১. জাদুর পাহাড়

২০৬১ : ওডিসি থ্রি – আর্থার সি ক্লাক
অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান

প্রথম প্রকাশ : জুন ২০০৫

উৎসর্গ

নিপুণকে
আমার এতো ভাল বন্ধুভাগ্য কোথা থেকে এসেছে কে জানে!

.

লেখকের কথা

২০১০: ওডিসি টু যেমন ২০০১: এ স্পেস ওডিসি র সরাসরি সিকুয়্যাল নয় তেন্নি ২০৬: ওডিসি খ্রি ও দ্বিতীয়টার সরাসরি ঝাণ্ডাবাহী নয়। বরং এই সবগুলোকে একই থিমের উপর বিস্তৃতি ধরা যায়, আর সেই অর্থে, সময়কে মাপকাঠি ধরে সিকুয়্যাল বলা যায়। কিংবা, সরলতার জন্য একই নাম ও চরিত্র-ঘটনা থাকা সত্ত্বেও যেন একই ঘটনা নয়, বরং সমান্তরাল চলতে থাকা বিভিন্ন ইউনিভার্সে একই ধারার ঘটনা।

মানুষের চাঁদে পা রাখার বছর পাঁচেক আগে, ১৯৬৪ সালে যখন স্ট্যানলি কুবরিক প্রস্তাব রাখলেন, সত্যিকার ভাল সায়েন্স ফিকশন মুভি বানাবেন, তখন ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু তারপর, এ ধারণায় আগের দুটি বই বিজ্ঞানে সরাসরি অনেক প্রভাব ফেলল, ফলে বলা চলে সেগুলো সার্থক সায়েন্স ফিকশন।

২০১০ খিতে উৎসাহী হই ১৯৭৯ সালের সফল ভরেজার অভিযানের পর। কিন্তু বৃহস্পতীয় অঞ্চলে ভয়েজারের অভিযানের পর আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযান গ্যালিলিও পাঠানো হয়।

আশায় বুক বেঁধেছিলাম গ্যালিলিওকে নিয়ে, সে যাবে, বৃহস্পতির বাতাবরণে একটা প্রোব ছুঁড়ে দেবে, দু বছর খুঁটিয়ে দেখবে বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ। এর উৎক্ষিপ্ত হবার কথা ছিয়াশির মে মাসে। ডিসেম্বর আটাশিতে লক্ষ্যে যাবার কথা এবং উনিশশো নব্বইতে নূতন বাণীর স্রোতে ভেসে যাবার কথা আমার।

হায়, চ্যালেঞ্জটা পিছিয়ে গেল, জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে গ্যালিলিও তার ক্লিন রুমে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আরেকটা লঞ্চ ভেহিকলের আশায় তার বসে থাকা। হয়তো নির্ধারিত সময়ের সাত বছর পর সেটা ঠিকই জায়গামতো পৌঁছবে, তদ্দিন আমার ধৈর্য থাকলেই হল।

গ্যালিলিওকে নিয়ে তৃতীয় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, সেটায় চিড় ধরার আগেই আমি অপেক্ষা বন্ধ করে কলম হাতে নিলাম।

কলম্বো, শ্রীলঙ্কা,
এপ্রিল, ১৯৮৭

প্রথম পর্ব – জাদুর পাহাড়

১. বরফ জমাট বছরগুলো

সত্তুর বছরের বুড়োদের তুলনায় তোমার শরীর অনেক অনেক ভাল, মেডকমের চূড়ান্ত প্রিন্ট আউট থেকে চোখ তুলে বলল ড, গ্লাজনভ, আমিতো তোমার বয়স পঁয়ষট্টিরও কম বলতাম।

বড় খুশির খবর, ওলিগ। বিশেষত আমি যখন কাঁটায় কাঁটায় একশ তিন বছর পেরিয়ে এসেছি, তুমিতো ভাল করেই জান।

এইযে, আবার শুরু! যে কেউ ভাববে তুমি প্রফেসর রুডেঙ্কোর বইটা কখনো পড়ে দেখনি।

ডিয়ার ওল্ড ক্যাথেরিনা! ওর শততম জন্মদিনে আরেকবার সবাই একত্র হওয়ার প্ল্যান করা যেত। কিন্তু ও কখনোই এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। প বেশি বেশি সময় ব্যয় করার এ এক ঝঞ্ঝাট।

একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। অথচ ও-ই সেই বিখ্যাত উক্তির জননী, মাধ্যাকর্ষণই বার্ধক্য টেনে আনে।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড চিন্তাক্লিষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর গ্রহের চির পরিবর্তনীয় লম্বাটে ছবির দিকে; মাত্র ছ হাজার কিলোমিটার দূরে; যেখানে তার সবুজ শৈশব, দুর্দম তারুণ্য আর অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্মজীবন কেটেছে; সেখানেই আর কখনো সে হাঁটতে পারবে না। এ যেন ভাগ্যের আরো শক্তিময় পরিহাস, সে জীবনের সবচে বোকামিপূর্ণ দুর্ঘটনার পরও শক্ত-সমর্থ আছে অথচ তার পুরনো বন্ধুদের প্রায় সবাই চলে গেছে পরপারে।

মাত্র সপ্তাখানেক আগে সে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। কাছের মানুষেরা তো সব সময় সাবধান করতেই, সে নিজেও ছিল সতর্ক। তাছাড়া স্পেস ভ্রমণ এক জীবনে কম তো করেনি! এমন কিছু তার ক্ষেত্রে হতেই পারে না! কিন্তু বিধি বাম। দোতলার ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়। (হ্যাঁ, সে ছিল এক সেলিব্রিটি, খ্যাতিমান অভিযাত্রী। লিওনভ যে নতুন পৃথিবীতে ফিরে এসেছে সেই দুনিয়ায় সেও এক হিরো।) তারপর হাড়ের ভাঙনগুলো আরো জটিল হয়ে পড়ে, পাস্তুর স্পেস হসপিটালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।– সেসব ২০১৫ সালের কথা। আর আজ… তার বিশ্বাসই হয় না, কিন্তু দেয়ালের ক্যালেন্ডারই বলছে, ২০৬১ সাল।

পৃথিবীর তুলনায় এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণ শুধু তার বয়সের জৈব-ঘড়িকে ধীর করে দেয়নি, বরং হাসপাতালটার এ অবস্থা জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো ঘড়ির কাঁটাকে পেছনদিকে ফিরিয়ে দিল। বৃহস্পতি অভিযানের সেই হাইবারনেশন শুধু তার বয়েস বেড়ে যাওয়া রোধ করেনি, বরং উল্টোদিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। আজ এ কথা সর্বজনবিদিত, কেউ কেউ অবশ্য দ্বিমতও পোষণ করে । ফ্লয়েড সত্যি সত্যি বৃহস্পতি মিশন শেষে আরো ঝলমলে তারুণ্য ফিরে পেয়েছিল; আমার যাওয়াটা নিরাপদ? তাহলে তুমি সত্যি সত্যি মনে কর?

“এই ইউনিভার্সে কোনোকিছুই নিরাপদ নয়, হেউড। আমি যতটা জানি, তাতে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া ইউনিভার্স এর পরিবেশ এখানকার মতোই হবে। হ্যাঁ, সেখানে হয়তো-যাকে বলে-আমাদের এই পাস্তুরের মতো মেডিক্যাল এক্সপার্টদের দেখা মেলা ভার, কিন্তু ড, মাহিন্দ্রন খুবই ভাল লোক। তার আওতার বাইরে পরিস্থিতি একবিন্দু সরে গেলেই সে সোজা তোমাকে হাইবারনেশনে পাঠিয়ে দেবে, তারপর আবার পাঠাবে আমাদের কাছে, সি ও ডি।

ফ্লয়েড এমন কোনো সুযোগ পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাচ্ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎই তার আনন্দের সাথে বেদনা মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বাসা পেছনে ফেলে কয়েক সপ্তাহ থাকতে হবে। ছেড়ে যেতে হবে গত কয়েক বছরের বন্ধুদের । আজকের ইউনিভার্স কে পরিবহনের ক্ষেত্রে তুলনা করা হয় আদ্দিকালের লিওনভ এর সাথে । (লিওনভ এখন ল্যাগ্রেন্স জাদুঘরে এক দর্শনীয় পুরোনো মহাকাশযান। মহাকাশের সন্তান লিওনভ কখনো মাটি ছোঁয়নি, এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর বাইরের জাদুঘরটার সাথে ।) হাজার তুলনা করা হোক, আজো বড় মহাকাশ অভিযানগুলোয় কিছু কিছু ঝুঁকি থাকে। বিশেষত এমন মাইলফলক কোনো অভিযান হলেতো কথাই নেই….

কিন্তু তারপরও সে হয়তো ঠিক এমন কোনো মওকাই খুঁজছিল-এই একশ তিন বছর বয়েসেও। (কিংবা মৃত প্রফেসর ক্যাথেরিনা রুডেস্কোর কমপ্লেক্স জেরিয়াট্রিক এ্যাকাউন্টিংয়ের হিসেবে তরতাজা পঁয়ষট্টি।) আজো সে বুভুক্ষের মতো চেয়ে থাকে; এতো আরামদায়ক, নির্ভেজাল জীবন সহ্য হচ্ছিল না গত এক যুগ ধরে।

সৌরজগত জুড়ে আজ হাজারো চমৎকার প্রজেক্টের ছড়াছড়ি। মঙ্গলের নব্যকরণ, মার্কারি বেসের উদ্বোধন, গ্যানিমেডে সবুজায়ন… আসলে আজ আর এমন কোনো স্বতন্ত্র প্রজেক্ট বাকী নেই যেখানে সে তার ক্ষয়িষ্ণু দেহমন নিবেদন করতে পারে। দুই শতাব্দী আগে বৈজ্ঞানিক যুগের প্রথমদিকের এক কবি তাঁর আবেগকে তুলে ধরেছিলেন নিখুঁতভাবে, ওডিসিউস / ইউলিসিসের কণ্ঠ দিয়ে:

জীবনের উপর জীবনের স্তূপ
সব ছিল একেবারে ক্ষীণকায়, এর মধ্যে একটা আমার
থেকে যায় সামান্যই, কিন্তু বেঁচে যায় প্রতি ঘণ্টা
সেই অপার নিরবতা থেকে, এরচেও বেশি কিছু,
নূতনের আমন্ত্রক: এবং এ ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আমাকে তিনখানা সূর্য যক্ষের ধন করে রাখতে হয়,
আর এই ধূসর আত্ম প্রত্যাশা-কাতর
পিছু ধাওয়া করে ডুবন্ত সূর্যের মতো জ্ঞানকে,
মানুষের অকিঞ্চিৎকর ক্ষমতার অনেক অনেক বাইরে।

তিনখানা সূর্য, অবশ্যই। চল্লিশেরও বেশি ছিল, ইউলিসিস হয়তো নিজেই লজ্জা পেয়ে যেত। কিন্তু পরের পদ্যটা আরো বেশি মিলে যায়:

উপসাগরের দল আমাদের ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেও পারে,
আমরা অবশেষে সুখ-দ্বীপপুঞ্জের সন্ধান পেয়ে যেতেও পারি,
আর মহান একিলিসকে দেখ একটি বার, আমরা যাকে চিনতাম।
যদিও নেয়া হয়েছে অনেক, অপেক্ষা করছে অনেক; এবং যদিও
আজ আর অতীতের শক্তি-মদ-মত্ততা নেই আমাদের ভেতর
নিরন্তর ঘুরে চলে পৃথিবী আর স্বর্গ; আমরা যা, আমরা তা-ই;
সেই একই সমান, সতেজ বীর-হৃদয়
সময় আর ভাগ্য যাকে ক্ষীণকায় করে তুলেছে, শুধু আছে শক্ত ইচ্ছা
সংগ্রামের জন্য, অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য, পুরস্কারের জন্য নয়।

অনুসন্ধানের জন্য, পাবার জন্য… আজ সে জানে ঠিক কী খুঁজে বেড়াচ্ছিল এতোদিন তার মন। খোঁজার জন্য এবং পাবার জন্য… সে জানে খোঁজার ও পাবার স্থানটা কোথায়। আর তাকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই।

এই লক্ষ্যটাকেই যে সে সব সময় সচেতনভাবে মনে রেখেছিল এমন নয় । ফ্লয়েড জানেও না ঠিক কী কারণে ব্যাপারটা এত অগ্রাধিকার পাচ্ছে। সে হয়তো মানবজাতির দিকে আবারো আসতে থাকা জ্বরের প্রতিষেধক মনে করে নিজেকে দ্বিতীয় বারের মতো!-কিন্তু তার ভুলও হয়ে থাকতে পারে। কিংবা ইউনিভার্স এর অভিযাত্রীদের শর্ট লিস্টে তার নাম রাখার অতল প্রলোভন তার মনের গহীনে লুকিয়ে ছিল, সেটাই জেগে উঠছে।

আরো একটা সম্ভাবনা আছে, এই এতো বছর পরেও, ১৯৮৫/৮৬ সালের দ্বন্দ্বে মানুষের মনোভাবের কথাটা ভোলা যায়নি। এবার একটা সুযোগ এসেছে-তার জীবনের শেষ সুযোগ-আর মানুষের জন্য প্রথম বারের মতো-যার মাধ্যমে আগের সব অসন্তুষ্টি কাটিয়ে ওঠা যায় ।

সেই বিংশ শতাব্দীতে শুধু ওড়াউড়িই সার ছিল। এরচে বেশি কিছু করা মুশকিল। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি ল্যান্ড করা সম্ভব। পথ দেখিয়েছিল আর্মস্ট্রং আর। অলড্রিনের চাঁদের বুকে প্রথম পদক্ষেপ।

ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ২০০১ সালের চাঁদের মনোলিথ বিষয়ক সিদ্ধান্তদাতা, ২০০১ সালের বৃহস্পতি-শনি মিশনের সর্বেসর্বা, ২০১০-১৫ সালের বৃহস্পতি অভিযানের অংশগ্রহণকারী তার সমস্ত কল্পনাকে উড়তে দিল। অতল মহাকাশ থেকে উঁকি দেয়া সেই পরিদর্শকের চারপাশে উড়তে দিল। সেই অতিথি নিজের গতি আরো আরো বাড়িয়ে নিচ্ছে, প্রদক্ষিণ করবে সূর্যকে। আর পৃথিবী ও শুক্রের অর্বিটের মাঝামাঝি এখনো অসম্পূর্ণ স্পেস লাইনার ইউনিভার্স তার প্রথম উড্ডয়নেই মিলিত হবে স-ব ধূমকেতুর রাজার সাথে।

সম্মিলনের জায়গাটা কাঁটায় কাঁটায় ঠিক করা হয়নি, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ঠিকই ঠিক করা হয়ে গেছে।

হ্যালি-এইতো, আসছি আমি…, ফিসফিস করে ওঠে হেউড ফ্লয়েড।

২. প্রথম দর্শন

এমন কোনো কথা নেই- কেউ পৃথিবী ছাড়লেই যে পরিপূর্ণ স্বর্গসুধা পানের উদ্দেশ্যেই শুধু যাবে। আর আকাশ থেকে দেখা আকাশ ও পৃথিবীর যে কোনো উঁচু পর্বতশৃঙ্গ থেকে মেঘহীন রাতে দেখা আকাশের মধ্যেও একচুল ফারাক নেই। আসলে আকাশ এর চিত্রপটে তেমন কোনো বদল দেখাই যায় না। এমিতে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে তারার আলো আরো উজ্জ্বল দেখায়, সাথে নক্ষত্রলোককে আরো উদ্দীপিত লাগে, কিন্তু খালি চোখে স্পেস থেকে দেখা আকাশ আর নিচ থেকে দেখা আকাশের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ পাওয়া যাবে না। এই অবজার্ভেশন উইন্ডো তো এক লহমায় তুলে আনতে পারে না আধখানা পৃথিবীকেও।

হেউড ফ্লয়েড সৃষ্টিজগতের উপর যতটা দৃষ্টি দিতে পারতো তা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, বিশেষত তার আবাসিক এলাকা যখন ধীরে ঘূর্ণায়মান হসপিটালের আঁধার অঞ্চলে মুখ লুকায়। তখন তার চতুষ্কোণ দৃষ্টি জুড়ে থাকে তারকালোক, গ্রহ জগৎ, নেবুলা আর সব… সব কিছুকে স্নান করে দিয়ে নূতন নক্ষত্র লুসিফারের ক্ষীণ আলোর ঝলক। লুসিফার, সূর্যের নবীন প্রতিদ্বন্দ্বী।

কৃত্রিম রাত শুরুর মিনিট দশেক আগেই সে সাধারণত কেবিনের সবগুলো আলো নিভিয়ে দেয়। লাল ইমার্জেন্সি লাইটটাও বাদ পড়ে না। নিকষ কালো অন্ধকার চাই তার। স্পেস ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় একটু দেরিতেই বলতে হয়, সেও খোলা চোখের মহাকাশবিদ্যার অপার্থিব আনন্দের একটু সন্ধান পেয়েছে। আজ সত্যি সত্যি সে প্রায়ই নক্ষত্র-বিবর্তনের সন্ধান পায়, নগ্ন চোখে। এমনকি এ প্রক্রিয়ার একটু আলোকছটা ছিটকে এলেই সে ধরতে পারবে।

সেই মে মাসের প্রতিটি রাতেই ফ্লয়েড ধূমকেতুটার অবস্থান দেখে নিয়েছে স্টার চার্টে। তখন সেটা মঙ্গল-এলাকা পেরুচ্ছিল। একজোড়া ভাল দূরবীণেই অবশ্য হ্যালিকে পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সে কিছুতেই সেসব জিনিস ছুঁয়ে দেখবে না। এ যেন এক খেলা। আর কদুর তার বুড়োটে চোখ সয়ে যেতে পারে তা দেখার চ্যালেঞ্জ। অবশ্য এরই মধ্যে মাউনা কিয়ার দুজন অ্যাস্ট্রোনোমার খালি চোখে ধূমকেতুটাকে দেখার দাবী করে বসেছে। তাদের কথায় কেউ কান দেয়নি। আর পাস্তুরের অন্য বাসিন্দাদের দাবীকে তো অবশ্য মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

কিন্তু আজ রাতে তার ভাগ্য হয়তো প্রসন্ন। গামা থেকে এফসাইলন পর্যন্ত সে যেন একটা রেখার দেখা পাচ্ছে। এর উপর বসানো কল্পিত কোনো এক ত্রিভুজের দিকে পড়ে আছে দৃষ্টি। যেন একটু চেষ্টা করলেই চোখের মামুলী দৃষ্টি দিয়ে পুরো সৌর জগৎ তেড়ে-ফুঁড়ে বেরুতে পারবে।

এবং এইতো সেই আকাক্ষার বস্তু!-সেই প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতার মতোই। ছিয়াত্তর বছর আগে! অস্পষ্ট, কিন্তু ভুল হবার জো নেই। অবশ্য সে যদি কাঁটায় কাঁটায় খোঁজার জায়গাটা না চিনত তাহলে দেখলেও বোঝার নিশ্চয়তা থাকত না। যেন দূরের কোনো নেবুলা।

খোলা চোখে জিনিসটা নিখুঁত গোল, ধোয়াটে অবয়ব। এতোদূর থেকে বিখ্যাত লেজের দেখা পাওয়া দুষ্কর। চারধারে ভেসে চলা ছোট্ট ফ্লোটিলা প্রোবগুলো একে মাসের পর মাস ধরে পাহারা দিচ্ছে। এরই মধ্যে এর গায়ের একটু বিস্ফোরণের ছোঁয়া আবিস্কৃত। আর মাত্র কিছুদিন পরই সৌকর্যময় পুচ্ছ আলোক-ধোয়ার বন্যা বইয়ে দেবে, নির্দেশ করবে এর স্রষ্টা-সূর্যের ঠিক বিপরীত দিক।

আর সবার মতো হেউড ফ্লয়েডও সেই চিরাচরিত হিমশীতল, আঁধার… না পুরোপুরি কালো গড়নটাকে সৌরজগতের ভিতরদিকে প্রবেশ করতে দেখেছে। শত্রুর বছরের শীতলতা কাটিয়ে সেই পানির জটিল মিশ্রণ, অ্যামোনিয়া আর অন্য বরফের স্তূপ ফুটতে শুরু করে। এ এক উড়ন্ত পাহাড়, আকার আকৃতিতে কিম্ভূত, ম্যানহাটান আইল্যান্ডের মতো বিশাল। হ্যালির ধূমকেতুকে সূর্য একটা ফুটোওয়ালা স্টিম বয়লারের মতো আকৃতি দিচ্ছে। জলীয় বাষ্পের স্কুণের সাথে মিশে আছে ধুলার আস্তর। আর আধডজন জ্বালামুখ থেকে অবিরাম বেরিয়ে আসছে রাসায়নিক ধোঁয়াশা। স্থানীয় সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুয়েক পরেই সবচে বড়টাও উদ্গীরণ শুরু করে। সেটার আকার বিশাল একটা ফুটবল মাঠের সমান। ঠিক যেন কোনো বিশাল বাষ্প-উদগীরক।

এরই মধ্যে সেই জ্বালামুখের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকার ফ্যান্টাসিতে ভুগছে সে, যেন অপেক্ষা করছে সূর্যোদয়ের জন্য। চারপাশে পরিচিত পরিবেশ, পরিবেশটাও দেখেছে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। অবশ্য হ্যালির বুকে মহাকাশতরী নোঙর ফেললেও ক্রুরা বাইরে যেতে আদৌ রাজী হবে না।

সেই ছোট প্রিন্ট আউটে এ কাজটাকে শক্তভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

আমাকে থামানো তাদের জন্য বড় ঝামেলার ব্যাপার হবে, ভাবল হেউড ফ্লয়েড। আমি নিশ্চিত আজো একটা স্পেসস্যুট ভালমতো ব্যবহার করতে জানি। আর যদি কোনো ভুল হয়েই যায় তো…

একবার তাজমহল দেখতে দেখতে কোনো এক পর্যটক বলেছিল: এমন একটা স্মৃতিসৌধের জন্য আমি কালকেই মরে যেতে রাজি।

সে মহানন্দে তাজমহলের জায়গায় হ্যালি শব্দটা বসিয়ে দিতে চায়।

৩. পুনঃপ্রবেশ

এমন ভয়াল দুর্ঘটনার কথা হিসেব থেকে বাদ দিলেও তার পৃথিবীতে পা রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।

প্রথম চমক এসেছিল জেগে ওঠার পরপরই। ড. রুডেস্কো লম্বা ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। তার পাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল ওয়াল্টার কার্নো। সেই আধঘুমেও ফ্লয়েড বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড় আছে। তারা যেন ফ্লয়েডের জেগে ওঠায় খুব একটা খুশি নয়। সে আগে পুরোপুরি জেগে ওঠে; তারপর জানতে পারে ড. চন্দ্র আর নেই তাদের সাথে।

মঙ্গলের পেছনে কোনো এক জায়গায় তার নিষ্প্রাণ দেহ ভেসে বেরিয়ে যায়। অনেক অনেক আগেই সে লীন হয়ে গেছে সূর্যের সাথে।

কেউ জানে না তার মৃত্যুর কারণ। ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি তার ধারণার কথা বলল, একেবারে অবৈজ্ঞানিক কারণ হলেও সার্জন-কমান্ডার ক্যাথেরিনা রুডেঙ্কা কথাটা ফেলে দিতে পারেনি।

সে হালকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেনি।

ওয়াল্টার কার্নো আরেকটা কারণ বলেছিল সবাইকে টপকে গিয়ে।

কে জানে হাল ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে! সেও বিমর্ষ, কোনো…একটা কিছু আমাদের স-ব দেখছে। আজ বা কাল, সে ঠিকই জানতে পারবে।

আর আজ কার্নোও অন্য সবার সাথে চলে গেল; আছে শুধু ছোট্ট জেনিয়া। গত বিশ বছর ধরে তার দেখা নেই। শুধু প্রতি ক্রিসমাসে আজো তার সুন্দর কার্ড ভেসে আসে। সর্বশেষটা তার ডেস্কে পিন দিয়ে সাঁটা আছে, সযত্নে।

কার্ডে আঁকা আছে রাশিয়ান শীতের নিদারুণ বরফ, তার সাথে অতি ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল।

পঁয়তাল্লিশ বছর! যেন এই গতকালই লিওনভ পৃথিবীর অর্বিটে ফিরে এসেছিল। পৃথিবীজুড়ে স্বাগত জানানোর জোয়ার যেমন ছিল তেমনই ছিল একটু শীতলতা। লিওনভের বৃহস্পতি মিশন ছিল অনেকাংশে সফল, দামী, সেইসাথে সেই মিশনই আবার একটা প্যানডোরার বাক্স খুলে দিয়ে এসেছে, যেন পৃথিবীর মানুষের জন্য খাল কেটে টেনে এনেছে মস্ত নরখাদক কুমীরকে। কিন্তু সেই বাক্সের রহস্য আজো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি।

টাইকো মনোলিথ বা টাইকো জ্বালামুখের চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা আকারে একশিলাস্তম্ভটা চাঁদের বুকে আবিস্কৃত হবার পরই সব বিশৃঙ্খলার শুরু। তখন হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন সেটার অস্তিত্বের কথা জানতো। তার মধ্যে অনেকেই নিশ্চিত ছিল না; মানে রাশিয়ানরা তো শুধু গোয়েন্দা রিপোর্ট পেয়েছিল, ফ্লয়েডের মতো ছুঁয়ে দেখেনি। সময় এগিয়ে গেল, ব্যর্থ হল ডিসকভারির মিশন; পৃথিবীর মানুষ জানল, চার মিলিয়ন বছর আগে অপার্থিব বুদ্ধিমত্তা আমাদের ছুঁয়ে গিয়েছিল। শুধু চাঁদের বুকে ফেলে গিয়েছিল কলিংবেলটাকে। খবরটা স্বস্তিদায়ক হলেও সারপ্রাইজ ছিল না মোটেও। কত দশক ধরে মানুষ এমন একটা খবরের আশায় দিন গুনেছে!

এসবই মানব জাতির আগমনের অনেক অনেক আগের কথা। ডিসকভারির চারধারে আরো কত অব্যাখ্যাত ঘটনা যে ঘটে গেল তারপর? শুধু কম্পিউটারের বিগড়ে যাবার ঘটনা ছাড়া আর কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দার্শনিক তত্ত্বে কোনো বিচ্যুতি আসেনি, দেখা পাবার কথা গোনায় ধরলে, ত্রিশ-চল্লিশ লাখ বছরে সেই আগন্তুকরা হারিয়ে গেছে এমন মনে করলে, মানুষ তখনো সৃষ্টিজগতের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী।

কিন্তু আজ আর সে কথাও সত্যি নয়, মাত্র এক আলোক মিনিট দূরে, ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় ধূলিকণার চেয়েও কম দূরত্বে এমন এক বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে যে বা যারা আস্ত নক্ষত্রের জন্ম দিতে পারে। যারা নিজেদের সামান্য এক ইচ্ছা পূরণের জন্য পৃথিবীর চেয়ে হাজার গুণ বড় একটা গ্রহকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করতে পারে। তারা মানুষের ব্যাপারে যে পুরোপুরি সচেতন তার প্রমাণস্বরূপ ডিসকভারির মাধ্যমে খবরও পাঠিয়েছে; তারপরই ধ্বংস হয়ে যায় বৃহস্পতি, জন্ম নেয় লুসিফার, শুধু মানুষের মনে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁটে দেয় সেই মেসেজ

এই স-ব দুনিয়া তোমাদের –শুধু ইউরোপা ছাড়া।
সেখানে নামার কোনো চেষ্টা করো না।

সেই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র লুসিফার পৃথিবীর বুকের রাত কেড়ে নিল বছরে কয়েক মাসের জন্য, যখন সে সূর্যকে অতিক্রম করে। নিয়ে এল আশা, কেড়ে নিল অমানিশা, বয়ে আনল ভয়। ভয়-মানুষ চিরদিনই অজানাকে ভয় পায়। আশা-কারণ বিশ্বপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, সভ্যতার জন্মদাত্রী আলোক আজ সুলভ, পৃথিবীর রাজনৈতিক পট যাচ্ছে বদলে এবং মানুষ চিরদিনই অজানাকে দেখে আশায় বুক বাঁধে।

সব সময় বলা হতো, পুরো মানবজাতি এক হবে সেদিনই যেদিন বাইরের জগৎ থেকে কোনো হুমকি আসবে। কারণ মানুষ সব সময় একতাবদ্ধ হয় হুমকির বিরুদ্ধে আর হুমকিস্বরূপ মানুষের অন্যপক্ষ শুধু মানুষই অবশিষ্ট ছিল। কেউ জানে না লুসিফার হুমকি ছিল কিনা, জানে শুধু এ এক চ্যালেঞ্জ। এই যথেষ্ট।

হেউড ফ্লয়েড পাস্তুরে বসে বসে পৃথিবীর রাজনৈতিক পট বদলে যাওয়া দেখেছে, যেন সে এক অ্যালিয়েন দর্শক। প্রথমদিকে তার আর স্পেসে থাকার সাধ ছিল না, একবার সুস্থ হলেই চলে যেত। কিন্তু তার ডাক্তারেরা অপ্রয়োজনীয় রকমের লম্বা সময় নিয়ে ফেলল।

পরের বছরগুলোর উত্তেজনা দেখে সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারে ঠিক কী জন্য তার হাড়গুলো ফিরে যেতে চাচ্ছে না।

সে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে চায়নি। নিচের সেই সাদাটে-নীলচে গোলকে তার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ সে বুঝতে পারে কেন চন্দ্রর বাঁচার কোনো ইচ্ছা বাকি ছিল না।

সেই ইউরোপের ফ্লাইটে তার প্রথম স্ত্রীর সাথে না যাওয়াটাই বদলে দিল সবকিছু। ম্যারিয়ন আজ অন্য জীবনের অংশ, তার দুই কন্যা নিজের নিজের পরিবারে নবাগতদের নিয়ে ব্যস্ত।

কিন্তু সে ক্যারোলিনকে নিজের কারণেই হারিয়েছে, কিন্তু কিছু করার ছিল না। সে কোনোদিনই বোঝেনি। (ফ্লয়েড নিজে কি বুঝেছে?) কেন সে নিজের এতো যত্নে গড়া ঘর ছেড়ে, কয়েক বছরের জন্য সূর্য ছেড়ে এতোদূরে গেল?

মিশনের অর্ধেকটা পেরুনোর পরও সে জানতো আর কোনো উপায় নেই, ক্যারোলিনকে পাওয়া যাবে না। শুধু আশা ছিল ক্রিস তার বাবাকে বুঝবে। কিন্তু তার ছোট্ট ছেলে ততদিনে বাবা ছাড়া অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বসেছে। ফিরে এসে ফ্লয়েড দেখে তার স্থান অন্য একজন দখল করে বসে আছে, ক্রিসের মনও। ভেবেছিল কোনোদিন এত সব দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারবে না। ঠিক ঠিক পেরেছে, এতোগুলো বছর মুখের কথা নয়। তবে পৃথিবীও তাকে আর ঠিক গ্রহণ করেনি। শরীরও সয়নি। ফিরে যেতে হয়েছে পাস্তুরে, পৃথিবীর কত কাছে! কিন্তু পৃথিবীতে নয়। পৃথিবীর বুকে মানুষ আজ এক শতাব্দী ধরেই অবলীলায় দশ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়, অনেকে প্রতিদিন। সে মাত্র ছ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে সবুজ গ্রহটা দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না।

সে অবশ্য পরিত্যক্ত হয়নি-বরং উল্টো। এমনকি চিকিৎসার সময়ও রিপোর্ট করে যাচ্ছিল, বলছিল হাজারো কমিশনের খবর, ইন্টারভিউ দিচ্ছিল দেদার। সে ছিল এক বিখ্যাত লোক, উপভোগ করত ব্যাপারটাকে। তার নিজের দুঃখময় দুনিয়া থেকে একটু সরে আসতে, একটু স্বস্তি পেতে এই ব্যাপারগুলো অনেক সহায়তা করত।

প্রথম পূর্ণ দশক, ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়টা এত দ্রুত কেটে গেছে যে এখন সেদিকে তাকালে কেমন যেন মনে হয়। কোনো চিরাচরিত সংকট ছিল না, বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি, শুধু সেই ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্প। কী প্রতাপ ছিল সেটার! পরে স্ক্রিনে দেখেছিল দৃশ্যগুলো। বিশাল মহানগরী মিশে যায় ধুলার সাথে । সেই মহাদানব তার ঐশ্বরিক চোখকে এক-দুজন মানুষের উপর নিবদ্ধ করেনি বলেই অনেক অনেক মানুষ বেঁচে যায় । আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যামেরাগুলোই মূল দৃশ্য তুলে আনতে পেরেছিল।

সেই দশকে ভৌগোলিক টেকটোনিক প্লেটের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্লেটগুলোও বারংবার রূপ বদলায়। তার দৃষ্টি যেন সময়কে কেটে পৃথিবীর গোড়ার দিকে চলে যাচ্ছে, একমাত্র মহাদেশ প্যানগায়ার দিকে। তারপর কত শত সহস্রাব্দের ভাঙাগড়ায় এতোগুলো মহাদেশের সৃজন চলতে থাকে। মানুষের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য। কত অগুনতি গোত্র, উপগোত্র, জাতি, উপজাতি! পুরনো সাংস্কৃতিকতা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসে; ভাষার লক্ষ-কোটি উচ্চারণ, আঞ্চলিকতা ঝরে পড়ে। তারপর মানুষ আস্তে আস্তে এক হয়ে যায়। তবু এই এক হওয়ার প্রক্রিয়াটা মাত্র দু-চার শতাব্দীর অবদান।

ঘটনাটায় অনুঘটকরূপে যোগ দেয় মহাজাগতিক সেইসব ঘটনা, লুসিফার স্বয়ং। আর যে পরিবর্তন আরো কয়েক শতাব্দীতে হবার কথা ছিল তা ঘটে যায় খুব দ্রুত।

জেট যুগ বৈশ্বিক ভ্রমণের দ্বার খুলে দিয়েছিল। প্রায় একই সাথে স্যাটেলাইট আর ফাইবার অপটিক্স যোগাযোগের পথকে আরো সহজ করে তোলে। দু হাজার সালের একত্রিশে ডিসেম্বর থেকে আর কোনো লঙ ডিসটেন্স কল বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। ফাইবার অপটিক্সের বদৌলতে পৃথিবীর সবখানে কলরেট সমান। আর, মানবজাতি তৃতীয় সহস্রাব্দকে বরণ করে, দু হাজার এক সাল অবাক চোখে দেখে পৃথিবীতে পুরো মানবজাতি একটি মাত্র পরিবার।

আর সব পরিবারের মতো এটাতেও অশান্তি ছিল টুকটাক। কিন্তু এর সেসব খুনসুটি আর আগের মতো পুরো গ্রহটাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় না। দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ নিউক্লিয়ার যুদ্ধে মানুষ পারমাণবিক বোমার স্বরূপ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করে। আস্তে আস্তে শান্তির দিকে চোখ ফেরে সবার। তেলের উপর চাপ কমাতে পারমাণবিক গবেষণাকে শান্তি-শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতো সহজে এতোকিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল না। তিন দানব-আমেরিকা, রাশিয়া আর চীন বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়।

এক শতাব্দী আগে কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের অচিন্তনীয় যুদ্ধের মতোই ২০২০ ২০৩০ এর বড় যুদ্ধটা ছিল অকল্পনীয়। তারপর তারা শান্তির কাজে লাগানো শুরু করে শক্তিকে। দেখতে পায় এখানেও কাজ করছে উত্তেজনা…

কোন আদর্শবাদী লোক পিস হোস্টেজ প্রকল্পের কর্মসূচী হাতে নেয়নি। হঠাই দেখা গেল আমেরিকায় কয়েক লাখ সোভিয়েত লোকের আনাগোনা চলছে আর রাশিয়ায় আধ মিলিয়ন আমেরিকান সব সময় থাকে। এইসব মানুষ থেকেও শান্তির পণবন্দী চিন্তার একটু সূত্রপাত হয়। তাদের পরিজন আছে অনেক অনেক, দু দেশেই। সম্পদ আর রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়িতে তারা উপাদান হতে চায়নি।

আর কোনো দেশ চাইলেও লম্বা কোনো যুদ্ধ বাধানোর উপায় ছিল না। কারণ যুগটা হল স্বচ্ছতার। স্বচ্ছতার যুগের শুরু ১৯৯০ এর পরপরই। সংবাদ সংস্থাগুলো নিজেদের স্যাটেলাইট ছাড়ে সে সময়টায়। তাতে ছিল হাই রেজুলেশন ক্যামেরা, সামরিক স্থাপনাও বাদ পড়ত না সেসবের করাল দৃষ্টি থেকে। পেন্টাগন আর ক্রেমলিন ভয়ংকর, তারচেও বেশি ভয়াল এসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স আর চব্বিশ ঘণ্টা-জাগ্রত নিউজ সার্ভিস এর অর্বিটাল ক্যামেরাগুলো। তথ্য লুকিয়ে রাখার যুগ তখন থেকেই তিরোহিত হয়।

২০৬০ সালের মধ্যে যে সারা পৃথিবীকে একেবারে নিরস্ত্র করা গেছে তা নয়, কিন্তু অবশিষ্ট মাত্র পঞ্চাশটা পারমাণবিক বোমাকে আন্তর্জাতিক নজরদারীর আওতায় আনা হয়। সেই জনপ্রিয় দানব অষ্টম এডওয়ার্ড প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গৃহপতি নির্বাচিত হবার সময় তেমন কোনো বাদানুবাদ ওঠেনি। মাত্র কয়েকটা স্টেট সমর্থন দেয়নি, আর তারা তেমন শক্তিশালীও ছিল না। আর্জেন্টিনা-ব্রিটেন বিবাদের মতো ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে কেটে যায়।

এরপর বিশ্ব অর্থনীতিতে এলো প্রবল প্রতাপশালী জোয়ার। সেটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও ছিল। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান ঝরে গেল, ডুবল বড়গুলোও।

এতদিনে নূতন আরো কিছু বানানোর সময় এসেছে। মানবজাতি যুদ্ধের সমান অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ায় মানুষ হাজার সহস্রাব্দ এগিয়ে যাবার কথা ভাবছে, এত সামনে এগুনোর কথা ভাবছে আজকাল, যেখানে যাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে ভয় পেত আগের মানুষ।

৪. উত্তাল ঝড়

জন্মের সময় উইলিয়াম সুংকে বিশ্বের সবচে ব্যয়বহুল শিশু বলা হয়। দাবীটা দু বছর টিকে ছিল। তার বোনই রেকর্ড ভেঙে বসে। এরপর পারিবারিক আইন উঠিয়ে দেয়া হলে আর একে চ্যালেঞ্জ করার মতো কিছু বাকী থাকল না।

তাদের বাবা, কিংবদন্তীতুল্য স্যার লরেন্সের জন্ম চীনের সেই বিখ্যাত এক সন্তান, এক পরিবার নীতির সময়ে। প্রজন্মটা ছিল মনোবিদ আর সমাজবিদদের হাজারো কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত। সেকালে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। কোনো ভাইবোন নেই, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কোনো চাচা-ফুপুও নেই… মানব ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। মনস্তত্ত্ব আর সমাজবিদ্যার প্রয়োগকাল বলা যায় তাই সে সময়টাকে।

২২ সালে তার দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় লাইসেন্সিং সিস্টেমটি আইনে পরিণত হয়েছে। আপনি যত খুশি সন্তান নিতে পারেন, শুধু পর্যাপ্ত ফি টা পরিশোধ করতে হবে। (পুরনো কমিউনিস্টরাই যে এর পথে সমস্ত দৃঢ়তা একা একা দেখিয়েছিল এমনটা হয়নি। বরং তাদের সমর্থন জানিয়েছে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক।)

প্রথম দু সন্তানের কোনো ফি ছিল না। তৃতীয় সন্তানের জন্য দিতে হত এক মিলিয়ন সোল, চতুর্থজনের জন্য দুই, পঞ্চম চার এবং এভাবে দ্বিগুণ করে বাকী সবার হিসাব ধরা হবে। মজার ব্যাপার হল পুঁজিবাদী সমাজে এমিতেও তিন সন্তানের প্রতি কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

তরুণ মি. সুং (অনেক বছর আগের কথা অবশ্যই, কিং অ্যাওয়ার্ড তাকে তার কে বি ই দেয়ার আগে) মনে মনে কোনো ফন্দি এঁটেছে বলে মনে হতো না; তার পঞ্চম সন্তান জন্মের সময়ও সে এক নিতান্ত গোবেচারা কোটিপতি। কিন্তু তখন বয়স মাত্র চল্লিশ। তারপর হংকং হাতবদলে তার যতটা অৰ্থক্ষয় হওয়ার কথা ছিল ততোটা না হওয়ায় দেখতে পেল হাতে মোটামুটি কিছু টাকাকড়ি দেখা যাচ্ছে।

সুতরাং, এগিয়ে চলল ঐতিহ্য… কিন্তু স্যার লরেন্স সম্পর্কে আরো অনেক গল্পের মতো এটারও সত্যমিথ্যার কোনো মা-বাপ নেই। যেমন আগের গুজবটিও ছিল ভিত্তিহীন, তার হাতে নাকি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের একটা চোরাই এডিশন ছিল, আকারে মাত্র জুতার বাক্সের সমান।

চান্দ্র চুক্তিতে আমেরিকার সই করতে না পারার ফলেই পুরো মলিকুলার মেমোরি মডিউল র‍্যাকেট প্রজেক্ট আলোর মুখ দেখে।

এমনকি স্যার লরেন্স একজন মাল্টি ট্রিলিয়নিয়ার না হলেও তার কর্পোরেশনের জটিল ধাঁধাগুলো তাকে বিশ্বের শক্তিমান আর্থিক শক্তিতে পরিণত করে। সে তার ষষ্ঠ সন্তানের জন্য আট মিলিয়ন বা অষ্টমের জন্য বত্রিশ মিলিয়নের ঘোড়াই পরোয়া করত। কিন্তু নবম সন্তানের জন্য চৌষট্টি দেয়ার পর বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোর টনক নড়ে। দশমজনের পর বাজিকররা তার একাদশ সন্তানের জন্য দুশো ছাপ্পান্ন খরচ করা না করা নিয়ে দর কষাকষি শুরু করে দিয়েছিল। বাধ সাধল লেডি জেসমিন। তার মনে হল হঠাৎ, দশ সন্তান নিয়ে সুং গোশিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা গেছে।

বাই চান্স (যদি এ নামে আসলেই কিছু থেকে থাকে) স্যার লরেন্স একেবারে ব্যক্তিগতভাবে স্পেস বিজনেসের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তার অবশ্যই অনেক আনন্দের যোগাড়যন্ত্র করা থাকতো, আর মহাকাশবিদ্যায়ও ছিল অপার আগ্রহ, কিন্তু এসব দেখাশোনার জন্য পাঁচ ছেলে আর তাদের সেক্রেটারিরাই যথেষ্ট। কিন্তু স্যার লরেন্সের আসল ভালবাসা পড়ে আছে সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যমে-অবলুপ্তি থেকে টিকে যাওয়া কয়েকটি সংবাদপত্র, বই, ইলেক্ট্রনিক আর কাগজের ম্যাগাজিন এবং সবচে বড় কথা, আন্তর্জাতিক টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলোতে।

এরপর এক কথায় সে কিনে ফেলল পুরনো পেনিনসুলার হোটেল ভবনটা। কারণ, কোনো এক কালে এক গরীব চীনা ছেলে হোটেলটা দেখে নিজের বাড়ি করার কথা ভেবেছিল। বিশাল শপিং মল আর রাজকীয় মার্কেটগুলোকে খুব ভদ্রভাবেই উঠিয়ে দিয়েছে, আজ ভবনটার চারধারে গড়ে উঠেছে মনোরম পার্ক। আর সেই ঐতিহ্যবাহী সুরম্য অট্টালিকা তার বাসভবন এবং মূল অফিস। আসলে নতুন লেসার অ্যাক্সক্যাভেশন কর্পোরেশনের ভাগ্য একটু প্রসন্ন হয়েছিল, আর তা থেকেই কিছু বাড়তি লাভ চলে আসে, এই যা।

একদিন, পোতাশ্রয়ের ওপাশ থেকে মহানগরীর অসম আকাশ দেখে সে সন্তুষ্টির সাথে সাথে আরো কিছু উন্নয়নের কথা ভাবে। পেনিনসুলারের নিচের কয়েকটা তলা সামনের একটা বিশাল, গলফ মাঠ টাইপ বিল্ডিংয়ের জন্য কেমন আড়াল হয়ে যাচ্ছে! এটার-সিদ্ধান্ত নিল স্যার লরেন্স-এখানে থাকা চলবে না।

হংকং প্ল্যানেটরিয়ামের ডিরেক্টরকে পৃথিবীর সেরা পাঁচের মধ্যে ধরা হয়। তার অন্য কিছু প্ল্যানও ছিল। আর স্যার লরেন্স জীবনে প্রথমবারের মতো পয়সায় কেনা যায় না এমন কিছু দেখে বেশ চমৎকৃত হয়। তাদের মধ্যে বেশ গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। এবং অতঃপর স্যার লরেন্সের ষাটতম জন্মবার্ষিকীতে সে পার্টি দিয়েছিল; কিন্তু তার জানা ছিল না যে, পুরো সৌরজগতের ভাগ্যলিপি বদলে দেয়ার পথে সুং গোষ্ঠি সহায়তা করতে পারে।

৫. বরফের বাইরে

১৯২৪ সালে জেসিয়া সর্বপ্রথম জিনাতে প্রোটোটাইপ বানান। তার শত বছর পরেও কয়েকটা অপটিক্যাল প্ল্যানেটরিয়াম প্রজেক্টর কাজে লাগছে। আজো সেগুলো দর্শকের চোখের সামনে মিটমিটিয়ে জ্বলে। হংকং তৃতীয় প্রজন্মের যন্ত্রপাতির দিন ছাড়িয়ে এসেছে কয়েক দশক আগেই।

বিরাট ডোমের পুরোটাই এক দৈত্যাকার টেলিভিশন স্ক্রিন। এজন্য কাজে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন প্যানেল। আসলেই, এ টিভিতে ধরা যায় না এমন কোনো দৃশ্য নেই।

প্রোগ্রামটা উদ্বোধন করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক চৈনিক আবিষ্কারককে উৎসর্গ করার মাধ্যমে। অচেনা সেই বৈজ্ঞানিক রকেটের জনক ছিলেন বলে দাবী করা হয়। প্রথম পাঁচ মিনিট তুমুলবেগে ঐতিহাসিক জগৎ খুঁড়ে দেখার কাজ চলল। তারপর ড. হিউ সেন জিয়াংকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক উপরে তোলা হল; অবশ্যই তার ক্যারিয়ারের পেছনে আমেরিকা, রাশিয়া আর জার্মানির বিজ্ঞানীদের সব অবদানকে তুচ্ছ করে। অবশ্য তার দেশের মানুষকে মাফ করা যায়, এমন একটা জমকালো অনুষ্ঠানে লোকজন তাঁকে রকেটশিল্পের জগতে গদার, ভন ব্রাউন কিংবা কোরেলভের সাথে তুলনা করলেও অত্যুক্তির মতো দেখাতো না। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রে তার গ্রেফতার হওয়ার কথা নিয়ে তুবড়ি ছোটে, ঘটনাটার কিছুদিন আগেই ডক্টর জিয়াং সুখ্যাত জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন এবং তার পরপরই ক্যালটেকের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম গদার প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তারপর তিনি গ্রেফতারের ঘটনায় আঘাত পেয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।

১৯৭০ সালে লঙ মার্চ ১ রকেটের মাধ্যমে চীন যে প্রথমবারের মতো মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় সেকথা খুব কমই উচ্চারিত হল। কারণ হয়তো এই যে, সে সময়টায় আমেরিকানরা চাঁদের বুকে দাপড়ে বেড়াচ্ছে। আসলেই, বিংশ শতাব্দীর বাকী সময়টা দু-চার মিনিটেই যেন কেটে গিয়েছিল। এরপরই সেই অবিস্মরণীয় স্পেসশিপ জিয়াং এর সৃষ্টির ঘটনা, ২০০৭ সালে।

ভাষ্যকার বাকী কাহিনীটুকু বলেনি, বলেনি যে জিয়াঙের অনেক আগেই, ২০০১। সালে আমেরিকার ডিসকভারি মাতিয়ে রেখেছিল বৃহস্পতি-শনি জগৎ, এমনকি জিয়াং যাত্রা শুরু করার সামান্য কিছুদিন আগে রাশিয়ার একক প্রযুক্তিতে মার্কিন-রাশিয়ান অভিযান চালানো হয় বৃহস্পতির দিকে কসমোনট অ্যালেক্সি লিওনভ স্পেসশিপে করে । এ কথা উচ্চারণ করাও যায় না, কারণ তড়িঘড়ি করে জিয়াংয়ের এগিয়ে যাবার ফলটা ছিল বড় মর্মপীড়াদায়ক; অন্যদিকে সফলতার সাথে লিওনভ ফেরত আসে।

টিভি সম্প্রচার খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু ইউরোপার বুকে জিয়াংয়ের কুরা টিভি ডকুমেন্টারি প্রস্তুত করার চেয়ে জরুরী কাজ করছিল; ব্যস্তভাবে।

তারপর বৃহস্পতির চান্দ্রজগতে মানুষের প্রথম পদার্পণের গৌরবগাঁথা বলা হল সুন্দর করে। লিওনভের বুক থেকে সেই ল্যান্ডিং আর তার ফলে অবধারিত দুর্ঘটনার ধারাভাষ্য দিয়েছিল হেউড ফ্লয়েড, সবিস্তারে। আর ইউরোপাকে চিত্রিত করার মতো

অনেক অনেক ডকুমেন্টারি পাওয়া যায় লাইব্রেরিগুলোতে, সেসবও দেখানো হল দেদারসে। সেই সাথে ফ্রয়েডের ঐতিহাসিক কথা:

“ঠিক এ মুহূর্তে আমি শিপের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি নির্নিমেষ চোখে। আপনারা ভোলা চোখে চাঁদকে যেমন দেখেন আমি দেখছি তারচে দশ গুণ বড়। আর আসলেই, দৃশ্যটা ভয়াল।

“উপরিতলটা মোটামুটি গোলাপী বর্ণের। সাথে আছে কয়েকটা ধূসর আঁচড়। কিছু সরু রেখা জটিল গোলকধাঁধা গড়ে তুলেছে; কোকড়ানো, ঢেউ খেলিয়ে চারদিকে ছড়ানো। বাস্তবে কোনো মেডিক্যাল টেক্সটবুকের শিরা-ধমনীর ছবির মতোই লাগে।

“সেসব রেখার কয়েকটি শত শত এমনকি হাজার মাইল লম্বা। দেখতে অনেকটা পার্সিভাল লোয়েল ও অন্যান্য বিংশ-শতাব্দী-বিজ্ঞানী বর্ণিত মঙ্গলের খালের মতো।

“কিন্তু মঙ্গল-নালার মতো ইউরোপা-নালা মোটেও ফাঁকিবাজী নয়। আর ঐ বিজ্ঞানীরা যেমন দাবী করতেন যে মঙ্গলের খালগুলো সভ্য প্রাণীর গড়া-তেমন কোনো ব্যাপারও এখানে নেই। এসবই প্রাকৃতিক। উপরি পাওনা হল, মঙ্গলের সেসব কল্পিত খাল ছিল খটখটে শুকনো, আর এখানে অকূল পানি; অন্তত অনেক অনেক বরফ পাওয়া যাবে। কারণ এই উপগ্রহটা চারদিকে গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর সমুদ্রে ঢাকা পড়ে গেছে।

“সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে হওয়ায় বৃহস্পতির এই প্রজার উপরিতল তাপমাত্রায় অনেক অনেক কম । শূন্যের দেড়শো ডিগ্রীরও নিচে। সুতরাং যে কোনো সুস্থ মানুষ ভাবতে পারে যে পুরো সাগরটা বরফের এক টুকরো।

“কিন্তু অবাক হলেও সত্যি যে, বাস্তবটা তেমন নয়, ইউরোপার অভ্যন্তরীণ তাপ একে গলিয়ে রাখে, তার উপর প্রতিবেশী আগ্নেয়-উপগ্রহ আইওর জোয়ার-আকর্ষণ সব সময় পানিটাকে নড়াচড়ার উপরই রাখছে। আর আছেন গ্রহরাজ, তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপ সমেত।

“তাই সারাক্ষণ বরফ ভাঙছে, গলছে, আবার জমে উঠছে শক্ত হয়ে। আর তাই আমাদের মেরুদেশে ভাসমান বরফের উপরের ফাটলের মতো দেখতে কিন্তু তারচে শতগুণ বড় আর গভীর ফাটল তৈরি হচ্ছে সারাক্ষণ। এই সব জটিল খানাখন্দই দেখছি এখন। এদের বেশিরভাগই অতি পুরোনো আর অন্ধকার। কোনো কোনোটা লাখ লাখ বছরের পুরনোও হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনোটা একেবারে তুষারশুভ্র। তারা মাত্র জন্মাচ্ছে, কারো কারো খাদ মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার গভীর।

“এই সাদা গর্তগুলোর কোনো একটার পাশেই জিয়াং অবতরণ করে। পনেরশ কিলোমিটার লম্বা গড়নটা; নাম গ্র্যান্ড ক্যানেল। স্বাভাবিকভাবেই চৈনিকেরা এ থেকে পানি তুলতে চায়; সেই পানি পোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে ভরে নিয়ে তারা বৃহস্পতীয় উপগ্রহ জগৎ ছুঁড়ে বেড়িয়ে পৃথিবীতেও ফিরে যাবার মতলব এটেছে। কাজটা ছেলের হাতের মোয়া নয়, কিন্তু তারা আগুপিছু না ভেবে এসেছে এমনটা হতেই পারে না। তারা অবশ্যই যা করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে।

“আজ আর ব্যাপারটায় কোনো পর্দা নেই। বোঝাই যাচ্ছে, আসার পথে কেন প্রোপ্যাল্যান্টের সবটুকু খুইয়ে বসেছিল তারা আর ইউরোপার মতো বিরান এক উপগ্রহের দাবী নিয়ে কেনইবা আসর মাতিয়ে রেখেছিল এতোদিন। রিফুয়েলিং পয়েন্ট হিসেবে ধরলে এখান থেকে শুধু পুরো সৌর জগৎই দাপড়ে বেড়ানো যাবে না, বরং যাওয়া যেতে পারে দূর নক্ষত্রলোকের…

কিন্তু তা আর কাজে লাগল কৈ? ভাবছে স্যার লরেন্স তার কৃত্রিম আকাশরূপী শেল্টারের নিচে বিলাসবহুল চেয়ারে বসে থেকে। কোনো এক অজানা কারণে ইউরোপার দপীয়সী সাগরগুলো আজো মানুষের জন্য অগম্য। আর শুধু অগম্য হলেও সারা হতো, একেবারে অদৃশ্য আর অদৃষ্টপূর্ব। বৃহস্পতি নক্ষত্রে পরিণত হবার পর পরই এর ভিতরের দিকের গ্রহগুলো (ভাবতেও অবাক লাগে, যেগুলো ক দশক আগেও উপগ্রহ ছিল সেগুলো আজ গ্রহ!) বারাজ্যে নিজেদের ঢেকে রেখেছে, আগাগোড়া। এ বাষ্প তাদের শরীর থেকেই উথলে উঠছে অবিরাম।

স্যার লরেন্স আজকের ইউরোপার কথা ভাবছে না, ভাবছে ২০১০ সালের কথা।

সে তখন এক দুরন্ত কিশোের। সেদিন কী গর্বই না অনুভব করেছিল সে, তার দেশের লোক কুমারী বরফাবৃত ইউরোপার ঘুম প্রথমবারের মতো ভাঙিয়েছে। তখনও রাজনীতির লোকেরা হংকং আর চীন নিয়ে কীসব বলে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে।

সেসব দৃশ্য ধারণের জন্য কোনো ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল না। তবু মনশ্চক্ষে সে দেখত কীভাবে ইউরোপার মিশকালো আকাশে ধ্বংসের দেবতা নেমে এলো, কীভাবে ধ্বংস হয়ে গেল স্পেসশিপটা। কীভাবে গ্র্যান্ড ক্যানেলে আবার নেমে গেল সেই আততায়ী; পানির স্তরটা কেমন করে আবার বরফে পরিণত হল।

সবাই জানতো এমনটাই ঘটেছে, তাই কল্পনায় দেখে নিতে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। এবার সেই পুরনো ইউরোপার বদলে এমন একজনের ছবি ভেসে উঠল যাকে চীনারা এতোটা চেনে যতোটা রাশিয়ানরা চেনে গ্যাগারিনকে।

প্রথম ছবিতে রুপার্ট চ্যাংয়ের গ্র্যাজুয়েশন ডের চেহারা ভেসে উঠল, ১৯৮৯ সালের কথা। লাখো মানুষ থেকে ব্যতিক্রমী মেধাবী তরুণ মুখ, পরের দুই দশকে কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সে মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিতে।

একটু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে সাথে ভাষক ড. চ্যাংয়ের ক্যরিয়ার বর্ণনা করা শুরু করল। একেবারে জিয়াংয়ের সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত বলে গেল একটানা। একের পর এক বয়েসি ছবি এসে আগেরটা দখল করে নিচ্ছে। সবশেষে তার মিশনের আগ মুহূর্তে ভোলা ছবি ভেসে ওঠে।

স্যার লরেন্স প্ল্যানেটরিয়ামের আধো অন্ধকারকে অশেষ ধন্যবাদ দিল। কারণ ড. চ্যাংয়ের লিওনত্রে উদ্দেশ্যে পাঠানো সেই অনিশ্চয়তাময় কথাগুলো প্রচারিত হবার পর তার আশপাশের বন্ধু-শত্রুরা তার চোখে জড়ো হওয়া জলীয়তা দেখতে পাবে না।

…জানি আপনারা লিওনভেই আছেন… হয়তো খুব একটা সময় পাব না হাতে… আমার স্যুট অ্যান্টেনাটা লক্ষ্য করে যেখানে…

কয়েক মুহূর্তের জন্য চলে গিয়েই সিগন্যাল আবার ফিরে আসে। আরো স্পষ্ট, কিন্তু ক্ষীণতা বজায় থাকে।

“…তথ্যগুলো দয়া করে পৃথিবীতে পাঠান। তিন ঘণ্টা আগেই জিয়াং ধ্বংস হয়ে গেছে। একা আমিই আছি বেঁচে। জানি না আমার স্যুট রেডিওর যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কিনা, কিন্তু এটা ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আবারও বলছি আমি, জীবন আছে ইউরোপায়…

সিগন্যাল অস্পষ্ট হয়ে যায় আবারো।

“স্থানীয় মধ্যরাতের পরপরই। আমরা বেশ ভালভাবে পানি পাম্প করছিলাম, প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক অর্ধেকটা ভরে উঠেছে ততক্ষণে। পাইপ পরিবহন পরীক্ষা করতে আমি আর ড. লি এগিয়ে গেলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে… ছিল… গ্র্যান্ড ক্যানেলের কিনারা থেকে ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপ সোজা এখান থেকে নিচে নামানো, বরফ খুবই হালকা। হাঁটাটা নিরাপদ নয়। তার উপর নিচ থেকে গরম পানির ধাক্কাতে এ উপগ্রহে…

আবারো এক লম্বা নিরবতা।

“…নো প্রব্লেম। শিপের উপর পাঁচ কিলোওয়াটের বাতি টানানো আছে। ঠিক যেন এক ক্রিসমাস ট্রি। বর্ণে বর্ণে বর্ণিত, বরফের ভিতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। প্রথমে সেটাকে লি-ই দেখতে পায়। গভীর থেকে এক বিশাল কালচে আকৃতি উঠে আসছে। প্রথমে আমরা মনে করেছিলাম কোনো মাছের ঝাঁক, বিশাল কোনো দল। একক সত্তার পক্ষে আকারটা বিশালতো, তাই। স্বচ্ছ বরফ দিয়ে দেখতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না।

“…অনেকটা সামুদ্রিক শৈবালের ঝোঁপ যেন। এগিয়ে আসছে বরফের বুকে ক্রল করে করে। লী ক্যামেরা আনতে দৌড়ে গেল শিপের দিকে। আমি থেকে গেলাম দেখার জন্য। দেখতে দেখতে রিপোর্ট করব রেডিওতে। জিনিসটা এতো ধীরে নড়াচড়া করছিল যে আমি ইচ্ছা করলেই এরচে দ্রুত যেতে পারতাম। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড় সামুদ্রিক গুল্মবনের ছবি আমার দেখা কিন্তু খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল অনুমানের বেলায়।

“… প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।

“আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…।

বলে চলেছে প্রফেসর চ্যাং, … জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট্ট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।

“…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও এন্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সব কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।

“শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে-তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।

“সম্ভবত প্রাণীটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…।

তারপর ভেঙে গেল আমাদের শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লম্বালম্বিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দুমিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকী সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।

“জানি না কী হল এর পর । আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তৃপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূক্ষ্ম ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ । এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।

“চারাগাছটি–আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি! জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।

“তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাণ্ডটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে জিনিসটি আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল । দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো ।

“একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, একটি বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা-আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।

“তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম অন্য কথা, এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়! কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্লি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।

“চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর…জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমতো দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না-যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।

“বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাঁজ ভাঙার খাঁজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র শুয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল-ডানায় ভাঁজ ভাঁজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ-আমি ক্রমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।

এই মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি-যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে শুকনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না-জলজপ্রাণীর ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটা স্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সমুদ্রগর্ভে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।

“ছোট্ট প্রাণীর একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামী রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়েও গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?

“তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো…এ নামেইতো ডেকেছিলাম-এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো-সেগুলোও আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…

ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।

“জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। এটাতে হ্যাঁচকা টান মারলে লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয়ও পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতরাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।

“ধীরে ধীরে প্রাণীটি তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দুই উপগ্রহ গ্যানিমেড আর ক্যালিস্টো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফেরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই প্রাণীটার পেছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ…ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে…এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুটি অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা এই প্রাণীকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।

“আর…ডক্টর…প্লিজ…পরের শিপ আসার সময়-তাদের একটু বলে রাখবেন আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর…আমার বাসায় আছে ছোট্ট…না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ

কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব। অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।

“ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…

সংকেতটি ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের জন্য ফিরে এসে শ্রাব্যতার সীমার নিচে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেল ।

আবার যোগাযোগের সুযোগ হয় এক সময়। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে লিওনভ মনোযোগ দেয়-কিন্তু প্রফেসর চ্যাংয়ের কাছ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি কোনোদিন।

৬. গ্যানিমিডের সবুজ হয়ে ওঠা

রালফ ভ্যান ডার বার্গ ই এ কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত। উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে। আর কোনো সমন্বয়ই কাজে লাগত না।

সেই সঠিক মানুষ কারণ সে দ্বিতীয় প্রজন্মের আফ্রিকানা রিফিউজি; এবং একজন সুপ্রশিক্ষিত ভূগোলবিদ। দুটো ব্যাপারই সমান গুরুত্বপূর্ণ। জায়গাটা উপযুক্ত, কারণ এটা হল বৃহস্পতি উপগ্রহ জগতের সবচে বড় সম্পদ; আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টোর মধ্যে তৃতীয়টা।

সময়টা উপযুক্ত, কারণ গত কয়েক দশক ধরে হাজারো পর্যবেক্ষণের ডাটা পাহাড় গড়েছে। ভ্যান ডার বার্গ সাতান্ন সালের আগে এ ভাবনাটার মুখোমুখি হয়নি। আরো একটা বছর তার কেটে গেল নিজেকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে। এ ব্যাপারটা বোঝাতে যে সে পাগলাটে নয়। আর পরের বছর অর্থাৎ উনষাট সালে পদক্ষেপ নেয় যাতে তার আবিষ্কারে আর কেউ নাক না গলাতে পারে। এবং এতোকিছুর পরে পরের সমস্যাটায় মনোযোগ দেয়ার সময় পেল: এবার কী করা?

সবটাই শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার শুরু তার উপজাতীয় চোখে কিছু এলাকা আর ঘটনা খুটিয়ে দেখা থেকে। তার চাকরি প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্সে, একজন সদস্য হিসেবে সে দেখে বেড়াতো গ্যানিমিডের প্রাকৃতিক সম্পদ। এর সাথে আরেকটু কাজও ছিল, মাঝে মাঝে পাশের নিষিদ্ধ উপগ্রহে চোখ ফেরানো।

কিন্তু ইউরোপা যেন এক রুদ্ধদ্বার কিংবদন্তী। তার আশপাশের কাউকে প্রবেশাধিকার দেবে না। সাতদিন অন্তর সে গ্যানিমিডের পাশ দিয়ে যায়, আর পাশ কাটিয়ে যায় সেই ক্ষুদে তারকাকে যেটা এককালে বৃহস্পতি ছিল। তৈরি হয় চন্দ্রকলার মতো কলা, মাত্র বারো মিনিটের জন্য। সবচে কাছ থেকে এটাকে দেখতে পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে একটু ছোট। কিন্তু অন্যপাশে চলে গেলে অনেক ছোট হয়ে যায়।

এর চন্দ্রকলার আকার দেখতে মনোহর। কিন্তু যখন লুসিফার আর গ্যানিমিডের মাঝামাঝি চলে আসে তখন একটা কালো চাকতি যেন। চারধারে আগুনের গোল দাগ। জ্বলন্ত। সেটা ছোট সূর্যেরই আলোর বিচ্ছুরণ।

মানুষের জীবদ্দশার অর্ধেক সময়ের মধ্যেই ইউরোপা আমূল বদলে গেল। লুসিফারের দিকে সারাক্ষণ মুখ করে থাকা প্রান্তের গহীন বরফ গলে গেল কদিনেই। সৃষ্টি হল সৌর জগতের দ্বিতীয় গলিত সাগর। একটা যুগ ধরে এটা বাষ্পের ঝড় তুলে চলল। অকূল সমুদ্রের চারদিকে পানির ফোয়ারা বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। তারপরই দেখা দিল অদৃষ্টপূর্ব ভূভাগ। আজ ইউরোপার আছে একটা নিজস্ব, কার্যকর (কিন্তু মানুষের জন্য নয়) পাতলা বাষ্প-বায়ুমণ্ডল। এখানে আছে হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন। সালফার ডাই অক্সাইডও এতে শামিল। এমনকি নাইট্রোজেন আর বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্যাসের সমাহারও চোখে পড়ে।

উপগ্রহটার তথাকথিত রাতের দিক আজো জমে আছে গত কোটি বছরের মতো। তার পরও মাঝে মাঝে পানির দেখা মেলে, সেই পানিতে ভাসে বরফের বিশাল বিশাল চাকতি। আর পেছনের বরফ-ভাগটা আফ্রিকার সমান।

এসবই পৃথিবীর অর্বিটে ভেসে বেড়ানো টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখতে হয়েছে। তারপর ২০২৮ সাল এগিয়ে এল । গ্যালিলিয়ান চাঁদগুলোর দিকে চালানো হল প্রথম পূর্ণমাত্রার অভিযান। এরই মধ্যে ইউরোপা এক স্থায়ী মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে সারা জীবনের জন্য। এরপর খুবই সাবধানে প্রোবিংয়ের পালা। দেখা গেল এখনো সাগর শুকায়নি। পুরো ইউরোপা আজো সৌরজগতের সবচে মসৃণ রিয়েল এস্টেট।

দশ বছর পরই আর কথাটা খাটলো না। অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে সেখানে; ইউরোপায়। সাগরের বুক চিরে, চির গোধূলী অঞ্চলের বরফ তেড়েফুঁড়ে মাথা তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে এভারেস্টের মতো বিশাল এক পর্বত। হাজার হলেও, ইউরোপার প্রতিবেশী আইও। তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এই উপগ্রহও অগ্নি উদগীরণ শুরু করে দিল। তারই ফলে এই মহাপর্বতের উত্থান কিনা কে জানে!

কিন্তু এই ব্যাখ্যার সাথে কিছু ঘাপলাও আছে। মাউন্ট জিউস অনেকটা অমসৃণ পিরামিড। স্বাভাবিক অগ্নিগিরির মতো নয়। আর রাডার স্ক্যানেও স্বাভাবিক লাভা প্রবাহের কোনো খোঁজ লাগানো যায়নি। কারণ আছে। গ্যানিমিড থেকে সারাক্ষণ তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকার পর হালকা মেঘ সরে গেলে যে ছবি তোলা যায় তাতে মনের তুষ্টি আসে না কিছুতেই। বরং অস্পষ্ট ছবিতে যেটুকু ঠাহর করা যায় তাতে পর্বতটাকেও বরফের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। গঠনে যাই থাক না কেন, এর অনধিকার দ্রষ্টাদের চোখে মাউন্ট জিউস এক মহাবিস্ময়।

কোন এক ম্যাভেরিক বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে, মাউন্ট জিউস কোনো মহাজাগতিক বরফখণ্ড। স্পেস থেকে ইউরোপার উপর পড়ে যাওয়া কোনো মহাজাগতিক শিলাখণ্ড । অদূর অতীতে এমনটা যে ঘটেছে সে প্রমাণ দিচ্ছে ক্যালিস্টো। কিন্তু তত্ত্বটা গ্যানিমিডের বুকে খুবই অজনপ্রিয়। তার হতেও-পারে-অধিবাসীরা এর মধ্যেই সমস্যায় পড়ে গেছে। এমন যদি হয়েই থাকে, তবে তাদের জীবন কাটবে শঙ্কায় শঙ্কায়।

তারা অনেকটাই আশ্বস্ত হয় যখন ভ্যান ডার বার্গ তার নূতন থিওরি উপস্থাপন করে। উপর থেকে এতো বড় বরফখণ্ড মানুষের চোখ এড়িয়ে গত এক শতাব্দীতে পড়াটা খুবই কঠিন। আর যত কমই হোক, ইউরোপার একটা নিজস্ব গ্র্যাভিটি তো আছে, তার টানে পাহাড়টা ভেঙে যাবার কথা। জবাব আর যাই হোক, বরফ নয়, কারণ ধীরে ধীরে বরফটা সাগরে ডুবছে।

সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যদি একটা, মাত্র একটা ছোট্ট পোব ইউরোপার আকাশে পাঠানো যায়। কিন্তু একটা কথাই সব উৎসাহে বরফ শীতল পানি ঢেলে দেয় পলকে।

এই সব দুনিয়া তোমাদের–শুধু ইউরোপা ছাড়া।
এখানে নামার কোনো চেষ্টাই করো না।

ডিসকভারি স্পেসশিপের বুক থেকে ধ্বংসের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘোষিত সতর্কবাণী ভুলে যাবার কথা নয়। তবু এ নিয়ে লক্ষ যুক্তি তর্কের ধোঁয়া উঠছে অবিরাম।

“নামার দিয়ে কি ভোব পাঠানোও নিষেধ করা হয়েছে, নাকি শুধু মনুষ্য যানের বেলায় নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য? আর না নেমে যদি কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যাওয়া হয়, মানুষ থাক বা না থাক, তাহলে? অন্তত বায়ুমণ্ডলের উপরদিকটায় একটা ভাসমান বেলুন পাঠালে ক্ষতি কী?

বৈজ্ঞানিকের দল সমাধান বের করার জন্য চিন্তায় মরলেও সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিতে নারাজ। ভালইতো আছি ভাই পৃথিবীর বুকে। আরো অর্ধশতাধিক গ্রহ উপগ্রহওতো আমাদের। কেন শুধু শুধু ইউরোপায় নাক গলাতে যাওয়া? তাছাড়া সেসব দেখতেই তো শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যাবে। তারপর নাহয় নাক গলাই।

সেজন্যেই ভ্যান ডার বার্গ ভালমতো বারবার শুনতে পেয়েছে যেন সেসব নিয়ে খুব বেশি ভাবাভাবি না করে। ইউরোপার চিন্তা গৌন। লাখো কাজ পড়ে আছে গ্যানিমিডে। (হাইড্রোপোনিক ফার্মগুলোর জন্য কার্বন, ফসফরাস আর নাইট্রেট যৌগ কোথায় পাই? আর বসতির কাঠামো? সবুজায়ন কেমন হবে, কতটুকু? এবং এমনি আরো হাজারটা প্রশ্নের প্রহেলিকা…)

কিন্তু তার জিনে পরিবাহিত পূর্বপুরুষদের একাগ্রতা সব সময় জেগে থাকে। আর তার চোখ সবসময় থাকে ইউরোপার দিকে, নির্নিমেষ।

তারপর একদিন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, মাউন্ট জিউসের প্রহেলিকাময় যবনিকা একটু সরে যেতেই দেখা গেল তার কাঙ্ক্ষিত চেহারা।

৭.ট্রানজিট

আমিও নিচ্ছি ছুটি, ছুটি নিচ্ছি, যা ছিল আমার, সবকিছু থেকে…

স্মৃতির কোন গহীন থেকে সাঁতরে লাইনটা উপরে উঠে এল? হেউড ফ্লয়েড বন্ধ করল চোখ দুটো। অবশ্যই কোনো কবিতার লাইন। আর কলেজ ছেড়ে আসার পর সে কি আদৌ কোনো কবিতা পড়েছে? অবশ্য একবার একটা ছোট ইংরেজির সেমিনারে বসেছিল।

তারপরই স্টেশন কম্পিউটারে কথাটা প্রবেশ করিয়ে দেয়ার পর লাইনটা খুঁজে বের করতে বেশ অনেকটা সময় নেয় কম্পিউটার। দশ মিনিট। কবিতার নাম জানা থাকলে কয়েক সেকেন্ড লাগতো, কিন্তু পুরো ইংরেজি সাহিত্য চষে ফেলে লাইনটা খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

যুদ্ধের কবিতা, কিন্তু কোন যুদ্ধের? বিংশ শতাব্দীটাইতো যুদ্ধের ডামাডোলে গেল…

এখনো মনের কুয়াশা ছিন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে সে লাইনটাকে। এরই মধ্যে তার মেহমানরা এসে পড়েছে; এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণে অভ্যস্ত তারা, নড়াচড়া করে ধীরে ধীরে। পাস্তুরের সমাজ কেমন বদলে যাচ্ছে। যারা নড়তে পারে না তেমন, তারা পছন্দ করে হাসপাতালের মাঝামাঝি এলাকাটাকে। প্রায় মাধ্যাকর্ষণহীন। আর পাস্তুরকে ভালবাসে যারা তাদের আবাস কিনারা আর মধ্যবিন্দুর মাঝে। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ চাঁদেরই মতো। কিন্তু একদল মানুষ ফিরে যেতে চায় উৎসভূমি পৃথিবীতে, তারা বেছে নিয়েছে প্রান্তভাগ। এখানেই ফোর্সটা সবচে বেশি।

আজকাল জর্জ আর জেরিই হেউড ফ্রয়েডের সবচে পুরনো বন্ধু। ব্যাপারটা মজার, কারণ তাদের মধ্যে মিল ছিল সামান্যই।

তুমি কি কখনো ডিভোর্সের কথা ভাবনি? সে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দেয়ার ভঙ্গীতে প্রশ্ন করেছিল।

স্বভাবত জর্জও বাঁকা পথে জবাব দেয়। জর্জের কারণেই ক্লাসিক অর্কেস্ট্রা ফিরে এসেছে বিনোদনের জগতে।

ডিভোর্স-কখনোই না তারপর একটু থামে, খুন-কখনো কখনো।

অবশ্যই, সে কখনোই পালাবে না। ফোড়ন কাটে জেরি, সেবাস্টিয়ান বরং সিমগুলো ফেলে দিবে।

সেবাস্টিয়ান হল তাদের আনা তোতা পাখি, অনেক কষ্টে তাকে আনা গেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সাথে বচসা করে। সে শুধু কথাই বলতে পারে না, বরং সিবেলিয়াস ভায়োলিন কনসার্তোও বাজাতে পারে মুখে মুখে। যে কাজে জেরি অর্ধশতাব্দী আগে অ্যান্টোনিও স্ট্রাভার্দির সাথে বিস্তর সুনাম কুড়িয়েছিল।

এবার জর্জ, জেরি আর সেবাস্টিয়ানকে বিদায় জানাবার পালা। হতে পারে মাত্র কয়েক হপ্তার জন্য, চিরদিনের জন্যও হতে পারে। এরই মধ্যে বাকী সবার সাথে বিদায় নেয়া হয়ে গেছে একটা পার্টি দেয়ার মাধ্যমে। হাসপাতালের মদের সেলারটাও বেশ। হাল্কা হয়ে গেছে সেই সুযোগে। তেমন কোনো কাজ আর বাকী নেই।

আর্চি, তার পুরনো মডেলের কার্যকর কমসেককে ভালমতো প্রোগ্রাম করা হয়েছে, সে ঠিকঠিক গুছিয়ে নিতে পারবে নতুন আসা মেসেজগুলোকে। বেশিরভাগের সুন্দর, ভদ্র জবাব পাঠিয়ে দেবে সাথে সাথে। বেশি গুরুত্বপূর্ণগুলো চলে যাবে ইউনিভার্সের বুকে।

এই এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও যদি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলা না যায় তো ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকবে? অবশ্য ভাল দিকও আছে, যাকে অপছন্দ তাকে এড়ানো যাবে সহজেই। এতো দূর চলে যাবে ইউনিভার্স স্পেসশিপ যে আর সরাসরি কারো সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। কারণ আলো যেতেই মিনিট-ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে। কথা হবে টেলিটেক্সট অথবা রেকর্ডে।

আমাদের ধারণা ছিল তুমি আমাদের বন্ধু, অভিযোগ করছে জর্জ, তোমার পক্ষে কাজ করতে হবে আমাদের, অথচ রেখে যাচ্ছ না কিছুই।

দু একটা চমক তো তোমাদের জন্য থাকছেই, ক্যাবলা-হাসি দিয়ে বলল ফ্লয়েড, সাধারণ খবরগুলো দেখবে আর্চি। তোমরা শুধু দেখবে ও কিছু বুঝতে না পারলে, এই আরকি।

ও না পারলে আমরা কস্মিনকালেও পারব না। তোমার ওই ছাইপাশ সায়েন্টিফিক সোসাইটির মাথামুণ্ডু আমরা যে কী বুঝব আল্লা মালুম।

ওদের নিয়ে চিন্তা নেই আমার, নিজেদের আখের ভালই গোছাতে জানে। খেয়াল রেখ যেন ক্লিনার ঘরটাকে উজবুকের মতো আলুথালু করে না ফেলে। আর যদি ফিরে না-ই আসি তো এখানে কিছু ব্যক্তিগত জিনিস আছে, সেসব বিভিন্নখানে পৌঁছে দিতে হবে। বেশিরভাগই পারিবারিক।

পারিবারিক! কথাটা বলার মধ্যে যেন নিযুত দুঃখ এগিয়ে আসে, আর আসে অনেক অনেক সুখের স্মৃতি।

আজ তেষট্টি বছর ধরে… তেষট্টি বছর! ম্যারিয়ন নেই। সেই যন্ত্রণাময় বিমান দুর্ঘটনা! আর এর পরই একটু অপরাধী মনে হয় নিজেকে, যতটা উচিত ততটা বেদনাবোধ যেন তার নেই, কিংবা স্মৃতি অনেক অনেক পলেস্তারা বসিয়ে দেয় মানুষের মনে।

সে কি আজো বেঁচে থাকতো না? মাত্র একশ বছর বয়েস হত এতোদিনে। কাঁটায় কাঁটায়…

আর তার সেই দুই অতি আদুরে কন্যা আজ ধূসর চুল নিয়ে হাজির হয়, সাথে থাকে ছেলেমেয়ে, এবং নাতি নাতনী! তাদের নিজের। বয়েস তো ওদেরও কম হল না, ষাটের ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে।

সেদিকে আছে নজন। আর্চির সহায়তা ছাড়া তাদের নামও ঠিকমতো মনে করা কঠিন। আর ভালবেসে হোক বা দায়িত্ববোধে- তারা প্রতি ক্রিসমাসেই তাকে মনে করে। জানে তার নাম।

অন্যদিকে আবার বিয়ে; প্রথম স্ত্রী হারানোর যন্ত্রণা মুছে যাওয়া; আবার বিচ্ছেদ-অর্ধশতাব্দী আগে; পৃথিবী আর বৃহস্পতির মাঝামাঝি কোথাও। কিন্তু আশা ছিল-ছেলেকে ফিরে পাবার আশা, স্ত্রীকে ফিরে পাবার আশা। কিন্তু দেখা হল ফিরে আসার পরে সবার জন্য দেয়া পার্টিতে। নিতান্ত পরিচিত একজনের মতোই! তারপর আর কী, অসাবধানতা, অবসাদ, ভরবেগের হিসাব ঠিক রাখতে না পেরে দোতলার বারান্দা থেকে পড়ে যাওয়া এবং সবশেষে, পাস্তুর।

কিন্তু পরের দেখাটাও কাজে লাগল না। বিস্তর খরচ করে কত চেষ্টা-তদ্বির! এই রুমেই, এই পারে। ক্রিস এরই মধ্যে বিশে পড়েছে, বিয়ে করেছে মাত্র। ফ্লয়েড আর ক্যারোলিনের মধ্যে একটা মাত্র মিল ছিল, ক্রিসের পছন্দকে পছন্দ না করা।

এরমধ্যে একটা ব্যাপারে হেলেনাকে বেশ সফল বলে মনে হল। সে ক্রিস টুর যত্ন-আত্তিতে কোনো অংশে কম নয়। ক্রিসদের বিয়ের মাসখানেক পরেই জন্ম নেয় ফ্লয়েডের নাতি। অন্য অনেকের মতো হেলেনাও কোপার্নিকাস দুর্ঘটনা য় বিধবা হয়। কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়েনি মেয়েটা।

কী অদ্ভুত মিল, ক্রিস আর ক্রিস টু দুজনেই মহাকাশে নিজেদের জনককে হারিয়েছে; দু পথে। ফ্লয়েড তার আট বছর বয়েসি ছেলের কাছে একেবারে অচেনা মানুষ হয়ে এসেছিল, কিন্তু ক্রিস টু তার জীবনের প্রথম দশকটায় নিজের বাবাকে দেখতে পেয়েছে চোখের সামনে, এই যা সান্ত্বনা।

কিন্তু এই দিনগুলোতে ক্রিস ছিল কোথায়? ক্যারোলিন বা তার তদানীন্তন বেস্ট ফ্রেন্ড হেলেনা, কেউ জানেনি কোথায় ছিল সে। পৃথিবীতে নাকি শূন্যে। শুধু ক্ল্যাভিয়াস বেস লেখা পোস্টকার্ড দেখে বোঝা গেছে যে সে চাঁদে প্রথমবারের মতো পা রেখেছে।

ফ্লয়েড এ কার্ডটাও আঠা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে ডেস্কের উপর। ক্রিস টু যেমন রসিক ছিল তেম্নি ইতিহাসে ছিল তার অপার আগ্রহ। সে দাদুকে যে কার্ড পাঠিয়েছে সেটায় একটা কালো মনোলিথের ছবি, তার আশপাশে কয়েকজন স্পেসস্যুট পরা মানুষ। জায়গাটা চাঁদে। অর্ধ শতাব্দী আগের কথা।

ফ্লয়েড যে ছবিটা নাতির কাছ থেকে ক্রিসমাস কার্ড হিসেবে পেল সেটায় সে নিজেও আছে। এবং তখন, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, চাঁদের বুকে সেই কালো একশিলা স্তম্ভের কথা মানবজাতির একশ সদস্যও জানতো কিনা সন্দেহ। সে দলের বাকী সবাই আজ মৃত। আর মনোলিথটাও নেই সেখানে। ২০০৬ সালেই চাঁদ থেকে তুলে এনে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের বিল্ডিংটার সামনে বসিয়ে দেয়া হয়। সে যেন সেই বিল্ডিংটারই প্রতিবিম্ব । চিৎকার করে যেন সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে, আমি একা নই।

একা নয় মানবজাতি।

কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর, তারপরই লুসিফারের আলো ছিল কথাটা বলার জন্য।

আজকাল ফ্লয়েডের আঙুলগুলো যেন কথা শুনতেই চায় না। বিশেষ করে ডান হাতের আঙুলগুলোর যেন আলাদা স্বাধীনতা আছে কার্ড খেলার সময় বা পকেটে হাত ঢোকানোর সময়। এই একটা সমস্যাই সৃষ্টি হতে পারে ইউনিভার্সে তার যোগ্যতার ব্যাপারে।

মাত্র পঁচিশ দিন, আছ নাকি নেই তা আমরা বোঝার আগেই ফিরে আসবে। বলল জেরি, আর হ্যাঁ, শুনলাম অভিযানে নাকি দিমিত্রি তোমার সাথী হচ্ছে; আসলেই?

সেই ছোটখাট কসাক! বলল জর্জ, বাইশ সালের কথা মনে আছে, তার দ্বিতীয় সিফনীর ঝংকার।

না, না। ভুল করে বসেছ তোমরা। সেটা মাত্র দিমিত্রি, মাইকেলোভিচ নয়। আর…

যাই হোক, অন্যজনতো? আমি তার কথাই বলছি। রাস্কেলটাকে আমার ভালবাসা দিও। আর জিজ্ঞেস করো ভিয়েনার কথা তার মনে আছে কিনা, সেই রাতের কথা। আর কে কে থাকছে তোমার সাথে?

আমি জোর গুজব শুনলাম, প্রেসের পান্ডারাও নাকি ভিড় জমাবে? জেরি চিন্তার ভাণ করে বলল।

চিন্তার কারণ নেই। যারাই হই না কেন, আমরা সবাই আমাদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সৌন্দর্য, আরও নানাবিধ মানবিক-অতিমানবিক-অমানবিক গুণাবলীর কারণে স্যার লরেন্সের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছি। পোশাকি সুরে বলে চলল ফ্লয়েড।

আর কর্মক্ষমতা?

যাক, প্রসঙ্গটা যখন তুললেই, আমি আসলে যাচ্ছি বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে। আমরা প্রত্যেকেই কিছু কাগজ জমা দিয়েছি। আমারটাও আছে।

আমরা কি সেটা পেতে পারি কোনোও সুযোগে? আশা করে জর্জ বলল ।

সুং আমাকে হ্যালি পর্যন্ত নিয়ে যেতে, ফেরত আনতে এবং পথে খাবার-দাবার দিতে ও দেখার জন্য একটা জানালা সহ ঘর দিতে রাজি হয়েছে।

আররাহা খরচের বিনিময়ে?

ফিরে আসার পর ভবিষ্যতের অভিযান যাতে চলে সেসব পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। লিখতে হবে কিছু প্রবন্ধ, খুবই প্রাসঙ্গিক হতে হবে সেসব । যাতে সারা জীবনের জন্য কাজে লাগে। ও, আরো একটা ব্যাপার, আমি আমার সঙ্গীদের এক আধটু বিনোদনও দিব।

কীভাবে? নেচে-গেয়ে?

ভাল কথা, এককালে নেচেছি গেয়েছি বৈকি। কিন্তু প্রফেশনালদের সাথে পাল্লা দেব সে ক্ষমতা কি আর আছে? ও, তোমরা তো জানো না, শিপে ইভা মারলিনও থাকবে।

কী? ওকে কেমন করে পার্ক এভিনিউর গরাদ থেকে বের করে আনল?

ওতো নিশ্চই একশ এবং…উফ, কী হল? খোঁচান ক্যান ভাইসাব?

যেন আহত হয়েছে ফ্লয়েড, বেচারির বয়স সত্ত্বর, পাঁচ যোগ বা বিয়োগ করতে পার, মিস্টার।

বিয়োগটা ভুলে যাও, নেপোলিয়ান মুক্তি পাবার সময় আমি ছোট ছিলাম।

এবার বেশ লম্বা বিরতি। তিনজনেই স্মৃতি মন্থনে মগ্ন। কোনো কোনো সমালোচকের মতে তার পরিচয়ের জন্য স্কারলেট ওহারা চরিত্রটাই মানানসই ছিল। কিন্তু সাধারণ্যে সেই ইভা মারলিন আজো জোসেফাইন রূপেই নমস্য। বেচারীর জন্ম হয় সাউথ ওয়ালেসে, ইভিলিন মাইলস নামে। অর্ধ শতাব্দী আগে ডেভিড গ্রিফিনের অমর মহাকাব্য ফরাসী আর ব্রিটিশ রসিকদের উদ্বেলিত করেছিল দারুণভাবে। আজ তারা সবাই মানে যে তার কাজগুলোতে ক্লাসিকের কিছু গুবলেটও মিশানো থাকত।

এতো স্যার লরেন্সের বিলাসিতা। বলল জর্জ, সেই চিন্তান্বিত মুখেই।

মনে হয় আমিও কিছুটা গর্ব পেতে পারি এ ব্যাপারে। তার বাবা ছিল একজন অ্যাস্ট্রোনোমার, কাজ করেছিল আমার সাথে কিছুদিন। মেয়েও বিজ্ঞানে অনেক আগ্রহ রাখে। সুতরাং আমি বেশ কিছু ভিডিও কল করেছিলাম তাকে।

ফ্লয়েড ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কথাগুলো বলা দরকার কিনা। কিন্তু কথাতো সত্যি, সে জি ডব্লিউ এম টির মার্ক টুর আমলে এই মেয়ের প্রেমে পড়েছিল।

অবশ্যই, বলে চলে সে, স্যার লরেন্স খুব আনন্দে ছিল তখন। কিন্তু আমিই তাকে বিশ্বাস করিয়েছি যে অ্যাস্ট্রোনোমিতে তার সাধারণ আগ্রহই শুধু নেই, আছে আরো বেশি কিছু। ভয়েজটা এক ঘেয়েমিতে ভরে উঠত এমন কেউ না থাকলে।

আর এ কথাটাই মনে করিয়ে দিল যে, নাটকীয়ভাবে জর্জ পেছন থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলল, একঘেয়েমি কাটাতে তোমার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে ছোট্ট এক উপহার আছে।

এখন ভোলা যাবে? খুলব?

কী মনে হয়? এখানে খোলা উচিত হবে তার? জেরি বেশ ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন তোল।

তাহলেতো অবশ্যই উচিত বলেই খুলে ফেলল রিবনটা।

ভেতরে চমৎকার ফ্রেমবন্দী এক পেইন্টিং। ফ্লয়েড আর্ট সম্বন্ধে খুব একটা না জানলেও এটা সম্পর্কে ভালমতোই জানে। কে না দেখেছে?

ঢেউয়ের দোলায় টলায়মান ফেনা, অর্ধনগ্ন পরিবেশ, দূরে-একমাত্র অলঙ্কার একটা জাহাজ। নিচে লেখা:

দ্য র‍্যাফট অব দ্য মেডুসা
(থিওডোর গেরিক্যাল্ট, ১৭৯১-১৮২৪)

তার নিচে জেরি আর জর্জের লেখা, সে পর্যন্ত পৌঁছুলেই আধা মজা মাত্র পাওয়া হবে…।

ফাজিলের মানিকজোড়, কিন্তু ভালবাসি তোমাদের, অসম্ভব ভালবাসি। জড়িয়ে ধরল ফ্লয়েড তাদের। আর্চির কিবোর্ডে এ্যটেনশন লাইট জ্বলছে। সময় এসেছে যাবার।

বন্ধুদের পেছনে ফেলে, সামনে গেল সে, শেষবারের মতো হেউড ফ্লয়েড তার ঘরের চারদিকে চোখ বোলাল, ছোট্ট একটা ঘর, তার অর্ধেক জীবনের ইউনিভার্স।

আর হঠাৎ করেই তার সেই কবিতার শেষটা মনে পড়ে গেল। একেবারে হঠাৎ করেই:

সুখে ছিলাম আমি। এবার যাচ্ছি, যাচ্ছি চলে।

৮. তারকা বহর

স্যার লরেন্স মোটেও আবেগকে প্রাধান্য দেয় না, আর কাজের ক্ষেত্রেও জাতিভেদ তার মাথায় আসে না। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাজুয়েট হওয়াতে শিল্প-সংস্কৃতির তৃতীয় অভ্যুত্থান তেমন নাড়া দিতে পারেনি তার মনোজগতে। কিন্তু একটা বিশেষ বয়সে জিয়াংয়ের দুর্ঘটনায় মনে বেশ ছাপ পড়েছিল। স্পেসের প্রতি বাড়তি দুর্বলতার শুরু সেখান থেকেই।

অনেক আগে থেকেই সে মাঝে মধ্যে চাঁদে বেড়াতে যেত। এখন তার বত্রিশ মিলিয়ন সোল পুত্র চার্লসকে সুং অ্যাস্ট্রোফ্রাইটের ভাইস প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটা তেমন কিছু করতে পারেনি, দুটো উৎক্ষেপণ ছাড়া। এর ফলে চার্লস একটা কথা ভালমতো বুঝেছে যে আগামী দশকগুলোতে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী । অবশেষে সত্যি সত্যি স্পেস এজ বা মহাকাশ যুগ এগিয়ে আসছে।

মাত্র আধ শতাব্দীর কিছু বেশি সময় নিয়ে মানুষ রাইট ব্রাদারের পুরনো আশীর্বাদ ছেড়ে কার্যকর এরোপ্লেনের সুফল ভোগ শুরু করে। আর এ থেকে উত্তরণের জন্য, সৌর জগতের প্রান্তসীমা ছুঁড়ে ফেরা শুরু করার জন্য লেগেছে এরও দ্বিগুণ কাল।

লুইস আলভারেজ ১৯৫০ এর দশকে তাঁর দলবল নিয়ে আবিষ্কার করেন মিউওন-ক্যাটালাইজড ফিউশন এর পদ্ধতি। সেদিন ব্যাপারটাকে খরুচে ল্যাবরেটরি-আগ্রহ কিম্বা স্রেফ তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। ঠিক মহান বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের আবিষ্কারের মতো। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন না তা আবিষ্কারের কার্যকারিতার ব্যাপারে। শীতল নিউক্লিয়ার ফিউশন আদৌ কাজে লাগবে তো? তারপর হঠাৎ করেই ২০৪০ সালের দিকে স্থিত মিউওনিয়াম-হাইড্রোজেন যৌগগুলো আবিস্কৃত হয়ে মানুষের ইতিহাসে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করে। যেমন হঠাৎ করে নিউট্রনের আবিষ্কার মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল আণবিক যুগের দিকে।

আজ সহজেই বহনযোগ্য আণবিক শক্তি স্থাপনা গড়া যায়; খুব বেশি প্রতিরক্ষা বর্মের প্রয়োজনও নেই। এর ফলাফল একেবারে প্রথমেই বিশ্ব বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পড়েনি; পড়ে যায় স্পেস সায়েন্সের উপর। এর সাথে একটা ব্যাপারেরই তুলনা চলে-উড়োজাহাজের যুগ থেকে রকেটের যুগে প্রবেশের স্মরণীয় ঘটনা।

প্রোপ্যাল্যান্টই মহাকাশ যাত্রায় সবচে বড় সমস্যা; সব সময়। সেই আদ্দিকালে বিশাল বিশাল প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেত মূল যান, এক রত্তি দেখা যেত সেগুলোকে। আর গতিও ছিল ঢিমে তাল। এমনকি ডিসকভারিতেও চুল্লী আর শীতলীকরণ এলাকাটাই আশিভাগ দখল করে রেখেছিল। আর আজ মূল যানটাই সব। অন্যদিকে এখন যাত্রাকাল বছর কিংবা মাসের বদলে সপ্তাহে এসে ঠেকেছে। কিন্তু মিউওন ড্রাইভ আজো রিয়্যাকশন ডিভাইস। তাই চিরাচরিত রকেটগুলোর প্রথম ধাক্কার জন্য কিছু কার্যকর তরলের প্রয়োজন পড়ে। আর কাজের জন্য সবচে সরল, সস্তা, নির্ভেজাল, সহজলভ্য তরল জিনিস হল খাঁটি পানি।

প্যাসিফিক স্পেসপোর্টে এ জিনিসের অভাব পড়ার কথা না। পরের বন্দরে ব্যাপারগুলো উল্টে যায়। সার্ভেয়র, অ্যাপোলো আর লুনা মিশনগুলোয় চাঁদে এক ফোঁটা পানির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আর যদি কোনোকালেও দু চার ফোঁটা পানি থেকে থাকত চাঁদে-অসীম সময়ের মহাজাগতিক বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে সেটুকু উবে গেছে পুরোপুরি।

অথবা এটা চান্দ্রবিদ বা সেলেনোলজিস্টদের বিশ্বাস। এই চেঁচামেচি আর রহস্যের শুরু প্রথম যেদিন গ্যালিলিও গ্যালিলি চাঁদের দিকে তাঁর টেলিস্কোপ ফেরান সেদিন থেকেই। কারণ কিছু কিছু চান্দ্র পর্বত এমনভাবে আলো ছড়ায়, যেন মাথায় বরফ-কিরীটি নিয়ে বসে আছে। আধুনিক অ্যাস্ট্রোনমির জনক উইলিয়াম হার্শেল মহা ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন অ্যারিস্টার্কাস পর্বতের বিরাট জ্বালামুখটার দেদীপ্যমান রূপ দেখে; নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন চাঁদে অগ্নি উদগীরণ হচ্ছে। তার উপর সময়টা রাতের। কিন্তু এখানেও ভুল হয়েছিল। তিনি তিনশো ঘণ্টায় জমে ওঠা পাতলা চকচকে কিছু দেখেছিলেন জ্বালামুখটায়। আর তার থেকে যে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিল তা পৃথিবী থেকেই আসা।

কিন্তু অবশেষে হতাশা থেকে বাঁচা গেল। চাঁদের গভীরে এক বিশাল বরফ স্তর আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই মহাকাশ ভ্রমণের বাধা আরো কমে যায়।

সুং নৌবহরের প্রথমটির নাম কসমস। সে মানুষ আর জিনিসপাতি বহন করে পৃথিবী-চাঁদ-মঙ্গল রুটে। একই সাথে পরীক্ষা চলছে মিউওন ড্রাইভের। এটা নির্ভেজাল চলতে থাকলে ড্রাইভটা স্বীকৃতি পাবে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান আর সরকারের কাছে। কারণ কসমসের সাথে হাজারো রকমের চুক্তি হয়েছে তাদের। ইম্বিয়াম শিপইয়ার্ডে জন্মাবার পর সে শুধু চাঁদের মাধ্যাকর্ষণটুকু কাটিয়ে উড়ে যাবার ক্ষমতা পেয়েছে। তাও আবার বিনা ভারে। আর কোনোকালেই সে কোনো ভূমি স্পর্শ করবে না। অর্কিট থেকে অর্বিটে ঘুরবে, গ্রহ থেকে গ্রহে। অনেকটা বিজ্ঞাপন হিসেবেই স্যার লরেন্স এটাকে স্পুটনিক দিবসের শততম বার্ষিকীতে মহাকাশে পাঠায়। দিনটা ছিল চৌঠা অক্টোবর, দু হাজার সাতান্ন।

দু বছর পরেই কসমসের আরেক বোনের জন্ম হয়। গ্যালাক্সির জন্ম পৃথিবী বৃহস্পতি পথ ধরে চলার জন্য। সে আরো ক্ষমতা রাখে, নিয়মিত বৃহস্পতীয় চাঁদগুলোয় নামতে এবং উঠতে পারবে, বেশ খানিকটা পে-লোড সহ! এমনকি প্রয়োজনে একটু চিকিৎসা নিতে তার জন্মস্থান চাঁদের বুকেও নেমে যেতে পারবে।

মানুষের বানানো সর্বকালের সবচে গতিময় বাহন সে। সবটুকু প্রোপ্যাল্যান্ট এক ধাক্কায় পুড়িয়ে দিলে প্রতি সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারবে। অবিস্মরণীয় গতি! বৃহস্পতি-পৃথিবী ট্রিপ সম্ভব মাত্র এক সপ্তাহে, দু বছর নয়। আর এই অবিস্মরণীয় গতিতে নিকটতম নক্ষত্রলোকে যেতে লাগবে হাজার বছরের কিছু বেশি সময়।

এ নৌবহরের তৃতীয়জনই স্যার লরেন্সের সমস্ত বিজ্ঞানীকুলের সব দরদ ঢেলে তৈরি করা ক্ষণজন্মা মহাকাশ অগ্নিরথ, ইউনিভার্স। দু বোনের সমস্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি যুক্ত হয়েছে তার সারা গায়ে, অলঙ্কারের মতো।

পৃথিবী থেকে সৌর জগতের হীরা শনির দিকে সেই প্রথম যাত্রীবাহী রণপোত।

স্যার লরেন্সের ইচ্ছা ছিল এর উদ্বোধনে আরো বিচিত্র কিছু করার। কিন্তু কিছু বিদঘুঁটে আন্দোলনের কারণে নির্মাণ পিছিয়ে যায়; কয়েকটা টেস্ট ড্রাইভের পর লয়েডস এর সার্টিফিকেট নিতে নিতে দু হাজার ষাটের শেষ মাস এসে পড়বে। কিন্তু আফসোস, হ্যালির ধূমকেতু তো আর অপেক্ষা করবে না, এমনকি স্যার লরেন্স সুংয়ের জন্যও নয়।

৯. দেবরজের পর্বত

ইউরোপা-৬ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ পনের বছর ধরে অর্বিটে ঝুলে আছে। অবশ্য এর প্রত্যাশিত আয়ু এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে একেবারে; কিন্তু কাজ চলায় একে সেখানেই রাখা হবে, নাকি অন্য একটা বসানো হবে তা নিয়ে গ্যানিমিডের ছোট্ট সায়েন্টিফিক এস্টাবলিশমেন্টে একটু কথাবার্তার ঝড় উঠবে এই যা।

এতে চিরাচরিত জিনিসপাতি ঠাসা ছিল। যেমন আজকাল অচল হিসেবে বিবেচিত ইমেজিং সিস্টেম। তবু বিজ্ঞানীরা ইউরোপার সদা অপরিবর্তিত মেঘের দল ভেদ করার লক্ষ্যে সেটাকেই তরতাজা রাখে। বর্তমানে কুইক লুক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক সহজে পৃথিবীর পথে ডাটার প্রবাহ পাঠানো যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। তাই ওরা বরং স্বস্তি পাবে যদি ইউরোপা-৬ তার অপ্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার খালি করে আর সামনে না এগোয়, যদি অকেজো হয়ে যায়।

কিন্তু এখন, এ্যাত্তোদিন পরে, প্রথমবারের মতো শিউরে দেয়া কিছু কাজের কাজ করল সে।

অরবিট ৭১৯৩৪, বলল ডেপুটি চিফ অ্যাস্ট্রোনমার, রাতের পাশ থেকে এগিয়ে আসছে, সরাসরি মাউন্ট জিউসের দিকে। অবশ্য আগামী দশ সেকেন্ড কিছুই দেখতে পাবেন না।

ভ্যান ডার বার্গ দেখল স্ক্রিনটা পুরোপুরি কালো । অবশ্য কল্পনা বশ মানছে না। মেঘের ছাদের হাজার কিলোমিটার নিচে বরফের মহাসাগর দিব্যি চোখে ধরা দেয়। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূরের সূর্য দেখা যাবে। এদিকে ইউরোপা ঘুরে গেছে আরো একপাক। প্রতি সাত পৃথিবী-দিনের পর পরই ঘোরে। রাতের পাশ না বলে আসলে গোধূলী পাশ বলাই ভাল। অর্ধেক সময় শুধু হাল্কা আলো ছিল, তাপ নয়। কারণ এর অন্য অর্থ আছে, ইউরোপা সূর্যোদয় চেনে, লুসিফারোদয় নয়।

আর এগিয়ে আসছে সেই দূরের সূর্য, সৌরজগতপতি; মিলিয়ে যাচ্ছে আঁধার।

এতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি এলো যেন কোনো আণবিক বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে। এক সেকেন্ড না পেরুতেই রঙধনুর সবগুলো রঙ পেরিয়ে উজ্জ্বল সাদার বন্যা তলিয়ে দিল সবকিছু। কারণ সূর্য এবার উঠে এসেছে পাহাড় পেরিয়ে। তারপর হারিয়ে গেল। অটোম্যাটিক ফিল্টারগুলো সার্কিট কেটে দিয়েছে।

এই সব। আফসোস, সেখানে কোনো অপারেটর ডিউটিতে নেই। সে ক্যামেরাটা প্যান করে নিচের দৃশ্য স্পষ্ট ধারণ করতে পারত। সার্কিটও বন্ধ রাখা যেত তাহলে। আমি জানি আপনি জিনিসটা দেখতে চান, যদিও তাতে করে আপনার থিওরির গুড়ে বালি লেপ্টে যাবে।

কী করে? বিরক্ত হওয়ার চেয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছে ভ্যান ডার বার্গ।

দৃশ্যটুকু স্লো মোশনে দেখলে বুঝবেন। এই সৌকর্যময় রঙধনুগুলো বায়ুমণ্ডলের ফল নয়, বরং স্বয়ং পাহাড়ের কারসাজি। শুধু বরফের পক্ষেই এমন দৃশ্য তুলে আনা সম্ভব, আর নাহলে কাঁচ দরকার। কাঁচটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক, কী বলেন?

অসম্ভব নয়, আগ্নেয়গিরি থেকেও গলিত কাঁচ সৃষ্টি হয়, কিন্তু ওগুলো সাধারণত কালো রঙের…অবশ্যই!

মানে?

তথ্য না পেলে আমি কোনো দাবী করব না। কিন্তু আশা করি আমার ধারণাটা একেবারে স্বচ্ছ। ওটা স্বচ্ছ কোয়ার্টজের সৃষ্টি নয়তো? এ দিয়ে সহজেই প্রিজম আর লেন্স বানানো যায়। আরো অবজার্ভেশনের সম্ভাবনা আছে কি?

মনে হয় না। একেবারে ভাগ্যগুণে এবার পেরেছি। ভাগ্য আর কাকে বলে, সূর্য, পাহাড়, ক্যামেরা সব একই সাথে এসেছে। তার সাথে ছিল মেঘহীন আকাশ। দুর্লভ; সত্যি, হাজার বছরে আরেকবার এ সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না আর।

“থ্যাঙ্কস, এনি ওয়ে, আপনি কি একটা কপি পাঠাতে পারবেন? তাড়াহুড়োর কিছু নেই। পেরিনের দিকে একটা ট্রিপে বেরুচ্ছি, না ফিরে চোখ বুলাতে পারব না।

ভ্যান ডার বার্গ একটা ছোট, সুন্দর হাসি দিল।

ইউ নো, সেটা যদি সত্যি সত্যি রক ক্রিস্টাল হয়ে থাকে তো আমাদের নানা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনকি বেতন নিয়ে গণ্ডগোলটাও কেটে যাবে সই করে…

কিন্তু ভাবনাটা একেবারেই ছেলেমানুষী। কবেইতো মানা করে দেয়া হয়েছে, সবখানে যাও তোমরা, এখানে নয়। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। এমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয়নি যাতে বোঝা যাবে যে নির্দেশটা আর বহাল নেই।

১০. বোকার স্বর্গ

অভিযানের প্রথম আটচল্লিশ ঘণ্টা পর্যন্ত হেউড ফ্লয়েডের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না কোনোকিছুই; ধূমকেতু, ইউনিভার্স আর এর জীবনপদ্ধতি, সবই যেন অবিশ্বাস্য। এরই মধ্যে তার সহযাত্রীদল আনন্দে আটখানা। যারা কোনোদিন পৃথিবী ছাড়েনি এর আগে, তারা মনে করে স-ব স্পেসশিপ অবশ্যই এমন হতে হবে। হওয়াটা উচিত।

কিন্তু সে এতো কাঁচা নয়, অ্যারোনটিক্সের ইতিহাস ঘাঁটতে হবে তাকে। তার জীবদ্দশায়ই কত শত উত্থান-পতন! নিজেই পেছনের সেই জ্বলজ্বলে গ্রহটার উড্ডয়নবিদ্যায় কতশত নূতনত্বের স্বাদ যে নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই পুরনো লিওনভ আর এই তারুণ্যমাখা ইউনিভার্সের মধ্যে পড়ে আছে কাঁটায় কাঁটায় পঞ্চাশটা বছর। আবেগিক দিক দিয়ে সে ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না কথাটা, কিন্তু কী করা, বিধি বাম, এই ছিল কপালে।

সেই রাইট ব্রাদারদের যুগ, তার আধ-শতক কাটতে না কাটতেই রকেটের তর্জন-গর্জন, তার পর পরই একের পর এক ফুয়েল-উন্নয়ন! অবিস্মরণীয়। আর এখন সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার। কিন্তু মাঝের বিশাল সময়টাও বিবেচ্য।

তাই, হয়তো, তার উচিত ছিল না আশ্চর্য হওয়া। হোক না ঘরটা অতি সুন্দরভাবে সাজানো, এমনকি এই সাজানো ঠিক রাখার জন্য একজন কাজের লোক থাকলেও অবাক হওয়ার মতো কী হল? জানালার বাহারও দেখার মতো। আর ঘরতো ঘর নয়, প্রকাণ্ড স্যুইট। ভেতরে টনকে টন বাতাসের চাপ থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাইরে, নিঃসঙ্গ শূন্যতায় ।

আধুনিক সাহিত্য তার মনকে ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত করেছিল, তবু, মাধ্যাকর্ষণের স্বচ্ছ উপস্থিতি যেন কেমন ভড়কে দেয়। ইউনিভার্স মানবেতিহাসে প্রথম স্পেসশিপ যা একবার ধাক্কা দিয়ে সারা পথ চলবে না বরং, নিয়মিত ত্বরণে গতিবৃদ্ধি চলতেই থাকবে মাঝখানের সামান্য তুনা রাউন্ড বাদ দিয়ে।

তার দানবাকার প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কে পাঁচ হাজার টন পানি পূর্ণ করে নিয়েও এক দশমাংশ জি তোলা সম্ভব হয়। মোটামুটি ভালই বলা চলে, কিন্তু তার পরও নতুন যাত্রীদের নড়াচড়ার রীতি আর স্যুপ খাবার সময় আস্তে চামচ তোলার কায়দা রপ্ত করার পথে হোঁচট খেতে খেতে কদিন কেটে গেছে ।

এরই মধ্যে ইউনিভার্স তার বুকের মানুষদের চার শ্রেণীতে ভাগ করে নিয়েছে।

আভিজাত্যের শুরু ক্যাপ্টেন স্মিথ আর তার অফিসারদের থেকে, পরের শ্রেণীতে আছে যাত্রীরা; এরপরই নন কমিশন্ড আর সাধারণ ক্রুরা। সবশেষে …।

এই বাস্তব কৌতুকটা প্রথমদিকে পাঁচ তরুণ মহাকাশ বিজ্ঞানী নিজেদের জন্য ঠিক করেছিল, পরে ব্যাপারটা বেশ তিক্ত হয়ে পড়ে। ফ্লয়েডের সুইটের সাথে তাদের ছোট্ট কোয়ার্টারের বিস্তর তফাৎ। ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনের চোখে তুলে ধরা ছাড়া উপায় ছিল না।

শিপকে প্রস্তুত করতে হয়েছে শেষ মুহূর্তে, চট-জলদি করে। কারণ হ্যালির জন্যে সে আরো পৌণে শতাব্দী নাও টিকতে পারে। তাই আবাসনের জটিলতা হতেই পারে।

আর সায়েন্টিফিক টিমের তো হাজারো কাজ করার আছে, শিপের বাইরে যাওয়া, হ্যালির বুকে নামা, আরও কত ঝক্কি-ঝামেলা। তাছাড়া এই অভিযানের গুরুত্বও তো তারা জানে, তাই না? প্রথম ধাক্কায় একটু খারাপ লাগতেই পারে।

একটু আবেগ আর উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসে সেসব তরুণের বুক থেকে। তাদের গুঞ্জন তোলা ভেন্টিলেশন সিস্টেম, দমবন্ধ হয়ে যাওয়া কেবিন আর অজানা পদের বিশ্রী গন্ধ নিয়ে আরো হাজারো অভিযোগ করার আছে।

কিন্তু খাবার নিয়ে টু শব্দও নয়। এক কথায় চমৎকার। অনেক ভাল, বলল ক্যাপ্টেন, অন্তত বিগলের বুকে ডারউইন যেমনটা খেয়েছিলেন তার চেয়ে।

এ নিয়ে ভিক্টর উইলিস বলেছিল, তিনি কি আর জানতেন ইতিহাসে বিগল কোথায় গিয়ে ঠেকবে? বিলাস আসবে কোত্থেকে? আমরা আমাদের অভিযানের সাথে ইতিহাসের যোগসূত্র জানি। আর, বাই দ্য ওয়ে, জানা থাকলে বিগলের কমান্ডার ইংল্যান্ডে ফিরে নিজের গলাই কেটে ফেলত।

ব্যাপারটা ভিক্টরের কাছে যথেষ্ট চিন্তার। তিনি ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অথবা পপ-বিজ্ঞানী, তার ভক্ত শ্রোতাদের সামনে। তার মধ্য-প্যাসিফিক উচ্চারণ, ক্যামেরার সামনে ব্যয়বহুল হস্ত-সঞ্চালন অনেক কৌতুকের কারণ ছিল। তার উপর বিরাট দাড়ির বহর ছিল দর্শনীয়।

যে লোক এতো লম্বা চুল-দাড়ি গজাতে পারে, বলত সমালোচকের দল, সে লুকাতেও জানে বিস্তর।

ছজন ভি আই পির মধ্যে সে-ও একজন, কিন্তু ফ্লয়েড নিজেকে ঠিক সেলিব্রিটি মনে করে না। বরং বাকীদের ডাকে দ্য ফেমাস ফাইভ নামে। ইভা মারলিন খুব দুর্লভ সময়গুলোয় নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্ক এভিনিউর নির্জন প্রান্ত ধরে কখনো-সখনো হাঁটতেও পারে। দিমিত্রি মাইকেলোভিচ তার ক্ষুদ্র উচ্চতার জন্যই হয়তো হাজার খণ্ড অর্কেস্ট্রার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।

ক্লিফোর্ড গ্রিনবার্গ আর মার্গারেট মবালাও অচেনা বিখ্যাত তালিকায় পড়ে-অবশ্য পৃথিবীতে ফেরার সাথে সাথেই ব্যাপারটা আমূল বদলে যাবে। মার্কারিতে পা রাখা প্রথম মানব চেহারা-সুরতে তেমন আহামরি কিছু নয় যে তাকে তেমন আলাদাভাবে মনে রাখা যাবে। তার উপর খবরের জগতে রাজত্ব চালানোর কালটা চলে গেছে বছর ত্রিশেক আগেই। অন্যদিকে, যেসব লেখক সাক্ষাৎকার, টক-শো আর অটোগ্রাফ দেয়ার নেশায় আসক্ত নয়, তাদের মধ্যে মিসেস মবালা তার লাখ লাখ পাঠকের মনে কাজের মধ্য দিয়েই চির জাগরূক হয়ে থাকবে।

চল্লিশের দশকে তার সাহিত্যকর্ম বেশ নাড়া দিয়েছিল। যথারীতি এ স্কলারি স্টাডি অফ দ্য গ্রিক প্যান্থিয়ন বেস্ট সেলারের লিস্টে কামড়াকামড়ি করেনি, কিন্তু মিসেস মবালা এ বইয়ের অন্তর্নিহিত আর আবেগকে, ঐতিহ্যকে একটা আনকোরা যুগের সন্ধিক্ষণে, মহাকাশ যুগের প্রারম্ভে প্রকাশ করেছিল। এক শতাব্দী আগে যে নামগুলো শুধু অ্যাস্ট্রোনমার আর চিরায়ত মেধাবীদের কাছে পরিচিত ছিল তা আজ প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের দুনিয়ার এক অংশ। প্রতিদিনই দু-চারটে খবর আসবে গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো, আইও, টাইটান, বৃহস্পতি… এমনকি আরো নির্জন দুর্গম সব এলাকা থেকে ক্যারমে, প্যাসিফা, হাইপেরিয়ন, ফোবস… [**দেখুন: প্রাসঙ্গিক টিকা]

তার বই শুধু সার্থকই হয়নি বরং মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার পুরনো ঐতিহ্যের ছোঁয়া। প্রকাশ করেছে জুপিটার-জিউসের পারিবারিক কাহিনী যিনি ছিলেন সব দেবতার পিতা। এমনকি সম্পাদকরা এ-ও বলেছিল যে, তার দ্য ভিউ ফ্রম অলিম্পাস, টু দ্য প্যাশন্স অফ দ্য গডস এর মতো একটা লেখা লিখতে পারলে তারা সার্থক হত।

যাত্রীদের একজন শিপটাকে বোকাদের জাহাজ বলে বেড়ায়। ভিক্টর উইলিস ব্যাপারটার সাথে শতাব্দী-পুরনো এক ঘটনার মিল খুঁজে পেয়েছে। কয়েকজন বিজ্ঞানী আর লেখককে সাথে নিয়ে ক্যাথরিন এ্যান পোটার পাল তুলে দিয়েছিল সমুদ্রে; এ্যাপোলো ১৭ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে চান্দ্র অভিযানের প্রথম অধ্যায়ের পতন দেখার জন্য।

ব্যাপারটা মনে রাখব। মবালা বলল, তৃতীয় দৃষ্টি দেয়ার আসল সময় হয়তো এখুনি, তবে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে পৃথিবীতে ফেরার পর…

১১. মিথ্যা

কয়েক মাস আগেই রালফ ভ্যান ডার বার্গ দ্বিতীয়বার মাউন্ট জিউসের দিকে চোখ তুলে মনোযোগ দেয়ার এনার্জি খুইয়ে বসেছে। গ্যানিমিডকে বশ । মানানোটাই ফুল টাইম জবের চেয়ে বেশি কিছু। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো সে এই ফুল টাইম জব করেও হপ্তার পর হপ্তা মূল এলাকা দার্দানাস বেসের বাইরে থেকে প্রস্তাবিত গিলগামেশ-ওসিরিস মনোরেল নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে বেড়ায়।

গ্যালিলীয় জগতের তৃতীয় উপগ্রহের ভূগোল উল্টে গেছে বৃহস্পতির রূপ বদলের সাথে সাথে। বদলাচ্ছে আজো। নূতন সূর্যটা ইউরোপার বরফ গলিয়ে দিলেও তার দৈবতেজ এখানেও সমান নয়, কারণ চার লক্ষ কিলোমিটার দূরত্ব। কিন্তু সারাক্ষণ সূর্যটার দিকে মুখ করে থাকা অংশকে চলনসই উত্তাপ দিয়ে যেতে পারে।

উপগ্রহের এখানে-ওখানে ছোট ছোট অগভীর সমুদ্র। কোনো কোনোটা দুনিয়াবী মেডিটারিয়ানের মতো বড়। বিংশ শতাব্দীতে করা ভয়েজার অভিযানগুলোর চোখ থেকে খুব বেশি এলাকা বাঁচেনি, তাই আগের দিনের মানচিত্র ছিল প্রায় পূর্ণ এবং সে মানচিত্রও বদলে গেছে আমূল। আজো বদলাচ্ছে, দেদার। গলতে থাকা পার্মাফ্রস্ট, তাপে দ্রুত হওয়া টেকটোনিক প্লেটের চলন, তার উপর দু পাশের অভ্যন্তরীণ উপগ্রহের সমান জোয়ার-শক্তি প্রতিনিয়ত উপগ্রহটাকে এমনভাবে উল্টেপাল্টে দেয় অহর্নিশি যে মানচিত্রকারদের দুঃস্বপ্ন দেখতে আর বাকী নেই।

কিন্তু এই একই ব্যাপার উল্টে গেছে, প্ল্যানেটারি ইঞ্জিনিয়াররা এখন আহ্লাদে আটখানা। এ যেন তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস। রুদ্র, অসভ্য, পুরনো মঙ্গলকে হিসাবের বাইরে রাখলে এ-ই সে মহাজাগতিক এলাকা যেখানে একদিন মানুষ চড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে পারে; খোলা বাতাসে বুক ভরে নিয়ে। গ্যানিমিড়ে আছে প্রচুর পানি, জীবনের সব রাসায়নিক উপাদান, আর লুসিফার যখন মন-মর্জি ভাল রাখে তখন পৃথিবীর চেয়েও ভাল আবহাওয়ার দেখা পাওয়া যায়।

সবচে বড় আশীর্বাদ, সারা শরীর মুড়ে নিয়ে স্পেসস্যুট পরার কোনো দরকার নেই। আজো পরিবেশের বাতাস টেনে নেয়া নিরাপদ না হলেও শুধু একটা মাস্ক আর অক্সিজেন সিলিন্ডার হলেই কাজ চলে যায়। আর মাত্র কয়েক দশক… বলে বেড়ায় মাইক্রোবায়োলজিস্টরা, যদিও ঠিক কবে তা বলতে তারা রাজী নয়… তারপরই উপড়ে ফেলব গ্যাসমাস্ক আর ভারী সিলিন্ডার। গ্যানিমিডের মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অক্সিজেন উগড়ে দেয়া ব্যাক্টেরিয়ার দঙ্গল। অবশ্যই, প্রথম চোটে ইচ্ছামতো তারা মারা পড়ে উপগ্রহের বিরূপ পরিবেশে, তারপরও কেউ কেউ বেঁচে গেছে; বাঁশঝাড়ের মতো বিস্তার করছে নিজের বংশ, অতি ধীরে বাড়াচ্ছে বায়ুমণ্ডলের চার্টের একটা বিশেষ রেখার বক্রতা, সাথে সাথে বাড়ছে দার্দানাসে বসে থাকা লোকগুলোর আশা।

প্রথম প্রথম ভ্যান ডার বার্গ ইউরোপা-৬ থেকে আসা ডাটার উপর চোখ রাখত, যদি…যদি একবার মেঘটা সরে যায় জিউস পর্বতের উপর থেকে… সে জানে, সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবু চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে না কখনো। রিসার্চের আর কোনো পথ ধরে চলার ধার ধারে না তখন। অবশ্য তাড়াহুড়োর কিছু নেই, সে খুব ভালমতোই জানে। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে পড়ে আছে; সেসব না করলে কপালে পড়বে উপজাতীয় হওয়ার দোষ আর অজনপ্রিয় হবার বোঝা।

আর তারপরই, অকেজো হয়ে পড়ল ইউরোপা-৬; একেবারে হঠাৎ করেই এলোপাথাড়ি উল্কাঝড়ের কবলে পড়ে। এদিকে পৃথিবীতে ভিক্টর উইলিস বেশ একটা বোকাটে কাজ করে বসেছে। গত শতাব্দীর ইউ এফ ও গুজবদাতাদের স্থান পূরণ করা ইউরোপাগল মানুষগুলোর কথা শুনতে গিয়েই এই দুর্গতি। তাদের মতে-এই কৃত্রিম উপগ্রহের পতন হয়েছে নিচের বিচিত্র দুনিয়ার অধিবাসী অথবা তাদের রক্ষাকারীর কল্যাণে। মজার ব্যাপার হল, জিনিসটা যে এর তৈরি করা ও ডিজাইনের সময়ে প্রত্যাশিত জীবদ্দশার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি টিকেছে, প্রায় পনের বছর-সে কথাটা যেন ধর্তব্যই নয়। এ কথা বলে ভিক্টর উইলিস অনেক চিৎকার করলেও এখন আর করার কী থাকতে পারে! সে-ই তো এই সব মানুষকে প্রচার দিয়ে খাল কেটে কুমির টেনে এনেছে প্রথমদিকে।

ভ্যান ডার বার্গের হিসাব মতে তার এই সহকর্মী হল একেবারে কাঠখোট্টা ডাচম্যান; সে এই তত্ত্ব সব সময় চাউর করে বেড়াতেও চেষ্টা করে। ইউরোপা-৬ এর পতন তার কাছেও এক চ্যালেঞ্জ। আর এই বিশ্বস্ত উপগ্রহটার বদলে আরেকটা বসানোর টাকা অনুমোদনের বিন্দুমাত্র লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, যাবার কথাও নয়।

তাহলে বিকল্পটা কী? নিজস্ব চিন্তা আর করণীয় নিয়ে বসে গেল কাজের মানুষ ভ্যান ডার বার্গ। যেহেতু সে একজন ভূতত্ত্ববিদ-কোনো অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট বা মহাজাগতিক পদার্থবিদ নয়, গ্যানিমিডে অবতরণের সাথে সাথেই তার দিক নির্ধারিত হয়ে বসে আছে।

গালি দেয়ার দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচে ভাল ভাষাগুলোর মধ্যে একটা হল আফ্রিকান; অতি ভদ্রভাবে বলার সময়ও ভ্যাজাল পাকিয়ে বসে। ভ্যান ডার বার্গ কয়েক মিনিটের জন্য বাষ্প বন্ধ রেখে টিয়ামাট অবজার্ভেটরিতে একটা কল করল। ওই অবজার্ভেটরিটাও নগ্ন লুসিফারের ছোট্ট সদা জ্বলন্ত চোখের নিচে অবস্থিত। অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টরা, মহাজাগতিক সুবিশাল রহস্যগুলো নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তিত বিজ্ঞানীর দল প্রায়ই বিরক্তির চরমে পৌঁছে যায় ভূতত্ত্ববিদদের একটা গ্রহের মতো অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে মাতামাতি দেখতে দেখতে। কিন্তু সামনের সেই রণক্ষেত্রে সবাই সবাইকে সহায়তা করছিল যথাসম্ভব; আর ড. উইলকিন্স শুধু আগ্রহীই নয় বরং সহমর্মী।

টিয়ামাট অবজার্ভেটরি মাত্র এক উদ্দেশ্যে গড়া হয়েছে, যে উদ্দেশ্যটা গ্যালিমিডে বেস গড়ার অন্যতম কারণ। লুসিফারের উপর গবেষণা শুধু বৃহস্পতি-অবলোপন রহস্য বা সাধারণ বৈজ্ঞানিক চিন্তা চেতনা নয় বরং নিউক্লিয়ার প্রকৌশলী, উল্কাতবিদ, সমুদ্রবিজ্ঞানী এমনকি দার্শনিকদেরও বাস্তব প্রয়োজন মেটাতে পারে : একটি সূর্য। তার উপর কী ঘটলে একটা গ্রহ পরিণত হয় নক্ষত্রে সেই চিন্তাও সহস্ৰজনকে জাগিয়ে রেখেছে রাতের পর রাত। ব্যাপারটা জানা মানবজাতির জন্য খুবই প্রয়োজন। এই জ্ঞানই এমন কোনো কাজ করতে সক্ষম করবে মানুষকে, অথবা এমন কোনো সম্ভাব্য ঘটনা ঠেকাতে করবে সহায়তা যা…

আর এজন্যই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে টিয়ামাট একে জরিপ করে চলেছে অবিরত; সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। প্রতিটি মিলি সেকেন্ডের সমস্ত তথ্য টুকে রাখছে সেসব যন্ত্র। পুরো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ব্যান্ডের সমস্ত আলোক বর্ণালী রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। আর পরীক্ষা চলছে আগ্নেয়গিরির মুখে বসানো একটা শত মিটারের ডিশ অ্যান্টেনা দিয়ে।

ইয়েস, বলল ড. উইলকিন্স, আমরা মাঝেমধ্যে ইউরোপা আর আইওর দিকে তাকাই বটে, কিন্তু আমাদের ডিশটা একেবারে লুসিফারের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে; ফিক্সড। উপগ্রহগুলো যখন লুসিফারকে পার করে যায় তখনই শুধু কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে পাই-এই যা। আপনার ঐ জিউস পর্বত তত দিনের প্রান্তে, না?

হ্যাঁ।

“আমরা ইউরোপার রাতের দিকটাই শুধু দেখতে পাই।

আমিও ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারছি। একটু অস্থির যেন ভ্যান ডার বার্গ, কিন্তু আপনারা কি বিমটাকে সামান্য একটু সরিয়ে সেট করতে পারেন? ইউরোপা লাইনে আসার আগেই যেন দেখা যায় এমন কোথাও? দশ-বিশ ডিগ্রি ঘোরাতে পারলেই দিনের পাশটা দেখা সম্ভব।

“এক ডিগ্রিই লুসিফারকে হারিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর অন্যদিকে ইউরোপাকেও পাওয়া যাবে। কিন্তু লুসিফারের ক্ষমতার এক শতাংশও পাব না তখন। তারপরও একটা চেষ্টা করে দেখা যাবে। আপনি এক কাজ করুন, ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর বর্ণালী, তরঙ্গ খাম, মেরুকরণ সহ আর যা যা করা গেলে কাজ হবে এমন তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিন। দু-এক ডিগ্রির জন্য কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সবচে বড় কথা, এ ব্যাপার নিয়ে আমাদের কেউ এত বেশি মাথা ঘামাবে না যে ডিশটা সরালে তেমন সমস্যা হতে পারে। ভাল কথা, আপনি ইউরোপায় বরফ আর পানি ছাড়া আর কিছু নিশ্চই আশা করেন না?

যদি জানতামই আনন্দিত কণ্ঠ ভ্যান ডার বার্গের, তাহলে সাহায্যের কথা বলতাম না, বলতাম কি?

আর আমিও পাবলিকের সামনে বাহাদুরি ফলাব না। তার উপর আমার নামটাই যাচ্ছেতাই, শেষ অক্ষর দিয়ে শুরু। আপনি আমার চেয়ে একটা মাত্র অক্ষরের জন্য এগিয়ে থাকবেন।

এক বছর আগের কথা: লঙ রেঞ্জ স্ক্যানগুলো তেমন কাজের ছিল না। তারপর ইউরোপার উপর বিম তাক করতে গিয়ে আশাতীত কষ্ট হল সবার। কিন্তু সবুরের মেওয়া ফলবেই, কম্পিউটারে সুন্দর তথ্য এলো অযুত-নিযুত। ফলে ভ্যান ডার বার্গ মানবজাতির প্রথম সদস্য হিসেবে লুসিফার-পরবর্তী ইউরোপার অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে পেয়েছিল সেদিন।

আসলেই, ড. উইলকিন্সের কথামতো প্রায় পুরোটাই বরফ আর পানিতে ভর্তি। ব্যাসল্টের সাথে সাথে কোথাও কোথাও দেখা গেল সালফারের তূপ। কিন্তু দুটো ব্যাপার বেশ গণ্ডগোল পাকায়।

একটা যেন একেবারে নিখুঁত কৃত্রিম বস্তু। দু-কিলোমিটার টাক লম্বা। কোনো রেডিও প্রতিফলনই হচ্ছে না সেটা থেকে। ভ্যান ডার বার্গ ড. উইলকিন্সকে এ নিয়ে ধাঁধায় পড়ে যেতে দিল। তার নিজের ধাঁধা শুধু মাউন্ট জিউস।

ব্যাপারটা বুঝে উঠতে অনেক অনেকদিন লেগে গেল তার। কারণও আছে, এমন কথা আগেভাগে কল্পনা করতে পারে শুধু দুজন-হয় এক পাগল, নাহয় কোনো অতি অগ্রসর কল্পনার বিজ্ঞানী। এমনকি এখনো-সবকিছু কঠিনভাবে চুলচেরা হিসাব করার পরও তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। পরবর্তীকালে কী যে করবে বা করা উচিৎ তাও ভাবছে না এক বিন্দু।

ড. উইলকিন্স কল করে দু-একটা এদিক-সেদিক করা কথা বলল, খুব বেশি অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়… কোয়ার্টজের কোনো দুর্নল গোত্ৰটোত্র হবে আর কী। পৃথিবীর স্যাম্পলের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এখনো…

এই প্রথমবারের মতো সে কোনো সহকর্মী বিজ্ঞানীর কাছে কাজের ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলল।

কিন্তু এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল তার?

১২. ওম পল

রালফ ভ্যান ডার বার্গ প্রায় একযুগ ধরে তার চাচাকে দেখে না। চর্ম-মাংসের শরীরে তাদের আবার দেখা হবার কথাও নয়। এখনো সে এই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে খুব কাছ থেকে অনুভব করে। এই একজনই তাদের উপজাতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন এখন, তাদের সেই পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী।

ওম পল নামেই ড. পল ক্রুগারকে ডাকে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব। প্রয়োজনের সময় প্রতিবারই তাকে কাছে পেয়েছে ভ্যান ডার বার্গ, সরাসরি অথবা আধ বিলিয়ন কিলোমিটার লম্বা রেডিও সংযোগের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তার পার্টিকেল ফিজিক্স বিষয়ক আবিষ্কারটি ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে আরো নানা কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় সভ্য দুনিয়ার ধুলো-ময়লা থেকে পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নতুন যুগের সূচনা হয়। বাজারে জোর গুজব প্রচলিত যে তার প্রাপ্য নোবেল পুরস্কারটি প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপসৃষ্টির কারণেই ঠেকে আছে।

কথাটা সত্যি হলেও ড. পল ক্রুগারের কিস্যু যায় আসে না। একেবারে সাদাসিধে লোক, কারো সাতে-পাঁচে নেই, ব্যক্তিগত একজন শত্রুও মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবী এম্নিতেই তাকে শ্রদ্ধা-সম্মানের ডালি সাজিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েকবার তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছেন নিমন্ত্রণ। ইউ এস এস এ বা ইউনাইটেড স্টেটস অব সাউদার্ন আফ্রিকা ভ্রমণ করলে যে তার শারিরীক কোনো ক্ষতি হতে পারে বা আক্রমণ আসতে পারে সে সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র নেই কিন্তু তিনি অতীতকে আর সামনে আনতে চান না; চান না অসহ্য নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতে।

ভ্যান ডার বার্গ যে ভাষা ব্যবহার করেছে সেটা সর্বমোট দশ লাখ লোকও বোঝে কিনা সন্দেহ। নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য যে কোনো মানুষের কাছে এর কোনো অর্থই নেই। ড, পল খবরটিকে তেমন গুরুত্বের সাথে নিতে পারলেন না, যদিও ভাস্তের মেসেজ বুঝতে তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। তার ধারণা রালফ ছোঁড়াটা কোনো গাঁজায় পড়েছে অথবা তাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে চাচ্ছে, একটু কাছে টানার চেষ্টাও হতে পারে। ঠিক যেমন তিনি সহজে সাধারণ মানুষের কাছে যান না, অন্তত তাঁর চুপ করে থাকার ক্ষমতাটা ভালই ছিল…

তবু ধরা যাক-শুধু ধরাই যাক না-যদি কথাটা সত্যি হয়েই থাকে, তাহলে? মলিন চুলগুলো পলের ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে। সম্ভাবনার এক নূতন দুয়ার; বৈজ্ঞানিক, আর্থিক, রাজনৈতিক… হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে খুলে গেল। তিনি ব্যাপারগুলোকে যতই গোনায় ধরলেন ততই তারা ফুলে-ফেঁপে উঠল।

তার পূর্বপুরুষদের মতো নন তিনি। বিপদে, মানসিক অস্থিরতায়, সিদ্ধান্ত হীনতায় ভরসা দেবার মতো কোনো ঈশ্বর তার নেই। এখন তিনি ব্যাপারটাকে মিস করছেন, অবশ্য থাকলেও কোনো কাজে আসততা কিনা সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান। এখন কম্পিউটারে বসে ডাটা ব্যাঙ্কে ঢোকার মুখে তিনি বারবার ভাবছেন একটা কথাই- ভাস্তে কি আসলেই কোনো বোকামিতে ভরা আবিষ্কার করে বসেছে নাকি আন্দাজের উপর বগল বাজাচ্ছে! সেই পুরনো জন কি আসলেই মানব জাতির উপর এত বড় একটা চাল চালতে পারে! তার মনে পড়ে যায় মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি, যদিও তিনি ছিলেন মহারহস্যময়, কখনোই অকল্যাণময় ছিলেন না।

দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ কর, নিজেকেই বললেন ড. পল ক্রুগার। তোমার ভাল লাগা বা মন্দ লাগা-তোমার আশা অথবা ভয় দিয়ে পুরো ব্যাপারটার একেবারে কিস্যু আসে যায় না।

তার সামনে, সৌরজগতের অর্ধেকটা জুড়ে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ঘুরপাক খাচ্ছে, আসল সত্যের একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পাবেন না।

১৩. কেউ আমাদের সাঁতারের পোশাক আনতে বলেনি..

পঞ্চম দিন পর্যন্ত ক্যাপ্টেন স্মিথ ছোট্ট চমকটা জিইয়ে রেখেছিল, ঘুরে যাবার কয়েক ঘণ্টা আগেও কথাটা বলেনি কাউকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার ঘোষণায় সাড়া পড়েছে দারুণ!

ভিক্টর উইলিসই প্রথমে কথা বলছিল।

সুইমিং পুল। তাও আবার একটা স্পেসশিপের ভিতর! রসিকতা করছেন, আপনি নিশ্চই রসিকতা করছেন!

পেছনে হেলান দিয়ে ব্যাপারটা উপভোগ করতে লাগল ক্যাপ্টেন। একটা ঝরঝরে হাসি দিল হেউড ফ্রয়েডের দিকে তাকিয়ে। সেও ব্যাপারটা জেনে গেছে।

আসলে, আমার মনে হয় কলম্বাসও তার পরবর্তী যুগের শিপগুলো দেখে ভড়কে যেত। এটাই স্বাভাবিক।

তাহলে তো ডাইভিং বোর্ডও থাকার কথা, আছে নাকি দু একটা? গ্রিনবার্গের কথায় আশার ধ্বনি, আমি আবার কলেজ চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।

বুঝতেই পারছেন-আছে। উচ্চতা মাত্র পাঁচ মিটার। তাতে কী বা এসে যায়? পাক্কা তিন সেকেন্ডের পতন উপভোগ করতে পারবেন আপনি। হাজার হলেও আমাদের মাধ্যাকর্ষণটা জির দশ ভাগের এক ভাগ। তাতেও জনাবের তুষ্টি না এলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। কার্টিস সাহেবকে অনুরোধ করলে নিশ্চই তিনি ফেলবেন না। থ্রাস্ট কমিয়ে দিলেই জি অনেক কমে যাবে।

তাই নাকি? বলল চিফ ইঞ্জিনিয়ার শুকনো গলায়, আর তারপর আমার অর্বিট ক্যালকুলেশনের সবটুকু গড়বড় হয়ে যাক আর কী! পানি উপচে চলে আসার ঝুঁকির কথা নাইবা বললাম। পৃষ্ঠটানের কাহিনী কে না জানে…

কিন্তু এমন এক স্পেস স্টেশন কি ছিল না যেটায় চতুষ্কোণ সুইমিং পুল… প্রশ্ন করতে নিয়েছিল কেউ একজন।

“তারা পুলটাকে পাস্তুরের অক্ষে বসানোর চেষ্টা করেছিল, ঘূর্ণন শুরুর আগেই। কথা কেড়ে জবাব দিল ফ্লয়েড, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও বাস্তব নয়। শূন্য গ্র্যাভিটিতে জিনিসটা পুরো ভর্তি থাকার কথা। আর একটু অপ্রস্তুত হয়ে নামলেও আপনি ডুবে যেতে পারেন। তার উপর যদি ভয় পান তো…

তো রেকর্ড বুকে নাম উঠবে। মহান নাম। মহাকাশে ডুবে যাওয়া প্রথম মানব ছিলেন…

বাগড়া দিল মবালা, তার একটাই চিন্তা, কেউ তো আমাদের সাঁতারের পোশাক আনতে বলেনি।

যার পরার দরকার সে আনতেই পারত, মানা করেছে কে? আমি বাবা খালি গায়েই নেমে যাব। মাইকেলোভিচ ফিসফিস করল ফ্লয়েডের কানে কানে।

আদালতে অর্ডারের ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন স্মিথ টেবিলে টোকা দিল কয়েকবার।

কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। প্লিজ। আপনারা একটু শুনুন। আমরা জানি, আজ রাতেই সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছব। গতিও কমাতে হবে। ব্রেক করব তখন থেকেই। ড্রাইভটা বন্ধ হয়ে যাবে ২৩:০০ টায়। শিপ পিছুটান দেবে। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ওজনহীনতা আসবে। পরবর্তী থ্রাস্ট দেব ১:০০ টায় ।

“বুঝতেই পারছেন, সমস্ত কু ব্যতিব্যস্ত থাকবে। ইঞ্জিন আর শিপের শরীর বা হাল পরখ করার সুবর্ণ সুযোগ বলা যায় সময়টাকে। পাওয়ারে থাকার সময় কিন্তু এসব সম্ভব নয়। আমি আপনাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করব সে সময়টায় ঘুমিয়ে থাকার জন্য। আর ক্রস করে যেন লুজ বেল্ট আটকানো থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখবেন আশা করি। স্টুয়ার্ড লক্ষ্য রাখবে যেন গতি ফিরে পাবার সময় কোনো আলগা জিনিস না থাকে। তখন গতির কারণে সংঘর্ষ নিশ্চিত। কোন প্রশ্ন?

একটা স্থির নিরবতা চারদিকে। সদস্যরা যেন ঠিক ঠাউরে উঠতে পারছে না কী। করবে বা বলবে।

“যাক। আশা করেছিলাম আপনারা এই বিলাসের কারণ এবং খরচা সম্পর্কে দু একটা প্রশ্ন তুলবেন। তবু বলছি। এটা আসলে মোটেও বিলাস নয় এবং এর পেছনে স্পেসশিপের তুলনায় একটা কানাকড়িও ব্যয় করা হচ্ছে না।

“আপনারা তো ভাল করেই জানেন, পাঁচ হাজার টন পানি বয়ে নিচ্ছি। এ পানিটাই রিয়্যাকশন মাস। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, এটার সর্বোচ্চ ব্যবহারে সদগতি না করলেই নয়। একটা ট্যাঙ্ক বর্তমানে চার ভাগের তিন ভাগ খালি। এ অবস্থাতেই রাখব এটাকে। তোআগামীকাল ব্রেকফাস্টের পর সমুদ্রতটে দেখা হচ্ছে আমাদের…

.

ইউনিভার্সকে মহাশূন্যের সন্তানে পরিণত করার মতো দামী কাজটা এতো যে সহজসাধ্য হবে তা এককালের মহাকাশযানে ভাবাই যেত না।

সমুদ্রতটটা আসলে ধাতব। মিটার পাঁচেক চওড়া হবে টেনেটুনে। একটু বেঁকে গেছে; যেমনটা বাস্তবে হয়। দূরের দেয়াল বড়জোর বিশ মিটার দূরে; কিন্তু পরিবেশ দেখে মনে হয় দূরত্বটা অসীম। আর এই সমুদ্র এমন একটা অপর পাড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে মিশেছে যেখানে কারো যাওয়া সম্ভব নয়। আর যে কোনো ট্রাভেল এজেন্ট দৃরের প্যাসেঞ্জার ক্লিপারটাকে সুং সি স্পেস কপোরেশনের দুরন্ত পালতোলা। পোত ভাবতেই পারে।

এই ধোঁকাটাকে আরো জীবন্ত করে তুলেছে পায়ের নিচের বালি-স্তর। অবশ্য স্তরটা একটু ম্যাগনেটিক করে রাখা হয়েছে যাতে নিজের জায়গা ছেড়ে তেমন নড়তে না পারে। উপরি পাওনা হিসেবে আছে একটা সত্যিকার ছোট্ট বেলাভূমি, শেষ হয়েছে ঘন পাম বনের ভিতরে। কাছ থেকে না দেখলে বনটাকে নিয়ে তেমন অভিযোগ উঠবে না। মাথার উপরে একটা গনগনে আরামদায়ক সূর্যও বসে আছে আলসে পরিবেশ মাতিয়ে। ব্যাপারটা এই পরিবেশে বিশ্বাসই হতে চায় না যে সামনের দেয়ালের ওপাশেই আসল সূর্য পৃথিবীর যে কোনো সাগর তীরের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে জ্বলছে।

ডিজাইনারের কাজটা আসলেই চমৎকার; বিশেষত এই ছোট্ট পরিসরে। তারপরও যেন মন ভরল না গ্রিনবার্গের, ইস্! সার্ফিংয়ের সুযোগটা থাকলেই হতো…

১৪. অনুসন্ধান

বিজ্ঞানের এ ব্যাপারটা বেশ ভাল; কোনো জানা ব্যাপারকেও গোনায় ধরা হয় না। এমনকি বেশ সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলেও না। মানা হবে তখনই যখন কোনো স্বীকৃত, যাচাই করা মাপকাঠির সাথে ব্যাপারগুলো মিলে যাবে। এমনও হয়-একটা কিছু আবিষ্কার হলো; সেটাই মেনে নেয়া হল। কিন্তু আদপে এমন ঘটনা সহজে ঘটে না। হাজার হলেও, গ্যালিলিও আর আইনস্টাইনরা শতবর্ষে একবারই জন্ম নেন; আর জন্মে পাল্টে দেন বিশ্বের চেহারা-সুরত।

ড. ক্রুগার এই নীতিতে অটল। ভাস্তের আবিষ্কারকে কোনো পরিচিত সুরতের সাথে মেলাতে না পেরে সুরতহাল রিপোর্টে তেমন বিশ্বাস করতে পারেননি। আর কাজটা সরাসরি ঐশ্বরিক হওয়া ছাড়া কোনো উপায়ও নেই। রালফ কোনো ভুল করে বসেছে ভেবে ব্যাপারটার কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই সহজ।

ড. পল বেশ অবাক না হয়ে পারেন কীভাবে! হাজার হলেও এ যুগের নির্ভরযোগ্য রাডারের তথ্য ভেসে এসেছে। আর সেটাকে পরীক্ষা করার কাজ নিয়ে দেরি করলেও ঘাঘু ঘাঘু রাডার এক্সপার্টের রিপোের্ট বলছে সেই একই কথা। এবং সাথে একটা বিস্ময়, কোত্থেকে পেলেন এ রেকর্ড?

স্যরি, জবাব দিতেন তিনি প্রতিবার বাড়তে থাকা গর্বের সাথে, বলার অনুমতি পাইনি।

পরের ধাপটা কম কষ্টের নয়। অসম্ভবটাই যে বাস্তব তা প্রমাণ করা। আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে ধরা যাক কেউ চর্চা শুরু করতে চাচ্ছে; ব্যাপারটা অকুল সমুদ্রে পড়ার মতো তার জন্য, যে জানে না কোত্থেকে শুরু করতে হবে। একটা কথা ঠিক, প্রচণ্ড এক শক্তির ধাক্কা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। এ দিনটার সাথে রন্টগেনের এক্স রে আবিষ্কার করার পরের দিনের তুলনা চলে। তিনি সে সময়কার ফিজিক্স জার্নালগুলো চষে ফেলছিলেন এ বিষয়ে একটু তথ্যের আশায়। এমন কোনো তথ্যের আশায় যেটা পদার্থবিজ্ঞানের সাময়িকীগুলোতে পাওয়া গেছে ঠিকই; বেশ কয়েক বছর পর।

তবু বিজ্ঞানের এই গঙ্গাস্নানের যুগে আশা করা যায় বিশাল তথ্য-মহাসাগরের কোনো না কোনো এলাকায় এমন কিছুর হদিস পাওয়া যাবে। খুব সাবধানে ড. ক্রুগার এমন একটা প্রোগ্রাম করলেন যেটা সার্চের সময় তার আশার তথ্য পেলে তো নিবেই এমনকি কাছাকাছি কিছু পেলেও যাচাই বাছাই করে নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে প্রোগ্রামটার কাজ একটু সহজ হয়েছে কারণ পৃথিবী সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক সব ব্যাপারই সে বাদ দেবে। নিশ্চই কোটি কোটি…। আর সার্চের কাজ চলবে অপার্থিব সব ব্যাপার নিয়ে।

ড. ক্রুগারের হাজার সুবিধার একটা হল: তিনি কম্পিউটারে অসীম বাজেট পেয়ে থাকেন। বিনিময়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানকেই তাঁর প্রজ্ঞা কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেন। এই সার্চে দেদার খরচ হচ্ছে, হোক না, বিল নিয়ে কারো কোনো বিকার নেই।

কাজ শেষ হবার পর বেশ অবাক হতে হল ড. ক্রুগারকে। তিনি বেশ ভাগ্যবান, মাত্র দু ঘণ্টা সাতাশ মিনিটে কেল্লা ফতে। একুশ হাজার চারশো ছাপ্পান্নতম রেফারেন্সেই কাজ হয়ে গেল।

টাইটেলটাই যথেষ্ট। পল এতো উত্তেজিত ছিলেন যে তার এক্কেবারে নিজস্ব কমসেক তার ভয়েস কমান্ডকে অগ্রাহ্য করে বসেছে! ভাল প্রিন্ট আউটের জন্য আরো একবার বলতে হল।

উনিশশো একাশিতে ন্যাচার পত্রিকায় রিপোর্টটা এসেছিল। তার জন্মেরও পাঁচ বছর আগে। এবার মাত্র পৃষ্ঠাখানেক রিপোর্টে চোখ বুলিয়েই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তার ভ্রাতুস্পুত্র শুধু ঠিক কথাই বলেনি বরং এমন কোনো আবিষ্কার করে বসেছে যাকে এক কথায় অলৌকিক বলা চলে।

ঐ আশি বছরের বুড়ো পত্রিকার সম্পাদককে বেশ রসিক বলা চলে। এই পেপারটা আউটার প্ল্যানেটগুলোর কোরের গঠন নিয়ে আলোচনা করেছে বিস্তর। কিন্তু সেকালের পত্রিকা হিসেবে টাইটেলটা তেমন ভয়াল ছিল না। বরং এক কালে একটা বিখ্যাত গানের অংশ ছিল কথাগুলো।

যাই হোক, পল ক্রুগার কখনো বিটল বা তাদের উন্মাতাল চমকের কথা বিন্দুমাত্র জানতেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *