আলাভান্ডার হত্যা মামলা ১৯৫২

আলাভান্ডার হত্যা মামলা ১৯৫২

১৯৫২ সাল। সবেমাত্র পাঁচবছর হল ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। সদ্যোজাত দেশটিতে ধীরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে শিল্প, কৃষি। পোক্ত হচ্ছে অর্থনীতি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অভ্যাস থেকে তখনো মুক্ত হতে পারেনি দেশের মানুষ।

ঠিক এমনই এক সময়ে ১৯৫২ সালের ২৯শে আগস্ট দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ শহরের দুই প্রান্তে ঘটল দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

ঘটনা এক। ইনস্পেক্টর রমন্থ আয়ার মাদ্রাজ থানায় তাঁর চেয়ারে বসে কিছু রুটিন ফাইলে সই করছিলেন। অলস দুপুর। থানায় তেমন কাজের চাপ নেই। সইসাবুদপর্ব মিটে গেলে ইনস্পেক্টর আয়ার ভাবছিলেন, একবার রাউন্ড দিয়ে আসবেন বাইরে।

এমনসময় হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকলেন এক মহিলা। বয়স আন্দাজ সাঁইত্রিশ, আটত্রিশ। বেশভূষা দেখে বোঝা যায়, বিবাহিতা হিন্দু রমণী। উদ্ভ্রান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘স্যার! আমার স্বামী দু-দিন হয়ে গেল বাড়ি ফেরেননি!’

ইনস্পেক্টর আয়ার জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। বললেন, ‘বসুন। আপনি কোথায় থাকেন? কী নাম আপনার স্বামীর? কী করেন উনি?’

মহিলা কম্পিতস্বরে বললেন, ‘স্যার, আমার স্বামীর নাম চেট্টি আলাভান্ডার। চীনা বাজারে জেম অ্যান্ড কোম্পানির যে বড় দোকানটা আছে, উনি তার সামনে বসে প্লাস্টিকের টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করেন। আমরা থাকি জর্জ টাঊনে, নাট্টু পিলাইয়ার কোইল স্ট্রিটে।’

জেম অ্যান্ড কোম্পানি দেশের অন্যতম বড় পেনের কোম্পানি। তারা নিজেরা তো পেন তৈরি করেই, বিদেশের নামীদামি সব ফাউন্টেন পেনেরও ডিলার তারাই।

ইনস্পেক্টর আয়ার বললেন, ‘শেষ কবে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন?’

‘পরশুদিন দুপুরে।’ শ্রীমতী আলাভান্ডারের চোখ ছলছল করে উঠল, ‘তারপর থেকে কোনো খবর নেই। আমি কাল জেম অ্যান্ড কোম্পানিতে গিয়েছিলাম। ওঁরা কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। তাই আজ এলাম।’

‘আপনার কী মনে হয়, উনি কোথায় যেতে পারেন?’

শ্রীমতী আলাভান্ডার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর হঠাৎ জোরে ফুঁপিয়ে উঠলেন, ‘জেম কোম্পানির কাউন্টারে গণেশ বসে। সে বলল, ওঁকে ওই দেবকী ডাইনিই পরশুদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিল স্যার!’

‘দেবকী ডাইনি? সে আবার কে?’

মহিলা এবার জোরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘অসভ্য একটা মেয়েছেলে স্যার। কেরালায় আদি বাড়ি, এখানে থাকে রোয়াপুরমে। আমার স্বামীকে ফুঁসলে আমার থেকে কেড়ে নেওয়াই ওর একমাত্র লক্ষ্য। কলেজে পড়া মেয়েরা যেমন নষ্ট হয় আর কি।’

পাঁচের দশক। কলেজপড়ুয়া শিক্ষিতা তরুণীরা তখন রক্ষণশীল সমাজের কাছে নষ্ট। ইনস্পেক্টর আয়ার দ্রুত একজন কনস্টেবলকে পাঠালেন রোয়াপুরমে।

বাড়ির ঠিকানা ৬২, সিমেটারি রোড, রোয়াপুরম, মাদ্রাজ। ছিমছাম একতলা বাড়ি। কিন্তু সদরদরজায় তালা। আশপাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বাইশ বছরের দেবকী আর তার স্বামী প্রভাকর ভাড়া থাকে এই বাড়িতে। তারা নববিবাহিত যুগল। সঙ্গে থাকে একজন বালক ভৃত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউই নেই।

কনস্টেবলটি সাইকেলে চড়ে গিয়েছিল। আরও কিছু লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং দেবকী বা প্রভাকর ফিরলেই থানায় খবর দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে সাইকেলের মুখ ঘোরাল থানার দিকে।

রোয়াপুরম সমুদ্রের তীরেরই এক অঞ্চল। দেবকীদের বাড়ি থেকে সমুদ্র ঢিল ছোঁড়া দূরত্ব। ফেরার পথে কনস্টেবলের হঠাৎ চোখ গেল সমুদ্রের দিকে। দেখল, একটা বড় বস্তু ঢেউয়ের তালের সঙ্গে এগিয়ে এসে পাড়ে ধাক্কা মারছে, আবার স্রোতের সঙ্গে চলে যাচ্ছে দূরে।

তার বেশ কৌতূহল হল। সাইকেল থামিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, একটা খয়েরি রঙের শার্টে জড়ানো গোলাকার কিছু। অনেকটা কুমড়োর মতো আকার। সেটাই বারবার তীরে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে।

কনস্টেবলটি জিনিষটা তুলে শার্টের মোড়কটা খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। একটা আস্ত মানুষের মাথা। গলার কাছটা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, দু-একদিন আগে কেউ সমুদ্রের বালির চরে পুঁতে দিয়েছিল, ঢেউয়ের স্রোত এসে খুঁড়ে বের করে ফেলেছে।

কনস্টেবলটি অসীম সাহসী, ওই অবস্থাতেও সে টাল খেল না, শার্টে আবার সাবধানে মুণ্ডুটা জড়িয়ে নিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল। তীরবেগে যেতে লাগল থানার দিকে।

ঘটনা দুই। ওই একইদিনে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ইন্দো-সিলন বোট মেল কু ঝিকঝিক করতে করতে এসে দাঁড়িয়েছে মানামাদুরাই স্টেশনে।

আগের দিন রাত আটটায় সেই ইন্দো-সিলন বোট মেল যাত্রা শুরু করেছে মাদ্রাজের এগমোর স্টেশন থেকে। সিলন অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা। তখন প্রচুর মানুষ কর্মসূত্রে নিয়মিত দক্ষিণ ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা যাতায়াত করতেন। ইন্দো-সিলন বোট মেলে করে মাদ্রাজের এগমোর স্টেশন থেকে তাঁরা যেতেন ধানুশকোডি। সেখান থেকে স্টিমারে করে সাগর পার হয়ে শ্রীলঙ্কার তালাইমান্নার। গোটা যাত্রাপথে সময় লাগত বাইশ ঘণ্টারও বেশি।

মানামাদুরাই থেকে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় উঠলেন একজন টিকিট পরীক্ষক। তাঁর সেদিনের মতো ডিউটি শেষ, ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরছেন।

কামরায় এসে সিটে বসতেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মারল। কৌতূহলী চোখে চারদিক দেখতে যেতেই উলটোদিকের সিটের লোকটা বলল, ‘আপনার সিটের নীচে যে বাক্সটা, সেইখান থেকে গন্ধটা আসছে স্যার। আমরা ভাবছিলাম বড় কোনো স্টেশন এলে খবর দেব, তা আপনি তো রেলেরই লোক, একটু দেখুন না! টেকা যাচ্ছে না। কেউ মরা বিড়াল রেখে গিয়েছে কিনা কে জানে?’

‘মরা বিড়াল?’ চমকে উঠলেন টিকিট পরীক্ষক।

অন্য আরেকজন বলল, ‘বিড়াল কি কুকুরই হবে। দেখুন না, বাক্সের গায়ে কেমন রক্তের ছোপ!’

টিকিট পরীক্ষক নীচু হয়ে দেখলেন, সত্যিই তো। সবুজ রঙের একটা পেল্লাই আকারের স্টিলের ট্রাঙ্ক। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে। আরও ভালো করে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। বাক্সের গায়েই শুধু রক্তের ছোপ নয়, নীচ দিয়ে সরু হয়ে বেরিয়ে আসছে রক্তের ধারা।

 ট্রেন তখনও ছাড়েনি। তিনি তড়িঘড়ি নেমে গিয়ে ডেকে আনলেন স্টেশন মাস্টারকে। খবর পেয়ে উপস্থিত হল স্টেশনে কর্তব্যরত পুলিশও। কামরা ভরতি লোকের সামনে সেই বাক্স খোলা হতেই সবাই আতঙ্কে চমকে উঠল।

একি বীভৎস দৃশ্য!

ট্রাঙ্কের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে ঢোকানো রয়েছে একটা আস্ত মৃতদেহ। না, ভুল হল। আস্ত নয়। মৃতদেহটার ধড় মাত্র, মুণ্ডু নেই। লাশটা সম্পূর্ণ উলঙ্গ, শুধুমাত্র পায়ে একজোড়া সবুজ মোজা। জায়গায় জায়গায় একাধিক ক্ষত, পচতেও শুরু করেছে। উৎকট গন্ধে সবার গলা দিয়ে খাবার উঠে আসার জোগাড়!

শোরগোল পড়ার আগেই পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে ট্রাঙ্কটাকে স্টেশনে নামিয়ে ফেলল। ইন্দো সিলন বোট মেলের ওই কামরাটিকেও সিজ করা হল। মানামাদুরাই তখন রামনাদ জেলা। জেলার সদর হল মাদুরাই। লাশ অবিলম্বে চলে গেল মাদুরাইয়ের এরস্কিন হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল এখন মাদুরাই মেডিকেল কলেজ।

এরস্কিন হাসপাতালের প্রধান রেডিওলজিস্ট ড. কৃষ্ণস্বামী মস্তকহীন লাশটার অটোপসি করলেন। করে রায় দিলেন, এটি পঁচিশ বছর বয়স্ক কোনো যুবকের লাশ। লাশের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ চর্মছেদিত, অতএব এটি কোনো মুসলিম যুবকের লাশ।

মনে রাখতে হবে সময়টা পঞ্চাশের দশক। ডাক্তারি যন্ত্রপাতি থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা কোনো কিছুই অত আধুনিক নয়। তাই অটোপসির ফলাফলও নির্ভুল হল না।

লাশটির বয়স পঁচিশ বছর নয়, বিয়াল্লিশ বছর। সঠিক ফলাফল এল, কিন্তু তা দ্বিতীয়বার অটোপসি করার পর। লাশ মাদুরাই থেকে মাদ্রাজ আসার পর মুণ্ডু এবং লাশের একসঙ্গে অটোপসি করলেন মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. গোপালকৃষ্ণ। তিনি জানালেন, চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে বয়স এই পুরুষটির। খুব ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে, এবং তাতে সারভিকাল ভারটিব্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুণ্ডু এবং লাশের হাড়ের গঠন দেখে নির্ভুল বলা যায়, যে এই দুটি একই ব্যক্তির।

এরমধ্যে সারা শহরে এই ভয়ংকর কাণ্ডে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। শ্রীমতী আলাভান্ডার এসে লাশ দেখে জ্ঞান হারালেন। তারপর ধাতস্থ হয়ে শনাক্ত করলেন, হ্যাঁ। এই লাশটি তাঁর স্বামীরই বটে।

কে এই আলাভান্ডার? কেন তাকে এমন নৃশংসভাবে খুন হতে হল?

জানতে হলে চলে যেতে হবে আরও কয়েকবছর পেছনে।

দক্ষিণ ভারতের তেলেগুভাষী হিন্দুদের মধ্যে নানা জাত রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল বৈশ্য সম্প্রদায় কোমতি চেট্টি। এই কোমতি চেট্টিরা সাধারণত প্রত্যেকেই বেশ ধনী ও অর্থবান ব্যবসায়ী। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের কাহিনীর অন্যতম মূল চরিত্র আলাভান্ডার সেই সম্প্রদায়ের একজন হয়েও ধনী ছিল না। প্রথম জীবনে সে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ফৌজের একজন সিপাই ছিল। পোস্টেড ছিল আভাদি হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু স্বাধীনতার পর সে পড়ল বিপাকে।

আগেই বলা হয়েছে, মাদ্রাজের চীনা বাজারের জেম অ্যান্ড কোম্পানি ছিল অন্যতম বড় পেনের কারখানা কাম দোকান। সেই দোকান আজও আছে।

জেম অ্যান্ড কোম্পানির মালিক কুন্নান চেট্টি মাদ্রাজের প্রথম সারির একজন ব্যবসায়ী এবং জাতিগতভাবে কোমতি চেট্টি বৈশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত।

আলাভান্ডারের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই চেনাশোনা ছিল। এই দুর্দিনে আলাভান্ডার তাঁর পায়ে গিয়ে স্রেফ কেঁদে পড়ল।

‘কিছু একটা সুরাহা করে দিন আমার। নাহলে বউ বাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরব কুন্নান সাহেব! আপনার দোকানে যাহোক তাহোক একটা কাজ দিন আমায়।’

জ্ঞাতি বলে কথা, কুন্নান চেট্টি বিচলিত হলেন। কিন্তু নিজের দোকানে আলাভান্ডারকে ঢোকাতে রাজি হলেন না।

তার একটা কারণ ছিল।

আলাভান্ডারের ছিল প্রচণ্ড পরিমাণে মহিলা আসক্তি। সেনাবাহিনীতে থাকার সময়েই তার এই বিশেষ গুণের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। বাড়িতে খাবার থাক না থাক, সে নিজে সবসময় এমন ফিটফাট থাকত, এমন ঝকঝকে পোশাকে সেজে থাকত, যে মনে হত বুঝি সে দারুণ ধনী একজন কেউ। এছাড়াও নেশা করার মতো কুপ্রবৃত্তিও তার ছিল। সে নিয়মিত ওপিয়াম মাদক সেবন করত। সব দেখেশুনেই বোধ হয় কুন্নান চেট্টি নিজের দোকানে আলাভান্ডারকে জায়গা দিলেন না। তবে, দোকানের সামনেই একটা ছোট পরিসরে প্লাস্টিকের নানা জিনিস নিয়ে বসার অনুমতি দিলেন।

আলাভান্ডার সেখানেই শুরু করল তার ব্যবসা। প্লাস্টিকের দ্রব্যের সঙ্গে জেম অ্যান্ড কোম্পানির থেকে পাইকারি দরে কেনা পেনও বিক্রি করতে লাগল। আর সেই পেনের জালেই টেনে আনতে লাগল শহরের সুন্দরী মেয়েদের। মেয়েরা পেন কিনতে আসত, দোকানের সামনে বসে থাকা আলাভান্ডার শিকারি মাছের মতোই অপেক্ষা করত তাদের জন্য।

সেইসময়ে বিদেশি নামী কোম্পানির ফাউন্টেন পেন সংগ্রহে থাকাটা রীতিমতো আভিজাত্যের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হত। আলাভান্ডার সেইসব পেন কম দামে জেম অ্যান্ড কোম্পানির থেকে কিনে বিক্রির বদলে উপহার দিতে লাগল নিজের মহিলা ক্রেতাদের। মেয়েরা তো এমন উপহার পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেত। তারপর ধীরে ধীরে কথার জালে তাদের ফাঁসিয়ে আলাভান্ডার নিয়ে গিয়ে তুলত ব্রডওয়ের এক হোটেলে। ঘনঘন নতুন নতুন শারীরিক সম্পর্ক না করলে যেন সে কিছুতেই থাকতে পারতনা।

এই নিয়ে সে রীতিমতো কলার তুলত বন্ধুমহলে। গর্ব করে বলত, ‘আমি কমসে কম চারশো মেয়ের সাথে শুয়েছি! হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান কিস্যু বাদ দিইনি। আমি হলাম গিয়ে খাঁটি সেকুলার, বুঝলি! হা হা!’

নিজের যৌনলিপ্সায় সে এমন মশগুল ছিল, কোনো এক হাতুড়ে চিকিৎসকের পরামর্শে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের চর্মছেদেও পিছপা হয়নি। তাতে নাকি যৌনশক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। যদিও তা ভুল কথা।

কিন্তু এইজন্যই পুলিশ প্রথমে লাশটি কোনো মুসলমানের বলে ভুল করেছিল।

ওই একই লোভে নানারকমের মাদকও সে নিত নিয়মিত। তার বউ যে স্বামীর কীর্তির কথা জানত না তা নয়, কিন্তু সন্তানদের মুখ চেয়েই হয়তো স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা সে কখনো ভাবেনি।

খুন হওয়ার প্রায় একবছর আগে তার সঙ্গে পরিচয় হল দেবকীর। ১৯৫১ সালের গোড়ার কথা। দেবকী তখন বাইশ বছরের ঝকঝকে এক তরুণী। সদ্য কলেজ পাশ করে বেরিয়ে সে বেশ কিছু টিউশনি করে, সঙ্গে নানারকম সমাজকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে। বাবা-মা ও পরিবারকে নিয়ে সে থাকে আদম সাহিব স্ট্রিটে। একদিন জেম অ্যান্ড কোম্পানিতে পেন কিনতে এসে স্মার্ট, সপ্রতিভ, সুদর্শন আলাভান্ডারের সঙ্গে আলাপ হয়ে সে মুগ্ধ হয়ে গেল।

প্রথম যৌবনে মানুষ এমনিতেই বেশি সংবেদনশীল থাকে। দেবকীরও মুগ্ধতা প্রেমে উত্তীর্ণ হতে বেশি সময় নিল না। হোক তার চেয়ে বয়স একটু বেশি, তো কি! এত গুণী সপ্রতিভ একজন অবিবাহিত পুরুষ তার পাণিপ্রার্থী, এ তার সৌভাগ্য ছাড়া আর কি?

আলাভান্ডার যখনই বুঝল, এই শিকারও টোপ গিলেছে, ধরা দিয়েছে প্রেমের বাঁধনে, সে লাটাইয়ের সুতো আস্তে আস্তে ছাড়তে লাগল। প্রথমে প্রেমের অভিনয়, টুকটাক ঘুরতে যাওয়া, তারপর একদিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেবকীকে নিয়ে গিয়ে হাজির হল জর্জ টাউনের এক হোটেলে।

দেবকীর কৌমার্য গেল। জীবনের প্রথম প্রেমের কাছে বৃষ্টিস্নাত পাখির মতোই নিজেকে উজাড় করে দিল সে। আঁকড়ে ধরতে চাইল তার প্রাণাধিক প্রিয় প্রেমিককে।

কিন্তু আলাভান্ডারের কাছে তো সে অন্যান্য সব মেয়ের মতো ভোগ্যবস্তু ছাড়া কিছুই নয়। দেবকী যেমন আছে থাকুক, আলাভান্ডার তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় অন্য মেয়েদের সঙ্গেও প্রেম চালিয়ে যেতে লাগল।

এইভাবে কতদিন চলত কে জানে, একদিন সব ফাঁস হয়ে গেল। দেবকী সামাজিক নানা প্রকল্পের সূচি মাদ্রাজের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিত। এইভাবেই একদিন সে কাকতালীয়ভাবে গিয়ে পৌঁছল আলাভান্ডারের বাড়ি।

দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই হোক না কেন, সেইসময় আলাভান্ডার তার স্ত্রী-সন্তান সহযোগে বৈঠকখানাতেই বসে ছিল। দেবকীকে দেখে সে চমকে উঠল। তারপরেই না চিনতে পারার ভান করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। সংসার হারালে তার চলবে না, তার স্ত্রী ধনীর একমাত্র কন্যা, স্ত্রীর মৃত্যুর পর সে-ই হবে সব সম্পত্তির মালিক।

দেবকীও অবাক। এটা কি আলাভান্ডারের বাড়ি? এই বিবাহিতা মহিলাটি কে? ওর দিদি বা বোন? আর ওই যে দুটো বাচ্চা? ওর বোনের ছেলেমেয়ে? কিন্তু আলাভান্ডার ওকে দেখে না চেনার ভান করছে কেন?

কিছু বলার আগেই আলাভান্ডারের স্ত্রী এগিয়ে এসেছে। নিয়মমাফিক বাড়িতে কে কে আছেন, তাঁদের বয়স, ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করার কথা দেবকীর। তার হাতের কাগজপত্র দেখে আলাভান্ডারের স্ত্রী অনুমান করতে পেরে নিজে থেকেই বলতে শুরু করে।

‘আমরা চারজন থাকি বাড়িতে। আমি, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়ে।’

দেবকী লিখতে লিখতে টের পায়, ওর হাত কাঁপছে। ও যেন তলিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অন্ধকার চৌবাচ্চার অতল গভীরে। বন্ধ হয়ে আসছে নিশ্বাস। ডুবতে ডুবতে ক্ষীণ এক আশার আলো দেখার প্রত্যাশায় সে জিজ্ঞাসা করে, ‘আ-আপনার স্বামী? তিনি কি বাইরে?’

‘ওমা বাইরে থাকবেন কেন?’ মহিলা মিষ্টি করে হাসে। তারপর আলাভান্ডারকে দেখিয়ে বলে, ‘এই তো!’

দেবকী সেদিন জ্বোরো রুগীর মতো টলতে টলতে বাড়ি ফিরল। ফিরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। বাড়িতে ওর বিয়ের জন্য কয়েকদিন ধরেই কথাবার্তা চলছে, ও ঠিক করেই রেখেছিল এই সপ্তাহেই আলাভান্ডারের কথা বাড়িতে জানাবে।

মানুষ এত বড় প্রতারক হয়? দিনের পর দিন আলাভান্ডার ওকে মিথ্যা কথা বলে ওর মন নিয়ে, শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে?

মা বললেন, ‘কীরে? কাঁদছিস কেন?’

‘কিছু হয়নি মা।’

‘আজ বিকেলে ওরা দেখতে আসবে তোকে। তাড়াতাড়ি স্নান করে নে। ভালো করে সাজিয়ে দেব তোকে।’

দেবকী কোনো কথা না বলে মা’কে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে লাগল হাপুসনয়নে।

মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন, ‘ওই দ্যাখো। বোকা মেয়ে। ওরে বাবা, তোকে ছেড়ে আমরাই কি ভালো থাকব? ওইজন্যই তো কাছেপিঠে ঠিক করলাম মা। প্রভাকর খুব ভালো ছেলে।’

দেবকী ভেঙে পড়লেও প্রচণ্ড মনের জোরে নিজেকে সামলে নিল। বাড়ি থেকে ঠিক করা সম্বন্ধে সম্মতি দিয়ে ১৯৫১ সালের শেষদিকে বিয়ে করে ফেলল প্রভাকর মেননকে।

প্রভাকর মেনন বছর সাতাশ আঠাশের যুবক। একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সে কেরাণীর কাজ করত। অবসরে ভালোবাসত লেখালেখি করতে। দেবকীর সঙ্গে বিয়ে পাকা হওয়ার পরই ভাগ্যক্রমে ‘ফ্রিডম’ নামক এক নামী সংবাদপত্রে সে এডিটরের চাকরি পেয়ে গেল। নিজের মনোমতো চাকরি পেয়ে সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

‘তুমি আমার জীবনের লক্ষ্মী দেবকী।’

‘ধুর! কী যে বলো!’

‘সত্যি বলছি। তুমি জানো, কবে থেকে আমি এই চাকরিটা চাইছিলাম! ইনস্যুরেন্সে কাজ করতে একটুও ভালো লাগতনা, তবু পেটের দায়ে করতে হত। তুমি আমার জীবনে আসার পরই দেখো সবকিছু কেমন ভালো হচ্ছে। ফ্রিডমের মতো পেপারে এডিটর পোষ্ট, ভাবা যায়!’

দেবকী চুপ করে থাকে। ভাবে দুজন মানুষ, কত আলাদা! আলাভান্ডারের মতো শরীরসর্বস্ব পুরুষ তার জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। অথচ বিয়ের পর থেকে প্রভাকর পরম যত্নে আগলে রেখেছে তাকে। শুধু ভালোবাসা নয়, সাংসারিক দায়দায়িত্বও সে সমানভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছে।

রোয়াপুরমের সিমেটারি রোডে ইউসুফ মহম্মদ নামক এক ভদ্রলোকের ফাঁকা বাড়ি পড়েছিল, বিয়ের পরই প্রভাকর সস্ত্রীক সেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। নির্ঝঞ্ঝাট তাদের সংসার। সকালে খেয়েদেয়ে প্রভাকর অফিস বেরিয়ে যায়, দেবকী রান্নাবান্না সেরে যায় কয়েকটা বাচ্চাকে হিন্দি পড়াতে। সন্ধ্যেবেলা প্রভাকর ফিরে এলে দুজনে ছোট্ট একচিলতে বারান্দায় বসে চা খায়, তারপর হাতে হাতে রাতের রান্নাবান্না সেরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

ছোট অথচ স্বস্তির জীবন। দেবকী বই পড়তে ভালোবাসে, প্রভাকর মাঝেমধ্যেই তার জন্য কিনে আনে নতুন কোনো ভালো বই। কিংবা কোনো সন্ধ্যায় দুজনে সিনেমা দেখতে যায়। অথবা কখনো গিয়ে বসে থাকে সমুদ্রতীরে।

এভাবেই চলছিল। তাল কাটল একদিন দুপুরে।

দেবকী সেদিন টিউশন সেরে ফিরে শুয়েছিল। সকাল থেকে গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে, মুখে কিছু দিতে ইচ্ছে করছেনা। অলস ক্লান্ত শরীরে চুপচাপ শুয়ে ছিল ঘরে।

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ।

এই অসময়ে কে এল? বিস্মিত দেবকী উঠে বসল। এখন তো কারুর আসার কথা নেই। প্রভাকর ফিরবে সেই সন্ধ্যাবেলায়।

শঙ্কিত চিত্তে দরজা খুলতেই ও ভয়ে আতঙ্কে কেঁপে উঠল। উল্কার গতিতে বন্ধ করতে গেল দরজার পাল্লা। কিন্তু পারল না। ওকে ধাক্কা মেরে ততক্ষণে নির্জন দুপুরে ঘরে ঢুকে এসেছে আলাভান্ডার!

‘তুমি?’ চিৎকার করে উঠল দেবকী, ‘ তুমি এখানে কেন? বেরোও শিগগীর, আমি … আমি কিন্তু চেঁচাব!’

আলাভান্ডার কর্কশ হাতে চেপে ধরল দেবকীর মুখ, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হিসহিসে গলায় বলল, ‘চুপ! একদম চুপ! জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব টুঁ শব্দ করলে!’

দেবকী তবু চেঁচাতে গেল। কিন্তু পারলনা। আলাভান্ডারের হাতের পাঞ্জার চাপে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। দু-চোখ দিয়ে জল গড়াতে গড়াতে ও টের পাচ্ছিল, আলাভান্ডার নির্দয়ভাবে ছিঁড়ে ফেলছে ওর পরনের পোশাক। কামুক জন্তুর মতো লালসায় আঁচড়াচ্ছে কামড়াচ্ছে তাকে।

মিনিট পনেরো পর আলাভান্ডার বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেল, ‘মাঝেমাঝেই আসব। কোনো পাঁয়তারা করলে তোর বরের কাছে খবর চলে যাবে বিয়ের আগে তোর নষ্টামির কথা! চললাম।’

দেবকী কাঁদতে কাঁদতে উঠে বসল। শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও মানসিক বেদনায় সে শেষ হয়ে যেতে লাগল। একদিকে তার মনের কোণে তখনও বোধহয় প্রথম প্রেমের কিছুটা অনুভূতি জেগে ছিল। প্রভাকর তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও তার মনে তখনও হয়তো কোথাও আলাভান্ডার ছিল। তাই সেই অনুভূতির দৌর্বল্যে সে চাইলেও বাধা দিতে পারল না।

একি গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পড়ল সে!

সেই শুরু। এরপর মাসে একবার কি দু-বার হানা দিতে লাগল আলাভান্ডার। মাসছয়েক হল, তার ব্যবসাপত্তর তলানিতে এসে ঠেকেছে। মহিলা ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করার জন্য পেন আর শাড়ি উপহার দিয়ে দিয়ে সে একদিকে ফতুর, অন্যদিকে জেম কোম্পানিও তাকে আর ধারে পেন দিতে রাজি নয়। সব মিলিয়ে তার এখন শনির দশা। কিন্তু শরীরের খিদে যে কথা শোনেনা। নিজের স্ত্রীও কাছে ঘেঁসতে দেয়না, চারদিকে আলাভান্ডারের চরিত্র নিয়ে অপবাদ।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে সে সদ্যবিবাহিতা দেবকীর দিকে হাত বাড়িয়েছে।

প্রথম প্রথম দেবকী বাধা দিত, তারপরেই প্রভাকরকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকিতে চুপ করে যেত। তারপর এমন হল, দেবকী এটাকে ভবিতব্য বলে মেনে নিল। নিজের একসময়ের কৃতকর্মের খেসারত হিসাবে সহ্য করতে লাগল আলাভান্ডারের অত্যাচার। শুধুমাত্র নিজের সুন্দর সংসারটা ছারখার না হয়ে যাওয়ার ভয়ে।

কিন্তু একদিন তাল কাটল।

সেদিন প্রভাকরের অফিস আগেভাগে ছুটি হয়ে গেল, বিকেল হতে না হতেই সে ফিরে এল বাড়িতে। বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লে বেশ কিছুক্ষণ পর ভীতসন্ত্রস্ত মুখে দরজা খুলল দেবকী।

স্বামীকে দেখে তার মুখটা পার্চমেন্ট কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

‘তু-তুমি!’

‘হ্যাঁ।’ প্রশান্ত মুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রভাকর বলল, ‘অফিসে আজ ছুটি হয়ে গেল। মিনার্ভায় একটা দারুণ ভালো সিনেমা এসেছে। হিন্দি। তোমার সেই প্রিয় নায়ক, রাজ কাপুর। দুটো ইভনিং শোয়ের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম।’ বলতে বলতে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আলাভান্ডারের দিকে চোখ পড়তে তার ভ্রূ কুঁচকে গেল।

স্ত্রীর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই দেবকী আড়ষ্টগলায় বলল, ‘ইনি মি. আলাভান্ডার। চীনা বাজারে ওঁর ব্যবসা আছে। আগে ওই দোকানে পেন কিনতে যেতাম, সেই থেকে পরিচয়।’

প্রভাকর কিছুই বুঝতে পারলনা। চীনা বাজারের একজন ব্যবসাদার এই নির্জন দুপুরে তার বাড়িতে কী করছে?

আলাভান্ডার তখন শোবার ঘর থেকে সবেমাত্র পোশাক আশাক ঠিক করে এসে ড্রয়িং রুমের চেয়ারে বসেছে, তার বিস্রস্ত বসন তখনো স্পষ্ট।

দেবকীর কাছে আসার সময় সে নেশা করেই আসে, সেইজন্য কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে ইতস্তত। চটুল জড়ানো গলায় সে বলল, ‘আইয়ে মেনন সাহাব, আইয়ে! এই দেবকী, ওঁকে ঠান্ডা শরবৎ পিলাও।’

কথাটা বলতে বলতে আলাভান্ডার দেবকীর কাঁধে হাত রাখল। দেবকী অস্থির হয়ে সেই হাত নামিয়ে দিতে যেতে সে আবার ধমকে উঠল, ‘আহ, কী হল জানেমন?’

প্রভাকরের মাথা রাগে দাউদাউ করে জ্বলছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে ও নিজেকে সংযত করে রাখল। হাজার হোক, দেবকী তার বিবাহিত স্ত্রী, বাইরের লোকের সামনে তাকে জেরা করা মানে নিজেদের বৈবাহিক সম্পর্ককেই অপমান করা।

আলাভান্ডার নিজের মনে আবোলতাবোল বকে যাচ্ছিল। প্রভাকর বেডরুমে চলে গেল। হিম চোখে দেখল, বিছানার চাদর এলোমেলো, বালিশ দোমড়ানো মোচড়ানো।

প্রচণ্ড রাগেও তার চোখে হঠাৎ হু হু করে জল চলে এল। সে ছোট থেকে অনেক সংগ্রাম করে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। শৈশবেই বাবা-মা মারা যাওয়ায় অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে আশ্রমের হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশুনো করেছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারপর দেবকীকে নিয়ে শুরু করেছে নতুন জীবন।

ভেবেছিল, এতদিনের সব অন্ধকার তার জীবন থেকে মুছে গিয়েছে। এখন তার জীবনে শুধুই উজ্জ্বল আলো। দেবকীকে আঁকড়ে ধরে তাই প্রথম পাওয়া পরিবারের স্বাদ নিচ্ছিল সে প্রাণভরে।

কিন্তু এসব কী! যাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে, সে-ই কিনা এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করল?

মানসিক চাপে শরীর জুড়ে ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু চেষ্টা করেও ওই বিছানায় প্রভাকর শুতে পারল না। বাইরের একফালি বারান্দায় একটা তক্তপোষ পাতা ছিল, সেখানেই গিয়ে শুয়ে পড়ল।

আলাভান্ডার চলে যাওয়ার পরে দেবকী কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। আত্মগ্লানিতে, অনুশোচনার তীব্র কষাঘাতে তার ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল।

প্রভাকরের মতো এত ভালো একজন স্বামী পেয়েও সে তাকে রাখতে পারল না। একটা প্রতারক লম্পটের জন্য তার সংসারটা শেষ হয়ে গেল।

কতক্ষণ থম মেরে একভাবে বসেছিল জানেনা, হঠাৎ কাঁধে কারুর হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে তাকাল।

প্রভাকর।

দেবকী কেঁপে উঠল। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।

কিন্তু প্রভাকর যেন মাঝসমুদ্রের মতোই শান্ত। তার চোখে জল নেই, কিন্তু লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। দেবকীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে শান্তস্বরে বলল, ‘রাজ কাপুরের নতুন ছবি এসেছে মিনার্ভায়। আওয়ারা। টিকিট কেটে এনেছি। চলো দেখে আসি।’

দেবকী থতমত খেয়ে গেল, কিন্তু কিছু বলল না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তৈরি হতে লাগল।

‘আওয়ারা’ এরমধ্যেই ঝড় তুলেছে বক্স অফিসে। সিনেমাহলে অজস্র হাততালি ও সিটির মধ্যে প্রভাকর কয়েকবার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেল। কিন্তু কিছু বলল না।

সিনেমা শেষ হতে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে প্রভাকর একটা রিকশা ধরল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিনেমাহলে যাওয়া, সিনেমা দেখা, এই লম্বা সময়ে দুজনের মধ্যে একবারও কোনো বাক্যবিনিময় হয়নি।

সমুদ্রের কাছাকাছি এসে প্রভাকর রিকশা ছেড়ে দিল। দেবকীকে নিয়ে চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ল বালির ওপর। সামনে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। নোনা হাওয়ায় চুল উড়ছে।

উদাস চোখে সমুদ্রের দিকে দেখতে দেখতে প্রভাকর বলল, ‘ছবিটা কেমন লাগল দেবকী?’

‘ভালো।’ আড়ষ্টগলায় উত্তর দিল দেবকী। পরনের কাপড়টাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল সে।

‘তুমি কি ওই বিজনেসম্যানকে ভালোবাসো, দেবকী?’ হঠাৎ প্রভাকর সোজা তাকাল স্ত্রীর দিকে।

দেবকী মনে হয় শেষ কয়েকঘণ্টা ধরে এই প্রশ্নেরই প্রত্যাশা করছিল। কান্নাভেজা গলায় ও বলল, ‘তুমি … তুমি বিশ্বাস করো প্রভাকর, আলাভান্ডার রোজ আসেনা। তুমি চাইলে জেম কোম্পানির দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারো …।’

‘আমার অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই তো দেবকী।’ কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল প্রভাকর, ‘তুমি আমার স্ত্রী। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। সম্মান করি। সম্মান করি তোমার ইচ্ছাকেও। তাই তুমি খোলাখুলি বলো, তুমি কি ওই লোকটাকে ভালোবাসো? যদি তোমার উত্তর হ্যাঁ হয়, আমি তোমাকে মুক্তি দেব। তুমি ওর সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে।’

বলতে বলতে গলা বুজে এল প্রভাকরের, ‘আমার যত কষ্টই হোক, আমি তোমাকে আটকাব না। কারণ ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায়না।’

‘তুমি ভুল বুঝছ প্রভাকর!’ দেবকী চেঁচিয়ে উঠল, ‘আলাভান্ডার একটা শয়তান! আমি ওকে ঘেন্না করি। ভীষণ ঘেন্না করি।’

‘ঘেন্না করো?’ বিস্মিত হয়ে বলল প্রকাভর, ‘তাহলে সে দুপুরবেলা আমাদের বাড়িতে আসার সাহস পায় কি করে?’

দেবকী ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে ও উপলব্ধি করল, এই ঘটনায় ও প্রভাকরকে নতুন করে চিনছে। ওদের এই কয়েকমাসের দাম্পত্যজীবন যা চেনায়নি, একটা বিপদ যেন উৎঘাটন করে দিয়েছে প্রভাকরের নতুন রূপ।

অন্য কোনো স্বামী হলে শারীরিক বা মানসিক যে কোনোরকম নির্যাতন চালাত ওর ওপর। কিন্তু প্রভাকর যেন অন্য কোনো ধাতুতে গড়া!

প্রভাকর প্রাণপণ নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওর চোখের কোণে চিকচিক করা জল দেবকীর নজর এড়াল না।

এত কষ্টেও দেবকী অনুভব করল, প্রভাকর স্বামীর চেয়েও বেশি ওর বন্ধু। এমন বন্ধু, যাকে নিঃসংকোচে সব খুলে বলা যায়। নির্ভয়ে শোনানো যায় একটা ভুলের জন্য দিনের পর দিন ওর ধর্ষিত হওয়ার কাহিনী।

সব শুনে প্রভাকর স্তব্ধ হয়ে গেল। বলল, ‘এ তো ব্ল্যাকমেল!’

‘তা নয় তো কী?’ ছলছলে চোখে দেবকী বলল, ‘এখন তুমি জেনে গেলে, কিন্তু তাতেও আমি মুক্তি পাব না। আলাভান্ডার আমার কিছু ছবি তুলে রেখেছে প্রভাকর। ওর কথা না শুনলে বলেছে মাদ্রাজের প্রতিটা কোণে ছড়িয়ে দেবে। তুমি বুঝতে পারছ? ওর এই শয়তানির থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা ছাড়া কোনো উপায় নেই প্রভাকর! যে পাপ দু-বছর আগে করেছিলাম, তার প্রায়শ্চিত্ত এভাবেই করতে হবে আমায়।’

প্রভাকর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত স্বামীস্ত্রীর আলোচনা চলল। বাড়িতে সারাক্ষণের কাজকর্মের জন্য থাকত একটা তেরো বছরের ছেলে। নাম নারায়ণন। নারায়ণন মাসকয়েক আগে তার কোয়েম্বাটুরের বাড়ি থেকে মাদ্রাজ পালিয়ে এসেছিল।

নারায়ণন পরে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিল, সেদিন রাতে সে দু-বার বাথরুমে গিয়েছিল। একবার রাত সাড়ে বারোটায়, একবার রাত আড়াইটেয়। দুবারই সে প্রভাকর-দেবকীর শোবার ঘর থেকে নীচু গলায় কথাবার্তা শুনেছে। কী কথাবার্তা, তা বুঝতে না পারলেও কন্ঠস্বরের মধ্যে উত্তেজনা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি।

২৮ শে আগস্ট, ১৯৫২। প্রভাকর সেদিন অফিস গেল না। বেলা বাড়লে স্বামী-স্ত্রী দুজনে একসঙ্গে বেরল বাড়ি থেকে। দেবকী গেল জেম অ্যান্ড কোম্পানিতে। আর প্রভাকর গেল দোকানে।

আলাভান্ডার দেবকীকে দেখে চমকে উঠল। এই নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার পর থেকে মেয়েটা একবারও এখানে আসেনি। আজ হঠাৎ কী মনে করে?

দুপুরবেলা। চীনা পট্টি বেশ ফাঁকা। দেবকী এসে আলাভান্ডারের একদম গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

আলাভান্ডার বেশ অবাক হচ্ছিল মনে মনে। দেবকী আজ বেশ সেজেগুজে এসেছে। গাঢ় বেগুনি রঙের স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে হলুদ রঙের কাঞ্জিভরম। চুল খোলা, সামনের দিকটা ফাঁপিয়ে বাঁধা। নাহ, মনে মনে ও স্বীকার করতে বাধ্য হল, দেবকীকে আজ খুব মোহময়ী লাগছে।

‘কী ব্যাপার?’ মুখে কিছু প্রকাশ না করে আলাভান্ডার জিজ্ঞেস করল, ‘পেন লাগবে?’

দেবকী তার লিপস্টিকরঞ্জিত ঠেঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘নাহ। পেন অনেক আছে। লাগবে তোমাকে। একঘন্টার মধ্যে আমার বাড়ি চলে এসো।’

আলাভান্ডারের বিস্ময়ের পারদ উত্তরোত্তর বাড়ছিল। বিয়ের পর থেকে দেবকীর সঙ্গে সে রীতিমতো জোর করে সম্পর্ক রেখেছে। সেখানে আজ হঠাৎ করে মেয়েটা এত প্রগলভ হয়ে উঠল কেন?

দেবকী আলাভান্ডারের মন বুঝতে পেরেই বোধহয় ঠোঁট উলটোল। বলল, ‘কাল তো সেভাবে কথাই হল না। অসময়ে আমার বর এসে হাজির হয়ে গেল। তাই মনটা ভালো লাগছিল না গো। আজ চলো না। চিন্তা নেই, আমার বর অফিসের কাজে মাদুরাই গেছে। ফিরতে অনেক রাত হবে।’

আলাভান্ডার ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। দেবকীর এমন ব্যবহার ও কোনোদিনও দেখেনি। কিন্তু মনে খটকা লাগলেও ও বেশিক্ষণ ভাবতে পারলনা। একেই কাল দুপুরে সবে অন্তরঙ্গ হতে শুরু করতে না করতেই এসে উপস্থিত হয়েছিল হতচ্ছাড়া দেবকীর বরটা। অতৃপ্ত শরীরে রোজকার মতোই সে নেশা করেছে, মনে মনে ছটফট করেছে শারীরিক খিদে মেটানোর জন্য।

আহ, ঈশ্বর ওর কথা শুনেছেন।

মনে পুলক চেপে রেখে আলাভান্ডার বলে, ‘আচ্ছা, ঘণ্টাখানেক পরে আসছি। তুমি যাও।’

‘দেরি কোরো না কিন্তু!’ দেবকী চোখে একরাশ কামনা নিয়ে বলল, ‘আমি অপেক্ষা করব।’

আলাভান্ডারের ইচ্ছা হল একছুটে ওর সঙ্গে চলে যেতে। অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করল। পেছনে জেম কোম্পানির দারোয়ান গণেশ বসে আছে। ব্যাটা সব কথা গিয়ে আলাভান্ডারের বউকে লাগায়। দেবকীর সঙ্গে আশনাইটাও বাদ দেয়নি। এখন একসঙ্গে গেলে বাড়ি ফিরলেই অশান্তি শুরু হবে। তার চেয়ে একটু পরে যাওয়া ভালো।

দেবকী ফিরে এসে দেখল প্রভাকর আগেই বাড়ি চলে এসেছে। ও জিজ্ঞেস করল, ‘নারায়ণন কোথায়?’

‘ওকে আজ ছুটি দিয়ে দিয়েছি।’ প্রভাকর বলল, ‘কিছু টাকা দিয়ে বললাম, মাদ্রাজে তো নতুন এসেছিস, কত ভালো ভালো দেখার জায়গা, ঘুরে আয়। সন্ধ্যের মধ্যে ফিরলেই হবে।’

দেবকী উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না প্রভাকর। তুমি আজ আলাভান্ডারকে কেন আসতে বললে? আমার আর ভালো লাগছেনা! আমি তো কাল বহুবার তোমার কাছে ক্ষমা চাইলাম বলো!’

‘তুমি কেন ক্ষমা চাইছ দেবকী?’ প্রভাকর বলল, ‘কাল ওই আওয়ারা ছবিটায় দেখলে না, ভাগ্যের দোষে রাজ কাপুরকে চোর হতে হল? সে কি তার দোষ? যে দোষী, ক্ষমা তো তার চাওয়ার কথা!’

আলাভান্ডারকে প্রভাকর মেননের বাড়ি ঢুকতে অনেকে দেখেছিল। বাড়ির লাগোয়া সাইকেলের দোকানের মালিক, দু-জন প্রতিবেশী।

কিন্তু বেরোতে কেউ দেখেনি।

* * *

মেননের বাড়ি তালাবন্ধ দেখার পর কেটে গেছে প্রায় পনেরো দিন। কোনো হদিশ না পেয়ে পুলিশ গিয়ে ধরল নারায়ণন নামক সেই বালক ভৃত্যকে। সে সেয়ানা ছেলে, আগেরদিন রাতেই গন্ডগোলের আঁচ পেয়েছিল। সে সটান বলল, ‘ওরা মনে হয় বোম্বাই চলে গিয়েছে স্যার!’

‘বম্বে?’ ইনস্পেক্টর আয়ার ধমকে ওঠেন, ‘কী করে তোর মনে হল ওরা বোম্বে গেছে?’

নারায়ণন আমতা আমতা করে বলে, ‘সেদিন রাতে দু-বার বম্বে কথাটা শুনেছিলাম যেন। আর তাছাড়া সেখানে দেবকীদিদি’র মামার বাড়ি।’

পুলিশ আর দেরি করল না। সময় খুবই অল্প। ইতিমধ্যে মাদ্রাজ শহর তো বটেই, গোটা দেশে এই আলাদা আলাদাভাবে পাওয়া ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে ঝড় উঠেছে। সংবাদপত্রগুলো মাদ্রাজ পুলিশের সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। উপরমহল থেকেও চাপ আসছে ক্রমাগত। হত্যাকারীরা আরও দূরে পালানোর আগেই ধরতে হবে। দেবকীর বাবা রমন মেননও কিছু তথ্য দিতে পারেননি। এই ছেলেটার কথাই এখন ভরসা।

ইনস্পেক্টর রমন্থ আয়ার সেদিন রাতেই বাঙ্গালোরের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। বাঙ্গালোর পৌঁছে সেখান থেকে উড়ে গেলেন বোম্বাইতে।

নারায়ণন ঠিক তথ্যই দিয়েছিল। প্রভাকর আর দেবকী মাইসোর হয়ে চলে গিয়েছিল বোম্বে। প্রভাকর স্থানীয় একটা কেবল কোম্পানিতে কাজ নিয়েছিল। সব ভুলে শুরু করেছিল নতুন জীবন।

বোম্বে পুলিশের সাহায্য নিয়ে যখন ইনস্পেক্টর আয়ার দেবকীর আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছলেন, তখন সেখানে প্রভাকর একাই ছিল। পুলিশ দেখে চমকে উঠলেও সে পালানোর চেষ্টা করল না, শান্তভাবে ধরা দিল।

দেবকী কোথায় গেল?

‘দেবকী হাসপাতালে ভরতি।’ নীচুস্বরে বলল প্রভাকর।

কেন? হাসপাতালে কেন? কী হয়েছে তার?

প্রভাকর একইরকম নীচুগলায় জানাল, দেবকী খুব অল্পদিনের প্রেগন্যান্ট ছিল। এত ছোটাছুটিতে তার গর্ভপাত হয়ে গিয়েছে। প্রচুর রক্তপাতে অবস্থা খুব সংকটজনক হওয়ায় ভরতি করতে হয়েছে হাসপাতালে।

ইনস্পেক্টর আয়ার খোঁজ নিয়ে জানলেন, প্রভাকর মিথ্যা বলছে না। দেবকীর সত্যিই গর্ভপাত হয়েছে।

তিনি আর দেরি করলেন না। মিডিয়া রোজ প্রথম পৃষ্ঠায় জানতে চাইছে তদন্তের অগ্রগতি। দেবকীকে বোম্বে পুলিশের জিম্মায় রেখে প্রভাকরকে নিয়ে ১৩ই সেপ্টেম্বর তিনি ফেরত এলেন মাদ্রাজে।

দেবকী সুস্থ হয়ে মাদ্রাজে পা রাখল ২২শে সেপ্টেম্বর। ততদিনে সাধারণ মানুষের মনে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। পুলিশমহলেও তৎপরতা তুঙ্গে। পঞ্চাশজনকে ইতিমধ্যেই জোগাড় করা হয়েছে যারা সেই বিশেষ দিনে আলাভান্ডার ও প্রভাকর মেননের গতিবিধি কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ করেছে।

ব্রডওয়ের একটা পার্ক থেকে উদ্ধার হয়েছে একটা ছুরিও। মালাবার ছুরি। সেদিন যখন দেবকী গিয়েছিল আলাভান্ডারকে ডেকে আনতে, প্রভাকর এই ছুরিটাই কিনে এনেছিল। ছুরির গায়ে শুকিয়ে থাকা কালচে রক্তও ফরেনসিক রিপোর্টে মিলে গেল আলাভান্ডারের রক্তের সঙ্গে। দেবকীর ব্যাগ থেকে পাওয়া গেল আলাভান্ডারের পেন আর ঘড়িও।

যথেষ্ট প্রমাণ মজুত হয়েছে। জোগাড় করা গিয়েছে সাক্ষীও। সবদিক সাজিয়ে পুলিশ আদালতে কেস পেশ করল। একেবারে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় নৃশংস খুন। প্রভাকর নিজে হাতে খুন করেছে, তারপর ধড় আর মুণ্ডু আলাদা আলাদা করে সরিয়েছে। ফাঁসি তো হবেই।

আর দেবকী? সে নিজে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকলেও খুনে সাহায্য করেছে। তাই তার বেশ কয়েকবছরের কারাদণ্ড পাকা।

ফরেনসিক বিশেসজ্ঞ ড পিনচান্ডি আইনআদালতের ব্যাপারেও বেশ ওয়াকিবহাল। তিনি মাথা নাড়লেন, ‘এভিডেন্স যতই থাক, আলাভান্ডারের মার্ডারের কোনো আই-উইটনেস চাই। নাহলে কেসটা অতটা শক্তিশালী হবেনা।’

‘শক্তিশালী কেন হবেনা? সাইকেল দোকানের মালিক আলাভান্ডারকে ঢুকতে দেখেছে বেরোতে দেখেনি। ছুরির রক্তের সঙ্গে আলাভান্ডারের রক্ত মিলে গিয়েছে।’

‘হলেও। প্রভাকরকে নিজের হাতে খুন করতে আপনার কোনো সাক্ষী দেখেছে?’ পিনচান্ডি বললেন, ‘হতেও পারে, আলাভান্ডার অ্যাটাক করেছিল, প্রভাকর আত্মরক্ষা করতে গিয়েছিল। তার শাস্তি প্ল্যানড মার্ডারের চেয়ে অনেক কম হবে। আই-উইটনেস ছাড়া দাঁড়াবে না কেস।’

পুলিশ একটা ফন্দি আঁটল। তথ্যপ্রমাণ বা সাক্ষী মজুত হলেও প্রভাকর যখন খুনটা করছে, তখনকার প্রত্যক্ষদর্শী বলতে একমাত্র দেবকী। সে যদি সত্যি কথা বলে, জজসাহেব প্রভাকরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে বাধ্য হবেন।

ইনস্পেক্টর রমন্থ আয়ার একদিন গেলেন দেবকীর সেলে। দেবকী তখন কারাগারের একটা ছোট্ট সেলে চুপ করে বসেছিল। তার চুলগুলো রুক্ষ বিধ্বস্ত হয়ে লুটিয়ে ছিল চারপাশে।

ইনস্পেক্টর আয়ার গিয়ে কোনো ভণিতা না করে বললেন, ‘শোনো দেবকী। বুঝতেই পারছ, প্রভাকরের ফাঁসি হবেই। আমরা এমন সব এভিডেন্স পেয়েছি, যে পালাবার কোনো পথ নেই।’

‘ও কেমন আছে?’ কেমন ঘোলাটে চোখে তাকাল দেবকী।

‘কে?’

‘প্রভাকর? খাওয়াদাওয়া করছে?’ দেবকী অস্ফুটে বলল, ‘ওকে কেউ মারধোর করছে না তো দারোগাবাবু?’

‘না। ও ঠিক আছে।’ ইনস্পেক্টর আয়ার বললেন, ‘শোন আমি এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে। সেদিন খুনের গোটা ঘটনাটা একমাত্র তুমি দেখেছিলে। তাই তুমি যদি রাজসাক্ষী হয়ে যাও, তাহলে তোমার শাস্তি অনেক কম হবে। এমনকী কোর্ট তোমায় বেকসুর খালাসও করে দিতে পারে।’

‘মানে?’ লালচোখে তাকাল দেবকী।

‘মানেটা খুব সিম্পল দেবকী। প্রভাকর তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে খুন করেছে।’ ইনস্পেক্টর আয়ার ইচ্ছে করেই ‘ভালোবাসার মানুষ’ কথাটা ব্যবহার করলেন, ‘তুমি তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে আইনব্যবস্থাকে সাহায্য করো। তাতে গণতন্ত্রের জয় হবে, তুমিও নতুন করে তোমার জীবন শুরু করতে পারবে।’

দেবকী চুপ করে রইল। কোনো কথা বলল না।

ইনস্পেক্টর আয়ার আবার বললেন, ‘তোমার গর্ভের সন্তান। তাকেও তো একরকম খুনই করেছে প্রভাকর। ওই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ছোটাছুটি করে। তুমি চাও না যে তার শাস্তি হোক?’

দেবকী এবারেও চুপ করে রইল। শুধু চোখদুটো ভরে উঠল জলে।

‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং’ ধরে নিয়ে ইনস্পেক্টর আয়ার পকেট থেকে গোটানো একটা কাগজ আর পেন বের করলেন, ‘এই নাও। এটায় সই করে দাও।’

‘কীসের কাগজ এটা?’

‘এটা তোমার রাজসাক্ষী হতে চাওয়ার ডিক্লেরেশন।’ আয়ার বললেন, ‘দেবকী, আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, তোমায় আমি বেকসুর খালাস করাব।’

‘চাইনা আমি খালাস পেতে!’ বহুবছরের ঘুম ভেঙে যেন হঠাৎ জেগে উঠল দেবকী। চিৎকার করে বলল, ‘আমার স্বামী যদি আলাভান্ডারকে খুন করেই থাকেন, আমার সম্মান রক্ষা করতে করেছেন। আমাকে নতুন জীবন দিতে নিজেকে বিপন্ন করেছেন উনি। আপনারা ভাবলেন কী করে যে আমি তাঁরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেব? নিয়ে যান। নিয়ে যান কাগজটা এখুনি!’

ইনস্পেক্টর আয়ার দেবকীর রুদ্রমূর্তি দেখে আর ঘাঁটালেন না, বেরিয়ে এলেন কুঠুরি থেকে।

ভারতের চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার ইতিহাসে আলাভান্ডার হত্যা মামলা শুধুমাত্র খুনের নৃশংসতার জন্য বিখ্যাত নয়, বিখ্যাত তার আদালতের শুনানির জন্যও।

কেস উঠল মাদ্রাজ হাইকোর্টে। বিচারক হলেন বিখ্যাত জাস্টিস সুব্রহ্মণ্য পঞ্চপকেশন আয়ার।

সরকারি কৌঁসুলি অর্থাৎ ষ্টেট প্রসিকিউটর হলেন গোবিন্দ স্বামীনাথন। লড়বেন পুলিশের হয়ে। ইনিও তখনকার প্রথম সারির আইনজীবীদের মধ্যে একজন।

উলটোদিকে প্রভাকর ও দেবকীর স্বপক্ষে দাঁড়ালেন আইনজীবী সুন্দররাজন এবং কৃষ্ণমূর্তি।

মনে রাখতে হবে, সময়টা পঞ্চাশের দশক। তখনো মাদ্রাজ হাইকোর্টে জুরি — সিস্টেম চালু রয়েছে। এই মামলাতেও ন-জন জুরি হলেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন সমাজের রীতিমতো মান্যগণ্য মানুষ।

যথাসময়ে শুনানি শুরু হল। একজন উচ্চশিক্ষিত সুসভ্য সমাজের স্বামী-স্ত্রীকে খুনের আসামি হিসেবে দেখা খুব সাধারণ নয়। শুনানির প্রতিটা দিন কোর্টরুম তো বটেই, আদালত প্রাঙ্গণেও ভিড় উপচে পড়তে লাগল। ১৯৫৩ সালের ১৩ই মার্চ Indian Express তো লিখেই ফেলল, ‘the crowd in the courtroom became unmanageable, delaying the proceedings.’

প্রতিদিনই এক অবস্থা। কোর্ট হলের সামনের লম্বা বারান্দাও ভিড়ে ভিড়াক্কার, কোথাও তিলমাত্র জায়গা নেই। পুলিশ বাহিনী একা সামলাতে পারল না, রিজার্ভ ফোর্স পাঠানো হল।

সরকারি কৌঁসুলি গোবিন্দ স্বামীনাথন সুপরিকল্পিত হত্যার স্বপক্ষে একটা শক্তপোক্ত কেস দাঁড়করালেন। বললেন, ‘ধর্মাবতার! মেনন পরিবারের চাকর নারায়ণন নিজে বলেছে, আগের দিন রাতেই খুনের ছক কষেছিল প্রভাকর আর দেবকী।’

‘অবজেকশন ইয়োর অনার!’ প্রভাকর-দেবকীর আইনজীবী সুন্দররাজন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘নারায়ণন বাইরের বারান্দায় শুতো। সেখান থেকে বন্ধ ঘরের দরজা টপকে কোনোভাবেই কথাবার্তা শোনা সম্ভব নয়। আলাভান্ডার একজন কামুক প্লেবয় ছিল। নিজের যৌনক্ষিদে মেটানোর জন্য সে অনেক ঘৃণ্য কাজ করত। তার পাকস্থলীতে ওপিয়ামের মতো ড্রাগও মিলেছে। মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তারপর ব্ল্যাকমেল করাই ছিল তার কাজ। জেম কোম্পানির স্টাফ থেকে শুরু করে তার প্রতিবেশীরা, সবাই তার এই কামলালসার কথা বলেছে। সেদিন আলাভান্ডার প্রভাকরের উপস্থিতিতেই তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিল। যে কোনো পুরুষের মতো প্রভাকরও সেটা সহ্য করতে পারেনি, এবং সে নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়েছিল। দুজনেই দুজনকে আক্রমণ করে এবং আলাভান্ডারের অ্যাটাকে প্রভাকর আত্মরক্ষা করতে যায়। চরম উসকানিতে হওয়া এই হত্যাকাণ্ড কোনো মার্ডার নয়। It’s a homicide. It’s an accidental death’

এইখানে বিচারক সুব্রহ্মণ্য পঞ্চপকেশন আয়ার সম্পর্কে দু-একটা কথা না বললেই নয়।

পঞ্চপকেশন আয়ার জন্মেছিলেন কেরালার একটা ছোট গ্রামে। গ্রামের নাম তখন ছিল পালঘাট। এখন পালাক্কার। সেই অখ্যাত গ্রাম থেকে উঠে আসা অত্যন্ত মেধাবী পঞ্চপকেশন ছিলেন মাদ্রাজের প্রথম I.C.S. অফিসার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো করে পরে তিনি বিচারক হন। এছাড়া তিনি অনেক বইও লিখেছিলেন। তাঁর উপন্যাস ‘বালাদিত্য’ ভারতীয় সাহিত্যে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা প্রথম প্রেমের উপন্যাস। ব্রিটিশ আমলে তিনি কোনোদিনও ইংরেজদের তোষামোদ করেননি, ফলে সেইসময় তাঁকে সামান্য একজন জেলা জজ করে রেখে দেওয়া হয় বহুবছর। স্বাধীনতার পর তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পান। তিনিই মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় চিফ জাস্টিস।

 পঞ্চপকেশন আয়ার ছিলেন অত্যন্ত ঋজু চরিত্রের মানুষ। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার চেয়েও তাকে অপরাধী বানানো অপরাধীদের তিনি বেশি ঘৃণা করতেন। মনে করতেন, অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতি, সবার ঊর্ধ্বে হল মানুষের মূল্যবোধ আর চরিত্র।

এই আলাভান্ডার মামলার জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন, আলাভান্ডার তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে। এবং যেহেতু পরিকল্পিত হত্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এবং দেবকী একবারও তার স্বামীর হাত ছাড়েনি, তিনি আইনের রক্ষাকর্তা হিসেবে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে পারেননা। বরং এক্ষেত্রে এই মামলাকে সমাজের সেই মানুষদের প্রতি শিক্ষা হিসেবে দেখা উচিত, যারা মহিলাদের পণ্য মনে করে।

দীর্ঘদিন শুনানি শেষে বিচারে প্রভাকরের সাতবছরের জেল হল। দেবকীর তিন বছর।

সরকারি কৌঁসুলি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডে এত লঘু দণ্ড?

প্রভাকর আর দেবকী উচ্চ আদালতে আপিল করতে চাইছিল, কিন্তু তাদের আইনজীবী বারণ করলেন। পঞ্চপকেশন আয়ার ব্যতিক্রমী জজ, উচ্চ আদালতে গেলে শাস্তি বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

শোনা যায়, জেলে অত্যন্ত ভালোভাবে থাকার জন্য মেয়াদের কিছু সময় আগেই প্রভাকর আর দেবকী মুক্তি পেয়েছিল। ছাড়া পেয়ে তারা চলে গিয়েছিল কেরালায়।

খুলেছিল একটা ছোট রেস্তোরাঁ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রমে আর একাগ্রতায় তাদের সেই ব্যবসা বেড়েছিল বহুগুণ। কেরালার অন্যমতো বড় এক শহরে এক ঝাঁ চকচকে হোটেল খুলেছিল তারা। কালের নিয়মে সবাই ভুলে গিয়েছিল তাদের সেই অপরাধের কথা।

কিন্তু আলাভান্ডার হত্যা মামলা কেউ ভোলেনি। তখনকার দিনে ফরেন্সিক সায়েন্সকে তদন্তে এত ভালোভাবে কাজে লাগানো সত্যিই ব্যতিক্রমী।

যে ইন্দো-সিলন বোট মেলে উদ্ধার হয়েছিল আলাভান্ডারের দেহ, সেই ট্রেন এখন আর দুই দেশের মধ্যে চলে না। ১৯৬৪ সালে রামেশ্বরের ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের পরই প্রচুর যাত্রীর মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় এই আন্তঃ-দেশীয় রেলযাত্রা।

জাস্টিস পঞ্চপকেশন আয়ারকে এই নিয়ে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল পক্ষপাতিত্বের মতো গুরুতর অভিযোগও। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন।

পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা শ্রীমতী অশোকা ঈশ্বরম লিখেছেন এই মামলার কথা। লিখেছেন কীভাবে সরকার অসন্তুষ্ট হলেও তাঁর বাবা নিজের মূল্যবোধ থেকে লঘু দণ্ড দিয়েছিলেন প্রভাকর— দেবকীকে। তাঁর বাবার ভাষায় এই হত্যা ছিল, ‘Justifiable execution of an unwanted rascal.’

অশোকা ঈশ্বরম তাঁর বাবার মৃত্যুর পর অনেক খুঁজেছেন ওই জুটিকে। কেরালার সেই বড় শহরে গিয়ে খুঁজেও পান তাঁদের। তাঁদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। মেননদের বাড়ির ঠাকুরঘরে ঢুকে তিনি স্তব্ধবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

কারণ সেখানে অন্যান্য সমস্ত ঠাকুরের মূর্তি ও ছবির সঙ্গে সযত্নে রক্ষিত ছিল তাঁর বাবা জাস্টিস আয়ারের ছবিও।

আচ্ছা, ওঁরা কি এখনো বেঁচে আছেন?

বাহান্ন সালে বাইশ তেইশ বছর বয়স হলে দেবকী মেননের এখন বয়স হওয়ার কথা নব্বই। জানিনা তিনি জীবিত কিনা। এই কেস সম্পর্কে অনেক কিছু জানলেও সেই তথ্য জানতে পারিনি।

বাকি জীবনটা তাঁরা কাটিয়েছিলেন অন্তরালে। ব্যস্ত দিনের শেষে নিজেদের বাড়ির বারান্দায় এসে অস্তমান সূর্যকে যখন তাঁরা দেখতেন, হয়তো ভাবতেন কীভাবে তাঁদের জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে গেল।

কীভাবে দেবকীকে কামুক আলাভান্ডারের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে তাঁর স্বামী পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আর পাঁচজনের মতো তাঁকে ছেড়ে চলে যাননি।

ভাবতে ভাবতে তাঁরা নিশ্চয়ই দুজন দুজনের হাত তখন জড়িয়ে ধরতেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *