সুরূপা গুহ হত্যা মামলা ১৯৭৬

সুরূপা গুহ হত্যা মামলা ১৯৭৬

প্রথমেই বলি, আজকের পর্বে যে সত্যকাহিনীটি গল্পাকারে লিপিবদ্ধ করতে বসেছি, তা কালের বিচারে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূরণ করলেও আজও এতটাই স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল, যে, প্রতিটি শব্দচয়ন আমায় করতে হয়েছে সতর্ক হয়ে।

আজও এই মামলাটি এমনই রহস্যাবৃত, এমনই মেঘের চাদরে ঢাকা, যে আলটপকা লেখনীতে যাতে কোনো অংশই প্রভাবিত না হয়, সেই কারণেই আমি শরণাপন্ন হয়েছি আইনি আর্টিকেলের। মূলত কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া মামলা, পিটিশন, রায় এবং ৩১শে অক্টোবর, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডে’র একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে লেখা আমার এই সত্যঘটনাশ্রয়ী নাট্যকাহিনী।

যে মর্মন্তুদ ঘটনায় দিনের পর দিন ভরে থাকত আনন্দবাজার কিংবা যুগান্তর পত্রিকা, চায়ের কাপে যে আলোচনায় তুফান উঠত ক্লাবে ক্লাবে কিংবা অলস পাড়ার রকে, সেই ঘটনা এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো জানেন না, কিন্তু যারা চল্লিশ কি পঞ্চাশের কোঠায়, বা আরও বেশি, তাঁদের মনে আজও রয়ে গিয়েছে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের রেশ।

আমি হলফ করে বলতে পারি, তাঁরা আজও শুনলেই চমকে উঠবেন, ‘ওহ! সেই সুরূপা গুহ’র কেসটা!’

কে এই সুরূপা গুহ? কী হয়েছিল তাঁর সঙ্গে?

প্রথমেই সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে চলে যাব রুদ্ধশ্বাস ঘটনাক্রমে, যা কোনো অংশে নাটকের চেয়ে কম নয়। যা সহজেই হার মানাবে কোনো গোয়েন্দাকাহিনীকে।

সুরূপা ছিলেন স্বচ্ছল ব্যবসায়ী রমেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। শিক্ষিতা ও সুন্দরী। ১৯৬৬ সালে তাঁর বিবাহ হয় ইন্দ্রনাথের গুহর সঙ্গে।

কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত ও অভিজাত স্কুল সাউথ পয়েন্টের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সতীকান্ত গুহর একমাত্র পুত্র ইন্দ্রনাথ গুহ। শ্রী সতীকান্ত গুহ শুধুই সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নন, তিনি প্রখ্যাত লেখক, নিজের ‘নাট্যকার’ নাটকের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কারও। এছাড়াও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর অবদানও কম নয়। ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায় তিনি সাউথ পয়েন্ট স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

যে সময়ের কথা বলছি, সেইসময় এই গুহ পরিবার কলকাতার অন্যমতো বর্ধিষ্ণুও মান্যগণ্য পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। হিন্দুস্থান পার্কের মতো অভিজাত এলাকায় প্রাসাদোপম অট্টালিকা। সতীকান্ত গুহ এবং তাঁর স্ত্রী প্রীতিলতা গুহ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মালিক। পুত্র ইন্দ্রনাথ ওই স্কুলেরই প্রিন্সিপাল।

ইংরেজির শিক্ষক ইন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি ও অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী। ছাত্রমহলে অসম্ভব জনপ্রিয়, শুধু তাঁর পড়ানোর জন্যই নয়, তাঁর বন্ধুসুলভ স্বভাবের জন্যও। প্রিন্সিপাল হলেও তিনি গোটা স্কুলে ভীষণ প্রিয়। ছাত্রছাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে শোনে উদাত্ত কণ্ঠে তাঁর শেক্সপীয়র আবৃত্তি, কিংবা কিটসের কবিতার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা।

কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত এমন একটি পরিবারে বিয়ে হয়েও সুরূপার জীবনে শান্তি ছিল না। বিবাহের পর থেকেই শ্বশুর, শাশুড়ি ও স্বামীর মানসিক অত্যাচারের শিকার হতে হত তাকে। তার কারণ মূলত তার অনমনীয় মনোভাব।

সুরূপার বিয়ে হয় মাত্র আঠেরো বছর বয়সে। শিক্ষামণ্ডলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকলেও গুহ পরিবার বাড়ির বউ হিসেবে চেয়েছিল কম লেখাপড়া জানা মেয়েকে। নিজেরা প্রথম সারির ক্লাব, বিনোদনে মজে থাকলেও পুত্রবধূকে হতে হবে আক্ষরিক অর্থেই ‘ঘরোয়া’, কম শিক্ষিতা। তার পেছনে কি কাজ করেছিল ‘উচ্চশিক্ষিতা হলে পোষ মানবেনা’ জাতীয় ধ্যানধ্যারণা?

কে জানে!

ভবিতব্যে থাকলে হিসেব কষে চলা রাস্তাও এলোমেলো হয়ে যায়। চেনা অঙ্কও ছক বদলে হাঁটতে থাকে নতুন পথে। গুহ পরিবারের ক্ষেত্রেও তাই হল। সবদিক বিবেচনা করে মাত্র আঠেরো বছরের মেয়েকে বউ করে আনলেও অল্প কয়েকদিনেই তাঁরা বুঝতে পারলেন না, অষ্টাদশী হলেও সুরূপা মোটেও বাধ্য নয়, সে দৃঢ়চেতা, স্বাধীন মনোভাবসম্পন্না।

শ্বশুরবাড়ির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সে বিয়ের পর প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশেও দাঁতে দাঁত চেপে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগল। সে মেধাবিনী, কেমিস্ট্রি তার প্রিয় বিষয়। কবে থেকে তার স্বপ্ন, কেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করার। এত সহজে সব মিথ্যা হতে দেওয়া যায় নাকি!

উচ্চবিত্ত গুহ পরিবারে প্রচুর দাসদাসী, ড্রাইভার, রান্নার লোক থেকে শুরু করে সবকিছুরই পরিচারক রয়েছে। তা সত্ত্বেও বাড়ির বউয়ের প্রত্যেকদিন কলেজ যাওয়া নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি শুরু হল। স্বামী ইন্দ্রনাথ বটেই, শাশুড়ি প্রীতিলতা, শ্বশুর সতীকান্ত, কারুরই এতে তেমন মত নেই।

সমস্যা যে শুধু সুরূপার লেখাপড়া নিয়ে, তা নয়। সুরূপা এমনিতে খুব শক্তমনের মেয়ে হলেও কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে বাপের বাড়ি গিয়ে সে ছলোছলো চোখে বাবাকে বলে ফেলেছে, ‘ইন্দ্রনাথ রাতের বেলা পুরো অন্য মানুষ হয়ে যায় বাবা! পেটে অ্যালকোহল পরলে কে বলবে, ও অত ভালো একজন শিক্ষক! আমার ভালো লাগেনা বাবা, প্রতিরাতের অত্যাচার! প্রায়দিন ও আমার গায়ে হাত তোলে।’

বাবা রমেন্দ্রমোহন দু-দু’বার এই নিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছেন। ইন্দ্রনাথ হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।

‘কী যে বলেন বাবা! দোলা বাচ্চা মেয়ে, ওর কথা অত ধরতে আছে? কোন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়না বলুন তো?’

দোলা সুরূপার ডাক নাম।

রমেন্দ্রমোহন আর কিছু বলার সাহস পাননি। অসম এই কুটুম্বিতার সম্পর্কে তিনি অনেক নীচে। খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যে পরিবারের ঘনিষ্ঠ, তাঁদের সঙ্গে অনেক বুঝে কথা বলতে হয়।

আর তা ছাড়া ইন্দ্রনাথ এমন শিক্ষিত সপ্রতিভ যুবক, ওঁর ব্যক্তিত্বে সবাই মুগ্ধ, তাঁর সম্পর্কে এমন অভিযোগ বিশ্বাস করাও একটু কষ্টকর বইকি!

অতএব রমেন্দ্রনাথ মেয়ে দোলাকে সেই তিনটি অমোঘ শব্দ বলে প্রবোধ দেন। সেই তিনটি শব্দ, যা যুগে যুগে নিজের বাবা-মায়ের থেকে শুনে আসতে হয়েছে বিবাহিতা মেয়েদের।

‘মানিয়ে নে, মা!’

সুরূপা মানিয়ে নিচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু নিজেকে ছোট না করে যতটা মানিয়ে নেওয়া যায়। স্বামীর সঙ্গে ক্রমশই তার দাম্পত্য তলানিতে এসে ঠেকছিল। স্বামী যত জড়িয়ে পড়ছিল বাইরে, সেও আঁকড়ে ধরছিল তার পড়াশুনোকে। উঠতে বসতে শ্বশুর-শাশুড়ির বক্রোক্তি, কটু কথা গা-সওয়া হয়ে উঠছিল তার কাছে।

যখন অত্যাচার অসহনীয় হয়ে উঠত, তখন সে দাঁতে দাঁত চেপে শাসাত, ‘একদিন আমি দুনিয়ার সবাইকে বলে দেব, কলকাতার সো কলড সবচেয়ে শিক্ষিত পরিবারের চার দেওয়ালের মধ্যে কী চলে! সব্বাইকে জানাব, ফিল্মের ওই হিরোইনের সঙ্গে তোমার কী চলছে! সেদিন তোমরা টের পাবে! শিক্ষাবিদ? মাই ফুট!’

চাকরবাকর থেকে ড্রাইভার সবাই জানে বাড়ির পুত্রবধূটির এই কষ্টের কথা। সবাই দেখেও না দেখার ভান করে, শুনেও না শোনার অভিনয় করে চলে যায় নিজের কাজে।

এইভাবেই কাটল ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬, দশ-দশটা বছর। এই দশবছরে সেদিনের অষ্টাদশী তরুণী সুরূপা পরিণত হয়েছে বছর আঠাশের এক ইস্পাতকঠিন যুবতীতে। হাজার লাঞ্ছনাতেও সে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যায়নি। চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। বাবার গলগ্রহ হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরতে চায় না সে।

একদিন সে ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সেদিন এই বাড়ির সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলে যাবে। মুক্তি পাবে এই নিত্য অত্যাচার থেকে।

সে এখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে উচ্চশিক্ষায় ব্যস্ত। আর মাত্র এক-দু’বছর, তারপরই জুটে যাবে কোনো না কোনো চাকরি। সোনার খাঁচার সেই পাখির মতো নিজের ঘরে বসে নীরবে স্বপ্ন বুনে চলে সুরূপা।

তারিখটা ছিল ৪ঠা মে, ১৯৭৬ সাল। সেদিন সুরূপা ল্যাবে নিজের রিসার্চের কাজ করতে করতে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, যখন খেয়াল হল অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তড়িঘড়ি ল্যাব থেকে বেরোল সে।

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান পার্ক। বৈশাখের গরম, ঘেমেনেয়ে সে যখন বাড়িতে পৌঁছল, তখন ঘড়িতে রাত দশটা।

ইদানীং বাড়ির কারুর সঙ্গেই বাক্যালাপ হয়না ওর। সবাই যেন ওকে অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য করে। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত সুরূপা ফ্রেশ হয়ে এসে সবে নিজের বিছানায় বসেছে, দরজায় উঁকি মারল ঝন্টুচরণ, ওদের বাড়ির চাকর।

‘কী ঝন্টু, কিছু বলবে?’

ঝন্টুচরণ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে।

‘হ্যাঁ বউদিদি, এই যে লস্যি আর শশা এনেছিলাম। খেয়ে নিন।’ লস্যিভরতি কাঁচের গ্লাস ও প্লেটভরতি শশা বিছানার পাশের টেবিলে রাখে ঝন্টু।

এর চেয়ে ভূত এসে দর্শন দিলেও এত অবাক হত না সুরূপা। আজ দশবছর হতে চলল বিয়ে হয়েছে, কোনোদিনও কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এক গ্লাস জলও পায়নি ও। চাকরবাকররা হয়তো দিত, কিন্তু ওদের নিশ্চয়ই কড়া বারণ করা আছে।

আর সেখানে আজ একেবারে কাজুবাদাম দেওয়া পুরু মালাইয়ের লস্যি?

সুরূপা আর বেশি ভাবতে পারল না। সেই কখন দুপুরে চাট্টি ভাত খেয়েছে, তারপর থেকে পেটে একটা দানাপানিও পড়েনি। একটু করে শশার কুচি মুখে দিতে দিতে গোটা লস্যিটা খেয়ে ফেলল ও।

আহ, কি ঠান্ডা! শরীর জুড়িয়ে গেল যেন!

ঠিক কুড়ি মিনিট। তারপরই ভয়ানক গা পাক দিতে শুরু করল সুরূপার। হড়হড় করে বমি হতে লাগল, তার সঙ্গে থেকে থেকে অচৈতন্য হয়ে যাওয়া। অসহ্য পেটে যন্ত্রণায় প্রায় বেঁকে যেতে লাগল ও।

‘ও মাগো! আমার পুরো গলাটা জ্বলছে! আহ! কী প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে আমার! ও মাগো!’

চাকরবাকর মারফত খবর গেল সুরূপার শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর কাছে। দশমিনিটের মধ্যে এসে পড়লেন গুহ পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক। ততক্ষণে সুরূপা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, মুখ দিয়ে সাদা ফেনা উঠছে। গোটা শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রয়েছে বিছানায়।

ডাক্তারবাবু এসে বেশি দেরি করলেন না। কয়েক সেকেন্ড পরীক্ষা করেই বললেন, ‘একদম ভালো বুঝছি না। পালস রেট প্রায় নেই। হসপিটালাইজড করতে হবে। এখুনি!’

এস এস কে এম, অর্থাৎ পিজি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সুরূপাকে যখন এমারজেন্সিতে ঢোকানো হল, তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা।

এমারজেন্সির ডাক্তাররা স্টমাক ওয়াশ করানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। একজন ডাক্তার ঝুঁকে পড়ে সুরূপাকে বললেন, ‘কী খেয়েছিলেন আপনি? আপনি কি কোনো পয়জন খেয়েছিলেন?’

সুরূপার দৃষ্টিশক্তি তখন ঝাপসা হয়ে আসছে, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। তবু তার মধ্যেই অসীম মনের জোরে ও ডান হাত নাড়ল, ‘ন-না ডাক্তারবাবু! বিষ কেন খেতে যাব। আমি তো … আমি তো কলেজ থেকে ফিরে একটু লস্যি আর শসা …!’

আসল গল্প শুরু এখান থেকেই।

রাত একটার সময় মুখার্জি বাড়ি অর্থাৎ সুরূপার বাপের বাড়ির টেলিফোনটা যখন নিস্তব্ধতা ভেঙে ঝনঝন করে বেজে উঠল, রমেন্দ্রমোহন ঘুমচোখে গিয়ে রিসিভার কানে দিলেন, ‘হ্যালো!’

‘হ্যালো, আমি ইন্দ্রনাথ বলছি। আপনি … আপনি শীগগিরই একবার পিজি হাসপাতালে আসুন বাবা!’

‘অ্যাঁ! পিজিতে? কেন? কী হয়েছে? দোলা … দোলা ঠিক আছে তো?’

উত্তর শোনার আগেই পিঁ পিঁ শব্দে কেটে গেল ফোন। বিপর্যস্ত আতঙ্কিত রমেন্দ্রমোহন আরো দু-বার চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাইন পেলেন না। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওই মধ্যরাতে তিনি একাই রওনা দিলেন পিজি হাসপাতালের দিকে। স্ত্রীকে নিলেন না, পাছে কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হয়!

রমেন্দ্রমোহন যখন গিয়ে পৌঁছলেন, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁদের একমাত্র আদরের কন্যা সুরূপার মৃত্যু হয়েছে। থমথমে মুখে করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুরূপার শাশুড়ি প্রীতিলতা ও শ্বশুর সতীনাথ।

রমেন্দ্রমোহনের এমনিতে হার্টের অবস্থা ভালো ছিল না। সাদা চাদরে ঢাকা নিথর কন্যার দেহ দেখে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেনা, লুটিয়ে পড়লেন হসপিটালের করিডরেই।

মূর্ছা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে শুনলেন, ইন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত হয়েছে। বলছেন, ‘বালিগঞ্জ থানায় এফ আই আর করে এলাম। স্ত্রী বিষ খেয়েছেন শুনে ওঁরা এখুনি আসছেন। আমি সিস্টারকে বলছি, সুরূপার জামাকাপড়গুলো দিয়ে দিতে।’

পরেরদিন সকালে সারারাত জেগে থাকা বিধ্বস্ত রমেন্দ্রনাথ বালিগঞ্জ থানায় এফ আই আর করলেন। অত্যন্ত গুরুতর তাঁর অভিযোগ।

‘আমার কন্যা সুরূপাকে বিয়ের পর থেকেই নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হত। মৃত্যুর সামান্য আগে তাকে লস্যি আর শসা খাওয়ানো হয়েছিল। আমার স্থির বিশ্বাস, তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে।’

সাংঘাতিক ব্যাপার! কলকাতার অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ? আর্থিক প্রতিপত্তি থেকে রাজনৈতিক নেতা, সবই যে তাঁদের হাতের মুঠোয়!

ইতিমধ্যে পিজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তাতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘‘Cardio respiratory failure due to unknown poisoning.’’

ময়নাতদন্তে সুরূপার পাকস্থলীতে মারকিউরিক ক্লোরাইড নামক ভয়ংকর বিষ পাওয়া গেল।

কোথা থেকে এল এই বিষ?

স্থানীয় থানার পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে গিয়ে জানতে পারল, সেদিন রাতে সুরূপার মৃত্যুর পর পরই ইন্দ্রনাথ তার বমি লেগে থাকা জামাকাপড়, বিছানার চাদর বাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ইন্দ্রনাথ বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে সুরূপার ল্যাবেও হানা দিয়েছেন, এবং তিনি নাকি নিঃসন্দেহ তাঁর স্ত্রী ল্যাবেই ভুলবশত কোনো বিষাক্ত রাসায়নিক খেয়ে ফেলেছেন। কিংবা হয়তো স্বেচ্ছায় খেয়েছেন, আত্মহত্যা করার জন্য।

পুলিশ কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।

ততদিনে সংবাদমাধ্যমে ঝড় উঠে গিয়েছে। প্রতিদিন গোটা পশ্চিমবঙ্গের সব কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে থাকছে সুরূপা গুহর রহস্যজনক মৃত্যুর কাহিনী। ইন্দ্রনাথ গুহর ব্যক্তিগত জীবনের নানা রসালো আলোচনা থেকে বাড়ির কাজের লোকদের অসংগতিপূর্ণ বয়ান, সব আতশ কাচের তলায় রেখে কাটাছেঁড়া করছেন সাংবাদিকরা।

সমাজেও উঠেছে আলোড়ন। এমন উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের বধূর যদি এমন পরিণতি হয়, তবে নারীর সমাজে অবস্থান যে এখনো কতটা ভঙ্গুর, মেয়েদের যে কত অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র।

চাপ বাড়ছে পুলিশের ওপর। জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তড়িঘড়ি রমেন লাহিড়ী নামক একজনকে অপরাধী সাজিয়ে সেশান কোর্টে চার্জশীট পেশ করা হল। ভারতীয় দণ্ডবিধির 120-B, 328, 302 and 201 নম্বর ধারায়।

কে এই রমেন লাহিড়ী? সে গুহ পরিবারের মাসমাইনে করা ড্রাইভার।

সে বাড়ির বউকে মারবে কেন?

‘অসম্ভব!’ সেশান জাজ এ পি ভট্টাচার্য বলে ওঠেন, ‘এই চার্জশীট একেবারেই ভ্রান্ত। বাড়ির ড্রাইভারের মোটিভ কী? সে কেন মার্ডার করবে মিসেস গুহকে? আর তাছাড়া হাসপাতালের চাদরে মিসেস গুহর বমির স্যাম্পল পাওয়া গেছে। ওঁর খাবারে বিষ পাওয়া গিয়েছে। বাইরে থেকে এসে ড্রাইভার কী করে খাবার বিষ মেশাবে?’

পুলিশ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনা। যতই তারা যুক্তি দিক, শেষপর্যন্ত বিচারপতি কিছুতেই পুলিশের তত্ত্ব মানলেন না। তিনি চার্জশিট খারিজ করে দিয়ে সি আই ডি তদন্তের নির্দেশ দিলেন।

অতএব মামলার তদন্তের ভার নিল সি আই ডি। তারা প্রথমে ঝন্টুচরণ নামক সেই চাকরকে গ্রেফতার করল। শুরু হল ঝন্টুচরণের ম্যারাথন জেরা।

ততদিনে গোটা বাংলায় তোলপাড়। বাংলা থেকে ইংরেজি প্রতিটি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে সুরূপা গুহ হত্যা মামলা। স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বললেন, ‘সঠিক পথেই তদন্ত হবে। কোনোরকম প্রভাব বরদাস্ত করা হবেনা।’

অবশেষে সি আই ডি-র চাপে ঝন্টুচরণ মুখ খোলা শুরু করে। ধীরে ধীরে খুলতে থাকে রহস্যের জট। একে একে ডেকে পাঠানো হতে থাকে বাড়ির ঝাড়ুদার কালু নায়েক থেকে শুরু করে অন্যান্য পরিচারক পরিচারিকাদের।

সকলেরই এক কথা, ‘বউদিমণিকে বড় অকথা কুকথা বলতেন বড়মা! দাদাবাবুও বলতেন।’

আসামী পক্ষের আইনজীবী বললেন, ‘খুন নয়, সুরূপা আত্মহত্যা করেছেন।’

‘না।’ বিচারপতি খারিজ করে দিলেন সেই তত্ত্বও, ‘সুরূপাকে বাথরুমের দরজা ভেঙে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি অসহায়ভাবে কাঁদছিলেন। তাছাড়া, মৃত্যুর আগে পিজি হাসপাতালের ডাক্তারদের কাছে সুরূপা নিজে বলে গিয়েছেন, তিনি বিষ খাননি।’

সুরূপার দাদু রবীন্দ্রমোহন মুখার্জি অশক্ত দেহে এলেন সাক্ষ্য দিতে। বললেন, ‘ধর্মাবতার! আমার দিদিভাইয়ের ওপর অত্যাচার তো চলতই। খুনের দশ-বারোদিন আগে থেকে সেই অত্যাচার চরমে উঠেছিল। ফোনে আমাকে বলতে বলতে দিদিভাই কেঁদে ফেলেছিল। শুধু বলেছিল, আমাকে সব জিজ্ঞেস কোরোনা দাদু, তোমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে!’

সুরূপার মা অমিয়া মুখার্জি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘ইন্দ্রনাথ প্রায়দিন রাতে ফিরে মেয়ের ওপর মদ্যপ অবস্থায় অত্যাচার চালাত! ওর শাশুড়িও নির্যাতন করত।’

সাউথ পয়েন্ট স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবরেটরি স্টাফ ছিল সুকুমার নায়েক এবং সুবোধ দাস। তাদেরকে ডেকে পাঠানো হল।

তারা সাফ জানাল, ‘প্রিন্সিপাল স্যার তো বটেই, আমাদের সব স্যার ম্যাডামেরই ল্যাবে ঢোকার পারমিশন রয়েছে।’

‘স্কুলের ল্যাবে কি মারকিউরিক ক্লোরাইড রয়েছে?’

‘হ্যাঁ স্যার। রয়েছে।’ মাথা হেলিয়ে উত্তর দিল সুকুমার ও সুবোধ।

দীর্ঘ পাঁচবছর চলল Sati Kanta Guha And Anr. V State Of West Bengal on 25 July, 1977 মামলার শুনানি। উঠে এল নানা দিক, নানারকম সাক্ষ্যদান। গুহ পরিবারের পরিচিতরা থেকে টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী, নিষ্কৃতি পেলেন না কেউই।

অবশেষে বিচারপতি রণবীর মহাপাত্র সুরূপা গুহ হত্যার জন্য ইন্দ্রনাথ গুহকে দোষী সাব্যস্ত করেন। মৃত্যুর সময়ের পোশাক বাড়ি নিয়ে গিয়ে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

সেই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। ১৯৯১ সালে প্রয়াত হয়েছেন সতীকান্ত গুহ। প্রীতিলতা মারা গিয়েছেন ২০০৫-এ। সাউথ পয়েন্ট স্কুল চলে গিয়েছে বিড়লা গ্রুপের হাতে, ইন্দ্রনাথ গুহ এখন শহরের আরেক অভিজাত স্কুল গার্ডেন হাই-এর প্রতিষ্ঠাতা। বিচারপতি রণবীর মহাপাত্র প্রয়াত হয়েছেন ২০১৮ সালে।

সময় এগিয়েছে, দেশ এগিয়েছে। আগাথা ক্রিস্টির রহস্যগল্পের চেয়েও টানটান সুরূপা গুহ হত্যা মামলা চলে গিয়েছে স্মৃতির অন্তরালে। ছিয়াত্তর সালের সেই মে মাসের রাতে কী হয়েছিল, তা আজও রহস্যাবৃত।

তবু আজও অকালে ঝরে যেতে হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী মিতা দাসকে, কিংবা ধুবুলিয়ার পায়েলকে। মেয়েরা জীবনে যত সাফল্যই অর্জন করুক, যতবারই গর্বিত করুক বাবা-মা’কে, আজও অধিকাংশক্ষেত্রে তাদের দেখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবেই।

আজও বিবাহিতা মেয়ের ছলছলে মুখ দেখলে বাবা-মা বলে ওঠেন, ‘মানিয়ে নে, মা!’

[ কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া মামলা, পিটিশন, রায় এবং ৩১শে অক্টোবর, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডে’র একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এই সত্যঘটনাশ্রয়ী নাট্যকাহিনী। ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *