২. কালো তুষারের উপত্যকা

দ্বিতীয় পর্ব – কালো তুষারের উপত্যকা

১৫. সম্মেলন

হ্যালি এখন বলতে গেলে চোখের সামনে। তবে পৃথিবীতে বসা দর্শকরাই ধূমকেতুটাকে সবচে স্পষ্ট দেখতে পাবে। তখন এর পুচ্ছ ছড়িয়ে পড়বে আরো আরো। এখনি পাঁচ কোটি কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাজত্ব করছে এর লেজ। যেন কোনো রণপোত তার বিশাল ত্রিকোণ নিশান উড়িয়ে চলেছে সৌর বাতাসে শিষ কেটে; কোন্ এক দেশের খোঁজে।

সম্মেলনের দিন হেউড ফ্লয়েড সকাল সকাল একটা ক্লান্তিকর ঘুম ছেড়ে উঠল। স্বপ্ন দেখাটা তার কাছে বেশ অস্বাভাবিক। অন্তত স্বপ্নের কথা মনে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না–বিশেষত আগামী কয়েক ঘণ্টার আসন্ন উত্তেজনায় স্বপ্ন দেখার দিন কি এখনো আছে? অবশ্য ক্যারোলিনের মেসেজটাও বেশ কষ্ট দিল; গত কদিনে ক্রিসের কোনো খবর পেয়েছে কিনা ফ্লয়েড-এই ছিল তার প্রশ্ন। সে খবর পাঠালো, একটু বিরক্ত হয়েই। ফ্লয়েড ক্রিসকে ইউনিভার্সের সিসটার শিপ কসমসে বর্তমান পদে সুযোগ করে দিলেও কক্ষনো ক্রিস দাদুকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো কষ্ট স্বীকার করেনি। সে হয়তো এর মধ্যেই চাঁদ-পৃথিবী-চাঁদ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অন্য কোনো উত্তেজনা খুঁজছে অন্য কোথাও।

যথারীতি, ফ্লয়েড এটুকুও যোগ করল, আমরা তার জবাব পাব যদি কখনো সুন্দরমতো সময় করে গুছিয়ে উঠতে পারে…

সকালের নাস্তার পর পরই যাত্রী আর বিজ্ঞানীদল ভিড় করল ক্যাপ্টেন স্মিথের কাছে। পরবর্তী ব্রিফিংয়ের আশায়। বিজ্ঞানীদের আসলে এমন কোনো ব্রিফিংয়ের আদৌ প্রয়োজন নেই, কিন্তু এটা নিয়ে না রাখার পর যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি হয়েই যায় তো পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে। তারচে ক্যাপ্টেনের কাছে ক্লিয়ার থাকাই ভাল।

এমনটা ভাবা খুবই সহজ যে ইউনিভার্স কোনো নেবুলার মধ্যদিয়ে পথ করে যাচ্ছে-ধূমকেতুর পাশ দিয়ে নয়। সামনের পুরো আকাশ সাদা কুয়াশায় আচ্ছন্ন । একই রকম নয়-কোথাও কালচে, কোথাওবা ঘন, মাঝে মাঝে উজ্জ্বল জেটের ছোঁয়া; ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই ম্যাগনিফিকেশনে ধূমকেতুটির নিউক্লিয়াস পর্যন্ত দেখা যায়; কালো, ছোট্ট বিন্দু। আর এই উৎস থেকেই চারপাশের সব জাদুর উৎপত্তি।

ঘণ্টা তিনের মধ্যে ড্রাইভ বন্ধ করতে পারব আমরা। বলল ক্যাপ্টেন, তখন নিউক্লিয়াসের কত কাছে থাকব আপনারা কি কল্পনা করতে পারেন? মাত্র এক হাজার কিলোমিটার। এবং আপেক্ষিক গতি থাকবে শূন্য। তখনই চূড়ান্ত কয়েকটা পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষার পালা। তারপর? ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে বের করব আমরা।

“তারমানে ওজনশূন্যতা আসছে কাঁটায় কাঁটায় ১২:০০ টায়। তার আগে আপনাদের কেবিন স্টুয়ার্ডরা সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখবে। আবারও ব্যাপারটা বদলে যাবে, তবে এবার দু ঘণ্টার পালা নয়-টানা তিন দিন। এই যা, তারপরই আবার ওজন ফিরে পাচ্ছি।

“হ্যালির মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে চিন্তিত? ভুলে যান। পৃথিবীর হাজার ভাগের এক ভাগ। অনেক অনেকক্ষণ থাকলে ব্যাপারটা এক-আধটু বুঝে উঠতে পারবেন হয়তো; ব্যস-এটুকুই। কোনো জিনিসের এক মিটার পতন হতে সময় লাগে মোটামুটি পনের সেকেন্ড…

“নিরাপত্তার খাতিরে আমি আপনাদের সবাইকে এখানে, অবজার্ভেশন লাউঞ্জে পেলেই বেশি খুশি হব। বেল্ট যেন শক্ত করে বাঁধা থাকে, অন্তত সাক্ষাৎ আর

স্পর্শের সময়টায়। অবশ্য এখান থেকেই সবচে ভালভাবে ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করা যাবে। পুরো অপারেশনে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগবে না আশা করি। খুবই ছোট ছোট থ্রাস্ট কারেকশন ব্যবহার করব; কিন্তু সেসব ছোট্ট থ্রাস্ট শিপের যেকোন অংশ থেকে আসতে পারে, তাই কাছেপিঠে থাকাটা ঠিক নয়; আঁকিলাগতে পারে।

আসলে ক্যাপ্টেন স্পেস সিকনেসের কথাই বলতে চায়। কিন্তু এই শব্দটা ইউনিভার্সে ব্যবহার না করার চুক্তি হয়েছে আগেই। অনেক হাতই সিটের নিচে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলাটা আছে তো? প্লাস্টিক ব্যাগটা না থাকলে বিপদে পড়তে হতে পারে।

ম্যাগনিফিকেশন বাড়ছে, স্ক্রিনের ইমেজটা আরো আরো চলে যাচ্ছে ভিতরের দিকে। মুহূর্তকালের জন্য ফ্লয়েডের মনে হল যেন কোনো এরোপ্লেনে আছে সে-প্লেনটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে হাল্কা মেঘের ভিতর পথ করে নিয়ে। নিউক্লিয়াসটা আরো আরো স্পষ্ট হচ্ছে; এখন আর দেখতে মোটেও কালো বিন্দু নয়, বরং এবড়োথেবড়ো চন্দ্রকলার মতো। যেন মহাসৃষ্টির অসীম সাগরে পথ হারানো কোনো নিঃসঙ্গ দ্বীপের পথ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ধীরে ধীরে হাজার বছরের রহস্য-কুয়াশার চাদর সরে যাচ্ছে।

এখনো পরিমাপ বোঝার কোনো উপায় নেই। যদিও ফ্লয়েড জানে সামনের দৃশ্যটা টেনেটুনে দশ কিলোমিটার হবে, তবু দেখেশুনে চাঁদের কথা মনে পড়ে যায়। চাঁদটা এতো বাষ্প ছড়ায় না, আর বুকে এমন বিশাল কোনো জ্বালামুখও নেই।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল মাইকেলোভিচ, এটা আবার কী?

সে নিউক্লিয়াসের নিচের প্রান্তে আঙুল তুলল; আঁধার অংশটার শেষপ্রান্তে আলো দিচ্ছে কী যেন। নিয়মিত ছন্দে অন-অফ, অন-অফ! দু-তিন সেকেন্ডে একবার করে। নিশ্চই কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। যেন কোনো সিগন্যাল বাতি।

যেন কেন? অবশ্যই বাতি। কৃত্রিম বাতি। কোনো ইশারা দিচ্ছে ওটা। কী ইশারা?

ড. উইলিস তার ধৈর্যের পরিচয় দিল, আমি এক লহমায় আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে পারি।

কিন্তু ক্যাপ্টেন স্মিথ প্রথমে শুরু করল ব্যাখ্যাটা, আপনাকে হতাশ করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, মাইকেলোভিচ সাহেব। ওটা স্যাম্পলার পোব টুর বিকন। জিনিসটা মাসখানেক হল হ্যালির গায়ে সেঁটে আছে; আমরা যাব, তুলে আনব।

কী লজ্জার কথা! আর আমি কিনা ভেবে বসে আছি সেখানে কেউ একজন…কিছু একটা আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

তেমন কোনো সৌভাগ্য কি আর হবে? একা আমরাই ওর দিকে এগিয়ে গেছি। বিকনটা আমাদের ল্যান্ড করার জায়গা নির্দেশ করছে। হ্যালির দক্ষিণ মেরুতে; এখন স্থায়ী আঁধার সেখানটায়। আমাদের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সাপেক্ষে সেটাই সুবিধাজনক স্থান। সূর্যালোক পাশে তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রী। পানির স্ফুটনাঙ্কের অনেক উপরে।

দেখেশুনে খুব একটা স্বাস্থ্যসম্মত মনে হচ্ছে না যে যাই বলুক। তিতকুটে চেহারা করে দিমিত্রি বলল, বিশেষত ঐ জেটগুলোতো মোটেও ভাল লক্ষণ দেখায় না। আচ্ছা, এই মরার পার্ক কি না করলেই কি নয়?

“ওই জেটগুলোও আমাদের অন্যপাশে পার্কিয়ের অন্যতম কারণ। ওখানে কোনো ব্যস্ততা নেই। এখন, আপনারা ক্ষমা করলে আমি একটু ব্রিজের দিকে যেতে চাই। একেবারে আনকোরা কোনো ভুবনে প্রথমবারের মতো ল্যান্ড করার সুযোগ আমার জীবনে এই প্রথম এলো। আর বড় সন্দেহ হয় জীবনে আর একবার নতুন দেশে প্রথমবার নামতে পারব কিনা। সুতরাং…

ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন স্মিথের সমাবেশ ফাঁকা গড়ের মাঠ হয়ে গেল। জুমটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে, নিউক্লিয়াসটা আবারো পরিণত হয়েছে কালো, ছোট্ট বিন্দুতে ।

দেখা হবার চার ঘণ্টা আগেও শিপটা ধূমকেতুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার বেগে।

খেলার এই পর্যায়ে মূল ড্রাইভে যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, তো হ্যালির বুকে যে কোনো জ্বালামুখ হার মেনে যাবে।

১৬. স্পর্শ

ল্যান্ডিংটা হল একদম ঠিকমতো; যেমনটা আশা করেছিল ক্যাপ্টেন স্মিথ। ঠিক কোনো মুহূর্তে যে ইউনিভার্স তার ভর ছেড়ে দিয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। স্পর্শেরও মিনিটখানেক পর সব যাত্রী বুঝতে পারল; তার পরই জয়ধ্বনি।

এক সরু উপত্যকার প্রান্তে, টেনেটুনে শত মিটার উঁচু পর্বতঘেরা এলাকায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ইউনিভার্স। চান্দ্র-প্রকৃতি দেখার আশা যেই করে থাক না কেন-বেশ অবাক হতে হবে তাকে। চাঁদের প্রকৃতি হাজার বছরের মহাজাগতিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বোমাবর্ষণে মসৃণতা পেয়েছে। আর তার গঠন লাখো বছরের পুরনো।

অন্যদিকে হ্যালি চিরযুবা। চির পরিবর্তনশীল। এমনকি পার্থিব পিরামিডগুলোও এসব পাহাড় আর উপত্যকার চেয়ে পুরনো। এখানে হাজার বছরের পুরনো বলে কোনো কথা নেই। প্রতিবার সূর্যের চারধারে ঘোরার সময় নক্ষত্রটার কাছাকাছি এসে পেরিয়ে যেতে যেতে সৌর আগুনে আমূল বদলে যায় হ্যালির পুরো চেহারা। এমনকি ১৯৮৬ সালের হ্যালির সাথেও বর্তমানের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। ভিক্টর উইলিসের মতো নির্জলা কন্ঠে বলতে গেলে, ৮৬ সালের বাদাম আকৃতি এখন সরু কোমর হয়ে গেল!

ঠিকই, বোঝা যাচ্ছে এভাবে আরো দু-চারবার চললে সূর্য একে প্রায় সমান দু ভাগ করে বসবে। আঠারোশ ছিচল্লিশের মহাকাশবিদদের মাথা খারাপ করে দিয়ে যেমন করে দুভাগ হয়ে যায় বিয়েলার ধূমকেতু, সেভাবে।

প্রায় না থাকা মাধ্যাকর্ষণও বোঝা যাচ্ছিল এই আজব ভূমিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে কিম্ভূত বস্তু আর তার আরো কিতাকার গঠন। মাকড়শা-জালের মতো হাল্কা, ফাপা জিনিসের বহর দেখেই এখানটার আকর্ষণ ঠাহর করা যায়। এমনকি চাঁদের বুকেও এগুলো কয়েক মিনিট টিকবে না, মিশে যাবে।

ক্যাপ্টেন স্মিথ মহাকাশ যানটাকে আঁধার প্রান্তে ল্যান্ড করালেও চারপাশ দেখা খুব সহজ। গ্যাসের যে বিশাল মোড়ক নিউক্লিয়াসটাকে মুড়ে রেখেছে সেটা যথেষ্ট আলো দেয়। দেখে মেরুজ্যোতি মনে হওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আর তাও যেন দেখা যাচ্ছে অ্যান্টার্কটিকার বরফপ্রান্ত ছাড়িয়ে। এ-ও যথেষ্ট না হলে লুসিফারের দেয়া শত সূর্যের আলো তো আছেই।

সবাই আশা করেছিল রঙের কোনো খেলা দেখা যাবে না এর বুকে-তবু না পেয়ে বেশ হতাশ হতে হল ক্রুদের। যেন ইউনিভার্স কোনো খোলা কয়লাখনিতে বসে আছে। চারপাশের কালোকে গোনায় ধরলে তুলনাটা মন্দ নয় মোটেও। তুষার আর বরফের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি মিশে আছে কার্বন আর কার্বনঘটিত যৌগের দল।

ক্যাপ্টেন স্মিথ, তার দায়িত্বানুযায়ী, ধীরে মূল এয়ারলক থেকে সাবলীলভাবে নিজেকে বের করে দিল। ভূমিতে পৌঁছতে পৌঁছতেই যেন বয়ে গেল অসীম সময়। তারপর গুঁড়োয় ঢাকা উপরিতল থেকে খানিকটা সে তুলে নিল মুঠো ভরে, গ্লাভস পরা হাতে রেখে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে দেখাও তার আগ্রহের অংশ।

আর এদিকে, ইউনিভার্সে বসে থাকা প্রত্যেকে অধীর আগ্রহ নিয়ে ইতিহাসের বুকে জায়গা করে নিবে যে কথাটুকু তার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করল।

ক্যাপসিকামের বিচি আর নুনের দানার মতো দেখাচ্ছে। বলল ক্যাপ্টেন, ছিটিয়ে দিলে বেশ ফসল ফলবে বোধহয়।

* * *

মিশনের পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। একটা পূর্ণ হ্যালির-দিন গবেষণায় কাটানোর কথা। পৃথিবীর হিসাবে পঞ্চান্ন ঘণ্টা। তারপর যদি কোনো সমস্যা না দেখা দেয় তো দক্ষিণ মেরু থেকে মাইল দশেক দূরে বিষুবীয় এলাকায় আরেকটা চক্কর দেয়া যেতে পারে। সুযোগ বুঝে সেখানে কোনো উষ্ণ প্রসবণ নিয়ে মেতে থাকা যাবে পুরো একটা দিবস-রজনী চক্র সাথে নিয়ে।

প্রধান বিজ্ঞানী পেভ্রিল সময় নষ্ট করায় বিশ্বাসী নয়। অপেক্ষারত প্রোবের বিকনের দিকে বেরিয়ে গেল সে একজন সহকারী সাথে করে নিয়ে দুজনের জেট স্নেডে করে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সগর্বে ফিরে এল তারা। সাথে বিভিন্ন স্যাম্পলের দঙ্গল। ডিপ ফ্রিজে রাখা হবে সেগুলো।

অন্য দলগুলো উপত্যকাজুড়ে তার-টারের একটা জাল বুনে ফেলেছে। খুঁটি দিয়ে বসানো সেসব, শেষপ্রান্ত ভাজা ভাজা কয়লার গহীনে। ফলে শুধু শিপের হাজারো যন্ত্রের সাথে সংযোগ হয়নি, বরং বাইরে চলাচলে বেশ সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। ঝক্কিঝামেলার এক্সটার্নাল ম্যানুভারিং ইউনিট বাদেই চলাচল সহজ হল এবার। শুধু ক্যাবলগুলোতে দু হাত দিয়ে আড়াআড়ি ধরলেই চলবে, আপনিই ধীরে ধীরে চলাচল করা যায়। খটমটে ই এম ইউ ব্যবহার করার চেয়ে এ কাজ অনেক সহজ আর আনন্দদায়ক। আসলে কোনো যন্ত্র যখন বেশি পূর্ণতা পায় তখনি সেটার প্রতি মানুষের আসক্তি কমে আসে। এই ইউনিটগুলো এক মানুষের জন্য পূর্ণ স্পেসশিপের কাজ করে দেখেই হয়তো এ অনাসক্তি।

যাত্রীরা এসব দেখেশুনে বেশ উত্তেজিত; আর আবিষ্কারের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টাতেও কোনো ত্রুটি নেই। এই উত্তেজনা খিতিয়ে আসতে আসতে প্রায় বারো ঘণ্টা কেটে গেল। সাবেক মহাকাশচারী ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গের মতে সময়টা অনেক কম। শিঘ্নি বাইরে যাওয়া নিয়ে কথা উঠল; শুধু ভিক্টর উইলিস কোনো কথা তোলেনি।

আমার ধারণা ও ভয় পাচ্ছে, খুব। দিমিত্রি বলল ঝাঁঝের সাথে। এমিতেও সে ভিক্টরকে কক্ষনো পছন্দ করতো না; বিশেষত এই বরেণ্য লোকটার কানে সামান্য খাটো হবার কথা জানার পর। ভিক্টরের প্রতি এটা অতি অন্যায় অবিচার। কারণ সে নিজেরই অসীম কৌতূহল আর পরীক্ষায় নিজেকে গিনিপিগ বানানোর মতো সাহস দেখিয়েছিল। দিমিত্রি কথাটার সাথে আরো একটু যোগ করার লোভ সামলাতে পারল না, যে মানুষের ভিতরে নেই সংগীতের মূৰ্ছনা; তার থাকবে শুধু অতৃপ্তি, অনন্ত সংগ্রাম আর অপূর্ণতা।

এদিকে পৃথিবীর অর্বিট ছেড়ে আসার আগেই ফ্লয়েড সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। ম্যাগি মবালা নিজেই যথেষ্ট, ধার করা উৎসাহের কোনো প্রয়োজন নেই তার ক্ষেত্রে। (হাজার হলেও, তার প্রিয় স্লোগান, একজন লেখকের কখনোই নূতন অভিজ্ঞতার সুযোগ হারাতে নেই। তার আবেগিক জীবনে অনেক অনেক বিখ্যাত প্রভাব পড়েছে)

ইভা মারলিন যথারীতি সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে; তাকে নিয়ে একটা ট্যুরের ইচ্ছা আছে ফ্লয়েডের মনে। সবার জানা, ফ্লয়েড তার একটু ভক্ত বটে; তার উপর প্যাসেঞ্জার লিস্টে ইভার নামটা উঠে আসার পেছনে ফ্লয়েডের যে হাত আছে তা নিয়েও কথা কম হয়নি। সেসব কথা বাড়তে বাড়তে এখন দারুণ একটা রূপ পেয়েছে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে ব্যস্ত সবাই। ব্যাপারটায় একটু হিংসা করছে যেন দিমিত্রি আর শিপের ফিজিশিয়ান ড. মহিন্দ্র।

প্রথম প্রথম বিরক্ত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না; কিন্তু কিছু সময় কাটার পর ফ্লয়েডের তারুণ্যের কথা মনে পড়ে যায়। এখন আর তাই রসিকতাটুকু খারাপ লাগে না, বরং উপভোগ্য মনে হয় । কিন্তু এসব ঠাট্টায় ইভা কী মনে করে তা ফ্লয়েড জানে, জিজ্ঞেস করার মতো ঠিক সাহসও জোটানো যাচ্ছে না। এই এখানে, ছোট্ট সমাজে, যেখানে হাজার রহস্যময় ব্যাপারও ঘণ্টা ছয়েক গোপন থাকে না, সেখানেও ইভা তার সেই রহস্যগুলো অবগুণ্ঠনে সযত্নে ঢেকে রেখেছে-যে রহস্য দিয়ে তিন তিনটা প্রজন্মকে সে পাগল করে রেখেছিল বছরের পর বছর।

ভিক্টর উইলিস পড়েছে আরেক ঝামেলায়।

ইউনিভার্সে সর্বাধুনিক স্পেসস্যুট মার্ক এক্স এক্স সাজানো আছে; এর ভিতর আবার নন ফগিং, নন রিফ্লেক্টিভ এবং নিশ্চয়তা দেয়া থাকে যে মহাকাশের অসমান্তরাল দৃশ্য পাওয়া যাবে। হেলমেটগুলো বিভিন্ন আকার আর প্রকারের হলেও ভিক্টর উইলিস কোনোটাতেই মাথা গলাতে পারবে না বড়সড় অপারেশন করানোর আগ পর্যন্ত।

তার প্রতীক প্রতিষ্ঠিত হতে পনেরটা বছর চলে গেল।

এখন দাঁড়িই ভিক্টর উইলিস আর হ্যালির মাঝে বাঁধা; এ দুয়ের মাঝে যে। কোনোটাকে বেছে নিতে হবে এবার।

১৭. কালো তুষারের উপত্যকা

ক্যাপ্টেন স্মিথ ই ভি এর পক্ষে। তার মতে, ধূমকেতুর বুকে পা না ফেলাটাই উত্তম।

ইন্ট্রাকশন মতো চললে কোনো সমস্যাই দেখা দেবে না, তার সেই অপ্রতিরোধ্য ব্রিফিং চলছে, এমনকি আগে কোনোদিন স্পেসস্যুট না পরলেও কুছ পরোয়া নেহি-দূর জানি, কমান্ডার গ্রিনবার্গ আর ড. ফ্লয়েড এ ধরনের স্যুট গায়ে গলিয়েছিলেন-তবে আজকের স্যুটগুলো কিন্তু সে আমলের মতো নেই। পুরোপুরি অটোম্যাটিক, পরেও বেশ আরাম পাবেন। কোনো কন্ট্রোল বা অ্যাডজাস্টমেন্ট নিয়ে গলদঘর্ম হবার দরকার নেই, শুধু এয়ারলক দিয়ে বেরিয়ে যাবেন, ব্যস।

একটা স্থির নিয়ম মানতেই হবে, ই ভি এ দিয়ে একবারে মাত্র দুজন বেরুতে পারবেন। পাহারা কিন্তু থাকছেই, ভয় নেই। পাঁচ মিটার লম্বা দড়িতে বাঁধা থাকবে যানটা, প্রয়োজনে বিশ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো যাবে দূরত্ব। আরো অ্যাডভেঞ্চার চান? তো ভ্যালি জুড়ে যে ক্যাবলগুলো ঝুলিয়ে রেখেছি তার একটায় দুজনকেই বেঁধে দেয়া যাবে। চলাচলের নিয়মকানুন পৃথিবীর মতো-সবাই নিজের নিজের ডানদিক ধরে যাবেন। প্রয়োজনে একজন ছুটে যেতে পারেন, এমনকি দুজনে ছুটলেও অসুবিধা নেই, নিউক্লিয়াসের বাইরে ভেসে যাওয়াতেও ভয়ের কিছু দেখছি না। স্পেস থেকে ধরে আনতে জানি আমরা। কোনো প্রশ্ন?

কতক্ষণ বাইরে থাকা যাবে?

আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা, মিস মবালা। কিন্তু আমার মতে একটু অস্বস্তি হলেই ফিরে আসা উচিত। প্রথম আউটিংয়ে ঘণ্টাখানেকই ভাল। যদিও মনে হবে মিনিট দশেকের মধ্যেই সময় কেটে গেল…

ক্যাপ্টেন স্মিথের কথাটা অনেকাংশেই ঠিক। পেরুনো সময় ডিসপ্লেতে তাকিয়েই আৎকে উঠল ফ্লয়েড। কোন ফাঁকে চল্লিশ মিনিট উড়ে গেল কে জানে! অবশ্য এ নিয়ে এতো অবাক হবার কিছু নেই, শিপ এখান থেকে কিলোমিটার-টাক দূরে।

যে কোনো বিচারে সবচে জ্যেষ্ঠ যাত্রী হিসেবে সেই প্রথম ই ভি এ তে ওঠার সৌভাগ্য অর্জন করে। আর সহযাত্রীর ব্যাপারে কিছু বলার সুযোগ পায়নি ফ্লয়েড।

ই ভি এ উইথ ইভা! বলেছিল মাইকেলোভিচ, কী করে এই সম্মিলনকে হেলা করা যায় হে! এমনকি যদি, একটা বিস্তৃত মুচকি হাসি দিয়ে যোগ করল বাকী কথাটা, তুমি চাও-ও, তবু ওই খটমটে স্যুটগুলো তোমাদের বাড়তি যে কোনোকিছু করার চেষ্টায় বাধা দেবে।

ইভা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে গেল; অবশ্য বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাসও প্রকাশ পেল না… এই ব্যাপারটা, বলল ফ্লয়েড মনে মনে, তার ক্ষেত্রে চিরায়ত । আর বিরক্তও হল বেশ। বিরক্তিটা ইভার উপর নয়, নিজেরই উপর। হাজার হলেও, ইভার সাথে মোনালিসার তুলনা হয়েছে বেশ অনেকবার; তাদের দুজনের কাউকেই আর যা-ই দেয়া যাক না কেন, দোষ দেয়া যায় না।

তুলনাটা আসলেই… বেখাপ্পা লা জিওকন্ডাও রহস্যময়ী। কিন্তু সে তো অবশ্যই উত্তেজক নয়। ইভার ক্ষমতাটা ঠিক এখানে লুকিয়ে থাকে, এই দুয়ের মাঝামাঝি কোথাও-সাথে নিষ্পাপ সারল্যের একটা ছোঁয়া… এই আধ শতাব্দী পরও তার ভেতরে এই তিনের দারুণ সমাহার দেখা যায়; অন্তত বিশ্বাসীর চোখে।

শুধু একটা ব্যাপারেরই বেশ অভাব দেখা যাচ্ছে-এভাবে ভাবতে চায় না ফ্লয়েড, তবু না ভেবে উপায় নেই, একটা সত্যিকার ব্যক্তিত্বের বেশ অভাব তার ভিতরে।

ইভার উপর মনোসংযোগ করার জোর চেষ্টা করলে দেখা যায়, ওর পার্সোনালিটিটা আসলে ওর অভিনয় করা প্রতিটি চরিত্রের অদ্ভুত মিশেল। কোনো এক সমালোচকের সেই বিখ্যাত উক্তির সাথে একমত না হয়ে উপায় নেই, ইভা মারলিন আসলে সব মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন; কিন্তু একটা আয়নার কোনো নিজস্ব চরিত্র নেই।

এখন, হাজার বছরের রহস্যমাখা, সৌর জগতের সাময়িক অতিথি হ্যালির ধূমকেতুর বুকে, কালো তুষারের উপত্যকা জুড়ে একটা ক্যাবলে আটকানো অবস্থায় এই বিচিত্র সৃষ্টিই তার পাশে পাশে ভেসে চলেছে। উপত্যকাটাকে এ নামেই ডাকে সবাই, কেউ কোনোদিন কোনো স্থির মানচিত্রে একে দেখতে পায়নি। হুবহু দেখতে পাবেও না, কারণ পৃথিবীর ঋতু বদলের মতো করে এখানকার মানচিত্র বদলায়। সে ব্যাপারটাকে দারুণ উপভোগ করছে; এই চারপাশের দৃশ্যগুলো কোনো মানুষের চোখ কোনোকালে দেখেনি, সম্ভবত এমনভাবে কোনোকালে দেখবেও না। এদূর আসার সাহস হবে না সবার।

চাঁদের বুকে, অথবা মঙ্গলের বুকে, কোনো কোনো এলাকায় কিস্তৃত আকাশের কথাটা হিসাব থেকে বাদ দিলে মানুষ পৃথিবীর সাথে কিছু না কিছু মিল দেখতে পাবেই, অথবা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। এ অঞ্চলে সে আশায় গুড়ে বালি। প্রায় ভেসে থাকা কালো কালো ফেনা ফেনা তুষার দেখে বোঝাই যায় না যে এখানে বিন্দুমাত্র গ্র্যাভিটি থাকা সম্ভব। এমনকি সত্যি সত্যি ফেনার বিশাল বিশাল দঙ্গল ভেসে আছে চারদিকে। কখনো কখনো অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উপর-নিচ নির্ধারণ করতে হয়।

তবে কালো তুষারের উপত্যকায় কাহিনী উল্টো। এর আকৃতি একেবারে কঠিন। পানি আর হাইড্রোকার্বনের বিচিত্র বরফ-সাগরের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন কোনো রিফ। ভূতত্ত্ববিদরা এখনো এর উৎপত্তি নিয়ে হা-পিত্যেশ করে বেড়ায়। কারো কারো মতে এটা কোনো গ্রহানুপুঞ্জের অংশ, অজানা অতীতে ধূমকেতুটার বুকে আঘাত হেনেছিল, আজো নিজের ভিন্ন অস্তিত্বের কথা ভোলেনি। এর ভিতরে জৈব যৌগের বিচিত্র সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়, অনেকটা যেন জমাট কাঠকয়লা, যদিও এটুকু নিশ্চিত যে জীবন এখানে খেলা করেনি কোনোকালে।

ছোট্ট ভ্যালিটাকে ঢেকে ফেলা তুষার কিন্তু সত্যিকার অর্থে পুরোপুরি কালো নয়; ফ্লয়েডের ফেলা আলো লেগে এমনভাবে ঝিকিয়ে উঠল-যেন লাখ লাখ অতি খুদে হীরা দিয়ে তৈরি। কে জানে, ভাবল ফ্লয়েড, হ্যালিতে হীরা থাকতেও পারে, অন্তত কার্বনের কোনো অভাবতো নেই। আর এ-ও সত্যি যে হীরা গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপ বা চাপের কোনোটাই নেই এখানে।

হঠাৎ কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে দু মুঠো ফেনা তুলে নেয়ার জন্য নিচু হল… কাজটা করার সময় একটু ভাড় ভাড় লাগছিল নাকি তাকে? অন্তত সার্কাসের দড়িখেলায় লোকগুলো যেভাবে শক্ত রশির উপর লাফায়-এগোয় অনেকটা সেভাবেই এগিয়েছিল সে, শুধু উপরের দিকটা নিচে, এই যা। ভঙ্গুর উপরিতলটা একটুও বাঁধা দিল না তার মাথা আর কাঁধকে। তারপর ভদ্রভাবে নিজের উর্ধ্বাঙ্গ উদ্ধার করল ফ্লয়েড, মুঠোভর্তি হ্যালি নিয়ে।

ব্যাপারটা হাতের গ্লাভসগুলো বেয়ে অনুভব করতে পারলে বেশ হত। এমনকি দলা করে একটা বলের মতো গোল চকমকে আকার দেয়ার সময়ও টের পাওয়া যায়নি। এইতো! মিশকালো বলটাও কী সুন্দর দ্যুতি ছড়ায় নাড়াচাড়া করার সময়!

আর সাথে সাথেই, কল্পনার রঙে রঞ্জিত হয়ে বলটা হয়ে গেল সাদা, দুধসাদা। আর সে যেন সেই ছোট্ট ছেলে, শীতের মাঠে খেলছে, হাতে বরফ, আর সামনে পেছনে-চারদিকে ভূত-প্রেত-ডাইনী। শুনতে পাচ্ছে খেলার সাথীদের চিৎকার, হুমকি; অনুভব করছে তাদের ছোঁড়া বলগুলোর আঘাত…

স্মৃতিটা ছোট্ট, কিন্তু বেশ বড়সড় ধাক্কা দিয়ে যাবার মতো। অসহ্য এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল তার মনে। আজ এই শত বছর পরে তার ভূত-প্রেত বন্ধুদের কারো কথাই মনে পড়ে না। ওদেরই কারো একজনকে সে ভালবাসত, কী ভালই না বাসত…

ফ্লয়েডের আঙুলগুলো মমতা নিয়ে অপার্থিব তুষারের গোলাটাকে আদর করছে, আর চোখ দিয়ে নামছে অবিরল জলধারা। এরপর দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে; কেটে যায় ঘোর। এতো দুঃখের মুহূর্ত নয়, আনন্দের সময়।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল হেউড ফ্লয়েড, তার শব্দগুলো স্পেসস্যুটের ছোট্ট, আঁটসাঁট জগতে প্রতিধ্বনিত হয়ে গুমরে মরছে, আমি হ্যালির ধূমকেতুতে দাঁড়িয়ে আছি, আর কী চাই! এখনি যদি কোনো উল্কার আঘাতে মরে যাই তো কী এসে যায়!

তারপর সে তুলে আনে হাত দুটো, বলটাকে ছুঁড়ে দেয় তারার রাজ্যে। একেবারে ছোট বলটা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় কালো আকাশের গায়ে, তাতে কী, হেউড ফ্লয়েড একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সেদিকেই।

ঠিক তক্ষুনি এলোমেলোভাবে আলোর একটা ঝাক এসে পড়ল। অপ্রত্যাশিতভাবে, লুকানো সূর্য তার আলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ঐ বলটার গায়ে। লাখো প্রতিফলক কণার গায়ে পড়ে আধো আঁধারির আকাশে স্পষ্ট দেখা গেল সেটাকে।

এখনো ফ্লয়েড তাকিয়ে আছে, হারিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা। কে জানে কোথায় হারালো, নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, আবার চলেও যেতে পারে অনেক অনেক দূরে। উপরের তেজস্ক্রিয়তার ঝড়ে বেশিক্ষণ টিকবে না, তাতে কী, কজন মানুষ নিজের বানানো ধূমকেতু নিয়ে বাহাদুরি করতে জানে?

১৮. ওল্ড ফেইথফুল

ইউনিভার্স মেরু এলাকায় থাকতে থাকতেই সাবধানে সব অভিযাত্রা শুরু হয়ে ১ গেল। প্রথম প্রথম এক মানুষবাহী ই এম ইউগুলো এখনো অনেকে জানে না যে ই এম ইউ মানে এক্সটার্নাল ম্যানুভারিং ইউনিট) দিন-রাত সব এলাকাই চষে বেড়ালো, আগ্রহ জাগানো সব বিষয়ই টুকে নিল সতর্কভাবে। প্রাথমিক নিরীক্ষা একটু ঝিমিয়ে আসতেই সর্বোচ্চ পাঁচ বিজ্ঞানীর দল ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পেসশিপের শাটল নিয়ে। কৌশলগত পয়েন্টগুলোতে বিদঘুঁটে সব যন্ত্রপাতি পেতে আসাই মূল উদ্দেশ্য।

লেডি জেসমিন হল ডিসকভারি যুগের প্রাচীন স্পেস পোডের অতি আধুনিক বিবর্তিত রূপ। শুধু গ্র্যাভিটি বিহীন এলাকায় রাজত্ব চালানো এর কাজ। আসলে ছোটখাট একটা স্পেসশিপ। চাঁদের, মঙ্গলের বা বৃহস্পতীয় উপগ্রহ থেকে ইউনিভার্সে হাল্কা-পষ্কা মাল সামান অথবা মানুষ পারাপারের কাজ এর কাঁধে ন্যস্ত। ওর গর্বিত চিফ পাইলট ওকে সামান্য একটা ধূমকেতুতে কাজে লাগানোর পক্ষপাতী নয়।

হ্যালির বহিরঙ্গে কোনো বিশেষ চমক নেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ক্যাপ্টেন স্মিথ মেরুদেশ ছেড়ে উড়ল। মাত্র ডজনখানেক কিলোমিটার যেতে না যেতেই ইউনিভার্স নতুন এক জগতে উপস্থিত। মাসের পর মাস অন্ধকারে পড়ে থাকা এলাকা ছেড়ে ছন্দিত দিবা-রাত্রির সাথে পরিচিত অঞ্চলে হাজির হল এই সর্বাধুনিক স্পেসশিপ। এখানে সূর্যোদয়ের পর পরই ধীরে ধীরে ধূমকেতুর গায়ে নূতন প্রাণের সঞ্চার হয়।

সূর্যের কিরণ সরাসরি পড়ার সাথে সাথে জ্বলজ্বল করে উঠবে সব পর্বতচূড়া। বেশিরভাগই স্তব্ধ হয়ে থাকবে, তাদের সরু কণ্ঠনালী বেয়ে খনিজ নুন উঠতে উঠতে এখন একেবারে বুজে গেছে স্বর।

তারপরও, সূর্য এবার হ্যালির বুকে রঙের খেলা দেখাবে। জীববিদরা চিৎকার শুরু করে দিল, এখানে প্রাণ জন্ম নিচ্ছিল ঠিক প্রাচীন পৃথিবীর মতো। কেউ কেউ সে আশা ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

অন্য জ্বালামুখগুলো থেকে বাস্পের রেখা উঠে যাচ্ছে উপরে। অতিপ্রাকৃতভাবে শুধু সোজা উপরে উঠে যাচ্ছে, কারণ বাঁকা করে দেয়ার মতো কোনো বাতাস নেই চারপাশে। যথারীতি প্রথম দুয়েক ঘণ্টায় আর তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু সূর্যের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে এসব ঘটনার তেজও বাড়বে, আড়মোড়া ভাঙবে ভিতরের জমাট যৌগ। ভিক্টর উইলিস একেই বলে, তিমির জলোচ্ছাস।

মোটামুটি চিত্রিত করা গেলেও কথাটা দিয়ে আসল উদাহরণ টানা যায় না। হ্যালির পানি ছোঁড়া সামান্য সময় ধরে হয় না, বরং ঘন্টার পর ঘণ্টা চলতেই থাকে। তার উপর, কখনো বেঁকে আবার সারফেসে ফিরে আসে না, বরং উঠতেই থাকে সেই কুয়াশার দিকে যার সৃষ্টিতে ওরা অবদান রেখে যাচ্ছে।

প্রথম প্রথম বিজ্ঞানীরা এমনভাবে উষ্ণ প্রসবণগুলো নিয়ে পরীক্ষা করছিল যেন তারা অগ্নিগিরি বিশেষজ্ঞ, এগুচ্ছে এটনা অথবা ভিসুভিয়াসের দিকে, অতি সাবধানে। একটু পরই ভুল ধরা পড়ল। না, মাঝেমধ্যে এক-আধটু বেয়াদবি করলেও তারা আসলে তেমন হিংস্র নয়। সাধারণ আগুন নেভানোর হোজ থেকে যেভাবে পানি বেরোয় ঠিক সেভাবেই বিচ্ছুরণ ঘটে। পানিটা বেশ গরম। আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার থেকে বেরিয়েই মুহূর্তের মধ্যে বাষ্প আর ক্রিস্টাল বরফের মিশ্রণরূপে লুটিয়ে পড়ে উপরের বিশাল সাদা অঞ্চলে। উপরের দিকে পড়তে থাকা তুষারঝড়ে আবৃত এক ধূমকেতুর নাম হ্যালি। এমনকি সবচে দ্র বেগে বেরুনো জিনিসগুলোও আর ফিরে আসছে না আপন উৎসের বুকে। প্রতিবার সূর্যের কাছাকাছি এসে আবার ফিরে যাবার পথে হ্যালি তার জীবন অমৃতের অনেকটা হারিয়ে বসে মহাশূন্যের নিঃসীম শূন্যতায়।

যথেষ্ট সময় ধরে অপেক্ষা করার পর ক্যাপ্টেন স্মিথ ইউনিভার্সকে ওন্ড ফেইথফুলের শত মিটারের মধ্যে নিতে রাজি হল। দিবা-ভাগের সবচে বড় উষ্ণ প্রসবণের নামটা মন্দ হয়নি। ধোঁয়াশার এক স্থূল স্তম্ভ, যেন কোনো অতি ক্ষুদ্র মূলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বপু গাছের গা। ধূমকেতুর অন্যতম প্রবীণ জ্বালামুখটার ব্যাস তিনশো মিটার। বিজ্ঞানীরা আরো আগেই এর আশপাশ চষে বহুরঙা বীজ নিয়ে এসেছে। হায়, নিষ্ফল বন্ধ্যা বীজ! যথারীতি থার্মোমিটার আর স্যাম্পলিং টিউব দাবিয়ে দেয়া হয়েছে চারপাশে, এমনকি স্তম্ভের গায়েও।

যদি আপনাদের কাউকে এটা উপরে ছুঁড়ে দেয়, সাবধান করেছিল ক্যাপ্টেন, তাড়াতাড়ি উদ্ধার পাবার আশা করবেন না আশা করি । অপেক্ষা করতে হবে, অন্তত নিজে নিজে ফিরে আসা পর্যন্ত।

কী বলল ব্যাটা? কী বোঝাতে চায়? ধাঁধায় পড়ে দিমিত্রি মাইকেলোভিচ প্রশ্ন তোলে।

ভিক্টর উইলিস জবাব দিতে তেমন দ্বিধা করেনি, মহাজাগতিক বিদ্যায় ব্যাপারগুলো আমাদের আশা অনুযায়ী বা কল্পনা অনুযায়ী ঘটে না। হ্যালি থেকে নির্দিষ্ট গতির চেয়ে জোরে ছুঁড়ে দেয়া যে কোনোকিছু মোটামুটি নিয়মানুযায়ী অর্বিট ধরেই ঘুরতে থাকবে। বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য প্রচুর গতি দরকার। সুতরাং, একবার আবর্তন শেষ হইলে কক্ষপথদুইটি পরস্পরকে ছেদ করিবে; এবং তুমি আবার আগের জায়গাতেই ফিরে আসবে। বয়েস বাড়বে ছিয়াত্তর বছর, ব্যস।

ওল্ড ফেইথফুলের আশপাশেই এমন একটা কিছু ছিল যা কেউ আশা করেনি। প্রথম দেখে বিজ্ঞানীদলতো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। হ্যালির বুকে কয়েক হেক্টর জুড়ে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া যে এলাকা দেখা গেল তাকে সোজা কথায় হ্রদ বলা যায়। শুধু চরম কৃষ্ণত্ব বাদে।

আর যাই হোক, পানি নয়। এখানে ভারী তেল জাতীয় পদার্থ ছাড়া অন্য কোনো

তরলের টিকে থাকা অসম্ভব। আসলে লেক টুনেলা দেখে পিচকালো পদার্থের কথাই বেশি করে মনে পড়ে। ঠিক যেন পিচ। প্রায় কঠিন, শুধু উপরিতলে এক মিলিমিটারের চেয়েও কম পুরু একটা আধ-তরল স্তর। এই অত্যন্ত কম গ্র্যাভিটিতে ব্যাপারটায় নিশ্চই বেশ কবছর সময় লেগে গেছে… সম্ভবত সূর্যের চারদিকে কয়েকবার ঘুরে আসার ফল। বিশেষত এর উপরিতলটা আয়নার মতো সমতল হতে এমন সময়ই লাগার কথা।

ক্যাপ্টেন এর উপর থামার পর পরই হ্যালির বুকে এটা এক বিশেষ পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হল। কেউ একজন (কৃতিত্বটা কেউ দাবী করছে না) বলেছিল যে এর উপর হেঁটে যাওয়া বেশ মজার এবং আরামদায়ক হবে, ঠিক পৃথিবীর মতো। সারফেসের আঠালো ভাবটা পা আটকে রাখার কাজ ভালভাবেই করবে। খুব বেশিক্ষণ পেরুনোর আগেই অভিযাত্রীদের বেশিরভাগ পানির উপর হেঁটে যাওয়া অবস্থায় নিজেদের ভিডিওচিত্র ধারণ করল..

এর পরপরই ক্যাপ্টেন স্মিথ এয়ারলক এলাকা পরিদর্শন করে, এবং আবিষ্কার করে যে দেয়ালগুলো খুব সুন্দরভাবে আঠালো হয়ে আছে। এরপর, তাকে যতটুকু রাগতে দেখা গেল তাও বিস্ময়কর।

খুব খারাপ কথা, দাঁতের ফাঁক গলে বলল ক্যাপ্টেন স্মিথ, শিপের বাইরের দিকটা-ছাইগুড়োয় মোড়া দেখা আমার জন্য… আমার জীবনে দেখা সবচে নোংরা জায়গা হল হ্যালির ধূমকেতু…

এরপর আর কখনোই লেক টুনেলায় আলসী হাঁটাহাঁটির ঘটনা ঘটেনি।

১৯. অটি কুঠুরী নয় দরজা

ছোট্ট ভুবনে, পিচ্চি কোনো ইউনিভার্সে, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের নাড়ীনক্ষত্র জানে, সেখানে এক্কেবারে নবাগতের মতো বিস্ময় আর কোনো কিছু উৎপাদন করতে জানে না।

এই বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে ফ্লয়েড, করিডোর ধরে ভদ্রভাবে মূল লাউঞ্জের দিকে ভেসে যাবার সময়। অবাক হয়ে নাক গলানো লোকটার দিকে তাকালো সে, কী করে শিপের ভিতর এ্যাদ্দিন লুকিয়ে থাকল ব্যাটা! অন্যজন তার দিকে একই সাথে বাহবা আর অপ্রস্তুতভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন ফ্লয়েডই আগে কথা বলবে।

ও, ভিক্টর! অবশেষে কথা বলল সাবেক অ্যাস্ট্রোনট, স্যরি! প্রথম প্রথমতো চিনতেই পারিনি। তো, তুমিই বিজ্ঞানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছ… নাকি বলব তোমার লোকজনের জন্য?

হু, একটু যেন বিরক্ত হল উইলিস, কোনোমতে একটা হেলমেটে এঁটে যেতে পারলাম আর কী! কিন্তু মরার হেলমেট-গাত্রে এতো বিরক্তিকর শব্দ ওঠে যে কাউকে একটা কথাও বোঝাতে পারি না। শুধু খসখস শব্দেই দুনিয়া ঢেকে যায়।

তো, বাইরে যাচ্ছ কখন?

ক্লিফ ফেরার সাথে সাথেই। বিল চ্যান্টের সাথে সেই যে বেরিয়েছে…

.

সেই ১৯৮৬-তে প্রথম যেবার হ্যালির দেখা পেল বিজ্ঞানীদের টেলিস্কোপের বাহিনী। তখনই জানা যায়, ধূমকেতুটার ঘনত্ব পানির চেয়েও কম। তার মানে, হয় সূক্ষ্ম ছিদ্র ছিদ্র উপাদান ভর্তি, নয়তো শক্ত গায়েই বড় বড় গর্ত ছড়িয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে দু ব্যাখ্যাই সত্যি।

সুড়ঙ্গ-অভিযানের ব্যাপারে চির সাবধান ক্যাপ্টেন স্মিথ সোজাসাপ্টা মানা করে দিয়েছে। কিন্তু বাঁধা মানে কে! ড. পেড্রিল তার নিজের মতে স্থির, পেড্রিলের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ড. চ্যান্ট খুবই অভিজ্ঞ মহাকাশ-ভূগোলবিদ। তাকে সুযোগ দেয়া যায়। আর কী করা, দেয়া গেল।

লো গ্র্যাভিটিতে গুহায় ঢোকা অসম্ভব, সন্দিগ্ধ ক্যাপ্টেনকে বলেছিল পেড্রিল, তার মানে, আটকে পড়ার কোনো ভয় নেই।

হারিয়ে পড়ার ভয়ের খবর কী?

চ্যান্ট ব্যাপারটাকে পেশাদারী অপমান মনে করতে পারে। সে ম্যামথ গুহার বিশ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে অভ্যস্ত। যাই হোক, তার হাতে একটা গাইডলাইন থাকবে।

যোগাযোগ?

লাইনের ভিতরে ফাইবার অপটিক্স থাকছে। আর স্যুট রেডিওর যোগাযোগ ক্ষমতাও প্রকট।

“উমম! তো, কোনখান দিয়ে যেতে চায় সে?

এটনা জুনিয়র বেসের কাছাকাছি যে মরা উষ্ণ প্রসবণটা আছে, সেটায়। অন্তত হাজার বছরে সেখানে কোনো উদগীরণ হয়নি।

তার মানে আশা করি আরো দিন দুয়েক চুপ থাকবে গর্তটা। খুবই ভাল-আর কেউ কি যেতে চায়?

ক্লিফ গ্রিনবার্গ স্বেচ্ছাসেবক হতে চাচ্ছে। এক পায়ে খাড়া। সে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে অনেক আন্ডারওয়াটার গুহায় অভিযান চালিয়েছে এককালে।

“আমি একবারই চেষ্টা করেছিলাম… ওটুকুই যথেষ্ট। ক্লিফকে বলল, তার দাম অনেক। যে পর্যন্ত প্রবেশপথ দেখা যায় সে পর্যন্ত যাবার অনুমতি মিলবে। এর এক পা-ও ভিতরে নয় । আর যদি কোনোমতে চ্যান্টের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে যায় তো পিছুধাওয়া করতে পারবে না। অন্তত আমার অনুমতিতে নয়।

তারপর নিজের মনে বাকী কথাটা শেষ করল কাপ্তান, অনুমতি দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার…

.

মহাকাশ-ভূগোলবিদদের নিয়ে যেসব পুরনো রসিকতা বাজারে চালু আছে তার মধ্যে মহাকাশ ভূগোলবিদরা আবার গর্ভে ফিরে যেতে চায় ভয়ে… টা সবচে চলতি কৌতুক। ড. চ্যান্ট এ কথাটা বৃথা করে দিতে বদ্ধ পরিকর।

মরার জায়গাটায় নিশ্চই বিজবিজে শব্দ চলবে সারাক্ষণ; সদা-সর্বদা অলক্ষুনে গর্তটা তর্জন-গর্জন-জাবর কাটা ছাড়া আর কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবে বলেতো মনে হচ্ছে না। তার বিরক্ত মতামত এমনই, আমি খানাখন্দ-গর্ত পছন্দ করি কারণ সেগুলোতে বিন্দুমাত্র শব্দ নেই। আর সময় থাকে থেমে। হাজার বছরে কিস্যু বদলে যায়নি, শুধু স্ট্যালাকলাইটগুলো আরো একটু মোটা হয়েছে, ব্যস।

আর এখন, চিকন কিন্তু দুর্দান্ত শক্ত রশি দিয়ে ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গের সাথে বাঁধা অবস্থায় হ্যালির আরো আরো গভীরে ভেসে যাবার সময় সে বুঝতে পারছে যে কথাটা সত্যি নয়। কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়াই তার ভূগোলবিদের মন বলছে যেন এ আজব এলাকাটা মাত্র গতকাল তৈরি হল… অবশ্যই, সৃষ্টি জগতের সময় মাত্রায় হিসেবটা ধর্তব্য। আসলেও, গুহাটা কোনো কোনো মানব-সৃষ্ট মহানগরীর চেয়েও নবীন।

যে সুড়ঙ্গ ধরে সে নেমে যাচ্ছে তার সরু ঠোঁটগুলো বড়জোর মিটার চারেক চওড়া। তার উপর পরিবেশের ওজনহীনতা পানির নিচের গুহা-ডাইভিংয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক যেন পৃথিবীর কোনো জলমগ্ন সুড়ঙ্গে বাড়তি কিছু ওজন বয়ে নিচ্ছে সে, তাই নেমে যাচ্ছে আরো আরো নিচে। শুধু বিন্দুমাত্র বাঁধা না থাকায় বোঝা যায় যে এলাকাটা বায়ুশূন্য, পানিতো দূরের কথা।

তুমি কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছ, অভিযোগ তুলল গ্রিনবার্গ, প্রবেশপথের পঞ্চাশ মিটার ভিতরে যাবার পর পরই, রেডিও লিঙ্ক বেশ ভাল কাজ দিচ্ছে। আশপাশটা কেমন?

বলা মুশকিল-আমি কোনো ফরমেশন পাচ্ছি না খুঁজে, সুতরাং ব্যাখ্যা করার মতো ভাষা নেই। ঠিক কোনো প্রকারের পাথর নয়, আঙুল ছোঁয়ালেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে-যেন কোনো বিশাল পনিরের ভেতর বসে আছি আমরা…

তার মানে জিনিসটা জৈবিক?

হ্যাঁ-কিন্তু অর্গানিক অর্থে-প্রাণের কোনো সম্পর্ক নেই, আশাও করা যায় না। কিন্তু প্রাণ সঞ্চারের প্রাথমিক উপাদানে ভরপুর। সব ধরনের হাইড্রোকার্বন… কেমিস্টরা বেশ মজা পাবে। এখনো দেখতে পাচ্ছ তো আমাকে?

শুধু তোমার লাইটের হাল্কা আলো। তাও মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

আহ-এখানে একটু খাঁটি পাথরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে…দেখেশুনে ঠিক এখানটার সাথে মেলানো যায় না। আরে! আমি স্বর্ণের সাথে ধাক্কা খেলাম!

মশকরা বাদ দাও তো!

পুরনো পশ্চিমে হাজার মানুষকে এ জিনিসটা ধোঁকা দেয় যুগ যুগ ধরে-আয়রণ পাইরাইটস। বাইরের দিকের উপগ্রহগুলোতে সহজলভ্য। কিন্তু এ জিনিস এখানে কী করছে দয়া করে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলো না…

ভিজুয়াল কন্টাক্ট লস্ট। দুশ মিটার ভিতরে চলে গেছ, সাবধান।

এক ভিন্ন স্তর ধরে এগুচ্ছি। দেখেশুনে উল্কাজাত খণ্ড মনে হয়। নিশ্চই দারুণ। কিছু হয়েছিল সে সময়ে-আশা করি দিনক্ষণ বের করতে পারব পঞ্জিকা উল্টে-ওয়াও!

এমন কিছু আমার বেলায় না করলেই হল।

স্যরি-আসলে দম আটকে ফেলেছে-সামনেই একটা বিশাল… কী বলা যায় একে? চেম্বার। আমার চাওয়া শেষ জিনিস। দাঁড়াও, আলোটা একটু আশপাশে বুলিয়ে নিই…

পুরোপুরি চতুষ্কোণ। এপাশ-ওপাশে ত্রিশ-চল্লিশ মিটার হবে। আর… অবিশ্বাস্য! হ্যালির বুক জুড়ে শুধু চমক আর চমক! স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালেগমাইট।

এ নিয়ে এতো অবাক হবার কী হল?

এখানে পানির মুক্ত পতন নেই, নেই চুনাপাথর-অন্তত এতো লো গ্র্যাভিটিতে থাকার কথা নয়। কোনো ধরনের মোম হবে হয়ত। এক মিনিট, ভালমতো ভিডিও নিয়ে নিই… চমৎকার আকৃতি… যেন গলন্ত মোম থেকে তৈরি… কী ব্যাপার…

আবার কী হল?

ড. চ্যান্টের স্বরের সুর পাল্টে গেল অনেকটা। গ্রিনবার্গের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

কয়েকটা কলাম ভেঙে গেছে; পড়ে আছে ফ্লোরের উপর… ঠিক যেন…

বলে যাও।

.. যেন কিছু একটা ভর করেছে ওগুলোর উপর।

পাগলের মতো কথা বলোনা! ভূকম্পনে এমন হয়নি তো?

এখানে ভূমিকম্পের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু জীবিত প্রসবণ থেকে মৃদু কম্পন আসে, এই যা। যেন কোনো এক সময় বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল গুহাটা। যাই হোক, অন্তত কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা। পড়ে থাকা কিছু স্তম্ভের উপর কয়েক মিলিমিটার পুরু মোম পড়েছে, মুখের কথা না।

ড. চ্যান্ট ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছে যেন। সে এম্নিতে মোটেও কল্পনা বিলাসী নয় কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বিধি বাম; মনের বিরক্তিকর স্মৃতির কুঠুরী খুলে গেছে হঠাৎ করে। স-ব কলাম দেখে মনে হয় যেন কোনো বিশাল দৈত্য খাঁচা খুলে পালানোর পর লোহার দণ্ডগুলো পড়ে আছে চারপাশে…।

অবশ্যই, কল্পনাটা অতিরঞ্জিত; এবং মানানসই। ড. চ্যান্ট অবশ্য কোনো সম্ভাবনাকেই খাটো করে দেখতে শেখেনি। যে কোনো পরিবর্তনই ভাবায়, আর সাবধানের মার নেই-পুরনো কথা। এই সাবধানতাই জীবন বাঁচিয়েছিল একাধিকবার। ভয়ের কারণ ধরতে পারার আগ পর্যন্ত এই চেম্বার ছাড়িয়ে যাবে না সে। নিজের সাথে চাতুরীর কোনো ইচ্ছাও তার নেই, শব্দটা আসলে ভয়ই হবে।

বিল-সব ঠিকঠাক চলছে তো? কী হল?

এখনো ভিডিও করছি; আসলে কলামগুলো দেখে ঠিক রেড ইন্ডিয়ানদের তাঁবু লুটের কথা মনে পড়ে গেল। কী বলব, বিতিকিচ্ছিরি!

সে মনের ভয়-ভয় ভাবটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে বেশ জোরেসোরে। কাজের কথা ভাবতে থাকলেই হল। তার উপর মানসিক দৃষ্টিটা যদি বেশ উঁচু হয় তো যে কোনো অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ। অবশ্য এই খাঁটি যান্ত্রিক রেকর্ডিংয়ের কাজটা মনের অনেক অংশ দখল করে রাখে, ভয় জাতীয় আবেগ নয়।

আরে, উল্টা-পাল্টা কিছু নেই; সে নিজেকে জানিয়ে রাখল, স্বাস্থ্যবান ভয়কে সাথে নিয়েই। তার জানা আছে, ভয় বাড়তে বাড়তে আতঙ্কে পরিণত হলে মানুষ এম্নিতেই মরে যেতে পারে। আতঙ্ক কাকে বলে, কত প্রকার ও কী-কী, প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞা সহ উদাহরণ দিতে পেরেছে সে, জীবনে দুবার। একবার পাহাড়ের উপর, আরেকবার পানির নিচে। এখন-ভাগ্যকে হাজার ধন্যবাদ-সে আতঙ্ক থেকে যোজন যোজন দূরে। কেন কে জানে, মনে একটু ভরসা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে হঠাৎ । এই পরিবেশের ঠিক কোথায় যেন হাস্যরসাত্মক কিছু একটা লুকিয়ে আছে।

আর তারপরই বলা নেই, কওয়া নেই, সে হাসা শুরু করল-হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে নয়, বরং স্বস্তিতে।

পুরনোদিনের স্টার ওয়র্স ছায়াছবিগুলো দেখেছ নাকি কখনন? গ্রিনবার্গের দিকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে।

অবশ্যই-অন্তত আধ ডজনবার।

“যাক, এবার বোঝা গেল কোন দুঃখে এমন অস্বস্তিতে ছিলাম। একটা দৃশ্যে লিউকের স্পেসশিপ গ্রহাণুর গায়ে আছড়ে পড়ে। তারপর এক দানবীয় সাপ জাতীয় প্রাণীর দিকে এগিয়ে যায়। প্রাণীটা সেই গ্রহাণুর গর্তে বাস করত।

লিউকের শিপ নয়-হ্যান্স সোলোর মিলেনিয়াম ফ্যালকন। আমি সারাক্ষণ ভেবে মরতাম বেচারা প্রাণী কী করে এমন জীবন্ত জিনিসকে হজম করল। ওটা নিশ্চই সাংঘাতিক ক্ষুধায় ছিল, স্পেস থেকে কোনো খাবার আসবে সে আশায় মুখ ব্যাদান করে থাকা ছাড়া আর কোনো যুক্তিতো মনে পড়ে না। আর প্রিন্সেস লিয়া নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কথা না, কী বল?

এখানে, হ্যালির ধূমকেতুতে, ছিয়াত্তর বছরে যেখানে এক বছর হয়, এবং মাত্র একবার সামান্য সময়ের জন্য অকল্পনীয় তাপে ফুটতে থাকে পুরো হ্যালি, অন্য সময়টুকু অবিরত হিম-সেখানে কোনো প্রকার জীবন-ঝর্নার অস্তিত্ব অসম্ভব নয় কি?

সে প্রাণ থাকার কথা ভাবতে ভালবাসে; কিন্তু শুধু ভালবাসা দিয়েই সব হয় না। তার ফিরে গিয়ে কিছু এক্সপ্লোসিভ নিয়ে আসতে হবে, আর অন্য করিডোরটা এদিকে…

এই রুট ধরে আর বেশিক্ষণ যেতে পারব না। গ্রিনবার্গকে বলল সে, বরং অন্যটায় একটু ঢু মেরে যাই। জংশনে ফিরে আসছি আবার, অন্য ফিতা উল্টো পেঁচিয়ে নিয়ে।

সে আর রহস্যময় আলোটার কথা তুলল না। আলো জ্বালতেই হারিয়ে গেল সেটা।

গ্রিনবার্গ সাথে সাথেই জবাব দেয়নি। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। সম্ভবত শিপের সাথে কথা বলছে; চ্যান্ট এ নিয়ে ভাবে না। নিয়মানুযায়ী, জবাব না দেয়া পর্যন্ত সে কথাটা বলেই যাবে।

বিরক্ত হবার সুযোগ নেই, গ্রিনবার্গ একটু মাফ চেয়ে নিল সাথে সাথে ।

ফাইন-ক্লিফ-আমি অবশ্য তোমাকে মিনিটখানেকের জন্য হারিয়ে বসেছিলাম। চেম্বারে ফিরে এসেছি, যাচ্ছি অন্য টানেলটায়। আশা করি সেখানে কোনোকিছু পধরোধ করে দাঁড়াবে না।

এবার গ্রিনবার্গ সাথে সাথেই জবাব দিল ।

“স্যরি, বিল। শিপে ফিরে এসো। একটু ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি দেখা দিল-না, ইউনিভার্সে নয়। কিন্তু আমাদের এক্ষুনি পৃথিবীতে ফিরতে হতে পারে।

.

ড. চ্যান্ট সেই ভাঙা কলাম আবিষ্কারের কয়েক সপ্তাহ পরের কথা…

সূর্যের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে প্রতিবারই যেহেতু এই বিখ্যাত ধূমকেতু বেশ অনেকটা ভর উগড়ে দেয় স্পেসের বুকে-সেহেতু এর ভর-বিন্যাস বদলে যায় প্রতিনিয়ত। এবং এমন হতে হতে কয়েক সহস্র বছর অন্তর অন্তর ঘূর্ণনের আগাপাশতলা আমূল পরিবর্তিত হয়। বদলে যায় মধ্যবিন্দু, বেশ নিষ্ঠুরভাবেই কেঁপে ওঠে পুরো হ্যালি। শক্তিক্ষয়ের অপরিবর্তনীয় এ খেলায় যে ভূকম্পনটা হয় তার মাত্রা রিখটার স্কেলে পাঁচের কম হবে না কোনোমতেই। এজন্য স্ট্যালাকলাইটগুলো পড়ে ছিল।

কিন্তু সে আর কখনোই সেই রহস্যঘেরা আলোর কোমল বিচ্ছুরণ-রহস্য ভেদ করতে পারেনি। আর এখনকার নূতন নাটকের যবনিকাপাত হবার পর পরই এ ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু এ নষ্ট সুযোগের কষ্ট সারা জীবন তাকে জ্বালিয়ে যাবে।

ব্যাপারটা যে সে দেখেছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মনে। কেন যেন কলিগদের আর বলা হয়নি। ভিডিও ক্যামেরায় যা ওঠেনি, অন্ধকারে সামান্য সময় তা দেখার দাবী খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তাও যথেষ্ট সন্দেহজনক।

কিন্তু তার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই পরবর্তী অভিযানের জন্য একটা সিল করা নোট ছেড়ে যাচ্ছে।

সে নোটটা ছেড়ে যাচ্ছে ২১৩৩ সালে ভোলা হবে, এই আশায়।

২০. অবির পড়েছে ডাক

ভিক্টরকে দেখেছ নাকি? আনন্দে মাইকেলোভিচের দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। এদিকে ফ্লয়েড কাপ্তানের ডাকে সাড়া দিচ্ছিল। কথা শেষ করল প্রশ্নকর্তা, ওর মনটা ভেঙে গেল যে!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ধাক্কা কাটিয়ে উঠবে। কাটছাট জবাব দিল ফ্লয়েড, খোঁচাখুঁচি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই, অন্য ব্যাপারে সে ব্যস্ত, কী হল সেটা খতিয়ে দেখছি…

ক্যাপ্টেন স্মিথ এখনো স্থাণুর মতো গোঁজ হয়ে বসে আছে নিজের কেবিনে। সত্যি যদি স্মিথ মনে করত শিপের কোনো ঝুঁকি আছে-সাথে সাথেই নিজের এনার্জি-ঝড়টাকে ডানে-বামে আদেশ-নিষেধের স্রোতে ছড়িয়ে দিত। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তার কিছু করার নেই, বসে বসে পৃথিবী থেকে আসতে থাকা পরবর্তী মেসেজের আশায় মাছি মারতে হবে ।

ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস তো আজকের বন্ধু নয়-অনেক পুরনো, সে কেমন করে এমন তালগোল পাকালো কে জানে! গোনায় ধরার মতো কোনো দুর্ঘটনা নেই, না আছে পরিচালনায় কোনো ভুল বা যান্ত্রিক ত্রুটি। তাহলে কেন এই গ্যাড়াকলে ফেলারে বাবা! ইউনিভার্সেরও অন্য কোনো পথ ছিল না। অপারেশন্স সেন্টার ঠিকঠাক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল পালাক্রমে। মহাকাশের সেই চিরাচরিত ইমার্জেন্সির মতো লাগছে দেখেশুনে-খবর পাঠানো আর নেয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু ফ্লয়েডের কাছে রিপোের্ট দেয়ার সময় সে অসন্তুষ্টির বিন্দুমাত্র আভাস দেয়নি।

দুর্ঘটনা ঘটে গেল যে, এক্ষুনি পৃথিবীতে ফেরার হুকুম এসেছে। একটা রেসকিউ মিশনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

কোন ধরনের একসিডেন্ট?

আমাদের সিস্টার শিপ গ্যালাক্সি গাঁজায় পড়েছে। বৃহস্পতীয় উপগ্রহগুলো চষছিল একটা সার্ভের সময়। তারপর হঠাৎ ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে হয়।

ফ্লয়েডের চোখেমুখে অবিশ্বাস ফুটে উঠতে দেখল ক্যাপ্টেন স্মিথ।

ঠিক তাই, আমিও জানি এমন কিছু হওয়া অসম্ভব। কিন্তু আপনি পুরোটা শোনেননি। জাহাজটা ইউরোপার মাটি কামড়ে পড়ে আছে।

ইউরোপা!

এমনটাই মনে হচ্ছে। ক্ষতি হল শিপটার, আর উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা কে জানে!-কিন্তু কোনো প্রাণহানি হয়নি। এরচে বেশি জানতে হলে এখন অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।

কখন?

বারো ঘণ্টা আগে। গ্যানিমিডে খবর পাঠাতে বেশ দেরি করে ফেলেছিল।

কিন্তু আমরা কী করতে পারি? আমরাতো সৌর জগতের অন্যপ্রান্তে। এখন চাঁদে দৌড়ে গিয়ে রিফুয়েলিং করে বৃহস্পতি জগতের দিকে যেতে যেতে অন্তত মাস দুয়েক লেগে যাবে! (এবং মনে মনে বাকীটা যোগ করল ফ্লয়েড, লিওনভের যুগে ব্যাপারটা বছর দুয়েক ঠেকার কথা…)

আমিও জানি। কিন্তু কাজে লাগার মতো আর কোনো শিপ নেই।

তাহলে গ্যানিমিডের নিজস্ব আন্তঃউপগ্রহ ফেরিগুলোর খবর কী?

ওগুলো শুধু অর্বিটাল অপারেশনের জন্য তৈরি। কক্ষপথের চেয়ে নিচে নামতে পারবে না।

ক্যালিস্টোতে নেমেছে না সেগুলো?

বেশ নিম্নস্তরের এনার্জি মিশন ছিল সেসব। ও, ইউরোপায় কোনোমতে নামতে পারবে, কিন্তু প্রায় খালি অবস্থায়। এদিকেও নজর দেয়া হয়েছে, অবশ্যই!

ফ্লয়েড এখনো অবিশ্বাসের চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে আছে, খবরটা হজম করা বেশ কষ্টকর। আধ শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথম এমনটা হল, আর মানব ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো। একটা শিপ নিষিদ্ধ চাঁদের বুকে পা রেখেছে। এই একটা চিন্তাই হাজার ভাবনার জন্ম দেয়ার জন্য যথেষ্ট…

ক্যাপ্টেন স্মিথ, আপনার কি মনে হয় ওই… যেই হোক-ই হোক না

কেন-ওরাই এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী?

এ নিয়েই ভাবছিলাম। কিন্তু অনেক বছর ধরেইতো এলাকাটার আশপাশে ঘুরছি আমরা। এতোদিন কিছু হয়নি।

আরো একটা কথা থেকে যায়, উদ্ধার করতে গেলে আমাদের ক্ষেত্রে কিছু হবার সম্ভাবনা থাকে কি-না।

সবার আগে আমার মাথায় এ চিন্তাটাই গোত্তা দিয়েছে। কিন্তু সবটা না জেনে রাজা-উজির মেরে কোনো লাভ নেই। ও, যেজন্য আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এইমাত্র গ্যালাক্সির তালিকা হাতে এল। ভাবছিলাম…

ক্যাপ্টেন একটু দ্বিধার সাথে একটা কাগজ ঠেলে দিল টেবিলের ওপাশে। জানে, ফ্লয়েড কী বলবে এবার।

মাই গ্র্যান্ডসন…

এবং মনে মনে বাকীটা যোগ করল সে, একমাত্র মানুষ, যে আমার নাম সাথে নিয়ে কবরে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *