাসিন্দা খবরটা পায়নি যে আমরা একেবারে অখাদ্য।

একটা মাত্র পথই খোলা, তাই না? তার মানে কথাটা শক্তিমান, এবং আমি প্রভাবিত হতে যাচ্ছি। বলে যান, বলে যান।

এ নিয়ে মি. চ্যাঙের সাথে বিস্তর কথা হল; বললেন, তিনি পারবেন কাজটা করতে। জিউস পর্বত মাত্র তিনশো কিলোমিটার দূরে। শাটলটা একটানে চলে যেতে পারবে, ঘণ্টাখানেক সময়ও লাগবে না।

তারপর একটা ল্যান্ড করার জায়গা খুঁজবেন? মনে আছে তো, মি, চ্যাঙ এ কাজে তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি কদিন আগেই।

অসুবিধা নেই, স্যার। উইলিয়াম সুং আমাদের পুরো ওজনের এক শতাংশ মাত্র। এমনকি সেই বরফগুলোতেও নামা সহজ। তাছাড়া আরো ডজনখানেক ল্যান্ডিং সাইট দেখে রেখেছি।

কীভাবে? প্রশ্ন তুলল ক্যাপ্টেন।

ভিডিও দেখে।

তাছাড়া, যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে গেল ভ্যান ডার বার্গের, পাইলটের মাথায় কোনো পিস্তল ধরা থাকবে না। এই চিন্তাটাও ঠিকমতো ল্যান্ডিংয়ে সহায়তা করবে।

শিওর, কেন নয়? কিন্তু আসল সমস্যা অন্য কোথাও। শাটল বের করবেন কীভাবে গ্যারেজ থেকে? একটা ক্রেন যোগাড় করতে পারবেন? এই গ্র্যাভিটিতেও লোডটা খুব বেশি হয়ে যাবে না?

প্রয়োজনই পড়বে না, স্যার। চ্যাঙ সহজেই উড়িয়ে বের করতে পারবে।

নিরবতা প্রলম্বিত হচ্ছিল; ক্যাপ্টেন জানে, উইলিয়াম সুংকে ডিজাইন করা হয়েছিল শুধু কক্ষপথে ব্যবহারের জন্য। ছোট্ট শাটলটার জনপ্রিয় নাম বিল টি। সাধারণত এটাকে গ্যারেজ থেকে ঠেলে বের করা হয়, তারপর মাদারশিপ থেকে অনেকটা দূরে না গেলে জেট চালানোর কথা মাথায় আনাই হয় না।

“বোঝাই যাচ্ছে, আপনারা অনেক খেটেখুটে সব ঠিক করে রেখেছেন প্রস্তাব দেয়ার আগেই। ভাল লাগছে কথাটা ভেবে। কিন্তু একটু ভাবুন, টেক অফ এ্যাঙ্গেল কী হবে? বিল টি কে ওড়ানোর জন্য দাঁড় করাতে হবে, এ আবার বলে বসবেন না যেন, এজন্য গ্যালাক্সিকে গড়িয়ে নিব। গ্যারেজের একপাশ মাটির দিকে, ভাগ্য ভাল-ঐদিকটা নিচে রেখে আমরা ল্যান্ড করিনি।

উপরের দিকে ষাট ডিগ্রি করে টেক-অফ করতে হবে। আশপাশের থ্রাস্ট দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

মি. চ্যাঙ বলে থাকলে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু আগুনে শিপের কী হাল হবে?

আসলে গ্যারেজের ভিতরটা দুমরে-মুচড়ে যাবে, কিন্তু তাতে কী, আদৌ আর কখনো সেটা ব্যবহার হবে না। ও, হ্যাঁ-বাল্কহেডগুলো অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। তাই জাহাজের বাকী অংশে কোনো আসর পড়বে না। আর, যদি অভিযানে যাই-ই, তো ফায়ার ফাইটিং ক্রুদের ভিতরের দিকে প্রস্তুত রাখব, বাড়তি সাবধানতা-আর কী!

ধারণাটা দারুণ, যদি জিউসের পর্বত ঘুরে আসা যায় তো পুরো অভিযানকে ব্যর্থ বলা যাবে না।

গত এক সপ্তাহে সবার উপর যে ঝড় গেল তাতে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস পাহাড়টার রহস্যের দিকে চোখ ফেরানোর ফুরসতই পায়নি; চাচা, আপনা পরান বাঁচা টাই ছিল আসল ধান্ধা।

কিন্তু এখন বেঁচে যাবার আশা জাগছে; কাটছে অনিশ্চয়তা, গুছিয়ে আনা গেছে নিজেদের অনেকটাই-যথারীতি ভাবার মতো সময় হাতে পাওয়াতে নতুন চিন্তা দানা বাঁধছে।

যে মাউন্ট জিউস নিয়ে এতো কল্পনা-অতিকল্পনা তাকে দেখার চান্স কে মিস করে!

এখন, ভাবনার সময় পাওয়া মানেই আবারও ঝুঁকি নেয়ার সুযোগ। সুযোগ কে আর হাতছাড়া করে, নেয়া যাক আরো কিছু ঝুঁকি-মাথা পেতে।

৪৬. শাটল

স্মৃতি থেকে বলছি কথাগুলো, ড. অ্যান্ডারসন কথা পাড়ছে আসরে, গদারের প্রথম রকেটটা মিটার পঞ্চাশেক চলেছিল টেনেটুনে; আল্লা মাবুদ জানে মি. চ্যাঙ রেকর্ডটা ভাঙতে পারবেন কিনা।

আরো ভালোও হতে পারে-কিংবা কে জানে, হয়তো সবাই মহা গায় পড়বে।

সায়েন্স টিমের প্রায় সবাই অবজার্ভেশন লাউঞ্জে জড়ো হয়েছে। চোখ অস্থির, শিপের গায়ের শেষপ্রান্তে কী হয় তা নিয়ে চিন্তিত। এখান থেকে গ্যারেজটা দেখা না গেলেও অসুবিধা নেই, বিল টি বেরিয়ে যেতে নিলে, (যদি আদৌ বেরোয়…) ঠিকই দেখা যাবে।

কাউন্ট ডাউন বলে কিছু নেই; যথেষ্ট সময় নিচ্ছে চ্যাঙ, সম্ভাব্য সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিচ্ছে শেষ মুহূর্তে-একেবারে নিশ্চিত বোধ না করলে ফায়ার করবে না। শাটলকে যথাসম্ভব হাল্কা করে নেয়া ছিল আগেভাগেই। একশ সেকেন্ড ওড়ার মতো প্রোপ্যাল্যান্ট নিয়ে উড়বে। সব ঠিকমতো চললে সমস্যা হবে না, কিন্তু যদি কোনো সমস্যা হয়েই যায়-ঠেকানোর উপায় নেই।

হোয়ার উই গো… সপ্রতিভভাবে বলল চ্যাঙ।

এ এক পুরনো ট্রিক। এ কৌশলে সহজেই টেনশনকে বিকল করে দেয়া যায়; চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেল।

কেউ বিল টি কে বেরুতে দেখেনি। দেখবেই বা কীভাবে, মুহূর্তের মধ্যে চলে গেছে সেটা চারদিকে ধোঁয়া আর বাষ্পের জমাট আস্তর রেখে । মেঘ সরতে সরতে দেখা গেল দুশ মিটার দূরে ল্যান্ড করছে খেয়া নৌকাটা।

লাউঞ্জের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আনন্দের একটা হুল্লোড় বয়ে গেল।

হি ডিড ইট! সাবেক ভারপ্রাপ্ত কাপ্তান লি আনন্দে কেঁদে ফেলল, সে গদারের রেকর্ড ভেঙেছে! এক তুড়িতেই!

ইউরোপার অচেনা ভূমিতে চারপায়ে কিম্ভূতভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় বিল টি কে দেখতে প্রায় আগেরদিনের অ্যাপোলো চান্দ্র মডিউলের মতো লাগছিল। কিন্তু এই চিন্তাটা এখন ব্রিজে থাকা ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের মাথায় ঘুরছে না।

হঠাৎ মনে হল তার শিপটা যেন কোনো অকেজো মা-তিমি মাছ মারা যাবে আর একটু পরই-সদ্য জন্মানো বাচ্চাটা যেন বাঁচে সে প্রত্যাশা তার মনে।

.

আরো অনেক অনেক ব্যস্ত আটচল্লিশটা ঘন্টা পেরিয়ে উইলিয়াম সুখকে রণসজ্জায় সাজানো হল। দ্বীপের দশ কিলোমিটার সার্কিটে বারবার তাকে বাজিয়ে নেয়া হয়েছে এরই মধ্যে। এখনো মিশন পুরো করতে অনেক সময় পাওয়া যাবে।

আরো তিন দিনের মধ্যে ইউনিভার্সের চলে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এদিকে জিউস পর্বতের অভিযান নিবে মাত্র ছঘণ্টা সময়। এমনকি ড. ভ্যান ডার বার্গের জটিল যন্ত্রপাতি বসানো সহ অন্যান্য কাজ হিসাবে নিলেও এরচে বেশি সময় লাগবে না।

সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ ল্যান্ড করার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন তাকে কেবিনে ডেকে নিল।

স্কিপারকে এমন অসুস্থ আর অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে কেন! ভাবল চ্যাঙ।

দারুণ কাজ, ওয়াল্টার-কিন্তু অবশ্যই, এ ফলটা আমরা আশা করেছিলাম। ক্যাপ্টেন সহজে অফিসার ও প্যাসেঞ্জারদের কাউকে ডাকনাম ধরে ডাকে না। আন্তরিকতা প্রকাশ পাচ্ছে তার কথায়।

“থ্যাঙ্কস, স্যার-তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

হেসে দিল ক্যাপ্টেন। কোনো ভাল স্পেস –পেটে কথা রাখতে জানে না।

হেড অফিস, যথারীতি। আমি আপনাকে নিরুৎসাহিত করতে চাই না মোটেও। কিন্তু ভাই, বিধি বাম। সোজা আদেশ এসেছে, ড, ভ্যান ডার বার্গ আর সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড এ অভিযানে বেরুচ্ছেন।

মনের চোখে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। বেচারা হতাশ মনে তিক্ত গলায় বলল, তো, আপনি কী জবাব দিলেন?

যথারীতি, কোনো জবাবই দেইনি। এখনো দেইনি বলেই আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছি। আমি নির্দ্বিধায় বলব যে আপনিই মিশনটা চালানোর সবচে যোগ্য পাইলট।

তারাও জানবে যে কথাটা… ননসেন্স হয়ে যাবে। ফ্লয়েড আমার মতো ভালভাবেই কাজটা করতে পারবে। অভিযানে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেই-যদি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা না দেয়, তো। আর যান্ত্রিক ত্রুটি আপনাকে-আমাকে বা ফ্লয়েডকে দেখে আসবে না।

আমি এখনো নিজের ঘাড়ে দোষ নিতে রাজি আছি যদি আপনি চান। হাজার হলেও, আমার ইচ্ছাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। তার উপর পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আমরা সবাই হিরোতে পরিণত হব, তখন মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর সাহস পাবে কোন্ ব্যাটা?

চ্যাঙ এর মধ্যেই মনে মনে কিছু হিসাব কষা শুরু করে দিয়েছে। ফল দেখে বোধহয় বেশ তুষ্ট হল।

পে লোডের বদলে আরো শ কিলো প্রোপ্যাল্যান্ট ভরতে পারলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে চোখের সামনে। আগেই মনে হয়েছিল, কিন্তু বিল টি থেকে কে নামবে সেটা ভাবতেই বিব্রতবোধ করতাম, এখন ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে। বিশেষত ঐ অতিপ্রাকৃতিক প্রাকৃতিক জিনিসটার…।

আর বলা লাগবে না। চীনের মহা প্রাচীর, বলে যান।

ঠিক তাই, জ্বালানী বেশি ভরতে পারলে কুছ পরোয়া নেহি। আগাগোড়া ছুঁড়ে ফেরা যেত। এটা আসলে কী তাও বের করা যেত সহজেই।

আমার ধারণা, দারুণ একটা আইডিয়া আছে আমাদের হাতে। ঠিক জানি না কাছাকাছি যাওয়া উচিত হবে কিনা… আমাদের কপালে পেরেক ঠুকতে পারে ব্যাপারটা।

পারে। কিন্তু আরো একটা কারণ আছে, আমাদের কারো কারো কাছে এ মরণ অনেক অনেক ভাল…

বলে যান।

জিয়াং। সেটা দেয়াল থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে। সেখানে একটা প্রোব ফেলতে পারলে দারুণ কাজ হয়।

তো, এই কথাই তার ক্রুরা সারাদিন গুজগুজ করে আলাপ করত! আরো অনেকদিনের মতো আবারও তার ম্যান্ডারিন ভাষা জানার খুব ইচ্ছা হল। চীনের শত কোটি লোক এ ভাষায় কথা বলে, জানলে কাজে লাগতো বেশ।

ব্যাপারটা বুঝতে পারছি আমি, শান্ত সুরে বলল কাপ্তান, ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। আর এ নিয়ে কথা বলব ফ্লয়েড ও ভ্যান ডার বার্গের সাথে। কাজটা তারা হাজার হলেও, মনোযোগ দিয়ে করবে বলে মনে হয়।

আর হেড অফিস?

ড্যাম ইট! এটা হবে আমার সিদ্ধান্ত।

৪৭. টুকরোগুলো

তাড়াতাড়ি করাই ভাল, গ্যানিমিডের সেন্ট্রাল কমান্ড উপদেশ দিল, ইউরোপার সাথে আইওর অর্বিটের পরের বারের সম্মিলনটা মোটেও জুতসই হবে না। আইওর সাথে সাথে আমরাও ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠব।

আমরা আপনাদের ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি, কিন্তু আমাদের রাডারের মাথা খারাপ না হয়ে থাকলে, পাহাড়টা আরো শত মিটার নিচে দেবে গেছে, গতবার চেক করার পর, কীভাবে-গড নোজ।

এই হারে চলতে থাকলে, ভাবল বার্গ, আর বছর দশেক, তারপরই ইউরোপা একেবারে সমতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর চেয়ে কত দ্রুত এখানে ঘটনা ঘটছে দেখে তাল সামলানো কষ্টকর। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সবার আগ্রহ থাকবেই-কিন্তু এই অকল্পনীয় পট-পরিবর্তনও ভূগোলবিদদের এই উপগ্রহের দিকে আকৃষ্ট করে।

এসব ভাবছে সে ফ্লয়েডের ঠিক পেছনে বসে থেকে; চারদিকে নিজের আনা জিনিসপাতির দঙ্গল। নড়াচড়ার যো নেই।

অদ্ভুত হলেও, সে একইসাথে আগ্রহ আর ভয় দেখতে পাচ্ছে মনের ভিতর। আর মাত্র হাতেগোনা কয়েক ঘণ্টা-তারপরই তার জীবনের সবচে বড় অভিযান সম্পন্ন হবে। ফলটা ভাল হোক আর মন্দ-শেষ যে হবে তা নিশ্চিত। এ ঘটনার সাথে মেলানোর মতো আর কোনোকিছু একজন মানুষ জীবনে একাধিকবার পায় না… ভাবতে ভাবতেই ভ্যান ডার বার্গের মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ ফ্রয়েডের কথা। এক জীবনে সে তিন তিনবার যুগ পাল্টানো ঘটনায় জড়িয়ে গেল!

এম্নিতে তেমন ভয় স্পর্শ করছে না মনটাকে-মনোবল বাড়িয়ে রেখেছে তার আত্মবিশ্বাস এবং যন্ত্রবিশ্বাসের সমন্বয়। একটা কথা ভেবে মন কেমন যেন করছে। মৃত রোজি ম্যাককোলেনের কথা ভেবেই এ চিন্তা আসে ঘুরেফিরে। মেয়েটা এমন না করলে কোনোদিনই সে এ সুযোগ পেত না।

ঠেসে ভরা বিল টি টেক-অফের সময় বড়জোর এক-দশমাংস মাধ্যাকর্ষণ সহ্য করতে পারে; এমন কাজের জন্য সে মোটেও উপযুক্ত নয়। কিন্তু পোক্তভাবে বানানোয় টিকে যাবে, বেশ ভাল কাজ দিবে এই অভিযানটায়।

অনেক যুগ পরে যেন আকাশে উড়ল শাটলটা। এদিকে এতোক্ষণে শিপ-গাত্রের ক্ষতি খতিয়ে দেখার সময় পেল তারা। এসিড বৃষ্টি হয়েছে সেখানে-মৃদু।

ফ্লয়েড যখন উঠতে উঠতে যন্ত্রপাতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে তখন ভ্যান ডার বার্গ ভিউপোর্টে দেখে দেখে শিপের অবস্থা নিয়ে একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল দ্রুত। অবশ্য খুব একটা কিছু যায় আসে না, আর দিন দু-তিন-তারপরই গ্যালাক্সি বিরান হয়ে যাবে।

তারা পুরো স্বর্গ দেখতে পাচ্ছে তাদের ঠিক নিচে। এখন ভ্যান ডার বার্গ ঠিক বুঝতে পারছে অ্যাক্টিং ক্যাপ্টেন লি কী কঠিন কাজটাই না করেছে শিপ ভিড়ানোর সময়।

এই স্বর্গে শিপটা রাখার মতো মাত্র কয়েকটা স্থান ছিল আর সাবেক নাবিক কী অদ্ভুত দক্ষতায় কাজ করল, তাও আবার বাতাস-সাগরের ঢেউ কাজে লাগিয়ে!

বিশ মিনিট ধরে চারদিকে শুধু রহস্যময় মেঘ, কারণ বিল টি শক্তি বাঁচাতে সেমি ব্যালাস্টিক মিসাইল হয়ে প্রায় সোজা উঠে গেছে উপরে, নামবেও সোজা। সাগরের উপর দিয়ে সরাসরি উড়িয়ে নিতে গেলে প্রতিনিয়ত ফুয়েল খোয়াতে হবে, দরকার কী!

একটু মন খারাপ হল গ্যানিমিডের বিজ্ঞানীর, আমি নিশ্চিত নিচের সমুদ্রে অজানা অচেনা অনেক প্রাণী সাঁতরে বেড়াচ্ছে, আর আমার পরে আর কেউ সেগুলো দেখার কোনো সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না…

ইঞ্জিন কাট অফ হতে যাচ্ছে। বলল ফ্লয়েড, এভরিথিং নরমাল।

ভেরি গুড, বিল টি! আপনাদের উচ্চতায় কোনো যানবাহন থাকার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। এখনো ল্যান্ডিং রানওয়েতে আপনারাই প্রথম।

ভাঁড়টা কে? প্রশ্ন তুলল ভ্যান ডার বার্গ।

রনি লিম। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই ল্যান্ডিং রানওয়েতে আপনারাই প্রথম। ডায়ালগটা অ্যাপোলো যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় খুব।

ভ্যান ডার বার্গ সহজেই বুঝতে পারে কেন কথাটা বলছে ফ্লয়েড। এটা আসলে ঠিক ঠাট্টা নয়, চিরাচরিত রসিকতা কিংবা ভাড়ামো নয়, যখনই কোনো বড় ধরনের বিপদের দিকে কেউ এগিয়ে যায় তাকে এমন করে উৎসাহ দেয়া উচিত। কথার উৎসাহ নয়, রসিকতা দিয়ে হাল্কা করা।

ব্রেকিং শুরু করতে পনের মিনিট বাকী। বলল ফ্লয়েড, দেখা যাক আর কে এখন অন দ্য এয়ার।

সে অটোস্ক্যানের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ব্লিপ আর আলোর ওঠানামা দেখতে হচ্ছে তীক্ষ্ণ চোখে। না, কোনো না কোনো জায়গা থেকে শব্দ তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে এগিয়ে আসছে। কোত্থেকে, তারা না জানলেও আন্দাজ করতে জানে।

আপনাদের লোকাল বিকন আর ডাটা ট্রান্সমিশনে বোঝা যাচ্ছে বলল ফ্লয়েড, অনেকটা আনমনেই, মনে করেছিলাম যে… আহ্ এই তো, এসে পড়েছি!

একটা ছোট্ট মিউজিক্যাল টোন বাড়ছে-কমছে। ফ্লয়েড তাকালো সেদিকে।

ডপলার শিফট চলে গেছে-নামিয়ে আনছি তাকে।

এটা আবার কী? টেক্সট?

স্লোস্ক্যান ভিডিও, যদ্দূর মনে হয়। তারা গ্যানিমিডের বিগ ডিশটা দিয়ে সারাক্ষণ হাজারটা তথ্য পাঠায় পৃথিবীতে। নেটওয়ার্ক নতুন খবরের জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে।

এই কিম্ভূত শব্দের দিকে তারা অনেকক্ষণ কান পেতে থাকল। এ কেমন মিউজিক? বাজনার তো একটা ধরণ থাকা উচিত। আর না, ফ্লয়েড সাথে সাথে বন্ধ করে দিল সুইচটা। এখন এসব শোনার কোনো মানে হয় না। ইউনিভার্স এগিয়ে আসছে, সাহায্য আসতে দুদিন বাকী।

কেন যাচ্ছে তারা? অসম্ভবের দিকে কেন যাওয়া? কেন নিষিদ্ধের পথে? নিষেধ না মানার জন্য, নাকি বিজ্ঞানের কল্যাণে? নাকি শুধু নিজের কৌতূহলে! কে জানে!

ভ্যান ডার বার্গ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলল, পরে আর আপনার দাদার সাথে কথা হয়েছে নাকি?

হয়েছে। অবশ্যই, কথাটা কেমন যেন খাপছাড়া। কোটি কিলোমিটার দূর থেকে কথা হওয়ার ব্যাপারটা সহজ নয়। তাই মানুষ সব সময় সহজ বিকল্প বেছে নেয়। ভয়েসগ্রাম, অডিওমেইল বা এ-মেইল, ভোকার্ড এর উন্নতি এতো দ্রুত হয়েছে যে বলে প্রকাশ করার মতো না। তারপর স্রেফ মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।

এখনো মানুষ আশা ছাড়েনি। সৌর জগতের বিশাল এলাকায়, কোটি কোটি কিলোমিটারের দূরত্বে, এখনো মানুষ রিয়েল টাইম স্পিকিংয়ের আশা নিয়ে বসে আছে। সারাক্ষণ তারা একটা যন্ত্রণা করে বেড়ায়: আপনারা বিজ্ঞানীরা কোন ঘোড়ার ঘাস কাটেন? কেন পারছেন না এ কাজটা করতে?

হ্যাঁ বলল ফ্লয়েড বেশ কিছুক্ষণ পরে, ভালই আছে। আশা করি দেখব কদিন পরেই।

তার সুরের ঠিক কোথায় যেন একটু টান টান উত্তেজনার ভাব লুকানো। কে জানে… ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, কিন্তু টাচডাউনের আগে কোনোরকম বাগাড়ম্বরে যাবার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।

প্রোগ্রাম সিকোয়েন্সরটা ঢোকানোর পর পরই নিভে গেল কমেন্স ব্রেকিং অ্যালার্ম ।

আমার ভার ভাল হাতের উপরই পড়েছে, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, রিল্যাক্স করে নিজের কাজে মন দেয়া উচিত আমার। ক্যামেরা কোথায় গেল-বলোনা আবার ভেসে গেছে একদিকে…।

মেঘ সরে যাচ্ছে আকাশ থেকে। অথবা তারা মেঘময় আকাশ থেকে নেমে আসছে। যদিও চোখে দেখার মতো স্পষ্ট করে রাডার দেখিয়েছে ঠিক কোথায়, কীভাবে জিউস পর্বতটা মাথা তুলে দাঁড়ালো, তবু মেঘ কেটে যেতেই ঠিক নিচে, কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়টা দেখে কেমন যেন করে উঠল তাদের মনের ভিতরটা।

দেখুন! চিৎকার করে উঠল ফ্লয়েড, ব দিক দিয়ে। জোড়া চূড়ার দিকে দেখুন… একটু আন্দাজ করা সম্ভব কী ঘটছে সেখানে।

শিওর। আপনার কথাই ঠিক। মনে হয় না আমরা কোনো ক্ষতি করেছি-জিনিসটা শুধু ছড়িয়ে পড়েছিল-অন্যটা যে কোথায় পড়ল…

উচ্চতা এক হাজার। কোনো ল্যান্ডিং সাইটটায়? এখান থেকে আলফাঁকে দেখে তেমন ভাল লাগছে না।

“ঠিক বলেছেন-গামাতে চেষ্টা করলে কেমন হয়-মাউন্টেন থেকে বেশ কাছে…

পাঁচশো। এটা গামা। বিশ সেকেন্ডের জন্য ভাসব-আর যদি পছন্দ না হয় তো বল, বিটাতে যাচ্ছি। চারশো… তিনশো… দুশো,… (গুডলাক, বিল টি–বলল গ্যালাক্সি সংক্ষেপে)… থ্যাঙ্কস রনি… ওয়ান হান্ড্রেড অ্যান্ড ফিফটি… এবার কী করা যায়? কয়েকটা পাথর ছড়ানো আছে সেখানে। আর-এটাতো বেমানান-সারাটা জায়গাজুড়ে ভাঙা কাঁচ ছড়ানো, অন্তত দেখে এমনি মনে হচ্ছে-কারা যেন এখানে জঙলি পার্টি দিয়েছিল… এখনো ওকে?

পারফেক্ট। নামতে থাক, ক্রিসি।

“চল্লিশ… ত্রিশ… বিশ… তোমরা নিশ্চিত? এখনো মন বদলাবে না?… দশ… একটু ধুলা ওড়াচ্ছি লাথ মেরে… যেমনটা বলেছিল এককালে নিল আর্মস্ট্রং-নাকি বলেছিল ব্যস্ত?… পাঁচ… কনটাক্ট! একদম সহজেই, তাই না? ঠিক বুঝলাম না কেন আমার ঠিক ইজি লাগেনি।

৪৮. লুসি

হ্যালো, গ্যানি সেন্ট্রাল-আমাদের ল্যান্ডিংটা একেবারে নিখুঁত। মানে, ক্রিস কোনো এক কিম্ভূত পাথরের উপর নামিয়ে দিয়েছে যানটাকে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মাত্র কিলোমিটার দুয়েক দূরে। কিন্তু আমার মনে হয় এরচে কাছে যাবার কোনো মানে নেই…

এখন টপ স্যুটগুলো পরে নিচ্ছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আনলোডিং শুরু হয়ে যাবে। মনিটর চালু রাখব, অবশ্যই। আর প্রতি পনের মিনিটে একবার করে কল করব। ভ্যান আউট।

এরচে কাছে যাবার কোনো মানে নেই… মানেটা কী? প্রশ্ন তুলল ক্রিস।

মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে দিল ভ্যান ডার বার্গ। গত কমিনিটে যেন সে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে; এখন শাসন না মানা দুরন্ত কোনো বাচ্চা ছেলে যেন।

সারকামস্পিস আরো যেন খুশি হয়ে উঠেছে গ্যানিমিডের বিজ্ঞানী, ল্যাটিন শব্দ। মানেটা হল, নিজের চারদিকে তাকাও চোখ কান খোলা রেখে। আগে বড় ক্যামেরাটা বের করা যাক… ওয়াও!

হঠাৎ কেমন যেন ঝাঁকি খেল বিল টি। তারপর ঠ্যাঙগুলো শক অ্যাবজর্ডিং প্রোগ্রামের কল্যাণে এমনভাবে দুলল যে আরেকটু হলেই সি সিকনেস শুরু হয়ে যেত।

ভূকম্পনের ব্যাপারে গ্যানিমিডের কথাই ঠিক। বলল ফ্লয়েড, গুছিয়ে নেয়ার পর, কোনো সিরিয়াস ভয় নেইতো?

না-ও থাকতে পারে। মিলে যেতে আরো ত্রিশ ঘণ্টা বাকী। এটাকে দেখে পাথরের শক্ত স্ল্যাবের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু তবু, এখানে আমরা বসে বসে বাদাম খেয়ে সময় নষ্ট করব না। আর, আমার মাস্কটা ঠিক আছে তো? লক্ষণ বেশি ভাল ।

স্ট্রাপ শক্ত করে দিচ্ছি। এইতো, ঠিক হ্যায়। শক্ত করে দম নিন, এখন আরাম লাগছে, না? আমি আগে যাব।

ভ্যান ডার বার্গ খুব আশা করেছিল সেই আগে লিটল স্টেপ ফেলবে। কিন্তু বিধি বাম হলে কী আর করা? এখানে ফ্লয়েডই কমান্ডার, তার উপর ভূকম্পনে কোনো ক্ষতি হল কিনা তা দেখতে যাবার দায়িত্ব আছে ওর কাঁধে। যদি এখনি আবার উড়াল দিতে হয় তো সেটা বের করার জন্য ওকেই পা রাখতে হবে মাউন্ট জিউসের পাদদেশে।

প্রথমেই সে একবার ছোট্ট স্পেসক্রাফটটার চারপাশে চক্কর কেটে নিল। ল্যান্ডিং গিয়ারগুলো এমন ঝাঁকি খেয়ে ঠিক আছে তো? ঠিকই আছে, বুড়ো আঙুল দেখালো মই বেয়ে নামতে থাকা ভ্যান ডার বার্গের দিকে। যদিও সে স্বর্গে পরা সেই হাল্কা ব্রিদিং অ্যাপারেটাসের সাথে সেই স্পেস স্যুটই পড়েছে, তবু কেমন যেন লাগছে তার।

ল্যান্ডিং পড়ে নেমেই একটু ঠিকঠাক করে নিতে চেষ্টা করল বিজ্ঞানী। কিন্তু সাথে সাথেই উপরে তাকিয়ে ফ্লয়েডের কাজ খেয়াল করল।

স্পর্শ করবেন না! চিৎকার করল সাথে সাথে, ডেঞ্জারাস!

চিৎকার শুনে এক লাফে মিটার খানেক সরে গেল ফ্লয়েড। এক বিচিত্র পাথরকে সে পরীক্ষা করছিল। একটা বড় কাঁচের টুকরা দ্যুতি ছড়াচ্ছিল সেখানে।

“নিশ্চই তেজস্ক্রিয় নয়, কী বলেন? বেশ ভয় পেয়ে গেল সে।

না। কিন্তু আমি যাবার আগে দূরে থাকুন।

অবাক হয়ে ফ্লয়েড দেখল যে ভ্যান ডার বার্গ আগে থেকেই মোটা হাতমোজা পরে এসেছে। একজন স্পেস অফিসার হিসেবে ফ্লয়েড অনেক সময় নিল একটা ব্যাপার বিশ্বাস করতে; এখানে-এই ইউরোপায় খোলা হাওয়ায় চামড়া বের করা যাচ্ছে। এই সৌর জগতের কোথাও, এমনকি মঙ্গলের বুকেও শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত করা অসম্ভব।

অতি সাবধানে ভ্যান ডার বার্গ নিচে এসে কাঁচের জিনিসটার একটা টুকরো তুলে নিল। এমনকি এই কিম্ভূত আলোতেও দারুণভাবে ঝিকিয়ে উঠল জিনিসটা। আর ফ্লয়েড দেখল এর ধারটা বেশ তীক্ষ্ণ।

চেনা সৃষ্টিজগতে সবচে ধারালো ছুরি।

দাঁত কেলিয়ে বলল ভ্যান ডার বার্গ। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারল মাস্কের নিচে কাজটা সহজ নয়।

তো, আপনি এখনো জানেন না জিনিসটা ঠিক কী?

এখন মনে হচ্ছে একমাত্র আমিই জানি না।

সাথীকে কাঁধে ধরে জিউস পর্বতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল ভ্যান ডার বার্গ। এই দূরত্ব থেকে পর্বতটা আধ আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সদম্ভে। শুধু শ্রেষ্ঠ বললেই চলে না-বরং এই জগতের একমাত্র পর্বত এটা।

দৃশ্যটা শুধু মিনিট খানেকের জন্য দেখতে থাকুন, তারিফ করতে থাকুন মনে মনে। আমি একটা জরুরী কল করব এর মধ্যে।

একটা কোড দিল সে তার কমসেটে। একটু পর রেডি ফ্ল্যাশ ভেসে উঠল, সাথে সাথেই হড়বড় করে বলে উঠল জোর গলায়, গ্যানিমিড সেন্ট্রাল ১০৯, দিস ইজ ভ্যান। রিসিভ করেছেন?

একটু পরই স্পিকার থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল:

হ্যালো, ভ্যান। গ্যানিমিড সেন্ট্রাল ১০৯ বলছি। রিসিভ করতে প্রস্তুত।

ভ্যান ডার বার্গ তার জীবনের চিরস্মরণীয় মুহূর্তটাকে আরো একটু প্রলম্বিত করে তারপর শুরু করল কথা।

পৃথিবীর আইডেন্ট আঙ্কল ৭৩৭ কে বের করুন, এখুনি। তারপর কথাটা প্রচার করুন, লুসি ইজ হেয়ার, লুসি ইজ হেয়ার। বলুন দেখি কী বলতে হবে?

গ্যানিমিড ম্যাসেজটা রিপিট করাতে ফ্লয়েড ভাবল, যে খবরই সে পাঠিয়ে থাক না কেন, আমার হয়তো উচিত ছিল তাকে বাধা দেয়া। কিন্তু দেরি যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে।

স্যরি অ্যাবাউট দ্যাট, ক্রিস। দাঁত কেলিয়ে আবারও হাসল ভ্যান ডার বার্গ, আবারও তার হাসি বাঁধা পেল মুখোশের কারণে, আমি আর সবকিছুর উপর প্রাধান্য পেতে চেয়েছিলাম।

তোর প্রাধান্যের খেতা পুড়ি, তুমি যদি এখুনি কথা বলা শুরু না কর, তত তোমার প্যাটেন্ট করা সেসব গ্লাস-চাকু দিয়ে এফোঁড়-ওফোড় করে দিব।

গ্লাস, অবশ্যই! যাক, ব্যাখ্যাটা… এই! সবুর! ভয় পাইয়ে দিবে তো! ব্যাখ্যা করতে গেলে জল আরো ঘোলা হবে, আমারও চাকুর ঘা খেতে হতে পারে, তাতে পরিবেশ পরিষ্কার হবে না একটুও। তারচে সরাসরি ফ্যাক্ট নিয়ে কথা বলা যাক…

“জিউসের পর্বত… জিউসের পর্বত একটা অখণ্ড হীরা। অনুমিত ভর? এক মিলিয়ন মিলিয়ন টন। কিংবা, তুমি যদি অন্য পথে ব্যাপারটাকে দেখতে চাও, সতেরতম ক্যারেটের চেয়ে অন্তত দু বার দশ দিতে হবে উপরে। আমি কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারব না এটার সবটাই অটুট কিনা সে বিষয়ে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *